যে যেখানে যায় – ৩

মাঝে মাঝে ক’দিন খুব ঝড় দিচ্ছে। দু’চারটে গাছ পড়ছে। ছিটকিনি না লাগানো জানলার কাচ মুড়মুড় করে ভেঙে যাচ্ছে, শুকোতে দেওয়া কাপড়—চোপড় ক্লিপসুদ্ধ ছিটকে উড়ে যাচ্ছে। কিন্তু ঝড় পরবর্তী বজ্রবিদ্যুৎসহ বৃষ্টির এখনও দেখা নেই। গরমে হাঁসফাঁস করতে করতে করতে যশোধরা তৃতীয় বার চান করে, সারা গায়ে ট্যালকম পাউডারের বৃষ্টি ঝরিয়ে স্লিভলেস একখানা ব্লাউজ গলিয়েছেন, দরজায় বেল বাজল। বেলের আওয়াজটা বিশ্রী। একেবারে চ্যাঁ ভ্যাঁ মতন। শুরু করলে থামতে চায় না। কিন্তু যশোধরা এই বেল বদলাতে দেন না। এটা বাবা লাগিয়েছিলেন। বাবার জীবনের শেষ বেল। সুহৃৎ যদি বলেন—ওফ এটা তো দেখছি মরা মানুষকেও দাঁড় করিয়ে দেবে।

পাবলো ফোড়ন কাটবে—মারকুটেও করে দিতে পারে। বেলটা শুনলেই মনে হয় দরজাটা খুলেই বেলঅলাকে দিই এক থাপ্পড়।

না না এতটা রি—অ্যাক্ট করিস না। তোর রি—অ্যাকশনগুলো আজকাল বড্ড স্ট্রং হয়ে যাচ্ছে রে পাবুল। সামলে। সামলে।

যশোধরা বলেন—যার বাড়িতে আরামসে থাকতে পারছ, প্রেমসে খাওয়া—দাওয়া, আড্ডা, মজা মারতে পারছ, তার বাড়ির বেল—কে একটু সহ্য করতে হবে।

‘হবে’টা অতিরিক্ত জোর দিয়ে বলে যশোধরা পাউডার মাখতে থাকেন। আজ কেউ নেই। যশো নিজের মনেই বলেন—বাবা রে বাবা বেল বটে একখানা। পিলে চমকে যাবে। তাড়াতাড়ি করে শাড়িখানা কাঁধে ফেলতে না ফেলতেই আবার চ্যাঁ!

উঃ লোকে বোঝ না প্রথম বেলে সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না মানে গৃহকর্ত্রী ব্লাউজ পরছেন, শাড়িটা এখনও দুরস্ত হয়ে ওঠেনি। এই সামান্য কথাটা না বুঝলে…উফফ।

তাড়াতাড়ি গিয়ে দরজা খুলে যশোধরা দেখেন একটি যথেষ্ট সরু মেয়ে সিড়িঙ্গে মতন প্যান্ট পরা, ওপর দিকে একটা বেঁটে মতো টপ, পাশে একটি গাবদা গোবদা ছেলে। তার পরনে বারমুডা, পাতলা আদ্দির মতো কোনও কাপড়ের একটা ফতুয়া, এত পাতলা যে, ভেতরে পইতে দেখা যাচ্ছে।

মেয়েটি বললে—স্যরি ফর দা বেল।

আমার বেলের জন্যে তুমি কেন স্যরি হতে যাবে ভাই?—যশোধরা মোলায়েম করে বলেন।

মেয়েটি বলল—আপনারা স্যরি না হলে আমাদেরই হতে হয়। একটু হাসল—কিছু মনে করবেন না আমি একটু ট্যাঁক ট্যাঁক করে কথা বলি। বেলটা পালটে নিলেই পারেন। না পাবলোবাবুর সেটুকু উদ্যোগও নেই!

বেলটা পাবলোবাবুর নয় ভাই, বেলটা আমার, আরও ভাল করে বলতে গেলে আমার বাবার। বাবার লাগানো শেষ বেল। পালটাবার উপায় নেই।

ফ্যামিলি এয়ারলুম? ছাওয়ালটি এতক্ষণে বলল।

রাইট।

পাবলো কি বাই এনি চান্স বাড়িতে আছে?

নো চান্স—যশোধরা বলেন, তা তিনি আবার কোথায় উধাও হলেন? তাঁর ক’টি ঠেক!—মোটের ওপর?

জানলে তো বলব! ভেতরে আসতে বলবেন না?

কে জানে, ভেতরে আসতে বললে আবার স্যরি—টরি বলবে কি না!

দুই মক্কেল ভেতরে ঢুকে এল।

আ—হ। কু—ল—ছেলেটি বলল।

মেয়েটি বলল—আর্কিটেকচার।

ছেলেটি বলল—ওল্ড ইজ গোল্ড।

মেয়েটি বলল—প্ল্যাটিনাম।

এতক্ষণে ধৈর্যচ্যুতি হল যশোধরার। এসে সোফার ওপর গদিয়ান হয়ে বসেছে ছোকরা—ছুকরি, বসে নিজেদের মধ্যে একাক্ষরে প্রায় কথা বলছে। তাঁর ইচ্ছে হচ্ছিল মধুকে ডেকে আনেন। এদের বেয়াদপি দেখান। তারপর দুই বোন মিলে একেবারে দূর করে দেন। একা একা অতটা সাহস হয় না। আজকালকার ছেলে! কখন তেরিয়া কখন মরিয়া!

তোমরা কে বলো তো!

পাবলোর বন্ধু অবভিয়াসলি। আপনি কি পাবলোর মা না মাসি না পিসি না দিদি!

এত কথার উত্তর আমি দিই না। পাবলোকে খুঁজতে ভর সন্ধেবেলা এখানে কেন?

ও যে বলে বাড়িটা ওর সন্ধেবেলার চান করার জায়গা।

কী বলে? বিস্ময়ের আর কুল পান না পাবলোর মা।

বলে বাড়িটার প্রধান ইউটিলিটি হল বাথটব একটা। ছেলেটি হাত ছড়িয়ে দেখায়—এত বড়। খুব মোটা লোকও ধরে যাবে। গড়িয়ে গড়িয়ে চান করতে পারবে।

রাগে গরগর করতে করতে যশোধরা বললেন—গেট আউট। জাস্ট গেট আউট। এক্ষুনি। ওঠো ওঠো। তিনি আঙুল নাচিয়ে নাচিয়ে বলতে লাগলেন।

উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে হতভম্ব ছেলেটি বলল—কী আশ্চর্য রেগে যাচ্ছেন কেন? অত রেগে যাচ্ছেন কেন? রাগ তো আমাদের করবার কথা! পাবলো ইজ দা কালপ্রিট। চুরিটুরি করে এখন লুকিয়ে পড়েছে।

সে তার সঙ্গে বুঝে নাও। এ—বাড়িতে আর এক দণ্ড নয়। যাও, যা—ও।

এই সময়ে মধুমহলের দিকের দরজা খুলে মধুক্ষরা ও তার মেয়ে সম্পৃক্তা ঢোকে।

আরে কার্জন, উন্নি তোরা? ও কী? মাসি? ওরকম ফুঁসছ কেন? দাপাচ্ছ কেন? ওরা আমাদের বন্ধু যে!

কী রকম বন্ধু করেছ যে, সে আমার বাড়ি বয়ে এসে গাল টিপলে দুধ বেরোয় আমাকে মোটা বলে যায়! এত বড় সাহস? বলতে বলতে দেখা গেল যশোধরা ভীষণ টলছেন। শম্পি দৌড়ে এসে মাসিকে ধরে। তার মা আসে। ছেলেমেয়ে দুটিও হাত লাগায়। এবং সবাইকেই প্রায় সঙ্গে নিয়ে যশোধরা ব্যানার্জি নিজের বাইরের ঘরের সোফার ওপর অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান।

মধু দৌড়োতে দৌড়োতে বরফ নিয়ে আসেন। শম্পি ডাক্তারকে কল দেয়, মধু জামাইবাবুকে কল দেন, উন্নি মোবাইলে একটার পর একটা কল করে যায়।—তোরা কেউ পাবলোর নম্বর জানিস? জানলে খবর দিয়ে দে। ওর মা সেন্সলেস হয়ে গেছেন। খুব সিরিয়াস কেস!

এসব ক্ষেত্রে যা হয়ে থাকে, ডাক্তারের আসার আগেই রোগীর জ্ঞান ফিরে আসে। সুবল ডাক্তারবাবু ঢুকে প্রথমেই হৃষ্ট হয়ে হাতে হাত ঘষে বললেন—এই তো চোখ চেয়েছেন।

মধুক্ষরা কণ্ঠে বিষ ঢেলে বললেন—সে তো আপনি সেন্সে আসার সময়টুকু ইচ্ছে করে পার করেই ঢুকলেন সুবুলদা! মোড়ের মাথায় আপনার ডাক্তারখানা, এইটুকু আসতে আধঘণ্টা লাগে? এতক্ষণে অজ্ঞান থাকা মানে তো সিভিয়ার হার্টঅ্যাটাক!

ম্যা—সিভ—যশোধরা ক্লান্ত গলায় বললেন।—যাক মধু, তুই সুবুলদার সঙ্গে ঝগড়া করিসনি। এখন আর ঝগড়া করা মানায় না।

তুই চুপ কর।

ডা. সুবল মিত্রও স্টেথোস্কোপ বার করতে করতে বললেন—আপনি চুপ করুন, পেশেন্টের অত কথা বলা ঠিক নয়। হ্যাঁ জোরে জোরে শ্বাস নিন। জোর পাচ্ছেন না? একটু চেষ্টা করুন, ডাক্তারের সঙ্গে কো—অপারেট করতে হয় ম্যাডাম।

ইতিমধ্যে শম্পি তার দুই বন্ধুকে নিয়ে ঘরের এক কোণে সরে গেছে। খুব উত্তেজিত ভাবে নিচু গলায় কথা বলছে। খুব সম্ভব পেশেন্টকে নিয়ে নয়।

মধুক্ষরা বললেন—ওহে মাসির আদরের বোনঝি, একবার এদিকে এসো। দিদি নেয়ে গেছে, তার জামাকাপড় পালটাতে হবে, নিউমোনিয়া হয়ে যেতে পারে।

ডাক্তার মিহি গলায় বললেন—এরকম কি আগেও হয়েছে!

মধু বললেন—আপনি জানতে পারতেন না, হলে? হাউস ফিজিশিয়ান বলে যে—কোনও এমার্জেন্সিতে আমরা তো আপনাকেই কল দিই।

ব্ল্যাকআউট জিনিসটা ভাল না—ডাক্তার তাড়াতাড়ি বললেন—ইমিডিয়েটলি একটা ই সি জি আর ব্লাড সুগার করানো দরকার।

খসখস করে প্রেসক্রিপশন লেখার কথা। কিন্তু সুবুল ডাক্তার লিখলেন কাঁপা কাঁপা হাতে। মধুক্ষরা মুখার্জির ধমকে বিলক্ষণ ভড়কে গেছেন।

উন্নি নামে মেয়েটি এসে দাঁড়িয়েছিল, কোমরে হাত দিয়ে বেঁকে দাঁড়িয়ে বলল—এরকম ট্রেমেলো কেন? কেসটা কী?

একজন মাসি অজ্ঞান হয়ে পড়ে রয়েছেন আর তুমি আলতু—ফালতু বকছ? মধুক্ষরা ধমকে উঠলেন।

উন্নি পাত্তা দিল না। শম্পির দিকে তাকিয়ে বলল—গলায় ট্রেমেলো হাতে ট্রেমেলো। কেসটা কী রে শম্পি?

শম্পি অবাক হয়ে বলল—কী বকছিস বল দিকি?

এই সময়ে ভিজে জবজবে পেশেন্ট ক্লান্ত গলায় বললেন—ধরেছ ঠিকই, গুড! কেস প্রতাপ—শৈবলিনী।

মিনস?

ওহ তোমরা আবার বঙ্কিমচন্দ্র—টন্দ্র পড়ো না। প্রতাপ শৈবলিনী একটি বাল্যপ্রেমের কেস যা সারাজীবন টানা হয়েছিল। বুঝলে কিছু!

আই সি!—উন্নি চকচকে মুখে বলল।—কেসটা আপনার না ওঁর। সে অপাঙ্গে মধুক্ষরার দিকে চাইল।

আমার কোনও কেস নেই, ফাইল নেই। আমি খোলা পাতা। জীবনের ঝরাপাতা এখন।

ওহ মাসি, মাত্র এক বার দু’সেকেন্ডের জন্যে অজ্ঞান হয়েছ বলে অমনি ঝরাপাতা হয়ে গেলে। তোমরা অ্যাত্ত সেন্টিমেন্টাল না!—শম্পি বকে উঠল।

ডাক্তারবাবু কাঁপা কাঁপা হাতে প্রেসক্রিপশনটা শম্পির দিকে এগিয়ে দিয়ে একরকম পালিয়ে গেলেন।

উন্নি বলল—হাউ সুইট! আমরা এবার চলি!

মানে? বাড়িতে একটা ব্যাটাছেলে নেই, আমার দিদি অজ্ঞান আর তোমরা তোমরা—চলে যেতে চাইছ?—মধুক্ষরা ঝাঁঝিয়ে উঠলেন।

আমি কিন্তু ব্যাটাছেলে নই আন্টি। ব্যাটাছেলে ওই কোণে বসে দাঁতে নখ কেটে যাচ্ছে তখন থেকে, আরেকজন একটু আগেই ভোঁ—কাট্টা হয়ে গেলেন।

তা যদি বলো তুমি ব্যাটাছেলের বাড়া—শুয়ে শুয়ে ‘অজ্ঞান’ দিদিটি বললেন।

চমৎকার। আই টেক ইট অ্যাজ আ কমপ্লিমেন্ট। কিন্তু আমার মনে হয় আপনারা দুই আন্টি নির্ঘাত আঙ্কলদের থেকে বেশি স্মার্ট। কোনও ক্রাইসিসের মোকাবিলা করাটা আপনাদের কাছে কোনও ব্যাপার না। তাই আমি বেশ নিশ্চিন্ত হয়েই যাচ্ছি। পাবলোর কাছে খবরও চলে গেছে। তার মায়ের ফিট সে এসে সামলাক। এটুকু কর্তব্যও যদি না করে তো তার ত্যাজ্যপুত্র হওয়া উচিত। আমার সোজা কথা।

পেশেন্ট এবার জোর গলায় বলে উঠলেন—ফিটটা যে তোমাদের জন্যে হল! সে দায় কে নেবে? মারল একজন, গলায় গামছা দিয়ে টেনে আনা হচ্ছে আরেকজনকে। ভেবেছ যা খুশি বুঝিয়ে যাবে, না?

উন্নি বলল—আই সি, এইভাবেই আপনারা পাবলো ব্যানার্জিকে স্পয়েল করে আসছেন। তাই আজ সে একটা ইরেসপন্সিবল, গুড—ফর—নাথিং—বাঃ। বুঝলাম, তবে আন্টি একটা কথা—আমরা আপনাকে মোটা বলিনি। কিন্তু—সে একটু অর্থপূর্ণ বিরতি দিয়ে বলল—কিন্তু মোটা বললেই যদি আপনার ফিট হয় তা হলে আপনার ও রোগ ভগবানের বাবা এলেও সারাতে পারবে না। পাবলো তো কোন ছার! চলি! উন্নি পত্রপাঠ টকাটক টকাটক করে সদর দরজা খুলে চলে গেল। কোণে বসে থাকা ব্যাটাছেলেটিকে নিয়ে গেল না। তাকে অবশ্য কেউ লক্ষই করছিল না।

ইতিমধ্যে জামাকাপড় পালটাতে যশো ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।

ওরে মধু—আলমারি থেকে নীল—ছাপ কোটাটা নিয়ে আয়। ম্যাচিং ব্লাউজ ওখানেই ঝুলছে। শম্পি, পেটিকোট একটা দেখেশুনে আন বাবা। আলনায় আছে। বলে যশো ফটাশ করে শাড়িটা খুলে ফেললেন। তখন কোণের দিক থেকে একটা ভীত গলা শোনা গেল—আমি আছি, আমি আছি।

তিনটে মাথাই একসঙ্গে কোণের দিকে ঘুরে গেল।

মধুক্ষরা বললেন—এই যে ক্যানিং, ইয়ারকি পেয়েছ! হাইলি সাসপিশাস! কোণে বসে বসে কী করছ? ভয়ারিজম? তোমায় পুলিশে দেব।

ক্যানিং নয় মা কার্জন—শম্পি মাকে শুধরে দেয়।

যশো বলেন—ওকে পালাতে দিসনি। আটক কর। আটক কর। শম্পি, ওকে বাথরুমে নিয়ে গিয়ে বন্ধ করে দে।

তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে কার্জন বলল—এই শম্পি। খবরদার বলছি। খবরদার আমার গায়ে হাত দিবি না। বন্ধ করে রাখবি মানে! আমি কি ইচ্ছে করে এখানে বসে আছি!

তবে কোন কর্মে বসে আছ শুনি একঘর লেডিজদের মধ্যে! মধুক্ষরা গর্জন করলেন।

কার্জন বলল আমি পাবলোর জন্যে ওয়েট করছিলুম। সে আমার কিছু দরকারি জিনিস নিয়ে হাপিস করে দিয়েছে। আঙুল তুলে শাসানোর ভঙ্গিতে সে বলল, এখন যাচ্ছি, কিন্তু আমি আবার আসব। পাবলোকে বলে দেবেন।

কার্জন নামে ছেলেটি চলে গেলে যশো শম্পিকে চা করতে পাঠিয়ে দিলেন। শম্পি চলে যাওয়ামাত্র ফিসফিস করে বললেন—এখনও, বুঝলি মধু, সুবুলদা এখনও তোর চক্করে পড়ে আছে।

হ্যাঁ তোমাকে বলেছে! দিব্যি স্ত্রী—পুত্র নিয়ে সুখে ঘর করছে।

তা করুক না। তাতে প্রেম আটকায় না। এ হল বাল্যপ্রেম। অভিশপ্ত। চিরকাল কাঁপাবে।

হ্যাঁ যখন মাসের শেষে মোটকা বিলটা পাঠাবে?

তুই একেবারেই কচিখুকি রয়ে গেলি। বিলের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক কী! ডাক্তার ডাক্তারি করেছে ফি নেওয়া তার কর্তব্য। জীবিকা। জীবিকার জন্যে যা করার করে যাচ্ছে। সবাই কি আর মরতে পারে রে?

তাই বলে শুধু শুধু একগাদা টেস্ট লিখে দেবে।

শুধু শুধু! বলিস কী রে! আটচল্লিশ বছর বয়স হয়ে গেছে, ব্ল্যাকআউট। ভীষণ খারাপ জিনিস!

দিদি, আমাকে ন্যাকা পাওনি, তোমার চালাকি আমি জানি না। অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলে না আরও কিছু। কী মতলবে চোখ বুজে মটকা মেরে ছিলে বলো তো এবার!

ইসস, তুই চিরদিনের ছোট্ট স্নেহের বোনটি হয়ে আমার মধ্যে মতলব দেখছিস! সত্যি বলছি মাথাটা কেমন বাঁই করে ঘুরে গেল। পড়ে যেতে যেতে মনে হল চোখ দুটো প্যাঁট প্যাঁট করে খোলা রাখাটা ঠিক হবে না। দ্যাখ মোটা মানুষ পড়ে গেলে লোকে হাসবেই। কিন্তু যদি অজ্ঞান হয়ে যায়! তখন তো তার হাসতে হচ্ছে না!

এত কথা তুমি ওই ক’সেকেন্ডে ভেবে নিলে! নাঃ, তোমার মাথা বটে একখানা!

শুধু মাথা নয়। চোখ কান সবই আমার খুব দুরস্ত। ওই ক্যানিং না কার্জন নির্ঘাত শম্পির ক্যান্ডিডেট, বিওয়্যার অব হিম। আর পাবলোটা কী হাপিস করেছে বল তো! প্রেমপত্র? ক্যানিংহামের কাছে শম্পির প্রেমপত্র। দু’জনে কীরকম গুজগুজ করছিল দেখেছিলি? শম্পি আর ওই ক্যানিংহোম!

ওহ দিদি, তোমার মাথাটা প্রেম প্রেম করে এক্কেবারে গেছে। ওরা কি পত্র—টত্র লেখে নাকি আর? ওরা চ্যাট করে, ই—মেল পাঠায়, মোবাইলে এস এম এস রাখে।

তা—ও তো বটে!—উদাস হয়ে গেলেন যশো। প্রেমপত্র? আহা সে যে কী জিনিস তা যদি এরা জানত!

.

এইরকম উদাস—উদাস ভাবেই যশো জামাকাপড় বদলালেন, চা খেলেন, ছাড়া জামাকাপড়গুলো জড়ো করে ধোবি—বক্সে দিয়ে দিলেন। শম্পি যখন বিদায় চাইল, সস্নেহে তাকে বিদায় দিলেন। এমনকী মধুক্ষরা পর্যন্ত টেলিফোন এসেছে বলে অপসৃত হলেন, যশোধরা তখনও একই রকম ঘোরে। কালীঘাটের অতিপরিচিত পটের মতো। খালি, হাতে তালপাখার বদলে পেল্লাই এক চায়ের মগ। একটু একটু করে চুমুক দিচ্ছেন আর ডুব দিচ্ছেন। কোথায়? কোন পুকুরে? অতীত পুকুরে, যৌবন পুকুরে। ডুব গালছেন কিন্তু কান চোখ সব খোলা রেখে। ওদিক থেকে খাই মেরে উঠল একটা ধাড়ি কাতলা। একমাত্র বাবরি চুল, মাথাটা বেশ বড়সড়, ফুল—গ্রোন ডাবের মতো। বিজয়মুকুলদা না?

কী চাও বিজয়মুকুলদা?

ইয়ে মানে তুই আজকাল কী করছিস যশো?

কী আবার করব? বি এ পাশ করে বসে আছি।

নাচ ছেড়ে দিয়েছিস?

মা ছাড়িয়ে দিয়েছে। বলেছে এত বড় মেয়েকে আর ধেইধেই করে নাচতে হবে না। কেন তুমি কি ট্রুপ খুলছ?

বিজয়মুকুলদা তার বংশীবাদনের জন্য বিখ্যাত। সামান্য একটু বেসুর হয়ে যায় মাঝে মাঝে। কিন্তু বাঁশের বাঁশির মেঠো সুরটি বার করে চমৎকার।

তুই—ই যদি না থাকিস তো ট্রুপের বক্স—আর্টিস্ট হবে কে?

কাতলা পুকুর তোলপাড় করে ডুবে গেল। যৌবন পুকুরের ঘাটে বসে যশো ভাবেন—ওটা কীসের তাগিদ? ট্রুপ খুলে ব্যাবসার তাগিদ সংস্কৃতির তাগিদ, না… না…বিজয়মুকুলদা আরও কয়েকবার কারণে অকারণে ঘাই মেরেছে। কেন? কেন? কীসের তাগিদে?

আবার ডুব দেন যশোধরা। একেবারে পাতলা রাজ্যে পৌঁছে যান। এখন তিনি আবার ইউনিভার্সিটিতে ভরতি হয়েছেন। আর কী—ই বা করতে পারেন। মা নাচ বন্ধ করে দিয়েছেন, বাবা হকি বন্ধ করে দিয়েছেন। তাঁদের মনোমতো পাত্রও জোটেনি। সুতরাং এম এ পলসায়েন্স। সরু সরু লম্বা লম্বা ওগুলো কী মাছ রে বাবা। ম্যাকারেল নাকি? পুকুরে তো হয় না? তবে এ—পুকুর তোমার সে—পুকুর নয়। যৌবন পুকুর। এখানে সামুদ্রিক মাছের সঙ্গে, ভেড়ির মাছ, পুকুরের মাছ, নদীর মাছ, এমনকী বাহারি লালনীল মাছ পর্যন্ত একই সঙ্গে বিহার করে।

অ্যাই যশো, কাল এসেছিলি?

হুঁ।

তোর খাতাখানা দে তো মাইরি। একটা বিশাল কাজ ছিল, বেজায় খাটুনি আসতে পারিনি।—হালকা দাড়ি গোঁফওয়ালা মুখখানা খরচোখে তাকিয়ে বলে উঠল।

কালকের খাতা আজকে আনিনি।

ইয়ারকি হচ্ছে? বিনুনি সুদ্ধু মুন্ডু ঘুরিয়ে দেব কিন্তু।

যাও খাতা পাবে না।

দে না, মিনতি করছি দ্যাখ, কমলেশ সিনহা মিনতি করছে তোকে। ভাবতে পারছিস!

না খাতাটা সে দেয়নি। সত্যিই খাতাটা ছিল না। আরেক বার কমলেশ তার খাতা নিয়ে হাপিস করে দিয়েছিল। এখন সন্দেহ হয়, নোটস নয়, খাতাটা, জাস্ট যশোর খাতাটার জন্যেই কমলেশের আকিঞ্চন ছিল। হাপিস খাতাটাও আসলে হাপিস হয়নি। কমলেশের নিজ ডেস্কে রক্ষিত আছে সযত্নে। দ্বিতীয় না—দেওয়া খাতাটা যশো মনে মনে ফেরত পায়। মনে মনে খুলে দেখে পলসায়েন্সের অকিঞ্চিৎকর ক্লাস নোটসের পাশে পাশে মার্জিনে লেখা। কী লেখা? যশো, যশোধরা, আমি তোকে মানে ইয়ে, বুঝিস না কেন? কে এসব খাস্তাগজা নোটস চায় রে? কমলেশ চায় তোর হাতের লেখা, তোর হাতের ছোঁয়া, তোকে, মানে তোকে।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন যশো। এটাও মিস। কে এমন নাছোড়বান্দা প্রেমিক আছে জগতে যে, তুমি না বুঝলেও তোমাকে বোঝানোর জন্যে অনন্তকাল অপেক্ষা করবে! হে প্রেমের ভগবান রতিকান্ত, যশোকে এত বোকা করলে কেন?

একমাত্র রামলাখন অপেক্ষা করেছিল। রামলাখন তাদের স্কুলের দারোয়ানের ছেলে। সে—ও পড়াশোনা করত বিস্তর, কিন্তু জিভের আড় ভাঙেনি।

এ যশোধরা, এ খোঁখি।

উঃ, কী বলছ? আমি কি এখনও খুকি আছি।

না রে যশোধরা, তোকে দেখলেই আমাদের ধউলি গাইটার কথা মনে পড়ে যায়। মুলুকে ফেলে এসেছি।

যশো সঙ্গে সঙ্গে অ্যাবাউট—টার্ন। রামলাখন পেছন পেছন আসতে থাকে। সবে বকনাবাছুর থেকে জওয়ান হয়ে উঠেছে। কী চিকন গা, দুধসফেদ, আঁখ কী! মালুম হয় কি তোদের মতো কাজল দিয়েছে আঁখে। লেজের বালগুলো ঠিক তোর এই বিনুনির শেষে ছাড়া বালগুলোর মতো যশো। যশো, তোকে ঠিক হামি বহুত পেয়ার করি। তুই আমার ধউলি, আমি তোর মার্তণ্ড। ধউলি, আরে যশো শোন শোন।

একটা কথাও শুনব না। তুমি আমাকে গোরুর সঙ্গে তুলনা করছ? সাহস তো কম নয়।

আরে!—একটা অবাক বাজখাঁই আওয়াজ দিল রামলাখন।

আরে ভঁইস নয়, লেকেন গাই তো দুনিয়া কি সবসে আচ্ছি চিজ হ্যায় রে। তার ওপর ধউলি সবসে খুবসুরত।

এরপরে তার বিরক্তি বুঝে রামলাখন ধউলির তুলনা ত্যাগ করেছিল। পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিল সে যশোর প্রেমে পড়েছে। তার বাবা স্কুলের দারোয়ান হতে পারে। কিন্তু ভাগলপুরে তাদের মস্ত বড় ফার্ম। দুধের ব্যবসায় তারা সেখানকার তিন নম্বর। সে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ছে। ফার্ম মডার্নাইজ করবে, ভাগলপুরে গঙ্গার ধারে বেস্ট জায়গায় মকান বানাবে। তত দিনে বাংলা জবান শিখে যাবে জরুর। যশোধরার সঙ্গে তার বাংলাতেই প্যার কি বাত হবে।

দ্য ওনলি ওয়ান। যশোর মরুভূমিতুল্য প্রেমহীন জীবনে রামলাখনই একমাত্র জেনুইন প্রেমিক। সে জাত, শ্রেণি, প্রদেশ, সব বাধা ত্যাগ করেছিল। পরিষ্কার মনের কথা জানিয়েছিল যশোকে। দেখতেও রামলাখনকে খুব ভাল ছিল। ফরসা, ব্যায়াম করা—লম্বা চওড়া অথচ অতি সুকুমার চেহারা। মুখখানা নিষ্পাপ। দেখলেই চুমু খেতে ইচ্ছে করে। যদিও খোকন হিসেবে।

এবার অতীতের কল্পনাপুকুর থেকে অতীতেরই বাস্তব ঘাটে ওঠেন যশোধরা। হেঁটে হেঁটে ঢোকেন বাস্তবের ড্রয়িংরুমে। চার দিকে ঢাউস সোফাকৌচ। কোন কালের একখানা কার্পেট ডাঙায় কুমিরের মতো ঘাপটি মেরে শুয়ে আছে। দেয়ালে দেয়ালে ঠাকুমা—ঠাকুরদাদের অয়েল পেন্টিং। মহারানি ভিক্টোরিয়ার একখানা আর বর্তমান রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের একখানা ছবিও আছে। যখনই কোনও অতিথি আসে যশোধরা, মধুক্ষরা, তাদের বাবা, মা সবাই কৈফিয়ত গাইতে থাকেন জাস্ট শিল্পমূল্য, ছবিমূল্যের জন্যেই ছবিগুলো আছে। এর মধ্যে কোনও কলোনি—মনোবৃত্তি কেউ যেন না খোঁজে। যাই হোক, সেই বৈঠকখানার কোণের দিকে তেপায়ায় একটি মার্বলের বাচ্চা ছেলের মূর্তি, বল হাতে চমৎকার ভঙ্গিতে আধা পেছন ফিরেছে। আরেক কোণে চোঙঅলা গ্রামোফোন।

এই ঘরে ঢুকেই মুখোমুখি তিনটি তরুণের সামনে পড়ে গেল যশো। একটি ধলো একটি কালো আরেকটি বাদামি। তার দিকে পেছন ফিরে দুটি বিনুনি। মাঝে ঘাড়, তার তলায় ছিটের কামিজের পেছন। মধু বসে বসে হাসছে, কথা বলছে, দৌড়ে ভেতরে চলে যাচ্ছে, ট্রে—তে করে চা নিয়ে এল।

এই তোরা চা খাবি তো?

খাবে না মানে? যশো মনে মনে বলে—ওদের ঘাড় খাবে। মধুক্ষরা চাটুজ্যের হাতে করে আনা চা বলে কথা!

এই আমার দিদি। দিদি, দ্যাখ একটা তরুণ।

যশো মনে মনে বলে—সে তো দেখতেই পাচ্ছি। মুখে বলে ও, তরুণ বুঝি? আমি তো ভেবেছিলুম বৃদ্ধ।—তার এই রসিকতায় ফরসা ছেলেটির মুখ হাঁড়ি হয়ে যায়। প্রেম মানুষকে বড্ড রসকষহীন করে দেয়। বোকা, ভ্যাদভেদে মার্কা।

কীসে আমাকে বৃদ্ধ দেখলেন? রোজ ব্যায়াম করি তা জানেন?

যশো হেসে বলে—মাসকুল আছে? গুলি?

পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে ছেলেটি প্রাণপণে মাসল ফোলাবার চেষ্টা করে।

যশো বিচ্ছুর মতো হাসে—লুচি ফুলল না তো! বুঁচি, তোর অন্য বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দে।

এ হল কৃষ্ণেন্দু।

সেটিও মালুম হচ্ছে—ফ্যাক ফ্যাক করে হাসে যশো—এ যেন বেড়াল এঁকে দাগিয়ে দেওয়া।

এ—ছেলেটির একটু রসবোধ আছে, বললে—আরে সত্যি বেড়াল হবে তবে তো দাগাবে দিদিভাই। কৃষ্ণ আবার ইন্দু কী?

কেন অমাবস্যার চাঁদ?

উঁহু যে—জিনিস দেখাই যাচ্ছে না তাকে কোনওভাবে ডিফাইন করা চলবে না। বাড়িতে ভরতি ইন্দু, পুষ্পেন্দু, কমলেন্দু, অমলেন্দু, শরদিন্দু,…তাই অবশেষে কৃষ্ণেন্দু।

শুধু কৃষ্ণ রাখলেই হত, দিব্যি কদমগাছের তলায় তিনবেঁকা হয়ে দাঁড়ানো যেত।

ততক্ষণে মধু দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়াচ্ছে।—আহ দিদি, কী হচ্ছে?

না না বলতে দাও না। বেশ জমেছে। আজকাল আর তিনবেঁকা হয়ে দাঁড়ালে হয় না দিদি। ডেজ হ্যাভ চেঞ্জড। এখন সটান বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে হয়। বাঁশির বদলে হাতে স্টেনগান, নেহাত না জুটলে চপার।

আচ্ছা আচ্ছা, অনেক হয়েছে মধু বলল—ওর সঙ্গে পরিচয় করবি না, ওর নাম মিহিরকিরণ।

আন্দাজ করতে পারনেনি তো!—দাঁত বার করে বাদামি ক্যান্ডিডেট বলল—

যশো বলল—যেই কথা বললে অমনি ধরা পড়ে গেলে ভাই। মিহি মিহি গলা। ওইটুকু তো অন্তত মিলল। মিহি—র কিরণ!

বলে যশো অন্দরের দিকে পা বাড়ায়। পরে মধু এসে দিদিকে এই মারে তো সেই মারে। তুই ওদের সামনে আমার ডাকনাম ধরলি কেন, কে তোকে বুঁচি বলে ডাকতে বলেছিল! ঠাকুমা ছাড়া কেউ তো ও নামে ডাকেই না। তুই নিজে ডাকিস! তোর চালাকি আমি বুঝি না?

দিদি বলে—আরে বাবা বুঁচি বললেই কি আর তুই বুঁচি হয়ে গেলি? তোর এমন বাঁশির মতো নাক!

বিচ্ছিরি নাম। কেউ লোকের সামনে বলে? মান রইল না।

কী যে বলিস মধু, মধু বললেই কি তোর মান থাকত? মধু কাদের নাম হয় বল তো? অনেক দিনের পুরনো কাজের লোকেদের। ম্যয়নে চাকর রাখো জি! মধো, মেধো—বাবুরা ডাকত।

ভাল হবে না দিদি, আমিও তোকে যশো বলে পরিচয় করিয়ে দেব। যশোও কাজের লোকদের নাম হয়। বাসন মাজার যশো।

অম্লান বদনে সে বলে—তো বল না। আই ডোন্ট মাইন্ড।

আসল কথা কাদের কাছে পরিচয় করিয়ে দেবে! তার এমন বাইরে ঘরভরতি ক্যান্ডিডেটই নেই। দ্বিতীয় কথা—বিশ্বসুদ্ধু লোক তাকেই ইতিমধ্যেই যশো বলে ডাকে। এক রামলাখনই সমীহ করে যশোধরা বলেছিল।

মা—আ—আ—ওদিক থেকে ভাঙা গলায় একটা ডাক উঠল এই সময়ে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *