মূর্তিপূজা
মিলনার্ত বসন্তপ্রদোষে,
তোমার চরণতলে, নবাঙ্কুর তৃণাসনে ব’সে,
পুলকি পাইন্-বন অসম্ভব পণে,
বলিব না, “তুচ্ছ মানি ইন্দ্রের বৈভবও,
অন্তরের অন্তঃপুরে তব
পরিত্যক্ত স্থানটুকু দাও যদি মোরে ॥”
উৎকণ্ঠিত বিদায়ের উন্মন লগনে,
ছড়ায়ে শিথিল হস্তে, ক্ষণে ক্ষণে,
পুষ্পিত প্রান্তরে উন্মুলিত ক্রোকাসের দল,
চক্ষে বৃথা জল,
আমি কহিব না কভু, “জীবনসঙ্গিনী,
বিরহাশঙ্কায় তব নরকেরে আজ আমি চিনি,
প্রলয়ের পাই পূর্বাভাস।
হতবুদ্ধি পিপাসায় আমার আকাশ
অতঃপর শূন্য চক্রবালে
দুরত্যয় মরুকুঞ্জ নিরখিবে দুর্মর খেয়ালে।।”
কত বার, কত মধুমাসে
কখনও প্রকৃত দুঃখে, কখনও বা কৃত্রিম হতাশে,
কভু অতিরঞ্জিত কথায়,
ফুটায়েছি তপ্ত রাগ পরম্পর প্রেয়সীর কানে
মধুপগুঞ্জনমত্ত মাধবীবিতানে।
জাগাতে চাহি না পুনরায়
সে-নাট্যের অভিনয়ে মুগ্ধ মরীচিকা
নীলাভ ধূসর চোখে তব।।
বিদায়ের লগ্নে আজ নিঃসংকোচে কব,
“হে মোর ক্ষণিকা,
তোমার অরূপ স্মৃতি, সে নহে শাশ্বত।
আগন্তুক শ্রাবণের বৈদ্যুতিক উল্লাসের মতো,
তীব্র প্রবর্তনা তব সাঙ্গ হোক সাশ্রু অন্ধকারে;
অবেদ্য বিস্ময় তারে
ক’রে দিক অনির্বচনীয়।”
ইচ্ছা হলে আমারে ভুলিও,
ইচ্ছা হলে দিও
নিঃসঙ্গ সন্ধ্যায় তব মুহূর্তের নিষ্ক্রিয় মমতা।
আর যদি পারো, তবে মনে রেখো এইটুকু কথা—
অপণ্য দ্রব্যের ভারে যবে মোর তরী
নিঃস্রোত জীবনপঙ্কে হয়েছিল নিতান্ত নিশ্চল,
তুমি কৃপা করি,
এনেছিলে আজন্মের সকল সম্বল
সে-জঞ্জাল কিনে নিয়ে যেতে;
নিষ্কাম সংকেতে
তুমিই দেখায়েছিলে নিরুদ্দেশে আশ্রয়ের তীর
শান্তিসুনিবিড়।।
সপ্তসিন্ধুপরপারে মর্মরিত নারিকেলবনে,
ফাল্গুনের আড়ম্বরশূন্য জাগরণে,
যেই চিরন্তনী
একদা জাগায়েছিল অলক্ষিত নূপুরের ধ্বনি
আমার শোণিতে;
প্রমোদ্রের বিহ্বল নিশীথে
যার নিমন্ত্রণলিপি কণ্ঠাশ্লেষে এনেছে ব্যবধি;
বারংবার যে-নির্বাক, অমূর্ত দরদী,
দারুণ দুর্যোগ ভেদি, দুরাশার জ্বলদর্চিশিখা
মেঘরন্ধ্রে দেখায়েছে মোরে;
মোর জন্ম-জন্মান্তের সেই অনামিকা
ফেলেছে তোমার নীল নয়নের আয়ত সায়রে
আপনার প্রতিবিম্ব চপল খেলায়।।
আজিকার অকপট গোধূলিবেলায়,
আমাদের জীবনের ঊষর সংগমে,
নমিলাম, প্রিয়তমে,
নমিলাম গৰ্বনত শিরে
কোমল হৃদয়ে তব অচিনের পদচিহ্নটিরে।।
৮ মে ১৯২৯