যক্ষের ধন বা কুবেরের ধন
যক্ষ বা যকের ধন বলতে বুঝায় প্রাণপণে রক্ষিত ধন। অতি কৃপণ ব্যক্তির রক্ষিত ধনসম্পদকে সাধারণ অর্থে যক্ষের ধন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় আমাদের দেশে।
প্রাচীনকালে কৃপণ বিত্তবানদের কেউ কেউ নিজেদের ধনসম্পদ নিরাপদে রাখার উদ্দেশ্যে মাটির নিচে একটি ঘর তৈরি করতো। সেখানে মুদ্রাভর্তি কলসি রেখে কোনো এক বালককে গোপনে ধরে এনে পূজা শেষে সেই ঘরে আটক করে রাখতো, কেউ জানতে পারতো না। বদ্ধ পাতাল ঘরে ঐ বালক অসহায় অবস্থায় মরে গিয়ে যক্ষ বা যক হয়ে অর্থসম্পদ পাহারা দিতো। এটি ছিল প্রাচীনকালের অন্ধ সংস্কার। এই সংস্কারমতে উক্ত কৃপণ ব্যক্তির নির্দেশমতো তার উত্তরাধিকারীকে ঐ সম্পদ প্রত্যর্পণ করার পর প্রেত অবস্থা থেকে মুক্তি পেতো উক্ত যক্ষ বা যক। এইরূপ যক্ষরক্ষিত ধনকে যক্ষের ধন বলা হয় অর্থাৎ ধনের মালিক যে ধন কিছুতেই ব্যয় করে না।
যক্ষ হলো কুবেরের অনুচর। এরা ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, মুখ বিকৃতাকার ও চোখ পীত আভাযুক্ত রক্তবর্ণ। যক্ষের পেট বিশাল, কেউ কেউ ক্রিস্টাল (স্ফটিক) পাথরের ন্যায়, চেহারা রক্তবর্ণ ও দীর্ঘ কাঁধযুক্ত। পদ্মপুরাণে যক্ষের জন্ম সম্পর্কে বলা হয়েছে—
ব্রহ্মা প্রজা সৃষ্টি করার কাজে যখন নিয়োজিত তখন এক সময় প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত হয়ে পড়েন। সুতরাং রেগেমেগে অন্ধকারের মধ্যেই প্রজাসৃষ্টির কাজ চালিয়ে যান। ফলে অন্ধকারের মধ্যে বিকৃতরূপ ক্ষুধার্ত প্রজার সৃষ্টি হলো। তাদের কেউ কেউ আবার চরম ক্ষুধার্ত হয়ে সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মাকেই খেয়ে ফেলার উপক্রম করলো। তাদের এই হঠকারিতাকে বাধা দিল অন্য কেউ কেউ। এ থেকে দু’ধরনের প্রজা তৈরি হলো। যারা ব্রহ্মাকে খেতে উদ্যত হয়েছিল তারা হলো যক্ষ। আর যারা নিষেধ করেছিল বা রক্ষার জন্য এগিয়ে এসেছিল তারা হলো রক্ষ বা রাক্ষস।
রামায়ণে বলা হয়েছে যে, সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা প্রথমে জল সৃষ্টি করলেন। তারপর সেই জল রক্ষার জন্য প্রাণী সৃষ্টি করলেন। প্রাণীদের মধ্যে কেউ কেউ বললো যক্ষামঃ—অর্থাৎ আমরা পূজা করবো। অন্য দল বললো রক্ষামঃ— অর্থাৎ আমরা জল রক্ষা করবো। ব্রহ্মার সিদ্ধান্তে পূর্বোক্ত দল হলো যক্ষ এবং দ্বিতীয় দল বা জলসম্পদ রক্ষাকারীরা রাক্ষস।
যক্ষরা সাধারণত মানুষের বন্ধু। এরা কুবেরের ভৃত্য। রাক্ষসরা মানুষের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন। কুবের হচ্ছেন যক্ষদের রাজা। তিনি ধনাধিপতি। বিশ্ববা মনির ঔরসে ভরদ্বাজ-কন্যা দেববর্ণিনীর গর্ভে তার জন্ম। তার আর এক নাম বৈশ্রবণ। এই বিশ্রবার ঔরসে নিকষার গর্ভে আবার রাক্ষসরাজ রাবণের জন্ম। সেদিক থেকে কুবের হলেন রাবণের বৈমাত্রেয় ভাই। কুবের প্রথমে বাস করতেন বিশ্বকর্মা-নির্মিত লঙ্কাপুরীতে। রাবণ লঙ্কা দখল করে কুবেরের পুষ্পক রথ ছিনিয়ে নেন। কুবের লঙ্কা ছেড়ে কৈলাসে আশ্রয় নেন।
সমস্ত ধনের প্রদাতা ও অধ্যক্ষ হলেন কুবের। তিনি যক্ষ ও কিন্নরদের (স্বর্গের সাধারণ গায়ক) অধিপতি। তার দেহের গঠন অতি কুৎসিত ছিল বলে নাম হয় কুবের। তিনটি পা ও আটটি দাঁত ছিল তার। স্ত্রীর নাম আহুতি। দুই পুত্র-নলকূবর ও মণিগ্রীব এবং এক কন্যা মীনাক্ষী। তার পুরীর নাম অলকা। ব্রহ্মার বরে কুবের অমর এবং উত্তর দিকের দিপাল এবং ধনাধিপতি। যক্ষরা তার প্রজা এবং প্রহরী।
তাহলে আমরা দেখতে পাই যে, আমাদের দেশে প্রচলিত কুবেরের ধন বা যক্ষের ধন প্রবাদের উৎস পৌরাণিক কুবের ও যক্ষের ধারণা থেকে এসেছে।