রক্তের দোষ

রক্তের দোষ

হাঁটছে লিটা। শশব্যস্ত।

তাড়া আছে ওর। আজকে দেরি হয়ে গেছে বাসা থেকে বেরোতে। তার উপর বৃষ্টি। মড়ার উপর খাড়ার ঘায়ের মতো পথে গাড়িঘোড়া একদম নেই।

অবশ্য না গেলেও চলত।

কাজে যাওয়ার তেমন ইচ্ছা ছিল না আজকে। সকাল থেকে ঝঞ্ঝার আভাস। এই নিয়ে দোনোমনো করতে করতে দেরিটা হয়েছে।

তবু শেষ পর্যন্ত যে আলসেমির কাছে হার মানতে হয়নি, এতেই খুশি ও। যাক, আজকের কামাইটা নষ্ট হলো না। উপরি পাওনা হিসাবে খদ্দেরদের টিপস তো আছেই।

ভালোই দেয়।

টাকা জমাচ্ছে ও। দুই বছরে বেশ কিছু জমেছে। আরও কিছু জমলে হাতে ছেড়ে দেবে কাজটা। শরমের চাকরি।

ভদ্রসমাজে বলাও যায় না।

স্বপ্ন ছিল, নায়িকা হবে। নিদেন পক্ষে মডেল। দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়াবে। ঈশ্বর রূপ আর ফিগার দিয়েছে। কিন্তু এখানে-ওখানে ঠোকর খেয়ে বুঝেছে, দুনিয়া বড় কঠিন ঠাই।

এখন জমানো টাকা দিয়ে ছোটখাটো ব্যবসা করার পরিকল্পনা। বিউটি-পারলারের দিকেই ঝোঁক।

আরও জোরে পা চালাল লিটা। ইস, কী যে পচা বৃষ্টি শুরু হয়েছে! নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়েছে নাকি সাগরে। মধ্য-এপ্রিলে এরকম বাদল সিয়াটলবাসী আর দেখেছে কি না, সন্দেহ।

শহরটাকে ধুয়েমুছে দেয়ার পণ করেছে যেন দেবরাজ জিউস।

বাদলার চাইতে বেশি হচ্ছে ঝড়। ক্ষণে ক্ষণে গতি পালটাচ্ছে। বাড়ছে। কমছে। যন্ত্রণাকাতর আহত মানুষের মতো আর্তনাদ করছে। উন্মাদের মতো এক-একবার এক এক দিকে ধেয়ে যাচ্ছে বাতাস। বৃষ্টিকে তাড়া করছে যেন। ভয় দেখাতে চাইছে। পাগলা হাওয়ার ধাওয়া খেয়ে জানালার কাঁচে, দরজার কবাটে মাথা কুটছে বৃষ্টির ফোঁটা। অবিরাম। দিশাহারা কোনও হতভাগিনীর মতো।

মাথার উপরে স্নান আকাশ। যেন ব্লটিং পেপার দিয়ে সব রং শুষে নেয়া হয়েছে। নগরীর বুকে ধূসর ছায়া।

আকাশ চিরে ছুটে যাচ্ছে বিদ্যুতের নীলচে শিখা। দিগন্ত থেকে দিগন্তে। আলোকিত করে দিচ্ছে ধরণীকে। সেই সঙ্গে চলছে গুড়ুম-গুড়ম।

লিটার মনে হচ্ছে, এক ঝাঁক ফোটোগ্রাফার উপর থেকে ছবি তুলছে পৃথিবীর। আলোটা ফ্ল্যাশলাইটের। কোথায় জানি পড়েছে, পৃথিবীতে মিনিটে ছয় হাজার বার বজ্রপাত হয়। কী সব গবেষণা! এত হিসাব কে রাখল? পাগল বিজ্ঞানীগুলোর বোধ হয় খেয়েদেয়ে কাজকম্ম নেই।

নাক-মুখ-চোখ কুঁচকে রেখেছে ও। ঝোড়ো হাওয়া মাথা থেকে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করছে রেইনকোটের হুড। চিবুকের নিচে শক্ত করে গিট মারা থাকায় পারছে না। কিন্তু নিরাবরণ জায়গাগুলোতে বৃষ্টির নির্মম খোঁচা হজম করতে হচ্ছে। হিমঠাণ্ডা কণাগুলো এত বড় যে, ব্যথা লাগছে রীতিমতো।

মাথাটা নুইয়ে এগিয়ে চলেছে লিটা বিক্ষুব্ধ প্রকৃতির সঙ্গে

অবিরত যুঝতে যুঝতে।

আর বেশি নয়। ওই তো দেখা যাচ্ছে এলম গাছটা। গার্ডিয়ান অ্যাঞ্জেলের মতো দাঁড়িয়ে। ঝকড়া পাতাগুলো বেদম দুলছে।

বিচিত্র একটা অনুভূতি হচ্ছে ওর। মনে হচ্ছে, ওর উপরে নজর রাখছে কেউ। পিছন পিছন অনুসরণ করছে। ওটার অস্তিত্ব টের পাচ্ছে ও। মা বলত, মেরুদণ্ডে যদি সুড়সুড় করে, বুঝতে হবে, শয়তানের কাজ ওটা।

থামল না ও। পিছন ফিরে চাইল না। ভয়টা অমূলক, বোঝে। মাঝে মাঝেই এরকম হয় ওর। কারণ ছাড়াই।

চেনা গলিতে পা রেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল লিটা।

ঘুপসি জায়গা। ভিতরে তেমন সেঁধোতে পারছে না বৃষ্টি। আস্তরবিহীন ইটের দেয়াল বেয়ে গড়িয়ে নামছে পানি। নদর্মার নোংরা পানির সঙ্গে গিয়ে মিশছে।

ময়লা ফেলার একটা ড্রামকে পাশ কাটাল ও।

দারিদ্র্যের চিহ্ন চারদিকে। সব কিছু বিবর্ণ। নিষ্প্রভ। খালি বোতল ছড়িয়ে রয়েছে এখানে-সেখানে।

দু পাশের দ্বিতল দালানগুলো থমথমে গাম্ভীর্যে চুপ করে আছে। ছাতলাপড়া প্রাচীর। কোনও বৈচিত্র্য বা অলঙ্করণ নেই।

একটা ভেন্টিলেটর দিয়ে বাষ্প বেরোচ্ছে।

এগুলোর বেশির ভাগ সস্তার হোটেল। প্রতিটা জানালায় পরদা। বদ্ধ কাঁচের শার্শি। বাইরের জগৎ থেকে নিজেদেরকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে ভাড়াটেরা। কারণ আছে। ওই পরদার অন্তরালে অনেক কিছু হয়। জুয়া। ড্রাগস। ফ্লেশ-ট্রেড। বেআইনি কাজকারবারের আড্ডাখানা।

অন্য সময় জায়গাটা গমগম করে। মলিন পোশাক। পরিহিত পথচারী কিংবা নেশাখোরের আনাগোনা দেখা যায়। পুলিসের নজর এড়িয়ে নীল ছবির পসরা সাজিয়ে বসে ভাসমান ফেরিঅলা। জটলা পাকায় রকবাজ ছোকরারা। গলিমুখে জমে ওঠে রূপোপজীবিনীর ভিড়।

আজ কেউ নেই।

ভেজা ঠাণ্ডা কাঁপুনি তুলল লিটার শরীরে। ছমছম করে উঠল গা-টা। অকারণে।

তা পাঁচটা বাজে। বৈরী আবহাওয়ার কারণে অসময়ে অন্ধকার হয়ে এসেছে। এই মুহূর্তে পৃথিবীর সব রং আটকে আছে যেন ওয়াইল্ড অর্কিড লেখা নিয়ন-সাইনটাতে।

বেগুনি সাইনবোর্ডটা কানাগলির শেষ মাথায়। তার নিচে। একটা দরজা। বন্ধ।

লিটা নবে হাত রাখার আগেই দরজাটা খুলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ওর কানের পরদায় নানান রকম আওয়াজের ঢেউ আছড়ে পড়ল।

ইভা। শিফট শেষ ওর।

সোনা-রং চুলগুলো পনিটেইল করেছে। মেয়েটা। এমনিতেই লম্বা, জিনস পরাতে আরও লম্বাটে লাগছে। সহকর্মীকে দেখে হাসল। হাই, লিটা।

হাই।

আধখোলা জ্যাকেটের চেইন পুরো তুলে দিল ইভা। ব্রাউন লেদার। পানি লেগে চকচক করছে। রেক্সিনের ব্যাগটা কাধবদল করল। জঘন্য ওয়েদার, না?

একদম।

এই অনুযোগ বোধ হয় পছন্দ হলো না বাতাসের। ফুলপাতার ছাপ মারা ছাতাটা খুলতেই টান দিয়ে কেড়ে নিতে চাইল ইভার হাত থেকে। পারল না অবশ্য। তবে পুরোপুরি উলটে গেল ছাতা। মটমট করে ভাঙল তিন-চারটা শিকের জোড়া।

ছাতাটার জন্য চিৎকার করে কাঁদবে বুঝি মেয়েটা। চেয়ে রয়েছে দোমড়ানো কাপড়ের দিকে। লিটার দিকে এমন ভাবে তাকাল, যেন সব দোষ ওর।

হাসি দিয়ে সহমর্মিতা জানাল ওকে লিটা। পা রাখল ভিতরে।

অপরিসর করিডোর। আলো কম। ভিড় উপচে পড়ছে। জোয়ান। বুড়ো। মাঝবয়সী। মেয়েও আছে। স্টাফ। কাস্টমার।

প্রাইভেট কর্নারে ঢুকছে কেউ কেউ বেরোচ্ছে। ধোয়া, সেন্ট আর মদের দুর্গন্ধে পরিবেশ গুমট।

গান বাজছে বিকট শব্দে। অশ্লীল কথা। চটুল সুর। ড্রামের বিড়িম-ধিড়িমটাই কানে লাগে বেশি। গা গরম করতে আসা খরিদ্দাররা চোখ দিয়ে ধর্ষণ করছে ওকে।

কারও দিকে তাকাল না লিটা, একে-ওকে পাশ কাটিয়ে চলে এল ড্রেসিং রুমে।

টিনা ছাড়া কেউ নেই রুমে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ব্রা, অ্যাডজাস্ট করছে মেয়েটা।

আয়নাটা ঘিরে বালব বসানো। ফ্রেমের উপরে। জ্বলছে সব কটা। উজ্জ্বল সাদা আলো ।

আরশির ভিতর দিয়ে লিটাকে দেখল মেয়েটা।

এসেছ! বলে উঠল। আমি তো ভাবলাম, আসবে না।

এলাম। বাসায় বসে থেকে বের হতে ইচ্ছা করল না।

ভালো করেছ।

চলে গেল টিনা দর্শকদের মনোরঞ্জন করতে।

নাইলনের বর্ষাতি খুলে হ্যাঁঙ্গারে ঝুলিয়ে রাখল লিটা। লেবু-রঙের সোয়েটারটাও। স্কার্টটা খুলে। এদিক-ওদিক তাকাল টাওয়েলের খোঁজে। হাত-মুখ মুছে মাথায় চেপে ধরল।– তোয়ালে। বেশি ভেজেনি।

