যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল – দ্বিতীয় ভাগ

দ্বিতীয় ভাগ

এইবার যাবো আমরা অন্য জায়গায়
যেখানে মহিলা এক রাস্তায় দাঁড়ায়
বয়ঃক্রম অনধিক তিরিশ বৎসর
ভাবে সে কোথায় যাবে ছেড়ে স্বামীঘর
ঘরে যে-শাশুড়িমাতা, ঘরে যে-শ্বশুর
তাদের যন্ত্রেই স্বামী বেঁধেছেন সুর
রাত্রে তিনি পরীক্ষক দরজাবন্ধ রোজ
কী পারছ, কী পারছ না চুলচেরা খোঁজ
রাতের বৃত্তান্ত থাক বন্ধ আপাততঃ
রাত্তিরে লজ্জার মাথা গিলে খেতে হতো
তারও আগে আছে দিন, ভোর থেকে শুরু
বহু পান, বহু চুন, বহু লঘুগুরু
কাকভোরে উঠে জল দেবে দরজায়
তারপর স্টোভ জ্বেলে চা করার দায়
তারও আগে মনে রেখো কাপড়টি বাসি
আমরা তো কাপড় কেচে রান্নাঘরে আসি
শীত হোক বর্ষা হোক, ইথে নাহি আন
(আমাদের বৌমা ভাই শীতে মুর্ছা যান)
তারপর ঘুরে ঘুরে, আগে আর পরে
স-দুগ্ধ বা চিনিছাড়া চা পৌঁছোও ঘরে
কার কখন শয্যাত্যাগ ধ্যানে রেখো তবে
উল্টোপাল্টা হয়ে গেলে কুরুক্ষেত্র হবে
এ কিন্তু হোটেল নয়, হোটেলের বড়
এ হলো শ্বশুরঘর, মন দিয়ে করো
চা দেওয়া আরম্ভ ক’রে ছাই পরিষ্কার
প্রধান উনুনটি সেজে রাখো এইবার
সাজো, কিন্তু দেখো যেন ধরানো না হয়
শাশুড়ি ৭টায় উঠলে ‘কী বলবেন’ ভয়!
এরপর ছোট তোলা উনুনটি নিয়ে
উঠোনেই আঁচ দাও হাওয়া দিয়ে দিয়ে
আছে দেরী করে আসা ঠিকে ঝি একজন
তার জন্যে যেন ফেলে রেখোনা বাসন
দেখতে দেখতে স্বামী উঠবে, শ্বশুর, দেবরও
হাঁকেডাকে পদভরে বাড়ি পড়োপড়ো
সকালে দু’জন কাজে বেরিয়ে যাবার
পরে নিয়ে বসতে পারো চা-জলখাবার
‘সকালে কী রান্না হবে, কী হবে বিকেলে
জিজ্ঞেস না করে তুমি খেতে বসে গেলে!’
এ-ও শুনবে কোনোদিন, কোনো কোনো দিন
খুঁতের ভিতরে খুঁত, অতি সুকঠিন
এরপর কাচতে আসবে বাসন্তীর মা
সেখানেও আছে বৌমা ওয়াসিং নিরমা
তিরস্কারে ক্ষান্ত দিয়ে দুপুর গড়ায়
বৌমা একাকিনী ঘোরে ছাদ-বারান্দায়
ট্রেনের লাইন দূরে, উঁচু উঁচু গাছে
বর্ষা ফিরি করতে আসা মেঘ থেমে আছে
সব চুবড়ি খোলা হয়নি, ঢালতে বাকি জল
কেমন আছে মিতা, পর্ণা, সঙ্গীতা, কাজল?
ক্লান্ত লাগে বড়, চোখে তন্দ্রা ভেঙে আসে
কেমন জীবন ছিল কলেজের ক্লাসে?
পাস করতে বাড়ি থেকে জোর করে বিয়ে
শুভদৃষ্টি? তার আগে দেখিনি তাকিয়ে
ছবিসহ যোগাযোগ করে থাকে কারা?
বিজ্ঞাপনগুলি করে মা বাবাকে তাড়া
বক্স নম্বরের চিঠি বাড়ি বাড়ি ঘোরে
নির্বিবাদে গিলে ফ্যালে মেয়ে ধরে ধরে
এ-ও বুঝি তেমনি এক গলাধঃকরণে
বৌমা হয়ে পৌঁছে গেছে এই গৃহকোণে
বাড়িটি বনেদি, মুখবিবরটি গোল
কতশত অনুনয়:‘খোল বাবা খোল’…
যদি খোলে: ‘আমার এই মেয়েটাকে নে না
সমস্ত ফুল্‌ফিল করব, সব পাওনাদেনা’
সবই কি মেটানো যায়? দেনাপাওনা নয়
থাক্‌। ধামাচাপা দিয়ে শুভদৃষ্টি হয়
সে-ঘোরে কী দেখলাম মনে নেই ভালো
হাসিকান্না বান্ধবীরা বাসর জাগালো
যা-ই দেখ, মোদ্দা কথা, দেখার আগেই
তাকে স্বামী বলতে হবে, এতে ভুল নেই
মনে কোনো মূর্তি ছিল? তা ভেবোনা আর
বাড়িতে ব্যবস্থা হতো মেয়ে দেখাবার
গা ধুয়ে বিকেলবেলা কাঁপা হাতে সেজে
ঘরে ঢোকা, তাকাবার জায়গা শুধু মেঝে
মাঝে মাঝে, প্রশ্ন হলে, মুখ তুলে তাকানো:
কী পড়েছ? কী রেঁধেছ? ক’টা গান জানো?
উত্তম-সুচিত্রা থেকে অমিতাভ-রেখা
তা-ও হয়ে গেল, শুধু হয়নি পাকাদেখা
আঙুলে কেবলই খুলে জড়িয়েছে বেণী
পাত্রপক্ষের চিঠি কিছুতে আসেনি
আশ্রয় কাকার বাড়ি, বাবা মারা যেতে
সামান্য পেনশন, তা’তে খেতে-পরতে পেতে?
মাস্টার পাওনি পড়তে। ফ্যান নেই গরমে।
ভোর থেকে মা রান্নাঘরে। কাকীমা থমথমে।
ক্লাস টেন থেকে ছিল টিউশানি সম্বল
তা দিয়ে মায়ের জন্য মিষ্টি আর ফল।
মা কিন্তু খেতো না। দিত কাকীমাকে ধ’রে
খুড়তুতো ভাইরা খেতে ফেলাছড়া ক’রে
মেয়েকে দিলে যে মেয়ে খাবে না, মা জানে
রাতে শুয়ে মা-মেয়েতে ঝগড়া কানে কানে:
‘না, তুমি খাবে না কেন? ভূতগুলো খাবে?
যদি কিছু হয়, ওরা ডাক্তার দেখাবে?’
‘চুপ! চুপ! বলতে নেই! বুনো আর তুই
বড় হ, তারপর হবে… দাঁড়া, ফিরে শুই,
এদিকটায় বেদ্‌না হয়’—‘হবেই তো! হবেই!
আরও হবে! মরা অব্দি আর চিন্তা নেই!’
‘রাগ করছিস মিথ্যে, উপায় তো চাই
তোদের দু’টোকে নিয়ে কোথায় বা যাই।’
‘যাওয়ার তো দরকার নেই, মরো খেটেখেটে
যা আনবো ওদের দিয়ে থাকো খালিপেটে।’
‘তোর বাবা যাবার পর ইচ্ছে করে না রে
আছি যদি, খাটতে তো হবেই সংসারে,
খাওয়াটা, জানিস, ওই, মন থেকেই বাধা।
তুই, বুনো, খেলে’—‘সে তো আনি-ই আলাদা!
আনিনা? বুনোর জন্য?’—‘আনিস তো, জানি,
বোনের জন্য যে তোর মন কতখানি
তা আমি জানি না? তবু, দ্যাখ ভেবে-বুঝে
এদেরই আশ্রয়ে থাকতে হয় মাথাগুঁজে
তাইতো এদেরও একটু তুষ্ট করতে হয় …’
‘থামো! সেই এক কথা, আশ্রয়! আশ্রয়!
পেনশনের পুরো টাকা কাকীমার কাছে
ধ’রে দাও না?’—‘হ্যাঁ, দিই তো।’—‘তা হলে কী আছে?
আশ্রয় আশ্রয় করছ?’—‘শোন, মাথা খাটা,
বুনো আর তোর নামে আছে যে টাকাটা
তোদের বিয়ের জন্যে, বাবা রেখে গেছে,
ঠাকুরপো, ক’ দিন আগে, সেটাও চেয়েছে।’
‘কী বলছ মা!’ মেয়ে উঠে বসে বিছানায়
‘হ্যাঁ রে তাই!’ অন্ধকারে গলা কেঁপে যায়।
বাবার পি এফ ., আগে দিলে তো সেটাও?
‘কী করব! ঠাকুরপো চাইল: বৌদি ওটা দাও।
বড্ড ঠেকে গেছি … আর জানো তো দিনকাল
একটাই সংসার টানতে লোকে নাজেহাল
আমার দু দুটো … কতো আমির-ওমরাও
ফেল পড়ে যাচ্ছে … যদি এখন তোমরাও
একটু না সাহায্য করো … বড়দা থাকলে তো
চিন্তাই ছিল না, গিয়ে হাত পাতা যেতো!
বড়দা নেই। ঠিক। কিন্তু নেই কী একেবারে
বউদি আছে, চাইলে বউদি না বলতে কি পারে?
বউদি মানে, শাস্ত্রে বলে, মায়েরও অধিক
ছ’মাসের মধ্যে, দেখো, দিয়ে দেব ঠিক।’
—‘সে ছ’মাস কবে গেছে।’—‘তিনবছর হলো।’
—‘রোজ বলি আমার সামনে কথাটাকে তোলো
তারপর আমি দেখছি!’—‘খবরদার নয়!
এর মধ্যে তুই যাবি না। কী থেকে কী হয়!’
—‘কী করবে? তাড়িয়ে দেবে?’—‘দেয় যদি তাড়িয়ে!
তখন? তখন উঠব কার বাড়ি গিয়ে?’
মেয়ে মাকে দোষ দেয়। মা ভাগ্যকে দোষে।
মা-মেয়ের রাত যায় বিছানায় বসে।
মা বলে, ‘সেবার তা-ও দেরী করালাম।
জায়ের থমথমে মুখ। সই করে দিলাম।
জানি না ঠেকাতে পারব কতদিন আর।’
—‘না তুমি দেবে না, মাগো, দেবে না এবার!’
মেয়ে মাকে আঁকড়ে ধরে। মা ধরে মেয়েকে।
চাঁদ ডোবে মা-মেয়েকে জাগরিত রেখে।
মেঝেতে তোষক পাতা, জ্যোৎস্না পড়ে পা-য়
শেষরাতের শীত লাগছে, বোন কুঁকড়ে যায়।
মা দেয় চাদর টেনে, ও বোন, ও বুনো
সে যখন বড় হবে তার গল্প শুনো।
এখন চাদর থেকে পা বেরিয়ে তার।
মা শুয়েছে। বড় মেয়ে বালিশের ধার
মুঠো করে কান্না চাপছে: ‘জানো তুমি? জানো?
(তার মনে পড়ছে মুখ রাস্তায় দাঁড়ানো।)
যে-তুমি সাইকেল হাতে আমার রাস্তায়
রোজ দাঁড়াও, রোজ তাকাও … বলো, বলা যায়
তোমাকে এসব কথা? তুমি বুঝবে কি?
তোমাকেও রোজ আমি দূরে থেকে দেখি
না-দেখার ভান ক’রে। অথচ যখনই
সামনে পড়ি, শুনতে পাই হৃদপিণ্ডধ্বনি
পোষ্টাপিসপাড়া আর কলেজের মোড়ে
ছেলেরা মেয়েরা সব জোড়ে আর জোড়ে
হাসে, গল্প করে, বলে সিনেমার কথা
কে কবে নতুন বই দেখে এল ক’টা
কার সঙ্গে কার হলো। অথচ তখনই
রুমাল মুঠোয় আমি যাই টিউশনি
কিংবা হাতে খাতা নিয়ে টাইপইস্কুল
সে-যাওয়ায় লম্বা-রোগা তুমি ঝাঁকড়াচুল
দাঁড়াও, চশমার নীচে তাকাও ঝকঝকে
মিত্রা বলে, কে ছেলেটা? খুব দেখলো তোকে?
—‘জানি না তো।’—‘বল্ না বাবা! লুকিয়ে কী আর
লাভ হবে! ভাল কিন্তু! কী টল ফিগার।’
কী দেখেছ, কী দেখেছ, ও অচেনা ছেলে
তুমি তাকিয়েছ বলে সমস্ত বিকেলে
এত রঙ লেগে যায়! সমস্ত সকাল
উঠোনে রোদ্দুর বলে: কী হয়েছে, কাল?
কী আবার হবে—আমি না-বোঝার ভানে
দৌড়ে ঘরে এসে ভাবি: মা যেন না জানে।
মা জানলে তো মেরে ফেলবে। নাকি মরবে নিজে?
আমার বালিশ হলো কান্না জলে ভিজে।
সে কথা বলিনি, মরে গেলেও বলব না
এত যে অভাব, ভয়, এত দুর্ভাবনা
যখন অতিষ্ঠ করে চেপে ধরে দম
তোমাকে, তোমাকে বলি—তুমিই প্রথম!
কে প্রথম কে বা শেষ কী বা আসে যায়
আজ এই মহিলা ভাবছে দাঁড়িয়ে রাস্তায়
মহিলার বয়ঃক্রম তিরিশ বৎসর
কী হবে সে সব ভেবে দশবছর পর?
সে সব দিনের তবু ছিল পরদিন
পথে নামলে আশা জাগত, উজ্জ্বল বা ক্ষীণ,
সে আসবে, সে আসবে, নাকি আসবেই না আজ
এ মোড় ও মোড়—ওই তো—শিরে পড়ত বাজ!
দু’চার ঝলক মাত্র! হেঁটে বা সাইকেলে …
ও ছেলে অবাককরা যাদু করে গেলে!
ম্লান ছাত্রবাড়ি, ঘিঞ্জি টাইপ ইস্কুল
যে দিকে তাকাবে শুধু ফুল আর ফুল
বাড়িতে এসেও মেয়ে ফুল দেখতে পায়
লন্ঠন মাদুর বই সমস্ত জায়গায়
পরদিন দুপুরবেলা চান করতে গেলে
তখনও তোমাকে ডাকি, ও অচেনা ছেলে
কেননা যখনই স্নানে যাই কলঘরে
ছাত থেকে একজন স্নান লক্ষ্য করে
সেই একজন হলো খুড়তুতো ভাই
এবং তখনই তার ছাতে আসা চাই
বেঁটে বন্ধু আছে এক! চাউনি ভাল নয়!
বিরক্তি দেখাই যদি হাসাহাসি হয়
সমস্ত লুকিয়ে রাখি, তবু মা-র চোখে
ভয় লজ্জা ধরা পড়ে, ‘কী করেছে তোকে?’
‘কে কী করবে,’ আমি বলি, ‘বিল্টু আর ওর
বিচ্ছিরি বন্ধুটা,’ ‘গায়ে হাত দিয়েছে তোর?
বলতো, ঠিক করে বল’ … ‘কী বলছ! যাও তো!
পাগলা হয়ে গেছ তুমি’ … তবু মায়া হতো
যতই ধমকাই মুখে মনে জানতাম
মা বোঝে, বয়স দিয়ে, চাউনির কী নাম।
কাঁটা হয়ে থাকা ও গো, কাঁটা সর্বক্ষণ!
এমন সময় ঘটল সত্য-অঘটন।
পরের রাস্তায় থাকত ঘোষ সীতারাম
দু’তিনটে মাছের ভেড়ি, চালের গুদাম
উপরন্তু ফ্ল্যাট বানায় বড় ছেলে তার
পাড়ায় প্রভাব খুব, উঠতি প্রোমোটার
একদিন হঠাৎ দেখি দরজায় এসে
কী বলছে কাকার সঙ্গে মাইডিয়ার হেসে
বলুক গে, তখন তাড়া, টিউশনি-সকাল
আমাকে দেখেই কাকা হাসল একগাল
ব্যাপার কী? হাসির এত কী হল হঠাৎ?
কী জানি, কোথাও হয়ত খুলেছে বরাত
কেননা কাকার চাকরি ছাড়াও তো আরো,
নানা রাস্তা: ফাটকা, রেস, শেয়ার বাজারও …
গুড নিউজ, গুড নিউজ, কী বলল ছেলেটা?
ও নিশ্চয়ই এসবের জানে এটা সেটা
যা হোক সন্ধেয় দেখি ঘরে জ্বলছে আলো
কাকিমা আদর করে তরকারি পাঠালো
‘একটু তো নজর দিবি শরীরের দিকে
এত পরিশ্রম নইলে সয় কী গতিকে?’
বুঝলাম না কী ব্যাপার। পরে মা বলেছে
কোম্পানিকাগজ আর কী কী সব বেচে
মোটা টাকা পেল কাকা, যাকে বলে দাঁও
এর মধ্যে ছিল না কি ওই ছেলেটাও।
আর মাথা ঘামাইনি, দু’চারদিন পরে
সন্ধেবেলা ডাক পড়ল কাকাদের ঘরে
গিয়ে দেখি কাকা আছে কাকি আছে আর
সেই ছেলেটাও আছে, সেই যে, প্রোমোটার
কাকা বলল, আয় আয়, চিনিস তো মন্টুকে?
(খুব চিনি, মাধ্যমিকে ধরা পড়ল টুকে)
মুখে বলি, হ্যাঁ জানি তো, থাকেন সামনেই
‘তোমার সঙ্গে তো ঠিক পরিচয় নেই’
দেঁতো হাসলো লোকটা—‘কিন্তু আজ তোমার কাছে
আমার একটা পার্সোনাল রিকোয়েস্ট আছে’
চিনিনা! জানিনা! একি! রিকোয়েস্ট? মানে?
তুমি করে কথা বলছে, সহবৎ জানে?
‘আমার ভাইঝির একটা টিউটর দরকার
তুমি যদি করো তবে চিন্তা নেই আর
সিক্সে উঠল, কতদিন বলছি সোনাদাকে
পাড়ায় শিক্ষিত মেয়ে থাকতে আর কাকে
ফালতু গিয়ে ধরি … যাক্। বলো তুমি রাজি
পেমেন্টও, লোকে যা দেয়, বেশি তার। বাজি!’
‘না এখনই কিছু বলতে পারছি না আপনাকে
পরে বলব, এ সময়টা একটু চাপ থাকে’
বলে, ঘরে আসি। লোকটা কী রকম যেন!
কাকা-কাকিমারও এত ইনটারেস্ট কেন?
যাকগে ওরা কার প্রতি আগ্রহ দেখাল
আমার সে সব নিয়ে না ভাবাই ভালো!
মাসখানেক কেটে গেছে। কাকীমা দু’বার
মনে করিয়েছে। আমি এগোইনি আর।
সেটা রবিবার ছিল, দুপুরের পরে
বসেছি সেলাই নিয়ে, কে ঢুকল ঘরে?
মুখ তুলে তাকিয়েছি—মন্টু প্রমোটার!
‘কী ব্যাপার, বহুদিন খবর নেই আর?’
উঠে দাঁড়িয়েছি হাতে সেলাইটা নিয়ে
‘উঠলে কেন?’ লোকটা বসে পা দুটো ছড়িয়ে
বলে সে নিঃশ্বাস ফেলে ম্লান করে মুখ;
‘আমার ভাইঝিটা তবে ‘মুখ্যুই থাকুক!’
‘না, না, সে কী! কী বলছেন!’ বাধ্য হয়ে বলি।
‘এত কাছে, সামনে তো, দুটো মাত্র গলি
পরেরটাই … ছাদে উঠলে প্রায় দেখা যায়
তাও কেন রাজি হও না আসে না মাথায় …’
‘না, মানে, আমার পক্ষে সময় করাই
এখন মুশকিল … অল্প ক’জনকে পড়াই
তা ছাড়া নিজের কাজ, আছে পরীক্ষাও …
‘কী পরীক্ষা?’ ‘পি.এস.সি.-র’।
—‘চাকরি করতে চাও?’
‘আমাকে বলনি কেন? (কেন বলব ওকে?)
ফি-বার এই হাত দিয়ে কতজন ঢোকে!
কীসে চাকরি করতে চাও? রেলে ঢুকবে? রেলে?
কেবল আমার সঙ্গে একদিন গেলে
সব হয়ে যাবে। একটা বায়োডাটা দিও,
কেমন?’ … দাঁড়িয়ে উঠল, দরজায় … যদিও
যাবার লক্ষন নেই। দুএক পায়ে কাছে
এগোল: অমন হাত ফাঁকা রাখতে আছে?
(বুঝলাম না।) ওইটুকু সরু একটা ঘড়ি,
এটা কিন্তু আমি খুব ডিসলাইক করি।
সোনা পরে থাকবে হাতে … ওই চিকণ হাত!
অর্নামেন্ট নেই ঘরে?’ বলেই হঠাৎ
কাঁধ ধ’রে টেনেছে সামনে: ‘কী লাগবে তোমার?’
ফোলা নাক। ফোঁস ফোঁস শ্বাস বইছে তার।
‘ছাড়ুন!’—‘না, আগে বলো!’—‘ছাড়ুন বলছিনা!’
ধাক্কায় সরাই, পেটে পাক দেয় ঘৃণা
সামনে লাল-কালো মুখ, কষে থুতু আসে
হাঁপায়, লজ্জাও নেই, আবছা মতো হাসে
‘রেগে যাচ্ছো কেন?’ কাধে হাত রাখতে যায়
নিজেকে সরিয়ে নিয়ে এক ঝটকায়
দাঁতে দাঁত বলি: ‘একটা কথা নয় আর।
এক্ষুণি বেরোন নইলে চেঁচাব এবার।’
লোকটা বেরিয়ে যেতে মুখ চাপা দিয়ে
একা একা কাঁদলাম বাথরুমে গিয়ে
সময় লাগলো না বেশি জানাজানি হতে
কাকীমা শুনিয়ে দেন: ‘কী হয়েছে ওতে
কিছুতো করেনি হাতটা ধরেছিল মোটে!
অত পয়সাঅলা ছেলে সবার কি জোটে?
পয়সাঅলা ছেলে? জানো বউ আছে ওর!
সে থাকে থাকুক গে, তাতে কী হয়েছে তোর?
ওরা কত দ্যায় থোয়, শাড়ি গয়না টাকা
ওসব লোকের সঙ্গে ওঠাবসা থাকা
কত ভাল তা জানিস? মানইজ্জত রাখ
ঘরে একটা পয়সা নেই, রূপের দেমাক!’
রূপ একটু ছিল, সেটা বুঝিনি তখন
তখন বুঝতাম যেটা সেটা হল মন
শক্ত একটা মন ছিল, সে-অল্পবয়সে
কেউ ঘুরে গেছে তার বাইরে দূরে এসে
ভাবিনি তখন আমি, ও অচেনা ছেলে,
কেবল রাত্তিরবেলা মা-র কাছে গেলে
যতই লুকোই, দেখি, মা সমস্ত জানে
‘তোকে সামনে রেখে ওরা ছেলেটাকে টানে’
‘কী করে বেরোব মাগো, পালাব কী করে?’
মা মেয়েকে আঁকড়ায়, দমকা হাওয়া ঘোরে
তারাচক্র ঘোরে বাইরে, রাত্রির মাথায়
একাকী চাঁদের খেয়া অন্যপারে যায়
দুইজন নারী ওরা, দু’জনেই নারী
আমরা কী ওদের কথা ঠিক বুঝতে পারি?
তাদের একজন আজ দশবছর পর
সব ছেড়ে দাঁড়িয়েছে রাস্তার উপর
কেন সে এমন করছে, মা কোথায় তার?
আমরা সেসব কথা শুনব এইবার।

সেই ঘটনার দু’-এক মাস পরে
মন্টু তখন ঢোকে না আর ঘরে
কাকার সঙ্গে সদর দরজায়
দাঁড়িয়ে কথা বলেই চলে যায়
কাকাও খুব বিরক্ত, ভাইঝিকে
বুঝিয়ে দেয় সাপোর্ট কোন দিকে
লেখাপড়াও ভস্মে ঢালা ঘৃত
পরে আবার বেইমানি করবি তো?
আবার? মানে? করেছি একবারও?
মুখের ওপর কথা বলতে পারো?
কাকা হয় না? কাকা হয় না? কাকা?
খুব বেশিদিন এই বাড়িতে থাকা
বোঝাই যাচ্ছে সম্ভব নয় আর
এমন সময় একদিন আবার
মন্টু তাকে ধরলো, ঘরে নয়,
যেন অনেক আলাপ-পরিচয়
এমন ভাবে বিকেল পাঁচটায়
রাস্তা আটকে দাঁড়াল রাস্তায়
‘দরকার আছে, কোথায় যাচ্ছো?’—‘বাড়ি।
কী দরকার বলুন তাড়াতাড়ি।’
‘সেদিন আমায় লোফার ভেবেছ তো
তোমার জন্য একটা ছোটমতো
প্রেজেন্ট ছিল, সঙ্গে সেটা নিয়ে
গিয়েছিলাম’—‘প্রেজেন্ট? মানে?’— ‘ইয়ে,
একটা হার, পিয়োর গোল্ড, মানে,
জিগেস কোরো, তোমার কাকা জানে!’
কাকাও জানে! সেদিন কাকীর কথায়
শাড়িগয়নার আভাস ছিল। ‘কোথায়?
কোথায় সেটা? কাকাকে দেননি তো?’
‘মাথা খারাপ!’ মন্টু বিগলিত
‘তোমার কাকা! জানি না কী জিনিস?
হাতে পেলেই একবারে ফিনিস!
তোমার হাতেই দেব…সে জন্যই
সেদিন গিয়ে ফালতু সব ওই…
যাকগে, কিছু মাইন্ড করোনি তো!’
নাক ফুলছে: চাউনি কিছু ভীত
কিন্তু লোভী। ‘যাক্, এবার তবে
বলো তোমার বাড়ি যাচ্ছি কবে?’
‘বাড়িতে? কেন?’… ‘মানে কী, ইয়ে, যাতে,
নিজেই দিতে পারি তোমার হাতে।’
‘বরং নিজের বউকে গিয়ে দিন’
‘বউকে… ইয়ে…’—‘থামুন, কোনোদিন
এরপরেও এগোন যদি, তবে
আমায় কিন্তু লোক ডাকতে হবে।’
বলেই দ্রুত এগিয়ে যায় মেয়ে
এবং দেখে একদৃষ্টে চেয়ে
দাঁড়িয়ে আছে অচেনা সেই ছেলে!
অবাক চোখ, এক হাত সাইকেলে…

সন্ধেবেলায় মুখনিচু বাড়ি আসি
বিছানায় দেখি বসে আছে বড়মাসী
মাসীর সঙ্গে মা-ও আছে সেই ঘরে
বোন দুলে দুলে পড়া মুখস্থ করে
ঘরে ঢুকতেই: ‘এসেছিস? আয় আয়
চা খাবি তো?’—‘না না’—‘আধকাপ হবে প্রায়
না আবার কী রে’…বলে মাসি ঢালে প্লেটে
মা বলে: ‘এমন পাপ না-ধরলে পেটে
চিন্তা ছিল না! কবে ছেড়েছুড়ে গিয়ে
অনাথাশ্রমে থাকতাম ঠাঁই নিয়ে!’
মাসী বকে ওঠে: ‘তোর মা, সত্যি, পারে,
মাথাটা দেখছি বিগড়েছে একেবারে
নিজের মেয়েকে এভাবে বলছে! এ কী!
যার নেই তার ভাগ্যটা ভাব দেখি!’
মা ঝামরে ওঠে: ‘ভাগ্য দেখাসনি রে
ঠাকুরকে ডাকি প্রতিদিন ফিরে ফিরে
চেয়েও দ্যাখে না, মেয়েকে নিয়েই রোজ
সে-ই এককথা, একশো রকম খোঁজ
কার বাড়ি যায়, কী করে বেড়ায়, কাকে
ধরেবেঁধে বিয়ে বসে যাবে কোন্ ফাঁকে
তখন দেখব কত হয় বাড়িগাড়ি—!’
‘কে বলে এসব? —‘কে আবার, যার বাড়ি
সে-ই বলে’—‘কাকা?’-‘ঠাকুরপো নিজে নয়
বউকে দিয়েই এসব বলানো হয়।’
‘ওদের হুকুমে আমাকে এখন তবে
ওই মন্টুর সঙ্গে মিশতে হবে!’
এইসব শুনে মাসী অপ্রস্তুত
‘কে কার সঙ্গে মিশবে? কী অদ্ভুত!
মন্টু কে?’—‘আছে।’—‘আছে তো! কে সেটা শুনি।’
মা বলে, ‘আস্তে, যদি আসে এক্ষুনি!’
‘কে আসবে, কাকি? পাটা আছে নাকি বুকে
স্ট্রেট উত্তর দিয়ে দেব মুখে মুখে
বাড়ি কি ওদের? অংশ আছে তো বাবারও।’
‘বলিস না, তোকে বারণ করছি আবারও
বুঝিস না ওরা আহ্লাদ পাবে এতে?
সঙ্গে সঙ্গে বলে দেবে কোর্টে যেতে।’
‘যেতে হলে যাব। ডিসিশন হয়ে যাক
ওরাই কেবল ধমকাবে?’—‘রাখ রাখ
কে করবে শুনি ওসব কোর্টকাছারি
কত টাকা লাগে! ওসব আমরা পারি?’
এইবার বোন অভিযোগ করে ওঠে
‘আমার কিন্তু পড়া হচ্ছে না মোটে!
তোমরা ঝগড়া করবে কেবল, আমি
একা পড়ে যাব?’—‘শুরু হল বাঁদরামি!’
মা ধমকে ওঠে—‘ওই তো বারান্দায়
অতটা জায়গা ওখানে তো বসা যায়!’
‘বারান্দায় কি মশা নেই নাকি তাই!’
বড়মাসী বলে, চল্ আমরা ছাদে যাই
—‘ছাদে? সেই ভালো!’—‘আচ্ছা, তোরা যা তবে’
মা বলে, ‘আমাকে রান্নায় যেতে হবে!’
‘তবে চলো’, বলে আমি আর বড়মাসী
পায়ে পায়ে পায়ে একছাদ উঠে আসি
পাশে পাশে আরও একছাদ ওঠে চাঁদ
ঘেঁষাঘেষি বাড়ি, বিবাদ, বিসম্বাদ
কানাঘুষো কথা, সন্দেহ ভাঙা কাঁচে,
এক-এক ছাদের দূরত্বে পড়ে আছে
শুধু গাছগুলি কাছের মানুষ, জল
নিচের পুকুরে—‘সব আমায় খুলে বল
কী। হয়েছে তোর।’ অমনি ভেঙেছে বাঁধ
হু হু করে আরো একছাদ ওঠে চাঁদ
সব বলে দিই, সব বলি, ‘ওগো মাসী
এই ফাঁদ কেটে কী করে বাইরে আসি?
একাও তো নই, সঙ্গে মা আর বোন।’
মাসি বলে, ‘শোন, কাঁদিস না, অ্যাই শোন
আমি রয়েছি তো! আমি তো আছি এখনো’…
বুকে মাথা রেখে কেঁদে চলি, আর কোনও
সান্ত্বনা যেন স্পর্শ করে না প্রাণে
মাথাটি জড়িয়ে মাসী বলে কানে কানে
‘এই মেয়ে চুপ! কাঁদার কী এত আছে?
হ্যাঁ রে, বল দেখি, থাকবি আমার কাছে?’

মাসীর বাড়ির ওপর-নিচে পাঁচখানা ঘর
সামনে একটু বাগানমতো জায়গা আছে
লম্বা টানা ছাদ আছে, তার একপাশে শেড
শহরতলিই, কিন্তু অনেক অন্যরকম
আগের মতো ঘিঞ্জি-গুমোট এখানে নেই
আগের বাড়ি এখান থেকে দুটো স্টেশন
সব মিলিয়ে মিনিট কুড়ি সময় লাগে
উপায় আছে যেমন খুশি যাওয়া-আসার
বাড়ির সামনে পিচরাস্তা শুরু হয়নি
গেটের থেকে সদর অব্দি মাটির রাস্তা
এটাই ভালো, কেমন যেন না -বাঁধা পথ
পাশ ঘিরে সব আগাছাঝোপ, গ্রীষ্মকালে
হাওয়া দিলেই ধুলো উড়বে, আষাঢ় মাসে
জল পড়লেই কাদায় কাদা, তা-ও কি খারাপ?
মেসো বিরাট চাকরি করে, অফিস থেকে
আনা-নেওয়ার গাড়ি আসে সকাল সন্ধে
একটি ছেলে ওদের। এখন বিদেশবাসী
মেসোও খুব খুশি আমার চলে আসায়
মাসী আসতে চেয়েছিল মা-দের নিয়েই
দুটো স্টেশন গিয়েই না হয় বুনো এখন
স্কুল করতো। আনা-নেওয়ার লোক রয়েছে।
তেমন হলে পরের বছর স্কুল বদলে…
কিন্তু মায়ের আপত্তিটা অন্য হলো
মা বললো যে আজ একবার ছেড়ে এলে
পরে কি আর ওই বাড়ির দখল পাবো?
ক’দিন বরং কষ্ট করে পড়েই থাকি
কিছু একটা ব্যবস্থা ঠিক হবেই দেখিস
আমার কলেজ শেষ হয়েছে। কেবল দুটো
টিউশনি আর টাইপকরা। বলল মাসী:
‘টিউশনি তো এপাড়াতেও পাবি অনেক’
পেয়েও গেলাম, সকাল-সন্ধে দু জায়গাতে
বাকি সময় নিজের, যেন বেঁচে গেলাম
সেই যে একটা সবসময়ের দুর্ভাবনা
সেটা তো নেই, সব সময়েই কাকা-কাকির
মুখ দেখা আর কলঘরে সেই সতর্কতা
এখন অনেক নিজের মতো চান করা যায়
মা আর বুনো এর মধ্যে ঘুরেও গেল
শুনলাম যে ওদের নাকি মেজাজ গরম
মন্টু নাকি কাকার সঙ্গে ক’দিন আগে
ঝগড়া করল কীসব পাওনাগণ্ডা নিয়ে
হাসিই পেল। সত্যি, তবে বেঁচেই গেলাম?
কলেজবেলার বান্ধবীরাও হঠাৎ এসে
হইহইতে একটা বেলা কাটিয়ে গেল
কিন্তু শুধু একজনেরই সন্ধান নেই
কী আর হবে? নামটাই তো জানি না তার
এখন সে কি এসে দাঁড়ায় বিকেলবেলা?
তাকায় অমন? ঝকঝকে চোখ, সত্যি তাকায়?
কার দিকে সে কার দিকে আর আমি ছাড়া?
না না এসব বন্ধ, এসব ভাবব না আর
বন্ধু বন্ধু ওসব বন্ধ। ঠিক করলাম
পড়ব আবার। চাকরি পাবার পড়াশুনো
এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জের কার্ড তো ছিলই
সময় হতেই চলে গেলাম রিনিউ করতে
ফিরছি, হঠাৎ পিছন থেকে: ‘শোনো একটু’
তাকিয়ে দেখি প্রবীণ মতো একটি মানুষ
চেনা লাগছে? হ্যাঁ হ্যাঁ এই তো একটু আগেই
এই অফিসের কাউন্টারেই দেখলাম না?
চশমা পরা, ফর্সা, মাথায় সব পাকাচুল
আমার দিকে স্মিতহাস্য তাকিয়ে আছেন
‘হ্যাঁ মা আমিই ডাকছি, কিছু ভাবলে না তো?’
‘না ঠিক আছে, বলুন, কিন্তু আপনাকে ঠিক—’
‘চিনলে না তো? আমি কিন্তু তোমায় চিনি
তোমায় তুমি বলছি, কেমন? রাগ কোরো না?’
‘না, তা’তে কী? —‘কিন্তু তাতেই অনেক, মাগো!
যাক গে নিজের নামটা বলি, কমল বসু
এই অফিসেই চাকরি করি, রিটায়ারের
সময় তো প্রায় হয়েই এলো…এসো একটু
ছায়ায় দাঁড়াই, রোদটা আজ বড্ড চড়া
তোমার নাম তো জানাই আছে, কার্ড দেখেছি
বাড়ি কোথায়? কোন পরীক্ষা দেবে এবার?
ক’ভাইবোন? দু বোন মাত্র? আর কে আছেন?
তোমার বাড়ির অ্যাড্রেসটা বলো দেখি
তোমার মা-কে কখন গেলে পাওয়া যাবে?
মা-র কাছে নয়? মাসীর কাছে? আচ্ছা, আচ্ছা!
পড়াশুনোর সুবিধে হয়? তা-তো বটেই!
মাসীর ঠিকানাটাও তবে লিখে রাখছি।’
সত্যি, আমার অবাক লাগছে। মানুষটাকে
খারাপ ভাবা সম্ভবই নয়। কিন্তু হঠাৎ
বেছে বেছে আমায় এসব প্রশ্ন কেন?
মায়ের কাছে আসবে? কিন্তু কেন! কেন!
ক’দিন পরে নতুন করে পড়াশুনোয়
মন বসাচ্ছি, হঠাৎ মেসোর অফিস থেকে
খবর এলো মেসো এখন হাসপাতালে
যে গাড়িতে অফিস যেত সেই গাড়িতেই
অ্যাক্সিডেন্ট
অফিসে ঠিক ঢোকার মুখেই
একটা লরি…
আমরা ছুটে যেতে যেতেই সমস্ত শেষ
হাসপাতালের সামনে মেসোর কলিগরা সব
দাঁড়িয়ে আছে, মাসি এমন অবাক চোখে
তাকিয়ে রইল যেন কোথাও কিচ্ছু হয়নি
পরক্ষণেই চোখের দৃষ্টি বদলে গিয়ে
জ্ঞান হারালো
তারপরের কয়েকটা দিন কেমন ভাবে
কাটলো সেসব আমার বলার সামর্থ্য নেই
সর্বসময় মা রইলো পাশে পাশেই
বিদেশ থেকে মাসীর ছেলে প্রবুদ্ধদা
দুদিন পরে উড়ে এলো, অল্প ছুটি
শ্রাদ্ধশান্তি মিটে যাবার পরে পরেই
বলল: ‘বাড়ি বিক্রি করে চলো এবার।’
‘কোথায় যাবো?’ —‘আবার কোথায়? আমার সঙ্গে
আমেরিকায়’…..
মাসী বলল: ‘যাবো কিন্তু বাড়িটা থাক
ফিরব যখন’…. ‘ফিরবে কেন?’ —‘ফিরতে হবেই।
এক বছরের জন্য যাব। একটা বছর
তালা থাকুক। কেয়ারটেকার রেখে যাচ্ছি।
আর তা ছাড়া ও-ই তো আছে’….। আমার দিকে
তাকিয়ে মাসি বলল: ‘কিন্তু একলা ওকে
এই বাড়িতে রেখে যাওয়া বিপজ্জনক
ওর মা-তো আর আসবে না, কী, আসবি নাকি?’
মা বলল: ‘উঁ— না, মানে ওই বাড়ির অংশ’…
‘অংশ নিয়েই থাক তা হলে’: বকল মাসী
বলতে বলতে দেখলাম যে গেটের সামনে
দুটো রিক্সা থামছে এসে, একটা থেকে
নামছেন এক বয়ঃজ্যেষ্ঠা মহিলা, এক
বৃদ্ধপুরুষ, অন্যটিতে বসে বসে
খুচরো গুনে ভাড়া মেটান যে ভদ্রলোক
তিনি আমার পূর্বচেনা।
কী নাম যেন? এক্সচেঞ্জের?
কী এক বসু…

সেইদিন থেকে বুঝতে পারছো
কোনদিকে যাবে মেয়ের ভাগ্য
আন্দাজ করা কঠিন না, তবু
গল্প-খাতিরে বলতে হচ্ছে
ঘরে যারা ছিল তারা হতবাক
মা, মাসী, বুনো, প্রবুদ্ধদা-ও
দেখল যে গেট খুলে তিনজন
বাগান পেরিয়ে এদিকে আসছে
কে রে এরা? কারা? মেয়েটি তখন
দরজাটা খুলে বাইরে দাঁড়াল
সেই মানুষটি হেসে বললেন:
‘কী গো মা আমায় চিনতে পারছো?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। মা ইনি আমার
এমপ্লয়মেন্ট অফিসের চেনা।’
মা এবং মাসী দুজনেই: ‘ও ও
আচ্ছা, আচ্ছা, আসুন, বসুন।’
অতিথিত্রয়কে ঘরে ডেকে এনে
বসাবার পর যা-যা জানা গেল:
এ ভদ্রলোক, শ্রীকমল বসু
ইনি হচ্ছেন বরের মাতুল
বর? হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক! ঠিকই ধরেছেন
আর ওই দু জন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা
ওরা যে বরের মা বাবা সেটাও
বুঝতে এখন কোনো ভুল নেই
‘তোমাকে দেখেই মনে হয়েছিল
সত্যি সর্বসুলক্ষণা
কী দিদি তা-ই না?’ মহিলা বলেন:
‘এমন মেয়েই খুঁজছি আমরা।’
ছেলে কাজ করে, সরকারি কাজ
মাইনেপত্র ভালই। স্বভাব?
‘নিজের মুখে তা কী আর বলব
একদিন যদি পদধূলি দ্যান
এমন মেয়েকে ঘরে আনবার
শখ আমাদের বহুদিন ধরে
কমলকে তাই বলতাম রোজ…
এসো মা, অমন লজ্জা পেও না।’
ওরা চলে যেতে তখনও সবার
ঘোর কাটছে না কথা সরছে না
ব্যাপারটা ঠিক কী হল ভাবতে
সকলে কেমন দিশেহারা মতো
অবশ্য দিশা হারানোরই কথা
মেঘ না চাইতে এতখানি জল
কাকার ওখানে কতবার বসা
পাত্রী দেখানো, সবই নিস্ফল
শেষকালে কী না বাড়ি বয়ে এসে!
এমন ভাগ্য ক’জনের হয়?
দাবিদাওয়া কিছু নেই সেরকম
পাত্রীই শুধু ছিল বিবেচ্য
তাই না অমন খোঁজাখুঁজি আর
অপছন্দের তালিকা বাড়ানো
মেয়েটি ভাবল: আমার মতন
কতসব মেয়ে বাতিল হয়েছে
মা যেন সঙ্গে সঙ্গেই রাজি
না বলবে তার পথ রাখলো না
এত বড় মেয়ে, এত হাঙ্গামা
কাকা আর মাসী ক’দিন পুষবে?
কী রকম যেন বোঝা হয়ে গেছে
তাড়াতে পারলে বাঁচবে সবাই
মাসীও বলল : ভালোই তো হয়
একদিন গিয়ে দেখে আসা যায়
দেখার আগেই সকলে কিন্তু
মনে মনে যেন রাজি হয়ে গেল
এক্ষুনি বিয়ে? এত তাড়াতাড়ি?
না আমি পড়ব। চাকরি করব।
পড়ুক না আরো, ওরা তো বলছে!
পড়াশুনো হয় বিয়ের পরেও
চাকরি পেলে তো সোনায় সোহাগা
এক্ষুনি এত না-এর কী আছে?
এমনকি মাসী, মাসীও বোঝালো:
‘এখন থেকে তো আমি থাকব না
তুই কী করবি চিন্তা তো হবে…
বিয়ে হয়ে গেলে সবচেয়ে ভালো…
নিজেদের বাড়ি, জমিজমা আছে
এক ভাই সবে কলেজে ঢুকেছে
শ্বশুর শাশুড়ি। ভাব তো এমন
নিঝঞ্ঝাট ফ্যামিলি কি পাবি?
আসলে মাসীকে দিশেহারা করে
দিয়ে গিয়েছিল স্বামীর মৃত্যু
মাসীরও তখন সব দিক ঠিক
ভাবার মতন অবস্থা নেই
দেখতে দেখতে সব মিটে গেল
মাস তিনেকের মধ্যেই প্রায়
মাসীও কেবল বিয়ের জন্যে
ওই ক’টা মাস রইল তখন
তারপর এক নতুন জায়গা
নতুন নিয়ম, নতুন নিষেধ!
স্বামীটি শান্ত, কঠিন স্বভাব
মা বাবাকে খুব মান্যও করে
রাত্রি হলেই অন্য মূর্তি
কথা নেই কোনো, ভূমিকাও নেই
প্রথম থেকেই মারনোন্মুখ
বিচিত্র সব হুকুম, আদেশ
সব ঠিকমতো পালন করবে
এটা চাই আর ওইটাও চাই
ভালোবাসাহীন রীতিপদ্ধতি
ঘাড়মুখগোঁজা নিয়মনিষ্ঠা
সকালে উঠেই অন্য দিকের
আরেক রকম হুকুম তামিল
ঘড়ি ধরে আর ঘাড় ধরে ধরে
একটা একটা ধাপ থেকে ধাপ
যদি বলো: আমি পরীক্ষা দেব।
তাহলে বাড়ির কাজ করবে কে?
সংসারে সব কাজ শেষ করো
তারপর গিয়ে পড়তে বোসো গে
কাজ শেষ হতে সন্ধে, তখন
স্বামী এসে যাবে, বলবে: এটা কী
বই-খাতা নিয়ে কী শুরু করেছ?
পড়াশুনো করে হাতিঘোড়া হবে?
‘আগে তো এমন কথা হয়েছিল
আবার পড়ব, চাকরি করব।’
‘চাকরি? হঠাৎ? আমি কি তোমাকে
খাওয়াতে-পরাতে পারছি না আর?’
‘খাওয়া-পরা নয়, চাকরি তো কাজ
সংসারে কিছু সাশ্রয় হয়।’
‘কেউ তো বলেনি। এ-বাড়িতে এত
কাজ পড়ে আছে তাতে হচ্ছে না?
এর পরে আর কথা বাড়াবার
অর্থ হয় না। চুপ করে যাওয়া
ছাড়া আর কোন উপায়ও থাকে না
তাই সে মেয়েটি চুপ করে গেছে
দিনের অন্তে সুবিধামতন
নিজের চাহিদা মেটানো মাত্র
পাশ ফিরে ঘুম, নাক ডেকে ওঠা
এ ব্যতীত কোনো যোগাযোগ নেই
ভোর থেকে রাত, রাত থেকে ভোর
যন্ত্রের মতো দুই জায়গায়
দাঁতে দাঁত চেপে শুধু ব্যবহার
শুধু ব্যবহার হতে দিয়ে যাওয়া
এই চক্রেই বছর ঘুরেছে
মেয়ে ঘুরে গেছে মায়ের বাড়িতে।
মাসীও এসেছে। ফিরে গেছে ফের।
না। মেয়ে কাউকে কিছু বলেনি।
মাসী বলেছিল: ‘ভালো আছিস তো?’
‘কেন থাকব না?’ —‘না, তোর মুখটা
কীরকম যেন শুকনো দেখছি!
রোগা হয়েছিস, কিছু হয়নি তো?’
‘কী আবার হবে? রোগাই তো ভাল।’
বলেই মেয়েটি চোখ সরিয়েছে
জানলায় ঝুঁকে বলেছে: ‘ও মাসী
এ গাছটা কবে আনিয়েছিলে গো?’
‘সেই তোর মেসো যাবার আগেই
লাগিয়েছিলাম। বড় হয়েছে না?’
‘তা তো হয়েছেই। ছায়াও দিচ্ছে
দেখতে দেখতে কত বড় হলো।’
‘মাসী তুমি জানো আগেকার দিনে
পাত্র না পেলে মেয়েদের নাকি
গাছের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিত
গাছবর বেশ মজার না? বলো?’
‘সত্যি বল তো বরের সঙ্গে
ঝগড়া হয়েছে?’ —‘পাগল হয়েছো?
ঝগড়া করার লোকই নয় সে!’
মাসী বলে: ‘আমি তাই তো বলছি’
মনে মনে বলে মেয়েটি : মাসী গো
ঝগড়া করার জন্যেও কিছু
যোগাযোগ লাগে, আলো নেভানোর
হুকুম মাফিক যোগাযোগ নয়
গাছ তো কখনো বলবে না আর
গোড়া ঘসে দাও, পাতা মুছে দাও
যাও বাগানটা সাফ করে এসো
মাটি খুঁড়ে দাও, আগাছা ওঠাও
গাছ তো কখনো তোমার জন্যে
সাইকেল হাতে দাঁড়াবে না আর
‘গাছ কোথা গেলে?’ বলে তো কখনো
তুমি রাস্তায় ঘুরে মরবে না!
ও মাসী তোমার বাড়ির দুপাশে
এতগুলো গাছ, এতগুলো গাছ
তার থেকে কেন একটাকে তুমি
আমার সঙ্গে জুটিয়ে দিলে না!
বলতে বলতে মেয়ে বাথরুমে
চান করবার ছল করে কাঁদে
দু চোখের জল স্নানজলে মিশে
মেয়েটিকে বলে : ‘বৌমা কেঁদো না।’
আর বাগানের গাছগুলি দ্যাখে
গেটের সামনে রিকসা থামলো
আর শাওয়ারের জলধারা শোনে
মাসী দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে :
‘এই শোন, এই বেরো শিগ্‌গির!
জামাই এসেছে তোকে নিয়ে যেতে’…

সময় নেই কাঁদার
আরো কঠিন, আরো
শান্ত ক’রে বাঁধার
নেই উপায় নেই
পুরুষরা সব অফিস
বেরিয়ে যাবার পরে
একলা হবে যেই
সঙ্গে সঙ্গে ডাক :
‘কী করছ ওপরে?’
—‘ছাদের ছোট ঘরে
খবরের কাগজ
গুছিয়ে রাখছিলাম।’
—‘এখন ওসব থাক
বলেছি কতদিন
কাপড় কাচার ওই
বালতিটা কক্ষনো
কলঘরে রাখবে না
একটু যদি শোনো
আমরা সব কেনা
গোলাম হয়ে থাকি।
পাখি পড়াই রোজ
শকড়ি হল ওটা
কাচাবধায়ার জিনিস
বাইরে রেখে দেবে
একটু যদি ভেবে
কাজ করো তো হয়।
আচারবিচার আছে
মানতে চাও না জানি
তাই বলে সব সীমা
ছাড়িয়ে যেতে নেই।
—‘ঠিক আছে, রাখছি মা।’
—‘রাখার আগে ধোবে,
আর হ্যাঁ, শোনো, স্টোভে
পলতে আছে কিনা
সেটাও তো দ্যাখোনি
এক্ষুনি ফুলমণি
তেল আনবার টাকা
আর রেশনকার্ড
চাইতে এল ব’লে
মনে পড়ল, গিয়ে
দেখলাম যে, ঠিক
যা ভেবেছি— তা-ই।
তুমি বাড়ির বউ
তোমার তো সবদিক
খেয়াল রাখাই কাজ।
আর কী হবে। যাই
এখন বসে বসে
পলতেই পরাই…’
—‘আমি পরাচ্ছি মা।’
‘আগে বালতি মাজো
ছেলের বিয়ে দিয়ে
যা শিক্ষাই হল
বকতে বকতে মুখে
কেবল ফেনা তোললা…’
বালতি হাতে নিয়ে
মনে পড়ল আজো
চান করবার সময়
কান্না এসেছিল
বাপের বাড়ির মতো
এই বাড়িতেও তো
কাঁদতে হলে সেই
বাথরুমই আশ্রয়
সেই অগতির গতি।
গায়ে তখন জল
গা হাতমুখ মাথা
সমস্ত সাবান
রাস্তা থেকে হঠাৎ
দূরের মাইক থেকে
পথভোলা এক গান
জাফরির ফাঁক দিয়ে
ঢুকে পড়ল এসে
সন্ধ্যা মুখার্জীর
সেই মধুমালতি
ডাকল আবার : আয়
কার প্রতি? কার প্রতি
পাঠাল আহ্বান
কোন ছোটবেলায়
বেতারযোগে শোনা।
আসব না আসব না
যতই আমায় ডাক
এইটা জেনে রাখ
কিচ্ছুটি শুনব না
দূর হয়ে যা দূরে
স্কুলের রাস্তা ঘুরে
ছোট্টবেলার ছাদে
হুমড়ি খেয়ে পড়
বাবার আঙুল ধর
বাবার কাছেই পড়
হ্রস্ব উ দীর্ঘ ঊ।
এ ঐ ও ঔ
এ ঐ ও ঔ
ভাবতে ভাবতে চোখে
সাবান ফেনা ঢোকে
আর এ বাড়ির বউ
ভুল হয়ে যায় তোমার
বালতি রাখার ভুল
হাজার শুচিবাই
মানিয়ে চলা চাই
চলতে তো চাই, জানি
গুলিয়ে দিল সব
গানটার শয়তানী
ওই গানই তোমার
বাপের বাড়ির লোক
ওই গানই তোমার
সই, সখী, সহেলী
প্রশ্ন করে এসে
ও কার হেঁসেল ঠেলিস
ওই গানই তোমার
সকল কথা জানে
তোমায় ছিড়ে খুঁড়ে
রাত্রিবেলা স্বামী
ঘুমিয়ে পড়লে পরে
মন্ত্রণা দেয় কানে :
‘এমন প’ড়ে প’ড়ে
মার খেলে কি চলে!
ফিসফিসিয়ে বলে :
‘রাজি আছিস বল
রাজি আছিস বল?’
কীসের রাজি? কিসের?
‘দুই সখীতে মিলে
আমরা কোথাও পালিয়ে যাই, চল!’

এইভাবে বৌমাটির দিন গুজরান
একই ছাদ, একই খাট, একই অসম্মান
একদিন সকাল থেকে পরদিন প্রত্যুষে
সংসার গড়ায় তার প্রাণরক্ত শুষে
পরিবারে মাত্র তার এই অধিকার
খাটবার পরিবর্তে খাওয়া ও পরার
প্রতিবাদ করে জানে নেই কোনও ফল
না আছে যাবার জায়গা, না আছে সম্বল
কাকার বাড়িতে সেই তো মা বোন আশ্রিত
—‘টাকা খরচা করে বুঝি কাকা বিয়ে দিত!
রূপ একটু ছিল তাই ধরে গেল চোখে
ভাইয়ের কথায় বউ করলাম তো ওকে।’
এ হল পড়শির কাছে শাশুড়ি উবাচ :
‘দাওনি ছেলের বিয়ে, কত ভালো আছো।
দশটা নয়, পাঁচটা নয়, একটাই দেওর
দ্যাখো গিয়ে তারও সঙ্গে ভাব নেই ওর।’
বৌমাটি ভাবল, ভাব থাকবে কী উপায়ে?
দীঘা যাচ্ছে বৌদি দেবে সুটকেস গুছায়ে।
দেবরের অনুরোধে সুটকেস গুছাতে
যাওয়া মাত্র ছ্যাঁকাপোড়া লেগে গেল হাতে
সুটকেসে ছবি ভর্তি চৌকো ছোট বই
কিছু নয়, শুধু নগ্ন মিলনদৃশ্যই
পাতায় পাতায় ভরা— বইয়ের তলায়
আরও বই— শ্বাস আটকে গিয়েছে গলায়।
ঘেন্নায় শরীর কাঁপছে, ঘেন্না নয়, ক্রোধ!
বই নিম্নে সারি সারি প্যাকেটে নিরোধ
বেড়াতে যাবার সব সজ্জা পরিপাটি
দাদাটি গোপন আর প্রকাশ্য ভ্রাতাটি
হঠাৎ পিছনে শব্দ : ‘কী দেখলে সুটকেসে!’
দেওর গায়ের কাছে দাঁড়িয়েছে এসে।
‘রাখছ কেন? দ্যাখো দ্যাখো, কীসব চেহারা!
এদেশে এসব পাবে? সব ঠাণ্ডামারা।’
এবার বৌমার চোখে রক্ত উঠে যায়
সে-মেয়ে বেরিয়ে আসে, যে রুখে দাঁড়ায়
‘শোনো, আর কোনোদিন, কখনো, এইভাবে
কথা বলো যদি, তবে মজা দেখতে পাবে।
প্রথমে দাদাকে বলব, তারপর মাকে—’
‘এই, বৌদি, মজা করছি…’ ‘যেন মনে থাকে
কোনোদিন এমনি মজা করবে না আর!
যাও নিচে ঢাকা আছে তোমার খাবার…’
এরপর দেওরটির সঙ্গে আর বেশি
কথা হয় না, দুজনেই ঠাণ্ডা প্রতিবেশী
বৌমাটি বেরোয় না বেশি। ছাদেই দাঁড়ায়
বিকেলের দিকে যদি অবসর পায়।
দিনগুলি বয়ে যায় নিয়মের দিনে
সন্ধেগুলি বাড়ি ফেরে ফুলকপি কিনে
সকাল কাগজ পড়ে, গুঁজে নাকে মুখে
অফিসের পথ ধরে লাঠি ঠুকে ঠুকে
দুপুর পরীক্ষা দেয় স্কুলে বা কলেজে
বহু শুকনো কথা দিয়ে বহু চিঁড়ে ভেজে
অপরাহ্ন ঝালমুড়ি খায় পার্কে বসে
মধ্যবিত্ত রাত্রি ফোঁসে আধাতৃপ্তি দোষে
সে পথে বছর ঘোরে, মাস অন্তে মাস
ঢ্যাঁড়া দিয়ে চলে যায়, শাশুড়ি হতাশ।
‘এ কী কাণ্ড বলো দেখি? হল না এবারও?
তাহলে ডাক্তারবদ্যি দেখালেই পারো।’
ধরা পড়ল, বৌমা নয়, স্বামীই জখম
নারী সুস্থ, পুরুষটির স্পার্ম-কাউন্ট কম।
এতেক বছর গেল, যদি একটা কোলে
থাকত, বেঁচে থাকা হতো সহজ তাহলে
থাক, না হয়েছে ভালো, ভাবে পরক্ষণে
সন্তান মানুষ করা শক্ত এ-ভবনে
বাবা কাকা হতো হয়তো, কিংবা ঠাকুমা-ই
অথবা ব্যক্তিত্বহীন শ্বশুরমশাই
হঠাৎ সম্বিত ফেরে, এ কী ভাবছ সে :
সরতে সরতে কোনখানে দাঁড়িয়েছে এসে
এ বাড়ির প্রতি তার এতখানি ঘৃণা!
যে শিশু আসেনি, আর সত্যি আসবে কি না
নিশ্চয়তা নেই কিছু, তার ওপরও এত
ঘৃণা! ভয়! সত্যি, মন নিজেরও অজ্ঞাত!
গাছবর হলেও তো শিশু থাকতো না
ফুলপাতাকে বলা যেতো চাঁদ-মানিক-সোনা
না,না, শান্ত করো মন, সে নিজেকে বলে
মন নোংরা হয় যদি রইল কী তাহলে?
এখন নিশীথ কাল, নিচু বারান্দায়
সে দাঁড়িয়ে আছে ঘরে, স্বামী নিদ্রা যায়
আজ সে বিরল দিন, কারণ আজ বর
রেহাই দিয়েছে বাতি নেভানোর পর
রাত্রির আকাশ মেঘে হালকা চাঁদ ভাসে
ঝড়াং ঝড়াং রিক্সা দূর থেকে আসে
কে এখন বাড়ি ফিরছে? ভুক-ভুক-ভৌ
কুকুর বিরক্ত হলো। এ বাড়ির বউ
দ্যাখে ও বাড়িতে আলো দোতলার ঘরে
প্রতিবেশী যুবকটি পত্নীসেবা করে
জানলা দিয়ে দেখা যায়, সে সরায় চোখ
ওদের নতুন বিয়ে, ক’দিন পার হোক
তখন বুঝবে খেলা কোনদিকে যায়
তোমারও কি সুখ ছিল প্রথম দিকটায়?
না, আজ নিজের সঙ্গে একমত হই
শরীর প্রথমে আলোআঁধারি ছিলই
বিবাহের পরে হলো চিরঅন্ধকার
শুধু শক্ত, জালাযন্ত্র, বমি ও উদগার
তোমরাও তেমন হবে নতুন বধূটি
খাটে ওঠা, নেমে আসা, ভাত-ডাল-রুটি
ঘরে ঘরে প্রতিক্ষণে এটুকুই চেয়ে
হাপিত্যেশ করে আছে কতো কতো মেয়ে
আবার চমক ভাঙে, এ ভাগ্য সবার
হবে কেন? কেন হবে? বোঝাবো ক’বার?
না, মন ওঠাও। দ্যাখো সিঁড়িদরজাতে
তালা দাওনি, ওঠো তবে তিনতলার ছাদে
সেই মেঘ, সেই হাওয়া, সেই ভাঙা চাঁদ
টালি, টিন, চিলেকোঠা। ছাদ আর ছাদ।
মেঘ ফসকে দুটো একটা তারা দূরে কাছে
ওই তারাটির নিচে কার ঘর আছে?
তারা কি আদর্শ, সুখী, ছোট পরিবার?
স্বামী স্ত্রী শুয়েছে, মধ্যে বাচ্চাটি বাবার
গায়ে পা তুলেছে, ঘুমে, হাত মা-র গায়ে
গলায় ধুকধুকি একটা, মল বাঁধা পায়ে
আর ওর মা-বাবারা? জানো কি ওদের
দ্যাখাশোনা করা বিয়ে? নাকি পছন্দের?
কে যে কাকে মেনে নেয় সে বাতা কে জানে?
কিন্তু আমি? আজীবন কী করছি এখানে?
দেখতে দেখতে দশবছর হতে চলল প্রায়
আমারই মতন বউ কত না জায়গায়
রয়েছে, প্রত্যেকদিন কাগজে কাগজে
তারা কেউ দড়ি, কেউ কেরোসিন খোঁজে
কীভাবে তাদের সঙ্গে দেখা করা যায়?
ও সখী, মধুমালতি, তুই ডাকবি আয়!
ডাকবো’খন। আপাতত মা-বোনের কাছে
ঘুরে এসো, পরে হবে ভাগ্যে যা যা আছে
‘যাব’ বলতে শাশুড়ির শুরু হল মুখ
‘আমার ছেলেটা বোকা, হদ্দ উজবুক
বউকে আদর দিয়ে তুলেছে মাথায়
বাড়িতে অতিথি আসবে, এখন কেউ যায়?’
অতিথি অর্থাৎ মামা, সেই যে ঘটক
তিনিও সবার মতো দিদি-সমর্থক
বিষয়-সম্পত্তি-বাড়ি-জমি মালিকানা
শাশুড়ির নামে, তাই প্রতাপটি জানা
তাকে তুষ্ট করে চলে আত্মীয়স্বজন
(মামা ও মাইমা ছাড়া আছে বা ক’জন?)
স্বামী বলল : ‘তোমার কি না গেলেই নয়?’
—‘তোমাকেও তো মাঝে মাঝে বাইরে যেতে হয়!’
বর অবাক : ‘অফিসের কাজে আমি যাই!’
—‘আমারও তো দু’একদিন ছুটি পাওয়া চাই!’
—‘তোমার কীসের ছুটি?’—’রোজ এই সংসারে
কতো কাজ, একটা লোক কতো টানতে পারে?’
স্বামী হতভম্ব ; তার বউয়ের মুখে তো
জবাব ছিল না ! তার জিভ লাগল তেতো।
নিজেকে সে সামলে নিল ‘কী হয়েছে তোমার?’
—‘কিছু না! আমার একটু বিশ্রাম দরকার।’
‘আচ্ছা, তবে যাও, আমি বলব’খন মা-কে
এ বাড়িতে থাকতে গেলে মায়ের কথাকে
মানতে হবে, মা’র জায়গা সবচে’ ওপরে।
বৌমাটি সামান্য হাসল : হ্যাঁ ভাত-কাপড়ে
কিনে রেখেছেন, নাকি তুমি?… হ্যাঁ, ঠিক-ই তো
বাড়িতে কুকুর থাকে যেমন শিক্ষিত
বল ছুঁড়লে নিয়ে আসে, নিজের প্রভুকে
সে-ও কিন্তু কামড়ে দেয়, কী-গো দেয় না? মুখে
এসব বলেনি শুধু ভেবে গেছে মনে
ট্রেন ধরে পৌঁছে গ্যাছে বাড়ির স্টেশনে
স্টেশনের সামনে রাখা রিক্সা সারসার
একটাতে উঠেছে, অমনি নাম ধরে চিৎকার
কে ডেকেছে, কে ডেকেছে ইস্কুলের নামে
পিছনে হঠাৎ একটা রিক্সা এসে থামে
তা থেকে আর একটি মেয়ে নেমেছে লাফিয়ে
‘কী রে!’ —‘তুই!’ —‘ইস্!’ ‘উফ্‌। গিয়েছি হাঁপিয়ে।’
এই হলো রীণা, পড়তো ইস্কুলে দুজনে
একই সঙ্গে ঘোরা, বসা একই বেঞ্চিকোণে
কলেজে বিজ্ঞান নিল, গেল অন্য ঘরে
তারপরই হঠাৎ বিয়ে, বাড়িতে লুকিয়ে
পালাল সুটকেস হাতে, এ পাট চুকিয়ে
বাড়িতে মানল না ব’লে করেনি ভ্রূক্ষেপ
‘তোরা সব বিয়ে করে বরের পা টেপ!
আমি ভাই চাকরি করব সরকারি অফিসে।’
এ-ই বলত। সে মেয়েকে ভর করল কিসে!
মামাতো দাদার বন্ধু, উড়লো তাকে নিয়ে
অল্পদিন পরিচয় বিয়েবাড়ি গিয়ে।
খোঁজখবর নেই আর তারপর থেকে
সখীরা রীণাকে হিংসে করেছে প্রত্যেকে।
দু’টো একটা চিঠি আসতো (ঠিকানা ছিল না)
‘বিয়েটি কঠিন বস্তু, মনে রেখো সোনা।’
সেই থেকেই দেখা হয়নি, আজই সাক্ষাৎ
রিক্সা যাচ্ছে, তপ্ত মুঠো ধরে নিল হাত।
‘ইস্‌ আমার কী যে লাগছে! আগে একটু ছুঁই!’
বীণা বলছে— ‘দেখি, এটা সত্যি সত্যি তুই!
বিশ্বাসই হচ্ছে না। এ কি! ঘেমে দেখছি জল!
রুমাল আনিস নি? এই নে’—‘ও ঠিক আছে, বল
তোর খবর বল আগে।’ —‘দাঁড়া রিক্সা ছাড়ি।
আমরা তো কিছুক্ষণ মাঠে বসতে পারি।’
ডোরাকাটা ব্লাউজ একটা, ঘোর-রং শাড়ি
সরু ঘড়ি। চেহারাটা আগের চেয়ে ভারী।
‘আমি দিচ্ছি।’ খুচরো গুনতে মুখ করল নিচু।
সিথি সাদা। হাতেও তো চিহ্ন নেই কিছু!
এইটা স্কুলের মাঠ। একপাশে বাচ্চারা
খেলছে। মা-রা বসে আছে। বয়োবৃদ্ধ যাঁরা
লাঠি হাতে বেড়াচ্ছেন। ছোট শহর ব’লে
বেড়ানোর জায়গা কম। সে হেতু সকলে
ষ্টেশনের ধারে কিংবা স্কুল ময়দানে
নিজেরা বেড়ায়, আর বাচ্চাদেরও আনে।
ফুচকা, আইসক্রীমও আসে। —‘আগে তো বসতাম’
তাই না?’—‘হ্যাঁ’—‘ফুচকা খাবি?’—‘ইচ্ছে করছে না।’
—‘সে কি রে! ফুচকায় না? এ তুই অচেনা।
কী হয়েছে তোর বল তো?’—‘কী আবার হবে?
আর কি ছোট আছি? আর মন থাকে ওসবে?’
‘তোর খবর বল তবে’ —‘কী আর খবর!
বিয়ের পাঁচবছর বাদে ভেগে গেল বর!’
‘সে কি রে? এ কী বলছিস? কী বলছিস রীণা?’
‘থামলি কেন?চল্। তোকে নিয়ে তো পারি না।
ভাগল কিন্তু তার আগের সে-পাঁচটা বছরে
আমাকে সে পাস করালো দিনরাত্রি পড়ে।’
‘সত্যি?’ —‘সত্যি। ও আর আমি। কেউ নেই আর।
ও বেরোলে আমি পড়তে বসতাম আবার।
পড়া ছেড়ে ওর সঙ্গে পালিয়েছিলাম
ও চেয়েছে যেন ঘোচে সেই বদনাম।
হরদম পরীক্ষা, শেষে চাকরি। সরকারি।
ও যে কী পাগল হল! ফুলে ফুলে বাড়ি
ছয়লাপ করে দিল। লোক ডাকল খেতে,
কদিন, পাগল, রইল এই নিয়ে মেতে।’
‘তারপর?’ —‘তারপর কী ! যেতে হতো ট্যুরে,
ওকে চাকরি করতে হতো সারাদেশ ঘুরে।
একদিন তেমনি গেছে, আগুন লাগল ট্রেনে।
বাড়ি ফিরল। ওই লোককে কার সাধ্য চেনে!
না, আমি শ্মশানে যাইনি। গিয়ে লাভ হতো?
ও তো শুধু সারাক্ষণ মজা করতো। ও তো।
চাইত আমি সেজে থাকি। হাসিখুশি থাকি।
তা-ই, দেখ, আমি ঠিক তা-ই আছি না কি?’
কী বলবে, এর উত্তরে কথা বলা যায়?
দুই সখী স্তব্ধ বসে। বিকেল গড়ায়।
শেষে নীরবতা ভেঙে রীণা কথা বলে :
—‘এবার ট্রান্সফার নিয়ে কলকাতায় চ’লে
এসেছি তো। তোর সঙ্গে খুব দেখা হবে।
বল তুই আমার বাড়ি আসছিস কবে?’
—‘সকালবেলা যাই যদি? থাকবি তুই কাল?’
—‘তুই গেলে নিশ্চয়ই থাকব। হ্যাঁ, কত সকাল?
ন’টায় ট্রেন ধরি আমি।’ —‘যদি খুব ভোরে
যাই?’ —‘খুব ভাল হবে। দু জনে চা করে
ছাদে বসব।’ —‘ছাদে আমি সারারাত থাকি।’
‘নিজের সঙ্গে কি কথা বলা যায় নাকি
ছাদ আর বাথরুম ছাড়া? দাঁড়া একটু ভাবি।
না, কাল সমস্ত দিন তুই এসে কাটাবি।
বরং সি-এল নেব অফিসে, কেমন?
আসবি তো?’—‘হ্যাঁ আসব।’—‘ওই দেখ তোর বোন।’
একটা বাইক যাচ্ছে। পিছনের সিটে
বুনো বসে আছে, হাত চালকের পিঠে।
মাথা ঘুরে উঠল। সত্যি? বুনোই তো ! আরে।
কোমর জড়িয়ে ধরছে। এতটাই পারে।
—‘কী ভাবছিস!’ —‘ভাবছি কেউ লক্ষও করে না?’
রীণা হাসলো : ‘তুই তেমনি আছিস। ওরে, না
এখন সব পাল্টে গেছে। ওই ছেলেটার
নাম নীলকমল। ওর দাদা প্রমোটার।
বাবার আড়ত আছে। দাদাটা তো জেলে
ঘুরে এল। এক মাস। এটা ছোট ছেলে।’
মাথাটা কেমন করছে। কোথায়, কোনখানে,
এগোতে চলেছে বুনো, নিজেও কী জানে?
না জানুক। মা-তো জানে! মা বলছে না কিছু?
ঘাস ছিঁড়ছে। ঘাস কাটছে দাঁতে। মুখ নিচু।
—‘কী রে? কী হয়েছে তোর? জানতিস না আগে?’
—‘না রে সত্যি জানতাম না। কী অবাক লাগে!
মাদুরে ঘুমোতে, পায়ে মশা বসতো ওর
পাখা হাতে পড়তাম সারা রাতভোর।
বাড়ি ফিরুক। যদি যায় একটুও বোঝানো…’
‘উঁহু উঁহু। যদি বলে তোমরা কী জানো
সইতে পারবি তো?’ —‘বড্ড দুশ্চিন্তা হচ্ছে রে!’
‘ভাবিস না, বেরিয়ে আসবে। ওই চিন্তা ছেড়ে
মন দে নিজের দিকে। নিজের সংসারে।
ওই দ্যাখ আসলটাই আমি এক্কেবারে
ভুলে বসে আছি। বল্‌ শ্বশুরের ভিটে
কোথায়? কেমন বর? ক’টা কোলেপিঠে?’
‘একটাও না।’ —‘সে কী ! কেন? চাস্‌ না বুঝি?’ —‘চাই।’
‘বিয়ের ক’বছর হলো!’ —‘দশবছর।’ —‘তাই!
তাই মুখটা শুকনো এতো! বর কিসে আছে?’
‘সেকেন্ডারি এডুকেশন। পার্ক স্ট্রিটের কাছে
অফিস।’—‘তার মানে?’ রীণা লাফ দিয়ে উঠেছে
‘পার্ক স্ট্রিটের কাছে নয়! পার্ক স্ট্রিটেই। এ যে
মির‍্যাক্‌ল! কী নাম বল।’—‘কার?’ ‘কার আবার!
তোমার বরের নাম ! বলো তো এবার।’
—‘অসীম সেন। কেন?’ —‘ওটা আমারও অফিস।
চিনি তো অসীম সেনকে। চিনি। বুঝেছিস।
দ্যাখ কেমন যোগাযোগ!’ বলতে বলতে রীণা
উঠে পড়লো। ‘কাল আসছিস। আজ আর যাচ্ছি না।
তোর বাড়ি।’ —‘কেন, চল না!’ —আজকে থাক। তোকে
বরং এগিয়ে দিই।’ —‘তুই সত্যি ওকে
চিনিস? অদ্ভুত।’ —‘কিন্তু, সুন্দর চেহারা।’
‘আর লোকটা?’ —‘ভালই তো। ডিপার্টমেন্টে যারা
একসঙ্গে বসি তারা ভাই-দিদি-দাদা
হয়ে গেছে…. আর উনি তো বসেন আলাদা।
ফলে শুধু নমস্কার, প্রতিনমস্কার।
যাকগে, বাড়ি গিয়ে বোনকে বকিস না আবার।
ওই যে বাড়ি দেখা যাচ্ছে…। আইরি- ক্ষেতের আড়ে।’
‘বাঃ ওইটা মনে আছে!’ —‘না থেকে কি পারে?
শান্তাদি কী মেরেছিলেন হাইবেঞ্চে তুলে
অত রাগী বাংলা-দিদি আসেন নি ইস্কুলে!
এই তো ব্যাস। বাপের বাড়ি। কন্যা যান! প্রীত
হয়েছেন তো?’ —‘মার লাগাবো, ইয়ারকি করবি তো!’
হাসতে হাসতে রীণা ফিরছে। কে পারবে এটা !
সব দুঃখ মেঘ করে দিয়েছে মেয়েটা।
অথচ নিজের মধ্যে অত কষ্ট। অত
কষ্ট চেপে ও রয়েছে হাসিঠাট্টারত।
ওরই জন্যে বহুকাল, বহুকাল পরে
সারামন অন্য এক সুখদুঃখে ভরে
যখন বাড়ির মেয়ে বাড়ি ফিরল আজ
তখনই সন্ধ্যাটি নামল। ঘোর হলো সাঁঝ।
মা দেখে অবাক। ‘ও মা এ কে? আয়। বোস।
কীরে কিছু হয়নি তো?’ মা-র ওই দোষ
প্রথম থেকে অমঙ্গল আশংকা স্বভাব।
‘তোমার না ! কী আবার হবে?’ —‘আচ্ছা, ভাব্‌
এই ভরসন্ধেবেলা’ …—‘কী হয়েছে তাতে?
সন্ধে হলে আসতে নেই ! তা-ও তো মাঝরাতে
আসিনি !’ —‘কী হয়েছে বল। ঝগড়া হয়েছে কি?’
এবার বিরক্ত লাগছে।—‘একটু সরো দেখি।’
‘কী খুঁজিস?’ —‘জল খাবো। বুনো কই? বুনো?’
‘আমি দিচ্ছি। বেরিয়েছে। ও তো ঘরকুনো
স্বভাব পায়নি ! এই নে। বাড়ি থাকতে চায়?
সারাদিন টেটে কোথায় কোথায়
ঘোরে তার ঠিক কিসে!’ মা চোখ সরালো
‘জামাই কেমন আছে? বাড়ির সব?’—‘ভালো।’
‘হাতমুখ ধুবি তো?’—‘উঁহু। একটু পরে গিয়ে
চান করেই আসব। মা গো, রাত্রে রুটি দিয়ে
তোমার স্পেশাল সেই আলুর চচ্চড়ি,
বেশি ঝাল !’ —‘আমি আর কী-বা রান্না করি!
শাশুড়ি যা রাঁধে তোর !’—‘রাঁধে বুঝি? বেশ।
বুনোর কী দেরি করে ফেরাই অভ্যেস?’
‘অন্য দিন তো এসে যায়!’ মা সরালো মুখ।
তার মানে ঘটনা এই। বেশ তো চলুক।
বাইকের শব্দ বাইরে। মা বেরোল। —‘যাই।
রান্নাঘরে গিয়ে আগে কড়াটা নামাই।’
কিন্তু রান্নাঘরে নয়। গেল উলটোদিকে
তার মানে সাবধান করে আসবে বোনটিকে।
আবার বাইকের শব্দ। চুড়িদার পরে
ঠোঁটে রং, ঝল্‌মলে বুনো ঢুকল ঘরে।
‘দি’ভাই, কখন এলি?’ —‘এই একটু আগে
লালকমলের আগে যখন নীলকমল জাগে।’
মুখ বদলে গেল। —‘ভ্যাট।’ —‘ওই তো যখন,
বাইকে বেরোলে তুমি, এলাম তখন।’
‘বাইকে বেড়াতে গেলে দোষের কী আছে?’
‘বাইক বা বেড়ানো নয়। কিন্তু কাছে কাছে
যে থাকছে জানিস তাকে? ভালো কি চিনিস?’
‘আমি না তো তুই চিনিস?… “যে থাকছে”… ইস্
ভারি তো “যে”! কী করবে রে?’… ভেঙেচুরে হেসে
বুনো ঘুরে বিছানায় শুয়ে পড়ল এসে।
‘দি’ভাই রাগছিস কেন? কত যে জায়গায়
নিয়ে যায়। রেস্টুরেন্টে কত কী খাওয়ায়।
বাড়িতে সে সব খাওয়া জন্মেও হতো না।
ছেলেটা ভালো না। কিন্তু খুব খারাপও না।
দামী গিফ্ট দেয়। একটু ক্যাবলা মতো আছে।
ভাবিস না, একদিন নিয়ে আসবো তোর কাছে।”
ফের মাথা ঘুরছে। গিফ্ট ! রেস্টুরেন্টে খাওয়া !
নিজের বোন? এর চেয়ে ভাল মরে যাওয়া !
‘সে যাই হোক। বিয়ে করতে রাজি হবে তোকে?’
‘বিয়ে? সে কি!…হি হি …হো হো …বিয়ে …ও-ও, ..ওকে?
বিয়ে …হা হা …আহা দিদি পেট ফেটে এবারে
মরে যাবো ঠিক, ঠিক, হু হু…’—‘এ কি ! আরে!
হাসার কি আছে এত ! হাসি বন্ধ কর।’
‘করছি করছি। দাঁড়া তোকে বলি। যদি, ধর
ওকে ওড়নায় বেঁধে একমাইল যাই
পিছনে পিছনে আসবে। দু’মাইলেও তাই !
তিন মাইলও। চার মাইলও। যদি বলিস, ডালে
পা ঝুলিয়ে বোসো কিংবা চাঁদ আনো কপালে
তাই আনবে। ছোঁক ছোঁক করবে। যেন ফেউ।
আর যাই করুক, একে বিয়ে করবে কেউ?
আমি তো কর’ব না।’—‘তবে কেন মিশতে গেলি?’
‘দেখ দিদি অনেক দিন পরে তুই এলি।
সমস্ত জানিস না তুই। তোদের পুরনো
ওই সব মার খাওয়ার মূল্য নেই কোন !
বুঝবি না।’ —‘তবু বল।’ —‘ও আমাকে চায়।
তাই ওর সঙ্গে মিশি। ও আনন্দ পায়।
আমিও অনেক কিছু পাই ওর কাছে।
এই তো ব্যাপার। বল্‌, কী বলার আছে।’
‘কিছু না। কিচ্ছু না। ভাবছি, এই রসাতলে
একবার নামলে, পথ শুধু নেমে চলে !’
‘আহা। আহা। আস্তে। তুই যা ভাবিস তা না।
কোথায় থামতে হবে সব মেয়ের জানা।’
‘এরপর কী করবি তুই। কী করবি তাহলে?’
‘চাকরি করব। টাকা করব।’ —‘চাকরি করব বলে
অমনি পাবি? অত সোজা? কতো কাঠখড়
পুড়ে তবে চাকরি হয় ! মন দিয়ে পড়।’
‘পড়া তো ছাড়িনি। কিন্তু আমি একটা মেয়ে।
কী করলে কী হয় সেটা কে আমার চেয়ে
ভালো জানবে? বড় বড় সমস্ত জায়গায়
যারা বসে থাকে, যারা বসে থাকতে চায়
তারা তো পুরুষ? তারা পুরুষই কেবল?
পুরুষ মানে কী, আমরা বুঝবো না বল?
তাকাবো। সামান্য হাসবো। কথা বললে স্বর
পালটে নেব, ব্যাস, খেলা শুরু তারপর।
দেখবো কোথাকার জল কোথায় গড়ায়।
ওরা তো ইউজ করে। ইউজ করায়
ওরাই অভ্যস্ত। শুধু এইবার খেলা
উলটো দিকে ঘুরে যাবে। এই মেয়ের বেলা।
খেলব কিন্তু মুঠো থেকে ছাড়ব না রাশ
ক’জনকে খেলাতে পারি নিজে দেখে যাস।’
‘চুপ কর। চুপ কর বুনো। চুপ কর বোন।
যা যা ইচ্ছে হয় তুই করিস।’—‘না, শোন
তারপর মাকে নিয়ে ছাড়ব এই বাড়ি
তুই তো পারলি না, দেখবি, হ্যাঁ। আমিই পারি!’
—‘আমি পারলাম না। কিন্তু ভাবতাম তো সেটা !
কত চেষ্টা করতাম। জোর করে বিয়েটা
দিয়ে দিল সব। আমি বাঁধা পড়লাম !’
—‘জোর করে আবার কী রে? তুইও তো গোলাম।’
‘আমি কারও গোলাম নই, নই দাসীবাঁদী !
কেউ বলতে পারবে আমি ছাদে গিয়ে কাঁদি?’
সারা ঘরে শব্দ নেই। শুধু এক-একবার
দেওয়ালে ঝাপট মারছে বাঁকা ক্যালেন্ডার।
ওড়নাটা মেঝেতে পড়ে। ব্যাগ দরজায়।
ঘরে কোন লোক আছে? লোক নেই প্রায় !
মা ঢুকে অবাক হল, ভয় পেল দেখে
বড় মেয়ে বসে আছে হাতে মুখ ঢেকে।
ছোট ঘরে নেই। জ্বলছে কলঘরে আলো।
মেয়েদের স্নানঘরে উঁকি দেওয়া ভালো
অভ্যাস অবশ্য নয়—তবুও কথক
বলে, লেখাসূত্রে যদি দ্বারে রাখতে চোখ
দেখতে বুনো বসে আছে চৌবাচ্চার ধারে
একা একা কেঁদে যাচ্ছে কী অঝোরধারে…

সকালে আজ সারা আকাশ কেবল মেঘ
ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি আসে, উড়েও যায়
থেকে থেকেই ঝোড়ো বাতাস এদিক ওদিক
ঢ্যাঙা মতন ঝাঁকড়াচুল অনেক গাছ
মাথা ঝাঁকায়, যেমন রাগি বাচ্চারা
খাবার ছুঁড়ে ফেলে
আমি এখন ছাদের ধারে আলসে ধরে
একলা বাড়ি বউমা
বৃষ্টি মুখে লাগছে, গুঁড়ো বৃষ্টি সব
ঝাঁপিয়ে এসে পড়ছে যেন আদর কার
নরম হাত কার যেন
সকাল থেকে এবাড়ি আজ ফাঁকাই আছে
সবাই গেছে শিবপুরের ননদ, তার
মেয়ের মুখেভাতে
কাউকে বাড়ি থাকতে হবে, বৌমা থাক
ভালই হল, ভালই, এর চেয়ে এখন
ভাল তো নেই
রাস্তাঘাটে মানুষ কম, ছেলেগুলোও
পাড়ার মোড়ে নেই এখন, হয়ত ওই
ঘোষবাড়ির ঢাকা দালান সেখানে সব
বসেছে এক বারোয়ারির ক্যারামবোর্ড
সেটা ঘিরেই গুলতানি
কাপড়মেলা তারগুলোও ফাঁকাই আজ
ছাদের পর ছাদে কেবল অ্যান্টেনা
দেওয়ালগুলো ভিজে, পথের পিচভাঙা
গর্তে শুধু গতরাতের
বৃষ্টিজল
প্রতিবেশীর নতুন বৌ কার্নিশের
টবগুলোকে যত্ন করে সরাচ্ছে
হাসলো, হেসে চেঁচিয়ে বলে : ‘বাতাস কী !
উলটে যদি নিচে পড়েই !’
এ বাড়িতেও টবের গাছ করলে হয়
করলে হত। এখন আর
হয় না। আর
হয় না।
বৃষ্টি এই বৃষ্টি উঃ কতদিনের
পরে আবার, ‘বৃষ্টি আর আমি কেবল
বৃষ্টি আর আমি। আবার
গভীর দুই সখী
বৃষ্টি তার নরম হাত এই সেদিন।
নরম হাত সখীর হাত যেন আদর
এই প্রথম
তবু এখন জলে হাওয়ায় থেকো না আর
এবার ঘরে গিয়ে বোসো কিংবা শোও
বাড়িতে কেউ নেই এখন, কাজও নেই
ঘুমোও যাও কিন্তু আর ঠাণ্ডাতে
দাঁড়িয়ো না
কে বলল :
‘শরীরটাকে ভাল রাখিস।’
কী হবে আর? ভালো খারাপ কী এসে যায়?
আমাকে আর কী প্রয়োজন?
হ্যাঁ প্রয়োজন। তুই ছাড়া
কে থাকে আর তোর পাশে
নিজেকে তুই দেখবি না? কে দেখবে?
সেই যেদিন, ভোরে যেদিন, ছাদের ঘর
সারাটা দিন ছাদের ঘর সন্ধেতেও বাড়ি ফেরা
হল না আর সারাটা রাত ছাদের ঘর
সেইদিনই সে বলেছে
কে বলেছে?
সেই রীণা
কী বলেছে? অনেক সব অনেক সব
সারা দুপুর সারা বিকেল কথা বলেও
শেষ হয়নি আমি তখন মাকে খবর
দিতে এলাম ওর বাড়িই থাকব আজ
শুনে কেমন মুখ করে তাকাল মা :
ওই মেয়ে ! সেই যে, কার সঙ্গে, সেই কবে যেন
পালিয়েছে !
সত্যি মা ! পারো তুমি ! সেই কবের
ঘটনা। আজ ওর স্বামী
মারা গেছে। তা-ও তোমার মন থেকে সেই কথা
যায়নি—‘ওঃ মারা গেছে? হায় কপাল
এই পাপের শাস্তি’—‘ছিঃ মাগো তোমার
এ কী হল ! ওর বাড়ির কেউ ওদের অনেকদিন
নেয়নি তাও মারা যেতেই গিয়ে সবাই…
আর তোমার সেটাও নেই?’
বলে সোজাই চলে এলাম বসিনি আর
বলিনি তা-ও… আর তোমার ছোটমেয়ে?
সেই রাতেই রীণাকে সব, সব বলি
আমার সব।
ও বলে ‘তোর বাচ্চা নেই। দেখাসনি?’
‘দেখিয়েছি। বরের দোষ।’ —‘ঠিক জানিস?’
—‘ঠিক জানি। আমি রিপোর্ট দেখেছি সব লুকিয়ে।’
‘রোজ রাতেই এত সবের পরেও নেই? তার মানে…
কিন্তু তুই কেন মানিস? এমনি খুব
শক্ত তুই। তখন তোর
কী হয়?’
‘কী হবে আর? পুরুষলোক ! ওই সময়
অমন জোর গায়ে ! আমার
ভয় করে।’
‘কেবল ভয়? আর কিছুই হয় না? সুখ
হয় না? হয়? একটুও?’
‘না রে ওসব নেই আমার। কবে থেকেই
নেই। এখন আরোই নেই। রোজ যা সব
করে—ওয়াক !’
‘আস্তে। এই আস্তে। শোন। এই দাঁড়া
এই নে জল। চোখমুখে জল দি’ আয়।’
—‘তা ছাড়া ভয়। অনেক ভয়। চাহিদা ওর না মানলে
যদি আমায় তাড়িয়ে দেয়?’
—‘তার মানে?’
—‘বাড়ি থেকেই তাড়িয়ে দেয়?’
রীণা হঠাৎ থমকে যায়। কপাল থেকে চুল সরায়
আর বলে : ‘শোন ওসব ভাববি না। ভয় পাবার কিছু নেই।
তাড়ানো খুব সহজ নয়।’
—‘রাত্রে ওর চাহিদা আর ভোর থেকেই
সংসারের হাজার কাজ। এদিক-ওদিক হলেই উঃ
কী অপমান! এমন কথা শুনতে হয় !..সত্যি আর
পারছি না।’
রীণা দাঁড়ায়। গেলাস নেয়। জল গড়ায়। বারান্দায়
তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। ভাবে কী সব।
—‘তাড়িয়ে দেবে বললি না? তা-ও তোকে বলিই নি
সেই কথা।’
—‘কোন কথা?’
—‘অসীম সেন। তোর স্বামী। তার বিষয়।
শোন এবার লাগবে তোর। লাগবে খুব।
তবুও শোন।’
—‘কী কথা বল?’
‘শিপ্রা ঘোষ এই নামের কাউকে তুই
চিনিস?’ —‘না।’
‘চিনি না’—‘ঠিক?’
—‘একশোভাগ।’
—‘শিপ্রা ঘোষ তোর বরের রক্ষিতা।’
—‘কী বলছিস? ঠিক জানিস?’
—‘একশো ভাগ। ক্যামাক স্ট্রিট। সেখানে এক
অফিস ক্লার্ক। রোজ আসে। নিয়মিত। ঘুরতে যায়। এমন কি
ছুটি কাটায়। জানবি তুই, তোর স্বামী মাঝে মাঝেই
দু’চারদিন যায় কোথাও? ডুব মারে?’
—‘হ্যাঁ যায় তো।’
‘কোথায় যায়? জানিস?’
—‘না।’
—‘কলকাতায় কিংবা তার আশপাশের হোটেলে যায়।
রাত কাটায়। ফিরে আসে। বাড়িতে কী
বলে তখন?’
—‘বলে, অফিস পাঠাচ্ছে। জরুরি কাজ।’
—‘ছাই। অফিস ওকে কোথাও পাঠায় না। ওর তো সেই
পোস্ট-ই নয়। দ্যাখ তোকে
এত বছর ঠকিয়েছে। কী ভাবছিস?’
—‘ভাবছি ওই শিপ্রা ঘোষ ঠিক কেমন দেখতে রে?’
—‘কালপ্যাঁচা। কিচ্ছু নয় তোর পাশে।’
—‘হয়ত ওই অন্যসব পারে ভালো।’
—‘বাদ দে তো।’
এই সময় বাইরে জোর ঝড় উঠল
সান্ধ্যমেঘ ঘুরছিলই বহুক্ষণ
সারা বিকেল, সন্ধে খুব দমচাপা
গরমভাপ। সব ভেঙে
ঝড় উঠল এক্ষুনি
দড়াম দম্ জানলাটাও ধাক্কা খায় হাটখোলা
এক কোণের মোমদানি
ওল্টালো
উঠে দাঁড়াই : ‘আটকে দিই জানলাটা?’
—‘খোলাই থাক। থাক নারে। আমরা আজ ঝড় দেখি।’
রীণা সুইচ নিভিয়ে দেয়। কড়কড়াৎ বাজ পড়ে।
—‘দ্যাখ কেমন লাগছে দ্যাখ !’
বিদ্যুতের ঝলসানি। পিচসড়ক। একটা লোক
নেই কোথাও। দোকান সব ঝাঁপ ফেলা। অন্য দিক
লম্বা ছাদ।
ঠিক তখন চারদিকের টিনের চাল
চড়বড়ায়। বৃষ্টি ! —‘আয় বাইরে যাই’
রীণা আমায় বার করে
বৃষ্টি জোর বৃষ্টি আঃ মুখ মাথায়
সারা শরীর বৃষ্টি আয়
বৃষ্টি গা’য় নিতে কেমন সাহস চাই
আয় সাহস
লম্বা ছাদ। আমরা চুপ দাঁড়াই আর
ভিজি কেমন ! কেমন শীত!
—‘এবার চল দাঁড়াস নে
জ্বর হবে।’
—‘হয় তো হোক। এই শরীর চুলোয় যাক।’
রীনা আবার ধমক দেয় :
‘শরীর ঠিক রাখতে হয়
তোকে এখন তুই ছাড়া
দেখবে কে?’
ভিজে পোশাক ছেড়ে ফেলি। রীণা রীণার নাইটি দেয়।
নিজেও এক শাড়ি জড়ায়।
বাইরে খুব বৃষ্টি, ছাঁট জানলাতে
সারা শহর অন্ধকার
বলে আমায়—‘আমার খুব কষ্ট হয়।
জানিস এই বৃষ্টি হওয়া রাতগুলোয়
কষ্ট হয় খুব—’
—‘রীনা!’
—‘এই যে তুই বললি না তোর ওসব নেই এখন, কখনো নেই
আমার খুব ছিল, জানিস! আসতো খুব। কিন্তু ও
চলে যাবার সঙ্গে সব নিয়ে গ্যাছে।
ভাবি যখন ওর শরীর, মুখটা ওর
কী ভয়ানক কষ্ট হয়! দম কেমন
আটকে যায় সে কী ভীষণ কষ্ট ! আর বলি কেবল !
ভুলিয়ে দাও ভুলিয়ে দাও হে ভগবান ! ঠাকুরকেই
ডাকি তখন।
আর যা হোক এ জীবনে
অন্য কোনও পুরুষ আর,
পারবো না।’
—‘আমিও না ! আমিও না ! উঃ এখন
পুরুষ এই শব্দটাই ভাবলে ভয়, ওর কথা।
ওর কথাই। পুরুষ এই শব্দটায় ওর শরীর। ওই শরীর।
আর আমার যন্ত্রণা।’
রীণাকে নয়। মনে মনেই বলেছি সব।
—জানিস সেই আগের সব বর্ষারাত
কত আদর, কত আদর ! শেষে আমার
বুকের ওপর ক্লান্ত মুখ ডুবত ওর
ঠিক যেমন…’
—ঠিক যেমন চাবুক খায় গোলাম তার মুখ বুজে
এসে কেবল হুকুম আর ঝাঁপ দেওয়া
কামড়, চাপ, জ্বলন, রাগ, নখের দাগ,
দাঁতের দাগ, রক্ত আর কাতরানি
ঠিক যেমন ধর্ষণের
—‘ঠিক যেমন শিশুর মুখ ডুবত ঠিক
তেমনি আঃ যদি আমায়
শিশু আমায় দিয়ে যেতও ! তাকে নিয়েই সারাজীবন
তাকে নিয়েই…’
—একটা কেউ থাকত ওই পশুর ওই পশুরও কেউ
তাতেও সব ভুলে যেতাম বাচ্চাটা নিয়েই সব
ভুলে যেতাম ! যদি আমার একটা কেউ….
রীণা আমায় জড়ায় : ‘এই কী হল? এই, ঘুমোচ্ছিস?’
‘—না কই আমি ঘুমোইনি।’
—‘একী রে ! তোর গলা কেমন ভাঙা শোনায় !
কী হয়েছে? এই মেয়ে !’
—‘কিচ্ছু না।’
—‘ছি ছি ছি তুই ফের কাঁদিস? পাগলী শোন !
আয় আমার…কাছে আমার…
আয় দেখি…আয়…’
আমার মুখ দু’হাতে ধরে তুলল আর
চোখের জলে নিজের ঠোঁট চুঁইয়ে জল
মুছিয়ে দিল দুহাতে মুখ ধরে আমায় নিল গভীর
নিজের ভারী ভরাট বুকে : ‘বল তো, তোর
কষ্ট কই, কোথায়, বুক শুকিয়ে গেছে কেন এমন
আঘাত কই, আঘাত?—‘এই, এই যে ডানকাঁধের নিচে
এইখানে ও কামড়ে ধরে প্রতিটা দিন দাঁত বসায়…’
—‘ইস কী দাগ, কী কষ্ট! ব্যথা?’— ‘ভীষণ, ব্যথা ভীষণ’
হাত বোলায়, নরম হাত : ‘ঘুমো এখন
তুই আমার বুকের দুধ তুই আমার
না-হওয়া মেয়ে ঘুমো এখন ঘুমিয়ে পড়’…
ভরাট বুকে গন্ধ পাই, ছেলেবেলার গন্ধ আর
রেলগাড়ির শব্দ পাই, মায়ের গায়ে আনাজ ঘাম
হলুদ আর হাত রুটির, আদার আর আদর আর
আদর তার গন্ধ পাই, ঘুমিয়ে যেতে যেতেও বলি :
‘মা গো’…
… … …
সকাল থেকে বৃষ্টি আজ সারা আকাশ
কেবল মেঘ সেই রাতের মতোই কাল
গভীর রাতে বৃষ্টি এল সারা আকাশ
বৃষ্টি আর ঘুম ভাঙিয়ে বারান্দায়
দাঁড় করিয়ে দিল
আজ আর ভোরে উঠিনি সেই রাত থেকেই
জেগে ছিলাম। স্বামীকে কাল বলেছি : আজ
পারব না।
অবাক হল কিন্তু কিছু বলেনি আর
সকালে আজ রিক্সা ডেকে ছাতা মাথায়
বেরিয়ে গেছে ওরা সবাই শিবপুরের
ননদ, তার মেয়ের মুখেভাতে
ওরা আমায় বাকি জীবন দেখার লোক?
আমি ওদের বাকি জীবন খাটার লোক?
বাকি জীবন? বাকি জীবন?
নাঃ
এখন আর হয় না আর হয় না।
আর হয়?

সবাই বাড়িতে ফিরে দিনকয়েক পরে
কী সুন্দর বাচ্চা তাই আলোচনা করে
শাশুড়ি বলেন ঝি-কে : ‘কপালে তো নেই
যা জুটেছে তা-ই নিয়ে কাটাতে হবেই।’
ইঙ্গিতটি বোঝা যাচ্ছে যায় কার দিকে
‘মা কি শুনেছেন?’ বৌমা বলে শ্বাশুড়িকে
‘কী শুনব? কী বলছ?’ তিনি বোঝেন না ভাল :
‘ওই যে আপনার ছেলে ডাক্তার দ্যাখালো
আমাকে, নিজেকে তার রিপোর্টে কী আছে
শুনেছেন কিছু?’ ‘আমি শুনব কার কাছে?
আমাকে কি বলে কেউ?’ ‘সে রিপোর্টে কার
দোষ সেটা স্পষ্ট করে বলেছে ডাক্তার’
‘কী বলেছে? কার দোষ?’ ‘আপনার ছেলে
সমস্তই জানে। আজ অফিস থেকে এলে
দেখবেন জিগেস করে’ ‘—মানে? তার মানে?
তুমি কিছু জানছো না, ছেলে সব জানে?’
‘আমি জানি।’ ‘জানো যদি বলতে কী হয়?’
‘এটুকু অন্তত জানি দোষ আমার নয়।’
‘তার মানে? কী বলতে চাইছ? ছেলের সব দোষ?
কার নামে কী বলছ জানো? এত দুঃসাহস !’
‘সাহসের কথা নয় মা, আমি তো বলিনি
তিনি বড় চিকিৎসক, বলেছেন যিনি।’
‘ঘরে ঘরে কতো আছে অমন হাতুড়ে
ওরা আর কতো চিনবে কে বাঁজা, আটকুঁড়ে?
চিকিৎসক ! ওঃ, সব পরে দেখা যাবে
ছেলের ফের বিয়ে দিলে প্রমাণটি পাবে !’
‘বেশ তবে তাই দিন।‘ —‘উঃ ভগবান
বাঁজা বৌ ঘরে এনে অ্যাতো অপমান!
মুখে মুখে কথা বলছে, সমানে সমানে
হাতে মাথা কাটবে কী না তা-ই বা কে জানে?’
সব সহ্য হয় শুধু বাঁজা ঢুকলে কানে
এক মুহূর্তও থাকা যায় না সেখানে
একি নিজে মেয়ে ছিল? শুধোও তো একে,
কী করে এ কথা বলে অপর মেয়েকে?
কোথায় আড়াল পাবে ; কোথা অতঃপর
দাঁড়াবে, একই তো জায়গা, সেই কলঘর
আজও যদি চোখ থেকে আগুন না পড়ে
কবে পড়বে? বৌমাটিকে জল প্রশ্ন করে
এরকম মেয়ে যারা আছে সবখানে
তারা কেউ মাথা তুলে বেঁচে থাকতে জানে?
রীণা বলে, ‘জানে, তুই কাগজে কাগজে
যতো মেয়ে কেরোসিন-দেশলাই খোঁজে
তাদেরই দেখিস শুধু? বাঁচার উপায়
তা-ও তো পড়েই থাকে, কত মেয়ে পায় !’
‘কী করে পায় রে?’ ‘যদি সৎসাহস থাকে
যদি জেদ থাকে তবে কে আটকায় তাকে?
ঘর চাই, বরও চাই, কিন্তু মরা ছাড়া
যদি অন্য রাস্তাঘাট না দেখায় তারা
কী করবি?’— ‘কী করবো বল, কী করবো তখন।’
‘তুই। আমি। এই দুইয়ে, আমরা তো দুজন !
হ্যাঁ কি না? —‘হ্যাঁ।’ ‘শুরু হল সংগঠন। দল।
এবার আমাদের দলে কাকে নিবি, বল?’
‘মিতা, পর্ণা’— ‘ঠিক, কিন্তু রাজি হবে ওরা?’
—‘না হলে হবে না, তা’তে এসে যাবে থোড়া’
‘কিন্তু কী কাজ করবো? —‘কাজের কী কোনও
মা বাবা রয়েছে নাকি? মেয়ের কথা শোনো !
যে কোনো, যে কোনো কাজ শুরু করতে পারি
শুধু চেষ্টা, শুধু চেষ্টা, চেষ্টাটা দরকারি
বাতি-বাতি খেলতাম না? লণ্ঠন-লণ্ঠন?
তুই আমি দুই খেলনা, এক সংগঠন।’
ছেড়ে দে রীণার কথা— (বলে স্নান জল)
স্বামী এলে কী করবি তা ঠিক করে বল !
রাত্রে ঘরে ঢুকে স্বামী জামা ছাড়তে থাকে
এদিকে তাকায় না, বলে, ‘কী বলেছ মা কে?’
‘উনি ফুলমণির কাছে বলছিলেন, তাই,
ভাবলাম যা সত্যি তা বলে দেওয়াটাই
ভালো হবে।’ —‘কোন সত্যি?’ ‘ওই যে রিপোর্টে
যেটা আছে!’ স্বামীচক্ষে সুবিস্ময় ফোটে !
‘রিপোর্ট তো দ্যাখোনি তুমি’— ‘হ্যাঁ দেখেছি আমি!’
এইবার একদম হতভম্ব স্বামী,
‘তার মানে কাগজপত্র লুকিয়ে দেখেছো?
(ভয় পাচ্ছে সাপ বেরোবে। খুঁড়তে গিয়ে কেঁচো)
আড়ি পাতছ?’—‘আড়ি নয়, স্বাস্থ্যের বিষয়
রিপোর্টটা দেখে রাখা দরকার নিশ্চয়।’
—‘ওসব রিপোর্ট বাজে, ও বাজে ডাক্তার
অন্য ডাক্তারের খোঁজ পেয়েছি এবার
নিয়ে যাবো কিন্তু আগে ভাল করে শোনো
মার মুখে মুখে কথা বলবে না কক্ষনো
কাল আমি বাইরে যাব। কাজে। সে সময়,
সে কয়েকটা দিন যেন অশান্তি না হয়
সকালে মার কাছে যাবে। সব দিক ভেবে
তবে কাজ করতে হয়। মাপ চেয়ে নেবে।
শোও এবার, নাও এসো, এগারোটা বাজে
কী হল কী?… কাল আবার… অফিসের কাজে…
এ- এই যে-হ্যাঁ… (পজিসন) দেরি করলে হয় !…
স্ত্রী বলে, সংযুক্তা হয়ে : ‘কালকে এসময়
শিপ্রা ঘোষ থাকবে তো আমার জায়গায়?’
‘আঁক’-শব্দ, একমুহূর্তে কাঠিন্য পালায়
ওই অবস্থায় স্থির ! হাপর ফোঁসফোঁস।
স্বামী বলে : ‘কী বললে? অ্যাঁ?’— ‘বলছি, শিপ্রা ঘোষ,
এইভাবে থাকবে তো কাল?’—‘শি-পরা…ঘো’ —‘যার
সঙ্গে তুমি ঘুরে এলে ডায়মন্ডহারবার !’
নিজেকে উঠিয়ে স্বামী চিৎ একপাশে,
স্ত্রী ওঠে, সাব্যস্ত হয়, জল নেয় গ্লাসে…
‘এবারও কি কাছাকাছি? দেখো, দূরে গেলে
ফের যেন চাবি ফেলে এসো না হোটেলে !’
স্বামী বলে : ‘কী বলছ কী সেই তখন থেকে?’
—‘কী বলছি তা অফিসের লোকেদের ডেকে
একবার জিগ্যেস কোরো। বোঝাবে ওরাই।’
—‘আমি তো অফিস থেকে টুর নিয়েই যাই!’
সব শান্ত, স্থির, যেন সবই যথাযথ
রয়েছে, উত্তর করে নারী সেইমতো :
‘কী ট্যুরে পাঠায় এত অফিস তোমাকে
যেখানে প্রত্যেকবার শিপ্রা ঘোষ থাকে !
যার অন্য অফিসে চাকরি?’ বলে সেই নারী :
‘তাছাড়া তোমার পোস্টে ট্যুর কি দরকারি?
তোমাকে তো ঘুরতে হয় না। টেবিলেই কাজ!’
স্বামী ধড়মড়িয়ে ওঠে : ‘তুমি কিন্তু আজ
বড্ড বেশি কথা বলছ। অফিস-ব্যাপারে
কী জানো কী, কতরকম কাজ থাকতে পারে!’
‘পারে, কিন্তু থাকে না তা। তোমার অন্তত
থাকে না, ওটুকু মিথ্যে না বললেই হতো।’
‘কী বললে !!’ — ‘না, ভুল বলেছি। ওটা না বললে তো
চলত না, ফুর্তিতে যাওয়া পণ্ড হয়ে যেত
তাই না? রক্ষিতা নিয়ে? ওই শিপ্রা ঘোষ?’
‘বাড়তে বাড়তে কতদূর বেড়েছে সাহস
আর কথা বললে চামড়া খুলে নেব তোর !’
‘বাঃ ! বেশ তো ! নাও।’ — অমনি পড়েছে থাপ্পড়।
ঘুরে পড়ল। খাট ধ’রে ধ’রে উঠল! আর
কিছু মনে পড়ছে না। মাথা অন্ধকার।
মারল? আগে তুই বলেছে। ওসব সময়ে
তখন তো মানুষ নয়। তাই লজ্জা-ভয়ে
পরে কিছু বলতে যায়নি। কিন্তু আজ? আর
কোনো পথ রাখছে না বাড়িতে থাকবার।
কাঁপতে কাঁপতে উঠল বউ। দাঁড়াল দরজায়।
একই ঘরে, একই খাটে আর থাকে যায়?
তবে সে কার কাছে যাবে এখন? থানায়?
কেউ কেউ, সে শুনেছে, পুলিশে জানায়।
তা-ই করবে? যাবে তাই? তা-ই যেতে হবে।
‘—চটি পরছো?’—‘হ্যাঁ পরছি।’—‘বাঃ, পরো তবে !’
‘যাও না। যেখানে খুশি দূর হয়ে যাও।’
‘দূরে না, থানায় ছাড়া যাবো না কোথাও,
বুঝতে পারছো, আজ বৌ থানায় দাঁড়ালে
কাল তোমার অবস্থাটা কী হবে সকালে?’
স্বামী ঠাণ্ডা। খাটে বসে। সিগ্রেট ধরালো।
স্ত্রী জানলায়। প্রতিবেশী-জানলাতেও আলো।
যুবকটি চুম্বন করছে নিজের পত্নীকে
কেউ দেখবে কি না লক্ষ নেই সেইদিকে।
মুখোমুখি জানলা, মধ্যে শীর্ণ পিচপথ
দুদিকে দুভাবে চলছ, হে দাম্পত্যরথ !
স্বামী বলছে, ঠাণ্ডা স্বর, ‘হ্যাঁ শোন এবার—
আজকাল তো হাসব্যান্ডকে পুলিসে দেবার
খুব একটা চল হয়েছে। ভাবিনি তোমারও
মাথায় এসব আসবে। চাইলে দিতে পারো।
ভেবে দেখো ফিরে এসে দাঁড়াবে কোনখানে?
এই বাড়িতে?… হ্যাঁ, তোমার মা-বোন কি জানে?
যতটুকু যা চিনেছি ওই বোনকে, মাকে
ওরা খুব ওয়েলকাম করবে কি তোমাকে?
তা যদি করেও, তবে, মামলা কে চালাবে?
মামলা, মামলা ! ডিভোর্সের। মিউচ্যুয়ালি পাবে?
আমি তো দেব না। তবে ঠাণ্ডা হয়ে ভেবে
দ্যাখো যে আমায় সত্যি পুলিসে কি দেবে?
আরো একটা কথা। স্যরি। হাত তুলেছি গা’য়।
ভুলে যাও। যা হয়েছে রাগের মাথায়।
শেষ যেটা… সেটা বলেই শুয়ে পড়ব আমি…’
বলে, অ্যাশট্রেতে অগ্নি ঠেসে দিল স্বামী।
‘সে কথাটা ইম্পর্ট্যান্ট… সে কথাটা ওর…
শিপ্রার… শিপ্রাকে নিয়ে। জানি না খবর
কী করে পেয়েছ তুমি। অফিসের লোক
শত্রুতা করেছে হয়ত… করুক গে।… যা হোক
শিপ্রা, তুমি, দুজনকেই, আমার দরকার।
এক বৌতে সব হয়?… এসব নিয়ে আর
গোলমাল কোরো না…. আর ভরণ-পোষণ?
সে আমি করবও, করে যাবো লাইফলঙ্‌…
আর, কিছু মনে করো না… তোমার সঙ্গে তো
সে রকম লাইফ নেই ! তুমি কোল্ড। সে তো
নিজে জানো। নিজমুখে করেছো স্বীকারও।
এবার তুমি কী করবে তা ভেবে দেখতে পারো।
আমি তবে শুয়ে পড়ছি, ভোর-ভোর আমায়
ডেকে দিও, যেন ট্রেন মিস্ না হয়ে যায় !’….
নিজে রক্ষিতাকে নিয়ে প্রমোদে বেরোবে
আর বৌকে ভোর-ভোর ডেকে দিতে হবে।
বাইরে একজন থাকবে, একজন ঘরে —
থাকতে হবে। থাকতে হবে এ-ই সহ্য করে !
বৌ শোয়নি। সারারাত সেই বারান্দায়
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দ্যাখে আলো ফুটে যায়
নীলচে মেঘে আরো হালকা নীল উঠছে ভেসে
কার্নিশে প্রথম কাক উড়ে বসলো এসে
বেরোল প্রথম রিক্সা, সওয়ারী ছাড়াই
বাড়ি বাড়ি জেগে উঠছে পড়োশি সবাই
ওরা ঝাঁট দিচ্ছে, দ্বারে জল দিচ্ছে এরা
কাজের বাড়িতে যাচ্ছে কাজের মেয়েরা
দেখল, দেখল, তাকে বলল ভোরবেলার হাওয়া
এ জীবনে হয়ে গেল বহু কিছু পাওয়া
এরপরও রয়ে গেছে আর কী চাহিদা
তাই নিয়ে দরখাস্ত করো মুসাবিদা
ভাত আর কাপড় ! শুধু কাপড় আর ভাত?
জন্মসূত্রে এ জন্যেই ওই দুটো হাত
পেয়েছিলে বুঝি? বেশ। বলে হাওয়া আর
দাঁড়াল না : ডেকে দাও স্বামীকে তোমার।
ডাকতে তো হল না, স্বামী নিজে গেছে উঠে
সঙ্গে সঙ্গে চা বানাতে নিচে যাওয়া ছুটে
পরপর লেগে যাওয়া সেই এক রুটিনে
এক রেকর্ড, এক আওয়াজ একই ভাঙা টিনে…
সবাই দুপুরে একটু শুয়েছে যখন
বৌমাটি প্রস্তুত হয়ে দাঁড়ায় তখন
দিকে দিকে চায় আর মনে মনে বলে
গেলাম বারান্দা-ছাদ, গেলাম তাহলে
তোরা সব এত দিন আমাকে এখানে
কীভাবে আগলেছিস কেউ কী আর জানে?
কলঘর জানে, আমি গেলাম কলঘর
আমার সমস্ত কষ্ট আজ মনে কর
তুই, তোরা ঘিরেছিলি আমাকে ভাগ্যিস !
আজ সব দোষত্রুটি মাপ করে দিস।
ব্যাগ সুটকেস নিয়ে শাশুড়িকে ডাকে :
‘মা আমি ক’দিন একটু দেখতে যাব মা-কে।’
শাশুড়ি ঘুম থেকে উঠে হতভম্ব হন :
‘ক’দিন আগেই তো মাকে দেখে এলে ধন !
দু’হপ্তা পোরেনি, অমনি উঠে গেল বাই
আজ থাকগে।’—‘না, মা, আমি আজই যেতে চাই।’
‘স্বামীটি বেরিয়ে গেল, তক্ষুনি বাপের
বাড়ি ছুটছে, যেন পাঁচ-পা দেখেছে সাপের !’
শ্বশুর ঘুম ভেঙে উঠে বললেন : ‘আর
সময় পেলে না তুমি মাকে দেখবার?
খোকা বাড়ি নেই আর বাড়ি একা ফেলে’…
‘দুদিনেই এসে যাবে আপনাদের ছেলে।
তাছাড়া দেওর তো আছে, একা বাড়ি কই?’
হেঁট হয় : ‘আচ্ছা আমি তাহলে এগোই।’
—‘ব্যাগ-বাক্স কেন? কবে আসা হবে শুনি?’
—‘যাই তো। না গিয়ে বলতে পারছি না এক্ষুনি।’
শাশুড়ি ফুটছেন : ‘আচ্ছা ! যেন মনে থাকে,
বাড়ি ফিরলে এক-এক করে সব বলব তাকে !’
বাইরে বেরিয়ে রিক্সা। —‘কোথায়?’ —‘স্টেশন’
‘তুমি ভাই জানো ডাউনে ট্রেন আছে কখন?’
‘হ্যাঁ জানি গো বৌদিমণি, বেলা দেড়টায়।’
এখন তো একটা কুড়ি, যদি ধরা যায়…
ধরা যেতে তিন স্টেশন দ্রুত পার হয়
তারপর নেমে পড়া। সেই পিত্রালয়।
সেইসব মাঠঘাট, স্টেশন, বাজার !
এসেছি, আবার ফিরে এসেছি, আবার !
অকস্মাৎ কন্যাটির থমকে যায় মন
স্টেশনে দাঁড়ায়ে কন্যা, কী ভাবো এখন?
ফিরেছি, মা ভাববে বোঝা ফিরে এল ঘরে
যেমন বেড়াল ছাড়লে ফিরে আসে পরে
এখানে ঝিরঝির বৃষ্টি, উলটো পালটা হাওয়া
আর যা হোক, অসম্ভব মা-র কাছে যাওয়া।
তাহলে কার কাছে যাবো? আছে মাত্র রীণা।
কে জানে কী মনে করবে, ভুল বুঝবে কি না!
যাই না রীণার কাছে?… কিন্তু ও এখন
অফিসে.. কখন আসবে?… কখন?…কখন?…
ভাবছে এ মহিলা আজকে, দাঁড়িয়ে রাস্তায়
ভাবতে ভাবতে বাতাসের গতি বেড়ে যায়
বৃষ্টি মুখে ধাক্কা মারে, ঝাপটা দেয় ঝড়
মহিলার বয়ঃক্রমে তিরিশ বৎসর।
রীণা আজকে ফিরবে? যদি না-ই ফেরে রীণা
সেসব এখন আমরা বলতে পারছি না।
মহিলা দাঁড়ায় থাক হোথা কিছুক্ষণ
সেই ফাঁকে অন্য দিকে আমরাই বরং
দশবছর পিছনে কী ঘটছে দেখে আসি
যেখানে জুলাই মাস, উনিশশো পঁচাশি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *