রম্যাঁ রলাঁ

রম্যাঁ রলাঁ

রম্যাঁ রলাঁ দেশকে অতিক্রম করতে পেরেছিলেন, এইখানে তাঁর জিত। কালকে অতিক্রম করতে পারেননি, এইখানে তাঁর হার।

এ হার তাঁর একার নয়, এক জন কী দুজন বাদে আর সকলের। অথচ এ জিত তাঁর মতো এক জন কী দুজনের। আমরা আজ বিজেতাকে অভিনন্দন জানাব, কিন্তু বিজিতকেও সমবেদনা জানাতে ভুলব না! আত্মার সঙ্গে আত্মার সম্বন্ধ এমন নিগূঢ় যে হয়তো আমাদের আনন্দ-বেদনা মৃত্যুর পরপারে তাঁর কাছে পৌঁছোবে।

আঠারো-উনিশ বছর বয়সে তাঁর জন ক্রিস্টোফার আমার হৃদয় হরণ করেছিল। ‘পিপলস থিয়েটার’ আমাকে অনুপ্রাণিত করেছিল। ইচ্ছা করত জন ক্রিস্টোফারের মতো বাঁচতে, জনসাধারণের জন্যে সৃষ্টি করতে। জানতুম যে, জনসাধারণ আমাকে বুঝবে না, ক্রিস্টোফারকেও বুঝল না, সেইজন্যে আগে থাকতে শোক করতুম। শোক করতুম আর সুখী হতুম এই ভেবে যে, আমি সেই স্বল্পসংখ্যক দুঃখীজনের একজন যাদের কেউ বুঝবে না, অথচ যারা সকলের জন্যে সর্বস্ব দিয়ে গেছে। যখন বুঝবে তখন আর খুঁজে পাবে না, তার আগে আমরা জ্বলেপুড়ে নিঃশেষ।

এই যে ‘elite’ বা স্বল্পসংখ্যকের মোহ, এ মোহ আমার অনেক দিন পর্যন্ত ছিল, এখনও পুরোপুরি যায়নি। কিন্তু রলাঁ তাঁর এ মোহ শেষবয়সে কাটিয়ে উঠেছিলেন। যদি কেউ কোনোদিন তাঁর জীবনচরিত হৃদয় দিয়ে লেখেন তাহলে দেখবেন, এইটুকুর জন্যে তাঁকে কী অমানুষিক দুঃখ পেতে হয়েছিল। নিজেকে বহুসংখ্যকের একজন ভাবা শুনতে যত সহজ আসলে তত নয়। যাঁদের এক ছটাক প্রতিভা আছে তাঁরাও এক-একটি কেষ্টবিষ্টু। রলাঁর মতো দুর্লভ প্রতিভার অধিকারীর পক্ষে নোবেল প্রাইজের সিংহাসন থেকে নেমে চাষি-মজুরের সঙ্গে কাঁধ-মেলানো ইতিহাসে অপূর্ব। সতেরো বছরের অবিরাম অন্তর্দ্বন্দ্বের পরে তিনি তাঁর জীবনের মূল সমস্যার মীমাংসায় পৌঁছেছিলেন।

তাঁর জীবনের মূল সমস্যা বলেছি। বলা উচিত ছিল, তাঁর সাহিত্যিক বা শিল্পীজীবনের। এ ছাড়া তাঁর আরও একটা জীবন ছিল, নৈতিক বা আধ্যাত্মিক জীবন। তিনি ছিলেন মূর্তিমান বিবেক। টলস্টয়ের পরে ইউরোপের বিবেক ছিলেন তিনি এবং বার্নার্ড শ। বিবেকের সঙ্গে আপোশ দুজনের মধ্যে একজনও করেননি। কিন্তু শ-এর বিবেকের চেয়ে রলাঁর বিবেক নির্ভরযোগ্য। গত মহাযুদ্ধে এর অগ্নিপরীক্ষা হয়ে যায়।

