১০
সুহৃৎবরণ শ্যালিকার ফোন পেয়ে আহ্লাদে আটখানা। একই বাড়িতে ওরা থাকে ওধারে। চব্বিশ ঘণ্টা না হলেও গড়ে তিন—চার ঘণ্টা করে তো দেখছেন রোজ, তবু শালি—তৃষ্ণা যায় না। শালি চিরসবুজ, চিরনতুন, চিরকালের অপ্রাপ্য পরকীয়া। তার সঙ্গে ফস্টিনস্টি জামাইবাবুদের জীবনের মহত্তম সুখ।
কী হে কী খবর! আর কতদিন আমাদের বিরহজ্বালায় জ্বালাবে?
আপনার বোধহয় চিরবিরহ শুরু হতে যাচ্ছে সুহৃৎদা।
কেন? ফ্ল্যাট কিনেছ? মধুমহল ছেড়ে চললে?
ধুত। মধু মধুমহলেই আছে কিন্তু যশো যশোমহলে ফিরছে না।
অ্যাঁ?
দিদি সন্ন্যাস নিচ্ছে।
বলো কী! দার্জিলিঙে গিয়ে সন্ন্যাস? কী, হিমালয়টয় দেখে, না কী?
না হিমালয়ের চেয়েও জ্যান্ত কিছু। জনৈক সন্ন্যাসী বাবা মহারাজকে দেখে।
বুড়ো?
উঁহুহু। মধুক্ষরা খুব সময় নিয়ে অর্থপূর্ণ ভাবে বলল—আপনার বোধহয় একবার আসা দরকার। পাবলোরও।
.
সুহৃৎবরণ মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। এই সন্ন্যাসী—সন্ন্যাসী আধ্যাত্মিক—আধ্যাত্মিক বাই এই বয়সটাতেই মেয়েদের চেপে ধরে। স্বামী চাকরিতে সুপ্রতিষ্ঠিত। লড়াই শেষ। ছেলে বড় হয়ে গেছে। মাকে আর তেমন দরকার নেই। খাঁ খাঁ শূন্যতা চতুর্দিকে। অমনি ভগবান হাতছানি দ্যান—কোনও সুদর্শন বা যুবক বা দুইই মহারাজের মাধ্যমে। আয় আয়, সংসারের পঙ্কে আর কত ডুবে থাকবি! হল তো সব! এবার আমায় দ্যাখ। সুহৃতের নিজের মা—ই গুরুঅন্ত প্রাণ ছিলেন। সংসার টংসার ছেড়ে দেওঘরের আশ্রমে গিয়ে বসে থাকতেন। বাবা মারা যাবার সময়েও তিনি উপস্থিত ছিলেন না। তিনি কি সাধে ঘরজামাই হয়েছেন? মায়ের ষড়যন্ত্র। ছেলে অন্যত্র চলে যাবে, আর দেখাশোনা করতে হবে না। ড্যাংডেঙিয়ে রাজি হয়ে গেলেন। তাঁর দিদি অবশ্য মাকে ও তাঁর গুরুদেবকে খুব ভক্তি করত। তার আর কী! তাকে পড়ালেখা শেষ করিয়েই বিয়ে—থা দিয়ে তবে মা ভক্তিমতী হয়েছেন। শাশুড়ির সঙ্গে তো জেনেটিক মিল থাকার কথা নয়। সাংসারিক মিলমিশও হয়নি। শাশুড়ি নিয়ে ঘর করতেই হয়নি যশোকে। তা হলে? দুটো ফেসের মধ্যে কমন ফ্যাক্টর তিনিই একমাত্র। তবে তাঁরই মধ্যে কি এমন কিছু আছে যা মাদের স্ত্রীদের সংসার ত্যাগ করতে প্ররোচিত করে!
পাবলো সেদিন রাত সাড়ে এগারোটায় বাড়ি ফিরে একেবারে বাঘের মুখে পড়ে গেল। গর্জন করছে বাবা—ইয়ারকি পেয়েছ? এটা হোটেলখানা? যখন খুশি আসছ যাচ্ছ, কোনও দায়িত্বজ্ঞান নেই, বাবা—মা কেউ কিছু নয়। খালি বন্ধু, বন্ধু, বন্ধু এদিকে তো বাপের হোটেলেই খাও। এখনও মা কোলে বসিয়ে পাবুল পাবুল করে ডুডু খাইয়ে দেয়। সেই মা—বাপের কী হল না হল কোনও খেয়ালই নেই। ছিঃ ছিঃ ছিঃ—রাগে গনগনে মুখে সুহৃৎ অপসৃত হলেন।
পাবলো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে, একেবারে বাক্যহারা হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। জীবনে কোনওদিন সে বাবার কাছে বকুনি খায়নি। মা বকেছে, দু’ঘা দিয়েছে, কিন্তু বাবা কখনও না। পাবুল বলে সত্যি কথা বলতে কী, মা কোনওদিন ডাকেনি, ডেকেছে বাবাই। বেশি আদরের মুড থাকলে আবার শুধু পাবুল নয় পাবুল বাবুল, যার জন্যে ছোটবেলায় তার বন্ধুরা তাকে বাবলগাম বলে খেপাত। তার ওপর আবার ‘বাপের হোটেল?’ ওরে ব্বাপ—এমনতর অশ্লীল কথা পাবলো জীবনে শোনেনি। তবে কি ভেতরে থেকে তার রেজাল্ট জেনেছে বাবা? খুব খারাপ? সি গ্রেড? নাকি বাবার হঠাৎ প্রেশার চড়ে গেছে!
শম্পি উঁকি মারছে।—কী হল রে, চেঁচামেচি শুনলুম যেন?
পাবলো ফ্যাকাশে মুখে বসে আছে, মুখে কথা নেই।
শম্পি তাকে ঝাঁকিয়ে দিল—কী রে, বল।
বলব আর কী! জীবনযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল—বুঝলি! কুলি খেটে কি রিকশা চালিয়ে কোনওরকমে যা হোক কিছু…।
তুই—ই বা এত দেরি করলি কেন? মাসি নেই, মেসোর একা—একা লাগছে এগুলো তো একটু ভাবতে হয়!
আরে রিহার্স্যালে মেতে গেছি। খেয়াল নেই।
মেসোর ঘরে উঁকি মেরে এসে শম্পি বলল—মেসো বাগডোগরার দুটো টিকিট বুক করল রে। কালই। ঠিক বলেছি। মাসির জন্যে মেসোর মন কেমন করছে বুঝলি!
তাই বলে অমন অগ্ন্যুৎপাত! এ তো পুরো ভলক্যানো রে! তা দুটো টিকিট কার? বাবার আর মেসোর?
কী জানি! বাবাকে তো কিছু বলতে শুনিনি। বাবা বরং খুশিতে আছে, মায়ের খবরদারি নেই তো! আমি বকেঝকে যা হোক করে ম্যানেজ করছি। মিষ্টির তো পোকা—বাবাটা। এদিকে সুগার এসেছে ব্লাড—টেস্টে।
পাবলো কড়িকাঠের দিকে মুখ করে চিতপাত হয়ে শুয়ে আছে। মাথার তলায় দুটো হাত। ডান পা—টা বাঁ পায়ের উঁচু করা হাঁটুর ওপর তোলা। তার চোখ সাদা। ঘুম নেই। সে খায়নি। মানে খেয়েছে। কিন্তু বাবার সঙ্গে বা সামনে নয়। রান্নাঘরে গিয়ে দেখল রাঁধুনি চিকেন স্টু আর রুটি করে রেখে গেছে। তুলে নিয়ে তার যা ভাগের মোটামুটি খেয়ে নিয়েছে।
সুহৃদ খেতে যানইনি। মিহির এসে বললেন—তোমার খাওয়া—দাওয়া হয়েছে দাদা।
খাওয়া? সুহৃৎ অবাক হয়ে তাকালেন। খাওয়া কথাটা যেন জীবনে এই প্রথম শুনলেন।
শম্পি, শম্পি—ই—মিহির ডাক পাড়লেন। শম্পিই অবশ্য বেগতিক দেখে বাবাকে পাঠিয়েছে। সে কাছেপিঠেই ছিল।—কী বাবা! বলে এসে দাঁড়াল যে কিচ্ছুটি জানে না।
আরে সুহৃৎদাকে পাবলোকে খেতে দে!
শম্পি বলল ও মেসো, তুমি বাবার সঙ্গে কথা বলো আমি তোমার খাবার এনে দিচ্ছি।
সে মাইক্রোওয়েভ চালু করে দিল। রুটি মাংস সব সুচারুরূপে সাজিয়ে ট্রেতে করে এনে বলল—খাও মেসো, অনেক রাত হয়ে গেছে।
যশো! পাবুল!—বোকার মতো সুহৃৎ বলে উঠলেন।
পাবলো খেয়েছে। মাসিও নিশ্চয় খেয়েছে। তুমি এখন খাও বাবার সঙ্গে গল্প করতে করতে। বাবা, তোমার ওভালটিনটা এখানে দেব নাকি?
ওভালটিন? হ্যাঁ হ্যাঁ দিবি বইকি! তা সুহৃৎদা, কাল তোমার কী প্রোগ্রাম?
মিহিরকিরণ উকিল মানুষ, তিনি জানেন ভালমানুষ সেজে কীভাবে লোকের পেটের কথা টেনে বার করতে হয়।
কাল? কাল তো দার্জিলিং যাচ্ছি। আমি আর পাবুল।
তাই নাকি? হঠাৎ?
যশোর হঠাৎ খুব অসুখ করে গেছে। বুঝলে হে! না গেলেই নয়। জানো তো তোমার শালিটি কেমন আউপাতালি, আর অসুখ—বিসুখ করলেই…জানোই তো—একটু যেন লজ্জা লজ্জা হাসি ফুটল তাঁর মুখে।
দিদির অসুখ! কই মধু তো বলল না কিছু?
কিচ্ছু—উ বলেনি?—ঘোর সন্দেহের দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন সুহৃৎ। কতটা জানে এই ঘোড়েল ভায়রাভাইটি! মধু কি আর ওকে বলতে বাকি রেখেছে? এই বয়সে যশো গৃহত্যাগী হতে চাচ্ছে সেটা কার ডিসক্রেসিট! অবশ্যই তাঁর! এই নিয়ে চতুর্দিকে কত জল্পনা—কল্পনা হবে এখন! তার চেয়েও বড় কথা যশো, সেই বাচ্চা হাতির মতো সাদা ধ্বধবে নরম—নরম যশো আর তাঁর নেই। কোন যেন মহারাজের হয়ে গেছে।
পাবলো জানে, সে যাবে?—মিহিরের কথায় চটকা ভাঙল তাঁর।
ও হ্যাঁ না। মানে সকালে বলব, গুছোতে আর ক’মিনিট লাগবে।
কিন্তু তার আগেই যদি পাবলো গৃহত্যাগ করে?
গৃহত্যাগ? পাবলো? কেন? সে কী? পাবুল পাবুল—সুহৃৎবাবু চটাস, চটাস করতে করতে ঊর্ধ্বে চললেন। —পাবুল—কাল আমরা, মানে তুমি আর আমি দার্জিলিং যাচ্ছি। বুঝলে? গৃহত্যাগ—ফ্যাগের মতলব ছাড়ো।
পাবলো উঠে বসল আমি? দার্জিলিং? কেন?
তোমার মা’র অসুখ করেছে। তাকে ফিরিয়ে আনতে।
কী আবার হল মায়ের? তো আমি কেন?
তুমি কেন? মানে? মানে কী কথাটার? জবাব দাও। মানে কী? মায়ের বিদেশবিভুঁইয়ে অসুখ করেছে শুনেও তোমার হেলদোল নেই? আমি কেন! আচ্ছা! এই পুরস্কার। এই রিটার্ন। ছ্যা ছ্যা যশো এই ছেলে তৈরি করেছে!
পেছন থেকে মিহির বললেন—পাবলো, ভাল চাস যদি তো তোর বাক্স গুছিয়ে নে। সত্যিই তো—আমি কেন—মানেটা কী! তোর মা—বাপের অসুখ করলে তোর দায়িত্ব থাকে না?
পাবলো মাথা চুলকে বলল—আসলে আমরা তো আর কাঁধে করে মাকে নিয়ে আসব না যে দু’জন লোক লাগবে! একজন গেলেই তো হল! তা ছাড়া তেমন কিছু হলে সোজা অ্যাম্বুল্যান্সে।
বা বা বা বা!—সুহৃতের গলায় এত জোর, এত রাগ ছিল তিনি নিজেই জানতেন না—শি ইজ রাইট। যা’র একমাত্র ছেলে এইরকমের ক্যালাস তার, তাদের গৃহত্যাগ করাই উচিত। আই আন্ডারস্ট্যান্ড য়ু যশো।—ফুললি ফুললি—বলতে বলতে সুহৃৎ বেগে নিজের ঘরে চলে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন।
সত্যি দিস ইজ টু মাচ পাবলো—শম্পি বলল।
কাঁধে করার কথাটাই বা তুই উচ্চারণ করলি কী বলে? মিহির খুবই বিরক্ত।
দ্যাখো মেসো, আমি মাকে খুব জানি। মা খুব ঘোড়েল। এর আগে একদিন খবর পেলুম মা’র নাকি স্ট্রোক হয়েছে—অজ্ঞান। দৌড়োতে দৌড়োতে সব কাজকর্ম ফেলে বাড়ি এসে দেখি—ফিস্টি হচ্ছে। মেলা লোক। সবাইকার জন্যে শরবত সাপ্লাই দাও। রাখাল বালক যেমন বাঘ বাঘ বলে মিছিমিছি চেঁচাত!
কিন্তু তার পালে সত্যিই তো একদিন বাঘ পড়ল। বাবা—মা তো পাড়ার লোক নয় যে, মিথ্যে অ্যালার্ম বলে তোমরা উড়িয়ে দেবে। এসব কথা ভাল নয় পাবলো। আমি অ্যাপ্রুভ করছি না। হাইলি অবজেকশবেল।
মেসো, পরশু আমাদের প্রথম শো যে—কাতর কণ্ঠে পাবলো বলল, হল বুক হয়ে গেছে, ইনভিটেশন লেটার চলে গেছে। এখন আমিই মূল আমিই পরিচালক—
কীসের শো? কী নাটক পরিচালনা করছিস?
নাটক নয় ব্যান্ড, মেসো—নিচু গলায় পাবলো বলল।
কীসের ব্যান্ড পার্টি? তুই শেষপর্যন্ত ভ্যাঁপপপোর ভ্যাঁপোর করতে করতে ব্যাগ পাইপ টাইপ বাজাতে বাজাতে রাস্তা দিয়ে প্রসেশন করবি?
উঃ তোমরা যে কোন যুগে আছ! বিটলস শোনোনি? রোলিং স্টোন? স্পাইস গার্লস শোনোনি? বাংলা ব্যান্ড শোনোনি?
তোরা ব্যান্ড বেঁধে গাইবি?
গাইব, বাজাব, র্যাপ করব, নাচবও।
বলিস কী রে, তুই তা হলে শিগগির বিখ্যাত হয়ে যাচ্ছিস? সেলেব? বাব্বাঃ হাতে হাত মিলাও ইয়ার। নাম কী ব্যান্ডের?
ভ্যাগাবন্ড।
বাঃ দারুণ। অ্যাপ্রোপ্রিয়েট। একদম ঠিক।
সত্যি বলছ মেসো!
সত্যি না তো কি মিথ্যে? তোদের জেনারেশনের ছেলেগুলোদের দেখে একদম ঠিক এই কথাটাই এই শব্দটাই মনে আসে। ভ্যাগাবন্ড। সারাদিন কানে মোবাইল, ইয়ার—প্লাগ, জনবহুল রাস্তা দিয়ে লক্ষ্যহীন চলছে। জিনসের পকেট ফেটে ঝুলে গেছে। ফতুয়া ফ্যাতফেতে। চুলে পনিটেল। এক কানে মাকড়ি, এক হাতে বালা। কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে কিছু বোঝা যায় না। এমনকী—জেন্ডার পর্যন্ত বোঝার বাইরে। ভ্যা—গা—ব—ন্ড। ঠিক! তোমার কেস বুঝলুম। কিন্তু তুমি কাল দার্জিলিং যাচ্ছ। মায়ের অসুখের ওপর আর কোনও ব্যান্ড নেই।
পরে শম্পি বাবাকে বলে—মাসির কখনও অসুখ করেনি। করলে মা আমাদের বলত না? আমাকেও ফোন করেছিল তো। কিছু বলেনি। অন্য কিছু।
মিহির বললেন তুই শিয়োর? ডেঞ্জার টেঞ্জার কিছু?
তা হলেও বলত। অন্য কিছু। মায়ের নানারকম দুষ্টুবুদ্ধি খেলে তো?
তা খেলে। আমাকে কম নাকাল করেছে!
কোনও একটি রহস্যময় কারণে মা মেসোকে দার্জিলিঙে নিয়ে ফেলতে চায়। কিছু একটা মজা!
কিন্তু পাবলো! পাবলো কেন!
পাবলোটা হয়তো মেসোর নিজের আইডিয়া।
.
একটি বড় ঘর। মেঝেতে কার্পেট পাতা। এক প্রান্তে একটি প্রশস্ত হাতলঅলা আরাম চেয়ারে বসে আছেন অভীপ্সানন্দ মহারাজ। ভ্রমরকৃষ্ণ চুল ও দাড়ির মধ্যে থেকে ফুটে আছে তাঁর গোলাপফুল রং হাসিমাখা মুখখানি। সামনে হাঁটু মুড়ে সমবেত শিষ্যকুল। একেবারে সামনে যশোধরা। স্বামীজি মহারাজের মুখের দিকে তাকিয়ে তদগত। তন্ময়।
তার বোনের হয়েছে বিপদ। এখন দার্জিলিঙে নানা মজা। পরিচিত মানুষকুলকে এখানে দেখে দিদির ভাল না লাগতে পারে, মধুক্ষরার কিন্তু মোটেই খারাপ লাগছে না। তা ছাড়া মধুক্ষরা এখানে নিত্য নতুন অবতারে। বেশিরভাগ দিনই ফুল প্যান্ট, জ্যাকেট। কোনও কোনও দিন সালোয়ার কামিজের ওপর কার্ডিগান। লং স্কার্ট পরেও সে অবতীর্ণ হয়েছে। তার চলন পালটে গেছে। পকেটে হাত দিয়ে সামনের দিকে ঝোঁক দিয়ে দিয়ে পাহাড়ি চলা সে রপ্ত করেছে। অচেনারা তো মুগ্ধ চোখে চেয়ে চেয়ে দেখেই, চেনার, যেমন মিনিদি সঙ্ঘদি এরাও বলে—তোর যে দশ বছর বয়স কমে গেছে রে মধু! ওদিকে রয়েছে ব্যাঙা—বেঙি। বেঙি যতই বয়সে ছোট হোক, মধু তাকে টেক্কা দিয়েছেই দিয়েছে। বিজয়মুকুলদা চিরকুমার সুতরাং চিরহরিৎ। সুবুলদা আর বিজয়মুকুলদার সঙ্গেই তার আড্ডা জমে সবচেয়ে ভাল। অথচ দিদি এইসব বাধিয়েছে। দিদিকে চোখে চোখে রাখতে হচ্ছে। দিদি রোজ মহারাজের ওখানেই প্রসাদ গ্রহণ করছে। রাত্তিরে শুতে আসে যখন, চোখের তারা শিবনেত্র। শুয়ে শুয়ে জপ করে। ভোরে উঠে প্রাণায়াম। বলে—মধু, নশ্বর জীবন, একটা কি লক্ষটা কে জানে, নষ্ট করিস না। নষ্ট করিস না। কথামৃত শুনবি আয়।
কথামৃত আমি পড়েছি দিদি।
আরে এ যে নতুন যুগের নতুন কথামৃত রে! যুগে যুগে যেমন পৃথিবী পালটায়, সমাজ সংসার মানুষ পালটায় তেমন কথাও পালটায়। না শুনলে বুঝবি না।
এই তো অবস্থা! আসল কথাটা অবশ্য মধু একটু একটু বুঝতে পারে। দিদির চিরকেলে রোম্যান্টিক মন।—নতুন, অ্যাডভেঞ্চার, অজানার দিকে তার চিরকালীন টান। দিদি বড্ড চেয়েছিল একটি জম্পেশ লভ ম্যারেজ। তো বাবা—মা অবিলম্বে তাকে সুহৃদ্দার গলায় ঝুলিয়ে দিলেন। সুহৃদ্দা আদৌ খারাপ নয়। গুণী কৃতি মানুষ, দিদির যত্ন নেয়। অসুখ—বিসুখ করলে তো বিছানার পাশ থেকে নড়ে না। কিন্তু দিদির তাতে মন ওঠে না। একখানা উত্তমকুমার কি বিনোদ খান্না দিদির সঙ্গে দুর্ধর্ষ প্রেম করবে, দিদি তার সঙ্গে ইলোপ করবে। মা—বাবা কাঁদবে, পুলিশে খবর দেবে, অভিশাপ দেবে—কিন্তু দিদি ফিরবে না। দিদি তার উত্তমকুমারের প্রতি বিশ্বস্ত থাকবে। প্রেমের এই আটলান্টিক উদ্দামতা আর প্রশান্ত মহাসাগরীয় গভীরতা দেখে শেষপর্যন্ত বাবা—মা মেনে নেবেন। প্রবল ঘটা করে বিয়ে হয়ে যাবে। তারপরে দিদি চিরকাল অমিত রায় লাবণ্যর দীপক—মানসী গোছের একটা জীবনযাপন করবে। দিদির ইচ্ছের খুঁটিনাটি অবশ্য সে জানে না।
কিন্তু সে অনেক সময়েই ঠারে ঠোরে দিদিকে বোঝাতে চেয়েছে প্রেমের বিয়েও ক্রমে ক্রমে একই রকম ম্যাদামারা হয়ে যায়। তাকে আর মিহিরকে দেখেও কি দিদি বোঝে না? সর্বক্ষণ মোটা মোটা আইনের বই নিয়ে বসে আছে, চেম্বারে, আর বক বক বক। কোথায় গেল সেই সপ্রেম চাউনি, সেই কাতরতা! সেই কামনাতুরতা! তার চেয়ে বরং সুহৃদ্দা অনেক অনেক বেশি মনোযোগী স্ত্রীর প্রতি। তার তো সুহৃদ্দাকে বেশ লাগে। বেশ মজাদার মানুষ। দিদিটা চিরকালের গোঁয়ার এবং ভোঁদা। কী যে মাথায় প্রেম সেঁধিয়ে বসেছে। এখন অভীপ্সানন্দকে নিয়ে গদগদ। ভক্তি না আরও কিছু! ভগবান না ঘণ্টা! আবার ফোঁস ফোঁস করে প্রাণায়াম করা হয়। দু’মিনিট পরেই অবশ্য ফোঁস ফোঁসটা ভোঁস ভোঁস হয়ে যায়। ভোঁসলে একটা।
তিন—চারদিন হল এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। উত্তর প্রদেশীয়, যুগেশকুমার। খুব জমে গেছে। কে কুইন অব হিল স্টেশনস—শিমলা না মুসৌরি না দার্জিলিং এই নিয়েই ঘণ্টার পর ঘণ্টা উড়ে যায়। সুবুলদা ঘুরঘুর করতে থাকে। সুবুলদা যদি ভেবে থাকে সে—ই একমাত্র মধুর গপ্পো করার লোক, তো ভুল ভেবেছে। আবার যুগেশকুমার যদি ভেবে থাকে সেই একমাত্র, যদি কোনওরকম আপারহ্যান্ড নেবার সম্ভাবনা দেখা যায় অমনি সে সুবুলদার সঙ্গে জমে যাবে। অত সস্তা না। যুগেশকুমার, সুবুলদা, ব্যাঙা—বেঙি এদের সঙ্গে সে টাইগার হিল ঘুরে এসেছে। দিদি কিছুতেই গেল না—আমি শান্তির জন্য এসেছি মধু, বোঝবার চেষ্টা কর। টাইগার হিল—এ সূর্যোদয় অনেক দেখেছি। এখন জীবনে নতুন সূর্যোদয় হচ্ছে। তুই যা না, ঘুরে আয়।
সূর্যোদয় অবশ্য দেখা হল না। মেঘ সরল না। তবু ঠান্ডায় জমে দই হয়ে ভোর চারটের সময়ে টাইগার হিল যাওয়া তো হল! মধুর এই পথ চলাতেও আনন্দ।
এইরকম এক কনকনে ঠান্ডা, কনকনে হাওয়া, আর ঝুপঝুপ বৃষ্টির মধ্যে সুহৃৎবরণের ডাকোটা মানে ল্যান্ডরোভারটি দার্জিলিং মল—এ পৌঁছোল। হোটেল সানশাইন—এ আর ঘর নেই। সব ভরতি।
আমার ওয়াইফ রয়েছে—যশোধরা ব্যানার্জি। আমি সেই ঘরেই থাকব। তিনি গোঁয়ারের মতো বললেন—
কিন্তু যেখানে তো মিসেস মুখার্জিও রয়েছেন। কী করে যেতে পারেন আপনি!
তিনিও আমার আপনজন, স্ত্রীর মতোই।
অ্যাঁ? তিনিও আপনার স্ত্রী?
উফফ, স্ত্রী যেমন আপনজন তিনিও তাই। আমার সিস্টার ইন—ল।
আপনি দেখা করে আসতে পারেন। কিন্তু ডবল বেডরুমে, চারজনকে আমরা জায়গা দিতে পারি না। দু’—দুজন জেন্টলম্যান।
রেগে—মেগে সুহৃৎ—আয় রে পাবুল—বলে হোটেল ত্যাগ করলেন।
পাশের হোটেলে একটি ডিলাক্স সুইট পেলেন। নিয়ে নিলেন। পাবলো গোমড়া মুখে সঙ্গে সঙ্গে বাথরুমে চলে গেল। দার্জিলিং—ই হোক আর যা—ই হোক সে এখন চান করবে।
বৃষ্টি থেমেছে। রোদ হেসেছে। আকাশ ক্লিয়ার। চোখে বাইনোকুলার লাগিয়ে সামান্য জানলা ফাঁক করে সুহৃৎ দেখতে পেলেন—একটি সুন্দরী মড যুবতি হোটেল সানশাইন থেকে বেরিয়ে এল। দু’পা যেতেই এক পুলোভার পরা পুঙ্গব এগিয়ে গেল, দু’জনে কথা বলতে বলতে এগিয়ে যাচ্ছে। আরে সুবুল ডাক্তার না? খুব জমিয়েছে মনে হচ্ছে! এ কী! এ তো মধু! তাঁদেরই মধু! মধু সার্টেনলি সুবুলের সঙ্গে কথা বলতে বলতে এগিয়ে গেল। ওদিক থেকে আর একটি পুঙ্গব এসে যোগ দিল। বাইনোকুলারটা ঠিকঠাক ফোকাস করেও লোকটাকে ঠিক ধরতে পারলেন না সুহৃৎ। কদম কদম এগিয়ে চলেছে মধুক্ষরা, তাঁর শ্যালিকা, দুই পুরুষের মধ্যবর্তিনী হয়ে।—ক্যামেরা, ক্যামেরাটা পাবুল! তিনি চিৎকার করলেন।
পাবলো পোশাক পরছিল, বলল—কী? কাঞ্চনজঙ্ঘা বেরিয়েছে নাকি?
আজ্ঞে না। বেরিয়েছে তোমার মাসিমণি, দু’পাশে দুই কলাগাছ মধ্যিখানে মহারাজ।
এইটুকু বলে সুহৃৎ নিজেকে সামলে নিলেন।
ক্যামেরা তো আনা হয়নি বাবা!
বলিস কী! ক্যামেরা তো তোর ব্যাগে সব সময়ে মজুত থাকে!
অন্য ব্যাগ এনেছি যে!
তোর একবারও মনে হল না দার্জিলিঙের মতো সুন্দর জায়গায় বেড়াতে এসেছিস ক্যামেরাটা অবশ্যই আনিতব্য?
কিন্তু বাবা তুমি ভুলে যাচ্ছ আমরা দার্জিলিং বেড়াতে আসিনি, অসুস্থ মাকে নিয়ে যেতে এসেছি। এখনও পর্যন্ত মাকে দেখতেই পেলুম না! কী অসুখ কী বৃত্তান্ত জানলুমই না! স্ট্রেঞ্জ! আমার তো মনে হয় না মায়ের কোনও অসুখ করেছে।
অসুখ গুরুতর। সংক্ষেপে বললেন সুহৃৎ। চল, লাঞ্চটা খেয়ে নিই। তারপর তোর মাকে গিয়ে পাকড়াব।
পাবলো হাঁ করে তাকিয়ে রইল। মিস্টিরিয়াস! এ ভদ্রলোক কখনও রেগে ফায়ার হয়ে যাচ্ছেন। কখনও বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে মাসিকে বেরোতে দেখছেন, আবার মাসিমণি! মায়ের অসুখ গুরুতর অথচ নিশ্চিন্তে মুরগির ঠ্যাং চুষছেন। তার পিতৃদেবকে এত এলোমেলো এত রহস্যময়, তাঁর কথাবার্তায় এমন দ্বিমুখী তাৎপর্য পাবলো কখনও দেখেনি শোনেনি। ইন্টারেস্টিং!
গুরুদেবের ঘরটা কোথায়?—হোটেল ‘সানশাইন’—এর কাউন্টারে গিয়ে পাবলোর কান বাঁচিয়ে বললেন সুহৃৎ। পাবলো অবশ্য তখন হোটেলের লাউঞ্জে তন্ময় হয়ে বব ডিলানের পোস্টার দেখছে। তার অন্যতম আইকন। রোল মডেল। মাইনাস বিদ্রোহ। এখন বিদ্রোহের দিন নয়, সমারোহের দিন, সামঞ্জস্য ও সংহতির দিন। সাধু ভাষা, চলিত ভাষা, পরিশীলিত শব্দ, স্ল্যাং, কৃষক মজদুর মেট্রোবাসী সবাইকে গানের মাধ্যমে এক করার দিন। লিরিকের সীমাবদ্ধতা ভেঙে দেবে ভ্যাগাবন্ড। গানের সীমাবদ্ধতাও। কবিতা আসবে, গদ্য আনবে। ব্যাপক ভাবনা—চিন্তার ব্যাপার। আর এই সময়ে বাবাটা তাকে ফালতু দার্জিলিঙে টেনে নিয়ে এল। শো’টা ক্যানসেল করতে হল। খুব, খু—ব ক্ষতি হয়ে গেল। পঙ্কজটা গেঁতো বলে তারা খানিকটা বেঁচে গেছে। খবরের কাগজে অনুষ্ঠানের খবরটা পাঠায়নি। চেনাশোনার মধ্যেই আমন্ত্রণগুলো গেছে।
অভীপ্সানন্দ মহারাজ এখন তো কনফারেন্স রুমে। লেকচার দিচ্ছেন।
কোথায় সেটা?
লাউঞ্জের ও—দিকের দরজাটা খুলে চলে যান।
আয় রে পাবুল!
মঞ্চের ওপর অভীপ্সানন্দ মঞ্চ আলো করে বসে ইংরেজি হিন্দি মিশিয়ে বক্তৃতা করছেন। থেকে থেকেই বলছেন—ভাইয়োঁ ঔর বহেনো।…
একজন বললেন—কোনও গুরুদেবকে কখনও শিষ্যদের ভাইবোন বলে অ্যাড্রেস করতে শুনেছ! হি ইজ আ গ্রেট ম্যান।
হ্যাঁ। বিবেকানন্দ একেবারে, সাক্ষাৎ।—সুহৃৎ মন্তব্য করলেন।
ভিভেকানন্দজিকে ফির আনেকা টাইম হো গিয়া ভাইয়া, কওন জানে মহারাজজি ভিভেকানন্দজিকেই অবতার হ্যাঁয় ইয়া নহি।
পাবলো বলল—ও বাবা, ওই তো মা ফার্স্ট রো—এ বসে বসে দুলছে।
দেখতে পেয়েছিস? কই কই? দোলা তোর মায়ের রোগ। ঠিক ঠিক ওই তো দুলছে। যেন নামতা মুখস্থ করছে।
আরে সিট ডাউন। বইঠ জাইয়ে। —চতুর্দিক থেকে চাপা গর্জন ভেসে এল। সুহৃৎ ভাল করে যশোকে দেখতে পেলেন না।
অসুখ করেছে বলে তো মনে হল না!—পাবলো ফিসফিস করে বলল।
অসুখ গুরুতর, গুরুত্ব দে, তা হলেই বুঝতে পারবি—চাপা গলায় বললেন সুহৃৎ। পাশের ভদ্রমহিলার ভ্রূকুটিতে বললেন—আর বলব না, স্পিকটি নট। এই চুপ করলুম।
তা—ও তো মন্দ বলছেন না। বলব না—টাও একরকম বলা। আওয়াজ সৃষ্টি করা, অমৃতবাণী শুনতে বাধার সৃষ্টি করছে।
বাইরে যান, বাহার যাইয়ে। বাহার যাকে গপসপ কিজিয়ে—চার দিক থেকে আওয়াজ উঠল।
অভীপ্সানন্দ বললেন, দিস ইজ লাইফ। অবাঞ্ছিত আওয়াজ। চতুর্দিক থেকে আসছে, আমাদের অন্তরাত্মার ধ্যান ভাঙিয়ে দিচ্ছে। নিজেতে আমরা খুঁজে পাচ্ছি না। ছোট্ট মেয়েটি ভিড়ে হারিয়ে গেছে। বলছে ‘হারিয়ে গেছি আমি’। বিশ্ব নিখিল চেয়ে আছে, কিন্তু দেখছে না। এখন বালিকাটি কী করবে? দিস ইজ আ কোয়েশ্চেন!
রোয়েগি, কাঁদবে, শি উইল ক্রাই। চার দিক থেকে জবাব এল।
রাইট। তখনকার দৃষ্টি আকর্ষণ করবে এই কান্না! দিস টু ইজ আর কোয়েশ্চেন।
কেউ কেউ বলল—স্নেহশীল মানুষজন।
রাইট। কিন্তু আরও দুই ধরনের মানুষ। এক নম্বর প্রতারক, শিশু পাচারকারী, ভুলিয়েভালিয়ে তাকে নিয়ে যাবে। আর দ্বিতীয় হল—পুলিশ। তার কর্তব্যই হল আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা। একটি ছোট মেয়ে হারিয়ে গেছে এটাও একমাত্র সে—ই কর্তব্য বোধে দেখবে। সঠিক জায়গায় পৌঁছে দেবার দায়িত্ব নেবে। ঠিক কি না?
সবাই মাথা নাড়তে লাগল।
এমন সময়ে এক মহিলা উঠে দাঁড়ালেন—মহারাজজি, হোয়াই ছোট মেয়ে? ছোট ছেলে নয় কেন? হারানো অন্তরাত্মার প্যারাডাইম কী করে মেয়ে হয়! অন্য সময়ে তো আপনারা বয়, ম্যান, হি ব্যবহার করেন। প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড গুরুজি। আপনিও? আপনিও হয়তো আপনার অজ্ঞাতসারেই পেট্রিয়ার্কির জালে ধরা পড়ে গেছেন। দিস উই রিজেক্ট।
অনেকে হইচই করে উঠল। কিন্তু স্বামীজি দু’হাত তুলে সবাইকে থামিয়ে দিলেন। বললেন—প্রশ্ন। প্রশ্ন হল সাধনার পথে উত্তরণের প্রথম সিঁড়ি। অজস্র প্রশ্ন মাথা তুলবে। তার জবাব খুঁজবে প্রাণ। এক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেল তো আবারও এক প্রশ্ন। এইভাবে একদিন আপসে প্রশ্ন শেষ হয়ে যাবে। তখন সংসারময় শান্তি, সংগতি দেখবে প্রাণ। আমি জবাব দিচ্ছি মা আপনাকে। আমাদের এই সমাজ সভ্যতার ইনফ্রাস্ট্রাকচারে একটি ছোট ছেলের চেয়েও একটি ছোট মেয়ে অনেক অসহায়, ভালনারেবল, সে স্বভাবতই অনেক ভিতুও।
সকলেই সায় দিল। ভদ্রমহিলা তবু বললেন—এই জেন্ডার ডিসক্রিমিনেশনটা ঠিক কী বলব, আপনার মুখ থেকে মহারাজ ….না ঠিক…
স্মিতমুখে মহারাজ বললেন—বাস্তবকে তো স্বীকার করতেই হবে। আমি আদর্শ সমাজের কথা বলিনি। এখন সমাজ যেরকম তার কথাই বলেছি। যাই হোক—গুরু হলেন—এই সস্নেহ কর্তব্যশীল পুলিশ। হারিয়ে যাওয়া অন্তরাত্মাগুলিকে তিনি প্রথমে তাঁর মিসিং স্কোয়াডে জড়ো করেন। তারপর শুরু হয় কাউন্সেলিং। প্রশ্নোত্তর। এইভাবে কার কী ঠিকানা জেনে সেখানেই তাকে পাঠান। প্রত্যেকের ঠিকানা, চাহিদা, প্রয়োজন আলাদা ভাইবোনেরা। সবাই মহামায়ার অনন্ত আঙুলের একটি মাত্র। দুটো আঙুল কি কখনও এক হয়?
ক্রাইস্ট দা শেফার্ড—এক লালমুখো গুর্খা ভদ্রলোক বললেন। তিনি ঘনঘন মাথা নাড়ছেন। পছন্দ হয়েছে তুলনাটি।
এই সময়ে পাবলোকে অবাক করে দিয়ে তার বাবা উঠে দাঁড়ালেন। আমি একটা প্রশ্ন করতে পারি?
চারদিক থেকে অস্বস্তির রব উঠল। কিন্তু মহারাজজি সব হাতের ইঙ্গিতে থামিয়ে দিয়ে বললেন—কোয়েশ্চনস আর অলওয়েজ ওয়েলকাম। বাতাইয়ে জি।
সুহৃৎ চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বললেন—একটি ছোট মেয়ে হারিয়ে যেতে পারে। কিন্তু একজন অ্যাডাল্ট, বিবাহিত, সন্তানের জননী যদি বলে ‘হারিয়ে গেছি আমি’, সেটা কি বিশ্বাসযোগ্য? তিনি গেলে বলব না কি ইচ্ছে করে গেছেন? কর্তব্য থেকে পালিয়েছেন? তাঁর মতলব মোটেই ভাল নয়।
যশো মুখ ফেরাল। পাবলোর সঙ্গে মায়ের চোখাচোখি হয়ে গেল। চোখ দুটো আস্তে আস্তে বড় বড় হয়ে যাচ্ছে। সুহৃৎ কিন্তু সেদিকে তাকাচ্ছেনই না।
চার পাশে সব আপত্তি করে উঠল।—আহা, ছোট মেয়ের কথা বলা হচ্ছে নাকি? সে তো পথ হারানো মানবাত্মার উদাহরণ প্রতীক। য়ু সিলি ফুল!
ব্যস এইটুকুই আমার বলার ছিল। ওঠ রে পাবুল আমরা চলে যাই। বেলা হল। যাবার। বলে পাবুলোর হাত ধরে টানাটানি করতে লাগলেন সুহৃৎ। চেয়ার—ফেয়ার ঠেলেঠুলে বেরিয়ে এলেন বাইরে। কনফারেন্স রুমে একটা হইচই উঠল। যশোও ভিড় ঠেলে বেরিয়ে এলেন। সুহৃৎ তখন হোটেলের দরজা খুলে বেরিয়ে যাচ্ছেন এবং মধুক্ষরা, জিনস ও উইন্ডচিটার পরা মাথায় স্কার্ফ বাঁধা, ঢুকছে!
এ কী জামাইবাবু! পাবলো! কখন এলি! কিছু বলিসনি তো!
পেছন থেকে যশো এই অবসরে তড়িঘড়ি গিয়ে সুহৃতের সামনেটা অবরোধ করে দাঁড়ায়।
তু তুমি… তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?
এই বয়সে কোনও মহিলা যদি মহারাজের মিসিং স্কোয়াডে যেতে চায়, তার আপনজনের হক আছে তাকে ওয়ার্নিং দেবার, তার মহারাজকে ওয়ার্নিং দেবার।
চলুন চলুন সুহৃদ্দা। ওপরে আমাদের ঘরে চলুন। মাথা ঠান্ডা করুন।
ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই ছোট সে তরী। চল রে পাবুল।—সুহৃৎ হনহন করে নিজ হোটেলের দিকে যাত্রা করলেন। দুই বোনও পেছন পেছন এসে পড়ল।
কেউ কোনও কথা বলছে না।—বাঃ ভারী সুন্দর সুইটটা পেয়েছেন তো সুহৃদ্দা! মধুই শেষে বলে।
যশো এতক্ষণে বললে—তুমি শুধু শুধু আমাকে পাবলিকলি অপমান করলে, আমার এতদিনের স্বামী হয়ে?
এতদিনের স্ত্রী যদি হঠাৎ একটা উটকো মহারাজের সঙ্গে গৃহত্যাগ করতে চায়, স্বামী হ্যাজ এভরি রাইট টু ইন্টারফিয়ার।
কে বলেছে গৃহত্যাগ করেছি? আবার মহারাজের সঙ্গে? ছি ছি! ছেলে শুনছে!
কেউ নিশ্চয়ই বলেছে—মধুর চোখের দিকে চেয়ে সুহৃৎ বললেন। কেননা সে প্রাণপণে চোখ টিপছে।
রং ইনফর্মেশন। আমি দুটো স্পিরিচুআল কথা শুনতে পাব না তাই বলে?
হ্যাঁ স্পিরিচুআল কথা না আরও কিছু। হাঁ করে দেখছিলে তো ওই মহারাজটার দিকে। দিব্যি চেহারাটি বাগিয়েছে, টিপিক্যাল গিন্নি—ভোলানো চেহারা।
পাবলো আর পারল না। তার ভীষণ হাসি পাচ্ছে। সে মাসির হাত ঠেলে ঘরের বাইরে টেনে আনল।
আচ্ছা মাসি, তুমি বুঝি বাবাকে এইসব বলেছ? মায়ের অসুখ বলে বাবা আমাকে নিয়ে এল। নাঃ, বাবার রাগ আর জেলাসি এই প্রথম দেখলুম। ফ্যান্টাস্টিক! ব্রেভো মাসি!
না রে, সিরিয়াসলি। আমি দারুণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলুম। দিদি দিবারাত্র ওই মহারাজের কাছে পড়ে আছে। বেরোয় না, আমার সঙ্গে খায় না। খালি প্রসাদ ভক্ষণ হচ্ছে। সে একেবারে কেলেঙ্কারি কাণ্ড। দেখি ঝগড়া কদ্দূর এগোল?
মধুক্ষরা মুখটা বাড়িয়েই চট করে বের করে আনল।
পাবল বলল ঝগড়া কদ্দুর?
মাসি বলল—অনেক দূর। চল, আমরা দু’পাক ঘুরে আসি। খেয়েছিস?