মৌর্য – ১০৫

১০৫

বাবার অবর্তমানে বিন্দুসারের আতিথেয়তায় মুগ্ধ হেলেন। তিনি অতিথিদের জন্য কিছু করতে পারছেন না। কারণ, অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। এতগুলো দুঃসংবাদ শুনবার পর সুস্থ থাকা কঠিন। চন্দ্রগুপ্ত কাছে থাকলে হয়তো শারীরিক ও মানসিক ধকল কাটিয়ে ওঠা যেত। তবে যত্ন-আত্তির কমতি নেই। স্বজনেরাও সবাই তাঁর পাশে আছেন।

কারও মুখে হাসি নেই। দিদাইমেইয়া, লাউডিস, ফাওলিন ও স্ট্রেটোনিস বুকে পাথরচাপা দিয়ে আছেন। ফাওলিনের বাবা, লাউডিসের স্বামী এবং নিকোমেড্রেস প্রয়োজনের বাইরে কথা বলছেন না। হারমিজ আগের মতো নেই। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন এসে গেছে। শুধু সারা প্রাসাদময় দৌড়াচ্ছে ফাওলিনদের সন্তান মিকি।

কী করে তাদের মধ্যে প্রাণ ফিরে আসবে, এ নিয়ে চিন্তিত বিন্দুসার। মায়ের কষ্টটা দেখছেন তিনি। হেলেন সুস্থ হয়ে উঠবেন এঁরা প্রাণবন্ত হলে। এঁরা শোকে নয়, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত। এই অবস্থায় কী করা যায়, বুঝতে পারছেন না তিনি।

.

আচার্য ভদ্ৰবাহু ব্যস্ত দুর্ভিক্ষ নিয়ে। মনে হয় একে ঠেকানো যাবে না। সুবন্ধু সংবাদ দিচ্ছেন নতুন করে কোথায় কোন এলাকায় দুর্ভিক্ষ দেখা দিচ্ছে। তিনি (ভদ্রবাহু) পরিকল্পনা করলেন, কিছু লোককে সমৃদ্ধ এলাকা বলে খ্যাত দাক্ষিণাত্যে পাঠিয়ে দেবেন। কাদের পাঠাবেন, তালিকা করতে শুরু করলেন। স্থুলভদ্রের নাম এক নম্বরে লেখা হলো। তিনি চান সুলভদ্র জৈনধর্মের জন্য বেঁচে থাকুক।

কিন্তু স্থুলভদ্র ভিন্ন কিছু ভাবলেন। মনে করলেন, তাঁকে দুর্ভিক্ষের অজুহাতে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এ জন্য তিনি বিশাখার দিকে আঙুল তুললেন মনে মনে। সিদ্ধান্ত নিলেন, তালিকায় নাম থাকলেই যেতে হবে, এমন কথা নেই। সময়মতো কথা বলবেন আচার্যের সঙ্গে।

হেলেন ভদ্রবাহুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে ইচ্ছে প্রকাশ করলেন। তাঁর অবস্থা আসলেই ভালো নয়। চন্দ্রগুপ্তের ওপর অভিমান করে আছেন। তাই কোনো পত্রও লিখছেন না। তাঁর শুধু চিন্তা বিন্দুসারকে নিয়ে, এ দুঃসময়ে কী করবে ছেলেটি। নানা চাপে তাঁর দেহ-মনে পরিবর্তন এসে গেছে। ভিনদেশি মায়ের প্রতি দায়িত্ববোধ আরও তাঁকে কাহিল করে দিচ্ছে। মায়ের আত্মীয়স্বজন যাঁরা এসেছেন, এঁদেরও ব্যক্তিগতভাবে খোঁজখবর রাখছেন। প্রচুর সময় দিচ্ছেন।

ভদ্রবাহু এসে হেলেনের অবস্থা দেখে নিশ্চিত হলেন তিনি ‘লাভ সিকনেসে’ ভুগছেন। তার ওপর নানা দুঃসংবাদ। সহ্য করা কঠিন হয়ে গেছে। বিন্দুসারের সাম্রাজ্য চালনার অতিরিক্ত বোঝা তাঁর ঘাড়ে। প্রয়োজন নেই, তবু ভাবছেন। ভদ্রবাহু বললেন, তুমি দুশ্চিন্তাটা ছেড়ে দাও, মা। সব ঠিক হয়ে যাবে। অন্ধ্র জয় করে চন্দ্র ফিরে আসবে, দিদাইমেইয়ারা যত দিন খুশি এখানে থাকবেন। একটা সময় তাঁদেরও মানসিক সংকট কেটে যাবে। আর বিন্দুসার? খুবই চৌকস রাজপুত্র। সবকিছু ঠিকঠাক সামলে নেবে। তুমি একটুও চিন্তা কোরো না। তাঁদের, তোমার আত্মীয়স্বজনদের সময় দাও। বড় দুঃসময় তাঁদের। তুমি চাইলে আমি শর্মিলাকে পাঠিয়ে দেব, যত দিন তুমি চাইবে, এখানে থাকবে।

শুয়ে থেকেই হেলেন বললেন, আচার্য দক্ষিণ ভারতে আপনার লোক পাঠানোর কথা শুনছি, এতে এখানকার লোকজন ভয় পেয়ে যাবে না তো?

জীবিকা আর ধর্মীয় প্রচারণার উদ্দেশ্যে যাবে এরা।

সম্রাট ফিরে এলে এ রকম সিদ্ধান্ত নিলে হয় না?

বেশ, তা-ই হবে। তুমি সুস্থ হয়ে ওঠো।

আরেকটা কথা। আপনি কাউকে বলবেন না যেন, চন্দ্র আসার আগে যদি আমার মৃত্যু হয়, চন্দ্র না আসা পর্যন্ত আমার মরদেহের সৎকার হবে না। তবে আমার সৎকার হবে দিদাইমেইয়ার ইচ্ছেতেই।

কী বলছ তুমি, হেলেন? তুমি শান্ত হও, তোমার কিচ্ছু হবে না।

আচার্য, আপনি অনেক কিছু জানেন, আমার এ মরণব্যাধির কথা জানেন না, তা হয় না। আপনি আশীর্বাদ করুন, আমি যেন শান্তিতে মরতে পারি।

আমি রাজবৈদ্যের সাথে কথা বলব।

এ কথা শুনে হেলেন মৃদু হাসলেন। যেতে দিতে চাচ্ছেন না, আচার্য, আপনিও জানেন, আমাকে ধরে রাখা যাবে না।

তুমি কি চাচ্ছ আমি কেঁদে বুক ভাসাই?

আপনার বুকটা দিন, আচার্য, আমি সেখানে মাথা রাখব। এ পৃথিবীতে কত কিছু পাওয়ার আছে। সব পাওয়ায় শান্তি নেই, কোনো কোনো পাওয়ায় অপার শান্তি। হেলেন আচার্যের বুকে মাথা রেখে বললেন, ভারতবর্ষ এক অদ্ভুত জায়গা। শান্তির মৃত্যুর জন্য এখানে আসা উচিত, বাঁচার জন্যও এখানেই আসা উচিত। আপনি কি জানেন, কেন নিখিল করুণ সুরে বাঁশি বাজাল?

জানি। সে আগাম অনেক কিছু জানে।

এর চেয়ে বড় পাওয়া কী থাকতে পারে। আমি ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, তাই না?

কোন সিদ্ধান্ত?

চন্দ্রগুপ্তকে বিয়ে করব।

ঠিক সিদ্ধান্ত।

আচার্য, আপনি কাঁদছেন?

না, কাঁদছি না, কাঁদতে পারছি না আমি।

আমার মাথায় কি আপনার আশীর্বাদ ঝরে পড়ছে?

জানি না, হেলেন, তুমি একটু শান্ত হও। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।

কোনো গ্রিক আমার জন্য কাঁদত না, বাঁশি বাজাত না। আমার মৃত্যুর পরও যেন নিখিল বাঁশি বাজায়।

পাগলটা কখন কী করে কে জানে।

ভারতবর্ষ আসলেই অদ্ভুত জায়গা, এখানেই অন্তর আছে, আর কোথাও নেই।

আছে হেলেন, সর্বত্র আছে, খুঁজে নিতে হয়। তুমি যেভাবে সবার অন্তর জয় করে নিয়েছ, আর কেউ পারে নি।

ভালোবাসার প্রতিদান দিতে চেয়েছি, আর কিছু নয়। আচার্য, এখন আপনি আসুন, অনেকেই আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।

আমি আবার আসব, বারবার আসব।

আচার্য ভদ্ৰবাহু চলে গেলে দিদাইমেইয়ারা সবাই এলেন। তাঁদের দেখে হেলেন ঝটপট উঠে বসলেন। দিদাইমেইয়া বললেন, এখন কেমন আছ, হেলেন?

আমি ভালো আছি। দুয়েক দিনে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাব। ফাওলিনের বাবা এসেছেন, স্ট্রেটোনিস এসেছেন, মিকি এসেছে। এঁরা প্রথম এসেছেন, আমার অনেক কিছু করার ছিল। মিকি সোনা কত চমৎকার দেখতে হয়েছে। ঠিক ফাওলিনের মতো। জেনারেল কিউকেকাস থরের যুদ্ধে আমার কমান্ডার ছিলেন।

তুমি তো যুদ্ধ করো নি, বন্দিদশা থেকে আমাকে মুক্ত করেছ।

মুক্ত করেছে লাউডিস, আমি নই। সেই আমাকে দিয়ে করিয়েছে। কিন্তু আমাকে বাঁচিয়েছে আমার বডিগার্ড।

বডিগার্ড?

হ্যাঁ, নিকোমেডেস।

তোমরা খুব ঝুঁকি নিয়ে ফেলেছিলে, লাউডিস আমাকে বলেছে।

ঝুঁকি নিয়ে আপনারা যুদ্ধ করেছেন, আমি ঝুঁকি নিতে পারি না?

স্ট্রেটোনিস এবার কথা বললেন, এ পর্যন্ত তিনি কারও সঙ্গে কথা বলেন নি। বললেন, হেলেন, তুমি যদি অনুমতি দাও, আমি আমার দায়িত্ব পালন করতে চাই।

কী দায়িত্ব?

মায়ের দায়িত্ব।

এ মেয়ের কথা শুনে সবাই চমকে উঠলেন, এমনকি হেলেনও, কিন্তু দিদাইমেইয়া চমকালেন না, তিনি বললেন, তাকে আমি যত দূর জেনেছি, সে অন্তর থেকে কথাটা বলেছে।

অন্তর?

হ্যাঁ তাই, এ মেয়ে খুবই ব্যতিক্রম। তার কথায় নির্ভর করা যায়।

হেলেন হাত বাড়িয়ে তার বয়ঃকনিষ্ঠ মাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, মা।

সবাই অবাক হলেন।

হেলেন বললেন, বিন্দুসার আমাকে মা বলে ডাকে। এটা আমি ভারতবর্ষ থেকে শিখেছি। ডাকটি বড় মধুর, ভারতবর্ষের অপরাপর সংস্কৃতির মতোই, অন্তর্গত।

লাউডিস হেসে দিয়ে বললেন, আমিও তা-ই ডাকব।

স্ট্রেটোনিস বললেন, কী সৌভাগ্য, আমার বড় বড় দুটি মেয়ে আছে, যারা আমাকে মা বলে ডাকে।

এরা সবাই এক সময় উঠে গেলেন। রয়ে গেল নিকোমেডেস আর ফাওলিন

নিকোমেডেসের চোখ ছলছল করছে। তুই সবার চোখ ফাঁকি দিতে পারলেও আমার চোখকে পারবি না। তোর অবস্থা ভালো নয়। একি করেছিস তুই!

আমি কী করেছি?

সম্রাটের কথা তুই একবারও মুখে তুলিস নি। কী হয়েছে বল?

কিচ্ছু হয় নি, অযথা তুই ভাবছিস।

তোকে আমি ছোটবেলা থেকে চিনি, কর্নি। ফাঁকিটা অন্যকে দে।

যুদ্ধ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেছে সে।

কোনো চিঠি দেয় নি, এই তো?

ফাওলিন একেবারে চুপ হয়ে আছ, কিছু বলো।

ফাওলিন কথা বলবে। তুই প্রসঙ্গ পরিবর্তন করবি না। তুই কেন এত অভিমান করলি? তুই কোন দিকে যাচ্ছিস, জানিস?

প্রত্যাশিত পথেই এগোচ্ছি আমি।

তুই সঙ্গে যাস নি কেন?

তুই তো ছিলি না, বডিগার্ড ছাড়া যেতে পারি? এ ছাড়া ও যুদ্ধ করবে, আমি কার সঙ্গে সময় কাটাব। তুই থাকলে খুনসুটি করে সময় কাটত।

এখন যাবি, চল। আমরা তিনজন মিলে যাব।

মিকিকে নিবি না?

এখনো তোর দুষ্টুমি গেল না। যাবি?

ফাওলিন, এদিকে এসো। তুমি কেমন যেন গম্ভীর হয়ে গেছ। এ কথা শোনার পর ফাওলিনের দুচোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছে। হেলেন আবার বললেন, তুমি কাঁদছ কেন?

তাহলে শক্ত করে একটা চিঠি লিখে দিই, বলল নিকোমেডেস।

হেলেন বললেন, হৃদয়ে ডাক পাঠাতে হয় রে গাধা, চিঠি না।

তা-ও তো পারলি না। এখন মরতে বসেছিস!

সেবিকার বেশে স্ট্রেটোনিস এসে উপস্থিত হয়েছেন। নিকো, আর কথা নয়, এখন হেলেনের খেয়ে ঘুমানোর সময়। তার আগে ওষুধ খাবে তুমি। রাজবৈদ্যকে আমি ডেকে পাঠিয়েছি।

এ সময় উপস্থিত হলেন শর্মিলাও। আচার্য ভদ্রবাহু পাঠিয়েছেন। স্ট্রেটোনিসের কাছে তাঁকে ভালো লাগে নি। কিন্তু যখন গ্রিক ভাষায় কথা বলতে শুরু করলেন, এবার তাঁর অবাক হওয়ার পালা।

তোমাদের সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে, নিকোরা ফিরে যাওয়ার সময় বললেন শর্মিলা।

মন্দাকিনী রাজবৈদ্যকে নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। তার মুখেও গ্রিক শুনে অবাক হয়ে স্ট্রেটোনিস বললেন, তুমি তো সবাইকে গ্রিক বানিয়ে ফেলেছ।

না মা, আমি বানাই নি। আমি এসে এদের দুজনকে গ্রিকই পেয়েছি।

রাজবৈদ্য স্বাস্থ্যের খোঁজখবর নিয়ে পরীক্ষা করে দেখলেন। দেওয়া ওষুধটাই নিয়মিত সেবন করতে বললেন। পরামর্শ দিলেন যাতে পরিপূর্ণ ঘুম হয়।

হেলেনের খাদ্য গ্রহণ এবং ওষুধ সেবনের পর স্ট্রেটোনিস বললেন, মন্দাকিনী, তুমি একটু বসো। আমরা বারান্দায় আছি।

মন্দাকিনী হেলেনের দিকে তাকিয়ে চোখের জল ছেড়ে দিল। রাজবৈদ্য তাকে যা বলেছেন, তাতে আর আশা নেই। তা গোপন করেই সে কাঁদছে।

হেলেন তাকে কাছে ডাকলেন। বসতে ইশারা করলেন। মন্দাকিনী বিছানায় বসল না। হেলেন ধমক দিয়ে বললেন, বসো।

মন্দাকিনী বসল। হেলেন তার মাথায় হাত রেখে বললেন, তোমার মতো মেয়ে হয় না। কাউকে পছন্দ থাকলে বলো, আমি বিয়ের ব্যবস্থা করি।

মন্দাকিনী মাথা নাড়ল, মুখে বলল, এমনিতে ভালো আছি রানিমা, আপনি সুস্থ হয়ে উঠুন। তুমিই আমাদের সেতুবন্ধন তৈরি করে দিয়েছিলে মন্দাকিনী। না হলে কি ভালোবাসার এ বিশাল ভারতবর্ষে প্রবেশাধিকার পেতাম? মানুষের জীবন একটাই, এ জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া ভালোবাসা। তা তোমাদের কাছ থেকে আমি পেয়েছি। এখন মৃত্যুতেও আমার কষ্ট নেই।

মন্দাকিনী এবারও কাঁদল। উচ্চ স্বরে কাঁদল।

স্ট্রেটোনিস শর্মিলাকে পছন্দ করে ফেললেন। বললেন, যে কদিন এখানে থাকি, তুমি নিয়মিত আসবে!

শর্মিলা বললেন, সম্রাজ্ঞী সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত আমাকে এখানে থাকার আদেশ করেছেন আচার্য।

এখানে থাকবে কোথায়? শুবে কোথায়? ঠিক আছে, আমার সাথেই থেকো।

প্রাসাদেই আচার্য এবং আমাদের থাকার ব্যবস্থা আছে।

তাই?

আচার্য বলেছেন সম্রাজ্ঞীর অবস্থা ভালো নয়, তিনি খুব চিন্তিত

চেষ্টা করে দেখি। বাকিটা জিউসের হাতে।

.

সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য অশান্তিতে আছেন। মন তাঁর কিছুতেই টিকছে না। শুধু মানবিক কারণে অন্ধ্রবাসীদের, বিশেষ করে অমরাবতীর বাসিন্দাদের পুনর্বাসনের কাজ শেষ না করে আসতে পারছেন না। মহামন্ত্রী চাণক্যের ওপর ছেড়ে দিয়ে আসতে পারতেন, কিন্তু এ লোকটিকে আর ভরসা করতে পারছেন না। তাঁর উচিত ছিল তাঁকে সরিয়ে সুবন্ধুকে মন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া। সুবন্ধুকে অভিযানে আনাও হলো না বিন্দুসারের তাঁকে প্রয়োজন হবে বলে। সুবন্ধুকে বিশ্বাস করা যায়, তাঁর ওপর নির্ভরও করা চলে।

মানবিক উন্নয়নের জন্য চন্দ্রগুপ্ত দক্ষিণের রাজ্য অন্ধ্রের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে বেড়ালেন। শুধু দম নেওয়ার জন্য যেন মাঝেমধ্যে প্রকৃতির খুব কাছে চলে যান। সেখানে প্রকৃতির সঙ্গে বোধ হয় কষ্টগুলো ভাগাভাগি করা যায়। সে সময় হেলেনের কথা মনে হয়, বিন্দুসারের কথা মনে হয়। ক্ষমাহীন অপরাধ সংগঠন থেকে এঁরাই তাঁকে সাবধান করে দিয়েছিলেন। তাঁদের কী বলবেন তিনি?

মহামন্ত্রী চাণক্য বেশ উৎফুল্ল। সম্রাট যা-ই বলুন না কেন, অভিযান তাঁর সফল হয়েছে। একেবারে দক্ষিণে সমুদ্র পর্যন্ত মৌর্য সাম্রাজ্য বিস্তৃত হয়েছে। তিনি এ রকম বিশাল এক সাম্রাজ্যের মহামন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন। সেনাপ্রধানকে বললেন, বুঝলে বিজয়গুপ্ত, মানুষের সব সাধই পূর্ণ হয়, যদি চেষ্টা থাকে। আমি তক্ষশীলায় আচার্য থাকাকালে অমরাবতীর নাম শুনেছিলাম। এর সৌন্দর্য আর সম্পদের গৌরব-সৌরভ যেন সেখানে বসেই পাচ্ছিলাম। রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার পর বহুবারই স্বপ্ন দেখেছি, অমরাবতী আমরা দখল করব, এখানে আমাদের একটি রাজ্যকেন্দ্র থাকবে। সে সুযোগ এসে গেল। কাজে লাগালাম। তুমি যদি সব কাজে শুধু স্বচ্ছতার কথা ভাবো, নীতি-নৈতিকতার কথা ভাবো, তোমার দ্বারা কিছুই অর্জন সম্ভব হবে না। লক্ষ্মণ বলেছিলেন, ‘মারি অরি পারি যে কৌশলে’। মাঝেমধ্যে মিথ্যেও বলতে হয়। যুদ্ধে মিথ্যে বলা যায়, তাতে দোষের কিছু থাকে না। এখন অমরাবতীর সৌন্দর্য ও সম্পদ আমাদের। এখানে একটি রাজ্যকেন্দ্র হবে। আমি মাঝেমধ্যে সমুদ্রের সৌন্দর্য উপভোগের জন্য এখানে আসব। এখানে নৌবাণিজ্যের সুবিধা অনেক। ভবিষ্যতে এখানকার অমাত্যকে বলতে হবে বাণিজ্যিকভাবে যেন অমরাবতী তক্ষশীলাকেও ছাড়িয়ে যায়। তুমি পৃথিবীর কোথাও পাবে না লক্ষ্মী আর সরস্বতীর বসবাস এক জায়গায়। লক্ষ্মীকে আমি অমরাবতীতে নিয়ে আসব।

বিজয়গুপ্ত বললেন, সেনাবাহিনীতে আর আমার ভালো লাগছে না, আচার্য, আমাকে আপনি অমরাবতীর মহা-অমাত্য করে দিন।

তুমিও অমরাবতীর প্রেমে পড়ে গেলে, বিজয়গুপ্ত? তাহলে সদাচার সেনাপ্রধান হবে। ওকে বিশ্বাস করা যায় না। ও একটা জংলি।

ওর মতো স্বচ্ছ সেনাপতি হয় না, আচার্য। আমাদের সেনাবাহিনী এ রকম সেনাপ্রধানই চায়।

গরুকে জিজ্ঞেস করে হাল চাষ করতে হবে? আমি যত দিন আছি, তুমিই সেনাপ্রধান থাকবে।

বিজয়গুপ্ত চাণক্যের হাতের লাঠি। যেখানে যেভাবে খুশি ব্যবহার করতে পারেন। লাঠিটা তাই হাতছাড়া করতে চান না তিনি।

আচার্য ভদ্রবাহুকেও একটা ধন্যবাদ দেবেন তিনি। কারণ, তিলকে তাল করার ব্যাপারটা জেনেও তিনি বন্ধুর মর্যাদা রেখেছেন। তারপরও চাণক্যের কাছে একটা রহস্য থেকে যায়, কেন আচার্য ভদ্ৰবাহু জেনেশুনে চুপ করেছিলেন এবং স্বপ্নের ব্যাখ্যাটা সম্রাটকে পরিষ্কার করেন নি।

.

নিখিল, ভবদানব ও সরোজ সকাল থেকে বসে আছে সম্রাজ্ঞীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে। দ্বারবান তাদের অনুমতি দিচ্ছে না। কারণ, সম্রাজ্ঞীর অবস্থা খুবই খারাপ। ভেতরে আচার্য ভদ্রবাহু এবং যুবরাজ বিন্দুসার আছেন।

পাণ্ডুর মুখমণ্ডল। তারপরও ওদের সঙ্গে হেসে কথা বলছেন হেলেন। বললেন, আচার্য, ভবিষ্যতে আপনারা একজন অতি উচ্চমানের সম্রাট পাচ্ছেন, আমাদের বিন্দুসার প্রমাণ করে দেবে, সেই বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্রাট!

এ কথা কেন বলছ, মা?

আমার বলতে ভালো লাগছে, বিন্দুসার।

বাবা কি শ্রেষ্ঠ সম্রাট নন?

সব বাবা-মাই চান পুত্র তাঁদের ছাড়িয়ে যাক। অন্য কাউকে ছাড়িয়ে যেতে দেখলে ঈর্ষা হয়, কিন্তু সন্তানের বেলায় হয় গর্ব।

আচার্য ভদ্রবাহু বললেন, ঠিক বলেছে হেলেন। তোমার মা-ও তাই চাইতেন, বিন্দুসার।

তিনিই তো আমার মা, আচার্য।

তাই আশীর্বাদটা যথার্থ।

কিন্তু তিনি বেঁচে না থাকলে আমার এ আশীর্বাদের মূল্য কি, আচার্য?

আমরা তাকে বাঁচিয়ে রাখার সে চেষ্টাই করছি।

স্ট্রেটোনিস ও শর্মিলা এলে উঠে গেলেন এঁরা। কারণ, এখন রোগীর সেবাযত্ন শেষ করে ওষুধ সেবন ও পথ্য খাওয়ার সময় হয়েছে।

ভদ্রবাহু আবার ফিরে গেলেন। জিজ্ঞাসু নেত্রে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালেন হেলেন। আচার্য বললেন, নিখিলরা সাক্ষাৎ করতে চায় মা, একটু সময় দেবে?

পাঠিয়ে দিন, আচার্য।

তিনজন একসঙ্গে সম্রাজ্ঞীর কক্ষে প্রবেশ করল। শিল্পীরা খুব আবেগপ্রবণ হয়। এরা কোনো কথা বলছে না, শুধু কাঁদছে। কী বলবে? হেলেন তাদের কাছে ডাকলেন। এরা দাঁড়িয়েই রইল। হেলেন এবার ওঠার চেষ্টা করলেন। এরা দৌড়ে পালঙ্কের কাছে চলে গেল। সরোজ তাৎক্ষণিক বলল, উঠবেন না মা, আপনার শরীর খারাপ।

হেলেনের আবেগ কম নয়। কিন্তু নিজেকে বহু কষ্টে সামলে নিয়ে বললেন, নিখিল, সেদিন তোমার বাঁশিটা শেষ পর্যন্ত শুনতে পারি নি, আবার একদিন বাজিয়ে শোনাবে?

নিখিল আবেগে মাথা নাড়ল। সরোজ, তুমি কি আমার অসুস্থাবস্থার ছবি আঁকবে?

সে চুপ করে থাকল। তার অর্থ, আমি আপনার এ রকম ছবি আঁকতে চাই না।

ভবদানবকে ইশারায় কাছে ডাকলেন হেলেন। তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললেন, ওদের বলো না যেন, আমার সমাধিটা তুমি নির্মাণ করে দেবে।

ভবদানব কাউকে বলল না বটে, কিন্তু চিৎকার করে উঠল এবং তা এত বুকফাটা যে সবাই দৌড়ে এল।

.

প্রাসাদের বাইরে অনেক লোকসমাগম। আজকে দুর্ভিক্ষের ভয়ে নয়, সম্রাজ্ঞীর খবর জানতে লোকজন জড়ো হয়েছে। প্রাসাদ থেকে বলা হয়েছে, সম্রাজ্ঞী ঠিক আছেন, সুস্থ আছেন। কিন্তু তাদের বিশ্বাস হচ্ছে না। ইতিহাসে আছে, প্রজারঞ্জক রাজাদের জন্য তাঁদের অসুস্থতাকালে প্রজারা এভাবে রাজার খোঁজখবর নিতে এবং মঙ্গল কামনা করতে জড়ো হতেন। সম্রাজ্ঞীর জন্য জড়ো হয়েছে এমন দৃষ্টান্ত নেই। একজন যবন নারী যুদ্ধপরাজয়ে চুক্তির শর্তস্বরূপ সম্রাটের স্ত্রী হয়ে এসেছেন, এ জন্য তা তাদের কাছে গর্বের, সে কারণেই সে নারীর প্রতি কোনো সহমর্মিতা থাকার কথা নয়। কিন্তু হেলেন এ প্রাসাদে আসার পর থেকেই একে একে প্রাসাদ এবং প্রাসাদের বাইরের সব মানুষের মন জয় করেছেন। মানুষের ভালোবাসা পাওয়ার জন্য বহু কিছু করার প্রয়োজন নেই, ঠিক কাজটি করলে এবং এর কথা জানতে পারলে রাজা- রানিদের ভালোবাসা অর্জনের পথ এমনিতেই পরিষ্কার হয়ে যায়। সাধারণ মানুষ কিংবা প্রজাসাধারণ চায় ব্যক্তিগতভাবে তার জন্য কিছু করার দরকার নেই, রাজা যেন ন্যায়পরায়ণ হন, এটুকুই তাদের চাওয়া।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *