2 of 3

মাৎস্যন্যায় অবস্থা

মাৎস্যন্যায় অবস্থা

সপ্তম শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে অষ্টম শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত সুদীর্ঘ প্রায় একশো বছর বাংলার রাষ্ট্রক্ষেত্রে জটিল ও গভীর আবর্ত অস্তিমান ছিল। নানা অঞ্চলে ছোট ছোট ক্ষণস্থায়ী রাজবংশের অস্তিত্ব, ভিনদেশী সমরাভিযান, স্থানীয় পর্যায়ে চলমান দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ, যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং তিব্বত, কাশ্মীর, নেপাল, কামরূপ ইত্যাদি হিমালয়-সন্নিহিত দেশের সাথে বাংলার নানামুখী যোগাযোগ এদেশের রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় তথা সামগ্রিক ক্ষেত্রে সঙ্কট ও জটিলতা সৃষ্টি করেছিল। বিদ্যমান অবস্থায় লেগেছিল ব্যাপক বিবর্তনের ধাক্কা।

গৌড়বঙ্গের ঐ সময়কাল সাধারণভাবে মাৎস্যন্যায় বলে অভিহিত। একক কোনো রাজা নেই অথচ সকলেই রাষ্ট্রীয় প্রভুত্বের দাবিদার। বাহুবলই একমাত্র বল। সারা দেশময় উচ্ছৃঙ্খল-বিশৃঙ্খল অপশক্তির তাণ্ডবনৃত্য—এমন দুর্যোগময় কালকে প্রাচীন অর্থশাস্ত্রে মাৎস্যন্যায় বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। বড় মাছ কর্তৃক ছোট মাছকে গিলে খাওয়ার যে ন্যায় বা যুক্তি, সেই ন্যায়ের অপ্রতিহত রাজত্বই মাৎস্যন্যায়।

মাৎস্যন্যায় যুগের গৌড়বঙ্গ সম্পর্কে তিব্বতীয় ঐতিহাসিক লামা তারনাথ ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে লেখা গ্যাগার ছোজুঙ্গ বা ভারতে বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস-গ্রন্থে বলেছেন—

‘উড়িষ্যা, বঙ্গ এবং প্রাচ্যদেশের আর পাঁচটি প্রদেশের বিভিন্ন অংশে প্রত্যেক ক্ষত্রিয়, প্রত্যেক ব্রাহ্মণ এবং প্রত্যেক বৈশ্য পার্শ্ববর্তী ভূভাগে নিজ নিজ প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, কিন্তু সমগ্র দেশের কোনো রাজা ছিল না।’

মূলকথা হলো, শশাঙ্ক ও হর্ষবর্ধনের পর এদেশে একচ্ছত্র অধিপতি না থাকায় দেশটি চরম নৈরাজ্য ও অস্থিরতার মধ্যে ছিল। স্থায়ী ও শক্তিশালী শাসন-ব্যবস্থার অনুপস্থিতি, পূর্ব প্রত্যন্ত দেশে নিদারুণ দুর্ভিক্ষ, উৎপীড়িত প্রজা-সাধারণের দুর্ভোগ, উপর্যুপরি বৈদেশিক আক্রমণ এবং ক্রমাগত আঞ্চলিক বিচ্ছিন্ন শক্তিসমূহের আক্রমণ-প্রতি আক্রমণ গৌড়বঙ্গকে প্রকৃত মাৎস্যন্যায় অবস্থার মধ্যে নিপতিত করে।

সংক্ষেপে মাৎস্যন্যায়ের প্রকৃতি আলোচনা করা হলো। দুর্বলের প্রতি সবলের অত্যাচার, পরস্পর হানাহানি, অরাজকতা এবং বিশৃঙ্খলা পরিবেশ লক্ষ করলে তা মাৎস্যন্যায় অবস্থা হিসেবে প্রতীয়মান হয় এবং প্ৰবাদকথায় উল্লিখিত হয়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *