মানুষ – গল্প – সমরেশ বসু
উনিশশো বাহান্নর নভেম্বরের মাঝামাঝি, দু-একটা দিন বেশি হতে পারে। অগ্রহায়ণ মাস পড়ে গিয়েছে। বেলা ছোট, পাঁচটার পরেই ছায়া ঘনিয়ে এসেছিল। ছটা বাজতে না বাজতেই রাত। বি টি রোডের ওপর আলো জ্বলে উঠেছে। আশেপাশে, দোকানে, রাস্তার গাড়িতে, সর্বত্রই আলো। সাড়ে ছটার মধ্যেই মিটিং-এর চেহারাটা কেমন যেন আলগা আলগা মনে হচ্ছিল। পৌনে সাতটা নাগাদ সভার উদ্যোক্তারাও বুঝতে পারল, আর বেশিক্ষণ না, এই ছোট মাঠটাও এবার ফাঁকা হয়ে যাবে।
বিপ্লবী দলগুলোর কোনওটারই অবস্থা, এ সময়ে খুব সংগঠিত না, এই বাহান্ন সালে বিশেষ করে। সংগঠিত হবার চেষ্টা চলছে। তিপান্ন চুয়ান্ন নাগাদ কী অবস্থা দাঁড়াবে, এখনই ঠিক বলা যাচ্ছে না, যে কারণে, সভা ডাকলেও, সভাগুলোতে তেমন লোকজন আসছে না। বক্তাদের বা সংগঠকদের কিছুটা উৎসাহ থাকলেও, সাধারণ মানুষের মধ্যে উৎসাহের অভাব, উত্তেজনা নেই একটু। কেন্দ্রে বা রাজ্যে দক্ষিণপন্থী সরকার নিরঙ্কুশ রাজত্ব করছে এবং বাংলায় বামপন্থী দলগুলোকে দক্ষিণপন্থী সরকার যে বেশ শক্ত হাতে কেবল দমনই করেছে, তা না, কিছুটা সন্ত্রাস আর সংশয়ের ভাবও জাগিয়ে তুলেছে। জেলগুলো খালি হয়েছে বা এখনও হচ্ছে, কমিউনিস্ট পার্টি নীতি আর কৌশলের পরিবর্তন ঘোষণা করেছে, অতি বামপন্থার সন্ত্রাস আর নৈরাজ্যের বিচ্যুতিগুলো কাটিয়ে ওঠবার চেষ্টায় আছে, এবং দক্ষিণপন্থী সংশোধনবাদের বিষয়েও সাবধান জানিয়ে লেখালেখি চলছে। সব মিলিয়ে অবস্থাটা এইরকম, যে কারণে সভায় বিশেষ লোকজন আসছেনা, এবং আজকের এই সভাটাও তেমনি, অনেকটা খাপছাড়াভাবেই, তাড়াতাড়ি শেষ করে দিতে হল। সভাটা হচ্ছিল কলকাতা থেকে মাইল দুই-তিনেক দূরের শহরতলিতে। একটা দোকান থেকে ইলেকট্রিকের তার টেনে, একশো পাওয়ারের একটি মাত্র আলো, ডায়াসের কাছে জ্বলছিল। সভা শেষ ঘোষণা হতেই সকলেই দাঁড়িয়ে উঠল, চলাফেরা শুরু করল, তাদের লম্বা লম্বা ছায়ায় অন্ধকারটা বেড়ে উঠল।
সুজিত পিছন দিকে ছিল। পাতলা একটা চাদর মুড়ি দিয়ে বসেছিল, এবার উঠে দাঁড়াল। ওর জামা কাপড় চাদর সবই যেন কেমন রুক্ষু ধুলা ধুলা, চেহারাটাও সেইরকম। চুলগুলো অনেকদিন কাটা হয়নি, পাকানো পাকানো চুলে ধুলার জট, মুখের তুলনায় মাথাটা অনেক বড় দেখাচ্ছে। বক্তাদের বক্তৃতা শুনে, খুব যে একটা উৎসাহ উদ্দীপ্ত ভাব, মুখে সেরকম কোনও চিহ্ন নেই, কিন্তু অস্পষ্ট আলোয়, দেখলেই বোঝা যায়, ওর মুখটা শক্ত হয়ে আছে। ঠোঁটের দুই কোণ, চিবুকের আশপাশ, চোয়াল, সবই যেন পাথরের মতো শক্ত। চওড়া কপাল আর মোটা ভুরুর তলায়, চোখ দুটো যেন বিশেষ একদিকে, ডায়াসের কাছাকাছি বিশেষ একজনের দিকে স্থির হয়ে আছে। স্থির হয়ে আছে বলা যায় না, বিশেষ একজন, যখন যেদিকে যাচ্ছে, নড়াচড়া করছে, সুজিতের কঠিন দৃষ্টি যেন সেদিকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। একজনকে চোখে চোখে রেখে, ও দাঁড়িয়ে পড়া মানুষদের লম্বা কিম্ভুত ছায়া অন্ধকারে এগিয়ে চলল। অনেকটা যেন সুন্দরবনের মানুষখেকো বাঘেদের মতো। একসঙ্গে যতগুলো লোকই থাকুক বাঘ তাদের মধ্যে, যে-বিশেষ একজনকে তার শিকার হিসেবে বেছে নিয়েছে, লক্ষ্য শুধু সেইদিকেই। বাকিরা তার দৃষ্টিতে নেই।
অথচ তুলনাটার সঙ্গে, সুজিতের আপাত শক্ত মুখ, কঠিন দৃষ্টি ছাড়া, চেহারার কোনও মিল নেই। চেহারায় পোশাকে একটু ধুলারুক্ষ ভাব থাকলেও, ওর চোখ মুখ খারাপ না। কমনীয়তা টের পাওয়া যায়, চোখ দুটো কালো আর ডাগর। সব মিলিয়ে, একটা শান্ত আর গম্ভীর ব্যক্তিত্বের ছাপ আছে ওর সাতাশ আটাশ বছরের চেহারায়। কিন্তু ওর দৃষ্টি, মুখের ভাব এবং ভাবভঙ্গিটা, একটা আরণ্যক চিন্তাকে জাগিয়ে তোলে।
সভার লোকজনের মধ্যে কেউ যে ওকে চেনে, তা মনে হয় না। কেউ ওর সঙ্গে কথা বলছে না, সুজিতও কারোর দিকে চেয়ে দেখছে না। ওর গায়ের চাদরটা অনেকখানি নেমেছে। দুটো হাতই ঢাকা রয়েছে। লোকজন সব রাস্তার দিকে চলতে আরম্ভ করেছে, একমাত্র ওই উজানে, ডায়াসের দিকে চলেছে। বক্তারা সবাই চলে গিয়েছেন। উদ্যোক্তাদের কয়েকজনই সেখানে আছে, নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছে। মাইক খোলা শুরু হয়েছে, হলেই, আলোর বালটা খুলে নিয়ে, তার খুলে গুটিয়ে নেবে।
সুজিত প্রায় ডায়াসের সামনে একজনের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। যার পাশে গিয়ে দাঁড়াল, সে সুজিতেরই প্রায় সমবয়সি হবে। ট্রাউজারের সঙ্গে, হাফ শার্ট, হাতকাটা হাতে বোনা ঘননীল সোয়েটার। পেটানো স্বাস্থ্য, বেশ লম্বা, ফরসা, মাথার চুল একটু পাতলা, রুক্ষু ভাব, কপালের ওপর এসে পড়েছে। দেখলেই মনে হয়, বেশ স্মার্ট। ডায়াসের ওপরে যারা কয়েকজন ছিল, নীচে দাঁড়িয়ে তাদের সঙ্গেই সে কথা বলছিল। কথা বলার সময় তার মোটা ভুরু বেঁকে বেঁকে উঠছিল, চোখ দুটো চঞ্চল, অথচ যেন একটা বাজ পাখির তীক্ষ্ণতা আছে। যে কারণে, সুজিত তার পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই, সে ফিরে তাকাল, বলে উঠল, আরে, সুজিতবাবু যে। জেল থেকে কবে বেরোলেন কমরেড।
সুজিত হাসল, আর মুহূর্তের মধ্যে ওর কঠিন দৃষ্টি নরম করে তুলল। বলল, এই মাস কয়েক হল।
ডায়াসের ওপরে যারা ছিল, তারা সুজিতের দিকে একবার দেখল, কিন্তু কোনও কৌতূহল দেখা গেল না। তারা নিজেদের মধ্যেই কথাবার্তা বলতে লাগল। সুজিত যার সঙ্গে কথা বলল, তার ঠোঁট দুটো কেমন একটা ধারালো হাসিতে বাঁকানো। পকেট থেকে সিগারেট বের করে, নিজের ঠোঁটের কোণে একটা গুঁজে দিয়ে সুজিতের দিকে প্যাকেট বাড়িয়ে বলল, চলবে নাকি।
সুজিত এবার আস্তে আস্তে ডান হাতটা বের করল বুকের কাছ থেকে চাদর ফাঁক করে, একটু হেসে, সিগারেট নিল। বলল, কেমন আছেন ধীরেশবাবু।
ধীরেশ ঘাড়টাকে একটু তুলে, দু হাতে একটা ভঙ্গি করল। এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে বলল, মন্দ না, এখন যেরকম চলবার, সেইরকম। তারপর? আপনি হঠাৎ এ তল্লাটে কী মনে করে?
সুজিতের সাদা ঝকঝকে দাঁতের হাসিটা কেমন যেন বিষণ্ণ। বলল, একটু কলকাতায় গেছলাম, নেবেই যাই, শুনে যাই। দুটো ট্রেন পরে না হয় বাড়ি ফেরা যাবে। শত হলেও বেকার তো।
ধীরেশ বলল, বেশ বেশ। চাকরিটা ফিরে পেয়েছেন নাকি?
কথা বলতে বলতে, ধীরেশ ওর বাজের মতো চোখে যেন সুজিতকে মেপে নিচ্ছিল। সুজিত বলল, গভর্নমেন্ট চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে, রি-ইনস্টেট করা সম্ভব নয়।
ধীরেশ খুব গম্ভীর ভাবে মাথা নাড়ল। ওর চোখা ধারালো একটা ব্যক্তিত্বের ভাব যেন ভাবে-ভঙ্গিতে চোখে-মুখে ঝকঝকিয়ে উঠেছে। ওর সব কিছুতেই যেন একটা চমক আছে, প্রথম দৃষ্টিতেও যে-চমকটা ও অপরের চোখে ঝলকিয়ে দিতে পারে।
ধীরেশ বলল, এখন তা হলে স্টেশনে যাবেন?
সুজিত বলল, হ্যাঁ যাই। মিটিংও তো শেষ হয়ে গেল। আপনাকে এখানে দেখে একটু অবাক হয়েছিলাম। আপনি কি এখন এ তল্লাটেই আছেন।
ধীরেশ গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ, পার্টি লোকাল কমিটিতে আছি।
মাথা ঝাঁকিয়ে, কপালের চুল সরিয়ে, তার সঙ্গে যোগ করল, দুটো ফ্যাক্টরি ইউনিয়নের সেক্রেটারির কাজও করতে হচ্ছে।
সুজিতের চোখের দৃষ্টি একপলকের জন্য কঠিন হয়ে উঠল, আবার সঙ্গে সঙ্গে নরম করল।
ধীরেশ অদ্ভুত ভঙ্গিতে, সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরোটা দূরে ছুঁড়ে দিল। বলল, আমাকেও একবার স্টেশনের দিকে যেতে হবে। চলুন, একসঙ্গেই যাওয়া যাক। তা ছাড়া আপনার সঙ্গে একটু কথাও বলা যাবে। ৫৪৬
সুজিতের চোখ দুটো যেন ঝকমকিয়ে উঠল, বুকের রক্ত কেমন ছলছলিয়ে উঠল। কিন্তু ও নিজেকে শান্ত রাখবার চেষ্টা করল, তথাপি ওর হাত থেকে সিগারেটটা মাটিতে পড়ে গেল। তাড়াতাড়ি পা দিয়ে সিগারেটটা এমনভাবে মাড়িয়ে দিল, যেন ইচ্ছা করেই ফেলেছে। ও নিজেকে ভাল করে চাদর মুড়ি দিল। ধীরেশ ডায়াসের দিকে ফিরে বলল, কমরেডস, আমি যাচ্ছি। কাল সকালে অফিসে আসব।
সকলেই ঘাড় নাড়ল, কে যেন বলল, ঠিক আছে।
ধীরেশের পাশে পাশে সুজিত চলতে লাগল। মাঠটা পেরিয়ে, রাস্তায় পড়ে, ধীরেশ বলল, আপনাদের ওদিকে পার্টির হালচাল কেমন বুঝছেন, এখন তো পার্টির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে।
সুজিতের মুখ ইতিমধ্যেই শক্ত হয়ে উঠেছিল। পাছে গলার স্বর অন্যরকম শোনায়, তাই ও একবার কাশল, বলল, আমি ঠিক কিছুই বুঝতে পারছি না।
ধীরেশ বলল, সুসলভের আর্টিকেলটা পড়েননি।
সুজিত বলল, জেলে থাকতেই পড়েছি। আসলে, এখন চারদিকেই যেন কেমন একটা ছন্নছাড়া ভাব। আমাদের ওদিকেও সেইরকম অবস্থা, যা হয় আর কী, নানারকম ভুল বোঝাবুঝি। এ ওর ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছে, ও এর ঘাড়ে।
সুজিতের কথা শেষ হবার আগেই, ধীরেশ মাথা ঝাঁকিয়ে বলে উঠল, হ্যাঁ, এখন আই পি এস-এর সময়।
ইনার পার্টি স্ট্রাগলের সময় এটা, বলছে ধীরেশ। সুজিতের শক্ত ঠোঁটের কোণ দুটো বেঁকে উঠল। রাস্তায় ধোঁয়া, চারদিকেই ধোঁয়াটে ভাব, বাতাস নেই। আলোগুলোকে টিমটিমে মনে হচ্ছে। বড় বড় ট্রাক বাস-এর হেড লাইটগুলোও তেমন জোরালো দেখাচ্ছে না। কারোর মুখই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না যেন, রাস্তার মানুষদের সবাই যেন ছায়া ছায়া, সব কিছুই ঝাঁপসা।
সুজিত মনে মনে বলে উঠল, আই পি এস, আই পি এস, ধীরেশ বলছে। ওর চোখ দুটো জ্বলে উঠল, সামনের দিকে তাকাল। পাশে পাশে ধীরেশ চলেছে, এ বিষয়েও সজাগ, ধীরেশের প্রতিটি পদক্ষেপ ও শুনছে। ও জানে, ধীরেশ কীভাবে হাঁটে, ওর হাঁটার একটা বিশেষ ভঙ্গি আছে। একটু ঝুঁকে, একটা কাঁধ সামান্য একটু উঁচিয়ে আর একটা পায়ের ওপর একটু বেশি জোর দিয়ে। প্রথম যখন সুজিত ধীরেশকে দেখেছিল, ভেবেছিল, ধীরেশের কোনওরকম শারীরিক গোলমাল আছে। পরে জেনেছিল, না, ওটা একটা ভঙ্গি। একটা বিশেষ ভঙ্গি, সম্ভবত ওর চমকের সঙ্গেই এটার মিল আছে। চলা ফেরা, সব কিছুতেই ধীরেশ বিশিষ্ট।
ধীরেশ আবার বলল, নিজেদের মধ্যে একটা বোঝাঁপড়ার দরকার আছে, কিন্তু তা বলে, ওসব নিয়ে বসে থাকলেই তো হবে না। কাজ করতে হবে, কাজ, বাকি সব ফালতু।
নেতার মতো কথা বলছে ধীরেশ, বরাবর তা-ই বলে এসেছে। বোঝাঁপড়া, হ্যাঁ বোঝাঁপড়া তো নিশ্চয়ই চাই, কাজও চাই, তবু সুজিতের ঠোঁটের কোণ যত বেঁকে উঠল, তত শক্ত হল। বোঝাঁপড়ার কথা ধীরেশ বলছে, তা-ই হবে, বোঝাঁপড়া হবে। সেইজন্যই আজ সুজিত এসেছে এখানে। মিথ্যা কথা বলেছে, কলকাতায় ও যায়নি, কাগজে কিছুই দেখেনি। ও সব খবরাখবর নিয়ে, তৈরি হয়েই এসেছে, জেনেই এসেছে, ধীরেশ এখানে আছে, পার্টি কমিটির মেম্বার, দুটো ইউনিয়নের সেক্রেটারি। সুজিত যদি ঈশ্বরে বিশ্বাস করত, তবে ঈশ্বরকে ডেকে উঠত, ধীরেশ নিজের দরকারেই স্টেশনে যেতে চেয়েছিল, এই কারণে।
হয়তো ধীরেশের স্টেশনে কোনও দরকার নেই, সুজিতের কাছ থেকে, ওদের অঞ্চলের খবরের জন্যই সম্ভবত স্টেশনে যাচ্ছে। সুজিত জানে, ধীরেশের নিজের লোক আছে ওদের অঞ্চলে, খবর মোটামুটি পায়, তবে ধীরেশের লোককে সবাই চেনে, কেউ তাকে সুনজরে দেখে না, কোনও কথাই বলে না। ধীরেশ কী কী জানতে চায়, তাও সুজিত জানে।
ধীরেশ বড় রাস্তাটা পার হল, সুজিতও ওকে অনুসরণ করল। ধীরেশ বড় রাস্তাটা পার হয়েই, একটা অন্ধকার সরু কাঁচা রাস্তার দিকে এগিয়ে গেল। সুজিত প্রায় থমকে দাঁড়িয়ে পড়তে যাচ্ছিল, ওদিকে কোথায় যাচ্ছে ধীরেশ। স্টেশনে যাবার রাস্তা তো আরও খানিকটা দক্ষিণ দিকে এগিয়ে বাঁয়ে। চাদরের মধ্যে ঢাকা ওর হাত শক্ত হয়ে উঠল, চোখে সন্দেহের ছায়া। ধীরেশ কি কিছু অনুমান করতে পেরেছে, কিছু জানতে পেরেছে, অথবা সন্দেহ করেছে কিছু, এবং হয়তো সেই জন্যই অন্ধকার ফাঁকা সরু রাস্তায়। সুজিতকে নিয়ে যেতে চাইছে। ও জিজ্ঞেস করল, এটা কোন রাস্তা।
ধীরেশ বলল, স্টেশনে যাবার শর্টকাট রাস্তা। ওদিকটা অনেক ঘুরতে হয়। পেছনে পেছনে চলে আসুন।
তারপরই ধীরেশের গলায় একটু হাসির শব্দ শোনা গেল, আবার বলল, তবে আপনাদের আলোতে চলা অভ্যেস, ভাল রাস্তায় হাঁটেন, একটু কষ্ট হবে।
ধীরেশের বিদ্রূপ গায়ে মাখার সময় নেই এখন সুজিতের, শোনবার কান মন, কিছুই নেই। আর একবার ওর বুকের মধ্যে রক্ত ছলাৎ ছলাৎ করে উঠল, উত্তেজনায় ঢিপ ঢিপ করতে লাগল। একবারও ভাবতে পারেনি, এইরকম একটা রাস্তা ওর ভাগ্যে জুটবে, আর ধীরেশ নিজেই সেই রাস্তাটা দেখিয়ে দেবে। সত্যি কি এরকম হয় নাকি, মৃত্যু মানুষকে অবচেতনে সম্মোহিত করে নিশির ডাকের মতো, তাকে হাতছানি দিয়ে ডেকে নিয়ে যায়। ধীরেশের এই শর্টকাট পথ ধরা দেখে সুজিতের তাই যেন মনে হচ্ছে। বড় রাস্তা থেকে এ রাস্তায় ঢুকতেই মনে হয়, অন্য একটা জগতে এসে পড়েছে। রাস্তার দু পাশে, অন্ধকারে যতটুকু চোখে পড়ে, বড় কাঁচা নর্দমা, পুকুর, তাতে বড় বড় কচুরিপানা যেন হাজার হাজার ফণা তোলা সাপের মতো উঁচিয়ে আছে, আশশ্যাওড়া কালকাসুন্দের জঙ্গল, বড় বড় গাছপালা নিবিড় অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে। ঝিঁঝির রকমারি ডাক, তার সঙ্গে একটা অদ্ভুত চাপা শব্দকে কোনও পাখির ডাক বলে মনে হচ্ছে। দু-একটা বড় বড় শেড দেখা যায়, যেগুলোর কালো আকৃতি অন্ধকারে জেগে আছে, অথচ কোনও আলো নেই, সাড়া শব্দ নেই। সামনের দিকে দূরে, একটা লাইটপোস্টে টিমটিম করে আলো জ্বলছে। সুজিত দাঁতে দাঁত চেপে, নিজের উত্তেজনাকে শান্ত করতে চাইল, নিজেকে শক্ত করল, প্রস্তুত করতে চাইল। ধীরেশের দিকে একবার দেখল, তারপরে ডান হাতটা চাদরের বাইরে নিয়ে এসে ডাকল, ধীরেশবাবু।
ধীরেশ চলতে চলতেই বলল, বলুন।
সুজিত এখন নিজেকে অনেকটা স্থির আর শক্ত বোধ করছে। বলল, বলব না, দেখাব একটা জিনিস, যাতে আপনি ভুল না বোঝেন।
ধীরেশ দাঁড়িয়ে পড়ল। সুজিত ছয়ঘরা রিভলবারটা তুলে, সামনের একটা গাছের গায়ে তাক করে, ট্রিগার টানল। সমস্ত অঞ্চলটাকে কাঁপিয়ে একটা শব্দ হল, একটা ঝিলিক, আর গাছের গাটা যেন নড়ে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে অনেকগুলো পাখি এবং কাক অন্ধকারের মধ্যে ডেকে উঠল, গাছের পাতায় পাখার ঝাপটা বাজল। দূরে কোথায় একটা কুকুর ডেকে উঠল।
ঘটনার চমকে ধীরেশ কথা বলতে পারছিল না, অবাক হয়ে সুজিতের দিকে তাকিয়ে রইল। সুজিত অন্ধকারে, ধীরেশের মুখের দিকে চেয়ে বলল, এতে আর পাঁচটা গুলি আছে। পাছে আপনি ভাবেন যে আমি ফাঁকা ভয় দেখাচ্ছি, তাই এটা আমাকে করতে হল, অনেক রিসক আছে জেনেও। এবার তাড়াতাড়ি চলুন, স্টেশনে যাই। গাড়িরও সময় হয়ে এল।
ধীরেশের মুখ দিয়ে কোনওরকমে বেরোল, তার মানে?
সুজিত বলল, তার মানে, বাইশ মাইল দূরে, আমাদের তল্লাটে আপনাকে নিয়ে যেতে এসেছি আমি। আমি সব খবর নিয়েই এসেছি। আমার সঙ্গে ট্রেনে উঠে আপনি যাবেন। যদি পালাবার চেষ্টা করেন, সেই মুহূর্তে, যে কোনও অবস্থায়, যে কোনও জায়গায় আপনাকে আমি গুলি করব, আর তার পরের রেজাল্টের জন্যও আমি প্রস্তুত আছি। কিন্তু দেরি করবেন না, চলতে থাকুন।
ধীরেশের বিস্ময় যেন তখনও কাটেনি, তাই সে নড়তে চড়তে পারছিল না। তবু একবার শুকনো নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করল, কিন্তু কেন নিয়ে যাবেন?
সে কথা পরে বলব, আপনি চলতে থাকুন।
সুজিত কঠিন গলায় আদেশ করল। ধীরেশ সামনে ফিরে চলতে আরম্ভ করল। ছাই ঘেঁসের ওপর দুজনের পায়ের শব্দ খস খস করে বাজছে। রিভলবারের শব্দটা শহরের কোথাও কোনওরকম সন্দেহ বা কৌতূহল সৃষ্টি করেছে বলে মনে হয় না। সুজিত আবার বলল, আপনাকে দেখে অনেক সময় আমার ব্রিটিশ স্পাই জর্জ রিলি-এর কথা মনে পড়ে যায়। সোভিয়েট বিপ্লবকে যে বানচাল করতে রাশিয়ায় ঢুকেছিল। কিন্তু সেরকম অ্যাডভেঞ্চার করার চেষ্টা করবেন না, দৌড়ে পালাবার মতলব করবেন না, তার পরিণতি খুব খারাপ হবে। তবে আপনার মুখে অনেকবার শুনেছি, আপনার মরার ভয় নেই। তা হলে যা ভাল বুঝবেন তাই করবেন।
ধীরেশ ঘাড় না ফিরিয়েই জিজ্ঞেস করল, আপনি কি আমাকে স্পাই ভাবেন?
সেটা দেখা যাবে, আপনার কবুল খাওয়া থেকে কী বেরিয়ে আসে।
ধীরেশ আবার বলল, এই যা করছেন, এটা কি পার্টির নির্দেশে করছেন কমরেড?
সুজিত বলে উঠল, কমরেড না, আপনি আমাকে সুজিতবাবু বলুন। না, আমি কোনও পার্টিরই নির্দেশে আসিনি, আমার বিবেকের নির্দেশে এসেছি।
ধীরেশ বলল, সেটা কী, জানতে পারি?
পরে, এখন না। ডান দিকে যান।
দূরের যে আলোটা দেখা যাচ্ছিল, তার কাছে আসতেই দেখা গেল, একশো হাত দূরেই স্টেশন। সামনের চত্বরে কয়েকটা রিকশা, চা পান বিড়ির দোকান, যাত্রীদের আনাগোনা। রাস্তাটা সত্যিই শর্টকাট।
সুজিতের ডান হাত চাদরের মধ্যে। বাঁ হাত বের করে ঘড়ি দেখল, গাড়ি আসবার সময় হয়েছে। ওর খেয়াল আছে, ধীরেশ ভীষণ চতুর, লোকজনের মাঝখানে পড়লেই দৌড় দিতে পারে। সে জন্য ও ধীরেশের খুব কাছ ঘেঁষে, পিছনে চলেছে, যাতে ওদের দুজনের মাঝখানের ফাঁকে কেউ ঢুকতে না পারে। এও জানে সুজিত ধীরেশ হঠাৎ চিৎকার চেঁচামেচি করে, একটা হই চই লাগিয়ে দিতে পারে। তা হলে, তৎক্ষণাৎ ধীরেশকে মরতে হবে, সকলের সামনেই। কথাটা ভেবেই মনে মনে একটু হাসল। কথাটা যখন ধীরেশকে শুনিয়ে বলছে না, তখন মনে মনে ভেবে কোনও লাভ নেই। রিভলবারটার সম্পর্কে, ধীরেশ নিশ্চয়ই ভুল কিছু ভাববে না। তবু ও বলল, কোনওরকম হই চই করে চালাকি করবেন না, তাতে পার পাবেন না। সোজা সিঁড়ি দিয়ে স্টেশনে উঠে প্ল্যাটফরমের মাঝামাঝি জায়গায় চলে যাবেন।
ধীরেশ যেন একটা জরুরি কথা মনে করিয়ে দেবার মতো বলল, টিকেট?
সুজিত বলল, আগে থেকেই কাটা আছে।
এই সময় ওরা স্টেশনের চত্বরে। ধীরেশ ফিরে তাকাল সুজিতের দিকে। স্টেশনের আলোয় দুজনের চোখাচোখি হল। ধীরেশের মুখের রং ফ্যাকাশে, চোখের কোল দুটো যেন হঠাৎই অনেকখানি বসে গিয়েছে। তার সেই বাজপাখির চোখে একটা তীক্ষ্ণ অনুসন্ধিৎসা, অথচ ঝকঝক করছে, যেন আলো কাঁপছে। সুজিতের শক্ত মুখ, দৃষ্টি স্থির কঠিন।
ধীরেশ সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে অবাক স্বরে বলল, টিকেটও কেটে রেখেছেন? জানতেন, আমাকে পাবেনই, নিয়ে যাবেনই?
সুজিত বলল, হ্যাঁ, যে কোনও উপায়ে।
যাত্রীদের সঙ্গেই ওরা চলছিল। গেট দিয়ে প্ল্যাটফরমে ঢোকবার মুখে ধীরেশ দাঁড়িয়ে পড়ল। সুজিত তৎক্ষণাৎ এক পাশে সরে দাঁড়াল, নিচু গলায় বলল, কোনও বাজে চেষ্টা করবেন না, ফল হবে না, তাড়াতাড়ি চলুন।
দু-একজন যাত্রী ওদের দিকে তাকিয়ে দেখল, এমনি দেখল, কোনও কৌতূহল নেই। কারণ, দুজনের মধ্যে আস্তে আস্তে কোনও কথা হচ্ছে, এটাই মনে করেছে। যদিও ধীরেশ প্রত্যেকটি লোকের দিকেই এমন ভঙ্গিতে তাকাচ্ছে, তাদের একটা কৌতূহল বা সন্দেহ হবার কথা। সুজিতকে সে বলল, আমার একটু দরকার ছিল স্টেশনে।
সুজিত চাদরের ভিতর থেকে অস্ত্রটা ধীরেশের পাঁজরের কাছে ছুঁইয়ে, দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ওসব দরকার পরে দেখা যাবে, চলুন, তা না হলে–
ধীরেশ চকিতে একবার সুজিতের মুখের দিকে তাকিয়ে চলতে আরম্ভ করল। ভয়টা তার মনের মধ্যে ঢুকেছে। এখন প্ল্যাটফরমে খুব বেশি লোকের ভিড় নেই। সকলেই সামনে পিছনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এই স্টেশনের কাছে বড় কারখানা নেই। তা ছাড়া শীতকাল বলেই কাজের লোকেরা দেরি না করে, আগে আগেই বাড়ি ফিরে গিয়েছে। প্ল্যাটফরমের মাঝামাঝি এসে সুজিত বলল, দাঁড়ান।
ধীরেশ দাঁড়াল। প্ল্যাটফরমের আলোগুলো খুব জোরালো না, টিমটিমে লালচে। এই আলোয় ভাল করে মুখ দেখা যায় না, কেউ কাউকে চিনতে পারে না। দুরে ট্রেনের আলো দেখা যাচ্ছে অন্ধকারে একটা প্রকাণ্ড লাল চোখের মতো। সুজিত দেখল, ধীরেশ পকেটে হাত দিয়েছে। চকিতের জন্য ওর মনে একটা সন্দেহের ঝিলিক হানল, যদিও এই বিশ্বাস ওর আছে, ধীরেশের কাছে এখন কোনও অস্ত্র নেই। ধীরেশ সিগারেটের প্যাকেট বের করল। সে যে নানারকম ভাবছে, ভয় পাচ্ছে, আর দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছে, সেটা ভাবভঙ্গি দেখেই বোঝা যাচ্ছে। অন্য সময়, সে যে কেবল চোখে মুখে কথা বলে, তা না, হাতে পায়েও কথা বলে। ধীরেশের সমস্ত কিছুর মধ্যেই একটা ভঙ্গি থাকে, পকেট থেকে সিগারেট বের করা, ধরানো, নানান কায়দার ব্যাপার, এরকম অন্যমনস্ক আর আস্তে আস্তে কিছু করবার লোক নয় সে।
গাড়ির শব্দ পাওয়া গেল, আলোটা আরও বড় হয়ে উঠছে। ধীরেশ জিজ্ঞেস করল, ওখানে কি আপনাদের আরও সবাই আমার জন্য অপেক্ষা করছে?
সুজিত বলল, গেলেই দেখতে পাবেন।
ধীরেশ বলল, এখন আর বলতে ক্ষতি কী, শুনতে ইচ্ছে করছে।
ধীরেশের ধারালো স্বর ইতিমধ্যেই কেমন মরচে পড়া ভাব লাগছে। সুজিত বলল, এখন কিছুই বলা যাবে না।
ধীরেশ তবু জিজ্ঞেস করল, ওখানে কি আমার বিচার হবে?
বলেছি, এখন কোনও কথাই বলা যাবে না। গাড়ি ঢুকছে, সরে আসুন।
ধীরেশ কয়েক পা সরে আসতে আসতে বলল, ভয় নেই, ঝাঁপিয়ে পড়ে ট্রেনের তলায় আত্মহত্যা করব না।
সুজিতের ঠোঁট বেঁকে উঠল, বলল, জানি আপনি তা করবেন না, আপনার জীবনের দাম, আপনার কাছে অনেকখানি।
ধীরেশ কী একটা কথা বলতে গিয়ে থেমে গেল, গাড়িটা এসে দাঁড়াল। সুজিত ধীরেশের দিকে চোখ রেখেই, গাড়ির দিকে উঠতে যাচ্ছিল, সুজিত বলে উঠল, ওখানে না, ডান দিকে ফার্স্ট ক্লাসে উঠুন, আমাদের টিকেট তা-ই আছে। খুলুন, দরজা খুলুন।
ধীরেশ ফার্স্ট ক্লাসের দরজা খুলল। সুজিত ধীরেশের গায়ে গা লাগিয়ে ঢুকল, যাতে সে ভিতর থেকে বন্ধ করে না দিতে পারে। চার বার্থের কামরা। দু দিকের সিটে, দুজন মাত্র যাত্রী। দুজনেই মধ্যবয়স্ক। একজনের পোশাক দেখে মনে হচ্ছে উকিল, আর একজন অফিসার হতে পারে। ধীরেশ একদিকে, জানালার পাশ ঘেঁষে বসল, সুজিত তার উলটো দিকে, প্রায় মুখোমুখি বসল। ফাস্টক্লাস বলেই, দুটো সিটের মাঝখানে অনেকখানি জায়গা। বেশি ফারাকের জন্য, কথা বলার অসুবিধা। অন্য দুজন যাত্রীর মধ্যে, উকিলের চোখ বোজা, তাকিয়ে দেখল, বাকি লোকটি ওদের দিকে একবার দেখে, টাই-এরনটে একবার হাত বুলিয়ে নিল। দৃষ্টি দেখলেই বোঝা যায়, ধীরেশ আর সুজিতকে প্রথম শ্রেণীর যাত্রী বলে মেনে নিতে যেন অসুবিধা বোধ করছে। এ ধরনের লোকগুলো একেবারে বাজে। সুজিত এদের সহ্য করতে পারে না।
গাড়ির কাচের জানালাগুলো সবই বন্ধ। বাইরের শব্দ বিশেষ আসছে না। কামরার ভিতরে আলোর তেমন জোর নেই। ধীরেশ সেই প্ল্যাটফরমে সিগারেট বের করেছিল, এতক্ষণে সেটা ধরাল। দুশ্চিন্তায় এত ডুবে গিয়েছে যে, কিছুই ঠিকমতো করতে পারছে না। এমনকী দুটো হাত, কোথায় কী ভাবে রাখবে, বা পা দুটো কীভাবে রাখলে সুবিধা হয়, তাও যেন ঠিক করতে পারছে না। তার ফরসা মুখটা এখন আরও ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। পাতলা চুল কপালের ওপর থেকে সরানো। এ কথা অস্বীকার করা যাবে না, ধীরেশের চেহারাটা বেশ ভালই, তথাকথিত নায়ক ভাব আছে এবং সে নিজেও সে বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন। এখন ওর বাজপাখির মতো চোখের কোণগুলো থেকে থেকে কুঁচকে উঠছে, আর চোয়াল দুটো মাঝে মাঝে নড়ছে।
হঠাৎ ধীরেশ কিছু একটা বলবে বলে মুখ তুলতেই, সুজিত অন্য দুজন যাত্রীর দিকে তাকাল। ধীরেশকে সে কথা বলতে বারণ করছে। কিন্তু ধীরেশ যেন বদ্ধপরিকর, বলল, আচ্ছা সুজিতবাবু, সকলের জীবনই কি নিজের কাছে দামি না?
সুজিত দেখল, অফিসার মতো লোকটি ধীরেশের দিকে তাকাল। সুজিত বুঝল, ধীরেশ ওকে একটু জব্দ করতে চায়। সুজিত মুখের ভাব স্বাভাবিক করে হাসল, বলল, না।
না?
হ্যাঁ।
সুজিত অফিসার লোকটির দিকে দ্রুত একবার চোখ বুলিয়ে নিল। এখন ও নিজেও মনে মনে দৃঢ় হয়ে উঠল, ধীরেশ যা জিজ্ঞেস করবে, সব কথারই জবাব দেবে। বাকি যাত্রী দুজন শুনুক, ক্ষতি কী। তারা ব্যাপারটা সব বুঝতেই পারবে না। কিন্তু ধীরেশ তাতে মুক্তি পাবে না।
ধীরেশ সুজিতের মুখের দিকে তাকিয়েছিল এখনও তার চোখে জিজ্ঞাসা। সুজিত শক্ত মুখে একটু হাসল, বলল, কেন, আপনি জানেন না নিজের জীবন তুচ্ছ করে অনেকে অনেক কাজ করেছে, অনেক মানুষ। সেরকম লোক কি আপনি আপনার জীবনে দেখেননি?
সুজিতের কঠিন দৃষ্টি থেকে ধীরেশ আস্তে আস্তে চোখ সরিয়ে নিল, হাতের তালু দিয়ে মুখ ঘষল। সুজিত আবার না বলে পারল না, তাদের আপনি আমার থেকে কম দেখেননি।
ধীরেশ বলল, এটা কি একটা রিঅ্যাকশনারি আইডিয়া নয় যে, মানুষ নিজের জীবনকে ভালবাসে না?
অফিসার লোকটি, খানিকটা অবুঝ কৌতূহলে, দুজনের দিকেই দেখতে লাগল। ধীরেশ তার বাজপাখি চোখের কোণ দিয়ে লোকটিকে একবার দেখে নিল। কিন্তু এতে কী লাভ ধীরেশের, কীসের সুযোগ খুঁজছে সে। সুজিত বলল, নিজের জীবনকে ভালবাসা, আর নিজের জীবনকে আর সকলের থেকে বেশি দামি মনে করার মধ্যে অনেক তফাত আছে। ক্ষুদিরামও নিজের জীবনকে ভালবাসতেন, কিন্তু তুচ্ছ জ্ঞান করতেও আটকায়নি। আপনার জানাশোনা দু-একজনের নামও আমি করতে পারি।
ধীরেশ বলল, কিন্তু থিয়োরির দিক থেকে
সুজিত বাধা দিয়ে জিজ্ঞেস করল, কীসের থিয়োরি?
ডায়লেকটিক।
সুজিত বলে উঠল, কোনও পলেটিকাল কথা আপনার সঙ্গে আমি আলোচনা করতে চাই না। অন্তত ডায়লেকটিকসের কথা আপনার সঙ্গে নয়।
ধীরেশ যেন একটু অবাক হল, চকিতে একবার অফিসার লোকটিকে দেখে নিল, বলল, কিন্তু পলেটিকান কারণেই কি আপনি আমাকে নিয়ে যাচ্ছেন না?
সুজিত বুঝতে পারছে, ধীরেশ কোনদিকে যেতে চাইছে। বোধহয় এটাই তার মরিয়া চেষ্টা, অফিসার লোকটিকে কৌতূহলিত করে তুলবে, তার অবস্থাটা বোঝাবে যে, তাকে কীভাবে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তারপরে লোকটির সাহায্যে একটা গোলমাল পাকাবে। কিন্তু ও ভুলে যাচ্ছে, আসল জিনিসটা সুজিতের হাতে এবং সেটা দেখিয়েই ওকে ঠাণ্ডা করা যাবে, বা অন্য লোকেরা যদি মাথা গলাতে আসে, তারাও ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। ধীরেশের ভিতরের অনেক দূর পর্যন্ত ভয়ের শিকড় নেমে গিয়েছে। ওকে নিয়ে বেশি ভাববার কোনও কারণ নেই। একটা মানুষ অবস্থার পাকে পড়ে, কত তাড়াতাড়ি বদলে যেতে পারে, ধীরেশ তার প্রমাণ। সুজিত হেসে উঠল, যদিও সেটা হাসি না, বলল, না, আপনি কোনও পলেটিকাল কারণেই আমার সঙ্গে যাচ্ছেন না।
গাড়িটা একটা স্টেশনে থামতে যাচ্ছে। ধীরেশ যেন উত্তেজিত হয়ে বলল, তবে কী কারণে?
সুজিত কঠিন চোখে তাকিয়ে বলল, সেটা আপনি গেলেই জানতে পারবেন।
অফিসার লোকটি উঠে দাঁড়াল, বলল, কই বাড়ুজ্জে মশাই, উঠুন, এসে পড়ল।
বাড়ুজ্জে টলতে টলতে উঠলেন, হালকা মদের গন্ধ পাওয়া গেল। ধীরেশ যেন ব্যস্ত সুরে বলে উঠল, এখনই বলুন না।
সুজিতের চাদরের ভিতরে, রিভলবারের অবয়বটা স্পষ্ট হয়ে উঠল, বলল, পরে শুনবেন, এখন চুপ করুন।
গাড়ি দাঁড়াল।ধীরেশ আবার কী বলবার জন্য মুখ তুলতেই, অফিসার লোকটি হেসে বলে উঠল, আপনাদের কথাবার্তা অদ্ভুত।
বলেই লোকটা নামল, পিছনে পিছনে বাড়ুজ্জে উকিল, টলতে টলতে। দরজাটা খোলাই রইল।
সুজিতের স্থির দৃষ্টি ধীরেশের দিকে, ধীরেশের খোলা দরজার দিকে। সুজিত উঠে দরজাটা বন্ধ করতে গেল এবং মুহূর্তের মধ্যে ফিরে দাঁড়াল। ওর ডান হাত চাদরের বাইরে, ধীরেশ উঠে দাঁড়িয়েছে। ধীরেশ শুকনো গলায় বলল, বাথরুমে যাব।
পরে যাবেন, বসুন।
গাড়িটা হুইসল দিয়ে ছাড়ল। ধীরেশ আস্তে আস্তে বসল। সুজিত দরজাটা বন্ধ করে ভিতর থেকে লক করল। অন্য দিকের দরজাটাও লক করল। এখন আর ডান হাতটাও চাদরের ভিতরে নিল না। মুখোমুখি বসে বলল, আপনার ভাগ্যই এমন, দুজনেই নেমে গেল। তাই বলছি, কোনওরকমে বাজে চেষ্টা আর করবেন না।
ধীরেশ রীতিমতো নম্র স্বরে বলল, না, আমি কোনও চেষ্টাই করছি না।
সুজিত ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল, বলল, দেখা যাক।
ধীরেশ হাত পা নিয়ে আবার ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সুজিতের দিকে চেয়ে বলল, আপনাকে আমি বরাবর খুব ঠাণ্ডা শান্ত লোক বলে জানতাম সুজিতবাবু। আপনার একটা সুইট পারসোনালিটি ছিল, অ্যান আরটিস্টিক।
সুজিত যেন আর শুনতে পারল না, বলে উঠল, সত্যি? কিন্তু আপনার জানার মধ্যে অনেক ভুল আছে ধীরেশবাবু। মানুষ জানাটা এত সহজ না।
ধীরেশ কয়েক সেকেন্ড চুপ করে সুজিতের দিকে চেয়ে রইল। বাজপাখির শিকলে বাঁধা পড়লে তার চোখ কেমন দেখতে হয়, সুজিত জানে না। কিন্তু ধীরেশের চোখের মধ্যে একটা অসহায় অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে। যেন ধারালো ঠোঁট দিয়ে পারলে শিকল কেটে ফেলত। ধীরেশ আবার মুখ খুলল, বলল, আচ্ছা আপনি বলছিলেন, পার্টির নির্দেশে আপনি আমাকে নিতে আসেননি, বিবেকের নির্দেশে এসেছেন, তার মানে কী?
তার মানে খুবই সহজ, যা বলেছি তা-ই।
কিন্তু পার্টির থেকে কি বিবেক বড়?
মানুষের বিবেকই পার্টি তৈরি করেছে।
ধীরেশ চুপ করল, মুখ নামিয়ে নিল। সিগারেট বের করল, ধরাবার আগে আবার জিজ্ঞেস করল, আপনি কি আমাকে লোকাল পার্টির কাছে নিয়ে যাচ্ছেন?
সুজিত বলল, গেলেই সব জানতে পারবেন।
কিন্তু আপনি তখন বলছিলেন, কোনও রাজনৈতিক কারণে আপনি আমাকে নিয়ে যাচ্ছেন না, তার মানে কী।
তার মানে, তা-ই, কোনও রাজনৈতিক কারণে না, খুব একটা সোজাসুজি নীতির কারণে।
সেটা কী?
গেলেই জানতে পারবেন।
ধীরেশ যেন একটা ক্লান্ত আর হতাশ ভঙ্গিতে, গদির মধ্যে হেলান দিয়ে ডুবে গেল। খানিকক্ষণ চোখ বুজে চুপ করে রইল। সিগারেট হাতে ধরা, জ্বালানো হয়নি। সুজিত দেখছে, এই সেই দুর্জয় ধীরেশ, যে নিজেকে সকলের থেকে চতুর, বুদ্ধিমান, পণ্ডিত, সাহসী মনে করত। কথা বলতে গেলে যার চোখে মুখে আগুন ছিটকে যেত, বিদ্রুপের কষাঘাতে সবাইকে ধরাশায়ী করে দিত। সে দুরন্ত, দুর্বার।
ধীরেশ সিগারেট ধরিয়ে আবার সোজা হয়ে বসল, বলল, কিন্তু সুজিতবাবু, এটা নিশ্চয় মানেন, ফরটি নাইনে, পার্টির ওপর মহল থেকেই আমাকে আপনাদের এলাকায় পাঠানো হয়েছিল।
সুজিত বলল, মানি।
জানি না, আপনাদের অঞ্চলে আমার কোনও ত্রুটি হয়েছে কি না, কিন্তু যা করেছি, পার্টির নির্দেশেই করেছি।
সুজিত শক্ত মুখে বলল, মিথ্যা কথা। পার্টির নির্দেশ, আর নিজের ক্ষমতার স্বেচ্ছাচারিতা, এক নয়।
আমি কি তা-ই করেছি?
সন্দেহ আছে আপনার? প্রমাণ অজস্র।
কী প্রমাণ বলুন। এক-আধটা মৃত্যু, প্রচুর অ্যারেস্ট, এ তো সব জায়গাতেই ঘটেছে।
ঘটেছে, কিন্তু সব জায়গার মধ্যে কোথাও কোথাও, অন্য ঘটনাও আছে। সেটাই আজ বোঝাঁপড়া হবে।
তা হলেই আবার পার্টির নির্দেশের কথা আসছে।
হ্যাঁ, যদি প্রমাণ করতে পারেন, পার্টির নির্দেশেই সব কিছু করেছেন।
সুজিতের সমস্ত মুখটাই যেন দপদপ করে জ্বলছে। আবার বলল, এই মুহূর্তেই, আপনাকে একটা কথা আমি জিজ্ঞেস করব, সত্যি জবাব দিতে পারবেন?
বলুন।
সুজিত রিভলবারটা দেখিয়ে বলল, চেনেন, দেখেছেন এটা কখনও?
ধীরেশের স্বরটা যেন ঘষে গিয়েছে, এইভাবে বলল, ঠিক মনে করতে পারছি না।
সুজিত হাসল, বলল, জানি, মনে করতে পারবেন না। এটা আপনি যাকে দেড়শো টাকায় বিক্রি করে এসেছিলেন, সেই শেখ আখতার রসুল এটা আমাকে দিয়েছে।
ধীরেশের চোখের ওপরে যেন একটা ঘষা কাঁচ নেমে এসেছে, যেন কিছুই দেখতে পাচ্ছে না, আলো। নেই তার চোখে। সে চুপ করে রইল। সুজিত আবার বলল, কোন পার্টির নির্দেশে, কোথা থেকে এটা আপনি আমাদের অঞ্চলে আমদানি করেছিলেন, জানতে পারি?
ধীরেশ খসকা গলায় বলল, এটা আত্মরক্ষার জন্য আমি
আপনার আত্মরক্ষার জন্য, কারণ, এলাকার সব মেম্বারের থেকে আপনার জীবন অনেক বড়। কিন্তু কার নির্দেশে? পার্টির?
ধীরেশ চুপ করে রইল। সুজিত বলল, সেই জন্যই ভেবে দেখতে হবে, আপনি দক্ষিণপন্থী সরকারের এজেন্ট কি না, কিংবা আরও গভীর কিছু।
ধীরেশের সমস্ত শরীরটাই যেন ঢেউয়ের ধাক্কায় দুলে উঠল, বলল, না না, বিশ্বাস করুন, ওসবের মধ্যে আমি ছিলাম না।
সুজিত বলল, সেটা বিচার সাপেক্ষ। আমাদের হাতে প্রমাণ আছে, কলকাতার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাবাজদের সঙ্গে আপনার যোগাযোগ ছিল, তাদের কাছ থেকেই আপনি এটা আমদানি করেছিলেন।
ধীরেশ চুপ করল, চুপ করে, এক পাশে কাত হয়ে বসে রইল। সুজিতও কোনও কথা বলল না।
.
এই মুহূর্তে ওকে কেমন যেন অন্যমনস্ক দেখাতে লাগল। ওর চোখের সামনে উনপঞ্চাশ সালের দিনগুলো ভাসছে, সেই সঙ্গে অনেক মুখ, অনেক পুরুষ আর মেয়ে। বিশেষ করে একজনের মুখ। একটি মুখ, ওর নেতার মুখ, একটি দুঃখিনী বিধবা মায়ের ছেলের মুখ, হাজার হাজার শ্রমিকের নেতার মুখ, নিষ্পাপ স্বপ্নিল কিন্তু শক্ত। কত সাল হবে সেটা, বোধ হয় উনিশশো বিয়াল্লিশ, আগস্টের পরে। সিলকের পাঞ্জাবি, কাঁচির ধুতি ধুলায় ললাটে, হাতে সিগারেটের টিন, এক যুবক। সুজিতের থেকে দু-এক বছরের বড় হতে পারে। পরিচয় কী? বড় চাকরি করে, শিক্ষিত, অত্যন্ত সামাজিক আর মিশুকে, সবাই ভালবাসে, নাম ধ্রুব। বাড়ি পূর্ববঙ্গে, এই মফস্বল শহরে নতুন এসেছে। শহর কি পুরোপুরি বলা চলে? যেন চলে না। কলকারখানা, শ্রমিক বস্তি অঞ্চল বাদ দিলে, নিটোল একটা বাঙালি গ্রামের ছাপ ছিল। বাগদিপাড়া, নিকিরি চুনুরি মালোপাড়া,বামুনপাড়া, সদগোপপাড়া, জাত্যাভিমান, গ্রাম্য বিবাদ, জ্ঞাতি বিরোধ, দলাদলি, বিজলি বাতি, বাঁধানো রাস্তা, পুকুর ডোবা, রেল লাইনের ওপারে দুরবিস্তৃত ধানখেত, বিল, সব মিলিয়ে আধা গ্রাম, আধা শহর ভাব।
ধ্রুবকে কলকাতা ছেড়ে এখানে আসতে হয়েছিল চাকরির কারণে। ছমাসের জন্য, একটা বণিক কোম্পানির কারখানায় তাকে বিশেষ কাজে বদলি করা হয়েছিল। আধা শহরের বাসিন্দাদের মন গ্রামীণ লোকদের মতোই সন্দেহপ্রবণ, অচেনাকে অবিশ্বাসী সংশয়ের চোখে দেখে। তার ওপরে ধ্রুব পূর্ববঙ্গের ছেলে, বাঙাল! আস্তানা মেলা কঠিন, বিশেষত সেই বিয়াল্লিশের যুগে। কিন্তু ধ্রুবর বাসা জুটতে দেরি হয়নি, প্রীতি ভালবাসা জুটতেও না। বিশেষ করে যুবকদের প্রিয়পাত্র হতে দেরি হয়নি। ছাত্র কেরানি মজুর, সবরকম যুবকদের সঙ্গে তার মেলামেশা, লাইব্রেরি থেকে যাত্রার আজ্ঞা, সবখানে ধ্রুব। সুজিত তখন একটা কেন্দ্রীয় কারখানায় কাজ করে, ওর সঙ্গে আলাপ হতে দেরি হয়নি। এর সঙ্গে আর একটা যোগাযোগ, একটা ইঙ্গিতকে স্পষ্ট করে তুলছিল, তার ঘরে কাস্তে হাতুড়ি ছাপা বই। একটা যেন ভয়ংকর বিপজ্জনক লাল চিহ্ন। পার্টির জেলা সেক্রেটারি নিমাই চৌধুরী তার বন্ধু। কলকাতা থেকে এই শ্রমিকাঞ্চলে তার আনাগোনা।
তিন মাসের মধ্যেই সুজিত দেখেছিল, কোম্পানির থেকে, কোম্পানির মজুর মিস্তিরিদের নিয়ে ধ্রুব বেশি চিন্তিত, মেলামেশা বেশি। হাতে আর সিগারেটের টিন ছিল না, পার্টির কাগজ তার বদলে। লুটানো ধুতির ভাঁজ আর ঝলক ক্রমে হারাচ্ছিল, সিলক পাঞ্জাবি ছেঁড়া, কারণ এতটা আত্মসেবার সময় নেই। পাঁচ মাস পড়তেই দেখা গিয়েছিল, ধ্রুব নিজেই শ্রমিকদের এক বিরাট মিছিল নিয়ে চলেছে। আলুগুদামের দিকে, কলকাতায়। আলুগুদামআগোডাম পর্তুগিজ শব্দ, যার মানে হেড অফিস। কলকাতার হেড অফিস কতটা স্তম্ভিত হয়েছিল বলা যায় না, ইওর সার্ভিস ইজ নো লঙ্গার রিকোয়ার্ড চিঠিটা হাতে হাতেই ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
কিন্তু এই একটি ঘটনাই অনেক পরিবর্তনের সূচনা করেছিল। আধা শহরের বয়স্ক আর রক্ষণশীলেরা সকলেই ভীষণ ভয় পেয়েছিল। ধ্রুবকে তাড়াবার জন্যে সকলেই উঠে পড়ে লেগেছিল। অথচ তাদের ছেলেরা তখন নতুন করে ধ্রুবকে দেখছে। ধ্রুবর বুকের আগুন তখন ওদের বুকেও ধিকিধিকি জ্বলছে। অতএব, এবাড়ি ওবাড়ি, ধ্রুবর বাড়ি। এঘর ওঘর, ধ্রুবর ঘর। এর খাওয়া তার খাওয়া, এর কাপড় তার কাপড়, ধ্রুবর খাওয়া পরা।
সেই সময় ধ্রুবর মা একবার এসেছিলেন ছেলের সঙ্গে দেখা করতে। সেই দিনটিতে, সেই সময়ে, সুজিত সামনে ছিল। মা আর ছেলের মুখ দেখতে একরকম। ধ্রুবর প্রথম মুখের ভাবটা ছিল, দুষ্টুমি করে মায়ের কাছে ধরা পড়া ছেলের মতো। ওর মা কিন্তু বেশি কথা বলেননি। পূর্ব বাংলার টানে বলেছিলেন, তোর ওপরে আমার নির্ভর নেই, আমার দিন একরকম চলে যাবে, সেটুকু সঙ্গতি আছে। কিন্তু তোর সারাটা জীবন?
কথা শেষ করতে পারেননি, গলার কাছে আটকে গিয়েছিল। শেষ কথা বলে গিয়েছিলেন, এটা তোদের রক্তের মধ্যেই আছে, তোদের বংশের রক্তে।
সুজিতের মনে হয়েছিল, ধ্রুবর মধ্যেও যেন সেই ভারতীয় ঐতিহ্যের পরিচয়, সুখ ঐশ্বর্য ছেড়ে পথে নেমে আসা। ধ্রুবর মুখে সুজিত শুনেছিল, রাজনৈতিক কারণে, ওর বাবা সারাটা জীবন ব্রিটিশ পুলিশের তাড়া খেয়ে ছুটে বেড়িয়েছে। ওর ঠাকুরদার পাঁচ বছর জেলে কেটেছে। সেই জন্যই ওর মা রক্তের কথা বলেছিলেন। সেই অঞ্চলে, ধ্রুব প্রথম কাজ হিসাবে বেছে নিয়েছিল, একটা শ্রমিক ইউনিয়ন গঠন করা, যেটা প্রবল বাধায়, কখনও সম্ভব হয়নি। উনিশশো সাতাশে কারখানাগুলোর ধর্মঘটে যে মহিলা নেতৃত্ব করেছিলেন, তিনি দুহাতে পয়সা ছড়িয়েছিলেন মজুরদের মধ্যে। তাঁকে সবাই মাইজি বলত। কিন্তু অনেকেই জানত, সাতাশের ধর্মঘট আসলে, কোম্পানিগুলোর ভিতরের দুরবস্থার দরুন, তারা তখন ধর্মঘট চেয়েছিল, আর ধর্মঘটকে জিইয়ে রাখার জন্য মাইজির হাতে অগাধ পয়সাও দিয়েছিল। এদের কথা আলাদা। কিন্তু সর্বভারতীয় অনেক বড় বড় ট্রেড ইউনিয়ন লিডারও সেই অঞ্চলে একটা নিয়মিত ইউনিয়ন গঠন করতে পারেননি। নানাভাবে তাদের তাড়ানো হয়েছে। ধ্রুব সেই দায়িত্ব তুলে নিয়েছিল নিজের কাঁধে।
সহজে সে কাজ হয়নি। প্রচণ্ড বাধা, প্রতিদিন দাঙ্গাহাঙ্গামা, রোজ পুলিশের হামলা, আর কুখ্যাত খলিফা গুণ্ডাদের সন্ত্রাস, পদে পদে গোলমাল করেছে। ধ্রুব অটল, ওর নতুন গড়ে তোলা দলও অটল। সুজিত তখন ওর নেতার প্রতিটি কাজের সঙ্গী, নির্দেশের অপেক্ষায়। সুজিতের এখনও মনে আছে, ছেচল্লিশের সেই প্রচণ্ড গোলমালের দিনগুলোর কথা। ছেচল্লিশে, কারখানাগুলোতে রাজনৈতিক আন্দোলনের ঢেউ লেগেছিল, গভর্নমেন্টের কাছে যেটা আরও ভয়ের কথা। লাঠি গুলি টিয়ারগ্যাসিং, সবরকম আক্রমণের মুখোমুখি তখন শ্রমিকেরাও। সেই সময়েই, একটা কারখানার দারোয়ানেরা পিটিয়ে মেরে ফেলল, দু জন শ্রমিককে।
তখনকার চটকলগুলোতে ছিল ফিউডাল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন। জন কয়েক অশিক্ষিত স্কচ গোরা, তাদের গুটিকয় কালা অনুচর আর দুর্ধর্ষ গুণ্ডা প্রকৃতির কয়েকজন সর্দার, তারাই হাজার হাজার মানুষের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। সেই সময় ধ্রুব খালি একটি কথা বলল, এই কারখানা লোপাট করে দাও, গঙ্গায় ফেলে দাও।
তা-ই করেছিল শ্রমিকেরা। সম্পূর্ণ না হোক, সেই কারখানার এক-তৃতীয়াংশ উপড়ে গঙ্গায় ফেলে দিয়েছিল, দারোয়ান সর্দারেরা পালিয়েছিল, সাহেবরা কুঠিতে জুজুবুড়ির মতো লুকিয়েছিল, মেমসাহেবরা জানলা দিয়ে মুখ বের করে, হাত জোড় করে কেঁদেছিল। ধ্রুব নিজে দাঁড়িয়ে রাগে আর ঘৃণায় সেই বিক্ষোভ পরিচালনা করেছিল! এখনও সেই মুখটা সুজিতের মনে পড়ে, জ্বলন্ত অঙ্গার কেটে তৈরি করা সেই মুখ। ম্যানেজারের কুঠির উঠোনে গিয়ে তাকে ডাকা হয়েছিল। প্রাণের ভয়ে আসতে চায়নি। ধ্রুব তাকে আশ্বাস দিয়েছিল, তুমি অক্ষত থাকবে, কিন্তু বেরিয়ে এসে এই হাজার লোকের সামনে অঙ্গীকার করে সমস্ত দারোয়ানের চাকরি যাবে, মৃত দুইজন শ্রমিকের পরিবারের সমস্ত ভরণপোষণের দায়িত্ব তোমরা নেবে, এমন ঘটনা কারখানায় আর ঘটবে না। তোমার প্রাণের দায় আমার।
সাহেব বেরিয়ে এসেছিল হাজার হাজার শ্রমিকের মধ্যে, তখন তাকে ভয়ে কাঁদতে দেখা গিয়েছিল। সে অঙ্গীকারও করেছিল, কিন্তু হঠাৎ একটা পাথরের টুকরো সাহেবের গায়ে এসে পড়েছিল। সুজিত ছুটে গিয়ে সাহেবকে আড়াল করে দাঁড়িয়েছিল। চিৎকার করে জিজ্ঞেস করেছিল, কে, কে মেরেছে?
সমস্ত বিক্ষুব্ধ মানুষগুলোই যেন এক মুহূর্তের জন্য লজ্জিত হয়ে পড়েছিল, মাথা নিচু করে চুপ করেছিল। আর চ্যাপটা নাক, খোবলানো মুখ, খালি গা একজন শ্রমিক বলে উঠেছিল, আমি মেরেছি, ম্যানেজারকে আমি সহ্য করতে পারছি না।
ধ্রুব বলেছিল, আমিও পারছি না। কিন্তু আমি বলেছিলাম, ওর প্রাণের দায় আমার। তার মানে, তোমাদেরও। কথার খেলাপ করবে তা হলে?
শ্রমিকটি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েছিল। ধ্রুব ম্যানেজারকে বলেছিল, আমি দুঃখিত, তোমার যা বলবার আছে, বলল।
বলে নিজেই কাগজ কলম নিয়ে, ম্যানেজারের সমস্ত কথা লিখেছিল, তারপরে সেই কাগজ আর কলম এগিয়ে দিয়ে বলেছিল, সই করে দাও।
ম্যানেজার সই করে দিয়েছিল। ছেচল্লিশের সেই দিনে, সুজিত পৃথিবীর বহু ঘটনার, অনেক নায়কের সঙ্গে ধ্রুবকে মিশে যেতে দেখেছিল। তারপর এসেছিল উনিশশো ঊনপঞ্চাশ। একদিকে চরম বামপন্থী নীতি, ফলে সংগ্রামে বিচ্যুতি এবং নিষেধাজ্ঞা, আর একদিকে জাতীয় দক্ষিণপন্থী সরকারের প্রচণ্ড দমননীতি। সেই সময়ে ধ্রুবকে খানিকটা বিব্রত আর দিশেহারা মনে হয়েছিল। যেন অবস্থার সঙ্গে,নীতি আর কৌশল মেলাতে পারছিল না। নিষেধাজ্ঞার সঙ্গে সঙ্গেই অঞ্চলে প্রথম গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছিল তার নামে। পার্টির নির্দেশে, তার আগেই সে আত্মগোপন করেছিল। পার্টির সমস্ত যন্ত্রই তখন আন্ডারগ্রাউন্ডে। যারা বাইরে ছিল অথচ আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টির সঙ্গে যোগাযোগ রাখত, সুজিত তার মধ্যে একজন। জেলা সেক্রেটারি নিমাই চৌধুরী আর ধ্রুব, দুজনের সঙ্গে প্রায়ই ওকে দেখা করতে হত, সংগ্রাম কমিটির কাছে নির্দেশ পৌঁছে দিতে হত, কিন্তু কখনও এক জায়গায় নয়। তখন ধ্রুব আর চৌধুরী, দুজনকেই একরকম মনে হত, খানিকটা বিভ্রান্ত দিশেহারা, অথচ প্রতিটি নির্দেশ তারা কড়ায় গণ্ডায় মানত, সেই অনুযায়ী কাজ করত। সেই সময়ে এল এই ধীরেশ।
ধীরেশ একলা নয়, সঙ্গে আর একজন, তার নাম নিখিল। ধ্রুব আর চৌধুরীকে এদের নির্দেশেই কাজ করতে বলা হয়েছিল।
.
সুজিত চকিতে উঠে দাঁড়াল, হাতের অস্ত্র উদ্যত। ওর গায়ের ওপর ছায়াটাই, সংবিৎ ফিরিয়ে দিল। দেখল, ধীরেশ ওর দেড় হাত দূরে এসে দাঁড়িয়েছে। ধীরেশের দিকে তাকাতেই দেখল, তার চোখে যেন আলো ঝলকে উঠেছে। এক মুহূর্ত, ধীরেশের চোখের ঝলক নিভে গেল। সুজিতের নিশ্বাস প্রায় বন্ধ, জিজ্ঞেস করল, কী চাই।
ধীরেশ পাশ ফিরে জানালার দিকে হাত বাড়িয়ে যেন দমবন্ধ নিচু স্বরে বলল, কিছু না, বড় গরম লাগছে তাই জানালা খুলে দেব।
সুজিত কঠিন গলায় বলল, দরকার নেই, বাইরে বেশ ঠাণ্ডা আছে, বসুন।
ধীরেশ ফিরে গিয়ে ওর জায়গায় বসল। সুজিতের মনে হল, সত্যি যেন তার মুখে ঘাম, অবসন্ন আর হতাশ দেখাচ্ছে। কিন্তু তা নয়, আসলে ধীরেশ কয়েক মুহূর্তের উত্তেজনায় ঘামছে। সুজিতের অন্যমনস্কতার ফাঁকে, একটা সুযোগ নিতে চেয়েছিল, তারই উত্তেজনায় গরম লাগছে, গলায় স্বর ফুটতে চাইছে না এবং এখন সে পরাজিত। গায়ের ওপর ছায়াটাই, ধীরেশের সঙ্গে শত্রুতা করেছে। সুজিত নিজেকে স্থির করল, আর যেন অন্যমনস্ক না হয়। ও দেখতে পাচ্ছে, ধীরেশের ভুরুর নীচের ছায়ায় ঢাকা চোখ দুটো, ওর দিকেই নিবদ্ধ। বোধহয় ভাবছে, আস্তে নিঃসাড়ে কিছু না করে, ঝাঁপিয়ে পড়লেই ভাল হত। কিন্তু সুজিতের আঙুল ট্রিগারেই ছিল। একমাত্র পরিণতি ছিল, ধীরেশের মৃত শরীরটা চলন্ত ট্রেন থেকে ফেলে দেওয়া। যদিও, সত্যি কি তাই ঘটত? সুজিত রিভলবারটার দিকে একবার তাকিয়ে দেখল। আবার ধীরেশের দিকে।
ধীরেশ আবার কথা বলল, আপনারা সবাই মিলে বিচার করে যদি আমাকে কোনও শাস্তি দিতে চান, আমার কিছু বলবার নেই, কিন্তু।
ধীরেশ একটু থামল, তারপরে আবার বলল, এই রিভলবারের ব্যাপারটা ছাড়া আমি সবই পার্টির নির্দেশে করেছি।
সুজিতের ঠোঁটের কোণ বেঁকে উঠল, বিদ্রুপে ঢেউ দিয়ে বলল, সত্যি?
সত্যি, বিশ্বাস করুন।
সুজিতের হেসে উঠতে ইচ্ছা করল, কিন্তু এরকম একজন মিথ্যাবাদীর সামনে সে ইচ্ছাও ওর হল না। ও শক্ত মুখে ধীরেশের চোখে চোখ রেখে বলল, আপনার সঙ্গে এসব কথা আলোচনা করবার ইচ্ছা আমার ছিল না, কিন্তু বারে বারেই আপনি পার্টি নির্দেশের কথা বলছেন, তাই কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করছি, জবাব দেবেন?
ধীরেশ ঘাড় কাত করে বলল, দেব।
বলুন তো, এটা কি পার্টির নির্দেশে ঘটেছে, একটা অঞ্চলের পার্টির ছেলে বুড়ো মেয়ে সবাই অ্যারেস্ট হয়ে যায়, কেউ জখম হয়, খুন হয়। আর নির্বিবাদে সেখান থেকে নিরাপদ আশ্রয়ে মাত্র দুজন ফিরে যায়, একজন ধীরেশ, আর একজন নিখিল।
ধীরেশ এক মুহূর্ত চুপ করে রইল, তারপরে বলল, ভেবে দেখুন, তখনকার যা অবস্থা, সব অঞ্চলেই সেরকম ঘটেনি কি?
একটু কি বিশেষত্ব ছিল না? শুধু দুজন ছাড়া একটা লোক জেলের বাইরে ছিল না। আপনি আর নিখিল।
তিনজন মহিলা সভ্য।
সুজিত বাধা দিয়ে বলে উঠল, সে কথাও আমিই জিজ্ঞস করব আপনাকে। রমলা, তৃপ্তি, নমিতা তিনজন বাইরে ছিল। রমলার কাছ থেকে নগদ তিনশো টাকা আর সোনার হার নিয়েছিলেন, পার্টির নির্দেশ? পার্টি জানে?
ধীরেশ থতিয়ে গেল, অবাক হয়ে তাকাল সুজিতের দিকে। সুজিত বলল, চুপ করে রইলেন কেন। ভেবেছিলেন, রমলা আপনার প্রেমের মর্যাদা রক্ষা করতে, চিরদিন সে কথা গোপন রাখবে। তৃপ্তি আর তার স্বামী নরেন আজও আপনাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। নরেন জেলে চলে যাবার পরে, সেই বাড়িতে আপনি আশ্রয় নিয়েছিলেন, আর তৃপ্তিকে বুঝিয়েছিলেন, তার স্বামী একজন দক্ষিণপন্থী বিচ্যুত লোক, আর কী সব করেছিলেন, সেসব আলোচনায় যেতে চাই না। গরিব একটা মিস্তিরির বউ নমিতা, তার কাছ থেকেও সাতাত্তর টাকা নিয়েছেন আপনি।
ধীরেশ বারে বারে কিছু বলতে চাইছিল, সুজিতের জিজ্ঞাসার তোড়ে পারছিল না। সুজিত থামতেই বলল, কিন্তু এর মধ্যে খারাপ কিছু ছিল না, বিশ্বাস করুন। ওইসব টাকা আমি মজুরদের জন্য।
সুজিত তীব্র গলায় বলে উঠল, কোনও প্রমাণ আছে, লেখাজোখা হিসাবপত্র?
তখন একটা অন্যরকম অবস্থা, কাগজ রাখা যেত না।
সুজিত বলল, বুঝেছি, কিন্তু এর কোনওটাই পার্টির নির্দেশে হয়নি। তা ছাড়া ওরকম একটা বিচ্যুতির সময়, এ ধরনের বিকৃতিটাই বোধ হয় স্বাভাবিক, বিশেষ আপনার মতো লোকের পক্ষে। সেজন্য এসব আলোচনায় আমি যেতে চাই না। নিমাই চৌধুরীর অ্যারেস্টের ঘটনা কী। কুড়িজন লোকের একটা মিছিলে, চৌধুরীকে আপনি কড়া নির্দেশ দিয়েছিলেন, যাবার জন্য। আর মিছিলের রুটটাও ঠিক করেছিলেন আপনি। চৌধুরীকেই যেতে হবে সেই মিছিলে, এরকম কোনও নির্দেশ কি আপনাকে পার্টি দিয়েছিল?
ধীরেশ বলল, তা দেয়নি, কিন্তু একজন নেতৃস্থানীয় লোকের যাওয়া উচিত ছিল সেই মিছিলে, যাতে অপরেরা সাহস পায়।
তার জন্য আপনি নিমাই চৌধুরীর মতো লোককেই ঠেলে দিয়েছিলেন, চব্বিশ পরগনায় যারা পার্টি গড়ে তুলেছিল, তাদেরই একজনকে। আর জেনেশুনে, চৌধুরী অ্যারেস্ট হবেই।
তা কেন?
আপনার নির্দিষ্ট রুট। এমন রাস্তা দিয়ে মিছিলে নিয়ে যাবার ঠিক করেছিলেন, যার আধ মাইল জায়গা, দু পাশে কেবল কারখানার পাঁচিল, পুলিশ এলে কোনওদিকে যাবার পথ নেই। আপনাকে বলা হয়েছিল, রুট চেঞ্জ করতে। তার জবাবে আপনি কী বলেছিলেন, আমার এখনও মনে আছে, কোনও কাপুরুষের কথায় আমি রুট চেঞ্জ করব না। সবাই কাপুরুষ, আপনি সাহসী। আর এমনই একটা সময় আর পরিস্থিতি, আপনার মেকি বিপ্লবীয়ানার সামনে সবাই চুপ। আসলে, পার্টির মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব কেউ চায়নি, তা-ই আর প্রতিবাদ করা হয়নি। কিন্তু সেই দুই দেওয়ালের মাঝখানেই, চৌধুরী ধরা পড়েছিল। পিছন থেকে পুলিশের গাড়ি আসছিলই, দেওয়ালের পথের মাঝামাঝি, সামনে থেকেও হঠাৎ পুলিশের গাড়ি তেড়ে এসেছিল, আর সবাইকে ছত্রভঙ্গ করে দিয়ে মাত্র দুজন লোককে সে দিন পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছিল। চৌধুরী আর নরেন মিস্তিরিকে। সেই রুট কি আপনাকে পার্টি নির্দেশ করে দিয়েছিল?
ধীরেশ হঠাৎ কোনও কথা বলতে পারল না। সুজিতের চোখ জ্বলতে লাগল। ধীরেশ যেন ভেঙে পড়া স্বরে বলল, কিন্তু আমি শুধু এলাকার কথাই মনে রেখেছিলাম, আমাদের একটা মিছিল যাতে ওই এলাকাটা প্রদক্ষিণ করে। কিন্তু কিন্তু আপনি কি আমাকে স্পাই ভাবছেন?
সেটা বিবেচ্য, কিন্তু পার্টির নির্দেশেই সব করেছেন, বলছিলেন কিনা, তা-ই।
এই সময়ে গাড়িটা দুলে উঠে দাঁড়াল। সুজিত উঠে দাঁড়াল। বলল, চলুন, দরজাটা খুলুন।
সুজিত গাড়িটার লাইন চেঞ্জ করা থেকেই বুঝতে পারে, ওদের স্টেশন এল। ধীরেশ উঠে দরজার কাছে গেল। ইন্টারলক খুলে হাত ঘুরিয়ে নামাবার আগে, প্ল্যাটফরমের দিকে একবার দেখে নিল। সুজিত এখন তার পিঠের কাছে। বলল, চলুন।
তেমন একটা ভিড় নেই প্ল্যাটফরমে। শীতের রাত বলেই ভিড় কম। ডেইলি প্যাসেঞ্জাররা যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে গিয়েছে। উত্তর দিক থেকে বাতাস ছাড়তে আরম্ভ করেছে। এঞ্জিনের ধোঁয়া প্ল্যাটফরমটাকে ঢেকে ফেলতে চাইছে। আরও যেন অন্ধকারে ঢেকে দিচ্ছে। সুজিত দুটো টিকেট দিল গেটে। স্টেশনের বাইরের চেহারাটা বেশি আলোকিত। দোকানপাটগুলো এখনও সবই ভোলা। রিকশাওয়ালারা ভেঁপু বাজিয়ে আর চিৎকার করে, আবহাওয়াটা সরগরম করে তুলল। ধীরেশ নেমেই, মানুষের ভিড়ের মধ্যে চলতে লাগল। সুজিত তার পিছনে পিছনে। বাইরে এসে বলল, বাঁ দিকে চলুন।
ধীরেশ খানিকটা না শোনার মতো করে, চলতেই লাগল। সুজিতের মুখ শক্ত হয়ে উঠল। ডান হাত চাদরে ঢাকা। ও ঠিক করেই নিল, যে কোনও গোলমালের মুখোমুখি হওয়া ছাড়া উপায় নেই। ও ধীরেশের জামা চেপে ধরল, কিন্তু স্বাভাবিক গলায় বলল, বাঁ দিকে চলুন।
কয়েকজন লোক ওদের দিকে তাকাল। সারাদিনের খাটুনিতে ক্লান্ত, কাজ সেরে বাড়ি ফেরা মানুষের দল। বাইরের ব্যাপারে কারোরই তেমন কৌতূহল নেই। ধীরেশ সেটা জাগিয়ে তুলে একটা গোলমাল লাগিয়ে দিতে পারে। কিন্তু সুজিতের মুখের দিকে চেয়ে বলল, ও, বাঁ দিকে? চলুন।
কয়েক পা যেতেই, সারি সারি রিকশাওয়ালাদের মধ্যে থেকে দুজন হাত তুলে বলে উঠল, সুজিতদা, আমরা এখানে।
সুজিত থমকে দাঁড়াল, বলল, দাঁড়ান।
ধীরেশ দাঁড়াল। সুজিত দুজনকেই ডাকল। ওরা রিকশা নিয়ে আসতে, সুজিত সামনের রিকশাটা দেখিয়ে ধীরেশকে বলল, সামনেরটায় উঠুন।
ধীরেশ জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাচ্ছি? পার্টি অফিসে?
সুজিত বলল, গেলেই দেখতে পাবেন, আপনার অচেনা জায়গা না।
ধীরেশ যেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে আগের রিকশায় উঠল। সুজিত বলল, জলিল, যেখানে যাবার কথা, সেখানে চলো। আমি পিছনে বিমলের রিকশায় আছি।
সামনের রিকশাওয়ালা বলল, বহুত আচ্ছা।
দুটো রিকশা প্রায় গায়ে গায়ে চলল। সুজিত ধীরেশের মাথা থেকে পিঠের খানিকটা অংশ দেখতে পাচ্ছে। জলিল আর বিমলকে আগেই বলা ছিল। গন্তব্য ওদের বলা আছে, এবং এ কথাও জানানো আছে, ওরা যেন সাবধান থাকে, যে-লোকটা সুজিতের সঙ্গে যাবে, সে যেন কোনওরকমেই সুজিতের কাছ থেকে বেশি দূরে না যায়। রাস্তাটা ক্রমেই অন্ধকার হয়ে এল। এখন আর বিশেষ দোকানপাট নেই, কেবল কারখানা। কখনও কখনও বস্তি। দোকানগুলো প্রায় সবই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, বা গিয়েছে। সুজিত জানে, এ সমস্ত জায়গাই ধীরেশের নখদর্পণে।
প্রায় মাইলখানেক উত্তর দিকে যাবার পরে, রিকশা বাঁ দিকে মোড় নিল। রাস্তাটা ফাঁকা, দু পাশে জংলা মাঠ, দু-চারটে ছোটখাটো চালাঘর রাস্তার সামনে। দূরে লাল আলো দেখা যাচ্ছে। তার আগে, একটি মাত্র ইলেকট্রিকের টিমটিমে আলো। রিকশা কাছে যাবার পরে বোঝা যায়, রেলওয়ে গেটের লাল আলোটা জ্বলছে। গেট বন্ধ। সামনে উত্তর দক্ষিণে রেললাইন। সামনের রিকশা থেকে জলিল ডাকল, হোই সাতচল্লিশ নম্বর চাচা, দরজা খোল।
বলে ভেঁপু বাজাতে লাগল ঘন ঘন। সুজিত রিকশা থেকে নেমে ধীরেশের কাছাকাছি এসে দাঁড়াল। ধীরেশ মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করল, এটা সাতচল্লিশ নম্বর গেট না?
হ্যাঁ।
ওপারেই তো কাঁকির গ্রাম।
আপনার অন্তত সেটা ভোলা উচিত না।
ধীরেশ এক মুহূর্ত চুপ করে রইল। ইতিমধ্যে গেটম্যানের জবাব পাওয়া গেল, আরে ভাতিজা চুপ রহ বেটা, খুলতানি।
জলিল বলল, চাচাকো দোয়া।
ধীরেশ বলে উঠল, কিন্তু পার্টি অফিস তো এখানে না।
আপনাকে তো আমি একবারও বলিনি, পার্টি অফিসে যাব।
তবে এখানে কোথায় যাচ্ছেন?
ধীরেশ, কথায় কথায় যার জীবনমৃত্যুভয়হীন ব্যঙ্গবিদ্রূপ ফুটে উঠত, সকলকেই যে দেখত ভীরু আর কাপুরুষ হিসাবে, তার গলায় উদ্বেগ এবার স্পষ্ট হয়ে উঠল। হয়তো এই শীতে সে ঘামছে, সুজিত দেখতে পাচ্ছে না, অনুমান করতে পারছে। বলল, গেলেই দেখতে পাবেন।
ইতিমধ্যে গেটটা খোলা হয়ে যায়। সুজিত রেল লাইনের ওপর ধীরেশের রিকশার পাশে হেঁটে পার হল। গেটম্যান জানতে চাইল, রিকশা দুটোর ফিরতে কতক্ষণ লাগবে। বিমল জানিয়ে দিল, আধ ঘণ্টার মধ্যেই ফিরে আসবে।
ধীরেশ আবার কথা বলল। এবার তার গলায় হতাশা আর উদ্বেগ একসঙ্গে ফুটে উঠল, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না, এভাবে আপনি কী করতে চান আমাকে।
সুজিত সে কথার কোনও জবাব না দিয়ে বিমলের রিকশায় উঠে বসল। রেল লাইন পার হবার পরেই সমস্ত পরিবেশ বদলে গেল। অন্ধকার আরও গাঢ় হল। দু পাশে কোথাও জলাশয়, কোথাও বাবলা বা আশশ্যাওড়া বা নিশিন্দার জঙ্গল। তার আড়ালে দুপাশে মাঠ। আমন ধান মাঠে, কোথাও কোথাও কাটা শুরু হয়ে গিয়েছে। কাঁচা মাটির রাস্তা বটে, শীতের সময়ে কাদা নেই, ধুলা আছে, কিন্তু রিকশা যাবার অসুবিধা নেই।
প্রায় দশ মিনিট রিকশা চলার পরে, একটা কালভার্ট পার হয়ে গ্রামের চেহারাটা স্পষ্ট হয়ে উঠল। অন্ধকারের মধ্যে গাছপালার আড়ালে, দু-একটা আবছা চালাঘর দেখা যায়। ডান দিকে, রাস্তার ধারেই একটা টালির দোচালা বড় ঘর। দোকানঘর, ইতিমধ্যেই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সুজিতকে কিছু বলতে হল না, বাঁ দিকের একটা গাম্বিল গাছের অন্ধকার তলায়, দুটো রিকশাই দাঁড়াল। এদিকটায় কোনও ঘর চোখে পড়ে না, কেবল ফণীমনসার বেড়া।
সুজিত নেমে এল, আর তখনই বাঁ দিকে, দু-পাশে ফণীমনসার বেড়ার মাঝখানের গলিতে, দূরে একটা আলো দেখা দিল। আলোটা এগিয়ে আসতে লাগল। ধীরেশ তখনও রিকশা থেকে নামেনি। বলে উঠল, আচ্ছা, এখানে–মানে, এটা তো কেষ্ট মিস্তিরি, মানে কেষ্টাদার বাড়ি।
সুজিত বলল, ঠিক ধরেছেন, চটকলের মিস্তিরি কেষ্টাদার বাড়ি এটা। আপনি কিন্তু তাকে কেষ্ট কুলাক বলতেন।
ধীরেশ যেন অবাক হয়ে বলল, কুলাক।
আলোটা এগিয়ে আসছে। সুজিত বলল, হ্যাঁ, কেষ্টদা তো চাষি, কিন্তু মিস্তিরি হতে হয়েছে। এই মাটির ঘর, আর একটা ডোবা, আর তিন বিঘা জমি আছে বলে, আপনি বরাবর ওকে কেষ্ট কুলাক বলেই বলতেন। রাশিয়ায় বোধ হয় ধনী কৃষক বা জোতদারদের ওই রকম কিছু বলে।
ধীরেশ শুকনোভাবে হাসবার চেষ্টা করে বলল, ওটা আমি ঠাট্টা করে বলতাম।
সুজিত বিদ্রূপ করে বলল, সত্যি নাকি? কিন্তু অনেকদিনই আমাদের বৈঠকে কেষ্টদাকে আপনি বলেছেন, সে কুলাক চরিত্রের নোক, তার মধ্যে ভ্যাসিলিয়েটিং টেন্ডেন্সি সব সময় থাকবে। তবে, আমি আপনার সঙ্গে এসব রাজনৈতিক আলোচনা করব না। এখন মত বদলেছে, আপনারও বদলেছে।
আলো হাতে কেষ্টদা এসে দাঁড়াল। কালো খাটো রোগা মতো একটি লোক। মাথার পাতলা চুল উশকো-খুশকো। মুখটা এবড়ো-খেবড়ো, তার ওপরে, বলতে গেলে, ঢাউস একজোড়া গোঁফ। পরনে নীল হাফ প্যান্ট, গায়ে একটা চাদর, হাতে হ্যারিকেন! মোটা ভুরুর তলায়, চোখ দুটো ছোট, কিন্তু ধার আছে। ধীরেশের দিকে একবার দেখে, সুজিতের দিকে অবাক চোখে তাকাল। সুজিত জানে, কেষ্টদা অবাক হয়েছে, ভাবতে পারেনি সত্যি ও ধীরেশকে এখানে নিয়ে আসতে পারবে।
ধীরেশ বলে উঠল, এই যে কেষ্টদা যে, কেমন আছ?
কেষ্টদা একবার তাকাল ধীরেশের দিকে, তারপরে সুজিতের দিকে চেয়ে বলল, এসো তা’লে।
হ্যাঁ চলো।
ও পকেট থেকে পয়সা বের করে জলিল আর বিমলকে দিল। বিমল জিজ্ঞেস করল, ফিরবেন কখন, আবার রিকশা পাবেন তো।
সুজিত বলল, পরে দেখা যাবে, তোমরা চলে যাও।
ধীরেশ তাড়াতাড়ি বলে উঠল, রাত্রে এ জায়গায় কি পরে রিকশা পাবেন সুজিতবাবু। এদের থাকতেই বলুন না।
সুজিতের সঙ্গে কেষ্টদার একবার চোখাচোখি হল। দুজনেরই মুখ, হ্যারিকেনের আলোয় শক্ত আর কঠিন দেখাল। সুজিত বলল, নেমে আসুন! বিমল, তোমরা চলে যাও।
ধীরেশকে নামতে হল। বিমল আর জলিল রিকশা নিয়ে চলে গেল। সুজিত বলল ধীরেশকে, এখান থেকে কি কেবল রিকশা করেই যাওয়া যায়। কতদিন তো হেঁটে এসেছেন, গেছেন। আরও অনেকভাবে যাওয়া যায়। ধ্রুবকে এখান থেকে থলেয় ভরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। চলুন!
সুজিতের গলার স্বরটা যেন শেষদিকে চাপা গর্জনের মতো শোনাল। ধীরেশ এক জায়গাতেই দাঁড়িয়েই প্রায় ভাঙা গলায় বলল, তার মানে?
কেষ্টদা ঘুরে দাঁড়িয়ে ডাকল, সুজিত এসো।
সুজিত বলল, চলুন, মানে বলব!
কেষ্টদা হ্যারিকেনটা পাশে ঝুলিয়ে নিল, যাতে পিছনে আলো পড়ে। তারপরে ধীরেশ, পিছনে সুজিত। একমাত্র ধীরেশের জুতোরই যা শব্দ বাজছে, বাকি দুজনের তেমন না। দুপাশে ফণীমনসার বেড়ার শেষে, একটা উঠোন চোখে পড়ে। উঠোনের দু-দিকে দুটো ঘর। একটা ঘরের দাওয়ায়, কোণের দিকে টিমটিমে কুপি জ্বলছে, লোকজন কাউকে দেখা যাচ্ছে না। কেষ্টদা উঠোনের দিকে গেল না। আলোটা নিয়ে, উঠোনের পাশ কাটিয়ে, খানিকটা উত্তর দিকে গেল! সেখানে, কয়েকটা গাছ থাকায়, অন্ধকারটা আরও নিবিড়। বাঁ দিকে একটা ছোট জলাশয়। অনেকটা যেন অন্ধকারে আয়নার মতো পড়ে আছে, আর তাতে নক্ষত্রের ছায়া পড়েছে। ডান দিকে গাছপালার মধ্যেই একটা ঘর দেখা যায়। ছিটে বেড়ার ওপর মাটির প্রলেপ, মাথায়, নারকেল খেজুর, যা পাওয়া গিয়েছে, সব রকম পাতা দিয়েই, চাল করা হয়েছে।
কেষ্টদা এগিয়ে গিয়ে দরজার শিকল খুলল। ধীরেশ দরজার বাইরে থমকে দাঁড়াল। সুজিত বলল, ঢুকুন, ঘরটা চিনতে পারছেন?
ধীরেশের গলায় যেন স্বর নেই, নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে, এমনিভাবে বলল, হ্যাঁ, চিনি, কিন্তু এখানে তো কেউই নেই। আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন কেন। কী করবেন আমাকে?
ধীরেশ এই প্রথম এমন অসহায় ভয়ে কথাটা জিজ্ঞেস করল। সুজিত বলল, ঘরে ঢুকুন, বলছি।
ধীরেশ আস্তে আস্তে ঘরে ঢুকল। ঘরের একপাশে একটা পেঁকি! আর এক পাশে একটা খাটিয়া পাতা। খাটিয়ায় কিছু পাতা নেই! কেষ্টদা হ্যারিকেনটা এক পাশে রেখে দাঁড়িয়েছে। সুজিত দরজার কাছে। ধীরেশ আস্তে আস্তে ঢুকে, ঘাড় ফিরিয়ে ঘরটার চারপাশে দেখতে লাগল। কয়েক মুহূর্তের জন্য যেন সে বর্তমান পরিস্থিতিটাই ভুলে গেল। তারপরে মুখ তুলে চালের দিকে তাকাল।
সুজিত নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করল, কী ধীরেশ গাঙ্গুলি, কিছু মনে পড়ছে?
ধীরেশ চমকে উঠে শব্দ করল, অ্যাঁ? তারপরে একবার কেষ্টদাকে আর একবার সুজিতকে দেখল, ঢোঁক গিলে বলল, হ্যাঁ, ইয়ে, মানে এখানে তো অনেকদিন কেটেছে, মানে অনেক ঘটনা, অনেক ছোটখাটো বৈঠক…।
কথাটা ধীরেশ শেষ করতে পারল না। সে আবার কেষ্টদা আর সুজিতের দিকে তাকাল। তার চোখের কোল দুটো আরও বসে গিয়েছে। তার সেই বাজ চোখে, ভয়ের মধ্যে এখন একটা উৎকণ্ঠিত সন্দেহ তীব্র হয়ে উঠেছে। সুজিত বলল, চালের দিকে দেখছিলেন? সেই পোড়া চালটা আর নেই, কেষ্টদা নিজের হাতে নতুন করে ছেয়েছে। খাটিয়ায় গিয়ে বসুন।
ধীরেশ যেন খানিকটা চমকে উঠে বলল, না না, থাক না, বেশ তো দাঁড়িয়ে আছি।
সুজিতের ঠোঁট বেঁকে উঠল। দুঃসাহসী নায়ক নার্ভাস হলে, কী রকম কথা বলে বোঝা যাচ্ছে। সুজিত বলল, সেই খাটিয়াটা নেই, এটা নতুন খাটিয়া। নারকেলের দড়ি দিয়ে, কেষ্টদা নতুন বুনেছে। খাটিয়াতেই বসুন আপনি।
সুজিতের গলার স্বরে অনুরোধের সুর নেই, ও আদেশ করছে ধীরেশকে। ধীরেশ সুজিতের দিকে তাকাল, তারপরে কেষ্টদার দিকে। কেষ্টদার চোখে বোধ হয়, সাদা অংশ কিছু নেই, সবটা জুড়েই কালো তারা। সে যে কোনদিকে তাকিয়ে আছে বোঝা যায় না। ধীরেশকে এখন যে শুধু ফাঁদে পড়া দেখাচ্ছে, তা না, ভয় আর সন্দেহের মধ্যেও, তাকে খুব সাবধানী মনে হচ্ছে। সে খাটিয়ার দিকে আর একবার তাকিয়ে, আস্তে আস্তে গিয়ে বসল। হারিকেনের আলোয়, তিনটে ছায়াই ঘরের মাটির দেওয়ালকে ঢেকে দিল।
ধীরেশ জিজ্ঞেস করল, পার্টির সবাই কি এখানে আসবে?
সুজিত বুঝতে পারছে, ভাল মন্দ যা-ই ঘটুক এরকম নিঝুম পরিবেশ আর ধীরেশ সহ্য করতে পারছে না। তার এখনও বিশ্বাস, এ অঞ্চলের লোকাল পার্টি তাকে, সুজিতকে দিয়ে ধরিয়ে এনেছে, সবাই মিলে একটা চরম বিচার করবে বলে। চরম অভিযোগটা কী বা বিচারটা কী হবে, সে বিষয়ে একটা তীব্র ভয় আর সন্দেহ আছে হয়তো, কিন্তু আরও সবাইকে দেখতে চাইছে সে। ঘর ভরতি লোক, অনেক লোক, অনেক কথা, তার মধ্যে হয়তো খানিকটা স্বস্তি বোধ করত, কিন্তু অগ্রহায়ণের শীতের রাত্রে এই পরিবেশে, মাত্র দুজন লোক, ওকে ভয় ধরাচ্ছে বেশি। সুজিত বলল, আপনাকে আগেই বলেছি, আপনাকে নিয়ে আসার সঙ্গে পার্টির কোনও সম্পর্ক নেই। এখানে আর কে আসবে না আসবে, সেটা পরে দেখতে পাবেন।
কেষ্টদা হ্যারিকেনটা ঢেঁকির ওপরে রাখল, যাতে ঘরের সব জায়গায় আলো পড়ে। সুজিতের দিকে চেয়ে বলল, তা হলে আমি যাই, তুমি যা করবার করো।
সুজিত সে কথার কোনও জবাব না দিয়ে কেবল ঘাড় নাড়ল। দুজনের মধ্যে কয়েক বারই চোখাচোখি হল। যেন চোখে চোখে কোনও কথা হয়ে গেল। কেষ্টদা বেরিয়ে গেল, আর ধীরেশ যেন অনেকটা মরিয়া হয়ে, একটা নীতির প্রশ্ন তুলল, পার্টির কোনও সম্পর্কই যদি না থাকবে, তবে আপনি আমাকে নিয়ে এলেন কেন? আমার যা কিছু, সবই তো পার্টিগত।
সুজিত দেখল, ধীরেশ সত্যি ঘামছে। তার গাল গলা কপাল ঘামে চকচক করছে। ও গায়ের থেকে চাদরটা খুলে ফেলে, মাটির মেঝেরই এক পাশে রাখল। ওর হাতে রিভলবারটা এখন দেখা যাচ্ছে। এগিয়ে গিয়ে, দরজাটা ভেজিয়ে দিল আর সেখান থেকেই বলল, এর আগেও কয়েকবার বলেছেন, সবই পার্টির নির্দেশে করেছেন, আপনার সবই পার্টিগত। কিন্তু অনেক কিছুই করেননি, অনেক কিছুই পার্টিগত নয়, সেটাও আপনাকে আমি প্রমাণ করে দিয়েছি। যা আপনি নিজের ইচ্ছায় করেছেন, তাও কি পার্টিগত ব্যাপার বলে আমাকে ভাবতে হবে।
ধীরেশ এমনভাবে সুজিতের কথা শুনছে, যেন কথার যুক্তি দিয়েই, এ ফাঁদ থেকে ও বেরিয়ে যেতে পারবে।
বলল, কিন্তু আমি তো পার্টির কথা ভেবেই সব করেছি।
সুজিত ধীরেশের চোখে চোখ রেখে বলল, পার্টির কথা ভেবে, আপনি যে কোনও কাজেরই সাফাই গাইতে পারেন না। পার্টির নাম করলেই, ন্যায় অন্যায় বদমাইসি ইতরতা একাকার হয়ে যায় না। যেহেতু পার্টির মধ্যে আছেন, পার্টির মেম্বার, তাতেই সমস্ত শয়তানির সাত খুন মাপ হয়ে যায় না। পার্টি কারোর শয়তানি করবার একটা যন্ত্র নয়, যদিও সাময়িক ভাবে সেই ট্র্যাজেডি না ঘটেছে, তা নয়। যেমন আপনাদের মতো লোকের হাতে যখন পার্টির ক্ষমতা থাকে, তখন এই ট্র্যাজেডি দেখা দেয়। যাই হোক, মেয়েদের আর টাকার কথা আগেই আপনাকে বলেছি। সুধীরের কথা আপনার মনে আছে?
কোন সুধীর?
সুধীর ভট্টাচার্য, যাকে একদিন ভোরবেলা ওয়ার্কাররা পিটিয়ে মেরে নর্দমায় ফেলে দিয়েছিল?
ধীরেশ যেন সুজিতের জিজ্ঞাসার কারণটা বুঝতে চাইল, বলল, হ্যাঁ, মনে আছে, কিন্তু সেটা কি আমার দোষ? সেটা তো।
পার্টির নির্দেশে স্ট্রাইক করতে গিয়ে, জানি, তার দায় আমরা সকলেই নেব, কিন্তু সেজন্য আপনাকে সুধীরের বিষয় কোনও কথাই বলিনি, যদিও আপনার বোধহয় মনে আছে, পার্টি তার আত্মসমালোচনায় বলেছিল, সেই সমস্ত অ্যাকশনটাই টেররিস্ট অ্যাডভেঞ্চারিজম হয়ে গেছল।
মনে আছে।
তার আগেই আরও কেউ কেউ সে কথা বলেছিল, যেমন নিমাই চৌধুরী বা ধ্রুব। আপনি তখন তাদের কী বলেছিলেন?
ধীরেশ চুপ করে রইল। সুজিত বলল, বলেছিলেন, ভীরু কাপুরুষ প্রতিক্রিয়াশীল পাতিবুর্জোয়া। কিন্তু ও বিষয়ে আমার কিছু বলার নেই। ওটা ছিল পার্টির সামগ্রিক ভাবে নীতি আর কৌশলের ভুল। সে সবই মিথ্যা প্রমাণিত হয়ে গেছে। সেই ভুলের জন্য সুধীরকে মরতে হয়েছিল, কিন্তু যা আপনি মিথ্যা প্রমাণ করতে পারবেন না, সেই কথা কবুল করুন।
বলতে বলতে সুজিত দু-পা এগিয়ে গেল ধীরেশের দিকে, আর পিছনে পিছনে ওর ছায়াটা যেন একটা অতিকায় জীবের মতো এগিয়ে এল। রিভলবারটা ওর নিজের কোমরের কাছে, শক্ত হাতে ধরা, তর্জনী ট্রিগারে। ধীরেশের নিশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে। বাইরে ঝিঁঝির ডাকের সঙ্গে একটা রাতজাগা পাখি, সরু গলায়, কুককুক করে ডাকছে। ডোবায় দু বার ছপ ছপ শব্দে মনে হল, ভোঁদড় মাছের খোঁজে নেমেছে।
ধীরেশ অস্ফুট স্বরে জিজ্ঞেস করল, কী?
সুজিত গলাটা কিছুতেই স্বাভাবিক রাখতে পারল না, অনেকটা গোঙানির মতো শোনাল বা অস্পষ্ট গর্জনের মতে, আপনি কি পার্টির নির্দেশে ধ্রুবকে খুন করেছিলেন?
খুন?
ধীরেশ প্রায় উঠে দাঁড়াতে যাচ্ছিল। সুজিত হাত তুলে বলল, বসুন। হ্যাঁ, খুন।
ধীরেশ খাটিয়ার ওপর খানিকটা সরে গিয়ে প্রায় আর্তস্বরে বলল, না না, আমি ধ্রুবকে খুন করিনি, কখনও না, ওর অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল।
মিথ্যুক। সুজিত নিচু স্বরে গর্জে উঠল, নোংরা খুনি একটা, এখুনি ওই মাথার খুলি উড়িয়ে দিতে পারি। দেবও, কিন্তু তার আগে, তোমার নিজের মুখে কবুল করতে হবে।
এই প্রথম সুজিত রাগে আর উত্তেজনায়, ধীরেশকে তুমি করে বলল। এখন ওর চোখ দুটো দু খণ্ড অঙ্গারের মতো দেখাচ্ছে। ওর শক্ত মুখটা হ্যারিকেনের আলোয় পাথরের মুখ বলে মনে হচ্ছে। এখন আর কোনও ভদ্রতা রক্ষার কথা ওর মনে নেই। দপদপে ঘৃণায় আর রাগে, ধীরেশের চোখের দিকে চেয়ে আছে। ধীরেশ সেই চোখ থেকে চোখ সরাতে পারছে না। ভয়ে সরাতে পারছে না, তার সমস্ত শরীর শক্ত হয়ে উঠেছে, হাতের আর মুখের পেশি দেখলেই বোঝা যায়। খাটিয়ার নারকেল দড়ি, দু হাতের থাবায় খামচে ধরেছে।
হ্যারিকেনের লাল শিখাটা দু বার দপ দপ করে উঠল। ধীরেশ চকিতে ঘাড় ফিরিয়ে সেদিকে তাকাল। তার চোখে একটা আশার ঝিলিক ফুটে উঠল। সুজিতও হ্যারিকেনটার দিকেই থাকাল। শিষটা এখনও দপদপ করছে, হঠাৎ নিভে যেতে পারে। ধীরেশ তা-ই চাইছে, তা হলে অন্ধকারে ও পালাবার চেষ্টা করতে পারে। সুজিত মুহূর্তেই স্থির করে নিল, সঙ্গে সঙ্গে দরজাটা খুলে বাইরে চলে যাবে ও। কেষ্টদা নিশ্চয়ই বাইরে আছে। শুধু কেষ্টদা না, আর একজনও আছেন, নিশ্চয়ই এসে গিয়েছেন এতক্ষণ।
আলোর শিখাটা আবার স্থির হল। সলতের ময়লা হোক, বা ভিতরের গ্যাস হোক, কেটে গিয়ে, আলো স্থির হল আবার। সুজিত তাকাল ধীরেশের দিকে, ধীরেশও তাকাল। ধীরেশের চোখে আবার অন্ধকার আর হতাশা নেমে এল। সুজিতের ঠোঁটের কোণ একবার বেঁকে উঠল, তারপরে নিচু গলায় বলল, এই ঘরটার দিকে ভাল করে তাকান, চারদিকে দেখুন অনেক কিছু মনে পড়ে যাবে। হয়তো দেখতে পাবেন কিছু শুনতেও পাবেন কিছু ঘরটা ভাল করে দেখুন।
শেষদিকে, সুজিতের গলাটা এত নিচু হয়ে গেল, যেন চুপি চুপি স্বরে কথা বলছে। ধীরেশ সত্যি সত্যি, ঘরটার চারদিকে মুখ ঘুরিয়ে দেখল, তারপরে তার গলাটাও অনেকটা সুজিতের মতোই ফিসফিসে শোনাল, কী দেখতে পাব, কী শুনতে পাব?
শুনতে পাচ্ছেন না কিছু?
না তো।
ধীরেশের যেন নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। সুজিত বলল, কোনও শব্দ, ভীষণ জোরে কোনও শব্দ, আর তারপরেই কে যেন গুঙিয়ে উঠল, ওয় মা! শুনতে পাচ্ছেন না? শুনতে পাচ্ছেন না, কার গলায় যেন ঘড়ঘড় শব্দ হচ্ছে, নিশ্বাস টানবার শব্দ হচ্ছে, শুনতে পাচ্ছেন না?
ধীরেশের চোখ দুটো বড় দেখাল, কিন্তু নিশ্বাসের কষ্টে সে যেন কথা বলতে পারছে না, কেবল ঘাড় নেড়ে জানাল, না। তার চোখ সুজিতের দিকে। সুজিত আবার বলে উঠল, শুনতে পাচ্ছেন না? দেখতে পাচ্ছেন না কিছু, ওই চেঁকিটার পাশে একজন পড়ে আছে? দেখতে পাচ্ছেন না, তার একটা হাত কনুই থেকে আলাদা, ঘরের মাঝখানে পড়ে আছে। আর একটা হাত কাঁধের কাছ থেকে ছিঁড়ে তার মাথার কাছে পড়ে আছে? দেখতে পাচ্ছেন না? দেখতে পাচ্ছেন না, তলপেটের কাছটা ফেটে গিয়ে, তার রক্তমাখা অ্যাবডোমিন বেরিয়ে এসেছে?
ধীরেশ প্রায় ভাঙা আর্ত গলায় বলে উঠল, না না না, দেখতে পাচ্ছি না।
সুজিতেরও যেন নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে, তা-ই কথা বলতে বলতে হাঁপিয়ে উঠেছে। দ্রুত নিশ্বাসে, ওর শরীরটাও কাঁপছে। ধীরেশের চোখে একটা আতঙ্কের ভাব, কিন্তু দৃষ্টি তার সুজিতের দিকেই। সুজিত বলল, এখনও চোখ বুজে থাকতে চাইছেন ধীরেশ গাঙ্গুলি, এখনও বোবা হয়ে থাকতে চাইছেন। তিন বছর ধরে আপনি চোখ কান বুজে আছেন, তিন বছর আগে, আর এক নভেম্বরে–তা সেই রাত এত অন্ধকার ছিল না, অল্প জ্যোৎস্না ছিল। চালের মাঝখানটা উড়ে গিয়েছিল, সেই ফাঁক দিয়ে ঘরে জ্যোৎস্নার একটু আলো এসে পড়েছিল। সেই আলোয় সবই প্রায় দেখা যাচ্ছিল। দেখুন, দেখুন, ভাল করে দেখুন, দেখতে পাচ্ছেন না কিছু–ওই ঢেঁকিটার কাছে?
ধীরেশ হাঁপ ধরা গলায়, ঘাড় নেড়ে বলল, না, না তো।
নাকে কোনও গন্ধ পাচ্ছেন না এই ঘরে? বারুদের গন্ধ, আর নাইট্রিক অ্যাসিডের গন্ধ তখনও টাটকা?
ধীরেশের নাকের পাটা সত্যি ফুলে উঠল, এবং চেঁকিটার দিকে আর একবার ফিরে দেখে, আবার সুজিতের দিকে তাকাল, কোনও কথা বলল না। সুজিত বলল, আপনি শুনতে পাচ্ছেন না, আপনাকে যেন কেউ ওই চেঁকিটার কাছ থেকে গোঙানো গলায় জড়িয়ে জড়িয়ে ডাকছে, ধীরেশ ধীরেশ, আমাকে সরান, পুলিশ আসবার আগে। শুনতে পাচ্ছেন না আপনি?
ধীরেশের চোখে, ভয় আর আতঙ্কের মধ্যেও, কেমন একটা অন্যমনস্কতা যেন ফুটে উঠেছে। সে নিঃশব্দে কেবল ঘাড় নাড়ল। সুজিতও শক্ত মুখে, কয়েকবার মাথা দোলাল, বলল, তার কারণ মনুষ্যত্বটুকু সব খেয়ে বসে আছেন, অথচ রাজনীতি থেকে সরেননি। ভেবেছেন মনুষ্যত্ব বাদ দিয়ে, রাজনীতে চালিয়ে যাবেন। চক্র গড়ে তুলবেন, গরম কথা বলবেন, তাতেই রেহাই পেয়ে যাবেন। কিন্তু এতে রেহাই পাওয়া যাবে না ধীরেশ গাঙ্গুলি, সেজন্য আপনাকে আমি নিয়ে আসিনি।
সুজিত সরে গেল, ওর সঙ্গে ছায়াটাও সরে গেল। ও চেঁকিটার সামনের দিকে গিয়ে, মাটির মেঝের ওপরে বসল। ধীরেশের চোখও সেই দিকে ঘুরে গেল। সুজিত রিভলবারটা হাত থেকে নামাল না। একবার কেবল অস্ত্রটার দিকে তাকিয়ে দেখল, আর ওর ঠোঁটের কোণটা বেঁকে উঠল। বলল, আপনার সেই সাহস কোথায় গেল। জেল মৃত্যুর ভয় করলে চলবেনা, এ কথা সব সময় আপনার মুখে শোনা যেত, আর সে কথার প্রমাণ, এই তল্লাটের একশো সত্তরজন দিয়েছে। জেল মৃত্যু, বেকারি অনাহার, কোনও কিছুই বাদ যায়নি, সকলেই সাহসের সঙ্গে নিয়েছে, আর আপনি সত্যি বলতে পারছেন না?
ধীরেশ যেন একটা প্রশ্ন খুঁজে গেল, জিজ্ঞেস করল, কী সত্যি?
ধ্রুবকে আপনি খুন করেছিলেন।
ধীরেশের এক কথা, আমি ওকে খুন করিনি, ওটা অ্যাকসিডেন্ট।
মিথ্যুক। মিথ্যুক আর ভণ্ড, জিভটা উপড়ে নেওয়া উচিত। সুজিত যেন গরগর করে উঠল, তারপরে হঠাৎ ও রিভলবার তুলে বলল, বেশ, অন্তত মিথ্যের জন্যই তা হলে মরুন, সেটুকু সাহস আপনার থাকা উচিত।
ধীরেশ রিভলবারের নলের দিকে তাকাল, একটা হাত তুলল, নিচু দম বন্ধ গলায় বলল, আমার একটা কথা শুনুন সুজিতবাবু।
সুজিত একভাবে থেকে জিজ্ঞেস করল, কী কথা?
ধীরেশের কপাল থেকে ঘাম ঝরে পড়ল, একটু দম নিল, তারপরে বলল, আপনি আপনারা আমার বিরুদ্ধে পার্টির কাছে অভিযোগ করুন না কেন।
তাতে কী হবে?
আমি যদি ধ্রুবকে খুন করে থাকি, তা হলে পার্টিই আমাকে শাস্তি দিতে পারে।
সুজিতের ঠোঁট বেঁকে গেল, হাসির মতো একটা শব্দ বেরোল ওর গলা দিয়ে। বলল, পার্টি আপনাকে কী শাস্তি দেবে? আপনাকে পার্টি থেকে তাড়িয়ে দেবে, তাই না?
হ্যাঁ, তা দিতে পারে।
আপনার কাছে সে শাস্তির কী মূল্য? পার্টি আপনাকে তাড়াবে, আজ না হোক কাল, নিশ্চয়ই তাড়াবে, যোগ্যতা পার্টি একদিন অর্জন করবেই, আপনাদের দখলেই চিরদিন থাকবে না, থাকতে পারে না। শ্ৰেণী হিসাবে পরগাছা তো বটেই, তাও আবার নেতৃত্বে আছেন। কেন জানেন? সেই কথাটা মনে করুন, নেই তাই খাচ্ছ, থাকলে কোথায় পেতে? যে-শ্রেণীর নেতৃত্বের কথা বলা হয়, পার্টি এখনও সেই শ্রেণীর নেতৃত্বের নাগালের বাইরে, তাই বুকনির মধ্যে খাসা চাল দেখাচ্ছেন।
সুজিত হঠাৎ থামল, শক্ত ঠোঁট একবার বাঁকাল। আবার বলল, কিন্তু আপনাকে এ সব কথা শোনানোর কোনও মানে হচ্ছে না। আমি জানি পার্টি থেকে তাড়িয়ে দিলেও, আপনার বিবেকের কোথাও একটু ধাক্কা লাগবে না। এবার আপনি নিজেকে একটা এলিমেন্ট হিসাবে চিন্তা করুন, আর ভেবে দেখুন, আপনি একলা নন, আপনারা আছেন, আপনার মতো এলিমেন্ট যারা, নিজের প্রয়োজনে, কোনও অন্যায় বা পাপেই যাদের হাত কাঁপে না, এই কীর্তিনাশাকে বইতে দিয়ে কী লাভ? এই কীর্তিনাশাকে জিইয়ে রেখে, তার ধারে কোনও গ্রাম নগর খেত খামার কারখানাই গড়ে উঠতে পারে না। তার যা ধর্ম, সে তলে তলে খাবে, ভাঙবে, ভাসাবে সেদিক দিয়েও আপনার বেঁচে থাকবার অধিকার নেই, কিন্তু
সুজিত থামল, ধীরেশের মুখের দিকে কয়েক পলক দেখে নিয়ে বলল, এ সব রাজনীতির কথা, এ কথা থাক। একটা জীবনের দাম দেবে কে–একটা জীবন, ধ্রুবর মতো মানুষের জীবনের দাম দেবে কে। এখানে কোনও আপোষ থাকতে পারে না, একমাত্র দাবি, জীবনের বদলে জীবন চাই।
সুজিতের গলায় যেন কঠিন প্রতিজ্ঞা ফুটে উঠল। ধীরেশ এ সময়ে হঠাৎ খাটিয়া থেকে নেমে মাটিতে বসে বলে উঠল, শুনুন, শুনুন সুজিতবাবু।
তার কথা শেষ হবার আগেই, সুজিত বলে উঠল, আগে আপনি উঠে বসুন।
এখানেই বসি না, মাটিতেই বসি।
না, সরে যান, উঠে বসুন, আপনাকে আমি ভালভাবে দেখতে চাই।
ধীরেশ আস্তে আস্তে উঠে বসল আবার। ব্যগ্র দ্রুত গলায় বলল, আপনি যদি মনে করেন, আমি ধ্রুবকে মেরেছি–মারিনি, বিশ্বাস করুন, ধ্রুবর মতো মানুষকে, জানি আমাদের সে প্রিয় নেতা ছিল, বিশ্বাস করুন।
বাজে কথা বলবেন না, ঠিক কী কথা বলতে চাইছেন বলুন।
আমি আমি ধীরেশের হাত দুটো বুকের কাছে জোড়া হল, প্রায় কাঁপা গলায় বলল, আমাকে মেরে ফেললেই কি ধ্রুব ফিরে আসবে?
সুজিতের ঠোঁট আবার বেঁকে উঠল, বলল, আপনি কি এবার আমাকে অহিংস ধর্মে দীক্ষা দেবেন নাকি?
না, তা না, এটা একটা কথা বললাম।
সুজিত দেখল, আর ভাবল, সেই ধীরেশ, সেও মৃত্যুভয়ে এরকম করে, এরকম বলে। ও বলল, তবে আপনার কথারও জবাব আছে। ধ্রুব ফিরবে না, কোনও কারণেই তাকে ভোলাও যাবে না, কিন্তু ধ্রুবর খুনি এভাবে বেঁচে থাকবে, তা হতে দিতে পারি না। আরও যারা ধ্রুবদের মতো মানুষদের মেরেছে, তারা কেউ-ই বাঁচবে না। কিন্তু দেরি হয়ে যাচ্ছে, মুখ খুলুন, কবুল করুন।
ধীরেশ চুপ করে রইল, বুকের কাছে হাত দুটো জড়ো করে আর্ত চোখে সুজিতের দিকে তাকাল। অথচ, তার আর্ত চোখে যেন অত্যন্ত দ্রুত চিন্তার ছায়া খেলা করছে। সুজিত বুঝতে পারছে, ধীরেশ ভাবছে, কী বলবে। কী বললে, এ অবস্থা থেকে নিষ্কৃতি পাবে। ধীরেশ বড় আশাবাদী–না, একে আশাবাদী বলে না, একে বলে ধূর্ত আর মতলববাজের আশা, শয়তানের আশা।
বাইরে উত্তরের বাতাসটা হয়তো একটু জোর হয়েছে, ভেজানো কপাটটা একটু একটু নড়ছে, মাঝে মাঝে ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ করছে। চালের ওপরে কোনও জানোয়ার খুব আস্তে আস্তে চলাফেরা করছে। ভা হতে পারে। চালার ওপর থেকে, কোন গাছের পাখির বাসার দিকে নজর পড়েছে বোধহয়। বনবেড়াল হওয়া অসম্ভব না, অথবা পলাতক ধাড়ি ইঁদুর। পাখিটা এরকম ভাবেই, নিচু স্বরে কুক্কু করে ডেকে চলেছে। এই সময়ে, খুব কাছ থেকেই এক পাল শেয়াল ডেকে উঠল। ধীরেশ বুকের কাছ থেকে হাত নামিয়ে, এদিকে ওদিকে দু-একবার দেখল, একটু নড়েচড়ে বসল। সুজিতের দিকে তাকাল, সুজিত তার দিকেই চেয়ে রয়েছে। ধীরেশকে সে প্রতিটি মুহূর্তে দেখছে, তার প্রতিটি ভাবভঙ্গি। ধীরেশকে চিনতে ওর একটুও অসুবিধা হচ্ছে না। ধীরেশ মুখ খুলল আবার, ডাকল, সুজিতবাবু।
বলুন।
আচ্ছা, আমি কেন শুধু শুধু ধ্রুবকে মারব?
শুধু শুধু কি না জানি না, সেটাই আপনার মুখ থেকে শুনতে চাইছি।
ধীরেশ বলল, আপনি আমাকে সত্যি স্পাই মনে করেন না তো?
সেটা আপনার কবুল করা থেকে বোঝা যাবে।
ধীরেশ যেন একটু চিন্তা করল, তারপরে বলল, আচ্ছা, এতটা সিওর হচ্ছেন কেন, আমি ধ্রুবকে মেরেছি। আপনার হাতে কি কোনও প্রমাণ আছে?
আছে।
আছে?
হ্যাঁ, আর সে সব প্রমাণ যদি আপনাকে দেখাই, তা হলে তৎক্ষণাৎ আপনার মাথাটা গুঁড়িয়ে দেব। কিন্তু এত সহজে আপনাকে আমি ছাড়ব না, এই মুখ থেকেই আমি সব শুনব। তবে ধীরেশ গাঙ্গুলি, মনে রাখবেন, আমার ধৈর্যের সীমা আছে, আপনার চালাকির চাল আমি আর বেশিক্ষণ সহ্য করব না।
সুজিতের কথা শেষ হবার আগেই দরজাটা খুলে গেল। কেষ্টদা। কেষ্টদা সুজিতের দিকে তাকিয়ে বলল, এসেছেন।
সুজিত রিভলবারটা ঢেঁকির ওপর রেখে উঠে দাঁড়াল, দরজার কাছে যেতে যেতে বলল, এসেছেন?
হ্যাঁ।
ওঁকে তোমার ঘরে বসাও।
ঠিক এই মুহূর্তে ধীরেশ চেঁকিটার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল, রিভলবারটা হাতে তুলে নিল। একেবারে সরাসরি সুজিতের দিকে রিভলবার তুলে বলে উঠল, আমি আর এক সেকেন্ড থাকতে চাই না সুজিত, আমাকে এখুনি বেরিয়ে যেতে দাও, দরজা ছাড়ো।
ধীরেশের চোখে শিকারি বাজের ঝলক। তার সমস্ত শরীর শক্ত, চোয়াল কঠিন। সুজিতের সঙ্গে কেষ্টদার চকিতে একবার চোখাচোখি হল। কেষ্টদা ম্যাজিকের মতো দরজার কাছ থেকে সরে গেল। ধীরেশ এবার জোর গলায় চিৎকার করল, যাবে না কেষ্ট। কোথায় গেল ও?
বলতে বলতেই সে দরজার কাছে এসে পড়ল। কেষ্টও তখন দরজার কাছে আবার এসে দাঁড়িয়েছে। কেষ্টদার গায়ে চাদর নেই, একটা ময়লা জামা, হাতে একটা ঝকঝকে শানানো দা। প্রায় দেড় হাত লম্বা ধারালো দা-টা যেন একটা ফণা তোলা গোখরোর মতো কেষ্টদার হাতে ঝকঝক করছে, যার একটা ঘায়ে ধীরেশের মাথাটা ধড়ছাড়া হয়ে যেতে পারে। সুজিত জানে, দাটা কেষ্টদা দরজার বাইরেই রেখে দিয়েছিল। ধীরেশকে তারও বিশ্বাস ছিল না। কেষ্টদাকে যেন ঠিক মানুষের মতো দেখাচ্ছিল না। কালো এবড়োখেবড়ো মুখ, ছোট চোখে কেবল কালো দুটো তারা আর ঢাউস গোঁফজোড়া যেন খাড়া হয়ে উঠেছে। সুজিত তাকাল ধীরেশের দিকে। ওর ঠোঁটের কোণ দুটো আবার বেঁকে উঠল, আর ধীরেশ কেষ্টদার দিকে চোখ রেখে বলে উঠল, দা? দা দিয়ে তুমি আমার কী করবে?
সুজিত বলল, সবই, গর্দানটি কেটে ফেলা হবে। কারণ ওটাতে গুলি নেই।
ধীরেশ প্রায় আর্তনাদ করে উঠল, গুলি নেই?
বলেই কয়েকবার ট্রিগার টিপল, বুলেটহীন চেম্বার ঘুরে ঘুরে, কট কট করে শব্দ হল। ধীরেশ তৎক্ষণাৎ ছিটকে ঘরের পিছনের দেওয়ালের কাছে সরে গেল। সুজিতের দিকে চেয়ে বলে উঠল, মাত্র একটা গুলি ছিল? ফাঁকা রিভলবারটা দেখিয়ে, এত দূরে নিয়ে এলেন আমাকে?
সুজিত স্থির চোখে ধীরেশের দিকে চেয়ে, আস্তে আস্তে মাথা নাড়ল। বলল, হ্যাঁ, ধীরেশ গাঙ্গুলিকে চিনতে আমার তখনও ভুল হয়নি, এখনও ভুল করিনি। আমি ইচ্ছে করেই ওটা রেখে উঠেছিলাম, আর যা ভেবেছিলাম, তাই হল। ধীরেশ গাঙ্গুলি যেভাবেই হোক বাঁচতে চায়, পালাতে চায়, তবু সত্যের মুখোমুখি হবার সাহস নেই।
ধীরেশ যেন সুজিতের কথা শুনছিল না। তার শরীরটা কাঁপছিল, না কি দ্রুত নিশ্বাসে দুলছিল, বোঝা যাচ্ছিল না। সে আবার ফিসফিস করে বলল, ফাঁকা, এটা ফাঁকা।
রিভলবারটা মাটিতে ফেলে দিয়ে, সে দেওয়ালে হেলান দিয়ে, মাটিতে বসে পড়ল, চিবুকটা বুকের কাছে ঝুলে পড়ল, আর হাত দিয়ে মাথাটা চেপে ধরল। সুজিত তাকাল কেষ্টদার দিকে। কেষ্টদা বলল, ইচ্ছে করছে, ধ্রুবর মতো, হাত দুটো কেটে আলাদা করে ফেলে দিই, বেইমান খুনি।
ধীরেশ চোখ তুলে একবার কেষ্টদাকে দেখল, আবার মাথাটা নামিয়ে নিল। কেষ্টদার দিকে তাকাতে সাহস পাচ্ছে না।
সুজিত বলল, রিভলবারটা যে ফাঁকা, এ কথাটা আমি মনে মনেও ভাবতে চাইনি। তবু ওটার দিকে তাকিয়ে কয়েকবারই আমার ঠোঁট বেঁকে গেছে। আপনার বাজপাখির মতো চোখ তা দেখতে পায়নি।
কেষ্টদা সুজিতকে বলল, দেরি করছ কেন, জিইয়ে রেখে লাভ কী।
সুজিত বলল, আর একটু কেষ্টদা, একবার ও নিজে বলুক।
কেষ্টদা আবার অন্ধকারে হারিয়ে গেল। সুজিত ধীরেশের দিকে ফিরে তাকাল। এগিয়ে গিয়ে, টেকির ওপর থেকে হ্যারিকেনটা নামিয়ে, সামনের দিকে এগিয়ে, চেঁকির ওপরেই বসল। বলল, এবার আরও স্পষ্ট বোঝা গেল আপনাকে। কিন্তু আপনি বুঝতে পারছেন, আপনাকে কে শেষ করবে। আপনার দুটো কাটা হাত, এ ঘরে আজ গড়াগড়ি যাবে। কিন্তু
ধীরেশ সুজিতের দিকে তাকাল, যেন নতুন আশায় জিজ্ঞেস করল, কিন্তু?
সুজিত মাথা নেড়ে বলল, না, আপনার আশা করার কিছু নেই, এ ঘরে আর একজনের খুনের শোধ এ-ঘরেই হবে। কিন্তু আমি আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম।
ধীরেশ ব্যস্ত গলায় বলল, বলুন। আপনার মনে আছে, কেষ্টদার কাছ থেকে চটের বোরা নিয়ে, কী ভাবে আপনি ধ্রুবকে তার মধ্যে ঢুকিয়েছিলেন, অথচ ধ্রুব তখনও বেঁচে।
হ্যাঁ, আপনি–আপনিও তো তখন এসে পড়েছিলেন, আমার মনে আছে, আপনি।
সুজিত বাধা দিয়ে বলল, হ্যাঁ, কোনও খবর না দিয়েই আমি এখানে এসেছিলাম। যেটা নিয়মবিরুদ্ধ হয়েছিল, আর আপনি ধমকে বলেছিলেন, কার পারমিশনে আপনি এখানে এসেছেন? এর জন্য আপনাকে জবাবদিহি করতে হবে বলে দিলুম। ধ্রুব তখন মাটিতে পড়ে। আসলে আমি সেই রাত্রে এসেছিলাম আর একজনের অনুরোধে, ধ্রুব যাতে এখানে না থাকে, সেই কথা বলতে। কিন্তু তার আগেই, আপনার যা করবার, আপনি করেছিলেন।
না না, সুজিতবাবু, আমি কিছু করিনি।
চুপ করুন, চুপ করে শুনুন। আপনার মনে আছে, তখন আপনাকে আমি কী বলেছিলাম? আমি আপনাকে বলেছিলাম, এভাবে বস্তার মধ্যে করে নিয়ে যাবেন না, কমরেড ধ্রুব এখনও বেঁচে আছেন। কেষ্টদা আছে, আমি আছি। চলুন কাঁধে করে নিয়ে যাই সবাই মিলে।তার জবাবে আপনি বলেছিলেন, একে বেঁচে থাকা বলে না, এ তো প্রাকটিকালি একটা মড়া। আপনার উপদেশ শোনবার সময় নেই আমার, যেমন করে হোক, এখন তাড়াতাড়ি এটা সরিয়ে নিয়ে ফেলতে হবে। দরকার হয়, রেল লাইনে নিয়ে ফেলে দেব, পার্টির সঙ্গে যাতে টাচ্ না থাকে, পুলিশ যাতে জানতে না পারে, ট্রেস না করতে পারে। আমি বললাম, কিন্তু ওঁকে বাঁচাবারই চেষ্টা করতে হবে, উনি বেঁচে আছেন এখনও। শুনে আপনি আমার দিকে জ্বলন্ত চোখে তাকালেন, বললেন, আপনি আমার কাজে বাধার সৃষ্টি করবেন না। আপনাকে এখানে কেউ আসতে বলেনি, মনে রাখবেন, এর জন্য, আর প্রত্যেকটি কথার জন্য, পার্টির কাছে আপনাকে কৈফিয়ত দিতে হবে। আপনি আমাকে আবার শাসিয়ে উঠলেন। আর সেই জবাবদিহি কৈফিয়ত ব্যাপারটা যে কী, আমি ভাল ভাবেই জানি। তবু আমি মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম তখন। সব ব্যাপারটাই তো অন্ধকারে ঘটছিল, আলো জ্বালাবার উপায় ছিল না। একটা প্রচণ্ড শব্দে আশে পাশের লোক জেগে গেছল। কিন্তু সবাই ঘুমন্ত অবস্থায় শব্দটা শুনেছিল বলে, ঠিক আন্দাজ কিছুই করতে পারছিল না। তা ছাড়া পাড়াগাঁ জায়গা, শব্দে অনেকেই ভেবেছিল, কারোর বাড়িতে বোধ হয় ডাকাত পড়েছে, ভয়ে কেউ বেরোতে চায়নি।
আমি যখন অন্ধকারের মধ্যেই দেখতে পেলাম, ধ্রুবকে আপনি সেই দুমনের বস্তার মধ্যে পুরছেন, তখন না বলে পারলাম না, কমরেড ধ্রুবর মুখটা অন্তত বাইরে রাখুন, না হলে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এখনি মরে যাবে।আপনি একবার আমার দিকে দেখলেন, কিন্তু কিছু বললেন না, আর দয়া করে ধ্রুবর মুখটা বাইরেই রাখলেন। তবে এমনভাবে আপনি ধ্রুবকে বস্তায় পুরছিলেন, আমার মনে হচ্ছিল, তাতেই শেষ হয়ে গেছেন, কিন্তু, কিন্তু।
সুজিতের গলাটা বন্ধ হয়ে গেল, যেন কোথায় তলিয়ে গেল। ধীরেশ ওর দিকে তাকাল। সুজিত এক হাত দিয়ে নিজের মুখটা চেপে ধরল, আর যেন আটকে যাওয়া শক্ত কিছু ঢোঁক গিলে, ভিতরে নিতে চাইল। আর হাত চাপা মুখের ভিতর যেন অনেক দূর থেকে ওর গলা শোনা গেল, এখনও আমার কানে ভাসছে ধ্রুব গুপ্তের গোঙানো গলা। হঠাৎ শোনা গেল, তিনি বলে উঠলেন, আমার একটা হাত বাইরে পড়ে আছে, ওটা ভেতরে ঢুকিয়ে দিন।
সুজিতের গলা একেবারে বন্ধ হয়ে গেল। ধীরেশের গর্তে ঢোকা চোখ দুটো সুজিতের দিকে নিবদ্ধ, কিন্তু তার চোখে অন্যমনস্কতা। একটা ঘোর লাগা আচ্ছন্নতা তার চোখে। বাইরে সেই রাতের পাখিটার ডাক শোনা যাচ্ছে না। চালে কোনও শব্দ নেই। দরজাটা খোলা, বাইরের অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না। এখন কোথাও কোনও শব্দ নেই।
কয়েক মিনিট পরে সুজিত মুখ তুলল, মুখ থেকে হাত নামাল। ওর চোখ দুটো লাল দেখাচ্ছে। ও ধীরেশের দিকে তাকাল, আর তাতেই যেন ধীরেশের চোখে সংবিৎ ফিরে এল। সুজিত বলল, মনে আছে সেই রাত্রের কথা?
ধীরেশ বলল, আছে।
তবু এ ঘরে কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না?
ধীরেশ চুপ করে রইল। সুজিত বলল, তারপরে আপনি সেই বস্তার মাঝখানটা চেপে ধরে, এক বস্তা পুরনো মালের মতো পিঠের ওপর ফেলে কাঁধে নিলেন। ধ্রুবর গলায় তখন একটা শব্দ পাওয়া গেছল, মনে করেছিলাম, সেটাই ওঁর শেষ শব্দ। রেল লাইনের ওপরে উঠে আপনি একবার থমকে দাঁড়িয়েছিলেন। আমার আর কেষ্টদার দিকে একবার তাকালেন। কী ভাবছিলেন বলুন তো, লাইনের ওপর ফেলে দেবেন কি না?
ধীরেশ কথা বলতে পারল না। সুজিত বলল, কিন্তু আমাদের সামনে সেটা আপনি পারেননি, যদিও আপনার ইচ্ছা ছিল তা-ই। তবু, আর একটা কথা জিজ্ঞেস করি, আপনি ভগবতী দিদির বাড়িতে হঠাৎ ধ্রুবকে নিয়ে সেই রাত্রে তুলেছিলেন কেন?
ধীরেশ যেন অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, অ্যাঁ?
ভগবতী দিদির বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তুলেছিলেন কেন? আপনি জানতেন, তাঁর বাড়িটা কত গোপন জায়গা, একজন ডিস্ট্রিক্ট নেতা সেখানে অ্যাবসকন্ড করে ছিলেন, ভগবতীদিদি নিজে একজন দায়িত্বশীল মহিলা সভ্য, বাইরের থেকে তাঁকে কেউই কিছু জানে না। ধ্রুবকে বস্তায় পুরে আপনি সেখানে নিয়ে গিয়েছিলেন কেন?
ধীরেশের মুখ এখন নিচু। আগের মতো সতর্ক এবং সুজিতের চোখে চোখে চেয়ে থাকা ভাবটা তার আর নেই, যেটা সে অবিশ্বাস ভয় আর সুযোগের সন্ধানের জন্য চেয়ে থাকছিল। সে বলল, আমার তখন মাথার ঠিক ছিল না।
সুজিত বলল, এতেই সন্দেহ হয়, আপনি দক্ষিণপন্থী সরকারের গুপ্তচর কি না।
ধীরেশ বলল, বিশ্বাস করুন, আমি পাই নই।
সেটা আরও প্রমাণসাপেক্ষ, কিন্তু মাথা আপনার ঠিক ছিল। ভগবতীদিদি যখন ধ্রুবর অবস্থা দেখে কেঁদে উঠলেন, আপনি তাঁকেও ধমকে উঠেছিলেন। বলেছিলেন, ওসব মড়াকান্না রাখুন। ডিস্ট্রিক্টের কমরেড সুবীর এখানে আছে জেনেই, ধ্রুবকে এখানে এনেছি। তার সঙ্গে পরামর্শ করতে চাই। তখন আপনাকে আমি বলেছিলাম, এখন কোনও পরামর্শের থেকে, ধ্রুবর চিকিৎসা আরম্ভ হওয়া দরকার। আপনি আমাকে আবার ফুঁসে উঠেছিলেন, আপনি চুপ করুন, কোনও বিষয়ে কথা বলার এক্তিয়ার নেই আপনার। বলে আপনি ধ্রুবকে নিয়ে সোজা ভগবতী দিদির ওপরের ঘরে চলে গেলেন। কমরেড সুবীর সেখানে বসেছিলেন। তিনি খালি ব্যাপারগুলো চুপচাপ দেখছিলেন। সেই প্রথম ইলেকট্রিকের আলোয় আমরা সবাই ধ্রুবকে দেখলাম। মেঝেয় রাখা বস্তার ভিতর থেকে তাঁর মাথাটা বেরিয়ে আছে। তাঁর চোখ খানিকটা খোলা, মনে হল, চোখের মণি নড়বে না, একেবারে স্থির হয়ে গেছে। কিন্তু আমরা সবাই যখন তাঁর দিকে ঝুঁকে পড়লাম, তখন তাঁর চোখের মণি খুব আস্তে আস্তে নড়ল। ধ্রুব একে একে আমাদের সকলের মুখের দিকে দেখলেন। তাঁর গালে, ঠোঁটে রক্ত। চিবুকের একটা অংশ পোড়া। ঠোঁট নেড়ে তিনি কিছু বলতে চাইলেন, আমার মনে হয়েছিল, তিনি ঠোঁট নেড়ে বলেছিলেন, কমরেডস বিদায়। তারপরে ভগবতীদিদির দিকে ধ্রুবর চোখে পড়ল। দিদির চোখে তখন জল। একটা মানুষের দুটো হাত নেই, অ্যাবডোমিন বেরিয়ে পড়েছে, মালের বস্তার মতো ঝুলে এতটা পথ আসার পরেও তাঁর চোখে জল দেখা দিল, গলায় তাঁর শেষ গোঙানি শোনা গেল, ভগবতীদিদি… সেই তাঁর শেষ কথা। সেই সময়ে আমার একবার ধ্রুবর মায়ের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল, মায়ের একমাত্র ছেলে, কারোর সঙ্গে কারোর আর কোনওদিন দেখা হয়নি।…
সুজিতের গলা আবার বন্ধ হয়ে গেল, স্বর ডুবে গেল। ধীরেশ খোলা দরজার দিকে বাইরে তাকিয়ে আছে, কিন্তু সে কিছুই দেখছে না। সে কী ভাবছে, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। পরাভূত নায়কের মতো তাকে দেখাচ্ছে এখন। কপালের ওপর চুল পড়ে আছে। বোধহয়, সেই রাত্রের কথাই ভাবছে।
সুজিত আবার বলল, সুবীর আমাকে আলাদা ডেকে নিয়ে তখুনি পার্টির ডাক্তার নরেন্দ্রকে ডেকে নিয়ে আসতে বললেন, আর বললেন, সম্ভবত এখানে পুলিশ চলে আসবে। আমি চলে যাচ্ছি। নরেন্দ্র বললেন, তার বন্ধু, আকবর হোসেনের গাড়ি নিয়ে, ধ্রুবকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কলকাতার হাসপাতালে পাঠিয়ে দিতে। শুধু মনে রাখবেন পার্টির কেউ যেন সঙ্গে না যায়, তা হলে ধরা পড়ে যাবে। বলেই তিনি চলে গেলেন। আমি আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে, কেষ্টদাকে পুলিশ আসার সম্পর্কে সজাগ করে দিয়ে, নরেন্দ্রকে ডাকতে চলে গেলাম। নরেন্দ্র সমস্ত সংবাদ শুনে তখুনি ফার্স্ট এইডের বাক্স নিয়ে, আগে ছুটল আকবর হোসেনের কাছে। আকবর পার্টির কেউ না, কিন্তু পার্টির সকলের প্রতি তার বিশেষ শ্রদ্ধা ছিল। সে তখুনি গাড়ি বের করে নিয়ে ছুটল। আমরা গিয়ে দেখলাম, আপনি নেই। ভগবতীদিদি আর কেষ্টদা অসহায় ভয়ে সেই বস্তা আগলাচ্ছে, আর আপনি সেখানে নেই। তখন আপনি কোথায় গিয়েছিলেন ধীরেশ গাঙ্গুলি?
ধীরেশ সুজিতের দিকে তাকাল, বলল, আমি ডাক্তারের খোঁজ করতে গেছলাম।
কোন ডাক্তারের?
যে কোনও একজন ডাক্তারের।
নিজেদের ডাক্তার নরেন্দ্র থাকা সত্ত্বেও? আবার সেই মিথ্যা কথা শুরু করেছেন। বাইরের যে কোনও ডাক্তারকে ডাকা মানেই বিপদ ডেকে আনা, এটা জেনেও বাইরের ডাক্তারকে ডাকতে যাওয়ার মতো মাথা আপনার খারাপ ছিল না। আপনি কোথাও যাননি, রাস্তার অন্ধকারে লুকিয়েছিলেন। ঘটনা কোনদিকে মোড় নেয় তাই দেখার জন্য স্পট থেকে সরে গিয়েছিলেন। প্রথমত আপনি ধরেই নিয়েছিলেন, ধ্রুব আর বেঁচে নেই, দ্বিতীয়ত পুলিশ এসে পড়বে। তার মানে ভগবতীদিদি আর কেষ্টদা অ্যারেস্ট হয়ে যাবে, ধ্রুবর ব্যাপারে সব জানবার জন্য তাদের ওপর নির্যাতন চলবে। আসছি বলে আপনি বেরিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু পুলিশ আসবার আগেই, আমরা এসে গিয়েছিলাম। নরেন্দ্র সমস্ত ব্যাপারটা এক লহমায় দেখে নিয়েই, দু হাতে বস্তাটা কোলে করে আকবরের গাড়িতে তুলে দিল। বলল, শেষ চেষ্টা হিসাবে একবার হাসপাতালে পাঠানো যাক, এখনও বেঁচে আছে। আপনি আবার ফিরে এলেন। আপনিও গাড়িতে উঠলেন। আপনার যাওয়া উচিত না জেনেও আপনি গেলেন, আপনার মতো একজন দায়িত্বশীল পদের লোকের এরকম বিপদের ঝুঁকি নেওয়া উচিত না, জেনেও আপনি গিয়েছিলেন, আর এর জন্য পার্টিকে আপনি লিখিত কৈফিয়ত হিসাবে জানিয়েছিলেন কাজটা আমার ঠিক হয়নি, কিন্তু ধ্রুবকে ওইভাবে ছেড়ে দিতে পারছিলাম না, তাকে বাঁচাবার শেষ চেষ্টার জন্য আমি গিয়েছিলাম। অথচ কথাটা একেবারেই মিথ্যা। আকবরের কাছ থেকে জানা গিয়েছিল, আপনি বার বার আকবরকে গেলে বলেছিলেন, হসপিটালাইজড করতে গেলে বিপদের ভয়, ধ্রুব মরেই গেছে, বডি ফেলে দেওয়া যাক। কিন্তু আকবর পার্টির মেম্বার না, আপনার ম্যান্ডেটের কোনও দাম নেই তার কাছে, তাই সে বলেছিল, যেভাবেই হোক, ধ্রুবকে সে হাসপাতালে নিয়ে যাবেই। আপনি হাসপাতালের গেটেই নেমে গিয়েছিলেন। আকবরের সাহসের অন্ত নেই, সে হাসপাতালের মধ্যে গাড়ি দাঁড় করিয়ে ধ্রুবকে পাঁজাকোলা করে বস্তাসুদ্ধ তুলে, এমারজেন্সিতে নিয়ে গিয়েছিল। কারোর দিকে না তাকিয়ে, ধ্রুবকে বাইরের খালি বেঞ্চে রেখেই, চোখের পলকে চলে এসে, গাড়ি স্টার্ট দিয়ে পালিয়েছিল। কিন্তু তখনই ধ্রুবকে নিয়ে, লোকের খোঁজাখুঁজি পড়ে গেছে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই পুলিশ চারদিকে খোঁজাখুঁজি আরম্ভ করেছিল। সাদা পোশাকের পুলিশ হন্যে হয়ে গিয়েছিল। আকবর বলেছিল, ধ্রুবকে যখন রেখে এলাম, তখন মনে হল, সে আর বেঁচে নেই। আর ভগবতীদিদির বাড়ি থেকে, ধ্রুবকে নিয়ে চলে যাবার বিশ মিনিটের মধ্যে পুলিশভ্যান এসে পড়েছিল। ভগবতীদিদি ছাড়া, আমরা কেউই তখন ছিলাম না। পুলিশ তন্নতন্ন করে বাড়িটা সার্চ করেছিল, ভগবতীদিদিকে পুলিশ বারে বারে জিজ্ঞেস করেছিল, একটু আগে বাড়িতে কারা এসেছিল। একটা গাড়ি বাড়ির সামনে দাঁড়িয়েছিল, কার গাড়ি, কী জিনিস তাতে পাঠানো হয়েছে, কোথায় পাঠানো হয়েছে। তাতে বোঝা গিয়েছিল, পুলিশ সব ব্যাপারটা না জানলেও একটা খবর নিশ্চয় পেয়েছিল। খুবই স্বাভাবিক, রাত্রি দুটোর সময় ভগবতীদিদির বাড়িতে লোকজন এলে, পুলিশ খোঁজ করবেই, কারণ সেই বাড়িটার ওপর পুলিশের যে একেবারেই সন্দেহ ছিল না, তা না।
সুজিত উঠে দাঁড়াল। ধীরেশ বলল, কিন্তু এর দ্বারা কী প্রমাণ করতে চান, আমি পুলিশকে খবর দিয়েছিলাম?
সুজিত বলল, সেটা আপনার স্বীকারোক্তি থেকে বোঝা যাবে। এবার আপনি আসল কথা কবুল করুন। আর আপনাকে সময় দেওয়া যাবে না।
ধীরেশ বলল, কিন্তু সুজিতবাবু, আমি–
সুজিত বাধা দিয়ে বলে উঠল, মরতে আপনাকে হবেই ধীরেশ গাঙ্গুলি, ধ্রুব হত্যার প্রতিশোধ চাই-ই, কিন্তু তার আগে আপনি স্বীকার করলেই ভাল করতেন।
সুজিত কঠিন গলায় অত্যন্ত দ্রুত কথাগুলো বলল, তারপরেই ডাক দিল, কেষ্টদা।
কেষ্টদাকে দরজার বাইরে অন্ধকার থেকে জেগে উঠতে দেখা গেল। হাতে সেই ধারালো দা। তার দৃষ্টি এখন সুজিতের দিকে না, ধীরেশের দিকে। বাইরের থেকে তার মোটা নিচু ক্রুদ্ধ গলা শোনা গেল, আর দেরি করছ কেন?
সুজিত বলল, না, আর দেরি না কেষ্টদা।
কেষ্টদার গায়ে তখনও একটা পাতলা জামা। বাইরে উত্তরের ঠাণ্ডা বাতাস। কিন্তু তার যেন শীত নেই। সে ঘরে এসে ঢুকল। ধীরেশ তার দিকে চেয়ে আস্তে আস্তে দেওয়াল ধরে উঠে দাঁড়াল। সুজিত বলল, কিন্তু কেষ্টদা, ধীরেশ গাঙ্গুলি আমার কাছে প্রমাণের কথা বলছিল। সেই প্রমাণ আমি দেব, শেষ প্রমাণ তুমি দেবে, তারপরে আমরা আমাদের কাজ করব। ওঁকে ডেকে নিয়ে এসো।
কেষ্টদা একবার ধীরেশের দিকে তাকিয়ে, আবার অন্ধকারে চলে গেল। ধীরেশ প্রায় চুপি চুপি স্বরে জিজ্ঞেস করল, কে আসছেন?
দেখতেই পাবেন।
.
একটু পরে দুজনেই পায়ের শব্দে দরজার দিকে তাকাল। একজন মহিলা এসে দাঁড়ালেন। বিধবা, থান পরা, ফরসা, কাঁচায় পাকায় ধূসর মাথার চুলের ওপরে থানের আঁচলে খানিকটা ঘোমটা টানা। থানের ওপরে একটা মোটা চাদর। কপালে, আর চোখা নাকের পাশে গভীর রেখা। বড় বড় চোখ দুটি এমনিতেই শান্ত, কিন্তু ধীরেশের দিকে চোখ পড়তেই, সেই চোখের দৃষ্টি যেন ঠাণ্ডা আর কঠিন হয়ে উঠল। ধীরেশ কিছু বলতে চাইল, কিন্তু তার ঠোঁট দুটো একবার নড়ল মাত্র, কথা বলতে পারল না। সুজিত ডাকল, আসুন ভগবতীদিদি।
ভগবতীদিদি ঘরের মধ্যে এসে ঢুকলেন। চাদরের মধ্যে তাঁর একটা হাত ঢাকা। আর একটা হাত বাইরে বুকের ওপর। অল্প বয়সে বিধবা হয়েছিলেন। দুই ছেলের মধ্যে, একজন বিয়াল্লিশের আগস্টে পুলিশের গুলিতে মারা গিয়েছে, আর এক ছেলে এখন কারখানায় কাজ করে। মা ছেলে দুজনেই পার্টি মেম্বার। ভগবতীদিদি সুজিতের দিকে চোখ ফেরালেন। সুজিত বলল, ভগবতীদিদি, আমি জানতাম, ধীরেশ গাঙ্গুলি সহজে ভাঙবে না, তাই আপনাকে আসতে বলেছিলাম।
বয়সের ভারে ভগবতীদিদির গলা একটু মোটা। বললেন, সে মনুষ্যত্ব ওর নেই, জানি। ও ধরেই নিয়েছে, রাজনীতি আর বিপ্লব করতে হলে, নেতা হতে হলে, মনুষ্যত্বের কোনও দরকার নেই। ও এখনও বহাল তবিয়তে চালিয়ে যাচ্ছে, পার্টিতে রয়েছে। ওকে প্রমাণ দিয়েই বা লাভ কী।
কেষ্টদা পেছন থেকে বলে উঠল, আমিও তাই বলি।
সুজিত বলল, ধীরেশ গাঙ্গুলি শেষ জেনে যাক, বিনা প্রমাণে কিছু হয়নি। কোনও খিঁচ রাখতে চাই না। আপনি ওগুলো এনেছেন ভগবতীদিদি?
ভগবতীদিদি বললেন, এনেছি। কিন্তু আসলগুলো তো আমি প্রাদেশিক কমিটির কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি, কপিগুলো নিয়ে এসেছি।
সুজিত বলল, তাতেই হবে, দিন।
ভগবতীদিদি চাদরের ভিতর থেকে কয়েকটা কাগজ বের করে সুজিতের হাতে দিলেন। সুজিত একটা কাগজ নিয়ে ধীরেশের দিকে তাকাল। ধীরেশের ভীত চোখে জিজ্ঞাসা, সে কাগজগুলোর দিকে তাকিয়েছিল। সুজিত জিজ্ঞেস করল, সেই ঘটনার দিন রাত্রে, ধ্রুবকে আপনি কেষ্টদার বাড়িতে আসতে বলেছিলেন।
ধীরেশ যেন একটু ভাবল, বলল, মনে পড়ছে না তো, ডাকবার তো কোনও কারণ ছিল না।
সুজিত ভগবতীদিদির সঙ্গে একবার চোখাচোখি করল। তারপরে সুজিত কেষ্টদার দিকে তাকাল। কেষ্টদা চোয়াল শক্ত করে, ধীরেশের দিকে তাকিয়েছিল। সুজিত বলল, ঠিক আছে, শুনুন, আগে আমি ধ্রুবর দুটো চিঠি পড়ছি, ভগবতীদিদিকে লেখা। অরিজিনাল কপি প্রাদেশিক কমিটির কাছে পাঠানো হয়েছে, এগুলো তার নকল। তারিখ ৯-৯-৪৯, শ্রদ্ধাভাজনীয়াসু ভগবতীদিদি, শেষ পর্যন্ত আপনাকে একটা চিঠি না লিখে পারলাম না। কারোর সঙ্গে একটু প্রাণ খুলে অনেকদিন কথা বলতে পারিনি। আপনার সঙ্গে দেখা হলে বেশিক্ষণ বসে কথা বলবার সময় নেই। মনে হয় আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন না, সেই জন্যই আপনাকে লিখছি। আমি অবিশ্বাসী নই। আমাকে বিশ্বাস করবেন, সেই আস্থা আছে বলেই এ সব কথা আপনাকে লিখতে পারছি। অন্য কাউকে এ সব কথা বললে বা লিখলে, স্থানীয় পার্টিতে একটা গোলমাল লেগে যেতে পারে। আমি অনেকের মনোভাব জানি, কেউ ঠিক নিজেদের কাজকর্মে সন্তুষ্ট না। পার্টির প্রতি গভীর কর্তব্যবোধে সবাই কাজ করছি, তার মধ্যে, আমার এ সব কথা জানতে পারলে, পরিণাম, হতাশা অবিশ্বাস এবং মারামারি।
আমার কাছে, এখন দিনগুলো সব সময়েই কেমন একটা অন্ধকার আর বিষণ্ণতায় ঢাকা বলে মনে হয়। কমরেড নিমাই চৌধুরীর গ্রেপ্তারে আমি বিচলিত। নিজেকে আমার সব সময়ে বিভ্রান্ত মনে হচ্ছে। মাঝে মাঝে ভয় পাচ্ছি, আমাদের অত্যন্ত প্রিয় কমরেড চন্দ্রনাথের মতো, আমি হঠাৎ আত্মহত্যা করে বসব কি না। তবে এতে ভয় পাবেন না, আত্মহত্যা আমি কোনওদিনই করব না, সেজন্য আমি পৃথিবীতে জন্মাইনি। আমাদের সকলেরই অনেক গুরুতর কাজ রয়েছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এ অবস্থা কখনও থাকবে না। এখন একটা অস্বাভাবিক অবস্থা যাচ্ছে, কিন্তু বিপ্লব একটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার, অনেকটা চাষ আবাদের মতো, ঠিক সময়ে কেবল কাজ শুরু করা দরকার। এই সময়ের ব্যাপারটাই আমাকে বিভ্রান্ত করছে। এ কথাটা আজ মুখ ফুটে বলাও বিপদ, কারণ তা হলে, অ্যান্টি পার্টি কথাবার্তার দোষ চাপবে। এখন বলবার কিছু নেই, কেবল করবার আছে।
এর থেকেও যেটা গুরুতর বিষয় বলে মনে হচ্ছে, সেটা হল, আমি বিশ্বাস করি, সৎ আর সাহসী মানুষের যা কিছু গুণ, তা একমাত্র বিপ্লবীদের চরিত্রেই থাকতে পারে। খাঁটি মানুষ ছাড়া বিপ্লব হয় না। কিন্তু এ বিষয়ে ইদানীং আমার মনে নানা প্রশ্ন জাগছে। জাগছে, বিশেষ করে ধীরেশ গাঙ্গুলিকে নিয়ে। সে এখন আমাদের লোকাল পার্টির সর্বেসর্বা, দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। তার কথাবার্তা ভাবভঙ্গি দেখলে, তাকে বস বলতে ইচ্ছা করে।
এই ধীরেশকে আমি দু বছর আগে থেকে জানি। উত্তর কলকাতার কোথাও সে ছিল একটা ক্লাবের ব্যায়ামবীর, পাড়ায় বেশ প্রতিপত্তি, মারামারি করতে ওস্তাদ। ছেচল্লিশের দাঙ্গায় সে হিরো হয়েছিল, হাতে তার প্রচুর রক্তের দাগ। তারপর সে ওখানকার লোকাল একজন পার্টি লিডারের সংস্পর্শে আসে। পার্টির সভ্যপদ পায়, একজন বিপ্লবী হয়ে ওঠে। এ ভাবে সভ্যপদ পাওয়া এবং বিপ্লবী হয়ে ওঠা, আমার কাছে খুব বিপজ্জনক ব্যাপার বলে মনে হয়। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাবাজ থেকে রাতারাতি বিপ্লবী হয়ে ওঠা একটা বিস্ময়কর অবিশ্বাস্য ব্যাপার। যদি মেনেও নিই, এ ধরনের এলিমেন্ট পার্টিতে ঢুকে পড়া অসম্ভব, কিন্তু তারা নেতৃপদে উন্নত হয়ে উঠতে পারে কী করে, বুঝতে পারি না। ধীরেশ সম্পর্কে যা ভাবছি, তা যদি সত্যি হয়, তা হলে বুঝতে হবে, পার্টির নীতি এবং পার্টি যন্ত্রের কাজের মধ্যে, কোথাও ফাঁক আছে। যাই হোক, ধীরেশ হিন্দিতে ভাল কথাবার্তা বলতে পারত বলে, ট্রেড ইউনিয়নের দিকে চলে আসে। আমাদের এ অঞ্চলে সে আগেও কয়েকবার ঘুরে গিয়েছে।
পুরনো নেতৃত্ব, পাটির নুতন নীতিকে কার্যকরী করতে পারবে না, সেজন্য ধীরেশকে আমাদের এ অঞ্চলে ওপর থেকে পাঠানো হয়েছে। এতে আমি আপত্তির কিছু দেখি না, হয়তো সেটা ঠিকই। কিন্তু ধীরেশের আচার আচরণ বড় অস্বস্তিকর। দোহাই ভগবতীদিদি, ধীরেশের প্রতি ঈর্ষায় আমি কিছু বলছি, ভাববেন না। সেদিক থেকে যদি বলেন, তা হলে আমার মনে হয়, এখানকার পার্টির মধ্যে, সকলের কাছে, সে এখনও একজন বহিরাগত ছাড়া কিছু না। এখানকার কারোর ভিতরেই সে প্রবেশ করতে পারেনি। আমি বুঝতে পারি। একটা ছোট নতুন রিক্রুটেড গ্রুপ ধীরেশের খুব বিশ্বাসী। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তারাই কুরিয়রের কাজ করে। তা করুক, কিন্তু অধিকাংশের মনে, ধীরেশ সম্পর্কে এই রকম মনোভাব থাকা ভাল না, বিশেষ সে-ই যখন নেতা। আমাকে সে কিছুতেই যেন মন থেকে বিশ্বাস করতে পারে না। এমন সব কথা বলে, যা অপমানকর। ভীরু কাপুরুষ বিপ্লববিরোধী এ সব কথা সবসময়ে তার মুখে লেগেই আছে। নিজেকে আমি অত্যন্ত বিচ্ছিন্ন বোধ করছি। পার্টির ওপর মহলে যোগাযোগ করার কোনও উপায় নেই, আর সেটা নীতিবিগর্হিত এবং অনুচিত।
এখন অনেক রাত হয়েছে, আমি আপনাকে এ চিঠি লিখছি, আমার আস্তানায় বসে নয়। আমার আস্তানা উড়ে পুড়ে গিয়েছে, এতক্ষণে সেখানে পুলিশের পাহারা বসে গিয়েছে। বিশেষ করে এই ঘটনা লেখবার জন্যই চিঠি। আর আপনাকে লিখছি, আপনার যথেষ্ট বয়স হয়েছে, আপনি এ সংবাদ শুনে উত্তেজিত হবেন না, শান্তভাবে ভেবে চুপ করে থাকতে পারবেন। আজ সন্ধেবেলা ধীরেশ হঠাৎ আমার আস্তানায় আসে। আপনি জানেন, আমি একেবারে শ্রমিক বস্তির মধ্যে একটা ঘরে থাকি, যেটা আমার আত্মগোপনের পক্ষে প্রশস্ত। ধীরেশ একটা ব্যাগ হাতে নিয়ে এসে বলল, ব্যাগটা সে আমার ঘরে রেখে, ঘণ্টাখানেক ঘুরে আসবে। ব্যাগের মধ্যে কী ছিল, আমি জানতাম। যদিও ব্যাপারটা সম্পূর্ণ পার্টি নির্দেশের বিরোধী। কিন্তু নিতান্ত জরুরি সাময়িক প্রয়োজনে, আপত্তির কোনও কারণ দেখিনি। সে চলে যাবার মিনিট দশেক পরে, আমি ঘরে তালা বন্ধ করে, শুখালু তাঁতির ঘরে একটু চা খেতে যাই। ওর ঘরেই আমার খাবার ব্যবস্থা ছিল। শুখালুর ঘরে যাবার মিনিট দুয়েক পরেই, একটা প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ। আমি ছুটে বাইরে গেলাম, দেখলাম, আমার ঘরের খোলার চাল ফুটো হয়ে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। তাড়াতাড়ি শিকল খুলে ফেললাম। অন্যান্য ঘর থেকেও সবাই বেরিয়ে এসে ভয়ে চেঁচামেচি জুড়ে দিয়েছে। দেখলাম আমার ঘরের একদিকের মাটির দেওয়াল অনেকখানি ভেঙে পড়েছে। ভাগ্য ভাল, পাশের ঘরে তখন কেউ ছিল না। আমি তাড়াতাড়ি কয়েকটি কাগজ খুঁজলাম, ভাগ্যের জোরে সেগুলো পেয়েও গেলাম, কারণ ওগুলো ছিল একটা টিনের স্যুটকেশে। ওগুলো নিয়ে, ভিড়ের মধ্যে বেরিয়ে এসে শুখালুকে খালি বলে এসেছি, আমার আসল নামটা যেন কেউ না জানে, পুলিশ এখুনি এসে পড়বে। পুলিশ এসেছিল খবর নিয়েছি, এখনও সেখানে পাহারা আছে, কিন্তু শুখালুকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে নিয়ে গিয়েছে। তবে আমার এটুকু বিশ্বাস আছে, শুখালু কিছুই স্বীকার করবে না।
কিন্তু সমস্ত ব্যাপারটা এতই বিভ্রান্তিকর, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আরও বিভ্রান্তিকর এই জন্য যে ধীরেশের আস্তানায় খবর দেওয়া সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে তার কাছ থেকে কোনও খবর পাইনি, বা সে কিছু বলেওনি। এতে কোনও সন্দেহের কারণ আছে কি না, আমি জানি না। সে কথা বলবার সময় এখনও আসেনি তবে এ বিষয়ে আমার কোনও সন্দেহ নেই, আমাদের এলাকায় কেউ জেলের বাইরে থাকবে না, সবাইকেই যেতে হবে। একটা কথা, বিপুলের আচরণ আমার ভাল লাগছে না, সে প্রকাশ্যেই ধীরেশের সঙ্গে বিবাদ করছে। এতটা মরিয়া হয়ে ওঠা উচিত না।
আপনি সাবধানে থাকবেন। শ্রদ্ধা ও অভিনন্দনান্তে, ধ্রুব।
চিঠিটা পড়া শেষ হলে, সুজিত ধীরেশের দিকে তাকাল। ভগবতীদিদি আর কেষ্টদা, ধীরেশের মুখের দিকেই তাকিয়েছিল। চিঠি পড়া শেষ হতে ভগবতীদিদির বড় একটা নিশ্বাস পড়ল। তিনি মাটির দিকে তাকালেন, তাঁর গলা শোনা গেল, ধ্রুবর মুখটা আমি দেখতে পাচ্ছি। ওর চোখ সব ব্যাপারে ছিল, সকলের দিকে ছিল। আহ্, ওর মতো মানুষের কী দুর্গতি, কীভাবে মরেছে।
ধীরেশ চোখ তুলে ভগবতীদিদির দিকে তাকাল, আবার সঙ্গে সঙ্গেই চোখ নামিয়ে নিল। সে এখনও দেয়ালটা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। কেষ্টদা বলে উঠল, এমন একজন নেতা আর কবে আসবে জানি না। সে আমাদের ঠিক বুঝত।
ধীরেশ মুখ তুলল না আর। সুজিত দ্বিতীয় চিঠি খুলল, পড়তে লাগল, তারিখ ১২-১০-৪৯। ভগবতীদিদি, আবার আপনাকে চিঠি লিখছি। আগের ঘটনার জন্য ধীরেশ একটা মামুলি ভুল স্বীকার করেছিল। এর মধ্যে একদিন কথায় কথায় ধীরেশকে বলেছিলাম, আমি মারা যেতে পারতাম। তার জবাবে সে বলল, তা যেতে পারতেন, সেটাও একটা ভুলেরই অঙ্গ হত। কথাটা হয়তো সত্যি, কিন্তু ধীরেশ এমন ভুরু বাঁকিয়ে, ঠোঁট কুঁচকে বলল, নিজেকে বড় অকিঞ্চিৎকর করুণ বলে মনে হতে লাগল। এটা হয়তো আমারই দুর্বলতা। তবে আমার মনের অবস্থার কোনও পরিবর্তন হচ্ছে না। আমি বিচ্ছিন্নতা বোধ কাটিয়ে উঠতে পারছি না, বিভ্রান্তি বাড়ছে বই কমছে না।
এবার আপনাকে আর একটা খবর দিই। তিন দিন আগে আমাকে কোনও কারণে গঙ্গার ওপারে যেতে হয়েছিল। সন্ধ্যার অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে আমি চুনুরিপাড়ায় গিয়েছিলাম, হারু মাঝির নৌকায় লুকিয়ে যাব বলে। হঠাৎ ঘাটে এসে আমার সঙ্গে দেখা করল ধীরেশ। সে অবিশ্যি জানত, আমি ওপারে যাচ্ছি। তার হাতে একটা প্যাকেট, প্রায় এক ফুট স্কোয়ার, আট ইঞ্চির মতো মোটা। প্যাকেটটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ওপারে নিখিলের হাতে এটা পৌঁছে দেবেন। নিখিল ঘাটেই থাকবে। আমি জানতে চাইলাম, ওতে কী আছে। ধীরেশ রেগে নীতির প্রশ্ন তুলল, আমার নাকি জিজ্ঞেস করবার অধিকার নেই। এই প্রথম আমি ধীরেশের অবাধ্যতা করলাম। ওকে বললাম, কী নিয়ে যাচ্ছি, জানা না থাকলে আমার পক্ষে নিয়ে যাওয়া সম্ভব না। ধীরেশ প্রথমে বিদ্রূপ করল, ভয় পাচ্ছেন? তারপরে সে রক্তচক্ষু করে রাগে ফেটে পড়ল, কিন্তু মনে রাখবেন, আপনি পার্টির নির্দেশ অমান্য করছেন। আমি বললাম, পার্টির নির্দেশেই আমি ওপারে যাচ্ছি। সে বলল, এটাও পার্টিরই নির্দেশ।তবু আমি রাজি হতে পারলাম না। ব্যাপারটা আমার ভাল লাগেনি।
তারপরে যখন দেখলাম, আমার সঙ্গে সেও হারু মাঝির নৌকায় উঠল, প্যাকেটটা নিয়ে, তখন আমার মনটা খচখচ করছিল। আমি নিলাম না বলেই তাকে যেতে হচ্ছে, এই ভেবেই মনটা খচখচ করছে। ধীরেশ একেবারে গলুয়ের ধারে এক পাশে বসেছিল। একবার আমার মনে হল, একটা হালকা বারুদের গন্ধ যেন পেলাম। তারপরেই হঠাৎ জলের মধ্যে একটা শব্দ পেলাম, আর ধীরেশের গলা শুনতে পেলাম, এ হে, প্যাকেটটা হাত ফসকে জলে পড়ে গেল। হারু মাঝি বলে উঠল, তা হলে কী হবে। এত জলে তো আর খুঁজে পাওয়া যাবে না, সোঁতে টেনে নিয়ে যাবে। ভগবতীদিদি, কেন জানি না, আমার শিরদাঁড়াটা একবার কেঁপে উঠল। হয়তো, সবটাই অমূলক, কিন্তু অন্ধকার গঙ্গার ওপরে, মনটা কী রকম যেন পঙ্গু হয়ে গেল। ওপারের ঘাটে গিয়ে নিখিলকেও দেখতে পেলাম না। সেই রাত্রিটা আমার ওপারেই থাকবার কথা ছিল। হারু মাঝিকে পরের দিন একই সময়ে ঘাটে এসে আমাকে নিয়ে যাবার কথা বলে দিলাম। ধীরেশ আর নামল না, সে হারু মাঝির সঙ্গে আবার ফিরে গেল। আমি তাকে কোনও কথা জিজ্ঞেস করিনি, সেও আমাকে কিছু বলেনি। কিন্তু ওপারে আমি যেখানে গিয়েছিলাম, সেখানে নিখিলের দেখা পেয়ে গেলাম। কথাটা তাকে জিজ্ঞেস করব কি না, ভাবছিলাম। সে আমাকে কিছুই জিজ্ঞেস করেনি। ধীরেশের বিশেষ বন্ধু নিখিল। ওরা একসঙ্গে কলকাতা থেকে আমাদের এলাকায় এসেছিল। শেষ পর্যন্ত আর না থাকতে পেরে তাকে জিজ্ঞেস করেই ফেলেছিলাম, তার ঘাটে থাকবার কথা ছিল কি না। সে প্রথমে অবাক হয়ে বলল, না, কেন? আমি ধীরেশের কথা তাকে বললাম, প্যাকেটের কথাও বললাম। নিখিল একটু চুপ করে রইল, তারপরে যেন হঠাৎ মনে পড়েছে, এমনিভাবে জানাল, হ্যাঁ হ্যাঁ, এরকম একটা কথা ছিল বটে। অবাক হওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। এপারে ওপারে যারা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছে, সেই নিখিল একটা কাজ একেবারে ভুলে গেল কী করে।
আরও অবাক লাগছে, তিন দিন হয়ে গেল, ধীরেশ এ বিষয়ে আমাকে আর কিছুই বলেনি। সে যেভাবে আমাকে শাসিয়েছিল, তাতে আমি একটা শাস্তিমূলক কোনও কিছুর আশঙ্কা করছিলাম। এখনও পর্যন্ত তার কিছুই দেখছি না। মরতে আমার ভয় নেই ভগবতীদিদি, সমস্ত পরিবেশের আর পরিস্থিতির অস্বস্তি যেন এক এক সময় ধৈর্যচ্যুতি ঘটাচ্ছে। কিন্তু আমার বিশ্বাস নষ্ট হয়নি। এই বিচ্ছিন্নতা, এত বিভ্রান্তি সত্ত্বেও এই বিশ্বাস আছে, এ অবস্থার পরিবর্তন হবে। মাঝে মাঝে আমার অদ্ভুত সব গল্প মনে পড়ে যায়। কেরেনসকি সরকারের সঙ্গে বলশেভিকদের লড়াই হচ্ছিল, তখন ছিনতাই ডাকাত মস্তানরাও নিজেদের সুযোগ সন্ধানের জন্য পথে বেরিয়ে পড়েছিল, একটা উপন্যাসে পড়েছিলাম। কাউকে কাউকে দেখে আমার সেরকম মনে হলেও বর্তমান অবস্থাকে একটা ট্রানজিশনের পিরিয়ড বলে মনে করি না, যে, এই উনপঞ্চাশে তারাও পথে বেরিয়ে পড়েছে। আজ এখানেই শেষ করলাম। আমার শ্রদ্ধা ও অভিনন্দন জানাই, ধ্রুব।
চিঠিটা শেষ করে সুজিত তাকাল ধীরেশের দিকে। ধীরেশ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তার ঘাড়ে যেন আর শক্তি নেই, মাথাটা বুকের কাছে ঠেকে আছে, হাত দুটো দু পাশে ঝুলে পড়েছে। সুজিতের চোখে মুখে যেন ধ্রুবর চিঠির ঝলক। ভগবতীদিদি আর কেষ্টদাও ধীরেশকে দেখছে। সুজিত বলল, ট্রানজিশন পিরিয়ড না, আর মাস্তানরা পথেও বেরিয়ে পড়েনি, তারা কেউ কেউ আমাদের ভিতরে ঢুকে পড়েছিল।
ধীরেশের দিকে চেয়ে সে কথাগুলো বলল, তারপরে জিজ্ঞেস করল, কী ছিল সেই প্যাকেটে ধীরেশ গাঙ্গুলি, এক্সপ্লোসিভ?
ধীরেশ একবার মাথা তুলে সুজিতের দিকে তাকাল। তার গলাটা শোনাল অসুস্থ রুগ্ন ক্ষীণজীবীর মতো, এক্সপ্লোসিভ? না তো।
এখনও মিথ্যা? ওটা তা হলে দ্বিতীয় চেষ্টা ছিল।
ধীরেশের মাথা আবার ঝুলে পড়ল, সে কোনও কথা বলল না। ভগবতীদিদি ভারী গলায় বললেন, কিন্তু কেন, সংসারের এত লোক থাকতে ধ্রুবর মতো ছেলেকে কেন মরতে হয়। সরকার মারত, পুলিশ মারত, বুঝতে পারতাম, কিন্তু ঘরেই জল্লাদ। ধ্রুবর বদলে কি আমাদের কাউকে দিয়ে ওর কাজ মিটত না।…
ভগবতীদিদির গলা যেন নিচু হয়ে ডুবে গেল। ধীরেশের শরীরটা নড়ে উঠল, তার হাত দুটো মাটির দেওয়ালে যেন কিছু হাতড়াতে লাগল, আর তার জুতো পরা একটা পা পিছলে খানিকটা এগিয়ে এল। সুজিত বলল, ভগবতীদিদি, ধ্রুবকে আসতে বলে যে চিঠিটা ধীরেশ গাঙ্গুলি দিয়েছিল, সেটা দিন তো।
ভগবতীদিদি তখন নীচের দিকে মুখ করে আছেন। সেইভাবেই চিঠির কপিটা এগিয়ে দিলেন। সুজিত পড়ল, তারিখ-বিহীন চিঠি, কমরেড ধ্রুব, আপনার সঙ্গে আমি একটু বসতে চাই! আমার মনে হয়, আপনার সঙ্গে আমার একটা ভুল বোঝাবুঝি চলছে। পার্টির পক্ষে এটা ক্ষতিকর। আপনি আজ রাত্রে, কেষ্টদার বাড়িতে এলে ভাল হয়। বিপ্লবী অভিনন্দনসহ, ধী। পড়া শেষ করে সুজিত কেষ্টদার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, এই চিঠিটা তুমি কোথায় পেয়েছিল কেষ্টদা?
কেষ্টদার মোটা স্বর শোনা গেল, সেই রাত্রের পরের দিন, এ ঘরের মেঝেয়।
সুজিত জ্বলন্ত কঠিন চোখে একবার ধীরেশের দিকে তাকাল। বলল, এবার বলো কেষ্টদা, তুমি কী দেখেছিলে সেই রাত্রে, ধীরেশ গাঙ্গুলিকে শেষ প্রমাণ দাও। তারপরে
কেষ্টদা এক পা এগিয়ে এল। ভগবতীদিদি যেন চমকে উঠে কেষ্টদার দিকে তাকালেন। সুজিতও কেষ্টদার দিকে তাকাল। কেষ্টদার শুধু কালো তারা চোখ দুটো যে ধীরেশের শরীরের কোনখানে বিধে আছে, বোঝা যায় না। তার কালো এবড়োখেবড়ো মুখটা এখন শক্ত পাথরের চাংড়ার মতো দেখাচ্ছে। দা ধরা হাতের পেশিগুলো ফুটে উঠেছে। ধীরেশ একবারও মুখ তুলল না, তাকাল না। কেষ্টদার গলা শোনা গেল যেন গর্তের ভিতর থেকে, আমি তখনও বুঝতে পারিনি কী সব্বোনেশে কাণ্ড ঘটতে যাচ্ছে। ধুরবো এল, এই খুনি তখন ঘরের মধ্যে, চারটে বোমা খাটিয়ার সামনে চটের ওপর বেছানো। আর একটার সুতোর পাক তখনও পুরো হয়নি। ধুরবোর সঙ্গে আমার উঠোনে দেখা হল, আমাকে চাদ্দিকে নজর রাখতে বলেছিল। ধুরবো আমাকে জিজ্ঞেস করলে, কেমন আছ কেষ্টদা। বললাম, ভাল। জানতাম না, তার সঙ্গে আর এ জীবনে আমার কথা হবে না…।
কেষ্টদার কথা হঠাৎ থেমে গেল। আর ধীরেশের গলায় একটা কী রকম শব্দ শোনা গেল। তার ঝোলানো হাত দুটো তখন বুকের কাছে জামা খামচে ধরেছে। ধীরেশের গলার শব্দ শুনে, কেষ্টদা তৎক্ষণাৎ হিসিয়ে উঠল, কী, কী? কী মিছে কথা বলবে, তাই ভাবছ?
ধীরেশ মাথা নাড়ল। তার ফিসফিসে স্বর শোনা গেল, না না…।
সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে কেষ্টদা বলল, ধুরবো যেয়ে ঘরে ঢুকল, এই খুনি তখন খাটিয়ায় বসে সিগারেট ফুঁকছিল, আমি অন্ধকার উঠোন থেকে দেখছিলাম। অথচ ও ঘরে সিগারেট ফোঁকা বারণ। ধুরবোকে ডেকে ও খাটিয়ায় বসাল, তা পরে কী যেন বললে, বলে ধরবোকে ঘরে রেখে হঠাৎ ঘর থেকে বেইরে এল। ভাবলাম, পেসাব করতে যাচ্ছে। কিন্তু ঘর থেকে বেইরে, খানিকটা গিয়ে, অন্ধকারে দাঁড়াল, ঘরের দিকে দেখতে লাগল। আর তখন-তখন এই বেইমানের হাতে সিগারেটটা ছেল না, তা’পরেই…।
কেষ্টদার গলাটা চড়ে উঠল। ধীরেশের গলায় কী রকম একটা শব্দ হল, আর ধপাস করে, উপুড় হয়ে সে মেঝেয় আছড়ে পড়ল। কেবল শোনা গেল, মারো, আমাকে মেরে ফ্যালো…।
কেষ্টদা চিৎকার করে উঠল, তোকে টুকরো টুকরো করব…।
ভগবতীদিদি হঠাৎ কেষ্টদার হাত চেপে ধরলেন। ধীরেশের গোঙানো গলা শোনা গেল যেন মাটির মেঝের নীচে থেকে, করো করো।
এই প্রথম দেখা গেল, ধীরেশের প্যান্ট ভেজা, মাটির মেঝেটা ভিজে উঠেছে ওর কোমরের কাছে। তার সরু আর গোঙানো স্বর তখনও শোনা গেল, মারো কেষ্টদা, তোমাদের অমন ভালবাসার নেতাকে আমি মেরেছি। ধ্রুব কেন এত ভালবাসার নেতা ছিল, আমি সহ্য করতে পারিনি। সকলের ওপরে থেকেও কোনওদিন তোমাদের মধ্যে ঢুকতে পারিনি, তোমাদের সকলের মধ্যে ধ্রুবর মুখ দেখেছি ধ্রুব ধ্রুব–আমার এত ক্ষমতা–।
শেষ দিকে ধীরেশের গলায়, কেবল ভাষাহীন গোঙানি বাজতে লাগল, অনেকটা মূর্ছা রুগীর মতো, আর সেইরকমভাবেই, তার দুই থাবা দিয়ে সে মাটির মেঝেটাকে খামচাতে লাগল, দলা দলা কাঁচা মাটি উঠে গেল। তারপরে তার হাতের শক্তি যেন ফুরিয়ে গেল, এলিয়ে পড়ে রইল। তার সমস্ত শরীরটা মড়ার মতো দেখাচ্ছে।
কেষ্টদার কালো তারায় তখনও আগুন, কিন্তু ঘটনার আকস্মিকতার চমক তার পাথর চাংড়া মুখে। ভগবতীদিদি তখনও তার হাত ধরে আছেন। তিনি সুজিতের দিকে তাকালেন। তাদের চোখাচোখি হল। সুজিতের শক্ত কঠিন মুখটা এখন শান্ত, কিন্তু চোখে বিস্ময়। ও ধীরেশের দিকে দেখে আবার ভগবতীদিদির দিকে তাকাল। ভগবতীদিদি ধীরেশকে দেখলেন, বললেন, ওর জ্ঞান নেই। চলো আমরা বাইরে যাই।
কেষ্টদা সুজিতের দিকে তাকাল। সুজিতের একটা নিশ্বাস পড়ল, বলল, হ্যাঁ, চলুন।
ভগবতীদিদি কেষ্টদার হাত ধরে বাইরে এলেন, পিছনে পিছনে সুজিত। তিনজনেই এসে অন্ধকার উঠোনে দাঁড়াল। চারদিক নিঝুম, গ্রাম ঘুমোচ্ছে, কেবল ঝিঁঝির ডাক শোনা যাচ্ছে। কয়েক মুহূর্ত কারোর কথা শোনা গেল না। একটু পরে সুজিতের গলা শোনা গেল, যে ধীরেশকে আমি নিয়ে এসেছিলাম, এ সে নয়, আমি বুঝতে পারছি। ধ্রুবর জীবনের বিনিময়ে, ও এখন নিজেই মরতে চায়।
ভগবতীদিদি বললেন, না, ধীরেশের মরা চলে না। যখন এখানে আসি, তখনও ওকে মানুষ বলে মনে করতে পারিনি, এখন ওকে একটা মানুষের মতো লাগছে, যেটা আমরা, সবাই হতে চাই, আরও বেশি করে।
কয়েক মুহূর্ত কেউ কোনও কথা বলল না। তারপর সুজিত বলল, কেষ্টদা, আমি ভগবতীদিদিকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে চলে যাচ্ছি।
কেষ্টদা যেন অবাক হয়ে বলল, তোমরা যাচ্ছ? ধীরেশের কী হবে?
ভগবতীদিদি বললেন, ওর যা ইচ্ছে, তা-ই যেন করে। এখন ওর ভার তোমার ওপর রইল।
আমার ওপর?
হ্যাঁ।
ভগবতীদিদির সঙ্গে সুজিত বেড়ার দিকে এগোল। কেষ্টদা হাতের দাটা একবার দেখল। সামনেই একটা মাঝারি খড়ের গাদা ছিল, এগিয়ে গিয়ে দাটা তার মধ্যে ঢুকিয়ে দিল। বলল, দাঁড়াও, একটা বাতি নিয়ে আসি, এগিয়ে দেব।
সুজিতের গলা শোনা গেল, দরকার হবে না কেষ্টদা, আমরা ঠিক যাব।
তবু কেষ্টদা ওদের সঙ্গে সঙ্গে, রেলের গেট অবধি এল। ফিরে যাবার সময়ে, সুজিত আর ভগবতীদিদি তার দিকে ফিরে তাকাল। অন্ধকারে কেষ্টদার মুখের কিছুই দেখা যায় না। কেবল তার মোটা গলা শোনা গেল, এসো তালে। এতখানি রাস্তা যাবে একটা রিকশাও তো নেই।
আত্মীয় বিদায়ের মতো কোমল তার গলা। ভগবতীদিদি বললেন, দুজনে কথা কইতে কইতে চলে যাব। তুমি যাও কেষ্ট।
কেষ্টদার যেন হঠাৎ কিছু মনে পড়েছে, এমন ব্যস্তভাবে বলল, হ্যাঁ যাই।
বলেই সে পিছন ফিরে হাঁটা ধরল। ভগবতীদিদি তাকিয়ে দেখলেন। সুজিত বলল, ঠিক আছে ভগবতীদিদি, চলুন যাই।
তথাপি ভগবতীদিদি একবার ব্যগ্র গলায় ডেকে উঠলেন, কেষ্ট।
অন্ধকার থেকে কেষ্টদার গলা ভেসে এল, ঠিক আছে ভগবতীদিদি, তোমরা যাও। আমি একটা মানুষ গো!
ভগবতীদিদিকে নিয়ে সুজিত লাইন পার হল। পার হবার সময়, লাইনে পা দিয়ে মনে হল, দূর থেকে গাড়ি আসার একটা ক্ষীণ স্পন্দন যেন বাজছে। এদিকটায় আলো নেই, রাস্তাটাও ভাল না। দুজনে সাবধানে হাঁটতে লাগল।