মহামৃত্যুর পথে মহানগর
মহানগর থেকে অনেক দূরে লোকালয়ের বাইরে কোনো তন্ত্রপীঠের নির্জন গ্রাম্য শ্মশানে অমাবস্যার অন্ধকারে চলতে চলতে যখন একটার—পর—একটা শুকনো মাথার খুলি পায়ে ঠোক্কর লেগে গড়িয়ে যায়, তখন একনিমেষে চোখের সামনে হঠাৎ বিদ্যুৎঝলকে পৃথিবীর হাজার হাজার সব জ্যান্ত মহার্ঘ্য মাথা ঝকমক করে ওঠে। সাধারণ মানুষের ঘিলুশুষ্ক মাথা নয়, সোনা দিয়ে বাঁধিয়ে রাখার মতো বড় বড় সব ভারিক্কি মাথা, যার ভিতরে অফুরন্ত বৃদ্ধির গলন্ত ঘিলু অহরহ টগবগ করছে। আন্দামানের আদিম মানুষের মতো তখন অবাক হয়ে ভাবি চন্দ্রলোক অভিযানের পেছনে বৈজ্ঞানিক মাথাগুলোর কথা, পারমাণবিক মারণাস্ত্র নির্মাণে নিমজ্জিত সব মাথা, যুদ্ধ, হত্যা ও সর্বাত্মক নাশকর্মে নিযুক্ত সব মাথা এবং অজস্র মাথা শুষে শুষে ঝুনো নারকেলে পরিণত করছে যে বিরাট রাষ্ট্রযন্ত্র ও অর্থযন্ত্র তার কর্ণধারদের মহামূল্যবান সব মাথা, বাস্তবিক মানুষের মাথার কী বাহাদুরি! ওরাং, গোরিলা, শিম্পাঞ্জিদের বিপুল দেহের তুলনায় মাথা কত ক্ষুদ্র, ঘিলু কত কম। এমনকী—হাতি গন্ডারেরও! কিন্তু দ্বিপদ স্তন্যপায়ী জীব মানুষের মাথা কত বড় এবং ঘিলু কত বেশি। মাথাই মানুষের সব। সবার উপরে মাথা, তারপর মানুষ।
মানুষ বীর তাই তার মাথা উন্নত। মানুষ উট নয়, মানুষ গোরিলা নয়, মানুষ গন্ডার নয়। গোরিলা, গন্ডার, অজগর, উট প্রভৃতি সমস্ত জন্তুর দোষগুণ মিলিয়ে—মিশিয়ে মানুষ। বিশেষ করে বড় বড় মাথাওয়ালা মানুষ। তাই মানুষ শ্রেষ্ঠ জীব। উট চলে মরুভূমিতে, মানুষ চলে বড় বড় শহরের রাজপথে, সরীসৃপ চলে জঙ্গলে, মানুষ চলে জেট—বিমানে। বনের হিংস্র বাঘ ‘ম্যানইটার’, মহানগরের সুসভ্য মানুষ ‘ম্যানকিলার’। যে—কোনো হিংস্র জীবের দংশনের পদ্ধতি একরকম, যেমন নখ বা দাঁত দিয়ে আঁচড় বা ছোবল, কিন্তু শ্রেষ্ঠ জীব মানুষের দংশন ও আক্রমণের বৈচিত্র্য অনন্ত। জন্তুর আঁচড় বা ছোবল দিয়ে যুগপৎ একাধিক জীবকে আঘাত বা হত্যা করা যায় না, কিন্তু মানুষ ন্যাপলাম ও হাইড্রোজেন বোমা দিয়ে নগরের পর নগর ধ্বংস করতে পারে এবং হাজার হাজার মানুষকে স্বচ্ছন্দে হত্যা করতে পারে। তা ছাড়া নৃশংস হত্যার উদাহরণ সভ্য মানবজগৎ থেকে যত দেওয়া যায়, কোনো জীবজগৎ থেকে তার সহস্রাংশের একাংশ দেওয়া যায় না। তার কারণ মানুষের মাথা আছে এবং সেই মাথার কানায় কানায় ভরা বুদ্ধি আছে। অন্য জন্তুর মাথা থাকলেও বুদ্ধি নেই, অন্তত মানুষের মতো বুদ্ধি নেই। মানুষের বৈজ্ঞানিক নাম তাই ‘বুদ্ধিমান মানুষ’ বা ‘হোমো—স্যাপিয়েন্স’।
বুদ্ধির উত্তুঙ্গ শিখরে আজ মানুষ পৌঁছেছে। বৈজ্ঞানিক অভিব্যক্তিবাদের একটি মূসূত্র হল—যে দৈহিক হাতিয়ারের জোরে যে যুগে (ভূতাত্ত্বিক যুগ) যে জীবের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়, পরে সেই হাতিয়ারের ক্রমোন্নতির ফলে অত্যুন্নত হাতিয়ারই হয় তার ধ্বংসের কারণ। এইভাবেই জীবজগতে ‘ইভল্যুশন’ বা ক্রমাভিব্যক্তি সম্ভব হয়েছে। বর্তমান ভূতাত্ত্বিক যুগ স্তন্যপায়ী জীবের যুগ এবং সমস্ত স্তন্যপায়ী জীবের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হল ‘মানুষ’। মানুষের এই শ্রেষ্ঠত্ব বা প্রাধান্য প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে বড় সহায় হয়েছে ‘বুদ্ধি’। নখ ও দাঁতের মতো বুদ্ধিও দৈহিক হাতিয়ার বিশেষ (কর্পোরিয়াল টুল) কারণ দেহহীন বুদ্ধি বলে কিছু নেই। দৈহিক ক্রমবিকাশের উন্নত স্তরেই মস্তিষ্কের বিকাশের ফলে মানুষের মধ্যে বুদ্ধির আশ্চর্য প্রকাশ হয়েছে। সেই বুদ্ধির অনুশীলন ও ক্রমিক বিকাশের ফলে মানুষ অন্যান্য জীবজন্তুর দেহাবদ্ধ হাতিয়ারের দৃঢ়বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে, দেহাতিরিক্ত পাথুরে হাতিয়ার থেকে আধুনিক নানা রকমের বৈজ্ঞানিক ও যান্ত্রিক হাতিয়ার (নন—কর্পোরিয়াল টুল) তৈরি করতে শিখেছে। আজ মানুষের বুদ্ধির এমন চরম বিকাশ হয়েছে যে, বৈজ্ঞানিক অভিব্যক্তির সূত্রানুসারে সেই বুদ্ধিই বর্তমানে সর্বগ্রাসী সংহারমূর্তিতে সর্বত্র মানুষের সম্মুখীন।
অর্থাৎ মানবজাতির অবলুপ্তির অনিবার্যতা আজকের জাগতিক পরিবেশে এত সুপরিস্ফুট যে মানুষের বুদ্ধি যদি দুর্বুদ্ধির বাঁকা পথ ছেড়ে এখনও সহজ সরল পথে চলতে না পারে, তাহলে মানুষের এই শখের সমাজ ও শৌখিন সভ্যতা, এমনকী মানুষের অস্তিত্ব পর্যন্ত, এক ব্যাপক ধ্বংসলীলায় মহাপ্রলয়ের মধ্যে একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। কিন্তু দুর্বুদ্ধির বাঁকা পথেই আজ মানববুদ্ধির দুরন্ত অভিযান অব্যাহত। এই অভিযানের সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত চন্দ্রলোকে অভিযান। মনে হয় যেন মানুষের আর কোনো সমাধানযোগ্য সমস্যা নেই এবং প্রকৃত রহস্য কিঞ্চিৎ উদঘাটন করেই যেন বিজ্ঞানের প্রকৃতিজয়ের সমস্ত সাধনাও শেষ হয়ে গেছে। যেন পরাজিত প্রকৃতির সামনে বিজয়ী মানুষ সদম্ভে দাঁড়িয়ে আছে, তার আর কিছু করার নেই। বাস্তবিক আর কী—ই বা করার আছে। পরমাণু বিদীর্ণ করে তার ভিতরের মূলশক্তি আয়ত্ত করা হয়ে গেছে, স্পেসক্রাফট তৈরি করে ঘণ্টায় চব্বিশ হাজার মাইল বেগে ২ লক্ষ ২৫ হাজার মাইল দূরে চন্দ্রলোকে পৌঁছোনো ও পদার্পণ করাও সম্ভব হয়েছে। এমন সব বোমা তৈরি করা সহজসাধ্য হয়েছে যা দিয়ে সমগ্র মানবজাতিকে, তার বহুকালের কীর্তিচিহ্নসহ, নিমেষে নিশ্চিহ্ন করে ফেলা যায়। অ্যাটম বোমা নয় শুধু, রাসায়নিক ও বিষাক্ত বীজাণুর বোমা পর্যন্ত স্তূপাকার মজুত হয়েছে। এ ছাড়া ভোগবিলাসের সামগ্রীর এত বৈচিত্র্য ও প্রাচুর্য আজ সৃষ্টি করা হয়েছে যে পৃথিবীর অন্তত শতকরা দশজন মানুষ আজ রাজার মতো বিলাসিতা করতে না পারলেও অন্তত ছোটখাটো সামন্তের মতো বেশ আরামে ও স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতে পারে। অতএব করার আর কিছুই নেই, বিজ্ঞান ও টেকনোলজির সাহায্যে সবই করা হয়ে গেছে। অবশ্য পৃথিবীর অন্তত শতকরা ৭৫ জন লোক আজও বেঁচে থাকার মতো খাদ্য পায় না, অনেকটা জানোয়ারের মতো জীবনধারণ করে, সমাজে চলার মতো সামান্য শিক্ষা পায় না, রোগব্যাধির চিকিৎসা ভূতুড়ে—হাতুড়েদের দিয়েই করায়, বল্কল ছাড়লেও অর্ধাবৃত অবস্থায় দেহরক্ষা করে এবং মাথা গোঁজার আশ্রয় খুঁজে পায় না। কিন্তু তাতে কী? টেকনোলজি ও বিজ্ঞানের মহিমা তাতে ম্লান হয় না।
তবু আজও যখন ভূমিকম্পে নগরের পর নগর ধ্বংস হয়ে যায়, হাজার হাজার প্রাসাদ তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে, লক্ষ লক্ষ মানুষ অসহায় শিশুর মতো (শ্রেষ্ঠ নভশ্চর ও অ্যাটমিক বৈজ্ঞানিক পর্যন্ত) আর্তনাদ করতে থাকে এবং পৃথিবীর শতকোটি ভগবানের নাম করে বাঁচতে চায়, তখন বৈজ্ঞানিক কম্পনযন্ত্রে ভূমিকম্পের এপিসেন্টার কোথায় বা কত দূরে তা জানা গেলেও, পৃথিবী যে কাঁপছে বা টলছে তা থামানো যায় না। নিউক্লিয়ার—বোমা ও স্পেসক্রাফট—এর ল্যাবরেটরিও তখন কাঁপতে থাকে, বড় বড় চেয়ারে বসে বিজ্ঞানীরা কাঁপতে থাকেন, বিশাল বিশাল প্রাসাদের বাসিন্দারা কাঁপতে থাকেন, রাজার সিংহাসন ও ডিকটেটরদের পায়ের তলাও কাঁপতে থাকে। তবু তো প্রকৃতি অনেক উদার, এক—দুই মিনিটের বেশি কাঁপে না। যদি কাঁপত—তাহলে। তাহলে যা—ই হোক—না কেন, বিজ্ঞান বা টেকনোলজির মর্মান্তিক পরাজয় হত। কিন্তু ভূকম্পনের কথা থাক, কয়েকটা খুব সাধারণ সমস্যার কথা বলি।
ঝড় বা বৃষ্টি কোনোটাই আজও বিজ্ঞানের আয়ত্তে আসেনি। বৃষ্টি হবে কি হবে না, ঝড় হবে কি হবে না, অথবা হলে কত মাইল বেগে হবে, তা অবশ্য হাওয়াবিজ্ঞানীরা বলতে পারেন। বিজ্ঞানের এই পর্যন্ত কৃতিত্ব। তাতে মানুষের অনেকটা উপকার হলেও প্রকৃত উপকার কী হয়েছে তা ভাববার বিষয়। যদি বৃষ্টি না হয় তাহলে আজও পৃথিবীর সমস্ত মানুষ কাতর দৃষ্টিতে আকাশের দিকে চেয়ে থাকে কেন এবং আদিম মানুষের মতো হোমিয়োপ্যাথিক ম্যাজিকের সাহায্যে বৃষ্টি কামনা করে কেন? বৈজ্ঞানিকরা রকেট নিক্ষেপ করে বৃষ্টিপাত অথবা বৃষ্টির মতো জল—সরবরাহ কেন করতে পারেন না? প্রচণ্ড বেগে ঝড় যখন হয়, তখন ঝড়ের বেগ ও গতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে কত বিপদ থেকে মানুষ মুক্তি পেতে পারে, কিন্তু আজও তা করা সম্ভব হয়নি কেন? বায়ুসংঘর্ষে মেঘনিঃসৃত বিদ্যুতের মধ্যে কত কোটি কোটি ওয়াট বৈদ্যুতিক শক্তি সঞ্চিত থাকে এবং তার অপচয় হয়। সামান্য কয়েকটি বিদ্যুৎ ধরে ফেলতে পারলে পৃথিবীর প্রত্যেক গ্রাম বৈদ্যুতিক আলোয় ঝলমল করে উঠতে পারে এবং অন্ধকারের মানুষ আলোর স্পর্শে নতুন জীবন পেতে পারে। কিন্তু প্রকৃতির বিনামূল্যের বিদ্যুৎকে বন্দি করে আজও ইলেকট্রনিক যুগে বৈজ্ঞানিকদের পক্ষে আলো বিতরণ করা সম্ভব হয়নি। পৃথিবীর মাত্র এক—চতুর্থাংশ স্থলভাগ, এবং তার অর্ধেক স্থানে এত অত্যধিক ঠান্ডা বা উত্তাপ যে তাতে আবাদ করে ফসল ফলানো যায় না। যখন বিজ্ঞান ও টেকনোলজির এত কীর্তি চতুর্দিকে বিঘোষিত হচ্ছে, তখন পৃথিবীর এই অর্ধেক জায়গাতে ভালো ফসল ফলাতে পারলে আজকের বাড়ন্ত মানুষের খাদ্যসমস্যার সমাধান হয়ে যেত। কিন্তু তা করা হয়নি কেন? এবং তা না করে চন্দ্র ও অন্যান্য গ্রহ—উপগ্রহ পরিদর্শনের জন্য এই বিপুল অর্থের অপচয় করা হচ্ছে কেন? চন্দ্রে অবতরণ করে মহাবীর নভোশ্চরা পৃথিবীতে ফিরে এলে কি পৃথিবীর একজন অভুক্ত মানুষ খেতে পাবে, একটিও নিশুতি রাতের মতো অন্ধকার গ্রামে আলো জ্বলবে, অসংখ্য অশিক্ষিত মানুষের মধ্যে একজন মানুষও কি শিক্ষা পাবে? তা পাবে না, শুধু যান্ত্রিক মানুষ চন্দ্রলোক থেকে ফিরে এলে যন্ত্রদানবরা বাহবা দেবে, কিন্তু প্রকৃত মানুষ যারা তারা হাসবে।
বিজ্ঞানাচার্য চন্দ্রশেখর বেঙ্কট রমন তাই চন্দ্রলোক অভিযানের এই বৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টাকে হাস্যকর পাগলামির চূড়ান্ত নিদর্শন বলে অত্যন্ত দুর্মর ভাষায় সমালোচনা করেছেন (মাদ্রাজ ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে সমাবর্তন ভাষণ, ১৯৬৬)। রমন বলেছেন :
It is nothing but sheer raving lunacy to spend millions of dollars to shoot men into space and make them walk there. I simply smile with loathing and contempt at this lunacy on the part of mankind.
বিখ্যাত কসমোলোজিস্ট অধ্যাপক ফ্রেড হয়েল বোম্বাইতে ‘টাটা ইনস্টিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ’ পরিদর্শনকালে চন্দ্রলোকযাত্রা সম্বন্ধে ‘criminal waste of money and a useless kind of activity’ বলে মন্তব্য করেছেন। রমন বলেছেন যে চন্দ্রলোকে কী আছে না—আছে তা দেখবার ইচ্ছা প্রকাশ করা গোলামের চেয়েও অধম একদল বৈজ্ঞানিকের বাগাড়ম্বর ও বুজরুকি ছাড়া কিছু নয়। অবিমিশ্র অবজ্ঞা ও ঘৃণায় রমন বলেছেন, তাঁর সমগ্র সত্তা পর্যন্ত শিউরে ওঠে যখন তিনি শাসকশ্রেণির কেনা—গোলাম এই বৈজ্ঞানিকদের কথা চিন্তা করেন। বিগত ষাট বছরের মধ্যে, রমনের মতে, অগ্রগতির নামে বিজ্ঞানের এরকম দুর্গতি ও দুশমনমূর্তি আর কোনোকালে দেখা যায়নি।
রমনের বক্তব্যের সঙ্গে পৃথিবীর আরও অনেক বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক একমত। যাঁরা রাষ্ট্রযন্ত্রের কর্ণধারদের কাছে নিজেদের মগজ ও বিবেক লক্ষ লক্ষ টাকার বিনিময়ে বিকিয়ে দেননি, এরকম স্বাধীনচেতা বৈজ্ঞানিক এখনও বিভিন্ন দেশে যাঁরা আছেন, তাঁরা রমনের উক্তি বর্ণে বর্ণে সমর্থন করেন। চন্দ্রলোকে এক—একটি অভিযানের জন্য যে কোটি কোটি ডলার ও রুবল ব্যয় হয়, তা দিয়ে শত শত গ্রামকে মহানগরে রূপায়িত করা যেতে পারে, লক্ষ লক্ষ অভুক্ত মানুষকে দিনের পর দিন খাওয়ানো যেতে পারে, শতাধিক হাসপাতাল তৈরি করে লক্ষাধিক পীড়িত মানুষের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যেতে পারে, এবং আমেরিকার নিজের দেশের লক্ষ লক্ষ অমানুষ ও আধামানুষদের পরিপূর্ণ মানুষের মতো বাঁচার অধিকার দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু তা না করে চাঁদে যাবার চেষ্টা হল ধনতান্ত্রিক সমাজের জীর্ণ কাঠামোকে অফুরন্ত অপব্যয়ের ভিতর দিয়ে কোনোরকমে বাঁচিয়ে রাখার অপচেষ্টা ছাড়া কিছু নয়। দুঃখ হয় যখন দেখা যায় সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েট ইউনিয়নও আমেরিকার সঙ্গে এই বৈজ্ঞানিক বালচাপল্য ও পাগলামির প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়ে কোটি কোটি রুবল অপব্যয় করছে। প্রতিরক্ষার খাতিরে না—হয়, সোভিয়েট রাষ্ট্রের পারমাণবিক মারণাস্ত্র তৈরির যৌক্তিকতা ভাবা যায়, কিন্তু চন্দ্রমুখী অ্যাপোলো—স্পুটনিক—লুনিকের প্রতিযোগিতার কথা বাস্তবিক ভাবা যায় না।
বিজ্ঞানের কীর্তি অনেক, রীতিমতো তাজ্জবও যে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আজও যখন আন্দামানি ও অন্যান্য আদিম জনগোষ্ঠীর মতো ঝড়জল বজ্রবিদ্যুৎ অতিবৃষ্টি অনাবৃষ্টি ভূকম্পন প্রভৃতি অনাদিকালের প্রাকৃতিক লীলা মানবশক্তির নিয়ন্ত্রণের বাইরে মনে হয়, এবং আদিম দেবতা ও আদিম ম্যাজিকের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া অ্যাটমিক বৈজ্ঞানিকেরও গত্যন্তর থাকে না, তখন কি এ কথা বলা যায় যে বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীর সমস্ত কীর্তি ও কর্তব্য শেষ হয়ে গেছে? তা বলা যায় না।
যদি সমাজ ও সভ্যতার কথাই বলা যায়, তাহলে আজ প্রায় অনিবার্য আত্মবিলোপের অতল অন্ধকারের সামনে দাঁড়িয়ে পৃথিবীর অন্তত শতকরা নব্বুইজন মানুষ প্রশ্ন করতে পারে, আহা! সভ্যতার কী অপরূপ মূর্তিই না এতকাল ধরে গড়ে তোলা হয়েছে। কোনো অপরূপ সুন্দরী রমণীর সর্বাঙ্গে যদি বীভৎস দগদগে ঘা থাকে তাহলে তার রূপদর্শনে যে মানসিক প্রতিক্রিয়া হয়, মানুষের এই কয়েক হাজার বছরের সমাজ ও সভ্যতার দিকে চেয়ে দেখলেও তা ছাড়া অন্য কোনো প্রতিক্রিয়া হয় না। ধনতন্ত্রের ‘অ্যাফ্লুয়েন্ট’ সমাজ এবং সমাজতন্ত্রের সর্বার্থসাধক সমাজ, কোনো সমাজেই সত্যিকার ‘মানবিক’ পরিবেশ রচিত হয়নি। ‘মানবিক’ পরিবেশ বলতে এমন পরিবেশের কথা বলছি, যার মধ্যে মানুষ মুক্ত আলো বাতাসের আস্বাদ পেতে পারে, বুকভরা শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে পারে, পরস্পরের সঙ্গে প্রাণ খুলে মিশতে পারে ও প্রীতির সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে, জাতি—ভাষা—ধর্ম—বর্ণ প্রভৃতি বহুকালের ব্রহ্মদৈত্যদের কবল থেকে মুক্তি পেতে পারে, নিজের কথা ও বক্তব্য সকলের কাছে নিঃসংকোচে ও নির্ভয়ে বলতে পারে, ইচ্ছামতো শিক্ষা ও জ্ঞানলাভ করতে পারে, খাওয়া—পরা—বসবাসের চিন্তা থেকে মুক্ত হতে পারে এবং সমগ্র সমাজটাকে একটা বৃহৎ পরিবার মনে করে নিজের মেহনত ও বুদ্ধি সকলের কল্যাণের জন্য নিয়োগ করতে পারে। এই ‘মানবিক’ পরিবেশ কোথাও রচনা করা সম্ভব হয়নি। টেকনোক্রাসি ও ব্যুরোক্রাসির অখণ্ড প্রতিপত্তি দুই সমাজেই। এই যন্ত্রতন্ত্র ও আমলাতন্ত্রের নিষ্পেষণে ‘অ্যাফ্লুয়েন্ট’ ধনতান্ত্রিক সমাজ ক্রমেই যেমন একটি বিশাল পাগলাগারদে পরিণত হচ্ছে, ‘সর্বার্থসাধক’ সমাজতান্ত্রিক সমাজও তেমনি পরিণত হচ্ছে বিশাল জেলখানায়। দুই গারদের মধ্যে মানুষ হাঁপাচ্ছে, স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার মতো একটু নির্মল বায়ুসেবনের সুযোগ পাচ্ছে না কোথাও।
প্যাকার্ডের ‘ওয়েস্ট মেকারস অথবা হোয়াইটের ‘অর্গানাইজেশন ম্যান’ সম্বন্ধে কোনো মন্তব্য না করেও আমেরিকার ধনতান্ত্রিক ভূরিসমাজের (অ্যাফ্লুয়েন্ট সোসাইটি) বাহ্য জৌলুষেসর অন্তরালবর্তী বিকট বাস্তব রূপটি সহজেই উদ্ঘাটন করা যায়। টুকরো চলচ্চিত্রের মতো আমেরিকান সমাজজীবনের সামান্য কিছু তথ্যের আলোকসম্পাতে সেই রূপটি উদ্ভাসিত হয়ে উঠতে পারে। অন্য কারও নয়, প্রেসিডেন্ট জনসনের নিজের হিসেবমতোই দেখা যায়, আজও আমেরিকায় কমপক্ষে ৪০ লক্ষ বালক—বালিকা প্রতিদিন প্রায় অনাহারে স্কুলে যায়, ১৮ বছরের কম বয়সের ছেলেমেয়েদের মধ্যে শতকরা অন্তত ১০ জনকে গর্হিত অপরাধের জন্য আদালতে যেতে হয়, প্রত্যেক বছর স্কুলের লেখাপড়া ছাড়তে হয় অন্তত ১০ লক্ষ ছাত্রকে, এবং আরও ১০ লক্ষ ছাত্র মস্তিষ্কের ব্যাধি ও মৃগীরোগে আক্রান্ত হয়। শিশু ও ঢিনএজারদের জীবনের একটি ছবি সম্পূর্ণ ছবির একটি অংশ মাত্র। নিউ ইয়র্ক শহরে প্রতিদিন গড়ে ১৪৯ জন লুণ্ঠিত, ৭৮ জন আক্রান্ত, ৫ জন নারী ধর্ষিত এবং ৩ জন নিহিত হয়। এ ছাড়া ৪৭৫টি চুরি—ডাকাতি হয় প্রতিদিন। আমেরিকার বড় বড় দশটি মহানগরের মধ্যে (যেমন হাউস্টন, টেক্সাস, ব্যালটিমোর, ওয়াশিংটন, শিকাগো প্রভৃতি) নিউ ইয়র্কেই নাকি দৈনিক খুনের সংখ্যা (তিনটি) সবচেয়ে কম। সমস্ত শহরে বাৎসরিক খুনের হিসেব করলে লক্ষের অঙ্ক ছাড়িয়ে যায়, নারীধর্ষণ, লুণ্ঠন, ডাকাতি ইত্যাদির তো কথাই নেই। বিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকে (অর্থাৎ প্রকৃতপক্ষে আমেরিকার ধনতান্ত্রিক টেকনোলজিক্যাল উন্নতির সূচনা থেকে) আজ পর্যন্ত আমেরিকায় কেবল আগ্নেয়াস্ত্রের সাহায্যে আত্মহত্যা ও খুনের সংখ্যা হল ৭ লক্ষ ৫০ হাজার। এই সংখ্যা প্রথম মহাযুদ্ধে নিহত আমেরিকানের চোদ্দোগুণ এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে নিহতের তিনগুণ। বর্তমানে প্রতিদিন আমেরিকায় গড়ে ৫০ জন আগ্নেয়াস্ত্রের সাহায্যে নিহত ও খুন হয়, অর্থাৎ প্রতি আধ ঘণ্টায় একটির বেশি। এ ছাড়া আত্মবিস্তৃতির জন্য নেশার বৈচিত্র্য ও বিস্তার প্রত্যহ যে কী হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে আমেরিকায় তা বলা চলে না। অ্যালকোহল তো আছেই, কত রকমের ড্রাগ ও তার সেবনভঙ্গি এবং নেশাখোরদের কত রকমের যে চক্র ও গোষ্ঠী তার ঠিক নেই। সমাজজীবনের অন্যান্য দিকের বিকৃতি—বৈচিত্র্যের সামান্য আভাস দিতে গেলেও প্রায় একটি আধ টন ওজনের রিপোর্ট রচনা করতে হয়। আপাতত তা না করেও শুধু কয়েকটি তথ্যের আলোকে আমেরিকার যান্ত্রিক ভূরিসমাজের যে আসল কঙ্কালটি চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ভেসে ওঠে, তা আর যা—ই হোক, বিচারের কোনো মানদণ্ডেই সুস্থ সমাজ মনে হয় না। যন্ত্র ও টেকনিক মূল লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে মানুষকে একরঙা মানুষে পরিণত করেছে একদিকে, যে মানুষ শ্রেণিবৈষম্য ও শ্রেণিবিরোধ পর্যন্ত ভুলে গিয়ে আজ কেবল উপভোগ ও প্রলোভনের নেশায় মশগুল, এমনকী নিজের সত্তা সম্বন্ধেও অচৈতন্য—আর অন্যদিকে ক্রমে মানুষকে করেছে খণ্ডিত বিকৃত বীভৎস উন্মার্গ ও আত্মঘাতী।
এদিকে প্রায় অর্ধশতাব্দীর সমাজতন্ত্রের প্রয়োগ—পরীক্ষায় সোভিয়েট সমাজ যে স্তরে উত্তীর্ণ হয়েছে, তাতে জঠরাগ্নি ও বেকারত্বের নিবৃত্তি হলেও মানবোচিত চরিত্র ও গুণের বিকাশ হয়নি। অন্যান্য আধুনিক শিল্পোন্নত সমাজের মতো সোভিয়েট সমাজেও আজ যন্ত্রতন্ত্র ও আমলাতন্ত্রের দোর্দণ্ড প্রতাপ এবং সমাজতন্ত্রের পুণ্য নামে তার নিরেট নিশ্ছিদ্রতা অনেক বেশি। আত্মতুষ্ট মানুষ সেখানে যন্ত্রের মতো নির্বিকার। কেবল নির্বিকার নয়, বৈকল্য ও বিকৃতি সোভিয়েট সমাজের মানুষের মধ্যেও দেখা দিচ্ছে। অধ্যাপক জুরি টখাচেভস্কি লিখেছেন (প্রাভদা, ২৯ মার্চ ১৯৬৯) যে ১৯৬৮ সালে শুধু মস্কো শহরে যতগুলি দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে, তার মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি সুরাপানজনিত মত্ততার জন্য, এবং যতগুলি ডিভোর্স হয়েছে তার প্রায় অর্ধেকের (৪০ শতাংশ) কারণ একই। ব্যক্তিগত—দলগত বিরোধ ও মারামারির ফলে মস্কো শহরে যত খুন ও হত্যাকাণ্ড ঘটেছে (১৯৬৮—তে), তার মধ্যে শতকরা ৮৫টি পানোন্মত্ত অবস্থায় সংঘটিত। মস্কো শহরে যত খুন হয় তার মধ্যে শতকরা ১৮টি খুন করে সমাজবিরোধী লুচ্চা—গুন্ডারা। ১৯৬৬ সালে সুপ্রিম—সোভিয়েট থেকে গুন্ডামি দমনের জন্য একটি জরুরি আইন পাশ করা হয়েছিল দু—বছরের জন্য। কিন্তু তাতে বিশেষ কোনো ফল হয়নি বলে আবার ১৯৬৮ সালে সেটি বলবৎ করা হয়েছে। আশ্চর্য লাগে এই ভেবে যে, যে দেশে বেকার নেই, খাদ্যাভাব নেই, সেই দেশের সমাজে ও মহানগরেও আজ খুন—জখম—হত্যা ও আত্মহত্যার দৃশ্য প্রকট হয়ে উঠেছে, সমাজবিরোধী লুচ্চা গুন্ডাদের প্রতাপ বাড়ছে। কেন এই সব উপসর্গ দেখা দিচ্ছে? লেনিনের রচনাবলি আবৃত্তি করে, অথবা আমেরিকার সঙ্গে চন্দ্রাভিযানের প্রতিযোগিতায় কোটি কোটি রুবল অপব্যয় করে, এই ‘কেন’—র উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। অথচ উত্তর দেওয়া প্রয়োজন।
উত্তর পরিষ্কার। শিল্পোন্নত সমাজের আদর্শভ্রষ্ট বিজ্ঞান টেকনোলজি ও ব্যুরোক্রাসি, ওয়েস্ট—মেকার, স্টেটাস—সিকার (ইকনমিক ও পলিটিক্যাল) ও অর্গানাইজেশন ম্যান—আজ ধনতান্ত্রিক নিউ ইয়র্ক ও সমাজতান্ত্রিক মস্কোর মধ্যে ভৌগোলিক ও আদর্শগত ব্যবধান প্রায় ঘুচিয়ে দিয়েছে। তাই আজ উভয়েরই অপচয়—প্রতিযোগিতা চন্দ্রলোক এবং পৃথিবী ছাড়া অন্যান্য গ্রহ লক্ষ্য করে। যন্ত্রতন্ত্র ও আমলাতন্ত্রের প্রতিপত্তি উভয় সমাজেই সমান, কোথাও ধনতান্ত্রিক গণতন্ত্রের নামে, কোথাও বা সমাজতন্ত্রের নামে। তাই মানসিক প্রতিক্রিয়া দুই সমাজের মানুষের মধ্যেই এক ও অভিন্ন। তা—ই হওয়ার কথা, কারণ মানুষ তো মানুষ এবং মানুষের বায়োলজিক্যাল পরিবর্তন নিশ্চয় ইডিওলজিক্যাল কারণে হয় না।
চাঁদের কথা বলি। দু—জন লোককে চন্দ্রলোকে পদার্পণ করানোর জন্য আমেরিকার মোট খরচ হয়েছে প্রায় ২৪০০ কোটি ডলার অর্থাৎ ১৯২০০ কোটি ভারতীয় টাকা। এই যন্ত্রবৈজ্ঞানিক ভোজবাজিতে মানুষের ও বিজ্ঞানের কিছু উপকার হবার সম্ভাবনা আছে? তা এখনই বলা সম্ভব নয়, বিজ্ঞানীরা বলেছেন। এখন যেটুকু ভাবা হয়েছে তা হল এই : চন্দ্রলোক থেকে জ্যোতিষীয় পর্যবেক্ষণের সুবিধা হবে অনেক, কারণ সেখানে কোনো অ্যাটমসফেরিক ও অয়নসফেরিক গন্ডগোল থাকবে না। চন্দ্রলোকে একটি জ্যোতিষীয় পর্যবেক্ষণের ঘাঁটি গড়া হবে, আপাতত এই হল বৈজ্ঞানিকদের পরিকল্পনা। কিন্তু তার জন্য খরচ হবে কত? যদি কুড়িজন লোক কাজ করতে পারে এরকম একটি খুব ঘাঁটি গবেষণার জন্য তৈরি করতে হয়, তাহলে তার জন্য বাৎসরিক খরচ হবে প্রায় ১০০ কোটি ডলার, পৃথিবী থেকে জিনিসপত্র ও খাদ্যদ্রব্য বহন করার জন্য খরচ পড়বে প্রতি কিলোগ্রামে ১০ হাজার ডলার এবং লেবার বা মজুরি চন্দ্রলোকে প্রতি ঘণ্টায় লাগবে এক লক্ষ ডলার। তারপর জ্যোতিষীর গবেষণার ফলে পৃথিবীর মানুষের কী লাভ হবে না—হবে তা কিছুই বলা যায় না। তাহলে এই বিরাট অর্থমেধযজ্ঞের কারণ কী এবং এত ঘটা করে তা প্রচার করার উদ্দেশ্যই বা কী?
যদি ব্রহ্মাণ্ডের কথা ধরা যায় তাহলে চন্দ্রলোকে পৌঁছোনোও নিতান্ত ছেলেখেলা ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। পূর্ণিমার রাতে নির্মেঘ আকাশে যে অসংখ্য নক্ষত্র আমরা দেখতে পাই, তার মধ্যে সূর্যের সবচেয়ে কাছাকাছি যে নক্ষত্র সেখানে পৌঁছতে বর্তমান অ্যাপোলোর ঘণ্টায় ২৫ হাজার মাইল বেগে কতদিন সময় লাগবে? চন্দ্রলোকে পৌঁছোতে তিন—চার দিন লাগে কিন্তু নিকটতম নক্ষত্রে পৌঁছোতে? ঘণ্টায় ২৫ হাজার মাইল বেগেও কম করে এক লক্ষ বছর লাগবে। যদি ভবিষ্যতে স্পেসক্রাফটের স্পিড আরও বাড়িয়ে দ্বিগুণ করা সম্ভব হয়, তাহলেও ৫০ হাজার বছরের আগে সবচেয়ে কাছের নক্ষত্রে পৌঁছোনো সম্ভব হবে না। অতএব ব্রহ্মাণ্ডের রহস্য ভেদ করার যদি প্রশ্ন ওঠে, তাহলে অ্যাপোলোর চন্দ্রলোকযাত্রা মনে হয় ঠেলাগাড়িতে কলকাতা থেকে বর্ধমানযাত্রার মতো। কাজেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের রহস্য ভেদের ব্যাপারটা স্পেস গবেষণায় নিযুক্ত বিজ্ঞানীদের বুজরুকি ছাড়া যে কিছু নয় তা বোঝা যায়। আসল রহস্য হল, সামরিক মারণাস্ত্রের গবেষণা নানা রকমের রকেট—নিক্ষেপ থেকে শেষ পর্যন্ত চন্দ্রলোক অভিযানের স্তর পর্যন্ত পৌঁছেছে। ধনতান্ত্রিক ভূরিসমাজে আজ সামরিক মারণাস্ত্র উৎপাদনই মুনাফাভিত্তিক অর্থনৈতিক গড়ন অটুট রাখার একমাত্র উপায়, তা ছাড়া তার ভাঙন ও বৈপ্লবিক পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। অ্যাপোলো এগারো সেই প্রচেষ্টারই সার্থক নিদর্শন। যেমন অ্যাপোলো এগারো ও তার স্যাটার্ন পাঁচ রকেট তৈরির জন্য প্রায় ৫০ লক্ষ যান্ত্রিক কলকবজা লেগেছে এবং তেরো—চোদ্দো হাজার কোম্পানির কারখানায় এইসব কলকবজা তৈরি হয়েছে। এর সঙ্গে আরও নানাবিধ মারণাস্ত্র তৈরির বিপুল সংগঠনের কথা যদি ভাবা যায়, তাহলে বোঝা যাবে যান্ত্রিক ভূরিসমাজে আজ মানুষের বিদ্যাবুদ্ধি, প্রতিভা এবং সাধারণের অর্থ কী বিপুল পরিমাণে শুধু ধ্বংসাত্মক কাজে প্রয়োগ করা হচ্ছে। সমাজ ও মানুষের পার্থিব জীবনের কোনো উন্নতি, কোনো কল্যাণ বা বাসনা—কামনার সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই এবং থাকতে পারে না।
এই কারণেই বিজ্ঞানাচার্য রমন চন্দ্রলোক ও গ্রহান্তরে যাত্রার বৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টাকে চূড়ান্ত অপচেষ্টা ও পাগলামি বলে উল্লেখ করেছেন। বিখ্যাত ঐতিহাসিক ও সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে টয়েনবি ও লুইস মামফোর্ডও এই বৈজ্ঞানিক কীর্তির কোনো প্রশংসা করতে পারেননি। টয়েনবি বলেছেন :
In a sense, going to the moon is like building the pyramid or Louis XIV’s palace at Versailles. Sizing up man’s achievement, one would say how amazing, how strange, that this creature is so marvellous in his technology, but in morals and social behaviour, he has stayed practically stationary. This makes technology a menace.
সমাজবিজ্ঞানী লুইস মামফোর্ড বলেছেন :
Though many now credulously believe that space travel will open up marvellous new possibilities, there are strong historical grounda for believing rather that this marks the fatal terminus of a process that has from the Pyramid Age on curbed human development. Space exploration itself is strictly a military by-product and without presure from the Pentagon and the Kremlin it would never have found a place in any national budget.
রমন—টয়েনবি—মামফোর্ডের মন্তব্য একসুরে বাঁধা। যাঁরা বাস্তবিকই সমাজচিন্তা ও মানবচিন্তায় মগ্ন, তাঁরা এ ছাড়া অন্য কোনো অভিমত পোষণ করতে পারেন না। মনীষী বার্ট্রান্ড রাসেল ৯৭ বছর বয়সে তাঁর আত্মজীবনীর তৃতীয় খণ্ড সম্প্রতি প্রকাশ করেছেন। তাতে মানবসমাজের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে তিনি গভীর আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন যে, যদি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হয়—এবং তা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি—তাহলে পারমাণবিক ও রাসায়নিক মারণাস্ত্রের ধ্বংসলীলায় সমগ্র মানবসভ্যতা ও মানবজাতির বিলুপ্তি অবশ্যম্ভাবী। আপাতত সমজ ও রাষ্ট্রের যে রূপ দেখা যাচ্ছে তাতে মহামৃত্যুর এই অবশ্যম্ভাবী পরিণতির বাইরে তিনি কোনো আশার আলোকরেখা দেখতে পাননি।
কিন্তু যদি বিশ্বযুদ্ধ না—ও হয়, এবং বিজ্ঞানের বর্তমান সমাজবিমুখ গতি ও মারণাস্ত্র উদ্ভাবনের গবেষণা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে বর্তমান মর্ত্যলোকে মানুষের পরমায়কত্মউ যে কতদিন তা বলা যায় না। বিশ্বরাষ্ট্রসংঘের প্রধান কর্মসচিব ইউ. থান্ট কিছুদিন আগে (জুন ১৯৬৯) ষাট পৃষ্ঠার একটি সংক্ষিপ্ত রিপোর্টে, বিজ্ঞানীরা কীভাবে পৃথিবীর আলো—বাতাস—জল পর্যন্ত বিষিয়ে তুলছেন, সেদিকে আবহাওয়া—বিজ্ঞানীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন এবং তাঁদের বিশ্বসম্মেলনে মিলিত হয়ে আলোচনার জন্য অনুরোধ করেছেন। থান্ট বলেছেন, যান্ত্রিক শিল্পোন্নত দেশে বিপুল আবর্জনা ও অপচয়—পদার্থ (যাকে ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়েস্ট’ বলা হয়), ডি. ডি. টি. পতঙ্গবিষ গ্যাস ধোঁয়া ধাতুমল ইত্যাদি প্রাকৃতিক আবহাওয়া এমনভাবে বিষিয়ে তুলেছে যে, সে সম্বন্ধে রাষ্ট্রনায়ক ও চিন্তাশীল বিজ্ঞানীদের অবিলম্বে অবহিত হওয়া কর্তব্য। এই বিপুল বিষাক্ত আবর্জনা—অপচয় যেভাবে সমুদ্রগর্ভে নিক্ষেপ করা হচ্ছে তাতে অল্পদিনের মধ্যে প্রাকৃতিক আবহাওয়ায় মানুষের বাঁচার মতো ন্যূনতম অক্সিজেনের অভাব ঘটতে পারে। এর সঙ্গে যদি পরীক্ষার জন্য পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের ফলাফলের কথা চিন্তা করা যায়, তাহলে মানুষের ভবিষ্যৎ যে কত ভয়াবহ ও অনিশ্চিত তা সহজেই বোঝা যায়। থান্ট সেই কথা স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন :
The consquence for the weather and climate of the world are uncertain, but could be catastrophic.
এই মহাবিপর্যয় ও মহামৃত্যুর পথে আজ যন্ত্রবিজ্ঞান ও যান্ত্রিক বিজ্ঞানীদের অগ্রগতি অপ্রতিরোধ্য মনে হয়। বোধহয় এই পরিণতির হাত থেকে মানুষের মুক্তি নেই। ‘বোধহয়’ বলছি এইজন্য যে মানবিক যুক্তিবুদ্ধির সুস্থ—স্বাভাবিক প্রয়োগের দ্বারা অবশ্যই মানুষের এই মহামৃত্যু এই প্রতিরোধ করা সম্ভব। কিন্তু যে সমাজ—রাষ্ট্রব্যবস্থা আজ বুদ্ধিমান মানুষের শ্রেষ্ঠ শক্তি ‘বুদ্ধি’কে মানুষের সর্বাত্মক সংহারের পথে পরিচালনা করছে, শুধু মুষ্টিমেয় ক্ষমতাবিলাসীর স্বার্থ চরিতার্থতার জন্য, সেই সমাজ ও রাষ্ট্রের বহু পুরোনো জীর্ণ কঙ্কাল পর্যন্ত না বদলাতে পারলে মানুষের মহামৃত্যুর পথে প্রতিরোধ করা কিছুতেই সম্ভব নয়।
১৯৬৯