দুধসাদা তোয়ালেটা আগের জায়গায় ছুঁড়ে দিয়ে হেয়ার ড্রাইয়ারের দিকে হাত বাড়াল ও। ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে তুলে নিয়ে চালু করল সেটা। ঘাড় একদিকে হেলিয়ে উষ্ণ বাতাসের পরশ লাগাল চুলে।

জলদি করার তাগিদ অনুভব করে ও। ফিরল বলে টিনা। সে এলে ওর শুরু। মা ওঅরড্রোব খুলল লিটা। বেছে বেছে এক সেট কালো সিল্কের অন্তর্বাস বের করল। নিজেরগুলো খুলে পরে নিল ওগুলো। তারপর মেক-আপ সারতে লাগল চটপট।

এরই মধ্যে চলে এল টিনা। উদোম বুক। জায়গামতো লসের বক্ষবন্ধনী। স্বত্ব ত্যাগ করে বিলিয়ে দিয়েছে দর্শনার্থীদের মাঝে। লজ্জাস্থান ঢাকার চেষ্টা কিংবা তৎপরতাও নেই ওর মধ্যে। দুই হাতে অনেকগুলো ডলার।

এসবে অভ্যস্ত ওরা। নগ্নতাই স্বাভাবিক এখানে। প্রস্তুত লিটা।

প্রথম প্রথম খারাপ লাগত। পয়সার জন্য কত কী যে করতে হয় মানুষকে! তা-ও ভালো, নিচেরটা খুলতে হয় না এখানে। নিয়ম নেই।

লোক কম আজকে।

ডজন দুই লোলুপ দৃষ্টির সামনে বাজনার তালে দেহ। প্রদর্শন করে ফিরে এল লিটা গ্রিন রুমে।

যাওয়ার উদ্যোগ করছে টিনা। কাপড় পরা শেষ। প্লেবয় এর লোগোঅলা গেঞ্জি আর জেগিংস।

দাঁড়াবে একটু? অনুরোধ করল লিটা। একসাথে বেরোব।

চটজলদি কাপড় পালটায় ও। সোয়েটারে মাথা গলিয়েছে, রাফায়েল এসে হাজির।

স্প্যানিয়ার্ড। ক্লাবের অ্যাটেণ্ড্যান্ট। থুতনিতে এক মুঠো দাড়ি।

কী, রাফ? লিটার জিজ্ঞাসা।

পরনে ঢোলা প্যান্ট। দুই হাত পকেটে ভরে রেখেছে রাফায়েল মার্টিনেজ। বলল, প্রাইভেট কল। তিন নাম্বার বুথ।

মানা করে দাও। আজকে পারব না।

কাঁধ ঝাঁকাল স্প্যানিশ। পিছন দিকে ঠেলে দিল মোটা ফ্রেমের চশমাটা। তোমার ভালো তুমিই বোঝে। তবে দুই শ দেবে। দশ মিনিটের জন্য।

যুবকের টি-শার্টে চোখ লিটার। কালো ব্যাকগ্রাউণ্ডে বড় বড় হরফে লেখা: ডোন ট টাচ মি, আই ম আ ভেজিটেরিয়ান।

ডাহা মিথ্যা। মাংসে বিন্দুমাত্র অরুচি নেই মার্টিনেজের।

দুই

গাড়ি চালাচ্ছে জন ডিউক। লাল একটা চেরোকি। নাম্বারপ্লেটটা ম্যারিল্যাণ্ডের। 42458OM.

ওর এক হাত স্টিয়ারিং-এ। গাঢ় রঙের শার্টের হাতা গোটানো।

একটা এরিয়্যাল দুলছে জিপের মাথায়। ছাতে তেরপল দিয়ে ঢাকা মালসামান। কষে বাঁধা রশি দিয়ে।

স্পিড বেশি নয় গাড়ির।

জায়গা চিনবার জন্য একটু পর-পর বাইরে তাকাতে হচ্ছে ওকে জানালা দিয়ে। হোল্ডিং প্লেটের নাম্বার দেখতে হচ্ছে চোখ সরু করে।

একই ধাঁচে বানানো রাস্তার দু পাশের বাড়িঘরগুলো। তেমন কোনও চিহ্ন নেই আলাদা, করার। তবে এই ব্লকেই বাড়িটা, জানে ও।

একটার পর একটা ল্যাম্পপোস্ট পেরোচ্ছে গাড়ি। পিছনে পড়ছে আইভি লতায় ছাওয়া ফটক… পাথরের সীমানা-পাঁচিল… মেইলবক্স… পাতাবাহারের বেড়া।

হুশ করে উলটো দিকে চলে গেল একটা সাইকেল। আরোহী এক কিশোরী।

এই তো! ১৯১০।

পাশের জানালা দিয়ে ঘরবাড়িগুলো পর্যবেক্ষণ করছিল মনিকা লোরেন। চাইল হাবির দিকে।

মুখে হাসি জনের। ঝকমক করছে চোখ দুটো। ওর ইতালিয়ান বউ কী রকম খুশি হবে, কল্পনা করে চওড়া হলো হাসিটা।

কম ধকল যায়নি ওর জন্য এই সারপ্রাইজটা রেডি করতে। রিয়েল এস্টেটের লোকটাকে বার-বার করে বলে দিয়েছে, সতেরোই এপ্রিলের আগেই যেন তৈরি থাকে বাড়িটা।

শেষ মোড়টা ঘুরে ছিমছাম, নিরিবিলি একটা রাস্তায় প্রবেশ করল চেরোকি।

দোতলা একটা বাড়ির উপরে চোখ পড়ল মনিকার। ছবির মতো সুন্দর বাড়িটা। লাল সিরামিক ইট আর হলুদ রঙে মানিয়েছে দারুণ। চিমনি আছে। দরজা-জানালাগুলো ধবধবে সাদা।

এক চিলতে লন সামনে। এক পাশে একটা পাইন গাছ। দাঁড়িয়ে। নিঃসঙ্গ।

তোমার উপহার,  বলল জন।

মনিকার কালো চোখের মণিতে অবিশ্বাস।

খোয়া বিছানো ড্রাইভওয়েতে উঠল গাড়ি। থামল কিছুটা এগিয়ে।

আগেই পৌঁছে গেছে মালপত্রে ঠাসা দুটো ভ্যান। জিপটা দেখে মাল নামাতে তৎপর হলো লেবারাররা।

সিটবেল্ট খুলল মনিকা। নামল গাড়ি থেকে।

রাতভর বর্ষণের পর রৌদ্রোজ্জ্বল একটা দিন। আকাশটা মনে হচ্ছে কোবাল্ট ব্লু রঙের। এত নীল!

চনমনে ভাব বাতাসে। টুইই-টুইই করে নাম না জানা একটা পাখি ডাকছে ফুলের দঙ্গলে। দেখা যাচ্ছে না।

বুক ভরে শ্বাস নিল মনিকা। বুকের উপরে দুই হাত বেঁধে রাজনন্দিনীর মতো তাকাল এদিক-সেদিক। ওর সৌভাগ্যে ঈর্ষান্বিত হওয়ার মতো কাউকে দেখতে পেল না আশপাশে।

ঘাড় ফিরিয়ে হাসি দিল জনের উদ্দেশে।

গাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে বউয়ের প্রতিক্রিয়া উপভোগ করছিল জন। হাসল চোখে চোখ পড়তে। এগিয়ে গেল সামনে।

আমাদের বাড়ি? ভীষণ রোমাঞ্চ অনুভব করছে মনিকা। চোখেমুখে মুগ্ধতা।

হ্যাঁ, ডার্লিং।

তৃপ্তিতে ভরে উঠল মেয়েটার বুক। নিজের বাড়ি! মাথা নাড়ল ওর গর্বিত স্বামী।

ওহ, জন! শিশুর মতো উচ্ছ্বাস দেখাল মনিকা। এত সুন্দর বাড়ি জিন্দেগিতে দেখিনি।

হাসল জন। নিজেদের একটা বাড়ির চাইতে সুন্দর কিছু আছে পৃথিবীতে? আগে যেখানটায় থাকত, বিচ্ছিরি এক অ্যাপার্টমেন্ট ছিল সেটা।

সিঁড়ি ডিঙিয়ে উঠতে হয় টেরাসে। রেলিং-ঘেরা টানা বারান্দা। শুধু সিঁড়ির মুখটা খোলা।

হাত ধরাধরি করে উঠে এল ওরা। সদর দরজার সামনে এসে থামল।

ব্রাস-নকার বসানো দরজার গায়ে। উপরের দিকে কাঁচের প্যানেল। ফ্রস্টেড।

পকেট থেকে চাবির গোছা বের করল জন। বিশেষ একটা চাবি খুঁজে নিয়ে ধরিয়ে দিল মনিকার হাতে।

লাজুক হাসল মেয়েটা। হাসিটা ফিরিয়ে দিল জুন। তালা খুলল মনিকা। ঠেলা দিল পাল্লা। হাততালি দিল জন। তারপর দু জনেই চমকে উঠল একটু। ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখে, ভ্যানের কর্মচারীরাও করতালি দিয়ে অভিনন্দন জানাচ্ছে ওদেরকে।

আন্তরিক ধন্যবাদ দিল ওদের স্বামী-স্ত্রী। সাবধানে কাজ করতে বলে চৌকাঠ ডিঙাল জন বউকে নিয়ে।

নিরেট শূন্য ঘর।

ঘরের মাঝখানে এসে ব্যালে নৃত্যের ভঙ্গিমায় একপাক ঘুরল মনিকা। দেখতে লাগল চারপাশটা। তাকাল সিলিং-এর দিকে। নির্মেঘ আকাশের মতো নিষ্কলুষ ছাত।

কী সুন্দর নতুন-নতুন সৌরভ ছড়াচ্ছে সব কিছু থেকে! সদ্য পেইন্ট করা সফেদ দেয়াল, উপরতলায় যাওয়ার সিঁড়ি, মোমপালিশ করা তেলতেলে মেঝে- সব একেবারে বকঝকে

সিঁড়ির গোড়ায় এসে উপরে তাকাল মনিকা। স্পর্শ করল কাঠের রেলিং। মসৃণ। বার্নিশের মিষ্টি সুরভি এল নাকে।

সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে শুরু করল ও। ধীরে ধীরে। কাঠের উপরে জুতোর হিলের শব্দ উঠতে লাগল। ঠকাস। ঠকাস।

ওর পিছু নিল জন।

প্রশস্ত ল্যাণ্ডিং-এ গিয়ে শেষ হয়েছে ধাপ। পিকচার উইণ্ডো পাশে। খিড়কি গলে রোদ আসছে।

বাইরে রোজ-র্যাম্বলারের ঝাড়। বেড়ে উঠেছে বাতায়ন ছুঁয়ে। তিরতির কাঁপছে পাতা।

জানালায় মুখ ঠেকাল মনিকা। নাকটা চেপ্টে গেল কাঁচে। রাস্তার ওধারের বাড়িটা দেখা যাচ্ছে পরিষ্কার। সাদা হুডি পরা এক কৃষ্ণাঙ্গ ছোট একটা কার্টন তুলে নিল ভ্যানটা থেকে। এগিয়ে আসছে বাড়িটার দিকে।

অদ্ভুত এক অনুভূতি হলো, মনিকার। কী জানি ঠেকে আছে গলায়। আশ্চর্য! জল আসছে কেন চোখে?

ঘুরে দাঁড়াতেই ভুবন ভোলানো হাসি হাসল জন। দু হাত বাড়িয়ে আলিঙ্গন করল ওকে মনিকা। চুমু খেল।

বলো তো, এই মুহূর্তে দুনিয়ার সবচাইতে সুখী মানুষ কে? গলাটা কাঁপছে ওর আবেগে। নিজেই উত্তর দিল, আমি। থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ, ডিয়ার! এটা আমার বেস্ট বার্থডে গিফট।

তিন

পাওনা বুঝিয়ে দিয়ে পিক-আপ দুটোকে বিদায় করতে করতে বেলা পড়ে এল। রাস্তায় দাঁড়িয়ে ও-দুটোর চলে যাওয়া দেখল জন।

অল্পবয়সী এক মা প্যারাসুলেটর ঠেলে ঢুকে গেল এক বাড়ির গেট দিয়ে।

বিদায়ী রোদ্দুরটায় যেন জাদু আছে। কেমন মায়াবি লাগছে সব কিছু। কেমন আপন। মনেই হচ্ছে না, নতুন জায়গা এটা।

বাসায় ঢোকার জন্য ঘুরতেই দেখতে পেল জন মহিলাকে।

পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়স। বেঁটে। বোঝা যায়, সুন্দরী ছিল এক সময়। নরম কাপড়ের ট্রাউজার পরনে। গায়ে পুরুষের শার্ট। খড়রঙা চুলগুলো ক্লিপ দিয়ে এক পাশে আটকানো।

কাছে এল। সহৃদয় হাসি দিয়ে বলল, গুড ইভনিং। আজকেই এলে বুঝি?

মহিলার মুখে সিগারেটের গন্ধ পেল জন। জি। সে-ও। হাসছে আন্তরিক।

ভালোই হলো। নতুন পড়শি পেলাম।

কাছেই থাকেন আপনি?

আধ ব্লক দূরে। একটা দিক দেখাল হাত দিয়ে। ভদ্রমহিলার হাতে খবরের কাগজ। অন্য হাতটা বাড়িয়ে দিল জনের দিকে। তামারা ব্রাইস।

নাম শুনে অনুমান করল জন- আইরিশ মহিলা। তবে কথায় টান নেই কোনও। চেহারাসুরতও টিপিক্যাল মার্কিনদের মতো। হাতটা ধরতেই ঝাঁকিয়ে দিল। ছোট্টমোট্ট হলেও জোর আছে গায়ে।

জন ডিউক,  বলল যুবক।

আমেরিকান? জনের ইংরেজিতে জড়তা নেই কোনও; কিন্তু ওর কালো চুল, কালো চোখ দ্বিধায় ফেলে দিয়েছে মিস ব্রাইসকে।

ইয়াহ।

বাপ বাঙালি জনের। অনেক বছর আগে এসেছিলেন এখানে, চাকরিসূত্রে। পরে সেটল করেছেন। জনের আমেরিকান মায়ের প্রেমে পড়ে বিয়ে করেন তাকে। সেই সুত্রে পান যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকতু।

এখানেই জন্ম জনের। অতএব, সে-ও এই দেশের নাগরিক।

সেকথা বলল ও মহিলাকে।

কোথাকার লোক তোমার বাবা? ইনডিয়া নিশ্চয়ই!

নো, ম্যাম, বাংলাদেশ। একটু হাসল জন। মনে মনে। বলল, এরপর আপনি জিজ্ঞেস করবেন, বাংলাদেশ জায়গাটা। কোথায়। সচরাচর যেটা হয়।

কিন্তু ওকে বিস্মিত করে দিয়ে বলে উঠল ভদ্রমহিলা, ওয়াও! রিয়েলি? আমার এই শার্টটা কিন্তু ইমপোর্টেড ফ্রম বাংলাদেশ!

গর্বে বুকটা ফুলে উঠল জনের। একবার মাত্র বাংলাদেশে গেলেও বুকের ভিতরে প্রবল মমতা লালন করে ও দেশটার জন্য। একেই বোধ হয় বলে নাড়ির টান।

তামারা ব্রাইসকে ভালো লেগে গেল ওর।

এর আগে কোথায় ছিলে তোমরা? প্রসঙ্গ ঘোরাল প্রৌঢ়া।

ওঅশিংটন ডি.সি.-তে। ভাজ করা দৈনিকটার একটা হেডলাইনের উপরে চোখ আটকে গেল জনের। লাল ফন্টে ছাপা স্ট্রিপার ফাউণ্ড মার্ডারড পর্যন্ত পড়তে পারছে। বাকিটা ভাজের অন্যপাশে।

মে আই? হাত বাড়িয়ে দেখতে চাইল ও পত্রিকাটা। ওহ, শিয়োর।

স্থানীয় কাগজ। সান্ধ্য সংস্করণ। আয়োজন করে পরিবেশন করা হয়েছে সংবাদটা। চার কলাম জুড়ে। সাথে বড় করে ক্লোজ-আপ ছবি। রঙিন। হাস্যোজ্জ্বল।

চট করে চোখ বুলিয়ে নিল ও নিউজটায়।

বিশেষ কোনও তথ্য নেই। খালি নানান সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেছে প্রতিবেদক। গল্প ফেঁদে বসেছে আন্দাজের উপরে।

বয়স উনিশ মেয়েটার। নির্জন এক অ্যালিতে পাওয়া গেছে লাশ। ধড় আছে, মাথা নেই!

কে, জন? কার সাথে কথা বলছ? পোর্চে দাঁড়িয়ে মনিকা। অ্যাপ্রন পরে নিয়েছে একটা। ইতোমধ্যে ধুলোবালিতে ময়লা হয়ে গেছে সেটা। কালিঝুলি লেগে আছে। হাতে, মুখে।

হাতছানি দিল ওকে জন। কাছে এলে ইন্ট্রোডিউস করিয়ে দিল তামারা ব্রাইসের সঙ্গে।

সন্ধ্যায় চলে এসো না আমার বাসায়! ডিনারটা ওখানেই করবে, দাওয়াত দিয়ে বসল মহিলা।

দৃষ্টি বিনিময় করল স্বামী-স্ত্রী। চোখে চোখে কথা হলো ওদের।

ধন্যবাদ, মিস ব্রাইস, ক্ষমাপ্রার্থনার সুরে বলল মনিকা। নিশ্চয়ই আসব। তবে আজ নয়, আরেক দিন। বুঝতেই পারছেন, হাজারটা কাজ পড়ে আছে ওদিকে! বহুত গোছগাছ। বাকি।

সেজন্যই তো বলছি… রান্নাবান্নার ঝামেলা কোরো না। চলে এসো।

পেপারটা ফেরত দিল জন।

যাই তা হলে। দেখা হচ্ছে সন্ধ্যায়।

বাসার দিকে চলল তামারা। চোখের আড়াল হতেই মুখ খুলল মনিকা। মহিলা বেশ মিশুক।

হুম, মাথা দুলিয়ে সহমত প্রকাশ করল জন। ললাটে কুঞ্চন। ভাবছে নর্তকীর কথা।

এমন নৃশংস ভাবে হত্যা করল কে মেয়েটাকে?

কেন?

চার

পরের দিন সকাল।

বন্ধুকে চমকে দেবে বলে আগে থেকে জানায়নি কিছু, সোজা ওর কর্মস্থলে এসে হাজিরা দিল জন। কাজে যায়নি। আজ ও। ছুটি নিয়েছে কয়েক দিন।

সিয়াটল জননিরাপত্তা ভবন। আটতলা একটা বিল্ডিং। অফ-হোয়াইট ডিসটেম্পার।

বিলি বব থর্নটন কোথায় বসে, জানা আছে ওর।

এলিভেটরে চেপে উঠে এল ছ তলায়। নির্ধারিত কক্ষের। সামনে এসে দাঁড়াল। কেউ ওকে আটকায়নি। কড়াকড়ি

যা আগেও এখানে এসেছে ও। শেষ এসেছিল বছর দুয়েক আগে। পরিচিত কয়েকটা মুখ চোখে পড়ল। কিন্তু কেউ ওকে খেয়ালই করল না।

মৌচাকের ব্যস্ততা গোটা প্রতিষ্ঠানে। ব্যস্তসমস্ত লোকজন ছুটোছুটি করছে। মশমশ শব্দ হচ্ছে জুতোর।

এদিকে ফোন বাজছে। অনবরত। ডাকে আসা এক গাদা চিঠিপত্র নিয়ে বসেছে কেউ। খটাখট চাবি টিপছে কমপিউটারের।

হাজারও রকমের অভিযোগ নিয়ে আসছে লোকে। কথা বলছে উচ্চস্বরে।

সন্দেহভাজনদের ধরে এনে বসিয়ে রাখা হয়েছে বিশেষ বেঞ্চে।

দরজার আগায় লাগানো ইস্পাতের পাত। খোদাই করে লেখা ওতে লেফটেন্যান্টের নাম। পাল্লার দু পাশের দেয়াল গ্লাস-প্যানেল করা। ভেনিসিয়ান ব্লাইণ্ডস ঝুলছে ওদিকটায়।

পরদার ফাঁক দিয়ে বন্ধুকে দেখতে পেল জন। নিখুঁত ছাটের কালো সুট, কালো টাই পরেছে ওর বন্ধ। কালো প্যান্ট। শার্টটা শুধু ধবধবে সাদা।

মেন ইন ব্ল্যাক মুভিটার কথা মনে এল ওর। শুধু একটা সানগ্লাসের অভাব।

নির্মল হাসি ফুটল জনের ঠোঁটে। বন্ধু ওর আগের মতোই আছে। একই রকম ধোপদুরস্ত। খাটো করে হেঁটেছে সোনালি চুল।

এক তা কাগজ ববের হাতে। আরেক হাতে কী জানি। নড়ছে মুখ। বিপরীত দিকের দেয়ালে নিবদ্ধ চোখ দুটো।

দেয়ালে ঝোলানো শ্বেত পটভূমির উপরে ফুটে আছে একটা ইমেজ। সামনে প্রজেক্টর। সেখান থেকে আলোকরশ্মি গিয়ে পড়ছে পরদায়। ঘরের এক মাত্র আলোর উৎস ওই

যন্ত্রটা। মিটিং চলছে ভিতরে।

হাতের জিনিসটা প্রজেক্টরের দিকে মুখ করে ধরে টিপে দিল বব। বদলে গেল ছবি। রিমোট কন্ট্রোলিং ডিভাইস ওটা।

ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল সে উপস্থিত অন্যদের দিকে। দৃষ্টি পড়ল কামরার বাইরে দাঁড়ানো লোকটার উপরে। নজর ফিরিয়ে নিতে যাচ্ছিল, কী মনে হতে মুখ ঘোরাল আবার। সুদীর্ঘ একটা মুহূর্ত তাকিয়ে রইল লোকটার দিকে। বাইরের আলোর দিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মুখ দেখা যাচ্ছে না লোকটার। কিন্তু ভীষণ পরিচিত ঠেকছে গড়নটা।

কাগজটা টেবিলে ফেলে দরজার দিকে এগোল বব। যেতে যেতে বড় হয়ে উঠল চোখ দুটো। টানল ডোরন ঘুরিয়ে।

দোস্ত! বত্রিশ পাটি দাঁত বেরিয়ে পড়ল জনের।

আবে ইয়ার! তুই কোত্থেকে? গলাটা একটু চড়ে গেল অফিসারের।

অন্তত পনেরো জোড়া চোখ ঘুরে চাইল ওর দিকে।

ববের চোখ-মুখ হাসিতে উদ্ভাসিত। আস্তে করে ভিড়িয়ে দিল দরজাটা।

ডান হাতটা এগিয়ে দিল জন। হাসি এখনও একান ওকান।

হ্যাণ্ড শেক করার কিছুমাত্র আগ্রহ দেখা গেল না ববের মধ্যে। বদলে জড়িয়ে ধরল বন্ধুকে।

পরস্পরের হৃদয়ের উষ্ণতা অনুভব করল ওরা বহু দিন পর।

একেবারে চমকে দিয়েছিস! বলল বব জনকে ছাড়তে ছাড়তে।

চেয়েছি তো সেটাই। তবে এখন মনে হচ্ছে, ফোন করে আসা উচিত ছিল। তোদের বোধ হয় ডিসটার্ব করলাম। কাঁচের ভিতর দিয়ে ভিতরে তাকাল জন। এদিকে তাকিয়ে আছে লোকগুলো। চোখে প্রশ্ন। বিরক্ত কি না, বোঝা গেল না।

আরে, না! মিটিং প্রায় শেষ। টানল বব বন্ধুর হাত ধরে। আয়।

রুমের বাতি জ্বেলে দিল লেফটেন্যান্ট।

গোলগাল চেহারার হাসিখুশি এক লোক বলে উঠল, হেই, জনি বয়!

পাতলা কেশ কমে এসেছে। বেরিয়ে পড়েছে বিরাট কপাল। ঝোঁপের মতো এক জোড়া ভুরু ওখানে। ডাবল চিন। আগে তরমুজ ছিল, এখন মিষ্টি কুমড়ো। তার পরও ডানকান জনসনকে না চেনার কোনও কারণ নেই।

খবর কী, বিগ শো? কুশল জানতে চাইল জন। হাসছে।

যেমন দেখছ। আদরের নামে ডাকায় যার-পর-নাই খুশি বিশালদেহী। তা, তুমি এখানে কী করছ, জনি? তোমার তো দক্ষিণ সাগরের কোনও দ্বীপে থাকার কথা! শুনেছি, বিলাসী জীবন যাপন করছ তুমি ওখানে। ধনী হয়ে গেছ নারকেল আর কলা বেচে।

কার কাছে শুনলে?

যার কাছেই শুনি- সত্যি নাকি কথাটা? ভুরু নাচাল ধুমসো অফিসার।

একদমই না। যে বলেছে, সে আস্ত একটা মিথ্যুক।

তা-ই হবে। আমি তো আসমান থেকে পড়েছিলাম শুনে। তোমার মতন ডাকসাইটে এজেন্টের মাথায় কী খেয়াল চাপল আবার! হা-হা-হা!

এমনিতেই ভারি গলা জনসনের। গমগম করে ওঠে। আর হাসলে মনে হয়, কামান দেগেছে কেউ।

তার কথায় বাকিদের কাছে অতিথির পরিচয় খোলসা করল বব। বন্ধুর কাঁধে হাত রেখে বলল, এ হচ্ছে জন, জন ডিউক। (মাথাটা সামান্য ঝুঁকিয়ে নড় করল জন)

এফবিআইতে আছে। হমিসাইড স্কোয়াডে।– ইটের মতো লাল চুলঅলা এক তরুণ নড়েচড়ে বসল।

আপনাকে চিনি আমি। আই মিন, নাম শুনেছি। বছর খানেক আগে মিডিয়াতে নাম এসেছিল না আপনার? এক সিরিয়াল কিলারকে ধরেছিলেন… ওই যে, ভিকটিমদের খেয়ে ফেলত যে-লোকটা! কী যেন নাম! ম্যানডারিন?

মারাণ্ডি। সিদ্ধার্থ মারাণ্ডি।

এক শ ওঅটের লাইটের মতো দপ করে জ্বলে উঠল লাল চুলের চোখ জোড়া। ইয়েস! মারাণ্ডি হাসল এক গাল। বিদঘুঁটে নাম। মনে থাকে না। ইনডিয়ান লোকটা, রাইট?

হ্যাঁ, এনআরআই (নন-রেসিডেন্ট ইনডিয়ান)।

অমানুষ আর কাকে বলে! পাশে বসা কলিগের দিকে তাকাল লাল ইট। টাকমাথা লোকটার গায়ে সরকারি পারকা। মধ্যবয়সী। গলায় বোলো টাই। চিন্তা করতে পারেন? মানুষ হয়ে মানুষ খাচ্ছে! খায় কীভাবে? শেষ, বাক্যটা জনকে উদ্দেশ্য করে।

পিঁয়াজ আর আলু দিয়ে রান্না করত,  নির্বিকার চেহারায় বলল জন। তরুণ অফিসারের গাল কুঁচকে উঠতে দেখে যোগ করল, কেন, আফ্রিকার নরমাংসভোজীদের কথা শোনেননি?

শুনব না কেন? কিন্তু ওরা তো অসভ্য-বর্বর-জংলি ভূত। সভ্য সমাজে–

চিরকাল এই সব রহস্য আছে নীরব রুদ্ধ ওঠাধর। জন্মান্তের নবপ্রাতে সে হয়তো আপনাতে পেয়েছে উত্তর।

কী বললেন, বুঝলাম না! বোকা দেখাচ্ছে লালচুলোর চেহারা। কোন ভাষা এটা?

বাংলা,  জবাব দিল জন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম তো নিশ্চয়ই শুনেছেন?

না, শুনিনি। হু জ দ্যাট গাই?

স্মিত হাসল জন। আমারই ভুল। ডু ইউ নোউ ট্যাগোর

ইয়া। আই হ্যাভ হার্ড অভ হিম।

ট্যাগোরের কবিতা এটা।

আই সি। মানে কী এটার?

এক কথায় বললে: দেয়ার আর মোর থিংস ইন হেভেন অ্যাণ্ড আর্থ। খুনিদের মনস্তত্ত্ব তো আপনার-আমার সাথে মিলবে না। আপনাকে আমি আরেক জন সাইকোপ্যাথের কথা বলতে পারি। মিনেসোটায় থাকত লোকটা। নাম মরিস রেমণ্ড। সে কোনও বাসার দরজা খোলা পেলে সেই বাসায় নিমন্ত্রিত মনে করত নিজেকে। তারপর বাসায় ঢুকে যাকে পেত, তাকেই কোপাত কুড়াল দিয়ে।

ছোকরা অফিসারের মুখ-চোখ কুঁচকে উঠল। ধরা পড়েনি?

পড়েছে। অনেক চেষ্টার পর। তিনটা মাস আমাদের ঘোল খাইয়ে ছেড়েছিল লোকটা।

ওকে, গাইজ, অধৈর্য ভাব ফুটে উঠল ববের গলায়। ব্রিফিং আজকের মতো এখানেই শেষ।

চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়াল তিন গোয়েন্দা পুলিস। যার যার জিনিসপত্র তুলে নিল টেবিল থেকে। জি [ বলতে ফাইল, প্যাড, কলম আর কফিকাপ। চেম্বার থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে করমর্দন করল জনের।

পাঁচ মিনিট পর।

ভালোই চালাচ্ছিস তা হলে! একটা চেয়ার দখল করে চারদিকে চোখ বোলাচ্ছে জন। বলতে গেলে, কিছুই বদলায়নি। ডেস্ক। ফোনসেট। ফাইলিং ক্যাবিনেট। দেয়াল জুড়ে ম্যাপ। বাঁধানো ফোটোগ্রাফ। তাকে রাখা ট্রফি। আপন মনে গুনগুন করছে এয়ারকুলার। পরিবর্তনের মধ্যে- পিসিটা নতুন মডেলের।

খারাপ না। চলছে-আর-কী ধরনের একটা ভঙ্গি করল বব। দু জনে বসেছে মুখোমুখি। মাঝখানে টেবিল। তোর খবর কী, বল। কী করছিস সিয়াটলে?

চলে এলাম।

চলে এলাম মানে?

পার্মানেন্টলি। বাড়ি কিনেছি।

গ্রেট! কোথায়?

এজেকিয়েল ড্রাইভে। উনিশ শ দশ- এজেকিয়েল ড্রাইভ।

সিলভার-কালারের একটা ফ্লাস্কের ঢাকনা খুলল বব। দুটো প্লাস্টিকের কাপে সবুজ রঙের তরল ঢালল। দোস্তের দিকে এগিয়ে দিল একটা কাপ।

কী এটা?

গ্রিন টি।

চা! জাপানিদের মতন চায়ের অভ্যাস করলি কবে থেকে?

গোমড়া মুখে বলল বব, বিড়ি ছাড়ার পর থেকে।

আরিশ-শালা, কস কী! বিড়ি ছেড়েছিস! তুই! জনের চোখ কপালে উঠেছে। রাতদিন চব্বিশ ঘণ্টা কেটলির মতন ধোয়া ছাড়ত যে!

উথলে ওঠা দীর্ঘশ্বাস চাপল বব। নো ওয়ে, ম্যান। বউ মারে।

বিমর্ষ, কাতর বন্ধুর কথায় দন্ত বিকশিত হলো জনের। তা হলে তো থ্যাঙ্কস দিতে হয় ওকে। খেয়ালই করিনি যে, এতক্ষণে একটাও চুরুট ফুকিসনি তুই।

চায়ের কাপে চমক দিল ও। ভালো জিনিস, মন্তব্য করল। তো, কেমন আছে মারিয়া?

