মৌর্য – ১০২

১০২

সেপ্টেম্বর, ২৮১ খ্রিষ্টপূর্ব।

সকালে ঘুম থেকে উঠে সেলুকাস বেশ ফুরফুরে মেজাজে আছেন। প্রাতরাশের আয়োজন হয়েছে আরসিনোয়ের ভোজনশালায়। সেখান থেকে সম্মিলিত যুদ্ধযাত্রা ইজিপ্টের বিরুদ্ধে। রানি আরসিনোয়ের সৈন্যরাও যোগ দেবে তাদের সঙ্গে। এরা সেলুসিয়ায় আগেই পৌঁছে গেছে।

আরসিনোয় স্বাগত জানালেন সেলুকাসকে প্রাতরাশের টেবিলে। দুজনই প্রাণবন্ত। একে অপরকে জড়িয়ে ধরলেন দেখা হওয়ামাত্র। সেলুকাস একটা প্রগাঢ় চুম্বনও এঁকে দিলেন আরসিনোয়ের ঠোঁটে। তারপর সামনাসামনি বসলেন। সেলুকাস ভোজনপ্রিয় মানুষ। আয়োজন দেখে উৎফুল্ল হলেন। বললেন, আমার পছন্দের সব খাবারই আছে। তুমি এত সব কীভাবে জানলে?

রানি এ কথার জবাব না দিয়ে হেসে শুধু বললেন, নিন, শুরু করুন।

সেলুকাস শুরু করলেন। আরসিনোয় শুরু করছেন না। হঠাৎ করেই বললেন, আমি নিরাপত্তা বোধ করছি না। ছেলেদের অন্য দেশে লুকিয়ে রেখেও শান্তি কোথায়? আমি একটা জায়গায় শান্তি খুঁজে পেয়েছি। আপনি কি আমাদের চিরস্থায়ী আশ্রয় দেবেন?

একজন রানি আশ্রয় চাইছেন। হেসে দিয়ে সেলুকাস বললেন, আমি তোমার মাথায় ছাতা ধরতে পারি, ঝড় থেকে আগলে রাখতে পারি, স্বর্গসুখ এনে দিতে পারি, কিন্তু আশ্রয় দিতে পারি না। বিয়ে কেন আরসিনোয়, এমনিতেই যদি জীবনকে উপভোগ করা যায়?

আপনিও সেলুকাস! দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন আরসিনোয়। তাঁর আর খাওয়া হলো না।

তুমি না খেলেও আমি খেয়ে শেষ করব। দূরের যাত্রা, বললেন সেলুকাস। এখন যুদ্ধ ছাড়া আর কিছু ভাবছি না। যুদ্ধ শেষে এলে পাওনা পরিশোধ করে দিয়ো।

তাই দেব। আমার জন্য যে যুদ্ধ, তার মূল্য পরিশোধের কথা তো আমারই।

সম্রাট সেলুকাস দ্রুত বের হয়ে গেলেন। তাঁর কাছে আজকের দিনটি অনেক মূল্যবান। রাতের সুখ তাই সকালেই ঝেড়ে ফেলেছেন। কিছুই মনে রাখতে চান না। এমনকি আরসিনোয়কেও না। বীরের যুদ্ধযাত্রা বলে কথা।

ছুটে চলেছে সেলুকাসের চতুরাশ্বযান। ধুলো উড়ছে রাস্তায় অশ্বখুরের আঘাতে আঘাতে। কেমন একটা ছন্দসুখ অনুভব করছেন তিনি গত সুখরাত্রির মতো। ঘটছে সুখস্মৃতির রোমন্থনও। কিন্তু আরসিনোয় বুঝতে পারছেন না, প্রকৃত সুখটা বিয়ে করে সংসারী হওয়ার মধ্যে নয়, দু-চার দিনেই যাতে ভাটা পড়ে যায়। তার ‘উপ’ হয়ে থাকাই শ্রেয়। যে সুখ ফুরোবার নয়।

হঠাৎই চতুরাশ্বযান থেমে গেল। সেলুকাস বিরক্ত হলেন। ঠকঠক শব্দের মতো মিলিয়ে গেল সুখস্মৃতিও। বললেন, কী হলো কোচয়ান, থামলে কেন?

কারা যেন ছুটে আসছে, মহামান্য সম্রাট।

আমাদের লোকই হবে। আমার নিরাপত্তাবাহিনী কোথায়?

তারা সামনে-পেছনে আছে। সামনের এরা বেশি সামনে চলে গেছে।

বরাবরই এরা তা-ই করে। মূল নিরাপত্তা দেয় পেছনের এরাই। তুমি যাও। রানি আরসিনোয়ের এলাকা। খুবই নিরাপদ। ভয় নেই।

কোচয়ান চতুরাশ্বযান নিয়ে এগিয়ে যায়। ওরাও ছুটে আসে। থ্রেস পার হতে পারেন নি সম্রাট। ওরা ঘিরে ফেলে। তড়িৎ আক্রমণে তাঁর নিরাপত্তাবাহিনীর সৈন্যরা একে একে প্রাণ হারাল। এখন সেলুকাস একা শত্রুবেষ্টিত। কাপুরুষ টলেমি কেরাউনোস! যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে গুপ্তহত্যার পথ বেছে নিয়েছ? আসো তুমি আর আমি খোলা তলোয়ারে যুদ্ধ করি, দেখি কে জিতে আর কে হারে।

ক্রুর হাসি হেসে কেরাউনোস বললেন, পঙ্কিল এক বৃদ্ধের রক্তে আমি আমার হাত অপবিত্র করতে চাই না। আমার তরবারি ঝলমলে তরুণের টগবগে রক্তের হুলি খেলার জন্য।

জেনারেল টলেমির পুত্র তুমি। আমি যখন তাঁর নৌ এডমিরাল, তখন তুমি ক্ষুদ্র এক বালক। আরসিনোয়ও তখন তোমার চেয়ে বড় এক আকর্ষণীয় তরুণী। তুমি নাকি এখন তাকে বিয়ে করতে চাইছ? এসো, তোমার বিয়ের সাধ আমি মিটিয়ে দিই।

খোপ থেকে তরবারি খুলে চতুরাশ্বযান থেকে লাফিয়ে নেমে এলেন সেলুকাস। তাঁর সামনে বিশ জনের একটি সৈন্যদল। সারিসা, তরবারি এবং আরও নানা অস্ত্র হাতে।

সেলুকাস লড়ে চলেছেন তাদের সাথে। সারিসার আঘাত কৌশলে এড়িয়ে গিয়ে শত্রুদের পেটে, মাথায়, বুকে আঘাত করে ফালাফালা করে দিচ্ছেন। মর্মান্তিকভাবে মৃত্যু হচ্ছে তাদের। একে একে সবাইকে নিঃশেষ করে বললেন, শক্তি থাকলে এবার এসো কেরাউনোস।

কেরাউনোস লাফিয়ে পড়েন সেলুকাসের ওপর। তাঁর হাতের তরবারি সূর্যের আলোয় ঝলমল করে ওঠে। বহুদূর পর্যন্ত ছড়ায় আলোর ঝলকানি।

সেলুকাস তরবারি চালনায় শ্রেষ্ঠ। লড়াই করে চলেছেন। কেরাউনোস বললেন, সেলুকাসকে নিয়ে বাবা গর্ব করতেন। কিন্তু তিনি কি জানতেন তাঁর প্রিয় মেয়ে আরসিনোয়ের অবৈধ শয্যাসঙ্গী এ ঘৃণ্য সেলুকাস। তিনি কি জানতেন তাঁর সন্তানের প্রিয়তমা প্রেমিকা সেলুকাসের লালসার শিকার। আজ সব প্রতিশোধই একসঙ্গে নেওয়ার সময়।

এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে সেলুকাস কেরাউনোসের কপোলে তরবারির এক ঘা বসিয়ে দিলেন। ফিনকি দিয়ে বের হয়ে বুক ভাসিয়ে দিচ্ছে রক্তের স্রোত। সেলুকাস বীরদর্পে বললেন, এটি স্ট্রেটোনিসের সৌজন্যে।

বড় সৌভাগ্যবান সেলুকাস তুমি। তাহলে আরেকবার সৌজন্য দেখাও আরসিনোয়ের জন্য। সে জানে না আজ আসার সময় তার দুই ছেলেকে সাবাড় করে দিয়ে এসেছি, আরেকটি পালিয়ে গেছে। তুমি নিশ্চয়ই তাদের রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছ? এখন তোমাকে কে রক্ষা করবে?

আরে অ্যাপোলো কুলের কুলাঙ্গার, নিজের কথা ভাবো। এখন টলেমি, আমার প্রিয় টলেমি চাইলেও তোমার রক্ষা নেই, বলে আবার আঘাত করলেন নাক-বরাবর। বললেন, দেখো, তোমার নাক কেটে গেছে। আর হাসলেন পৈশাচিক হাসি।

রাগে কাঁপতে কাঁপতে কেরাউনোস দুহাতে তরবারি ধরে এত জোরে আঘাত করলেন যে সেলুকাসের দেহ দুই টুকরো হয়ে গেল। দুটি পায়ের ওপর একটি খণ্ড লাফাতে থাকল কিছুক্ষণ। মাথার অংশটি তখনো দুই হাতে তরবারি চালাচ্ছে, শরীরে গতি নেই। তাই হেলে পড়ল ডালপালা নিয়ে যেন বটবৃক্ষের পতন। কিন্তু বিস্ফোরিত চোখ থেকে তখনো অগ্নি বের হচ্ছে তার, কণ্ঠ থেকে অদ্ভুত বিকট অর্থহীন শব্দ হয়তো গালি, তুচ্ছ কথাই, কিন্তু ইতিহাস। সেলুকাসের মৃত্যুর ইতিহাস। কাছেই লাইসিমেসিয়া। রানি আরসিনোয়ের রাজধানী। এই সকালে সেখান থেকেই এসেছেন তিনি। হয়তো আরসিনোয়ের কথাই ভেবেছেন মৃত্যুর আগে। এদিকে অগ্নিমূর্তি নিয়ে তরবারি মুছছেন কেরাউনোস।

.

অন্ধ্র আক্রমণটা হলো প্রত্যুষে। তখনো ঘুমন্ত অন্ধ্র। চারদিকে হাঁকডাক, ঘোড়ার হ্রেসাধ্বনি, হাতির হৃদয় কাঁপানো ভয়ংকর চিৎকার। গ্রামের পর গ্রাম দৌড়ে পার হয়ে যাচ্ছে এরা।

জেগে উঠল সব অন্ধ্রবাসী। যার যা আছে, তা নিয়ে মুখোমুখি দাঁড়াল। তাদের শান্তিপূর্ণ জনপদে কোন তস্কর হামলে পড়েছে। তাদের ভাষায় চিৎকার করে প্রতিরোধের আহ্বান জানাল গ্রামপ্রধান। প্রতিরোধের মুখে প্রায় সবাইকে প্রাণ দিতে হলো মৌর্য সৈন্যদের হাতে। এরা এগিয়ে চলেছে আদিবাসীদের রক্তের ওপর দিয়ে, প্রতি জনপদেই প্রতিরোধ।

চাণক্য সম্রাটকে বললেন, দেখুন সম্রাট, কত সৈন্য আছে অন্ধ্রে। তিন লাখ ছাড়িয়ে যাবে। রাজপ্রাসাদ আক্রমণের আগে প্রবল প্রতিরোধ হবে। প্রধান সেনাপতি, তুমি সর্বশক্তি নিয়োগ করবে। রাজপ্রাসাদ, তাদের যুদ্ধশিবির অর্থাৎ মূল ঘাঁটিতে প্রবল প্রতিরোধ হবে। রাজপ্রাসাদ আক্রমণকালে আমি থাকব। অধিকৃত একটি দুর্গে আমাদের সম্রাট অবস্থান করবেন।

সম্রাট বুঝতে পারছেন না যুদ্ধটা কার সঙ্গে হচ্ছে। নিয়মিত সৈন্যরা কোথায়? তাঁকে একটি দুর্গে অবস্থান করতে দেওয়া হলো। স্বপ্নের কথা মনে হলো তাঁর। শিয়াল বৃদ্ধ ষাঁড়কে তাড়া করছে। শিয়ালের বুদ্ধি তো মহামন্ত্রী চাণক্যের। দূরে দৃষ্টি দিয়ে দেখলেন সমস্ত বায়ুমণ্ডল ধোঁয়াচ্ছন্ন। জনপদে আগুন দেওয়া হয়েছে। লুটপাট হচ্ছে। পাখি, রাজহংসরা আকাশে উড়ছে। তাঁর মনে হলো, এ রকম রাজহংসদেরই স্বপ্নে উড়তে দেখেছিলেন তিনি। কিন্তু শত্রুপক্ষের সৈন্যরা কোথায়!

বিকেলে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত বাহিনী নিয়ে বের হয়ে পড়লেন। চাণক্যের নেতৃত্বে তখন মৌর্য বাহিনী রাজপ্রাসাদের উদ্দেশ্যে মালভূমিতে উঠে পড়ছে। এ অভিযানেও শুধু আদিবাসী জনগণই (পুরুষ-মহিলা) প্রতিরোধ সৃষ্টি করেছে। সম্রাট এবং তাঁর ব্যক্তিগত বাহিনী অন্ধ্র রাজপ্রাসাদে পৌঁছার আগেই যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। লক্ষ মানুষের (সৈন্য?) মৃত্যু হয়েছে। অন্ধ্রের আদিবাসী রাজাকে বন্দী করে হাজির করা হলো সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের সামনে। অতি সাধারণ রাজা। তাঁর ভাষায় তাঁর প্রজাদের হত্যার কারণ জানতে চাইছেন তিনি বারবার। প্রতিবাদ করছেন। কাঁদছেন তিনি। প্রজাদের রক্ষা করতে পারেন নি বলে মাথা ঠুকছেন। তিনি উন্মাদপ্ৰায়।

সম্রাট তাঁর কথা শুনতে দোভাষী খুঁজছেন।

মহামন্ত্রী বললেন, মহামান্য সম্রাট, যুদ্ধে আমাদের জয় হয়েছে। আপাতত তাঁকে কারাগারে পাঠাই। পরে তাঁর কথা শুনব। আমরা এখন অমরাবতীর রাজপ্রাসাদে।

পূর্বে নাম শুনে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন চন্দ্রগুপ্ত, ‘অমরাবতী’ মৃদু উচ্চারণও করেছেন। কিন্তু আজ যে মৃত্যুপুরী। মহামন্ত্রী, এদের নিয়মিত সৈন্যরা কোথায়, কাদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন আপনারা?

মহামন্ত্রী বললেন, আদিবাসী সৈন্যদের পোশাক এ রকমই, সম্রাট। ছদ্মবেশধারী।

সম্রাট পশ্চিম আকাশের দিকে তাকালেন। সূর্য অস্ত যাচ্ছে। স্বপ্নে যা দেখেছিলেন, ঠিক সে রকম। অমরাবতী ডুবে যাচ্ছে অন্ধকারে। সূর্যাস্তের অব্যবহিত আগে রাজপ্রাসাদে আদিবাসী পতাকা নামিয়ে মৌর্য পতাকা উত্তোলন করা হয়েছে। তা দেখেও সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের আনন্দ হচ্ছে না। হৃদয় যেন কাঁদছে তাঁর। অস্তগামী সূর্যের লাল রঙের সঙ্গে সমস্ত অন্ধ্রের মানুষের রক্তের রং মিশে গেছে। তাঁর মনে প্রশ্ন, কেন এ রকম যুদ্ধ? সবই তাঁকে জানতে হবে আগামীকাল সূর্য ওঠার আগেই। অন্ধ্রের রাজার সব কথা শুনতে হবে তাঁকে।

বিজয়ী মৌর্য সৈন্যরা মশাল জ্বালিয়ে লুটপাটে ব্যস্ত। সম্পদ আহরণে তাদের ক্লান্তি নেই। রাজকোষের চাবি এখন মহামন্ত্রীর হাতে। তবে তিনি রাজার ধন-সম্পদ নিয়ে চিন্তিত নন। চিন্তিত রাজাকে নিয়ে। রাজার কথা শুনে সকালে সম্রাট কী সিদ্ধান্ত নেন, তা নিয়ে দুশ্চিন্তা হচ্ছে। চট করে তাঁর মাথায় দুর্বুদ্ধি চাপল। তিনি ওই বিদ্রোহী সেনাপতিকে ডেকে পাঠালেন। তাঁকে তিনি সঙ্গেই নিয়ে এসেছেন নানা কথা চিন্তা করে।

তুমি আমাদের মিথ্যে বলেছিলে? আমাদের সাম্রাজ্য আক্রমণ করবে তোমাদের রাজা, তার প্রস্তুতি কোথায়? তোমাদের নিয়মিত সৈন্যরা কোথায়?

সে চুপ করে আছে, কিছু বলছে না।

এখন আমি যা বলছি শোনো, তুমি তোমার কিছু লোক নিয়ে কারাগারে যাবে। সেখানে তোমাদের রাজা বন্দী অবস্থায় আছে। তুমি তোমার প্রতিশোধ নাও তার ওপর। তাকে হত্যা করো।

অন্ধকার কুঠরিতে হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখা হয়েছে অন্ধ্রের রাজাকে। দু-চারটি মশাল জ্বেলে কালো পোশাকের মুখোশধারী ঘাতকদের নিয়ে সেনাপতি তাতে প্রবেশ করলেন।

কারাগারে তাঁকে দেখে চমকে উঠলেন রাজা আন্ধারেই। বললেন, তাহলে তুমি, বিশ্বাসঘাতক! এ রাজ্যের শান্তিপ্রিয় মানুষদের তুমিই হত্যা করিয়েছ? অশান্তি সৃষ্টির কারণে তোমাকে আমি প্রজাদের ইচ্ছায় রাজ্য থেকে বের করে দিয়েছিলাম। কেন সেদিন তোমাকে দয়া করেছিলাম, কেন হত্যা করি নি?

সে ভিলেনের মতোই বলল, এখন আমি আপনাকে হত্যা করব বলে, বলে হাসল সে, পিত্ত জ্বলে যাওয়ার হাসি।

হত্যা করার কিছু বাকি রেখেছ? আমি জানি না কত নিরীহ প্রজা মারা গেছে।

রাজাকে রাজনীতি জানতে হয়, হত্যা করতে হয়, ষড়যন্ত্র করতে হয়।

তুমি কি এখন রাজা?

মৌর্যদের করদ রাজা। তবে এখনো হই নি, হব।

করদ রাজা, থু!

এ রাজ্যের কোনো প্রজাকে আপনি হত্যা করেন নি। রাজা হিসেবে আপনাকে দিয়ে আমি হত্যার রাজনীতি শুরু করব।

কাল সকালে আমি মৌর্য সম্রাটের কাছে পুরুর মতো রাজার অধিকার দাবি করব। রাজ্য ফিরে চাইব স্বাধীন রাজা হিসেবে।

সে সুযোগ আপনি পাবেন না, বলে ঘাতকদের ইঙ্গিত করল সে। ঘাতকরা ছুরি চালাল রাজার পিঠে। কারণ, তাকে উপুড় করে ফেলে রাখা হয়েছিল।

তিনি ঘাড় কাত করে বললেন, তুমি তার প্রতিফল ভোগ করবে সেনাপতি। আমি আমার প্রিয় প্রজাদের সাথে যাচ্ছি। তুমি যাবে একা। অন্ধ্রের মানুষ তোমাকে বিশ্বাসঘাতকরূপে জানবে। এ অভিশাপ আমি দিচ্ছি।

মৌর্য সৈন্যরা তখন কারাগারে প্রবেশ করল। বিদ্রোহী সেনাপতি উল্লাস করে তাদের স্বাগত জানিয়ে বলল, মহামন্ত্রীর ইচ্ছে পূরণ করা হয়েছে, দেখুন রাজা আন্ধারেই কীভাবে মারা যাচ্ছে। বলে বিদ্রূপের হাসি হাসল সে।

মৌর্য সৈন্যদের অধিনায়ক বলল, আচার্যের আরেকটি ইচ্ছে বাকি রয়ে গেছে।

কী ইচ্ছে, বলুন, আমি পূর্ণ করে দিচ্ছি।

আপনাকে কষ্ট করে আর কিছু করতে হবে না, সেনাপতি। আমরাই তা করে দিচ্ছি।

এরা ঝটিকা আক্রমণে সেনাপতি এবং তার সঙ্গীয় ঘাতকদের হত্যা করল।

রাজা আন্ধারেই ঘাড় কাত করে ক্রুদ্ধ হাসি হাসলেন। বললেন, তোমার মৃত্যু অন্ধ্রদের হাতে হওয়াই উচিত ছিল। তোমার মতো বিশ্বাসঘাতকদের জন্ম যেন এ অন্ধ্রে কিংবা অমরাবতীতে আর না হয়, সে বরই চাইছি বনদেবতাদের কাছে।

.

পার্শ্বব মন্ত্র উচ্চারণ শুরু করলেন আচার্য ভদ্রবাহু। উদ্দেশ্য দুর্ভিক্ষ যাতে না হয়। এ জনপদ তাহলে জনশূন্য হয়ে পড়বে। মৃত্যুপুরীতে কেউ থাকতে চাইবে না। সব জৈন এ প্রার্থনায় যুক্ত হয়েছেন। আলাদাভাবে প্রার্থনা করছেন অন্য ধর্মাবলম্বীরাও। যুদ্ধজয়ের প্রার্থনা কেউ করছেন না, এমনকি হেলেনও না। হেলেন আর মেগাস্থিনিস অ্যাপোলো মন্দিরে গেছেন। ফসলের দেবতার কাছে প্রার্থনা করছেন দুর্ভিক্ষের প্রকোপ যাতে না ছড়ায়। দ্রুত ফসল যাতে ঘরে আসে।

সুবন্ধু আর বিন্দুসার গেছেন রাজকোষ এবং রাজশস্যাগার দেখতে। মজুত তেমন নেই। এত বিশাল এক রাজ্য, দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে গেলে মহাবিপদ।

বিন্দুসার জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় কোথায় বেশি ফসল ফলে? সেখানকার মহা অমাত্যের কাছে দূত পাঠান, আমি পত্র লিখে দিচ্ছি, যাতে ফসল সংগ্রহ করে। ব্যবসায়ীদের ডাকুন, অনুশাসন জারি করুন, যাতে কেউ ফসল মজুত না করে। তত্ত্বাবধায়কদের বলুন, সেচে যারা ভর্তুকি পেয়েছে, আবশ্যিকভাবে তাদের প্রয়োজন-অতিরিক্ত শস্য সাম্রাজ্যের শস্য সংগ্রহশালায় জমা দিতে হবে। যারা শস্যভান্ডার থেকে ঋণ হিসেবে খাদ্যশস্য নিয়েছে, কাকনিক কিংবা পণ মুদ্রায় নয়, ফেরত দিতে হবে শস্যে। দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়লে সেসব খাদ্যশস্য প্রজাদের মধ্যে বিতরণ করতে হবে।

অ্যাপোলো মন্দির থেকে ফিরে এসে হেলেন দেখতে পেলেন, প্রচুর লোকজনের সমাগম। বিন্দুসার বললেন, মা, তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। ব্যবসায়ীসহ পাটালিপুত্র নগরীর গুরুত্বপূর্ণ লোকদের ডেকেছি। তারা উচ্চ স্বরে অনুযোগ করে বলল, উল্টো পায়ের লোকজনকে লোকালয়ে নিয়ে আসায় এ দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে। তাদের আবার নুলো পর্বতে না পাঠালে তা মহামারিতে রূপ নেবে। এরই মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। তা দেখে হেলেন আচার্য ভদ্রবাহুর কাছে সংবাদ পাঠালেন

বিন্দুসার তাদের উদ্দেশ্যে বললেন, আপনাদের ডেকে এনেছি আমার কথা শুনবার জন্য। আগে আমার কথা শুনুন, পরে আপনাদের কথা শুনব। সবাই চুপ করলে বিন্দুসার বললেন, দুর্ভিক্ষ নিয়ে এত বেশি চিন্তা করার কিছু নেই। ফসল কম উৎপাদিত হলে এ সমস্যা হয়। আমাদের ভালো মজুত আছে। তবে সতর্কতার বালাই নেই। আপনারা ব্যবসায়ীরা খাদ্যশস্য মজুত করে রাখবেন। অধিক মুনাফার জন্য এ রকম মজুত শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। যারা সেচ ভর্তুকি পেয়েছেন, তাঁদেরও দায়িত্ব আছে। আপনাদের কী করতে হবে, সুবন্ধু তা বলে দেবেন।

এরই মধ্যে আচার্য ভদ্রবাহু উপস্থিত হয়েছেন। সবাই তাঁকে যথাযথ সম্মান জানান। বিন্দুসার তাঁর গৃহীত পদক্ষেপগুলো আচার্যকে জানালেন। আচার্য উপস্থিত সবার উদ্দেশে বললেন, যুবরাজ অত্যন্ত কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছেন। দুর্ভিক্ষ আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। দুশ্চিন্তার কিছু নেই।

একজন উঠে দাঁড়িয়ে আচার্যের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে বলল, নুলো পর্বত থেকে উল্টো পায়ের লোকদের লোকালয়ে নিয়ে আসার পরই এ দুর্ভিক্ষ। আচার্য, এদের ফেরত না পাঠালে আরও কত দুর্ভোগ, আরও কত মৃত্যু অপেক্ষা করছে, কে জানে।

অন্যরা তার কথায় সায় দিতে গিয়ে হইচই করে উঠল।

আচার্য এবার উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, দুর্ভিক্ষের সঙ্গে তাদের লোকালয়ের উপস্থিতির কোনো সম্পর্ক নেই। তা অযৌক্তিক। ফসল কম হয়েছে, তাই খাদ্যসংকটের সৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া সম্রাট যে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, তা বুঝেশুনেই দিয়েছেন।

একজন বলল, আমরা জানি, গ্রিক দূতের পরামর্শে সম্রাট এ পদক্ষেপ নিয়েছেন। তাঁর শাস্তি চাই।

এবার সম্রাজ্ঞী দাঁড়ালেন এবং বললেন, তিনি ভুল বলে থাকলে নিশ্চয়ই তার ব্যবস্থা আছে। আমরা দুর্ভিক্ষ নিয়ে চিন্তিত, তা থেকে মৌর্য সাম্রাজ্যকে মুক্ত রাখতে হবে। আচার্য যথার্থই বলেছেন, ফসল কম হয়েছে, তাই খাদ্যসংকট। এটা যুক্তিসংগত। আপনারা যা বলছেন, একটি কুসংস্কার থেকে বলছেন, যার সঙ্গে কার্যকারণ কোনো সম্পর্ক নেই। আপনারা যদি আচার্য এবং আমার ওপর আস্থা রাখেন, আমাদের কথার ওপরও আপনাদের আস্থা থাকতে হবে। ঠিক না?

শেষে বিন্দুসার আবার বললেন, আমি যুবরাজ হলেও আমি জানি, আপনারা সম্রাজ্ঞী এবং আচার্য ভদ্ৰবাহুকেই বেশি শ্রদ্ধা করেন। আমিও তাঁদের শ্রদ্ধা করি। আপনারা সম্রাটের অনুশাসন মানুন এবং যার যার কাজে ফিরে যান। আপনাদের সবার সহযোগিতায় আমরা সংকট মোকাবিলা করতে পারব।

সভা শেষে সুবন্ধু বললেন, আমরা শক্তি প্রয়োগ করব।

হেলেন বললেন, আপনি ভুল বলছেন, সুবন্ধু, সে সময় এখনো আসে নি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *