৫
কার্জন খোঁড়াতে খোঁড়াতে চলেছে। মাঝে মাঝে নিচু হয়ে আইসব্যাগটা চেপে ধরছে। বড্ড লেগেছে। একটা একফোঁটা মেয়ে সে কিনা পেছন থেকে লেঙ্গি মেরে তাকে ধরাশায়ী করল? মধ্যপ্রদেশে মেয়ে ডাকাত—ফাকাত আছে সবাই জানে। থেকে থেকেই শোষণের বিরুদ্ধে সেখানকার লোকেরা বাগী হয়ে যায়। চম্বলের বেহড়ে ঘোরে। ডাকাতদল গঠন করে। কিন্তু এই মেয়েটাকে তো এম পি—র বলে মনে হল না। তবে কি আজকাল মেদিনীপুর—টুরেও মেয়েরা বাগী হয়ে যাচ্ছে! চম্বল উপত্যকার বদলে কলকাতা শহর, এবং ঠাকুরদের বদলে কলকাতার সাধারণ নাগরিকদের তাক করছে! রীতিমতো অর্গ্যানাইজড বলে মনে হল। এবং এর মধ্যে মধুবনও আছে। জেনে বা না জেনে। আজ যে—মেয়ে তার বন্ধুকে লেঙ্গি মারল, কাল যে সে মধুবনকেও মারবে—এই সামান্য সত্যটা মধুবন বুঝছে না। উঃ হাঁটুটা খচখচ করে উঠল।
প্রায় সাড়ে আটটা বাজছে। কিন্তু বান্ডিলটার একটা হেস্তনেস্ত না হওয়া পর্যন্ত কার্জন বাড়ি ফিরতে চায় না। সে পঙ্কজদের বাড়ি চলল। সামনে যে—অটোটা পেল, উঠে পড়ল। পাবলোর বেস্ট ফ্রেন্ড হল পঙ্কজ ধুধুরিয়া। এবং ধুধুরিয়া বেশ ঘুঘুমাল। ঘুঘুরিয়া পদবি হলে ভাল মানাত। ওই ঘুঘুই চোরাই মালটি রেখেছে নিজের ভল্টে। নিশ্চয়ই!
পঙ্কজদের বাড়ির সদর অনেকক্ষণ অবধি খোলা থাকে। একজন খেঁকুরে মতো কেয়ারটেকার টুলে বসে ঢোলে। সে লোকটাকে পাশ কাটিয়ে লিফটে উঠে পড়ল।
কে? কে? কে?—তালপাতার সেপাইয়ের ঘুম ভেঙেছে। তাকে দেখে বলল—ও পঙ্কজখোকার বন্ধু! কী যেন নাম ক্যানিং না ম্যানিং। ইংরেজি নামের ছেলেদের হেভি রেলা। যাও যাও ওপরে যাও।
লিফট থেকে বেরোতেই লোডশেডিং। ঘুটঘুট করছে অন্ধকার। পঙ্কজদের দরজায় বিশাল ঘুসি মেরে কার্জন চেঁচাল—পঙ্কজ, দরজা খোল!
নিশ্চয় আই হোল থেকে কেউ তাকে জরিপ করছিল। কিন্তু জরিপের রেজাল্ট শূন্য। কেননা অন্ধকারে কিছু দেখা যায় না। এই সামান্য সেন্সটুকু পঙ্কজের বাড়ির লোকেদের নেই।
সে হেঁকে বলল—অন্ধকারে কী দেখছেন? শুনুন, কান পেতে শুনুন। দিস ইজ কার্জন ফ্রম একডালিয়া। সার্চ ওয়ারেন্ট ইন হ্যান্ড!
দরজাটা একটু খুলল—পঙ্কজ মুখ বাড়িয়ে বলল, আবার এসেছিস? কী মনে করে? বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে নাকি?
নিজের বডিটা দরজার ওপর ফেলে দিল কার্জন। ঢুকে পড়ল। বলল—বার কর, বার কর।
যা ব্বাবা এ যে দেখি ডাকাত।
আর তুমি যে বাটপাড়? তোমার বন্ধু পাবলো যদি চোর হয়, চোরাই মাল যদি তোমার কাছে থাকে হে বাটপাড়। তা হলে তো আমাকে হয় ডাকাত নয় পুলিশ হতেই হয়!