তারপর থেকে ইউরোপের বিবেকীদের দৃষ্টি শ-এর প্রতি তেমন নয়, রলাঁর প্রতি যেমন। কিন্তু এবারকার এই মহত্তর যুদ্ধে দেখা গেল, রলাঁর বিবেকও অনির্ভরযোগ্য। বেঁচে থাকলে তিনি আর বিবেকীদের দৃষ্টিপথে পড়তেন না। সে-দৃষ্টি পড়ছে অলডাস হাক্সলি প্রমুখের ওপর। যদিও এঁরা কেউ রলাঁর মতো, শ-এর মতো বিরাট পুরুষ নন। এইখানেই তাঁর ট্র্যাজেডি।

কিন্তু এর উপর তাঁর হাত ছিল না। এ ট্র্যাজেডি অনিবার্য। তাঁর জীবন আলোচনা করে আমি বুঝতে পেরেছি, তিনি কেন সেবারকার যুদ্ধে যোগ দেননি, কেন এবারকার যুদ্ধে ঝাঁপ দিয়েছেন। কারণটা রাজনৈতিক বললে কিছুই বলা হয় না, কারণটা তাঁর স্বভাবের মধ্যে নিহিত। ওটা তাঁর নিয়তির নির্দেশ। বিবেক হেরে গেছে নিয়তির হাতে। তাঁর দোষ নেই।

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে ফরাসিদের দেশে যে বিপ্লব ঘটে তার স্মৃতি ফরাসি মাত্রেরই মনোজীবনের অঙ্গ। এমন দিন নেই যেদিন তাদের মনে পড়ে না বিপ্লবী জনতার সুকৃতি বা দুষ্কৃতি, বিপ্লবী নেতাদের উদয় বা অস্ত। তারপরেও আরও কয়েক বার বিপ্লব ঘটে গেছে সেদেশে। ১৮৪৮ সালের বিপ্লবের আঠারো বছর পরে রলাঁর জন্ম। তাঁর যখন পাঁচ বছর বয়স তখন আরও একবার বিপ্লব বাঁধে, কিন্তু ইতিহাসে তাকে বিপ্লব বলে গণ্য করা হয় না; বলা হয়, কমুনার্দ বিদ্রোহ। রলাঁর মনোজগতে এইসব বিপ্লব বা বিদ্রোহের জের চলছিল জন্মকাল থেকে।

কিন্তু যাদের মাঝখানে তিনি মানুষ তারা মধ্যবিত্ত বা বুদ্ধিজীবী, তাদের স্বার্থ প্রথম বারের বিপ্লবেই সাধিত হয়েছে, দ্বিতীয় বারের অপেক্ষা রাখেনি। দ্বিতীয় বারের বিপ্লবে তাদের যেটুকু সহানুভূতি ছিল তৃতীয় বারের বেলা সেটুকুও রইল না। কমুনার্দ বিদ্রোহে তো তাদের সহানুভূতির বদলে অবজ্ঞার ভাব ছিল। মধ্যবিত্তরা বিপ্লবের নেতৃত্ব করা দূরে থাক, বিপ্লবকে হাড়ে হাড়ে ভয় করত। আবার বিপ্লব বাঁধবে, এতে তাদের অন্তরের সায় ছিল না। তবে তারা ভালো করেই বুঝত যে, জনসাধারণকে যদি তাতিয়ে কিংবা মাতিয়ে রাখা না যায় ওরা বিপ্লবের কথা ভাববে। সেইজন্যে জার্মানির সঙ্গে আবার কবে যুদ্ধ বাঁধবে, এবার ফ্রান্স জিতবে, এই ছিল তাদের নিত্যকার জল্পনা। আর ছিল আমোদপ্রমোদের ফলাও ব্যবস্থা। অন্তহীন মত্ততা এবং তপ্ততা।

রলাঁ মানুষ হন এই আবহাওয়ায়। তিনিও মধ্যবিত্ত তথা বুদ্ধিজীবী। স্বার্থের দিক থেকে বিচার করলে যুদ্ধবিগ্রহ ও ইন্দ্রিয়সুখ এই তো জীবনের লক্ষ্য। এর জন্যে যত পারো টাকা কামাও, যেমন করে পারো—ছলে-বলে-কৌশলে। তখনকার দিনের নৈতিক আদর্শ এর উপরে উঠত না। কিন্তু অতি অল্পবয়স থেকে রলাঁর তাতে বিরাগ আসে। দ্বিতীয়ত, তিনি যখন স্কুলের ছাত্র তখন থেকে টলস্টয়ের শিষ্য। যাকে বলে জীবনের সাফল্য তার চরমে উপনীত হয়েও টলস্টয়ের তৃপ্তি হল না, তিনি একে একে সব ত্যাগ করলেন—যা কিছু অর্থকরী, যা কিছু অনর্থকরী। কী করে মানুষকে ভালোবাসবেন, মানুষের সেবা করবেন—সব মানুষের, দীনহীন মানুষের—এই চিন্তায় টলস্টয় বিভোর। এমন সময় রলাঁর চিঠি—অজানা অচেনা তরুণের চিঠি তাঁর হাতে পৌঁছোয়। নগণ্য একটি তরুণকে ‘প্রিয় ভ্রাতা’ বলে সম্বোধন করে তিনি যে উত্তর দিয়েছিলেন সে-উত্তর দু-কথায় দায়সারা গোছের নয়। এই তরুণটি যেন তাঁর উত্তরাধিকারী, উত্তরাধিকারীকে সমস্ত জানাতে ও বোঝাতে হয়, তাই তিনি তাঁকে প্রকান্ড একখানি পত্র লিখেছিলেন। এইভাবে রলাঁর মন্ত্রদীক্ষা হল।

স্কুলের পড়া শেষ করে তিনি ইটালি যান, সেখানে দু-বছর কাটান। এক হিসাবে তাঁর শিক্ষানবিশি শেষ হয়েছিল স্বদেশেই। শিক্ষানবিশির পরে এক বছর দেশভ্রমণের রীতি ইউরোপের সনাতন প্রথা। রলাঁর ভ্রমণকাল কাটল ইটালির রোম প্রভৃতি অঞ্চলে। সেখানে তাঁর আলাপ হল এক বর্ষীয়সী জার্মান মহিলার সঙ্গে, নাম মালভিডা ফন মাইজেনবুগ। ইনি গ্যেটের সময়কার মানুষ। ভাগনার, নিটশে, মাতসিনি, গারিবল্ডি, ইবসেন প্রমুখের অন্তরঙ্গ বন্ধু। রলাঁকে দেখে ইনি চিনতে পেরেছিলেন তাঁর অন্তরবাসীকে। দুজনেই আদর্শবাদী, যে আদর্শ মরজগতে মহত্তম সেই আদর্শ দুজনের। মালভিডা তাঁকে আত্মপ্রত্যয় দিলেন, অস্তগামী তারা যেমন সূর্যকে দেয়। রলাঁ যখন রোম থেকে ফিরলেন তখন তিনি আদর্শনিষ্ঠ হতে কৃতসংকল্প। তখন আর তাঁকে মধ্যবিত্ত বলে ভুল করা যায় না। যাঁদের সে-ভুল ছিল তাঁদের ভুল ভাঙতে দেরি হল না। একজন তাঁকে বিয়ে করলেন ও বিয়ের অল্পকাল পরে আলাদা হলেন।

উপরে যাকে স্কুল বলা হয়েছে তা প্রকৃতপক্ষে কলেজ। রলাঁ হলেন সেখানকার অধ্যাপক। পরে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের, প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হন। পরবর্তী বয়সে তিনি পদত্যাগ করেন। লেখা থেকে যা পেতেন তাতেই তাঁর চলত। সারাজীবন সামান্য খরচে চালিয়েছেন।

ইটালি থেকে ফেরার পরে তিনি যখন সাহিত্যে প্রবেশ করলেন তখন তাঁর প্রিয় বিষয় হল বিপ্লব ও প্রিয় বিভাগ হল নাটক। জনগণের নাট্যশালা বলে তাঁর একটি পরিকল্পনা ছিল। সাধারণ রঙ্গালয় তো আমোদপ্রমোদের দোকান। তারজন্যে নাটক লেখা মানে দোকানদারি। যাতে দু-পয়সা হবে না তেমন কোনো নাটকে কেউ অভিনয় করবে না। আর অভিনয় করলেও কেউ পয়সা দিয়ে দেখবে না। অথচ নাটকের মতো সার্বজনীন অভিজ্ঞতাকে আমোদপ্রমোদের আধার করে তাই দিয়ে বণিকবৃত্তি সম্পাদন যে ঘোর অসভ্যতা ও অনীতি। গ্রিকদের নাট্যশালা গির্জার মতো, মন্দিরের মতো ধনগন্ধহীন ছিল। ফরাসিদের নাট্যশালাও তাই হবে। তারজন্য তিনি লিখতে লাগলেন বিপ্লবের কাহিনি। বিপ্লবের ও ন্যায়নিষ্ঠতার। কিন্তু লিখলে কী হবে! বিপ্লবের প্রতি মধ্যবিত্তদের মনোভাব প্রসন্ন নয়, তাদের হাতেই কলকাঠি। তাতে জল মেশাতে রলাঁ রাজি নন। সবচেয়ে দুঃখের কথা, জনগণ উদাসীন। হাড়ভাঙা খাটুনির পরে তারা চায় একটু রঙ্গ, একটু বিস্মৃতি। রলাঁ তা দিতে অক্ষম।

এরপরে তিনি নাটক লেখায় ক্ষান্তি দিয়ে জীবনচরিত ও উপন্যাস রচনায় মন দিলেন। এসব জনগণের জন্যে নয়। এগুলিতে বিপ্লবের কথা ছিল না, তবে বিদ্রোহের কথা ছিল। তাঁর মনের তার বিপ্লবের না হোক বিদ্রোহের সুরে বাঁধা প্রথম থেকেই। কিন্তু যুদ্ধের ওপর তাঁর আন্তরিক বিরাগ। যুদ্ধ বলতে ফরাসির কাছে বোঝায় জার্মানের সঙ্গে যুদ্ধ। জার্মান মানে মালভিডা ফন মাইজেনবুগ, জার্মান মানে বেঠোফেন। সংগীতের প্রতি তাঁর আকর্ষণ আশৈশব। তিনি বোধ হয় মনে মনে চেয়েছিলেন সংগীতশিল্পী হতে, ঘটনাচক্রে হয়ে দাঁড়ালেন সংগীতসমালোচক ও সাহিত্যিক। সংগীত ভালোবাসতেন বলে সংগীতনায়কদেরও ভালোবাসতেন। তাঁদের মধ্যে বেঠোফেনকেই ভালোবাসতেন সকলের চেয়ে বেশি। বেঠোফেন ছিলেন তাঁরই মতো বিপ্লবী বা বিদ্রোহী। সেই বেঠোফেনের স্বজাতির বিরুদ্ধে অসিধারণ? রলাঁর জন ক্রিস্টোফারও জার্মান। জন ক্রিস্টোফার-এর স্বদেশের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ? কখনো নয়। যুদ্ধ যদি আর কারও বিরুদ্ধে হত তাহলে হয়তো কথা ছিল। কিন্তু আর কারও বিরুদ্ধে হলেও তিনি যুদ্ধবিরোধী হতেন। কারণ তাঁর হৃদয়টা আন্তর্জাতিক। তিনি জাতিভেদে বিশ্বাস করতেন না। সেইজন্যে তাঁর পক্ষে কঠিন হত যেকোনো জাতির বিরুদ্ধে খড়্গধারণ।

অথচ তিনি যে ঠিক অহিংসাবাদী ছিলেন তা নয়। তা যদি হতেন বিপ্লবের কথা ভাবতেন না। বিপ্লব কি কোনোদিন বিনা রক্তপাতে হয়েছে? না। তিনি তা জানতেন। সেইজন্যে তাঁকে অহিংসক বলে ধরে নেওয়া যায় না। কিন্তু টলস্টয়ের প্রভাবে তিনি অহিংসার প্রয়োজন মানতেন। বিপ্লব বা বিদ্রোহ ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। উদ্দেশ্য যদি অহিংসভাবে সিদ্ধ হয় তো অহিংসাই শ্রেয়, যদি না হয় তো হিংসার আশ্রয় নিতে হবে। উপায়কে উদ্দেশ্যের উপরে স্থান দিলে চলবে না। এটা যে কেবল তাঁর শেষবয়সের যুক্তি তা নয়, এ যুক্তি বরাবরই তাঁর মনের তলে প্রচ্ছন্ন ছিল। কিন্তু এক বার যদি এ যুক্তিকে প্রশ্রয় দেওয়া হয় তো যুদ্ধবিগ্রহেরও সমর্থন করা হয়। যুদ্ধবিগ্রহকে সমর্থন করলে জার্মানির বিরুদ্ধে ইটালির বিরুদ্ধে যুদ্ধ বাঁধে। বেঠোফোনের বিরুদ্ধে, মাইকেল এঞ্জেলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ? ক্রিস্টোফার-এর বিরুদ্ধে, গ্রাতসিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ? অসম্ভব।

