২
বসন্ত বলে ইদানীং আর কিছু নেই। রোদে ফেব্রুয়ারির শেষ থেকেই লঙ্কার ঝাঁঝ আর ঘাম। সেই সঙ্গে হাঁসফাঁস করো। প্রাণ বেরিয়ে যায় একেবারে। মধুক্ষরা মুখার্জি যশোধরা ব্যানার্জিকে বললেন—কী রে, মার্চ এপ্রিল কি এখানেই পচব আমরা? শহর তো নয় এ যেন সাহারা—কালাহারি। এইবেলা ব্যবস্থা না করলে এপ্রিলের শেষে বেরোনো যাবে?
কর্তার ইচ্ছায় কর্ম! যশো হাত উলটে বললেন।
মানে? তুই বলতে চাইছিস সুহৃৎদা তোর কথায় ওঠেবসে না!
দ্যাখ মধু, তুই খুব ভাল করেই জানিস আমার কথায় কেউ ওঠেবসে না। শুধু তোর সুহৃৎদা কেন? সুহৃৎদার ছেলে, ছেলের মাসি, মাসির মেয়ে, সেই মেয়ের বাবা কারও ওপর যশোধরা বাঁড়ুজ্যের কোনও ইনফ্লুয়েন্স নেই।
তাই বলে তুই এই স্কোয়াডে আমাকেও ইনক্লুড করবি?
তো কী? তুই—ই বল না, তুই আমার একটা কথা শুনিস, রাখিস? তোকে বলেছিলুম হকি না খেলে নাচ প্র্যাকটিস কর, করেছিলি?
বলিস কী রে? সে যে আমার ১৩/১৪ বছর বয়সের কথা! সেই কথা এখন তুলছিস!
যশোধরা এসব কানেই নিলেন না, বললেন—তোর কাছ থেকে একটা, একটা মাত্র তিলের নাড়ু চেয়েছিলুম আর আমসত্ত্বর ছেঁড়া কোণ, দিয়েছিলি?
মধু হাঁ করে দিদির অভিমানাহত থমথমে মুখের দিকে চেয়ে থাকেন। কেননা দিদি আরও পিছিয়ে গেছে।
আমার পিচকিরিটা কাজ করছিল না। তোরটা একবার মাত্র চেয়েছিলুম, ব্যাঙাদাকে রং স্প্রে করব বলে, ধার শুধু, কয়েক সেকেন্ডের জন্যে। ব্যাঙাদা পাস করে গেল, মুখ তুলে আমাদের যথারীতি ভেঙিয়ে গেল—’এই যে দুষ্টু সরস্বতী, এইবারে ছিলি খুলেছে। বাঁদুরে রংটা কে মাখালে? তার বেশ রসজ্ঞান আছে দেখছি!’ তোর মনে না থাকতে পারে, আমার মনে দগদগে হয়ে জেগে আছে। শুধু একটি পিচকারি—ব্যাটাকে নাইয়ে দিতুম—দিলি না।
সে তো ভালই হয়েছে রে! তখন ব্যাঙাদাকে পিচকিরি আবির গুলাল ছোড়ার কী মানে হত বল তো!—এতক্ষণে ভাষা খুঁজে পায় মধুক্ষরা—মানে হত ব্যাঙাদার প্রেমপত্তরের উত্তর দেওয়া। ব্যস লেগে যেত তাক ধুম ধুম, তুই ব্যাঙাদার সঙ্গে গঙ্গার হাওয়া খেতে যাচ্ছিস, ভাবতে পারছিস দিদি?
যশো কোমরে আঁচল গুঁজে নেয়—মানে? মানে? প্রেমপত্তর আবির গুলাল, গঙ্গার ধারে হাওয়া খাওয়া—এ সব কী? মাথায় এল কী করে?
ব্যাঙাদার ওই সব চ্যাটাং চ্যটাং কথার আসল মানে যে পিরিত সে তো আমি তখনই বুঝতুম। তুইও নিশ্চয় বুঝতিস। তোর নিশ্চয় ব্যাঙাদের সঙ্গে ভিড়ে যাবার মতলব ছিল না! কী রে কিছু বলছিস না যে বড়?
যশোধরা ফোঁস করে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন—তুই যে বরাবর আমার শত্রুতা করে যাচ্ছিস তা টের পেয়েও কেন যে পেলুম না এটাই বিস্ময়।
মানে?
দেখ, আমি বুঝতে পারিনি, পারিনি, তুই আমাকে বোঝাতে পারতিস ব্যাঙাদার প্রেমের কথাটা।
বুঝে কী করতিস?
সান্ত্বনা। সান্ত্বনা পুরস্কার। তোর তখন এক বাইরে ঘর ভরতি প্রেমিক। আমারও একটা আছে—চ্যাঙা হোক ব্যাঙা হোক, এই সান্ত্বনা। আর কী! যশো বিয়ের পিঁড়িতে বসছে অথচ পাড়া বেপাড়ায় কারও বুক ফেটে যাচ্ছে না, কেউ সন্ন্যাসী হওয়ার কথা ভাবছে না, এ যে কত বড় কলঙ্ক একটা মেয়ের পক্ষে তা তুই ভাবতে পারছিস! আমার সে জোর কই, কনফিডেন্স কই যে, তোর সুহৃৎদাকে ওঠাব বসাব?
কলঙ্ক কীসের? কার কেচ্ছা হচ্ছে! বলতে বলতে এই সময়ে পাবলো ঢুকল।—কে আমার বাবাকে ওঠবোস করাতে চায়!
তোর মাসি—বলে যশোধরা বন্দ্যোপাধ্যায় সরে পড়লেন।
বছর দশ বয়স থেকে পাবলো বাড়ির ব্যাপারে উদাসীন হয়ে গেছে। বাবা কোথায় গেছে, মা কী করছে, কার মন খারাপ, কেন কার মন ভাল তাই—ই বা কেন…এ সব পাবলো ভাবে না। বাড়িটাতে সে পরম আরামে বাস করে, চমৎকার খাওয়া—দাওয়া করে। এদিকে বাবা—মা ওদিকে মাসি—মেসো যে সামনে পড়ে তার সঙ্গেই কথাবার্তা বলে। কেউ দেখলে বা দু’দিন বাস করলে বুঝবে না যে পাবলো আলগা হয়ে বাড়ির বোঁটাটিতে ঝুলছে। কিন্তু প্রকৃত সংবাদ হল এই যে, পাবলোর একটি বিশাল বন্ধুকুল আছে। তার মনপ্রাণ সেই বন্ধুদের কাছেই গচ্ছিত আছে। বাড়িতে সে যা বলে তা হল কাজের কথা—পাজামাটা কোথায়? জিনসটা কাচতে দিয়েছে কে? বারবার বলেছি না আমার জিনিসে হাত দেবে না! বাঃ আজ পরোটা মাংস? চমৎকার মেনু করেছ মাম্মি। তোমার হবে। হ্যাঁ বাবা, পড়াশোনা ভাল হচ্ছে। কিন্তু এগুলো ওই কথার পিঠে কথা। আসল গুরুত্বপূর্ণ কথাবার্তার জন্যে আছে রোহন, পঙ্কজ, আমন, উন্নীতা, বল্লী ইত্যাদি ইত্যাদি। তার মাসতুতো বোন সম্পৃক্তা বা শম্পিও এই বন্ধুকুলের মধ্যে পড়ে। আছে ফুটবলার আরমান, এবং পরিধির কাছে যারা ঘোরাফেরা করছে তাদের মধ্যে রয়েছে মধুবন।
স্কুলের পর পাবলো বাড়িতে একবার ঢুঁ মেরেছে প্রধানত একটু চান করে নেবার জন্যে। এবং গৌণত নিয়মরক্ষার জন্যে। তার মা যশোধরা ভীষণ রক্ষণশীল, ঘোর নিয়মবাদী। ছেলে বিকেলবেলায় বাড়িতে না ঢুকলে মায়ের ফিটটিট হতে পারে, আর তা যদি না হয় তো পাবলোরই ফিটটা হবে, কেননা মা পাবলোকে খেতে শুতে চান করতে তিষ্ঠোতে দেবে না। বকেই যাবে, বকেই যাবে। পাবলো অশান্তি পছন্দ করে না। সে বিদ্রোহী। কিন্তু নীরব গোত্রের।
মধুমাসি অমনি সাতখানা করে বলতে বসল—দেখ না দিদিকে বকছিলুম ঠান্ডা কোথাও ঘুরে আসি, তা তোরা সবাই, ইনক্লুডিং সুহৃৎদা যে দিদির কত অবাধ্য সেই পুঁটলি খুলে বসল। এই গরমে টেকা যায়, তুই—ই বল।
পাবলো হাঁ করে মাসির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বলল—আচ্ছা মাসি, তোমার ওজন তো বেশি নয়!
আমার ওজন? ওজনের কথা উঠছে কেন?
না, ধরো ঊনষাট—ষাট ওজন এমন কিছু বেশি নয়। তাই না?
অ্যাঁ?
তোমার তার বেশি হবে না। অবশ্য ঊনআশি—টাশি হবে।
মোটেই না। দিদি বড়জোড় পঁচাত্তর হবে। বাজে বকিসনি।
কথাটা তা না। কথাটা হচ্ছে চর্বির লেপ যার গায়ে যত বেশি তার গরমও তত বেশি। এখন মাসি, তোমাদের এই পিতৃভবনের কথা ধরো। এটিতে কুড়ি ইঞ্চির দেয়াল। পনেরো ফুটের হাইট। গরম তোমাদের লাগে কী করে? রোদ তো দাঁত ফোটাতে পারছে না তোমাদের বাড়ির ইনসাইডে। সন্ধেবেলা পেল্লাই পেল্লাই জানলাগুলো খুলে দিলে দক্ষিণ সমুদ্দুরের হাওয়া হু হু করে বয়ে যেতে থাকে। যাবে পঙ্কজদের বাড়িতে?
কে পঙ্কজ? তার বাড়ি আমি যেতে যাব কেন? আচ্ছা তো!
উঃ, যেতে বলছি না। কমপেয়ার করছি। ওদের টপ ফ্লোরের ফ্ল্যাটে এসি চলছে গদাম গদাম করে, কিন্তু নো ঠান্ডা, নো রিলিফ। পঙ্কজের মা একখানা মসলিনের না কীসের সি—থ্রু নাইটি পরে ঘোরেন।
পাবলো! অসভ্যতা হচ্ছে!
বা রে, অসভ্যতাটা কি আমি করছি? ভেবে দেখতে গেলে পঙ্কজের মাকেও দোষী করা যায় না। তাঁকেও তো টিকতে হবে রে বাবা! আমাদের মতো তো আর শর্টস পরে, খালি গায়ে বসে থাকতে পারেন না! পারেন? কিন্তু তোমাদের কেস আলাদা। এইরকম ন্যাচার্যালি এয়ার কন্ডিশনড আর্কিটেকচার এখন অর বেশি নেই। তা—ও তোমাদের যখন এত গরম হচ্ছে, মনে হচ্ছে প্রবলেমটা অন্য কোথাও। প্রেশার মাপিয়েছ?
চুপ কর।
আহা রাগ করো কেন? মেসোর কি আরও টাকা হয়েছে?
ভাল হবে না বলছি পাবলো।
কী আশ্চর্য। আমি মাওবাদী নই যে, মেসোর টাকায় আপত্তি করব। গরমটা টাকার কি না সেটাই বুঝতে কথাটা তোমায় জিজ্ঞেস করলুম।
পাবলো আর দাঁড়াল না। তিন লাফে দোতলার সিঁড়ি টপকে বাথরুমের দিকে রওনা দিল।
আর্কিটেকচারের সঙ্গে সঙ্গে এই বাড়ির মেজাজমর্জি সাজসজ্জা সবই জমিদারি। বাথরুমটাই একখানা ঘরের মতো। তাতে পেল্লায় এক বাথটব। অনেক দিনের পুরনো। প্রচুর যত্ন সত্ত্বেও তাতে সামান্য একটু হলদেটে ভাব এসেছে, কিছু কিছু চিড় খাওয়া জায়গার ওপর পট্টি লাগানো হয়েছে। কিন্তু তাতে কী! বাথটবটাতে পাবলো তার পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি লম্বাই ছড়িয়ে আরামসে চান করে আর চান করে।
পাবলিক প্রসিকিউটরকে সংক্ষেপে কী বলে? পি পি। কিন্তু পি পি—র প্রচলিত মানে হচ্ছে পাবলো—পঙ্কজ। জুটিটি অবিচ্ছেদ্য বলে বিখ্যাত। কিন্তু ইদানীং এদের মধ্যে একটা ডিফারেন্স দেখা যাচ্ছে। পঙ্কজের ইচ্ছে সে স্টেটস—এ যাবে। পাবলো স্টেটসকে ঘৃণা করে। কেন? বুশ—এর জন্যে? ইরাক—আফগানিস্তানের ওপর বুশী হামলার জন্যে? না। একেবারেই না। কে কোথায় কার ওপর হামলা করছে সে সব নিয়ে ঘেন্না—পিত্তি থাকলে তো আর এ—পৃথিবীতে টেকা যাবে না। গুড বাই জানিয়ে বেহেস্ত—জাহান্নম যে—দিকে হোক কেটে পড়তে হবে। আসলে বড্ড কমন, ভালগার হয়ে গেছে। তবে কি পাবলো অস্ট্রেলিয়া যেতে চায়? আজকাল লোকে খুব অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছে। হাজার হাজার ডলার খরচ করে ক্যানবেরা সিডনির ইউনিভার্সিটিতে পড়তে যাচ্ছে। আর ফিরছে না। অস্ট্রেলিয়া পৃথিবীর তৃতীয় মেল্টিং স্পট হতে যাচ্ছে। প্রথমটা রবীন্দ্রনাথ নামে গুরুদেব ভদ্রলোকটি দাগিয়ে গিয়েছিলেন—’শক হুন দল পাঠান মোগল এক দেহে হল লীন।’ দ্বিতীয়টি অবশ্যই আমেরিকা। বিশ্বসুদ্ধু সায়েন্টিস্ট জড়ো করে অ্যাটম বোমা বানাল, বলল আমেরিকার উদভাবন। ভাল বাবা কর। তৃতীয় মেল্টিং স্পট হতে চলেছে অস্ট্রেলিয়া। একরের পর একর খালি জমি পড়ে রয়েছে সেখানে। ভারত স্বাধীন হবার পর দলে দলে অ্যাংলো ইন্ডিয়ানরা অস্ট্রেলিয়া পাড়ি দেন, বিকল্প হোম।
আর এখন অস্ট্রেলিয়া তার খালি জমি, চাষবাস, খামার—টামার, ক্রিকেট—টিকেট, বিশ্ববিদ্যালয়—টয় নিয়ে ডাক পাঠাচ্ছে দিকে দিকে। এসো, এসো আমাকে ধনী করো, যেমন করেছ আমেরিকাকে। লোকে যাচ্ছেও, খুশিতে যাচ্ছে। খুশিতে থেকে যাচ্ছে। কিন্তু পাবলো অস্ট্রেলিয়াতেও যেতে চায় না। উঃ পাবলো যে কী চায়! সে ম্যানেজমেন্ট পড়বে না। ডাক্তার হবে না। ইঞ্জিনিয়ার হবে না। আর্টিস্ট হবে না। তবে পাবলো কী হতে চায়! পঙ্কজ ধুধুরিয়ার আইকন হচ্ছে বিল গেটস। সে আই টি—তে যাবে, ছুঁচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরোবে। প্রথমে বি পি—ও জয়েন করবে একটা কেননা তার এগ্রিগেট রেজাল্ট তেমন সুবিধের হচ্ছে না। সে যাই হোক সে ক্রমে ক্রমে ঊধের্ব উঠবে, বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিংয়ের জন্যে যা যা থাকা দরকার পঙ্কজ ধুধুরিয়ার সে সবই আছে। স্মার্টনেস, চটপট চিটিরপিটির কথা বলবার ক্ষমতা, অ্যালার্টনেস যাকে বলে। কম্পিউটারের বেসিকস তো সে কবেই জেনে গেছে। সে বি এস সি—টা করবে, তার পরে বি পি ও, তার পরে সিলিকন ভ্যালি স্ট্রেট। বাড়িতে গোড়ায় গোড়ায় টাকা পাঠাবে। তারপর প্রথমে ভাইকে তারপরে বাবা—মাকে ওখানে নিয়ে গিয়ে ফেলবে। এবং যদি ম্যানেজ করতে পারে তো নিয়ে যাবে বল্লীকে বল্লী ধুধুরিয়া করে। মুশকিল হচ্ছে বল্লী ঠাকুর হচ্ছে অতি ধুরন্ধর মেয়ে। পঙ্কজ যদি চলে ডালে ডালে তো বল্লী চলে পাতায় পাতায়। এবং বল্লী ঠাকুরকে ন্যাশন্যালিস্ট পোকায় কেটেছে। বল্লী মনে করে, সে না থাকলে ভারতবর্ষকে আর দেখবার কেউ থাকবে না। তাই সে স্টেটস অস্ট্রেলিয়া তো কোন ছার, হাতের কাছে মায়ানমার কি চায়না পর্যন্ত যেতে চায় না।
এখন বন্ধু মহলে পি—পি বলতে যেমন পঙ্কজ পাবলো বোঝায় তেমন পি বি এক্স বলতে টেলিফোনের প্রাইভেট বক্স এক্সচেঞ্জ বোঝায় না। বোঝায় বল্লী কমন ফ্যাক্টর কিন্তু পি—টি কোন পি? পাবলো? না পঙ্কজ? সেইজন্যেই শেষে এক্সটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। কোন পি সেটা পি—রাও জানে না, বল্লীও জানে কি না সন্দেহ আছে। এই নিয়ে একটা সূক্ষ্ম টেনশন যে তাদের মধ্যে নেই তা নয়। কিন্তু কোনও মনোমালিন্য এখনও নেই।
পাবলোর কম্পিউটার—সম্পর্কিত চাকরির ওপর ভীষণ ঘেন্না। প্রচুর মাল ছাড়ে কোম্পানিগুলো তারপর তোমাকে স্রেফ কিনে নেয়। কারও ক্রীতদাস হবার সাধ পাবলোর নেই। তার বাবা সুহৃৎ বন্দ্যোপাধ্যায় তার খাটুনিটা খেটে দিচ্ছেন, বাবার এক ছেলে সে, আর্থিক দিক থেকে যাকে বলে সাউন্ড। টাকার জন্যে দাসত্ব করার মতো গাঁইয়ামি করবার পাত্র পাবলো নয়। তবে সে কী করবে? ক’দিন পরই আই এস সি পরীক্ষা। তার মধ্যেই ঠিক করে ফেলতে হবে। বাবা জিজ্ঞেস করছে, মধুবন পর্যন্ত জিজ্ঞেস করছে।
কী রে পাবলো, কী ঠিক করছিস?
কোনও একটা নির্দিষ্ট দিন থেকে পাবলোর মাসতুতো বোন মধুবন কেমন একটু তেতো, তির্যক, বিদ্রূপাত্মক হয়ে উঠেছে। এটা একটা ডেফিনিট চেঞ্জ। কেননা মধুবন চিরকাল পাবলোর খুব বন্ধু। মধুবন পাবলোর মায়েরও খুব বন্ধু। হেন জিনিস নেই পৃথিবীতে যা মধুবন আজ অবদি পাবলোর সঙ্গে ভাগ করে নেয়নি। সে চকলেট—ফুচকাই বলো, আর মধুবনের নিগূঢ় প্রেমাকাঙ্ক্ষা, তার নিদারুণ ডিপ্রেশন সে মোটা বলে কেউ তাকে সিরিয়াসলি নেবে না…ইত্যাদি ইত্যাদি সে পাবলোর সঙ্গে যত সহজে আলোচনা করে, শম্পির সঙ্গেও ততটা নয়। যদিও পাবলো মোটেই তার গোপন কথাবার্তার ভাগ মধুবনকে দেয় না। যাই হোক, যে—মধুবন সব সময়েই তার নিজস্ব বন্ধু হয়ে টিকে ছিল, সেই মধুবন হঠাৎ কেমন খামখেয়ালিনী তিক্তা হয়ে উঠেছে।
কী রে পাবলো, কিছু যে বলছিস না! ভ্যারেন্ডা ভাজবি নাকি?
কেন। তুই জেনে কী করবি? তোর এত কৌতূহল কেন?
বাঃ চিরকাল সব আমাকে বলে এসেছিস, হঠাৎ এখন মোস্ট ইম্পর্ট্যান্ট স্টেপটা বলছিস না।
বেশ তো তুই বল না তুই কী করছিস।
আমি তো ভাই বহুত দিন আগে থেকেই বলে দিয়েছি সায়েন্সই পড়ি আর যাই করি শেষ পর্যন্ত আমি ইংলিশ হনস নিয়ে পড়ব, মাস্টার্স করব, তারপর ড্যাংডেঙিয়ে কলেজে পড়াব। মধুবনদি। মধুবনদি, ম্যাডাম, ম্যাডাম বলে ছাত্র—ছাত্রীগুলো ঘিরে ধরবে। এই আমার অ্যাম্বিশন।—হতে পারে ছোটখাটো। কিন্তু আমি জানি আমি কী চাই। তোদের মতো অন্ধকারে ঢিল ছুড়ি না।
বলে মধুবন বেশ কায়দা মেরে চলে গেল। পাবলো এখন বাথটবে গা ডুবিয়ে ভাবছে, সত্যিই সে কী করবে! ছোট থেকে এত কিছু সে করেছে যে, এখন নিজেকে বাঁশবনে ডোম কানা মনে হচ্ছে।
পাবলোর দারুণ ড্রয়িংয়ের হাত বুঝলেন আনন্দবাবু। আপনি যদি ওকে একটু…। যশোদা—মা গদগদ। পাবলোকে ‘বসে আঁকো’—ফাঁকোতে না বসালে চলছে না। ফুল আর্টিস্ট কিন্তু নয়, পার্ট টাইম আর্টিস্ট হতে হবে।
আনন্দ গোস্বামীর কাছে পাবলো আঁকা শিখেছে। ড্রয়িং, স্কেচ, জলরং, তেলরং, ওয়াশ, সবই।
পাবলোর সুরতালজ্ঞান সাংঘাতিক বুঝলে যশো—সুহৃৎবাবুর উক্তি। কেননা পাবলো সব চলতি হিন্দিবাংলা গান গাঁক গাঁক করে গেয়ে দিত। যত ধাঁই ধপাধাপ টাইপ হবে তত ফুরতি। সুতরাং, তাকে নাচের ক্লাসে ভরতি হতে হল। ক্রিয়েটিভ ডান্স। সেই সঙ্গে গানও। জ্ঞানদা তালুকদারের কাছে। গোটা দশেক রাগ সে ভক্তিভরে শিখেছে। বাড়ি ঢোকা থেকে শুরু করে ঘুমোতে যাবার আগে পর্যন্ত গান গুনগুন করে থাকে। এক—এক সময় এক—একটা গান তাকে পেয়ে বসে। এক সময়ে ছিল ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা’—মধুবন একদিন বলল—আর য়ু অ্যান ওল্ডি?
শম্পি বলল—যা বলেছিস! তারপরে সে ধরল ‘ডম ডম ডিগা ডিগা’। মা তাকে শুধু মারতে বাকি রাখত তখন। ‘উফফ পাবলো আমার মাইগ্রেন শুরু হয়ে গেল।’
তুই একটু থামবি?
ইদানীং সে গাইছে ‘আশিক বানায়া’।
ফোটোগ্রাফিতেও দারুণ শখ পাবলোর। পোর্ট্রেট বিশেষ করে। রীতিমতো কালেকশন তার। গোটা তিনেক ক্যামেরা কোডাক, ক্যানন, নাইকন, আলাদা আলাদা লেন্স। ফিল্টার। ডার্করুমের কাজও সে জানে। যেখানে যায়, ক্যামেরাবাবু সঙ্গে যান। ডিজিটাল ক্যামেরায় তার শখ নেই। সে আর্টিস্টিক ছবি তুলতে চায়। ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট পছন্দ করে।
এত গুণ, এত শখ নিয়েও পাবলো বাথটবের মধ্যে স্রেফ লক্ষ্যহীন ভাবে শুয়ে থাকছে। বেশ কিছু দিন। মায়েরটা তবু পাশ কাটানো যায়।—উফ আগে আই এস সি—র ধাক্কাটা সামলাতে দাও! মাথার মধ্যে সব তালগোল পাকিয়ে আছে বুঝলে মাদার?
ব্যস মা গলে জল। মাদার ডাকলেই কি মায়ের নিজেকে মাদার টেরিজা মনে হয়, না গোর্কির মাদার, কে জানে কিন্তু মাদার ডাকে মা খুশি হয়ে যায়—এক্কেবারে পাবলোর পরীক্ষিত সত্য।
বাবাকে পাশ কাটানো অত সোজা নয়। রোববারের মধ্যাহ্নভোজন পর্যন্ত মোটামুটি এড়িয়ে থাকা গেল, তারপর চটি চটাস চটাস করতে করতে সুহৃৎ ব্যানার্জি ঘরের ভেতর ঢুকে আসবেন—পাবলো খাবি না! চল!
ভাত ভেঙেই প্রথম প্রশ্ন—শরীর স্বাস্থ্যটা ঠিক রাখছ তো? ওজন বাড়িয়ে যাওয়াটা কোনও কাজের কথা নয়।
মাতৃদেবীর ঝংকার সঙ্গে সঙ্গে—কেন ওজন বেশি বলে কোন কাজটা আমি হালকা করে করছি? তোমার অসুবিধে হচ্ছে কোনও?
আমাদের নয়। তোমার, অসুবিধেটা তোমার, এই সিম্পল কথাটা না বুঝলে তাকে বলে সিম্পলটন।
থাইরয়েড টেস্ট করাও। বারবার তো বলছি আমার হাইপোথাইরয়েড হয়েছে। চোখের পাতা পড়ে যাচ্ছে। ক্লান্ত লাগে সব সময়ে তা জানো?
ফোন রয়েছে, তুলে দিয়ে জাস্ট একটা কল দাও না অরূপ ল্যাবরেটারিতে।
কেন? আমার অসুখে আমি করব কেন? তোমাদের অসুখের বেলা তো তখন আমাকেই সব করতে হয়। ডাক্তার ডাকা, ওষুধ খাওয়ানো, পথ্য করা—আমার বেলা কেন আলাদা হবে! আমি কাউকে ফোন করব না। চুপচাপ মোটা হতে হতে একদিন ফটাস করে পটল তুলব। তখন দু’হাত তুলে নেচো।
মা হাঁসফাঁস করতে করতে চলে গেল।
ব্যস সুহৃৎ ব্যানার্জির মনোযোগ ছেলে থেকে স্ত্রীর দিকে ঘুরে গেল।—এ হে হে, এটা তো আমার মনে হয়নি। ডাক্তারের কাছেও নিয়ে যাওয়া হয়নি। থাইরয়েডটা—এহে হে…বাবার প্রবল বিবেক দংশন হচ্ছে দেখে পাবলো বলে, ডাক্তার না হলেও হাফ—ডাক্তার দেখেছেন।
হাফ ডাক্তার? বাবার চোখ গোল হয়ে যায়—হাফ ডক্টারস আর ভেরি ভেরি ডেঞ্জারাস পাবুল।
না বাবা। ওই মধুবনের জিম মাস্টার। তাঁর সঙ্গে তো মায়ের খুব ভাব। বিকেলবেলা হাঁটতে তো উনিই মাকে পাঠিয়েছেন। উনিই বলেছেন ডায়েট মানতে হবে।
তা তোর মা কি মানছে না?
পাবলো কাঁধ নাচাল—আমি কী করে বলব। সারাদিন থাকি? একা বাড়ি। কোথাও কেউ নেই। মা কী করছে না করছে, আইসক্রিম খাচ্ছে না রসগোল্লা খাচ্ছে কে দেখতে যাচ্ছে!
তা তুই থাকিস না—ই বা কেন? বাবা মাছভাজা খেতে খেতে নিষ্পাপ চোখে জিজ্ঞেস করে।
বোঝো। একটা আঠারো বছরের ছেলে। সে নাকি মা আইসক্রিম খাচ্ছে কি না নজরদারি করবার জন্যে বাড়ি বসে থাকবে। পারেও বটে এরা।
তুমি থাকো না কেন?
আমি? সুহৃৎবাবুর মাছভাজা খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল।—আমি? হো হো হো! না ভাল বলেছিস পাবুল। আমি, অ্যাঁ?
কতক্ষণ বাবার এই ‘আমি আমি’ বিস্ময় চলবে কে জানে তাই পাবলো বলল—আমার কলেজ নেই? কোচিং নেই? খেলা নেই?
বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আড্ডার কথাটা কেয়ারফুলি বাদ দিয়ে গেলি, কেমন?—বাবা চশমার ফাঁক দিয়ে তার দিকে তাকাল।
ওটা হল অকুপেশন্যাল হ্যাজার্ড। থাকবেই বাবা।
কী বললি? কী হ্যাজার্ড? অকুপেশন্যাল? বলি তোর অকুপেশনটা কী?
স্টুডেন্ট। পড়াশোনা, কলেজ করা—ছবি আঁকা, গান—নাচ, তালিম, সব জায়গায় গোছা গোছা বন্ধু। ও তুমি আটকাতে পারবে না, আমিও পারব না। উঠি বাবা, অনেক কাজ হ্যাঁ?
না না, উঠিস না। হাত ধুয়ে এসে টেলিফোন বুকটা দে, আমার সেলফোনটা টেবিলে আছে এনে দে। এইখানে আমার পাশটিতে দাঁড়িয়ে অরূপ ল্যাবে ফোন কর।
অগত্যা পাবলোকে তাই করতে হয়।
ফোন করে নিয়ে পাবলো বলে—বাবা, জিজ্ঞেস করছে কী টেস্ট?
থাইরয়েড।
থাইরয়েডের কী জিজ্ঞেস করছে।
ওই সব টি এইট এস, টি এইচ ওয়ান টু থ্রি যা আছে সব।
বাবা, ডক্টরের নামটা চাইছে ওরা।
বাবা বললেন,—ডক্টর সুহৃৎ ব্যানার্জি বল।
নির্বিকার মুখে নামটা বলে ফোন অফ করে দিয়ে পাবলো বললে, বাবা, তোমার বিরুদ্ধে এবার কিন্তু কেস হবে।
কেন? আমি কি ডক্টর নই!
তুমি ডক্টর অফ সায়েন্স, ওরা মেডিক্যাল ডক্টর চাইছে।
সে তো বটেই। কিন্তু আমার হল কাজটা চটপট হয়ে যাওয়া নিয়ে কথা, এবং মিথ্যে না বলা নিয়ে কথা—বলে বাবা ‘যশো যশো ইটস ডান, তোমার স্বামী তোমার থাইরয়েড টেস্টের ব্যবস্থা করে দিয়েছে, আর রাগঝাল করে থেকো না। একটু খাওয়া—দাওয়া করো।’—বলতে বলতে চলে গেল।
এই বলছে খায় কি না নজর রাখিস। আবার এই বলছে একটু খাওয়া—দাওয়া করো—এই মা—বাবা জাতীয় লোকগুলোকে পাবলো আজও বুঝে উঠতে পারল না।