রবিনসন ক্রুশো মেয়ে ছিলেন
রবিনসন ক্রুশো! আসলে তিনি কে ছিলেন জানেন? একজন মেয়ে। সকলের দিকে চেয়ে একটু অনুকম্পার হাসি হেসে ঘনশ্যামবাবু বললেন, তবে আপনারা আর সেকথা জানবেন কী করে?
আহত অভিমানে শিবপদবাবু কী একটা বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু আর সকলের চোখের ইশারায় নিজেকে তিনি সামলে নিলেন।
ঘমশ্যামবাবুর এই উক্তি নিঃশব্দে হজম করে উৎসুকভাবে সকলে তাঁর দিকে তাকালেন।
ঘনশ্যামবাবুর কথার প্রতিবাদ পারতপক্ষে কেউ আজকাল করেন না। কেন যে করেন না তা বুঝতে গেলে ঘনশ্যামবাবুর এই বিশেষ আসরটি ও তাঁর নিজের একটু পরিচয় বোধ হয় দেওয়া দরকার।
কলকাতা শহরের দক্ষিণে একটি কৃত্রিম জলাশয় আছে, করুণ রসিকতার সঙ্গে আমরা যাকে হ্রদ বলে অভিহিত করে থাকি। জীবনে যাদের কোনও উদ্দেশ্য নেই।
অথবা উদ্দেশ্যের একাগ্র অনুসরণে যাঁরা পরিশ্রান্ত, উভয় জাতের সকল বয়সের স্ত্রী পুরুষ নাগরিক প্রতি সন্ধ্যায় সেই জলাশয়ের চারিধারে এসে নিজের নিজের রুচিমাফিক স্বাস্থ্য অর্থ কাম মোক্ষ এই নব চতুর্বর্গের সাধনায় একা-একা বা দল বেঁধে ঘুরে বেড়ায় বা বসে থাকে।
এই জলাশয়ের দক্ষিণপাড়ে জলের কাছাকাছি এক-একটি নাতিবৃহৎ বৃক্ষকে কেন্দ্র করে কয়েকটি বৃত্তাকার আসন পরিশ্রান্ত বা দুর্বল পথিক ও নিসর্গদৃশ্য-বিলাসীদের জন্য পাতা আছে।
ভাল করে লক্ষ করলে এমনই একটি বৃত্তাকার আসনে প্রায় প্রতিদিনই সন্ধ্যায় পাঁচটি প্রাণীকে একত্র দেখা যাবে। তাঁদের একজনের শিরোশোভা কাশের মতো শুভ্র, একজনের মস্তক মর্মরের মতো মসৃণ, একজনের উদর কুম্ভের মতো স্ফীত, একজন মেদভারে হস্তীর মতো বিপুল আর একজন উষ্ট্রের মতো শীর্ণ ও সামঞ্জস্যহীন। প্রতি সন্ধ্যায় এই পাঁচজনের মধ্যে অন্তত চারজন এই বিশ্রাম-আসনে এসে সমবেত হন। এবং আকাশের আলো নির্বাপিত হয়ে জলাশয়ের চারিপার্শ্বের আলো জ্বলে ওঠার পর ফেরিওয়ালাদের ডাক বিরল না হওয়া অবধি, স্বাস্থ্য থেকে সাম্রাজ্যবাদ ও বাজার-দর থেকে বেদান্ত-দর্শন পর্যন্ত যাবতীয় তত্ত্ব আলোচনা করে থাকেন।
ঘনশ্যামবাবুকে এ-সভার প্রাণ বলা যেতে পারে, প্রাণান্তও অবশ্য তিনিই।
এ-আসর কবে থেকে যে তিনি অলংকৃত করেছেন ঠিক জানা নেই, তবে তাঁর। আবির্ভাবের পর থেকে এ-আসরের প্রকৃতি ও সুর একেবারে বদলে গেছে। কুম্ভের মতো উদরদেশ যাঁর স্ফীত সেই রামশরণবাবু আগেকার মতো তাঁর ভোজন-বিলাসের কাহিনী নির্বিঘ্নে সবিস্তারে বলার সুযোগ পান না, ঘনশ্যামবাবু তার মধ্যে ফোড়ন কেটে সমস্ত রস পালটে দেন।
রামশরণবাবু হয়তো সবে গাজরের হালুয়ার কথা তুলেছেন, ঘনশ্যামবাবু তারই মধ্যে রানি এলিজাবেথের আমলে প্রথম কীভাবে হল্যান্ড থেকে ইংল্যান্ডে গাজরের প্রচলন হয় তার কাহিনী এনে ফেলে সমস্ত প্রসঙ্গটার মোড় ঘুরিয়ে দেন।
কোনও দিন বিলিতি বেগুনের জেলি সম্বন্ধে রামশরণবাবুর উপাদেয় আলোচনা শুরু না হতেই ঘনশ্যামবাবু তাঁর শীর্ণ হাড় বেরোনো মুখে একটু অবজ্ঞার হাসি টেনে বলেন, হ্যাঁ, বেগুন বলতে পারেন, তবে বিলিতি নয়।
তারপর কবে দু-শো খ্রিস্টাব্দে গ্যালেন নামে কোন গ্রিক বৈদ্য মিশর থেকে আমদানি এই তরকারিটির বিশদ বিবরণ লিখে গিয়েছিলেন, তারও প্রায় বারো-শো বছর বাদে দক্ষিণ আমেরিকার পেরু থেকে কীভাবে জিটোমেট নামে অ্যাজটেক জাতের এই তরকারিটি টোম্যাটো নামে ইংল্যান্ডে ও ইউরোপে প্রচলিত হয়, বিষাক্ত ভেবে কত দিন খাদ্য হিসেবে টোম্যাটো ব্যবহৃত হয়নি সেই কাহিনী সবিস্তারে বলে ঘনশ্যামবাবু ভোজন-বিলাসের প্রসঙ্গকে ইতিহাস করে তোলেন।
মস্তক যাঁর মর্মরের মতো মসৃণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতপূর্ব ইতিহাসের অধ্যাপক শিবপদবাবুর ঐতিহাসিক কাহিনীকেও আবার তেমনই ভোজন-বিলাসের গল্পে
অনায়াসে ঘুরিয়ে দেন।
আসল কথা এই যে, সব বিষয়ে শেষ কথা ঘনশ্যামবাবু বলে থাকেন। তাঁর কথা যখন শেষ হয় তখন আর কিছু বলবার সময় কারও থাকে না।
তাঁর ওপর টেক্কা দিয়ে কারও কিছু বলাও কঠিন। কথায় কথায় এমন সব অশ্রুতপূর্ব উল্লেখ ও উদ্ধৃতি তিনি করে বসেন, নিজেদের অজ্ঞতা প্রকাশ পাবার ভয়েই যার প্রতিবাদ করতে কারও সাহসে কুলোয় না।
ঘনশ্যামবাবু এই সান্ধ্য-আসরের প্রাণস্বরূপ হলেও তাঁর সম্বন্ধে বিশেষ কিছু কারও জানা নেই। কলকাতার কোনও এক মেস-এ তিনি থাকেন ও ছেলে-ছোকরাদের মহলে ঘনাদা-রূপে তাঁর অল্পবিস্তর একটা খ্যাতি আছে এইটুকু মাত্র সবাই জানে। শীর্ণ পাকানো চেহারা দেখে তাঁর বয়স অনুমান করা কঠিন আর তাঁর মুখের কথা। শুনলে মনে হয় পৃথিবীর এমন কোনও স্থান নেই যেখানে তিনি যাননি, এমন কোনও বিদ্যা নেই যার চর্চা তিনি করেন না। প্রাচীন নালন্দা তক্ষশিলা থেকে অক্সফোর্ড কেমব্রিজ হার্ভার্ড, চিনের প্রাচীন পিঁপিঁন থেকে ইউরোপের সালো প্রাগ হিডেলবার্গ লাইপজিগ পর্যন্ত সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গেই তাঁর প্রত্যক্ষ যোগাযোগ আছে বলে মনে হয়।
তাঁর পাণ্ডিত্যে যত ভেজালই থাক, তার প্রকাশে যে মুনশিয়ানা আছে এ-কথা স্বীকার করতেই হয়।
তাঁর কথার প্রতিবাদ না করে আমরা আজকাল তাই নীরবে তাতে সায় দিয়ে থাকি।
রবিনসন ক্রুশোর প্রসঙ্গটার বেলায়ও সেইজন্যেই জিভের উদ্যত বিদ্রোহ আমরা কোনওরকমে সামলে নিলাম।
মাথার কেশ যাঁর কাশের মতো শুভ্র সেই হরিসাধনবাবুর ছোট্ট দৌহিত্রীটির দরুন সেদিন প্রসঙ্গটা উঠেছিল।
দৌহিত্রীটিকে সেদিন হরিসাধনবাবু বুঝি আদর করে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। যে বয়সে ছেলেদের সঙ্গে তাদের পার্থক্যটা মেয়েরা বুঝতে শেখে না বা বুঝেও মানতে চায় না, মেয়েটির বয়স ঠিক তাই। আমাদের গল্পগুজবের মধ্যে কিছুকাল মনোনিবেশ করবার বৃথা চেষ্টা করে হ্রদের মাঝখানের দ্বীপের মতো জায়গাটিকে দেখিয়ে সে বুঝি বলেছিল, দেখেছ দাদু, ঠিক যেন রবিনসন ক্রুশোর দ্বীপ!
দাদু কিংবা আর কারও মনোযোগ তবু আকর্ষণ না করতে পেরে সে আবার বলেছিল, বড় হলে আমি রবিনসন ক্রুশো হব—জানো?
এত বড় একটা দুঃসাহসিক উক্তির প্রতি উদাসীন থাকা আর বুঝি আমাদের সম্ভব হয়নি। মেদভারে যাঁর দেহ হস্তীর মতো বিপুল সেই ভবতারণবাবু হেসে বলেছিলেন, তা কি হয় রে, পাগলি। মেয়েছেলে কি রবিনসন ক্রুশো হতে পারে।
মেয়েটির হয়ে হঠাৎ ঘনশ্যামবাবুই প্রতিবাদ করে বললেন, কেন হয় না? একটু চুপ করে কিঞ্চিৎ অনুকম্পার সঙ্গে আমাদের দিকে চেয়ে তিনি আবার যা বললেন, তার উল্লেখ আগেই করেছি।
আমাদের কোনও প্রতিবাদ করতে না দেখে ঘনশ্যামবাবু এবার শুরু করলেন, রবিনসন ক্রুশো ড্যানিয়েল ডিফোর লেখা বলেই আপনারা জানেন। এ-গল্পের মূল কোথায় তিনি পেয়েছিলেন তা জানেন কি?
মস্তক যাঁর মর্মরের মতো মসৃণ সেই শিবপদবাবু সসংকোচে বললেন, যতদূর জানি, আলেকজান্ডার সেলকার্ক বলে একজন নাবিকের জীবনের অভিজ্ঞতা শুনেই এ-গল্প তিনি বানিয়েছিলেন।
যা জানেন তা ভুল! ঘনশ্যামবাবুর মুখে করুণামিশ্রিত অবজ্ঞা ফুটে উঠল, আত্মম্ভরি ইংরেজ সাহিত্যিকরা আসল কথা চেপে গিয়ে যা লিখে গেছে তা-ই অম্লান বদনে বিশ্বাস করেছেন। মনমাউথের বিদ্রোহে যোগ দেবার জন্যে ড্যানিয়েল-এর একবার ফাঁসি হবার উপক্রম হয় জানেন তো? লন্ডনের বাসিন্দা বলে কোনওরকমে। সে-যাত্ৰা তিনি রক্ষা পান। তারপর নতুন রাজা-রানি উইলিয়ম আর মেরি দেশে আসার পর ড্যানিয়েল কুগ্রহ কাটিয়ে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠা অর্জন করেন। সেই সময় ব্যবসা সংক্রান্ত কাজে তাঁকে যেতে হয় স্পেনে। সেই স্পেনেই মাদ্রিদ শহরের এক ইহুদি বুড়োর দোকানে খুঁটিনাটি জিনিসপত্র ঘাঁটতে-ঘাঁটতে একটি ত্রয়োদশ শতাব্দীর পুঁথি পেয়ে তিনি অবাক হয়ে যান। সে-পুঁথির অনুলেখক রাস্টিসিয়ানো আর তার কথক স্বয়ং মার্কো পোলো।
উদর যাঁর কুম্ভের মতো স্ফীত সেই রামশরণবাবু সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করলেন মার্কো পোলো মানে, যিনি ইউরোপ থেকে প্রথম চিনে গেছলেন পর্যটক হয়ে, রবিনস ক্রুশোর মূল গল্পের লেখক তা হলে তিনি!
একটু রহস্যময়ভাবে হেসে ঘনশ্যামবাবু বললেন, না, তিনি হবেন কেন! তিনি শুধু সে-গল্প সংগ্রহ করে এনেছিলেন মাত্র। সংগ্রহ করেছিলেন চিন থেকে।
ষোলো বছর বয়সে মার্কো পোলো তাঁর বাপ আর কাকার সঙ্গে পৃথিবীর অদ্বিতীয় সম্রাট কুবলাই খাঁর রাজধানী ক্যাম্বালুকের উদ্দেশে সাগর-সম্রাজ্ঞী ভেনিসের তীর থেকে রওনা হন। ফিরে যখন আসেন তখন তাঁর বয়স একচল্লিশ। দীর্ঘ পঁচিশ বছর ধরে অর্ধ-পৃথিবীর অধীশ্বর কুবলাই খাঁ-র বিশ্বস্ত কর্মচারীরূপে প্রায় সমস্ত চিন তিনি পর্যটন করে ফিরেছেন। ১২৮২ খ্রিস্টাব্দে ইয়াং চাও-এর এক লবণের খনির পরদিৰ্শক হিসাবে কাজ করবার সময় বিখ্যাত চিনা লেখক ও সম্পাদক সান কাও চি-র সঙ্গে তাঁর সম্ভবত সাক্ষাৎ হয়। সান কাও চি তখন অতীতের সমস্ত চিনা কাহিনী ও কিংবদন্তি সংগ্রহ করে তাতে নতুন রূপ দিচ্ছেন। সেই সান কাও চির কাছে শোনা। একটি চিনা গল্পই রবিনসন ক্রুশোর প্রধান প্রেরণা।
মার্কো পোলোরা চিন থেকে তাঁদের বিশ্রী ননাংরা বেঢপ তাতার পোশাকের ভেতরে সেলাই করে শুধু হীরা মোতি নীলা চুনিই নয়, আরও অনেক কিছুই এনেছিলেন। ভেনিস-এর ডোজেকে তাঁরা যা যা উপহার দেন, ১৩৫১ খ্রিস্টাব্দে লেখা মারিনো ফালিএবোর প্রাসাদের মূল্যবান দ্রব্যের তালিকায় তার কিছু বিবরণ পাওয়া যায়। সেসব উপহারের মধ্যে ছিল স্বয়ং কুবলাই খাঁর দেওয়া আংটি, তাতারদের পোশাক, তেলা একটি তরবারি, টাঙ্গুটের চমরিগাই-এর রেশমি ললাম, কস্তুরী মৃগের শুকিয়ে রাখা পা আর মাথা, সুমাত্রার নীলগাছের বীজ।
কিন্তু বাইরে যা এনেছিলেন তার চেয়ে অনেক বেশি সম্পদ এনেছিলেন পোলো তাঁর স্মৃতিতে বহন করে। জেনোয়া-র কারাগারে বসে সেই স্মৃতি-সমুদ্র-মথিত কাহিনীই তিনি মুগ্ধ শ্রোতাদের কাছে বলে যেতেন।
মুগ্ধ শ্রোতা কারা? না, শুধু তাঁর কারাসঙ্গীরা নয়, জেনোয়া-র অভিজাত সম্প্রদায়ের আমির-ওমরাহ পুরুষ-মহিলা সবাই। এই কারাকক্ষ তখন জেনোয়া-র তীর্থস্থান হয়ে দাঁড়িয়েছে রূপকথার চেয়ে বিচিত্র সুদূর ক্যাথের অপরূপ কাহিনীর মধুতীর্থ।
কিন্তু সাগর-সম্রাজ্ঞী ভেনিসের পরম শ্রদ্ধা ও ভালবাসার পাত্র মার্কো পোলো জেনোয়ার কারাগারে কেন? সে অনেক কথা। দেশে ফেরবার মাত্র তিন বছর বাদে ভেনিস-এর চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী জেনোয়া-র নৌবাহিনী লাম্বা দোরিয়ার নেতৃত্বে একেবারে আদ্রিয়াতিক সাগরে চড়াও হয়ে এল। আর সকলের সঙ্গে মার্কো পোলো গেলেন একটি রণতরীর অধিনায়ক হয়ে যুদ্ধে। সেই যুদ্ধে পরাজিত হয়েই আরও সাত হাজার ভেনিসবাসীর সঙ্গে তিনি জেনোয়ায় বন্দি হলেন।
জেনোয়া-র কারাগারে তাঁর মুগ্ধ শ্রোতাদের মধ্যে হেলে-পড়া মিনারের শহর পিসা-র এক নাগরিক ছিলেন। নাম তাঁর রাস্টিসিয়ানো। কাব্যের ভাষা প্রেমের কাহিনীর অপরূপ ভাষা হিসেবে ফরাসি তখনই ইউরোপে সর্বেসর্বা হয়ে উঠেছে। পিসার লোক হলেও সেই ফরাসি ভাষায় রাস্টিসিয়ানোর অসাধারণ দখল ছিল। মার্কো পোলোর অপূর্ব সব কাহিনী সেই ভাষায় তিনি টুকে রাখতেন।
তাঁর সেই টুকে রাখা কাহিনীই সারা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছে তারপর। দেড়শো বছর বাদে জেনোয়া-র আর এক নাবিক সেই কাহিনীর ল্যাটিন অনুবাদ পড়তে-পড়তে, সিপার সোনায় মোড়া প্রাসাদচূড়া যেখানে প্রভাত-সূর্যের আলোয় ঝলমল করে সেই সুদূর ক্যাথের স্বপ্নে বিভোর হয়ে গেছেন। সে নাবিকের নিজের হাতে সই করা ও পাতার ধারে ধারে মন্তব্য লেখা বইটি এখনও সেভিল-এর কলম্বিনায় গেলে দেখতে পাওয়া যায়। সেনাবিকের নাম কলম্বাস।
আরও প্রায় দু-শো বছর বাদে ড্যানিয়েল ডিফো মাদ্রিদ-এর এক টুকিটাকি শখের জিনিসের দোকানে রাস্টিসিয়ানোর অনুলিখিত এমনই আর-একটি পুঁথির সন্ধান পান। সেই পুঁথি থেকেই তেত্রিশ বছর বাদে রবিনসন ক্রুশোর গল্প তিনি গড়ে তোলেন।
মর্মরের মতো মস্তক যাঁর মসৃণ সেই শিবপদবাবু এবার বুঝি না বলে পারলেন না, কিন্তু রবিনসন ক্রুশো মেয়ে হলেন কী করে?
সান কাও চি-র যে-গল্প মার্কো পোলোর মুখে শুনে রাস্টিসিয়ানো টুকে রেখেছিলেন, তাতে মেয়ে বলেই তাঁকে বর্ণনা করা আছে। ড্যানিয়েল অবশ্য সেগল্পের নায়িকার নাম ও জাতি দুই-ই পালটেছেন।
মাথার কেশ যাঁর কাশের মতো শুভ্র সেই হরিসাধনবাবু বললেন, কিন্তু সেই পুঁথির গল্পটা কিছু শুনতে পারি?
সেই গল্প শুনতে চান? কিন্তু আসল কাহিনী অনেক দীর্ঘ, সংক্ষেপে তার সারটুকু আপনাদের বলছি শুনুন—
সুং রাজবংশের রাজধানী তখনও উত্তরের কাইফেং থেকে টাসুট দৌরাত্ম্যে কিত্সাই নগরে সরিয়ে আনা হয়নি। পৃথিবীর আশ্চর্যতম শহর হিসাবে কিনসাই-এর নাম কিন্তু তখনই মালয়, ভারতবর্ষ, পারস্য ছাড়িয়ে সুদূর ইউরোপে পর্যন্ত পৌঁছেছে। দ্বাদশ তোরণ ও দ্বাদশ সহস্র সেতুর এই নগরে চুয়ান উ নামে এক সদাগর তখন বাস করেন। সদাগরের মণি-মাণিক্য ধন-রত্নের অবধি ছিল না, কিন্তু সবচেয়ে মূল্যবান যে-সম্পদ তাঁর ছিল, সে হল তাঁর একমাত্র কন্যা নান সু।
কিসাই-এর খ্যাতি যেমন সারা পৃথিবীতে, নান সু-র রূপের খ্যাতি তেমনই সারা। চিনে তখন ছড়িয়ে গেছে। অসামান্য রূপ হয় নিজের, নয় সংসারের সর্বনাশ ডেকে আনে। নান সু-র রূপের বেলায়ও সে নিয়মের ব্যতিক্রম হল না? উত্তরের কিতানরা তখন কাইফেং-এর ওপর সমুদ্রের তরঙ্গের মতো বারবার হানা দিচ্ছে। সেই কিতানদের দলপতি চুয়ো সান-এর কানে একদিন কী করে নান সু-র অসামান্য রূপ-লাবণ্যের খবর পৌঁছোল। কাইফেং-এর নগর প্রাকারের ধারে তার দুরন্ত সৈন্যবাহিনীকে থামিয়ে চুয়োে সান তার সন্ধির শর্ত সুং রাজসভায় জানিয়ে পাঠাল, দ্বাদশ তোরণ ও দ্বাদশ সহস্র সেতুর যে নগরের মরকত নীল হ্রদের জলে স্বপ্নের মতো সব হরিৎ দ্বীপ ভাসে সেই নগরের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ চিনের নয়নের মণি নান সু-কে তার চাই। নান সু-কে পেলেই কাইফেং-এর প্রান্ত থেকে ভাঁটার সমুদ্রের মতো তার দুর্ধর্ষ বাহিনী সরে যাবে।
রবি ন স ন তু শো মেয়ে ছিলে ন
২৩ সমস্ত চিন চঞ্চল হয়ে উঠল এ-সংবাদে, রাজসভা হল চিন্তিত, নান সুর পিতা চুয়ান উ সদাগর প্রমাদ গনলেন।
একটি মাত্র মেয়ের জীবন বলি দিয়ে সমগ্র চিনের শান্তি ক্রয় করতে সুং রাজসভা শেষ পর্যন্ত দ্বিধা করলেন না। চুয়ান উ-র কাছে আদেশ এল নান সু-কে কাইফেং-এ পাঠাবার।
জাফরি কাটা জানলার ভেতর দিয়ে আর গজদন্তের পাখার ওপর দিয়ে ব্রীড়াবনতা নবযৌবনা নান সু তখন বাইরের পৃথিবীর যেটুকু পরিচয় পেয়েছে তার সমস্তই জুড়ে আছে একটিমাত্র মানুষের মুখ। সে-মুখ কিত্সাই নগরের তরুণ নৌ-সেনাপতি সি হুয়ান-এর।
নান সু কেঁদে পড়ল বাপের পায়ে, নতজানু হল সি হুয়ান। কিন্তু চুয়ান উ নিরুপায়। রাজাদেশ লঙ্ঘন করার শক্তি তাঁর নেই।
যেতেই হবে নান সু-কে সেই বর্বর কিতান-দলপতিকে বরণ করবার জন্যে উত্তরের সেই হিমের দেশে। নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাসে সি হুয়ান-এর ওপরই নান সু-কে নিয়ে যাবার ভার পড়ল।
দ্বাদশ তোরণ আর দ্বাদশ সহস্র সেতুর নগর থেকে সি হুয়ান-এর রণপোত যেদিন মেঘের মতো সাদা পাল মেলে রওনা হল সমস্ত কিসাই নগর সেদিন চোখের জল ফেললে। কিন্তু সি হুয়ান আর নান সুর মনে কোনও দুঃখ সেদিন নেই। ভাগ্য তাদের যদি পরিহাস করে থাকে ভাগ্যকেও তারা বঞ্চনা করবে—এই তাদের সংকল্প।
সাত দিন সাত রাত রণপোত ভেসে চলল সীমাহীন সাগরে। রণপোতের হাল ধরে আছে স্বয়ং সি হুয়ান। উত্তরে হিমের দেশের কোনও বন্দরে নয়, দক্ষিণের রৌদ্রোজ্জ্বল সাগরের মায়াময় কোনও দ্বীপই তার লক্ষ্য। একবার সেখানে পৌঁছেলে নিঃশব্দে রাত্রের অন্ধকারে নান সু-কে নিয়ে সে নেমে যাবে। সুং সাম্রাজ্যের অবিচার আর বর্বর কিতান বাহিনীর অত্যাচার যেখানে পৌঁছোয় না তেমনই এক নির্জন দ্বীপে নান সু-কে নিয়ে সে ঘর বাঁধবে। হালকা হাঁসের পালকের ভেলা সেজন্যে সে আগে থাকতেই সঙ্গে নিয়ে এসেছে।
মানুষের এ-স্পর্ধায় ভাগ্য বুঝি তখন মনে মনে হাসছে। সাত দিন সাত রাত্রি বাদে হঠাৎ দুর্যোগ নেমে এল আকাশে। দুর্যোগ ঘনাল মানুষের মনে।
সি হুয়ান নিজের হাতে হাল ধরায় তার অনুচরেরা গোড়া থেকেই একটু বিস্মিত হয়েছিল, সাত দিন সাত রাত্রিতেও গন্তব্য স্থানে না পৌঁছে তারা সন্দিগ্ধ হয়ে উঠল। উত্তর নয়, দক্ষিণ দিকেই তাদের রণপোত চলেছে, আকাশের তারাদের অবস্থানে সে-কথা বোঝবার পর তাদের সে-সন্দেহ বিদ্রোহ হয়ে জ্বলে উঠল।
রাত্রের আকাশে তখন প্রচণ্ড ঝড় উঠেছে। সমুদ্র উঠেছে উত্তাল হয়ে। ভাগ্যের সঙ্গে যারা জুয়া খেলে, বিপদকেই সুযোগরূপে ব্যবহার করবার সাহস তারা রাখে। এই ঝটিকাক্ষুব্ধ সমুদ্রেই পালকের ভেলা সমেত নান সু-কে নীচে নামিয়ে সি হুয়ান তখন নিজে নেমে যাবার উপক্রম করছে। বিদ্রোহী অনুচরেরা হঠাৎ এসে তাকে ধরে বেঁধে ফেলল।
উন্মত্ত এক তরঙ্গের আঘাতে রণপোত থেকে ভেলা সমেত দূরে উৎক্ষিপ্ত হতে-হতে নান সু শুধু ঝড়ের গর্জন ছাপিয়ে একটা চিৎকার শুনতে পেল, ভয় নেই, নান সু, ভয় নেই। আমি যাচ্ছি। আমি যাব-ই।
জ্ঞান যখন হল নান সুর ভেলা তখন ছোট্ট এক পার্বত্য দ্বীপের সৈকতের ওপর পড়ে আছে।
সভয়ে নান সু উঠে বসল, উৎকণ্ঠিতভাবে তাকাল চারিদিকে। কয়েকটা সাগর-পাখি ছাড়া কোথাও কোনও জনপ্রাণী নেই। দূরে অশান্ত নীল সমুদ্রের ঢেউ পার্বত্য তটের ওপর ক্ষণে ক্ষণে আছড়ে এসে পড়ছে।
শশকের মতো ক্ষুদ্র নবনী-কোমল নান সু-র পা—সে পা তো কঠিন পার্বত্য ভূমির ওপর দিয়ে হাঁটবার জন্য নয়, তবুনান সু-কে ক্ষত-বিক্ষত পায়ে সমস্ত দ্বীপ পরিভ্রমণ। করতে হল, কোথাও কোনও জনপ্রাণীর দেখা সে পেলে না।
তুষারধবল নান সুর অতিসুকোমল হাত—গজদন্তের চিত্রিত পাখা ছাড়া আর কিছু যে-হাত কখনও নাড়েনি, তবু সেই হাতে কণ্টকগুল্ম থেকে ফল ছিঁড়ে নান সু-কে ক্ষুধা নিবৃত্তি করতে হল।
ভীরু সলজ্জ নান সুর চোখ—আঁখি পল্লব তার কাঁপতে কাঁপতে একটু উঠেই চিরকাল নেমে এসেছে, তবু সেই চোখ উৎকণ্ঠিতভাবে মেলে পাহাড়ের চূড়া থেকে দূর সাগরের দিকে তাকে চেয়ে থাকতে হল দিনের পর দিন সি হুয়ান-এর আশায়। আসবে, সে বলেছে, আসবেই।
কত দিন কত রাত গেল কেটে। উত্তরের আকাশে কতবার সপ্তর্ষিমণ্ডলের বদলে শিশুমার আর শিশুমারের বদলে সপ্তর্ষি ধ্রুবতারার প্রধান প্রহরী হয়ে তাকে প্রদক্ষিণ করে গেল, তার কোনও হিসেবই নান সুর আর রইল না।
কখন ধীরে ধীরে তার হৃদয় থেকে সমস্ত লজ্জা আর দেহ থেকে জীর্ণবাস খসে পড়ে গেল সে জানতে পারল না।
অনেক কিছু তার গেল, গেল না শুধু চোখের সেই উৎসুক দিগন্ত সন্ধানী দৃষ্টি আর মনের সেই অবিচলিত প্রতীক্ষা।
একদিন সেই প্রতীক্ষা সফল হল। দূর দিক্রবালে দেখা দিয়েছে সাদা পালের আভাস। দেখতে-দেখতে দূরের সেই পোত স্পষ্ট হয়ে উঠল, লাগল এসে শিলাকঠিন কূলে।
কে নামছে সেই পোত থেকে। ওই তো সি হুয়ান!
অধীর আগ্রহে পাহাড়ের চূড়া থেকে উচ্ছল ঝরনার মতো নামতে লাগল নান সু।
মাঝপথেই সি হুয়ান-এর সঙ্গে দেখা হল।
উচ্ছ্বসিতভাবে নান সু যেন গান গেয়ে উঠল, এসেছ, সি হুয়ান, এসেছ এতদিনে?
লুব্ধভাবে যে তার দিকে এগিয়ে আসছিল সে যেন অনিচ্ছা সত্ত্বেও একটু বিমূঢ়ভাবে চমকে দাঁড়াল, কর্কশ কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলে, এসেছি এতদিনে মানে? কে তুমি!
সি হুয়ান-এর বিস্মিত অথচ লুব্ধ দৃষ্টি নিজের সর্বাঙ্গে অনুভব করে নান সু কাতরভাবে বললে, আমায় চিনতে পারছ না, সি হুয়ান? আমি নান সু।
নান সু!নান সু তো এই দ্বীপের নাম। যে-দ্বীপ খুঁজতে আমরা বেরিয়েছি, যে-দ্বীপ। এতদিনে খুঁজে পেয়েছি!
আমার খোঁজে তা হলে তুমি আসোনি? এসেছ দ্বীপের খোঁজে!
হ্যাঁ, এই নান সু দ্বীপের খোঁজে সাত সাম্রাজ্যের ঐশ্বর্য যার মাটিতে পোঁতা আছে। বলো কোথায় সে-ঐশ্বর্য?
অশ্রুসজল চোখে নান সু এবার যেন আর্তনাদ করে উঠল, তোমার কি কিছু মনে
নেই, সি হুয়ান! মনে নেই তোমার রণপোত থেকে কেমন করে ঝড়ের রাতে আমাদের ছাড়াছাড়ি হয়েছিল?
রণপোত থেকে ছাড়াছাড়ি! সাত পুরুষে আমাদের কেউ রণপোত চড়েনি। আট পুরুষ আগে এক সি হুয়ান কীরকম নৌ-সেনাপতি ছিলেন বলে শুনেছি। এই নান সু দ্বীপের গুপ্ত তথ্য নাকি তাঁর কাছ থেকেই পাওয়া। কিন্তু সে তো কাইফেং যখন চিনের রাজধানী ছিল সেই দু-শতাব্দী আগের কথা!
দু-শতাব্দী আগেকার কথা! অস্পষ্ট আবেগরুদ্ধ স্বরে উচ্চারণ করলে নান সু, তারপর নবাগত নাবিকের লুব্ধ দৃষ্টিতে হঠাৎ নিজের পরিপূর্ণ নগ্নতা আবিষ্কার করে চমকে উঠল।
নাবিক তখন লোলুপভাবে তার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। নান সু শরাহত হরিণীর মতো প্রাণপণে ছুটে পালাল, ছুটে পালাল সেই পর্বতচূড়ার দিকে, জীবনের পরম স্বপ্ন আজও যাকে ঘিরে আছে।
কিন্তু পদে-পদে তার দেহ কী গুরুভারে যেন ভেঙে পড়ছে, লুব্ধ হিংস্র নাবিকের হাত থেকে আর বুঝি রক্ষা পাওয়া যায় না।
পর্বতচূড়ার প্রান্তে এসে যখন সে আছড়ে পড়ল তখন শরীরে এতটুকু শক্তি আর তার অবশিষ্ট নেই।
কিন্তু লুব্ধ নাবিক তাকে সবলে আকর্ষণ করতে গিয়ে হঠাৎ সভয়ে শিউরে পিছিয়ে এল।
সবিস্ময়ে নান সু একবার তার দিকে, তারপর নিজের দিকে তাকিয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেল। তার একাগ্র প্রতীক্ষা দীর্ঘ দুই শতাব্দী ধরে যে-যৌবনকে অক্ষয় করে ধরে রেখেছিল সে-যৌবন দেখতে-দেখতে সরে যাচ্ছে। চোখের ওপর তার শরীর শুকিয়ে যাচ্ছে, কুঁকড়ে যাচ্ছে, কুৎসিত হয়ে যাচ্ছে।
বহু যুগের অভ্যাসে আচ্ছন্ন দৃষ্টিতে দূর-দিগন্তের দিকে সে বুঝি একবার তাকাল। চারিদিকে নীল সমুদ্র মথিত করে ও কারা আসছে! কারা? সে চিৎকার করে উঠল।
ওরাও সি হুয়ান! অট্টহাস্য করে উঠল নাবিক, হুয়ান-এর পাঁচ হাজার বংশধর! ওরাও আসছে এই নান সু দ্বীপের গুপ্তধনের সন্ধানে, আসছে পুড়িয়ে মারতে সেই ডাকিনীকে দু-শতাব্দী ধরে এ-দ্বীপের গুপ্তধন যে আগলে রেখেছে।
যে-পাহাড়ের চূড়া থেকে নান সু-র উৎসুক চোখ দুশতাব্দী ধরে দিচ্চক্রবাল সন্ধান করে ফিরেছে সেদিন রাত্রে জীবন্ত মশালরূপে তারই শীর্ষ সে উজ্জ্বল করে
ঘনশ্যামবাবু চুপ করলেন।
কিছুক্ষণ স্তব্ধ থাকবার পর মর্মরের মতো মস্তক যাঁর মসৃণ সেই শিবপদবাবু বললেন, কিন্তু রবিনসন ক্রুশোর সঙ্গে এ-গল্পের কোনও মিল তো নেই?
থাকবে কী করে? ঘনশ্যামবাবু একটু হাসলেন, সপ্তদশ শতাব্দীর ইংরেজ কসাই-এর ছেলে, গেঞ্জি আর টালির ব্যবসাদার ড্যানিয়েল ডিফো এ-গল্পের সূক্ষ্ম মর্ম কতটুকু বুঝবেন! মোটা বুদ্ধিতে তাই একে তিনি ছেলে-ভুলোনো গল্প করে তুলেছেন!
এ গল্পের আসল মর্মটা তাহলে কী? মাথার কেশ যাঁর কাশের মতো শুভ্র সেই হরিসাধনবাবু জিজ্ঞাসা করলেন। কিন্তু উত্তরে ঘনশ্যামবাবু এমনভাবে তাকালেন যে, এ-প্রশ্ন দ্বিতীয় বার তোলবার উৎসাহ কারও রইল না।
“মামাবাবু “ও “পরাশরবর্মা” (প্রেমেন্দ্র মিত্র) দিবেন প্লিজ