যে যেখানে যায় – ৮

এদিকে পাবলোদের বাড়িতে জোর জলসা জমেছে। উলটোনা হাঁড়ি বাজাচ্ছে পঙ্কজ ধুধুরিয়া। স্প্যানিশ গিটার হাতে ট্যাং ট্যাং আওয়াজ তুলে গাইছে পাবলো।

গরমেতে হাঁসফাঁস করবি?
না জলে ডুবে মরবি?
তার চেয়ে শীতে জমে শিলালিপি—ই—ই
নর্থ পোল গলে আসা হিজিবিজি হিবিজিপি—ই
সুনামির জল রোজ বাড়ছে
কোল থেকে কালো জমি কাড়ছে
তার চেয়ে এই বেলা জমি—জমা নদী—টদি নালা—টালা ছেলেপুলে
বেচে—বুচে টাকাকড়ি বুঝে নিয়ে চলো কাকা
আমেরিকা আমেরিকা আমেরিকা

হাঁড়ি বাজাতে বাজাতে সমঝদারি মাথা নাড়ছে পঙ্কজ। মাঝে মাঝে পাবলো হাঁক দিচ্ছে—শম্পি—ই কিছুমিছু এনে দে না বিন্দাস। এটা গানেরই অঙ্গ না শম্পিকে অনুরোধ বা অর্ডার বলা যাচ্ছে না। শম্পি দু’বার এসে ফিরে গেল। দ্বিতীয় বার এসে বলল মাংসের পুরটা তৈরি হয়ে গেছে। একটু দাঁড়া। শিঙাড়াগুলো গড়ছে।

উহুঃ ডাকিনি তো কোনও ডাক ডাকিনীকে।

একই ভাবে মাথা নাড়তে নাড়তে পাবলো গেয়ে উঠল।

আমায় ডাকিনী বললি? খাওয়াচ্ছি মাংসের শিঙাড়া, শম্পি তেড়ে আসে।

গিটারটা রেখে পাবলো বলে—শোন, জীবনের অন্তর্গত রক্তের ভেতরে যেখানে যা কিছু খেলা করে স—ব সমস্ত গানের বিষয়। কাউকে ডাকছি কাউকে বকছি, চুকলি কাটা হচ্ছে, কেচ্ছা, সেলফ—পিটি, হেভি খাওয়া, জমল না খাওয়া—এভরিথিং পসিবল আন্ডার দা স্কাই।

শম্পি গালে হাত দিয়ে বসল। বোতল থেকে ঢকঢক করে জল খেয়ে পাবলো বোতলটা পঙ্কজকে এগিয়ে দিল। বলল মুখ লাগিয়ে খাবি না। ছোত ছেলে দুদু খায়।

পরের গান এইখান থেকেই শুরু হল।

ছোতো ছেলে পঙ্কজ দুদু খায়
এত্তুখানি বড় হয়ে মদু খায়।

আর এত্তু বড় হলে উকারটা বাদ দেবে—ব্যাটা ছেলে কে দিচ্ছো উঁকিঝুঁকি? দিয়ো নাকো।

বলো খোকা ঢুকু খায়
ঢুকু ঢুকু ঢুলু ঢুলু চুল্লু খায় (খাওয়াচ্ছি)

এইরকম সময়ে সেই চ্যাঁ বেল বাজিয়ে আদি অকৃত্রিম কার্জন ঢুকে এল। এ ক’দিনে বেচারির চেহারায় একটা বড় রকম বদল হয়ে গেছে। সে খুব ম্লান হয়ে গেছে। বিষণ্ণ। চুপচাপ এসে একটা টুল টেনে নিয়ে বসল।

শম্পি রান্নাঘরের দিক থেকে হেঁকে বলল, কেউ এসে শিঙাড়ার ঝুড়িটা নিয়ে যা।

যাবি নাকি কার্জন?

যদি তোরা দয়া করিস!—কার্জন এলোমেলো হেঁটে চলে গেল।

কী ব্যাপার বল তো? কার্জনটা কি মদ খেয়েছে নাকি? পাবলো জিজ্ঞেস করল পঙ্কজকে।

পঙ্কজ কাঁধ নাচাল, বলল—দ্যাখ সব লোকের বাড়িতেই বড়রা নেই। আমার বাড়ি ফাঁকা, তোর বাড়ি ফাঁকা। কিন্তু আমরা কি এই স্বাধীনতা মিসইউজ করছি? আমরা সিগারেট বিড়ি খইনি পানপরাগ পর্যন্ত খাইনি। মদ কফ সিরাপ—গাঁজা—এসবের কথা ছেড়েই দে। মাঝখান থেকে কার্জনটা বয়ে গেল। স্যাড!

আর কোনও কারণ নেই বলছিস? পাবলো চোখ সরু করে বলল।

আবার কী কারণ থাকতে পারে?

আরে ইয়ার, ও পুয়োর ফেলো কা বান্ডুল ছোড় দো না ভাই। উসমে বহোত সারে লভ—লেটার্স হ্যায়।

তার মানে? আমার দিকে অমন গোয়েন্দা—গোয়েন্দা চোখে তাকাবার মানে? অ্যাকিউজ করছিস?

আরে ভাই দে দো না। উসকো নেই বাতাউঙ্গা। কী করছিস পঙ্কজ, ব্ল্যাকমেল—ফেল করে ব্যবসার ক্যাপিটাল জোগাড় করার তালে আছিস, না কী? মেয়েটা কে? মালদার নাকি?

পঙ্কজ তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বলল—আই অবজেক্ট। আমার নিজের বন্ধু আমাকে সন্দেহ করছে। আবার যাচ্ছেতাই সব অ্যালিগেশন!

ইতিমধ্যে একটা ছোট ঝুড়িতে গরম গরম মাংসের শিঙাড়া নিয়ে কার্জন প্রবেশ করে। বেচারা বেচারা মুখ করে পঙ্কজের কাছে যায়, করুণ কণ্ঠে বলে—শিঙাড়া নে, বান্ডিল দে ভাই।

তারপর সে পাবলোর কাছে যায়, করুণতর কণ্ঠে বলে—বান্ডিল দে, শিঙাড়া নে ভাই।

আরে তুই কি খেপে গেলি নাকি? আমাকে ডিটেকটিভ এমপ্লয় করে আমাকেই আসামি ঠাউরাচ্ছিস?

ভাঙা গলায় কার্জন বলল—সবচেয়ে মারাত্মক সেই গোয়েন্দা গল্পই যেখানে গোয়েন্দাই খুনি। আজও লেখা হয়নি। হয়তো ভবিষ্যতে লেখা হবে।

শম্পি পেল্লাই একটা চায়ের পট নিয়ে এসে গেল। বাঁ হাতে প্লাস্টিকের কাপ। নে নে চটপট করে নে চা—টা। আমাকে উদ্ধার কর খেয়ে। ভবিষ্যতে কী লেখা হবে রে কার্জন?

পাবলো বলল—গোয়েন্দাই খুনি।

কে লিখবে? তুই না কার্জন?

ওরা কেউই লক্ষ করেনি কার্জন ক্রমাগত পা বদল করছে যেন ভীষণ নার্ভাস। সে বলল—শম্পি, কেন দিক করছিস ভাই। ইউ আর লাইক মাই সিস্টার। দিয়ে দে না।

অ্যাঁ?—শম্পির বিষম খাবার জোগাড় হয়। —আমি কী দেব?

তুই জানিস তুই কী দিবি। আমিও জানি। আমি শিয়োর এখন যে তুই—ই নিয়েছিস বান্ডিলটা। এমন কতকগুলো ইন্ডিকেশন দিলি!

আশ্চর্য তো! শম্পি ঝাঁঝিয়ে উঠল, সে দিন মাসির হঠাৎ অসুখ করল সেই দিন উন্নিকে নিয়ে আমাদের বাড়ি বান্ডিল খুঁজতে এসেছিল, তখন ওর সন্দেহ ছিল পাবলোকে। এখন আমাকে সন্দেহ করছে। মাথাফাতা দেখা রে কার্জন। কেমন অবসেসিভ টাইপ হয়ে যাচ্ছিস!

মাংসের শিঙাড়া ভেঙে ফুঁ দিয়ে ঠান্ডা করতে করতে পাবলো বলল—শম্পি এর মধ্যে আসছে কোত্থেকে? তোর ডিডাকশনে মেলাই ভুল। বান্ডিল নিয়ে তুই গিয়েছিলি বল্লীর বাড়ি সেখানে বল্লী ছাড়া ছিলুম আমি আর পঙ্কজ। শম্পি তো ছিল না!

এবার ধূর্ত চোখে তাকাল কার্জন—ফ্রম পাবলো টু শম্পি—খুব কি ঘুরপথ হয়ে গেল! পাবলো, অত গাধা আমি নই।

কী করলে তুই বিশ্বাস করবি আমরা নিইনি।

অন্য কোনও জায়গা থেকে ওটাকে প্রোডিউস করলে।

দ্যাখ হয়তো ডাস্টবিনে চলে গেছে।

শিউরে উঠল কার্জন।—পাবলো!!! হোয়াই ডাস্টবিন!

ফর দা সিম্পল রিজন যে ওটা নিশ্চয় তোর পকেট ফকেট থেকে পড়ে গিয়ে রাস্তায় লুটোচ্ছিল, ন্যাচার‍্যাল কোর্সে ডাস্টবিনে চলে গেছে। তুই লভ—লেটারগুলোর আশা ছেড়ে দে কার্জন। ভাল কথা বলছি শোন, মাথাটা ঠিক থাকলে লভ—লেটার অনেক পাবি। এই তো সবে কলির সন্ধে।

কার্জন একটা শিঙাড়া নিয়ে পাবলোর লম্বা নাক লক্ষ্য করে ছুড়ল। তারপর রেগেমেগে ঝড়ের বেগে দরজা খুলে বেরিয়ে গেল।

এ তো মহা সিরিয়াস ব্যাপার হয়ে গেল দেখছি—পাবলো বলল—ছেলেটা তো একেবারে ডিসট্র্যাক্টেড হয়ে রয়েছে। তোর কী মনে হয় পঙ্কজ!

পঙ্কজ বলল—ফার্স্ট থিং জিনিসটা কী তা আমাদের বলছে না। ও কি নতুন কোনও বোমার ফর্মুলা বার করেছে? এত সিক্রেটিভ কেন?

পাবলো একটু ভাবল—তুই চিন্তাটাকে একটা নতুন খাতে বইয়ে দিলি। বোমার ফর্মুলা হয়তো নয়। কিন্তু এমন কিছু যা ও ডিসক্লোজ করতে চায় না। তার মানে পেটেন্ট নিতে চায়। পেটেন্ট নিয়ে শাঁই শাঁই করে বড়লোক হয়ে যাবে মণি ভৌমিকের মতো।

শম্পি হঠাৎ হা হা করে হেসে উঠল—কার্জনকে হঠাৎ তোরা সায়েন্টিস্ট বানাতে লাগলি কেন? ও তো কমার্সের ছাত্র!

পঙ্কজ বলল—ঠিক আছে। কমার্সেও তো কিছু না কিছু আছে বেসিক প্রবলেম, প্রিন্সিপল। কম্পুটার হতে পারে। হ্যাকিং ট্যাকিং করার কিছু মেথড বার করেছে, কি নতুন কোনও সফটওয়্যার।

তো সেটা তো কম্পুটারেই থাকতে পারে! শম্পি বলল।

দুই বন্ধুই নখ খাচ্ছে প্রবল বেগে।

শম্পি বলল—নখ খেয়ে পেট ভরিয়ে ফেললে শিঙাড়াগুলো ঢুকবে কোথায়? নে খেয়েদেয়ে ভাব।

.

আবহাওয়াটা ভিজে ভিজে। সমানে মেঘ ভেসে আসছে। জামাকাপড় ভিজিয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছে। বেশিরভাগ লোকেই অবশ্য চামড়ার জ্যাকেট বা উইন্ডচিটার পরেছে। মধুক্ষরাও প্যান্টের ওপর জ্যাকেট পরেছে। খালি যশোরই হয়েছে মুশকিল। তবে তার গায়ে একটা মোটাসোটা টুইডের কোট। মাথায় স্কার্ফ, ভিজলেও জলটা ভেতরে ঢুকছে না এই যা রক্ষা। পাইন আর ফার গাছগুলোর মধ্যে দিয়ে শনশন করে হাড় কাঁপানো হাওয়া দিচ্ছে। সূর্য ডুবলেই আর বাইরে থাকা যাচ্ছে না।

মীনাক্ষী আর তার স্বামীর সঙ্গে সঙ্ঘমিত্রাদের খুব পটে গেছে। চারজনে একসঙ্গে হ্যাপি ভ্যালি ঘুরে এলেন। যশোধরাদের বলা হয়েছিল মধুক্ষরা রাজিও হয়েছিল। কিন্তু যশো বললে—আমি স্রেফ ঠান্ডাটা উপভোগ করতে এসেছি। পাঁচটা লোকের মুখ দেখতে পচে গেছে। গোটা চেনা কলকাতাটা দার্জিলিঙে উঠে এল গো! মল দিয়ে হাঁটতে বেরোলেই এখানে বিজয়মুকুলদা ওত পেতে, ওখানে ব্যাঙা—বেঙি হাত ধরাধরি করে বেড়াচ্ছে। সেখানে সন্তোষ তাঁর বিশাল শরীর নিয়ে পনিতে চড়েছেন। পনিটা হাঁপাচ্ছে। হিলকার্ট রোড না গড়িয়াহাট রোড বোঝা দায়।

তুই সামাজিকতা কর যত খুশি—বোনকে ঢালাও অনুমতি দিয়ে যশো নিরালা নিভৃত খোঁজে।

চুপচাপ রুম হিটারের কাছাকাছি বসে একটু করে চায়ে চুমুক আর আত্মসমীক্ষা। যশোর এমনটাই চলছে।

তুই যা না। তোকে কে বারণ করেছে। তুই আর কত আমার মুখ দেখবি! ছোট বোনকে সকাল হলেই ঠেলে বার করে দেয় যশো।

নানান কথা মনে ওঠে। এই যে দড়িদড়া ছিঁড়ে নিজের উদ্যোগে পাহাড়ে চলে এল, কেন? গরমের জন্যে? সংসার করতে করতে অতিষ্ঠ লাগছিল বলে? একঘেয়েমি এসে গিয়েছিল জীবনে? সব প্রশ্নের উত্তরই বেরোয় হ্যাঁ, খানিকটা, কিন্তু সবটা নয়। নিজের মনোবীক্ষণ করতে করতে অবশেষে যশো আবিষ্কার করল তার বৈরাগ্য এসেছে। এই যে জীবনে পাওয়া আর না পাওয়ার মধ্যে অহর্নিশ দ্বন্দ্ব চলছিল সেই লড়াইয়ে সে ক্লান্ত। সুহৃৎবরণ খুবই ভাল স্বামী। কিন্তু কেমন যেন আনমনা। পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে বেশ অভিনিবেশ সহকারে যশোর সঙ্গে প্রেম বা দাম্পত্য তিনি করেননি। কিছু বলবার নেই। কিন্তু একটা অভাববোধ থেকে গেছে যশোর লভ—লাইফে। বড্ড ইচ্ছে ছিল প্রেমের বিয়ে করে। মধু তো তার উমেদারদের মধ্যে থেকে মিহিরকিরণকে বেছে নেবার সুযোগ পেল। বাইরে থেকে দুই দম্পতিকে দেখলে অবশ্য কেউই বুঝবে না বড়রটি অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ, ছোটরটি লভ—ম্যারেজ। দুটোই একই রকমের একঘেয়ে। আসল কথা যশোর রোম্যান্টিক মন। চির—রোম্যান্টিক। সেই রোম্যান্টিক মনটুকু বড্ড উপোসি থেকে গেছে।

লোকে যা চায় সেই টাকাপয়সার অভাব নেই। নিজেরই অঢেল। একটি ছেলে। ছোটতে ছেলেকে নিয়ে যশো অবশ্যই খুব মেতে ছিল। কিন্তু যত বড় হল—পাবলো দূর থেকে দূরে সরে গেল। সে বুঝতে পারে পাবলোর মনের মধ্যে আর মাতৃমূর্তি সদা—জাগরূক নেই। এখন থেকেই। তবে? কা তব কান্তা কস্তে পুত্রঃ শাস্ত্রে কি সাধে বলেছে! এই আটচল্লিশ—ঊনপঞ্চাশ বছর বয়সেই যশোর সব সাংসারিক কর্তব্য সারা হয়ে গেছে। এরপর বাবার মতো পাবলোও আপিস—কাছারি করবে, খুব ধুমধাম দেখনাই করে ছেলের বিয়ে দেবে নিশ্চয়ই সুহৃৎ—যশো। কিন্তু সবই যেন কেমন গতানুগতিক। জীবনে কি আর নতুন কিছু নেই? কোনও চমক? কোনও আচমকা আনন্দ?

ভাবতে ভাবতে যশোর নাক ডাকতে লাগল। এই গুণটা তার আছে। খুব চট করে সে ঘুমিয়ে পড়তে পারে। বিশেষ করে ভাবনাচিন্তা করতে গেলেই দুম করে ঘুম এসে যায়। কতক্ষণ ঘুমিয়েছে কে জানে। কে যেন কানের কাছে বলল—কীসের ক্লান্তি মা। কীসের অবসাদ! ওঠো, জাগো, তোমার জন্যে নির্দিষ্ট কাজ আছে। জগৎ তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে।

ঘুমের মধ্যেই যশো ছড়িয়ে জড়িয়ে বলল—আমার জন্যে কারও অপেক্ষা নেই গুরুদেব। আমি একা, বাতিল। দিনগত পাপক্ষয় করছি।

ঝট করে ঘুমটা ভেঙে গেল। সেই ঘর। জানলার কাচ দিয়ে ঝকঝকে রুপোর মুকুটের মতো কাঞ্চনজঙ্ঘার আধখানা দেখা যাচ্ছে। বাকি অর্ধেক মেঘে ঢাকা। ঘরে কেউ নেই। সোফায় নেতিয়ে রয়েছে সে। সামনে নিচু টেবিলে চায়ের সরঞ্জাম। ড্রেসিং টেবিলে ফুলদানে গোলাপি বেগুনি অর্কিড সাজানো, ঘরের দেয়ালে শেরপার ছবি। মাউন্ট এভারেস্টের ছবি। সে কি স্বপ্ন দেখল? কিছু তো দেখেওনি! খালি শুনেছে! নাঃ মাথাটা ঝাঁকিয়ে উঠে পড়ল যশো। বড্ড বেশি একা একা থাকা হয়ে যাচ্ছে। তাকে কি ভূতে পাচ্ছে নাকি! বেশ ভাল রোদ উঠেছে আজ। বাইরেটা এতক্ষণে তার কাছে ডাক পাঠাচ্ছে। ক্লজেট থেকে মোটা অ্যাঙ্গোরার কার্ডিগ্যানটা গলিয়ে নিয়ে মাথায় স্কার্ফ, ঘরে চাবি লাগাল যশো। তারপর নীচে নেমে গেল। কাউন্টারে চাবি রাখতে গিয়ে দেখে সেখানে মেলাই লোক। সাহেব, মেম, বাঙালি, মাড়োয়ারি সব নিজেদের মধ্যে কথা বলছে এবং তার পরই দরজা দিয়ে ঢুকলেন গৈরিক পরনে এক সাধু। আহা কী রূপ! কালো ভ্রমরকৃষ্ণ দাড়িগোঁফ। মাথার চুল কাঁধ পর্যন্ত। এই শীতে গেরুয়া আলখাল্লা আর গেরুয়া চাদর তার ওপরে। ব্যস। মাথায় কানঢাকা বিরিঞ্চিবাবা টুপিটা পর্যন্ত নেই।

সবাই সসম্ভ্রমে জায়গা করে দিল। একটি মেমসাহেবের সঙ্গে তিনি তাঁর জন্য নির্দিষ্ট ঘরের দিকে চলে গেলেন। যাবার সময়ে হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে যশোর চোখে চোখ রাখলেন। যশো স্থাণু হয়ে রইল। লাউঞ্জে ছড়িয়ে ছিটিয়ে এঁরা সব বসে নানা আলোচনা করছিলেন। বোধহয় ভ্রমণসূচি নিয়ে। যশো মন্ত্রমুগ্ধের মতো একজনের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল—উনি কে?

উনি? ওঁকে চেনেন না? চিনবেন কী করে? প্রচার ভালবাসেন না। হৃষীকেশে থাকেন। আর মাঝে মাঝে বিদেশ যান। উনি অভীন্সানন্দ মহারাজ।

আপনারা?

আমরা ভাগ্যবান। ওঁর মন্ত্রশিষ্য।

কেমন একটা ঘোরের মাথায় যশো লাউঞ্জ থেকে বেরিয়ে কাউন্টারে যায়।—মহারাজজি কওন রুম পে হ্যাঁয়।

দোসো সাত।

যশো রোদ ঝলমলে দার্জিলিং প্রকৃতির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে স্বপ্নচালিতের মতো দোতলার সাত নম্বর ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। দরজায় সামান্য শব্দ। দরজা খুলে গেল। সামনে মেমসাহেব। বেশ বুড়ি তবে চটপটে। অদূরে অভীন্সানন্দ একটি আরামচেয়ারে বসে স্ট্রেট যশোর দিকে তাকিয়ে আছে। যশো হরিণশিশুর মতো এগিয়ে যায়। কার্পেটের ওপর বসে পড়ে। মহারাজ বলেন—মা, বড় ক্লান্ত না?

হ্যাঁ বাবা। বড্ড।

.

মধুক্ষরা মুখার্জি অভ্যাস মতো আগে ক্যাভেন্টার্স—এ ঢুকেছিলেন। সেখানে স্বভাবতই আরও অনেকের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। সবাইকে হাই হ্যালো করে মধুক্ষরা মাঝখানের একটি টেবিলে একলা বসে চা আর চকোলেট পেস্ট্রি অর্ডার করল।

তোর দিদি কি হারিয়ে গেল?—মীনাক্ষী রসিকতা করলেন।

সঙ্ঘমিত্রা বললেন—ঝগড়া হয়েছে দু’বোনে।

মিটিমিটি হেসে মধুক্ষরা চায়ে চুমুক দিল। দিয়েই ভূত দেখার মতো চমকে উঠল! ডক্টর সুবল মিত্র ঢুকছেন। আড়চোখে দেখেছিল। প্রথম ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠে এখন আবার স্বাভাবিক হয়ে গেছে মধুক্ষরা।

মিহিরকিরণের গলা মিহি ছিল। ছিল কেন এখনও আছে। কিন্তু সুবলদার গলায় বল নেই। কেমন উইক উইক। তা নয়তো বেশ স্লিম চেহারা, সুবলদা যোগশিক্ষা দিয়ে থাকেন,অর্থাৎ নিজেও করেন। নিয়মিত। চেহারায় সেই ব্যায়াম আর সংযমের ছাপ আছে। কত ছোট থেকে সুবুলদাদের সঙ্গে চেনাশোনা তাদের। আসা যাওয়া তেমন ছিল না। ওই দূর থেকে। তাই আপনি—আজ্ঞেটা আর ঘুচল না।

যাঃ, মধুক্ষরার সামনের খালি চেয়ারটাতেই সুবুলদা এসে বসলেন।

বসতে পারি?—বসেটসে বললেন।

আপনি বসুন। তবে আমি এখুনি উঠব।

ম্যাডাম কোথায়?

দিদি?—হোটেলে।

কেন? আবার শরীর খারাপ?

উঁহু, মন খারাপ।—বলেই মনে মনে জিব কাটলেন মধুক্ষরা। সুবুলদার চোখ হাসিতে চিকচিক করছে। বললেন,—আর তোমার?

আমার শরীর—মন বেশ তরতাজা ঝরঝরে আছে।

সেটাই তো তোমার চার্ম মধু। ডাক্তারেরা সবচেয়ে কী অপছন্দ করে বলো তো।

মধুক্ষরা অবলীলায় বলে দিলেন—পছন্দ করে নার্স। কিন্তু অপছন্দ কী করে তা তো জানি না!

হাঃ হাঃ হাঃ। বলতে পারলে না?—অসুখ, অসুখ, ডিজিজ। রোগ দেখলেই ডাক্তারদের রাগ হয়ে যায়, মেজাজ খিঁচড়ে যায়, মনে হয় সব ব্যাটাকে খুব কষে কান মুলে দিই।

রোগীকেও?

দ্যাট ডিপেন্ডস। রোগীর আশেপাশে যারা থাকে তাদেরও হতে পারে।

আপনি অনুপযুক্ত সুবুলদা। ডাক্তার হওয়াটা আপনার আদৌ উচিত হয়নি।

হয়নি—ই তো। কিন্তু তুমি তো জানো ক্ষরা আমাদের যুগে কর্তার ইচ্ছেয় কর্ম। এবং কর্তা তখন দুটি ইচ্ছে করতেন। হয় ডাক্তার নয় ইঞ্জিনিয়ার। অঙ্কটায় তেমন সুবিধে করতে পারতুম না। এদিকে বায়ো—ক্লাসে অবলীলায় আরশোলা থেকে কেঁচো, কেঁচো থেকে ব্যাং কেটে যাচ্ছি। অতএব…

ইঃ! নিন, আপনি আরশোলা কেঁচোর কথা ভাবুন আমি চলি।

যাবে?—মিটিমিটি হেসে সুবুলদা বলল—যাও। তবে যাবে আর কোথায়?

মধু ট্রাউজার্স পরা স্মার্ট পা ফেলে জ্যাকেটের পকেটের হাত ঢুকিয়ে গটগট করে বেরিয়ে এল। বলে কিনা যাও, তবে যাবে আর কোথায়! সাহস তো কম নয়!

আজ আর হিলকার্ট রোড ধরে বেড়াতে ইচ্ছে করছে না। আবহাওয়া ভাল বলে কাঁড়ি কাঁড়ি লোক জমেছে। সব বাঙালি। দেখলেই পিত্তি জ্বলে যায়। সোজা পার্কে উঠে গেল মধুক্ষরা। এখানেও ছোট ছোট ছেলেমেয়ে খেলা করছে। তাদের বাবা—মা’রাও চার দিকে ছড়িয়ে—ছিটিয়ে আছে। কিন্তু মধু একটি নীরব নির্জন বেঞ্চ পেয়ে গেল।

সুবুলদা যে এরকম স্মার্ট কথাবার্তা বলতে পারে, এমন গটগট করে হাঁটে, এমন মিটিমিটি হাসতে পারে কস্মিনকালেও কেউ ভেবেছিল! দার্জিলিঙে এসে সুবুলদার মলাটখানাই পালটে গেছে। সাতসকালে সুবুলদা নিশ্চয়ই পান করে আসেনি। কোনও গন্ধও তো পায়নি মধু কথা বলবার সময়ে। আশ্চর্য, আশ্চর্য এবং আশ্চর্য!

কলকাতায় যে—লোক কথা বলতে গেলেই তো—তো করে, কাঁপা গলায় ওষুধের নাম বলে, কাঁপা হাতে প্রেসক্রিপশান লেখে, ঈষৎ কুঁজো হয়ে চলে, সোজাসুজি চোখের দিকে তাকায় না, দার্জিলিঙে সেই লোক এমনি? তাজ্জব কি বাত! এ সবই কি সুবুল বউদির সৌজন্যে! বউদি মেট্রন, নার্স মানুষ, রাশভারী হবে তাতে আর বিচিত্র কী! কিন্তু তাই বলে পুরো অন্যরকম হয়ে যাবে! কলকাতার সুবুল, দার্জিলিঙে সু—বল। আহা, সুবুলদা আমি খুব খু—উব পাকা মেয়ে ছিলুম। তোমার মনোভাব কি আর আমি টের পাইনি? কিন্তু মিনমিনে টাইপের মানুষ আমার কোনওদিন মনে ধরে না। কত ক্যান্ডিডেট এল গেল জীবনে। খুব ভাব সবার সঙ্গেই। কিন্তু—সিনেমা যাবি?—ধুত, রেস্তোরাঁয় যদি ঢোকো তো পরদা—ফরদার মধ্যে নয়, একেবারে হট্টমেলার মধ্যিখানে চাটুজ্জেবাড়ির রূপসি মেয়েকে নিয়ে বসবার সাহস হয় তো বসো বাবা। নইলে এসো। ছোঁকছোঁকেদের কোনওদিন পাত্তা দেয়নি মধুক্ষরা মুখার্জি। ছিনে জোঁকদেরও না। ঠগ বাছতে বাছতে গাঁ উজাড় হয়ে গেল, কেউ মধুর মন পেল না। শেষপর্যন্ত মন্দর ভাল মিহিরকিরণ মুখুজ্জে। সেন্স অব হিউমার, ব্রঞ্জের মতো রং, খয়েরি রঙের একমাথা চুল আর অফুরন্ত বাক্যি। বাক্যবাগীশ একেবারে। বাক্য দিয়েই বাবাকে মাকে বাগিয়ে নিল। মধুক্ষরা প্র্যাকটিক্যাল মানুষ, দেখলে বাছতে গেলে সর্বত্র খুঁত বেরোবে। তার চেয়ে হাসিখুশি যুবকটিতেই সম্মতি দেওয়া যাক।

সুবুলদাকে কোনওদিন ধর্তব্যের মধ্যেই আনেনি মধুক্ষরা। শুধু মিনমিনে ব্যক্তিত্বই না। সুবুলদারা ইয়ে মানে বড্ড মিডল মিডল ক্লাস। সুবুলদার বাবা লুঙ্গি পরেন বাড়িতে, চেক—চেক বিচ্ছিরি লুঙ্গি। সুবুলদার মা বাইরে বেরোলেই মাথায় একটু ঘোমটা, সিঁদুরের টিপ, শাঁখা লোহা তাবিজ নানানখানা। বাড়িটা অবশ্য নিজেদের। কিন্তু কী—ই বা বাড়ির ছিরি। যখন যে যেটুকু পেরেছে যোগ করে দিয়েছে—প্ল্যান না কিছু না। রাস্তার লেভেল থেকে নিচু একতলা। ঠ্যাঙা ঠ্যাঙা সিমেন্টের চৌকাঠ। ঘরে আলো—হাওয়া ঢোকে না। দোতলাটায় যদি বা ঢোকে সেটাকে বোকার মতো ভাড়া দিয়েছে। তার ওপর সুবুলদার তিন তিনটে বোন। এক দিদি, দুই বোন। দিদির বিয়েতে মাংস কম পড়ে গিয়েছিল। সে এক কেলো। বরযাত্রীরা বলে মাংস না খেয়ে আমরা নড়ছি না। লোকে বাজার গেল, মাংসের দোকানের ঝাঁপ খুলিয়ে কাকুতিমিনতি করে পাঁঠা কাটিয়ে আনলে, সেই পাঁঠা রান্না হল। ততক্ষণ বরযাত্রীরা এঁটো হাতে খোশগল্প করেই যাচ্ছে, যেন কিচ্ছুই হয়নি। কোনও ব্যাচ বসতে পাচ্ছে না। বেশিরভাগ লোক—দুচ্ছাতার নেমন্তন্ন বলে বাড়ি চলে গিয়েছিল। খালি যশো আর মধু কিছুতেই আসেনি। মাটন রান্না হলে ওই বরযাত্রীরা কতক্ষণে খাবে দেখতে বসে ছিল। মাংস মুখে দিতেই টাকরা পর্যন্ত জ্বলে গেল। উস আস হুস হাস করে বরযাত্রীরা সব লন্ডভন্ড করে আর কী! সুবুলদার বাবা হাতজোড় করে মাফ চান—আর ভাই তাড়াতাড়িতে একটু ঝাল বেশি পড়ে গেছে তো রসগোল্লা খান, পানতুয়া খান। বোকা বরযাত্রীগুলো তাইতে ভুলে গেল। আসল কথা সুবুলদার বাবা আর রান্নার ঠাকুর দু’জনে মিলে এই কীর্তিটা করেছিলেন। বরযাত্রীরা উঠে গেলে জ্যাঠামশাই নিজে এসে যশো—মধু এবং অন্যদের চুপিচুপি বলে গেলেন কিনা—বোসো বোসো আঝালা মাংস আছে। খেয়ে যাবে। সেই সময় সুবুলদাকে বলতে শুনেছিল—যেমন কুকুর তেমনি মুগুর।—ওদের দেখতে পায়নি সুবুলদা। সে তখন মেডিক্যাল থার্ড ইয়ারের ছাত্র। ভাল বেশ। আপন মনেই মিচকে মতন হাসতে হাসতে বলেছিল। এখন স্পষ্ট মনে পড়ছে মধুর। তার একটু আশ্চর্য লেগেছিল। কেননা সুবুলদা নিরীহ মতো ছেলে কারুর সাতেপাঁচে থাকে না। তার এমন কথা! মিচকে হাসি!

এখন মধুক্ষরা বুঝতে পারছে, সুবুলদা ইচ্ছে করে নিজের অমন একটা ইমেজ বানিয়ে রেখেছিল। বোধহয় বাবা—মাকে ভড়কি দিতে। এখন বউদিকে ভড়কি দিচ্ছে।

তার দিদির কিন্তু এ বিষয়ে কতকগুলো স্বাভাবিক জ্ঞান আছে। সে বলে থাকে যে—লোক চোখে চোখ রেখে কথা বলে না, যারা হাত কচলায় আর যারা স্পন্ডিলাইটিস না থাকলেও কুঁজো হয়ে থাকে, তাদের মধ্যে গন্ডগোল আছে। খবরদার তাদের বিশ্বাস করবি না। তারা দু’মুখো। জেকিল—হাইডের মধ্যে হাইড অ্যান্ড সিক চলছে।

এক হিসেবে তাকেও তো ভড়কিই দিয়েছে সুবুলদা। জানতে দেয়নি আসলে সে কত চালাক—চতুর, কত কৃতী। দেখেশুনে শাঁসালো কর্মীমেয়ে বিয়ে করেছে। শোনা যায় পৈতৃক বাড়ি ভেঙে এখন সুবুলদার জয়পুরী পিঙ্ক মার্বলের মেঝেঅলা চমৎকার দোতলা বাড়ি। তাতে নাকি জাকুজি আছে। লেকগার্ডেন্সের চেম্বারটিও খুব মনোরম করে সাজিয়েছে সুবুলদা। কখনও গিয়ে দেখে দেয়ালের ছবি সব যামিনী রায়, কখনও সব চিনে জাপানি, ঠান্ডা ঠান্ডা কুল কুল। ওয়েটিং রুমটাতে যথেষ্ট গদিআঁটা সোফা, প্রচুর পত্রিকা, ওয়াটার কুলার, চমৎকার বাথরুম। জি—পি তো ইদানীং খুব কমে গেছে। সুবুলদা ইলেত—বিলেত যায়নি। এম ডি করে এখানেই জেনারেল প্র্যাকটিস করছে। কার্ডিওলজিতেও ডিগ্রি আছে। সুবুলদার একমাত্র ছেলে কানাডায় ডাক্তারি করছে। একমাত্র মেয়ে জাপানে ডাক্তারি করছে। ভাবা যায়? আর মধুর একমাত্র বর দিনরাত মক্কেলের সঙ্গে ঘ্যানর ঘ্যানর। চেম্বারটা একটা গুদাম বিশেষ। মধুর একমাত্র মেয়েও সেই পথেই যাবে বলছে। কোম্পানি ল’ পড়বে নাকি! দিগদিগন্তে কোথাও, কোনও কৃতিত্বের ছোঁয়া নেই।

তবে কি সে ভুল করল? অত কাঁটা বাছাবাছি করতে গিয়ে ইলিশ মাছটাই খাওয়া হল না! মধুর দীর্ঘশ্বাস পড়ল। কিন্তু সুবুলদা যে—ধরনের তুখোড় লোক আসলে বলে মনে হচ্ছে, সে ইচ্ছে করলে মধুকে হাসিল করতই। তার মানে ইচ্ছে করেনি। অথচ ইচ্ছে এরকম ভাব দেখিয়েছে। সবটাই চালাকি! যাতে মধু তার দিকে না ঝোঁকে। দারুণ সাইকলজি বোঝে তো লোকটা!

বেশ রেগেমেগে মধুক্ষরা নেমে এল। খটখট গটগট করে এক চক্কর দিয়ে হোটেলে ফিরে এল। ঘরে গিয়ে দেখে চাবি। দিদি বেরিয়েছে। কাউন্টার থেকে চাবি নিয়ে সে ঘরে যায়। লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে। একটু ঘুমিয়েও নেয়। বেলা দুটোয় ঘুম ভাঙে। চোখ খুলে দেখে নো দিদি। সন্ধেবেলাও দিদি এল না। দিদি কি ভ্যানিশ হয়ে গেল?

.

মুড়কিশোলা গ্রামে মোট একশো ঘর লোকও নেই। কিন্তু যে ক’ঘর আছে তারা ঝেঁটিয়ে এসেছে শহরের দাদা—দিদিদের দেখতে। পরি ক্রমাগত বলে যাচ্ছে—আহ, ভিড় জমাচ্ছ কেন? পালিয়ে তো আর যাচ্ছে না।

ভোরবেলায় ঘুম ভেঙে গিয়েছিল দু’জনের। গায়ে, হাতে, পায়ে খুব করে মশার ওষুধ লাগিয়ে মশারিবিহীন শুয়েছিল। অন্যরা সব দাওয়ায় মশারি টাঙিয়ে শুয়েছে। ওদের একটা ঘর ছেড়ে দিয়েছিল। হাতপাখা ছিল, কিন্তু বড্ড গরম। বরং বাইরে হু হু করে হাওয়া দিচ্ছে। ভোরে উঠে পড়ে আগে মধুবন।—দাদা, এই দাদা, এদের তো টয়লেট—ফেট আছে বলে মনে হচ্ছে না। ওঠ, আমাকে নিয়ে চল। ঋজুরুস্তম জেগেই ছিল, কেমন একটা ঘোরের মধ্যে ছিল। ঠিক তো! সে তড়াক করে উঠে বসল। অন্তত পাঁচ মাইল যাওয়া পাঁচ মাইল আসা, তবে প্রাতঃকৃত্য হয়। ফিরে আসতে দেখল পরি আর পরির বাবা উদ্বিগ্ন মুখে খোঁজাখুঁজি করছে।

বেড়াতে গিয়েছিলুম—মধুবন বলল।

পরি বলল—সাপ—খোপ বিছেটিছে কত কী আছে, কে তোমাদের বলেছিল অত দূরে যেতে! মনোহরদাদুর বাড়ি কলঘর আচে সেখানেই ব্যবস্থা করেছিলুম।

বাধিত করেছ—রুস্তম বলল।

এবার রুস্তমের ব্যাগ থেকে চা বেরোল। হাঁড়িতে জল বসল, খড়কুটোর আঁচে। রুস্তম চটপট গোটা দুই পাউরুটি বার করে ফেলল। বাড়ির সবাই ভিড় করে এসেছে। পরির চার ভাইবোন, মা বাবা ঠাকুমা। কৌটো থেকে মাখন বেরোল। মোটা মোটা রুটিতে মাখন মাখিয়ে সবাইকে বিতরণ করল রুস্তম।

ঠাকুমা মন্তব্য করল—নাঃ ছাওয়ালটা ভাল।

পরির বোন বাতাসি ওরা এসে থেকেই মধুবনকে খুব পছন্দ করে ফেলেছে। সে মধুবনের গা ঘেঁষে বসে। খুব সন্তর্পণে আঙুল দিয়ে মধুবনের হাত—ফাত টিপেটুপে দেখে। এখন সে মন্তব্য করল—এই দিদিটা মাখন পাউরুটি দিয়েই তৈরি। দেখলেই ইচ্ছে করে খেয়ে নি।

রুস্তম এবার তার নোটবই—টই নিয়ে ডেটা কালেকশনে বেরিয়ে পড়ল। পরির ঝুলি থেকে এইবার সমবেত পরিবারের সামনে বার হতে লাগল—মায়ের জন্যে চারখানা শাড়ি। দুই বোনের জন্যে চারটে সালোয়ার কামিজ। ভাইয়ের জন্যে শার্ট প্যান্ট দু’সেট। বাবার জন্যে শার্ট প্যান্ট—দেখে বাবা মহালজ্জা পেয়ে বলল—এই বুড়া বয়সে ছোকরা সাজতে পারবনি। ঠাকুমার জন্যে তিনখানা ধুতি বেরোল। সব নতুন। সবই মধুবনের বাবার। ঠাকুমা একগাল হেসে বললে—জেবনের বাকি তিন বছর চলে যাবে। তা আমার জন্যে সালোয়ারকামিজ আনতে পারতিস। বলে বুড়ি ফিক ফিক করে হেসে উঠল।

কত বয়স আপনার ঠাকুমা?—

সে কি আর খ্যাল আছে রে ভাই। গাছ পাতর নাই। তা ধরো দু’কুড়ি দশ হবে। আমার পনেরো বছরে পরির বাপ হয়েছিল, পরির বাপের বিশ বছরে পরি হল। তা সে এখন ষোলো বছুরে তো হয়ে উঠল। তবে হিসেব করো।

মধুবন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। এই মহিলার একান্ন বছর বয়স? তার বাবার চেয়েও দু’বছরের ছোট তার মানে? চুল যেটুকুই আছে কালচেই আছে। কিন্তু শুধু মুখ সমস্ত শরীরটাই তাল তোবড়ানো। দাঁত পড়ে গেছে বেশ কিছু। চোখ কোটরে, ভুরু নেই। গায়ের চামড়া খসখসে মোটা অদ্ভুত। কিছুতেই এঁকে তার বাবার সঙ্গে মেলানো যায় না। বাবাকে এঁর ছেলে মনে হবে।

একটু পরেই হঠাৎ দেখা গেল আশেপাশের কুঁড়ে থেকে ছোট ছেলেমেয়ে এবং মহিলারা ছুটে আসছে।

এখানে নাকি কাপড় দিচ্ছে?

তখনও এদের কোলেপিঠে শাড়ি—ধুতি ইত্যাদি পড়ে রয়েছে। এক মহিলা ছোঁ মেরে একটা শাড়ি তুলে নিল। আরেকটি ছোট মেয়ে বাতাসির সঙ্গে সালোয়ারকামিজ নিতে গিয়ে হাতাহাতি লাগিয়ে দিল।

কোমরে হাত দিয়ে মুখ বাঁকিয়ে ওরা বলতে লাগল—হ্যাঁ, সব একজনা নেবে, না? আমরা আর মানুষ না। আমাদের সব ন্যাংটো পোঁদে থাকলেই চলবে। বাঁদর কিনা।

উঃ, মধুবন কানে আঙুল দিল।

কতা ভাল লেগতেছে না, না গো শহুরে বিবি! গেঁয়ো ঘেয়ো মনিষ্যি আমরা।—দু’—তিনজন মহিলা তেড়ে এল।

পরির মা উঠে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে বলল—খবরদার বলছি যমুনামাসি, পরির মুনিব আমাদের অতিথি। দু’দিনের জন্যে এয়েচে। যা—তা বলবি না। বলি তোদের জন্যে কাপড় আনবে কেন? তোরা খেতে দিবি? দু’বেলার খোরাকি এখন কোত্থেকে জোগাড় করি তার নেই ঠিক। উনি এলেন কাপড় মাঙতে।

মহিলাটি একটু মিইয়ে যায়। যুক্তি বোঝে। বলল—তা বটে, তা বটে। তো অ শহরের মেয়ে আমাদের জন্যে কিচু হবে না?

মধুবন ক্ষীণ গলায় বলল—এতজনের কাপড় কি বয়ে আনা সম্ভব? আপনিই বলুন। আমরা বাড়ি ফিরে দফায় দফায় কিছু পাঠিয়ে দেবোখন।

আর দিয়েচ মা!

সত্যি বলছি। কেউ আমাদের সঙ্গে গেলে তার হাতে কিছু পাঠিয়ে দিতে পারি। কিন্তু পুরো গ্রামের কাপড় জোগানো কি আমার পক্ষে সম্ভব, আপনারাই বলুন।

খুব বুঝদারের মতো ভিড়টি মাথা নাড়ল। তখন মধুবন তার ঝোলা—ঝুলি হাতড়ে মুঠো মুঠো চকলেট আর চিকলেট বার করে আনল। বলল, বাচ্চাদের জন্যে লজেন্স এনেছি।

হরির নুট দাও গো মা। হরিবোল বলে ছুড়ে দাও। কুড়িয়ে কাড়িয়ে সব নেবেখনি।

না, তা হবে না। আমি হাতে হাতে দেব। বাচ্চারা কিউ করো। লাইন করো। পরি, ওদের লাইন করে দাঁড় করা।—দেখতে দেখতে গ্রামের যত ছোট ছেলেপিলে কোত্থেকে খবর পেয়ে হরির নুটের জন্যে ভিড় করে এল। ভাগ্য ভাল। প্রত্যেকে কিছু না কিছু পেল।

দুপুর একটা নাগাদ রুস্তম ফিরল। এদিকে রান্নাও হয়ে গেছে গরম গরম ফ্যানাভাত কলমি শাক সেদ্ধ আর তেঁতুলের টক।

ঠাকুমা বললেন—কেমন রান্না হয়েচে গো? ও শহরের ছেলে—মেয়ে?

ভাল, খুব ভাল—রুস্তম হাত চাটতে চাটতে বলল। মধুবন করুণ কণ্ঠে বলল—ভাল।

বাকি দুপুর রুস্তম বাড়ির বাইরে গাছের ছায়ায় বসে কাজ করতে লাগল। পুরুষ—১০০, এর মধ্যে ৩০ জন বৃদ্ধ।

নারী—৯৭।

শিশু—২০১।

জীবিকা—চাষবাস, খেতমজুরি, দু’ঘর ছুতোর আছে।

ধর্ম—১৩ ঘর মুসলমান।

মাথাপিছু গড় আয়—সাড়ে সতেরো পয়সা।

প্রধান খাদ্য—কলমি ইত্যাদি শাক, সবজি নিজেদের জমিতে যেটুকু ফলে। ভাত রোজ নয়। গম জাতীয় শস্যের চল নেই।

চাষ—ধান ও সবজি।

মধুবন লজেন্স দিয়ে গ্রামের ছেলেমেয়েদের খুব প্রিয় হয়ে গেছে। সে দল বেঁধে পাড়া বেড়াতে লাগল। বিকেলবেলার দিকে খুব চু—কিতকিত খেলা হল। প্রচণ্ড খিদে পেয়ে গেছে। সে পরিকে বলল, তোদের বাড়িতে গোরু নেই?

চাষের বলদ আছে, গোরু নেই।

কারুরই নেই?

হ্যাঁ আছে কারও কারও।

দুধ দোয় না!

পরি বললে—তোমার খিদে লেগেছে না গো! যারা গরু পোষে দুধ তো সব বিককিরি করে দেয়। আচ্ছা চলো তো দেখি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *