ভোজ
এক
অরিন্দম মুখ দিয়ে চুকচুক করে একটা আফসোসের ভঙ্গি করল৷ হাতে একটা শুকনো ডাল নিয়ে ঘুরছিল, সেটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলল, ‘‘দূর দূর! এখন মনে হয় কি করতে এই লাইনে এলাম! এর চেয়ে হাতিবাগানে ঘন্টুদা’র কাছে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকলে ঠিক একটা না একটা ছোটখাটো চাকরি জুটে যেত৷’’
‘‘এত অধৈর্য হোস কেন!’’ ভাত হাঁড়িতে টগবগ করে ফুটছিল, আমি সাবধানে হাতা দিয়ে দু’টো ভাত তুলে আঙুল দিয়ে টিপে দেখলাম৷
হুম, মোটামুটি সেদ্ধ হয়েছে৷ বাকিটা ভাপেই হয়ে যাবে৷
বললাম, ‘‘গুইতে তো বলেছে আজ কিছু একটা খবর আনবে৷ একটা লোককে ও হাতও করেছে ভালো দু’পেটি ঈয়াই দিয়ে৷’’
ঈয়াই এই নাগাল্যান্ডের উপজাতিদের একধরনের প্রিয় পানীয়৷ আসার পরে পরেই একদিন আমরা খেয়েছিলাম৷ ওই দিশি মদ আর কি! আহামরি কিছু নয়, তবে নেশা হয় জোর৷
তবে আজ মনে হচ্ছে আমাকেও একটু খেতে হবে৷
কাল গুইতের মুখে কথাটা শোনার পর সারারাত এক ফোঁটা ঘুমোতে পারিনি৷ বিস্ময়ে, আতঙ্কে৷ এমনও হয়! মানে হতে পারে! তাও আবার এই একবিংশ শতাব্দীতে?
অরিন্দম মুখ বেঁকাল, ‘‘হুস! ওকে আমার বিশ্বাস নেই৷ সারাক্ষণ ওই চোলাই খেয়ে পড়ে থাকে৷ আদৌ কথাটা সত্যি কি না তারই কোনো প্রমাণ নেই!’’
‘‘আরে প্রমাণ তো অনেক কিছুরই আগে পাওয়া যায় না৷’’ আমি স্টোভটা নিভিয়ে দিলাম, ‘‘তা বলে সব কিছু মিথ্যে হয়ে যায়?’’
কেরোসিন তেল বেশি নেই৷ তিনদিন হয়ে গেল ডিমাপুর থেকে নিয়ে এসেছিলাম৷ আবার যেতে যেতে পরের সপ্তাহ৷ তার ওপর এখানে সব কিছুরই আগুন দাম, বুঝেশুনে খরচ করতেই হবে৷
ন্যাকড়ায় হাত মুছতে মুছতে বললাম, ‘‘আর ঘন্টুদা ঘন্টুদা করছিস, ঘন্টুদার ওই বিপিও’তে গেলে দিনরাত কানে হেডফোন গুঁজে বকতিস, আর লোকেদের গালাগালি খেতিস৷ এত ধরনের অভিজ্ঞতা হত জীবনে?’’
‘‘কি হবে অভিজ্ঞতার পাহাড় বানিয়ে? অভিজ্ঞতা আমায় খাওয়াবে, অ্যাঁ?’’ অরিন্দম খিঁচিয়ে উঠল, ‘‘এত হাড়মাস কালি করে রিপোর্ট দিয়েও তো সেই একজনকে তাড়াবে, নয় তোকে, নয় আমাকে৷ অন্যজন কি করবো ভেবে দেখেছিস? হয় আবার এ’রকম কোনো এন জি ও’র হাতে পায়ে ধরে নতুন জায়গায় ঝাঁপাঝাঁপি করো আর গলাধাক্কা খাও, নয়ত বাটি হাতে রাস্তায় বসে পড়ো! আর বাড়িতে ফিরলেই মা’র মুখঝামটা! সেই এক কথা, বাবা বসে পড়ল, ভাইটা এইরকম, আর তুই এখনো দাঁড়াতে পারলি না!’’
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম, ‘‘কি আর করবি বল৷ সবই আমাদের কপাল! না হলে দু’মাস হয়ে গেল দুজনে এই জঙ্গলে পড়ে আছি, এত ধরনের রিপোর্ট পাঠালাম, এতরকমের হেল্প করলাম, তবুও হেড অফিসকে খুশি করতে পারলাম না! খালি এক কথা, একসেপশনাল রিপোর্ট চাই, এসব তো সবাই পারে! এখন ওই গুইতেই ভরসা!’’
অরিন্দম কিছু বলতে যাওয়ার আগেই আমাদের ঘরের ছাদ থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল পড়তে শুরু করলো৷
বাইরে তাকিয়ে দেখলাম, আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে৷
খো আং গ্রামের এই এক সমস্যা, এখানে এই খটখটে রোদ, পরের মুহূর্তেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি৷ এইভাবে সবদিক সামলানো যায়!
আমি দৌড়ে গেলাম বাইরের ঘরে, সেখানে অনেকটা ধান বস্তার ওপর বিছিয়ে শুকোতে দিয়েছিলাম, তাড়াতাড়ি বস্তাটাকে গুটিয়ে ভেতরে নিয়ে এলাম৷
অরিন্দমের কি হয়েছে কে জানে, যত আমাদের অ্যাসাইনমেন্ট শেষের দিন এগিয়ে আসছে, তত ও কেমন বদমেজাজি হয়ে উঠছে৷ রান্নাবান্না, ঘরের কাজ কিছুই করছে না, প্রোজেক্টের কাজেও মন নেই বিশেষ, সারাদিন আধশোয়া হয়ে দেওয়ালে হেলান দিয়ে কি যেন ভেবে চলেছে৷ আর সবসময়েই রেগে রয়েছে৷ দাড়িও কামায় না, ঠিক করে চুলও আঁচড়ায় না, কেমন যেন দেখতে লাগে ওকে আজকাল৷
আমি এবার একটু উষ্ণভাবেই বললাম, ‘‘দেখছিস রান্নাটা চাপিয়েছি, গিয়ে ধানটা তুলে আনতে পারছিস না? একা কতদিক সামলাব আমি!’’
অরিন্দম ভাবলেশহীন ভাবে বসে রইল, ছাদের দিকে ওর দৃষ্টি৷ কথাগুলো আদৌ কানে ঢুকল বলে মনে হল না৷
আমি বিরক্ত মুখে চালের হাঁড়ির ঢাকনাটা আরো একবার তুললাম৷ হাত দিয়ে টিপে দেখলাম সেদ্ধ হয়ে গেছে৷ আজকের মেনু ফকফকে সাদা মোটা চালের ভাত, সঙ্গে ডুমুরসেদ্ধ আর এখানকার এক ধরণের শাক৷ আগের সপ্তাহে ডিমাপুর থেকে ডিম এনেছিলাম কিছু, কিন্তু সেগুলো এর মধ্যেই শেষ হয়ে গেছে৷ এখানকার আদিবাসীদের জন্য আনা জামাকাপড়, শুকনো খাবার, সেগুলোও শেষের পথে৷
ঠিক আছে, কি আর করা যাবে! এই ডুমুরসেদ্ধ দিয়েই চালাতে হবে, পেট ভরানো নিয়ে কথা, নিজের মনেই কাঁধ ঝাঁকিয়ে ভাবলাম৷
বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়েছে৷ আমি একটা মাটির কলসি বসালাম মেঝের সেই জায়গাটায়, যেখানে ছাদের বাঁশের ফাঁক দিয়ে জল পড়ছে ঝরঝর করে৷
সবদিক মোটামুটি সামলে অরিন্দমের দিকে একটা বিরক্তির দৃষ্টি হেনে বাইরের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালাম৷ আর তক্ষুনি মনে পড়ে গেল গুইতে’র বলা কথাগুলো৷
সত্যিই কি জেসুমিদের কাছে আমরা পৌঁছতে পারব? আর পৌঁছতে পারলেও সাক্ষী কি হতে পারব ওই অদ্ভুত ঘটনার? বন্দী করতে পারব সেটা ভিডিও ক্যামেরায়?
দূরে হঠাৎ তাকিয়ে দেখি ভিজতে ভিজতে কেউ একটা আমাদের কুঁড়েঘরের দিকে আসছে৷ আরো একটু কাছাকাছি আসতে বুঝলাম, ওই তো, গুইতে আসছে৷ গুইতে’র হাঁটাটা ভারী অদ্ভুত৷ সমতল রাস্তাতেও শরীরটা একটু সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে দুলে দুলে হাঁটে৷ তাই দূর থেকেই বোঝা যায়৷
দরজার কাছে এসে গুইতে চোখমুখ উল্টে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বলল, ‘‘নিম্নচাপ৷ চলবে এখন দুদিন৷’’
গুইতে বলতে গেলে এখানকার একমাত্র স্থানীয় মানুষ যে ভাঙাভাঙা হলেও ইংরেজি জানে৷ সেইজন্যই ওকে আমরা আমাদের সঙ্গে উপজাতির লোকেদের কো-অরডিনেটর হিসেবে বেছে নিয়েছি৷ লোকটা এমনিতে কাজের, সব উপজাতিদের সাথে আমাদের ইন্টার্যাকশন সুন্দরভাবে করিয়ে দিয়েছে, কিন্তু টাকার খাঁই একটু বেশি৷ রোজগারের বেশিরভাগটাই ঢালে নেশাভাঙে৷
কাল সারাদিন অনেক খাটাখাটনি গিয়েছিল৷ কাল আমরা গিয়েছিলাম এখান থেকে প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে এক জঙ্গলে, সেখানে জেলিয়াং বলে এক ধরনের নাগা উপজাতি বাস করে৷ জেলিয়াংরা মোটামুটি সভ্যতার ছোঁয়া পেয়েছে৷ পড়াশুনো না শিখলেও তাদের মধ্যে বিয়ে হয়, নানারকম উৎসবেরও প্রচলন রয়েছে৷ এখন মাঝেমধ্যে তাদের দু-একজন ডিমাপুর বা তিনসুকিয়াতে পড়তেও যাচ্ছে৷ আমরা প্রধানত গিয়েছিলাম দুধ, পনির, আরো এইজাতীয় ডেয়ারি প্রোডাক্ট নিয়ে৷ নাগা উপজাতিদের অধিকাংশই দুধকে অত্যন্ত অশুভ মনে করে৷ এমনিতে নাগারা সব খায়৷ সব ধরনের মাংস, মাছ, লতাপাতা, সবজি৷ কুকুরের মাংস, বিশেষ করে কালো কুকুর তো এদের কাছে লাক্সারি খাবার, আমাদের বিরিয়ানির মতো৷
কিন্তু দুধ নিয়ে এদের সাংঘাতিক ট্যাবু৷ আমরা সেটাই কাটাতে গিয়েছিলাম৷ দুধের প্রয়োজনীয়তা, গুণাগুণ এবং প্রয়োগ নিয়ে বোঝাচ্ছিলাম, গুইতে সেটাকে ওদের ভাষায় অনুবাদ করছিল আর অরিন্দম পুরোটা রেকর্ড করছিল ওর ভিডিও ক্যামেরায়৷ ধীরে ধীরে এক-দু’জন এগিয়েও আসছিল দুধ চেখে দেখার জন্য৷
মোটামুটি পুরো দিনটা ভালোই কাজ করে ঘরে ফিরেছিলাম সন্ধ্যে নাগাদ৷ গুইতে’র এখন আমাদের সাথে থেকে থেকে সিগারেট ফোঁকার অভ্যেস হয়েছে৷ অরিন্দমের থেকে একটা সিগারেট নিয়ে ফসফস করে টানতে টানতে বলেছিল, ‘‘দেখুন স্যার, আঙ্গামি, চাং, কোনিয়াক, জেলিয়াং, লোথা, সবার সাথেই মোটামুটি কাজ করিয়ে দিলাম৷ এবার আমার টাকাটা একটু বাড়িয়ে দিন!’’
আমি এমনিতে নরম স্বভাবের মানুষ৷ চট করে গলে যাই৷ কিন্তু অরিন্দম আমার উল্টো, আমাকে কিছু বলতে না দিয়ে বলেছিল, ‘‘আরে গুইতে! এগুলো তো আমরাও করতে পারতাম বলো! তুমি যতজনের কাছে নিয়ে গেছ, সবাই ব্যাটা সভ্য হয়ে গেছে অল্পবিস্তর৷ জেসুমিদের তো ম্যানেজ করতে পারলে না! এদিকে আবার টাকা বাড়াতে বলছ! এভাবে হয় নাকি?’’
আসার পরে পরেই গুইতে একদিন বলেছিল জেসুমিদের কথা৷ জেসুমি’রা হল নাগাল্যান্ডের সবচেয়ে দুর্লভ এবং অন্তরালে থাকা এক উপজাতি৷ এরা এতটাই রক্ষণশীল যে অন্য উপজাতির লোকেদের সঙ্গেও মেশে না৷ এদের এখনো এমন সব প্রথা আছে, যা শুনলে শিরদাঁড়া দিয়ে বরফকুচি নেমে যাবে৷
জেসুমি’র নাম শোনামাত্র গুইতে’র মুখে একটা ভয়ের ছায়া পড়েই মিলিয়ে গেল, লক্ষ্য করলাম আমি৷
আমিও এবার একটু উস্কোলাম, ‘‘কি হল? থতমত খাচ্ছ কেন? ওরা কি গেলেই মেরে ফেলবে নাকি?’’
গুইতে মাথা নাড়ল, ‘‘না তা নয়৷ এমনিতে ওরা ভালো৷ নিজেদের নিয়েই থাকে৷ কিন্তু একবার ওদের কেউ চটালে …!’’
‘‘চটানোর প্রশ্ন আসছে কোত্থেকে!’’ অরিন্দম বলে উঠেছিল, ‘‘আমরা তো ওদের ভালো করতে চাইছি!’’
‘‘আপনার ভালো করতে চাওয়াকে ওরা ভালো হিসেবে নাও নিতে পারে৷’’ গুইতে ঘনঘন দুপাশে মাথা নেড়েছিল, ‘‘না না, জেসুমিদের না ঘাঁটানোই ভালো৷’’
অরিন্দম বিরক্তমুখে আমার দিকে তাকাল৷ আমি মিনতির চোখে বললাম, ‘‘যাহ গুইতে! তুমি এত কাজের জানতাম, আর সামান্য একটা ট্রাইবকে … দ্যাখো না একটু! সে না হয় হেড অফিসে বলে কয়ে তোমার দৈনিক টাকাটা তিনগুণ করে দেব৷’’
গুইতের চোখমুখ চকচক করে উঠেছিল, কিন্তু পরক্ষণেই বলেছিল, ‘‘জেসুমি উপজাতির লোকেরা সাংঘাতিক!’’
‘‘কেন?’’ অরিন্দম জিজ্ঞেস করেছিল, ‘‘ওরাই কি মুণ্ডু কাটে লোকদের?’’
‘‘না৷ ওরা কারুর মুণ্ডু কাটে না৷’’ গুইতে একমুহূর্ত থেমেছিল, ‘‘ওরা নিজের মা’কে বুড়ো হয়ে গেলে কেটে খেয়ে নেয়৷’’
‘‘মা-মানে?’’ আমি চমকে উঠেছিলাম, ‘‘মা মরে গেলে খেয়ে ফেলে?’’
‘‘মরে গেলে নয়৷’’ গুইতে মাথা নেড়েছিল, ‘‘বুড়ো হয়ে গেলে৷ ওরা মনে করে, মা যেমন ওদের পেটে রেখেছিল, ওরাও তেমনই মা’কে পেটের মধ্যে রাখবে, তাতে মা শান্তি পাবে৷ ওদের গ্রামে একটা বিশাল বঁটি রাখা আছে, সরু একফালি চাঁদের মতো আড়াআড়ি রাখা থাকে সেটা৷ কারুর মা বুড়ো হলেই তাতে ফেলে কেটে ফেলা হয়৷ তারপর ছেলেমেয়েরা সেটা খায়৷’’ গুইতে থেমে বলল, ‘‘ওরা কাউকে ওদের গ্রামে ঢুকতেই দেয় না৷ আজ অবধি বাইরের লোক তো দূর, অন্য নাগা উপজাতির কেউ দেখেনি এসব৷ শুধু শোনা কথা৷ ওসব ভুলে যান৷’’
আমি আর অরিন্দম বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম, কোনো কথা বলতে পারিনি৷
মিনিট দুয়েক পরে অরিন্দম লাফিয়ে উঠে গুইতের দুটো কাঁধ চেপে ধরেছিল, ‘‘যে করেই হোক, ওই জেসুমিদের গ্রামে আমাদের নিয়ে যেতেই হবে গুইতে! তোমাকে , তোমাকে আমি প্রচুর টাকা দেব৷ তুমি কি ওদের ভাষা জানো?’’
গুইতে বলেছিল, ‘‘না৷’’ নিজের মনেই কি একটা বিড়বিড় করতে শুরু করেছিল, মন্ত্র জপছিল মনে হয়!
এমনিতে নাগাল্যান্ডের অফিশিয়াল ভাষা হল ইংরেজি, কিন্তু সেটা বলতে গেলে কোহিমা, ডিমাপুর, মকোকচঙের মতো বড় শহরেই প্রচলিত৷ এই রাজ্যে অজস্র নাগা উপজাতি বাস করে, তাদের ভাষাও অগুনতি৷ নাগামিজ বলে একটা ভাষার প্রচলন বড় বড় উপজাতির মধ্যে আছে, যেটা অনেকটা অসমিয়া ভাষার মতো৷ আর এছাড়া প্রতিটা উপজাতির নিজস্ব ভাষা রয়েছে, সেই সব ভাষার অধিকাংশই চীনা বা তিব্বতি ডায়ালেক্ট থেকে অনুপ্রাণিত৷
এত কিছু জ্ঞান আমার ছিল না, এই অ্যাসাইনমেন্টে আসার আগে অফিস থেকে আমাকে আর অরিন্দমকে এই ব্যাপারে ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে৷ নাগামিজ, সাংতামের মতো ভাষাগুলোও অল্পস্বল্প করায়ত্ত করতে হয়েছে৷
মাঝেমাঝে রাতের গভীরে তক্তার ওপরে চটে মোড়া বিছানায় শুয়ে যখন সহজে ঘুম আসতে চায় না, তখন আকাশপাতাল ভাবতে থাকি৷ উত্তর কলকাতার শ্যামবাজারের এঁদো গলির ছেলে আমি, কস্মিনকালেও ভাবতে পেরেছিলাম আমাকে এই নাগাল্যান্ডের এক প্রত্যন্ত জঙ্গলে এসে দিনের পর দিন থাকতে হবে? সত্যি বলতে কি, নাগাল্যান্ড যেন ভারতের মধ্যে একটা সম্পূর্ণ আলাদা দেশ!
আমি আর অরিন্দম দুজনেই ছোট থেকে অভিন্নহূদয় বন্ধু বলতে যা বোঝায়, ঠিক তাই ছিলাম৷ একই স্কুলে পড়াশুনো, তারপর একই কলেজ, একই বিষয়৷ পড়াশুনোয় দুজনেই আহামরি কিছু ছিলাম না৷ ওই মোটামুটি ভদ্রস্থ নম্বর নিয়ে পাশ করে যেতাম আর কি! ওইরকম রেজাল্ট নিয়ে এখনকার দিনে ডিগ্রি হয়ত পাওয়া যায়, কিন্তু নিজের পায়ে দাঁড়ানো বলতে গেলে অসম্ভব৷ অঙ্কে কারুরই তেমন মাথা ছিল না, উচ্চমাধ্যমিকের টিমটিমে রেজাল্টের পর কোনো অনার্সই শেষমেশ না পেয়ে সোশিওলজি নিয়ে ভর্তি হয়েছিলাম মার্কামারা একটা কলেজে৷ সে’কলেজে লেখাপড়া যতটা না হত, পার্টি-পলিটিক্স, গুন্ডাবাজি হত চতুর্গুণ৷
তবে কি, আমরা পড়াশুনোয় ভালো না হলেও ছেলে খারাপ ছিলাম না৷ কোনোদিন কোনো ঝামেলায় জড়িয়েছি বা কোনো খারাপ কাজে আমাদের দেখা গেছে, এমন অপবাদ অতি বড় শত্রুও দিতে পারবে না৷ বরং আপদে বিপদে পাশে দাঁড়াতাম বলে পাড়ার সকলে আমাদের পছন্দই করত৷ আসলে দুজনেই নিম্নমধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলে, একটু বড় হওয়ার পর থেকে প্রাণ খুলে আড্ডা বা বন্ধুদের সঙ্গে মিশতে পারতাম না, মাথায় খালি ঘুরত কি করে দু’পয়সা রোজগার করা যায়৷
টুকটাক টিউশনি, মাঝেমধ্যে খুচখাচ ইনস্যুরেন্সের দালালি, আর পরীক্ষার আগে রাত জেগে দুই বন্ধু মিলে পড়াশুনো, এইভাবে গ্র্যাজুয়েশনটাও করে ফেললাম৷ সরকারি চাকরি পাওয়ার মুরোদ যে আমাদের কারুরই নেই, সেটা দুজনেই বিলক্ষণ জানতাম, তাই সেদিকে আর সময় নষ্ট না করে একদিকে এম এ ক্লাসে ভর্তি হলাম, আর সঙ্গে দেদার টিউশনি শুরু করলাম৷
আমাদের দুজনেরই অনার্স ছিল সোশিওলজি, বাংলায় যাকে বলে সমাজবিদ্যা৷ কিন্তু গড়পড়তা রেজাল্টের জন্য এম এ পড়তে গিয়ে কিছুতেই ভালো স্পেশালাইজেশন জুটল না, সোশিওলজিতে এম এ পড়ার চান্স পাচ্ছিলাম না৷
হতাশ হয়ে দুজনেই যখন ভাবছি আর পড়াশুনো করে লাভ নেই, এবার পুরোদস্তুর রোজগারের ধান্দায় লাগি, তখন পাড়ার পিকলুদা বুদ্ধি দিয়েছিল ট্রাইবাল স্টাডিজের ওপর এম এ করতে৷
‘‘শোন, তোরা দুজনেই যে হাতিঘোড়া ছেলেপুলে নোস, তা জানি, তাই স্কুল কলেজে মাস্টারি তো জোটাতে পারবি না৷ ট্রাইবাল স্টাডিজে বরং এম এ টা করে ফেল, নতুন সাবজেক্ট, চান্স পেয়ে যাবি৷ সোশিওলজির ছেলেদেরই নেবে ওরা৷’’ পান চিবোতে চিবোতে বলেছিল পিকলুদা৷ পিকলুদা নিজে ইতিহাসের ছেলে, হাওড়ার দিকে কোন একটা স্কুলে পড়ায়৷ চাকরিবাকরি, পড়াশুনোর ব্যাপারে ও খুব খোঁজখবর রাখে৷
‘‘চান্স তো পাব, কিন্তু ওই ট্রাইবাল স্টাডিজ না কি, ওইসব পড়ে কিছু চাকরি বাকরি পাব কি?’’ অরিন্দম আমতা আমতা করেছিল, ‘‘আদিবাসীদের নিয়ে পড়াশুনো করে কি কোনো লাভ আছে পিকলুদা? তার চেয়ে আমি তৃষিতকে বলছিলাম যে চল, একটা কম্পিউটারের কোর্স করে রাখি৷ তাহলে আইটি কোম্পানিগুলোতে …!’’
‘‘থাম দিকিনি!’’ পিকলুদা সপাটে থামিয়ে দিয়েছিল অরিন্দমকে, ‘‘এহ, কম্পিউটারের কোর্স করে উনি আইটি কোম্পানিতে চাকরি করবেন! বলি এখনকার কোনো খবরাখবর কি তোরা কিছুই রাখিস না? হাজার হাজার ছেলে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে বসে আছে, পাত্তা পাচ্ছে না, আর তোরা সামান্য কোর্স করেই আইটিতে চাকরি পেয়ে যাবি? ওইসব কুড়ি বছর আগে হলে হত, তখন সবে কম্পিউটার এসেছিল, এইসব কোর্স করেই লোকজন বড়বড় চাকরি পেয়েছে৷ কিন্তু এখন ওসব ভুলে যা৷’’ মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে হাত নাড়িয়েছিল পিকলুদা, ‘‘শোন, ট্রাইবাল স্টাডিজে এম এ টা করে ফ্যাল৷ সরকারি দপ্তরে ইদানীং কন্ট্র্যাকচুয়াল লোক নিচ্ছে, আর তাছাড়া প্রচুর এন জি ও এখন আদিবাসীদের নিয়ে কাজ করছে, ওদের কাছে এটার খুব ডিমান্ড হবে, বুঝলি! একটু বনে জঙ্গলে ঘুরতে হবে, তো কি আছে! ঘুরবি, ওটাও তো একটা নতুন অভিজ্ঞতা হবে! তারপর একটু সিনিয়র হয়ে গেলে বড় টাউনগুলোয় চলে আসবি! ’’
সেইমত আমি আর অরিন্দম দুজনেই ট্রাইবাল স্টাডিজে এম এ পাশ করেছি, এই ছ’মাস হল৷ আর এর মধ্যে আমাদের দুজনের বাড়িতেই ঘটে গেছে অনেক ক’টা বিপর্যয়৷
আমার বাবা চাকরি করতেন একটা মাড়োয়ারি ফার্মে, হঠাৎ সেরিব্রাল অ্যাটাক এসে বাবার বাঁ দিকটা পুরোপুরি প্যারালাইজড করে দিয়েছে৷ বাবার মাড়োয়ারি মালিক এককালীন কিছু টাকা দিয়ে দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলেছে৷ অন্যদিকে অরিন্দমের অবস্থা আরো সঙ্গিন৷ ওর বাবা রিটায়ার করেছেন কয়েক বছর আগে, পেনশন না থাকলেও থোক টাকা ভালোই পেয়েছিলেন, কিন্তু নিয়তির ভুলে সঞ্চয়ের প্রায় সিংহভাগই গচ্ছিত রেখেছিলেন বেসরকারি একটা চিট ফান্ডে, শুধুমাত্র কিছু শতাংশ বেশি সুদের লোভে৷ মাসকয়েক আগে সেই চিট ফান্ড লাটে উঠেছে, গ্রেপ্তার হয়েছে মালিক৷ পথে বসেছেন অরিন্দমের বাবার মতো আরো অনেক মানুষ৷ এত বড় বিপদে অরিন্দমের বাবাও স্ট্রোক হয়ে শয্যাশায়ী৷ উপরন্তু অরিন্দমের ভাই জড়বুদ্ধিসম্পন্ন, বয়স বাড়লেও তার বুদ্ধির বিকাশ হয়নি৷ অরিন্দমের মাথায় এসে পড়েছে পাহাড়প্রমাণ চাপ৷
সব মিলিয়ে আমাদের দুজনের পরিবারই যখন নানারকম প্রতিকূলতার সম্মুখীন, ঠিক সেইসময়েই কাগজে বেরিয়েছিল বিজ্ঞাপনটা৷ একটা এন জি ও তাদের একটা বিশেষ প্রোজেক্টের জন্য নাগাল্যান্ডের প্রতিকূল প্রতিবেশে আদিবাসীদের মধ্যে কাজ করার মতো উপযুক্ত কর্মী চাইছে৷ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন নয়, নতুন৷ আপাতত কনট্র্যাক্টে, তারপর কাজ পছন্দ হলেই চাকরি পাকা হবে৷
আমি চিরকালই একটু ঘরকুনো প্রকৃতির, বিজ্ঞাপনটা দেখে বিরসবদনে বলেছিলাম, ‘‘শেষে নাগাল্যান্ডে গিয়ে থাকতে হবে? ধুর, তার চেয়ে ছেলে পড়িয়েই তো ভালো আছি ভাই!’’
অরিন্দম তেড়েফুঁড়ে উঠেছিল, ‘‘ওরে গাধা, টিউশনির বাজারের কোনো ভরসা আছে? একে আজকাল বাপমায়েরা স্কুলের টিচার ছাড়া কারুর কাছে পড়াতে চায় না, তার ওপর অঙ্ক ইংরেজিও পড়াই না৷ ওই ইতিহাস ভূগোলে তুই কদিন ছাত্র পাবি? তার চেয়ে চল এই চাকরিটা পাওয়ার চেষ্টা করি৷ একবার পার্মানেন্ট হয়ে গেলে আর চিন্তা থাকবে না৷ বাড়িতে দিনদিন যা অবস্থা হচ্ছে, আর দেখা যাচ্ছে না রে তৃষিত! মা তো পরশুদিন রাগের মাথায় ভাইকে খুন্তি দিয়ে…’’ অরিন্দম এগিয়ে এসে আমার হাত চেপে ধরেছিল, ‘‘চল দুজনেই অ্যাপ্লাই করি৷’’
আমি তেতোমুখে হেসেছিলাম, ‘‘সেই! এতদিন স্কুল, কলেজ পড়াশুনো সবই যখন একসাথে করেছি, চাকরিটাই বা বাকি থাকে কেন!’’
কিন্তু ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে দেখলাম ব্যাপারটা যতটা সহজ ভেবেছিলাম, ততটা নয়৷ এই এন জি ও’টা প্রধানত ভারতের বিভিন্ন উপজাতির মধ্যে কল্যাণমূলক কাজকর্ম করে৷ অফিস উত্তর ভারতে হলেও এদের কর্মীরা আন্দামান, মধ্যপ্রদেশ বা ছত্তিশগড়ের বিভিন্ন আদিবাসী উপজাতিদের মধ্যে নানারকম ত্রাণ পাঠায়, শিক্ষার আলো বিস্তার করে, পোশাক আশাক বিতরণ করে, স্বনির্ভর প্রকল্পে ট্রেনিং দেয়৷ আর এই ব্যাপারে পুরো টাকাটা আসে বিদেশের বিভিন্ন অনুদান থেকে৷
ইন্টারভিউ যিনি নিলেন, তিনি রাজস্থানের লোক, হিন্দিতে সামান্য টান৷ সবকিছু ফর্মালিটিজ মিটে যেতে তিনি আমাদের দুজনকেই একসঙ্গে ডেকে পাঠালেন, ‘‘দ্যাখো, আমাদের একটা আর্জেন্ট অ্যাসাইনমেন্ট এসেছে, কিন্তু সেটার ঝুঁকির কথা ভেবে আমরা এই ব্যাপারে নতুন অথচ স্পেশালাইজড ডিগ্রি আছে এমন লোক খুঁজছিলাম৷ তোমাদের দুজনকেই আমাদের পছন্দ হয়েছে৷ আসলে এই মিশনটার ওপর বিদেশের একটা বিশাল ফান্ড নির্ভর করছে৷’’
‘‘আমাদের কি করতে হবে?’’ অরিন্দম সোৎসাহে জিজ্ঞেস করেছিল৷
‘‘তোমাদের দু’জনকে দু’মাসের জন্য নাগাল্যান্ডে একটা অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে যেতে হবে৷ ডিমাপুর থেকে প্রায় কুড়ি কিলোমিটার ভেতরে একটা গ্রামে৷ সেখানেই তোমাদের থাকার জায়গা করা হবে৷ সব ব্যবস্থা আমরাই করবো৷ নাগাল্যান্ডে প্রচুর ধরণের ট্রাইব মানে উপজাতি আছে৷ তার মধ্যে আও, আঙ্গামি, চাখেসাং, লোথা এইসব ট্রাইবগুলো ইতিমধ্যেই অনেকটা আধুনিকতার সংস্পর্শে এসেছে৷ তাদের মধ্যে অনেকেই পড়াশুনো শিখে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে, চাকরিবাকরি করছে৷ কিন্তু এরা ছাড়াও এমন কিছু নাগা ট্রাইব আছে, যাদের মধ্যে এখনো বর্তমান জগতের কোনো ছাপই পড়েনি৷ উল্কার গতিতে যুগ এগিয়ে চললেও তারা পড়ে আছে সেই আদিম যুগেই৷ তোমাদের কাজ হবে এই সমস্ত নাগা ট্রাইবদের নিয়ে একটা রিপোর্ট বানানো৷’’
‘‘রিপোর্ট বানানো বলতে … আমরা কাজটা কি করবো?’’ আমি ইতস্তত করে বলেছিলাম৷
‘‘বলছি৷’’ রাজস্থানি ভদ্রলোক কফির কাপে চুমুক দিয়েছিলেন, ‘‘তোমরা পুরো প্রোগ্রাম সেট করে নেবে৷ যে ট্রাইবগুলো অলরেডি সভ্য হয়ে গেছে, তাদের শিক্ষা, নারীকল্যাণ, খাবার এইসব ব্যাপারে হেল্প করবে৷ ভিডিও ডকুমেন্টারি বানাবে৷’’ ভদ্রলোক ঝুঁকে এসেছিলেন, ‘‘কিন্তু তোমাদের আসল কাজ হবে এখনো যে সব উপজাতি প্রকাশ্যে আসেনা, তাদেরকে নিয়ে এক্সক্লুসিভ রিপোর্ট বানাতে৷’’
‘‘মানে তাদের শিক্ষাদীক্ষা, সংস্কার … এইসব নিয়ে?’’ অরিন্দম বলেছিল৷
‘‘শিক্ষা!’’ ভদ্রলোক অদ্ভুত মুখব্যাদান করেছিলেন, ‘‘ট্রাইবাল স্টাডিজের ছেলে হয়ে কি সব বলছ? ওইসব ট্রাইবরা শিক্ষা তো দূর, জামাকাপড়ই পরতে শেখেনি৷ ভয়ঙ্কর হিংস্র, কয়েক দশক আগেও শত্রুকে খুন করে সেই মুণ্ডু জমানো ছিল এদের স্বভাব৷ কাঁচা মাংস খেয়ে, গায়ে লতাপাতা জড়িয়ে এদের দিন কাটে৷ এখনো এদের মধ্যে এমন সব অদ্ভুত রিচুয়ালস আছে, যা শুনলে রাতে ঘুমোতে পারবে না৷ তোমরা তেমন সব অজানা দিকগুলো হাইলাইট করে রিপোর্ট বানাবে৷ আমরা ওদের এইসবগুলো জানিয়ে আর আমরা যে ওদের নিয়ে কাজ করব সেটা বলে ফরেন গ্রান্টটা আদায় করবো৷ বুঝেছ?’’
আমরা দুজন দুজনের দিকে চাওয়াচাওয়ি করেছিলাম৷ শেষে নাগাল্যান্ডে গিয়ে নিজেদের মুণ্ডুগুলো দান করে আসতে হবে?
ভদ্রলোক আরো বলেছিলেন, ‘‘আর হ্যাঁ, অ্যাসাইনমেন্ট শেষে আমাদের দিল্লি অফিসে তোমাদের আরো একমাস কাজ করতে হবে৷ সেই কাজের ভিত্তিতে আমরা যে কোনো একজনকে পার্মানেন্ট করবো৷’’
‘‘সেকি!’’ আমি বলেছিলাম, ‘‘আ-আমরা দুজনেই বন্ধু তো, দুজনকেই পার্মানেন্ট করা যায় না?’’
‘‘কাজের জায়গায় আবার বন্ধু-শত্রু কি!’’ ভদ্রলোক এবার আমাদের উঠে পড়ার ইঙ্গিত করে মাথা নেড়েছিলেন, ‘‘দেখছি৷ তোমরা আগে শুরু করো৷’’
সেইমত আমরা দুজন দু’মাস আগে কলকাতা থেকে ডিব্রুগড় এক্সপ্রেস ধরে নেমেছিলাম ডিমাপুরে৷ ডিমাপুর নাগাল্যান্ডের একটা বড় শহর৷ আসার আগে পড়েছিলাম ডিমাপুর ছিল প্রাচীন ডিমাসা রাজ্যের রাজধানী, এখন অবশ্য সেই ইতিহাসের ছিটেফোঁটাও নেই৷
এন জি ও’র তরফে আমাদের একটা ফোন নম্বর দেওয়া হয়েছিল, সেখানে ফোন করতে হাজির হয়েছিল একটা ছোট গাড়ি৷ তাতে করে রওনা দিয়েছিলাম আমরা৷
শহর ছাড়িয়েই নদী, নদীর পাড় বরাবর ছুটছিল গাড়ি৷ আমি, অরিন্দম, আর ড্রাইভার৷ আর কেউ নেই৷ ড্রাইভার খাবার, জামাকাপড় শুদ্ধু গাড়ি এনেছে, আমাদের নামিয়ে দিয়ে চলে যাবে৷
অরিন্দম ফিসফিস করে বলেছিল, ‘‘আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে রে তৃষিত! ওই মুণ্ডু কেটে ফুটবল খেলবে না তো!’’
‘‘ধুর!’’ আমি হেসে ফেলেছিলাম, ‘‘বনসল স্যার তো বলেই দিয়েছেন, আমাদের খো আং বলে একটা গ্রামে রাখা হবে৷ সেখান থেকে সমস্ত ট্রাইবদের কাছে যাওয়াটা সহজ৷ সঙ্গে যা সব শুকনো খাবারের প্যাকেট, জামাকাপড় দিয়েছে, সেগুলো শুধু বিতরণ করা, আর ছবি তোলা, ব্যাস! বনশল সাহেবের দরকার তো শুধু আমেরিকার ওই গ্রান্ট নিয়ে!’’ কথাটা বলে আমার নিজেরই কেমন একটু খারাপ লাগল৷ আগে এন জি ও মানেই ভাবতাম বুঝি নিঃস্বার্থভাবে দুঃস্থদের জন্য কিছু করা, এন জি ও’র মধ্যেও যে এতরকমের অঙ্ক, রাজনীতি, ব্যবসা চলে সত্যিই জানতাম না৷
বৃষ্টির মধ্যে আমাদের কুঁড়েঘরে দাঁড়িয়ে প্রথম দিনগুলোর কথা ভাবতে ভাবতে কোথায় চলে গিয়েছিলাম৷ তাকিয়ে দেখি গুইতে হাঁ করে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে, বলল, ‘‘কি ভাবছেন?’’
‘‘কিছু না৷’’ আমি মাথা নাড়লাম, ‘‘কোনো উপায় পেলে?’’
গুইতে ঘনঘন মাথা নাড়ল, ‘‘জেসুমিরা সাংঘাতিক! ওদের গ্রামে কেউ ঢুকলে ওরা মেরে তো ফেলবেই, আরো কি কি করবে কে জানে! প্রতি পূর্ণিমায় ওদের একজন করে বয়স্ক মা’কে কাটা হয়৷’’ গুইতে একটা নিঃশ্বাস ফেলল, ‘‘কাল পূর্ণিমা৷’’
‘‘যা করে করুক!’’ অরিন্দম কখন ভেতর থেকে উঠে এসেছে জানি না, ‘‘ওই বঁটির ছবি আমাদের তুলতেই হবে৷ তুমি যা হোক করে ম্যানেজ করো গুইতে!’’
আমি তাকিয়ে দেখলাম অরিন্দমের চোখদুটো উত্তেজনায় জ্বলছে৷
দুই
পরের দিন ভোরবেলা বাইরে থেকে একটা অনুচ্চ ডাকে আমার ঘুম ভেঙে গেল৷
কাল সারারাত ধরে বৃষ্টি হয়েছে, ভোরের দিকে বেশ একটা ঠান্ডা ঠান্ডা আমেজ৷ আমি ঘুমচোখে বিছানা থেকে উঠে বাইরে এসে দেখি গুইতে দাঁড়িয়ে আছে, সঙ্গে একটা বছর ষোলো সতেরোর ছেলে৷
ছেলেটাকে দেখলেই বোঝা যায় ওর সারা শরীরে জঙ্গলের বুনো গন্ধ লেগে আছে৷ চোখ-মুখ সারল্যে ঢাকা, মাথার বড় বড় চুল অযত্নে তামাটে বর্ণ ধারণ করেছে৷ কিন্তু অদ্ভুতভাবে বয়সের সঙ্গে বেমানান দাড়ি এলোমেলো হয়ে নেমে এসেছে বুক অবধি৷ একঝলক তাকালে সবচেয়ে আগে যেটা নজরে পড়ে, সেটা হল ওর পোশাক৷ ঊর্ধ্বাঙ্গে একটা শহুরে গেঞ্জি, নিম্নাঙ্গে একফালি কাপড় কোনোরকমে জড়ানো৷ কাপড়টার রঙ হয়তো কোনো একযুগে সাদা ছিল, এখন হলদেটে হয়ে গেছে৷
আমি নিম্নাঙ্গের এই পোশাকটাকে চিনি৷ এটাকে বলে সুবসু, এই পোশাক পরে লোথা সম্প্রদায়ের উপজাতিরা৷ ছেলেটা তার মানে লোথা উপজাতির৷ কিন্তু আমার মনে পড়ল, গুইতে লোথাদের গ্রামে যাওয়ার দিন ভালো করে বুঝিয়েছিল, লোথা পুরুষদের চেনার সবচেয়ে সোজা উপায় হল তাদের কান দেখা৷ প্রত্যেকে কানে তিনটে করে দুল পরে, এছাড়া প্রত্যেকে রামছাগলের দাড়ি দিয়ে তৈরি একধরনের টুপিও পরে থাকে৷
কিন্তু ছেলেটার গায়ে সে’সব কিছুই নেই৷ ঊর্ধ্বাঙ্গে অমন গেঞ্জি পরতেও আমি কোনো নাগাকে দেখিনি৷ তবে কি এ লোথা নয়?
আমি গুইতের দিকে তাকালাম, ইংরেজিতে বললাম, ‘‘কি ব্যাপার গুইতে? এ আবার কাকে নিয়ে এলে? লোথাদের সঙ্গে কাজ তো মিটে গেছে৷’’
গুইতে আড়চোখে একবার ছেলেটার দিকে তাকিয়েই আমার দিকে চেয়ে ফিসফিস করল, ‘‘নিয়ে এসেছি স্যার!’’ তারপর ইংরেজিতে বানান করে বলল, ‘‘জে-সু-মি!’’
‘‘কোত্থেকে পেলে?’’ আমি তো অবাক! গতকালই গুইতে বলছিল জেসুমিরা কারুর সাথে মেশে না, জামাকাপড় পরে না৷ এই ছেলেটা তো তেমন নয়!
গুইতে ইংরেজিতে চাপা গলায় বলল, ‘‘এ জেসুমি, কিন্তু বছর দুয়েক আগে পালিয়ে লোথাদের গ্রামে চলে গিয়েছিল৷ অনেক কিছু ইনফরমেশন দিতে পারবে৷’’
আমি সঙ্গে সঙ্গে বারান্দায় চাটাই পেতে দিলাম৷ বললাম, ‘‘বোস৷ আসছি ভেতর থেকে৷’’
অরিন্দমের কুম্ভকর্ণের মতো ঘুম ভাঙানো আরেক দুঃসহ কাজ, তবু সেটাই আমাকে এখন করতে হবে৷
খো আং গ্রামের একজন সম্পন্ন লোকের থেকে এই কুঁড়েঘরটা আমরা ভাড়া নিয়েছি৷ প্রতিটা নাগা কুঁড়েঘরের কিছু বৈশিষ্ট্য আছে৷ পাহাড়ি জায়গা বলে ছোট টিলার ওপর একেকটা কুঁড়েঘর তৈরি করা হয়৷ ফলে বাড়িগুলো বেশ ছড়ানো ছিটানো থাকে৷ আমাদের কুঁড়েঘরটাও একটা ছোট অনুচ্চ টিলার ওপরে৷
গুইতে এখানে আসার পরেই একদিন বলেছিল, ‘‘যে কোন নাগা কতটা বড়লোক সেটা বুঝবেন তার বাড়ির সামনের ঘর আর ছাদের কারুকার্য দেখে৷’’
এমনিতে সব বাড়িরই ছাদ খড় বা তালপাতা দিয়ে বিছানো থাকে, দেওয়ালগুলো হয় শক্ত বাঁশের৷ আর সামনের ঘরে থাকে ধান থেকে চাল ভানার এক ধরনের ছোট টেবিল, যেটাকে ওরা বলে সুমকি৷ এই সুমকির মেকানিজম অনেকটা আমাদের গ্রামবাংলার ঢেঁকির মতো, শুধু পায়ের জায়গায় হাত দিয়ে ঠেলতে হয় সুমকিতে৷
যাই হোক, গুইতে ছেলেটাকে নিয়ে সুমকির পাশেই পেতে দেওয়া চাটাইয়ের ওপর বসলো, আমি গিয়ে অরিন্দমকে ডেকে তুললাম, ‘‘পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছিস, এদিকে বলছিস গুইতে কাজ করছে না৷ জলদি ওঠ, গুইতে একটা জেসুমি ছেলেকে নিয়ে এসেছে৷’’
অরিন্দম ধড়মড় করে উঠে বসে চোখ কচলাতে লাগল, ‘‘তাই? বাহ ! গুইতে লোকটা কাজের আছে তো!’’
‘‘গুইতে তো কাজের, তুই এবার একটু কাজ দেখা ঘুমনো ছাড়া!’’ আমি কথাটা বলে ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে অরিন্দমও আমার পিছু নিল৷
গুইতে আমাদের দুজনকে দেখে গলাখাঁকারি দিয়ে বলল, ‘‘স্যার, এই ছেলেটার নাম মাকুরি৷ মাকুরি আসলে জেসুমি উপজাতির, কিন্তু তিন বছর আগে ওদের গ্রাম থেকে চলে এসেছে লোথাদের গ্রামে৷ এখন ওখানেই থাকে৷ লোথারা অনেক মুক্তমনের, ওদের এক বয়স্ক সর্দার ওকে বেশ আগলে রেখেছে৷ সেই সর্দারের জমিতে ও এখন ঝুম চাষে সাহায্য করে৷ এছাড়া জেলিয়াংদের গ্রামেও ওর যাতায়াত আছে, সেখানেও ওকে সবাই ভালোবাসে৷’’
জেলিয়াংরা ইদানীং শহুরে জামাকাপড় কিনে আনে ডিমাপুর থেকে৷ আমি বুঝলাম ছেলেটার নিম্নাঙ্গে লোথাদের সুবসু থাকলেও ওপরের গেঞ্জিটা তার মানে জেলিয়াংদের দেওয়া৷
‘‘কিন্তু নিজের গ্রাম থেকে চলে এসেছে কেন?’’ আমি জিজ্ঞেস করলাম৷
মাকুরি আমার কথা কিছুই বুঝছে না, পাখির মতো অবোধ দুটো চোখ মেলে তাকিয়ে আছে এদিকে৷
গুইতে এবার গলা নামাল, ‘‘স্যার, ও চলে এসেছিল ভয়ে৷ ওর মা বুড়ো হয়ে গেলে ওকেও মায়ের মাংস খেতে হবে বলে! ছোট থেকেই তো দেখত ওইসব৷’’ গুইতে ছেলেটার দিকে একঝলক তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিল, ‘‘জেসুমিরা খুব ডেঞ্জারাস৷ কেউ একবার দলছুট হয়ে গেলে তাকে ওরা প্রাণে মেরে দেয়৷ নেহাত মাকুরির খোঁজ এখনো পায়নি৷ লোথারাও মাকুরিকে ভালোভাবে লুকিয়ে রেখেছে, জামাকাপড় পরা, ভালোভাবে কথা বলা শিখিয়েছে৷ ও নাগামিজও বলতে পারে এখন৷ জেলিয়াংরাও খেয়াল রাখে ওর৷’’
আগেই বলেছি এখানে আসার আগে দিল্লিতে আমাদের নাগামিজ ভাষার ট্রেনিং দেওয়া হয়েছিল৷ ওই কয়েকদিনের ট্রেনিং এ তেমনভাবে বলা না শিখলেও বুঝতে পারি৷ আমি বললাম, ‘‘গুইতে, তোমাকে ট্রান্সলেট করতে হবে না তাহলে৷ ওকে তুমি আমাদের সামনেই নাগামিজেই জিজ্ঞেস করো, ও বলুক যা জানে৷ শুধু একটু থেমে থেমে স্পষ্টভাবে বলো, নাহলে বুঝব না৷’’
গুইতে মাকুরি বলে ছেলেটার দিকে ফিরল, ‘‘মাকুরি, এঁরা শহর থেকে এসেছেন৷ জেসুমিদের নিয়ে পড়াশুনো করছেন৷ তুমি কি তোমাদের কথা একটু বলবে?’’
আমি লক্ষ্য করলাম, জেসুমি নামটা শোনামাত্র মাকুরির মুখে একটা কালো মেঘ জমা হল৷ একটু তুতলে সে বলল, ‘‘আ-আমি তো জেসুমি নই! আমি লোথা!’’
গুইতে এবার পিঠ চাপড়ে দিল মাকুরির, ‘‘ভয়ের কিছু নেই৷ জেসুমিরা কিচ্ছু টের পাবে না৷ তুমি তোমাদের গ্রামের কথা বলো এদের৷’’
মাকুরির কানে কথা গেল না৷ ও চোখ বুজে বিড়বিড় করতে লাগলো, ‘‘আমি লোথা, জেসুমি নই৷’’ মাথাটা দু’পাশে নড়তে লাগলো ওর৷
গুইতে আরো দু-একবার চেষ্টা করে হতাশ গলায় বলল, ‘‘ও কিছুতেই স্বীকার করবে না যে ও জেসুমি ছিল৷ আসলে ওদের গ্রাম থেকে কেউ পালিয়ে গেলে জেসুমিরা তার শরীরটাকে প্রথমে বর্শা দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে, তারপর ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলে দেয় শকুনের কাছে৷ এরকম আগেও দু-একবার হয়েছে৷ ও তাই সবার কাছে এখন লোথা বলে পরিচয় দেয়৷ লম্বা লম্বা দাড়ি রাখে৷ যদিও যে কোনো জেসুমির মনে কোনোদিন একফোঁটা সন্দেহ হলেই ও ধরা পড়ে যাবে৷’’
‘‘কেন?’’ অরিন্দম এতক্ষণে মুখ খুলল, ‘‘কি করে বুঝবে ওরা?’’
‘‘পেট দেখে৷’’ গুইতে বলল৷
‘‘পেট দেখে মানে?’’
‘‘সমস্ত জেসুমি বাচ্চার জন্মের পর কুড়িদিন বয়স হলে আগুনে গনগনে করে পোড়ানো একটা তামার পাত চেপে ধরা হয় বাচ্চাটার পেটে৷ নাভির চারপাশ বরাবর৷ বাচ্চাটা চিৎকার করে কাঁদতে থাকে, অনেক বাচ্চা মারাও যায়৷ তাতে জেসুমি উপজাতি মনে করে যে সব বাচ্চা মারা যাচ্ছে, তারা ততটা শক্তিশালী নয়, মরে যাওয়াই ভালো কারণ তারা ওদের সমাজের কোনো কাজে আসবে না৷ আর যে সব বাচ্চা ওই কুড়িদিন বয়সে অতটা যন্ত্রণাভোগ করেও বেঁচে যায়, তাদের পেটে সারাজীবনের জন্য নাভির চারপাশ বরাবর কালো একটা পোড়া দাগ হয়ে যায়৷ ওটাই জেসুমিদের সনাক্ত করার চিহ্ন৷’’ গুইতে একটু থামল, তারপর আচমকা মাকুরির গেঞ্জিটা পেটের ওপর তুলে দিল৷
আগেই বলেছি আমি একটু নরম প্রকৃতির, ওই বীভৎস চিহ্ন দেখে চমকে উঠে চোখ ফেরালাম অন্যদিকে৷ পেটের নাভিদেশের চারপাশে বৃত্তাকারে দগদগ করছে একটা কালো পুরু দাগ৷ জড়ুলের মতো নয়, কুৎসিত পোড়া৷ বলয়টা ঈষৎ ফুলে গোটা পেটটাকে একটা ভয়ঙ্কর রূপ দিয়েছে৷
অরিন্দম এবার এক কাণ্ড করলো, ছুটে গিয়ে ঘর থেকে টাকার ব্যাগটা নিয়ে এল৷ দিল্লির অফিস থেকে গুইতের মতো কো-অরডিনেটরদের সঙ্গে কাজ করার জন্য আমাদের একটা আলাদা ফাণ্ড দেওয়া হয়েছে৷ সেই টাকা থেকে আমরা আদিবাসী গ্রামের সর্দারদের, বা কোনো স্থানীয় লোককে মাঝেমধ্যে বখশিশ হিসেবে দিই, খুশী করতে৷ সেই ফাণ্ডের টাকাটাই ওই ব্যাগে আমরা রাখি৷ অরিন্দম ব্যাগটা খুলে একতাড়া নোট বের করে গুঁজে দিল মাকুরি বলে ছেলেটার হাতে, তারপর ভাঙা ভাঙা নাগামিজ ভাষায় বলতে লাগলো, ‘‘শোনো মাকুরি! আমরা তোমার শত্রু নই, আমরা জেসুমিদের কেউ নই, আমরা শুধু জেসুমিদের ওপর একটা বই লিখতে চাইছি, তুমি তাতে আমাদের হেল্প করবে৷ ঠিক মতো হেল্প করলে আমরা তোমাকে আরো টাকা দেব৷ আরো অনেক টাকা!’’ কথাটা শেষ করেই অরিন্দম মাকুরির পেটের ওই চিহ্নের ছবি তুলতে লাগল খচাত খচাত করে৷
টাকাগুলো হাতে নিয়ে আর বই লেখা নিয়ে অরিন্দমের কাঁচা মিথ্যেটা শুনে মাকুরি যতটা না খুশি হল, গুইতে’র চোখদুটো জ্বলজ্বল করছিল তার চেয়ে অনেক বেশি৷
আমি একটা ব্যাপার খেয়াল করে দেখেছি৷ গুইতে’র মতো এই প্রায় সভ্য নাগা, যারা আমাদের মতো আধুনিক মানুষদের সাথে কাজ করে, কিংবা ডিমাপুরে কাজকর্ম করে, তাদের টাকার খাঁই এই কম সভ্য, আধুনিকতার স্পর্শ না পাওয়া নাগাদের চেয়ে অনেক বেশি৷ জেলিয়াং, লোথা বা আওদের মতো সভ্য গ্রামে গিয়ে আমরা টাকা দিলে ওরা আনন্দে উল্লসিত হয়ে পড়ত৷ অথচ পোচুরি বলে একটা উপজাতির গ্রামে গিয়েছিলাম, তারা জেসুমিদের মতো ভয়ানক না হলেও এখনো জামাকাপড় পরে না, গায়ে লতাপাতা জড়িয়ে থাকে, তারা কিন্তু পার্থিব টাকার প্রতি বেশ নির্বিকার৷ বরং গুইতে’র বুদ্ধিমতো আমরা পাটকোই পাহাড়ের বুনো শুয়োরের মাংস জোগাড় করে নিয়ে গিয়েছিলাম, তাতে ওরা অনেক খুশি হয়েছিল৷ বাচ্চাগুলো তো ঝাঁপিয়েই পড়েছিল একরকম৷
গুইতে এবার মাকুরিকে ঝাঁকিয়ে অবোধ্য ভাষায় কি হুড়মুড় করে বলে গেল৷ মাকুরিও তখন মাথা নেড়ে নেড়ে কি সব বলতে লাগল, আমরা একবর্ণও বুঝতে পারলাম না৷
অরিন্দম মাঝে একবার বাধা দিতে যেতে আমি ইশারায় থামিয়ে দিলাম, ‘‘দাঁড়া না! গুইতে ওকে রাজি করাচ্ছে মনে হয়৷ এত অধৈর্য হোস না!’’
প্রায় মিনিট পাঁচেক এইভাবে কথোপকথন চলার পর গুইতে আমাদের দিকে তাকাল, প্রথমেই বলল, ‘‘অনেক কষ্টে ওকে রাজি করিয়েছি স্যার! গুইতে কাজে কখনো ফাঁকি দেয় না! আমাকেও যদি একটু কিছু দিতেন এখন …৷ একবোতল ঈয়াই হয়ে যেত …’’
অরিন্দম পাত্তা না দিয়ে বলল, ‘‘বেশি না বকে জিজ্ঞেস করো ওকে৷’’
গুইতে বেজার মুখে মাকুরির দিকে তাকাল, ‘‘তুই কেন পালিয়ে এলি মাকুরি?’’
মাকুরি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে গুইতে’র খোঁচা খেয়ে ধীরে ধীরে বলল, ‘‘সহ্য করতে না পেরে৷’’
গুইতে আমাদের নির্দেশ মতো একটা করে প্রশ্ন করতে লাগলো আর মাকুরি উত্তর দিতে লাগলো৷ আমি ফোনের ভয়েস রেকর্ডারটা অন করে দিয়েছিলাম৷
ধীরে ধীরে ছেলেটার আড়ষ্টতাটা কাটছিল৷
‘‘কতজন আছে তোদের গ্রামে?’’
তা প্রায় দু-আড়াই হাজারজন৷
কিভাবে থাকতিস?
সবাই পাশাপাশি ঘরে থাকা হত৷ মাটির ঘর, ওপরে খড়ের ছাউনি৷
জামাকাপড় পরতিস?
এক ধরনের পাতা আছে, সেই পাতা জড়িয়ে থাকে সবাই৷
গ্রামের লোকেদের জীবিকা কি?
জীবিকা বলতে তেমন কিছু তো নেই৷ ঝুম চাষ হয়, আর জঙ্গলে শিকার করে৷
সব জন্তুর মাংস খাস তোরা?
সব৷ শুধু মাংস নয়, জন্তুর গায়ের চামড়া, রক্ত, চোখ, আমরা সব খাই৷ এছাড়া পিঁপড়ে, মাকড়সাও খাওয়া হয়৷ আর প্রতি পূর্ণিমায় একটা করে উৎসব হয়, সেখানে সবাই খায় কুকুর আর কুকুরের চোখ৷ ওটা অবশ্য উৎসবের খাবার৷
প্রতি পূর্ণিমায় কি উৎসব হয়?
পূর্ণিমার দিন আমাদের ‘উবশু’ উৎসব হয়৷ উবশু-র পরে নাচগান হয়, তারপর সবাই মিলে কুকুরের মাংস খাওয়া হয়৷
উবশু উৎসবেই কি মা’কে মেরে খাওয়া হয়?
এইবার মাকুরি মুখ নিচু করে ফেললো৷ দু-হাতে মুখ ঢেকে উত্তর না দিয়ে বিড়বিড় করতে লাগলো কিছু৷
গুইতে বলল, ‘‘বল মাকুরি, উবশু উৎসবেই কি মা’কে মেরে ফেলা হয়?’’ আমাদের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে নিয়ে ও আবার বলতে লাগলো, ‘‘এই শহরের বাবুরা অনেকদূর থেকে এসেছেন৷ ওঁরা বইয়ে এইসব লিখে সবাইকে জানালে উবশু উৎসব বন্ধ হয়ে যাবে৷ তুই তো সেটাই চাস বল! আর কারুর মা’কে খেতে হবে না৷ তুই সব খুলে বল৷’’
মাকুরি হাতদুটো মুখ থেকে সরাল৷ তার রুক্ষ গাল দিয়ে জলের ধারা গড়িয়ে পড়ছে, ‘‘সত্যিই উবশু বন্ধ হবে?’’
আমার মনটা কেমন করে উঠল৷ এই অশিক্ষিত অসভ্য ছেলেটা নীরবে যেন ওর চোখের জল দিয়ে ধিক্কার দিল আমাকে৷ আমরা শুধুমাত্র টাকার জন্য, নিজেদের চাকরিটা পাকা করবার জন্য ওর আবেগ, ইমোশন, কষ্ট নিয়ে খেলছি৷
এটা কি আমরা ঠিক করছি? সত্যিই তো উবশু বন্ধ করার ক্ষমতা আমাদের নেই! বনশল স্যার এই সব অজানা প্রথার ছবি দিয়ে কি করবেন জানিনা, তবে তাঁর আসল উদ্দেশ্য কেবল বিদেশের সেই গ্রান্ট৷
অজান্তেই কেমন যেন মাকুরির কাছে নিজেকে ছোট লাগল আমার৷
অরিন্দম ওদিকে বলে চলেছে, ‘‘হ্যাঁ মাকুরি, উবশু বন্ধ হবে৷ তুমি শুধু পুরোটা আমাদের বলো৷’’
মাকুরি হাতের চেটো দিয়ে চোখের জল মুছে নিল, বলল, ‘‘ছোট থেকে জ্ঞান হবার পরে দেখতাম প্রতি পূর্ণিমায় একটা উৎসব হত৷ কিন্তু সেই উৎসবে ছোটদের নিয়ে যাওয়া হত না৷ গ্রামের সবচেয়ে বয়স্ক পুরুষমানুষ হবে গ্রামের প্রধান, সেটাই জেসুমিদের নিয়ম৷ সেই সর্দারের কাছে সব বাচ্চাদের রেখে বড়রা চলে যেত উবশু উৎসবে৷ ফিরে আসত অনেক রাতে৷ হাতে কোনো একটা জন্তুর হাড়গোড় নিয়ে৷ রাতে অনেকবার ঘুম ভেঙে মা’কেও আসতে দেখেছি৷ তারপর সেই অজানা জন্তুর হাড়গোড় সেদ্ধ করা জল মা পরেরদিন সকালে খেত৷ ওতে বোধহয় কোনো পুণ্য হয়৷
‘‘আমাদের গ্রামটা পাহাড়ের গায়ে হলেও মোটামুটি সমতল জায়গায়, গোটা গ্রামটা চৌকো ধরনের৷ গ্রামের বাইরেটা পুরোটা লম্বা লম্বা শক্ত বাঁশের পাঁচিল দিয়ে ঘেরা৷ কয়েক ফুট অন্তরই সেই পাঁচিলের ওপর পাহারা দেয় একজন করে জেসুমি রক্ষী, তাদের হাতে বিষ মাখানো তির, কোমরে ডাও৷’’
‘‘ডাও কি?’’ বাধা দিয়ে জিজ্ঞেস করলো অরিন্দম৷
মাকুরি উত্তর না দিয়ে ইঙ্গিতে গুইতে’র কোমরের দিকে দেখাল৷ গুইতে’র কোমরে রয়েছে লম্বা চকচকে ধারালো ফলার একটা ছুরি৷ এই দু’মাসের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, উপজাতি নির্বিশেষে এই ছুরি প্রতিটা নাগা লোকের জাতীয় অস্ত্র৷
মাকুরি বলল, ‘‘আমরা এগুলোকে ডাও বলি৷’’
‘‘বুঝলাম৷ তারপর?’’
‘‘আমাদের গ্রামের প্রতিরক্ষা এত শক্তপোক্ত, যে কোনোভাবেই কোনো বাইরের লোকের পক্ষে আমাদের গ্রামে জীবিত ঢোকা সম্ভব নয়৷ আর প্রাণ থাকতে কোনও জেসুমি সেটা হতেও দেবে না৷ আর সেটা প্রধানত ওই উবশু উৎসবের জন্য৷ গ্রামের একদম মাঝখানে একটা বড় চাতালে প্রতি পূর্ণিমায় উবশু পালন হয়৷ গ্রামের একজন করে মা’কে বাছা হয়৷ যে মা অশক্ত, খর্ব হয়ে বার্ধক্যের ভারে নুয়ে পড়েছে৷ তাকে নিয়ে আসা হয় সেই চাতালের মাঝখানে৷ কুড়ি বছর বয়স হলে তবেই উবশু দেখা যায়, তার নীচের ছোটরা থাকতাম সর্দারের কাছে৷ সকলে জড়ো হয় ওই চাতালে৷ প্রচণ্ড জোরে জোরে বাজনা বাজানো হয়৷ নাচগান শুরু হয়৷ সবাই ঈয়াই খেয়ে নাচগান করে৷’’
‘‘এক মিনিট!’’ আমি বাধা দিলাম, ‘‘তোমার তো এখনো কুড়ি বছর হয়নি মনে হয়! তুমি কি তাহলে উবশু উৎসব নিজের চোখে দেখোনি? শুনেছ কারুর মুখে?’’
‘‘দেখেছি৷’’ খুব আস্তে বলল মাকুরি৷ ওর গলাটা সামান্য কাঁপছিল, ‘‘আমার এক বন্ধু ছিল, মারাং বলে৷ বয়সে যদিও বা মারাং অনেকটা বড় ছিল আমার থেকে, কিন্তু ওর বুদ্ধিশুদ্ধি ছিল একটু ছেলেমানুষ গোছের৷ এক পূর্ণিমার দিন সকালে আমাকে ও বলল, জানিস মাকুরি, আজ আমার সারাদিন উপোস৷’’
‘‘উপোস কেন?’’ আমি জিজ্ঞেস করলাম৷
মারাং হূষ্টগলায় বলল, ‘‘আজ তো আমার উবশু রে মাকুরি!’’
উবশু জিনিষটা কি, সেটা এর আগে অনেককে জিজ্ঞেস করেছি৷ কিন্তু কারুর কাছে কোনো উত্তর পাইনি৷ আমি তাই সঙ্গে সঙ্গে মারাংকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘উবশু টা কি রে মারাং?’’
মারাং খুশির গলায় বলল, ‘‘মা তো বুড়ো হয়ে গেছে৷ তাই আজ থেকে আমার মা’কে আমি পেটে রাখবো, বুঝলি?’’
‘‘পেটে রাখবি মানে?’’ আমি তো অবাক, ওর পেটের দিকে তাকিয়ে বলি, ‘‘পেটে কি করে রাখবি?’’
‘‘বাহ! আমি যখন অনেক ছোট ছিলাম, নিজে হাঁটতে পারতাম না, চলতে পারতাম না, মা তো আমাকে পেটের মধ্যে রাখত৷ নিজে খেত, সেই খাবার আমিও পেটের মধ্যে থেকে খেতাম৷ এবার থেকে আমি যা খাব, মা’ও সেগুলো খাবে৷’’
‘‘কি করে খাবে?’’ আমি তখনো বুঝতে পারছিলাম না৷
‘‘আরে ওটাই তো উবশু!’’ মারাং আমার অজ্ঞতায় রীতিমতো বিরক্ত হয়েছিল, ‘‘মা’কে আজ আমি খেয়ে ফেলব, ব্যাস!’’
মাকুড়ি একটু থামল৷ তারপর দুর্বল গলায় বলল, ‘‘জল আছে একটু?’’
আমি তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে ঘরের কোণে রাখা মাটির কুঁজো থেকে জল নিয়ে এলাম৷
জল খেয়ে মাকুরির গলাটা একটু স্বাভাবিক হল৷ বলল, ‘‘আমি তখনো মারাং এর কথা বিশ্বাস করিনি৷ ভেবেছিলাম মারাং একটু ভুলভাল বকে, এটাও তেমনই৷ কিন্তু মনের মধ্যে খচখচ করছিল৷ সেদিন রাতে তাই সবাই বাজনা বাজিয়ে মারাং আর মারাং এর মা’কে নিয়ে চলে যেতেই অন্যদিনের মতো খেলা করার বদলে ফন্দিফিকির খুঁজছিলাম কি করে ওই চাতালে যাওয়া যায়৷ কৌতূহলে আমার মাথা কাজ করছিল না৷ শেষে অনেক ভেবে ভেবে একটা পথ বের করলাম৷
‘‘আমাদের গ্রামের যারা পাঁচিল পাহারা দেয়, তারা একধরনের বেতের মুখোশ পরে থাকে সবসময়৷ যাতে আক্রমণকারী শত্রু চট করে চোখে বা কপালে আঘাত করতে না পারে৷ একটা পাহারাদার ছেলের কাছ থেকে অনেক কষ্টে মুখোশটা আদায় করলাম, প্রায় চার কলসি ঈয়াই দিয়ে৷ ঈয়াই যত পুরনো হয়, তত ভাল স্বাদ৷ আর আমার ছিল ঈয়াই তৈরি করে জমানোর নেশা৷ পুরোটা দিয়ে দিলাম ছেলেটাকে৷ সেও নেশার ঘোরে তার মুখোশ দিয়ে দিল আমাকে৷ উবশু চলার সময় চারপাশে কয়েকজন পাহারাদারও থাকে৷ আমি ছেলেটার মুখোশ পরে পাহারাদার সেজে চলে গেলাম চাতালে৷
‘‘উত্তেজনায়, ভয়ে আমার বুক ঢিপঢিপ করছিল৷ জেসুমি গ্রামের নিয়ম ভীষণ কড়া৷ নিয়ম অমান্য করলে ওরা লোক মানে না৷ নিজেকে যতটা সম্ভব শক্ত রেখে ওই ছেলেটার তীর ধনুক কাঁধে নিয়ে, ডাও কোমরে বেঁধে, অন্য হাতে বর্শা ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম৷’’
‘‘দেখতে পাচ্ছিলাম, মারাং, এর মা’কে কিছু একটা খাওয়ানো হয়েছিল, ঝিমিয়ে পড়েছিল এমনিতেই৷ চাতালে গোল হয়ে ঘুরে ঘুরে সকলে নাচছিল, এক ধরনের বুনো পাখির পালক মাথায় পরেছিল সবাই৷ তার মধ্যে আমার নিজের মা’ও রয়েছে৷’’
‘‘আর তোর বাবা?’’ অরিন্দম বাধা দিল৷
মাকুরি বলল, ‘‘আমাদের জেসুমি গ্রামে কে কার বাবা সে’ব্যাপারে আমরা কিছু জানিনা৷ পুরুষরা নিজেদের মধ্যেই থাকে৷ বাচ্চারা মা’র কাছে বড় হয়৷
‘‘যাই হোক, অনেকক্ষণ নাচগানের পর মারাং এর মা’কে চাতালের একদম মধ্যিখানে নিয়ে আসা হল৷ আমিও অন্য পাহারাদারদের মতো মারাং এর মা’র পেছন পেছন গিয়ে উপস্থিত হলাম চাতালের মাঝখানে৷ সেখানে দেখলাম একদম মধ্যিখানে রয়েছে একটা বিশাল বড় লোহার পাত৷ একফালি চাঁদ যেমন বাঁকানো দেখতে হয় ঠিক তেমন৷ প্রচণ্ড ধারালো৷ মারাং এর মা’কে সবাই মিলে ধরে ধরে নিয়ে গেল সেই ধারালো ফলার কাছে৷
‘‘আমি তখনো অবধি বুঝতে পারিনি কি হতে চলেছে৷’’ মাকুরি রুদ্ধশ্বাসে বলে যাচ্ছিল, ‘‘চারপাশে প্রচণ্ড জোরে মোষের শিং চাপড়াচ্ছে সবাই৷ মারাং এর মা’র সারা মুখটা কুকুর বলির রক্তে লাল করে দেওয়া হয়েছে, কুকুরের একটা চোখ উপড়ে সেটা আটকে দেওয়া হয়েছে কপালে৷ ওর মা চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করছে কিছু … এমন সময় মারাং আকাশের দিকে তাকিয়ে জোরে একটা চিৎকার করেই ওর মা’কে ঠেলে ওই ধারালো পাতের ওপর ফেলে দিল৷ চোখের নিমেষে ওর মা আড়াআড়ি দু’ভাগে কেটে পড়ে গেল ওই বিশাল বঁটির দু’পাশে৷’’
আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে শুনছিলাম৷ মাকুরি থামতেই বলে উঠলাম, ‘‘তারপর?’’
মাকুরির চোখ লাল হয়ে গিয়েছিল৷ ওই ভয়ঙ্কর স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে ওর হাত-পা’র শিরাগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠছিল৷ বলল, ‘‘তারপর সবাই মিলে মারাং এর মা’র শরীরটাকে কুচিকুচি করে কাটল৷ হাড়, মাংস, রক্ত আলাদা করা হল৷ একটু পরে মারাংকে সেই মাংস খাওয়ানো হল৷ হাড়গোড়গুলো বিলিয়ে দেওয়া হল গ্রামের সবার মধ্যে৷ ওটাই উবশু’র প্রসাদ৷’’
‘ওয়াক’ করে একটা শব্দ পেতেই দেখি অরিন্দম বমি করে ফেলেছে৷ নেহাত খালি পেটে আছে, তাই সামান্য জল ছাড়া আর কিছু বেরোয়নি৷ না হলে আমার কাজ আরো বাড়ত৷
মাকুরি মৃদুস্বরে বলল, ‘‘সেই রাতেই আমি গ্রাম ছেড়ে পালাই৷ যদি কখনো ধরা পড়ি, জানি বাঁচবো না৷ কিন্তু না বেঁচে থাকি তবু ভাল, কিন্তু ওইভাবে নিজের মায়ের মাংস আমি খেতে পারব না৷’’ কথাটা বলেই ও হঠাৎ আমার হাতদুটো চেপে ধরল, ‘‘আপনারা শহরের লোক৷ আপনাদের অনেক ক্ষমতা৷ ঠিক পারবেন তো উবশু বন্ধ করতে? পারবেন তো?’’
আমি অপরাধীভাবে তাকালাম অরিন্দমের দিকে৷
অরিন্দম মুখটুখ মুছে বলল, ‘‘আরে কেন পারব না? তুমি কিচ্ছু চিন্তা কোরো না মাকুরি! শুধু আমাদের একবার নিয়ে চলো জেসুমি গ্রামে৷’’
মাকুরির মুখ এবার দৃশ্যতই সাদা হয়ে গেল৷ আমার হাতটা ছেড়ে দিয়ে ও তাকাল গুইতের দিকে৷
গুইতে বলল, ‘‘এ কি বলছেন স্যার! আপনারা বলেছিলেন উবশু’র ব্যাপারে জানতে চান, আমি অনেক কষ্টে লোথাদের বলে কয়ে ওকে নিয়ে এলাম৷ এখন আবার বলছেন জেসুমিদের গ্রামে যাবেন? মাথা-টাথা ঠিক আছে তো আপনার?’’
‘‘আলবাত ঠিক আছে৷’’ অরিন্দম বলল, ‘‘আজ পূর্ণিমা৷ আজ রাতে আমরা ওখানে যাব৷ গুইতে, তোমাকে এই জন্য আমরা দশ হাজার টাকা দেব৷’’
গুইতেকে আমরা এ’যাবত কখনোই পাঁচশো টাকার বেশি একবারে বখশিশ দিইনি, ফলে দশ হাজার টাকা শুনে ওর চোয়ালটা ঝুলে পড়ল৷
অরিন্দম ভাঙা ভাঙা নাগামিজে বলে চলেছিল, ‘‘যেভাবেই হোক, আমাদের ওই চাতালে পৌঁছতেই হবে৷ একবার ভিডিও তুলতে পারলে…’’ পরক্ষণেই মাকুরির দিকে তাকিয়ে ও বলল, ‘‘তোমাদের উবশু চিরকালের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে৷’’
গুইতে ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছে, মাথা নেড়ে বলল, ‘‘না না এটা সম্ভব নয় স্যার! সে যত টাকাই দিন না কেন! আপনাদের কিছু হয়ে গেলে তখন কি করব? আপনারা নাগাল্যান্ড সরকারের পারমিশন নিয়ে এই রাজ্যে এসেছেন, কিছু একটা হয়ে গেলে…৷’’
অরিন্দম এবার একটা সিগারেট ধরাল৷ জোরে একটা ধোঁয়া ছেড়ে বলল, ‘‘বুদ্ধি খাটালে কিস্যু হবে না৷ তোমার জানা আঁকতে পারে এমন কোনো লোক আছে?’’
‘‘আঁকতে পারে এমন লোক?’’ গুইতে অবাক হয়ে গেল, কিছুক্ষণ ভেবে বলল, ‘‘না তেমন আঁকতে হয়ত পারে না, কিন্তু উল্কি টুল্কি …৷’’
‘‘ওতেই হবে৷ নিয়ে এসো তাকে৷’’ অরিন্দম দু’হাজার টাকার একটা গোলাপি নোট গুঁজে দিল ওর হাতে, ‘‘আজ রাতে তো? বেশি সময় নেই৷ জলদি যাও৷ আর তোমাকে যে ফোনটা দিয়েছি, ওটা অন রেখো৷’’
মাকুরি গুইতের সঙ্গে চলে যাওয়ার আগেও আমার দিকে একবার তাকাল, অস্ফুটে বলল, ‘‘আমার টাকা চাই না৷ উবশু বন্ধ হবে তো বাবু?’’
ওরা চলে যেতে আমি বললাম, ‘‘সামান্য একটা চাকরির জন্য জেসুমিদের গ্রামে যাওয়াটা কি ঠিক হবে? মরেই যদি যাই, কি হবে এই এন জি ও’র চাকরি দিয়ে?’’
অরিন্দম ধোঁয়ার রিং ছাড়তে ছাড়তে বলল, ‘‘এন জি ও না ছাই! কে বলল তোকে আমরা এন জি ও’র কাজে এসেছি?’’
‘‘মানে?’’ আমি এবার হাঁ৷
‘‘এখনো বুঝিসনি?’’ অরিন্দম বলল, ‘‘এই এন জি ও’টা একটা লোক দেখানো মুখোশ৷ বনশল লোকটা আসলে দালাল, এইভাবে ভিডিওগুলো আমাদের থেকে নিয়ে কোটি কোটি টাকায় বিদেশি চ্যানেলগুলোতে বিক্রি করবে৷ ওইসব গ্রান্ট ট্রান্ট সব ভাঁওতা৷’’
‘‘তুই শিওর?’’ আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, ‘‘তুই কি করে বুঝলি?’’
‘‘ঘটে একটুও বুদ্ধি থাকলে তুইও বুঝতিস৷’’ অরিন্দম সিগারেটে লম্বা টান দিল, ‘‘বনশলের ওই এন জি ও তে অন্তত পঞ্চাশজন ফিল্ড লেভেল কর্মী রয়েছে৷ যারা ছত্তিশগড় থেকে শুরু করে আন্দামানের প্রত্যন্ত জায়গায় কাজ করে বেড়ায়৷ এত ইম্পরট্যান্ট একটা মিশনে ওদের মতো অভিজ্ঞদের কাউকে না নিয়ে আমাদের মতো আনকোরা দুজনকে পাঠাবে কেন?’’
‘‘কেন? আমি এখনো ধরতে পারছিলাম না অরিন্দম কি বলতে চাইছে৷
অরিন্দম বলল, ‘‘বনশল লোকটা ঘাগু হলেও একটা বড় বোকামি করে ফেলেছিল৷ এখানে আসার আগের দিন আমাকে নাগাল্যান্ডের কোন কোন জায়গা কভার করতে হবে, কোন কোন উপজাতির দিকে স্পেশাল নজর রাখতে হবে, এইসব ডিটেইল লিখে আমাকে একটা ইমেল করেছিল৷’’
‘‘তাতে বোকামির কি হল?’’
‘‘আরে ইমেলটা আসলে ও নিজে লেখেনি, ওটা ছিল ফরওয়ার্ড করা৷ আর ওই ইমেলটা বনশলকে পাঠিয়েছিল আমেরিকার একটা নামকরা ওয়াইল্ড লাইফ চ্যানেল৷ আমার সেই ইমেল আইডি দেখেই সন্দেহ হয়৷ বনশলকে যদি কোনো বিদেশি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা অনুদান দিতে চায়, তার মধ্যে বিদেশি চ্যানেল আসবে কেন?’’
‘‘তারপর?’’
অরিন্দম আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, ‘‘আমরা এত কষ্ট করে এখানে থেকে, নিজেদের জীবন বাজি রেখে ভিডিও কভারেজ করবো, সেটা তো আমরা সরাসরিই বিক্রি করতে পারি ওই বিদেশি চ্যানেলে, কি বলিস? মাঝখানে বনশলকে রাখলে ও-ই পুরো মধুটা খেয়ে নেবে, আমরা পাব শুধু মাইনে, তাও আবার একজনকে লাথি মেরে তাড়াবে৷ আমরা নিজেরা যদি বিক্রি করি, তাতে প্রায় পনেরো হাজার ডলার দেবে ওরা৷ ভাবতে পারছিস? দশ লাখ টাকারও বেশি৷’’
‘‘কিন্তু তা কি করে হয়?’’ আমি প্রতিবাদ করলাম, ‘‘বনশলের উদ্দেশ্য যাই হোক, আমরা তো ওর এন জি ও’র কর্মচারী৷ এখানে আমাদের থাকা, খাওয়া, বা ওই কাজ, সবকিছুর জন্যই আমাদের পে করছেন ওঁরা৷ এইভাবে ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়া কি উচিৎ? বাই চান্স যদি বনশল জানতে পারে, এটা খুব বাজে ব্যাপার হবে৷’’ আমি সরু চোখে ওর দিকে তাকালাম, ‘‘তুই কি ওদের সাথে যোগাযোগ করেছিস নাকি?’’
অরিন্দম দুদিকে মাথা নেড়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু গুইতে উল্কি আঁকতে জানা একটা ছেলেকে নিয়ে আসতে কথাটা সেখানেই থেমে গেল৷
গুইতে বলল, ‘‘স্যার৷ যা বলছেন করে দিচ্ছি, যাকে নিয়ে আসতে বলছেন, এনে হাজির করছি৷ কিন্তু দয়া করে জেসুমিদের গ্রামে যাবেন না৷’’ আমরা কিছু বলার আগেই ও আমাকে দিকে তাকিয়ে খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসল, ‘‘ইয়ে, টিশিট স্যার, একটা সিগারেট ছাড়ুন না!’’
গুইতে’র যত আবদার আমার কাছে৷ আসলে বুঝে গেছে নরম মাটিতে আঁচড় কাটা সোজা! আমার ‘তৃষিত’ নামটা প্রথম থেকেই ঠিক মতো উচ্চারণ করতে পারে না, খয়েরি ছোপ পড়া দাঁতগুলো বের করে ঠোঁট দুটোকে ছড়িয়ে দিয়ে বলে, ‘‘টি-শি-ট!’’
আমি বিনাবাক্যব্যয়ে সিগারেট দিতে যেতেই অরিন্দম হাত বাড়িয়ে সিগারেটটা টেনে নিল, ‘‘এসব আরাম পরে হবে গুইতে৷ হাতে সময় বেশি নেই৷ আজ রাতে আমাদের যেভাবে হোক, জেসুমিদের গ্রামে ঢুকতেই হবে৷’’
গুইতে’র মুখ থেকে হাসিহাসি ভাবটা উধাও হয়ে গেল, বলল, ‘‘আপনারা কি সত্যিই যাবেন ভাবছেন নাকি?’’
‘‘যাব৷ আর সেটা শুধু ভাবছি না, যাবই৷’’ অরিন্দম সংক্ষেপে উত্তর দিল, ‘‘তুমি মাকুরিকে ডেকে নিয়ে এসো৷’’
‘‘মাকুরি তো লোথাদের গ্রামে ফিরে গেল৷’’ মিনমিন করলো গুইতে৷
‘‘আশ্চর্য তো!’’ স্বভাববিরুদ্ধভাবে চিৎকার করে উঠল অরিন্দম, ‘‘আমি তো বলে দিলাম আজ রাতে আমরা ওদের গ্রামে যাব, তুমি ওকে যেতে দিলে কেন? এক্ষুনি ডেকে নিয়ে এসো৷’’
নাগা উপজাতিরা সাধারণত মিতবাক হয়, আর নীচু স্বরে কথা বলে৷ সে সভ্য নাগা হোক বা অসভ্য নাগা৷ নাগাদের প্রতিটা গ্রামই তাই বেশ শব্দহীন, প্রকৃতির কোলে একেকটি হ্যামলেট৷
সেখানে অরিন্দমের এই আকস্মিক চেঁচানোতে চারপাশের নরম নৈঃশব্দ্যটা যেন মুহূর্তে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে বর্ষার মেঘের মতো খানখান হয়ে গেল৷
গুইতে হতভম্ব হয়ে চলে যেতেই আমি অরিন্দমকে বললাম, ‘‘এত চেঁচাচ্ছিস কেন? ভালো করে বললেই তো হয়৷’’
অরিন্দম আমার কথার উত্তর না নিয়ে গুইতে’কে পিছু ডাকল, ‘‘দাঁড়াও, আমিও তোমার সাথে যাব৷’’ তারপর আমার দিকে ফিরে বলল, ‘‘তুই রাতের খাবারটা বানিয়ে ফ্যাল৷ খেয়ে নিয়েই বেরিয়ে পড়তে হবে৷ মাকুরি বলেছিল ঠিক রাত বারোটা থেকে শুরু হয় উবশু৷’’
আমি রাগতস্বরে বললাম, ‘‘রোজই তো আমিই খাবার বানাচ্ছি, বাসন ধুচ্ছি, ধান ভানছি, ঘরদোর সাফ করছি৷ তুই একটু হেল্প কর? আমি সব একা কি করে করবো? তাছাড়া সকাল থেকে এইসব তালেগোলে আজকের প্রোগ্রাম মেল করাও হয়নি, সেটাও করতে বসতে হবে৷’’
নিয়ম হল, আমরা যখন যে গ্রামে যাই, তার আগে আমাদের ডিটেইলড প্ল্যান মেল করে পাঠাতে হয় দিল্লিতে, বনশল স্যারকে৷ গ্রাম থেকে ফিরে এসেও প্রায় সাথে সাথে সমস্ত ছবি, ভিডিও এবং জোগাড় করা খুঁটিনাটি তথ্য মেল করে পাঠানোর নির্দেশ রয়েছে৷ অরিন্দম যখন আজ মরণপণ প্রতিজ্ঞা করেইছে যে জেসুমিদের গ্রামে যাবে, সেটা তো লিখে পাঠাতে হবে! তারপর বেঁচে থাকব না আজই জীবনের শেষদিন সেটা পরে জানা যাবে৷
অরিন্দম আমার কথাকে পাত্তাই দিল না, শুধু উল্কির ছেলেটাকে ইশারায় বসতে বলে বেরিয়ে গেল৷
আমার অসম্ভব রাগ হচ্ছিল৷ অরিন্দমের কাণ্ডকীর্তি দিনদিন বোঝা দায় হয়ে উঠছে৷ ও যেন এমন ভাব করছে যে ও এখানে চাকরি করতে এসেছে, আর আমি এসেছি ওর ফাইফরমাস খাটতে, রান্নাবান্না করতে৷ এইভাবে সব কাজ একা কতদিন করা যায়? আমারও তো অভ্যেস ছিল না কোনোকালে এসব করার!
নিজের মনে গজগজ করতে করতে ভাত বসালাম, ভালো করে ধুয়ে আলু ওই ভাতের মধ্যেই ফেলে দিলাম৷ গরম ভাতের গন্ধ ছড়িয়ে পড়া মাত্রই দেখি দালানে বসে থাকা উল্কি আঁকার ছেলেটা তৃষ্ণার্ত চোখে তাকিয়ে আছে ধোঁয়া ওঠা ভাতের হাঁড়ির দিকে৷
আমি একটা থালায় কিছুটা ভাত আর আলুসেদ্ধ মেখে ওর সামনে দিতেই ব্যাটা কোনো কথা না বলে গবগবিয়ে খেতে শুরু করল৷
মোটামুটি সব কাজ সেরে ঘরে গিয়ে ল্যাপটপটা নিয়ে বসলাম, কিন্তু কিছুতেই ইন্টারনেটের ডঙ্গলটা কোথাও খুঁজে পেলাম না৷ অদ্ভুত ব্যাপার তো! অথচ আমার স্পষ্ট মনে আছে, পরশুদিন কাজ থেকে ফিরে সব ডিটেইলস মেল করে পাঠিয়ে আমি ডঙ্গলটা ল্যাপটপে লাগিয়েই রেখেছিলাম৷ এখানে নেটওয়ার্কের খুব সমস্যা৷ একটা মাত্র সার্ভিস প্রোভাইডারেরই ইন্টারনেট কানেকশন পাওয়া যায়৷
আমি আঁতিপাঁতি করে গোটা ঘরটা খুঁজলাম৷ প্রথমে সম্ভাব্য জায়গাগুলোয়, তারপর অসম্ভব জায়গাগুলোও বাদ দিলাম না৷ কিন্তু কিছুতেই খুঁজে পেলাম না৷ যেন হাওয়ায় উবে গেছে জিনিষটা! কেউ যে নিয়ে পালিয়েছে, এমন সম্ভাবনাও কম৷ কারণ পরশু রাতে মেল করার পর থেকে আমরা বলতে গেলে বাইরেই বেরোইনি৷ ঘরেই ছিলাম৷ জানলার পাশেও ছিল না ল্যাপটপটা, যে কেউ হাত বাড়িয়ে নিয়ে পালাবে৷ তাছাড়া নাগা উপজাতির লোকেরা তেমন নয়৷ এদের মধ্যে চুরিচামারি নেই বললেই চলে৷ বেশিরভাগ কুঁড়েঘরই খোলাই পড়ে থাকে৷
আমি আরো কিছুক্ষণ সব ভালো করে খুঁজে হতাশ হয়ে গেলাম৷ যাহ, আজকে রাতের প্ল্যানটা তাহলে আর বনশল স্যারকে জানানো যাবে না৷ যদি আজ রাতের পর বেঁচে থাকি, কাল সকালেই চলে যেতে হবে ডিমাপুর, একটা ডঙ্গল কিনে আনতে হবে৷
কি করব ভাবতে ভাবতে কি মনে হল, ফোন করলাম পিকলুদা’কে৷ এখানে আসার পর বাড়ির লোক ছাড়া পিকলুদা’র সাথেই মাঝেমধ্যে একটু কথাবার্তা বলি৷ আগেই বলেছি, পিকলুদা ইতিহাসের লোক, তাছাড়া অনেক কিছুর খবর রাখে৷
পিকলুদা সব শুনেটুনেই বলল, ‘‘বলিস কি! এন্ডোক্যানিবালিজম শুনেছি৷ মরে গেলে তার আত্মীয়রাই মৃতদেহ দাহ বা কবর না দিয়ে কেটে খেয়ে নেয়৷ আফ্রিকার জুকুন উপজাতি, সাউথ আমেরিকার ওয়ারি উপজাতির মধ্যে এই চলটা আছে৷ আর শুধু আফ্রিকা, আমেরিকা কেন, আমাদের ভারতেও তো অঘোরী সন্ন্যাসীরা অমরত্ব লাভের আশায় গঙ্গায় ভাসতে থাকা মরার মাংস খেত, এখনো হয়ত খায়৷ কিন্তু মা বুড়ো হয়ে গেলে কেটে খাচ্ছে, এমন তো ফার্সট টাইম শুনছি ভাই!’’
আমি উত্তেজিতভাবে বললাম, ‘‘তবে আর বলছি কি পিকলুদা৷ এই জেসুমি লোকেরা মনে করে, মা’কে খেয়ে ফেললে একই আত্মা একই বংশে বারবার করে ঘুরপাক খেয়ে জন্মাবে, অন্য কোনো বংশে জন্মাতে হবে না৷ কি অদ্ভুত বলো তো!’’
পিকলুদা হাইস্কুলে মাস্টারি করলেও দিনরাত লেখাপড়াতেই ডুবে থাকে৷ বলল, ‘‘শোন, আজ আমি সময় করে একবার ন্যাশনাল লাইব্রেরি চলে যাচ্ছি৷ দেখি পুরনো জার্নাল ঘেঁটে এদের সম্পর্কে কিছু পাই কি না! তোরা কি সত্যিই আজ যাচ্ছিস নাকি ওদের গ্রামে?’’
‘‘কি করবো, না গিয়ে উপায় আছে?’’ আমি বেজার মুখে বললাম, ‘‘অরিন্দম প্রতিজ্ঞা করেছে, ওদের ভিডিও ও তুলবেই৷’’
‘‘যদি ধরা পড়ে যাস? এত বছরে কোনো বাইরের লোক যখন ঢুকতে পারেনি, ঢোকাটা অতটাও সহজ হবে বলে কিন্তু মনে হয় না৷’’ বলল পিকলুদা৷
‘‘সে তো জানি! জানি না ওর কি মতলব, এখন উল্কি আঁকতে পারে এমন একটা ছেলেকে নিয়ে এসেছে৷ তাকে দিয়ে কি করবে কে জানে!’’ আমি আরো কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন রেখে দিলাম৷
ঘড়িতে দেখলাম প্রায় বেলা সাড়ে বারোটা৷ অরিন্দম গুইতে’কে নিয়ে অনেকক্ষণ হয়ে গেল মাকুরির খোঁজে গেছে৷ এখনো এল না কেন?
তিন
সন্ধ্যে সাড়ে ছ’টা৷ উত্তেজনায় বুকের ভেতরটা কেমন গুড়গুড় করছে৷ অরিন্দমের চাপাচাপিতে এত বড় ঝুঁকিটা নিতে রাজি হয়ে গেলাম বটে, কিন্তু মনের মধ্যে কে যেন সারাক্ষণ কু ডেকে চলেছে৷ আমি উত্তর কলকাতার সাধারণ একটা ছেলে, বাড়ির নিম্নবিত্ত অবস্থার জন্য গাদা গাদা টিউশন পড়িয়ে দু’পয়সা রোজগারের চেষ্টা করতাম, সকালবেলা বাজার আর সন্ধ্যেবেলা পড়ানোর ফাঁকে রকে বসে কিছুক্ষণের আড্ডা, এই ছিল আমার জীবন৷
সেই আমি কিনা এখন চলেছি এমন একদল মানুষের ডেরায়, যারা নিজের জন্মদাত্রী মা’কেই জ্যান্ত কেটে খেয়ে নেয়৷ তাহলে আমার মতো ভিনদেশির অবাঞ্ছিত প্রবেশে তারা কী করবে?
কলকাতা ছাড়ার সময় টুকিটাকি জিনিসের সঙ্গে দাড়ি কামানোর জন্য একটা ছোট আয়নাও নিয়ে এসেছিলাম৷ যদিও ওটাকে লুকিয়েই রাখি৷ বেশিরভাগ নাগা উপজাতি আয়না জিনিসটাকে খুব অশুভ কিছু মনে করে, ভাবে যে আয়নার কাঁচের মধ্যে এপাশের মানুষটার আত্মাটা আটকে যাবে৷
বাইরের ঘরে গুইতে, মাকুরি আর উল্কি আঁকার ছেলেটা বসেছিল, আমি ভেতরের ঘরে গিয়ে সাবধানে আয়নাটা বের করে নিজের মুখটা দেখতেই চমকে উঠলাম৷
রঙ মাখিয়ে এ কি অবস্থা করেছে আমার মুখের! গোটা মুখ, গলা কে যেন আলকাতরায় ঢেকে দিয়েছে, কুচকুচে কালো হয়ে গেছে আমার মুখ৷ অন্ধকারে নিজেদের আড়ালে রাখতেই অরিন্দমের এই টোটকা৷
ভাগ্যক্রমে দুজনেই কালো জামা, কালো প্যান্ট নিয়ে এসেছিলাম৷ অরিন্দম ওর প্ল্যানটা এখনো খোলসা করে না বললেও এটুকু বুঝতে পারছিলাম ,রাতের মিশমিশে কালো অন্ধকারে, কালো জামাকাপড়, কালো চেহারায় ও ঢুকতে চাইছে জেসুমিদের গ্রামে৷
কিন্তু সেটা কি সম্ভব?
মাকুরি সকালেই বলছিল, ওদের গ্রামে ঢোকার মুখে প্রতিরক্ষাবাহিনী থাকে৷ তাদের সঙ্গে থাকে বিষমাখানো ফলা৷
আমি মোটামুটি প্রস্তুত হয়ে বাইরের ঘরে বেরিয়ে এলাম৷ মাকুরি, গুইতে আর অরিন্দম সবাই কালো ভূত হয়ে বসে আছে৷ উল্কি আঁকা ছেলেটা বোধ হয় এর মধ্যেই চলে গেছে৷
অরিন্দম গুইতে’কে নিয়ে সেই যে মাকুরিকে আনতে গিয়েছিল, ফিরল এই একটু আগে৷ দুপুরে খায়ওনি, জিজ্ঞেস করতে বলেছিল, ‘‘খাবো না৷’’
এতক্ষণ কোথায় কি করছিল কে জানে! ওর হালচাল কিছুই বুঝতে পারছি না৷
আমি ওদের কাছে এসে বসতে অরিন্দম বলল, ‘‘এই তো তৃষিত এসে গেছে৷ মাকুরি, তুই বল এবার, যেটা বলছিলি৷’’
‘‘আমাদের গ্রামের পুরোটাই প্রায় বাঁশের পাঁচিল দিয়ে ঘেরা৷’’ বলল মাকুরি, ‘‘শুধু গ্রামের পেছনের দিকে ডংসিরি নদী বয়ে গেছে৷ নদীপথে কেউ যদি খুব সাবধানে ঢুকতে চায় আমাদের গ্রামে, সে ঢুকতে পারবে৷ কারণ ডংসিরির দিকে কেউ থাকে না৷’’
‘‘ডংসিরি মানে কোন নদীটা বলছে বুঝতে পারছিস তো?’’ অরিন্দম আমাকে বলল, ‘‘ডিমাপুরে নেমে যে ধানসিঁড়ি নদীর ব্রিজ পেরিয়েছিলাম মনে আছে? ওরা ওই ধানসিঁড়িকেই ডংসিরি বলে৷ ধানসিঁড়ি আসলে ব্রহ্মপুত্রের উপনদী, নাগাল্যান্ডের কি একটা পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়ে পরে ব্রহ্মপুত্রে গিয়ে মিশেছে৷’’
‘‘ওহ৷’’ আমি মাকুরিকে বললাম, ‘‘তা নদীপথে অন্ধকারে তুমি রাস্তা চিনতে পারবে তো?’’
উবশু প্রথা বন্ধ হবে, সকালে এই প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পর থেকেই দেখছি মাকুরির মধ্যে ভয়ের ভাবটা অনেকটা কেটে গেছে, উৎসাহে টগবগ করে ফুটছে ছেলেটা৷ আমার প্রশ্নের উত্তরে ঝকঝকে দাঁত বের করে হাসল, ‘‘ছোটবেলা থেকে ডংসিরিতে কত সাঁতার কেটেছি, দাপাদাপি করেছি, আর চিনতে পারব না! আর সবচেয়ে সুবিধা হল নদীর পাড় দিয়ে উঠলে ওখান দিয়েই চাতালে পৌঁছনো যায়৷ মানে কোনো রাস্তাটাস্তা নেই কিন্তু৷ জঙ্গল দিয়েই সাবধানে এগোতে হবে৷ কিছুক্ষণ যাওয়ার পর ওই খোলা জায়গাটা পড়বে, যেখানে চাতাল রয়েছে৷’’
‘‘তার মানে আমরা জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়েই যদি চাতালের ভিডিও করতে চাই, সেটা কি সম্ভব?’’ আমি জানতে চাইলাম৷
‘‘সম্ভব৷’’ মাকুরি ভেবে বলল, ‘‘তবে খুব সাবধানে লুকিয়ে থাকতে হবে৷ তবে ভালো ছবি আসবে কিনা জানি না৷ চাতালে মশাল জ্বলে অবশ্য৷’’
‘‘কিন্তু শুধু দূর থেকে ভিডিও করলে তো হবে না৷’’ অরিন্দম ছটফটিয়ে উঠল, ‘‘কাছে গিয়ে চাঁদের মতো ওই বিশাল বঁটির ছবিটাও তো তুলতে হবে৷ আচ্ছা, জেসুমিদের যদি অনেক টাকা দেওয়া যায়?’’
মাকুরি মাথা নাড়ল, ‘‘ওরা আপনার টাকা নিয়ে কি করবে? আমাদের গ্রামে ওইসব টাকা ফাকা চলে না৷ কেউ শহরেও আসে না যে কাজে লাগবে৷ আমাদের গ্রামে সবাই শহুরে লোকেদের এড়িয়ে চলে৷’’
‘‘কেন?’’ আমি জিজ্ঞেস করলাম৷
মাকুরি বলল, ‘‘আগে দু-একজন কোনো না কোনো সময় শহরের লোকেদের বিশ্বাস করে ঠকেছিল, সেইটাই মুখে মুখে চাউর হয়ে গেছে গোটা গ্রামে৷ জেসুমি লোকেরা বিশ্বাস করে শহুরে লোক মানেই স্বার্থপর, তারা খালি ক্ষতি করে৷’’ একটু থেমে ও সরল হাসল, ‘‘কিন্তু আমি জানি যে ঠকব না৷ আপনাদের হাত ধরেই বন্ধ হবে ওই জঘন্য উৎসব৷ তাই তো বাবু?’’
আমি সঙ্গে সঙ্গে চোখ নামিয়ে নিলাম৷
এই ছেলেটা বারবার আমাকে অপরাধী করে তুলছে৷
কিন্তু অরিন্দম নির্বিকার, বলল, ‘‘নিশ্চয়ই৷ আচ্ছা মাকুরি, বঁটিটার ছবি কি করে তুলবো তাহলে!’’
গুইতে পাক্কা কলকাতার ব্যবসায়ীদের মতো থুতু দিয়ে নোট গুনছিল৷ ভালো করে লক্ষ্য করে বুঝলাম, সকালে যে টাকাগুলো অরিন্দম মাকুরিকে দিয়েছিল, সেটাই গুইতে হাতিয়ে নিয়েছে মাকুরির মাথায় হাত বুলিয়ে৷ কিংবা মাকুরি হয়ত নিজেই দিয়ে দিয়েছে, সেটাও হতে পারে৷
মাকুরি কিছুক্ষণ ভেবে বলল, ‘‘বঁটিতে প্রথমে আধাআধি করে কাটা হয়৷ তারপর গোটা শরীরটাকে কুচিকুচি করে ফেলে হাড় মাংস আলাদা করে ফেলা হয়৷ তারপর নিজের ছেলেমেয়ে সেগুলো খেয়ে নিলে অন্যদের মধ্যে হাড়গুলো বিলিয়ে দেওয়া হয়৷ সব মিলিয়ে আধঘন্টা৷ এরপরেই কিন্তু চাতালটা ফাঁকা হয়ে যায়৷ সবাই তখন ঈয়াইয়ের নেশায় মত্ত, ঘরে চলে যায়৷ বঁটিটা পরিষ্কার করা হয় পরেরদিন সকালে৷ কাজেই, সব মিটে যাওয়ার পর কাছে গিয়ে তোলা যেতে পারে৷ কিন্তু কেউ যদি একবার দেখে ফেলে …!’’ মাকুরি ভয়ে ঢোঁক গিলল, ‘‘তবে যতক্ষণ উবশু চলে, ততক্ষণ অনেক মশাল জ্বালা থাকে, সবাই চলে যাওয়ার পর জায়গাটা মোটামুটি অন্ধকার হয়ে যায়, দু-একটা মশাল জ্বলে৷ তাই কেউ দেখতে পাবে না হয়ত৷’’
‘‘অন্ধকার হয়ে গেলে ছবি উঠবে কি করে?’’ অরিন্দম বলল, ‘‘ফ্ল্যাশলাইট জ্বেলে তুলতে হবে তাহলে!’’
বনশল স্যার যে ক্যমেরাটা আমাদের দিয়েছিলেন, সেটা বেশ উন্নতমানের৷ আর অরিন্দমের ছবি তোলার হাতও ভালো৷ মনে পড়তেই আমি অরিন্দমকে বললাম, ‘‘আচ্ছা ইন্টারনেটের ডঙ্গলটা কোথায় জানিস তুই?’’
‘‘মাকুরি, খুব তাড়াতাড়ি তাহলে কাজটা সারতে হবে বুঝলে!’’ অরিন্দম আমার দিকে ফিরল, ‘‘ডঙ্গল? নাতো! ল্যাপটপে তো তুই-ই কাজ করিস, আমি হাত দিই নাকি?’’
কথাটা সত্যি৷ ছবি তোলা যেমন অরিন্দমের ডিপার্টমেন্ট, তেমনই ইন্টারনেটের কাজটা আমার৷ আমি বললাম, ‘‘আরে ডঙ্গলটা কোথাও পাচ্ছি না৷ বনশল স্যারকে জানাতেও পারলাম না আজকের মিশনটা৷ ফোন তো এখন করা যাচ্ছে না, টাওয়ার নেই৷ কি করি বল তো!’’
নাগাল্যান্ডের এই প্রত্যন্ত জঙ্গলে আমরা যে সার্ভিস প্রোভাইডারের কানেকশন ব্যবহার করছি, সেটা শুধু এই এলাকার মধ্যেই টাওয়ার ধরে৷ ওই ডঙ্গলই ছিল আমাদের বহির্জগতের সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম৷
পিকলুদা’কে যখন ফোন করেছিলাম, তখন অবশ্য টাওয়ার ছিল৷ আমি বললাম, ‘‘ইশ! এখন মনে হচ্ছে সকালে ফোন করে পুরোটা জানিয়ে দিলেই হত!’’
অরিন্দম বলল, ‘‘ঠিক আছে৷ তাড়াহুড়োর কি আছে! কাল সকালে এসে সব জানাবি৷’’
*******
আমরা যখন আমাদের কুঁড়েঘর থেকে বেরোলাম, তখন ঠিক রাত সাড়ে দশটা৷ ভয়ে, উত্তেজনায় বুকের ভেতরটা ঢিপঢিপ করছে৷ খো আং গ্রামের পেছন দিয়েই বয়ে গেছে ছোট একটা খাঁড়ি, সেখানে গুইতে একটা ছোট ডিঙিনৌকোর ব্যবস্থা করে এসেছে৷ এই খাঁড়ি দিয়ে কিছুদূর দক্ষিণে গেলেই আমরা ডংসিরি নদীতে পৌঁছে যাব, মাকুরি বলল৷ তারপর সেখান থেকে আরো কিছুটা৷
আমি আত্মরক্ষাবাবদ একটা লাঠি নিলাম৷ জানি প্রয়োজনে এই লাঠি জেসুমিদের বিষমাখানো তীর, ডাও, বর্শার সামনে খড়কুটোর মতোই উড়ে যাবে, তবু নিজের একটা জোর আর কি!
মিনিট পাঁচেক পরে আমি, অরিন্দম, গুইতে আর মাকুরি, চারখানা কালো আলকাতরার মতো রং মাখা মানুষ রাতের অন্ধকারে শুকনো পাতা খচমচ করে মাড়িয়ে চলছিলাম খাঁড়ির দিকে৷
পূর্ণিমা রাত, চাঁদের পূর্ণভাত জ্যোৎস্না আমাদের চোখমুখ এই রাতের অন্ধকারে ধুইয়ে দিচ্ছিল৷ দূরের ঘন জঙ্গলের কোনো অজানা জন্তুর ক্রন্দনে চমকে চমকে উঠছিল হূদপিণ্ডটা৷ আকাশছোঁয়া গাছগুলো যেন এই গভীর রাতে আমাদের মত অনাহূতদের দেখে নির্বাক হয়ে যাচ্ছিল৷
আমি আড়চোখে দেখলাম, অরিন্দমের কালো জ্যাকেটের পকেটে উঁচু হয়ে রয়েছে ক্যামেরাটা৷
আমার অপ্রাসঙ্গিকভাবে একটা প্রশ্ন মনে উদয় হল৷ সকালে অরিন্দম বলল বিদেশি চ্যানেলটা নাকি এইসব ভিডিও, ছবি ওদের হাতে তুলে দিলে প্রায় দশ লাখ টাকা দেবে৷ অরিন্দম তো বলল ও নিজে যোগাযোগ করেনি, তাহলে টাকার অঙ্কটা ও কি করে জানল?
চার
পূর্ণিমার আলো মাখা আমাদের ডিঙি নৌকোটা ডংসিরি নদীতে যতই ভাসতে ভাসতে এগিয়ে চলেছিল, ততই আমার হূদস্পন্দন দ্রুত হচ্ছিল৷ আমি আবার ছোট থেকেই একটু ভাবুক প্রকৃতির, সামান্য একটা জিনিস থেকে ভাবতে ভাবতে কোথায় যে চলে যাই, তার কোনো ঠিক নেই৷
ডিঙিনৌকোতে যখন নিশ্চলভাবে বসে নদীর মৃদুমন্দ স্রোতের দোলা অনুভব করছি, তখন অকস্মাৎ আমার মনে হল, এই নদীপথ দিয়ে আবার ফিরতে পারব তো? এখান থেকে বহুদূরে শ্যামবাজারের সেই ঘিঞ্জি কানাগলি দিয়ে এঁকেবেঁকে ঢুকে আমাদের অন্ধকার জমাটবাঁধা বাড়িটায় যারা আমার জন্য অপেক্ষা করছে, যারা আমার স্বনির্ভর হওয়ার আশায় বুক বেঁধেছে, সেই বাবা মা’কে আবার দেখতে পাব তো?
উত্তেজনার বশে দুঃসাহসিকতাও অনেক সময়ে বোকামিতে পর্যবসিত হয়৷ আমাদেরটাও কি তেমনই কিছু হচ্ছে?
গুইতে আর মাকুরি নৌকোর দাঁড় বাইছিল৷ ওরা এখানকার লোক, নৌকোচালনায় বেশ পটু৷ ওদের ক্রমাগত দাঁড় বাওয়ার জন্য একবার ঝুঁকে পড়া, পরক্ষণেই সোজা হওয়া পিঠ দেখতে দেখতে আমার কেমন যেন ঘোর লেগে যাচ্ছিল৷ মনে হচ্ছিল আমরা চলেছি কোনো এক না ফেরার জগতের দিকে৷
চাঁদের আলোয় নদীর ছলাৎ ছলাৎ শব্দের মাঝে অরিন্দম ফিসফিস করলো, ‘‘পুরো প্ল্যানটা একবার সাজিয়ে নিই৷ আমরা জেসুমিদের গ্রামে পৌঁছে ডাঙায় উঠেই প্রথমে পাব জঙ্গল৷ সেখান থেকে আড়াআড়ি হাঁটব, বেশ কিছুদূর আড়াআড়ি হাঁটার পরে জঙ্গলের ভেতর থেকে দূরের ওই চাতাল দেখতে পাব৷ তাই তো মাকুরি?’’
মাকুরি ঘাড় নাড়ল, ‘‘আড়াআড়ি হাঁটলেই চাতাল পড়বে না৷ মাঝে একবার বাঁ দিকে বেঁকতে হবে৷ নাহলে সোজা গেলে গ্রামের ভেতর দিকে পৌঁছে যাবেন, একবার ভেতরে ঢুকে গেলে খুব মুশকিল হবে৷’’
‘‘তবে?’’
‘‘আমি সামনে থাকবো, দেখিয়ে নিয়ে যাব৷’’ মাকুরি বলল৷
আমি মাকুরিকে বললাম, ‘‘তুমি আর গুইতে’ও তো আমাদের মতো হাঁটু অবধি গামবুট পরতে পারতে৷ সকালেই ডিমাপুর থেকে কিনে আনা যেত৷ এত রাতে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে খালি পায়ে গেলে জোঁক তো ছেঁকে ধরবে!’’
গুইতে বা মাকুরি কিছু বলার আগেই অরিন্দম তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বলল, ‘‘আরে ওদের ওসব লাগে না৷ আসল কথায় আয়৷ আমি যখন দূর থেকে ভিডিও করবো, তোরা চারপাশ দেখবি৷ তারপর যখন ওদের সব কাটাকাটি খাওয়াখাওয়ি হয়ে যাবে, সবাই চলে গেলে তখন ধীরেসুস্থে যাব চাতালটার দিকে৷’’
আমরা সবাই মাথা নাড়লাম শুধু গুইতে ছাড়া৷
অরিন্দমের সঙ্গে ফিরে আসার পর থেকে দেখছি গুইতে গুম হয়ে রয়েছে, বিশেষ কথাবার্তা বলছে না৷
অরিন্দম কি ওকে বেশি টাকা দেবে না বলেছে?
ডংসিরি নদী দিয়ে কতক্ষণ চলছিলাম হিসেব নেই, মাকুরি আর গুইতে দাঁড় বেয়ে একটা সরু খাঁড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ল৷ খাঁড়িটা বড়জোর ফুটবিশেক চওড়া, দুপাশে ঘন জঙ্গল, দু’পাশ থেকে মোটা গাছের ডাল উঁচু হয়ে এসে আমাদের মাথার ওপরে যেন তোরণ রচনা করেছে৷ ঢেকে দিয়েছে চাঁদের আলো, আকাশ৷
‘‘আর কতদূর মাকুরি?’’ আমি বললাম, ‘‘রাস্তা তো একদম সরু হয়ে এল গো!’’
‘‘সামনেই৷’’ মাকুরি সংক্ষেপে জবাব দিল৷
আমার বুকের ভেতরের লাবডুবটা আবার বেড়ে গেল৷ ফিরতে পারব তো আবার এই পথেই?
মিনিটদশেক পরেই ডানপাশের একটা জঙ্গলের সামনে মাকুরি আস্তে করে আমাদের ডিঙিটাকে নোঙর করলো৷ তাকিয়ে দেখি, ঘাট তো দূর, একটা কোনো সমতল জায়গাও নেই, যেখান দিয়ে মানুষ সহজে উঠতে পারে ডাঙায়৷ বোঝাই যাচ্ছে, জেসুমি উপজাতির মানুষরা এই পেছনের দিকটা ব্যবহার করে না৷ কিন্তু ওরা তাহলে জল পায় কোথায়?’’
মাকুরিকে জিজ্ঞেস করতেই ও বলল, ‘‘গ্রামের পূর্বদিকে একটা ছোট নদী আছে, সবাই সেটার জল খায়৷ বললাম না, জেসুমিরা আধুনিক সভ্য মানুষদের এড়িয়ে চলে৷ ডংসিরি তো নাগাল্যান্ডের শহর হয়ে আসছে, শহুরে মানুষের ছোঁয়া জল তাই জেসুমিরা খেতে চায় না৷’’
আমি চুপ করে গেলাম৷ যারা শহুরে মানুষের ছোঁয়ার জন্য নদীকে অচ্ছুৎ করে দেয়, তাদের গ্রামে শহুরে মানুষরা লুকিয়ে প্রবেশ করেছে জানতে পারলে যে কি দশা করবে ভেবেই আমার পা দুটো সামান্য কাঁপতে লাগলো৷
অরিন্দম বলল, ‘‘কি হল, দাঁড়িয়ে রয়েছিস কেন তৃষিত? চল দেরি করিস না৷ মাকুরির পেছন পেছন আমাদের যেতে হবে৷ সময় আর বেশি নেই৷ পৌনে বারোটা বেজে গেছে কিন্তু!’’
মাকুরি খুব সাবধানে হাঁটছিল৷ তার পেছনে অরিন্দম আর আমি, আর একদম পেছনে গুইতে৷ গুইতে’র কোমরে ছুরি তো আছেই, আজ ও সঙ্গে একটা বর্শাও নিয়েছে৷
আমরা যতটা সম্ভব সাবধানে শব্দহীন ভাবে পা ফেলছিলাম, তবু যে সামান্য আওয়াজ উৎপন্ন হচ্ছিলো, সেটাই যেন হাজার গুণ হয়ে কানে এসে লাগছিল৷
মাকুরি কিছুটা সোজা গিয়ে বাঁ দিকে বেঁকল৷ আমরাও ওর পিছু পিছু বাঁ দিকে বেঁকলাম৷ গাছপালা এখানে আরো গভীর৷ আমি কোমরে একটা মাফলার বেঁধে এসেছিলাম, সেটাকেই এখন মুখে ভালো করে বেঁধেছি৷ যেভাবে চারপাশে সরু সরু ডাল এদিক সেদিক বিছিয়ে রয়েছে, কিছু একটা ফুটে গেলে রক্তারক্তি হয়ে যাবে৷ সারা মুখ ঢেকে চোখদুটোকে কোনোমতে বের করে হাঁটতে হচ্ছে৷
অরিন্দম তড়বড় করে হাঁটছিল৷ কয়েকদিন ধরে ওর খিঁচিয়ে থাকাটা যেন আজ বিকেল থেকে আরো বেড়েছে৷ সাধারণ কথার উত্তরও উত্তপ্ত স্বরে দিচ্ছে৷
কিন্তু এমনিতে ওর ওপর যতই বিরক্ত হই না কেন, অরিন্দমকে আমি খুব ভালোবাসি৷ আমার নিজের কোনো ভাইবোন বা দাদাদিদি নেই৷ ছোট থেকে একসাথে বড় হতে হতে অরিন্দম আমার নিজের ভাই-ই হয়ে গেছে৷ ওর রাগ-দুঃখ সবই আমি বুঝি৷ এটাও বুঝতে পারছি কোনো একটা কারণে ও খুব দোলাচলে আছে, সেটা প্রকাশ করতে পারছে না বলেই অস্বস্তিটা বদমেজাজের খোলস পরে প্রকাশ পাচ্ছে৷
ও কি কিছু লুকোচ্ছে আমার থেকে? সকালে গুইতে’র সঙ্গে কোথায় গেল, এসে সে’ব্যাপারে কিছু বলল না৷ আমি জিজ্ঞেস করতেও এড়িয়ে গেল৷ তারপর বিদেশি চ্যানেলের ওই পনেরো হাজার ডলারের ব্যাপারটাও আমায় ভাবাচ্ছে৷
জানি না ওর মনে কি চলছে, কিন্তু ওর ভালোমন্দর দায়িত্ব একরকম আমারই৷ কাকিমা মানে অরিন্দমের মা একেই অসুস্থ স্বামী আর ছোটছেলেকে নিয়ে নাজেহাল, তার ওপর অরিন্দমের কোনো ক্ষতি হলে আমি মুখ দেখাতে পারব না৷
আমি হাঁটতে হাঁটতে অরিন্দমের কাঁধে মৃদু টোকা দিলাম, ‘‘ওই?’’
‘‘কি হল?’’ অরিন্দম যথারীতি রুক্ষস্বরে জবাব দিল৷
‘‘বলছি, এটা যদি একটা ফাঁদ হয়?’’ বাংলায় বললাম আমি৷
‘‘ফাঁদ? কীসের ফাঁদ?’’ অরিন্দম খর চোখে আমার দিকে তাকাল৷ চোখটা যেন মুহূর্তে সাদা হয়ে গেছে৷
‘‘ধর, মাকুরি ছেলেটা যদি এইভাবে ইচ্ছে করে আমাদের জেসুমি’দের হাতে ধরিয়ে দেওয়ার ফন্দি করে?’’
‘‘ওর আমাদের ধরিয়ে দিয়ে কী লাভ?’’ অরিন্দম বেজার মুখে বলল, ‘‘ও তো নিজেই পালিয়ে বেড়াচ্ছে! তোর মতো মাথামোটা আমি একটাও দেখিনি৷’’
কেন জানি না, আমার কানে ‘মাথামোটা’ কথাটা খট করে এসে লাগলো৷ বন্ধুদের মধ্যে ইয়ার্কি, ফাজলামি করে বলা একরকম, কিন্তু ওর বলার ভঙ্গিটা এমন ছিল যে আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, অরিন্দম যেন শুধুমাত্র এই ‘মাথামোটা’ শব্দটার মধ্যে দিয়ে আমার দিকে ছুঁড়ে দিল একরাশ তাচ্ছিল্য আর অবজ্ঞা৷
ওর কি গুরুতর কিছু হয়েছে? আমি আর কথা বাড়ালাম না, এখান থেকে ভালোয় ভালোয় সব কাজ সেরে কলকাতায় ফিরে ওকে নিয়ে ভালো করে বসতে হবে৷ বাড়ির লোকেদের ছেড়ে এতদিন এই বনেবাদাড়ে থেকে থেকে মনে হয় ওর মধ্যে একটা অবসাদ চেপে বসছে৷
এরই মধ্যে মাকুরি হঠাৎ কেমন উবু হয়ে দাঁড়িয়ে থেমে গেল, ফিসফিস করে বলল, ‘‘এসে গেছি৷ চুপ৷’’
অরিন্দম বলল, ‘‘কই?’’
‘‘চু-উ-প!’’ মাকুরি ঠোঁটের ওপর আঙুল দিয়ে সামনের বিশাল বিশাল পাতা ছড়ান গাছটা অল্প করে ফাঁক করলো৷
মুহূর্তে অন্ধকার ছিঁড়ে একটা ক্ষীণ আলো চোখে এসে লাগল আমার৷
আমি, অরিন্দম আর গুইতে মাকুরির এদিক ওদিক দিয়ে উঁকি দিলাম সেই পাতাগুলোর ফাঁক দিয়ে৷
কয়েক মুহূর্ত লাগল এতক্ষণের অন্ধকার শেষে চোখদুটোকে একটু সইয়ে নিতে, তারপর চারপাশের বুনো পরিবেশে একটু দূরের দৃশ্যটাকে হূদয়ঙ্গম করতে পারার সাথে শিরদাঁড়া দিয়ে একটা হিমকুচি নেমে গেল যেন৷
মুহূর্তে সকালে মাকুরির বর্ণনাটা মনে পড়ে গেল৷
এখান থেকে প্রায় একশো ফুট দূরে যে সমতল জায়গাটা রয়েছে, অন্ধকারে ভালো বুঝতে না পারলেও সেটাই যে মাকুরির বলা চাতাল, তা অনুমান করতে অসুবিধা হল না৷
আমরা একটু দেরি করে ফেলেছি৷ উবশু করার আগের নাচগান হয়ে গেছে বোঝা যাচ্ছে৷ চাতালটা ঘিরে রয়েছে প্রায় শ’খানেক মানুষ৷ কয়েকজন অন্তর অন্তর একজন করে হাতে উঁচু করে ধরে রয়েছে মশাল৷ সেই মশালের গনগনে আলোয় সুবিশাল সেই বাঁকানো চাঁদের মতো বঁটিটা দেখতে পেলাম আমি৷
ভালো করে দেখার আগেই আমাদের ঠেলেঠুলে অরিন্দম এগিয়ে এল, ও ক্যামেরায় টেলিলেন্স লাগিয়েই রেখেছিল৷ এই লেন্সে বহুদূর পর্যন্ত জুম করা যায়৷ চোখের সামনে ক্যামেরা ফোকাস করে ছবি তুলতে লাগল৷
আমার বুকটা কেমন হিম হয়ে যাচ্ছিল আসন্ন ঘটনার কথা ভেবে৷ ছোটবেলায় মেলায় গিয়ে একধরনের বিশাল বিশাল নৌকো চড়তাম, প্রথমে নৌকোগুলো অল্প অল্প দুলতো, তারপর এদিক ওদিক প্রচণ্ড জোরে আসত যেত, অনেকটা সরল দোলগতির মতো৷ একটা দিকে অনেকটা উপরে উঠে গেলে নৌকোটার যেমন শেপ হয়, ঠিক তেমনভাবে বসান আছে বঁটিটা৷
কত মহিলাকে যে কী এই বঁটিতে কাটা হয়েছে কোনো ইয়ত্তা নেই৷
অরিন্দম ছবি তুলতে ব্যস্ত, মাকুরি গাছের লতাপাতাগুলোকে এমন ভাবে হাত দিয়ে ধরে রেখেছে যাতে আমরা দেখতেও পাই, আবার ঝট করে কোনো শব্দও না হয়৷
আমি গুইতে’র দিকে তাকালাম, ‘‘ভয় করছে নাকি গুইতে?’’
গুইতে’র চোখদুটো কেমন অস্বাভাবিক লাল, আমার চোখের দিকে তাকাল না ও, বিড়বিড় করে কি একটা বলে চুপ করে গেল৷
আমিও আর কথা না বাড়িয়ে সামনের দিকে তাকালাম৷
ওই তো! ওই তো একটা মহিলাকে নিয়ে আসা হচ্ছে৷ মাকুরি আগেই বলেছিল, জেসুমি মহিলারাও পুরুষদের মতো শুধু নিম্নাঙ্গে পাতা জড়িয়ে রাখে৷ দূর থেকে মহিলার বয়স খুব ভালোমতো বোঝা না গেলেও নেশার ভারে সে যে সম্পূর্ণ মদমত্ত, তার মাথার লম্বা লম্বা চুলগুলো যে তার ভয়ানক গতিতে মাথা দোলানোর সাথে সাথে দুলছে, তা বুঝতে পারছিলাম৷
সহজাত কারণেই চোখ চলে গেল তার উন্মুক্ত স্তনের দিকে, সে’দুটো মাংসল পিণ্ড চুলের মতোই বেপরোয়াভাবে এদিক ওদিক দুলছে, আমি অনুভব করলাম একজন পুরুষ হয়েও এই দৃশ্য দেখে উত্তেজিত হওয়া তো দূর, আতঙ্কে বিবমিষায় আমার মাথা ঝিমঝিম করছিল৷
মহিলাটির মুখে কিছু তরল ঢালা হচ্ছে এবার, সেই তরল চুইয়ে চুইয়ে তার চোখ, নাক, ঠোঁট পেরিয়ে স্তন, নাভিদেশ হয়ে নামছে৷ আমার মনে পড়ল মাকুরির কথা, কুকুরের রক্ত!
আশপাশে সবাই বিজাতীয় ভাষায় কিছু একটা সুর করে বলছে৷ একটা অদ্ভুত বাজনার শব্দ আসছে, ঠিক সুরেলা নয়, কেমন যেন খ্যানখেনে তবলার মতো৷ এটাই কি মোষের শিং বাজানোর আওয়াজ?
আমার সামনেই অরিন্দম তন্ময় হয়ে ভিডিও করছে৷ ক্যামেরাটা দামি হলেও ভিডিও কোয়ালিটি এতদূর থেকে তাও আবার মশালের আলোয় কতটা ভালো আসবে জানি না৷ মোহিত হয়ে দেখছিলাম, হঠাৎ জামায় একটা শক্ত টান অনুভব করতে চমকে উঠে তাকালাম৷
আশ্চর্য! গুইতে দেখি ঠোঁটে আঙুল দিয়ে আমাকে ইশারায় কিছু বলছে৷
গুইতে আবার আমায় কি বলতে চাইছে এইভাবে?
আমি বিস্মিত চোখে কানটা ওর মুখের কাছে নিয়ে যেতেই গুইতে আড়ষ্টভাবে বলল, ‘‘টিশিট স্যার, আ-আপনি বঁটির দিকে ঝুকবেন না!’’
কথাটা বলেই ও চুপ করে গেল৷
আমি মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারলাম না৷ কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে যেতেই গুইতে আমার মুখ চাপা দিয়ে সামনের দিকে ঘুরিয়ে দিল৷ অরিন্দম আর মাকুরি রয়েছে সামনের দিকে, ওরা কিছু টেরও পেল না৷
আর তক্ষুনি সেই গা হিম করা ঘটনাটা ঘটল৷
হঠাৎ শিং বাজানোর আওয়াজ আর ওদের সেই উল্লাস চরমে পৌঁছতেই ভিড়টা আরো জমাট বাঁধতে লাগল, ভিড়ের মধ্যিখানের গোল জায়গাটা স্বাভাবিকভাবেই আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম না৷ কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই দেখলাম, সেই রক্তমাখা মহিলাটিকে কেউ যেন ওই মাঝখান থেকে একটু উঁচু করে ছুঁড়ে দিল লম্বালম্বি দাঁড়ানো সেই বঁটির ওপর৷ মুহূর্তের মধ্যে তার শরীরটা কেটে দ্বিখণ্ডিত হয়ে পড়ল ওইপাশে৷
আমার মাথাটা যেন বোঁ করে ঘুরে গেল৷ পড়ে যেতে যেতেও গুইতে’র কাঁধ ধরে টাল সামলালাম৷
ওদিকে অরিন্দম বলে উঠল, ‘‘শিট!’’
‘‘কি হল স্যার?’’ গুইতে জিজ্ঞেস করলো৷
‘‘কেটে ফেলার ভিডিওটাই তো তোলা গেল না!’’ আফসোসের ভঙ্গিতে চাপা গলায় গর্জে উঠল অরিন্দম, ‘‘সব ক’টা এমন ভাবে গার্ড হয়ে গেল!’’
‘‘আরে ঠিক আছে, যা তুলেছিস, তাতেই বনশল চেয়ার ছেড়ে উল্টে পড়ে যাবে আনন্দে৷’’ আমি বললাম৷ বুকের ভেতরটা তখনো কেমন করছে৷
ওদিকে ভিড় পাতলা হয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে৷ সবাই উবু হয়ে বসে কিছু একটা জিনিস নিয়ে নাড়াঘাঁটা করছে৷
জিনিসটা কী, সেটা বুঝতে আমার বিন্দুমাত্র কষ্ট হল না৷ গলার কাছটা কেমন শুকিয়ে উঠল আমার৷
অরিন্দমের কানে কথা গেল বলে মনে হয় না৷ ওর চোখ যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছিল৷ একনাগাড়ে ভিডিও রেকর্ড করে যাচ্ছিল ও৷
ভিড়টা আস্তে আস্তে পাতলা হতে শুরু করতেই দেখতে পেলাম দৃশ্যটা৷
একটা ছেলে, আমারই বয়সি, উবু হয়ে বসে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে মাংস৷ একদম কাঁচা মাংস৷ খেতে খেতে ছেলেটার মুখের দু’পাশের কষ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে টাটকা রক্ত৷
কিন্তু তাতে তার কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই৷ ছেলেটা একবার চিবোচ্ছে, পরের মুহূর্তেই আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করছে কিছু৷
পাশেই আরো ভয়ঙ্কর দৃশ্য৷ একটা বড় লাশ থেকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে আলাদা করা হচ্ছে হাড়গুলো, ছুঁড়ে ছুঁড়ে সেগুলো দেওয়া হচ্ছে একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা জেসুমিদের দিকে৷ তারা পুজোর নৈবেদ্য গ্রহণের মতো ঝুঁকে গ্রহণ করছে সেই হাড়গুলো৷
আমার মাকুরির মা’র হাড় সেদ্ধ করে জল খাওয়ার ব্যাপারটা মনে পড়ল৷ আর মনে পড়তেই আমি নিজের অজান্তে মাকুরির দিকে তাকালাম৷
মাকুরিও একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে৷ চোখের পাতা পড়ছে না৷ বিস্ফারিত মণি৷ ওর চোখে আমার মতোই হয়তো বিবমিষা, ভয়, আতঙ্ক সব একাকার হয়ে গেছে৷ ওর দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেওয়ার আগে আমার চোখ পড়ে গেল ওর মুখের দিকে৷ পূর্ণিমার চাঁদের আলো এই ঝোপের অন্ধকারে এসে পড়েনি৷
তবু ঠোঁটের দুপাশ দিয়ে কি গড়াচ্ছে ওটা? লালা? জিভটা সামান্য বের করে চেটে নিল মাকুরি৷
আমি দ্বিধাগ্রস্থ অবস্থায় সামনে তাকাতেই দেখলাম, ভিড় একদমই আর নেই৷ দলে দলে চলে যাচ্ছে সেই হাড় নিয়ে৷ ছেলেটাকে একটা বড় মাংসপিণ্ড দেওয়া হয়েছিল, সেটা তার খাওয়া প্রায় শেষ৷ বাকি অনেকটা রক্ত ঝরতে থাকা মাংস একটা গাছের পাতায় মুড়ে তুলে দেওয়া হচ্ছে ছেলেটার হাতে৷
আমার মনে পড়ল মাকুরির কথা৷ উবশু’র সময় যতটা পারবে খাবে, তারপর ওই মাংস একটু একটু করে শেষ করতে হবে ছেলেটাকে পরের দু-একদিন ধরে৷ কিন্তু মাংস যদি পচে যায় বা না খেতে পারে, তবে তা সাংঘাতিক অশুভ, জেসুমি উপজাতির বিশ্বাস তাতে মা তো শরীরের মধ্যে থাকবেই না, উল্টে অতৃপ্ত আত্মার মতো ঘুরে বেড়াবে গ্রামে, তাতে গ্রামের মধ্যে নেমে আসবে নানা দুর্বিপাক৷
অরিন্দম হঠাৎ বলে উঠল, ‘‘লেটস গো৷ কুইক!’’
আমি চমকে তাকিয়ে দেখলাম, চাতাল ফাঁকা হয়ে গেছে৷ সবাই চলে গেছে গ্রামের মূল বসতির দিকে৷
শেষ দু’জন রক্ষী হেঁটে চলে যাচ্ছে বাঁদিকে, গ্রামের ওইদিকের পাঁচিলে সম্ভবত৷
দুটো মশাল তখনো ধিকিধিকি জ্বলছে৷ উবশু’র পর দ্রুত চাতাল ফাঁকা করে দেওয়াটাও ওদের প্রথার অন্তর্গত, সারারাত নির্জন চাতালে শুধু মশাল জ্বলে, আর সেই বঁটি থেকে টুপটুপ করে রক্ত ঝরে পড়ে৷
আমি এতদূর থেকেও যেন দেখতে পেলাম ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝরে পড়ছে চাতালে৷ এখন শীতকাল নয়, তবু গুঁড়ো গুঁড়ো ভেজা কুয়াশা যেন ঝাপসা করে দিচ্ছে আমার চোখদুটোকে৷
অরিন্দম একটু দূর থেকে গর্জে উঠল, ‘‘হাঁ করে কী ভাবছিস তৃষিত? সময় বেশি নেই, জলদি চল! কেউ যদি একবার ভুলেও চলে আসে, তার আগেই কাজ সারতে হবে৷’’
‘‘কেউ আসবে না৷’’ মাকুরি বলল, ‘‘সারারাত এখানে কোনো জেসুমি আসে না, তাতে উবশু অপবিত্র হয়৷ তবু সাবধানের মার নেই৷’’
কাঁপা কাঁপা পায়ে আমরা জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এগিয়ে চললাম সেই চাতালের দিকে৷
বুকের মধ্যে দ্রিমি দ্রিমি ড্রাম বাজাচ্ছে কেউ, হাঁটু যেন চূড়ান্ত ভয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করে ভেঙে পড়তে চাইছে মাটিতে৷ তবু আমি প্রচণ্ড মনের জোরে এগিয়ে চললাম৷
চাতালের সামনে এসে উঁচু জায়গায় উঠতে গিয়ে অনুভব করলাম, পা যেন সহস্রগুণ ভারী একটা থামে পরিণত হয়েছে, কিছুতেই তুলতে পারছি না চাতালে৷ অরিন্দম বুঝতে পেরে জোর করে আমাকে ঠেলে উঠিয়ে দিল৷
বঁটির একদম কাছাকাছি এসে আমরা চারজন দাঁড়ালাম৷
ওপরে তখন একফোঁটা মেঘও নেই যে পূর্ণিমা চাঁদের সাদা মাখনের মতো জ্যোৎস্নাকে আড়াল করে৷ পূর্ণচন্দ্রালোকে আমরা, তথাকথিত সভ্যজগতের প্রতিভূরা কতক্ষণ নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম জানি না, হঠাৎ অরিন্দম বলল, ‘‘দাঁড়িয়ে থেকে সময় নষ্ট করলে চলবে না৷ মশাল দুটো এমনভাবে রেখে গেছে যে বঁটির পুরো ক্লিয়ার ছবি ক্যামেরায় আসছে না৷’’
কথাটা ঠিকই৷ মশাল দুটো বেশ খানিকটা দূরে দুটো ন্যাড়া কাণ্ডসর্বস্ব গাছের ওপর আটকানো রয়েছে, তাতে বঁটিটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না৷ বঁটি থেকে চুইয়ে পড়া রক্ত, কিংবা চাতাল ভর্তি মাখামাখি হয়ে থাকা রক্তও অতটা দূরের আলোয় ক্যামেরায় ধরা পড়বে না৷
অরিন্দম আদেশের সুরে বলল, ‘‘গুইতে আর মাকুরি তোমরা দুজনে বঁটির দুদিকে মশাল দুটো নিয়ে দাঁড়াও, আর তৃষিত, তুই বঁটির সামনে দাঁড়িয়ে আঙুলে করে বঁটি থেকে একফোঁটা রক্ত তুলবি, তুলে ক্যামেরার সামনে দেখাবি, কেমন?’’
আমি আড়ষ্ট হয়ে বললাম, ‘‘ওই রক্তে হাত দিতে হবে?’’
অরিন্দম মৃদু ধমকের সুরে বলল, ‘‘তা হাতে নিয়ে না দেখালে কি করে লোকে বুঝবে ওটা রক্ত? বঁটির কালো পাত থেকে অত ভালো করে কিছু বোঝা যাবে নাকি? তুই ভয় পেলে বল … আমি দাঁড়াচ্ছি, তুই ভিডিওটা কর না হয়!’’
আমার ছবি বা ভিডিও তোলার হাত যে জঘন্য, তা আমার চেয়ে অরিন্দম ভালো করে জানে৷ আলো বা কভারেজ সেন্স বলতে গেলে আমার একদমই নেই৷ এত হাঙ্গামা করে প্রাণ হাতে করে এসে যদি ঠিকমত ভিডিওটাই না ওঠে, সবই তো বেকার হয়ে যাবে৷ আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম, ‘‘না না ঠিক আছে৷ আ-আমিই দাঁড়াচ্ছি৷’’
থরো থরো পায়ে আমি বঁটিটার একদম সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম৷ আমার ঠিক দুপাশে বঁটির দু’দিকে মশাল নিয়ে দাঁড়াল গুইতে আর মাকুরি৷
অরিন্দম ক্যামেরা নিয়ে চলে এল ঠিক আমার মুখোমুখি, ‘‘আর একটু এই দিকটা আয়, আর একটু, হ্যাঁ, একটু ডানদিক চেপে যা, ব্যাস, পারফেক্ট!’’
আমি নড়াচড়া করে অরিন্দমের জায়গামতো দাঁড়াতে অনুভব করলাম, মাত্র ঘণ্টাখানেক আগে এই জায়গাতেই, হ্যাঁ, ঠিক এই জায়গাতেই দাঁড়িয়েছিল এতক্ষণে ছেলের উদরস্থ হওয়া মহিলাটা৷
আমি অবসন্নভাবে বললাম, ‘‘তা, তাড়াতাড়ি তোল৷’’
অরিন্দম ফোল্ডেড স্ট্যান্ডটা বসিয়ে তার ওপর ক্যামেরা সেট করে ভিডিও অন করল, তারপর কেমন যেন একটা অদ্ভুতভাবে আমার দিকে তাকাল৷ পরক্ষণেই চাপাস্বরে চেঁচিয়ে উঠল, ‘‘হো-ই-ই-ঈ!’’
নাগামিজ ভাষায় হোই মানে যে ‘এইবার’ সেটা বুঝতে পেরে আমি কিছু জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু তার আগেই যেটা ঘটল, সেটার সঠিক বর্ণনা করার সাধ্য আমার নেই৷
অরিন্দমের ‘হোই’ এর সঙ্গে সঙ্গে মাকুরি ডানপাশ থেকে বজ্রমুষ্টিতে চেপে ধরল আমায়, উঁচু করে ধরে ঠেলে ফেলে দিতে চাইল ওই বঁটির ওপর আচমকা৷ আমি হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিলাম, শুধু ওই কয়েক মাইক্রোসেকেন্ডে অনুভব করতে পারছিলাম, আমি পড়ে যাচ্ছি, পড়ে যাচ্ছি বঁটির ওপর, আর দু-এক মুহূর্তের মধ্যেই দু’ভাগ হয়ে যাবে আমার শরীরটা!
ঠিকরে বেরিয়ে আসা চোখে দেখতে পাচ্ছিলাম আমার ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অরিন্দম, আমার ছোটবেলার সাথি অরিন্দম, আমার প্রিয় বন্ধু অরিন্দম, আমার ভাতৃসম প্রাণের সঙ্গি অরিন্দম নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে, তার হাতদুটো আড়াআড়ি বুকের ওপর ভাঁজ করা, মুখে নিষ্ঠুর হাসি৷
ওইটুকুর মধ্যেই ঘটে গেল আরো এক অদ্ভুত ঘটনা৷ বঁটির ওপর আমি প্রায় পড়ে গেছি, ঠিক তার আগেই শূন্য থেকে কেউ যেন তুলে নিল আমাকে৷ ভয়ে অজ্ঞান হতে হতে আমি দেখতে পেলাম গুইতে ওর হাতের মশালটা দিয়ে সজোরে আঘাত করলো মাকুরির মুখে, তার পরমুহূর্তেই ঝুঁকে পড়ে অরিন্দমের মাথায়৷
জ্ঞান হারানোর ঠিক আগের মুহূর্তে শুনতে পেলাম কারা যেন রে রে করে ছুটে আসছে, ঘিরে ফেলছে আমাদের৷
আমি রক্তমাখা চাতালের ওপর আছড়ে পড়ে জ্ঞান হারালাম৷
**********
জ্ঞান যখন হল, তখন প্রথমে সব কিছু কেমন ঝাপসা লাগছিল৷ তারপর আস্তে আস্তে দেখি আমার মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে কেউ ব্যগ্রভাবে কিছু দেখছে৷
কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারলাম, লোকটা গুইতে৷ আমার জ্ঞান ফিরতে দেখে ওর মুখ চোখ ঝলমল করে উঠল৷
আমি ধড়মড় করে উঠে বসতে চেয়েও পারলাম না, সারা গায়ে অজস্র ব্যথা৷ হতবুদ্ধির মতো তাকালাম গুইতে’র দিকে, ‘‘গুইতে! আমি কোথায়?’’
গুইতে বলল, ‘‘টিশিট স্যার, আপনি খো আং, এর বাড়িতে৷’’
‘‘খো আং-এ? খো আং-এ কি করে এলাম? আমরা তো…আমরা তো গিয়েছিলাম জেসুমিদের গ্রামে!’’ আমার সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল, তবু আমি প্রাণপণে মনে করতে চেষ্টা করছিলাম৷
জেসুমিদের সেই বীভৎস বঁটি, সেই বঁটির সামনে আমি…অরিন্দম ক্যামেরার সামনে…মাকুরি হঠাৎ…!
আমি চমকে তাকালাম, ‘‘অরিন্দম? অরিন্দম কোথায়?’’
গুইতে একটু থামল, তারপর বলল, ‘‘কাল রাতে অরিন্দম স্যার আমাকে আর মাকুরিকে হাত করে আপনাকে ওই বঁটিতেই ফালাফালা করতে চেয়েছিলেন৷’’
‘‘কেন?’’ আমি প্রায় চেঁচিয়ে উঠলাম৷ আমার মনে পড়ে গেল আমার বঁটির ওপর পড়ে যাওয়ার মুহূর্তে ওর মুখের ক্রুর হাসিটা৷
‘‘অরিন্দম স্যারের আপনার ওপর ভীষণ রাগ ছিল টিশিট স্যার৷ কাল সকালে আমাকে আর মাকুরিকে নিয়ে গিয়ে উনি বুঝিয়েছিলেন কিভাবে ছোট থেকে আপনারা দুজনে একসাথে বড় হলেও আপনার ওপর ওঁর হিংসা একটু একটু করে বেড়েছিল৷’’
আমি হাঁ হয়ে যাচ্ছিলাম শুনতে শুনতে, ‘‘হিংসা? অরিন্দমের? আমার ওপর?’’
‘‘হ্যাঁ৷’’ গুইতে মাথা নাড়ল, ‘‘আপনি সোজাসরল, অত তলিয়ে ভাবেননি কখনো, আপনারা খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু হলেও অরিন্দম আপনাকে হিংসা করতেন, আপনার ব্যবহারের জন্য সবাই আপনাকে ওঁর চেয়ে বেশি পছন্দ করতেন, এতে ওঁর হিংসা হত৷ উনি এও বুঝেছিলেন যে ওই এন জি ও শেষমেশ আপনাকেই পার্মানেন্ট করবে, ওঁকে নয়৷ তাই আপনাকে সরিয়ে দিতে পারলে ওর চাকরি পাকা হয়ে যাবে৷ এর সাথে এসে মিশেছিল টাকার লোভ৷’’
‘‘টাকার লোভ? কিসের টাকা?’’ আমার বিস্ময় উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছিল৷
‘‘ওই বিদেশি চ্যানেলের৷ অরিন্দম স্যার নিজে ওদের সাথে যোগাযোগ করেছিলেন, ওরা জেসুমি’দের ওই ফুটেজ বাবদ পনেরো হাজার ডলার দাম দেয়৷ অরিন্দম স্যার জানতেন, আপনি এতে বাধা দেবেন, কারণ এতে ওই এন জি ও’র প্রতি আপনাদের বিশ্বস্ততা নষ্ট হবে৷ অরিন্দম স্যারের আরো ভয় ছিল, আপনাকে ওই টাকার আধাআধি দিতে হবে৷ সেইজন্য উনি এমন প্ল্যান করেছিলেন যাতে এক ঢিলে দুই পাখি মারা যায়৷ একদিকে উনি ওই চ্যানেলকে ফুটেজগুলো বিক্রি করে পুরো টাকাটাই গাপ করবেন, অন্যদিকে এন জি ও অফিসে জানাবেন আপনি ওই চ্যানেলকে বেআইনিভাবে ফুটেজ বিক্রি করার লোভে পড়ে নিজের দোষেই প্রাণ দিয়েছেন ওদের হাতে৷ একদিকে উনি টাকাও পাবেন, অন্যদিকে এন জি ও’ও ওঁর চাকরিটা পাকা করবে৷’’
‘‘কাল সকালে আমাকে আর মাকুরিকে নিয়ে গিয়ে বুঝিয়েছিলেন কিভাবে প্ল্যান করে আপনাকে ওই বঁটির ওপরেই কেটে মারা হবে৷ ওইভাবে মেরে চলে এলে জেসুমি’রা ছাড়া কেউ জানতেও পারবে না খুনের কথা৷ ওরা তো আর সভ্যজগতে কাউকে বলবে না, আর অরিন্দমস্যারও গিয়ে রটিয়ে দেবেন আপনি বেশি সাহস দেখাতে গিয়ে নিজেই নিজের প্রাণ দিয়েছেন ওদের হাতে৷’’ গুইতে মাথা নীচু করলো, ‘‘আমাকে দেখিয়েছিলেন টাকার লোভ আর মাকুরিকে নরমাংসের৷’’
‘‘নরমাংসের? মানে?’’ আমি স্তম্ভিত হয়ে যাচ্ছিলাম৷
গুইতে বলল, ‘‘মাকুরি আমাদের বলেছিল ও ওর মা’র মাংস খেতে পারবে না বলে পালিয়েছিল জেসুমিদের গ্রাম থেকে৷ কিন্তু এটা বলেনি যে, নিজের মায়ের মাংস হয়ত ওর খেতে আপত্তি ছিল, কিন্তু জেসুমি’রা নরমাংস অহরহই খায়৷ এর আগে কোনো বিদেশি জেসুমিদের গ্রামে গিয়ে কোনো বাজে কাজে ধরা পড়লে তারও ওই দশাই হয়েছে৷
‘‘ছোট থেকে জেসুমি গ্রামে থাকতে থাকতে মাকুরিও একজন নরমাংসলোভি হয়ে উঠেছিল৷ সবচেয়ে বড় কথা মারাং এর মা’র উবশু’র দিন মাকুরি কিন্তু শুধুই মা’কে খাওয়ার ভয়ে পালিয়ে আসেনি৷ ওর ওপর এতটাই খাপ্পা হয়ে উঠেছিল জেসুমি’রা, ও নিজেই পালিয়ে এসেছিল ভয়ে৷’’
‘‘খাপ্পা হয়ে উঠেছিল কেন?’’ আমি দুর্বল গলায় বললাম৷
‘‘জেসুমিরা এমনিতে নরমাংস খায়৷ কিন্তু উবশু উৎসবে মারাং এর মা’র মাংস শুধু মারাং এর নিজেরই খাওয়ার নিয়ম ছিল৷ কিন্তু সেটা লোভের চোটে লুকিয়ে খেয়ে ফেলেছিল মাকুরিও৷ সেটা উবশু প্রথায় ভয়ঙ্কর অপরাধ৷ গোটা জেসুমি জাতি ক্ষেপে গিয়েছিল ওর ওপর, প্রাণের দায়ে তাই ও পালিয়েছিল সেদিন৷’’ গুইতে বলে চলেছিল, ‘‘এটা লোথা গ্রামে কেউ জানতো না৷ কাল অরিন্দম স্যার প্রথমে আমাদের দুজনকেই যখন প্রচুর টাকার অফার করলেন, মাকুরি দুম করে বলে বসেছিল, টাকা নয়, ও আপনার মাংস খেতে চায়৷ আমি তো শুনে অবাক৷ পরে বুঝতে পারি, আসলে নিজেদের গ্রাম ছেড়ে অপেক্ষাকৃত সভ্য লোথা গ্রামে চলে এলেও নরমাংসের ওপর লোভ মাকুরি’র যায়নি৷ আপনাকে দিয়েই ও সেই লোভ নিবারণ করবে ভেবেছিল৷
আমার চট করে মনে পড়ে গেল, দূরে নরমাংসভোজ দেখে মাকুরির ঠোঁটের দু’পাশ দিয়ে লালা গড়ানোর কথা৷
‘‘আর আমাকে দেখিয়েছিল পঞ্চাশ হাজার টাকার লোভ৷’’ গুইতে একটা শ্বাস ফেলে হাসল, ‘‘হ্যাঁ আমি টাকা চিনি৷ টাকার জন্য আমি অনেক কিছু করতে পারি৷ তাই বলে টাকার জন্য জলজ্যান্ত একটা ভালোমানুষকে মেরে ফেলব? অরিন্দম স্যার আমাকে এতটা খারাপ কি করে ভাবলেন জানি না৷ কাল সারাটা সকাল আমাদের প্ল্যান হয়েছিল কিভাবে আপনাকে মারা হবে, কিভাবে কিছুটা মাংস নিয়ে আমাদের সঙ্গেই পালিয়ে আসবে মাকুরি৷’’ গুইতে একটা লম্বা নিঃশ্বাস নিল, ‘‘কিন্তু শেষ মুহূর্তে আমি সব ভেস্তে দিলাম৷
‘‘তবে আগে থেকে ওদের সামনে কিচ্ছু প্রকাশ করিনি৷ কারণ আমি জানতাম আমি বাধা দিলে ওরা আমাকে বাদ দিয়েই কাজটা করবে৷ তার চেয়ে আমি সঙ্গে থেকে আটকাব, কাঁটা দিয়েই কাঁটা তুলব, সেটাই ভেবেছিলাম৷ কাল ওই চক্রান্তের পরই টুকটাক জিনিস কেনার নাম করে আমি চলে যাই সোজা জেসুমিদের ওই গ্রামে৷ জেসুমি’রা বিদেশিদের এড়াতে চায়, আমাদের মতো অন্য উপজাতির নাগাদের সাথে তেমন মেশে না৷ কিন্তু অকারণে দুর্ব্যবহার করে না৷ আমি গিয়ে কোনোমতে আকারে ইঙ্গিতে সব খুলে বলতেই ওদের গ্রামের পাহারাদাররা আমাকে নিয়ে গেল ওদের সর্দারের কাছে৷ মাকুরির কথা বলতেই সবাই চিনতে পারলো৷ আমি ওদের সবাইকে অনুরোধ করলাম, একটা ভালো মানুষের প্রাণ বাঁচানোর জন্য যদি ওরা সহযোগিতা করে৷ ওরা একটা শর্তেই রাজি হল৷’’ গুইতে এতক্ষণ একটানা বলে দম নিল, ‘‘মাকুরি আর অরিন্দমকে ধরার পর ক্যামেরা থেকে ভিডিও বা ছবি সব মুছে দিতে হবে৷ কোনোভাবেই যেন ওদের উবশু সভ্যজগতের কেউ দেখতে না পায়৷’’
‘‘তারপর?’’
‘‘তারপর অরিন্দম স্যার প্ল্যানমাফিক আপনাকে বললেন বঁটির একদম সামনে দাঁড়াতে৷ যাতে আমি আর মাকুরি দুদিক থেকে আপনাকে বঁটির ওপর ফেলে দিতে পারি৷ তাই হল৷ ‘হোই’ বলে ইশারা করতেই মাকুরি আপনাকে টেনে ফেলতে গেল বঁটির ওপর৷ কিন্তু আমিও তৈরি ছিলাম, মশাল দিয়ে জোরে মারলাম ওকে৷ দূরে জেসুমি’রা আমার কথামত অপেক্ষা করছিল, ছুটে এল ওরা সাথে সাথে৷’’ গুইতে বলল৷
আমার মুখে কথা সরছিল না৷
যে গুইতে’কে আমি অর্থপিপাসু ছাড়া কিছু ভাবতাম না, সে এত ঝুঁকি নিয়ে আমার প্রাণ বাঁচালো?
আর যার টাকার লোভ নেই ভেবে ভুল করেছিলাম সেই মাকুরি কিনা …! আর … আর আমার প্রাণের চেয়েও প্রিয়তম বন্ধু … সে? অরিন্দম পারলো এটা করতে? সামান্য ক’টা টাকা আর চাকরির জন্য? এত হিংসা? এত দ্বেষ ও জমিয়ে রেখেছিল আমার প্রতি?
আমি মুহ্যমান অবস্থায় কিছুক্ষণ থেকে বললাম, ‘‘ওরা কোথায়?’’
গুইতে বলল, ‘‘জেসুমিদের গ্রামে৷ ওদের আটকে রেখেছিল৷ এখন জানি না কি করবে ওদের নিয়ে৷ কাল রাতে একটা জেসুমি ছেলে আর আমি আপনাকে নিয়ে নৌকোয় ফেরত আসি খো আং ,এ৷ তারপর এখানে৷ ওদের সর্দারের আদেশমতো ছেলেটা আপনাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে তবে ফিরে গেছে৷’’
আমি গুইতে’র হাতদুটো ধরে বললাম, ‘‘তুমি না থাকলে …!’’
‘‘এভাবে বলবেন না টিশিট স্যার! আমি তেমন কিছুই করিনি৷ জেসুমি’রা না সাহায্য করলে আমি একা কি করে আপনাকে বাঁচাতাম বলুন?’’ গুইতে একটা নিঃশ্বাস ফেলল, ‘‘একদিকে ওরা হয়ত ওরকম বর্বর প্রথা পালন করে, কিন্তু অন্যদিকে সভ্যদের সাথে না মিশে ওরা ভালোই করে, দেখুন৷ ওরা কখনো পারবে নিজের বন্ধুকে এইভাবে মারার ষড়যন্ত্র করতে!’’
আমার চোখ দিয়ে অজান্তেই জল পড়তে শুরু করেছিল৷ সেই অশ্রু ঝরছিল বেঁচে যাওয়ার আনন্দে, না বন্ধুর এমন অকল্পনীয় প্রতারণার দুঃখে, আমি জানি না৷
কে সভ্য, কে অসভ্য তাও জানি না৷ যারা মা’কে নিজের মধ্যে লালন করার তাগিদে মেরে খেয়ে নেয়, অথচ অজানা অচেনা বিদেশির প্রাণ বাঁচানোর জন্য এমনভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তারা সভ্য? না যারা ওপরে আধুনিকতার, সহমর্মিতার খোলস পরে পেছন থেকে শেষ করে দিতে চায়, তারা সভ্য!
গুইতে চুপ করে বসেছিল৷ অনেকক্ষণ পরে বলল, ‘‘কিছু খাবেন স্যার? কাল রাত থেকে তো কিছু খাননি৷’’
আমি চমক ভেঙে বললাম, আমার সাথে একবার যেতে পারবে এখন গুইতে?’’
‘‘কোথায়?’’ গুইতে বিস্মিত৷
আমি দুর্বল হলেও উঠে দাঁড়ালাম, বললাম, ‘‘জেসুমিদের গ্রামে৷’’
‘‘আবার? কেন?’’
‘‘তুমি চলোই না৷’’ আমি গুইতে’র উত্তরের অপেক্ষা না করে কুঁড়েঘর থেকে বেরিয়ে এলাম৷ ছটফট করছিলাম ভেতরে ভেতরে৷
ছোটবেলায় সংস্কৃতে পড়েছিলাম,
উৎসবে ব্যসনে চৈব দুর্ভিক্ষে রাষ্ট্রবিপ্লবে
রাজদ্বারে শ্মশানে চ য তিষ্ঠতি স বান্ধবঃ
বন্ধুর বিপদে আপদে যে পাশে দাঁড়ায় সে-ই আসল বন্ধু৷ করুক সে ভুল, করতে চাক সে ক্ষতি, তাকে পাল্টানোর দায়িত্ব তো আমারই!
অরিন্দমকে ফিরিয়ে এনে ভালো মানুষ, হিংসাবর্জিত মানুষ তো আমাকেই করে তুলতে হবে!
—