গত মহাযুদ্ধের মধ্যভাগে রাশিয়ায় যখন বিপ্লব ঘটে তখন রলাঁ পড়লেন দোটানায়। বিপ্লবী তিনি, তাঁর তো আনন্দে উদবাহু হওয়া উচিত। লেনিন না কি তাঁকে সহযাত্রী হতে সেধেছিলেন সুইটজারল্যাণ্ড থেকে রুশ দেশে। তিনি গেলেন না। বিপ্লব হলেই প্রতিবিপ্লব হবে, উভয় পক্ষে হাতাহাতি বেঁধে যাবে, তার মানে গৃহযুদ্ধ। তাই হল রাশিয়ায়। যুদ্ধের বিরুদ্ধে যিনি সুইটজারল্যাণ্ড থেকে প্রচারকার্য চালাচ্ছিলেন তিনি কেমন করে গৃহযুদ্ধের পোষকতা করতেন? অসংগতির অপবাদ রটত। তবে একথাও ঠিক যে, তিনি রক্তপাতে কাতর ছিলেন। ইতিহাসের বৃহত্তম যুদ্ধজনিত যে ভয়াবহ রক্তপাত ও তজ্জনিত শোকতাপ ইউরোপের বক্ষ ব্যাকুল করেছিল, রলাঁর বুকে বাজছিল সেই ব্যাকুল ব্যথা। এর উপর আবার বিপ্লব! তিনি প্রস্তুত ছিলেন না তারজন্যে।

মহাযুদ্ধের পরেও বহুকাল যাবৎ প্রস্তুত ছিলেন না। বিপ্লব যে মন্দ, এ যুক্তি তাঁর নয়। তাঁর যুক্তি, বিপ্লবের পদ্ধতি মন্দ। উদ্দেশ্য মন্দ নয়, উপায় মন্দ। বারবুসকে লিখেছিলেন,

I wrote in Clerambault (and I am more than ever of that opinion) : It is not true that the end justifies the means. The means are ever more important for true progress than the end. ..For the end (so rarely reached and always incompletely) but modifies the external relation, between men. The means, however, shape the mind of men according either to the rhythm of justice or to the rhythm of violence.

কিন্তু উপায়ের উপর এতটা জোর দিলে প্রকারান্তরে বিপ্লবের মূলোচ্ছেদ করা হয়, কারণ ইতিহাসে এমন বিপ্লব কোথায় যাতে উপায়ের শুদ্ধিরক্ষা হয়েছে? এই স্বতোবিরোধ রলাঁকে নিষ্ফল করত যদি-না তিনি আকস্মিকভাবে আবিষ্কার করতেন গান্ধীকে। গান্ধীও বিদ্রোহী জননায়ক, অথচ তাঁর উপায় অশুদ্ধ নয়। রলাঁর মন যা চায় তিনি তাই, তিনিই সেই বিপ্লবী যাঁর যুক্তি বিপ্লবের মূলোচ্ছেদ করে না। গান্ধীকে রলাঁ ইউরোপের বিপ্লবীমহলে পরিচয় করিয়ে দিলেন। কিন্তু ইউরোপের বিপ্লবীদের সম্মুখে তখন জরুরি প্রশ্ন : সোভিয়েত রাশিয়া যদি বিপন্ন হয় তাহলে কি উপায়ের কথা ভেবে সময় নষ্ট করা উচিত? রলাঁর গান্ধীচরিত এ প্রশ্নের উত্তর নয়। রলাঁ তা বুঝতে পেরেছিলেন। তাই শেষপর্যন্ত উপায়ের অশুদ্ধতা মেনে নিয়েছিলেন।

ভালো হোক মন্দ হোক এতকাল পরে একটা বিপ্লব ঘটেছে, তার ফলে জনসাধারণের অধিকার ও ক্ষমতা বেড়ে গেছে, এটা তো স্পষ্ট। কথা হচ্ছে, তার দুর্দিনে তাকে বাঁচাতে হলে হিংসার আশ্রয় নেওয়া চলবে কি না? রলাঁ বললেন, চলবে। যদি সোভিয়েতকে নিয়ে যুদ্ধ বাঁধে তাহলে যুদ্ধে যোগদান চলবে কি না? রলাঁ বললেন, চলবে। এমনি করে তিনি যুদ্ধবিরোধী থেকে যুদ্ধসমর্থক হয়ে উঠলেন। কিন্তু এর জন্যে তাঁর অন্তর্দ্বন্দ্বের সীমা ছিল না। জার্মানির সঙ্গে ইটালির সঙ্গে যুঝতে হল ফ্রান্সকে। বেঠোফেনের সঙ্গে মাইকেল এঞ্জেলোর সঙ্গে তাঁকে। কী প্রগাঢ় বেদনা! এ যেন নিজের হাতে নিজের পাঁজর ভাঙা।

খানিকটা আত্মপ্রতারণাও ছিল। রলাঁ মনে করেছিলেন, সময়মতো হস্তক্ষেপ করলে যুদ্ধ বাঁধবেই না। ‘অ্যাকশন’ ‘অ্যাকশন’ বলে তিনি যখন হাঁক ছাড়তেন তখন এই কথাটাই বোঝাতে চাইতেন যে, সময় থাকতে চেষ্টা করলে যুদ্ধ বন্ধ হবে। আমাদের অনেকেরই সেই ধারণা ছিল। হিটলারকে উঠতে না দিলে কি এত বড়ো যুদ্ধ বাঁধত? মুসোলিনিকে বাড়তে না দিলে কি হিটলারকে হারানো এত শক্ত হত? রলাঁর যুক্তি এক হিসেবে যুদ্ধবিরোধীরই যুক্তি। কিন্তু আমরা যেমন ছেলেমানুষ ছিলুম তিনিও তেমনি শিশু ভোলানাথ। জানতেন না যে, সরষের ভিতর ভূত থাকে।

লাভের মধ্যে হল এই যে, রলাঁর নৈতিক উচ্চতা টলস্টয়ের ধারেকাছেও রইল না। গান্ধীর কাছে তো নয়ই। নিয়তি।

তবে রলাঁ ছিলেন স্বভাবশিল্পী, সুযোগ পেলেই পিয়ানো নিয়ে বসতেন, বেঠোফেন বাজাতেন। নাটক বা উপন্যাস লিখতেন। লিখতেন সংগীত বিষয়ক প্রবন্ধ। মহাপুরুষদের জীবনদ্বন্দ্ব। জীবনছন্দ। তাঁর রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দচরিত একপ্রকার শিল্পকাজ। ও-বই লিখে তিনি সোভিয়েত রাশিয়ার বা বিপ্লবী ইউরোপের জিজ্ঞাসা দূর করেননি। ভারতের আত্মার সঙ্গে পরিচয় করিয়েছেন ইউরোপের আত্মার। সাধনার সঙ্গে সাধনার। আবিষ্কার করে আনন্দিত হয়েছেন যে, বাইরে আমাদের দূরত্ব যত হোক অন্তরে আমরা নিকট। এই আবিষ্কার তাঁকে শান্তি দিয়েছে শেষবয়সের চরম অশান্তির মাঝে। বলও দিয়েছে।

সাহিত্য হিসেবে তাঁর জীবনবৃত্তগুলির মূল্য কত জানিনে। তাঁর নাটক বেশি পড়িনি, মূল্য আমার অজানা। দুখানি উপন্যাস পড়েছি—‘জন ক্রিস্টোফার’ ও ‘মন্ত্রমুগ্ধ আত্মা’। দ্বিতীয়টি শেষ করিনি। যতদূর পড়েছি তার ওপর নির্ভর করে বলতে পারি প্রথমটির সমান হয়নি, কিন্তু তার চেয়েও গভীর হয়েছে। রসঘন হয়েছে। হয়েছে মর্মন্তুদ।

