ব্যারাক বাড়িটার বাইরে এসে দাঁড়ালেন সায়ন্তন। সামনে একটা ছোট মাঠের মতো জমি। তারপর শাল—পিয়াল—মহুয়ার জঙ্গল। শুধু সামনেই নয়, জঙ্গলটা চক্রাকারে ঘিরে রেখেছে মাঠ সমেত পুরো ব্যারাক বাড়িটাকেই। সকালের আলোতে ঝলমল করছে সামনের জমিটা। কয়েকটা ছাতারে পাখি পোকা খুঁটে খাচ্ছে সেখানে। জঙ্গলের দিক থেকেও পাখির ডাক ভেসে আসছে। বেশ মনোমুগ্ধকর পরিবেশ চারিদিকে। আধা সামরিক বাহিনীর অফিসার সায়ন্তন গোস্বামী চারপাশে তাকিয়ে বেশ একটা উৎফুল্ল ভাব অনুভব করলেন। আজকের দিনটা এখানে কাটিয়ে দিতে পারলেই হল। কাল সকালেই তিনি সঙ্গীদের নিয়ে যাত্রা করবেন করবেন তিরিশ মাইল দূরে জেলা সদরের দিকে, তারপর কলকাতায় রওনা হবেন নিজের বাড়িতে কিছুদিনের ছুটি কাটাবার জন্য। এখানে ছ’মাস আগে আসার পর থেকে আর বাড়ি ফেরার সুযোগ হয়নি তার। এসব চাকরিতে এমনই হয়ে থাকে। এ জায়গাটা জঙ্গল অধ্যুষিত অঞ্চল। আর জঙ্গলের মধ্যেই এখানকার ভূমিপুত্র অর্থাৎ আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষদের ছোটছোট গ্রাম আছে। এমনিতে তারা নিরীহ, গরিব মানুষ, জঙ্গলের শালপাতা, কাঠ সংগ্রহ করে বা ছোটখাটো কাজ করে জীবন নির্বাহ করে। কিন্তু বছর তিনেক আগে হঠাৎই কেউ বা কারা এ অঞ্চলকে উত্তপ্ত করে তুলেছিল, শুরু হয়েছিল খুনজখম। বাধ্য হয়ে এ অঞ্চলে শান্তি ফেরাবার জন্য সরকারকে আধা সামরিক বাহিনী—পুলিশ মোতায়েন করতে হয়েছিল। তারপর ধীরে ধীরে শান্তি ফিরেছে। গত একবছর ধরে পুলিশ—আধা সামরিক বাহিনীর ক্যাম্পগুলোও উঠিয়ে নিতে শুরু করেছে সরকার। সায়ন্তন গোস্বামীর আধা সামরিক বাহিনীর ক্যাম্পটাই শেষ ক্যাম্প যা আজ পর্যন্ত রয়েছে এখানে আগামীকাল পাকাপাকিভাবে উঠে যাবার জন্য। সায়ন্তনের অধীনে গত ছয় মাস কুড়িজন জওয়ান আর একজন সহকারী অফিসার ছিলেন এই ক্যাম্পে। সেই অধস্তন অফিসারের তত্ত্বাবধানে আঠারো জন জনয়ানকে গতকালই জেলা সদরে পাঠিয়ে দিয়েছেন কমান্ডিং অফিসার সায়ন্তন। ক্যাম্প উঠিয়ে চলে যাবার আগে তার কাছ থেকে কিছু সরকারি কাগজ তাকে তুলে দিতে হবে স্থানীয় থানা প্রশাসনকে। সে কাগজগুলো ঠিকঠাক করে তাদের হাতে তুলে দেবার জন্যই দু—জন জওয়ানকে নিয়ে রয়ে গেছেন সায়ন্তন। এই ব্যারাক বাড়িটা আসলে একটা সরকারি স্কুল ছিল। এখানে আধা সামরিক বাহিনীর ক্যাম্প হবার কারণে স্কুলটাকে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কাল এখান থেকে ক্যাম্প উঠিয়ে দেবার পর আবার এখানে স্কুল বসবে।
ব্যারাক বাড়িটার বাইরে দাঁড়িয়ে বেশ কিছুক্ষণ ধরে চারপাশের সূর্যালোকিত প্রকৃতির শোভা উপভোগ করলেন সায়ন্তন। তবে তাকে নিজের ঘরে ফিরে কাগজপত্র নিয়ে বসতে হবে। তাই তিনি এরপর যখন ব্যারাক বাড়িটার ভিতরে ঢুকতে যাচ্ছেন ঠিক তখনই বাড়িটার বারান্দা থেকে নেমে এসে তার সামনে এসে দাঁড়াল তার সঙ্গে রয়ে যাওয়া দু—জন জওয়ান। বছর পঁচিশ বয়স হবে তাদের। ইস্পাতের মতো কঠিন সুঠাম চেহারা, মাথার চুল জওয়ানদের মতোই ছোটো করে ছাঁটা। হিন্দিভাষী, বিহারের মানুষ। তাদের একজনের নাম দুর্যোধন দুবে, অন্যজন কৌশল দুবে। শুধু বাসস্থান, ভাষা আার পদবীতেই তাদের মিল নয়, সায়ন্তন শুনেছেন এরা দুজন সম্পর্কে জ্ঞাতি ভাই হয়, একই সাথে ফোর্সে চাকরি পেয়েছে। দু—জনে বেশ কুস্তি জানে। ব্যারাকের বারান্দাতে ওঠার মুখে একপাশে যে মাটি কোপানো জায়গাটা আাছে সেখানে বিকালের অবসরে এই দুই ভাই কুস্তি প্রদর্শন করে ফোর্সের মনোরঞ্জন করে। দুজনই অত্যন্ত কর্মঠ জওয়ান। নিয়মকানুন মেনে চলে। সায়ন্তনের সামনে দাঁড়িয়ে প্রথমে তারা দুজন স্যালুট করল তাকে। তারপর কৌশল দুবে প্রথমে একটু ইতস্তত করে বলল, ‘স্যার, এখন কি আমাদের কোনো কাজ দেবেন? নইলে একটা আবেদন ছিল।’
সায়ন্তন জানতে চাইলেন, ‘কি আবেদন?’
দুর্যোধন দুবে জবাব দিল, ‘স্যার কালতো আমরা এখান থেকে চলে যাব। আজ রবিবার, হাটবার। আপনি যদি অনুমতি দেন তবে এ জায়গা ছেড়ে চলে যাবার আগে হাট থেকে ঘুরে আসতাম। তেমন কিছু জিনিস পেলে শহরে কিনে নিয়ে যাব।’
হ্যাঁ, এখানে এক আদিবাসী গ্রাম লাগোয়া জঙ্গলের মধ্যে রবিবার সকালে হাট বসে। ঘাস আর পাতায় বোনা ঝুড়ি, টুপি সহ আদিবাসীদের তৈরি নানারকম ছোটখাটো, সস্তার জিনিস বিক্রি হয় সেখানে। তাছাড়া সাধারণ সবজি, মুরগি ইত্যাদি বিক্রি হয়। সামান্য কিছু মনোরঞ্জনের ব্যবস্থা থাকে। যেমন আদিবাসী নাচ—গান ইত্যাদি। সায়ন্তন নিজেও বেশ কয়েকবার সেখানে গেছেন ক্যাম্পের রসদ কেনার জন্য। আজ এখন এই সকালে এই দুই জওয়ানকে দেবার মতো তেমন কোনো কাজ সায়ন্তনের নেই। যা কাজ আছে তা সায়ন্তনকে নিজেই করতে হবে। তাই একটু ভেবে নিয়ে তিনি তাদেরকে বললেন, ‘ঠিক আছে যাও। তবে ফিরতে বেশি দেরি কোরো না। দুপুরের রান্না করতে হবে তো।’
কৌশল দুবে সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল, ‘আপনি চিন্তা করবেন না স্যার। আমরা দুপুরের মধ্যেই ফিরে আসব। দেশি মোরগ পেলে কিনে আনব রান্নার জন্য। ও মোরগ শহরে পাবেন না।’— এ কথা বলে আবারও তাকে স্যালুট ঠুকে সেই দুই জওয়ান ক্যাম্প ছেড়ে রওনা হয়ে গেল জঙ্গলের দিকে তার ভিতরে হাটে যাবার জন্য। আর সায়ন্তনও ব্যারাকে নিজের ঘরে ঢুকে কজে মগ্ন হয়ে গেলেন।
ঘণ্টা দুই পর বেলা দশটায় একটা হাঁক বাইরে থেকে কানে এল তার। আদিবাসী কোন মানুষের ডাক— ‘হেই সাহেব, ঘরে আছিস?’
সেই হাঁক শুনে সায়ন্তন ঘরে থেকে বাইরে বেড়িয়ে বারান্দাতে এসে দাঁড়ালেন। বারান্দাতে ওঠার মুখেই সামনের জমিটাতে এসে দাঁড়িয়েছে মাঝবয়সি একজন আদিবাসী মানুষ। তার পরনে লুঙ্গির মতো করে জড়ানো লাল রঙের একটা কাপড়, মাথায় ঝাঁকড়া চুল লাল ফেট্টি দিয়ে বাঁধা, গলা থেকে ঝুলছে বেশ কিছু তাবিজ আর পাথরের মালা। চোখে মুখে একটা উত্তেজনার ভাব। এখানে গত ছ—মাস থাকার সূত্রে লোকটাকে চেনেন সায়ন্তন। লোকটার নাম ‘মোরগা গুনিন’। স্থানীয় আদিবাসী গ্রামের বাসিন্দা। লোকটা নাকি তুকতাক, ঝাড়ফুঁক করে রোগ সারায় স্থানীয় আদিবাসীদের।
সায়ন্তনের অনুমান এসব তুকতাক নয়, আসলে চিকিৎসা শাস্ত্রে প্রাথমিক কিছু জ্ঞান আছে লোকটার। জঙ্গলে বেশ কিছু ওষধি গাছ পাওয়া যায়। আসলে তা দিয়েই রোগ সারায় লোকটা। ওসব তুকতাক, ঝাড়ফুঁকের ব্যাপারটা ফালতু।
সায়ন্তনকে দেখতে পেয়ে লোকটা বলল, ‘হেই তোর সেপাহি দুটো কুথায়রে? ওরা আমার মোরগ দুটো লিয়াইছে।’ হ্যাঁ, যাবার সময় মোরগ কেনার কথা সায়ন্তনকে বলে গেছিল তারা। সায়ন্তন, লোকটাকে প্রশ্ন করল, ‘কেন, মোরগ নিয়ে পয়সা দেয়নি তারা?’
মোরগা গুনিন জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, দিয়েছে। আমি ঘরে ছিলাম না। আমার বউ মোরগ দুটো ওদের হাতে বেঁচে দিয়েছে। আমি পয়সা লিয়েসেছি। মোরগ দুটো ফিরিয়ে লিয়ে যাব। মোরগ দুটো চাই, ওরা আমার কলজে।’
কথাটা শুনে সায়ন্তন বললেন, ‘জওয়ানরা হাট থেকে ফেরেনি এখনও।’
মোরগা গুণীন বলল, ‘ওরা ফিরলে বলবি মোরগ ফিরিয়ে লিতে এসেছিলাম আমি। মোরগা দুটোর যেন কোনো ক্ষতি না হয়। আমি আবার কিছু পরে আসব।’
মোরগা গুনিনের কথা শুনে সায়ন্তন মনে মনে বললেন, ‘যতসব উটকো ঝামেলা!’ কিন্তু মুখে তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে, ওরা এলে আমি ওদের বলব, মোরগ দুটোর যেন ক্ষতি না হয়। তোমার মোরগ তোমাকে ফিরিয়ে দিতে।’
সায়ন্তনের কথা শুনে মোরগা গুনিন একটু আশ্বস্ত হয়ে পা বাড়াল আপাতত ফেরার জন্য। আর সায়ন্তনও আবার তার ঘরে ঢুকে কাজে বসলেন।
২
বেলা বারোটা নাগাদ কাজ শেষ হল সায়ন্তনের। ঘর থেকে ব্যারাকের বারান্দাতে বেরিয়ে আসতেই তিনি দেখলেন জঙ্গলের দিক থেকে মাঠ পেরিয়ে জওয়ান দু’জন ব্যারাকের দিকে আসছে। তাদের সঙ্গে ঝুড়ি, ব্যাগ ইত্যাদি জিনিস। মোরগের ব্যাপারটা জানাতে হবে তাদের। সায়ন্তন তাই বারান্দা থেকে নীচে নেমে বারান্দায় ওঠার মুখটাতে দাঁড়ালেন। তারা দু’জনও এসে দাঁড়াল তার সামনে। সায়ন্তন দেখলেন দুর্যোধনের হাতে ধরা নাইলনের ব্যাগের ভিতর থেকে উঁকি মারছে মোরগের ঠ্যাং। সায়ন্তন সেই ব্যাগটার দিকে তাকাতেই দুর্যোধন বলল, ‘এক জোড়া ভালো মোরগ এনেছি স্যার, এখনই রান্না শুরু করব।’
কথাটা শুনে সায়ন্তন বললেন, ‘ও মোরগ দুটো মোরগা গুনিনের। তাকে না জানিয়ে ওর বউ মোরগ দুটো বিক্রি করেছে। গুনিন মোরগ ফিরিয়ে নিতে এসেছিল। আবারও আসবে। তাকে মোরগ দুটো ফিরিয়ে দিতে হবে। তেমন হলে আবার হাটে গিয়ে অন্য মোরগ কিনে আনো।’
সায়ন্তনের কথা শুনে কৌশল দুবে বলল, ‘কিন্তু এখন তো আর তাকে মোরগ ফেরানো যাবে না স্যার।’
সায়ন্তন বললেন, ‘কেন ফেরানো যাবে না?’
দুর্যোধন এবার তার ব্যাগের ভিতর থেকে ঠ্যাং ধরে মোরগ দুটোকে টেনে বার করল। বেশ বড় দুটো মোরগ। একটা লাল, অন্যটা সাদা রঙের। তবে তারা মৃত। মোরগ দুটোর গায়ে রক্ত লেগে আছে। গায়ের নানা জায়গার পালক খসে ক্ষতচিহ্ন বেড়িয়ে পড়েছে। মৃদু বিস্মিতভাবে সায়ন্তন জানতে চাইলেন, ‘মোরগ দুটো মরল কীভাবে?’
কৌশল তার কথার জবাব দিতে যাচ্ছিল, ঠিক সেই সময় সবাই দেখতে পেল জঙ্গলের দিক থেকে মোরগা গুনিন ‘আমার মোরগ ফিরিয়ে দে, ফিরিয়ে দে’ বলতে বলতে ছুটে আসছে! তাকে দেখে জওয়ান কৌশল সায়ন্তনের কথার জবাব দিতে গিয়ে থেমে গেল। মোরগা গুনিন হাঁফাতে হাঁফাতে তাদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে কোমর থেকে টাকা বার করে বলল, ‘লে, তুদের টাকা লিয়ে লে। আমার মোরগ ফিরিয়ে লিব।’
গুনিন প্রথমে ভালো করে খেয়াল করেনি তার মোরগ দুটোর অবস্থা। দুর্যোধন এবার মোরগ দুটিকে তুলে ধরল মোরগা গুনিনের সামনে। তারপর ইতস্তত করে বলল, ‘মোরগ দুটো লড়াইতে মারা গেছে। হাটে মোরগ লড়াই হচ্ছিল, ওদের লড়াইতে নামিয়ে ছিলাম। দুজনই দুজনকে মেরে ফেলেছে। এ মোরগ নিলে নিয়ে যেতো পারো।’
মোরগ দুটোকে দেখে আর জ৬য়ান দুর্যোধনের কথা শুনে মোরগা গুনিন আর্তনাদ করে উঠল, ‘তুরা ওদের মেরে ফেললি!’
ব্যাপারটা বুঝতে আর কোনো অসুবিধা হল না সায়ন্তনের। এখানকার হাটে মোরগ লড়াই হয়। দুটো মোরগের পায়ে ধারালো ছুরি বেঁধে পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াইতে নামিয়ে দেওয়া হয়। মোরগগুলো তার প্রতিপক্ষকে পায়ে বাঁধা ছুরির আঘাতে ফেলার চেষ্টা করে। কোনো সময় ছুরির আঘাতে আহত হয়ে দুটো মোরগই মারা যায়। যেমন এক্ষেত্রে হয়েছে। এই মোরগ লড়াইয়ে খেলাটা এখানকার হাটে দেখেছেন সায়ন্তন। এই লড়াইটা অনেক লোক পছন্দ না করলেও আদিবাসী লোক সংস্কৃতির অঙ্গ। প্রচুর মানুষ ভিড় করে সে লড়াই দেখে উত্তেজনা লাভ করে।
এ অবস্থায় জওয়ান দুজন বা মোরগা গুনিনকে কী বলবেন তা বুঝে উঠতে পারলেন না সায়ন্তন। আর্তনাদ করার পর পাথরের মূর্তির মতো তার মোরগ দুটোর দিকে তাকিয়ে আছে গুনিন। সায়ন্তন তাকিয়ে রইলেন গুনিনের মুখের দিকে। আর এরপরই হঠাৎই যেন মোরগা গুনিনের মুখের ভাব বদলে গেল। চোখ দুটো যেন জ্বলে উঠল তার। জওয়ান দুজনের দিকে তীব্র ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে সে বলে উঠল, ‘তুরা দুই ভাইকে লড়িয়ে দিলি, মেরে ফেললি! মরবি, মরবি, তুরাও মরবি। মোরগা গুনিনের কথা মিথ্যা হবে না।’—এ কথাগুলো বলেই সে স্থান ত্যাগ করে পাগলের মতো ছুটতে ছুটতে ফাঁকা জমিটা পেরিয়ে জঙ্গলের মধ্যে মিলিয়ে গেল মোরগা গুনিন।
মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে দুই জওয়ান ভাই। তাদের দেখে সায়ন্তনের মনে হল তুকতাক জানা গুনিনের কথাগুলো যেন ভয় ধরিয়েছে তাদের মনে। সায়ন্তনের নিজের অবশ্য এসব তুকতাক, অভিশাপের ব্যাপারে কোনো বিশ্বাস নেই। তবে তিনি তিরস্কারের স্বরে জওয়ান দুজনের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘মোরগ দুটোকে লড়াইতে নামিয়ে তোমরা ঠিক করোনি।’
দুর্যোধন বলল, ‘আমাদের ভুল হয়েছে স্যার। আসলে দেহাতে আমাদের গ্রামেও মোরগ লড়াই হয়। মোরগ দুটো দেখে কয়েকজন লোক লড়াইতে নামাতে বলল তাই নামিয়েছিলাম। লোকটা যে মোরগ ফেরত নিতে আসবে তা বুঝিনি।’
সায়ন্তন ভেবে দেখলেন, এই জওয়ান দুজনকে তেমন দোষ দেওয়া যায় না। পয়সা দিয়ে তারা মোরগ কিনেছে। লড়াইতে মোরগ নামিয়ে তারা ঠিক কাজ না করলেও হয়তো বা তারা গুনিন মোরগ খুঁজতে আসার আগেই রান্নার জন্য কেটে ফেলতে পারত। তাই তিনি শুধু তাদের উদ্দেশ্য বললেন, ‘ওই কাটা—ছেঁড়া মোরগ খাবার ইচ্ছে আমার নেই। তোমরাই ওদের মাংস খেও।’
এই বলে বারান্দায় উঠে নিজের ঘরের দিকে এগোলেন তিনি। ঘরে ফেরার কিছুক্ষণের মধ্যেই বারান্দায় রান্নার জায়গা থেকে মাংস রান্নার গন্ধ নাকে এল তার। মোরগ দুটো রান্না করছে জওয়ানরা। সায়ন্তন স্নান করার পর দুর্যোধন তার দুপুরের খাবার রুটি, ডাল, সবজি দিয়ে গেল নিশ্চুপভাবে। খাওয়া সেরে ক্যাম্পখাটে শুয়ে পড়লেন সায়ন্তন।
তার যখন ঘুম ভাঙল তখন সূর্য ডুবতে চলেছে। ঘর থেকে বেরিয়ে ব্যারাকের সামনের মাঠে নেমে এলেন তিনি। তবে বারান্দা বা কুস্তির জায়গাতে জওয়ান দুজনকে দেখতে পেলেন না তিনি। সায়ন্তন অনুমান করলেন, ভরপেট মোরগের মাংস খেয়ে তারা নিশ্চয়ই ঘরে ঘুমোচ্ছে। ব্যারাকের সামেন পায়চারি শুরু করলেন তিনি। জঙ্গলের আড়ালে সূর্য ডুবে যেতে শুরু করেছে। হঠাৎই তিনি একজনকে ব্যারাকের দিকে আসতে দেখলেন। এ লোকটাকেও চেনেন সায়ন্তন। লোকটা এই প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক। শহরের লোক, চাকরি সূত্রে এখানে থাকেন। ভদ্রলোক সায়ন্তনের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘শুনলাম কাল আপনারা চলে যাচ্ছেন, তাই দেখা করতে এলাম। আপনাদের জন্যই শান্তি ফিরল।’
সায়ন্তন হেসে জবাব দিল, ‘হ্যাঁ ফিরে যাচ্ছি। আপনারা আমাদের সাহায্য করেছেন বলেই শান্তি ফিরল। আর এমনি টুকটাক ঝামেলাতো সব জায়গাতেই থাকে। স্থানীয় পুলিশ ওসব সামলে নিতে পারে।’
ভদ্রলোক বললেন, ‘হ্যাঁ, স্থানীয় ছোট ঝামেলাতো থাকেই। এই যেমন মোরগা গুনিন আত্মহত্যা করল।’
কথাটা শুনে সায়ন্তন বিস্মিতভাবে বলে উঠলেন, ‘কোথায়? কখন?’
শিক্ষক মশাই জবাব দিলেন, ‘দুপুর বেলাতে। শুনলাম তার সঙ্গে ঝগড়া করে তাকে না জানিয়ে তার মোরগ দুটো নাকি বেচে দিয়েছে তার বউ। এই মোরগ দুটোর পালক দিয়েই লোকটা ঝাড়ফুঁক করত। তাই লোকে ওকে ‘মোরগা গুনিন’ ডাকত। মোরগের শোকে বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া করে জঙ্গলের মধ্যে শাল গাছ থেকে ঝুলে পড়েছে লোকটা। একটু আগে আমিও দেখে এলাম তাকে। বীভৎস দৃশ্য মশাই! জিভ, চোখ সব যেন ঠিকরে বাইরে বেরিয়ে এসেছে।’
লোকটার কথা শুনে সায়ন্তন হতভম্ভ হয়ে গেলেও আসল ব্যাপারটা সঙ্গত কারণেই প্রকাশ করলেন না তাঁর কাছে। আধা সামরিক বাহিনীর কমান্ড্যান্ট সায়ন্তনের সঙ্গে আরও কিছু সৌজন্যসূচক কথা বলে বিদায় নিলেন সেই স্কুল মাস্টার। বনের আড়ালে সূর্য ডুবে গেল। আবার ব্যারাকের ভিতর ঢুকে পড়লেন সায়ন্তন।
ঘরে ঢুকে তার কাগজপত্রগুলো শেষবারের মতো পরীক্ষা করতে বসলেন তিনি। সে কাজ শেষ করে নিজের জিনিসপত্র গুছোলেন তিনি। কারণ পরদিন ভোরেই স্থানীয় পুলিশ আধিকারিককে কাগজ বুঝিয়ে দিয়ে গাড়ি নিয়ে তিনি এ জায়গা ছেড়ে রওনা হয়ে যাবেন। সব কাজ মিটতে তার রাত আটটা বেজে গেল। রোজ ঠিক আটটাতে তাকে রাতের খাবার দিয়ে যায় দুবে ভাইদের একজন। কিন্তু রাত ন’টা নাগাদও যখন কেউ খাবার দিতে এল না সায়ন্তন তখন তার ঘর থেকে বেরিয়ে দুটো ঘর পরে তাদের ঘরের দিকে এগোলেন। জওয়ানদের ঘরের দরজাটা খুলে ঘরে ঢুকলেন তিনি। মাথার ওপর থেকে ক্ষয়াটে একটা বাতি ঝুলছে সে ঘরে। সায়ন্তন দেখলেন, ঘরটার দুই কোণে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হাঁটু মুড়ে মাটিতে বসে রয়েছে দুই ভাই। বেশ অদ্ভুত দৃশ্য। সায়ন্তনকে দেখে উঠে দাঁড়াল তারা। তিনি তাদের বললেন, ‘রাতের খাবার হয়নি?’
কৌশল দুবে প্রথমে যেন কেমন জড়ানো গলায় উত্তর দিল, রান্না করিনি স্যার। মাফ করবেন।’
ভাইয়ের দিকে চোখ রেখেই এরপর দুর্যোধন বলল, ‘শরীরটা ভালো লাগছে না স্যার। আপনার কাছে খাবার থাকলে আজকের রাতটা চালিয়ে দিন।’
ফোর্সের কেউ সাধারণত ওপরঅলার সঙ্গে এমন আচরণ করে না। হয়তো বা তাদের সত্যি শরীর খারাপ হয়েছে। রান্না না করার জন্য এই শেষ দিনের রাতে তাদের আর বকাঝকা করতে মন চাইল না। তাদের আর কিছু না বলে ঘরে ফিরে শুকনো খাবার খেয়ে বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়লেন তিনি।
৩
বিছানাতে শুলেও কিছুতেই ঘুম এল না কমান্ড্যান্ট সাহেবের। তার দুই জওয়ারনের আচরণ যেন এখন কেমন অদ্ভুত মনে হচ্ছে তার কাছে। শরীর খারাপের জন্য তারা রাতের রান্না নাই করতে পারে, কিন্তু সে কথাটা তারা তাদের ওপরঅলাকে জানাবার প্রয়োজন বোধ করল না? তাছাড়া ঘরের কোণে ওভাবে বসে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকাটা মেন যেন অদ্ভুত ছিল। ঘুম না আসার কারণে নানা কথা ভাবতে থাকলেন তিনি। বাইরে রাত বেড়ে চলল।
তখন মধ্য রাত, ঘুম না আসার কারণে সায়ন্তন জেগেই ছিলেন। হঠাৎ সতর্ক কানে ধরা দিল একটা শব্দ! বারান্দার গেট খোলার ‘ক্যাঁচ শব্দ। এত রাতে কে ঢুকেছে বা বেরোচ্ছে ব্যারাক থেকে? শব্দটা সায়ন্তনের মনে সন্দেহের উদ্রেক ঘটানোতে বিছানা ছেড়ে উঠে তিনি ঘরের বাইরে বেরিয়ে এলেন। প্রথমে কিছুটা হেঁটে তিনি জওয়ান দুজনের ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালেন। দরজার পাল্লা খোলা, ভিতরে বাতিটাও জ্বলছে। কিন্তু তিনি ঘরের ভিতর উঁকি দিয়ে দেখলেন, দুবে ভাইরা ঘরে নেই। এত রাতে তারা গেল কোথায়? সায়ন্তন এরপর এগিয়ে গিয়ে বারান্দা ছেড়ে সামনের জমিতে নেমে এলেন তার জওয়ানদের খুঁজতে। হ্যাঁ, এবার তিনি দেখতে পেলেন তাদের। কিছুটা তফাতে কুস্তি লড়ার জমিটাতে কুস্তি শুরু করার ভঙ্গিতে নিজেদের মধ্যে কিছুটা দূরত্ব রেখে হাতে ভর দিয়ে বসে পরস্পরের মুখোমুখি তারা! ব্যাপারটা দেখে বেশ বিস্মিত হলেন কমান্ড্যান্ড সাহেব। এত রাতে কুস্তি লড়তে নেমেছে দুবে ভাইরা! পরস্পরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে স্থির দৃষ্টিতে তারা পরস্পরের দিকে চেয়ে আছে। তাদের কাছেই দাঁড়ানো কমান্ড্যান্ট সাহেবকে তারা যেন দেখতেই পাচ্ছে না। লড়াই শুরু করার আগে দুজনের শরীরটা একটু নড়ল। আর তার সাথে তাদের পায়ে বাঁধা কী যেন একটা জিনিস যেন ঝিলিক দিয়ে উঠল চাঁদের আলোতে। আর সেগুলোর দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ে চমকে উঠলেন সায়ন্তন। দুই জওয়ান কৌশল আর দুর্যোধনের পায়ের গোড়ালিতে বাঁধা রয়েছে তাদের রাইফেলের মাথাতে যে ছুরি বসানো থাকে সেই ছুরি অর্থাৎ বেয়নেটের ফলা! মোরগ লড়াইতে ঠিক যেভাবে মোরগের পায়ে ছুরি বাঁধা হয় ঠিক তেমনি ভাবেই ইস্পাতের ধারালো ছুরি পায়ে বেঁধেছে দুই ভাই। ব্যাপারটা কী ঘটছে তা অনুমান করে সায়ন্তন চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘থামো, থামো, কী করছ তোমরা?’
কিন্তু তার কথায় কর্ণপাত না করে মোরগ লড়াইয়ের মতো পরস্পরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল দুই জওয়ান। সায়ন্তন তাদের থামাবার জন্য চিৎকার করতে লাগলেন, কিন্তু থামল না তারা। সায়ন্তন তাদের কাছে যেতে পারছেন না। এমনভাবে তারা দুজন পরস্পরকে ছুরি দিয়ে চিরে ফেলার জন্য পা ছুঁড়ছে যে সায়ন্তন তাদের কাছে গেলে ধারালো বেয়নেটের আঘাতে তারও আঘাত লাগার সম্ভাবনা আছে। হঠাৎ সায়ন্তনের মনে হল ঘর থেকে বন্দুক এনে যদি তাদের ভয় দেখানো যায় তবে হয়তো তারা থামতে পারে। —একথা ভেবে নিয়ে তিনি সঙ্গে সঙ্গে বারান্দাতে উঠে বন্দুক আনতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তিনি সে দিকে ফিরতেই দেখলেন, চাঁদের আলোতে বারান্দায় ওঠার পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছে একজন লোক— মোরগা গুনিন। চোখ, জিভ যেন মুখমণ্ডল থেকে ঠিকরে বেড়িয়ে আসতে চাইছে, আর গলাটা অস্বাভাবিক লম্বা দেখাচ্ছে। আর সেই গলাতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে দড়ির ফাঁসের স্পষ্ট কালো দাগ। সায়ন্তনের উদ্দেশ্যে মোরগা গুনিন বলল, ‘দেখ সাহেব দেখ, আমার মোরগ দুটো কেমন লড়ছে। ভায়ে ভায়ে কেমন লড়ছে!’
তার কথা শুনে সায়ন্তন আবারও তাকালেন সে দিকে। কিন্তু জওয়ানরা কোথায়? সায়ন্তন দেখলেন দুবে ভাইদের জায়গাতে লড়াই করছে দানবাকৃতির দুটো মোরগ! তাদের একটার রঙ লাল অন্যটার রঙ সাদা। তবুও মনে জোর এনে গুনিনকে ঠেলে সরিয়ে বন্দুক আনতে যাচ্ছিলেন সায়ন্তন। কিন্তু তার আগেই মোরগা গুনিন ছুটে এসে ধাক্কা মেরে মাটিতে ফেলে দিল সায়ন্তনকে। মোরগা গুনিনের হাতের স্পর্শে সায়ন্তন বুঝতে পারলেন অমন শীতল কঠিন হাত কোনো মানুষের হাত হতে পারে না। জীবিত মানুষের সঙ্গে লড়াই করা চলে, কিন্তু মৃত মানুষের সঙ্গে লড়াই চলে না। জ্ঞান হারাবার আগে সায়ন্তন দেখলেন, লড়াই করে চলেছে সেই মোরগ দুটো। পায়ে বাঁধা ছুরির আঘাতে তারা ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে পরস্পরের শরীর। রক্ত ঝরছে, বাতাসে পালক উড়ছে ছুরির ফলার আঘাতে। আর সেই মোরগ লড়াইয়ের দিকে তাকিয়ে পৈশাচিক আনন্দে হাসছে মোরগা গুনিন।
পরদিন ভোরের আলো ফোটার পর স্থানীয় থানার পুলিশ কর্মীরা সায়ন্তনদের বিদায় জানাতে এসে অবাক হয়ে গেল। ব্যারাকের বারান্দার সামনের জমিতে তারা পড়ে থাকতে দেখল অচৈতন্য সায়ন্তনকে। আর তার কিছুটা তফাতেই কুস্তির জায়গাতে পড়ে আছে জওয়ান কৌশল দুবে আর দুর্যোধনের ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ। তাদের পায়ে বাঁধা আছে বেয়নেটের রক্তাক্ত ফলা। মোরগ লড়াইতে মোরগের পায়ে যেমন ছুরির ফলা বাঁধা হয়, ঠিক তেমনই তাদের পায়ে বঁধা রয়েছে বেয়নেটের ফলা।