১১০
মৌর্য সাম্রাজ্যের জন্য নতুন দিন। নতুন সকাল।
রাতে ঘুম হয় নি। তাই চন্দ্রগুপ্ত প্রাসাদের বারান্দায়ই ছিলেন। ভোরের হিমেল হাওয়া শরীর মন জুড়িয়ে দিচ্ছিল। মনে শান্তি ছিল না। বাতাসটা ভালো লাগল। সবকিছুই ছেড়ে যাচ্ছেন তিনি। এই বারান্দা, এই প্রাসাদ, ভোরের হিমেল হাওয়া, সবকিছু। দূরে আবার দৃষ্টি গেল হেলেনের সমাধির দিকে। অস্ফুটে বললেন, তুমি নেই তো কিছুই নেই। এ সাম্রাজ্য, এত ঐশ্বর্য কেন? একটি জীবনের জন্য এত কিছুর প্রয়োজন নেই, শুধু একজন ভালো সঙ্গীর প্রয়োজন। সে নেই তো কিছুই নেই। এখন প্রাসাদে বন্দিত্ব ছাড়া আর কিছু নেই। সংসারও এক বন্দিশালা। ছেড়ে যাওয়ার মধ্যেই মুক্তি।
কিন্তু ওদের প্রতিক্রিয়া কী হবে? কীভাবে তা মোকাবিলা করবেন তিনি? ওরা জোর করবে, চাইবে তিনি যেন সিংহাসন ছেড়ে না যান। শক্ত কথা বলা যাবে না, বুঝিয়ে-শুনিয়ে বিন্দুসারকে দায়িত্ব দিয়ে জৈনমন্দিরে চলে যেতে হবে। নিত্যব্যবহার্য জিনিস দুয়েকটি সঙ্গে যাবে। তিনি গতকালই এগুলো আলাদা করে রেখেছেন। সন্ন্যাব্রতের প্রয়োজনীয় দীক্ষা মন্দিরে হবে। আচার্যের সঙ্গে এ নিয়ে কথা হয়েছে। সবই ঠিকঠাক আছে।
প্রাসাদের ভেতরে এসে বসলেন তিনি। এখন বুঝতে পারলেন, অস্থিরতাটা কমে এসেছে। স্নান নিজেই সেরে নিলেন, দাসদাসীদের ডাকলেন না। সম্রাটের পোশাক-পরিচ্ছদ পরলেন বটে কিন্তু সাজসজ্জায় মনোহারিত্ব নেই। সম্রাটের মুকুটটি রাখা ছিল শয্যার পাশেই। এর প্রতি তাঁর দৃষ্টি গেল। এটি ক্ষমতার প্রতীক। এর দিকে তাকিয়ে ভাবান্তর ঘটল তাঁর। তিনি দাসদাসীদের ডাকলেন। পোশাক-পরিচ্ছদ পরিবর্তন করালেন। উত্তমরূপে সাজসজ্জা করলেন। শরীরে সুগন্ধি মাখলেন। মুকুটটি পরিধান করলেন। এক দাসী স্বচ্ছ জলের একটি পাত্র সামনে এনে রাখল। তিনি নিজের চেহারা দেখলেন। দুয়েকটা গয়না বেমানান মনে হলো। সেগুলো পরিবর্তন করলেন।
এ রকম শোকের দিনে সম্রাটকে সাজসজ্জা করতে দেখে অবাক হলো দাসদাসীরা। এরা তার কারণ খুঁজে পেল না। এক দাসী ছুটে গেল মন্দাকিনীর কাছে। বৃত্তান্ত বলল। মন্দাকিনী চিন্তিত হয়ে পড়ল। কী ঘটতে যাচ্ছে তাহলে? সে ছুটে এল। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না সম্রাটকে দেখে। তার ধারণা ছিল, সম্রাট শোকের পোশাকেই দরবারে যাবেন। সম্রাজ্ঞী দুরধরার মৃত্যুর পর সম্রাট বহুদিন শোক করেছিলেন। দরবারেও যেতেন না। সাম্রাজ্য প্রায় অচল হতে বসেছিল। সম্রাজ্ঞী হেলেনের মৃত্যুতে মনে হয়েছিল এবার সাম্রাজ্য অচল হবেই। সবারই কালো পোশাকের ভেতর ছিল দীর্ঘশ্বাস। সম্রাট নিষ্ক্রিয় থাকলে মহামন্ত্রীর দৌরাত্ম্য বাড়ে। সম্রাজ্ঞী দুরধরার মৃত্যুতে অবশ্য সে রকমটি ঘটে নি। মহামন্ত্রী বড় বেকায়দায় ছিলেন। এবারও বেকায়দায় আছেন। তবে একটু অন্য রকমভাবে। কোনো কিছুর সঙ্গে নিজেকে মেলাতে পারছেন না। সব কাজেই তাকে যেন বাদ দিয়ে রাখা হয়েছে পরিকল্পিতভাবে। তা সাম্রাজ্যের অমাত্য, রাজন্যবর্গ এবং কর্মচারীদের সঙ্গে দাসদাসীদের দৃষ্টিও এড়িয়ে যায় নি।
মন্দাকিনী বলল, মহামান্য সম্রাট, আপনার কি কিছু লাগবে?
না, মন্দাকিনী, কিছু লাগবে না। তবে তোমাকে কিছু বলার আছে। তুমি খুবই বুদ্ধিমতী। বয়স কম হলে আমি বিন্দুসারের সঙ্গে তোমার বিয়ে দিতাম। তোমার কি কাউকে পছন্দ আছে? থাকলে বলো, তার সঙ্গে তোমার বিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করব।
মন্দাকিনীর কাছে এ ব্যাপারটিও অদ্ভুত ঠেকল। সে ভাবল, সম্রাটের মাথা কি খারাপ হয়ে গেছে? হেলেনের প্রতি সম্রাটের ভালোবাসার দীর্ঘদিনের সাক্ষী সে। তাও তাকে দেখতে হলো? বলল, না মহামান্য সম্রাট, আপনার সেবা করেই আমি বাকি জীবন কাটিয়ে দেব।
শুনে সম্রাট হাসলেন। আর কয়েক ঘণ্টা মাত্র। মনে মনে বললেন, সে সুযোগ আর নেই, মন্দাকিনী। প্রকাশ্যে বললেন, মন্দাকিনী, আমার ভাগ্যটা খুবই ভালো। আমি কতগুলো ভালোমানুষের সঙ্গে সময় অতিবাহিত করেছি। এদের মধ্যে তুমি একজন। যেমন বিশ্বস্ত, তেমনি আন্তরিক।
মন্দাকিনী বলল, পরশ পাথরের সংস্পর্শে এসে পাথরও সোনা হয়, মহামান্য সম্রাট। আপনার সংস্পর্শে এখানে সবাই খাঁটি হয়ে উঠেছে। আমি শুনেছি রাজার সংস্পর্শে এসে দাসীদের অজস্র সন্তানের মা হতে হয়েছে। আর আমরা আপনার সংস্পর্শে এসে মানুষের মর্যাদায় অভিসিক্ত হয়েছি।
তা কেন জানো, মন্দাকিনী? আমার ভাগ্যে যা ঘটেছিল, আমার মায়ের ভাগ্যে যা ঘটেছিল, আমি চাই নি কোনো মা বা সন্তানের ভাগ্যে তা ঘটুক।
.
দিদাইমেইয়া হেলেনের সমাধি দেখতে যাবেন। সবাই প্রস্তুত হচ্ছেন। একজন দূত এসে জানাল, সম্রাট এখানে আসবেন। এ কথা শুনে সবাই অবাক হলেন।
এখানে এসে সম্রাট বললেন, আমি মন্ত্রণাসভায় যাওয়ার আগে মনে হলো, আমার আপনাদের সঙ্গে নিয়ে হেলেনের সমাধিতে যাওয়া উচিত
দিদাইমেইয়া বললেন, আমরাও সেখানে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম।
তার আগে আমি ব্যক্তিগতভাবে এ সাম্রাজ্যে থেকে যাওয়ার জন্য আপনাদের অনুরোধ জানাতে চাই।
কিউকেকাস বললেন, এ ব্যাপারে আমরা আপনার একটি আমন্ত্রণপত্রও পেয়েছি।
কী সিদ্ধান্ত আপনাদের?
নিকোমেডেস বলল, আমরা আপনাকে জানাব।
ফাওলিনের বাবা বললেন, আমরা উভয় দেশে থাকতে চাই। তবে তা চূড়ান্ত হয় নি।
নিজের দেশের সঙ্গে একটি সম্পর্ক থাকা উচিতই। নতুন সম্রাটের সঙ্গে কি কোনো যোগাযোগ হয়েছে?
দিদাইমেইয়া বললেন, আমরা তাঁর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করতে চাই না। উভয় দেশ অর্থ সেলুসিয়া নয়, গ্রিস ও ভারতবর্ষ।
ভারতবর্ষেই আপনাদের স্থায়ী ঠিকানা হোক।
কিন্তু আপনাকে দেখে আমরা একটা আস্থার সংকটে পড়ে গেছি।
সম্রাট মৃদু হেসে বললেন, এ রাজপোশাকে দেখে?
আপনার ঘোষিত শোকের সময় এখনো শেষ হয়ে যায় নি
সংকটটা শুধু আপনাদের নয়, আমারও। অনেক ভেবেচিন্তে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি!
কারণটা জানতে পারি?
এখনই নয়, তবে অবশ্যই জানবেন। এখন চলুন।
হেলেনের সমাধিকে ঘিরে দাঁড়িয়েছেন এঁরা। তাঁর জন্য প্রার্থনার সূচনা করলেন ফাওলিনের বাবা।
চন্দ্রগুপ্ত চোখ বন্ধ করলেন এবং স্পষ্টই দেখতে পেলেন হেলেন বিয়ের পোশাকে কবর থেকে বের হয়ে আসছেন। তাঁর সেই সাজসজ্জা, দেবীরূপ, মুখে অহংকারের হাসি। হেলেন তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন এবং বলছেন, জ্যোৎস্নারাতে আমরা নিখিলের বাঁশি শুনব, চন্দ্ৰ।
প্রার্থনাটা হচ্ছে গ্রিক পলিথিজমে। ফাওলিনের বাবার উচ্চারণটা সুন্দর। এ প্রার্থনার মধ্যে শুধু চন্দ্রগুপ্ত নয়, সবাই যেন হেলেনকে নানারূপে দেখছেন। দিদাইমেইয়ার মনে হলো, সেই দৃশ্য যখন নিকোসহ হেলেন সামরিক পোশাকে ভারতবর্ষের দিকে চতুরাশ্বযানে যাত্রা করেছিলেন। লাউডিস সে দৃশ্যটা দেখলেন, হেলেনের একটি কান্নার দৃশ্য, যখন তিনি চন্দ্রগুপ্ত বিবাহিত, সে সংবাদ পেয়েছিলেন। নিকোমেডেস দেখল সিন্ধুতীরের সে বাংলোর দৃশ্য যেখানে এরা বেশ কিছুদিন কাটিয়েছিল। স্ট্রেটোনিস দেখলেন, হেলেনের রোগশয্যার দৃশ্য, যখন তিনি শীতল নিঃশ্বাস ত্যাগ করছেন। কিউকেকাসের তার বন্দী অবস্থায় হেলেনের কৌতুকপূর্ণ কথার দৃশ্য মনে হলো। আর হারমিজের মনে হলো, কবুতরের সে শূন্য সোনার খাঁচাটার কথা, যেখানে কবুতর ছিল না, কিন্তু হেলেন তা আগলে রেখেছিলেন। ফাওলিনের মনে হলো, সে বিয়ের সাজের দৃশ্য, যাতে ভারতের সঙ্গে গ্রিসের ঐতিহ্যের মেলবন্ধন ঘটেছিল।
গ্রিক পলিথিজমের মন্ত্রপাঠ শেষ হলো। সবাই চোখ মেললেন। চন্দ্রগুপ্ত নেই। তাঁদের এভাবে রেখে চলে গেলেন! সবারই মনে প্রশ্ন। খোঁজাখুঁজি হলো। দেখা গেল, চন্দ্রগুপ্ত সমাধির ভেতর প্রবেশ করেছেন। মমিসদৃশ হেলেনের রেপিং করা দেহের মুখমণ্ডল অনাবৃত এবং অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। বিয়ের সে সাজসজ্জা, দেবীর পোশাক। চন্দ্রগুপ্তের সাজসজ্জার সঙ্গে মিল আছে।
স্ট্রেটোনিস, লাউডিস ও ফাওলিন পরস্পরের মুখ-চাওয়াচাওয়ি করলেন। তিনজনই সমাধিতে প্রবেশ করলেন। এঁদেরই দায়িত্ব আবার মরদেহ মমিপ্রতিম রেপিং করে রাখা।
.
প্রথমে আপত্তিটা করলেন চাণক্য। বললেন, মহামান্য সম্রাট, আমার শেষ অনুরোধটুকু রাখুন। সাম্রাজ্যের এ দুঃসময়ে আমাদের ছেড়ে যাবেন না।
চন্দ্রগুপ্ত হেসে বললেন, আচার্য, আপনার শেষ অনুরোধ আমি রেখেছি, অমরাবতী থেকে আসার পথে শেষ অনুরোধের কথা আপনি ভুলে গেছেন।
চাণক্যের মতো বুদ্ধিমান মানুষও আর কিছু বলতে পারলেন না। এবার বিন্দুসার বললেন, মহামান্য সম্রাট, আমি আপনার সন্তান হিসেবে সিদ্ধান্তটা আবার ভেবে দেখার জন্য অনুরোধ করব।
বিন্দুসার, সেদিন তোমার অনুরোধ আমি রাখি নি। এতে যে এত বড় ক্ষতি হয়ে গেল, আমি তার দায় এড়াতে পারি না। সে সময়ই আমি সিংহাসন ছেড়ে দেওয়ার কথা ভেবেছি। হেলেনের মৃত্যু আমার সিদ্ধান্ত গ্রহণের পথ সহজ করে দিল। এবার এসো, উঠে এসো। আমার সামনে দাঁড়াও।
বিন্দুসার সম্রাটের সামনে এসে দাঁড়ালেন। সম্রাট বিন্দুসারের মাথা থেকে যুবরাজের মুকুট সরিয়ে নিজের মাথার মুকুট পরিয়ে দিলেন। মন্ত্রণাসভায় তখন পিনপতন নীরবতা। কেউ বুঝতে পারছেন না কী করতে হবে। কী করা উচিত তাঁদের।
সম্রাট এবার বিন্দুসারের হাত ধরে তাঁকে সিংহাসনে বসিয়ে দিলেন এবং রীতিসিদ্ধভাবে নিজে মাথা নুইয়ে নতুন সম্রাটকে অভিবাদন জানালেন। উপস্থিত সবাই তাঁকে অনুসরণ করলেন।
তারপরই পাশের কক্ষে গেলেন চন্দ্রগুপ্ত। সেখানে রাজপোশাক খুলে ফেললেন। রাজপোশাকের ভেতরে শোকের কালো পোশাক। জুতোও খুলে ফেললেন, নগ্ন পা।
নতুন সম্রাট বিন্দুসার বুঝতে পারছেন না পাশের কক্ষে কী হচ্ছে। কক্ষের দরজা ভেতর থেকে আটকানো। তিনি মন্ত্রণাকক্ষের বাইরে এসে দাঁড়ালেন। সঙ্গে সভাসদগণ। এঁরা দেখলেন, চন্দ্রগুপ্ত শোকের পোশাকে একটি অশ্বে আরোহন করে দ্রুত চলে যাচ্ছেন।
.
দুদিন পরের কথা। বারো হাজারের বেশি জৈন সন্ন্যাসী জড় হয়েছেন জৈনমন্দিরের সামনে। চন্দ্রগুপ্তও আছেন। তিনি কালো পোশাক পরে আছেন। অন্যরা দিগম্বর। আচার্য ভদ্রবাহুর আদেশ মেনে চন্দ্রগুপ্ত এ পোশাকে আছেন। তীর্থাঙ্কর মহাবীরের রীতি অনুসরণ করে পোশাক ছেড়ে যাওয়ার যে রেওয়াজ আছে, একটি নির্দিষ্ট স্থান পার হওয়ার পর তা কার্যকর হবে।
আচার্য ভদ্রবাহু তাদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য দিচ্ছেন। তা মূলত নির্দেশনা’। পদব্ৰজে যেতে হবে তাঁদের। অনেক দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে। তার জন্য মানসিক শক্তির প্রয়োজন। অবশ্য তাঁদের সে রকম শক্তি অর্জনে যোগব্যায়াম (মেডিটেশন) করা আছে। শক্তিটা অর্জন করতে হয় আধ্যাত্মিক এবং বাস্তবিক উপায়ে শরীরচর্চার মাধ্যমে। অধ্যবসায় ছাড়া তা সম্ভব নয়। আচার্য ভদ্রবাহু সবাইকে সে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন, চন্দ্রগুপ্ত ছাড়া। তিনি বললেন, চন্দ্রগুপ্তের জন্য যাত্রাটা কঠিন হবে। কিন্তু আমার বিশ্বাস, সে পারবে।
মন্দির এলাকার বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন তাঁদের আত্মীয়স্বজন। আছেন নতুন সম্রাট বিন্দুসার, মহামন্ত্রী চাণক্য, মন্ত্রী সুবন্ধু, অমাত্যবৃন্দ ও দিদাইমেইয়ারা। মেগাস্থিনিস তাঁদের থেকে একটু দূরে দৃশ্যমান স্থানে দাঁড়িয়ে আছেন।
শর্মিলা খুবই ব্যস্ত। তাঁদের সঙ্গে যাচ্ছেন, তার চেয়ে বড় কথা তিনি আচার্যের সহকারী, তাই তাঁকে অনেক কিছুর দেখভাল করতে হচ্ছে। কার কী সমস্যা আছে বা ভবিষ্যতে হবে, অভাব- অভিযোগ সবকিছুর সঙ্গে আছেন তিনি।
সুলভদ্র এখনো দিগম্বর জৈন। পদযাত্রীদের তিনিও নানাভাবে সহায়তা করছেন। বিশাখার ব্যস্ততার কমতি নেই। সবচেয়ে বড় কথা, তাঁদের ছেড়ে আচার্য ভদ্রবাহু চলে যাচ্ছেন। দীর্ঘকাল আচার্যের সাহচর্যে কেটেছে। কেমন যেন শূন্যতাবোধ করছেন তিনি। আড়ালে চোখ মুছছেন।
স্থুলভদ্রের মধ্যে আবেগ নেই। তিনি ধীরস্থির প্রকৃতির শক্ত মানুষ। এ ছাড়া এখানকার ধর্মীয় নেতৃত্বটা তাঁর কাছেই যাচ্ছে। ভেতরে ভেতরে উৎফুল্ল বোধ করছেন।
ব্যস্ততার মধ্যেও মাঝেমধ্যে শর্মিলার চোখ যাচ্ছে মেগাস্থিনিসের দিকে। বেচারা অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে আছেন। বোঝা যাচ্ছে, তাঁর ভেতর একরকম তোলপাড় হচ্ছে, কিন্তু বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। দীর্ঘ নিঃশ্বাসটাও চেপে রেখেছেন।
চাণক্যের ইচ্ছে, তিনি আচার্য ভদ্রবাহুর সঙ্গে কথা বলবেন। কিন্তু সুযোগ হচ্ছে না। বিন্দুসার তাঁর বাবার সঙ্গে কথা বলতে চান। চন্দ্রগুপ্ত ইচ্ছে করেই সবার মায়া কাটাতে সন্ন্যাসীদের মাঝখানে আছেন। তাই সম্ভব হচ্ছে না। তিনি ভাবলেন, বাবা কি তাঁকে শাস্তি দিচ্ছেন? কেমন ওলটপালট হয়ে গেল সবকিছু। তার মূলে কী আছে, তিনি তা খুঁজে বের করবেন।
দিদাইমেইয়াদের কাছে সবকিছু অদ্ভুত ঠেকছে। এত দিগম্বর নারী-পুরুষ একসঙ্গে এঁরা কখনো দেখেন নি। বস্তুত কেউই দেখে নি। এ নিয়ে এঁদের মধ্যে একটা অস্বস্তিকর ব্যাপার আছে। তবু অপেক্ষা আচার্য কিংবা চন্দ্রগুপ্তকে যদি কাছে পাওয়া যায়, দু-চারটি কথা বলা যায় এবং রীতিসিদ্ধভাবে বিদায় জানানো যায়।
ভদ্রবাহু ব্যস্ততার মধ্যেও সবকিছু লক্ষ করছেন। শর্মিলাকে ডেকে বললেন, তুমি ওদের কাছে যাও। ওদের নানা কৌতূহল আর প্রশ্ন আছে, এসবের জবাব দেবে। এ ছাড়া মেগাস্থিনিস দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁর সঙ্গে কথা বলবে।
শর্মিলা আচার্যের নির্দেশমতো দিদাইমেইয়াদের কাছে গেলেন। গ্রিক ভাষায় বুঝিয়ে দিলেন, এতগুলো লোকের পাটালিপুত্র ছেড়ে দাক্ষিণাত্যে চলে যাওয়ার উদ্দেশ্য কী। কীভাবে এঁরা যাবেন।
পদব্রজে এত দূর যাওয়া কি সম্ভব, প্রশ্ন করলেন দিদাইমেইয়া। শর্মিলা হেসে দিয়ে বললেন, ভারতে এমনও ধর্মমন্দির আছে, যেখানে ভক্তরা গড়িয়ে গড়িয়ে যায়। পদব্রজে যাবে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেই। এ নিয়ে তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু চন্দ্রগুপ্ত? স্ট্রেটোনিস সাবেক এই সম্রাটকে নিয়ে চিন্তিত। কেমন যেন মায়া হচ্ছে তাঁর। ভিনদেশি এক স্ত্রীর বিয়োগে সাম্রাজ্যের সিংহাসন ছেড়ে বনবাসে যাচ্ছেন তিনি। কত বড় ত্যাগ। শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে এই পুরুষদের জন্য। অথচ সেলুকাস কী ব্যবহারটাই না করেছেন তাঁর সঙ্গে। সারা বিশ্বের সব ঘৃণা যেন সেলুকাসের জন্য।
শর্মিলা নিঃসংকোচে গেছেন মেগাস্থিনিসের কাছে। তিনি বেশ শক্ত, মানসিকভাবে। কিন্তু মেগাস্থিনিস সত্যিই ভেঙে পড়েছেন। বললেন, শর্মিলা, আমিও তোমাদের সঙ্গে যেতে চাই। আচার্যকে বলো। অথবা নিয়ে চলো আমি কথা বলি।
আপনাকে শক্তভাবে ধৈর্য ধারণ করতে হবে। এমন কিছু অনুগ্রহ করে করবেন না, যাতে নসমক্ষে, আচার্যের কাছে আমাকে হেয়প্রতিপন্ন হতে হয়।
কী করব আমি? তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারব না।
আমাকে যদি সত্যিই ভালোবাসেন, ধৈর্যধারণ করতে হবে। আচার্য আপনার আমার মনের অবস্থা বুঝেই শেষ বিদায়ের জন্য পাঠিয়েছেন। তাঁকে আমরা অসম্মান করতে পারি না।
আমার যাওয়ার মধ্যে তো কোনো সম্মানহানির ব্যাপার নেই।
তা নেই। কিন্তু কী পরিচয়ে যাবেন। আপনি ভুলে যাচ্ছেন আপনি কে?
নিকোমেডেস ও ফাওলিন এতক্ষণ তা লক্ষ করছিল। এরা শর্মিলাকে সাহায্য করতে চাইল। তাই এগিয়ে গেল। শর্মিলা তাদের দেখে স্মিত হেসে ভিড়ের মধ্যে ঢুকে গেল।
প্রস্তুতি প্রায় শেষ। আচার্য ভদ্রবাহু চন্দ্রগুপ্তের কাছে গেলেন। ভেতর থেকে তাঁকে বের করে নিয়ে বিন্দুসারের সামনে এসে দাঁড়ালেন। বললেন, চন্দ্র, নতুন সম্রাট তোমার ছেলে। তাঁর কাছ থেকে বিদায় নেওয়া তোমার কর্তব্য। এ ছাড়া তোমার প্রাক্তন সহকর্মীদেরও বিদায় বলো। দুদিন আগেকার পরম পরাক্রমশালী সম্রাট সুবোধ বালকের মতো আধ্যাত্মিক গুরুর আদেশ পালন করলেন। প্রথমে গেলেন মহামন্ত্রী, মন্ত্রী ও রাজন্যবর্গের কাছে। বললেন, আপনারা ভালো থাকুন। মহামন্ত্রী বললেন, আমাকে ক্ষমা করে দিন। চন্দ্রগুপ্ত কোনো কথা না বলে দিদাইমেইয়াদের কাছে চলে গেলেন। শর্মিলা তা লক্ষ করে এগিয়ে এলেন। কথা বলার সময় তাঁর প্রয়োজন হতে পারে।
দিদাইমেইয়া বললেন, আমি জানতাম না মানুষের বড় প্রেম তাকে এত বড় ত্যাগের কাছাকাছি নিয়ে যায়। চন্দ্র, আমার জীবনটা আজ সার্থক, আমি এমন একটা ব্যাপারও আমার জীবদ্দশায় দেখে যেতে পারলাম। আমরা মিথ্যে স্বর্গের কথা বলি, তুমি যা দেখালে, তা স্বর্গের চেয়েও বেশি কিছু। তোমাকে অন্তর থেকে শ্রদ্ধা করি আমি।
চন্দ্রগুপ্ত নির্বাকভাবে নিকোমেডেস ও ফাওলিনের দিকে তাকিয়ে রইলেন, তাদের মধ্যে বোধ হয় হেলেনকে খুঁজে ফিরছিলেন। হেলেন এবং তাদের নিয়ে তাঁর কত সুখস্মৃতি।
একটু এগোতেই স্ট্রেটোনিস সামনে এসে দাঁড়ালেন। চন্দ্র বললেন, আমি শুনেছি হেলেনের যমদূতের সঙ্গে আপনি একাই লড়ে গেছেন, সম্রাজ্ঞী। আপনাকে আমি শ্রদ্ধা জানাই, বলে মাথা নত করলেন চন্দ্রগুপ্ত। স্ট্রেটোনিস বললেন, না না, চন্দ্রগুপ্ত, আপনি নন, মাথা নত করব আমি, আপনাকে একবার গড় হয়ে প্রণাম করার সুযোগ দিন, এ রকম ত্যাগী পুরুষের জন্ম কমই হয়, বলে তিনি চন্দ্রগুপ্তকে ভারতীয় কায়দায় গড় হয়ে প্রণাম করলেন।
এ দৃশ্য মনে হয় সবাইকে কাঁপিয়ে দিল। চন্দ্রগুপ্ত এক পা পেছনে গিয়ে থামলেন। পরে পুত্রের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। পিতা-পুত্রের সাম্রাজ্য পরিচালনা নিয়ে কোনো কথা হলো না, আশীর্বাদ কিংবা পার্থিব কোনো বিষয় নিয়েও আলোচনা নেই, যেন দুজনই বোবা হয়ে গেছেন। চন্দ্রগুপ্ত শুধু একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। পুত্র পিতার বিদায়ে অশ্রুপাত করতে পারলেন না বটে, কিন্তু গোপনে কেঁদে কেঁদে হৃদয় ভাসালেন।
আচার্য ভদ্ৰবাহু কাছে এসে বললেন, চন্দ্র, এখনই আমাদের যাত্রা শুরু করতে হবে।
চন্দ্রগুপ্ত ফিরে গেলেন। সবার মাঝখানে তিনি। বারো হাজারের বেশি মানুষের কাফেলা। যাত্রা শুরু করেছেন। দিগম্বর মানুষদের সুশৃঙ্খল পদচালনায় অভূতপূর্ব এক দৃশ্যের অবতারণা হয়েছে। কোনো দিকে দৃষ্টি নেই তাদের। শুধু ভূমির দিকে, নিচের দিকে দৃষ্টি।
সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছেন। ক্রমে ক্রমে এঁরা মন্দির প্রাঙ্গণ পার হয়ে গেলেন। দূরে, আরও দূরে ক্রমে ক্রমে মিলিয়ে যাচ্ছেন।
কেউ একজন লক্ষ করলেন, এক সেট কালো পোশাক মাটিতে পড়ে আছে। এ পোশাকটাই চন্দ্রগুপ্ত পরিহিত ছিলেন। বিশাখা বললেন, তীর্থাঙ্কর মহাবীর এভাবেই ফেলে যান তাঁর রাজকীয় পোশাক। এটা প্রতীকী। সবকিছু ত্যাগ করে যাওয়ার অর্থ রয়েছে তার মধ্যে।