চতুর্থ অংশ
“রাশিয়া শাস্তি দিতে পারে না।” কফির পেয়ালা টেবিলে রেখে অবনী বলল। “আমেরিকাও না।” হামজা বলল।
“কিন্তু একটা তৃতীয় শিবির—”
অবনীর কথায় বাধা দিয়ে হামজা বলল, “তোমার এই তৃতীয় শিবির একটি পক্ষিরাজ ঘোড়া। কল্পনায় আছে, বাস্তবে নেই। আর আছে নেহরুর বাগাড়ম্বরে। নেহরু হচ্ছে ভিক্ষুকের প্রবৃত্তি আর অভিজাতের বিবেক দিয়ে তৈরি এক বিচিত্র কেমিক্যাল কম্পাউণ্ড। ভিক্ষে নেবার বিবেক দংশন থেকে মুক্তি পাবার ফরমুলা এই তৃতীয় শিবিরের ধুয়ো। রাশিয়া বা আমেরিকা বা ঐ আন্তর্জাতিক সার্কাসটা, যার নাম ইউ এন ও, ওরা কেউই শাস্তি দিতে পারে না। তার কারণ, শাস্তি বলে কোনও বস্তু আমাদের দরকারে লাগে না।”
“আসলে তুমি একটা যুদ্ধবাজ।” অবনী ক্রুদ্ধ হয়েছে।
“তোমার এই সিদ্ধান্তের হেতু?”
“তোমার উক্তি। তুমি বলছ, শান্তি আমাদের দরকারে লাগে না। তোমার দরকার যুদ্ধ। তুমি কমিউনিস্ট।”
“আমি তো বলিনি, আমি যুদ্ধ চাই! বলেছি, মানুষের জীবনে শান্তির কোনও স্থান নেই।”
অবনী বলল, “পৃথিবীতে হয় যুদ্ধ, নয় শান্তি—এ ছাড়া আর কিছু নেই।”
“পৃথিবীতে নয়, দুটো দলের মধ্যে বলো।” হামজা শান্তভাবে বলল। “বলো- হয় যুদ্ধ, নয় সন্ধি। শান্তির কোনও ভূমিকা এর মধ্যে নেই।” একটু থামল হামজা। “তুমিই তো কমিউনিস্টদের মত শান্তি শান্তি বলে গাবিয়ে বেড়াচ্ছ। আবার আমাকে কমিউনিস্ট বলছ কেন?”
“তুমি তো রাশিয়ার কোনও দোষই দেখতে পাও না!” অবনীর স্বরে তখনও ঝাঁজ। “তুমি কমিউনিস্ট নও তো কী?”
“দ্যাখো অবনী,” হামজা এক ঢোক কফি খেল, “তুমি সব সময় আমার কথার কদর্থ করো। আমি কখনওই রাশিয়ার দোষ ঢেকে কথা বলিনে। তবে তোমরা যেসব অভিযোগে রাশিয়াকে অভিযুক্ত করো, আমি বলতে চাই, সেসব দোষে রাশিয়াই একমাত্র দোষী নয়। অন্তত পৃথিবীতে প্রথম আণবিক বোমা ফাটিয়ে হিরোশিমা আর নাগাসাকির অবলুপ্তি ঘটানোর অপকৃতিত্ব রাশিয়ার নয়। ডেমোক্রেটিক ভ্যালুস পাইকারি হত্যাকাণ্ডের সৃষ্টি করতে পারে, বিবেক যে বাধা দিতে পারে না—এই নিষ্ঠুর সত্য ইতিহাস বহন করছে। আণবিক মারণাস্ত্র তৈরির পাল্লায় রাশিয়া কিছু এগিয়ে গিয়েছে বলে সব দোষের দোষী রাশিয়া, আর আমেরিকা পিছিয়ে পড়েছে বলে সে ধোয়া তুলসী পাতা—এ আমি মানতে রাজি নই।
“তবে দুটোর মধ্যে গণতান্ত্রিক পক্ষ কি সমর্থনীয় নয়?” অবনী যেন আত্মপক্ষ সমর্থন করছে।
“আমার কাছে রাশিয়ার আর আমেরিকার তৈরি আণবিক বোমার মধ্যে কোনও প্রভেদ নেই। বিটুইন দি ডেভিল অ্যাণ্ড দি ডিপ সি পছন্দ করার কিছু নেই। রামের মারেও মরব, রাবণের মারেও মরব।
“রাম আর রাবণকে তুমি এক আসনে বসাতে চাও?”
“কেন নয়?”
“রাম কি একটা নীতির জন্য সংগ্রাম করেননি?”
“কিসের নীতি?”
“বিশৃঙ্খল দেশে একটা ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি লড়েছিলেন। প্রেমের জন্য তিনি লড়েছিলেন।”
“সেই কারণে রাশিয়াতেও তো সমরায়োজন হচ্ছে। কমিউনিস্ট রাজ্য—ধর্মরাজ্য—প্রতিষ্ঠার জন্য বিরাট ধ্বংসযজ্ঞের আয়োজন হচ্ছে। পৃথিবীর বুক থেকে মানুষ নামক জীবকে অবলুপ্ত করার পর যে বিস্তীর্ণ শ্মশানক্ষেত্র অবশিষ্ট থাকবে, তার ওপর হয় কমিউনিস্ট পতাকা উড়বে, নয় ডেমোক্রেসির পতাকা উড়বে। যেমন কুরুক্ষেত্রের পর ভারতের মহাশ্মশানে পাণ্ডবদের পতাকা উড়েছিল, যেমন স্বর্ণলঙ্কার বীভৎস শ্মশানে রামের ঝাণ্ডা গাড়া হয়েছিল। কিন্তু সেসব ধর্মরাজ্যের প্রসাদ পেয়েছিল কারা? শকুনি-গৃধিনী-শৃগালের দল। মানুষ ভস্মাবশেষে মিশে গিয়েছিল। এই যদি নীতির জয় হয় তো হোক, আমার তাতে লোভ নেই।” হামজা কফি খেতে লাগল।
“আসলে নীতি-ফিতি নয়, সব লড়াইয়ের মূলে পলিটিক্স্ আর পলিটিক্সের মূলে পার্সন্যাল ইগো।” হামজা কাপ থেকে মুখ তুলল। “তুমি প্রেমের কথা বললে না? সীতার প্রেমে পাগল রাম তাঁর স্ত্রীর উদ্ধারের জন্য তখনকার সব থেকে সমৃদ্ধ নগর ছারখার করে দিয়েছিলেন, কয়েক লক্ষ লোকের ভবলীলা সাঙ্গ করেছিলেন। তুমি বলছ, প্রেমের জন্য, নীতির জন্য রাম এ কাজ করেছিলেন। যাত্রা-থিয়েটারের নাটক-রচয়িতারাই ওসব গাল-ভরা কথা বলেছেন। বাল্মীকি বলেছেন, রাম তাঁর বংশমর্যাদা রক্ষার জন্যই লঙ্কা ধ্বংস করেছিলেন। রাম যুদ্ধ শেষে সেই রণক্ষেত্রেই সীতাকে ডাকিয়ে এনে জানিয়ে দিয়েছিলেন, তুমি জেনো, এই রণপরিশ্রম তোমার জন্য করা হয়নি।
রক্ষতা তু ময়া বৃত্তমপবাদং চ সর্বতঃ।
প্রখ্যাতস্যাত্মবংশস্য নাঙ্গং চ পরিমার্জতা ॥
(নিজের চরিত্ররক্ষা, সর্বত্র অপবাদ খণ্ডন, এবং আমার বিখ্যাত বংশের গ্লানি দূর করবার জন্যই এই কার্য করেছি।)—তা হলে রাম রাবণের চাইতে মহৎ কিসে?” একটু থেমে হামজা বলল, “কার অস্ত্রে মরণ ভাল, এই ব্যাপারে ভোট দেবার কোনও মানে হয় না। আমার কোনও পছন্দ নেই। আমার শুধু যন্ত্রণা আছে।”
“তার মানে তুমি ফেটালিস্ট। অদৃষ্টবাদী। জগতের সংকট মোচনে তোমার কোনও আগ্রহ নেই। তুমি একটি নির্বীর্য ইনটেলেক্চুয়াল। কফি হাউসে আর বারে বসে মস্তিষ্ক কণ্ডূয়ন করা তোমার বিলাস। আসলে তুমি শালা একটি বোতল-বাজ ছাড়া কিছু নও। যন্ত্রণা তোমার লিভারে।”
“অদৃষ্টবাদী হতে পারলে হয়তো বেঁচে যেতাম; প্রাত্যহিক অস্তিত্বের যন্ত্রণায় ঘেয়ো কুকুরের মত অস্থির হয়ে উঠতাম না।” হামজার স্বর বড় ক্লাস্ত। “জগতের সংকট মোচন করা কারও সাধ্য নয়। জগতের তো আর একটা-দুটো সংকট নয়, যত কোটি লোক তত কোটি সংকট। পলিটিক্যাল বা অর্থনৈতিক ফরমুলা দিয়ে এইসব সংকটের সমাধান কোনও দিনই করা যাবে না।”
“তা বলে তো আর হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা যায় না!” অবনী অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে। “তোমার কথা শুনে মনে হয়, আমাদের কোনও ভবিষ্যৎ নেই—কোনও কিছু করবার নেই।”
“নেই আমি বলিনি। আছে কি না, আমি তা নিজেই জানি না। ভবিষ্যৎ যদি থাকে, থাক তার প্রতি আমার কোনও বিদ্বেষ নেই। সে ভবিষ্যৎ যদি কোনও দিন আমার জীবনে বর্তমান হয়ে ওঠে, ভাল, তখন তাকে গ্রহণ করব। তবে এখানে বসে সেই ভবিষ্যতের কোনও ছবি—রঙিন বা বিবর্ণ – আমার চোখে ভাসে না। আমি আমার বর্তমান নিয়েই ব্যস্ত।”
“এতে কি তুমি সুখী, হামজা?”
“সুখী মানে?”
অবনী, আমার মনে আছে, হামজার এই প্রশ্নে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিল। সে প্রশ্নটার পুনরাবৃত্তি না করে সংশোধন করল। “তুমি কি এতে সন্তুষ্ট?”
“আদৌ না।”
“তবে?”
হামজা জবাব দিল না। কারণ, এর জবাব নেই। সে ম্লান হাসি তার মুখে ফুটিয়ে তুলল।
.
হামজার মুখে পুরাণের গল্প শুনলে আমার অদ্ভুত এক মনোভাব জেগে উঠত। ওর গল্প বলার অসাধারণ দক্ষতা ছিল। আর একদিন বলেছিল, “মাত্র পাঁচখানা গ্রামের জন্য কুরুক্ষেত্রের এত বিরাট ধ্বংসের কোনও মানে হয়? এত নরহত্যার পর আসলে পাণ্ডবেরা পেয়েছিল তো এক মহাশ্মশান, আর শোকের অপরিমেয় বোঝা, আর নিরবচ্ছিন্ন আর্ত হাহাকার! এর চাইতে জনপূর্ণ ভারতকে অটুট রেখে পাঁচটা পুরুষ আর একটা নারীর বনে বনে ঘুরে বেড়ানো খারাপ কী ছিল?
“আসলে ওরা প্রিন্সিপ্-এর দাস হয়ে পড়েছিল। প্রিন্সি-এর জন্য লড়াই করতে গিয়েই পাণ্ডবেরা এই মহা সর্বনাশটা ঘটিয়েছিল।”
আমি বলেছিলাম, “তা হলে কি ওরা ক্লীবের মত কাজ করত না?”
“তাই করত। পাণ্ডবদের সেই ইচ্ছাই ছিল। কারণ, ওরা অনেক সেনসিবল লোক ছিল। গীতার সূত্রপাতে অর্জুনের যে উক্তি, তাতে তাকে বিবেচক লোক বলেই প্রতিষ্ঠিত করেছে। ধ্বংসের চাইতে পরাজয় স্বীকার যে কখনও কখনও অনেক মূল্যবান, অর্জুন বীরের মতই তা উপলব্ধি করেছিলেন। তাঁর সংকট আজকের যুগের যে-কোনও বিবেচক ব্যক্তিরই সংকট। কিছু দিন আগে গণতান্ত্রিক শিবিরের কর্ণধারগণকে আণবিক অস্ত্রের উৎপাদন বন্ধ করার পরামর্শ দিয়ে রাসেল যে বক্তব্য পেশ করেছিলেন তার সঙ্গে অর্জুনের ঐ উক্তির মূলত কোনও তফাত আছে বলে আমার মনে হয় না।
“কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ যদি পাণ্ডবদের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করত, তা হলে এই যুদ্ধ ঘটত কি না, সন্দেহ। সর্বনাশের মূলাধার হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণ। তিনি আদর্শবাদের আরক খাইয়ে অর্জুনের স্বচ্ছ দৃষ্টিকে ঘোলা করে দিলেন।
“এইসব আদর্শবাদ, নীতিবোধ—এগুলো যে কী সাংঘাতিক, কী অমানুষিক মনোবৃত্তি, কী জঘন্য মনস্তাত্ত্বিক বিকার, তা ভাবলে আমার মাথা ঘুরে যায়। এই রক্তপিপাসু দেবীদের পায়ে যুগে যুগে যে কত লক্ষ কোটি নরবলি দেওয়া হয়েছে তার সীমাসংখ্যা নেই।”
আমি বলেছিলাম, “নীতিবিবর্জিত মানুষ—সে কি পশুর সমান নয়?”
হামজা পাল্টা প্রশ্ন করেছিল, “আর মানুষবিবর্জিত নীতি—সেটা কী বস্তু?”
হামজা স্নান হেসেছিল। “আদর্শবাদের ভূত আমাকে কি করেছিল, জানো? ঐ তুমি যা বললে—পশু। আমি আমার বাবাকে ভুলে গিয়েছিলাম। একেবারে। বাবাকে আমার মানুষ বলে মনে হয়নি; যখন জেল থেকে বেরিয়েছিলাম, একটা মানুষ পরিবর্তিত হয়েছিল আদর্শগত এক সংজ্ঞায় দেশদ্রোহী, ট্রেটর! ইনফরমার, এক ঘৃণ্য জীব, একটা কাল্পনিক জঘন্য অস্তিত্ব। কে তার খোঁজ নেয়? সন্ত্রাসবাস পরিত্যাগ করলাম, মার্কসবাদে বিশ্বাস হারালাম (অদৃষ্টে, নিয়তিতে আমার কোনও দিনই বিশ্বাস ছিল না, ইতিহাসের নির্দিষ্ট গতিতেও তাই মন সমর্পণ করতে পারলাম না।)—তবু আদর্শবাদ ঘাড় থেকে নামেনি। তাই সেদিনও এক জঘন্য দেশদ্রোহীর কোনও খোঁজখবর করিনি। ইতিমধ্যে চাকরি নিয়েছি। পরিচ্ছন্ন হোটেলে ঘর নিয়েছি। আমার জীবনে প্রেম এসেছে—টুকি। বাবার কথা আর মনেও পড়ে না।”
হামজা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। “টুকি আমার জীবন ভরে দিয়েছে। এই জগতের কোথাও একটা সান্ত্বনা আছে, অর্থ আছে, জীবনের একটা কিছু উদ্দেশ্য হয়তো বা আছে—এ কথা ভাবতে আরম্ভ করেছি। একটা সকাল, একটা দুপুর, একটা বিকেল, একটা সন্ধ্যা, রাত্রি, ভিন্ন ভিন্ন ঋতু যে পীড়াদায়ক বিষয় নয়, সে কথা মনে উকিঝুঁকি দিতে শুরু করেছে। একজনের প্রতীক্ষা করার মধ্যে যে কত মুহূর্তের আশা-নিরাশা লুকিয়ে থাকতে পারে, সেসব আবিষ্কার করে আশ্চর্য হচ্ছি। বাবাকে—যে বাবা মাতৃহারা এক শিশুর একাধারে জনক আর জননীর ভূমিকা গ্রহণ করে তাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন, নিজেকে বঞ্চিত করে তাকে বালক থেকে কিশোরে, কিশোর থেকে যুবকে পরিণত হতে সাহায্য করেছিলেন, সেই বাবাকে একদম ভুলে গিয়েছি। এক ছুটির দিনে, সম্ভবত ঈদের পরবে, টুকির সঙ্গে বেরিয়েছি, হঠাৎ সিনেমার সামনে বাবার সঙ্গে দেখা। ভিক্ষে করছেন। একেবারে মুখোমুখি পড়ে গিয়েছিলাম, তাই, নইলে হয়তো চিনতেই পারতাম না! বাবার চোখ দুটো অন্ধ হয়েছিল, তাই, নইলে হয়তো চিনতে পারতেন! (‘কুছ খয়রাত করো সাব, অন্ধাকো কুছ খয়রাত করো। ‘) চন্ করে আমার মাথা ঘুরে গেল। টাইটা বুঝি ফাঁস লাগিয়ে দিয়েছে। সব কিছু—সিনেমা, চৌরঙ্গি, গাড়ি, লোকজন, টুকি, একটা ভিক্ষুক, একটা দেশদ্রোহী, ইনফরমার, আমার বাবা, বাপজান—বোঁ বোঁ করছে, ঘুরছে। আমার মাথা খালি, বুক-পেট সব ফাঁপা হয়ে গিয়েছে। কতজন যেন গুলিতে মরেছে, কে যেন ফাঁসিতে মরেছে, কার দ্বীপান্তর হয়েছে? কে যেন এর জন্য দায়ী ছিল? (‘কুছ খয়রাত করো সাব, ভুমে হ্যায়। ‘) হঠ যাও গাদ্দার—একটা চিৎকার নাভিকুণ্ডের কাছ থেকে ভীষণ বেগে ওপরে উঠতে লাগল, বুকের ভিতর দিয়ে পাক খেতে খেতে গলা পর্যন্ত এল। টাই-এর ফাঁসে আওয়াজটা আটকে গেল। বাবা–বাবা- বাপজান! গলার ফাঁসে কাতর আহ্বানটা আটকে গেল। দম আটকে আসছে, পড়ে যাচ্ছি ঘুরে, গলগল করে ঘাম ঝরছে। ‘কী হল, কী হল, এই কেয়া হুয়া তুমহারা?’ টুকি ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করছে। আমার হাত ধরে ঝাঁকাচ্ছে। ভয় পেয়েছ টুকি। ‘কেয়া তুম বিমার হো? ঘর চলো, ঘর চলো জলদি। ‘
“টুকিকে নিয়ে পাশের একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকে পড়লাম। জল খেলাম। আমার শরীরে আর একটুও বল ছিল না। বললাম, “টুকি, আমার বাবা!’ টুকি চমকে উঠল। ও জানত, আমার বাবা বেঁচে নেই। অবাক হয়ে সে জানতে চাইল, ‘কৌন? বললাম, ‘আমার বাবা।’ ‘কাঁহা?’ বললাম, ‘ঐ যে, সিনেমার সামনে ভিক্ষে করছে।’ ‘কেয়া, ভিখ মাঙ রহা হ্যায়?’ বললাম, ‘হ্যাঁ।’ টুকি থ মেরে বসে রইল। তারপরই লাফ মেরে উঠল। ‘আও মেরে সাথ।’ আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল। আমার বাবাকে গিয়ে ধরল। আমাকে বলল, ‘ট্যাক্সি বোলাও, জলদি।’ বাবাকে বলল, ‘আও মেরে সাথ।’ হতভম্ব বাবাকে দ্বিতীয় কথা বলতে সুযোগ না দিয়ে ট্যক্সিতে তুলল। তারপর আমাকে হোটেলে যেতে বলল।
“আদর্শবাদ! হুঁ!” হামজা চুপ করল। “টুকির কাছ থেকে আমি অনেক শিখেছি। টুকিকে বিয়ে করে সংসার পাতলাম। আমি, টুকি, বাবা—জীবন্ত তিনটে অস্তিত্ব——রক্তমাংসে গড়া। আমার সংসার, আমার কাজ, এই শহর—এ ছাড়া জগতে আর কোনও কিছুর গুরুত্ব আমার কাছে ছিল না। তারপর দাঙ্গা এল। এই কলকাতা দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেল। হিন্দুর কলকাতা আর মুসলমানের কলকাতা। মুসলমানের হাতে হিন্দু মরল। হিন্দুর হাতে মুসলমান মরল। এবং আমার বাবাও—ড্রসিতে তাঁর উত্থানশক্তি রহিত হয়েছিল মরলেন। আমি বেঁচে গেলাম। তোমরা আমাকে আটকে দিয়েছিলে, দু’ দিন বাড়ি যেতে দাওনি। টুকি আগেই বাপের বাড়ি চলে গিয়েছিল। সেও বেঁচে আছে।
“দাঙ্গাও আদর্শবাদের লড়াই!” হামজা কৌতুকের হাসি হাসল।
“তবু মানুষের একটা আদর্শ থাকবে তো?”
হামজা বলল, “কেন? কিসের জন্য?”
“নইলে জীবনের সার্থকতা বোঝা যাবে কিসে?”
“বেঁচে থাকাই তো চরম কথা! আর চাইটা কী?”
“যেন তেন প্রকারেণ বাঁচার কোনও মানে হয়? বাঁচতে হবে মানুষের মত।
হামজা এবার জোরে হেসে ফেলল। “মানুষ মানুষের মতই বাঁচে।”
.
“মৃত্যু যখন এত নিশ্চিত, এত অবধারিত,” হামজা আর একদিন বলেছিল, “তখন তাকে এমন ঘটা করে এগিয়ে আনার জন্য কেন যে এত বুদ্ধি, এত শক্তি, এত অর্থ ব্যয় করে চলেছি, আমি অন্তত তার কোনও কারণ খুঁজে পাই না। এই যুদ্ধ, এই দাঙ্গা- ব্যাপারগুলো বিরাট পণ্ডশ্রম। পশুশ্রম ছাড়া আর কিছু নয়। আমাদের এত বুদ্ধি কী করে যে এমন প্রকাণ্ড মূর্খামিতে পরিণত হয়, সে একটা দারুণ রহস্য।
“জনে জনে তুমি জিজ্ঞেস করে দ্যাখো, কেউ যুদ্ধ চায় না, কেউ দাঙ্গা চায় না, আর অধিকাংশ লোকই আন্তরিকভাবে কোনও মহা-হননে লিপ্ত হতে চায় না। তা সত্ত্বেও যুদ্ধ হয়, দাঙ্গা হয়, সবাই আমরা আন্তরিকতার সঙ্গেই তাতে জড়িয়ে পড়ি। আমাদের মধ্যে কোথাও একটা বড় ফাঁকি আছে। কোথায় যে, তা জানিনে। আমাদের বিশ্বাস, বোধ, উপলব্ধি তাই এত অসাড়। শুধুমাত্র কথার কথা।”
.
হঠাৎ হঠাৎ এইসব কথাগুলো লাফ দিয়ে দিয়ে আমার মগজে এসে উদায় হয়। কখনও কথার সূত্রে, কখনও অপ্রাসঙ্গিকভাবেই। আমার চিন্তায় এসে ঘা মারে, ভাসিয়ে নিয়ে যায় কিছুদূর, মনোযোগ নষ্ট করে দেয়। অতীত থেকে বর্তমান, বর্তমান থেকে সুদূর অতীত—এমনি টানাপোড়েন। কখনও একটা স্মৃতির উপর আর একটা স্মৃতি এমনভাবে এসে পড়ে ফিলমের ডাব্ল ট্রিপ এক্সপোজারের মত—যে, দুটোকে আর বিচ্ছিন্ন করা যায় না। সুশীলা বলছিল, “এই বনে বাঘ আছে।” সুশীলা বসে ছিল বলরামের হোটেলের পিছনের কামরায়—খাটে, নরম বিছানায়। আমি বসে ছিলাম তার সামনে, একটা টুলে। হামজা ধারে-কাছেও ছিল না। বহুদিন ওর সঙ্গে দেখা হয়নি। তবু ওর কথা এসে ধাক্কা মারল। আবার এখন সুশীলাও নেই, হামজাও নেই, বন নেই, বাঘ নেই। তবু সুশীলার কথা কানে এসে ঢুকল।
“এই বনে বাঘ আছে।” সেই অন্ধকার-অন্ধকার ঘরে চুলের গোছা খুলে দিয়ে সুশীলা বলেছিল। “বলরামের কোনও ভয়ডর নেই। ওর কাছে এলে আমারও ভয়ডর থাকে না। বলরাম আশ্চর্য লোক!”
সুশীলা কেমন মাংসল হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। ও যখন কাজের মধ্যে ডুবে থাকে, তখন ও ধরা-ছোঁয়ার বাইরে চলে যায়। এমনিতেও, আমি দেখেছি, ওর শারীরিক সীমার বাইরে কেমন একটা শূন্যতার পরিখা কাটা আছে। সুশীলার সম্মতি ছাড়া সে পরিখা ভেদ করে ওর অস্তিত্বের কাছে যাওয়া যায় না। দৈবাৎ সে আকর্ষণের সেতুটা নামিয়ে দেয়। এখন যেমন দিয়েছে। ওটা পার হয়ে যেতে আমার খুব ইচ্ছে করছিল। সুশীলা আমার দিকে চাইছিল না। সে তার চুলের পরিচর্যায় মনপ্রাণ ঢেলে দিয়েছে।
সত্যি বলতে কি, আমার সেদিন আমার এই দেহ বুঝি বা শুকিয়ে
“ঘর বাঁধবার কথা আমার কখনও মনে হয়নি। পর্যন্তও ধারণা ছিল, আমি বোধ হয় বুড়িয়ে গিয়েছি। গিয়েছে। ডাক্তারি পড়লে যা হয়, দেহ সম্পর্কে কোনও রহস্য, কোনও মোহ আর থাকে না! এই ঘরেই প্রথম আমি বুঝতে পারি, ডাক্তারি চোখে দেহ বলে যা দেখে এসেছি, তা ছাড়াও দেহের আর একটা রূপ আছে। যা বিশেষ অবস্থায় উত্তাল হয়, উদ্বেল হয়ে ওঠে। এক পরিতৃপ্তি সব অস্থিরতাকে শান্ত করে আনে। মনে হয়, আঃ, বেঁচে সুখ আছে। পরমুহূর্তেই ভয় হয়, আশঙ্কা জাগে——এই সুখ আঙুলের ফাঁক দিয়ে গলে যাবে না তো? হারিয়ে ফেলব না তো? আবার অস্থির হয়ে ওঠে শরীর। কামনা থরথর করে কাঁপায়। সুখের উৎসটি প্রাণপণে আঁকড়ে ধরি। প্রবল সংগ্রাম শুরু হয়। তারপর ক্ষান্তি! তৃপ্তির অ্যানাস্থেসিয়া শরীরকে বিবশ করে দেয়। আঃ, কী শান্তি! প্রশান্তিতে গভীর ঘুমের ঢল নামে। পুরনো খোলস ছেড়ে আনকোরা নতুন একটা অস্তিত্ব ভোরের আলোয় জেগে ওঠে।”
বলতে বলতে সুশীলা নিজেও পরিবর্তিত হয়ে যায়। সুশীলা এখন শুধু উজ্জ্বল একটি শিখা। পোড়ায় না, স্নিগ্ধ আলো বিতরণ করে। এই সময়ে আমার ভাল লাগা মন্দ লাগার বোধটাকে নিষ্প্রয়োজন বলে মনে হয়। তারপর, অনেক পরে, সুশীলার সান্নিধ্য থেকে দূরে সরে যাবার পরে, আমার মনের কোনও গভীর গহনে একটা বেদনা ঝিনঝিন করতে থাকে। আর, বলরামকে ঈর্ষা করতে ইচ্ছা হয়।
যেমন রথীন আমাকে ঈর্ষা করতে শুরু করেছিল। রথীন সে কথা স্বীকার করেনি। আমি খোলাখুলিই ওর সঙ্গে আলোচনা করতে চেয়েছিলাম। রথীন আমার প্রশ্নগুলোকে হেসে উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করেছিল। আমি তাতে সন্তুষ্ট হইনি।
“আমি জানি, তুমি আমার ওপর সেদিন চটেছিলে, আস্তরিকভাবেই চটেছিলে। তার কারণ—”
“তুই বিশ্বাস করিস, তোর ওপর আমি চটতে পারি? সত্যি সত্যিই তুই বিশ্বাস করিস এ কথা?” রথীন তার কথায় আন্তরিকতা ফোটাবার চেষ্টা করেছিল।
“আমার বিশ্বাস-অবিশ্বাসের কথা হচ্ছে না। সেদিনকার মিটিং-এ তুমি আমাকে গালাগালি দিয়েছ, সেটাও আমি বড় করে ধরছিনে। তোমার কথার মধ্যে তিক্ততার একটা জ্বালা ছিল, আমার কাছে সেইটেই বড় কথা। তুমি তা অস্বীকার করতে চাইছ কেন, আমি বুঝতে পারছিনে।”
“তোর মাথা খারাপ হয়েছে।” রথীন হাসল। “চল, বাসায় চল, তোর মাথায় মধ্যমনারায়ণ তেল মালিশ করে দেব।”
“মাথা আমাদের কারওই খারাপ হয়নি।” আমি নীরস কণ্ঠে বললাম। “সে তুমিও জানো, আমিও জানি। আচ্ছা, তুমি তোমার বুকে হাত দিয়ে বলো তো, আমার ওপর তোমার বিদ্বেষ জেগেছে কি না?”
“বিদ্বেষ! তোর ওপর! তুই, তুই এ কথা বলতে পারলি?” রথীন খুব রেগে উঠল। তারপর অকস্মাৎ সে চুপ করে গেল। একটি কথাও বলল না। গুম মেরে বসে রইল।
আমার মনে নিষ্ঠুর উল্লাস। চোর যেন ধরা পড়েছে। সামনে বসে আছে। এখন তো মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না?”
রথীনের চোখ বাঘের মত জ্বলে উঠল। যেন আমাকে ছিঁড়ে খাবে। কিন্তু সে রাগ সামলে নিল। ঠাণ্ডা অপরিচিত এক কণ্ঠে রথীন বলল, “আমি ভেবেছিলাম, আমাদের মনোমালিন্য আর বাড়াব না। কিন্তু তুমি যখন খুঁচিয়ে তুললে কথাটা, তখন ফয়সালা হয়ে যাক।”
“আমিও তো তাই চাইছি।” (এসো, আজ মুখোমুখি দাঁড়াই।)
“হ্যাঁ, তোমার ওপর চটেছি, মর্মান্তিক চটেছি। (সে আমি জানি রথীন। তুমিই তো লেজে খেলছিলে!) আমার বিরুদ্ধে যারা ষড়যন্ত্রে মেতেছে, তুমি তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছ। (এ আবার কী অভিযোগ!) তুমি ভেবো না, আমি কোনও খবর রাখি না!”
“কী বাজে বকছ!” আমি ওকে ধমক দিলাম।
“একটুও বাজে বকছি না, সে কথা তুমিও জানো। রসময়বাবুরা এত দিন বাদে ইউনিয়নের কর্তৃত্ব বাগিয়ে নিতে চাইছেন। আর, তুমি জেনে-শুনে ওদের হাতে ইউনিয়নের ভার তুলে দিতে মদত দিচ্ছ। ওদের হাতে ইউনিয়ন গেলে কী হবে, জানো? পরদিনই মজুররা সব বেরিয়ে যাবে। ইউনিয়ন সেই যথাপূর্বং বাবুদের ইউনিয়ন হয়ে উঠবে। কমিউনিস্টরা এক দিক দিয়ে শ্রমিকদের টেনে নেবে, অন্য দিকে বাবু ইউনিয়নেও খাবল দেবে। এখন শ্রমিকদের চাইতে বাবুরাই তো বড় কমিউনিস্ট! রসময়বাবু কমিউনিস্টদের টোপ গিলেছেন, তা জানো? ওরা ওঁকে ওএফেয়ার কমিটির চেয়ারম্যান করে দেবে বলে কথা দিয়েছে। তোমারও তো, দেখছি, সেই একই মতলব। একটা চোর, ঘুষখোর, মালিকের পা-চাটা কুত্তা—তাকে তোমরা এখন মাথায় তুলে নাচছ। সেই কারণে তোমার ওপর চটেছি। তুমি এখন আমার সঙ্গে কোনও পরামর্শ করো না, রসময় এখন তোমার পেয়ারের লোক। সেই কারণে যদি তোমার ওপর চটে থাকি তো অন্যায় কিছু করেছি?” রথীন আমার দিকে শান্তভাবে চেয়ে থাকল। ওর আন্তরিকতা ওর চোখে-মুখে ফুটে উঠল।
আমি কী ভেবে রেখেছিলাম আর রধীন কী অভিযোগ তুলল! এক ধাক্কায় আমাকে সে সম্পূর্ণ এক নতুন অবস্থার মধ্যে ফেলে দিল। ওর অভিযোগ একেবারে ভিত্তহীন, তা বলি কী করে? তবে ব্যাপারটা রথীন যে চোখে দেখেছে, সেটা সত্যি নয়। রথীন আমার বন্ধু। যদিও ইউনিয়ন সংগঠন করার মধ্য দিয়েই ওর সঙ্গে আমার পরিচয়, তবু সে বন্ধুত্ব কর্মক্ষেত্রের পরিধি ছেড়ে শিকড় গেড়েছে ব্যক্তিগত সম্পর্কের ভিত্তির মধ্যে। ওর প্রতি আমার এখনও আন্তরিক টান আছে। একেবারে অটুট। কাজেই ওর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের কোনও কথাই ওঠে না। রথীন সৎ, ওর আদর্শের প্রতি ওর সততা সব সন্দেহের ঊর্ধ্বে। মানুষ হিসেবেও ওর তুলনা মেলা ভার। ইউনিয়ন ওর বলেই বলীয়ান। এ সবই সত্য। না রথীন, আমি তোমার বিরুদ্ধে কোনও ষড়যন্ত্রে মাতিনি-এ আমি হলফ করে বলতে পারি। তবে হ্যাঁ, রসময়বাবুকে আমি একটু খাতির করছি বটে। জানি, তুমি ওকে পছন্দ করো না, তবুও রসময়বাবু সুবিধাবাদী, সেটা জেনেও। এমন কি, লোকটা ঘুষ খায়, তা সত্ত্বেও। আর, এ ব্যাপারে তোমার অনেকটা দোষ আছে। সত্যি বলতে কি, ওএফেয়ার কমিটি গঠন, সম্পর্কে তোমার অনমনীয় বিরূপ মনোভাবই আমাকে ক্রমশ রসময়বাবুর গালে চুমু খেতে বাধ্য করেছে। শোনো রথীন, এখানে তোমার বন্ধুত্ব আর তোমার নীতি——এ দুটোকে পৃথক করে ফেলতে বাধ্য হয়েছি। না করে উপায় ছিল না। তুমি ব্যাপারটা ভাল করে বুঝে নাও : তুমি ওএফেয়ার কমিটি সমর্থন করতে চাইছ না, আমার পার্টি চাইছে। তুমি, এর দ্বারা শ্রমিকদের উপকার হবে না, এ কথা ধরেই নিয়েছ (অবশ্য বড় কোনও সমস্যার সমাধান যে এতে হবে না, সে সম্পর্কে তোমার সঙ্গে আমিও একমত।), তাই তুমি প্রস্তাবটা একেবারে খারিজ করে দিতে চাইছ, এমন কি পরীক্ষামূলকভাবেও এটা গ্রহণ করতে রাজি নও। অথচ আমার পার্টি এই প্রস্তাব গ্রহণ করার পক্ষে। আমি জানি, সম্ভবত তুমিও জানো, কমিউনিস্টরা তলে তলে (প্রকাশ্যে জোর বিরোধিতা করলেও) এই কমিটি অধিকার করবার ফিকিরে আছে। এখন তুমিই বলো রথীন, এই অবস্থায় আমি কী করতে পারতাম, কী করতে পারি, রসময়বাবুর সঙ্গে হাত মেলানো ছাড়া? আমি রসময়বাবুকে চিনি। মানুষ হিসেবে তাঁর প্রতি আমার কোনও শ্রদ্ধা নেই। তোমার ওপর আমার অগাধ শ্রদ্ধা। মানুষ হিসেবে, কর্মী হিসেবে তুমি অনেক বড়। তার ওপর তুমি আমার বন্ধু। তোমাকে আমি গভীরভাবে ভালবাসি (ঠিক এই মুহূর্তে, রথীন, শপথ করে বলতে পারি, তোমার বউকে আমি যত ভালবাসি, তার চাইতেও দশ-বিশগুণ তোমাকে ভালবাসি)। কিন্তু তা সত্ত্বেও, রথীন, তোমার নীতিকে আমি গ্রহণ করতে পারছি না। ব্যক্তিগতভাবে তোমার অনেক যুক্তিই আমি মানি। তুমি বলো, শ্রমিক ইউনিয়নের প্রধান লক্ষ্য শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষা। ঠিক কথা। আমি সমর্থন করি এ কথা, মনে-প্রাণে। তবুও, রথীন, তোমার কাজে আমি যে সায় দিতে পারছিনে, সে আমার পার্টির স্বার্থের জন্য, পার্টিরই নির্দেশে। আর, সেই কারণেই আমাকে রসময়বাবুর সঙ্গে হাত মেলাতে হচ্ছে। আমি জানি, রসময়বাবুর দ্বারা শ্রমিকস্বার্থ একটুও রক্ষিত হবে না, তোমার দ্বারা ষোল আনা রক্ষিত হবে; কিন্তু তোমার নীতি আমার পার্টির নীতির বিপক্ষে চলে যেতে চাইছে। তাই কর্মক্ষেত্রে আমাকে তোমার বিপক্ষের সঙ্গে হাত মেলাতে হচ্ছে। তোমার বন্ধুত্ব আমার কাম্য। ব্যক্তিগত জীবনে তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্ক অন্তরঙ্গই থাকবে।
“কিন্তু আমি তা হতে দেব না।” রথীন দৃঢ় স্বরে বলল। ‘ওএফেয়ার কমিটির ধুয়ো তুলে আমাদের বাঁচার দাবিকে শিকেয় তুলে রাখতে দেব না। আমাদের দাবি না মেটালে আমরা চাকা বন্ধ করব।”
“কিন্তু রথীন, তোমাকে তা হলে কার্যনির্বাহক সমিতির প্রস্তাবের বিরোধিতা করতে হবে। কার্যনির্বাহক সমিতি ওএফেয়ার কমিটি গঠনের প্রস্তাব আনন্দের সঙ্গে সমর্থন করেছে এবং এরই পরিপ্রেক্ষিতে ধর্মঘটের প্রস্তাব তুলে নিয়েছে।”
“কখন এই নতুন প্রস্তাব পাস হল? আমি বললাম না, অনেক সদস্য আসেনি বলে এত বড় গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ মুলতুবি রাখা হোক! কখন প্রস্তাবটা গৃহীত হল?” রথীন অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে চেয়ে রইল।
“আমাকে গালাগালি করে তুমি বেরিয়ে যাবার পর।”
“বাঃ!” রথীন আরও বিস্মিত হল। “আর তুমি, তুমি এই জোচ্চুরিতে মত দিলে!”
“না, আমি মত দিইনি। আমিও বলেছিলাম মুলতুবি রাখতেই। কিন্তু ওরা কেউ শুনল না।”
“তবে আবার মিটিং ডাকা হোক। ব্যাটাদের জোচ্চুরি বার করে দিই।”
আমি বললাম, “তাতে লাভ হবে না, রথীন। কারণ, যে পদ্ধতিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, সেটা আমার পছন্দ না হলেও প্রস্তাবে আমার মত আছে। তুমিও এটাকে মেনে নাও।”
“কিছুতেই না, প্রাণ গেলেও না। আর, তা ছাড়া, আমি আর তোমাদের মধ্যে নেই। তোমরা সব চোর, ধাপ্পাবাজ।” রথীন হনহন করে চলে গেল।
মুহূর্তে আমার বুকটা হাল্কা হয়ে গেল। খালি হয়ে গেল। ওর বাসার দরজা আমার মুখের উপর বন্ধ হয়ে গেল। আর খুলবে না, কখনও খুলবে না। ধীরে ধীরে একটা ব্যথা বুকের ভিতর জন্ম নিতে লাগল। (“আপনি কী রে? একসঙ্গে কাজ করতে হবে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করতে হবে, এসব আপনি-আজ্ঞে চলবে না। “) আর আমরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কখনই লড়াই করব না। পাঁচ বছর ধরে করেছি। বহু পরিশ্রম করেছি দুজনে। লাইনে লাইনে, গুমটিতে, লোকো শপে, কারখানায়, বস্তিতে ঘুরেছি। গালাগাল খেয়েছি একসঙ্গে। ইউনিয়নের সদস্য করেছি। আজ এই ইউনিয়ন যা, আমি যা, তার বারো আনাই রথীনের গড়া। আজ সব শেষ হয়ে গেল। আমি এখানে থাকব, রথীন থাকবে, অথচ আমরা পরস্পরের কাছাকাছি থাকব না। পরস্পরকে ভালবাসব না। রথীন আর আমাকে ভালবাসবে না। ঘৃণা করবে। আর রথীনের বউ? না, না— সে আমাকে ঘৃণা করবে না। একখানা ছুরির ফলা আমার বুকের ভিতর কে যেন চালিয়ে দিল। সংশয়ের ছুরি। সেও কী আমাকে ঘৃণা করবে? না, না, না। কিন্তু যদি করে? সে যদি আমাকে আর ভাল না বাসে? সে কী সত্যিই আমায় ভালবাসে? কখনও বেসেছে? (“আমাদের দুজনের মধ্যে তুমি কাকে বেশি ভালবাসো?” “কেন বলো তো? সেদিন এ কথা ও-ও জিজ্ঞেস করছিল!” “ওকে কী জবাব দিলে?” “বললাম, তোমাকেই বেশি ভালবাসি।” “আর আমাকে কী বলবে?” “তোমরা বড় বোকা! কিছু বোঝো না!”) সত্যিই আমি বোকা! কিছু বুঝতে পারিনি। এখন বুঝেছি, আমাকে সে ভালবাসে না। রথীন না, সেও না।
না, না—সে ভালবাসে। সে ভালবাসে। মুখে না বলুক, দিনের পর দিন তার শরীর এ কথা বলেছে। তবু তার মুখের কথা আমাকে একবার শুনতে হবে। শেষবার। কী হবে শুনে? সে এখন আমার কে? সে এখন রথীনের বউ। ষোলো আনা রথীনের। রথীনের বাসার দরজা আমার জন্য আর কখনওই খুলবে না। আর কখনও ওর বারান্দায় বসে আমরা তিনজন আড্ডা দেব না। আর কখনও ভয়কাতর এক নারী আমাকে আঁকড়ে ধরে সান্ত্বনা খুঁজবে না। না, না, না। কিন্তু কেন? রথীনের জন্য। রধীনের একগুঁয়েমির জন্য। কেন এই প্রস্তাব মানছে না রথীন? কেন মানবে না? শ্রমিকদের ক্ষুদ্র স্বার্থ ওর কাছে এত বড় হল! আজ দুনিয়াতে যেখানে বাঁচা-মরার লড়াই শুরু হয়েছে, সেই যুদ্ধে যাতে কিছুমাত্র বিঘ্ন না ঘটে, শ্রমিকদের তা দেখা কী কর্তব্য নয়? উদরের আহ্বান কী এত বড়? অবশ্য এখানকার শ্রমিকেরা মানুষের জীবন যাপন করছে না, সেটা ঠিক; যুদ্ধ আমাদের মাথার উপর এসে পড়েনি, সেটাও ঠিক; তবু—তবু–না, পার্টির নির্দেশ মানতেই হবে। পার্টির কাছে সব তুচ্ছ; প্রেম, বন্ধুত্ব গৌণ। আমার কোন ভুল হয় নি। বরং পার্টির স্বার্থরক্ষায় ভালবাসা, বন্ধুত্ব উৎসর্গ করে শহিদ হতে পারছি, এ আমার পরম সৌভাগ্য।
.
সুশীলা বলছিল, “এ একটা আশ্চর্য ব্যাপার কিন্তু। যতদিন বলরামকে দেখিনি, জানিনি, ততদিন ওকে হারাবার প্রশ্নও ওঠেনি। এখন বলরামের কাছে আমি নিষ্প্রয়োজন—এ কথা ভাবতেই ভয় লাগে। আমিও আছি এই পৃথিবীতে, বলরামও আছে, অথচ আমি বলরামের কাজে লাগছিনে বাবা!” সুশীলা যেন শিউরে উঠল। “মাঝে মাঝে হয় কিন্তু। বলরাম শান্ত হয়ে যায়, শীতল হয়ে যায়, ওর মন নিথর, দেহ নিঃসাড়। আমার ভেতরটা কেমন করতে থাকে, যেন অথই শূন্যে নেমে যাচ্ছি। আমার শরীর ফাঁপা হয়ে যায়। ভয় করে। বুঝি মরে যাচ্ছি। দম বন্ধ হয়ে আসে। এমন হয়! বলরাম বলে, তোমার মাথায় ছিট আছে।” সুশীলা হাসল। চুলের মোটা গোছ দু হাতে ধরে আলগা বিনুনি বাঁধতে লাগল। মাথাটা সুন্দর আন্দাজে সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে দিল। ঘরে আমি, সুশীলা, দুখানা খাট, ধবধবে বিছানা, ড্রেসিং আয়না, একটা টুল, একটা নিচু টেবিল, ব্যাটারি সেট রেডিও, একটা উজ্জ্বল লণ্ঠন, ইতস্তত বিক্ষিপ্ত সংলাপ, একটা তীব্র ইচ্ছা, একটা নমনীয় শরীর থেকে অবিরল বেলোয়ারি বিচ্ছুরণ, মৃদু মৃদু সৌরভ। ঘরের বাইরে কী আছে? মনে পড়ছে না। বাইরে কে আছে? মনে পড়ছে-না। ভূত-ভবিষ্যতের সব আলো বর্তমানের স্পট্লাইটের ভিতর দিয়ে একটি মাত্র চরিত্রের উপর ফোকাস ফেলছে। সে কথা বলছে অনর্গল, স্বপ্ন দেখছে অবিরল। (“সুশীলা অমৃতলোকবাসিনী। আমি মরজগতের জীবন, হাউ ক্যান আই রিচ হার, ম্যান?” অনেক দিন পরে রঙ্গচারী আমাকে লিখেছিল। “টু মি শি ডাজ নট বিলং টু রিয়ালিটি।” কথাটা এখন মনে পড়ল, এই মাত্র—যখন সুশীলা নেই, রঙ্গচারী নেই, যখন সুশীলা অবাস্তবে মিশে রয়েছে, তার স্মৃতি শুধু ভেসে উঠেছে মনে কল্পনায়। কল্পনারও বাস্তব অস্তিত্ব আছে।)
“মানুষকে দুটো রিয়ালিটির মধ্যে অহরহ বাস করতে হয়।” হামজা বলেছিল, “একটা রিয়ালিটি বস্তুর, একটা রিয়ালিটি ভাবনার—আইডিয়ার। এই দুটো রিয়ালিটির অস্তিত্ব মানুষের জীবনে জটিলতার সৃষ্টি করেছে, আর এই জটিলতা মানুষকে পশুত্ব থেকে উন্নীত করেছে, মনুষ্যত্ব দিয়েছে। মানুষ ভাবতে পারে, কল্পনা করতে পারে। বুঝতে পারে, সৃষ্টি করতে পারে। এই হচ্ছে মনুষ্যত্ব। সৃষ্টি মানুষের সার্থকতা নয়, পরিচয়।”
হামজা আর একদিন বলেছিল, “মানুষ সৃষ্টিও করতে পারে, ধ্বংসও করতে পারে। অফুরন্ত সৃষ্টি আর অফুরন্ত ধ্বংস—দুটোর সম্ভাবনাই মানুষের মধ্যে আছে, একেবারে আধাআধি। সেইটাই মানুষের জটিলতা। এবং সেই কারণে মানুষের ভূত, ভবিষ্যৎ, বর্তমান একটি মাত্র বাঁধা সড়ক ধরে চলেনি, চলছে না, চলবে না। এ কথা বড় বড় ব্যাপারের বেলাতে যেমন সত্য, ছোটখাট আচরণ সম্পর্কেও তেমনি সত্য। মানুষের জীবন তাই বিচারের বিষয় নয়, অতিবাহিত করার বিষয়।”
“প্রেম মানুষের অজস্র সৃষ্টির একটি। মেয়েমানুষের সঙ্গে বিছানায় শোয়া এবং পুত্রকন্যা উৎপাদন করা—শুধুমাত্র এই বায়োলজিক্যাল অভ্যাসটুকু নিয়েই যদিও মানুষের জীবনে এর কোনওটাই তুচ্ছ করার নয়—তবু শুধুমাত্র দেহগত এই অভ্যাসটুকু নিয়েই মানুষ তৃপ্তি পায় না। এটা গ্রহণ করার মধ্য দিয়েই সে কায়মনের আর একটা মনোরম আশ্রয় সৃষ্টি করে। এই জটিল প্রক্রিয়াটিকেই আমরা বলি প্রেম। সব মেয়ের সঙ্গেই হয়তো শোয়া যায়, সব মেয়ের সঙ্গে প্রেম হয় না। কেন? তা বলতে পারব না।
সুশীলা বলছিল, “উপন্যাস-গল্পের প্রেসক্রিপশন ধরে আমি বলরামের প্রেমে পড়তে পারিনি। সত্যি বলতে কি, প্রথম যে ব্যাপারে ওর ওপর আমার চোখ পড়ে, তা ওর প্রেম নয়, ওর চমৎকার স্বাস্থ্য, ওর সুগঠিত দেহ, আর বলা যায় আত্মপ্রত্যয়। ওর ওপর প্রথম খুশি হয়ে উঠি, ওর হাতে ‘কাকাবাবু’র করুণ অবস্থা ঘটতে দেখে। বাস, আর কিছু না! তারপর তো আমরা চলে গেলাম। কিছু দিন পরে আবার আমাকে ধরমকোর্টে আসতে হল। হাসপাতালটা তৈরিও হয়ে গিয়েছিল, আর ‘কাকাবাবু’রও বোধ হয় আমাকে জব্দ করার ইচ্ছে হয়েছিল—না, ‘কাকাবাবু আমার সঙ্গে আর কখনও কোনরকম অশালীন ব্যবহার কিছু করেননি। তিনি বরং আমাকে একটু সাজা দেবার জন্যই তৎপর হয়ে উঠেছিলেন। কানাঘুষোয় শুনছিলাম, আমি সকলের মর্যাল নষ্ট করছি।
“ধরমকোটে এসে হাসপাতালের কাজেই ডুবে গিয়েছিলাম। এই হাসপাতালে তখনও উদ্বাস্তু রোগীর ভিড় বিশেষ হতে শুরু করেনি। ফাঁকা হাসপাতালে ধুনি জ্বালিয়ে বসে থেকে কী করব? মধ্যপ্রদেশের স্বাস্থ্য দপ্তর আমাদের অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের সাহায্য প্রার্থনা করেছিলেন। আমার ওপর নির্দেশ এল, আমি যেন আদিবাসীদের চিকিৎসা করি। আমি কাজ পেয়ে বর্তে গেলাম। হাসপাতাল সম্পর্কে ওদের দারুণ ভয়। মরে গেলেও টিকা কি কলেরার সুঁই নেবে না। আমাকে তো পাদ্রির মত মেডিক্যাল সুসমাচারের প্রচারে নিয়মিত বের হতে হত। ক্রমে ক্রমে আমি ওদের দীক্ষিত করে তুললাম। আমার হাসপাতাল ভরে উঠতে লাগল। কাজের মধ্যে ডুবে গেলাম। অনেক রোগী ঘাঁটতে ঘাঁটতে দেখলাম, এখানে একরকম ফুসকুড়ি হয়, অনেকটা জলবসন্তের ছোট গুটির মত চেহারা। কিছু দিন বাদে শুকিয়ে যায়। গায়ে ছোট ছোট গর্ত রেখে যায়। রোগটা মেয়েদেরই হয় বেশি। এদিকে আমার নজর পড়ল। অনেক রকম ওষুধ দিলাম। সারাতে আর পারি না! আমার কেমন রোখ চেপে গেল। ওর কারণ অনুসন্ধানে মেতে উঠলাম।
“কী আশ্চর্য ঘটনা! বলরাম আমার এক মাইলের মধ্যেই থাকে অথচ আমার মনে বলরাম নেই। সেখানটা জুড়ে বিরাজ করছে অজানা এক ফুসকুড়ি।” সুশীলা হাসল। হাসলে সুশীলার গালে টোল পড়ে না। মুখে-চোখে তরঙ্গ ওঠে না। ব্রেক কষলে মোটরগাড়ির পিছনের লাল আলো যেমন উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, হাসলে সুশীলার মুখ তেমনি উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। বুলার ছিল উপচে-পড়া হাসি। এখন সে আর হাসে না। যদিও বা হাসে, তাতে একটুও আলো থাকে না। “দ্যাখো, ভাল লাগে না, একদম ভাল লাগে না। এত সময় আমার হাতে অথচ কিছু করবার নেই। সময়ের চাপেই একদিন বোধ হয় গুঁড়িয়ে যাব।” বুলা একদিন আমাকে ধরেছিল। সেদিনও সুরাসত্রে বসে আমি মদ খাচ্ছিলাম। বুলা আপত্তি করেনি। অনায়াসে পাশের চেয়ারে এসে বসেছিল। “কিচ্ছু কাজ নেই—–জানো, চুপচাপ বাড়িতে বসে থাকি! তাইতে আরও শরীর খারাপ করে।” বুলা ওর মা’র কথা বলল না, ভাইয়ের কথা বলল না। “আমি কিন্তু তোমাকে অনেক দিন এখানে খুঁজে গিয়েছি। তোমার সেই বন্ধুটিকেই দেখেছি, তোমাকে এক দিনও দেখিনি।” তা বুলার সঙ্গে প্রায় দেড় বছর পরে দেখা হল। হামজা বলেছিল বটে, আমার মনে পড়ল, বুলা এখানে মাঝে মাঝে আসে। নেশার ঝোঁকে কি না বলতে পারব না, আমার মনে হল, একটি মাছি মাকড়সার জালে জড়িয়ে গিয়ে ছটফট করছে। “এভাবে আর চলে না, মানুষ তো আর আসবাব নয়! ভাবছি, কাজকর্ম কিছু করব।” বুলা হেসেছিল। সেদিনই দেখলাম, ও হাসতে ভুলে গিয়েছে। “তোমাকে তো যেতে বলা বৃথা, আর আমারও বাড়িতে বসে থাকতে ইচ্ছে করে না—এসব দিকে এলে তবু খানিকটা সময় ভাল কাটে। তুমি এখানেই বরং এসো; যদি পয়সা না থাকে, আমিই দেব। তোমার সঙ্গে কথা বললে ভাল লাগে। এরপর থেকে এক বছর, দেড় বছর ধরে বুলার সঙ্গে আমার কয়েকবার দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে।”
একটা সাক্ষাৎ : বুলা সোস্যাল ওআর্ক করছে। ওদের পাড়ায় রেড ক্রস কেন্দ্র খুলেছে।
আর একটা সাক্ষাৎ : বুলা কয়েকজন সেকেলে লেডির সঙ্গে প্রাচীন শিল্প পুনরুদ্ধারে ব্রতী হয়েছে। বনেদি পরিবারে ঘুরে ঘুরে পুরনো আমলের ছেঁড়া শাড়ি, শাড়ির পাড়, জমিনের নক্শা সংগ্রহ করে বেড়াচ্ছে। “মিউজিয়াম করব, জানো—বিরাট মিউজিয়াম। কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে টাকা পাব, আমেরিকার এক ফাউন্ডেশন সাহায্য করবে। ভারতীয় শাড়ির এত বড় মিউজিয়াম আর কোথাও নেই। কত অমূল্য সম্পদ যে অনাদরে-অবহেলায় নষ্ট হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা আমরা সত্যিই দিতে জানিনে।” বুলা জানিয়েছিল, এত দিন পরে সে কাজের মত একটা কাজ পেয়েছে। অমুক লেডির সঙ্গে সে কাথিয়াবাড় যাচ্ছে, তমুক লেডির সঙ্গে দিল্লি। তার আর ফুরসত নেই।
আর একটা সাক্ষাৎ : বুলা বিষণ্ণ। বাজে কাজে এত দিন সময় নষ্ট করেছে। তার আর কিছুই ভাল লাগে না। আবার সে ঘরের চৌহদ্দিতে নিজেকে শামুকের মত গুটিয়ে এসেছে। এই প্রথম সে আমার কাছে ভাঙল, তার দাম্পত্যজীবন সুখের হয়নি। তার স্বামীটি এমনই আত্মকেন্দ্রিক যে, বুলাও যে একটা মানুষ, তার একটি সত্তা আছে, এ কথা তার স্বামী কোনও দিনই ভেবে দেখেনি। দেখতেও চায় না। “উনি চান, সর্বদা ওঁর মত অনুসারেই চলি। আমার ভাল লাগা মন্দ লাগার কোনও পরোয়াই উনি করবেন না। জীবনটা আমার দুর্বিষহ হয়ে গিয়েছে।”
আর একটি সাক্ষাৎ : বুলা গৌরপ্রেম মহারাজের কাছে দীক্ষা নিয়েছে। মহারাজের পায়ে আত্মনিবেদনে শাস্তি এসেছে তার মনে। বুলার পরিবর্তন হয়েছে, অনেক পরিবর্তন—সে জানাল। পরিবর্তন হয়েছে, সে আমিও লক্ষ করলাম। সে এখন গেরুয়া সিল্ক পরে। কণ্ঠিতে তুলসীর দানা—সোনার তৈরি, চুল শ্যাম্পু করা। আর আশ্চর্য, এত দিন পরে তার এই যোগিনী দেহে, আমার মনে হল, রতির আবির্ভাব হয়েছে। তোমার তো আবার কিছুতে বিশ্বাস নেই! তবু বলছি, চলো না একদিন গুরুদেবের কাছে! দেখবে, সব অশান্তি দূর হয়ে যাবে। কী চেহারা! কাঁচা সোনার মত রং, গায়ে পদ্মগন্ধ, আর কী সুমধুর গলা! আশ্রমে গেলেই দেখবে, কত জজ, বিলাত-ফেরত ব্যারিস্টার যৌবনকালে এক-একজন আস্ত কালাপাহাড় ছিলেন। কয়েকজন নাম করা বৈজ্ঞানিকও আছেন গুরুদেবের শিষ্য। সকলের অশান্তি তিনি দূর করেছেন। গুরুদেব বলেন, মন্দির, মসজিদ, চার্চ—ওসব ফাঁকা। ওখানে যাবার কোনও প্রয়োজন নেই। দেহই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ মন্দির। আর প্রেমের চাইতে বড় দেবতাই বা কে আছে! আশ্চর্য, তখন মনে এমন ভাব হয় না, কী বলব!”
আর একটি সাক্ষাৎ : বুলা আশ্রমের বন্ধন কাটিয়েছে। এক নাট্যকারের সঙ্গে ভিড়েছে। “ও একটা জিনিয়াস, জানো! আমরা নিউ এম্পায়ারে ওর নাটকটা নামাচ্ছি। অবশ্যই এসো কিন্তু! আমার মধ্যে যে অভিনয়ের ক্ষমতা আছে, এ আমি জানতাম না। রিহার্স্যালে তো ভালই উতরেছি; দেখি, মঞ্চে উঠে কী হয়! তোমাকে বলব কী, এত দিনে যেন সার্থকতা খুঁজে পাচ্ছি।”
নিউ এম্পায়ারে গিয়েছিলাম। লোকজন বিশেষ হয়নি। বুলার ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হল। তার মেম-বউও এসেছিল। বুলার স্বামী আসেনি। যেমন নাটক, তেমনি তার অভিনয়। বুলাকেই সব থেকে করুণ লাগছিল। বুলার ভাই বললে, “দিদির দিন দিন অবনতি ঘটছে। কী যে করে বেড়াচ্ছে, তার ঠিক নেই! জামাইবাবুর সঙ্গে একদম বনছে না! এখন বোধ হয় কথাবার্তাও বন্ধ। এখন দিদি নাটক নিয়ে মেতেছে। ওর ধারণা, ও একটা মস্ত অভিনেত্রী। বোগাস! আমার তো ঘুম পাচ্ছে!” অভিনয়-শেষে ক্ষীণ হাততালির ধ্বনি উঠল। দিয়ে বুলার ভূয়সী প্রশংসা করলেন। ওকে একটা বড় ফুলের তোড়া উপহার দিলেন। বুলা যখন মেক-আপ তুলে, সাজ বদলে তোড়াটা হাতে করে এল, তখন ওকে দেখে মনে হচ্ছিল, জীবনের শ্রেষ্ঠ পাওয়া বুঝি পেয়ে গিয়েছে। আমরা ফারপোতে লাঞ্চ খেলাম। দেখলাম, বুলার ভাই-বউয়ের সঙ্গে ওর খুবই ভাব। নাট্যকার বুলাকে ট্যাক্সি করে নিয়ে গেল। বুলার ভাই আমাকে বলল, “তুমি দিদিকে একটু বুঝিয়ে বলো না! আমার তো ভয় হচ্ছে, ওর পরিবারে একটা বিপর্যয় এল বলে। মেমসাহেব বলল, “এসব ব্যাপারে তোমরা মাথা গলাবে কেন, আমি তো বুঝতে পারিনে। ইট্স নান অব ইওর বিজনেস। শি হ্যাজ এভরি রাইট টু ডু হোআট শি ওআন্ট্স্ টু ডু।”
বুলার ভাইয়ের সঙ্গে অনেক দিন পরে আবার দেখা হয়েছিল। বিমর্ষভাবে জানিয়েছিল, তার আশঙ্কাই সত্য হয়েছে। বুলা স্বামীর ঘর চিরদিনের মত ছেড়েছে। সেই নাট্যকার ওকে ভাগিয়ে নিয়ে যায়। পরে সেও বুলাকে ছেড়েছে। বুলা এখন রাজস্থানে আছে। এক কলেজে পড়ায়। ওর ছেলেটাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। জামাইবাবু দেয়নি। তাকে দার্জিলিং-এর এক বোর্ডিং-এ রেখে দিয়েছে। বুলার স্বামী বুলাকে টাকা দিতে চেয়েছিল, বুলা প্রত্যাখ্যান করেছে।
বুলাকে আর একদিন দেখেছিলাম। বুলাকে নয়, তার একখানা ফটো। ডুয়ার্সে চা-বাগানের নানাবিধ সমস্যা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হবার জন্য আমার কাগজ আমাকে পাঠিয়েছিল। সেটা যে বুলাদের বাগান, পনের বছর পরে সে কথা আমার মনে ছিল না। গেস্ট হাউসে ঢুকে ঝপ করে মনে পড়ল। আমি প্রথমটা চমকে গিয়েছিলাম। বুলা! দেওয়ালে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের বাগানে রাজ্যপাল এসেছিলেন। তাঁকে নিয়ে ওরা ফটো তুলিয়েছিল। বুলা, তার বাঁ পাশে রাজ্যপাল, তার বাঁ পাশে বুলার ভাই, পিছনে বুলার বাবা, বুলার মা। উজ্জ্বল বিজলির আলোয় ওরা তাজা হয়ে উঠেছে। “সত্যি, আপনার সাহসকে বলিহারি যাই!” ভয় কেটে গিয়ে বুলার মুখে কৌতুকের হাসি ছড়িয়ে পড়ছিল। বুলা তখন অনেক রকম হাসতে পারত। “সত্যিই তুমি দারুণ রিস্ক নিয়েছ।” বুলার বাবা হাসতে হাসতে বলেছিলেন। “পরশুদিনই বাঘে আমাদের একটা কুলিকে ঘায়েল করেছে। এখানে বাঘ আছে।”
“স্টেশন থেকে এতটা পথ, এই বনের মধ্যে দিয়ে অত রাত্রে একা একা হেঁটে এলেন!” পরদিন সকালে বুলা বলেছিল। “শুধু শুধু এমন ঝুঁকি নিতে গেলেন কেন?” বলেছিলাম, “শুধু শুধু হবে কেন, বড্ড দরকার পড়েছিল, তাই।” বুলা তখন কথা বললেই মনে হত, আবদার করছে। “কী এমন জরুরি দরকার, শুনি?”
তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছিল।” সত্যি কথাই বলেছিলাম।
“এই দরকার! যা!”
“সত্যি বলছি, বুলা!”
বুলা হেসে উঠল। তারপর আমার মুখের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকল। “সত্যি বলছেন?” ওর তরল গলা গাঢ় হয়ে এসেছিল।
“সত্যি বলছি।”
একটু পরেই সুশীলাকে ডেকে এনেছিল বুলা। ওর বাবাও সেই বাগানে কাজ করতেন। সুশীলা তখন খুব লাজুক ছিল। মনে আছে, সেইদিনই আমি প্রথম সাহিত্য রচনা করেছিলাম, কাগজে-কলমে নয়, মুখে মুখে। এক ভয়াবহ রোমাঞ্চকর ভ্রমণ-কাহিনী ফেঁদে বসেছিলাম। “তারপর বাগানের মুখ এসে পড়লাম। দূর থেকে বুলাদের ঘরের বিজলি আলো দেখা যাচ্ছিল। আর একটু গেলেই নিরাপদ আশ্রয়। আর একটু এগুলেই বুলা। আর ভয় কী? প্রাণে নতুন উৎসাহের সঞ্চার হল। এত দূরের পথশ্রমে কাতর শরীরে বলসঞ্চার হল। পা বাড়াতে গিয়েই অন্তরাত্মা শুকিয়ে গেল। আমার সামনেই দুটো বড় বড় আগুনের ভাঁটা জ্বলছে। (বুলা অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠল, সুশীলা বড় বড় চোখ তুলে আমার দিকে চেয়ে আছে। বুলার ভাইয়ের হাতে এয়ারগান।) অন্ধকার দিয়ে গড়া প্রকাণ্ড এক শরীর আমার দিকে এগিয়ে আসছে। দেখলাম—বাঘ। (“বাঘ! সর্বনাশ! তারপর?”—বুলা।) দেখলাম, আর রক্ষা নেই। এক্ষুনি আমার ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ল বলে। আমার হাড়-মাংস কড়মড় করে চিবিয়ে খেল বলে। ঠিক সময়ে আমি ধমকে বললাম, ‘এই বাঘ, পথ ছাড়—আমি বুলার কাছে যাচ্ছি। দেরি করিয়ে দিলে মজাটা টের পাবি।’ যেই না বুলার নাম শোনা, বাঘ বাপ বলে এক লাফ মেরে পালিয়ে গেল।”
সব-প্রথমে সুশীলাই খিলখিল করে হেসে উঠেছিল। বুলা প্রথমটায় ধরতে পারেনি। পরক্ষণেই সেও হেসে উঠল। “ঠাট্টা হচ্ছে। বাঘ, না হাতি! আপনার সব মিথ্যে কথা!” বুলার ভাই গম্ভীরভাবে বলে উঠল, “সত্যি হলেই বা ভয় কিসের? আপনি আমাকে ডাকলেই আমি দৌড়ে যেতাম, তারপর গুড়ুম।” এয়ারগান ফায়ার করল।
.
ছবিখানার দিকে বারবার চাইলাম। সেই বুলা, সেই বুলার ভাই। আমার মনে হল, এয়ারগানের সেই আওয়াজটাও যেন আমার কানে এসে বাজল। ফট! আমি চমকে উঠেছিলাম। একটু পরেই বর্তমান ম্যানেজার এসে জিজ্ঞাসা করলেন, “ড্রিংক্স্ চলবে তো? আমার এখানে সব ব্যবস্থা আছে।” শব্দটা তবে মিথ্যে নয়? আমি হেসে ইচ্ছেটা জানালাম।
“তুমি সত্যিই একটা পাগল। আমাকে দেখবার জন্য প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে আমাদের বাগানে গিয়ে হাজির হয়েছিলে, কথাটা আমি কখনও ভুলতে পারিনে।” বুলা কলেজ থেকে পালিয়ে বোটানিক্যাল গার্ডেনে যাবার বায়না ধরেছিল। স্টিমারের সামনের রেলিং-এ হেলান দিয়ে হঠাৎ পুরনো প্রসঙ্গ টেনে আনল। “আচ্ছা, আমার মধ্যে কী আছে?” গলায় আবদার উথলে উঠল ওর। “কী দেখতে ছুটেছিলে?”
কী আমি দেখছি সুশীলার মধ্যে? ওর শরীর? ওর মন? ওর স্বপ্ন? ওর আশা? কী আমি দেখছি? দেখতে পাচ্ছি? আয়নায় ওর প্রতিবিম্ব পড়ছে। কখনও সিকি, কখনও আট আনা, কখনও বা বারো আনা। পুরো সুশীলা আয়নায় কখনও আঁটছে না, থাকছে না। আর আমার চোখে? “বলরামকে আমি বাঁধতে চাইনি। এখনও চাইনে। আমি ওর দেহের বা মনের বোঝা হতে চাইনে। ও আমাকে নিয়ে পূর্ণ হোক, তৃপ্ত হোক। নিজের শক্তিকে অজস্র ধারায় বইয়ে দিক। আমাকে নিয়ে ও যা খুশি তা করুক। তাতেই আমার তৃপ্তি। আমার যা কিছু আছে, সব ওকে নিঃশেষ করে দেব, দিয়ে আমি পূর্ণ হব।” সুশীলা আমাকে নয়, নিজেকেই যেন কথাগুলো শোনাচ্ছিল। “বাঁধাবাঁধির মধ্যে এই জন্যই যাব না; ওকে বাঁধার মত অত শক্তি আমার নেই, তা আমি জানি। এও জানি, ওকে বাঁধতে গেলেই হারাব।”
বলরামকে আমি সুশীলার কথা জিজ্ঞাসা করেছিলাম। প্রায় সাংবাদিক বৈঠকের জেরা।
আমি : সুশীলাকে তোমার কেমন লাগে?
বলরাম : বলা মুশকিল। কখনও ভাল, কখনও খারাপ।
আমি : (আশ্চর্য হয়ে) খারাপ লাগে? সুশীলাকে তোমার খারাপ লাগে?
বলরাম : আমার ধারণা, ওর মাথায় ছিট আছে। মাঝে মাঝে ও একটা হেঁয়ালি হয়ে দাঁড়ায়। অনেক সব বড় বড় কথা বলে। ‘মুক্ত মন’, কী কী আরও সব কত বুলি কপচায়। আমার বিরক্তি লাগে। সারা দিন খেটেখুটে ওসব বকম বকম কী ভাল লাগে? আমি তো ওর অনেক কথার মানেই বুঝতে পারিনে। তবে কিছু বলিনে।
আমি : কেন, কিছু বলো না কেন?
বলরাম : মেয়েদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়লেই কিছু-না-কিছু খেসারত দিতেই হয়। কাউকে টাকা, কাউকে গয়না। তা ওকে তো সেসব কিছু দিতে হচ্ছে না! সেসব ব্যাপারে ওর কোনও লোভ নেই। ওর লোভ আমাকে কিছু জ্ঞান দেওয়ায়। এটাও একরকম খেসারত। আমি ভাবি, লেখাপড়া-জানা মেয়ের পাল্লায় পড়লে এই খেসারতই বোধ হয় দিতে হয়। তাই চুপচাপ শুনে যাই। মাত্রা বেশি হয়ে গেলেই মেজাজ খাট্টা হয়ে যায়।
আমি : তখন কী করো?
বলরাম : এক-একদিন ধমক দিই।
আমি : সুশীলা তখন কী করে?
বলরাম : কেঁচো হয়ে যায়।
আমি: তুমি ওকে বিয়ে করছ না কেন?
বলরাম : বিয়ে? সুশীলা আমাকে বিয়ে করবে? তবেই হয়েছে!
আমি : (আবার আশ্চর্য হই) তার মানে?
বলরাম : সুশীলাই জানে। আর এতে অবাক হবার কী আছে? আমি কী লেখাপড়া জানি যে, ওর মত মেয়ে আমায় বিয়ে করবে?
আমি : কিন্তু ও তো তোমাকে ভালবাসে—খুবই ভালবাসে!
বলরাম : তোমাদের এই একটা জবর হেঁয়ালি। আমার মাথায় একটুও ঢোকে না।
আমি : ও যে সব ছেড়ে তোমাকে আঁকড়ে ধরেছে, সেটা তো বোঝো!
বলরাম : সব ছেড়ে কি না, জানিনে। তবে বর্তমানে আমাতে যে মজেছে, তাতে ভুল নেই।
আমি : এর কারণ কী? তোমার কী মনে হয়?
বলরাম : (হাসল) আমার ধারণা, ও একটা বাহাদুরি নিতে চায়।
আমি : (অবাক) বাহাদুরি নিতে চায়। কার কাছে?
বলরাম : তোমার কাছে, ওর বাপ-মায়ের কাছে, যাদের সঙ্গে কাজ করে তাদের কাছে, আমার কাছে, এমন কী ওর নিজের কাছেও।
আমি : কেন? এতে ওর লাভ কী?
বলরাম : লাভ-লোকসানের কথা সুশীলাই জানে। আমি : তোমার কী মনে হয়?
বলরাম : আমার মনে হয়, ওর মাথায় ছিট আছে।
আমি : (কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে) আচ্ছা বলরাম, তুমি বিয়ে করতে চাও না? বলরাম : নিশ্চয়ই চাই! তবে আর কিসের জন্য এত খাটছি? কার জন্য এত গড়ছি? আমার ওয়ারিসের জন্যই তো! বিয়ে না করলে আমার ওয়ারিস আসবে কেমন করে? কোনও বেজম্মাকে তো আর ওয়ারিস করতে পারব না!
আমি : তবে তুমি সুশীলাকেই বা বিয়ে করছ না কেন?
বলরাম : সুশীলাকেই বিয়ে করতে হবে, এমন কোনও খতে সই করেছি নাকি? আমি : সুশীলা যদি তোমাকে বিয়ে করতে চায়?
বলরাম : ওকেই বিয়ে করব।
আমি : সে কথা ওকে বলেছ?
বলরাম : না। কিন্তু না বললেও ও এ কথা জানে। ও সব বুঝতে পারে। সেইজন্যই তো ওকে আমার এত ভাল লাগে। মেয়েটা সত্যিই ভাল!
আমি সুশীলাকে এ কথা জানিয়েছিলাম। “লোকটা ওইরকমই।” সুশীলা বলেছিল। সে একটুও বিচলিত বোধ করেনি। “হঠাৎ হঠাৎ নিজের চারদিকে এক পাঁচিল গেঁথে দেয়। তখন আর ওর কাছে এগোনোই যায় না! তা বলে ওকে সন্দেহ কোরো না। ওর ভালবাসায় ফাঁকি নেই। তবে নিজেকে লুকিয়ে রাখার অভ্যাস ওর আছে। ওর সঙ্গে আলাপ হবার দু-তিন মাস পরে তবে আমি জেনেছি, ও বাঙালি। ওর দোকানের ছোকরাটার শক্ত অসুখ হয়েছিল। সেই সূত্রেই আমাদের হাসপাতালে ও যাতায়াত করেছিল কিছুদিন। আমি ওর সঙ্গে বরাবর হিন্দিতে কথা বলে গিয়েছি, ও-ও হিন্দি বলেছে। আমাদের কম্পাউন্ডারবাবু একদিন দেখি ওর সঙ্গে দিব্যি বাংলাতে কথা বলছে। আমি ওকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তুমি বাংলাও বোঝো? কম্পাউন্ডারবাবু অবাক হয়ে বললেন, “বুঝবে না কেন? ও তো বাঙালী!’ আমার অবস্থাটা বুঝে দ্যাখো একবার! আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম! ‘সে কী, তুমি বাঙালি? বাঃ! আচ্ছা লোক তো! তা তুমি তো একবারও সে কথা জানাও নি?’ বলরাম সাফ বলে দিল, ‘এটা কী এমন জানাবার কথা? তা ছাড়া কেউ তো জিজ্ঞেসও করেনি!’ তবেই বোঝো!
“ও কখনও এগিয়ে আসে না,” সুশীলা একটু হেসে বলল, “কখনও আসেনি, আমিই ওর কাছে এগিয়ে গিয়েছি। সেইজন্যই তো আমাদের সম্পর্কটা মুক্ত রাখতে চাই। কোনও কারণেই ও যেন মনে না করে, কোনও মতলবের প্যাঁচে আমি ওকে জড়িয়ে ফেলতে চাই। ও যে লক্ষ টাকার মালিক, তুমি ওকে দেখলে বুঝতে পারবে?
“আমার কাছে ও কিছু লুকিয়ে রাখতে পারে না। আমি ওর অন্ধিসন্ধি জানি। আমার সঙ্গে ওর সম্পর্ক দেহের সীমাতেই আবদ্ধ—এ কথা যদি ভাবো, তা হলে ভুল বুঝবে।
“আমি কিন্তু একটুও ভুল বুঝিনি। সেদিন রাত্রে ওর চোখ দেখেই বুঝেছিলাম, ও আমার কাছে কিছু চায়। সেই রাত্রে ও আমাকে ডাকতে এসেছিল। ওর দোকানের ছোকরাটার বাড়াবাড়ি রকমের অসুখ করেছে। এক্ষুনি আমাকে একবার নিয়ে যেতে চায়। সে সময়ে চারদিকে নিউমোনিয়ার হিড়িক পড়েছে। আমি প্রস্তুত হয়েই গেলাম। গিয়ে দেখি, আমার আন্দাজ সত্যি। ছেলেটা হাঁসফাঁস করছে। পেনিসিলিন দিলাম। অনেক রাত পর্যন্ত ওর শিয়রে জাগলাম দুজন। তারপর ছেলেটা ঘুমিয়ে পড়লে ফিরতে চাইলাম আমার কোআর্টারে। ও আমার খুব কাছ ঘেঁষে চলছিল। মাঝে মাঝে দুজনের শরীরে ছোঁয়াছুঁয়ি হচ্ছিল। আমার স্তিমিত শরীরে এই প্রথম যেন জোয়ার আসতে লাগল। আমি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। ওর দিকে চাইলাম। সেই অল্প অল্প আলোয় দেখলাম, ওর চোখ দুটো আমার ওপর স্থির হয়ে রয়েছে। আমি থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। বুঝতে পারলাম, ও কী চাইছে। আমি তখন থরথর করে কাঁপছি। আমার কাছে ও কী চায়? আমার মন প্রশ্ন করল। তা কি আমার আছে? নিশ্চিত উত্তর পেলাম না। আশঙ্কা হল, তা যদি আমার না থাকে? ও যদি গ্রহণ করে খুশি না হয়? যদি বিরক্ত হয়? ওর চোখের এই জ্যোতি আর কোনও দিন জ্বলে না ওঠে? আমার সাহস হল না। আমি চোখ সরিয়ে নিলাম। ধীরে ধীরে কাঁপতে কাঁপতে নিজের কোআর্টারে ফিরে এলাম। বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিলাম। খুব ঠাণ্ডা হয়ে পড়েছিলাম। তবু ঘুম এল না। দুটো স্থির জ্যোতি আমার শরীরের ওপর জ্বলতে লাগল। ঘুম এল না।
“পরদিন দুপুরে গেলাম। বলরাম ব্যস্ত ছিল। ওর দোকানে খদ্দেরের ভিড়। একবার এসে খোঁজ নিয়ে গেল। কাল রাত্রে ছেলেটার শ্বাসবন্ধ হয়েছিল, সে রিপোর্ট দিল। আমার ভয় হয়েছিল, আজ হয়তো ওর সামনে অস্বস্তি বোধ করব। কিন্তু না, বলরামের চালচলনে, কথায় বার্তায় কালকের লোকটিকে আর খুঁজে পেলাম না। সত্যি বলতে কী, বেশ স্বস্তি পেলাম। বলরামকে বললাম, আমাকে সন্ধে পর্যন্ত থাকতে হবে। কয়েকটা ইনজেকশন দিতে হবে ছেলেটাকে। আমার দুপুরের খাওয়া আর বিশ্রামের ব্যবস্থা যেন করে রাখে। বিশ্রামের ব্যবস্থা কথাটার ওপর জোর দিয়েছিলাম কেন, বলতে পারছিনে। সম্ভবত কাল রাত্রে ঘুমের ব্যাঘাত হয়েছিল, আর সে যে বলরামের জন্যই (ওরই রোগী চিকিৎসা করতে এসে) –হয়তো সেই কথাটাই ওকে জানাতে চেয়েছিলাম। সত্যি বলতে কি, শরীরটাও আর বইছিল না। বলরাম যেন খুশিই হল। ওর ব্যবসাদারি খোলসটা ও ছাড়ল না। যে স্বরে কাকাবাবুকে থাকার কথা বলেছিল, আমাকে তেমনি স্বরেই বললে, ‘তার জন্য অসুবিধা হবে না। ঘর তো আপনার চেনাই আছে। যতক্ষণ খুশি থাকবেন।’ আমি বললাম, ‘সন্ধে পর্যন্ত থাকতে হবে। পরে যদি বুঝি ইনজেকশনের আরও দরকার, তা হলে কম্পাউণ্ডারবাবুকে পাঠিয়ে দেব।’ আমিও পাকা ডাক্তারের মত নিস্পৃহ গলায় বললাম। ‘আর হ্যাঁ, দ্যাখো, খেয়েদেয়ে আমি ঘুমিয়ে পড়তে পারি; তিনটের সময় আমাকে তুলে দেবে।’ বলরাম ‘আচ্ছা’ বলে চলে গেল।
“দিনেও আমার ঘুম এল না। বিছানায় শুয়ে—এই বিছানাটায়—” সুশীলা দু হাত দিয়ে বিছানাটা থাবড়ে নিল। “ঠিক এই বিছানাতেই শুয়ে ছিলাম। এখন যেমন বলরামের বোর্ডাররা পাশের লটাতে থাকে, তখন তা হত না। এই দুটো বিছানাতেই ও খদ্দের রাখত। এমনি ফার্নিই ছিল। আমার ঘুম আসছিল না। শুয়ে শুয়ে . আমি বলরামেরই প্রতীক্ষা করছিলাম। আমার কেমন মনে হচ্ছিল, ও আসবে। মাঝে মাঝে ট্রাক ড্রাইভারদের হেঁড়ে গলার চিৎকার শুনছিলাম (‘কোম্পানি, চার চাপাটি, আলু-মটর; এ কোম্পানি, মিটশাক লাগাও; এ কোম্পানি, লস্যি লাগাও, চার নমকিন লস্যি। ‘)। ওরা হো হো করে হাসছিল, রসিকতা করছিল, ঝগড়া করছিল কেউ কেউ। বলরামের গলা পাচ্ছিলাম মাঝে মাঝে (অহো জাড় দে ইয়ারা)। কে বলবে, ও বাঙালি?
“ক্রমে ক্রমে কথাবার্তা ফিকে হয়ে এল। খদ্দেরের ভিড় কমেছে বলে মনে হল। এইবার তবে আসবে? কী অছিলা নিয়ে ঢুকবে বলরাম? ‘ভেবেছিলাম, তিনটে বেজে গিয়েছে।” ‘আমার দোকানে ঘড়ি নেই।’ ‘আমার ঘড়িটা খারাপ হয়ে গিয়েছে, তাই বুঝতে পারিনি।’ ‘ছোকরাটা কেমন যেন হাঁসফাঁস করছে। ‘ ‘ভাবলাম, আপনার হয়তো চা খাবার সময় হয়েছে।’ অথবা সে কিছুই বলবে না মুখে। চুপ করে চেয়ে থাকবে। আমার কাছে যা চাইবার, তা ওর চোখ দুটোই চেয়ে নেবে। আমি কী করব তখন? আজও আমল দেব না? সাড়া দেব না ওর আহ্বানে? আরও অপেক্ষা করব? পরীক্ষা করব ওকে? নিজেকে প্রস্তুত করব? কী আমার আছে? কী ওকে দিতে পারি?
“কিন্তু কই, ও তো এল না! একবারও ঢুকল না ঘরে! ওর কাজকর্ম কী এখনও শেষ হয়নি? নাকি, নাকি অকস্মাৎ প্রবল আশঙ্কায় আমার শরীর হিম হয়ে গেল। ওকে কী আমি আকর্ষণ করতে পারিনি? পারিনি? পারিনি? কাল তবে যা দেখেছি, সে কী ভুল দেখেছি? প্রচণ্ড এক ব্যর্থতা অকস্মাৎ আমাকে সুগভীর এক শূন্যতার মধ্যে ছুড়ে ফেলে দিল। নিজের ওপর দারুণ অশ্রদ্ধা হল। আমার মনে হতে লাগল, আমার পায়ের নীচ থেকে মাটি সরে গিয়েছে। আমার দাঁড়াবার জায়গা নেই। ব্যর্থ, ব্যর্থ— আমার জন্ম ব্যর্থ বলে মনে হতে লাগল। তবে কী আমার শরীর নেই? শুধু একটা অস্থির কাঠামো মেদ-মাংস- চামড়া দিয়ে ঢাকা? স্তূপীকৃত মৃত কোষের একটা বোঝা মাত্র? পৌরসভার আবর্জনার বেশি মূল্য কেউ এটাকে দেবে না? আমার হৃৎপিণ্ডটাকে একটা ফাটা বাঁশের মধ্যে পুরে কেউ যেন মোচড় দিচ্ছে। নাকি আমি নারীই নই? পুরুষের কাছে এ দেহের কোনও আকর্ষণই নেই? শিয়রের দিকে ড্রেসিং টেবিলটা রয়েছে। উঠে নিজের চেহারাটা দেখতে ইচ্ছে করছিল। সাজ-পোশাকে রুচি ছিল না আমার। আয়নায় নিজের আকৃতি যাচাই করে দেখবার প্রবৃত্তি কোনও দিন হয়নি। আজ মনুষ্যকৃত আচ্ছাদনের আবরণ দু হাতে সরিয়ে বিধিদত্ত দেহটার মুখোমুখি হবার বাসনা তীব্রতর হয়ে উঠল।
“সঙ্গে সঙ্গে অ্যালার্ম ঘড়ির তীব্র আওয়াজে চমকে উঠলাম। হাতঘড়িতে চোখ ফেলে দেখলাম, কাঁটায় কাঁটায় তিনটে বেজেছে। বুক খালি করে একটা শুকনো নিশ্বাস—মরুভূমিরই বাতাস বুঝি—পড়ল। আর সঙ্গে সঙ্গে চায়ের ট্রে হাতে করে বলরাম ঢুকল। আমার মনে হল, কাল রাত্রে কয়েক মুহূর্তের জন্য, হয়তো অজ্ঞাতসারেই, বলরাম আমার যত কাছে এগিয়ে এসেছিল, আজ ও স্বেচ্ছাকৃত প্রচেষ্টায় ততটা দূরেই সরে যেতে চাইছে। আমি খুব ক্লান্ত বোধ করছিলাম। বেশি কথাবার্তা না বলে চা খেয়ে নিলাম। তারপর আমার বৃত্তির মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে খানিকটা শক্তি সঞ্চয় করলাম। ছেলেটাকে একটা ইন্জেকশন দিয়ে, ওষুধপত্রের ব্যবস্থা করে আমি বলরামকে বললাম, ‘আমি এখন যাব।’ আমার স্বরটা নিজের কানেই ক্লান্ত লাগল। আমার মনে হল, বলরাম যেন একটু অবাক হল। গলাতে যথাসম্ভব নিস্পৃহতা আর নীরসতা এনে আবার বললাম, ‘আমি এখন যাব। (একবার মনে হল বলি, আমার শরীরটা ভাল লাগছে না। পরক্ষণেই মনে হল, কেন, এত কৈফিয়তেরই বা দরকার কী?) কম্পাউণ্ডারবাবুকে পাঠিয়ে দেব। তিনিই সন্ধে আর রাত্রের ইজেক্শন দিয়ে দেবেন।” বলরাম বলল, ‘আচ্ছা।’ তারপরে বেরিয়ে গেল। একটু পরেই এসে বলল, ‘এত রোদে আর হেঁটে যাবার দরকার নেই। একটু পরেই ওদিকে একটা ট্রাক যাচ্ছে, ড্রাইভার আপনাকে নামিয়ে দিয়ে যাবে’খন।’
“একবার ভাবলাম, ধন্যবাদ দিয়ে প্রত্যাখ্যান করি। কিন্তু না, বাইরে রোদ বেশ কড়া। এতটা পথ হাঁটতে বেশ কষ্ট হবে। আশ্চর্য, আসবার সময় এ কথা কিন্তু একবারও মনে হয়নি। বাসায় ফিরে বেশ অনেকক্ষণ ধরে চান করলাম। তারপর বিছানায় গিয়ে শোয়া মাত্র ঘুম এসে গেল। ঘুম থেকে উঠে শরীরটা ঝরঝরে বোধ হল। তখন প্রায় সন্ধে লেগে এসেছে। কম্পাউণ্ডারবাবুকে ডাকিয়ে এনে সব বুঝিয়ে দিলাম। বাস, এখন থেকে কম্পাউণ্ডারবাবুই সব করবেন। সত্যি, রোজ রোজ এতটা পথ যাওয়া-আসা আমার পক্ষে সম্ভবও নয়! তবে বিশেষ দরকারে বলরাম যদি ছুটে আসে, সে কথা আলাদা।
“কিন্তু সে আসবে না- আমি জানি, সে আসবে না। ওর মন দেমাকে ভরা। আমি এটা লক্ষ করেছি। ও ড্রাইভারদের কাছে যত সহজ, আমাদের কাছে তত দেমাকি। এই দেমাক দেখাবার জন্যই কাকাবাবুকে ও অপমান করেছিল। না-হয় মানলাম, কাকাবাবুও ওকে অপমান করেছিলেন, ও তার শোধ নিয়েছে। কিন্তু আমি? আমি ওর কী করেছি? ওকে তো কখনও ঘুণাক্ষরেও অপমান করিনি! তবে আমার সঙ্গে এরকম ব্যবহার করছে কেন? সেই রাত্রেই আমি আয়নার সামনে বসলাম।” সুশীলা হাসল, ড্রেসিং আয়নাটায় একবার উকি মারল। মোটা বেণীটাকে এদিকে-ওদিকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখল। “আমি জানি, আমার চেহারাটা দেখতে ভাল নয়।”
“বাজে কথা!” আমার মুখ দিয়ে এতক্ষণ পরে কথা বেরুল। ‘তোমার যা আছে, তার অর্ধেক পেলেও অনেক মেয়ে বর্তে যাবে!”
“যাক, আর মন-রাখা কথা বলতে হবে না!” সুশীলা ধমক মারল। “এই বয়সে মন-রাখা কথা শুনলে আর মন গলে না।” তবু সুশীলার চোখ দুটো চিকচিক করে উঠল।
“সত্যি বলছি, সুশীলা!” আমার স্বর আন্তরিকতায় গাঢ় হয়ে এল। “সত্যিই তুমি সুন্দর! আর এই মুহূর্তে তোমার তুল্য সুন্দরী আর দেখেছি কি না, সন্দেহ।”
সুশীলার মুখে একটা আভা ফুটে উঠল – ও হাসল। “তবু তো তুমি বুলার থাপ্পড় খেতেই ছুটেছিলে!”
“সেটা একটা—একটা দৈবযোগ। এখন আমার বলরামের ভাগ্যে কেমন হিংসে হয়। আমার একারই হয়, এ কথাই বা বলছি কেন! এখানকার অফিসার মাত্রেই তো বলরামকে বাগে পেলে কাঁচা চিবিয়ে খায়!”
“তা যা বলেছ!” সুশীলা জোরে হেসে উঠল।
.
বলরাম আর সুশীলার সঙ্গে কথা বলে আমার পক্ষে বোঝা মুশকিল হল, ওদের এই সম্পর্কের ভিত্তিটা কোথায়। সুশীলা এ যাবৎ বলরাম সম্পর্কে যেসব বিবরণ দিয়েছে, তার মধ্যে কিছু নাটকীয়তা আছে। কিন্তু সে নাটকীয়তা বলরামের চরিত্রের কোনও কোনও দিকের সঙ্গে খাপও খেয়ে যায়। যেমন ওর ওমর। যেমন ওর প্রখর ব্যবসাবুদ্ধি। যেমন ওর লক্ষ্য সম্পর্কে স্থির নিশ্চিতি। একটা অজগর যেমন নিশ্চিত প্রতীক্ষায় বসে থাকে—শিকার তার জুটবেই, তেমনি একটা অটল মনের জোর বলরামের আছে—নির্দিষ্ট পরিধির মধ্যে সিদ্ধিতে সে পৌঁছবেই। তাই তার কোনও তাড়াহুড়ো নেই, কিন্তু তৎপরতা আছে। অদৃষ্টে তার বিশ্বাস নেই, পুরুষকারে আছে। তার পরিপার্শ্ব সম্পর্কে সে ভয়ানক সচেতন। সামান্যতম পরিবর্তনের সংবাদও সে রাখে। কোনও ঘটনাই তার কাছে তুচ্ছ নয়। একটা ঘটনা যে হাজার রকম ঘটনার জন্ম দিতে পারে, সে সম্ভাবনা সম্পর্কে সে অতিমাত্রায় সচেতন। আর যে ঘটনাকে অবলম্বন করলে সে তার লক্ষ্যে পৌঁছবে, হাজারের মধ্যে সেটা বেছে নেওয়াই তার জীবনের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার বলে সে মনে করে। ভুল সে করে না, তা নয়; তবে ভুল শোধরাতে সে যেমন বিন্দুমাত্র দেরি করে না, তেমনি অতীতের ভুলের জন্য কখনওই অনুশোচনায় কালক্ষেপ করে না। সঞ্চয়ে তার অগাধ আস্থা। “সঞ্চয় মানে টাকা পুঁতে রাখা নয়, টাকা খাটানো।”
বলরামের কোনও কোনও মন্তব্য বেশ মজার। এই উদ্বাস্তু উপনিবেশের নাম সে দিয়েছে “বাবুদের শখের বাগান”।
“কেন, শখের বাগান কেন?”
“দেখছ না, কেমন যত্ন! রাস্তা বানাচ্ছে, জমি হাসিল করছে, গ্রাম পত্তন করছে। যেন ফুলের কেয়ারি হচ্ছে।” বলরামের গলায় ঠাট্টার আমেজ একটুও নেই। “বাবুরাই সব করে কম্মে দিচ্ছে। তাই যাদের জন্য এত সব, তাদের তো আবদার করা
ওরা তো শখের বাগানে দামি সব আগাছা!” এই ধরনের ধার ছিল। কিন্তু রঙ্গচারীকে এই ধরনের
ছাড়া আর কোনও কাজ নেই। আশ্চর্য, রঙ্গচারীর মন্তব্যেও মন্তব্যের জন্য ক্ষমা করা যায়। কারণ, সে যে রাজ্যের লোক, সেখানে এই উদ্বাস্তু সমস্যার উদ্ভব হয়নি। তার পক্ষে নিষ্করুণ হওয়া স্বাভাবিক, যদিও বিবেচনাসম্মত নয় বলেই আমার মত। কিন্তু বলরাম তো বাঙালি, খেটে-খাওয়া লোক—সে এমন বিরূপ মন্তব্য করবে কেন?
বলেছিলাম, “এ তোমার অন্যায় কথা, বলরাম। এরা বাঙালি। সর্বস্ব হারিয়েছে। নিজেদের দোষে নয়—”
“সর্বস্ব হারানোটাই তো দোষের!” বলরাম আমাকে থামিয়ে দিয়েছিল। “আর বাংলা দেশের আগাছায় ভাল ফসল হয়—এ কথা আমার জানা ছিল না।”
বুঝলাম, বলরামকে বোঝানো যাবে না। ও ইতিহাস দিয়ে যাচাই করে না, যাচাই করে ফল দিয়ে।
“বাঁচার লড়াই সে অন্য জিনিস; যে বাঁচতে চায়, এ লড়াই শুধু তারই। তার জন্য আর কারও মাথাব্যথা হয় না।” বলরাম বলেছিল।
“আমাকে অনেক লাথি খেতে হয়েছে।” বলরাম একদিন আমার প্রশ্নের খোঁচাখুঁচিতে অস্থির হয়ে তার জীবনের কিছু কিছু ঘটনা বলেছিল। “নালিশ কার কাছে জানাব? ছোটবেলায় ধারণা ছিল—ভগবান আছেন, বিচার তিনিই করবেন। কিন্তু ভগবানের আদালতের বিচারের রায় বেরুতে দেওয়ানি মামলার চাইতেও দেরি হয়। তাই সে আদালতে মামলা রুজু একেবারে পশুশ্রম। নিজের ওপর নির্ভর করাই ভাল। ভাল ফল পাওয়া যায়। কলকাতার এক পাইয়ার হোটেলে আট বছর ধরে লাথি খেয়ে টিকে ছিলাম। হাল ছাড়িনি। শুধু একটা উদ্দেশ্য ছিল, বয় থেকে কারিগর হব। রান্না শিখব। সুযোগ পেলে হোটেল করব একটা। আঠারো বছরের জোয়ান যখন আমি, ভাল কারিগর হয়ে উঠেছি, তখন একদিন সুযোগ হল। বুড়ো পাইয়া বছর খানেক আগে এক ছুকরিকে কোত্থেকে বাগিয়ে এনেছিল, সেই ছুকরির নজর পড়েছিল আমার ওপর। তাকে নিয়ে ভেগে পড়লাম লখনউতে। সঙ্গে ছিল হাজার কয়েক টাকা আর গয়না। ভাল হোটেল খুলেছিলাম। ছ মাসের মধ্যেই নামডাক হয়েছিল। খ্যাপা কুকুরের মত পাঁইয়া এসে হানা মেরেছিল সেখানে। উপায় ছিল না—প্রাণ বাঁচাতে সেই মেয়েটাকে উন্মুক্ত কৃপাণের তলায় ঠেলে দিয়ে চম্পট দিয়েছিলাম। আবার দেড় বছর ধরে শুধু লড়াই। এক দিকে প্রতিহিংসার আগুনের হাত থেকে সমানে প্রাণ বাঁচাতে হয়েছে, আর এক দিকে খিদের হাত থেকে। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে এমন জায়গা খুঁজে বের করতে হল, যেখানে রেলের লাইন নাগাল ধরতে পারবে না। এই অঞ্চলে এসে আশ্রয় নিলাম। তখন এদিকে একবারে জঙ্গল। এই জঙ্গলে ডেরা বাঁধার মত একটা জায়গার খোঁজে এক বছর ধরে সমানে ঘুরেছি। কাঠের ব্যবসাদার ছাড়া আর কেউ এদিকে আসত মা। একদিন দেখি, গোটা কতক সাহেব, এক বাঙালিবাবু আর জনকয়েক লোক এখানে তাঁবু ফেলল। ঐখানে, ঐ গাছের নীচে। আমি ওখানে কাজ নিলাম। তিন মাস ধরে জরিপ হল, অনেক পাথর-টাথর এনে বাঙালিবাবু পরীক্ষা করল। তখন শুনলাম, এখানে এক মাইন পাওয়া গিয়েছে। খুব দামি জিনিস। আস্তে আস্তে লোকজন আসতে শুরু করল। কুলি, কামিন। আমি ঠিক করে ফেললাম—বাস, এইখানেই বসা।”
বলরাম চুপ করল। যেন দম নিচ্ছে। “তারপর থেকে বিশ বছর ধরে এখানে আছি। প্রথমে ঐ গাছতলায় একটা চায়ের দোকান করেছিলাম। কুলিরা কখনও কখনও খেত। তারপর এখানে সড়ক হল, একটু একটু করে শহর বাড়ল। আমিও বাড়লাম। কতবার ফেল হয়ে গিয়েছি। পুলিসে ধরে নিয়ে গিয়েছে। দোকান লুঠ হয়ে গিয়েছে। আবার শুরু থেকে আরম্ভ করতে হয়েছে। মাটি ধরেই উঠতে হয়েছে।”
“তারপর?”
“তারপর আর কী, এই তো দেখছ!”
“তুমি নাকি বড় হোটেল খুলবে?”
“এখানে নয়, বড় কারখানার কাছে। কাজ তো শুরু হয়ে গিয়েছে!” বলরাম সাধারণভাবে উত্তর দিল। “চাইলে তোমাকে কে দেবে? তোমার যা দরকার, তোমাকে জোগাড় করে নিতে হবে। গায়ে জোর থাকে, কেড়ে নাও; মাথায় বুদ্ধি থাকে, বুদ্ধি খাটিয়ে আদায় করো। এই তো মন্তর! আর কী?”
হঠাৎ আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তা হলে কী তোমার ধারণা, এই যে এখানে বিরাট বসতি বানাচ্ছে সরকার, এ দিয়ে কিছু হবে না?”
“হবে না কেন? এত টাকা ঢালছে সরকার, সে টাকা পচেও তো কিছু সার হতে পারে! আমি বুঝতে পারছি না, এত টাকা এর পিছনে ঢালছেই বা কেন?”
“বাঃ! যারা আসবে, থাকবে এখানে, তাদের জন্য বাড়িঘর বানাতে হবে না?”
“তারা কী সব ঘরজামাই?”
সেই আবার রঙ্গচারীর সুর : “এই অরণ্যেই যদি ওদের বসতি দেবে ঠিক করল, তবে এখানে এনে ওদের ছেড়ে দিল না কেন? হোআই দিস কলোস্যাল ওয়েস্ট, ম্যান?”
বলেছিলাম, “কী যে তুমি বলো, রঙ্গচারী! এই বনে কোনওরকম ক্ষেত্র প্রস্তুত না করেই ওদের এনে ছেড়ে দেওয়া হোক, আর ওদের সাপে-বাঘে খেয়ে ফৌত করে দিক! চমৎকার সমাধান হয়ে যাবে এত বড় একটা সমস্যার! তুমি বরং নেহরুকে প্রস্তাবটা পাঠাও। তোমাকে ভারতরত্ন খেতাব দিয়ে দেবে।”
রঙ্গচারী বিষণ্ণভাবে বলল, “আমার কাছে এটা কোনও তামাশা নয়। ভারতরত্নের প্রতিও আমার কোনও লোভ নেই। হোআই ডু ইউ ওআন্ট টু মেক ইট অ্যান অ্যাসাইলাম ফর দি ক্রিস্—আমি সেই কথাটা কিছুতেই বুঝতে পারিনে। লেট দেম লিভ লাইক মেন, লেট দেম ডাই লাইক মেন’! তোমার এ রিহ্যাবিলিটেশন কিসের রিহ্যাবিলিটেশন? মনুষ্যত্বহীন মানুষের? এর কী সার্থকতা আছে?”
এদের সেই সারভাইভ্যাল অব দি ফিটেস্ট বাতিকে ধরেছে। রঙ্গচারী আর বলরাম উদ্বাস্তু সম্পর্কে “যোগ্যের অধিকার” নীতিতে বিশ্বাসী। এই নীতি কী সব প্রয়োগ করা চলে?
“তুমি যদি ঢোল-শহরত সহযোগে তৈরি জমিতে এনে এনে এদের বসিয়েও দাও,” বলরাম বলল, “আবার যে সে জমি এদের হাত-ছাড়া হবে না, তা বলতে পারো? এদের রক্ষা করবে কে?”
“কেন, আইন?”
“আইন!” বলরাম হাসল।
রঙ্গচারীও একদিন এই কথায় এমনিভাবে হেসেছিল। “দি ল ইজ নট অলওয়েজ এ ভেরি ফেইথফুল মিসট্রেস অব দি উইকলিংস্!”
(সমাপ্ত)