মহাশ্বেতা
মনে হয়েছিল বুঝি উদ্ভ্রান্ত হৃদয়
অনুভব করিবে না কভু আর সহজ বিস্ময়;
বিয়োগের অমিত অভাবে
সুন্দরের আবির্ভাব কেবলই হারাবে।।
তাই যবে বসন্তের উচ্ছৃঙ্খল দিনে,
গতাসু বরষে,
সহসা উঠিল জেগে নিম্বের বিপিনে
বিহ্বল চন্দনগন্ধ মলয়ের কবোষ্ণ পরশে;
ধৈর্যহীন অপব্যয়ে বৃথা পুষ্পাঞ্জলি
বসুন্ধরা নিজেরে অর্পিল;
বন্দ্ৰ অলি
তালে বেঁধে দিল
সৃষ্টির স্বয়ম্ভূ সামগান;
উৎকণ্ঠিত প্রজাপতি করিল সন্ধান
অনুর্বরা প্রোষিতারে, বিরহীর চিত্রলিপি ল’য়ে;
কে পরাল রজনীর কনক বলয়ে
উদ্বাহসিন্দুরবিন্দু গোধূলিলগনে;
সে-দিনের দক্ষযজ্ঞে, সার্বভৌম মিলনপার্বণে
পড়িল না তাই মোর ডাক।।
পুনর্বার এসেছে বৈশাখ;
গেছে মুছি
প্রতীচীর পাণ্ডু গণ্ডে জীবনের শেষ রক্ত রুচি।
আজি তবে কেন
বাজায় মোহনবেণু শীর্ণ কুঞ্জে কালের রাখাল?
অতিক্রান্ত সন্ধিলগ্ন, ভ্ৰষ্টপাল
কামধেনু যেন,
পৃথিবীর অন্য প্রান্ত থেকে ঊর্ধ্বশ্বাসে
স্মরণের গোষ্ঠে ফিরে আসে।
এক দিন
পুলকি অপরিচিত নদীর পুলিন
তাপতাম্র এমনই নিদাঘে,
যে-অপূর্ব জপমন্ত্র কানে মোর নিবিড় সোহাগে
দিয়েছিল সুন্দরের দূতী,
ভ’রে ওঠে বর্তমান নৈঃসঙ্গ্যের শ্রুতি
সে-প্রণাদ অনুলাপে;
বক্ষে কাঁপে
কী এক বচনাতীত, তীব্র সংবেদন;
সপ্তসিন্ধুপরপারে বিচঞ্চল নারিকেলবন
মৃদুল মর্মরে
সহসা সম্পূর্ণ করে
অসমাপ্ত পরিচয় তার।।
বারংবার
নির্নিমেষ নেত্রে চেয়ে দেখি,
সমস্ত ভুবন জুড়ে, আবার এলে কি,
ক্ষণিকা পরমা?
প্রতিবেশী পত্রে, পুষ্পে নেহারি যে তোমারই উপমা;
সে-দিনের ভুলে-যাওয়া তুচ্ছ দানগুলি
ভারাক্রান্ত করি তুলে তপোরিক্ত বৈশাখের ঝুলি।
ঘুচে যায় ভয়;
জানি, জানি বিধাতা নির্দয়
কোনও দিন পারিবে না অর্গলিতে সে-স্বর্গের দ্বার,
ইন্দ্রত্বের ধ্রুব অধিকার
তোমার প্রেমের স্মৃতি রচিয়াছে মোর লাগি যেথা,
অয়ি মহাশ্বেতা।।
২১ এপ্রিল ১৯৩০