যেরকম দেখেছিলি। দুদিন পর-পর এক-একটা বিষয় নিয়ে মেতে ওঠে। এবারে ধরেছে ভেষজ। দুই মাস হলো, ও-ই নিয়েই আছে। এক-একটা এক্সপেরিমেন্ট করে, আর গিনি পিগ বানায় আমাকে।

ফের দাঁত কেলাল জন।

ভ্যাটকাইস না! ফান্দে পড়িস নাই তো! পড়লে কানতি। এক রাত্তিরে মকানে ফিরে দেখি, বিবি দরজা খোলে না। অনেক অনুনয়-বিনয় করলাম… অনেক সাধ্য-সাধনা। খোলা-খোলো দ্বার… রাখিয়ো না আর বাহিরে আমায় দাঁড়ায়ে। মন গলল। কিন্তু বেকসুর খালাস পেলাম না। সশ্রম কারাদণ্ড। যদ্দিন সিগ্রেট না ছাড়ছি, নিজের খাবার নিজে বেড়ে খেতে হবে। ঘুমাতে হলে- ড্রইং রুমে। আর… ওইটা করার চিন্তা মাথাতেও আনা যাবে না। যাকে বলে, একদম রিমাণ্ডে! নিরুপায় একটা মুখভঙ্গি করে চায়ে চুমুক দিল বব। পরক্ষণে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলে উঠল, বন্ধু, তোদের আসাটা তো সেলিব্রেট করা দরকার। তাকাল ডেস্কে রাখা ক্যালেণ্ডারের দিকে। এই রোববারে?

ওসব পরে হবে। আগে মেয়েটার ব্যাপারে বল… এলিটা রে। প্রজেক্টরের পরদার দিকে আঙুল নির্দেশ করল জন। এ মুহূর্তে কিছু নেই ওখানে। অফ করে দেয়া হয়েছে প্রজেক্টর।

ব্যাটা ব্লাডহাউণ্ড। গন্ধ পেয়ে হাজির। বল,কী জানতে চাস?

পত্রপত্রিকায় যা গেছে, সেগুলোর বাইরে।

এক মহর্ত চিন্তা করল বব। অফিশিয়াল সিক্রেট যদিও তবে তোকে বলতে আপত্তি নেই। শুট।

কাপটা নামিয়ে রাখল জন। কী অবস্থায় পেয়েছিস ডেডবডি?

চিত হয়ে পড়ে ছিল।

উইপন পাওয়া গেছে?

মাথা নাড়ল বব। না।

ভিসেরা?

হাতে আছে।

এত আগে?

সেই দিন কি আর আছে! দিন বদলাইছে না?

রিপোর্ট কী বলে?

ছুরি-ছোরা জাতীয় ধারাল অস্ত্র ইউজ করা হয়েছে।

রেপ ফলোড বাই মার্ডার?

নো, স্যর।

কাপড়চোপড় ছিল গায়ে?

ছিল। গ্রিন টপস। ব্ল্যাক স্কার্ট। …সেক্স-ম্যানিয়াকের কাজ কি না, ভাবছিস তো? না সম্ভবত। খুনির যৌন বিকৃতির আলামত পাওয়া যায়নি কোনও।

আইডেন্টিটি বের করলি কীভাবে?

অজ্ঞাত পরিচয় লাশ হিসাবে রিপোর্ট ফাইল করা হয়। প্রথমে। পরে টিভিতে কাপড় দেখে শনাক্ত করে একজন।

জনের খেয়াল হয়, বাসাবদলের ঝক্কির কারণে গত তিন চার দিন টিভি দেখা হয়নি। কে শনাক্ত করল?

একটা মেয়ে। নাম: চায়না।

অ্যানাদার শো-গার্ল?

মাথা ঝাঁকাল বব।

আর কিছু?

আছে। ইউরিন-টেস্ট। ড্রাগ পাওয়া গেছে পিশাবে। মারা যাওয়ার আগে নিয়েছিল।

কী ড্রাগ?

জিএইচবি।

চেনা চেনা লাগছে নামটা। ফুল ফর্ম কী?

গামা হাইড্রক্সিবিউটিরেট।

ইলিগ্যাল?

ইলিগ্যাল তো বটেই। কড়া ঘুমের ওষুধ। এটার আরেক নাম লিকুইড এক্সট্যাসি। খুব চলে পার্টিতে। বর্ণ-গন্ধ-স্বাদ না থাকায় যে-কোনও পানীয়র সাথে মিশিয়ে দেয়া যায়।

বলতে চাচ্ছিস, কেউ খাইয়ে দিয়েছে মেয়েটাকে? খুনের উদ্দেশ্যে?

খুব সম্ভব।

আর?

সুঁইয়ের দাগ। কবজিতে।

তুড়ি বাজাল জন। এই তো পাওয়া গেছে একটা পয়েন্ট। নিজেই তো মাদক, নিতে পারে মেয়েটা, সিরিঞ্জ ব্যবহার করে।

অল্প বিদ্যা ভয়ঙ্করী, খোঁচা মারল বব। এই ড্রাগ শরীরে ইনজেক্ট করে না কেউ। মুখ দিয়ে নেয়।

কত অজানা, রে!

দেখবি তো লাশটা?

যাবে দেখা?

ডেফিনিটলি। ঠিক আছে। যাওয়ার সময় দেখব।

এক হাতের আঙুলের ফাঁকে আরেক হাতের আঙুল আটকে সামনে ঝুঁকল বব। তো, মিস্টার শার্লক হোমস, এ থেকে আপনি কী বুঝলেন?

কিছু না। আরও ইনফর্মেশন দরকার। ভাবছি, হট হাউসে একবার ঢু মারব।

চোখ মটকাল বব। ঘরে সুন্দরী বউ থাকতেও হচ্ছে না? আবার নেকেড ড্যান্স দেখতে হবে!

হাসি ছড়িয়ে পড়ল জনের মুখে। দূর, ব্যাটা! অ্যাড্রেসটা দে!

পাঁচ

সাজঘরের বাইরে অপেক্ষা করছে জন। একজনের সঙ্গে আলাপ করবে।

নাচে গেছে মেয়েটা। ওসব নষ্টামি দেখার ইচ্ছা নেই জনের।

নতুন কোনও চিন্তার খোরাক জোগায়নি এলিটা রের মৃত দেহটা। এখন জিজ্ঞাসাবাদে যদি কিছু বেরিয়ে আসে।

বেশিক্ষণ ওয়েট করতে হলো না। আরিয়ানা গ্রান্দের একটা গানের সুর ভাজতে ভাজতে ফিরে এল টিনা। অচেনা লোককে দেখে থেমে গেল গান। থামল দরজা দিয়ে ঢোকার মুখে। আত্মবিশ্বাসে ভরা একটা মুখ। ইয়েস, প্লিজ?

ব্লণ্ড চুল। শাণিত চাউনি। জনের মনে হলো, আগুনের শিখার সাথে এই দৃষ্টির তুলনা করা যায়। অবশ্য আপাদমস্তকই আগুন মেয়েটা। ফরসা দেহে দুরন্ত যৌবন। কেবল জি-স্ট্রিং পরনে। নাভিটা গভীর।

টিনা অ্যাণ্ডারসন?

পেয়ে গেছ আমাকে।

হাতের পত্রিকাটা তুলে ধরল জন।

লিটার ছবি দেখে আড়ষ্ট হয়ে গেল মেয়েটা। আবার কেন? একবার তো স্টেটমেন্ট দিয়েছি পুলিসকে।

পুলিসের লোক নই আমি।

তা হলে কী? প্রাইভেট আই?

তা-ও না। এফবিআই।

পুরানো একটা কৌতুক মনে পড়ল টিনার। নতুন এক জায়গায় লেকের পানিতে নামতে যাচ্ছে এক লোক। গোসল করবে। এই সময় এক ভদ্রলোক যাচ্ছিল সেদিক দিয়ে। ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করল লোকটা, ভাই, সাপখোপ নেই তো লেকে? ভদ্রলোক আশ্বস্ত করল, না, রে, ভাই। যা-ও বা ছিল- কুমিরে খেয়ে সাবাড় করে ফেলেছে সব।

কিছু না বলে ভিতরে ঢুকে গেল মেয়েটা। জনের নজরে পড়ল, ওর ডান দিকের শোল্ডারব্লেডের নিচে একটা প্রজাপতি। উল্কি।

কাপড় পরার জন্য দু মিনিট সময় দিল সে মেয়েটাকে। তারপর প্রবেশ করল ভিতরে।

পিঙ্ক কালারের একটা রোব গায়ে চড়িয়েছে টিনা। আলগোছে বেঁধেছে কোমরের ফিতে। দুই হাত বুকের উপর ভাজ করে রাখা। কী জানতে চাও, বলো।

মিউজিকের শব্দ ভেসে আসছে হলরুম থেকে। চাপা আওয়াজ।

তোমার সাথেই তো শেষ কথা হয়েছিল ওর, তা-ই না? কনফার্ম হতে চাইল জন।

কে বলেছে এটা?

মিস্টার মার্টিনেজ।

মিথ্যে বলেছে। শেষ কার সাথে কথা হয়েছে, জানা নেই আমার। তবে আমার সাথে যে না, এটুকু নিশ্চিত করতে পারি। বিড়বিড় করল টিনা। চেহারায় তীব্র অসন্তোষ। সম্ভবত গালি দিল।

ভুরু কুঁচকে গেল জনের। ভাজ পড়ল কপালে। এক মুহূর্ত ভাবল কিছু। বিশেষ কেউ কি আসত ওর কাছে?

জানি না। খেয়াল করিনি।

যেদিন শেষ দেখেছ, অস্বাভাবিক কোনও কিছু লক্ষ করেছ ওর মাঝে?

না।

ভালো করে ভেবে দেখো।

ভেবেই বলছি। ত্যক্ত বোধ করছে টিনা।

এমন কোনও কথা, যেটা পুলিসকে বলোনি…

বনবিড়ালির থুতু ছিটানোর ভঙ্গি করল মেয়েটা। সব কথাই বলেছি আমি পুলিসকে। আমার সাথে বেরোতে চেয়েছিল ও। এই সময় একটা কল আসে। থেকে যায় লিটা। তারপর কী হয়েছে, বলতে পারব না।

এ পর্যন্ত জানে জনও। জেনেছে যে, ওই কাস্টমারকে সেদিনই প্রথম দেখেছে অ্যাটেণ্ড্যান্ট। আমেরিকান নয় লোকটা, বলেছে রাফায়েল মার্টিনেজ, ইংলিশ বলে যদিও। তবে কোন্ দেশি, বলতে পারেনি লোকটা। চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ হবে বয়স। চুলের রং সাদা। গোঁফ আছে। চোখে চশমা।

তোমরা কি ক্লায়েন্টের সাথেও যাও? জিজ্ঞেস করল জন। এসকোর্ট সার্ভিসের কথা বলছি।

সবাই না। কেউ কেউ যায়। ক্লাবের কোনও সম্পর্ক নেই এর সাথে।

মিস রেও কি যেত?

যেত।

ওই দিন গিয়েছিল কারও সাথে?

কেমন করে বলব? আমি তো চলে গিয়েছিলাম।

ও, হ্যাঁ, সরি।

কসমেটিকসের শিশি-বোতল-ডিব্বার সমাহার টেবিলের উপরে। এক প্যাকেট সিগারেটও রয়েছে। রেড অ্যাণ্ড হোয়াইট।

সিগারেটের প্যাকেটটা তুলে নিল টিনা। ঠোঁটে লাগিয়ে ধরাল একটা। কাঁপছে হাতটা। ধোয়া ছাড়ল এক মুখ। ধনুক-ভ্রু কুঁচকে তাকাল ধোয়ার ভিতর দিয়ে। ধরতে পারবে তোমরা খুনিকে?

আশা তো করি। কী মনে হয় তোমার, কে মারতে পারে ওকে?

যে-কেউ।

ভুরু দুটো কুঞ্চিত হলো জনের। কেন, কী কারণে?

মেয়েদের খুন করতে আবার কারণ লাগে নাকি? বিতৃষ্ণায় মুখ বাঁকাল টিনা। লাগে তো খালি এক্সকিউজ!

গম্ভীর জন। কিছু বলতে গিয়েও বলল না। ওর আসলে। কিছু বলার নেই।

ছয়

স্ট্রিপ ক্লাবটা থেকে বেরিয়ে এল জন। রিস্টওঅচ দেখল। রাডোর কাটা বলছে: সাড়ে সাতটা।

একটা ফোন করা দরকার। মোবাইলটা বের করে দেখল, ব্যাটারি ডাউন।

পারফেক্ট! বেরিয়ে এল মুখ দিয়ে। টেলিফোন আছে কাছেপিঠে?

আছে। শ খানেক গজ দূরে। জনহীন এক গ্যাসস্টেশনে।

স্টেশনটার দিকে হাঁটা ধরল ও। বড় বড় পা ফেলছে। সাফারি জ্যাকেটের কোণ উড়ছে বাতাসে।

ভিজে রাজপথ। লাইটপোস্টের আলোতে দীর্ঘ ছায়া পড়েছে ওর। সঙ্গে সঙ্গে আসছে। টে।

একটা গাড়ি চলে গেল। শেভ্রোলে ক্যাভালিয়ার।

ফোনবুথে ঢুকল জন। রিসিভার কানে ঠেকিয়ে কয়েন ফেলল স্লটে। ডায়াল করল তারপর।

একবার রিং হতেই রিসিভার তুলল সিয়াটল পাবলিক সেফটি বিল্ডিং-এর অপারেটর।

বিলি বব থর্নটনের এক্সটেনশনে লাইন দেয়ার অনুরোধ করল জন মেয়েটাকে।

খুট করে শব্দ হলো একটা।

হ্যালো!

বব, আমি… জন।

কী অবস্থা, বল। ক্লাবে গিয়েছিলি?

এই মাত্র বেরোলাম ওখান থেকে। …শোন, একটা কাজ করতে হবে।

কী কাজ?

ক্লাবের অ্যাটেণ্ড্যান্টকে অ্যারেস্ট কর।

জনের গলার স্বরে শীতল রাগ টের পেল বব। কেন? কী করেছে?–

ব্যাটা কিছু লুকাচ্ছে! কাঠিন্যের ছাপ পড়ল জনের চেহারায়। এমনিতে বলবে না, চাপ দিতে হবে। আপাতত সাসপেক্ট হিসাবে ধরে নিয়ে আয়। জেরা কর। ভয়-টয় দেখা। দেখ, কী রি-অ্যাকশন হয়।

তুই থাকবি?

না। বাইরের লোক আমি। আমার এর মধ্যে ইন্টারফেয়ার করা ঠিক হবে না। রাখলাম। কী হলো,

জানাস।

ওকে, বস।

সাত

সেরাতেই ফোন এল। সাপার সেরে উঠেছে, এমন সময় বেজে উঠল জনের সেলফোনটা।

স্ক্রিন টাচ করে কানে ঠেকাল ও নকিয়া সেটটা। হ্যাঁ, বব!

গরম খবর আছে!

ঠাণ্ডা হওয়ার আগেই বলে ফেল।

তোর কথাই ঠিক, ওস্তাদ। মার্টিনেজই কালপ্রিট বলে। মনে হচ্ছে।

মনে হচ্ছে? স্বীকার যায়নি?

না, রে। শোন, কী হয়েছে। ইন্টেরোগেশনের মুখে স্বীকার গিয়েছে ব্যাটা, প্রাইভেট বুথগুলোতে গোপন ক্যামেরা ফিট করে রেখেছিল ও। গত কাল সকালে টিভিতে খুনের খবরটা দেখা মাত্র ক্লাবে চলে যায় হারামজাদা। পুলিস হানা দেয়ার আগেই ক্যামেরাগুলো সরিয়ে ফেলে। ওগুলো ওর বাসা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে।

সাবাস। সন্তুষ্ট হলো জন। পারভার্ট হালায়। নাইটক্লাবে কাজ করে তো! …দাঁড়া! দাঁড়া! পর্নো ফিল্মের প্রডিউসার কি নিজে দেখার জন্য রেকর্ড করত, নাকি অন্য কোনও মতলব?

ঠিকই ধরেছিস। ব্যবসা। বিপুল পরিমাণ সিডিও জব্দ, করা হয়েছে লোকটার বাসা থেকে।…অনেক দিন ধরে এসব অপকর্ম করে আসছে সে। সাইড-বিজনেস ক্লাবের কেউই টের পায়নি।

ভিডিয়ো-ক্লিপগুলো চেক করা হয়েছে?

হচ্ছে। এলিটার একটা ফুটেজ পাওয়া গেছে। আরও থাকতে পারে। …কালকে আসবি তুই?

অফ কোর্স।

আরও দুয়েকটা কথা হলো টুকটাক।

সিঙ্কের সামনে দাঁড়িয়ে আধোয়া প্লেট ধুচ্ছিল মনিকা, জনের কথা শেষ হতেই ট্যাপ বন্ধ করল। ঘুরে তাকিয়ে জানতে চাইল, কী ব্যাপার, জন? নতুন কোনও কেস?

আমার না, ববের। হেল্প করছি ওকে।

খুনের কথা শুনলাম… কে খুন হয়েছে?

এলিটা নামে একটা মেয়ে। ড্যান্সার।

ব্যালেরিনা?

না-না… ওই নাচ না। এগজোটিক।

ও, আচ্ছা। কাজে মনোযোগী হলো আবার মনিকা।

আসব নাকি, বেগম সাহেবা? একটু সাহায্য করি?

না, সাফ মানা করে দিল জনের বউ। আমার বাসনগুলো ভাঙার দরকার নেই।

আট

সকাল থেকেই বন্ধুর অফিসে, রয়েছে জন। গভীর অভিনিবেশের সঙ্গে ভিডিয়োগুলো দেখছে।

আটাশটা ভিড়িয়ে মোট। তিনটায় লিটা আছে। এর মধ্যে একটা আবার শেষ দিনের।

অনেক বার দেখা হলো সেটা। সব দেখে-টেখে শেষ করতে সারা দিন লেগে গেল।

চলনসই পিকচার-কোয়ালিটি। তবে অডিয়ো খুব খারাপ। হেডফোন লাগিয়েও বোঝা যায় না ভালো। নিচু লয়ে, গান ছাড়া কথা অবশ্য বিশেষ নেই।

ছোট খুপরি ক্লায়েন্টের মাথার উপরে ক্যামেরা, পিছনের দেয়ালে। চেহারা দেখার উপায় নেই। নাচনেওয়ালীর দিকে ফোকাসটা।

কয়েক শ বার ফ্রিজ করা হলো ছবি। রি-ওয়াইণ্ডের পর রি-ওয়াইণ্ড করা হলো। দেখা হলো জুম করে। সঙ্গে চলল চা। কাপের পর কাপ।

প্লে বাটন চাপতে চাপতে আঙুল ব্যথা হয়ে গেল জনের। লাল হয়ে গেল বুড়ো আঙুলের মাথা। টাটাচ্ছে চোখ দুটো।

এলিটা রে অভিনীত শেষ ছবিটা শেষ বারের মতো দেখে মনিটরটা অফ করে দিল জন। সকালের কৌতূহল এখন পরিণত হয়েছে বিরক্তিতে।

জার্মান ভাষায় কথা বলছে অদেখা লোকটা। জন আসার আগেই বিশেষজ্ঞ-মত দিয়েছে ল্যাঙ্গুয়েজ-এক্সপার্ট। তবে কয়েকটা ওঅর্ডের মানে বোঝা ছাড়া বেশি দূর অগ্রসর হতে পারেনি। এতটাই বাজে সাউণ্ড!

জার্মান ভাষা একটা ক্ল। তবে এই সূত্র দিয়ে লোকটার তালাশ করা খড়ের গাদায় আলপিন খোঁজার শামিল। প্রচুর জার্মান রয়েছে সিয়াটলে।

ডেস্কের সামনের কিনারে নিতম্ব ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বব। হতাশ গলায় উদগীরণ করল, ছাতার ভিডিয়ো।

হাহ,  বন্ধুকে সমর্থন করল জন। যা-ও বা কয়টা শব্দ বুঝলাম, সেগুলোর পরম্পরা বোঝা গেল না। দুম করে কিল বসাল সামনে রাখা টেলিফোন ডিরেক্টরির উপরে। মেজাজটাই খারাপ করে দিল!  

শালা বোধ হয় কবিতা আওড়াচ্ছে।

কবিতা?

ওই আর কী! উত্তর-আধুনিক টাইপের কিছু কবি আছে। … কী যে লেখে, কিছু বোঝা যায় না? আকাশপানে তীর মারিলাম, লাগল কলা গাছে… হাঁটু দিয়ে রক্ত ঝরে… চোখ গেল রে, বাবা! সেরকমই কিছু একটা হবে।

আলোচনায় ছেদ টানল ম্যাডোনা। লা ইসলা বনিটা বাজছে নকিয়া লুমিয়া ৭৩০ মডেলে।

ডিসপ্লের দিকে তাকাল জন। আনোউন নাম্বার।

হ্যালো।

মিস্টার ডিউক? তামারা ব্রাইস বলছি! তোমাদের প্রতিবেশী! ত্রস্ত কণ্ঠে কথাগুলো বলল মহিলা। খারাপ খবর আছে একটা!

অজানা আশঙ্কায় লাফাতে লাগল জনের হৃৎপিণ্ড। কী হয়েছে, মিস ব্রাইস?.

অ্যাকসিডেন্ট করেছে তোমার বউ!

শক্ত হয়ে গেল জনের শরীরটা। অজান্তেই ঢোক গিলল একটা। ওহ, গড! কীভাবে?

পড়ে গেছে। স্লিপ খেয়েছে পোর্চের সিঁড়িতে। গত রাতের বৃষ্টিতে পিছল হয়ে ছিল বারান্দা। ভাগ্যিস, দেখেছিলাম আমি!

গুরুতর কিছু হয়নি তো? বলতে বলতে চেয়ার ছাড়ল জন।

বলতে পারছি না। মাথায় আঘাত পেয়েছে মেয়েটা। ব্লিডিং হচ্ছিল। নিজে রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করলাম। পারলাম না। শেষে অ্যামবুলেন্স ডাকতে হলো।

কোন হসপিটাল? শুকনো গলায় জিজ্ঞেস করল জন।

শিরদাঁড়া খাড়া হয়ে গিয়েছিল ববের। হাসপাতালের কথা শুনে কথোপকথনের গুরুত্বটা বুঝে নিল। বন্ধু কান থেকে ফোন সরাতেই সিধে হলো ও।

পা পিছলে পড়ে গেছে মনিকা!

হায়-হায়, বলিস কী!

হসপিটালে গেলাম আমি!

চল, আমিও আসছি।

গাড়ি আনেনি আজ জন। গ্যারাজে এল বব বন্ধুকে নিয়ে। সাঁ করে বেরোল ওর টয়োটা প্রিমিয়ো। এত জোরে ড্রাইভিং করা নিষেধ। আইনের লোক হয়েও পরোয়া করল না অফিসার।

নয়

নার্সিং হোমটা ছোট। দ্বিতল কাঠের বাড়ি। জীবাণুনাশক ও অন্যান্য ওষুধের কড়া ঘ্রাণ বাতাসে।

লবির এক পাশ দিয়ে সিঁড়ি উঠে গেছে। সিঁড়ির পাশে ইনফর্মেশন-সেন্টার। রিসেপশনিস্ট বসা রুপালি রং করা কাঠের ডেস্কে।

দ্রুত পদক্ষেপে তার দিকে এগিয়ে গেল জন।

ঢিলেঢালা আকাশি রঙের ইউনিফর্ম মেয়েটার গায়ে। বুকের কাছে লেখা নাম। ক্যাটরিনা।

– কোঁকড়া চুলে এক্সটেনশন লাগিয়েছে ফ্রন্ট ডেস্ক স্টাফ। বাদামি চুলের জট থেকে বেরিয়ে আছে টকটকে লাল একটা গোছা। ডিম্বাকৃতির মুখে হালকা প্রসাধন। টেলিফোনে কথা বলছিল, ফোন রেখে তাকাল প্রশ্নবোধক চোখে।

এক্সকিউজ মি! উল্কণ্ঠিত গলায় বলল জন। আমার স্ত্রীকে ভর্তি করা হয়েছে এখানে কিছুক্ষণ আগে! মনিকা নাম?

মাথায় আঘাত পেয়েছে:… পাশ থেকে বলল বব।

সামনে রাখা ক্লিপবোর্ডটা তুলে নিল তরুণী। ক্যাপবিহীন একটা কলমের পিছন দিকটা বোর্ডে আটকানো লিস্টে ঠেকিয়ে নামিয়ে আনছে নিচে। মাঝামাঝি এসে থেমে গেল।

মনিকা লোরেন? শুধাল যান্ত্রিক কণ্ঠে।

ইয়েস! বলা মাত্রই চোখাচোখি হলো মিস ব্রাইসের সঙ্গে।

কফি ভেণ্ডিং মেশিনের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল মহিলা। এগিয়ে আসছিল জনকে দেখে। সিঁড়িতে পা রেখে বলল, এসো আমার সাথে।

সিঁড়ি বেয়ে উঠতে আরম্ভ করল ব্রাইস। দুই বন্ধু অনুগমন করল তাকে।

কেমন আছে ও? জিজ্ঞেস না করে পারল না জন।

ভালোই আছে এখন। বিষণ্ণ দেখাল ভদ্রমহিলার হাসিটা। চকচকে পালিশ করা পিতলের রেইলে হাত।

ঘুমাচ্ছে। সিডেটিভ দিয়েছে নার্স)—-

দ্বিতীয় তলায় পৌঁছে ডাইনে-বাঁয়ে সমান প্যাসেজ। বিশ ফুট আন্দাজ গিয়ে ঠেকেছে দেয়ালে।

বাঁ দিকে চলল মহিলা। একটা কেবিনের পরদা সরিয়ে ঢুকল ভিতরে।

জলপট্টি দিচ্ছিল নার্স পেশেন্টের কপালে। পানি ভর্তি গামলাতে রুমালটা ফেলে গায়ের উপর টেনে দিল কম্বলটা। বেরিয়ে গেল গামলা, নিয়ে। যাওয়ার আগে ঠোঁটে আঙুল রেখে জোরে আওয়াজ করতে বারণ করল ওদের।

বিছানার কাছে এল জন। অপলকে তাকিয়ে থাকল।

মনিকার ফ্যাকাসে মুখটা যেন মোম দিয়ে তৈরি। ঠোঁট জোড়া সাদাটে। খুব আস্তে ওঠানামা করছে বুক।

নিচু স্বরে বলল মহিলা, জ্বর এসেছে।

একটু পরে বেরিয়ে এল তিনজনে।

কী বলে যে ধন্যবাদ দেব আপনাকে! কৃতজ্ঞতা ঝরে পড়ল জনের গলা থেকে।

কী যে বলো! এ আর এমন কী!

তা হলে… মিস ব্রাইস, এবার বাড়ি চলে যান আপনি। বন্ধুর দিকে চাইল জন। বব, একটা ক্যাব ডেকে দিবি ওনাকে?

দরকার নেই। নিজেই যেতে পারব আমি।

আসুন, মিস ব্রাইস,  বলল বব।

দশ

চোখ মেলল জন।

রেডিয়াম লাগানো দেয়ালঘড়ি সোয়া এগারোটা বাজার সঙ্কেত দিচ্ছে।

ভাঙল কেন ঘুমটা?

শব্দ। আলোছায়ার নড়চড়। বসে থাকতে থাকতে চোখ লেগে এসেছিল, ডিউটি-নার্স রুমে ঢাকায় টুটে গেছে নিদ্রা।

চোখ মিটমিট করল ও। বন্ধ করল। খুলল। একবার। দু বার। চোখ থেকে পুরোপুরি কেটে গেল ঘুমের রেশ।

মনিকার হাতের শিরায় সুচ ঢুকিয়ে রক্ত নিতে লাগল সিস্টার। টেস্ট করবে বোধ হয়। এ আরেক জন। সন্ধ্যার সেই মেয়েটা নয়।

নিরাসক্ত চোখে তার কাজ দেখতে লাগল জন।

হঠাৎ ওর মগজের ভিতরটা ঝাঁকুনি খেল ঝনঝন করে। কাঁপন শুরু হলো বুকের মধ্যে।

কাউচ ছেড়ে উঠে দাঁড়াল জন। বেরিয়ে এল কেবিন। থেকে।

দেয়াল ঘেঁষে পাতা-এক সারি আসন। তার একটায় বসে ঢুলছিল বব। জেগে গেল কাঁধে হাত পড়তেই। পূর্ণ সজাগ। চোখ মেলেই প্রশ্ন: কী অবস্থা এখন?

ঘুমাচ্ছে এখনও।

চলে গেল মেয়েটা কাজ সেরে।

ববের পাশের চেয়ারটা ছেড়ে বসল জন। শান্ত কণ্ঠে বলল, কয়েকটা প্রশ্ন জ্বালাচ্ছে মাথায়।

কী নিয়ে?

এলিটা মেয়েটার ব্যাপারে।

যেমন?

মেয়েটার ব্লাডগ্রুপ জানা আছে তোর?

না। তবে জেনে দেয়া যাবে।

নিজের ডিডাকশন ব্যাখ্যা করল জন। শেষে বলল, শিয়োর হতে হলে প্রশ্নগুলোর উত্তর জানা দরকার।

উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে গেল বব। দাঁড়া, জেনে দিচ্ছি! যে লোক ওর পোস্টমর্টেম করেছে, ফোন লাগাচ্ছি তাকে।

কিন্তু একবার ট্রাই করেই কালো হয়ে উঠল ববের মুখ। বন্ধ ফোন!

অফিসে গেলাম আমি, ত্বরিত সিদ্ধান্ত ওর। তুই কি আসবি?

যেতে মন টানছে না জনের। তার পরও উঠল। মনিকার কেবিনের সামনে এল পায়ে পায়ে। দরজার উপরের কাঁচটকা গোল গর্তটা দিয়ে ভিতরে চাইল।

জাদুর খাটে শুয়ে আছে যেন স্লিপিং বিউটি।

এগারো

আণ্ডারগ্রাউণ্ড মর্গ। বেইসমেন্টে।

সার্ভিস-এলিভেটরে করে নিচে নামল ওরা।

ঠাণ্ডা, ফাঁকা প্যাসেজ। তবে জনশূন্য নয়। বুড়োমতো এক লোক নেকড়ার ঝাড় দিয়ে ফ্লোর মুছছে। ফ্ল্যাট ক্যাপ মাথায়। চাইল না ওদের দিকে। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ও না। হাতি গেলেও বোধ হয় তাকাত না।

একটা বাঁক ঘুরে কিছুদূর গেলেই লাশকাটা ঘর। ব্লিচিং পাউডার আর ফরমালডিহাইডের গন্ধ ভুরভুর করছে।

আগে আগে চলেছিল বব, হ্যাঁণ্ডেল ধরে ঠেলা মারতে গেল দরজায়।

তার আগেই আটকাল জন ওকে। থামতে ইঙ্গিত করল কাঁধ চেপে ধরে।

প্রশ্ন করতে যাচ্ছিল বব, ঠোঁটের উপরে তর্জনি ঠেকিয়ে কথা বলতে নিষেধ করল জন।

কান খাড়া করল। শিসের আওয়াজ। আসছে ভিতর থেকে। কানপাতল দরজায়।

ঠোঁটস্থ একটা সুর। বিটলস-এর। লুসি ইন দ্য স্কাই ইন ডায়মণ্ড গলাও শোনা গেল একটা। গান ধরেছে কণ্ঠের মালিক।

অ্যাকসেন্ট!

সহজাত প্রবৃত্তির বশে ববের হাতে উঠে এসেছে পিস্তল। নাইনএমএম টরাস। মডেল ৮০৯। ব্ল্যাক টেনিফার। স্নায়ু। টান-টান। নিঃশ্বাস ভারি।

দরজা ঠেলল জন। সন্তর্পণে। সুইং ডোর। খুলে গেল। নিঃশব্দে।

একা এক লোক মর্গে। দরজার দিকে রওনা হয়েছিল ফরেনসিক প্যাথলজিস্ট, থতমত খেয়ে গেল ওদের দেখে। { দাঁড়িয়ে গেছে লোকটা। থেমে গেছে গান। চোখের তারায় নগ্ন ভয়।

বারো

তিন দিন পর। রোববার।

রোদেলা দিন। চমৎকার।

ববের বাসার আঙিনায় চলছে বারবিকিউ-পার্টি। কাবাবের সুবাসে ম-ম করছে বাতাস।

ভেড়ার মাংসের শেষ টুকরোটা মুখের ভিতর চালান করে দিয়ে প্লেটের উপর ধাতব শিকটা নামিয়ে রাখল জন। আয়েশ করে চিবোচ্ছে। চাকা-চাকা করে কাটা শসায় এক কামড় দিচ্ছে, আরেক কামড় দিচ্ছে টমেটোতে।

ফার্স্ট ক্লাস হয়েছে মাংসটা! চিবোনোর ফাঁকে বলল ও। এই নিয়ে তৃতীয় বার। পরিষ্কার বুঝতে পারছি একটা জিনিস, কোনও দিনও ভেজান হওয়া সম্ভব না আমার পক্ষে! বাঁচা অসম্ভব!

ওর বলার ধরনে হেসে উঠল সবাই।

কিন্তু সায়েন্টিস্টরা তো বলে- সম্ভব, খেই ধরল। মারিয়া। এবং ভালো ভাবে।

দূর-দূর! মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে হাত নাড়ল জন।

টিসু-পেপার দিয়ে মুখ মুছছে মনিকা। আগের দিন। সকালে বাসায় ফিরেছে নার্সিং হোম থেকে।

কালকে টিভিতে দেখলাম তোমাকে,  বলল ববের। উদ্দেশে। কনগ্রাচুলেশন!

ক্রেডিটটা আসলে ওর প্রাপ্য। জনের দিকে তাকাল বব।

কৃতিত্ব আমার একার না,  কাঁচের জগ থেকে গ্লাসে পানি। নিতে নিতে বলল জন। লাকটা ভালো ছিল আমাদের।

বুঝলে কীভাবে, ওই লোকই হত্যাকারী? প্রশ্ন মারিয়ার।

উচ্চারণ। গ্লাসে ঠোঁট ছোঁয়াল জন। দুই ঢোকে খালি করে ফেলল অর্ধেকটা। জার্মান লোকটা। মর্গের ভিতরে ও যখন গান গাইছিল, উচ্চারণে ছিল জার্মান টান।

খুন হওয়ার আগের একটা ভিডিয়ো পেয়েছি আমরা এলিটার। ওখানে এক লোকের মুখেও ছিল জার্মান ল্যাঙ্গুয়েজ। ব্যস

দুইয়ে দুইয়ে চার,  ববের কথাটা শেষ করে দিল জন।

অথচ লোকটা আমাদের ওখানেই চাকরি করত। আগেও ওকে দেখেছে জন, লাশ দেখার সময়। কথাও বলেছে। কিন্তু তখন আমরা বুঝতেই পারিনি যে, একেই খুঁজছি আমরা।

সেটার কারণ আছে, দোস্ত। মার্টিনেজের বর্ণনা খেয়াল কর- সাদা চুল, মোচ, চশমা। এজন্যই ইমিডিয়েটলি ক্যাচ করতে পারেনি ব্রেইন।

তার মানে, নকল ওগুলো?

হুম, ছদ্মবেশ।

কবিতার ব্যাপারটা বল,  মনে করিয়ে দিল বব।

কীসের কবিতা? বুঝতে পারল না জন।

আকাশপানে তীর মারিলাম…

ওহ। হাসল জন একচোট। মারিয়া আর মনিকা মুখ চাওয়াচাওয়ি করল।

হ্যাঁ। এটাও একটা ব্যাপার বটে। খোলসা করতে শুরু করল জন,, আমরা যখন ভিডিয়োটা পরীক্ষা করি, মনে হয়েছিল, কবিতা পড়ছে লোকটা। আসলে, ওটা ছিল গান।

বুঝলাম না,  বলল মনিকা। এ

গান গাওয়াটা ওর মুদ্রাদোষ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে একা হলেই গান গেয়ে ওঠে সে। ঠিক এই ব্যাপারটাই ঘটেছে। মর্গে। ফলে ধরাও পড়েছে সহজে।

খুনের মোটিভ কী? ববকে জিজ্ঞেস করল মনিকা।

জানো না তুমি? বলেনি ও?

না! সুরটা নালিশের। টিভিতে যা শুনেছি, ওটুকুই।

কেন বলিসনি?

অসুস্থ ও, সাফাই গাইল জন। আরও যদি অসুস্থ হয়ে যায়!

হয়েছে! মুখ ঝামটা দিল মনিকা। বলল এবার। নইলে কিন্তু কথা বন্ধ!

এর ওরেব্বাপ, রে! আত্মরক্ষার ভঙ্গিতে দুই হাত তুলল। জন। পা আমিই বলি… একটু থামল বব। কোত্থেকে শুরু করব… হা… মেডিকেল জার্নাল থেকে শুরু হয়েছে। ব্যাপারটা। হেরমান হেস- মানে, আমাদের প্যাথলজিস্ট মহাশয় একটা আর্টিকেল পড়েছিল দিন কয়েক আগে। আর্টিকেল না বলে বিজ্ঞাপন বলাই ভালো। এক বড়লোক বুড়ির জরুরি অপারেশন দরকার। কিন্তু রক্তের অভাবে। কাজটা শুরু করতে পারছিল না সার্জনরা।

কেন, ডোনার পাওয়া যাচ্ছিল না?

না।

কী গ্রুপ রক্তের? এবি নেগেটিভ, না বি নেগেটিভ?

বলছি। বুড়ি থাকে লাস ভেগাসে। রক্ত জোগাড় করে দেয়ার বিনিময়ে অসম্ভব একটা অঙ্ক প্রস্তাব করেছে। ডোনার তো পাবেই, সন্ধানদাতাও পাবে একই পরিমাণ টাকা। …ব্যাপারটা ওখানেই ভুলে গেল হেস। আর তার পরই ঘটল ঘটনা।

এলিটার প্রবেশ রঙ্গমঞ্চে, নাটক করল জন।

হেসের সাথে কী সম্পর্ক মেয়েটার?

কোনও সম্পর্ক

নই। তার সম্পর্ক সুজানার সাথে।

এ আবার কে?

নার্স। কাজ করে এক ক্লিনিকে। হেসের প্রেমিকা।

তথ্যগুলো সাজানোর চেষ্টা করল মনিকা। পারল না। আরও বেশি এলোমেলো হয়ে গেল।

সাহায্য করতে মুখ খুলল বব, ওই ক্লিনিকে গিয়েছিল এলিটা। রক্ত পরীক্ষা করাতে।

কেন?

এইচআইভি টেস্ট। এইডস আছে কি না, জানার জন্য।

অনেক কিছুই পরিষ্কার হয়ে আসছে এখন। তা হলে ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে এই… রক্ত পরীক্ষা করাল এলিটা… ওর আর বুড়ির রক্তের গ্রুপ সেইম… সুজানার কাছ থেকে জানতে পারল এটা হেস।

একটা ফাঁক আছে এখানে,  বলল, মারিয়া। সুজানা কেন বলতে যাবে ডাক্তারকে? যদি না সে বুড়ির ব্যাপারটা জেনে থাকে… )

সুজানা কিছুই জানত না, বলল জন।

পুরোটা শোনো আগে। বুঝতে পারবে তা হলে,  বলল বব।

শুনে তো চমকে গেল হেস, বলতে লাগল জন। লোভে পেয়ে বসল তাকে। বান্ধবীর মাধ্যমে ক্লিনিকের এন্ট্রি-লিস্ট থেকে ঠিকানা জোগাড় করে ফেলল এলিটার। দু দিন বাসা থেকে ক্লাব পর্যন্ত ফলো করল মেয়েটাকে। তৃতীয় দিন প্রাইভেটে নাচ দেখল মেয়েটার। ভাড়াও করল। একা মানুষ। বাসায় নিয়ে এসে উইস্কির সাথে জিএইচবি মিশিয়ে অজ্ঞান। করে ফেলল।

মারল কেন? প্রশ্ন মনিকার।

মারার ইচ্ছা ছিল না প্রথমে। মুহূর্তের খেয়াল ওটা। মেয়েটাকে অচেতন করার পর রক্ত নেয়ার কাজ শুরু করল। হেস। এই সময় তার মনে হলো- কতটুকু লাগবে, তা তো জানি না। কাজেই, যতটা পারি, নিয়ে নিই। নেয়ার পর দেখা গেল, এমনিতেও বাঁচবে না এই মেয়ে। মারা যাবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই। তখন মাথা কাটার প্ল্যান করে সে। হেসের হিসাবটা ছিল, কেউ যেন বুঝতে না পারে, রক্তশূন্যতার কারণে মৃত্যু হয়েছে এলিটার। মাথা কেটে বোঝাতে চাইছিল, কোনও সাইকোপ্যাথের কাজ এটা। ডিগ্রি পাওয়া ডোম সে। মানুষ কাটাছেঁড়ায় অভ্যস্ত। মাথাটা কেটে ঢুকিয়ে রাখল ফ্রিজে।

বুদ্ধি দেখো লোকটার,  বলে উঠল বব। আমরা ভেবেছি, মাথা কাটার কারণে ব্লিডিং হয়েছে বলে রক্ত নেই শরীরে। আসল ঘটনা যে এত কিছু, কে জানত!

কিন্তু পাপ তো বাপকেও ছাড়ে না। রক্তের প্যাকেটগুলো ফ্রিজে রেখেছিল সে। ফ্রিজটা খারাপ হয়ে গেল হঠাৎ। ধরা পড়ল যেদিন, সেরাতেই। বাসায় এসে দেখে হেস, ফ্রিজ নষ্ট। গুতোগুতি করে কাজ হলো না। অত রাতে মেকানিক পাবে। কোথায়? উপায় না দেখে মর্গে ফিরে এল রক্ত রাখার জন্য।

নিয়তির খেলাটা দেখ, জন। নেগেটিভ রেজাল্ট এসেছিল এইচআইভি টেস্টে। তার পরও মরতে হলো মেয়েটাকে। পজিটিভ হলে তো এমনিতেই মরত।

রক্তের দোষ!

ঠিকই বলেছিস! রক্তের দোষ।

বললে না তো,  বলল মারিয়া। সুজানা কেন মেয়েটার কথা বলল ডাক্তারকে!

এই যাহ, ভুলে গিয়েছিলাম! বলার ভঙ্গিতেই বুঝল সবাই, ভুলে যায়নি, ইচ্ছে করেই এড়িয়ে গেছে তখন। বলেছে, কারণ, মেয়েটার রক্তের গ্রুপ খুবই- আই রিপিট, খুবই রেয়ার। বিষয়টা দাগ কেটে গিয়েছিল নার্সের মনে। সেজন্য, শেয়ার করে ডাক্তারের সাথে।

কী গ্রুপ?

এটুবি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *