৯
এদের গাঁয়ে সবগুলোই মাটির ঘর। খড়ের চাল। কারও কারও টিনের, অ্যাসবেস্টসের চালও আছে। মাটিটা বড্ড রুক্ষ।
রুক্ষ, কাঁকুরে। গাছগুলোও যেন কেমন গিঁট গিঁট, হাড় সার। সেই ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় গ্রাম মোটেই নয়। সকালে সব খেত খাটতে বেরিয়ে গেছে। বিকেল ঘুরে গেলে ফিরছে। দিগন্তের দিকে তাকিয়ে পরি বলল—উইদিকে সব ধানখেত, বোরো হয় না, আমাদের হচ্ছে আউশ। যেটুক জমি আছে সব খেটেখুটে দোফসালি করেচে। শীতে কিছু ধান, কিছু সবজি হয়। গোরু—বাছুর পোষা খুব একটা পোষায় না। কেন বলো তো! খাবার নেই ওদের। মুড়িয়ে একবার ঘাস পাতা খেয়ে নিলে আবার গজাবে তবে খাবে। খড়—বিচালি সব আমরা বিককিরি করি। নিজেরা খেতে পাই না, গোরুকে কী দেব।
গ্রামে কোনও স্কুল নেই। কোনও ডাক্তার—বদ্যি নেই। বাড়ি এসে একধামা মুড়ি নিয়ে বসল সবাই। মুড়ি খেয়ে পেট ভরে জল খেয়ে নাও—পরি মধুবনকে নির্দেশ দেয়।
রাত্তিরবেলা আবার মুড়ি, রাঙালুসেদ্ধ, গাঁঠি কচু পোড়া।
মাঝরাত্তিরে ঘুমের মধ্যে মধুবন স্বপ্ন দেখল যশোমাসি তাকে বলছে—খা খা। কচুপোড়া খা।
দু’বেলা এখানে কেউ রান্না করে না।—অত জ্বালানি কোথায়? একবেলা যা হল হল। রাত্তিরে ওই মুড়ি চিঁড়ে খেয়ে থাকা।
গভীর রাত্তিরে রুস্তম চুপিচুপি বোনকে বিস্কুট দেয়, বলে—খেয়ে নে।
খাব? উচিত হবে?
কী করা যাবে! কাল এদের হাট বসে। একটু হাটে যাব, তুই যাবি? আর শোন, জিওলিন ছাড়া জল খাবি না।
হ্যাঁ। হাটে যাব। ওরা তো জিওলিন দেয় না।
ওরা অভ্যস্ত। ইমিউন। আধপেটা খেয়ে কীভাবে বেঁচে আছে আবার উদয়াস্ত খাটছে, ভাবতে পারিস?
ট্যাঙস ট্যাঙস করতে করতে রোদের মধ্যে দিয়ে হাঁটা। মাইল পাঁচ তো হবেই।
মধুবন বলল—দাদা, জিলিপি ভাজছে। তেলেভাজা।
ধারেকাছে কোনও ডাক্তার হাসপাতাল নেই মধুবন, উলটোপালটা খেয়ে অসুখ করলে কে দেখবে?
তোর রিসার্চের কদ্দূর?
হচ্ছে, আরেকটু বাকি আছে। মৌজাটাই পুরো এইরকম, চাষবাস তেমন হয় না। ক্যাশ ক্রপ বলতে কিছু নেই। ইল্ড খুব সুবিধের নয়। একটা খাল আছে। বর্ষায় ছাড়া তেমন জল নেই। কুয়ো ইঁদারা আছে। কিন্তু টিউবওয়েল তেমন নেই। তোকে কি কলকাতায় রেখে আসব?
না, কেমন গোঁয়ারের মতো মধুবন বলল—তুই যদি পারিস তো আমিও পারব।
হাট থেকে টাটকা কুচো মাছ আর ডিম কিনল রুস্তম। মুশুর ডাল দশ কেজি। বেশ কিছু সবজি। সবই অবশ্য শুকনো শুকনো। আলু কিনল, তা—ও কুড়ি কেজি। দু’জনে ভাগাভাগি করে মালগুলো নিল। মুড়ি তেলেভাজা খাওয়া হল।
আহ্লাদে আটখানা ঠাকুমা। বললেন—ছাওয়ালটার মন ভাল। দেকেই আমি বুজেচি।
মাছ কিছু পাশের বাড়ি দেওয়া হল। ঠাকুমা বললেন—দ্যাকো মেয়ে আমি কেমন বাটি চচ্চড়ি রাঁধি। মাছ বেছেধুয়ে নুন হলুদ তেল প্যাঁজ দিয়ে চড়িয়ে দোব, দ্যাখ না দ্যায় হয়ে যাবে।
অনেক দিন পর আলু, অনেক দিন পর মাছের আঁশ গন্ধ। রাত্তিরের জন্য পাতলা করে ডাল রান্না করে রাখা হচ্ছে। মুড়ির সঙ্গে খেয়ে রাত্তিরে পেটটা একটু ভরে।
রুস্তম তার টেপরেকর্ডার নিয়ে আরও দূরে দূরে যেতে শুরু করেছে। মধুবন বাচ্চাগুলোকে জড়ো করে পড়াচ্ছে। মহিলারাও এসে বসছে।
হঠাৎ একদিন ভারী বৃষ্টি নামল। সে কী তুমুল বৃষ্টি রে বাবা। চার দিক ধোঁয়া ধোঁয়া হয়ে যাচ্ছে। টিনের চালে বৃষ্টি পড়ার আওয়াজে কান পাতা যায় না। যার যেখানে যা হাঁড়িকুড়ি বালতি কলসি আছে সব জল ভরে। বৃষ্টির জল একটু থামে বৃষ্টি আবার নামে। কারও দেয়ালই ধসে গেল। কারও চাল উড়ে গেল। চাল দিয়ে জল তো পড়ছেই। বাইরে আর শোয়া যাচ্ছে না। ঘরের মধ্যেই সব গুঁতোগুঁতি। তবু কী আনন্দ! কী আনন্দ!
.
শহর কলকাতায় তখনও হা বৃষ্টি যো বৃষ্টি। একেক দিন আকাশ মেঘলা হয়। আরও ভ্যাপসা গরম। তার ওপর থেকে থেকে লোডশেডিং শুরু হয়েছে। নিয়ম মেনে নয়, যখন তখন। দুপুর দুটোয় চলে গেল। রাত্তির একটায় চলে গেল। পঙ্কজদের কমপ্লেক্সে লোকে এইসান এ সি চালিয়েছে যে ওভারলোড হয়ে একদিন গদাম গদাম করে একটার পর একটা মিটার বোমার মতো ফেটে আগুন ধরে গেল। বাপ রে সে কী আগুন! সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামা যাচ্ছে না। মিটারগুলো সিঁড়ির নীচেই। পঙ্কজ আজকাল নানান কিসিমের তালবাদ্য সিনথেসাইজার নিয়ে পড়েছে। একমনে বাজাচ্ছিল। ঘুরে ঘুরে নেচে নেচে। এমন সময়ে গদাম গদাম গদাম। সঙ্গে সঙ্গে পঙ্কজ খাটের তলা খুঁজছে। যাচ্চলে এসব খাটের তো তলা নেই। সব বক্স। কী করে পঙ্কজ! টেবিলের তলায় ঢুকে পড়ল। ঠকঠক করে কাঁপছে। টেবিলের ওপর থেকে সব বইখাতা কলমদানি খাটের ওপর সরিয়ে সিনথেসাইজারখানা সেখানে রেখেছিল। তা ছাড়া দুটো ড্রাম। চেয়ারটাকে ধাক্কা মেরে সেই টেবিলেরই তলায় সেঁধিয়ে গেছে পঙ্কজ। কাঁপুনি একটু থামলে ভাবছে—মাওবাদী না কে এল ও না আলফা, না কি আলকায়দাই ঢুকে এল? পকেট থেকে সেলফোনটা বেরিয়ে আছে। পঙ্কজ এস এম এস পাঠাল পাবলোকে—পাবলো, হেল্প! পুলিশে খবর দে, আমাদের বাড়িতে জঙ্গি হামলা।
কী বলছিস!
আর কী বলছে! পঙ্কজ তখন আরেকটা হেল্প লাইন ধরেছে—কার্জন পুলিশ ডাক, আমাদের বাড়িতে আলকায়দা…
কার্জন ঠান্ডা গলায় বলল—বন্ধুলোকের সঙ্গে কায়দা করলে আলকায়দা আসবেই।
পঙ্কজ শুনল, কিন্তু তার মাথার মধ্যে কিচ্ছু ঢুকছে না। এমন সময়ে জানলা দিয়ে ঘন কালো ধোঁয়া ঢুকতে লাগল। চার দিকে আওয়াজ—আগুন আগুন।
বল্লীর ফোন বাজল—বল্লী, আগুনে পুড়ে মারা গেলাম। বাই।
উন্নির ফোন বাজল—উন্নি। তোদের পঙ্কজ শেষ। বাই।
পঙ্কজের বন্ধুদল যখন ওদের বাড়ি পৌঁছোল, তখন পুলিশ থিকথিক করছে। দমকলের পাইপের মুখ থেকে গ্যাস বেরোচ্ছে আগুন নিভে গেছে, কিন্তু তখনও ধোঁয়া প্রচুর।
কার্জন একজন কনস্টেবলকে জিজ্ঞেস করল—আলকায়দার জঙ্গিটাকে ধরতে পেরেছেন?
অ্যাঁ? কনস্টেবল চমকে উঠে লাঠি উঁচিয়ে কার্জনকে তাড়া করল।
পাবলো এগিয়ে গিয়ে বলল—নিরীহ গোবেচারা মানুষ দেখলেই আপনাদের লাঠি ওঠে, না? লন্ডনের টিউব স্টেশনে এইভাবেই একজন ইনোসেন্ট মানুষকে খুন করেছিলেন।
অ্যাঁ? আমি আবার কাকে খুন করলুম! আচ্ছা ফ্যাসাদের চাকরি হয়েছে! একজন বলছে আলকায়দা, একজন বলছে লন্ডনে গিয়ে খুন করে এসেছি। মহা পাগলা পাবলিক তো!
পঙ্কজদের ব্লকের সবাই ছাদে উঠে গিয়েছিল। ধোঁয়ায় তাই অতটা কাবু হয়নি। কিন্তু পঙ্কজ যেহেতু টেবিলের তলায় মুখে খবরের কাগজ চাপা দিয়ে গোঁয়ারের মতো বসে ছিল, সে প্রচুর ধোঁয়া খেয়েছে এবং অজ্ঞান মতো হয়ে গেছে।
পুলিশ দরজা ভাঙে, দমকল নির্বিচারে চতুর্দিকে জল ছিটিয়ে যায় এবং বন্ধুরা টেবিলের তলায় পঙ্কজকে আবিষ্কার করে। সে নার্সিংহোমে যায়। সুবুল ডাক্তারের নার্সিংহোম—পাবলোই ব্যবস্থা করে দিল। সেখানে দু’দিন ডাক্তার—নার্সদের আদর খেয়ে পঙ্কজ খোকা বাড়ি ফিরলেন। তবে নিজের বাড়িতে নয়। এক নম্বরের বন্ধু পাবলোর বাড়ি।
পঙ্কজের হল একটু মুশকিল কেননা পাবলোর বাবা সুহৃৎবাবু ও মিহিরকিরণ সুযোগ পেলেই তাকে নানা কথা জিজ্ঞেস করেন। পেছনে পড়ে আছেন যাকে বলে। পঙ্কজ দিব্যি চায়ের সঙ্গে মুচমুচে পকোড়া খাচ্ছিল, সামনে পাবলো আর তার বোন শম্পি সকরুণ মমতাময় দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে রয়েছে, তারাও পকোড়া খাচ্ছে, কিন্তু পঙ্কজের নার্সিং সম্পর্কে তারা খুব যত্নশীল।
সুহৃৎবাবু কাগজ পড়তে পড়তে বললেন—স্ট্রেঞ্জ, তুমি টেবিলের তলায় গেলে কেন? বাড়িতে ডাকাত—টাকাত পড়লে বেগতিক দেখে মানুষ লুকোয় বটে। আগুন ঢুকলে কি তোমাকে টেবিলের তলা বলে ছেড়ে দিত?
শম্পির সাততাড়াতাড়ি কথা বলা চাই—না মেসো, ও ভেবেছিল আলকায়দার আক্রমণ!
তখন মিহিরকিরণ বেশ রসিয়ে রসিয়ে বলেন—অ্যাঁ, তুমি কি তলে তলে জঙ্গি—টঙ্গিদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখো! সেক্রেটারিয়েট গেল, অ্যাসেমব্লি গেল, হাইকোর্ট গেল, আলকায়দা একেবারে বেছে বেছে পঙ্কজ ধুধুরিয়ার বাড়ি, কী যেন কমপ্লেক্সটার নাম ‘সংকেত’। হ্যাঁ ‘সংকেত’ আক্রমণ করে বসবে? তোমার ব্যাকগ্রাউন্ডটা দেখতে হচ্ছে তো!
সুহৃৎবাবু সমানে মাথা নাড়ছেন—না হে, কাজটা তুমি ভাল করোনি। তোমার উচিত ছিল…
আচ্ছা বাবা, যা হয়ে গেছে তা নিয়ে আবার এত সময় নষ্ট করা কেন? পাবলো বাবাকে ধমকায়।
নেক্সট—টাইম যখন আগুন লাগবে একটা কম্বল গায়ে দিয়ে ছাদে উঠে যাবে। ওপেন জায়গায়। এবং পাবলোরও আগে দমকলকে ফোন করবে। জিরো ডায়াল করে লালবাজারেও করতে পারো ফোনটা। দে উইল টেক কেয়ার অব দমকল। আসল কথা পঙ্কজরাম, বুঝলে—তুমি একটু মানে বেশিই ভিতু। না না এটা ঠিক নয়। এতটা ভয়! তোমার বয়সের একটা ছেলে হবে ডাকাডুকো, নওজওয়ান তোমরা। তুমি টেবিলের তলা! নাঃ এটা ঠিক…
আচ্ছা বাবা, একে ও শেকি হয়ে রয়েছে, ওকে আবার নেক্সট টাইম আগুন লাগার ভয় দেখাচ্ছ?
মিহিরকিরণ বললেন—এ তো দেখছি ভয়ে জুজুবুড়ি টাইপ! নাঃ এই বয়সের ছেলে! তোরা ওর একটা কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা কর। সত্যিকারের বিপদ হলে ও কী করবে?
দুই ভায়রাভাই মিলে নিজেরা এদের বয়সে কত ডাকাবুকো ছিলেন সেই সব গল্প মারতে লাগলেন। পঙ্কজ প্লেটে পকোড়াগুলো নাড়াচাড়াই করছে কাঁচুমাচু মুখে। লজ্জায় মুখে তুলতে পারছে না।
কী রে খা!—লজ্জা পাচ্ছিস কেন?
মিহিরকিরণ চলে যাচ্ছিলেন নিজের বীরত্বকাহিনি পেশ করার পর, থেমে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন—আবার লাজুকও? নাঃ পাবলো, তোদের জেনারেশনে লাজুক—টাজুক আমি এই ফার্স্ট দেখলুম। টেবিলের তলা—লাজুক—নাঃ।
এরপরে পঙ্কজ জেদ ধরে সে বাড়ি চলে যাবে। তাদের বাড়ির ইলেকট্রিক কানেকশন যে সি ই এস সি কেটে দিয়েছে, ধোঁয়ার কালিতে, সব কালো হয়ে আছে—সে সব সে মানতে চায় না।
দার্জিলিঙে খবর গেল। পঙ্কজের বাবা বিনোদ ধুধুরিয়া বললেন—ফায়ার? তো অব তো সব ঠিকঠাকই হ্যায়। ক্যা বোলা? পঙ্কজকো নার্সিংহোম ভেজনা পড়া? উও উল্লু একদম ফাস্টক্লাস ডরপোক হ্যায়।
পাবলো কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করল—সব বাবাই একই রকম সেলফিশ অ্যান্ড ইনসেনসিটিভ।
শম্পি বলল—এর মধ্যে সেলফিশনেসের কী দেখলি? তুই যা—ই বল, আমাদের বাড়িতে ওরকম কিছু হলে আমি অন্তত টেবিলের তলায় লুকোতুম না।
পঙ্কজ দু’কানে আঙুল দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল—ওফ টু মাচ, ইটস টু মাচ।
পাবলো বলল—রিয়্যালি শম্পি, আফটার অল আমরা হলুম শিল্পী। একটু ভয়, একটু লজ্জা, একটু হেজিটেশন, একটু প্যানিক আবার হঠাৎ অ্যাগ্রেশন…এরকম একটু ক্রমশই গ্রো করতে থাকবে আমাদের ভেতর। তুই খেয়াল কর। এই চেঞ্জটা উচ্চৈঃস্বরে বলে দিচ্ছে আমরা ঠিকঠাক পথেই এগোচ্ছি! চল পঙ্কজ, আমরা রিহার্স্যালে যাই। তুই লজ্জা ঘৃণা ভয় সব ঝেড়ে ফ্যাল। দু’জনে প্রেমসে লেগে পড়ি। পঙ্কজকে প্রায় বগলদাবা করে পাবলো লম্বা দিল।
শম্পি বলল—যা ব্বাবা! এটাও তো দেখছি খেপে গেল!
সুহৃৎবাবু কাগজটা তুলে নিয়ে যেতে এসেছিলেন, বললেন—আমি তো বরাবর জানি পাবুলটার মাথার স্ক্রু ঢিলে। তুই আজ জানলি!
.
বাজার—হাট, যানবাহন, দোকানপত্তর, হাজার হাজার মানুষজন, তাদের চলাফেরা, খাওয়া—দাওয়া, হই—হল্লা এইসব দু’পা গেলেই, অথচ তোমার বাড়িটা নির্জন নিভৃত, শান্তির নীড়। সেখানে ওই আওয়াজ ওই হট্টমেলা পৌঁছোয় না। এরকম জায়গা কলকাতার দক্ষিণে একটাই আছে। সে হল ফার্ন রোড। এ দিকে গোলপার্ক ও দিকে গড়েহাটা। কোলে বালিগঞ্জ গার্ডেন্স ঝমঝম করছে—সব সময়ে সার দিয়ে সব খাবার দোকান, রাস্তায় ঠ্যালাগাড়িতে চাওমিন রোল। তার পাশেই ভাঁড়ের চা। ফুল চাও? ফুটপাত জুড়ে ফুলঅলারা বসে গেছে। বিয়ে কি শ্রাদ্ধ কি জন্মদিনের বাড়ি চাও? আছে, ভাড়া দেয়। টাঙাইল শাড়ির সেল—বিশুদ্ধ ফুলিয়া। পুরাতন নয়। টোয়েন্টি পার্সেন্ট রিডাকশন। ভেজিটেবল ডাইয়ে নিজ শিল্পীদ্বারা ছাপা শাড়ির এগজিবিশন—ওই বালিগঞ্জ গার্ডেনেই। সোজা চলে গেলে তুমি খিড়কি দিয়ে গড়িয়াহাট মার্কেটের মধ্যে ঢুকে যেতে পারছ। দু’পা হেঁটে রামকৃষ্ণ মিশন লাইব্রেরিতে সারাদুপুর পড়াশোনা করে হেলে দুলে বাড়ি ফিরে এলে। ট্যাক্সি চাও? চলতিই পেয়ে যাবে, মোড়ে গেলে তো ভাবনাই নেই। ফার্ন গাছের যেমন একটা একটা ডাঁটি থেকে সরু সরু পাতা বেরোয় সবটা মিলিয়ে তবে একটা পাতা, ফার্ন রোডও তেমন বালিগঞ্জ গার্ডেন্স থেকে সরু সরু করে বেরিয়েছে। তিন চারটি সরু—লম্বা গলি। দু’ধারে সব তালঢ্যাঙা বাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। গলিতে ঢুকলে, আর শব্দবিজ্ঞানের কী আজব নিয়মে কে জানে টুপ করে ডুবে গেল হট্টরোল। এই গলিদের দ্বিতীয়টায় ঢুকে এগোও। এ—গলিটা বাঁ দিকে বেঁকে গেছে, এইখানে কর্নার প্লটে তিনতলা বাড়ি। একতলায় রেশন দোকান, ব্লাউজের দোকানের কারখানা। নিশিদিন সেখানে সেলাই চলছে, মেশিন তো চলছেই সেই সঙ্গে হেম সেলাই, বোতাম ঘর, বোতাম বসানো। চুপচাপ সব কাজ করে চলেছে। সামনের দিকে অবশ্য গ্যারাজ। একটি গাড়ি আর একটি মোটরবাইক রাখা আছে। দোতলায় দক্ষিণমুখো ঘর। জানলা দিয়ে রোদ আর হাওয়া লুটোপুটি খাচ্ছে। কোলে ছোট্ট বারান্দা। চেয়ারে বসে টেবিলে কিছু রেখে মেয়েটি নিবিষ্টচিত্তে পড়ছে। রং ময়লা। চকচকে চোখে সরু কালো ফ্রেমের চশমা—আঁটা। চুলগুলো খুব কোঁকড়া, মাথার ওপর ঝুড়ির মতন হয়ে আছে। হাফ প্যান্ট আর ঝোল্লাঝাল্লা টপ পরে আছে। ইনি হলেন বল্লী ঠাকুর। হঠাৎ দেখলে কম বয়সের ছেলে বলেই মনে হবে। ইনি আরও অনেকের মতো দুই পি অর্থাৎ পাবলো ও পঙ্কজের হার্ট থ্রব।
কী পড়ছে বল্লী?—স্টেপল করা একতাড়া কাগজ পড়ছে। ‘একটি অজ্ঞাত পরিচয় মনুষ্যের আত্মজীবনী।’
”আমি একটি বাপে—তাড়ানো, মায়ে—খেদানো, ভাইয়ে ঠোকরানো, পিয়ার—পীড়িত, অশান্ত, সান্ত্বনাহীন, প্রান্তিক মানুষ বিশেষ। বাবা—মা বড্ড আদর করে নাম দিয়েছেন ক্যাবলা। তাকেই নানা ভাবে বেঁকিয়ে চুরিয়ে নানান ভ্যারাইটি (বৈচিত্র্য) বার করে নেয় লোকে যেমন—ক্যাবলরাম, ক্যাবলাকান্ত, কেবল, ক্যাবলাচরণ, ক্যাবলাপদ, এমনকী বললে বিশ্বাস যাবেন না ক্যাবলাকুসুম, কেবলসুন্দর পর্যন্ত। নামের অষ্টোত্তর শতনাম যতই হোক, ক্যাবলটি থাকেই।—উচ্চারণ করার সময়ে প্রত্যেকে নিজের নিজের মৌলিক প্রতিভাজাত ব্যঙ্গ বিদ্রূপ উচ্চহাস্য মিশিয়ে নিজস্ব কায়দায় ক্যাবলটি উচ্চারণ করে থাকেন, যাতে করে আমি ক্যাবলা হই বা না হই, একেবারেই ক্যাবলা প্রতিপন্ন হই। ”হোয়াটস ইন আ নেম” কোন মহামতি যেন বলেছিলেন—শেক্সপিয়র কিংবা মোক্ষমুলর—তিনি মানবচরিত্রের কিছুই জানতেন না। প্রকৃতপক্ষে নামই সব। কলৌ নাস্ত্যেব নাস্ত্যেব নাস্ত্যেব গতিরন্যথা—অন্য কিছু মহাজন বলেছেন। ঠিক বলেছেন। একটি মানুষকে কী করে শুধু নাম দিয়ে ছোট, অধম, মূল্যহীন, এলেবেলে করে দেওয়া যায় আমার নামটি তার এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আবার উলটোটাও সত্যি। নামের দাপে গগন ফাটে, শুধু নাম দিয়ে একটি অকিঞ্চিৎকর মানুষকে অনেক অনেক ওপরে তুলে দেওয়া যায়। নাম একটি মই বিশেষ। উদাহরণ : আমার দাদার নাম—আলোকসুন্দর। আলোক বলেই তাকে ডাকা হয়ে থাকে। তার বেলা অন্য কোনও ডাকনাম নেই। সে ভ্যাবলা বা ন্যাপলা বলে যে আমার ক্যাবলা নাম তা কিন্তু নয়। খুব আদুরে মুহূর্তে আমাদের মাতৃদেবী তাকে ‘বাবু বাবু’ করে ডেকে থাকেন। যদিও বাবু ডাকবার বয়স তার চলে গেছে বলেই আমি মনে করি। মধু ঝরে ঝরে পড়ে তা থেকে। প্রসঙ্গত আলোকসুন্দরের সঙ্গে মিলিয়েই বোধহয় আমার পরম পূজনীয় গুরুজনরা আমাকে ক্যাবলাসুন্দর বলে ডেকে থাকেন মর্জি—মেজাজ অনুযায়ী। আমার একটি পোশাকি বা ভাল নাম অবশ্য তাঁরা কৃপা করে দিয়েছেন। কিন্তু সেখানেও কিছু শব্দজব্দ রসিকতা আছে—অচ্যুতনন্দন। তাঁরা কি জানতেন না এ—নামে কেউ কখনও কাউকে ডাকতে পারে না! নিজের নামের বানান শিখতে গিয়ে কি আমার কম পেনসিল ভেঙেছে শৈশবে! তার পরে নামের মানে! তাই নিয়েই কি কম হেনস্থা নাকি? বলা বাহুল্য পূজ্যপাদ মাস্টারমশাইরা অক্লেশে আমাকে অচ্ছুৎ অচ্ছুৎ করেন, হরিজনদের জন্য মন্দির খুলে দেওয়ার এই যুগে তাঁরা যে নিজেদের কত দুর্গতিশীল প্রমাণ করছেন না বুঝেই। সহপাঠীরা অবিলম্বে ডাকনামের খোঁজ পেয়ে যায়। কেননা অচ্ছুৎ শব্দটা এই প্রজন্মের কাছে র্যাগিংয়ের জন্য যথেষ্ট ইঙ্গিতবহ নয়। তারা সহর্ষে ‘ক্যাবলা এই ক্যাবলা’ করে আমার কান ঝালাপালা করে দেয়। দরকারে যত না অদরকারে ডাকে তার চেয়ে ঢের বেশি এবং বড়ই আত্মপ্রসাদ অনুভব করে। ক্লাসের ক্যাবলাতম ছেলেও আমাকে ক্যাবলা ডাকতে ডাকতে কলার তোলে।
তুলনা ও প্রতিতুলনায় অর্থাৎ কমপেয়ার ও কনট্রাস্টে আলোকসুন্দরের ও অচ্যুতনন্দনের সম্বন্ধে কী কী তথ্য বেরিয়ে আসে দেখুন।
১। আলোকসুন্দরের চুল খাড়া খাড়া, সে সবেতেই খ্যাঁক খ্যাঁক করে খ্যাঁকশেয়ালের মতো হাসে। অপর পক্ষে অচ্যুতনন্দনের চুল মাথায় সহজেই পাট করা যায়, সে অত্যন্ত ভদ্র। তার হাসিতে সাধারণত আওয়াজ হয় না। হলেও তা স্বাভাবিক কিশোরসুলভ। আলোকসুন্দরের নাম—বিদ্রূপসুন্দর দিলে কি অনেক মানানসই হত না?—পাঠকের কী অভিমত?
২। আলোকসুন্দর মোটেই আলোকপ্রাপ্ত নয়। তার ন্যাবা হয়েছিল, জনৈক হাতুড়ের পরামর্শে তাকে আমাদের মাতৃদেবী একটি মালা পরান। তাতে সে আপত্তি করেনি। মালা পরে হলুদ চোখে যখন সে ইতি—উতি তাকাত তাকে অনেক বেশি ক্যাবলা এবং অন্ধকারসুন্দর দেখাত। অপর পক্ষে অচ্যুতের জলবসন্ত হওয়ায়, তাকে মৎস্য মাংস বঞ্চিত করার চেষ্টা হয়েছিল। যদিও ডাক্তারের পরামর্শ ছিল প্রোটিন আহারের পক্ষে। সে সময়ে অচ্যুত মৎস্য—মাংস ব্যতীত হাঙ্গার স্ট্রাইক করবার সিদ্ধান্ত নেয়। মৎস্যাদির লোভে নয়, বিজ্ঞানের স্বার্থে, লোকশিক্ষার স্বার্থে। সে প্রমাণ করেই ছাড়ে যে জৈব প্রোটিন আহারে সে অনেক শীঘ্র দেহবল ফিরে পেয়েছে। তার পর থেকে বাড়িতে কারও জলবসন্ত হলে আর নিরামিষ ও বার্লি—পথ্যের অবতারণা হয়নি। কুসংস্কার দূরীকরণে এটি কি একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নয়?
৩। আকৃতি—প্রকৃতিতেও আলোকসুন্দর আদৌ সুন্দর নয়। দৈহিক রূপ ঈশ্বরদত্ত বা বলা যায় জিনদত্ত। তা নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি সভ্য মানুষের লক্ষণ নয়, আমি সভ্য উদার সংস্কৃতি সম্পন্ন মানুষ। এ নিয়ে বিশেষ কিছু বলতে চাই না। কিন্তু যখন আলোকসুন্দর, যথেষ্ট কৃষ্ণবর্ণ, গুলি চক্ষু, উদ্ধতকর্ণ ও ব্যোমকেশ হওয়া সত্ত্বেও ‘হ্যান্ডসম’ ও পুরুষোচিত খ্যাতি পায় এবং আঠারোতেই কর্কশ দাড়ি—গোঁফাক্রান্ত তাকে বালসুলভ ‘বাবু, বাবু’ ডেকে আদিখ্যেতা করা হয় এবং অচ্যুত গৌরবর্ণ ও চোদ্দোয় দাড়ি—গোঁফহীন সুকুমার থাকে বলে তাকে মেয়েলি, মাকুন্দ বলা হয়ে থাকে তখন বাইরের আকৃতির প্রসঙ্গ না এসে কি পারে?
প্রকৃতিতেও আলোক স্বার্থপর। প্রমাণ সে নিজের টি—শার্ট একই সাইজ হওয়া সত্ত্বেও কখনও ভাইকে ধার দেয় না এমনকী পিতৃদেব একদিন একটি পরে ফেলেছিলেন বলে সে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করে। অচ্যুত পরার্থপর—সে অকাতরে দান করে। দরিদ্রকে অন্নদানে করার সামর্থ্য তার এখনও হয়নি, কিন্তু দরিদ্রের ছেলেকে সে নিজের, দাদার এবং বাবার জামাকাপড় দিয়ে থাকে। কেউ টের পায় না। বাড়িতে তুলকালাম হয়, সে নীরব থাকে। দাদার টিউটোরিয়ালের বিশেষ নোটের খাতা জেরক্স করে সে দাদারই টিউটোরিয়ালহীন বন্ধুদের সাপ্লাই দেয়। নিজের অঙ্কের খাতা, ইতিহাসের প্রশ্নোত্তর লেখা খাতা সে নির্বিচারে ক্যাবলা বন্ধুদের ধার দেয়, ঠিক এবং ভুল অঙ্ক, ঠিক এবং ভুল তারিখসমেত। আকবরের দীন—ইলাহির মর্মকথায় সে বাহাই—ধর্মের উল্লেখ করায় কালাতিক্রমণ দোষ ঘটেছে বলে তিরস্কৃত হয়। সেই উত্তরপত্রটিও সে অকাতরে পরখাতা—পিপাসু সতীর্থদের দিয়ে থাকে।—তিন তফা প্রমাণাদি দাখিল করলাম পাঠক ভেবে দেখুন। অভিমত দিন। আপনাদের অভিমত পাঠাবেন ৭৫৭৫ নম্বরে এস এম এস করে…’
এত মন দিয়ে বল্লী পড়ছিল যে এর মধ্যে যে দরজার ঘণ্টি বেজেছে, তাদের কাজের লোক খুলে দিয়েছে সে কিছুই টের পায়নি। ঘরের মধ্যে যে মার্জার চরণে দুই মূর্তি ঢুকেছে তা—ও সে বুঝতে পারেনি। পেছন থেকে একটি হাত এসে খপ করে কাগজগুলো তুলে নিল। বল্লী চমকে মুখ তুলে দেখে ফরসা গোলমাল একটি মুখ সরে যাচ্ছে—কার্জন। পেছনে দাঁড়িয়ে পাবলো বলল—নিজেই দ্যাখ রে কার্জন গদ্দার কে, মিথ্যুক কে! ঠিক বলেছিলুম কি না!
দু’জনে দুটো মোড়া টেনে বসল। বল্লী হেসে বলল—কী করে ধরলি?—সে একটুও অপ্রস্তুত হয়নি।
সিম্পল ডিডাকশন, ওয়াটসন। সার্কামস্ট্যানশ্যাল এভিডেন্স—পাবলো বলল। পঙ্কজ বল্লী পাবলো তিনজনের উপস্থিতিতে কাগজের রোলটা কার্জন বল্লীর টেবিলে রাখে। ভুলে চলে যায়। দু’মিনিটের মধ্যে ফিরে আসে—নো পঙ্কজ, নো পাবলো, কাগজ ভ্যানিশ। পাবলো জানে সে নেয়নি। পঙ্কজ হ্যাজ বিন ক্লোজলি এগজামিন্ড। সে নেয়নি। পড়ে রইল বল্লী। সোজা হিসেব সে—ই নিয়েছে, ব্যস। প্রথমে, বল্লী নিয়েছে অথচ স্বীকার করছে না—এটা বল্লীর চরিত্রের সঙ্গে খাপ খাচ্ছিল না। তাই টিকটিকি একটু মিসলেড হয়। তারপর দেখা গেল লজিক বলছে—বল্লী ইজ দা কালপ্রিট। তখন টিকটিকি চরিত্রের ব্যাপারটা ন্যাচার্যালি ইগনোর করে।—এখন দ্যাখ ধরার কাজটা চ্যালেঞ্জ ছিল ধরে দিয়েছি। কেন নিয়েছিস, কী মতলবে, সে কৈফিয়ত তুই কার্জনকে দিবি। আমার কথা আমি রেখেছি। এবার তোরা বোঝ—বলে টলে দু’লাফে পাবলো ঘরের বাইরে চলে গেল।
মুচকি হেসে বল্লী বলল—খাসা লিখেছিস কিন্তু প্রান্তিক, সহর্ষে, কলৌ নাস্ত্যেব নাস্ত্যেব…র্যাগিংয়ের ইঙ্গিতবহ…গুলি—চক্ষু উদ্ধতকর্ণ…এত সব ভাল ভাল বাংলা সংস্কৃত কোত্থেকে শিখলি রে?
তোরা যখন ঘাড় গুঁজে সিলেবাস পড়িস আমি তখন হরেক কিসিমের বই পড়ি। বই পড়া ছোট থেকে আমার ভীষণ নেশা। বঙ্কিম টু বুদ্ধদেব বসু সব পড়ে ফেলেছি।
তার পরের?
সব সব। আগেকারটা কত পড়েছি বোঝবার জন্যে বললুম কথাটা। তোর কেমন লাগল?
বললুম তো খাসা। শেষ কর। মজাদার একটা উপন্যাস।
আমি তো তোকে পড়াব বলেই এসেছিলুম। কী ছাইভস্ম হচ্ছে, সেকেন্ড ওপিনিয়ন চাই তো একটা!—তোর চুরি করার কী দরকার ছিল?
জাস্ট কিউরিয়সিটি। বিশ্বাস কর। আনহোলি কিউসিরিটি মানছি। যেভাবে আগলে আগলে আনছিলি আমি ভেবেছি লভ—লেটার। কে দিল, না তুই কাউকে দিচ্ছিস, খুব কৌতূহল হল বুঝলি? খুলে পড়তে গিয়ে দেখি আরে এ যে একটা স্টোরি! তোর লেখা বলে মনেই হয় না। সত্যি তুই লিখেছিস?
সত্যি না তো কি মিথ্যে?
আমি ভেবেছিলুম কোথাও থেকে টুকলিফাই করেছিস। তারপর দেখলুম, বেশ কিছু ক্যারেক্টার চিনতে পারছি। তুই তা হলে রাইটার হচ্ছিস?
ইচ্ছে তো তাই—কার্জন লাজুক মুখে বলল—পরিস্থিতি প্রতিকূল। আমাকে সি এ ফি এ পড়তে হবে। নইলে কম্পুটার লাইনে কি ম্যানেজমেন্ট ঢুকিয়ে দেবে। কী করি বল তো! লাইফ হেল হয়ে যাবে ওসব লাইনে গেলে। তা ছাড়া আমার সময় চাই। অনেক অনেক সময়। তা তুই কি আজই সবে ওটা নিয়ে বসেছিলি?
বল্লী বলল—একরকম তাই ধর। উলটেপালটে একটু দেখে নিয়েছি যে শেষ হয়নি। তারপর তুই এমন ধরপাকড় শুরু করলি! আমি দিয়ে দিতে পারতুম। কিন্তু তখন একটা জেদ চেপে গেছে। মজাও আছে। একটু পড়ে ইন্টরেস্ট পেয়ে গেছি। তারপর তো পরীক্ষা এগিয়ে এল। শেলফের পেছনে রেখে ভুলে মেরে দিয়েছি। মামার বাড়ি গিয়েছিলুম ক’দিনের জন্যে। এসেই হঠাৎ মনে পড়ল দেখি তো! আচ্ছা কার্জন, তোদের বাড়িতে কেউ লেখক আছেন? ছিলেন?
আরে আমার বড়মামাই তো লেখক ছিলেন। মানে হতে চেয়েছিলেন। তা কেউ হতে দিলে তো! দিদিমা কান্নাকাটি শুরু করলেন—ছেলেটা না খেতে পেয়ে মরবে। দাদু হুংকার ছাড়লেন একখানা, মামা সুড়সুড় করে এঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চলে গেলেন। ডি ভি সি—র এঞ্জিনিয়ার। বাড়ি ভরতি বই। তাকের পেছনে তাড়া তাড়া খাতায় পদ্য। মামা আমাকে খুব উৎসাহ দিচ্ছে বুঝলি! বলছে আমার প্রতিভা শেষ করে দিয়েছে সবাই মিলে। তুই লেগে থাক। আদা—জল খেয়ে লাগ। তবে একদম স্পিকটি নট। আমি দুটো পদ্য লিখেই ধরা পড়ে গিয়েছিলুম। তুই স্ট্রিক্ট সিক্রেসি মেনটেন করবি। কাকপক্ষী যেন টের না পায়। খবরদার ঝোলা ব্যাগ নিবি না, প্যান্টের ওপর পাঞ্জাবি পরবি না। চোখের দৃষ্টিটা তোর আনমনা আনমনা হয়ে থাকে, ওটা পালটা। চতুর্দিকে নজর রেখে যাবি। ট্রেনে বাসে বাজারহাটে রাস্তাঘাটে বাড়িতে। মানুষ কীভাবে কথা বলে, কীভাবে চলে ফেরে।
কার্জন বলল—মামার পদ্য আমার গদ্য। লাইন একটু আলাদা। মামার লাইব্রেরি থেকে মেলা বই পড়েছি রে। এই সিক্রেসি মেনটেন করতে গিয়েই যত্ত ঝামেলা। জানিস বল্লী, আমি একটা ছোট, ব্যাটারি সেট টেপ রেকর্ডার কিনেছি। হাতে করে নিয়ে বাজারে, দোকানে ঘুরি। কথাবার্তা টেপ করি।
লড়ে যা। আমি আছি—বল্লী বলল।
এটা জাস্ট একটা এক্সপেরিমেন্ট বুঝলি?
তা বুঝেছি। কিন্তু আত্মজীবনী এভাবে লিখতে গেলি কেন?
অসুবিধে কী!
আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব সব নিজেদের ভূত দেখবে যে!
কার্জন হাসল। বল্লীও হাসি হাসি মুখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।
তোর ভূত দেখেছিস?
না।
তবে কার দেখলি?
অবভিয়াসলি তোর নিজের, তোর দাদার, বাবা—মা’রও বোধহয়!
কার্জন একটা বেশ বোদ্ধার হাসি দিল, —সিবলিং কনফ্লিক্ট বা সিবলিং জেলাসি একটা খুব কমন থিম, বুঝলি? এটা সিরিয়াসলিও নেওয়া যায়, আবার এটা নিয়ে বেশ মজাও করা যায়। মজাটা করেছি। পড়ে তুই যদি বুঝে থাকিস সত্যিই আমি একটা অ্যাগ্রিভড পার্টি, দাদা বেশি অ্যাটেনশন পাচ্ছে বলে খেপে আছি, বন্ধুরা আমাকে নিয়ে মজা করে, মাস্টারমশাইরাও, তবে বুঝতেই পারছিস খুব ভুল করবি। আমি প্র্যাক্টিক্যালি আমার মা—জ্যাঠাইমার গোপাল। দাদাও আমার প্রচণ্ড বোঝে, বন্ধুদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কেমন তা তো তুই জানিসই। আমার জেঠু বীভৎস মজাদার মানুষ। বাবা গম্ভীর। কিন্তু ঝুনো নারকোল, ফাটালেই ফোয়ারা। আমার দিদি মানে জ্যাঠাতুতো দিদি একটা এক নম্বর ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। চিরকাল। দাদা বা আমি কেউই ওর ধারেকাছে নেই। কিন্তু এ নিয়ে আমাদের বাড়িতে কোনও টেনশন, কোনও প্রেশার কিচ্ছু নেই। দিদি নিজেও প্রচণ্ড মজা করতে ভালবাসে। যা এক একখানা মেল পাঠায় না। হাসতে হাসতে পেট ফেটে যাবে।
এখন কথা হল ফিকশন বলে কেন? তুই দেখবি ফ্যাক্ট যতই অদ্ভুত হোক তা নিয়ে লেখা, মানে বিশুদ্ধ তথ্য দিয়ে লেখা চট করে সার্থক হয় না। কল্পনা। কল্পনা হচ্ছে সেই জিনিস যা ঠিক পরিমাণে মেশালে তবে জীবন থেকে সাহিত্য পাওয়া যায়। কী রে বোর করছি?
বল্লী বলল প্লিজ, ডোন্ট স্টপ, গো অন।
‘আমি’টা কেন নিয়েছি বল তো? ওতে ক্যারেক্টারটার সঙ্গে আইডেন্টিফাই করতে সুবিধে হয়। ওই ক্যাবলা নামে চরিত্রটার মধ্যে ঢুকে গেলুম। মোটামুটি আমাদের বাড়ির যা সেট আপ সেইরকম একটা সেট—আপ কল্পনা করে নিলুম। সুবিধে হল।
বল্লী বলল—দাদাকে না নিয়ে দিদি বা বোনও তো নিতে পারতিস!
বোন বা দিদি? একটু মিন হয়ে যায় না একটা টিন—এজ ছেলের দিদি বোনের সঙ্গে হিংসেহিংসিটা? বোনে বোনে যতটা হয় ভাইয়ে ভাইয়ে যতটা হয় ভাই—বোনে অতটা হয় না। সিরিয়াস হয়ে যেতে পারে। এনিওয়ে, দাদার সঙ্গে খুনসুটির ধরনটা আমার জানা ছকের মধ্যে পড়ে। ওটাই সহজে এসে গেল। কিন্তু এটাই আমার একমাত্র নয়। পোয়েটিক জিনিস লিখেছি, ক্রিটিক্যাল জিনিস লিখেছি, কবিতাও লিখেছি।
তো সেগুলো কবে পড়াবি?
তুই সত্যি ইন্টরেস্টেড?
তবে? আমিও তো একটু আধটু…মানে ওই আর কী!
লিখিস! তুই! বলবি তো।
ধ্যাত বলবার মতো কিছু নয়। তোর মতো এত ভালই নয়। বল্লীর মুখে লজ্জার আভা।
কালই আসছি। তোরগুলো রেডি রাখিস। ঠিক আছে?
ঠিক।—কার্জন উদ্ভাসিত মুখে বেরিয়ে গেল—সি ইউ!