উভয় গ্রন্থেই গ্রন্থকারের মনে একই জিজ্ঞাসা—কেমন করে বাঁচব? একই উত্তর—মিথ্যার সঙ্গে আপোশ করব না, সত্য করে বাঁচব। এর দরুন যদি দুঃখ পেতে হয় দুঃখ পাব, এড়াব না। জীবনে বহু দুঃখ আছে তা জেনেও জীবনকে ভালোবাসব। সেই তো বীরত্ব। মর্তলোকে একমাত্র বীরত্ব।

ক্রিস্টোফার ও আনেত, দুই উপন্যাসের নায়ক-নায়িকা, উভয়েই অসুখী। তাদের সুখী করার জন্যে তাদের স্রষ্টার বিন্দুমাত্র প্রয়াস নেই। কিন্তু যাতে তারা খাঁটি থাকে—পোড়-খাওয়া সোনার মতো খাঁটি—সৃষ্টিকর্তার সমস্তক্ষণ লক্ষ। সাংসারিক অর্থে তারা সাধু বা সাধ্বী নয়, কিন্তু উচ্চতর অর্থে তারা শুদ্ধ, তারা নির্মল। পিউরিটি বলতে কী বোঝানো উচিত তার এক জোড়া নতুন উদাহরণ দিয়ে গেলেন রলাঁ। হয়তো শুধু এইজন্যেই তাঁকে এ দুটি মহাভারত-রামায়ণ লিখতে হয়েছিল এতকাল ধরে।

মহাভারত-রামায়ণের সঙ্গে এ দুটি এপিক উপন্যাসের তুলনা করছি আর এক কারণে। উভয়েরই অন্তরালে রয়েছে দুই প্রলয়ংকর যুদ্ধ। ভাবী যুদ্ধের ছায়া পড়েছে ‘জন ক্রিস্টোফার’-এর ওপরে। ‘মন্ত্রমুগ্ধ আত্মা’র ওপর ভূত-ভবিষ্যৎ উভয় যুদ্ধের ছায়া। সুতরাং পরোক্ষভাবে এ দুখানি যুদ্ধকাব্য। উচ্চাঙ্গের কি না, স্মরণীয় কি না, সে-বিচার মহাকাল করবে।

আমাদের কারো কারো জীবনে রলাঁর এ দুটি পুথি স্থায়ী প্রভাব রেখে গেছে। বিংশ শতাব্দীর ইউরোপে জন ক্রিস্টোফার অপ্রতিদ্বন্দ্বী। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীতে ওর সমকক্ষ অনেক। ওর চেয়েও মাথায় উঁচু টলস্টয় ডস্টোয়েভস্কির একাধিক উপন্যাস। রলাঁর স্থান সাহিত্যের সভায় তাঁদেরই পাশে। তবে জন ক্রিস্টোফার বা মন্ত্রমুগ্ধ আত্মা প্রধানত জীবনজিজ্ঞাসুদের জন্যে। ‘সমর ও শান্তি’ বা ‘কারামাজভ’ জীবনজিজ্ঞাসু তথা সর্বসাধারণের জন্যে।

‘জন ক্রিস্টোফার’ বিশেষ করে সংগীতপ্রেমিকদের জন্যে। এর পাতায় পাতায় সংগীত প্রসঙ্গ। বোধ হয় বেঠোফেনের জীবনী লিখে রলাঁর সংগীত সম্বন্ধে বলবার কথা ফুরোয়নি, তার সঙ্গে মিলেছে সাহিত্য সম্বন্ধে বক্তব্য। ক্রিস্টোফারের সঙ্গে অলিভিয়েরের। জার্মানের সঙ্গে ফরাসির। ক্রিস্টোফারকে জার্মান না করলে কি চলত না? না, চলত না। উঁচুদরের সংগীতকার যাঁরা তাঁদের শিক্ষা এক পুরুষের নয়, তিন-চার পুরুষের। বাখ ও বেঠোফেন প্রমুখ পুরুষানুক্রমে সংগীতশিল্পী। জার্মানিতে এর ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত, ফ্রান্সে বিরল। তারপর সংগীতশিক্ষা তো কেবল পরিবারে হয় না, হয় রাজরাজড়ার দরবারে। জার্মানিতে শত শত দরবার ছিল একশো বছর আগেও। ফ্রান্সে বড়োজোর ছিল একটি। তারপর জার্মানি এমন দেশ যে তার ছোটো-বড়ো সব শহরেই থিয়েটার, অপেরা, কনসার্ট ও সেই-জাতীয় অনুষ্ঠানের প্রতিষ্ঠান অগুনতি। পাড়ায় পাড়ায় জলসা, ঘরে ঘরে গানবাজনা। কাজেই ক্রিস্টোফারকে জার্মান করতেই হল। কিন্তু জার্মানিতে তখন সামরিকতার বাড়াবাড়ি, খুদে কর্তাদের সঙ্গে মুখ সামলে কথা কইতে হয়, কথায় কথায় বিধিনিষেধ। স্বাধীনচেতা ক্রিস্টোফারকে তাই বিপদে পড়ে ফেরার হতে হল প্যারিসে। সেখানে তাঁর ধীরে ধীরে পসার জমল, নামডাক হল। প্যারিস যদিও ফ্রান্সের রাজধানী তবু আন্তর্জাতিকতার পীঠস্থানও বটে। গুণী লোক দেখলে ফরাসিরা খাতির করে। ক্রিস্টোফার তাদের একজন হয়ে উঠল, ফ্রান্সকে ভালোবাসল অলিভিয়েরকে বন্ধু পেয়ে। এদের দুজনের বন্ধুতা প্রেমের চেয়েও নিখাদ। দেশের ব্যবধান অলীক, ভাষার ব্যবধান অলীক।

অলিভিয়ের আদর্শবাদী সাহিত্যিক। ক্রিস্টোফার আদর্শবাদী সংগীতকার। এমনই আরও কয়েক জন আদর্শবাদীকে বাস্তববাদীকে আমরা পাচ্ছি, তাদের কেউ নারী কেউ পুরুষ। তাদের এক-একজনের এক এক ধারা, এক এক দিকে গতি। একজনের নাম ফ্রাঁসোয়াজ উদোঁ। অভিনেত্রী। এঁর সম্বন্ধে গ্রন্থকার বলেছেন,

But especially he was indebted to her for a better understanding of the theatre; she helped him to pierce through to the spirit of that admirable art, the most perfect of all arts, the fullest and most sober. She revealed to him the beauty of that magic instrument of the human dreams,—and made him see that he must write for it and not for himself, as he had a tendency to do…Francoise’s ideas were in accordance with Christopher’s, who, at that stage in his career, was inclined towards a collective art, in communion with other men, Francoise’s experience helped him to grasp the mysterious collaboration which is set up between the audience and the actor…It was this common soul which it was the business of the great artist to express.

এরপরে আধুনিক ইউরোপ সম্বন্ধে বলা হয়েছে,

Modern Europe had no common book : no poem, no prayer, no act of faith which was the property of all. Oh! the shame that should overwhelm all the writers, artists, thinkers, of to-day! Not one of them has written, not one of them has thought, for all. Only Bethoven has left a few pages of a new Gospel of consolation and brotherhood : but only musicians can read it, and the majority of men will never hear it.

রলাঁর সাধ ছিল সংগীতকার হতে। বিধাতা বাদী। পূর্বপুরুষেরা সংগীতশিল্পী নন। নাট্যকার হতে স্পৃহা ছিল। তাঁর স্পৃহা থাকলে কী হবে, লোকের আগ্রহ ছিল না। বার বার তিন বার। এবার ঔপন্যাসিক। এবার সিদ্ধার্থ।

কিন্তু তাঁর সম্বন্ধেও ঠিক সেই কথাই বলা যায় বেঠোফেন সম্বন্ধে যা তিনি বলে গেছেন। একটু ঘুরিয়ে বললে যা দাঁড়ায় তা এই :

Rolland has left a few pages of a new Gospel of consolation and brotherhood : but only seekers after Life can read it, and the majority of men will never hear it.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *