ফুলানি মূলানি চ ভক্ষয়ন্ বনে
গিরীংশ পশ্যন্ সরিতঃ সরাংসি চ।
বনং প্রবিশ্যেব বিচিত্রপাদপং
সুখী ভবিষ্যামি তবাস্তু নির্বৃতিঃ ||
বাল্মীকি।
There is pleasure in the pathless woods,
There is a rapture on the lonely shore.
Childe Harold
হা ধরণি ধর কি রে হৃদয়মণ্ডলে,
ধর কি কোথাও মম, মনোমত স্থলে?
কি আছে সংসারে আর বাঁধিবারে মোরে!
যে কালে কেটেছে কাল ভরসার ডোরে ||
মনে করি কাঁদিব না রব অহঙ্কারে।
আপনি নয়ন তবু ঝরে ধারে ধারে ||
গোপনে কাঁদিবে প্রাণ সকলি আঁধার।
জীবন একই স্রোতে চলিবে আমার ||
আঁধার নিকুঞ্জ যেন নীরবেতে নদী।
একাকী কুসুম তায় চলে নিরবধি ||
কারে নাহি বাসি ভাল, কেহ নাহি বাসে।
হৃদে চাপা প্রেমাগুন, হৃদয় বিনাশে ||
সংসার বিজন বন, অন্তরে আঁধার।
দেখিতে অপ্রেমী মুখ, না পারি রে আর ||
বিজন বিপিনময় দ্বীপে একা থাকি।
ভাবিয়া মনের দুঃখ ভ্রমিব একাকী ||
দেখিব দ্বীপের শোভা মোহিত নয়নে।
বিপিন বারিধি নীল বিশাল গগনে ||
চারি পাশে গরজিবে ভীষণ তরঙ্গে।
শ্বেত ফেনা শিরোমালা নাচাইব রঙ্গে ||
শিরে মত্ত সমীরণ, শব্দ মিশে তার।
থেকে থেকে রেগে রেগে ছাড়িব হুঙ্কার ||
নিরখিব নীরধারে, ভীষণ ভূধর।
ফুলায়ে বিশাল বক্ষ জলধি উপর ||
তুলিয়া ললাট ভীম প্রবেশে গগনে।
গরজে গভীর স্বরে নব মেঘগণে ||
পদে তার আছাড়িবে প্রমত্ত তরঙ্গ,
বুকে তার প্রহারিবে পাগল পবন।
মহীধর মানিবে না অধমের রঙ্গ,
ললাটের রাগে করি ভয় প্রদর্শন ||
কর্ক্কশ সানুতে তার বিহরি বিজনে।
আ মরি এসব কবে হেরিব নয়নে ||
মোহে মন মজাইবে প্রকৃতি মোহিনী।
জীবন যাইবে যেন স্বপনে যামিনী ||
আলো মাখা কালো বাস ঊষা পরে যবে।
শুনিব সে তরতর জলনিধিরবে ||
দেখিব বিশাল বক্ষ মিলিছে আকাশে।
শ্বেত শশিছায়া নীলে ধীরে ধীরে ভাসে ||
শিহরিবে হৃদি মোর, সে স্নিগ্ধ সমীরে।
পাশে কুঞ্জ লতা ফুল নাচাবে সুধীরে ||
নিরখিব শশী শ্বেত গগনমণ্ডলে।
কত মেঘ বায়ুভরে শ্বেতাকাশে চলে।
গিরিপরে সুখ-তারা নেচে নিবে যায়।
যেন শেষ মন আশা নিরাশা নিবায় ||
নাচাইবে কর তার জলের ভিতর।
তাহারি পানেতে চেয়ে রব নিরন্তর ||
শুনিব সুরব মৃদু সমীরণ করে।
সুধার শিশির মাখা নিকুঞ্জ নিকরে ||
পুলকে দেখিব আমি লোহিত আকাশে।
পয়োধির পাশ থেকে তপন প্রকাশে ||
তরল তরঙ্গ মেঘ অনল সাগরে।
রবি নিজে নভরাজ দেখাইবে করে।
চঞ্চল সুনীল জলে তরুণ তপন,
চিকিমিকি চিকিমিকি নাচাইবে কর।
তরুলতা তৃণ মাঝে করিবে তখন,
ঝিকিমিকি ঝিকিমিকি নীহারনিকর ||
দ্বিপ্রহরে ঘননীল বিমল অম্বরে,
রাগিয়া রহিলে রবি অনলসাগরে,
শ্বেত মেঘ অগ্নি মেখে ফিরিয়া বেড়ায়,
রব তবে অন্ধকার নিকুঞ্জ মাঝায় ||
দীর্ঘ ভীম তরুগণ আচ্ছাদে আধার,
করিবেক চারুলতা স্নিগ্ধ চারি ধার ||
নীরব নিশ্চল দ্বীপে রহিবে সকল।
স্পন্দহীন পত্র আর কুসুমের দল ||
শুনিব গরজে ঘোর তরঙ্গনিকরে।
অথবা বিদরে বন এক পিকস্বরে ||
তরুলতা মাঝে দিয়া বিমল গগন।
কিম্বা জলে রবিকর হবে দরশন ||
কালো জলে ঢাকা দিলে প্রদোষ আঁধার-
অনিবার তরতর বিশাল বিস্তার-
সেই দুঃখস্বরে হৃদি, শিহরি চঞ্চল,
কাঁদিবে; না জানি কেন আঁখিময় জল!
মনে হয় যেন কোন সুখের সঙ্গীত।
নাচাইয়ে হৃদি ডোরে জাগে আচম্বিত ||
আপনি ভাসিবে আঁখি দর দর ধারে।
অনন্ত স্মরিব চেয়ে পয়োধির পারে ||
নবীনা রূপসী একা কাঁপে এক তারা,
যেন নব প্রণয়িনী প্রণয়সাগরে।
ছেড়ে গেছে কর্ণধার একা পথহারা,
কত আশা কত ভয়ে কাঁপিছে অন্তরে ||
যখন সন্ধ্যায় শ্বেত অর্দ্ধ শশধরে
ধীরে ধীরে ভেসে যাবে নীলের সাগরে
আকাশ বারিধি সনে করি পরশন
চারি পাশে ধরিবেক বিঘোর বসন
বারেক ভাবিব সেই রমণীরতন
রেখেছিল বেঁধে যার প্রেমমোহে মন ||
যবে ভাসি অর্দ্ধ শশী তারাময়াকাশে
স্বপ্নভূমি সম ধরা অস্পষ্ট প্রকাশে
ঝর্ঝর বাতাস বয় ক্ষীণালোকে যবে
ধাইবে সমুদ্র স্থির অনিবার রবে
অনিবার সর সর ঊর্দ্ধ্বে তরুগণ
দেখিব মিশিবে শূন্যে রমণীরতন ||
আঁখি আর নীলাকাশ মাঝে তার ছায়া।
আলোময় বেশে সেই ফুলময় কায়া।
নিবিড় কুন্তল দাম খেলিছে পবনে।
মৃদু স্থির মোহময় প্রণয় বদনে ||
দেখিতে দেখিতে মোহে হারাব চেতন।
চেয়ে রব; জানিব না মিলাল কখন ||
পূর্ণ শশী মোহমন্ত্রে চন্দ্রিকায় যবে
গিরি বারি বনাকাশ নিদ্রিত নীরবে ||
মনঃসুখে মনোদুখে মোহিত হৃদয়ে।
তার মাঝে বেড়াইব চারু তরি লয়ে ||
ভাসিবে নিবিড় নীলে একা শশধর।
দেখিব জ্বলিছে স্থির নক্ষত্রনিকর ||
পাশে নীল জল স্থির রব অনিবার।
যেমন স্বপনে কথা যৌবনে আশার ||
একবার পরশিবে মলয়সমীরে।
যেমন সে পরশিত ভাগীরথীতীরে ||
ধূমেতে আকাশে মিশে তরুদলতীরে।
পরস্পর গায় পড়ে ঢলে ধীরে ধীরে ||
প্রেমমোহ ভরে যেন, আবেশের রঙ্গে।
প্রণয়ী ঢুলিয়া পড়ে প্রণয়ীর অঙ্গে ||
ভীম স্থির মাঝে কোন রব শুনিব না।
তবে যদি নিরুপমা স্বর্গীয় ললনা
শূন্যভরে শশিকরে স্বপ্নসম মিশে,
বাজায় মুরলী মৃদু মনোমোহ ভরে,
প্রকাশিয়ে যত জ্বালা প্রণয়ের বিষে,
গভীর কোমল ধীর যাতনার স্বরে ||
মনোসাধে মজে তায় ভাবিবেক মন,
স্বপনে নিরাশা সঙ্গে আশার মিলন ||
মরি রে মোহিত মনে শুনিব সে স্বরে,
মোহভরে মুখ পানে চেয়ে রব তার।
হা বিধাতঃ বল বল বারেক বল রে;
হবে কি এমন দিন কপালে আমার ||
অথবা দেখিব স্তব্ধ লতিকার কুঞ্জে।
জ্বলে যথা শশিকর স্থির পাতাপুঞ্জে ||
নবীন কুসুম হাসি ছাড়িছে সুবাস।
যেন তৃণ লতা মাঝে নক্ষত্র প্রকাশ ||
দেবের ললনা দলে নাচে মাঝে তার।
চন্দ্রের কিরণে যেন চম্পকের হার ||
শত বীণা স্বর্গসুরে অপ্সরে বাজায়।
শত গান এক সুরে শূন্যেতে মিশায় ||
ঝরে ফুল জ্বলে মণি দেহের বর্ত্তনে।
কতই তরঙ্গ বয় আলোক বসনে ||
তারা গেলে হবে কুঞ্জে বিজন আঁধার।
একাকী কাঁদিব দেখে ঝরা ফুলহার ||
নিমিষে ঘুচিবে স্বপ্ন বিজনমণ্ডলে।
সেই ফুল সেই লতা ধীরে ধীরে দোলে ||
কাননে সাগরে যবে অমাবস্যা বসি-
কালো মেঘে ঢাকা শির ভীষণ রাক্ষসী-
গিরিগুহা মাঝে গর্জ্জে ক্রোধ ঝটিকার।
শুনে তাহে মিশাইব, অংশ হব তার ||
ভীমরণে প্রাণপণে পাগল পবন।
ঘুরিয়া ঘুরিয়া রাগে করে গরজন ||
গরজিবে রেগে রেগে অসংখ্য তরঙ্গ।
তমোমাঝে শ্বেত ফেনা আছাড়িবে অঙ্গ ||
শুনিব গভীর ধীর জলধরধ্বনি।
ফাটাবে গগন হৃদি চেচায়ে অশনি ||
উপরি উপরি রেগে ছিড়িবে শিখর।
পর্ব্বতে পর্ব্বতে যেন হতেছে সমর ||
ভয়ঙ্কর ভূতগণ, নেচে নেচে ঝড়ে,
উচ্চৈঃস্বরে কাঁদিবেক ঝড়নাদ সঙ্গে।
বিকট বদন ভঙ্গী গিরি পড়ি চড়্যে,
ভীম শ্বেত দন্তাবলী দেখাইবে রঙ্গে ||
পরেতে গভীর স্থির জগৎসংসার।
কাঁদিয়া ঘুমালো যেন নবীন কুমার ||
যেন তাঁর করুণার প্রতিমা প্রকাশ।
পূজিব গভীর মোহে, বিগত বিলাস ||
সঁপিয়া জীবন মন, যৌবন রতন।
এমন সুধীর মনে হইবে পতন ||
ভাবিব ঝটিকা মত ছিল মম মন।
এ গভীর স্থির মত হয়েছে এখন ||
কারো অনুরাগী নই বিনা সনাতন।
জপিয়া পবিত্র নাম হইব পতন ||
অনন্ত মহিমা স্মরি ছাড়িব এ দেহ।
জানিবে না শুনিবে না কাঁদেবে না কেহ ||
অনিবার জলরব কাঁদিবে কেবল।
আছে কি পৃথিবি হেন বিমোহন স্থল!