মাসুদ রানা ৪৫১ – মায়া মন্দির – কাজী আনোয়ার হোসেন – সেবা প্রকাশনী
০১.
কনকনে ঠাণ্ডা। নভেম্বর মাস।
চারদিকে ভেজা মখমল চাদরের মত ভারী, ধূসর কুয়াশা। আর্কটিক সাগরের বুক চিরে চলেছে পঞ্চাশ ফুটি রাশান ট্রলার যেযদা বা নক্ষত্র।
ওটার নাবিক ও যাত্রীরা ভাগ্যবান, উত্তর মেরু থেকে ধেয়ে আসছে না মৃত্যুশীতল হু-হু হাওয়া। বিপজ্জনক বেয়ারিং সি এখন শান্ত। তাপমাত্রা পনেরো ডিগ্রি ফারেনহাইট, অর্থাৎ -৯.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাপ আরও হ্রাস পেলে সাগর হবে জমাট বরফের সফেদ মাঠ। সেক্ষেত্রে আটকা পড়বে ট্রলার যেযদা।
ফলাফল: সবার নিশ্চিত মৃত্যু!
আবছা আঁধারে পাইলট হাউসে দাঁড়িয়ে আছে ক্যাপ্টেন সার্গেই দিমিতভ, দমে গেছে মন। রুক্ষ চেহারার বয়স্ক লোক সে। লালচে, বড় সাইজের বেলের মত ন্যাড়া মাথা। এ মুহূর্তে চোয়াল দৃঢ়বদ্ধ। ঝুঁকে পড়েছে ষাঁড়ের কাঁধের মত মস্ত দুই কাঁধ। ভীত ও চিন্তিত সে। ট্রলারের বো-র ওপর দিয়ে চেয়ে আছে দূরে। কান পেতে শুনছে, পুরনো লোহার খোলে ঠুং-ঠাং শব্দে টোকা দিচ্ছে ছোট-বড় মেরু বরফের চাই। ওই শব্দ ছাপিয়ে কানে আসছে ইঞ্জিনের চাপা ধুব-ধুব আওয়াজ।
এখানে-ওখানে ভাসছে সাদা, ছোট বরফের চাই। তারই মাঝ দিয়ে অর্ধেক গতি তুলে চলেছে দিমিতভের ট্রলার।
বছরের এ সময়ে হঠাৎ করেই মারাত্মক প্লেগের মত বরফের মাঠ ছড়িয়ে পড়ে দক্ষিণ-সাগরে। অথচ মাত্র একঘণ্টা আগেও হয়তো ওখানে ছিল উন্মুক্ত টলটলে জল।
অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে সাগর পাড়ি দিচ্ছে দিমিতভ। ভাল করেই জানে, কত বড় ঝুঁকি নিয়েছে। উষ্ণ জলে ফিরতে না পারলে চারপাশ থেকে ট্রলারটাকে চেপে ধরবে কঠিন বরফ। শত মাইল বিস্তৃত হিম-প্রান্তরে এমন কেউ নেই যে সাহায্য করবে।
ওরা যা করেছে, তাতে ওদের বোধহয় প্রাপ্যই হয় এমনি শীতল, করুণ মৃত্যু!
ধু-ধুম! শব্দে বড় এক টুকরো হিমশিলা লাগতেই থরথর করে কাঁপল ট্রলার। বরফের টুকরো আকারে বাড়ছে, দিমিতভের পেছন থেকে বলল এক লোক। গতি বাড়িয়ে সরে যাওয়া উচিত আপনার।
পাইলট হাউসের যন্ত্রপাতির মৃদু আলোয় ঘুরে তাকাল দিমিতভ। ওকেই দেখছে ভারী গড়নের মাঝবয়সী দিমিত্রি নিকোলভ। মানব কার্গো গোপনে পৌঁছে দিতে ওর সঙ্গে চুক্তি করেছে এই লোকই। এখন তীব্র ঠাণ্ডার মাঝেও নাকের ডগা ও ঠোঁটের ওপরের অংশে জমছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। দিমিতভের আন্দাজ ভুল না হলে, লোভ ও ভয়ের বিপজ্জনক সুতোয় ঝুলছে নিকোলভ লোকটা। একবার ভাবছে, দশ মিলিয়ন ডলার পেলে বাকি জীবনে আর থাকবে না অর্থকষ্ট। আবার ভাবছে, ধরা পড়লে স্রেফ খুন হয়ে যাবে রাশান কর্তৃপক্ষের হাতে।
আসলে এত দুশ্চিন্তা কেন, নিকোলভ?
আমরা বোধহয় পথ হারিয়ে ফেলেছি, তাই না? দ্বিধা ঝেড়ে বলল নিকোলভ। একবার দেখল সার্কিট বোর্ড। ওখানেই ন্যাভিগেশন সিস্টেম।
আট ঘণ্টা আগে নষ্ট হয়েছে জিপিএস রিসিভার। দপ করে আলো ছিটিয়ে নিভে গেছে স্ক্রিন। আগুন ধরেছে কেসিং এ। ঝরঝর করে মেঝেতে পড়েছে একরাশ লাল ফুলকি। যন্ত্রটা পরীক্ষা করে বুঝেছে দিমিতভ, আর মেরামত হবে না ওই জিনিস। পরবর্তী একঘণ্টা চলেছে নক্ষত্র দেখে। কিন্তু এরপর ঘন হয়ে উঠল কুয়াশা, দেখা গেল না আকাশ। তখন বাধ্য হয়ে ব্যবহার করেছে ট্রলারের কমপাস।
নেভিতে যোগ দেয়ার আগে জেলে ছিলাম, ছোটবেলায় বাবার কাছে শিখেছি কীভাবে ন্যাভিগেট করতে হয়, আশ্বাসের সুরে বলল দিমিতভ। ভাল করেই জানি, কী করতে হবে।
একফুট এগিয়ে এসে প্রায় ফিসফিস করল দিমিত্রি নিকোলভ, নাবিকরা কিন্তু চিন্তিত। ওরা বলছে, এই যাত্রা অশুভ।
অশুভ?
নয় তো কী? পিছু নিয়েছে এক ঝাঁক কিলার ওয়েইল, বলল দিমিত্রি। প্রতি সকালে দেখছি হাঙর। সংখ্যায় বাড়ছে। ক্রমে। আগে কখনও এত হাঙর-তিমি দেখিনি এই সাগরে।
ব্যাপারটা সত্যি অস্বাভাবিক, ভাবল, দিমিতভ। যাত্রার শুরু থেকেই ছায়ার মত পিছু নিয়েছে সাগরের নাছোড়বান্দা শিকারি কিলার ওয়েইল ও হাঙরের দল। কিন্তু ট্রলার ডুবে না গেলে তাদের পেটে যাবে না ওরা। এই যে অনুসরণ করছে, সেটা বোধহয় স্রেফ কাকতালীয় কোনও ঘটনা।
প্রায় ভোর হয়ে এল, প্রসঙ্গ পাল্টাল দিমিতভ, বড়জোর দুএক ঘণ্টা আলো থাকবে, তবে তা-ই যথেষ্ট। একবার কুয়াশার চাদর সরে গেলেই গতি বাড়াতে পারব।
নিকোলভকে ভরসা দিতে না দিতেই গা রি-রি করা কর্কশ শব্দে গুতো মারল বড় কোনও হিমশিলা, স্টারবোর্ডে কাত হলো ট্রলার। পরিষ্কার বুঝল দিমিতভ, সাগরের এদিকে প্রচুর খুনে বরফ।
কমিয়ে গতি পাঁচ নট করল সে। আপ্রাণ চেষ্টা করেছে এ ফাঁদ এড়াতে। নিকোলভকে বলেছে: বেশি হিমশিলা মানেই কমবে গতি, এদিকে সামনের সাগরে জমাট বাঁধবে বরফ।
সিলিঙের বাতি জ্বালতেই সে-আলো প্রতিফলিত হলো ধূসর কুয়াশায়। ধাধিয়ে গেল দিমিতভের চোখ। চট করে চোখ বন্ধ করে বলল, মাস্তুলে কাউকে তুলব। আগেই জানতে চাই কোথায় আছে হিমশিলা।
কাউকে ডাকার আগেই সামনে থেকে এল আরেক জোর ধাক্কা। হোঁচট খেয়ে ওপরে উঠল বো, থেমে গেছে নৌযান যেন গুতো দিয়েছে তীরে।
ইঞ্জিন বন্ধ করো! গলা ছাড়ল দিমিতভ।
নিচে বন্ধ হয়ে গেল ইঞ্জিন।
কয়েক সেকেণ্ড পর নড়ে উঠে একফুট পিছিয়ে সাগরে নামল বো। স্বস্তির শ্বাস ফেলল দিমিতভ, সাহস নেই যে আবারও ইঞ্জিন চালু করতে বলবে।
এখানে থামা যাবে না, বলল দিমিত্রি নিকোলভ।
নিচের ডেক থেকে উঠে পাইলট হাউসে উঁকি দিল এক নাবিক। পানি ঢুকছে, ক্যাপ্টেন। স্টারবোর্ড। সামনের দিকে।
কতটা খারাপ? জানতে চাইল দিমিতভ।
মনে হয় ফাটল বুজিয়ে দিতে পারব, বলল নাবিক, কিন্তু আবারও অমন হলে, তখন…
অন্যদেরকে ঘুম থেকে তোলো, বলল দিমিতভ। সবাই যেন পরে নেয় সার্ভাইভাল সুট। তারপর কাজে নামবে।
এ কথা বলেছে সতর্ক করতে। আরেকটা উদ্দেশ্য: ভয় কমিয়ে দেয়া। বাস্তবে শীতল এই সাগরে সার্ভাইভাল সুট পরেও কোনও লাভ হবে না কারও। আধঘণ্টাও টিকতে পারবে না কেউ।
নিকোলভের দিকে ফিরল সার্গেই দিমিতভ। তোমার চাবিটা দাও।
কেন? আপত্তির সুরে বলল আদম ব্যাপারী।
ওকে সরিয়ে নেয়া উচিত, বলল দিমিতভ। জাহাজ ছেড়ে যেতে হলে তখন বাড়তি সময় পাব না।
দ্বিধা করল নিকোলভ, তারপর সোয়েটারের তলা থেকে বের করল সুতলি বাঁধা চাবি।
ওটা নিয়ে আদম ব্যাপারীকে ঠেলে সরিয়ে ডেকে বেরিয়ে এল দিমিতভ। চারপাশে ভাসছে থোকা-থোকা ধূসর কুয়াশা। চরম ঠাণ্ডায় মনে হলো, ধারালো কাঁচ দিয়ে চির-চির করে কাটা হচ্ছে ওর মুখ। এক চিলতে বাতাস নেই। আগেই বন্ধ করা হয়েছে ট্রলারের ইঞ্জিন। চারদিক কবরের মত নিস্তব্ধ।
পুরু হয়ে বরফে ছেয়ে গেছে ডেক। ব্রিজ, মই ও রেইল থেকে ঝুলছে ছোরার মত ধারালো সব হিমখণ্ড। প্রায় মুড়ে গেছে গোটা ট্রলার। যেন পরিত্যক্ত কোনও জাহাজ!
একটু পর পাইলট হাউস থেকে বেরোল দিমিত্রি। নিকোলভ, শীতবস্ত্রের ওপরে পরেছে সার্ভাইভাল সুট।
তাকে বোকা বলে মনে হলো দিমিতভের।
আরে, শালা, ট্রলার ডুবলে একঘণ্টাও টিকবি! তো এত কষ্ট করে এসব পরে হবেটা কী?
থামলে কেন? জানতে চাইল দিমিত্রি।
যাতে ডুবে না যায় জাহাজ।
কিন্তু এখানে রয়ে গেলে শীতে জমে মরব!
থামা অনুচিত, জানে দিমিতভ। তবে আঁধারে চললে নিশ্চিতভাবেই ডুববে ট্রলার। কুয়াশা এতই ঘন, দেখা যাচ্ছে না কিছুই। অধৈর্য হলে বিপদ বাড়বে, ফলে মরতে হবে। এখন পর্যন্ত ভাগ্য সাহায্য করেছে ওদেরকে। আস্তে আস্তে হালকা হচ্ছে কুয়াশার পর্দা। দেখা দিয়েছে আবছা আলো। পৃথিবীর এত উত্তর দিকে আকাশে না উঠে দিগন্তে ঝুলবে সূর্য। চারপাশে ছড়াবে ধূসর আলো, তাতেই এগোতে পারবে ওরা।
কিন্তু আজ চেনা এই সাগরকে অচেনা লাগছে দিমিতভের। পুবাকাশ কালো কেন? উল্টো হওয়ার কথা! কুয়াশার বিচিত্র কোনও খেলায় বোধহয় অনুপস্থিত সূর্যের রশি!
কিন্তু তা হলে ভুল দিকে উঠছে কেন সূর্য?
দিমিতভ কিছু বলার আগেই মাঝারি আওয়াজ তুলে ট্রলারে পুঁতো দিল কিছু! একদিকে সামান্য কাত হলো নৌযান!
কী হলো? চমকে গিয়ে জিজ্ঞেস করল দিমিত্রি নিকোলভ।
স্রোতে ভেসে আসা বরফখণ্ডের ধাক্কা এমনই হবে। ট্রলারের রেলিং থেকে সাগরে চোখ রাখল দিমিতভ। একেবারে নিথর পানি। নড়ছে না কোনও হিমশিলা।
দিমিতভ! ভয় পেয়ে বিড়বিড় করল নিকোলভ।
তাকে পাত্তা না দিয়ে বো-র দিকে পা বাড়াল ক্যাপ্টেন। অনেকটা হালকা হয়েছে কুয়াশা। কিন্তু তার ফলে যে দৃশ্য দেখল, নিজ চোখকে বিশ্বাস করতে পারল না। সেই দিগন্ত তক শুধু জমাট বরফের সাদা মাঠ!
হায়, ঈশ্বর! ফিসফিস করল দিমিতভ।
বরফের কঠিন প্রান্তর ভেদ করে চলা অসম্ভব।
কিন্তু কী করে এমন হলো?
সাগরের এদিকে এমন হওয়ার কথা নয়!
কয়েক সেকেণ্ড পর সত্যিই দিগন্তের কোলে মুখ তুলল সূর্য।
কিন্তু সরাসরি সামনে নেই ওটা। অবাক কাণ্ড, লালচে গোলক ঝুলছে ডানদিকে, তাদের পেছনে!
এমন কী নিকোলভও বুঝল, কী সর্বনাশ হয়েছে। কর্কশ কণ্ঠে বলে উঠল সে, তুমি সারারাত উত্তর দিকে চলেছ!
ভাবতে গিয়ে মাথা ঘুরে উঠল দিমিতভের। বারবার দিক ঠিক করে নিয়েছে ম্যাগনেটিক কমপাস দেখে। মেরুর এত কাছে ওই জিনিস মাঝে মাঝে উল্টোপাল্টা রিডিং দেয়। কিন্তু তাতে কী, সে তো অপেশাদার নাবিক নয়! সাগরে এত হিমশিলা দেখেই বোঝা উচিত ছিল, সামনেই মস্ত বিপদ!
বুঝলাম না, কী করে… শুরু করল দিমিতভ।
হাতের ঝাপটা মেরে তাকে থামিয়ে দিল দিমিত্রি নিকোলভ। আরে, গাধা, সবাইকে পৌঁছে দিয়েছ ভয়ঙ্কর নরকে!
এতই বিস্মিত, হাঁটুতে জোর পেল না দিমিতভ। মনটা চাইল ধপ করে বসতে। কিন্তু বিপদ বুঝে নিজেকে সামলে নিয়ে থামল স্টার্নে। পেছনে জমে যায়নি সাগর। কপাল ভাল হলে পিছিয়ে গিয়ে এখনও বাঁচতে পারবে।
প্রায় ঠেলে নিকোলভকে সরিয়ে পাইলট হাউসের দিকে ছুট দিল দিমিতভ। কিন্তু ওখানে যাওয়ার আগেই আবারও ধুম করে ধাক্কা দিল কিছু!
এবার অনেক জোরে!
কাত হয়ে কমপক্ষে দশ ডিগ্রি সরল ট্রলার!
চিৎকার করে ক্রুদের বলল দিমিতভ, রিভার্স! রিভার্স! পিছিয়ে যাও!
ডেকের তলায় গর্জন ছাড়ল ইঞ্জিন, পেছাতে লাগল যেযদা। কিন্তু ডান থেকে এল বো-তে গুতো। কাত হয়ে ভাসমান বরফখণ্ডের ওপর চেপে বসল ট্রলার।
হ্যাঁচকা টানে দরজা খুলে হুইলের সামনে থামল দিমিতভ। ঠেলে এক নাবিককে সরিয়ে খামচে ধরল থ্রটল। পিছাতে শুরু করে বাঁক নিল।
কী যেন ধাক্কা দিচ্ছে! আতঙ্কিত সুরে বলল নাবিক।
স্রোতে ভেসে এসে বরফের চাই লাগছে, বলল দিমিতভ। মনে মনে জানে, বলেছে ডাহা মিথ্যা।
ওই গুঁতো ইচ্ছাকৃত, আঘাত হানছে জেনে বুঝেই। কিলার ওয়েইল ও হাঙরের কথা মনে আছে দিমিতভের।
টলমল করতে করতে ব্রিজে ঢুকল নিকোলভ। ওটা সাবমেরিনও হতে পারে! এফএসবির কথা ভুললে চলবে না!
ওদের কার্গো ও গুরুত্বের কথা ভাবল দিমিতভ। পুরনো কেজিবি ভেঙে সৃষ্টি হয়েছে এফএসবি। কয়েক সপ্তাহ ধরে সাইবেরিয়াঁয় ধাওয়া করেছে তাদের এজেন্ট। নিশ্চয়ই এখনও খুঁজছে। অবশ্য তাই বলে সাবমেরিনে করে এসে তো দেবে ভাঙাচোরা ট্রলারে, এটা মেনে নেয়া কঠিন। হতে তো পারে বহু কিছুই, কিন্তু টর্পেডো মেরে বা পুঁতিয়ে ওদের মানব কার্গোসহ ট্রলার ডুবিয়ে দেয়ার কথা নয়।
বনবন করে হুইল ঘুরিয়ে ট্রলারের নাক সরাল দিমিতভ। পূর্ণ বেগ চাইল ইঞ্জিন থেকে। নব্বই ডিগ্রি বাঁক নিয়ে বাড়তে লাগল গতি। হিমশিলার মাঝ দিয়ে পথ করে নিচ্ছে ট্রলার।
দূরে দেখল দিমিতভ, কালো সাগরে বরফখণ্ড নেই। একবার ওখানে পৌঁছুতে পারলে লেজ তুলে পালাবে ওরা। ভাবল, ঈশ্বর! মাত্র পাঁচটা মিনিট পেলেই…।
একপাশ থেকে এল প্রচণ্ড গুঁতো। থরথর করে কাঁপতে শুরু করে ডানদিকে কাত হলো ট্রলার। উঠে এসেছে বো, কসেকেণ্ড পর ধড়াস্ করে নামল পানিতে। এ ধরনের হামলা হলে বেশিক্ষণ টিকবে না পুরনো, জং ধরা খোল।
পুরো থ্রটল খুলে দিল দিমিতভ। হিমখণ্ডে লেগে কর্কশ শব্দ তুলছে ধাতব খোল। যে-কোনও সময়ে খসে পড়বে প্রপেলার।
ক্যাপ্টেন, বাঁচতে হলে গতি কমাতে হবে, সতর্ক করল নাবিক।
আগে যাব অন্তত এক মাইল! ধমকের সুরে বলল দিমিতভ, তারপর কমিয়ে দেব গতি!
কথা শেষ হতে না হতেই ধাক্কা এল পোর্ট সাইডে। বাঁশ ফাটা আওয়াজে বেজে উঠল বেসুরো অ্যালার্ম। ট্রলারের ভেতর বন্যার পানির মত ঢুকছে সাগরের জল।
সবাইকে উঠে আসতে বলো! নির্দেশ দিল দিমিতভ।
পাল্টা চেঁচিয়ে কী যেন বলল নাবিক, কিন্তু অ্যালার্মের আর্তনাদে চাপা পড়ল তার কথা।
সাহায্য চেয়ে রেডিয়ো করো, বলল নিকোলভ।
কড়া চোখে ওকে দেখল ক্যাপ্টেন দিমিতভ। অনেক দেরি হয়ে গেছে।
ডেক থেকে চিৎকার করল কে যেন! আকুলা!
রাশান ভাষায় ওটার অর্থ: হাঙর!
জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল দিমিতভ। সাগরের কালো পানি চিরে আসছে আরও কালো কী যেন! লাগল ওঅটার লাইনের নিচে। প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়ে হুড়মুড় করে মেঝেতে পড়ল ক্যাপ্টেন।
পরক্ষণে এল আরেক ধাক্কা। আরও জোরে। ভারী কিছু গুতো দিয়েছে ট্রলারের খোলে। বার কয়েক আওয়াজ হলো ধু-ধুম!
যেন বন্ধ ধাতব দরজায় প্রাণপণে কিল বসাচ্ছে কেউ। জীবন্ত টর্পেডোর মত খোলের ওপর হামলে পড়ছে একের পর এক হাঙর। আহত হতেও দ্বিধা নেই।
এসব কী হচ্ছে, দিমিতভ! কাঁপা গলায় বলল নিকোলভ।
কিছুই স্পষ্ট নয় দিমিতভের কাছে। আগে কখনও দেখেনি এমন অবাক কাণ্ড!
কী কারণে যেন খেপে গেছে কিলার ওয়েইল আর হাঙররা!
স্টারবোর্ডের দিকে চেয়ে চমকে গেল দিমিতভ, যে কোনও সময়ে কাছের হিমখণ্ডের গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়বে ওরা!
সাবধান! শক্ত করে কিছু ধরো!
হিমখণ্ডের উঁচু একাংশে লেগে টলতে টলতে পিছিয়ে এল যেযদা। একবার দুলছে এদিকে, আবার ওদিকে। যখন-তখন কাত হয়ে তলিয়ে যাবে ট্রলার। ডেকে উঠে আসছে আস্ত সাগর!
লাইফবোট নামাও! আদেশ দিল দিমিতভ, জলদি!
বসে নেই নাবিকরা, পৌঁছে গেছে স্টার্নে। পাঁচজন মিলে সাগরে নামাল লাইফবোট। দিমিতভ বুঝল, রয়ে গেছে পাইলট হাউসের নাবিক, দিমিত্রি নিকোলভ, নিচে রাখা ওই মানব কার্গো আর নিজে সে। লাইফবোটে ওঠো! দেরি কোরো না!
নৌকায় নাবিকরা নামতেই নিচের ডেক লক্ষ্য করে ছুটল দিমিতভ। হ্যাঁচ খুলে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল। লোহার মেঝেতে ঘূর্ণি তৈরি করছে হাটু সমান পানি। এতই ঠাণ্ডা, অবশ হয়ে যেতে চাইল দুই পা। পানি ছিটিয়ে সবচেয়ে কাছের কেবিনের সামনে থামল সে। পকেট থেকে চাবি নিয়ে খুলে ফেলল তালা। জোরে ঠেলতেই আপত্তির শব্দ তুলে খুলে গেল দরজা। মেঝের ওপর ছল-ছলাৎ আওয়াজ করছে। সাগরের জল।
ধ্যানরত বুদ্ধের মত পা ভাঁজ করে সরু বাঙ্কে বসে আছে পাঁচ বছরের ছোট্ট এক ছেলে। চাঁদের মত গোল মুখ। মাথা ভরা কালো চুল। বোঝার উপায় নেই, সে ইউরোপিয়ান না এশিয়ান।
পাবলো! ডাক দিল দিমিতভ, এসো!
জবাব না দিয়ে সামনে-পিছে দুলে গুনগুন করে কী বলছে পিচ্চি ছেলেটা।
যে-কোনও সময়ে তলিয়ে যাবে ট্রলার। সামনে বেড়ে বাঙ্ক থেকে বাচ্চাটাকে কাঁধে তুলে নিল দিমিতভ। বেরোবে কেবিন ছেড়ে, কিন্তু তখনই আবারও কাঁপতে কাঁপতে একপাশে কাত হলো জাহাজ।
ধাতব শব্দে গুঙিয়ে উঠছে টইটম্বুর যেযদা। একপাশের দেয়াল ধরে তাল সামলে নিল দিমিতভ। বিশ ডিগ্রি কাত হলো কেবিন। তবে ভারসাম্য ফিরতেই উরু-সমান পানি ঠেলে করিডোরে বেরিয়ে এল সে।
গলা পেঁচিয়ে ধরে ঝুলছে পাবলো।
হুড়মুড় করে ট্রলারের খোলে ঢুকছে সাগরের জল। ওই স্রোত ঠেলে সিঁড়ির দিকে চলল ক্যাপ্টেন দিমিতভ। পণ করেছে, মরতে হলে মরবে, কিন্তু শেষ চেষ্টা করবে বাচ্চাটাকে বাঁচাতে। সিঁড়ি বেয়ে পৌঁছে গেল হ্যাঁচ কাভারের কাছে। লোহার ডালা খুলতেই ত্রিশ ডিগ্রি কাত হলো যেযদা, ডুবে যাবে যে-কোনও সময়ে!
পেছনের ডেক দেখল দিমিতভ। স্টার্ন থেকে তিরিশ গজ দূরে লাইফবোট। কিন্তু স্বস্তিতে নেই নাবিকরা। মনে হলো খুব ভীত সন্ত্রস্ত। বারবার আঙুল তুলে দেখাচ্ছে কী যেন, সাগরের পানিতে।
কয়েক সেকেণ্ড পর তাদের বোটের নিচে হাজির হলো কালো-সাদা প্রকাণ্ড এক অবয়ব। ওপরে উঠল ত্রিকোণ ডরসাল ফিন। পরক্ষণে দুটুকরো হলো লাইফবোট। বোটের এদিকে-ওদিকে ছিটকে পড়ল নাবিকরা। তাদের ওপর হামলা করল কালো লেজের কয়েকটা দানব। অসহায় মানুষের করুণ আর্তচিৎকার চিরে দিল নীরব পরিবেশ।
হতবাক দিমিতভ দেখল, কিলার ওয়েইলের পাল খুন করছে যেযদার নাবিকদেরকে!
আরও কাত হলো যেযদা। খোলা সব কেবিনেট থেকে সাগরে ভেসে গেল হালকা মালপত্র। হ্যাঁচ থেকে সরে গেল দিমিতভ। যে-কোনও সময়ে গড়ান দেবে ট্রলার। ওটার ভেতরের পানি ভেদ করে উঠে এল একরাশ বুদ্বুদ।
বাচ্চাকে কাঁধে রেখে রেলিং টপকে ঝাঁপ দিল দিমিতভ। পা পড়তেই পিছলে গেল জমাট বরফে। হাত থেকে ছুটে গেছে ছেলেটা। মুখ থুবড়ে পড়ে সরে যাচ্ছে দূরে।
প্রচণ্ড ও ভারী আওয়াজ শুনে ঘুরে তাকাল দিমিতভ। সাগর তলদেশ লক্ষ্য করে রওনা হয়েছে তার ট্রলার। যেযদার বুকভরা দীর্ঘশ্বাস মস্ত সব বুদ্বুদ হয়ে বিস্ফোরিত হলো সাগর সমতলে।
মাত্র কয়েক মুহূর্ত পর থমথম করতে লাগল চারপাশ।
টলমল করছে সাগরের কালো জল।
ভাসছে ভাঙাচোরা মালপত্র।
যেযদা ট্রলার যেখানে ছিল, ওখানে এখন ছোট বরফখণ্ড।
দক্ষিণে চোখ বোলাল দিমিতভ। ডুবে গেছে লাইফবোট। খুন হয়েছে নাবিকরা। ভেসে আছে ঘেঁড়া দুটো লাইফ জ্যাকেট। খাওয়ার মত কিছু পাবে ভেবে ওখানে এখনও ঘুরঘুর করছে দুটো হাঙর। নির্জন সাগরের বুকে হিমশিলায় রয়ে গেছে শুধু বাচ্চা ছেলেটা আর সে নিজে!
কপাল ভাল, সমতল জায়গায় পড়েছে, নইলে পিছলে গিয়ে বেঘোরে ডুবে মরত সাগরে। তিনফুট পুরু সিমেন্টের কঠিন চাপড়ার মতই এই হিমখণ্ড।
ঘুরে পাবলোর দিকে তাকাল দিমিতভ। কার্গো আসলে ওই বাচ্চা ছেলে। এক লোকের হাতে পৌঁছে দিলে মিলত দশ মিলিয়ন ডলার। কাজটা নিয়েছিল বলেই খুন হয়েছে যেযদার নাবিকরা। নেই ওর সাধের যেযদাও।
ছেলেটাকে কেন এত দরকার ওই লোকের?
জানা নেই দিমিতভের। এখন আর ভেবেই বা কী হবে?
ভীষণ কনকনে ঠাণ্ডায় জমে যেতে চাইছে শরীর। উঠে দাঁড়াল দিমিতভ। দূরে দিগন্তজোড়া সফেদ মাঠ! প্রতিফলিত উজ্জ্বল আলোয় ধাধিয়ে গেল চোখ।
লবণাক্ত সাগরে শত মাইল জুড়ে বরফ-প্রান্তরে আর কিছুই নেই! বলা হয় এটা মহাদেশ। কিন্তু এখানে, এই মহাদেশে এই মুহূর্তে আছে মাত্র দুজন মানুষ!
আরেকবার সূর্যোদয়ের আগেই হয়তো মারা পড়বে ওরা!
.
০২.
দুই চার হাত-পায়ে হাঁচড়েপাঁচড়ে মাউন্ট পুলিমাণ্ডোর চূড়ায় উঠছে মিতা দত্ত, মনে ভীষণ ভয়। পাহাড়ে প্রায় দৌড়ে উঠে হাঁফ লেগে গেছে। পরিশ্রমের কারণে পাথরের মত শক্ত হয়ে গেছে কাফ মাসল, আগুনের মত পুড়ছে ফুসফুস। কিন্তু গতি কমিয়ে দেবে, সে উপায় নেই!
দেখার মত সুন্দরী, সুশিক্ষিত, ছিপছিপে মেয়ে মিতা। সৌন্দর্য তার গায়ের রঙে নয়, চেহারায়। বয়স মাত্র পঁচিশ বছর। যে-কেউ ঘুরে তাকায় দ্বিতীয়বার। ওর মা আমেরিকান, তাঁর কাছ থেকেই পেয়েছে বেদানার দানার মত ত্বকের রঙ। অবশ্য কাজলকালো বাঙালী দুচোখ পেয়েছে বাবার কাছ থেকে। উনি ছিলেন বাঙালি ফিযিসিস্ট।
চট করে পেছনে তাকাল মিতা। পিছু পিছু আসছে বাদামি রঙা এক মেক্সিকান তরুণ। তার ত্রিশ ফুট নিচে কুচকুচে কালো, বিখ্যাত আর্কিওলজিস্ট প্রফেসর জর্জ হ্যারিসন। পাহাড় বেয়ে উঠতে গিয়ে স্টিম ইঞ্জিনের মত তাঁর নাক-মুখ দিয়ে বেরোচ্ছে ফোঁসফোঁস আওয়াজ।
আরও জলদি, স্যর। ভাবুন, কেউ আগুন দিয়েছে আপনার লেজে! তাড়া দিল মিতা।
আমার লেজ পেলে কই? ভুরু কুঁচকে গতি বাড়ালেন হ্যারিসন।
ওরা কিন্তু খুব কাছে চলে এসেছে!
করুণ চোখে মিতাকে দেখলেন ডক্টর হ্যারিসন। ভাবছেন, বয়সটা পঁয়ষট্টি হোক, হাড়ে হাড়ে টের পাবে তখন!
তরুণ গাইডের দিকে তাকাল মিতা। তার বয়স মাত্র বিশ। নাম পিকো। চিয়াপাস ইণ্ডিয়ান। আর কতটা দূরে?
আগে উঠতে হবে চূড়ায়, ইণ্ডিয়ান সুরে ইংরেজি বলল পিকো। ওপাশেই সেই মন্দির।
পরের দুমিনিটে মাউন্ট পুলিমাণ্ডোর চূড়ায় উঠল ওরা।
হাঁটুতে দুহাত রেখে কুঁজো হলেন প্রফেসর হ্যারিসন। এবার একটু বিশ্রাম না নিলেই নয়।
থমকে গিয়ে ব্যাগ থেকে বিনকিউলার নিয়ে চোখে তুলল মিতা। ওরা আছে প্রায়-সুপ্ত এক আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের কিনারায়। একহাজার ফুট নিচে পাহাড়ি লেক। সুনীল জলের মাঝে বর্শার ফলা আকৃতির দ্বীপ। মাঝের অংশ উঁচু, ঘন হয়ে জন্মেছে গাছপালা। মিতা পরিষ্কার বুঝল, ওই দ্বীপের জন্ম আগ্নেয়গিরির কল্যাণে। পাথুরে জমির ফাটল দিয়ে বেরোচ্ছে গন্ধকের ভারী, হলদে ধোঁয়া, প্রায় ঘিরে রেখেছে দ্বীপের চারপাশ।
ওই দ্বীপই তো? পিকোর দিকে তাকাল মিতা।
মাথা দোলাল ইণ্ডিয়ান তরুণ। আইলা কিউবিয়ার্তা।
লুক্কায়িত দ্বীপ বা গোপন দ্বীপ, মন্তব্য করলেন প্রফেসর হ্যারিসন।
মনোযোগ দিয়ে দ্বীপটাকে দেখছে মিতা।
বোধহয় ঠিক জায়গাতেই এনেছে পিকো। এখানে থাকার কথা ওই বিশেষ মায়ান সাইট। হাজারো বছর ধরে বলা হয়েছে: ওটা রহস্যময় এক আয়না। দ্বীপে ছিলেন মায়াদের আগুন-দেবতা তোহিল। কপালে অবসিডিয়ান আয়না। ওটাই বুঝিয়ে দিত, কত ক্ষমতাশালী দেবতা তিনি।
এবারের এই অভিযানে এসেছে ওরা ওই আয়না বা স্ফটিক খুঁজতে। ওকে বলা হয়েছে: আমেরিকান সরকারের শক্তিশালী সংগঠন এনআরআই থেকেই দেয়া হয়েছে সব খরচা। যা চাইছে তারা, ওটা পেলে উপকৃত হবে গোটা পৃথিবীর প্রতিটি দেশ।
তুমি ঠিক জানো তো, ওই দ্বীপই? আবারও জানতে চাইল মিতা।
সত্যিই মূর্তি আছে, জোর দিয়ে বলল পিকো। কয়েক বছর আগে আমাদের গ্রামের ওঝার সঙ্গে এসে দেখে গেছি। উনি বলেছিলেন, মায়া-দেবতার জন্যে একদম পাল্টে যাবে পৃথিবী।
ধোঁয়াটে দ্বীপ থেকে চোখ সরিয়ে জ্বালামুখের ভেতর দিকে তাকাল মিতা। বেশ খাড়াভাবে নেমেছে ঢালু জমি। আছে অসংখ্য ফস্কা ও পিচ্ছিল পাথর। সতর্ক না হলে সোজা গিয়ে পড়বে একহাজার ফুট নিচের নরকে। জ্বালামুখ বেয়ে নেমে যাওয়ার কাজটা পাহাড়ে ওঠার চেয়েও ঢের কঠিন।
বিনকিউলার ব্যাগে রেখে কুচকুচে কালো চুল পনি টেইল করল মিতা। ঘর্মাক্ত ঘাড়ে শীতল হাওয়া পেয়ে খুশি। প্রফেসর হ্যারিসনের দিকে তাকাল। বসে পড়েছেন তিনি। এখনও বারবার ফুলে উঠছে বুক। লিনেনের খোলা শার্টের নিচে ভিজে চুপচুপ করছে টি-শার্ট। দরদর করে গাল বেয়ে নামছে ঘাম। কালো মুখে সরু কয়েকটা লোনা ঝর্না। পঁয়ষট্টি বছর বয়সের তুলনায় যথেষ্ট শক্তপোক্ত ডক্টর হ্যারিসন।
গত তিন দিন ধরে তাড়া খেয়ে পাগলের দশা হয়েছে ওদের। পালাবার সময় সঙ্গে নিতে পেরেছে মাত্র তিনটে ব্যাকপ্যাক। তাতে সামান্য রসদ ও খাবার।
প্রফেসর, আপনি রেডি তো? জানতে চাইল মিতা। ভারছে, গতবারের মত মায়াবী চোখের ওই বাঙালী যুবক পাশে থাকলে আজ আর এত দুশ্চিন্তা করতে হতো না। কিন্তু মাসুদ রানার সঙ্গে যোগাযোগই করা গেল না।
মুখ তুলে মিতাকে দেখলেন প্রফেসর। মোটেও প্রস্তুত নন।
এবার সাবধানে নেমে গেলেই হবে, আশ্বস্ত করল মিতা।
ছোটবেলায় ভাবতাম বড় হলেই সব সমস্যা শেষ, এখন বুড়ো হয়ে মনে হচ্ছে, তাড়া খেয়ে পালাচ্ছি সারাজীবন ধরে! দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাত নাড়লেন হ্যারিসন। রওনা হও, ডক্টর মিতা, দেখি পিছু নিতে পারি কি না।
মাত্র চব্বিশ বছর বয়সেই নিউ ইয়র্কের নামকরা এক ইউনিভার্সিটি থেকে পদার্থ বিজ্ঞানে ডক্টরেট করেছে মিতা। গত বছর অদ্ভুত এক ইলেকট্রোম্যাগনেটিক পাথর খুঁজতে গিয়ে ডক্টর হ্যারিসনের সঙ্গে ছুঁড়ে বেরিয়েছে আমাযনের জঙ্গল। পেয়েছে মাত্র একটি স্ফটিক, ওটা এখন আছে এনআরআই হেডকোয়ার্টার-এ। ওটা থেকে বেরোচ্ছে বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ। এ ব্যাপারে গবেষণা করছে মিতা, ঘন ঘন যাতায়াত করছে এনআরআই ল্যাবে।
আর্কিওলজিকাল সাইটের শিলালিপি থেকে জেনেছেন ডক্টর হ্যারিসন, আরও আছে অমন পাথর বা স্ফটিক। এনআরআইকে তা জানাবার পর সমস্ত খরচ ও নিরাপত্তা দিতে চাইলেন এনআরআই চিফ।
কিন্তু মানা করে দিলেন তিনি। তার সোজা কথা: একদল মার্সেনারি বা গার্ড নিয়ে ঘুরলে সবার চোখ পড়বে তাঁর ওপর। তাই চান পরিচিত মানুষ, যে বা যারা নিরাপত্তাও দেবে, আবার এনার্জি বিচ্ছুরণের ব্যাপারেও সাহায্য করবে তাকে।
এ পর্যায়ে প্রফেসরের কথায় মিতার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন এনআরআই চিফ জেম্স্ ব্রায়ান। আলাপের শুরুতেই বললেন, খুব অনুরোধ করেছেন প্রফেসর হ্যারিসন, যাতে ওই স্ফটিকের ব্যাপারে সাহায্য করার জন্যে তুমি যাও তাঁর সঙ্গে। কিন্তু আমি চাই না মেক্সিকোতে পা রাখো। নিরাপত্তার জন্যে মাসুদ রানাকেও পাশে চান ডক্টর। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নিজ দেশের রাষ্ট্রীয় কোনও জরুরি কাজে ব্যস্ত ওই যুবক।
যখন-তখন ভয়ানক সব বিপদের সম্ভাবনা, তবুও ইলেকট্রোম্যাগনেটিক স্ফটিক পেতে মুখিয়ে ছিল মিতা। এনআরআই চিফকে জোর দিয়ে বলল, ও প্রফেসরের সঙ্গে যেতে আগ্রহী।
মাসুদ রানাকে পাশে না পেয়ে একটু হতাশ হলেও হ্যারিসন ভেবেছেন, ওই যুবকের কাছ থেকেই বিপদ এড়াবার কঠিন ট্রেনিং নিয়েছে মিতা। তারপর নামী-দামি কারাতে জুডো প্রশিক্ষণ কেন্দ্রেও ক্লাস করেছে কিছুদিন। কাজেই মন্দ করবে না মেয়েটা।
সত্যিই গত কয়েক দিনে নিজ যোগ্যতা প্রমাণ করেছে মিতা, নইলে অনেক আগেই খুন হতেন তাঁরা।
মরে গেলেও আপনাকে বিপদে ফেলে যাব না, বলেছে মিতা, তা ছাড়া, স্যর, আর্কিওলজির ব্যাপারে আপনি এক্সপার্ট, আমি তো নই। বড়জোর দেখব ফিযিক্সের কিছু বিষয়।
কিন্তু ওরা যদি আমাদেরকে ধরে ফেলে, তখন?
ওদের চাই ওই মূর্তি। ধাওয়া করে আমাদেরকে ধরতে যাবে না। হাত বাড়িয়ে দিল মিতা।
চোখে সন্দেহ নিয়ে ওকে দেখলেন প্রফেসর, তারপর পেলব হাতটা ধরে উঠে দাঁড়ালেন। কিনারা থেকে সাবধানে নামতে লাগল ওরা। বারবার পিছলে যেতে চাইছে পা। কোনও কোনও জায়গায় নামছে হালকা দৌড়ের ভঙ্গিতে। বেশিক্ষণ লাগল না একহাজার ফুট নেমে আসতে। ওপরে শুনল চিৎকার। চূড়ায় উঠে পড়েছে শত্রুপক্ষের কয়েকজন!
জলদি চলুন, প্রফেসর, শেষ তিরিশ ফুট প্রায় দৌড়ে নামল মিতা। শক্ত জমি পেয়ে ছুটে গিয়ে থামল লেকের পারে। পরক্ষণে ঝাঁপিয়ে পড়ল পাহাড়ি, শীতল লেক-এ।
ওরা দ্বীপে যাওয়ার অর্ধেক পথ পাড়ি দিয়েছে, এমনসময় চূড়ার কাছ থেকে গর্জে উঠল আগ্নেয়াস্ত্র। ওদের চারপাশের পানিতে গাঁথল বুলেট। পিছলে গেল কয়েকটা। প্রাণের ভয়ে ডুব দিয়ে এগোল ওরা। কিন্তু একটু পর ভেসে উঠতে হলো দম নেয়ার জন্যে।
কটুগন্ধী গন্ধকের ধোঁয়ার মাঝে সবার আগে উঠেছে দক্ষ সাতারু মিতা। নাক কুঁচকে ফেলল। কয়েক সেকেণ্ড পর ওর পাশে পৌঁছুল পিকো ও কৃষ্ণকায় প্রফেসর।
এদিকে থেমে গেছে গুলি। শোনা গেল আরেকটা আওয়াজ। অন্য দুজন বোধহয় শুনতে পায়নি, কিন্তু বিপদ বুঝে গলা শুকিয়ে গেল মিতার।
তীব্রগতি পাখার চাপা ধুব-ধুব আওয়াজ!
পুবের পাহাড়ের ওপর দিয়ে আসছে হেলিকপ্টার!
শত্রুদের পুঁজির ভেতর ছিল নতুন ওই কৌশল!
ওই মূর্তিটা কোথায়! জানতে চাইল মিতা।
আঙুল তুলে দ্বীপের পাহাড়ি অংশ দেখাল পিকো। চূড়ার ওদিকে। গাছপালার ভেতর। এদিক থেকে দেখা যায় না।
কয়েক সেকেণ্ড পর তীরে পৌঁছুল ওরা। ছোটবড় গাছের ডাল ও ঝোপঝাড় ধরে উঠছে পাহাড়ি জমিতে। চূড়ায় উঠে দেখল বৃত্তাকার, সমতল এক অংশের মাঝে সত্যিই রয়েছে ওই মূর্তি। তবে মূর্তি বলা যায় কি না, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। ওটা বিশাল এক চৌকো আকৃতির কালো পাথর। একদিকে খোদাই করা মায়ান কোনও রাজা। মাথায় বিচিত্র মুকুট। বুক-কোমরে নক্সা করা পোশাক। ডানহাতে জালের মত কিছু। ওখানে গোল চারটে পাথর। বামহাতে বিশাল ফুটবলের মত কী যেন। সেখানে লেখা হায়ারোগ্লিস্। নিচে মুচড়ে আছে বিশাল এক সাপ। এক গ্রাসে রাজাকে গপ করে খেয়ে নেবে বলে মস্ত হাঁ মেলেছে।
শিলালিপির শিরোনামের থ্রি পড়লেন প্রফেসর হ্যারিসন: আহাউ বালাম মায়া জাগুয়ার রাজা। তিনিই ছিলেন ভ্রাতৃসঙ্রে আত্মার পথনির্দেশক।
পিকোর পূর্বপুরুষ মায়াজাতির মানুষ, ভয় ও শ্রদ্ধা নিয়ে প্রাচীন রাজার মূর্তি দেখছে সে। একেবারে বিমোহিত হয়ে গেছেন পাড় আর্কিওলজিস্ট প্রফেসর হ্যারিসন। তবে এসব কিছুই স্পর্শ করল না মিতার মন। কীভাবে সামনের সমূহ বিপদ উৎরে উঠবে, তা নিয়ে চিন্তিত। আওয়াজ শুনে বুঝে গেছে, বড়জোর তিন মিনিট, তারপর হাজির হবে ওই হেলিকপ্টার। এদিকে জ্বালামুখ বেয়ে নামতেও বেশিক্ষণ লাগবে না শত্রুপক্ষের অন্যদের।
যা খুঁজছিলেন, সে-তথ্য পেলেন, প্রফেসর? জানতে চাইল মিতা।
পাথরে খোদাই করা লেখা মন দিয়ে পড়ছেন হ্যারিসন। স্পর্শ করে দেখলেন একটা গ্লিফ। তারপর দ্বিতীয়টা। মনে হলো পড়েছেন দ্বিধার মাঝে।
প্রফেসর?
ঠিক বুঝছি না, মাথা নাড়লেন হ্যারিসন।
কাছে পৌঁছে গেছে হেলিকপ্টার। ইঞ্জিনের গর্জন বাড়ল। একটু পর কানফাটা শব্দে হাজির হবে মাথার ওপরের আকাশে।
বড়জোর দুমিনিট পাবেন, প্রফেসর, বলল মিতা, আগেও পৌঁছে যেতে পারে।
অবিশ্বাস নিয়ে মাথা নাড়লেন হ্যারিসন। এখানে তো কোনও গল্পই নেই! কোনও ব্যাখ্যাও দেয়নি। হাজারখানেক সংখ্যা দিয়ে কী বুঝব?
কোনও তারিখ-টারিখ?
না, খালি অজস্র সংখ্যা!
প্রফেসরের কথা শুনে অবাক হয়েছে মিতা। মোটেও এমনটা হওয়ার কথা নয়!
আসলে হয়েছে কী, এখন যদি… শুরু করছিলেন প্রফেসর।
কিন্তু তাঁকে থামিয়ে দিল মিতা: এখন গবেষণার সময় নয়, স্যর। ব্যাগ থেকে ক্যামেরা নিয়ে স্ক্রিনের দৃশ্য দেখল ও। ছবি তুলল কয়েকটা। হাজার হাজার বছরের প্রাকৃতিক অত্যাচারে ক্ষয়ে যাওয়া পাথর। ঝাপসা হয়ে প্রায় মুছে গেছে বহু অক্ষর। আরেক অ্যাঙ্গেল থেকে ছবি নিল মিতা। বিশেষ সুবিধা হলো না। পাওয়া গেল না ছবির যথেষ্ট ডেফিনেশন।
কাছে পৌঁছে গেছে হেলিকপ্টার। তবে ওটার ইঞ্জিনের বিকট আওয়াজের ওপর দিয়েও শোনা গেল হৈ-চৈ। জ্বালামুখ বেয়ে নেমে আসছে তারা।
অস্পষ্ট সব ছবি, মন্তব্য করল মিতা।
ড্যাবড্যাব করে কসেকেণ্ড ওকে দেখলেন প্রফেসর, তারপর চট করে খুলে ফেললেন লিনেনের শার্ট। মূর্তির সামনে বসে মায়ান হায়ারোগ্লিসের ওপর ডানহাতে রাখলেন ভেজা শার্ট। বামহাতে পাথুরে মেঝে থেকে নিলেন মুঠোভরা আগ্নেয়, ঝুরঝুরে মাটি। শার্টের পিঠে চেপে ধরছেন।
তার কাজে সাহায্য করল পিকো।
বিকট আওয়াজে মাথার ওপর দিয়ে গেল হেলিকপ্টার। একটু দূরে থেমে ঘুরে গিয়ে খুঁজতে লাগল নামার জায়গা।
ওদিকে চেয়ে স্রষ্টাকে ধন্যবাদ দিল মিতা।
ছোট্ট এই দ্বীপে অবতরণের সুযোগ নেই।
সাহায্য করতে প্রফেসরের পাশে বসল মিতা। ভেজা শার্টের পিঠে ফুটিয়ে তুলছে চারকোল ড্রয়িঙের মতই ঝাপসা মায়ান অক্ষরের ছাপ। আপাতত এরচেয়ে বেশি কিছু করার নেই।
নিজেদের কাজে ব্যস্ত ওরা। কিন্তু মাথার ওপর ধীরে ধীরে ঘুরছে যান্ত্রিক ঘাসফড়িং। বিশালাকার ঘুরন্ত পাখার হাওয়ায় তৈরি হয়েছে তুমুল ঝড় নানা দিকে উড়ছে শুকনো পাতা, ভাঙা ডালপালা, পাইনের কাটা, শুকনো ফল, তুষ, বালি ও মাটি।
ব্যস, হাতে আর সময় নেই, গলা ফাটিয়ে জানাল মিতা।
শিলালিপি থেকে শার্ট গুটিয়ে নিয়ে ব্যাকপ্যাকে রাখলেন প্রফেসর। এদিকে দশইঞ্চি হঁটের সমান এক পাথর নিয়েছে মিতা, বারবার ওটা নামল মূর্তির গোলকের অক্ষরের ওপর। ছুরি-কাঁচি ধার করার মেশিনের মত কাজ করছে চোখা পাথর। কমলা ফুলকি তুলে ছিটকে পড়ছে অমূল্য আর্টিফ্যাক্টের টুকরো!
কিন্তু হঠাৎ করেই ডালপালার মাঝ দিয়ে সাপের মত কিলবিল করে নামল ভারী ওজন নেয়া কয়েকটি দড়ি।
এবার পালাতে হবে! চেঁচিয়ে উঠল মিতা।
উঠে দাঁড়িয়ে ঝেড়ে দৌড় দিল পিকো ও হ্যারিসন।
কপ্টারের দড়ি থেকে ঝুলছে নীল পোশাক পরা কয়েকজন, হাতে আগ্নেয়াস্ত্র। সরসর করে নেমে আসছে, গাছের মাঝ দিয়ে।
ঘুরেই ব্যাগ থেকে নাইন এমএম গ্লক পিস্তল নিল মিতা। কিন্তু গুলি শুরু করার আগেই ওর শার্ট ভেদ করে ত্বকে গাঁথল ধাতব দুটো দাঁড়া। ব্যথা এতই তীব্র, ভীষণ চমকে হুমড়ি খেয়ে মাটিতে পড়ল মিতা। তাতেই থামল না যন্ত্রণা। দমকা হাওয়ায় পড়া বাঁশ পাতার মত ওকে থরথর করে কাঁপিয়ে দিল টেইযারের হাইভোল্ট বিদ্যুৎ।
কাত হয়ে পড়ে আছে মিতা। ঝাপসা চোখে দেখল, চূড়ার ওপাশ দিয়ে দুদ্দাড় করে নেমে যাচ্ছে পিকো, পেছনে প্রৌঢ় হ্যারিসন। প্রফেসরকে গেঁথে নিতে পেছনে যাচ্ছে। টেইরের দাঁড়া। দৌড়ের ওপরেই বেসবলের পাকা খেলোয়াড়ের মত ডজ মেরে সরে গেলেন তিনি। কিন্তু তাতে রক্ষা নেই, ওপর থেকে এল সাবমেশিন গানের গুলি। হঠাৎ হোঁচট খেয়ে সামনে বাড়লেন প্রফেসর। ছিটকে উঠেছে রক্ত। প্রায় খাড়া ঢাল বেয়ে গড়িয়ে অনেকটা নিচে গিয়ে পড়লেন তিনি।
আবারও বৈদ্যুতিক শক খেল মিতা। প্রচণ্ড ব্যথায় আরও ঝাপসা হলো দৃষ্টি। তারই মাঝে টের পেল, ওকে ঘিরে ফেলেছে কজন সশস্ত্র লোক। হাতদুটো পিছনে নিয়ে আটকে দেয়া হলো হ্যাণ্ডকাফে। হেলিকপ্টারের পাখার হাওয়ায় চারপাশে শুরু হয়েছে প্রচণ্ড ঝঞ্ঝা। সেই সঙ্গে বিকট আওয়াজ।
আকাশের দিকে তাকাল অসহায় মিতা। ঘন জঙ্গলের ওপরে ভাসছে কালচে দানবীয় উড়োজাহাজ- সিকোরস্কি স্কাইক্রেন। দেখতে অনেকটা বাঘের থাবার মত। পেটের ভেতর রাখতে পারে অত্যন্ত ভারী মালপত্র। কেবল দিয়ে বেঁধে নিলে ছোট ট্যাঙ্ক বহন করাও কঠিন নয় ওটার জন্য। মায়ান রাজার মূর্তি নিয়ে যেতেই আনা হয়েছে ওটাকে!
প্রকাণ্ড কপ্টার থেকে মোটা চেইন ফেলতেই, মাত্র কয়েক সেকেণ্ডে বেঁধে নেয়া হলো ওজনদার মায়ান পাথর। টানটান হলো শেকল। হ্যাঁচকা টান খেয়ে আকাশে উঠল রাজার মূর্তি।
মিতার পাশে এক লোক কোমর থেকে রেডিয়ো নিয়ে বলল, একটাকে ধরেছি! চূড়ার কিনারার দিকে তাকাল সে। পিকো ও হ্যারিসন ওদিকে কোথাও নেই। পালিয়ে গেছে ওই স্থানীয় ছোকরা। কিন্তু বুড়ো হাবড়াটা মরে ভূত!
মন খারাপ হয়ে গেল মিতার। এত চেষ্টা করেও বাঁচাতে পারল না মানুষটাকে!
ধোঁয়া থেকে মেয়েটাকে বের করো, বলল আরেক লোক। ওরা হেলিকপ্টার থেকে বাস্কেট নামাবে।
টান দিয়ে দাঁড় করানো হলো মিতাকে, পরক্ষণে দুজন লোক টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চলল ওকে।
চূড়ার যেদিক থেকে পড়েছেন প্রফেসর হ্যারিসন, সেদিকে চোখ গেল মিতার। তিরিশ ফুট নিচে মোটা এক গাছের কাণ্ডে লেগে কাত হয়ে থেমেছেন প্রফেসর। অত্যন্ত বেকায়দা ভঙ্গি। লাশের ডান চোখ খোলা, নেই প্রাণের একবিন্দু ছোঁয়া। টকটকে লাল রক্তে ভিজে গেছে টি-শার্ট।
মিতার মন চাইল, হাঁটু ভেঙে বসে বুক চাপড়ে কাঁদবে।
সত্যি, খুব অনুচিত হয়েছে নিরীহ মানুষটাকে এ দেশে আনা। অন্তত বাধা তো দিতে পারত! প্রফেসর খুব ভরসা করেছিলেন ওর ওপর। তার ধারণা ছিল, মাসুদ রানার কাছ থেকে সবই শিখে নিয়েছে ও। এখন নিজেই বুঝতে পারছে, বাস্তবে শিখতে পারেনি কিছুই!
পেছন থেকে ঠেলা দিতেই আবারও সামনে বাড়ল মিতা।
পাঁচ মিনিট পর ওকে তুলে নেয়া হলো প্রকাণ্ড হেলিকপ্টারে।
হতাশ চোখে মিতা দেখল, একটু দূরেই বে-তে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে মায়ান রাজার মূর্তি। একবার দুলে উঠে রওনা হলো সিকোরস্কি স্কাইক্রেন। বুকে হাহাকার জাগল ওর। পেছনে পড়ে রইল ধূম্রাচ্ছন্ন দ্বীপে তরুণ পিকো আর মৃত প্রফেসর জর্জ হ্যারিসন!
.
কালো আগ্নেয় মাটিতে নিথর পড়ে আছেন প্রফেসর হ্যারিসন। নিষ্পলক একটি চোখ দেখছে ঢালু জমিন। প্রায় খাড়া জমিতে গড়াতে শুরু করেই নিচের এই জঙ্গলের গাছে লেগে থেমেছেন। তাতে পিঠে লেগেছে বেদম ব্যথা। হাত থেকে ছিটকে গিয়েছিল ব্যাকপ্যাক। ওটা হারিয়ে গেছে আরও নিচে কুয়াশার মত ধোঁয়ার ভেতর। সেই তখন থেকে অপলক দেখছেন ঢালু জমি। নড়বেন, সে সাধ্য নেই। সবই দেখেছেন, তার সাধের মূর্তি ও স্নেহের পাত্রী মিতাকে হেলিকপ্টারে তুলে নিয়ে গেছে কারা যেন!
প্রফেসর বুঝতে পারছেন, অবশ হয়ে গেছে দেহের নিচের অংশ। শীত লাগছে বড়। তবে আপাতত প্রাণ আছে, শ্বাসও নিতে পারছেন, তাতেই তিনি খুশি।
গলা দিয়ে চিচি করেও আওয়াজ বেরোচ্ছে না, দূরে থাক সাহায্যের আশায় চিৎকার। বড় একা লাগছে। তাঁকে চেপে ধরছে নিদারুণ ভয়। সত্যি শরীর অবশ হলে, সরে যেতে পারবেন না! সেক্ষেত্রে জ্বালামুখের এদিকটায় এসে তাকে পাওয়ামাত্র হাসতে হাসতে খুন করবে লোকগুলো!
নিজ চোখে দেখেছেন গুলি লেগেছে পায়ে। কত রক্ত যে বেরোল! এখন অবশ্য প্রায় শুকিয়ে এসেছে ওই স্রোত। কোমর থেকে নিচের অংশে কোনও অনুভূতি নেই। পাদুটো আছে ওপরের জমিতে, তাই উরু বেয়ে পেট ও শার্ট ভিজিয়ে দিয়েছে রক্ত।
বারবার পা নাড়াতে চাইছেন প্রফেসর, কিন্তু বিন্দুমাত্র সাড়া নেই। নিজের অসহায়ত্ব বুঝে রাগ ও দুঃখে কেমন পাগল পাগল লাগছে তার।
চুপ করে পড়ে রইলেন। একটু পর ভাবলেন, মিতা ও তার ভেতর কে আসলে বড় বিপদে আছে। আরও কিছুক্ষণ পর মন বলল, তার তো মরে যাওয়ার কথা, তা হলে স্বাভাবিক হয়ে উঠছে কেন শ্বাস! শুধু তাই নয়, চাপা একটা ব্যথাও শুরু হয়েছে দুপা জুড়ে! ঠিক ব্যথাও নয়, ঝিনঝিনে অনুভূতি। যেন হালকাভাবে খুঁচিয়ে দেয়া হচ্ছে পিন বা কাঁটা দিয়ে। কিন্তু কেউ নেই যে তাকে বকবেন!
বাড়ছে অস্বস্তিকর ব্যথা। কষ্ট ও বিরক্তি বাড়তেই মন বলল, ওরে, নড়েচড়ে দে তো, উঠে দাঁড়াতে পারিস কি না!
নাড়তে গিয়ে বুঝলেন, সামান্য অনুভূতি ফিরেছে দুহাতের বুড়ো আঙুলে। শরীর মুচড়ে কাত হলেন বামদিকে।
সামান্য বিশ্রাম নিয়ে নতুন উদ্যমে নামলেন কাজে। একটু পর মুক্ত হলেন ঝোপ ও ডালপালার জটলা থেকে। প্যারালাইয হয়ে যে যাননি, তা ভেবে খুশি। একটু কষ্টও পেলেন মনে। বেড়ে গেছে গুলির ক্ষতের ব্যথা। আড়ষ্ট লাগছে শরীর। তার ওপর দুর্বলতার শেষ নেই! তবুও হামাগুড়ি দিয়ে কয়েক ফুট গিয়ে ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়লেন। গালে লাগছে ধুলোভরা ঢালু মাটি।
একটু বিশ্রাম নিয়ে মাথা তুলে আবছাভাবে দেখলেন চূড়ার দিকে কে যেন!
সে পুরুষমানুষ নয়, রুপালি পোশাকের ভদ্রমহিলা!
চোখ পিটপিট করলেন হ্যারিসন। তখনই হাওয়ায় মিলিয়ে গেল ছায়ামূর্তি।
আহত ও জ্বরাক্রান্ত হ্যারিসন ভাবলেন: কে ওই মহিলা? একটু আগেও ছিল ওদিকে!
জেদ ধরে দুহাতের ভর দিয়ে উঠে বসলেন হ্যারিসন। হামাগুড়ি দিয়ে উঠতে লাগলেন ঢালু জমিতে। টলমল করে উঠে দাঁড়িয়ে কয়েক পা হেঁটে হাল ছেড়ে দিলেন। এই শরীরে খাড়া জমি বেয়ে ওঠা সাধ্যের বাইরে। হেঁচড়ে এগোলেন। হাতের তালুর নিচে কুড়মুড় শব্দে গুড়ো হচ্ছে আগ্নেয়মাটি। হঠাৎ হড়কে গিয়ে ফিরলেন আগের জায়গায়। তারপর সেখানেও রয়ে যেতে পারলেন না, পিছলে পৌঁছে গেলেন কুয়াশার মত ধোঁয়ার ভেতর। থামল না তাঁর পতন, শেষে স্থির হলেন লেকের কিনারায় নরম মাটিতে। পাশেই পেলেন আধঘণ্টা আগে খুইয়ে বসা ব্যাকপ্যাক।
লোভীর মত ওটা দেখলেন প্রফেসর হ্যারিসন। কাছে টেনে খুলতে চাইলেন যিপার। মনে হলো কাজটা খুবই কঠিন। আঙুল দিয়ে ছিঁড়তে চাইলেন যিপার। সফল হওয়ার আগেই শুনলেন লেকের পানিতে ছপছপ শব্দ। ঘুরে তাকালেন তিনি।
অগভীর পানি ভেঙে তীরে উঠে আসছে পিকো। করুণ কণ্ঠে বলল তরুণ, হেলিকপ্টারে করে তুলে নিয়ে গেছে মূর্তি, নিজের চোখে দেখেছি!
জানি, মাথা দোলালেন প্রফেসর। কিছুই করার ছিল না। রক্তাক্ত পা দেখালেন, আমাকে সরাতে চাইলে লোক ডাকতে হবে।
লোক পাব কই? বলল পিকো। আমরা গ্রাম থেকে অনেক দূরে।
ওর সাহায্য নিয়ে ক্ষতটা ড্রেস করলেন হ্যারিসন। কাজটা শেষ হওয়ায় ওঅটারপ্রুফ কন্টেইনার থেকে স্যাটেলাইট ফোন বের করল পিকো। যন্ত্রটা ঠিক আছে কি না, তা নিয়ে দুশ্চিন্তা ছিল, কিন্তু চালু হতে দেখা গেল জ্বলে উঠেছে সবুজ স্ক্রিন। ঠিকই ধরছে সিগনাল।
হাতে মোবাইল ফোন দেয়ায় ইনিশিয়েট বাটন টিপলেন প্রফেসর। কয়েক সেকেণ্ড পর লিঙ্কআপ হলো স্যাটেলাইটের সঙ্গে। ওয়াশিংটন ডি.সি.-র সিকিয়োর এক কমিউনিকেশন রুম থেকে কর্কশ কণ্ঠে কথা বলে উঠল এক লোক।
কিন্তু তাকে দিয়ে চলবে না প্রফেসর হ্যারিসনের। তিনি চান কর্তৃপক্ষের উঁচু পর্যায়ের কাউকে। তাই বললেন, প্রফেসর জর্জ হ্যারিসন বলছি। আমি প্রজেক্ট মিররের সঙ্গে জড়িত। আমার কোড: সেভেন সেভেন সেভেন ওয়ান সিক্স। হামলা হয়েছিল আমাদের ওপর। সর্বনাশ হয়েছে মিশনের। তাই এনআরআই চিফ জেমস ব্রায়ানের সঙ্গে আলাপ করতে চাই।
.
০৩.
প্রফেসর জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে এনআরআই চিফ জেমস ব্রায়ানের আলাপের পর পেরিয়ে গেছে পুরো চব্বিশটি ঘণ্টা। এ মুহূর্তে হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে প্রেসিডেন্টের সামনে বসে আছেন ব্রায়ান। একবার হাত বুলিয়ে ঠিক করতে চাইলেন অবাধ্য ধূসর চুল। প্রেসিডেন্ট তার পুরনো বন্ধু হলেও অস্বস্তির ভেতর রয়েছেন তিনি।
বিশাল ডেস্কের ওদিকে রাজকীয় চেয়ারে বসে অবহেলার সঙ্গে কিছু ডকুমেন্টে সই করছেন প্রেসিডেন্ট। কাজটা শেষ করে নিখুঁতভাবে গুছিয়ে নিলেন কাগজ, তারপর রেখে দিলেন পাশে। নিজে তিনি বয়সে বড় হলেও জুনিয়র বন্ধু এনআরআই চিফকে যথেষ্ট শ্রদ্ধার চোখে দেখেন। সরাসরি জানতে চাইলেন, নিশ্চয়ই কোনও দুঃসংবাদ? আজকাল তোমার অফিস থেকে ফোন এলে ভয় লাগে! তো বলে ফেলো কী হয়েছে!
ভাঁজ করা কাগজটা প্রেসিডেন্টের দিকে ঠেলে দিলেন ব্রায়ান। আমি অবসর নিতে চাইছি।
পদত্যাগের চিঠিটা দেখলেন প্রেসিডেন্ট, হাতে নিলেন না। তুমি তো গলফ খেলো না। সিনেমাও দেখো না। কোনও নেশা নেই। শখ বলতেও লবডঙ্কা। রিটায়ারমেন্টের পর কী করবে?
চুপ করে বসে থাকব বাড়িতে।
তোমার মত যোগ্য এবং দক্ষ কাউকে এনআরআই চিফ হিসেবে পাওয়া খুব কঠিন হবে আমেরিকান সরকারের জন্যে। খুলে বলো তো কী হয়েছে, জেমস?
মৃদু হাসি প্রেসিডেন্টের ঠোঁটে। ওটা দিয়েই মাত করেছিলেন কোটি ভোটারকে। ওই হাসি যেন বলে: সমস্যা? ভেবো না, সব কিছুরই সমাধান থাকে!
মস্ত ঝামেলায় পড়েছি। তা-ও একটা নয়, দুটো। এসব সলভ করা আমার পক্ষে অসম্ভব। তাই ভাবছি অপমানিত হয়ে বিদায় নেয়ার আগে পদত্যাগ করাই ভাল।
ডেস্ক থেকে রেযিগনেশন লেটারটা তুলে ফড়াৎ করে ছিঁড়ে ফেললেন প্রেসিডেন্ট, কাগজের টুকরো ট্র্যাশ-ক্যানে ফেলে বললেন, আমার সাধ্যমত করব, জেমস। তোমাকে পাশে চাই। খুলে বলো কী ধরনের সমস্যা। একটু ঝুঁকে বসলেন। আলাপ করলে হয়তো বেরিয়ে আসবে সহজ কোনও পথ।
এক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন ব্রায়ান, তারপর কোলে ব্রিফকেস তুলে ওটা থেকে নিলেন দুটো কাগজ। রাখলেন প্রেসিডেনশিয়াল ডেস্কের ওপর।
প্রথম কাগজটা তুলে নিয়ে দেখলেন প্রেসিডেন্ট।
ওটা স্যাটেলাইট ছবি।
প্রশান্ত মহাসাগর চিরে আলাস্কার দিকে চলেছে রাশান নেভির একটি ফ্লিট।
দ্বিতীয় কাগজে ছোট কয়েকটি ছবি, সঙ্গে কিছু তথ্য।
রওনা হয়েছে চাইনিজ নেভির একটি নৌবহর। তাদের সঙ্গে জুটে গেছে কয়েকটা বাণিজ্য তরীও।
আগেও দেখেছি এসব, বললেন প্রেসিডেন্ট, সকালে কথাও হয়েছে রন ল্যাডলওর সঙ্গে। ল্যাডলও নেভির চিফ অভ স্টাফ। এতে দুশ্চিন্তার কিছু দেখছি না। কয়েকটা ক্রুযার, আধডজন ডেস্ট্রয়ার, কয়েকটা রেকোন্যাসেন্স এয়ারক্রাফট। কিন্তু এসব দিয়ে আর যাই হোক, আলাস্কা দখল করতে পারবে না ওরা। ওই একই কথা খাটে চাইনিজদের ব্যাপারেও।
তা জানি, মাথা দোলালেন ব্রায়ান। ওরা হামলাকারী দল নয়। তবে মনোযোগ দিলে বুঝবেন, বেছে নিয়েছে সেরা দ্রুতগামী জাহাজ। ছড়িয়ে পড়ে এগোচ্ছে। এই যে… বেয়ারিং সি-র ইন্টারন্যাশনাল ডেট লাইনের কাছে ম্যাপের নির্দিষ্ট জায়গায় আঙুল রাখলেন এনআরআই চিফ।
ল্যাডলও বলেছে, ওরা সার্চ পার্টি, বললেন প্রেসিডেন্ট।
আমিও একমত, সায় দিলেন ব্রায়ান, কিন্তু সার্চ করার মত কী আছে ওদিকে? এত ব্যস্ত কেন তারা? এর কোনও কারণ বের করতে পেরেছে আমাদের নেভি?
আরেকবার স্যাটেলাইট ছবি দেখলেন প্রেসিডেন্ট। চুপ করে আছেন।
নতুন তথ্য পাওয়ার জন্যে বললেন এনআরআই চিফ, মিস্টার প্রেসিডেন্ট, আমি খোঁজ নিয়েছি। বেয়ারিং সি-র ওদিকে আকাশ থেকে কিছুই পড়েনি। সব চ্যানেল মনিটর করেও পাওয়া যায়নি, কোনও ডিসট্রেস কল। স্যাটেলাইট ছবিতেও নেই অয়েল স্লিক বা কোনও ডেব্রি। ইনফ্রারেড স্ক্যান থেকেও জানা গেছে, কোনও বিস্ফোরণ হয়নি যে হিট স্পাইক হবে। আসলে এমন কিছুই নেই, যা থেকে ধরে নেব, আকাশ থেকে পড়েছে এয়ারক্রাফট, বা তলিয়ে গেছে কোনও ভেসেল। অথচ, প্রায় একইসময়ে সার্চের জন্যে রওনা হয়েছে দুদেশের নেভি ও কয়েকটি বাণিজ্য জাহাজ। সেক্ষেত্রে কেন অন্যদেরকে দৌড়ে হারিয়ে ওখানে পৌঁছুতে চাইছে?
মৃদু হাসলেন প্রেসিডেন্ট, বলো তো, আসলে কী জানতে চাও, জেমস?
ওদিকের সাগরে কী আমাদের সাবমেরিন আছে? সোনার থেকে কিছু জানা গেছে, যেটা থেকে বুঝব, একইসময়ে ওদিকে ছিল রাশান বা চাইনিজ সাবমেরিন?
দুঃখজনক, তবে ওদিকে আমাদের নৌযান ছিল না, বললেন প্রেসিডেন্ট। তীক্ষ্ণ চোখে দেখলেন জুনিয়র বন্ধুকে। ওখানে ওরা কী খুঁজবে বলে ভাবছ?
আমরা এখনও আছি অন্ধকারে, বললেন ব্রায়ান।
কিন্তু কিছু আঁচ করছ। নইলে আমার অফিসে আসতে।
আমেরিকান ইন্টেলিজেন্স সংস্থাগুলোর চিফরা কোনও বিষয়ে জানতে চাইলে তোলপাড় করেন গোটা দুনিয়া। এরপরও দরকারী তথ্য না পেলে চুপ থাকেন। কিন্তু ওই বিষয়ে হঠাৎ প্রেসিডেন্ট বা তাঁর স্টাফদের কাছ থেকে তলব এলে, তখন সত্যিকারের বিপদে পড়েন তাঁরা।
বাধ্য হয়েই মুখ খুললেন ব্রায়ান, রওনা হয়েছে রাশান ফ্লিট, কিন্তু তার কয়েক ঘন্টা আগে বেয়ারিং সি-র এক জায়গা থেকে এসেছে গামা রে। বড় বিস্ফোরণ নয়। কিন্তু ওই ধরনের এনার্জি ওখানে খুবই অস্বাভাবিক।
গামা রে? নড়েচড়ে বসলেন প্রেসিডেন্ট। তুমি তো জানো, ভাল লাগত না সায়েন্স। তাই পড়েছি আইন। একটু খুলে বলল কী হয়েছে।
গামা রে আসলে হাই-এনার্জি ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ, বললেন ব্রায়ান, হাইপার-পাওয়ারফুল এক্স-রে বা নিউক্লিয়ার সার্জারির মত কাজে ব্যবহার করা হয়। অস্ত্র হিসেবেও ব্যবহার করতে গবেষণা চলছে। ভবিষ্যতে হয়তো আকাশ থেকে ফেলে দেয়া যাবে মিসাইল। অথরা, খতম হবে হাজার হাজার সৈনিক।
ভুরু কুঁচকে ফেললেন প্রেসিডেন্ট। তা হলে এ কথা আমাকে বলেনি কেন ল্যাডলও?
উনি বোধহয় জানেন না, বললেন এনআরআই চিফ। তার স্যাটেলাইটগুলো এ ধরনের জিনিস স্ক্যান করে না। আপনাকে এখন যে তথ্য দিচ্ছি, তা এসেছে গতবছর লঞ্চ করা এনআরআই স্যাটেলাইট থেকে।
চুপ করে অপেক্ষা করছেন প্রেসিডেন্ট।
আবারও মুখ খুললেন ব্রায়ান, একইসময়ে মহাশূন্যে আর্কটিক সার্কেলের ওপরে ছিল আমাদের চারটে জিপিএস স্যাটেলাইট, সবই জিয়োসিনক্রোনাস অরবিটে ঘুরছে সুমেরু সার্কেলে। গামা রে বিচ্ছুরণ হওয়ায় কয়েক সেকেণ্ডের জন্য অন্ধকার হয়ে যায় প্রতিটি। তারপর চালু হয় নতুন করে। তবে ওরা প্রত্যেকেই রেকর্ড করেছে ওই বিচ্ছুরণ।
প্রেসিডেন্টের হাতে আরেকটা প্রিন্টআউট দিলেন ব্রায়ান। আপনি জানেন, এসব জিপিএস স্যাটেলাইটে রয়েছে অ্যাটমিক ক্লক, প্রতি সেকেণ্ডের লক্ষভাগ সময় হিসাব কষতে পারে ওগুলো। সঠিকভাবে বুঝতে পারে টার্গেটের দূরত্ব। কিন্তু লগ অনুযায়ী এক সেকেণ্ডে এক বিলিয়নভাগের একভাগ সময়ে বন্ধ হয়েছিল চারটে জিপিএস স্যাটেলাইট। গ্রাউণ্ড বেড় কোনও সিস্টেম নেই যেটা চার জায়গা থেকে অত নিখুঁতভাবে নির্ধারণ করবে সময়।
এসব থেকে কী বুঝব?
ওই চার স্যাটেলাইট বন্ধ হয় বিশেষ কোনও দুর্যোগের কারণে।
কাগজটা কয়েক সেকেণ্ড দেখে নিয়ে এনআরআই চিফের দিকে তাকালেন প্রেসিডেন্ট। তো তুমি বলতে চাও, ওটা কোনও অস্ত্র, যেটা ছিল কোনও সাবমেরিনের ভেতর? ত্রুটির কারণে ওভারলোড় হওয়ায় ধ্বংস হয়েছে ওটার প্ল্যাটফর্ম। তাই ওটার ধ্বংসস্তূপ উদ্ধার করতে রওনা হয়েছে চিনা ও রাশান সার্চ পার্টি? দুদলেরই চাই ওই জিনিস। আর আমরা এ ব্যাপারে পিছিয়ে পড়েছি?
হতে পারে, বললেন ব্রায়ান, তবে আমরা অন্য একটা সম্ভাবনা নিয়ে ভাবছি। আমাদের মতই প্রায় একইসময় থেকে এনার্জি ওয়েপন্সের ওপর গবেষণা করছে রাশা ও চিন। হয়তো অস্ত্র পরীক্ষা করেছে সাগরের ওদিকে।
কাগজগুলো এনআরআই চিফের দিকে ঠেললেন প্রেসিডেন্ট। বুঝলাম। তো এ ব্যাপারে কাজে নামলে কী ধরনের সহায়তা বা ইকুইপমেন্ট লাগবে তোমার?
প্রথমত, চাই যথেষ্ট সময় ও এনএসএর ভল্টের ডেটা। তাতেই হবে না, কাজে লাগাতে হবে প্রশান্ত মহাসাগরে আমাদের প্রতিটি সোনার। চাইব না এনএসএ, সিআইএ বা অন্য কোনও সংস্থা আমাদের সংগৃহীত ডেটা জেনে নাক গলাবে, বা প্রশ্ন তুলবে। তাই ওই বিষয়ে দিতে হবে পুরো ব্লকেড।
এনআরআই চিফের কথা শুনে মনে মনে হোঁচট খেয়েছেন প্রেসিডেন্ট। লালচে হয়ে গেল চেহারা। জেম্স, পাগল হলে? কেন ভাবছ, ওরা এ ধরনের আবদার মানবে?
টুঁ শব্দ করলেন না ব্রায়ান। অন্য ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির থেকে নানা দিক দিয়েই আলাদা এনআরআই, তা ভাল করেই জানেন প্রেসিডেন্ট। এ কারণেই সবসময় এ সংস্থার চিফের পাশে থেকেছেন তিনি। এবারও তার ব্যত্যয় হবে না ভাবছেন ব্রায়ান।
প্রায় সব সুযোগ সুবিধা পাবে, কিন্তু সোনার লাইন দেয়া অসম্ভব, বললেন প্রেসিডেন্ট। খুবই কাছে পৌঁছে গেছে রাশান ফ্লিট, এই অবস্থায় ল্যাডলওকে সোনার ব্লক করলে, স্রেফ উন্মাদ হবে সে। তবে অন্য ব্যবস্থা হতে পারে। তোমার কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত সোনারের সব তথ্য নিয়মিত দেবে নেভি। তোমাকে পুরো আটচল্লিশ ঘণ্টা সময় দিলাম। পরে জরুরি প্রয়োজন পড়লে কমিয়েও দিতে পারি সময়টা বা বাতিলও করতে পারি আদেশ।
মৃদু মাথা দোলালেন ব্রায়ান। ভাবছেন, যাক, আদায় করা গেছে অনুমতি!
এবার আসি আমার দ্বিতীয় সমস্যার বিষয়ে, ব্রিফকেসে নোটগুলো রাখলেন। কখনও কোনও অনুরোধ করিনি, মিস্টার প্রেসিডেন্ট। কিন্তু আজ একটা সাহায্য চাইব আপনার কাছে।
ব্যক্তিগত অনুরোধ?
ধরুন, তা-ই। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকলেন ব্রায়ান, তারপর বললেন, কিডন্যাপ হয়েছে আমার প্রিয় একজন। তথ্য পেয়েছিঃ যারা ওকে তুলে নিয়ে গেছে, তারা কাজ করে চাইনিজ বিলিয়নেয়ার হুয়াং লি ল্যাং-এর হয়ে। আমি চাই ওই লোকের কজা থেকে মেয়েটিকে ছিনিয়ে আনতে।
আরও গম্ভীর হয়ে গেলেন প্রেসিডেন্ট। কী করে? ভাল করেই জানো দুনিয়া জুড়ে কী চলছে! আমাদের কোনও ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির কেউ মহাচিনে ধরা পড়লে মুখ থাকবে না আমেরিকার।
জানি, মিস্টার প্রেসিডেন্ট।
তা হলে কেন?
হঠাৎ এ প্রশ্নে বিস্মিত হয়েছেন ব্রায়ান। ঠিক কী জানতে চাইছেন, মিস্টার প্রেসিডেন্ট?
ওই মেয়ের কাছে জরুরি কোনও তথ্য আছে, যেটা আমাদের বিপক্ষে যাবে? জিজ্ঞেস করলেন প্রেসিডেন্ট।
না, তা নেই, বললেন ব্রায়ান, কিন্তু আমরা সাহায্য না করলে দুনিয়া থেকে হারিয়ে যাবে মেয়েটি। প্রয়োজন মিটে গেলে অত্যাচার করে ওকে মেরে ফেলবে হুয়াং লি ল্যাং।
থমথম করছে প্রেসিডেন্টের মুখ। তুমি বা আমি আমেরিকান সরকারের হয়ে কাজ করেছি এবং করছি। এই ঝুঁকি নিতে হবে, সেটা জানত না ওই মেয়ে?
ওই মেয়ে এনআরআই-এর এজেন্ট নয়, সামান্য দ্বিধা নিয়ে বললেন ব্রায়ান। অনুরোধ করে ওকে কাজে নিয়েছিলাম।
কার কথা বলছ? জানতে চাইলেন প্রেসিডেন্ট।
মিতা দত্ত, নিচু স্বরে বললেন ব্রায়ান।
সামান্য কুঁচকে গেল তার সিনিয়র বন্ধুর চোখ।
মিতার বিষয়ে প্রায় সবই জানেন প্রেসিডেন্ট।
নিউমোনিয়ায় প্রিয় স্ত্রীর মৃত্যু হলে দ্বিতীয়বার বিয়ে করেননি ব্রায়ান। নিঃসন্তান মানুষ, নিজের মেয়ের মতই ভালবাসেন মিতাকে। আর তা করবেনই বা না কেন?
ঘনিষ্ঠ বন্ধুর একমাত্র মেয়ে। কিন্তু একবছর আগে সত্যি ওকে চিনলেন তিনি। হার্ট অ্যাটাক হওয়ায় ভর্তি ছিলেন হাসপাতালে। দুএক দিন দেখতে গেল অফিসের অনেকে, তারপর সবাই যেন ভুলে গেল তার কথা।
কিন্তু ওই একটি মেয়ে প্রতিদিন যেত গোলাপ ও চকোলেট হাতে। গল্প করত মাথার পাশে বসে। জুগিয়ে দিত সাহস। তাঁর মনে হতো, তাই তো, দুবার হার্ট অ্যাটাক হলেও আসলে কিছুই হয়নি!
সুস্থ হওয়ার পর নতুন উদ্যমে কাজে নেমে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন।
বিপদে পাশে থাকার অদ্ভুত গুণ মিতা পেয়েছে ওর বাবা বিনয় দত্তের কাছ থেকেই।
তাঁর মতই দক্ষ ফিযিসিস্ট মিতা। আরও কত গুণ যে আছে, অন্য কেউ না জানলেও ব্রায়ান জানেন। যেমন ওর সাহস, তেমনি ন্যায়নীতি বোধ।
হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে অবাক হন তিনি। সবই ছিমছাম। ধুলো বলতে কিছুই নেই। গুছিয়ে রাখা হয়েছে প্রতিটি আসবাবপত্র। বিছানায় পরিষ্কার চাদর। বেড-টেবিলে তার প্রতিটি প্রয়োজনীয় ওষুধ।
পুরো সুস্থ হওয়া তক তার পছন্দের পদ জেনে নিয়ে তা বেঁধে পাশে বসে পরিবেশন করেছে মিতা।
আপন মেয়ে থাকলে যা করত, তাই করেছে মেয়েটি।
এই মুহূর্তে আশা ও চরম উৎকণ্ঠায় দুলছে ব্রায়ানের মন। চুপচাপ চেয়ে আছেন প্রেসিডেন্টের দিকে।
মৃদু মাথা নাড়লেন প্রেসিডেন্ট। তুমি জানো এই খেলার নিয়ম। কয়েক বছর ধরেই চিনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আড়ষ্ট। তার ওপর সামনে নির্বাচন। ফুরিয়ে আসছে আমার টার্ম। এখন হুয়াং লি ল্যাং-এর ব্যাপারে ভুল পদক্ষেপ নিলে সর্বনাশ হবে। সমস্ত দায় পড়বে পার্টি এবং আমার ওপর। সরি, জেমস, পানি আরও ঘোলা করার সময় এখন নয়।
হুয়াং লি ল্যাং কিন্তু চিন সরকারের কেউ নয়, বললেন ব্রায়ান, এমন এক চিনা নাগরিক, যে কি না কিডন্যাপ করেছে এ দেশের এক নাগরিককে।
ল্যাং সাধারণ কেউ নয়, চিনের সবচেয়ে বড় বিলিয়নেয়ার। আরেকবার মাথা নাড়লেন প্রেসিডেন্ট।
হাল ছাড়লেন না এনআরআই চিফ। গোপনে কাজে নামতে পারি আমরা।
চোখ থেকে চোখ সরিয়ে দরজা দেখলেন প্রেসিডেন্ট। এ ব্যাপারে আমার আর কিছু বলার নেই, জেমস।
বড় করে দম দিলেন এনআরআই চিফ। অনুরোধ করে লাভ হবে না। দ্বিতীয়বার এই বিষয়ে ভাববেন না প্রেসিডেন্ট।
পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ব আমরা, নরম সুরে বললেন পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাশালী মানুষটা। তবে সময় লাগবে কাজ হতে।
মাথা দোলালেন ব্রায়ান। উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ওই গামা রে-র ব্যাপারে নতুন তথ্য পেলে দেরি না করে তা জানিয়ে দেব।
ঘুরে দরজার দিকে চললেন তিনি।
সামনের ডকুমেন্টে চোখ রাখলেন প্রেসিডেন্ট, তবে দুসেকেণ্ড পর জানতে চাইলেন, তোমার ওই দুই সমস্যার ভেতর কোনও সম্পর্ক আছে?
বহু বছর হলো সরকারী চাকরি করছেন ব্রায়ান। ভাল করেই জানেন, কখন উচিত তথ্য চেপে রাখতে হয়। ঘুরে তাকালেন তিনি।
চেয়ে আছেন প্রেসিডেন্ট। পূর্ণগতি তুলে বেয়ারিং সি-তে হাজির হয়েছে চাইনিজ ফ্লিট। এদিকে মেক্সিকো থেকে মিতা দত্তকে কিডন্যাপ করেছে চাইনিজ বিলিয়নেয়ার। এ-দুটো ঘটনার ভেতর কোনও সংযোগ নেই তো?
তেমন কিছু আমাদের জানা নেই।
ভুরু কুঁচকে ব্রায়ানকে দেখলেন প্রেসিডেন্ট। বলল তো, জেমস, মিতা আসলে কী করছিল মেক্সিকোতে?
অত্যন্ত গম্ভীর ব্রায়ান বললেন: ওর কাজ ছিল একটা স্ফটিক খুঁজে বের করে ওটা এ দেশে নিয়ে আসা। জটিল ফিযিক্সের সঙ্গে তা জড়িত। আমরা নিশ্চিত নই, তবে পৃথিবী রক্ষা বা ধ্বংসের সঙ্গে এটা ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত।
ঠিক আছে, এ ব্যাপারে নতুন কোনও ডেটা পেলে জানাবে। আবারও কাগজে নাক খুঁজলেন প্রেসিডেন্ট।
ওভাল অফিস থেকে বেরিয়ে এলেন বিমর্ষ ব্রায়ান, হোয়াইট হাউসের পার্কিং লটের দিকে পা বাড়িয়ে ভাবলেন: মিতাকে সাহায্য করতে পারল না আমেরিকা। ক্ষুধার্ত বাঘের মত হিংস্র হুয়াং লি ল্যাং-এর বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারবেন না তিনি।
তা হলে? কেউ কি নেই যে সাহায্য করতে পারবে?
অসহায় মানুষকে বাঁচাতে নিজ জীবন বাজি ধরতেও রাজি, এমন একজনের কথা মনে পড়ল এমআরআই চিফের।
হাঁটতে হাঁটতে বিড়বিড় করলেন, আছে এখন নিউ ইয়র্কে, কিন্তু সে কী রাজি হবে সাহায্য করতে?
তাঁর মন বলল: কেউ যদি পারে মিতাকে উদ্ধার করতে, সে ওই বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স বা বিসিআই-এর উজ্জ্বলতম তারকা, দুর্ধর্ষ, দুঃসাহসী এজেন্ট এমআরনাইন!
হ্যাঁ, জগতে অমন আর কেউ নেই! মাসুদ রানার দুয়ার থেকে খালি হাতে ফেরে না বিপদগ্রস্ত মানুষ।
চট করে হাতঘড়ি দেখলেন তিনি, তারপর পকেট থেকে আইফোন নিয়ে কল দিলেন নিউ ইয়র্কে রানা এজেন্সির অফিসে।
.
০৪.
নিউ ইয়র্কে বিকেলের আকাশ কালচে। আবহাওয়া দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে: যে-কোনও সময়ে শুরু হবে মাঝারি থেকে ভারী তুষারপাত এবং সেইসঙ্গে দমকা হাওয়া।
কাজ গুছিয়ে নিয়ে যে যার বাড়ির পথে ছুটছে মানুষ। আগামী একঘণ্টার ভেতর ফাঁকা হয়ে যাবে শহরের রাস্তাঘাট।
রানা এজেন্সিতে নিজের অফিসে বসে আছে মাসুদ রানা, চোখ বোলাচ্ছে ফাইলে। ওটা দেখা শেষ হলেই ছুটি, আগামীকাল থেকে কোনও কাজ নেই ওর। ভেবে বের করতে হবে কীভাবে কাটাবে সময়।
আজকের মত কাজ শেষ করে বিদায় নিয়েছে প্রায় সবাই। অবশ্য রয়ে গেছে রিসেপশনিস্ট সৈকত। গত একবছর হলো ওপরতলায় রানার ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টের গেস্টরুমে আস্তানা গেড়েছে ও। শেষপর্যন্ত জমাতে পেরেছে যথেষ্ট টাকা। কদিন পর ফিরছে দেশে। বিয়ে করবে স্বপ্নের রানি, দূরসম্পর্কের খালাতো বোন তৃষ্ণাকে। জানেও না, ওদের বিয়েতে উপহার হিসেবে মোটা অঙ্কের তহবিল গড়েছে রানা এজেন্সির নিউ ইয়র্ক শাখার সবাই মিলে। দেশে যাওয়ার সময় তুলে দেয়া হবে সৈকতের হাতে।
রিপোর্ট দেখা শেষ করে মন্তব্য লিখে সই করবে রানা, এমনসময় বেজে উঠল ইন্টারকম।
রিসিভার তুলে বলল রানা, ইয়েস, প্লিয?
ওদিক থেকে বলল সৈকত, মাসুদ ভাই, এনআরআই চিফ। নিয়ে আসব?
নিয়ে এসো। ইন্টারকম রেখে সামনে থেকে ফাইল সরাল রানা, চিন্তিত। মাঝসকালে ফোনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছেন জেমস ব্রায়ান। নিউ ইয়র্কে এসে দেখা করবেন। কিন্তু কেন তখনই আলাপ করলেন না, ব্যাপারটা কৌতূহল উদ্রেক করছে ওর।
এনআরআই চিফ জেমস ব্রায়ানকে চেনে রানা,, তবে ঘনিষ্ঠতা নেই। আগেও বিসিআই-এর এক মিশনে তাঁর সংগঠনের সঙ্গে কাজ করেছে ও।
সৈকত দরজা খুলে হাতের ইশারা করতেই রানার কামরায় ঢুকলেন ব্রায়ান। পেছন থেকে আকাশে দুটো আঙুল তুলল সৈকত। মৃদু মাথা দোলাল রানা। এনআরআই চিফের পেছনে বন্ধ হয়ে গেল দরজা।
রানা চেয়ার ছেড়ে হাত বাড়াতেই করমর্দন করলেন জেমস ব্রায়ান।
বসুন, আরামদায়ক চেয়ার দেখাল রানা।
ধপ করে চেয়ারে বসলেন ব্রায়ান। কৌতূহলী চোখে তাঁকে দেখছে রানা। ভদ্রলোকের চোখে-মুখে চরম দ্বিধা ও অস্বস্তি।
বলুন? স্বাভাবিক সুরে বলল রানা।
কিছুক্ষণ কী যেন ভেবে তারপর বললেন এনআরআই চিফ, বিপদে পড়ে সাহায্য চাইছি। বিষয়টি ব্যক্তিগত। চুপ হয়ে গেলেন তিনি।
মৃদু হাসল রানা। আপনিঃ এনআরআই চিফ, বিপদে পড়ে এসেছেন দরিদ্র একটি দেশের সামান্য এক গুপ্তচরের কাছে?
ওকে দেখছেন জেমস ব্রায়ান, মুখে রা নেই।
চোখে চোখ রেখে অপেক্ষা করছে রানা।
ওয়াশিংটন ডিসি থেকে ছুটে এসেছি, কারণ মনে হয়েছে সাহায্য পাব আপনার কাছে, বললেন ব্রায়ান।
চাইলেই তো মাঠে নামাতে পারেন আপনার শতখানেক এজেন্ট, বলল রানা।
নীতির কারণে তা পারি না। যেহেতু ব্যাপারটা ব্যক্তিগত। প্রেসিডেন্টের সঙ্গেও আলাপ করেছি। বলেছেন, কোনও সাহায্য করতে পারবেন না তিনি।
কী বিষয়ে সাহায্য চাইছেন?
আপনার কি মনে আছে মিতা দত্তের কথা?
হ্যাঁ।
বিপদটা আসলে ওর।
গতবছর এনআরআই-এর জটিল এক মিশনে যান ডক্টর জর্জ হ্যারিসন নামে কৃষ্ণ বর্ণের এক আর্কিওলজিস্ট। তাঁর সঙ্গে ছিল মাথা ঘুরিয়ে দেয়ার মত অপূর্ব সুন্দরী, চব্বিশ বছর বয়সী ফিযিসিস্ট মিতা দত্ত। ওদের নিরাপত্তার জন্যে এনআরআই থেকে কয়েকজন মার্সেনারিকে ভাড়া করা হয়, কিন্তু সবাই নৃশংসভাবে খুন হয়েছিল শত্রুপক্ষের হাতে। তখন বাংলাদেশ সচিবালয়ের ডেপুটি সেক্রেটারি, ফুপাতো ভাই অপরেশ ব্যানার্জির কাছে ফোন দেয় অসহায় মিতা।
ভদ্রলোক যোগাযোগ করেন বিসিআই-এ।
ছুটিতে ব্রাযিলে ঘনিষ্ঠ বন্ধু রাফায়ালের কফি প্ল্যান্টেশনে ছিল রানা। ওরা ঠিক করে, রাফায়ালের সদ্য কেনা ভাঙাচোরা দুটো হেলিকপ্টার মেরামত হলে, ওগুলো বিক্রির টাকা সমানভাগে ভাগ করে নেবে দুজন। পরে ও-দুটো কিনে নেয় শ্রীলঙ্কান আর্মি। নিজের ভাগের টাকা দাঁতব্য একটি সংগঠনে দান করেছিল রানা।
একটা হেলিকপ্টার প্রায় মেরামত করেছে, এমনসময় সন্ধ্যায় ফোন দিলেন বিসিআই থেকে মেজর জেনারেল (অব.) রাহাত খান। দুচার কথার পর ওকে বললেন, ছুটির এ সময়ে মিতা দত্তকে সাহায্য করলে তিনি খুশি হবেন। ভাইয়ের সঙ্গে কথা হয়েছে মেয়েটার, এ অভিযানে বাংলাদেশের জন্যে প্রয়োজনীয় কিছু পাওয়া গেলে তা বিসিআই-এর হাতে তুলে দিতে দ্বিধা করবে না ও।
রানাও ভেবেছে, ওর উচিত মেয়েটার পাশে থাকা।
পরদিন দুপুরে প্ল্যান্টেশনে এসে দেখা করল মিতা। সরাসরি বলল, আমার ভাই ফোন করে বলেছেন, আপনি হয়তো আমাকে সাহায্য করবেন। তাই চলেই এলাম।
রানার মনে হলো, অদ্ভুত রূপসী মেয়েটির আচরণ খুব সাবলীল ও সহজ। অভিযানে কোথায় যেতে হবে জানার পর অল্প কথায় রানা জানাল, যেতে আপত্তি নেই। কিন্তু আমাযনে ঢোকার পর থেকে আমার নির্দেশের বাইরে যাওয়া। চলবে না।
তাই হবে, খুশি মনে রাজি হয়েছিল মিতা।
এরপর জড়িয়ে গেল ওরা আমাযনের জঙ্গলে বিপজ্জনক এক মায়ান অভিযানে। নানান দিক থেকে এল হামলা। এক জার্মান বিলিয়নেয়ারের ব্যক্তিগত আর্মির বিরুদ্ধে লড়ল রানা। মায়ান মন্দিরে ওদের ওপর হামলে পড়ল অদ্ভুত কিছু মিউটেড জন্তু, প্রায় মরতে মরতে রক্ষা পেল ওরা। আরও বহু ঝামেলা পোহাবার পর মিলল মাত্র একটি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী স্ফটিক।
ওটার বিষয়ে বিসিআই চিফকে রানা ফোন দিলে, তিনি জানান, আপাতত অমন গবেষণার জন্যে, তৈরি নন বাঙালী ফিযিসিস্টরা। কাজেই ওই স্ফটিক যেন দেয়া হয় এনআরআই-কে। তাদের গবেষণা সফল হলে উপকৃত হবে গোটা পৃথিবীর মানুষ।
রানার মনে আছে, আগে থেকেই মিতা জানত আত্মরক্ষার জন্য আনআমড় কমব্যাট। চোখ ধাঁধিয়ে দেয়া মেয়েটির খুব আগ্রহ দেখে কুংফুর নতুন কিছু কৌশল ও নানান আগ্নেয়াস্ত্রের ওপর সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ দিয়েছিল ও।
এনআরআই চিফের কাছে জানতে চাইল রানা, কী ধরনের বিপদে পড়েছে মিতা?
খুট করে খুলে গেল অফিসের দরজা। উদয় হলো সৈকত। দুহাতে সুন্দর এক ট্রের ওপর রাখা চমৎকার ডিযাইনের দুটো মগ ও এক প্লেট অলিম্পিক নোনতা বিস্কিট।
রানা ও মিস্টার ব্রায়ানের সামনে কফির মগ ও বিস্কিটের প্লেট রেখে বিদায় নিল সৈকত।
হাতের ইশারায় কফি ও বিস্কিট দেখাল রানা।
মাথা দোলালেন ব্রায়ান। হাতে নিলেন না কফির মগ। ওই বিপদের নাম হুয়াং লি ল্যাং। মিতাকে মেক্সিকো থেকে তুলে নিয়ে গেছে ওই চাইনিজ বিলিয়নেয়ার। প্রয়োজন মিটে গেলেই খুন করবে। এদিকে হাত-পা বাঁধা আমার। কিছুই করতে পারব না। তাই এসেছি আপনার কাছে সহায়তা পাওয়ার আশায়।
মিতা এখন কোথায়? কড়া কফির মগ ঠোঁটে তুলে মৃদু চুমুক দিল রানা।
খোঁজ নিয়ে জেনেছি, ওকে আটকে রেখেছে হংকং-এ নিজের দুর্গের মত প্রকাণ্ড অফিস দালানে।
চুপ করে আছে রানা। কিছুক্ষণ পর বলল, মিতাকে চাইনিজ বিলিয়নেয়ারের খপ্পর থেকে ছুটিয়ে আনতে হলে, চাই যথেষ্ট প্রস্তুতি। লাগবে প্রয়োজনীয় টাকা, সেটা কি দেবে আমেরিকান সরকার?
মৃদু মাথা নাড়লেন জেমস ব্রায়ান। না, তা দেবে না।
তা হলে?
টাকা যা লাগে, সেটা,আমিই দেব।
কেন দেবেন?
কারণ মিতাকে নিজের মেয়ের মতই মনে করি আমি। ওর বাবা ছিলেন আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তা ছাড়া, মিতার কাছে আমি ঋণী। নিজের জীবন দিতেও দ্বিধা করব না।
কিছুক্ষণ ভেবে তারপর বলল রানা, এ ধরনের মিশনে গেলে খরচ হতে পারে লাখ লাখ ডলার।
জানি। সেজন্যে এরই ভেতর অফিসের ফাণ্ড থেকে আমার প্রাপ্য সমস্ত টাকা তুলে নিয়েছি। আপনি রাজি হলেই আপনার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে সব টাকা ট্রান্সফার করে দেব।
নীরবে বসে আছে রানা।
মিস্টার রানা, বন্দি এক মেয়ের অসহায় বাবার অনুরোধ: দয়া করে মিতাকে ফিরিয়ে আনুন, মাথা নিচু করে নিজের দুহাত দেখছেন এনআরআই চিফ।
সিআইএ বা এনএসএর মতই শক্তিশালী সংস্থা এনআরআই, সেই সংগঠনের বড়কর্তা কাতর হয়ে সাহায্য চাইছেন, যেন চাইনিজ এক দানবের হাত থেকে রক্ষা করা হয় তার মেয়েকে।
নরম সুরে বলল রানা, আপনার এই কাজটা হাতে নেব কি না, তা আগামীকাল সকালে ফোনে জানিয়ে দেব।
অন্তত জানব, সাধ্যমত করেছি, চেয়ার ছাড়লেন জেমস ব্রায়ান। এতই চিন্তিত, ভুলে গেছেন কফি বা বিস্কিটের কথা।
ভদ্রতা করে চেয়ার ছাড়ল রানা। গুড বাই, স্যর।
একবার মৃদু মাথা দুলিয়ে অফিস ছেড়ে চলে গেলেন মিস্টার ব্রায়ান।
কয়েক সেকেণ্ড, পর এনক্রিপ্টেড ফোনের দিকে হাত বাড়াল রানা। জরুরি আলাপ করবে বিসিআই চিফ মেজর জেনারেল (অব.) রাহাত খানের সঙ্গে। বিড়বিড় করল রানা, খুকখুক করে কেশে নিয়ে ঠিক এই ভঙ্গিতে বলবে কট্টর বুড়ো: জরুরি কোনও কাজ নেই, ইচ্ছে করলে তুমি যেতে পারো। পরে আমাদের দেশের কাজে আসবে ওঁর মত দক্ষ একজন নিউক্লিয়ার ফিযিসিস্ট।
কানে রিসিভার ঠেকিয়ে ডায়াল করল রানা। বুকের মাঝে ধুপ-ধাপ লাফ দিচ্ছে অস্থির হৃৎপিণ্ড। আজও কেন যেন ভয় লাগে ওই কট্টর বুড়োর সঙ্গে কথা বলতে।
.
০৫.
ঘুটঘুটে আঁধার চিরে আসছে চিৎকার: তুমি কী দেখছ?
ব্যথা! বিশ্রী দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে গেছে মিতা। চোখ মেলতে চাইল। থরথর করে কাঁপছে শরীর। খুব ঠাণ্ডা! পরক্ষণে নরকের মত গরম! শিরার মাঝ দিয়ে বইছে বিষের মত কিছু!
তীব্র আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে গেল ওর।
তুমি কী দেখছ? আবারও কর্কশ কণ্ঠে জানতে চাইল কেউ।
বনবন করে ঘুরছে মাথা, হাজার ফুট ওপর থেকে ভয়ানক কোনও নরকে পড়ছে মিতা! পতন ঠেকাতে হাত পেছনে নিয়ে ধরতে চাইল কিছু। কিন্তু কোনও হাতল বা পিঠ নেই এই চেয়ারে। আছে শুধু টেবিলের কিনারার মত কিছু।
সূর্যের মত আলো নিভে জ্বলে উঠল নরম বাতি। মিতার মুখের খুব কাছে এল একটা মুখ। ওই চেহারা চৈনিক। এত কাছে, তার দুই চোখ স্পষ্ট দেখল ও। দুহাতে ওকে ধরল লোকটা। কাঁপা, শীতল দুটো হাত। চোখ রাখল চোখে। যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে ওর আত্মা।
দুশ্চিন্তা কোরো না, হাসিমুখে বলল লোকটা, আমরা জানি, ব্রাযিলে যে আর্টিফ্যাক্ট খুঁজতে গিয়েছিলে, ওই একই জিনিস চাই তোমার। খেক-শেয়ালের মত কর্কশ হেসে পিছিয়ে গেল সে।
চলছে একটানা বিশ্রী হাসি। ভয় পেয়ে পিছু হটতেই টেবিল থেকে মেঝেতে পিছলে পড়ল মিতা। তাতে কয়েক মুহূর্তের জন্যে পরিষ্কার হলো মগজ। চোখ তুলে দেখল, ভীষণ কুশ্রী, বয়স্ক এক লোক মোটরাইড় এক হুইলচেয়ারে বসা। দৈহিক কোনও অদ্ভুত কম্পনের জন্যে মুচড়ে আছে। শরীর।
এত কষ্টের মাঝেও তার জন্যে মনে করুণা এল মিতার।
ওর ভাবনা বুঝে প্রচণ্ড রাগে বিকৃত হলো লোকটার মুখ। চিৎকার করে উঠল সে, ওকে নিয়ে যাও! এতবড় দুঃসাহস…আমাকে করুণা করে!
বিশালদেহী দুই চাইনিজ খপ করে ধরল মিতাকে, তুলে ধুপ করে ফেলল এগযামিনেশন টেবিলের ওপর। এল তৃতীয়জন, হাতে হাইপোডারমিক সিরিঞ্জ। সুই থেকে টপটপ করে পড়ছে সোনালি তরল!
না চেঁচিয়ে উঠল মিতা, ছুটে যেতে চাইল লোকদুজনের হাত থেকে। কিন্তু তাদের শক্তি অনেক বেশি, ঠেসে ধরে রাখল টেবিলের ওপর।
আবারও চোখ ঝলসে দিয়ে জ্বলে উঠল অত্যুজ্জ্বল আলো।
তখনই মিতার কাঁধের মাংসে বিঁধল সুঁই। এক সেকেণ্ড পর আঁধার হয়ে গেল চারপাশ।
.
ঘুম ভাঙতেই মিতা বুঝল, পড়ে আছে মেঝেতে। হৃৎপিণ্ড দাপিয়ে চলেছে ছুটন্ত ঘোড়ার মত। আগে দুঃস্বপ্ন দেখে জ্ঞান ফিরলে, আবারও ঘুম পাড়িয়ে দেয়া হয়েছে চেতনানাশক ওষুধ ব্যবহার করে। ওর জানা নেই, এভাবে কতবার অজ্ঞান হয়েছে। এখন ঝুলছে বাস্তব আর অবাস্তবের মাঝে। কোটা যে সত্যি, আর কোন্টা মিথ্যা, বোঝা দায়।
কিছুক্ষণ পর ধীরে ধীরে উঠে বসল মিতা।
চারদিকে সাদা দেয়াল। হালকা বাদামি রঙা আসবাবপত্র। একপাশে দামি ডেস্ক ও কয়েকটি আরামদায়ক চেয়ার। এ ঘর জানালাহীন। ঘড়ি, রেডিয়ো, টিভি বা কমপিউটার নেই। ওর মনে পড়ল, মস্ত এক হেলিকপ্টারে তুলেছিল ওকে। তখন অচেতন করে দেয় লোকগুলো। তারপর আর কিছুই মনে নেই।
এখন বুঝতে পারছে, ও কারও বন্দি।
ওই যে কুৎসিত লোকটা?
সেই ওকে আটকে রেখেছে।
কেন, তা ওর জানা নেই।
কত দিন আগে কিডন্যাপ করেছে ওকে?
হয়তো এক সপ্তাহ, বা এক মাস- কে জানে!
এরই মধ্যে হয়তো পেট থেকে বের করে নিয়েছে সব কথা!
মিতার মনে পড়ল মেক্সিকোর কথা। ঢালু জমিতে মোটা এক গাছের কাণ্ডে বাড়ি খেয়ে আটকে গিয়েছিল জর্জ হ্যারিসন।
আহা, বেচারা প্রফেসর!
তার কথা ভেবে খুব দমে গেল মিতার মন।
বুড়ো মানুষটা চোখের সামনে মারা গেল।
ও কিছুই করতে পারল না!
ব্রাযিলের মায়ান সাইটের ওই স্কটিকটা থেকে আসে ঠাণ্ডা বিদ্যুৎ। আর্কিওলজিস্ট জর্জ হ্যারিসন মায়া আর্টিফ্যাক্ট থেকেই জেনেছিলেন, আরও আছে ওই জিনিস। এনআরআই বিজ্ঞানীরাও চেয়েছিলেন ওই বিষয় নিয়ে আরও গবেষণা করতে।
আর্কিওলজিস্ট জর্জ হ্যারিসন অনুরোধ করেন, তাই গুরুত্বপূর্ণ ওই মিশনের ব্যবস্থা করে দেন জেমস ব্রায়ান। চাইলে মানা করতে পারত ও। কিন্তু মন বলল, বিপদ এলেও সময়টা কাটবে দারুণ। তা ছাড়া, ভেবেছিল পাশে পাবে মাসুদ রানাকে। সেক্ষেত্রে আর কী চাই! মানুষটার সঙ্গ সত্যি খুব লোভনীয়!
কিন্তু প্রথমেই পড়ল বাধা।
এ অভিযানে পাওয়া গেল না ব্যস্ত রানাকে।
অমন স্ফটিক আরও খুঁজতে গিয়ে মস্ত ঝুঁকি নিল মিতা। এখন নিজেই হয়তো চিরকালের জন্যে হারিয়ে গেছে সভ্যজগৎ থেকে!
আনমনে বিড়বিড় করল মিতা, হায়, ঈশ্বর, কীভাবে এত বড় ভুল করলাম?
অসুস্থ লাগছে। মন চাইল আবারও শুয়ে পড়তে।
আহ্, কী ভালই না হতো চুপচাপ মৃত্যু এলে!
পরক্ষণে বিদ্রোহ করল ওর অন্তর- এত সহজেই হেরে যাবি?
বাবার কথা মনে পড়ল ওর। ক্যান্সারে চরমভাবে অসুস্থ মানুষ, কিন্তু কখনও হাল ছাড়েননি। ওই একই কথা খাটে আঙ্কেল ব্রায়ানের ক্ষেত্রে। তাঁদের বা মাসুদ রানার জীবন থেকে বহু কিছুই শেখার আছে ওর!
বিশেষ করে মনে পড়ছে মাসুদ রানার কথা। ব্রাযিলে মানুষটা ছিল বিশাল এক বটবৃক্ষের মত, আগলে রেখেছিল সব ঝড়-বৃষ্টি-ঝঞ্ঝা থেকে। সত্যিই যখন বিদায় নিয়ে চলে গেল, কেমন ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল ওর জীবন।
মিতা ভাবল: আজ যদি মানুষটা জানত, ও পড়ে আছে। এই নরকে, ঠিকই উদ্ধার করে নিয়ে যেত।
এসব ভাবতে গিয়ে একটু শান্ত হলো ওর মন। বুঝল, প্রথম কাজ এই বন্দিশালা থেকে মুক্ত হওয়া।
স্রেফ মনের জোরে দুর্বলতা কাটিয়ে উঠে দাঁড়াল মিতা।
পায়ের নিচে নরম কার্পেট। চলে গেল ও ঘরের আরেক পাশে। সতর্ক হাতে স্পর্শ করল দরজা। যা ভেবেছে, ওটা লক করা। এদিকে ইলেকট্রনিক কি-প্যাড। ওদিকে থাকবে কার্ড রিডার। ফিরে এসে একে একে ঘেঁটে দেখল ডেস্কের ড্রয়ার।
সব ফাঁকা।
শেষ ড্রয়ার ধুপ করে বন্ধ করে মেঝেতে বসল মিতা। নতুন করে বাড়ছে মাথা-ব্যথা। ছাতের ওই সাদা বাতি অতিরিক্ত উজ্জ্বল, অথবা সমস্যা হয়েছে ওর চোখে। ফোলা লাগছে নয়নতারা। বোধহয় ওকে দেয়া হয়েছে কড়া কোনও ড্রাগ। এ কারণেই দেখেছে ভয়ানক সব দুঃস্বপ্ন।
চোখ তুলে ডানবাহু দেখল মিতা। ওখানে সুইয়ের কমপক্ষে ছয়টা দাগ। ব্যথা হয়ে আছে জায়গাগুলোয়।
সোডিয়াম পেন্টোথাল বা স্কোপোলামিন, ভাবল মিতা।
বারবিচুরেট ব্যবহার করে তৈরি হয় ওই দুই ওষুধ। অনেকে ভাবে, এসব সত্যিকারের টুথ সিরাম। সম্পূর্ণ ভুল চিন্তা। কাউকে ইঞ্জেক্ট করলে, তার মন চাইবে বকবক করতে। হয়তো মুখ ফস্কে বলবে বহু কথা। কিন্তু মনের কথা আদায় করতে হলে চাই হাই-ডোয, যেটা অত্যন্ত বিপজ্জনক। সেক্ষেত্রে সম্ভাবনা খুবই বেশি, চিরকালের জন্যে ঘুমিয়ে পড়বে মানুষটা।
ওই ওষুধই দিয়েছে, নইলে এত শুকনো লাম্বত না গলা, ফুলেও উঠত না চোখের তারা।
এবার কী করবে, ভাবছে মিতা। এমনসময় খুট করে খুলে গেল দরজা। ঘরে ঢুকল দুজন চাইনিজ লোক। শক্তপোক্ত দেহ, গায়ে ইস্ত্রি করা শার্ট, গলায় সিল্কের টাই, পরনে দামি সুট।
তাদের একজনকে নেতা বলে মনে হলো মিতার।
এগিয়ে এল সে, ডেস্কের ওপর ওর বুট রেখে বলল, পরে নাও। লোকটার ডান চোখের নিচে শুকনো ছোট ক্ষত।
ভাবতে গিয়ে মিতার মনে পড়ল, প্রথমবার অচেতন হওয়ার আগে ও-ই তৈরি করেছিল ওই ক্ষত।
বুট তুলে নিল মিতা। কোথায় যেতে হবে?
তোমাকে যেখানে নেব, সেখানে লাগবে বুট।
বক্তব্যটা সুবিধার ঠেকল না মিতার। তবে পরল ডান পায়ের বুট। ফিতা বাঁধতে বাঁধতে ভাবল, দ্বিতীয় পাটি ব্যবহার করবে অস্ত্র হিসেবে। পরক্ষণে বুঝল, এরা ঘায়েল হলেও এখান থেকে বেরিয়ে ও যাবে কোথায়? আসলে আছে ও কোন্ নরকে?
সুযোগ পাবে বড়জোর একবার!
হয়তো এ ঘর থেকে বেরোলেই সামনে পড়বে বিশ ফুট দূরে আরেকটা দরজা। কাজেই এখন উচিত হবে না কিছু করা।
দুপায়ে বুট পরতেই ঘর থেকে ওকে বের করল লোক দুজন। থামল একটা এলিভেটরের সামনে। বাটন টিপতেই খুলে গেল কবাট। ভেতরে ঢুকল ওরা। পকেট থেকে নিয়ে অন্যসব বাটনের নিচে অ্যাকসেস প্যানেলে চাবি ভরল দলনেতা। প্যানেলের সবচেয়ে নিচের বাটন টিপল। জ্বলে উঠল ইনডিকেটর বাতি। বন্ধ হলো এলিভেটরের দরজা। নামতে লাগল স্টিলের বাক্স।
চট করে মিতা দেখল, বাটন কতগুলো। নিচের তিন সারিতে সব মিলে বিশটা করে।
দ্রুত চলছে এলিভেটর। কানে ধাঁধা লাগতেই মিতা বুঝল, এটা এক্সপ্রেস লিটু। অর্থাৎ, ষাটতলার চেয়েও উঁচু এই ভবন। সব বাটন হিসেবে নিলে এই দালান হবে প্রায় এক শ তলা।
মহাচিনে কতগুলো বাড়ি এত উঁচু? ভাবল মিতা।
সংখ্যায় সেগুলো খুব বেশি নয়।
বিশেষ একটি বহুতল ভবনের কথা মনে পড়ল ওর।
টাওয়ার ল্যাং।
ওটার মালিক হুয়াং লি ল্যাং। হংকঙের অত্যন্ত দামি ওই জায়গাটা ভিক্টোরিয়া হার্বারের মুখে।
ও, তা হলে আমি হংকঙে? ভাবল মিতা। কয়েক সেকেণ্ড পর বলল, আমেরিকান কনসুলেটের সঙ্গে কথা বলতে চাই।
চোখের তলের শুকনো ক্ষত বিরস সুরে বলল, এরই ভেতর অনেক বকবক করেছ, আর না।
গতি কমিয়ে থামল এলিভেটর। খুলে গেল দরজা।
সামনে যেমন দৃশ্য দেখবে ভেবেছে, তেমন কিছুই দেখতে পেল না মিতা। নেই, চওড়া প্যাসেজ। লোহার বাক্স নেমেছে প্রাচীন আমলের কালো পাথরের ছোট এক বদ্ধ করিডোরে। চারপাশে পচা আবর্জনা ও প্রস্রাবের বোটকা গন্ধ।
কোন্ নরকে এনেছেন? জানতে চাইল মিতা।
এলিভেটর থেকে নেমে পড়ল চোখের নিচে ক্ষতওয়ালা। এক হাতে তৈরি টেইযার। তীব্র বিদ্যুৎ প্রবাহের কারণে কাঁকড়াবিছের লেজের মত নড়ছে দুই দাঁড়া।
অনিচ্ছাসত্ত্বেও করিডোরে বেরোল মিতা।
প্রাকৃতিকভাবেই তৈরি পাথরের এই করিডোর। পরে ব্যবহার করেছে চুন-সুরকি। অনেকটা মেডেইভেল আমলের দুর্গের আঁধার ডানজনের মত ভেজা, স্যাঁতস্যাঁতে। ডানদিকে ভারী কাঠের দরজা। বহু বছর পানি লেগে পচে গেছে কজার কাছে। ছাত থেকে সরু কেবল-এ ঝুলছে স্বল্প ওয়াটের ন্যাংটো বালব। ওই দুর্বল আলোয় চারপাশ দেখা প্রায় অসম্ভব।
লোহার পুরু শিক দিয়ে তৈরি এক দরজার সামনে থামল ওরা। পরক্ষণে কিছু বোঝার আগেই কবাট খুলে পেছন থেকে ঠেলে দেয়া হলো মিতাকে। সামান্য উঁচু চৌকাঠে পা বেধে হুড়মুড় করে মেঝেতে পড়ল ও। রুক্ষ পাথরে লেগে ছড়ে গেল দুহাত।
ব্যথা অগ্রাহ্য করে মেঝে ছেড়ে উঠেই দরজার কাছে ফিরল মিতা। কিন্তু ওর মুখের ওপর ধুম্ করে বন্ধ হলো লোহার কবাট।
আপনারা কেন এসব করছেন? অসহায় সুরে জানতে চাইল মিতা। কী চান আপনারা আমার কাছে?
কিছুই না, বলল শুকনো ক্ষত।
চারপাশের আঁধারে চোখ বোলাল মিতা। শুনল কয়েক ধরনের আওয়াজ। নড়ছে কারা? ঘড়-ঘড় শব্দে শ্বাস নিচ্ছে কিছু! গুঙিয়ে উঠল কেউ!
মিতার মনে হলো, ওর আগমনে ঘুম ভেঙে জেগে উঠেছে বিশ্রামরত ভয়ঙ্কর কোনও হিংস্র জানোয়ার!
হঠাৎ করেই বেড়ে গেল বিশ্রী দুর্গন্ধ!
এটা কোথায়? ভীত স্বরে জিজ্ঞেস করল মিতা।
নিভল করিডোরের বাতি। দুই চাইনিজ উঠেছে এলিভেটরে। বুজে যাচ্ছে দরজা, পুরো বন্ধ হওয়ার আগেই একজন বলল: এখন থেকে এটাই তোমার বাড়ি!
.
০৬.
শক্ত মেঝেতে পাতলা চাদরের ওপর চুপ করে শুয়ে আছেন প্রফেসর জর্জ হ্যারিসন, চোখ সোজা খড়ের হলদেটে ছাতে। মাউন্ট পুলিমাণ্ডো থেকে প্রায় বয়ে নিজেদের চিয়াপাস ইণ্ডিয়ান গ্রামে তাকে এনেছে পিকো। তাতে লেগেছে কয়েক দিন। প্রতিদিন আগের চেয়েও দুর্বল হয়েছেন ডক্টর। বুলেটের ক্ষতে ধরে গেছে ইনফেকশন। ওই বিপদ কম নয়, তার ওপর তার ঘাড়ে চেপে বসেছে গ্রামের বদমাশ এক ওঝা। ওই থুথুড়ে বুড়োর স্থির বিশ্বাস, দারুণ কোনও জাদু দিয়ে সুস্থ করবে কালো লোকটাকে।
দুর্গন্ধময় ওই ব্যাটা খুন করবে বুঝেই, ডক্টর হ্যারিসন পিকোকে বলেছেন, সত্যিকারের ডাক্তার ডেকে আনতে। এখন চাই অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ। এ কথা মনে গেঁথে যেতে কাছের শহরের উদ্দেশে রওনা হয়েছে পিকো। কিন্তু ওদের গ্রাম এতই দুর্গম, কাছের জনপদ ঘুরে আবার ফিরে আসতে লাগবে তিন থেকে চার দিন।
ততদিন বাঁচবেন কি না, এ নিয়ে গভীর সন্দেহে আছেন প্রফেসর। গ্রামের মোড়ল গভীর শ্রদ্ধা রাখে ওই শয়তান বুড়োর ওপর। তাই নিজ বাড়ি থেকে হ্যারিসনকে পাচার করে দিয়েছে ওই ব্যাটার বাড়িতে। এখন যা খুশি করতে পারে সে!
হ্যারিসনের বামপাশে কড়মড় আওয়াজে পুড়ছে চ্যালা কাঠ। চাইলেও দেখতে পাবেন না ওদিকটা। গুলি খেয়ে নিচের ওই গাছে গিয়ে বাড়ি খাওয়ার পর থেকেই মেরুদণ্ড যেন লোহার শিক। আড়ষ্ট হয়ে গেছে দেহ। একটু নড়লেই এমন খচ্ করে লাগছে, মনে হচ্ছে ছিঁড়ে পড়ছে পেশি।
বামহাত নিচে নিয়ে আস্তে করে উরুর ক্ষত স্পর্শ করলেন হ্যারিসন। ফুলে আছে গর্তের চারপাশ। তবুও বলতে হবে, কপাল ভাল, সরাসরি মাংস ভেদ করে বেরিয়ে গেছে বুলেট।
দেবতার ওই দ্বীপেই অ্যান্টিসেপটিক মলম মেখে ক্ষত ব্যাণ্ডেজ করেছেন, তবুও ধরে বসল ইনফেকশন। পা যে শুধু ফুলে গেছে তা নয়, জ্বরও এসেছে। হাত ফিরিয়ে এনে কোলে রাখলেন হ্যারিসন। ঘামছেন দরদর করে। কপাল থেকে চোখে পড়ল একফোঁটা লোনা জল। মাথা ঝেড়ে ওটা ফেলে দিলেন চোখ থেকে।
মন খারাপ লাগছে তাঁর। তিনিই বারোটা বাজিয়ে দিয়েছেন নিজের। একরাতে স্টাডিতে বসে পড়ছিলেন ব্রাযিল থেকে সংগ্রহ করা মায়ান প্রাচীন গ্লিফ। তখনই চোখে পড়ল; মায়ানদের লিখিত বক্তব্য। ওদের ছিল নিজস্ব গার্ডেন অভ এডেন টুলান যুইয়োয়া। বুঝলেন, আরও আছে অমন বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী স্ফটিক। প্রথমটার নাম: যিপাকনার হৃদয়। কল্পকাহিনির মায়ান এক ভয়ানক জন্তু যিপাকনা। পরের তিনটে হচ্ছে: মন উৎসর্গের আয়না, দূর সাগরের আত্ম উৎসর্গের আয়না, আর শেষেরটা দেহ উৎসর্গের আয়না।
কিন্তু কোথায় আছে ওই তিনটে স্ফটিক পাথর?
নিজের সব নোট ও ছবি ঘাটতে শুরু করে জানলেন, বহু দূরে নেয়া হয়েছিল ওই চার পাথর। একটা ছিল ব্রাযিলে, অন্য দুটো শত মাইল দূরে, আর শেষেরটা সাগর পাড়ি দিয়ে রাখা হয়েছিল অন্য কোথাও। যেসব চিহ্ন ছিল, সেগুলোকে আর যাই হোক, মানচিত্র বলা যাবে না। তবে তিনি নানান হিসেব কষে বুঝলেন, দুটো পাথর গেছে উত্তরে ইউক্যাটানের দিকে। অন্যটা উত্তর চিন বা দক্ষিণ সাইবেরিয়ায়। এ-ও ঠিক, স্রেফ শখে করা হয়নি ওই কঠিন কাজ। জরুরি উদ্দেশ্য ছিল প্রাচীন আমলের মানুষগুলোর।
বিষয়টা বুঝে সরাসরি যোগাযোগ করলেন এনআরআই এর চিফ জেমস ব্রায়ানের সঙ্গে। ওটা অনুচিত ছিল, আরও মন্দ কাজ করেছেন মিষ্টি মেয়ে মিতাকে এসবে জড়িয়ে।
অবশ্য, এখন বুঝতে পারছেন, তাঁর ধারণা ভুল নয়। ওসব আয়না বা পাথর ব্যবহার হতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কোনও কাজে। নইলে কেন তাদেরকে মেরে ফেলতে চাইল একদল লোক? কারা তারা? অন্য কোনও দেশের স্পাই?
হ্যারিসন নিজেকে চেনেন, তাই আনমনে বললেন: যতবড় বিপদই হোক, একবার সুস্থ হলেই আবারও খুঁজব ওই স্ফটিক।
কে যেন ঢুকেছে কুঁড়েঘরে।
ঘাড় কাত করে দেখতে চাইলেন হ্যারিসন। পিকো? এলে?
জবাব দিল ফিসফিসে এক কণ্ঠ: পিকো এক্সিহুয়া থেকে ফেরেনি।
এবার তরুণকে দেখলেন প্রফেসর। সে ইংরেজি জানে। তাঁর আর ওঝার কথা চালাচালি করে।
ছেলেটার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে হাস্যকর, বিদঘুটে পোশাক পরা বুড়ো ওঝা। মাথায় পাখির পালকের মুকুট। কণ্ঠে মরা মানুষের হাতের হাড়। কোমরে পাতার তৈরি কৌপীন।
কখন ফিরবে পিকো? জানতে চাইলেন হ্যারিসন।
হয়তো ফিরবে আগামীকাল বা তার পরের দিন, বলল দোভাষী, কিন্তু সেজন্যে অপেক্ষা করতে পারব না আমরা। বিষ ছড়িয়ে পড়ছে রক্তে।
মাথা কাত করে ওঝার জড় করা জিনিসপত্র দেখতে চাইলেন প্রফেসর। ওঝা কী করতে চান?
উনি বলছেন, তিনি জেনে গেছেন কেন আপনি অসুস্থ, জানাল দোভাষী।
আমি অসুস্থ, কারণ গুলি লেগেছে পায়ে, বিরক্ত হয়ে বললেন হ্যারিসন। ইনফেকশন হয়েছে।
দোভাষী জানাতেই বিশ টাকার রসগোল্লার মত ফোলা, সর্দিঝরা নাক নেড়ে প্রবল বেগে মাথা নাড়ল ওঝা। অন্য কারণে রোগ হয়েছে হ্যারিসনের। ঝড়ের বেগে বলল কী যেন।
আপনার অন্য কিছু হয়েছে, বলল তরুণ দোভাষী, আপনি জানেনও না জীবনে আসলে কী চান। ওসব জানেন ওঝা। ভয় নেই আপনার, যা চান, সেটা এনে দেবেন তিনি। বুক থেকে দূর হবে ভয়। ওঝা বলেছেন, আপনার আত্মা লড়ছে সত্যের বিরুদ্ধে।
আমি মরেছি, বিড়বিড় করলেন ডক্টর হ্যারিসন। সুস্থ থাকলে দুনিয়ার এপার আর ওপার নিয়ে ওঝার সঙ্গে আলাপ জুড়তেন, এখন আস্তে করে নামিয়ে নিলেন মাথা। মুখ তুলে কথা বলতে গিয়ে ঘাড়ে এমনই ব্যথা, মনে হচ্ছে আপাতত মাথাটা খুলে ঝুলিয়ে রাখা উচিত শিকেয়। বুড়োটা মেরে ফেলবে, কিন্তু কিছুই করতে পারব না, খুব দুঃখ নিয়ে বিশাল এক দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি।
পাশে বসে প্রফেসরের মুখে ফুঁ দিল ওঝা।
তার দাঁতের ফাঁকে জমা পচা মাংসের ভয়ানক দুর্গন্ধে নাক কুঁচকে ফেললেন হ্যারিসন।
চিৎকার করে একনাগাড়ে কী যেন বলে চলেছে নোংরা বুড়ো।
আপনার বিষাক্ত রক্তই ডেকে এনেছে খারাপ আত্মা, বলল দোভাষী। আর তাই ঘুমের ভেতর আসছে সে। বাজে সব স্বপ্ন দেখাচ্ছে। কিন্তু এবার রক্ষে নেই তার। সহজ লোক নন সর্বজ্ঞানী ওঝা বামা হাগুড়ি। ওই মন্দ আত্মাকে তাড়া দিয়ে পাঠিয়ে দেবেন অন্য জগতে। তখন ঠিকই কাজ করবে তাঁর ওষুধ।
কচমচ শব্দ পেলেন হ্যারিসন। উস্কে দেয়া হয়েছে আগুন। গালে লাগছে তাপ। বিড়বিড় করে কীসব বকতে শুরু করেছে হারামি ওঝা। তার পাশেই বসে কী যেন গুঁড়ো করছে ছোকরা। ঢেলে দিল একটা কাপে। এবার যোগ করল ছাগলের দুধ। তিন সেকেণ্ড পর ঘাড় ধরে তুলে হ্যারিসনের মুখে ঢেলে দেয়া হলো ওই তরল!
জিনিসটা এতই তিতা, হ্যারিসন এত অসুস্থ না থাকলে এক লাফে ছাত ফুড়ে পৌঁছে যেতেন সপ্ত আসমানে। গলা দিয়ে বেরোল শুধু গোঙানি। পাঁচ সেকেণ্ড পর কেমন নেশা নেশা লাগল তার। হঠাৎ ঝাপসা হয়ে গেল ঘরের সব কিছু।
কানের কাছে গুনগুন করছে ওঝা। পাতার পাখা দুলিয়ে গনগনে করে তুলছে আগুন। প্রফেসরের মনে হলো, বনবন করে ঘুরছে গোটা ঘর। ভারী হয়ে উঠল তার মাথা। দূর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে ওঝার কণ্ঠস্বর। অচেনা কোথাও থেকে আসছে দোভাষীর দুর্বল স্বর। হঠাৎ শুনলেন আরেকজনের কণ্ঠ।
পিকো? আশা নিয়ে ডাকলেন হ্যারিসন।
না! পিকো নয়, এ তো মহিলা কণ্ঠ!
কথা বলছে খুব ফিসফিস করে!
ডক্টর হ্যারিসনের চোখের সামনে বারকয়েক হাত দোলাল ওঝা। সারামুখে পড়ল কীসের মিহি গুঁড়ো। আগুনের আভায় ঝিকমিক করছে। তারই মাঝে প্রফেসর দেখলেন একটা মুখ। ওদিকে মন দিতে চাইলেন।
কিন্তু হাত নেড়ে গুঁড়ো সরিয়ে দিল ওঝা।
ক-কী দিয়েছেন আমাকে? ক্ষীণ, স্বরে বললেন হ্যারিসন।
জবাব দিল তরুণ দোভাষী, ওই জিনিস ঠাণ্ডা করে দেবে কালো জগতের আত্মাটাকে। আর বিরক্ত করতে পারবে না আপনাকে।
কিছুতেই কিছু যায়-আসে না, মনে হলো হ্যারিসনের। টের পেলেন, কমে গেছে উরুর ব্যথা। ভাবলেন, পৃথিবী ছেড়ে যাচ্ছেন বহু দূরে কোথাও। মনে পড়ল প্রিয় স্ত্রীর কথা। কয়েক বছর আগে মাত্র তিন দিনের জ্বরে মৃত্যুবরণ করেন উনি। সবসময় ভরসা দিতেন বিপদে। আগলে রাখতেন স্বামী ও সন্তানকে। নিজে অসুস্থ, তবুও উল্টে সান্তনা দিয়েছিলেন হ্যারিসনকে চিন্তা কোরো না, আমি না থাকলেও সবই ঠিকভাবে চলবে।
তুমি কোথায়, হান্না? বিড়বিড় করলেন প্রফেসর। আমি তোমাকে খুঁজে বের করব!
তাঁর নাকের ডগায় পাখির পালক নাড়ছে ওঝা শালা! ভীষণ হাঁচি আসতেই মস্ত হাঁ মেললেন প্রফেসর। কিন্তু খপ করে মুখ চেপে ধরল ওঝা। হাঁচির চাপা কয়েকটা বিস্ফোরণের পর নেতিয়ে গেলেন ডক্টর।
ঝুঁকে তাঁর চোখ দেখছে ওঝা। দাউদাউ করে জ্বলা আগুনে ফুঁ দিয়ে তুলছে কালচে ধোঁয়া। হাতে কী যেন দেখলেন হ্যারিসন। ওঝাকে ভেদ করে তার চোখ গেল বহু দূরে। দেখলেন স্ত্রীকে। শুনলেন রিনিঝিনি কণ্ঠ: না, আমার কাছে এসো না, আমাকে নিয়ে যাও তোমার কাছে!
স্ত্রীকে কাছে টেনে নিতে দুহাত তুললেন হ্যারিসন, আর তখনই আগুনের মাঝ থেকে টকটকে লাল লোহার শিক তুলে তার ক্ষতে চেপে ধরল ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর ওঝা!
করুণ এক বিকট আর্তচিৎকার ছাড়লেন প্রফেসর, তারপর একবার দাপড়ে উঠেই অচেতন হয়ে গেলেন!
.
০৭.
মাঝরাত। মেঘভরা আকাশে থেকে থেকে উঁকি দিচ্ছে একটা দুটো নক্ষত্র।
হংকং থেকে তিন মাইল পুবে ল্যান্ট্যাউ দ্বীপের চেপ ল্যাপ কোক এয়ারপোর্টে নামল এয়ারবাস এ-থ্রিএইটি কার্গো বিমান।
দেরি না করে কার্গো আনলোডে ব্যস্ত হয়ে উঠল কুরা। তাদের একজন বোধহয় সুপারভাইযার। হাত লাগাল না কাজে।
মালামাল নামিয়ে উজ্জ্বল বাতি ভরা প্যাসেঞ্জার টার্মিনালের দিকে গেল বিমান। তবে নতুন করে এয়ারক্রাফটে ওঠেনি ওই সুপারভাইযার। বিশাল এক ওয়্যারহাউসের র্যাম্পের পাশে থামল সে।
এনআরআই চিফের মোটা অঙ্কের ঘুষ পেয়েছে রাতের ফোরম্যান ও কাস্টমস অফিসার। আগেই ঠিক করা আছে, কীভাবে গোপনে এয়ারপোর্ট থেকে বেরোবে মাসুদ রানা।
ওর জন্যে অপেক্ষা করছিল ফোরম্যান। চট করে লুকিয়ে ফেলল ওকে ওয়্যারহাউসে। একটু পর এল কাস্টম্স্ অফিসার। রানার জন্যে এনেছে ট্র্যাভেল পেপার্স ও পাসপোের্ট। আগেই এনআরআই এজেন্ট রেখে গেছে রানার উপযুক্ত পোশাক।
আধঘণ্টা পেরোবার আগেই দ্বিতীয় শিফটের ক্রুদের সঙ্গে এয়ারপোর্ট ছাড়ল রানা, অন্যদের মতই উঠে পড়ল হংকংগামী বাসে। কথা হয়েছে, চালক ওকে নামিয়ে দেবে শহরের মাঝে।
রাত দুটোয় হংকঙের সেন্ট্রাল ডিস্ট্রিক্ট-এ পৌঁছুল বাস। চারপাশে সাদা ও হলদে স্কাইস্ক্র্যাপার। ঝলমল করছে কোটি বাতি। বিশেষ করে চোখে পড়ছে কমলা হ্যালোজেন বালব। নিচু মেঘে গুঁতো খেয়ে ফিরছে অত্যুজ্জ্বল আভা। এত রাতেও পুরো নির্জন নয় রাস্তা। বরাবরের মতই এবারও রানা টের পেল মস্ত এ শহরের ব্যস্ততা, চাপা এক গুনগুন আওয়াজ।
অনেকে ভেবেছিল কমিউনিস্ট চিন হংকং ফিরে পেলে হারিয়ে যাবে ঝাঁ-চকচকে শহর। তখন এখান থেকে সরিয়ে অন্য দেশে টাকা নিয়েছে বড় ব্যবসায়ীদের অনেকে। কিন্তু কিছু দিন পর টের পেল, কিছুই বদলে যায়নি হংকঙের। শুধু তাই নয়, এ শহরের ছোঁয়া লেগেছে গোটা চিনে। আধুনিক হয়ে উঠছে এ দেশের অন্য সব বড় শহর।
চিনা কমিউনিস্ট সরকার সৃষ্টি করেছে প্রচণ্ড ক্ষমতাশালী একদল ব্যবসায়ী। আর তাদেরই সেরা বিলিয়নেয়ার হুয়াং লি ল্যাং। তার সম্বন্ধে ফু-চুঙের সঙ্গে আলাপ করেছে রানা। মিথ্যা আশ্বাস দেয়নি ওর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সতর্ক করেছে ওকে। পারতপক্ষে ওই লোককে ঘাঁটাতে যাবে না চিনা ইণ্টেলিজেন্স। মহাচিন সরকার আঙুল না নাড়লেও ওই লোকের ব্যক্তিগত আর্মিই যথেষ্ট, ওদের বসের বিরুদ্ধে কিছু করতে গেলে ভয়ানক বিপদে পড়বে যে-কেউ।
বাস থামতেই কাঁধে ব্যাগ তুলে নেমে পড়ল রানা, ঢুকল ফুটপাথের পাশে ছোট এক খাবারের দোকানে। ক্যান্টোনেজ চিকেন ও এক কাপ সবুজ চা সাবাড় করে বেরিয়ে এল পাঁচ মিনিট পর। হাঁটতে শুরু করে পৌঁছুল পেনিনসুলা হোটেল এ। পাসপোর্ট অনুযায়ী ওর নাম মিস্টার টেলি রিগ্যান। ষোলোতলায় ভাড়া করা হয়েছে সিঙ্গল কামরা।
কাউন্টারে ক্লার্কের কাছে জিজ্ঞেস করল রানা, আমার কোনও মেসেজ এসেছে?
জী, রানার হাতে সাদা একটা এনভেলপ দিল যুবতী।
কামরার চাবি সংগ্রহ করে একটু সরে এসে খাম খুলল। রানা। ভেতরের কাগজে কারও নাম নেই। শুধু চারটে শব্দ: উপভোগ করুন মোপেড ভ্রমণ।
খাম ও কাগজ পকেটে রেখে লিফটে চেপে ষোলোতলায় উঠল রানা, তালা খুলে ঢুকে পড়ল নিজের কামরায়।
বিছানায় বসে ব্যাগ থেকে বের করল জেমস ব্রায়ানের দেয়া ল্যাপটপ কমপিউটার। যন্ত্রটা চালু করে ঢুকল ইন্টারনেট-এ। ব্যবহার করল বিশেষ এনক্রিপশন করা প্রোগ্রাম। কানেকশন সিকিয়োর হওয়ার পর দেখল কোনও মেসেজ এসেছে কি না। তেমন কিছু নেই। ট্যাপ করল রানা নিজের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে।
সিকিউরিটি প্রোটোকল শেষ হলে দেখল, জেমস ব্রায়ানের কাছ থেকে ওর অ্যাকাউন্টে ক্রেডিট করা হয়েছে পুরো দুই মিলিয়ন ডলার। সারাজীবনের সঞ্চয় ভদ্রলোক তুলে দিয়েছেন ওর হাতে। বদলে চেয়েছেন, যেন আমেরিকায় নিরাপদে পৌঁছে দেয়া হয় মিতাকে।
মৃদু হাসল রানা।
মিতা প্রিয় বান্ধবী। ওর বিপদ হয়েছে জানলে নিজে থেকেই এ দেশে ছুটে আসত ও, সেজন্যে প্রয়োজন হতো না কারও টাকা। ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ও প্রোগ্রাম থেকে লগ আউট শেষে ব্রাউয়ার বন্ধ করে ল্যাপটপ শাটডাউন করল ও।
একবার দেখল হোটেলের ডেস্ক থেকে পাওয়া এনভেলপ, তারপর চোখ রাখল কাগজের ওই চারটে শব্দের ওপর। উঠে চলে গেল পিকচার উইণ্ডোর সামনে। কাঁচে নাক ঠেকিয়ে দেখল নিচে। রাস্তার ওদিকে একটু দূরে মোপেড ভাড়ার দোকান। কন্ট্যাক্টের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হলে ভোরে যেতে হবে ওকে ওখানেই।
.
০৮.
বদবু ভরা আঁধারে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে মিতা। নড়াচড়া করছে কী যেন। এগিয়ে আসছে ওর দিকে। আত্মরক্ষার জন্যে সতর্ক হয়ে পযিশন নিল মিতা। হামলা ঠেকাবে। গলা উঁচু করে জানতে চাইল: কে? নিজের পরিচয় দাও!
নিচু স্বরে বলল এক লোক, বিশ্রামের সময় বিরক্ত করছ। নিজেই বরং চেহারা দেখাও!
ঘরের এক পাশে জ্বলছে তেলের একটা প্রদীপ। আবছা ওই আলোয় কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তবে চোখ সয়ে আসতে মিতা দেখল, ওর দিকে পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে বয়স্ক এক লোক। গাল ভরা দাড়ি, মুখ ঢাকা পড়েছে ঝোঁপের মত গোঁফে। ঘরের মেঝেতে নোংরা কাঁথা পেতে শুয়ে আছে বেশ কয়েকজন। মিতার মনে হলো, তারা ঘুমন্ত। পেছনে পাথরের দেয়াল। একসময়ে এই ঘরের মাঝে ছিল লোহার একসারি শিক। দুভাগে ভাগ করা হয়েছিল এই জেলখানা।
এটা কি জেল?
বয়স্ক লোকটা বলল, হ্যাঁ, ফাটক। কোনও আদালত শাস্তি দেয়নি আমাদের, তবুও বাকি জীবন থাকতে হবে এখানে। ধরে নাও, নরকে পৌঁছে গেছ, মেয়ে। এর চেয়ে খারাপ জায়গা নেই।
ভারী গলায় ধমক দিল কে যেন, চোপ, বুড়ো শালা!
ঘরের এক পাশে আরেক বন্দিকে দেখল মিতা।
সে যুবক। আকারে প্রকাণ্ড।
আগ্রহ নিয়ে মিতাকে দেখছে সে। জিভ বের করে লোভীর মত ঠোঁট চাটল।
শিউরে উঠল মিতা। বুঝে গেছে, সুযোগ পেলে ওর বারোটা বাজাবে ওই লোক।
কে তুমি? মন শক্ত করে কড়া সুরে জানতে চাইল ও। বয়স্ক মানুষটাকে ধমক দিচ্ছ কেন? তোমার খায় না পরে?
মনে হলো, ওর কথায় অপমানিত হয়েছে বিশালদেহী যুবক।
মিতা বুঝে গেল, এই কারাগারে সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে হলে দাপট দেখাতে হবে। বুঝিয়ে দিতে হবে, কম যায় না ও-ও।
কাঁথা ছুঁড়ে ফেলে উঠে দাঁড়াল যুবক। মিতার চেয়ে অন্তত দেড় ফুট লম্বা সে। ওজনে কমপক্ষে এক শ বিশ পাউণ্ড বেশি। অন্য বন্দিদের তুলনায় বেশি খাবার পায়। মিতা বুঝে গেল, শক্তি খাঁটিয়ে অন্যদের খাবার কেড়ে নেয় এই লোক। নারকীয় এই খাঁচার ইঁদুরগুলোর রাজা সে।
মিস্টার লৌ নামে ডাকবে, গম্ভীর কণ্ঠে জানিয়ে দিল যুবক। এখানে থাকবে বহু বছর। কাজেই বুঝে নাও কী করতে পারবে, আর কী পারবে না। আমার কথার বাইরে গেলে রক্ষা নেই।
এগোতে শুরু করেছে লৌ।
আত্মরক্ষার জন্যে তৈরি হয়ে গেল মিতা।
প্লিয, থামো! বলল বুড়ো, এখন মারামারি কোরো না। দূরের দেয়ালে আঙুল তাক করল সে। ওখানে সরু ফাটল। একসময় ছিল গানপোর্ট। একটু আগেও ওদিক ছিল কালো, এখন ওখানে মৃদু আবছা ধূসর আলো। ভোর হচ্ছে।
একটু পর আসবে, আবারও বলল লোকটা, এখন মারপিট শুরু করলে কাউকে খাবার দেবে না ওরা।
ঘুরে বুড়ো মানুষটাকে দেখল মিতা। গায়ে মাংস নেই, বেরিয়ে গেছে বেচারার পাজরের হাড়। অগ্রসরমাণ লৌ-র দিকে চোখ রেখে পাথরের বাঙ্কের দিকে পিছিয়ে গেল ও।
মেঝেতে বসে পড়ল লৌ, ঘুমন্ত এক লোককে ডেকে তুলে দেখাল মিতাকে। ওই মেয়ে বাড়াবাড়ি করছে।
চুপচাপ মাথা দোলাল তার চেলা।
পেরোল থমথমে কয়েক মিনিট, তারপর সরু ফাটল দিয়ে এল সূর্যের সোনালি আলো।
জেগে উঠছে কারাগারের অন্য বন্দিরা।
মিতা দেখল, ওরা এই ঘরে আছে মোট সাতজন। বুড়ো, লৌ, তার বন্ধু, সর্বক্ষণ চোখ নামিয়ে রাখা ভারতীয় এক মহিলা, ইউরোপিয়ান এক প্রৌঢ়, চার-পাঁচ বছরের এক ছেলে আর ও নিজে।
ছেলেটার পাশের প্রৌঢ় খাটো। অবশ্য চওড়া কাঁধ। মনে হলো অসুস্থ। কথা ছেড়ে উঠে বসল না। কয়েক সেকেণ্ড দেখার পর মিতার মনে হলো, ওই লোক মৃত্যুপথযাত্রী।
.
০৯.
মোপেড ভাড়া দেয়ার দোকানের সামনে লাইনে দাঁড়িয়ে চারপাশ দেখছে মাসুদ রানা। আকাশছোঁয়া সব দালানের ফাঁক দিয়ে রাস্তায় পড়েছে সূর্যের লালচে রোদ। এরই ভেতর শুরু হয়ে গেছে সকালের হুড়োহুড়ি। নানাদিকে ছুটছে গাড়ি, বাস ও ট্রাক। গাড়িঘোড়ার মাঝ দিয়ে পথ করে নিচ্ছে পথচারী ও শত সাইকেল আরোহী। বাঁক নিয়ে পরের জ্যামে গিয়ে থামছে ডাবল-ডেকার বাস। বোধহয় ঝট করে লেন বদল করতে ওগুলোর ড্রাইভারদেরকে বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়েছে ফর্মুলা ওয়ান কর্তৃপক্ষ থেকে। সর্বক্ষণ চলছে হর্নের প্যাঁ-পোঁ-ভ্যাঁ! পথচারী এড়াতে গিয়ে ইন্টারসেকশনে কর্কশ শব্দে ব্রেক কষছে গাড়ি।
গোলমেলে এই পরিবেশে মোপেড নিয়ে রাস্তায় নামা সহজ কথা নয়। ব্যাপারটা প্রায় শত শত গরুর স্ট্যাম্পিডের সময় ছাতি হাতে তেড়ে যাওয়ার মত। তবুও মোপেড ভাড়া দেয়ার দোকানের সামনে চাইনিজ ও বিদেশির দীর্ঘ লাইন। সবারই চাই হালকা বাহন।
লাইনে দাঁড়ানো কাস্টোমারদের ওপর চোখ পড়তেই রানাকে দেখল ক্লার্ক। হাতের ইশারা করে ডাকল, কাম কাম, স্যল! আপনার বাইক লেডি।
লাইন থেকে বেরিয়ে এল এভারেস্ট বিজয়ী রানা। হিংসা নিয়ে ওকে দেখছে সবাই। ক্লার্কের পিছু নিয়ে দোকানের অন্দরমহলের দিকে পা বাড়াল ও। একটু বিস্মিত, কোনও মোপেড চায়নি। এই লোক ওকে চিনে ফেলেছে, কারণটা বোধহয় এনআরআই চিফ জেমস ব্রায়ান। ছবি দেখানো হয়েছে ওর।
কাম-কাম, স্যল!
দোকানের একেবারে শেষাংশে পৌঁছে রানা দেখল, সামনের দরজা পেরোলেই সারি দিয়ে রাখা অন্তত চল্লিশটা ধচা মোপেড।
দরজার ওদিকে যেতেই দেখল চার চাইনিজ লোককে। তবে দুঃখের কথা, তাদের হাতে সাবমেশিন গান! মাযল ওর বুকেই তাক করা!
মাই গত, মাই গত! মাথার ওপর দুহাত তুলল ক্লার্ক। ভালই অভিনয়। পরে কেউ বলতে পারবে না সে-ই ফাঁসিয়ে দিয়েছে রানাকৈ। চরকির মত ঘুরেই আবারও ঢুকে পড়ল দোকানের ভেতরে। তাকে আর দেখা গেল না।
এ ধরনের বিপদের জন্যে তৈরি ছিল না রানা।
চার চাইনিজের একজন হাতের ইশারা করল ওকে। বসতে হবে পাশের ওই ওঅর্ক বেঞ্চে। পেছন থেকে ওর কাঁধে চাপ দেয়ায় বেঞ্চে বসল রানা। এক পাশ থেকে এল এক চাইনিজ, তন্নতন্ন করে সার্চ করল ওর দেহ।
অস্বাভাবিক কিছুই পেল না। চুপ করে বসে আছে রানা। ভাবছে, শুধু যে হুয়াং লি ল্যাং-এর লোকদের ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে, তা নয়, আর কোনও দলও নেমেছে অন্য কোনও উদ্দেশ্যে। অবশ্য এরা হতে পারে সিক্রেট পুলিশ বা মিনিস্ট্রি ফর স্টেট সিকিউরিটির সদস্য। শেষের ওই সংগঠন এফবিআই-এর মতই। তবে এরা এত তাড়াতাড়ি ওকে খুঁজে নেয়ায় বেশ বিস্মিত রানা।
এখন কথা হচ্ছে, ওকে টার্গেট করল কেন?
এখনও কিছুই করেনি ও!
পাসপোর্ট নিয়ে দেয়া হলো পেছনের লোকটার হাতে। পাতা ওল্টাবার খসখস শব্দ শুনল রানা। কয়েক সেকেণ্ড পর বলে উঠল পেছনের লোকটা, তো কেন হংকঙে এসেছেন, মিস্টার… টেলি রিগ্যান?
ব্যবসার কাজে, বলল রানা। তবে তার আগে ঘুরে দেখব দর্শনীয় জায়গাগুলো।
পেছনের লোকটা বলল, বিপদ আপনাকে খুব কাছে টানে, তাই না, মিস্টার রিগ্যান? ব্যবসায়ীরা কখনও মোপেড ভাড়া করে না। তাদের লাগে গাড়ি।
ওঅর্ক বেঞ্চে থপ করে ফেলা হলো পাসপোর্ট। চোখের কোণে একটা বুট সামনে বাড়তে দেখল রানা। মাথার পেছনে টেনে নেয়া হলো আগ্নেয়াস্ত্রের স্লাইড। এবার বোধহয় গুলি করে ফুটো করবে ওর মাথা!
পেছন থেকে বলল লোকটা, তো এবার কী ধরনের বিপদে পড়তে চান?
জবাব দিল না রানা, লড়তে তৈরি। চেষ্টা করবে আত্মরক্ষা করতে, কিন্তু থমকে গেল অন্য কারণে। ইংরেজি বললেও এই লোকের কণ্ঠে অন্য ভাষার সুর!
ওর পেছনে অস্ত্র হাতে লোকটা একজন রাশান!
.
১০.
পাথরের তৈরি কারাগারে খাবার যে এনেছে, তাকে পাহারা দিতে এসেছে সশস্ত্র কজন গার্ড। তুবড়ে যাওয়া নোংরা গামলায় দিয়েছে কয়েক দিন আগে তৈরি পাথরের মত শক্ত, বাসি পাউরুটি ও অতিরিক্ত লবণ দেয়া পচতে শুরু করা ডাল। সাত বন্দির জন্যে সাতটে গামলা, কিন্তু গার্ড ও খাবার পরিবেশনকারী লোহার গেট বন্ধ করে এলিভেটরে ওঠার আগে, নিয়ম অনুযায়ী খাবারের দিকে হাত বাড়াল কেউ।
বন্দিদের মধ্যে প্রথমে সামনে বাড়ল লৌ, বেছে নিল সবচেয়ে বেশি ডাল ভরা গামলা। শুধু তাই নয়, নিজের জন্যে জড় করল সব পাউরুটি। বাচ্চা ছেলেটার বোধহয় খুবই খিদে, হঠাৎ ছুটে এসে লৌ-এর হাত থেকে কেড়ে নিল এক টুকরো পাউরুটি।
খাবার ছিনতাই হয়েছে দেখে খেপা বাঘের মত ছেলেটার ঘাড় আঁকড়ে ধরতে চাইল লৌ। কিন্তু অনেক চালু ওই পিচ্চি। এক দৌড়ে ফিরে গেল ঘরের পেছনে।
এজন্যে তোর হাতদুটো ভেঙে ফেলব! হুঙ্কার ছাড়ল দানব।
জবাব দিল না পিচ্চি। কাঁপা হাতে পাউরুটি তুলে দিতে চাইছে মৃতপ্রায় ইউরোপিয়ান লোকটার মুখে।
ঝড়ের বেগে ওদিকে ছুটল লৌ। ফেরত দে আমার পাউরুটি, হারামজাদা!
সামনে বেড়ে বাধা দিল মিতা। ওর পাউরুটি ও নিয়েছে।
ধাক্কা দিয়ে মিতাকে সরিয়ে ছোঁ মেরে বাচ্চা ছেলেটার হাত থেকে পাউরুটি কেড়ে নিল লৌ। তাতেও রাগ কমেনি, কষে এক চড় বসাল বেচারার মাথার পাশে। ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠে এক পাশে পড়ে গেল বাচ্চাটা। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
ভয় পেয়েছে অন্য বন্দিরা।
হতবাক হয়ে লৌকে দেখল মিতা, পরক্ষণে রাগে গনগন করতে লাগল মগজ। কঠোর চোখে বদমাশ লোকটাকে দেখল ও।
অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি দেখে দাঁতমুখ খিঁচিয়ে আপাদমস্তক ওকে দেখল লৌ। দারুণ তোর শরীর, শালী! এবার দেখব কত মজা দিতে পারিস! নিজের নোংরা কৌতুকে হো-হো করে হেসে উঠল নিজেই। ওটা না থাকলে তোকে আগেই মেরে ফেলত ল্যাং!
চোখে আগুন নিয়ে দানবটাকে দেখল মিতা।
ঠোঁট বাঁকা করে বলল লৌ, তুই কি ল্যাং-এর নাগরী, না পতিতা? এবার চেখে দেখব তুই আসলে কী!
ভয় দেখাতে দেড় ফুট ওপর থেকে মিতাকে দেখল সে। ফলে সরে গেছে একটু বামে। সোজা করে রেখেছে পা, একটু বেকায়দা কোমরের ওপরের অংশ।
মাসুদ রানার প্রিয় একটা কৌশল মনে পড়তেই চট করে পাথরের বাঙ্কে বসল মিতা। পিছিয়ে গেছে। যে-কেউ ভাববে ভয় পেয়েছে ভীষণ। চুপ করে দেখল, চওড়া হাসি ফুটে উঠেছে লৌ-এর পুরু দুই ঠোঁটে।
তার মতই নিজেও হাসল, মিতা, তবে হাসিটা মিষ্টি। পরক্ষণে ঝট করে সামনে বাড়ল ওর ডান পা, লাগল দানবের হাঁটুর বাটির ওপর। পুতিয়ে যাওয়া ছোট পটকার মত বিশ্রী ফটাক শব্দে সরে গেল বাটি। চিরকালের কুঁজোর মত বাঁকা হয়ে, হাউমাউ করে উঠে পিছিয়ে যেতে চাইল লৌ।
তখনই বাঙ্ক থেকে সামনে বাড়ল মিতা।
ল্যাংড়া ফকিরের মত টলমল করতে করতে ওর বুকে ঘুষি বসাতে চাইল লৌ। কিন্তু ভজ মেরে সরে গেছে মিতা। দেহের ভারসাম্য রাখতে না পেরে হুড়মুড় করে মেঝেতে পড়ল দানব। এজন্যেই অপেক্ষা করছিল মেয়েটা, ওর বুট পরা পা ঠাস্ করে লাগল লৌ-এর মুখে। নরম হাড় ভেঙে যাওয়ায় নাকের দুই ফুটো দিয়ে ছিটকে বেরোল রক্ত।
ওরে, বাবারে! মেরে ফেলেছে! করুণ আর্তনাদ ছাড়ল চৈনিক দানব।
বাঙ্ক থেকে নেমে মিতার দিকে ছুটে এল লৌ-এর বন্ধু। ট্যাকল করবে, হাত বাড়িয়ে দিয়েছে শত্রুর গলা খপ করে ধরতে। কিন্তু অনায়াসেই ব্লক করল মিতা। ওই লোকেরই গতি কাজে লাগিয়ে জুডোর কৌশলে তাকে ছিটকে ফেলল দেয়ালের ওপর।
তাতেই শেষ হলো না লড়াই। ফেলে দেয়ার সময় লোকটার ডানহাত মুচড়ে ধরেছে মিতা। ওর বামহাতি ঘুষি নেমেছে তার কনুইয়ের পেছনে। ফলে মড়াৎ করে ভাঙল হাড় প্রচণ্ড ব্যথায় পাগল হয়ে উঠল লোকটা। খাবি খেতে লাগল মেঝেতে পড়ে। মিতার জোরালো এক লাথি তাকে পৌঁছে দিল প্রিয় বন্ধুর পাশে। গোঙাতে শুরু করে সে দেখল, টকটকে লাল রক্তে ভেসে যাচ্ছে বন্ধুর মুখ।
দুফুট দূর থেকে দুই মাস্তানকে দেখল মিতা। আরও কিছু লাগবে? নাকি আজকের মত যথেষ্ট হয়েছে?
মেঝেতে ছেঁচড়ে পিছিয়ে গেল লৌ। পাশেই তার বন্ধু। মৃদু কাতর ধ্বনি ছেড়ে জেলখানার গভীরে আঁধারে লুকিয়ে পড়ল তারা।
অন্য সবাই প্রশংসার চোখে দেখছে মিতাকে।
খুশিতে খিলখিল করে হাসছে বুড়ো। সামনে বেড়ে প্রাপ্য পাউরুটি নিয়ে খেতে লাগল সে।
যে যার পাউরুটি আর ডাল বুঝে নাও, বলল মিতা। লৌ বা তার বন্ধুর জন্যে কিছুই রাখতে হবে না।
সত্যি? আরেক টুকরো পাউরুটি নিল বুড়ো। অ্যাই, নাও তোমরা! লৌ বা চুং খাবে না! আর খাবেই বা কী করে, সামনের দাঁত তো একটাও নেই! আজ আমাদের পেট ভরে খাওয়ার দিন!
দৌড়ে এসে ডালের সবচেয়ে বড় গামলা ও মস্ত এক টুকরো পাউরুটি নিল পাঁচ বছরের বাচ্চা ছেলেটা। ফিরে গিয়ে চেষ্টা করল মৃতপ্রায় বন্ধুকে খাওয়াতে।
দুর্বল স্বরে বলল লোকটা, তুমি খাও, পাবলো, তোমার কাজে লাগবে।
কথা শুনে তাকে পুব ইউরোপ বা রাশার লোক বলে মনে হলো মিতার। অবাক হয়ে ভাবল, অসুস্থ এই লোক বা বাচ্চা ছেলেটা কী করেছে, যে ওদেরকে এভাবে আটকে রেখেছে। হুয়াং লি ল্যাং! এটা অসম্ভব, এরা হুমকি ছিল ওই লোকের কাছে!
কষ্টেসৃষ্টে মেঝেতে উঠে বসে মিতাকে বলল লোকটা, এবার ওরা খুন করবে আপনাকে। থামবে না প্রতিশোধ না নিয়ে।
মৃদু মাথা নাড়ল মিতা। মনে আছে রানার একটা কথা: হাত-পা যদি চালাতেই হয়, তো এমনভাবে চালাও, শত্রু যেন আগামী কয়েক দিনের ভেতর উঠে বসতে না পারে।
না, কাজ ঠিকই শেষ করেছি, ভাবল মিতা। লোকটাকে বলল, ভাববেন না, আপাতত এক সপ্তাহের ভেতর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না ওরা।
ঘুমের সময় সাবধান, বলল ককেশিয়ান। প্রথম সুযোগেই খুন করবে। ছোট্ট ছেলেকে দেখাল সে। রাতে আপনার ওপর চোখ রাখবে পাবলো। কখনও ঘুমায় না ও।
ছেলেটাকে দেখল মিতা, বাঙ্কে বসে ছোট্ট একটা চড়ই পাখির মতই ঘাড় কাত করে ওকে দেখছে।
পাবলো কি আপনার ছেলে? জানতে চাইল মিতা।
না, মাথা নাড়ল প্রৌঢ়। কিডন্যাপ করেছিলাম ওকে, যাতে বিক্রি করতে পারি হুয়াং লি ল্যাং-এর কাছে।
বিস্মিত হলো মিতা। আসলে কী বলতে চাইছে লোকটা? ওর মনে হয়েছে, বাচ্চাটাকে অন্তর থেকে ভালবাসে সে। আপনি কিডন্যাপ করেছিলেন?
বাবা-মার কাছ থেকে নয়, ওর কোনও পরিবার নেই। সেই ছোটবেলা থেকে যেখানে ছিল, সেই দালানের চেনা কিছু লোকের কাছ থেকে নিয়েছিলাম। তবে ওটা ওর বাড়ি ছিল না।
দেখে তো ওকে রাশান মনে হচ্ছে, আন্দাজ করল মিতা।
মৃদু মাথা দোলাল লোকটা। ওর দায়িত্বে ছিল সায়েন্স ডিরেক্টোরেট। বছরের পর বছর এক্সপেরিমেন্ট চালিয়েছে।
কেন যেন খাড়া হয়ে গেল মিতার ঘাড়ের রোম।
এক্সপেরিমেন্ট?
জবাব দিতে গিয়ে বেদম কাশির কারণে থেমে গেল লোকটা। একটু পর সামলে নিয়ে বলল, যদি বলতে পারতাম যে ওকে রক্ষা করতে চেয়েছি, তা হলে মনটা ভাল হতো, কিন্তু পুরো ঘটনা অনেক জটিল। পাবলোকে চেয়েছিল হুয়াং লি ল্যাং। আমাদেরকে বলেছিল, ওকে নিরাপদে রাখরে। ব্যবস্থা করবে চিকিৎসার। কিন্তু বাস্তব কথা হচ্ছে, পাবলোকে চুরি করি আমরা পয়সার জন্যে।
ওকে কিডন্যাপের পর কী হয়েছিল? কী করে এই নরকে এসে পড়লেন?
আরেক দফা প্রচণ্ড কাশি ঝাঁকিয়ে দিচ্ছে লোকটাকে। কিছুক্ষণ পর দমক থেমে গেলে বলল, ট্রলার নিয়ে বেয়ারিং সি পাড়ি দেয়ার সময় পড়লাম ভয়ানক বিপদে। নষ্ট হলো ন্যাভিগেশন সিস্টেম ও রেডিয়ো। শুধু তাই নয়, পথ হারিয়ে ট্রলার চলে গেল আর্কটিক-এ। আমার নাবিকরা বলতে লাগল, অভিশাপ পড়েছে আমাদের ওপর। হয়তো ঠিকই বলেছিল ওরা।
অভিশাপ? কীসের অভিশাপ? জানতে চাইল মিতা।
আমি ট্রলারের ক্যাপ্টেন, কমপাস অনুযায়ী সারারাত দক্ষিণে গেলাম, কিন্তু ভোরে সূর্য উঠলে দেখলাম গেছি পুরো উল্টো দিকে। পিছু নিল হাঙর আর কিলার ওয়েইল। যেন জানত, শেষ পর্যন্ত ওদের পেটে আমরা যাবই। ট্রলার ঠেলে নিয়ে বারবার ফেলল হিমশিলার ওপর। একেকবারে হামলা করল দুই থেকে তিনটে। জাহাজ ডুবে যাচ্ছে দেখে লাইফবোটে চড়ল নাবিকরা। কিন্তু ওদের ওপর চড়াও হলো ওরা। সাগরে পড়তেই খুন হলো আমার নাবিকরা। নিজের চোখে দেখলাম, তলিয়ে গেল লাইফবোট। তবে বেঁচে গেলাম আমি পাবলোকে নিয়ে। ঠাই হলো বড় এক টুকরো বরফের ওপর।
অসুস্থ লোকটার কাছে যেতেই পচা মাংসের গন্ধ পেল মিতা। নোংরা কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে রাখা হয়েছে কেটে ফেলা ডান হাঁটু। এ ছাড়া, গ্যাংগ্রিনে কালো দুহাত, নাক ও মুখ। কিন্তু ক্যাপ্টেনের মত অসুস্থ হয়নি পাবলোলা।
ছেলেটার ফ্রস্টবাইট হয়নি কেন? জানতে চাইল মিতা।
ছুরি দিয়ে বরফ খুঁড়ে ছোট গুহা তৈরি করি, বলল সার্গেই দিমিতভ। সর্বক্ষণ আগলে রেখেছিলাম ওকে। ওখানেই ছিলাম পুরো তিন দিন। সূর্য উঠল না। বুঝলাম চতুর্থ দিন মরে যাব আমরা। কিন্তু তৃতীয় সন্ধ্যায় এল হেলিকপ্টার। আমাদের খুঁজে বের করে সরিয়ে নিল হুয়াং লি ল্যাং–এর লোক।
কী কারণে আপনাকে এই জেলখানায় আটকে রেখেছে সে?
কোর্স থেকে এত সরে গিয়েছিলাম, ওরা ধরে নিয়েছে বিশ্বাসঘাতকতা করতে চেয়েছি।
পাবলোকে দেখল মিতা। এত কিছু হলো ছোট্ট এই ছেলের জন্যে? এর কারণ কী? কে এই ছেলে?
ওর কোনও পরিবার নেই। বংশ জানা নেই আমার। কিন্তু খুব অস্বাভাবিক ক্ষমতা আছে ওর। দুর্বল লাগতেই কাঁথার ওপর শুয়ে পড়ল ক্যাপ্টেন দিমিতভ। জন্ম থেকেই ওর ডিজেনারেটিভ নিউরোলোজিকাল ডিসঅর্ডার রোগ। ওর বাবা-মার টাকা ছিল না যে চিকিৎসা করাবে, তাই দান করে দেয় রাশান সায়েন্স ডিরেক্টোরেটকে। বিজ্ঞানীরা একের পর এক এক্সপেরিমেন্ট করতে লাগল পাবলোর ওপর। অনেকটা ঠেকিয়েও দিল অসুখ। কিন্তু এর ফলে শুরু হলো সাইড এফেক্ট। অনেক কিছু দেখতে আর শুনতে পায় পাবলো। সাধারণ মানুষ এসব জানতেও পারে না।
কাঁপা ক্যাপ্টেন দিমিতভের কণ্ঠ।
তার বক্তব্য সঠিক, না জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকছে, এ নিয়ে মনে গভীর সন্দেহ তৈরি হয়েছে মিতার। জানতে চাইল, তা হলে কি পাবলো আসলে সাইকিক?
মৃদু মাথা নাড়ল দিমিতভ। না, ওটা দৈহিক। ম্যাগনেটিক অ্যানোম্যালি বা ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ডিসটার্বেন্স চট করে টের পায়। ফলে সাধারণ মানুষ যা বুঝবে না, ওর কাছে সেসব পানির মত পরিষ্কার।
মিতা চমকে গেছে ফিযিসিস্ট হিসেবে। একটু পর জানতে চাইল, সত্যিই কি তা পারে?
জানি না, আবারও কাশতে লাগল ক্যাপ্টেন। কাশি থেমে যাওয়ার পর বলল, হুয়াং লি ল্যাং মনে করত পাবলো ওসব পারে।
দিমিতভ অতীত ক্রিয়া ব্যবহার করেছে, তাই জানতে চাইল মিতা, তো ওকে এখানে ফেলে রাখল কেন? ল্যাং এখন আর তা মনে করে না?
আস্তে করে মাথা নাড়ল ক্যাপ্টেন। না, তার কোনও কথাই শুনবে না পাবলো। হুমকি দিয়ে, মারপিট করে বা ড্রাগ দিয়েও ওর মুখ খোলাতে পারেনি সে। বড়জোর নিজের সঙ্গে কথা বলে বা গান গায়। মরে গেলেও সরবে না আমার কাছ থেকে। তাই শেষে আমার সঙ্গে ওকেও এখানে পাঠিয়ে দিয়েছে ল্যাং। তার লোকজন জানিয়ে দিয়েছে, চোখের সামনে আমার মৃত্যু দেখতে হবে ওর। তখন ঠিকই খুঁজে নেবে নতুন প্রভু।
বাচ্চা ছেলেটাকে দেখল মিতা। সড়াৎ-সড়াৎ আওয়াজ তুলে ডালে চুমুক দিচ্ছে ও। পাবলো কি বুঝতে পেরেছে, কী চাইছে ল্যাং?
আমার তো তা-ই মনে হয়, বলল দিমিতভ, তবে কিছুই পাত্তা দিচ্ছে না ও।
হঠাৎ মুখ তুলে তাকাল ছেলেটা, চোখ গেল এলিভেটরের বন্ধ দরজার ওপর। কিছুইঘটল না। বাইরে থেকে এল না কোনও আওয়াজ। কিন্তু কয়েক সেকেণ্ড পর শাফটের নিচে এসে থামল এলিভেটর কার। খুলে গেল দরজা।
টেইযার হাতে বেরিয়ে এল গার্ডরা।
আপনার নাম কি? সার্গেইর কাছে জিজ্ঞেস করল মিতা।
সার্গেই দিমিতভ, বলল ট্রলারের ক্যাপ্টেন। কথা শেষে ভীষণ কাশতে লাগল। বিশ সেকেণ্ড কেশে মুখের ওপর থেকে সরাল ঘেঁড়া কাঁথা। ওই ক্লাপড়ে মেখে আছে তাজা রক্ত।
মিতা বুঝে গেল, বড়জোর আর দুএক দিন আছে, মানুষটা।
.
১১.
রাশান লোকটার প্রশ্নের জবাব না দেয়ায় তার দলের এক পাণ্ডা অস্ত্র তাক করেছে রানার চোখে।
আমি যদি মরেই যাই, আর একটা শব্দ বেরোবে না মুখ থেকে, বলল রানা।
ভয়ঙ্কর কঠিন চেহারা করে চেয়ে আছে চাইনিজ মাস্তান, কিন্তু রানার কথাটা শুনে হেসে ফেলল রাশান। ঠিক আছে, আমাদের সঙ্গে নিয়ে চলো ওকে।
পেছন থেকে কে যেন খসখসে এক তোয়ালে দিয়ে বেঁধে দিল রানার চোখ, তারপর ঠেলে ওকে তোলা হলো একটু দূরের ভ্যানে। কিছুক্ষণ পর ওরা পৌঁছুল সাগরতীরে। পিঠে গুঁতো খেয়ে রানা উঠল ডিজেল ইঞ্জিনওয়ালা এক জাঙ্ক-এ।
ইঞ্জিনের বিকট ভ্যাট-ভ্যাট শব্দ তুলে বন্দরের মাঝ দিয়ে চলল প্রাচীন যুগের ভারী নৌকা। বেঞ্চে বসে রানা বুঝতে চাইছে কোথায় চলেছে, বা গতি কেমন। কয়েক মিনিট পর জিজ্ঞেস করল, আমাকে কোথায় নিয়ে চলেছ?
খুশি মনে বলব সব, কিন্তু তার আগে আমার জানতে হবে, আসলে কী কারণে এসেছ তুমি, জবাব দিল রাশান লোকটা।
চুপ করে থাকল রানা। বুঝতে চাইছে পরিস্থিতি।
ব্যাপারটা গোলমেলে হয়ে গেল না?
ধরে এনে বাঙালী এক গুপ্তচরকে জেরা করছে এক রাশান লোক কেন ও হংকঙে!
কসেকেণ্ড পর পাটাতনের নিচে ভ্যাট-ভ্যাট-ভুট-ভুট পুট-পুট-পুট-পুট-ফুস্! শব্দে থেমে গেল ডিজেল ইঞ্জিন। আর এগোল না জাঙ্ক, একবার এদিক, আবার ওদিক দুলছে। সাগরের ঢেউয়ে।
উঠে দাঁড়াও, আদেশ দিল রাশান।
রেলিং ধরে বেঞ্চ ছেড়ে উঠে দাঁড়াল রানা। বাঁধন খুলে সরিয়ে নেয়া হলো চোখের ওপর থেকে তোয়ালে। ঘুরে দাঁড়াতে গেল রানা। কিন্তু নির্দেশ এল, তাকাও সোজা সামনে!
ওর পিঠে খোঁচা দিল রাইফেলের মাল।
নির্দেশ মত সরাসরি তীরে তাকাল রানা। ও আছে নড়বড়ে জাঙ্কে, তীর থেকে এক মাইল দূরে।
ওই যে ভিক্টোরিয়া হার্বার!
ওদিকেই আছে হংকঙের আকাশে খোঁচা দেয়া মস্ত উঁচু সব বহুতল অফিস।
শুনেছি, বর্তমান পৃথিবীর সেরা একজন স্পাই তুমি। শুধু তাই নও, নিজের ছোট্ট ওই দেশের জন্যে প্রাণ দিতেও দ্বিধা নেই তোমার। কাউকে ভয় পাও না।
চুপ করে থাকল রানা।
তোমার নাম মাসুদ রানা, বলল রাশান। বাঙালী গুপ্তচর। এমন তো নয় যে দল বদল করেছ? বাংলাদেশের জন্মের আগে থেকেই তোমাদের দেশের প্রাপ্য স্বাধীনতা ঠেকাতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছে আমেরিকান সরকার বা সিআইএ। সেক্ষেত্রে মার্কিন সংস্থার হয়ে কাজ করতে এ দেশে এলে কেন? এর জবাব জানতে চাই।
রেলিঙে হাত রেখে রানা ভাবল, এরই ভেতর বেশ কিছু প্রশ্ন তুলেছে রাশান লোকটা।
নীরবতা ভাঙল না ও।
তুমি হয়তো আছ বন্ধুদের ভেতর, কাজেই মুখ খোলো, বলল লোকটা। নইলে বুঝব, সত্যিই বেঈমানি করেছ। দেশের সঙ্গে। আমেরিকার হয়ে ক্ষতি করতে চাও চিনের। সেক্ষেত্রে জানব, যা ভাবতাম তোমার ব্যাপারে, সবই মিথ্যা। সত্যিই কি কোনও চাইনিজ কর্মকর্তাকে খুন করতে এসেছ?
আমি খুনি নই, বলল রানা, আমাকে মেরে ফেলতে না চাইলে কাউকে খুন করি না।
তা হলে এ দেশে এলে কেন?
রানা একবার ভাবল, রেলিং টপকে ঝাঁপিয়ে পড়বে সাগরে। পরক্ষণে বুঝল, পেছন থেকে আসা গুলি ঝাঁঝরা করবে ওর পিঠ।
জানতে চাইছি, কেন তুমি এই দেশে?
এসেছি আমার ব্যক্তিগত একটা কাজে, মুখ খুলল রানা।
তার মানে এনআরআই থেকে তোমাকে পাঠানো হয়নি?
ওই সংগঠনের চিফের সঙ্গে সম্পর্ক আছে আমার কাজের।
সেক্ষেত্রে এসেছ হারিয়ে যাওয়া ওই মেয়ের জন্যে?
যা খুশি ভেবে নিতে পারো।
এফএসবি ভাল করেই জানে, ওই মেয়েকে আটকে রেখেছে ল্যাং।
চুপ করে আছে রানা।
তোমার মিশন সফল করা খুব কঠিন, বলল রাশান, তবে ওই যে, সরাসরি সামনে টার্গেট।
রানা দেখল, তীরে সোনালি রোদে ঝিকঝিক করছে সাদা মার্বেল দিয়ে কারুকাজ করা বহুতল ভবন, টাওয়ার ল্যাং।
ওই মেয়ের কাছ থেকে কী যেন আদায় করতে চায় ল্যাং।
টাওয়ারের পাথরের ভিত্তি দেখছে রানা। ভাবছে, উবে গেছে ওর কাভার। সবই জানে রাশান ইন্টেলিজেন্সের এই লোক। ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াল ও। এবার বাধা দিল না কেউ।
জাঙ্কের পাইলট হাউসের ছাউনির ছায়ায় আরাম করে দাঁড়িয়ে আছে শক্তপোক্ত দেহের এক লোক, পরনে কালো পিকোট, হাতে চামড়ার গ্লাভস্। দৈর্ঘ্যে বড়জোর পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি। চুল ধূসর। তুবড়ে গেছে ফ্যাকাসে গোল মুখ। দুগালে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি। কৌতূহলী চোখ, আত্মবিশ্বাসী। আশপাশে দলের লোক নেই। অস্ত্রও নেই রাশানের হাতে।
এই লোকের বয়স আন্দাজ চল্লিশ, ভাবল রানা। গম্ভীর কণ্ঠে জানতে চাইল, কে তুমি?
নাম ইগোর দিমিতভ, বলল লোকটা।
তুমি কি আমার কন্ট্যাক্ট?
না, তা নই।
সে কোথায়?
ডানহাতে মাছি তাড়াবার ভঙ্গি করল ইগোর দিমিতভ। ওর মত হারামজাদা পাওয়া দায়। এদেরকে অন্তর দিয়ে ভালবাসি। আমার দেয়া ঘুষ খেয়ে ল্যাং মেরে দিয়েছে। তোমাকে। এদিকে তুমি চাইছ হুয়াং লি ল্যাংকে ল্যাং মারতে। তাতে আগ্রহ কম নেই আমারও। বলতে পারো, আমরা আসলে একই দলের লোক।
আমার কাছে কী চাও?
ওই যে, আগেই বলেছি, চাই সাহায্য করতে, বলল ইগোর, যাতে ল্যাং-এর হাত থেকে ছুটিয়ে নিতে পারো ওই মেয়েকে।
বদলে কী দিতে হবে?
ছাউনির তলা থেকে বেরিয়ে রানার পাশে থেমে টাওয়ার ল্যাং-এর দিকে তাকাল ইগোর দিমিতভ। রাশান এক বাচ্চা ছেলেকে আটকে রেখেছে ল্যাং। সায়েন্স ডিরেক্টোরেটের বড় পদে আছেন ওর মা। আমার কাজ ওই ছেলেকে দেশে ফিরিয়ে নৈয়া।
ছেলেটাকে কিডন্যাপ করল কেন? জানতে চাইল রানা।
কারণ, ওর মা কাজ করেন হাই-এনার্জি ফিযিক্সের ওপর, কাঁধ ঝাঁকাল ইগোর। টাকা দিয়ে কিছু কিনতে না পারলে, তা চুরি করে ল্যাং। তা না পারলে, আদায় করে গায়ের জোরে। ওই ছেলের মা-র কাছ থেকে জরুরি তথ্য চাইছে সে।
হাই-এনার্জি ফিক্সি, ভাবল রানা। ওই বিষয়ে লেখাপড়া করেছে মিতা। সেজন্যেই গেছে আর্কিওলজিস্ট হ্যারিসনের সঙ্গে মেক্সিকোতে বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী স্ফটিক খুঁজতে।
হাই-এনার্জি ব্যবহার করে অস্ত্র তৈরি করতে চাইছে। রাশা? জানতে চাইল রানা।
কয়েক সেকেণ্ড পর বলল ইগোর, জানি না। তবে সায়েন্সের নানান দিকে গভীর আগ্রহ ল্যাং-এর। সেসবের ভেতর একটি হচ্ছে: জেনেটিক ডিফর্মেশন বিষয়ে মেডিকেল সায়েন্স। শুনেছি, জন্ম থেকে ত্রুটিপূর্ণ এমন একদল মানুষকে নিয়ে চিড়িয়াখানা তৈরি করেছে সে।
বাহ্! আরও গম্ভীর হলো রানা। কিন্তু কী কারণে আমাকে চাই তোমার? নিজেই তো সরিয়ে নিতে পারো ওই ছেলেকে।
বড় করে শ্বাস ফেলল ইগোর। বাধ্য হলে তাই করব। কিন্তু জানলাম, ওই একই কাজ করতে এসেছ তুমি, উদ্ধার করবে মেয়েটাকে। তখন ভাবলাম, ওকে ছুটিয়ে আনার সময় এনে দিতে পারবে ওই ছেলেটাকেও। তাতে কাজ কমবে আমার। এজন্যে তোমার যা লাগবে, সবই দেব। বলতে পারো, ঘোলা পানিতে মাছ ধরছি। হঠাৎ ল্যাং খেয়ে ল্যাং কিছু বোঝার আগেই ওই মেয়ে আর ছেলেটাকে নিয়ে হাওয়া হয়ে যাব আমরা। তুমি তোমার পথে, আমি আমার পথে। প্রস্তাবটা ভেবে দেখতে পারো।
একা কিছু না করে রাশানদের সাহায্য নেয়াই তো ভাল, মনে হচ্ছে রানার। আরেকবার দেখল টাওয়ার ল্যাং। ভাবছ, ওরা আছে ওই টাওয়ারে?
মাথা দোলাল ইগোর। আমাদের কাছে সার্ভেইল্যান্স ভিডিয়ো আছে। ওদেরকে ওখানে নিয়েছে, কিন্তু তারপর বের করেনি।
মিতাকে কিডন্যাপের পর পেরিয়ে গেছে বেশ কয়েক দিন।
তোমরা পুরো শিয়োর নও, আন্দাজ করল রানা।
ল্যাংকে ভাল করেই চিনি, জোর দিয়ে বলল ইগোর, জানি তার প্রতিটা পদক্ষেপ। মিতা দত্ত বেঁচে থাকলে, সে আছে ওই টাওয়ারের ভেতরেই। তা ছাড়া, তখন তখনই খুন করবে ভাবলে ওখানে নেবে কেন?
টাওয়ার ল্যাং আবারও দেখল রানা। এক শর বেশি তলা। জানতে হবে কোথায় আছে ওরা।
ভাবতে হবে না তোমাকে, বলল রাশান। তুমি শুধু ভাববে একটা তলা নিয়ে। রানার হাতে ছোট বিনকিউলার ধরিয়ে দিল সে। খেয়াল করো টাওয়ারের ভিত্তি।
চোখে বিনকিউলার তুলে কালো পাথরের গোড়া দেখল রানা। ওখান থেকেই আকাশে উঠেছে টাওয়ার। একেবারে নিচে প্রাচীন দুর্গের বেসমেন্ট ও পাথরের দেয়াল থেকে সাগরে নেমেছে ভাঙা ধাপের সিঁড়ি।
ভিক্টোরিয়া ফোর্টের ধ্বংসস্তূপের ওপর নিজের টাওয়ার তৈরি করেছে ল্যাং, বলল ইগোর, আঠারো শ পঁয়তাল্লিশ সালে নিরেট পাথর খুঁড়ে ব্রিটিশরা গড়ে ওই দুর্গ। কয়েক বছর পর ফোর্ট স্ট্যানলি নির্মাণের পর সরিয়ে নেয় বেশিরভাগ সৈনিক। ফোর্ট ভিক্টোরিয়ার পুরনো কারাগার ব্যক্তিগত জেলখানা হিসেবে ব্যবহার করছে ল্যাং। যাদের কাছে কিছু পায়, অথচ দেয়ার মত কিছুই নেই, তাদেরকে আটকে রাখে ওখানে। কেউ বেঈমানি করলেও তার ঠাই হয় ওই নরকে। খুব কম মানুষই মুক্তিপণ দিয়ে রেহাই পায় ওর কাছ থেকে।
এবড়োখেবড়ো, কালো পাথরের ভিত্তি দেখল রানা। নিচের অংশে লেগে ছিটকে ফিরছে সাগরের ঢেউ।
মিতা দত্ত আর পাবলো এখন ওই জেলখানায়, বলল ইগোর দিমিতভ।
.
১২.
কানে ফোনের রিসিভার ঠেকিয়ে অপেক্ষা করছেন সিআইএর বর্তমান ডিরেক্টর মার্ল ক্যালাগু। ডেস্কের ওপর সতীর্থ এক ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির বিষয়ে কঠোর ভাষায় লেখা ইন্টারনাল রিপোর্ট। ওই সংগঠন এনআরআই, বেশ কবছর ধরে জংধরা পেরেকের মত খোঁচা মারছে মার্ণ ক্যালাগুর পশ্চাদ্দেশে।
এনআরআই-এর সৃষ্টির আদি থেকেই প্রতিদ্বন্দ্বী সংস্থাটিকে নানানভাবে দমাতে চেয়েছে সিআইএ। বেশ কয়েকবার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে প্রেসিডেন্টকে, যেন ল্যাংলির অধীনে কাজ করে এনআরআই। কিন্তু বারবার আবদার করেও কোনও ফল মেলেনি।
মার্ল ক্যালাগুর চরম ব্যর্থতার কারণ, প্রেসিডেন্টের বিশ্বস্ত, পুরনো বন্ধু জেমস ব্রায়ান এনআরআই-এর চিফ। তবে কয়েক বছর আপ্রাণ চেষ্টার পর, নতুন পথ খুঁজে পেয়েছেন। ক্যালাগু। এবার সম্ভাবনা খুবই বেশি, ডিগবাজি খেয়ে ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়বেন এনআরআই চিফ।
যতই জেমস ব্রায়ানের পুরনো বন্ধু হন প্রেসিডেন্ট, তাঁর প্রথম এবং গুরুত্বপূর্ণ পরিচয় তিনি রাজনৈতিক দলনেতা। আর সব উচ্চপর্যায়ের নেতার মতই, তিনিও অনৈতিক কিছু বরদাস্ত করেন না। অন্যায় হবে বা হয়েছে বুঝলেই ওই বিষয় থেকে সরিয়ে নেন নিজেকে।
ওটা মাথায় রেখেই নতুন উদ্যমে যুদ্ধে নেমেছেন ক্যালাগু। ঠিক করেছেন, এনআরআই-এর নামে প্রচার করবেন কেলেঙ্কারি। ওসবের সঙ্গে জড়িয়ে নেয়া হবে জেমস ব্রায়ানকে। উনি যেহেতু বন্ধু, সাধারণ অন্যায়কারীর চেয়েও বেশি কঠোরভাবে তাঁকে দমন করবেন প্রেসিডেন্ট। তা করবেন, কারণ, সবাইকে দেখাতে হবে, পেয়ারের লোক বলে কাউকে ছাড় দেন না তিনি।
যা চান, সবই এবার পাবেন, ভাবছেন মার্ল ক্যালাগু। বড় কথা, নিজে থেকে টু শব্দও করতে হবে না, তাকে।
রিসিভারে সামান্য খুট আওয়াজ পেয়ে ক্যালাগু বুঝলেন, তাঁর কল গেছে ওভাল অফিসে। এখন লাইনে আছেন প্রেসিডেন্ট।
শুভ বিকেল, ক্যালাগু, বললেন তিনি; কী কারণে ফোন করেছেন?
ক্যালাগু চোখ রাখলেন সামনের রিপোর্টে। বেছে নেয়ার মত বেশ কয়েকটা আপত্তিকর গুজব আছে ওটাতে। একটাতে লেখা: এনআরআই তাদের ভার্জিনিয়া কমপ্লেক্স-এ গোপনে বিপজ্জনক নিউক্লিয়ার এক্সপেরিমেন্ট করছে। এ কথা মিথ্যা বলেই মনে হয়েছে ক্যালার। কিন্তু অন্যান্য যেসব তথ্য খুঁড়ে বের করেছে তার লোক, সেসব যথেষ্ট ক্ষতিকর হবে জেমস ব্রায়ানের জন্যে।
মিস্টার প্রেসিডেন্ট, দক্ষিণাঞ্চলের মিষ্টি সুরে কয়েক পাউণ্ড দুশ্চিন্তা মিশিয়ে বললেন ক্যালাগু, ফোন করেছি আপনাকে সতর্ক করতে। স্যর, বোধহয় বেশ কিছুদিন আপনার বন্ধু এনআরআই চিফের সঙ্গে আলাপ করেন না? এ কথা বলছি, কারণ আপনার আপত্তি থাকবে, এমন কজনের মাথায় খাড়া নামাতে চাইছেন জেমস ব্রায়ান।
কী হয়েছে খুলে বলুন তো, ক্যালাগু? বললেন প্রেসিডেন্ট।
বলতে খারাপ লাগছে, কিন্তু ব্রায়ান বোধহয় নষ্ট করছেন দেশের সম্মান, বললেন ক্যালাগু, এরই ভেতর বাংলাদেশের গুপ্তচর মাসুদ রানার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। তাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন চিনে সম্পূর্ণ নিজের ব্যক্তিগত এক যুদ্ধে।
কী কারণে এমন মনে হচ্ছে আপনার? ক্লান্ত সুরে বললেন প্রেসিডেন্ট।
হংকং থেকে রিপোর্ট এসেছে, বললেন ক্যালাগু, আবারও সীমানার বাইরে গিয়ে ঝামেলায় জড়িয়ে গেছে এনআরআই।
বাঙালি গুপ্তচর মাসুদ রানার সাহায্য নিয়েছে?
জী। যে লোক বারবার ধোঁকা দিয়েছে আমাদেরকে!
ধোঁকা দিয়েছে? আপত্তির সুরে বললেন প্রেসিডেন্ট, আমার কিন্তু ধারণা, আপনারাই তাকে নানাভাবে খুন করার চেষ্টা করেছেন।
স্যর, সে আমেরিকার ক্ষতি করছে ভেবেই…
আগেও ওই যুবকের সাহায্য নিয়েছি আমরা, থামিয়ে দিয়ে বললেন প্রেসিডেন্ট, বেশ কবার আগের প্রেসিডেন্টের প্রাণ রক্ষা করেছেন। প্রয়োজন না পড়লে ব্রায়ান নিশ্চয়ই তাকে জড়াত না।
জেমস ব্রায়ানকে এবার বাগে পাবেন ভেবেছিলেন ক্যালাগু, কিন্তু কপাল মন্দ, কঠোর সুরে বললেন প্রেসিডেন্ট, আপনি যেসব সোর্স থেকে তথ্য পেয়েছেন, তাদের বলুন, তারা যেন সরাসরি আমার কাছে রিপোর্ট করে। যে রিপোর্ট পেয়েছেন, ওটা দেরি না করে মাটিচাপা দিন। আমার কথা বুঝেছেন? বাস্তবিক কী ঘটেছে, তা বোঝার আগে এসব তথ্য প্রকাশ্যে এলে, ঠিকই বুঝে নেব, পদ থেকে কাকে সরিয়ে দেয়া উচিত।
সবই ফাঁস হলে খুশি হতেন ক্যালাগু। কিন্তু তাতে লোভনীয় চাকরি হারাবার সমূহ সম্ভাবনা। তিনি ঠিক করলেন, প্রেসিডেন্টকে বুঝিয়ে দেবেন, আসলে কারা চালায় আমেরিকার ইন্টেলিজেন্স। জী, তা তো বটেই, মিস্টার প্রেসিডেন্ট, বললেন ক্যালাগু, সত্যি, ব্রায়ান মস্ত কোনও ভুল করে বসলে, আমার উচিত সাধ্য অনুযায়ী তার পিঠ রক্ষা করা।
ফালতু বকবক বাদ দিয়ে কাজের কথায় আসুন, ক্যালাগু, বললেন প্রেসিডেন্ট, আপনার অত দরদি হতে হবে না, আপনি তো আর নির্বাচনে নামছেন না। আগামীকাল সকাল সাতটায় উপস্থিত থাকবেন পশ্চিমের ফয়েতে। ড্রাইভ করবেন নিজের গাড়ি। সঙ্গে কোনও সহকারী চাই না।
ঠাস্ করে রিসিভার নামিয়ে রাখলেন প্রেসিডেন্ট।
ওই শব্দটা চড়ের মত লেগেছে ক্যালাগুর কানে। জানেন, তিনি যা বলেছেন, তা ঠিকই বুঝেছেন প্রেসিডেন্ট। রেগে গেছেন তাই। মনে হয়নি বিস্মিত। বিরক্ত হয়েছেন। ব্যাপারটা এমন: যে দুর্ঘটনা এড়াতে পেরে স্বস্তি পেয়েছেন, এখন দেখা যাচ্ছে ওটাই ঘটেছে তার জীবনে।
ফোনের রিসিভার রাখার সময় মার্ল ক্যালাগুর মুখে ফুটে উঠল টিটকারির হাসি। আদরের সঙ্গে বন্ধ করলেন রিপোর্টের ফাইল। যা ভেবেছেন, তার চেয়েও অনেক মজা পাবেন এনআরআই চিফ জেমস ব্রায়ানকে কোণঠাসা করতে পারলে।
.
১৩.
কারুকাজ করা টিন্টেড কাঁচ গায়ে জড়িয়ে থম মেরে আছে। বিশাল, উঁচু টাওয়ার ল্যাং। ডানে হংকঙের সারি সারি আকাশছোঁয়া স্কাইস্ক্র্যাপার। মস্ত শহরের এক পাশে কাউলুন ও ভিক্টোরিয়া হার্বার। মাঝে ব্যস্ত, নীল জলের শিপিং চ্যানেল। বামে খোলা সাগরে সালফার চ্যানেল ও ডিসকভারি বে, একটু দূরেই ল্যান্টাউ আইল্যাণ্ডের নতুন এয়ারপোর্ট।
সবমিলে দারুণ দৃশ্য। টাওয়ার ল্যাং-এর এক শ একতলা থেকে ওসব দেখতে আরও অনেক সুন্দর।
একসময়ে ওখান থেকে অদ্ভুত মায়াবী প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্টি সৌন্দর্য দেখে বিভোর হতো হুয়াং লি ল্যাং। তবে আজকাল ওই দৃশ্য কাঁটা হয়ে বেঁধে তার বুকে।
বন্ধ করো সব শাটার! হুঙ্কার ছাড়ল হুয়াং লি ল্যাং।
প্রায় দৌড়ে গিয়ে নিজের ডেস্কের সামনে হাজির হলো ল্যাং-এর সেক্রেটারি, পটাপট টিপল একপাশের বোর্ডের চারটে বাটন। সরসর করে ছাত থেকে নামল স্টিলের শাটার। অদৃশ্য করছে চারপাশের চমৎকার দৃশ্য। মাত্র দশ সেকেণ্ডে প্রকাণ্ড ওই ঘর হলো স্টিলের একটা বাক্স। সিলিঙে জ্বলে উঠেছে নরম, সাদা আলো।
সামান্য মাথা কাত করল ল্যাং, সঙ্গে সঙ্গে চালু হলো যান্ত্রিক হুইলচেয়ারের ইলেকট্রিক মোটর। বন্ধ জানালা ছেড়ে ঘরের মাঝে এসে থামল হুইলচেয়ার। বিলিয়নেয়ার খেয়াল করছে, তাকে দেখছে বেশ কয়েকজন লোক।
তারা সেক্রেটারি, টেকনিশিয়ান, সিকিউরিটি প্রধান, আন-অফিশিয়াল চিফ অভ স্টাফ ও মোটা এক লোক।
শেষজনের নাম ক্যাং লাউ।
এরা সবাই বোকা, অবজ্ঞা নিয়ে দেখছে কী করুণ পরিণতি হয়েছে দুর্দান্ত ক্ষমতাশালী ব্যবসায়ী ল্যাং-এর।
সবই টের পাচ্ছে ল্যাং। একসময়ে সত্যি দেখার মত পুরুষ ছিল সে। দৈর্ঘ্যে ছয় ফুট, ওজনে এক শ আশি পাউণ্ড। দুহাতে সঁড়ের ঘাড় মুচড়ে ফেলে দিত ওটাকে মাটিতে।
আর আজ?
গত কবছরের নিউরোলোজিকাল ডিসঅর্ডার শেষ করে দিয়েছে তাকে। ওই অসুখ প্রথমে ফুরিয়ে দিল কর্মশক্তি ও দৈহিক সমন্বয়, তারপর চুরি করল গায়ের সব জোর।
এখনও হাঁটে ল্যাং, তবে সেটা চিকিৎসা ও থেরাপির জন্যে। দিনে দিনে বাড়ছে অসুখ। এ কারণেই আজকাল বেশিরভাগ সময় বসে থাকে হুইলচেয়ারে। বারবার মুচড়ে ওঠে শরীর, থরথর করে কাঁপে। এসব হচ্ছে অসুখের জন্যে। রোগ কমিয়ে দিতে দেহে যোগ করতে হয়েছে ইলেকট্রিকাল স্টিমুলেটর, নইলে আরও ক্ষয়িষ্ণুতার কবলে পড়বে দুর্বল পেশি।
চোখে বিস্ময় ও করুণা নিয়ে চেয়ে আছে সবাই।
কিন্তু সেজন্যে তাদেরকে অন্তর থেকে ঘৃণা করছে ল্যাং।
তার আপত্তির আরেকটা কারণ: আজকাল বাধ্য হয়ে নির্ভর করতে হচ্ছে এদের ওপর। বিশেষ করে ক্যাং লাউ খুবই কঠিন হয়ে উঠছে ওকে সহ্য করা।
ওই মেয়ে এখন ফাটকে? জানতে চাইল ল্যাং।
আপনার হুকুম অনুযায়ী ওকে ওখানে রাখা হয়েছে, বলল ক্যাং লাউ। কিন্তু আমার মনে হয়…
হাতের ঝাপ্টায় তাকে থামিয়ে দিল বিলিয়নেয়ার, তোমার ধারণা জানতে চাইনি। আমাকে বিরক্ত না করে তোমার চিন্তা নিজের কাছেই রাখো।
জী, স্যর, মাথা দোলাল লাউ, তবে ওই মেয়ে আমাদের কোনও কাজেই আসবে না। আমাদের জানা নেই, এমন কিছুই জানে না সে। আমাদের বোধহয় উচিত ওকে মেরে ফেলা, বা বিক্রি করে দেয়া। আপনি তো জানেন, স্যর, ওই মেয়ে যেরকম সুন্দরী, অনেকেই লাখ লাখ ডলারে ওকে কিনতে চাইবে। তা ছাড়া, ওই মেয়ে এখানে রয়ে গেলে, যে কোনও সময়ে হামলা করবে আমেরিকান কোনও আইনী সংস্থা। ঝুঁকিটা না নেয়াই ভাল।
সময় ও ঝুঁকি, ভাবল হুয়াং লি ল্যাং। ওই সময় আর ঝুঁকিই সব!
কৃপার সুরে বলল ল্যাং, তুমি যা জানো, তার বাইরেও কিছু ব্যাপার আছে। আমি যতদূর দেখছি, তা দেখতে পাবে না তুমি।
হুইলচেয়ার সরিয়ে লাউয়ের মুখোমুখি হলো বিলিয়নেয়ার। আপাতত ওই মেয়ে কাজে আসবে না, এ কথা ঠিক। কিন্তু পরে ওর কাছ থেকেই আসবে জরুরি তথ্য। ওগুলো আমার দরকার। এখন তোমার কথা মত ওই মেয়েকে খুন করলে, বা পতিতালয়ে বিক্রি করলে কী হবে? তোমার তো জানা আছে, টাকার কোনও অভাব নেই আমার!
ক্যাং লাউ মাথা খাঁটিয়ে কিছু বুঝতে চাইছে। তাকে চুপচাপ দেখছে ল্যাং। একসময়ে পরস্পরের সহায়তা নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় মাস্তানি করে ধাপে ধাপে উঠেছে তারা সমাজের ওপরতলায়।
আজ ল্যাং-এর আছে আধুনিক সব জিনিসের উৎপাদনকারী ফ্যাক্টরি, শিপিং ও নির্মাণ ব্যবসা। কিন্তু এই সাম্রাজ্যের গোড়া ছিল নানান রকম অপরাধ। মাস্তানি, কিডন্যাপিং, পতিতালয়, স্মাগলিং, আদম পাচার বা ড্রাগ চোরাচালান। কিছুই বাদ দেয়নি ল্যাং ও লাউ।
এসবে ওদের সঙ্গে ছিল আরও তিনজন।
কিন্তু তারা ক্ষমতা চাইলে এক এক করে তাদেরকে খুন করিয়ে নেতৃত্ব বজায় রেখেছে ল্যাং।
যখন দৈহিক শক্তি ছিল, খালিহাতে ছিঁড়ে ফেলত যে কোনও মানুষের গলা। এখনও মনে পড়ে সেই পাশবিক শক্তির কথা।
কী ভালই না লাগত আঙুলের মাঝ দিয়ে অসহায় মানুষের রক্ত বইলে! আবারও চাই তার ওই আনন্দ! জগৎকে বুঝিয়ে দিতে হবে, সে কী পারে!
লাউ কোনও ঝামেলা করবে, তা হতে দেবে না সে!
কিন্তু, স্যর… বলল লাউ।
আমার কথার ওপর কথা বলবে না, গর্জে উঠল ল্যাং। যেন থরথর করে কেঁপে উঠেছে প্রকাণ্ড ঘর। থতমত খেয়ে গেছে সবাই।
মুখ বন্ধ করে ফেলেছে ক্যাং লাউ।
তার চোখে আপত্তি দেখল ল্যাং। বুঝে গেল, তার দোসরের মনে জেগে উঠেছে বিদ্রোহ। বহু বছর বিশ্বস্ত ছিল লাউ, কিন্তু আজকাল নিজেকে ভাবছে আরও বড় কিছু। এমনই হওয়ার কথা। মানুষ তো!
হুইলচেয়ার ঘুরিয়ে কনফারেন্স রুমের দিকে চলল হুয়াং লি ল্যাং। সে এগিয়ে যেতেই আপনাআপনি খুলে গেল বৈদ্যুতিক দরজা। বিলিয়নেয়ারের জন্যে ভেতরে রয়েছে দুটো জিনিস। এ ছাড়া, অপেক্ষা করছে একদল টেকনিশিয়ান ও দুজন ডাক্তার।
একপাশে ল্যাং-এর দুজন লোক পরীক্ষা করছে মেক্সিকো থেকে আনা পাথরের প্রাচীন মূর্তি। ভেতরের অবস্থা বুঝতে ব্যবহার করা হচ্ছে ইলেকট্রনিক ইকুইপমেন্ট।
আর কী জানলে? জিজ্ঞেস করল ল্যাং।
এই মূর্তির ভেতরে কিছুই নেই, বলল ডানদিকের কর্মচারী। সলিড গ্র্যানেটের। ফাটল বা গর্ত নেই। আসছে
কোনও ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ডিসচার্জ। এনআরআই যে ধরনের জিনিস খুঁজছে, তেমন কিছুই নেই এই মূর্তির ভেতর।
তাই? বলল ল্যাং। কিন্তু তোমরা যখন ছেলেটাকে নিয়ে এলে, তখন কিন্তু ছিল মৃদু ডিসচার্জ। মূর্তির গায়ের লেখা থেকে কিছু বোঝা গেল?
কমপিউটারের সামনে বসে আছে আরেক কর্মচারী, সে বলল, আমরা এখন কমপিউটার প্রোগ্রামের মাধ্যমে তৈরি করছি মূর্তির চুরমার হয়ে যাওয়া অংশের ছবি। বেশকিছু ছবি পেয়েছি মেয়েটার কাছ থেকে। কিন্তু ওগুলোর রেযোলুশন খুব খারাপ। অবশ্য বড় করে নেয়ার পর বুঝতে শুরু করেছি। হায়ারোগ্লিফের কোড।
আর কত দিন লাগবে?
কাঁধ ঝাঁকাল কমপিউটার বিশেষজ্ঞ। মূর্তির বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে ওই মেয়ে।
চেষ্টার ত্রুটি করছি না, স্যর, বলল দ্বিতীয় টেকনিশিয়ান।
সময় ফুরিয়ে আসছে, বলল ল্যাং, তোমাদের চেষ্টা আরও বাড়াতে হবে।
লোকগুলোর প্রতিক্রিয়া খেয়াল করল বিলিয়নেয়ার। চোখের কোণে দেখেছে, হাল ছেড়ে দেয়ার ভঙ্গিতে বড় করে দম ফেলেছে ক্যাং লাউ।
ল্যাং-এর মনে হলো, সবাই মিলে মস্করা করছে তার সঙ্গে। বিশেষ করে লাউ। হাসছে লোকটা আড়ালে!
দাঁতে দাঁত পিষে ল্যাং ভাবল, মন্দ হতো না এদের সবকটাকে খুন করলে। কাজটা কঠিন নয়, সিকিউরিটি চিফকে নির্দেশ দিলেই এ ঘরে বইয়ে দেবে রক্তের স্রোত।
কিন্তু এখন নয়!
নিজেকে সামলে নিল ল্যাং। হিসেব ভুল না হলে, আগামী কদিনেই সুস্থ হয়ে উঠবে সে। তখন, দৈহিকভাবে সক্ষম হলেই নিজ হাতে খুন করবে এই বেয়াদবগুলোকে!
.
১৪.
মেঘভরা কালচে আকাশ। হঠাৎ হঠাৎ ওপর থেকে খসে এসে এখানে-ওখানে পড়ছে বৃষ্টির বড় ফোঁটা। বন্দরের একটা টাগ-এর বো-তে দাঁড়িয়ে আছে রানা। পরনে উলের ভারী কোট। পায়ে বুট। মাথায় কালো ক্যাপ। কেউ দেখলে ভাববে, টাগের ক্রু।
কার্গো নিয়ে দক্ষিণে চলেছে টাগ।
নদীর দূরে চেয়ে অতীত স্মৃতির মাঝে ডুব দিয়েছে রানা।
.
ম্যানুয়াস শহরের নামকরা এক হোটেলের বার-এ বসে ছিল ও। ওই হোটেলেই উঠেছিল ওরা। আরেকটা ড্রিঙ্ক নেবে, এমনসময় ওর পাশের টুলে এসে বসল মেয়েটা। মৃদু মাথা দুলিয়ে নিচু স্বরে বলল, আপনি খুব নিঃসঙ্গ, তাই না?
কখনও কখনও, বলল রানা। আপনি?
আমি? মিষ্টি হাসল মিতা। বেশ কয়েক বছর ধরেই একা।
তাই? তার আগে একা ছিলেন না? জানতে চাইল রানা।
না, মাথা নাড়ল মিতা। বাবার মৃত্যুর পর থেকেই একা।
মিতার ডোশিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে সোহেল। ওটা পড়েছে রানা। মেয়েটার বাবার মৃত্যু হয়েছে ফুসফুঁসের ক্যান্সারে। শেষ দেড় বছর খুবই কষ্ট পেয়েছেন বিনয় দত্ত। তখন প্রায় সারাক্ষণ পাশে ছিল মিতা। ওর মা কয়েক বছর আগেই স্বামীকে ডিভোর্স দিয়ে চলে যায় লস অ্যাঞ্জেলিসে প্রেমিকের কাছে। এজন্যে কখনও মাকে ক্ষমা করতে পারেনি মিতা।
দুঃখিত, নরম সুরে বলল রানা, বুঝিনি কষ্ট দিয়ে বসব।
না, ঠিক আছে, বলল, মিতা। আজ কেন যেন মনে পড়ছে শৈশব ও কৈশোরের স্মৃতি।
রানার হাতের ইশারায় মিতার সামনে সফট ড্রিঙ্ক রেখে গেল বারটেণ্ডার।
থ্যাঙ্কস। স্পাইটের গ্লাসে চুমুক দিল মিতা। খুব মন চাইছে নিজের কথা কাউকে বলি।
বলুন না, বলল রানা।
খুব ভালবাসতাম বাবাকে। তিনি চেয়েছিলেন ছেলে হোক, কিন্তু হলাম আমি মেয়ে। জেদ কাজ করত আমার মাঝে। মেয়ে বলে পিছিয়ে পড়ব না। দশ বছর বয়সে পেলাম কারাতে দো-র ব্ল্যাক বেল্ট। চোদ্দ বছরে শুটিং-এ প্রথম। পনেরো বছরে সাইক্লিং-এ দ্বিতীয়। বাবা শেখালেন কীভাবে মেরামত করতে হয় গাড়ির ইঞ্জিন। হয়ে উঠলাম দক্ষ মেকানিক। আঠারো বছর বয়সে ভর্তি হলাম নিউ ইয়র্কের নামকরা ইউনিভার্সিটিতে। চুপ হয়ে গেল মিতা। কিছুক্ষণ পর বলল, কিন্তু একমাস পরেই ধরা পড়ল বাবার ক্যান্সার। ফিযিক্স পড়া বাদ দিয়ে ফিরলাম বাড়িতে। খুব বকলেন বাবা। বললেন, আমি নাকি হেরে গেছি। একটা কথাও বলিনি। সাধ্যমত সেবা করলাম তাঁর, কিন্তু ফেরাতে পারলাম না, চলেই গেলেন তিনি। এরপর পুরো মনোযোগ দিলাম ফিযিক্সের বইয়ে। নতুন করে ভর্তি হলাম। বেশিরভাগ ছাত্র ছাত্রী যে সময় দেয় বইয়ে, তার দ্বিগুণ দিলাম। আড়াই বছরের ভেতর শেষ করলাম অনার্স। এরপর মাস্টার্স ও ডক্টরেট। ভাল কোনও চাকরি খুঁজছি, তখনই যোগাযোগ করলেন এনআরআই চিফ জেমস ব্রায়ান। বাবার বন্ধু, প্রায় আদর করেই দায়িত্ব দিলেন, যেন একটা অভিযানে ফিযিক্সের দিকটা দেখি। চলে এলাম ডক্টর জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে যোগ দিতে। তার পরের ঘটনা আপনার জানা।
সে রাতে অতীত-বর্তমান এবং ভবিষ্যতের পরিকল্পনা নিয়ে অনেক কথা বলেছিল মিতা। আপনি থেকে সম্বোধন নেমে এসেছিল তুমি-তে।
বাবাকে ফেলে গিয়েছিল বলে মাকে মানুষ বলেই মনে করে না। আদর যা পেয়েছে, সবই বাবার আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে। এ কারণে অদ্ভুত ভালবাসা আছে ওর বুকে বাংলাদেশ ও বাঙালী জাতির প্রতি। দায়িত্বপূর্ণ চাকরি পেলে চলে যাবে সহজ, সরল মানুষের ওই সবুজ দেশে।
ভাঁপ-ভাঁপ বিকট শব্দ শুনে চমকে বাস্তবে ফিরল রানা। সামনেই একটা বার্জ, উপচে পড়ছে কয়লায়। দূরের পাওয়ার প্ল্যান্টেশনে নামিয়ে দেবে পেটের বোঝা। টাওয়ার ল্যাং-এর ঠিক সামনে দিয়ে যাবে বার্জ। সেসময়ে টাগ থেকে নদীতে নেমে পড়বে রানা, ডুব সাঁতার কেটে হাজির হবে পুরনো দুর্গের পায়ের কাছে।
মিতা ও পাবলোকে উদ্ধারের জন্যে কয়েকটা পরিকল্পনার বিষয়ে ইগোরের সঙ্গে কবার আলাপ হয়েছে রানার।
ইগোরের যুক্তি ছিল: চিরকাল ওদেরকে কারাগারে রাখবে না ল্যাং। যখন সরাতে যাবে, তখনই হামলা করা ভাল। সেজন্যে চাই ল্যাং-এর পরিকল্পনার শেকলে দুর্বল একটা
রানা বুঝে গেল, ইগোরের পরিকল্পনায় ত্রুটি আছে।
রাশানের কথা অনুযায়ী: প্রথমেই জানতে হবে কখন কোথায় তারা নেবে মিতা বা পাবলোকে। অথচ এটা স্বাভাবিক, কারাগার থেকে বেরোলেই পালাতে চাইবে বন্দি, কাজেই অত্যন্ত সতর্ক থাকবে প্রহরীরা। সেক্ষেত্রে খুব কঠিন হবে হামলা করে কাউকে ছিনিয়ে নেয়া। তা ছাড়া, ল্যাং কখন কোথায় সরাবে ওদেরকে, সেজন্যে অপেক্ষা করতে হবে। অথচ, নরকে কাটছে মিতা ও পাবলোর প্রতিটা পল।
দুর্গ ও টাওয়ারের স্কিম্যাটিক দেখে ওরা বুঝেছে, পুরনো দুর্গে আছে অদ্ভুত স্যানিটেশন সিস্টেম। ওটা তৈরি করেছিল ব্রিটিশ সৈনিকরা। কারাগারের বন্দিদের টয়লেটের সঙ্গে যুক্ত দুটো সুড়ঙ্গ, জোয়ারের সময় ওই দুই টানেলের কাঠের দরজা খুললে নদীতে বেরিয়ে যায় সমস্ত বর্জ্য।
শেষে ইঁদুরের মত সুয়ারেজ দিয়ে ঢুকবে? জানতে চেয়েছে ইগোর।
মন্তব্য করেনি গম্ভীর রানা।
পরে দেখা গেল, আজ আর নেই সে কাঠের দরজা, সেখানে আছে কংক্রিটের প্লাগ। তখন মিতা ও পাবলোকে ছুটিয়ে আনার মাত্র একটা উপায়ই থাকল।
বাধ্য হয়ে বাঙালী গুপ্তচরের যুক্তি মানল ইগোর দিমিতভ।
মুখ তুলে কালচে আকাশ দেখল রানা। ঘনিয়ে এসেছে সন্ধ্যা, যে-কোনও সময়ে ঝাঁপিয়ে নামবে বৃষ্টি। আঁধারে সহজেই লুকিয়ে পড়তে পারবে ও।
টাগ-এর পাইলট হাউসে এসে ঢুকল রানা। কোনও কথা হলো না ইগোরের সঙ্গে। চুপচাপ হাত লাগাল ওরা, পরীক্ষা করছে দরকারি গিয়ার।
হেলিকপ্টার তৈরি রাখতে বোললা, বলল রানা, কাজে ব্যস্ত। মাত্র একটাই সুযোগ পাব।
দুমিনিট পর টাগ-এর উল্টোদিক দিয়ে নদীতে নামল ও। পরনে কালো ওয়েট সুট, পিঠে রিব্রিদার। খয়েরি আকাশ হয়ে গেছে প্রায় কালো।
পানির নিচে তলিয়ে অপেক্ষা করল রানা। টাগ পেরোবার পর সাঁতার কেটে এগোল দুর্গের দিকে। চলেছে পানির পনেরো ফুট তলা দিয়ে। গতি ধীর, ছন্দোবদ্ধভাবে চলছে দুপা।
প্রয়োজনীয় অক্সিজেন পাচ্ছে সিসিআর থেকে। স্কুবা গিয়ারের মত ভারী নয় হালকা ক্লোযড-সার্কিট রিব্রিদার। ব্যবহৃত বাতাস আবারও ফিল্টার করবে। উঠবে না কোনও বুদবুদ।
শত্রুপক্ষ বিপদের আশঙ্কা করবে, তা মনে করছে না রানা। কিন্তু প্যারাননাইয়া আছে হুয়াং লি ল্যাং-এর। হয়তো দলের লোককে বলেছে নদীর দিকে চোখ রাখতে। সেক্ষেত্রেও কিছুই দেখবে না তারা।
কয়েক মিনিট সাঁতরে দুর্গের কাছে পৌঁছুল রানা। বন্দরের এদিকে উঠে এসেছে নদীর তলদেশ। কাদাগোলা পানি। সাবধানে এগোবার পর হঠাৎ থামল ও। নাকের এক ইঞ্চি দূরে দুর্গের ঢালু ভেড়িবাঁধ। উঠতে শুরু করে কাদাটে পানির স্তর ছেড়ে বেরিয়ে এল রানা। সামনে কালো রঙের রুক্ষ পাথরের ভিত্তি।
জলসমতল থেকে দুফুট নিচে থেমে, চিত হয়ে ওপরে চোখ রাখল রানা। কালচে পানি ভেদ করে আসছে সামান্য আলো, তবে ওটার মালিক ডিসেম্বরের সূর্য নয়। জেগে উঠেছে ঝলমলে শহর। বিশেষ করে টাওয়ার, ল্যাং নদীতে ফেলেছে সাদা রশ্মি।
ঘুটঘুটে আঁধার নামবে, সে আশা নেই, বুঝে গেল রানা। চট করে একবার দেখল হাতঘড়ি। কাজে নেমেছে শিডিউলের চেয়ে আগে। সমতল পাথরের স্তরে পিঠ ঠেকিয়ে শুয়ে থাকল। চুপচাপ দেখছে ওপরের পানি। নদীর বুকে টুপটাপ করে পড়ছে বৃষ্টির ফোঁটা, তৈরি করছে গোল আংটি। ছড়িয়ে গিয়ে মিশে যাচ্ছে অন্য ফোঁটার আংটির সঙ্গে। বোঝার উপায় নেই, এবার কোথায় হবে আলোড়ন। একটু পর শুরু হলো মাঝারি বর্ষণ।
মৃদু হাসল রানা। কপাল ভাল ওর। বর্ষার কারণে বেশিদূর দেখবে না কেউ। নদীতীরে শীতের রাতে যে ভিজতে আসবে পাহারাদার, সে সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। তা ছাড়া, রানা যাবে এমন দিকে, যেখানে ভুলেও কারও যাওয়ার কথা নয়।
সতর্ক কুমিরের মত চোখ জাগাল রানা। সামনেই ভাঙাচোরা, এবড়োখেবড়ো কালো পাথরের ভেড়িবাঁধ ঢালু হয়ে গেছে ওপরে। নদীতীর থেকে আশি ফুট দূরে আকাশে উঠেছে কারুকাজ করা সাদাটে ইটালিয়ান এ্যানেট দিয়ে তৈরি এক শ এগারোতলা দালান। ওটার বুক থেকে বেরোচ্ছে উজ্জ্বল আলো। নিচের কালো পাথরের মাঝ দিয়ে কালো পোশাক পরা এক লোক উঠে এলে টের পাওয়া কঠিন।
নদীতীরের পাথরে বসে ফ্লিপার, সিসিআর ও মুখোশ খুলল রানা, তারপর কালো পাথরের ঢালু ভেড়িবাঁধ বেয়ে উঠতে লাগল কাঁকড়ার মত। খুঁজে নিল আগেই দেখে রাখা ফাটলটা। ওটা বেয়ে দশ ফুট ওঠার পর পেল দুর্গের দেয়াল। একফুট চওড়া স্ল্যাব দিয়ে তৈরি ওটা। ক্ষয়ে গেছে চুন সুরকি। শুধু ওজনের কারণে এখনও জায়গামত রয়ে গেছে দেয়াল।
ওখানে বুক ঠেকিয়ে দাঁড়াল রানা। চারতলা ওপরে প্রাচীন দুর্গের ছাত এখন ম্যানিকিওর করা উঠান। এক পাশে ফুলের বেড, আরেকদিকে ওয়াকওয়ে, সোজা থেমেছে ল্যাং-এর টাওয়ারের প্রবেশপথে।
অনেক নিচে কালো নদী। পাথুরে দেয়ালে বুক ঠেকিয়ে এক পাশে সরতে লাগল রানা। একটু পর থামল উল্লম্ব এক ফাটলের সামনে। ওটা মাত্র একফুট উঁচু, চওড়ায় ছয় ইঞ্চি। আগে ছিল পুরনো কেল্লার গানপোর্ট। মাস্কেট ব্যবহার করে ওদিক দিয়ে গুলি চালাত শত্রুপক্ষের ওপর। রানা ঠিক করেছে, ওখানেই বসাবে বিস্ফোরক। কিন্তু তার আগে বুঝতে হবে, ঠিক জায়গায় পৌচেছে কি না।
ব্যাকপ্যাক পিঠ থেকে নামিয়ে ওখানে বসল রানা। ব্যাগ থেকে বের করল ছোট এক স্বচ্ছ বাক্স। ওটার পাশে রয়েছে, ব্যাটারি, ট্রান্সফর্মার, মাইক্রোফোন, ক্যামেরা ও অ্যান্টেনা।
এনআরআই ওই জিনিসের নাম দিয়েছে: দুর্ধর্ষ মাকড়সা।
আমেরিকা থেকে রওনার সময় ওটা জেমস ব্রায়ান দিয়েছিলেন রানাকে। বাটন টিপলে বাক্স থেকে বেরোয় সরু আট পাওয়ালা পোকা, দুর্গম জমিতে এগুলো চলে অনায়াসে। এমন কী লাফিয়ে উঠতে পারে সিঁড়ির ধাপ। তবে এ মিশনে তার প্রয়োজন পড়বে না। ইগোরের জোগাড় করা নক্সা অনুযায়ী নিচে নামতে হবে মাকড়সাকে।
যন্ত্রটা চালু করে সরু গানপোর্টের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিল রানা। ওদিকে কেউ নেই, ভেতরে ফেলতেই টুপ শব্দে নিচে পড়ল ডিভাইসটা।
একটু ডেবে যাওয়া দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসল রানা। বৃষ্টির ছাঁট ওখানে লাগছে না। ব্যাকপ্যাক থেকে নিল কন্ট্রোল ইউনিট। কানে পরল হেডসেট। ওটায় আছে ছোট্ট স্পিকার। মাইক্রোফোনের ধরা শব্দ শুনতে পাবে ও। ডান চোখে দেখবে ক্যামেরায় ধরা দৃশ্য। সেজন্যে আছে খুদে এলএসডি স্ক্রিন।
ডিভাইস অন করতেই চালু হলো আইপিস। দুর্গের ভেতর অংশ ষোলো শতকের কারাগারের মত। নোংরা, ঘিঞ্জি। নিচু ছাত। নানাদিকে জংধরা লোহার দরজা। সবই মেডেইভেল আমলের মত, কিন্তু দূর কোণে স্টিল ও রিএনফোর্সড় দশ ফুটি বৃত্তাকার কলাম। ওটা কারাগার ভেদ করে নেমেছে পাথরের বুকে। এ ধরনের কলাম ধরে রেখেছে ল্যাং-এর সুউচ্চ টাওয়ার। এক পাশে এলিভেটর শাফট।
বাটন টিপে যন্ত্রটাকে সামনে পাঠাল রানা।
একটু দুলছে ক্যামেরার দৃশ্য। মালিকের নির্দেশে শিকারে বেরিয়ে পড়েছে মাকড়সা!
.
১৫.
ল্যাং-এর কারাগারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে নানান উঁচু জায়গা বেছে শুয়ে-বসে আছে বন্দিরা। এ ছাড়া উপায়ও নেই। বৃষ্টির ছাঁট লেগে ভিজে গেছে শীতল মেঝে। একদিকের সেল-এ গিয়ে ঢুকেছে মিতার হাতে পিট্টি খাওয়া, আহত দুই বন্দি। মিতার সেল-এ রয়ে গেছে ও নিজে, দিমিতভ, পাবলো, বুড়ো চাইনিজ ও ভারতীয় মহিলা।
আপাতত জেগে আছে মিতা ও পাবলো। ঘুমিয়ে পড়েছে অন্যরা। একটু আগে নেমেছে সন্ধ্যা। এ নরকের মত গারদে বাস করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে উঠছে ওরা, তাই চাই বিশ্রাম। জানে, জীবনেও আর কখনও বেরোতে পারবে না এখান থেকে।
মিতা অবশ্য হাল ছেড়ে দেয়নি। নিজেকে বুঝিয়েছে, যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণ আশ। আগের চেয়ে হয়ে উঠেছে অনেক সতর্ক। ঠিক সময়ে খাবার পেলে খেয়ে নিচ্ছে। শরীর ঠিক রাখতে হবে। প্রথম সুযোগেই চেষ্টা করবে এখান থেকে বেরোবার।
পাবলোর দিকে তাকাল মিতা।
মাথা না ঘুরিয়েই ওর দিকে তাকাল ছেলেটা। কী করে যেন বুঝে গিয়েছে, ওর দিকে চেয়েছে কেউ। সত্যি কথাই বলেছে দিমিতভ, কখনও ঘুমায় না এই ছেলে।
মিষ্টি করে হাসল মিতা।
বদলে পেল মধুর হাসি।
পাবলোর দিকে চেয়ে চোখ পিটপিট করল মিতা। একই কাজ করল ছেলেটা। দুষ্টুমি করছে? বোঝা মুশকিল।
হঠাৎ ঝট করে ঝাঁকি খেল পাবলোর মাথা। কিছু শুনলে ওভাবে চমকে ওঠে অনেকে। ছেলেটার চোখ গেল করিডোরে।
কান পাতল মিতা। বাইরে দমকা হাওয়ায় ভর করে কাত হয়ে নামছে তুমুল বৃষ্টি। না, এ ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। আগেই দেখেছে, এলিভেটর নামলে কীভাবে যেন জেনে যায় ছেলেটা। কিন্তু এবার তেমন কিছু তো হয়নি?
উঠে বসল পাবলো। চুপ করে চেয়ে আছে করিডোরের দূরে। সাবধানে গা থেকে ফেলে দিল পাতলা কাঁথা।
হাতের ইশারায় ওকে কাছে ডাকল মিতা। এসো। আমার কাছে বসবে।
দ্বিধা করল বাচ্চা, তারপর এসে বসল মিতার উঁচু বাঙ্কে।
মাত্র কয়েকটা রাশান শব্দ জানে মিতা, তাতে কোনও কাজ হবে না। আসলে উপায় নেই আলাপ করার। আলতো হাতে পাবলোর কপালের ওপর থেকে চুল সরিয়ে দিল মিতা।
খুশি হয়ে ওকে দেখল বাচ্চাটা, পরক্ষণে আড়ষ্ট হয়ে গেল। হাত তুলে মেঝে দেখিয়ে রাশান ভাষায় বলল, ওদিকে! ওদিকে!
করিডোরে চোখ বোলাল মিতা।
কেউ নেই।
কিন্তু কয়েক সেকেণ্ড পর ও শুনল তবলার বোলের মত মৃদু আওয়াজ। ওটা আসছে এলিভেটরের কাছ থেকে। থেমে গেল শব্দটা। শুরু হলো আবার। এবার আবছা অন্ধকারে ওর মনে হলো, কী যেন এসে থামল সেল-এর দরজার সামনে।
মিতা ভাবল, ওটা হয়তো ইঁদুর। আগেও এখানে দেখেছে ওই প্রাণী। কিন্তু আলোর অভাব বলেই ঠিক বোঝা গেল না, কী করছে ওটা। এটা ঠিক, থেমে গেছে। একদম নড়ছে না।
বাঙ্ক থেকে দশফুট দূরে দরজা। আঙুল তুলে বারবার ওটাকে দেখাচ্ছে পাবলো। মিতা কিছুই করছে না দেখে হাতের তালু ওদিকে তাক করল ছেলেটা। ভাব দেখে মনে হলো ঠেকিয়ে দেবে কিছু। বার কয়েক বলল, মেশিন… মেশিন!
ঠিক আছে, ভয়ের কিছু নেই, ওকে শান্ত করতে চাইল মিতা। বাচ্চাটার হাত ধরে নিজের মুঠোয় নিল। ভয় নেই।
মেশিন! মেশিন! আবারও বলল পাবলো।
বাঙ্ক থেকে নেমে দরজার দিকে পা বাড়িয়ে চমকে গেল মিতা। ধক-ধক করছে হৃৎপিণ্ড।
সত্যিই একটা যন্ত্র!
আগেও ওই জিনিস দেখেছে ও এনআরআই অফিসে!
তা হলে কি সাহায্য করতে পৌঁছে গেছে কেউ?
মুক্তি পাবে ও?
আঙুল তাক করে যন্ত্রটা বারবার দেখাচ্ছে পাবলো।
ওই যন্ত্রে আছে ছোট মাইক্রোফোন, মনে পড়ল মিতার। দেরি না করে নিচু স্বরে বলতে লাগল এদিকের পরিস্থিতি।
আমরা সাতজন বন্দি। কোনও পাহারাদার নেই। কোনও ক্যামেরা নেই। বেরোবার কোনও পথও নেই। উঠতে বা নামতে ব্যবহার করতে হয় এলিভেটর। বুঝতে পেরেছেন?
চার পা ব্যবহার করে কয়েকবার ওপর-নিচ করল মাকড়সা। যেন বুঝিয়ে দিল সবই বুঝতে পেরেছে সে।
চারপাশ দেখে নিয়ে বলল মিতা, আপনি কি রেকি করতে এসেছেন?
এদিক-ওদিক দুলল মাকড়সা।
তা হলে মুক্ত করতে এসেছেন?
কয়েক সেকেণ্ড পর পায়ে ভর করে উঁচু-নিচু হলো মাকড়সা। তিনবার ওঠা-নামার পর থামল। বোকার মত যন্ত্রটার দিকে চেয়ে রইল মিতা। কী বলতে চাইছে লোকটা?
একটু বিরক্ত হয়ে বলল, কী বোঝাতে চেয়েছেন বুঝলাম!
আবারও তিনবার ওঠা-নামার পর থামল মেশিন। হতাশ হয়ে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বাঙ্কে জুত হয়ে বসল মিতা। তখনই এল করিডোর থেকে বিস্ফোরণের বিকট আওয়াজ।
থরথর করে চারপাশ কাঁপিয়ে দিল শকওয়েভ। আরেকটু হলে কাত হয়ে বাঙ্ক থেকে পড়ে যেত মিতা। পুরনো কারাগারের ভেতরে ঢুকেছে একরাশ ধুলো ও ধোয়া।
কাশতে শুরু করে করিডোরের দিকে তাকাল মিতা। ওর হাত ধরে আছে পাবলো। জেগে গেছে এ ঘরের সবাই, হতবাক।
কী হয়েছে? বেসুরো কণ্ঠে জানতে চাইল চাইনিজ বৃদ্ধ।
ওপর থেকে এল আবছা আওয়াজ। মিতা বুঝল না, ওটা আর্থকোয়েক না ফায়ার অ্যালার্ম। বেজে চলেছে একটানা।
পাবলোর টানে বাঙ্ক থেকে নেমে পড়ল মিতা। তখনই দেখল করিডোরের উড়ন্ত ধুলোর মাঝ দিয়ে হাজির হয়েছে এক লোক। জানতে চাইল সে, মিতা, ঠিক আছ তো?
ওই গম্ভীর কণ্ঠ চেনা চেনা লাগল মিতার। ধুলো ও ধোঁয়ার মাঝ দিয়ে এসে ওর সামনে থামল লোকটা।
ভীষণ অবাক হলো মিতা। রানা? তুমি? এখানে কী করে?
জবাব দিল না রানা, ব্যস্ত। ব্যাকপ্যাক থেকে বের করছে কী যেন! কী করে তা পরে শুনো, আগে ভাগতে হবে এখান থেকে!
বাজতে শুরু করেছে আরও কয়েকটা অ্যালার্ম।
ল্যাং-এর সিকিউরিটি অফিসাররা জেনে গেছে, জোর করে কারাগারে ঢুকেছে কেউ।
এখন কী করব আমরা? জানতে চাইল মিতা। রানাকে পাশে পেয়ে নিশ্চিন্ত।
কিন্তু যাব কোথায়? জানতে চাইল চাইনিজ বৃদ্ধ।
করিডোরের সামনে পাবেন ভাঙা গানপোর্ট, ওদিক দিয়ে বেরিয়ে নেমে পড়বেন নদীতে, বলল রানা, দক্ষিণে গেলে স্রোতের সঙ্গে ভেসে গিয়ে উঠবেন তীরে। পালাতে চাইলে এখনই।
চাইনিজ বৃদ্ধ বা ভারতীয় মহিলা যে এত চালু, আগে বুঝতে পারেনি মিতা। রানার কথা শেষ হতে না হতেই আঁধারে হারিয়ে গেল তারা।
চারপাশ দেখল রানা। তুমি বলেছিলে তোমরা সাতজন।
করিডোরের ওদিকের সেল দেখাল মিতা। আহত লৌ এবং তার মার খাওয়া বন্ধু গিয়ে ঢুকেছে ওদিকে।
ওরা আসছে না কেন? জানতে চাইল রানা।
আমাদের মতাদর্শে বিভেদ তৈরি হয়েছিল, নরম সুরে বলল মিতা। এখন দেহে-মনে কষ্ট নিয়ে শুয়ে আছে। কাউকে না কাউকে তো কয়েদখানার মালিক হতে হবে!
ও, তার মানে মার খেয়েছে?
হুঁ, চলো, বেরিয়ে যাই।
ছেলেটাকে সঙ্গে নেব, বলল রানা, ওর দায়িত্ব থাকল তোমার ওপর।
চেনো পাবলোকে? জানতে চাইল মিতা।
আমাদের চুক্তির অর্ধেক অংশ ও, বলল রানা। পরে বলব কী হয়েছে।
আরও কিছু বলত মিতা, কিন্তু লোহার গেটের সামনে থামল রানা। ওই গেট পেরোলেই সামনে এলিভেটর। তালার ভেতর সামান্য প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ ঠুসে দিল ও, তারপর পিছিয়ে এল।
চিৎকার জুড়ল পাবলো। যে কারণেই হোক, ভীষণ ভয় পেয়েছে। এক হাতে চেপে ধরেছে: ডান কান, বাম হাতে দেখাচ্ছে এলিভেটর। ওরা! ওরা!
হঠাৎ খুলে গেল এলিভেটরের দরজা, ভেতর থেকে ছিটকে এল কয়েকটা ডার্ট। পেছনে রয়েছে কেবল। রাইফেলের মত দেখতে কোনও টেইযার থেকে এসেছে। ওগুলো। রানা ঝট করে সরে গেলেও একটা ডার্ট লাগল মিতার গায়ে। হায়-হায় করে উঠল ওর মন, যাহ্, আবারও বন্দি হয়ে গেলাম!
শরীর জুড়ে শুরু হয়েছে তীব্র ব্যথা।
কাত হয়ে পড়ে যাচ্ছে মিতা। কিন্তু এক টানে ওর দেহ থেকে ডার্ট খুলে নিল রানা। বাম হাতে ধরল মিতাকে। পরক্ষণে পাবলো আর ওকে ঠেলে সরিয়ে নিল দেয়ালের ওদিকে। নিজেও আড়াল নিল ওখানে।
নিজের ওপর রেগে গেছে রানা। সিকিউরিটির লোক নেমে আসবে, আগেই জানত। কিন্তু এরা নিভিয়ে দিয়েছিল এলিভেটরের ভেতরের বাতি। দরজা খুলে যাচ্ছে, এমনসময় চেঁচিয়ে উঠল রাশান ছেলেটা তখন সামান্য মনোযোগ হারিয়ে বসে।
হাতের কারবাইন দিয়ে ওদিকে গুলি পাঠাল রানা।
বুকে গুলি, বিঁধতেই করিডোরের মাঝে শিয়ালের মত হুক্কাহুয়া করে উঠল এক লোক। ধুপ আওয়াজ হলো মেঝেতে লাশ পড়ার।
একজন গেল, বিড়বিড় করল মিতা।
এদিকে ডেটোনেটর সুইচ টিপেছে রানা।
গেটের তালায় গুঁজে রাখা সি-৪ বিস্ফোরিত হতেই ছিটকে খুলল লোহার শিকের দরজা। ওটার বাড়ি খেয়ে নাক ও চোয়াল ভেঙে অচেতন হলো দ্বিতীয় গার্ড।
কিন্তু তখনই করিডোর থেকে গুলি পাঠাল তৃতীয় গার্ড।
পাথরের ঘরে নানান দিকে ছিটকে যাচ্ছে বুলেট। ব্যাকপ্যাক থেকে গ্রেনেড নিয়ে পিন খুলে করিডোরে ছুঁড়ল রানা। ঠং শব্দে দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে মেঝেতে পড়ল হাতবোমা।
জানা আছে বলে এক এক করে সেকেণ্ড গুনতে শুরু করেছিল মিতা, কিন্তু তিন বলার আগেই করিডোরের ওদিকে বিস্ফোরিত হলো গ্রেনেড। ওই কংকাশন ছিটকে ফেলে দিয়েছে তৃতীয় গার্ডকে।
এক সেকেণ্ড পর দেয়ালের বাঁক ঘুরে বুলড়োযারের মত করিডোরে বেরোল রানা। দুই লাফে পৌঁছুল গার্ডের পাশে। মাত্র উঠে বসেছে সে। তার হাত থেকে টেইযারের মত অস্ত্রটা কেড়ে নিল রানা, পরক্ষণে ট্রিগারে তর্জনী ভরে মাযল তাক করল গার্ডের বুকে। বিদ্যুতের প্রচণ্ড শক খেয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগল লোকটা, মাত্র পাঁচ সেকেণ্ডে হয়ে উঠল সত্যিকারের যোম্বি।
এলিভেটরের দিকে তাকাল রানা। শাফট থেকে আসছে বেশ কয়েকটা অ্যালার্মের কান্না। তাল মিলিয়ে সুর ধরেছে বাইরের কিছু অ্যালার্ম। ওদিকে রাতের ঘুটঘুটে আঁধার ও ধোয়া চিরে নানা দিকে গেছে ফ্লাডলাইটের উজ্জ্বল সাদা আলো। চিৎকার শোনা গেল প্রাচীন দুর্গের ছাতে।
ওদিক দিয়ে গার্ডদের নামতে লাগবে কয়েক মিনিট। এখন ভাঙা গানপোর্ট দিয়ে বেরোলে খুন হবে রানারা।
মিতা, ছেলেটাকে নিয়ে এসো, ডাকল রানা। কটুগন্ধী ধোঁয়ার মাঝে দেখল, আরেক বন্দিকে উঠতে সাহায্য করছে মিতা ও পাবলো। হাতে একফোঁটা বাড়তি সময় নেই, তবুও ওদিকে পা বাড়াল রানা।
এমনিতেই মরব, রেখে যান, জড়ানো কণ্ঠে বলল লোকটা। পাবলোকে নিয়ে বেরিয়ে যান আপনারা!
না, আপনাকে রেখে যাব না, শক্ত হাতে দিমিতভের কবজি ধরল মিতা।
তা হলে খুন হবেন, বলেই উল্টো মিতাকে রানার দিকে ঠেলে দিল ট্রলারের ক্যাপ্টেন। ভারসাম্য সামলাতে না পেরে পড়ে গেল এক পাশের বাঙ্কের পাশে।বাঁচান পাবলোকে!
তার পাশে থামতেই রানা দেখল, কাটা হাঁটু রক্তাক্ত ন্যাকড়ায় মুড়িয়ে রেখেছে রাশান। তখনই নাকে লাগল গ্যাংগ্রিনের দুর্গন্ধ। এই লোক মারাত্মকভাবে আহত, বাঁচবে না।
দয়া করে পাবলোকে নিয়ে যান, ওকে বাঁচান! আবারও বলল রাশান। তার একটা হাত ধরে বসে পড়েছে ছেলেটা। নীরবে কাঁদছে। যাবে না বন্ধুকে ফেলে।
আবছা আলোয় রানার চোখে তাকাল মিতা, পরক্ষণে নিল সিদ্ধান্ত। খপ করে ধরল পাবলোর হাত, টান দিয়ে সরিয়ে নিল রাশান ক্যাপ্টেনের কাছ থেকে। গলা ছেড়ে কাঁদতে লাগল বাচ্চা ছেলেটা।
আমাকে একটা অস্ত্র দিয়ে যান, কাঁপা কণ্ঠে বলল দিমিতভ।
মানুষটা বন্দি হতে চায় না। ব্যাকপ্যাক থেকে রাশান পিস্তল ও একটি ফ্র্যাগমেন্টেশন গ্রেনেড নিল রানা, ধরিয়ে দিল লোকটার দুহাতে। উঠে দাঁড়িয়ে মিতার হাত ধরে ছুটল এলিভেটরের দরজা লক্ষ্য করে।
পাবলোর কনুই শক্ত করে ধরে রেখেছে মিতা। বেসুরো কণ্ঠে জানতে চাইল, আমরা এলিভেটরে উঠব?
ওরা বাইরের সীমানা পাহারা দিচ্ছে, কাজেই ছাতে উঠব, বলল রানা। ওদের নাকের ডগা দিয়ে বেরিয়ে যাব।
এলিভেটরে চাপল ওরা। রানা দেখল, এখনও সুট-এ ঝুলছে গার্ডের চাবি। ওটা মুচড়ে দিলে ওপরে উঠবে এলিভেটর কার। কিন্তু তার আগে কাজ আছে। এক পাশে রাইফেল ঠেস দিয়ে রেখে কন্ট্রোল প্যানেল টেনে খুলল রানা।
কী করছ? জানতে চাইল মিতা।
ওভাররাইড করব ওদের কমপিউটার, বলল রানা। প্যানেলের ভেতর থেকে টান দিয়ে বের করল চিরুনির মত দেখতে ইলেকট্রনিক ইন্টারফেস। ওটার সঙ্গে যুক্ত ক্যালকুলেটর আকৃতির কী যেন।
এলিভেটরের ইন্টারফেস-এ ঢুকেছে অসংখ্য তার। ওগুলো সাবধানে বের করে নিল রানা, তারপর আটকে নিল ওর আনা ইলেকট্রনিক ইন্টারফেস-এ। চিরুনি গেঁথে দিল ক্যালকুলেটরের বুকে। কি প্যাডে টাইপ করল: ১১১। কাজটা শেষ করেই টিপল এন্টার। ডিসপ্লেতে দেখা গেল: লক। বন্ধ হয়ে গেল এলিভেটরের দরজা, তীব্র গতি তুলে উঠতে লাগল এক্সপ্রেস কার।
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে পাবলো। দুহাতে তুলে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরল মিতা। কিচ্ছু হয়নি। কাঁদে না। সব ঠিক হয়ে যাবে।
সত্যিই ভাল মা হবে মিতা, ভাবল রানা। পরক্ষণে পরীক্ষা করল ডিসপ্লের রিডআউট। পেরিয়ে যাচ্ছে বিশতলা। গতি আরও বাড়ছে। যে ডিভাইস ব্যবহার করছে রানা, ওটা পেয়েছে এনআরআই চিফের কাছ থেকে। এই টাওয়ারের এলিভেটরের কমপিউটার সিকিউরিটি প্রোটোকল ওভাররাইড তো করছেই, কমপিউটারকে জানাচ্ছে ভুল তথ্য: এলিভেটর রয়ে গেছে এখনও জেলখানায়।
দুর্গ ঘিরে রাখবে হুয়াং লি ল্যাং-এর বাহিনী, আর আরেক দল লবিতে দাঁড়িয়ে বারবার কল বাটন টিপে ডাকবে এলিভেটর। এই বুঝি এল ওটা।
কিন্তু ততক্ষণে তাদেরকে কাঁচকলা দেখিয়ে ওরা উঠে যাবে ছাতে।
রানার মগজে ঘুরছে একটা চিন্তা: ঠিক সময়ে আসবে তো ইগোর দিমিতভের হেলিকপ্টার?
ব্যাকপ্যাক থেকে তিনটে হার্নেস বের করল রানা, ওগুলোর সঙ্গে রয়েছে স্টিলের তার। শেষমাথায় স্ন্যাপ রিং। একটা মিতার জন্যে, একটা পাবলোর জন্যে, অন্যটা ওর।
পাবলোকে হার্নেস পরাতে শুরু করে বলল রানা, মিতা, পরে নাও।
হার্নেস নিয়ে প্রথমে পা ওটার ভেতর ভরল মিতা, তারপর দুই হাত।
রানা হার্নেস পরিয়ে দিচ্ছে বলে খুব অবাক হয়েছে পাবলো। বন্ধ হয়েছে কান্না। ফোলা চোখ লাল। গালে লোনা জলের দাগ।
জানলে কী করে, আমি এখানে? জানতে চাইল মিতা।
মিস্টার ব্রায়ান নিউ ইয়র্কে এসেছিলেন তোমার খবর দিতে। অনুরোধ করেন, যেন হংকং থেকে তোমাকে নিয়ে পৌঁছে দিই আমেরিকায়।
উনি জানলেন কী করে যে আমি এখানে?
হুয়াং লি ল্যাং-এর লোক তোমাকে কিডন্যাপ করলে ব্রায়ানকে ফোন দেন প্রফেসর হ্যারিসন। এরপর কোথায় আছ। তা খুঁজে বের করেন ব্রায়ান।
তা হলে বেঁচে আছেন ডক্টর জর্জ হ্যারিসন? ঝলমল করছে মিতার দুই চোখ। ভেবেছিলাম খুন হয়ে গেছেন বুঝি।
এলিভেটর রিডআউট দেখল রানা। ঝড়ের গতি তুলে উঠছে ওরা। নব্বই তলা। পনেরো সেকেণ্ড পর পৌঁছাব ছাতে।
তারপর কী করবে? জানতে চাইল মিতা।
আমাদের জন্যে অপেক্ষা করবে হেলিকপ্টার।
তা হলে হার্নেস আনলে কেন?
ছাতে নামতে পারবে না হেলিকপ্টার।
বৃষ্টিভেজা, আঁধার ছাতে উঠে থামল এলিভেটর, খুলে গেল দরজা।
রানা রাইফেল হাতে বেরোতেই পাবলোর হাত ধরে ছাতে পা রাখল মিতা। জানতে চাইল, কোথায় হেলিকপ্টার?
মস্ত ছাতের আশপাশে কোথাও নেই ওই জিনিস!
তুমুল বৃষ্টি, সেই সঙ্গে দমকা হাওয়া।
রানার মনে হলো, গতরাতের মতই শহরের রঙিন আলো মেখে মাথার কাছে নেমে এসেছে ধূসর মেঘ। বাস্তবে ছাত থেকে আছে অন্তত সিকি মাইল ওপরে। ভাবছে রানা, স্কাইস্ক্র্যাপার ভরা শহরে বাজে এ আবহাওয়ায় কপ্টার আকাশে তুলবে না সুস্থ মগজের পাইলট। বৃষ্টির কারণে প্রায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না।
অবশ্য ইগোরের বক্তব্য অনুযায়ী, সঠিক সময়ে পৌঁছাবে যান্ত্রিক ফড়িং। রাশান ছেলেটাকে খুব দরকার তাদের।
ছাতে রেলিং বলতে কিছুই নেই, কিনারায় গিয়ে দাঁড়াল রানা। অনেক নিচে পাথুরে জমিন। আকাশ ভেঙে নেমেছে বৃষ্টি।
এল না কেউ, ভিজতে ভিজতে বলল হতাশ মিতা।
বৃষ্টির শব্দ পাত্তা না দিয়ে কান পাতল রানা। কোথাও নেই পাখার ধুব-ধুব আওয়াজ। কিছুক্ষণ পর দূর থেকে এল চাপা বিস্ফোরণের শব্দ। একবার মৃদু কাঁপল গোটা ছাত।
চট করে রানার দিকে তাকাল মিতা। বুঝে গেছে, কী হয়েছে। গ্রেনেড ফাটিয়ে দিয়েছে ট্রলারের ক্যাপ্টেন দিমিতভ, মারা যাওয়ার আগে বোধহয় সঙ্গে নিয়েছে কয়েকজন গার্ডকে।
এবার ওরা বুঝবে, এলিভেটর নিচে নেই, বলল মিতা।
মৃদু মাথা দোলাল রানা। একটু আগেই হয়তো টের পেয়েছে সিকিউরিটির লোক।
ওরা শুনল ভারী মেশিনের গুঞ্জন। দ্রুত উঠে আসছে দ্বিতীয় এলিভেটর।
নিশ্চয়ই ব্যাকআপ প্ল্যান আছে? আশা নিয়ে রানার দিকে তাকাল মিতা।
নেই। ব্যাকপ্যাক থেকে পিস্তল নিয়ে মিতার হাতে দিল রানা। রাইফেল হাতে নিজে কাভার করল এলিভেটর শাফট ও সিঁড়িঘর।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটু দূরে সরে বসল মিতা। একহাতে ধরে রেখেছে পাবলোর কনুই, অন্য হাতে ম্যাকারভ পিস্তল।
গন্তব্যে পৌঁছে টুং আওয়াজ তুলল এলিভেটর। রানা দেখল, দরজার তলা দিয়ে আসছে আলো। রাইফেল হাতে ওদিকে চোখ রাখল। তিন সেকেণ্ড পর খুলে গেল এলিভেটরের দরজা। ভেতরে কেউ নেই!
ঝট করে সিঁড়িঘরের দিকে রাইফেল তাক করল রানা।
তখনই পেছন থেকে এল কড়া ধমক: অস্ত্র ফেলো, নইলে খুন হবে!
কুঁচকে গেল রানার ভুরু। অস্বাভাবিক হলেও এই ছাতের পাশে উঠেছে ফায়ার এস্কেপ, ওই পথে এসেছে ল্যাং-এর লোক!
হাত থেকে রাইফেল ফেলে দিল রানা। ঠনাৎ আওয়াজে ছাতে পড়ল মিতার পিস্তল।
ঘুরে দাঁড়াও!
পাবলোকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে মিতা। খুব ধীর গতি তুলে ঘুরল রানা। তিনজন গার্ডকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মোটা এক চাইনিজ লোক। আগে তাকে দেখেনি রানা, কিন্তু ডোশিয়ে পড়েছে, বুঝে গেল এই লোকই ক্যাং লাউ ল্যাং এর খাস লোক, ডানহাত!
ছাতে শুয়ে পড়ো, আরেক ধমক দিল মোটকু।
অলসভঙ্গিতে ছাতে শুয়ে পড়ল রানা। দূর থেকে এল ভারী ধুব-ধুব আওয়াজ। আসছে খুব দ্রুত। মাত্র কয়েক সেকেণ্ডে হাজির হলো দালানের ছাতের ওপরে।
ঘাড় কাত করে হেলিকপ্টারের দিকে তাকাল রানা। ওটা চকচকে কালো ইউরোপিয়ান জিনিস। খুলে গেছে একদিকের দরজা। ওখান থেকে এল এক পশলা গুলি।
কিছু বোঝার আগেই বুক-পেটের বেশিরভাগ রক্ত ছড়িয়ে ছাতে লাশ হলো দুই গার্ড। জান বাঁচাতে ফায়ার এস্কেপের দিকে ছুটল ক্যাং লাউ এবং অন্য গার্ড।
রানাদের খুব কাছে এসে ঘুরে গেল হেলিকপ্টার।
সিঁড়িঘর থেকে হেলিকপ্টার লক্ষ্য করে এল গুলি।
আবারও রাইফেল তুলে নিয়েছে রানা, অর্ধেক ম্যাগাযিন খালি করল ওদিকের গার্ডদের উদ্দেশে।
এদিকে আরও কাছে এল হেলিকপ্টার। ওটার দরজা থেকে নিচে পড়ল স্টিলের কে। রানা গুলি ছুঁড়তে ব্যস্ত, লাফিয়ে উঠে কে টেনে নিল মিতা।
হার্নেসে আটকে নাও! নির্দেশ দিল রানা।
আগে পাবলোর হার্নেসে কেবল আটকে দিল মিতা। ফায়ার এস্কেপ থেকে এল একরাশ গুলি। হেলিকপ্টারের ফিউজেলাজে লেগে ফুলকি তুলল।
জলদি! তাড়া দিল রানা। আরেক পশলা গুলি পাঠাল সিঁড়িঘরের দিকে। মিতা ঝুলে পড়তেই নিজের হার্নেসের আঙটা চট করে কেবৃ-এ আটকে নিল।
হৈ-হৈ করে সিঁড়িঘর ও ফায়ার এস্কেপ থেকে তেড়ে এল ল্যাং-এর গার্ডরা। গুলি করছে ককপিট লক্ষ্য করে। পাল্টা গুলি পাঠাল রানা। কিন্তু ওকে ঝুলিয়ে-দুলিয়ে সরে গেল হেলিকপ্টার, ল্যাং টাওয়ারের ছাত ছেড়ে সোজা চলল নদীর ওপর দিয়ে।
রানার মনে হলো, বহু ওপর থেকে লাফ দিয়েছে। জাম্পারদের মত। ওরা যেন মস্ত ঘড়ির পেণ্ডুলাম। কেবল-এ ঘুরতে ঘুরতে গলা ছেড়ে কাঁদছে পাবলো। মিতার দিকে তাকাল রানা। নিচে তাকিয়ে আছে মেয়েটা। গুলির ভয়ে অনেক নেমে এসেছে কপ্টার। সাঁই-সাঁই করে পিছিয়ে পড়ছে নদী। ওদের গতি কমপক্ষে ঘন্টায় এক শ মাইল। বৃষ্টি ও তুমুল বাতাসের ভেতর আঁধার আকাশ চিরে ছুটে চলেছে। দেখতে না দেখতে এক হাজার ফুট পেছনে পড়ল ভিক্টোরিয়া হার্বারের ব্যস্ত এলাকা।
সামনে দুলতে দুলতে যাচ্ছে রানারা, পরক্ষণে হয়ে উঠছে ওজনশূন্য। আবার ধপ করে পড়ছে নিচে। তবে পাইলট স্পিড স্বাভাবিক করার পর কমল ঝকি। হেলিকপ্টারের পেছনে লেজের মত ঝুলতে ঝুলতে চলল ওরা। মুখে-হাতে গুলির মত লাগছে বৃষ্টির ফোঁটা। মিতা ও পাবলোকে দুহাতে জড়িয়ে ধরল রানা, তাতে একটু কমল দুলুনি।
হেলিকপ্টারের হালকা উইঞ্চ টেনে তুলতে পারবে না তিনজনকে, কাজেই ঠিক করা হয়েছে, কাউলুনের দিকে যাওয়ার পর ল্যাণ্ড করবে পাইলট। তখন দেরি না করে যে যার পথে সরে পড়বে ওরা।
শোঁ-শোঁ আওয়াজের ওপর দিয়ে চিৎকার করে জানতে চাইল মিতা, রানা, কে চালাচ্ছে হেলিকপ্টার?
আমার অচেনা কেউ, জবাব দিল রানা।
এরা কারা? আবার কিডন্যাপ করবে না তো আমাদেরকে?
এরা রাশান, বলল রানা।
আমার ধারণা হয়েছিল আঙ্কেল ব্রায়ান সবকিছু জানিয়েছে তোমাকে।
ঠিক তা নয়।
তা হলে কী?
এখানে পৌঁছেই পড়েছি রাশানদের প্যাঁচে।
রাশান? এরা কী চায় আবার?
ওরা ছেলেটাকে ফেরত চায়। পাবলোর মা বিজ্ঞানী, তাকে ব্ল্যাকমেইল করতে ওকে কিডন্যাপ করেছে হুয়াং লি ল্যাং।
মাথা কাত করল মিতা। মনে হল ভুল শুনেছে। কয়েক সেকেণ্ড পর বলল, একদম মিথ্যা! পাবলো এতিম। ওর ওপর নানান কঠিন এক্সপেরিমেন্ট করছে ওরা।
খুব গম্ভীর হয়ে গেল রানা। ওরও মনে হয়েছিল, অর্ধসত্য বলছে ইগোর দিমিতভ। এ ধরনের তথ্যের জন্যে তৈরি ছিল না। তুমি ঠিক জানো তো, মিতা?
আমার ভুল হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।
পাবলোকে একবার দেখে নিয়ে মিতার চোখে চোখ রাখল রানা।
আমি ওদের হাতে পারলোকে তুলে দেব না, বলল মিতা।
নিচের নদী দেখল রানা, আবারও দেখল মেয়েটাকে।
একজনকে কথা দিয়েছি, বলল মিতা। পাবলোকে কারও হাতে তুলে দেব না। জোরালো হাওয়া ও বৃষ্টির মাঝ দিয়ে অনুনয়ের দৃষ্টিতে তাকাল ও।
ভাবছে রানা। ওরা আছে জলসমতল থেকে বড়জোর পঞ্চাশ ফুট ওপরে। পাঁচ শ গজ দূরেই তীর।
আমি কিন্তু ওদের সঙ্গে চুক্তি করেছিলাম, বোঝাতে চাইল রানা। এখন সেটা ভঙ্গ করা অনুচিত হবে।
জান থাকতে ওকে দেব না! ছেলেটাকে আরও আঁকড়ে ধরল মিতা। ওকে নিয়ে যাব আমার সঙ্গে আমেরিকায়!
কয়েক সেকেণ্ড ভাবল রানা, তারপর বলল, তো তৈরি হও। কনুইয়ের ভঁজে পাবলোকে রেখে চট করে মিতার স্টিলের কেবল খুলে দিল ও। মেয়েটা আলুর বস্তার মত নিচে রওনা হতেই পাবলো আর ওর নিজের কেবল খুলল রানা। মিতাকে পেছনে ফেলে অন্ধকার নদীতে পড়ছে ওরা।
পাথরের মত পড়তে পড়তে রানার মনে হলো: ওই রাশান ব্যাটা সহজে ছাড়বে না! ঝামেলা হওয়ার আগেই মিতা আর পাবলোকে পৌঁছে দিতে হবে আমেরিকায়! কাজেই গোপনে বেরিয়ে যেতে হবে এই দেশ ছেড়ে!
নতুন কিছু ভাবতে পারল না রানা, অনেক ওপর থেকে ঝপাস করে নামল নদীতে। পরক্ষণে একহাতে পাবলোকে জাপ্টে রেখে তলিয়ে গেল পানির ত্রিশ ফুট নিচে!
.
১৬.
তাঁর সর্বনাশ করতেই এসেছেন সিআইএ চিফ মার্ল ক্যালাগু, ভাবলেন এনআরআই চিফ জেমস ব্রায়ান। ওই লোকের সঙ্গে এসেছেন স্বয়ং প্রেসিডেন্ট। এবার চেপে ধরা হবে তাকে: কার অনুমতি নিয়ে হংকং থেকে সরানো হয়েছে মিতা দত্তকে?
ভার্জিনিয়া ইণ্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্সের পঞ্চম ভবনে নিজ অফিসে প্রেসিডেন্ট ও সিআইএ চিফকে আপ্যায়ন করছেন ব্রায়ান। চট করে একবার দেখলেন সিনিয়র বন্ধুর চোখ। কী যেন ভাবছেন তিনি, অস্বাভাবিক গম্ভীর। মনে হচ্ছে, কী যেন দায়িত্ব দিয়েছেন সিআইএ চিফ ক্যালাগুর ওপর। এ কারণেই খুব চিন্তিত ব্রায়ান।
এদিকে কেমন যেন হতোদ্যম মনে হচ্ছে কমাণ্ডার ইন চিফকে, ভাবলেন ক্যালাগু।
আসল কথা, আমরা যখন শুনলাম আপনি আমেরিকার শত্রুর সাহায্য নিয়েছেন, অবাক না হয়ে পারিনি, নতুন উদ্যমে বললেন সিআইএ চিফ। আমরা আশা করেছিলাম, সহযোগী এবং অনেক দক্ষ কোনও এজেন্সির সহায়তা চাইবেন আপনি।
ফাঁদের ছক বুঝতে পারছেন ব্রায়ান। মাসুদ রানার অফিসে গিয়ে সাহায্য চেয়েছেন, এটা যদি প্রেসিডেন্টের কাছে অস্বীকার করেন, দেরি না করে প্রমাণ দেখাবেন ক্যালাগু। আবার যদি স্বীকার করেন কী করেছেন, তা হলেও বলা হবে বোকার মত ঝুঁকি নিয়েছেন তিনি।
আপাতত কিছুই করার নেই বুঝে আত্মরক্ষা করতে চাইলেন ব্রায়ান, নরম সুরে বললেন, এনআরআই অফিসকে ব্যবহার করে কিছুই করিনি।
তার মানেটা কী? ঘেউ করে উঠলেন ক্যালাগু।
ওই অপারেশনে ব্যবহার করা হয়নি এনআরআই ফাণ্ড, বললেন ব্রায়ান।
তো টাকা এল কোথা থেকে? জানতে চাইলেন ক্যালাগু।
এনআরআই ফাণ্ড থেকে আমার প্রাপ্য সব টাকা তুলে নিয়ে ট্রান্সফার করেছি মাসুদ রানার অ্যাকাউন্টে।
চট করে প্রেসিডেন্টের দিকে তাকালেন ক্যালাগু। আশা করছেন, এবার কঠিন একখানা গযল ঝাড়বেন তিনি। কিন্তু প্রেসিডেন্টকে চুপ দেখে বাধ্য হয়েই আবার তাকালেন ব্রায়ানের দিকে। আপনি কি পাগল হয়েছেন, ব্রায়ান? আপনার তো বোঝার কথা, চাইলেও সাধারণ নাগরিকের মত যা খুশি তাই করতে পারেন না। আপনি গুরুত্বপূর্ণ একটা অফিস চালান। আপনার জানার কথা, কতবড় ঝুঁকির ভেতর ফেলেছেন আমাদেরকে। তা ছাড়া…
রস পেরো যদি নিজের লোককে শত্রুদেশ থেকে তুলে আনতে পারেন, এবং সেজন্যে হিরো হয়ে যান, তো আমি কেন আমার প্রিয় কাউকে ফিরিয়ে আনতে পারব না? আইনের বাইরে গিয়ে অন্য দেশের কোনও নাগরিক আমার দেশের নাগরিককে তুলে নিয়ে গেলে আমি বসে থাকব?
বিস্ফোরিত হলেন ক্যালাগু, স্রেফ পাগল হয়ে গেছেন, ব্রায়ান! আপনি যদি আমার চাকরি করতেন, পেছনে লাথি দিয়ে চাকরি থেকে বের করে দিতাম, বা গ্রেফতার করাতাম।
চুপ করে নিজের সিটে বসে আছেন ব্রায়ান। নিজের আসল ইচ্ছে জানিয়ে ফেলেছেন ক্যালাগু। খুব নরম সুরে বললেন এআরআই চিফ, ও, তা হলে এটাই আপনার মনের খায়েশ? যেভাবে হোক এনআরআইকে পায়ের নিচে দলবেন? অর্থাৎ আপনার চাই আরও ক্ষমতা? যা খুশি করবে সিআইএ?
যথেষ্ট কারণ আছে বলেই আমার সংগঠনকে বলা হয় সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স, আড়ষ্ট কণ্ঠে বললেন ক্যালাগু।
আপনারা একদল খুনি ছাড়া আর কিছুই নন; বললেন ব্রায়ান। ইন্টেলিজেন্স বা বুদ্ধি আবার কোথায় পেলেন?
সান লোশন ছাড়াই যেন বসে আছেন সাহারা মরুভূমির মাঝে, রাগে লাল হয়ে গেল ক্যালার চেহারা। ধমকে ওঠার আগেই এক হাত ওপরে তুললেন প্রেসিডেন্ট। ধরে নিন বক্সিঙের এই রাউণ্ড শেষ। আপনার কথায় পয়েন্ট আছে, ক্যালাগু। কিন্তু ব্রায়ান যা বলেছেন বা করেছেন, তাতে আমেরিকার বেশিরভাগ মানুষ খুশি হবে; আদালতে গেলেও বাহবা পাবেন ব্রায়ান।
চুপ করে কথাটা শুনলেন ব্রায়ান। বুঝে গেলেন, এখনও তার পক্ষেই আছেন প্রেসিডেন্ট।
তা ছাড়া, মৌখিকভাবে নির্দেশ দেয়ার পর কাজে নামেন ব্রায়ান।
হতভম্ব হয়ে গেলেন ক্যালাগু। মৌখিক নির্দেশ? ভুরু কুঁচকে গেল তার। দয়া করে খুলে বলবেন, স্যর?
সহজ কথা, বললেন প্রেসিডেন্ট। চেয়েছি পরবর্তী সময়ে আদালত যেন আমাকে দায়ী না করে। আবার এ-ও চাইনি, আমার দেশের মানুষকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যাবে অন্য দেশের লোক, অথচ কিছুই করতে পারব না। কাজেই মিতা দত্তকে চিন থেকে তুলে আনার দায়িত্ব চেপে বসে ব্রায়ানের ওপর। একবার এনআরআই, চিফকে দেখলেন তিনি, তারপর বললেন, হুয়াং লি ল্যাং-এর কপাল ভাল, সে আছে চিনে। ওই দেশকে ঘাটাতে চাই না। কিন্তু মাসুদ রানা যখন ঝুঁকি নিয়ে মেয়েটাকে সরিয়ে আনতে রাজি হলেন, খুবই খুশি হয়েছি।
মুচকি হাসলেন প্রেসিডেন্ট। খারাপ কিছু হলে ভুলে যেতাম, এসবের সঙ্গে আমি জড়িত। আর আপনিও কিছুই টের পেতেন না, ক্যালাগু।
বিমর্ষ হয়ে গেছেন সিআইএ চিফ।
চুপ করে আছেন ব্রায়ান। বাস্তবে তাঁকে কোনও মৌখিক নির্দেশ দেননি প্রেসিডেন্ট। কাজেই বুঝতে পারছেন, তাঁকে রক্ষা করছেন তিনি। ঋণী ও কৃতজ্ঞ হয়ে গেলেন ব্রায়ান।
কথা তো শেষ, নাকি? বললেন প্রেসিডেন্ট। এবার আলাপ হোক… যে কাজে এসেছি।
চুপ করে অপেক্ষা করছেন ব্রায়ান।
গতকাল আপত্তিকর কিছু তথ্য পেয়েছেন ক্যালাগু, বললেন প্রেসিডেন্ট। সিআইএ গুজব শুনেছে এনআরআই সম্পর্কে। এখানে, কমপ্লেক্স-এ নাকি তৈরি করা হয়েছে এক্সপেরিমেন্টাল ফিউশন রিঅ্যাক্টর। কিন্তু সেটা সম্পূর্ণ বেআইনী। এ ধরনের কিছু ঘটে থাকলে, রাজধানীর সাধারণ মানুষ ভয়ঙ্কর ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
ব্রায়ান ভাবলেন, সিআইএর গুজব ভুল, কিন্তু ওই কাহিনির মাঝে যে একতিল সত্যি নেই, তা নয়। প্রথম দিনই প্রেসিডেন্টকে জানিয়ে কাজে নেমেছেন তিনি। ইচ্ছে করলে যে-কোনও সময়ে ওই তথ্য ক্যালাগু বা অন্য কাউকে দিতে পারতেন প্রেসিডেন্ট। এজন্যে ভার্জিনিয়ার এনআরআই অফিস ভিযিট করা প্রয়োজন ছিল না তার।
অর্থাৎ, অন্য কোনও উদ্দেশ্য আছে তাঁর।
ব্রায়ান আন্দাজ করলেন, প্রেসিডেন্ট চাইছেন এবার খুলে বলা হোক সব।
অনেক দিন ধরেই এমনসময় আসবে ভেবে আতঙ্কে ছিলেন ব্রায়ান। এবার হয়তো বন্ধ হবে সব। প্রেসিডেন্ট হয়তো চাইছেন সিআইএকে জানাতে, যাতে তারাও জড়াতে পারে এনআরআই-এর পঞ্চম ভবনের নিচতলার প্রোগ্রাম-এ। নিজ চোখে দেখবেন তিনি। বুঝে নেবেন জিনিসটা আসলে কী।
তার মানে নিজের চোখে আপনারা ওই প্রোগ্রাম দেখতে চান, বললেন ব্রায়ান।
মৃদু নড করলেন-প্রেসিডেন্ট।
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন ব্রায়ান। আপনি অনুমতি দিলে, চলুন, যাওয়া যাক।
ব্রায়ানের পেছনে চললেন প্রেসিডেন্ট ও দ্বিধান্বিত সিআইএ চিফ। সবাইকে ঘিরে এগোল প্রেসিডেন্টের সিকিউরিটি ডিটেইল। কিন্তু সিকিয়োর এক এলিভেটরের সামনে থামলেন এনআরআই চিফ, তাকালেন সিনিয়র বন্ধুর দিকে।
হাত তুলে দলের অন্যদেরকে নিষেধ করলেন প্রেসিডেন্ট। এখানেই অপেক্ষা করো। আমাদের সময় লাগবে।
ব্রায়ান কোড দেয়ার পর খুলে গেল এলিভেটরের দরজা। তারা তিনজন উঠে পড়ার পর পেছনে রয়ে গেল সিকিউরিটির লোকগুলো। একবার ভাবলেন এনআরআই চিফ, বলবেন নাকি: না-ই-বা গেলেন ওই প্রোগ্রাম দেখতে, স্যর! কিন্তু গম্ভীর চেহারায় দাঁড়িয়ে আছেন প্রেসিডেন্ট। এখন আর ওই বিষয়ে আলাপ করার উপায় নেই। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট চাইছেন সিআইএ জড়িয়ে যাক এনআরআই-এর এই প্রোগ্রামে। আর কোনও কথা চলে না।
এক মিনিট পেরোবার আগেই তারা নেমে এলেন অন্ধকারাচ্ছন্ন এক ল্যাবোরেটরিতে। এয়ার ফিল্টারেশনের জন্যে মৃদু গুনগুন আওয়াজ ছাড়া চারপাশ নীরব। প্রকাণ্ড ঘরের দেয়াল ও ছাতে জ্বলছে, নরম বিশেষ নীলচে লেড বাতি।
চুপচাপ বসে কমপিউটারের মনিটরে রিডআউট দেখছে। এনআরআই-এর দুই টেকনিশিয়ান। এনআরআই চিহ্ন, সিআইএ চিফ এবং স্বয়ং প্রেসিডেন্টকে দেখে উঠে দাঁড়াল তারা।
নিজের কাজ করুন, বললেন প্রেসিডেন্ট।
দুই অতিথিকে কাচের একটা প্যান-এর সামনে নিয়ে গেলেন ব্রায়ান। দুই ইঞ্চি পুরু কাঁচ আসলে কেভলার, রাইফেলের বুলেট লাগলেও কিছুই হবে না। পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি বাঁকা, সহজেই যেন দেখা যায় ভেতরের জিনিস।
পাঁচ ফুট নিচে বৃত্তাকার জ্বলন্ত লেড বাতির মাঝে মুকুটের মত বসে আছে ত্রিকোণ এক স্ফটিক। খুব সুন্দর করে পলিশ করা। নীলচে আলোয় ঝিকঝিক করছে হীরার মত।
কোনও পরিবর্তন? জানতে চাইলেন ব্রায়ান।
টেকনিশিয়ানদের একজন বলল, না, স্যর। গত মাসের বাইশ তারিখ থেকে আর কিছুই ঘটেনি।
কোহিনূর হীরার মত ঝলমলে স্ফটিক মনোযোগ দিয়ে দেখছেন সিআইএ চিফ মার্ল ক্যালাগু।
আগেও বহুবার দেখেছেন, তবুও ওই জিনিসের দিকে না চেয়ে পারলেন না ব্রায়ান।
আগে মাত্র দুবার ওই স্ফটিক দেখেছেন প্রেসিডেন্ট। অবশ্য, অতীতের কৌতূহল এখন নেই, এবার দেখছেন অস্বস্তি নিয়ে। চান না ওটার কারণে মস্ত কোনও ক্ষতি হোক মানুষের।
ওটা আসলে কী? জানতে চাইলেন ক্যালাগু।
আমরা ওটার নাম দিয়েছিঃ ব্রাযিল স্টোন, বললেন ব্রায়ান। আমাযন থেকে উদ্ধার করে এ দেশে আনা হয়েছে এক বছর আগে। প্রেসিডেন্টের দিকে মাথা কাত করলেন তিনি। দেরি না করে জানানো হয়েছে প্রেসিডেন্ট এবং কংগ্রেসের বড় মাপের কয়েক নেতাকে।
দুজনের চেহারা ও মনোভাব ভালভাবে বুঝতে একটু সরে দাঁড়ালেন ব্রায়ান।
ওই জিনিস কী করে? জানতে চাইলেন ক্যালাগু।
শক্তি উৎপাদন করে, বললেন ব্রায়ান, কীভাবে কী হচ্ছে তা আমরা এখনও জানি না।
এখানে রেখেছেন কেন? জানতে চাইলেন ক্যালাগু। ওটা কি রেডিয়োঅ্যাকটিভ বা ওই ধরনের কিছু?
না, তেমন নয়, বললেন ব্রায়ান, তবুও এই ভল্ট এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, নিউক্লিয়ার এক্সপ্লোশন হলেও ক্ষতি হবে না মানুষের। চারপাশের দেয়াল দেখালেন তিনি। আমরা আছি মাটির পঞ্চাশ ফুট নিচে। এই ভল্ট বাক্সের মত, টাইটানিয়ামের তৈরি। বাইরে ষোলো ইঞ্চি সীসার দেয়াল। তার বাইরে আছে চার-পাঁচ ইঞ্চি সিরামিক সিলিকন। সব আবার ঘিরে রেখেছে একফুট চওড়া স্টিল রিএনফোর্সড কংক্রিট। এ ছাড়া, ব্যবহার করা হচ্ছে শক্তিশালী ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ড্যামপেনিং ফিল্ড।
আসলে আমাদেরকে কী থেকে বাঁচাতে চাইছেন, ব্রায়ান? জানতে চাইলেন ক্যালাগু।
ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ডিসচার্জ। বিচ্ছুরণ হচ্ছে গামা ও এক্স-রে। হাই-এনার্জি। ছিটকে বেরোলে বারোটা বাজিয়ে দেবে ইলেক্ট্রনিক ইকুইপমেন্টের। ক্ষতি হতে পারে মানব দেহের টিশুর।
চারপাশ দেখলেন ক্যালাগু। দেখে তো মনে হচ্ছে সবই ঠিকঠাক চলছে।
সতেরো ঘণ্টা চৌত্রিশ মিনিট পর পর নিয়মিতভাবে বিচ্ছুরণ হচ্ছে। সে সময়ে সব সিস্টেম বা ইকুইপমেন্ট বন্ধ রাখা হয়। ওই সময় পেরোলে নতুন করে আবারও চালু করা হয় সব। এসব যথেষ্ট সহজভাবেই করতে পারি আমরা। কিন্তু নভেম্বরের বাইশ তারিখে অন্য কিছু হলো।
নভেম্বরের বাইশ তারিখ, আউড়ালেন ক্যালাগু। কী যেন মনে পড়তে গিয়েও পড়ছে না।
ওই দিন সার্চ পার্টি নিয়ে বেরিয়েছিল রাশান ও চিনারা, বললেন ব্রায়ান। সেদিন গামা-রে বিচ্ছুরণ হয়েছিল বেরিং সি-র আর্কটিক সার্কেলে। কাজ থামিয়ে দিয়েছিল আমাদের চারটে জিপিএস স্যাটেলাইটের।
চিন্তিত হয়ে পড়েছেন ক্যালাগু, হঠাৎ গভীর পানিতে পড়ে বুঝতে চাইছেন, কীভাবে উঠবেন তীরে। কিছুই তো বুঝছেন তিনি! একইসময়ে রাগ, কৌতূহল, দ্বিধা এল তাঁর মনে।
তাঁকে রক্ষা করলেন প্রেসিডেন্ট। ব্রায়ান, ওই একই দিনে হংকং থেকে মিতা দত্তকে তুলে আনার বিষয়ে তোমার সঙ্গে কথা হয়েছিল। আলাপ হয় রাশান ও চিনাদের বিষয়ে। সার্চ পার্টি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে তাদের নেভি। অন্যরা না জানলেও এনআরআই পেয়েছিল একটা তথ্য: এনার্জির বিচ্ছুরণ হয়েছে ওই দুই দেশের তৈরি কোনও এনার্জি ওয়েপন থেকে। দুই দেশের কোনওটা সম্ভবত হারিয়ে বসে তাদের অস্ত্র।
তার সঙ্গে সম্পর্ক আছে এই জিনিসের? রাগ নিয়ে ব্রায়ানের দিকে তাকালেনক্যালাগু।
আমি তা বলছি না, বললেন ব্রায়ান। কিন্তু ওই বিচ্ছুরণের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক আছে এই জিনিসের।
জ্বলজ্বলে স্ফটিকের দিকে তাকালেন ক্যালাগু। সন্দেহ নিয়ে দেখলেন প্রেসিডেন্ট ও ব্রায়ানকে। বুঝতে চাইছেন, সত্যি কথা বলা হয়েছে কি না। আপনারা ওটা নিয়ে কোনও এক্সপেরিমেন্ট করছেন?
না, তা করছি না, বললেন, ব্রায়ান, ওই স্ফটিক আমরা তৈরি করিনি। খুঁজে পেয়েছি। এখন স্টাডি করছি। এখনও জানি না এ থেকে নতুন কী বেরোবে।
কী জানতে পারবেন ভাবছেন?
আগেই বলেছি, এটা এমন কোনও উপায়ে শক্তি তৈরি করছে, যেটা আমরা বুঝি না। ভেঙে দিয়েছে ফিযিক্সের প্রথম সূত্র।
আমি এনআরআই-এর বিজ্ঞানী নই, ব্রায়ান। তবে উজবুকও নই। সব সহজ করে বুঝিয়ে বলুন।
এ ধরনের ঝামেলায় পড়বেন বলেই সিআইএকে এসবে জড়ানো হোক, তা চাননি ব্রায়ান। এনআরআই প্রাথমিকভাবে বিজ্ঞান সংস্থা, এর একটা কাজ অন্য দেশের আবিষ্কার হাতিয়ে আনা। এদিকে সিআইএর কাজ ক্ষমতা বদল করা এবং রাজনৈতিক জ্ঞান সংগ্রহ করা। এরা হুমকি দেয়: তোমরা এটা করলে, আমরা ওটা করব। চাইলেও, সিআইএ বা ক্যালাগুকে সহজে কিছু বোঝাতে পারবেন না ব্রায়ান। তবুও চেষ্টা করতে হবে। নরম সুরে বললেন তিনি, ফিযিক্সের প্রথম সূত্রের কথা ভাবুন। আমরা কিছুই তৈরি করি না বা নষ্ট করতে পারি না। ধরুন, আপনি চালু করলেন আপনার গাড়ি। তাতে পুড়তে লাগল তেল। ওটা জ্বলছে বলে তৈরি হলো তাপ। ওই তাপ আবার সৃষ্টি করল প্রসারিত গ্যাস। ওই গ্যাস ছড়িয়ে পড়ছে বলেই নড়তে লাগল পিস্টন। এত শক্তি এসেছে পেট্রোলিয়াম থেকে। ওই কেমিকেল ধীরে ধীরে তৈরি হয়েছে হাজার হাজার বছর ধরে। কী থেকে হয়েছে? লাখে লাখে মৃত ডাইনোসরের দেহ থেকে। নইলে পেতেন না ক্রুড অয়েল।
ক্যালাগু বুঝলেন কি না, তা জানতে গিয়ে থেমে গেলেন ব্রায়ান। কয়েক সেকেণ্ড পর বললেন, আপনি গাড়ি চালাচ্ছেন বলে বিচ্ছুরণ হচ্ছে এনার্জির। নিজে কিছুই তৈরি করছেন না। ওই একই কাজ করে নিউক্লিয়ার প্লান্ট, অবশ্য সেটা করে অন্য উপায়ে, ভাঙতে থাকে অ্যাটম। ওটা পেট্রোলিয়ামের কেমিকেলের বন্ধনের মতই। বেরিয়ে আসে জমে থাকা প্রচণ্ড নিউক্লিয়ার শক্তি বা এনার্জি। এই দুই ক্ষেত্রে কিন্তু আগে থেকেই ছিল শক্তি, আমরা শুধু জেনে নিয়েছি কীভাবে ব্যবহার করতে হবে।
স্ফটিকের দিকে আঙুল তুললেন ব্রায়ান। কিন্তু ওই পাথর একেবারেই অন্যরকম। আমাদের জানা কোনও উপায়ে ওটা তৈরি করছে না শক্তি। কখনও কখনও ওটা থেকে বেরোচ্ছে বিপুল পরিমাণের এনার্জি। আমরা শুধু আঁচ করছি, যেভাবেই হোক কোয়ান্টাম কোনও কারণে শক্তি তৈরি করছে ওটা, বা অন্য কোথাও থেকে নিয়ে আসছে শক্তি।
ব্রায়ান থেমে যাওয়ার পর কেমন অসহায় চোখে তাঁকে দেখলেন ক্যালাগু। ও, বুঝলাম। শক্তি তৈরি করে। এমন এক পাথর, যেটা এনার্জি দিচ্ছে। খুবই ভাল, তো ব্যবহার করুন গ্রিড-এ, কয়লার প্লান্ট বাতিল করে বন্ধ করুন গ্লোবাল ওঅর্মিং।…কিন্তু আমি এসব জানতে চাইনি। জানতে চাইছি, কী কারণে এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে এই পাথর। সাধারণ কেউ ওটার ব্যাপারে কিছু জানল না কেন? বা কী কারণে এখন জানাচ্ছেন আমাদেরকে?
প্রেসিডেন্টের দিকে তাকালেন ব্রায়ান।
আস্তে করে মাথা দোলালেন প্রেসিডেন্ট। সময় হয়েছে সব খুলে বলার।
প্রাকৃতিক কোনও পদার্থ নয় এই স্ফটিক, বললেন ব্রায়ান। নিরেট পাথর নয়। এক ধরনের মেশিন। অতীতে কখনও তৈরি করেছে মানুষ।
নাকের কাছে কালাকুত্তার গু দেখেছেন এমন ভঙ্গিতে নাক বাঁকা করে ফেললেন ক্যালাগু। বলতে চাইছেন হাজার হাজার বছর আগে তৈরি করেছে মানুষ ওই জিনিস?
প্রফেসর জর্জ হ্যারিসন যেসব মায়ান গ্রিফ পান, ওগুলো থেকে তা-ই জেনেছেন, বললেন ব্রায়ান। মাত্র সামান্য কিছু বোঝা গেছে, অনেক কিছুই আমরা জানতে পারিনি। আসলে অন্ধকারে হাতড়াচ্ছি বললেও ভুল হবে না।
বিরক্ত হয়ে তার দিকে চেয়ে আছেন ক্যালাগু।
ব্যাখ্যার দায়িত্ব নিলেন প্রেসিডেন্ট। এনআরআই ভাবছে, ওই পাথর বা স্ফটিক তৈরি করা হয়েছে হাজার হাজার বছর আগে। ওটা তৈরি করেছিল অন্য কোনও সভ্যতা। হয়তো আমাদের সভ্যতার চেয়েও অনেক আধুনিক ছিল তারা।
প্রেসিডেন্টের দিকে না চেয়ে ব্রায়ানকে বললেন ক্যালাগু, তা হলে এই জিনিস মানুষের স্বাভাবিক জীবনে ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারে?
পারে, বললেন ব্রায়ান, ডক্টর হ্যারিসন ব্রাযিলে পাওয়া হায়ারোগ্লিফ পড়ে যে ডেটা পেয়েছেন, তাতে পৃথিবীতে আছে এমন আরও তিনটে স্ফটিক বা পাথর।
আরও তিনটে?
হ্যাঁ। দুটো মধ্য আমেরিকায়। একটা ইউরোশিয়ান প্লেইন-এ। সম্ভবত মধ্য রাশায়।
আমরা কি এ কথা রাশাকে জানিয়েছি? প্রেসিডেন্টের দিকে তাকালেন ক্যালাগু।
মাথা নাড়লেন প্রেসিডেন্ট।
আচ্ছা, বললেন ক্যালাগু। এই পাথরের মত কিছু কী খুঁজছে এফএসবি?
জানি না, বললেন ব্রায়ান, ওই পাথর খুঁজতে গিয়ে ওদেরকে সতর্ক করতে চাইনি আমরা।
গুড, খুশি হলেন ক্যালাগু। কিন্তু পরক্ষণে আবারও হামলে পড়লেন, ধরে নিন আপনার কথা বিশ্বাস করলাম, কিন্তু তাতে এ পাথরের ব্যাপারে জরুরি কিছুই তো জানা গেল না। সেক্ষেত্রে কী বুঝব?
আমরা ঠিক জানি না, তবে একটা ব্যাপার আন্দাজ করছি, হাজার হাজার বছর আগের ওই পরিবেশ এখনকার মত সহজ ছিল না। তখন অনেক বেশি পরিমাণে ছিল রেডিয়োঅ্যাকটিভ পদার্থ, আকাশ থেকে পড়ত অ্যাসিড বৃষ্টি। তার সঙ্গে থাকত কার্বন ও সালফার।
তো এই পাথর এমন কিছু করেছে, যে কারণে হ্রাস পেয়েছে ওসব ক্ষতিকর পদার্থ?
এটা অযৌক্তিক নয়, বললেন ব্রায়ান।
এই পাথর এত গুরুত্বপূর্ণ হলে, আজ হঠাৎ কী মনে করে সব খুলে বলছেন?
প্রেসিডেন্টের দিকে তাকালেন ব্রায়ান। কারণ, আমি চাই এনআরআই এবং সিআইএ মিলেমিশে এ বিষয়ে কাজ করুক, বললেন প্রেসিডেন্ট, আপনারা কাজে লাগাবেন আপনাদের সেরা লোকজন।
এর ভেতরে সিআইএকে জড়িয়ে নেয়া কেন, স্যর? জানতে চাইলেন ক্যালাগু।
জবাবটা এবার দিলেন ব্রায়ান, কারণ স্ফটিক তৈরি করছে স্রোতের মত বিপুল এনার্জি। আমরা এখনও জানি না, ওই ভয়ঙ্কর শক্তি কী করবে। কমপিউটার সঠিক হলে ওটা চরম পর্যায়ে যাবে এবছরই ডিসেম্বরের বাইশ তারিখে।
.
১৭.
মালবাহী পুরনো জাহাজের ডেক থেকে হংকং শহর পিছিয়ে পড়তে দেখছে মিতা দত্ত। পাশেই চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে পাবলো। একটু দূরে রানা, হাতে স্যাটেলাইট ফোন।
ক্যাপ্টেনকে মোটা অঙ্কের ঘুষ দিয়ে নিজেদের জন্যে কেবিনের ব্যবস্থা করেছে রানা। ভোর হতে না হতেই রওনা হয়েছে এই জাহাজ। ছোট সব ইঞ্জিনের পার্ট দিয়ে ভরা পেট। দক্ষিণ-পুবে গিয়ে সব উগরে দেবে ম্যানিলা বন্দরে।
আরও হাজার মাইল দূরে মিতার বাড়ি। কিন্তু ঠিক করেছে, আপাতত ফিরবে না ইউনাইটেড স্টেট অভ আমেরিকায়।
রানার সঙ্গে কথা হয়েছে ওর।
প্রায় রাজিও হয়েছে রানা।
প্রথম সুযোগেই মিতা চলেছে দক্ষিণ আমেরিকায়।
হংকং ছেড়ে আমরা বেরিয়ে এসেছি, ওদিক থেকে ফোন কল রিসিভ হতেই জানাল রানা।
ল্যাং-এর টাওয়ারে বিস্ফোরণ হওয়ায় দুশ্চিন্তায় ছিলাম, বললেন এনআরআই চিফ জেমস ব্রায়ান। চিনের প্রতিটি টিভি চ্যানেলে এসেছে ওই নিউয। মারা গেছে কয়েকজন সিকিউরিটি গার্ড, তাদের হাতে খতম হয়েছে একদল টেরোরিস্ট। আপনি মিতাকে নিয়ে ডুব দিলে, মনে হচ্ছিল খুব খারাপ কিছু হয়েছে।
সত্যিই ডুব দিতে হয়েছে নদীর মাঝে, বলল রানা। ওর মনে পড়ল হাঁটু কেটে ফেলা লোকটার কথা। মারা গেছে দুএকজন। কিন্তু তারা টেরোরিস্ট ছিল না। মিতা এখন চাইছে দক্ষিণ আমেরিকায় গিয়ে প্রফেসর জর্জ হ্যারিসনকে খুঁজে বের করতে।
আপনি কি ওর পাশে থাকবেন? অনুরোধের সুরে জানতে চাইলেন ব্রায়ান।
ওকে বলেছি, ভেবে দেখব।
খুব ভাল হয় ওকে একা ছেড়ে না দিলে, বললেন ব্রায়ান।
অফিস থেকে জরুরি কোনও কাজ না এলে থাকছি ওর পাশে।
মিতা কিডন্যাপ হওয়ার পর যোগাযোগ করেছিলেন জর্জ হ্যারিসন, বললেন ব্রায়ান। বলেছিলেন, তিনি আহত। তবে গুরুতর কিছু নয়। তারপর থেকে কোনও খবর নেই। বিশাল দেশ মেক্সিকো। লোক পাঠিয়েও তার কোনও খোঁজ পাইনি।
মিতার কাছে শুনেছি, সন্দেহজনক কাউকে দেখলেই প্রাণের ভয়ে পালাবেন প্রফেসর, বলল রানা। ল্যাং-এর লোক তাকে ধরে নিয়ে যায়নি তো?
মনে হয় না, বললেন ব্রায়ান, আমাদের ডেটা অনুযায়ী পুরো ইউক্যাটান জুড়ে তল্লাসী করছে বিলিয়নেয়ারের লোক। এমন কোনও তথ্য পাইনি যে ধরা পড়েছেন প্রফেসর। বুদ্ধি খাঁটিয়ে লুকিয়ে পড়েছেন উনি। এখন তাকে খুঁজে বের করা জরুরি। আপনার বা মিতার কথা শুনবেন তিনি।
প্রফেসরের কথা মনে আছে রানার। সৎ মানুষ। তবে একবার মগজে কিছু ঢুকলে সেটা বেরোয় না। কোথাও না কোথাও লুকিয়ে আছেন। তবে নিজের কাজ শেষ না করে কোনওভাবেই ফিরবেন না দেশে।
এখন আপনার সঙ্গেই আছে মিতা? জানতে চাইলেন ব্রায়ান।
একটু দূরেই পাবলোর কাঁধে হাত রেখে তীরের দিকে চেয়ে আছে মিতা। কেউ দেখছে টের পেয়ে ঘুরে তাকাল। চোখে রানার প্রতি শ্রদ্ধা, সেই সঙ্গে আরও কী যেন অচেনা কিছু।
রানা ঠিক বুঝল না, তবে ওর মন বলল, মস্তবড় কিছু। হারিয়ে বসেছে মেয়েটা, তাই এত কষ্ট ওর চোখে।
হ্যাঁ, কাছেই আছে, কথা বলবেন? বলল রানা।
আশপাশের পরিস্থিতি কেমন বুঝছেন?
কর্তৃপক্ষ বা শত্রুপক্ষ টের পায়নি আমরা ছেড়ে এসেছি হংকং। তবে অন্য ঝামেলা হয়েছে।
একটু খুলে বলুন। দেখি দূর করতে পারি কি না।
সমস্যার নাম ইগোর দিমিতভ। একজন রাশান। নামটা আগে শুনেছেন?
ইগোর দিমিতভ? বললেন ব্রায়ান, পড়েছি ওর ফাইল। এফএসবির প্রডেজি। তরুণ বয়সেই নাম করে। তারপর অবসর নিলেও তাকে প্রয়োজনে ডাকতে থাকে ওরা। এতদিনে যত টাকা রোজগার করেছে, ওর তো অবসর নেয়ার কথা। আপনাদের এসবের সঙ্গে তার কী সম্পর্ক?
অবসর নেয়নি, বলল রানা। আপনার কন্ট্যাক্টকে ঘুষ দিয়ে আমাকে তুলে নিয়ে গেছিল।
তারপর? বিস্মিত কণ্ঠে জানতে চাইলেন ব্রায়ান।
রাশান কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কিছু চুরি করে ল্যাং, ওটা ফেরত নেয়ার চেষ্টা করছে।
জিনিসটা কী?
জিনিস নয়, এক ছেলে। বয়স পাঁচ বছর। নাম পাবলো।
ওকে নিয়ে কী করবে?
ইগোর দিমিতভের কাছ থেকে যা শুনেছে রানা, সংক্ষেপে বলল। এবার জানাল, ছেলেটা অনেকটা অটিস্টিক টাইপের। তবে ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বোধহয় কাজ করে এনার্জি ফিল্ড, ইলেকট্রিসিটি ও ম্যাগনেটিযমের বিষয়ে।
তাই? বললেন ব্রায়ান, সেক্ষেত্রে ব্রাযিলে আপনাদের আবিষ্কার করা ওই স্ফটিকের সঙ্গে ওর কোনও সম্পর্ক থাকতে পারে।
ছেলেটার ওপর চোখ পড়েছে ল্যাং-এর। ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক বিষয়ে হয়তো ওর ওপর এক্সপেরিমেন্ট করতে চাইছে।
তাই? বললেন ব্রায়ান, অনেক দিন ধরেই সাইকিক বা অলোকদৃষ্টির ব্যাপারে পরীক্ষা চালাচ্ছে রাশানরা। অবাক হচ্ছি না, ওই ছেলের ওপর এক্সপেরিমেন্ট করেছে ওরা। আজ পর্যন্ত কিছুই প্রমাণ করতে পারেনি। কিন্তু ইগোর দিমিতভ যেহেতু এসবে জড়িত, ব্যাপারটা সিরিয়াসলি নিতে হবে।
সব কথা না জানিয়ে আমার সঙ্গে চুক্তি করেছিল ইগোর দিমিতভ, কাজেই ওই চুক্তি ভেঙেছি, বলল রানা। আমার ভুল না হয়ে থাকলে, উন্মাদের মত আমাদেরকে খুঁজছে ও এখন।
মিস্টার রানা, খুব গর্বিত লোক সে, বললেন ব্রায়ান। এফএসবি মানা করে দিলেও ধরে নিন, জান থাকতে আপনার পিছু ছাড়বে না সে।
চুপ করে আছে রানা।
আমি চেষ্টা করব ওকে অন্য পথে সরিয়ে দিতে, জানালেন ব্রায়ান। ফলে বাড়তি সময় পাবেন। একটু চুপ করে থেকে তারপর বললেন তিনি, এবার কী করবেন, মিস্টার রানা?
কয়েক দিনের ভেতর পৌঁছুব ম্যানিলা।
গুড। আপনাদের আবিষ্কৃত ব্রাযিল স্টোন নিয়ে আমিও আছি বিপদে, বললেন ব্রায়ান, প্রেসিডেন্ট চাইছেন, আমরা যেন সিআইএর সঙ্গে মিলে গবেষণা করি।
তাই করুন, বলল রানা। অসুবিধে কী?
ওরা ওয়াশিংটনে আমাদের কমপ্লেক্স থেকে ওটাকে সরাতে চাইছে নেভাডায়, বললেন ব্রায়ান। আপনাকে আমার এসব বলার কথা নয়। বলছি, কারণ আপনিই আবিষ্কার করেছিলেন ওটা। ইয়াকা মাউন্টেনে একটা ল্যাবরেটরিতে রাখা হবে ওটা। ওখানেই ফেলার কথা ছিল সব নিউক্লিয়ার বর্জ্য।
রানা জানতে চাইল, এখনও এনার্জি বেরোচ্ছে ওই স্ফটিক থেকে?
বিপদ হতে পারে আমাদের কন্টেইনমেন্ট এরিয়ায়, তাই ভয় পেয়েছেন সিআইএ চিফ যখন-তখন বিস্ফোরিত হবে ব্রাযিল স্টোন বা ওটার কারণে অন্যকিছু। সুপার কমপিউটার থেকে জানা গেছে, ডিসেম্বরের বাইশ তারিখে প্রচণ্ড শক্তি বিচ্ছুরণ করবে ওটা। জর্জ হ্যারিসন বলেছিলেন, ওটার মত আরও তিনটে স্ফটিক আছে কোথাও। জরুরি কোনও কাজ করে ওগুলো।
কবে আপনাদের স্ফটিক সরিয়ে নেবেন? জানতে চাইল রানা।
এই সপ্তাহের শেষ দিকে। এর ভেতর যদি বুঝতে না পারি আসলে কী ওটা, হয়তো ধ্বংস করে দিতে হবে। আমাদের ওপর চাপ তৈরি করছে সিআইএ চিফ মার্ল ক্যালাগু।
সিআইএ চিফ চাপ সৃষ্টি করছে শুনে রানা ভাবল, ওই হারামি লোক অন্যের ক্ষতি করতে পারলে খুব খুশি হয়।
ক্যালাগু হয়তো এনআরআই-এর কাছ থেকে আদায় করে নেবে স্ফটিক, ওটা ধ্বংস না করে ব্যবহার করবে অস্ত্র তৈরিতে, বললেন ব্রায়ান, তাতে খুব খুশি হবে আমেরিকান আর্মি। আবার অন্য কিছুও করতে পারে। একবছর ধরে আরও বাড়ছে ব্রাযিল স্টোনের শক্তি। কে জানে, সত্যিই হয়তো ওটা ভয়ঙ্কর কোনও অস্ত্রই!
হয়তো গ্লিফ পড়ে এ বিষয়ে আরও অনেক কিছুই জানাতে পারবেন প্রফেসর জর্জ হ্যারিসন, বলল রানা। আগে দরকার তাকে খুঁজে বের করা।
কিন্তু আমাদের জানা নেই, কোথায় আছেন তিনি। …এবার অন্য প্রসঙ্গে আসি, ওই ছেলের ব্যাপারে কী করবেন? মনে করি না এ দেশে ওকে আনা উচিত। আর্মি বা সিআইএ ওকে পেলে কী করবে বলা মুশকিল। নিজেরা কাজে লাগাতে না পারলে সোজা ফেরত দেয়া হবে রাশান কর্তৃপক্ষের কাছে।
আমিও এটা নিয়ে ভেবেছি, বলল রানা। আপাতত থাকুক মিতার কাছে। ভাল খাতির হয়েছে ওদের। অন্য কোনও সমস্যা না এলে, আমরা তিনজনই যাচ্ছি ঘুরতে। ঠিক করেছে, মিতার কাছ থেকে জরুরি আরও কিছু তথ্য সংগ্রহ করবে।
কোথায় যাবেন? জানতে চাইলেন এনআরআই চিফ।
মেক্সিকোর ক্যামপেচেতে, বলল রানা, ওখান থেকেই খুঁজতে শুরু করব প্রফেসরকে।
এনআরআই চিফ জেমস ব্রায়ানের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে প্যান্টের পকেটে স্যাটেলাইট ফোন রাখল রানা। মিতার সামনে গিয়ে থামল।
ওর চোখের দিকে চেয়ে আছে মেয়েটা, কৌতূহলী। কয়েক সেকেণ্ড পর বলল, পাবলোকে উড়তে শেখাচ্ছি। পেলব দুহাত দুদিকে মেলে দিয়েছে ও।
ওকে অনুকরণ করছে ছেলেটা।
আদর করে পাবলোর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল রানা। ইউক্যাটানের কোথাও লুকিয়ে পড়েছেন প্রফেসর হ্যারিসন। যোগাযোগ করছেন না কারও সঙ্গে।
আমি যাব তাঁকে খুঁজতে, দৃঢ় স্বরে বলল মিতা। পাশে কি পাব তোমাকে?
তিনি বিপদে আছেন, আর সেজন্যে নিজেকে দায়ী ভাবছ তুমি, বলল রানা।
আস্তে করে মাথা দোলাল মিতা। যে দায়িত্ব নিয়েছি, সেটা পালন করতে পারিনি। উচিত ছিল না দায়িত্ব নেয়া। আমি তো আর মানুষকে নিরাপত্তা দেয়ায় তোমার মত দক্ষ নই।
আবারও মেক্সিকোতে গেলে হয়তো পড়বে আরও বড় বিপদে, বলল রানা।
জানি। সাগরের দূরে তাকাল মিতা।
এনআরআই চিফের সঙ্গে কথা হয়েছে। কাঁধ ঝাঁকাল রানা। আমিও যাচ্ছি তোমার সঙ্গে।
মধুর চেয়েও মিষ্টি এক টুকরো হাসি ফুটল মিতার লোভনীয় ঠোঁটে। থ্যাঙ্কস!
দেখা যাক শেষ পর্যন্ত কী হয়।
পাবলো, আমরা বেড়াতে যাব, মজা হবে না? ছেলেটার কাঁধে আলতো চাপড় দিল মিতা।
জবাব দিল না পিচ্চি। একবার মিতাকে আবার রানাকে, দেখছে। মনোযোগ পেয়ে খুশি।
মুখে স্বীকার করবে না মিতা, কিন্তু যাকে সবসময় চেয়েছে পাশে, আচমকা পেয়ে গেছে সেই দেবতাকে!
রানা তাকাতেই রক্তিম হলো ওর ফর্সা দুই কপোল।
.
১৮.
রঙচটা, পোভড়া দোতলা বাড়ি ছেড়ে বেরোলেন প্রফেসর হ্যারিসন, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে পৌঁছুলেন জেলে গ্রাম পুয়ের্তো আযুলের বুলেভার্ড-এ। যে বাড়িতে উঠেছেন, ওটা হোটেল বা মোটেল নয়। এ কারণেই বেছে নিয়েছেন। সদর দরজা ছাড়া অন্য কোনও গেট নেই। খাড়া সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠলে বারান্দার একপাশে পাঁচটা ঘর ও অ্যাটাচড় বাথরুম। তার মনে হয়েছে, ওখানে ঢুকে চট্ করে তাঁকে কিডন্যাপ করতে পারবে না কেউ।
আরও একটি কারণ: প্রিয় স্ত্রীকে নিয়ে হানিমুনে এসে ওই বাড়িতেই উঠেছিলেন। একটু দূরেই ছিল তাঁর খননের সাইট।
চিয়াপাস গ্রামে পড়ে থাকার সময় হ্যারিসনের মনে হয়েছে, আবারও ফিরে এসেছেন তাঁর স্ত্রী। তাঁকে আড়াল করে রেখেছেন, সাহায্য করছেন, বিপদ হলে আগেই জানিয়ে দেবেন।
গত কয়েক দিন বারবার দেখেছেন স্বপ্ন। সব ছিল সিনেমার মত। কোনওটা আনন্দের, কোনওটা প্রায় দুঃস্বপ্নের। আজকাল সবার সামনেই আলাপ করছেন অদৃশ্য স্ত্রীর সঙ্গে, তাতে মন্দ লাগছে না তাঁর।
অসুখ রয়ে গেছে, দূর হয়নি ইনফেকশন; তবে দুষ্ট ওঝার খপ্পরে পড়ে চুড়ান্ত ভুগে যাই-যাই অবস্থা, এমনসময় পাহাড়ি গ্রামে তরুণ গাইড পিকো আনল এক বোতল অ্যান্টিবায়োটিক। ওটা খেয়ে একটু সুস্থ হলেন। হাঁটার শক্তি ফিরতেই, তিন দিন হলো বদমাশ ওঝাকে লুকিয়ে ভেগে এসেছেন।
প্রথমে ভেবে পাননি, কোথায় যাবেন। পরে মনে হলো, যারা হামলা করেছে, তারা ধরে নিয়েছে মারা গেছেন তিনি। নইলে আর রক্ষা ছিল না। তখনই ভাবলেন, কারও সঙ্গে যোগাযোগ করা অনুচিত। মিতার কাছ থেকে সব শুনতেন এনআরআই চিফ, হয়তো তার অফিস থেকেই সব তথ্য পেয়েছে শত্রুরা। কাজেই, কাউকে জানানো যাবে না যে তিনি বেঁচে আছেন।
যেখানে উঠেছিলেন মিতা ও তিনি, ভুলেও সেখানে যাননি। প্রাণরক্ষা প্রথম কাজ, হোটেলে থাক দামি, দরকারী মালপত্র। চলে এলেন উত্তরদিকে ইউক্যাটান উপকূলে ক্যানকুন থেকে আশি মাইল দূরে। এ গ্রামেই আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে স্ত্রীসহ উঠেছিলেন পুরনো ওই বোর্ডিং হাউসে।
গত কয়েক দিনে বড় হয়েছে দাড়ি, চট করে কেউ চিনবে না তাঁকে। প্রতিদিন গ্রামটা ঘুরে দেখতে আসে শদুয়েক টুরিস্ট। কাজেই সহজে তাঁকে খুঁজে পাবে না শত্রুরা। উপকূলীয় এই এলাকায় রয়েছে অজস্র মায়ান সাইট। মিতা ও তিনি ধারণা করেছিলেন, এদিকেই কোথাও আছে বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী পরের স্ফটিক।
বুলেভার্ড ছেড়ে ধুলোময় পথে চললেন প্রফেসর হ্যারিসন। প্রতিদিন একই রুটিন তাঁর। এমনিতেই চুল-দাড়ি সব ধূসর, তার ওপর হাতে মোটা লাঠি, অন্যহাতে কালো নোটবুক- এসব দেখে আজকেও হৈ-হৈ করে উঠল গ্রামের ছেলেরা: মোযেস নিগ্রো! ওই যায় কুচকুচে কালো মুসা নবী!
নিজেকেও তেমনই মনে হয় প্রফেসরের। এনআরআইকে পথ দেখাচ্ছেন। ওই স্ফটিক খুঁজতে গিয়ে ইহুদি জাতির মত চল্লিশ বছর পার করতে হবে কি না, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
ব্রাযিলের জঙ্গলে ও মেক্সিকোর দ্বীপে যেসব গ্লিফ পেয়েছেন, তা থেকে জানতে পেরেছেন বহু কিছুই। এ ছাড়া, সাহায্য করেছে দুর্গম, পাহাড়ি গ্রামের মানুষগুলোর ফিসফিস করে বলা কথা, স্যাটেলাইট ইমেজারি ও ইনফ্রারেড এরিয়াল ফোটোগ্রাফি।
আগ্নেয় দ্বীপে স্ফটিক বিষয়ে সূত্র পাবেন ভেবেছিলেন, কিন্তু সেসময়ে হামলা করল শত্রুরা। কোনওমতে পাথরের গ্লিফের ছাপ লিনেন শার্টে তুলেই পালাতে হয়েছে। শার্টটা থেকে উদ্ধার করেছেন কিছু তথ্য। ওই দ্বীপের পাথরে লেখা ছিল: আহাউ বালামের মাধ্যমে শুরু আত্মার পথ। বর্শার ডগা গেছে বিশাল ওই শহরের যোদ্ধার মন্দিরে। ওখানেই হবে আত্মা বলিদান। তারপর যেতে হবে দেবতার ঝলমলে পথে, ত্যাগ করতে হবে দেহ। আর তখনই জাগুয়ারের ঢালের সাহায্য পেয়ে পৌঁছুবে স্বর্গে।
এসবের মানে জানেন না হ্যারিসন। দ্বীপের ওই রাজার কোনও ঢাল বা বর্শা ছিল না। শত শত সংখ্যা ছাড়া আর কিছুই দেখেননি। লেখা ছিল: ওই পথে যাও অন্যসব পথে, তারপর যাও তৃতীয় পথে।
প্রফেসর বুঝেছেন, এসব কোনও কাজে আসবে না। দরকার আরও তথ্য। সৈকতে যাওয়ার সময় মাঝপথে পেয়ে গেলেন ছোট এক ইন্টারনেট ক্যাফে। পয়সা দেয়ার পর নড়বড়ে চেয়ারে বসে লগ ইন করলেন। ট্যাপ করতে চাইলেন তাঁর ইউনিভার্সিটির মেইনফ্রেম কমপিউটার। ওটাতে আছে ইউক্যাটানের স্যাটেলাইট সার্ভের ডেটা। কানেকশন হওয়ার সময় ভাবলেন, চোখ রাখেনি তো শত্রুরা তার অ্যাকাউন্টে? সেক্ষেত্রে তারা জেনে যাবে, তিনি বহাল তবিয়তে আছেন মেক্সিকোতে।
হ্যারিসন ভাবলেন, কেমন হয় বাসে চেপে অন্য শহরে গিয়ে কোনও ইন্টারনেট ক্যাফে থেকে ইউনিভার্সিটির কমপিউটার ট্যাপ করলে? কিন্তু কাজটা কঠিন। রাতে বারবার লাগে শীত, আবার একটু পর ঘেমে ওঠেন গরুমে। গুলির ইনফেকশনের কারণে বড্ড ক্লান্ত তিনি।
সাবধানে নিজের পাসওঅর্ড লেখার পর এন্টার টিপে দিলেন প্রফেসর। একটু পর স্ক্রিনে দেখলেন এদিকের এলাকার বড় ছোট সব মায়ান সাইট। বেশিরভাগ ধ্বংসাবশেষে গিজগিজ করছে টুরিস্ট। এসব সাইট দিয়ে চলবে না তাঁর। অনেক পুরনো হবে স্ফটিকের মন্দির। এত দিনে গভীর জঙ্গল ঘিরে ফেলেছে ওটাকে।
মনোযোগ দিয়ে ইনফ্রারেড ইমেজ দেখতে লাগলেন তিনি। জঙ্গলের নানান ধরনের তাপ অনুযায়ী ভাগ করা হয়েছে ছবি। এ এলাকার নিচের দিকের জমির তাপ খেয়াল করতে গিয়ে নতুন করে মনে আশা জন্মাল তাঁর।
কিন্তু একটু পর আবারও হতাশ হয়ে গেলেন।
ইউক্যাটানে রয়েছে অনাবিষ্কৃত হাজারো মায়ান ধ্বংসাবশেষ। এ গ্রামের বিশ মাইলের ভেতর রয়েছে অন্তত এক ডজন। কোন সাইট দিয়ে কাজ শুরু করবেন তিনি?
হঠাৎ ভীষণ চমকে গেলেন প্রফেসর।
ঠাস করে পড়েছে পেছনের চেয়ারটা।
সরি! বলে উঠল এক কাস্টোমার।
হামলার ভয়ে বুক ধড়াস ধড়াস্ করছে হ্যারিসনের। ঘুরে তাকালেন লোকটার দিকে।
শেয়ালের চোয়ালের মত ভাঙা চোয়াল যুবকের। মাথা ভরা বাদামি চুল। চেয়ার তুলে ওটাতে বসে পড়ল সে।
হঠাৎ প্রফেসরের মনে হলো, তিনি আছেন মস্ত বিপদে। কাগজপত্র গুছিয়ে নিয়ে কমপিউটার লগ অফ করে বেরিয়ে এলেন বাইরে। পাশের দোকানের মালিক তীক্ষ্ণ চোখে দেখল তাঁকে।
তাতে খুব অস্বস্তি লাগল। এরা কি চোখ রেখেছে তার ওপর?
ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া সব টুরিস্ট।
না, এরা শক্ত হতে পারে না।
আমাকে সাহায্য করো, হান্না, বিড়বিড় করলেন তিনি। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না!
জবাব দিল না কেউ।
ভীষণ একা লাগল তাঁর।
নিরাপত্তা চাইলে ফিরতে হবে নিজের ঘরে।
তাই করলেন তিনি। ফিরলেন ওই বাড়িতে। দোতলার ঘরে ঢুকে ধপ করে বসলেন চেয়ারে। প্রিন্টআউট ও ডেটা রাখলেন টেবিলে। ভাবছেন, এসব তথ্য পেলে খুব খুশি হবে শক্ররা। নতুন কিছু পেলেই তাঁর কাছ থেকে কেড়ে নেবে। তখন মেরেও ফেলতে পারে তাকে।
ঠিক করলেন, এখন থেকে কোনও নোট রাখবেন না। সবই জমিয়ে রাখবেন নিজের মগজে। কিন্তু তা খুব কঠিন কাজ।
না, অন্য কিছু করতে হবে। সহজ উপায় আছে। চকবোর্ড কিনবেন তিনি। চক দিয়ে লিখবেন ডেটা। কাজ শেষ হলে ভেজা রুমাল দিয়ে মুছে ফেলবেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, প্রায় ঘুমন্ত এই গ্রামে কোথায় পাবেন তিনি চকবোর্ড?
না, পাবেন না।
খুব অসহায় বোধ করলেন হ্যারিসন। জানালাপথে চোখ গেল দূরে। ওই যে, সাগরে চলছে ভাটা। সরু রাস্তা মিশেছে। মসৃণভাবে লেপে থাকা রুপোলি বালির সৈকতে। মন চাইলে যা খুশি লিখতে বা আঁকতে পারেন।
একবার মাথা দোলালেন প্রফেসর হ্যারিসন।
পেয়ে গেছেন তিনি মস্ত এক চকবোর্ড!
খুশিমনে আবারও সব গুছিয়ে নিয়ে নেমে এলেন। সৈকতের দিকে হাঁটতে শুরু করে বিড়বিড় করলেন, তুমিই কি পথ দেখালে, হান্না? ধন্যবাদ না দিয়ে পারছি না!
সৈকতে লুটিয়ে পড়ছে মেক্সিকো উপসাগরের ঢেউ, তার পাঁচ ফুট আগে থামলেন। ভেজা বালি বেশ জমাট।
একবার চারপাশ দেখলেন প্রফেসর।
কেউ নেই।
বহু রাত ঘুমুতে পারেননি। মনে এসেছে নানান থিয়োরি। বসলেন ভেজা বালিতে, তর্জনী ব্যবহার করে লিখতে লাগলেন দরকারী সব তথ্য।
আগ্নেয় দ্বীপের মূর্তির মত আরও কিছু মূর্তি দেখেছেন। ওগুলোতেও ছিল প্রায় একই তথ্য। তথ্যের পাশে মানচিত্রের মত করে আঁকতে লাগলেন গুরুত্বপূর্ণ মায়ান মন্দির। ওগুলো থেকে সোজা সামনে বাড়বে বর্শা। ওটাই দেখিয়ে দেবে যোদ্ধার মন্দির। ছোট নুড়িপাথর হলো ছোট মন্দির, বালির ঢিবি হলো বড় মন্দির।
নিজের কাজে মগ্ন হয়ে গেলেন তিনি।
পেরিয়ে গেল কয়েক ঘণ্টা।
বারবার পরিবর্তন করলেন নানান সাইট।
পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় হাসিহাসি চোখে তাঁকে দেখল টুরিস্টরা, পাত্তা দিলেন না তিনি।
ওরা ভাবুক না, তিনি আসলে পাগল! কী যায়-আসে?
বুঝতে চাইলেন কোন্ ধ্বংসাবশেষ হিসেবের ভেতর রাখবেন, আর কোন্গুলো বাদ দেবেন।
আরও অনেকক্ষণ পর তৃতীয়বারের মত আঁকলেন বর্শা। এবার ওই রেখা গেছে উত্তরদিকে।
কিন্তু ওদিকে বড় কোনও মায়ান সাইট নেই!
নতুন করে বর্শা এঁকে দেখলেন, উপকূলের ঘন জঙ্গল।
হতাশ হলেন হ্যারিসন। হাতের চেটো দিয়ে সরাতে চাইলেন ভুরুর ওপর থেকে ঘাম। ফলে বালিতে মেখে গেল তার পুরো কপাল। মন খারাপ করে ঢালু সৈকত থেকে চোখ রাখলেন সাগরে।
প্রায় বিকেল, রোদ উষ্ণ করে তুলেছে বালি।
মৃদু ঢেউ সৈকত থেকে আবারও ফিরছে উপসাগরে।
ডক থেকে প্রচণ্ড শব্দে দূরে গেল স্পিডবোট। ফেনাভরা বড় ঢেউ এসে মুছে দিল তার আঁকা বর্শার সামনের অংশ। ঘুরপাক খেল পানি। আবারও ফিরল উপসাগরে।
মুছে দিতে চায় চকবোর্ড, বিড়বিড় করলেন প্রফেসর। তা হলে কি আবারও নতুন করে আঁকতে হবে সব?
উঠে দাঁড়ালেন। চোখ পড়ল তার তৈরি মানচিত্রে।
মন্দির বা অন্যসব সাইট না মুছে বর্শার ডগা গায়েব করে দিয়েছে ঢেউ। হঠাৎ প্রফেসরের মনে পড়ল একটা তথ্য। চট করে দেখলেন নিজের প্রিন্টআউট।
আজ থেকে হাজার বছর আগে নিচু ছিল সাগর!
তখন তৈরি হয়েছে ওই মন্দির!
তার তৈরি বর্শা এখন সোজা দেখাচ্ছে এই উপসাগর!
নিশ্চয়ই অজস্র ঢেউয়ের নিচে রয়েছে যোদ্ধার মন্দির?
হান্না, ডার্লিং? বিড়বিড় করলেন তিনি, অনেক ধন্যবাদ!
.
১৯.
গভীর রাত।
প্রশান্ত মহাসাগরের সাঁইত্রিশ হাজার ফুট ওপর দিয়ে মেঘভরা আকাশ চিরে ছুটে চলেছে এয়ারবাস এ-থ্রিএইটি বিমান।
ল্যাং-এর ব্যক্তিগত কমিউনিকেশন সুইটে দাঁড়িয়ে আছে ক্যাং লাউ। দেয়াল ঘেঁষে এক সারি ইলেকট্রনিক ইকুইপমেন্ট, রেডিয়ো ও স্যাটেলাইট ট্র্যান্সিভার। অপরিসর ককপিটের কথা মনে পড়ল লাউয়ের। ওখানে জানালা আছে। এখানে সেসবও নেই।
অবশ্য, জানালা থাকলেই বা কী হতো?
কিছুই দেখার নেই আঁধারে।
লাউয়ের হাতে একটা প্রিন্টআউট দিল রেডিয়ো অফিসার। একটু আগে ডিক্রিপ্ট করেছে স্যাটেলাইট ট্রান্সমিশন।
কাগজে চোখ বুলিয়ে খুশি হয়ে উঠল লাউ। বিমানের মাঝের সরু পথে গিয়ে থামল হুয়াং লি ল্যাং-এর ব্যক্তিগত সুইটের সামনে। এমনিতে জরুরি তথ্য পেলেও ভোরের আগে ল্যাং-কে ঘুম থেকে তোলে না সে, কিন্তু আজ অপেক্ষা করতে হবে না, বিলিয়নেয়ারের চিকিৎসায় ব্যস্ত বেশ কয়েকজন ডাক্তার।
কেবিনের দরজায় টোকা দিতেই ভেতর থেকে কবাট খুলল সুন্দরী এক চাইনিজ নার্স। আজ ল্যাং-এর দেহে ব্যবহার করা হচ্ছে নতুন এক শক্তিশালী ইলেকট্রিকাল স্টিমুলেটর। বরাবরের মত ত্বকে ইলেকট্রোড নেই, তার বদলে অপারেশন করে শরীরের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে কিছু ওয়ায়্যার। ডাক্তাররা আশা করছেন, এবার নতুন করে আবারও কাজ করবে বিশেষ কিছু নার্ভ। তার ফলে ল্যাং ব্যবহার করতে পারবে সদ্য আবিষ্কৃত কিছু যন্ত্র।
চিকিৎসার এ পর্যায়ে মস্ত ঝুঁকি নিয়েছেন ডাক্তাররা। রাজি হতেন না, কিন্তু হুইলচেয়ারের বন্দিজীবন আর সহ্য হচ্ছিল না ল্যাং-এর। গত কবছরে মেডিকেল সায়েন্সের আধুনিক প্রত্যেকটা চিকিৎসা নিয়েছে সে। স্টেম সেল, নিউরোলজিকাল ট্র্যান্সপ্ল্যান্ট, অপরীক্ষিত ড্রাগ থেকে শুরু করে কবিরাজের হাজারো ওষুধ কোনও কাজেই আসেনি।
রোগের আক্রমণ কমিয়ে দিয়েছে ইলেকট্রিকাল স্টিমুলেশন। কিন্তু ওই চিকিৎসার ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে ল্যাং। পেশির ক্ষয় কমলেই খুশি হওয়ার কিছু নেই। বারবার তাগিদ দেয়ায় নতুন থিয়োরি অনুযায়ী কাজ করছেন ডাক্তাররা। সঠিক ইলেকট্রিকাল স্টিমুলেশন ব্যবহার করেই সুস্থ করা হবে নার্ভ।
এগযামিনেশন টেবিলে ল্যাং-কে দেখল লাউ। প্রতিবার স্টিমুলেটর চালু হলেই ভীষণভাবে মুচড়ে উঠছে বিলিয়নেয়ারের দেহ। প্রথমে ঝাঁকি শুরু হচ্ছে হাতে, তারপর ছড়িয়ে পড়ছে পায়ে। আড়ষ্ট আঙুল সোজা হয়ে কাঁপছে থরথর করে। তারপর বিদ্যুৎ বন্ধ হলেই আঙুলগুলো আবারও কুঁকড়ে তৈরি করছে। ছোট একটা বল।
গত কয়েক বছর ধরে অসুস্থ ল্যাং। আজ হঠাৎ তার হাত পা নড়তেই চমকে উঠল লাউ। কেমন বিরক্তি এল তার।
ব্যথায় মুখ কুঁকড়ে ফেলেছে ল্যাং।
লাউয়ের মনে হলো, ভাল হতো এখান থেকে সে চলে যেতে পারলে।
কয়েকটা ঝাঁকুনির পর আবারও শিথিল হলো ল্যাং-এর দেহ। ডাক্তারের দিকে তাকাল সে। নরম আলোর এলসিডি মনিটরে ডেটা দেখছেন ডাক্তার।
মুখ খুলতে সময় নিচ্ছেন, বলল বিলিয়নেয়ার, দুঃসংবাদটা কি এতই খারাপ?
সরি, ডাক্তারদের নেতা বললেন, আপনার নিউরোলজিকাল রেসপন্স এখনও খুব দুর্বল।
সেক্ষেত্রে বাড়ান স্টিমুলেশন, বলল ল্যাং।
তাতে লাগবে প্রচণ্ড ব্যথা, বললেন ডাক্তার। আপনার মনে হবে দাউদাউ আগুনে পুড়ছে সারাদেহ। সহ্য করতে পারবেন না। চট করে দূরও হবে না সেই যন্ত্রণা।
আমার যা অবস্থা, ব্যথাও আজকাল হয়ে উঠেছে। আনন্দের, বলল ল্যাং।
মৃদু মাথা দোলালেন ডাক্তার। কয়েক মিনিট লাগবে সেটিং অ্যাডজাস্ট করতে। কিছু বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির সামনে গেলেন তিনি।
টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল লাউ।
তার চেহারা পড়ছে ল্যাং। কড়া সুরে বলল, তোমার এসব ভাল লাগছে না।
ভাল-মন্দ স্থির করার মালিক তো আমি নই, বলল লাউ।
তা ঠিকই বলেছ, বলল ল্যাং। কিছু বলবে?
নতুন তথ্য পেয়েছি। ওই যে, আমেরিকান কালো প্রফেসর, যাকে আমরা মনে করেছিলাম মরে গেছে? ওই লোক নাকি বেঁচে আছে।
তোমার আরেকটা ভুল, বলল ল্যাং। ওই লোককে অনেক আগেই মেরে ফেলা উচিত ছিল।
অপমান বোধ করতেই রেগে গেল লাউ। তবে চেহারা রাখল নিস্পৃহ। আজকাল একটু সুযোগ পেলেই জিভের ক্ষুর চালায় মৃতপ্রায় বস।
ওই ইউনিভার্সিটির মেইনফ্রেম কমপিউটারে ট্যাপ করেছিল প্রফেসর হ্যারিসন বা তার চেনা কেউ। কিছু তথ্য ডাউনলোড করেছে। তার ভেতর আছে ইউক্যাটানের স্যাটেলাইট ফোটো।
জানতে পেরেছ ওই লোক এখন কোথায়?
না। তবে যে কমপিউটার টার্মিনাল ব্যবহার করেছে, ওটা আছে মেক্সিকোর এক গ্রামে। যেখান থেকে কাজ শুরু করেছিল, সেখান থেকে অনেক সরে গেছে সে। ওই মেয়ে যদি যোগাযোগ করে তার সঙ্গে…চুপ হয়ে গেল লাউ।
অবশ্যই যোগাযোগ করবে, জোর দিয়ে বলল ল্যাং। এখন কোথায় আছে তোমার লোক?
তুলুম আর পুয়ের্তো মোরেলসে। এ ছাড়া আছে মেক্সিকো সিটির অ্যানথ্রোপলজির জাদুঘরে। ওখানে কিছু রিসার্চ করেছিল প্রফেসর আর ওই মেয়ে।
গুড, বলল ল্যাং, চোখের আড়ালে থাকুক ওরা। এবার সময়ের অনেক আগেই কাজে নেমে পড়েছ।
মাথা দোলাল লাউ।
যন্ত্রপাতির আড়াল থেকে মাথা বের করলেন ডাক্তার। আমরা তৈরি।
লাউকে বিদায় করতে হাত নাড়ল বিলিয়নেয়ার।
মৃদু নড করে কেবিন থেকে বেরিয়ে এল লাউ। পেছনে বন্ধ করে দিল দরজা। আবারও ফিরছে কমিউনিকেশন সুইটে। শুনতে পেল পেছনের ঘরে শুরু হয়েছে যান্ত্রিক গুঞ্জন। ব্যথা ও আনন্দের মিশেলে বিকট চিৎকার ছাড়ল হুয়াং লি ল্যাং।
.
২০.
ঝরঝরে পুরনো, প্রায় বাতিল জিপ ড্রাইভ করছে রানা। পাশের সিটে মিতা। পেছনে পাবলো। কয়েক ঘণ্টা ভাজা ভাজা হয়েছে ওরা মেক্সিকোর কড়া রোদে। হংকং ও দক্ষিণ চিন সাগরের বিশ্রী বৃষ্টির চেয়ে তা অনেক ভাল।
উপকূলীয় সড়ক ধরে চলেছে পুয়ের্তো আবুল গ্রাম লক্ষ্য করে। যাওয়ার পথে সাগরের বুকে সূর্যের ঝিকিমিকি দেখছে রানা। কেন যেন মনে হচ্ছে, ওরা এসেছে বেড়াতে। যেখানেই থেমেছে, সবাই ধরে নিয়েছে, মিতা এবং ও বিবাহিত। যে কারণেই হোক, পাবলোকে দত্তক নিয়েছে ওরা।
রিয়ারভিউ মিররে তাকাল রানা।
চুপ করে বসে আছে পাবলো। মাথায় টুরিস্টদের সমব্রেরো হ্যাট। চোখে প্লাস্টিকের সানগ্লাস। প্রায় কোনও কথাই বলে না ছেলেটা। রানা রাশান ভাষায় আলাপ করতে গিয়ে বুঝেছে, দুনিয়ার কোনও দিকেই মনোযোগ নেই পাবলোর। এখন দূরে চেয়ে দেখছে সবুজ জঙ্গল, নীলাকাশ ও সাগর।
ওর সত্যি কী হয়েছে? আনমনে বলল মিতা। পাবলো একটু পর পর খোলে সানগ্লাস। উঁটা দিয়ে ঠুকঠুক আওয়াজ করে, তারপর আবারও চশমা পরে। প্রথমে ভেবেছিলাম অটিস্টিক। কিন্তু পরে বুঝলাম, তা নয়। দুঃখের ছাপ পড়ল মিতার মুখে। নরম সুরে বলল, আসলে ওর ওপর দিয়ে অনেক গেছে।
চুপ করে থাকল রানা। গত কদিন ধরে ভাবছে, যে-কোনও সময় হামলা করবে ল্যাং বা দিমিতভ।
কোথায় রাখবে ছেলেটাকে?
ওকে ফেরত চাইবে রাশা, ঠেকাবার উপায় থাকবে না।
কী করে যেন রানার দুশ্চিন্তা টের পেয়ে বলল মিতা, আমরা হয়তো লুকিয়ে ফেললাম ওকে?
তা প্রায় অসম্ভব, বলল রানা।
ঝড়ের বেগে পিছনে পড়ছে পিচঢালা পথ।
আবারও প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখায় মন দিল মিতা।
ধুলোবালিতে মেখে আছে ওরা।
পুরো নয় ঘণ্টা হলো গাড়ি চালাচ্ছে রানা।
মিতার পরনে টি-শার্ট, সাদা জিন্সের প্যান্ট, মাথায় কাউবয় হ্যাট। সোনালি রোদে ঝিকঝিক করছে ফর্সা ত্বক। হ্যাঁ, দেখতে ভাল। মনে মনে ওর রূপের প্রশংসা না করে পারল না রানা।
কিছুক্ষণ পর ওরা ঢুকল মাঝারি এক জেলে গ্রামে।
জেলেরা তীরে তুলে রেখেছে রঙিন কিছু নৌকা।
একটু দূরেই ছোট কিছু বাড়িঘর।
ব্যস, আপাতত যাত্রা শেষ, বলল রানা।
প্রফেসর এখনও মেক্সিকোতে রয়ে গেলে, এখানেই থাকবেন, বলল মিতা।
নিশ্চিত হওয়ার উপায় নেই, বলল রানা।
বারবার বলতেন এখানে এসে কদিন বিশ্রাম নেবেন, বলল মিতা। আগেও কয়েক মাস এখানে ছিলেন স্ত্রীকে নিয়ে।
রাস্তার পাশে জিপ রাখল রানা। পরের পুরো একঘণ্টা ধরে গ্রামের সব মোটেল ছুঁড়ে দেখল ওরা।
কোথাও নেই প্রফেসর হ্যারিসন।
সাগরতীরে ছোট এক খাবারের হোটেলের মালিক জানাল, কালো লোকটা তো? তাকে, পাবেন ওদিকে। আঙুল তুলে দূরের দোতলা এক বাড়ি দেখাল সে।
পাঁচ মিনিট পর বোর্ডিং হাউসের সামনে জিপ রাখল রানা। মিতা নেমে পড়ার আগেই বলল, অপেক্ষা করো, আশা করি পাঁচ মিনিটের ভেতর ফিরব।
বাড়ির প্রথম ঘরে ডেস্কের পেছনে বসে আছে এক ক্লার্ক। প্রফেসরের গায়ের রঙ ও চেহারার বর্ণনা দিতেই মাথা দোলাল সে। মোয়েস নিগ্রো! বদ্ধ উন্মাদ!
কথাটা মানতে পারল না রানা। ব্রাযিলের ওই অভিযানে গিয়ে খুব ঠাণ্ডা মাথার মানুষ বলে মনে হয়েছে ওর হ্যারিসনকে।
সিঁড়ি দেখিয়ে দিল ক্লার্ক। দোতলা। তৃতীয় ঘর।
কট-মট আওয়াজ তুলে নড়বড়ে সিঁড়ির ধাপ পেরোতে লাগল রানা, উঠে এল চওড়া এক বারান্দায়।
বাইরে থেকে বাড়িটা দেখলে ভুতুড়ে মনে হলেও ভেতর দিক পরিষ্কার। দেয়ালে সাদা রঙ। ঘরগুলোর দরজার সামনে পাতলা কার্পেট। উল্টো দিকে মাঝারি সব ড্রামে লতাগাছ, নেমে গেছে একতলায়। ফুটেছে লাল ফুল। একপাশে উঠান। মাঝখানে পাথরের তৈরি ভাঙা ফোয়ারা। ছড়া-ছড়াৎ শব্দে পড়ছে পানি। পাশের চাতালে কিচিরমিচির করছে এক ঝাঁক পাখি।
তিন নম্বর ঘরের দরজায় থেমে টোকা দিল রানা। প্রফেসর হ্যারিসন?
জবাব দিল না কেউ।
ক্লার্ক বলেছে, আজ এখনও বেরিয়ে যাননি হ্যারিসন।
স্কেলিটন কি বের করে তালায় ভরল রানা, ডানহাতে বেরিয়ে এল .৩৮ ক্যালিবারের ওয়ালথার পি.পি.কে. পিস্তল।
প্রায় নিঃশব্দে তালা খুলে কবাট সরাল। ঘরে পা রেখেই কাভার করল চারপাশ। ভেবেছিল ঘর খালি, কিন্তু আছে কেউ!
পিছু নিয়ে ঘরে ঢুকেছে সোনালি রোদ, মেঝেতে পড়েছে ওর ছায়া, ওদিকে চেয়ে রানা দেখল, দরজার পাশ থেকে লাঠির মত কিছু সরাসরি নামছে ওর মাথা লক্ষ্য করে!
একলাফে সরে গেল রানা, পরক্ষণে ঘুরেই পিস্তল তাক করল আততায়ীর বুকে।
থমকে গেছেন প্রফেসর। উদ্যত পিস্তল বুকে তাক করা দেখে হাত থেকে ফেলে দিলেন লাঠি। কেমন বিভ্রান্ত চেহারা। বিড়বিড় করে বললেন, রানা? মাই গড!
সত্যিই মানুষটাকে পাগলাটে লাগছে, ভাবল রানা।
উস্কোখুস্কো চুল, মুখ ভরা গোঁফ-দাড়ি, চোখ গাঁজাখোরদের মতই লাল। কেমন আছেন, প্রফেসর?জানতে চাইল ও।
তুমি সত্যিই কি বাস্তব, রানা? বেসুরো কণ্ঠে জানতে চাইলেন হ্যারিসন। খসখস করে চুলকে নিলেন গাল।
তাই তো মনে হচ্ছে, মৃদু হাসল রানা।
একটু শিথিল হলেন প্রফেসর। ঠিক… কিন্তু কোথা থেকে এলে তুমি?
আমেরিকা, হংকং, ম্যানিলা, মেক্সিকো… নানান জায়গা ঘুরে, প্রফেসর, বলল রানা। আপনি কি সুস্থ?
বিছানার কিনারায় বসলেন হ্যারিসন। মাথা নাড়লেন। জানি না। কখনও হান্নার সঙ্গে গল্প করে চমৎকার কাটছে সময়। মনে হচ্ছে ভাল আছি, একটু পরেই মনে হচ্ছে, আমি খুব অসুস্থ।
হাই হিলের আওয়াজ উঠে এসেছে দোতলায়।
রানা বুঝল, গাড়িতে বসে থেকে বিরক্ত হয়ে চলে এসেছে মিতা। কয়েক সেকেণ্ড পর দরজা দিয়ে উঁকি দিল মেয়েটা। এক হাতে পাবলোর কবজি। আর অপেক্ষা করতে পারলাম না। প্রফেসর, কেমন আছেন?
ভীষণ চিন্তিত হয়ে গেলেন হ্যারিসন। খুব ভাল করেই চেনেন মিতাকে। কিন্তু ওর তো বিয়েই হয়নি! হচ্ছেটা কী? কোত্থেকে এল এই ছেলে?
ও কে? জানতে চাইলেন।
অনেক দীর্ঘ কাহিনি, স্যর, বলল মিতা। পরে সবই খুলে বলব। প্রফেসরের পাশে বসল। তাঁর ক্ষতের পুঁজ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে প্যান্টের ওপর। চমকে গেল মিতা। বুঝতে দেরি হলো না, ক্ষতটা এখনও দগদগে হয়ে আছে।
ওঝা বা আমার নানা চেষ্টার পরেও রাতে বারবার দেখি দুঃস্বপ্ন, নালিশ করলেন হ্যারিসন, ভীষণ ভয় লাগে। আগে কখনও এমন হতো না।
একে জ্বর, তার ওপর নেই ঘুম, বলল মিতা, এ ছাড়া আছে হামলার ভয়! স্যর, আপনার বোধহয় হাসপাতালে ভর্তি হওয়া উচিত।
প্রফেসরের টেবিলে চোখ গেল ওর। ওখানে এক বোতল বড়ি। মাথা নাড়ল মিতা। না, এগুলো ইনফেকশন ঠেকাতে যথেষ্ট নয়। আপনি বাড়তে দিয়েছেন ওটাকে। এবার সত্যিকারের অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ চাই। সুস্থ হলেই সোজা আপনাকে পাঠিয়ে দেব আমেরিকায়।
কোথাও যাব না, গোঁ ধরলেন হ্যারিসন। কয়েক সেকেণ্ড পর বুঝলেন, মনে কষ্ট পাবে মিতা। এবার বললেন, আসলে, ইয়ে, মিতা, আমিই তো শুরু করেছি সব, তাই কাজ শেষ না করে দেশে ফিরতে চাই না।
প্রফেসরের মন ঘুরিয়ে দিতে বলল মিতা, সেক্ষেত্রে কিন্তু আরও বড় কোনও বিপদে পড়বেন!
নরম সুরে বললেন হ্যারিসন, তুমি বরং বাড়ি ফেরো।
আপনাকে না নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।
তা হলে রয়েই যাও, দেখবে কদিনের মধ্যে পেয়ে গেছি পরের স্ফটিক।
বুঝলে, মিতা, তোমার মতই উনি, নিজের কাজ ফেলে রাখবেন না, বলল রানা।
ঠিকই পাব ওই স্ফটিক। ঠেকাতে পারবে না কেউ।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল মিতা। আপনি রয়ে গেলে, বাধ্য হয়েই আপনার পাশে থাকতে হবে আমাকে। দায়িত্ব এড়াব না আমি।
তুমি কী করবে ভাবছ? রানার কাছে জানতে চাইলেন বৃদ্ধ প্রফেসর।
বিশেষ কোনও কাজ নেই আমার, কাঁধ ঝাঁকাল রানা।
জানালা দিয়ে দূরে দেখলেন প্রফেসর। পাতলা পর্দা নেড়ে ঘরে ঢুকছে সাগরের ঝিরঝিরে হাওয়া। তাতে নোনা জলের গন্ধ। আনমনে বললেন তিনি, তোমাকে দেখে ভরসা পাচ্ছি, এবার ঠিকই ওই মন্দির খুঁজে পাব আমরা।
.
২১.
মস্কোর পার্ক কালচুরি মেট্রো স্টেশনে সাবওয়ে ট্রেন থেকে নেমে পড়ল ইগোর দিমিতভ। এই স্টেশন ভবন এতই সুন্দর, যে কেউ ভাববে, এটা জাদুঘর বা প্রকাণ্ড কোনও অপূর্ব প্রাসাদের অংশ। পালিশ করা বড় টাইল দিয়ে তৈরি মেঝে দাবার ছকের মত। দেয়ালে দেয়ালে মার্বেলের কারুকাজ, এখানে-ওখানে দুর্দান্ত সব মূর্তি। ছাত থেকে ঝুলছে একরাশ উজ্জ্বল ঝাড়বাতি।
এসব স্টেশন ছিল সোভিয়েত রাশার গর্ব। তৈরি উনিশ শ পঞ্চাশ থেকে ষাট দশকে। কথা ছিল এ দেশে সবার ওপর সম্মান পাবে সাধারণ কর্মীরা, তাই যাওয়া-আসার পথে তাদেরকে খুশি রাখতে নির্মাণ করা হয় বিশাল এসব স্টেশন।
ইগোর দিমিতভের মনে পড়ল, উরাল থেকে এসে প্রথমবারের মত নেমেছিল এই স্টেশনে। নতুন রিক্রুট, মাত্র যোগ দিয়েছে এফএসবিতে। তকতকে স্টেশন দেখে এ দেশের নাগরিক বলে গর্ব হয়েছিল ওর। তারপর দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেল সময়, দুবছর আগে অবসর নিয়েছে। বিয়ে করেনি, সন্তান নেই, টাকার কোনও অভাব নেই। তবুও কাজই খুঁজে নেয় ওকে।
মেট্রো স্টেশন থেকে বেরোতে দরজার দিকে পা বাড়াল দিমিতভ। খুব ঠাণ্ডা পড়েছে বাইরে। আগেই দুহাত ভরে দিল কোটের পকেটে। সোজা দেখছে সামনের দিক। কিন্তু পেছন থেকে ডাকল কেউ। গলার আওয়াজ নুড়িপাথর বাড়ি খাওয়ার মতই কর্কশ। ইগোর দিমিতভ। এত তাড়া কীসের?
থমকে গেল দিমিতভ। ওই কণ্ঠস্বর ভাল করেই চেনে।
ইউরি ম্যাকারভ।
দিমিতভের পাশে পৌঁছল দানবাকৃতি লোকটা। চলো, হাঁটতে হাঁটতে কথা বলি।
হঠাৎ এখানে কেন, ম্যাকারভ? ধীর পায়ে এগোল দিমিতভ, আমাকে সকালে মিটিঙে আসতে বলা হয়েছে। তাড়া কীসের?
হাতে বাড়তি সময় নেই, বলল ম্যাকারভ, এরই ভেতর বড়কর্তারা জেনেছেন হংকঙে কী হয়েছে। এবার আগুনে পুড়বে কেউ না কেউ।
আর সেই লোকটা আমি, না?
অথবা তোমার মতই আমিও পুড়ে মরব।
চুপ করে হাঁটছে দিমিতভ।
ওই বাঙালি গুপ্তচরকে কাজে নিলে কেন? জানতে চাইল ম্যাকারভ।
থমকে দাঁড়িয়ে ম্যাকারভের মুখোমুখি হলো ইগোর। আমার মনে হয়েছিল, আড়াল থেকে কাজ করিয়ে নিতে পারব।
তিক্ত হাসল ম্যাকারভ। মস্ত ভুল করেছ।
যা হবার হবে, এখন ভেবে কী লাভ! আবারও হাঁটতে শুরু করল দিমিতভ। পৌঁছে গেল ওরা সিঁড়ির কাছে। এক পা পেছনে আসছে ম্যাকারভ। সতর্ক হয়ে উঠল প্রাক্তন এজেন্ট।
মস্কোর হিমঠাণ্ডা পরিবেশে বেরিয়ে এল ওরা। আকাশ থেকে নামছে পেঁজা তুলোর মত তুষার। শহরের আলোয় কেমন অস্বাভাবিক লাগছে দেখতে। রাস্তায় জমে গেছে পাঁচ ইঞ্চি তুষার। একটু দূরে অপেক্ষা করছে কালো এক ম্যাসেরেটি সেডান। ওটার চাকা বেলুনের মত ফোলা।
ইগোর দিমিতভের কাঁধে হাত রাখল ম্যাকারভ। তুমি আমার সঙ্গে আসছ।
কোথায় যেতে হবে? কেন?
সব খুলে বলার জন্যে। শক্তভাবে দিমিতভের কাঁধ ধরল সে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেডানের পেছনের দরজা খুলে সিটে বসল দিমিতভ। ভেতরে আছে আরেকজন। তাকে চিনল না ও। বিশাল দেহ নিয়ে সামনের প্যাসেঞ্জার সিটে চাপল ম্যাকারভ। রওনা হয়ে গেল ড্রাইভার।
ও, তা হলে মস্কোর তুষার ঝরা এক রাতে শেষ হলো আমার সময়? ভাবল ইগোর দিমিতভ। আত্মীয়রা কেউ জানবে কী হয়েছে! হারিয়ে যাবে লাশ। তবে পাওয়া যাবে গ্রীষ্মে।
মস্কো নদী পেরিয়ে গেল সেডান। থামল রেড স্কোয়্যার-এ।
এখানে খুন করবে? হয়তো তাই! তাতে সাবধান করে দেয়া যাবে অন্যদেরকে।
সেডানের পাশে থামল আরেকটা গাড়ি। এত ঘেঁষে আছে, দরজা খুলতে পারবে না কেউ।
জানালার কাঁচ নিচু করে দ্রুত কী যেন বলল ম্যাকারভ। খপ করে ধরে কী যেন রাখল সিটের পাশে। ড্রাইভারকে বলল, রওনা হও।
চলতে শুরু করল ম্যাসেরেটি। আধঘুরে দিমিতভের দিকে তাকাল ম্যাকারভ। হাতে পুরু এনভেলপ। আরেকবার সুযোগ দিয়েছে। এখন থেকে সরাসরি এফএসবির নির্দেশে কাজ করবে।
কী লিখেছে? জানতে চাইল দিমিতভ।
খুঁজে বের করবে ওই ছেলেকে নিয়ে আসবে সায়েন্স ডিরেক্টোরেট-এ। যদি মনে হয় দেশে আনতে পারবে না, দেরি না করে মেরে ফেলবে। যারা ওর সঙ্গে কোনওভাবে জড়িত, বাঁচতে দেবে না তাদেরকে।
এনভেলপ নিয়ে খুলল ইগোর দিমিতভ। ভেতরে নতুন একটা পাসপোর্ট, প্রচুর টাকা ও পরামর্শের চিঠি। আজকাল আর এ ধরনের কাজ করি না, বলল সে। ওদেরকে বলল, অন্য কাউকে যেন বেছে নেয়।
দেশকে ছোট করেছ, রাগী গলায় বলল ম্যাকারভ। সার্গেই দিমিতভ তোমার ভাই ছিল।
সত্তাই, বলল ইগোর।
তাতে কী? বলল ম্যাকারভ। তোমাদের পরিবার বেঈমানি করেছে। সুদে-আসলে সব বুঝে নেবে এফএসবি।
বাইরে তাকাল ইগোর দিমিতভ। বংশের সুনাম কলঙ্কিত করেছে তার সম্ভাই। এখন দেশের হয়ে কাজ না করলে বাঁচবে না ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের কেউ।
মেক্সিকো সিটিতে এফএসবির লোক যোগাযোগ করবে। তোমার কাছ থেকে নির্দেশ নেবে ওরা। কিন্তু তাদেরকে ফেলে কোথাও যাবে না। কথাটা বুঝতে পেরেছ?
সবই বুঝেছে ইগোর। এফএসবির লোক ওরা। বেছে নেয়া হয়েছে নাই ডিরেক্টোরেট থেকে। খুন করা পেশা। যা বলা হবে, তাই করবে। যদি পাবলোকে ফেরত আনতে না পারে ও, খুন হয়ে যাবে তাদের হাতেই।
হয়তো ভাবছ হারাবার কিছুই নেই, বলল ম্যাকারভ, কথাটা কিন্তু ঠিক নয়। তোমার ভাতিজা-ভাতিজিরা রয়ে গেছে। তুমি সফল না হলে কেউ বাঁচবে না ওরা।
ম্যাকারভের দিকে চেয়ে রইল ইগোর দিমিতভ। পলক পড়ছে না দানবের চোখে। যা বলার বলে দিয়েছে সে। কোটের পকেটে এনভেলপ রেখে জানালা দিয়ে দূরে চেয়ে রইল ইগোর দিমিতভ। গাড়ি পৌঁছে গেছে মস্কো ইন্টারন্যাশনাল-এর কাছে। বাড়ি ফেরার সুযোগ নেই। একটু পর উঠতে হবে বিমানে।
বিশ্রাম নেয়ার কোনও উপায় তার নেই।
.
২২.
উপসাগরের ঢেউ কেটে তরতর করে চলেছে তিরিশ ফুটি ফিশিং বোট, বয়স চল্লিশ বছরেরও বেশি। এখানে-ওখানে চটে গেছে রঙ। সাগরের জল প্রায় পচিয়ে দিয়েছে পুরনো কাঠের খোল। ইঞ্জিন চালু হতেই প্রাচীন ট্রাক্টরের মত শুরু করল ফ্যাট-ফ্যাট আওয়াজ। কিন্তু থ্রটল ঠেলতেই খেলা দেখাল টুইন আউটবোর্ড মোটর, যেন খেপা ষড়। এই মুহূর্তে শান্ত সাগরে তুমুল গতি তুলে পেছনে ফেলছে দীর্ঘ ঢেউ।
মিতা, পাবলো ও প্রফেসরকে দেখল রানা। সবাই হাসিখুশি। নতুন করে গোঁফ-দাড়ি কামিয়ে ফেলেছেন হ্যারিসন। গত দুদিন ধরে তাঁর ক্ষত ড্রেস করছে মিতা, দিয়েছে। অ্যান্টিবায়োটিকের মেগা ডোয। বাপ-বাপ করে ভেগেছে সংক্রমণ। ঘুমের ওষুধ দেয়ায় বহু রাত পর নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পেরেছেন প্রফেসর। এখন তাকে দেখে মনে হচ্ছে না পাগলাগারদ থেকে ভেগে এসেছে ভয়ঙ্কর উন্মাদ।
অন্যদের মতই, খুশি পাবলো। রানা ভেবেছে, সত্যি রাশান ক্যাপ্টেনের কথা ঠিক হলে এনার্জি ফিল্ড ভরা ব্যস্ত শহর ছেড়ে নীরব জেলেগ্রাম পুয়ের্তো আযুলে এসে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল বেচারা। এখন চুপচাপ দেখছে শান্ত সাগর।
ওর পাশেই আছে মিতা। হঠাৎ সাগর থেকে চোখ সরিয়ে রানাকে বলল, এরচেয়ে ভাল বোট পেলে ভাল হতো।
পাব কোথায়? মাথা নাড়ল রানা। সবগুলোর ভেতর এটাই সবচেয়ে দ্রুতগামী।
তাই? মৃদু হাসল মিতা।
ওরা এই বোট ব্যবহার করে ওয়্যাহু মাছ ধরতে।
আমাদের ডাইভ গিয়ারও প্রথম সারির, বলল মিতা, সাগরে নামলে বিপদে পড়ার কথা নয়।
চুপ করে থাকল রানা। আধুনিক ইকুইপমেন্ট বলতে ওদের রয়েছে জিপিএস রিসিভার ও সস্তা এক সোনার ডেথ সাউণ্ডার। এতেই চলবে। বারবার হিসেব কষে প্রফেসর স্থির করেছেন, কোথায় যেতে হবে। তার হিসেব অনুযায়ী, বর্শার ডগা উপকূল থেকে সাত মাইল দূরে। সাগরের গভীরতা ওখানে কম। তবে কিছুই নিশ্চিত হওয়ার উপায় নেই। ওদিকের সাগরতলের ডেটা কখনও পরীক্ষা করেনি কেউ। তাতে সমস্যা নেই, নিচে পুরনো ধ্বংসাবশেষ রয়ে গেলে দাম্ভিক মেয়ের মত নাক উঁচু করে রাখবে ওটা।
আচ্ছা, পানির নিচে কেন মন্দির তৈরি করবে মায়ারা? জানতে চাইল মিতা। ওদের দ্বারা এ কাজ তো প্রায় অসম্ভব!
দুই কারণে ওদিকে হয়তো আছে মন্দির, বললেন প্রফেসর, প্রথম কথা, ওরা ওটা সাগরে তৈরি করেনি। ডাঙায় করেছিল, পরে তলিয়ে গেছে। হাত দিয়ে চারপাশ দেখালেন। এদিকের সাগরে প্রায়ই বদলে যায় স্রোত ও টেকটোনিক প্লেট। নিচের পাথর নরম। কিছু দিনের জন্যে জেগে উঠছে অনেক দ্বীপ, আবার তলিয়ে যাচ্ছে যখন-তখন। তা ছাড়া, হাজার বছরে পাল্টে যায় বহু কিছুই। আমাদের জানা আছে, চার-পাঁচ হাজার বছর ধরে এ এলাকায় বাস করেছে মায়ারা। ওই সময়ে তৈরি করা মন্দির সাগরে ডুবে যাওয়া মোটেও অস্বাভাবিক নয়।
আর অন্য কারণটা কী? জানতে চাইল মিতা।
সাগরের বুকেও তৈরি করা যায় মন্দির, বললেন প্রফেসর। তোমরা জানো, কেমিকেল রিঅ্যাকশনে শক্ত হয় কংক্রিট। সঠিকভাবে মিশ্রণ তৈরি করলে পানির নিচেও বাড়িঘর বা মন্দির তৈরি সম্ভব। বিশেষ করে যদি উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা যায় আগ্নেয় ছাই।
মিতার দিকে তাকালেন হ্যারিসন। আমরা যখন গেলাম আইলা কিউবিয়ার্তায়, জানলাম হাজার হাজার বছর আগে আগ্নেয় এলাকার মাঝ দিয়ে গেছে মায়ারা। এমনি এমনি নিশ্চয়ই তা করেনি? জরুরি কারণ ছিল কঠিন পথে যাওয়ার। তারা চেয়েছিল স্ফটিক রাখার মত ভাল জায়গা। এমন কোথাও, যেখানে তৈরি করবে টেকসই মন্দির। আগ্নেয়গিরি থেকে দরকারী সব উপাদান নিয়েছিল তারা।
মনের চোখে মিতা দেখল, হাজার হাজার লোক টুকরি ভরা ছাই নিয়ে হাঁটছে সাগরের দিকে।
জিপিএস রিসিভারে চোখ রাখল রানা। আরেকটু গেলেই জানব, সত্যিই মন্দির আছে কি না।
থ্রটল পিছিয়ে নিতেই কমে গেল বোটের গতি।
সহজ পরিকল্পনা করেছে ওরা।
যেহেতু নির্দিষ্ট এলাকায় পৌঁছে গেছে, দুঘণ্টা করে গ্রিড প্যাটার্ন অনুযায়ী খুঁজবে মন্দির।
অবশ্য বিশ মিনিট তন্নতন্ন করে চারপাশ খুঁজেও কিছুই পাওয়া গেল না। আগের মতই থাকল সাগরের গভীরতা।
এটা খারাপ নয়, বললেন প্রফেসর হ্যারিসন। ভাবছিলাম আসলে কী খুঁজছি আমরা। মনে আছে, ব্রাযিলের জঙ্গলে লুকিয়ে ছিল বিশাল মনুমেন্ট। পাহারা দিচ্ছিল একদল অদ্ভুত হিংস্র জন্তু। মায়ারা চেয়েছিল মন্দিরটাকে নিরাপদে রাখতে, যদিও থাকবে ওটা সবার চোখের সামনে।
যাওয়া কঠিন, কিন্তু খুঁজে পাওয়া সহজ, মন্তব্য করল মিতা।
আমাযনের জঙ্গলে খুঁজে বের করাও সহজ ছিল না, বললেন প্রফেসর। মায়ারা এমন মন্দির তৈরি করেছে, যেটা কখনও হারাবে না।
জন্তুগুলোর হামলায় আরেকটু হলে খুন হতাম আমরা, বলল মিতা। আপনি ভাবছেন, এবারও সহজে পাওয়া যাবে, এমন কোথাও থাকবে মন্দির- কিন্তু ওটাকে রক্ষা করবে কোনও কিছু?
জরুরি কোনও কারণে স্ফটিক নির্দিষ্ট সব জায়গায় রেখেছে ওরা, বললেন প্রফেসর। চেয়েছে এমন কোথাও রাখতে, যেখান থেকে চুরি হবে না ওসব।
নিশ্চয়ই জরুরি কাজেই রেখেছে, বলল মিতা, ফিযিক্সের সূত্র কাজ করছে না ওগুলোর ওপর। আমাদের জানতে হবে, বাইশ ডিসেম্বরে কী করবে এসব স্ফটিক। কেউ চাইবে না, প্রচণ্ড ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভের কারণে বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতিহীন হয়ে উঠুক পৃথিবীর মানুষ।
ধীর গতি তুলে ধিকধিক করে চলেছে বোটের ইঞ্জিন।
সবাই চুপ হয়ে গেল।
কিছুক্ষণ পর হঠাৎ করেই সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়াল পাবলো। চলে গেল রেলিঙের পাশে। চোখ রেখেছে বামদিকের সাগরে।
বোটের গতি আরও কমাল রানা। ঘুরে আবারও চলল ফিরতি পথে। মিতা বসল হুইলে।
বিপ-বিপ আওয়াজ ছাড়ল ডেথ সাউণ্ডার।
উত্তেজিত হয়ে উঠেছে পাবলো। রেলিং থেকে ঝুঁকে তাকাল সাগরে। পানি ভেদ করে যেন দেখবে অনেক নিচে।
চট করে পোর্ট সাইড থেকে সরে স্টারবোর্ড সাইডে দৌড়ে গেল বাচ্চা ছেলেটা। আঁকড়ে ধরল রেলিং। চিৎকার করে বলল, সাইরেন! সাইরেন! সাইরেন!
মনে হলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না নিজেকে। সামনে পেছনে দুলছে। কী মনে করে সাগরে নেমে পড়তে চাইল। কিন্তু দুকাঁধ ধরে ওকে পিছিয়ে নিল রানা।
শান্ত হও, বাছা! বললেন প্রফেসর।
সাইরেন! সাইরেন! সাইরেন!
জোর আওয়াজে বাজতে শুরু করেছে ডেপথ গজ। সাগরের খুব অগভীর অংশে হাজির হয়েছে ওরা।
রানার মুঠো থেকে নিজেকে ছুটিয়ে নিতে চাইছে পাবলো। ঘুরে কামড় বসাতে চাইল গত কয়েক দিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধুর হাতে।
বাচ্চা ছেলেটাকে শূন্যে তুলল সতর্ক রানা। ওর থুতনির নিচে ঝুলতে ঝুলতে চিৎকার করল পাবলো, সাইরেন! সাইরেন! সাইরেন! সাইরেন!
মিতা, বোট সরিয়ে নাও, বলল রানা।
থ্রটল ঠেলে দিতেই লাফ দিয়ে সামনে বাড়ল বোট।
ঘাড় কাত করে পেছনের সাগর দেখল পাবলো। নরম সুরে বলল, সাইরেন। সাইরেন।
কিছু দূর যাওয়ার পর বোটের গতি কমাল মিতা। বুকের কাছ থেকে পাবলোকে ডেকে নামাল রানা।
দৌড়ে গিয়ে মিতার কোমর জড়িয়ে ধরল বাচ্চা ছেলেটা।
রাশানরা জটিল কোনও অপারেশন করেছে ওর মগজে, রানাকে বলল মিতা। হাত বুলিয়ে দিল পাবলোর মাথায়। বসে কোলে নিল ছেলেটাকে। বলো তো, বাবু সোনা, সাইরেন আসলে কী জিনিস?
ঘাড় কাত করে অবাক চোখে ওকে দেখছে পাবলো, মুখে কোনও বোল নেই।
ঠিক আছে, কিছু হয়নি, তাই না? বলল মিতা। পাবলো অস্বস্তির ভেতর পড়েছে বলে মনে হচ্ছে ওর।
তুমি ঠিক আছ তো, পাবলো? জানতে চাইল রানা।
জবাব দিল না ছেলেটা। আবারও সানগ্লাসের দুই উঁটি ঠুকছে ঠুক-ঠাক শব্দে।
ওর কোনও ক্ষতি হয়নি তো? জানতে চাইলেন প্রফেসর হ্যারিসন।
মন খারাপ হয়ে গেছে মিতার। নিচু স্বরে বলল, জানি না।
তবে আপনি বোধহয় পেয়ে গেছেন আপনার বর্শার ডগা, মন্তব্য করল রানা। ঘুরিয়ে নিয়ে একটু দূরে বোট রাখল ও।
মুখে কিছু না বলে কাজে নেমে পড়ল মিতা। কতক্ষণ সাগরতলে থাকবে, কেমন হবে এয়ার মিক্সচার, বা কত সময় লাগবে ডিকমপ্রেশনে, এসব বুঝতে ডাইভ কমপিউটার ব্যবহার করছে।
এদিকে শার্ট খুলে উদোম গায়ে ইকুইপমেন্ট লকার থেকে গিয়ার বের করছে রানা।
একবার মুখ তুলে তাকাল মিতা।
যুবকের চওড়া কাঁধ, প্রশস্ত বুক, সরু কোমর, বটগাছের মত ঊরু পৌরুষদীপ্ত, পেশিবহুল সুঠাম দেহ দেখে রক্তিম হলো মিতা।
ভারী অক্সিজেন ট্যাঙ্ক বোটের পেছনে রাখল রানা।
বেখেয়াল রানার দিকে আবারও চোরা চোখে তাকাল মিতা। ওই দেহে নানান অংশে পুরনো ক্ষতের দাগ। মিতার ইচ্ছে হলো উঠে গিয়ে মানুষটার ক্ষতগুলো স্পর্শ করে।
মিতা, মন শক্ত রাখো, বললেন প্রফেসর হ্যারিসন। রানার মত মানুষকে কখনও বাঁধা যায় না। ও মুক্ত বিহঙ্গ।
তাই আসলে, স্যর, মুখ নিচু করে নিল মিতা। গত কয়েক দিন জাহাজে খুব কাছে ছিল রানা, কিন্তু সুযোগ থাকা সত্ত্বেও একটিবারও হাত বাড়ায়নি ওর দিকে।
তবে, তাই বলে হতাশ হয়ো না, দর্শনের বুলি ঝাড়লেন হ্যারিসন, আমার বাজপাখির মত তীক্ষ্ণ চোখে ধরা পড়েছে, গোপনে গোপনে পাকা চোরের মত তোমাকে দেখছে ছোকরা।
মাথা নিচু করে হাসল মিতা, লজ্জা গোপন করার ব্যর্থ প্রয়াস। চোখ তুলে দেখল: এখনও মুচকি হাসি লেগে আছে প্রফেসরের ঠোঁটে। আবার মনোযোগ দিল সে কমপিউটারের স্ক্রিনে। ওখান থেকে চোখ না সরিয়ে নিচু গলায় বলল, খবরদার! ও যেন টের না পায়!
হাসি বেড়ে গেল বদমাস বুড়োর।
যন্ত্র ঠিক হয়ে থাকলে এখানে সাগরতল বালিময়, গভীরতা আশি ফুট। সাগরের যেখানে এসে চেঁচিয়ে উঠেছিল পাবলো, ডেপথ ফাইণ্ডার অনুযায়ী পানির গভীরতা ওখানে পঞ্চান্ন থেকে সত্তর ফুট। সেডিমেন্ট থেকে ওপরে উঁচু হয়ে আছে কিছু। হয়তো রিফ, তলিয়ে যাওয়া দ্বীপ, অথবা মানবসৃষ্ট কোনও দালানকোঠার ধ্বংসাবশেষ।
হাতের ইশারা করছে রানা।
বোটের সামনে চলে গেল মিতা। আড়ালে সরে গিয়ে পরল ত্বকের মত পাতলা ডাইভ স্কিন লাইক্রা। ওটা নিয়োপ্রেন ওয়েট সুটের মতই, তবে ব্যবহার হয় উষ্ণ জলে। নিয়োপ্রেনের মত ভেসে ওঠে না, ছড়েও দেয় না ত্বক।
মিতার কোমল দেহে রাবারের গ্লাভসের মত এঁটে বসেছে পোশাকটা। গোড়ালির কাছে বেল্ট দিয়ে বেঁধে নিল চার ইঞ্চি ফলার ছোরা। ফিরল বোটের পেছনে।
রানাও তৈরি, পরনে ডাইভ শর্টস্ ও র্যাশ-গার্ড শার্ট। পরীক্ষা করে দেখছে ফুল ফেস ডাইভিং মাস্ক। সঙ্গে রয়েছে। রেডিও কমিউনিকেশন সিস্টেম এবং মিনিয়েচার হেড-আপ ডিসপ্লে। শেষের জিনিসটা আধুনিক ফাইটার বিমানের পাইলটের মুখোশের মতই ডানদিকে দেখাবে সাগরের গভীরতা, সময় ও কমপাস।
একেকটা মাস্কের দাম হাজার ডলার। এ ছাড়া, আরও আছে দুই ডাইভারের জন্যে অ্যালিউমিনিয়ামের দুই ট্যাঙ্ক ও প্রপালশান ভেহিকেল বা ডিপিভি। সবমিলে খরচ পড়েছে প্রায় দশ হাজার ডলার।
রানার এক মেক্সিকান বন্ধুর মাধ্যমে কেনা হয়েছে বলে দাম পড়েছে কম। গতকাল বিকেলে সব পৌঁছে দিয়েছে সে পুয়ের্তো আয়ুল গ্রামে।
স্ট্র্যাপ দিয়ে মিতার পিঠে ট্যাঙ্ক বেঁধে দিল রানা।
আমরা এই ডাইভের জন্যে নাইট্রক্স ব্যবহার করছি, বলল মিতা।
গভীর পানিতে বেশিক্ষণ রয়ে যেতে ব্যবহার করা হয়। বিশেষ ওই মিক্সচার তৈরি হয়েছে অক্সিজেন ও নাইট্রোজেন মিশিয়ে।
ফোরটি পার্সেন্ট মিক্সচার? জানতে চাইল রানা।
মাথা দোলাল মিতা।
মাত্র আশি ফুট নিচে নামতে প্রয়োজন পড়ে না নাইট্রক্স, কিন্তু সাগরতলের ওই সাইটের ভেতর অংশ কতটা নিচে গেছে জানা নেই, তাই ওই মিক্সচার ব্যবহার করছে ওরা। মন্দিরের ভেতর পারতপক্ষে দ্বিতীয়বার ফিরতে চায় না।
ডিকমপ্রেশন ছাড়াই সত্তর মিনিট থাকতে পারব, বলল মিতা, সবমিলে পারব দুঘণ্টা। তবে সেক্ষেত্রে ওঠার সময় দিতে হবে পুরো আধঘণ্টা।
ডাইভ ঘড়ি চালু করে পিঠে ট্যাঙ্ক ঝুলিয়ে নিল রানা। প্রফেসর হ্যারিসনকে বলল, নোঙর ফেললেও এদিক-ওদিক চলে যেতে পারেন। যেখানে আছি, সেটা জিপিএস-এ তুলে দিয়েছি। কিছুই ডিলিট করবেন না, নইলে ঠিক জায়গায় ফিরে তুলে নিতে পারবেন না আমাদেরকে।
তোমাদের মাস্কে না রেডিও আছে? বললেন হ্যারিসন।
বোটের ট্রান্সমিটার শক্তিশালী, কিন্তু আমাদেরগুলো অনেক দুর্বল, বলল রানা। মিতা আর আমি নিজেদের কথা শুনব, কিন্তু তিরিশ ফুট গভীরে যাওয়ার পর আপনার সঙ্গে আর যোগাযোগ করতে পারব না।
মাথা দোলালেন প্রফেসর।
রানা ইশারা করতেই বোটের পাশে সাগরে নামল মিতা। আগেই পরে নিয়েছে মাস্ক। ওর পর পর নেমে পড়ল রানা। সাগরের পানি বেশ উষ্ণ। টর্পেডো আকৃতির ডিপিভি পরীক্ষা করল ওরা। যন্ত্রটার সামনের দিকে দুপাশে খাটো ডানা, একটু পেছনে হ্যাঁণ্ডেলবার। চেপে বসে চালাতে হবে মোটর সাইকেলের ভঙ্গিতে।
ঝকঝকে নীলচে উপসাগরে তলিয়ে গেল ওরা। হেড-আপ ডিসপ্লে চালু করল রানা। চোখের সামনে দেখল উজ্জ্বল কিছু সবুজ সরল রেখা, যেন খেলতে বসেছে ভিডিয়ো গেম।
ডেপথ: ৪, বেয়ারিং: এনএনওডাব্লিউ (৩২৪), টেম্প: ৮৮, টাইম ইল্যান্স: ১:১৩।
কোন দিকে? জানতে চাইল মিতা।
বোটের তলা দিয়ে ওয়ান-ও-সিক্স বেয়ারিং-এ। ঝক থেকে সরে যাওয়া ডলফিনের মতই বামে বাঁক নিয়ে রওনা হলো রানা।
পিছু নিল মিতা। বোটের নিচ দিয়ে চলেছে আধমাইল দূরের বালির ঢিবি লক্ষ্য করে।
পানির তলা দিয়ে উড়ে যাওয়ার অনুভূতি নিয়ে রেডিয়োতে মিতার কথা শুনল রানা।
সত্যিই কি সামনে মন্দির পাব?
চলো, গেলেই দেখব কী আছে।
চল্লিশ ফুট গভীরতায় নেমে এল ওরা।
নিচের বালি সত্যিকারের রূপার মতই রুপোলি, কিন্তু অত গভীরে কমে গেছে সূর্যের আলো।
চোখের কোণে মিতাকে থামতে দেখল রানা।
ঘুরে দাঁড়াল মেয়েটা।
কোনও সমস্যা? জানতে চাইল রানা।
দূরে আঙুল তাক করল মিতা। হাঙর!
দেখা দিয়েছে বিশাল এক দানব!
হাতুড়িমাথা হাঙর, ফিসফিস করল মিতা।
সাধারণত মানুষের ওপর হামলা করে না, বলল রানা।
ভয় পেয়ে ঢোক গিলল মিতা। ওই হাঙরটা দৈর্ঘ্যে অন্তত বিশ ফুট, ওজন এক হাজার পাউণ্ড। কিন্তু সত্যি যদি… শুরু করেও চুপ হয়ে গেল সুন্দরী। দূরের অন্ধকার থেকে এল আরও দুটো হাঙর। দুসেকেণ্ড পর আরও একটা। ওটার লেজ ধরে এল আরও দুটো। আগে কখনও দেখিনি, ঝাঁক বেঁধে চলে!
অলসভঙ্গিতে সাগরের ওপরের দিকে উঠছে হাঙরের পাল।
এসো, থ্রটল মুচড়ে রওনা হয়ে গেল রানা।
কোথায় যাবে? চাপা স্বরে বলল মিতা।
ওদেরকে অনুসরণ করব, বলল রানা।
ওদেরকে বিরক্ত না করলে ভাল হতো না? আপত্তি তুললেও রানার পিছু নিল মিতা।
ওদের দিকে খেয়াল নেই হাঙরের ঝাঁকের। ধীর গতি তুলে বামে বাক নিল।
মিতার মনে পড়ল, পানিতে সামান্য কম্পন হলেও সতর্ক হয় হাঙর। ভয় চেপে শুকনো গলায় বলল ও, আমরা বরং ওদের পিছু না-ই বা নিলাম?
চমকে গিয়ে থামল রানা।
ধীর গতি তুলে ওদের দিকে আসছে কিছু হাঙর। এবার চার-পাঁচটা নয়, তৈরি করেছে সাগরতলে কয়েকটা হাইওয়ে। সংখ্যায় অন্তত চল্লিশ-পঞ্চাশটা! খুলে বসেছে এবড়োখেবড়ো, হলদেটে মুলোর দোকান!
নিঃশব্দে সাগরের মেঝের দিকে চলল রানা। চুপচাপ পিছু নিল মিতা। বালিতে নেমে যাওয়ার পর সূর্যের আলোয় ওপরের দৃশ্য পরিষ্কার দেখল ওরা। আধমাইল বৃত্তাকার এক পথে ঘুরছে ঝক ঝক হাঙর।
আমি কোনও সাবমেরিনে থাকলে এত ভয় পেতাম না, বলল মিতা।
আগেও দেখেছি দল তৈরি করে, কিন্তু একসঙ্গে আগে কখনও এতগুলো দেখিনি, বলল রানা।
সংখ্যায় কত হবে?
এক শর বেশি।
কাছাকাছি থাকছে সাত-আট ফুটি হাঙর, দূরত্ব বজায় রাখছে বড়গুলো। হাঙরের তৈরি বৃত্তের মাঝে চোখ গেল রানার। ওখানে আছে প্রবালের টিলা, মাঝে পাথর ও কাদার উঁচু স্তূপ। ঘুরে ঘুরে পাক দিচ্ছে হাঙরের ঝক। সাধারণ জ্ঞানের বইয়ের তথ্য মনে পড়ল রানার। হ্যামারহেড হাঙরের উটে থাকে সেনসিটিভ অর্গ্যান অ্যামপিউলা অভ লরেনযিনি। ওই নার্ভের একগাদা তন্তুর কারণে ওরা টের পায় ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ অথবা পালস্।
সাগরতলে অদ্ভুত ওই স্ফটিকের এনার্জি টের পেয়েই হাজির হচ্ছে হাঙরের দল। মিতার কাছে শুনেছে রানা, বেয়ারিং সাগরে কী হয়েছিল পাবলোকে বহনকারী বোটের।
জ্বলন্ত প্রদীপের শিখাকে ঘিরে যেভাবে ঘোরে উড়ন্ত পোকা, সেভাবেইঘিরে ঘুরছে ঝক ঝক হাঙর, বুকে কীসের এক হুতাশ।
ওপরে ঘুরন্ত হাঙরের ঝক একবার দেখে নিয়ে, প্রবালে ভরাদেখল রানা। কসেকেণ্ড পর বলল, ওদিকের প্রবালের রিফে যাব। স্ফটিক থাকলে, ওটা আছে প্রাচীন কোনও মন্দিরের ভেতরে।
হাঙরের ওপর চোখ রেখে প্রবাল প্রাচীরের দিকে চলল রানা। ওকে অনুসরণ করল মিতা। কাছে গিয়ে দেখল ওরা, পাথরের বিশাল সব চৌকো চাই দিয়ে তৈরি মন্দির। প্রতিটি পাথর নিখুঁতভাবে কাটা। ওজন রাখছে একটা আরেকটার ওপর।
পাথুরে দেয়ালের পাশ দিয়ে চলল রানা। বাইরের দিক অক্ষত, ভেতরে ঢুকতে হবে।
প্রফেসর বলেছেন: খুঁজে নেয়া কঠিন, তবে হারিয়ে ফেলা আরও কঠিন, বলল মিতা।
মন্দিরের নিরাপত্তার জন্যে ভাল ব্যবস্থা করেছে মায়ারা, হাত তুলে সাগর সমতলে হাঙরের মিছিল দেখাল রানা। আগেও দেখেছে এমন পাথুরে মায়া ডিযাইনের স্থাপত্য। হায়ারোগ্লিফিক নেই, তবে পাথরের বুকে খোদাই করা আছে দুটো সরীসৃপ।
রানাকে বলল মিতা, চলো, দেখি ঢোকা যায় কি না।
উঁচু দালানের ওপর দিয়ে ভেসে গেল ওরা। একটা চোখ রেখেছে হাঙরের দিকে। মন্দিরের ওদিকে পৌঁছে নামল বালির মেঝেতে।
সামনেই পাথুরে দেয়ালে সরু ফাটল। ফ্ল্যাশলাইট জ্বেলে ভেতরে আলো ফেলল রানা। মনে হচ্ছে সরু টানেল।
সুড়ঙ্গের দুপাশের দেয়াল প্রায় বুজে গেছে প্রবালে। একবার কৌতূহলী চোখে রানাকে দেখল মিতা।
ওর বাহু ধরল রানা। ঢুকতে পারবে, কিন্তু ভেতরে হয়তো আঁটবে না তোমার ট্যাঙ্ক।
উত্তেজিত মিতা ভুলে গিয়েছিল পিঠে রয়েছে জোড়া-ট্যাঙ্ক। ও দুটো ওর কোমরের চেয়ে চওড়া। পিঠ থেকে ট্যাঙ্ক নামাল ও।
বাড়তি কোনও ঝুঁকি নেবে না, নরম সুরে বলল রানা।
আমার ভয় কীসের, কাছেই তো আছে ওস্তাদ, মৃদু হাসল মিতা। চট করে একবার ওদিকটা দেখেই ফিরব। রেগুলেটর খুলে ট্যাঙ্কদুটো পাথুরে মেঝেতে রাখল। ফ্লিপার নেড়ে ঢুকে পড়ল সুড়ঙ্গে। তবে পনেরো ফুট যেতেই সংকীর্ণ হয়ে উঠল টানেল।
দম ফুরিয়ে আসতেই বেরিয়ে এল। ট্যাঙ্কের সঙ্গে আটকে নিল রেগুলেটর। পাশ করেছি?
তাই তো মনে হচ্ছে, মৃদু হাসল রানা।
বারকয়েক বড় করে শ্বাস নিল মিতা, চাইছে ফ্রি ডাইভারদের মত হাইপারঅক্সিজেনেট করতে। কপাল ভাল হলে তিন মিনিট টিকবে পানির নিচে। এতে ঝুঁকি আছে, কিন্তু প্রফেসর হ্যারিসনের অনুবাদ, হিসেব-নিকেশ, পাবলোর উত্তেজিত হওয়া আর হাঙরের উপস্থিতি ওকে জানিয়ে দিচ্ছে, ওরা পেয়ে গেছে স্ফটিকের দ্বিতীয় মন্দির।
রেগুলেটর খুলে আবারও টানেলে ঢুকল মিতা। অলিম্পিকের সাঁতারুদের মত চলছে দুই পা। পৌঁছুল টানেলের সংকীর্ণ অংশে।
টানেলের দুদেয়ালে ছোটবড় সব মরা প্রবাল।
গা বাঁচিয়ে সাবধানে এগোল মিতা।
অপেক্ষা করো, আমিও আসছি, পেছন থেকে বলল রানা।
বাতাস অপচয় অনুচিত, তাই চুপ থাকল মিতা। আরেক ফুট যেতেই পাঁজরের হাড়ে কামড় বসাল দুপাশের দেয়ালের প্রবাল। সামনের পথ আা রও সরু।
এবার ফিরতে হবে। কিন্তু পাথুরে টানেলে ঘুরতেই পারল মিতা, দুদিক থেকে চেপে ধরেছে মৃত প্রবালের ধারালো, শক্ত সব ডাল। তলোয়ারের ডগার মত ঠেকে গেছে বুক ও পিঠে। এদিকে ফুসফুঁসে শুরু হয়েছে ব্যথা। ধড়াস্-ধড়াস্ লাফ দিচ্ছে হৃৎপিণ্ড। জোর খাটাতেই মুটমুট শব্দে ভাঙল কিছু মরা প্রবাল, কিন্তু তার ফলে খুলল না ফেরার পথ।
আসছি, পেছন থেকে জানাল রানা।
ঘাড় কাত করে মিতা দেখল, হঠাৎ ভুস্ সুস্ শব্দ তুলল কিছু বুদ্বুদ। ট্যাঙ্ক বাইরে রেখে টানেলে ঢুকেছে রানা।
মিতা আবছাভাবে টের পেল, কোমর ধরে টানছে কেউ। কিন্তু ওকে ছাড়ছে না মরা প্রবাল। চিরে দিচ্ছে ত্বক।
ভয় পেয়ে বলল মিতা, একমিনিট!
রানাও বুঝতে পেরেছে বিপদটা, একবার রক্ত বেরোলেই তা মিশবে সাগরে। ওই লোভনীয় গন্ধ পেলেই হামলা করবে হাঙরের পাল, বাঁচার উপায় থাকবে না ওদের। এবার কী করবে ভাবতে গিয়ে মিতার কোমর থেকে হাত পিছিয়ে নিল রানা।
ফুসফুসের প্রচণ্ড চাপ অসহ্য হতেই, মেয়েটার নাক-মুখ দিয়ে বেরোল একরাশ বুদ্বুদ। রানা খেয়াল করল, ছাতে আটকে না গিয়ে নিঃশব্দে ফেটে গেছে বুদ্বুদ!
পেছন থেকে মিতাকে আটকে রাখা মরা সব প্রবাল মট-মট করে ভাঙতে লাগল রানা। এদিকে কয়েকবার খাবি খেল দিশেহারা মিতা, গলগল করে পেটে ঢুকল নোনা জল। হঠাৎ শিথিল হলো ওর বিবশ দেহ। চোখ জুড়ে নামল ঘুটঘুটে আঁধার।
চোখা আরও কিছু প্রবালের শাখা ভাঙতেই শিথিল মিতাকে ছুটিয়ে নিতে পারল রানা। সামনে বেড়ে দুহাতে ওর সরু কোমর ধরল ও, তুলে নিয়ে যেতে লাগল ছাতের দিকে। চাপা স্বরে বলল, একটু ধৈর্য ধরো! ওপরে বোধহয় বাতাস আছে!
কোনও সাড়া দিল না অচেতন মিতা।
কয়েক সেকেণ্ড পর ছাতের কাছে ভেসে উঠল রানা। ভাবল, এই মন্দিরে বিষাক্ত গ্যাস থাকলে নির্ঘাৎ মরব। তবে দম নিতেই বুক ভরে উঠল তাজা অক্সিজেনে। ছাত থেকে কয়েক ফুট নিচে রানার কাঁধের পাশেই শেষ হয়েছে পুরু এক প্রাচীর, ওদিকে প্রশস্ত পাথুরে চাতাল। বেশ ওপরে ওটার ছাত। অচেতন মিতাকে চাতালে তুলল রানা। পানি ছেড়ে উঠে এল নিজেও।
হ্যাঁ, ওরা পৌঁছে গেছে দুই নম্বর মায়া মন্দিরের অভ্যন্তরে!
.
২৩.
দুপা চেয়ারে তুলে মৌজ করে রেডিয়ো শুনছে ফলক্যান বোট রেন্টালের এজেন্ট। মাথায় কাত করে বসানো বেসবল হ্যাট। কিছুতেই চোখে রোদ পড়তে দেবে না। গান শুনতে শুনতে কান আরও খাড়া হলো তার।
কাঠের জেটিতে পায়ের আওয়াজ, এই বুঝি এল কাস্টোমার!
মুখ তুলে তাকাল এজেন্ট। অবাক হতে হলো তাকে। এগিয়ে আসছে বেশ কয়েকজন চাইনিজ। পরনে কালো স্ন্যাক্স আর গাঢ় নীল শার্ট। মনে হলো না কেউ মাছ ধরতে এসেছে।
হোলা, নরম সুরে বলল এজেন্ট।
তিন চাইনিজের মধ্যে সবচেয়ে বড়জন ঢুকে পড়ল বুথে। অন্যরা দাঁড়িয়ে পড়েছে বাইরে।
সকালে ভাড়া দিয়েছ একটা বোট, এজেন্টকে জানাল প্রকাণ্ডদেহী চাইনিজ। এক বাদামি লোক, এক কালো লোক, এক সুন্দরী আমেরিকান মেয়ে আর এক বাচ্চা ছেলে।
কত মানুষকেই তো বোট ভাড়া দিই, বলল এজেন্ট।
ওদেরকে তোমার মনে থাকার কথা। ওই ছেলে ওদের কেউ নয়।
মনে পড়েছে, মাথা দোলাল এজেন্ট। ছেলেটা কারও সঙ্গে কথা বলে না।
খুশি হয়েছে চাইনিজ। পকেট থেকে বের করল এক বাণ্ডিল এক শ ডলারের নোট। ওখান থেকে দুশ ডলার নিয়ে এজেন্টের দিকে বাড়িয়ে দিল। তোমার কি মনে হয়, ওদের সঙ্গে অস্ত্র আছে?
দুএকটা স্পিয়ার গান থাকতেও পারে, বলল এজেন্ট।
গেছে কোথায় ওরা?
ওয়্যাহু মাছ ধরতে। সুন্দরীর বাদামি সঙ্গীর কথা মনে পড়তেই বলল এজেন্ট, সঙ্গে নিয়েছে ডাইভিং ইকুইপমেন্ট।
এবার তার হাতে দেয়া হলো আরেকটা এক শ ডলারের নোট। এজেন্ট বুঝে গেল, আজ ওর দারুণ দিন!
কোনওভাবে ট্র্যাক করতে পারবে?
মাথা নাড়ল এজেন্ট। না। আমরা বোটের জন্যে ওদের কাছ থেকে টাকা জমা রেখেছি। ওটা নষ্ট হলেও ক্ষতি হবে না কোম্পানির। তবে একটা কথা, ওদের সঙ্গে যে ফিউয়েল আছে, যেতে পারবে বড়জোর পঞ্চাশ মাইল। তা ছাড়া, অন্য ডকগুলোয় খবর নিলেই জানব কোন দিকে গেছে।
একবার কেশে নিল ধেড়ে চাইনিজ। তা হলে কোন্ দিকে। গেছে ওরা?
বন্দর থেকে বেরিয়ে সোজা উত্তরদিকে।
এজেন্টের হাতে আরেকটা এক শ ডলারের নোট দিল চাইনিজ। আরও কিছু জানলে বলল। তারপর দেবে তোমাদের কোম্পানির সেরা বোট।
না, আর কিছু জানি না, কাউন্টারের তাক থেকে চাবি নিল এজেন্ট। যেটা দিচ্ছে, ওটার আছে পাইলট হাউস ও ইনবোর্ড মোটর। ব্যবহার করা হয় সোর্ডফিশ শিকারে। বাদামি লোকটার বোটের মত একই গতি তুলতে পারবে বিশেষ এই বোট।
.
২৪.
পায়ের সামান্য আওয়াজও প্রতিধ্বনি তুলছে মায়া মন্দিরের ভেতর। ঘুটঘুটে আঁধার। লেড ফ্ল্যাশলাইটের বাতি জ্বালল রানা।
একটু দূরে উঁচু গম্বুজ। এই ঘর বেশ বড়, চারদিকে পাথরের দেয়াল। সামনেই পাঁচ ধাপ সিঁড়ি নেমেছে শুকনো কোনও সুইমিং পুলের মত জায়গায়। মাঝে কাঠের বড় এক কফিন।
ফ্ল্যাশলাইট মেঝেতে রেখে মিতাকে কাত করে শোয়াল রানা, চাপড় দিতে লাগল পিঠে।
একটু পর খুকখুক করে কেশে উঠল মিতা। মুখ থেকে বেরোল দুই ঢোক পানি। তারপর বমি করল। খুলে গেছে। চোখ। কিছুক্ষণ পর ধীরে ধীরে উঠে বসল। তিক্ত চেহারা।
খুব অসুস্থ লাগছে? জানতে চাইল রানা।
মাথা নাড়ল মেয়েটা। নাইট্রোজেন নারকোসিস। বলা উচিত অক্সিজেন নারকোসিস। এই মিক্স ব্যবহার করেছি এর আগে মাত্র একবার। তাই বুঝিনি কী করা উচিত, আর কী নয়। ভেবেছি বেরোতে পারব টানেল ছেড়ে।
সত্যিই বেরোতে পেরেছ, তা হলে আর চিন্তা কী, হালকা সুরে বলল রানা।
লজ্জা পেয়ে ওর বাহুতে হাত রাখল মিতা। অনেক ধন্যবাদ। আজ তুমি না বাঁচালে পৌঁছে যেতাম ওপারে।
তাতে কমে যেত পৃথিবীর অনেক সৌন্দর্য, মৃদু হাসল রানা।
বেশ কিছু দিন ধরেই ঘুমাতে পারি না, বলল মিতা। চিনে অনেক ধরনের ড্রাগ দিয়েছে। ওদের হাতে বন্দি ছিলাম সব মিলে দশ দিন। তবে মনে রাখতে পেরেছি মাত্র আটচল্লিশ ঘণ্টা।
শরীর থেকে ড্রাগ যেতে সময় লাগবে, বলল রানা। টর্চ তুলে চারপাশে আলো ফেলল ও।
নিমজ্জিত মন্দিরের স্থাপত্য দেখার মত। ছাত নিখুঁত পাথরে তৈরি, কারুকাজ করা। হাজারো বছর ধরে আটকে রেখেছে। খাঁটি বাতাস। এখানে পৌঁছুতে হলে ব্যবহার করতে হবে সরু টানেল। আপাতত হামলা করতে পারবে না হাঙর।
একপাশে আলো পড়তেই ওরা দেখল হায়ারোগ্লিস্।
এখানে এলে খুবই খুশি হতেন প্রফেসর, বলল মিতা।
সিঁড়ি বেয়ে নেমে মস্তবড় কফিনের পাশে থামল রানা। পিছু নিয়েছে মিতা।
ঢাকনি খুলে দেখব, বলল রানা। তোমার আপত্তি নেই তো?
জবাব না দিয়ে ওর সঙ্গে হাত লাগাল মিতা। খুব সাবধানে ভারী কাঠের ঢাকনি,তুলে মেঝেতে নামিয়ে রাখল ওরা।
.
শান্ত সাগরে বোটে চুপচাপ বসে আছেন প্রফেসর জর্জ হ্যারিসন। মন খারাপ। অবাক কাণ্ড, রানা বিদায় নিতেই ভীষণ ভয় লাগছে তাঁর। বাচ্চা ছেলেটা একটু দূরে বসেছে। কিছু জানতে চাইলে জবাব দেয় না। সত্যিই, তিনি বড় একা।
ত্রিশ সেকেণ্ড পর পর দেখছেন জিপিএস স্ক্রিন। নিশ্চিত হতে চাইছেন হালকা বাতাস বা স্রোত দূর থেকে দূরে সরিয়ে নেবে না তাকে। আবছা দেখছেন সবজেটে তীর। বারকয়েক মনে হয়েছে, বিনকিউলার চোখে তুলে দেখবেন ওদিকটা। কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়েছেন। মন বলেছে, বিনকিউলার ব্যবহার করলেই হাজির হবে মস্ত কোনও বিপদ।
আরও কিছুক্ষণ পর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেন না। বিনকিউলার চোখে লাগিয়ে দেখলেন তীর।
না, ওদিকে কেউ নেই।
আবার মন দিলেন পাবলোর ওপর। বোটের মাঝখানে বসে আছে ছেলেটা, পরনে লাইফ জ্যাকেট।
বুঝলে, বললেন প্রফেসর, আমি বোধহয় পাগলই হয়ে যাচ্ছি। চোখের সামনে কীসব দেখি। আবার শুনতে পাই। ছেলেটা দেখছে সানগ্লাসের উঁটি। খুটখুট আওয়াজ তুলল। না, ছেলে, আমি এত কিছু জেনেও হেরে গেলাম তোমার ওই প্লাস্টিকের সানগ্লাসের ডাঁটির কাছে!
উপসাগরের দূরে বিনকিউলার তাক করলেন হ্যারিসন।
মাঝদুপুর। রুপালি-নীল আকাশ ঝরাচ্ছে গনগনে রোদ। তবে পুবে বিশাল এক মেঘ। অনেক দূরে। ধীরে ধীরে ছেয়ে ফেলছে চারপাশ। এখন ঝড় না এলেই বাঁচা যায়!
কী হলো, বাপু? আনমনে বললেন প্রফেসর। তোমরা কি সারাদিন সাগরের নিচে পার করে দেবে?
নতুন করে শুরু হলো ঝিরঝিরে হাওয়া।
আজ কথা বলছ না কেন, হান্না? আনমনে ভাবলেন প্রফেসর। জবাব দিল না কেউ। উদাস হয়ে পাবলোকে দেখলেন তিনি। ওর দিকেই ঘুরে তাকাল ছেলেটা। বোধহয় কিছুই শোনেনি।
কথা বলো না কেন? জানতে চাইলেন হ্যারিসন।
এবার শুনলেন গম্ভীর আওয়াজ। ওটা এসেছে পুবের মেঘ থেকে দূরে ওই মেঘ। ছড়িয়ে পড়ছে দক্ষিণ আকাশে। বিনকিউলার দিয়ে আবার উপকূল দেখলেন প্রফেসর। ঝড় আরম্ভ হলে তীরে পৌঁছানো কঠিন হবে।
নতুন কিছু চোখে পড়ল তাঁর।
দুটো বোট। দ্রুতগামী। আসছে তাঁদের দিকেই। সময় লাগবে পৌঁছুতে। এখনও আছে অন্তত পাঁচ বা ছয় মাইল দূরে।
সর্বনাশ! বিনকিউলার নামিয়ে ফিসফিস করলেন প্রফেসর। এবার কী করব? পাবলোকে দেখলেন।
পাত্তা দিল না পিচ্চি।
অগ্রসরমাণ দুই বোটের ওপর আবারও চোখ রাখলেন হ্যারিসন। ওগুলোর পেছনে মোরগের লেজের মত উঠছে পানি। হয়তো এসব বোট টুরিস্টদের, কিন্তু প্রফেসরের মনে হলো, এরা আসছে তাদের বারোটা বাজাতেই!
চেয়ার ছেড়ে পাবলোকে তুলে নিলেন হ্যারিসন, প্যাসেঞ্জার সিটে বসিয়ে ভালভাবে বেঁধে দিলেন সিটবেল্ট। পরক্ষণে গিয়ে চালু করলেন ইঞ্জিন।
.
গভীর মনোযোগ দিয়ে লাশটা দেখছে রানা ও মিতা। ওটা সাধারণ সাদা গজ কাপড় দিয়ে মোড়ানো। কফিনও আহামরি কিছু নয়। দুপাশে দুটো করে দণ্ড, বয়ে নেয়ার জন্যে।
লাশের করোটির ওপরের সাদা কাপড় খুলে ফেলল মিতা।
লোকটার চোয়াল ছিল জাগুয়ারের চোয়ালের মতই।
মায়ান রাজা। কিংবা ভিনগ্রহের কেউও হতে পারে।
কফিনের একদিকের তাকে রাজকীয় পোশাক। সূক্ষ্ম সোনার তার দিয়ে কারুকাজ করা। রাজার একহাত বুকের ওপর। মুঠোর ভেতর পানপাত্র। নাভির ওপর কাঁচের মত কিছু। ওটা চিনে ফেলল রানা ও মিতা। ব্রাযিলে পাওয়া স্ফটিকের মতই একই জিনিস। আকারে হবে আপেল বরইয়ের সমান।
রানার ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় ঝিকমিক করছে স্ফটিক। সতর্ক চোখে লাশের আশপাশ ভাল করে দেখে নিল ও।
না, কোথাও বুবি ট্র্যাপ নেই। এ
একবার রানার চোখে চোখ রাখল মিতা, তারপর লাশের নাভির ওপর থেকে তুলে নিল স্ফটিক। ওর মনে হলো, জিনিসটা অস্বাভাবিক ভারী। বেশ উষ্ণ। বিচ্ছুরণ করছে কোনও শক্তি। অন্তরটা বলল, কীভাবে যেন অনেক ক্ষমতা পেয়ে গেছে ও।
তুমি ঠিক আছ তো? জানতে চাইল রানা।
হ্যাঁ, মৃদু স্বরে বলল মিতা। ভাবতেই পারছি না, যেজন্যে এত দূরে এসেছি, পেয়ে গেছি সেটা। সাবধানে বেল্ট থেকে পাউচ নিয়ে ওটার ভেতর স্ফটিক রাখল ও। পাউচ ঝুলিয়ে নিল বেল্টে। এবার ব্যবহার করল প্রাচীন আমলের ফিল্ম ক্যামেরার মত দেখতে একটা ক্যামেরা। ওটা দিয়ে তুলছে ছবি।
ব্রাযিলের জঙ্গলে এক পর্যায়ে নষ্ট হয়েছিল রানাদের প্রায় সব বৈদ্যুতিক ইকুইপমেন্ট। তবে এই সেকেলে যন্ত্রে বৈদ্যুতিক কিছুই নেই।
মিতার ছবি তোলার জন্যে ঠিক দিকে আলো ফেলল রানা। কফিন, ঢাকনি, লাশ ও পোশাকের ছবি নিল মিতা। বাদ পড়ল না হায়ারোগ্লিস্। এরপর মন দিল মন্দিরের অন্যদিকে।
সবকিছুরই ফিল্ম নেয়ার পর রানার দিকে তাকাল মেয়েটা।
মাথা দোলাল রানা। এবার যেতে হবে।
সাগর সমতলে নিরাপদে উঠতে হলে চাই অন্তত বিশ মিনিট ডিকমপ্রেশন। অথচ বাইরে একপাল হাঙর।
ক্যামেরা গুছিয়ে রাখছে মিতা।
টানেলে চলে গেল রানা। একটু পর ফিরল চাতালের পাশে। দুহাতে ওদের দুজনের এয়ার ট্যাঙ্ক।
ডাইভিঙের জন্যে তৈরি হয়ে নিল ওরা।
আরেকবার প্রেশার গেজ দেখল রানা। বিশ মিনিটের বেশি বাতাস পাব। চলো, এবার বেরিয়ে যাই।
ঝুপ করে পানিতে নামল মিতা। বিশ সেকেণ্ড পর ওর পিছু নিয়ে মন্দির থেকে বেরোল রানা। ভাল লাগল আবারও স্বাভাবিক আলোয় ফিরতে পেরে। তখনই খড়মড় করে উঠল ইয়ারপিস। যোগাযযাগ করতে চাইছেন প্রফেসর হ্যারিসন।
..আসছে… দক্ষিণ-পশ্চিম থেকে… শুনছ তোমরা? দুটো বোট! হাই স্পিড! সোজা আমাদের…
.
২৫.
মায়া মন্দিরের টানেল থেকে বেরিয়েই ডিপিভিতে চেপে বসেছে রানা ও মিতা। স্টার্টার টিপে দিতেই চালু হলো প্রপেলার। দেরি না করে রওনা হয়ে গেল ওরা। উঠছে ওপরে। কপাল ভাল, সাগরতলে এতক্ষণ নেই যে, সত্যিকারের ডিকমপ্রেশন করতে হবে। তবে, রকেটের গতি তুলে উঠলে পরে বিপদে পড়বে।
কোনাকুনিভাবে সাগর সমতলের দিকে চলেছে ওরা। সময় দিচ্ছে শরীর থেকে নাইট্রোজেন দূর হবার।
আর বড়জোর এক বা দুমিনিট, তারপর দেখবে প্রফেসর হ্যারিসনের বোট। তখন কাজ শেষ হবে ডিপিভির।
সাবধান! হঠাৎ বলে উঠল রানা।
ওর কথা শুনে ঘাড় কাত করে তাকাল মিতা। কী যেন সাঁই করে গেল মাথার ওপর দিয়ে।
হ্যামারহেড!
পিছু নিল দ্বিতীয়টা। ঘেঁষে গেল মিতাকে। ডানদিকে ছিটকে যেতে গিয়েও সামলে নিল মেয়েটা।
দূর অন্ধকারে হারিয়ে গেছে হাঙরটা।
ওটার মতই লাইন ধরে আসছে একদল হ্যামারহেড!
একেকটা যেন মিসাইল!
.
সাগরসমতলে দুই বোটের ওপর থেকে চোখ সরাতে পারছেন না প্রফেসর হ্যারিসন। তুমুল গতি তাদের।
ট্রান্সমিটারের মাউথপিস খপ করে ধরে চিৎকার করে উঠলেন হ্যারিসন, শুনছ? জলদি! উঠে এসো! ওরা বড়জোর দুমাইল দূরে!
বিপদ কমাতে চাইলে ফুল স্পিডে পালাতে হবে পশ্চিমে। ওদিকেই আছে মেক্সিকোর কোস্ট গার্ডদের বোট। থাকতে পারে হেলিকপ্টার। ওগুলো ভয় দেখিয়ে তাড়াতে পারবে শত্রুদেরকে।
এখনই উচিত রওনা হওয়া, কিন্তু বন্ধুদের ফেলে যেতে আপত্তি আছে প্রফেসরের। থ্রটল পিছিয়ে নিয়ে বোট ঘোরালেন তিনি। আবারও ফিরছেন ডাইভ যোন লক্ষ্য করে। ট্রান্সমিটারের মাউথপিস মুখে তুলে বললেন, তোমাদেরকে যেখানে ফেলে এসেছি, ওখান থেকে আধমাইল দূরে আমি। যতক্ষণ পারি অপেক্ষা করব তোমাদের জন্যে।
হঠাৎ হাত থেকে সানগ্লাস ফেলে দিল পাবলো। সিটবেল্ট খুলে উঠে দাঁড়াল। চোখ সোজা সামনের সাগরে।
.
হাঙরের পালের হামলা থেকে বাঁচতে বামে বাঁক নিল মিতা, চলেছে নিচে। কিন্তু ডিপিভির প্রপালশন যথেষ্ট নয়। অন্তত তিন থেকে চার গুণ গতি তুলে আসছে হাঙরগুলো।
মিতাকে পাশ কাটিয়ে রকেটের মত গেল ছোট কয়েকটা হ্যামারহেড। পরক্ষণে ওপর থেকে ডাইভ বারের মত নামল বড় একটা। তো লাগাল মিতার মেরুদণ্ডে।
ভীষণ ভয় পেয়ে রানাকে খুঁজল মেয়েটার চোখ।
একটু পিছিয়ে পড়েছে বলে ডিপিভির পূর্ণ গতি ব্যবহার করছে রানা। তবে ওকে মোটেও পাত্তা দিচ্ছে না হাঙরের পাল। কারণটাও বুঝতে পারছে রানা। স্ফটিক মিতার কাছে।
ওই একই কথা ভেবেছে মিতা। ওটা ফেলে দিলেই কাটবে বিপদ, কিন্তু মরে গেলেও হাতছাড়া করবে না স্ফটিক। বহু কষ্টে পাওয়া জিনিস।
এখন পর্যন্ত কোনও হাঙর চায়নি কামড়ে দিতে। আসলে সেনসরি ওভারলোড হওয়ায় হতভম্ব ওরা। একের পর এক ওয়েভ আছড়ে পড়ছে ওদের মগজে।
আরেকটা বড় হাঙরের গুঁতো এড়াতে গিয়ে নতুন করে বাঁক নিল মিতা। কিন্তু এভাবে বেশিক্ষণ টিকবে না। চারপাশে হাঙর! কাছেই ঝলসে উঠছে সাদা পেট, মস্ত হাঁ করতেই দেখা যাচ্ছে। এবড়োখেবড়ো দাঁত!
মিতার ডান পায়ে গুঁতো দিয়ে গেল আরেকটা। পরেরটা প্রায় একইসময়ে ঘষা দিল পাঁজরে। ছিটকে গেল মিতা। চোট লেগেছে ঘাড়ে।
অপেক্ষা করো, আসছি! ব্যস্ত সুরে বলল রানা।
ওরা স্ফটিক চায়, দুর্বল কণ্ঠে বলল মিতা।
পরক্ষণে ওর ওপর হামলে পড়ল তরুণ একদল হাঙর। ওকে মাঝখানে রেখে ঘুরছে সিলিং ফ্যানের পাখার মত। ভীষণ ভয় পেয়েছে মিতা। টর্পেডোর মত দূর থেকে এল বড় এক হ্যামারহেড। সোজা গুতো দিল ডিপিভির বুকে। হাত থেকে হ্যাঁণ্ডেলবার ছুটে গেল মিতার। নিচের দিকে রওনা হলো হলদে যন্ত্রটা।
যান্ত্রিক সাহায্য হারিয়ে গেছে, নিজেকে সামলে নিয়ে ওপরে তাকাল মিতা। ওই যে একটু দূরে সাগর সমতল! কিন্তু পা-দুটো ছোঁড়ার আগেই খপ করে ওর কোমর কামড়ে ধরল কী যেন!
ঝট্ করে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল মিতা।
একহাতে ওর কোমর জড়িয়ে ধরে অন্য হাতে ডিপিভির গতি বাড়াল রানা। কিন্তু ওদের দিকে এল আরেক দল হাঙর। ব্যথা এবং মৃত্যুর জন্যে তৈরি হয়ে গেল মিতা। তেড়ে এল পাশাপাশি দুটো হাঙর, পেছনেই আরেকটা।
কিন্তু তখনই সাগর সমতলে উঠে এল রানার ডিপিভি, সরাসরি ছুটল প্রফেসরের বোট লক্ষ্য করে।
বিড়বিড় করে বলল মিতা: অনেক ধন্যবাদ!
গতি কমছে হ্যারিসনের বোটের। কিছুক্ষণ পর থামল রানা ও মিতার পাশে।
বোটের মই বেয়ে উঠতে উঠতে হঠাৎ হুমড়ি খেল মিতা। সাগর চিরে উঠে এসেছে সবুজ-ধূসর কী যেন! টর্পেডোর মত লাগল ওর কোমরে!
মিতাকে ওপরে ঠেলছিল রানা, ছুটে গেল ওর দুহাত। হতবাক হয়ে দেখল, দাঁতের সারির মাঝে মেয়েটাকে রেখে সরসর করে পিছিয়ে সাগরে নেমে পড়ল মস্তবড় হাঙর!
মই বেয়ে দৌড়ে ডেকে উঠল রানা। পিছু নিন, প্রফেসর!
থ্রটল খুলে বোট ঘুরিয়ে নিলেন হ্যারিসন।
এদিকে খপ করে ডেক থেকে স্পিয়ারগান নিল রানা।
.
খসে পড়ে গেছে মাস্ক, বিশাল হাঙরের করাল মুখে ছেঁড়া পুতুলের মত ঝুলছে মিতা, সই-সাঁই করে পেছনে পড়ছে নীল সাগর। ওর মনে হয়েছে, কোমরে বেদম ধাক্কা দিয়েছে দ্রুতগামী ট্রেন। এবার বাঁচবে না কোনওভাবেই। গা মুচড়ে নিজেকে মুক্ত করতে চাইল। কিন্তু কাজটা অসম্ভব। হাঙরের ত্রিকোণ মসৃণ মাথা ধরে নিজেকে ছোটাতে পারল না। এয়ার ট্যাঙ্ক কামড়ে ধরে রেখেছে দানবটা।
হঠাৎ কাত হয়ে গতি কমাল ওটা। এরই ভেতর মিতাকে সরিয়ে নিয়েছে বোট থেকে কমপক্ষে দুশ ফুট। এয়ার ট্যাঙ্কে কামড় ছেড়ে নতুন আগ্রহে মেলল আরও বড় হাঁ। এই সুযোগে দ্রুত পা নেড়ে সরে যেতে চাইল মিতা। হাঁফ লেগে গেছে ওর। পাগলের মত চারপাশে তাকাল বোটের জন্যে।
ওই যে! ঘুরে আসছে বোট ওর দিকে!
মিতার দুপায়ের মাঝে মাথা গুঁজে দিল মস্ত হাঙর, পরক্ষণে ছিটকে ফেলল দূরে! নতুন করে ঝপাস্ করে সাগরে পড়ল মিতা। ব্যথা পেয়েছে। ভেসে উঠেই দেখল হাঙরের গুঁতো খেয়ে কেটে গেছে কপাল। জলে পড়ছে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত!
ভীষণ ভয় পেল মিতা। ঝট করে পিঠ থেকে খুলে ফেলল এয়ার ট্যাঙ্ক, পরক্ষণে প্রাণপণে সাঁতরাতে লাগল বোটের দিকে। পানি থেকে তুলে রাখতে চাইছে মুখ।
.
বোট থেকে মিতাকে দেখছে রানা, হাতে স্পিয়ারগান। কেটে গেছে মেয়েটার কপাল। রক্তের গন্ধে পিছু নিয়েছে বেশ কয়েকটা হাঙর। সাগর চিরে আসছে ত্রিকোণ ডর্সাল ফিন!
ঝপাস করে বোট থেকে কার্গো নেট ফেলল রানা। জলদি, প্রফেসর!
সর্বোচ্চ গতি তুলে মিতার দিকে চলেছে বোট।
পাশ কাটিয়ে যাওয়ার আগেই নেট খামচে ধরল মিতা।
এদিকে গায়ের সমস্ত জোর ব্যবহার করে নেটসহ ওকে বোটে তুলতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে রানা।
তিন সেকেণ্ড পর জালে জড়িয়ে মৎস্যকুমারীর মত বোটে উঠে এল মিতা। একইসময়ে চিত হয়ে সাগর ছেড়ে বোটে উঠল এক হাঙর। এপাশ-ওপাশ করছে পিছিয়ে যাওয়ার জন্য। ওটার ভারী ওজনের কারণে কাত হলো বোট। হুড়মুড় করে উঠে এল অনেকটা পানি। নানান দিকে মাথা ঘোরাচ্ছে হাঙর, কিছু কামড়ে দিতে বেরিয়ে এসেছে দুই সারি দাঁত। কষে হাঙরের মাথায় লাথি মারল রানা, পরক্ষণে তুলে নিল স্পিয়ারগান।
কিন্তু আরেক ঝাঁকি মেরে বোট ছেড়ে সাগরে নেমে গেল হাঙর, বিশাল এক ঝল্পাস্ আওয়াজ তুলে।
প্রফেসর, সরে যান এখান থেকে! নির্দেশ দিল রানা।
প্রফেসর থ্রটল খুলে দিতেই লাফিয়ে সামনে বাড়ল বোট।
রানা খেয়াল করল, পিছু নিয়েছে পাল পাল হাঙর!
এদিকে জাল খুলে সত্যিকারের মৎস্যকুমারীর মতই উঠে বসল মিতা। কাঁপা গলায় বলল, ক্যাপ্টেন দিমিতভ মিথ্যা বলেননিঃ হাঙর আর কিলার ওয়েইল পাগল হয়ে যায় স্ফটিকের কাছাকাছি হলে! আমাদের কপাল ভাল যে বেঁচে গেছি!
মিতার পাশে বসে পড়েছে পাবলো। পাউচে হাত রাখল। এই তো সাইরেন। সাইরেন!
ছেলেটা উত্তেজিত। কাঁধে হাত রেখে ওকে শান্ত করতে চাইল মিতা। তাতে কাজ হচ্ছে না দেখে উঠে গিয়ে লকার খুলল, ভেতর থেকে নিল সীসা দিয়ে বাঁধানো বাক্স। ওটা এ ধরনের স্ফটিক রাখতেই তৈরি। বাক্সে রেখে ওটা ব্যাকপ্যাকে জল মিতা।
পাশে থেমে ফিসফিস করল ছেলেটা, সাইরেন। সাইরেন।
লকার আটকে দিল মিতা। হাত বুলিয়ে দিল ছেলেটার চুলে।
ওদিকে দূরে চেয়ে আছে রানা।
ওর চোখ অনুসরণ করল মিতা। দেখল, তুমুল বেগে ছুটে আসছে দুটো বোট। আর এক মাইল দূরেও নেই এখন। সোজা এগোচ্ছে এই বোটের দিকে।
রানার দিকে তাকাল মিতা।
নিচু স্বরে বলল রানা, সবচেয়ে কঠিন কাজটা বাকি এখন। এদেরকে এড়িয়ে উঠতে হবে তীরে।