যে যেখানে যায় – ১১

১১

বৃষ্টি। বৃষ্টি! বৃষ্টি—দারুণ চাঁদিফাটা গরমে যখন চড়চড় করে প্রথম বৃষ্টির ফোঁটাগুলো পড়েছিল—মুড়কিশোলা গ্রামে মহোৎসব পড়ে গিয়েছিল। সবাই বাইরে বেরিয়ে এসেছে দৌড়ে। বৃষ্টিতে সব সপাটে ভিজছে। গাছপালা দুলছে। পাখিরা সুদ্ধু গাছের ডালে বসে নিশ্চুপ ভিজছে। কোত্থেকে চাট্টি গঙ্গাফড়িং অবধি এসে গেল। এদের সর্বক্ষণের সঙ্গী।

পরি বলল, ঠাকমা, খিচুড়ি চাপাও।

পরির মা বলল—না, না। খিচুড়িতে তুক আছে। বিষ্টি থেমে যাবে। প্রথম দফায় বৃষ্টি তো মাটি শুষে নিল।

তা দ্বিতীয় দফার বৃষ্টিটা নামল একদিন মাঝ রাত্তিরে। মুষলধারে বৃষ্টি সঙ্গে উথালপাথাল ঝড়।

সকালেও অন্ধকার, তুমুল হাওয়া। তুমুল বৃষ্টি। রুস্তম বলল, সাইক্লোনিক বলে মনে হচ্ছে।

কিন্তু বৃষ্টি থামল না। একটু থামছে কি আবার দ্বিগুণ জোরে নামছে। দু’দিন এই রকমই চলল নাগাড়ে।

‘এক ছেলের মা কে আছ গো?’—বিষ্টি মাথায় করে দল বেঁধে একদল মেয়ে এল। এক ছেলের মা কেউ নেই। সবাইকার কোলে কাঁখে। অবশেষে পরির ঠাকুমা বললেন—ওমা, আমিই তো এক ছেলের মা।

কিন্তুক তুমি বেওয়া বটে!

এটাও ঠিক। কী ব্যাপারে? না সধবা এক ছেলের মা ভোরে উঠে বাসি মুখে বাসি কাপড়ে একটি বাটি নিয়ে গাছতলায় পুঁতে দেবে। তা হলেই বৃষ্টি থেমে যাবে। কিন্তু এক ছেলের মা পাওয়াই তো দুষ্কর।—মধুবন বিড়বিড় করে বলল—ইসস যশোমাসি যদি থাকত! কে জানত মুড়কিশোলায় যশোমাসির দরকার পড়বে।

তার তিন দিন পরে আর কারও বাড়ি রান্না হচ্ছে না। কাঠকুটো সব ভিজে গেছে। আগুন জ্বলবে না। দুর্যোগে কেউ বেরোতে পারছে না। জামডুবির মাঠে একজন বজ্রাঘাতে মারা গেল। মুড়ি—চিঁড়ে মুড়কি ফুরিয়ে এল।

রুস্তম বলল—যার বাড়িতে যত কাঠকুটো আছে জড়ো করুন। এক জায়গায় রান্না হবে। সবাই চাল দেবে। যা হবে সবাই খাবে।

তিন—চারটে উনুন জ্বলল। ভাত বসল। প্রথম প্রথম তাতে আধটু একটু আলু—টালু পড়ল, তারপর স্রেফ ফ্যানভাত।

সাতদিন প্রায় অবিশ্রান্ত বৃষ্টির পর দেখা গেল ফণা তুলে জল আসছে। বান বান—চতুর্দিকে রব উঠল। নদী অনেক দূর। চুটকি নদী গন্ধেশ্বরী। কিন্তু নদী তো! তার সঙ্গে কংসাবতীর যোগও বোধহয় আছে। সেই নদী দিয়েই বান ঢুকে পড়েছে খেজুরপটির খালে। খাল উপচে এখন সব ভাসাচ্ছে। এই খালকে একটা আধ—শুকনো নালা ছাড়া কিছু মনে হত না। সে এখন ফুলে ফেঁপে সব ভাসাচ্ছে।

মধুবন ক্ষীণস্বরে বলল, কোথাও থেকে হেলপ আসবে না, দাদা!

কী জানি, বুঝতে পারছি না। স্টেশনে যাব ভাবছি।

না না আমায় ফেলে তুই যাবি না।

ইসস মধুবন, তোকে অনেক আগে বাড়িতে রেখে আসা উচিত ছিল আমার।

তোর বিপদটাও তো বিপদই, নাকি।

রুস্তম বলল—এদের বিপদটাও বিপদ। খরা—বন্যার কথা, আমলাশোল, চা—বাগান, উত্তরবঙ্গের কথা শুনি, পড়ি। দিস ইজ দা ফার্স্ট টাইম উই নো হোয়াট ইট ইজ।

বেশ কিছু পুরুষ এসে রুস্তমকে বলল—চলুন দল বেঁধে যাই কিছু যদি খবরাখবর দেওয়া যায়।

তুই গেলে আমিও যাব—মধুবন গোঁ ধরল।

তুই এমনিই খুব উইক হয়ে গেছিস। চিঁ চিঁ করছিস, পারবি না, তোকে নিয়ে বিপদে পড়ব।

অনেক বুঝিয়েসুজিয়ে তাকে পরির জিম্মা করে জিওলিনের স্টক ধরিয়ে দিয়ে দশ—বারো জনের দলের সঙ্গে রুস্তম বেরিয়ে পড়ল। ভোর—ভোর। জামডুবির মাঠের ওপর দিয়ে জল বইছে। তবে বেশি নয়। বেশিরভাগ জায়গাতেই গোছ—ডোবা জল। রুস্তমের হাতে টর্চ। ভাগ্যিস সে বেশি ব্যাটারি সঙ্গে এনেছিল। অন্যদের হাতে টিমটিমে একটি লণ্ঠন। যখন দরকার হবে জ্বেলে নেবে।

বৃষ্টি পড়ে যাচ্ছে সমানে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি, হঠাৎ দমকাবৃষ্টি। শনশন হাওয়া। তিন ঘণ্টা জল ঠেলে হেঁটে স্টেশনে পড়ল ওরা। যত দূর দেখা যায় জল শুধু জল। লাইন জলের তলায়। স্টেশন মাস্টারের ঘর ফাঁকা। কোয়াটার্স ফাঁকা। তালা দেওয়া। চলো পরের স্টেশন পর্যন্ত। রাস্তায় বড় বড় গর্ত। পা পড়লে আর দেখতে হচ্ছে না। জনার্দন বলল, চলো আমরা হাইরোডে উঠি গিয়ে। বাঁকড়ো ঘুর হবে। কিন্তু পথে ট্রাক পাওয়া যেতে পারে।

বিকেল নাগাদ কী ভাগ্য একটা ট্রাক আসছে দেখা গেল। সবাই মিলে জলভরা রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে ট্রাক থামায়।

আপনারা ফিরে যান, আমি এই ট্রাকে গিয়ে দেখি কত দূরে যাওয়া যায়। খবর দিতে হবে। কিছু খাবারদাবার চাই। গ্লুকোজ চাই।

জনার্দন বলল—তা হবে না শহুরেবাবু, আমাদের বিপদে ফেলে তুমি পালাবে।

কী আশ্চর্য! পালাব কেন? আমার বোন রয়েছে না আপনাদের কাছে!

পেটের খিদের কাছে ভাইবোন কেউ নয়—একজন হিংস্রভাবে বলল।

ঠিক আছে আর একজন আমার সঙ্গে আসুক। তা হলে হবে তো!—সুতরাং মাধব সামন্ত চলল।

সকাল থেকেই সন্ধে, সন্ধে থেকেই রাত এখন। অন্ধকার কুপকুপ করছে। ঝিঁঝি আর ব্যাঙের চিৎকারে কান পাতা যায় না। পরিদের ঘর একটু উঁচুর দিকে, তাতেও সব তক্তপোশে উঠে বসেছে।

হঠাৎ একটা হল্লা মতো শোনা গেল। অনেক লোক যেন চিৎকার করতে করতে আসছে। দেখতে দেখতে পরিদের ঘরের সামনে একদল মারমুখো মেয়েপুরুষ এসে দাঁড়াল। চেঁচাচ্ছে—আমাদের বাচ্চাগুলো পটাপট মরে যাচ্ছে। আজ সিকন্দরকে মাটি দিয়ে এলুম। গতকাল যুগলো গেল। তোদের ঘরের ওই কটা ডাইনিটাকে বার করে দে। কালবিষ্টি আর বান নিয়ে এয়েচে। দে ওকে বার করে। ডাইনি নিকেশ করে তবে শান্তি স্বস্ত্যেন করব—অনেক গলা। এ একটা বলছে তো ও আর একটা বলছে। সব ছাপিয়ে খ্যানখ্যান করে উঠল ঠাকমাবুড়ির শান দেওয়া গলা। হাঁটু জল ভেঙে উঠোনে দাঁড়িয়ে চেঁচাচ্ছে বুড়ি।—কার এত বড় বুকের পাটা? এগিয়ে আয় সামনে। ওদের আনা লজেন, বিস্কুট, চাল, চিনি খেতে মনে ছিল না? ওই যে ছাওয়ালটা দুযযুগ মাতায় করে খপর দিতে গেল? ওষুদ দিয়েছে সমানে। উপোস করচে আমাদের সঙ্গে—ডান! থুঃ, ডান হলি তোরা! এক কড়ার মুরোদ নেই। ছেলেগুলোকে যে গুড়—নুনের জল খাওয়াতে বলে গেল। খাইয়েছিলি। সমানে গেরাম সুদ্ধু ওষুধের গুলি বিলোচ্চে কে? লজ্জা করে না!

পরি ঘরে এসে হাতড়ে হাতড়ে মধুবনকে ছুঁল। দিদি—ও দিদি।—মধুবন কাঁপছিল, কাঁদছিল নিঃশব্দে।

অন্ধকারে পরি তার মুখটা আন্দাজে খুঁজে কিছু একটা গুঁজে দিল—একটু খাও। —বেশ নরম নরম, গরম গরম, পোড়া—পোড়া গন্ধ।

কী দিলি এটা? তোরা খেয়েছিস? এটা কি মাশরুম? ব্যাঙের ছাতা?

খেয়েছ খাও। আমরা কতরকম খাই, সব কি তুমি জানো? না জানার দরকার! আমরা সবাই খেয়েচি। … জনাকাকারা তো এই ফিরল। হাইরোডে টেরাক পেয়েচে। দাদা আর মাধ্বকা চলে গেছে খবর দেবে। কাঁদচ কেন? শোকেতাপে মানুষের মাতা এমনি খারাপ হয়ে যায় গো! দেকো না দাদা গেছে, এইবার একটা উপায় হবেই।

মীনাক্ষী বিজেনকে বললেন—ছেলেমেয়ে দুটো গিয়ে অবদি একটা খবর দিল না! একটা ফোনটোন তো করবে!

ওখানে টাওয়ার কোথায়? কী যে বলো!

তা হলে চিঠি! চিঠি তো দিতে পারে!

তুমিও যেমন! রুস্তম লিখবে চিঠি! চিঠি কাকে বলে জানে?

.

দিনটা যশো—সুহৃতের বিবাহবার্ষিকী। হোটেল সানশাইন—এ পার্টি। কলকাতার পরিচিতরা সবাই এসেছে। এখানকার পরিচিতও কেউ কেউ। মীনাক্ষীরা সঙ্ঘমিত্রাদের সঙ্গে গ্যাংটক ঘুরে এসেছেন। বহুদিন পর এমন বেরোনো! কালই বেশিরভাগ ফেরত যাবেন? একমাত্র যশো মধু আর সুবুল ডাক্তার ছাড়া সব্বাই দার্জিলিংকে কেন্দ্র করে প্রচুর ঘুরে নিয়েছে। ব্যাঙাদারা গিয়েছিল ফালুট। বিজয়মুকুলদা ট্রেকিং করে এল সন্দকফু। যুগেশকুমার লাভা লোলেগাঁও। সব রং কালো, ফাটাফোটা রুখু মুখ সব। ব্যাঙাদার মিসেস পরচুলা বদল করেছে।

ড্রিঙ্কসের ব্যবস্থাও আছে। পাবলো সব তদারক করছে—দেখো আবার ছেলের সামনে ঢলাঢলি কোরো না, যশো বলল সুহৃৎকে। মধু বললে—সুহৃৎদা এমনি যা করছে বটে হুইস্কি পড়লে আর দেখতে হবে না!

সুহৃৎ বললেন—ছোঁবই না হুইস্কি। বাঘের মুখ থেকে ফিরে এসেছি বাবা!

বাঘ? বাঘ কোথায় পেলেন এখানে?—সুবল ডাক্তার জিজ্ঞেস করেন।

বাঘ? বাঘ বললুম বুঝি। সিঙ্গিও বলতে পারো। যা কেশর।

কী ব্যাপার? সুবল একবার এর দিকে একবার ওর দিকে তাকান।

মধু বলল—ও একটা ফ্যামিলি জোক আমাদের আপনি বুঝবেন না সুবুলদা।

মিহির এবার চিতার হাত থেকে ফিরে এলে হয়—শালির দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হেসে সুহৃৎ বললেন।

মধু বললে—ভাল হবে না সুহৃৎদা! কোনও চিতা, নেকড়ে, হায়না সিনেই নেই।

সুবল বললেন—এটাও কি ফ্যামিলি জোক?

মধু জোর গলায় বলল—আজ্ঞে হ্যাঁ। এসব আমাদের নিজেদের ব্যাপার। নাক গলাতে আসবেন না।

ওদিকে মীনাক্ষী পার্টি মাটি করে আর কী! চিকেন তন্দুরি মুখে দিয়ে বলেন—কী রকম ইঁদুর—ইঁদুর গন্ধ ছাড়ছে যেন!

ব্যস আর যায় কোথায়! মেয়েরা সব হাত গুটিয়ে বসল। বিজেন শুঁকেটুকে বলেন—ইঁদুর পোড়া, ব্যাং পোড়া কিন্তু খেতে ভাল, সাঁওতাল টাওতাল আদিবাসীরা তো খায়ই। চিকেনের সঙ্গে এইটুকুই তফাত যে ওগুলো আরও তুলতুলে।

আপনি খেয়েছেন নাকি দাদা? সুহৃৎ সোৎসাহে জিজ্ঞেস করলেন।

মহামাংস ছাড়া সবরকমের মাংস আমার টেস্ট করা আছে ভাই। অক্টোপাস ভাজা, ডলফিনের মাংস, সাপ, সব।

যশো ওয়াক তুলে বললেন—আমি ওয়াক আউট করব বিজেনদা। ছি ছি কী ঘেন্না। মীনাক্ষী বললেন—নাঃ তোমার একটা কাণ্ডজ্ঞান নেই।

বাঃ তুমিই তো শুরু করলে!

সুহৃৎ আর সুবল তৎক্ষণাৎ উঠে গিয়ে হোটলের রান্নাঘরে কমপ্লেন জানিয়ে এলেন। তারা কিচেন খুলে দিল, দেখে নিন সার।

কোথাও কিছু নেই। তবু মীনাক্ষী চার দিকে ইঁদুর—ইঁদুর গন্ধ পেতে থাকেন।—আমার শরীরটা কেমন করছে ভাই। আমি উঠি।

জলটা ফুটোনো খাচ্ছেন তো?—সুবল ডাক্তার জিজ্ঞেস করলেন।

ফুটোনো বলেই তো জানি!

শোবার আগে মীনাক্ষী বেশ খানিকটা বমি করে এলেন। ভাগ্যিস পরের দিনই টিকিট কাটা আছে। সোজা বাগডোগরা। সেখান থেকে ঘণ্টা দেড়েক কলকাতা।

পনের দিনের দীর্ঘ ট্যুর সেরে দু’জনে বাড়ি ফিরলেন। এত ছুটি আগে কখনও ম্যানেজ করতে পারেননি বিজেন। বাড়িতে তালা। মানে তারা ফেরেনি। টেলিফোনে কি কোনও মেসেজ আছে?—না। লেটার বক্সে কোনও চিঠি?—নাঃ।

বিজেন তেড়ে—ফুঁড়ে অফিস করতে লেগেছেন। কিন্তু মীনাক্ষী না পারছেন নারীকল্যাণ, না পারছেন সংসার। ছেলেমেয়ে দুটো তো আশ্চর্য! একটা চিঠি তো অন্তত…! একদিন স্বপ্ন দেখলেন সমুদ্রের মধ্যে একটা বেলুনে বসে তিনি ভাসছেন। কোথা থেকে পাবলো এল। পাবলো তবু সে পাবলো নয়। তিনি বললেন, একটু ঠেলে দে না রে বাবা, নইলে চলছে না! এক দিনে পাবলোকে খুব পছন্দ করে ফেলেছেন মীনাক্ষী। ঋজুর মতোই খানিকটা তবে ঋজু অনেক সিরিয়াস ধরনের। কখন কী করছে বা করতে চায় সে সম্পর্কে বাবা—মা’র সঙ্গে কোনও আলোচনা করে না। পাবলো কী সুন্দর শরবত ড্রিঙ্ক পরিবেশন করে। বাবার সঙ্গে দার্জিলিং যায়। বাবা—মা’র বিবাহবার্ষিকীতে কী সুন্দর মজা করল। গান করল। ভাবতে ভাবতে তাঁর ঋজু—মধুবন—তৃষ্ণা এমনই জোরালো হয়ে উঠল যে তিনি যশোকে একখানা ফোনই করে ফেললেন?

কী রে যশো? ফিরলি? বেশ হাল ফ্যামিলি মজা করে, বল!

আর বলিস না মিনি। টিকিট কি পাওয়া যায়! শেষে বিজয়মুকুলদা আর সুবুলদা স্যাক্রিফাইস করল। ওদের টিকিটে এঁরা এলেন। ধরলে কী হত জানি না। নট ট্রান্সফারেবল লেখা থাকে তো! পাবলো কী করে ৫৪/৫৫—র সুবুল ডাক্তার হয় তাই ভাব।

কী আবার হত। পাত্তি দিলেই সব মাফ। এ দেশে সবই চলে। তোকে এমন ভাব করতে হবে যেন হাতে মাথা কাটতে পারিস, আর চাই পাত্তি। যা খুশি কর, সার্টিফিকেট বেরিয়ে যাবে।

যা বলেছিস—যশোর কথাবার্তায় কেমন একটা নতুন নতুন ছলকানি। সামহাউ যশো খুব খুশিতে আছে।—তা মধুবনরা ফিরল?

না রে খুব ভাবনা হচ্ছে, ফিরল না কোনও খবরও নেই। পাবলো কিছু জানে?

পাবলো? পাবলো কী জানবে? জানলেও বলবে নাকি? সে বান্দাই নয়। বন্ধুদের সিক্রেট তার প্রাণভোমরা।

কেন তোর ছেলেটা তো খুব নেটিপেটি। কী সুন্দর ফ্রাঙ্ক, মা—বাবার বন্ধুদের জেনারেশানের সঙ্গে কী চমৎকার মেশে।

যশো হো হো করে হাসল—পাবলোকে তুই এই বুঝেছিস? ও শালা বহুরূপী। এই দ্যাখ হলদে, দ্যাখ না দ্যাখ সবুজ হয়ে গেছে। মহা সেয়ানা।

তুইও কম সেয়ানা নোস। তোর ছেলে সেয়ানা হবে এ আর বেশি কথা কী?

.

সেই সময়ে বাঁকুড়া দুর্গাপুর হাইওয়ে দিয়ে এ গণ্ডগ্রামের দিকে এগোচ্ছিল চার—পাঁচটি ট্রাক। বাঁকুড়ার ডি এম এ—র সঙ্গে যোগাযোগ করেছে রুস্তম।

অঞ্চলের খবর পৌঁছেছে সরকারি দফতরে। ত্রাণ যাচ্ছে। চিঁড়ে গুড়, চিনি, চাল, কেরোসিন তেরপল, ওষুধ, গুঁড়ো দুধ, লবণ। বাঁকুড়া শহরের গেরস্তদের থেকেও তোলা হয়েছে পুরনো জামাকাপড়ের বোঝা। চাল—ডাল। রুস্তম নিজে কিনেছে পাউরুটি, বিস্কুট। শুকনো মিষ্টি, গ্লুকোজ প্রচুর। জলের গাড়ি আসছে পেছন পেছন।

জামডুবির মাঠ থেকে জল সরে গেছে। কাদা থকথক করছে সেখানে।

ডি এম গ্রামের নামই শোনেননি মনে হল। বৃষ্টিতে হাল সব জায়গাতেই খারাপ। কিন্তু গন্ধেশ্বরী নদীর দরুন এমন একটা বান হয়ে যেতে পারে, কেউ ভাবেনি। এখন বাঁকুড়া শহরে শুকনো খটখট করছে। আর একটু বৃষ্টি হলে ভাল হত যেন।

লোক্যালাইজড রেন সব, অদ্ভুত। ডি এম বললেন—তা ভাই তুমি ওখানে মানে কী করে গেলে?

বাংলার একটা গ্রাম স্টাডি করার দরকার পড়েছিল।

তা এত গ্রাম থাকতে অমন ধাপধাড়া গোবিন্দপুর! মুড়কিশোলা?

ভাগ্যে গিয়েছিলুম। তা নয়তো চেহারাটা দেখতে পেতুম না। আপনার ঠিকেদারের মধ্যে দিয়েই আমার গোটা ভারতের ঠিকেদারদেরও চেনা হয়ে গেল।

সে আবার কী করল?

কী করল না সেটাই বলুন। চালটা পচা। গুঁড়ো দুধে ময়দা মেশানো, চিঁড়েতে গন্ধ বেরোচ্ছে। পুরনো তেরপল আর প্লাস্টিক শিট নিয়ে নতুনের দাম নিচ্ছে। এত ভেজাল সত্ত্বেও আবার প্রত্যেকটি জিনিসের ওজন কম। আর বলবেন না।

আমারপক্ষে কি আর ওজন দেখা সম্ভব, কাজ কি একটা? তুমিই বলো ভাই।

ওজন হয়তো পার্সন্যালি দেখা সম্ভব নয়। কিন্তু কারচুপি করলে সাজা হবে এ ভয়টাও তো ঢুকিয়ে দেওয়া যায়। প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড।

সমস্ত ওজন করাতে, গোনাগাঁথা করাতে, বাজে জিনিস ফেলে দিয়ে জেনুইন জিনিস তোলাতে, প্যাক করাতে পুরো আড়াইটে দিন শুধু শুধু নষ্ট হয়ে গেল আমার। কে জানে কতগুলো মানুষ মারা গেল। পরের ট্রাকগুলো দয়া করে পাঠাবেন ঠিক।

তাই ঠিকাদার তোমার ওপর অত খাপ্পা!—মানুষ মরার কথাটা কানেই তুললেন না ভদ্রলোক।

আমি কমপ্লেন লিখে দিয়ে যাচ্ছি ওর ঠিকেদারির বারোটা যদি না বাজাই তো আমার নাম ঋজুরুস্তম নয়।

কী নাম? কী নাম? ঋজুরুস্তম? নিউ জেনারেশনের অদ্ভুত সব নাম হচ্ছে। কে দিল ভাই?

বোঝাই যাচ্ছে ভদ্রলোক আবহাওয়াটাকে হালকা করতে চাইছেন।

রুস্তম কোনও জবাব দিল না। তার দেরি হয়ে যাচ্ছে। বোনটা কী অবস্থায় আছে কে জানে!

জামডুবির মাঠ অর্ধেকটা যেতে না যেতেই প্রচুর লোক গাড়ি ঘিরে ধরল। তেঁতুলতলা, মুড়কিশোলা, আমড়াতালি… তাদের তক্ষুনি ত্রাণ চাই। এ ওকে মাড়িয়ে, ভেদ করে ছুটে আসছে।

ঠিকেদারের লোক বলল—আমরা এইখানে সব ডাম্প করে দিয়ে চলে যাচ্ছি। এই হাড়—হাবাতের দল এক্ষুনি লুটপাট মারধর করবে।

ইয়ারকি নাকি!—রুস্তম তার কাউন্টি ক্যাপটা উলটো করে ঘুরিয়ে দিয়ে কোমরে হাত দিয়ে বলল—ভাল চাও তো ট্রাক চালিয়ে চলো।

গাঁয়ের রাস্তায় ট্রাক চলবে না।

আচ্ছা সে দেখা যাবে। এখন তো চলো।

লোকগুলো সরে না যে—মানুষ মারবে নাকি? আচ্ছা লোক তো মশাই আপনি!

আমি কেমন লোক দেখাচ্ছি। —রুস্তম লরির ওপর থেকে দু’হাত মুখের দু’পাশে ধরে চিৎকার করে বলল—আপনারা ক’জন এখান থেকে চলে যান। গ্রামে ফিরে গিয়ে এক্ষুণি সব সার বাঁধিয়ে দাঁড় করান। সব্বাই যা বরাদ্দ তাই পাবে। নইলে ট্রাক ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। কয়েকজন এখানে আসুন, লরিতে চড়ুন।

অনেক কষ্টে এই দাদা জিনিসপত্তর জোগাড় করেছে—মাধ্ব চেঁচিয়ে বলল। সবাই সব পাবি—একদম বেইমানি করবি না। গাঁয়ের নাম খারাপ করবি না।

খুট খুট করতে করতে জামডুবির মাঠ শেষপর্যন্ত পার হল ট্রাক।

গাঁয়ের সব লোক সার বেঁধে বেঁধে দাঁড়িয়েছে। জনা প্রতি বস্তা আলাদা বাঁধিয়েছে রুস্তম। পরপর সব বিতরণ করতে করতে এক জায়গায় এসে থেমে গেল রুস্তম। মধুবন দাঁড়িয়ে আছে।

নে হাত পাত, ত্রাণ নে—রুস্তম হেঁকে বলল।

মধুবন করুণ স্বরে বলল—দে।

শহরে যে গেলি বাড়িতে একটা খবর দিয়েছিস? বোন বলল।

দাদা বলল—আমার মাথার ঘায়ে তখন কুকুর পাগল, বাড়িতে খবর! কী খবরটা দেব?

জল সরে গেছে। ঠাকমা বলল—সেই আমার ন্যাংটো কালে একবার এরকম বান দেখেছিলুম। বাব্বাঃ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *