ভলিউম ৪৯ – মাছির সার্কাস – তিন গোয়েন্দা – রকিব হাসান – সেবা প্রকাশনী
প্রথম প্রকাশ: ২০০২
০১.
টেলিফোনের শব্দ শুনে নাস্তার টেবিল থেকে উঠে গেলেন মিসেস বেকার। হলরূমে গিয়ে ফোন ধরে ফিরে এলেন। কিশোর ফোন করেছে। কথা বলতে চায়। যে কোন একজন উঠে যাও। ডল, তুমিই যাও, তোমার নাস্তা তো শেষ।
কিশোরের কথা শুনে প্রায় উড়ে চলে গেল উল! মুসা আর জিনার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল রবিন। ওরাও হাসল।
কানে এল ডলের গলা, হালো, কিশোর! আমি ডল।
মিনিট তিনেক পর হাসিমুখে ফিরে এল সে। উৎসুক হয়ে তার মুখের দিকে হাকাল মুসা, জিনা, আর রবিন। কিন্তু চুপ করে রইল ডল। মা উঠে যাওয়ার মপেক্ষা করছে।
মিসেস বেকার ডলের মা।
জানালা দিয়ে উঁকি দিলেন তিনি। বাগান থেকে পানি ছিটানোর শব্দ আসছে। সেদিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার হলো? বাজারে যেতে হবে, মনে আছে?
আর একটু, এই হয়ে গেল, জবাব দিলেন মিস্টার বেকার। আরেক কাপ চা দিয়ে যাবে?
আনছি।
কাপে চা ঢেলে তাতে দুধ আর চিনি মিশিয়ে নিয়ে উঠে গেলেন মিসেস বেকার। তিনি বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একসঙ্গে কথা বলে উঠল রবিন আর জিনা, কি বলল!
বলল, সাড়ে দশটায় হলিডে ইনে দেখা করতে। মুসার হাতের দিকে তাকাল ডল।
পাউরুটিতে আধ ইঞ্চি পুরু করে মাখন মাখিয়েছে মুসা। তাতে এক ইঞ্চি পুরু করে লাগিয়েছে আপেলের জেলি। এক হাতে রুটির টুকরো, আরেক হাতে ইয়া বড় এক সাগর কলা নিয়ে একবার রুটিতে কামড় দিচ্ছে, আরেকবার কলায়; মুখ ভর্তি খাবার নিয়ে কথা বলতে পারছে না। কোনমতে গিলে নিয়ে বলল, খুব ভাল। তুমি আমাদের বিছানা-টিছানাগুলো গুছিয়ে ফেলো…
ইস্, পারব না, ঠোঁট গোল করে বলল ডল, যার যারটা সে সে গুছিয়ে নাওগে…আমিও যাব তোমাদের সঙ্গে। কিশোর ভাইয়া যখন জরুরী খবর দিয়েছে, নিশ্চয় কোন রহস্য। গোয়েন্দাগিরি করতে কেমন লাগে, আমিও দেখব।
বেশ, জিনা বলল, নিতে আপত্তি নেই। তবে দুতিন ঘণ্টার ছুটি আর বাড়ি থেকে বেরোনোর অনুমতিটা তোমাকেই নিতে হবে।
নেব, এককথায় রাজি হয়ে গেল ডল, যদিও জানে কাজটা কত কঠিন।
এবারের ছুটিটাই হয়েছে তিন গোয়েন্দা আর জিনার জন্যে ভোগান্তির। গোবেল বীচে বেড়াতে এসেও বাড়িতে টীচারের কাছে পড়তে বসতে হলো। কারণ পরীক্ষায় ভাল করতে পারেনি জিনা। মুসার রেজাল্ট তো আরও খারাপ। রবিনেরও ভাল না। বইয়ের পোকা হলেও পাঠ্যবইয়ে তার মনোযোগ নেই, পরীক্ষার আগেও রাত জেগে জেগে গল্পের বই পড়েছে। জিনার বাবা মিস্টার পারকার সাফ বলে দিয়েছিলেন, বাড়িতেও পড়তে হবে। সেই মত একজন শিক্ষকও রাখা হয়েছিল। কিন্তু শেষমেষ দেখা গেল সেই শিক্ষক আসলে একজন স্পাই। ফর্মুলা চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ল তিন গোয়েন্দার হাতে। পুলিশে দেয়া হলো তাকে।
বিপদে পড়ে গেলেন মিস্টার পারকার। শিক্ষক তো একজন চাই। স্কুল এখনও অনেক দিন ছুটি। তবে বাড়িতে আর টীচার রাখার সাহস হলো না তার। আবার কোন শয়তান লোক কিভাবে এসে জ্বালাতন করে। শেষে তাঁরই নিগ্রো বন্ধু বেকার দম্পতির ওপর ছেলেমেয়েদের ভার দিয়ে নিশ্চিন্ত হলেন। বেকাররা নির্ঝঞ্ঝাট। একমাত্র মেয়েকে নিয়ে বেশ বড়সড় একটা বাড়িতে থাকেন।
মিস্টার বেকার গোবেল বীচ স্কুলের শিক্ষক। মিস্টার পারকারের অনুরোধে। পড়াতে রাজি হলেন। তবে তিনি ছাত্রর বাড়ি যেতে পারবেন না, ছাত্রকেই তার বাড়িতে আসতে হবে। বাড়িতে জায়গা আছে, যদি ছাত্ররা থাকতে রাজি হয়, তাহলে আরও ভাল।
মিস্টার পারকার তো হাতে চাঁদ পেলেন। সঙ্গে সঙ্গে মুসা, রবিন আর জিনাকে পাঠিয়ে দিলেন মিস্টার বেকারের বাড়িতে। খাওয়ার খরচ তিনিই দেবেন। কিশোরের যেহেতু রেজাল্ট খুব ভাল, তার আর টীচারের বাড়িতে থাকতে যাওয়া লাগল না। সে রয়ে গেল জিনাদের বাড়িতে। সে আর জিনার কুকুর রাফিয়ান।
বড়ই বেকায়দায় পড়ে গেছে তিন গোয়েন্দা আর জিনা। স্কুলের হোস্টেল খোলা থাকলে কোনমতেই থাকত না কিশোর, ব্যাগট্যাগ গুছিয়ে সোজা ওখানে চলে যেত। মুসা আর রবিনের বাবা-মাও বাড়িতে নেই, ছুটি কাটাতে রকি বীচ থেকে বহুদূরে চলে গেছেন। কিশোরদের স্যালভিজ ইয়ার্ডে রাশেদ পাশা একা। ডনকে নিয়ে মেরিচাচী বেড়াতে চলে গেছেন তার বোনের বাড়িতে, অর্থাৎ উনদের বাড়িতে। কাজেই নানা রকম শর্ত আর বাধ্যবাধকতা সহ্য করে গোবেল বীচে পড়ে থাকতে হচ্ছে ওদের।
তবে একেবারেই যে নিরানন্দ কাটছে এখানে, তা বলা যাবে না। এই তো, এসেই তো কয়েক দিনের মধ্যেই একটা রহস্যের সমাধান করে ফেলল। আরও যে করতে পারবে না, সেটা কে বলতে পারে?
যাই হোক, বাইরে বেরোনোর অনুমতি নিয়ে ফেলল উল। পারত না, যদি বাবার বাজারে না যাওয়া লাগত। মিস্টার বেকার বাজারে যাচ্ছেন বলেই অত সহজে দুটি দিলেন।
তর সইল না আর গোয়েন্দাদের। দশটা বাজতেই বেরিয়ে পড়ল সাইকেল নিয়ে। ওদের প্রিয় জায়গা, গায়ের ছোট্ট ডেইরি শপটায় রওনা হলো। আইসক্রীম থেকে শুরু করে রুটি-বিস্কুট-কেক সব পাওয়া যায় ওখানে। এককালে সরাইখানাই ছিল ওটা, নাম ছিল হলিডে ইন, এখন সরাইখানা বন্ধ-টাকার অভাবে চালু করতে পারছে না মালিক, তবে ডেইরি শপটা বন্ধ করেনি।
সাড়ে দশটার আগেই দোকানে ঢুকে বসে রইল ওরা। কিশোর এল কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে দশটায়। সঙ্গে রাফিয়ান। সাইকেল রেখে ঘরে ঢুকল। দরজায় থাকতেই বন্ধুদের ওপর চোখ পড়ল তার। হাসিমুখে এগিয়ে এল। জিনার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল রাফিয়ান। আদর করে গালমুখ চেটে দিতে দিতে অস্থির করে তুলল।
বাড়িতে পেট পুরে নাস্তা করে এসেও হলিড়ে ইনে ঢুকে লোভ সামলাতে পারেনি মুসা। একগাদা কেকের অর্ডার দিয়েছে। কিশোর বসতেই প্লেটটা তার দিকে ঠেলে দিল, নাও।
না-রে, ভাই, হাত নাড়ল কিশোর, আমি খাব না। দেখছ না, আবার ফুলতে শুরু করেছি। ওজন বাড়লে বড় ঝামেলা!
কয়েক বছর আগে অনেক মোটা ছিল সে, একেবারে গোল। খাবারের লোভ তারও কম ছিল না। কিন্তু ডায়েট কন্ট্রোল আর প্রচুর ব্যায়াম করে করে অনেক কষ্টে ওজন কমিয়ে শরীরটা স্বাভাবিক করেছে।
আরে দূর, একটা টুকরো খেলে কিছু হবে না, মুসা বলল। খুব টেস্ট…
মাথা নাড়ল কিশোর, টেস্ট যে আমিও জানি। ঠিক আছে, ছোট এক কাপ আইসক্রীম খেতে পারি।
মুসাভাই, তুমি খাওয়ার গপ্পোটা একটু থামাও না, বাধা দিল ডল, সবার ছোট সে, বয়েস মাত্র আট, তাই কিশোর-মুসা-রবিন তিনজনকেই ভাই বলে ডাকে, জিনাকে জিনাআপু। কিশোরভাই, বলো, কি রহস্য পেয়েছ।
অবাক হলো কিশোর, রহস্য পেয়েছি কে বলল তোমাকে?
ফোনে বললে না জরুরী কথা আছে?
ও, সেটা! জোরে নিঃশ্বাস ফেলল কিশোর। আর বোলা না, এবার কপালটা নেহাতই খারাপ আমাদের, গোবেল বীচে বেড়াতে এসেছিলাম! ইস, মেরিচাচী যখন বলল, কেন যে তার সঙ্গে গেলাম না!
ভুরু কুঁচকে তার দিকে তাকাল জিনা, কেন, আবার কি হয়েছে? তুমি তো ভালই আছো, মার রান্না খাচ্ছো, স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াও, পড়তে হয় না… জেলখানায় তো রয়েছি আমরা…
সেই স্বাধীনতাটাই তো গেল বোধহয় এবার!
আরে এত ভণিতা না করে খুলেই বলে ফেলো না ছাই!
আগামী হপ্তায় একটা কনফারেন্স হতে যাচ্ছে, নিজের অজান্তেই এক টুকরো কেক তুলে নিয়ে কামড় বসাল কিশোর।
তাতে কি?
তোমার বাবার একজন বন্ধুও তাতে যোগ দেবেন।
বিজ্ঞান-সম্মেলন হলে তাতে তো যোগ দেবেই পাগলগুলো। বাবা যেমন পাগল, তার বন্ধুগুলোও পাগল, বড় বড় উন্মাদ একেকটা; তাতে তোমার অসুবিধেটা কোথায়?
মিস্টার গ্রেগাবেবিরনকে চেনো?
নাম শুনেছি। দেখিনি। বাবার কাছে মাঝে মধ্যে চিঠি লেখে।
বাপরে, নাম কি!মুসা বলল, দিনের মধ্যে শখানেক বার কাউকে আউড়াতে দিলে দম আটকেই মরে যাবে। ঝামেলা র্যাম্পারকটকে দেয়া দরকার…
অত বড়টা বলার দরকার কি, জিনা বলল, ছোট করে নিলেই হয়, মা যেমন নিয়েছে। কথা উঠলে মা বাবাকে বলে তোমার বন্ধু মিস্টার গ্রেগ, অত্তবড় নাম বলতে যায় না।
সেটা অবশ্য সমস্যা না, আরও সহজ করে নেয়া যায়, মিস্টার বেবি বললেই হয়, কিশোর বলল। যা বলছিলাম, সেই মিস্টার গ্রেগাবেবিরন গোবেল বীচে কনফারেন্সে যোগ দিতে আসছেন। জিনার দিকে তাকাল সে, আর উঠছেন কোথায় জানো? তোমাদের বাড়িতে।
উঠুকগে, তাতেই বা তোমার কি? সারাক্ষণ বাবার ঘরেই বসে থাকবে। যন্ত্রণাটা হবে মার। কফির চালান দিতে দিতে আর বাবার ফাইফরমাশ খাটতে খাটতে জান যাবে। তোমার কিছু না?
আমার ঘাড়েও একখান যন্ত্রণা চাপানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেই গ্রেগ ভদ্রলোক তার একমাত্র মেয়েকে নিয়ে আসছেন সঙ্গে করে।
এতক্ষণে চোখ বড় বড় হলো জিনার। এলিজা! বাপরে, তাহলে তো বিপদ! শুনেছি ওটার ধারেকাছে নাকি শয়তানও ঘেষতে চায় না, এতই বিরক্তিকর। দুই বছর বয়েসে মা মরে যায়, তারপর মিস্টার গ্রেগই তাকে মানুষ করেছেন। তোমার ঘাড়ে চাপাল কি করে?
খাওয়া বন্ধ করে তাকিয়ে আছে মুসা। ডল আর রবিনও উৎসুক চোখে চেয়ে আছে কিশোরের দিকে।
দুই বিজ্ঞানী থাকবেন নিজেদের নিয়ে, কিশোর বলল, আইলিন আর কেরিআন্টি রান্নাঘর আর ঘর সামলানোর কাজে ব্যস্ত, মেহমান হয়ে আসা মেয়েটাকে তাহলে কে দেখবে? একা একা থাকতে নিশ্চয় খারাপ লাগবে তার। তাই নিঃসঙ্গতা ঘোচানোর দায়িত্ব পড়েছে আমার ওপর।
হেসে ফেলল মুসা, খুব খারাপ খবর। কিশোর, তোমার জন্যে দুঃখ হচ্ছে আমার, যদিও সামান্যতম দুঃখের ছোঁয়া নেই তার কণ্ঠস্বরে। যেখানেই যাবে, ওই মেয়েটাও তোমার পিছে পিছে যাবে, দেখো, বলে দিলাম। সত্যি তুমি মরেছ।
সেটা জানি বলেই তো ভয়টা পাচ্ছি। স্বাধীনতা এক্কেবারে শেষ।
বাদ দাও বাড়িতে থাকাথাকি, হাত নাড়ল জিনা, বইপত্র নিয়ে পড়ালেখার ছুতোয় আমাদের কাছেই চলে এসো। এলিজার সঙ্গে বাড়িতে থাকার চেয়ে শান্তি।
এখানে আসার কথা বলিনি ভেবেছ। রেগে উঠলেন পারকার আঙ্কেল। কোন রকম চালাকি চলবে না, সাফ বলে দিয়েছেন তিনি। এলিজাকেই সঙ্গ দিতে হবে, কড়া নির্দেশ।
আল্লায় যা করে ভালর জন্যেই করে, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল মুসা। ভাগ্যিস রেজাল্ট খারাপ করেছিলাম। জোরে জোরে কেকের টুকরো চিবাতে শুরু করল সে।
হাতের টুকরোটা শেষ করে আনমনে আরেকটা টুকরো তুলে নিল কিশোর। কামড় বসাল তাতে। হঠাৎ খেয়াল করল কেক খাচ্ছে। চোখমুখ কুঁচকে বিরক্ত হয়ে নিজেই নিজেকে শাসাল, নাহ, আমি গাধারার শরীর কমবে না! এই রাফি, নে।
দৌড়ে এল রাফি। ওপর দিকে মুখ তুলে কিশোরের হাত থেকে ছেড়ে দেয়া কেকের টুকরোটা গাঁক করে দাঁতে চেপে ধরল। কোৎ করে গিলে ফেলল। উৎসুক হয়ে তাকিয়ে রইল আরও পাওয়ার আশায়।
ও, এজন্যেই, হাসতে হাসতে রাফিকে বলল জিনা, এতক্ষণে বুঝতে পারলাম। তাই তো বলি, এত ভূমা হলে কি করে…কিশোর হতে চাইছে স্লিম, আর তুমি…
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠল কিশোর, সর্বনাশ!
কি হলো? চমকে গেছে রবিন।
লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল কিশোর। মিস্টার বেবি আর তার মেয়েকে এগিয়ে আনতে যেতে বলেছেন আমাকে কেরিআন্টি। এগারোটার বাসে আসবেন। পৌনে এগারোটার বেশি বাজে।
.
০২.
টাউন হলের পাশ কাটানোর সময় রবিন বলল, কনফারেন্সটা এখানেই হবে। আগামী হপ্তায়, চারদিন ধরে চলবে। নোটিশ পড়েছি। কলিওপটারিস্টদের মীটিং। কলিওপটারিস্ট কি?
কলি? অবাক হলো ডল। বাবাকে জিজ্ঞেস করতে হবে।
হবে হয়তো কলি কুত্তা গোছের কিছু, নিরাসক্ত ভঙ্গিতে বলল মুসা।
মুসার কথার জবাব দিতে গিয়ে রাস্তার উল্টো দিকে চোখ পড়তে থেমে গেল কিশোর। ওই দেখো, আসছে। ঝামেলা র্যাম্পারকট। দুষ্ট হাসি ফুটল মুখে। তাকে স্লিম হবার পরামর্শ দিলে কেমন হয়?
সাইকেলে করে এগিয়ে এল গাঁয়ের পুলিশম্যান ফগর্যাম্পারকট। পেটের কাছে। ছিঁড়ে যাওয়ার জোগাড় হয়েছে বেল্টটা। ছেলেমেয়েদের দেখে গম্ভীর হয়ে গেল।
গলা ফাটিয়ে ঘেউ ঘেউ করে উঠল রাফিয়ান।
তার দিকে একটা চোখ রেখে জিনাকে বলল, এই, তোমার কুত্তাটাকে থামতে বলো। কামড়ে দিতে এলে ওর বিরুদ্ধে রিপোর্ট করব আমি বলে দিলাম।
হাসল জিনা। আগামী হপ্তায় অনেক কুত্তার বিরুদ্ধে রিপোর্ট করার সুযোগ পাবেন। কলি কুত্তা নিয়ে কনফারেন্স হচ্ছে। একটা কুত্তাও আপনাকে দেখে খুশি হবে বলে মনে হয় না…
জ্বলন্ত চোখে জিনার দিকে তাকাল ফগ। বলল, ঝামেলা! রাফিয়ানের দিকে তাকিয়ে সরে পড়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ মনে করল। বিড়বিড় করে আরও কি বলতে বলতে তাড়াতাড়ি প্যাড়ালে চাপ দিল।
পেছনে ঘেউ ঘেউ করে তেড়ে গেল রাফি। হাসতে হাসতে মুসা বলল, থাক থাক, রাফি, মিস্টার ফগর্যাম্পারকট তো পালাচ্ছেন, তাঁকে আর গালাগাল করার দরকার নেই।
জিনার কথায় ঝট করে ফিরে তাকাল ফগ। ভীষণ রাগে লাল হয়ে গেছে চোখমুখ। কিন্তু কুকুরটার ভয়ে ফিরে আসতে সাহস করল না। চোখের আগুনে ওদের ভস্ম করতে করতে দ্রুত প্যাড়াল করে চলে গেল।
হাসতে লাগল সবাই।
জিনাকে বলল কিশোর, কলি কুত্তার কথা বলে দিলে তো ফগের ঘুম-ন্দ্রিা হারাম করে। ও এখন সারা গায়ে কলি কুত্তা খুঁজে বেড়াবে।
ভাল করেছি। কিন্তু কলি-কলি করে কি যেন বলছিলে…
কলিওপটারিস্ট।
হ্যাঁ, কলিওপটারিস্ট। মানে কি? জানো মনে হচ্ছে?
জানি, মাথা ঝাঁকাল কিশোর। পারকার আঙ্কেলকে বলতে শুনলাম। গুবরেপোকার বিশেষজ্ঞ। গুবরে নিয়ে যারা গবেষণা করে তাদেরকে বলে। কলিওপটারিস্ট।
তাজ্জব হয়ে গেল সবাই। গুবরেও একটা জিনিস! আর সেটা নিয়ে গবেষণা, কনফারেন্স করার মত লোকও আছে! জানত না।
হেসে বলল মুসা, ফগের মত বোকা মনে কোরো না আমাদের যে, যা বলবে তাই বিশ্বাস করব।
করলে করো না করলে নেই, যখন হবে তখন দেখবে।
বাস স্টেশনটা দেখা গেল। একটা বাস এসে দাঁড়িয়েছে। ঘড়ি দেখল কিশোর। এগারোটা বেজে গেছে। যাহ, নেমেই পড়লেন কিনা কে জানে! আমাকে না পেয়ে একা একা বেবিরা বাপ-বেটি বাড়ি চলে গেলে কেরিআন্টি রাগ করবেন আমার ওপর।
তাড়াতাড়ি রাস্তা পেরোল ওরা। বাসটা এসে সবে থেমেছে। দরজা খুলল। সারি দিয়ে নামতে শুরু করল যাত্রীরা।
এক হাতে একটা ব্যাগ আর অন্য হাতে একটা বড় সুটকেস নিয়ে নামলেন কালো দাড়িওয়ালা, মোটা ফ্রেমের চশমা পরা একজন ছোটখাট ভদ্রলোক। পেছনে নামল তার চেয়ে ইঞ্চিখানেক লম্বা একটা মেয়ে। দেখতে মোটেও ভাল নয়। চুল খুব পাতলা। ওগুলো দিয়েই সরু সরু দুটো বেণি করেছে। পরনে স্কুল ড্রেসের মত পোশাক। তার ওপর নীল ওভারকোট। কোমরে গাঢ় নীল বেল্ট। মাথায় রঙিন ব্যান্ড। আর বাঁ দিকে একটা ব্যাজ লাগানো গাঢ় নীল ফেল্ট হ্যাট।
বেশ কিছুটা দূরে দাঁড়িয়েও মেয়েটার স্পষ্ট জোরাল শব্দ কানে এল কিশোরের, না, বাবা, কুলি লাগবে না। আমরাই পারব। তুমি ছোট ব্যাগটা নাও, আমি বড় সুটকেসটা নিচ্ছি। দাও, ছাড়ো, আমার হাতে দাও।
মেয়েটার মুরুব্বী মুরুব্বী ভঙ্গি ভাল লাগল না কিশোরের।
চারপাশে তাকাতে লাগল মেয়েটা। আপনমনেই বলল, আমাদের না নিতে আসার কথা ছিল…
সাইকেল রেখে এগিয়ে গেল কিশোর। ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি কি মিস্টার বেবি?
বেবি! ও, হ্যাঁ হ্যাঁ, আমিই..তা বাবা, শুধু বেবি তো নই, গ্রেগাবেবিরন, জবাব দিলেন ছোটখাট, দাড়িওয়ালা ভদ্রলোক।
চাবুকের মত শপাং করে উঠল মেয়েটার কণ্ঠ, ইয়ার্কি মারা হচ্ছে নাকি?
না না, ইয়ার্কি মারব কেন? বড় নাম তো, কঠিন, তাই…
ছোট করতে গিয়েছিলে। কারও নাম ছোট করা যে অভদ্রতা, এটাও জানো না? কক্ষনো আর কাউকে এভাবে ডাকতে যাবে না, অন্তত বাবার বয়েসী কাউকে। নাম কি তোমার?
মুখের হাসি নিভে গেছে কিশোরের। কি-কি-ক্বিশোর পাশা। সুটকেসটা নেয়ার জন্যে হাত বাড়াল।
দিল না মেয়েটা। না, আমিই পারব। এটাতে বাবার দামী দামী গুবরেপোকাগুলো আছে। ভেঙে ফেললে গেল।
সুটকেস ভাঙবে কি করে?
আরে বুদ্ধু, সুটকেসের ভেতরে কাঁচের বাক্স আছে। ওটা ভাঙবে।
ও, তাহলে তোমার কাছেই থাক, মিস এলিজা গ্রেগাবেবিরন।
থাক, আমাকে আর পুরো নাম নিয়ে ডাকতে হবে না। আমি বাবার বয়েসী নই। শুধু এলিজা বললেই চলবে।
ট্যাক্সি ডাকব?
ডাকো। গুবরেপোকা সহ বাবাকে তুলে দিই। আমি ট্যাক্সিতে উঠতে পারি। কেমন বদ্ধ বদ্ধ লাগে। তোমার সঙ্গে হেঁটে হেঁটেই যাব। বেশি দূরে নাকি?
ততটা নয়। হেঁটে যাওয়া যায়। কিন্তু আমি তো সাইকেল নিয়ে এসেছি।
তাহলে সাইকেলে চেপেই যাব। সামনে ডাণ্ডায় বসে, কিংবা পেছনের ক্যারিয়ারে। চালাতে পারবে তো? না পারলে চিন্তা নেই। আমি পারব। দুজন তিনজন নিয়ে চালিয়ে অভ্যেস আছে আমার।
মেয়েটার চ্যাটাং চ্যাটাং কথায় মনে মনে চটে গেলেও মুখে ভাবটা প্রকাশ পেতে দিল না কিশোর। একটা ট্যাক্সি যেতে দেখে হাত তুলল। মিস্টার গ্রেগকে তাতে তুলে দিল। সুটকেসটা কোনমতেই সীটের ওপর কিংবা মেঝেতে রাখতে দিলেন না তিনি, নিজের হাঁটুর ওপর রেখে শক্ত করে ধরে রাখলেন। ব্যাগটা মেঝেতে রেখে কোথায় যেতে হবে ড্রাইভারকে ঠিকানা বলে দিল কিশোর।
চলে গেল ট্যাক্সি। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল এলিজা। যাক, বাঁচা গেল। এখন। ধীরে সুস্থে যাওয়া যাবে। এই, কাছাকাছি খাবারের দোকান আছে নাকি? নাস্তা করেছি সেই সকাল সাতটায়, খিদেয় পেট জ্বলছে আমার।
খানিক দূরে দাঁড়িয়ে আছে মুসারা। প্রায় সব কথাই কানে যাচ্ছে তাদের। ওদের দিকে তাকাল কিশোর। ওর কাচুমাচু মুখ দেখে হাসতে শুরু করল ওরা। এলিজার, দিকে ফিরে বলল কিশোর, আছে, দোকান। আগে এসো আমার বন্ধুদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই।
সবাইকে হ্যালো বলল এলিজা। জিনার পাশে দাঁড়ানো রাফিয়ানকে দেখিয়ে, বলল, তোমার কুকুর নাকি?
তো আর কার?
জিনার মেজাজ জানা আছে কিশোরের। ছেড়ে কথা কইবে না এলিজাকে। ওর মুরুব্বীগিরি সওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। রাস্তার ওপরই না একটা কেলেঙ্কারি ঘটে যায় এ জন্যে তাড়াতাড়ি বলল, ঠিক আছে, তোমরা যাও এখন। আমি এলিজাকে নিয়ে চা দোকানে যাচ্ছি। তারপর বাড়ি যাব।
.
০৩.
সারাটা দিন কিশোরের ফোনের অপেক্ষা করল মুসারা, কিন্তু ফোন এল না। বিকেল বেলা চা খেতে বসেছে, এই সময় হাঁপাতে হাপাতে ঘরে ঢুকল কিশোর!
রান্নাঘর থেকে ট্রে হাতে ঢুকছিলেন মিসেস বেকার, কিশোরকে দেখে থমকে দাঁড়ালেন। বড় বড় হয়ে গেল চোখ। এ কি পোশাক পরেছু! ভেজা কেন? বৃষ্টি হচ্ছে নাকি?
সরি, মিসেস বেকার, দৌড়াতে বেরিয়েছিলাম। ওই পোশাকেই চলে এসেছি। বৃষ্টি না, ঘাম।
ডল বলল, কিশোর ভাই বেশি মোটা হয়ে যাচ্ছে তো, স্লিম হওয়ার জন্যে ব্যায়াম করে।
ও, আমি তো ভাবলাম… টেবিলের দিকে এগোলেন মিসেস বেকার, এসো। চা খাও।
ধপ করে একটা চেয়ারে বসে পড়ল কিশোর।
মিসেস বেকার চলে যেতে মুসা বলল, এত তাড়াতাড়ি দৌড়াতে বেরোলে যে?
সাধে কি আর বেরোই, গুঙিয়ে উঠল কিশোর। এলিজার হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্যে পালিয়েছি। একনাগাড়ে কথা বলতে থাকে ও, মাথা ধরিয়ে দেয়। যেখানে যাই, পিছে পিছে যায়। আর কোন উপায় না দেখে শোবার ঘরে গিয়ে ঢুকলাম। সেখানেও বাঁচতে পারলাম না। ঠিক গিয়ে হাজির। দরজায় থাবা মারতে শুরু করল। শেষে খুলে দিলাম। বলল, একটা বই নিতে এসেছে। বুককেসে রাখা বইগুলো ঘটতে শুরু করল।
ধাক্কা মেরে বের করে দিলে না কেন? রেগে উঠল জিনা।
দিতাম না ভেবেছ? কিন্তু কিছু করলেই তো পারকার আঙ্কেল যাবেন। খেপে…উহ, কি যে বিপদে পড়লাম!
এই বাবাটাই হলো যত যন্ত্রণার মূল! নিজে উন্মাদ, মানুষকেও পাগল বানিয়ে ছাড়বে। কাউকে শান্তিতে থাকতে দেবে না।
তারপর কি করলে? জানার জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছে রবিন। তাড়ালে কি করে?
তাড়াতে কি আর পারি, কিশোর বলল। এ বই দেখে, ও বই ওল্টায়, সেটা ঘাটে, আর সেই সঙ্গে বকর বকর। চালিয়েই গেল। বিরক্ত হয়ে বিছানা থেকে নেমে পড়লাম। অবেলায়ই দৌড়ানোর জন্যে তৈরি হতে লাগলাম। আমাকে রানিং সুট পরতে দেখে জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাচ্ছি। বললাম, দৌড়াতে। সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, সে-ও দৌড়াবে। নিজের ঘরে গেল কাপড় বদলাতে। এই সুযোগে নিচে নেমে বাগানে, গেট পেরিয়ে রাস্তায়; তারপর দৌড়, দৌড়, পেছন ফিরে তাকালাম না আর।
হেসে ফেলল মুসা, যদি এসে ধরে ফেলে এই ভয়ে?
মাথা ঝাঁকাল কিশোর।
ভাল বিপদেই পড়েছ।
বেশি দেরি করতে পারব না, করুণ কণ্ঠে বলল কিশোর। বেরোনোর সময় কেরিআন্টি দেখেছেন। দৌড়ানোর পোশাক দেখে বেরোতে বাধা দেননি, তবে তাড়াতাড়ি ফিরে যেতে বলেছেন। একা থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে যদি আঙ্কেলদের বিরক্ত করতে যায় এলিজা, এই ভয়ে।
সবাই সহানুভূতি জানিয়ে নানা কথা বলল কিশোরকে, কিন্তু এলিজার হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় বাতলাতে পারল না। শেষে কিশোর বলল, এই অত্যাচার সহ্য করা যাবে না। একটা বুদ্ধি বের করতেই হবে।
বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ি ফিরে চলল সে।
সেদিন শনিবারের সন্ধ্যা। পরদিন গির্জায় যেতে হবে বলে আর কিশোরকে বিরক্ত করার সময় পেল না এলিজা। সকাল সকাল ঘুমোতে গেল।
পরদিন সকালে উঠে গির্জায় গেল। ধর্মীয় রীতিনীতিগুলো মোটামুটি মেনে চলে সে। দুপুরে খাওয়ার পর চিঠি লিখতে বসল। তারপর যেই কিশোরকে বেরোনোর জন্যে তৈরি হতে দেখল, অমনি ডবল বেনি ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাচ্ছ?
কাজ আছে, জবাব দিল কিশোর।
ইকটু দাঁড়াও। চিঠিটা হয়ে গেছে আমার। তোমার সঙ্গে আমিও বেরোব।
ওকে এড়ানোর সুযোগটা পেয়ে গেল কিশোর। বেশ, তাড়াতাড়ি শেষ করো। এমনিতেই পোস্ট অফিসে যেতে হবে আমাকে, কেরিআন্টি একটা চিঠি দিয়েছেন পোস্ট করতে। তোমারটাও করে দিয়ে আমব।
ঠিক আছে। তারপর দুজনে বেড়াতে বেরোব।
চিঠি নিয়ে পোস্ট অফিসে গেল কিশোর। ইচ্ছে করেই ফিরতে দেরি করল। অযথা এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াল। মুসাদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ নেই। নিশ্চয় এখন পড়তে হচ্ছে এদের। গিয়ে ডিসটার্ব করা উচিত হবে না।
এলিজার ওপর ভীষণ রাগ লাগল কিশোরের। কোথায় এখন ঘরে কিংবা বাগানে বসে বই পড়ত সে, তা না, মেয়েটার ভয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে। ভাবতে ভাবতে একটা বুদ্ধি এসে গেল মাথায়। বাড়ি ফিরে এল। বসার ঘরের জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখল এলিজা আছে কিনা। নেই। তারমানে নিজের ঘরে বই পড়ছে কিংবা অন্য কিছু করছে। চট করে জানালার চৌকাঠ ডিঙিয়ে ঢুকে পড়ল সে। রাফিয়ান রয়েছে তার ঘরে, শেকলে বাধা। পারকার আঙ্কেল বেঁধে রাখার হুকুম দিয়েছেন, যাতে যখন তখন ঘরে ঢুকে বিরক্ত করতে না পারে। তাতে সুবিধে হলো কিশোরের। তার সাড়া পেয়ে ডাকাডাকি করে সারা বাড়ি জানান দিতে পারল না কুকুরটা।
চুপচাপ এসে নিজের ঘরে ঢুকে পড়ল কিশোর। দ্রুত ছদ্মবেশ নিয়ে ভবঘুরে সাজল। এলিজার অলক্ষে আবার ঘর থেকে বেরিয়ে, বাগান পেরিয়ে চলে এল ছাউনিতে। সঙ্গে করে বই নিয়ে এসেছে। আরাম করে বসে পড়তে শুরু করল। সে যে ফিরে এসেছে এলিজা জানতেও পারবে না। কোন কারণে যদি ছাউনিতে এসে উঁকি মারে, তাহলে দেখবে একজন ভবঘুরেকে। ধমক ধামক মারবে কিংবা হই-চই করে জোয়ালিনকে ডাকবে। নির্বিবাদে বেরিয়ে যাবে তখন কিশোর।
কিন্তু নির্বিবাদে বেরোনো আর হলো না। কিশোরের অপেক্ষা করতে করতে অস্থির হয়ে উঠল এলিজা। চিঠি পোস্ট করতে এত দেরি? শেষে আর ঘরে থাকতে না পেরে বেরিয়ে এল। কথা না বলে কতক্ষণ থাকা যায়। বাগানে অস্থিরভাবে পায়চারি করল কিছুক্ষণ। একা একা সময় কাটছে না। ছাউনিটা দেখে কৌতূহল হলো। ধীরে ধীরে চলে এল সেখানে।
পায়ের শব্দ শুনে একটা ফুটো দিয়ে উঁকি দিল কিশোর। এলিজাকে দেখে তাড়াতাড়ি ছিটকানি তুলে দিল দরজার।
শুনে ফেলল এলিজা। কৌতূহল বাড়ল তার। ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে দেখল, অচেনা একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে ঘরের মধ্যে। সঙ্গে সঙ্গে চোর চোর বলে চিৎকার শুরু করে দিল সে।
এলিজার ডাক শুনে রাফিও ঘাউ ঘাউ শুরু করল। শেকলে বাঁধা থাকায় আসতে পারছে না।
রান্নাঘরের জানালা দিয়ে উঁকি দিল জোয়ালিন।
কেরিআন্টি শুয়েছেন। বেডরূম থেকে বোধহয় চিৎকার কানে যায়নি তার। স্টাডিতে দরজা-জানালা আটকে বসে থাকা মিস্টার পারকার আর মিস্টার গ্রেগের কানেও নিশ্চয় যায়নি। তাহলে বেরোতেন।
কিন্তু গেল আরেকজন বিশেষ লোকের কানে। কাকতালীয়ভাবে ঠিক এই সময় সেখান দিয়ে যাচ্ছিল ফগর্যাম্পারকট। চোর চোর শুনে একটা মুহূর্ত আর দেরি করল না। গেটের কাছে সাইকেল রেখে ছুটে ঢুকল ভেতরে। দৌড়ে এল ছাউনির দিকে। চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, কই, কোথায় চোর?
ছাউনির মধ্যে! চিৎকার করে বলল এলিজা।
ঝামেলা! দরজায় থাবা মারতে শুরু করল ফগ। এই দরজা খোলো! জলদি! ভাল হবে না বলছি!
খুলে গেল ছিটকানি।
চোরকে জাপটে ধরতে তৈরি হলো ফগ।
কিন্তু বেরোল না চোর।
আস্তে করে পাল্লা ফাঁক করে ভেতরে উঁকি দিতে গেল ফগ। সঙ্গে সঙ্গে তাকে প্রায় ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে ছুটে বেরোল ভবঘুরের পোশাক পরা চোরটা। একদৌড়ে গিয়ে দেয়াল টপকে অদৃশ্য হয়ে গেল ওপাশে।
বিশাল বপু নিয়ে দেয়ালের কাছে যখন পৌঁছল ফগ, কয়েকটা ইট জোগাড় করে তার ওপর উঠে তাকাল অন্যপাশে, চোর ততক্ষণে হাওয়া।
.
০৪.
পরদিন সোমবার সকালে বড় এক প্লেট মাংস ভাজা, আর তিনটে ডিম দিয়ে নাস্তা সারতে বসেছে ফগ, এই সময় বাইরে এসে থামল একটা বড় গাড়ি। সেটার দিকে চোখ পড়তেই হাঁ হয়ে ঝুলে পড়ল তার চোয়াল। কাটা চামচে গাঁথা মাংস গাথাই রইল। ডান হাতটা স্থির হয়ে রইল মাঝপথে, মুখ পর্যন্ত আর পৌঁছাল না।
ঝামেলা! ভাবছে ফগ। এই সাতসকালে শেরিফ এসে হাজির হলেন কেন? কাজের বুয়া মিসেস টারমারিককে ডেকে বলল, শেরিফকে ড্রইংরুমে বসাতে। তারপর তাড়াতাড়ি উঠে ইউনিফর্ম পরতে শুরু করল।
এক মিনিটে পোশাক পরা শেষ করে ড্রইংরুমে ঢুকল। গুড মর্নিং, স্যার। কোন জরুরী কাজ? আমাকে ডাকলেই তো চলে যেতাম।
ফগ, কোন ভূমিকার মধ্যে গেলেন না শেরিফ লিউবার্তো জিংকোনাইশান, এই এলাকায় একটা সাংঘাতিক আসামী এসে ঢুকেছে। জেল পালানো কয়েদী। ভীষণ চালাক। ছদ্মবেশ নেয়ার ওস্তাদ। গোবেল বীচে যে মেলা হচ্ছে, আমার মনে হয় ওখানে কোথাও লুকানোর চেষ্টা করবে। নজর রাখবে সেদিকে। সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়লে সঙ্গে সঙ্গে জানাবে আমাকে।
শেরিফ বাড়ি বয়ে তাকে খবর দিতে এসেছেন, নিজেকে খুব কেউকেটা মনে হলো ফগের। কণ্ঠস্বরটাকে ভারী করে তুলে বলল, মেলাতে নজর রাখতে অবশ্যই যাব, স্যার, তবে ইউনিফর্ম পরে নয়, ছদ্মবেশে। আপনি বোধহয় জানেন না, স্যার, পুলিশ স্কুলে আমি ছদ্মবেশের ওপর স্পেশাল কোর্স করেছিলাম।
তাই নাকি? সন্দেহ জাগল শেরিফের চোখে। কিন্তু তোমার ওই মোটা শরীর লুকাবে কোথায়? পেট? ধরা পড়ে যাবে তো। ব্যায়াম-ট্যায়াম করে চর্বি একটু কমাও না। খাওয়াটাও কমাও।
আহত হলো ফগ। অস্বস্তিতেও পড়ে গেল। স্লিম হওয়ার চেষ্টা তো করছি, স্যার। সকালে দুতিন প্লেটের জায়গায় এক প্লেট শুয়োরের মাংস খাই এখন, দুই হালি ডিমের জায়গায় মাত্র তিনটে…।
হুঁ, হতাশ ভঙ্গিতে মাথা দোলেন শেরিফ। পকেট থেকে একটা খাম বের করলেন, নাও, এতে একটা ফটোগ্রাফ আর কিছু কাগজ আছে। লোকটার স্বভাব চরিত্র সব লেখা আছে। পড়ে নিয়ো।
আগ্রহের সঙ্গে হাত বাড়িয়ে খামটা নিল ফগ। কাগজ বের করে পড়তে লাগল, মাঝারি উচ্চতা…তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, পাতলা গোঁফ…ঠোঁটের ওপর একটা কাটা দাগ…
পড়তে পড়তে সহসা সজাগ হয়ে উঠল ফগ। স্যার, এ লোকটাকে তো দেখেছি আমি কাল!
ভুরু কুঁচকে গেল শেরিফের, কোথায়?
সাংঘাতিক লোক, স্যার! ভয়ঙ্কর! গায়ে মোষের জোর, মোষের মতই লাথি মারে। জাপটে ধরতে গেলাম। আমাকে দশ হাত দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে দৌড়ে পালাল।
আরে কোথায় দেখলে?
চোখগুলো বাঘের মত জুলছিল…না না, নেকড়েবাঘের মত! গোঁফ ছিল। কাপড়-চোপড়ে মনে হচ্ছিল সাধারণ ভবঘুরে। এখন বুঝতে পারছি, ভবঘুরে নয়, ছদ্মবেশে ছিল। ইস, আগে জানলে যতই মোষের শক্তি থাক ওর, ধরে রাখার চেষ্টা করতাম।
ফগ! কঠিন হয়ে উঠল শেরিফের কণ্ঠ, বকবকানি বাদ দিয়ে জলদি বলো আমাকে, কোথায় দেখেছ?।
ঝামেলা!…আঁ, ও, মিস্টার পারকারের বাড়িতে। বাগানের ছাউনিতে ঢুকে বসেছিল। একটা মেয়ে চোর চোর বলে চিৎকার শুরু করল। আমি তখন ওপথেই যাচ্ছিলাম। সাইকেল রেখে ঢুকে পড়লাম বাগানে। ছাউনির সামনে গিয়ে যে-ই বেরোনোর জন্যে ধমক দিলাম, হুড়মুড় করে বেরিয়ে এসে আমাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে…
মিস্টার পারকার…তারমানে জিনাদের বাড়িতে? কি যেন ভাবছেন শেরিফ, কিশোর ছিল নাকি তখন ওখানে?
থমকে গেল ফগ, না, স্যার, ও ছিল না। খোঁজ নিয়েছি। পোস্ট অফিসে গিয়েছিল চিঠি পোস্ট করতে।
হু, চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন শেরিফ। ঠিক আছে, তোমাকে যে কাজটা দিলাম, সেটা করো। আমি যাচ্ছি, কিশোরের সঙ্গে কথা বলতে।
ওর সঙ্গে কথা বলে কোন লাভ নেই, স্যার। ও তখন ওখানে ছিল না। লোকটার কথা কিছু জানাতে পারবে না…
কিন্তু ফগের কথা শোনার জন্যে বসে থাকলেন না শেরিফ। উঠে রওনা দিলেন দরজার দিকে। পেছন পেছন কে এগিয়ে দিতে চলল ফগ।
জিনাদের বাড়িতে এসে দরজার বেল বাজালেন শেরিফ।
খুলে দিল আইলিন। ও, মিস্টার জিংকোনাইশান! গুড মনিং।
আইলিন, কিশোর আছে? জিজ্ঞেস করলেন শেরিফ। আর কাউকে ডাকার দরকার নেই। শুধু ওকেই ডেকে দাও।
বসার ঘরে বসলেন শেরিফ। কয়েক মিনিট পরেই রানিং সুট পরে এসে হাজির হলো কিশোর।
কি, বেরোচ্ছ নাকি? ভুরু নাচালেন শেরিফ।
না, আঙ্কেল। বাইরে থেকে এলাম।
হঠাৎ ব্যায়াম শুরু করলে কেন?
মোটা হয়ে যাচ্ছি আবার। চর্বি কমানো দরকার।
ভাল। ফুগকেও সেই পরামর্শই দিয়ে এলাম। কিশোর, একটা প্রশ্ন করব, সত্যি জবাব দেবে। কাল ছাউনিতে কাকে দেখে গেছে ফগ?
একটা মুহূর্ত দ্বিধা করল কিশোর। তারপর মুখ তুলে বলল, আমাকে, স্যার।
হুঁ, মুখটাকে গম্ভীর করে রাখলেন শেরিফ, আমার ধারণা তাহলে ঠিকই। কিন্তু ছদ্মবেশ নিতে গেলে কেন? ফগকে বোকা বানানোর জন্যে?
না, আঙ্কেল। এলিজার হাত থেকে বাঁচার জন্যে।
এলিজা?
সব কথা খুলে বলল কিশোর।
অনেক কষ্টে হাসি চাপলেন শেরিফ। বললেন, এই ব্যাপার। আর ফগ ওদিকে তোমাকেই কয়েদী সন্দেহ করে বসে আছে।
আমাকে কয়েদী সন্দেহ করেছে!
জেল থেকে এক আসামী পালিয়েছে। খবর পেয়েছি, এ গায়েই এসে ঢুকেছে।
লোকটাকে কোথায় পাওয়া যেতে পারে, কিশোরকে জানালেন শেরিফ। কিশোরের ওপর ভরসা আছে তার। বলা যায়, ফগের চেয়ে অনেক বেশিই আছে। এর আগে অনেকগুলো জটিল কেসের রহস্য সমাধান করে দিয়েছিল কিশোর। পকেট থেকে এক মুঠো কাগজপত্র বের করে বেছে বেছে একটা কাগজ আর একটা ফটোগ্রাফ নিয়ে কিশোরের দিকে বাড়িয়ে ধরলেন, নাও, এগুলোতে লোকটার স্বভাব-চরিত্র আর চেহারার বর্ণনা পাবে। তোমাকেও যে লোকটার কথা জানানো হয়েছে, এটা ফগকে বোলো না। মেলা আর কনফারেন্সে যোগ দেয়ার জন্যে নতুন নতুন লোক আসছে, অচেনা মুখ দেখা যাবে অনেক। তাদের মধ্যে লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করবে নোকটা।
থ্যাংক ইউ, আঙ্কেল, কিশোরের নজর ছবিটার দিকে, আমাকে জানানোর জন্যে অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। লোকটাকে খুঁজে বের করার যথাসাধ্য চেষ্টা করব। আমি। মুসারা তো এ মুহূর্তে আটকে আছে মিস্টার বেকারের বাড়িতে। তদন্তে আমাকে তেমন সাহায্য করতে পারবে না। তবু, যতটা পারা যায়, কাজে লাগানোর চেষ্টা করব।
কিশোর, সাবধান করে দিলেন শেরিফ, ডাকাতির কেসে জেল হয়েছিল। লোকটার। ভীষণ বিপজ্জনক। সাথে পিস্তল- টিস্তলও থাকতে পারে। নজর রাখবে কেবল। কিছু করতে যেয়ো না! চিনতে পারলে সঙ্গে সঙ্গে আমাকে খবর দেবে।
ঠিক আছে, তাই করব, আঙ্কেল।
সোফা থেকে উঠে দরজার দিকে রওনা হলেন শেরিফ। এই সময় ওপর থেকে নেমে আসতে দেখা গেল এলিজাকে।
শেরিফ বেরিয়ে গেলেন।
কিশোরের সামনে এসে দাঁড়াল এলিজা। গোবেল বীচের শেরিফ, তাই না? কেন এসেছিলেন? গতকালকের সেই ভবঘুরেটার কথা জিজ্ঞেস করতে?
হ্যাঁ বেশি কথার মধ্যে গেল না কিশোর। জেলপালানো আসামীটার কথা জানাতে চায় না এলিজাকে।
আমাকে ডাকা উচিত ছিল তোমার, অভিযোগ করল এলিজা। হাজার হোক, ওকে আমিই প্রথম দেখেছি। আমার সাক্ষীর একটা দাম আছে। ছাউনিতে গিয়ে না দেখলে, চোর চোর করে চিৎকার না করলে ওই পুলিশম্যানটা আসত না, জানাজানি হতো না, কালকে সর্বনাশ করে দিয়ে যেত…।
আমাকে এখন বেরোতে হবে, এলিজা, জরুরী কাজ আছে…
জরুরা কাজটা কি?
দৌড়াতে যাব।
একটু আগে না দৌড়ে এলে? জানালা দিয়ে দেখলাম।
দৌড়ানো শেষ হয়নি। আবার যাব।
তাজ্জব ব্যাপার! এক সকালে কবার দৌড়াও?
যা যন্ত্রণা শুরু হয়েছে, দৌড়ানো ছাড়া উপায় কি?
কিশোরের কথা বুঝতে পারল না এলিজা, মানে?
মানেটানে কিছু না। আমি যাচ্ছি।
আমিও যাব। সাগর আর নদীর পাড় দিয়ে দৌড়াতে আমার ভাল লাগে।
আমি ওসব পারাপারে যাচ্ছি না। পাহাড়ের দিকে যাব।
ও, পাহাড় তো আরও ভাল লাগে। এক সেকেন্ড দাঁড়াও। আমি চট করে কাপড়টা বদলে আসি।
মনে মনে নাছোড়বান্দা মেয়েটার হাত থেকে বাঁচার উপায় খুঁজছে কিশোর, বাঁচিয়ে দিলেন কেরিআন্টি। ড্রইংরুমে ঢুকলেন। এলিজা, তুমি এখানে। আমার একটা কাজ করে দেবে?
বড়দের সম্মান করে এলিজা। কোন কিছু করতে বললে না করে না। কি কাজ, আন্টি?।
ফুলের তোড়াগুলো ঠিকমত বেঁধে ফুলদানিতে সাজিয়ে রাখতে হবে। আমি এক হাতে কুলিয়ে উঠতে পারছি না।
সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেল এলিজা। আর এই সুযোগে কিশোর দিল দৌড়। একছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। বাড়ির কোণ ঘুরে এসে জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখল, এলিজা কি করে। বড় একটা কাঁচি হাতে রান্নাঘরের দরজা দিয়ে বাগানে বেরোচ্ছে।
জানালা টপকে ভেতরে ঢুকে পড়ল কিশোর। মুসাকে ফোন করল। যথারীতি খাওয়ায় ব্যস্ত মুসা। রবিন ধরল।
কে, রবিন? বলল উত্তেজিত কিশোর। শোনো, খবর আছে। একেবারে হাতে এসে ধরা দিয়েছে চমৎকার একটা রহস্য। একটু আগে শেরিফ এসেছিলেন।
সংক্ষেপে যত দ্রুত সম্ভব, সব জানাতে লাগল কিশোর।
রান্নাঘরের দরজা দিয়ে বেরোলেও, সামনের দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকল এলিজা। হাতে এক গোছা ডাল সহ ফুল, কেটে এনেছে। কিশোরকে দেখে দাঁড়িয়ে গেল।
কথায় এতই মশগুল কিশোর, এলিজাকে ঢুকতে দেখেনি। পেছনে দাঁড়িয়ে সব। শুনে ফেলল এলিজা। ফোন রেখে কিশোর ঘুরে দাঁড়াতেই বলল, তুমি না বললে কালকের ভবঘুরেটার কথা জানতে এসেছিলেন শেরিফ? এখন রহস্য জোগাড় হলো কোনখান থেকে।
জবাব দিল না কিশোর। চট করে তাকিয়ে দেখে নিল, কেরিআন্টি আছেন কিনা। নেই দেখে সোজা দরজার দিকে রওনা হলো।
এই কিশোর, কোথায় যাচ্ছ? এলিজা ডাকল। আমাকে নিয়ে যাও। ফুলগুলো গোছাতে দশ মিনিটও লাগবে না আমার।
কে শোনে কার কথা। কিশোর ততক্ষণে বেরিয়ে চলে এসেছে দরজা দিয়ে। লাফ দিয়ে রাস্তায় নেমেই দৌড়। বেকারদের ওখানে যাবে। নিজের ওপর ভীষণ রেগে গেছে। টেলিফোনে কথা বলার সময় সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। সমস্ত রাগটা গিয়ে পড়ল এলিজার ওপর। ও-ই বা কেমন মেয়ে? চুরি করে অন্যের কথা শোনে!
.
০৫.
বেকারদের সামার-হাউসে কিশোরের জন্যে অপেক্ষা করছে মুসা, রবিন, জিনা আর ডল। কিশোরকে একা দেখে জিজ্ঞেস করল জিনা, রাফি কই? আনননি?
কি করে আনব? ওর চেন খুলতে গেলেই তো সুযোগ পেয়ে যেত মেয়েটা, পিছু নিত! হাঁপাতে হাঁপাতে জবাব দিল কিশোর। কি ভাবে পালিয়ে এসেছে জানাল।
রাগে মুঠো পাকিয়ে ফেলল জিনা। ধরে কাঁচি দিয়ে ওর বেণি দুটো যদি কুচ করে কেটে দিতে পারতাম এখন, ভাল হত!
তা যখন পারছ না, রবিন বলল, মেজাজ গরম না করে চুপ থাকাই ভাল। বরং রহস্যটার কথা শুনি।
আগের বিকেলে ফগ কি করে বোকা বনেছে, বন্ধুদের জানাল, কিশোর। শুনে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল সবাই।
শেরিফের দিয়ে যাওয়া কাগজ আর ছবিটা বের করল। ছবির ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল সবাই। লোকটার কালো চোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, খোটা জরু, সাদামাঠা নাক, পাতলা ঠোঁট, ওপরের ঠোঁটে নাকের ঠিক নিচে একটা কাটা দাগ।
দাগটার ওপর আঙুল রেখে কিশোর বলল, এটা নিয়েই মুশকিলে পড়বে লোকটা। লুকানোর জন্যে বড় গোঁফের ব্যবস্থা করতে হবে। এমনিতে পাতলা গোঁফ আছে লোকটার, তাতে দাগটা ঢাকা পড়বে না, আলগা নকল গোফ লাগাতে হবে। শুধু গোঁফ লাগালে যদি উদ্ভট লাগে, তাহলে সেটা চাপা দেয়ার জন্যে দাড়িও লাগাতে পারে।
কেউ কিছু বলল না। শোনার জন্যে তাকিয়ে আছে কিশোরের মুখের দিকে।
চুল বেশ ঘন, আর সোজা সোজা, কোকড়া বা আগাগুলো বাকা নয়, বলল সে। সেজন্যে পার্ম করে কোকড়া করে নিতে পারে। আজকাল চুল তুলে পাতলা করে নিয়ে সাময়িকভাবে টাকও বানিয়ে নেয়া যায়। লোকটা ছদ্মবেশের ওস্তাদ। ধরা না পড়ার জন্যে অনেক কিছুই করতে পারে।
তাহলে আর ওর ছবি দেখে লাভ কি আমাদের? রবিনের প্রশ্ন।
হাতের রগগুলো ফোলা, দেখো, মুসা বলল। এগুলো ঢাকবে কি দিয়ে?
দস্তানা পরে নেবে, জিনা বলল।
হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকাল রবিন। তা লোকটার পছন্দ-অপছন্দ কিছু আছে নাকি?
বিড়াল ভালবাসে, জবাব দিল কিশোর। কাগজটাতে লেখা আছে সব। আরও একটা ব্যাপার-অদ্ভুতই বলতে পারো-পোকামাকড়েও খুব আগ্রহ তার।
খাইছে! কলি? মুসা অবাক।
হ্যাঁ, শখের কলিওপটারিস্ট।
কনফারেন্সে যোগ দিতে যাবে না তো! চেঁচিয়ে উঠল জিনা। গুবরেপোকা ভালবাসে বলেই এসেছে গোবেল বীচে?
গোবেল বীচে হয়তো সেজন্যে আসেনি, কিশোর বলল, জেল থেকে পালিয়ে আর কোনদিকে যাওয়ার সুযোগ না দেখে এখানে ঢুকেছে। তবে আছে যখন, এ রকম একটা সম্মেলনে যোগ দেয়ার সুযোগ সে হয়তো হাতছাড়া করবে না।…কে ভাবতে পেরেছিল, জেলখাটা একজন দাগী আসামী গুবরেপোকা তালবাসে!..হ্যাঁ, বাকি রইল লোকটার তীক্ষ্ণ চোখসেটা ঢাকাও কোন ব্যাপার নয়, চশমা পরে নিলেই হলো…
এ খবরটা আগে জানলে, ডল বলল, মিস্টার বেবিকেই সন্দেহ করতাম আমি। লোকটাকে দেখে মোটেও বিজ্ঞানী মনে হয় না। হ্যাট, মাফলার, ভারী কোট, দাড়ি, গোঁফ-একেবারে জেলপালানো ছদ্মবেশী কয়েদী।
ভাল বলেছ তো! মুসা বলল। কিশোরের দিকে তাকাল, লোকটা লম্বা কতখানি?
মিস্টার বেবির সমানই হবে, হেসে বলল কিশোর।
এ কথা এলিজাকে বলতে যেয়ো না, রবিন বলল। বলোনি তো?
না, মাথা নাড়ল কিশোর, বললাম না, রহস্যটা কি জানার জন্যে চাপাচাপি করছিল সে, সেটাই বলিনি। শুধু টেলিফোনে তোমার সঙ্গে কথা বলার সময় যেটুকু শুনেছে।
এলিজার ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে তোমার। মেয়েটার আড়িপাতারও বদস্বভাব আছে। যাকগে, কিশোর, রহস্যের তদন্তটা কি করে শুরু করব?
তোমরা তো আর তেমন কিছু করতে পারবে না, বেরোতেই পারো না। যা করার আমাকেই করতে হবে।
নিজেদের অবস্থার কথা ভেবে মুখ কালো করে ফেলল রবিন। নিজেদেরকে জেলে বন্দি কয়েদী মনে হচ্ছে এখন। কোনখান থেকে শুরু করবে?
এখানে লোকের ভিড়ে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করবে সে, কিশোর বলল। হোটেল কিংবা বোর্ডিং-হাউসে থাকতে যাবে না, জানে, প্রথমেই ওসব জায়গায় হানা দেবে পুলিশ। কোথায় উঠল সেটার খোঁজ না করে বরং দুটো জায়গায় নজর রাখলে। সুবিধে হবে আমাদের জন্যে।
একা তো মেলায়, ডল বল। আরেকটা কোনখানে?
গুবরেপোকার সম্মেলনে, বলে দিল মুসা। তাই না, কিশোর?
গুবরেপোকার সম্মেলন বলে গুবরেপোকাদের সম্মেলন বোঝায়, হেসে শুধরে দিল কিশোর, আসলে পোকা নিয়ে তো হচ্ছে মানুষের সম্মেলন।
তাহলে কি বলব? গুবরেপোকাপ্রেমিক মানুষের সম্মোন?
হ্যাঁ, তা বলতে পারো। তবে বড়ই জটিল। বরং কলিপটাবিস্টদের কনফারেন্স বলা সহজ।
কলি হোক আর গলি হোক, জিনা বলল, যেটার সম্মেলনই হোক, যাব কি করে ওখানে আমাদের নিশ্চয় ঢুকতে দেবে না।
দেবে, কিশোর বলল। যদি মিস্টার বেবির সঙ্গে যাই। আন্টি আর আইলিন যাবে কিনা জিজ্ঞেস করেছিলেন তিনি, মানা করে দিয়েছে দুজনেই। পারকার আঙ্কেল সময় পেলে যাবেন বলেছেন। না গেলেই ভাল। আমরা যেতে পারব।
যদি ছুটি পাওয়া যায়, শুকনো মুখে বলল রবিন।
ছুটির ব্যবস্থা আমি করব, ডল বলল। যেতে না দিলে মার সামনে গিয়ে এমন কান্নাকাটি শুরু করব, বিরক্ত হয়েই শেষে বেরিয়ে যেতে বলবে।
হাসল মুসা, যদি ধমক দিয়ে বলেন?
তাহলেও বেরোব।
কিশোরের দিকে তাকাল জিনা, কবে থেকে তদন্ত শুরু করতে চাও?
আজ থেকেই, কিশোর বলল। আজ মেলায় যাব। কনফারেন্স কাল থেকে শুরু হবে।
কিন্তু আমরা আজ যেতে পারব কিনা বলতে পারছি না। সব নির্ভর করছে আমাদের দুটি পাওয়া না পাওয়ার ওপর।
এলিজাকে নিয়ে আমারও সমস্যা হবে। আমাকে বেরোনোর জন্যে তৈরি হতে দেখলেই সে সঙ্গে যেতে চাইবে। কেরিআন্টিও নিতে বলবেন। মেয়েটার হাত থেকে মুক্তির কোন উপায়ই দেখতে পাচ্ছি না! চালাকি করেও পার পাওয়া যাচ্ছে না। আচ্ছা এক মুশকিলে পড়লাম!
তোমার নাকি এত বুদ্ধি, কিশোরভাই, ডল বলল, ওকে এড়ানোর জন্যে কিছুই কি করতে পারো না?
দেখি, নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল কিশোর, ভাবতে হবে!
মেলায় গেলে রাফিকে নিয়ে যেয়ো, অনুরোধ করল জিনা। আমরা গেলে ওর সঙ্গে দেখা হবে।
আচ্ছা, নেব।
০৬.
বাড়ি ফিরে রান্নাঘরের জানালা দিয়ে উঁকি দিল কিশোর। ফিসফিস করে আইলিনকে জিজ্ঞেস করল, এলিজা কোথায়?
মুচকি হাসল আইলিন। ওপরে।
প্লীজ, আমার ঘর থেকে একটা বই এনে দাও। আমি যে এসেছি, আইলিনকে বোলো না।
হাসিটা বাড়ল আইলিনের। কি বই?
নাম বলল কিশোর।
মাথা ঝাঁকিয়ে চলে গেল আইলিন। কয়েক মিনিট পর ফিরে এল।
আইলিনকে ধন্যবাদ দিয়ে বইটা নিয়ে চুপচাপ ছাউনিতে চলে এল কিশোর। রাফিয়ান চেঁচামেচি করে এলিজাকে জানান দিতে পারে, সেজন্যে ওর সামনেও পড়ল না।
দুপুর পর্যন্ত নিরাপদেই বই পড়ে কাটিয়ে দিল।
লাঞ্চের আগে আগে ঘরে ঢুকল সে। কেরিআন্টি জিজ্ঞেস করলেন, এতক্ষণ কোথায় ছিলি?
বাড়িতেই তো, অবাক হওয়ার ভান করল কিশোর।
বাড়িতে কোথায়? দেখলাম না তো।
ছাউনিতে। বই পড়ছিলাম।
স্থির দৃষ্টিতে কিশোরের ছিকে তাকিয়ে রইলেন কেরিআন্টি। কি যেন ভাবলেন। তারপর নীরবে কাঁধ ঝাঁকিয়ে চলে গেলেন রান্নাঘরের দিকে।
ওপর থেকে নেমে এসে কিশোরকে দেখতে পেয়েই ঘ্যানর-ঘ্যানর শুরু করল এলিজা। ও কোথায় ছিল, কি করছিল, তাকে না নিয়ে কেন গেল-একশো একটা প্রশ্ন : এড়ানোর একটাই উপায়-চুপ করে থাকা। তা-ই রইল কিশোর।
আজ বিকেলে মেলায় যাচ্ছি আমরা, লাঞ্চের টেবিলে কিশোরের দিকে তাকিয়ে ঘোষণা করল এলিজা।
ভাল, শান্তকণ্ঠে বলল কিশোর, যদিও বুকের ধুকপুকানি বেড়ে গেছে তার।
সাবধান, হুপলা স্টলে গিয়ে রিঙ ছুঁড়ো না কিন্তু।
কেন? অবাক হলো কিশোর।
ওরা সব ঠগ রিঙগুলো ইচ্ছে করেই ছোট বানায়, যাতে পুরস্কারের জন্যে সাজিয়ে রাখা জিনিসগুলোর কোনটাতেই না ঢোকে। ঢুকলেই তো ওটা দিয়ে দিতে হবে, ওদের লস।
রিঙ ছুঁড়ে বহুবার আমি বহু জিনিস পেয়েছি। তুমি পারো না বলেই পাও না। ছোঁড়ার কায়দা আছে।
মিস্টার পারকার এলেন মিস্টার গ্রেগকে সঙ্গে করে। রান্নাঘর থেকে ট্রে হাতে ঢুকলেন কেরিআন্টি।
ভারী লেন্সের ভেতর দিয়ে কিশোর আর মেয়ের দিকে তাকিয়ে দরাজ হাসি। হাসলেন মিস্টার গ্রেগ, বাহ্, চমৎকার জমিয়ে নিয়েছ দেখছি। খুব ভালই কাটছে তোমাদের। সকালে কি কি খেললে?
বাবা, কড়া গলায় মুখ ঝামটা দিল এলিজা, এমন করে কথা বলো যেন আমার বয়েস সাত, আমি একটা খুকি। কোন খেলা খেলিনি। সত্যি কথাটা হলো, সকাল থেকে প্রায় দেখাই হয়নি কিশোরের সঙ্গে আমার।
তাই নাকি? চট করে কথাটা ধরলেন মিস্টার পারকার খুব খারাপ কথা। কিশোর, এলিজা আমাদের মেহমান, মনে রাখা উচিত তোমার।
আমিও আপনাদের মেহমান-বলতে গিয়েও ঝামেলা বাধার ভয়ে বলল না। কিশোর।
ব্যাপারটা বোধহয় আঁচ করতে পারলেন কেরিআন্টি; প্রসঙ্গটা চাপা দেয়ার জন্যে বললেন, খাওয়া শুরু করো। ঠাণ্ডা হয়ে গেলে আলুগুলো আর মচমচে থাকবে না।
প্লেটে একগাদা আলুভাজা তুলে নিলেন মিস্টার গ্রেগ। অন্য সব প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে মুহূর্তে চলে এলেন গুবরেপোকা আর কনফারেন্সের কথায়। হাপ ছেড়ে বাঁচল কিশোর।
তোমাদের টাউন হলে মীটিংটা কেমন হবে ভাবছি, কিশোরের দিকে তাকিয়ে বললেন তিনি। কোন গণ্ডগোল না হলেই বাঁচি, অনেক নামী-দামী লোক আসবে।
কারা কারা? আগ্রহী হয়ে উঠল কিশোর।
এই তো, যেমন ধরো জেফরি জেফারসন। ক্রস-ভেইন থ্রী-স্পট ম্যাকলিং বীটল অভ পেরুভিয়ার বিশেষজ্ঞ তিনি। দারুণ লোক, সত্যি অসাধারণ। একবার পুরো সাতটা দিন জলাভূমিতে গুবরেপোকার গর্তের সামনে উপুড় হয়ে পড়ে ছিলেন।
মিস্টার পারকার বিজ্ঞানী হলেও এ সব পোকামাকড় পছন্দ করেন না। অসাধারণ বলছ কি হে? ও তো একটা পাগল।
কিছু মনে করলেন না মিস্টার গ্রেগ। সেটা তোমার মনে হচ্ছে। ওঁর মত। ভদ্রলোক কোটিতে একটা পাবে না। কিশোরের দিকে তাকালেন তিনি, তারপর রয়েছেন ডরোথি কফিন। বিশ্বাস করো আর না-ই করো, তিব্বতের স্কালকিং হাঞ্চ গুবরেপোকার চুরাশিট। ডিমে তা দিয়ে বাচ্চা ফুটিয়েছেন তিনি।
মুরগীর মত তা দিয়েছেন! কিশোর অবাক।
আরে না না, নিজে বসে কি আর দিয়েছেন? একটা গরম বাক্সে রেখে দিয়েছিলেন। কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপারটা হলো, চুরাশিটা ডিম থেকে বেরিয়েছিল চুরাশি দুগুণে একশো আটষট্টিটা ছানা-অথচ বেরোনোর কথা চুরাশিটা। অবাক লাগছে না?
অবাক লাগবে কেন? যমজ হয়েছে আরকি, জবাব দিল কিশোর।
এই আলোচনাটা বন্ধ করলে হয় না? পোকামাকড়ের কথা শুনতে ভাল লাগছে না কেরিআন্টির। খাবারের মধ্যেও পোকা দেখা শুরু করব আমি।
সরি, মিসেস পারকার, মিস্টার গ্রেগ বললেন।
কিন্তু কিশোরের আগ্রহ কমেনি। কনফারেন্সে আর কে কে আসবে, মিস্টার গ্রেগ?
অনেকেই আসবেন, মাই বয়, কজনের কথা বলব? কিশোরের আগ্রহ খুশি করল মিস্টার গ্রেগকে। আলতু-ফালতু লোক নয় কেউ, সবাই বিশেষজ্ঞ।
আপনি তাদের সবাইকে চেনেন?
না, সবাইকে চিনি না। লিস্ট দেখেছি। নামের পাশে যে সব ডিগ্রি লেখা রয়েছে, তাতে বোঝা যায় কেউ কাঁচা লোক নয়।
লিস্টটা কোথায়? দেখা যাবে?
দিচ্ছি। পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে নামের তালিকাটা বের করলেন মিস্টার গ্রেগ। কনফারেন্সের ব্যাপারে খুব ইনটারেস্ট দেখা যাচ্ছে তোমার। যাবে নাকি? এমনিতে তো ঢুকতে দেবে না, তবে আমি সঙ্গে নিয়ে গেলে দেবে।
কিশোরের জন্যে এটা সুখবর। অবশ্যই যাব। লিস্টটা দেয়ার জন্যে ধন্যবাদ দিল মিস্টার গ্রেগকে। কনফারেন্স নিয়ে আলোচনা করে রীতিমত খাতির জমিয়ে ফেলল তার সঙ্গে। শেষে অদ্ভুত একটা প্রস্তাব দিয়ে বসল তাঁকে, আজ বিকেলে মেলায় যাচ্ছি আমরা, মিস্টার গ্রেগ। আপনার কনফারেন্স তো কাল। হাতে সময় থাকলে চলুন না আজ আমাদের সঙ্গে, রাউন্ডএবাউটে চড়তে কেমন লাগে দেখবেন।
কিশোরের মতলবটা বুঝতে পারছেন না কেরিআন্টি। মিস্টার গ্রেগের মত একটা বিরক্তিকর চরিত্রের সঙ্গে তার এই গায়ে পড়া খাতির অবাক করল তাঁকে।
অবাক কিশোরও হলো, যখন নির্দ্বিধায় জানিয়ে দিলেন মিস্টার গ্রেগ, আমার কোন আপত্তি নেই। সেই কবে ছেলেবেলায় চড়েছি, ভুলেই গেছি। আজ সেটা মনে করব।
.
০৭.
মেলার গেটে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে জিনা, মুসা, রবিন আর ডল দেখল মিস্টার গ্রেগকে সঙ্গে করে নিয়ে আসছে কিশোর। মহাবিরক্তি উৎপাদনের জন্যে এক এলিজাই যথেষ্ট, তার ওপর আবার তার বাবা! কিশোরের উদ্দেশ্যটা কি?
মস্ত বোকামি হয়ে গেছে! এক ফাঁকে চুপি চুপি রবিনকে জানাল কিশোর। আসলে একটু রসিকতা করতে চেয়েছিলাম, তার খেসারত দিতে হচ্ছে। আমি ভেবেছিলাম, আসতে বললে পারকার আঙ্কেলের মত হেসে উড়িয়ে দেবেন, কিন্তু চলে যে আসবেন কল্পনাই করিনি। তিনি না এলে তার মেয়েকেও কোন ফাঁকে ফেলে চলে আসতে পারতাম।
কিন্তু সেটা আর হলো না, হতাশ কণ্ঠে বলল রবিন। ভোগান্তির চূড়ান্ত হবে এখন আমাদের। মেলা দেখা খতম।
মেলা দেখতে কিন্তু আসিনি আমরা, মনে করিয়ে দিল কিশোর। এসেছি মেলা দেখার ছুতোয় লোকটাকে খুঁজতে।
সাধারণ মেলা। একটা রাউন্ডএবাউট, একসারি দোলনা, হুপলা স্টল, একটা শূটিং রেঞ্জ, কেক আর মিষ্টির দোকান, আর কিছু ছোটখাট সাইড-শোর ব্যবস্থা আছে। ওগুলোর আশপাশ দিয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগল গোয়েন্দারা। হুপলা স্টলে ভাগ্য পরীক্ষা করে দেখল। এলিজার কথাই যেন ঠিক, কোন জিনিসেই রিঙ পরাতে পারল না ওরা।
বলেছিলাম না, সব ফাঁকিবাজি, রিঙগুলো ছোট করে বানানো, মাথা সোজা করে বলল এলিজা। খামাখা আর পয়সা নষ্ট কোরো না।
ওর কথা শুনে ফেলল স্টল-মালিকের ছেলেটা এগিয়ে এসে বলল, মারতে পারো না, সেটা বলো। কোন ফাঁকিবাজি নেই। এই দেখো। কোনটাতে ফেলব? আট-দশটা রিঙ নিয়ে একে একে ছুঁড়তে লাগল। সে। প্রতিটা রিঙই লক্ষ্যভেদ করল। এলিজার দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচাল। কি বুঝলে? মারার কায়দা জানো না, তাই পারোনি।
লাল হয়ে গেল এলিজা। কথা জোগাল না মুখে।
সবচেয়ে বেশি মজা পাচ্ছেন মিস্টার গ্রেগ। হুপলা খেললেন। লজেন্স কিনে চুষতে লাগলেন। এলিজাকে সঙ্গে নিয়ে দোলনায় চড়াও রাদ দিলেন না।
কিছুতেই তো ওকে সরানো যাচ্ছে না, কি করি? জোরে নিঃশ্বাস ফেলল কিশোর। সন্দেহজনক কাউকে চোখে পড়েছে তোমাদের?
নাহ্, মাথা নাড়ল রবিন। চলো তো, ওই ভাঁড়ের তাবুটাতে গিয়ে দেখে আসি।
তেমন কিছু দেখার নেই ওখানে। তবে ভাঁড়কে দেখতে দেখতে হঠাৎ সচকিত হয়ে উঠল কিশোর। সেটা লক্ষ করল রবিন। জিজ্ঞেস করল, কি হলো?
ভাল করে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখো, রবিনের কানে কানে বলল কিশোর। নাক আর ঠোঁটের মাঝে এত গাঢ় করে লাল রঙ দিয়েছে কেন? দাগ ঢাকার জন্যে?
হতে পারে! লোকটার হাতের দিকে তাকাল রবিন। দস্তানা পরা। রগ ফোলা কিনা তা-ও বোঝা যাচ্ছে না।
লোকটার দিকে তাকিয়ে আছে কিশোর। ছবির লোকটার মতই ভাডের চোখ দুটোও তীক্ষ্ণ। চুলের রঙ বা ধরন বোঝা যাচ্ছে না, টুপির নিচে ঢাকা থাকায়। উচ্চতাটাও মিলে যায়। মাঝারি উচ্চতার লোক সে।
আমাদের সন্দেহের তালিকায় রাখতে হবে একে, রবিন বলল। এটাই শেষ? নাকি আরও দুতিনজনকে দেখবে?
দেখব। ভাঁড়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আরেকবার দাগটা খুঁজল কিশোর। রঙের জন্যে বোঝা যাচ্ছে না। রবিনের হাত ধরে টেনে নিয়ে এল পাশের চায়ের স্টলটায়।
চা খাবে? জিজ্ঞেস করল স্টলওয়ালা।
দিন, মাথা কাত করল কিশোর। তাকিয়ে রইল লোকটার মুখের দিকে। দাগ নেই। পাশের ভাড়ের তাবুটার দিকে হাত তুলে জিজ্ঞেস করল, ওর নাম কি জানেন?
পুরো নাম জানি না। ডাকনাম ডক, কিশোরের হাতে চায়ের কাপ ধরিয়ে দিল চা-ওয়ালা। ওকে আগে কখনও দেখিনি।
মেলায় মেলায়ই ঘোরে নিশ্চয়?
কি করে জানব? তবে মেলা ছাড়া ভাঁড়ের খেলা আর কোথায় দেখাবে? আরেকজন খদ্দের দেখে তার দিকে এগিয়ে গেল চা-ওয়ালা। ফিরে তাকিয়ে কিশোরকে বলল, ওকেই গিয়ে জিজ্ঞেস করো না।
কথাটা মন্দ বলেনি চা-ওয়ালা। কিন্তু এখন কথা বলার সময় নেই ওদের কারোরই। ব্যস্ত। আগামী দিন সকালে এসে ভাড়ের সঙ্গে কথা বলবে, ঠিক করল কিশোর। তখন হয়তো ভাড়ের পোশাকেও থাকবে না লোকটা, মুখে রঙ থাকবে না, কাটা দাগ থাকলে চোখে পড়বে।
চা খেতে ভাল লাগল না। দুজনেই ঢেলে ফেলে দিয়ে শূটিং রেঞ্জের দিকে চল।
চেয়ারে বসে টিকিট বিক্রি করছে এক বুড়ি। মাঝে মাঝে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাচ্ছে শূটারদের দিকে। ওদের গুলি আর এয়ারগান সরবরাহ করছে একটা ছেলে। দুই গোয়েন্দা তাকিয়ে থাকতে থাকতেই ওর পাশে এসে দাঁড়াল যুবক বয়েসী একটা লোক। ছেলেটাকে সাহায্য করতে লাগল।
রবিনের গায়ে কনুইয়ের গুঁতো দিল কিশোর। ছবির সঙ্গে অনেক মিল লোকটার। তীক্ষ্ণ চোখ, মোটা ভুরু, ঘন চুল। তবে নাকের নিচে দাগ দেখা গেল না।
নিচু স্বরে কিশোর বলল, না, এ আমাদের লোক নয়।
মাথা ঝাঁকাল রবিন, দাগ নেই। হাতের রগও ফোলা নয়।
সরে আসার সময় চেয়ারে বসা বুড়ি টিকিট বাড়িয়ে ধরল ওদের দিকে, ফ্যাঁসফেঁসে শ্লেষ্মাজড়িত কণ্ঠে বলল, শূটিং করবে? দেখোনা ভাগ্য পরীক্ষা করে।
মাথা নেড়ে মানা করল কিশোর।
বুড়ির দিকে তাকিয়ে দুঃখ লাগল রবিনের। নিশ্চয় কমিশনে কাজ করছে। এতই অসহায় মনে হতে লাগল বুড়িটাকে, একবার মনে হলো শুধু ওর হাতে দুটো পয়সা তুলে দেয়ার জন্যেই একটা টিকেট কাটে। বয়েসের ভারে কুঁচকানো মুখের চামড়া, অসংখ্য ভাঁজ পড়েছে। গায়ে-মাথায় জড়ানো শালটাও যেন তারই মত পুরানো।
দোলনাগুলোর কাছে লালমুখো এক লোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল ওরা। লাল গোঁফ, লাল দাড়ি। গলায় জড়ানো ময়লা নীল একটা মাফলার। মাথার নীল টুপিটা কপালের ওপর টেনে দেয়া। গায়ের কোটটা অতিরিক্ত টাইট। প্যান্টটাও খাটো। অন্য কারও পোশাক পরে এসেছে যেন। কেমন হাস্যকর লাগছে ওকে। লোকে পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে।
থমকে দাঁড়াল কিশোর। ফিসফিস করে রবিনকে বলল, চিনতে পারছ?
মাথা নাড়ল রবিন।
নাহ, ভাল গোয়েন্দা কোনদিনই হতে পারবে না! ঝামেলাকে চিনতে পারছ না?
ফগ!
চুপ! আস্তে! মুসাদের ডেকে নিয়ে এসোগে।
একটা তাঁবুর পাশে দাঁড়িয়ে ফগের অলক্ষে তাকে দেখতে লাগল ওরা।
দোলনার সামনে দাঁড়িয়ে গভীর মনোযোগে কি যেন দেখছে ফগ। দুষ্টবুদ্ধি খেলে গেল মুসার মাথায়। ফগের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। বিনয়ের সঙ্গে জিজ্ঞেস করল, কটা বাজে, স্যার?
ভুরু কুঁচকে মুসার দিকে তাকাল ফগ। ঘড়ি দেখল। চারটে। যাও, ভাগো! এমন জোরে ধমকে উঠল সে, চমকে গেল মুসা।
থ্যাংক ইউ, স্যার, বলে হাসতে হাসতে সরে এল অন্যদের কাছে।
মনে মনে সন্তুষ্ট হলো ফগ। ভাবল, বিচ্ছ ছেলেটা ওকে চিনতে পারেনি। তারমানে ওর ছদ্মবেশ সফল হয়েছে। মনের আনন্দে গোঁফে চাড়া দিতে গিয়ে মনে পড়ল, নকল গোঁফ, টান লাগলে খুলে যাবে। হাত সরিয়ে আনল তাড়াতাড়ি।
মুসার পর গেল জিনা। সঙ্গে রাফি। ফাঁকে দেখেই ঘাউ ঘাউ করে উঠল কুকরটা। চেন ধরে তাকে আটকাল জিনা। চুপ থাকতে বলল। মেলার মধ্যে গোলমাল করলে বের করে দেবে দারোয়ান।
আড়চোখে ওদের দিকে তাকাল ফগ। ঠেলে বেরোনো গোলআলুর মত গোল চোখে ভয় আর বিরক্তি। কিন্তু ছদ্মবেশ ফাস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় কিছু বলতেও পারছে না।
হে মিস্টার, জিনা জিজ্ঞেস করল, আপনি কি জানেন, মেলা কটার সময় বন্ধ হবে?
সাড়ে দশটায়। সরো, কুত্তা সরাও তোমার। কামড়ে দেবে তো। মেলা কর্তৃপক্ষের কাছে নালিশ করব আমি! মাথা ঝাঁকি দিয়ে কথা বলতে গিয়ে তার আলগা লাল গোঁফের একটা পাশ খুলে গেল। তাড়াতাড়ি আঙুল দিয়ে টিপে ধরে আড়চোখে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল, জিনা ওকে চিনতে পারল কিনা।
কিন্তু জিনার মুখে চেনার কোন লক্ষণ নেই। নিরীহ স্বরে বলল, রাফিকে ভয়। পাবার কোন কারণ নেই, মিস্টার। গায়ের হাঁদা পুলিশম্যান ঝামেলার্যাম্পারকট ছাড়া আর কাউকে কামড়াতে যায় না সে। বলে আর দাঁড়াল না। সরে এল। নীরব হাসিতে ফেটে পড়ছে।
ভয়ানক রাগে জ্বলে উঠল ফগের মুখ। ঠাস করে চড় মারার ইচ্ছেটা বহু কষ্টে রোধ করল। শেরিফের প্রশ্রয় পয়েই ছেলেমেয়েগুলো এতটা বেয়াড়া হয়েছে। ওর হাতে ছেড়ে দিলে কবে সিধে করে ফেলত। নিজের অসহায়ত্বে অজান্তেই ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস বেরিয়ে এল তার। চাকরির ওপর ঘেন্না ধরে গেল।
এরপর এল রবিন। ফগের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় নিচু হয়ে কি যেন তোলার ভঙ্গি করল। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে একটা বোতাম দেখিয়ে বলল, এ বোতামটা কি আপনার, স্যার?
মাথা নাড়ল ফগ। অনেকটা শান্ত হয়ে এসেছে। তিন-তিনটা বিচ্ছু এল, কেউ তাকে চিনতে পারেনি ভেবে রাগটা কমে গেছে। না, থোকা, আমার না। মেলা দেখতে এসেছ বুঝি? কেমন লাগছে?
খুব ভাল।
রবিন ফিরে এলে কিশোর গিয়ে দাঁড়াল ফগের কাছে। তীক্ষ্ণ চোখে নিচের দিকে তাকিয়ে কি যেন দেখতে লাগল। মুখ তুলে জিজ্ঞেস করল, কিছু মনে বরবেন না, স্যার। আপনার পায়ে ওগুলো পুলিশের বুট মনে হচ্ছে। চুরি করেছেন নাকি?
চমকে গেল ফগ। মনে মনে ঝাড়পেটা করতে লাগল নিজেকে। ছদ্মবেশ নেয়ার সময় জুতো বদলানোর কথা মনে ছিল না। কটমট করে তাকাল কিশোরের দিকে।
জুতোগুলো চেনা চেনা লাগছে, কিশোর বলল আবার। ফগের জুতোর মত…
ফগর্যাম্পারকট! ধমকে উঠল ফগ। বলেই বুঝল, ভুল করে ফেলেছে। শোধরানোর উপায় নেই আর। খেঁকিয়ে উঠল, ঝামেলা! শয়তান ছেলে! যাও, ভাগো এখান থেকে! ঘাড় মটকে দেব নইলে!
.
০৮.
অনেক কষ্টে হাসি থামাল ওরা।
মুসাকে জিজ্ঞেস করল কিশোর, এলিজা কোথায়?
বাপের সঙ্গে রাউন্ডএবাউট চড়ছে। মিস্টার বেবি আসলেই পাগল। মেলায় হেন জিনিস নেই, যেটাতে চড়ছেন না তিনি।
চলো তো, দেখি।
রাউন্ডএবাউটের সামনে এসে দেখে ফগ দাঁড়িয়ে আছে। আড়চোখে ওদের দিকে তাকাল ফগ। চোখ জ্বলছে। মুখে কিছু বলল না। আশেপাশের লোকের কাছে ছদ্মবেশ ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয়ে।
মেলায় যে জেল পালানো কয়েদীটাকেই খুঁজতে এসেছে ফগ, সন্দেহ রইল না কিশোরের। কিন্তু কাকে দেখছে এমন মনোযোগ দিয়ে?
বুঝতে পেরে হতবাক হয়ে গেল কিশোর। আগে লক্ষ করেনি ভেবে অবাক হলো ভীষণ।
মিস্টার থেগের দিকে জাকিয়ে আছে ফগ।
ছবির কয়েদীটার সঙ্গে প্রচুর মিল মিস্টার গ্রেগের। তীক্ষ্ণ চোখ, মোটা ভুরু, গোঁফ, দাড়ি, হাতের ফুলে ওঠা রগ, মাঝারি উচ্চতা-সব মিলে যায়। গোঁফের জন্যে ঠোঁটে কাটা দাগ আছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। থাকলে শিওর হওয়া যেত।
নিশ্চয় তার মত এখন একই কথা ভাবছে ফগও। কি করবে? অ্যারেস্ট করবে মিস্টার গ্রেগকে? থানায় নিয়ে গিয়ে গোঁফের নিচে দাগ আছে নাকি দেখবে? ইস, সে-চেষ্টা যদি করত! দেখার মত দৃশ্য হতো একটা।
ধীরে ধীরে গতি কমতে কমতে থেমে গেল রাউন্ডএবাউট। মেয়েকে নিয়ে নেমে এলেন মিস্টার গ্রেগ। ঘড়ি দেখলেন। কিশোরের দিকে তাকিয়ে বললেন, বাড়ি যাওয়া দরকার। চা নিয়ে বসে থাকবে পারকার।
অবাক হয়ে ওদের দিকে ফগকে তাকিয়ে থাকতে দেখল কিশোর। একটা কয়েদীর সঙ্গে কিশোরের অত খাতির দেখে নিশ্চয় ভীষণ অবাক হচ্ছে। ফগের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে মুচকি হাসল সে।
বিড়বিড় করে কি বলল ফগ। চোখের দৃষ্টিতে কিশোরকে ভস্ম করার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়ে সরে গেল ওখান থেকে।
.
মেলা থেকে ফিরতে কিছুটা দেরিই হয়ে গেল ওদের। তবে টেবিল থেকে ওঠেননি মিস্টার পারকার। বন্ধুর জন্যে চা নিয়ে বসে আছেন।
চা খেতে বসে মেলা দেখা নিয়ে একনাগাড়ে বকবক করে যেতে লাগলেন মিস্টার গ্রেগ। খুব উপভোগ করেছেন তিনি, সেকথা বলতে থাকলেন উৎফুল্ল হয়ে। সবই দেখলাম, একটা জিনিস বাকি রয়ে গেল কেবল, মাছির সার্কাস। মাছিকে ট্রেনিং দিয়ে কি করে ওদের দিয়ে কাজ করায় দেখার খুব শখ ছিল।
দেখে এলেই পারতে, মিস্টার পারকার বললেন।
দেখাল না তো আজ। কি নাকি অসুবিধা আছে।
নাক কুঁচকালেন কেরিআন্টি। আমি হলে ওই সার্কাসের দশ মাইলের মধ্যে যেতাম না। মিস্টার গ্রেগ, সত্যি কি সার্কাস দেখানোর মত অতটা মগজ মাছির আছে?
মাছি খুব বুদ্ধিমান প্রাণী, মিস্টার গ্রেগ বললেন। তবে গুবরেপোকার ক্ষেত্রে তারতম্য আছে। কোন কোনটা খুবই বুদ্ধিমান, কোনটা একেবারে বোকা। অ্যাটলাস পর্বতমালায় দুই হাজার ফুট ওপরে এক ধরনের গুবরে বাস করে, যারা পাতার সঙ্গে পাতা জুড়ে সেলাই করতে পারে…
গুবরের কথায় কান নেই কিশোরের। সে ভাবছে অন্য কথা মাছির সার্কাস! কয়েদীটা পোকামাকড় ভালবাসে। হয়তো ওই তাবুতেই লুকিয়ে রয়েছে। কিংবা সার্কাসটার মালিকই সে। ভিন্ন নামে চালাচ্ছে।
মাছির সার্কাস এসেছে মেলায়, জানতই না সে। বিজ্ঞাপনও দেয়নি ওরা। ঠিক করল, সকালে উঠেই দেখতে যাবে। ওই সময় শো থাকবে না, জানা কথা। তাতে বরং সুবিধেই হবে। কথা বলতে পারবে। কিভাবে দেখায় ওরা মাছির সার্কাস, জেনে আসবে। এই ছুতোয় দেখেও আসা যাবে লোকটা ওখানে রয়েছে কিনা।
কিন্তু যাবে কি করে? এলিজা তো সঙ্গে যেতে চাইবে। গেলেই ঝামেলা। পালানো ছাড়া গতি নেই। কেরিআন্টি বকবেন। তা বকুনগে। সেটা তো সে ফিরে আসার পর। ততক্ষণে কাজ উদ্ধার হয়ে যাবে তার।
অতএব পরদিন সকালে ছদ্মবেশ নিয়ে, এলিজাকে ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে পড়ল। সে? সকালে দৌড়াতে বেরোয়নি। তক্কে তক্কে ছিল, কখন এলিজা রান্নাঘরে ঢোকে যেই ঢুকেছে, অমনি ড্রইংরুমের জানাল গলে সটকে পড়েছে। মেয়েটার। চোখে পড়েনি। পড়লে চিৎকার করে পাড়া জানাত।
রাফিয়ানকে সঙ্গে আনেনি কিশোর। নানার মানে তার ছদ্মবেশ ফাস করে। দেয়া। আপনমনে শিস দিতে দিতে রাস্তা দিয়ে চলল।
পথে দেখা ফগের সঙ্গে। এই একটা ব্যাপার রীতিমত অবাক করে কিশোরকে। কোন ব্যাখ্যা খুঁজে পায় না। যখনই সে ছদ্মবেশে কিংবা জরুরী কাজে বেরোয়, প্রায় সময়ই দেখা হয়ে যায় ফগের সঙ্গে। যেন আড়ালে থেকে ইচ্ছে করে কেউ দেখা করিয়ে দেয় ওদের।
সাইকেল চালিয়ে যেতে যেতে কিশোরের সামনে দাঁড়িয়ে গেল ফগ। ঝামেলা! এই ভিখিরিটা আবার এল কোত্থেকে? নিশ্চয় পাশের গাঁ থেকে, ভাবল সে! ধমক দিয়ে জিজ্ঞেস করল, অ্যাই ছেলে, অ্যাই, নাম কি তোমার?
টম, স্যার। হাত বাড়াল কিলোর, দুদিন কিছু খাইনি, স্যার। একটা রুটি খাওয়ার পয়সা দেবেন?
ঝামেলা! দ্বিধা করল ফগ। পকেট হাতড়ে একটা পঞ্চাশ সেন্টের মুদ্রা বের করে কিশোরের হাতে ফেলে দিল। কড়া গলায় বলল, পয়সা দিলাম, কিনে খাওগে। খবরদার, কারও বাড়িতে চুরি করতে ঢুকবে না। ধরা পড়লে চাবকে পিঠের ছাল তুলে ফেলব।
ফগের চলে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল কিশোর। তারপর রাস্তা থেকে নেমে। মাঠ পেরিয়ে কোনাকুনি এগোল। এই সকালবেলা ওকে সার্কাসে ঢুকতে দেখলে সন্দেহ করতে পারে ফগ। ওর চোখে পড়া চলবে না।
.
০৯.
গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকল কিশোর। মরে আছে যেন জায়গাটা। গত বিকেলের হই চইয়ের কোন চিহ্নই এখন নেই। ভাড়ের তাঁবুটার কাছে এসে দাঁড়াল।
বালতি হাতে পানি আনতে যাচ্ছে একটা ছেলে। কিশোরকে দেখে দাঁড়াল। কাউকে খুঁজছ?
ডক। ভাঁড় সাজে যে।
ও তো নেই। দাঁত তুলতে গেছে। ব্যথায় পাগল হয়ে যাচ্ছিল।
কখন ফিরবে?
তা তো বলতে পারব না। দাঁত তুলতে যতক্ষণ লাগে। দেখা করতে চাইলে বসতে হবে তোমাকে।
ছেলেটা চলে গেল। কিশোর বসে রইল। আধঘণ্টা পর এল ডক।
উঠে দাঁড়াল কিশোর। ভাড়ের পোশাক নেই। সাধারণ প্যান্ট-শার্টে বড়ই সাদামাঠা লাগছে লোকটাকে। মাথায় ঘন চুল। চোখের দৃষ্টি এখন ঘোলা, যন্ত্রণার ছাপ। গালের একটা দিক ফুলে আছে, দাঁত ফেলে সে-জায়গাটায় ঠেসে তুলা ভরে দিয়েছেন ডাক্তার।
ভুরু কুঁচকে ওর দিকে তাকাল লোকটা।
নাকের নিচে রঙ নেই এখন। ভালমত দেখা যায়। কোন রকম কাটা দাগ নেই। ওখানে।
এই ছেলে, কে তুমি? জিজ্ঞেস করল ডক। মুখে তুলা থাকায় কথা কেমন জড়িয়ে যাচ্ছে।
টম। একটা চাকরির আশায় এসেছিলাম।
লেখাপড়া জানো? হিসেব করতে পারবে?
ঘাড় কাত করল কিশোর, পারব।
তাহলে এসো। একটা পার্ট টাইম চাকরি তোমাকে দেয়া যেতে পারে। দাঁত। তুলে এসেছি আমি। এখন ওসব হিসেব-নিকেশ করতে পারব না।
ডকের চাকরিতে আর আগ্রহ নেই কিশোরের। যা দেখার দেখে নিয়েছে। বলল, পার্ট টাইম চাকরিতে হবে না আমার। দেখি, সারাক্ষণের জন্যে কেউ নেয় কিনা। দেখায় কারা, বলতে পারেন?
ওই যে ওদিকে গেলেই তাঁবুটা পাবে। কিন্তু ওরাও তোমাকে ফুল টাইম চাকরি দিতে পারবে না।
না দিলে আপনার কাছেই আসব।
এসো, বলে তাবুতে ঢুকে গেল লোকটা।
মাছির সার্কাসের তাবুটা খুঁজে পেল কিশোর। বড়ই জীর্ণ দশা। রঙ উঠে গেছে কাপড়ের। কয়েক জায়গায় তালি। তাবুর কানায় রঙ দিয়ে লেখা রয়েছে :
বুবুকার বিখ্যাত মাছির সার্কাস
তাঁবুটার চেহারা দেখেই অনুমান করা যায়, যতই বিখ্যাত বলে বিজ্ঞাপন। করুক, দেখার আগ্রহ নেই লোকের। ব্যবসা লি না।
আগের দিন চোখে পড়েনি কেন, বুঝতে পারল কিশোর। একে তো মাছি দেখার আগ্রহ নেই বলে লোকের ভিড় ছিল না, তার ওপর তাবুটা রয়েছে একেবারে শেষধারে, কয়েকটা স্টল আর আরও কয়েকটা তাবুর আড়ালে। এদিকে আসেইনি। ওরা। ফগের ওপর নজর ছিল বলে সে যেদিকে যেদিকে গেছে, ওরাও সেদিকেই থেকেছে।
তাবুর পর্দা ফাঁক করে ভেতরে উঁকি দিল সে। এক বুড়ি বসে আছে। সেই বুড়িটা, গতকাল যাকে শূটিং রেঞ্জের সামনে টিকেট বেচতে দেখেছিল। একটা টেবিলে রাখা বড় কাঁচের বাক্সের দিকে তাকিয়ে আছে গভীর মনোযোগে।
কেমন আছেন, মা? কোমল গলায় জিজ্ঞেস করল কিশোর।
চমকে গেল বুড়ি। ফিরে তাকাল। মুখের ভাঁজগুলো গম্ভীর হলো। ময়লা শালের প্রান্তটা কাঁধের ওপর খসে পড়েছিল, মাথায় টেনে দিল আবার।
মাছির সার্কাস খুলবে কখন, বলতে পারেন? জানতে চাইল কিশোর।
সময় হলেই খুলবে, ফ্যাঁসফেঁসে শ্লেষ্মাজড়িত কণ্ঠে জবাব দিল বুড়ি। খুকুর। খুকুর করে কাশল। আমার মেয়ে তো নেই এখন, সে এসে খুলতে
ও, আপনার মেয়েই দেখায়। তার নামই বুবুকা?
না, বুবুকা ছিল আমার স্বামী। মারা গেছে। আমার মেয়ের নাম ওগলা। ওর বাবা ওকে শিখিয়ে দিয়ে গেছে কি করে মাছিকে দিয়ে কাজ করাতে হয়। বুদ্ধিমান প্রাণী এই মাছিগুলো। গায়েও ভীষণ জোর। দেখলে অবাক না হয়ে পারবে না। ভারসুদ্ধ যেভাবে গাড়ি টেনে নিয়ে যায়।
গাড়ি? মাছির গাড়ি বুঝি?।
সে তো বটেই। মাছি কি আর ঘোড়ার গাড়ি টানতে পারবে? নিজের রসিকতায় নিজেই হাসল বুড়ি।
কিশোরের হাসি পেল না। আপনি তাহলে মিসেস বুবুকা?
স্বামীর নাম বুবুক হলে তাই তো হওয়ার কথা, আবার হাসল বুড়ি। আমি এখন আর কোন কাজ করতে পারি না। দেখাতে পারতাম আগে, এখন দেখাতে গেলে তালগোল পাকিয়ে যায়। কি আর করব? ছেলেমেয়ের ওপর বসে বসে খেতে লজ্জা লাগে। তাই অন্যভাবে ওদের সাহায্য করি।
কাল শূটিং গ্যালারির সামনে আপনাকে টিকেট বিক্রি করতে দেখেছি।
ওটা আমার ছেলের গ্যালারি। ওগলার ভাই। রাবুকা। কাঁচের বাক্সটার দিকে তাকাল বুড়ি। হাত নাড়ল কিশোরের দিকে চেয়ে। দেখে যাও, গাড়িটাকে টানতে শুরু করেছে ওরা! কেমন গড়িয়ে যাচ্ছে ছোট ছোট চাকাগুলো! খুব মজার, তাই না?…দাঁড়াও, আরেকটা খেলা দেখাচ্ছি তোমাকে। বাক্সের ডালা তুলতে হাত বাড়াল বুড়ি।
মা! আবার তুমি মাছির বাক্সের দিকে নজর দিয়েছ! পুরুষালী কণ্ঠের কর্কশ চিৎকারে কুঁকড়ে গেল বুড়ি।
কিশোর আর মিসেস বুবুকা, দুজনেই ফিরে তাকাল। দরজায় দাঁড়িয়ে আছে লম্বা চওড়া এক তরুণী। কালো চুল, চোখের দৃষ্টি ছুরির মত ধারাল, চেহারা আর পোশাকেই বোঝা যায়, জিপসি। ধমকে উঠল বুড়ির দিকে চেয়ে, তোমাকে না। কতবার বলেছি, ওটাতে হাত দেবে না!
গলা শুনে মনে হয় পুরুষমানুষ কথা বলছে। কোন মেয়ের মুখ দিয়ে বেরোচ্ছে, বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। বুড়ির মেয়ে ওগলা, বুঝতে অসুবিধে হলো না কিশোরের। ওর দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগল, এই চেহারা কোথায় দেখেছে? চেনা চেনা লাগছে কেন?
এই ফকিরের বাচ্চাটা কে? ঢুকতে দিলে কেন? কি না কি চুরি করে নিয়ে যায়! কিশোরের দিকে তাকিয়ে খেঁকিয়ে উঠল, এই, কে রে তুইঃ মতলবটা কি?
মিনমিন করে জবাব দিল কিশোর, টম। খেতে পাই না, তাই একটা চাকরির আশায়…।
ভাল মানুষের কাছেই এসেছ চাকরির জন্যে! গজগজ করে বলতে লাগল। বুড়ি। আমাকেই দিনের মধ্যে বিশবার খেদায়। থাকব না, আমি থাকব না এখানে। অন্য কোথাও চাকরি খুঁজে নেব। কথায় কথায় এমন দুর্ব্যবহার…লাথি মারি অমন ছেলেমেয়ের মুখে!
যাও না, দেখি কে তোমাকে চাকরি দেয়? মুখ ঝামটা দিল ওগলা। এই ছেলে, বেরো! পারলে চড় মারে কিশোরকে। হাঁটতে হাঁটতে আবার রাবুকার আঁবুর কাছে চলে যাসনে! মেজাজ ভীষণ খারাপ হয়ে আছে ওর। সামনে পড়লে লাথি মারবে।
বাপরে বাপ, কি ভয়ানক পরিবার! বেরিয়ে আসতে যাচ্ছিল কিশোর, ডাক দিল ওগলা, এই ছেলে, শোন! ঘর ঝাড় দিতে পারবি?
ফিরে তাকাল কিশোর। ওগলার মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ মনে পড়ে গেল কেন চেনা চেনা লাগছিল। ওর ভাই রাবুকার সঙ্গে অনেক মিল। শুটিং রেঞ্জে ছেলেটার পাশে যে লোকটা এসে দাঁড়িয়েছিল, সে-ই তাহলে রাবুক।
বুবুকার পরিবারটাকে অদ্ভুত লাগল কিশোরের। কি জানি কেন মনে হলো। এদের কাছে কয়েদীটার খোঁজ পাওয়া যাবে। ঘর ঝাড় দিতে রাজি হয়ে গেল। বলল, পারব।
পয়সা কিন্তু বেশি পাবি না, সাবধান করে দিল ওগলা। একবার ঝাড় দিলে পঁচিশ সেন্ট দেব।
দুদিন কিছু খাই না, মুখটাকে করুণ করে তুলল কিশোর, যা পাব তা-ই সই।
এত কমে রাজি হচ্ছে দেখে অবাক হলো ওগল। চুরি করবি না তো?
না, ম্যাম। বাপ-দাদা চোদ্দ গোষ্ঠীর মধ্যে কেউ চোর ছিল না আমার।
গোষ্ঠীর মধ্যে হয়তো তুইই প্রথম পেশাটা চালু করলি, বলা যায় কিছু ঠিক আছে, শুরু কর। ওই যে ওখানে ঝাড়।
ঝাড় দিতে দিতে তথ্য আদায়ের চেষ্টা চালাল কিশোর, ম্যাম, মিস্টার রাবুকার সঙ্গে আপনার চেহারার অনেক মিল।
হবেই। যমজ ভাই যে।
মায়ের সঙ্গে তেমন মিল নেই, চোখ ছাড়া।
মুখ বাকাল ওগলা। মাকে দুচোখে দেখতে পারে না, বোঝা গেল।
তাঁবুতে কোন বিছানা চোখে পড়ল না কিশোরের। এখানেই ঘুমান নাকি আপনারা? মাটিতে বিছানো মাদুর দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল সে।
ভিখিরির বাচ্চার কথা শোনো! এই গাধা, সারারাত মাটিতে পড়ে থাকা যায় নাকি? ক্যারাভান আছে আমাদের।
কই, মেলার আশেপাশে তো কোন ক্যারাভান দেখলাম না।
নতুন নাকিরে তুই এখানে? মেলার মাঠে ক্যায়াভান রাখার জায়গা আছে? নাকি রাখলে লোকে পছন্দ করবে? গাঁয়ের দক্ষিণে একটা ভোলা মাঠে আমাদের ক্যারাভান। আপনমনেই বকর বকর শুরু করল ওগলা, ওখানেও কি আর শান্তি আছে! ব্যাঙের পোনার মত লোক বাড়ছে। ক্যারাভানে ক্যারাভানে গিজগিজ। দম নেয়ার জো নেই। আচমকা কি মনে হতে ভুরু কুঁচকে তাকাল কিশোরের দিকে। এত প্রশ্ন করছিস কেন? নিশ্চয় চোরের দলের ছেলে! স্পাই! কোথায় কার কাছে মাল আছে, জানার জন্যে পাঠিয়েছে। এই ছোঁড়া, আর কে কে আছে তোর দলে?
সত্যি বলছি, ম্যাম, আমি চোর নই। মেলা আমার ভাল লাগে। মেলার। লোকজন, পশুপাখিও খুব ভাল লাগে, সেজন্যেই খোঁজ-খবর নিচ্ছি। সার্কাসে যদি একটা চাকরি পেতাম, বাঘ-সিংহের খাঁচায় কাজ করতে বললেও আপত্তি করতাম না।
বাঘ-সিংহ, না? মুখে ওসব বলাই যায়। কাজ করতে গিয়ে দেখো না কেমন লাগে! দুটো পয়সার জন্যে সারাজীবনের জন্যে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাবে শরীরটা। দাগে ভর্তি করে দেবে।
ক্ষত? দাগ? দাগের কথাই যখন তুললেন, একটা কথা জিজ্ঞেস করি-ঠোঁটের ওপর দাগওয়ালা কাউকে দেখেছেন?
কি বললি? মুহূর্তে বদলে গেল ওগলার চোখের দৃষ্টি। এই, কি বললি? দাগ দিয়ে কি করবি তুই?
রীতিমত অবাক হলো কিশোর। না, কিছু না।
তাহলে বললি কেন?
আপনি বাঘ-সিংহের কথা বললেন…
যা, বেরো! আর ঝাড় দেয়া লাগবে না। এই নে, পঁচিশ সেন্ট, মাটিতে পয়সা ছুঁড়ে দিল ওগলা।
অত রেগে যাচ্ছেন কেন, ম্যাম? দাগের কথা বলে ভুল করেছি। মাপ করে দেবেন…
বেরো! নইলে এক্ষুণি রাবুকাকে ডেকে আনব। ফকির আর চোর দেখলে পেটানোর জন্যে অস্থির হয়ে যায়। একবার তোর মত একটা শয়তান ছেলের হাত মুচড়ে ভেঙে দিয়েছিল। ডাকব?
না, না, ঘাবড়ে যাওয়ার ভান করল কিশোর। যাচ্ছি, যাচ্ছি। মাটি থেকে পয়সা তুলে নিয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এল সে।
.
১০.
বিকেল বেলা দল বেঁধে গুবরেপোকার কনফারেন্সে গেল ওরা। কিশোর চলল এলিজা আর তার বাবার সঙ্গে। রাফিকে নেয়া হলো না। কারণ, জানা কথা, এ রকম একটা অনুষ্ঠানে কোনমতেই ঢুকতে দেয়া হবে না তাকে। মিস্টার বেকারের বাড়ি থেকে সোজা টাউন হলে চলে গেল মুসারা চারজন-সে, জিনা, রবিন আর ডল। কিশোরদের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইল গেটে। বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে যাবে শুনে ওদের ছুটি দিতে রাজি হয়েছেন মিস্টার বেকার।
টাউন হলের গেটে আরও একজনের দেখা পাওয়া গেল। ফগর্যাম্পারকট। পাহারা দেয়ার ছুতোয় দারোয়ানের সঙ্গে দাঁড়িয়ে রইল সে। আসল উদ্দেশ্য, কারা কারা আসে চোখ রাখা। ছেলেমেয়েদের দেখে গোলআলুর মত চোখ বড় বড় হয়ে গেল তার। ঢুকতে বাধা দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু মিস্টার গ্রেগর জন্যে পারল না। দারোয়ানকে জানালেন, তিনি নিয়ে এসেছেন ওদের। জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার রইল না ফগের।
সম্মেলনটা মোটেও আহামরি লাগল না ছেলেমেয়েদের কারও কাছে, একমাত্র এলিজা ছাড়া। কোনরকম মজা, কোনরকম বৈচিত্র নেই। কয়েদীটার খোঁজে সবার মুখের দিকে তাকাতে লাগল কিশোর। লোকটার চেহারার সঙ্গে দুতিনজনের মিল থাকলেও ওদের কারও ঠোঁটেই কাটা দাগ দেখতে পেল না।
দুই ধরনের গুবরেপোকা প্রেমিক এসেছে সম্মেলনে-দাড়িগোঁফ আর ঝাকড়াচুলো, নয়তো দাড়িগোঁফ আর টাকমাথা; মেয়েরা বাদে। বেশির ভাগই চশমা পরা।
শুরু হলো সম্মেলন। বিরক্তিকর আলোচনা। ভাল লাগল না। ফিসফিস করে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে গিয়ে ধমক খেয়ে থেমে গেল ছেলেমেয়ে। ঢুকে পড়েছে, মীটিং শেষ না হলে বেরোনোও যায় না। কি আর করবে? বসে বসে ঢুলতে শুরু করল মুসা। প্রচণ্ড বিরক্তিতে মুঠো শক্ত করে ফেলল জিনা। রবিনের কোন ভাবান্তর নেই। ডল অতটা বিরক্ত হচ্ছে না, কারণ বাড়ি থেকে বেরোনোর। অন্তত সুযোগ পেয়েছে। তাকে একা বাড়ি থেকে দূরে কোথাও যেতে দেয়া হয় না। হাই তুলতে শুরু করল কিশোর। দরজার দিকে তাকাতেই দেখল টুলে বসে ফগও হাই তুলছে। চোখাচোখি হতেই পিঠ সোজা হয়ে গেল ফগের। মনে মনে গাল দিতে লাগল বিচ্ছু ছেলেটাকে। সে ভেবেছে দেখাদেখি হাই তুলে তাকে রাগাচ্ছে কিশোর।
সত্যি সত্যি যখন ঘুম এসে যাওয়ার জোগাড় হলো, তখন শেষ হলো সম্মেলন। সবার আগে আগে তাড়াহুড়া করে বেরিয়ে এল গোয়েন্দারা। গেটের বাইরে মাঠের কোণে বসে সকালে মেলায় গিয়ে কি কি জেনে এসেছে কিশোর, সেই আলোচনা শুরু করল।
সব শোনার পর মাথা দোলাল রবিন, হুঁ, সন্দেহজনক। কাটা দাগের কথা শুনে খেপে গেল কেন ওগলা?
এর একটাই মানে, কাটা দাগওয়ালা লোকটা কোথায় আছে, জানে সে, জিনা বলল।
মাথা ঝাঁকাল কিশোর, আমারও তাই ধারণা।
ক্যারাভানে লুকিয়ে রাখেনি তো? মুসা বলল। গিয়ে দেখো না একবার।
সেকথাই ভাবছি। আজই যাব। রাতে। অন্ধকার হলে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল মুসা, আমাদের আর যাওয়া হবে না। এমন প্যাঁচেই পড়েছি..যাকগে, যাও, তুমি একাই যাও। কি হলো না হলো জানিয়ে।
কোথায় যাবে একা একা
চমকে ফিরে তাকাল সবাই। এলিজা দাঁড়িয়ে আছে। পা টিপে টিপে এসে দাঁড়িয়েছে ওদের পেছনে।
রেগে উঠল মুসা, সেটা তোমার জানার দরকার নেই। আড়ি পাততে লজ্জা করে না?
লজ্জা কি ওর আছে নাকি! আরেক দিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকাল জিনা।
রাগে, দুঃখে কেঁদে ফেলার অবস্থা হলো এলিজার। জিনাকে বলল, দাঁড়াও, তোমার আম্মাকে গিয়ে বলব, তুমি আমাকে অপমান করেছ।
বলোগে! ঝাজিয়ে উঠল জিনা। ইচ্ছে হলে বাবাকেও বোলো। আমি থোড়াই কেয়ার করি!
জিনাকে রাগালে এলিজার কপালে দুঃখ আছে। অঘটন ঠেকানোর জন্যে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল কিশোর। জিনা, তোমরা এখন যাও। আমি এলিজাদের সঙ্গে বাড়ি যাচ্ছি।
এলিজার হাত ধরে টানতে টানতে কিছুদূরে দাঁড়িয়ে থাকা মিস্টার গ্রেগের কাছে নিয়ে এল কিশোর। গুবরেপোকার পিঠের মতই চকচকে টাকমাথা এক বরে বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলছেন মিস্টার গ্রেগ। সম্মেলনে এতক্ষণ কথা বলে আর শুনেও যেন প্রাণ ভরেনি দুজনের।
এলিজা বলল, বাবা, বাড়ি যাবে না? ডিনার নিয়ে তোমার জন্যে বসে থাকবেন পারকার আঙ্কেল।
হা হা, চলো। গুবরে-বিশেষজ্ঞের দিকে তাকিয়ে বললেন মিস্টার ঘেণ, রস, পরে কথা হবে। কাল আসছ তো?
আসব না মানে? যতদিন থাকব, রোজ আসব। এ রকম আলোচনা মিস করা যায়!
.
১১.
ডিনারের পর পারকার আঙ্কেল আর মিস্টার গ্রেগ গিয়ে ঢুকলেন স্টাডিতে। কখন বেরোবেন, কোন ঠিক নেই। কেরিআন্টি চলে গেলেন তার শোবার ঘরে। এলিজা গেল তার ঘরে। কিশোরের সঙ্গে আড্ডা দিতে চেয়েছিল, ঘুমিয়ে পড়ার ভান করে তাকে ভাগিয়েছে কিশোর। আইলিন রান্নাঘরে খুটুর-খাটুর করছে। বেশিক্ষণ করবে না আর, বোঝা যায়।
নিজের ঘরে দরজার ছিটকানি লাগিয়ে ছদ্মবেশ নিতে বসল কিশোর। অন্য কারও জন্যে বিশেষ ভয় নেই, তার ভয় এলিজাকে। রাতে বেরোনোর কথা শুনেছে। যদি এসে দরজার কাছে ঘাপটি মেরে থাকে?
মুচকি হাসল কিশোর। থাকো, যত পারো। ঘরের আলো নিভিয়ে অন্ধকার করে দিল সে। দরজার কাছে এসে কান পাতল। কোন শব্দ নেই। এলিজা থাকলেও একেবারে নিঃশব্দ হয়ে আছে।
আস্তে করে জানালার পাল্লা খুলল কিশোর। চৌকাঠ ডিঙিয়ে শেডের ওপর দাঁড়িয়ে পাশে হাত বাড়াল। বৃষ্টির পানি নামার পাইপটা হাতে ঠেকতেই চেপে ধরল শক্ত করে। কোন রকম শব্দ না করে নেমে এল ওটা বেয়ে। রাফিয়ানের ঘরটা রয়েছে উল্টোদিকে। সে দেখতে পেল না ওকে। ডাকাডাকি করল না। নিরাপদেই বাগান পেরিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এল কিশোর। তারপর সোজা হনহন করে হাটা দিল। ফগ যদি টহলেও বেরিয়ে থাকে, তাকে দেখলে এখন চিনবে না। ভাববে, কোন বুড়ো মানুষ হাঁটতে বেরিয়েছে।
ক্যারাভানের মাঠে পৌঁছতে সময় লাগল না। ঠিকই বলেছে ওগলা, গিজগিজ করছে। গুণল। মোট বিশটা। কোনটা পুরানো, কোনটা নতুন। বেশিরভাগের ভেতরেই আলো জ্বলছে। রাবুকাদের কোনটা, কি করে জানবে?
উঁকি দিয়ে দেখা ছাড়া গতি নেই। দেখার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছে সে। সুতরাং বিপদের পরোয়া করল না। সামনে যে ক্যারাভানটা দেখল, সেটার চাকার ওপর উঠে দাঁড়িয়ে জানালার পর্দা সরিয়ে ভেতরে তাকাল। দুজন মানুষ ভেতরে। একজন মহিলা, সেলাই করছে; আরেকজন পুরুষ, বই পড়ছে। স্বামী-স্ত্রী।
নেমে এসে পাশের আরেকটা নতুন ক্যারাভানের চাকায় চড়ল। একই ভাবে জানালা দিয়ে ভেতরে উঁকি দিল। নাহ, এটাতেও সন্দেহজনক কাউকে চোখে পড়ল না। পর পর চারটা ক্যারাভান দেখল। পাঁচ নম্বরটার চাকার ওপর থেকে নেমে আসতেই কুকুরের ডাক শোনা গেল। কাছেই ঘেউ ঘেউ করছে ওটা। ওকে দেখে ফেলল নাকি? কুকুরটার কাছাকাছি কোন ক্যারাভানে ওঠার সাহস করল না আর। অনেকটা দূর দিয়ে ওটার পাশ কাটিয়ে মাঠের আরেকধারে চলল। ওদিকেও অনেকগুলো ক্যারাভান।
অনেক পুরানো, ভাঙাচোরা একটা ক্যারাভানের সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল। মাছির সার্কাসের তাবুটার কথা মনে পড়ল। ওটার করুণ দশার সঙ্গে এই ক্যারাভানটারও যেন মিল রয়েছে। ভেতরে আলোও জ্বলছে না।
পকেট থেকে টর্চ বের করল কিশোর। এদিক ওদিক তাকিয়ে সাবধানে উঠে দাঁড়াল ক্যারাভানের চাকায়। জানালা দিয়ে দেখা সম্ভব হলো না। চাকা থেকে নেমে দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। কান পেতে শুনল। কোন শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। আস্তে করে হাত বাড়িয়ে টান দিয়ে খুলে ফেলল দরজাটা। ভেতরে আলো ফেলল। খালি।
দূর! এ ভাবে হবে না! বিরক্ত হয়ে পড়ল সে। ওগলাদের ক্যারাভান কোটা, কারও কাছে জিজ্ঞেস করে জেনে নেবে কিনা ভাবল।
খালি ক্যারাভানটার পাশের ক্যারাভানের কাছাকাছি এসেছে, অন্ধকার থেকে পুরুষকণ্ঠের হাক শোনা গেল, কে রে ওখানে?
বুড়ো মানুষ, বাবা, গলা কাঁপিয়ে জবাব দিল কিশোর। রাত কাটানোর জায়গা খুঁজছি। কাছাকাছি কোথাও খড়ের গাদা আছে, বাবা?
আছে তো, বলল লোকটা। কিন্তু যার গাদা, সেই চাষীটা মানুষ না। তোমাকে দেখলেই কুত্তা লেলিয়ে দেবে। দেখি অন্ধকার থেকে সরে এসো তো, চেহারাটা দেখি।
ক্যারাভানের দরজা খুলে গেল। লণ্ঠন হাতে উঁকি দিল এক প্রৌঢ়। এ অন্য আরেকজন। যে লোকটা কথা বলছিল, অন্ধকার থেকে সরে এসে সে দাঁড়াল ক্যারাভানের পা-দানীর কাছে। কিশোরও বেরিয়ে এল আলোয়।
তার মুখের দিকে তাকিয়ে মায়া হলো লোকটার। বলল, মনে হচ্ছে বহুকাল কিছু পেটে পড়েনি তোমার। এসো, এক কাপ চা খেয়ে যাও।
চোখে ভাল দেখে না এমন ভঙ্গিতে পা-দানী বেয়ে ওপরে উঠল কিশোর। পা রাখল ভেতরে। নিচে দাঁড়ানো লোকটাও উঠে এল। লণ্ঠন হাতে লোকটার চেয়ে। দুচার বছর কম হবে তার বয়েস।
ক্যারাভানের ভেতরে জিনিসপত্র নেই বললেই চলে। তবে বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। প্রথম লোকটা দ্বিতীয় লোকটাকে দেখিয়ে বলল, আমার ভাই। চোখে দেখে না। বসে বসে ঝুড়ি বানায়, হ্যাঁঙ্গার বানায়। আমি নিয়ে গিয়ে বিক্রি করি। পয়সাকড়ি নেই আমাদের। তবে তোমাকে এক কাপ চা খাওয়াতে পারব।
আহ্, বড্ড দয়া তোমাদের, বলে মেঝেতেই বসে পড়ল কিশোর। অসুস্থ বুড়ো মানুষের মত ধুঁকতে লাগল।
মগে করে চা বানিয়ে আনল প্রথম লোকটা। তিনটে পুরানো কাপে ঢেলে দিল। চা খেতে খেতে বলল কিশোর, আসলে বুবুকাকে খুঁজতে এসেছিলাম আমি। শুনলাম, এখানেই আছে ওদের ক্যারাভান। অন্ধকারের মধ্যে খুঁজে পেলাম না। তাই ভাবলাম, রাতটা কোন খড়ের গাদায় কাটিয়ে সকাল বেলা খুঁজে বের করব।
বুবুকাকে পাবে কোথায়? অন্ধ বলল। ও তো নাকি কোনকালে মরে গেছে। শুনলাম। ক্যারাভানটা ঢুকিয়েছে ওই ওদিকে, মাঠের দক্ষিণ কোনাটায়, তাই না রে, জিফি?
মাথা ঝাঁকাল প্রথম লোকটা। বুবুকার ছেলেমেয়ে দুটো ভীষণ পাজি। বুড়ি মা’টাকে জায়গা দিতে চায় না। খালি ঝগড়া করে। বুড়িও কম যায় না। শাপশাপান্ত করে আর গাল দিতে থাকে। কত মেলা হলো, কত লোক এল এই মাঠে ক্যারাভান নিয়ে থাকতে, ওদের মত জঘন্য পরিবার আর দেখিনি। গেলে বাঁচি।
অন্ধ জিজ্ঞেস করল কিশোরকে, বুবুকা তোমার কিছু হতো নাকি? আত্মীয়?
না, বন্ধু ছিল। ছেলেমেয়েরা এখন হয়তো দেখলেও আমাকে চিনবে না।…চা’টার জন্যে ধন্যবাদ। খুব ভাল চা। বহুকাল এমন খাইনি।
খুশি হলো দুই ভাই। অন্ধ বলল, জিফি, রুটিটা কাট না। ওকেও একটু দে। রাতে আর বেশি লাগবে না আমাদের, হয়ে যাবে। কি বলিস?
দিচ্ছি।
না না, লাগবে না। চা খেয়েছি, তাতেই হবে। আজকাল রাতে কিছুই খাই না। খেলেই পেট খারাপ করে।
বুড়ো হওয়ার এই এক সমস্যা, আফসোস করে অন্ধ বলল। এক কাজ করো তাহলে। এখানে আমাদের সঙ্গেই থেকে যাও। এই রাতের বেলা কোথায় আবার খড়ের গাদা খুঁজতে যাবে।
না, না, তোমাদের আর কষ্ট দিতে চাই না। যেখানেই হোক, কাটিয়ে দেব রাতটা।
বাইরে মৃদু শব্দ হলো। কান খাড়া করল বুড়ো। নিশ্চয় বুড়ো বিড়ালটা। জিফি, দরজা খুলে দে। আসুক।
দরজা ফাঁক করতেই ভেতরে ঢুকে পড়ল হাড় জিরজিরে, লোম ওঠা একটা বুড়ো বিড়াল। একটা কান কামড়ে কেটে দিয়েছে অন্য বিড়ালে।
আপনার? বুড়োকে জিজ্ঞেস করল কিশোর। এ তো মরে মরে। খাবার পায় না নাকি?
না, আমাদের না, একটা পিরিচে সামান্য একটু দুধ ঢেলে দিল জিফি। রাবুকাদের বিড়াল। নামেই ওদের, জীবনেও একটা দানা খেতে দিয়েছে কিনা সন্দেহ।
চুকচুক করে দুধ খাচ্ছে বিড়ালটা। সেদিকে তাকিয়ে থেকে একটা বুদ্ধি মাথাচাড়া দিল কিশোরের মনে। বলল, রাবুকাদের ক্যারাভানে বরং নিয়ে যাই আমি এটাকে।
দুধ খাওয়া শেষ হলে বিড়ালটাকে তুলে নিল সে। বিড়াল দিয়ে আসার ছুতোয় ক্যারাভানের ভেতরটা দেখে নিতে পারবে।
দুই বুড়ো তাকে গুড-নাইট জানিয়ে বিদায় দিল। জিফি কিছুদূর এগিয়ে দেয়ার কথা বলল, রাজি হলো না কিশোর। বাইরে দাঁড়িয়ে হাত তুলে কোন ক্যারাভানটা রাবুকাদের, দেখিয়ে দিল জিফি। তারপর দরজা লাগিয়ে দিল।
কিশোর ভেবেছিল, ভাঙাচোরা হবে, কিন্তু বেশ বড় আর নতুন রাবুকাদের ক্যারাভানটা। মিউ মিউ করতে থাকা বিড়ালটাকে নিয়ে ওটার কাছে এসে দাঁড়াল সে।
বিড়ালের ডাক শুনে দরজা খুলে গেল। কে যেন ডাকল, পুষি, পুষি, কোথায় তুই? আয়।
গলাটা চেনা লাগল কিশোরের। ও কাছাকাছি হতে ক্যারাভানের পা-দানী বেয়ে নেমে এল একটা মূর্তি।
আপনার বিড়ালটা নিয়ে এলাম, কিশোর বলল। ওদিকে বসে বসে কাঁদছিল।
অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে থাকায় কালো অস্পষ্ট মূর্তিটার চেহারা দেখতে পেল না কিশোর। আর দেখলেও তারার আবছা আলোয় চিনত কিনা সন্দেহ। টর্চ জ্বালল সে।
মিসেস বুবুকা। হাত বাড়াল বুড়ি, পুষি, পুষি, আয়। হতচ্ছাড়ি মেয়েটা দুচোখে বিড়াল দেখতে পারে না। রাতের বেলা রাস্তায় পড়ে মরার জন্যে ওগলা তোকে বের করে দিয়েছিল, তাই না? আহারে!
বেড়ালটাকে কোলে নিয়ে আদর করতে লাগল বুড়ি।
ক্যারাভানে ঢোকার সুযোগ খুঁজছে কিশোর। গলা বাড়িয়ে উঁকিঝুঁকি মারছে। দেখতে চাইছে, ওগলা আর তার ভাই ছাড়া আর কেউ রয়েছে কিনা ভেতরে।
বিড়ালটাকে এনে দেয়ার জন্যে কোন রকম সৌজন্য দেখাল না বুড়ি। ভেতরে ঢোকার আমন্ত্রণ জানাল না কিশোরকে। বিড়ালটাকে কোলে নিয়ে ঘুরে রওনা হলো ক্যারাভানের দিকে। পা-দানীতে উঠল। বুড়ির কাপড় যেমন পুরানো আর ময়লা, স্যান্ডেল জোড়াও তাই। কোথা থেকে ইয়া বড় বড় দুটো স্যান্ডেল কুড়িয়ে এনেছে কে জানে। ক্যারাভানে উঠে একটা ধন্যবাদ পর্যন্ত না দিয়ে দড়াম করে লাগিয়ে দিল দরজাটা। রাগ লাগল কিশোরের। ছেলেমেয়েরা যে দেখতে পারে না, এ জন্যেই। এ রকম চাষাড়ে স্বভাবের বুড়ীকে কে পছন্দ করবে।
অন্ধকারে চুপ করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল কিশোর। তারপর পা টিপে টিপে এগিয়ে গেল দরজার কাছে। সামান্যতম ফাঁক পাওয়া গেলেই হতো। দেখে ফেলতে পারত ভেতরটা।
কিন্তু কোথাও কোন ফাঁক দেখতে পেল না। জানালাতে পর্দা টানা। নিরাশ হয়ে চাকা থেকে নামতে যাবে এই সময় নিচু গলায় তর্কাতর্কি শুরু করল দুজন লোক।
স্থির হয়ে গেল কিশোর। লোক! পুরুষ মানুষ! গলার স্বর বোঝা গেলেও, কথা বোঝা যাচ্ছে না। ওগলা আর তার মা মেয়েমানুষ। রাবুকা তর্ক করছে একজন পুরুষ মানুষের সঙ্গে-তারমানে চতুর্থ কেউ রয়েছে ক্যারাভানে।
পেছনে পায়ের শব্দ শোনা গেল। ফিরে তাকিয়ে তারার আলোয় মাঠ ধরে একটা ছায়ামূর্তিকে এগিয়ে আসতে দেখল কিশোর। নামার সময় নেই আর এখন। চোখে পড়ে যেতে পারে লোকটার। যেখানে ছিল, সেখানেই চাকার ওপর দাঁড়িয়ে ক্যারভানের গায়ে গা লাগিয়ে মিশে থাকার চেষ্টা করল কিশোর।
দরজায় দাঁড়িয়ে হাঁক দিল লোকটা।
দরজা খুলে দিল ওগলা, কে?
আমি, পোকার। রাবুকাকে জিজ্ঞেস করো, ডার্ট খেলতে যাবে নাকি।
রাবুকা, পোকার ডাকছে, ওগলা বলল। আমিও যাব তোমাদের সঙ্গে। ক্যারাভানের মধ্যে গাদাগাদি করে থেকে দম আটকে আসছে আমার।
ক্যারাভান থেকে নামল দুই ভাই-বোন। কিশোরকে কেউ দেখল না। পোকার যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকে হাঁটতে শুরু করল তিনজনে। ক্যারাভানে রয়েছে এখন দুজন-বুড়ি আর চতুর্থ লোকটা, ভাবছে কিশোর। দেখতে পারলে ভাল হতো। কিন্তু কি করে দেখবে?
চাকা থেকে নেমে দরজার দিকে এগোল সে। ওগলারা নেমে যাওয়ার সময় যদি ফাঁক করে রেখে গিয়ে থাকে, এই আশায়।
পা-দানী বেয়ে নামার শব্দ হলো। চট করে সরে গিয়ে ক্যারাভানের গায়ে মিশে। গেল আবার কিশোর। কে নামল? বুড়ি? নাকি অন্য লোকটা?
দেখতে পারল না ভাল করে। ওর দিকে পেছন করে হাঁটতে লাগল ছায়ামূর্তিটা। হারিয়ে গেল মাঠের অন্ধকারে। বাকি রইল আর একজন। হয় বুড়ি, নয়তো সেই চতুর্থ লোকটা। বুড়িই থাকবে, এত রাতে বেরোনোর কথা নয় তার। সেই লোকটাই বেরিয়েছে।
পা-দানীতে এসে উঠল সে। দরজায় ঠেলা দিল। লাগানো। তালা নেই নিশ্চয়। যা থাকে কপালে, খুলেই দেখবে। ভেতর থেকে বুড়ি দেখে ফেলে চেঁচামেচি শুরু করলে লাফিয়ে নেমে ঝেড়ে দেবে দৌড়। তবু ভেতরটা না দেখে যাবে না।
হাতল চেপে ধরে ঘোরাতে শুরু করল সে। ঘুরছে যখন, তারমানে তালা দেয়া নেই। পুরোটা ঘুরে যেতেই আস্তে করে ঠেলা দিল। ফাঁক হয়ে গেল পাল্লা।
ভেতরে উঁকি দিল। কাউকে দেখা গেল না। কোন শব্দও নেই। সাহস পেয়ে আরও ফাঁক করল। পুরোটাই খুলে ফেলল.শেষে।
কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না। কেউ নেই ভেতরে। আশ্চর্য! ভূতুড়ে কাণ্ড নাকি? গেল কোথায় চার নম্বর লোকটী? তার অলক্ষে কোন ফাঁকে নেমে চলে গেল।
ছাত থেকে একটা লণ্ঠন ঝুলছে। প্রচুর আলো ভেতরে। কেউ থাকলে দেখা যেতই।
এতটাই অবাক হয়ে গেছে কিশোর, এ ভাবে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকলে যে অন্য ক্যারাভানের কেউ দেখে ফেলতে পারে, সন্দেহ করতে পারে, সেটাও ভুলে গেল। টনক নড়ল চিৎকার শুনে, এই, কে তুমি? ওখানে কি করছ?
ঝট করে ফিরে তাকাল কিশোর। একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে নিচে। কিশোর তাকাতেই কড়া গলায় আবার জিজ্ঞেস করল, কে তুমি?
জবাব দেয়ার প্রয়োজন মনে করল না কিশোর। লাফ দিয়ে নেমেই দিল দৌড়।
চোর চোর বলে চিৎকার শুরু করল লোকটা। তার চেঁচামেচিতে ঝট ঝট করে খুলে গেল আরও কয়েকটা ক্যারাভানের দরজা। হাঁকডাক করে লোক ছুটে আসতে লাগল তাকে ধরার জন্যে।
মাঠ পেরিয়ে ওপাশের বনে ঢুকে যেতে পারলেই বেঁচে যেত, আর তাকে ধরতে পারত না, কিন্তু বাদ সাধল মাটিতে পড়ে থাকা একটা মরা ডাল। তাতে পা বেধে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল সে। কপাল ঠুকে গেল শক্ত কিসে যেন। চোখের সামনে হাজারটা তারা জ্বলে উঠল। জ্ঞান হারাল না। তবে উঠতে দেরি করে ফেলল। ততক্ষণে চারপাশ থেকে তাকে ঘিরে ফেলল লোকেরা।
টানতে টানতে তাকে নিয়ে আসা হলো ওগলাদের ক্যারাভানের কাছে।
খবর শুনে ওগলা আর রাবুকা এসে হাজির। বুড়িও এল বিড়াল কোলে নিয়ে। কোথায় গিয়েছিল সে কে জানে। হাওয়া খেতে বোধহয়। টানাহেঁচড়ায় কিশোরের ছদ্মবেশ নষ্ট হয়ে গেছে। লণ্ঠনের আলোয় দেখতে দেখতে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল ওগলা, কে রে তুই? সকালের সেই ছেলেটা না? তাই তো! গো, দেখো কি কাণ্ড! সকালেও এসেছিল ছদ্মবেশে, এখনও। ঠিকই সন্দেহ করেছিলাম। চোরের দলের পাই।
কাছে এসে দাঁড়াল বুড়ি। ভাল করে দেখতে লাগল কিশোরকে। আচমকা কিশোরের কানে ধ করে এক ঘুসি বসিয়ে দিয়ে বুড়ি বলল, পিটিয়ে তক্তা করে ফেলব! জলদি বল, কে তুই?
রাবুকাও কিলঘুসি মারতে শুরু করল।
ভয় পেয়ে বিড়ালটা লাফ দিয়ে নেমে গেল বুড়ির কোল থেকে। ছায়ার নিচে গিয়ে মিউ মিউ করতে লাগল।
যে লোকটা কিশোরকে উঁকি মারতে দেখেছিল, সে বাধা দিল। বলল, থাক, মারধরের দরকার নেই। সকালে পুলিশকে খবর দেব। যা করার ওরা করবে।
আরও পেটানোর ইচ্ছে ছিল রাবুকার। অন্যদের জন্যে পারল না। শেষে বলল, ঠিক আছে, বেঁধে নিয়ে গিয়ে ফেলে রাখি ভাঙা ক্যারাভানটার মধ্যে। সকালে পুলিশ এলে আরেক চোট ধোলাই হবে।
তা-ই করা হলো। ভাঙাচোরা খালি ক্যারাভানটার মধ্যে এনে ঢোকানো হলো তাকে। হাত-পা বেঁধে মেঝেতে ফেলে রেখে, দরজায় তালা লাগিয়ে চলে গেল লোকগুলো।
টানাটানি করে দেখল কিশোর। সামান্যতম ঢিল করতে পারল না বাঁধন। কিছুক্ষণ চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিল। বুঝল, এই দুর্গন্ধে ভরা ক্যারাভানের মধ্যেই রাত কাটাতে হবে তাকে। বেকায়দা ভঙ্গিতে মেঝেতে পড়ে থেকে।
.
১২.
ভোরবেলা হই-চই শুনে ঘুম ভেঙে গেল তার। এত অসুবিধার মধ্যেও যে ঘুমাতে পারে মানুষ, নিজের বেলায়ই সেটা প্রমাণ হয়ে যেতে দেখে অবাক হলো।
ক্যারাভানের কাছে অনেক লোক এসে দাঁড়িয়েছে। তালা খোলার শব্দ হলো। খুলে গেল দরজা।
প্রথমেই ফগের ওপর চোখ পড়ল কিশোরের। দরজা খুলেছে যে লোকটা, তাকে সরিয়ে তার জায়গায় এসে দাঁড়াল ফগ। কিশোরকে দেখেই বলে উঠল, ঝামেলা! চিনতে পেরেও দীর্ঘ একটা মুহূর্ত অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। এই বিন্দু ছেলেটাকে আশা করেনি। ফোনে ছদ্মবেশী চোর ধরা পড়ার খবর শুনে ভেবেছিল, সেই কয়েদীটাই ধরা পড়েছে। চোরটার বয়েস কত, সে-ও জিজ্ঞেস করেনি, যে ফোন করেছে সে-ও বলেনি।
কিশোরকে দেখে নিরাশই হলো ফগ। চুরি করতে যে আসেনি কিশোর, তারচেয়ে ভাল আর কেউ জানে না। নিশ্চয় কয়েদীটাকে খুঁজতে এসেছিল। ধরে নিয়ে গিয়ে হাজতে ভরেও লাভ হবে না। রিপোর্ট করতে হবে শেরিফের কাছে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই মুক্তি পেয়ে যাবে কিশোর। উল্টো হয়তো ধমক খেতে হবে তাকেই। তারচেয়ে এখানে ছেড়ে দিয়ে যাওয়াই ভাল।
কিশোরকে ছেড়ে দিতে বলল সে।
চোর ধরেও এ ভাবে ছেড়ে দেয়ায় পুলিশের ওপর নারাজ হলো ক্যারাভানের লোকেরা। ব্যঙ্গ আর গালমন্দ করতে লাগল। কিন্তু কিছু করার নেই ফগের।
*
গেট দিয়ে কিশোরকে ঢুকতে দেখল প্রথমে এলিজা। তার বিধ্বস্ত চেহারা দেখে হাঁ হয়ে গেল। দৌড়ে এল। কি ব্যাপার? কি হয়েছে তোমার? রাতে কোথায় ছিলে?
সরো তো! খিঁচড়ে আছে কিশোরের মেজাজ। কানটা ব্যথা করছে এখনও। নিজের অজান্তেই হাত চলে গেল কানের ওপর। ডলতে গিয়ে স্থির হয়ে গেল হাতটা। ঝিলিক দিয়ে উঠল চোখের তারা। এলিজাকে আরও অবাক করে দিয়ে দৌড় দিল ঘরের দিকে।
সোজা এসে ফোনের কাছে দাঁড়াল সে। প্রথমেই খবর দিতে হবে শেরিফকে। তারপর ফোন করবে মিস্টার বেকারের বাড়িতে। মুসাদের জানানোর জন্যে। পেয়ে গেছে কয়েদীর খোঁজ!
*
ঘণ্টা দুই পরে সেদিন সকালে দ্বিতীয়বারের মত পুলিশ ঢুকল ক্যারাভানের মাঠে। তবে এবার আর ফগ একা নয়, সঙ্গে শেরিফ রয়েছেন, আরও আছে চারজন কনস্টেবল। যে জেল থেকে কয়েদী পালিয়েছিল, শেরিফের ফোন পেয়ে সেখান থেকে পাঠানো হয়েছে। কিশোরও একা আসেনি। সঙ্গে রয়েছে এখন মুসা, রবিন, জিনা, ডল, রাফিয়ান। আর অবশ্যই এলিজা। এবার আর তাকে বাড়িতে রেখে আসা যায়নি। অবশ্য রেখে আসার চেষ্টাও করেনি কিশোর।
দলবল নিয়ে সোজা এসে ওগলাদের ক্যারাভানটার সামনে দাঁড়াল ওরা। শেরিফের নির্দেশে দরজায় থাবা দিল ফগ। হাঁক দিল, আই, খোলো, জলদি খোলো! পুলিশ!
খুলে দিল বুড়ি। চোখ মিটমিট করে তাকাতে লাগল। মিউ মিউ করে পায়ের কাছে এসে দাঁড়াল বিড়ালটা। কোলে তুলে নিল ওটাকে। ফগের ওপর চোখ পড়তে কাশা শুরু করল। কাশি থামলে জিজ্ঞেস করল, রিপোর্ট লিখতে এসেছেন বুঝি?
ঝামেলা! রিপোর্ট না, কয়েদী ধরতে। বুঝবে মজা আজকে। ভেতরে কে কে আছে, বেরোতে বলো জলদি।
কে আর থাকবে? আমার ছেলে আর মেয়ে…এই ওগলা, ওঠ। রাবুকে উঠতে বল। পুলিশ।
চোখ ডলতে ডলতে বেরিয়ে এল রাবুকা আর ওগলা। এত পুলিশ দেখে চমকে গেল। মাটিতে নেমে দাঁড়াল। বুড়িও নামল বিড়াল কোলে নিয়ে।
লাফ দিয়ে ক্যারাভানে উঠে ভেতরটা দেখে এল ফগ। ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল কিশোরকে, কই, কোথায় তোমার আসামী?
মুচকি হাসল কিশোর। যাক, একেবারে শিওর হয়ে নিলাম যে ভেতরে আর কেউ নেই। ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল বুড়ির সামনে। আচমকা হাত বাড়িয়ে বুড়ির চুল ধরে মারল এক হ্যাঁচকা টান।
আঁউ করে উঠল বুড়ি। কিশোরের হাতে চলে এসেছে তার পরচুলা। মাথা ভর্তি ঝাকড়া চুল বেরিয়ে পড়েছে। একটা মুহূর্ত দ্বিধান্বিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল বুড়ি। তারপর ঘুরে দিল দৌড়।
ঝট করে একটা পা সামনে বাড়িয়ে দিল ফগ। তাতে বেধে গিয়ে ধুড়স করে হুমড়ি খেয়ে পড়ল বুড়ির ছদ্মবেশে থাকা লোকটা। কোলের বিড়ালটা উড়ে গিয়ে পড়ল আরও দূরে। ব্যথা পেয়ে চিৎকার শুরু করল মিউ মিউ করে।
লোকটাকে টেনে তুলে চোখের পলকে হাতকড়া পরিয়ে দেয়া হলো।
রাবুকা আর ওগলার হাতে হাতকড়া পরাতে যেতেই কাকুতি-মিনতি শুরু করল ওরা : আমরা কিছু করিনি, জোর করে এসে থাকতে চেয়েছে, থাকতে দিতে বাধ্য হয়েছি!
এ সব কথায় মন গলল না পুলিশের। আসামী লুকিয়ে রাখার অপরাধে গ্রেপ্তার করা হলো ওদেরও। জানা গেল, আসামী ওদের দূর সম্পর্কের ভাই। ডাকাতির অপরাধে জেলে গিয়েছিল। ডাকাতির টাকা লুকিয়ে রেখে গিয়েছিল। পুলিশকে বলেনি। জেল থেকে পালিয়ে এসে প্রথমেই সেই টাকা বের করে কিছু দিয়ে মুখ বন্ধ করেছে রাবুকার। ওগলা তাকে দেখতে পারত না। টাকার জন্যে আসামীকে জায়গা দেয়ারও পক্ষপাতি ছিল না। কিন্তু কি করবে? রানুকা দিয়ে ফেলেছে। একটা প্রায় নতুন ক্যারাভানেরও বায়না করে ফেলেছে। টাকার জন্যে এসে চাপ দিচ্ছে মালিক। পুরো টাকা না দিলে বায়নার টাকাও মার যাবে। ভাঙাচোরা ক্যারাভান-যেটাতে কিশোরকে বন্দি করে রাখা হয়েছিল, সেটা ওদেরই ফেলে দেয়া ক্যারাভান।
চারজন কনস্টেবলকে দিয়ে তিন আসামীকে হাজতে পাঠিয়ে দিলেন শেরিফ। তারপর ফগ আর ছেলেমেয়েদের সহ রওনা হলেন জিনাদের বাড়িতে।
.
১৩.
এতবড় একটা দলকে নাস্তার জন্যে হাজির হতে দেখে অবাক হলেন না কেরিআন্টি। জানেন, আসবে। তাই প্রচুর মাংস, ডিম আর পাউরুটি বের করে রেখেছেন। ভাজতে আর টোস্ট করতে যা দেরি। শেরিফকে জিজ্ঞেস করলেন, এত সকালে তো নাস্তা করে নিশ্চয় বেরোতে পারেননি। সবাইকেই দেব তো?
দিন।
আমি বাদ, মিনমিন করে লজ্জিত কণ্ঠে বলল ফগ। নাস্তা করতেই বসেছিলাম, এই সময় ফোন এল…দৌড়ালাম।
হাসলেন কেরিআন্টি। তারমানে পুরো খাওয়া হয়নি আপনারও। বসে পড়ুন। কোন সমস্যা নেই। প্রচুর আছে।
মিস্টার গ্রেগ আর মিস্টার পারকার নাস্তা সেরে স্টাডিতে চলে গেছেন। আপাতত তাঁদের ডাকার প্রয়োজন মনে করলেন না কেরিআন্টি। খাবার আনতে রান্নাঘরে চলে গেলেন।
কিশোর, এবার বলো তো দেখি, টেবিলে দুই কনুই রেখে সামনে ঝুঁকে বসেছেন শেরিফ। বুড়িকে তোমার সন্দেহ করার কারণটা কি?
সূত্র অনেকগুলোই পেয়েছিলাম, কিশোর বলল, কিন্তু মেলাতে পারিনি প্রথমে। রাবুকা আর ওগলার মা সেজে থাকার বুদ্ধিটা সাংঘাতিক। এই এলাকায়। এই প্রথম মেলায় যোগ দিতে এসেছে ওরা। কেউ জানে না ওগলার মা, তার বাবার আগেই মরে গেছে। সেই জায়গাটা সহজেই দখল করল লোকটা। জানত, কেউ সন্দেহ করবে না। ঝগড়াঝাটি বাধিয়ে পরিস্থিতিটাকে এতই স্বাভাবিক করে রেখেছিল, সত্যিই কেউ সন্দেহ করেনি যে সে রাবুকা আর ওগলার মা নয়। লোকটার প্রশংসা করতে হয়। বুড়ির ছদ্মবেশে পারও পেয়ে গিয়েছিল প্রায়। ধরাটা পড়ল আমাকে ঘুসি মেরে।
রাতে আমাকে হাত-পা বেঁধে ভাঙা ক্যারাভানে ফেলে রাখল। কষ্টের চোটে মাথাটা ঠিকমত কাজ করছিল না তখন আমার। ভোরের বাতাসে হেঁটে এসে মগজটা পরিষ্কার হয়ে গেল। কান ব্যথা করছিল। উলা দিতে গেলাম। হঠাৎ মনে হলো, একটা জরাজীর্ণ বুড়ি, এত জোরে ঘুসি মারে কি করে? ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে আগের পাওয়া সূত্রগুলোর মানে পরিষ্কার হয়ে গেল।
বুবুকার তাঁবুতে বসে গভীর মনোযোগে বাক্সে রা মাছি দেখছিল সে। তারপর ক্যারাভানে হাড় জিরজিরে বিড়ালটাকে কোলে নিয়ে আদর করা। মনে পড়ল, কয়েদীটা কীট-পতঙ্গ আর বিড়াল ভালবাসে।
সারাক্ষণ শাল দিয়ে মাথা ঢেকে রাখার ব্যাপারটাও স্বাভাবিক নয়। কেন রাখত। পরচুলা ঢাকার জন্যে। যাতে কারও নজরে পড়ে না যায়, কেউ বুঝে না ফেলে ওগুলো আসল চুল নয়।
আরও আছে। রাতে ক্যারাভানে ওঠার সময় তার পা দেখেছি। বিরাট পা। এতবড় পা কোন মহিলার হতে পারে না।
বুড়ি সেজে থাকায় আরও অনেক সুবিধে পেয়েছে সে। ঠোঁটের কাটা দাগ আর হাতের ফোলা রগ আড়াল করে রাখতে পেরেছে সহজেই। কুঁচকানো মুখের ভাঁজে লুকিয়ে ফেলেছিল কাটা দাগটা। ছদ্মবেশটা এত চমৎকার হয়েছিল, তাঁজের মধ্যে নাকের নিচের একটা কাটা দাগ আলাদা করে বোঝা যায়নি। আর রগ লুকানোর কোন চেষ্টাই করেনি সে। বুড়ো মানুষের হাতের রগ ফোলাই থাকে, তাই দেখলেও সন্দেহ করবে না, জানত।
হাসলেন শেরিফ, কিন্তু তোমাকে ফাঁকি দিতে পারেনি।
দিয়ে ফেলেছিল আরেকটু হলে। তবে ভুল করেই ফেলে অপরাধীরা। আসলে ঘাবড়ে গিয়েছিল আমাকে ছদ্মবেশে যেতে দেখে। পুলিশের চর, না চোরের দলের লোক বুঝতে পারছিল না। মেজাজ ঠিক রাখতে পারেনি তাই। আর মাথা ঠাণ্ডা রাখতে না পারলেই ভুল করে বসে, যত চালাক লোকই হোক। আমার মুখ থেকে কথা আদায়ের জন্যে ঘুসি মেরে বসল।
আর ওই একটা ঘুসিই কাল হলো ওর, হাসলেন শেরিফ।
ঝামেলা! বিড়বিড় করল ফগ। এত কাছে থেকেও কয়েদীটাকে ধরতে না পারায় আফসোস হচ্ছে তার। নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে।
মিস্টার ফগ… বলতে গেল কিশোর।
ফগর্যাম্পারকট! শুধরে দিল ফগ।
সরি, মিস্টার ফগর্যাম্পারকট, হেসে বলল কিশোর, আমার কাছে একটা জিনিস পাওনা রয়ে গেছে আপনার।
ভুরু কুঁচকে তাকাল ফগ। তার গোলআলু চোখে বিস্ময়। ঘোৎ করে উঠল, কি জিনিস!
পকেট থেকে পঞ্চাশ সেন্টের মুদ্রাটা বের করে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, দেখুন তো এটা চিনতে পারেন নাকি?
প্রথমে কিছু বুঝল না ফগ। তারপর আপেলের মত টকটকে লাল হয়ে উঠল গাল।
নিন, মুদ্রাটা টেবিলের ওপর রেখে ঠেলে দিল কিশোর। কাঁপা হাতে তুলে নিল ফগ। তাকাতে পারছে না কিশোরের চোখের দিকে।
ভুরু কুঁচকালেন শেরিফ। একবার কিশোরের মুখের দিকে, একবার ফগের মুখের দিকে তাকাতে লাগলেন। কি ব্যাপার?
অনুরোধের সুরে কিশোর বলল, এই একটা রহস্য আমার আর মিস্টার ফগর্যাম্পারকটের মধ্যেই গোপন থাক, আঙ্কেল, না-ই বা ফাঁস করলাম।