৬
আই এস সি পরীক্ষার শেষ দিন আজ। এদের সব আজ মুক্তির দিন। প্রহর গোনা শেষ হল। গনগন করছে রোদ। সে সব উপেক্ষা করে দলে দলে মা ইতি—উতি বসে রয়েছেন। লনের ধারে। গাছের তলায় গুচ্ছ গুচ্ছ মা। সকলেই খুব টেনশনে। কিন্তু সাজ দিতে কারও ভুল হয়নি। টিপ, কাজল, লিপস্টিক।
মীনাক্ষী বলছেন,—যশো, তোকে তো চেনাই যাচ্ছে না।
এই তো দিব্যি চিনতে পেরেছিস?
ক’ কেজি নামালি?
যশোধরা দু’হাতের আঙুল মেলে দেখালেন ছ’কেজি। তাঁর বোন মধুক্ষরা বলল—শুধু শুধু হয়েছে নাকি? সুবুলদা ভয় দেখিয়ে গেল।
কে সুবুল? সেই তোর ক্যান্ডিডেট? এখনও লেগে আছে!
ধ্যাত। কী যে বলো মিনিদি। ডাক্তার তো বাড়ির।
মিহির জানে?
উফ। মিহিরের প্রেশার কে রেগুলার মাপে?
উদাস চোখে তাকিয়ে মীনাক্ষী বললেন—দ্যাখ প্রেশারের কারণ হয়তো ওটাই। প্রেশার মাপতে তো কম্পাউন্ডারই যথেষ্ট। ডাক্তার কী করবে!
সাইড—ট্র্যাক করে যাচ্ছিস কেন? যশোধরা আপত্তি করে উঠলেন।
জানিস দু’মাস নো ভাত। নো আলু, সিরিয়্যাল বলতে পাউরুটি—টোস্ট উইদাউট মাখন, পেঁপে সেদ্ধ, গাজর সেদ্ধ, বিনস সেদ্ধ, শসা নুন দিয়ে ছানা।
আর? এসব তো জানি?
হন্টন। সকালবেলায় চার রাউন্ড, বিকেলবেলায় চার রাউন্ড। প্লাস যোগাসন। তা ছাড়া ওপর নীচে। তিনতলা একতলা ছ’বার এ—বেলা, ছ’বার ও—বেলা। মিথ্যে বলব না, এ দু’মাস আমার সংসার মধুই দেখেছে।
মধুক্ষরা বললে—মাসাজও নিয়েছে দিদি। বেশ হয়েছে না? দেখো ওপর হাতের থলথলে ভাবটা চলে গেছে। গাল গলা দিব্যি ট্রিম।
আচ্ছা আচ্ছা তোকে এই পাবলিকে এখন আমার ফিগার ব্যাখ্যা করতে হবে না।
মধুবন কদ্দূর?
মীনাক্ষী হতাশায় হাত উলটে বললেন একটু কমেছিল। যেই পরীক্ষা ঘাড়ে এসে গেল, জিম, হাঁটা সব বন্ধ হয়ে গেল, খাওয়া—দাওয়াও তেমন রেস্ট্রিক্ট করতে খারাপ লাগল বুঝলি? খালি পেটে কি আর পড়া হয়! দেখা যাক এরপর!
এরপর জয়েন্ট আছে। না যদি দেয় তো এ—কলেজ সে—কলেজে অ্যাডমিশন টেস্ট আছে। তখনও তোর মায়ের প্রাণ খুঁতখুঁত করবে। ও আর হতে হচ্ছে না। ধাতই ওইরকম। বাপের ধাত পেয়েছে। ঠাকুমাও অমনি নোদলগোদল ছিলেন।
রত্মমালা, সঙ্ঘমিত্রা দু’জনেই এসেছেন। এঁরা বেশ একটু সিনিয়র। তার ওপরে রত্নমালা পটনার মেয়ে।
সঙ্ঘমিত্রা সাদা চিকনের শাড়ি পরে এসেছেন। গলায় শাঁখের মালা, কপালে চন্দনের টিপ।
মধুক্ষরা বললেন—হ্যাঁগো সঙ্ঘমিত্রাদি, এমন ‘যোগিনী হইয়া যাব সেই দেশে’ কেন গো?
দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে সঙ্ঘমিত্রা বললেন—বলেছিস ভাল। আমার রত্নটিকে তো আর জানো না। তাঁর রেজাল্টও বেরোবে আমিও গৃহত্যাগ করব।
তারপর এখন কোথায় কী ফিল্ম চলছে, কোনটা কোনটা দেখা হল না। নিজেদের পরীক্ষায়ও স্যাক্রিফাইস। ছেলেমেয়েদের পরীক্ষায়ও স্যাক্রিফাইস! সকলেই খুব ক্ষুব্ধ। মেয়েদের জীবনে স্যাক্রিফাইসের আর শেষ নেই।
হ্যাঁ কার্জন ছেলেটির মনমেজাজ উডুউডু—যশো বললেন।
রত্নমালাকে এঁরা চেনেন না। তিনি এক পা এগিয়ে এসে উঠলেন কার মন উডুউডু নয় ভাই, আপনি কার মা? উন্নির! সে তো ফুঁ দিলেই উড়ে যাবে। মানে উড়েই আছে।
ইনি কে হলেন? যশো একটু যেন অসন্তুষ্ট।
সঙ্ঘমিত্রা বললেন—ইনি হলেন বিন্দুবাসিনী। আমার বড় জা।
বিন্দুবাসিনী নাম?—স্লিভলেস ব্লাউজ পরা টাঙাইল মোড়া ভদ্রমহিলাকে দেখতে দেখতে আশ্চর্য হয়ে যশো বলে।
তোর চিরকালই সেনস অব হিউমারটা কম—সঙ্ঘমিত্রা বললেন।
আমার ছেলে কার্জনকে দিদিই নিয়ে নিয়েছে। কার্জনের ভালমন্দ সব ওর ভাবনা।
তুমি ঝাড়া হাত—পা সঙ্ঘদি! মধুক্ষরা বললেন।
ঝাড়া হাত—পা কি আজকাল আর হওয়া যায় ভাই! এক একটা ছেলের নানান ফ্যাঁকড়া।
কার্জন না ক্যানিং সে যদি তোমার ছেলে হয় সঙ্ঘদি আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, ও একটু ইনকনসিডারেট। একটু মানে গোলমেলে।
গোলমেলে কে নয়? ওদের পুরো জেনারেশনটাই প্রচণ্ড গোলমেলে।—রত্না বললেন—সেদিক থেকে দেখতে গেলে ভাই কিছু মনে কোরো না, তোমার উন্নি অনেক বেশি গোলমেলে।
কে বলেছে উন্নি আমার?—যশো হেঁকে উঠলেন—আমার কোনও মেয়েফেয়ে নেই।
তার মানে তুমি নিজে মেয়ে হয়ে অ্যান্টি—মেয়ে? রত্নার যেহেতু একটি কন্যা, তাঁরই গায়ে লেগেছে সবচেয়ে। তিনি হেঁকে বললেন।
অ্যান্টি—মেয়ে হতে যাব কেন? মেয়ে নেই এটা ফ্যাক্ট। আমার বোনেরই তো একটি মেয়ে। তাকে কি আমি নিজের মেয়ের মতো ভালবাসি না? বিন্দুবাসিনী হয়তো হতে পারিনি আপনার মতো। তবে হ্যাঁ অ্যান্টি—মেয়ে না হলেও আমি কিন্তু অ্যান্টি—উন্নি—তা বলে দিচ্ছি। ওরকম কাঠখোট্টা তেরিয়া মতো মেয়ে আমাদের পোষায় না। আমার মেয়ে হলে আমি ওর মলাট পালটে দিতুম।
মধুক্ষরা ভীষণ আহত হয়ে বললেন—দিদি, এবার ইনকনসিডারেট হচ্ছে কে? সেদিন উন্নি খবর না দিলে তোমার পাবলো অত তাড়াতাড়ি আসত। সঙ্গে করে কতক চাট্টি বন্ধুবান্ধবও এনেছিল। তারা কত কাজ করে দিল। অকৃতজ্ঞ হয়ো না।
ইতিমধ্যে ঘণ্টা পড়ে গেছে দলে দলে ছেলেমেয়ে বেরিয়ে আসছে।
কী রে উন্নি? কী রকম হল?
এ প্লাস। তোর?
পাবলো বলল বি ফর বেঙ্গল। বল্লী, তোর?
বল্লী ঠোঁট উলটে বলল লেখার কথা লিখে দিয়েছি এখন কেমন হল, কী মার্কস হবে এসব ভাবতে যায় কোন হাঁদা। ছাড়।
পঙ্কজ বলল—বলবি না তাই বল। এই বান্ডল তোর কেমন হল?
মনমরা গলায় কার্জন দু’দিকে ঘাড় নাড়ল। তারপর সোজা জেঠিমার কাছে গিয়ে চোঁচা করে একটা পেল্লাই ডাবের জল খেয়ে হাতের উলটো পিঠ দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে চলে গেল। ডাইনে তাকাল না। বাঁয়ে তাকাল না।
আসলে এদের মধ্যে দু’জন পরীক্ষাটা দিতে হয় দিয়েছে। আনমনে। কী এমন হাতি—ঘোড়া আছে পরীক্ষায়? বসে গেলেই তো হল। তাদের মন পড়ে রয়েছে অন্য কোথা অন্য কোনওখানে। সকলেই জয়েন্টে বসছে। পাবলো বসছে না। কার্জন বসছে না। যদি বাই চান্স র্যাঙ্ক এসে যায় বাড়ি থেকে চাপাচাপি করবে সবাই। ও সিনেই তাই নেই ওরা। দু’জনের বাড়ির অন্তঃপুরে খুব গুমোট তাই। সঙ্ঘমিত্রার ধারণা রত্নমালার প্রশ্রয়েই এতটা বেড়েছে কার্জন। ভেতরে ভেতরে তাঁর একটা গোঁসা তৈরি হচ্ছে। নিজের মেয়েটিকে তো বেশ ইলেকট্রনিক্স পড়িয়ে কানাডা পাঠিয়ে দিয়েছ সেখানে সে সাহেব বিয়ে করেছে প্লাস করে খাচ্ছে। আমার ছেলেটির বেলায়—তাতে কী হয়েছে? সবাইকেই কি ডাক্তার এঞ্জিনিয়ার হতে হবে!
কথাটা মনের মধ্যে গুলোচ্ছে, সঙ্ঘমিত্রা বলেই ফেললেন। রত্না শুনে অবাক এবং আহত।
দ্যাখ সঙ্ঘ, সংহিতা তোরই বেশি ন্যাওটা ছিল। তুইও জানিস, আমিও জানি কারও আদর তাকে তার সংকল্প থেকে টলাতে পারেনি। সেই যে ক্লাস এইটে পড়তে ভবিষ্যৎ ঠিক করে ফেলল, অর্জুনের মতো পাখির চোখটা ছাড়া আর কিছু দেখল না। কোনও দিন সেকেন্ড হয়েছে মেয়েটা?
ও, তার মানে বলতে চাইছ আমার ছেলেটা এলেবেলে। মাথা নেই। তাই তার কিস্যু হবে না—এটাই অবধারিত।
ডিফারেন্স! ডিফারেন্স!—ঠিকরে উঠলেন রত্নমালা, হাতের পাঁচটা আঙুল এক রকম হয় না কিন্তু প্রত্যেকটা ইমপর্ট্যান্ট। এক একটাকে দিয়ে এক এক রকম কাজ হয়। বুড়ো আঙুল লবডঙ্কা দেখায়। আজকাল অবশ্য ভিক্টরি দেখাচ্ছে। তর্জনী দিয়ে শাসানো হয়। মধ্যমা না থাকলে কিছু টিপে ধরে তোলা, অসাধ্য। অনামিকা আংটি পরে। আর ছোটটা? ধর কান সুড়সুড় করছে, কোন আঙুল ঢোকাস? কড়েটাকেই তো! সরু গর্ত, কেউ ঢুকবে না। কড়ে ঠিক ঢুকে যাবে। মানুষ এইরকম আলাদা আলাদা।
তা তোমার কার্জনসুন্দর কোন কম্মে লাগবেন? তোমায় কিছু গুপ্ত কথা বলেছেন?
তা হয়তো বলেনি। কিন্তু আমি যদি প্রকৃত মা—জেঠিমা হই তা হলে ওর গুপ্ত হোক সুপ্ত হোক বাসনাটি ক্রমশ আমার কাছে প্রকাশ পাবেই।
ভাল। ওই আনন্দেই থাকো। সঙ্ঘমিত্রা কখনওই তাঁর এই পটনাই জায়ের সঙ্গে কথায় পেরে ওঠেন না। তিনি রণে ভঙ্গ দিলেন।
.
জয়েন্ট এনট্রান্স শেষ হয়েছে। ঘোর গ্রীষ্ম। বল্লী মায়ের এসি রুমে গল্পের বই নিয়ে শুয়ে। পড়বার চেষ্টা করছে, ঘুম এসে অধিকার করছে তাকে, ঢুলে পড়ছে, আবার পড়ছে। এমন সময়ে সেলফোনটা বাজল। বল্লী সব সময়ে ফোন ধরে না। বাজছে বাজুক, বেজে যাক। তার এখন মুড নেই, কিন্তু ফোনটা চুপ করেই আবার বেজে উঠল। তুলে দেখে পাবলো।
পড়েছিস!
শনৈঃ শনৈঃ।
মানে?
মানে আস্তে আস্তে। হাতের লেখা খুব খারাপ তো!
ধুর অত ধরে ধরে লিখলুম! শচীনদেবের প্যারডি, কেমন?
হঠাৎ বল্লী সতর্ক হয়ে গেল। বলল হ্যাঁ যতদূর সাধ্য চেষ্টা করেছিস।
তোর কী মনে হচ্ছে, হবে?
সেটা নির্ভর করছে টোট্যাল এফেক্টটার ওপর। তুই কি সিরিয়াস?
তবে? আরে ইয়ার! এই জন্যেই তো তৈরি পাবলো।
পিকাসো না নেরুদা?
কিছুটা এ কিছুটা ও! সুরটা এক্সট্রা। —সুররিয়্যালিজম। বুঝতেই তো পারছিস?
হুঁ।
ঝেড়ে কাশ না। ঢোঁক গিলছিস কেন?
বলছি তো টোট্যাল এফেক্টটার ওপর নির্ভর করছে। এখন বিরক্ত করিস না। ঘুম আসছে। ছাড়ি।
পাবলো দেখল মিসড কল তার ফোনে। পরে করবে ভাবছে আবার ফোনটা বেজে উঠল। ভারী ভাঙা গলা ওধার থেকে—পাবলো আমার বান্ডিলটা দিয়ে দে প্লিজ। সারাজীবন তোর ক্রীতদাস হয়ে থাকব। যা বলবি তাই করব। পাবলো! পাবলো!
কতবার তোকে বলব তোর বান্ডল আমি নিইনি। নিইনি নিইনি।
বললেই তো হবে না পাবলো কনভিন্সিং হতে হবে। তুই সবচেয়ে বিচ্ছু। পাহাড়ি বিচ্ছু একেবারে। দ্যাখ তোর সুযোগ ছিল। ইচ্ছে ছিল, মোডাস অপারেন্ডাই…পাবলো—পাবলো। প্লিজ আমি তোকে কিচ্ছু বলব না। হ্যাভ পিটি অন মি।
আরে, আরে থাম তো জরা। বকেই যাচ্ছিস, বকেই যাচ্ছিস। কীসের সুযোগ?
আরে ভাই, বান্ডিলটা বল্লীর টেবিলে রেখেছিলুম, ক্লোজেস্ট বসেছিলি তুই। একটু দূরে পঙ্কজ। সারাক্ষণ তোর নজর ছিল বান্ডিলটার দিকে। ওটাকে মিসাইল বললি, আরও কত কী বললি!
ইচ্ছেটা হবে কেন? মোটিভটা কীসের?
জাস্ট একটা প্র্যাঙ্ক।
প্র্যাঙ্কের পক্ষে সময়টা একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে না? তুই আজ দু’মাস ধরে বান্ডুল বান্ডুল করে যাচ্ছিস। এতদিন ধরে তোকে ল্যাজে খেলানোর কী মানে? মোডাস অপারেন্ডাটাই বা কীরকম?
কেন? তোর কার্যকলাপ সব কেমন চুপিসাড়ে, তুই সিক্রেটিভ আছিস। তোর ডান হাত একটা কাজ করলে বাঁ হাত জানবে না।
বা বা বা? চমৎকার অ্যাসেসমেন্ট তোর। সব্বাইকে জিজ্ঞেস কর কার্জন, আমার মতো ফ্র্যাঙ্ক, খোলামেলা ছেলে আর একটাও ধারেকাছে নেই। তুই—ই কি কম সিক্রেটিভ না কি? কী ছিল তোর ওই রোল করা পেপার্সটাতে। সেটা তো বলছিস না। এটা বুঝি সিক্রেটিভনেস হল না?
তুই তো জানিসই।
জানি? বা বা বা। গেস করতে পারি। কারও কাছ থেকে লভ—লেটার পেয়েছিস—
ধুর। কে আমাকে লভ—লেটার দেবে তোরা থাকতে?
তবে কোনও দুষ্প্রাপ্য বইয়ের চ্যাপটারের জেরক্স!
সে তো পরীক্ষা ওভার। চুকেই গেছে তা হলে। এখনও খোঁজ করে আমার লাভ?
তা হলে…তা হলে…
বল কী তা হলে? তুই নিশ্চয় জানিস, বলছিস না। পাছে আমি ধরে ফেলি। চালাক কম না কি?
অনেস্টলি কার্জন, আমি তোর বান্ডল নিইনি।
তা হলে কে নিয়েছে? বার কর, তোর ব্রেন আছে গোয়েন্দাগিরি কর, বন্ধুর একটা উপকার।
ঠিক আছে, কথা দিচ্ছি ভাবব। তুই শিয়োর যে ওটা পকেটে করে নিয়ে যাসনি? রাস্তায় পড়ে গিয়ে থাকতে পারে!
না। আমি সঙ্গে সঙ্গে ফিরে এসেছি। দেখি দুই পি হাওয়া, বল্লী একা বসে সুডোকু খেলছে।
ঠিক হ্যায় কার্জন, জাসুসি করুঙ্গা তেরে বান্ডুলকে লিয়ে। খুশ?
আর খুশ!