মৌর্য – ৯৩

৯৩

মহামন্ত্রী চাণক্য এবং দাক্ষিণাত্যের সেনাপতির কথা শুনে চন্দ্রগুপ্তের বারবার স্বপ্নের কথা মনে হলো। মনে মনে বললেন, তাহলে এই উপজাতিদের রাজা ‘বানর’? এই মন্দলোক আমার ক্ষমতা দখল করবে? তখন মর্যাদাবান তলের সঙ্গে শামিল হবেন। সম্মানিত ব্যক্তিরা অসম্মানিত হবেন। বারো মাথা সর্পের অর্থই হলো সামনে বিপদ। বললেন, আচার্য, যুদ্ধের প্রস্তুতি নিন, আমি নিজে এ অভিযান পরিচালনা করব।

চাণক্য দেখলেন, কাজ হয়ে গেছে। কিছুটা ধূর্ততার সঙ্গে বললেন, ছোট রাজার বিরুদ্ধে অভিযান, আমরাই যথেষ্ট ছিলাম। আপনি বরং আয়েশ করুন, সম্রাট।

চন্দ্রগুপ্ত উত্তেজিত হয়ে বললেন, না আচার্য, আমরা সবাই এ অভিযান পরিচালনা করব। আপনি ব্যবস্থা নিন। সর্বাগ্রে আপনি দাক্ষিণাত্যের সম্ভাব্য যুদ্ধপথসংবলিত মানচিত্রসহ যুদ্ধাভিযানের গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো তুলে ধরবেন।

মহামন্ত্রীর নির্দেশে দ্রুত মানচিত্র নিয়ে আসা হলো। মাটির ওপর মেলে ধরা হলো। যাত্রাপথ চিহ্নিত করল মৌর্য সৈন্যদেরই অগ্রবর্তী কনটিনজেন্ট। একটি লম্বা কাঠি দিয়ে ডেকান পেলেটিওর যাত্রাপথ চিহ্নিত করল এক সেনাপতি।

দুটি নদী আছে মাঝখানে। একটি নর্মদা, অপরটি কৃষ্ণা নদী। নদী দুটোয় এ মৌসুমে জল কম থাকে। হাতি, ঘোড়া ও ষাঁড়চালিত মালবাহী গাড়ি সহজে পারাপার করা যাবে। সৈন্যরা যাবে হেঁটে। কাপড় ভিজলেও সহজে শুকিয়ে যাবে। তবে সমস্যা হবে নীলগিরি ও বিন্দপর্বত পার হতে। গলা শুকিয়ে যাবে। সমস্যা নেই, কাছেই হোগেনাকাল ঝরনা আছে। প্রাণভরে ঝরনার স্বচ্ছ জল পান করা যাবে। সঙ্গে করেও নেওয়া যাবে।

দাক্ষিণাত্য মালভূমির কোথায় সে উপজাতি রাজার রাজধানী?

দাক্ষিণাত্যের সেনাপতি তার জবাব দিল। নিজে কিছুটা অগ্রসর হয়ে মানচিত্রের কাছে এসে বলল, মহামান্য সম্রাট, এই এখানে। দুদিকে তার পূর্ব ঘাট ও পশ্চিম ঘাট। পশ্চিম ঘাটে নীলগিরি পর্বত।

চন্দ্রগুপ্ত বললেন, প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলো প্রমাণ করে, জায়গাটি খুব সুন্দর।

সেনাপতি বলল, খুবই সুন্দর, ছবির মতো আঁকা। প্রাকৃতিক সম্পদের ছড়াছড়ি।

কোন ঘাটে উপজাতি রাজা অবস্থান করেন?

পশ্চিম ঘাট, নীলগিরির পাদদেশে।

প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতা কি আছে?

মালভূমিটাই প্রধান বাধা। উত্তরে কিছুটা কম হলেও দক্ষিণে অনেক উঁচু পাহাড়। সৈন্যরা ওপরে উঠতে গেলে প্রথমে বড় বড় পাথর ফেলা হবে। সঙ্গে তির ছুড়বে।

তাহলে কী ব্যবস্থা নিতে হবে, মৌর্যদের প্রধান সেনাপতি এ প্রশ্ন তুলল।

ব্যবস্থা হলো সুড়ঙ্গপথ তৈরি করে ওপরে উঠে যাওয়া।

ওরা তো বাধা দেবে।

বহু দূর থেকে করতে হবে।

মহামন্ত্রী বললেন, তোমার মাথা। সম্রাটের উদ্দেশে বললেন, আপনি এ ব্যবস্থা আমাদের ওপর ছেড়ে দিন। পুরো যুদ্ধ পরিকল্পনা আপনার কাছে পেশ করব।

এ রকম সুড়ঙ্গ কেটে সৈন্য পাঠানোর চেষ্টা করেছিল এক যুদ্ধে শত্রুপক্ষের এক রাজা। মহামন্ত্রী চাণক্য সেখানে গুড় ঢেলে বিষপিঁপড়ে সরবরাহ করেছিলেন। এ পিঁপড়েই তার যুদ্ধজয় সহজ করে দিয়েছিল। আরেক যুদ্ধে ব্যবহার করেছিলেন ইঁদুর ধোয়া। সুড়ঙ্গ যুদ্ধ এখন আর নিরাপদ নয়।

নিজ কক্ষে এসে অস্থিরতায় সময় কাটাচ্ছেন সম্রাট। হেলেন তাঁর পাশে বসলেন। কোনো সমস্যা, বললেন তিনি।

স্বপ্ন তো মিলে যাচ্ছে হেলেন, দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন সম্রাট।

কী স্বপ্ন, আমাকে তো কিছুই বলেন নি।

বানর সিংহাসনে বসে আছে। এই বানরের ভয়ে রাজহংস উড়ে যাচ্ছে।

তাতে কী হয়েছে? স্বপ্ন তো স্বপ্নই।

না হেলেন, স্বপ্ন স্বপ্ন নয়, তার তাৎপর্য আছে। মহামন্ত্রী জানালেন, অন্ধ্রের উপজাতি রাজা মৌর্য সাম্রাজ্য আক্রমণ করছে। সে থাকে মালভূমিতে, বন্য পরিবেশে। সমস্যা বুঝতেই পারছ। বানরেরাও এ রকম পরিবেশে থাকে। স্বপ্ন মিলে যাচ্ছে।

আপনি অস্থির হবেন না। আমাদের সেনাশক্তির কাছে ওরা টিকতেই পারবে না।

সমস্যা আছে। মালভূমির ওপর আমাদের সৈন্যরা নাকি উঠতেই পারবে না। ওপর থেকে বড় বড় পাথর নিক্ষেপ করবে।

আমাদের সাম্রাজ্য দখল করতে চাইলে তো মালভূমিরাজকে নিচে নেমে আসতে হবে, নাকি?

তাই তো।

তাহলে আমাদের মালভূমিতে ওঠার দরকার কী?

তাকে যদি আমরা পরাজিত করতে চাই, তাহলে তো ওপরে উঠতেই হবে

তার সঙ্গে সন্ধি করে নিন।

দুর্বল রাজার সঙ্গে সন্ধি?

কেন, কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে বলেন নি যে দুর্বল রাজার সঙ্গেও সন্ধি করা যাবে?

বলেছেন।

তাহলে সমস্যা কোথায়? ওটা তো একটা কৌশলমাত্র, সময়মতো তার রাজ্য দখল করে নেবেন।

হেলেন, আমি মুগ্ধ যে তুমি রাজনীতি জানো। কিন্তু শত্রুকে আমি একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চাই।

তাহলে ঝুঁকি তো আপনাকে নিতেই হবে। এ যুদ্ধে আমি আপনার সঙ্গে থাকতে চাই।

তুমি?

কেন, আমি কি যুদ্ধ করতে জানি না? আগে সেলুসিড আর্মির হয়ে লড়েছি, এখন মৌর্যদের হয়ে লড়ব।

তোমাকে যুদ্ধ করতে হবে না, তুমি আমার সঙ্গে থাকলেই হবে।

একবার এ নিয়ে আচার্য ভদ্রবাহুর সঙ্গে কথা বললে হতো না?

বলেছি, স্বপ্ন নিয়ে কথা বলেছি।

আমি বলছিলাম যুদ্ধাভিযান নিয়ে কথা বলতে। আচার্যের আজকে প্রাসাদে অবস্থানের দিন। চলুন তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করি।

ঠিক বলেছ।

ভদ্রবাহু মঙ্গলবারে প্রাসাদে অবস্থান করেন। এদিনে সম্রাট মনে করলে মনস্তাত্ত্বিক কাউন্সেলিংয়ের জন্য আচার্যের কক্ষে যান। মাঝেমধ্যে ধ্যান করেন আচার্যের সঙ্গে। বাকি সময় পরামর্শ নেন কিংবা গল্প করে কাটান।

আচার্য শুধু প্রাসাদসংশ্লিষ্ট কাজগুলো এখানে করেন। কখনো কখনো গল্প করার জন্য আচার্য চাণক্যের কক্ষে যান। আচার্য চাণক্যই প্রয়োজনে এখানে বেশি আসেন।

সম্রাট এখানে আসার আগে সংবাদ পাঠান। হুট করে আসেন না। আজ না জানিয়েই সম্রাজ্ঞীসহ উপস্থিত হলেন। আচার্য হাসি দিয়ে বললেন, চন্দ্র, কোনো সমস্যা?

জরুরি পরামর্শ প্রয়োজন, আচার্য।

বসো, বসো। আমাদের সম্রাজ্ঞী এসেছেন। তাঁকে নিয়ে এলে, পূর্বে একটু জানাতে পারতে তিনি আসবেন।

হেলেন বললেন, ব্যস্ত হবেন না, আচার্য। ব্যস্ত হলে মনে হয় আপনি চন্দ্রকে যে জায়গায় রেখেছেন, সেখানে আমি নেই। আমার ঈর্ষা হয়। ‘আপনি’ বলে আরও দূরে সরিয়ে রাখেন।

হেলেনের কথায় আচার্য শুধু হাসলেন। পরে বললেন, আপনি আসবেন জানলে শর্মিলাকে আনিয়ে রাখতাম।

আবার ‘আপনি’ ‘আপনি’ করছেন।

ঠিক আছে। এখন থেকে তোমাকে মা বলে ডাকব।

যা-ই হোক, তাহলে আমিও সে জায়গাটা পেলাম।

সম্রাট বললেন, পেয়েছ কী, বলো ভাগ বসিয়েছ।

এবার সম্রাট সিরিয়াস হয়ে বললেন, মহামন্ত্রী জানালেন, অন্ধ্রের উপজাতি রাজা মৌর্য সাম্রাজ্য আক্রমণ করতে চায়। তাকে সুযোগ না দিয়ে আমরা আগে আক্রমণ করতে চাই।

আচার্য এ কথায় কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন না। সম্রাট আবার বললেন, সমস্যা হলো, ওই রাজার রাজধানী মালভূমির ওপর। সংবাদ নিয়ে জেনেছি, রাজা মালভূমির চারদিকে বড় বড় পাথর জড়ো করে রেখেছেন। নিচের দিকে ঠেলে দিলেই আক্রমণকারী সৈন্যরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।

আচার্য এবারও কিছু বললেন না। সম্রাট ক্রমে অস্থির হয়ে উঠছেন। তিনি আবার বললেন, জানেন তো এরা জয়ী হলে সেই স্বপ্ন ‘বানরের ভয়ে রাজহংস উড়ে যাচ্ছে’ সত্য হবে। আপনাদের হারাব আমি। আমি হারিয়ে যাই ক্ষতি নেই, আপনাদের হারাতে চাই না।

চন্দ্র, তুমি অস্থির হচ্ছ কেন? ধৈর্য ধারণ করো। পুরো ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে হবে আমাকে। অনেক বড় বড় অভিযানে গেছ, সফল হয়েছ। এখানেও সফল হবে।

আমিও সে কথাই বলছি, আচার্য। কিন্তু সম্রাটের অস্থিরতা কাটছেই না, বললেন হেলেন। তার কারণ আছে, মা। দাক্ষিণাত্য আমাদের কাছে অচেনা জায়গা। পাহাড়-পর্বত, বন- জঙ্গল, নদী-নালা, মালভূমি—এসব প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতা তো আছেই। এসব অপরিচিত জায়গার লোকজনও অচেনা, তাদের শক্তি-সামর্থ্য জানা নেই। তাই একটু চিন্তার ব্যাপার আছেই।

আচার্যের কথার মধ্যে সম্রাট বললেন, আমাকে ভাবাচ্ছে দুঃস্বপ্ন।

সে ব্যাপারটা আমি দেখছি, বললেন ভদ্ৰবাহু। এটা আমার ওপর ছেড়ে দাও। আমি আচাৰ্য চাণক্যের সঙ্গে কথা বলব। তিনি যে ব্যাপারটা তোমাকে বলবেন না, হয়তো আমাকে সেটা বলবেন।

তা ঠিক বলেছেন, আচার্য, বললেন হেলেন।

আচার্য ভদ্ৰবাহু আগেই কিছু বিষয় জানেন। এখন সম্রাটের মনোভাবও জানলেন। পরে চাণক্যের সঙ্গে মতবিনিময় করলেন। চাণক্য বললেন, অভিযানটা আমি করতে চাই। আশা করছি সম্রাটকে আপনি অভিযানের পক্ষে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করেছেন।

ভদ্রবাহু হাসলেন। বললেন, মালভূমির ওপর থেকে পাথর ছোড়া হবে, আচার্য, মাথা রক্ষা করার কথা ভাবুন।

পাথর আমার মাথায় পড়বে না, নিশ্চিত থাকুন।

কিন্তু বানর যে রাজহংসদের তাড়াচ্ছে।

আমাদের পাখা আছে, বানর নাগাল পাবে না।

নিজের নয়, আপনাদের জন্যই সম্রাট বেশি চিন্তিত। এখন বলুন আপনার পরিকল্পনাটা কী?

আপনাকে আগেই বলেছি।

এখন কোনো ভাবনা থাকলে বলুন।

আমি মূর্তি বানায়, এমন কিছু লোককে ডেকেছি।

কেন?

মূল পরিকল্পনাটা কী, বলতে হবে?

শুনতে চাই আমি।

মাটি বা বস্ত্রের তৈরি মূর্তিদের মুখোশ পরিয়ে মালভূমির নিচে সৈনিকের সাজে দাঁড় করিয়ে রাখব। এদের দেখে ওরা পাথর ছুড়বে এবং তা একসময় শেষ হয়ে যাবে। তখন আমরা ওদের আক্রমণ করব।

আপনার এ পরিকল্পনার কথা কি সম্রাটকে জানিয়েছেন?

না, এখনো জানাই নি।

সম্রাটকে তা জানাবেন। তাহলে তাঁর অস্থিরতা কেটে যাবে।

পরিকল্পনাটা একেবারে চূড়ান্ত নয়, পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে।

চূড়ান্ত করার আগে মেগাস্থিনিস থেকে পরামর্শ নিতে পারেন, বলে আচার্য ঠোঁট চেপে হাসলেন।

চাণক্য বললেন, তাহলে হয়েছে। তিনি তখন জিজ্ঞেস করতে পারেন মূর্তিগুলোর মধ্যে পেছনের দিকে হাঁটা মানুষের মূর্তি আছে কি না, বলে উচ্চহাস্য করলেন চাণক্য।

.

এদিকে মেগাস্থিনিস কূটনৈতিক বিষয় এবং অধ্যক্ষদের কার্যক্রম নিয়ে লেখা সম্পূরক প্রতিবেদন নিয়ে সেলুকাসের দরবারে হাজির হয়েছেন। প্রথমে দিয়েছেন বিভিন্ন বিভাগে নিয়োজিত অধ্যক্ষবৃন্দের বিবরণ। কোষাধ্যক্ষ বা ভান্ডার অধিপতির কথা বলতে গিয়ে বাঙ্গক ও পুণ্ড্রদেশের সিল্কবস্ত্র সম্পর্কে বলেছেন, কীটের লালা থেকে উৎপন্ন হয় পৌণ্ড্রিকা ও সৌবর্ণ কুড্যকা। সুবর্ণ অধ্যক্ষের কথা বলতে গিয়ে কয়েকটি পিঁপড়ের ছবি এঁকেছেন, যেগুলোর মুখে ছোট ছোট স্বর্ণকণিকা। অর্থাৎ পিঁপড়ে দ্বারা স্বর্ণ সংগ্রহের বিষয়টি এতে ব্যাখ্যাত হয়েছে। খনির দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রশাসক হচ্ছেন আকরাধ্যক্ষ। তার কাছ থেকে পাওয়া একটি সর্পমণি সম্রাটকে উপহার দিলেন। কোষ্টাগার অধ্যক্ষ, পণ্যাধ্যক্ষ, কুপাধ্যক্ষ, সূত্রাধ্যক্ষ প্রমুখের কথা সংক্ষিপ্তভাবে বলে মেগাস্থিনিস অপরাপর অধ্যক্ষদের কথায় বেশ কিছু কল্পিত কথা যুক্ত করলেন। বললেন, আয়ুধাগার অধ্যক্ষ বিশাল বপু এবং দীর্ঘ মোচের অধিকারী। সব অস্ত্রই থাকে তার তত্ত্বাবধানে। পৌতাধ্যক্ষ পরিমাপবিষয়ক অধ্যক্ষ। শুল্ক আদায়ের এবং হিসাব রাখার দায়িত্ব শুক্লাধ্যক্ষের। তবে দুজন অধ্যক্ষের কাজ আমাকে অবাক করেছে। একজন সুরাধ্যক্ষ এবং অপরজন গণিকাধ্যক্ষ।

এদের কী কাজ?

মহামান্য সম্রাট, একজন মদের দায়িত্বপ্রাপ্ত, অপরজন বারাঙ্গনাদের কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করেন। সে দেশে সম্ভোগসঙ্গী সহজে পাওয়া যায় না, গণিকাধ্যক্ষের অনুমোদনক্রমে লাভ করতে হয়।

রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাধীনে সম্ভোগসঙ্গী যে দেশে মেলে, সে দেশের সভ্যতা প্রশ্নাতীত। তুমি এখন সমরাধ্যক্ষ সম্পর্কে কিছু বলো।

সেনাধ্যক্ষ, রথাধ্যক্ষ, অশ্বাধ্যক্ষ, হস্ত্যধ্যক্ষ বিবীতাধ্যক্ষ সমরসংক্রান্ত নানা বিভাগের দায়িত্বে নিয়োজিত।

শেষে মুদ্রাধ্যক্ষের কথা বলতেই হয়। বিদেশি কেউ সে দেশে প্রবেশ করলেই তাকে মুদ্রাধ্যক্ষের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি তার লোকদের রিপোর্ট দেখে সিলমোহরযুক্ত অনুমতিপত্র ইস্যু করেন। বিদেশিদের দেখভালের কথা মূল রিপোর্টে বলেছি। এ অধ্যক্ষ অনুমতিপত্র না দিলে বড় সমস্যায় পড়তে হয়। ওই দেশের অনুশাসন না মানলে অনুমতিপত্র প্রত্যাহার করা হয়।

সুশৃঙ্খল শাসনব্যবস্থা। এত যুদ্ধবিগ্রহের পরও গড়ে তুলেছে। সাধুবাদ জানাতেই হয়। বেশ, তুমি এবার কূটনৈতিক ব্যাপারগুলো বলো।

ভারতীয় কূটনীতি শত্রু-মিত্রসম্পর্কিত।

যেমন?

ধরুন শত্রুরাজা। মৌর্যদের ধারণা, এরা তিন ধরনের হতে পারে। নিজ রাজ্যসংলগ্ন রাজ্যের অধিপতি আমির হলে সে হবে স্বাভাবিক শত্রু। সমকূল রাজা শত্রু হলে সে হবে সহজ শত্রু। অন্যের মাধ্যমে কারও সঙ্গে শত্রুতার সৃষ্টি হলে সে হবে কৃত্রিম শত্রু। এরা শত্রুর মিত্র।

এ বিভাজনটা কেন? শত্রু তো শত্রুই।

বিভাজনটা পররাষ্ট্রনীতি ও যুদ্ধকৌশলের কারণে।

এবারে মৈত্রীর কথা বলো।

তাদের ধারণা, শত্রুর মতো মিত্রও তিন ধরনের হতে পারে।

কী রকম?

একটি রাজ্যের ব্যবধানে অবস্থিত কোনো রাজ্যের রাজা যদি মৈত্রীবন্ধনে আবদ্ধ হন, তাঁকে মনে করা হয় প্রকৃতি মিত্ৰ।

প্রকৃত না প্রকৃতি মিত্র?

প্ৰকৃতি মিত্ৰ।

প্রকৃতি কেন?

সে কথায় পরে আসছি, সম্রাট। পিতা-মাতা বা পারিবারিক সম্পর্কযুক্ততার কারণে যদি মৈত্রীবন্ধনে আবদ্ধ হন, তাহলে তিনি হবেন সহজ মিত্র।

তা ঠিক আছে। আরেকটা কী?

সহায়তা লাভ বা আত্মরক্ষার্থে কেউ মিত্র হলে তিনি হবেন কৃত্রিম মিত্র।

তাঁকে অকৃত্রিম বন্ধু মনে করার উপায় নেই।

ঠিক তাই।

প্রকৃত আর প্রকৃতি রাজার কথা বলছিলে।

ওদের কূটনৈতিক শাস্ত্রে দ্বাদশ রাজপ্রকৃতির কথা আছে।

যেমন?

বিজয়াকাঙ্ক্ষী বারো ধরনের রাজা, যেমন মিত্রমিত্রমিত্র, অরিমিত্রমিত্রমিত্র, মধ্যম-মিত্রমিত্রমিত্র এবং উদাসীন মিত্রমিত্রমিত্র। তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে পাঁচটি দ্রব্যপ্রকৃতি, যেমন অমাত্য, জনপদ, দুর্গ, কোষ ও দণ্ড প্রভৃতি যুক্ত হয়ে সর্বমোট বাহাত্তরটি প্রকৃতি হয়। এসব প্রকৃতি থেকে….

থামো, থামো, বলে সেলুকাস মেগাস্থিনিসকে থামালেন। বললেন, প্রকৃতির জ্ঞান তোমার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাক। তুমি বরং বলো মিত্র হওয়ার জন্য কিংবা মিত্র থাকার জন্য কী করতে হবে?

পিতামহ-পিতার সময় থেকে বংশপরম্পরা বন্ধুত্বসূত্রে আবদ্ধ মিত্র হতে পারে। মিত্র হতে পারে বংশগতভাবে। যৌথ স্বার্থের ভিত্তিতে মৈত্রী হতে পারে। সহসা প্রয়োজনে, দুঃসময়ে হস্ত প্রসারণের জন্যও মিত্র হতে পারে।

মৈত্রী রক্ষা হয় কীভাবে?

কাজটা কঠিন। সম্পর্ক স্থাপন করা সহজ, রক্ষা করা কঠিন। এ জন্য এরা ছয়টি নীতি বা কৌশল অবলম্বন করে। যেমন সন্ধি তথা শান্তি, বিগ্রহ তথা যুদ্ধ (মিত্রের পক্ষে), আসন তথা নিরপেক্ষতা, সংশ্রয় তথা মৈত্রীগাহন, দ্বৈধীভাব

দ্বৈধীভাব?

একদিকে শান্তি স্থাপন এবং একই সঙ্গে যুদ্ধে জড়িত হওয়া।

এ কথা শুনে সেলুকাস হাসলেন। বললেন, ঠিক আছে। অনেক যুদ্ধই শান্তির জন্য।

এখানেও বিশ্বাসটা গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বস্ততা। মেগাস্থিনিস, প্রেম আর যুদ্ধে সবকিছুই ঠিক।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *