মিসেস্ ম্যাকউ ইলিয়ামস্ ও বিদ্যুৎ

মিসেস্ ম্যাকউ ইলিয়ামস্ ও বিদ্যুৎ
 
Mrs. Mcwilliams and the Lightning

দেখুন স্যার-মিঃ ম্যউইলিয়ামস্ বলতে লাগল, কারণ এটাই তার আলোচনার সূত্রপাত নয়-বিদ্যুতের ভয় মানুষকে সব চাইতে বেশী কাবু করে থাকে। প্রধানত মেয়েদেরই এ ভয়টা বেশী থাকে; তবে কখনও কখনও ছোট কুকুরের মধ্যেও দেখা যায়, আর কখনও বা পুরুষ মানুষের মধ্যেও। এই ভয়টা বিশেষভাবে ক্লেশকর, কারণ এই ভয়ের ফলে মানুষ যে ভাবে সাহস হারিয়ে ফেলে তেমন আর কোন ভয়ের বেলাতেই হয় না; তাছাড়া বিচার-বুদ্ধি দিয়ে বা লজ্জা দিয়েও মানুষের মন থেকে এ ভয়কে দূর করা যায় না। যে নারী স্বয়ং শয়তানের-বা একটা ইঁদুরের-মুখোমুখি দাঁড়াতে পারে, সেও কিন্তু বিদ্যুতের ঝিলিকের সামনে হাত-পা ছেড়ে দিয়ে একেবারে ভেঙে পড়ে। তার সে ভয়ের অবস্থা দেখলে সত্যি করুণা হয়।

হ্যাঁ, যা বলছিলাম, মার্টিমার! মার্টিমার! বলে একটা অনির্দিষ্ট চাপা চীৎকার কানে আসায় আমি জেগে উঠলাম। যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব আত্মস্থ হয়ে অন্ধকারেই এগিয়ে গিয়ে বললাম:

ইভাঞ্জেলিন, তুমি ডাকছ কি? ব্যাপার কি? তুমি কোথায়?

জুতোর ঘরে আটকা পড়েছি। বাইরে এমন ভয়ংকর ঝড় হচ্ছে, আর তুমি শুয়ে ঘুমুচ্ছি! তোমার লজ্জা পাওয়া উচিত।

সে কি? ঘুমিয়ে-ঘুমিয়ে আবার লজ্জা পাব কেমন করে? এটা খুবই অযৌক্তিক কথা; একটা লোক যখন ঘুমোয় তখন সে লজ্জা পেতে পারে না ইভাঙে লিন।

তুমি কখনও চেষ্টা কর না মর্টিমার-তুমি ভাল করেই জান যে তুমি কখনও চেষ্টা কর না।

চাপা কান্নার শব্দ কানে এল।

আমার ঠোঁটে যে কড়া কথা গুলো এসেছিল সেই শব্দ শুনে সেগুলো মাঠে মারা গেল; তার বদলে আমি বললাম

আমি দুঃখিত সোনা, সত্যি দুঃখিত। এ কাজ করতে আমি চাই নি। ফিরে এস, আর-

মার্টিয়াম!

কী আশ্চর্য! কি হয়েছে তোমার?

তুমি কি এখনও বিছানায় শুয়ে আছ?

তা তো আছি।

এই মুহূর্তে উঠে এস। তোমার নিজের জন্য না হোক, আমার জন্য আর ছেলেমেয়েদের জন্যও তো নিজের জীবনের প্রতি একটু সাবধান হওয়া তোমার উচিত।

কিন্তু সোনা-

কোন কথা শুনতে চাই না মার্টিমার। তুমি তো জান, এ রকম বজ্রবিদ্যুৎসহ ঝড়ের সময় বিছানার মত এত বিপজ্জনক আর কিছু নেই-সব বইতেই সে কথা বলে; তবু তুমি শুয়েই থাকবে-ইচ্ছা করে জীবনটাকে ছুঁড়ে ফেলে দেবে-কিন্তু কেন দেবে? শুধুই তর্ক আর তর্ক করবার জন্য, আর-

কিন্তু ইভাঞ্জেলিন, এখন আমি আর বিছানায় নেই। আমি-

[সহসা বিদ্যুৎ চমকাল আর তার পরেই শোনা গেল ম্যাকউ ইলিয়াস্-এর ভয়ার্ত আর্তনাদ ও প্রচণ্ড বজ্রের শব্দ, আর তার ফলেই আমার কথায় বাধা পড়ল।]

ঐ শোন! এবার ফলাফল বোঝ। ওঃ মার্টিয়াম, এমন সময়েও দিব্যি করবার মত অসৎ তুমি হলে কেমন করে?

আমি তো দিব্যি করি নি। আর করলেও এ সব তো তার ফল হতে পারে না। আমি যদি একটি কথাও না বলতাম তাহলেও এ সব কিছুই ঘটত না। এ সব তো তুমিও ভাল করেই জান ইভাঞ্জেলিন-অন্তত তোমার জানা উচিত-যে আবহাওয়া যখন বিদ্যুতে পূর্ণ হয়

হ্যাঁ, হ্যাঁ, তুমি তর্কই কর-তর্কই কর-তর্কই কর!-তুমি যখন জান যে এ বাড়িতে একটাও বজ্রবারণ দণ্ড নেই এবং তোমার বেচারী স্ত্রী ও ছেলে মেয়েদের জীবন একান্তভাবেই ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, তখনও এ কাজ তুমি কেমন করে করছ আমি তো বুঝতে পারছি না। কি করছ তুমি? এ হেন সময়ে দেশলাই জ্বালাচ্ছ! তুমি কি বদ্ধ পাগল হয়ে গেছ?

ধুত্তোর মেয়ে মানুষ; বলি, এতে ক্ষতিটা কি? এ স্থানটা তো নরকের মত অন্ধকার। আর-

নিভিয়ে ফেল! এক্ষুণই নিভিয়ে ফেল! তুমি কি আমাদের সবাইকে বলি দিতে কৃতসংকল্প? তুমি তো জান, আলো বিদ্যুৎকে যত আকর্ষণ করে এমন আর কিছুতেই করে না। [ফ টু!-ফট-র! বুম-ব্লু-বুমবুম!] ওই শোন! এখন চোখ মেলে দেখ তুমি কি করেছ!

না, আমি কি এমন করেছি আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। একটা দেশলাই বিদ্যুৎকে আকর্ষণ করতে পারে তা আমি জানি, কিন্তু তাতে কখনও বিদ্যুৎ সৃষ্টি হয় না-সে কথা আমি বাজি ধরে বলতে পারি। তাছাড়া, এক্ষেত্রে তো আমার দেশলাই ওটাকে এক তিলও আকর্ষণ করে নি, কারণ ঐ বিদ্যুৎটা যদি আমার দেশলাইয়ের দিকে তাক করে এসে থাকে তাহলে তো বলতে হবে ওর নিশানার জ্ঞান অত্যন্ত বাজে-লাখে একটাও লক্ষ্যভেদ হবে কিনা-

কি লজ্জার কথা মার্টিমার! এখানে আমরা মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি, আর তুমি কি না কাব্যিক বুলি আওড়াচ্ছ! তোমার যদি ইচ্ছা না হয়-মার্টিমার!

বল?

আজ রাতে তুমি কি প্রার্থনা করেছিলে?

আমি-আমি করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তেরোর বারে গুণ কত হয় সেটা নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম বলে–

[ফট!-বুম-বেরুম্-বুম! মা-আম্বল ব্যাং-ঝন্‌ঝন্‌]

হায়, আমরা মারা পড়লাম, আর কোন আশাই নেই! এ রকম সময়েও এ জিনিসকে কী করে যে তুমি উপেক্ষা করতে পারলে?

কিন্তু সময়টা তো খারাপ কিছু ছিল না। আকাশে এতটুকু মেঘ ছিল না। আর ও রকম একটু খানি ত্রুটির ফলে যে এতবড় হৈ-চৈ কাণ্ড ঘটবে তাই বা আমি জানব কেমন করে? আমার তো মনে হয়, এ নিয়ে হৈ-চৈ করাও তোমার পক্ষে ঠিক হয় নি, কারণ এ জিনিস তো আর সচরাচর ঘটে না। চার বছর আগে একটা ভূমিকম্প ঘটানোর পর থেকে আর কখনও আমার প্রার্থনা করতে ভুল হয় নি।

মার্টিমার! কী বলছ তুমি! পীতজ্বরের কথাটা কি ভুলেই গেলে?

আরে বাবা, তুমি তো সব সময়ই পীত-জ্বরটাকে আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দাও। কিন্তু আমি মনে করি এটা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। পুনঃপ্রচারের ব্যবস্থা ছাড়া একটা তারবার্তাও যখন মেমফিস পর্যন্ত পাঠানো যায় না, তখন আমার দিক থেকে এতটুকু ভক্তির অভাবে এতবড় কাণ্ডটা ঘটে কেমন করে? ভূমিকম্পটা আমি মেনে নিচ্ছি, কারণ সেটা কাছাকাছিই ঘটে ছিল। কিন্তু যে কোন ঘটনার জন্যই যদি আমাকে দায়ী করা হয় তাহলে-

 [ফট!-বুম-বেরুম-বুম! বুম!-ঝ না!]

হায়, হায়, হায়! ঐ আর একটা কিছুরই উপর পড়ল। আর একটা দিনের আলো আমরা আর দেখতে পাব না। আর আমরা যখন থাকব

না তখন যদি এই কথাটি স্মরণ কর যে তোমার এই ভয়ংকর কথাবার্তাই-মার্টিমার!

আবার কি হল?

তোমার গলার স্বর শুনে মনে হচ্ছে-মার্টিমার, সত্যি সত্যি তুমি খোলা অগ্নিকুণ্ডটার সামনে দাঁড়িয়ে আছ?

সেই দুষ্কর্মটাই তো করেছি।

এই মুহূর্তে ওখান থেকে সরে যাও! তুমি দেখছি আমাদের সব্বাইকে ধ্বংস করতে কৃতসংকল্প। তুমি কি জান না, খোলা চিমনির চাইতে ভাল বিদ্যুৎ-পরিবাহী আর কিছু নেই? তুমি কোথায় আছ?

এই তো জানালায়।

আঃ, দোহাই তোমার। তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে? এই মুহূর্তে ওখান থেকে সরে যাও! কোলের ছেলেটাও জানে যে বজ্রসহ ঝড়ের সময় জানালার পাশে দাঁড়ানো খুবই মারাত্মক। হায়, হায়, বুঝতে পারছি, আমাকে দিনের আলো আর দেখতে হবে না! মার্টিমার!

বল।

খসখস শব্দটা কিসের?

আমি করেছি।

তুমি কি করছ?

পাঁৎলুনের উপরের দিকটা খুঁজছি।

শিগগীর! ওটা ছুঁড়ে ফেলে দাও! না কি ইচ্ছা করেই তুমি এ সময়ে ওগুলি পরছ? অথচ তুমি তো ভাল করেই জান, পশমী

জামা-কাপড় যে বিদ্যুৎকে আকর্ষণ করে সে বিষয়ে সব পণ্ডিতরাই একমত। হায়রে, প্রাকৃতিক কারণেই তো মানুষের কত বিপদে ঘটে, কিন্তু তুমি দেখছি সে বিপদকে আরও বাড়িয়ে তুলতেই চেষ্টা করছ। আঃ, গান করো না! তুমি ভেবেছ কি?

কেন? এতে ক্ষতিটা কি হচ্ছে?

মার্টিমার, তোমাকে একবার বলেছি-হাজার বার বলেছি-গানের ফলে বাতাসে যে কম্পন হয় তাতে বৈদ্যুতিক তরঙ্গের গতি ব্যাহত হয়, এবং-আরে, তুমি আবার দরজাটা খুলছ কেন?

কী আশচর্য মেয়ে মানুষ! কেন? কেন? তাতে আবার কি ক্ষতি হবে?

ক্ষতি? এত মৃত্যু ঘটবে। এ বিষয়ে এতটুকু খবর যে রাখে সেও জানে যে বাতাসের ঝাল্টিা বিদ্যুৎকে ডেকে আনে। দরজাটা তো

অর্ধেকটাও বন্ধ কর নি; শক্ত করে বন্ধ করে-তাড়াতাড়ি কর, নইলে সর্বনাশ হবে। আঃ, এ রকম সময়ে একটা উন্মাদকে নিয়ে এক ঘরে কাটানো কী ভয়ংকর। মার্টিমার, কি করছ তুমি?

কিছু না। একটু কলটা খুলেছি। ঘরটা বড়ই গরম হয়ে উঠেছে। হাতে-মুখে একটু জল দেব।

তোমার মাথাটা একেবারেই খারাপ হয়ে গেছে। বিদ্যুৎ যখন অন্য জিনিসের উপর একবার পড়ে তকন জলের উপর পরে পঞ্চাশ বার। কল বন্ধকরে দাও। হায়, হায়, বুঝতে পারছি, আজ আর কোন মতেই আমাদের রক্ষা নেই। মনে হচ্ছে-মার্টিমার, ওটা কি হল?

ওটা-মানে একটা ছবি। ধাক্কা লেগে পড়ে গেল।

তার মানে তুমি দেয়ালের কাছে ঘেসেছ! এ রকম অবিবেচনার কথা আমি কখনও শুনি নি! তুমি কি জান না, দেয়াল অপেক্ষা ভাল বিদ্যুৎ-পরিবাহী আর কিছুই নেই? ওখান থেকে সরে এস। আরে, তুমি আবার বকবক করছ। তোমার পরিবারের সকলের এই বিপদ,

আর তোমার দুষ্টুমির শেষ নেই! মার্টিমার, আমি যে বলেছিলাম একটা পাগলকে বিছনার অর্ডার দিতে, সেটা দিয়েছিলে কি?

না। ভুলে গিয়েছি।

ভুলে গিয়েছ! তার ফলে যে তোমার জীবনটাই চলে যেতে পারে। এখন যদি একটা পালকের বিছানা থাকত তাহলে সেটাকে ঘরের মাঝ খানে পেতে তার উপর শুয়ে পড়ে সম্পূর্ণ নিরাপদে থাকতে পারতে। এখানে চলে এস-আরও কিছু পাগলামি করবার আগেই চলে এস।

আমি চেষ্টা করলাম, কিন্তু দরজা বন্ধ থাকায় সেই ছোট্ট কুটু রিতে আমাদের দুজনকে ধরে না। কিছুক্ষণ হাঁসফাঁস করে আমি জোর করে বেরিয়ে এলাম। আমার স্ত্রী হাঁক দিয়ে বলল:

মার্টিমার, তোমাকে বাঁচাবার জন্য একটা কিছু করতেই হবে। ম্যান্টে লপিসের এক কোণ থেকে জার্মান বইটা আর একটা মোমবাতি আমাকে দাও; জ্বলিও না; একটা দেশলাই দাও, আমি এখানে জ্বালিয়ে নেব। বইটাতে অনেক কিছু নির্দেশ আছে।

বইটা খুঁজে পেলাম, কিন্তু খুঁজতে গিয়ে একটা পাত্র ও টুকিটাকি কিছু জিনিস ভাঙল। ভদ্রমহিলা মোমবাতিটা নিয়ে দরজা বন্ধকরে দিল। আমি একটু খানি সময় স্বস্তি পেলাম। তারপরেই সে ডেকে বলল: মার্টিমার, ওটা কি?

 একটা বিড়াল; আর কিছু না।

বিড়াল! সর্বনাশ! ওটাকে ধর, আটকে রাখ। তাড়াতাড়ি কর সোনা। বিড়াল একেবার বিদ্যুতে ভরা। বুঝতে পারছি, এই এক রাত্রেই আমার সব চুল সাদা হয়ে যাবে।

আবার সেই চাপা কান্নার শব্দ শুনতে পেলাম। তা না হলে সেই অন্ধকারে আমি কিছুতেই হাত-পা নাড়তাম না।

যা হোক, কাজে লেগে গেলাম। চেয়ারে ধাক্কা খেলাম, নানা জিনিসের সঙ্গে ঠোকাঠুকি লাগল, এবং শেষ পর্যন্ত চার শ ডলারের বেশী মূল্যের জিনিসপত্র ভেঙে বিড়ালটাকে কমোডের মধ্যে আটক করলাম। তখন কুটুরির ভিতর থেকে এই চাপা শব্দগুলি শুনতে পেলাম:

এখানে লেখা আছে, ঘরের মাঝ খানে একটা চেয়ারে দাঁড়িয়ে থাকাই সব চাইতে নিরাপদ, আর সেই চেয়ারের পায়াগুলিকে ঢাকা দিয়ে অ-বিদ্যুৎপরিবাহী করে নিতে হবে। তার মানে, চেয়ারের পায়া গুলোকে কাঁচের পাত্রের মধ্যে বসিয়ে নিতে হবে। [ফট!-বুম-ব্যাং!-ঝনাৎ!] শুনতে পাচ্ছ! মার্টিমার, বিদ্যুতাহত হবার আগেই তাড়াতাড়ি কর।

কাঁচের পাত্র খুঁজতে গিয়ে সবগুলো ভেঙে কোন রকমে অবশিষ্ট চারটি পেলাম। চেয়ারের পাগু লোকে তার মধ্যে বসিয়ে তারপর কি করতে হবে জানতে চাইলাম।

এক গাদা জার্মান শব্দ উচ্চারণ শেষ করে সে বলল, মার্টিমার, এ কথাগুলোর অর্থ কি? ধাতুর জিনিস কাছে রাখতে হবে, না দূরে সরিয়ে ফেলতে হবে?

দেখ, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে! জার্মান ভাষার সব পরামর্শই কেমন যেন অল্প-বিস্তর গোলমেলে। তবে যতদূর মনে হয়, এর অর্থ-কিছু ধাতুর জিনিস সঙ্গে রাখতে হবে।

হ্যাঁ, তাই হবে। সেটাই যুক্তিযুক্ত মনে হচ্ছে। তুমি তো জান, ও জিনিসপত্রগুলি বজ্রবারণ দণ্ডের মতই কাজ করে। তোমার

অগ্নিনির্বাপক মস্তকাবরণটা পরে নাও মার্টিমার; ওর প্রায় সবটাই ধাতুতে তৈরি।

সেটা খুঁজে নিয়ে মাথায় চড়ালাম-বদ্ধ ঘরের মধ্যে এই গরমের রাতে জিনিসটা যেমন ভারী ও দেখতে বাজে, তেমনই অস্বস্তিকর মনে। হল। এমন কি আমার রাত-পোশাকটাও প্রয়োজনের চাইতে বেশী ভারী মনে হতে লাগল।

মার্টিমার, মনে হচ্ছে তোমার দেহের মধ্যাংশটাও সুরক্ষিত করা দরকার। দয়া করে তোমার সামরিক তলোয়ারটা কোমরে বেঁধে নাও না?

সেই মতই কাজ করলাম।

মার্টিমার, এবার তোমার পা দুটির সুরক্ষার ব্যবস্থা করা উচিত। দয়া করে ঘোড়ার কাট। পায়ে পরে নাও।

তাই করলাম-নিঃশব্দে-আর মেজাজটাকেও সাধ্যমত শান্ত করলাম।

আবার সেই বই থেকে একগাদা জার্মান শব্দ আউড়ে সে বলল, মার্টিমার, এর অর্থ কি এই যে বজ্রসহ ঝড়ের সময় গির্জার ঘটা না। বাজানোটাই বিপজ্জনক?

হ্যাঁ, সেই রকমই তো মনে হচ্ছে, কারণ গির্জার চূড়া খুব উঁচু হওয়ার আর লুফট যুগ না থাকায় ঝড়ের সময় ঘটা না বাজানোটা খুবই বিপজ্জন্মক। তা ছাড়া, যে ভাবে কথাগুলি-

ও সব থাক মার্টিমার; বাজে কথার মূল্যবান সময় নষ্ট করো না। বড় খাবার-ঘণ্টাটা নিয়ে এস; ওই হল-ঘরেই আছে। তাড়াতাড়ি মার্টিমার। এবার আমরা প্রায় নিরাপদ। আঃ, মনে হচ্ছে শেষ পর্যন্ত আমরা বেঁচে গেলাম!

আমাদের ছোট গ্রীষ্মবাসটি একসারি উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত। সামনেই উপত্যকা। আশেপাশে কয়েকটা গোলাবাড়ি আছে-সকলের চাইতে কাছেরটা প্রায় তিন-চার শ গজ দূরে।

চেয়ারের উপর সওয়ার হয়ে প্রায় সাত-আট মিনিট ধরে সেই ভয়ংকর ঘণ্টাটা বাজিয়েই চলেছি। এমন সময় জানালার খড়খড়িটা বাইরে থেকে সজোরে খুলে ফেলা হল; একটা ঝলমল ষাঁড়-চক্ষু বাতি জানালা দিয়ে ঢুকল; আর সেই সঙ্গে কানে এল কর্কশ প্রশ্ন:

এখানে ব্যাপারটা কি হচ্ছে?

জানালায় অনেকগুলি মাথা, আর সেই সব মাথার অনেকগুলি চোখ উদভ্রান্তভাবে আমার রাত পোশাক ও রণ-সজ্জার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে।

ঘণ্টাটা ফেলে দিলাম; কিছু না বুঝেই চেয়ার থেকে লাফিয়ে নামলাম। বললাম:

ব্যাপার কিছুই না বন্ধুগণ-শুধু এই বজ্রসহ ঝড়ের জন্যে একটু গোলমাল হচ্ছে। বিদ্যুৎকে দূরে রাখবার চেষ্টা করছিলাম।

বজ্র ঝড়? বিদ্যুৎ? সে কি মিঃ ম্যাকউইলিয়ামস্, আপনার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? কী সুন্দর তারায় ভরা রাত; ঝড়ের নামগন্ধও তো নেই।

বাইরে তাকালাম। বিস্ময়ে কিছুক্ষণ কথাই বলতে পারলাম না। তারপর বললাম:

কিছুই বুঝতে পারছি না। পর্দা ও খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে বিদ্যুতের ঝিলিক স্পষ্ট দেখতে পেয়েছি, শুনেছি বজ্রের গর্জন।

একের পর এক লোকগুলো হেসে মাটিতে পড়ল-দুজন তো মরেই গেল। একজন বলে উঠল:

বড়ই দুঃখের কথা, পর্দাটা খুলে দূরের ঐ পাহাড়টার দিকে তাকাবার কথাটাও আপনাদের মনেই হয় নি। আপনারা শুনেছেন কামানের শব্দ; আর যা দেখেছেন সেটা কামান দাগবার আগুনের ঝলক। কি জানেন, ঠিক মাঝ রাতে টেলিগ্রাফে কিছু খবর এসেছে; গারফিল্ড মনোনীত হয়েছেন-আসল ব্যাপারটা এই!

সত্যি মিঃ টোয়েন, গোড়াতেই আপনাকে যা বলছিলাম (মিঃ ম্যাকউইলিয়মস বলল), বিদ্যুতের হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করবার বিধি-ব্যবস্থা এতই চমৎকার ও অসংখ্য যে মানুষ কেমন করে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয় সেটা আমার কাছে অত্যন্ত দুর্বোধ্য।

এই কথা বলে ঝোলা ও ছাতা হাতে নিয়ে সে চলে গেল, কারণ ট্রেনটা তখন তার শহরে পৌঁছে গেছে।

[১৮৮০]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *