যে যেখানে যায় – ৪

অতীতমোক্ষণ এমনই অভিভূত, ডুবন্ত ছিলেন যশোধরা, হঠাৎ মা ডাকে মনে হল—ধ্যাত্তেরিকার মা, এখানে কারুর মা—ফা থাকে না। যতই আকাশ ফাটিয়ে চ্যাঁচাও।—কথাটা বলেই ফেললেন।

সামনে পাবলোসুন্দর দাঁড়িয়ে, দু’কোমরে হাত।

কী মা মা করে চ্যাঁচাচ্ছ হে ছোকরা পাশের বাড়ি দ্যাখো, এখানে সুবিধে হবে না—বলে যশো গালে হাত দিয়ে বিছানায় ডুবে গেলেন। পাবলো কিছুক্ষণ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইল, তারপর বলল—অ্যাক্সিডেন্ট কি জানান দিয়ে আসে যে, মজুত থাকব! খবর পেয়ে তো সঙ্গে সঙ্গে গিটার ফেলে চলে এসেছি। এমন রাগারাগির কোনও মানে হয়?

যশো আশ্চর্য হয়ে বললেন—অ্যাক্সিডেন্ট? কার অ্যাক্সিডেন্ট? কখন? গিটারই বা কার? জিনিসটা কী? কে হে তুমি পরের বাড়ি ঢুকে আলটুফালটু বকছ! ইয়ারকি পেয়েছ নাকি?—ও রামলাখন, রামলাখন দ্যাখো না তোমার দেশোয়ালি এক এঁড়ে বাছুর এসে আমায় গুঁতিয়ে দিচ্ছে।

এবার পাবলোর মুখখানা দেখবার মতো হল। সে তিরবেগে পাশের মধুমহলে পগারপার হল।—মাসি ও মাসি, মায়ের হঠাৎ পা পিছলে গেছে, স্ট্রোক এইসব বলে উন্নি আমাকে ডেকে পাঠাল, এসে তো দেখছি মা’র পাগলামির লক্ষণ! তোমরা সবাই কি সত্যি কথাটা চেপে গিয়েছিলে?

মধুক্ষরা একটা ফ্যাশন ম্যাগাজিনের পাতা ওলটাচ্ছিলেন—বললেন কে পাগল? তুই না তোদের বন্ধু উন্নি, না ক্যানিং। না তোর মা! বদসঙ্গ, বিশেষ করে পাগলসঙ্গ ছাড় পাবলো, নইলে…

আহ। মা আমাকে চিনতে পারছে না। আর তুমি…

কে চিনতে পারছে না? মা, তোকে? তুই কি চেনার মতো আছিস? ক্রমশই অচেনা হয়ে যাচ্ছিস। কোথায় আমাদের সেই পাবলোসুন্দর, যে কথায় কথায় ঠোঁট গোল করে মাসিকে হামি খেত, কোলে চড়ে জাহাজের আলো দেখে বলতো চাঁদের রাস্তা, কোথায় সেই ছেলে যে নারকোল নাড়ু দিলেই হাত ঘোরাত…

আহ মাসি, তুমিও তা হলে পাগল হয়ে গেছ। শিগগির চলো ও—বাড়ি, মা যেন কেমন করছে। শম্পি কোথায়?

শম্পি তো বেরিয়ে গেল!

আশ্চর্য। বাড়ির মেয়েরা যদি এইভাবে যখন—তখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়!

উত্তরে মধুক্ষরা বললেন—আশ্চর্য! বাড়ির ছেলেরা যদি এইভাবে যখন—তখন বাড়িতে ফিরে আসে!

মানে কী? মানে কী এর?

মানে তুই বুঝলে আর দুঃখ থাকত না রে।

যাই হোক, চৌকাঠ পার হয়ে যশোমহলে পা টিপে টিপে চলল দু’জনে। একটু হেঁড়ে গলায় গান ভেসে আসছে। বঁধু গো—এই মধু মাস বুঝি বা বিফলে গেল—শচীনদেব বর্মনের গান।

মধুক্ষরা বললেন—দিদি নাচটা ভাল শিখেছিল, গানটায় সুবিধে করতে পারেনি। কিন্তু মিড়গুলো দিব্যি আসছে তো! ও দিদি। কী হল তোমার?

শোবার ঘরে ঢুকে দেখা গেল যশোধরা চিতপাত হয়ে শুয়ে একটা গোলাপি উলের জামা বুনছেন এবং গান গাইছেন।

ও দিদি! কী করছ!

ভ্রূক্ষেপই করলেন না যশো।

ও দিদি, কার জামা বুনছ!

একটি শিশুর।

কে শিশু!

পৃথিবীতে ওই একটি জিনিসের এখনও অভাব হয়নি। যদিও তাদের মেরেধরে, কেটে ছিঁড়ে খেয়ে শেষ করে দিচ্ছ। তবু…কণ্ঠ আবেগে রুদ্ধ হয়ে গেল।

ও দিদি, তোমার নিজের শিশুটি যে কাঁদোকাঁদো হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে গো, তাকে একটু কাছে ডাকো!

কাচের মতো চোখে পাবলোর দিকে তাকালেন যশো—এই ধেড়ে কার্তিকটিকে শিশু বলছ! কে তুমি পাগলিনী?

যাঃ মাসি, তোমাকেও মা চিনতে পারছে না।

যশো গাইলেন—ভুঁলে গেছ তুমি সেই মধু নামে ডাঁকা। বঁধু গো…উপায় না দেখে মধুক্ষরাও সঠিক সুর ধরিয়ে দিলেন—এই মধুমাস বুঝি বা বিফলে গেঁল অঁ।

এই দ্বৈতসংগীতের মধ্যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পাবলো ঘামতে লাগল। হঠাৎ মনে হল সরু মোটা দুই গলায় গানটা তো দিব্যি জমাটি! সে—ও হঠাৎ খসখস করে নোটবুক বার করে কী সব লিখে নিল। তারপর গাইতে লাগল—

এই কলকাতা বুঁঝি বা ঝঁলসে গেঁল, বঁধু গো,

ভুলে গেছ তুঁমি বালিগঞ্জের বাঁসা

মোড়ে মোড়ে কত চাঁদামুখ খাঁসাখাঁসা

এই বালিগঞ্জ, এই কালীঘাট ঝুঁঝি বা ঝঁলসে গেঁল ও ও…

দি আইডিয়া! দি আইডিয়া, তিন তুড়ি দিয়ে পাবলো একটা ঘুরপাক খেয়ে নিল। মা, শেষপর্যন্ত মা—ই তাকে পথ দেখিয়ে দিলে। সে বলল—জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী। বলে ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রমাণ করল।

দৃশ্যটি যখন এইরকম—যশো শুয়ে শুয়ে উল বুনতে বুনতে হেঁড়ে গলায়, মধুক্ষরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু হাতে প্রাণ দিয়ে প্যাশন দিয়ে মধুমাস বিফলে যাওয়ার গান গাইছেন, পাবলো মেঝেতে সাষ্টাঙ্গ—ঠিক এই মুহূর্তে দুটি মানুষ ঢুকল, সুহৃৎ ব্যানার্জি আর মধুবন।

কী ব্যাপার? দরজা খোলা। কোথাও কেউ নেই। নীচেটা একেবারে, এ কী! আমি শুনলাম যশো জ্ঞান হারিয়েছে! খোকা এভাবে মাটিতে পড়ে আছে কেন? পাবুল ও পাবুল! সুহৃৎবাবু কাতরে উঠলেন। দেখা গেল তিনি স্ত্রীর চেয়ে ছেলের জন্যেই বেশি কাতর! হবে নাই বা কেন? স্ত্রী বহাল তবিয়তে গান গাইছেন, কিন্তু ছেলে মাটির ওপর সটান উপুড় হয়ে পড়ে আছে।

মধুবনও খুবই উচাটন, পাবলোর জন্যে—আমি শুনলুম মাসি পড়ে গিয়ে সেন্সলেস হয়ে গেছে। পাবলো সেন্সলেস এ—কথা তো কেউ বলেনি।—সেও খুব উতলা দেখা গেল। পাবলো, এই পাবলো!

মধুবনকে দেখেই যশো জ্ঞানে ফিরলেন।

এসেছিস মধুবন, আয় কাছে আয়।

মধুবন কাছে যেতে গোলাপি উলের বোনাটা তার গায়ের ওপর ফেললেন।—নাঃ একটু যেন ছোট হয়ে গেছে।

বলে পড়পড় করে বোনাটা খুলতে লাগলেন।

পাবলো ততক্ষণে উঠে পড়েছে।

তোর কী হয়েছে রে পাবুল! তার বাবা জিজ্ঞেস করেন।

আমি মাতৃদেবীকে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছিলাম বাবা। আমার সারা জীবনের কৃতজ্ঞতা। মা আমাকে জীবনের পথ দেখিয়ে দিয়েছে।

তা যেন হল—সুহৃৎবাবু বোকার মতো বললেন—আমি ফোন পেলুম শম্পির। কার অসুখ, কী অসুখ এখনও পর্যন্ত তো কিছুই বুঝতে পারছি না। একটা না একটা রোগী তো থাকবে!

যশো বললেন—এ—ও তো হতে পারে যে, তুমিই আসল রুগি। বুঝতে পারছ না। কিছুতেই রুগিকে কায়দা করতে না পারলে ভুলিয়ে ভালিয়ে তাকে ওষুধ খাওয়াতে হয়, না হয় না?

চতুর্দিকে চোখটা ঘুরিয়ে এনে সুহৃৎ বললেন—তা তোমাদেরও কি তাই—ই মত!

মধুবন বলে উঠল—কাকু, এই সামান্য জিনিসটা বুঝলে না? এখানে দু’জন শুয়ে আছে। এক যশোমাসি, আরেক পাবলো। পাবলো শুয়ে শুয়ে কী সব মন্ত্র—তন্ত্র বলছিল। আমার মনে হয় মধুমাসি ওঝা ট্রাই করেছিল। তারই নির্দেশে পাবলো অমন…যশোমাসি এই গরমে উল বুনছে, আমার ছোটবেলার সাইজ। কিছু একটা গোলমাল তো হয়েছেই। সিরিয়াস গোলমাল।

মধুক্ষরা বললেন—ওঝা? ওঝা ট্রাই করেছি আমি, সায়েন্সের মেয়ে? তোর কি মগজেও ফ্যাট ঢুকে গেছে!

মগজে তো ফ্যাট থাকেই মাসি। ঘিলু বলে না? আমি একটা ভীষণ ঘনীভূত রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি। যতই কথা ঘোরাও!

কী হয়েছে কেউ আমাকে বলবে?—এবার সুহৃতের গলা বেশ কড়া। ‘আমার সঙ্গে চালাকি হচ্ছে’ গোছের ভাব।

তখন যশো বালিশের তলা থেকে ডক্টর সুবল মিত্রের প্রেসক্রিপশনখানা বার করে দেন। ই সি জি, প্রেশার, ব্লাড কোলেস্টেরল…। সব ইনভেস্টিগেট করতে হবে।

তোমার হার্টের ট্রাবল, আর তুমি গান গাইছ? অবাক হয়ে সুহৃৎ বললেন।

যেরকম হাঁসফাঁস হাঁসফাঁস করো, তাতে করে এ সন্দেহটা আমার আগেই হয়েছে। এখন তুমি চুপটি করে শুয়ে থাকবে আর পাবুল আমাদের চা—টা দেবে। পাবুল যা—ও। চা কারো। মধুবন তুই দ্যাখ তো ‘টা’ বলতে কী আছে? প্রচণ্ড টেনশন নিয়ে এসেছি। এখন আমার খিদে পেয়ে গেছে। বলে—সুহৃৎবাবু কোণ থেকে একটা চেয়ার হড়হড় করে টেনে এনে যশোমাসির বিছানার কাছে বসলেন—এই আমি নজরদার বসলুম। দেখি কে কী অনিয়ম করতে পারে।—তিনি হাত বাড়িয়ে যশোর হাতটা টেনে নিলেন, তারপর কবজি টিপে ধরে ঘড়ির দিকে চেয়ে রইলেন।

মধুবন বলল—চ পাবলো চ। রাত প্রায় আটটা বাজছে। তোমরা কে কে চা খাবে?

সববাই—মধুক্ষরা বললেন।

রান্নাঘরে ঢুকে পাবলো হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইল। মধুবন বলল—নে, জল চাপা!

কোথায় চাপাব, আমার মাথায়? মায়ের রান্নাঘর এত ডিজরগ্যানাইজড!

বাজে কথা বলিসনি। ওই তো হুক থেকে সসপ্যান ঝুলছে। ওই দেখ সারি সারি কাপ। মেপে মেপে জল নিবি। পাঁচ কাপ।

তো তুই কী করতে আছিস?

আমি চলে যাব? বেশ তাই যাই। বলে মধুবন পেছন ফিরল।

আরে শোন শোন। আমি চা করতে জানি না।

সহজ কাজ। শিখে নে। কাজে দেবে। আমি শুধু সুপারভাইজ করতে আছি। তোর বিদ্যের দৌড় তো জানা আছে।

যা যা বাজে বকিসনি। ভারী একটা কাজ, চা করা।

এই এই তোর চায়ের জল ফুটে উঠেছে। ওই যে চা—পাতার কৌটো। গুনে গুনে চার চামচ দে। আরে অত ভরতি ভরতি নয়। তুই একটা হোপলেস!

সুবিধে পেয়ে খুব ডিং নিচ্ছিস, না?

বাজে কথা না বলে, ঘড়ি দ্যাখ, পাক্কা দেড় মিনিট রাখবি। কাপগুলোয় চিনি দে। যশোমাসির আর আমার সুগার—ফ্রি। বাকি তিনটে এক চামচ করে চিনি দিবি। যাঃ সুগার—ফ্রিটা আবার কোথায় গেল!

কিছুক্ষণ খুঁজে পেতে বড়িগুলো পেয়ে গেল মধুবন। বললে, নিজের রান্নাঘরের কোথায় কী আছে জানিস না, অ্যাঁ? লজ্জায় মুখ লুকো।

পাবলো নিবিষ্ট মনে ঘড়ি দেখছিল। এবার পটে ঢালতে গিয়ে মেলাই ফেলে দিল।

যাঃ। একজনের কম পড়ে গেল। ঠিক আছে আমি খাব না। পাবলো বলল—অ্যামি খ্যাব না! তোর ঘাড় খাবে। এই সময় নাগাদ চা—টা খেলে রাতে তোর খিদে কম হবে। আপসে ডায়েটিং হয়ে যাবে।

আমার ডিনার হয়ে গেছে।—গম্ভীরভাবে মধুবন বলল।

এর মধ্যে কী খেলি?

বাঁধাকপির সুপ, গাজর পেঁপে, বিন সেদ্ধ। একবাটি মুশুর ডাল, একখানা রুটি।

ওহ মধুবন কী কৃচ্ছ্বসাধনটাই না করছিস! অনেক করেছিস। ফ্রিজে বোধহয় আইসক্রিম আছে, একটু খেয়ে যা প্লিজ, এক স্কুপ।

একবার বলছিস চা খা, আরেক বার বলছিস আইসক্রিম খা, মাথাটাথা গন্ডগোল হয়ে গেল, না কী?

মধুবন পরম অবজ্ঞার সঙ্গে ট্রে—তে কাপগুলো সাজাল, বলল—যা নিয়ে যা এগুলো। আর শোন—আমি আরও চার কেজি কমেছি। এখন আমায় ব্রতচ্যুত করবি না।

মধুবনকে একবার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে পাবলো বলল—তুই কি ডিটারমিনড?

আজ্ঞে হ্যাঁ। এবং যখন আমি কোনও সংকল্প করি তখন সেটা করেই ছাড়ি।

চায়ে চুমুক দিয়ে সুহৃৎ বললেন—বা, বা, বা, বেশ চা করেছিস তো পাবুল! গুণ আছে ছেলেটার।

মধুবন বলল—আজ্ঞে না কাকু। উনি শুধু নেড়েছেন আমি বলে দিয়েছি। মানে হাতে—কলমে কাজ শেখানো আর কী!

পাবলো বেরিয়ে আসতে আসতে বলল—উঃ, আমার রিহার্স্যালটা মাঠে মারা গেল। এই বাবাগুলো এত স্ত্রৈণ হয় না!

মধুবন বলল—তাই বুঝি! যশোমাসির অসুখ শুনে কাকুর আসা উচিত হয়নি বলছিস! ভাল ভাল। চমৎকার এক ছেলে!

আসতে কে বারণ করেছে! সেই থেকে হাতটা ধরে পালস রেট দেখে যাচ্ছে। যাই বলিস এইরকম ডোর—ম্যাট টাইপের লোকগুলোকে আমার সহ্য হয় না।

মধুবন ঘেন্নার দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বলল—বটে।

বাড়ি ফিরতে ফিরতে মধুবন ভাবল তার আর পাবলোর জীবনদর্শন একেবারে আলাদা। পাবলো বাড়ির এক ছেলে। তাকে লাই দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলেছেন যশোমাসি। আর কাকুর তো কথাই নেই। পাবুল আর পাবুল। আর এই এত ভালবাসা প্রশ্রয় পেয়ে পাবলো ভাবছে তার আর কারুর জন্যে কিছু করার নেই। সে—ই সূর্য। বাকি সব গ্রহতারা তার চার দিকে ঘুরছে। বাঃ চমৎকার ফিলসফি, আর সে মধুবন! স্ট্রিক্ট শাসন তোমার জন্যে। মা’র শাসন, বাবার শাসন এমনকী পাঁচ বছরের বড় দাদা ঋজুরুস্তম পর্যন্ত তার গার্জেনি করবার সুযোগ পেলে ছাড়ে না। কিন্তু তাইতে কি মধুবনের মা—বাবার প্রতি ভালবাসা একটুও কমেছে? তার বাবা কি মা যদি এমন অজ্ঞান হয়ে যান। তারপর প্রাণপণে শচীনদেব বর্মন গাইতে থাকেন মধুবন কি এক মিনিটও অপেক্ষা করবে? ডাক্তার সাইকায়াট্রিস্ট, যে যেখানে আছে মধুবনের বিনতি শুনে তাদের বাড়িতে ডাক্তারি বক্স নিয়ে উপস্থিত হবেন না?

ছোটবেলায় যখন কাড়াকাড়ি করে যশোমাসির বাগান থেকে কুল পাড়া হত, ফুলের জন্যে ডাক্তার বিশ্বাসের বাগানে হানা দেওয়া হত তখন তারা বালক—বালিকা ছিল। অমিলগুলো বোঝা যায়নি। এখন যত বড় হচ্ছে ততই তাদের তফাতটা—অর্থাৎ পাবলোর স্বার্থপরতা আর তার নিজের পরোপকারিতা ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

ফোঁস করে নিশ্বাস ছাড়ে মধুবন। জীবন জীবন, তুমি আর কত অমিল পরিস্ফুট করবে? লাইফ ইজ আ চেন অব ডিস্যাপয়েন্টমেন্টস। চেন না হিস্ট্রি। ভাবতে ভাবতে নিঝুম হয়ে সে বাড়ি ফিরল। মা কোথায়? রান্নাঘরে খুটখাট আওয়াজ হচ্ছে। রান্নাঘরে বোধহয়। তা মাকে খুঁজতে গিয়ে রান্নাঘরে জিনপরিকে পেয়ে গেল মধুবন। পাউরুটিতে মোটা করে মাখন লাগিয়ে, তার ওপর জ্যাম ঢেলে খাচ্ছে বসে বসে। তাকে দেখে গলায় আটকে দম বন্ধ হয় আর কী! মধুবন আস্তে আস্তে তার ঘাড়ে থাবড়া মারে। এক গ্লাস দুধ বার করে বলে—পরি রে, সলিড জিনিস খাচ্ছিস, একটু লিকুইড কিছু রাখিসনি পাশে? নে একটু করে দুধ খা, আর একটু করে পাউরুটি।

পরির খাওয়া শেষ হওয়া অবধি মধুবন ঠায় রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে রইল।—আর কিছু নিবি?

সলজ্জ গলায় পরি বলল—এখন এই—ই যথেষ্ট। এর পর তো আবার রাত্তিরে খেতে হবে। যাকে তোমরা বলো ডিনার?

এটা তা হলে তোর কী? টিফিন?

বলতে পারো। দিদি, মাকে বলে দেবে না তো!

পাগল! বাড়িতে দুধ মাখন চিনি যত কমে যায় ততই তো ভাল, আমার জন্যে কোনও প্রলোভন থাকবে না।

অন্যায় করেছি দিদি। আমায় মাপ করো।

যা বাববা খিদে পেয়েছিল, খেয়েছিস। মাকে বলে খেলে আর কিছুই ঝামেলা ছিল না। তো তুই চার বেলা ভাল করে খেতে পাস তো? মা কী কী দেয় রে তোকে?

মা খুব ভাল—পরি অনুতপ্ত গলায় বলল—সকালে তো প্রথমেই আমার রুটি হয়। ফ্রিজে কিছু না কিছু থাকে। তাই দিয়ে চারখানা রুটি খাই। চা—খাই এক গেলাস।

তার পর?

তার পর—দুপুরে ভাত। অনেকটা ভাত খাই দিদি। লজ্জা লাগে। ডালও অনেকটা দেন মা। তারপরে সেদিন যা তরকারিপাতি হয়, খাই।

মাছ মাংস?

হ্যাঁ…রাত্তিরে নয়। সকালে যা হোক একটা থাকে। মা কী ভাল মাংস রাঁধে গো! ইচ্ছে করে বাতাসি, পাঁচু, ইতু সববাইকে ডেকে ডেকে খাওয়াই।

এরা কারা? কুকুর!

ওমা কুকুর কেন হতে যাবে? আমার ভাইবোন ওরা।

মা এখন কোথায়?

মা’র কোন বন্ধু অজ্ঞান হয়ে গেছে, মা দেখতে গেছে।

আবার কে অজ্ঞান হল? মা’র অঢেল বন্ধু তা যদি বলো। কিন্তু সে তো যশোমাসির বাড়িতে মাকে দেখেনি! আসবার সময়ে পথেও তো দেখতে পেতে পারত! যশোমাসিও যোধপুর পার্ক। তারাও যোধপুর পার্ক। আবার কে জ্ঞান হারাল রে বাবা!

এমন সময় পেছন থেকে খুব ভাঙা গলায় কে বলে উঠল—পাবলো কি কোনও বান্ডিল—বুন্ডিল তোর কাছে রাখতে দিয়েছে? সত্যি কথা বলবি।

ফিরে সে দেখে কার্জন। একটা পাতলা ফতুয়া পরেছে। ভেতরে পইতে দেখা যাচ্ছে। বছর খানেক আগে কার্জনের পইতে হয়েছে। একটা রংচটা জিনস, থ্রি—কোয়ার্টার, সুতো ঝুলছে।

কী রে? কিছু বল! পাবলোর বেস্ট ফ্রেন্ড! বান্ডিলটা দিয়ে দে। ভাল যদি চাস।

আর না চাইলে?—অকুতোভয় মধুবন কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল রণং দেহি ভঙ্গিতে।

না চাইলে নক আউট করে দেব—এইভাবে—বলে ঘুসি বাগিয়ে কার্জন যে—ই এগিয়ে এসেছে, হঠাৎ দেখা গেল সে কুপোকাত। পেছন থেকে পরি ল্যাং মেরে তাকে শুইয়ে দিয়েছে।

উঃ আঃ করতে করতে কার্জন এঁকেবেঁকে উঠে দাঁড়াল। মধুবন বলল—পরি, যা বরফ নিয়ে আয়।

আমি পারব না। গুন্ডো বদমাইশ, তোমাকে বাড়ি বয়ে মারতে আসে। আমি বরং পুলিশে ফোন করিছ।—পরি খরখর করতে করতে চলে যাবার উদ্যোগ করে।

এই পরি। এই পরি। থানা পুলিশ করিসনি। এটা আমার বন্ধু।

কার্জন বলল—আমি কি সত্যি—সত্যি মারতুম নাকি! মধুবন, তুই খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলি, না রে?

আমি একটুও ভয় পাইনি। চোর ডাকাত ফেরেববাজদের আমি ভয় পাই না।

তা হলে তোর অ্যাসিস্ট্যান্ট আমাকে ল্যাং মারল কেন!

সেটা ওকেই জিজ্ঞেস কর।

আচ্ছা মাফ করে দিলুম, পাবলো যে—বান্ডিলটা তোকে দিয়েছে—!

পাবলো আমাকে কোনও বান্ডিল দেয়নি। আমি পাবলোর মতো অকম্মা ছেলের বেস্ট ফ্রেন্ডও হতে পারি না। এবার যা—ও।

তবে যে বললি। স্বীকার গেলি যে নিয়েছিস!

স্বীকার করিনি তো! তুই ভাল চাসটাস বলে আমার ভয় দেখালি, তাই বললুম—না দিলে?—তার মানে কি দাঁড়ায় জিনিসটা আমার কাছে আছে! কী ছিল বান্ডিলটাতে?

সেটা তোকে বলতে আমি বাধ্য নই।—দু’হাত বুকে আড়াআড়ি রেখে কার্জন বলল।

তা নোস। কিন্তু এক্ষুনি এখান থেকে চলে যেতে তুই বাধ্য। এক্ষুনি আমার দাদা রুস্তম এসে পড়বে। সে হামলাকারীদের প্রশয় দেয় না।

তা হলে কতক চাট্টি বরফ অন্তত দে। ওঃ খুব লেগেছে রে!

পরি বেশ গুছিয়ে—গাছিয়ে বরফ আইসব্যাগে ভরে এনে দিল। প্রাণপণে আইসব্যাগ হাঁটুতে, পায়ের গোড়ালিতে চেপে ধরতে লাগল কার্জন নামে আহত ছেলেটি।

একটু পরে বলল—প্রত্যেক বন্ধুর বাড়িই দেখছি একই রকম ডেঞ্জারাস। একজনের বাড়ি থেকে তার মা মাসি বার করে দেয়, বিতিকিচ্ছিরি অ্যালিগেশন আনে, আরেকজনের বাড়ি থেকে স্বয়ং বন্ধুই বার করে দিতে চায়। আগে চ্যালাচামুণ্ডা দিয়ে মার খাইয়ে। সত্যি ইয়ারদোস্ত ব্যাপারটা আর টিকে থাকছে না।

তুই আইসব্যাগসুদ্ধু এবার ফুটে যা কার্জন। দাদা ফিরে এসে যদি সব শোনে তোর আর রক্ষে নেই।

আইসব্যাগটা নিয়ে যাব? তারপরে বলবি ঝেড়ে দিয়েছি।

দে ঝেড়ে। আমাদের বাড়ি অমন ডজনে ডজনে আইসব্যাগ আছে। প্রত্যেক বার দরকারের সময়ে খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রত্যেক বার নতুন আসে। আজই প্রথম খুঁজে পাওয়া গেল।

কার্জন খুব বিমর্ষভাবে চলে যায়। আজকে দিনটাই বেচারার খারাপ যাচ্ছে। উন্নি, ওই উন্নির জন্যে। উন্নিটা থাকলেই যত ঝামেলা। চ্যাটাং চ্যাটাং চলবে, কটাং কটাং বলবে। ফলটা ভুগতে হবে তাকে। এখন বান্ডিলটা কোথায় পায় সে? পাবলোকে দেখলে বোঝা যায় না, কিন্তু সে অতি ধড়িভাজ ছেলে। তার কার্যকলাপ, তার হোয়্যারঅ্যাবাউটস সবই খুব কষ্টকর খুঁজে বার করা।

মীনাক্ষী, অর্থাৎ মধুবনের মা যশোধরার মূর্ছা ও পতনের খবর পেয়েছিলেন পাবলোর থেকেই। মনে হয় পাবলো মায়ের যতজন আত্মীয়—বন্ধু জড়ো করা যায় তার একটা চেষ্টা চালাচ্ছিল। ওই যে উন্নির ফোনটা! সিরিয়াস কেস! সেই শুনেই সে সম্ভবত খুব দায়িত্বশীল পুত্রের কাজ করে। উন্নির ফোনটা এসেছিল আরমান মারফত। পাবলো তখন পঙ্কজের সঙ্গে প্র্যাকটিস করছিল। তার হাতে গিটার। সঙ্গে সঙ্গে পঙ্কজের চিলেকোঠা থেকে লাফ দিয়ে সে বার হয়। সিঁড়ি টপকাতে টপকাতে রাস্তা ভাঙতে ভাঙতে সে ক্রমাগত যার ফোন নম্বর মনে আছে বা স্টোর করা আছে সবগুলিতেই তার শোকসংবাদটি রাখছিল। মীনাক্ষীমাসি—মায়ের খুব শরীর খারাপ। সিরিয়াস কেস!

আলোমাসি—মায়ের হঠাৎ শরীরটা কেমন খারাপ হয়ে পড়েছে। না না ঘাবড়িও না। তবে সিরিয়াস কেস।

বিজয়মামা—শোনো একটা খারাপ খবর আছে। আমার মা মানে তোমার ট্রুপের যশোধরা ব্যানার্জির স্ট্রোক হয়েছে। হাঁ, না আজকাল মেলাই ওষুধ বেরিয়ে গেছে, ভয় কী!

মীনাক্ষী যশোধরার বাড়ির গেট থেকেই একটা কোলাহল মতন শুনতে পেলেন। অনেক কথা বললে যেমন হয় আর কী! দরজাটা আধ খোলা। ঠ্যালা মারতেই খুলে গেল। সেই বিকট বেলটা আর বাজাতে হল না। রাত প্রায় সাড়ে আটটা। এ সময়ে সদর খোলা! এমনই ক্রাইসিস, না কী? মীনাক্ষীর বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল। যশোর সঙ্গে তাঁর প্রায়ই ঝগড়া লাগত। কত তুচ্ছ কারণে তিনি যশোকে কত যাচ্ছেতাই করেছেন। মীনাক্ষী লেখাপড়ায় তুখোড় হওয়া সত্ত্বেও টিচারটা কেন কে জানে যশোকেই বেশি ভালবাসতেন। বাপ রে। সেই নিয়ে কম হিংসেহিংসি। তিনি একেবারে মুখের ওপর বলে দেন এক বার—আহ্লাদিগিরি করিস তো দিদিদের সঙ্গে! তোদের শাড়ির দোকানে থার্টিফর্টি পার্সেন্ট ডিসকাউন্ট দিস। সব দিদিকে কিনে রেখেছিস। নইলে আর যশোধরা চ্যাটার্জি ক্লাস ক্যাপ্টেন হয়? রাতদিন তো নিজেই গুজগুজ ফুসফুস করছিস। দারোয়ানের ছেলের সঙ্গে পর্যন্ত প্রেম করছিস।

ইস ছি ছি, এইটা যশোর খুব লেগেছিল। সবাই জানে রামলাখন স্কুল—দারোয়ান ভগৎরামের ছেলে। কিন্তু ছেলেটা কেমন তা তো দেখতে হবে! অত হ্যান্ডসাম ওদের ধারেকাছে কেউ ছিল না। আর অত ক্লাস কনশাস হবেই না কেন তারা? রামলাখন তো পাঁড়ে, বিহারি ব্রাহ্মণ! মুচি, ছুতোর, জেলে, মিস্ত্রি এদেরও যদি লেখাপড়া জানা হ্যান্ডসাম ছেলে থাকে, তা হলে কি মীনাক্ষী বা যশোধরাদের মতো আধুনিক মনের মেয়েদের আপত্তি থাকা উচিত? সমস্তটাই একটা কেলো। যশো অবশ্য জানে না রামলাখনের কথা সে—ই যশোর মা মিনতিমাসিকে বলে দেওয়ায় যশোর হুস করে বিয়ে হয়ে গেল। অবিশ্যি খারাপ কিছু হয়নি। ভাগলপুরে থাকার চেয়ে কলকাতার দক্ষিণে নিজ গৃহে থাকা হাজার গুণে ভাল। সুহৃৎদাও রামলাখনের চেয়ে লক্ষ গুণ ভাল। যশোকে কত ভালবাসেন, মানেন। মীনাক্ষীর ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস পড়ল। সেই সুখী গৃহকোণ আঁধার করে, গৃহকর্তাকে অনাথ করে এত অল্প বয়সেই যশো চলল!

সদর দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে আস্তে আস্তে সিঁড়ি ভাঙতে থাকেন মীনাক্ষী। এত আস্তে চলা আস্তে বলা তাঁর অভ্যাস নেই। রীতিমতো একটি নারীসমিতি চালাতে হয় তাঁকে। আজ গ্রান্টের জন্য সরকারি আপিসে ছোটো। কাল ছোটো ব্যাঙ্কে লোনের জন্য। সমিতির মেয়েদের হাতের কাজের এগজিবিশন করতে তাঁর ঘাম ছুটে যায়। যশোর মতো থপথপে হলে তাঁর চলে না। বলতে কি তাঁর খুব সন্দেহ তাঁর কন্যা মধুবনকে যশো ইচ্ছে করে, ইনটেনশন্যালি খাইয়ে—দাইয়ে ভাগলপুরী গাইটি বানিয়েছে খুব সূক্ষ্মভাবে তাঁর ওপর শোধ নিতে। ছোটবেলাকার রেষারেষি এইভাবেই সারাজীবন জিইয়ে থাকে। যাই হোক মধুবনকে নিজের ফ্রেমে এনে ফেলে যশোকে তিনি একহাত নেবেনই। এই রে! মীনাক্ষীর চট করে মনে পড়ে যায়। কীভাবে একহাত নেবেন তিনি যশোর ওপরে? সে তো চলল! যদি নাও যায় সে তো আর আগেকার যশোটি হয়ে থাকবে না! ছি ছি বাল্যসখীর দুঃসময়েও এসব ছেঁদো কথা তাঁর মনে এল কী করে? মীনাক্ষীর লজ্জায় দুঃখে নিজের দু’গালে চড় মারতে ইচ্ছে করল। স্বভাব সত্যিই মরার আগে যায় না। ছ্যাঃ।

মীনাক্ষী দোতলায় পা দিয়েছেন। চার দিকে একটা ব্যস্তসমস্ত ভাব দেখতে পেলেন। পাবলো রয়েছে। পাবলোর বন্ধুবান্ধব ক’জন। ও দিকে সুহৃৎদার জ্যাঠামশাইয়ের ছেলে যার সঙ্গে মীনাক্ষীর বিয়ের সম্বন্ধ হয়েছিল। ভেতর থেকে সরু মোটা নানান গলার আওয়াজ ভেসে আসছে। মীনাক্ষী পাবলোকে পাকড়ালেন—আমি কি কোনও হেলপ করতে পারি?

শিয়োর—পাবলো বলল—তুমি যদি আইস বার করে দাও, আমি স্প্রাইটের সঙ্গে আমপানা মিশিয়ে একটা ফার্স্টক্লাস পাঞ্চ করে দিতে পারি।

মানে?—মীনাক্ষীর হাঁ বুজতে চায় না—ডাক্তার শরবত খেতে বলছে? গরমে ভিরমি লেগেছে। না কী?

ভিরমিই বটে মাসি। এতগুলো ছেলেবুড়ো মেয়ে—মদ্দর ভিরমি সামলানো আমার একার কম্মো! তুমি প্লিজ একবারটি ফ্রিজে যাও!

কে এয়েচে রে? ঘরের ভেতর থেকে যে—কণ্ঠস্বরটি বেরিয়ে এল সেটি যশোর বলেই তো মনে হল।

পাবলো ফিসফিস করে বলল—দারুণ ক্রাইসিস মাসি। তুমি ওদিকে যেয়ো না। আমি শম্পিকে এক্সট্রা গ্লাস আনতে পাঠিয়েছি—তুমি ফ্রিজে যাও। আমি আসছি। উঃ প্রথমে চা, তার পরে শরবত, তার পরে যে কী!

পাবলোর চক্করে পড়িসনি। কে এলি?—যশোর কি মাথা খারাপের লক্ষণ দেখা দিল? পাবলো ওদিকে যেতে বারণ করছে। যশো আবার পাবলোর দিকে আসতে বারণ করছে। কিন্তু মীনাক্ষী অত সহজে ঘাবড়াবার পাত্র কিনা! তিনি সুহৃৎদার জ্যাঠতুতো দাদার সঙ্গে নিজের বিয়েটা ঠেকাতে পেরেছেন। আরও কতজনকে সারাজীবন ধরে ঠেকিয়ে আসছেন। তাঁর বীরত্ব চ্যালেঞ্জে পড়লে আরও বেড়ে যায়। তিনি পাবলো একটু মুখ ফেরাতেই সো—জা যশোর ঘর।

বাপ রে! এই নাকি সিকরুম! সমস্ত ঘরটা গমগম ঝনঝন করছে লোকে। এদের পুরো গুষ্টিই বোধহয় যশোকে দেখতে চলে এসেছে।

যশো বলল—লে মধু, মিনিও এসে গেছে, তুই এবার ওর সঙ্গে মিলে মেনুটা ঠিক করে ফ্যাল। মিনি, তুই আর গল্পো করতে বসিস না। আমি দ্যাখ জেরবার হয়ে গেলুম।

মীনাক্ষী হাঁ করে দাঁড়িয়েই আছেন। মধু রয়েছে। তার বর মিহিরকিরণও উপস্থিত। সুহৃৎদা যশোর একটা হাত নিজের হাতে নিয়ে বসে রয়েছেন। সুহৃৎদার সেই জ্যাঠতুতো দাদা পরিমল সার এক জোড়া কাঁচা—পাকা গোঁফ নিয়ে হাজির। তাঁর স্ত্রী ছোট্টখাট্টো কলিবউদিও মজুত। সোমা নামে তাঁদের আরেক বন্ধু এবং তার মেয়ে এসে গেছে। অল্প বয়স্ক কয়েকটি ছেলেমেয়েও ঘোরাফেরা করছে—তাদের মধ্যে আরমানকেই একমাত্র চিনতে পারলেন মীনাক্ষী। বিজয়মুকুলদাও রয়েছে আসর আলো করে। মাথায় বাবরি চুল ফুলিয়ে।

কী রে মিনি—তোর যে বাক্য হরে গেল? বল ঐক্য, বাক্য, মানিক্য!—

মীনাক্ষী অনেক চেষ্টায় নিজেকে দুরস্ত করে বললেন—তুই আছিস কেমন? হয়েছেটা কী? সেই আউপাতালিগিরি? আর কত অ্যাটেনশন দেবে তোর বর?

যশো হেঁকে বললেন—তুই চিরকালের শত্রু আমার। আমি মলে বাঁচিস। গেছি কি না দেখতে এসেছিলি। খুব ডিস্যাপয়েন্টেড। না রে? তোর বর যদি তোকে অ্যাটেনশন না দেয় তো আমার বর তুলে খোঁটা দিবি? যার ভাগ্য তার তার বুঝলি মিনি?—গলা উত্তরোত্তর চড়ছে দেখে যশোর জ্যাঠতুতো দাদা পরিমল বলে ওঠেন—আহাহা। এত উত্তেজিত হবার কী আছে যশো, বন্ধু বই তো নয়। দুটো ঠাট্টা তামাশা করতেই পারে। ওটা হল গিয়ে রিলিফ, বন্ধুকে ভাল দেখে ফুর্তি হয়েছে তো। তাই ঠাট্টা।

তোমার কুড—হ্যাভ—বিন পত্নীকে বুঝিয়ে বলো বড়দা। আমি নাটক করিনি। নাটক আমার আসে না।—লো সুগার, লো প্রেশার। সিচুয়েশন খুব খারাপ না হলে—ব্ল্যাক—আউট ভাল জিনিস না সুবুল ডাক্তার বলে গেছে।—বলে যশো বিশাল শরীর উলটে দেয়ালের দিকে মুখ করে শুলেন।

মধুক্ষরা বলল—মিনিদি, একবার বাইরে এসো।

দালানে বেরিয়ে এসে বলল এই সববাইকার রাতের খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে এখন। প্রথম দফায় শরবত, সেটা ছোটদের দায়িত্ব। এখন আমায় নাকি ডিনারের ব্যবস্থা করতে হবে। দিদির হুকুম। কী বে—আক্কেলে দেখো।

মীনাক্ষী বললেন—স্রেফ না করে দে। কে কবে শুনেছে অসুখের বাড়ি রাত ন’টায় ফিস্ট হয়। এটাও যশোর একটা অ্যাটেনশন সিকিং প্লয় বুঝলি?

বুঝি না আবার!—মধুক্ষরা ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলল। মিনিদির সঙ্গে মধুক্ষরার খুব ভাল বোঝাপড়া। ওই যে একটা ফর্মুলা আছে না তোমার শত্রুর শত্রু হল তোমার বন্ধু। সেই আর কী!

কিন্তু এখন কি আর না করা যায়! সব বসে আছে। খেয়েদেয়ে যাবে। সবাইকারই তো একটা রিলিফ হয়েছে!

না করা যাবে না বলছিস! তা হলে, ‘এসো বোসো।’

মানে?

জানিস না। ‘এসো বোসো’ বলে একটা সার্ভিস চালু হয়েছে। টেক—অ্যাওয়ে রেস্তোরাঁ। ফোন করে দিচ্ছি। ক’জন গুনে আয়। যেমন বলবি দিয়ে যাবে।

একটু পরেই সেলফোন বার করে মীনাক্ষী অর্ডার দিয়ে দিলেন—হ্যাঁ হ্যাঁ। সিম্পল মাছের ঝোল আর ভাত, একটু আলুসেদ্ধ দেবেন। হ্যাঁ। এই গরমে আবার কী! আটত্রিশ ডিগ্রি আজ নির্ঘাত।

এই সময়ে পাবলো আর শম্পি—শরবতের গেলাস ভরতি ট্রে নিয়ে দেখা দেয়। মধুক্ষরা আর মীনাক্ষী পটাপট দুটো গ্লাস তুলে নেন। ব্যাজার মুখে দু’জনে সিকরুমের দিকে এগোতে থাকেন। দুটো গ্লাস কমে গেল!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *