মৃত্যুক্ষুধা – ০৭
দিন যায়, দিন আসে, আবার দিন যায়।
এরই মধ্যে একদিন গজালের মা চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে ঘরে ঢুকে একেবারেই মেজোবউয়ের পায়ের ওপর পড়ে মাথামুড়ো খুঁড়তে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে গালি, উপরোধ, অনুরোধ, অনুনয়, বিনয় – তার কতক বুঝা গেল, কতক গেল না।
মেজোবউ তাড়াতাড়ি তার শাশুড়ির মাথাটা জোর করে পায়ের ওপর হতে সরিয়ে দুহাত পেছিয়ে গিয়ে দাঁড়াল। সে এর কারণও বুঝেছিল। তবু কটু কণ্ঠেই বলে উঠল, “একী মা, তুমি আমার পা ছুঁয়ে আমায় ‘গুনায়’ (পাপে) ফেলতে চাও নাকি? কেন, কী করেছি আমি?”
তার শাশুড়ি কান্না-বিদীর্ণ-কণ্ঠে চিৎকার করে বলতে লাগল, “তা বলবি বইকী লা, আমার জোয়ান-পুত-খাকি। আমার বেটার মাথা খেয়ে এখন চললি নিকে করতে! – ভালো হবে না লো, ভালো হবে না। এই আমি বলে রাখছি, বিয়ের রাতেই জাতসাপে খাবে তোদের দুই জনকেই।” –আবার চিৎকার!
তখন ভর-দুপুর! প্যাঁকালে কাজে চলে গেছে। ছেলেমেয়েরা বেরিয়েছে – কেউ কাঠ কুড়োতে, কেউ বা গোবর কুড়োতে।
সেজোবউ শুয়ে শুয়ে ধুঁকছে। তার পাশে খোকা, যেন গোরস্থানের নিবু-নিবু মৃৎ-প্রদীপের শেষ রশ্মিটুকু। শুধু একটু ফুঁয়ের অপেক্ষায় আছে।
বড়োবউ উঠোন নিকোনো ফেলে স্তম্ভিত হয়ে দেখছিল, শুনছিল সব। এইবার সে ভয় ও বিষাদ-জড়িত কণ্ঠে বলে উঠল, “সত্যি নাকি মেজোবউ?”
মেজোবউ আস্তে বলল, “সত্যি নয়।”
এই দুটি কথার আশ্বাসেই শাশুড়ি যেন হাতে চাঁদ পেয়ে গেল। সে হঠাৎ কান্না থামিয়ে মেজোবউয়ের মুখের দিকে চেয়ে বলতে লাগল, “সত্যি বলছিস মা আমার? সত্যি তুই নিকে করবিনে? তবে যে ভোলাদের ঘরে শুনে এলাম, তোকে নিকে করতে তোর বোনাই কোলকেতা থেকে এসেছে? তাই তো বলি, ওই বুড়ো মিনসে – থাক না ওর টাকা – ওকে কি তুই নিকে করতে পারিস? তাছাড়া মা, তোর এই ছেলেমেয়ে দুটোর মায়াই বা কাটাবি কী করে বল তো? নিকে করলে ছেলেমেয়ে দুটোকে ছেড়ে দিচ্ছিনে।”
মেজোবউ বড়োবউয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে অন্য কাজে গেল।
বড়োবউ মেজোবউ ভালো করেই জানত। সে জানে, মেজোবউ মিথ্যা বলে না এবং যা বলে, তা চিরকালের জন্যই সত্য হয়ে যায়। সে মেজোবউয়ের হাসির মানে বুঝে উঠোন নিকোতে চলে গেল। যেতে যেতে সেও একটু হেসে বলে গেল, “পাড়ার গতর-খাকিদের যেমন খেয়ে দেয়ে কাজ নেই, তোমারও মা তেমনই যত সব কি-বলে-না-ইয়ে –”
শাশুড়ি একটু লজ্জিত হয়েই চোখ মুছে বড়োবউ যেখানে উঠান নিকুচ্ছিল, সেখানে এসে চুপ করে দাঁড়াল। তারপর আস্তে আস্তে বলল, “হ্যাঁ লা বড়োবউ, সত্যিই ছুঁড়ি নিকে করবে নাতো? ছুঁড়ির যা রূপ ঠিকরে পড়ছে এখনও, তার ওপর পাড়ার মাগনেড়ে হতচ্ছাড়ারা দিনরাত আছে ছুঁড়ির পানে হা-পিত্যেশ করে তাকিয়ে। আ মলো যা! ড্যাকরারা যেন হুলো বেড়াল! ইচ্ছে করে, দিই চোখে ‘লগা’ঠেলে। আর ওই বুড়ো মিনসে – ওর বোনের সোয়ামি – মিনসে যে ওর সানি-বাপ! মিনসের লজ্জা করল না কোলকেতা থেকে কেষ্টলগর ছুটে আসতে ওই মেয়ের বয়েসি বউটাকে নিকে করতে! – ঝ্যাঁটা মার! ঝ্যাঁটা মার!”
আরও কত কী বকে যায় আপন মনে।
বড়োবউ আর থাকতে না পেরে একটু রেগেই বলে উঠল, “আচ্ছা মা, তোমার কি কিছুই আক্কেল হুঁশ নেই? ‘যার বিয়ে তার মনে নেই, পাড়াপড়শির ঘুম নেই।’যা নয় তাই। মেজোবউকে যদি তুমি চিনতে, তাহলে এ-কথা বলতে না।” বলেই জোরে জোরে উঠান নিকোয়।
শাশুড়ি বড়োবউয়ের রাগ বুঝতে পারে। অন্যদিন বউ এইরকম করে কর্তা বললে সে হয়তো লঙ্কাকাণ্ড বাধিয়ে তুলত। কিন্তু আজ সে সব সয়ে যেতে লাগল। তার বউ পর হয়ে যাবে না, এই খুশি যেন তার ধরছিল না। তাই আজ বউয়ের বকুনিও অদ্ভুত মিষ্টি শোনাতে লাগল তার কানে।
কিন্তু আজ অনেক কিছু শুনেও যে এসেছে পাড়াতে – তা সত্যিই হোক আর মিথ্যেই হোক। কাজেই পরিপূর্ণ সোয়াস্তি সে পাচ্ছিল না। এও জানত সে যে, মেজোবউকে এর বেশি জিজ্ঞেস করতে গেলে সে হয়তো এক্ষুনি বাপের বাড়িই চলে যাবে। রায়বাঘিনি শাশুড়ি সে, বউদের কথায় কথায় ‘নাকের জলে চোখের জলে’ করে । কিন্তু মেজোবউকে কেন যে তার এত ভয়, কেন যে ওকে আর বউদের মতো করে গাল-মন্দ দিতে পারে না, তা সে নিজেই বুঝতে পারে না।
মেজোবউয়ের দু-দুটো ছেলেমেয়ে হলেও তার শরীরের বাঁধুনি দেখে আজও আইবুড়ো মেয়ে বলেই ভ্রম হয়। বিধবা সে, তবু পান তো খায়ই, দু-একদিন চুড়িও পরে – রঙিন রেশমি চুড়ি। আবার তার পরের দিনই ভেঙে দেয়। কাপড়টাও তার পরবার ঢং একটু খেরেস্তানি ধরনের। সিঁথিটা সে সোজাই কাটে হয়তো; মেয়েরা কিন্তু বলে, ও বাঁকা সিঁথি কাটে। খোঁপায় তার মাঝে মাঝে গাঁদা ও দোপাটি ফুলের গুচ্ছও দেখা যায়। হাসি তো লেগেই আছে ঠোঁটে, তার ওপর দিনরাত গুন গুন করে গান।
তবু পাড়ার কেউ ওর বদনাম দিতে সাহস করেনি আজও। ও যেন পাড়ার ছেলেমেয়ে সব্বারই আদরের দুলালি মেয়ে।
শাশুড়ি যখন-তখন যার-তার কাছে বলে, “মা গো, আমি যেন আগুনের খাপরা বুকে নিয়ে আছি!”
মেজোবউ সত্যিই যেন আগুনের খাপরা। রূপ ওর আগুনের শিখার মতোই লকলক করে! কিন্তু ধরতে গেলে হাতও পোড়ে। ওই হাত পোড়ার ভয়েই হয়তো পাড়ার মুখপোড়ারা ওদিকে হাত বাড়াতে সাহস করে না।
ও যেন বসরা-গোলাবের লতা। শাখা-ভরা ফুল, পাতা-ভরা কাঁটা।
ও যেন বোবা টাকা। শুধু রুপো, খাদ নেই। বাজাতে গেলে বাজে না। লোকে জানে, ও টাকা দিয়ে সংসার চলে না। খুব জোর, গলায় তাবিজ করে রাখা যায়।…
কিন্তু এ নেকার জনরবটা নিছক মিথ্যা নয়।
মেজোবউয়ের বোনের সোয়ামি সত্যি বড়োলোক – কোলকাতার চামড়াওয়ালা। আগে তার নাম ছিল ঘাসু মিয়াঁ, এখন সে ঘিয়াসুদ্দিন আহমদ। পূর্বে সে ঘোড়ার গাড়ি চালাত, এখন ঘোড়ার গাড়িই তাকে চালিয়ে নিয়ে বেড়ায়।
‘ঘিয়াসুদ্দিন’নামে প্রমোশন পেয়ে যাওয়ার পর থেকে সে আর শ্বশুরবাড়ি মাড়ায়নি। স্ত্রী তার চির-রোগী। কাজেই বিয়ে তাকে আরও দুটো করতে হয়েছে। সে বলে, এক বিয়েতে ইজ্জত তাকে না লোকের কাছে। তার শালী – অর্থাৎ মেজোবউকে সে আগেই দেখেছিল। কাজেই মেজোবউ বিধবা হওয়ার পর থেকেই তার শ্বশুরবাড়ির দিকে টানটা আবার নতুন করে আরম্ভ হয়েছে।
বড়োলোক জামাইকে দেখে শ্বশুর-শাশুড়ি খুশির চেয়ে সন্ত্রস্তই হয়ে ওঠে বেশি। নিজেদের দারিদ্র্যের লজ্জায় সর্বদা যেন এতটুকু হয়ে যায় জামাইয়ের কাছে। অবশ্য বাইরে এ নিয়ে বারফট্টাই করতেও ছাড়ে না।
মেজোবউয়ের বাপের বাড়ি শ্বশুরবাড়ির একটু দূরেই কুড়চিপোতায়। কাজেই সে যখন ইচ্ছা বাপের বাড়ি চলে যায়। শাশুড়ি এতে মনঃক্ষুণ্ণ হলেও জোর করে কিছু বলতে পারে না। ওর সর্বদা ভয়, বেশি টান দিলেই বুঝি এই ক্ষীণ সুতোটুকু ছিঁড়ে যাবে!
শাশুড়ি-মেজোবউয়ের যেন ঘুড়ি খেলা চলছে। মেজোবউ খেলে বেড়ায় মুক্ত আকাশে মুক্ত বাতাসে। শাশুড়ি মনে করে, হাতের বন্ধন এড়িয়ে ও চলে যেতে চায় সুতো ছিঁড়ে। তাই বাতাস যত জোর বয়, ও তত সুতো চেপে না ধরে সুতো ছেড়েই দিতে থাকে। কিন্তু ও সুতোরও শেষ আছে! তা ছাড়া ওই পচা সুতোর জোরই বা কতটুকু – তাও তো অজানা নেই ওর। তাই তার অসোয়াস্তির আর অন্ত নেই।
অন্য বউদের নিয়ে সে ভয় নেই বলেই সে ওদের ওপর অত নির্মম হতে পারে। রূপের একটা মোহ আছে। ওতে যে শুধু পুরুষই মুগ্ধ হয় তা নয়, দজ্জাল মেয়েও রূপের আঁচে না গলুক, নরম হয়ে পড়ে অনেকটা।
বাড়ির পশুপক্ষীগুলো পর্যন্ত যেন ওর আকর্ষণ অনুভব করে। ওদের একটা গাই ছিল, দুঃখে পড়ে তাকে বিক্রি করে দিতে হয়েছে, –সে মেজোবউ ছাড়া আর কারুর হাতে সহজে খেতে চাইত না।
গোরুরও বোধশক্তি আছে কিনা জানি না, কিন্তু যেদিন ধলী গাইটাকে কিনে নিয়ে গেল ও পাড়ার রেমো, সেদিন মেজোবউ আর ধলী দুজনার চোখেই জল দেখা গেছিল। আজও প্রায়ই পালিয়ে আসে গাইটা। সারা রাস্তাটা যেরকম ছুটতে ছুটতে আর ডাকতে ডাকতে আসে সে, তা দেখে ও-বাড়ির সবারই চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে! এসেই মেজোবউকে দেখে সে কী আকুলি-বিকুলি ওই অবলা পশুর! গা-হাত চেটে চারপাশে ঘুরে তার যেন আর সাধ মেটে না।
বড়োবউ বলে “মেজোবউ, তুই জাদু জানিস।”
যেদিন ঘিয়াসুদ্দিন কুড়চিপোতা আসত, সেই দিনই মেজোবউকে নিয়ে যাওয়ার জন্য তার মা ধন্না দিয়ে বসত এসে। বেয়ানে-বেয়ানে খুব একচোট ঝগড়া হয়ে যেত। মায়ের কান্নায় মেজোবউ না গিয়ে পারত না। এই নিয়ে আসার উদ্দেশ্যও সে বুঝত! কিন্তু ওর ওই রহস্যভরা স্বাভাবটুকুর জন্যই সে হয়তো বা ইচ্ছা করেই যেত।
বড়োবউ হেসে বলত, “আবার আসবি তো মেজো?” মেজোবউ হেসে বলত, “জোড়ে ফিরব বুবু।”