ডেলিরিয়াস! পঙ্কজ মন্তব্য করল। অন্ধকারের অন্তর থেকে একটা মোটা গলা বলে উঠল টেম্পারেচার কিতনা? দেখ না! আরে প্যারাসিটামল দো দো খিলা দে ইয়ার। সব ঠিক হো জায়েগা।
এবার একটা অপেক্ষাকৃত সরু কিন্তু যথেষ্ট জোরালো গলা বলে উঠল—ঠাকুরজি সব ঠিক কর দেগা।
সিরিয়্যাল—পঙ্কজ বলল।
যতই আনশান বকিস আমি আজ খানাতল্লাসি করব। করবই।
কার্জন মেঝেতে পা ঠুকল, এবং সঙ্গে সঙ্গে উ—হু—হু করে উঠল।
দেখলি তো! খানাতল্লাশি—টাশির মতো বাজে কথা বলতে বাড়ির ফ্লোরটাই তোকে শাস্তি দিয়ে দিল। পানিশমেন্ট।
ফ্লোর না আরও কিছু। পা, হাঁটু। ব্যাপক লেগে গেছে।
ওষুধ দরকার? তা সে—কথা বললেই পারতিস! যখন—তখন যেখানে—সেখানে লোডশেডিং হচ্ছে। লোকে ধাক্কা খাবে কি কুপোকাত হবে এ আর বেশি কথা কী! আয়, আমার কাছে একটা স্প্রে আছে। সঙ্গে সঙ্গে আরাম পাবি।
পঙ্কজ আদর করে কার্জনকে নিয়ে যায় হাত ধরে ধরে কেননা তাদের বাড়ি ফার্নিচারে ঠাসা। তাতে ঠোক্কর খেলে কার্জনের সাড়ে সর্বনাশ।
অন্ধকারেই ড্রয়ার হাতড়ে স্প্রে—টা বার করল পঙ্কজ। কার্জনকে একটা চেয়ারে বসিয়ে ছ’ইঞ্চি দূর মাপল। তারপর স্প্রে—টা করল।
আহ! কী আরাম!
আরাম তো! দ্যাখ ইয়ার, এবার চুপচাপ দশ—পনেরো মিনিট বসে থাক এমনি। অ্যাকশনটা না হলে হবে না।
গুনে গুনে দশ মিনিট। তার পরই সব আলো ঝলমলে হয়ে উঠল। একটা হো মতো শব্দ উঠল চার দিক থেকে!
ওই তো আমার বান্ডিল—কার্জন ঝাঁপিয়ে পড়ল পঙ্কজের টেবিলের ওপর।—সে একটা মোটা মতো কাগজের বান্ডিল তুলে নিয়ে নিজের পকেটে ঢোকাবার ব্যর্থ চেষ্টা করতে লাগল। মুখে শুধু বলছে, মাফ করে দিলুম। পেয়ে তো গেছি। আর কোনও শত্রুতা মনে রাখব না। বন্ধু ইজ বন্ধু। হাতটা বাড়া পঙ্কজ, লেটস সে স্যরি।
পঙ্কজ হাত বাড়াল না। বলল—আমার কেমিস্ট্রির নোটস নিয়ে যাচ্ছিস কেন? শালা তুই না কমার্স পড়িস!
ঢপ কাকে দিচ্ছিস! কার্জন মৈত্র অত সহজে ঢপ খায় না। সদরের দিকে পা বাড়াল কার্জন।
আরে! একেবার দেখ তো সহি। কিসকা নোটস। কেয়া লিখখা হ্যায়।
বাড়ি যাব আগে। চান করব ফার্স্টক্লাস। খাওয়া—দাওয়া করব, তার পরে খুলব, দেখব আমার বান্ডিল।
তবে রে! ভাল কথার কেউ নয়। এ পিতাজি দেখিয়ে তো এক বদমাশ মেরা কেমিস্ট্রি নোটস লেগে ভাগতা হ্যায়।
বলার সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় পঙ্কজের বাবা এসে উপস্থিত হন।
আরে ক্যা হুয়া! এ বাচ্চালোগ বহোত বদমাশ! ভদ্রলোক আড়ে—দিঘে বিরাট।
মিনমিন করে কার্জন বলল দেখুন না আঙ্কল, আমার বান্ডিল, ও বলছে ওর নোটস।
ক্যায়া থা, তুমারা বান্ডিল মে!
নেই বলুঙ্গা—দু’হাত বুকে আড়াআড়ি রেখে কার্জন বলল। ভদ্রলোক বললেন—স্ট্রেঞ্জ! তো জরা দেখনে তো দো! কার্জন আর কী করবে বান্ডিলটি ধুধুরিয়াজির হাতে সমর্পণ করল। তিনি খুলে বললেন—আরে, ইয়ে তো কেমিস্ট্রিকিই হ্যায়, বহোত ফর্মুলা—উলা, গ্রাফ, দেখো ভাই, খুদ দেখ লো।
দেখে কার্জনের প্রায় কান্না পেয়ে গেল। না তার বান্ডিল নয়, অথচ তারই বান্ডিল। কাগজগুলো স্টেপল করে একটা সাদা বড় খামে ভরেছিল। তারপর পুরো জিনিসটা রোল করে বড় বড় দুটো রবার—ব্যান্ড দিয়ে আটকানো ছিল। একটা নীল, একটা হলদে। এ রবার—ব্যান্ড এখানের নয়, আমেরিকার। কার্জনের মামা কী সব পাঠিয়েছিলেন, তাতেই ছিল। সাদা খামটা একটু ময়লা হয়ে গেছে।
তার কাঁদোকাঁদো মুখ দেখে পঙ্কজের বোধহয় দয়া হল, সে বলল আরে ইয়ার, রোও মত। বান্ডল জরুর মিল জায়েগা।
হ্যাঁ মিল জায়েগা। তুমিই হাপিস করেছ। এই খাম কোথায় পেলে?
হ্যাপি স্টোর্স থেকে।
এই রবার—ব্যান্ড?
আমার মেটারন্যাল আঙ্কল আমেরিকা থেকে কী সব পাঠিয়েছিল, তাতেই ছিল।
কার্জন একেবারে হাঁ হয়ে গেল। হ্যাপি স্টোর্স না হয় বোঝা গেল। কিন্তু রবার—ব্যান্ড ঠিক এই রঙের পাঠানোর জন্যে সেই আমেরিকাতেই বসে রয়েছেন পঙ্কজের মামা! এরকম কাণ্ডে আনহ্যাপি ছাড়া আর কী হতে পারে সে!
খোঁড়াতে খোঁড়াতে সে লিফটের দিকে চলল। পঙ্কজ খুব ভালমানুষের মতো বলল—ক্যা থে উস বান্ডল মে? লভ—লেটার?
যা খুশি ভাবতে পারিস, বলতে পারিস, আমি বলব না।
কার্জন ব্যর্থ খানাতল্লাশি শেষে নিজের বাড়ির দিকে যাত্রা করল, মুখ কাঁদোকাঁদো, কাঁচুমাচু, ঠিক যেন এক ফেলটুস ছেলে।
.
পাবলো নয়, পঙ্কজ নয়, উন্নি নয়, একমাত্র বল্লীকেই তার গোপন প্রজেক্টের কথা সামান্য বলতে চেয়েছিল কার্জন। কাউকে না কাউকে বলতে তো হবে! চার পাশে এতগুলো ইয়ার দোস্ত। পেট ফুলবে যে না বললে! ইয়ারকিতে সব এক। সিরিয়াস কিছু করো। একজনের সঙ্গে আর একজনের থোড়ি মিলবে! পাবলো যেমন তার উচ্চাকাঙ্ক্ষার কথা একমাত্র পঙ্কজকেই বলে থাকে। পঙ্কজ অবশ্য তা নয়। সে সোজাসুজিই বলে তার টাকা চাই। প্রচুর টাকা। কোনও না কোনও এক দিন সে অন্ততপক্ষে ভারতীয় ধনকুবেরদের মেরিট লিস্টে নাম লেখাবেই। পঙ্কজ বলে, দ্যাখ, যাবতীয় কোয়ালিফিকেশন আমার আছে ধনকুবের হবার। দ্যাখ, ফার্স্ট থিং, আমি লেখাপড়ায় ভাল নই, অমনোযোগী, মিলে গেল কি না? দ্যাখ আমি প্রচণ্ড স্মার্ট। কখনও কোনও অবস্থাতেই তোরা আমাকে অপদস্থ করতে পারবি না। হাতেনাতে চুরি করছি এমন অবস্থাতেও যদি ধরিস ঠিক পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যাব।—ঠিকই বলে। আজই তো হাতেনাতে ধরা পড়েছিল। কার্জনের চুরি করা বান্ডিল ফুসমন্তরে হয়ে গেল কেমিস্ট্রির নোটস! আরও গুণ আছে পঙ্কজের। আলাদা আলাদা নামে অর্থাৎ বেনামে প্রপার্টি কেনবার মতো প্রচুর বিশ্বস্ত আত্মীয়স্বজন। পঙ্কজ উপরন্তু খুব খাটিয়েও। এবং তার বাবা সামান্য স্টেশনারির অর্ডার ধরার ব্যবসা থেকে এখন হিন্দুস্তান পার্কের মতো জায়গায় ফ্ল্যাট কিনেছেন। ঘরে ঘরে এসি। মারুতি ৮০০ বিক্রি করে এখন হোন্ডা সিটি কিনেছেন। এমন এলেমদার বাবার উদাহরণ সব সময়ে চোখের ওপর থাকতে পঙ্কজ পথ হারাবে—এ কথা ভাবা শক্ত।—ডোভার লেনে পড়ে, বালিগঞ্জ নিউ মার্কেটের পাশ দিয়ে সে গড়েহাটা রোডে পড়ল।
আরমান তো এখনই কেরিয়ারে ঢুকে গেছে। ফুটবল ওর নেশা, ভলিবল, বাস্কেটবল সবরকমের বল গেমই ওর আসে। খেলতে খেলতেই ও একটা ঘ্যাম চাকরি পেয়ে যাবে। তারপর যত দিন পারে খেলবে আর খেলবে। খেলতে খেলতে কোচ হয়ে যাবে। কোচিংয়ে বহুত ঝামেলা বলে ও কমেন্টেটরও হয়ে যেতে পারে। সেটা অবশ্য ক্রিকেটের। আরমান হল গিয়ে স্পোর্টসম্যান। রাস্তা পার হয়ে একডালিয়ার দিকে ঘুরল কার্জন।
মধুবন বলে থাকে সে—পড়বে। কিন্তু কার্জনের ধারণা মধুবন নিজেকে বিয়ের জন্যে তৈরি করছে। হঠাৎ এত হাঁটা, এত জিম, ডায়েট। ফিগারের পেছনে এত খরচ, পরিশ্রম, সময়! এর ওই একটাই মানে হয়। বেশ নিরাপদ একটি ম্যারেজ কেরিয়ারই হল তার লক্ষ্য।
শম্পি মানে সম্পৃক্তা ল পড়বে, ফর দা সিম্পল রিজন যে ওর বাবা অ্যাডভোকেট, উন্নি আর বল্লী হল দুই মিস্ট্রি ওদের মধ্যে। এরা যে কী চায়, কী করতে চায় কেউই বুঝতে পারে না। নিজেরা কিছু করবে টরবে না কারুর ঘাড়ে বসে খাওয়ার মতলব আঁটছে—ঘুণাক্ষরেও কেউ বুঝতে পারে না। তবে কার্জন নিশ্চিত যে, উন্নি জয়েন্ট আই আই টি এনট্রান্সে বসছেই। অল্প কথার মেয়ে। প্রচণ্ড তুখোড়। লেখাপড়াতে কোনওদিন এ প্লাসের কম পায়নি। হাঃ উন্নি। লেখাপড়াতে এমন তুখোড় হয়েও তুই কার্জন মৈত্তিরের কাছে হেরে যেতে চলেছিস। জানিস না, মানবি কি না তা—ও জানি না। কিন্তু কার্জন তার মনে মনে পুরো ছকটা কষে তো নিয়েছে। বল্লীও কম কথা বলে, ধারালো মেয়ে। বন্ধুর জন্যে উন্নী—বল্লী জান লড়িয়ে দেবে। কিন্তু বল্লী একটু বেশি সহানুভূতিসম্পন্ন, একটু বেশি বুঝদার। মানুষের আশা—আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ঠাট্টা—তামাশা করে না।
সেদিন বান্ডিলটি নিয়ে সে বল্লীর কাছেই গিয়েছিল। বান্ডিলটা তার পকেট থেকে বেরিয়ে ছিল।
ও মিসাইলটা কীসের রে?—বল্লীই জিজ্ঞেস করে। কী করে বলবে সে? পাবলো, পঙ্কজ দুই মূর্তিমানই মজুত। পাবলো বললে—অগ্নি থ্রি। পঙ্কজ বললে শেয়ার, শেয়ার। সব পকেটমানি তা ছাড়াও যেখান থেকে যা ঝাড়তে পারছে সব শালা সার্টিফিকেট কিনে রাখছে। মাল্টিপ্লাই করতে করতে ওর চব্বিশ বছর বয়সে, পাঁচ লাখপতি। অ্যানাদার সিক্স ইয়ার্স—বারো লাখপতি…ওদের উপস্থিতিতে কার্জন কী বলবে? তবে হ্যাঁ ওটা পকেটে নিয়ে বসতে অসুবিধে হচ্ছিল বলে সে বান্ডিলটা টেবিলের ওপর রাখে। এবং আড্ডা দিতে দিতে একেবারে ভুলে যায়, ক্ষমার অযোগ্য এই ভুল। ঝোঁকের মাথায় গল্পসল্প করে বেরিয়ে পড়েছিল। মোড় ঘুরতেই মনে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে রিটার্ন টিকিট। বল্লী আছে। বাট নো পঙ্কজ, নো পাবলো, নো বান্ডিল।
কী রে বল্লী, আমার বান্ডিলটা!
কীসের বান্ডিল! যেন আকাশ থেকে পড়ল।
ওই যেটাকে মিসাইল বলছিলি।
বল্লী গম্ভীরভাবে বললে—মিসাইল তো মিস হবেই।
বাজে ইয়ারকি করিসনি। দিয়ে দে বান্ডিলটা।
আমি সত্যিই জানি না ওটা কোথায়?
এখানেই তো রেখেছিলুম।
তখনই বল্লী বলেছিল—দ্যাখ পাবলোরা হয়তো তোকে নাচাবে বলে সরিয়েছে ওটা।
বল্লী আর যাই হোক মিথ্যে কথা বলবার লোক নয়। বিকেল থেকে ঘুরছে সে। অথচ এখন সন্ধের ঝোঁকে একটু লেখাপড়া করে নেবার মতলব ছিল তার। যতনই যাই হোক, পরীক্ষাটা যে কাছে চলে এসেছে এটা তো মিথ্যে নয়! কার্জন অগত্যা বাড়ি চলল। সংক্ষুব্ধ সমুদ্রের মতো ভেতরটা। পুরো দিনটাই জলে গেল আজ।—বাড়ি এসে গেল।
সদর দরজার সামনে জেঠু দাঁড়িয়ে, কী হে, বিশ্ব ভ্রমণ করে ফিরলে?
উত্তরে হাঁটু ধরে ধরে কার্জন জেঠুর পাশ দিয়ে বাড়ি ঢুকে যায়।
ন্যাংচাচ্ছ কেন? কে মেরেছে? তুমি তো আগে মারামারির মাল ছিলে না, গুণ বাড়ছে দেখছি।
উঃ জেঠু, পড়ে গিয়ে আমার ভীষণ লেগেছে, একটু চুপ করবে?
তবে যাও, গিয়ে মা—জেঠিমার কাছে আদর খাও। তবে জেনে রেখো তোমার বাবা আগতং। তার কাছে আজ তোমার হচ্ছে!
বন্ধুদের বাড়ি যেমন ডেঞ্জারাস, ওর নিজের বাড়িও তেমনই। সেখানে যদি বন্ধুর মা, মাসি কিংবা অ্যাসিস্ট্যান্ট, এখানে তেমনই জেঠু, বাবা, মা, দাদা। জেঠিমাই একমাত্র বন্ধুভাবাপন্ন। বোঝেন। তার বিপন্নতা তার আশা—আকাঙ্ক্ষা। সে যে শুধুই ভ্যারেন্ডা ভাজার ছেলে নয়। আই এস সি পরীক্ষার আগেটায় কোনও বিকেলে বেরিয়ে সে যদি রাত ন’টা পনেরোয় বাড়ি ফেরে তো তার সংগত কারণ আছে। এটা একমাত্র জেঠিমাই বিশ্বাস করে। অন্যদের রি—অ্যাকশন একদম সুবিধের না।
যাই হোক কার্জন ভয় পায় না। যা ফেস করার তা ফেস করতে হবেই। এই জানুয়ারিতেই তার আঠারো বছর পূর্ণ হয়েছে। এর পরের ভোটে সে অংশগ্রহণ করবে। এখন কথায় কথায় ভয় পাওয়া শোভা পায় না।
সে নিজের ঘরে মানে দাদা ও তার ঘরে গিয়ে ঢুকল। দাদা যথারীতি নেই। তিনি দিনে চাকরি করে রাতে ম্যানেজমেন্ট পড়ছেন। সবার মাথা কিনে নিয়েছেন সুতরাং। তাঁকে নিয়ে বাড়িতে কোনও প্রশ্ন ওঠে না। সে সত্যিই ক্লাসে যাচ্ছে না বন্ধু—বান্ধবীদের সঙ্গে আড্ডা মারছে কেউ খোঁজ নেয় না। জানতেও চায় না। অথচ একদিন লেক রোডের কাফে কফি ডে’তে দুটি বান্ধবীর সঙ্গে দাদাকে আড্ডা দিতে সে স্বচক্ষে দেখে এসেছে। লাগানি—ভাঙানি স্বভাব তার নয়। তবু যখন তার দিকে অভিযোগের তির ধেয়ে আসে সে তো না বলে পারে না!
দাদা কী করছে খোঁজ রাখো না? ক্লাস না করে সে কাফেতে বসে আড্ডা মারছিল গত মঙ্গলবার!
মা অম্লান বদনে বলে দিলে—একটু রিল্যাক্সেশনও তো দরকার। ছেলেটা নিশিদিন খাটে।
নাও কী বলবে বলো।
সে গা ছেড়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। এই পা ব্যথা নিয়ে সে এতটা পথ হেঁটে হেঁটে এসেছে। আলোটা টুক করে নিবিয়ে দিল। বান্ডিলটা কার কাছে থাকতে পারে! পঙ্কজের কাছে নেই, বল্লীর কাছে নেই, পাবলোর সঙ্গে এখনও মোলাকাত হয়নি। ওর কাছেও যদি পাওয়া না যায় কার্জন কী করবে? ভাবতে ভাবতে যা অবশ্যম্ভাবী তাই হল—সে অঘোরে ঘুমিয়ে পড়ল।
ওদিকে হচ্ছে এক নাটক। বোকা একচোখাদের বাড়িতে যা হয় আর কী। ল্যাপটপ নিয়ে মগ্ন ছিলেন কার্জনের বাবা ঋতম্ভরবাবু। কার্জনের জেঠিমা রত্নমালাদেবী তাঁকে ক’বারই তাড়া দিয়েছেন।—ও ঋৎ খেতে এসো না। আমরা কতক্ষণ হাত—পা কোলে করে বসে থাকব!
কোল থেকে নামিয়ে বোসো।
উঃ আর পারি না।
রাত দশটার সময় টেবিল পড়ল। ঋতম্ভরবাবু তাঁর স্ত্রী সঙ্ঘমিত্রা, রত্নমালাদেবী তাঁর স্বামী বিশ্বম্ভরবাবু সবাই হাজির। গরহাজির শুধু দুই ছেলে।
বিশ্বম্ভর বললেন—লাটসাহেব তো ন’টা নাগাদ ঢুকেছিলেন একবার, তোমাদের কারও সঙ্গে দেখা হয়নি?
রত্না বললেন—ওমা! কই না তো! আমার সঙ্গে দেখা না করে সে যাবে কোথায়! আহা রে!
বিশ্বম্ভর ঋতম্ভর কোরাসে বলে উঠলেন—বাহা রে! এমনি করেই ছেলেটার মুন্ডু চিবোচ্ছ।
সঙ্ঘমিত্রা বেশি কথার মানুষ নন, কাজের মানুষ। তিনি স্রেফ ফোনটা তুলে—পর পর কয়েকটি ফোন করে গেলেন।
এসেছিল? সন্ধের ঝোঁকে? কী হয়েছে যশোধরার? ও, যাক। পরের ফোন—হ্যাঁ মধুবন, কার্জন এখনও বাড়ি ফেরেনি। এসেছিল? বলিস কী? আচ্ছা ঠিক আছে।
হ্যাঁ বল্লী আছে? বলছিস? কার্জন তো এখনও বাড়ি আসেনি। শেষ দুপুরে? বলিস কী!
সঙ্ঘমিত্রা এবার ফোনের দিকে পেছন ফিরে বললেন লালবাজারে করব কি! ও মোটের ওপর সব বন্ধুবান্ধবের বাড়িই গিয়েছিল। কিন্তু সেখান থেকে চলেও এসেছে। ওকে নাকি উদবিগ্ন, টেনসড দেখাচ্ছিল। কোনও শত্রু—টত্রু?
বিশ্বম্ভর বললেন—অসম্ভব নয়। লেখাপড়ায় প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে সম্ভাবনা নেই। আমাদের ছেলে বেশি মার্কস পেয়ে কারও ঈর্ষার উদ্রেক করবে না। নিশ্চিতা। কিন্তু আরও একটা ক্ষেত্র রয়েছে।
কী ক্ষেত্র?—রত্না ভীষণ চিন্তিত স্বরে বললেন।
প্রেম! প্রেমে রাইভ্যালরি সাংঘাতিক জিনিস।
প্রেম! কার্জন! রত্নমালা হেসে ফেললেন—ওইটুকু বাচ্চা নাড়ুগোপাল ছেলের সঙ্গে কার প্রেম হবে গো!
আহা হা , একেবারে নাড়ুগোপাল, সঙ্ঘমিত্রা ঠিকরে উঠলেন। তোমার কেষ্টঠাকুরও নাড়ুগোপালই ছিলেন দিদি।
কিন্তু নাড়ুগোপাল অবস্থায় কি তিনি প্রেম করেছিলেন? রত্নার জিজ্ঞাসা।
খুব বেশি দিন দেরিও লাগেনি। ষোলো বছর বয়সে তো মথুরাতেই চলে গেলেন। গোপীপর্ব তার আগে। সেকালে আমাদের ছেলের তো আরও দু’বছর বয়স পেকেছে।
এই সময়ে বেল বাজল। বিশ্বম্ভর দরজা খুলে দিলেন তাড়াহুড়ো করে। না কার্জন না, তার দাদা অজিন। ওরফে পল্টন।
ওফফ কী গরম! আমি চান করে এসে বসছি বাবা। অজিন—পল্টন চলে যায়। সে মিনিট পনেরো পরে ঠান্ডা হয়ে যখন ফিরে আসে তখনও কৃষ্ণপর্ব চলছে।
ঋতম্ভর বলছেন—ও—সব গপ্পোকথা গপ্পোকথা। উঠতি বয়সে ছোকরাদের একটু ছোঁকছোঁক হয়। কৃষ্ণ গোয়ালার ঘরে মানুষ কিন্তু আসলে প্রিন্স। ধারেকাছে ব্রজবালা ছাড়া আর কাউকে পায়নি।
অমনি ফোঁস করে উঠলেন সঙ্ঘমিত্রা—ব্রজবালা বলে কি তারা ফ্যালনা নাকি! আজকের দিনে এই ধরনের ক্লাস—কনশাসনেস, জাতপাত ছিঃ। ধিক তোমাকে।
পল্টন বলল কী নিয়ে লাগ ধুম ধুম লেগে গেল এই ভদ্রলোক—ভদ্রমহিলার?
জেঠু বললেন—কথা হচ্ছিল কার্জন কেন এখনও ফেরেনি তাই নিয়ে তো তার থেকে তার প্রেম। তার নাড়ুগোপাল স্টেজ। এই পর্যন্ত আমি আর তোর জেঠি যোগ দিয়েছি। এবার তোর বাবা—মা’র মধ্যে জাতপাত, সংরক্ষণ ক্লাস—টলাস সবসুদ্ধু এসে গেছে।
পল্টন রুটি ছিঁড়তে ছিঁড়তে বলল—কে বলল কার্জন ফেরেনি।
অ্যাঁ?
নাহ। তোমরা সত্যিই হোপলেস ওল্ড ফুলস। ঘরটা একবার দেখোনি? সে তো ঘর অন্ধকার করে পাখা চালিয়ে ঘুম মারছে।
যা ব্বাবা। একটা ইনটারেস্টিং সম্ভাবনা জলে গেল।—জেঠু বললেন, জেঠিমা বললেন—তা তুই ওকে তুলে আনলি না? খাবে না ও!
আচ্ছা জেঠিমা, কার্জন খেয়েছে কি না খেয়েছে আমি জানব কী করে? সত্যিই তো! সত্যিই তো! চার দিক থেকে একটা রব উঠল। তারই মধ্যে হন্তদন্ত হয়ে রত্নমালা বেরিয়ে গেলেন। এ—বাড়িতে তাঁরই একমাত্র মেয়ে। মেয়ের যত দিন বিয়ে হয়নি সঙ্ঘমিত্রা সেই সংহিতা—অন্ত প্রাণ ছিলেন। রত্নমালা আবার কার্জন—ভক্ত। যশোদা—মা টাইপ। সংহিতা সুদূর বিদেশে মন্ট্রিয়ল না কোথায় বসে আছে। এখন কার্জনই এঁদের একমাত্র স্নেহের ধন। পল্টন হাত থেকে বেরিয়ে গেছে।
রত্নমালা আলো জ্বেলে দেখলেন—একটা নোংরা বারমুডা পরে, গায়ে পাতলা ফতুয়া, ধূলিধূসর পদদ্বয়, যশোদাদুলাল নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছেন।
এই কার্জন, কার্জন। রাগ করিস না বাবা, খাবি চল।
কয়েকবার এই পদাবলি আউড়ে যাবার পর, কার্জন অস্ফুটে বলল—কী বিরক্ত করছিস মাঝরাত্তিরে, হাটা তোর অ্যাসিস্ট্যান্টকে নইলে একদিন ও—ই তোকে স্টান্ট দেবে। বুঝবি মজা!
কী বকছিস। এই কার্জন! আমি জেঠিমা রে।
কার্জন অর্ধেক চোখ খুলল।
মাঝ রাত্তিরে ডাকাডাকি করছ কেন?
তুই যে খাসনি বাবা, রাত—উপুসি থাকলে হাতিসুদ্ধু পড়ে যায়। আমার ঠাকুমা বলতেন।
কার্জন তড়াক করে উঠে বসল।—আমি খাইনি?—নিজের শরীরে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল আমি চানও করিনি?
হ্যাঁ পা—ও ধুসনি। নোংরা ঘেমো জামা পড়ে শুয়েছিস।
নামতে গিয়ে—কার্জন গর্জে উঠল—উহহ।
ও কী রে? লেগেছে?
লেগেছে। লেগেছে। লেগেছে। না—ও কী করবে করো। তোমারও লাগেনি তোমাদের পেয়ারের পল্টনচন্দ্রের লাগেনি। লেগেছে এই বাপে—তাড়ানো মায়ে—খেদানোর। হল তো।
রত্নমালার চোখ ছলছল করে উঠল।—এমন কথা তুই বলতে পারলি? পেছন থেকে বাবার গম্ভীর গলা ভেসে এল—বাজে না বকে চানফান করে এসে খেয়ে নাও।
রাত এগারোটার সময়ে বল্লীর ফোন এল। কার্জন ফিরেছে?
হ্যাঁ হ্যাঁ ফিরেছে। হাঁটুতে খুব লেগেছে।
পাঁচ মিনিট পরে মধুবনের ফোন। ঘুমঘুম গলায়—জেঠিমা, কার্জন ফিরেছে?
হ্যাঁ ফিরেছে। হাঁটুতে খুব লেগেছে কী করে কে জানে?
আইস প্যাক দিয়েছিলুম তো!
তোর সামনেই পড়ল! কী করে?
একদম শুকনো ডাঙায় আছাড় খেল জেঠিমা, আর বলবেন না।
তা যদি বলো মধুবন, শুকনো ডাঙায় এই বয়সের ছেলে আছাড় খায় না। তোমরা অত্যন্ত কেয়ারলেস। জলটল ফেলে রেখেছিলে আর কী। আজ কার্জনের হাঁটুর ওপর দিয়ে গেছে। কাল তোমার হাঁটুর ওপর দিয়ে যাবে। গুরুজন কথাটা বলছি। কান পেতে শোনা। জল—ফলগুলো পড়ে থাকলে মুছে নিয়ো। নিজে নিচু হতে না পারো, তোমাদের কাজের লোককে বলো।
নিচু হতে না পারা কথাটা মধুবনের খুব লেগেছিল। মাসিমা পর্যন্ত! টেলিফোন রেখে সে নিঝুম হয়ে বসে রইল।
আর পাঁচ মিনিট পরে উন্নির ফোন।
মাসি, কার্জন ফিরেছে? ওর জিনিস পেয়েছে?
ফিরেছে। কী জিনিস?
তা তো জানি না, সারা বন্ধুমহল চষে ফেলেছে। আচ্ছা রাখি।
রত্নমালা সঙ্ঘমিত্রাকে বললেন—একটা জিনিস লক্ষ করেছিস। উতলা হয়ে কার্জনের খোঁজ যাঁরা করল তারা সকলেই নারী।
দ্যাখো দিদি—এইসব উন্নি, মধুবন, বল্লীদের নারী বলে নারীদের অপমান কোরো না। ওরা জাস্ট মেয়ে, এখনও টিন। পেছন থেকে ছেলে কি মেয়ে বোঝা যায় না। সামনে থেকেও তোমার কার্জনের যা আছে উন্নির তা নেই। হুঁঃ নারী!
আমি যেটা বলতে চাইনি সেটা হল—প্রেমের সম্ভাবনাটা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। প্রেমে রাইভ্যালরির ব্যাপার একটা হয়ে থাকতেই পারে। ছেলেটা খুব ডিপ্রেসড!
তুমি তো সব সময়েই ওকে ডিপ্রেসড কি রিপ্রেসড দেখছ। ইমপ্রেস করতেই খালি দেখা যাচ্ছে না।
আচ্ছা আচ্ছা—রত্না রণে ভঙ্গ দিলেন। কিন্তু মনের ভেতর খটকাটা তাঁর থেকেই গেল।