মানুষের হাহাকার – উপন্যাস – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
এক
রোজকার মতো আজও সে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনতে পেল। প্রথমে আস্তে, পরে বেশ জোরে। কেউ ডাকছে, কীরে ঘুম ভাঙল না। কত ঘুমোবি। কিন্তু কোনো সাড়া শব্দ না পেলে কেমন ভীতু গলা হয়ে যায় দাদুর। তখন আরও জোরে—নানু ও নানু, ঘুমোচ্ছিস না জেগে আছিস? এত বেলায় কেউ ঘুমোয়! ওঠ, আর কত ঘুমোবি? কথা বলছিস না কেন?
সে সকালে ঘুম থেকে উঠে একদিন চুপচাপ বসেছিল, ইচ্ছে করেই সাড়া দেয়নি। ইচ্ছে করেই ঘুম থেকে উঠে দরজা খোলেনি, জানালা খোলেনি—কেমন আর্ত গলা তখন দাদুর, ‘নানু দরজা খোল ওঠ ভাই।’ নিচ থেকে ছোট মাসি, দিদিমা পর্যন্ত ছুটে এসে দরজায় হামলে পড়েছিল। ‘নানু নানু!’ সারা বাড়িটা তটস্থ হয়ে উঠেছিল। ভারি মজা। এরা সবাই ভেবেছে, সেও একটা কিছু তার বাবার মতো করে বসবে।
নানু বিছানায় পাশ ফিরে অত্যন্ত সহিষ্ণু গলায় সাড়া দিল—’কী হচ্ছে!’ এই একটা কথাই যথেষ্ট। সে ঘরেই আছে, সে জেগে আছে, কিছু একটা করে বসেনি, তার সাড়া পেলেই দাদু এটা বেশ বোঝে। তারপর বীণাদি আসবে—’তোমার চা দাদাবাবু’। চা নিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে ওই একটি কথাই বলবে, আর কিছু বলবে না। ওরা কি জানে, চা—এর কথা শুনলে নানু আর বিছানায় শুয়ে থাকতে পারবে না। দরজা খুলে দেবে।
নানু উঠে পাজামা পরল। একটা গেঞ্জি গায়ে দিয়ে দরজা খুলে দিল। বীণাদির যা স্বভাব, ‘খুউব! চা রাখার সময় ওই আর একটি কথা। তারপর টেবিলে চা রেখে আর কথা না বলে দরজাটা ভেজিয়ে চলে যায়। এটাও নিয়মে দাঁড়িয়ে গেছে। আগে নানুকে বলতে হত, দরজাটা যাবার সময় ভেজিয়ে দিয়ে যেয়ো। কখনও কখনও ভুলে যেত বাণীদি। এখন অভ্যাস হয়ে গেছে। এই সংসারে সব কিছুই অভ্যাস—এবং মনে হয় নানুর বেঁচে থাকাটাও একটা অভ্যাসের ব্যাপার। এবং দাদুর বিশ্বাস এই অভ্যাসটা নানুর ঠিক গড়ে ওঠেনি। অথবা বাবার মতো সে অভ্যাসটার প্রতি বিরক্ত হয়ে যদি কিছু করে ফেলে। বাবা, তার বাবা। নানুর এ—কথাটাও চায়ে চুমুক দেবার সময় মনে হল। ভারি সুন্দর ছিল তার বাবা দেখতে। খুব উঁচু লম্বা নয়, মাঝারি সাইজের। তার বাবাটির চোখ মুখ ছিল ভীষণ মায়াবী। বাবার কথা মনে হলে, তার চোখ এখনও ঝাপসা হয়ে আসে। সে গোপনে কাঁদে।
শহরের এদিকটায় এখন অনেক নতুন ঘরবাড়ি উঠে যাচ্ছে। সে জানালায় বসে দেখল ক’টা পাখি উড়ে যাচ্ছে ঘরবাড়ি পার হয়ে। বাড়িটা পুবমুখো বলে, সূর্য উঠলেই রোদ এসে যায়। সামনে অনেকটা জমি। সেখানে কিছু ফুলের গাছ। এই যেমন কিছুদিন আগে একটা কলকে ফুলের গাছ ছিল।
সে এখানে আসার পরই দাদু একদিন কলকে ফুলের গাছটা কেটে ফেলল। বাড়ির কাজের লোকটাকে বেশ সতর্ক গলায় ডেকেছিল সেদিন, ‘নিধু গাছটা বুড়ো হয়ে গেল। ফুল হয় না। রেখে লাভ নেই। বরং এখানে একটা শ্বেতজবার গাছ লাগিয়ে দিবি।’ নানু বলেছিল, ‘দাদু এমন সুন্দর গাছটা তুমি কাটছ!’ দাদু হেসেছিল ‘গাছ সুন্দর হয় না। ফুল না হলে গাছ দিয়ে কী হবে।’
—তা ঠিক। সে চলে এসেছিল এবং জানালা থেকে সে দেখতে পেয়েছিল কলকের গোটাগুলি খুব সতর্ক চোখে তুলে নিচ্ছে দাদু। তার ভারি হাসি পেয়েছিল।
চা শেষ হতে না হতেই সে জানে দাদু আবার উঠে আসবে। খবর দেবে, নানু কাগজ এসে গেল। আয়।
সকালে এটাও অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। সেই শৈশবে সে যখন স্কুলে পড়ত, বাবা বেঁচে থাকতে, বাবা ও জ্যাঠামণি তখনও একসঙ্গে এক বাড়িতে, জ্যাঠামণির জন্য ইংরেজি কাগজ—আর বাড়ির সবার জন্য একটা বাংলা কাগজ—সে খেলার পাতাটা প্রথম দেখত, তারপর সিনেমার পাতা, এবং পরে সব কাগজটাই পড়ার অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।
সে চা খাবার সময় দেখল একটা রেলগাড়ি যাচ্ছে। এই জানালাটা দিয়ে অনেক কিছু দেখা যায়। সামনে বড় একটা পুকুর, কিছু গাছপালা, বাড়িঘর, এবং বড় রাস্তা থেকে একটা পথ বেঁকে বাজারের দিকে গেছে। সেখানে চায়ের দোকান, লোহা লক্করের দোকান, একটা ম্যাচ কারখানা, ক্লাব ঘর, ছোট্ট খেলার মাঠ, গোটা দুয়েক তিনতলা বাড়ি, বাড়ির জানালা, একজন বুড়ো মতো মানুষ ব্যালকনিতে বসে থাকে। এবং সব পার হয়ে রেল—লাইন।
এ—ঘরে দুটো জানালা, সামনে পুবমুখী দরজা, তারপর রেলিং ঘেরা বারান্দা। এখানে আসার পর এ—ঘরটাই থাকার মতো মনে হয়েছিল তার। দোতলার এক প্রান্তে আলগা এই ঘরটায় সে কিছু বই আমদানি করেছে। গোপনে সে বইগুলি পড়ে। বইগুলি পড়লেই কেন জানি পৃথিবীটাকে তার বদলে দিতে ইচ্ছে করে। এবং একতলার কোনো শব্দই এখান থেকে শোনা যায় না। ঘরের মধ্যে আছে একটা আলনা। ওটায় সে তার জামাকাপড় রাখে। একটা টেবিল, কিছু বি—কম পার্ট ওয়ানের বই এবং চেয়ার একটা। এক পাশে লম্বা খাট, দুটো মোড়া। সুটকেসটা খাটের নীচে। ওতে টুথ ব্রাস, পেস্ট, দাড়ি কামাবার সাজসরঞ্জাম সব থাকে। যেন কোথাও যাবার কথা থাকে তার সব সময়—সে সেজন্য কাজ হয়ে গেলে আবার স্যুটকেসের ভিতর পুরে রাখে। একটা তাক রয়েছে। ওটা খালি।
মানুষ যেখানেই থাকে সেটা এক সময় বড় নিজস্ব হয়ে যায়। অথচ তার মনে হয়, সে কিছুদিন এখানে থাকবে, তারপর আবার কোথাও চলে যাবে।
বাসা বাড়িতে সে বড় হয়েছে। সে শুনেছে বাড়ি বদলের স্বভাব তার বাবার যেমন বাতিক ছিল, জ্যাঠামণিরও। এক বাড়িতে দু—তিন বছরও কাটত না, সে তার দশ—বারো বছরের জীবনে এটাই দেখে এসেছে। বাবা মরে যাবার পর মার সঙ্গে সে তার দাদুর বাড়িতে চলে এসেছিল। একতলার একটা ঘরে তখন সে তার মায়ের সঙ্গে থাকত। তারপর মেসো খবর পেয়ে পাটনা থেকে চলে এলেন—মাকে বললেন, তুমি আমার ওখানে চল, কিছুদিন বেড়িয়ে আসবে। ওরা চলে গেল সেখানে—তখন অন্য একটা বড় শহরে মেসোর বদলি হবার কথা। বড় মাসি ওদের নিয়ে গাড়ি করে কখনও রাঁচি, কখনও হাজারিবাগ গেছে। কেবল ঘুরে বেড়িয়েছে। সে বোঝে এত বড় একটা শোক সামলে উঠতে মার সময় লেগেছিল। তারপর সংসারে যে কী হয়, সে বুঝতে পারত না। মা একদিন বলল, আমরা একটা বড় শহরে চলে যাব নানু তোমার মেসো আমার জন্য একটা চাকরি ঠিক করেছে। তুমি ওখানেই পড়বে।
বাবার মৃত্যুর জন্য তার এক বছর পড়া হয়নি। পৃথিবীটা ছিল তখন হাহাকারে ভরা। সর্বত্র সে দেখত, তার পাশে পাশে কেউ হেঁটে যাচ্ছে। আর যেন বলছে, নানু ভয় পাবি না। আমি আছি। মানুষ মরে শেষ হয়ে যায় না। সে তার মাকে বলত, মা বাবা এমন কেন বলে? তখন যা হয়ে থাকে, দাদু এবং মা তাকে গয়াতে নিয়ে গিয়ে পিণ্ডদান করাল। প্রয়াগে সে এবং দাদু ত্রিবেণীর জলে ডুব দিল। পৃথিবী থেকে তার বাবার স্মৃতি মুছে দেবার জন্য সংসারে তখন আপ্রাণ চেষ্টা। কেউ ভুলেও বাবার কথা তার সামনে উচ্চারণ করত না। মাও না। কিছুদিন মা পাথর হয়েছিল—তারপর মেসো সেই যে ‘বেড়াতে চল’ বলে নিয়ে গেল সেই শেষ, শোকের শেষ। মার মুখে হাসি ফুটে উঠল। গাড়িতে মা জানালায় মুখ বাড়িয়ে বলেছিল, মনীষদা ওই দেখো চা—ওলা যাচ্ছে। ডাকো, চা খাব।
মেসো বলেছিলেন, গাড়িটা এখানে অনেকক্ষণ থামবে। চলো নীচে নেমে খাই। নানু নামক বালকের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, তুমি বসো। আমরা এক্ষুণি আসছি।
কত আগেকার কথা অথচ মনে হচ্ছে তার, এই সেদিন যেন সব ঘটে গেল। মা নেমে গেল মেসোর সঙ্গে। মেসো কী একটা ঠাট্টা করল মাকে। মা মেসোকে সামান্য ঠেলা দিয়ে কী একটা রসিকতা করল এবং যেন জীবনে কিছুই থেমে থাকে না—সে দেখল তার মা যখন উঠে আসছে, তখন জোর হাসছে মেসোর কথায়।
নানু মাথা নীচু করে বসেছিল তখন। মার এমন হাসি তার একদম ভালো লাগেনি। সে তখনও মাথা নীচু করে চা খাচ্ছে। সে যখন কথা বলে কারও সঙ্গে, মাথা নীচু করে কথা বলে—কীভাবে যেন তার মাথাটা কারা ষড়যন্ত্র করে হেঁট করে দিচ্ছে। প্রথম ষড়যন্ত্রকারী কে? এই প্রশ্নটা অনেকদিন থেকে তার মাথায় ঘুরছে। বিশেষ করে এখানে আসার পরই মনে হয়েছে সব ষড়যন্ত্রকারীদের সে খুঁজে বার করবে। সব আত্মীয়দের বাসায় যাবে—এবং খোলাখুলি সবার সঙ্গে সে বাবার মৃত্যু সম্পর্কিত বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করবে।
এখানে আসার পর বছর পার হয়ে গেল। দাদু সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকে। কোথাও বের হতে দেয় না। যেখানে সে যাবে সঙ্গে দাদু যেতে চাইবেন। মানুষটাকে এক এক সময় তার দারুণ ভালো লাগে, এক এক সময় মনে হয় এই মানুষটার প্রতি তার করুণা হবারই কথা। আবার কখনও কী যে ঘৃণা! সে তখন চিৎকার করে ওঠে, ‘তুমি যাও, দাদু আমার সামনে তুমি এসো না। তুমি তো পি ডবল্যু ডির হেড ক্লার্ক ছিলে। একজন কেরানি কত আয় করে। এই আয়ে এত পয়সা কখনও হয়, মেয়েদের তুমিই নষ্ট করেছ—তোমার মেয়েরা কে কী আমার জানতে বাকি নেই। তখন মনে হয়, ছিঃ ছিঃ দাদুর সম্পর্কে এত সব খারাপ চিন্তা তার মাথায় আসে কী করে!
সকালে উঠে ঘুম ঘুম চোখে চা ভাবা যায় না! চা খেলেই যেন শরীরের সব জড়তা নষ্ট হয়ে যায়। সে টান টান হয়ে ওঠে। রক্ত মাংসে মজ্জায় অস্থিরতা জাগে। সে দাঁড়ায়। জানালা খুলে দিয়ে মুক্ত হাওয়া নেয় বুক ভরে। তারপর নীচে ছোটমাসির দরজায় গিয়ে দেখল, মাসি ঘরে নেই। তার জামা প্যান্ট মাসি জোর করে ঘর থেকে তুলে আনে। ধুয়ে ইস্ত্রি করে আবার রেখে দেয় তার ঘরে। তা রাখেনি। কোথায় রাখল তার জামা প্যান্ট! দাদুর ঘরে ঢুকেই অবাক। মাসি আজ সকাল সকাল দাদুর ঘরে ঢুকে গেছে। দাদু পঞ্জিকার পাতা ওলটাচ্ছে। ওকে দেখেই বলল, বোসো। সে বসল না। মাসির দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার কি কিছু হয়েছে ছোটমাসি?
মিতা সামান্য চোখ কুঁচকে বলল, আমার আবার কী হবে?
না এই বলছিলাম, কেমন দেখাচ্ছে তোমাকে, এত সকাল সকাল এখানে।
দাদু তখন বলল, পাঁচটা আঠারো গতে একাদশী।
নানু বলল, দাদু ছোটমাসি আজ একাদশী করবে!
দাদু জানে, নানুর মাথার মধ্যে কেউ গুণ টেনে নিয়ে যায়। একদিন নানু বলেও ছিল কথাটা। আমার মাথার মধ্যে কেউ গুণ টানে—’গুণ টানে’ এইরকম কথা নানুই বলতে পারে। বরং বলতে পারত, ধুনুরি তুলো ধোনে। তার বন বন ডবকা শব্দ মাথার মধ্যে বাজে। কিন্তু তা না বলে গুণ টানে—ভারি আজগুবি কথাবার্তা নানুর। সুতরাং বুড়ো রাসবিহারী সামান্য তামাকের পাতা মুখে ফেলে দিয়ে বললেন, তোমাকে আজ ছোটমাসির সঙ্গে একটু বেলঘরে যেতে হবে।
নানু বলল, আমার কাজ আছে। বুড়ো রাসবিহারী আবার চোখ তুলে দেখলেন নাতিকে তারপর কিঞ্চিৎ অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বললেন, তোমার এত কী কাজ!
আমার কলেজ আছে। সময় হবে না। মাসি আমার জামা প্যান্ট কোথায়!
মিতা লম্বা ম্যাকসি পরে আছে। চুল ঘাড় পর্যন্ত বর করা। চোখে বাসি আই ল্যাস। রাতে ভালো ঘুম হয়নি। চোখের নীচে রাজ্যের অন্ধকার। দিদিমা কলতলায় কাউকে বকছে। ঠিক এই সময়ে সহসা ছোটমাসির মুখটা বুড়ি হলে কী রকম দেখাবে—এই দিদিমার বয়সে, এবং ভেবেই সে বুঝতে পারল, আগামী ২০২০ সালের ২২ এপ্রিল ছোটমাসি দেখতে হুবহু দিদিমা—যতই চামড়া টান করার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি বের হক—ছোটমাসিকে কেউ আর ছোটমাসি রাখতে পারবে না। বুড়ি দিদিমা, গালে মাংস নেই, ফলস দাঁতে যখন হাঁ করবে—তখন শরীরের সবকিছু জারিজুরি ধরা পড়ে যাবে। সে বলল, মাসি তুমি হাঁ কর তো?
মাসি বলল, হাঁ করে কী হবে?
হাঁ করই না, দেখব।
কী দেখবি?
কোথাকার জল কতদূর গড়াবে ভেবে মিতা বলল, দেখে কী হবে?
কটা দাঁত আছে গুণে রাখব।
দাদু সহসা উঠে দাঁড়ালেন। না, পারা যাচ্ছে না। নানু আমার সঙ্গে এসো।
কোথায়।
চল বসার ঘরে। আমার কিছু বই আছে ওগুলো তুমি গুণবে। তখন নানু ভাবল এক সময় একটা লাইব্রেরি গড়ে তুলেছিলেন দাদু। কপালকুণ্ডলা উপন্যাস মা প্রথম দাদুর লাইব্রেরি থেকে পায়। দাদুর চিন্তাশক্তি, কিংবা বলা যায় বুদ্ধিমত্তা অত্যন্ত প্রখর। দাঁত না গুণে বই গুণতে বলছে। বুড়োটা বড় বেশি চালাক। সে বলল, দাঁত গোনা আর বই গোনা এক কাজ দাদু? তুমি বল, এক কাজ কী না?
রাসবিহারীর কপাল ঘামছিল। ছটি জীবিত কন্যার জনক তিনি। মরে গেলে জামাতারাই তার এই সম্পত্তির মালিক হবে। তিনি এখন তা চান না। কারণ নানু কেন জানি বুকের মধ্যে একটা জায়গা নিয়ে বসে যাচ্ছে। সেই জামাইয়ের মৃত্যু দিন থেকেই—তখন নানুর বয়স আর কত। একটা জাবদা খাতায় তাঁর সব কিছু লিখে রাখার অভ্যাস। তিনি লিখেও রেখেছিলেন। ওটা খুলে আর একবার দেখা দরকার। বেঁচে থাকতে থাকতে আর দুটি কাজ তাঁকে সম্পূর্ণ করে যেতে হবে। এক নম্বর মিতার বিয়ে, দুই নম্বর নানুর জন্য ভালো একটা কাজ এবং সুন্দর টুকটুকে নাত—বউ। তাহলে মোটামুটি লাইফ—সারকল সম্পূর্ণ। একজন মানুষের পৃথিবীতে আর কী লাগে!
মিতার বিয়ের জন্য ভালো একটা ছেলে পেয়েছেন। খোঁজখবর নিতে হবে পাত্রপক্ষ যা চায় মিতার সে—সব গুণ ষোলো আনা আছে। দাবি দাওয়া যথেষ্ট। পাত্র দেখা হয়নি। সেজ—জামাইয়ের অফিসের ক্যালকাটা ব্রাঞ্চে ছেলেটা কাজ করে। এই সব কথাগুলিও রাসবিহারীর মাথায় টরে টক্কা বাজিয়ে গেল। তবু কপাল খুবই ঘামছে। এক বয়সে ভাবতেন, দুটো ডাল ভাতের সংস্থান করতে পারলেই জীবন ধন্য। তারপরের কালে ভাবতেন, সন্তানগুলি বড় হলেই সব কষ্ট দূর হয়ে যাবে। এবং মেয়েরা বড় হতে থাকলে ভাবলেন, বিয়ে দিতে পারলেই লেটা চুকে গেল। কিন্তু এখন দেখছেন, নানুর কিছু একটা না হলে তিনি মরেও স্বস্তি পাবেন না। অথচ এই নানু দিনকে কী হয়ে যাচ্ছে! তিনি বললেন, কাল রাতে এত দেরি হল কেন তোমার ফিরতে?
আচ্ছা দাদু তুমি সত্যি করে বলত, তোমার ছোট মেয়ের দাঁত কটা?
আমি কী করে জানব?
বাবা হবে, অথচ খবর রাখবে না কটা দাঁত মেয়ের?
তুই যখন বাবা হবি, তখন খবর রাখিস সব কিছুর।
কী বললে!
রাসবিহারী প্রমাদ গুনলেন। নানুর চোখ ভীষণ টকটকে লাল। নানুর মাথায় রক্ত উঠে যাচ্ছে। তিনি বললেন, নানু দাদুভাই, আমার শরীর কেমন করছে।
নানু বলল, ডাক্তার ডাকব! ও ছোট মাসি!
না, না, তুই ওপরে যা! আমার শরীর এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে। তারপর মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি হাঁ করে ওকে দেখাতে পার না। তোমার এত গুমর।
নানু দাদুর দুরবস্থা দেখলে খুব স্বাভাবিক হয়ে যায়। তার চোখ দুটো আর লাল থাকল না এবং সে পাশে বসে বলল, দাদু তোমার বয়স হয়েছে। এখনও এত ভাব কেন বল তো। এ—বয়সে মানুষের ঠাকুর দেবতা ছাড়া আর কী থাকে!
নানু মাঝে মাঝে কত ভালো কথা বলে। মনেই হয় না তখন, এই শেষ বয়সের নাতিটা আত্মঘাতী হতে পারে। বরং বিবেচক, বুদ্ধিমান—নানু বড় কর্তব্যপরায়ণ। তিনি বললেন, নানু তোমার জ্যাঠামণি আজ বিকেলে আসবে। বাড়ি থেকো।
সে বলল, বাবার বড় ভাইয়ের কথা বলছ?
এই মুশকিল। কোনো কথা নানু কী ভাবে নেবে বুঝতে পারেন না রাসবিহারী। এখন যা কথাবার্তা নানুর,—তাতে মনে হয় জ্যেঠুর সম্পর্কে তার আর তিলমাত্র শ্রদ্ধা নেই। তিনি নানুর দিকে একবার ভালো করে তাকালেন। মিতা ঘরে নেই। সে কোন ফাঁকে ঘর থেকে বের হয়ে গেছে। কখন আবার নানুর মনে পড়ে যাবে ছোট মাসি দাঁত না দেখিয়েই চলে গেল! সুতরাং রাসবিহারী নানুকে কিছুটা অন্যমনস্ক করে রাখতে চাইছেন। নানুর জ্যাঠামণি অবনীশ এবং তার বউ দুজনেই আসবে। নানুর খোঁজখবর নিতে আসে। কারণ আফটার অল নানু অবনীশের ছোট ভাইয়ের ছেলে। আত্মীয়—স্বজন এমনিতেই প্রীতিশের মৃত্যু নিয়ে নানারকম কথাবার্তা বলে থাকে। আড়ালে এও শোনা যায় অবনীশের বউর স্বার্থপরতা প্রীতিশকে ভীষণভাবে মর্মাহত করেছিল। অবনীশ বিয়ে করেছিল বেশি বয়সে। ওদের এখন একটি মেয়ে। মেয়েটির বয়স আট। বউ শিক্ষকতা করে। ভালো ইস্কুলে মাস্টারি এবং কোচিং—এর আয় থেকে বেশ বাড়িঘর বানিয়ে আদর্শ স্বামী—স্ত্রী এখন তারা। অবনীশ একটা অফিসে আছে।
নানুর দিকে তাকিয়ে এতগুলি কথা রাসবিহারী মনে মনে ভেবে ফেললেন। অবনীশের কথাবার্তায় সব সময়ে খুব বিপ্লবী মেজাজ। রাজনীতি থেকে হাল আমলের সাহিত্য সম্পর্কে অগাধ পাণ্ডিত্য এবং পৃথিবীতে কোথাও কিছু হচ্ছে না, একমাত্র চীন দেশটি সম্পর্কে তার এখনও আস্থা আছে—না হলে যেন সে আর বেঁচে থাকতেও রাজি ছিল না। অবনীশ কথাবার্তা হাফ বাংলা হাফ ইংরেজি ঢং—এ বলতে অভ্যস্ত।
নানু কিন্তু বংশের কোনো কৌলীন্যই পায়নি। নানু দেখতে তার মার মতো কিন্তু ভীষণ লম্বা এবং অল্প বয়সেই দাড়ি গোঁফ উঠে যাওয়ায়, তাকে এই আঠারো উনিশ বছরে একজন পঁচিশ ছাব্বিশ বছরের যুবকের মতো লাগে। সে কখনও দাড়ি কামায়, কখনও কামায় না। কলেজে যায়, তবে কলেজ করে না। এবং যা খবর, তাতে দুশ্চিন্তা একমাত্র সার করে রাসবিহারীকে বেঁচে থাকতে হবে। নানু তার ইচ্ছা অনিচ্ছার কথা একমাত্র তার ছোট মাসিকেই বলে। এবং কখনও কখনও এমন সব সাংঘাতিক কথাবার্তা কানে আসে যে রাসবিহারী নিজের মৃত্যু কামনা করতে বাধ্য হন।
এই যেমন এখন নানু একটা চেক কাটা লম্বা পাজামা পরে স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে বসে কাগজ পড়ছে। চশমা চোখে—খুব অল্প বয়সেই চোখ খারাপ হয়ে যাওয়ায় বাবা তাকে চশমা পরিয়ে গেছে। এখনও সেই চশমাটাই চোখে। চশমার পাওয়ার বদলানো দরকার—কিন্তু মানুষের মনে কী যে থাকে—নানু বাবার দেওয়া চশমা কিছুতেই চোখ ছাড়া করবে না। রাসবিহারী জানে নানুর ইচ্ছা না হলে এই পাওয়ার বদলানোর কম্ম তার কেন, তার প্রপিতামহেরও সাধ্য নেই। ওর মার স্বভাব ঠিক উলটো। যখন যেমন, অর্থাৎ নেই বলে বসে থেকে লাভ নেই, সময়ের সঙ্গে শরীরের সঙ্গে তাল দিয়ে চলার স্বভাব। হাহাকারের মধ্যে একজন মানুষ কতক্ষণই বা থাকতে পারে। তুই ছেলে হয়ে মার দুঃখটা বুঝবি না। অবুঝের মতো মাথা খারাপ করবি। আজকাল তোর মার বয়সে কত মেয়ের বিয়ে হয়—আকছার এ—বয়সটা আজকালকার মেয়েদের প্রায় বিয়ের বয়স। পঁয়ত্রিশ—ছত্রিশ একটা বয়স!
তখনও দুম করে নানু বলে ফেলল, আচ্ছা দাদু তোমার তো বয়েস হয়েছে।
রাসবিহারী বললেন, বয়েস ত হবেই।
এ বয়সে মানুষ কিছু সত্য কথা বলে থাকে।
মানুষ সব সময়ই সত্য কথা বলে।
তুমিও বলেছ?
যখন যেমন দরকার। মানুষের সত্যাসত্য সঠিক কি, মানুষ কখনও বলতে পারে না।
নানু তর্কে যেতে চাইল না। এখানে আসার পর থেকেই ভাবছে, কেবল ভাবছে—কাকে দিয়ে সে আরম্ভ করবে, মাকে দিয়ে, দাদুকে দিয়ে, জ্যাঠামণিকে দিয়ে, না অন্য কাউকে দিয়ে? কিন্তু আজ সকালে মনে হল, দাদুকে দিয়েই শুরু করা যাক। বলল, দাদু, তুমি অনেক বেশি জানো। কিন্তু এটা কি জানো বাবা কেন আত্মহত্যা করলেন?
রাসবিহারী চিৎকার করে উঠলেন, নানু কে বলেছে তোমার বাবা আত্মহত্যা করেছেন?
আমি জানি দাদু, তোমরা যতই গোপন রাখো সব জানি। বাবা কুড়িটা ঘুমের ট্যাবলেট খেয়েছিলেন। বাবা লিখে রেখে গেছিলেন, আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। তার আগের রাতে মা আমাকে নিয়ে তোমার কাছে চলে এসেছিল। ঠিক বলিনি? আমার সব মনে আছে। আমার বাবা, প্রিয় বাবা, আমাকে নিয়ে কত স্বপ্ন দেখতেন। তিনি দুম করে মরে যাবেন কেন, তাঁকে তোমরা সবাই মিলে কিছু একটা করেছ—আমার কাজ সেই কিছুটা কী বের করা।
রাসবিহারী উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর হাত পা কাঁপছিল। তিনি ধীরে ধীরে ঘর থেকে বের হয়ে যাচ্ছেন। নানু চোখ তুলে দেখল, মানুষটা অনেক নুয়ে পড়েছে।
সে বলল, চলে যাচ্ছ কেন দাদু। আমার কথার জবাব দাও। এই আত্মহত্যায় কার হাত ছিল বলে যাও? তাদের সবাইকে আমি ফাঁসিকাঠে ঝোলাব।
দুই
তখন সকাল বেলা। সকালসকাল স্নান করে নেবার অভ্যাস রমার। তখনই কেউ এসে ডাকল, ‘রমা আছে!’
রমা বাথরুমে। রমা স্কুটারের শব্দে টের পায় সে এসে গেছে। রমা অনেক দূর থেকে শুনতে পায়, নীল রঙের স্কুটার চড়ে সে আসছে। অনেকদূর থেকে আওয়াজটা অতীব এক ভোমরার মতো শব্দ করতে থাকে। যেন দূরান্তে আছে লোকটা, স্কুটারে চাপলেই গড় গড় শব্দ, কোনো দূরবর্তী জায়গা থেকে শব্দটা ভেসে আসে। রমা তখন স্থির থাকতে পারে না।
দোতলায় বারান্দায় বোধহয় কেউ নেই। বাবা ঠিক কাগজ পড়ছে। মানুষটা নীচে দাঁড়িয়ে রোজকার মতো বলবে, রমা আছে। আশ্চর্য অভ্যাস মানুষটার। রমা যাবে কোথায়? রমা আছে কী নেই কথাটা অবান্তর। আসলে জানান দেওয়া, এলাম। স্কুটারের শব্দে টের পায় সবাই সে এসেছে। অধিকন্তু নীচে দাঁড়িয়ে বলা, রমা আছে? রমার ভারি হাসি পায় কথাটা ভেবে।
আজ ছুটির দিন। ছুটির দিন হলেই অরুণ সকালসকাল চলে আসে। রমা অন্য দিনকার চেয়ে ছুটির দিনে আরও একটু বেশি সময় নিয়ে বাথরুমে ঢোকে। যেন ছুটির দিনে সহজে সব কিছু সাফ—সোফ হতে চায় না।
আর গরমের দিনে কোথাও বের হতে হলে স্নান না করে বের হওয়াও যায় না। ফুরফুরে বাতাসে চুল উড়বে। শরীরে মেখে নিতে ভালো লাগে সব মনোরম গন্ধ। এবং লোকটার গায়ে মিশে থাকতে তখন কী যে আরাম লাগে! যথার্থ পুরুষমানুষের গন্ধ অরুণের শরীরে! কী সুন্দর গন্ধটা! ঠিক স্কুটারের মতই মনে হয়, যত সে বাতাসে ভর করে আসছে ততই গন্ধটা ক্রমে এগিয়ে আসে। এবং এভাবে নীচে এসে না ডাকলেও টের পায়, কোথায় কত দূরে আছে মানুষটা। রমা আছে, এমন প্রশ্নে সে অরুণের মধ্যে একজন কাপুরুষেরও গন্ধ পায়।
রমা জানে, অরুণকে দরজা খুলে দেবার লোকের অভাব নেই বাড়িতে। অরুণ সোজা বারান্দা ধরে সিঁড়িতে উঠে আসছে জুতোর শব্দে তাও সে টের পায়। এবং এমনই যখন সব কিছু তখন একটু দেরি করলেও ক্ষতি নেই। সে ঠিক উঠে আসবে ধীরে ধীরে। জুতোর শব্দ সিঁড়িতে। ওর উঠে আসা, বসা এবং প্রতিটি কথাবার্তা শোনার জন্যে তখন মাথায় জল ঢালে না রমা। কেমন গোপন এক অভিসার নিজের সঙ্গে নিজের।
একটু বাদেই সে সেজেগুজে বের হবে মানুষটার সঙ্গে। কখন ফিরবে ঠিক নেই। কোনো কোনোদিন অরুণ বড় ফাজিল হয়ে যায়। ফিরতে চায় না। রাত করে ফিরলে ঠান্ডা গলায় বাবা বলবে, ‘তোমরা বড় হয়েছ। সবই বোঝ। আমার বলার কিছু নেই।’
রমা তখন বাবাকে বলতে চায়, বাবা, আমি কী বড় হয়েছি! বড় হওয়াটা কী! আজকাল সে নিজের সঙ্গে দুষ্টু দুষ্টু খেলা যখন আরম্ভ করে দেয়, মনেই হয় না পৃথিবীতে কোনো দুঃখ আছে।
অরুণের নতুন স্কুটার কেনার পর এমন হয়েছে। ছুটির দিনগুলো ভারি মজার। সকাল হলেই অরুণ নীচে এসে ডাকবে—রমা, রমা। রমা তো তৈরি। তবু অরুণকে একটুক্ষণের জন্য ওপরে উঠে যেতে হয়। দোতলায় তিনখানা ঘরের একখানা বসার ঘর। সিঁড়ি দিয়ে ঠিক ঢোকার মুখে বাথরুম, তারপর সরু করিডোর। বাঁদিকে বসার ঘরের মুখেই রান্নাঘর। করিডোর দিয়ে ঢোকবার সময় প্রায় রান্নাঘরের সবই দেখা যায়। লোকজন এলে বাড়িটার কোনো আব্রু থাকে না।
সে উপরে এলেই দেখতে পাবে বাথরুমের দরজা বন্ধ। কেউ ভেতরে আছে। তখন জল ঢালার শব্দে, মগের ঠুংঠাং আওয়াজে সে টেরও পাবে বাথরুমে কে আছে, আর টের পেলেই যা হয়, সব কিছু তার চোখের ওপর তখন ভাসতে থাকবে। ভাবতেই রমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। নিজের শরীর বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখার এক আশ্চর্য বাসনা জাগে।
রমার ছোট ভাই মানু তখন রেলিঙে ঝুঁকে পড়েছে। এই মানুষটি এলে ছোটখাটো দুঃখ আর সংসারে ভেসে থাকে না। যেন সব সময়ই মানুষটার এই পরিবারের জন্য কোনো না কোনো সুখবর বয়ে আনার কথা। মানুর তো খুব প্রত্যাশা, একদিন যেমন দিদির চাকরির খবর নিয়ে এসেছিল, তেমনি তারও চাকরির খবর আনবে। বোধহয় বেলায় ঘুমোয় বলে, টেরই পায়নি, নীচে অরুণদা দাঁড়িয়ে আছে। বাইকের শব্দ থেমে গেছে। সে স্বপ্নের ভেতর বাইকের একটা শব্দ শুনতে পেয়ে যেন জেগে উঠেছিল। তারপর রেলিঙের ধারে এসে দেখেছে ঠিক অরুণদা, পাশে তার নীল রঙের স্কুটার, সুন্দর ব্যাকব্রাশ করা চুল, লম্বা বেলবটস আর রংদার বুশ—শার্ট।
বিগলিত হাসি মানুর—অরুণদা যে কী দারুণ লাগছে তোমাকে! ঘড়ি? ব্যান্ডটা দেখি—কবে কিনলে—সব ম্যাচ করা। দিদি বাথরুমে।
এই বাইকের শব্দ তো এ—বাড়ির বুকে একটা ছোট রেলগাড়ি চালিয়ে দেয়। সবাই নড়েচড়ে বসে। মা ঘোমটা টেনে বলে, ‘দ্যাখ অরুণ বুঝি এল।’
বাবার আজকাল ভীষণ ভয়, আতঙ্ক, যেন সব জায়গাতেই গণ্ডগোল লেগে আছে। কারণ শহরের দিনগুলো কোনো না কোনো জায়গায় ভয়ংকর খবরের মতো কাগজের পাতায় ভেসে থাকছে। বাবার যা স্বভাব, ঠিক বলবে, ‘অরুণ, তোমাদের ওদিকটাতে কোনো গণ্ডগোল হয়নি তো আর।’
রমা শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে এমন ভাবছিল। সবাই একটা যেন কী ভেবে ফেলেছে। অরুণ ওর অফিসে রমাকে এত ভালো মাইনের একটা কাজ জোগাড় করে দিতেই সহসা সবার সে বড় নিজের মানুষ হয়ে গেছে। এবং অরুণের জন্য সংসারের সব মানুষদের একটা কৃতজ্ঞতাবোধ জন্মে গেছে। দাদা পর্যন্ত অরুণকে আজকাল সমীহ করে কথা বলে!
অথচ অরুণ এ—সংসারে এসে স্বস্তি পায় না। এই যে রমাকে নিয়ে ছুটির দিনগুলোতে বের হয়, সম্পর্কটা যে সত্যি কী, কখনও ভেবে সে অস্থির হয়ে ওঠে, অথচ না এসেও পারে না, যে সংসারের একটা বড় কর্তাগোছের মানুষ রমা, ওর ইচ্ছেতেই এখন সব হয়। রমার ইচ্ছে না থাকলে সে কখনও এতটা এগোতে পারত না। যেন রমাই বুঝিয়ে দিচ্ছে, আমার নিজের মানুষের সঙ্গে ঘুরে বেড়াব, ভয়ের কি। আর এমন সুপুরুষ, ভালো মাইনের কাজ করা মানুষ, তোমরা যতই চেষ্টা কর, কিছুতেই আমার মতো মেয়ের জন্য আনতে পারতে না। সংসারে আমার ভার কত হালকা হয়ে গেছে, বুঝতেই পারছ তোমরা। তারপরই রমার মুখে কেমন দুঃখী দুঃখী দেখায়। আসলে ভেতরে অশুভ ছায়া তখন নড়েচড়ে বেড়ায়। সে জানে সেটা কী। সে বোঝে কতটা দূরে সে স্কুটারে উড়ে যেতে পারে।
আর তখনই বারান্দায় জুতোর শব্দ। রমা শাওয়ার বন্ধ করে জুতোর শব্দ শুনল। বসার ঘরের দিকে যাচ্ছে। ঠিক একজন বুড়ো মানুষের মতো মনে হয়। বারান্দা ধরে বসার ঘরে মিলিয়ে যাচ্ছে, যেন কোনো রুগণ মানুষকে ধরে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এবং এত করেও এই ভারিক্কি রুগণ শব্দটা রমা দূর করতে পারেনি অরুণের। বাড়িতে অরুণের এতটা কাপুরুষের মতো স্বভাব রমার পছন্দ না। যেন বাড়িতে চোর ঢুকেছে। বাড়িতেই এমনটা। কিন্তু যখন স্কুটার চালিয়ে দেয়, নীল আকাশের নীচে ধাবমান স্কুটার আর সে, পাগলের মতো অরুণ কত দূরে যে যেতে চায়। সে মাঝে মাঝে ভয়ে চিৎকার করে ওঠে, ‘এই পড়ে যাব। মরে যাব। আস্তে।’
অরুণ তখন আরও মজা পায়।
রমা যতটা পারে কোমর ধরে বসে থাকে। যত নীল আকাশ দুরন্ত ছেলের মতো দামাল হয়ে ওঠে, চারপাশের বাড়িঘর, গাছপালা যত দ্রুত ধাবমান দৃশ্যাবলি হয়ে যায় তত সে খামচে ধরে অরুণকে। যেন সে তখন পারলে অরুণের ভেতর সেঁধিয়ে যেতে চায়।
আর অরুণ এক উন্মুক্ত আকাশতলে প্রায় শক্ত বাহুতে ব্যালান্সের খেলা খেলতে খেলতে কোন এক সুদূর গোপন গহন অভ্যন্তরে প্রবেশ করে—রমা সত্যি থই পায় না। এমন একটা জীবন ছেড়ে দিতেও তার ভয় লাগে। সে তখন একা হয়ে যাবে। ভারি নিঃস্ব। পৃথিবীতে এমন কোনো নবীন যুবকের আর সন্ধান পাবে না, যে তাকে অরুণের মতো সুদূরে নিয়ে যেতে ভালোবাসে।
রমা বুঝতে পারল, অরুণ বসার ঘরে ঢুকে গেছে। সে এবার শাওয়ার পুরো খুলে দিল। শরীরে বৃষ্টিপাতের মতো এক স্নিগ্ধ করুণা। সে বুঝতে পারছিল, অতলে ডুবে যাচ্ছিল সে। সব জেনেও কিছু আর তার করার নেই।
আগে দাদা বাবা মিলে কী না করেছে। এখন দাদার ধারণা অরুণ ইচ্ছে করলে মানুকেও একটা চাকরি দিতে পারে। দাদা বাবা সবাই সেজন্যে স্কুটারের শব্দ পেলে ছুটে চলে যায়। কে আগে প্রাণ করিবেক দান এমন যেন ভাব। রমা হেসে বাঁচে না। শাওয়ারের জল মাথায় মুখে সর্বাঙ্গে—কি যে ঠান্ডা! শরীরের রোমকূপে বিন্দু বিন্দু জলকণা ক্রমে গভীরতর হচ্ছে। সারা শরীরে সাবানের ফেনা, পাম—অলিভের সৌরভ আর তখন সেই দুষ্টু লোকটা বাবা দাদার সঙ্গে সরল বালকের মতো ঠিক গল্প জুড়ে দিয়েছে। কে বলবে, ওর উদ্ভট সব পরিকল্পনা যে—কোনো কুটবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের চেয়ে প্রবল।
আয়নায় রমার শরীরের সবকিছু ভেসে বেড়াচ্ছে। শরীরে কী যে মোহ থাকে মানুষের, শেষ হয়ে যায় না, বার বার ঘুরে ফিরে নিজেকে দেখতে কেন যে এত ভালো লাগে—আচ্ছা অরুণ, তুমি বসে গল্প করছ, কিছু ভাবছ না তো। এই মিথ্যুক মারব! আমি বাথরুমে, তুমি কিছু ভাবছ না! তুমি আমাকে মনে মনে দেখতে পাচ্ছ, আমি এখন কী কী করতে পারি ঠিক তুমি জানো সব। তুমি খুবই অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছ, আমি জানি। আমার হয়ে গেল বলে। বের হলেই সাবানের গন্ধটা ভুর ভুর করবে তোমার নাকে। তেলের সুগন্ধ চুলে। তুমি তো খুব ভালোবাসো এসব গন্ধ নিতে। স্নান সেরে বের হলেই জানি আমাকে দেখতে খুব ভালো লাগে তোমার। পাগলামি করবে না। আজকাল যা করছ। কিন্তু তুমি তো জানো, আমার কী কী ইচ্ছে হয়, আমার কিন্তু ভয় লাগে অরুণ। সত্যি ভয় লাগে। কোনো বড় হলঘরে ঢুকে যাবার মতো ভয়।
অরুণ তখন বলল, এই যে মানুবাবু, তোমার ক্লাব তো হেরে গেল।
মানুর রাতে ভালো ঘুম হয়নি। হাই উঠছিল। দিদি না আসা পর্যন্ত কেউ না কেউ একজন ওরা জেগে থাকে। দাদা বাজার করতে যাবে—দাদাকে সে ঢুকে বলল, তুমি যাও। অতিথির অসম্মান না হয় আবার! মানু অথবা বাবা, যে কেউ একজন হলেই চলে! মা মানদাকে দিয়ে ঘরের ঝুল পরিষ্কার করাচ্ছে। মানু খুব বিষণ্ণ গলায় বলল, এত ক্লিকবাজি থাকলে হারবে না!
অরুণ বলল, ক্লিকবাজি কারা করছে?
কারা আবার। সাপোর্টাররা ভাবছেন ছেড়ে দেবে।
ঠ্যাঙাবে বলছ?
কিছু একটা হবেই।
এসব কথা খুবই অদরকারি অরুণের কাছে। তবু কিছু কথা অদরকারি হলেও বলে যেতে হয়। কাগজটা এক ফাঁকে তুলে প্রথম পাতার খবর দেখল। জনগণের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা—অরুণ প্রথম দু—চার লাইন পড়তে পড়তে কিছুই ভালো লাগছে না—র মতো রেখে দিল কাগজটা। মানুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তা হলে কিছু একটা হবেই।’
হবে না বলছেন! পর পর হেরে যাওয়া কত আর সহ্য করা যায় বলুন।
শুনলাম ক্লাবের সেক্রেটারি বিলেত চলে যাচ্ছেন?
গুজব। কতরকম যে গুজব রটাচ্ছে শত্রু—পক্ষরা।
মানুষের এই স্বভাব। সে নিজেই কোনো না কোনো জটিল সমস্যা নিজের জন্য সৃষ্টি করে নেয়। মুখ চোখ দেখে অরুণ বুঝতে পারছিল, মানু রাতে ভালো ঘুমোতে পারেনি। সে কোনো ক্লাবের একনিষ্ঠ সমর্থক নয়। যে জেতে তার পক্ষ নিতে শুধু তার ভালো লাগে। বরং এই সকালে অদরকারি কিছু কথাবার্তা বলতে গিয়ে বুঝল, মানু ভীষণ সিরিয়াস হয়ে উঠছে। ওর হাসি পায়। সে মানুকে সামান্য উত্তপ্ত করতে পেরে বরং খুশিই। সারা সকালে ওই একটা বিষয়েই তর্ক করা যেতে পারে। খেলোয়াড়দের প্রশংসা, নিন্দা দুটোই এখন তর্কের বিষয়বস্তু হতে পারে। জার্সির রং দেখে ঘাবড়ে যায় সে বলতে পারত, যদিও কোনো কিছুই তার বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না, বরং বাথরুমের দিকে চোখ—কখন খুট করে দরজা খোলার শব্দ হবে। কখন রমা বের হবে স্নান সেরে। দৃশ্যটা দেখার জন্যই সে একমাত্র উন্মুখ। পর্দায় প্রায় নগ্ন কোনো দৃশ্যের মতো তার কাছে অতীব প্রয়োজন রমার এই বের হওয়া। সে তবু বলল, মন খারাপ!
হবে না!
কেউ ডাকছে মনে হচ্ছে।
ওই তো ডেকে নিয়ে গিয়ে এখন লাগবে পেছনে।
যাবে না। তবে বল অন্তত বাড়িতেই আছ।
কিছু বলব না। আপনি একটু উঠে গিয়ে বলুন না অরুণদা, মানু নেই।
অরুণের উঠতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। যদি রমা ঠিক তখনই বের হয়ে যায়। রমার স্নানের দৃশ্যটা সে আজকের দিনটায় দেখতে পাবে না! ওই যে কী হয়, একবার ডায়মন্ডহারবারে সাগরিকায় দুপুরবেলা খাওয়া—দাওয়া করে খাবার পর বাথরুমে হাতমুখ ধুতে গিয়ে রমা বেরই হচ্ছিল না। যখন বের হল, তখন একেবারে স্নিগ্ধ ছবি রমার। স্নানটান শেষে মেয়েদের এত কেন যে ভালো লাগে।
তার বলতে ইচ্ছে হল, মানুবাবু, তোমার এমন একটা দৃশ্য দেখার জন্য বসে থাকতে ইচ্ছে হয় না। অথচ নীচে ডাকছে, তখন গলা পাওয়া যাচ্ছে—মানু আছিস?—মানু?
অরুণ অগত্যা জানালার পর্দা সরিয়ে বলল, ও তো নেই। এলে কিছু বলব?
বলবেন এসেছিল। বললেই বুঝতে পারবে। আমার নাম নানু।
অরুণ ভাবল বেশ সময় এটা মানুষের। একটা কিছু নিয়ে থাকা। কোনো ব্যর্থতাই ব্যর্থতা নয়। ওদের সময় কত সহজে কেটে যায়। ওর সময় লম্বা, দীর্ঘ, এবং একমাত্র রমা কাছে থাকলে সময় কীভাবে কেটে যায় সে টের পায় না। সে মানুকে বলল তোমার বন্ধু নানু এসেছিল। সঙ্গে সঙ্গে মানুর মুখটা কেমন গম্ভীর হয়ে গেল।
তখনই রমা খুট করে দরজা খুলে ফেলল। প্রায় আবির্ভাবের মতো লাগছিল। এমন উঁচু লম্বা মেয়ে সে কমই দেখেছে। চুল ঘন, মিহি চুলে তোয়ালে জড়ানো। হাতে ভেজা সায়া, শাড়ি, ব্লাউজ। বাসি কাপড় ধুয়ে একেবারে পরিচ্ছন্ন রমা। ভেতরের রক্তপ্রবাহ কেমন মাতাল সমুদ্রের মতো ওকে ধাক্কা মারে। এত উষ্ণতা জীবনে থাকে কেন! তার নিজের কিছু আছে, উলটে পালটে দেখতে দেখতে বছর দু’বছর না ঘুরতেই জীর্ণ বাসের মতো হয়ে যায় কেন! প্রকৃতির কোন কুটবুদ্ধি শরীরে তার খেলে বেড়ায়। কতবার মনে হয়েছে এটা ঠিক না। গোপনে সে একটা ভারি পাপ কাজে লিপ্ত হবার জন্য উন্মুখ। অথচ এই মেয়েটা তাকে নিয়ে বেশ খেলাচ্ছে। কোথাও যখন গভীরে ডুবে যেতে ইচ্ছে হয়, রমার বালিকার মতো দুঃখী মুখ। তখন সে আর গভীরে নেমে যেতে পারে না। চিৎকার করতে ইচ্ছে হয়, রমা প্লিজ। রমা মরে যাব।
রমা তখন পাশ কাটিয়ে বারান্দায় শাড়ি মেলতে যাচ্ছে। পালিয়ে পালিয়ে কিছুটা দেখছিল। খুব অবহেলা ভরে। চোখে বিন্দুমাত্র লোলুপতা ছিল না। আবার মানু অজস্র কথা বলে যাচ্ছে। সে হুঁ—হা করছে। সিগারেট টানছে। রমার সঙ্গে গোপনে যে কিছু কথাবার্তা হয়ে গেল মানু হয়তো টেরই পেল না। এই বাড়ি, ঘরদোর, আসবাবপত্র সবই ওর কাছে বড় মহার্ঘ হয়ে যায় রমার জন্যে। সে কেমন দীনহীনের মতো কেবল সব কিছু তাকিয়ে দেখে।
রমা নিজের মনেই বলল তখন, এই তুমি পালিয়ে পালিয়ে এত কী দেখছ! চোর কোথাকার! কী ভেজা বেড়ালের মতো বসে আছে দ্যাখ। কিছু যেন খুঁটে খেতে জানে না বাবু। রমা বারান্দা থেকে বলল, কী অরুণদা মানুর সঙ্গে বেশ জমে গেছ। আমরা যে বাড়িতে আছি দেখে তা মনে হয় না।
আরে না না। তুমি যাবে তো?
কোথায়!
বা রে বললাম না, জীবনবাবুর ছেলের অন্নপ্রাশন।
না গেলেই নয়?
দ্যাখ ভেবে। যাও তো সঙ্গে নিতে পারি।
না গেলে ভারি খারাপ দেখাবে?
অরুণ এসেই কত সব জীবনবাবুর বিয়ে, অন্নপ্রাশন, বউভাত, পিকনিকের কথাবার্তা বলে যে সুখ পায়। আগে এটা সত্যি বিয়ে অন্নপ্রাশন ছিল। পরে কিছুদিন যেতে না যেতেই দাদার মনে সংশয়, তারপর কিছুদিন সে এ—বাড়িতে আসতই না। দাদাই খবর দিয়ে ফের আনিয়েছে। ওদের ভুবনেশ্বরে সেলস এম্পোরিয়ামে একটা পোস্ট খালি আছে। যদি অরুণ চেষ্টা চরিত্র করে মানুকে ঢুকিয়ে দিতে পারে। সংসারে অরুণই একমাত্র ভরসা।
রমা নিজের ঘরে ঢুকে গেছে তখন। গলায় ঢুকে পাউডার ঢেলে দিচ্ছে। গলা বাড়িয়ে একবার মাকে বলল, অরুণদাকে চা দাও, মা।
ও—ঘর থেকে অরুণ বলল, কিচ্ছু না।
মা বলল, তুই ফিরবি কখন?
ফিরতে রাত হবে।
মা আর কিছু আজকাল বলতে সাহস পায় না। বসার ঘরে বাবা একা। বয়স বাড়লে মানুষেরা খুব নিঃসঙ্গ হয়ে যায়। বাবা একদিন বলেছিলেন, এবারে বল আর কতদিন ঝুলিয়ে রাখবে।
রমা কেমন বিষণ্ণ হয়ে গেছিল। বলেছিল, বললে কী হবে!
বললে কী হয় তোমরা জানো না।
চাকরিটা তবে থাকবে না।
যেন বাবার মনে পড়ে যায় সত্যি, তবে চাকরি থাকবে না। মেয়েটা তার উঁচু লম্বা বলেই এমন একটা দামি চাকরি পেয়ে গেল। শ্যামলা রং। চোখ বড় চিবুক সামান্য চাপা। তবু রমার মুখে এক ধরনের কোমল ব্যক্তিত্ব আছে, সে যে—কোনো মানুষের পক্ষে লোভনীয়। রমা নিজের টাকায় একাই বাড়ির আজকাল সব প্রাচুর্য রক্ষা করতে পারে। আসলে চাকরির শর্তটা এই রকমের। আসলে যারাই আসবে সেই বিরাট অফিস বাড়িটাকে, যেখানে রমা কাচের ঘরে বসে থাকে, সবার সঙ্গে সামান্য হেসে কথা বললে লোকগুলির মনের ভেতর এক সুন্দর জগৎ তৈরি হয়ে যায়, জটিল সব লেন—দেন অফিসের দোরগোড়ায় এসেই সহজ সরল হয়ে যায়। আসলে মেয়েটা তার গৌরব। অফিসবাড়ির অনেক কূটতর্ক ওর হাসিতে জলের দামে বিকোয়।
এ—সব কারণেই তিনি দ্বিধা এবং সংশয়ে ভুগছেন। কিছু স্থির করতে পারছেন না। বরং নিবেদিত যৌবন রমার—এমনই তিনি ভাবেন। তিনি মাঝে মাঝে ভাবেন, তারপর কী হবে!
তারপর কী হবে কেউ জানে না।
অরুণ নিজেও জানে না তারপর কী হবে।
আর রমাও বসে থাকে না তারপর কী হবে ভেবে। সে বরং অরুণ আছে বলেই তার সঙ্গে কিছুটা তারপর কী আছে জীবনে বুঝতে পারে। আর অফিস বস যেহেতু অরুণের আপন মামা, কেউ আর রমাকে ঘাঁটাতে চায় না। বরং অরুণ হাতে ধরে নিয়ে এসেছিল বলে, অরুণের সঙ্গে মাঝে মাঝে দেখে ফেললে, কেউ চটে যেতে পারে না। অরুণের কোনো আত্মীয় হবে। একবার তো জীবনবাবুই দেখেছিল, স্কুটারে একটা আগুনের স্ফুলিঙ্গ জ্বলজ্বল করছে। যে—কোনো সময় দাউ দাউ করে অগ্নিকাণ্ড ঘটে যেতে পারে, কিন্তু মুখে কিছু প্রকাশ করতে সাহস পাননি। অরুণবাবুর স্ত্রী যখন যুবতী এবং লাবণ্যময়ী, স্ত্রীর চোখেই দৃশ্যটা পড়বে একদিন। তখন যা হবার হবে। মজা দেখার মতো অন্তত জীবনবাবুর এই জীবনে একটা ঘটনা ঘটে যাবে। সেই আশাতেই তিনি লেজারে কেবল যোগ করে যাচ্ছেন। বিয়োগ করছেন না।
তিন
বিকেল মরে আসছে। গাছপালা থেকে রোদ ক্রমে সরে যাচ্ছিল। পার্কের বড় পুকুরে একদল মানুষ ডুবছে ভাসছে। কৃষ্ণচূড়া গাছের নীচে বুড়ো মানুষের জটলা। তারা সবাই মুখোমুখি বসে। কী কথা বলছে নানু শুনতে পাচ্ছে না। সে বলেছিল একটা বেঞ্চিতে। মাথায় কাকেরা উড়ছে। শিরিষের লম্বা একটা ডাল নেমে এসেছে তার মাথার ওপর। ও—পাশটায় কিছু ছেলের পায়ে একটা লাল বল। এবং যেখানে যেমন সুবিধা জোড়ায় জোড়ায় যুবক যুবতী। তার মনে হল বাবা মাকে নিয়ে বিশ বছর আগে এমনি কোনো নিরিবিলি জায়গায় বসত। তারপর তাদের বিয়ে হয়েছিল। স্মৃতির মধ্যে ডুবে গেলে, সে সব দেখতে পায়। জীবনের প্রথম কোনো স্মৃতি তার পেছনে, আরও পেছনে যেতে যেতে মনে হয় তার, সে সেই যখন মাতৃজঠরে অথবা তারও আগে শরীরের রক্ত কণিকার সামান্য ডি এন এ—তার আরও আগে যখন অপার্থিব কিছু মনের মধ্যে পাখা বিস্তার করতে থাকে, তখন তার মনে হয় সে সূদুর অতীতে চলে গেছে। সেখানে একজন বুড়ো মানুষ চোখে হাই পাওয়ারের চশমা, হাত ধরে আছে এক ছোট্ট শিশু—সাদা কেডস জুতো পায় লাফিয়ে লাফিয়ে এটা কী ওটা কী বলছে। এমন কেন মনে হয়, কিংবা কোনো গাছপালা মাঠ পার হয়ে তার নীল কুটির—পাশে একটা বড় দীঘি তাতে অজস্র পদ্মফুল ফুটে আছে। কিছু পদ্মফুল আর এক যুবতীকে সে দেখতে পায়—স্নান করায় শরীরের সব অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ছবির মতো স্পষ্ট। আকাশটা সেখানে থমকে দাঁড়িয়ে আছে।
বুড়ো মানুষগুলো আরও ঘন হয়ে বসেছে। সে তাদের একটা কথাও শুনতে পাচ্ছে না। সে নড়ে চড়ে বসল। তারপর উঠে দাঁড়াল। হেঁটে গেল কিছুটা। পায়চারি করার মতো। সে পাশ দিয়ে হেঁটে গেল। বুড়ো মানুষদের—মুখগুলি আবছা—যেন মৃত্যুর কাছাকাছি এই মানুষগুলি। আজ শেষ কিছু সত্য কথা বলার জন্য এক ঠাঁই হয়েছে। সে কাছে গেল। আর মনে হল একটা বুড়োও আর কথা বলছে না। এরা যেন সব বুড়ো মানুষের ডামি! এরা পরস্পরের দিকে ভারি সংশয়ের চোখে তাকিয়ে আছে। নানু বুঝতে পারল সব বুড়োরাই তাকে দেখে আর একটাও কথা বলছে না; তার মাথায় বিদ্যুৎ খেলে গেল—এবং এটা হয়েছে—সেইদিন থেকে—যেদিন মেসো এবং মাকে ভয়ংকর একটা বিতিকিচ্ছিরি অবস্থায় দেখে চোখ তার জ্বলে উঠেছিল, পায়ের রক্ত ঝা করে মাথায় উঠে গিয়েছিল—হাতে কিছু একটা থাকলে কী করত বলা যায় না—বুড়ো মানুষরাও কী সেটা টের পায়। মার ঠোঁটে লাল রঙের লিপস্টিক, মা সিল্কের শাড়ি পরতে ভালোবাসে। মা, তার মা বাবার কোনো স্মৃতিই আজ শরীরে ধরে রাখেনি। সে বাবার একটি ছবি বুকের মধ্যে রেখে দিয়েছে। সে ছবিটাও ক্রমে অস্পষ্ট হয়ে আসছে।
সে আবার এসে বেঞ্চিটাতে বসল। বেশ বাতাস দিচ্ছে! গরমকাল। গতকাল সন্ধ্যায় ঝড় হয়ে গেছে শহরে। বৃষ্টিপাত হয়েছে। এখন এই বিকেলে ঠান্ডা বাতাসে শরীরে ঘেমো গন্ধ নেই। তার চুল বড়, তার চোখে হাই পাওয়ারের চশমা এবং মাঝে মাঝে মানুষের মুখ সেই চশমার ভেতর কঠিন রুক্ষ এবং ইতরের মতো দেখায়। অবনীশ নামে একটা লোকের চোখ চশমার কাচে ধরা পড়লেই সে বুঝতে পারে—লোকটা এখন পেছনে হেঁটে যাচ্ছে। তাকে দেখলেই পায়ে পায়ে পেছনে হেঁটে সরে যেতে থাকে।
আজ একবার অবশ্য সে গিয়েছিল মানুর কাছে। এখানে আসার পর কেন জানি কলেজে এই মানুকে ভারি ভালো লেগেছিল। গিয়ে দেখেছে মানু বাড়ি নেই। বাড়ি থাকলে সে এখানে হয়তো আসতই না। অথচ মাথার ভিতরে যে কখন কী হয়ে যায়। মাঝে মাঝেই মনে হয়, হত্যাকারী কে, একবার তদন্ত করে দেখলে হয়। আবার কখনও মনে হয় সে কিছুই আর ফিরে পাবে না। মানুষ যা হারায় সে আর তা ফিরে পায় না।
আর তখনই নানু দেখল, পায়ের কাছে একটা লাল বল। ছোট ছোট শিশুরা সেই লাল বল পায়ের কাছ থেকে তুলে নিয়ে গেল। মাথার ভিতর সঙ্গে সঙ্গে শৈশবের নানা স্মৃতি ভেসে ওঠে। একটা লাল বল জেঠু হাতে দিয়ে বলেছিলেন কবে যেন, এটা তোমার। সেই লাল বলটা সে হারিয়েছে। তখনই নানুর কান্না পায়। বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে। এক আশ্চর্য নিঃসঙ্গতায় সে ডুবে যেতে থাকে। মনে করতে পারে না তখন, কেন এই পার্কটায় সে এসে বসে থাকে। সেই দুপুর থেকে এখানে—একা। কলেজ যাবার নাম করে সোজা চলে এসেছে এখানে—এবং এসেই মনে হয়েছে, খুব অসময়ে এসে গেছে। সুনীল কাকা এখন অফিসে। তাঁকে পাওয়া যাবে না। সন্ধ্যা না হলে বাড়িতে সে ফিরবে না। অকারণ আগে থেকে গিয়ে দরজায় খুট খুট করে লাভ নেই। অথচ সে সারাটা বিকেল আসল কথাটা একবারও মনে করতে পারেনি। স্মৃতিশক্তির পরীক্ষা চালিয়েছিল আজ। ওর মনে হয়েছিল এই পার্কটায় সে শৈশবে এসেছে। দৌড়ে বেড়িয়েছে। লাল বল নিয়ে খেলা করছে। অবনীশ নামক এক অবিবাহিত যুবক ছিল তার বন্ধুর মতো—যা সে চেয়েছিল, তা যত দুর্লভই হোক এনে দিয়েছে। এখন মানুষটাকে বললে কেমন হয়, তুমি তো আমার শৈশবে সব দুর্লভ বস্তু সংগ্রহের জন্য প্রাণপাত করেছ, এখন এনে দিতে পারো না বাবার একটা ছবি। তোমার বউ তোমার মেয়ে আমাদের সব বন্ধুত্ব মুছে দিল। তুমি ভুলে গেলে আমার সামান্য অসুখে তোমার চোখে ঘুম থাকত না। তোমরা এখন এত স্বার্থপর হয়ে গেছ।
সে উঠে দাঁড়াল। একা বসে থাকলে হিজিবিজি চিন্তা মাথায় ঝপাৎ করে ঢুকে যায়।
সে হাঁটছিল পার্কের এখানে সেখানে। আলোর ডুম জোনাকির মতো স্থির হয়ে আছে। পার্কটা শেষ হলে একটা কাঁটাতারের বেড়া এবং গেট। সে গেট পার হয়ে ডান দিকে দেখল, দুজন মাঝবয়সি লোক অন্ধকার রাস্তাটায় হেঁটে যাচ্ছে। পাশে গাছপালা নিবিড় এবং কেমন এক অরণ্যের গন্ধ। কোনো মেয়ে খিল খিল করে হাসছে। তার মনে হল, সে কতদিন হাসে না। সেই ভয়ংকর দৃশ্যটা তার মাথা খারাপ করে দিয়েছিল। তার মা, মা না ভদ্রমহিলা, না পড়ন্ত বয়সের যুবতী মাকে কেন সে যে আর কতদিন থেকে মার মতো ভাবতে পারে না, আর তার তখনও একটা ভীষণ কষ্ট হয়—ষড়যন্ত্র করে শেষ পর্যন্ত এই শহরটায় তার নির্বাসন হয়েছে। এবং তখনই মনে হল, সামনে সেই বাড়িটা। সে খুট খুট করে দরজায় কড়া নাড়বে ভাবল, কিন্তু পাশের জানালায় দাঁড়িয়ে আছে একটি মেয়ে। কোনো বনভূমির জ্যোৎস্নার মতো চোখ তুলে তাকে দেখছে।
সে বলল, এটা সুনীল বসুর বাড়ি?
হ্যাঁ।
তিনি আছেন?
এখনও ফেরেননি।
সে আবার সিঁড়ি থেকে নেমে এল। আর একটু ঘুরে আবার আসবে ভাবল। তখনই সেই তরুণী, তাকে বলল, বসুন, বাবা এক্ষুণি এসে যাবে, বলে দরজা খুলে দিল। দরজায় আরও দুটি সুন্দর শিশুর মুখ—তারাও তাকে দেখছে। নবনীতার কেউ হয়। ছোট ভাইবোন থাকলে মেয়েরা আরও সুন্দর হয়ে যায় নবনীতাকে দেখে এটাও টের পেল নানু।
নানুর চোখ এখন অন্য দিকে। সে দেয়াল দেখতে দেখতে ঘরে ঢুকে গেল। চোখে মুখে অতীব এক উদাসীনতা। সে যেন ঘুরতে ঘুরতে এখানে চলে এসেছে। তার কিছু জরুরি কাজটাজ আছে, অন্তত বসার ভঙ্গি দেখে তা বোঝা গেল না। বরং মনে হচ্ছিল, নানু শেষ পর্যন্ত সঠিক জায়গার খোঁজ পেয়ে গেছে। অথবা বহু দূরের পথ অতিক্রম করে গন্তব্যস্থলে পৌঁছে গেছে। কোথাও আর যাবার কথা নেই, কোথাও আর ফেরার কথাও নেই। সে বসেই জানালার দিকে তাকিয়ে বলল, এক গ্লাস জল দেবেন? খাব। কিন্তু কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে চোখ তুলে তাকাতেই বুঝল মেয়েটি ঘরে নেই।
এবার সে কেন জানি কিছুটা স্বস্তি বোধ করল।
বসার ঘরটা সে দেখছে। ঠিক আগের মতো নেই। নতুন চুনকামের গন্ধ। সামনে সেন্টার টেবিল। দু’দিকে দুটো লম্বা সোফা, একটা বেতের চেয়ার নীল রঙের, একটা টেলিভিশন সেট, দেয়ালের র্যাকে অনেক বই, গ্রন্থাবলী নতুন নতুন, একটা মাটির ঘোড়া এক কোণায়—খুব ছিমছাম, নীল রঙের পর্দায় লেসের কাজ। সে এবার মনে করার চেষ্টা করল, প্রথম যেদিন অবনীশের সঙ্গে এখানে এসেছিল—তখন ঘরটায় এ—সব ছিল কিনা! অনেক কিছুই ছিল না। অথবা আগে যা ছিল এখন আর কিছু নেই।
কেবল মনে হল সুনীলকাকার মেয়ে নবনীতা কুট করে তার হাত কামড়ে দিয়েছিল।
নানু সব স্পষ্ট মনে করতে পারছে। স্মৃতির এই খেলায় একমাত্র সে দেখেছে কখনও হেরে যায় না। যে দরজা খুলে দিয়েছিল, তার মুখ সে দেখেনি। আর দেখার সময়ও নয় এটা। তার এখন কত সব জরুরি কাজ, কারণ, সুনীলকাকা আর বাবা একসঙ্গে এক সময় এক অফিসে কাজ করত। সুনীলকাকা বাবার অধীনে কাজ করত এবং খুবই সমীহ করত বাবাকে। মেয়েটা কুট করে কামড়ে দিয়েছিল বলে, কাকা নবনীতাকে সেদিন মারবে বলে শাসিয়েছিল। তার সবই মনে পড়ছে।
সে ভীষণ একটা জরুরি কাজে এসেছে। এসেই তার নানারকম চিন্তা—ভাবনা—কীভাবে যে আরম্ভ করবে কথাটা? কারণ, সাত আট বছর আগেকার কথা সুনীল কাকা ভুলেও যেতে পারে। তবু সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে একের পর এক জেরা করে যাবে। প্রথম প্রশ্নটা সে কী করবে ভাবল। যেমন এলে পরে পায়ে টুক করে একটা প্রণাম ঠুকতে হবে। প্রণাম ঠুকলে সে দেখেছে, গুরুজনেরা খুব সদাশয় হয়ে যান। প্রণাম ঠুকে কাজ উদ্ধার করা খুব সহজ হবে ভাবল। তারপর পরিচয় দেবে। সে এখন যাদবপুরের দিকে আছে বলবে। মার কথা জানতে চাইলে বলবে, ভালো আছে, আসলে ভালো নেই বললে নানারকম সংশয় দেখা দেবে।
সে এক গ্লাস জল চেয়েছিল, কেউ নেই, অথচ জল খেতে হবে। সে এবার ঘড়ি দেখল। সাতটা বেজে গেছে। তার বাড়িফেরার কথা চারটের মধ্যে—দাদু বারান্দায় পায়চারি শুরু করে দিয়েছেন। বারান্দায় বুড়ো মানুষটার মুখ বড়ই দুঃখী। বুড়ো মানুষটার বড় আশ্রয় ছিল একটা—যা হোক নানু অন্তত জানে না, তার বাবা আত্মহত্যা করেছে। এখন আর তার সেই আশ্রয়টুকুও নেই। তখনই মনে হল কেউ ঢুকছে বাড়িতে। সিঁড়িতে জুতোর শব্দ। রাস্তায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে কেউ এ—বাড়িতে উঠে আসছে।
সে দরজার কাছে সরে দাঁড়াতেই দেখল, তিনি ঢুকছেন। হাতে ব্রিফকেস। কালো প্যান্ট পরা, সাদা শার্ট এবং কালো রঙের কোট। মাথার সামনেটায় কিছু কাঁচা—পাকা চুল। আগে গোঁফ রাখতেন, এখন মসৃণ মুখ। সে টুক করে প্রণাম করতেই সুনীলকাকা সামান্য ইতস্তত করে বলল, ‘আরে থাক থাক।’ আজকালকার উঠতি বয়সের ছেলেরা এতটা বিনয়ী হয়, সুনীলকাকার বোধহয় জানা ছিল না। ভালো করে মুখটা দেখছিল নানুর। নানু ভাবছে দেখি চিনতে পারে কী না। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর বলল, তুমি প্রীতিশদার ছেলে?
যাক মনে রেখেছে। সে বলল, হ্যাঁ।
কত বড় হয়ে গেছ।
সে কিছু বলল না।
বোস। তারপরই হাঁক দিল, নবনীতা দেখ কে এসেছে। তোমার মাকে ডাক। সুনীলকাকা গলার টাই আলগা করে প্যান্ট টেনে বসে পড়ল। বলল, কতক্ষণ?
সে বলতে পারত, অনেকক্ষণ। সেই দুপুরে বের হয়েছে। এখন বাজে সাতটা। সে তার কিছু না বলে বলল, এই মাত্র।
তোমরা সবাই ভালো আছ?
ভালো নেই বলতে পারত, সেটা ঠিক হবে না ভেবে বলল—ভালো। সবাই ভালো।
বউদি একটা কী কাজ নিয়েছে শুনলাম।
ঠিকই শুনেছেন। গলাটা আবার শুকনো লাগছে নানুর। সে বলল, এক গ্লাস জল। খুব তেষ্টা পেয়েছে।
আরতি এক গ্লাস জল।
আরতি এ—বাড়ির কাজের মেয়ে। এক ডাকেই হাজির। জল রেখে গেল। কিন্তু নবনীতা অথবা আর কেউ এল না। এখন তার মনে পড়েছে, কাকিমার ঠোঁটের নীচে একটা বড় তিল আছে। মুখটা মনে নেই—তিলটার কথা মনে আছে।
তখন সুনীলকাকা বলল, তুমি বস, আমি আসছি।
সুনীলকাকা ভিতরে ঢুকে গেল। এবং পরক্ষণেই নাটকের পাত্র—পাত্রীরা যেভাবে মঞ্চে ঢোকে—ঠিক সেভাবে প্রথমে কাকিমা, পরে নবনীতা। সে ভালো ছেলের মতো কাকিমাকেও টুক করে প্রণাম করে ফেলল। তার যা কাজ তাতে খুব ঘনিষ্ঠতার দরকার হবে। যেন সে এ—বাড়িরই ছেলে।
সুনীলকাকার স্ত্রীর নামটা সে মনে করার চেষ্টা করল। না, পারছে না। আপাতত এটার খুব প্রয়োজন নেই। তবু কেন যে মাথার মধ্যে কারা টরেটককা বাজায়—বাজাবার সময় সে শুনতে পেল, তুমি বড় হয়ে গেছ। নবনীতা, তোর নানুকে মনে পড়ে?
নবনীতা বলল, আমাদের বাড়ি খুব আসতে তুমি?
খুব মিথ্যে কথা। সে সুনীলকাকার বাড়িতে কখনও—সখনও বাবার সঙ্গে অথবা বাবার দাদার সঙ্গে আসত। খুব বেশি না। যাতায়াতের পথে বাড়িটা ছিল বলে মাঝে মাঝেই দেখা হয়ে যেত। এবং নবনীতার একটা ডল পুতুল ছিল। ভেতরটা ফাঁকা। তাতে নবনীতা চকলেট ভরে রাখত। মাথায় টুপি ছিল পুতুলটার।
তখনই নবনীতা বলল, চিনে আসতে কোনো অসুবিধা হয়নি? কত দিন পর!
নানু হেসে দিল। বলতে পারত, তুমি মেয়ে কথা না খুঁজে পেয়ে যা ইচ্ছে বলে যাচ্ছ। শৈশবের কথা কেউ ভুলে যায়! কেউ পারে ভুলতে।
সে বলল, দোতলায় নতুন ঘর হয়েছে দেখছি।
নবনীতা লম্বা ফ্রক পরেছে। ফাঁপানো চুল ঘাড় পর্যন্ত। এবং ডিমের মতো মসৃণ মুখ। যেন এই মাত্র ঘুম থেকে উঠে আসছে। আড় চোখে সে নানুকে দেখছে সেটাও সে টের পেল। যুবতী হবার মুখে এই মেয়ের চোখ টল টল করছে।
নবনীতার মা বলল, তুমি দেখনি ঘরটা?
আমাদের সময়ে ছিল না।
সহসা নবনীতা বলল, এত ঘামছেন কেন নানুদা?
নানু সত্যি ঘামছিল। নবনীতা উঠে পাখা ফুল স্পিডে চালিয়ে দিয়ে আবার বসল। তার কথাবার্তায় কোনো সংকোচ ছিল না। নানু যেন কিছুই লক্ষ্য করছে না, এমনকি নবনীতাকেও দেখছে না,—কেউ বসে আছে সামনে তাও তার যেন খেয়াল নেই—এমন চোখমুখ করে রেখেছে। অধিকাংশ সময় সে মুখ না তুলেই কথা বলছিল। সে একটি ভালো ছেলের মুখোশ পরে আছে এখন। এই যে কাকিমা, মারই বয়সি—শরীরে যৌবন ধরে রাখার কী প্রাণান্তকর চেষ্টা তার। কথাবার্তায় মনে হচ্ছিল মা আর মেয়ে যেন দু বোন। একবার বলতে ইচ্ছে হয়েছিল, আচ্ছা কাকিমা, আপনার আর কেউ আছে? কাকা মরে গেলে কারও সঙ্গে প্রেম করতে পারেন। তারপরই তার মনে হল প্রীতিশ নামক যুবক পাশের গলিটা পার হয়ে বড় একতলা বাড়ির নীচে আজ থেকে আট বছর আগে আত্মহত্যা করেছিল। সে এখানে জানতে এসেছে তার বাবা কেন আত্মহত্যা করলেন।
তখন কাকিমা বলল, তোমার বাবা বড় ভালোমানুষ ছিলেন।
সে বলল, ভালোমানুষ ছিলেন বুঝি! তারপর বলার ইচ্ছে হয়েছিল, আপনি জানলেন কী করে! বাবা ভালোমানুষ কী খারাপ মানুষ সেটা তো আমার মা—ই একমাত্র বলতে পারে। আপনি কি…।
তখনই কাকিমা বলল, তোমার বাবাকে মনে পড়ে? তখন তো তুমি খুবই ছোট ছিলে।
সে কী ভেবে বলল, না। তারপর কেমন অতলে ডুবে যাচ্ছিল। কীভাবে যে বলবে, আমার বাবা আত্মহত্যা করেছিল কেন জানেন—কিন্তু বলতে পারল না।
নবনীতার মনে হল মার যে কী স্বভাব! নানুদাকে এ—সময় তার বাবার কথা মনে করিয়ে দিয়ে কী লাভ। কেমন দুঃখী মুখ এবং কাতর দেখাচ্ছে। সে বলল, নানুদা শোলে দেখেছ?
নানু যেন শুনতেই পায়নি। সে দুজনের দিকে তাকিয়েই যেন প্রশ্ন করল, বাবার ছবি আছে এ বাড়িতে?
ছবি। দাঁড়াও। হ্যাঁরে নবি, প্রীতিশকাকার কোনো ছবি আছে? অ্যালবাম খুলে দেখবি।
নবনীতা বলল, না নেই।
নানু কেমন শক্ত গলায় বলল, থাকতেও তো পারে। খুঁজে দেখ না।
তখন সুনীলকাকা বেশ সাফসোফ হয়ে বসার ঘরে ঢুকে গেল। লম্বা পাজামা পাঞ্জাবি পরেছে। স্নান করায় শরীরে দামি সাবানের গন্ধ। মুখে পাইপ। বেশ কম বয়সে সুনীলকাকা খুব উঁচুতে উঠে গেছে। প্রায় আত্মস্থ এক মানুষ, সুখী এবং জীবনে যা যা দরকার সবই হাতের নাগালে। অনেকদিন পর তার বসের ছেলে এই বাড়িতে—সে কেমন আছে এটা দেখুক—এমনই স্মিত হাসিতে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল, তোমাদের ডিস্টার্ব করলাম না তো।
নানু এখন কিছুই শুনতে চায় না। সে আরও শক্ত হয়ে গেল। বলল, সুনীলকাকা, তোমার কাছে বাবার ফোটো আছে?
সুনীল কথাটার খুব গুরুত্ব দিতে চাইল না।—আছে বোধ হয় দেখতে হবে।
নানু বলল, এখন একবার দেখবে। বাবার একটা ফোটো আমার খুব দরকার।
কেন বাড়িতে নেই?
না।
সে কী! নবনীতা প্রায় চিৎকার করে উঠল।—বাড়িতে বাবার ছবি থাকে না সে কী করে হয়!
কখন যে একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে এদিকটায়। সামান্য ঝড়ও। নানুর ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেছে। রাস্তাটা এদিকের কতদিন মেরামত হয়নি। হবে কী না কেউ বলতেও পারে না। উঁচু নিচু খানাখন্দ—কোথাও বসে গেছে অনেকটা। ইঁট বের হয়ে পড়েছে—ফলে নানু যতটা দ্রুত হেঁটে রাস্তা অতিক্রম করবে ভেবেছিল, ঠিক ততটা জোরে হাঁটতে পারছে না। পা উঁচু নিচুতে পড়ে যে—কোনো সময় মচকাতে পারে। সে ঘড়িতে দেখল এগারোটা বেজে গেছে।
সুনীলকাকার বাড়ি থেকে বের হয়ে—সোজা রাস্তায় দাঁড়িয়ে জানালায় কারও মুখ দেখার চেষ্টা করছিল নানু। তাদের বাড়িটাতে অন্য কেউ থাকে এখন। বাবার মতো সেই মানুষটা সকাল সন্ধ্যায় এসে জানালায় হয়তো দাঁড়ায়। সে খুব বায়না করলে—বাবা কখনও ওকেও তুলে দাঁড় করিয়ে দিতেন জানালায়। তার মনে হয়েছিল, কেউ তেমন এখনও এসে এই জানালাটায় দাঁড়িয়ে আছে। বাড়িতে তার মতো কেউ হয়তো জেদ ধরলে জানালাটায় তুলে দেওয়া হয়। সেই ঘরটা এবং জানালাটা তাকে ভীষণভাবে কেমন এক আকর্ষণে ফেলে দিয়েছিল। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকলে কুজনে মন্দ কথা ভাবতে পারে—সেজন্য নানু, কিছুক্ষণ পার্কের বেঞ্চিতে বসে থেকে আবার রাস্তাটায় গেছে—জানালাটার কাছে গেছে। ঘণ্টাখানেক এরকম টানাপোড়েনের মধ্যে সহসা মনে হয়েছিল রেলিং—এ কেউ ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে—তার যাওয়া আসা লক্ষ্য করছে। ফলে সে স্থান ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল। এসব কারণে ফিরতে তার এত রাত। কাল একবার নবনীতাকে গিয়ে সে বলবে, আমাদের আগের বাসাটায় এখন কে থাকে? ওখানে যাব। তুমি আমাকে নিয়ে চল।
তারপরই মনে হয়েছে নবনীতাদের সঙ্গে আলাপ নাও থাকতে পারে। নবনীতা নাও যেতে পারে। নবনীতা না গেলে, বাড়িটায় তার যাওয়া মুশকিল। সোজাসুজি যদি চলে যায়, গিয়ে বলে এ—ঘরটাতেই আমার বাবা মা থাকতেন, এ—ঘরটাতেই আমি অনেকদিন থেকেছি—ওই রেলিংটা দেখছেন, সেখানে থাকত আমার কাঠের ঘোড়া। ঘোড়ার পিঠে বসে আমি দোল খেতাম। আমার বারবারই এখানে চলে আসতে ইচ্ছে করে।
রাস্তার অন্ধকারে নানু ফিরছে। পাশাপাশি বাড়িগুলোতেও কেউ জেগে নেই, কেবল দোতলায় রেলিং—এ দাদু এক অতিকায় জড়দগবের মতো। সে একটা ক্যালভার্ট পার হয়ে বাড়িটার গেটের কাছে ঢুকে গেল। দাদু ঝুঁকে অন্ধকারে কিছু আঁচ করলেন, তারপর নিঃশব্দে নেমে আসতে থাকলেন। নীচের একটা আলো জ্বেলে দিলেন তিনি। নিঃশব্দে লোহার গেট খুলে দিলেন। নানুর কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। সে সোজা সিঁড়ি ধরে উঠে গেল। ছোট মাসি এবং দিদিমা শুয়ে পড়েছে। এদিকের ঘরবাড়ি মাঠ গাছপালা এখন কেমন নিশুতি রাতের মতো।
নানু এখন চায় চুপচাপ শুয়ে পড়তে। তার খেতে পর্যন্ত ভালো লাগছে না। বাবার মুখটা কেমন, বাবার মুখ, সেই হিজিবিজি আঁকা মানুষের ছবির মতো, কোনো একটা ছবি—সমুদ্রের ঢেউয়ের সঙ্গে যেন ভেসে যায়। সে কেমন অসহায় বোধ করতে থাকল। মনে হয় তার শেষ অবলম্বনও চলে যাচ্ছে। পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য তার দরকার বাবার পাশাপাশি থাকা। তিনিও কেমন স্মৃতি থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছেন।
এইসব ইচ্ছের কথা মাঝে মাঝে আর কাউকে বলতে পারলে ভালো লাগত। অথচ সে দাদুর বাড়ি চলে আসার পর এমন কাউকে পেল না যাকে বলতে পারে, জানো আমার বাবা কুড়িটা ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে মারা গেছেন। জানো আমার মা আর আমাকে আগের মতো ভালোবাসে না। তার কোনো টান নেই—সংসারে আমি বড় একা। মাঝে মাঝে এও মনে হয় সে তার একমাত্র কাছের মানুষ মানুকে বলতে পারে। সে তার আগের জীবনের অনেক কথাই মানুকে বলেছে। ক্লাসের অফ পিরিয়ডে ওরা লাইব্রেরির মাঠে চলে গেছে এবং কত কথা—কিন্তু মানুষের সংগোপনে এমন কিছু কথা থাকে যা বুঝি কাউকে বলা যায় না। এই যে সে হত্যাকারীর খোঁজে বের হয়েছিল, মানুর সঙ্গে দেখা হলে হয়তো তার সে ইচ্ছাটা এত প্রবল হত না আজ।
দাদু ঘরে এসে বলল, চল খাবি।
নানু বলল, চল।
নীচের তলায় সে ভেবেছিল সবাই শুয়ে পড়েছে। এখন দেখছে সবাই জেগে! দাদু, দিদিমা, মাসি এবং সে। টেবিলে বসে সবাই একসঙ্গে খাবে। রান্নার মেয়েটা টেবিলে খাবার সাজিয়ে রেখেছিল আগেই—ওরা বসলে ঢাকনা খুলে দিল, প্লেট সাজিয়ে গেল। হাতে মুখে জল দেওয়ায় নানুর চোখ মুখ স্নিগ্ধ দেখাচ্ছিল।
দাদুর দিকে তাকিয়ে নানু বলল, তোমরা খেয়ে নিলেই পারতে।
দিদিমা বলল, তুমি না এলে খাই কী করে?
ছোট মাসি বলল, তুই কোথায় গেছিলি? এত কী কাজ! দিদিকে চিঠি লিখে জানিয়ে দেব। তুই আমাদের খুব জ্বালাচ্ছিস।
নানু খুব স্পষ্ট গলায় বলল, বাবার ফোটোর খোঁজে গেছিলাম।
কোথায়? দাদু উঠে দাঁড়ালেন।
তুমি অত উত্তেজিত হচ্ছ কেন দাদু?
না, মানে তুই ফোটো খুঁজতে কোথায় গেছিলি? ফোটো তো বাড়িতেই অনেক আছে। কত লাগবে?
কোথায়? তোমরা তো এতদিন বলেছ, ফোটো নেই।
তখন তুমি ছোট ছিলে, বাবার কথা মনে হলেই কষ্ট পাবে ভেবে তুলে রাখা হয়েছিল।
নানু বলল, অঃ। তারপর আর কিছু বলল না। তার মনে পড়ল, সেই অনেক আগে একবার বাবার ফোটো চেয়ে পায়নি। কোথাও পায়নি। তার মনে হয়েছিল, কোথাও নেই—বাবার ছবিটা বাড়িতে ভারি বিপজ্জনক। নানু এখন বড় হয়ে গেছে। নানু এখন বাবার সেই স্মৃতি বুকে বয়ে বেড়ায় না। সহজেই দেওয়া যেতে পারে ভেবেই হয়তো দাদু সেই স্মৃতি স্বীকার করলেন, আছে। তিনি দেবেন।
নানু খেয়ে উঠে ওপরে চলে গেল। সে এখন আর মনে করতে পারছে না, কেন সে সুনীল কাকার বাড়ি গিয়েছিল। ফোটোর জন্য না অন্য কিছু জানতে—আসলে কী সে মনের মধ্যে একটা তুমুল প্রতিহিংসার ঝড় নিয়ে বড় হচ্ছে। যার জন্য মাঝে মাঝেই মনে হয়, সে একটা কিছু ঠিক করবে। সেটা কী। সেটা কী কোনো শূন্যতা, জীবনে বিশ্বাসের অভাব। না অন্য কিছু!
তারপরই সে দরজা বন্ধ করে দিল। সে চিৎকার করে বলল, আমার কোনো পরিচয় নেই—আমি বাস্টার্ড। আমার মাকেই আমি পৃথিবীতে একমাত্র চিনি, চিনতে পারি, বলতে পারি তিনি আমার মা, তিনিও আমার প্রতি বিরূপ। কাছে রাখতে ভয় পেয়েছেন। ‘জননী আমার ধাত্রী আমার’—কবিতার লাইন সে বলে গেল, জননীগো—তুমি আমায় এক আশ্চর্য শূন্যতায় ভাসিয়ে দিলে? নানু শেষে কী ভেবে হেসে দিল, বলল, ধেড়ে খোকা, ধাতস্থ হও। সংসারে কেউ কারও নয়। ভেউ ভেউ করে এত কাঁদছ কেন? সে জানালা খুলে বুক ভরে নিঃশ্বাস নেবার চেষ্টা করল।
তখনই নানু দেখল বনভূমিতে জ্যোৎস্না। অপার্থিব এক ঈশ্বরের পৃথিবী সামনে। জ্যোৎস্নায় যেন কেউ দাঁড়িয়ে আছে। সহসা তার নবনীতার কথা মনে পড়ে গেল। ন—ব—নী—তা বলে সে টেনে টেনে দেখল কতটা লম্বা করে কথাটা বলা যায়।
নবনীতা বলেছিল, শোলে দেখেছেন? কতদিন সে কোনো সিনেমা দেখেনি। সেই বিতকিচ্ছিরি ঘটনাটা দেখার পর থেকেই সে গুম মেরে গিয়েছিল। মা অর্থাৎ শ্রীমতী রানু মানে রানুবালা, তার সঙ্গে কথা বলতে সাহস পায় না। নানুর মনে হয়েছিল শ্রীমতী রানুবালার এটা কলঙ্ক। কলঙ্ক মাথায় করে শেষ পর্যন্ত রানুবালা কতদিন বাঁচবে, না মরে যাবে। একদিন রানুবালাকে কাঁদতে দেখে তার মুখ কুঁচকে গেছিল। সে বলেছিল, লোকটা এ—বাড়িতে এলে অনর্থ ঘটবে।
রানু চিৎকার করে উঠেছিল, তুই কী বলতে চাস?
সেই উল্লুকের বাচ্চা এখানে আসবে না। এলেই খুন করব।
কী বলতে চাস তুই!
খুন করব বললাম। দরকার হলে তোমাকেও।
রানুবালার মুখ ভীষণ শুকিয়ে গেছিল। ক’দিন থেকে গুম মেরে আছে নানু। মনীশদার সঙ্গে সেদিন খারাপ ব্যবহার করেছে। নানু কী সব টের পেয়ে গেছে….
রানুবালা তারপর ঘরের সেই জায়গাটা বাইরের কোনো ফুটো দিয়ে দেখা যায় কিনা, তন্ন তন্ন করে খুঁজেছে। খুঁজতে গিয়েই মনে হয়েছে, ছেলে তার বড় হয়ে গেছে। আর একসঙ্গে থাকা যায় না। বাবাকে লিখেছে নানুকে পাঠিয়ে দেব। এখানে পড়াশোনা একদম করে না। দিনকে দিন হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে।
কতক্ষণ নানু জানালায় দাঁড়িয়ে আছে, টের পায়নি। মানুষের যে কী হয়! আজ সকালে এক রকম, বিকেলে এক রকম। সন্ধ্যায় সে যা ছিল, এখন আর তা নেই। আকাশ এবং এই পরিব্যাপ্ত জীবনে কী আছে কী নেই সে এখনও জানে না। তবু এক সুদূর থেকে মাঝে মাঝে এই পৃথিবীতে কেউ টরেটক্কা শব্দ পাঠায়। নানু আজ প্রথমে বুঝতে পারছে, সে তার বাবার জন্য কিছুই করতে পারে না। কারণ বনভূমিতে আজ সন্ধ্যায় জীবনে প্রথম জ্যোৎস্না দেখেছে।
ঘুমোবার আগে সে বিছানায় চুপচাপ বসে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, আমি সবাইকে ক্ষমা করে দিলাম। সে আলো নিভিয়ে দিল তারপর। শুয়ে কপালে হাত রাখল। এবং চোখে সেই লাবণ্যভরা মুখ। নবনীতা ভারি বিস্ময়ে ওর দিকে তাকিয়েছিল। ক্রমে সেই চোখ নরম হতে হতে এক সময় ভারি অন্তরঙ্গ হয়ে গেলে, নবনীতা চোখ নামিয়ে নেয়। পৃথিবীতে সে এমন সুন্দর লজ্জার চোখ কেউ নামিয়ে নিয়েছে, জীবনে দেখেনি। সিনেমায় দেখেছে, বন্ধুদের কাছে সে গল্প শুনেছে, কিন্তু জীবন দিয়ে প্রত্যক্ষ করেনি। সে বলল, নবনীতা। সে বলল, ন….ব…নী….তা। সে বলল, ন…ব…নী…তা।
চার
আজও আবার রমাকে নিয়ে অরুণ বের হয়ে গেল। ভুবনবাবু কান পেতে শুনলেন স্কুটারের শব্দ। দূরে আরও মিলিয়ে যাচ্ছে। তাঁর এমন সুন্দর মেয়েটাকে নিয়ে একটা লোক মাঝে মাঝে উধাও হয়ে যায়। বুকের ভেতর কষ্টটা টের পান। অসহায় চোখ মুখ দেখলে মায়া হবার কথা। ভুবনবাবু কত কিছু আশা করেছিলেন। তাঁর সংসার খুব বড় নয়। ভানু যেবারে হল, তিনি চাকরি খোয়ালেন। রমা যেবারে হল, তিনি প্রমোশান পেলেন আর মানু যখন নীরজার পেটে, চাকরিতে জটিল অবস্থা। সংসারে মেয়েটাকেই বার বার মনে হয়েছে পয়া। মেয়েটার কপালে খুব সুখ থাকার কথা। এবং মনে মনে যা কিছু স্বস্তি সবই রমাকে কেন্দ্র করে। সেই মেয়েটা ক’মাসের মধ্যে কেমন হয়ে গেল। একটা লোকের সঙ্গে ঘুরে বেড়ালে খারাপ দেখায়, এখন আর তেমন বলতেই সাহস পান না।
এবং সারাটা দিন অস্বস্তিতে কাটে। এই যে রমা বের হলে গেল, এবং কোথায় যাবে, যাবার সময় তো বলে গেল কোন এক অমলবাবুর বউভাত। কখন ফিরবে রমা? একবার খুব সংকোচের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করেছিলেন। যা হোক রমা খুব একটা মুখ করেনি। ভালো মতই বলেছে, ফিরতে সন্ধ্যা হবে।
ফিরতে সন্ধ্যা হওয়ার ব্যাপারটা খুব ভয়ের নয়। কতদিন তো রমার ফিরতে বেশ রাত হয়ে যায়। তিনি বারান্দায় পায়চারি করেন। রাস্তায় স্কুটারের শব্দ পেলেই বুঝতে পারেন, রমা এল। অরুণের স্কুটার অন্য দশটা স্কুটার থেকে যেন আলাদা। শব্দটা তাঁর ভারি চেনা। দশটা স্কুটারের ভেতর কোনটা অরুণের তিনি আজকাল ঠিক টের পান। ঘরের ভেতর বসে বুঝতে পারেন, মানু সদর খুলছে। ওরা এল।
অথবা স্ত্রীকে বলবেন, এত রাত করে যে ফিরছে, কিছু বল না কেন?
তুমিও তো বলতে পারো।
আমার কি শোভা পায়। তুমি মা। স্ত্রীজাতির কলঙ্কটা কী তা বোঝো। তুমি বললেই ভালো হয়। আমার পক্ষে বলা শোভা পায় না।
নীরজা যে কিছু বলেনি এমন নয়। কিন্তু রমা এমন গম্ভীর মুখে তখন চেয়ে থাকে যে তিনি সাহস পান না। রমা মাঝে মাঝে মাকে ভীতু দেখলে হেসে ফেলে।—আচ্ছা মা, আমি তো তোমার মেয়ে, তবে ভয় পাও কেন?
নীরজা ভিতরে আরও গুটিয়ে যায় তখন। রমা তো জানে না, ওর বয়সে তিনি খুব ভালো ছিলেন না। অথচ সব মায়েরাই তো এমন মুখ করে রাখে যে মনেই হয় না, যৌবনে কী একটা যেন হলে ভালো হয়, সব থেকেও কিছু একটা নেই, সব মায়েরাই যে সব বাচ্চাদের অজ্ঞাতে গোপনে কিছু করে ফেলতে পারে, রমা বুঝি তা জানে না। নীরজার চুলে পাক ধরেছে। বয়সানুযায়ী একটু বেশি পেকেছে। কপালে বড় সিঁদুরের ফোটা সতী—সাধ্বী করে রেখেছে। নীরজা বলতে পারত, আমাদের কালটা একটু অন্যরকমের ছিল। অতটা খোলামেলা ছিল না। তোমরা বড় খোলামেলা। ভয়টা সেজন্যই বেশি।
রমা মাকে জড়িয়ে বলত, আমাকে তুমি কী ভাবো মা?
নীরজা কিছু তখন বলতে পারত না। কারণ সংসারটা সত্যি আর আগের মতো নেই। জীবনধারণের জন্য কত কিছু আজকাল দরকার হয়। সাধাসিধে ভাবে বেঁচে থাকার কোনো অর্থ নেই আজকালের ছেলেমেয়েদের কাছে। যা আছে চারপাশে দেখে নাও, জীবন ফুরিয়ে যাচ্ছে। নীরজা আজকাল নিজের কাঙালপনাও মাঝে মাঝে টের পায়। মেয়েকে খুব বেশি একটা কিছু বলতে পারে না।
ভানু বাজারের থলে রেখেই বলল, মানদাকে বল চা করে দিতে। আমি বের হব।
কোথায় বের হবে সবাই জানে। নীরজা বলল, মানদা বাজারটা সাজিয়ে রাখ। দাদাবাবুকে চা করে দাও। ডিম ভেজে দাও টোস্টের সঙ্গে।
মানু গুনগুন করে তখন গান গাইছিল। মানু উবু হয়ে রেডিয়োর নব ঘোরাচ্ছে। ছুটির দিনে সকালেই বাড়িটা একে একে খালি হয়ে যায়। মানুবাবু এখনও ঘরে আছে দেখে ভানু বিস্মিত হল। গতকাল হেরে এসেছে। হেরে গেলে বাড়িতেই ঘাপটি মেরে বসে থাকে। কেউ ডাকলেও সাড়া দেয় না। মন ভালো নেই মানুর তবু একবার জিজ্ঞেস করল, অরুণ চলে গেছে?
দিদিকে নিয়ে চলে গেছে।
তোর কাজের কথা কিছু বলল?
না।
একবার জিজ্ঞেসা করলে পারতিস।
মানু কিছুতেই সেন্টারটা পাচ্ছে না। দাদার কথা খুব অবহেলা ভরে যেন শুনছে। বাড়ির ভেতর একটা জঘন্য ঘটনা ঘটছে দিনের পর দিন। অথচ সবাই চোখ বুজে আছে। কিছু বলতে সাহস পাচ্ছে না। কেমন ব্যক্তিত্বহীন বাবা। দাদা স্বার্থপর হয়ে উঠছে। মানু একটা চাকরি পেলেই পড়াশোনা ছেড়ে দেবে। দাদাও নিজেরটা বুঝে নেবার জন্য আজকাল বড় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে—সে কঠিন এবং রুক্ষ গলায় জবাব দেবে ভাবছিল আর তখনই বাবার কাশির শব্দটা বেয়াড়া রকমের। সে আর সাহসই পেল না কিছু বলতে। কেবল দাদার দিকে একবার মুখ তুলে তাকাল।
তখন বোঝাই যায় দিদির এমন অসামাজিক আচরণে সবারই সায় আছে। অরুণ এলে তাদের সবাইকে খুব ভদ্র হয়ে যেতে হয়। যতটা নয় তার চেয়ে বেশি। যেমন বাবা দাদা মা সবাই তখন একটা সুন্দর মুখোশ পরে ফেলে। পবিত্র সব কথাবার্তা। যেন কোনো দেবদূত অরুণদা। দেবদূতরা তো শরীরের কিছু বোঝে না। মানু বন্ধুদের কাছে খুব গর্বের সঙ্গে বুকে টোকা মেরে আর কথা বলতেও পারে না। বিশেষ করে কলেজে নানুর সঙ্গে দেখা হলে মাথাটা তার নুয়ে আসে। নানু গম্ভীর প্রকৃতির ছেলে। খুব সিরিয়াস জীবন সম্পর্কে। রাজনীতি নিয়ে কথা উঠলে নেতাদের সে চোর বাটপাড় ছাড়া ভাবে না। কী হয়ে গেল দিদিটা! আমরা কী হয়ে গেলাম!
দিদির আগের সুনাম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বোঝাই যাচ্ছিল। সে তো নিজেও কম হাঁটাহাটি করছে না, সে যদি কোথাও চাকরি পেয়ে যেত, তবে, তবেই বা কী, দিদি কী এমন একটা রঙিন জগৎ থেকে নেমে এসে বলবে, খোকা, আমি ফের ভালো হয়ে গেছিরে।
মানু তখন শুনতে পাচ্ছে বড়দা শিস দিচ্ছে ঘরে। বড়দা ফিরবে প্রায় একটায়। বাড়ি থেকে সকালে বের হবার সময় শিস দিয়ে গান গায় দাদা। মানু দাদার এত উচ্ছ্বাস কেন টের পায়! ছুটির দিনে প্রিয়নাথ কাকার বাড়িতে সকালটা কাটিয়ে আসবে। মন্দাকিনী বউদি আজকাল খুব যত্ন করছে। প্রিয়নাথ কাকার বিধবা পুত্রবধূ মন্দাকিনী বউদি। গত অক্টোবরে রাঁচির কাছে কার অ্যাকসিডেন্টে দাদা মারা গেলেন। বাবা কি টের পায় সব। বাবা কি টের পেলেই কাশতে থাকে খক খক করে।
মানু সেন্টারটা কিছুতেই পেল না। জয়ার কাছে একবার যাবে। জয়া তো এখন পার্লারে বসে কবিতা লিখছে। কোথায় একটা কাগজে জয়ার কবিতা বের হয়। আজকাল গিয়ে কাছে বসে থাকলেও জয়া টের পায় না, একজন তরুণ যুবক ওর সামনে বসে আছে। সে কবিতা—টবিতা পড়তে ভালোবাসে না। বোঝেও না। বরং খেলার খবর যত আছে—কে কোন সালে কার কাছে কত পয়েন্ট ছিনিয়ে নিয়েছে গড় গড় করে বলে দিতে পারে। উঠতি খেলোয়াড় টমসনের ফাস্ট বলের গতি কত, অমৃতরাজ ভ্রাতৃদ্বয় শেষ পর্যন্ত ডেভিস কাপের ফাইনালে উঠতে পারবে কী না, না উঠতে পারলে ওর রাতের ঘুমটাই মাটি হবে। বরং তাকে বললে, সে সহজেই খেলা বিষয়ক রচনা লিখে দিতে পারে। কবিতার মাথামুণ্ড সে কিছুই বোঝে না। জয়া তাকে একদিন বলেছিল, মানু তোমার এমন সুন্দর চোখ, তুমি কবিতা লিখতে পারো না কেন? তোমার চোখে যদি চুমো খাই রাগ করবে?
মানু বলেছিল, যাঃ তুমি তো মেয়ে। চোখে চুমো খাবে কী।
চোখে চুমো খেলে আমি সুন্দর কবিতা লিখতে পারব। এসো না খাই।
কী হবে কবিতা লিখে?
তুমি বুঝবে না মানু। মানুষ কী সুন্দর হয়ে যায় কবিতা লিখতে পারলে।
চোখে চুমু না খেলে কষ্ট হবে তোমার?
খুব।
তবে খাও। সে চোখ বুজে দাঁড়িয়েছিল।
জয়া তখন উঠে চারপাশে কী দেখে নিল। বাঘা পায়ের কাছে লেজ নাড়ছে। সে উঠে পড়তেই বাঘা উঠে পড়েছিল। সুন্দর জি আর মিনি স্কার্ট পরা মেয়েটার শরীরে কী যে আশ্চর্য গন্ধ! সে চোখ বুজেছিল—কারণ, বুঝতে পারছিল দুহাত বাড়িয়ে তাকে জড়িয়ে নিয়েছে জয়া। কুকুরটা ঘেউ ঘেউ করে উঠছিল তখন। জয়ার বাবা ওপর থেকে বলেছিল, ‘বাঘা অসময়ে ডাকছে কেন রে!’
জয়া চুমো খেতে খেতে বলেছিল, বাঘা খুব অসভ্য হয়েছে বাবা। সময় অসময় বোঝে না।
মানু একদণ্ড দেরি করেনি। ধাঁই করে লাথি মেরেছিল বাঘার পেটে। বাঘা আর একটুও চিৎকার করেনি। জয়ার ঠোঁটে মিষ্টি গন্ধ। সে বাড়ি ঢুকে বাথরুমে সাবানে ঘষে ঘষে গন্ধটা তুলে ফেলেছিল। পালিয়ে সিগারেট খাওয়ার মতো কোনো গন্ধ যদি দিদি টের পেয়ে যায়—মানুটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
সংসারে নষ্ট হয়ে গেলে কেউ আর তখন ভালোবাসতে চায় না। সে এ জন্যে সব সময় ভালো থাকতে চেয়েছে। উঠতি বয়সে যা সব ইচ্ছে থাকে, তারও আছে। সে একদিন সিগারেট খেতে পারল না পালিয়ে। কতদিন ভাবত নানুকে নিয়ে সে বাবুঘাটে চলে যাবে, অথবা গড়ের মাঠের ঠিক মাঝখানটায়। দু’জনে দুটো সিগারেট কিনে নেবে মেট্রোর নিচ থেকে। তারপর সন্তর্পণে হাঁটতে হাঁটতে একেবারে যখন বুঝবে কেউ নেই, পরিচিতি কোনো মুখই তাকে আর দেখছে না, তখন সিগারেট জ্বালিয়ে বেশ বড়দের মতো টানবে। ইচ্ছেটা সেই কবে থেকে। পরীক্ষায় সে ভালো করতে পারে না কেন বোঝে না। কেবল খেলা সম্পর্কে ভারি উৎসাহ তার। আসলে সে খেলা পাগল বলে, অন্য দশটা কুকর্ম করার সময় একেবারেই পায়নি। তার বয়সের ছেলেরা কত সব অভিজ্ঞতার কথা বলে। সে একটাও বলতে পারে না। তবু যা হোক জয়াকে মাস দুই আগে ভাগ্যিস হাতের কাছে পেয়ে গেল। জয়া তাকে মাঝে মাঝে আজকাল সাহসী হতে বলছে।
দিদির এই সকালে বের হয়ে যাওয়াটা ভালো লাগছিল না। বাবা কিছু বলে না। দাদাও বের হয়ে যাচ্ছে। কেমন সবাই আলগা হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন। ছ’মাস আগেও এটা ছিল না। কেমন সবাই মিলে সুন্দর একটা সংসারের ছবি ছিল বাড়িতে। দিদির চাকরিটা দাদাকেও কেমন স্বার্থপর করে ফেলেছে। সে বুঝি ভাবছে, এবার চলে যাবে। এতদিন তো টানা গেল, এবার ছুটি।
মা তখন ডাকল, মানু খেয়ে যা।
ওর খেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। এবং কেমন বিরক্ত গলায় বলল, রেখে দাও।
রেখে দেবটা কোথায় শুনি! তোমাদের সবার খাবার নিয়ে কতক্ষণ বসে থাকব?
কে বলেছে বসে থাকতে?
নীরজা আজকাল দেখেছে মানু প্রায়ই মুখে মুখে উত্তর করে। স্বভাবটা কেমন চোয়াড়ে হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন। বড়টাকে কিছু বলতে পারে না। মেজটা তো স্বাধীন হয়ে গেল চাকরি পাবার পর। ছোটটা পর্যন্ত মুখ করছে। নীরজা অগত্যা মানুর সকালের জলখাবার প্লেট দিয়ে তার ঘরে ঢেকে রেখে দিল। যখন খুশি খাবে। মুখে কিছু বলল না।
আজকাল বাড়ির খাবারের মেনু পালটে গেছে। আগে ছিল দুখানা রুটি, সামান্য আলুর তরকারি। দিদির চাকরিটা সংসারে প্রাচুর্য এনে দিয়েছে, ডিমের পোচ, মাখন, স্লাইস পাউরুটি, এক গ্লাস হরলিক্স। এত খাবার দেখে, তার বমি পাচ্ছিল। দিদি রুমাল উড়িয়ে কোথায় যায়, কী করে, সব বুঝতে পারে। একদিন ভেবেছিল বলবে, দিদি তুই আর যাস না। আমি কাঁচামালের ব্যবসা করব। আমাদের ঠিক চলে যাবে। তারপর মনে হয়েছিল ইস, কে শুনবে তার কথা। আর বাবা যদি জানতে পারে বাজারে আনাজপাতি বিক্রি করার কথা ভাবছে সে, তবে আর রক্ষে থাকবে না। মানসম্মান এভাবে খোয়াতে রাজি নই।
সে একটা জামা গায়ে দিল। সকালটাতে কিছু করার থাকে না। অন্যদিন দাদার অফিস, দিদির অফিস থাকে বলে বাজারটা সে করতে যায়। সকালের কাগজটা দেখা হয়ে গেলেই যেন সারাদিনের কাজ তার শেষ। গল্পের বই সে দু—একবার পড়ার চেষ্টা করছে, কোনো মজা নেই কোথাও। বরং এ পাড়ায় সে অনেকের ফুট—ফরমাস খেটে দেয়। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, কেউ মরে গেলে কাঁধ দেওয়া, দত্তবাড়ির বউ যাবে রামগড়ে, কে যাবে সঙ্গে, ভুবনবাবুর ছেলে মানুর কথা তখন সবার মনে পড়ে যায়। মানু পাড়ায় এভাবে বেশ ইজ্জত নিয়ে বেঁচেছিল। দিদিটা রুমাল উড়িয়ে বউভাত খেতে যাচ্ছে। বাবার এত সুখ সয় না বোধহয়। কেমন সব সময় শঙ্কিত মুখ। একটা জ্যান্ত উটের ছবির মতো বাবা গলা বাড়িয়েই আছে।
সেও নেমে গেল সিঁড়ি ধরে। কোথায় যাবে জানে না। বের হতে ইচ্ছে ছিল না। এই সময়টাই বোধহয় সবার ভালো না লাগার সময়। বিকেলে দো—আসমান দেখা যাবে। জয়া তাকে দিয়ে টিকিট কাটিয়ে রেখেছে। সকালটাই বড় বেশি একঘেয়ে। হাবুল পালের রোয়াকটাই সর্বোৎকৃষ্ট জায়গা। ওরা পাঁচ—সাতজন নানা রকম খবরে মেতে থাকতে পারে তখন। কিন্তু হেরে গেছে দল। সে মানত পর্যন্ত করেছিল। কালীবাড়িতে লাল জবা দেবে। গেলেই ছেঁকে ধরবে পিছনে লাগবে। তবু আড্ডা ছাড়া হাতের কাছে এখন তার করার কিছু নেই। এবং যেতেই রুমন বলে ফেলল, কত টেম্পারেচার?
কোনো টেম্পারেচার ওঠেনি।
আয় না দেখি।
মন ভালো নেই রুমন। ঝামেলা করবি না।
কী ঝামেলা করলাম মাইরি। বুককি শালা মাইরি তোকে কী বলবে বলে কখন থেকে বসে আছে।
কিছু বলতে হবে না। কে শুনছে ওর কথা।
বুককি বলল, খাঁ খাঁ করছে গুরু।
সবারই খাঁ খাঁ করছে। কেউ ভালো নেই। চুপচাপ বসে থাক। অথবা গান গাও, শুনি!
বুককি বলল, অসময়ে গান গাইতে বলছ?
গা না। যা মনে আসে।
চাঁদবদনী ধনি নাচ তো দেখি গাইব?
গা না। কে বারণ করেছে। যেটা ভালো লাগে গা।
রুমন বলল, আমি নাচব তবে।
মানু বলল, না তোমায় নাচতে হবে না।
বুককি চোখ বুজে ফেলেছে। ওর গানের গলা ভালো। হুবহু নকল করে ফেলতে পারে একবার শুনে। অথচ কোনো প্রচেষ্টা নেই। কে জানে চেষ্টা থাকলে হয়তো সেও একটা কিশোরকুমার হয়ে যেতে পারত। আসলে বুককি যতটা আড্ডাবাজ হুল্লোড়ে ততটা সিরিয়াস নয় জীবনে। অথচ সব সংগীত সম্মেলনে বুককিকে দেখা যাবে বাইরে গাছের নীচে বসে আছে। নিবিষ্ট মনে গান শুনতে সে ভালোবাসে। মানু বলেছিল, তুই তো গান শিখতে পারিস। চর্চা করিস না কেন?
এই যে করছি। বলেই সে গান জুড়ে দেয়। চর্চা তো তোমরা এলেই শুরু হয়ে যায়। তোমাদের ভালো লাগলে আর কার ভালো লাগল না লাগল গ্রাহ্য করি না। যেন এ কটি বন্ধুর জন্যেই সে অতি যত্নে গলায় গান তুলে ফেলে। এবং ওদের যতক্ষণ না শোনাবে বুককি কেমন অস্বস্তিতে থাকে।
বুককি বেশ মজার গান জুড়ে দিয়েছে। চাঁদবদনী ধনি নাচ তো দেখি। ওরা রেলিঙে ভর করে দাঁড়িয়ে আছে। পাশেই একটা পার্ক, সেখানে সকালে টেনিস খেলে কেউ কেউ। হকার্স কর্নারে দোকানপাট খুলছে। পাড়ায় কে কোন বাড়িতে থাকে সবই তারা জানে। তরুণী মেয়েরা অথবা যারা কৈশোর পার হয়ে যাচ্ছে সবার একটা করে তাদের নিজস্ব নাম আছে। ধবলী যাচ্ছে, যদি চাঁদবদনী ধনি নাচ তো দেখি বুককি না গাইত, তবে ঠিক চেঁচিয়ে বলত, ধবলী যায়, কী হবে হায় এই সব পঙ্গপালের।
যেন সত্যি আর একটা গান। অথচ বুককি সত্যি গানটা মন দিয়ে গাইছে। গান শুনে যে নিস্তেজ পর্বটা ছিল মানুর, নিমেষে কেমন উবে গেল। বলল, বুককি তুই কী বলবি বলেছিলি রে?
গুরু দোষ নেবে না বল।
দোষ নেব কেন!
দোষ হলে ক্ষমা করে দেবে বল।
এই হচ্ছে বুককি। আসল কথাটা বলার আগে এত বেশি ভনিতা করবে যে শোনার সব আকর্ষণ নষ্ট হয়ে যায়।
বুককি! কেমন চেঁচিয়ে উঠল মানু!
রুমন বলল, তোর কি মেজাজটা আজ ঠিক নেই রে!
মানু কিছু বলল না।
হার জিত তো খেলায় আছেই।
রুমন! খুব স্থির গলা মানুর।
কেমন হতচকিত রুমন। বুককি বলল, দোস্ত তুমি যা দেখাচ্ছ তারপর আর দেখছি কিছু বলাই যাবে না।
মানু হাতে বালা পরেছে বছর খানেক হয়ে গেল। সে ডান হাতের বালা বেশ টেনে ওপরে তুলছে। মানু ভেতরে ভেতরে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লে এমন করে থাকে। ওর কেন যে মনে হয় ঠিক এই সময়ে দিদি কিছু করছে। দিদিকে জোর করে কেউ কিছু করছে। সে রোয়াকে বসে পড়ল। পিন্টিদের বাড়ির তিনতলার জানালার দাঁড়িয়ে পিন্টির কাকা সিগারেট খাচ্ছে। পিন্টি একবার পুজোর মণ্ডপে রাত জেগেছিল। পিন্টির শরীরে এক রকমের সুন্দর গন্ধ আছে। সে মেয়েদের আলাদা গন্ধ টের পায়। জয়া পিন্টি বুলার শরীরে এক এক রকমের গন্ধ।
মানু মনে মনে হেসে ফেলল। যত সব বাজে ভাবনা তাকে সব সময় বিপর্যস্ত করছে। যেমন, দিদি যখন কলেজে পড়ত, একটু দেরি হলেই তার মনে হত, এই বুঝি কেউ এসে খবর দিয়ে যাবে অ্যাকসিডেন্ট। দিদির খাতায় রোল নাম্বার, ইয়ার এবং কলেজের নাম যদি না থাকে, কোনো ঠিকানায় তাকে খুঁজে পাবে না। এবং দিদি ফিরে এলেই বলেছিল, তোর খাতায় রোল নাম্বার, কলেজের নাম লিখে রাখিস তো?
রমা কিছুই বুঝতে পারত না। মানু এ—ধরনের কথা কেন বলছে, রমা একবার দেখেছিল, ওর ব্যাগে একটা চিরকুট। কী খুঁজতে গিয়ে আবিষ্কার করেছিল। নাম, ঠিকানা লেখা। এবং ঠিক মানুর হাতের লেখা।
মানুর এই ধরনের অশুভ চিন্তা করার একটা বাতিক আছে। বাবা যখন অফিস থেকে রিটায়ার করে তখন বয়স তার খুব একটা বেশি না। বাবা একটু রাত করে ফেললেই জানালায় দাঁড়িয়ে ছটফট করত মানু। আর মনে হত, কেউ বলছে—এটা কি ২৩/১০ এর বাড়ি? এখানে ভুবনবাবু বলে কেউ থাকেন? আপনি ভুবনবাবুর কে! তিনি হাসপাতালে।
মানু বলল, বুককি নির্ভাবনায় বলতে পারিস।
গুরু তোমার জয়া কিন্তু প্রেম করছে।
কার সঙ্গে?
সে তো গুরু জানি না।
ওর অনেক কবি বন্ধু আছে। জয়া বলেছে, কবি বন্ধুদের নিয়ে জয়া মাঝে মাঝে বেড়ায়।
বুককির মুখটা মানুর কথায় কেমন ফ্যাকাশে দেখাল। সে ভেবেছিল জোর একটা খবর দেবে আজ মানুকে। কিন্তু মানু কোনো উত্তর দিল না। কলেজ স্ট্রিটের পিছনের দিকটার একটা রেস্টুরেন্টে সে জয়াকে দুদিন দেখেছে। পর্দা ঘেরা সব কেবিনে নানা রকমের নষ্টামি করার জায়গা। বদনাম আছে জায়গাটার। উঠতি কলেজ পালানো সব ছেলেমেয়েদের খুব ভিড় হয়। সহজে কেবিন পাওয়া ভার। একবার ঢুকে গেলে কেউই বের হতে চায় না। এমন জায়গায় সে জয়াকে দেখেছিল। সঙ্গে সুন্দর মতো তার বয়সি একটা ছেলে।
বুককি বলল, কবি বন্ধুরা বুঝি খুব ভালো ছেলে হয়?
অন্তত তোমাদের মতো না।
রুমন বলল, মাইরি, আমিও কবিতা লিখতে আরম্ভ করব ভাবছি।
ভেবে দ্যাখ না। চাট্টিখানি কথা না। কবি হতে চাইলেই কবি হওয়া যায় না। জয়ার নাম আছে।
বুককি বলল, ছেলেটার যদি ফ্যাচাং করার ইচ্ছে হয়ে যায়।
মানু বলল, ফ্যাচাং করার ইচ্ছে হবেই না। কবিতা ভারি মধুর ব্যাপার। কবিরা কবিতা ছাড়া কিছু বোঝে না, জানে না।
রুমন বলল, বিকেলে তোর খেলা আছে?
বিকেলে আমি আর জয়া দো—আসমান দেখতে যাচ্ছি।
আর সেই আশায় সেদিন ম্যাটিনিতে সে হলের নীচে দাঁড়িয়েছিল জয়া আসবে—সে আর জয়া হলে ঢুকবে। টিকিট জয়ার কাছে। জয়ার জন্যে চারপাশের ভিড়ের ভেতর যখন উন্মুখ ছিল তখনই মনে হল দূরে জয়া কারও সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে। সে কাছে গিয়ে বলল, এসো। শো আরম্ভ হয়ে যাবে।
জয়া বলল, তুমি যাও মানু। বলে একটা টিকিট দিয়ে দিল। আমার যাওয়া হবে না। তোমার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলাম।
তার মানে?
আমার আজ কবিতা পাঠ আছে। এর নাম কালিদাস! ও আমাকে নিয়ে যাবার জন্যে বাড়ি গেছিল।
মানুর মাথাটা ঝিম ঝিম লাগছিল। ভেতরে একটা ক্রুদ্ধ বাঘ হাই তুলছিল। সে কিছু বলতে পারল না। কবিরা খুব সুন্দর কথা বলে! জয়া কত সুন্দরভাবে কথাটা বলল। সে কোনো রকমে বলল, আপনিও বুঝি কবিতা লেখেন?
কালিদাস বলল, জয়ার জন্য লিখি। জয়ার খুব ভালো লাগে আমার কবিতা। মানুর ইচ্ছে হয়েছিল জানার, তার জন্যে কেউ কিছু লেখে কিনা। কিন্তু সে দেখল, ওদের যাবার এত তাড়া যে আর একটা কথাও বলার সময় নেই। সে ভ্যাবলাকান্তর মতো দাঁড়িয়ে থাকল। সামনের বাসটায় দৌড়ে উঠে গেল জয়া আর তার কবিবন্ধু। সে দুঃখী মানুষের মতো দাঁড়িয়ে থেকে টিকিটটা মুখে পুরে দিল। তারপর শক্ত দাঁতে কট কট করে কাটতে থাকল।
পাঁচ
সকাল সকাল নানুর আজ ঘুম ভেঙে গেল। সে উঠেই জানালা খুলে দিল! বাইরে এসে দাঁড়াল। রাস্তাটার ওপারে একটা ছোট্ট মতো লাল বাড়ি। বারান্দা থেকে বাড়িটার সব কিছুই স্পষ্ট। এই প্রথম সে লক্ষ্য করল, একটা বাচ্চা মেয়ে সাদা ফ্রক গায়ে দিয়ে লনে দাঁড়িয়ে আছে। তারপর মনে হল, বাড়িটায় রয়েছে বড় একটা ছাতিম গাছ। ছাতিম ফুলের গন্ধ—আহা, একবার সে মেসোমশাই মা—
এই পর্যন্ত মনে হতেই তার চারপাশ অন্ধকারে ডুবে যেতে থাকল। এক কুৎসিত জগৎ থেকে সে পরিত্রাণের কথা ভাবছিল। সবাইকে সে ক্ষমা করে দিয়েছে। কারণ তার এখন বনভূমিতে জ্যোৎস্না। নবনীতা, ভারি সুন্দর নাম। নবনীতা তার হাত কামড়ে দিয়েছিল। এবং সেই দাঁত আর তার নেই। নবনীতা এখন নতুন এক পৃথিবী তার কাছে।
অন্তত এমন সুন্দর পবিত্র ইচ্ছের কথা সে মানুষকে বলতে পারে। একদিন ওদিকে সে গিয়েছিল। মানুদের বাসাটা সে দেখে এসেছে। সুন্দর মতো এক যুবা গলা বাড়িয়ে বলেছে মানু নেই। মানু বাড়ির গল্প করতে খুব ভালোবাসে। দিদির গল্প, বাবার গল্প, মার গল্প—কিছুই বাদ রাখেনি। খুব খোলামেলা এবং সরল সাদাসিদে ছেলে। কিন্তু কী আশ্চর্য কিছুদিন থেকে সেই মানুও কেমন গম্ভীর। সংসারে মানুর তো তার মতো হারাবার কিছু নেই। মানু সবার ছোট। তার বাবা রিটায়ার করেছেন সাত আট বছর। এবং এ—সময়ে মনে হল বাবা যদি আরও কিছু বেশি দিন বেঁচে যেতে চেষ্টা করতেন। অন্তত মার চুলে পাক ধরা পর্যন্তও যদি তিনি অপেক্ষা করতেন।
তারপরই ফের নবনীতার কথা মনে হতেই শিস দিতে দিতে সে নীচে নেমে গেল।—ও দাদু তোমার ঘুম ভাঙল না। দিদিমা, মাসি তোমরা কোথায়—চা কই। এখনও তোমরা ঘুমাচ্ছ। মিতা দরজা খুলে দেখল নানু নীচের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁত মাজছে। মিতা কাছে গিয়ে বলল, কী রে দিলি সকালের ঘুমটা মাটি করে।
—কেমন ঠান্ডা বাতাস। চল না সামনের রাস্তাটা পার হয়ে বড় মাঠটায় নেমে যাই।
এখনও এখানে একটা বড় মাঠ রয়েছে। এ—অঞ্চলে এখনও অনেক ফাঁকা জায়গা, গাছপালা আছে। হেঁটে গেলে অনেকটা দূর হেঁটে যেতে ইচ্ছে করে। দক্ষিণের মৃদুমন্দ হাওয়া গাছপালার মধ্যে বয়ে যায়। আশ্চর্য এক প্রশান্তি তখন বাড়ি—ঘরে। মনেই হয় না মানুষের কোনো দুঃখ আছে।
নানু আজ সকাল সকাল স্নান করল। চা, জলখাবার খেল দাদুর সঙ্গে। মাসি সকালবেলায় সহসা দুটো মেহেদি হাসানের গজল গেয়ে ফেলল। এবং মনেই হয় না কোথাও এ—বাড়িতে কারও কোনো গোপন দুঃখ আছে।
নানু আজ পড়ার বইগুলিও উলটে পালটে দেখল। তার মনে হচ্ছে এ—সব পড়ে মানুষের আখেরে কিছু হয় না। শুধু পণ্ডশ্রম। ফলে তার জোরে জোরে গান গাইতে ইচ্ছে করছে। বইগুলি সরিয়ে আয়নায় নিজের মুখ দেখল। নরম দাড়ি গালে। ভালো করে আজ আবার দাড়ি কামাল। গালে হাত রেখে বুঝল বেশ মসৃণ। চশমার ভেতর চোখ দুটো ভারি স্নিগ্ধ। কোনো জ্বালা নেই। তারপর খুব ধীরে সুস্থে দাদুর ঘরে এসে বসল। ফোন তুলে ভাবল নবনীতাকে ফোন করবে। তখনই মনে হল, নম্বর তার জানা নেই। বিকেলে আবার একবার যাওয়া দরকার। এবং সে ভাবল, গেলেই ত হবে না, একটা অজুহাতের দরকার। তখনই মনে হল, নবনীতাকে নিয়ে সেই বাড়িটায় একবার যাবে। যেখানে সে তার বাবা মা এবং ঠাকুমার সঙ্গে বছরের পর বছর ছিল।
তখন অবশ্য জেঠু তাদের সঙ্গে ছিল না। কোথায় সংসারে একটা কাঁটা বিধে যায়, জেঠু এক সকালে, সেই ধুমসো মোটা মতো মেয়েছেলেটাকে সঙ্গে নিয়ে এসে বলেছিল, এই হাসি। এম এ পাশ। মাস্টারি করে। আমি বিয়ে করব মা। অবনীশ শেষ পর্যন্ত এমন একটা রাক্ষুসে ডাইনির পাল্লায় পড়ে যাবে ঠাকুমা স্বপ্নেও ভাবেনি। রাক্ষুসীটা আসার পর থেকেই এমন একটা সুখী সংসার দুদিনে কেমন হতশ্রী হয়ে উঠল।
তখন সংসারে এটা থাকে না, ওটা থাকে না। খরচ কেন এত বেশি হয়। সে শুতে পায় না জেঠুর সঙ্গে। মা নিত্যদিন বাবাকে গালমন্দ করে। বাবার ভীষণ খরচের হাত। সংসারে জেঠুর টাকা পয়সা দেওয়া ক্রমে কমে যেতে থাকল। এবং এক সকালে সেই রাক্ষুসীটাকে নিয়ে অন্য বাসায় উঠে গেল। বাবা সেদিন এত বেশি আঘাত পেয়েছিলেন যে দু’দিন কিছুই খাননি। এসব মনে হলেই তার চোখ জ্বালা করতে থাকে এবং আক্রোশ জমে ওঠে। অথচ আজ সকালে সে ভেবেছিল—সব রকমের আক্রোশ মন থেকে সরিয়ে দেবে। সে তো সবাইকে ক্ষমা করে দিয়েছে।
রাসবিহারী সকালে নানুর এই পরিবর্তনে কিছুটা বিস্মিত হলেন। তিনি নানুকে বললেন, কাল তোমার ফিরতে এত দেরি হল কেন?
নানু কাগজ ওলটাচ্ছিল। সে দাদুর দিকে না তাকিয়েই বলল, এক জায়গায় গেছিলাম।
সে তো বুঝতে পারছি। সেটা কোথায়?
বেশি দূর না।
দিনকাল ভালো না। তোমার জন্য আমরা চিন্তা করি, সেটা একবার মনে রেখো।
আর হবে না।
রাসবিহারী নাতির এমন কথায় আরও অবাক হয়ে গেলেন। ভালো মানুষের যে স্বভাব, প্রায় সে রকম কথাবার্তা নানুর। তিনি বললেন, তোমার জেঠু কাল ফোন করেছিলেন।
কোত্থেকে?
অফিস থেকে।
কিছু বলল।
বলেছে মন দিয়ে পড়াশোনা করতে।
তাই বুঝি। তারপর কাগজটা রেখে হাত পা সটান করে বলল, তুমি কী বললে?
তুই পড়াশোনা একদম করছিস না বললাম।
নানু আর কথা বলল না। সে ভাবল আজই দুপুরে একবার ফোন করবে জেঠুকে। অফিসে এলেই তার ফোন পাবে জেঠু। সে বলবে, কাল তোমার ওখানে যাব জেঠু। কতদিন তোমাকে দেখি না। সংসারে আমার বড়ই প্রিয়জনের দরকার।
তারপর আর কেন জানি তার সময় কাটে না। কলেজ যাবে কী যাবে না ভাবছিল। একবার মনে হল কলেজে গেলে, সময়টা দ্রুত কেটে যাবে। মানু ক’দিন ধরে কলেজ কামাই করছে। ইস্টবেঙ্গল আর মোহনবাগানের খেলা এলেই সে কলেজে আসে না। আজ হয়তো আসতে পারে। এলে নবনীতার সঙ্গে তার যে আলাপ হয়েছে সে—কথা বলবে। জানতে চাইবে, নবনীতার এমন কথাবার্তায় কী মনে হয়। মনে হয় কী নবনীতা তাকে গোপনে কিছু দিতে চায়। তারপরই ভাবল—যা, সে এ—সব মানুকে বললে, নবনীতাকে ছোট করা হবে। বরং কোনো ক্রাইসিস দেখা দিলে সে মানুর পরামর্শ নেবে।
কলেজে আজ তিনটে ক্লাস—জে এমের ক্লাসে সে খুব মনোযোগ দিয়ে কনসাইনমেন্ট কাকে বলে, তার বিল ভাউচার কেমন হয় শুনল। এবং ব্যাংকিং—এর ক্লাসে সে আজ কিছু নোটও নিল। অনেকদিন পর মনে হয়ে ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য জীবনে এ—সব দরকার। কৃতী মানুষ না হতে পারলে নবনীতার মান সম্মান রাখতে পারবে না।
কলেজ ছুটির পর সে একটা রেস্টুরেন্টে বসে দুপিস পাউরুটি, ডিম এবং এক কাপ চা খেল। এবং তখনই মনে হল এ সময় রওনা হলে ঠিক পাঁচটার মধ্যে নবনীতার বাড়িতে পৌঁছতে পারবে।
যখন পার্কটায় এল, তখন মনে হল রোদের আঁচ এতটুকু কমেনি। গ্রীষ্মের দুপুর সহজে শেষ হতে চায় না যেন। নবনীতা এখন কী করছে! ওর পরীক্ষা আসছে বছরে। তারপরই মনে হল গ্রীষ্মের ছুটি, নবনীতাদের ছুটি হয়ে যেতে পারে। কাল বাদে পরশু তার কলেজও বন্ধ হয়ে যাবে। নবনীতা বাড়িতেই থাকবে—না কী নবনীতার অন্য কোনো প্রেমিক আছে—যদি থাকে তবে! এই প্রশ্নটা তাকে অস্বস্তির মধ্যে ফেলে দিল।
নানু তাদের পুরানো বাসাবাড়িটা পার হয়ে যাচ্ছে। তার মনেই নেই এ সেই বাড়ি, যেখানে বসে সে বাপের আদ্যশ্রাদ্ধ করেছিল। মাথা নেড়া, গায়ে নতুন মার্কিন কাপড়, প্রায় সন্ন্যাসী বালকের মতো তাকে দেখাচ্ছিল।
এ—বাড়িতেই তার শৈশব কেটেছে বলা চলে—বাবা জেঠু ঠাকুমা মা এবং সে! মা তখন বাড়ির বধূ। বড় করে কপালে সিঁদুরের ফোঁটা, সিঁথিতে লম্বা সিঁদুর এবং খুব সকালে প্রাতঃস্নান, তারপরই রান্নাঘরে ঢুকে বাড়ির মানুষদের জলখাবার থেকে অফিস স্কুলের সময়মতো ঝাল—ঝোল ভাতের ব্যবস্থা এক হাতে। জেঠু তাকে একটা মিশনারি স্কুলে দিয়ে আসত। তখন সব কিছুই ছিল মায়া মাখানো, এমনকি বাড়ির বেড়ালটাও খেল কী না লক্ষ্য থাকত সবার। অথচ আজ নানু বাড়িটা পার হয়ে গেল, লক্ষ্যই করল না বাড়িটার দরজায় কেউ দাঁড়িয়ে আছে। বাবা গ্রীষ্মের দিনে রোজ সকালে বাড়িটার রোয়াকে এসে বসত। কোথা থেকে বয়ে আসত ঠান্ডা হাওয়া। বাবার চুল উড়ত। সে পেছনে এসে কখনও ঝাঁপিয়ে পড়ত। বাবা তখন বলত, নানু পাশে বোস। ওই দেখ কে আসছে। ধরে নিয়ে যাবে। ওর ছোট বুকটা কেঁপে উঠত—যেন কেউ নিয়ে যাবার জন্য সত্যি আসছে। সে ভয় পেয়ে বলত, বাবা আমি দুষ্টুমি করব না। তোমার পাশে চুপচাপ বসে থাকব। বাবা বলত ঠিক আছে, বলে দেব, নানু খুব ভালো ছেলে। এত ভালো থেকেও শেষ পর্যন্ত কারা তার সর্বস্ব লুণ্ঠন করে নিয়ে গেল। এক অদৃশ্য অশুভ ভয়ংকর হাত তাকে উদাসীন মাঠে রেখে চলে গেছে। এখন সেই উদাসীন মাঠ থেকে সে দু—হাত তুলে ছুটছে—আর কিছুদূর গেলেই সে জলছত্র পেয়ে যাবে। নবনীতা সেখানে গাছের নীচে একজন দুঃখী মানুষকে কতদিন পরে জলদান করবে।
সে দূর থেকেই নবনীতাদের জানলা দেখতে পেল। বুকের ধুকপুকানি বাড়ছে। সহসা নবনীতা এত প্রিয়জন হল কী করে। চারপাশে সব লুণ্ঠনকারীরা। সে গোপনে বলল, নবনীতা আমি এসে গেছি।
তারপরই নানুর খেয়াল হল বাড়িটার দরজা জানালা বন্ধ!
সে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। প্রথমত কেমন সংকোচ, সে যে—এত দূর আবার চলে এসেছে কাকিমা যদি টের পায়, আসলে নবনীতাই তার আকর্ষণ। এ—সব মনে হতেই যতটা দ্রুত ভেবেছিল, দরজায় দাঁড়িয়ে বেল টিপবে, ঠিক ততটা দ্রুত সে কিছু করতে পারল না। এবং মনে হল, সে গতকালই এখানে এসেছিল—একটা দিন মাঝে পার হয়নি, নবনীতাও লজ্জায় পড়ে যেতে পারে, বেহায়া ভাবতে পারে তাকে। এত সহজে উতলা হওয়া ঠিক না। সে বেল টিপল না। সারাদিন একবারও মনে হয়নি কথাটা। সে নীচে নেমে কী করা উচিত ভেবে দেখবার জন্য পার্কটায় গিয়ে বসবে ভাবল।
তখনই মনে হল কেউ ডাকছে, এই নানুদা চলে যাচ্ছ কেন?
সে ওপরে তাকিয়ে দেখল, জানালার ফাঁকে ভারি মিষ্টি মুখ। আধভেজানো জানালায় রোদ এসে পড়েছে, রোদে ওর চোখ মুখ চিক চিক করছিল।
তারপরই কেমন গম গম করে বেজে উঠল বাজনা—শরীরের রক্তে সেই নিবিড় ধ্বনিমাধুর্য নানুকে কেমন ভালোমানুষ করে তোলে।
দরজা খুলে দিলে নানু বলল, সব বন্ধ। ভাবলাম কোথাও চলে গেছ।
কোথায় যাব?
এই কোথাও। তারপর মাথা নীচু করে সেই আগের মতো নানু বলল, তোমার কাছে একটা বিশেষ কাজে এলাম নবনীতা।
আগে বোস। তারপর না হয় কাজের কথা বলবে।
কতদিন নানুর কোনো প্রিয়জন ছিল না। সে সবাইকে ঘৃণা করে এসেছে। মানুষের কিছুই তার ভালো ঠেকেনি। সবাইকে মনে হয়েছে ফেরেব্বাজ, ধান্দাবাজ। যা খুশি সে বলে ফেলতে পারত। কিন্তু এখন সে কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছে না। সে লাজুক বালকের মতো শুধু বসে থাকল। নবনীতা তাকে বসতে বলেছে। তাকে দোতলার ঘর থেকে ডেকে ফিরিয়েছে—এতসব মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটার ওপর কৃতজ্ঞতায় চোখ কেমন ঝাপসা হয়ে গেল।
নবনীতা বলল, তুমি বসো। আমি আসছি।
কিন্তু আশ্চর্য। বাড়িতে যেন আর কেউ নেই। নবনীতার ভাইবোনেরও কোনো সাড়া পাচ্ছে না। কাকিমা কোথাও যেতে পারে, নবনীতা একা বাড়িতে। ওর শরীরটা ভীষণ দুলে উঠল। সে বলল, ঈশ্বর আমাকে ক্ষমা করবেন—আমি পারব না।
নানুর এই স্বভাব, অর্থাৎ শরীরের মধ্যে কোনো অশুভ ইচ্ছের প্রভাব বাড়তে থাকলে সব সময় এমন বলে সংযম রক্ষা করতে চায়।
তখনই নবনীতা ফিরে এল। সে খুব তাড়াতাড়ি শাড়ি পরে এসেছে। শাড়ি পরলে নবনীতাকে যুবতীর চেয়েও বেশি নারী মনে হয়! একজন নারী জীবনে কত দরকার, নবনীতাকে দেখার আগে নানু টের পায়নি।
নবনীতা আঁচলে গা ঢেকে বসল। বলল, আপনাকে একটা সারপ্রাইজ দেব নানুদা।
নানু এবং নবনীতার মাঝখানে শুধু একটা সেন্টার টেবিল। মাঝখানে এক গজ রাস্তা পার হতে হয়। অথচ এই এক গজ রাস্তা কত যোজন দূরে মনে হচ্ছে। আহা এই নারী সুধা পারাবার। অস্থিমজ্জায় রক্তে মাংসে বড় বেশি পটু নবনীতা।
সে বলল, নবনীতা কাকিমা কোথায়?
মা রবীন্দ্রসদনে গেছে আদিপাউস দেখতে।
তুমি গেলে না। ওরা কোথায়! তোমার ভাইবোন।
বাবার সঙ্গে গেছে! তুমি আদিপাউস দেখনি।
না।
দেখলে না কেন?
কী হবে দেখে?
কী হবে আবার! মানুষ নাটক দেখে কেন? সিনেমা দেখে কেন! আমি তো আজকাল কবিতার সকাল শুনতে যাই। কেমন একটা নতুন জগৎ মনে হয়।
কতদিন কিছুই দেখিনি।
এয়ারপোর্ট দেখেছ?
না।
একদিন দেখে এসো।
তুমি সঙ্গে গেলে যাব।
বারে আমি যাব কী করে! মা আমাকে তোমার সঙ্গে যেতে দেবে কেন?
দিলে কী হবে?
নবনীতা হেসেছিল। —তুমি সত্যি বড় সরল নানুদা। তোমার মতো মানুষ এখনও তবে পৃথিবীতে দু—একজন আছে।
জানো আমার খুব ইচ্ছে করে….তারপরই নানুর মনে হল, একদিনের আলাপে নবনীতাকে তার ইচ্ছের কথা বলতে পারে কিনা। সে সামান্য থেমে নবনীতার দিকে তাকাল। নবনীতা ছাপা হলুদ কলকা পাড়ের সিল্ক পরেছে। গায়ে সবুজ ব্লাউজ। গলায় সাদা পাথরের মালা। চোখে কাজল কিংবা ভ্রূ—প্লাক করা হতে পারে—কিংবা নবনীতার ভ্রূ এতই সুন্দর যে দেখলে মনে হয় আলগা হয়ে বসে আছে ভ্রূজোড়া। তখনই নবনীতা বলল, নানুদা তুমি কিছু খাবে?
কী খাব?
যা বলবে?
কত কিছু খেতে ইচ্ছে করছে নবনীতা—কিন্তু কে দেয়।
খুব ফাজিল।
নানু নিজের দিকে তাকাল। সে খুবই চঞ্চল হয়ে পড়ছে। নবনীতা এই বয়সে সবই কি বুঝতে পারে। সে ভেতরে ভেতরে কতটা অস্থির হয়ে পড়েছে এটাও কি চোখ মুখে ধরা দেয়। এমন কেন হচ্ছে। না কী এমনই স্বভাব তার, সহজেই সব জয় করে নেবার স্বভাব। কেউ যদি চলে আসে—কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী তার। সে বলল, নবনীতা তোমার আর কোনো প্রেমিক নেই তো?
ও মা, কী সব বিতিকিচ্ছিরি কথা বলছ নানুদা।
না এমনি বললাম। আচ্ছা তুমি কখনও পাহাড়ে গেছ?
যাব না কেন। ওইতো সেদিন আমরা রাঁচি থেকে ঘুরে এলাম। পাহাড়ে গেলে মন ভারি উদাস হয়ে যায়, না নানুদা?
যাও না। জেঠিমাকে নিয়ে তো যেতেই পার। কেদারবদরি যাওয়া তো খুব সহজ। সোজা ট্রেনে হরিদ্বার…..
নানু বলল, মা আর আমাকে নিয়ে কোথাও যাবে না।
নবনীতা উঠে জানালার পর্দাটা আরও বেশি ঠিকঠাক করে দিল। তারপর রেকর্ড প্লেয়ার থেকে সুন্দর একটা ভেনচারের মিউজিক তুলে নিল। এবং নানুর দিকে তাকিয়ে বলল, কেমন লাগে ভেনচারের মিউজিক। আর শুনবে?
নানু আজ যথার্থই সুন্দর এবং সতেজ। সে উঁচু লম্বা, তার ওপর উঁচু হিলের জুতো পরেছে। হাত—পা লম্বা, একজন তরুণের ঠিক যা যা থাকলে সুপুরুষ মনে হতে পারে নানুর সব আছে। এবং ওর দিকে সব সময় নবনীতা সোজা তাকাতে পারছে না। মাঝে মাঝে নানুদা ভারি সরল মানুষ হয়ে যায়—এটাই বড় বিপদ। সবাই তো আর একরকমের নয়। কে কোন কথার কী মানে করে বসবে কে জানে!
নানুদা তোমার লাল বলটা আছে?
লাল বলটা মানে?
ওই যে সকালেই দেখতাম তুমি একটা লাল বল নিয়ে পার্কের দিকে তোমার জেঠুর হাত ধরে চলে যাচ্ছ।
তুমি দেখতে।
বা, মা যে বলত, ওই দ্যাখ মিঃ চক্রবর্তীর ছেলে, কী সুন্দর। কাঁদে না।
তুমি বুঝি কাঁদতে খুব।
কে জানে!
জানো নবনীতা অনেকদিন থেকে সেই লাল বলটাই খুঁজছি। কীভাবে যে বলটা আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেল। বলেই নানু কেমন দুঃখী মুখ করে ফেলল। পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছল। যেন কোনো সুদূরে সেই লাল বলটা গড়িয়ে চলে যাচ্ছে—সে ছুটে কিছুতেই আর তার নাগাল পাচ্ছে না। মার মনীষদাই প্রথম টের পাইয়ে দিল তাকে, বলটা চুরি গেছে। কোথাও তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।
এবং সঙ্গে সঙ্গে মগজে সেই আগুনের আংরা ধিকি ধিকি জ্বলে উঠলে সে বলল, ঈশ্বর আমি তো সবাইকে ক্ষমা করে দিয়েছি, তবে আর আমার মাথায় ধক ধক রেলগাড়ি চালাচ্ছ কেন। সে তাঁর ঈশ্বরের কথা এ—সময় শুনতে পেল। তিনি বলছেন, সামনে দ্যাখ। —কী দেখছ?
নবনীতা।
সে কেমন?
তুলনা হয় না।
মাথার মধ্যে রেলগাড়ি আর চলছে?
না।
নবনীতা বলল, কার সঙ্গে কথা বলছ?
ও না না। নবনীতা আমি তোমার সঙ্গে কথা বলছি।
তবে শুনতে পাচ্ছি না কেন?
শুনতে পাচ্ছ না। তবে জোরে বলি।
সে তখন খুব ধীরে ধীরে বলল, লাল বলটা খুঁজে পেয়েছি। নবনীতা আমার লাল বলটা এখন বুঝতে পারছি কার কাছে আছে।
কার কাছে? নবনীতা খুব হতচকিত গলায় বলল।
বলটা তোমার কাছে আছে। তুমিই আবার লাল বলটা আমাকে ফিরিয়ে দিতে পারো।
আমার কাছে? কী বাজে বকছ নানুদা! আমি লাল বলটা দিয়ে কী করব!
তোমার কাছেই আছে। কাল সহসা জানলায় তোমার মুখ দেখে টের পাই। আশ্চর্য এক জ্যোৎস্না দেখতে পাই বনভূমিতে খেলা করে বেড়াচ্ছে।
নানুদা তোমার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে না তো!
না, আমি ঠিক আছি। সত্যি বলছি আমার মাথার কোনো গণ্ডগোল নেই। আগে ছিল। হুঁসহাস রেলগাড়ি মাথার মধ্যে ঢুকে যেত। তোমাকে দেখার পর সব আমার নিরাময় হয়ে গেছে নবনীতা।
নবনীতা এবার উঠে দাঁড়াল। নানুর দিকে আর তাকাতে পারছে না সে। একজন অসহায় যুবক মাথা নীচু করে এ—ভাবে পায়ের কাছে বসে থাকলে বড়ই অস্বস্তি। সে অন্য প্রসঙ্গে যেতে চাইল। এখন আপাতত চা জলখাবার সামনে রাখার ইচ্ছে। সে ভিতরে ঢুকে কাজের মেয়েটিকে বলল, চা দাও! দেখ ফ্রিজে মিষ্টি আছে। বের করে দাও।
ছয়
ভুবনবাবু খেতে বসার সময় দেখছিলেন, মানু খুব তাড়াতাড়ি খেয়ে উঠতে যাচ্ছে। সাধারণত ভুবনবাবু এবং মানু আজকাল এক সঙ্গেই খায়। তাড়াতাড়ি খেতে দেখে বলেছিলেন, আস্তে খা। বিষম খাবি। গলায় আটকে যাবে।
ভুবনবাবুর কথাতেই যেন মানু জল চেয়েছিল। গলায় সত্যি আটকে যেতে পারে। বড় বড় ড্যালা, খাদ্যনালির পক্ষে বা কষ্টকর এবং বেশি জোরে ঢোক না গিললে সবটা ভেতরে যায় না, যে—কোনো সময় কিছু একটা অঘটন ঘটে যেতে পারে—বাবা তাকে সব সময় এত বেশি সাবধানে রাখতে চায় যে মাঝে মাঝে করুণা হয়। তবু সে যতটা পারে বাবাকে সমীহ করে চলে।
বোধ হয় ভুবনবাবু আরও কিছু বলতেন। নীরজা ভাতের থালা এগিয়ে দিয়েছিল। সামান্য ঘি, তিন—চার টুকরো পটল ভাজা, বড় স্টিলের থালার মাঝখানে নৈবেদ্যর মতো ভাত চুড়ো করা। এবং ছোট বাটির একবাটি মুগের ডাল। এমন সুন্দর খাবার দেখে ভুবনবাবু বোধহয় বাকিটুকু বলতে ভুলে গেছিলেন।
ঠিক ওঠার সময় তিনি মানুকে বললেন, যতীন সেনের কাছে একবার বিকেলে যা দেখি। বলবি, বাবা আপনাকে যেতে বলেছে। আর একটা ঠিকুজি এসেছে। ভানুর কুষ্ঠির সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে হবে।
মানু খুবই বিরক্ত। কুষ্টি ফুষ্টি তার ধাতে সয় না। সে বুজরুকি ভাবে। তোয়ালে দিয়ে মুখ মোছার সময় সে বলল, কাল যাব।
আজ না গেলে ওর সঙ্গে দেখা হবে না।
মানু সাড়া না দিলে অগত্যা ভুবনবাবু বললেন, যাবে কোথায়!
ভুবনবাবু তখন ভাত মেখে খাচ্ছিলেন। নীরজা তাকিয়ে আছে। চৌকাঠের কাছে মানু। সে বাবার বাকি কথাটা শোনার জন্যে দাঁড়িয়ে!
তোর বুঝি অনেক কাজ? রাসবিহারীবাবু কালও ভানুর অফিসে লোক পাঠিয়ে খোঁজ নিয়েছেন।
আমার আবার কাজ! ম্যাটিনিতে টিকিট কাটা আছে।
তাহলে ফেরার পথে দেখা করে আসিস।
কী বলব?
ওইতো রাসবিহারীবাবু মেয়ের ঠিকুজী পাঠিয়েছেন।
মানু আর দেরি করেনি। রাসবিহারীবাবু, কেন লোক পাঠায় সে—সব জানার ইচ্ছে তার বিন্দুমাত্র নেই। বাবা ছক মিলিয়ে যাচ্ছেন। ছক ছাড়া কোনো কাজ হয় না। এবং এই নিয়ে কত যে ছক এ বাড়িতে এল। এবারে এসেছেন রাসবিহারীবাবু। সে মনে মনে হেসে ফেলল। তারপর সে ঘরে ঢুকে জামা গলিয়ে বের হয়ে পড়েছিল।
এবং ভুবনবাবু খেয়ে উঠে যখন করিডরে হেঁটে যাচ্ছিলেন—মনে হয় কেমন নিস্তব্ধ এই আবাস। কারও কোনো শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। ছুটির দিন, সবারই থাকার কথা, বড়টার তো একটায় বাড়ি ফিরে আসার কথা, আসেনি, বোধহয় প্রিয়নাথের বাড়িতে যাবে। প্রিয়নাথ দাবা খেলতে পছন্দ করে—খেলাটি প্রিয়নাথই ভানুকে শিখিয়ে নিয়েছে। প্রিয়নাথ ছেলের মৃত্যুর পর বাড়ি থেকে একেবারে বের হয় না। কেবল সন্ধ্যার দিকে পাশের আশ্রমে যায়। গীতাপাঠ, কীর্তন প্রভৃতির ভেতর কিছুক্ষণ ডুবে থাকতে ভালোবাসে। প্রিয়নাথ যৌবনে ঘোর নাস্তিক ছিল। সেই প্রিয়নাথ ধর্মে এমন মজে গেছে দেখে তার সামান্য হাসি পাচ্ছিল। প্রিয়নাথের নাতনি কাকলি মাঝে মাঝেই ভানুকে ডেকে নিয়ে যায়। কী যে জরুরি কাজ এত, তিনি বোঝেন না। ভানুকে আজকাল এ বাড়ির বড় ছেলে ভাবতে কষ্ট হয়। দায়—দায়িত্ব সবই ঠিকঠাক বহন করছে, কিন্তু তবু মনে হয় সংসার—বিচ্ছিন্ন মানুষ। দু—একবার মেয়ে পছন্দ করেছিলেন, কিন্তু ছেলের ভারি অমত। যা রোজগার তাতে বিয়ে করা বিলাস—ভুবনবাবু নিজের অক্ষমতাকেই যেন তখন বেশি করে দায়ী করেন। মা—বাবা ভাই বোনের দায় যার এত, বিয়ে করা তার পক্ষে শোভা পায় না। সে—জন্য একটা অপরাধবোধে মাঝে মাঝে ভীষণ কাবু হয়ে যান ভুবনবাবু। সংসারে ঠিক যেভাবে রাশ টেনে রাখা দরকার পারেন না। আলগা রশিতে সবই ঢিলেঢালা হয়ে যায়। তার গাম্ভীর্যকে কেউ আর বেশি আমল দেয় না।
তিনি তার বিছানায় এসে বসলেন। সামান্য শুয়ে থাকা। কিছু গাছপালা সম্পর্কিত বই, এবং তাঁর ভেষজ গুণাগুণ কী কী আছে, জানার খুব আগ্রহ তাঁর। এটা ইদানীং হয়েছে। পেটের নীচের দিকে একটা ব্যথা টের পান। মাঝে মাঝে ব্যথাটা তীব্র হয়ে ওঠে। মুখ ফুটে খুব একটা চিৎকার চেঁচামেচি করার স্বভাব না, তলপেটে হাত দিয়ে শুয়ে থাকেন অসার মানুষের মতো। ইদানীং কবিরাজি ওষুধে ভালো ফল পেয়েছেন। দেশীয় গাছ—গাছড়ার প্রতি এ—জন্য আকর্ষণ তার দিন দিন বাড়ছে। প্রিয়নাথের পুত্রবধূ বড় একটা পাঠাগারে কাজ নিয়েছে। সে—ই এ—সব পেলে তাকে পাঠিয়ে দেয়।
সুতরাং জানালা খুলে বসলেন তিনি। পাখা চালিয়ে খুব একটা লাভ নেই। গরম গুমোট হাওয়া। বরং গাছপালার অভ্যন্তরে যে হাওয়া বয়ে যায়, তাতে কিছুটা ঠান্ডা ভাব থাকে, পাখার হাওয়ায় শরীরে গিঁটে গিঁটে আজকাল ব্যথা ধরে যায়। সংসারের অনেক কিছুই আজকাল তার অপ্রয়োজনীয় ঠেকছে। পাখা না চালিয়ে বাইরের হাওয়ার জন্য জানালার কপাট আরও ভালো করে খুলে দিলেন।
তখন নীরজা একা রান্নাঘরে। কবে যে নীরজা এ—ভাবে ভারি একা হয়ে গেল, সব মানুষই বুঝি একদিন এ—ভাবে একা হয়ে যায়। তার সেই যৌবন, নীরজার মায়াবী মুখের কথা আর মনে পড়ে না। বাবা, মা, ছোট কাকা বড় পিসি সব মিলে যৌথ সংসারে নীরজা এসেছিল। তারপর নীরজার শহর বাস। সন্তানদের জন্যে সকাল বিকাল একদণ্ড তার বিশ্রাম ছিল না। কে স্কুল থেকে ফিরল, কার ফিরতে দেরি হচ্ছে, কেউ সময়মতো না ফিরলে বাসস্টপে ছুটে যাওয়া এবং ভুবনবাবুর তখন দুশ্চিন্তার শেষ ছিল না। সেই ছেলে মেয়েরা এখন বড় হয়ে গেছে, বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
কেউ একবার বলেও না, মা, তুমি কেমন আছ! ছুটির দিনে নীরজার আজকাল সবাইকে নিয়ে বেশ খাওয়া—দাওয়ার পর পুরানো দিনের গল্প করতে শখ জাগে কিনা একবার জিজ্ঞেস করবেন ভাবলেন। নীরজা তোমার ইচ্ছে হয় না, তক্তপোশের নিচ থেকে পানের বাটা বের করে পা ছড়িয়ে বসার। তুমি জাঁতিতে সুপুরি কাটতে কাটতে গল্প করবে, আমরা শুনব। অথচ দ্যাখ তোমার কেউ নেই। এত করে যে সবাইকে বড় করলে, ওরা কারা?
নীরজা বোধহয় খেতে বসেছে। নীরজা কী খায়, অথবা কীভাবে খায় দেখার ভারি ইচ্ছে হল। নীরজা কখনও খায় মনে হয় না। দুষ্টু বালকের মতো পা টিপে টিপে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালেন। অনেকদিন পরে স্ত্রীর সঙ্গে একটু দুষ্টুমি করার ইচ্ছে হল। তক্তপোশ থেকে নেমে সন্তর্পণে মুখ বাড়ালেন। নীরজা আলগা করে জল খাচ্ছে! সেই একটাই গ্লাস, গ্লাসটার সঙ্গে নীরজার বোধ হয় নাড়ির টান আছে। জল খাবার সময় নির্দিষ্ট গ্লাসটি তার চাই। অনেক উঁচু থেকে জল ঢেলে বেশ খাচ্ছে। বেশ অনেকক্ষণ ধরে। ভারি তৃষ্ণার্তের মতো! সংসারে এত তৃষ্ণা কীসের!
দরজায় ভুবনবাবু।
নীরজা চোখ মেলে তাকাল। ও মা তুমি! ঘুমাওনি! কী দ্যাখছ!
ভুবনবাবু বললেন, তোমাকে।
নীরজা খুব শান্ত গলায় বলল, আমার আর কিছু দেখার নেই।
ভুবনবাবু দরজার ওপর উবু হয়ে বসলেন।
শোও না গিয়ে।
ভুবনবাবু বললেন, তুমি খাও। আমি একটু বসি।
আর জায়গা পেলে না বসার?
নীরজা!
অসময়ে মানুষটার চোখ—মুখ খুব ভালো ঠেকছে না। নীরজা সামান্য মাছের ঝোল দিয়ে ভাত নেড়ে চেড়ে নিচ্ছিল। মানুষটা ঠায় বসে আছে। তার খাওয়া দেখছে।
নীরজা বলল, ঘুম আসছে না?
তুমি আর এক হাতা ভাত নাও। মনে হয় তোমার পেট ভরেনি।
নীরজা খেতে খেতে বলল, তবে এক হাতা ভাত দাও।
অনেকদিন আগের কথা মনে পড়ে গেল ভুবনবাবুর। তখন নীরজা আর সে। রাতের বেলা নীরজা খেতে বসে প্রায়ই ডাকত, ভাত দাও। ভাত লাগবে।
যেন নীরজা মানুষটাকে সব সময় কাছে কাছে রাখতে ভালোবাসত। এবং শরীরে তখন কী যে মোহ। শরীরে সব সময় আশ্চর্য সৌরভ মেখে ঘুমোত নীরজা। কাজে গেলে নীরজার জন্যে মনটা পড়ে থাকত বাসায়। কতক্ষণে ছুটি হবে, কতক্ষণে আবার দরজা খোলার সঙ্গে নীরজার মুখ দেখবে। এবং কত রকমের কূট চিন্তা যে মাথায় এসে ভিড় করত তার।
রান্নাঘরের দরজা বন্ধ করবার সময় ভুবনবাবু বললেন, নীরজা একটা কথা আছে?
নীরজা তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছছিল। —কী কথা।
লুডো খেলতে ইচ্ছে করছে।
বুড়ো বয়সে ও—সব শখ ভালো না!
খুব বুড়ো হয়েছি?
নীরজা কিছু বলল না। মানুষটা কিছুদিন থেকেই কেমন অন্যমনস্ক। রমার চাকরিটা হবার পর কিছুদিন ভারি খুশি ছিলেন, তারপর আবার আগের মতো। অরুণ এলে যতটা কথা বলা দরকার, ততটাই। এবং যেহেতু মানুর একটা চাকরি দরকার, অরুণের সঙ্গে বরং একটু বেশিই কথা বলেন। মাঝে মাঝে কথা বলতে গিয়ে হেসেও দেন।
দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পর নীরজা বেশ পা ছড়িয়ে বসবে একটুক্ষণের জন্য। বেশ সুন্দর করে আপন মনে সুপুরি কাটবে। পান খাবে। তারপর একটু গড়িয়ে নেওয়া স্বভাব। তখন মানুষটা তক্তপোশে শুয়ে থাকে। ঘুমিয়ে থাকে কী জেগে থাকে বোঝা যায় না। খুব দরকারি কথা মনে পড়ে গেলেও জিজ্ঞেস করে না নীরজা। কারণ মানুষটার আজকাল ঘুম এমনিতেই কম হয়। সব সময় কেমন সন্ত্রস্ত থাকেন। নীরজা মাঝে মাঝে না বলে পারে না, এখন তো তুমি সুখের নাগাল পেয়েছ। এত ভাবার কী আছে বুঝি না।
সুখের নাগাল পেয়েছেন ঠিক। সংসারে হা—অন্ন বলতে আর কিছু নেই। বরং বেশ উঁচু মধ্যবিত্তের যা যা লাগে সবই একে একে ছেলে মেয়ে দুজনে মিলে করে ফেলেছে। বেশি ভাড়ার বাড়ি, বসার ঘর, সোফা সেট, এবং কদিন পর বাড়িতে একটা ফ্রিজ—টিজ হয়তো চলে আসবে। মানুর চাকরিটা হয়ে গেলেই বোধহয় ওটা হয়ে যাবে। এবং তিনি বুঝতে পারেন, তখন তিনি আরও একাকী। অরুণের পিছনে মেয়েটা ছুটছে। রমার এ—বয়সে এত স্বাধীনতা সহ্য হবে কিনা বুঝতে পারছেন না। যদিও তিনি এ—কালের বাবা, অথচ এ—কালের সন্তানদের ঠিক বুঝতে পারেন না যেন—কেমন দুঃখী মুখে একটা আশঙ্কা লেগে থাকে সব সময়।
তিনি বললেন, রমাকে নিয়ে অরুণ কোথায় গেল?
অফিসের কোন বাবুর যেন বউভাত।
আসলে সবই বলে গেছে রমা। কিন্তু কেউ কোনো গুরুত্ব দেয়নি। ভবিতব্য ভেবে ছেড়ে দেওয়া। বিয়ের জন্যে খুব পীড়াপীড়ি করতেও আজকাল ভরসা পাচ্ছেন না। ফের সংসারে আবার কিছুটা হা—অন্ন ঢুকে যেতে পারে। এত বড় সমস্যায় মানুষ কখনও পড়ে যায় ভুবনবাবুর জানা ছিল না।
নীরজা বলল, ওষুধ খেয়েছ?
না।
নীরজা জল ও ওষুধ দিলে ভুবনবাবু বললেন, ওরা কখন ফিরবে বলে গেছে?
মানু বলেছে শো দেখতে যাচ্ছে। ফিরতে সন্ধে হবে।
রমা?
ও কখন ফিরবে ঠিক নেই?
কেন ঠিক থাকে না, তুমি একবার ওটা ভেবে দেখেছ?
কিছু ভাবি না। অত ভাবলে সংসার চলে না।
রমার বিয়ে দেওয়া উচিত।
উচিত, করলেই হয়। কে বারণ করেছে। নীরজা ক্ষুণ্ণ গলায় কথাটা বলল।
মেয়ে তোমার রাজি হবে কিনা একবার জিজ্ঞেস কর তো?
রাজি হবে না কেন?
ভুবনবাবু আর কিছু বলতে সাহস পেলেন না। কেবল মুখ ফিরিয়ে বললেন, ওদের কোনো টান নেই।
নীরজা দু’কুচি সুপুরি আলগা করে মুখে ফেলে দিল। বলল, টান না থাকলে এত কেউ করে না।
ছুটির দিনে দেখেছ কেউ বাসায় থাকতে চায় না।
নীরজা ভুবনবাবুর দুঃখটা কোথায় বুঝতে পারছে। মানুষটা সব সময় সবাইকে কাছে পিঠে নিয়ে থাকতে চায়। কাজের দিনে এমনিতেই কেউ বাড়ি থাকতে পারে না। কথাও বিশেষ হয় না। বড় ছেলে আজকাল অফিস থেকে সোজা বাড়ি ফেরে না, প্রিয়নাথের বাড়িতে দাবা খেলে রাত করে ফেরে! তিনি সবাই না আসা পর্যন্ত বারান্দায় পায়চারি করেন, দোতলার বারান্দায় বসলে রাস্তার অনেকটা দেখা যায়। কে কতদূর আছে কে কখন ঢুকছে সবই তিনি টের পান। এবং সবাই এলে তিনি আর কোনো কথা বলেন না। ঘরের আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়েন। এ—বাড়িতে ভুবনবাবু বলে কেউ আছে তখন বোঝা যায় না। কেবল রমা এলে বলবে, বাবার খাওয়া হয়ে গেছে? বাবা শুয়ে পড়েছে? শুয়ে থেকে মেয়ের এমন দু—চারটে কথা শুনতে পান। রাতে আজকাল রমা প্রায়ই বাড়িতে খায় না। কোথাও না কোথাও সে খেয়ে আসে। বাইরের হাবিজাবি খাওয়া আজকাল এত বেড়েছে যে তিনি যথার্থই শঙ্কা বোধ করেন।
ভুবনবাবু বললেন, খুব দুঃসময় আমাদের।
নীরজা এ কথার কোনো তাৎপর্য খুঁজে পেল না। বলল, এ—কথা বলছ কেন?
এখন রাহুগ্রাসের সময়। সাবধানে থাকা ভালো। বৃষ রাশির পক্ষে সময়টা খুব শুভ নয়। মানুকে বললাম যতীন সেনের কাছে যেতে। ও আমাদের কুষ্ঠি বিচার করে রাখবে। শান্তি স্বস্ত্যয়নের দরকার হতে পারে। ছেলেরা কেউ কথা শোনে না। এত কী কাজ, আসার সময় যতীনের কাছে হয়ে এলে কী যে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে বুঝি না। তা—ছাড়া রাসবিহারীবাবুও তাঁর মেয়ের ঠিকুজী পাঠিয়েছেন। সেটাও দেখা দরকার।
মিলে গেলে আমি আর দেরি করব না নীরজা। বিয়েটা ভানুর দিয়ে দেওয়া দরকার।
বয়স বাড়লে মানুষ বাতিকগ্রস্ত হয়ে যায়। আজকাল মানুষটার খুব করকোষ্ঠীর প্রতি বিশ্বাস জন্মে গেছে। যাত্রা শুভ কী অশুভ, এসব বাছবিচার করে চলার স্বভাবে দাঁড়িয়ে গেছে। নীরজার এতে খুব একটা অবিশ্বাস নেই, কিন্তু তার জন্যে সব সময় আতঙ্কিত হয়ে থাকা কেমন হাস্যকর লাগে। সে বলল, তুমি দিন দিন বড় ভীতু হয়ে পড়ছ।
নীরজা জানে মানুষটা এবার অনেক কথা বলবে। সে মেঝেতে ফল—ফুল আঁকা দামি সতরঞ্চি পেতে নিল! শুয়ে শুয়ে বাকিটুকু শোনা যাবে।
ভুবনবাবু বললেন, নীরজা তোমার ভয় করে না?
কীসের ভয়?
মেয়ে তোমার কিছু একটা করে ফেলতে পারে!
বড় হয়েছে। ছোট নেই। হলে ফলভোগ করবে। নীরজা কেমন উত্তপ্ত হয়ে উঠল। তোমার যখন এত সংশয়, মেয়েকে না ছাড়লেই পারতে। বাইরে বের হলে একটু স্বাধীনতা দিতেই হয়।
আগে বুঝতে পারিনি এতটা হবে।
যখন বুঝলে এতটা হচ্ছে তখন আর চুপ থাকা কেন। বলে দাও না, এ বাড়িতে থাকতে হলে চাকরি করা চলবে না। চাকরির জন্যে আগে তুমিও তো কম লোককে ধরাধরি করনি। ভাগ্যিস অরুণের সঙ্গে পরিচয় ছিল। এখন দুঃখ করে আর লাভ নেই।
তোমার বড় ছেলে দুপুরে কোথায় কী করছে তাও তুমি জান না।
সব জানি। বুঝি। কিন্তু এখন ওদের হাতে। কিছু বলতে পারি না।
আস্কারা দিয়েছ! বুঝবে।
আমার আর বোঝার কী আছে। সব বুঝে ফেলেছি। তুমি এখন বোঝো। সারাজীবন তো নিজের গোঁ নিয়ে থাকলে। কারও অধীন হয়ে থাকতে পারলে না। এখন নিজের কাছে নিজেই হেরে যাচ্ছ। মজা মন্দ না।
সাত
ভারি দুরন্ত হয়েছে কাকলি। চুল বব করা। দৌড়াতে গেলে গোটা শরীর যেন নেচে বেড়ায়। শাদা শাটিনের ফ্রক পরতে পছন্দ করে মেয়েটা। কাকাবাবুকে দেখলে ওর দুষ্টুমি আরও বেড়ে যায়। দাদু কাকাবাবু সকাল থেকে সেই যে উবু হয়ে বসেছে ওঠার নাম নেই। কাকলি দৌড়ে এসেছে দরজায়। মুখ বাড়িয়ে বলছে, তোমরা চান করে নাও। মা চান করতে বলছে।
প্রিয়নাথ বললেন, এই হয়ে গেল।
ভানু প্রিয়নাথের মুখ দেখল। সংসারে মন্দাকিনী বউদি, কাকলি এবং বুড়ো মানুষটা। ঠিক বুড়ো নয়, প্রৌঢ় বলা চলে প্রিয়নাথকাকাকে। বয়স বাবার চেয়ে কিছু বেশিই হবে। তবু কী করে যে কাকা হয়ে গেলেন! প্রিয়নাথকাকা, একসময় বাবার খুব বন্ধু ছিলেন। প্রিয়নাথ কাকা একসময় মা’র ভীষণ খোঁজখবর করতেন। এবং এখনও মা, একবার পুরীতে প্রিয়নাথকাকা কত অবহেলা ভরে সমুদ্রের ঢেউ থেকে তাকে তুলে এনেছিল তার গল্প করতে ভালোবাসে। সেবারে প্রিয়নাথকাকা সঙ্গে না থাকলে জলে ডুবেই মরতে হত। মা ঠেস দিয়ে বলত, তোমার বাবা যা একখানা পুরুষ! বয়সকালে প্রিয়নাথকাকা খুবই সুপুরুষ ছিলেন। আধ পাকা চুল। বাবার চেয়ে কম বয়সি মনে হয়। নিজে সুন্দর, বউমাকে বাড়ির মতো মানিয়ে এনেছিলেন। ভয় ছিল বাড়ির নীল রক্ত যেন কলুষিত না হয়। কাকলির উরু দেখা যাচ্ছিল ফ্রকের নীচে। বয়স তো খুব বেশি না। তার চাল ভুল হয়ে যাচ্ছে।
সে হেরে গেলে প্রিয়নাথকাকা খুশি হয় খুব। আর এই নিয়ে মন্দাকিনী বউদি হাসি ঠাট্টা করতে ভালোবাসে। —মন কোথায় থাকে?
প্রিয়নাথ শেষ চালে এসে দেখলেন, কিস্তি দেবার মতো গুটির বল নেই। সারাদিনই ছকের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে হবে। সুতরাং বললেন, তুমি বসো। স্নানটা সেরে নিচ্ছি। এবং কাকলিকে ডেকে বললেন, ভানুকে একটা কাপড় বের করে দে।
প্রিয়নাথ চানের ঘরে চলে গেলেই কাকলি ছুটে ঘরে ঢুকে পড়ল। বলল, তুমি ভারি মিথ্যুক।
ভানু বুঝতে না পেরে বলল, মিছে কথা কখন বললাম?
তোমাকে মারব। বলেই চুল খামচে ওর পিঠে ঝুলে পড়ল।
সান—ফ্লাওয়ার চলে গেছে বললে কেন?
আছে নাকি?
আমার বন্ধুরা তো দেখে এল।
তোকে সাউন্ড অফ মিউজিক দেখাব।
না দেখব না।
ক্রেজি বয়। খুব ভালো বই।
মেয়েটি ওর ঘাড়ে ঝুলে এভাবে অজস্র কথা আর আদর খাবার ছলনাতে বেশ জড়িয়ে যাচ্ছে। ভানুর এত ভালো লাগে কেন এটা। ইচ্ছে হয় কোলে নিয়ে ফাঁপানো চুলে বিলি কেটে দেয়। মেয়েটা বুঝতে পারে মা এখন কোথায়। তার ঘিলুতে সব সময় এই বাড়ির একটা প্রতিবিম্ব ভাসে, প্রৌঢ় মানুষটি সব সময় সতর্ক নজর রাখছেন। অথচ এই প্রৌঢ় মানুষটি না থাকলে সে যখন তখন হুট হাট এ বাড়িতে আসতে পারত না।
যেমন এখন রান্নাঘরে মন্দাকিনী বউদি, এ ঘরে সে আর কাকলি। স্নানের ঘরে প্রিয়নাথ কাকা বেশ সময় নিয়ে চান করতে ভালোবাসেন। মন্দাকিনীর চটির শব্দ পাওয়া যাবে, এ—দিকে এলেই টের পায় কাকলি মা আসছে। তখন সামনে বসে মেয়েটা পা দোলাবে। মন্দাকিনী হলুদ ছোপের হাত আঁচলে সামান্য মুছে বলবে, তোমাকে জ্বালাচ্ছে?
ভানু হেসে বলবে, খুব।
সে বলল, কাকলি রোমান—হলিডে দেখবে নাকি?
মাকে বল না!
মন্দাকিনীকে বললে, সেও বায়না ধরবে, আমাকে নিয়ে চল! এবং প্রিয়নাথকাকা মনে করেন সঙ্গে কাকলি থাকলে যে—কোনো জায়গায় ভানুর সঙ্গে মন্দাকিনী যেতে পারে। আজ রান্নার লোকটা কামাই করেছে। কামাই না করলেও ছুটির দিনে শ্বশুরকে নিজের হাতে রান্না করে খাওয়ায় বউদি। এবং ভানু এলে বুঝতে পারে, এত বড় একটা শোক, সহজেই মন্দাকিনী বউদির উবে যায়। কাকলি পর্যন্ত সে—দিনের সেই শোককে আর মনে করতে পারে না। ভানুকে দেখলে ওরা দুজনেই ভারি খুশি হয়ে ওঠে।
ভানু এখন বুঝতে পারে না আকর্ষণটা কার প্রতি তার প্রবল! কাকলি, না মন্দাকিনী। কাকলিকে ফ্রকে আর মানায়ও না। তবু মন্দাকিনী আরও কিছুদিন হয়তো কাকলিকে বালিকা সাজিয়ে রাখবে। এবং সে টের পায়, এই বালিকা সাজিয়ে রাখার ভেতর মন্দাকিনীর যে খুব একটা বয়স না, এখনও দীর্ঘ সময় ধরে সে যুবতীর মতো বেঁচে থাকতে পারে, কারণে অকারণে ইচ্ছেটা প্রবল হয়ে উঠলে, সদ্য পাশ করা যুবতীর চেয়ে কম যাবে না, এ—সব বোধহয় বলতে চায়। এবং বিয়ের সময় কত বয়স, কবে কাকলি হয়েছে, এই হওয়ার ভেতর জন্মের তারিখ বলে—টলে আজকাল মন্দাকিনী খুব একটা সুখ পায়। এবং ওর যে কী হয় তখন! নির্দোষ কথাবার্তা। অথচ ব্যাপারটার ভেতর এমন সব ঘটনা বা দৃশ্য থেকে যায়, যা তাকে ভীষণ প্রলুব্ধ করে। আর এ—সব কথাবার্তা যে খুব গোপনে হয় তাও না। প্রিয়নাথকাকার সামনেই যে—কোনো অছিলায় একবার মনে করিয়ে দেওয়া, বাবা তো আমাকে বালিকা বয়সেই নিয়ে এল। বালিকা বয়েস! বয়েসটা তরুণীর হলে ক্ষতি ছিল কী! এবং গত চোদ্দই জুন সকালবেলায় বউদি বলেছিল, বুঝলে ভানুবাবু, বালিকাবধূতে আলাদা সুখ আছে। আসলে কী বালিকা বয়সে বিয়ে হলে খুব একনিষ্ঠ থাকা যায় এমন কিছু বলতে চায় মন্দাকিনী! না অন্য কিছু? না পবিত্র আধারে প্রবিষ্ট হবার মতো রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা শুধু বালিকাবধূতেই! কোনটা?
প্রিয়নাথকাকা স্নান সেরে যাবার সময় উঁকি মেরে বললেন, যাও ভানু, আমার হয়ে গেছে।
মন্দাকিনী বউদি সকালেই বোধহয় আজ স্নান সেরে নিয়েছে। রবিবার ভানুর ছুটির দিন। এ—দিনটাতে মন্দাকিনীও ছুটি করে নিয়েছে। এবং ভানু আজকাল কখনও কোনো হলের নীচে প্রতীক্ষা করে থাকে। মন্দাকিনী বউদিকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ারও একটা কাজ আছে তার।
প্রিয়নাথ নানাভাবেই ভানুকে এ বাড়ির জন্যে ভারি দরকারি ভেবে থাকেন। সুতরাং প্রিয়নাথ বললেন, বউমা ওকে একটা কাপড় দাও!
মন্দাকিনী বাথরুমের দরজায় এসে দাঁড়াল। বলল, কী কিছু পরতে হবে না।
ভেতরে জল পড়ার শব্দ হচ্ছে। বোধহয় শুনতে পায়নি। সে বলল, ও ও মশাই কাপড় নেবেন না!
কাকলিও এসে গেছে। কেমন একটা মজা পায় এই মানুষটির কথাবার্তায়। ভেতরে মানুষটা চান করছে। শরীরে কী থাকে, স্নানের সময়ের কিছু কিছু দৃশ্য এ—সময় ওদের দুজনই ভেবে ফেলে। দুজন দু—রকম ভাবে। মন্দাকিনী খুব সরল বালিকার মতো মুখ করে আছে। কাকলি ভারি গম্ভীর। এবং দরজা সামান্য ফাঁক করে কাপড়টা নেবার সময় বোধহয় কেউ খুব একটা ভালো থাকছে না ভেতরে। লম্বা লোমশ ভেজা হাত, মন্দাকিনীর শরীর কেমন কাঁটা দিয়ে ওঠে। এবং কাকলির দৃশ্যটা বেশ মধুর লাগছিল। অথবা বলা যায় মানুষটার গায়ের গন্ধ কেমন স্নানে আর সাবানে মিশে গেছে। পরিচ্ছন্ন সুগন্ধযুক্ত সুশ্রী মানুষ, বয়স তিরিশের কোঠায়, এবং মুখে খুব বিনীত বাধ্যের ছাপ, এ মানুষকে পছন্দ না করে উপায় থাকে না।
কাকলির বায়না কত। আজকাল যে—কোনো বায়না, গোপনে অথবা সবার সমক্ষে এই মানুষটাই তামিল করে থাকে। রোমান—হলিডে দেখে কী হবে! সাউন্ড—অফ মিউজিক, একান্ত না হলে লাভ স্টোরি, সে ভেবেছিল ফিসফিস গলায় বলবে, লাভ স্টোরি বইটা দেখাবে ভানুকাকা? আমাদের ক্লাসের মাধুরী অনীতা দেখেছে। আমাকে দেখাবে? পালিয়ে তোমার সঙ্গে একদিন দেখে আসব। কেউ টের পাবে না? ফন্দি ফিকির ভাবতে সময় লাগে না কাকলির। ভানুকাকার ফোন নাম্বার জানা। বারোটা তিনটে, এবং তিনটের সময় বই দেখে ফিরলে দাদু ঠিক ভাববেন, কাকলি স্কুল থেকে ফিরছে। কোনো কিছুর জন্যে এমনিতেই আর দাদু তাকে তিরস্কার করেন না। কেবল মাঝে মাঝে দাদুর মুখ কেন জানি গম্ভীর হয়ে যায়। তখন সে বুঝতে পারে দাদু ভীষণ রাগ করেছেন। আর সে তখন এমন বিমর্ষ হয়ে যায় যে দাদু কিছুতেই আর গম্ভীর থাকতে পারেন না। —কাকলি কোথায় রে!
এই যে দাদু। সে লাফিয়ে দাদুর কাছে চলে যায়।
লেকের ধারে যাবি নাকি?
আমার ভাল্লাগে না। অতসী আসবে বিকেলে।
আমার সঙ্গে তোর কোথাও যেতে ইচ্ছে হয় না, না রে?
কেন, যাইতো। তোমার সঙ্গে সেদিন রেখা পিসিদের বাড়ি গেলাম তো।
আগে তো পা উঠিয়েই থাকতিস!
কাকলি বলবে, এখনও থাকি।
দাদু আর তারপর কিছু হয়তো বলবেন না। পত্রিকার কিছু কিছু কাটিং রাখার একটা স্বভাব আছে দাদুর। সবদিন রাখেন না। কখনও কোনোদিন রাখলে কাগজটা আলাদাভাবে তুলে নিয়ে বিছানার নিচে রেখে দেবেন। বিকেলে কাকলি এলে তাকে নিয়ে বসবেন। গঁদ এবং শাদা ফুলস্কেপ কাগজে এঁটে দেবেন দাদু কাটা কাগজগুলি। সে তা রোদে বিছিয়ে সামান্য শুকনো করে ফাইলে সাজিয়ে রাখবে। এবং কখনও দাদু ওর বই অথবা চশমা হাতে দিয়ে বলবেন, রেখে দে এবং নানারকমের সব হজমি ওষুধ খাবার পর আদর করে হাতে দেবেন! বলবেন, খা।
সুতরাং এ—বাড়িতে কাকলির বাবা নেই বলে সে হতাশায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ার কথা ছিল, দাদু, ভানুকাকা এবং মা মিলে সেটা পুষিয়ে দিচ্ছে। বরং সে এখন তার বান্ধবীদের সঙ্গে একটু রাত করে ফিরলেও দাদু কিছু বলেন না। বাবা থাকতে একটা সুন্দর রেকর্ড প্লেয়ার কিনে দিয়েছিল তাকে। তার প্রিয় গানের রেকর্ড আলমারিতে সাজানো। বাবার মৃত্যুর পর মাস দুই ভীষণভাবে মুহ্যমান ছিল। তখন দাদু যে সব গান সে শুনতে ভালোবাসত, তার কোনো একটা রেকর্ড—প্লেয়ারে বাজাতেন। যেন বাড়িটাকে আবার স্বাভাবিক করে তোলার জন্যে দাদুর শেষ চেষ্টা। শোকে বাড়িঘর অন্ধকার হয়ে থাকবে মনে হতেই বুঝি দাদু ডেকে এনেছিলেন ভানুকাকাকে। এই বাড়ির ব্যালকনিতে একজন মানুষ অফিস থেকে ফিরেই রাতের আকাশ দেখতে ভালোবাসত। এখন আর তা যেন কারও মনেই নেই। সবাই কেমন সহজেই সব কিছু মেনে নিয়েছে।
প্রিয়নাথ আজকাল নিরামিষ খেতে ভালোবাসেন। মাছ—টাছ খেতেই চান না। মন্দাকিনী তবু জোরজার করে খাওয়ায়। বাইরে প্রিয়নাথের আধুনিক মানুষের মতো ব্যবহার। ভেতরে তার এখনও একজন প্রাচীন মানুষ আছে। যে চায়—মন্দাকিনী আচার—বিচার মেনে চলুক। একজন সদ্যবিধবার পক্ষে আচার—বিচার কথাটা খুব জোর গলায় বলা ঠিক না। মাছটা মাংসটা মন্দাকিনী এখনও খাচ্ছে না। খেলে তিনি খুব একটা বাধাও দেবেন না। তবু যতদিন না খায় ততদিনই যেন একটা স্বস্তি আছে। মাছ মাংসের সঙ্গে শরীরের লোভ—লালসা বাড়ে বই কমে না। তিনি সেটা বোঝেন। এবং এ—জন্য নিরামিষ খাওয়ার ঝোঁকটা ইদানীং বেড়েছে। কাকলির অন্য রকমের স্বভাব। নিরামিষ খেতেই পারে না। তাছাড়া প্রোটিন জাতীয় খাবার বালিকা বয়সে খুবই দরকার। কাকলির জন্যে মাছ, কখনও মাংস অথবা ডিম বাড়িতে করতেই হয়। খেতে বসে মন্দাকিনী আজকাল জোরজার করে সামান্য মাছ—মাংস প্রিয়নাথকে খেতে দেয়। প্রিয়নাথও যেন কিছুটা বিরক্ত মুখে কোনোরকমে শুধু গলাধঃকরণ করা আর কিছু না, না হলেই ভালো ছিল, তবু শরীর বলে কথা, মন্দাকিনী সব সময়েই শরীরের কথা মনে করিয়ে দেয় প্রিয়নাথকে। —খান বাবা। না খেলে শরীর টিকবে কী করে। তার যেন বলার ইচ্ছে, শরীর যে সব বাবা। তার যে ইচ্ছের শেষ নেই। প্রিয়নাথের মুখোশ পরে থাকার স্বভাব সব সময়। ভেতরের লোভ তিনি সামলাতে পারেন না। খুব সহজেই খেয়ে নেন। খুব স্বার্থপরতার মতো দেখায়, এ—জন্য একদিন খাবার পর হজমি খাবার সময় ডেকেছিলেন, বউমা।
মন্দাকিনী হাত মুছতে মুছতে প্রিয়নাথের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। বউমার দিকে তিনি চোখ তুলে তাকাতে পারেননি। বড়ই পুষ্ট শরীর এবং নিরামিষ আহারে লাবণ্য বোধহয় শরীরে আরও বেড়ে গেছে। ভেতরে ভেতরে ভয় পেয়ে যান তিনি। বলেন, বউমা একটা কথা ছিল।
মন্দাকিনী শুধু তাকিয়ে ছিল শ্বশুরের দিকে, কিছু বলেনি। কোনো গুরুত্বপূর্ণ কথায় এলে শ্বশুরমশাই এ—ভাবেই কথা আরম্ভ করেন।
আমি বলছিলাম কি……
আবার প্রিয়নাথ কথা শেষ না করেই অন্যদিকে তাকিয়ে কী যেন দেখছিলেন। মন্দাকিনী তখনও কিছু বলেনি।
বলছিলাম, আজকাল কেউ আর অত মেনে—টেনে চলে না।
তুমি ইচ্ছে করলে…..’, আবার কথা শেষ না করেই সিগারেটের প্যাকেটটা খুঁজছিলেন।
মন্দাকিনী তখন বলেছিল, আমার বাবা কোনো কিছু অসুবিধা হচ্ছে না। আপনি এ নিয়ে ভাববেন না।
প্রিয়নাথ খুব খুশি হয়েছিলেন। বউমা এমনিতে খুবই বুদ্ধিমতী। কে কী পছন্দ করে বউমা ঠিক বুঝতে পারে। তিনি তখন আরও উদার হয়ে যান। বলেছিলেন, বউমা বাকি জীবনটা তোমার পড়ে থাকল। আমার দুর্ভাগ্য। চোখের ওপর দেখতে হবে সব।
এই চোখের ওপর দেখতে হবে সব, সেটা কী দেখতে হবে। দেখতে হবে, একজন সদ্য বিধবা যুবতী কীভাবে শরীরের সব ইচ্ছে নষ্ট করে দেয়। সব প্রলোভন জয় করে ফেলেছে, আসলে এটাকে কি প্রলোভন বলা চলে! একজন মানুষের স্মৃতি কতদিন বয়ে নিয়ে যাওয়া চলে! একজন মানুষের স্মৃতি তাকে কতদিন সুস্থ রাখতে পারবে—এটা কী তিনি কেবল দেখতে চান, খাদ্যবস্তুতে ভেজাল না থাকুক। এমনভাবে সব চলুক, সংসার ভেঙে না যায়, সব ঠিকঠাক চলছে, আহারে কিছু মাছ মাংস থাকুক, অথচ কেউ টের পাবে না, গোপনে সবাই সব কিছু খেতে পছন্দ করে থাকে।
মন্দাকিনী বলেছিল, বাবা, আজকাল আপনি বড্ড বেশি ভাবেন। আমার কপালে এমনই লেখা ছিল। আর আমার তো কোনো কষ্ট হয় না।
প্রিয়নাথ বউমার দিকে তাকিয়ে মনে মনে হেসেছিলেন। কষ্ট হয় না কথাটাই মিথ্যে। তবু শুনতে ভালো লেগেছিল। শরীরের কষ্ট কেউ লাঘব করতে পারে না। রুচির কথা যদি ধরা যায়, এটাও একজন প্রৌঢ় মানুষের কথা ভেবে, কারণ একমাত্র পুত্রের শোক মানুষের কাছে যে কী ভয়াবহ মন্দাকিনী সেটা বুঝতে পারে। সাধারণ রুচিতে বাধে বলেই কোনো কষ্টই কষ্ট বলে মনে করছে না মন্দাকিনী। এবং প্রিয়নাথ কখনও কখনও নিজেকে একজন সতর্ক প্রহরীর মতো দেখতে পান। যেন বাড়িটার চারপাশে হেঁটে বেড়াচ্ছেন। কখন দরজা খোলা পেয়ে চোর—ছ্যাঁচোড় ঢুকে যাবে ঠিক কি!
আর দিন যত যাচ্ছে প্রিয়নাথ বুঝতে পারছিলেন, যতই সতর্ক থাকুন, কিছু না কিছু অভ্যন্তরে ঘটেই যাচ্ছে। এবং যতই তিনি সতর্ক থাকুন না, অভ্যন্তরে যে সংকট, তা থেকে বউমার ত্রাণ নেই। ত্রাণ কথাটাই তাঁর মনে হয়েছিল। এবং নিজেকে এত সতর্ক রাখতে কেমন একটা অপরাধবোধ কাজ করছিল। যেহেতু খুব বিবেচক মানুষ হিসেবে তাঁর খ্যাতি আছে, এবং বিবেচক হতে গিয়েই টের পেয়েছিলেন, সংসারে তিনি যে গণ্ডী সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন সেটা একজন মানুষের ওপর অবিচারের শামিল! স্ত্রী গত হওয়ার পরে বুঝতে পারতেন রন্ধ্রে রন্ধ্রে তাঁর ভয়াবহ সব ইচ্ছেরা ইঁদুরের মতো কুরে কুরে খেত। এবং তিনি নীরজা নামক এক যুবতীর দরজায় কতদিন আহম্মকের মতো দাঁড়িয়ে থাকতেন। দরজা খোলা পেলে নীরজা কখনও কিছু দিয়ে বলত, আর না। ভারি লোভ। এত লোভ ভালো না। তখনই মনে হত সংসারে তিনি একটা গর্হিত কাজ করে বেড়াচ্ছেন। ভুবন সাদাসিধে মানুষ। স্ত্রীর প্রতি তার অন্ধ বিশ্বাস। বিশ্বাসের ঘরে এ—ভাবে সিঁদ কাটা ঠিক হচ্ছে না। মনে মনে অহরহ একটা অনুশোচনা ছিল, অথচ কিছুতেই তিনি অভ্যন্তরে পেরেক পুঁতে দিতে পারেননি। এই অসহায় দৃশ্যাবলি আজকাল তাঁকে খুব কাবু করছে। এবং নীরজার সন্তান ভানুর প্রতি কিঞ্চিৎ টানও অনুভব করছেন। সংসার ঠিকঠাক রাখার জন্যে এটা যে কত বড় দুর্বুদ্ধি ঠিক টের পান। তবু তিনি বুঝতে পারেন, কিছু আর করার নেই। নিয়তি এ বাড়িতে আর একটা পাপ কাজ করিয়ে নেবেই। তিনি শুধু নিমিত্ত মাত্র।
ভানু এসো। ভাত দিয়েছে!
ভানু লুঙ্গির মতো করে পরেছে কাপড়টা। চুল ব্যাকব্রাশ করা। জামাটা গায়ে গলিয়ে নিয়েছে। ভেতরে গেঞ্জি নেই। বুক খোলা। ভেজা লোম বুকে লেপ্টে আছে। এবং বুক খোলা বলে, প্রায় বুকের সবটাই দেখা যাচ্ছে। কী ঘন লোম। কাল কুচকুচে। এবং উষ্ণতা ভারি গভীর। মন্দাকিনী ডালের বাটি আলু পটলের ডিস রাখার সময় গোপনে দেখে ফেলল। এবং এই দেখে ফেলাটাই কাল। দরজায় দাঁড়িয়ে ওদের খাওয়া দেখছিল আর ভেতরে ভীষণ জ্বালা অনুভব করছিল। কিছুতেই যেন প্রলোভনের হাত থেকে সে নিজেকে রক্ষা করতে পারছিল না।
প্রিয়নাথ বললেন, তুমি তো কিছুই খাচ্ছ না। এ—বয়সে এত কম খেলে চলে!
ভানু বলল, এমনই তো খাই।
মাংসের বাটিটা বেশ ভরে দিয়েছে মন্দাকিনী। ভানু মাংসের বাটির দিকে তাকিয়ে মন্দাকিনীকে বলল, এত দিয়েছ কেন? এত আমি খাই?
কী খায় না খায় মন্দাকিনী তা কি জানে! প্রিয়নাথ সহসা অন্যমনস্কতার দরুণ বিষম খেলেন।
জল খান বাবা।
তাড়াতাড়ি প্রিয়নাথ জল খেলেন। এবং নাকে মুখে ভাতের কণিকা সব সুড়সুড়ি দিচ্ছিল। নিজের ব্রহ্মতালুতে হাত চেপে দিলেন দুবার। তারপর গলা খাকারি দিয়ে যেন অস্বস্তিটা লাঘব করার চেষ্টা করলেন।
এত আয়োজন! বলে ভানু আবার মন্দাকিনী বউদিকে দেখল। কাকলির খাওয়া হয়ে গেছে বলে সে বসে ছিল একটা মোড়ায়। কাকলি মার দিকে তাকিয়ে বলল, কী যে বল না কাকু! আয়োজন কোথায়। এটুকু দই খেতে পার না?
খেতে সবই পারি। তবে একটা তো পেট! কত খাব।
প্রিয়নাথ বললেন, যা—ই বল, বাঙালিদের খাবার খুব স্বাস্থ্যসম্মত। তেতো দিয়ে আরম্ভ। টক দিয়ে শেষ।
সহসা তিনি এমন কথা কেন বললেন ভানু বুঝতে পারল না। সে কথায় সায় দিল শুধু, তা ঠিক।
আমরা জানি না বলে, আমাদের যত হজমের গোলমাল।
ভানুর স্বাস্থ্য প্রবল। উঁচু লম্বা মানুষ। কোনো অসুখ—বিসুখ ইদানীং তার হয়নি। বাড়িতে মা খাবার সবসময় বেশ রিচ করে রাঁধে। বাবার জন্যে আলাদা রান্না হয়। ঝাল—টাল মা বেশি খায়। মশলা তেল বেশি দিতে ভালোবাসে। খুব একটা শরীর খারাপ হয় না তার। কিন্তু এ বাড়ির রান্না কম মশলায়। তেল ঝাল মশলা পরিমাণ মতো। তবু বুঝতে পারে মন্দাকিনীর অসুখটা ভেতরে রয়েই যাচ্ছে। কিছুতেই নিরাময় হচ্ছে না।
আসলে এটা অসুখ না স্বাভাবিক জীবন! যুবতী নারী বলতে যা বোঝায়, তার স্বাধীনতা থাকলে যা যা থাকে হাতের মুঠোয়, সবই করতে ভালোবাসে মন্দাকিনী। কিন্তু কখনও কোনো চপলতা দেখেনি। কাছে কাছে রাখতেই পছন্দ করে। অথচ প্রশ্রয় দেয় না। কেবল একটা আকর্ষণ রেখে দিয়েছে শরীরে। এমন পোশাক পরে থাকে যেন মায়াবী সব কিছুকে দূরে সরিয়ে রাখার ইচ্ছে। সাধাসিধে। এতেই আরও গন্ধটি প্রবল হয়ে যায়। পৃথিবীর যেখানেই সে থাকুক নাকের ডগায় বিধবা যুবতীর গন্ধটা লেগে থাকে।
মন্দাকিনী তখন বলল, কাকলি, তোর কাকার বিছানা করে দে।
একটু একা থাকলেই মন্দাকিনী কাজের ফাঁকে ঘরে ঢুকতে পারে। দুটো একটা কথা। কখনও চিৎ হয়ে শুয়ে থাকলে মন্দাকিনী জানলার কাছে এসে দাঁড়ায়। কপাট ভেজিয়ে দেয়। কাকলি দুষ্টুমি করতে ভালোবাসে। তখন প্রৌঢ় মানুষটা টের পায় একজন যুবক কত সহজে বাড়িটাকে স্বাভাবিক করে রেখেছে। ভানু এলেই যেন বাড়িটা প্রাণ পেয়ে যায়। তিনি তখন চোখ বুজে যৌবন বয়সের কিছু দৃশ্য দেখতে পান। নীরজা ঠিক এভাবে তাকে দেখলে চঞ্চল হয়ে উঠত। পৃথিবীতে এটা যে কী, শরীরে অথবা রক্তে এটা যে মানুষের কী এক আশ্চর্য অনুভূতি—কোনো বাধা নিষেধই কেন যে গ্রাহ্য করে না—এমন এক রহস্যময়তা টের পেয়ে পুত্রের ছবিটা দেখলেন। মুখে ভালোমানুষ, মৃত্যুটার সঙ্গে একটা ছোট কেলেঙ্কারি জড়িত। যদিও টের পায়নি কেউ। মন্দাকিনীর কী ছিল না! তিনি অঙ্ক কষে বের করতে বসে যান। তারপর বুঝতে পারেন, সবারই সব থাকে। ব্যবহারে পুরানো হয়ে গেলে আকর্ষণ কমে যায়। আর সংসারে চুরি করে খাবার স্বভাব, মানুষের বোধহয় সহজাত ব্যাপার। ঠেকানো যায় না। ছেলেটা গোপনে আর একটা প্রেম করছিল, বোধহয়। না হলে রাধা এবং সে একই গাড়িতে থাকবে কেন! রাধা আর সে একই সঙ্গে খাদে পড়ে শেষ হবে কেন!
আট
আমরা কোথায় যাব বলতো?
দাঁড়াও না। ঠিক কোথাও যাব। ভালো করে ধরে রাখো।
রমা মুখটা অরুণের পিঠে লাগিয়ে বলল, খুব ভালো লাগছে! না!
অরুণ যতটা সম্ভব স্পিড তুলে প্রায় হাওয়ায় গা ভাসিয়ে দিল যেন। দু—পাশের বাড়িঘর মাঠ দ্রুত সরে যাচ্ছে। ভি—আই—পির এই রাস্তাটা অরুণের ভারি প্রিয়। নিশ্চিন্তে সোজা সিটে বসে থাকতে পারে। মনে হয় কখনও নিজে ঘোড়সওয়ার, কখনও মনে হয় সে পৃথ্বিরাজের মতো ঘোড়ায় ছুটে যাচ্ছে। পিছনে জয়রাজ দুহিতা সংযুক্তা। রাজার মেয়ে চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে।
অরুণ বলল, তোমার বাবার নাম ভুবন না হয়ে জয়রাজ হলে ভালো হত।
রমা চেঁচিয়ে বলল, বুঝতে পারছি না, কী বলছ!
আসলে হাওয়ায় পিছলে যাচ্ছে সব শব্দ। জোরে না বললে কিছুই স্পষ্ট হচ্ছে না। অরুণ বলল, বলছি, তুমি রাজার মেয়ে।
রাজার মেয়ে হতে যাব কোন দুঃখে?
তোমাকে কী যে করতে ইচ্ছে হচ্ছে না।
কী করতে ইচ্ছে হচ্ছে?
রাজার মেয়েকে কী করতে ইচ্ছে হয়?
যাও জানি না। তুমি ভারি অসভ্য কথা বলতে পার।
অরুণ জোরে হেসে উঠল।
এই কী হচ্ছে। একটা কিছু না ঘটিয়ে ছাড়বে না!
ভালোই তো! হলে মন্দ কী!
এই বুঝি ইচ্ছে।
আরও দু—চারটে গাড়ি অতিক্রম করে অরুণ হাওয়ার পিঠে ভর করে যেন চলে যাচ্ছে। ক্রমে উল্টোডাঙ্গা, লেকটাউন, এয়ারপোর্ট পার হতেই রাস্তাটা ফের সরু হয়ে গেল। তেমন নিশ্চিন্তে আর বাতাসে ভেসে যাওয়া যাবে না। সে স্পিড সামান্য কমিয়ে দিতেই একটা ঝাঁকুনি খেল রমা। তারপর স্পিড একেবারে কমিয়ে দিয়ে অরুণ বলল,—এসো, এখানে সুন্দর নিরিবিলি একটা চায়ের দোকান আছে। চা খাব।
রমা বলল, কোথায় যাবে বলতো?
একটা কথা যে কতবার বললে তুমি রমা! এখন একটু ঘুরব। সন্ধ্যায় চাঙোয়াতে খাব। বিকেলে একটা কিছু আজ হবে।
হতে দিচ্ছেটা কে!
রমার মুখের দিকে তাকাল অরুণ। হতে দিচ্ছেটা কে—বলে চোখ নামিয়ে নিয়েছে। কেমন চাপা লজ্জা চোখে মুখে ফুটে উঠেছে। এমন সব কথাবার্তা অরুণ আজকাল প্রায়ই বলে। আসলে শেষ পর্যন্ত কিছুই হয় না। রমার ভীতু মুখ দেখলে সেও শেষ পর্যন্ত কেমন হয়ে যায়। কাপুরুষের মতো মুখ করে রাখে। ছেলেমানুষের মতো শুধু বলা, আর পারছি না।
রমা তখন মজা পায়। বলে, কেন, ঘরে তো বউ আছে। দুঃখটা সেখানেই সারিয়ে নেবে।
অরুণ আর বেশি কিছু বলতে সাহস পায় না। ঘরে সত্যি অমলা রয়েছে। সবই জানা। কোনো রোমহর্ষক ঘটনা আর ঘটে না। ডাল ভাতের মতো অমলা ওকে শুধু খেতে দেয়। বললেই মাদুর পেতে দেবার মতো। অথবা মনে হয় ওটা পাতাই আছে যে—কোনো সময় গড়িয়ে নিলেই হল। আর এ—ভাবেই বুঝি অমলা দিন দিন শরীরের সব রহস্য নষ্ট করে ফেলেছে। কোনো আকর্ষণ বোধ করে না। এই যে ছুটির দিনে সে বের হয়ে পড়েছে দশটা কাজের অজুহাত দেখিয়ে অমলার তাতেও কোনো রাগ নেই। ক্ষুণ্ণ হয় না, বরং ছুটির দিনটা সে বাপের বাড়ি যেতে পারবে বলে খুশিই হয়।
চা দাও তো। দু—কাপ।
রমা বলল, গরম জলে ভালো করে ধুয়ে দেবে। ভাঙা ফাটা কাপে দেবে না।
রমার এটা বাতিক। কোথাও বাইরে গেলে, চা—টা খেলে এ কথাগুলো নির্ঘাত একবার বলবেই। এবং সে জানে রমা দু—এক চুমুক চা খেয়েই বলবে, কী বিশ্রী চা। খাওয়া যায়!
ঘোরার ফলে কিছু নির্দিষ্ট দোকানি রমারও চেনা হয়ে গেছে। এ—জায়গাটা নতুন। রমাকে নিয়ে সে এ—জায়গাটায় নতুন এসেছে। সে মাঝে মাঝে বারাসাত এরিয়াতে কাজ থাকলে স্কুটার থামিয়ে একবার না একবার যাবার আসবার পথে এখানে নেমেছে। দোকানির ছোকরা চাকরটা অরুণকে খুব ভালো না চিনলেও কিছুটা মুখ চেনার মতো! সে গরম জলে পরিপাটি করে কাপ প্লেট ধুলো। চা দেবার সময় বলল, আর কিছু দেব?
রমা বলল, না কিছু না।
অরুণের এখন সময় কাটানো দরকার। দুপুরের রোদ খুব একটা তেজি না যেন। হাওয়া দিচ্ছে। ওর ইচ্ছে ছিল, ফ্লাস্কে করে সামান্য চা আর চিপস সঙ্গে নেবে। অমলাকে বললেই সব করে দিত। কিন্তু রমাকে তোলার সময় কাঁধে চায়ের ফ্লাস্ক দেখলে সংশয় দেখা দিতে পারত ভুবনবাবুর। সবাই তার সঙ্গে যদিও আচরণে খুব মেহেরবান হয়ে যায়, তবু সে বুঝতে পারে তলে তলে রমাদের বাড়িতে খুব একটা সুনজরে কেউ তাকে দেখে না। কেবল মাসিমা খুব সরল মুখ করে রাখে। যেন স্কুটারে চড়ে হাওয়া খেতে যাচ্ছে। খুবই পবিত্র ঘটনা।
রমা বলল, দুপুরের রোদে এ—ভাবে ঘুরে বেড়ালে লোকে পাগল বলবে।
অরুণ চারপাশটা দেখল। খদ্দের খুবই কম। অন্য অনেকদিন সে দেখেছে, খদ্দের গিজগিজ করছে। একটা বড় অশ্বত্থ গাছের নিচে দোকানটা। বেশ একটা নিরিবিলি ছায়া আছে। টুল পাতা বাইরে। দুজন চাষী মতো মানুষ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছে।
রমা সব চা—টাই খেল। বাড়ি থেকে সামান্য খেয়ে বের হয়েছে। এখানে চা, আরও দু—একবার চা হবে, তারপর অরুণ কোথায় যাবে সে জানে না। ঠা ঠা রোদ্দুরে ঘুরে বেড়াতে এত সুখ রমা আগে টের পেত না। কী শীতে কী বসন্তে এবং এই দাবদাহের ভেতরও যেন এক শান্ত সলিলা ভাব। কোনো কষ্টই কষ্ট মনে হয় না।
রমা এবারে ফিস ফিস গলায় বলল, খালি বাসাটা কি বারাসতে?
অরুণ পিছনে ফিরে দেখল। দুষ্টুমি হচ্ছে বোঝা যায়। রমা বিশ্বাসই করছে না বোধহয়, খালি বাসায় হাত পা ছড়িয়ে বসার সুযোগ কলকাতায় কোথাও থাকতে পারে! বড় হোটেলের ঘর পাওয়া যায়। রমা অবশ্য জানে এত সাহস অরুণের কোনোদিন হবে না। একটা পরিচয় তো দিতে হবে। আর তা ছাড়া কোথায় কোন ছলনা ওৎ পেতে আছে কে জানে! কাগজে কত সব কেলেঙ্কারির খবর থাকে। কেলেঙ্কারির ঠিক আগে বোধহয় ওরা এভাবেই একটা নীল স্কুটারে চড়ে বেড়ায়। বড় কোনো হোটেল ঘরের কথা এলেই সঙ্গে সঙ্গে পারিপার্শ্বিক দূষিত আবহাওয়ার কথা মনে হয়। অরুণ আর যাই করুক এতটা সাহস হবে না তার। সে বলল, কী কিছু বলছ না যে।
জায়গাটা তোমার খুব পছন্দ হবে রমা।
অরুণ এবার স্কুটারে চেপে হ্যান্ডেলটা সামান্য ঘুরিয়ে দিল। রমা বসল। আঁচল গুঁজে দিল কোমরে। ঘাম হচ্ছে খুব। রুমালে মুখ মুছল। চুল খোঁপা থেকে কিছু আলগা হয়ে গেছে। সেগুলো ফের খোঁপায় গুঁজে দিল। তারপর অরুণের পিঠের ওপর নিজেকে চেপে ধরল। প্রায় দুরন্ত বেগে স্কুটারটা সব মানুষজন, জ্যাম ভিড় কাটিয়ে দু—পাশে মাঠ ফেলে চলে যেতে থাকল। তারপর। এবং ক্রমে বিন্দুবৎ হয়ে ভেসে থাকল একটা আশ্চর্য সুখ। প্রকৃতির কূট খেলা তখন আরম্ভ হয়ে গেছে শরীরে।
মানু তখন হাঁটছিল। মানুষজন, গাড়ি বাড়ি, ট্রামের তার ফেলে সে একটা নির্জন জায়গার খোঁজে চলে এসেছে। চুপচাপ কোথাও বসে থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে। মুখের ভেতর টিকিটের কাগজ দলা পাকানো। চুইংগামের মতো সে চিবিয়ে খাচ্ছে কেবল। জয়া সুন্দর শাড়ি পরেছিল আজ। পাশে বসে শো দেখার আরামটুকুও তাকে ওরা দিল না। সব ইচ্ছে কোথাকার দুটো কবি এসে গুঁড়িয়ে দিয়ে গেল। কিছুই ভালো লাগছিল না। কিছু ভিখিরি বসে আছে রেলিঙের ধারে। শুকনো রুটি রোদে আরও শুকিয়ে নিচ্ছে। একটা ওর বয়সি ছেলে কাক শালিক তাড়াচ্ছে। এবং বড় নিবিষ্ট চোখে পাহারা দিচ্ছে। খাওয়ার সুখ কত আরামের ওদের চোখ মুখ দেখলে টের পাওয়া যায়। মানুর বলতে ইচ্ছে হল তোমাদের মতো আমিও ভিখিরি। কাঙাল বলতে পারো। সে রেলিঙের ধারে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল। শহরে কত কিছু ঘটে যাচ্ছে। ওই যে বুড়োটা, হাতে রেশন ব্যাগ নিয়ে ট্রামে উঠবে বলে দৌড়াচ্ছে, সে জানে না পাশেই আছে তার হাজার কিশিমের হতাশার ছবি।
এমন কী অহংকার, মেয়ে তোমার, অনায়াসে দুজন কবি আমার থেকে ছিনিয়ে নিতে পারে তোমাকে। মানুর ভেতরে ভেতরে জেদ বাড়ছিল। সে একটা ঢিল তুলে ছুঁড়ে দিল। এবং কত দূরে গিয়ে পড়ছে, আর এভাবে কত দূরে সে ঢিল ছুঁড়তে পারে তা দেখে নিচ্ছে। মানুষের মাথায়, গাড়ির জানলায় লাগলে কেলেঙ্কারি হবে সে জানত। তবু কেমন ভেতরের একগুঁয়ে একটা স্বভাব আছে তার। সে যা আশা করেছিল, যা সকাল থেকে তাকে স্বপ্নের ভেতর জমিয়ে রেখেছিল, কবি ছোঁড়া দুটো তছনছ করে দিয়ে গেল। সে কিছুই বলল না। এখন মনে হচ্ছে তার কিছু বলা উচিত ছিল। নিজের সঙ্গে কিছু কথাবার্তা আরম্ভ করে দিল এ—ভাবে।
তুমি একটা আহম্মক।
কী করব। জয়া এমনভাবে বলল,—
আরে মেয়েমানুষ তো, ধরে রাখতে হয়। সবই তোমাকে বলে দিতে হবে। বলতে পারলে না, রাখো কবিতা। বাড়াবাড়ি করলে চেঁচামেচি শুরু করে দেব।
কী ফল হত তাতে?
অনেক কিছু হত। ভয় পেত।
জয়া দুঃখ পাক আমি এটা চাই না?
তাহলে তুমি দুঃখ পাও এটা সে চায় কেন?
তা তো বলতে পারব না।
তুমি কাপুরুষ। কেউ এভাবে মুখের গ্রাস ছেড়ে দেয় না।
মানু কিছুক্ষণ তারপর অন্যমনস্কভাবে ফের হেঁটে গেল। আইসক্রিমের বাক্স টেনে টেনে নিয়ে যাচ্ছে একটা লোক। দুজন হাফ—যুবতী বালিকার মতো আইসক্রিম মুখে দাঁড়িয়ে আছে। ওকে দেখে ওরা হাসছিল। এবং সে তখনই বুঝতে পারল ওর হাতে একটা বড় ঢিল। এমন সুন্দর ছেলেটা ইঁটের টুকরো হাতে নিয়ে কোথায় যাচ্ছে! কার মাথা ফাটাতে যাচ্ছে! ওর মাথার গোলমাল আছে ভেবে হয়তো তারা হাসছে। সে গোপনে ঢিলটা হাত থেকে ফেলে দিল। হাত ঝাড়ল। একবার বলবে নাকি—এই মেয়েরা, তোমরা এখানে কেন! ঘরে ভালো লাগে না কেন! তোমাদের কেউ আসবে? আচ্ছা, তোমরা সেজেগুজে বের হয়েছ বেড়াতে, সত্যি বেড়াতে চাও তো না অন্যকিছু? চারপাশে সবুজ মাঠ, গাছপালা, এবং মনের ভেতরে কেবল দুষ্টুমি—সব বুঝি! জয়াটা যে কী করল আজ! গন্ধে গন্ধে ওর কবি বন্ধুরা ঠিক পিছনে হেঁটে যাচ্ছে। মেয়েদের গন্ধ পুরুষেরা এত পায়, পুরুষের গন্ধ মেয়েরা পায় কিনা একবার জিজ্ঞাসা করবে নাকি! পুরুষের গন্ধ পাও না! আমি যে হেঁটে যাচ্ছি, তোমাদের ভালো লাগছে না!
এবং সে দেখল সত্যি হাঁ করে ওদের দিকে সে তাকিয়ে আছে। আর ওরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে।
সে বলল, না আপনাদের আমি কিছু বলছি না।
বড় মেয়েটার চুল দু’বেণীর। ছোট মেয়েটার কোমর খুব সরু। গেঞ্জি পরেছে। বুক উঠছে নামছে নিশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে। বড়টা সামান্য লাজুক প্রকৃতির। মানুর দিকে সামান্য চোখ তুলেই নামিয়ে নিয়েছে। ছোটটা সাহসী। সে এগিয়ে এসে বলল, কিছু বলছেন?
আপনারা এখানে কতক্ষণ?
ঘড়ি দেখে বলল, বিশ মিনিটের ওপর।
তাহলে বলে লাভ নেই।
মানুর প্রতি যে—কোনো কারণেই ছোটটার কৌতূহল বেড়ে গেল। বোধহয় ওরা দুবোন। কিংবা বোধহয় দুজনেই কলেজের বান্ধবী। অথবা প্রতিবেশী। ঘরে ভালো লাগে না। হেঁটে হেঁটে চলে এসেছে ময়দানের এদিকটায়। এবং গাছপালায় ছায়ায় বসে আইসক্রিম খাচ্ছে। শহরের ঘরে ঘরে এই এখন ক’টা যুবতী আছে, ক’শো, ক’হাজার অথবা ক’লক্ষ, যেমন সে জানে তার দিদি, এবং জয়া, মন্দাকিনী বউদি সবাই কোথাও যেতে চায়। কোথাও যাওয়ার সুখ অথবা অসুখের ভিতর পড়ে গিয়ে নিদারুণ হয়ে উঠেছে। জয়াটা শুধু দু’জন কবির সঙ্গে চলে গেল। কবিতা পাঠ এত কী মধুর, অথচ অসুখের মতো ওটাও একটা সুখ কিনা কে জানে! তাকে ফেলে তো চলে গেল। কত বড় অসুখ হলে জয়া তাকে ফেলে যেতে পারে এতক্ষণে সে এটা টের পাচ্ছে। এবং টের পেলেই মনে হল মাথাটা দু’ফাঁক করে দিলে কী ক্ষতি ছিল! কবিতা বের হয়ে যেত সব ফাঁক করা খুলি দিয়ে।
ছোটটা আর কিছু বলছে না। অবোধ বালিকার মতো তাকে দেখছে। বোধ হয় দয়া হল। বলল, বলে লাভ নেই কেন!
ফিরে গেছে হয়তো!
সময়মতো আসেন না কেন?
দেরি হয়ে গেল। বাস ট্রামের যা অবস্থা।
বাড়ি থেকে আগে বের হতে হয়।
আপনারা বাড়ি থেকে আগে বের হয়েছেন?
অনেক আগে। আগে এলে তো দোষের হয় না!
তা হয় না।
বড় মেয়েটার চুল কোঁকড়ানো। চোখ টানা নাক একটু চাপা। বেশ উঁচু লম্বা। প্রায় দিদির মতো হবে। শাড়ি পেটের নীচেও খানিকটা নেমে গেছে। শাড়ির ফাঁকে নাভির নীচেও বেশ কিছু অংশ দেখা যাচ্ছে। সে বলল, আপনাদের ওরা কখন আসবে?
এসে পড়বে। দশ মিনিট অ্যালাউন্স দেওয়া আছে।
মাত্র দশ মিনিট!
দশ মিনিট কতটা সময় আপনি জানেন না! ছোটটা খুক খুক করে হাসতে থাকল।
ওরা আসবে তো ঠিক?
এখনও সময় যায়নি।
একবার দেখুন না! বলে সে সেই ইঁটের টুকরোটা আবার কুড়িয়ে আনল।
ক্যাচ ধরতে পারেন?
মীনা তো প্রাকটিস করছে।
তবে আর কি। ওপরে ছুঁড়ে দিচ্ছি ক্যাচ লুফতে পারলে ওরা ঠিক আসবে।
কথাটা কতটা বিশ্বাসের বোঝা না গেলেও সময় কাটানোর পক্ষে মন্দ না। মীনা বলল, দিন দেখি।
সে বেশ উঁচু করে ছুঁড়ে দিল। মীনা খপ করে ধরতে গেলে সে দেখল তার বুক লাফিয়ে উঠল। শরীর ওর কাঁটা দিয়ে উঠল। সে ইচ্ছে করলে পাগলের মতো এখন সত্যি কিছু করে ফেলতে পারে। জাপটে ধরতে পারে। যে—কোনো যুবক এখন লম্পট হয়ে গেলেও দোষের না। ওর মাথা ঝিমঝিম করছিল। দিবালোকে একটা হত্যাকাণ্ডের জন্যে সে ক্রমে কেমন মরিয়া হয়ে উঠেছিল।
নয়
রাসবিহারী বাগানে কিছু নতুন গাছগাছালি লাগান এ—সময়টাতে। বীজ পুঁতে দেন। কলম লাগান। গাছে ফুল না ফুটলে ফল না ধরলে এ—সময় সব সাফসোফ করে নতুন গাছপালা পুঁতে যান। এই একটাই হবি এখন রাসবিহারীর। বয়স হয়ে গেছে, শরীরের সামর্থ্য কমে আসছে—তবু এই বাড়িটার প্রতি তাঁর ভারি মমতা। এবং গাছপালার মধ্যে যতক্ষণ ডুবে থাকেন ততক্ষণই তাঁর স্বস্তি। কত রকমের খবর বুড়ো বয়সের জন্য অপেক্ষা করে থাকে। মেয়েদের এক একজন এক এক রকমের খবর পাঠায়—কারও বরের বদলি, কেউ পেটের আলসারে ভুগছে, কারও ছেলে বদমেজাজি—যেন বুড়ো বয়সে কোনো ভালো খবর পেতে নেই। চিঠি এলেই অদ্ভুত শঙ্কায় ভোগেন রাসবিহারী। আর ক’মাস থেকেই মিতার ঠিক পিঠের দিদি অমলা রবিবারে এখানে চলে আসে। অরুণের রবিবারে প্রায় কাজ থাকে। সপ্তাহে একটা ছুটির দিন তাও কাজ। এবং অমলা বাড়িতে এসেই হইচই শুরু করে দেয়। সকালে মিতাকে নিয়ে বের হয়ে যায়। দুপুরে ঘুমোয়, তারপর, কাকার বাসায় যাবে বলে চলে যায়। ঢাকুরিয়ায়। সেখান থেকে বেশ রাত করে ফেরে। একদিন রাসবিহারী ছোট ভাই বঙ্কুবিহারীকে প্রশ্ন করেছিলেন, অমলার দেখছি তোমার প্রতি খুব টান। বঙ্কুবিহারী জানে অমলা ওর বাড়িতে মাসে দু—মাসে এক আধবার যায় কিছুক্ষণ থাকে, কাকিমা এবং ছোটদের বলে যায়, যাচ্ছিরে। একটু মার্কেটিং করতে যাব। কখনও বলে টিকিট কাটা আছে, কলামন্দিরে যাব। একা একা ঘুরতে মেয়েটা খুব ভালোবাসে।
ঠিক এ—সব ভাববার সময়ই মনে হল অমলা আসছে। হাতে মীনা করা বড় বটুয়া। কাঁধে ব্যাগ। ওতে ওর রাতে পরার জন্য শাড়ি সায়া ব্লাউজ থাকে। এক সময় সান্টু আসত খুব এ—বাড়িতে। সান্টু তার ছোট বোনের দেওর। অমলার বিয়ের পর সান্টুর এ—বাড়ি আসা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। ইন্ডিয়ান অকসিজেনে সান্টুর ভালো মাইনের চাকরি অথচ তখন কেন যে অমলার পছন্দ না সান্টুকে তিনি এখনও তা বুঝে উঠতে পারেন না। অথচ একটা প্রবল টান রয়েছে দু’জনের মধ্যে, এবং এটা তিনি নিজে ঠিক চোখে না দেখলেও কোনো এক গোপন খবর থেকে তা টের পান।
ইদানীং এখানে আসা অমলার বেড়ে যাচ্ছে কোন টানে বুঝতে কষ্ট হয় না। অমলা এসেই যেমন বাবাকে প্রণাম করে তেমনি প্রণাম করে সোজা ভিতরে ঢুকে গেলেই আবার একটা প্রবল শঙ্কা সেই বুকের মধ্যে গুড় গুড় করে উঠল।
সেদিক থেকে স্ত্রী হেম খুব সুখে আছেন। তার এখনও একটাই কাজ—বাড়ির রান্নাবান্না এবং ঠাকুর চাকরের প্রতি সজাগ সতর্ক চোখ। হেমের বিশ্বাস, এরা সবাই দুর্বৃত্ত। সংসারের সব জিনিস গোপনে চুরি করে নিয়ে যায় ফলে সারাদিন এ—ঘর ও—ঘর। এটা ওটা সামলাচ্ছে। মাঝে মাঝে মিতার সঙ্গে ধর্মমূলক ছবি এলে দেখতে যায়। নানুর জন্য তার দুর্বলতা কম। মেয়েটার জন্য একটাই সমস্যা—বড় হয়ে গেছে, বিয়ে দিয়ে দাও—ধিঙ্গি করে আর কতদিন রাখবে। সংসারে এই বয়সে সাধারণ একজন নারীর যে স্থান হেমের তাই হয়েছে। কালেভদ্রে রাসবিহারীর মনে হয়, হেম তার স্ত্রী। বরং হেমকে বাড়ির পাহারাদার ভাবতেই এখন বেশি ভালো লাগে। সব সময় সন্তর্পণে সব কিছুর প্রতি নজর রাখছে। কোনো কিছু অপচয় হবার উপায় নেই।
রাসবিহারীর মনে আছে, হেম যৌবনে বিকেল হলেই গা ধোয়া, পাট ভাঙা শাড়ি পরা, গলায়, কাঁধে, মুখে পাউডার এবং সুঘ্রাণ ছড়িয়ে বসে থাকত। পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা—এটা হেমকে না দেখলে বোঝা যেত না। তবে শেষ পর্যন্ত একের পর এক কন্যাদের জন্ম দিয়ে বোধ হয় হাঁপিয়ে উঠেছিল। একদিন শুতে গিয়ে দেখে রাসবিহারী, বিছানা আলাদা—হেম আলাদা ঘর নিয়েছে। এবং সেই থেকে ক্রমে যে দূরত্ব বাড়ছিল তা এখন চরমে। প্রায় সারাদিন দুটো চারটে কথা ছাড়া ওদের আর কোনো সম্পর্ক আছে অথবা ছিল তা বোঝাই যায় না। রাসবিহারী দুটো বীজ পুঁতে দেবার সময় ভাবলেন, সংসারের বুঝি এই নিয়ম।
রাসবিহারী বুঝতে পারেন মেয়েরা তাদের মায়ের মতই। নানুর মা এখন কী করে দিন কাটায় তিনি তা বুঝতে পারেন। সংসারে সব কথা খুলে বলা যায় না। একবার নানু তার মাকে জিজ্ঞেস করেছিল—
খুব দরকার ছিল চাকরি করার!
নানুর মা বলেছিল, বারে আমার ভবিষ্যৎ আছে না।
সত্যি তো ভবিষ্যৎ বলে কথা। তিনি বোঝেন, ভবিষ্যৎ বস্তুটি কী। তিনি নিজেকে দিয়েই এটা বুঝতে পেরেছেন। ভবিষ্যৎ মানে শেষ পর্যন্ত একটা বড় ফাঁকা মাঠে দাঁড়িয়ে যাওয়া। সবাই অবলম্বন পেয়ে তাকে নিরালম্ব করে রেখে গেছে একটা পত্র—পুষ্পহীন বৃক্ষের মতো। রাসবিহারী নিজেকে এখন কোনো পত্র—পুষ্পহীন বৃক্ষের মতোই ভাবতে ভালোবাসেন। আর এ—সব কথা বেশি করে মনে হয়—যখন বুঝতে পারেন নাতিটার ভার না নিলেই ভালো হত। কিন্তু ওই যে বলে ফাঁনদে পড়িয়া বগা কান্দে। …..আর তখনই তিনি দেখলেন, নানু এদিকে আসছে। সকালের হাওয়ায় নানু বাগানে পায়চারি করতে বের হয়েছে। মুখে ব্রাস, দাঁত মাজছে—ফস ফস করে কথা বলার চেষ্টা করছে। রাসবিহারী সেই কথার এক বর্ণ বুঝতে পারছেন না।
নানু বলল, দাদু এই গরমে তোমার গাছ বাঁচবে?
বাঁচবে না কেন ভাই, বাঁচাতে জানলেই বাঁচে!
এখনও বৃষ্টি শুরু হয়নি ভালো করে।
জল দিতে হবে।
এ—সব কথা একেবারেই অকারণ। আসলে রাসবিহারী এখন নানুকে যে—কথাটা বললে খুশি হতেন সেটা হচ্ছে, তুমি রোজ রাত করে বাড়ি ফিরলে আমি খুব উদ্বিগ্ন থাকি। আরও কিছুদিন বাঁচতাম, তুমি আর তোমার মা মিলে সময়টা খুবই সংক্ষিপ্ত করে দিলে।
নানু বলল, আজ জেঠুর বাড়ি যাব ভাবছি।
তোমার জেঠু অবনীশ কাল দুপুরে ফোন করেছিল।
কী বলল?
বলল তুমি রোববারে যাবে।
আজ গেলে কী হবে?
তোমার জেঠিমার শরীর ভালো নেই।
তবে রোববারেই যাব।
তাই যেও। মানুষের সুবিধা অসুবিধা বুঝতে হয়।
সবাই কি বোঝে?
না বুঝলে চলবে কেন?
না সবাই বোঝে না দাদু। বলে মুখ থেকে সে থু থু ফেলল। তাহলে আমাকে এখানে চলে আসতে হয় কেন?
এ—সব কথায় রাসবিহারী ভীত হয়ে পড়েন। তিনি বুঝতে পারেন সংসারের সেই মৃত ছবিটা আবার নানু তুলে দেখাতে চায়। একটা জোড়াতালি দিয়ে যা তিনি ভুলতে চেয়েছেন, এবং যা কিছু তিনি মেনে নিয়েছেন, অর্থাৎ সায় না থাকলেও ইজ্জতের খাতিরে মুখ বুজে আছেন, সেই নানু আবার তা ছিন্নভিন্ন করে দিতে চায়। তিনি অন্য কথায় চলে এলেন, তোমার মুখ ধোওয়া হলে বল। একসঙ্গে চা খাব।
নানু বলল, এখন তো দেখছি মার সঙ্গে জেঠুরও খুব ভাব। প্রায়ই নাকি চিঠি দেয়। আমার খবরাখবর নেবার কথা বলে। আগে ও সব কোথায় ছিল! ভিন্ন বাড়ি দেখে জেঠু উঠে গেল কেন! আমার বাবা কি সত্যি খুব খারাপ মানুষ ছিলেন?
রাসবিহারী প্রমাদ গুণলেন। সাতসকালে নানু আবার কী ঝামেলা না বাধায়। তিনি তাড়াতাড়ি বাগান থেকে ঘরের দিকে হাঁটা দিলেন। নানু পাশে পাশে যাচ্ছে। এবং মনে হচ্ছে রাসবিহারীকে কেউ এখন তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এমন অবস্থা দেখে নানু হেসে ফেলল। বলল, অত ছুটবে না, পড়ে যাবে।
রাসবিহারী ঘাড় ফিরিয়ে বললেন, আমি দৌড়লাম কোথায় আবার।
নানু ফের খুব অমায়িক গলায় বলল, আচ্ছা দাদু তোমরা সব সময় বাবার সম্পর্কে এত চুপ থাক কেন? আমি সবই জানি। বাবার মৃত্যুর জন্য কে কে দায়ী তাও জানি যেমন ধর, এক নম্বর খুনি আসামি সেই ধুমসো ভদ্রমহিলাটি, দু নম্বর আমার মা, তিন নম্বর জেঠু। ওরা তিনজন বাবার সংসারে তিনটে ফ্রন্ট খুলেছিল। বাবা ভেবেছিলেন—একটা ফ্রন্ট খোলা আছে, সেখান দিয়ে অন্তত পালানো যাবে—কিন্তু দেখা গেল সেখানেও একজন দাঁড়িয়ে আছে।
রাসবিহারী বললেন, সেটা আবার কে?
নানু মাথা নীচু করে বলল, আমি। আমাকে দেখে বাবা নিজেকে খুব অসহায় বুঝতে পেরেছিলেন। বেশি টাকা রোজগার করবেন বলে কাজ ছেড়ে দিলেন—কারণ সংসারে তখন টাকার দরকার খুব। সংসারে বেশি সুখের জন্য বেশি টাকার জন্য বাবা ব্যাবসা করতে গেলেন এবং ফেল মারলেন। তখন বাবার চারপাশ ফাঁকা। দাদা বউদি ফ্ল্যাট নিয়ে উঠে গেছে। বাবা তবু ভয় পেতেন না। মার গঞ্জনা শুরু হল। একদিন মনে আছে, মা আমার সামনে বাবাকে বলেছিল, পুরুষের রোজগার না থাকলে বেঁচে থেকেও লাভ নেই। পাশে আমি দাঁড়িয়ে। বাবা মাথা নীচু করে ঘর থেকে বের হয়ে গেছিলেন।
রাসবিহারী বারান্দায় দাঁড়িয়ে। নানু মুখোমুখি। এমন একটা নাটকের সময় মিতা বাথরুমে শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দেখছে। হেম চা চিনি মাখন ডিম বের করে ডাকছেন, ও কালোর মা, সব নিয়ে যা।
নানু দেখল দাদু তাকে অপলক দেখছে। কেমন বিমূঢ়। শূন্য দৃষ্টি। আবার না হেসে পারল না। —দাদু, ও দাদু, খুব মিথ্যে বলেছি! তুমি অত ভয় পাও কেন। আমি তো এখন সবাইকে ক্ষমা করে দিয়েছি।
রাসবিহারীর এবার বাহ্যজ্ঞান ফিরে আসছে। নানুর মাথায় আবার রেলগাড়ি চলছে। রেলগাড়ি চলতে থাকলেই নানু অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলে। রাসবিহারী ভাবে, নানু যা স্বভাবের তাই হয়ে গেছে। তখন নানুকে আর অত খারাপ লাগে না।
রাসবিহারী খুরপিটা রাখার জন্য বাইরের দিকে আউট—হাউসে হেঁটে গেলেন। এখন হাত মুখ ধুয়ে সামান্য জলযোগ। তারপর পত্রিকা এসে যাবে এবং চা। পত্রিকা পড়তে পড়তে বেলা দশটা। তারপর চান, এবং আহার। আহারের পর দিবানিদ্রা, শেষে আবার চা এবং বিস্কুট। বেলা পড়ে এলে হাতে লাঠি এবং সান্ধ্য—ভ্রমণ। মোটামুটি জীবনের এই রুটিন দাঁড়িয়েছে রাসবিহারীর।
তখন ঘরে ঢুকে অমলা বলেছিল, কার সঙ্গে কথা বলছিসরে এত?
কেন তোমার কি ফোনের দেরি হয়ে যাচ্ছে?
অমলা বলল, খুব ফাজিল হয়েছ।
অরুণ মেসোমশাইকে বল একদিন যাব ওদের অফিসে।
কী দরকার।
চাকরি টাকরি যদি হয়।
তোমার চাকরি হলেই হয়েছে।
বোঝাই যায় নানু দুপুরে ফোনে কার সঙ্গে কথা বলছিল। খুব সংযত কথাবার্তা। কিছুক্ষণ কথা বলার পর শিস দিতে দিতে ওপরে উঠে গিয়েছিল। সে তার অমলা মাসিকে আর ফিরে তাকিয়েও দেখল না। সে জানে এখন অমলা মাসি ফোনটার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়বে।
তারপর নানু সুন্দর পোশাক পরে করিডরে পায়চারি করতে করতে মাঝে মাঝে ঘড়ি দেখছিল। তারপর একটা সিগারেট খেয়েছিল গোপনে। এবং এক সময় কী সংকেত পেয়ে নীচে নেমে বাস রাস্তার দিকে হেঁটে গেল।
তারপর নানু সিনেমা হাউসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকল। এখন সে জটিল চিন্তাভাবনা মাথায় রাখতে ভালোবাসছে না। কারণ এমন একটা আনন্দের দিন তার আসবে সে কখনও কল্পনা করেনি। বনভূমিতে ‘জ্যোৎস্না’ আসছে। ফোনের সেই সংকেত থেকে এতক্ষণ পর্যন্ত সে বড়ই অধীর। তাকে স্পষ্ট বলেছে, ঠিক আছে যাব।
তুমি একা আসবে কিন্তু!
সে কি। একা কী করে আসব। বাড়ি থেকে ছাড়বে কেন। বাবা ফিরে এসে শুনলে কী ভাববে। বকবে না? জানো, মা বলছিল নানু যেন কেমন হয়ে গেছে!
তুমি কী বলেছ?
আমি কী বলব আবার!
না, এই যদি বলে দাও লাল বলটা তোমার কাছে আছে, বলেছি। তুমি বলেছ, না নেই। আমি বলেছি, হ্যাঁ আছে—এইসব আর কি।
আমার বয়ে গেছে বলতে।
নানুর মাথার মধ্যে কথাগুলি বিজ বিজ করছিল। রাস্তা, মানুষজন, ভিড় এবং হকারদের চিৎকারের মধ্যে সে একটা লম্বা মতো মানুষ হয়ে যেতে চাইছে। সে অনেকদূর থেকে নবনীতাকে আবিষ্কার করতে চায়। কিন্তু ক্রমে সময় যাচ্ছে। এখানে সে আধ ঘণ্টার মতো দাঁড়িয়ে নবনীতাকে আবিষ্কার করতে পারল না। তবে কী নবনীতা তাকে ধোঁকা দিল।
নিজের সঙ্গে নিজের এই কথা নানুর আজন্মকালের। নানু সব সময় পৃথিবীতে একটা বাতিঘরে সুখ খুঁজে বেড়াচ্ছে। নবনীতা তার বাতিঘর। যেন নবনীতা ইচ্ছা করলেই তাকে এখন নিরাময় করে তুলতে পারে। এবং তখনই দেখল নবনীতা আসছে। বড় মহিমময়ী। শাড়ি পরেছে। কানে গোল ইয়াররিং। মনটা মুহূর্তে বিশাল সাম্রাজ্য হয়ে গেল তার। সে ছুটে গিয়ে বলল, ও এলে তবে!
কী করব, এত করে বললে না এসে পারা যায়!
কী যে ভালো করেছ না। এসো কোথাও বসে একটু খাই কিছু।
শুধু আইসক্রিম খাব।
আর কিছু খাবে না?
না। আমাকে কিন্তু ছটার মধ্যে বাড়ি ফিরতে হবে।
কী হবে না ফিরলে?
মা বাবা ফেরার আগেই যেতে হবে।
সে যেও। নবনীতা…ন…ব …নীতা।
এই কী হচ্ছে! গান করছ কেন?
কী গান করলাম।
এই যে ন—ব—নী—তা।
জানি না নবনীতা, যখনই একটু সময় পাই, তখনই জানালা খুলে আকাশ দেখি, তখনই সব আনন্দের প্রকাশ, আজকাল আমার একটি শব্দে শুধু আনন্দের প্রকাশ—
ন—ব—নী—তা!
নবনীতা ঠোঁট টিপে চোখ বাঁকিয়ে বলল, আহা কী কথা! নবনীতা না ছাই।
নানু বলল, নবনীতা, কী যে ভালো লাগছে। এমন সরল প্রকাশ, নানুর নবনীতাকে কেমন একটা টানের মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। নবনীতা পাশাপাশি হাঁটছিল। শাড়ি পরায় তাকে আর কিশোরী ভাবা যাচ্ছে না। যেমন নানুকে দেখেও বোঝার উপায় নেই সে কৈশোর পার হয়ে সবে যৌবনে পা দিয়েছে। বরং দুজনকেই পৃথিবীর আদিম নরনারীর মতো মনে হচ্ছিল। সে আর নবনীতা বুনো ফুলের গন্ধ নিতে ছুটছে। এই বয়সে মানুষের আর কিছুরই দরকার নেই—কেবল ছুটে যাওয়া হাত ধরে, কোথাও হ্রদের ধারে বসে থাকা, কখনও নদীর জলে প্রতিবিম্ব দেখা অথবা কোনো এক সবুজ পাহাড়ের মাথায় ছোট্ট ডাকবাংলোয় রাত্রি যাপন। যদি শীতের সময় হয় সামান্য উষ্ণতা চাই, গ্রীষ্মের সময়ে অজস্র বৃষ্টিপাত—নানু কত কিছু নবনীতাকে নিয়ে ভেবে ফেলে।
কিন্তু নবনীতা এখনও এতটা ভেবে দেখেনি। তার কাছে শহরটা শহরই থাকলে ভালো হয়। মাঝে মাঝে বাড়ি থেকে কিছু মিছে কথা বলে, এই একটু ঘুরে যাওয়া, আইসক্রিম খাওয়া, খুব সাহসী হলে সে ভাবতে পারে সন্ধের অন্ধকারে একটু মাঠে বসে নিরিবিলি নানুদাকে ডেকে নেওয়া। বাবা আসেন সাতটার পর, মা দিবানিদ্রা যান। তারপর ক্লাবে যান। দুপুরে কিংবা সকালে সে মাকে শুধু বলে রাখে বিকালে একটু বের হব মা। অগ্নির কাছ থেকে কিছু ক্লাস—নোটস নিতে হবে।
বাবা মাঝে মাঝে বসার ঘরে তাকে ডাকেন। এবং কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলেন, তুমি সত্যি বড় হয়ে গেছ। বিয়ে দিয়ে দেব।
আর তখনই সে বাপের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, বল, একথা আর বলবে!
সুনীল তখন তার স্ত্রীর শরণাপন্ন হয়ে বলে, দেখে যাও তোমার মেয়ে আমাকে মেরে ফেলল। বড় হয়েছে বললে কেউ এভাবে রেগে যায়।
এই বড় হওয়া যে কী মজার। যখন একা থাকে, কিংবা গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেলে বুঝতে পারে, তাকে কেউ কোথাও নিয়ে যাবে বলেছে। এবং সব সময়ই সে যেন তাকে বলে যাচ্ছে, আমার ভয় করে।
নানু তখন দুটো আইসক্রিম নিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে ফিরছে। একটা নবনীতার হাতে দিয়ে বলছে, নাও। নবনীতা ঠিক পদ্মকলির মতো আইসক্রিমটা ধরে আছে।
যদি কেউ দেখে বুঝবে এই নর এবং নারীর মধ্যে এখনও আশ্চর্য পবিত্রতা বিরাজ করছে। এখনও কোনো দ্বিতীয় ভূখণ্ডে ওরা পা রাখেনি। বড় সুসময় এদের এখন। এই সুসময়ে প্রীতিশ আর রাণু কুড়ি বছর আগে ঠিক এই হল ঘরটায় আইসক্রিম খেয়েছিল। কেউ না জানলেও চারপাশের ইট পাথর দালান কোঠা তার সাক্ষী। অথচ মানুষ তার পবিত্র সময় বেশিদিন ধরে রাখতে পারে না।
নানু ডাকল, ন—ব—নী—তা।
নবনীতা একেবারে পোষা বেড়ালের মতো নানুর গা সংলগ্ন হয়ে হলের ভিতরে ঢুকে গেল। অন্ধকারে সব অস্পষ্ট। নানু হাত ধরে আছে।
দশ
ও মা আপনি বসে পড়লেন কেন?
মানু ছুটে আসছিল। সামনে এমন একজন তরুণী! খোলা মাঠ, নীল আকাশ এবং দূরে অশ্বারোহী মানুষ, গাড়ি যাচ্ছে দ্রুত, এ—সবের ভেতর মাথাটা তার গোলমাল করে ফেলছিল। সে সাপ্টে ধরবে, তারপর যা হবার সব হবে, ভেতরে সে এইসব ভাবতে ভাবতে অস্থির হয়ে উঠছিল। দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য অথবা মাতালের মতো টলতে টলতে ছুটে যাচ্ছিল। খোলা আকাশ নিচে দিবালোক, কিছুই তার খেয়াল ছিল না। সে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। তারপরই মার মুখ চোখে ভেসে উঠল। মা, দরজায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে! বাবা বারান্দায় পায়চারি করছে। এত সব নিজের মানুষরা নড়েচড়ে উঠলে, সে আর ছুটতে পারেনি। মাথা ধরে বসে পড়েছে। এটা সে কী করতে যাচ্ছে!
মীনা বলল, কী হয়েছে আপনার?
জবা বলল, আপনার কোনো অসুখ আছে?
মানু কোনোরকমে বলল, বোধহয় আছে।
বোধহয় আছে মানে! জবা সামান্য ঝুঁকে কথাটা বলল। এমন সুপুরুষ একজন যুবকের কথা বলতে কেন এত কষ্ট বুঝতে পারছে না।
মানু বসেই থাকল। বুড়ো মানুষের মতো লাগছে নিজেকে। সে খুব সময়মতো নিজেকে নিরস্ত করতে পেরেছিল। এবং এটাই তাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছে। কেন তার এটা হল! নিজের ওপর সে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছে। সবার কী হয় সে জানে না, কিন্তু তার এটা একটা খারাপ স্বভাব। কোনো সুন্দরমতো যুবতী দেখলে সে অনেকটা পথ তার পিছু পিছু হেঁটে যায়। হেঁটে যেতে ভালো লাগে। তীব্র আকর্ষণ বোধ করে। এবং যুবতীর সবকিছুতে যে রহস্য, সেই রহস্যের অভ্যন্তরে পৌঁছবার জন্য সে এইমাত্র ছুটে এসেছিল, অথচ বাহ্যিক সব নিয়মকানুন তাকে কারাগারে বন্দী মানুষের মতো করে রেখেছে। তার মনে হয়েছিল সে একটা আত্মহননের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। যদি মায়ের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা ব্যাজার মুখ তার মাথায় বিদ্যুতের মতো ক্রিয়া না করত, যদি ঘটনাটা ঘটেই যেত, তবে কাল সকালে খবরের কাগজের শিরোনাম হয়ে যেত সে। এই দুঃসাহসী, দুঃসাহসী না লম্পট, কোন শব্দ ব্যবহার করত সাংবাদিকরা ঠিক এ মুহূর্তে তার মাথায় আসছে না। রাতে সে বাড়ি ফিরতে পারত না। ছাল চামড়া ছাড়িয়ে নিত সব সাধু ব্যক্তিরা। এত সাহস তোমায়! পুলিশ, ব্যাটনের গুঁতো মেরে বলত—হারামি বদমাস স্কাউন্ড্রেল! তুমি ভরদুপুরে ভদ্রলোকের মেয়েকে জড়িয়ে ধরেছ! শ্লীলতাহানি! তোর কী শূয়রের বাচ্চা মা বোন কেউ নেইরে!
জবা বলল, অসুখ থাকলে আসেন কেন?
হাঁটুতে জোর পাচ্ছে না—র মতো সে এলিয়ে দিয়েছে শরীর। এবং ঘাসের ভেতর হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ল। সামনে জবা মীনা দাঁড়িয়ে আছে, ওরা খুব বিব্রত বোধ করছে। সে কিছুই লক্ষ্য করল না! চোখ বুজে পড়ে থাকল। দিদি কোথাও রুমাল উড়িয়ে যাচ্ছে স্কুটারে। সে হাওয়ায় রুমাল উড়তে দেখল।
জবা মীনা ভীষণ অস্বস্তির ভেতর পড়ে গেছে। পিন্টু এবং গোপাল এলে এত ভয় লাগত না, ফেলে চলে যেতেও পারছে না। আজকাল কত রকমের ঘটনা ঘটছে শহরে। ব্যর্থ প্রেমে আত্মহত্যা নয় তো! মীনা বলল, কী খেয়েছেন?
মানুর খুব অবাক লাগল কথাটা শুনে। সে সোজাসুজি বলল, ভাত।
ভাত তো সবাই খায়। আর কিছু খাননি তো?
মাছ, ডাল, কাসুন্দি।
তবে চোখ আপনার টানছে কেন!
নেশাখোরের মতো লাগছে নাকি! সে তো নেশা করেনি। কিছুক্ষণ রোদে রোদে ঘুরেছে। কিছুক্ষণ নিজের সঙ্গে নিজের কথোপকথন হয়েছে। একসময় মনে হয়েছে সব মানুষের মাথা ঢিল মেরে ভেঙে দেবে। একসময় মনে হয়েছে পাশের মেয়েটিকে সাপ্টে ধরে তলপেটে চুমু খাবে। আর কিছু তো সে ভাবেনি। সে শুয়ে থেকেই বলল, আমাকে আপনারা মাতাল ভাবছেন?
চোখ লাল, বসে পড়লেন, টলছিলেন, আমাদের কী দোষ।
সে বলল, আমি যদি কিছু একটা করে ফেলতাম, মাতাল ভাবতে পারতেন। এই যদি জড়িয়ে টরিয়ে ধরতাম!
আপনি কিছু করতেই পারতেন না।
আমি পারি। কিন্তু আপনাদের এত বিশ্বাসের পর সত্যি আর পারব না।
মীনা বলল, আমাদের বন্ধুরা এসে পড়বে। আলাপ করিয়ে দেব।
জবা বলল, গোপাল খুব ভালো। খুব হাসাতে পারে।
মীনা বলল, পিন্টুর মুখে সব বিগ বিগ টক। রোববারে মাঠে আমরা ঘুরে বেড়াই। জ্যোৎস্না উঠলে বাড়ি ফিরি। কতদিন আমরা ওই যে গাছটা দেখছেন, তার নিচে বসে কেবল গান গেয়েছি।
ওর মনে হল সত্যি এমন মেয়েদের সঙ্গে বসে গান গাওয়া যায়। আর কিছু করা যায় না। আর কিছু করতে ভালোও লাগবে না।
কিছু দূরে ক্লাব টেন্টের পাশে মানু দেখল, একজন ফুচকাঅলা ফুচকা বিক্রি করছে। কোথা থেকে সব মানুষজন, ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে চারপাশে। এত বড় শহর এত মানুষজন, হাউসগুলোতে শো হচ্ছে, ভিড়, ফুচকাঅলা ফুচকা বিক্রি করছে, চা—অলা হেঁকে যাচ্ছে, চাই চা, কিছুই তার কাছে এখন খুব প্রয়োজনীয় নয়। জয়া কবিতা পাঠ করছে। কবিতা পাঠ না অন্য কিছু। দাদা দুপুরে বাড়ি এলই না। মন্দাকিনী বউদির কাছে সে রুপোর কৌটায় সোনার ভ্রমরের খোঁজ পেয়েছে বুঝি। সংসারে সবাই কী তবে কাজকর্মের ফাঁকে এমন একটা ইচ্ছের ভেতর ডুবে যেতে ভালোবাসে। খোঁড়া, অন্ধ, বেকার, ফেরেব্বাজ, কৃপণ, অকৃপণ, ধনী, দরিদ্র, এটা না হলে বুঝি বেঁচে থাকতে পারে না। একবার কলেজে নানুকে জিজ্ঞেস করে জেনে নেবে নাকি! তারপরই মনে হল—বাবা! যা গম্ভীর ছেলে। হয়তো জবাবে এমন দার্শনিক কথা বাতলাতে শুরু করবে যে তার কোনো ছাই মাথামুণ্ডু বুঝবে না। তখন হাওয়ার গন্ধ ভেসে আসছিল, কেবল মেয়েদের সুঘ্রাণ চারপাশে।
জবা বলল, এই!
মীনা বলল, এই কী ভাবছেন?
মানু বলল, গন্ধ পান না?
জবা বলল, হ্যাঁ, পাই?
কীসের গন্ধ পান?
মুচকি হাসল জবা। বলল, আপনি কোথাকার কী লোক, বলব কেন?
খুব খারাপ লোক না। ভুবনেশ্বরে আমার একটা সেলস এম্পোরিয়ামে কাজের কথা চলছে। কাজটা হয়ে গেলেই সুন্দর মতো কোনো মেয়েকে আমি ভালোবেসে ফেলব ভেবেছি।
এ রাম! এখনও বাসেননি!
এখন তো সবাইকে ভালো লাগে। সুন্দর দেখলেই ইচ্ছে করে হাত ধরতে।
আমাদেরও ইচ্ছে করে।
সে বোকার মতো তাকিয়ে বলল, কী ইচ্ছে করে?
জবা বলল, কী পাজি, সব জানতে চায়। আপনাকে বলব কেন?
মানু বলল, বলুন না, এখানে তো আর কেউ শুনতে আসছে না।
মীনা বলল, কিছু বলিস না রে পেয়ে বসবে।
জবা বলল, ন্যাকা।
মানু মীনার দিকে তাকিয়ে বলল, আচ্ছা আমাকে ন্যাকা মনে হয়। তারপর কিছুই না ভেবে বলল, বসুন না। দাঁড়িয়ে আছেন কেন।
জবার বসতে অসুবিধা নেই। সে জিনস পরেছে। হাফ—হাতা টপ পরেছে। গলায় সরু সোনার হার। পুষ্ট শরীরে সব কিছু বাড়বাড়ন্ত। প্রতিটি নখে সুন্দর রূপালি পালিশ। আঙুল সরু সরু আর লম্বা। হালকা একটা রুপোর আংটি কড়ে আঙুলে। চুল শ্যাম্পু করা, কিছুটা বাদামি রঙের। সে সহজেই বসে পড়তে পারল।
মীনার লাল শাড়িতে রুপোলি চুমকি বসানো। হাতের বটুয়া লাল রঙের। বগলকাটা ব্লাউজ লাল রঙের। গলায় লাল পাথরের মালা। সে বসার সময় প্রথমে হাঁটু মুড়ে বসল। তারপর শাড়ি টেনে পায়ের পাতা ঢেকে দিল।
মানুর মনে হল সহসা চারপাশে একটা স্বপ্নের পৃথিবী তৈরি হয়ে যাচ্ছে। কথা বললে সে ওদের জিভ দেখতে পাচ্ছে। টকটকে লাল! এদের দুজনের কেউ কনস্টিপেসনের রুগি নয়। যেমন তার বাবা মা এবং আজকাল দাদাও আয়নায় জিভ দেখে। পাকস্থলী পরিষ্কার রাখার জন্যে ঘুম থেকে উঠেই ত্রিফলার জল খায়। আসলে জবা মীনাদের শরীরের সব কোষগুলোই দারুণ তাজা! রক্তকণিকারা মাথা কুটে মরছে হাওয়া খাওয়ার জন্য।
বিকেলের মাঝামাঝি সময়। বেশ হাওয়া দিচ্ছে। গাছটা মাথার ওপর ছায়া দিচ্ছে নিরন্তর। দুটো একটা পাখি ডাকছিল। মানু পা গুটিয়ে বসেছিল। জবা মীনা মাঝে মাঝেই দূরে কিছু দেখছে। ওদের আসার কথা, ওরা আসছে না কেন! অথচ অন্যদিন ওরা এসে দেখেছে, গোপাল পিন্টু বসে আছে অথবা পায়চারি করছে। ট্রাম অথবা বাস থেকে নামতে না নামতেই ওরা দৌড়ে এসেছে। অবশ্য সব সময়ই এটা হয় না। আবার কোনোদিন ওরা আগে চলে এসেছে। আসলে কত আগে বের হওয়া যায়, বাড়িতে সময় কাটে না, রাস্তায় বের হতে পারলেই, কী যেন হিল্লোল বয়ে যায় শরীরে।
মানু মাঝে মাঝে চোখ তুলে দেখছে। মানুষের জীবন ভারি মায়াবী। জবা মীনাকে আর মনেই হয় না অপরিচিত। যেন সে তাদের কতবার দেখেছে, কত কালের চেনা। দূরে ভিক্টোরিয়া স্মৃতিসৌধ, সামনে সমান উঁচু ম্যাচ বাক্সের মতো বাড়িগুলো। ট্রামের ট্রাকশানে কখনও বিদ্যুতের ঝিলিক। পিছনে ফোর্ট উইলিয়াম। এবং কত প্রাচীন অথবা নবীনা এই শহর।
মানু বলল, হাফ—হাতা টপে আপনাকে দারুণ মানিয়েছে।
জবা নিজের বুকের দিকে তাকাল। বুকটা ধুকপুক করছে।
মীনার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনাকে শাড়িতেই বেশি সুন্দর দেখায়। এটা আপনি বোঝেন কী করে!
মীনা হাঁটুর ওপর হাত রেখেছে আড়াআড়িভাবে। চিবুক রেখেছে হাতের ওপর। মীনা সোজা তাকিয়েই বলল, আমাদের খুব ভাগ্য ভালো!
মানু বলল, এ বয়সে মেয়েদের ভাগ্যটা ভালোই থাকে।
সে কথা বলছি না মশাই। বলছি, ভাগ্যিস তার সঙ্গে আপনার দেখা হয়নি।
দেখা হলে কী হত?
স্বার্থপর হয়ে যেতেন না। আমরা যে আছি একবারও চোখ তুলে দেখতেন।
মানুর কী রকম যেন একটা বড় রকমের ব্যথা বুকের গভীরে বেজে উঠল। একটা ভারি দীর্ঘনিশ্বাস বয়ে গেল সত্যি। জয়ার কবিতা পাঠ বোধহয় জীবনেও শেষ হবে না। সে সত্যি কথা বলে ফেলল, আসলে মানুষ বোধহয় পবিত্র হয়ে গেলে কিছু আর গোপন রাখতে পছন্দ করে না। —জয়ার সঙ্গে শো দেখব বলে এসেছিলাম। হাউসে দেখা হতেই জয়া বলল, বাড়িতে দুজন কবি হাজির। কবিতা পাঠ আছে। আমাকে ফেলে ওদের সঙ্গে জয়া চলে গেল।
আর সেই থেকে একা ঘুরছেন? জবা বলল, আমরা হলে মারামারি করতাম।
মানু বলল, পারতেন।
খুব পারতাম।
মানু নীচের দিকে তাকাতে পারছে না। সেই জঙ্ঘার সন্ধিস্থলে দামি টেরিকটনের ভাঁজটা ওকে মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক করে দিচ্ছিল। এবং সে চুরি করে যতবার সেদিকে তাকাতে গেছে, জবার চোখে চোখ পড়ে গেছে। তার মুখ অতর্কিতে জ্বলে উঠেই আবার নিভে গেছে।
আপনার লাভার বুঝি পদ্য লেখে?
লাভার! তা লাভারই বলতে পারেন। খুব লঘুস্বরে লাভার বললে, ছোটই করা হয় জয়াকে। সে মনে মনে বলল, আমি ঠিক কিছুই জানতাম না। জয়া চোখে চুমু খাবার পরই আমার মাথা গোলমাল হয়ে গেছে। আগে তো রোয়াকে বসে আড্ডা মারতুম, মেয়েদের দেখলে আমার বন্ধুরা টপ্পা গাইত, শিস দিত, কিন্তু জয়াটা আমার চোখে চুমো খেয়ে যে কী করল এটা! জয়ার কথা ভাবলেই মাথা এখন ঝিম ঝিম করে। চোখ বুজলে জয়াকে দেখতে পাই। দু’জনে আমরা একটা কিছু করে ফেলব এবার।
মীনা বলল, এই আবার আপনি ভাবতে শুরু করেছেন।
আমাকে বলছেন!
তবে কাকে? চলুন উঠুন। কোথাও বসে একটু খাওয়া যাক।
আমাকে আপনারা খাওয়াবেন!
আসুন না। দেখি কতটা কী খাওয়াতে পারি।
ওরা!
ওরা এসে দেখবে আমরা নেই।
মীনা, জবা এবং মানু মাঠ পার হয়ে চলে যাচ্ছে। এবং যদি কোনো গ্রহান্তরে টেলিপ্যাথি থাকে, ধরা যাবে, সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়ে এক যুবক দুজন যুবতীর পিছু পিছু খাবার লোভে হেঁটে যাচ্ছে।
জবা মীনা গান গাইছে। হাত ধরাধরি করে ওরা দুজনে গান গাইতে গাইতে হেঁটে যাচ্ছে। শরীরে ভারি আনন্দ হিল্লোল। কোষে কোষে রন্ধ্রে রন্ধ্রে ওরা বিহ্বল হয়ে পড়ছে। গানের ভেতর কেবল কিছু পাওয়ার জন্য পাগল।
এগারো
জয়া বলল, আর কতদূর?
আয় না। বলে একটা সরু গলিতে কালিদাস ঢুকে গেল। তারপর পানের দোকান থেকে দুটো সিগারেট কিনে জয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, পান খাবি?
মিষ্টি পান খাব।
এই তিনটে মিঠে পাতা লাগাও।
কালিদাস পকেটে খুচরো খুঁজছিল।
জয়া বলল, আর কে কে আসছে?
বিনয় বলল, অনেকের তো আসার কথা। না এলে বোঝা যাবে না।
জয়া এলিভেটেড সু পরেছে। মাঝারি ধরনের লম্বা শরীর, মনে হয় জয়া সবার থেকে লম্বা থাকতে চায়। সু পরায় মোটামুটি লম্বাই হয়ে গেছে। কালিদাস বেঁটে মতো মানুষ—ওর মাথা ছাড়িয়ে উঠে গেছে জয়া এবং সারাক্ষণ তার দেহ থেকে ক্রিমের একটা সুন্দর গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। কালিদাস বিনয় পিছনে পিছনে এসেছে গন্ধটা শুকতে শুকতে। প্রায় দুটো কুকুরের শামিল—এবং জয়ার পিছনটা এত মনোরম যে সারা রাস্তায় ওরা আর কোনো দৃশ্য দেখেনি। শাড়ি সিল্কের হলে যা হয়, পিছনে লেপ্টে থাকে। ফলে চলার সময় শরীরের সঙ্গে শাড়িটার বেশ একটা ছন্দ থাকে। এই ছন্দ যে কত আনন্দের বেদনার এবং দুঃখের তারা এখনও জানে না।
বিনয় বলল, জয়া, ওই ছেলেটি কে রে?
ও মানু। খুব ভালো ছেলে। জয়া বলল, তোদের মতো না। তোরা তো কবিতা লিখিস। মানুর ওসব বাই নেই। ভালো ছেলে। ওর চাকরি হলে আমাকে বিয়ে করবে বলেছে।
কালিদাস বলল, আমরা কী দোষ করলাম?
তোরা তো বলিসনি বিয়ে করবি।
আজই বলে রাখলাম।
বিনয় বলল, জয়া তোর পান।
সে পানটা হাতে নিয়ে খুলে দেখল। চুন বেশি হলে গাল পুড়ে যায়। দেখল ঠিকই আছে। আরও দু’কুচি ভাজা সুপারি চেয়ে নিল হাত পেতে।
বিনয় বলল, আমি পান খাচ্ছি না। রেখে দিচ্ছি।
বললেই পারতিস কিনতাম না। কালিদাস দু’টো পান এবং সিগারেটের পয়সা দিয়ে দিল।
জয়া দেখেছে বিনয়ের একটা অদ্ভুত স্বভাব আছে। আরও দুবার তাকে নিয়ে দু—জায়গায় কবিতা পাঠের জন্যে গেছে। পান কিনে খেয়েছে। বিনয় খায়নি। বিনয় হাত পেতে বলেছে, জয়া দে। প্রথম দিন সে বুঝতে পারেনি, সে বলেছিল, কী দেব! বিনয় পানের ছিবড়ে চাইছে। এবং জয়া বলেছিল, কী কাঙাল রে তুই!
কাঙাল কী। তোর এঁটো খেতে আমার ভালো লাগে। তারপর এক সময় অবসর বুঝে বলে ফেলেছিল, জয়া, তুই আমার একটা কথা রাখবি?
কী কথা!
তোর জিভের ডগা থেকে আমি একটু পান নেব।
ঠিক আছে, নিস।
এবং এক বিকেলে কলেজস্ট্রিট থেকে একটা দামি পান কিনে সত্যি সে সোজা চলে গিয়েছিল জয়াদের বাড়িতে। জয়ার বাবা অফিসে। জয়ার পিসি স্কুলে। মা রুগণ। দিনরাত শুয়ে থাকে। এবং জয়ার একমাত্র সঙ্গী বাঘা পায়ের নিচে শুয়ে ঘুমোচ্ছিল। তখন শহরের রাস্তায় সবে মাত্র আলো জ্বলে উঠছে। বিনয় বেল টিপে ধরতেই দরজা খুলে গেল। জয়ার পরনে মখমলের পোশাক। একেবারে লম্বা গাউনের মতো পায়ের পাতা অবধি। হাতে রুপোর বালা। চুল ঘোড়ার লেজের মতো টান করে বাঁধা। বিনয় ঢুকেই খুব ফিস ফিস গলায় বলেছিল, এনেছি।
কোনো নিষিদ্ধ বস্তু নিয়ে যেন সে ঢুকেছে। চোখে মুখে খুব একটা থমথমে ভাব। —তুই, একা আছিস তো?
কী হবে একা থাকলে।
বিনয় কলাপাতার ভাঁজ থেকে একটা পানের খিলি বের করে বলেছিল, নে খা।
পান খেলে ঠোঁট টুকটুকে লাল হয় না জয়ার। জয়া কতদিন ঠোঁট উলটে দেখেছে। মোটেই লাল হয়নি। সে বলল, ঠোঁট লাল হবে তো?
হবে। খা না। কে আবার এসে পড়বে তখন আর হবে না। তাড়াতাড়ি খা তো—
জয়া খেতে খেতে প্রায় সবটাই খেয়ে ফেলেছিল। বিনয় দেখছে। —এই রে সবটা খেয়ে ফেলেছিস! কী কথা ছিল?
ও! বলেই জয়া উঠে দাঁড়িয়েছিল। নে—জিভের ডগা সামান্য বের করে দিল। আর বিনয় কাছে আসতেই আবার জিভটা ভেতরে পুরে ফেলল। বিনয় হতাশ গলায় বলেছিল, এই জয়া এমন করিস না। মাইরি, মরে যাব। জয়া খুব কুঁচকে বলেছিল, তুই দাঁত মাজিস না।
আজকাল রোজ দাঁত মাজি। বিনয় দাঁত বের করে দেখিয়েছিল।
আচ্ছা নে।
জয়া মা কালীর মতো অনেকটা জিভ বের করে রেখেছিল। এবং মিষ্টি পানের অতীব সুমধুর গন্ধ। বিনয় জিভ থেকে সবটা চেটে খেয়ে বলেছিল, কী আরাম! জয়া তোরা যে কী না! তোরা আমাদের দেখছি মেরে ফেলবি।
কালিদাস তখন বলল, এসে গেছি।
দরজায় নীরদ দাঁড়িয়ে। সতরঞ্চি পাতা। দু—একজন ইতিমধ্যে এসে গেছে। জয়া চেনে না এদের। নীরদ বলল, জয়া, ভিতরে বস গিয়ে। নীরদ ওদের তুলনায় সামান্য বেশি বয়সের মানুষ। এবং গলায় একটা গম্ভীর স্বর রেখে দেয় সব সময়। কবিতার ক্ষেত্রে সে কিছুটা অভিভাবকের মতো। ওরা সবাই নীরদদা বলে ডাকে। সব কবিতার আসরেই মানুষটিকে দেখা যায়। নিজে খুব ভালো কবিতা লিখতে পারে না। তবে কবিতা—অন্ত প্রাণ। ভালো কবিতা কী, মানুষটা বোঝে। এবং এই কবি অন্তপ্রাণ মানুষটিকে জয়া শ্রদ্ধা করে। মান্য করে। সে ভেতরে ঢুকে ভালো মেয়ের মতো বসে পড়ল। খাতাটা এক পাশে।
কালিদাস বলল, এই হচ্ছে আলোক, এই হচ্ছে কাশী আর এই আমাদের জয়া। পৃথিবীর নতুন নতুন সব খবর এর ঝোলায় ভরা আছে।
ওরা হাত তুলে নমস্কার করল জয়াকে। জয়া দেখল একজন বড় গোঁফঅলা মানুষ। লম্বা গোঁফ। গালপাট্টায় অধিকাংশ মুখটা ঢেকে আছে। লোকটার নাম কাশী। কাশীনাথ দত্ত। ওর কবিতার বিষয় মৃত জীবজন্তু নিয়ে। যুবতী নারীর কোনো গন্ধ নেই কবিতায়। জয়া মনে মনে বলল, কিচ্ছু হবে না। গবেট। গবেট ছাড়া মুখটাতে লোকটার আর কোনো চিহ্ন নেই।
ক্রমে ক্রমে আরও দুজন, পরে একজন, আবার একজন শেষে পাঁচ—সাতজন এল। কবিতা পাঠ করতে বেশ সময় লাগবে। চারটেয় আরম্ভ হওয়ার কথা। কিন্তু যার বাড়িতে কবিতা পাঠ, তিনি কোথায়! তার দেখা নেই। অথচ সুন্দর করে সতরঞ্চি পেতে রেখেছে। মাঝখানে মাটির কাজ করা ফুলদানি! একগুচ্ছ রজনীগন্ধা ফুটে আছে ওপরে। দেয়ালে রবিঠাকুরের ছবি। আর কোনো ছবি নেই। সতরঞ্চির ওপর ফুল—ফল আঁকা চাদর পাতা। সবার খুব গম্ভীর চোখ মুখ। কবিতা ব্যতিরেকে আর কিছু জানা নেই। পাশেই জয়া, কিছুক্ষণের ভেতরেই ফুল্লরা, আর একজন কেউ হবে, সেও যুবতী, এল। তবে এত কালো আর শীর্ণ যে কেউ ওর দিকে তাকাচ্ছে না। ফুল্লরা দেখতে মন্দ না, তবে জয়া সবার চেয়ে সুন্দরী। কেবল যখন কোনো সভায় সেই বজ্জাতটা আসে, নবীনা না কী যেন নাম, তখন নিষ্প্রভ হয়ে যায়। এবং তখন কালিদাস, বিনয়, এমনকি যে নীরদদা এত গম্ভীর মানুষ, তিনিও খুব বিচলিত হয়ে পড়েন! জয়া সে সব ঘয়োয়া আসরে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। বড়লোকি চাল, গাড়ি, সোফার উড়ু উড়ু চুল, চোখে টানা আইল্যাশ আর দামি পারস্য দেশের আতর বোধহয় শরীরে মেখে রাখে। যতক্ষণ থাকে একইভাবে গন্ধটা ম ম করে। জয়ারও কম জানা নেই। বাজারে কার কী রকম গন্ধ সব সে জানে। কেবল নবীনার গন্ধটা তার এখনও জানা নেই, কোথায় কোন পৃথিবীতে কিনতে পাওয়া যায়। নবীনা মেয়েটিই একমাত্র ঈর্ষার উদ্রেক করতে পারে তার।
নীরদদা এবার বোধহয় বেশ গুরুগম্ভীর গলায় কবিতা কত পবিত্র ব্যাপার এ সম্পর্কে সামান্য বক্তব্য রাখবেন। যিনি উদ্যোক্তা তাকেও দেখা গেল। আদ্দির পাঞ্জাবি, ফিনলে ধুতি পরে পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে হাত তুলে সবাইকে অভিবাদন করলেন। নীরদদা তখন তার কথাবার্তা আরম্ভ করে দিয়েছেন। হাত তুলে ইশারায় বসতে বললেন। ধূপ জ্বেলে দেওয়া হয়েছে। কেউ কেউ খাতা খুলে দেখছে কিছু। জয়ার কিছু দেখতে হয় না। তার কবিতা মুখস্থই থাকে। তবু কোথাও আটকে গেলে অসুবিধা হবে ভেবে খাতাটা অথবা দুটো একটা মুদ্রিত কবিতা সামনে রাখার স্বভাব।
সেই কাশীনাথ দত্ত উঠে বলল, নীরদদা, আজ আপনাকে দিয়েই কবিতা পাঠ আরম্ভ হোক।
সে হবে’খন। বোস।
প্রায় এক ধমকে বসিয়ে দেবার মতো। জয়ার ভীষণ হাসি পাচ্ছিল, সে এক ফাঁকে সামান্য হেসেও নিল। তারপরই মনে হল, বাথরুমে গেলে মন্দ হত না। সে চারপাশে তাকাল। মানুটা খুব দুঃখ পেয়েছে। মানুর জন্যে একটা দুঃখবোধ শরীরে খেলা করে বেড়াচ্ছে। কবিতা পাঠ ভারি উজ্জ্বল ঘটনা জীবনে। একটা সুখানুভব খেলা করে বেড়াচ্ছে শরীরে। গুঁফো লোকটার চোখ মাঝে মাঝে তাকে বিব্রত করছে। সামান্য অস্বস্তিও বোধ করছে। এ সব অনুভূতি একই শরীরে খেলা করে বেড়ালে সে কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। এবং সে জানে কবিতা পাঠ প্রথম তাকে দিয়েই আরম্ভ হবে। সে উঠে এক মিনিট সময় চেয়ে নিল নীরদদার কাছে। তারপর বলল, আজ কিন্তু সবার শেষে আমি।
নীরদদা আবারও হাত তুলে ওকে বসতে বললেন। তিনি সুন্দর বর্ণনা সহকারে কবিতার কথাবার্তা বলতে পারেন। এবং বলতে বলতে ভারি নিমগ্ন হয়ে যান। চারপাশে কোথাও দুঃখ—টুঃখ আছে বোঝাই যায় না। এই বড় শহরে ফুটপাতে লোক থাকে, একবেলা আহার জোটে না মানুষের, মৃত্যু এবং ঈর্ষা অথবা অনুতাপে দগ্ধ হয় শহর—এখন এই সরু গলির অন্ধকারে টের পাওয়া যাচ্ছে না। মনে হয় সর্বত্রই ফুল ফুটে আছে। কেবল কবিতা পাঠই মানুষের একমাত্র কাজ।
নীরদ হাজরা বলে চলেন, শরীর মন ঈশ্বর অথবা যন্ত্রণা মানুষের কবিতার বিষয়বস্তু হতে পারে। কবিতা দুঃখ জাগায়। কিছু না পাওয়ার দুঃখ থেকেই কবিতার জন্ম। আমরা নিয়তি—তাড়িত, অথচ কখনও পরাজিত হতে চাই না।
ফুল্লরা তখন শাড়ি টেনে পা ঢেকে দিল। ফুল্লরা আলতা পরেছে। ফুল্লরা আজ চুলে শ্যাম্পু করেছে। ওর চুল সারা পিঠে ছড়িয়ে আছে। কবিতা পাঠের সময় ফুল্লরার খুব ঘাম দেখা দেয়। দুটো রুমাল ওর বটুয়াতে থাকে। একটা ঘামের আর একটা গন্ধের। গন্ধের রুমাল বের করে সে চশমা মুছছে।
গুঁফো কাশীনাথের চোখ ট্যারছা হয়ে যাচ্ছে। সে বার বারই জয়ার পিঠের খালি অংশটা দেখার চেষ্টা করছে। সুড়সুড়ি লাগছিল জয়ার। সে শাড়ির আঁচল টেনে ভালো করে পিঠ ঢেকে দিল।
এবং গুঁফো কাশীনাথ ভাবল এই মেদ মাংস ভেদ করে একটা ফুসফুস থাকে মানুষের। অন্তঃকরণ থাকে পাশে। দুটোই এখন জ্বলছে আর নিভছে। এবং শরীরে করাত চালালে দুটো আলাদা ভাগে ফুসফুসের অর্ধাংশ, অন্তঃকরণ সবটাই একদিকে, পাকস্থলী, মূত্রাশয় সব সমান দু’ভাগ হয়ে যায়। সে পাশাপাশি বসা দুজন মেয়ের শরীর ভাগ করে দেখছিল। সে অ্যানাটমির ছাত্র। মেয়েদের দেখলেই ফুসফুস এবং জরায়ু দুটোর রঙের কতটা আসমানজমিন ফারাক বুঝতে পারে।
কালিদাসের কাছে জয়া দেবীর মতো। নাকে নথ পরে থাকলে জয়াকে সরস্বতী ঠাকুরণ ভাবা যেত অনায়াসে। বসার ভঙ্গিটা ঠিক তেমনি। জয়ার বুক ভারী উঁচু এবং প্রবল। শাড়ির অভ্যন্তরে থাকতে চায় না যেন। সে চুরি করে এখন মাঝে মাঝে তাই দেখছে।
এবার কবিতা পাঠ আরম্ভ হোক, নীরদ হাজরা বলে উঠলেন।
তখনই গাড়ির শব্দ পাওয়া গেল দরজায়। জয়ার মুখটা কালো হয়ে গেল।
নবীনা এখানে আসবে, কালিদাস বলেনি। জয়ার মুখটা কালো হয়ে গেল। না আসবারই তো কথা। তবু চুপি চুপি ঠিক বলে রেখেছে। কালিদাস এবং বিনয় এখন আর ওর দিকে তাকাবেই না। শুধু ওরা কেন, সবাই। সে এলেই সবাই যেন চঞ্চল হয়ে ওঠে। নীরদদা দরজা ঠেলে বাইরে বের হয়ে গেলেন। এবং নবীনা যখন এল, প্রায় সম্রাজ্ঞীর মতো। নবীনাকে এলিভেটেড সু পরতে হয় না। ঈশ্বর আসল জায়গাতেই জয়াকে মেরে রেখেছে। সে কেবল তীব্র ঈর্ষাবোধে কাতর হতে থাকল।
নবীনা সবাইকে এমনকি বয়োজ্যেষ্ঠ নীরদদাকে তুই তুকারি করে। এমন একটা ভঙ্গি কথাবার্তায় অথবা চালচলনে, যে সে এই সব যুবকদের থোরাই কেয়ার করে। যেন এদের সবার জন্যে সে কিছুটা দিতে পারে। কার জন্যে ঠ্যাং, কার জন্যে জঙ্ঘা, কার জন্য বুক, চিবুক অথবা ঠোঁট সবাই কিছুটা কিছুটা পাবে, সবটা পাবে না। সবটা সে কোনো একজনকে দিতে পারে না। জয়া কিন্তু সবটা একজনকেই দিতে পারে। জোর জবরদস্তি না করে দু’মাস আগের এক সকালে ওর চোখে মানু চুমো খেয়েছিল। মানুটা এত বোকা! বুঝতে এত সময় নেয় কেন তার মাথায় আসে না। সে কেমন নীরস গলায় বলল, নবীনাদি, তোর আসতে এত দেরি কেন রে!
আর বলিস না ভাই। উমাশংকর এসেছিল। উঠতেই চায় না। ওর কোথায় জলছবির কারখানা আছে, ওটা দেখাতে নিয়ে যাবে। প্রেস খুলেছে নতুন। কবিতার বইয়ের জন্য ঝোলাঝুলি করছে।
ফানটুস! ভেতরে এই একটা শব্দ বেলুনে পিন ফুটিয়ে দেবার মতো বের হয়ে গেছিল প্রায়। সে বলল, তোর মাইরি ভাগ্য বলতে হবে।
কালো মতো, রোগা মতো মেয়েটা বলল, নবীনাদি তোমার মতো ভাগ্য ক’জনের আছে। আমাদের একটা কবিতার বই ছাপিয়ে দাও না।
হবে হবে। বলে পা আলগা করে বসে পড়ল নবীনা। তারপর বলল, এখনও আরম্ভ হয়নি।
হবে এবার। তুমিই আরম্ভ কর। নবীনা থাকলে আর কারও যেন আরম্ভ করার অধিকারই নেই। নবীনা আসায় নীরদদা গর্বে ডগমগ করছেন। ফুল সেসান! নীরদদা গৃহকর্তার দিকে তাকালেন। এ সময়ে একরাউন্ড চা হলে মন্দ হয় না। গৃহকর্তা কোঁচা দুলিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল।
জয়ার মনে হল, আজই সব সে একজনকে দেবে। দিয়ে দেখবে কবিতার চেয়ে কত বেশি তীব্র সুখ। এবং এ সময় মানুর জন্যে প্রবল টান বোধ করল। মানুকে বাড়ি ফিরেই ডেকে পাঠাবে। তার চোখ মুখ উত্তাপে জ্বলছিল। যেন প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে জ্বর আসছে। রোমকূপে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিচ্ছিল। সে আর সত্যি বসে থাকতে পারছে না। কবিতা—ফবিতা মাথায় উঠেছে।
নবীনা তখন বলল, কী রে জয়া, শরীর ভালো নেই! এমন করছিস কেন?
জয়া বলল, বোধহয় ভালো নেই।
কালিদাস, বিনয় এবং অন্য সবাই বুঝতে পারছে সেই রোগটা বুঝি দেখা দিয়েছে জয়ার। নবীনা এলেই জয়ার অস্বস্তি ফুটে ওঠে।
নীরদদা বললেন, পাখাটা জোরে চালিয়ে দাও অমিয়। জয়া বড্ড ঘামছে।
নীরদদা চায়ের কাপগুলো এগিয়ে দিচ্ছিলেন! নবীনা ঝুঁকে আছে তার কবিতার ওপর। কাশীনাথ পাতা উলটে যাচ্ছে। বিনয় কালিদাস ফিস ফিস করে কী সব বলছিল। বিনয় উঠে চা এগিয়ে দিল জয়াকে, ফুল্লরাকে। আবার বসে পড়ে সেই ফিস ফিস কথাবার্তা আরম্ভ করলে জয়া ধমকে উঠল, ভালো হচ্ছে না বিনয়। কী যা তা সব বলছ, শুনতে পাচ্ছি।
তোমাকে বলছি না।
যাকেই বলছ, সে আমার গোত্রের।
কালিদাস বলল, নো আর সত্যি কথা নয়। কবিতা পাঠ এবার কার?
কাশীনাথ তাকাল নীরদদার দিকে। শেষের দিকে হলে কিছুটা অসম্মান সে ভেবে থাকে। এবং নীরদ সেটা জানে।
নীরদ বলল, কাশী এবার তুমি পড়ো। গম্ভীর গলায় পড়ো।
জয়ার হাই উঠছিল। এখনি কবিতার গোটা শরীরটা চিরে ফেলবে হারামি লোকটা। আরে মানুষের ভেতরে কী থাকে এটা তোমার কাছে কে জানতে চায়, বাইরে সে কী ভালোবাসে তার কথা বল। জয়া হয়তো বলেই ফেলত ধমাস করে, নীরদদা উঠি। ভাল্লাগছে না। এবং তখনই মানু মাথার ভেতরে হেঁটে যায় তার। সে বুঝতে পারল তার কবিতার গভীরতা একমাত্র এই বয়সে মানুই প্রথম পরিমাপ করে দেখতে পারে।
কাশীনাথ দুবার গলা খেকারী দিল। তারপর বলল, একটু জল।
একগ্লাস জল হোস্ট ব্যক্তিটি সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে গিয়ে আনল।
কাশীনাথ জল খেল চুক চুক করে।
এই জল, বলে সে কবিতার লাইনটা দুবার দুরকমভাবে ঘুরিয়ে বলল, জল এই, এই জল। ভেতরে যতদূর যায়। দেখবে গভীর হলুদ অন্ধকার। আরও নীচে তার কোনো পরিমাপ নেই।
কাশীনাথের কবিতায় পরিমাপ শব্দটির খুব বেশি বোধহয় ব্যবহার আছে। জয়া কী তবে গভীরতা পরিমাপ করার ব্যাপারে কাশীনাথের কবিতা থেকে ইনফ্লুয়েন্সড হয়েছে। ভাবতেই গা—টা কেমন গুলিয়ে উঠল জয়ার। সে উঠে বলল, দাদা যাই।
সে কি!
হা হা করে উঠল সবাই।
আমার শরীরটা ভালো নেই।
কেন কী হল!
ঠিক বুঝতে পারছি না।
নবীনা বলল, জয়া তোমার কবিতা শুনব বলে এত কাজের ভেতরেও চলে এলাম।
আর একদিন শুনবে।
নীরদ ঠিক বুঝতে পারল না কেন জয়ার শরীর খারাপ, কেন সহসা কবিতা পাঠের আসর ছেড়ে চলে যেতে চাইছে। জয়াকে আজ ইচ্ছে করেই শেষের দিকে রেখেছে। মেয়েটা সত্যি কবিতা ভালো লেখে। এবং সবার শোনার আগ্রহ থাকে। অন্য সময় ভালো কবিতা দিয়ে সে আরম্ভ করে দেখেছে সবাই কোনো অজুহাত দেখিয়ে কবিতা পাঠ শেষ না হতেই চলে যায়। এবং যারা নতুন, অথবা কবিতার মুদ্রাদোষে আক্রান্ত, খবর পেলেই গন্ধে চলে আসে যারা, ফাঁকা মাঠে পড়ে যায়। সুতরাং নীরদ এবার ভেবেছে, ভালো সবকিছু শেষের দিকে।
কালিদাস বলল, এই বোস, আমি তোকে এগিয়ে দিয়ে আসব।
কোথায়?
যেখানে যাচ্ছিস রাগ করে।
সেটা কতদূর যখন জানিস না, কথা বলিস না বোকার মতো।
নীরদদা বলল, তোমার যাওয়া উচিত হচ্ছে না জয়া। বরং তুমি তোমার কবিতা পড়েই যাও। কাশীনাথের হলে তুমি পড়বে।
জয়া হেসে ফেলল। আচ্ছা নীরদদা আপনি কী!
কেন বলত!
আপনি আমাকে কী ভাবেন! কেমন গম্ভীর গলা জয়ার।
নীরদ বললে, কী ভাবি!
খুব ছেলেমানুষ ভাবেন!
ধুস, মেয়েরা বারো পার হলেই আর ছেলেমানুষ থাকে না। তোমার তো সে হিসেবে অনেক বয়েস।
গাছ—পাথর নেই।
গাছ—পাথরের কথা বলতে চাই না। এ—বয়সে মেয়েরা নিজের সম্পর্কে খুব সচেতন হয়ে ওঠে এটা বুঝি।
কাশীনাথ কবিতার খাতা বন্ধ করে দিয়ে বলল, আপনারা আর কতক্ষণ কথা বলবেন?
নীরদ খুব ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল কথাটায়। সত্যি যখন কবিতা পাঠ হচ্ছে, এভাবে জয়ার সঙ্গে কথা বলার সময় পরেও পাওয়া যাবে। সে বলল, আচ্ছা তা হলে জয়া তুমি যাও।
জয়া বাইরে এসে ভাবল কাজটা অনুচিত হয়েছে, আসলে সে যে কেন বলেছিল দাদা আমার কিছু ভালো লাগছে না বুঝতে পারছিল না। এখন মনে পড়ছে মানুর জন্য সত্যি মনটা খারাপ হয়েছিল। একা সিনেমায় ছেড়ে চলে এল, মানু কত কিছু ভাবতে পারে। মানুকে তার খুব ভালো লাগে। লম্বা হাত পা, চোখ বেশ সুন্দর, এবং চুলে কী যে তার মহিমা আছে, এখন যে হাড়ে হাড়ে সে এটা টের পাচ্ছে। সে তখনই দেখল পেছনে কালিদাস ছুটে আসছে। কালিদাস হাঁকছে, এই জয়া দাঁড়া।
জয়া দাঁড়াল না। হন হন করে হাঁটতে থাকল। কেমন বেহায়াপনা আছে কালিদাসের ভেতর।
কী রে শুনতে পাচ্ছিস না।
জয়া গলির মোড়ে এসে দাঁড়াল। কালিদাস কাছে এলে বলল, কীরে এত চিল্লাচ্ছিস কেন!
চল তোকে আমি এসকট করি।
আর কিছু করবি না?
করতে দিলি কই।
জয়া বলল, সব এত সোজা ভাবিস কেন? জয়াকে ভীষণ গম্ভীর দেখাল। জয়ার উঁচু হিলের জুতোর ফাঁকে গোড়ালিটা দেখা যাচ্ছে। কী লাবণ্য এই পায়ে। কালিদাসের উপুড় হয়ে পড়তে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু মেজাজ মনে হচ্ছে সত্যি জয়ার ভালো না। সে পাশাপাশি হাঁটতে থাকল শুধু। কী কথা বলবে ঠিক বুঝতে পারল না।
অগত্যা যা হয়, কবিতার কথা। এবং দুটি একটি টিপ্পনি কাটল নবীনা সম্পর্কে। কাশীনাথ বুড়ো হাবড়া জাহান্নামে যাওয়া সব চিন্তা ভাবনা, যুবতীদের শরীর নিয়ে এত হ্যাংলার মতো লেখার কী আছে—এসবই কথা প্রসঙ্গে জয়াকে বলতে থাকল। জয়া কখনও না কখনও হাঁ করে যাচ্ছে। এবং ট্রাম স্টপ আসতেই প্রায় চলন্ত ট্রামে লাফিয়ে উঠে গেল। এবং হাত নেড়ে কালিদাসকে টা টা করল। কালিদাস কিছুক্ষণ বোকার মতো তাকিয়ে দেখল, ট্রামটা বেশ দ্রুত চলে যাচ্ছে। জয়ার শাড়ির আঁচল অতি অল্প হাওয়ায় উড়ছিল, তারপর অদৃশ্য হয়ে গেল। জয়ার তো এ—ট্রামে ফেরার কথা নয়।
বারো
এই বাড়িটায় নানু আরও ক’বার এসেছে। একবার সে এসে দেখেছিল, কেউ নেই, কাজ করে যে বালিকাটি শুধু সেই আছে। আর একবার এসে দেখেছিল, জেঠু বের হয়ে গেছে কোথায়। জেঠুর মহিয়সী ভূড়ি দুলিয়ে ব্যাগ দুলিয়ে মেয়ের হাত ধরে কোথায় রওনা হবার জন্য বের হচ্ছে। ওকে দেখেই, আরে নানু এলি। ও—মা কত দিন পর এলি। তোর বুঝি আমাদের কথা মনে থাকে না। তোর জেঠুর তো ঘুম নেই দুচোখে, তোর কথা ভেবে। যাক তবু যে এলি। বোস। তারপরই সেই মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল, ডাল বসিয়ে দে। পোস্ত বাটা আছে। মাছ টাছ তো আর পাওয়া যায় না।
নানুর দিকে তাকিয়ে বলেছিল, তুমি খেয়ে যাবে। জেঠি তার বেশি সোহাগে তুই তুকারি করে। আর বিরক্ত হলে তুমি তুমি করে।
নানু বলেছিল, জেঠু কোথায়।
মহীয়সী বলেছিল, আসবে। তুমি কিন্তু চলে যেও না আবার। তোমার জেঠু তবে খুব খারাপ ভাববে।
নানু বলেছিল, না না। জেঠুর সঙ্গে দেখা করে যাব।
খেয়েও যাবে।
তা যাব।
আমি যাচ্ছি বুঝলে। এই কণা, শুনতে পাচছিস না, মহীয়সী চিৎকার করে সেই বালিকা চাকরাণীকে ডেকে, বলেছিল, নানুবাবুকে চানের জল তুলে দিস। রান্না হলে গুল দিস। পুকুর থেকে জল এনে সাদা শাড়িটা কাচবি। কলের জলে ধুলে তোমার একটা দাঁতও আস্ত রাখব না।
জেঠুর মেয়েটা তখনই কুঁই করে উঠল। চল মা। যাবে না।
নানু বলেছিল, এই হাবলা।
আমাকে হাবলা বলবে না আমার নাম কুটু।
নানু চুল নেড়ে বলেছিল, কেমন আছিস। যাবি আমার সঙ্গে আমাদের বাড়িতে। ছোট্ট বোনটিকে মাঝে মাঝে নানুর ভারি আদর করতে ইচ্ছে হয়। সে বলেছিল, কোথায় যাচ্ছিস, আমার সঙ্গে থাক।
কুটু বলেছিল, না। মার সঙ্গে আমি যাব।
নানু বলেছিল, আমি তোর দাদা। দাদার কথা শুনতে হয়।
বের হবার আগে আর কী কী আদেশ জারি করা বাকি আছে ভেবে বোধ হয় সেই মহীয়সী বারান্দায় দু—বার পায়চারি করল, একবার শোবার ঘরে ঢুকে তালা ফালা সব জায়গা মতো দেওয়া আছে কিনা দেখে নিয়েছিল। শোবার ঘরের জানালা বন্ধ করে দরজার শেকল তুলে সেখানেও একটি বৃহৎ ঘণ্টার মতো তালা ঝুলিয়ে দিয়েছিল। কেবল খোলা রেখে গেল বাইরের ঘরটি—সেখানেই জেঠু না আসা পর্যন্ত নানুকে অপেক্ষা করতে হবে। বড়ই সাবধানী মহিলা। জীবনের কোনো ক্ষেত্রে ঠকতে রাজি না। নানুর স্বভাব কেমন কে জানে! নানুর মনে হয়েছিল, তখনই সে চলে যায়—কিন্তু গেলে জেঠু কষ্ট পেতে পারে—জেঠু, আহা সেই জেঠু যে তাকে হাত ধরে পার্কে নিয়ে যেত, লাল বল নিয়ে তার সঙ্গে খেলা করত। একজন মহীয়সীর পাল্লায় পড়ে জেঠুর লাইফ জেরবার—এবং তখনই মনে হয়েছিল, সারাদিন থেকে জেঠুর জীবনের বাকি সময়টা কেমন করে কাটে দেখে যাবে।
বাথরুম খোলা ছিল বলে একবার সেখানে ঢুকতে পেরেছিল। আর বাকি সময়টা ভীষণভাবে লক্ষ্য করে যাচ্ছিল বালিকাটি একহাতে সব কাজ কেমন করে একে একে করে যাচ্ছে। ওর ভারি চা খেতে ইচ্ছে হয়েছিল। এবং সেজন্য সে মুখ বাড়িয়ে বলেছিল, কীরে এক কাপ চা হবে? বালিকাটি ভারি কাঁচুমাচু চোখে ওর দিকে তাকিয়েছিল—তখনই বুঝেছিল, কত অসহায় এই মেয়েটি।
জেঠু এল বারোটা বাজে বাজে সময়ে। নানুকে দেখেই খুব ছেলেমানুষের মতো জড়িয়ে ধরেছিল, তুই এলি তবে! কেমন আছিস। তোর জেঠিমা বাড়ি নেই। থাকলে কী খুশি হত।
নানু বলেছিল, দেখা হয়েছে।
ওয়েল। দেন, বাড়ি চিনে আসতে কোনো ট্রাবল ফেস করতে হয়নি তো!
নানু বলেছিল, আমি তো আরও এসেছি। জেঠি ছিল। তোমার অফিসে ফোনে জানিয়েছিলাম মনে নেই? ট্রাবল ফেস করতে হবে কেন।
ও ইয়েস, ইয়েস। ইউ কেম। ভেরি গুড, নাউ ইউ কমপ্লিট ইউর বাথ। আমিও চানটা সেরে নেই। তারপর দুজনে জানালা খুলে শুয়ে পড়ব।
নানু জানে জেঠু সারাক্ষণ বক বক করতে ভালোবাসে। এবং জেঠু একটিই রেকর্ড চালিয়ে দেয়। রেকর্ডে সব মহৎ ব্যক্তিদের উক্তি এবং জীবন সম্পর্কে অতিশয় কঠিন সত্যের প্রকাশ থাকে। আরম্ভ হল বলে। প্রথম দিন শুনলে মনে হবে, বড়ই পণ্ডিতপ্রবর। দ্বিতীয় দিন শুনলে মনে হবে বড়ই রাজনৈতিক সচেতন। তৃতীয় দিন শুনলে মনে হবে, দেশের একজন চিন্তানায়ক তিনি! চতুর্থ দিনে আদর্শ শিক্ষক, পঞ্চম দিনে পরম রসিক, ষষ্ঠ দিনে ধর্মপরায়ণ, সপ্তম দিনে কবিয়াল, অষ্টম দিনে হাপুর বাজারের দালাল, নবম দিনে কোতোয়ালের পুত্র, দশম দিনে রমণীরঞ্জন, একাদশ দিনে একটি আস্ত আরশোলা। অর্থাৎ দশ দিনের ওপর জেঠুর সঙ্গে যে ব্যক্তি আলাপ করেছে তার বিন্দুমাত্র ভাবতে কষ্ট হয় না, মানুষটা জীবনে কোথাও এতই জেরবার যে পা রাখার আর জায়গা নেই। আস্ত একটি ভাঁড়। এ—হেন ব্যক্তিটি খেতে বসে বলেছিল, পোস্ত আলু আর ডাল বড়ই ডেলিসিয়াস ফুড। আমার ফেবারিট লাঞ্চ।
ভোজ্যদ্রব্য গলাধঃকরণ করতে নানুর খুবই কষ্ট হয়েছিল। বলতে ইচ্ছে হয়েছিল, আসলে সেই মহীয়সী তোমার জন্য আর কিছু বরাদ্দ করেনি। তুমি যা রোজগার করো এবং মহীয়সী যা রোজগার করেন, সঞ্চয়ের জন্য। বেঁচে থাকার চেয়ে সঞ্চয়ের প্রবৃত্তি বড়ই আরামদায়ক। অথবা তোমাকে একটি আস্ত অশ্ব বানিয়ে চেপে বসেছেন, এখন তোমার সওয়ারি নিয়ে শুধু ছোটা বাদে অন্য কোনো গত্যন্তর নেই। তবু নানু সাধারণত এই কাপুরুষ মানুষটিকে দুঃখ দিতে চায় না। সেও জেঠুর সঙ্গে খেতে খেতে বলেছিল, বড়ই সুস্বাদু খাবার!
যাইহোক আজ সে খবর দিয়ে এসেছে। এতদিনে জেঠির শরীর ভালো হয়ে যাবার কথা। এবং পেটের চর্বির নীচে বড়ই আন্ত্রিক গোলযোগ। মাঝে মাঝে যখন ঢেকুর তোলে তখন কাছে তিষ্ঠোয় এমন নরাধম জগতে কমই আছে। সেদিন সে বাড়ি ঢুকেই দেখেছিল মহীয়সী পা ছড়িয়ে বসে আছেন। কুলোয় পোয়াটেক খেসারীর ডাল। কাঁকর এবং আবর্জনা বাছার কাজটি তিনি সারছিলেন। এ—হেন সময়ে নানুর প্রবেশ। জেঠি আপাতত বিড়ম্বনা এবং বিরক্তি লুকিয়ে ঠোঁটের ফাঁকে হেসে বলেছিলেন, হ্যাঁরে এসেছিস। তবু যে তোর জেঠির কথা মনে পড়ল।
রান্নাঘরে আজ সে অন্য এক বালিকাকে দেখতে পেল। ঠিক বালিকা বলা চলে না, কিশোরী, ছেঁড়া ফ্রক গায়ে—চোখ দুটো ভারি মিষ্টি। গরিব দুঃখী ঘরের মেয়ে—শীর্ণকায়, কতদিনের উপবাসের কত বড় দুর্ভাগ্য হলে এমন একটি পরিবারে শেষ পর্যন্ত আশ্রয় পায়। জেঠু ভেতর থেকে কাঁধটা সামান্য স্রাগ করে লম্বা প্যাকাটির মতো মুখ বার করে দিয়ে বলল, হ্যালো নানু। এসে গেছ। মাই লিটল চ্যাপ। ভিতরে চলে এসো। বসে পড়। লুডু খেলছি। কুটুর সঙ্গে। উড য়ু লাইক টু প্লে লুডু।
শোবার ঘরটিতে নানুর ঢুকতে সাহস হচ্ছে না। কারণ এক্ষুণি জেঠি বাজারে যাবে। সেদিন যা দেখেছে তাতে মনে হয়েছে, যাবার আগে জেঠি আজও শোবার ঘরে জীবজন্তুসহ তালা বন্ধ করে চলে যাবে। ফাঁক পেলে কে কখন জান মাল দুই তছরূপ করে নেবে সেই একমাত্র ভয়। তখনই ছোট ছোট কাপে চা নিয়ে এল সেই কিশোরী। নানু এত সকালে এসে উপস্থিত হবে হিসেবের বাইরে ছিল। দুখানা করে স্যাঁকা পাউরুটি এবং চা। নানু আসায় স্যাঁকা রুটির ভগ্নাংশ বেড়ে গেল। মেয়েটি একটা স্টিলের বড় থালায় চা সাজিয়ে এনেছে। এবং নানু দেখল, বড়ই জবু থবু হয়ে হাঁটছে মেয়েটি। ওর ফ্রকের পেছনটা একটা হিংস্র বাঘের থাবায় পড়েছিল বোঝা যায়। বাঘ না বাঘিনী এখনও নানু সেটা আন্দাজ করে উঠতে পারেনি।
জেঠি বলল, নানু চা নে। তারপর রুটির প্লেট এগিয়ে দিয়ে বলল, খা। তুই এত সকালে আসবি বুঝতে পারিনি। ঘরে মাখন ডিম আজই ফুরিয়ে গেল। আর তোমার জেঠু এমন জায়গায় বাড়ি করেছে যে যদি কিছু পাওয়া যায়। নানু জানে সবই মিথ্যা বাক্য। জায়গাটি জেঠিই পছন্দ করেছে—বাজার বেশি দূরেও নয়। সবই পাওয়া যায়। সে শুকনো রুটি একদম খেতে পারে না। অগত্যা চায়ে ভিজিয়ে তিনবারের মাথায় খেতে গিয়ে দেখল অভাগা রুটি সবটুকু চা শুষে নিয়েছে। এ—সব কারণেই নানু জেঠুর বাড়ি আসতে চায় না।
কুটু বলল, এই দাদা, খেলবে তো ঠিক হয়ে বস।
নানু বলল লুডু খেলছিস, পড়াশোনা নেই।
জেঠু বলল, আছে, পড়াশোনা আছে। তবে সকাল থেকেই বায়না, তুমি আসছ, সুতরাং পড়বে না। বললাম পড়বি নাত কী করবি? কুটু বলল লুডু খেলব। তাই লুডু নিয়ে বসেছি।
নানু বলল, খেলতে চাইলেই খেলতে দেবে। সময় অসময় নেই?
জেঠি বলল, আর বলিস না। কুটুকে নিয়ে আর পারছি না। একদম কথা শোনে না। কী যে হয়েছে!
নানু অগত্যা খাটে পা ঝুলিয়ে বসল। এবং একবার জেঠিকে বলবে ভাবল, যাবার সময় কিন্তু আজ আবার তালা মেরে যেও না। তোমার ঘরে এমন কিছু মহার্ঘ বস্তু নেই যা হারাবার। কারণ তুমি জীবনের সব কিছু আগেই হারিয়ে বসে আছ। বয়স বাড়বে, এখন পেটের আন্ত্রিক গোলযোগ, পরে সেটা বুকে উঠবে, শেষে মুখে—জীবনের সবটাই ব্যর্থতায় তোমার ভরা। আমার বাপকে দেখে শেখা উচিত ছিল জীবন কাকে বলে।
যাই হোক নানু শেষ পর্যন্ত লুডু খেলতে বসে গেল। জেঠি বাজারে যাবার আগে সেই কিশোরীকে ডেকে বলল, জল হলে ভাত বসিয়ে দিবি। মশলা বাটবি—জিরে ধনে লংকা আদা। চাবির রিংটা বটুয়াতে ভরে নিয়ে বের হবার মুখে বলল, ভাত বসিয়ে ঘরদোর ঝাঁট দিয়ে মুছে ফেলবি। পেছনে লেগে আমি কাজ করাব না। একদিন বললে শুনে রাখবি। সেই একদিন আজই কী না নানু বুঝতে পারল না। জেঠি গড় গড় করে বলেই যাচ্ছে, চায়ের বাসন ধুয়ে তুলে রাখ। ছাড়া সায়া শাড়ি জলে ধুয়ে দড়িতে ঝুলিয়ে দিবি। ক্লিপ এঁটে দিবি। গোনা গুনতি ক্লিপ বুঝিয়ে দিতে হবে। একটা যেন না হারায়। তারপর বের হবার মুখে বলল, বিকেলে কিছু গোবর কুড়িয়ে আনবি।
বাড়ির চারপাশে এখনও কিছু ফাঁকা মতো জায়গা আছে। সেখানে গোরু চরে বেড়ায়। অনায়াসে একটু হিসেবি হলে ঘুঁটে কিনতে হয় না। আর জেঠি বাজার থেকে ফিরে এসেই বলল, তাড়াতাড়ি মাছটা বসিয়ে দে। একটু চাটনি কর। এবং দশটা বাজলেই বলল, সব নামিয়ে রাখ। এই নে টাকা, রেশন নিয়ে আয়। তাড়াতাড়ি আসবি। তারপর কিশোরী মেয়েটির নাম ধরে বলল, লীলা প্লাসটিকের বালটিতা কোথায় রেখেছিস। খুব মৃদু শব্দ এল রান্না ঘর থেকে—আমি জানি না মাসিমা।
জেঠির ঝংকারে বাড়িটা মুহূর্তে কেঁপে উঠল, তুমি জান না তো কে জানে! আর কে এ—বাড়িতে খেতে আসে!
লীলা আর কিছু বলল না। নানুর কেন জানি এ—সময় কিশোরী বালিকাটির মুখ দেখতে ইচ্ছে হল। পৃথিবীতে কেন এরা জন্মায়, বড় হয়! কী দরকার এমন মুখ ঝামটা খাওয়ার। ওর বুকের মধ্যে কোনো জলছবির রং ধরা আছে কী না একবার প্রশ্ন করে জানলে কেমন হয়। চোখ দুটো বড়ই মায়াবী। একবার মাত্র নানুর দিকে সামান্য চোখ তুলে তাকিয়ে ছিল—বড়ই বিহ্বল চোখ। অবোধ। নানুর কেন জানি জেঠির গলা টিপে ধরতে ইচ্ছে হয়েছিল তখন।
তখনই কুটু বলল, আর খেলব না। তুমি পার না। বাবাকে বলল, তোমার কিছু হবে না বাবা। তুমি বার বার হেরে যাচ্ছ।
নানু বলল, হারলি তো তুই।
বাবার জন্য হারলাম।
নানু বলল, খেললি তুই আর হারলি বাবার জন্য।
তাই ত। বাবার গুটি বাঁচাতে গিয়েই তো দান নিলাম না।
অবনীশ বলল, তাই হয় নানু। তোমার মা চিঠি দিয়েছে তোমাকে?
দেয় মাঝে মাঝে।
আসবে লিখেছে?
আসতে পারে।
তোমার মাকে নিয়ে, তারপর কী ভেবে, অবনীশ সবটা শেষ করল না। স্ত্রীর নাম ধরে ডাকল। ও—ঘর থেকে তখন জবাব, অত চিল্লাচ্ছ কেন। বলতে হয় এখানে বলে যাও। অবনীশ সুড় সুড় করে উঠে গেল। তারপর ফিরে এসে বলল, তোমার মা এলে এখানে নিয়ে আসবে। ক—দিন এখানে থাকবে।
নানু বলল, দেখা যাবে। বলেই সে বাইরে বের হয়ে বারান্দায় পা দিতেই দেখল, জেঠি দরজায় দাঁড়িয়ে বিড় বিড় করে বকছে। —এতক্ষণ লাগে! ওখানে কী পাত পেড়ে খেতে বসেছিস। আজ একবার ফিরে আয় কত ধানে কত চাল দেখাচ্ছি। এক ফোঁটা জল রেখে যায়নি বাথরুমে।
নানু বলল, কখন তুলবে। এক দণ্ড তো বসে নেই।
জেঠি নানুকে যে—কোনো কারণেই হোক ভয় পায়। সেটা সেই বাবার আত্মহত্যাজনিত অপমান বোধ কী না নানু জানে না।
জেঠি খুব বিপদে পড়ে যাচ্ছিল নানুর কাছে। সুতরাং বিপদ থেকে ত্রাণ পাবার জন্য বলল, যাও চান সেরে নাওগে। কী করবে কপাল। জেঠির বাড়িতে এসেছ বেড়াতে, সেখানেও জল তুলে চান করতে হচ্ছে।
নানু জল তুলে চান টান করে বের হয়ে দেখল জেঠি দরজা হাট করে তেমনি দাঁড়িয়ে আছে। চোখ মুখ লাল। এবং মনে হচ্ছে, রাগে দুঃখে জেঠির এবার চুল খাড়া হয়ে উঠবে। বাথরুমে ঢোকার মুখে দেখেছিল, জেঠির খোপা বাঁধা। বের হয়ে দেখল, খোপা খোলা, এবং মনে হল কিছুক্ষণের মধ্যেই চুল পট পট করে দাঁড়িয়ে যাবে। নানু বুঝতে পারল, আজ লীলার কপালে খুবই দুর্ভোগ আছে। ঘণ্টা দেড়েক হয়ে গেল। কী করছে মেয়েটা?
এমন সময় লীলা চাল, চিনি, গম, তেল নিয়ে বাড়ি এল। আর অমনি জেঠি করালবদনী হয়ে গেল—লম্বা দুই হাত আরও লম্বা করে দিল, অনায়াসে লীলার বড় বড় চুল খামচে ধরল—তারপর টানতে টানতে ভিতরে নিয়ে সজোরে লাথি, মুখে পিঠে পায়ে—যেখানে যতটা সম্ভব লাথি চালাতেই নানু মাথা ঠিক রাখতে পারল না। বলল, এ—সব কী হচ্ছে!
জেঠু বলল, মাই লিটল চ্যাপ, তুমি মাথা গলিও না। সব এক সময় ঠিক হয়ে যাবে। সংসার এমনই জায়গা।
নানু বলল, তার মানে!
মানে ঝড় একদিক থেকে কেটে গেল। যে রক্ত তোমার জেঠির মাথায় উঠে গেছিল চড়াৎ করে তা সহজেই এবার স্বাভাবিক হয়ে আসবে। নইলে অনর্থ ঘটত। তোমার জেঠি হয়তো সংজ্ঞা হারাত। মাথায় রক্ত ওঠা বলে কথা।
নানু বসার ঘরে গুম মেরে বসেছিল। কারণ লীলার এই নির্যাতন তার মাথার মধ্যে কে আবার রেল গাড়ি ছুটিয়ে দিয়েছে। তার মনে হয়েছিল, জেঠুর তবে এই সংসার! জেঠুর এই হেনস্থা দেখে তাজ্জব। জেঠুর সামনে লীলাকে এত মারধোর করতে সাহস পায় কী করে! জেঠুকে বিন্দুমাত্র সমীহ করেন না মহিলা বোঝাই যায়। জেঠির সঙ্গে জেঠুর একদা প্রেম হয়েছিল—কেমন সব অবিশ্বাস্য ঠেকে। কুটু আস্তে আস্তে তোয়ালে নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল। কেউ আর কোনো কথা বলছে না। লীলা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে রান্না ঘরে একটা আহত জন্তুর মতো ঢুকে গেল। একটুও কাঁদল না। বাড়িটা এখন ঠান্ডা। জেঠি খাটে বসে হাঁপাচ্ছিল বোধ হয়। এবং লোডশেডিং বলে, জেঠু পাখা খুঁজছে। সংসার এত বিরক্তিকর—জেঠু বলল, এই লীলা পাখা কোথায়? কোথায় যে সব তোরা রাখিস! কুটু বাথরুমে মাথায় জল ঢালছে—কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। নানু তখন চিৎকার করে বলল, পাখা দিয়ে কী হবে?
জেঠু বলল, বাতাস!
নানু বলল, কাকে?
অবনীশ বলল, তোমার জেঠিকে। কেমন করছে দেখে যাও।
নানু বলল, তুমি দেখ। আমার দেখে কাজ নেই।
অবনীশ বড়ই একা। সে পাখাটা দেখল খাটের ও—পাশে পড়ে আছে। টেনে আনল পাখাটা। তারপর হাওয়া করতে লাগল। বোঝাতে থাকল—তুমি কেন মিছিমিছি মাথা গরম করো বুঝি না। মাথা গরম করলে কার ক্ষতি। তোমার না লীলার।
নানুর মুখে তখন কূট হাসি খেলে গেল। —জেঠু তাহলে তোমার এই সংসার। এই জীবন। জেঠু লীলাকে মুখ দেখাতে ফের তোমার লজ্জা হবে না! আমার কিন্তু হবে। এমন অসহায় একটা মেয়ের ওপর নির্যাতন করো তোমরা! তোমাদের ফাঁসি হওয়া উচিত না! বল, বিচারে তোমাদের কী কী শাস্তি প্রাপ্য। অথচ সে একটা কথা বলতে পারছে না। নবনীতা যদি জানে, তার পরিবারে এসব হয়, একজন অসহায় মেয়ের ওপর নির্যাতন হয়—কী ভাববে!
এত স্বার্থপরতা মানুষের মধ্যে থাকলে লীলারা যাবে কোথায়! কী সুন্দর চোখ মেয়েটার। নিরীহ নিরপরাধ। সে সহসা ডাকল, লীলা লীলা।
তারপরই ভাবল সে এটা কী করতে যাচ্ছে।
নানুর মাথার মধ্যে রেলগাড়ি চলছে! নানু বারান্দা পার হয়ে গেল। দেখল, জেঠু পাখায় বাতাস করছে। সে দাঁত শক্ত করে ফেলল। এবং রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বলল, লীলা তোমার এত দেরি কেন?
লীলা জবাব দিল না।
কেন এত দেরি? বল। চুপ করে থাকলে কেন?
অবনীশ তাড়াতাড়ি পাখা ফেলে ছুটে এল—কী হচ্ছে নানু। তুমি আবার কী আরম্ভ করলে!
নানু শান্ত গলায় বলল, জবাব না দিলে, লীলাকে আমি খুন করব।
পুলিশ আসবে নানু।
যা হয় হবে।
অবনীশ বলল, লীলা বলে দে মা। কেন নানুকে রাগাচ্ছিস, জানিস ত এ—বাড়িতে রাগলে মাথা কার ঠিক থাকে না।
তখন লীলা বলল, দাদাবাবু লাইনে অনেক লোক ছিল। না দিলে আসি কী করে।
অবনীশ বলল, নে এবারে যা লীলা বলেছে, লাইন পড়েছিল লম্বা। আসে কী করে! আর ওর দোষ কী বল! সমাজে শোষণ নানাভাবে চলছে। ফেরেববাজ না হলে এ—দেশে নেতা হওয়া যায়! সুস্থ মস্তিষ্কের লোক কটা আছে। আয় এবার।
নানু হাত ছাড়িয়ে নিল, তারপর বলল, লীলা তুমি কেন এখানে মরতে এসেছ।
লীলা চুপ।
অবনীশ কেমন হতবাক।
জেঠি উঠে বসেছে।
লীলা আজই তুমি চলে যাবে।
অবনীশ চিৎকার করে উঠল, নানু তোর সত্যি মাথা খারাপ হয়ে গেছে।
নানু ফের বলল, লীলা আজই তুমি চলে যাবে।
লীলা ঘরের কোণ থেকে জবাব দিল, কোথায় যাব দাদাবাবু।
নানু আর একটা কথা বলতে পারল না। সে কিছুক্ষণ বিমূঢ়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকল। সত্যি তো কোথায় যাবে? মেয়েটির যাবারও জায়গা নেই। সে সোজা বসার ঘরে ঢুকে পায়চারি করতে থাকল। সমস্ত পরিবারটাকে তার এ—সময় পুড়িয়ে মারতে ইচ্ছে হচ্ছিল। কুটু, কুটু বড় ভালো মেয়ে। দরজায় দাঁড়িয়ে বলছে, দাদা আয়। খাবি না।
কুটুর কথার মধ্যে কী যেন আশ্চর্য নিরাময়ের সঞ্জীবনী সুধা ছিল। নানুর মাথার মধ্যে ফলে রেলগাড়িটা আর চলছে না। কুটুকে সে কাছে ডেকে আদর করল। এক মাথা চুল, মিহি উলের বলের মতো। সে মাথার চুল এলোমেলো করে দিল কুটুর। তারপর ভাবল, কুটু বড় হলে যদি তার মার মতো, জেঠির মতো হয়ে যায়। সে কুটুকে বলল, চল আমরা কোথাও চলে যাই।
বিকেলে নানু দেখল সবাই ঘুমিয়ে আছে। সে বসার ঘরে শুয়ে ছিল। কুটুকে নিয়ে ওর বাবা মা দরজা বন্ধ করে ঘুমচ্ছে। লীলা রান্নাঘরেই বোধহয় সব সময় থাকে। খাওয়া শোওয়া সব তার ও—ঘরে। লীলার কোনো সাড়া—শব্দ সে পাচ্ছিল না। তাছাড়া কেন জানি লীলার কথা ভেবে আশ্চর্য এক দুঃখ বোধে সে নিরন্তর পীড়িত হচ্ছিল। সংসারে মানুষের যে কত রকমের দুঃখ। এক সময় সে ডাকল, লীলা আমাকে এক গ্লাস জল দেবে।
মুহূর্তের মধ্যে দেখল, লীলা দরজায় এক গ্লাস জল হাতে দাঁড়িয়ে আছে। সে বলল, ভিতরে এসো।
লীলা সন্তর্পণে ঢুকে জল এগিয়ে দিল।
নানু বলল, বোস।
লীলা দাঁড়িয়েই থাকল।
নানু বলল, তোমার কে কে আছে?
লীলা কিছু বলল না।
নানু পকেট থেকে কিছু এক টাকার নোট বের করে বলল, তোমার কাছে রাখো। ভালো মন্দ খেতে ইচ্ছে হলে খাবে। আর মাইনে পেলে শাড়ি কিনে নেবে। তোমার আর ফ্রক পরে থাকা ঠিক না।
লীলা কী—বলতে গিয়ে বলতে পারল না!
নানু অভয় দিয়ে বলল, বল ভয় কী!
আমার টাকা নেই দাদাবাবু। সব টাকা মাকে পাঠিয়ে দেয় মাসিমা।
তোমার মা আছে তা হলে?
লীলা আবার তেমনি চুপ।
তুমি বললেই পারো, কাজ করো তুমি, টাকা তোমাকে দিতে হবে।
লীলা চারপাশে ভালো করে তাকিয়ে বলল, দাদাবাবু দোহাই ও—সব কথা বলবেন না। মাসিমা শুনতে পেলে আমার আর রক্ষে থাকবে না। মার সঙ্গে ওই কড়ারে আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে।
নানু বলল, ঠিক আছে। তুমি যাও।
লীলা চলে যাচ্ছিল। নানু ফের ডাকল, টাকা কটা নিয়ে যাও।
না দাদাবাবু, মাসিমা জানতে পারলে আমাকে আস্ত রাখবে না।
ধুস তোমার মাসিমা। যা বলছি করো।
দোহাই দাদাবাবু।
লীলা কেমন পাথর হয়ে যাচ্ছে। ওর ছেঁড়া ফ্রক গায়ে, চুল কোমর পর্যন্ত।
নানু বলল, কাল আসব। তোমার সায়া শাড়ি কিনে আনব। তোমাকে পরতে হবে। লজ্জা করে না পুরুষের সামনে তোমার বের হতে।
লীলা এবার ভেউ ভেউ করে কেঁদে দিল। —দাদাবাবু, তুমি ভগবান।
নানু বলল, গুলি মার ভগবানকে।
তারপর নানু ভগবানকে সত্যি গুলি মেরে উঠে পড়ল। লীলা চলে যাচ্ছে—আবার সেই রান্নাঘরে কিংবা দাওয়ায় বসে থাকা—নিরপরাধ এই কিশোরীর জন্য নানু আজ এই প্রথম ভারি মায়া বোধ করল।
তেরো
ঠিক দুপুরে খাওয়ার পর প্রিয়নাথের সামান্য দিবানিদ্রার অভ্যাস। শুলেই ঘুম আসে না। দোতলার ঘরটা ওর খুবই নিরিবিলি। কাকলি এ সময় নিজের ঘরে বসে ছবি—টবি আঁকে। অথবা খুব মৃদু শব্দ বাজে রেডিয়োর। হরলিক্সের আসর বোধহয় শুনছে। ঘড়ির কাঁটার মতো একটা শব্দ এবং কিছু প্রশ্ন, প্রশ্নগুলি কাকলি শুনে নিজেই একটা জবাব খাড়া করে রাখে। আজকালকার ছেলেমেয়েদের জন্য কত রকমের প্রোগ্রাম করে থাকে রেডিয়ো। এবং এ—বাড়িতে প্রয়োজন কাকলিরই সবচেয়ে বেশি। তিনি অবশ্য সাড়ে সাতটার খবর নিবিষ্ট মনে শোনেন। যেন আজকালকার মধ্যেই কোনো বিপজ্জনক খবর আবার রেডিয়োতে ভেসে আসবে। কোথাও কিছু একটা হচ্ছে। যেন সব ভেঙে চুরমার করে দেবার জন্য কারা গোপনে প্রস্তুত হচ্ছে। তার বুক কাঁপে। পাশে ধর্মজীবন বাবাজীর আশ্রম আছে। সন্ধ্যায় সেখানে গীতাপাঠ, রামায়ণ পাঠ এবং ধর্মাধর্মের ওপর নানারকম আলোচনার সুবন্দোবস্ত আছে। বুড়ো মানুষদের জন্যে খুবই জরুরি এটা, তিনি অন্যমনস্ক থাকার জন্য কিছুটা সময় সেখানে অতিবাহিত করেন। কত রকমের বয়সের ছাপ মারা মুখ। যৌবনে ওরা কতটা তেজি ঘোড়া ছিল মাঝে মাঝে ভাববার চেষ্টা করেন। কত রকমের যে সংকট শরীর বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে দেখা দেয়। একটা বয়সের পরে আবার তা নিভে আসে। এবং তখন সেই যে বলে না প্রকৃতির কূটবুদ্ধি অথবা নির্জনে তার খেলা—মানুষ টেরও পায় না, অহরহ রক্তে মাংসে মজ্জায় এবং স্নায়ুতে কী তুমুল তুফান তুলে পালের দড়িদড়া ছিন্ন—ভিন্ন করে দিচ্ছে। এবং ওই সময়টাতে জীবনের সঠিক অর্থ কী, জীবন কী, জীবন মানে তো মাটির হাঁড়ি কলশি নয়, ভেঙে গেলেই অকেজো হয়ে যাবে—এবং দেখেছেন যত ভেঙে যায়, তত তার তেজ বাড়ে এবং তখন এক অন্যমনস্ক বৃদ্ধের ছবি এবং মৃত্যু ভয়। অদৃশ্য অস্পষ্ট অন্ধকারের ভয়। দিন যত যাচ্ছে ভয়টা তাকে ক্রমশ শিথিল করে দিচ্ছে। পুত্রের নিহত হওয়ার ঘটনা খুব একটা আর ভাবায় না! স্ত্রী গত হয়েছে দেড় দু—যুগ আগে। মাঝে মাঝে স্বপ্নে এক বালিকার ছবি দেখতে পান। সে বেণী দুলিয়ে হেঁটে যায় তাঁর পাশে।
বাবা আপনার জল।
প্রিয়নাথ বসে থেকেই জলটা খেলেন।
তোমার এখনও খাওয়া হয়নি!
এই হয়ে যাবে। আপনি শুয়ে পড়ুন না।
ভানু চলে গেল।
যায়নি। ও ঘরে আছে। পত্রিকা পড়ছে।
ওকে বল, যেন চলে না যায়। ওর সঙ্গে খেলা শেষ হয়নি। একটু গড়াগড়ি দিয়েই লড়ব।
মন্দাকিনী সামান্য হাসল। বলল, বলব।
প্রিয়নাথ জানে এ বাড়িতে এই যুবক কত প্রয়োজনীয়। খুব কম বয়স থেকেই এটা তার চরিত্রের দোষ বা গুণ যাই—ই বলা যাক—দুঃখ—টুঃখ একদম দু’চোখের বিষ। শোকতাপকে আমল দেওয়াই মানুষের অনুচিত।
এ—জন্য ভেতরের প্রাচীন মানুষটার সঙ্গে সংঘর্ষ বেধে যায় মাঝে মাঝে। তখন প্রিয়নাথ কিছুটা নির্মোহ হয়ে পড়েন। এই নির্মোহ স্বভাবের জন্যেই সে অনায়াসে নীরজার সঙ্গে কিছুটা পাপে লিপ্ত হতে পেরেছিল। এই নির্মোহ স্বভাবের দরুনই বিধবা পুত্রবধূর সামনে একজন যুবকের উপস্থিতি আদৌ কষ্ট দেয় না। প্রাচীন মানুষটা ভেতর থেকে বের হয়ে আসতে চাইলেই থাবা মেরে বসিয়ে দেন। বলেন, তুমি বুড়ো জান না, কিছু বোঝো না, বাইরের কেলেঙ্কারির চেয়ে এটা অনেক ভালো। ও—বাড়ির সঙ্গে দীর্ঘদিনের সখ্যতা। ভানু আগেও এ—ভাবেই চলে আসত, থাকত, দাবা খেলত, সেই রেওয়াজটাই আছে। একজনের মৃত্যুতে কিছুই ব্যতিক্রম হয়নি।
এবং শুয়ে পড়ে চোখ বুজলেন প্রিয়নাথ। সামাজিক সম্মান—বোধটাই ওকে বেশি তাড়া করে। মন্দাকিনীর যা বয়েস ধরে রাখা যেত না। ভানু থাকতে বয়েসটা বাড়িয়ে দিতে পারলে ফ্রন্টে কিছুটা সুবিধা মিলতে পারে। যদ্দিন চলে চলুক। প্রিয়নাথের হাই উঠছিল। যা রেখে যাচ্ছেন তাতে দুটো
প্রাণীর হেসে খেলে চলে যাবে। কাকলির দুষ্টু দুষ্টু গলা এখন আর পাওয়া যাচ্ছে না। মেয়েটা কী ঘুমিয়ে পড়ল! এবং প্রিয়নাথ ভুলে গেছেন একটা শো দেখার কথা আছে কাকলির। কাকলি এবং তার ক্লাশের বান্ধবীরা মিলে কোথায় যেন একটা বাচ্চাদের ফিল্ম দেখতে যাচ্ছে। স্কুল থেকে নিয়ে যাচ্ছে। সুতরাং কিছুটা নিশ্চিন্তে দিবানিদ্রায় মগ্ন হওয়া যায়। তিনি পাশ ফিরে শুলেন। হাতটা মাথার কাছে। পা দুটো ভাঁজ করে শুয়েছেন।
মন্দাকিনী দুটো শব্দ একই সঙ্গে পেল।
কাকলি বলল, যাচ্ছি মা। ভানু কাকা যাচ্ছি। তুমি কিন্তু চলে যাবে না। কথা আছে।
ভানু বুঝতে পারে না মেয়েটা এমন সব কথাবার্তা শিখল কার কাছে! কথা আছে বললেই যে কিছু আড়াল আবডাল, কিছু সংশয়, কিছু লজ্জা মিশে থাকে মেয়েটা বোঝে না।
শ্বশুরমশায়ের নাক ডাকছে, মন্দাকিনী ঘরের দরজা অতিক্রম করার সময় টের পেল।
তখনই দ্রুত এক জলতরঙ্গ বাজনা সারা শরীরে খেলে যায় মন্দাকিনীর, শরীর কাঁপে থর থর করে। কানে কেমন ঝোড়ো হাওয়ার শব্দ। এমন নির্জন বাড়ি যে মনে হয় মন্দাকিনী বেশিদূর এগোতে পারবে না। সামান্য আওয়াজই ভয়ংকর শোনাবে। সে ওই ভানু নামক যুবকের ঘরে তখন পা টিপে টিপে হেঁটে যেতে চায়। অথচ কোথায় কী ভাবে যে কিছু প্রবল বাধা থাকে, ভানুর ইচ্ছে কী, কেন এ—বাড়িতে পড়ে থাকতে ভালোবাসে সব টের পেয়েও মন্দাকিনী জল খায় ঢক ঢক করে। শুনিয়ে শুনিয়ে জল খাচ্ছে। খাবার পর, কিছু সময় পার করে সে অনেকটা খায়। বারান্দায় দাঁড়িয়ে বেশ আয়াস ও তৃপ্তির সঙ্গে খায়। যেন জানান দিচ্ছে, হয়ে গেল।
জানালার পর্দা ফেলা। মন্দাকিনী করিডোর ধরে হেঁটে গেল। ভানু মরার মতো চোখ বুজে পড়ে আছে। কে বলবে বাইরের পৃথিবীতে ট্রাম বাস গাড়ি ঘোড়া এবং স্টেশনে বানভাসি জলে মানুষ উঠে আসে? অথবা কোথাও বড় রাজনৈতিক ঝড়, ভিয়েৎনামে অনেক রক্তপাত, লিবিয়া নামক একটা দেশ আছে কে বলবে! এবং বারান্দায় ছায়া ছায়া কিছু নড়ছে। ওদের কোনো কথা হয়নি, ওরা দুজনই একটা বিষয়ে এতদিন পরও ফয়সালা করতে পারেনি, কতটা এগোনো দরকার! একজন পুরুষের সান্নিধ্য উষ্ণতা দেয়, কিন্তু নিকটবর্তী হয়ে প্রপাতের জলে ডুবে যাওয়া এখনও হয়ে ওঠেনি। অথবা তেমন একটা সুযোগ হয়ে উঠছে না। আজ যেন সবাই মিলে একটা সুযোগ করে দিয়েছে দুজনকে। কাকলি চলে গেল। প্রিয়নাথকাকার নাক ডাকছে। এবং বাড়ির রান্নার মেয়েটির কামাই। করিডরে আর পায়ের শব্দও শোনা যাচ্ছে না।
ভানু জোরে হাই তুলল। সে জানান দিল, ঘুম আসছে না।
মন্দাকিনী দেয়ালে ভর করে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।
ও—ঘরে প্রিয়নাথের নাক ডাকছে বাঘের মতো। যেন প্রলয়ঙ্কর ঝড়ে পড়ে সব জন্তু জানোয়ার ছুটোছুটি লাগিয়েছে।
ভানু ঘাড় তুলে দেখল পর্দা ফেলা দরজার। নিচে ঠিক রেলিঙের কাছে প্রিয়নাথের বেড়ালটা থাবা চাটছে।
মন্দাকিনীর পা কাঁপছিল। দাঁড়াতে পারবে না মনে হচ্ছে। এ—ভাবে শরীর অসাড় হয়ে যায় কোনোদিন টের পায়নি। এমন একটা দুপুর বিকেলের মাঝামাঝি সময়ে শরীরে এটা যে কী হচ্ছে!
মন্দাকিনী ভাবল ঘরে ঢুকে ঠেলা দিয়ে ঘুম ভাঙিয়ে দেবে। কী মানুষ রে বাবা! কিছু বোঝে না। গাছের চারপাশে বেড়া না থাকলে গোরু ছাগল তো খাবেই। মন্দাকিনী নানাভাবে নিজেকে দমন করতে চাইছে।
তখন নিচে বাতাবি লেবু গাছটায় দুটো চড়ুই কিচির মিচির করছে। এবং একটা আর একটাকে তেড়ে যাচ্ছে। প্রকৃতির কূটখেলা পাখি দুটোর ভেতরে জেগে উঠছে। মন্দাকিনী আর সত্যি পারছে না।
সে না পেরে ভাবল, নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়বে। সে উপুড় হয়ে মৃত স্বামীর জন্য কিছুক্ষণ কাঁদবে ভাবল। আশ্চর্য কোনো দুঃখেই সে ব্যথাতুর হতে পারছে না। এমন কেন হয়। সে যেন বলল, ঈশ্বর আমি এটা চাইনে! আমি ভালো থাকতে চাই। কিন্তু শরীরে যেন রক্তপাত হচ্ছে। তারপরই মনে হল এটা পাপ। পাপ পাপ! সে দুবার পাপ কথাটা উচ্চারণ করল। তারপরই মনে হল, সুখ সুখ। সে দুবার সুখ কথাটা উচ্চারণ করল।
তারপরই আবার ভেতর থেকে কে কথা কয়ে উঠল, সুখই পুণ্য। তাকে অবহেলা করতে নেই। সে ফের উচ্চারণ করল, এটাই আমার পাপ, এটাই আমার পুণ্য।
চোদ্দ
রমা দাঁতে ঘাস কাটছিল। সে ভীষণ রকমের উজ্জ্বল সাদা সিল্ক পরেছে। শরীর ভালো করে ঢেকে বসেছে। পায়ের কাছে অরুণ, লম্বা হয়ে শুয়ে আছে। স্কুটারটা রাস্তার পাশে দাঁড় করানো। নীল রঙের স্কুটারে কোথা থেকে একটা শালিক পাখি উড়ে এসে বসেছে। শেষ জ্যৈষ্ঠের খাঁ খাঁ দুপুর। মাঠে গভীর নলকূপ থেকে জল উঠছে। ভট ভট শব্দটা প্রকৃতির ভেতর বে—আক্কেলে জোতদারদের মতো যেন হাঁকছে কেবল। আর মাটি যত ভিজে যাচ্ছে চাষ—আবাদের নিমিত্ত সব চাষীরা তত লাঙল ঢুকিয়ে দিচ্ছে অভ্যন্তরে। সে ঘড়ি দেখল। কিছুতেই ঘড়ির কাঁটা চারটেয় এসে থমকে দাঁড়াচ্ছে না। এখন উঠতে হবে। কিছু খুনসুটি করেছে রমার সঙ্গে। এবং রমাকে সে উত্তপ্ত করতে চেয়েছে। সকাল থেকেই বুঝি রমা টের পেয়ে গেছে, ভয়ে রমা ঠান্ডা মেরে যাচ্ছে ক্রমশ।
সে বুঝিয়েছে, কীসের এত ভয় বুঝি না।
রমা বলেছে, তুমি অরুণ, মেয়েদের কী ভয় বুঝবে না।
আজকালকার তুমি কিছু খবর রাখ না রমা!
একটা বালিকাও তো জানে, কীসে কী হয়। আমি রাখব না কেন। তবে তুমি নিজের দিকটা দেখছ অরুণ।
এত সব তবে কী দরকার ছিল। আগে বললেই পারতে।
আমি কী জানি, সত্যি তুমি একটা জায়গা ঠিক রেখেছ।
না, মনে হচ্ছে, ঘরে বউ আছে বলে তুমি আমাকে পর পর ভাবছ।
পর পর ভাবতে পারছি না বলেই তো যত কষ্ট। তুমি এলেই স্নায়ুতে তোলপাড় আরম্ভ হয়ে যায়। ঘরে তোমার কে আছে কিছুই মনে থাকে না।
থাক তবে। বরং চল, বাড়িতেই রেখে আসি তোমাকে।
সেই ভালো ছিল। কিন্তু ফিরলে মা ঠিক ভাববেন, তোমার সঙ্গে আমার ঠিক বনিবনা হচ্ছে না। ওরা কষ্ট পাবেন।
রমা বলতে পারত কত রকমের সংকট অরুণ এক জীবনে। ফিরে গেলেই মা বাবা অস্থির হয়ে উঠবে। মানুর জন্যে এমন একটা দামি চাকরির তুমি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছ, আমিই হেতু, আমার কথা তোমার কাছে দিব্যজ্ঞানের মতো—সেটা হারাতে ওরা রাজি নয়। ওরা টের পায়, তুমি আমার কতটুকু ক্ষতি করতে পার। ওরা সব জেনেও চুপচাপ আছে। সংসারে সুখ ব্যাপারটা ভারি দরকার। আমার কাছে অবশ্য এটা খুব অন্যায় ঠেকছে।
তারপর থেকেই দুজনে চুপচাপ। প্রায় ঘণ্টাখানেক লেগে যাবে শহরে ফিরতে। কোথাও কোনো রেস্তোরাঁয় যাবে, তারপর কোনো ঘরে, সাদা বিছানা এমনই সব কথা হতে হতে রমা দু’হাটুর মধ্যে মাথা গুঁজে দিয়েছে। দুজনই খাওয়ার কথা যেন ভুলে গেছে। আগে একটা ফয়সালা হওয়া দরকার। অরুণ রমাকে ঠিক বুঝতে পারে না। রমা কিছুটা আস্কারা না দিলে সে সাহস পেত না। সেই রমাই গাছের নিচে বসে কেমন সতী—সাধ্বী হয়ে গেল। আসলে প্রকৃতি উদার, উদাস। বাধা বন্ধন না মানার কথা শেখায়। কিন্তু সে কোন প্রকৃতির কোলে উঠে এসেছে! সামান্য পাপবোধ সেও অনুভব করে থাকে। কিন্তু শরীরটা তো ব্যাকরণ নয়, যে নির্দিষ্ট সূত্র ধরে এগোবে।
এবং তার এতটা উদ্যম বিনষ্ট হতে যাচ্ছে ভেবে মুখ কালো করে রেখেছে। কমল এবং তার বউ গোপালপুরে গেছে। ফ্ল্যাটের চাবি দিয়ে গেছে ওকে। ফ্ল্যাটটা ক’দিন ওর জিম্মায় থাকবে। চাবিটা দিয়ে যেত না। কিন্তু কমলের বোন এবং ভগ্নিপতির আসার কথা। ওদের টিকিট কাটা, এবং ফ্যাসাদেই পড়ে গেছিল। চাবিটা অরুণ রাখতে রাজি হওয়ায় খুব সুবিধে হয়েছে। ওরা চিঠিতে জানিয়ে দিয়েছে, অফিসে অরুণ নামক একজন সেলস অফিসারের কাছে চাবি রেখে যাচ্ছে। দরকার মতো যেন নিয়ে নেয়। এবং এমন সুযোগ রমা হাতছাড়া করবে সকালেও ঘুণাক্ষরে টের পায়নি। সুতরাং আর কোনো কথা বলার ইচ্ছে হল না রমার সঙ্গে।
তাহলে ওঠো। ফিরব।
রমা উঠে দাঁড়াল। চোখ মুখ থমথম করছে অরুণের। তাকানো যাচ্ছে না। ভারি কষ্ট ভেতরে বুঝতে পারছে। ভারি বেচারা মনে হচ্ছে অরুণকে।
রমার কেমন কষ্ট হল মুখটা দেখে। সে বলল, চল!
তাড়াতাড়ি খেয়ে নেব কোথাও।
সেই ভালো।
তোমাকে বাড়িতে পৌঁছে দেব, না নিজেই ট্যাক্সি করে চলে যাবে?
সে দেখা যাবে।
গাড়ি স্টার্ট দেবার সময় বলল, খুব খারাপ মানুষ আমি না?
খারাপ ভালো বলিনি তো।
যাইহোক, শেষ পর্যন্ত অনিষ্ট কিছু ঘটল না।
এতে আবার শরীরে অনিষ্ট হবার কী আছে বুঝি না।
অরুণ এবার কেমন চিৎকার করে বলতে চাইল, তবে তুমি কী চাও? সে দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে সামলে নিলে। তারপর বাতাসে ভেসে যাবার মতো গাড়ি ছেড়ে দিল।
ওরা কেউ আর একটা কথা বলল না।
খাবার অর্ডার দিয়ে দুজনেই দুদিকে তাকিয়ে থাকল।
রমা মাঝে মাঝে অবশ্য চোখ ঘুরিয়ে দেখছে। কালো ট্রাউজার, চেক—কাটা বুশ শার্ট পরণে পুরুষ মানুষটা কেমন দুঃখী বালকের মতো মুখ করে আছে। তার ঘুড়ি কেটে গেছে মনে হয়।
কাউন্টারে চাইনিজ মেয়েটি বসে দাঁত খুঁটছে। একজন মোটা মতো চাইনিজ ভদ্রলোক উবু হয়ে ফিস ফিস গলায় কথা বলছে। একটা ষণ্ডা মতো মানুষ কোণার টেবিলে গিয়ে বসল। ও—পাশের কেবিনের ভেতর দু’জোড়া পা দেখা যাচ্ছে! একজন পুরুষের এবং একজন যুবতী—টুবতী হবে। তবে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। পায়ের পাতা থেকে শাড়ি মাঝে মাঝে উঠে যাচ্ছিল।
রমা ন্যাপকিন বিছিয়ে নিল হাঁটুর ওপর। অরুণের দিকে একটা প্লেট এগিয়ে দিল। খাবার স্পৃহা দুজনের কারও আছে বলে আর মনে হচ্ছে না। অরুণ চামচ দিয়ে সামান্য নেড়ে চেড়ে একটু ঝোল ঢেলে নিল।
খাওয়া হয়ে গেলে রমা বলল, দেখি বিল।
বয় বিল নিয়ে এলে অরুণ পার্স বের করল।
আমি দিচ্ছি। রমা ব্যাগ থেকে টাকা বের করতে গেল।
অরুণ ঠান্ডা গলায় বলল, না।
একদিন না হয় আমি দিলামই।
কী দরকার। সে তিনটে দশ টাকার নোট বের করে দিল। আইসক্রিমের সুগন্ধ এখনও নাকে লেগে আছে তাদের।
তুমি রাগ করছ কেন?
কোথায় রাগ দেখলে। সে খুব আস্তে আস্তে বলল শুধু, সত্যি, বোকা মনে হচ্ছে নিজেকে।
কথাটা ভেতরে গিয়ে কেন যে বিঁধল রমার। সে বলল, আমিও তো কম যাই না। তোমার কী দোষ? তারপর গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বলল, অরুণ, তুমি বুঝবে না।
এতে আর বোঝাবুঝির কী আছে?
আছে বইকি? আমি কি পাথর, আমার কি শরীরে কিছু নেই! আমার কি ইচ্ছে টিচ্ছে বলে কিছু নেই!
অরুণ উঠে দাঁড়াল। সিগারেট জ্বালল। তারপর বের হবার সময় বলল, বার বার মনে হচ্ছে রমা, নিজেকে শুধু অসম্মান করে গেছি। অমলাকে অসম্মান করেছি। তুমি সেই মজাটা কতদূর পর্যন্ত গড়াতে পারে কেবল চোখ মেলে সেটাই দেখতে চেয়েছ। কাজের সময় চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছ, এটা ঠিক না।
অরুণ রাস্তায় নেমে আরও কেমন ক্ষেপে গেল। বলল, ন্যায় অন্যায় বোধটা আমারও কম নেই রমা। তবু বুঝি মানুষের অসুখটা ভেতরেই আছে। সে কিছুতেই নষ্ট হতে না পারলে শান্তি পায় না। তোমার ধারণা কিছু হলেই পবিত্রতা নষ্ট হয়ে যায়। সেটাতো আমার দিক থেকেও হতে পারে। তুমি আমার চোখ খুলে দিয়েছ।
রমা মাথা নিচু করে রেখেছে। রোদ্দুর। ভীষণ গরম। এই রোদ্দুর এবং দাবদাহ ওদের বিন্দুমাত্র বিচলিত করছে না। একটা কঠিন সংকটের মুখে ওরা পড়ে গেছে এখন।
বরং আমারই বেশি ক্ষতির সম্ভাবনা। তুমি তো যে—কোনো দিন শরীর পবিত্র আছে বলে, নতুনভাবে জীবন গড়ে ফেলতে পারবে। আসলে আমি তো তোমার মনের মানুষ না। আর তুমিও জানো আমরা যত দূরেই যাই না কেন একটা বিন্দুতে গিয়ে কখনো আমরা মিলতে পারব না। অমলা তো কোনো দোষ করেনি।
রমা বলল জানি।
সহসা অরুণের মনে হল সত্যি সে একজন অপরিচিতার সঙ্গে কথাবার্তা বলছে। রমার মুখ কঠিন থমথমে। সে কেমন ভয় পেয়ে গেল। বলল, চল, দিয়ে আসি, ওঠো।
রমা পিছনে বসতেই কী যে হয়ে যায়—সেই এক সুমধুর সমীরণে যেন ভেসে যাচ্ছে। পাশের একটা দোকানে আশ্চর্য মিউজিক বাজছে। মিউজিক বাজলে ভেতরে রক্তের ঝড়টা প্রবল হয়ে ওঠে। সে বুঝতে পারছিল, ভয়ংকর অবমাননায় অরুণ কাতর হয়ে পড়েছে। একজন পুরুষের এমন উদার এবং নিবিষ্ট আপ্যায়ন সে কেন যে কিছুতেই ঠেলে ফেলতে পারছে না। ভেতরটা কেমন অবশ অবশ লাগছে। ঘুম পাচ্ছে মতো। যা হয় হবে। জীবনটা তো সত্যি ব্যাকরণ নয়। সে বলল, অরুণ আমি যাব।
নিয়ে তো যাচ্ছি।
তোমার সেই ফ্ল্যাটে যাব!
অরুণের ভেতরটা সহসা বিদ্যুৎ চমকের মতো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
সে বলল, সত্যি বলছ রমা। সত্যি।
রমা কিছু বলল না। কেবল মুখটা পিঠে ঘসে দিল অরুণের। অরুণ আবার বাতাস কাটিয়ে বের হয়ে যেতে থাকল। অতীব অকিঞ্চিৎকর, জীবনের অন্য সব কিছু—নতুন গ্রহ সন্ধানের মতো মনে হচ্ছে রমার সবকিছু। সে ভেসে যাচ্ছে, রমা ধরে রেখেছে, কেমন এক গোলকধাঁধার ভেতর মাথাটা দুলে উঠছে তার। তখনই মনে হল তার, কিছু টুকিটাকি জিনিস সঙ্গে নেওয়া দরকার। সে বাইক ঘুরিয়ে দিল সাঁ করে।
পনেরো
রাসবিহারী সান্ধ্য ভ্রমণ সেরে বাড়ি ফিরে দেখলেন, কেমন নির্জন এবং ফাঁকা বাড়িটা। বাইরের বাগান থেকে নিধু খুরপি কোদাল তুলে নিয়ে যাচ্ছে কলতলায়। কেউ আলো জ্বালেনি বাড়ির। হেম কিংবা মিতার তো যাবার কথা নেই কোথাও। দরজা জানালাও সব হাঁট করে খোলা। তিনি প্রথমে দরজার ভেতরে ঢুকে নিজের ঘরের আলো জ্বেলে দিলেন। তারপর লাঠি এক পাশে রেখে বেশ জোর গলায় ডাকলেন, মিতা মিতা। কোনো সাড়া নেই। নানু এখনও ফিরে আসেনি। অবনীশ কি নানুকে থেকে যেতে বলেছে! নাদন কী আবার এ—বাড়িটায় এসেছিল। মিতা কি নাদনের সঙ্গে কোথাও গেছে। তিনি এটা পছন্দ করেন না। মিতা বাবার পছন্দ অপছন্দের দাম দেয়। বাবা অপছন্দ করে বলেই একসময় রাসবিহারী দেখেছেন, নাদন এ বাড়িতে আসা কমিয়ে দিয়েছে। মিতা বলতেও পারে নাদনকে, তুমি আর আমাদের বাড়িতে এসো না। বাবা তোমার আসা পছন্দ করেন না। সেই মেয়েটাও নেই। তিনি বুঝতে পারছেন বয়স যত বাড়ছে তত সংকট চারপাশ থেকে ঘিরে ধরছে তাকে। তিনি আবার ডাকলেন, হেম তোমরা কোথায় সব! আর তখনই যেন ও—ঘর থেকে হেমর ক্ষীণ গলা পাওয়া গেল। —এখানে, কেন কী হয়েছে?
বাড়িটাতে আলো জ্বালা নেই।
কী হবে জ্বেলে?
রাসবিহারী পাশের ঘরে ঢুকে আলোটা জ্বেলে দেখল হেম শুয়ে আছে। শরীর খারাপ। না হলে হেমর শুয়ে থাকার কথা না। তিনি মোড়া টেনে পাশে বসলেন। —শরীর ভালো নেই?
না। খুব সংক্ষিপ্ত জবাব।
কী হল?
কিছু হয়নি!
সহসা রাসবিহারীর চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছে হল, কিছু হয়নি তো শুয়ে আছ কেন। কিন্তু তিনি জানেন, এতে সংসারের অনর্থ বাড়বে বই কমবে না। তিনি দেখেছেন, বাড়িতে ঝি চাকর কামাই করলেও হেমর শরীর খারাপ হয়ে যায়। বিকেলে ঠিকা ঝি বীণার কামাই হলে হেম গজ গজ করে। সব একটা মানুষের আসকারাতে গেল এমনই ভাব হেম। মাইনে কাটলে ঠিক শিক্ষা হয়—কিন্তু রাসবিহারী জানেন, লোকজনের যা সমস্যা তাতে এক দু দিনের মাইনে কেটে কিছু হয় না। আবার নতুন একটা লোক ঠিক করতে রাসবিহারীর মাথার ঘাম পায়ে নেমে আসবে। অথচ কাজের লোক এলেই দেখা যাবে হেমর সংশয় বেড়ে যাচ্ছে। এবং এমন নিষ্ঠুর আচরণ করবে মাঝে মাঝে যে রাসবিহারীর মনে হয় হেমর মন বলে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। কেমন নির্মম এবং অবিবেচক হয়ে পড়ছে দিনকে দিন। একে ঠিক অবুঝ বলা যায় না, বরং যেন ছ’টি মেয়ের জননী করার জন্য শেষ বয়সে প্রতিশোধ নিচ্ছে। রাসবিহারী সে—জন্য ঠান্ডা মাথায় বললেন, রান্নার লোকটা আসেনি!
আবার সংক্ষিপ্ত জবাব, না।
মিতা কোথায়?
দেখতে গেছে কেন এল না।
নানু ফিরে আসেনি?
জানি না।
এরপর আর কী করা যায়। তিনি উঠে পড়লেন। একটু চা খেতে ইচ্ছে হচ্ছে। সান্ধ্য ভ্রমণ সেরে এসেই তার চা খাবার অভ্যাস। তিনি রোজ হাত মুখ ধুয়ে বসার সঙ্গে সঙ্গেই দেখতে পান কাজের মেয়েটা চা দিয়ে গেছে। আজ কপালফেরে তাও জুটবে না। তিনি ডাকলেন, নিধু। তুই একবার যা তো পঞ্চাননের কাছে। ওদের বস্তিটা জানিস কোনদিকে?
সে বলল, জানি কর্তা।
এই নিধুই সংসারে একমাত্র সরল মানুষ যার কোনো চাহিদা নেই। সে এসেছিল, দূর বালেশ্বর থেকে। রাসবিহারীর হাতে পায়ে ধরে একটা বেয়ারার কাজ জুটিয়েছিল। এবং রিটায়ার করার চার পাঁচ বছর আগে নিধু রাসবিহারীর খাস বেয়ারা হয়ে যায়। সেই থেকে দশ বারো বছর ধরে দু’জনের একসঙ্গে জীবন কাটছে। এই নিধুকেও খুব একটা পছন্দ নয় হেমর। উটকো লোক মনে করে থাকে নিধুকে। বাড়ির বাগান দেখাশোনা করার জন্য দুবেলা, দু—কেজি চালের ভাত খাওয়ানোটা কোনো বিবেচক গেরস্থর কাজ নয়। রাসবিহারী জানেন, এটাও হেমর বাড়াবাড়ি, নিধু ভাত সামান্য বেশি খায়—আটা খেয়ে ওর সহ্য হয় না, সে—জন্য নিধু এ বাড়ির দুবেলাই অন্ন ধ্বংস করে। ধ্বংস শব্দটি হেমর দেওয়া। এই শব্দটি তিনিও এ—সময় ব্যবহার করলেন এ—জন্য যে নিধুর উচিত ছিল খোঁজ খবর নেওয়া। হেম ইচ্ছে করলে নিধুকেই পাঠাতে পারত। কিন্তু ভেতরে এত জ্বালা এই রমণীর যে মিতাকে পাঠিয়ে এক সঙ্গে রাসবিহারী এবং নিধুর ওপর প্রতিশোধ নেওয়া গেল। বুঝে দেখো তুমি যাকে গুরুঠাকুর করে রেখেছে সংসারে তাকে দিয়ে কী কাজটা হয়!
রাসবিহারী নিধুকে পঞ্চাননের খোঁজে পাঠিয়ে সামান্য বিশ্রাম নেবেন ভাবলেন।
বাথরুমে ঢুকে হাতমুখ ধুলেন, ঘরে এসে পাখা ছেড়ে দিলেন। তারপর মুখে এক টুকরো হরীতকী ফেলে চিবুতে থাকলেন। জিভে লালা জমতেই মাথার ঘিলুর মধ্যে কে যেন খোঁচা দিতে থাকল। বুঝতে পারলেন নানুর জন্য চিন্তা হচ্ছে। খচ খচ করছে মনটা। এই ছেলেটা বাড়ি না থাকলেই আজকাল কেমন একা লাগে রাসবিহারীর। অমলা কখনও বাসায় ফিরে যাবার আগে বাড়ি হয়ে যায়। অমলা তার আরও কাছের। সে কী করছে না করছে এই জন্য কেন যে তেমন চিন্তা হয় না। যা হবার হবে। তিনি নানুর জন্যও এমন ভাবতে পারলে অনেক দুশ্চিন্তা থেকে রেহাই পেতেন। আসলে তিনি বুঝতে পারেন মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেলেই পর হয়ে যায়। সম্পর্ক আলগা হয়ে যায়। একটি পুত্র সন্তান থাকলে সম্পর্ক এতটা বোধ হয় আলগা হত না। একটা দীর্ঘনিশ্বাস বুক বেয়ে এ—সময় তাঁর উঠে এল। তারপরই মনে হল, আসলে সবারই হাজার সমস্যা। মানুষের বয়স যত বাড়ে সমস্যা তত বাড়ে। এখন তাঁর মেয়েদেরই হাজার রকমের সমস্যা। কোনো কোনো সমস্যার খবর তিনি রাখেন, কিছু তাঁকে আঁচ করে নিতে হয়—বাকিটার তিনি কিছুই জানেন না। আর তখনই মনে হল বারান্দা পার হয়ে কেউ চলে যাচ্ছে। তিনি ডাকলেন, কে রে?
আমি।
তিনি বুঝতে পারলেন, মিতা ফিরে এসেছে।
কী বলল?
আসবে। ওর মেয়েটার জ্বর হয়েছে।
এই আসবে। শব্দটিতে রাসবিহারী আশ্চর্য রকমের একটা স্বস্তি বোধ করলেন। না হলে রাতের খাবার নিয়ে এই বাড়িতে একটা কুরুক্ষেত্র হত। মিতা রান্নাঘরে গেলেই সব ভণ্ডুল করে দেয়। সুতরাং হেমর শরীর খারাপ সত্ত্বেও কাজ কাম করত, সায়া শাড়ি ঠিক থাকত না আর রাসবিহারীর চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করত, বে—আক্কেলে মানুষের কপালে এই লেখা থাকে বলত। এমনকি এক সময় চিৎকার চেঁচামেচি করতে করতে ফিট হয়ে যেতেও কসুর করত না। যেন তেন প্রকারেণ বুঝিয়ে দেওয়া কাপুরুষ মানুষের এমনই হয়। কেউ ভয় পায় না, কেউ ভয় পায় না। সেদিনকার নানু সেও মুখের ওপর কথা বলে।
তিনি ফের ডাকলেন, মিতা চলে গেলি!
মিতা দূর থেকে জবাব দিল, আমাকে কিছু বলছ।
একটু শুনে যাবি।
মিতা বলল, আসছি।
তারপর খানিকটা সময় কেটে গেছে। নিধু ফিরে এসেছে। সে গলা বাড়িয়ে বলল, এসে গেলি! আর নিধুর মুখটা সহসা আলোর মধ্যে আবিষ্কার করে কেমন ভড়কে গেলেন রাসবিহারী। আশ্চর্য নিশ্চিন্ত মুখ। মানুষের এমন নিশ্চিত মুখ কী করে হয়! তিনি কতদিন পর, কতদিন পর কেন, যেন এই প্রথম তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করবেন, তোর আর কে আছে? তুই এখানে আর কতদিন পড়ে থাকবি! তোর জমানো টাকা বুঝে নিয়ে দেশে চলে যা। ওতে বাকি জীবন আরামে কেটে যাবে তোর। তারপরই মনে হল নিধু ওর চেয়ে বয়সে বড়ই হবে। নিধুর দেশে ছেলেমেয়ে সবই আছে। একবার মাত্র ছুটি নিয়ে দেশে গিয়েছিল, বউর অসুখ শুনে। তিনমাস পরে এল। বলল, চুকে বুকে গেল সব বাবু। তারপর আর কোনো টান বোধ করেনি দেশে ফিরে যাবার! বরং এখন দেখলে মনে হয়, তিনি শহরের প্রান্তে যে খোলামেলা জায়গা নিয়ে বাড়িটা করেছেন এটাই তার প্রাণ। ফসল তোলার সময় কিছুদিন সোনারপুর তাকে চলে যেতে হয়। সেখানে পঞ্চাশ বিঘার বড় একটা জোত আছে রাসবিহারীর। ধান, পাট, কলাইর দিনে কলাই সবই সে বুঝে আদায় করে নিয়ে আসে। তারপর বলতে গেলে বাড়ির দুটো গাভী, গোয়ালঘর আর এই বাগান মিলে তার জীবন। মানুষ কীভাবে কোথায় যে অবলম্বন পেয়ে যায় কেউ বোধ হয় বলতে পারে না।
তখনই হাজির মিতা! বলল, ডাকছিলে কেন?
নানু আজ ফিরে আসবে ত।
আমাকে কিছু বলে যায়নি।
আমাকেও তো বলেনি।
নানু কাকে বলে!
সত্যি নানু কাউকে কিছু বলে যায় না। পৃথিবী সুদ্ধু লোকের ওপর নানুর আক্রোশ। অমলা কতবার বলেছে, আমাদের বাসায় যাস নানু। যদি একবার যেত! সেজ মাসি কত বলে গেছে, যাস। কিছুই তোয়াক্কা করে না ছেলেটা। মা যার এমন তার আর কী হবে! তাঁর মনে হল, মেয়েদের জন্মসূত্রেই দোষ থেকে গেছে। এখন বুঝতে পারেন সব কটা মেয়েই ছিল তার অবাঞ্ছিত। ওদের কপালেও অবাঞ্ছিত কিছু লেখা থাকবে তাতে আর বিস্ময়ের কী!
রাসবিহারী বললেন, ও তো অবনীশের বাড়িতে গেছে। বিকেলেই ফেরার কথা। বলে ঘরের দেয়ালে চোখ রাখলেন। তাঁর ঘরটার দেয়ালে কিছু ছবি আছে। বিশেষ করে একটি ছবি খুবই বড়। ছবিটি সি আর দাশের। পাশে নেতাজীর ছবি। উত্তরের দেয়ালে আছে মহাত্মা গান্ধী এবং রবীন্দ্রনাথ। তা ছাড়া বিদ্যাসাগর মশায়েরও একটা ছোট ছবি টাঙানো আছে। এত সব মহাজনের এই দেশ, এই দেশে তিনি জন্মেছেন বলে গর্বিত। অথচ তাঁর পরের প্রজন্ম থেকেই কেমন দোষ পেয়ে গেল।
রাতে নানু ফিরলে রাসবিহারী বললেন, তোমার মা চিঠি দিয়েছে।
নানু বলল, আচ্ছা দাদু, বাবা আমার নামে কিছু টাকা রেখে গেছেন। সেটা কত টাকা?
এমন কথায় রাসবিহারী খুবই বিস্মিত হলেন। বললেন, দেখতে হবে।
তুমি জান না কত?
সুদে আসলে যা আছে তা মন্দ না।
ঠিক আছে কত টাকা আমার জানার দরকার নেই। আমাকে কালই ব্যাংকে নিয়ে চল, তুমি তো জান, বছরখানেক হয়ে গেল আমি সাবালক হয়ে গেছি।
দাদু বললেন, টাকার খুব দরকার?
দরকার অদরকারের কথা হচ্ছে না। বাবা তাঁর দুঃসময়েও এ’ কটা টাকা আমার অ্যাকাউন্ট থেকে তোলেননি। এখন আমি সে টাকা সদ্ভাবে খরচ করতে চাই।
রাসবিহারী বললেন, ঠিক আছে, তোমার টাকা তুমি বুঝে নেবে। তবে তোমার মাকে জানালে হত না।
নানু চিৎকার করে উঠল, সে কে?
অগত্যা রাসবিহারী প্রসঙ্গ পালটে বললেন, নবনীতা বলে কেউ আছে?
হ্যাঁ আছে।
তোমাকে ফোন করেছিল!
কখন?
দুপুরে।
কিছু বলল?
না। বাড়ি নেই জেনে কিছু বলল না।
ঠিক আছে। নানু তড় তড় করে নিচে নেমে ফোন করল, এবং অপর প্রান্ত থেকে গলা পেয়ে বলল, কাকিমা আমি নানু বলছি। নবনীতা আছে?
এত রাতে কোথায় যাবে?
এই কোথাও যদি বেড়াতে যায়।
না বাড়িতেই আছে। দিচ্ছি। ধর।
নবনীতা।
আমাকে ফোন করেছিলে?
হ্যাঁ। কেমন ঘুমকাতুরে গলা। নানুদা আগামী রোববার আমাদের সঙ্গে যাবে?
কোথায়?
আমরা হাজারদুয়ারী যাচ্ছি।
কে কে?
আমার মাসি, মেসো, দাদা, দাদার বন্ধুরা। আমি যাব, মা যাচ্ছে। বাবা শুধু যাবে না।
নানু মুখ কুঁচকে বলল, তোমার আবার দাদা এল কোত্থেকে?
ন’মাসির ছেলে। বরুণদা। খুব ভালো গিটার বাজায়।
খুব গেঞ্জাম হবে মনে হচ্ছে।
তা একটু হবে।
নবনীতা তুমি যদি না যাও কেমন হয়?
নবনীতা কেমন অপর প্রান্তে আমতা আমতা করতে থাকল।
সে কী করে হবে! মা আমাকে রেখে যাবে না।
কেন রেখে যাবে না!
নবনীতা বলবে কী বলবে না করেও বলে ফেলল, ধরা পড়ে গেছি।
আমরা তো কিছু করিনি। তুমিই বল। আমরা কিছু করেছি।
আজকালকার মায়েরা ও সব বিশ্বাস করতে চায় না। আমরা তো এ বয়সে কত কিছু জেনে ফেলেছি।
যাকগে যাবে কী যাবে না তুমি বুঝবে। তারপরই দুম করে বলল, আমি গেলে কাকিমা মনে কিছু করতে পারে।
মাকে বলেছি।
তুমি জানলে কী করে আমি যাব।
বা রে আমি যাব, তুমি যাবে না সে কী করে হয়। তাই বললাম, নানুদা যাবে বলেছে।
তোমার মা কী বলল!
বলল, এই মানে!
ঠিক করে বল। মানে ফানে বুঝি না।
বলল, ওর মাথার ঠিক নেই। সঙ্গে নিবি, সামলাতে পারবি তো।
নানু কেমন কাতর গলায় বলল, সত্যি নবনীতা আমার মাথার ঠিক নেই। কী করতে কী করে বসব আমি নিজেও আগে থেকে বুঝতে পারি না। তুমিই বরং ঘুরে এসো। বলে নানু ফোন নামিয়ে রাখল।
তারপর সে কিছুক্ষণ ফোনের পাশে গুম হয়ে বসে থাকল। তার মধ্যে মাথা খারাপের লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে—কিন্তু সে বুঝতে পারে আসলে যদি একজনও সুস্থ মানুষ থাকে, তবে সে। কারণ সে যখনই রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায় অথবা কখনও বাসে কিংবা কোনো গাছের নিচে যখন দাঁড়িয়ে থাকে তখন মনে হয় রাস্তার ফুটপাথে বড়ই দুঃখী মানুষের ভিড়। লীলার কথা তার মনে হল। কিছু একটা করার মতো হাতের কাছে কাজ পেয়ে সে মুহূর্তে আবার চাঙ্গা হয়ে উঠল।
সে উঠে আবার সিঁড়ি ভেঙে নিজের ঘরে ঢুকে গেল। সে ভেবে ফেলেছে পড়াশোনা আর তার হবে না। মাথার মধ্যে নানা রকম চিন্তা ভাবনা—এবং সংসারে বড় হতে হতে সে যা দেখল, খুব কম মানুষের জীবনেই বোধ হয় এত কম বয়সে এমন বোধোদয় ঘটে। আজই যা সে দেখে এল, তাতে মনে হয়েছে মানুষের জীবন শেষ পর্যন্ত যদি তার জেঠু অবনীশের মতো হয়ে যায়, অথবা বাবার মতো হয়ে যায় কিংবা দাদুর মতো—তা হলে জীবনযাপনের মহিমা কোথায়। সংসারে সে নিজেকে বড়ই অসহায় বোধ করল। মানুষ এমন অসহায় বোধ করলেই বুঝি শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যার ঝুঁকি নেয়। যদি তাই হয়, তবে জেঠুর তো বেঁচে থাকার কথা না। এমন একটা নিষ্ঠুর মেয়েমানুষ নিয়ে জেঠু কোন প্রবল প্রাণশক্তির জোরে এখনও বেঁচে আছে, ভাবতেই তার বিস্ময় লাগল।
আর তখনই নানু দেখতে পেল, কুটু, সেই ছোট্ট মেয়ে বব করা চুল, দু চোখ পৃথিবী সম্পর্কে অপার বিস্ময় নিয়ে জেগে আছে। কুটুর কত রকমের প্রশ্ন, বাঘ কেন মানুষ খায়, ভিখিরি ভিক্ষা চায় কেন, পাখিরা উড়ে কোথায় যায়, আকাশের তারারা দিনের বেলায় কোথায় থাকে, চাঁদের বুড়ি সুতো কাটে কেন এবং শেষ প্রশ্ন তার বোধ এমন সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে মানুষ চলেই বা যায় কেন। এগুলো খুবই জটিল প্রশ্ন। সহজে তার পক্ষে উত্তর দেওয়া সম্ভব না। বিকেল বেলাটা কুটু এমন অজস্র প্রশ্ন করেছে তাকে। এই কুটুই সংসারে বেঁচে থাকার মতো একমাত্র জেঠুর শেষ অবলম্বন। আত্মহত্যার আগে কুটুর মতো বাবা যদি তার কথা ভেবেও অন্তত আর কিছুদিন বেঁচে থাকত—অন্তত মার শেষ বয়স পর্যন্ত, তাহলে কোনো অঘটনই ঘটত না।
সেই যেদিন বাসায় ঢুকে দেখল, মেসো অসময়ে বসে আছে বাড়িতে, মার সঙ্গে হৈ—হল্লা করছে, মা পিঠে পায়েস করছে, যেন উৎসব বাড়িতে—সেদিন সে স্কুলের বইপত্র ফেলে সোজা বাইরে ছুটে চলে গেছিল—ভিতরে কীসের যে হাহাকার—সেই থেকে পড়াশোনায় সে মন বসাতে পারত না। কোনোরকমে সে ক্লাসের পর ক্লাস পার হয়ে গেছে, এই পর্যন্ত। পালাবে পালাবে করে তার কত বছর কেটে গেল! আজ আবার মনে হচ্ছে, সব ছেড়ে ছুড়ে পালালে কেমন হয়। তখনই দেখল সেই লীলার মুখ ছল ছল করছে। সে বুঝতে পারছে—জীবনের কোথাও দু’জনের মধ্যে একটা ভারি মিল রয়ে গেছে।
ষোলো
মন্দাকিনী কেমন নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে। কী করবে ঠিক বুঝতে পারছে না। সে ভারি চঞ্চল হয়ে পড়ছে। পা টিপে টিপে কোথাও যেতে না পারলে শরীরের জ্বালা মিটবে না। চোখ মুখ জ্বলছে। শরীরে এটা যে কী থাকে। কিছুতেই মরে না। স্বামীর মুখ সে ক’বার ধ্যানে দেখার চেষ্টা করল। যদিও কিছু ব্যভিচার ছিল মানুষটার, তবু যখন কাছে আসত ঠিক থাকতে পারত না। আসলে এই শরীর তাকে খুব সহজেই সহনশীল করে রেখেছিল। রাতে ফিরে মানুষটা অপরাধী মুখে তাকালেই কেমন জল হয়ে যেত সব রাগ! অভিমানটা শরীরে বেশিক্ষণ পুষে রাখতে পারত না। অথবা জ্বালা বলা যেতে পারে—মন্দাকিনীর যে চরম আকাঙ্ক্ষা বীজ বীজ করছে! কতক্ষণে শরীর জুড়াবে। সে দুটো একটা অভিমানের কথা বলেই হাত পা ছড়িয়ে পড়ে থাকত। মানুষটা তখন তাকে লুটেপুটে খেলে সে পরম শান্তি বোধ করত এবং ঘুমিয়ে পড়ত।
এখন তেমনি জ্বলছে। স্বামীর মৃত্যুর পর; কিছুদিন শরীরটা বেশ ঠান্ডা ছিল। শোকতাপ বোধহয় কিছুদিনের জন্য শরীর ঠান্ডা করে রাখতে পারে। কিন্তু প্রকৃতি কত উদার—সে কোনো শোকতাপই গায়ে জড়িয়ে থাকতে দেয় না। ক্রমে কেমন সব ফিকে হয়ে যায়।
ভানু আগেও আসত এ—বাড়িতে। তখন থেকেই ক্ষণে ক্ষণে মনে হত একটা প্রতিশোধ নেওয়া যেতে পারে সহজেই। কারণ সে সহজেই জানে কী আকর্ষণ এ—বাড়িতে ভানুর, কেন সময় পেলেই চলে আসে, মানুষটাকে সে দাদা দাদা করত। মানুষটা খুব একটা গ্রাহ্য করত না। কতটা আর লুটে খাবে। কিংবা এমনও হতে পারে, আমি যখন আর একটা লাট্টু ঘোরাচ্ছি, তখন এই পুরনো লাট্টু তোমাকে দিয়ে দিলাম বাপু। ইচ্ছে করলে ঘোরাতে পারো।
এবং তখনই মনে হত মন্দাকিনীর তবু মানুষের শেষ পর্যন্ত কিছু একটা থেকে যায়, ইচ্ছে হলেই হাত পাতা যায় না! কী যেন সংকোচ থাকে। অথবা শালীনতাবোধ মন্দাকিনীকে এতদিন পর্যন্ত পবিত্র রাখতে সক্ষম হয়েছে। পবিত্র কথাটা তার কাছে এ সময় খুবই হাস্যকর। তবু শ্বশুরমশাইর প্রতি এটা একটা কর্তব্য, অথবা শৈশবের কিছু ধর্মাধর্ম, যার ভেতর সে বড় হয়ে উঠেছিল, যার থেকে বের হয়ে আসা খুব সহজ নয় বলে মনে হয়েছে, এই বেলা তার মনে হল, সব ভেঙে তছনছ করে দেওয়া যেতে পারে।
সে পর্দা তুলে দেখল একবার। ভানু পাশ ফিরে শুয়ে আছে। ঘুমিয়ে আছে কী না বোঝা যাচ্ছে না। কেউ কী এমন একটা নিরিবিলি সুযোগ উপেক্ষা করে বসে থাকতে পারে! আর যে—দিনই সে ভানুর সঙ্গে রাত করে ফিরেছে, কিছু কোথাও খেয়ে যখন ফিরছে, সবসময় একধরনের সাধাসিধে কথা। অধিক কিছু না। অথচ কত কিছু সহজেই হতে পারত।
মন্দাকিনী কিছুতেই মুখ খুলতে পারছিল না। আর ভানু নিজে থেকে কোনো কথা তুলতে পারছিল না। কোনো অঘটনের আশায় দু’জনেই বসে আছে। যে ভাবেই হোক সহসা সেটা ঘটে যাবে! এমন সুযোগ ভানু অবহেলায় নষ্ট করে দিচ্ছে কেন, ভানু ভানু! সে চিৎকার করে উঠত প্রায়, তখনই প্রিয়নাথের নাকের শব্দ আরও প্রবল, ভানু তুমি কী করছ, কেউ নেই। তুমি কী ঘুমোচ্ছ! মন্দাকিনীর শরীর কেমন অবশ হয়ে আসছিল। সে দ্রুত পায়ে পর্দার ভেতর ঢুকে আরও সতর্ক হয়ে গেল। ভানু পাশ ফিরে তেমনি শুয়ে আছে। একটা কাপুরুষ! সামান্য সাহসটুকু নেই। একজন মেয়ের পক্ষে এটা খুবই অশোভন। নীচে মনে হল কেউ সিঁড়ি ভাঙছে। সে ফের দরজায় মুখ বাড়াল। না মনের ভুল। এবং নিজেকে ভারি বেহায়া মনে হচ্ছে। সে তো চেয়েছিল একজন পুরুষমানুষ যেমন বেড়ালের মতো ওৎ পেতে থাকে, ভানুও মাছ খাবার লোভে তেমনি ওৎ পেতে থাকবে। সময় এবং সুযোগের অপেক্ষা। তারপর বেশ আরামে আহার।
আহারের কথা মনে হতেই মন্দাকিনীর প্রবল জ্বর এসে গেল শরীরে। চোখ জ্বালা করছে। তবু অশোভন, খুবই অশোভন, কিন্তু শরীর ক্রমে নিরালম্ব হতে থাকলে সমাজ সংস্কার বিনষ্ট হয়ে যায়। সে ডাকল, ভানুবাবু ঘুমোলে!
ভানু বলল, ওম।
ঘুমোলে!
না—আ!
পুরুষমানুষের অত ঘুম ভালো না।
মন্দাকিনী আর কী বলবে! বসবে পাশে! মানুষটা কী! উঠতে পারছে না। সে আর কতদূর এগোবে।
মন্দাকিনী বলল, তুমি এবারে বিয়ে করো ভানুবাবু।
করব ভাবছি। বাবা ঠিকুজি কোষ্ঠী মেলাচ্ছে।
করব নয়। করে ফেলো। নিশ্চিত হই।
তোমার কী চিন্তা।
পুরুষমানুষ বিয়ে না করে থাকে কী করে!
করব।
না, করে ফেলো।
ভানু এবার মন্দাকিনীর দিকে চোখ তুলে তাকাল। তাকাতে পারছে না। মন্দাকিনীর চোখের পাতা জড়িয়ে আসছে, এবং কেমন অভিমানীর মতো জানালায় ঠেস দিকে দাঁড়িয়ে আছে। ভানু উঠে বসল। মাথাটা তার ধরেছে। সে ঠিক করতে পারছে না কী করবে! একবার প্রথম দিকে ভানুর একটু হাত লাগতে মন্দাকিনীর প্রবল ধমক খেয়েছিল। মন্দাকিনীর হয়তো তা মনে নেই। কিন্তু বেচারা পুরুষ মানুষ সেই যে মনে করে বসে আছে আর এগোতে পারছে না। কোনো ভুল বোঝাবুঝি হলে আবার ঠিক প্রিয়নাথকাকার কানে উঠাবে। এখানে আসাই বন্ধ হয়ে যাবে। কী যে আছে এ বাড়িতে! কাকলি এবং মন্দাকিনী দুজনেই তাকে ভারি বশে রেখেছে। বরং কাকলীর সঙ্গে সম্পর্কটা বেশ খোলাখুলি। সে যদিও খুব একটা বাড়াবাড়ি করতে পারে না, কারণ সেই ধার্মিক পিতা ভুবনবাবুর মুখ মাঝে মাঝে অসহায় করে রাখে তাকে। লম্পট নিজে হলে ক্ষতি নেই, কিন্তু লম্পটের ছেলে লম্পট হয়, এবং ভুবনবাবু নামক ব্যক্তিটি তবে হয়তো আত্মহত্যা করেই বসবেন। মুহূর্তে ভানুর মগজের ভেতর এতগুলো চিন্তা ভাবনা করাত চালাচ্ছিল। তার সামনে সেই লাস্যময়ী নারী, শুধু বুকের কাপড় আলগা করে নেই, যেন দু ফুট মতো জায়গায় পা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে মন্দাকিনী! এবারেও যদি বেড়াল লাফ না দেয় তবে মন্দাকিনী আর কতটুকু সাহায্য করতে পারে। মন্দাকিনীর এ হেন দৃশ্য দেখে ভানুবাবুর চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে। এবং তখন মন্দাকিনী সরল বালিকার মতো ভানুর হাত ধরে কাছে টেনে নিল। লেপ্টে যেতে গিয়ে মনে হল ও—ঘরে প্রিয়নাথ নামক ব্যক্তিটি হাই তুলছে। মা তারা করুণাময়ী। বউমা ও বউমা। জল দাও ওষুধ খাব।
দৌড়ে ছুটে মন্দাকিনী কাপড়চোপড় সামলে—যাই বাবা, আপনিতো খুব যা হোক ঘুমোলেন। কাকলি কখন গেছে ফেরার নাম নেই, ও ভানুবাবু ওঠো, বেলা যেতে দেরি নেই—সহসা এত সব কথা বলে মন্দাকিনী চোখে মুখে বাথরুমে ঢুকে জল দিতে লাগল। ভানুবাবু ফের সটান শুয়ে পড়েছে। এবং যত জোরে সম্ভব নাক ডাকাবার চেষ্টা করছে!
প্রিয়নাথই শেষ পর্যন্ত উঠে এসে ভানুবাবুর ঘুম ভাঙালেন। কী হে খুব যে ঘুম। তা হবে। এই বয়সে সব কিছুই বেশি বেশি থাকে। ঘুম, আহার, তারপর কী বলতে গিয়ে থেমে গেলেন প্রিয়নাথ কাকা। প্রিয়নাথকাকা কি শেষ কথাটা মৈথুন ভেবেছিলেন! সে উঠে পড়তেই মন্দাকিনী এক কাপ চা রেখে গেল। মুচকি হেসে গেলে বোঝা গেল দু’জনের ভেতর শেষ পর্যন্ত যখন জানাজানি হয়ে গেছে তখন সময় বুঝে আহারে বসে গেলেই হবে।
প্রিয়নাথকাকা তাঁর ঘর থেকে হাঁকলেন, হবে নাকি আর এক হাত।
ভানুবাবুর মন মেজাজ কেমন তিরিক্ষি হয়ে গেছে। এবং ভেতরে অসহ্য কষ্ট—বোধ, যেন যেটা হবার কথা ছিল, সেটা শেষ পর্যন্ত এই স্বার্থপর লোকটার জন্য হল না, তার সঙ্গে খেলতে তার আদপেই আর ইচ্ছে নেই। কিন্তু না খেললে সারাটাক্ষণ থাকে কী করে! এই একটা বড় রকমের সুবিধা প্রিয়নাথকাকা এ বাড়িতে আসার জন্য করে রেখেছে। হেলায় হারানো ঠিক না। সে চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে প্রিয়নাথকাকার ঘরে ঢুকে গেল। প্রিয়নাথ একবার মুখ তুলেও দেখল না। হাত তুলে ইশারায় বসতে বলল। তারপর কী ভেবে বললেন, বেশিক্ষণ খেলব না।
এবং কাকলী ফিরে এলেই খেলা বন্ধ করে উঠে পড়লেন। বললেন একটু ঘুরে আসি।
প্রিয়নাথকাকার এই ব্যবহারটা ভানু বুঝতে পারে। কাকলী ওর মায়ের প্রহরী। কিন্তু প্রিয়নাথকাকা কী জানে আজই মন্দাকিনী বউদি তাকে সাপটে ধরেছিল! এতদিন সে যেটা চাইছিল, কারণ ভানু বুঝতে পারে, তার ভেতর ভুবনবাবুর কাপুরুষতা বেশ বর্তে গেছে। কাপুরুষ না হলে এক স্ত্রীতে কেউ বেশিদিন মত্ত থাকতে পারে না। সব সময় মুখে সাধু সাধু ভাব, যেন গোল্লায় যাচ্ছে সব, এবং আহাম্মুকির এক শেষ। ভানু এ কারণেই নিজে সাহস করে সুযোগ তৈরি করতে পারেনি। সে যুবতীদের সঙ্গে খুব একটা মেলামেশাও করেনি। তাছাড়া মেয়েদের চরিত্র সে ঠিক বোঝেও না। অনেক সুযোগ এ বাড়িতে সে আজ বুঝতে পারল, হেলায় হারিয়েছে। আজই স্পষ্ট বুঝতে পারল, সে যে লোভে এ বাড়িতে আসে মন্দাকিনী বউদির সেই লোভ। কেবল দুজনেই সাহসের অভাবে পরপর এতগুলো দিন অকারণে কাটিয়ে দিয়েছে।
প্রিয়নাথকাকা এখন ধর্মসভায় বসে ঈশ্বর সম্পর্কিত ভাবনায় ডুবে আছেন, না বাড়িতে বউমা কাকলী ভানুবাবু তিনজন কে কী করছে তার একটা ছায়াছবি চোখে তাঁর ভাসছে।
মন্দাকিনী তাড়া লাগাচ্ছিল, কাকলী পড়তে বসগে। ভানুবাবু এঘরে এসো। তুমি থাকলে ও পড়তে চায় না।
ভানু বলল, এই কাকলী পড়তে বোস। তোর মা বকছে আমাকে।
তুমি যাবে না। গেলে পড়ব না বলছি।
বউদি তোমার মেয়ে পড়বে না বলছে।
চুপ করো ভানুকাকা। সে মুখে দুহাত চাপা দিল ভানুর। তারপর কী ভেবে কেমন অভিমানের গলায় বলল, আচ্ছা পরে দেখবে। বলেই সে টেবিলে চলে গেল। ভানু দরজা পার হয়ে মন্দাকিনীর ঘরে ঢোকার মুখে বলল, যাই। খুব চিন্তা করবে।
মাসিমা জানে তুমি কোথায় আছো। মায়েরা সব বোঝে।
ভানু বলল, তবু এখন যাওয়া উচিত।
বাবা এসে খোঁজাখুঁজি করবেন।
বলবে চলে গেছি।
বোস না!
বসে কী হবে?
মন্দাকিনী মুচকি হাসতে পারল না এবার। ভেতরের দাহ আগুনের ফুলকির মতো দু চোখে ভেসে উঠল। কী যে করে! কিছু করতে না পারলে এই মহামূল্য সময় তার হাত ছাড়া হয়ে যাবে। খুব বেপরোয়া হয়ে যাচ্ছিল মন্দাকিনী। যেন এক্ষুনি পারলে কাকলীকে নীচের তলায় অথবা অন্য কোথাও ছলছুতোয় পাঠিয়ে এই সর্বনাশা আগুনের প্রজ্বলন থেকে রেহাই পায়। পবিত্র আধারে প্রবিষ্ট হতে না পারলে কারও আজ রেহাই নেই। সে দুবার উঁকি দিল। এবং কতটা বেপরোয়া হলে সে ঝাঁপিয়ে টেনেহিঁচড়ে ভানুবাবুকে তুলে নিতে পারে, এবং কাকলী যে ও ঘরে পড়ছে, মাথায় তাও কোনো বিদঘুটে শব্দ তুলছে না, কেমন একটা মাতাল রমণীর মতো দরজার পাশে আড়াল তৈরি করে ডুবে গেল তারা। কোনো পরোয়া নেই। প্রায় পাগলিনীর মতো সাপটে ধরেছে ভানুবাবুকে। এবং অতীব পবিত্রতা বিরাজ করছিল চোখে—মুখে। পৃথিবীর সবকিছু এখন এই নারী এবং পুরুষের কাছে অকিঞ্চিৎকর।
ও—ঘরে কাকলীর সাড়া পাওয়া যাচ্ছিল না। বাথরুমে যাবার সময় মন্দাকিনী কেমন সতর্ক। এবং অপরাধীর মতো চোখ তুলে একবার দেখতেই বুকটা হিম হয়ে গেল। জানালায় চোখ কাকলীর। কেমন উদাস চোখমুখ। কাকলী কি…….আর ভাবতে পারছিল না। যেন এতক্ষণে চৈতন্য হয়েছে, কাকলী বাড়িতেই ছিল। কাকলী যদি……আর এসব মনে হতেই ভানুবাবুর উপর কেন যে মনটা ভীষণ বিষিয়ে গেল। সে হাতে মুখে জল দিয়ে বাইরে বের হয়ে দেখল, ভানুবাবু চলে যাচ্ছে। যাবার সময় কাকলীর সঙ্গে কোনো কথা বলে গেল না। কতকাল থেকে এই বাড়িটা ধ্রুবতারার মতো কেবল ভানুর মগজের ভিতর দপ দপ করছিল। সব চেনাশুনা হয়ে গেলে বুঝি রহস্য মরে যায়। মন্দাকিনী সিঁড়ি ধরে নিচে নেমে ডাকল, ভানুবাবু।
ভানুবাবু ভালোভাবে তাকাতে পারছে না।
তুমি চলে যাচ্ছ?
ভানু চোখ না তুলেই বলল, হুঁ।
কবে আসছ।
আসব ঠিক।
কাকলীর সঙ্গে কথা বলে গেলে না।
ভয় লাগছে।
কীসের ভয়?
ঠিক জানি না।
এসো ওপরে এসো বসো! এখন চলে গেলে ভালো দেখাবে না। উনি আসুন।
ভানু কেমন বাধ্য ছেলের মতো ওপরে উঠে এল। মন্দাকিনীর বুকটা সেই যে কেমন হিম হয়ে আছে আর স্বাভাবিক হচ্ছে না। সে করিডোর দিয়ে যেতে যেতে বলল, খুকু দেখ ভানুকাকা চলে যাচ্ছিল।
কাকলীকে কখনও আদরের গলায় ডাকলে মন্দাকিনী খুকু বলে ডাকে। মন্দাকিনী দেখল কাকলী কিছু বলছে না। সে ভানুর দিকে তাকিয়ে চোখ টিপল। ভানুবাবু আর কী করে, সে কাকলীর ঘরে ঢুকে বলল, কিরে পড়ছিস না।
কাকলী এবার চোখ তুলে তাকাল। কিছু বলল না।
মন্দাকিনী ওপাশ থেকে বলল, তোর অঙ্ক কটা দেখে রাখ না।
কাকলী অঙ্কের খাতা বার করে ছুড়ে দিল ভানুবাবুর দিকে।
কত প্রশ্নমালা?
কাকলী উঠে গিয়ে দেখাল সব।
ভানুবাবু অন্য সময় হলে বলতে পারত। কাকলীর মন খারাপ আরও কতবার হয়েছে। ভানুবাবু তার স্বাভাবিক কথাবার্তায় ওকে সহজেই উৎফুল্ল করে তুলতে পারত। এবং কী কী কথা বললে, কাকলীর মেজাজ আবার স্বাভাবিক হবে সে জানে। অথচ কী একটা সংকোচ ভিতরে রয়ে গেছে। কাকলীর সঙ্গে সে খুব স্বাভাবিক কথা বলতে পারছে না। অঙ্ক বই—এর পাতা উলটে যাচ্ছে কেবল।
কাকলীই বলল, তুমি ভানুকাকা ভালো না।
কেমন চমকে গেল ভানু।
তুমি মার সঙ্গে আর মিশবে না।
ভানুর, এতটুকু মেয়ের এমন স্পষ্ট কথা শুনে, কান লাল হয়ে উঠল। এই মুহূর্তে আর বসতে ইচ্ছে করছে না।
কাকলী বলল, তুমি আমাকে ভালোবাসতে পারতে!
এত সহজ করে এমন কথা মেয়েটা কী করে বলতে পারল!
কিছু বলছ না কেন?
ভালোবাসব।
কবে!
দেখি কবে পারি।
কথা দিতে হবে।
ভানু বলল, অঙ্ক করো। তোমার মা শুনতে পাবে!
তোমরা এতক্ষণ ও—ঘরে কী করছিলে!
কই কিছুই না তো।
সত্যি বলছ!
সত্যি।
তিন সত্যি।
তারপর ভানু কেমন মরিয়া হয়ে বলল, কী করছিলাম উঠে গিয়ে দেখলেই পারতে।
আমার সাহস হয়নি। একবার উঠেও কী ভেবে বসে পড়লাম। তোমরা ছোট হয়ে গেলে আমার কিছুই থাকবে না ভানুকাকা। বলে ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলল কাকলী।
ভারি বোকা মেয়েতো! বলে ভানু সেই স্বাভাবিক ভানুবাবুর মতো কাকলীর চুল এলোমেলো করে দিয়ে শিস দিতে দিতে নিচে নেমে গেল। মন্দাকিনী আর ভানুবাবুকে আটকে রাখল না।
সতেরো
কী গো, তোমার ঘুম ভাঙবে না?
ভুবনবাবু, স্ত্রীর আলতো গলার স্বর শুনতে পেলেন। তিনি চোখ বুজে পড়ে আছেন। সময় বড় দীর্ঘ, কিছুতেই তার সময় কাটতে চায় না। বিকেলে এ—সময় তিনি এক কাপ চা খান, তবু উঠতে ইচ্ছে করছে না।
নীরজা ফের বলল, ওঠো। কত আর ঘুমোবে। চায়ের জল বসিয়ে দিয়েছি কিন্তু।
ভুবনবাবু উঠে পড়লেন। বাথরুমে ঢুকে চোখ মুখে জলের ঝাপটা দিলেন। ভেজা গামছায় মুখ মুছে বের হয়ে এলেন। তারপর রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বললেন, ভানু ফেরেনি এখনও?
কোথায় আর ফিরল।
ওরা কি কেউ বাড়ির কথা ভাবে না?
যা দিন কাল, ভেবে আর কী হবে?
ভুবনবাবুর মনটা কেমন অস্বস্তিতে ভরে গেল। ছেলের জন্যে তো মায়েরই ভাবনা থাকার কথা। কিন্তু নীরজার অদ্ভুত নিস্পৃহ স্বভাব। জীবনের এই শেষ অঙ্কে যেন আরও বেশি নিস্পৃহ স্বভাব। তিনি হয়তো বলেই ফেলতেন, পেটের দোষ, কিন্তু তিনি জানেন, বললেই পার পেয়ে যাবেন না। এমন সব কুৎসিত কথা নীরজা অনায়াসে বলে যাবে যে তখন আর দাঁড়াবার জায়গা থাকবে না।
ওপাশের রাস্তার তিনতলার কার্নিশের নিচে সূর্য হেলে গেছে। বারান্দায় ছায়া আছে এখন। বোধহয় মানদা এসেছে। বারান্দা মুছে দিচ্ছে। বারান্দায় কিছু বেতের চেয়ার আছে। একটা ইজিচেয়ার আছে। ইজিচেয়ারটা ভেঙে গেছিল, বাবার অসুবিধা হচ্ছে ভেবে রমা সারিয়ে দিয়েছে। শরীর এলিয়ে দিলেন চেয়ারটাতে। মানুষের এ সময়টা বুঝি খুবই অর্থহীন। ছেলের বিয়ে মেয়ের বিয়ে দিতে পারলে সংসারটাতে বেঁচে থাকার একটা অর্থ খুঁজে পাওয়া যেত। কিছুই হচ্ছে না।
প্রথম যৌবনে মনে হত, ছেলেপিলেরা দাঁড়িয়ে গেলেই এ জীবনের জন্য ছুটি নেওয়া যাবে। এবং প্রথম যখন ভানু অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার হাতে নিয়ে এসেছিল, তিনি যথার্থই কিছুটা হালকা বোধ করছিলেন এবং ক’মাস আগে যখন রমার চাকরি হয়ে গেল; বেশ বড় রকমের একটা দায়িত্ববোধ থেকে পরিত্রাণ পেয়েছেন ভেবেছিলেন। কেবল মানুটার চাকরি। সেটাও হয়ে যাবে হয়তো। কিন্তু ইদানীং মনে হচ্ছে তার কোনো কাজই শেষ হয়নি। তাঁর মুক্তি মেলেনি। বরং তিনি এখন আরও বেশি টেনসনের মধ্যে আছেন। মুখের ওপর কিছু বলতে সাহস পান না। দশ রকমের অজুহাত দেখিয়ে দেবে। বাড়ি সময়মতো না ফিরলে যে বাবা—মার চিন্তাভাবনা থাকে এটা তারা আজকাল একেবারেই বুঝতে পারে না বুঝি।
নীরজা চা রেখে গেল আর সঙ্গে দুটো বিস্কুট একটা সন্দেশ। ভুবনবাবু প্রথম সন্দেশ ভেঙে খেলেন। তারপর চায়ে বিস্কুট ডুবিয়ে খেলেন। মেয়েটা এখন কী করছে কে জানে। আজকাল তো হামেশাই দুর্ঘটনা ঘটছে। মানুটা বের হয়ে গেল। একবার বলেও যায় না কোথায় যায় এরা! সবাই ধীরে ধীরে আলাদা সত্তা ধারণ করছে। একই সংসার একই আবাস, একরকম দুঃখ। তিনি এতদিন বাড়ি থেকে যে দুঃখটা দূর করার জন্য আপ্রাণ খেটেছেন সেটা একবিন্দু নড়েচড়ে বসেনি।
বরং মনে হয় সবাই এখন ঠিক ওর মতো নিজেদের জগৎ তৈরি করতে ব্যস্ত। তিনি যেমন নীরজা ভানু রমা মানুকে নিয়ে একটা সত্তা আবিষ্কার করেছিলেন, ওরাও তেমনি, কোনো মন্দাকিনী, কোনো জয়া, কোনো অরুণ ছানাপোনা নির্মাণের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ওরা যে তাঁর কেউ না, এটা উপলব্ধি করে কেমন হতাশ হয়ে পড়লেন। চা কেমন যেন বিস্বাদ লাগছিল। চোখ ঝাপসা হয়ে উঠছে।
মন্দাকিনীর সঙ্গে ভানুর একটা অবৈধ সম্পর্ক ঠিক কীভাবে গড়ে উঠেছে তিনি জানেন না। বিয়ে দিলে হয়তো সব সেরে যাবে। প্রিয়নাথ আছে বাড়িতে। সে তো টের পায়। যদি সত্যি হয়, যদি সম্পর্কটা সুস্থই না থাকে, এই অবেলায় বাড়ি ফিরলে ভানুকে নিজের আত্মজ ভাবতে তার কষ্ট হবে। ভানু আলাদা একটা অস্তিত্ব। সে ক্রমে আলাদা হয়ে যাচ্ছে। যেন অভ্যাস বসে সংসারের বাজার, বাসা ভাড়া, জামাকাপড় শুধু জুগিয়ে যাচ্ছে। আর কোনো প্রবল টান অথবা আকর্ষণ এ—সংসারের জন্যে তার নেই। তিনি এবারে ডাকলেন, নীরজা।
নীরজা হাত মুছে বারান্দায় এসে দাঁড়াল।
তুমি বলতে পারো তোমার ছেলেমেয়েরা এখন কে কোথায় কী করছে?
লোকটা আজকাল যখন তখন এমন সব অদ্ভুত প্রশ্ন করে ফেলে। নীরজা খুব একটা অবাক হল না। বলল, ওরা কিছু তো একটা করছেই। বাড়ি ফিরলে জিজ্ঞেস কোরো।
তুমি টের পাও না!
না।
আমি কিন্তু টের পাই।
সেই এক কথা বলবে। বলবে ওরা আর আমার কেউ নয়। ওরা আমার জন্যে যতটুকু করছে, সবটাই ওদের মান—সম্মানের জন্যে। আমাদের সময়ে কিন্তু এমনটা ছিল না। বিয়ের পর তোমাকে কলকাতার বাসায় আনব কথাটা কত বছর যে বাবা—মাকে বলতেই পারিনি। থেকে থেকে পেটের ব্যামোটা ধরাতে না পারলে বোধহয় শেষপর্যন্ত সাহসই পেতাম না। বেশ একটা অজুহাত দাঁড় করিয়ে তবে নিয়ে এসেছিলাম।
নীরজা বলল, তুমি বুড়োমানুষ, বাড়ি থেকে বের হতে চাও না। তোমার মতো ওরা যখন হবে, ওদের তাই হবে। বাইরে একটু ঘুরে না বেড়ালে সংসারে ওরা বড় হবে কী করে! বুঝবে কী করে জীবনটা শুধু যোগ বিয়োগ নয়, গুণ ভাগও আছে।
নীরজার সঙ্গে কথায় তিনি কখনও পারেন না। আর তাছাড়া এই বুড়ো মানুষটা হয়তো তাঁর সেই যৌবনেও এমনি তাকে তাড়া করেছে। স্ত্রীর প্রতি যতই সংশয় থাকুক, প্রিয়নাথ এলেই সেটা বোঝা যেত, তিনি তো, আর আহাম্মক নন, যে কিছুতেই বুঝতেন না, তবু ভেবেছিলেন, যৌবন সবাইকে একটু বেয়াড়া স্বভাবের করে দেয়, ছেলেপুলে হলে সব আবার ঠিক হয়ে যাবে। ঠিক হয়েও গিয়েছিল। যদি মাথা গরম করতেন, তবে সংসারে অশান্তি বাড়ত। এবং চরম সহ্য পরীক্ষার দ্বারা নীরজার ভেতর বোধহয় পাপবোধই জাগিয়ে তুলতে পেরেছিলেন। এক সময় নীরজা সত্যি নিরাময় হয়ে গেল। এই বুড়োটে স্বভাবই তাকে কোনো আত্মহত্যা অথবা খুন থেকে রেহাই দিয়েছে। আজকের ছেলে—ছোকরাদের ভিতর এটা দেখা যায় না। ভয়টা সেইজন্যেই। মানু তো দিন দিন যা উগ্র স্বভাবের হয়ে উঠছে! কাউকে আর গ্রাহ্য করে না। সবাই যেন ওর শত্রু। সহিষ্ণুতা ও আত্মসংযম বলতে এদের আর কিছু নেই।
এবং মানুর জন্যই আজকাল তার বেশি ভয়। তিনি দেখলেন, কথার আর কোনো জবাব দিচ্ছে না বলে নীরজা চলে যাচ্ছে। তিনি ফের ডাকলেন, নীরজা।
নীরজা এবার একটু ক্ষুণ্ণ গলায় বলল, আমার কাজ আছে।
নীরজা সংসারে এত যে কাজ করছ, কী হচ্ছেটা বিনিময়ে।
কী হচ্ছে না। সবই হচ্ছে।
এটাকে হওয়া বলে।
আমি তো সংসারে এটুকুও যে হবে আশা করিনি। তুমি যা মানুষ ছিলে।
ভুবনবাবু জানেন নীরজার খোঁটা দিয়ে কথা বলার স্বভাব। সময় সময় দারিদ্র্যের জ্বালা নীরজাকে সহ্য করতে হয়েছে। অভাবের ভিতর একটা মধুর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। স্বচ্ছলতা মানুষকে বড় দূরে সরিয়ে রাখে। সংসারের জন্যে যদি অভাববোধ না থাকল তবে মানুষ বাঁচবে কী নিয়ে। তার মনে আছে একবার ইলিশের মরশুম চলছে, অর্থাভাবে গোটা ইলিশ একদিনও আনতে পারছেন না। ব্যাগের ভিতর থেকে ইলিশ মাছের রুপোলি লেজটা উঁকি মারবে কতদিন এমন আশা করেছে নীরজা। বাবার কড়া নাড়ার শব্দ পেলেই রমা ছুটে গেছে ব্যাগ খুলে দেখেছে, গোটা ইলিশ নেই। মানু বলেছে, বাবা তুমি আনবে না? তিনি বলেছেন, দেখি মাইনে পাই, একদিন আনব। এবং স্বপ্নে পর্যন্ত ভানু দেখেছে বাবা আস্ত ইলিশ নিয়ে বাজার থেকে ফিরেছে। আর যেদিন এল সত্যি সত্যি সে এক উৎসবের ব্যাপার। গোল হয়ে বসা, সবার খাওয়া একসঙ্গে। আজকাল একসঙ্গে বসে খাওয়া কালেভদ্রে হয়ে থাকে। এত যে করা, শেষে কি সবই এমন একটা বিচ্ছিন্ন খাপছাড়া জীবনের জন্য! ভুবনবাবু ভারি বিচলিত হয়ে পড়লেন।
নীরজা দেখল কেমন ঝুঁকে আছে মানুষটা। চুল সাদা হয়ে যাচ্ছে। কপালের দিকে যৌবনেই সামান্য টাক পড়েছিল, সেটা আর বাড়েনি। চেহারাতে বেশ একটা সৌম্যকান্তি ফুটে উঠেছে। ধুতি কখনও লুঙ্গির মতো পরেন না। বেশ কোঁচা দুলিয়ে ধুতি পরার অভ্যাস। বাড়িতে এখন বাটিকের কাজ করা লুঙ্গি চল হয়েছে। দুই ছেলেতে বাসায় ফিরে কতক্ষণে শরীর হালকা করবে, কতক্ষণে লুঙ্গি মাথায় গলিয়ে দিয়ে বেশ আরাম করবে,—আর মানুষটার তখন গজ গজ বেড়ে যায়। বামুনের বাড়ি, লুঙ্গি, কী যে হচ্ছে আজকাল, এবং এটা নীরজা বুঝতে পারে অনেক কিছু অপছন্দের মতো এটাও একটা অপছন্দ। এবং সব যেমন সরে যাচ্ছে এটাও তার সয়ে গেছে। কেবল নিজে কখনও দলের নাম লেখাবেন না কিছুতে।
নীরজার মনে হল, আসলে মানুষটা সব অনাসৃষ্টি থেকে নিজেকে পৃথক রাখতে ভালোবাসে। অথবা নিজে সাধু থেকে যদি পরিবারের সবার মঙ্গল করা যায়। নিজের এই সাধু স্বভাবের জন্যেই তার বিশ্বাস সংসারে খুব একটা অধর্ম বাসা বাঁধতে পারবে না। নীরজা মনে মনে তখন না হেসে পারে না। সে বলল, কী আর কথা বলছ না কেন?
ভুবনবাবু সহসা জেগে ওঠার মতো তাকালেন। বললেন, তুমি এখনও আছো!
থাকব না কেন। সহজ কথাটা মেনে নিতে এত বাধে কেন!
ওরা বাড়ি না থাকলে তোমার কষ্ট হয় না?
ওরা বড় হয়েছে।
বড় হলেও তুমি মা। তোমাকে তো কেউ বলে না, মা তুমি কেমন আছো?
ওরা ভালো থাকলেই আমি ভালো। সেটা বুঝতে পারে।
ওরা কী সত্য ভালো আছে!
আছে বইকি।
তোমার চোখ নেই নীরজা। তুমি কিছু টের পাও না।
সব টের পাই। মানুষ শিখতে শিখতে বড় হয়। একটু কিছু শিখুক না।
এটা তো শেখা না, শরীরকে পীড়ন করা।
নীরজা বলল, সবই সংসারে দরকার হয়। তোমার মতো ওরা যে ভীত হয়নি, উদাসীন হয়নি, এতে আমার সাহস বাড়ে।
তুমি কী সত্যি সত্যি তবে এটা চাইছ?
আমি কে চাইবার! চাইলেও যা হবে, না চাইলেও তাই হবে। সেজন্যে ভাবি না। সময়মতো সবাই ঠিক ফিরে আসে।
তোমার কথা শুনলে মনে হয় নীরজা, পৃথিবীতে কোনো দুর্ঘটনা ঘটে না। সময়ে সব ঠিকঠাক হয়ে যায়।
নীরজা এবার কী বলবে ভেবে পেল না। ধীরে ধীরে পরাজিত হওয়ার মতো বলল, ওরা তোমার সন্তান, তেমন কিছু করবে না।
ভুবনবাবুর মাথাটা আবার ঝুঁকে গেল। বলল, নীরজা, ওরা তোমারও সন্তান। ভুললে চলবে কেন!
আঠারো
কলেজ থেকে ফেরার পথে পিয়া মাঝে মাঝে মোড়ের পানের দোকানটার সামনে দাঁড়াত। বলত, তুই দাঁড়া, আমি একটা পান খেয়ে আসছি। সে পানের খিলি এনে বলত, তুইও খা। দেখবি কী সুন্দর লাল টুকটুকে ঠোঁট হয়। সামান্য পান চিবিয়ে ঠোঁট উলটে দেখাত, কীরকম রে!
খুব লাল।
জয়া বলত, আমার লাল হয় না।
যে যত বেশি ভালোবাসতে জানে তার ঠোঁট তত লাল হয় জানিস।
অদ্ভুত সব কথা বলত পিয়া। আমি এখন ভালোবাসায় ডুবে আছি। কী সুখ কথাটা বলেই পিয়া চোখ বুজে ফেলত। মুখটা পিয়ার আশ্চর্য লাবণ্যে ভেসে যেত। চোখ ভারী ভারী দেখাত। চিবুক রাঙা হয়ে উঠত। গোপনে বোধহয় পিয়া কিছু করছে। লজ্জা সংকোচ পিয়ার একদম আজকাল নেই। সুখ কত তীব্র একদিন জানার ইচ্ছে হয়েছিল জয়ার। বলেছিল, এই তোর কেউ আছে?
বলব কেন?
বল না। আমি কাউকে বলব না। আমারও তো কী যে হয় রে। রাতে বিছানায় গেলেই যেন একজন যুবার শরীর আমার পাশে শুয়ে থাকতে চায়। এত দুষ্টুমি আরম্ভ করে দেয় কী বলব, ঘুমই আসে না।
যুবকটি কে? আমি চিনি? প্রিয়া বলল।
পৃথিবীর সব যুবকদেরই বলতে পারিস। সুন্দর মতো যুবক দেখলেই সারাদিন মনটা আনচান করে। রাতের বেলা কী করি বল। বিছানায়ও দেখতে পাই সে লম্বা হয়ে পাশ ফিরে আছে।
পিয়া বলল, খুকি। তোমার কিছু হবে না।
আমার ভয় করে।
এবং এই ভয় সূত্রে ধীরে ধীরে তার সব জানা হয়ে গেছে। কোথায় কত নম্বর ধর্মতলায় কত টাকার বিনিময়ে শরীর ফের পবিত্র হয়ে যায় তাও তার জানা। কী কী ব্যবহারে রহস্যময় আধারে ডুব দিলেও দাগ ধরে না তা জানতেও বাকি নেই। কেবল ভেবেই গেছে। মানুই তার একমাত্র মানুষ যার কাছে সহজেই সে তার ইচ্ছের কথা বলতে পারে। মানুকে সে যেটুকু দিয়েছিল, পৃথিবীর কোনো কাকপক্ষী টের পায়নি, জয়া মানুর চোখে চুমো খেয়েছে! কী আরাম! ট্রামটা তখন গড়িয়াহাটের মোড়ে এসে গেছে। এখানে নেমে উলটোদিকে যাবে। পঁয়তাল্লিশ নম্বরেই সহজ হবে। কালিদাসকে না হলে এড়ানো যেত না। সে ভাবল এবার সেই দোকানটায় যাবে। একবার পিয়া লাল ত্রিকোণ চিহ্নিত কিছু কিনে বলেছিল ‘তুইও কিনে নে’। কখন কাজে লেগে যাবে টেরও পাবি না। সে পিয়ার মতো মহিলা হতে পারেনি, বরং পিয়ার এমন একটা নষ্ট চরিত্র তাকে পীড়া দিয়েছে। অথচ আজ ওর কী যে হচ্ছে যেন সে লাল ত্রিকোণের সাহায্য না নিয়ে কিছুতেই আর বাঁচবে না। মানুটা কোথায় কী করছে কে জানে।
সে খুব বিনীতভাবে কথাটা বলল। এবং দোকানি বোধহয় সামান্য বিস্মিত হয়েছে কথাটায়। কারণ এ মুখ তার ঠিক চেনা নয়। এখানে এ—পাড়ায় কোনো কোন বাড়িতে কী কী ভাবে পরিবার পরিকল্পনা চলছে মোটামুটি তার জানা। জানাশোনার ভিতর এ মেয়েটা কিছুতেই পড়ছে না। জয়া মুখ ঘুরিয়ে প্যাকেটটা কিনে কোনোরকমে দোকানিকে সে দু টাকার নোট দিয়ে দিল। এত বেশি ঘামছিল যে কিছুতেই ফেরত পয়সাটা আর হাত পেতে নিতে পর্যন্ত পারেনি। এবং বাসে উঠেও মনে হয়েছিল সবাই দেখে ফেলেছে। কার দিকে চোখ তুলে তাকাতেই ওর ভীষণ সংকোচ হচ্ছিল।
সারাটা বাস কান মাথা ঝাঁ ঝাঁ করছে। এবং সেই প্রবল এক পুরুষ বিশাল দু বাহু নিয়ে সাপটে ধরেছে এমনই একটা দৃশ্য সারাক্ষণ চোখের ওপর ভেসে চলছিল। শহরের গাছপালা, বাড়ি, ঘর, ট্রাম, বাস, ভিড় কিছুই সে অনুভব করতে পারছিল না। বটুয়ায় সেই নিষিদ্ধ বস্তুটি সারাক্ষণ তাকে উদভ্রান্ত করে রেখেছে।
এবং সে বাড়ি ফিরে এলেই মা বলল, জয়া এলি। আমার পাশে একটু বোস না। সারাদিন কোথায় যে টো টো করিস।
বারে আজ আমাদের কবিতার আসর ছিল না।
কোথায়?
কালিদাস বিনয় এসে নিয়ে গিয়েছিল। ভবানীপুরের দিকে।
তুই কবিতা পড়লি?
বারে পড়ব না।
কোন কবিতাটা পড়লি।
ওগুলো তোমাকে শুনাই নি।
জয়া যে কবিতা পাঠ করেনি, সে চলে এসেছে এবং ভেতরে মানু নামক যুবকের ভয়ংকর দাপট সারাক্ষণ মাতালের মতো রেখেছে, এবং এই বটুয়ার ভেতরে রয়েছে এক সঞ্জীবনী সুধা, যার বিনিময় সে জীবনে প্রথম গভীরে আরও সুগভীরে ঢুকে যাবার জন্য ছটপট করছে—সে সম্পর্কে মাকে কিছুই আঁচ করতে দিল না। খুব স্বাভাবিক গলায় গান গাইল। হাতের আঙুল বটুয়া ঘোরালো! পায়ে পায়ে বাঘা ঘুর ঘুর করল। সেলফের অত্যধিক নিচে লুকিয়ে রাখল তার অন্তর্যামীকে। এবং বাথরুমে ঢুকে তারপর শুধু স্নান। কী কী আছে এই শরীরে প্রায় নাভিমূলে সেই স্বর্ণ কেশদামের মতো অতীব বিলাসিনী রাই। সে স্নান করতে করতে ডাকল মন্টু মন্টু।
কোনো সাড়া নেই।
মা মন্টুর সাড়া নেই কেন!
মা শুনতে পাচ্ছে না কিছু। বিছানায় শুয়ে থেকেই বলছে, কিছু বলছিস জয়া।
মন্টু কোথায় মা?
মন্টু কোথায় জানি না, তো।
আজ আসুক! মাথাটা ভাঙব—বাড়ি না থাকলে স্বাধীন।
বাথরুম থেকে বের হয়ে ঘাড় গলা এবং চুল মুছতে নীল আলোটা জ্বেলে দিল করিডোরের। তারপর ফের ডাকল, মন্টু তুমি কী আমার মতো মরেছ!
মন্টু বলল, যাই দিদিমনি! আমি মরিনি।
দ্যাখ তো, মানুবাবু বাড়ি আছে কিনা!
কিছু বলব?
থাকলে এই চিঠিটা দিয়ে আসবি। খুব দরকার।
আর এসব কথাগুলো বলতে গলা কাঁপছিল জয়ার এবং কেমন একটা জ্বরের মতো ঘোরে পড়ে আছে। ঘোরের ভেতরই সে এতসব করতে পারছে। সামান্য অসুস্থতা শরীরে না জন্মালে বুঝি এতটা বেপরোয়া হওয়া যেত না। সে হাত পা লম্বা করে শুয়ে পড়ল। আলোটা চোখে বড় লাগছে। উঠে আলোটা নিভিয়ে দিল। এবং পৃথিবীতে মা বাবা কিংবা পিসির আদুরে সব ন্যাকামো চিন্তাভাবনা কিছুই আর মাথায় নেই। কেবল এক যুবককে দেখতে পাচ্ছে, সুদূর থেকে হেঁটে আসছে, কত কাল, কত যুগ ধরে হেঁটে আসছে আর বারবার শরীরে মিশে যাচ্ছে। সে কেমন জ্বালা বোধ করল। চোখ জ্বলছে। ওর মনে হচ্ছিল, মানু আসতে না আসতেই সে মরে যাবে।
স্কুটারটা কিছুদূর বাতাসে ভেসে গিয়ে ঝুপ করে একটা জায়গায় থেমে গেল।
রমা বলল, কী হল অরুণ!
অরুণ দেখল, নাকের ডগা দিয়ে আর একটা স্কুটার বের হয়ে যাচ্ছে। এত দ্রুত বের হয়ে গেল বোঝা গেল না কিছু। আরোহী একেবারে বাঘের মতো বাতাসের ওপর দিয়ে লাফিয়ে চলে গেল। মরীচিকা মতো সে কিছু দেখেই তার গতিপথ পালটে সামনের আরোহীকে ধাওয়া করল।
রমা বলল, ওদিকে কোথায় যাচ্ছ!
অরুণ কিছু বলল না। চোখে ভারী গগলস। মাথায় লোহার টুপি এবং কোমরে বেল্ট থাকলে তাকে এখন দস্যুর মতো মনে হতে পারত। সে রেড রোড ধরে হাওয়ার আগে ছুটে যেতে চাইছে।
রমা দেখল, নিমেষে বাস—স্ট্যান্ড পার হয়ে কখন মিন্টের পাশ দিয়ে অরুণ বেগে ছুটে যাচ্ছে আর মাঝে মাঝে স্কুটারের স্পিড তোলার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করছে। কোথায় যাবে কিছু বোঝা যাচ্ছে না।
স্কুটারটা বাঁক ঘুরতেই দূরে আর একটা স্কুটার রমার চোখে ভেসে উঠল। ঠিক ওর মতো কেউ যেন পিছনে বসে রয়েছে। কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। সোজা ডায়মন্ডহারবার রোড ধরে একটা হলুদ বলের মতো দিগন্তে চলে যাচ্ছে স্কুটারটা। রমা এবার আর্ত গলায় বলল, অরুণ কোথায় যাচ্ছ! এত জোরে চালিয়ো না। মরে যাব অরুণ।
অরুণের যেন কিছু শোনার সময় নেই। সামনে আড়াল পড়ছে একটা ট্রাকের। দেখা যাচ্ছে না আর। সূর্য এবার দিগন্তে হেলে পড়ছে। কিছু কাঞ্চন ফুলের গাছ দু—পাশে। মাঠ, জলা জমি, উর্বরা শস্যক্ষেত্র পার হয়ে সে চলে যাচ্ছে। রমা কিছুতেই আঁচল কোমরে গুঁজে রাখতে পারছে না। খোঁপা খুলে গেছে। এবার সব চুল পালের মতো উড়বে। সামনের ট্রাকটা অরুণ নিমেষে পার হয়ে গেল। জীবন নিয়ে এক আশ্চর্য ছিনিমিনি খেলায় মেতে উঠেছে অরুণ। দূরের স্কুটার তার আরোহী এবং যুবতী কিছু যেন চুরি করে নিয়ে পালাচ্ছে, অরুণ যত দ্রুত পারছিল তাদের চেষ্টা করছে ধরার।
রমা বলল, অরুণ তোমার কী হয়েছে।
বাতাসের বিশাল থাবায় সব শব্দ গন্ধ ধুয়ে মুছে যাচ্ছে। রমার কোনো কথাই আর তার কাছে স্পষ্ট নয়। সে কেবল পাগলের মতো হাঁকপাঁক করছে সামনের স্কুটারটা ধরার। আর তারপরই বিশাল একটা দ্রুতগামী যান উঠে এল রাস্তায়। সবকিছু আড়াল দিয়ে একেবারে চিরস্থায়ী হয়ে গেল। যেন আশ্চর্য নিয়তি খাড়া হয়ে আছে সামনে। দ্রুতগামী যান নিশ্চল নিথর। সে চিৎকার করে উঠল, শা…আর কিছু প্রকাশ করতে পারল না। টলতে টলতে স্কুটার থেকে নেমে লাফিয়ে গেল সামনে। আর দূরে দেখল স্কুটারটা বিন্দুবৎ হয়ে যাচ্ছে। ক্রমে ছোটো হতে হতে তার আর দেখা পাওয়া গেল না। প্রকৃতি ভীষণ নির্দয় নিষ্ঠুর। হা হা করে যেন গাছপালা মাঠ, আকাশ হাসছিল।
রমা বলল, কী হয়েছে তোমার।
পেছনে কে বসেছিল।
রমা বলল, লোকটার কেউ হবে।
তুমি মেয়েটার মুখ দেখেছ?
স্পষ্ট কিছু দেখিনি। চুল খোলা ছিল।
অরুণ কেমন নিস্তেজ গলায় বলল, আমি শেষ।
কী বলছ যা তা!
আমার আর অহংকার করার মতো কিছু থাকল না।
অরুণ কী হয়েছে তোমার, বলবে তো?
কিছু হয়নি। চলো।
এবং সোজা সে রমাকে ওর বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে বলল, একটা ফোন করব।
রমা অরুণকে নিয়ে নিচের তলায় গেল। ফোনে অরুণ বলল, অমলা আছে?
কে?
আমি অরুণ বলছি।
ও অরুণ মেসো। কেমন আছেন।
অরুণ বুঝতে পারল না কে কথা বলছে। বিরক্তি এবং অধৈর্য আর কী যে বলবে, যেন পারলে সে এখন গালাগাল দিতে পারলে বাঁচে। তারপরই মনে হল মেজদির ছেলে এখানে বেশ কিছুদিন থেকে আছে। বেয়াদপ ছোকরাটার সঙ্গে তার এখনও দেখাই হল না। যখনই গেছে তখনই শুনেছে বাড়ি নেই। বোধহয় সেই। এবং এতসব ভাবার তার সময়ও ছিল না। তড়িৎপ্রবাহের মধ্যে সব কথাগুলি বড় দ্রুত টরে টক্কা বাজিয়ে গেল। সে বলল, অমলা আছে?
অমলা মাসির কথা বলছ?
তবে আর কার কথা বলব?
অমলা বলতে কত মেয়ে আছে পৃথিবীতে।
সামনে থাকলে হয়তো গালে চড় বসিয়ে দিত একটা। ছোকরার মার সঙ্গে বনিবনা হল না বলে এখানে চলে এসেছে। অমলা কতবার নাকি বলেছে, যাস আমাদের বাসায়। ধুস সে কেন আবার মাথার মধ্যে এতসব টরে টক্কা নিয়ে বেঁচে থাকবে। চোখমুখ জ্বলে উঠছিল। রাগে দুঃখে সে কী যে বলে ফেলত। কিন্তু নিজেকে খুব সামলে নিয়ে বলল, মিতা আছে? মিতাকে ফোনটা দাও।
ছোটমাসি নভেল পড়ছে।
তোমার ন’মাসি কোথায় জান?
মানে অমলা মাসি। সকালে একবার দেখেছিলাম। তারপর আর দেখিনি। দাদুকে ডেকে দেব। দাদু জানতে পারে।
এই দাদুই খেল ছোকরাটাকে। একটা কথার সোজা জবাব দেয় না। একেবারে সব সময় আশ্চর্য রকমের বেয়াড়া কথাবার্তা। অরুণ বলল, তাই দাও।
তখনই ও—পাশ থেকে আবার কথা—ছোটমাসি এসে গেছে।
তুই কার সঙ্গে এত কথা বলছিস নানু?
অরুণ মেসো। অমলা মাসিকে পাওয়া যাচ্ছে না।
মানে?
মানে অরুণ মেসো জানতে চাইছে—এখানে অমলা মাসি আছে কি না। বলেই সে ফোন ছেড়ে আবার রা রা করে গান গাইতে থাকল।
অরুণ ও পাশ থেকে সব শুনে আরও অস্থির হয়ে উঠল। বুঝতে পারছে নানু নামে ছোকরাটা যথার্থই ইতর।
মিতা বলল, অরুণদা।
হ্যাঁ।
দিদিতো ছোটকাকার বাসায় যাবে বলে দুপুরে বের হয়ে গেছে। মুখটা অরুণের ভারি ফ্যাকাশে দেখাচ্ছিল।
তারপরই মিতা বলল, আপনি কোত্থেকে বলছেন? বাসায় দিদি ফিরে যায়নি।
অরুণের সত্যি মনে হল ভুল করে ফেলেছে। আগে বাসায় না গিয়ে এভাবে ফোন করা ঠিক হয়নি। কাকে না কাকে স্কুটারের পেছনে বসে থাকতে দেখে এতটা উত্তেজিত হয়ে পড়া ঠিক হয়নি। সে কেমন নিস্তেজ গলায় বলল, না এমনি ফোন করেছিলাম। তারপর অরুণ ভাবল আর কী বলা যায়। শেষে সামান্য বানিয়ে বলল, বাসায় ফিরতে একটু দেরি হবে দিদিকে বলো।
যদি সোজা চলে যায়!
তা হলে আর বলতে হবে না। তোমাদের ফোন করতে পারে!
অরুণের মাথাটা তারপরেই কেমন ফাঁকা হয়ে গেল। সামনে রমা দাঁড়িয়ে আছে—এই রমাকে নিয়ে আজ পাতালে প্রবেশ করার তালে ছিল—সামান্য একটা স্কুটার তার মাথার মধ্যে কীসব গণ্ডগোলের ছবি জুড়ে দিয়ে গেল—আর সেই থেকে কী যে ভীষণ সংশয়। সে পাগলের মতো রমাকে বলল, যাচ্ছি!
রমা অত্যন্ত ক্লান্ত অবসন্ন। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। সিঁড়ি ধরে ওপরে উঠতে পারছে না।
ভুবনবাবু তখন দৈনিক কাগজটা নীরজাকে পড়ে শোনাচ্ছিলেন। নীরজা চোখে আজকাল ভালো দেখতে পায় না। দিনের বেলাতে সাত পাঁচ কাজের মধ্যে ডুবে থাকে। সন্ধের সময় তিনি নীরজাকে একটু অবসর বুঝে কাগজটা পড়ে শোনান। তিনি পড়তে পড়তে বললেন, শুনতে পাচ্ছ।
নীরজা বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ পড়ে যাও না।
তিনি আবার বললেন, শুনতে পাচ্ছ। বাকিটা যেন এমন শোনাত সিঁড়িতে পায়ের শব্দ…।
তুমি পড়ে যাও না!
তিনি পড়লেন, বাড়ছে পারিবারিক হিংসা। কমছে মানুষের সহিষ্ণুতা। বিবাহ বিচ্ছেদ তো বাড়ছিলই। বাড়ছে আত্মহত্যা। অজ্ঞাত রহস্যময় মৃত্যু বিশেষত নারীদের। তিনি কাগজটা রেখে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যাবেন ভাবলেন। কিন্তু যেতে সাহস পেলেন না! রমা বিপর্যস্ত হয়ে ফিরছে। হিংসা দ্বেষ লোভ, শারীরিক মোহ, স্বার্থপরতা সব মিলে মেয়েটার অস্তিত্বে ঝড় তুলেছে বুঝি।
রমা তখন সোজা বাথরুমে ঢুকে শাওয়ার ছেড়ে দিল। বিকট শব্দ করে জল চারধারে লাফিয়ে ছড়িয়ে ওকে ক্রমে ঠান্ডা করে দিতে লাগল। আর একটা ব্যথাতুর কাতর যন্ত্রণা শরীর বেয়ে যা তাকে সারাদিন অতিশয় সব নিষ্ঠুরতার ভিতর দৌড় করিয়ে মেরেছে ক্রমে শীতল হতে হতে কেমন হিমঠান্ডা হয়ে গেল। আর আশ্চর্য এত কান্না কেন বুক গুমরে উঠে আসছে তার! কী যে থাকে, অপমান আর লাঞ্ছনার যেন শেষ নেই জীবনে। যুবতীর সব ঐশ্বর্য হেলায় লোকটা আস্তাকুঁড়ে কোন অহংকারে ছুড়ে দিতে পারল বুঝল না। তার মরে যেতে ইচ্ছে করছিল।
আরও রাত করে ফিরল ভানু। সে কেমন গুমরে বসে থাকল কিছুক্ষণ। মানু ফিরে এলে নীরজা বলল, জয়া তোকে যেতে বলেছে কী একটা বই নিয়ে। মানু বলল, কাল যাব।
দুবার খোঁজ করেছে। তাছাড়া একটা ছেলে এই চিঠিটা দিয়ে গেছে। নীরজা বলল।
করুকগে। মানু রেডিয়োর নব ঘুরিয়ে আর একটা নতুন সেন্টার ধরার চেষ্টা করার সময় চিঠিটা খুলে ফেলল—সেই অহংকারী ছেলেটার চিঠি। চিঠিতে লিখেছে, বুঝতে পারছি তুমি আর ভালো নেই। বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থায় মানুষ ভালো থাকে না। এখন চাই সৎ মানুষ, পরিশ্রমী মানুষ। ঠিকঠাক বেঁচে থাকার জন্য আজ এটা আমাদের বড় বেশি দরকার। মানু রেডিয়ো বন্ধ করে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। সামনে বিরাট উদার আকাশ। তার নিচে কত অবহেলিত জনপদ। সে যেন কবে থেকে কোথাও যাবার জন্য অস্থির হয়ে উঠছে।
সবাই ঠিক ঠিক ফিরে আসায় ভুবনবাবু আজকের মতো রাতে ভালো ঘুমাতে পারবেন। কাল পরশু এবং তারপর অন্য কাল পরশু কী হবে তিনি জানেন না। শুধু এটুকু জানেন, যতদিন আছেন নির্বিঘ্নে আর জীবন কাটাতে পারবেন না। সমস্যা দিন দিন সবার মতো তারও কেবল বাড়ছে। আগে একমাত্র সমস্যা ছিল তিনি নিজে, নীরজা এলে দু’নম্বর সমস্যা। সন্তান হলে তিন নম্বর সমস্যা। ওরা যত বড় হতে থাকল, তত অজস্র সমস্যায় নিপীড়িত হতে থাকলেন তিনি।
উনিশ
নানুর ঘুম আসছিল না। সে পাশ ফিরে শুল। জানালা খোলা। আকাশে কিছু নক্ষত্র। সে শুয়ে শুয়ে এক দুই করে নক্ষত্র গুনতে থাকল। সব দেখা যায় না। যতবার গুনছে ততবারই মনে হচ্ছে অসংখ্য নক্ষত্র বাদ পড়ে গেল। অনেকক্ষণ এসব করার পর হাতে মুখে জল দেবার জন্য বারান্দায় এল। পাশে বাথরুম। বাথরুমে ঢুকে ঘাড়ে গলায় জল দিল। চোখে জলের ঝাপটা দিল। বেশ নিশুতি রাত—কিছুক্ষণ বাইরের ইজিচেয়ারে শুয়ে থাকল। একটা রেলগাড়ি এইমাত্র চলে গেল। শেষ বাস গুমটিতে ঢুকে যাচ্ছে। সে মানুর কাছে গিয়েছিল, ভেবেছিল মানু কলেজে আসবে। ওর সঙ্গে পরামর্শ করার দরকার ছিল। সে একটা সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। এত বড় শহরে মানুকেই সব খুলে বলতে পারে।
ঘুমটা হয়তো এজন্যই আসছে না। মানুষের জীবন এক—একটা সময় আসে যখন একজন কাছের জন দরকার হয়ে পড়ে। সারাদিনটা আজ বিদঘুটে সব ঘটনার মধ্য দিয়ে কেটে গেল। শেষমেশ অরুণ মেসোর ফোন। আশ্চর্য, মাসিদের কী কোনো রোগ আছে—অমলা মাসি দেখতে কী সুন্দর—কেমন মিষ্টি কথা বলে, চোখ দুটো দেখলে বড় পবিত্র পবিত্র লাগে। মাসি কোথায় যায় মেসো খবর রাখে না কেন এবং ফোন ধরে কেন জানি অমলা মাসির খোঁজ করতেই তার মার মুখ মনে পড়ে গেছিল। যেমন মা তাকে একা রেখে কোনো কোনো দিন বেশ রাত করেই ফিরেছে। সে ভারি ছটফট করত। অথচ তার ভিতরের দুঃখ অথবা অভিমানের কোনো দামই দিত না। মেসোর ফোন পেয়ে প্রথম মনে হয়েছিল, বেশ জব্দ তুমি বাপ—বউ কোথায় জান না। তারপরই মনে হয়েছে—সে মানুষটাকে দেখেই নি। কেমন দেখতে অরুণ মেসো—বিয়ের সময় সে অথবা মা কেউ আসতে পারেনি। এখানে আসার পরও আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে সে কখনও যায়নি। ওর মনে হয়েছে সবাই জানে তার বাবার আত্মহত্যার খবর। যে ছেলের বাবা আত্মহত্যা করে তার মাথা তুলে কথা বলারও যেন অধিকার নেই। এসব কারণেই তার কোথাও আর যাওয়া হয় না। অথবা কী এ—সময়ে মানুষেরা সব্বাই গ্রন্থিমোচনে ব্যস্ত। সম্পর্কহীন মানুষই কী শহরে বেশি—ঠিক তার মতো। ফলে এইসব আজেবাজে চিন্তায় নানুর সত্যি ভালো ঘুম হল না রাতে। শেষ রাতের দিকে সে একটা দীর্ঘ স্বপ্ন দেখল। স্বপ্নটা জলজ্যান্ত একটা চাটুর। গোল চাটুটা আগুনে দগদগে লাল। চাটুটা ঘুরছে। এবং চাটুটার মধ্যে বাবার সেই চশমাটা। চশমার একটা কাচে নানুর মুখ আর একটা কাচে নবনীতার মুখ। নবনীতা ঠোঁট টিপে হাসছিল।
অদ্ভুত সব ঘটনার মধ্যে স্বপ্নটা শেষ হয়ে গেল। সে দেখল একটা রাজবাড়ি, দরজায় এক হাত গন্ডারের ছবি—এবং ফুটপাথে অজস্র না খেতে পাওয়া মানুষের বিপ্লব। রাজবাড়ির পাঁচিল থেকে ইঁট খসিয়ে কারা নিয়ে যাচ্ছিল। দলের মধ্যে সেও একজন। আবার একটা মস্ত মই দেখল সে সিঁড়ির মতো আকাশে উঠে গেছে। সিঁড়িটা ধরে বেশ উঠে যাচ্ছিল। কখন যেন কারা সিঁড়ির নিচটা আলগা করে দিল। সিঁড়িটা শূন্যে ঝুলে আছে। নিচে দেখল লীলা দাঁড়িয়ে বলছে, তুমি কোথায় যেতে চাও দাদাবাবু। নেমে এসো। সে লাফ দিয়ে পড়তে গিয়ে মনে হল, ডানা গজিয়েছে এবং নীল আকাশের নিচে তখন সে আর লীলা। ওরা পাখি হয়ে গেছে। তখনই দেখল একটা বড় মাঠ, মাঠে নবনীতা ছুটছে। পেছনে ওর বাবা ছুটছে। নবনীতার ম্যাকসি বাতাসে উড়ছিল। চুল উড়ছিল। নবনীতাকে ধরার জন্য এখন আর তার বাবা ছুটছে না, তার পাড়ার দাদারা ছুটছে। একটা নদীর ধারে নবনীতা এসে দাঁড়িয়ে হতবাক হয়ে চেয়ে আছে। তখন নবনীতার গায়ে পোশাক নেই। সে দূরে দেখতে পাচ্ছে দাদারা আসছে—ওদের হাতে গাছের ডাল, ইঁটের টুকরো। নবনীতা প্রাণভয়ে নদীতে ঝাঁপ দিল। এখানেই স্বপ্নটা শেষ। দেবী বিসর্জনের মতো জলে ঝাঁপ দিলে যে শব্দ হল সে শব্দমালা তাকে জাগিয়ে দিয়ে গেল। সে উঠে দেখল সকাল হয়ে গেছে। তার অনেক করণীয় কাজ। এবং বাথরুম থেকে আরম্ভ করে সকালের খাবার সে তাড়াতাড়ি শেষ করল। তারপর ব্যাংক এবং দাদু এই দুই কর্তাব্যক্তির সঙ্গে দিনটা কেটে গেল তার।
এর কিছুদিন পরেকার কথা। বাইরে ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুর গরম হাওয়া বইছে। বৃষ্টি হবে হবে করেও হচ্ছে না। রোজই খবরের কাগজে বড় করে বিদ্যুৎসহ বৃষ্টিপাতের কথা থাকে। কিন্তু দিন শেষে না ঝড় না বিদ্যুৎ। কেবল এলোমেলো বাতাস। প্রবল দক্ষিণা বাতাসে ভ্যাপসা গরম এবং সূর্য হেলে গেলে কিছুটা ঠান্ডা আমেজ নেমে আসছে শহরে। শহরতলির একটা বাড়িতে লীলা তখন ভাঙা আয়নার সামনে চুল বাঁধছিল।
তখনই খুট খুট শব্দ দরজায়। এই পড়ন্ত বিকেলে মামাবাবুর সঙ্গে কেউ দেখা করতে আসতে পারে ভেবে সে দরজা খুলতেই দেখল, দাদাবাবু। খুব মিষ্টি হাসি মুখ। হাতে কীসের একটা প্যাকেট। লীলা বলল, ওরা কেউ বাড়ি নেই।
নানু বলল, তুমি আমাকে ঢুকতে দেবে তো।
লীলা সরে দাঁড়াল। ওর চুল বাঁধা এখনও শেষ হয়নি। সে কিছু না বলেই চুল বাঁধতে রান্নাঘরে ঢুকে গেল। বসার ঘরটায় তালা ঝুলিয়ে যায়নি, তাই রক্ষা। নানু বসার ঘরে ঢোকার আগে বলল, দরজা বন্ধ করে দিয়ে যাও।
দরজা বন্ধ করতে গিয়ে লীলার হাত কাঁপছিল।
চা করতে পারবে?
লীলা রান্নাঘর থেকে বলল, কিছুই বাইরে নেই দাদাবাবু।
ঠিক আছে। তুমি এসো। ও ঘরে তুমি কী করছ?
লীলার গলাটা কেমন শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে। দাদাবাবুর চোখের দিকে সে তাকাতে পারে না। তাকালেই ভিতরটা গুড় গুড় করে ওঠে। সে বলল, কী হবে গিয়ে?
এসোই না।
মামিমা বকবে।
কে বকবে?
মামিমা।
গুলি মারো মামিমাকে। আসতে বলছি আসবে।
লীলা কোনোরকমে দরজা পর্যন্ত হেঁটে এল। ভারি ভয় তার। সে ভয়ে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকল।
এই নাও। বাইরে দাঁড়িয়ে কেন। আমি বাঘ না ভালুক। ভয় পাচ্ছ কেন?
লীলা ভেতরে ঢুকে বলল, কী নেব?
দেখই না খুলে।
লীলার মুখটা ভীষণ লাল হয়ে গেছে। চোখ দুটোতে আশ্চর্য নীরবতা। এবং বুকের মধ্যে সমুদ্রের ঝড়। সে তাকিয়ে থাকল শুধু।
কী হল, নাও। দাঁড়িয়ে থাকলে কেন। ছেঁড়া ফ্রক গায়ে দিয়ে লোককে না দেখালে বুঝি ভালো লাগে না।
লীলা খুব শান্ত হবার চেষ্টা করছে। সে বলল, দাদাবাবু আপনি খুব ছেলেমানুষ।
তুমি বুঝি খুব বুড়ি।
নানুর কথার কোনো জবাব না দিয়ে বলল, আমাকে আস্ত রাখবে না।
সাহস হবে না লীলা।
লীলা আর জোর পাচ্ছে না। সে হাঁটুমুড়ে বসে পড়ল। সমস্ত শরীর তার ভেঙে আসছে। কতকাল পর একজন ভালো মানুষের কাছ থেকে এই সহৃদয় ব্যবহার। সে বলল, দাদাবাবু কপালে আমার এত সুখ সইবে না।
নানু লীলাকে হাত ধরে টেনে তুলল—ওঠো। তুমি যাও। পরে এসো। আমি দেখব লীলা। তোমাকে শাড়ি পরে কেমন লাগে দেখব।
লীলা অগত্যা উঠে চলে গেল। এবং যখন শাড়ি পরে এসে সামনে দাঁড়াল, নানু প্রথমে তাকাতে পারল না। সে বলল, ন…ব…নী…তা।
লীলা কিছুই বুঝতে না পেরে বলল, আমি যাব?
নানু ভারী আবেগে সেই কথাটাই শুধু বলল, ন…ব…নী…তা। গানের মতো করে বলল।
নানু আজকাল কোনো কারণে ভারী আবেগ বোধ করলে শিস দেবার মতো বলে ওঠে নবনীতা। তার সব আনন্দের প্রকাশ এই একটিমাত্র কথাতেই। সব দুঃখ এবং হতাশা থেকে আজকাল এই একটা মাত্র কথাই জীবনে তাকে মুক্তি এনে দেয়। সে বলল, নবনীতা আবার আমি আসব।
লীলা বলল, ওরা বাড়ি থাকলে আসবেন।
নানু বলল, আমার খুশিমতো আসব। আসলে নানু একটা কিছু করতে চায়। সেটা যে কী সে নিজেও জানে না। রোজই সকালে উঠে ভাবে, সে একটা ভয়ংকর সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে এবং সেই সিদ্ধান্তটা যে কী ঠিক কিছু তার কাছে স্পষ্ট নয়। ভিতরে এক ধরনের অস্থিরতা দানা বাঁধছে। কলেজে যাচ্ছে না। মানুর সঙ্গে দেখা নেই। মানুর সঙ্গে দেখা হলে ভালো লাগত। কিন্তু তার এখন কোথাও যেতেও ইচ্ছে করছে না। একা এবং নিজের মধ্যে থাকার স্বভাব ধীরে ধীরে তার গড়ে উঠছে সে এটা ক্রমশ টের পাচ্ছে।
এবং সত্যি সে আর একদিন খুশিমতো চলে এল। যখন শহরে ঘুরে সিনেমা দেখে অথবা কোনো পার্কে চুপচাপ বসে থেকে তার কিছু ভালো লাগে না, তখনই মনে হয়, অসহায় সেই তরুণীর কাছে তার ভালো লাগবে।
একদিন কী হল, একটা বড় রেস্তোরাঁয় বসে ফ্রাইড রাইস, চিকেন কারি, এবং আইসক্রিম খেতে তার মনে হয়েছিল, লীলা জানে না, ফ্রাইড রাইস এবং চিকেন কারি বলে কোনো সুন্দর খাবার আছে। সে নিজে খেয়ে এক প্যাকেট ফ্রাইড রাইস এবং চিলি চিকেন নিয়ে সোজা সেই শহরতলির বাড়িটার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল। সকালের দিকে বৃষ্টি হওয়ায় বেশ ঠান্ডা আমেজ রয়েছে বাতাসে। এবং বর্ষা এবারে চলে আসবে বলে হাওয়ায় আর্দ্রতা অনুভব করা যাচ্ছে। শহরতলিতে নেমেই দেখল, গাছপালা সবুজ, ঝোপঝাড় জলের গন্ধ পেয়ে বেড়ে উঠেছে—পাশাপাশি অন্য সময়ের চেয়ে যেন বেশি উড়ছে। বলতে গেলে বেশ সুসময়। সে লীলার জন্য এক প্যাকেট ফ্রাইড রাইস নিয়ে আসতে পেরেছে। ভারি তৃপ্তি বোধ করছিল মনে মনে। এবং যখন দরজা ঠেলে বাড়িটায় ঢুকল, দেখল, জেঠু কলতলায় বসে চায়ের বাসন ধুচ্ছে।
দাদা এসেছে। দাদা এসেছে। কুটু এসে নানুকে জড়িয়ে ধরল। জেঠি অসময়ে শুয়ে আছে। ঘটর ঘটর টেবিল ফ্যানটা চলছে। তাকে দেখে জেঠি উঠে বসল, এলি? আমার শরীরটা ভালো নেই বাবা। শুয়ে আছি।
সে ভেবেছিল, সেদিনের মতো বাড়ি কেউ থাকবে না। সে এবং লীলা শুধু থাকবে। লীলাকে বলবে, তুমি আমার সামনে বসে খাও। লীলা যখন খাবে অথবা লজ্জায় লীলা যদি খেতে না পারে সামনে বসে তখন সে বলবে লজ্জা কী মানুষই তো খায়। না খেলে কেউ বাঁচে। কিন্তু সেই লীলাকেই দেখতে পাচ্ছে না। সে তখন সোজা বলল, লীলা কোথায় জেঠি?
জেঠির মুখ কুঁচকে গেল। বলল, আর বলিস না বাবা, এমন মেয়ে কোথায় কী কেলেঙ্কারি করবে, তাই ছাড়িয়ে দিয়েছি।
কীসের কেলেঙ্কারি জেঠি?
এই মানে, আমরা বাড়ি থাকি না, কিছু হলে কলঙ্কের ভাগী। মেয়েটার স্বভাব ভালো না বাবা।
নানুর মাথায় সেই যে বলে না, একটা রেলগাড়ি ঢুকে যায় মাঝে মাঝে, সেটা আবার ঢুকে যেতে থাকল। সে দাঁড়িয়ে প্রথমে মাথার মধ্যে গোটা রেলগাড়িটাকে ঢুকতে দিল। তারপর যখন রেলগাড়িটা মাথার মধ্যে ঢুকে চোখ তুলে লাল লাল হয়ে গেল, মুখ গম্ভীর হয়ে গেল, পেশি ফুলে উঠতে থাকল, তখনই জেঠির চিৎকার, ও মা দ্যাখ এসে ও কুটু তোর বাবা কোথায়, তাড়াতাড়ি আসতে বল, নানুর চোখমুখ কেমন হয়ে যাচ্ছে।
কলতলা থেকে অবনীশ কাপ প্লেট ফেলে ছুটে এল, কী হয়েছে নানু? তোর কী হয়েছে?
নানু বলল, কিছু হয়নি তো।
জেঠি বলল, তোমার মরণ। দেখছ না নানুর চোখ কোথায় উঠে গেছে।
নানু বুঝতে পারছিল না, সে একটা অন্যরকমের মানুষ হয়ে যাচ্ছে। খবরটা শোনার পর সে কিছুতেই আর ধাতস্থ হতে পারছে না। সবকিছু তচনচ করে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে। তখন জেঠু সামনে দাঁড়িয়ে শুধু বলল, বোস। দাঁড়িয়ে রইলি কেন?
কুটু বলল, দাদা হাতে তোমার কী দেখি?
নানু হাত সরিয়ে নিল। কুটু আবার কোমর জড়িয়ে বলল, দাদা তুমি রাগ করেছ?
কুটু ফের বলল, না দাদা আমি তাড়াইনি। মা লীলাদিকে চুল ধরে বের করে দিয়েছে।
তখনই মহীয়সী বলল, কুটু চুউপ। তুমি আমার হাড়মাস জ্বালিয়ে খাচ্ছ। কে বলেছে আমি বের করে দিইছি। নারে নানু কুটুর কথা তুই বিশ্বাস করিস না।
নানু কিছুই আর শুনতে পাচ্ছে না। কতদিন ধরে সে একটা অন্ধকার পথে হেঁটে যাচ্ছিল। কতদিন ধরে চারপাশে কেউ আলো জ্বেলে দেয়নি।
লীলাকে দেখার পর মনে হয়েছিল, ভারী অসহায় এই মেয়ে—আশ্চর্য আকর্ষণ রয়েছে লীলার চোখে মুখে—সে লীলার জন্য প্রাণপাত করতে পর্যন্ত পারে।
সে কুটুকে বলল, লীলা কোথায় গেছে জানিস?
কুটু বলল, না।
সে অবনীশকে বলল, লীলা কোথায় আছে তুমি জান?
অবনীশ তাকাতেই তার স্ত্রী চোখ টিপে দিল। অগত্যা সে বলল, কোথায় আর যাবে। কোথাও কাজটাজ আবার ঠিক করে নিয়েছে হয়তো।
ওর বাড়ির ঠিকানাটা দেবে?
অবনীশের স্ত্রী বলল, লাবণ্য জানে। লাবণ্যই ঠিক করে দিয়েছিল।
লাবণ্য কে? কোথায় থাকে?
সত্যি ফ্যাসাদে পড়া গেল। অবনীশের স্ত্রী বলল, মাথা খারাপ করিস না নানু। ঝি—মেয়ের জন্য তুই মাথা খারাপ করিস না।
নানু বলল, আমার মাথা খারাপ, ভালোই বলেছ। আমার মাথা খারাপ, বাবার মাথা খারাপ, বাবা মরে যাবার পর তো তোমরা পুলিশকে এমনই সব বলেছিলে। অথচ তোমরা বাবার মৃত্যুর জন্য দায়ী। তুমি, তোমাকে আমি খুন করব।
ওগো, ও কী বলছে।
অবনীশ বলল, নানু, আয় ঘরে আয়।
কোথাও যাব না। বলো, লীলা কোথায় আছে?
খুন হওয়ার চেয়ে ঠিকানা দেওয়া অনেক সহজ। অবনীশের স্ত্রী একটা গাঁয়ের নাম বলল, একটা রেল স্টেশনের কথা বলল। চার ক্রোশ পথ হেঁটে যেতে হয় বলল। একটা বড় অশ্বত্থ গাছের নিচে নদী বয়ে গেছে বলল। এবং নদীটা পার হলেই মেঠো পথ ধরে গেলে লীলাদের বাড়ি দেখা যায়।
গাঁয়ের নাম, স্টেশনের নাম নিয়ে নানু বের হল। অশ্বত্থ গাছের নিচে নদী এবং নদী পার হয়ে মেঠো পথ খাঁ খাঁ মাঠ এবং শেষে কিছু গ্রাম গঞ্জ। গ্রাম গঞ্জ পার হলে আবার খাঁ খাঁ মাঠ তারপরই খড়ের বাড়ি—লীলা এমন একটা বাড়ি থেকেই এসেছে। সে আর দেরি করল না। বাইরে এসে সাইড ব্যাগের মধ্যে খাবার গুলি পুরে রাখল। বাইরে ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুর। গাছপালা সবুজ হয়ে আছে, এবং পাখিদের কলরব সবই আগের মতো। শুধু লীলা নেই। লীলা না থাকলে এইসব কত অর্থহীন। নানু টের পেল। সে হাঁটছে ঠিকই কিন্তু পায়ে জোর পাচ্ছে না। কতদূরে লীলা চলে গেছে। আর তারপর এক সকালে সেই স্টেশনে নেমে সে হাঁটা দিল। কথামতো অশ্বত্থ গাছ এবং নদী পেয়ে গেল। নদী পার হলে মেঠো পথ ধরে সে এগোতে থাকল। কথামতো সে খাঁ খাঁ মাঠও পেয়ে গেল। খড়ের মাঠ দিগন্ত বিস্তৃত রোদে সব যেন পুড়ে যাচ্ছে। সে হাঁটছে। সে হেঁটে যাচ্ছে। দুপুর গড়াতেই দূরে দেখতে পেল খড়ের ঘর। একটা পরিত্যক্ত গাঁ। মানুষজন সব কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে।
যত খড়ের বাড়িটা এগিয়ে আসছিল, তত বুক ধুকপুক করছিল নানুর। সে কত গ্রাম—মাঠ—গঞ্জ ভেঙে এসেছে, তার ব্যাগে এখনও খাবার রয়েছে। খাবারগুলো পচে যাচ্ছে। এগুলো খেলে লীলার অসুখ হতে পারে। এ কথাটা মনে হওয়ামাত্র সে খাবারগুলো ফেলে দিল। শূন্যদিগন্ত, চারপাশে, অন্য টিলার মতো উঁচু জায়গায় সেই খড়ের বাড়িঘর নিয়ে একটা গাঁ। লীলা এখানে বড় হয়েছে—এমন নীরস অনুর্বর ভূমিতে লীলার জীবন কেটে গেছে ভাবতেই সে দেখল, একটা লোক এক কাঠা ধান নিয়ে রাস্তায় বসে আছে নদী পার হয়ে যাবে বলে। নানু তাকে লীলার কথা বললে, সে চিনতে পারল না। নানু লীলার মার নাম বলল, লোকটা বলল, এগিয়ে যান, ধুলো দফাদারের বউয়ের হল গে এই বেটি।
সেই উঁচু টিলার মতো জায়গাটা ক্রমে এগিয়ে আসতে থাকল। দু—পাশে শুধু ধু ধু প্রান্তরের মতো খড়ের মাঠ। কোথা কিছু ছাগল, রাখাল বালক এবং শীর্ণকায় গভীর দল চোখে পড়ল তার। দূর থেকে গাঁটা যতটা পরিত্যক্ত মনে হয়েছিল আসলে ততটা পরিত্যক্ত নয়। গরিব—দুঃখীদের বাস এই গাঁয়ে। কোনো বড় বাড়িঘর এখনও চোখে পড়ছে না।
বারবারই তার মনের মধ্যে একটা সংশয় পাক খাচ্ছে। লীলা আছে তো। লীলা যদি এখানে না এসে অভিমানে কোথাও চলে যায়! যদি লীলাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়! যদি লীলা নদীর জলে ডুবে মরে—অথবা সবসময় কেন জানি লীলার সেই বড় বড় চোখ তাকে বারবার তাড়া করে আসছিল। হয়তো লীলা একটা গঞ্জের মতো জায়গায় গাছের নিচে শুয়ে আছে। একটা পুঁটলি মাথায়। না খেয়ে না খেয়ে চোখে কালি পড়ে গেছে। চুল উসকোখুসকো। অথবা কোনো নির্জন নদীতীরে মেয়েটা আউল—বাউলের মতো কেবল হেঁটে যাচ্ছে। নানুর মনে কত রকমের যে কুচিন্তার উদয় হচ্ছে।
এবং তখনই সেই ঘরের সামনে সে হাজির। ভাঙা মাটির দেয়াল, খড়ের ছাউনি, কিছু কলাগাছ, একটা ছাগল খুঁটিতে বাঁধা, দুটো মোরগ ঘাড় বাঁকিয়ে ওকে দেখল, সে বাধ্য হয়ে গলাখাঁকারি দিল একটা। কেউ বের হচ্ছে না। সে এবার বলল, ধুলো দফাদার আছো? তবু সাড়া নেই। চারপাশে ঝোপ—জঙ্গল, পেছনে বাঁশের ঝাড় কেমন অত্যন্ত শ্রীহীন মানুষের আবাস। সে একটা গাছের গুঁড়িতে অগত্যা বসে পড়ে ডাকল লীলা, লীলা।
এবার কেউ যেন সাড়া দিল। ঘরের ভেতর থেকে কারও গোঙানি আসছে। তাহলে কেউ আসছে। আর তখনই সে দেখল জঙ্গলের ভিতর থেকে চার—পাঁচটা নগ্ন কচিকাচা ছেলেমেয়ে বের হয়ে আসছে। তাকে দেখেই চোখে ওদের সন্দিগ্ধ দৃষ্টি। কলকাতায় নকশালবাবুরা সব গাঁয়ে গাঁয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। তিনি যদি তাঁদের কেউ হন। সে বলল, লীলা আছে? লীলা? ওর কথা শুনে ওরা যেমন লাফিয়ে লাফিয়ে এসেছিল আবার তেমনি লাফিয়ে লাফিয়ে জঙ্গলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল এবং তখনই মনে হল সে কোনো এক নারীকণ্ঠ শুনতে পাচ্ছে বনের গভীরে। সে বুঝতে পারল, লীলার কণ্ঠস্বর। ওর ভিতর থেকে কে যেন বলল, তখন, ভগবান লীলাকে আমি খুঁজে পেয়েছি। সে জোরে ডাকল, লীলা—লীলা।
কিছুক্ষণের মধ্যে সেই নারী এসে হাজির। মলিন বসন। চোখে অপার বিস্ময়।—তুমি দাদাবাবু?
কোথায় ছিলে? কখন থেকে ডাকছি।
শেয়াল মুরগি ধরে নিয়ে গেছে। খুঁজতে গেছিলাম।
ওর চারপাশে সেই কাচ্চাবাচ্চা। প্রায় দু গন্ডা, লীলার কোলে একটা সাত আটমাসের বাচ্চা। এরা কারা? এই প্রশ্নটাই নানুর মাথায় বিজবিজ করছিল।
তখন সেই নারী সুধা পারাবার বলল, দাদাবাবু, কেন তুমি এলে?
বারে কতদিন তোমাকে দেখি না। এখন আমাকে আগে এক গেলাস জল খাওয়াও তো।
একটা নিকেলের তোবড়ানো গেলাসে নানুকে লীলা জল এনে দিল। তারপর বলল, একী চেহারা করেছ শরীরের।
সব ঠিক হয়ে যাবে।
লীলা হাসবে কী কাঁদবে ভেবে পেল না। বাড়িঘরের এই দশা, কোথায় এমন পাগল মানুষটাকে যে সে বসতে দেবে। ঘরে ছেঁড়া কাঁথায় লেপ্টে আছে তার জননী। জ্বর কতদিন থেকে। লীলাকে বলছে কে রে লীলা।
লীলা শুধু বলল, দাদাবাবু।
কোথাকার দাদাবাবু?
আমি যেখানে ছিলাম মা।
সহসা আর্তচিৎকারে সেই জননীর গলা ভয়ংকর হয়ে উঠল! তোর মরণ হয় না কেন রে, তোরে যমে দেখে না কেন রে, তুই আবার মরতে ফিরে এলি, কটা তোর বাপ আছে যে খাওয়াবে? দাদাবাবুর সঙ্গে পীরিত করতে গিয়ে তোর কাজ গেল রে। লীলা বলল, মা চুপ চুপ। দাদাবাবু খুব ভালো মানুষ।
সঙ্গে সঙ্গে কেমন জল হয়ে গেল লীলার মা। সত্যি বলছিস ভালোমানুষ। ভালোমানুষের বংশ তবে মারধর করে তোকে তাড়িয়ে দেয় কেন?
নানু বুঝতে পারল অভাবে অনটনে লীলার মার মাথাটি গেছে। সে ঘরে ঢুকে বুঝল, আসলে এটা মানুষের আবাসই নয়। খড় বিচালী সরে গিয়ে আকাশ দেখা যাচ্ছে। একদিকের মাটির দেওয়াল ধসে পড়েছে। এক কোণায় একটা তালপাতার চাটাইয়ে এক অস্থিচর্মসার রমণী পড়ে আছে। শুধু গলার আর্ত চিৎকারই সম্বল। নানু শিয়রে বসে বলল, ধুলো দফাদার কোথায়?
পাত্তা নেই। কোথায় থাকে, কী খায়, কেউ জানে না বাবু। আমার গতরে আর রস নেই।
নানু বলল, তোমার কী হয়েছে মা?
আমার মরণ অসুখ ধরেছে বাবা।
কিছুই হয়নি। তুমি দেখো ভালো হয়ে যাবে। তারপর লীলার দিকে তাকিয়ে বলল, ডাক্তার পাওয়া যায় না এখানে?
স্টেশনে আছে, সে তো অনেক দূর।
গাঁয়ের কাউকে পাঠাবে? টাকা দিচ্ছি সাইকেলে যদি যায়।
লীলার মা উঠে বসল। বলল, তুমি সাক্ষাৎ দেবতা বাবা। ভগবান আমার কপালে এত সুখ।
নানু বলল, উঠে বসো না। খুবই দুর্বল দেখছি। এবং লীলার একটা ভাই কোথাকার একজন খাকি প্যান্ট পরা মানুষকে নিয়ে এসে বলল, শ্রীহরিদা এয়েচে।
সে শ্রীহরিকে বলল, এই টাকা নাও। লীলার দিকে তাকিয়ে বলল, কী কী আনতে হবে বলে দাও। ঘরে তো কিছুই নেই মনে হচ্ছে। তারপর নানু শ্রীহরির দিকে তাকিয়ে বলল, তুমিও রাতে এখানে খাবে।
সন্ধ্যার দিকে সাইকেলের ঘণ্টি বাজিয়ে ডাক্তার এল। অষুধ এবং পথ্যি দিয়ে নানুর দিকে তাকিয়ে বলল, মহাশয়ের কোথা থেকে আগমন?
নানু বলল, কলকাতা থেকে।
সেই একবার কলকাতায় গেছিনু। কতকালের কথা! এখন চোখে ভালো দেখতে পাই নে। কোথাও যাই না।
নানু পাঁচটা টাকা দিলে অনন্ত মাঝি বলল, তিন পুরিয়া করে অষুধ থাকল। দিনে তিনবার। বার্লি আর কাগজি লেবু। ভালো খেলে শরীর সুস্থ হয়ে যাবে। সকালে ভাত দিতে পারেন কাল। শিঙি মাছের ঝোল হলে ভালো হয়। গাঁদাল পাতার ঝোলও দিতে পারেন।
তারপর ঘণ্টি বাজিয়ে চলে গেল ডাক্তার অনন্ত মাঝি। নানু উঠোনে দাঁড়িয়ে দেখতে পেল মাথার ওপরে আজ কতদিন পর মুক্ত আকাশ। লীলা চাল ডাল তেল বুঝে নিচ্ছে শ্রীহরির কাছ থেকে। শ্রীহরি বলল, বিড়ি আনলাম দাদাবাবু এক প্যাকেট। নানু বলল, বেশ করেছ। তোমার গাঁটা আমি দেখব শ্রীহরি। এবং তখনই লীলা বলল, দাদাবাবু তুমি থাকবে কোথায়?
নানু বলল, সে নিয়ে ভাববে না। উঠোনে একটা চাটাই পেতে দিয়ো। তাতেই হবে।
যেন কতদিন পরে নানু প্রবাস থেকে ফিরে এসেছে। আশ্চর্য মুক্তির স্বাদ। যেন নতুন জীবন শুরু হল। সে কোথাকার নানু, তার বাবা আত্মহত্যা করেছিল, মা একটা নতুন লাল বল পেয়ে তার কথা ভুলে গেল এবং সে কত যে অসহায় ছিল, এখন আর তা কিছুই মনে পড়ছে না। জীবন জুড়ে এক নতুন অস্তিত্বের আস্বাদ। লীলা এরই মধ্যে একটা ফুলতোলা আসন নিয়ে এল। নানুকে বারান্দায় বসতে দিল। এবং এত সংকোচ লীলার যে সে প্রায় সবসময়ই নির্বাক—নানুই যেমন একসময় বলল, আমি চান করব লীলা। অবশ্য এখানে আসার আগে তার মনে হয়নি রাতের পোশাক দরকার, জামাকাপড় আলাদা দরকার। সে এক জামাকাপড়ে এখানে চলে এসেছে। এখন এই রাতটা কাটাতে পারলে তার ভাবনা নেই। সকালে উঠে যেমন একজন গৃহীমানুষ সওদা করতে যায়, সে তেমনি কাল সওদা করতে যাবে। সঙ্গে লীলা থাকবে। এবং এমনই যখন ভাবছিল তখন লীলা বলল, দাদাবাবু পুকুরের জলে চান সইবে?
খুব সইবে। অর্থাৎ যেন বলার ইচ্ছা নানুর, তুমি এত সইতে পারো, আর আমি এটুকু সইতে পারব না।
লীলা বলল, তোমাকে কী পরতে দিই বলতো। কিছু নেই। আমার ধোওয়া শাড়িটা নাও। ওটা পরবে। নানু দেখল, তার দেওয়া একটা শাড়ি লীলা সুন্দর করে ভাঁজ করে রেখেছে সামনে। তারপর নানু চান করল পুকুরের জলে। ছোট ছোট দু’গণ্ডা ভাইবোন, কিছু লীলার বাবার, ধুলো দফাদারের—এ পঙ্গপাল বলা চলে, শহরের এমন ছিমছাম ভদ্রমানুষ দেখে সবসময় ব্যাকুল হয়ে আছে—কখন কী লাগবে এগিয়ে দেবার জন্য দু’গণ্ডা ভাইবোন মিলে নানুকে চান করাতে নিয়ে গেল। আকাশে তখন কিছু নক্ষত্র উঠে গেছে। পুকুরের জলে চান করে আশ্চর্য পবিত্র মনে হচ্ছে জগৎ সংসার।
লীলার পরের ভাইটা কোথা থেকে কলাপাতা কেটে নিয়ে এল। ধুলো দফাদারও কোত্থেকে খবর পেয়ে ভাত খাবার লোভে ছুটে এসেছে। লীলা এক হাতে খোলা আকাশের নিচে উনোনে রান্না করছিল। অদূরে একটা আসনে নানু বসে আছে। দু’গণ্ডা কাচ্চাবাচ্চা তাকে ঘিরে আছে। গাঁয়ের কেউ কেউ খোঁজখবর নিতে এল—নতুন মানুষটা কে? লীলা বলল, দাদাবাবু। এই পর্যন্ত। আর কিছু বলতে তার এই সময় ভারি সংকোচ হচ্ছিল।
নানু বলল, ও লীলা তোমার রান্নার আর কত দেরি? আমার খুব খিদে পেয়েছে।
তখন লীলা মুগের ডাল সম্ভার দিচ্ছে। মুগের ডাল, বেগুন ভাজা, চাটনি। কলাপাতা সার সার পেতে দেওয়া—লীলার মুখ ঘামছে। উনুনের আলোতে লীলাকে কোনো সূদুর নীহারিকাপুঞ্জের মতো মনে হচ্ছিল, হাতে একগাছা করে কাচের চুড়ি। আহা লীলা জীবনে আর এত পবিত্রতা নিয়ে কখনও কিছু রাঁধেনি। মুগের ডালের চমৎকার গন্ধটা বাতাসে ম ম করছিল।
ধুলো বলল, তুমি এসেছ যখন দুদিন থেকে যাও। হাঁ আমাকে কাল এক প্যাকেট সিগারেট কিনে দেবে কিন্তু।
নানু বলল, আর কী চাই তোমার?
আমার খুব বাসনা ছিল একটা শান্তিপুরী ধুতি পরি!
নানু বলল, হবে।
লীলার ভাইবোনগুলো সমস্বরে বলে উঠল, আমার জামা চাই, আমার প্যান্ট চাই।
নানু বলল, হবে। হবে।
লীলা তখন ধমক না দিয়ে পারল না। এই গোবড়া, সন্টি, মন্তি, কালো, এদিকে আয়। দাদাবাবু তুমি অত আসকারা দেবে না। সুখের গন্ধ বড় গন্ধ। তখন লীলার মা পর্যন্ত হামাগুড়ি দিয়ে উঠে এসে দরজায় বসে। চাঁদের হাট দেখছে। এবং বলছে, লীলা আমায় দুটো খেতে দিস।
নানু বলল, আজ না মা। কাল খাবেন। কাল মাগুর মাছ নিয়ে আসব। ঝোল ভাত। আজ আপনাকে বার্লিই খেতে হবে।
লীলার ভেতরে তখন ঝড় বইছিল। মানুষটার জন্য তার মায়ার শেষ নেই। অথচ সে বড়ই অভাগী। মনে হয় ছুঁয়ে দিলেই মানুষটার জীবনে তাদের মতো বিড়ম্বনা নেমে আসবে। সে ভাবল কাল যে করে হোক ঘরের ছেলেকে ঘরে পাঠিয়ে দেবে। এদের সে ভালো করেই জানে। দু’হাতে নানুবাবু টাকা ওড়ালে ধুলো দফাদারও বাড়ি থেকে আর বের হবার নাম করবে না। সংসারের এতবড় হাহাকারের জন্য দায়ী যারা তাদের সে ক্ষমা করতে পারে না। লীলা মনে মনে শান্ত হতে চাইল। স্বার্থপর কূট এই ধুলো দফাদার—মাকে ফুসলিয়ে ফাসলিয়ে পাঁচ বাচ্চার জননী করে দিল। সে জানে বাবা বেঁচে থাকতে এত বিড়ম্বনা ছিল না তাদের জীবনে। বাবা বেঁচে থাকলে, তাকে একটা সুন্দর মানুষ দেখে বিয়েও দিয়ে দিত। এবং তখনই কেন যে মনে হল সুন্দর মানুষটা দেখতে ঠিক নানুবাবুর মতো হত। এবং সঙ্গে সঙ্গে নিজের আস্পর্ধার কথা ভেবে লীলা হতচকিত হয়ে গেল।
তখনই ধুলো মেটে হাঁড়িতে এক হাঁড়ি জল নিয়ে এল। গাঁয়ের শেষ মাথায় সরকারি নলকূপ থেকে ধুলো জল এনেছে। উৎসবে কেউ বসে থাকে না। সেজন্য জলটা কাঁধে করে নিয়ে এসেছে। এবং ভাঙা তোবড়ানো এনামেলের গেলাসে জল, কলাপাতায় গরম ভাত, এবং টুকরো কাগজি লেবু এবং বেগুন ভাজা। লীলা কোমরে আঁচল গুঁজে সবাইকে ভাত দেবার আগে নানুর পাতে সুন্দর করে ভাত বেড়ে দিল। সেই সময় নানু তাকাল লীলার দিকে, লীলা তাকাল নানুর দিকে—বড়ই সুখে নানুর বুক বেয়ে অজস্র কান্না অত্যধিক বেগে বের হয়ে আসতে চাইল। সে চোখ নামিয়ে নিল। ভাত মেখে খাবার সময় কেউ লক্ষ্য করল না—নানু গোপনে আজ কাঁদছে।
কুড়ি
সারারাত রাসবিহারী ভয়ংকর উচাটনের মধ্যে কাটিয়েছেন। নানু রাতে বাড়ি ফেরেনি। সকালে তিনি তবু একবার কী ভেবে দোতলায় নানুর ঘরে উঁকি দিয়েছিলেন, না নেই। দরজার শেকল তোলা। তিনি এখন কী করবেন বুঝতে পারছেন না। পুলিশে জানাবেন? অবনীশকে! আজকাল যত্রতত্র মানুষ খুন হচ্ছে। পুলিশ তাড়া করে নিয়ে যাচ্ছে, তারপর মাঠে কিংবা নদীর পাড়ে লাশ ফেলে রেখে চলে আসছে। সারা পশ্চিমবঙ্গে নরমেধ যজ্ঞ শুরু হয়ে গেছে। আর কার কাছে খবরটা দেওয়া যায়। ঘুম না হওয়ায় চোখ জ্বালা করছে। তিনি ধীরে ধীরে নেমে আসছেন সিঁড়ি ধরে। এখনও এ—বাড়ির কেউ জানেই না নানু রাতে বাড়ি ফেরেনি। কারণ নানুর ফেরার জন্য শেষ খাওয়ার পর কিছু কথাবার্তা থাকলে হেমর, অথবা হেম যদি প্রসন্ন থাকে, একটু পান জর্দা খাবার ফাঁকে পাড়ার কারও কারও বাড়ির গুপ্ত খবর দিতে যতটুকু দেরি কিংবা যাকে বলা যায় অপেক্ষা—ততটুকুই নানুর জন্য অন্য সবার চিন্তা। অন্য সব বলতে অবশ্য দু’জনই। হেম আর মিতা। এরা কেউ নানুর জন্য এর বেশি কোনো টান বোধ করে না।
হেমর ঘরের দরজা বন্ধ। ঘুম থেকে ওঠেনি। মিতার ঘুম ভাঙতে বেলা হয়। সবারই আলাদা ঘর। ঘরগুলির পাশ কাটিয়ে গেলেন—কাউকে ডাকলে না। খুব সকালে তিনি সিঁড়ি ধরে ওপরে উঠেছেন—আকাশ ভালো ফর্সা হয়নি। সিঁড়ি ধরে নেমে করিডোর দিয়ে হেঁটে যাবার সময় মনে হল, আকাশ ফর্সা হতে শুরু করেছে। ভিতর ঘরটা পার হলেই হেমর ঘর। তারপর তাঁর ঘর, শেষে বসার ঘর। হেঁটে যেতে যেতে তিনি বুঝতে পারছিলেন, আলাদা ঘরে থেকে সবাই ক্রমে সম্পর্কহীন হয়ে পড়েছে।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই তিনি কাচের জার থেকে খালি পেটে এক পেট জল খান। যৌবন থেকেই কনস্টিপেসান। যৌবন থেকেই এই জল খাবার অভ্যাস। ইদানীং তিনি সকালে পায়চারি করে ভালো ফল পেয়েছেন। জলটা খেয়েই পথে কিছুক্ষণ হেঁটে বেড়ান এবং এক সময় তার ঠিক বাথরুমে যাবার সময় হয়ে যায়। তিনি আজকাল আরও একটি অভ্যাস গড়ে তুলেছেন। সকাল বিকাল বাথরুমে যাবার আগে সামান্য খৈনি মুখে দেন। এটি নিধুর দান। নিধুই তাঁকে শেষ বয়সে একটা নেশার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। তিনি হাতে সামান্য খৈনি পাতা এবং চুন কৌটা থেকে বের করে নিলেন।
আশ্চর্য এখন তাঁর এসব ভাববার সময় নয়। তিনি যে সারারাত ঘুমোননি, কেউ এটা টেরই পায়নি। ঘর বারান্দা লন এই সারারাত করেছেন। এখন তিনি ঢক ঢক করে জল খাচ্ছেন—যদি অবনীশের বাড়িতে নানু থেকে যায়, তবে ফিরতে সাতটা আটটা হবে। এই সময়টুকু তাঁকে অপেক্ষা করে দেখতে হবে। তারপরই কেমন তিনি সংসারের সবার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। যেন সবাই মিলে তাঁর বিরুদ্ধে একটা ষড়যন্ত্র করছে। ষড়যন্ত্রটা এই নানুকে কেন্দ্র করে মনে হল তাঁর। এই বয়সে এত ভাবনা তিনি আর বইতে পারছেন না।
অথচ রাসবিহারীকে দেখলে মনে হবে না ভিতরে ভিতরে এতটা বিচলিত তিনি। নিধু বারান্দায় এসে ডাকল, বাবু।
রাসবিহারী বাইরে বের হয়ে এলেন।
কিছু বলবি?
দড়ি কিনতে হবে। টেপি দড়ি ছিঁড়ে ফেলেছে।
কিনে আনবি।
নিধু চলে যাচ্ছিল। তিনি ফের ডাকলেন, কারণ কাল রাতে কেবল নিধুকেই বলা হয়নি। নিধু কাছে এলে বললেন, দাদাবাবু তোকে কাল কিছু বলে গেছে?
না ত।
ওতো রাতে ফিরে আসেনি।
কোথাও থেকে গেছে।
কোথায় থাকবে।
কেন তেনার জ্যাঠার বাড়িতে।
জানি না। রাস্তাঘাটের যা অবস্থা। এত করে বলেছি পকেটে ঠিকানা রাখবি।
নিধু ঠিক বুঝতে পারছিল না, পকেটে ঠিকানা রাখলে কী হয়। সে চলে যাচ্ছিল।
রাসবিহারী বললেন, এই শোন।
নিধু কাছে এসে দাঁড়াল।
কোথাও কোনো গণ্ডগোল হয়েছে?
কীসের গণ্ডগোল।
এই মানে…তারপরই মনে হল কতটা বিচলিত হলে এমন হয় এই প্রথম তিনি টের পেলেন। যেন সারা কলকাতা শহরের কোথাও গণ্ডগোল হওয়ায় ট্রাম বা বাস বন্ধ ছিল এবং সেজন্য নানু ফিরতে পারেনি। রাতে অবশ্য নিধুকে একবার ডেকে তুলে বলেছিলেন, পঁয়তাল্লিশ নম্বর বাস চলছে কিনা দেখে আয় তো।
সে রাস্তা থেকে দেখে এসে বলেছিল, চলছে বাবু।
তারপর তিনি বলেছিলেন, ফোন করবেন। কিন্তু কাকে—তখন রাত বারোটা। সবাই ঘুমে মরে আছে। রিসিভার হাতে নিয়ে বসেছিলেন, পুলিশ বাদে আর কাকে এত রাতে ফোন করা যায়। তাঁর একবার মনে হয়েছিল, কাউকে করা যায় না। সবাই তাঁর উচাটনে বিরক্ত বোধ করবে। তিনি রিসিভার তুলে নামিয়ে রেখেছিলেন।
তাঁর মনে হয়েছিল, বেলঘরেতে মেজ—জামাইকে খবরটা দেওয়া দরকার। অরুণকে দেওয়া দরকার। এবং তাঁর মনে হয়েছিল, নানুর খুব রাত করে ফেরার অভ্যাস বলে মাঝে মাঝেই খুব বেশি বিচলিত হয়ে পড়লে এমন দরকারের কথা মনে পড়ছে তাঁর। এসব যখন ভাবতেন তখনই দেখতে পেতেন সদর খুলে একটা অস্পষ্ট ছায়ামূর্তি লনে ঢুকছে। কালও ভেবেছিলেন, নানু ঠিক এসে যাবে। অনেক দূর পর্যন্ত তিনি অস্পষ্ট অন্ধকারে তাকিয়ে থেকেছেন—রাস্তায় কেউ ফিরলেই মনে হয়েছে, বোধহয় নানু আসছে। পাতা নড়লে মনে হয়েছে কারও ছায়া নড়ছে। কুকুর হেঁটে গেলে মনে হয়েছে, হামাগুড়ি দিয়ে দিয়ে আসছে কেউ। এবং এসব করতে করতেই রাতটা কাবার হয়ে গেল। সদর খুলে একবার তিনি একা রাস্তায় গিয়েও দাঁড়িয়েছিলেন কিছুক্ষণ। কেউ আর ফিরছে না। সব বাড়িগুলির দিকে তাকিয়ে মনে হয়েছিল, বড়ই সৌভাগ্যবান এরা। এদের সবাই অন্তত আজকের রাতের মতো ফিরে এসেছে। তাঁর একজন এখনও আসেনি। তারপরই মনে হয়েছিল এত রাতে একা দরজা খোলা রেখে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক না। তিনি নিধুকে সঙ্গে নিতে পারতেন। কিন্তু নিধু ঠিক পরদিন হেমকে বলবে এবং নাতির দুশ্চিন্তায় ঘুম হচ্ছে না ভেবে মুখ বেঁকিয়ে হাসবে হেম। কারণ নানু ওদের কাছে জাহান্নামে যাওয়া ছেলে। ইদানীং ওটা নানুর আরও বেড়েছে। এই বাড়ার মূলেও আছেন তিনি। বড়ই উভয় সংকটে পড়ে গেছেন রাসবিহারী।
তখনই মনে হল হেম দরজা খুলে বের হয়ে এসেছে। হেম এই সময় ঈশ্বরের নাম করতে করতে বের হয়ে আসে। হেম যে কার মঙ্গল প্রার্থনা করে রাসবিহারী ঠিক বুঝতে পারেন না। আসলে হেম নিজেরই জন্য প্রার্থনা করে বোধহয়। পৃথিবীতে এমন স্বার্থপর এবং নিষ্ঠুর রমণীর হাতে তাঁর জীবনটা কেটে গেল। পরজন্মে বিশ্বাস আছে বলেই রক্ষে। কিন্তু এতসব কথা কী তখন আর মনে থাকবে।
রাসবিহারীর একবার ইচ্ছে হল বলে, নানু ফিরে আসেনি। কিন্তু কী হবে বলে। তিনি খৈনিটা ঠোঁটের ফাঁকে ফেলে দিলেন। তারপর দেখলেন বীণা সদর দরজা দিয়ে ঢুকছে। বীণাকে ঢুকতে দেখেই বললেন, তোমাদের নানুবাবু কাল ফেরেননি।
কোথায় গেছেন?
কোথায় গেছেন তিনিই জানেন। তারপরই একটু থেমে বললেন, তোমাদের ওদিকে কোনো গণ্ডগোল হয়েছে?
ন তো!
কিছুটা স্বস্তি। রাসবিহারী ফের বললেন, যা রাস্তাঘাট! রোজই কোথাও না কোথাও গণ্ডগোল।
বীণা বলল, কোথাও থেকে গেছে। বন্ধুবান্ধবের কাছে। খুব নিজের লোকের মতো কথাগুলো বলল বীণা।
ওরতো বন্ধুবান্ধবও নেই।
কেন ওই যে মানুবাবুর কথা বলে!
মানুবাবুরা কোথায় থাকে তুমি জানো?
এ বাড়িতে নানুবাবুর সঙ্গে বীণার তবু কিছু কথা হয়। রাসবিহারীর সঙ্গে কিছু কথাবার্তা এবং মিতার সঙ্গে নানুবাবু খুব প্রয়োজনে কথা বলে থাকে। অথবা এক ধরনের জেদ দেখা দিলে মাথায় মিতাদির পেছনে লাগার স্বভাব নানুবাবুর। সে মাসে দু—মাসে এক আধবার। অন্যসময় নানুবাবু নিজের ঘরেই শুয়ে বসে কাটিয়ে দেয়। বই পড়ে, খবরের কাগজ পড়ে, কলেজ যায়, রাত করে ফেরে—জামাকাপড় কেচে দেয় বীণা, ঘর ঝাঁট দেয় বীণা, চা—জলখাবার দেয় বীণা—সুতরাং এ—বাড়িতে রাসবিহারীর পরই নানুর সঙ্গে বীণার সামান্য মধুর সম্পর্ক। সুতরাং মানুবাবুর কথাও তার জানার কথা থাকতে পারে। সে বলল, না বাবু।
কেমন বিরক্ত হলেন রাসবিহারী।
তোমরা কোনো খবরই রাখো না।
বীণার কাজ অনেক। এই বারান্দায় দাঁড়িয়ে শুধু কথা বললে চলবে না। হেমর খুব পছন্দও নয় বাড়ির কর্তাব্যক্তি এভাবে সাতসকালে এত কথাবার্তা বলুক। রাসবিহারী বললেন, ঠিক আছে যাও।
আসলে রাসবিহারীর আশঙ্কা—যদি নানু গণ্ডগোলের মধ্যে পড়ে যায়, কিংবা জড়িয়ে যায়। যদি নানু আর না ফেরে—যদি নানু তার বাবার মতো কিছু একটা করে ফেলে। দুর্ঘটনার জন্য তিনি সবসময় নানুর পকেটে একটা ছোট চিরকুট রাখতে পছন্দ করেন। চিরকুটে ঠিকানাটা লেখা থাকে। যেখানেই দুর্ঘটনাটা ঘটুক খবর পেতে যেন দেরি না হয়। প্রথম প্রথম তিনি বলতেন, বুঝলে নানু, কলকাতার রাস্তাঘাট খুবই খারাপ। কাগজ খুললেই দেখতে পাবে দুর্ঘটনায় মৃত্যু। সঙ্গে একটা ঠিকানা রেখে দেবে সবসময়।
নানু হেসে বলেছিল, ওটা কী মৃতসঞ্জীবনী।
রাসবিহারীর চোখ মুখ লাল হয়ে উঠেছিল, সবকিছু নিয়ে তোর ঠাট্টা।
তুমিই বল দাদু যদি ঘটেই যায়, ওটা আমার কতটা উপকারে আসবে।
আমাদের খবরাখবর পেতে হবে না। এমন বলতে গিয়ে সেদিন রাসবিহারীর মনে হয়েছিল—বড় স্বার্থপরের মতো কথাটা শোনাবে। তিনি আর তাকে কিছু বলেননি—শুধু বিকেলে তিনি সেদিন নানুর ঘরে বসে ওর বইখাতায় সর্বত্র এ—বাড়ির ঠিকানা লিখে রেখেছিলেন। অর্থাৎ কলেজ করে বাড়ি ফিরতে দেরি হলে যেন ভাবনার নেই। খাতাটায় ঠিকানা লেখা আছে। পুলিশের চোখে, না হয় অন্য কারও চোখে এটা পড়বেই। এবং একটা সুন্দর ডায়েরিতে ঠিকানা লিখে নানুকে দিয়ে বলেছিলেন, ডায়েরি ব্যবহার করতে শেখো, সঙ্গে রাখতে শেখো। ভবিষ্যতে কাজে আসবে।
নানু কলেজে অথবা বাড়ির বাইরে বের হলেই রাসবিহারী ওর ঘরে ঢুকে দেখতেন, সঙ্গে ডায়েরিটা নিল কিনা। প্রশ্ন করলে এমন ট্যারা জবাব দেবে যে আর একটাও কথা বলতে ইচ্ছা হবে না। আসলে ওর মাথার মধ্যে সেই যে রেলগাড়িটা ঢুকে গেল আর বের হল না। নানুই বলেছিল, দাদু বিরক্ত করবে না। মগজের মধ্যে আস্ত একটা রেলগাড়ি ঢুকে আছে। রাসবিহারী ওর কথাবার্তার ধরন দেখেই বুঝতে পারেন কখন সেটা ঢুকে যায়, কখন সেটা বের হয়ে আসে। তিনি ওর টেবিল হাটকেই দেখতে পেতেন, লাল ডায়েরিটা টেবিলে পড়ে আছে। সঙ্গে নিচ্ছে না। মাঝে মাঝে সেজন্য চিরকূট রেখে দিতেন ওর জামা অথবা প্যান্টের পকেটে। একদিন নানু হেসে বলেছিল, দাদু তুমি বড় ভীতু স্বভাবের মানুষ। অথচ দাদু, তোমার মেয়েরা এক একজন কংকাবতী। এটা কেমন করে হয়।
রাসবিহারী ঢোক গিলে ফেলতেন। নানুর কথার জবাব দিতে পারতেন না। পারতেন না যে তা ঠিক নয়, পারতেন। তবে খুব রূঢ় শোনাত। এমনিতে মাথাটা গেছে, তার ওপর বাপের মৃত্যুর জন্য দায়ী আসামিদের এখন খুঁজে বেড়াচ্ছে। কী যে হবে! এবং তখনই তিনি হেঁকে উঠলেন নিধু—নিধু, দেখত কাগজ দিতে এত দেরি করছে কেন!
নিধু রাস্তার দিকে চেয়ে বলল, আজ্ঞে আসবে। সময় হয়নি বাবু।
তিনি এখন কী যে করেন! বাথরুমেও ঢুকতে পারছেন না। যদি কাগজটা এসে যায়। কাগজটা পড়লে তিনি কিছুটা স্বস্তি পাবেন। কোনো গণ্ডগোলের খবর থাকলে কাগজে ঠিক থাকে। সে শহরের যেখানেই ঘটুক। এই কাগজটা পড়ার পর চিন্তা করবেন, কোথায় কীভাবে খোঁজখবর নেওয়া যায়।
এবং কাগজটা এলে প্রথমেই সারা পাতায় তন্ন তন্ন করে খুঁজলেন। কাগজে একটাও মৃত্যুর খবর নেই। শুধু কিছু নিরুদ্দেশের খবর আছে। এই কলমে নানুর একটা ছবি মাপতে হবে। যা একখানা বাড়ি, নানুর ছবিও হয়তো সময়কালে ঠিক হাতের কাছে পাওয়া যাবে না। আর তখনই মিতা হাই তুলতে তুলতে ঘর থেকে বের হয় আসছে। সামনে মিতাকে দেখেই তিনি কাগজটা সরিয়ে রেখে বললেন, হ্যাঁরে নানুর ছবি আছে বাড়িতে?
এই সাতসকালে বাবা নানুর ছবির কথা জিজ্ঞেস করায় খুব অবাক হয়ে গেল মিতা। সে বলল, কেন নাতির বিয়ে ঠিক করেছ নাকি।
রাসবিহারী বুঝতে পারেন সবকিছুর মূলে হেম। মেয়েরাও ঠিক তাকে সমীহ করে না। এ ছাড়া এই বাড়িতে নানুকে জায়গা দেবার পর থেকেই সবাই কেমন তাঁর ওপর বিরূপ হয়ে উঠেছে। তিনি বললেন, আছে কী না বলো। বিয়ে দেব কী দেব না সেটা আমি বুঝব।
তুমি রেগে যাচ্ছ কেন বাবা?
এমন কথা তোরা বলিস। জানিস কাল রাতে নানু ফেরেনি। কেমন ছেলেমানুষের মতো নালিশ জানালেন যেন রাসবিহারী।
মিতা দেখল তার বাবা, তার বাবা রাসবিহারী, শ্যামলা রঙের দোহারা চেহারার মানুষ। চোখে নিকেলের চশমা। হাতে কাগজ। দুশ্চিন্তায় চোখের নিচে কালি। তিনি ধুতি পাট করে পরে আছেন। তাই পরে থাকেন। এবং তাঁর দিকে অপলক তাকিয়ে আছেন। বাবার জন্য বুকটা মিতার ভিতরে কেমন গুড় গুড় করে উঠল। এমন শূন্য দৃষ্টি সে বাবার চোখে কখনও দেখেনি। বলল, বাবা ও ফেরেনি, ফিরবে।
কখন আর ফিরবে।
মিতা খুব যেন বয়সি মেয়ে হয়ে যাচ্ছে। তার আর হাই উঠছিল না। সে বাবার পাশে বসে বলল, তুমি সেজদিকে বরং লিখে দাও, সে যেন তার ছেলেকে নিয়ে যায়। ওর জন্য তোমার আয়ুক্ষয় হচ্ছে বাবা।
রাসবিহারী মনে মনে এ—কথাটা সত্য ভাবেন। যদি বুড়ো বয়সে এই উটকো ঝামেলা ঘাড়ে এসে না চাপত তবে তিনি আরও কিছু বেশিদিন বাঁচতেন। হেমর নিষ্ঠুরতার জন্যও একসময় তাঁর এ কথাটা মনে হত। দীর্ঘদিন সয়ে সয়ে ওটা ভুলে গেছিলেন। নানু আসার পর থেকে আবার সেই আয়ুক্ষয়টা চলছে এমন মনে হল তাঁর।
দুপুরেই রাসবিহারী সব আত্মীয়স্বজনকে ফোনে জানালেন, নানু কাল রাতে বাড়ি ফেরেনি। পুলিশে খবর দেওয়া হবে কিনা এটা যেন বসে সবাই ঠিক করে। কারণ রাসবিহারী এখন আর একজন উঠতি যুবকের দায় নিজের ঘাড়ে একা রাখতে সাহস পাচ্ছেন না। কোথাও গিয়ে নানু যদি আত্মহত্যাই করে বসে তবে আবার একটা কেলেঙ্কারি। এখন বসে ঠিক করা দরকার কী করা হবে।
প্রথমে তিন জামাইয়ের অফিসে ফোন, তারপর অবনীশের অফিসে। রাসবিহারী বললেন, আমি রাসবিহারী বলছি।
অঃ তাওইমশাই ভালো আছেন? নানুকে একবার দেখতে যাব ভাবছিলাম, কিন্তু আপনাদের মেয়ের শরীরটাতো ভালো না, রাস্তায় চলাও আজকাল ভেরি রিসক। কখন কোথায় কারা পুলিশ খুন করছে, স্কুলে আগুন দিচ্ছে, বিদ্যেসাগর মশাইর মুন্ডু উড়িয়ে দিচ্ছে—কী অরাজক অবস্থা—বাড়ি থেকে বের হতেই ভয় করে। ইয়েস অ্যানাদার কোয়েশ্চান হচ্ছে নানুর মা চিঠি দিয়েছে? আমরা তো অনেকদিন পাইনি। নানুর ব্রেন ভেরি ব্যাডলি অ্যাফেকটেড। ওটাও ওর মাকে জানানো দরকার। আপনার কী মনে হয়?
যাক তবু কথা শেষ করল। তিনি জানেন, তাঁর এই আত্মীয়টি হরবকত কেবল কথা বলে! কথা বলতে আরম্ভ করলে শেষ করতে চায় না। ভদ্রতা বোধটা পর্যন্ত গেছে। অত্যন্ত ঠান্ডা গলায় রাসবিহারী বললেন, নানু কাল রাতে ফেরেনি।
মাই গড। হোয়াট হেপেনড!
কী হেপেনড আমি জানিনা। তোমাকে জানানো দরকার তাই জানালাম। ফোন নামিয়ে রাখবেন ভেবেছিলেন, কিন্তু ও—প্রান্ত থেকে গলা সরু করে সে অজস্র কথা বলে যাচ্ছে—নাথিং কেন বি ডান। বলুন আপনি কী করতে পারেন। আমাদের সামাজিক স্ট্রাকচারটা ভেঙে না ফেললে কিছু করা যাবে না। নানু এই সামাজিক স্ট্রাকচারের এগজামপল।
রাসবিহারী অধৈর্য হয়ে পড়ছিলেন—কিন্তু কথা শেষ না হলে ছাড়েন কী করে!
আমরা ওকে সামারিলি ডিসমিস করে দিয়েছি। নো হোপ। যত পড়ান আই মিন, ডে বিফোর ইয়েসটারডে নানু কেম টু মাই হোম, অঃ হো নো নো, নট ডে বিফোর ইয়েসটারডে। ইট ইজ অন সিকসটিনথ। এসেই আমাদের মেড—সারভেন্টের ঠিকানা চাইল। সব তো বলা যায় না। স্ক্যান্ডাল। পারিবারিক স্ক্যান্ডাল।
রাসবিহারী যেন কোনো সূত্র খুঁজে পাচ্ছেন—তিনি অধীর গলায় বললেন, বল বল তারপর কী!
তারপর স্ক্যান্ডাল! বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থায় এটা হবেই। ইট মাস্ট হেপেন।
রাসবিহারী জানেন, এখনই ঠিকমতো ধরিয়ে দিতে না পারলে, তাঁর এই পরম আত্মীয়টি কথার সূত্র হারিয়ে ফেলবে। তিনি বললেন, নানু কবে গেছিল তোমার ওখানে যেন?
সিকসটিনথ।
কী বলল নানু যেন?
বলল লীলা কোথায়?
লীলা।
আমাদের মেড—সারভেন্ট। আমরা বাড়ি থাকি না, নানু মাঝে মাঝে বাড়ি না থাকলে চলে আসত। তারপরই যেন দৃঢ়তার সঙ্গে বললে, আফটার অল উই লিভ ইন সোসাইটি। সব করা যায় কিন্তু সোসাইটির ভ্রূকুটিকে সামারিলি ডিসমিস করা যায় না।
রাসবিহারী ভাবলেন, এই রে আবার অন্য নৌকায় উঠে পড়তে চাইছে। প্রায় তিনি ঠ্যাং চেপে ধরার মতো বললেন,
নানু কী বলল?
বলল, লীলা কোথায়?
সে কোথায়?
ওকে তো আপনাদের মেয়ে তাড়িয়ে দিয়েছে। নানু ইজ আওয়ার কমপ্লিটলি লস্ট বয়। কী বলব, পারিবারিক কথা, মেয়েটা নেই জেনে নানু আপনাদের মেয়েকে খুন করবে বলে শাসিয়ে গেছে। বাট দিস মার্ডার ইউ থিংক হাউ আগলি টক। সমাজব্যবস্থা কতটা জাহান্নামে যেতে বসেছে ভাবুন। তুই তোর মাতৃসমাকে একথা বলতে পারলি। তোর কী এই শিক্ষা হল। তুই প্রীতিশের ছেলে, আর তুই আমার ভাইপো হয়ে জেঠিকে খুন করতে চাস!
রাসবিহারী এত সব কিছুই জানতে চান না। নাতির জন্য তাঁর মধ্যে যে উদ্বেগ ছিল, সেটা যেন কিছুটা প্রশমিত হচ্ছে। হয়তো নানুর আরও খবর ওর জেঠা এখন দেবে। তিনি বললেন, তারপর ও কোথায় গেছে জান?
কী হবে জেনে! হোয়াই আই স্যাল ফিল এনি ইনটারেস্ট—আপনি বলুন, ইফ ইট উড বি ইয়োর কেস আপনি কী করতেন!
রাসবিহারী বললেন, সত্যি। কী করব বলো কোথায় ফেলি! তোমাদের ওখান থেকে কোথাও যাবে কিছু বলেছে?
ইয়েস যাবে বলেই নানু ক্লাইমেকসে এসে গেল। বলল, ঠিকানা না দিলে খুন করব।
কার ঠিকানা?
আর কার সেই মেয়েটার।
তোমরা ওকে ঠিকানা দিয়েছ?
না দিয়ে উপায়। খুন হওয়ার চেয়ে ঠিকানা দেওয়া কত সহজ কাজ বলুন। এট লাস্ট উই গেভ দ্য অ্যাড্রেস।
ভালো করেছ।
ভালো করিনি বলুন। যদি খুন হয়ে যেত, তবে আবার পুলিশের ঝামেলা, কোর্ট কাছারি, উই হ্যাভ টু সুট এ কেস এগেইনস্ট হিম।
রাসবিহারী বুঝতে পারলেন, ফোনে এত কথা হয় না। তবে নানু মেয়েটির ঠিকানা নিয়ে চলে যেতে পারে কারণ সে তার টাকাপয়সাও বুঝে নিয়েছে, এ অবস্থায় রাসবিহারীর আপাতত কিছু করার নেই। এখন জামাইদের নিয়ে এ বিষয়ে কিছু একটা স্থির সিদ্ধান্তে আসা দরকার। এই বয়সে আর এত উদ্বেগ বয়ে বেড়াতে পারছেন না। তারপরই মনে তিনি কেমন প্রশান্তি বোধ করলেন। নানুর মধ্যে ভালোবাসার জন্ম হচ্ছে। ভালোবাসা শব্দটি কতদিন পর বড় প্রিয় শব্দ মনে হল তার। কাজ করতে করতে আর সংসার করতে করতে হেমর সঙ্গে একসময় সব মানুষের মতো ভালোবাসা শব্দটি তিনি হারিয়ে ফেলেছিলেন। সব বিস্তারিত জানা দরকার। ফোনে সব শোনা যায় না ভালো করে। তিনি অবনীশকে বললেন, বিকেলে আমার তিন জামাই আসবে। বিষয় নানু। যদি তুমি আসো খুব ভালো হয়। তোমাদের পরামর্শ এখন আমার খুবই দরকার। যদিও রাসবিহারী জানেন, এই মানুষটির কাছে তার পরামর্শ চাইবার মতো কিছু নেই, কিন্তু নানুর জেঠু এই স্বত্বাধিকারে পরামর্শ করা বাঞ্ছনীয়। পরে যেন কোনো অনুযোগের ভাগী হতে না হয়। রাসবিহারী ফোন ছেড়ে দিতে যাচ্ছিলেন, তখনই আশ্চর্য কান্না কান্না গলা অবনীশের—আই ক্যান সেড টিয়ার্স ফর নানু বাট আই ক্যান ডু নাথিং মোর। সো হোপলেস আই অ্যাম তাওইমশাই।
তুমি এসো।
যাব।
তারপরই রাসবিহারী মিতাকে ডেকে বললেন, নানুর কিছুটা খোঁজ পাওয়া গেছে। ওর জেঠু বলল সব। নানু আমাদের হাতের বাইরে চলে গেল। কিন্তু ঘটনাটা কী মেয়েকে বললেন না। লজ্জা বোধ করলেন। তারপরই মনে হল কলঙ্ক। একটা ঝি—মেয়ের জন্য নানুর মতিভ্রম হবে তিনি কখনও এমন ভাবেননি। কিন্তু ভালোবাসা শব্দটি কতদিন পর মাথায় এসেছে। এটা মাথায় এলে নানু কখনও আর আত্মহত্যা করতে পারে না। রাসবিহারী সহসা আশ্চর্য রকমের হালকা বোধ করলেন কথাটা ভেবে। তিনি প্রায় লাফিয়ে সিঁড়ি ধরে ওপরে উঠে যেতে থাকলেন।
একুশ
দুপুরে প্রচণ্ড জোরে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল। ভুবনবাবু জানালা বন্ধ করে আবার শুয়ে পড়লেন। দিবানিদ্রার অভ্যাসটি নীরজারই দান। খাওয়া হয়ে গেলেই নীরজাকে দেখা যাবে তার ঘরের বিছানার চাদর ঝেড়ে বিছানা ঠিক করে দিচ্ছে। মানুষটা শোবে। যত বিশ্রাম পাবে মানুষটা তত বেশিদিন বাঁচবে। তার শাঁখা সিঁদুর অক্ষয় থাকবে ততদিন। তাছাড়া ভুবনবাবুর আগে যাবারও একটা প্রচ্ছন্ন ইচ্ছে নীরজার মনের মধ্যে রয়েছে। তালে কত সতী লক্ষ্মী প্রমাণের তার আর কিছু বাকি থাকে না। পাশ ফিরে শোবার সময় ভুবনবাবু মুচকি হাসলেন। মানুষের কত রকমের যে ইচ্ছে থাকে।
আর তখনই মনে হল রাসবিহারীবাবুর মেয়ের কোষ্ঠি নিয়ে যতীন সেন আজ আসবে। এই মানুষটি তাঁর দেশের মানুষ। যতীন সেনের বাবাও ভালো জ্যোতিষী জানতেন। ভুবনবাবুদের সব কোষ্ঠি ঠিকুজি তাঁরই করা। এ দেশে এসে যতীন সেন বাবার বিদ্যেটা তুলে দেয়নি। এল. আই. সি—তে ভালো কাজ করে। আর সকাল সন্ধ্যা এই পুণ্য কাজটাও সেরে বেড়ায়। যতীন সেন এ কাজটাকে ভারি পুণ্য কাজ ভেবে থাকে। উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া গেলে খুব নিষ্ঠা আছে কাজে। যতীন সেনের কিছু কিছু কথা ফলেও ভুবনবাবুর জীবনে। বিশেষ করে নীরজা জ্যোতিষ বলতে এক যতীন সেনকেই বোঝে। সবরকমের কাজকর্মের পরামর্শে যতীন সেনকে প্রায়ই এ বাড়িতে আসতে হয়—তাছাড়া কিছুক্ষণ ফেলে আসা দেশ—বাড়ির গল্প করতেও ভালোবাসে যতীন সেন। এলে সহজে আর উঠতে চায় না। নীরজাকে সবসময় বউদি বউদি করে। আজ যতীন সেন আসবে বলেই নীরজা মানদাকে দিয়ে আলাদা মিষ্টি আনিয়ে রেখেছে। এই সব সাতপাঁচ ভেবে ভুবনবাবুর হাই উঠছিল, ঘুম এল না। উঠে বসলেন, বাইরে বের হয়ে দেখলেন বেলা বেশি গড়ায়নি। তিনটে বাজে। আর কী যে হয় আজকাল, কেউ আসার কথা থাকলেই ঘুমটুকু আর আসে না চোখে। আজকাল মাথাটাকে তিনি আর ফাঁকা রাখতে পারছেন না কিছুতেই। মানুটা সারাদিন বাড়িতেই থাকে না। কোনো দিন দুপুরে খেতেও আসে না। নানুর সঙ্গে আজকাল নতুন নতুন মুখ দেখা যায়। ওরা কারা! মানুকে বলে, এক কথা, ওরা বন্ধু। ব্যস ওই কথা—কেমন ছেলে, কোথাকার ছেলে, কার ছেলে, বংশমর্যাদা কী এসব আর তিনি জিজ্ঞেস করতেই সাহস পান না। যতীন সেন এলে এবারে সাফ সাফ বলবেন। দেখতো আর কত দেরি মানুর কাজের। একটা কাজটাজে ঢুকে গেলে বাঁচি যতীন। পড়াশুনা যখন হবে না তুমি গুণে বলে দাও না—এ বছরের মধ্যে ওর কোথাও কিছু হবে কিনা?
যতীন সেন এর আগেও বলেছে সময় হলেই হবে।
সময়টা কবে হবে আর। এবারে তিনি একটা নির্দিষ্ট সময় চান। তা ছাড়া আজকাল ভুবনবাবু পাথর—টাথরে বিশ্বাস জন্মে গেছে। রাহুর অবস্থান খারাপ বলে তিনি একটা বেশ বড় আকারের গোমেদ ধারণ করেছেন। রমাকে যতীন সেন একটি মুনস্টোন পরতে দিয়েছে। এতে ভুবনবাবুর মনে হয়েছে—সংসারে কিছু শান্তি ফিরে এসেছে এবং বেশ উন্নতিরও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। ভানুকে অবশ্য কোনো আংটি ধারণ করার ব্যাপারে এখনও রাজি করতে পারেননি। পরস্ত্রীর প্রতি টানটা ক্রমশই মনে হচ্ছে বাড়ছে ভানুর। এজন্য তিনি নিজেই দায়ী। বয়েস হলে বিয়ে দিতে হয়। শরীর তো অবুঝ! তার একটা কিছু চাই।
এবং এ সময়েই তিনি নিচে সিঁড়িতে কারও শব্দ পেলেন। যতীন সেন হতে পারে ভেবে তিনি করিডোর ধরে হেঁটে গেলেন। তারপর সিঁড়ির দরজা খোলার মুখে দেখলেন অন্য একজন কেউ। লোকটাকে তিনি চেনেন না। শুধু বললেন, কী চাই?
ভুবনবাবু আছেন?
আমি ভুবনবাবু।
চিঠি দিয়েছে।
কে?
যতীন সেন।
দেখি।
ভুবনবাবু চিঠি না খুলেই বললেন, ভিতরে আসুন।
আমি আর বসব না। তিনি আসতে পারলেন না। কোথায় একটা তাঁর মিটিং আছে। বড় গোছের নেতা—তিনি ভোটে দাঁড়াবেন। মনোনয়নপত্র দাখিল করার জন্য দিন দেখবেন। যতীন সেন আজ সেখানেই গেছেন।
ভুবনবাবু বললেন, বেশ। কবে আসবে কিছু লিখেছে কিনা ভেবে তিনি চিঠিটা খুললেন। লোকটি দাঁড়িয়ে থেকেই বলল, আচ্ছা যাই।
ভুবনবাবু এক হাতে চিঠিটা রেখে অন্য হাতে দরজা ঠেলে দিলেন। চশমা না হলে তিনি কিছুই দেখতে পান না। বারান্দায় এসে বসার আগে টেবিলের ওপর থেকে চশমা প্রথমে নিলেন।
তারপর বাইরে এসে চিঠি খুলতে অবাক। বিরাট একটা ফুলস্কেপ পাতায় মাত্র দুটো লাইন লেখা। রাজযোটক—আপনি এ—বিয়েতে অমত করবেন না। মেয়ের কর্মফল খুবই ভালো। এত ভালো রাশিফল আমি অনেকদিন হাতের কাছে পাইনি। বিশেষ অসুবিধা থাকায় যাওয়া হল না। ইতি—আপনার বিনীত যতীন সেন। সঙ্গে মেয়ের কোষ্ঠি ভাঁজ করা খামের মধ্যে। সেটা তিনি একবার খুলে দেখলেন। বয়স বাইশ। বাইশ বয়সটা এ—কালে মেয়েদের খুবই কম বয়েস। তাঁর মনে হল, বয়েসটা আরও বেশি হলেও ক্ষতি ছিল না। ভানু আগামী মাঘে ত্রিশ পার হয়ে যাবে। এবং তাঁর মনে হল, অনেকটা বয়েস ভানুকে তিনি আটকে রেখেছেন। তিনি বিয়ে করেছিলেন, একুশে। চোদ্দ বছর বয়সে প্রথম তিনি টের পেয়েছিলেন, একজন বালিকার শরীরে আশ্চর্য সুঘ্রাণ। তাঁর বয়সে যদি ভানু এটা টের পায় তবে পাক্কা ষোলোটি বছর তিনি ভানুকে এভাবে বন্দি করে রেখে ভালো কাজ করেননি। জীবনে ষোলোটা বছর কম কথা না। মানুষ যদি সময়ে আহার না পায় তবে সে গোপনে কিছু করবেই। তিনি এজন্য ছেলেমেয়েদের খুবই কম বয়সে বিয়ের পক্ষপাতী। এবং এসব ভাবনার সময়ই সহসা দেখতে পেলেন, তাঁর আত্মজা কিশোরী রমা সবে তখন ফ্রক ছেড়ে শাড়ি পরেছে। শাড়ি পরছে কতকাল আগে থেকে যেন। সংসারে তিনি সবার সামনে বিরাট বাধা। তিনি নীরজা উভয়ে। তিনি উঠে দাঁড়ালেন—কান মাথা ঝাঁ ঝাঁ করছে। আসলে মেয়েদের এবং ছেলেদের সব গোপন ইচ্ছেগুলি তাঁদের চোখের ওপর নিদারুণ হয়ে দেখা দিলে তিনি ডাকলেন, নীরজা, নীরজা।
নীরজা কাছে এলে ঠিক যেমন কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন, সেভাবে তাকিয়ে থাকলেন ভুবনবাবু। নীরজা তুমি বুঝছ আমি কী ভাবছি! নীরজা, আমার ছেলেরা বড় হয়ে গেছে কবে, মেয়ে বড় হয়ে গেছে কবে—ওদের শরীরে কবে বান এসে গেছে অথচ ওরা এতদিন ঠিক আছে কী করে—না কী কিছুই ঠিক নেই—সবাই গোপনে খাওয়া—দাওয়া ঠিকমতোই করে যাচ্ছে।
নীরজা বললেন, তোমার যে আজকাল কী হয়েছে!
কী হবে আবার?
ডাকলে কেন?
এতক্ষণে মনে হল, তিনি নীরজাকে আসলে একটা প্রশ্ন করতে চাইছিলেন। নীরজার বিয়ে হয়েছিল তেরো বছরে। নীরজার সঙ্গে তাঁর মনে আছে শুভ—রাত্রিতেই সবকিছু জানাজানি হয়ে গেছিল। এবং তেরো বছরের মেয়ের মনে যে ভয় থাকার কথা ছিল, অর্থাৎ তিনি ভাবছিলেন হাত দিলে মেয়েটা ঠান্ডা মেরে, অথবা ভয়ে সরে শোবে এমন সব কিছু ভেবে যখন হাত রাখতে গেলেন —তখন আশ্চর্য নীরজা চিত হয়ে শুয়েছিল। তিনি পাশে গিয়ে জড়িয়ে ধরলে নীরজা চোখ বুজেছিল। তিনি হাত দিলে নীরজা ভয়ংকর উদ্যমশীল হয়ে পড়েছিল। তেরো বছরটা কত মারাত্মক একজন মেয়ের পক্ষে ভুবনবাবু সেদিনই প্রথম বুঝতে পেরেছিলেন। এবং গভীরে প্রবেশ করতে যদিও দু’চারদিন সময় লেগে গেছিল—কিন্তু তেরো বছরের বালিকা হিক্কা—ধ্বনি তিনি যেন এখনও কান পাতলে শুনতে পান। রমার বয়স বাইশ। তেরো এবং বাইশের মধ্যে কত পার্থক্য। এই বয়সটা রমা পার করে দিয়েছে—বড়ই পবিত্র চোখ মুখ মেয়েটার অথচ শরীরে নীরজার মতো কষ্টটা তার যাবে কোথায়?
তিনি বললেন, মানু কোথায়?
মানু তো ঘরেই ছিল।
ভুবনবাবু ডাকলেন, মানু আছিস?
মানুর কোনো সাড়া পাওয়া গেল না।
নীরজা বলল, আবার বোধহয় বের হয়েছে।
কোথায় যায়! তারপরই কী ভেবে বললেন, তুমি দেখেছ কী সব বই—টই ঘরে নিয়ে আসে মানু?
কী বই?
ওর ঘরে ঢুকে মাঝে মাঝে দেখো।
তুমিই তো দেখেছ।
তুমি মা। তোমার দেখা খুব দরকার।
নীরজা বলল, আমাকে এজন্য ডেকেছিলে?
ভুবনবাবু এবার যথার্থই যেন মনে করতে পারলেন না কীজন্য নীরজাকে ডেকেছিলেন। নীরজা চলে গেলেই মনে হল তিনি আজ জানতে চেয়েছিলেন নীরজা ঠিক কত বছরে একজন মানুষের সঙ্গ কামনা করেছিল। বয়েসটা কী আট সাত না দশ। কোনটা। মেয়েরা কত বয়সে একজন পুরুষকে ঠিক নিতে পারে। একজন পুরুষের কথা তিনি জানেন, সেটা তিনি নিজে। চোদ্দো থেকে পনেরোয় মনে হয়েছিল, একজন মেয়ের শরীরে আশ্চর্য সুঘ্রাণ। তিনি সে সুঘ্রাণ পাবার জন্য প্রায় ষোলোতেই পাগল পাগল বোধ করতেন।
তিনি এবার ঘরে ঢুকে বললেন, নীরজা আমাকে চাবিটা দেবে।
তিনি আলমারির সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেন। নীরজা হয়তো শুনতে পায়নি। আবার ডাকলেন, নীরজা চাবিটা দেবে?
মানদা ঘরে ঢুকে বলল, মাকে কিছু বলছেন?
চাবিটা দিতে বল।
নীরজা এই অবেলায় চাবি দিয়ে কী হবে জিজ্ঞেস করলেন।
আমি বের হব নীরজা।
কোথায় যাবে?
রাসবিহারীবাবুর বাড়িতে।
সেটা কোথায়?
ঢাকুরিয়ার কাছে। ঠিকানা চিঠিতে আছে। কত নম্বর বাসে যেতে হবে তাও লেখা আছে।
সেই সম্বন্ধের ব্যাপারে?
হ্যাঁ।
বারে তুমি একা যাবে কেন। কী যে তোমার বাই। রমাকে সঙ্গে নিয়ে যাও। প্রিয়নাথ ঠাকুরপো আছে তাকে সঙ্গে নাও। তা ছাড়া খবর দেবে তো দেখতে যাচ্ছ। খবর না দিয়ে যায় নাকি।
আমার অন্য কাজ আছে নীরজা।
নীরজা বললেন, জানিনা। যা খুশি করো।
সবই বড় দেরি করে ফেলেছি।
এতদিনে বোধোদয়। বলে ঠোঁট বাঁকাল নীরজা।
নীরজা, তুমি আমাকে একদম মান না।
মানার কাজটা সারাজীবন ধরে কতটা করেছ?
আমি কিছুই করিনি। তুমি আমাকে আর আগের মতো ভালোবাস না।
বুড়ো বয়সে ঢং হচ্ছে।
বুড়ো হলে কী মানুষের কোনো ইচ্ছে থাকতে নেই?
ইচ্ছে থাকবে না কেন। ইচ্ছের কী শেষ আছে।
ভুবনবাবু বললেন, আমি আজই যাব। যদি চাবি না দাও, এভাবেই চলে যাব।
নীরজা বাধ্য হয়ে একবার মানুর ঘরে উঁকি দিলেন। মানু বের হয়নি। আসলে সে দরজা বন্ধ করে ঘুমোচ্ছে। সে আজকাল কোথাও বের হলেও দরজায় তালা লাগিয়ে যায়। নীরজা জানালায় দাঁড়িয়ে ডাকলেন, মানু দেখ তোর বাবা কী আরম্ভ করেছে। কিন্তু মানু সাড়াশব্দ না করায় চেঁচিয়ে ডাকলেন, ও মানু তোর বাবা কী করছে উঠে দ্যাখ।
মানু পাশ ফিরে শুয়ে বলল, বাবার কী হয়েছে?
কী হবে আবার। উঠে দেখতে পারো না।
মানুর মনে হল বাবার কিছু একটা হয়েছে। বড় আর্ত গলা মার। সে দৌড়ে বের হয়ে এসে দেখল, বাবা আলমারির সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন।
সে মাকে বলল, কী হয়েছে?
কী জানি! এখন বলছে কোথায় মেয়ে দেখতে বের হবে।
ভুবনবাবু কেমন অপরাধীর গলায় বললেন, তোমাকে বলেছি আমি মেয়ে দেখতে যাচ্ছি?
তবে কী করতে যাচ্ছ?
আমার অনেক কথা আছে বুড়ো মানুষটার সঙ্গে। বলেই তিনি ফের চাবিটার জন্য পীড়াপীড়ি করতে থাকলেন।
মানু ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে কিছুক্ষণ বিমূঢ়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকল। আজকাল প্রায়ই সে দেখছে মায়ের সঙ্গে বাবার খিটিমিটি চলছে। এসব সময়ে সে প্রায়ই চুপচাপ থাকে। আর দিদির জন্য মাথায় যে তার একটা শিরঃপীড়া আছে সেটা তখন কেন জানি চাগিয়ে ওঠে। সে গুম মেরে যায় তখন।
ভুবনবাবু বললেন, অনেকদিন আমার সঙ্গে কোনো বুড়ো মানুষের দেখা হয় না নীরজা। আজ আমি আমার সমবয়সি একজন মানুষের কাছে যাব। কথা বলব। কথা বললে বুঝতে পারছি মনটা হালকা হবে।
কী যে বলে মানুষটা! আজকাল প্রায়ই এমন সব কথা বলে যাতে করে বড়ই অপরিচিত লাগে মানুষটাকে। এতদিন যাকে নিয়ে ঘর করেছে সে যেন এই মানুষ নয়। সে ছিল অন্য মানুষ। যত দিন যাচ্ছে তত নীরজার কাছে ভুবন নামে একটা পৃথিবী আলগা হয়ে যাচ্ছে। নীরজা বাধ্য হয়ে বলল, প্রিয়নাথ ঠাকুরপো আছে। ওঁর বাড়িতে যাও। সেও তো তোমার বয়সি মানুষ।
প্রিয়নাথ! ভুবনবাবু দু’বার প্রিয়নাথ নামটি উচ্চারণ করলেন। মেয়েদের কবেই বিয়ে হয়ে গেছে। প্রিয়নাথের। ছেলের মৃত্যুর পর সে বোধহয় আরও হালকা হয়ে গেছে। সংসারের মায়া মমতা তার এখন কাকলীকে নিয়ে। কাকলীর বয়সে নীরজাকে তিনি বিবাহ করেছিলেন। এ—সময়ে প্রিয়নাথের সঙ্গে দেখা হলে কাকলীর কথা তিনি বলতেন। প্রিয়নাথ, কাকলীর ভিতরে কষ্টের উদ্রেক হচ্ছে এটা তুমি যত সত্বর টের পাবে তত মঙ্গল হবে সংসারের। এবং তখনই প্রিয়নাথের বিধবা পুত্রবধূর কথা তাঁর মনে হল। এমন কাম ও যৌবন নিয়ে প্রিয়নাথের বিধবা পুত্রবধূই বা দিন কাটাচ্ছে কী করে । ভানু আর কতদিন। অথবা যে সংশয়টা মনের মধ্যে বাসা বেঁধে আছে সত্যি নাও হতে পারে। প্রিয়নাথ জীবিত থাকতে ঘরের মধ্যে কোনো ব্যাভিচার চলবে সেটি বিশ্বাস করাও পাপ। তিনি বললেন, চাবিটা দাও নীরজা। আমি যাব।
নীরজা আর না পেরে চাবির গোছাটা ছুড়ে দিল। যা খুশি করো।
মানু আর থাকতে না পেরে বলল, কোনো খবর থাকে তো দিন, আমি দিয়ে আসি।
যাবি তুই!
তোমরা যা করছ?
যদি যাস তবে আর আমি যাব না। চিঠি নিয়ে যা। ওদের দিনক্ষণ দেখে আসতে বলবি। আমরা পরে যাব। তুই যাবি আমাদের সঙ্গে?
মানুষ সোজাসুজি বলল, না।
ঠিক আছে, আমি রমা তোর মা আর প্রিয়নাথ সঙ্গে যাবে।
ভুবনবাবু এবার কলম এবং প্যাড নিয়ে বসলেন। চিঠি লিখলেন, আপনার ছোট কন্যা মিতাকে দেখতে আমাদের অমত নেই। তবে প্রথমে আপনারা এসে দেখে যান। পরে আমরা যাব। পছন্দ হলে কথাবার্তা হবে। এই কয়েকটা কথা লিখে তিনি মানুকে চিঠিটা দিতেই, চিঠির উপর ঠিকানা দেখে মানু কেমন বিস্মিত হল। এই ঠিকানায় আজ তার এমনিতে যাবার কথা। নানু চলে যাবার আগে একটা চিঠি রেখে গেছে। চিঠিতেও এই ঠিকানা লেখা আছে। রাসবিহারী নানুর দাদু। সেই দাদুর কাছে মানুকে আজ তবে দুটো চিঠি নিয়ে যেতে হচ্ছে। একটা নিখোঁজ মানুষের চিঠি, অন্যটা বিয়ের চিঠি। সে ভাবল ভবিতব্য আর কাকে বলে?
তখন কাকলী বিছানায় শুয়ে। জানালা দিয়ে আকাশ দেখেছিল। বৃষ্টি হওয়ায় বেশ ঠান্ডা। সারাদিন পেটের নীচে আবার সেই ফিক ব্যথাটা সে টের পাচ্ছে। ব্যথাটা উঠলে কাকলী স্কুলে যায় না। স্নান করতে ভালো লাগে না। খেতে ভালো লাগে না। কেবল শুয়ে থাকে। মুখে একটা ক্লিষ্ট ছাপ থাকে। সে জানে ব্যথাটা সন্ধ্যার দিকে সেরে যাবে এবং তারপরই সে ঋতুমতী হবে আবার। মাস ছয়েক ধরে এমনই চলছে। এবং তার মাও টের পায় তখন ভিতরে মেয়েটা বড় হয়ে যাচ্ছে। গরম জলে তলপেটে সেঁক দিতে বলে। এবং সন্ধ্যার দিকেই কাকলী বাথরুমে ঢুকে গেল। মার কাছে থেকে সে কিছুই জেনে নেয়নি। সংসারে যে এটা হয়, এবং একেই নারীত্ব বলে আসছে মানুষেরা, অর্থাৎ কাকলী বুঝতে পারে সময় বড় সুসময়। তিন—চারটে দিন তার একটা গা ঘিন—ঘিন ভাব থাকলেও কেমন মনের মধ্যে একজন পুরুষের জন্য হাহাকার বাজতে থাকে। ভানুকাকা রাতে মার সঙ্গে এ বাড়িতে আসবে। সে বাথরুম থেকে বের হয়েই আয়নার সামনে দাঁড়াল। দাদু এখন নিচে নেমে যাবে। রান্নার মেয়েটা শুধু বাড়িতে। একা কাকলী এখন আয়নার সামনে। দরজা বন্ধ। জানালাও বন্ধ করে দিল কাকলী। আয়নার সামনে ফ্রক খুলে, বগলে পাউডার দেবার সময় কেমন এক নীলাভ রঙের মধ্যে সে ডুবে যায়—শরীরের প্রতিটি অংশ বড় বেশি ফুটে বের হচ্ছে। সে শরীরের চারপাশটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছিল। পৃথিবীতে কোথাও কোনো অন্য কষ্টে আছে, কাকলীকে দেখে এখন আর এতটুকু বোঝার উপায় নেই। সে পাউডারের ব্রাশ আলতো করে মুখে বুলিয়ে কাজল দিল চোখে। খুব লম্বা কাজল চোখে সে নিজের সৌন্দর্যে কেমন মুগ্ধ হয়ে গেল। যেন কোনো যুবক এখন চারপাশে কেবল নৃত্য করে বেড়াচ্ছে। কাকলী সুন্দর লেস দেওয়া ফ্রক গায়ে বের হয়ে রেকর্ড প্লেয়ারে একটা আশ্চর্য মিউজিক দিয়ে দিল। সে খুব নিভৃতে মিউজিকের মধ্যে ডুবে যেতে যেতে দেখল, ভানুকাকার সঙ্গে এক বড় সবুজ মাঠে দাঁড়িয়ে আছে। ভানুকাকা তাকে ক্রমে একটা অজগরের মতো পেঁচিয়ে ধরছে। ভিতরে প্রচণ্ড উষ্ণতার জন্ম হচ্ছে। শরীর কাঁপছে থির থির করে মুখ কাঁপছে প্রতিমার মতো। সে চোখ তুলে তাকাতে পর্যন্ত পারছে না। তার ঘুম চলে আসছে।
মানু চিঠির নম্বরটা মিলিয়ে দেখল—না, সে ঠিকই এসেছে। সামনে সুন্দর লন, পাঁচিলের পাশে কিছু গন্ধরাজ কাঠ—মালতীর গাছ। গেটে সবুজ বোগেন—ভেলিয়ার ঝাড়। নানুর দাদুর রুচি আছে।
লন পার হলেই দোতলা বাড়ি। ওপরের ঘরগুলিতে একটাও আলো জ্বলছে না। সেটা যেন নিচের ঘরগুলিতে পুষিয়ে নেওয়া হচ্ছে। নিচের ঘরগুলোতে বেশ মানুষজনেরও ভিড়। এ—বাড়ি থেকে একটা ছেলে উধাও হয়ে গেছে এত আলো জ্বলতে দেখে সেটা আদপেই অনুমান করা যায় না। প্রায় উৎসবের মতো বাড়িটা। নিচের ঘরে সে রাস্তা থেকে মানুষজনের চলাফেরা টের পাচ্ছে। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে প্রথমে মানু ঝুঁকে দেখল, কাছে কেউ নেই—সে গেট খোলার চেষ্টা করতে গিয়ে দেখল, খুলছে না। কোথায় আটকে যাচ্ছে। গেট থেকে সোজা লাল নুড়ি বিছানো পথটা বারান্দায় সিঁড়িতে গিয়ে শেষ হয়েছে। নানু ওর সঙ্গে দেখা করে বলেছিল, এই চিঠিটা তুই দিয়ে আসবি। চিঠিটাতে নানু লিখেছে, দাদু আমি লীলাকে খুঁজতে যাচ্ছি। কবে ফিরব, কী ফিরব না ঠিক নেই। আমার জন্য তুমি চিন্তা করবে না। এবং এই চিঠি পৌঁছে দেবার ভার মানুর ওপর রেখে গেছে। আরও কত কথা বলে গেল নানু। সে একবার তার খোঁজেও এসেছিল। কিছু সমস্যার কথা বলার ছিল তখন। কিন্তু লীলা চলে যাবার পর তার নাকি মনে হয়েছে জীবনে তার একটিই সমস্যা—এবং সে লীলাকে আবার খুঁজে পেলেই সে সমস্যাটা মিটে যাবে। অদ্ভুত গম্ভীর রাশভারি ছেলে নানু—অথচ কাল ওকে খুব উদাস দেখাচ্ছিল। লীলা! কে এমন প্রশ্ন করেছিল মানু। জবাবে নানু বলেছে, লীলা কিশোরীর নাম। লীলা বড় সুন্দর নাম। শুনেই তোমার বোঝা উচিত মানু লীলা বড় ভালো মেয়ে। তারপর নানু সহসা গান গেয়ে ওঠার মতো বলেছিল ন…ব…নী…তা। আজকাল নানুর মনের মধ্যে পৃথিবীর কোনো সৌন্দর্য নাড়া খেলেই এমন একটা শব্দে সে তা প্রকাশ করতে চায়।
সে এবারে গেট খুলে ভিতরে ঢুকে গেল। সন্তর্পণে সে হেঁটে যেতে থাকল। এ বাড়ির জন্য দুটো চিঠি তার হাতে। কোনটা আগে দেবে অথবা কোন খবরটা তার আগে দেওয়া উচিত। এ সময় সে বুঝে উঠতে পারল না।
বারান্দায় উঠতেই অবাক। চার পাঁচজন লোক খুব গম্ভীর মুখ করে বসে আছে। আর আশ্চর্য সে এখানে এসে দেখল অরুণদাও এ—বাড়িতে হাজির। সে কখনও অরুণদাকে ধুতি—পাঞ্জাবি পরতে দেখেনি। সে দেখেই সহসা ডেকে উঠল, অরুণদা তুমি!
বারান্দায় আবছা অন্ধকারে একটা ছায়ামূর্তি দেখেই অরুণের মনে হল ভারী চেনা গলা। বুকটা ওর কেঁপে উঠল। সে বের হয়ে বলল, তুমি, কী ব্যাপার।
আপনি এখানে!
এই মানে…অরুণ আমতা আমতা করতে থাকল।
মানু বলল, এ—বাড়িতে রাসবিহারী রায় কে?
অরুণের ভিতরটা আবার কেমন ঘাবড়ে গেল। মানু কী তার সঙ্গে যে রমার সম্পর্ক আছে, গোপনে সে একটা কিছু করছিল, সে খবর এ বাড়িতে পৌঁছে দিতে এসেছে।
তখন রাসবিহারী বের হয়ে এলেন। কোথাকার কোনো উটকো লোক অথবা যদি কোনো দুঃসংবাদ বয়ে আনে কেউ সবাই কেমন তটস্থ ভঙ্গিতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বলল, কাকে চাই?
রাসবিহারী রায় আছেন?
রাসবিহারী বলল, আমি রাসবিহারী।
চিঠি আছে। আগে সে বাবার চিঠিটা রাসবিহারীর হাতে দিল। বলল, আমার বাবার নাম ভুবনমোহন গাঙ্গুলী।
ভিতরে এসো। বাইরে দাঁড়িয়ে কেন! কে একজন যেন কথাটা বলতেই সে ওদের সঙ্গে ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল। ঘরের দেয়ালে বিদ্যাসাগরের ছবি। সি. আর. দাশের ছবি, নেতাজীর ছবি এবং গান্ধীজীর ছবি। এইসব ছবি কোনো বাড়িতে দেখলেই মনে হয় মানুর মানুষগুলো ভালো নেই। অথবা ভালো না থাকতে পেরে বড় মানুষদের দোহাই দেবার জন্য ছবিগুলিকে সাক্ষী রেখেছে। ওর তখন ঠোঁট কুঁচকে যায়। আপনারা বেশ মাছের তেলে মাছ ভাজছেন মশাইরা। সে চিঠিটা হাতে দিয়ে বলল, বাবা নিজেই আসতেন। কিন্তু ওঁর শরীর ভালো না। আমরা আসতে দিইনি।
অরুণ এখন একেবারে অপরিচিতের ভঙ্গি করে বসে আছে। এবং মুখগুলি দেখেই মনে হল ওরা কোনো গোপন শলাপরামর্শ করছিল এতক্ষণ। ওর মতো একজন মানুষের আগমনে ভেস্তে গেছে। সে বলল, বসব না। বলেই আর একটা চিঠি যখন বের করতে যাবে তখন হা হা করে উঠলেন রাসবিহারী। সে কী সে কী। তুমি এসেই চলে যাবে কেন বোস। মানু বলল, আরও একটা চিঠি আছে। আপনাকে দিতে বলেছে।—ও আমাদের বাসায় কাল সকালে গেছিল। চিঠিটা আপনাকে দিতে বলেছে।
প্রথম চিঠিটা পড়ে শেষ করেছেন মাত্র—তারপরই নানুর চিঠি। রাসবিহারী মাথার মধ্যেও নানুর মতো একটা রেলগাড়ি ঢুকে যাচ্ছে। এই প্রথম বুঝতে পারলেন, তিনিও ইচ্ছে করলে আস্ত একটা রেলগাড়ি মাথার মধ্যে ঢুকতে দিতে পারেন। সবটা ঢুকে গেলে চোখ মুখ কিছুটা অস্বাভাবিক লাগল দেখতে। অবনীশ তখন চিৎকার করে উঠল, সর্বনাশ, তাওওইমশাই আপনার চোখ দেখছি নানুর মতো হয়ে যাচ্ছে। নানু কী লিখেছে?
রাসবিহারী বললেন, নানু লীলার খোঁজে চলে গেছে। নানু নিরুদ্দেশ।
রাসবিহারী তারপর মানুর দিকে তাকিয়ে বললেন, নানু তোমার সঙ্গে বুঝি পড়ে?
মানু বলল, হ্যাঁ। পড়ে।
নানু আর কিছু বলে যায়নি?
না। আমি যাই।
বোসো বাবা। ভিতরে এসে বসো। এখুনি যাবে কী!
তিনি ফের বললেন, অরুণ দেখতো অমলা কী করছে। তোমার মাকে বলো, ওকে একটু মিষ্টি দিতে। কত সব সুখবর আজ আমার। আমার কী হবে। তারপর অরুণ উঠে যেতে চাইলে মানু বলল, অরুণদা বাইক এনেছ? তোমার গাড়িতে যেতাম।
অরুণকেও চেন!
অরুণদা আমাকে চাকরি দেবে বলেছেন, না অরুণদা।
অরুণ বোকার মতো তাকিয়ে থাকল। যেন কিছুই বুঝতে পারছে না। কোনো শব্দই কানে যাচ্ছে না।
রাসবিহারী বাহবা নেবার জন্য, অর্থাৎ দেখো আমি কত বড় মানুষের শ্বশুর বোঝানোর জন্য যেন বললেন, অরুণ আমার জামাই। এরাও জামাই। আর এই হল নানুর জ্যেঠু অবনীশ। ইয়েস বয়, তোমাকে নানু কী বলেছে ফের ফিরে আসবে?
চিঠিতে তো তেমন কিছু লেখা নেই।
আই মিন এনি ডিসকাসান?
মানু বলল, না। ওর ডিসকাসান করার বাড়তি সময় হাতে ছিল না।
তারপর মানুর কেন জানি মনে হল এই মুখগুলি সব মুখোশ পরা। সে রাসবিহারীর দিকে তাকিয়ে বলল, আমি তাহলে যাই।
আরে না না। বোস। আমরা শিগগরিই খবর পাঠাব কবে যাচ্ছি।
মানুর মনে হল, টাক মাথার লোকটা আবার বোধহয় ডিসকাসানের কথা তুলবে। আসলে নানু তাকে যা বলেছে খুবই সংক্ষিপ্ত। যা পরিচয় তাতে নানুর এর চেয়ে বেশি বলারও কথা নয়। সে রাস্তায় দাঁড়িয়েই চিঠি দিয়েছে। একবার মাঝে খুঁজে গিয়েছিল, পায়নি। এবং সেজন্য তার কোনো অনুযোগই নেই। নানুর সঙ্গে একদিন দিদিরও পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। নানুর দিদির সঙ্গে একটা কথাও বলেনি। দিদি যে খারাপ হয়ে গেছে নানু কী সেটা টের পেয়ে গেছিল!
তখন অরুণদা খুব ভালো মানুষের মতো রাসবিহারীকে বলল, বাবা, মানু আমার খুব পরিচিত। ওদের বাড়ির সবাই। মিতার সঙ্গে ভানুবাবুর বিয়ে হলে বেশ মানাবে। ভানুবাবু মানুষটিও খুব ভালো। সংসারের প্রতি বড়ই কর্তব্যপরায়ণ।
কী আশ্চর্য আমি এত সবের কিছুই জানতাম না।
মানু কী বলবে ভেবে পেল না। সে কেবল বলতে পারত, অরুণদা তুমি দিদিকে নিয়ে বাইকে কতদূর যেতে চাও! কিন্তু কিছুই না বলে সে দেয়ালে বিদ্যাসাগরমশাইর ছবিটির দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর একটু মিষ্টিমুখ। সে যতক্ষণ ছিল, ‘ওর আর নানু সম্পর্কে একটা কথাও বলেনি। মিতার সম্বন্ধের ব্যাপার আর এ বাড়ির এক ছেলে গতকালই নিরুদ্দেশ। তাও একটি ঝি—মেয়ের জন্য। আর সেই খবর বয়ে এনেছে ছেলের ছোট ভাই। এসব ভেবেই হয়তো ওরা নানু যে তাদের আত্মীয় হয় তা আর দ্বিতীয়বার মুখ ফুটে বলতে চাইল না।
বাড়িতে ফিরে মানু নিজের ঘরে কিছুক্ষণ বসে থাকবে ভাবল। কারণ সে আজ তার বাড়ির জন্য দুঃসংবাদ বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বাবা মা এবং দিদির জন্য বিশেষ করে। অরুণদা নানুর মেসো। অরুণদাকে নিয়ে বাবার অনেক স্বপ্ন। ভালো জামাইর জন্য একটা বয়সে বাপেদের বড় দুর্ভাবনা। মেয়েকে যে এত বড় করা তা একজন ভালো সুপাত্রের কাছে ভোগের নিমিত্ত তুলে দেওয়া। ভোগের নিমিত্ত কথাটিই তার মনে হল। রাসবিহারীবাবু ভোগের নিমিত্ত একজনকে বড় করে তুলেছেন ঘরে। ভানুবাবু ভোগের নিমিত্ত। দিদির নিমিত্ত হয়তো এতদিনে অনেকবারই হয়ে গেছে। দিদি এখন শুধু এঁটো বাসন। পড়ে থাকলে কেবল মাছি ভন ভন করবে।
বাড়ি ফিরলেই বাবা জিজ্ঞেস করলেন, কীরে দিয়ে এলি?
সে বলল, হ্যাঁ। তারপর মানুর আর কিছু বলতে ইচ্ছা হল না। দাদা এখনও বাড়ি ফিরে আসেনি। দিদি শুয়ে গল্পের বই পড়ছিল। মাথার কাছে রেডিয়োতে রবীন্দ্রসংগীত। দিদির মুখ ভারী উৎফুল্ল ছিল। দাদার বিয়ের চিঠির কথা শুনেই সে লাফিয়ে উঠেছিল। তারপর আঁচল ঠিক করে বাবার ঘরে হাজির। —কবে আমরা দেখতে যাব?
মানু সহসা কেন জানি ছোটলোকের মতো তখন চিৎকার করে উঠল, তোমায় যেতে হবে না।
রমা অবাক। মানু কখনও এভাবে কথা বলে না। বাবা অথবা মার সঙ্গে ঠান্ডা কথাবার্তা মাঝে মাঝে বলে থাকে। মাথা গরমও করে থাকে মাঝে মাঝে। কিন্তু তার সঙ্গে মানু সব সময় বেশ সহজ হয়ে কথা বলে। মানুর জামা—প্যান্ট হাতখরচা সবই রমা দেয়। ছোট ভাইটির জন্য তার ভারি মমতা। অরুণদাকে সে ধরে রেখেছে—ঠিক কিছু একটা হয়ে যাবেই। হায় সেই মানুর চোখ বাঘের মতো হয়ে যাচ্ছে কেন। রমা তাকাতে পর্যন্ত ভয় পাচ্ছে।
বাবা বললেন, আজকাল যে তোদের কী হয়েছে বুঝি না। একটুকুতেই রেগে যাস। রমা গেলে কী হবে!
মানু ভাবল, সত্যিতো দিদি গেলে এমন কী অনিষ্ট হবে। দিদিকে জানতেই হবে সব। বাবা—মাকেও। তারপর আর বোধহয় বাবা এ—বিয়েতে রাজি থাকবেন না। মেয়ের জামাইবাবুর খবরে বাড়ির সবার সংশয় দেখা দিতে পারে। সে এবার বলে ফেলল, বাবা মেয়েটি অরুণদার আত্মীয়।
নীরজা বলল, তাই নাকি। ওমা আমরা তো তা জানি না।
মানু বলল, মেয়েটি অরুণদার স্ত্রীর ছোট বোন।
ভুবনবাবু বললেন, অরুণ মানে অরুণের কথা বলছিস তো!
তাই বলছি। বুঝতে এত কষ্ট হচ্ছে কেন?
সবার মুখ কেমন থম মেরে গেল। মা দিদির দিকে তাকিয়ে কী যেন আঁচ করার চেষ্টা করল। তখন দিদি সরল গলায় বলল, অরুণের স্ত্রী আছে বলে কী হয়েছে?
ভুবনবাবু শুধু বললেন, কিছু হয়নি। তারপর বারান্দার অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। অথবা বলা যায় ভুবনবাবুকে সহসা একটা বড় রকমের অন্ধকার সহসা গ্রাস করে ফেলল। রমা দেখল তার সামনে আর কেউ দাঁড়িয়ে নেই। সে কেমন একা নিঃসঙ্গ হয়ে গেল। তারপর যেন জনান্তিকে বলা, একটা লোক বিয়ে করেছে বলে চণ্ডীপাঠ অশুদ্ধ হয়ে যাবে! আমি তো জেনেই মিশছি। মানুর জন্য কী চেষ্টা করছে জানো!
রমা আবার কী বলতে যাচ্ছিল—ও—ঘরে মানু ফুল ভলিউমে রেডিয়ো ছেড়ে দিয়েছে। রমার কথাগুলি শব্দের মধ্যে অসংখ্য বুদবুদ তুলে তলিয়ে যেতে থাকল। এবং রাতে বাবা অসুস্থ বলে কিছুই খেলেন না। নীরজা কোনোরকমে দরকারি কাজ সেরে তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। পরদিন সকালে দেখা গেল মানু নিচে একটা লোকের চুলের মুঠি ধরে টেনে আনছে। লোকটা নীরোদবাবুর ড্রাইভার। সে গাড়ি চাপা দিয়ে কাউকে হত্যা করেছে। মোড়ের মাথায় হল্লা। গাড়ি ভেঙে দিয়েছে। এবং গাড়িতে আগুন দেওয়া হচ্ছে। দোষ, সে গাড়ি গ্যারেজ করতে গিয়ে দেখতে পায়নি পাশে কেউ বাচ্চা রেখে বাবুদের বাড়িতে কাজ করতে গেছে। ড্রাইভার না জেনেই একটা দু মাসের বাচ্চার বুকে গাড়ির চাকা তুলে দিয়েছে। রক্তাক্ত চাকার নিচ থেকে সেই শিশুর আর্তনাদ মানু শুনতে পাচ্ছিল। এবং সে জানে চুলের মুঠি ধরে এখন না নিয়ে এলে, ড্রাইভারকে সাহসী বিবেকবান মানুষেরা খুনই করে ফেলবে। সে নীরোদবাবুর ড্রাইভার অনিমেষকে আপাতত একটা ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। পুলিশের ভ্যান না আসা পর্যন্ত সে এখান থেকে নড়তে পারছে না।
বাইশ
নানুর সকাল সকাল ঘুম ভেঙে গেল। এখনও সূর্য ওঠেনি। অথচ ঘুম ভেঙে গেল। এত সকালে ওঠার অভ্যাস কোনোদিন নেই। এবং সুনিদ্রা হলে যা হয়, নানু উঠেই আড়মোড়া ভাঙল, হাই তুলল। ছেঁড়া মাদুরের ওপর কারুকাজ করা কাঁথা লীলা পেতে দিয়েছিল। অর্থাৎ এত অভাবের মধ্যেও লীলার পরিচ্ছন্নতা বোধ খুবই তীব্র। ঘুমের এজন্য কোনোই ব্যাঘাত ঘটেনি। বরং কতকাল পর ঘুমের শেষে এক আশ্চর্য প্রশান্তি। সে দেখল, তরুলতার ফাঁক দিয়ে লাল সূর্য উঠে আসছে। আর চারপাশে তরুলতার সবুজ ঘ্রাণ, হালকা হলুদ রঙ। এবং একধরনের নির্জনতায় সে ডুবে যাচ্ছিল। বাড়িতে কেউ নেই যেন। গোবড়া সন্টি মন্তিরা গেল কোথায়, লীলা কোথায়! তখনই মনে হল সে কি কাল কোনো স্বপ্নের মধ্যে লীলাকে আবিষ্কার করেছিল। আসলে সে কি লীলার খোঁজ করতে করতে এক গভীর বনের মধ্যে প্রবেশ করেছে! এসব মনে হতেই বুকটা গুড় গুড় করে উঠল। তখনই দরজার ভিতর কাশি শোনা গেল। লীলার মা কাশছে। সে অবাক হল, এমন কেন হয়, সবসময় লীলাকে তার এত হারাবার ভয় কেন! সে ডাকল, লীলা! লীলা!
লীলা দুধ আনতে গেছে বাবা।
দুধ দিয়ে কী হবে?
আজ্ঞে আপনি চা খাবেন না!
নানু জেঠুর বাড়িতে গেলেই বলত, চা করো লীলা। লীলা করতে পারত না। লীলার কষ্ট হত তখন। সে কী ভালোবাসে না বাসে লীলা এত টের পায় কী করে! লীলা তো তখন রান্নাঘর থেকে বের হতে চাইত না। ডেকে ডেকে সারা হতে হত। দাদাবাবুরা বোধহয় ভালো হয় না। লীলা এর আগে অন্য কোথাও কাজ করেছে কী না এখনও জানে না। ভাবল লীলা ফিরে এলে জিজ্ঞেস করবে—লীলা আমি কী খুবই খারাপ। আমি কী তোমাকে অসম্মান করব ভেবেছ! তারপর নানুর মনে হল লীলাকে আসলে এসব কথা সে কখনও বলতেই পারবে না। লীলাকে এসব বললেই মাথা নিচু করে রাখবে। এমনকি চোখ থেকে টস টস করে জলও ফেলতে পারে।
সে এবার বাইরে বের হয়ে এল। সত্যি মুক্ত আকাশ। যত দূরেই সে চায় দূরদিগন্ত প্রসারিত মাঠ সামনে। কেমন শস্যবিহীন, এবং অনুর্বর। লীলাদের বাড়ির তিন দিকেই আগাছা এবং জঙ্গল। সামনে সদর রাস্তা। দূরের গঞ্জে বোধহয় চলে গেছে।
তখনই ভিতর থেকে লীলার মার ক্ষীণ গলা পাওয়া গেল, ও গোবড়া গেলি কুথি! বাবাকে জল দে। হাত মুখ ধুবে বাবা।
নানু বলল, আমি দেখছি গোবড়া গেল কোথায়। আসলে নানু লীলার ভাইদের নাম এখনও ঠিক ঠিক জানে না। কোনটাকে লীলা গোবড়া বলে কাল রাতে ডেকেছে সে এখনও তা মনে করতে পারল না! পর পর লীলার চারটি ভাই। সব কটির রঙ শ্যামলা—চোখ বড় বড়, হাত পা কাঠি কাঠি। শুধু মাথাটা সম্বল করে এরা বেঁচে আছে। ছোটটা এত শীর্ণ যে জোরে কথা বলতে পারে না। তারপরই কোলে পর পর দুটো। একটা ঘরে আছে সে টের পেল। বাকিগুলির একটাও বাড়ির ত্রিসীমানায় নেই। ধুলো কাল খেয়েই চলে গেছে। বলেছে, আজ আবার আসবে খেতে। নানুকে বলে গেছে, বাবা আপনি থাকুন। নিজের বাড়ি মনে করে থাকুন। কথাবার্তায় এত সুন্দর যে মনেই হয় না লোকটার মনে কোনো পাপ চিন্তা আছে। এসব ভাবতে গিয়েই সামান্য অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। শ্রীহরি লোকটিকেও তার ভালো লেগেছে।
নানু হাঁটতে হাঁটতে সদর রাস্তায় চলে এল। এই রাস্তাটাই গতকাল তাকে এখানে নিয়ে এসেছে। একটা নদী পার হলে রাস্তাটা পাওয়া যায়। কিছু গ্রাম গঞ্জ পার হয়ে দুক্রোশের মতো ফাঁকা মাঠ। ফাঁকা মাঠের মাথায় এই গ্রাম! গ্রামটার নাম তার জানা ছিল। আবার দু ক্রোশ হেঁটে গেলে সামনে কোনো গ্রামটাম পাওয়া যেতে পারে। উত্তরে বিশাল একটা বনভূমি আছে বলে তার মনে হল। আসলে ওটা বনভূমি না অন্য কিছু এখনও ঠিক জানে না। লীলাকে নিয়ে সব একবার দেখবে ভাবল। কিন্তু লীলা সোমত্ত মেয়ে—তাকে নিয়ে ঘুরলে কথা হতে পারে। লীলার বড় ভাইটা যদি সঙ্গে থাকে অথবা শ্রীহরি, শ্রীহরিই তার যেন সহায়—সেই সব খবর দিতে পারবে।
লীলা দূর থেকেই দেখল দাদাবাবু রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। সে লোহারদের বাড়ি গেছিল দুধ আনতে। এ গাঁয়ে ওরাই এখনও দু বেলা দুমুঠো পেট ভরে খেতে পায়। অনেক জমিজমা—কিছু আবাদ হয় কিছু অনাবাদি। পুকুরে মাছ আছে গোয়ালে গোরু আছে। এখনও শ্যাম লোহার গাঁ ছেড়ে যায়নি। ওর অন্য ভাইরা শহরে চলে গেছে। পাটকলে কাজ করে তারা। লোহারদের সেজ বউ শহরের ইস্কুলের মাস্টারনি। সেই লীলাকে কাজ ঠিক করে দিয়েছিল। গাঁয়ের দুঃস্থ পরিবারগুলির ভরসাও এই লোহার পরিবার। সম্বৎসরই এই লোহার পরিবারকে ধরে কেউ না কেউ শহরে কাজ নিয়ে চলে যায়। লীলাকে নিয়ে গিয়েছিল লাবণ্য বউদি। নেবার সময় বলেছিল, মাকে, খাবে থাকবে সঙ্গে ত্রিশ টাকা মাইনা। পূজায় শাড়ি পাবে—কাজকর্ম বলতে তিনজন লোকের দেখাশোনা। এই কড়ারেই লাবণ্য বউদি লীলাকে নিয়ে গিয়েছিল। ত্রিশটা টাকা মার অনেক। ত্রিশ টাকায় এখনও এক মণ ধান পাওয়া যায়। এক মণ ধান লীলাদের সংসারে অনেক। এক মণ ধানের জন্য মা তাকে প্রায় বিক্রি করে দিয়েছিল। দাদাবাবুকে নিয়ে সে এখন কী যে করে! মানুষটা যেন এ—পৃথিবীরই মানুষ নয়।
লীলাকে দূর থেকে দেখেই নানু চিৎকার করে বলল, লীলা কী ফাইন। লীলাকে দূর থেকে বড় রহস্যময়ী নারীর মতো মনে হচ্ছে। লীলার হাতে একটা এনামেলের গেলাস। গেলাসটা হাতে নিয়ে বড় সন্তর্পণে হাঁটছে লীলা। সামনে পেছনে লীলার সেই সৈন্যবাহিনী—কেউ দৌড়ে আসছে, কেউ হেঁটে আসছে, কেউ লাফিয়ে আসছে। লীলা কাছে এসে বলল, তুমি দাদাবাবু হাত মুখ ধুয়ে নাও। তখনই নানু সামান্য থেমে বলল, গোবড়া কার নাম?
গোবড়া এগিয়ে বলল, আমি গোবড়া।
লীলার বড় ভাইটিকে নানু বলল, তুই একবার শ্রীহরিকে ডাকবি?
লীলা সামান্য হেসে বলল, ডাকতে হবে না। চায়ের গন্ধে ও এমনিতে চলে আসবে।
আর আশ্চর্য নানু দেখল, ঠিক চায়ের গন্ধে শ্রীহরি সত্যি চলে এসেছে। মুড়ি চা—প্রায় গোল হয়ে বসে গেল। খেতে খেতেই নানু বলল, শ্রীহরিদা, তোমাকে একটা কথা বলব?
বলেন বলেন। আজ্ঞে আপনি বলবেন না তো কে বলবে!
প্রথমে তুমি আমাকে এখানকার সব ঘুরিয়ে দেখাবে।
যথার্থ কথা। আজ্ঞে দেখাব।
তোমার তো একটা দেখছি ভাঙা সাইকেল আছে?
তা আছে দাদাবাবু।
ওটাতে দুজন যাওয়া যায়?
ও আমার পুরনো বান্দা। বড় বিশ্বাসী দাদাবাবু। —কোথায় যাবেন।
চম্পাহাটিতে।
কখন?
এখুনি বের হব।
লীলা বলল, দাদাবাবু রাতে তোমার ঘুমের কষ্ট গেছে। এখানে থাকলেই কষ্ট। তোমাকে বরং শ্রীহরিদা ট্রেনে তুলে দিয়ে আসুক।
নানু বলল, আমাকে চলে যেতে বলছ?
লীলা নিজের মাথা খেয়ে ভাবল, কেন যে এমন কথা বলতে গেল! মানুষটা এত ভিতর থেকে কষ্টের কথা বলে যে স্থির থাকা যায় না। মানুষটার মাথাও বোধহয় ঠিক নেই। মামিমা ঠিকই বলত, নানুটা পাগল হয়ে যাচ্ছে। তা না হলে এমন পাণ্ডববর্জিত জায়গায় লীলার খোঁজে কেউ চলে আসতে পারে। সুস্থ মস্তিষ্ক হলে দাদাবাবু আর দশজন দাদাবাবুর মতো হতেন। সে নানুকে আর একটা কথা বলতেও সাহস পেল না।
তখন নানু কেমন ছেলেমানুষের মতো শ্রীহরিকে বলল, আচ্ছা শ্রীহরিদা তুমি আমাকে একটু থাকবার জায়গা দেবে? আমাকে কেউ কাছে রাখতে সাহস পায় না। কেন এটা হয় বলো তো! সবাই তাড়িয়ে দেয়।
এমন কথায় লীলার মুখ খুবই ব্যাজার হয়ে গেল। সে তবু শক্ত হয়ে থাকল। কোনো কথা বলল না।
শ্রীহরি বলল, আরে দাদাবাবু আপনি একটা মানুষ—একটা মানুষের ভাবনা কী বলেন। আমারে দ্যাখেন আমি একটা মানুষ, সেই কোন সালে বাপ গেল, মনে নেই, সেদিন মা চিঠি পেল—বড়ই ভাগ্যবান না হলে কপালে এত সুখ লিখা থাকে শ্রীহরির।
লীলা মাথা নিচু করে রেখেছে বলে, সে গোবড়াকে বলল, কীরে তোর দিদি আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছে। তুই কিছু বলবি না।
লীলার মা তখন ভিতর থেকে বলল, আপনি চলে যাবেন কীগো বাবা, ঝোল—ভাত খাব বলে বসে আছি। জিয়ল মাছের ঝোল। ও লীলা তুই কী রে—বাবা কি তোদের পর। না বাবা দু’দিন থেকে খেয়ে যান—লীলা কে এ বাড়ির! তুই কেরে আবাগির বিটি আমার বাবাকে তাড়িয়ে দিস!
লীলা বুঝতে পারে মানুষের স্বার্থপরতা কতটা হীন হলে এতটা নিচে নেমে কথা বলতে পারে মা। দাদাবাবু কিছুই বুঝবে না। দাদাবাবু তার মার এই লোভের দিকটা টের পেলে ভালো হত। আঙুল উঁচিয়ে বলতে ইচ্ছে হল, দাদাবাবু অভাবে আমাদের কারও মাথা ঠিক নেই। আমাদের মধ্যে থাকলে তুমিও মাথা ঠিক রাখতে পারবে না। তোমার যা আছে আমরা সব রাক্ষসের পাল দুদিনে শেষ করে দেব! তুমি আমাদের কত খাওয়াবে? শেষে মানুষটার দিকে চোখ তুলতেই লীলা কেমন সংকুচিত হয়ে গেল। যেন সত্যি মানুষটাকে অপমান করে তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। সে অগত্যা বলল, তুমি যেন কোথায় যাবে বললে দাদাবাবু!
চম্পাহাটিতে যাব। কিছু মাছ টাছ, তোমার জন্য সায়া শাড়ি বলেই সে শ্রীহরির দিকে তাকাল। তারপর বলল, যদি আমি একটা ঘর করে থাকি তোমরা বাধা দেবে না তো কেউ?
শ্রীহরি বলল, কে বাধা দেবে। কত জায়গা পড়ে আছে। দিন দিন ঝোপঝাড় বাড়ছে, মানুষজন গাঁ ছেড়ে চলে যাচ্ছে, পাঁচ কুড়ি টাকা দিলে আপনাকে এক কাঠা ভুঁই দেব দাদাবাবু!
নানু লাফিয়ে উঠল, সত্যি বলছ! এত সস্তা!
কেউ আসে না। জমিতে কিছু ফলে না। জল হলে কিছু হয়, না হলে সম্বৎসর অজন্মা। এ—পোড়া দেশে কে থাকে দাদাবাবু বলেন।
শ্রীহরির কথায় নানু হাতের কাছে যেন এক বড় আকাশ পেয়ে গেল। অনাবাদি থেকে থেকে ক্রমে খড়ের জমি হয়ে যাচ্ছে। লীলার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি তাড়িয়ে দিলে কী হবে। শ্রীহরিদা আমার আছে। আমি শ্রীহরিদার কাছে থাকব।
লীলা বলল, সেই ভালো। এখন যেখানে যাবে বলছিলে তাড়াতাড়ি যাও। ফিরতে বেশ বেলা হবে। শ্রীহরির দিকে তাকিয়ে বলল, শ্যাম লোহারের সাইকেলটা দ্যাখো পাও কিনা। তুমি চাইলে না করবে না। পেছনে বসে যেতে ওঁর কষ্ট হবে।
নানু বলল, আমার কষ্টে তোমার কী আসে যায়?
লীলা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, আমার কেন আসতে যাবে, আমি আপনার কে?
নানু লীলার কথায় বিমর্ষ হয়ে গেল। লীলা আঘাত পেয়েছে। সে লীলাকে আঘাত দিতে চায় না। এখানে আসার পর সে অন্য মানুষ হয়ে গেছে। এখন আর কেন জানি তার কাউকে আঘাত দিয়ে কথা বলতে ইচ্ছে হয় না। সে তাড়াতাড়ি কথা ফিরিয়ে নিয়ে বলল, লীলা কিছু মনে করো না। তুমি আঘাত পাবে জানলে সত্যি এভাবে বলতাম না।
লীলার চোখ জলে ভার হয়ে গেল। এই মানুষটার মধ্যে কী যে আছে! কথায় কথায় আজকাল তার চোখে জল আসে। এমনটা তার আগে কখনও হত না। সাইকেল নিয়ে এলে শ্রীহরিকে লীলা বলল, তুমি একটা ভালো দেখে মাদুর নিয়ে এসো। বালিশ চাদর কিছু ঘরে নেই। রাতে আমি ভালো ঘুমতে পারিনি।
নানু বলল, তোমার আর কী লাগবে বলে দাও।
লীলা বলল, আমার? সামান্য হেসে বলল, যা বলেছি ঐটুকু মনে করে এনো। তা হলেই আমার সব হয়ে যাবে।
তারপর লীলা শাড়িটা কোমরে পেঁচিয়ে উদ্ধব দাসের বাড়ি গেল। উদ্ধব দাসের বউ কামিনীর কাছ থেকে কোদালটা চেয়ে নিল। গোবড়া এবং সে মিলে বাড়ির আনাচে কানাচে যে ঝোপজঙ্গল ছিল সব সাফ করে ফেলল। মানুষটার মর্জি বোঝা ভার। কতদিন থাকবে, কে জানে। সাপের উপদ্রব আছে। এতক্ষণে মনে হল, একটা টর্চ বাতি আনতে বললে ভালো করত। চারদিক থেকে সে সতর্ক থাকতে চায়। পুকুরের জল সহ্য নাও হতে পারে। সে গোবড়াকে দিয়ে এক কলসি জল আনিয়ে নিল—এবং স্নান সেরে রান্নার জন্য উনুনে শুকনো খড়কুটো গুঁজে দিল। সন্টি মন্তিকে পাঠাল মাঠে, ওরা ছাগল দুটোকে ঘাস খাওয়াবার জন্য নিয়ে গেল। মোরগগুলি ঠুকরে ঠুকরে ঘাসের পোকামাকড় খাচ্ছে। ছোট বোনটা কাঁদছিল—একটু বাড়তি দুধ ছিল, সবটা গরম করে খাওয়াল। শ্যাম লোহারকে বলতে হবে—এ’ কদিন দুধের দরকার হবে। একটু বেশি দুধ চাই। বাবু মানুষের ছেলে দাদাবাবু। ভালোমন্দ খেতে অভ্যস্ত।
এখন কত সব এমন ভাবনা মাথায় কেবল ঘুরপাক খাচ্ছে লীলার। বাপ ধুলো দুপুর হলেই চলে আসবে—এখানেই খাবে। সে বড় এনামেলের হাঁড়িটা চাপিয়ে মাকে বলল, এসো মাথাটা ধুয়ে দি। ওরা ফিরে এলে সময় পাব না!
রাস্তায় নানু বলল, শ্রীহরিদা এখানে চাষ—আবাদ বুঝি ভালো হয় না?
শ্রীহরি বেশ দ্রুত সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিল। পাশে নানু। বাতাসের সাঁ সাঁ শব্দে শ্রীহরি নানুর কথা বুঝতে পারছিল না। সে নানুর দিকে তাকিয়ে বলল, আজ্ঞে আমাকে কিছু বললেন?
নানু বুঝতে পারছে আর জোরে তাকে কথা বলতে হবে। ওরা এখন পাশাপাশি যাচ্ছে—এখানে রাস্তাটা বেশ প্রশস্ত। নানু প্রায় শ্রীহরির সংলগ্ন হয়ে এল—এখনও সে সাইকেল ভালোই চালায়, কতদিন সাইকেল চড়া অভ্যাস ছিল না, কতদিন পর আবার একটা সাইকেলে সে সকালের মাঠে বের হয়ে পড়েছে। সে বেশ জোরে বলল, শ্রীহরিদা এখানে চাষ—আবাদ কেন হয় না?
জল নেই। জল হলে সোনা ফলতে পারে।
নানু বলল, তুমি চাষ বোঝো শ্রীহরিদা?
ঐটাই সংসারে বুঝি দাদাবাবু।
তুমি নাকি পুলিশে নাম লিখিয়েছিলে?
ওরে ব্বাস, ও—কথা আর বলবেন নি!
কেন কী হয়েছে?
কাল রাতে লীলা যখন ওর বিছানা করে দিচ্ছিল, তখন শ্রীহরিদার সম্পর্কে অনেক খবর দিয়েছে। কোথাও গিয়ে থাকতে পারে না মানুষটা। গাঁয়ের টানে চলে আসে। ওর মামা পুলিশে কাজ করে—সেই বাউণ্ডুলে ভাগ্নেকে পুলিশে নাম লেখাতে বলেছিল। শ্রীহরিদা সাইকেল থেকে হাত তুলে হাওয়ায় দুলিয়ে বলল, আর যাচ্ছিনে ও লাইনে।
কোন লাইনে যাবে তবে?
ও একটা লাইন ঠিক ধরে নেব।
নানু বলল, আমারও যে একটা লাইন ধরতে হবে শ্রীহরিদা। খেতে হবে তো!
কী যে বলেন! শ্রীহরি খুব লজ্জায় যেন পড়ে গেছে নানুর এমন কথা শুনে। কোনো মরণে ধরেছে যে নানুবাবুকে লাইন ধরতে হবে! সে তো আর তার মতো উলটোপালটা লোক নয়। শ্রীহরি বলল, চম্পাহাটির ঘোষালরা খুবই অর্থবান লোক দাদাবাবু। ছোট ঘোষালের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব। আমাকে খুব ভালো চোখে দেখে। সলা করলে দুটো একটা বুদ্ধি দিতে পারবে ছোট ঘোষাল।
নানু শ্রীহরির কথায় হেসে ফেলল। —কেন তুমি কোনো সলা দিতে পারবে না?
আমার কথা কে লয় দাদাবাবু। আমি একখানা আবার মানুষ!
নানু বলল, আমার একখানা ঘরের দরকার।
সে করে দেবনে।
কোথায় করবে?
লীলাদের বাড়িতেই দেবনে।
ওরা দেবে কেন?
শ্রীহরি বলল, আপনি দাদাবাবু পাগল আছেন।
ও—কথা কেন হরিদা! সবাই আমাকে পাগল ভাবে কেন?
আপনি আর থাকার জায়গা পেলেন না! এমন একটা আজাগাঁতে চলি এলেন! মাথায় খুন আছে!
নানু বলল, হরিদা আমি আর কোথাও সত্যি যাব না। মাথায় আমার সত্যি খুন আছে।
সত্যি বলছেন?
হ্যাঁ হরিদা।
শ্রীহরির কেন জানি এই বাবু মানুষটাকে বেশ ভালো লেগে গেছে। গতকাল গাঁয়ের সবাই খবরটা জেনে গেছিল। শ্রীহরিই বাড়ি বাড়ি বলে বেড়িয়েছে, লীলার দাদাবাবু এয়েছে। এই দাদাবাবুটি কে, এই নিয়ে গাঁয়ের কেউ কেউ টীকাটিপ্পনি কেটেছে। তবে এখন যা সময়কাল কার ঘরে কে আগুন দেয়। সব ঘরেই আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। খিদের আগুন। একটা লোকের দয়াতে ধুলো দফাদারের বিটি বউ ছানাপোনারা ভরপেট খাচ্ছে, এজন্য কোনো কোনো ঘরে কিছুটা হিংসার উদ্রেক হচ্ছিল। লীলার ভয় অন্য রকমের। পাঁচ রকমের কথার ভয় তো আছেই, তার ওপর এই দাদাবাবুর মর্জির কথাও সে জানে। কিন্তু সবচেয়ে বড় ভয় পুতনা রাক্ষসীর মতো সেই বিশাল জীবটিকে, যার চোখের পলকে লীলার বুকের জল নিমেষে শুকিয়ে যেত। সে যদি চলে আসে। এবং এসেই যা করবে, দরকার হলে পুলিশ—টুলিশও নিয়ে আসতে পারে—এতসব ভয়ের মধ্যে সারাটা রাত লীলার কেটেছে—লীলা সারারাত ভালো ঘুমাতে পারেনি, এবং মনে হয়েছে দাদাবাবুকে যে করে হোক বুঝিয়ে সুজিয়ে ট্রেনে তুলে দিতে হবে। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে গেলে লীলার নিশ্চিন্তি। কিন্তু সকালে লীলা বলতে গিয়েই থেমে গেছিল। তেমনি শ্রীহরিও থাকা নিয়ে কোনো আর কথা বলতে পারল না নানুকে। রোদে শ্রীহরি ঘামছিল। দাদাবাবুর মুখটাও লাল হয়ে উঠেছে রোদে। সামনে রোদ পড়লে যা হয়। শহুরে মানুষের এত কষ্ট সহ্য হলে হয় শেষপর্যন্ত। নানুর সেসব কোনো হুঁশই ছিল না। দেখলেই বোঝা যায় বেঁচে থাকার এক প্রচণ্ড আবেগে সে টগবগ করে ছুটছে এখন। সে গুন গুন করে গাইছে….. ন—ব—নী—তা।
তেইশ
আজও নবনীতা ফোনের ডায়াল ঘোরাল। এ সময়টাতে কেউ বাড়ি থাকে না। এ—সময়টাতে আরতী মাসি ঘুমিয়ে থাকে। সে শুধু একা। ক’দিন স্কুল বন্ধ—কম্পার্টমেন্টাল পরীক্ষার সিট পড়েছে স্কুলে। স্কুল ছুটি থাকলে দিনটা বড় দীর্ঘ মনে হয়! বিকেল বেলাটায় সে প্রতিদিনই ফোন করছে—কিন্তু আশ্চর্য একটাই জবাব, সে বাড়ি নেই। কোথায় গেছে বললে কিছু বলছে না। বাড়ির ছেলে কোথায় গেছে বলতে এত সংকোচ কেন নবনীতা বুঝতে পারে না। নানুদা বেটাছেলে, মেয়ে হলে এক কথা ছিল—একজন পুরুষমানুষের খবর দিতে ওদের এত দ্বিধা কেন নবনীতা বুঝতে পারে না। নানুদের বাড়ির নম্বর ঠিকানা কিছুই সে জানে না। ভাগ্যিস সে ফোনের নম্বরটা চেয়ে রেখেছিল। এবং এখন নবনীতার একটাই কাজ, যখনই একা থাকে, নিরিবিলি থাকে, রিং করে বলে, হ্যালো নানুদা আছে? নানুদা নেই! আবার হ্যালো, নানু আছে, নানু নেই। হ্যালো কে আপনি? আমি মিতা, আমি দাদু, আমি নানুর দিদিমা—নানুদা নেই কেন? কোথায় গেছে? কবে আসবে?
অপর প্রান্ত থেকে এক জবাব, জানি না।
কিন্তু আমার যে নানুদাকে খুব দরকার ছিল। ওকে বললেন আমি ফোন করেছিলাম। বলবেন কিন্তু। আমার নাম নবনীতা। ওর বাবার বন্ধুর মেয়ে আমি। আমার বাবার নাম….
ততক্ষণে ফোন ছেড়ে দিয়েছে। সে বাধ্য হয়ে আজ বাবার নামও বলল। কারণ সে যে বাজে মেয়ে নয়, সে খুব ভালো মেয়ে—বাবার নাম বলতেও যার কুণ্ঠা নেই কোনো, সে কেন নানুদা কোথায় জানতে পারবে না।
নবনীতা চুপচাপ রিসিভারটা হাতে নিয়ে বসে থাকল। বড় নিষ্ঠুর নানুদার আত্মীয়স্বজন। সে তো নানুদাকে খেয়ে ফেলবে না। বরং বাড়িতে ভয় নানুদাই তাকে খেয়ে ফেলবে। আসলে নানুদার চোখে এক আশ্চর্য মায়ার খেলা আছে। মানুষের বাবা আত্মহত্যা করলে বোধহয় এমনই চোখমুখ হয়ে যায়। কেমন চোখের মধ্যে এক অতল গভীরতা। নবনীতা সব ভুলতে পারে—কিন্তু নানুদার চোখের অতল গভীরতার কথা ভুলতে পারে না। নানুদা ঠিকই বলেছিল, অনেক দাদা জুটে গেল তোমার নবনীতা। তবে আর ভাবনা কী। সত্যি এ বয়সে কী করে যে অজস্র দাদা জুটে যায়! দাদারা আজকাল বাড়িতে আসছে—তারা বেল বটস পরে চুল ঘাড় পর্যন্ত লম্বা করে গোঁফ সরু করে তার দিকে চেয়ে থাকতে ভালোবাসে। এবং শরীরের সব পোশাক ভেদ করে দাদারা সবাই তার সব কিছু দেখতে চায় আজকাল। একজন দাদা তো একদিন একা পেয়ে জোরে জড়িয়ে ধরল, চুমো খেল। সে বাধা দিতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত পেরে উঠল না। নিজের মধ্যেই কী যে থাকে! একটা ইচ্ছে ইচ্ছে ভাব সহসা শরীরে মাথাচাড়া দিয়ে যে উঠল আর তাতেই সে কাত হয়ে গেল। কিন্তু পরে সম্বিত ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গেই দাদাটিকে ধিক্কার দিল। বলল, আপনি আমাদের বাড়িতে আর আসবেন না। এলে বাবাকে বলব, আপনি ভালো না। এ—ছাড়া নবনীতা অন্য দাদাদের কথাটা বলে দেবে বলে ভয় দেখিয়েছিল। সেই যে ভয় পেল দাদাটি, তারপর থেকে সত্যি আর এ মুখো হচ্ছে না। নবনীতার মনে হয়েছিল কাপুরুষ। পৃথিবীতে কারও কাছে এসব কথা বলা যায় না, আহাম্মকটা তাও যদি জানত।
যাই হোক নবনীতার দিন ভালো কাটছে না। স্কুল থেকে ফিরেই বলত নবনীতা, কেউ আমায় ফোন করেছে?
না তো!
কেউ করেনি!
না তো!
কোনো ফোন আসেনি!
বাবা রাত করে ফেরেন। বাবা মাঝে মাঝে নেশা করে বাড়ি ফেরেন। মাও সংসারে এত অঢেল সময় যে বাড়িতে একা বসে থাকতে পছন্দ করে না। মার বন্ধুবান্ধবরা মিলে একটা কাটা কাপড়ের এজেন্সি নিয়েছে পার্ক স্ট্রিটে। হাল ফ্যাশানের ডিজাইনের ফ্রক নানা জায়গায় চালান দিয়ে মার হাতে আজকাল অনেক পয়সা আসছে। মা বলেছে এখন আর ভাড়াবাড়ি নয়। নতুন ফ্ল্যাট। ম্যান্ডেভিলা গার্ডেনসে। ওখানে উঠে গেলে নানুদার সঙ্গে জীবনেও আর তার দেখা হবে না। অন্তত উঠে যাবার আগে নানুদার ঠিকানা তাকে খুঁজে বার করতেই হবে। নানুদা ফিরে এলে তাকে ফোন করলে অন্য কোনো নবনীতা জবাব দেবে। তার আগে সে একবার ভাবল এক্সচেঞ্জ থেকে খোঁজখবর নিয়ে জানার চেষ্টা করবে বাড়ির ঠিকানাটা কী। একবার সে বাবাকে দেখেছিল, এভাবে বাড়ির ঠিকানা পেতে। ঠিকানা পেলে কোনো দাদার সঙ্গে সে ঠিক ও—ঠিকানার পৌঁছে যেতে পারবে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে আজকাল বাড়িতে খুব কড়াকড়ি চলছে। সেই যে নানুদার সঙ্গে গোপনে সিনেমা দেখে এসেছিল সেই থেকে। এ—বয়সে নাকি ছেলেমেয়েদের মাথা ঠিক থাকে না। যে—কোনো অসম্ভব ঝুঁকি জীবনে নিতে ভ্রুক্ষেপ করে না তারা। তাকে কোথাও যেতে হলে আরতী মাসিকে সব বলে যেতে হয়।
নবনীতা রিসিভারটা এবার রেখে দিল। খুব একা এবং নিঃসঙ্গ মনে হচ্ছে নিজেকে। কটা দিন তার বেশ হৈ—হুল্লোড়ের মধ্যে কেটে গেছে। বহরমপুরে বাবার মেসো থাকে। সেখানে দুদিন, গঙ্গার ধারে বেড়াতে যাওয়ার মধ্যেও ছিল আশ্চর্য আনন্দ। সবাই মিলে গাড়ি করে গিয়েছিল লালবাগ, তারপর নদী পার হয়ে খোসবাগ। সিরাজের কবরের পাশে সুন্দর মতো আমবাগান, সেখানে সবুজ ঘাস, ওরা ঘাসের ওপর বসে গরম ফুলকো লুচি মাংস খেয়েছে।
নানুদাটা যে কী—সঙ্গে থাকলে কী ক্ষতিটা ছিল!
এ—সময় মনে হল নবনীতার এ—বাড়িতে কেউ রেকর্ড প্লেয়ার চালিয়ে দিয়েছে, নতুন দম্পতি একতলার বাসাটায় উঠে এসেছে। সঙ্গে একজন অফিসেরই বেয়ারা অথবা পিয়ন থাকে বাড়িতে। সকাল বিকেল স্বামী স্ত্রী সেজেগুজে কোথায় যায়। আজ বোধহয় যাওয়া হয়নি। নতুন বউকে ছেড়ে এক দণ্ড কোথাও গিয়ে থাকতে বোধহয় মানুষটার কষ্ট হয়। অফিস যায় সবার শেষে, আসে সবার আগে। ছাদে উঠলে বউটি তার সঙ্গে আলাপও করেছিল। মিষ্টি হাসিখুশি মুখ। নতুন বিয়ে হলে সবারই এমনটা হয়। ওর ইচ্ছা হল, উঁকি দিয়ে দেখে এখন বউটি কী করছে। অসময়ে আজ রেকর্ড প্লেয়ার বাজছে কেন! সিঁড়ির কার্নিশ থেকে হাঁটু গেড়ে বসলে, ওদের শোবার ঘরটা স্পষ্ট, জানালায় কারুকাজ করা পর্দা, বাতাসে উঠে গেলেই কিছুটা আব্রু খুলে যায়। দেখা যায় গোদরেজের লকার, নতুন পালিশ করা খাট, ছোট সেন্টার টেবিলে, শিয়রের কাছে এক গেলাস জল রেকাবে ঢাকা। এসব দেখতে দেখতে নবনীতার কখনও কখনও গলা শুকিয়ে যায়।
সে উঠে এসে দেখল বউটি সামনে দাঁড়িয়ে। শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ ঘসছে। পাশে মানুষটি বসে আছে। পা দোলাচ্ছে। আর সিগারেট খাচ্ছে। একবার উঠে খচ করে কী যেন টিপে দিল। বাজছে কোনো মিউজিক। অবেলায় মানুষটা এমন কেন করছে? সারা রাতটা তবে কী করবে? এসব মনে হতেই দেখল বউটি বড় করে সিঁদুরের টিপ পরছে। প্রসাধন করছে। এবং সায়া শাড়ি খুলে ফেলছে। নবনীতা বুঝতে পারছে না সায়া শাড়ি খুলে ফেলার আগে এত করে প্রসাধন করার কী দরকার থাকতে পারে। পুরুষমানুষটাকে দেখতে পাচ্ছে না। সে পর্দার আড়ালে এবং তারপরই বাতাসে ঢেউ খেলে গেলে সে দেখল, সেই পুরুষমানুষ লম্বা হয়ে শুয়ে আছে। বউটি এগিয়ে যাচ্ছে। দিনের বেলায় আলো জ্বেলে নিয়েছে। পর্দা ফেলা বলে যে সামান্য অন্ধকার ছিল সেটাও থাকতে দিল না। নবনীতার চোখমুখ ঝাঁ ঝাঁ করতে থাকল। সেই আগের মতো গলা কাঠ—নিচে মনে হল খুট খুট শব্দ। আরতি মাসি চলে আসতে পারে। দৌড়ে নিচে নেমে গেল এবং খাটে হাত পা বিছিয়ে পড়ে থাকল কিছুক্ষণ।
আরতি এ—ঘরে এলে নবনীতা জলটা খেয়ে কী করবে বুঝতে পারল না। সন্ধ্যায় সংস্কৃতের মাস্টারমশাই আজ আসবেন। কিছু টাস্ক করা বাকি। এগুলো করে রাখা দরকার ছিল। কিন্তু কিছুই করতে ইচ্ছে করছে না। শরীরে আজকাল যে কী হয়! নানুদার কথা ভাবলেই মাথা ঝিম ঝিম করতে থাকে। নানুদা বড় নিষ্ঠুর তুমি। তোমাকে এত ভালো লাগে, তুমি তা টের পাও না কেন।
সে উঠে এবার দেরাজের কাছে গেল। সেখানে একটা বড় অ্যালবামে নতুন ফোটো। ফোটোগুলি সে দেখবে বলে অ্যালবামটা টেনে বের করল। দাদারা কত রকমের ছবি তুলেছে তার। একটা গাছের নিচে বসে আছে সেই ছবি, দৌড়াচ্ছে সেই ছবি—সুন্দর সুন্দর সব ফ্রিজ সট। কখনও বাতাসে চুল উড়ছে, কখনও চোখ উদাস, কখনও নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে। এতসব ছবি তার নিজের। সে প্রায় দেখতে নায়িকার মতো। সিনেমায় সে যদি একটা চান্স পেত। তাঁর চোখ মুখ যে—কোনো উঠতি নায়িকার চেয়ে সুন্দর, সে উঁচু লম্বা। একবার কাগজে একটা বিজ্ঞাপন দেখেছিল—নায়িকা চায়। তার ইচ্ছে একটা ছবি গোপনে পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু ওর ওই একটা আলস্য আছে—হবে হবে করে শেষ পর্যন্ত আর হয়ে ওঠে না।
নানুদাকে প্রথম দিন দেখেই ভেবেছিল বাঃ বড় সুন্দর হয়েছে দেখতে নানুদা। যুবক সন্ন্যাসীর মতো দেখতে। রেশমের মতো দাড়ি গোঁফ গালে। হাত দিয়ে ইচ্ছে হয়েছিল দেখতে কত নরম—কোনো উলের বলের মতো কিনা—আর এসব ভাবলেই মাথাটা ঝিম ঝিম করে—সে তার মনের কথাটা কিছুতেই দুম করে বলে ফেলতে পারেনি। আবার দেখা হলে বলবে, নানুদা তুমি আমাকে ভালোবাসবে? আমি তোমার যা ভালো লাগবে তাই করব। কিন্তু সে মানুষটার পাত্তা নেই।
তখনই সে কী ভেবে তার সবচেয়ে সুন্দর ম্যাকসি বের করে ফেলল। গলায় মুখে পাউডার বুলাল। কপালে সুন্দর করে লাল টিপ পরল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদের খুটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকল—এমন শরীর নিয়ে তার এখন কান্না পায়। তার কিছুই ভালো লাগে না কেন! পড়াশোনা ভালো লাগে না। এখন শুধু বেড়াতে ভালো লাগে। সে চিৎকার করে বলল, আরতি মাসি আমি কাকলীদের বাড়ি যাচ্ছি।
আরতি বলল, কাকলীদের বাড়িতে এখন কী করতে যাবে!
কাজ আছে।
কী কাজ বলবে তো! দিদি এলে কী বলব!
দিদি আসার আগেই ফিরে আসব।
আমি কিছু জানি না!
ভারি ঝামেলা দেখছি—পড়া দেখে আসব, তাও তোমাদের জ্বালায় জানতে পারব না।
পড়ার কথায় আরতি আর কিছু বলতে পারল না। দাদামণি মেয়ের পড়াশোনার ব্যাপারে খুবই আলগা। এই একটা বিষয়ে আরতির মাতব্বরি নবনীতার ওপর খাটে না। যেতে না দিলেই দাদামণি এলে নালিশ করবে—আমি কী করব, আরতি মাসি যেতে না দিলে আমি কী করব। তখন দাদামণির দুটো একটা ধমক খেতেও হতে পারে। আরতি অগত্যা বলল, যাও। সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসবে। দিনকাল ভালো না—যেখানে সেখানে খুন টুন হচ্ছে।
আজকাল পত্রিকার খুব খুনের খবর ফলাও করে বের হচ্ছে। ক’দিনের মধ্যে চেতলার কাছে একটা সতেরো বছরের মেয়ে খুন হয়েছে, শোভাবাজারের কাছে একটি তেরো চোদ্দো বছরের মেয়েকে কারা তুলে নিয়ে গেছে। কিশোরী মেয়েদের কারা ধরে নিয়ে যাচ্ছে—আন্ত—রাজ্য মেয়ে চালানকারীদের উপদ্রব বাড়ছে এমনই সব খবর পত্রিকায় আজকাল লেখা থাকে। পত্রিকা পড়লে নবনীতার গা—টা শির শির করে। সে বলল, যাব আর আসব।
আসলে নবনীতা এখন বের হতে চায়। চারপাশে কেবল আনন্দ উজাড় করে দিচ্ছে প্রকৃতি। ঠান্ডা বাতাস বইছে। পার্কের কৃষ্ণচূড়া রাধাচূড়া গাছগুলিতে ফুলের সমারোহ। সেজেগুজে সব মানুষেরা যেন কোথায় যাবে বের হয়ে পড়ছে! এ—সময়ে একা ঘরে থাকতে কার মন চায়! এবং বিকেল বেলাটার যেন কী মোহ আছে—তাকে সবসময় ঘর থেকে বের করে নিতে চায়। একটু পার্কে ঘুরে বেড়ানো, কিংবা রাস্তায় যেতে যেতে সুন্দর যুবকদের দিকে দূর থেকে সামান্য চোখ তুলে তাকানোর মধ্যে আছে আশ্চর্য এক মনোহারিণী জীবন। সে কাকলীর বাড়িতে যাবার পথে এসবই দেখবে। কাকলী যদি ওর সঙ্গে একটু বেড়াতে বের হয়, ওর ইচ্ছে, সে কাকলীকে নিয়ে একদিন যাবে মানুদের বাড়িতে। কারণ একা যাওয়া ঠিক হবে না। কোনো মেয়েই কোনো যুবকের বাড়িতে একা যেতে বোধহয় পছন্দ করে না। সে আজ ভারি সেজেগুজে বের হয়েছে। খোঁপায় গুঁজেছে গোলাপ ফুল। রানি ক্লিয়োপেট্রার জীবন নিয়ে একটা ছবি সে দেখেছিল। নিজেকে সে আজ ক্লিয়োপেট্রার মতো দুর্ধর্ষ করে তুলেছে।
রাস্তায় নেমেই সে বুঝতে পারল সারা পৃথিবী এ—মুহূর্তে তাকে উঁচু হয়ে দেখছে। যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই ভয়ংকর লোভী দৃষ্টি তার শরীরটার প্রতি। এমনকি পার্কের বুড়ো লোকগুলিও বাদ গেল না। ভারী দৃপ্ত এবং অহংকারী হয়ে উঠছে তার শরীর। সে সোজা হেঁটে যাচ্ছে। কোনোদিকে দেখছে না মতো সে হাঁটছে। আসলে সে সবই দেখছে। গ্রীষ্মের রোদ্দুর মেঘমালায় ছেয়ে যাচ্ছে বলে পার্কের চারপাশে সবুজ সমারোহ। বাতাসে কোনো ধূলিকণা উড়ছে না। নির্মল পৃথিবীতে সে এখন যুবতী নারী। মন এ—সময়টাতেও এত চঞ্চল হয়ে ওঠে যে কোনটা সে চায় কিছুই বুঝে উঠতে পারে না।
ক্লিনিক হাউজের রোয়াকে সেই বকাটে ছোকরারা আজও তাকে দেখে শিস দিল। এবং অশ্লীল দুটো একটা কথাবার্তা—যেন এদের মা বোন নেই—এবং আর যা মনে হয়, এরা তো তাকে ভালোবাসতেও পারে। ভালোবাসার জিনিস দূরের মনে হলেই ক্ষেপে যায় যুবকেরা। ঠিক নানুদার মতো এরা তাকে আর ভাবতে পারে না।
একদিন মনে হয়েছিল, বাবাকে বলবে সব, পরে ভেবে দেখেছে বাবা শুনলে কী ভাববে। নবনীতা জানে এদের থেকে ভয়ের কিছু নেই। সে একবার ভাবল, কাছে গিয়ে বলবে, এই আমার সঙ্গে বেড়াতে যাবে? এই একটু বেড়াব। তখন কী হবে নবনীতার তাও জানা। সবাই এত ভালো ছেলে হয়ে যাবে যে কে আগে প্রাণ করিবে দান গোছের হয়ে যাবে। তার ইজ্জত রক্ষার্থে ওরা তখন হেলায় জীবন দান করতে পারে। এসব মনে হয় বলেই নবনীতা কিছু মনে করে না। অশ্লীল কথাবার্তা নতুন শিখলে যা হয়। এবং সে যে খুব একটা কড়াশাসনে রয়েছে, সেও জেনে ফেলেছে ওদের সব কথার অর্থ কী। আসলে একটাই অর্থ, আমরা বড় হচ্ছি, তোমরা বড় হচ্ছ, আর অপেক্ষায় থাকতে পারছি না।
নবনীতা কেমন স্বগতোক্তি করল, সে তো আমারও। সে এবারও আরও দূরে এসে বুঝল ওদের আর দেখা যাচ্ছে না। এদের মুখগুলি তার চেনা। চুল বেশ লম্বা করে ঘাড় পর্যন্ত ছেঁটে দেওয়া। একটা কালোটুপি ঘাড় পর্যন্ত বসিয়ে দিলে যা হয়—এরা সুচলো দাড়ি রেখেছে সিনেমা হিরোদের মতো, চুল কাটে সিনেমা হিরোদের মতো। সবকিছুই ভাবে সিনেমা হিরোদের মতো। স্বপ্নও দেখে সিনেমা হিরোইনের। নবনীতার তাই শখ সে একদিন বড় হিরোইন হয়ে যাবে। আয়নার সামনে দাঁড়ালে তার এটা বেশি করে মনে হয়। অবশ্য এখন নানুদার মতো একজন যুবক তার পাশে থাকলে ভালো হয়। খুশিমতো খাওয়া গেলেই হল—জীবনের আর কী দরকার এ—সময় আর সে কিছু মনে করতে পারে না।
নবনীতা দরজায় দাঁড়িয়ে কড়া নাড়ল খুট খুট করে। কোনো সাড়াশব্দ নেই। ওপরে জানালা খোলা। কেউ বাড়ি না থাকলে জানালা বন্ধ থাকত। কাকলী বাড়ি থাকলে এতক্ষণ দৌড়ে নেমে আসত। সে কড়া নেড়ে আবার ডাকল কাকলী।
তখন বুড়ো মতো মানুষটার গলার শব্দ পাওয়া গেল। কাকলীর দাদু সিঁড়িতে কে কে করে নেমে আসছে।
আমি নবনীতা দাদু।
আরে নবনীতা। প্রিয়নাথ ভারী প্রসন্ন গলায় কথাটা বলল। এসো এসো।
কাকলী বাড়ি নেই?
ওরা গেছে ভুবনের বাড়িতে।
নবনীতা বলল, তা হলে যাই। কাকলীকে বলবেন, আমি এসেছিলাম।
এসো না। ওরা এক্ষুনি চলে আসবে।
নবনীতা ইতস্তত করছিল। বুড়ো মানুষদের তার কেন জানি কখনও ভালোমানুষ মনে হয় না। কাকলীর দাদু খুব শক্ত সমর্থ মানুষ। চুল এখনও কালো রেখেছে। চুল কালো না কলপ মাখে বুড়োটা। সে বলল, কাকলীর আসতে খুব দেরি হবে নাতো?
না না। এল বলে।
নবনীতা দরজার ভিতরে ঢুকে গেল। বাড়িতে আর কেউ নেই কিনা সে এখনও জানে না। মাসিমা থাকবে না কারণ কাকলীর দাদু, ওরা তা হলে বলত না। রান্নার মেয়েটা যদি থাকে। সে ভেবেছিল কাকলীকে নিয়ে সে বেড়াতে বের হবে। কিন্তু কাকলী নেই। সে আবার কী ভেবে বলল, থাক আজ দাদু, কাল আসব।
প্রিয়নাথ লম্বা পাজামা পাঞ্জাবি পরেছে। বেশ দীর্ঘকায় মানুষ। সিঁড়িতে আরও লম্বা হয়ে গেল যেন কথাটা শুনে! —ভয় কী এসো না।
না না ভয় নয়। আমি বলছিলাম কী….। কাকলীর সঙ্গে আমার জরুরি কথা আছে।
প্রিয়নাথ বলল, বোস, ওরা চলে আসবে।
নবনীতা কী করবে বুঝতে পারছে না। সে যে খুব আর বালিকা নেই, সে যে ইচ্ছে করলেই দাদুর ঠাট্টা তামাসার মধ্যে আগের মতো মজা পায় না সেটা বোঝায় কী করে! তবু শালীনতা বোধ ওর খুব তীব্র। খুবই খারাপ দেখায় না গেলে। সে উঠে প্রিয়নাথের ঘরে বালিকার মতো মুখ করে ঢুকে গেল। এবং বেশ দূরত্ব রেখে সে একটা চেয়ারে বসল।
আর এই ঘরটাতে এলেই সে একজন বুড়ো মানুষের গন্ধ পায়। প্রিয়নাথ না থাকলেও সে টের পেত এ—ঘরে একটা বুড়ো মানুষ থাকে। কিন্তু এখন সে এই গন্ধটা পাচ্ছে না কেন! সে দেখল প্রিয়নাথ জানালার পর্দা সরিয়ে দিচ্ছে। দরজার পর্দা সরিয়ে দিচ্ছে। দরজার পর্দা সরিয়ে দিতে দিতে বলল তোমার বাবা কেমন আছেন?
ভালো।
একদিন মাকে নিয়ে বেড়াতে এসো।
আসব।
আসলে দুই প্রজন্মের ফারাক এত বেশি যে—কোনো কথা খুঁজে পাওয়া ভার। প্রিয়নাথ বারবারই নবনীতার সুন্দর পোশাক লক্ষ্য করছে। তাদের সময়ে মেয়েরা এত সুন্দর করে সাজতে জানত না। তার ভারি আদর করতে ইচ্ছে হচ্ছিল নবনীতাকে। কিন্তু ওই যে বয়েস, মনে হচ্ছে বড় তাড়াতাড়ি জীবন ফুরিয়ে যাচ্ছে। এই বয়েসও কেন আকাঙ্ক্ষার এত বেশি চাড় ভেবে পায় না।
নবনীতারই বা ভালো লাগবে কেন! সে উসখুস করছিল। দু—বার উঠে গিয়ে রাস্তায় উঁকি দিয়েছে। অথবা নিচের সিঁড়িতে যদি পায়ের শব্দ পাওয়া যায়। কিন্তু কিছুই না। কাকলীর দাদু ঘরের মধ্যে কৌটা খুলে কী খুঁজছে। দুটো বোতলের ছিপি খুলে ফেলল। এবং সে যে এ—ঘরে আছে তা যেন খেয়াল নেই তার।
তখন বাধ্য হয়ে নবনীতা বলল, আমি যাই দাদু।
আরে না না। চা করছি। চা খাও। ততক্ষণে ওরা এসে যাবে।
নবনীতা কী বলবে বুঝতে পারল না। না, বলতে পারত, কিন্তু চায়ের প্রতি ওর একটা আজন্ম প্রলোভন আছে। সে বলল, কেউ তো নেই।
তাতে কী হয়েছে। আমি কী খুব বুড়ো মানুষ ভাব! মনে হল প্রিয়নাথ এবার সত্যি যুবক হয়ে যাবে। সে প্রায় একজন যুবকের মতোই ঘর থেকে বের হয়ে গেল। এবং রান্নার গ্যাস জ্বেলে জল চাপাল।
নবনীতার এটা খারাপ লাগছিল। সে বলল, আমি করছি। আপনি এ—সময় বুঝি চা খান?
ওই অভ্যাস। তবে সবই তো ছেড়ে দিয়েছি। এটা এখনও আছে। তুমি করবে! আহা আমার কী সৌভাগ্য। এসো না ভিতরে। তুমি তো আমার নাতিন। এত সুন্দর করে সাজো কেন?
নবনীতা লজ্জা পেল। কিছু বলল না।
এই বয়সে আমরা এত সাজতে জানতাম না। তোমাকে আদর করলে রাগ করবে নবনীতা!
সে কপট রাগ দেখিয়ে বলল, যান আমাকে কেন, কাকলীকে করতে পারেন না!
প্রিয়নাথ হাসল। বলল, ওকে তো সব সময় করি—তোমাকে করলে কেমন না জানি লাগবে।
নবনীতার চোখমুখ কেমন গম্ভীর হয়ে গেল।
তখন এই শহরে সূর্য ডুবে যাচ্ছে। বাসে ট্রামে অফিস ফেরত মানুষেরা গাদাগাদি করে ফিরছে। ভাবতেই পারবে না একজন উঠতি যুবতী একজন প্রৌঢ় মানুষের সামনে এমনভাবে মুখ গম্ভীর করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। চোখমুখ লালচে। নবনীতার বুক ঢিপ ঢিপ করছিল। সিঁড়িতে পায়ের শব্দ হতে পারে। সে বলল, না যাই। কাকলী এলে কিন্তু বলবেন, ওকে আমার খুব দরকার।
প্রিয়নাথ তখন হা হা করে হেসে উঠল। এবং তুই তুকারি আরম্ভ করে দিল কথাবার্তায়। বলল, তুই কী রে! আমাকে দাদু ডাকিস, আদর করলে তোর কী ক্ষতিটা হবে! এই বলে কাপে চা ঢালল। তারপর বলল, নে না। এই নে বলে সে ক্রিম ক্রেকার বিস্কুট, ফ্রিজ থেকে দুটো সন্দেশ দিল বের করে।
নবনীতা কেমন বোবার মতো হাতে তুলে নিল সব। বুড়ো মানুষটা আসলে তাকে নিয়ে মজা করছে। সে সব সত্যি ভেবে সামান্য আহাম্মকের কাজ করেছে। খুব কাচুমাচু গলায় বলল, আপনি কিন্তু কাকলীকে কিছু বলবেন না।
বললে কী হবে?
না বলবেন না।
কেন দোষের কী আছে। আমি তো তোকে নিয়ে বিছানায় শুইনি!
ভারী অসভ্য আপনি।
প্রিয়নাথ তার গাল টিপে বলল, সব বুঝিস তা হলে!
নবনীতার হাত পা কাঁপছিল। কত তাড়াতাড়ি চা খাওয়া যায় যেন তার পাল্লা দিচ্ছে। তারপর প্লেট মেঝেতে রেখে সে প্রায় দৌড়ে সিঁড়ি ভাঙতে থাকল।
প্রিয়নাথ বলল, এই তুই চলে গেলে সব বলে দেব। বলব, তুই আমাকে ভালোবাসিস। তুই আমার বউ। বেশ জমবে।
নবনীতার কেমন দ্রুত শ্বাস ওঠানামা করছিল। বুড়ো মানুষটা কী সত্যি কিছু করতে চায়—না মজা—না পাগল, তাও সে বুঝল না। সে ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকল। তার কপালে ঘাম দেখা দিয়েছে। মাথাটা কেমন তার ঘুরছে।
চব্বিশ
নীরজা বলল, ওগো এসো, ঘরে এসো।
বারান্দায় ভুবনবাবু এক কোণে একটা নীল রঙের বেতের চেয়ারে চুপচাপ বসেছিলেন। সামনের রাস্তায় একটা ভিখারি হেঁটে যাচ্ছে। পর পর দুটো বাস পাল্লা দিচ্ছে। একটা আর একটাকে পেছনে ফেলে ছুটতে চাইছে। রাস্তার ওপাশে মাঠ এবং নতুন ঘরবাড়ি উঠছে। তিনি ঘরের ভেতরে খুব কোলাহল শুনতে পাচ্ছেন। বারান্দায় ছোট ছোট কাচ্চা—বাচ্চারা দাপাদাপি করছে, রেলিং—এ ঝুঁকছে এবং ভিতরে কেউ হাসছে জোরে, কিছু যেন হাত থেকে পড়ে গেল—নীরজা এইমাত্র ডেকে গেল। আবার কেউ ডাকতে আসবে। রমা অথবা মন্দাকিনী। অরুণ এবং অমলা—আজও আসতে পারে। ছোট শ্যালিকা মল্লিকা এসেছে। অনেকদিন পরে ভানুর আশীর্বাদ উপলক্ষে রমাই নিয়ে এসেছে। আরও অন্যান্য আত্মীয়। এবং ভুবনবাবু মনে হয় সবাই কেমন বড় দূরে সরে গেল। দাদা বউদি ভাইয়েরা এবং ভাইপোরা। ভুবনবাবুর এক বিরাট আত্মীয়স্বজনের সংসার ছিল, আজকের আশীর্বাদে সামান্য ক’জন মানুষের উপস্থিতি তাকে কেমন ভিতরে ভিতরে পীড়া দিচ্ছে।
ওদিকে বারান্দায় বেশ হাসি ঠাট্টা হচ্ছিল। মন্দাকিনীর গলা স্পষ্ট। বেশ জোরে কথা বলতে পারে। এবং আশ্চর্য ভঙ্গি মেয়েটার। ওর স্বামীর মৃত্যু সেদিন হয়েছে। আচ্ছা, মানুষ কী শোক দীর্ঘদিন বয়ে বেড়াতে পারে! বয়ে বেড়ানোটা স্বাভাবিক, না সেখানে জীবনের লক্ষণ আছে। এত সহজে যে শোক মন্দাকিনী ভুলতে পেরেছে ওটাতো জীবনেরই লক্ষণ। কিন্তু তিনি মন্দাকিনীর উচ্চস্বরে কথাবার্তার মধ্যে খুঁত ধরতে যাচ্ছেন কেন! আসলে কী মন্দাকিনী এবং ভানুর মধ্যে একটা সংশয়ের ব্যাপার ছিল বলে! আজতো আশীর্বাদের দিন। এ—দিনে এসব কথা মনে আসছে কেন! মন্দাকিনী এ—বাড়িতে আশীর্বাদের সময় থাকবে সেটা পছন্দ ছিল না বলে! মনে মনে বিরক্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত বারান্দার নিরিবিলি জায়গা কী তাই বেছে নিয়েছেন!
রমা ডাকল, বাবা আসুন!
ভুবনবাবু উঠে দাঁড়ালেন। রমা কী আগেই জানত অরুণের বউ আছে! সে জেনেই কী মিশত? তখনই অমলা দরজায়—আসুন মেসোমশাই। সব মুখগুলি কত পবিত্র দেখতে এখন! কে বলবে এরাই কখনও কী যে ভয়াবহ হয়ে যায়। আচ্ছা, তিনি ভয়াবহ কথাটা ভাবছেন কেন! মানুষের যে স্বভাবই এই। সে ধার্মিক, লম্পট, সে সরলমতি কখনও কুটিল মতি। সে লোভী আবার উদাসীন!
এজন্য কখনও স্বার্থপর দৈত্য এবং কখনও বিদ্যাসাগরমশাই। তিনি ভিতরে ঢুকে অরুণকে বললেন, নানুর খোঁজে কেউ তোমরা গেছিলে?
অরুণ এরকম কথা এই সময় প্রত্যাশা করেনি। সে বলল, না, মানে…..অরুণ কেমন সত্য গোপন করতে চাইছে।
তোমরা ওর খোঁজখবর নিচ্ছ না, বাবা নেই ছেলেটার!
অরুণ কাঁচুমাচু গলায় বলল, যাব ভাবছি।
কোথায় যেন গেছে!
মানু তো কিছু বলে না। মানু এখন দেখছি নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। দেখা কোথায় হয় যে তার কাছ থেকে নানুর খবর নেব। সারাদিন কোথায় কী করে বেড়ায় তাও জানি না। নানুর মা বিয়েতে আসবে তো?
আসার কথা আছে। তবে সরকারি কাজ ছুটিছাটা নিয়ে নানা ঝামেলা। নানুর মা আমাদের বিয়েতে আসতে পারেনি।
অমলা এক কোণায় দাঁড়িয়ে জানালায় মুখ রেখেছে। ওর মুখ স্পষ্ট নয়। অমলাদের বাড়ি থেকে ওর জামাইবাবু এবং অরুণ এসেছে আশীর্বাদ করতে। আশীর্বাদের কাজ প্রায় শেষ—ভানু বড় আসনে বসে আছে শুধু বাবার জন্য। বাবা মাথায় সামান্য ধানদূর্বা দিলেই তার ছুটি। সে উঠব উঠব করছিল—কিন্তু এতক্ষণ অমলা এবং অরুণই জোর করে বসিয়ে রেখেছে।
ভুবনবাবু আবার কী বলতে যাচ্ছিলেন, তখন রমা অরুণের দিকে তাকাল অরুণ ভুবনবাবুর দিকে—গোপন বেদনার ঝড় কোথা থেকে যে উঠে আসে কখন কে জানে, রমা হাত বাড়িয়ে বলল, বাবা ধরুন। হাতে ধানদূর্বা দিয়ে বলল, দাদার মাথায় দিন।
ভুবনবাবু কেমন যন্ত্রের মতো হাত তুলে পুত্রের মাথায় দিলেন। সবই হচ্ছে, কিন্তু কেন জানি প্রবল জোর পাচ্ছেন না ভিতর থেকে! সংসারে একটা বড় রকমের ফাটল দেখা দিয়েছে। তখনই সবাই উলু দিল। নীরজা এবং মন্দাকিনীর উলু বেশ তীক্ষ্ন। মল্লিকাও কম যায় না। বড়ই নিষ্প্রভ রমার উলু তার চেয়েও নিষ্প্রভ অমলার।
তখন ভুবনবাবু বললেন, মানু কোথায়?
রমা বলল, আপনার ছোট পুত্রটির কথা আর বলবেন না, একদণ্ড যদি বাড়ি থাকে।
মনে মনে ভুবনবাবু বললেন, ওর দোষ কী। সংসারে সবাই সব টের পায়। তোমরা মনে করো কেউ কিছু বোঝে না। কিন্তু রমার মুখের দিকে তাকিয়ে ভুবনবাবুর কষ্ট হল! যেন রমা এক গোপন দুঃখ আজকাল লুকিয়ে রাখছে। কত পালটে গেল সব। এক জীবনে তিনি কী না দেখলেন! এক সময় মানুষের সামনে বড় রকমের আদর্শ থাকত। তাদের সময় কত সব শ্রদ্ধেয় মানুষ বেঁচেছিলেন। একবার মনে আছে ভুবনবাবু প্রায় ত্রিশ মাইল রাস্তা ঝড়বৃষ্টিতে হেঁটে গিয়েছিলেন। সঙ্গে একটা চিঠি। তাঁদের স্কুলের অনাদি মাস্টারমশাই চিঠিটা পৌঁছে দিতে বলেছিলেন। তখন স্বদেশি যুগ, গান্ধীজীর স্বরাজ আন্দোলনে কত মানুষ জীবনের সবকিছু অবহেলা করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। নেতাজীর কংগ্রেস থেকে বের হয়ে আসা, আরও কত উত্তেজক খবর তখন মানুষের জীবনে একটা আলোড়ন তুলত। এখন আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। মানু কিংবা সেই ছেলেটা কী যেন নাম, হ্যাঁ নানু একটা ঝি—মেয়ের খোঁজে চলে গেল, তারা এ—ছাড়া আর কী করবে! তিনি বললেন, অরুণ বাইরে এসো। কথা আছে।
অরুণ সেই ঘটনার পর অনেকদিন এ—বাড়িমুখো হয়নি। এই বুড়ো মানুষটাকে মনে মনে সে ভয় পায়। এবং সমীহ করে। কথাবার্তা কম বলেন। খুবই সহিষ্ণু মানুষ। এখন ডেকে নিয়ে কী বলবে কে জানে!
অথচ ওরা যখন পাশাপাশি বসল, তখন ভুবনবাবু অন্য মানুষ। তিনি বললেন, বিয়েতে আমরা কিছুই চাইনি। শাঁখা সিঁদুর দিয়ে বিয়ে দিলেও আপত্তি নেই তুমি জানো। কিন্তু একটা কথা—মিতা এ—বাড়িতে এসে সুখী হবে তো! মানু বড়ই অবুঝ ছেলে। ওকে নিয়েই আমার ভয়।
অরুণ বলল, আপনি কিছু ভাববেন না। আজকালকার ছেলে এ—রকমেরই সবাই। বয়স হলে, চাকরি করলে তারপর বিয়ে হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। তারপর কী ভেবে বলল, নবীনদার সঙ্গে আপনার আলাপ হয়নি। ওকে ডাকি।
ভুবনবাবু বললেন, ডাকো।
নবীন এলে অরুণ বলল, এই দাদাটি আমার বোম্বাই থাকে। কাগজে কাজ করে।
কোন কাগজে।
টাইমস অফ ইন্ডিয়া গ্রুপে আছে।
খবরের কাগজের লোকদের সম্পর্কে ভুবনবাবু এক ধরনের শ্রদ্ধা আছে। তিনি বললেন, বসুন। আপনারা খবরের কাগজের লোক কত খবর রাখেন।
নবীন বলল, ওই বাইরে থেকে এমনটা মনে হয়।
ভুবনবাবু কথাটা শুনেও শুনলেন না। তিনি বললেন, কাগজে আজকাল খুব আশার কথা লেখা থাকে।
নবীন বুঝতে পারল না ভুবনবাবু কেন এ—কথা বলছেন।
প্রায়ই দেখি দেশের নেতারা কেবল হোপস দিচ্ছে, বেকার থাকবে না বলছে। কিন্তু দিন দিন যে বেকারের সংখ্যা বাড়ছে।
নবীন বলল, দেশের সম্পদ কম। জনসংখ্যা বেশি। আন্ডার ডেভালাপড কান্ট্রিগুলোর এই একটা বড় বিষফোঁড়া।
মানুষের স্বাধীনতা নিয়ে আজকাল কাগজে খুব লেখা হচ্ছে।
সত্যিকারের স্বাধীনতা এখনও অর্জন করা গেল না।
মহান ব্যক্তিদের মাথা কাটা হচ্ছে। কারা করছে জানেন?
ভুবনবাবু খুবই অসংলগ্ন হয়ে পড়েছিলেন কথাবার্তায়। আসলে একটু আলাপ করা। সত্যবাদী কাগজগুলির একজন এই লোকটা। দেশের লোক ঈশ্বরের পরই খবর কাগজ সত্য ভেবে থাকে। সেই দপ্তরের একটা লোক তাঁর বাড়িতে আজ অতিথি। এটা একটা বড় রকমের অহংকার তাঁর জীবনে। তিনি নবীনের সঙ্গে কী বিষয় নিয়ে কথা বলবেন—ঠিক গুছিয়ে উঠতে পারছেন না। তিনি অগত্যা অরুণের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমরা সবাই চা মিষ্টি খেয়েছ ত!
অমলা তখন বারান্দায় এসে দাঁড়াল। রাসবিহারীবাবুর মেয়েদের চেহারায় আভিজাত্য আছে। অমলা কাছে আসতেই বললেন, এসো মা! আমরা দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলছি।
অমলা হাসল। রমাও তখন উঁকি মারছে। বেশ গম্ভীর গলায় বললেন, জানো তো নবীন আমাদের একজন জাঁদরেল রিপোর্টার। ওর এক কলমের খোঁচায় কত কিছু হতে পারে। তারপর নবীনের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমাদের খুব দৌড়ঝাঁপ করতে হয়।
তা করতে হয়।
আচ্ছা কাগজে যে দেখি দেশের গরিবদের নিয়ে সরকারের খুব মাথাব্যথা সেটা কি সত্যি। না লিখতে হয় বলে লেখা। জনমনে সুড়সুড়ি দেওয়া।
নবীন বলল, কাগজ বিক্রি চায়। জনগণ যাতে খুশি তাই লেখা হয়। সরকারও চায় যে—কোনোভাবে ক্ষমতা দখলে রাখা।
অথচ দেখো আমরা সব সত্য ভেবে রোজ সকালে সন্ধ্যাপাঠের মতো কাগজ পাঠ করি।
অভ্যাস।
এই অভ্যাসের কথা আসতেই ভুবনবাবুর মনে হল, সত্যি এটা অভ্যাস। এক সময় ছিল, যখন খবরের কাগজ সম্পর্কে তার কোনো স্পৃহা ছিল না। তখনও দিন চলে যেত। এখন খবরের কাগজ না পেলে দিনটা বড়ই ফাঁকা ঠেকে। কোথায় কী ঘটছে জানার জন্য বড়ই উদগ্রীব তিনি। ভুবনবাবু এবার নবীনের দিতে তাকিয়ে বললেন, তোমাদের নানুও একটা খবর হতে পারত।
নবীন বলল, নানু মানে, রানুদির ছেলের কথা বলছেন!
ভুবনবাবু বললেন, কেন তুমি ওকে চেন না?
মানে ওকে খুব ছোট দেখেছি।
নানুকে আমার খুব দেখতে ইচ্ছে হয়। একটা ছেলে সংসারের সবকিছুই অবহেলায় ফেলে চলে গেল—সে না জানি কত বড়!
নানুর সম্পর্কে কোনো কথা উঠলেই ভুবনবাবু বুঝতে পারছেন অরুণরা খুব ঠান্ডা মেরে যায়। কিন্তু যা বুঝেছেন তাতে তো নানুকে খুবই পরোপকারী এবং আদর্শবাদী যুবক বলে মনে হয়। তিনি বললেন, বিয়েতে নানুকে আসতে বলো, আমি তার সঙ্গে আলাপ করব। বাবা নেই, মা দূরে থাকে, বড়ই একা।
অরুণ কিঞ্চিৎ অন্যমনস্কভঙ্গিতে বলল, কারও কথা শোনে না। মানুবাবুকে পাঠাব, যদি আসে।
আমার কথা বোলো। নিশ্চয়ই আসবে। ছেলেটা নাকি আমাদের বাড়িতেও এসেছে। কত ছেলেইতো আসত মানুর কাছে—আমি ঠিক এখন মনে করতে পারছি না নানুটা কে!
সবই অহেতুক কথাবার্তা। মন্দাকিনী বারান্দায় আলো জ্বেলে দিল। সব ঘরে এখন আলো জ্বালা হচ্ছে। এই বাসা বাড়িটা যেন মুহূর্তে প্রাণ পেয়ে গেল। অথচ ভুবনবাবুর মনে হয় যতই আলো জ্বালা হোক, বাড়ির চামচিকেটা ঠিক উড়বেই।
সংসারে এই একটা চামচিকে নিয়তই উড়ছে। চামচিকেটা একটা উদ্বেগের মতো, এই উদ্বেগ নিয়ে সব সময় দিন কাটে। বিয়ের পর থেকেই ভুবনবাবুর এটা হয়েছে। এখন মনে হয় শুধু ভুবনবাবুর জীবনে হবে কেন সবার জীবনে চামচিকেটা অন্ধকারে উড়ে বেড়ায়। এবং এজন্যই ভুবনবাবু আসল কথাটা এবার পাড়লেন। বললেন, অরুণ তোমার তো অনেকের সঙ্গে আলাপ, তুমি রমার জন্য একটা ভালো বর দেখে দাও। নবীনের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমাকেও বলছি। তোমরা তো আমার এখন আর পর নও।
রমা সামান্য ঠোঁট বাঁকিয়ে উঠে গেল। ওরা না থাকলে সে হয়তো ভুবনবাবুকেই ধমক দিত। তুমি আর সংসারে মানুষ পেলে না, তুমি অরুণকে আমার বর খুঁজে দিতে বলছ। তুমি তো জান না, ও কত বড় স্বার্থপর। ও বউ বাদে এখন আর কিছু বোঝে না। আচ্ছা, অমলার চেয়ে আমি দেখতে খারাপ! এ—কথা মনে হতেই সে বাথরুমে ঢুকে আয়নার সামনে কতদিন পর যেন নিজেকে খুঁটিয়ে দেখল। মনে মনে বলল অরুণ তুমি আমাকে কী ভাব জানি না, তবে মনে রেখো মরে গেলেও আমি বিয়ে করছি না।
এই সংসারে এখন আরও সব ঘটনা ঘটছে। মানুর ঘরে কাকলী বসে একটা সিনেমা ম্যাগাজিন ওলটাচ্ছে। দু বার ভানু এসে বলেছে, কী কাকলী তুমি এত চুপচাপ?
কাকলী সাড়া দেয়নি—সে একটা ফ্যাশান ম্যাগাজিনে ডুবে আছে। ভানু ফের বলল, তোমার মা কোথায়?
কী জানি! খুব তাচ্ছিল্য গলায় ফুটে উঠল। তারপরই বলল, ভানুকা এবার থেকে তো তুমি আমাদের ভুলে যাবে।
যা পাগলি!
আমাদের কথা মনে থাকবে না।
খুব থাকবে।
তোমার তো ভালোবাসার মেয়ে চলেই আসছে।
সংসারে সবাইকে ভালোবাসতে হয়। ভানুবাবু কেমন দার্শনিক অথচ শয়তানের প্রতিভূর মতো কথাটা একটা অবোধ কিশোরীকে শুনিয়ে দিল।
তারপর দরজা দিয়ে বের হতে গিয়ে করিডোরে মন্দাকিনীর সঙ্গে ভানুর গায়ে গা লেগে গেল। মন্দাকিনীকে আইবুড়ো মেয়ের মতো দেখাচ্ছে। গলায় হার, হাতে দু গাছা সোনার চুড়ি এবং ঠোঁটে খুবই হালকা লিপস্টিক। মন্দাকিনী ফাঁক বুঝে ভানুবাবুর শরীরে একটা চিমটি কেটে দিল। ভানুবাবু বলল, এই কী হচ্ছে!
খুব তো নেবে। চোখে মুখে তো লালা উপছে পড়ছে।
কেমন দেখলে?
কাকে?
কাকে আবার?
ও মিতাকে! ধুস। তোমার পাশে ও কিছু না। অমলা আসছিল, ওরা কথা পালটে নিল। ও ভানুবাবু কাকলীকে দেখেছ?
দেখগে মানুর ঘরে চুপচাপ বসে আছে।
অমলা চোখ তুলে ভানুবাবুকে দেখল। উঁচু লম্বা মানুষ—অরুণের মতোই সুপুরুষ। মিতার সঙ্গে মানাবে খুব। এবং সেই এক দৃশ্য চোখে ভাসে—বিয়ে কেন হয়, কীজন্য এই শুভ কাজ, একজনকে ধরে আনা, অর্থাৎ বড়ই সুসময় চলে যাচ্ছে জীবনে, তাকে অবহেলায় ফেলে রাখতে নেই, জমি উর্বর, শুধু শস্য বুনে দিলে সুজলা সুফলা ধরণি। অমলা ভানুর দিকে চেয়ে এইসব ভেবে সামান্য হাসল। ভানুবাবুও সামান্য হেসে পাশ কাটাতে গেলে দু হাত তুলে দিল অমলা—কোথায় যাচ্ছেন?
কোথাও না।
খুব ভালো করে ঘুমাবেন।
কেন বলুন তো।
চোখে কালি পড়ছে কেন!
অঃ। ও ঠিক হয়ে যাবে।
অমলা তারপর বাথরুমের দিকে চলে গেল। রমা বাথরুমে আছে, অমলা দরজায় শব্দ করতেই রমা বের হয়ে এল। …….ও তুমি। তোমাকেই খুঁজছি।
রমা এই অমলাকে আজ প্রথম দেখল। মানু সেদিন বাড়িতে এসে সব ভেঙে দেবার পর কী কারণে অনেকদিন অরুণ এবং রমা পাশ কাটিয়ে গেছে। কোনো কথা বলেনি দু’জন তারপর বাবার চিঠি অরুণের হাতে দিতেই সম্পর্কটা আবার জোড়া লেগে গেল। চিঠিতে বাবা আশীর্বাদের কথা লিখেছিলেন! এখন আর মানুকে পাঠাতে হয় না। রমাই যা কিছু দরকারি কথা পাত্রীপক্ষকে অরুণের মারফত জানিয়ে দেয়।
অমলা বলল, আমরা এবার যাব।
অমলা সুন্দর লতাপাতা আঁকা সিল্কের শাড়ি পরেছে। পায়ের পাতার ওপর পড়ে আছে সায়ার কারুকাজ করা লেস। মুখটা ডিমের মতো মসৃণ, সামান্য চাপা। হাসলে গালে টোল পড়ে। ডানদিকের গজদাঁত অমলাকে কেমন সোহাগী করে রেখেছে। রমা বলল, যাবেইতো। এত তাড়াতাড়ি কেন। তোমার কর্তাকে কেউ খেয়ে ফেলবে না।
অমলা চোখ টেনে কপালে তুলে বলল। —আমার বড় ভয়, কেউ যদি সত্যি খেয়ে ফেলে! তারপর রমাকে জড়িয়ে ধরে হা হা করে হেসে দিল।
এই সেই মেয়ে—সামনের বাইকে অরুণ আগেই কী ঠিক দেখেছিল—না ছুটেছে, তার নিজের জনকে অন্য কেউ সহজেই নিয়ে চলে যেতে পারে। অনেকদিন ভেবেছে অরুণকে বলবে, কী হল, বাড়ি গিয়ে কী দেখলে?
কিন্তু বলি বলি করেও বলা হয় না। তা—ছাড়া সেদিন আর অরুণ আগের মতো সহজেই ডেকে নিতে পারত না—কেমন সাধুপুরুষ হয়ে গেছিল। রমার কাছে অরুণ দিনকে দিন দূরের মানুষ হয়ে যাচ্ছিল। মানুষ দূরের হয়ে গেলে সংসারের গোপন কথা আর জানার অধিকার থাকে না। রমার মনে হয়েছিল, সে অরুণের ওপর তার অধিকার হারিয়েছে।
অমলা বলল, আমার দিকে তাকিয়ে আছো কেন?
না এমনি। রমা আঁচলে মুখ মুছল। তারপর বলল, আর এক কাপ চা খাও। বাবার সঙ্গে ওরা বোধহয় জমে গেছে।
মেসোমশাই অরুণ বলতে দেখছি অজ্ঞান।
অরুণ এবাড়ির খুবই নিজের মানুষ। ওর উপকারের কথা আমরা ভুলতে পারব না অমলা।
ওতো একটা অকম্মা লোক। ওকে দিয়ে কারও কোনো উপকার হয়!
রমা কী বলতে গিয়ে থেমে গেল। অরুণের ওপর তার কোনো অভিমান নেই। কোনো রাগ নেই, যেটুকু সে অরুণের কাছে পেয়েছে তার স্মৃতিটুকু ভারী অম্লান এবং এখন বুঝতে পারে রমা যত দিন যাচ্ছে, অরুণকে ভিতর থেকে গভীরভাবে ভালোবেসে ফেলছে। সে জানে আরও যত দিন যাবে যত গভীরতা বাড়বে। অরুণ যত ওকে পাশ কাটিয়ে যাবে তত অঘটন তীব্রতর হবে। এবং দিন যত যাচ্ছে বুঝতে পারছে এক ভয়ংকর কষ্টের মধ্যে সে পড়ে যাচ্ছে। এই কষ্ট থেকে রেহাই পেতে হলে তাকে অন্য কোথাও চলে যেতে হবে। একই অফিস বাড়িতে কাজ করা তার পক্ষে ক্রমে অসম্ভব হয়ে উঠেছে।
অমলা বলল, দাদার বিয়েটা হয়ে গেলেই তোমার লাগিয়ে দেব।
রমা বলল, দিয়ো। এইটুকু বলেই সে সরে পড়ল। একটা গোপন দুঃখ নিয়ে সরে পড়ল। কেন যে সে এভাবে মরতে গেল। প্রথমে খেলার ছলে যা সে নিয়েছিল, এখন বুঝতে পারছে তাই ভিতরে ভিতরে প্রচণ্ড দাপাদাপির সৃষ্টি করেছে। সে ফের বাথরুমে ঢুকে চোখে জলের ঝাপটা দিল। তারপর মাকে বলল, মানদা কোথায়?
মানদা অন্য ঘর থেকে বলল, যাই দিদিমণি।
আর এক কেতলি জল বসাও। আমি যাচ্ছি!
মল্লিকা বলল, তুই ওদের সঙ্গে কথা বল। আমি করছি।
মল্লিকা মাসিকে বলল, আমি করি না? তোমরা সবই করছ।
মল্লিকা তবু বলল, যা তো। বলে প্রায় ঠেলে ঠুলে রান্নাঘর থেকে বের করে দিল রমাকে। আসার পর থেকে মল্লিকা দেখেছে, রমা রান্নাঘরেই আছে। সেই সকাল থেকে—মাছ তরিতরকারি কোটা, মাছ ভাজা, টক, মিষ্টান্ন, ছোলার ডাল সব এক হাতে করেছে। রমা এত কাজের, কী পরিচ্ছন্ন সব কাজ! কেমন লক্ষ্মীশ্রী সব কাজে। নীরজা আজ শুধু বসে বসে হুকুম করছে আর সামনে পানের বাটা নিয়ে বসে আছে।
এবং সবার আগে রমা ছোট ভাইটিকে রান্নাঘরে বসিয়ে খাইয়েছে। কারণ সে জানে ভাইটির অভিমান বড় বেশি। আগে কত আবদার করত, এখন আর কোনো আবদার করে না। মানু অরুণকেও সহ্য করতে পারে না। তাকে ঘৃণা করে। মাঝে মাঝে রমার অসম্ভব জেদ মাথায় চেপে যায়, সংসারের জন্য এত করি, দিনরাত খাটি, বাড়ি এসে এক দণ্ড বিশ্রাম পাই না, আমার এতটুকু সুখ পর্যন্ত তোমরা হরণ করে নিতে চাও! আমি যাব। অরুণ এলেই যাব। কিন্তু আজকাল সে বুঝেছে সে ভুল করেছে। ভাইকে আদর করে আজ সে বসিয়ে রান্নাঘরে খাইয়েছে। মানু যা পছন্দ করে পাতে তা বেশি বেশি করে দিয়েছে। না খেলে বলেছে, এখনও আমার ওপর তোর রাগটা যায়নি!
সেদিনই বেশ রাত করে ফিরল মানু। চোখমুখ গম্ভীর। ভুবনবাবু বারান্দায় পায়চারি করছিলেন। সবাই বাড়ি ফিরে না আসা পর্যন্ত উদ্বেগের মধ্যে থাকেন। কিন্তু এসেই মানু বলল, সে এক্ষুনি বের হয়ে যাবে আবার। সে বলল, বাবা দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে যান।
ভুবনবাবু এই প্রথম চিৎকার করে উঠলেন, তুই কোথায় যাবি এত রাতে?
কাজ আছে।
কী কাজ?
চিৎকার রমা নীরজা ভানু সবাই বের হয়ে এসেছে। সারাদিন খাটা খাটানি গেছে। সবাই শুয়ে পড়েছিল। কেবল ভুবনবাবু জেগে। মানু এলে দরজা বন্ধ করে দেবেন। এখন সবাই দেখছে মানু নিজের ঘরে কীসব তন্ন তন্ন করে খুঁজছে। এবং একটা ব্যাগের মধ্যে সব ভরে নিচ্ছে।
ভুবনবাবু শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
নীরজা একটা কথা বলতে পারছে না।
ভানু কাছাকাছি যেতে পর্যন্ত সাহস পাচ্ছে না।
রমা শুধু ঘরে ঢুকে বলল, পাগলামি করিস না। কোথায় যাচ্ছিস। বলে ব্যাগটা টেনে নিতে গেলে কেমন অনেক দূর থেকে ভারী অপরিচিতের গলায় যেন বলল, আঃ কী করছ! সে বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, কাল সকালে পুলিশ আসতে পারে, আমার খোঁজে। বলবেন কিছুই জানেন না। বলে সে কাউকে আর কথা বলতে না দিয়ে তড় তড় করে নিচে নেমে রাস্তার অন্ধকারে হারিয়ে গেল।
পঁচিশ
পরদিন পুলিশ এসে তন্ন তন্ন করে খুঁজল বাড়িটা। ওরা এটা ফেলছে, ওটা টেনে নামাচ্ছে, এবং কথায় কথায় শালা বানচুত বলছে ভুবনবাবুকে। শালা বানচুত শব্দটি তাঁর প্রতি কেউ কখনও জীবনে ব্যবহার করেনি। তিনি স্থির ধীর মানুষ। সৎ মানুষ। পুত্রের কল্যাণে পুলিশ যা কিছু মুখে আসে গালাগাল করে গেল তাঁকে। তাঁর পরিবারের কেউ গালাগাল থেকে রেহাই পেল না। মানুকে বেজন্মার বাচ্চা বলল কয়েকবার।
পুলিশ ঘিরে রেখেছে বাড়িটা। দু বার দুটো ব্যাটনের বাড়ি খেল ভানু—বল কোথায় গেছে হারামির বাচ্চা। দেশটাকে জ্বালিয়ে খেল। তারপর পুলিশ অফিসারটি একসময় খুব অমায়িক গলায় ডেকে নিয়ে গেল ভুবনবাবুকে। ঘরের দরজা বন্ধ করে দিল।
রাস্তায় মানুষজন জমে গেছে। রমা রান্নাঘরে নীরজা রান্নাঘরে। মানদা কেবল বলছে, এ—কোন আপদ! পুলিশ সব খুঁজে পেতে দুটো লিফলেট পেল। লিফলেট দুটো দোমড়ানো, বোধহয় একটিতে সুপুরির কুচি রেখেছিল নীরজা এবং একটায় হরীতকী। সেই দুটো সম্বল করে গোঁফে তা দিয়ে একটা বড় রকমের খোঁজখবর মিলে গেছে মতো পুলিশের দলটা বড়বাবুর জন্য দাঁড়িয়ে থাকল।
তখন পুলিশ অফিসারটি দরজা বন্ধ করে বলে গেল, বুড়ো হয়েছেন, কত কিছু দেখতে হবে। আজকাল মানুষ বড়ই ধান্দাবাজ। আপনারা সেকেলে লোক টের পান না। ছেলেটাকে আপনার চোট্টারা সর্বনাশ করে তবে ছাড়ল। কোথা গেছে বলুন! আমরা ধরে এনে শুধরে দেব। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে আসবে।
ভুবনবাবু বললেন, জানি না।
পুলিশ অফিসারটি বলল, বড়ই দুঃখময়। দেশে বড় লোক কেবল বড় লোক হচ্ছে, গরিব কেবল গরিব হয়ে যাচ্ছে।
দু দলই লড়াই করবে বলে হাঁকপাঁক করছে। আমাদের হয়েছে মরণ। কার দিকে যাই বলুন। আপনার ছেলেটি কোন দলে গেছে আপনি জানেন! সেটা খুব ভালো দল না। মনীষীদের যখন তখন মাথা কাটছে। আপনি নিশ্চয় জানেন। বাবা যখন পুত্রের খবর আপনি জানবেনই। বলুন—ধরে আনি। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরিয়ে দি।
ভুবনবাবু বললেন, জানি না।
দেশটা দেখতে দেখতে কী হয়ে গেল বলুন। এখন শুধু ধান্দাবাজদের রাজত্ব। রাজনীতি বলুন, অর্থনীতি বলুন সমাজ সংস্কৃতি বলুন সব ধান্দাবাজাদের মুঠোয়। আপনারা সৎমানুষ, সে—সব পথে যাবেন কেন। ছেলেটা আপনার রত্ন। রত্নগর্ভা আপনার স্ত্রী। কোথায় আছে নিশ্চয় জানেন। বলুন বলে ফেলুন।
আমাদের সামনে কোনো আদর্শ নেই। অথচ দেখুন এই দেশেই নেতাজী জন্মলাভ করেছেন। গান্ধীজী বলুন, তিলক বলুন, রামকৃষ্ণ, বিদ্যাসাগর, নেহরু কত নাম করব বলুন, তাঁরা সবাই আমাদের এই ভারতবর্ষে জন্মলাভ করেছেন। শিক্ষা, স্বার্থত্যাগ শিক্ষা, অহং শিক্ষা—কী শিক্ষা না দিয়ে গেছেন তেনারা। কিন্তু হল কী—হল কচু। চোর বাটপার জোচ্চোর। ইতর নেমকহারামে দেশটা ছেয়ে গেল। কী বলেন, ঠিক বলিনি! তা যাক এখন বলুন আপনার সুপুত্রটি গেল কোথায়!
ভুবনবাবুর এক কথা, জানি না।
কিন্তু আপনি না জানলে তো হবে না। এত জানেন আর এটা জানবেন না সে কী করে হয়। বয়স হয়ে গেল, দুদিন বাদে নিমতলা যাবেন, মিথ্যে কথা বললে নরকে জায়গা হবে না, ধর্মাধর্ম জ্ঞানতো অন্যের চেয়ে আপনার কম না! মিথ্যা কথা বললে কত বড় পাপ হয় জানেন, মহাভারতে যুধিষ্ঠির বলে একজন ধার্মিক ব্যক্তি ছিলেন, পড়েছেন নিশ্চয়ই—সামান্য মিথ্যাকথা, অশ্বত্থামা হত নর নহে ইতি গজ, ঠিক মিছা কথাও নয়। একটু ঘুরিয়ে বলা, একটু আস্তে গলা খাকারি দিয়ে বলা, তাতেই কী না নরক দর্শন হয়ে গেল। বলেন এটা ঠিক হল—আমরা কত মিছা কথা বলি আমাদের কী হয়—কচু হয়। মহাভারতেই ও—সব লেখা হতে পারে। তারপরই কী ভেবে বেলাইনে চলে যাচ্ছেন ভেবে অফিসারটি ঘুরিয়ে বলল, না না কী যেন বলেন, মহাভারতের কথা অমৃত সমান, কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান। আপনি বড়ই পুণ্যবান মানুষ, বলে ফেলুন, আপনার সাধের বিপ্লবী পুত্রটি কোন নিরুদ্দেশে গেল!
ভুবনবাবুর সেই এক কথা—জানি না।
শুনুন, জানতে হয় কী করে জানিয়ে দিতে পারি। সবই পারি। কিন্তু আমাদেরও বাবা মা ভাই বোন আছে। মনে করবেন না আমরা কলাগাছ ফুঁড়ে বসুন্ধরায় হাজির হয়েছি। সব পারি—আপনি পিতৃস্থানীয় ব্যক্তি, হাত চালাতে লাগে। সেজন্যই বলছিলাম বলে দিন—ও—সব বিপ্লবে টিপ্লবে বিশ্বাস করবেন না, ও বয়সে আমরাও অনেক বিপ্লব টিপ্লব করার কথা ভেবেছি, মিছিলে ঝান্ডা উড়িয়েছি, তারপর চাকরি হয়ে যাবার পর সাধু পুরুষ হয়ে গেছি। এখন মাগ ছেলে বাদে আর কিছু বুঝি না মশাই। আমার অত রাখঢাক নেই। ডমফাই করতে ভালোবাসি না। দুটো পয়সা কী করে হবে, সেই ধান্ধাতেই থাকি। যা দিনকাল, চোখ বুজলে মাগ ছেলে সব রাস্তায়। আদর্শ ধুয়ে জল খাব? রাশিয়া চীন আমেরিকায় নানা রকমের মগজ ধোলাইর কারখানা আছে, কিন্তু শালা আমাদের দেশিমগজ ধোলাইর মতো মহাকার্যোদ্ধারকারী বটিকা আর একটিও নেই। জয়া বলে একটি প্রেমিকা আছে আপনার পুত্রের সেটা কী জানা আছে?
ভুবনবাবু বললেন, জানি না।
আপনি দেখছি মশাই একেবারে বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি। পার্থিব বিষয়ে সম্পূর্ণ উদাসীন। কিন্তু সব খবরই পুলিশের খাতায় আজকাল লেখা হয়ে থাকে। জয়া মেয়েটিকে এনে দু হাত এক করে দিলেই বিপ্লবের কেতাতে আগুন ধরে যেত। আপনারা এত প্রাজ্ঞ হয়ে কেন যে এটা বোঝেন না। দু তিনমাসের মধ্যে আপনার ছেলেটির অধোগতি হয়েছে। হরিবল। পুলিশ অফিসারটি ধার্মিক পাঁঠার মতো তারপর একটা হাই তুলল। কিছুতেই কাজ হবে না। আস্ত ত্যাঁদোর লোক। জায়গামতো না নিয়ে গেলে হবে না। পুলিশ অফিসারটি টুপি টেনে দরজা খুলে তারপর দুলাফে বের হয়ে গেল।
ভুবনবাবু স্থির চোখে বসে থাকলেন।
নিচে পুলিশ ভ্যানটি গর্জে উঠল।
রমা এবং ভানু ছুটে দেখল, বাবা স্থির নিষ্পলক।
রমা ডাকল, বাবা কী বলল লোকটা?
ভুবনবাবু রমাকে দেখলেন।
কী বলল?
কিছু না।
এতক্ষণ শাসাচ্ছিল, আপনি কিছু বলছেন না! ভানু কেমন বিরক্ত গলায় কথাটা বলল।
কপাল। বলে ভুবনবাবু উঠে পড়লেন।
রমা নীরজা ভুবনবাবুর পেছন পেছন গেল। ভুবনবাবু করিডোর ধরে হেঁটে কোথাও যাবেন যেন।
রমা বলল, আপনি কোথায় যাচ্ছেন?
জয়াদের বাড়ি যাব।
জয়াদের বাড়ি এখন যেতে হবে না।
কেন, গেলে কী হবে?
রাস্তায় লোকজন জড়ো হয়েছে। নিচে নামলেই আপনাকে আজে বাজে প্রশ্ন করবে। আপনি এখন কোথাও বের হবেন না।
ভুবনবাবু পুত্রকন্যার কথায় নিরস্ত হলেন। চারপাশের মানুষ তামাশা দেখতে ভিড় করেছে। ভুবনবাবু ধীরে ধীরে মানুর ঘরে ঢুকে ওর খাটে বসে পড়লেন। ছেলেটা এমন কী করত যার জন্য পুলিশ এ—ভাবে তাকে অপমান করে গেল! এই অপমান লাঞ্ছনা নির্যাতন শেষ বয়সে তাঁর কপালে লেখা ছিল তবে। মনে মনে বললেন, মানু বাপের দিকটা দেখলি না একবার। সংসারে আমি তো কোনো অপরাধ করিনি। তুই কোথায় গেলি তাও বলে গেলি না। এত উদ্বেগ নিয়ে মানুষ বাঁচতে পারে! তারপরই মনে হল, না বলে গিয়েছে ভালোই করেছে। পুলিশ তাকে সহজে ছাড়বে বলে মনে হচ্ছে না। নির্যাতন শেষ পর্যন্ত এমন হতে পারে যে তিনি সব ফাঁসও করে দিতে পারতেন। আর ঠিক দুপুরেই এল দুজন পুলিশ, তারা ভুবনবাবুকে থানায় ধরে নিয়ে গেল।
বিপদের সময় রমার একমাত্র মানুষ অরুণ, যাকে সে ফোনে সব বললে ছুটে এল। সব খুলে বললে, অরুণ বলল, দেখছি। এখন বিকেল হয়ে গেছে, গোবিন্দদা এখানে আছেন। তাছাড়া অরুণের দূর সম্পর্কের এক দাদা বিধানসভার সদস্য। দেশ স্বাধীন হবার আগে বিপ্লবী ছিল, এখন কংগ্রেসি। যখন যে দল ভারী সেখানে নাম লেখাবার প্রবণতা আছে মানুষটার। মানুষটা খুবই রাশভারি, খুব প্রভাব আছে উঁচু মহলে। ছয়কে নয় করতে বড়ই ওস্তাদ মানুষ। অরুণ বুঝতে পারছে এ—সময়ে দাদার স্মরণাপন্ন হওয়া ছাড়া তার উপায় নেই। মনে মনে সে তার দাদাকে ঘৃণা করে। কারণ সে জানে, ভদ্রলোকের রাজনীতির দিন শেষ হয়ে গেছে। গুণ্ডা বদমাসরা সব এখন এম এল এ। লম্পট হলে তো কথাই নেই—তার দাদাটির ক্ষেত্রে সবই প্রযোজ্য। সে তার শরণাপন্ন হয়ে বিকেলের দিকে ভুবনবাবুকে বাড়ি নিয়ে আসতে পারল।
কিন্তু এ কী চেহারা মানুষটার! উদভ্রান্তের মতো চোখ। কারও সঙ্গে একটা কথা বলছেন না। পাগল পাগল চেহারা। সিঁড়ি ধরে উঠতে পারছিলেন না। শরীরে হাত দিলেই কঁকিয়ে উঠছেন। রমা বাপের এমন অবস্থা দেখে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল! ভানু কেমন হঠকারী যুবক হয়ে গেল, বলল শালাদের আমি খুন করব।
অরুণ বলল, কোথায় লেগেছে মেসোমশাই।
ভুবনবাবু, বললেন, জল খাব রমা।
ওরা সবাই বুঝতে পারল, পাঁজাকোলে করে তুলে নিয়ে যেতে হবে। রমা মুখ নিচু করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। সব রাগ কেন জানি এখন মানুর ওপর গিয়ে পড়ছে। নীরজা দরজায় হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে। ভুবনবাবুকে বিছানায় শুইয়ে দিলে, রমা জল নিয়ে এল। ভুবনবাবু উঠে বসতে চাইলেন। অরুণ বলল, বসতে পারবেন?
ভুবনবাবু উঠে ততক্ষণে বসে পড়েছেন। জলটা খেলেন। তারপর বললেন, তোমাদের একটা কথা বলছি, মানু যদি বাড়ি ফিরে আসে, ওকে কিন্তু এসব কিছু বল না।
অরুণ বলল, পুলিশের অত্যাচার দিন দিন বাড়ছে। অথচ যা চেহারা দেখছি কোনদিক থেকে ঝড় উঠবে বলা যাচ্ছে না। সেও বলল, মানুকে না বলাই ভালো। ওদের দলটাও বসে নাই। তারপরই অরুণ বলল, আচ্ছা রমা, মানু এভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল, তোমরা কেউ আগে তো আমায় বলনি!
এই প্রথম রমা কেমন মানুর পক্ষে দাঁড়িয়ে কথা বলল, একে নষ্ট হওয়া বলে অরুণ!
তা হলে তোমাদের আসকারাতেই এটা হয়েছে!
রমা বলল, না তাও না। যা সময়কাল অরুণ, এটাই হওয়ার কথা। আমরা ধরে বেঁধে কতদিন আর সব ঠিকঠাক রাখব। তারপর রমা বুকের আঁচল টেনে বলল, তবে আমরা ওকে আসকারা দিইনি। বাড়িতে খুব বেশি একটা সময় মানু এদিকটায় থাকতও না। পড়াশোনাও মন দিয়ে করল না। অবশ্য ওরই বা দোষ কী বল—চারপাশে যা সব দেখছে!
কী দেখছে?
কী দেখছে না বল?
হঠাৎ রমাকে বিপ্লবী কথাবার্তা বলতে দেখে অরুণ এই পরিবারের এত দুঃখের সময়েও না হেসে পারল না।
তুমি হাসছ?
না হাসছি না।
দেখছ না চারপাশে কেমন সব ধান্ধাবাজ মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারপর কেমন অপরাধীর গলায় বলল, আমরাও অরুণ ভালো ছিলাম না।
অরুণ আর কথা বলতে পারল না। এই পরিবারে সবারই বুকে কথাটা বড় বেশি বাজল। সংসারে পাপ ঢুকে গেলে এমন হয়—এই এক বিশ্বাস নিয়ে ভুবনবাবু আপাতত চোখ বুজে পড়ে থাকলেন। নীরজা পায়ের কাছে বসে ভুবনবাবুর পায়ে হাত বুলিয়ে দিতে থাকল।
সন্ধ্যার পরই লোডশেডিং। পাড়াটা অন্ধকার। কেমন নিঝুম হয়ে গেছে। পাশের বাড়িটার একতলায় ব্যাংকের অফিস। ওপরের তলায় ব্যাংকের এজেন্টের কোয়ার্টার। ওদের বাড়িতে এ সি জ্বলে, চারপাশে যখন অন্ধকার থাকে, তখন ও—বাড়িটায় আলো জ্বলে। সেই আলোতে ভুবনবাবুর ঘরটা কেমন আবছা ফ্যাকাশে বিবর্ণ রঙ ধরেছে। টেবিলে ল্যাম্প জ্বেলে দিয়ে গেছিল নীরজা। ভুবনবাবু এখন অন্ধকার পছন্দ করছেন বলে আলোটা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। আর সেই সময় মনে হল খুট খুট করে কেউ কড়া নাড়ছে। গোপনে মানু ফিরে এল না ত! ভুবনবাবু খুবই চঞ্চল হয়ে উঠলেন। তিনি উঠতে যাবেন, তখন মনে হল কেউ দরজা খুলে দিচ্ছে। তিনি দরজার মুখে গিয়ে দেখলেন, চুপি চুপি কেউ করিডরে ঢুকতেই নীরজা দরজা বন্ধ করে দিচ্ছে। অস্পষ্ট আলোতে তিনি বুঝতে পারলেন না কে ঢুকছে। রমা নীরজা দু জনই আছে। তারাও কিছু বলছে না। তিনি বললেন, কে!
বুককি।
বুককি! সে কে!
ভুবনবাবু মানুর বন্ধুদের খুব একটা চেনেন না। আলো থাকলে তিনি মুখ দেখলে চিনতে পারতেন।
রমা বলল, গোবিন্দবাবুর ছেলে।
অঃ।
তারপরই মনে হল সে যদি মানুর খবর রাখে। রাখারই কথা। বলে যেতেও পারে তাকে! তিনি বললেন, বুককি এদিকে আয়।
খুব সতর্ক বুককি। সে এসে ঘরে ঢুকেই ফিস ফিস করে বলল, জয়াকে ধরে নিয়ে গেছে পুলিশ!
জয়াকে!
রমা বলল, জয়াকে দিয়ে কী হবে?
পুলিশের ধারণা জয়া সব খবর রাখে মানুর।
ভুবনবাবু বললেন, জয়া যদি বলে দেয় সব।
রমা নীরজা দাঁড়িয়েছিল। বুককিও দাঁড়িয়ে আছে। ভুবনবাবু খাটে বসে আছেন। আবছা বিবর্ণ অন্ধকারে তিনি বুককির মুখ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন না। কার কাছে কী আবার বলে ফেলবেন ভয়ে বললেন, দাঁড়িয়ে আছো কেন, আলোটা এ ঘরে দিতে পারছ না?
রমা তাড়াতাড়ি টেবিল ল্যাম্প এনে রাখলে ভুবনবাবু বুককিকে চিনতে পারলেন। এ বাড়িতে মাঝে মাঝে এসেছে। তিনি বললেন, তুমি জানো মানু কোথায় গেছে?
বুককি কেমন ইতস্তত করতে থাকল।
আমি তো ওর বাবা! ও যতদিন ফিরে না আসবে আমি আর ঘুমোতে পারব না, জানো।
চিন্তা করবেন না। ও ভালো আছে।
কোথায় আছে?
সে আমিও জানি না মেসোমশাই। মানু এদিকে কেমন হয়ে গেছিল।
ওর কাছে প্রায়ই চিঠি আসত। আমিই দিতাম চিঠিগুলি।
তোমাকে কে দিত?
রোগা মতো একটা ছেলে দিয়ে যেত।
তুমি জানতে না, কোথায় থাকে সে।
না। বারবারই এক কথা বলত।
কী বলত?
বলত, অতসব জানার দরকার নেই। মানু বলেছে চিঠি তোমাকে দিতে। তুমি দিয়ে আসবে।
মানুর কাছে আসত না কেন?
এ পাড়ার কেউ কেউ তাকে চিনে ফেলতে পারে। ভয়ে আসত না।
তখনই মনে হল, গৌরীবাবুর ছেলে আজ সাত আট মাস হল পাড়া ছেড়ে চলে গেছে। বুককি ঠিক এ—পাড়ার ছেলে নয়। সে থাকে জমির লেনে। দুটো বাস স্টপেজ পার হয়ে তাকে এখানে আসতে হয়। জয়া বুককিদের পাড়ার মেয়ে।
রমা বলল, ছেলেটা রোগা ফর্সা মতো?
ঠিক ফর্সা নয়, শ্যামলা রঙ।
চোখ বড় বড়?
চোখ বড় নয় বরং বেশ লম্বা বলা যেতে পারে।
এ পাড়ায় বছরখানেক আগে নানারকম খণ্ডযুদ্ধ লেগে থাকত। কোথায় উত্তরবঙ্গের একটা জায়গায় জোতদার খুন হল তারপর থেকেই ক্রমে শহরটায় কেমন একটা চাপা আক্রোশ কারা ছড়িয়ে যাচ্ছে। শহরের উচ্ছিষ্ট খাবার খেয়ে যারা বাঁচছে, যারা বস্তিতে থাকে, যাদের জীবনধারণের কোনো অবলম্বন নেই, তাদের পক্ষ হয়ে এই বিপ্লব। অন্নহীন মানুষের জন্য লড়াই। সমাজব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন না হলে মানুষের মুক্তি নেই এমন সব কথাবার্তা চারপাশে কারা ফিস ফিস করে কানে কানে যেন কেবল বলে যাচ্ছিল।
রমা জানত কোনোরকমে যদি একটা কাজ জুটিয়ে দিতে পারত মানুকে তবে এই কানাকানির ভয় থাকত না। এবং একসময় সে অরুণকে বলেছিল, যে—কোনো একটা কাজ দিয়ে অরুণ ওকে এখন বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া দরকার। তুমিত জানো, উঠতি ছেলেদের কী ছোঁয়াচে রোগে ধরেছে। ওকে ভুবনেশ্বর পাঠিয়ে দাও। ওখানে তো আমাদের একটা সেল—এম্পোরিয়াম আছে। তুমি ইচ্ছে করলেই পারো।
অরুণ বলেছিল, একটু সময় দিতে হবে।
রমা বলেছিল, কিন্তু জানোতো আমাদের পাড়াটা ভালো না। নষ্ট হয়ে যেতে কতক্ষণ। রমা কিংবা নীরজা অথবা ভুবনবাবু যা আশঙ্কা করেছিলেন শেষ পর্যন্ত মানু তাই হয়ে গেল।
ভুবনবাবু বললেন, জয়াকে ছেড়ে দিয়েছে?
না।
তুমি বসো না। নীরজা একটা মোড়া এনে দিল। নীরজার চোখমুখ শুকনো। ভানু বাড়ি নেই। অরুণ আর ভানু সেই দাদাটির সঙ্গে পরামর্শ করতে গেছে। কারণ পুলিশের পাল্লায় পড়লে সহজে আর রক্ষা থাকে না। কোথাকার জল কোথায় গড়িয়ে নিয়ে যাবে সেজন্য আগে থেকেই সতর্ক থাকা ভালো। মস্তান দাদাটিকে পুলিশ খুবই ভয় পায়। তার কারণ দাদাটি তার বাড়ির বসার ঘরে একটা এমন ছবি টাঙিয়ে রেখেছে, যা দেখলে পুলিশের হৃৎকম্প না উঠে উপায় নেই। সেই ফোটোটাই তার তুরুপের তাস।
ভুবনবাবু খুব বিস্ময়ের গলায় বললেন, জয়া ওখানে থাকবে কোথায়?
পুলিশ লক—আপে আছে।
সঙ্গে সঙ্গে ভুবনবাবু আর্ত চিৎকার করে উঠলেন, পুলিশ লক—আপে!
রমা বলল, ও কী মিসায় অ্যারেস্ট হয়েছে?
সে জানি না।
ভুবনবাবু বললেন, ভাবতে পারছি না! তিনি নিজের ওপর দিয়ে যা প্রত্যক্ষ করে এসেছেন, তার যদি বিন্দুমাত্র জয়াকে জিজ্ঞেস করে কিংবা দৈহিক নির্যাতন করে, এবং আরও কিছু উৎকট দৃশ্য চোখের ওপর ভাসতেই কেমন ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে গিয়ে বললেন, তোমরা পারোনা বুককি, এখনই গিয়ে থানাটায় আগুন ধরিয়ে দিতে? একটা সামান্য মেয়ে, কী ভালো মেয়ে, শুনেছি মেয়েটা সাত পাঁচে থাকে না, কবিতা লেখে, সেই মেয়েটাকে তোরা নিয়ে গেলি!
রমা বলল, কী বলছ যা—তা বাবা!
ভুবনবাবুর খেয়াল হল, জয়ার পর রমা। এমনকি রমার পর নীরজাকে ধরে নিয়ে যেতে পারে। পুলিশের হাতে অসীম ক্ষমতা। তিনি মুখে কুলুপ এঁটে দিলেন। আর একটা কথা বললেন না।
নীরজাই কেমন বোকার মতো বলল, ওকে মারধোর করেনি ত কথা বার করার জন্য?
ওর মাতো শুনেই অজ্ঞান। ওর বাবা ছুটোছুটি করছে। ওর পিসিমার দেওর পুলিশে কাজ করে। রুমন আরও সব পাড়ার ছেলেরা থানায় গেছে। পিসিমা গেছে ওর দেওরের কাছে।
ভুবনবাবু শুধু বললেন, কী যে হবে!
তারপর সবাই চুপ। বুককিও কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকল। খুব বিষণ্ণ দেখাচ্ছে ছেলেটাকে। কার কোপ কার ঘাড়ে পড়বে কেউ বলতে পারে না। কেমন ভীতসন্ত্রস্ত চোখমুখ। পুলিশ যদি জানে সেই পত্রবাহকের কাজ করছে তবে তাকেও ধরে নিয়ে যেতে পারে। এখন ছুতো পেলেই হয়েছে। বুককি বলল, আজ রাতের ট্রেনে আমিও চলে যাব। মুর্শিদাবাদে আমার মাসিমা থাকেন। তারপরই থামল, না বলা ঠিক হচ্ছে না। বড়ই গোপন রাখা দরকার। কোথা থেকে কীভাবে ফাঁস হয়ে যাবে কেউ জানে না। পুলিশের গুপ্তচর এখন পাড়ায় পাড়ায় ঘুরছে। তা না হলে জয়ার সঙ্গে মানুর সামান্য সম্পর্ক আছে সেটাই বা টের পেল কী করে পুলিশ। সে উঠে পড়ল। —আমি যাই।
ওরা কেউ আর একটা কথা বলল না। সে উঠে চলে গেল। সকালবেলায় দৈনিক কাগজে ভুবনবাবু দেখলেন, আবার দুজন পুলিশ খুন! ভুবনবাবু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খুনের খবরগুলি পড়লেন। পরদিন আবার দেখলেন, খুন, এবার ম্যানেজার এবং পর পর পাঁচদিন, পাঁচ জায়গায় পাঁচটি ম্যানেজার খুন দিনের বেলা, চার পাঁচটি ছেলে প্রকাশ্য রাস্তার ওপরে দাঁড়িয়েছিল। বাস ট্রাম সব থামিয়ে দিয়েছে। সব লোক নিমেষে ফাঁকা, দরজা—জানালা বন্ধ করে দিয়েছে ভয়ে সবাই। ম্যানেজারকে টেনে এনে গলার নলি কেটে ওরা উধাও হয়ে গেছে। যাওয়ার আগে দমাদম বোমা ফাটিয়েছে রাস্তায়।
একটা কিছু হচ্ছে। তারই নাম বুঝি বিপ্লব। গাঁয়ে গঞ্জেও সব বীভৎস খবর। স্কুল কলেজে হামলা ছাত্র নিহত হচ্ছে। আগুন দেওয়া হচ্ছে। যেন আজকালকার মধ্যে মুক্তি মিলে যাবে মানুষের। দেয়ালে দেয়ালে লেখা ফুটে উঠছে সত্তর দশক, মুক্তির দশক। সরকার হিমসিম খাচ্ছে, পুলিশ হিমসিম খাচ্ছে। ভয়ে আর কেউ পুলিশের কাজ নিচ্ছে না। কয়েক মাসের মধ্যে বিত্তবান মানুষের মধ্যে ভয়ংকর সন্ত্রাস ছড়িয়ে পড়তে থাকল।
শীতকালে ভানুর বিয়ে হয়ে গেল। নম নম করে কাজ করা হল। মল্লিকা বিয়েতে তার বড় মেয়েকে নিয়ে এসেছিল। মাঝে ভুবনবাবু একদিন মল্লিকাদের বাড়ি গেছিলেন। স্বামী মারা গেছে পাঁচ সাত বছর আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্র ছিল। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার কাজ করত। বড় মেয়ে মিনু সেই সংসারের হাল ধরেছে। মেয়েটা ভালোই রোজগার করে। এখনও মল্লিকার ঘর বেশ রুচিসম্মত। মিনু কী কাজ করে কোথায় কাজ করে বললে মল্লিকা কেন জানি এড়িয়ে গিয়েছিল। মল্লিকা আত্মীয় স্বজনের কাছেও একটা বড় যায় না। ভানুর আশীর্বাদের দিন প্রায় জোর করেই মল্লিকাকে ধরে নিয়ে এসেছিলেন। তিনি দেখেছেন, সব সময় মল্লিকা খুবই বিষণ্ণ থেকেছে। নিজের অভাবের কথা একসময়ে সে আত্মীয়স্বজনদের জানিয়েছিল। তখন কেউ বড় একটা সাহায্য করেনি। ভুবনবাবুরও ক্ষমতা ছিল না সাহায্য করার। এবং অভিমানবশেই আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে মল্লিকা দূরে সরে গেছে। বউভাতের দিন মল্লিকা মিনু দু’জনেই এসেছিল। মিনু মেসোমশাইর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করার সময় কেন জানি কেঁদে ফেলেছিল।
তিনি ভেবেছিলেন, মানুর কথা ভেবে বুঝি মেয়েটা কেঁদে ফেলেছে। তিনি তাড়াতাড়ি তাকে তুলে বলেছিলেন, আমার কপালে এই লেখা আছে মিনু। তুই এজন্য কাঁদিস না।
বলা ভালো মানুর আত্মগোপনের পরের সপ্তাহে থানার পুলিশ অফিসারটিও খুন হয়েছিল। গুজব জয়াকে সেই পুলিশ অফিসারটি ধর্ষণ করেছিল। কে বা কারা অদৃশ্য এক রন্ধ্র থেকে গুলি করেছিল এবং যাবার সময় ওর পুরুষাঙ্গটি কেটে দিয়ে গেছে।
ছাব্বিশ
নানু এখান থেকে চলে যাবার পর দুখানা চিঠি লিখেছে। চিঠি দুটো রাসবিহারী খুব যত্নের সঙ্গে তার নিজস্ব কাঠের বাক্সে রেখেছিলেন। তিনি ভাবলেন, চিঠি দুটো ফের আর একবার পড়ে দেখবেন। আজ দুপুরে রানুরও চিঠি এসেছে। চিঠিতে এবার রানু নানুর সব খবর জানার জন্য খুব উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এতদিন পরে ছেলের জন্য এই উদ্বেগটুকুতে রাসবিহারী বিশেষ প্রসন্ন। নানু মার কথা তার চিঠিতে কোথাও উল্লেখ করেছিল কী না, যদি না করে থাকে—আসলে কী একটা বয়েস হয়ে যায়, যখন ছেলেমেয়েরা নিজস্ব এক জগতের বাসিন্দা হয়ে যায়—তখন সম্পর্কে চিড় ধরে বোধহয়। কিন্তু আশ্চর্য চিঠি দুটো খুঁজে পেলেন না। তিনি তো চিঠি দুটো তার কাঠের বাক্সেই রেখেছিলেন। এখন আর কাউকে ডেকে বলতে পারেন না, তোমরা আমার বাক্স কেউ হাঁটকেছ। শেষ দিকে মিতার এই স্বভাব ছিল। টাকাপয়সার দরকার হলে সে অনেক সময় বাক্স হাঁটকাত। টাকাপয়সা তিনি সবসময় বইয়ের ভাঁজে রাখেন। বাক্সটায় তার কিছু ধর্মগ্রন্থ আছে। পাতার ভাঁজে ভাঁজে টাকা, চিঠি, পুজোর ফুল বেলপাতা, এবং তাবিজ ও একটি রুদ্রাক্ষের মালা সবই ঠিক আছে অথচ চিঠি দুটো নেই।
তিনি অগত্যা মেয়ের চিঠির জবাব লিখতে বসলেন। লিখবেন, নানু ভালো আছে। ওর পর পর দুখানা চিঠি পেয়েছি। ওখানে ও জমিজমা কিনে চাষ—আবাদ করবে বলে জানিয়েছে। শহর তার ভালো লাগছে না। সে লিখেছে, আমি একটা নতুন জগৎ আবিষ্কার করেছি দাদু। ফুল ফল গাছপালার কথাও লিখেছে। রাতের জ্যোৎস্না খুব মায়াবী। সকালের সূর্য আশ্চর্য প্রাণপ্রাচুর্য এনে দেয়। দিগন্ত বিস্তৃত আকাশ, আর রাতের গভীর নিস্তব্ধতার মধ্যে অজস্র নক্ষত্রমালা দেখতে দেখতে প্রায়ই তার মনে একটা প্রশ্ন জাগে, এবং সে প্রশ্নটা বাকি জীবনের সত্যাসত্য নিয়ে। নানু লিখেছে, দাদু তুমি নিজেও এই পৃথিবীতে এনে এমন একটা প্রশ্নের সম্মুখীন হবে। শেষে লিখেছে, আমি যে লাল বলটা হারিয়েছিলাম, এখানে এসে সেটা ফিরে পেয়েছি।
পরের প্যারাতে কী লিখবেন ভাবলেন, নানু সম্পর্কে চিঠি থেকে তার এই কথাটুকু মনে হয়েছে। তিনি নানুকে লিখেছিলেন, মাকে চিঠি দিয়ো। রানুকে চিঠি দিলে পত্রে তার উল্লেখ থাকত। পত্রে নানুর চিঠির কোনো উল্লেখ নেই দেখেই বুঝতে পারলেন, নানু তার মাকে কোনো খবরই দেয়নি। এমনকি আর কাউকে সে চিঠি লেখেনি। অবশ্য নানু যে স্বভাবের তাতে আর কাউকে সে চিঠি লিখতেও যাবে না। চিঠি পাবার পর মনে হয়েছে একবার তিনি সত্যি নানুর কাছে চলে যাবেন। কিন্তু স্টেশন থেকে পাঁচ সাত ক্রোশ হেঁটে গেলে নানুর সেই স্বপ্নের দেশ। এ—বয়সে এতটা পথ হাঁটতে পারবেন কিনা সংশয়ে এখনও তাঁর যাওয়া হয়ে উঠল না। সংসারে তিনি এখন মুক্ত। অথচ কথাটা যত সহজে ভাবতে পারলেন জীবনযাপনে যদি তার বিন্দুমাত্র আঁচ পাবার চেষ্টা করতেন। হাজার রকমের গেরো তাঁকে সবসময় বিড়ম্বনার মধ্যে রেখে দিয়েছে। হেমর শরীর দিনকে দিন খারাপের দিকে। ইদানীং শ্বাসকষ্টে ভুগছে। ওষুধপত্রে কাজ দিচ্ছে না। টোটকা করেছে কিছুদিন, তারপর দেবস্থানে গিয়েছে। বর্তমান গুরুর খোঁজে আছে। কোনো এক ব্রহ্মচারীর খবর পেয়ে দুদিন সেখান থেকে ঘুরে এসেছেন। কিন্তু গুরুটিকে পছন্দ হয়নি। তবে বাড়িতে সাঁইবাবার ছবি ঝুলিয়ে কিছুদিন বেশ প্রশান্তিতে ছিল, কিন্তু শ্বাসকষ্ট বাড়তেই সে বলেছে, আমাকে প্রভুর কাছে নিয়ে চলো। মনে মনে তার প্রভু ঠিক হয়েই আছে—অযথা গুরুর খোঁজাখুঁজি করেছে। শীতের শেষে ভেবে রেখেছেন, এবার প্রভুর কাছে হেমকে নিয়ে যেতেই হবে। প্রভুর দর্শনে যদি হেম আরোগ্য লাভ করে। নানুর কাছে কবে যাবেন কিছুতেই স্থির করে উঠতে পারছেন না।
চিঠি লিখতে বসে এই সব হাবিজাবি রাসবিহারীর মনে আসতে থাকে। মানুষের মৃত্যুভয় সব আত্মপ্রত্যয় নষ্ট করে দেয়। অথচ সহজভাবে ভাবলে, এটাই কী নিয়ম, এভাবেই মানুষ সংসার করতে করতে একদিন শেষ হয়ে যায়, এটা বোঝা উচিত। হেমকে এসব বলেও লাভ নেই। বয়স হলে রক্তের জোর কমে আসে, শরীরের ক্ষমতা কমে আসে, মহাপ্রস্থানের পথে তখন রওনা হতে হয়। এবং এসময় কিছু তীর্থস্থান দর্শনে মনে প্রসন্নতা আসে। তিনি লিখলেন, তোমার মার শরীর ভালো না। ভাবছি তোমার মাকে নিয়ে কিছুদিন দক্ষিণভারত ঘুরে আসব। তারপর কী লেখা যায়—মণীষের কথা লিখবেন কিনা ভাবলেন। তাঁর বড় মেয়েটি রুগণ। মণীষের সঙ্গে রানুর অবৈধ সম্পর্কটি তিনি এ—বাড়িতেই টের পেয়েছিলেন। কিন্তু চোখ বুজে থাক ছাড়া উপায় ছিল না। শরীর বলে কথা। তারপর তিনি আরও দু—লাইন লিখলেন, ভানুর চিঠি পেয়েছি, সে ভালো আছে। মিতা গত রবিবারে ভানুকে নিয়ে এসেছিল। ওরা দুপুরে এখানে খেয়েছে।
তারপরের লাইন লিখতে গিয়েই মনে হল, আসলে মানুষের মুক্তি বলে কিছু নেই। তিনি মুক্তি খুঁজছেন, আসলে সেটা সব কিছুর সঙ্গে শুধু কমপ্রমাইজ করে চলা। নানুও কী তাই করছে। না সত্যি সে মানুষের আরও বড় সত্যাসত্য আবিষ্কার করে ফেলেছে। কারণ রাসবিহারীর ধারণা মানু আর দশটা ছেলের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। সে বড় একটা কিছু করে ফেলতে চায়। কিন্তু সেই মুহূর্তেই মনে হল সামান্য একটা ঝি—মেয়ের জন্য যে চলে যায়, তার পক্ষে বড় কিছু করা অসম্ভব। তিনি লিখলেন, নানু চিঠিতে ঝি—মেয়েটির কোনো কথাই লেখেনি। তারপরই মনে হল, এ—বাক্যাংশটি রানুকে পীড়া দেবে। ভেবে কেটে দিলেন। বেশ ভালো করে কেটে দিলেন। কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা তিনি চাইলেন না। শেষে লিখলেন নানু ভালো আছে। তুমি এলে আমি মানুর কাছে যাব। বুঝিয়ে বলব, দেখি কী হয়। সে সেই যে চলে গেল আর একবারও এল না। যদিও এসে থাকে কলকাতায়, আমার এখানে এল না। আর একটা কথা লিখছি, মণীশ তো স্বরাষ্ট্র দপ্তরে আছে, তুমি কী ওকে দিয়ে পুলিশের মারফত নানুকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে পারো না। আসলে সে ওখানে পুলিশের ভয়ে আত্মগোপন করে আছে। মণীষের এত প্রভাব শুনছি, আর এতো সামান্য কাজ—একটা ঝি—মেয়ের জন্য ভদ্রসন্তান দেওয়ানা হয়ে যায় কবে কে দেখেছে। তিনি যে বাক্যাংশ কেটে দিয়েছিলেন, শেষ পর্যন্ত ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তাই আবার লিখলেন। মনের সেই আদিম সংস্কারের জায়গাটা খুঁচিয়ে শেষ পর্যন্ত তাকে দিয়ে তাই লেখাল। তিনি তারপর কিছুক্ষণ টেবিলে বসে থাকলেন। চিঠি লেখা শেষ হয়েও হচ্ছে না। শরীর থেকে চাদরটা সরে যাওয়ায় শীত শীত অনুভব করলেন। চাদরটি ফের ভালো করে জড়িয়ে নিতেই মনে হল, ও—ঘরে হেম খুব কাশছে। হেমর ঘরে আজকাল তার যেতেও ভয় লাগে। সব সময় একটা না একটা অনুযোগ। যেন হেমর সব কষ্টের হেতু তিনি নিজে।
রাত বাড়ছিল। এত বড় বাড়িটাতে এখন তিনি আর হেম। কেন এই বাড়িটা যে করতে গেলেন! যৌবনে মানুষের কত স্বপ্ন থাকে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সবই কাচের পাত্রের মতো মনে হয়। জীবনের ইচ্ছাগুলো বড়ই ক্ষণভঙ্গুর, তবু সব আগলে একটা প্রাচীন বটবৃক্ষের মতো এই আবাসে তিনি বেঁচে আছেন। সামনের জানলা খোলা, লনে জ্যোৎস্না। কিছু গাছপালা ডুবে আছে। এই গাছপালাগুলোই মনে হয় তাঁর শেষ বেলার সঙ্গী। এবং বাড়িটিতে যদি তার নিজের রোপণ করা গাছপালাগুলি না থাকত, তবে যে—কোনো পান্থনিবাসের মতো বাড়িটাকে ছেড়ে তিনি অন্যত্র চলে যেতে পারতেন। তার সেজন্য এতটুকু কষ্ট হত না। কিন্তু গাছপালা বোধহয় মানুষের নীরব বন্ধুত্ব কামনা করে। শেষ বয়সে এটা তিনি বেশি টের পান বলে কোথাও গিয়ে দুচার দিনের বেশি থাকতে পারেন না। এ বাড়িটাতে এখন গাছপালাগুলিই তাঁর আকর্ষণ। হেম যে এতদিনের সঙ্গী ছিল, সেও দিনকে দিন অদ্ভুতভাবে জীবন থেকে সরে যাচ্ছে। যদি হেমর মৃত্যু হয় তার কোনো কষ্ট হবে না। বরং কেন জানি কিছুদিন থেকে মনে মনে তিনি হেমর মৃত্যু কামনা করছেন। এই গেরোটা মানুষের খুবই বড় গেরো।
চিঠিটা ভাঁজ করলেন। কাল সকালেই চিঠিটা ডাকে দিতে হবে। রানু বিয়েতে এসেছিল মাত্র দুদিনের ছুটি নিয়ে। তখন ছেলে সম্পর্কে প্রায় নীরব ছিল। অথচ তার এই চিঠিটাতে নানুর জন্য ভারী আবেগের সঞ্চার হয়েছে। এতদিনে কী রানু শরীরের দিক থেকে কোথাও কিছু খামতি টের পেয়েছে। সে বুঝেছে কী শরীরের রক্তমাংসে আর তেমন বান ডাকার ব্যাপারটা নেই। ক্রমশ তা কমে আসছে। অথবা বয়সের রেখা ক্রমে শরীরে দগদগে ঘায়ের মতো ফুটে উঠছে। এখন তার একমাত্র সম্বল বলতে শ্রীমান দুর্গাদাস ওরফে নানু।
তিনি চিঠিটা টেবিলে রেখেই বাইরে বের হয়ে এলেন। শীতের জ্যোৎস্না তাঁর বাড়ির সর্বত্র এখন ছম ছম করছে। রাস্তায় দুটো কুকুর দৌড়ে যাচ্ছিল, আউট হাউসে নিধু ঘুমোচ্ছে বোধ হয়। গোরুর ঘরে খচ খচ শব্দ হচ্ছিল। দূরে শেষ বাস অথবা রিকশার টুংটাং শব্দ তিনি লনে দাঁড়িয়ে শুনতে পেলেন। শুনতে পেলেন, বহু দূর থেকে এক বালক, হাত তুলে তাঁকে যেন ইশারায় ডাকছে। বহুদূর অথবা যেন কোনো গতজন্মের ঘটনা, সেই বালকের হাত ধরে কেউ হাঁটছে। বাবার হাত ধরে সে কোথাও যাচ্ছে। তাঁর মনে হল বাবা এমনি শীতের রাতে তাকে লণ্ঠন নিয়ে আনতে যেতেন মাস্টারমশাইর বাড়ি থেকে। সে বাবার হাত ধরে বাড়ি ফিরত। বাবা বলতেন, সদা সত্য কথা বলিবে। বাবা প্রাতঃস্মরণীয় পুরুষদের জীবনী বলতেন, রাসু তুমি বড় মানুষ হবে। এইসব ভাবলে তিনি কেমন বিমর্ষ হয়ে যান। তিনি চেয়েছিলেন এক, হলেন অন্য। প্রবঞ্চনা শঠতা বাদে এক সময় জীবনে তাঁর কোনো সম্বল ছিল না। এখন তাঁর মনে হয় কার জন্য তিনি জীবনে এই শঠতা এবং প্রবঞ্চনা সম্বল করে এখানে এসে পৌঁছেছেন। শূন্য এক মাঠ, খাঁ খাঁ মরুভূমির মতো যেন তাঁকে এখন গিলতে আসছে। তিনি একা লনে দাঁড়িয়ে থাকতে ভয় পেলেন।
এবং ঘরে ফিরে মনে হল, এক পরিত্যক্ত আবাসে তিনি এসে ঢুকছেন। শুধু ইঁদুরের কিছু খুট খুট শব্দ শুনতে পেলেন। হেমর কোনো সাড়াশব্দ নেই। শ্বাসকষ্ট, যদি কম দম বন্ধ হয়ে গিয়ে শক্ত হয়ে যায় কেমন ভূতুড়ে একটা অস্তিত্ব অনুভব করে তিনি ভিতরে কেঁপে উঠলেন। এবং খুব সন্তর্পণে হেমর ঘরে ঢুকে টেবিল ল্যাম্পটা জ্বেলে দিলেন। হেম ঘুমোচ্ছে। হেমর মৃত্যু হয়নি তো! নিশ্বাস পড়ছে কী না ভেবে তিনি হেমর নাকের ওপর হাত রাখতেন, না, নিশ্বাস পড়ছে। যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। এই বাড়িতে একসময় সব ঘরগুলি শোরগোলে ভরে থাকত। ছয় মেয়ে এবং মেয়েরা বড় হতে থাকলে বাড়িতে যুবক আত্মীয়দের ভিড় লেগেই থাকত। সবসময় তখন হেম ছিল ব্যস্ত। একদণ্ড ওর দম ফেলবার সময় ছিল না। এক হাতে সব সে আগলে রেখেছিল। আত্মীয়স্বজনে বাড়িটা ভরে থাকত। কেউ এলে মেয়েরা ছাড়তে চাইত না। এখন মনে হয় সবই অন্য জন্মের ঘটনা। যদি নানুটাও থাকত। নানুর বউ এবং তখনই আবার একটা ঝি—মেয়ে এবং বংশের কৌলীন্য সব কেমন তার ঘিলুর মধ্যে রক্তের প্রবাহ বাড়িয়ে দিচ্ছে। নিমেষে তিনি একজন অবুঝ অভিভাবক হয়ে উঠলেন। তাঁর মনেই থাকল না, তিনি অসহায়, সবাই তাঁকে ছেড়েছুড়ে চলে গেছে। রক্তের মধ্যে কী যে এক নিছক আভিজাত্য মানুষের থেকে যায়। তিনি সব জটিলতা থেকে মুক্তি পাবার জন্য অবশেষে বললেন, ঠাকুর সবই তোমার ইচ্ছা।
আসলে এই ইচ্ছার কথা বলে যতই তিনি রেহাই পেতে চান ততই তাঁকে যেন কেউ দম বন্ধ করে মারতে চায়। কেমন এক জ্বালা মাথার মধ্যে কেবল কুট কুট করে কামড়াচ্ছে। আমরা তোর কাছে এত পর হয়ে গেলাম! একটা ঝি—মেয়ে তোর সর্বস্ব হয়ে গেল : এবং এই করে রাসবিহারীর মনে হল সামান্য একটা মেয়ে তাঁদের সব কৌলীন্য কেড়ে নিচ্ছে। প্রথম দিকে যতটা হালকাভাবে নিয়েছিলেন, দিন যত যেতে থাকল তত কেমন গুরুত্ব বাড়তে থাকল আর তিনি ভাবতে থাকলেন, ক্রমেই হেরে যাচ্ছেন। অথচ এই জ্বালা তার আগে তেমন হয়নি। যেন আমার কী যার ছেলে তার কোনো মাথাব্যথা নেই, আমি কেন চিন্তা করে মারি। এ—সবই তাঁকে দীর্ঘকাল চুপচাপ থাকতে সাহায্য করেছিল। কিন্তু রানুর উদ্বেগপূর্ণ চিঠি পেয়ে তিনি কিছুটা বিচলিত বোধ করলেন। বিধবা মার তুই একমাত্র ছেলে, কত আশা—ভরসা—আর তুই এখন একটা ঝি—মেয়ের সঙ্গে থেকে সত্য দর্শন করছিস।
আগামীকাল ভুবনবাবুর বাড়িতে তাঁর যাবার কথা। ভুবনবাবুর ছেলেটিরও খোঁজ নেই। নানুর মতো উগ্র রাজনীতির শিকার। ভুবনবাবুর সঙ্গে তাঁর জীবনের কোথায় যেন বড় রকমের একটা মিল আছে। শোবার সময় তিনি জল খেলেন, এবং ঘুমের ওষুধ খেলেন। আজকাল ঘুমের খুব ব্যাঘাত হচ্ছে। সারারাত কোনো কোনো দিন জেগে থাকেন। রাস্তায় গাড়ির শব্দ পান, খুব নিশুতি রাতে পাতা পড়লেও তিনি টের পান, গাছ থেকে পাতা ঝরছে।
পরদিন রাসবিহারীবাবু সকাল সকাল ভুবনবাবুর বাড়িতে চলে গেলেন। দু’জন সমবয়সি মানুষের দেখা হলে কিছুটা হালকা হবেন ভেবেছিলেন তিনি। সেখানে গিয়ে দেখলেন প্রিয়নাথও হাজির। আজকাল কী হয়েছে ভুবনবাবুর, তিনি মাঝে মাঝে কোনো বুড়ো মানুষের সঙ্গে দুদণ্ড কথা বললে সুখ পান। রমা তাঁকে অফিস থেকে ফোনে এমনই বলেছিল। আপনি আসবেন মেসোমশাই। বাবা আজকাল কেমন হয়ে যাচ্ছে। সে প্রিয়নাথকেও অফিস যাবার পথে বলে গেছিল। অন্তত বাবা কিছুটা সমবয়সি মানুষের সঙ্গে থাকলে স্বাভাবিক কথাবার্তায় মশগুল হয়ে থাকতে পারবেন। এবং কিছুদিন থেকেই ভুবনবাবু কতদিন বুড়ো মানুষের সঙ্গে দেখা হয় না বলে বেরই হয়ে যেতে চেয়েছিলেন।
রাসবিহারী ভুবনবাবুর বাড়ি পৌঁছে দেখলেন, রমা অফিস ছুটি নিয়েছে। ভানুও অফিস যায়নি। মিতা এখনও এ—বাড়িতে রান্নাঘরের ছাড়পত্র পায়নি। প্রিয়নাথবাবু বিধবা বউমাও এসেছেন। অনেক দিন পর তিন সমবয়সি মানুষ বারান্দায় বসে প্রথমে দেশের দ্রব্যমূল্য নিয়ে কথা আরম্ভ করলেন। দ্রব্যমূল্য থেকে, দেশ বাড়ি, শৈশবকাল, বাবা জ্যাঠাদের গল্প, একান্নবর্তী পরিবারের গল্প, এভাবে বর্তমান প্রজন্মের কথাও এসে পড়ল।
রাসবিহারী বললেন, মানুর কোনো আর খবর পেলেন না!
ভুবনবাবু ধুতি কোঁচা দিয়ে পরেন। গায়ে ফতুয়া। চুল খুব ছোট করে ছাঁটা। সাদা চুল এবং মুখ সদ্য কামানো বলে, খুবই শৌখিন মানুষের মতো দেখতে লাগছিল। ভুবনবাবু খুব লম্বা নন, খুব বেঁটে নন, এখনও অসুখ—বিসুখ কম। এদিকে রাতে দুবার উঠতে হচ্ছে, ব্লাডসুগার করাবেন। ভেবেছেন। রাতে আর ভাত খান না। দুধ রুটি এবং কলা এই প্রায় রাতের খাবারে এসে দাঁড়িয়েছে। এখনও চা—টাই বেশি খান। চা খেতে তিনি ভালোবাসেন। ইতিমধ্যে একবার চা হয়ে যাওয়ার পর দ্বিতীয় রাউন্ডের চা এসেছে। বেতের চেয়ারে গোল হয়ে বসছেন। তাস পাশা খেলার অভ্যাস থাকলে এ সময়ে এটাই জমে ওঠার কথা। কিন্তু ভুবনবাবুর তাস পাশার নেশা নেই, এক সময়ে বই পড়ার নেশা ছিল, এখন পত্রিকা পড়ার নেশা। পত্রিকার খবর থেকে বিজ্ঞাপন, পাত্র—পাত্রীর খবর এবং আজ কোথায় যাবেন এই শিরোনামায় তিনি কিছু কিছু খবর নিয়ে বিকেল হলেই আজ কোথায় যাবেন জায়গাতে নিঃশব্দে কোনো কোনো দিন চলেও যান। রমার কাছে, ভানুর কাছে এটা খুবই অস্বাভাবিক ঠেকছে। বাবাতো এমন ছিলেন না। কিছু বললে, বলেন, মহাবোধি সোসাইটিতে গেছিলাম। বেশ বললেন, দয়ানন্দজী। ধর্ম সম্পর্কে মানুষের বিশ্বাস নষ্ট হয়ে গেল বলে আজ দেশের এই দুরবস্থা। অবশ্য এখন মানু সম্পর্কে রাসবিহারী কিছু জানতে চাইছেন। কী বলবেন ভাবছিলেন। গোটা চারেক উড়ো চিঠি এসেছে, কে বা কারা করিডোরে রাতে ফেলে যায়। —আমি ভালো আছি বাবা। এই চারটি শব্দ লেখা থাকে। হাতের লেখা থেকে তিনি বুঝতে পারেন ওটা মানুরই চিঠি। কাজেই তিনি বললেন, মনে হয় ভালোই আছে। না থাকলে খবর পেতাম।
প্রিয়নাথ এই মানুষটি যে এমনই জবাব দেবে জানতেন।
প্রিয়নাথ বলল, ভুবন চলো আমরা কোথাও কিছুদিন ঘুরে আসি। রাসবিহারীবাবুও চলুন।
রাসবিহারী পরেছেন সিল্কের পাঞ্জাবি এবং ফাইন ধুতি। পায়ে পামসু মোজা। স্নান সেরে আহ্নিক করে তবে এসেছেন। এখনও সকালের শীত বারান্দায় জমা হয়ে আছে। ভুবনবাবু সুতোর চাদর গায়ে জড়িয়ে রেখেছেন। প্রিয়নাথের পরনে পাজামা পাঞ্জাবি। এটাই তার পোশাক। গায়ে জহরকোট। প্রিয়নাথ একসময় স্বদেশি করত। দেশ স্বাধীন হবার পর তার আত্মত্যাগের দৌলতে সরকারের তথ্য বিভাগে বেশ বড় চাকরি করেছে। এবং এখন রিটায়ার করার পর শৌখিন মানুষের মতোই বেঁচে থাকার চেষ্টা করছেন। পুত্রের মৃত্যুর জন্য যতটা কাতর হবার কথা তার বিন্দুমাত্র চোখে লেগে নেই। প্রিয়নাথের প্রস্তাবে সবারই সায় থাকা সত্ত্বেও কেউ কোনো জবাব দিলেন না।
কেবল রাসবিহারী বললেন, কোথায় যাবেন?
যেদিকে চোখ যায়, সেদিকে—এখন তো আমাদের সবারই পিছু টান কমে এসেছে।
ভুবনবাবু সামান্য সময় চুপ করে থাকার পর একটু মুচকি হেসে প্রিয়নাথকে উদ্দেশ্য করে বললেন, কোথায় যাবে? যেখানেই যাও সেই এক দৃশ্য—মনে হবে তুমি বড় পিছিয়ে পড়েছ। সবাই দৌড়াচ্ছে। এটা দেখতে কার ভালো লাগে বলো। তারপরই বললেন, নানু এসেছিল। বলল মেসোমশাই একবার আমাদের দিকটাই ঘুরে আসবেন! মন প্রফুল্ল হবে। বেঁচে থাকার অর্থ খুঁজে পাবেন।
রাসবিহারী এমন একটা খবরে ব্যথিত হলেন। নানু এখানে এসেছে অথচ তাঁর কাছে যায়নি। এমন কী তার রাগ হল ভেবে, মিতা কিংবা ভানু কেউ খবরটা দেয়নি। রাসবিহারী বললেন, কবে নানু, এসেছিল?
সে তো মনে করতে পারছি না। কেউ বাড়ি ছিল না। নীরজা দুপুরে নিদ্রায় মগ্ন ছিল। ও আমার সঙ্গেই দেখা করে গেল। বলল, কীসের একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং—এ এসেছিল। মানুর খবর কিছু রাখে কিনা বলতে বলল, ও নিয়ে ভাববেন না। মানু কখনও খারাপ কাজ করতে পারে না। তাছাড়া মানু ভালো আছে। আজ হোক কাল হোক ওর সঙ্গে মানুর দেখা হবেই। কী বিশ্বাস থেকে এমন বলল, তাও বুঝতে পারলাম না। আরও কত কথা। এমন সুন্দর কথা বলতে পারে ছেলেটা—সে বলছে, সবাইকে ক্ষমা করে দিয়েছি। এখন আর কারও ওপর তার কোনো রাগ নেই। জীবনে সৎ এবং পরিশ্রমী হওয়া বাদে মানুষের নাকি আর কিছু করণীয় থাকে না। হালের রাজনীতি নিয়ে কথা হল, উগ্র রাজনীতি নিয়েও সে কথা বলল। আজকের যারাই সৎ দেশে তারা কিছু করতে চায়। কীভাবে করবে ঠিক পথ খুঁজে পাচ্ছে না। তবে একটা কিছু ঠিক হবেই। এভাবে একটা দেশের মানুষ বেশিদিন বাঁচতে পারে না বলেও তার বিশ্বাস। যদি যাই ওর কাছেই যাব।
রাসবিহারী কেমন বিভ্রমের মধ্যে পড়ে যাচ্ছেন। নানুর চিঠির সঙ্গে এসব কথার যেন কোনো মিল খুঁজে পাচ্ছেন না। তিনি বললেন আমাকে কেউ খবরটা দিল না!
আপনি জানেন না সে এসেছিল!
না।
ভানু কিছু বলেনি!
না।
তাজ্জব! নানু যে এসেছিল, ওদের আমি বলেছি। গোপনে মানুও আসে। কারও সঙ্গে দেখা করে না। শুধু আমার সঙ্গেই কথা হয় গোপনে। তবে কী জানেন, আজকাল আমার ছেলেমেয়ে বউ কেউ আমার কথা বিশ্বাস করতে চায় না। ভাবে। আমার মাথা খারাপ।
তারপর কেন জানি কেউ আর একটা কথা বলতে পারল না। সবাই দেখল ভুবনবাবু কেমন উদাস মুখ করে বসে আছেন। রাসবিহারী রাস্তা দেখছিলেন। প্রিয়নাথ মাথা নিচু করে বসে আছেন। তিনজন সমবয়সি মানুষ আজ বড় বেশি টের পেলেন কেউ তাঁরা ঠিকঠাক বেঁচে নেই। তাঁদের জীবনের সবকিছু এক অদৃশ্য শক্তি ধীরে ধীরে হরণ করে নিচ্ছে।