ভারতনাট্যম / মাসুদ রানা ভলিউম-১ (অসংক্ষেপিত সংস্করণ) / কাজী আনোয়ার হোসেন / সেবা প্রকাশনী
প্রথম প্রকাশ: ১৯৬৬
.
০১.
৩০ আগস্ট, ১৯৬৫।
‘এবারে কথক নৃত্য পরিবেশন করছেন শ্রীমতী মিত্রা সেন।
ঘোষকের মিষ্টি গম্ভীর কণ্ঠস্বর ভেসে এল। সঙ্গে সঙ্গেই গিজগিজে ঠাসা প্রকাণ্ড হলঘরের প্রচণ্ড কোলাহল মৃদু গুঞ্জনে পরিণত হলো। হল কাঁপিয়ে বেজে উঠল তবলার তেহাই।
তিক ধা ধিগি ধিগি থেই/তিক ধা ধিগি ধিগি থেই/
তিক ধা ধিগি ধিগি/
ধা ধিন ধিন ধা/ধা ধিন ধিন ধা/না তিন তিন না/
তেটে ধিন ধিন ধা/…
একটা একটা করে সব বাতি নিভে গেল হলের মধ্যকার। স্তব্ধ প্রতীক্ষায় উন্মুখ হয়ে উঠল দর্শকবৃন্দ। নিশ্চুপ হয়ে গেল মস্ত হলঘরটা।
কালো স্ক্রিন সরে যেতেই প্রথমে লাল, পরে হালকা নীল আলো ঝিলমিল করতে থাকল ঢেউ খেলানো সিল্কের সাদা পর্দার উপর। তারপর সে পর্দাও দু’ফাঁক হয়ে সরে গেল ধীরে ধীরে। দেখা গেল নমস্কারের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে কলকাতার সাংস্কৃতিক শুভেচ্ছা মিশনের সর্বশ্রেষ্ঠ আকর্ষণ, অতুলনীয়া সুন্দরী নর্তকী শ্রীমতী মিত্রা সেন। স্পট লাইটের স্বপ্নিল আলো একটা মায়াবী পরিবেশ সৃষ্টি করেছে মিত্রা সেনকে ঘিরে। উদ্ভিন্ন যৌবনাক্ষীণ কটি-কাজল-কালো হরিণ চোখ। এক শ্রেণীর দর্শকদের মধ্য থেকে একটা আধা-অশ্লীল উল্লাস ধ্বনি উঠেই মিলিয়ে গেল।
তা তে থেই তাত/আ তে থেই তাত থেই আ থেই আ থেই/
থেই থেই তাত তাত থা/তেরে কেটে গদি ঘেনে ধা আ/
তেরে কেটে গদি ঘেনে ধা আ/তেরে কেটে গদি ঘেনে/
ধা ধিন ধিন ধা/ধা ধিন ধিন ধানা তিন তিন না/
তেটে ধিন ধিন ধা/…)
আরম্ভ হলো নাচ। শতকরা নব্বই জন দর্শকই সেই মুহূর্তে মনে মনে স্থির করল, যে করে হোক আগামী দিনের টিকেট জোগাড় করতে হবে–ব্ল্যাকে দশগুণ দাম দিয়ে হলেও।
হলঘরের অসহ্য ভ্যাপসা গরমে ফটোগ্রাফারের জন্যে নির্দিষ্ট আসনে বসে ঘামছে মাসুদ রানা। আর মনে মনে পিণ্ডি চটকাচ্ছে ঢাকায় এয়ারকণ্ডিশণ্ড-রুমে সুখে নিদ্রামগ্ন পাকিস্তান কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের কর্ণধার মেজর জেনারেল রাহাত খানের। যত সব রদ্দি পচা কাজের ভার বুড়ো বেছে বেছে ওর কাঁধে চাপায়। কেন? আর লোক নেই? ইণ্ডিয়ার নাম শুনলেই একেবারে যেন বাই চড়ে যায়। বুড়োর মাথায়। ডন কুইকজোটের মত খেপে গিয়ে হাওয়ায় তলোয়ার ঘোরাতে আরম্ভ করে দেয় একেবারে।
আরে বাবা, একদল ন্যাকা মেয়েছেলে আর তাদের সঙ্গে মেয়েলী স্বভাবের মিনমিনে কতকগুলো ননীর পুতুল পুরুষ এসেছে কলকাতা থেকে গায়ক-গায়িকা নর্তক-নর্তকী সেজে। এদের মধ্যে তাকে ঢোকাল বুড়ো কোন আক্কেলে? তাও যদি জার্নালিস্ট বা অন্য কোনও পরিচয় হত তো এক কথা। তা নয়। তার কাজ কী?–না ফটোগ্রাফি। এখন যে গরম লাগছে, তার কী হবে? পচা গরমে ঘামতে ঘামতে হঠাৎ পা থেকে মাথা পর্যন্ত জ্বলে উঠল রানার। সব রাগ গিয়ে পড়ল। রাহাত খানের উপর। দু’মিনিটের চেষ্টায় অনেক কষ্টে জোর করে দূর করে দিল। রানা মন থেকে সব বিক্ষোভ।
ভাদ্রের প্রায় মাঝামাঝি। শরৎ কাল। কিন্তু এবারের শরৎ যেন গুমোট ভাবটা কাটিয়ে উঠতে পারছে না। প্রিয়ার আঁখির মত নীল আকাশ, পুঞ্জ পুঞ্জ সাদা মেঘের অক্লেশে হাওয়ায় ভেসে যাওয়া, মাঝে মাঝে উত্তর থেকে অনেক স্মৃতি জাগিয়ে তোলা নীলুয়া বাতাস, সন্ধ্যেবেলায় পুজোর ঘণ্টা, শিউলির জমাট সুগন্ধ, আমেজ–সবই আছে। কিন্তু গরমটা যেন চেপে বসেছে গদির উপর; নড়বে না কিছুতেই।
তার উপর সিগারেটের ধোঁয়া আর এতগুলো লোকের আড়াই ঘণ্টা ধরে। অবিরাম নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসে ভারী হয়ে উঠেছে রাজশাহী টাউন হলের বদ্ধ বাতাস। কতক্ষণ আর সহ্য করা যায়? চোখ দুটো অল্প অল্প জ্বালা করছে রানার। সম্মোহিত দর্শকবৃন্দের দিকে একবার নির্লিপ্ত দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়াল ও। একটা থামের গায়ে হেলান দিয়ে নিজেও একটা সিগারেট ধরাল।
রানার বাঁ কাঁধে ঝুলছে ব্রাউন হবি EL 300 ইলেকট্রনিক ফ্ল্যাশ গান এবং বিভিন্ন ফোকাল লেংথের নিকর লেন্স, ফিল্টার, এক্সট্রা লেন্স-হুঁড়, কেবল-রিলিজ, একটা মোটর ড্রাইভ এবং অন্যান্য হাবিজাবিতে ভর্তি একখানা গ্যাজেট ব্যাগ; আর ডান কাঁধে টু-পয়েন্ট এইট লেন্সের একটা রোলিফ্লেকস ক্যামেরা। গলায় ঝুলছে একখানা বিখ্যাত নাইকন-এফ ক্যামেরা। লেন্স-হুঁডটা লাগানোই ছিল তাতে। দ্রুত ফোকাস করবার জন্যে স্পিট ইমেজ রেঞ্জ ফাইণ্ডার স্ক্রিন ব্যবহার করছে ও আজ।
পাকা ফটোগ্রাফারের বেশে নিজেকে কেমন বিদঘুঁটে দেখাচ্ছে কল্পনা করে। মুচকি হাসল রানা। তারপর ফ্ল্যাশ-গানটা ধীরে-সুস্থে ক্যামেরার উপর লাগিয়ে নিল। আড়চোখে একবার চেয়ে দেখল, সেই ছয়জন ইয়াং টাইগারস-এর মধ্যখানে বসে আছে সাংস্কৃতিক মিশনের দলপতি জয়দ্রথ মৈত্র। স্টেজের দিকে ওদের কারও চোখ নেই-চাপা গলায় কী যেন আলাপ করছে নিজেদের মধ্যে। নাইকন-এফ ক্যামেরায় অ্যাপারচার এফ এইট দিয়ে ডিসট্যান্স বিশ ফুটে সেট করে নিল রানা। এতে ডেপথ অভ ফোকাস ৯ ফুট থেকে ইনফিনিটি পাওয়া যাবে। আধ-খাওয়া সিগারেটটা মাটিতে ফেলে পিষে ফেলল ও জুতো দিয়ে। জমে উঠেছে নাচ।
ধিক তেই ধিগি তেই/ধিক তেই ধিগি তেই/ধিগি ধিগি থেই/
ধিগি ধিগি ধিক থেই/ধিগি ধিগি থেই/তা থেই তা থেই/
থেই তা থা/ থেই তা থা/থেই তা/ধিক তেই ধিগি তেই/
ধিক তেই ধিগি তেই/ধিগি ধিগি থেই/ধিগি ধিগি ধিক থেই/
ধিগি ধিগি থেই/তা থেই তা থেই/থেই তা থা/থেই তা থা/
থেই তা/
ধা ধিন ধিন ধা/ধা ধিন ধিন ধা/না তিন তিন না/
তেটে ধিন ধিন ধা…
এবার এগিয়ে গেল রানা দর্শকদের বিরক্তি উৎপাদন করে স্টেজের মাঝ বরাবর। তারপর হঠাৎ ঘুরে, যেন দর্শকদের ছবি তুলছে এমনি ভাবে সেই ছোট্ট দলটির ছবি তুলে নিল। অপ্রস্তুত দলটি ফ্ল্যাশ লাইটের হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে। প্রথমে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। তারপর জয়দ্রথ ছাড়া বাকি সবার হাত দ্রুত উঠে এসে নিজ নিজ চেহারা আড়াল করার চেষ্টা করল। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। মৃদু হাসল রানা।
এক, দুই করে নয় সেকেণ্ড পার হলো। জ্বলে উঠল ফ্ল্যাশ গানের পিছনে লাল বাতি। রি-চার্জিং সাইকল কমপ্লিট হয়েছে। এবার আরও কয়েকটি ছবি তুলল ও মিত্রা সেনের বিশেষ বিশেষ নৃত্য ভঙ্গিমার, বিভিন্ন দূরত্ব থেকে বিভিন্ন অ্যাপারচার। দিয়ে। মাথার মধ্যে দ্রুত চিন্তী চলছে রানার। ঢাকার কুখ্যাত ইয়াং টাইগারস পিছু ছাড়েনি তা হলে! কিন্তু এদের সঙ্গে কলকাতার সাংস্কৃতিক মিশনের দলপতির এই দহরম-মহরম কেন? কুষ্টিয়ায় মিত্রা সেনকে জোর করে ছিনিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করেছিল যারা, যাদের হাত থেকে রানা রক্ষা করেছিল মিত্রাকে কিন্তু প্রতিদানে পেয়েছিল কুৎসিত ব্যবহার, সব জেনে শুনেও তাদের সঙ্গে জয়দ্রথ মৈত্রের এই মৈত্রী কীসের? ঈশ্বরদি জংশনের রিফ্রেশমেন্ট রুমেই প্রথম রানার চোখে পড়ে এদের সঙ্গে ভাব জমিয়ে নিয়েছে জয়দ্রথ মৈত্র। কী মতলব আঁটছে সে এদের সঙ্গে? রাজশাহীতে পৌঁছে ডাকবাংলোতে মিত্রা সেনের ব্যবহারই বা এমন হঠাৎ পাল্টে গেল কেন? ঠিক তার পাশের ঘরটা বুক করল মিত্রা-দলপতি তাতে আপত্তি করল না। ট্রেনে তা হলে গুলিবর্ষণ করল কে? তা ছাড়া আজ সারাদিন মনে হচ্ছিল মিত্রা যেন কিছু বলতে চায় তাকে, কিন্তু বলি বলি করেও সুযোগ করে উঠতে পারছে না। কী সে কথা? নিশ্চয়ই কোনও ট্র্যাপ পেতেছে ওরা। সামনে। বিপদের গন্ধ পেল রানা।
হঠাৎ রানার মনে হলো মিত্রা যেন তার দিকে চেয়ে আবছা একটা ইঙ্গিত করল। আশ্চর্য হয়ে গেল রানা। শেষবারের মত ক্লিক করে শাটার টিপে দিল সে। এক ঝলক তীব্র আলো ছুটে গিয়ে আলিঙ্গন করল মিত্রা সেনকে। শাটারের উপর আঙুলের চাপ পড়তেই এক মুহূর্তের জন্যে অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল ভিউ ফাইণ্ডার। পরমুহূর্তেই ইনস্ট্যান্ট রিটার্ন মিরর যথাস্থানে ফিরে গিয়ে ভেসে উঠল আবার মিত্রার ছবি। নিজের আসনে গিয়ে বসে পড়ল রানা। একটা সিনিয়র সার্ভিস। ধরাল। আগাগোড়া সবটা ব্যাপার ভেবে দেখা দরকার। পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছে নিল ও।
…ক্ৰেধা আধা তেটে তেটে/কৎ তেটে ক্ৰেধা তেটে/ক্ৰেধা তেটে ধা/
ক্ৰেধা তেটে ধা/ক্রেধা তেটে/ক্রেধা আধা তেটে তেটে/
কৎ তেটে ক্ৰেধা তেটে/ক্রে তেটে ধা/
ক্ৰেধা তেটে/
ধা ধিন ধিন ধা/ধা ধিন ধিন ধা/না তিন তিন না/
তেটে ধিন ধিন ধা/…
মুখে চক্রধর বোল বলছে তবলচি। মিত্রা সেন এবার নাচের মুদ্রায় সে ছন্দকে মূর্ত করে তুলবে।চতুগুণ বেড়ে গেছে লয়। অত্যন্ত দ্রুত লয়ে চলছে নাচ।
হঠাৎ মনে হলো যেন মিত্রার পা আর মাটিতে নেই-সারাটা স্টেজময় যেন সে। হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে। মুগ্ধ, চমৎকৃত দর্শকবৃন্দের করতালিতে হলের ছাদ উড়ে যাবার উপক্রম। রানাও অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল–প্রশংসা না করে পারল না মনে। মনে। সত্যিকার শিল্প দেশ-জাতি-ধর্মের ঊর্ধ্বে।
হাততালি থেমে যেতেই হলের মাঝামাঝি জায়গায় বসে এক ফাজিল ছোকরা ‘ম্যা…এ্যা…’ করে জোরে ছাগলের ডাক ডেকে উঠল। চাপা হাসির গুঞ্জন উঠল। দু’একটা ধমক-ধামকের আওয়াজও এল।
নাইকন-এফ-এর লেন্সটা খুলে ফেলল রানা। খুলে ২০০ মি.মি. আঁটো নিকর এফ ২.৫ টেলিফটো লেন্সটা লাগিয়ে নিল। বেয়োনেট মাউন্টের উপর ক্লিক করে বসে গেল লেন্স। এবার ক্যামেরাটা চোখে তুলে ফোকাস অ্যাডযাস্ট করতে চেষ্টা করল সে। টেলিফটো লেন্সের ছোট অ্যাঙ্গেলের মধ্যে মিত্রা সেনকে ধরতে কয়েক সেকেণ্ড লেগে গেল। নাইকন-এর উজ্জ্বল ভিউ-ফাইণ্ডারে পর্দায় পৃথিবীর অদ্বিতীয় নিকর লেন্সের মাধ্যমে পরিষ্কার ভেসে উঠল এবার মিত্রার সুন্দর মুখচ্ছবি। প্রতিটি রেখা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে রানা। উপলব্ধি করল ও, এ মুখটাও পৃথিবীতে অদ্বিতীয়। কপালে চাদির টিপ আলো পড়ে মাঝে মাঝে ঝিক করে উঠছে, দু’চোখে টেনে কাজল পরা, সুপুষ্ট লোভনীয় অধর লিপস্টিকে লাল।
সোজা তার দিকে চেয়ে আবার ইঙ্গিত করল মেয়েটি। না, চোখের ভুল নয়। দূর হলো রানার সন্দেহ।
প্রবল করতালি এবং শেয়ালের ডাকের মধ্যে নাচ শেষ হলো। কালো পর্দাটা ধীরে ধীরে নেমে এসে আড়াল করল মিত্রাকে হাজার দুয়েক লুব্ধ চোখের দৃষ্টি থেকে।
সবাই একসঙ্গে বেরোতে চাইছে হল থেকে। গেটের কাছে দারুণ ভিড় ঠেলে রানা এগোল গ্রীনরুমের দিকে। হঠাৎ পিছন থেকে কেউ হাত ঢোকালো রানার প্যান্টের পকেটে। ধরতে পারল না রানা হাতটা। ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখল একটা লোমশ হাত সরে গেল পিছনের ভিড়ে।
পকেটে হাত দিয়ে একটা ছোট্ট কাগজ পেল রানা। ভাবল, বার্তা হবে কিছু।
চারকোণা ছোট কাগজের উপর ইংরেজিতে টাইপ করা:
BEWARE GENTLEMAN, DANGER AHEAD!
প্রথমেই রানা ভাবল, টাইপ করা যখন, এটা তাকে দেবে বলে কেউ আগে। থেকেই মনস্থ করে এসেছে, হঠাৎ করে তার মাথায় আসেনি এই সাবধান বাণী-অর্থাৎ, পূর্ব পরিকিল্পিত। কিন্তু কে তাকে সাবধান করতে চায়, শত্ৰু না মিত্র? এবং কেন? কীসের বিপদ সামনে? ঘাই হরিণীর মত কি মিত্রা ডাকছে তাকে মৃত্যুর পথে? নাকি কেউ ভয় দেখিয়ে দূরে সরাতে চাইছে ওকে?
দুই হাত মাথার উপর তুলে চিঠিটা টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ল রানা-যেন ওর উপরে যে বা যারা লক্ষ্য রাখছে, তারা স্পষ্ট দেখতে পায় ওর কার্যকলাপ। তারপর উপর দিকে টুকরোগুলো ছুঁড়ে ফুঁ দিয়ে ছিটিয়ে দিল চারদিকে। আশপাশে সবার মাথায় ঝরে পড়ল সেগুলো পুঘৃষ্টির মত।
ছোট দরজা দিয়ে বেরিয়ে স্টেজের পিছন দিকে চলে এল রানা। গেটের কাছে দাঁড়ানো নীল ব্যাজ বুকে আঁটা ভলান্টিয়ার রানাকে দেখে পথ ছেড়ে দিল। ভিতরে ঢুকে এদিক-ওদিক চাইতেই একটা ছোট ঘরের আধ-ভেজানো দরজা দিয়ে মিত্রা সেনকে দেখতে পেল রানা। দ্রুত কাপড় ছাড়ছে সে। স্টেজের পিছনে। অনাদর অবহেলায় পড়ে থাকা গোটা কতক ক্যানভাসের উইং, এলোমেলো করে ফেলে রাখা কয়েকটা বাঁশ আর কিছু নারকেলের রশি টপকে ড্রেসিংরুমের সামনে। গিয়ে দাঁড়াল রানা।
‘ভেতরে আসুন! মিত্রার চাপা কণ্ঠস্বর।
ঢুকতে গিয়ে আবার পিছিয়ে এল রানা। মিত্রার পরনে ব্রেসিয়ার এবং পেটিকোট ছাড়া কিছু নেই। এতক্ষণ একটানা নাচের পর হাঁপাচ্ছে সে। সেই সঙ্গে ওঠা-নামা করছে বুকের সঙ্গে ঘামে সেঁটে থাকা একখানা দামি লকেট। সারা শরীরে স্বেদ বিন্দু। নাচের ঝলমলে পোশাক-পরিচ্ছদ খুলে একটা ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখা। আয়না-ভাঙা ড্রেসিং টেবিলটা ষোড়শ শতাব্দী মডেলের।
রানা ভাবল: থারটি-সিক্স-টোয়েন্টি-টু-থারটি-সিক্স! আইডিয়াল!
চঞ্চল হয়ে ওঠা মনটাকে সংযত করল রানা।
কই, দাঁড়িয়ে কেন? ভেতরে আসুন।
এবার রানার টনক নড়ল। সেটির চাপা খসখসে অথচ তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বরে ধৈর্যচ্যুতির আভাস পাওয়া গেল। এ যেন অনুরোধ নয়, আদেশ। ঢুকে পড়ল রানা ঘরের ভিতর।
‘ছিটকিনি লাগিয়ে দিন দরজার। লজ্জা করার সময় এটা নয়। জরুরি কথা আছে। দোহাই আপনার, বোকার মত দাঁড়িয়ে না থেকে তাড়াতাড়ি করুন-সময় নেই মোটেও। এক্ষুণি ওরা সব এসে পড়বে।’
মেয়েটির কণ্ঠস্বরে এমন একটা উত্তেজিত জরুরি ভাব প্রকাশ পেল যে প্রায় চমকে উঠল মাসুদ রানা। সমস্ত ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে উঠল তার। অদ্ভুত কিছু শুনবার জন্য মনটাকে প্রস্তুত করে নিল ও একমুহূর্তে।
নড়বড়ে বল্টুটা লাগানো না লাগানো সমান কথা। তবু সেটা লাগিয়ে দিয়ে। ঘুরে দাঁড়াল রানা। স্থির দৃষ্টিতে আপাদমস্তক একবার দেখল মিত্রাকে। ভাবল, হঠাৎ আজ এই মুহূর্তে নিজের দলটা ‘ওরা’ হয়ে গেল কেন এই মেয়েটির কাছে? কুষ্টিয়ার অনুষ্ঠানে তার প্রতি স্পষ্ট ঘৃণা দেখতে পেয়েছে রানা মিত্রার চোখে। আজ সে-ই আপন লোক হয়ে গেল, অন্যেরা পর-কেমন করে হয়! এর মধ্যে গোলমাল আছে কিছু। সাধু, সাবধান!
রানার স্থির দৃষ্টির সামনে এবার একটু লজ্জা পেল মিত্রা সেন।
চট করে ঘুরে ব্লাউজ টেনে নিয়ে একটা হাত ঢুকিয়ে দিল। মুখে বলল, ‘আপনাকে এখানে ঢুকতে দেখেছে কেউ?
‘বোধহয় না,’ উত্তর দিল রানা নিরাসক্ত কণ্ঠে।
কুঁচি দেয়া পেটিকোটে ঢাকা একখানা চমৎকার সুডৌল নিতম্বের উপর চোখ। পড়ল রানার মিত্রা ঘুরে দাঁড়াতেই। এঁটে বাঁধা ব্রেসিয়ারের ফিতেগুলো পিঠের নরম-মাংসের উপর চেপে বসে আছে।
মৃদু হেসে এগিয়ে গিয়ে গ্যাজেট ব্যাগ আর ফ্ল্যাশ গানটা নামিয়ে রাখল রানা একটা চেয়ারের উপর। বলল, কুষ্টিয়ার সেই গুণ্ডাদের নিন্দে করে লাভ কী, দোষ তো তাদের নয়, দোষ আপনার। আমার মাথাটাও আজ খারাপ হয়ে যাবার জোগাড় হয়েছে, মিস মিত্রা। পৃথিবীর সব রূপ…’
‘চুপ করুন, আমার সঙ্গে ফ্লার্ট করবার জন্যে আপনাকে ডাকিনি। আপনার, আমার দুজনের সামনেই ভয়ানক বিপদ এখন।
মিত্রাকে শাড়ি পরে নেবার সুযোগ দিয়ে গ্রিনরুমের পিছন দিকের খোলা জানালাটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল রানা। ঠাণ্ডা এক ঝলক মুক্ত বাতাস এল জানালা দিয়ে। বুক ভরে শ্বাস গ্রহণ করল সে। তারপর চামড়া মোড়া দামি সিগারেট কেস থেকে একটা সিনিয়র সার্ভিস বের করে অগ্নি সংযোগ করল। বাইরে প্রায় জানালার সঙ্গে লাগানো একটা কচুরিপানা ভর্তি পুকুর। কানায় কানায় টই টম্বুর। মোলায়েম জ্যোৎস্নায় পুকুর পাড়ের নারকেল গাছ দুটোকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। দেখতে। রানা ভাবল, সুন্দর’ আর ‘বিপদ’ এই দুটো জিনিসে কোথায় যেন একটা যোগসূত্র আছে। পৃথিবীর বেশির ভাগ জিনিস যা সুন্দর, রানা দেখেছে তার। আশপাশেই ওত পেতে থাকে বিপদ। মিত্রার চারপাশে বিপদ ঘনিয়ে আসবে, এটাই তো স্বাভাবিক।
পাশে এসে দাঁড়াল মিত্রা।
‘একটা ভয়ঙ্কর চক্রান্তের জাল পাতা হয়েছে আপনার জন্যে, মি. …’
‘আমি নগণ্য এক ফটোগ্রাফার-তরিকুল ইসলাম। আমাকে আপনি এসব কী ভয়ঙ্কর কথা শোনাচ্ছেন?’-সত্যি সত্যিই বিস্মিত হবার ভান করল রানা।
বাজে কথায় সময় নষ্ট করবেন না, মি. মাসুদ রানা। মিত্রার কণ্ঠস্বরে স্পষ্ট তিরস্কার। সেই প্রথম দিন থেকেই আমি কেন, সাংস্কৃতিক মিশনের প্রত্যেকটি লোকই জানে আপনার আসল নাম, আসল পরিচয়। হাতে সময় নেই, এক্ষুণি ওরা এসে পড়বে, দয়া করে আমার কথাগুলো বলতে দিন। কপাল থেকে একগুচ্ছ অবাধ্য চুল নিয়ে গুঁজে দিল মিত্রা কানের পাশে। তারপর আবার বলল, আজ রাতে আপনাকে হত্যা করা হবে, মি. রানা!’
মিত্রার মুখে নিজের নাম শুনে অবাক হলো না রানা। মনে মনে ভাবল, আমাকে হত্যা করা হলে তোমার কী ক্ষতি, সুন্দরী। মুখে বলল, ‘কেন? আমার অপরাধ?
‘দলপতির বিশ্বাস আপনি আমাদের বিরুদ্ধে এমন কিছু তথ্য জানতে পেরেছেন যা আমাদের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক। কাজেই আর কোনও পথ নেই; সরিয়ে দিতে হবে আপনাকে এই পৃথিবী থেকে। আর আপনাকে এই নিশ্চিত মৃত্যুর ফাঁদে ফেলবার জন্যে আমাকে ওরা ব্যবহার করছে টোপ হিসেবে। খুব। দ্রুত কথাগুলো বলে গেল মিত্রা। ওর চোখে-মুখে স্পষ্ট উদ্বেগ ও উত্তেজনা।
‘চক্রান্ত, ফাঁদ, মৃত্যু, এইসব কথা শুনে মন খারাপ করছে, কিন্তু টোপটা আমার ভারি পছন্দ হয়েছে। আমি এই টোপ গিলতে রাজি আছি। যা থাকে কপালে! হাসল রানা।
আপনি হাসছেন? উহ, এর গুরুতু যদি আপনাকে বোঝাতে পারতাম!’ তর্জনী ভাজ করে কামড়ে ধরল অসহিষ্ণু মিত্রা সেন। ওই যে ওরা সব এসে পড়েছে।
বাইরে কয়েকটা পায়ের শব্দ শোনা গেল। এগিয়ে আসছে কারা কাঠের মেঝের উপর মচমচ শব্দ তুলে। আর সময় নেই। রানা চেয়ে দেখল উত্তেজনা, ভয় আর হতাশায় রক্তশূন্য হয়ে গেছে মিত্রার মুখ। বুঝল এটা অভিনয় হতে পারে না।
হঠাৎ রানার বাঁ হাতটা তুলে নিল মিত্রা তার হাতে। চাপা গলায় বলল, ‘আমাকেও জড়িয়েছে ওরা। এই নিষ্ঠুর ষড়যন্ত্র যদি সফল হয় তবে আত্মহত্যা ছাড়া আর পথ নেই আমার। আমি বাঁচতে চাই, মি. রানা! এই বিদেশে আপন কেউ নেই আমার। মৈত্র মশাই নিজেই এই চক্রান্তের উদ্যোক্তা। আমাকে ভাসিয়ে দিচ্ছে এরা বানের জলে। রক্ষা করবে আমাকে, রানা? তোমার কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাইছি আমি। বলো, বাঁচাবে আমাকে?
আকুল মিনতি মিত্রার চোখে। রানা বুঝল, ও এমন একটা ফাঁদে পা দিতে যাচ্ছে যেখান থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন হবে। স্থির দৃষ্টিতে মিত্রার চোখের দিকে চেয়ে ও বুঝল এই কাতর মিনতি অবহেলা করবার সাধ্য ওর নেই। কিন্তু কী সেই চক্রান্ত যাকে মিত্রার এত ভয়? লোকগুলো দরজার কাছে এসে গেছে। আর সময়। নেই সব কথা শুনবার।
‘চেষ্টা করব,’ বলল রানা।
মিত্রার কাছে এই আশ্বাসটুকুর অনেক দাম। কৃতজ্ঞতায় দু’ফোঁটা জল বেরিয়ে এল ওর চোখ থেকে। রানার বাঁ হাতের উল্টোপিঠে আলতো করে চুম্বন করল সে, তারপর নরম গালের উপর একবার চেপে ধরেই ছেড়ে দিল। খানিকটা চোখের জল লেগে গেল রানার হাতে।
দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শোনা গেল।
‘নিজেকে বড় স্বার্থপর বলে মনে হচ্ছে। নিজেকে বিপদমুক্ত করার জন্যে জেনে শুনে তোমাকে মৃত্যু-ফাঁদে পা দিতে অনুরোধ করছি। কিন্তু আমি বড় অসহায়। তুমি জানো না কত ভয়ঙ্কর লোক ওরা।’ শিউরে উঠল মিত্রা। আরেকটা শেষ কথা: যদি দ্বিধা হয়, যদি মৃত্যুর ঝুঁকি এড়িয়ে যেতে ইচ্ছে করে, তবে বাঁচার পথও বলে দিচ্ছি-আজ রাতে কিছুতেই ঘর থেকে বেরিয়ো না। কোনও অবস্থাতেই না। আমার যা হবার হোক…’।
মিত্রার খসখসে কণ্ঠস্বর ছাপিয়ে প্রবল বেগে আবার কড়া নাড়ার শব্দ হলো।
তুমি লুকিয়ে পড়ো কোথাও। না।’
গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর দিয়ে রানা দেয়ালে বসানো চার বাই তিন ফুট আলমারিটার ছোট্ট তালা এক ঝটকায় ভেঙে ফেলল।, যা ভেবেছিল, ঠিক তাই। ডালাটা খুলতেই দেখা গেল একখানা জাপানী ট্রানজিস্টার টেপ-রেকর্ডার নিশ্চিন্ত। মনে ঘুরছে ভিতরে বসে। ওদের কথাবার্তা সব রেকর্ড হয়ে গেছে।
ক্ষুদ্রাকৃতি স্কুল দুটো তুলে নিল রানা টেপ-রেকর্ডার থেকে। তারপর গ্রিনরুমের পেছনের খোলা জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল পানা ভর্তি পুকুরে।
তুমি জানতে? আলমারির ডালাটা বন্ধ করে জিজ্ঞেস করল রানা।
না।’
এবার প্রবল এক ধাক্কায় ছিটকিনি ভেঙে দু’ফাঁক হয়ে খুলে গেল দরজা। হুড়মুড় করে ঘরের মাঝখানে এসে দাঁড়াল জয়দ্রথ মৈত্র। পিছনে আরও কয়েকজন লোক।
হলুদ দৃষ্টি মেলে দুজনকে দেখল জয়দ্রথ মৈত্র। তারপর বলল, সরি ফর দ্য। ইন্টারাপশন। পরিষ্কার বিরক্তির ভাব প্রকাশ পেল তার কণ্ঠে।
‘দ্যাটস অল রাইট, উত্তর দিল রানা। তারপর দৃঢ় পদক্ষেপে মৈত্রকে পাশ কাটিয়ে চেয়ার থেকে গ্যাজেট ব্যাগ আর ফ্ল্যাশ-গানটা তুলে নিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। যেতে যেতে মিত্রার কৈফিয়ত কানে গেল তার।
‘উনি একটা ক্লোজ-আপ ছবি নিতে…’
দরজা বন্ধ করে নিয়েছিল কেন?’
‘আমি, মানে, উনি…
মৃদু হেসে রাস্তায় গিয়ে পড়ল মাসুদ রানা।
.
০২.
২৭ আগস্ট, ১৯৬৫।
মতিঝিল কমার্শিয়াল এরিয়ায় ছয়তলার উপর একটা কার্পেট বিছানো ঘরের পশ্চিমমুখী জানালাটা খোলা। পাকিস্তান কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের এজেন্ট মাসুদ রানা সে-জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আনমনে স্টেডিয়ামের সবুজ ঘাসের দিকে চেয়ে রয়েছে। অসম্ভব বৃষ্টি হওয়ায় মাঠে পানি জমে আজ বিকেলের ফুটবল খেলা বাতিল হয়ে গেছে। পতাকা নামিয়ে নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। বেশ কিছুক্ষণ হয় বৃষ্টি থেমেছে। পশ্চিম আকাশের সাদা মেঘের গায়ে এখন নানা রঙের খেলা। সারি সারি দর্শকদের গ্যালারি একেবারে ফাঁকা। দুটো ছাগল, বোধহয় দারোয়ানের হবে, নিশ্চিন্ত মনে চরছে মাঠে। পাশে সুইমিং পুলের টলটলে পরিষ্কার জলে আঁটসাঁট কস্টিউম পরে সাঁতার প্র্যাকটিস করছে কয়েকটা উন্নতস্তনা, অ্যাংলো। তরুণী। বায়তুল মোকাররমের গম্বুজের উপর চোখ পড়ল এবার রানার। তারপর সিঁড়িতে। কয়েকজন মুসল্লি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছে মগরেবের আজান শুনে। প্রকাণ্ড জিপিও বিল্ডিংটা গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য ডেড লেটার-এর বোঝা বুকে নিয়ে। আরও অনেক দূরে রেস কোর্সের শিব মন্দিরের চুড়ো দেখা যাচ্ছে। আবছা। ঢাকা নগরীর বুকে সন্ধ্যা নামছে ধীরে ধীরে।
হঠাৎ একটা সাইলেন্সর পাইপ ভাঙা বেবি ট্যাক্সি এমন বেয়াড়া শব্দ করে সামনের রাস্তা দিয়ে চলে গেল যে রানার বিরক্ত দৃষ্টি এইসব সুন্দর দৃশ্য ছেড়ে ফিরে এল কালো পিচ ঢালা ভেজা রাস্তাটার উপর। সাইড লাইট জ্বেলে মৃদু গুঞ্জন তুলে হরেক রঙের সুন্দর সুন্দর স্যালুন, সেডান চলে যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে ছবির মত। অপেক্ষা করছে রানা।
‘এক কাপ কফি দেব?’ ঠিক কানের পাশে মোলায়েম নারী কণ্ঠের এই প্রশ্নে চমকে উঠল রানা। দেখল নব-নিযুক্ত সুন্দরী স্টেনো-টাইপিস্ট মিস নাসরীন রেহানা তার একান্ত কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। রানার কাজের সুবিধার জন্যে ওকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেয়া হয়েছে হপ্তাখানেক হলো। চোখে চোখ রেখে রানা বুঝল মেয়েটি নীরবে বলছে, আশপাশে কেউ নেই, ইচ্ছে করলেই সুযোগ গ্রহণ করতে পারো, আমি আপত্তি করব না।’
কী বলছ?’ ইঙ্গিত না, বোঝার ভান করল রানা।
কফি? রেহানার চোখে স্পষ্ট আমন্ত্রণ। ঠোঁটে বাঁকা হাসি। লিপস্টিকে লাল ঠোঁট দুটোর ফাঁক দিয়ে চকচকে সাদা দাঁত দেখা যাচ্ছে অল্প একটু। আর একটু কাছে সরে এল সে। ভ্যাসলিনের গন্ধ ওর চুলে, মুখে পুরু প্রসাধনের প্রলেপ। ওড়নাটা একপাশে সরে যাওয়াতে গভীর খাদ দেখা যাচ্ছে বুকের মাঝামাঝি।
মনে মনে বিরক্ত হয়ে আবার জানালার বাইরে চোখ ফেরাল রানা। এরা তাকে কী মনে করে? তাদের ইঙ্গিত প্রত্যাশায় উন্মুখভাবে অপেক্ষমাণ বানর বিশেষ? ইশারা পেলেই ধন্য হয়ে গিয়ে নাচতে আরম্ভ করে দেবে? নারীসঙ্গ কামনা ছাড়া পুরুষের অন্য ভাবনা থাকতে পারে না আর?
‘বাতিটা জ্বেলে দাও রেহানা। আর হ্যাঁ, কফি এক কাপ দিতে পারো। তার আগে এক দৌড়ে U সেকশন থেকে একটা ফাইল নিয়ে এসো। ফোনে পারটিকুলাস দিয়ে দিয়েছি, মিসেস চৌধুরীর কাছে চাইলেই পাবে। কুইক।’
‘রাইট, স্যর, আহত আত্মাভিমান প্রকাশ পেল মেয়েটির কণ্ঠস্বরে। লাইট জ্বেলে দিয়ে মাথা নিচু করে বেরিয়ে গেল সে ঘর থেকে।
মেয়েটিকে এমন বিশ্রী ভাবে প্রত্যাখ্যান করে দুঃখ হলো রানার। কী করবে বেচারি। পুরুষ বস-কে সন্তুষ্ট রাখবার একটা পথই জানা আছে তার। পৃথিবীর সবাইকে যেমন দেখেছে, রানাকেও ঠিক তেমনি মনে করে একই উপায়ে খুশি। করতে চেয়েছিল। ভাল মাইনের লোভনীয় চাকরিটার নিরাপত্তা নির্ভর করে রানার ব্যক্তিগত সন্তুষ্টির উপর-এটা বুঝে নিয়ে ঋণী করে রাখতে চেয়েছিল ওকে।
রানা কিছু ভালমানুষ নয়, অনেক দোষত্রুটি আছে ওর চরিত্রে। কিন্তু ও জয় করে নিতেই অভ্যস্ত-চাকরি ভয়ে ভীতা একটি মেয়েকে বাগে পেয়ে সুযোগ গ্রহণ। করতে নয়।
ফাইলটা দেখেই চমকে উঠল রানা। তা হলে এই ব্যাপার। আবার সেই ইণ্ডিয়া? অল্প কিছুক্ষণ আগে মেজর জেনারেল রাহাত খানের আদেশ এসেছিল ইন্টারকমে: রানা, U সেকশন থেকে IE/VII/65 ফাইলটা আনিয়ে পড়ে ফেল। লিখে নাওঃ IF/VII/65 আমি একটু ডিফেন্স সেক্রেটারির অফিসে যাচ্ছি। অল্পক্ষণেই ফিরব। তুমি অফিসেই থেকো-কথা আছে।
তখনই বুঝেছিল রানা, বুড়োর মাথায় কোনও নতুন পোকা ঢুকেছে। ফাইলটা। দেখেই বুঝতে পারল আর একটা অ্যাসাইনমেন্ট তৈরি হচ্ছে ওর জন্য। আবার শক্তি পরীক্ষায় নামতে হবে ওকে কোনও বুদ্ধিমান ও শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে। খুশি হয়ে উঠল রানার মন।
ফাইলের পাতায় ডুবে গিয়েছিল মাসুদ রানা। একটা সিগারেট ঠোঁটে লাগিয়ে সেটা ধরিয়ে নিতেও ভুলে গিয়েছিল। শেষ পাতাটা উল্টাতেই হঠাৎ খট করে একটা শব্দে চমকে উঠল রানা। দেখল ওর রনসন লাইটারের ছোট্ট চোয়ালটা হাঁ হয়ে আছে। রেহানার হাতে ধরা সেটা।
সিগারেট ধরিয়ে রানা বলল, ‘থ্যাঙ্কিউ।’
‘ইউ আর ওয়েলকাম, স্যর। আপনার কফি ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।
ফাইলটা বন্ধ করে কফির কাপে চুমুক দিল রানা। তারপর সপ্রশংস দৃষ্টিতে রেহানার দিকে চেয়ে বলল, ‘অপূর্ব হয়েছে তো কফিটা! বানিয়েছে কে?
‘আমি।’
‘চমৎকার! কিন্তু তোমার কাছে আমার একটা অনুরোধ আছে, রেহানা। ওই। বুড়োকে (ছাতের দিকে চোখের ইঙ্গিত করল রানা) কোনওদিন কফি খাওয়াতে পারবে না।’
‘কেন? সত্যিই বিস্মিত হলো রেহানা। ওঁকে কফি খাওয়ালে কী হবে?
‘এক কাপ কফি খেলেই বুড়ো তোমাকে আমার কাছ থেকে সরিয়ে নিজের স্টেনো করে নেবে। আর ওই গোলাম সারওয়ার ভূতটা এসে পড়বে আমার ঘাড়ে।
তা হলে ভালই হবে,’ হেসে ফেলল রেহানা। সহজ হতে পেরে বেঁচে গেল ও।
ঠিক এমনি সময়ে ইন্টারকমের মধ্য থেকে একটা তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর যেন চাবুক মারল রানাকে।
‘ওপরে এসো, রানা। আর এইসব হালকা আলাপ করবার সময় ইন্টারকমের সুইচটা অফ করে দিয়ো।’
জিভ কাটল রেহানা চোখ বড় বড় করে।
‘সরি, স্যর, এক্ষুণি আসছি, স্যর,’ বলেই অফ করে দিল রানা ইন্টারকমের সুইচ। যেন চুরি করে ধরা পড়েছে এমনি মুখের ভাব হলো।
নিজের টাইপ রাইটারের সামনে ফিরে গিয়ে মুখটা হাঁ করে নিঃশব্দে হাসছে। রেহানা রানার এই পর্যুদস্ত অবস্থায় আন্তরিক খুশি হয়ে। জোরে হাসতে সাহস হচ্ছিল না, পাছে রাহাত খান শুনে ফেলে। পিত্তি জ্বলে গেল রানার তাই দেখে।
ধীর পায়ে এগিয়ে গেল ও রেহানার ডেস্কের সামনে। তারপর ধাই করে প্রচণ্ড এক কিল বসাল ডেস্কের উপর। আধ হাত লাফিয়ে উঠল টাইপ রাইটার।
হাসছ কেন? ফাজিল মেয়ে কোথাকার! এত হাসির কী আছে?’
রানার ছেলেমানুষি রাগ দেখে এবার উচ্চ কণ্ঠে হেসে উঠল রেহানা। তীব্র দৃষ্টিতে কয়েক মুহূর্ত তার প্রতি কপট অগ্নি বর্ষণ করে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল রানা ঘর থেকে।’
.
সাততলার উপর গোলাম সারওয়ারের কামরার মধ্যে দিয়ে গিয়ে মেজর জেনারেল রাহাত খানের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল রানা। হাতলে হাত দিয়ে, বরাবর যেমন হয়, হঠাৎ বুকের মধ্যে ছলাৎ করে উঠল এক ঝলক রক্ত। অন্যমনস্ক ভাবে গাড়ি চালাতে চালাতে হঠাৎ সামনে লোক পড়ে গেলে যেমন হয় তেমনি। ছুরির ফলার মত শান দেয়া ছিপছিপে লম্বা এই বুদ্ধিমান লোকটির তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সামনে। গিয়ে দাঁড়াতে হবে ভাবলেই কেন জানি রানার বুকের ভিতরটা হিম হয়ে আসে। এই বৃদ্ধকে ও কতখানি ভালবাসে, কতু ভক্তি করে তা ও জানে; কিন্তু এত ভয় যে কেন করে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না।
মস্ত এয়ারকণ্ডিশণ্ড রুমে একটা দামি সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ওধারে পিঠ উঁচু রিভলভিং চেয়ারে সোজা হয়ে বসে একটা প্যাডের উপর খস খস করে কী যেন লিখছেন রাহাত খান। চোখ না তুলেই বললেন, বসো।’
একটা চেয়ারে বসে ঘরের চারধারে চেয়ে দেখল রানা। মাস চারেক আগে যেমন দেখেছিল, প্রায় তেমনি ছিমছাম পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন আছে ঘরটা। বদলের মধ্যে এই, টেবিলের উপর কিং সাইজ চেস্টারফিল্ডের বদলে এক বাক্স কিউবার তৈরি হাভানা চুরুট। সপ্রতিভ অভিজাত চেহারায় এতটুকু পরিবর্তন নেই। তেমনি ধবধবে সাদা ঈজিপশিয়ান কটনের স্টিফ কলার শার্ট, সার্জের সুট আর বৃটিশ কায়দায় বাঁধা দামি টাই।
হংকং-এর ব্ল্যাক হক অ্যাসাইনমেন্ট-এ আমাদের সাফল্যে চাইনিজ গভর্নমেন্ট এতই সন্তুষ্ট হয়েছে যে পিসিআইকে গ্রাচুলেট করে বার্তা পাঠিয়েছে একটা। কিন্তু আমার ধারণা অতখানি রিস্ক নেয়া তোমার উচিত হয়নি। ডক্টর হকের পুরো রিপোর্ট আমি পড়ে দেখেছি। ছোরাটা আর এক ইঞ্চি বাম দিকে লাগলেই তোমার দুঃসাহসের ইতি হয়ে যেত। যাক, এখন বিষের ক্রিয়া আর নেই। এফ-সেকশন তোমাকে সম্পূর্ণ সুস্থ বলে সাটিফাই করছে।
রানা কোনও কথা বলল না। বুঝল, এই কথাগুলোর মানে, এবার নতুন কাজের ভার নিতে হবে তোমাকে, প্রস্তুত হয়ে নাও। বাক্স থেকে একখানা সেলোফেন পেপার মোড়া সিগার বের করে সযত্নে কাগজ ছাড়িয়ে ধরিয়ে নিলেন। রাহাত খান রানার উপহার দেয়া রনসন ভ্যারাফ্লেম গ্যাস লাইটার জ্বেলে। দামি তামাক পাতার কড়া গন্ধ এল নাকে।
‘U সেকশনের ওই ফাইলটা পড়েছ? কী লিখেছে ওতে?
‘পড়েছি, স্যর। সাংস্কৃতিক মিশন এসেছে কলকাতা থেকে গত বাইশ তারিখে। নাচ-গান-বাজনার জন্য জনা পনেরো শিল্পী আর দশ বারোজন টেকনিশিয়ান এসেছে স্টেজ ডেকোরেশন, মাইক এবং লাইট কন্ট্রোলের জন্য। নামগুলো মনে নেই, স্যর। পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠান করে বেড়াচ্ছে ওরা।’
ব্যস! এই? আর কিছু চোখে পড়েনি তোমার?
আর একটা ব্যাপারে একটু খটকা লেগেছে, স্যর। ঢাকার পরেই চট্টগ্রাম যাওয়া উচিত ছিল ওদের। তা না গিয়ে ওরা গেছে খুলনায়। তারপর যশোর। ওদের প্রোগ্রাম দেখছিঃ খুলনা, যশোর, কুষ্টিয়া, রাজশাহী এবং দিনাজপুর। অর্থাৎ আগাগোড়া পূর্ব পাকিস্তানের পশ্চিম সীমান্ত বা পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব সীমান্ত ঘেঁষে। রাহাত খানের মুখের দিকে চেয়ে রানা দেখল একটা প্রশংসাসূচক সূক্ষ্ম হাসির রেখা। রানা তার দিকে চাইতেই মিলিয়ে গেল হাসিটা।
‘বেশ। এখন বলো দেখি অল ইণ্ডিয়া রেডিয়ো যখন দৈনিক চার-পাঁচ ঘণ্টা চিৎকার করে পৃথিবীর কাছে নালিশ জানাচ্ছে আমরা কাশ্মীরে ইনফিলট্রেটর ঢুকিয়েছি, ছত্রী সেনা এবং স্যাবোটিয়ার পাঠিয়েছি শ্রীনগরে, কাশ্মীরে মুক্তি সংগ্রামীরা আসলে পাকিস্তানী সৈন্য ইত্যাদি, ইত্যাদি; ঠিক সেই সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে সাংস্কৃতিক শুভেচ্ছা মিশন পাঠাবার পেছনে কী মহৎ উদ্দেশ্য থাকতে পারে? নিশ্চয়ই এদের কোনও বিশেষ মতলব বা স্বার্থ লুকানো আছে এর পেছনে, তাই না?’ পায়ের উপর পা তুলে একটু আরাম করে বসলেন রাহাত খান।
অসম্ভব নয়, উত্তর দিল রানা। কী সেই স্বার্থ, তাই বের করতে হবে তোমাকে।
‘আমাকে?
‘হ্যাঁ। এ কাজের ভার ছিল আমাদের খুলনা এজেন্ট রহমানের ওপর। সে এদের সাথে আঠার মত লেগে গিয়েছিল। হয়তো কিছুদূর অগ্রসর হয়েছিল। কিন্তু ঘণ্টা দুয়েক আগে খবর এসেছে তাকে কেউ নির্মম ভাবে খুন করেছে। যশোর এয়ারপোর্টের কাছে একটা ঝোঁপের ধারে তার রক্তাক্ত মৃতদেহ পাওয়া গেছে।
‘আমাদের রহমান! অবাক হয়ে গেল রানা। রহমানের প্রাণবন্ত ও বুদ্ধিদীপ্ত চেহারাটা ভেসে উঠল তার চোখের সামনে। কিন্তু আমাদের দেশে আমাদের লোক মেরে রেখে যাবে এ কেমন কথা!
রানার চোখে সংকল্প দেখতে পেলেন, রাহাত খান। কয়েক সেকেণ্ড সময় দিলেন ওকে সামলে নেয়ার জন্য। নিভে যাওয়া চুরুটটা ধরিয়ে নিলেন। তারপর আবার আরম্ভ করলেন, কাল দশটার ফ্লাইটে তুমি যাচ্ছ ঈশ্বরদি। টিকেট বুক করা। হয়ে গেছে। ওখান থেকে ট্রেনে যাবে কুষ্টিয়ায়। তোমার নাম তরিকুল ইসলাম, এপিপি-র ভ্রাম্যমাণ ফটোগ্রাফার। আইডেন্টিটি কার্ড এবং অন্যান্য টুকিটাকি কয়েকটা জিনিস সকালে তোমার বাসায় পৌঁছে যাবে।
‘ঠিক কী ধরনের কাজ হবে আমার, স্যর?’
‘ওদের গতিবিধির উপর নজর রাখবে। সোহেলকে পাবে ডাকবাংলোর বয় বেয়ারাদের মধ্যে। ও তোমাকে অনেক সাহায্য করতে পারবে। আমার যতদূর। বিশ্বাস, একটা ভয়ানক প্ল্যান এঁটেছে ওরা এবার। আট-ঘাট বেঁধে নেমেছে ওরা। আমার অনুমান যদি সত্যি হয় তবে কত সাঙ্ঘাতিক আঘাত আসছে আমাদের দেশের উপর তা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। ডিফেন্স সেক্রেটারি তো আমার অনুমান শুনে হো হো করে হেসে উঠলেন। বেয়ারাকে ডেকে ঠাণ্ডা এক গ্লাস পানি খাওয়াতে বললেন, আমাকে।’ বিরক্তিতে কাঁচা-পাকা, ভুরু জোড়া কুঁচকে গেল। রাহাত খানের। কিন্তু তুমি তো আমাকে চেনো, রানা। আচ্ছা, আরেকটা জিনিস দেখাচ্ছি তোমাকে।
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন রাহাত খান। তারপর কম্পিউটারের সামনে গিয়ে কয়েকটা বোতাম টিপে দিলেন। কয়েকটা বাতি জ্বলল নিভল, ঘড়র ঘড় শব্দ হলো ওর ভেতর থেকে। আধুনিকতম বিরাটকায় কম্পিউটার প্রয়োজনীয় তথ্য টাইপ। করে দিল। কাগজটা ছিঁড়ে নিয়ে রানার হাতে দিয়ে রাহাত খান বললেন, কলকাতা থেকে এই ইনফরমেশন এসেছে।’
রানা চোখ বুলাল কাগজটার উপর। তাতে লেখা:
Something serious cooking up in Titagarh called ‘Operation Goodwill’–the present Mission is connected with it, ‘H’ leading the group.
শিরদাঁড়া খাড়া হয়ে গেল রানার কথা কয়টা পড়ে।
ব্যাপারটার গুরুত্ব বুঝতে পারছ এবার? রানা মাথাটা কাত করলে আবার শুরু করলেন রাহাত খান। ‘H’ যেখানে দলপতি হয়ে এসেছে সেখানে রহমানকে দেয়া আমারই ভুল হয়ে গিয়েছিল। বিপদের জন্য আমাদের রহমানও প্রস্তুত ছিল-কিন্তু মৃত্যুর জন্যে কে কখন প্রস্তুত থাকে? একটু কোথাও ভুল করেছে-ব্যস…
ডানহাতটা উপুড় করে রাখা ছিল টেবিলের উপর, তিন ইঞ্চি উপরে উঠিয়ে কব্জি থেকে সামনেটুকু ডান দিকে দ্রুত একবার ঝাঁকালেন রাহাত খান। অর্থাৎ-খতম।
কাজেই সাবধান। রহমানের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেব আমরা। চুপচাপ হজম করব না। কিন্তু প্রথমে ওদের উদ্দেশ্য জানা দরকার। ও হ্যাঁ, ভাল কথা। ইয়াং টাইগারস-এর নাম শুনেছ?
ইদানীং বেশ শোনা যাচ্ছে এদের নাম, স্যর। কতকগুলো বড় লোকের ছেলে।
হা। পূর্ব পাকিস্তানের সব বাঘা বাঘা শিল্পপতিরা মিলে করেছে টাইগারস ক্লাব-আর তাদের বখে যাওয়া অপদার্থ ছেলেরা মিলে ক্লাব গড়েছে ইয়াং টাইগারস। কোটিপতি বাপের টাকার জোরে মদ, জুয়া, মেয়েমানুষ নিয়ে। যথেচ্ছাচার করে বেড়াচ্ছে। ওদের কয়েকটা অপকর্মের কথা আমার কানেও এসেছে। খোঁজ নিতে গিয়ে দেখি টাকার জোরে ফাইল গায়েব। এদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় কয়েকজন নানান অপকৌশলে (ঘুষ, মদ, নারী) ভাল ভাল কিছু ইণ্ডাস্ট্রি বাগিয়ে নিয়েছে ইতিমধ্যেই। যাক, যশোর থেকে খবর এসেছে কয়েকজন। ইয়াং টাইগারস এই মিশনের সঙ্গে সঙ্গে ঘুরছে। ওদের একজন নর্তকীর উপর নাকি তাদের চোখ। এদের আণ্ডারএস্টিমেট কোরো না। প্রয়োজন হলে কঠিন। ব্যবস্থা গ্রহণ করতে দ্বিধা কোরো না। আমার সমর্থন থাকবে তোমার পেছনে। এখন বলো, তোমার কোনও প্রশ্ন আছে?’
না, স্যর।
কেন জানি রানার মনে হলো কোনও কারণে রাহাত খান ভিতর ভিতর বড় উদ্বিগ্ন এবং বিরক্ত। কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করতে সাহস হলো না। ব্যক্তিগত প্রশ্ন পছন্দ করেন না রাহাত খান। হয়তো H-এর ধৃষ্টতা এই উদ্বেগের কারণ হবে। রহমানের মৃত্যু হয়তো কুরে কুরে যন্ত্রণা দিচ্ছে ওকে।
প্যাড থেকে একটা কাগজ টান দিয়ে ছিঁড়ে চার ভাজ করে রানার দিকে বাড়িয়ে দিলেন তিনি।
‘এতে যা লেখা আছে কাল প্লেনে উঠে তারপর পড়বে। আজ সাতাশে আগস্ট-ওরা আছে যশোরে, কুষ্টিয়ায় থাকবে আটাশ-ঊনত্রিশ, রাজশাহীতে তিরিশ-একত্রিশ, দিনাজপুরে পয়লা-দোসরা। কথাগুলো মনে রেখো। আর কেবল বিপদ নয়, মৃত্যুর জন্যেও প্রস্তুত থেকো। ব্যস, আর কোনও কথা নেই, যেতে পার।’
আস্তে দরজাটা ভিড়িয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল মাসুদ রানা কামরা থেকে।
.
০৩.
২৮ আগস্ট, ১৯৬৫।
মোখলেস এসে খবর দিল ট্যাক্সি এসে গেছে। অর্থাৎ, এবার দয়া করে গাত্রোখান করুন।
‘তুই আমার সুটকেসটা তুলে দে তো গাড়ির পিছনে,’ বলল রানা।
‘দিয়েছি, স্যর।
তবে যা ভাগ এখান থেকে। চা খেয়ে নি-দাঁড়াতে বল্ ড্রাইভারকে।
রানাকে দেখেই লাফিয়ে ট্যাক্সির ড্রাইভিং সিট থেকে নেমে এল ড্রাইভার। বেঁটে-খাটো হাসি-খুশি চেহারার লোকটা। ঢিলা খাকি কোর্তার বুক পকেট দুটো ফুলে আছে রুমাল, লাইসেন্স, টাকা-পয়সা, কিংস্টর্ক সিগারেটের প্যাকেট, দিয়াশলাই, চিরুনি আর হরেক রকম হাবিজাবি কাগজে। ময়লা পাজামার ততধিক ময়লা ফিতে ঝুলছে হাঁটুর কাছে। পায়ে প্রচুর ঝড়ঝাঁপটাতেও টিকে থাকা একটা থ্যাবড়া নাকের লেস-হীন জুতো। বয়স চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশের মধ্যে হবে। সামনের দিকে একটা দাঁত নেই–সেই ফাঁকের মধ্যে একটা খেলাল ধরা। মিলিটারি কায়দায় ঝটাং করে এক স্যালিউট লাগিয়ে দিল সে রানাকে দেখে আনন্দের আতিশয্যে। থুক’ করে মুখ থেকে খেলালটা ফেলে দিয়ে ফোকলা হাসি হাসল।
‘আরে, হুজুর, আপনে! আপনেরে বিচরাইতে বিচরাইতে তো এক্কেরে পেরেসান হোইয়া গেছি গা। পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার দেখল সে রানাকে। ‘আমি দিলে ভাবি, মানুষটা গেল কই? এক্কেরে গায়েব হোইয়া গেল গা! ইমুন সাংগাতি পাওলানটারে হালায় এখি বস্কিং মাইরা রাবিস বানাইয়া ফালাইল! হিকমতটা কি-আরিব্বাপরে বাপ!’
রানাকে থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আবার বলল, আরে উইঠা পরেন, হুজুর; খামোস খায়া খারোইয়া রইলেন কেলেগা?
এমন বিচিত্র ভাব সংমিশ্রিত আকস্মিক অভ্যর্থনায় অবাক হয়ে গিয়েছিল রানা। ড্রাইভারের পাশের সিটে উঠে বসল সে। তারপরই মনে পড়ল সেই ঘটনার কথা। মাস ছয়েক আগে রাত প্রায় এগারোটার দিকে সাভার আর নয়ারহাটের মাঝামাঝি জায়গায় জঙ্গলের ধারে এর গাড়ি আটক করেছিল একদল দুবৃত্ত। রানা আসছিল মানিকগঞ্জ থেকে। দূর থেকেই ব্যাপারটা আঁচ করে হেড লাইট অফ করে গিয়ার নিউট্রাল করে নিঃশব্দে একেবারে কাছাকাছি এসে থেমেছিল রানা। প্রাণভয়ে থর থর করে কাঁপছিল আর ভেউ ভেউ করে কাঁদছিল ড্রাইভার। ছোরা মারার ঠিক আগের মুহূর্তে যমদূতের মত এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল রানা সর্দারের। উপর। বেশ মারপিটও হয়েছিল। বেগতিক দেখে পালিয়েছিল দুবৃত্তরা। প্রাণ রক্ষা। পেয়েছিল (কী যেন নাম বলেছিল…ও, হ্যাঁ) ইদু মিঞার। সেই কৃতজ্ঞতা এই খাস। ঢাকাইয়া কুট্টির মনে যে এমন উজ্জ্বল হয়ে থাকবে ভাবতেও পারেনি রানা।
‘কেমন আছ, ইদু মিঞা?’ জিজ্ঞেস করল রানা।
‘যিমুন দোয়া করছেন, হুজুর।’ বলেই স্টার্ট দিল ইদু মিঞা গাড়িতে। ফাস্ট গিয়ারে দিয়ে ক্লাচটা ছাড়ার কায়দা দেখেই বুঝল রানা, পাখোয়াজ ড্রাইভার।
হঠাৎ চোখ পড়ল রানার দরজায় দাঁড়ানো রাঙার মার উপর। মুখের দিকে চেয়েই বুঝল রানা, অনর্গল দোয়া দরুদ পড়ছে বুড়ি। গত রাতে জিনিসপত্র গোছগাছ করা দেখেই কয়েক রাকাত নামাজ বেড়ে গেছে বুড়ির। সাধে আর মোখলেস ওকে রানার মা বলে খেপায় না। কোথায় যেন ওর মৃত মায়ের সাথে। মিল আছে এই স্নেহময়ী বৃদ্ধার। একটা দীর্ঘশ্বাস পড়তে যাচ্ছিল, সচেতন হয়ে সামলে নিল রানা।
রাতের বেলা আর সাভারের দিকে যাও না তো, ইদু মিঞা?’
‘তোবা, তোবা। এই জিন্দেগীর মোদে তো আর না। আইজ ষোলো বচ্ছর ডাইবোরি করতাছি, হুজুর, যাই নাইক্কা। আর উই দিনকা যে কী অইলো-হালায়। এউগা পাসিঞ্জার, আমাগো মাহাল্লারই কণ্টেকদার… হঠাৎ থেমে গিয়ে কণ্ঠস্বর নামিয়ে ইদু মিঞা বলল, ‘আপনের পিছে আই.বি. লাগছে, হুজুর!
‘কী করে বুঝলে?’ ঘাড় না ফিরিয়েই জিজ্ঞেস করল রানা।
‘এউগা মার্সিডিচ আইতাছে পিছে পিছে। পুরানা পল্টন থেইকা লাগছে পিছে! খারোন সাব, টাইম তো আছে, সিজিল কইরা দেই হালারে।
হেয়ার রোড দিয়ে বেরিয়ে সাকুরার সামনে উঠে ডান দিকে না গিয়ে বায়ে চলল ইদু মিঞা। রেডিয়ো পাকিস্তান ছাড়িয়ে রিয়ার-ভিউ মিররের দিকে চেয়ে বলল, ‘আইতাছে।
শাহবাগের ঝর্ণাটা চট করে ঘুরেই আবার এয়ারপোর্টের দিকে চলতে থাকল। ট্যাক্সি।
‘চেহারাটা দেইখা রাখেন, হুজুর।
ওয়ান-ওয়ে রোড। আত্মগোপন করবার উপায় নেই। কালো মার্সিডিস বেঞ্জের ড্রাইভিং সিটে গোপদাড়ি পরিষ্কার করে কামানো সানগ্লাস পরা একজন ফর্সা লোক সোজা সামনের দিকে চেয়ে বসে আছে। এক নজরেই রানা বুঝল লোকটা ভারতীয় গুপ্তচর।
যখন সত্যি সত্যিই পিছনের গাড়িটাও ঝর্ণা ঘুরে এয়ারপোর্ট রোড ধরল তখন দ্রুত একটা বালি ভরা ট্রাককে ওভারটেক করে পেট্রল পাম্প ছাড়িয়ে হাতীর পুলের দিকে মোড় নিল ইদু মিঞা। পাওয়ার হাউসের পাশ দিয়ে যেতে বাতাসে ভেসে আসা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলকণায় সামনের উইণ্ড-স্ক্রিন ঝাপসা হয়ে গেল। ওয়াইপারটা চালু করে দিয়ে প্রায় এক লাফে পার হয়ে গেল পুলটা ইদু মিঞার ট্যাক্সি। পুল থেকে নেমেই ডান দিকে মোড় ঘুরে নানান গলি ঘুচি পেরিয়ে গ্রিন রোডে গিয়ে পড়ল এবার ওরা। তারপর ওখান থেকে সোজা এয়ারপোর্ট।
ফার্মগেটের কাছে এসেই গাড়ি থামিয়ে মিটার ডাউন করে নিল ইদু মিঞা যাতে এয়ারপোর্ট থেকে যে নতুন প্যাসেঞ্জার উঠবে তার ঘাড়ে কিছু পয়সা আগে থেকেই উঠে থাকে।
এয়ারপোর্টে পৌঁছেই রানা দেখল কালো মার্সিডিস বেঞ্জটা নিশ্চিন্তে দাঁড়িয়ে আছে NO PARKING লেখা একটা সাইন বোর্ডের নিচে। এত চালাকি খাটল না। দেখে ইদু মিঞার মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। চাপা গলায় বলল, হুজুর, নামলেই অ্যারেস করব আপনেরে। অখনও টাইম আছে। কন তো ভাইগা যাই গা।
মনে মনে হাসল রানা। ইদু মিঞা তাকে হয় ক্রিমিনাল, নয় তো কমিউনিস্ট ঠাউরে নিয়েছে। মুখে বলল, না, তার দরকার নেই। ভাল গাড়ি চালাও তুমি, ইদু মিঞা।
দু’জন পোর্টার এসে রানার সুটকেস নিয়ে গেল ওজন করে ট্যাগ লাগাতে। দুটো দশ টাকার নোট বের করে ইদু মিঞার দিকে বাড়িয়ে দিল রানা। আধ হাত জিভ বের করে কয়েকবার মাথা নাড়াল ইদু মিঞা এপাশ-ওপাশ।
‘ট্যাকা দিয়া আমার ইজ্জতটা পাংচার কইরেন না, হুজুর। এর থেইকা দুইটা জুতার বারি মাইরা যান গা। আহত অভিমান ওর কণ্ঠে।
এই সূক্ষ্ম মান-অপমান জ্ঞান সম্পন্ন ঢাকাইয়া কুট্টিকে আর বেশি না ঘটিয়ে ব্রিফিং কাউন্টারের দিকে এগোল রানা। সিঁড়ি দিয়ে উঠেই বাঁ দিকের টেলিফোন বুদের দরজাটা ফাঁক করে দেখল সেই সানগ্লাস পরা শ্ৰীমান ডায়াল ঘোরাচ্ছে সেখানে দাঁড়িয়ে মাল ওজন করিয়ে আইডেন্টিফিকেশন ট্যাগ এবং টিকেট দেখিয়ে সরু বোর্ডিং পাস নিল রানা।
‘অ্যাটেনশন, ইওর অ্যাটেনশন প্লিজ। পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্স অ্যানাউন্সেস দ্য ডিপারচার অভ ইটস ফ্লাইট পি-কে ফাইভ টোয়েনটি-ওয়ান টু ঈশ্বরদি। প্যাসেঞ্জারস অন বোর্ড প্লিজ। থ্যাঙ্ক ইয়ু।
খনখনে মেয়েলী কণ্ঠস্বর।
প্লেনে উঠে একটা চেনা মুখও দেখতে পেল না রানা। খুশিই হলো মনে মনে। মাঝামাঝি জায়গায় জানালার ধারে বসে সিট বেল্ট বেঁধে নিল ও, তারপর খুলল রাহাত খানের দেয়া কাগজটা। শুধু একটা লাইন লেখা:
DON’T HESITATE. TO KILL.
আকাশে উঠে গেল ফকার-ফ্রেণ্ডশিপ। হলুদ রোদ বিছিয়ে পড়েছে অনেক নীচে সবুজ মাঠের ওপর।
.
ছোট্ট শহর কুষ্টিয়া। রাস্তাঘাটের অবস্থা খুবই শোচনীয়। তৈরির পর মিউনিসিপ্যালিটি বোধহয় মানুষকে টিকা দিয়েই আর ফুরসত পাচ্ছে না-রাস্তার গায়ে যে স্থায়ী বসন্তের দাগ পড়ে গেছে, সেদিকে লক্ষ্যই নেই। যানবাহনের মধ্যে রিকশাই একমাত্র ভরসা।
খোলা অবস্থায় চললে নির্ঘাত ছিটকে পড়বে রাস্তার ওপর, তাই হুড তুলে দিয়ে চাদিতে খটাং খটাং বাড়ি খেতে খেতে চলল রানা রিকশায় চেপে।
ডাকবাংলোতে সৌভাগ্যক্রমে একখানা ঘর খালি ছিল, পেয়ে গেল রানা। খোঁজ নিয়ে জানা গেল অন্যান্য ঘরগুলোতে বিশ্রাম নিচ্ছে সকালের ট্রেনে যশোর। থেকে আসা কলকাতার সাংস্কৃতিক মিশনের শিল্পীবৃন্দ।
স্নান করে খাওয়া-দাওয়া সেরে একটু বিশ্রাম নেবে মনে করে সুটকেস থেকে কাপড়, টাওয়েল আর সাবান বের করে নিয়ে অ্যাটাচড বাথরুমে ঢুকতে গিয়ে। দেখল রানা দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। একটু ধাক্কাধাক্কি করে, বুঝল ভিতর থেকে ছিটকিনি লাগানো। মিনিট পাঁচেক পরে খুট করে বল্টু খোলার শব্দ পাওয়া গেল। আরও দু’মিনিট পার হয়ে গেলেও যখন কেউ বেরিয়ে এল না, তখন ব্যাপারটা বুঝতে পেরে মৃদু হেসে রানা গিয়ে ঢুকল বাথরুমে। ওটা পাশাপাশি দুটো ঘরের। কমন বাথরুম। পাশের ঘরের ভদ্রলোক কাজ সেরে এদিকের বন্টু খুলে দিয়ে নিজের ঘরে চলে গেছেন।
মিনিট দশেক শাওয়ারের ঠাণ্ডা পানিতে স্নান করে সন্তুষ্ট মাসুদ রানা গুনগুন করতে করতে বেরিয়ে এল বাথরুম থেকে, ওদিকের বল্টুটা খুলে দেয়ার কথা। বেমালুম ভুলে গেছে।
ঠিক বিকেল পাঁচটায় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল রানার। দরজা খুলেই দেখল, বিশ-বাইশ বছর বয়সের, অপূর্ব সুন্দরী এক মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে। মুখে এক-ফোঁটা মেক-আপ নেই, শুধু কপালে একটা লাল কুমকুমের টিপ। খোলা এলোচুল। চোখ দুটো একটু ফোলা-এই মাত্র ঘুম থেকে উঠে এসেছে মনে হচ্ছে। পরনে হালকা নীল অর্গাণ্ডির ওপর সাদা ছাপ দেয়া সাধারণ শাড়ি। সাংস্কৃতিক মিশনের কোনও শিল্পী হবে হয়তো। চোখ দুটো ঝলসে যাবার যোগাড় হলো রানার মেয়েটির একই অঙ্গে এত রূপ দেখে।
‘ভেতরে আসুন,’ বলল রানা।
‘আপনাকে বিরক্ত করতে হলো বলে আমি দুঃখিত। পরিষ্কার বাংলায় বলল মেয়েটি। কথা ক’টা যেন নিক্তি দিয়ে ওজন করা। একটু ফাঁসফেঁসে মেয়েটির কণ্ঠস্বর। যেন বেশ কিছুটা বাধা পেরিয়ে বেরোচ্ছে শব্দ। কিন্তু তীক্ষ্ণ অদ্ভুত একটা। মাদকতা আছে সে স্বরে। ঘরের ভিতরে প্রবেশ করবার কিছুমাত্র আগ্রহ দেখা গেল না তার। চোখে মুখে বিরক্তির স্পষ্ট ছাপ।
এক সেকেণ্ডে রানার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল সবকিছু। ও বলল, ‘আর আপনাকে দুঃখিত অবস্থায় দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে প্রথমে আমি বিস্মিত, তারপর চিন্তিত এবং সবশেষে একান্ত লজ্জিত। এক্ষুণি আমি বল্টু খুলে দিচ্ছি বাথরুমের। আর এই জোড়হাত করে মাফ চাইছি–জীবনে কোনওদিন আর এমন কাজ করব না।
হেসে ফেলল মেয়েটি। রানার ভণ্ডামি দেখে রাগ জল হয়ে গেছে তার।
‘বেশ লোক তো আপনি! ইচ্ছে করেই ছিটকিনি লাগিয়ে রেখেছিলেন নাকি?
না। সত্যি বলছি, ভুলে। ছি ছি ছি, দেখুন তো, আপনাকে কত অসুবিধের মধ্যে ফেললাম! আন্তরিক লজ্জিত হলো রানা।
‘আপনি কী করে বুঝলেন আমি পাশের ঘরেই আছি এবং এই কারণেই এসেছি?’
‘দেখুন, আমি নিতান্ত শান্তিপ্রিয় নিরীহ মানুষ। তবে ভয় পেলে কেন জানি আমার বুদ্ধি খুলে যায়। আপনার অমন মারমুখো মূর্তি দেখেই ভড়কে গিয়ে আমার মাথাটা খুলে গিয়েছিল। আর তা ছাড়া…’
‘মিত্রা!’ একটা ভয়ানক গম্ভীর কণ্ঠস্বর ভেসে এল।
চমকে উঠে রানা চেয়ে দেখল একজন লোক এগিয়ে আসছে বারান্দা ধরে। সাড়ে পাঁচ ফুট লম্বা। বয়েস চল্লিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে-ঠিক কত বোঝা যায় না। পরনে শান্তিপুরী ধুতি আর খদ্দরের পাঞ্জাবী-কালো জহর কোট চাপানো তার ওপর। পায়ে বিদ্যাসাগরী চটি, আর সারাটা মাথা জুড়ে চকচকে টাক। অদ্ভুত ফর্সা। গায়ের রঙ। বড় বড় কানের ফুটো। দেহের সঙ্গে বেমানান প্রকাণ্ড গোল মাথাটা কাঁধের ওপর চেপে বসে আছে-ঘাড়ের চিহ্নমাত্র নেই। আরেকটু কাছে আসতেই রানা লক্ষ্য করল পূর্ণিমার চাঁদের সমান গোল মুখটায় দাড়ি, গোঁফ, ভুরু, কিছু নেই-বোধহয় কোনদিন ওঠেইনি; কিংবা ঝরে পড়েছে Alopecia totalis রোগে। ছোট ছোট লম্বাটে হলুদ মঙ্গোলিয়ান চোখ দুটো নিপ্রভ, অভিব্যক্তিহীন। লালচে পুরু ঠোঁট দুটো ঘেন্না ধরায়। মুখের দুই কোণে আবার ঘায়ের চিহ্ন। সবটা মিলিয়ে অদ্ভুত রকমের বিশ্রী চেহারা লোকটার। এক নজরেই অপছন্দ করল রানা লোকটাকে। লোকটার চারপাশে একটা অশুভ ছায়া দেখতে পেল সে। বিপদ, ভয় আর অমঙ্গলের প্রতীক যেন লোকটা।
জিভ দিয়ে বাঁ দিকের ঘা-টা ভিজিয়ে নিয়ে মিত্রার দিকে চেয়ে সে বলল, ‘এখানে কী করছ মিত্রা, ঘরে যাও।
বিনা বাক্যব্যয়ে মাথা নিচু করে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল মিত্রা। এবার রানার ওপর চোখ পড়ল লোকটির। ভয়ঙ্কর হলুদ দৃষ্টি মেলে পা থেকে মাথা পর্যন্ত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল সে রানাকে। সাপের মত পলকহীন সে দৃষ্টি। অস্বস্তি বোধ করল রানা সেই ঠাণ্ডা দৃষ্টির সামনে। সাধারণ ভদ্রতার খাতিরে রানা বলল, ‘আমার নাম…’
তরিকুল ইসলাম। এপিপি-র ফটোগ্রাফার। রানার বক্তব্য নিজেই বলে দিল লোকটা। আর আমার নাম জয়দ্রথ। জয়দ্রথ মৈত্র। এই শুভেচ্ছা মিশনের অধিকারী। পরে ভাল করে আলাপ হবে, মি. ইসলাম-এখন আমি একটু ব্যস্ত।
ডান দিকের ঘা-টা চেটে নিয়ে ধীর পায়ে চলে গেল জয়দ্রথ মৈত্র। রানাও স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। এতক্ষণ যেন ভূতে ভর করেছিল ওর ওপর।
বাথরুমের দরজাটা খুলে দিয়ে একটা ইজি চেয়ারে বসে টেবিলের ওপর পা তুলে দিল রানা। তারপর একটা সিনিয়র সার্ভিস ধরিয়ে চোখ বুজে মারল কষে লম্বা টান। জয়দ্রথ মৈত্রের চেহারাটা ভেসে উঠল চোখের সামনে। তা হলে এই হচ্ছে ইণ্ডিয়ান সিক্রেট সার্ভিসের সেই ভয়ঙ্কর H-যার সঙ্গে সংঘর্ষে বহু পাকিস্তানী দুঃসাহসী সিক্রেট এজেন্ট নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। অথচ একটি আঁচড়ও পড়েনি এর গায়ে। অদ্ভুত বুদ্ধিমান এবং কৌশলী এই H সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে পাকিস্তান কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের মেজর জেনারেল রাহাত খান পর্যন্ত সমীহ প্রকাশ না করে। পারেন না। দুর্দান্ত এই ভয়ঙ্কর লোকটির পাশে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে নিজেকে বড় ক্ষুদ্র মনে হলো রানার। মাথা ঝাঁকিয়ে এই ভাবটা দূর করবার চেষ্টা করল মাসুদ রানা। মিত্রার কথা ভাবতে চেষ্টা করল। এই মেয়েটিকে কী শুধুই শিল্পী হিসেবে এনেছে, নাকি এ-ও স্পাই? গানের শিল্পী, না নাচের? নাকি চেহারা ভাল বলে ধরে এনেছে-কোরাস গাইবে? অথবা অ্যানাউন্সারও হতে পারে। পুরো নামটা কী মেয়েটার? মিত্রা চৌধুরী? মিত্রা ব্যানার্জী? মিত্রা সেন গুপ্তা বা ঠাকুরতা? কিংবা নাগ, ভৌমিক, রায়, চক্রবর্তী, মুখোপাধ্যায়…
হঠাৎ একটু খুট আওয়াজ হতেই চোখ মেলে রানা চেয়ে দেখল হাসছে সোহেলের উজ্জ্বল দুই চোখ। এতদিন পর রানাকে পেয়ে আনন্দে উদ্ভাসিত। কাঁধে একটা দেড় টাকা দামের ছোট্ট টাওয়েল। বয়-বেয়ারার সাদা ড্রেস পরা। কোমরের বেল্টে পিতলের মনোগ্রামে লেখা KUSHTIA REST HOUSE..
কী নাম হে তোমার, ছোকরা?’ খুব ভারিক্কি চালে জিজ্ঞেস করল রানা।
দাঁত দিয়ে নীচের ঠোঁট চেপে ধরে চোখ পাকিয়ে প্রথমে ঘুসি দেখাল সোহেল, তারপর বিনয়-বিগলিত কণ্ঠে বলল, ‘আজ্ঞে, রাখাল দাশ। চার নম্বর বলেও ডাকতে পারেন।’ বুকে আঁটা নম্বর দেখাল সে।
‘বেশ, বেশ। ঘরটায় চট করে ঝাড় লাগিয়ে দাও তো, বাবা রাখাল। বড় নোংরা হয়ে আছে। চোখ টিপল রানা; ভাবটা কেমন জব্দ!
সোহেল দেখল ওকে বেকায়দা অবস্থায় পেয়ে খুব এক হাত নিচ্ছে রানা। হেসে ফেলল সে। বলল, ‘আজ্ঞে, এখন ঝাঁট দিলে ধুলোয় টিকতে পারবেন না। আপনি বাইরে যাবার সময় চাবিটা দিয়ে যাবেন, পরিষ্কার করে দেব সব নোংরা।
‘তাই দিয়ে। এখন চা-টা কী খাওয়াবে খাওয়াও দেখি জলদি। সন্ধের দিকে। একটু বাইরে যাব ঘণ্টা খানেকের জন্যে।
ইঙ্গিতটা বুঝল সোহেল। বাইরে মানে সোহেলের বাংলো। হেড-অফিসের। সঙ্গে কথা আছে বোধহয়। নীরবে বেরিয়ে গেল সে ঘর থেকে।
হাঁটার সময় সোহেলের ডান হাতটা দুলছে, বাঁ হাতটা স্থির হয়ে রয়েছে দেখে খচ্ করে তীব্র একটা বেদনার খেচা বিঁধল রানার বুকে। একসময় রাহাত খানের সবচাইতে প্রিয়পাত্র ছিল ওরা দুজন। বক্সিং, যুযুৎসু, পিস্তল ছোঁড়া, শক্তি, বুদ্ধি, সাহস, সব, ব্যাপারেই দুজন কেউ কারও চেয়ে কম যেত না। নিজেদের মধ্যে যেমন ছিল ওদের তীব্র প্রতিযোগিতা, তেমনি ছিল গভীর বন্ধুত্ব। কিন্তু ভাগ্য সোহেলের উপর বিরূপ। একবার একটা অ্যাসাইনমেন্ট-এ চলন্ত ট্রেন থেকে লাফিয়ে পড়ে পাথরে পা পিছলে টাল সামলাতে না পেরে চাকার তলায় কাটা পড়ল বাম হাত। একেবারে ছাটাই না করে বিপজ্জনক কাজ থেকে সরিয়ে ওকে যশোর-কুষ্টিয়া ব্রাঞ্চের হেড করে দিয়েছেন রাহাত খান। কে জানে, হয়তো একদিন রানারও এমনি অবস্থা হবে। নিজের অজান্তেই ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল রানার বুক চিরে।
পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ট্রে-তে করে এক পট চা আর কিছু বিস্কিট নিয়ে ফিরে এল সোহেল। রানার পাশে টিপয়টা টেনে দিয়ে সেগুলো নামিয়ে রাখতে রাখতে চাপা গলায় বলল, ‘তোকে চিনে ফেলেছে ওরা, রানা! আমার যদ্র বিশ্বাস জেনে গেছে ওরা তোর পরিচয়। জয়দ্রথ মৈত্রের কাছ থেকে এক টুকরো কাগজ নিয়ে ওদের দলের একজন প্রত্যেক ঘরে ঘরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সবাইকে সাবধান করে দেয়া হচ্ছে খুব সম্ভব। আমি এখনও ওদের সন্দেহের বাইরে আছি। হিন্দু বলে বিশেষ ফেভারও পাচ্ছি।’ একটা চাবি বের করল সোহেল পকেট থেকে। এই নে, আমার ওয়ায়ারলেস রুমের চাবি। আমি সন্ধের সময় বেরোতে পারব না। তুই সোজা রেলস্টেশনে চলে যাবি। ওখান থেকে আমার লোক তোকে নিয়ে যাবে বাড়িতে। রাতে আমি নজর রাখব, আর হঠাৎ যদি দরকার মনে করিস, এই বেল টিপে দিস। আজই সকালে লাগিয়েছি। খাটের পায়ায় লাগানো গোপন কলিং,
বেলের সুইচ দেখিয়ে দিল সোহেল। |||||||||| বেশ জমিয়ে নিয়েছিস দেখছি, দোস্ত!’ সপ্রশংস দৃষ্টিতে চাইল রানা ওর দিকে। কিন্তু সেই সঙ্গে জুড়ে দিল, ‘দেখিস, ভুলে যাস না আবার, আমি বেরিয়ে গেলেই ঘরটায় একহাত ঝাড় লাগিয়ে দিস, বাবা!’ চোখে-মুখে দুষ্টামির হাসি। রানার।
যা-যাহ, বাজে বকিস না। ফাই-ফরমাশ খাটতে খাটতে জান বেরিয়ে যাবার জোগাড় হয়েছে। পিঠটা বাকা হয়ে গেছে আমার। ঘর ঝাড় দেব না, শালা। বেঁটিয়ে তোর বিষ ঝেড়ে দেব।’
বেরিয়ে গেল সোহেল। আবার রানার চোখে পড়ল, বাম হাতটা স্থির হয়ে। ঝুলছে সোহেলের। কিন্তু দমে যায়নি মানুষটা। তেমনি হাসি খুশি চেহারা, বুদ্ধিদীপ্ত উজ্জ্বল দুই চোখ। হার মানেনি ও ভাগ্যের কাছে।
রাতে মিত্রা সেন সত্যিই মুগ্ধ করল রানাকে। নৃত্যকলাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকৃতি দিল ও এই প্রথম। কিন্তু নাচের শেষে অকুণ্ঠ প্রশংসা করতে গিয়ে অপমানিত হয়ে ফিরে আসতে হলো রানাকে। পরিষ্কার ঘৃণা প্রকাশ পেল মিত্রার ব্যবহারে। আহত রানা বুঝল, সত্যিই ধরা পড়ে গেছে ও। ঢাকা এয়ারপোর্টের সেই সানগ্লাস পরা ছোকরাকে অবজ্ঞা করা তার উচিত হয়নি।
.
০৪.
২৯ আগস্ট, ১৯৬৫।
অনেক রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। ঠিক বিড়ালের মত চোখ মেলে চাইল রানা। ঘুমের লেশামত্র নেই সে চোখে। যেন জেগেই ছিল এতক্ষণ। আবছা একটা ধস্তাধস্তির শব্দ এল কানে। তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বসল ও বিছানার উপর। আন্দাজে বুঝল শব্দটা আসছে মিত্রা সেনের ঘর থেকে।
নিঃশব্দে বাথরুমের ছিটকিনি খুলে পা টিপে টিপে মিত্রার ঘরের দিকের দরজার পাশে গিয়ে দাঁড়াল রানা। মৃদু আলো আসছে মিত্রার ঘর থেকে। একটা ফুটোয় চোখ রেখেই তাজ্জব হয়ে গেল সে। চোখটা একবার কচলে নিয়ে আবার রাখল ফুটোতে। সেই একই দৃশ্য। টেবিল ল্যাম্পটা মাথা নিচু করে জ্বালানো, আছে টেবিলের ওপর। সেই আলোয় দেখা গেল চারজন ষণ্ডামার্কা মুখোশধারী লোকের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করছে মিত্রা সেন। মুখে রুমাল পুরে চিৎকারের পথ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে আগেই। এবার দু’হাত পেছনে নিয়ে দুই কনুই একসঙ্গে টেনে বেঁধে ফেলা হলো। আঁচল খসে পড়ে শাড়িটা লুটোপুটি খাচ্ছে মাটিতে। কিন্তু সমানে পা চালাচ্ছে মিত্রা। সামনের লোকটার তলপেট বরাবর ঝেড়ে একটা লাথি মারল সে। দু’পা পিছিয়ে গেল লোকটা। হঠাৎ পাশ থেকে ছুরি ধরা একজন লোক এগিয়ে এসে বাঁ হাতে ওর ব্লাউজটা একটানে ছিঁড়ে ফেলল। তারপর বুকের উপর চোখা ছুরিটা মারাত্মক ভঙ্গিতে ঠেসে ধরে নিচু গলায় কানের কাছে কিছু বলল। স্থির হয়ে গেল মিত্রা সেন। আর বাধা দেবার চেষ্টা করল না। চোখ দুটো ভয়ে বিস্ফারিত। নিজের অসহায় অবস্থার কথা চিন্তা করে জল গড়িয়ে পড়ল ওর চোখ থেকে।
ছিটকিনির অবস্থান আন্দাজ করে নিয়ে জোরে একটা লাথি মারল রানা বাথরুমের দরজায়। খুলে গেল কপাট। কেউ কিছু বুঝবার আগেই সামনের দু’জন লোক ধরাশায়ী হলো রানার প্রচণ্ড মুষ্ট্যাঘাতে। তৃতীয় জন ছুরি হাতে ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছে রানার উপর। প্রথমে ছোরাসুদ্ধ হাতটা ধরে ফেলল রানা, তারপর যুযুৎসুর এক প্যাঁচে আছড়ে ফেলল লোকটাকে মাটিতে। এবার দুই হাঁটু জড়ো করে ঝপাং করে পড়ল ওর পেটের ওপর। হুক করে একটা আওয়াজ বেরোল ওর মুখ দিয়ে; নড়বার আর শক্তি রইল না। কিন্তু রানা উঠে দাঁড়াবার আগেই প্রথম আক্রান্ত একজন উঠে এসে পেছন থেকে, সাপটে ধরল রানাকে। চতুর্থ লোকটি এবার কোমর থেকে টান দিয়ে একটা থ্রোয়িং নাইফ বের করল। মুখে বিজয়ীর হাসি।
আব কাঁহাঁ যাওগে, উল্লুকে পাটঠে।
রানার বুক বরাবর ছুরিটা ছুঁড়তে গিয়ে থমকে গেল সে। যেন যাদুমন্ত্রের বলে পেছনের লোকটা রানার সামনে চলে এসেছে। একটু হলেই সেইম সাইড হয়ে। যেত। নিতম্বের উপর রানার প্রচণ্ড এক লাথি খেয়ে হুমড়ি খেয়ে লোকটা গিয়ে পড়ল চতুর্থ জনের ওপর। টাল সামলাতে গিয়ে ছুরিটা পড়ে গেল হাত থেকে মাটিতে। আর মাটিতে পড়তেই পা দিয়ে এক ঠেলা দিয়ে মিত্রা সেটাকে পাঠিয়ে দিল ঘরের এক কোণে। খালি হাতেই ঝাঁপিয়ে পড়ল ভীষণ আকৃতির চতুর্থ লোকটা রানার ওপর। নাক বরাবর রানার গোটা দুই নক-আউট পাঞ্চ খেয়ে সে ছিটকে পড়ল জানালার ধারে।
রানা চেয়ে দেখল জানালার সবক’টা শিক বাঁকানো। এই পথেই প্রবেশ করেছে লোকগুলো। বাইরে ঝমাঝম বৃষ্টি আরম্ভ হয়ে গেছে কখন ও টেরই পায়নি। কী করবে ভাবছে রানা, এমন সময় বাইরের অন্ধকার থেকে মস্ত একখানা ঢিল ছুটে এসে খটাশ করে লাগল ওর কপালে। আঁধার হয়ে গেল রানার চোখ। পড়ে যাচ্ছিল, চেয়ারের হাতল ধরে সামলে নিল। মাথাটা আঁ আঁ করছে। কিন্তু জ্ঞান হারিয়ে ফেললে চলবে না। এখন জ্ঞান হারালে নিশ্চিত মৃত্যু।
যেন বহুদূর থেকে কয়েকটা কথা কানে এল রানার।
‘সালা ডাকু হ্যায়। মার ডালেগা। ভাগো! ভাগো স্যবলোগ ইয়াহসে!’
সেকেণ্ড চারেক পাজর বরাবর একটা ছুরির আঘাত এবং তীব্র এক ঝলক ব্যথা আশা করল রানা। কিন্তু তেমন কিছুই ঘটল না। মাথাটা একবার ঝাঁকিয়ে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল ও। তখনও ঘুরছে মাথাটা। চেয়ে দেখল চারজন মুখোশধারীই অদৃশ্য হয়ে গেছে। মিত্রা ছাড়া ঘরে কেউ নেই। ছুটে জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়াল রানা। বৃষ্টির ছাট লাগল চোখে-মুখে। একটু পরেই দেখল বড় রাস্তা। দিয়ে একটা গাড়ি সোজা চলে গেল উত্তর দিকে সামনের অনেকদূর পর্যন্ত আলোকিত করে। মিত্রাও পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল, চাপা গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘চলে গেল?
তাই তো মনে হচ্ছে।’
ঘরের এক কোণ থেকে ছুরিটা তুলে নিয়ে মিত্রা সেনের হাতের বাঁধন কেটে দিল রানা। হাত ছাড়া পেয়ে প্রথমেই নগ্ন বুক দুহাতে ঢাকল মিত্রা। তখনও থর থর করে কাঁপছে সারা অঙ্গ। আলনা থেকে একটা ব্লাউজ টেনে ছুঁড়ে দিল রানা ওর দিকে। তারপর বলল, ‘আপনি জামাটা পরে ফেলুন, আমি আপনার জন্যে একটু উইস্কি নিয়ে আসছি। বাথরুমের মধ্য দিয়ে নিজের ঘরে চলে এল রানা।
সুটকেস থেকে বোতল বের করে আধ গ্লাস উইস্কি ঢেলে নিয়ে পাশের ঘরে এল রানা। দেখল কাপড় পরে বিছানার ওপর বসে আছে মিত্রা সেন আড়ষ্ট ভঙ্গিতে।
‘টুক করে এটুকু খেয়ে ফেলুন, আমি মৈত্র মশাইকে ডেকে আনছি।’
চট করে একবার রানার চোখের দিকে চেয়ে নিল মিত্রা সেন। তারপর গ্লাসটা নিয়ে একহাতে নাক টিপে ধরে তিন ঢোকে খেয়ে ফেলল উইস্কিটুকু। রানা ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল, কী মনে করে মিত্রা ডাকল, ‘শুনুন।
কী?
‘মৈত্র মশাইকে ডাকা যাবে পরে। এখন এই চেয়ারটায় বসুন তো, কপালটা অসম্ভব ফুলে গেছে, জলপট্টি লাগিয়ে দিই। তা ছাড়া মৈত্র মশাই এসে এখন আহা-উঁহু ছাড়া আর কী করবেন?
একটা রুমাল চার ভাজ করে এক মগ পানিতে ভিজিয়ে ভিজিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ফোলা জায়গাটায় ধরল মিত্রা, তারপর ভেজা রুমালটা কপালে বসিয়ে আরেকটা কাপড় দিয়ে বেঁধে দিল রানার মাথাটা।
‘মৈত্র মশাইকে ডাকার কোনও দরকার নেই, হঠাৎ বলে উঠল মিত্রা। ‘বিপদগ্ৰস্তা ভদ্রমহিলার জন্যে নিরীহ শান্তিপ্রিয় ফটোগ্রাফারের কাছাকাছি থাকাই বেশি নিরাপদ।
ভাবছি, এই লোকগুলো কে। আপনি চেনেন এদের? আপনাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল কোথায়?
‘আমি কিচ্ছু জানি না। কোনদিন দেখিনি এদের।
সাধারণ গুণ্ডা বলেই তো মনে হলো। কিন্তু কোনও আভাসই পাননি আপনি, এটা কেমন কর্থা?
‘এমনি কানাঘুষোয় শুনেছি, একটা বদমাশের দল আছে, ইয়াং টাইগারস না কী একটা নাম-ওরা নাকি তোক লাগিয়েছে, সুযোগ পেলেই আমাকে ধরে নিয়ে যাবে ওদের আড্ডায়। তেমন কোনও গুরুত্ব দিইনি ওসব কথার।
ইয়াং টাইগারস-এর নাম শুনে একটু কঠিন হয়ে গেল রানার মুখ। পর মুহূর্তেই স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, আপনার দলের কাউকে যদি ডাকতে বলেন তো ডেকে দিতে পারি। আর নইলে আপনি বিশ্রাম করুন, আমি আমার ঘরে যাই। রাত এখনও অনেক বাকি আছে, এভাবে গল্প করলে কাটবে না।’
উঠে দাঁড়াল রানা। ঝমঝম অবিরাম বৃষ্টি পড়ছে এখনও। কাছেই কোনও পুকুরে ব্যাঙ ডাকছে কা-কোকা-কো একঘেয়ে সুরে। বিজলী চমকে উঠল আকাশ চিরে।
মিত্রাও উঠে দাঁড়াল।
‘কেমন লোক আপনি? আপত্তির সুর মিত্রার কণ্ঠে। এই ঘরে একা আমাকে ফেলে চলে যাচ্ছেন যে বড়? একা কী করে থাকব আমি এই জানালা ভাঙা ঘরে?
একটু ভেবে নিয়ে রানা বলল, ‘বেশ তো, আপনি আমার বিছানায় গিয়ে নিশ্চিন্তে শুয়ে পড়ুন। আমি না হয় এই ঘরে আপনার পাহারায় থাকব।
‘আমার এৰ্মনিতেই আজ রাতে আর ঘুম আসবে না। আসুন না, আপনার ঘরে বসে গল্প করে কাটিয়ে দিই রাতটা?’
না। আপনার ঘুম না এলেও আমার ঘুম আসবে। ঘুরে দাঁড়াল রানা।
‘আপনি আমাকে তাড়াতে পারলেই বাঁচেন মনে হচ্ছে।’
‘হ্যাঁ।’
কারণ? অনুষ্ঠানের শেষে দুর্ব্যবহার করেছিলাম, তাই?
না। মিত্রার চোখের দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে চাইল রানা। সেজন্যে নয়। কারণটা খুবই সাধারণ। আপনি সুন্দরী রমণী। আমি শক্তিশালী পুরুষ। এখন। অনেক রাত। বাইরে ঝমাঝম বৃষ্টি। এ ঘরে আপনি একা। আমি বহ্মচারী মহাপুরুষ নই। আমার মধ্যে পশু জেগে ওঠা কি একেবারেই অস্বাভাবিক?
মন দিয়ে কথাগুলো শুনল মিত্রা। বুঝল কথাটা বিশ্রী হলেও সত্য। মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল ওর। শুধু বলল, আপনি একটি ছোটলোক, তারপর হঠাৎ ঘুরে চলে গেল রানার ঘরে।
এক মিনিটের মধ্যেই আবার ফিরে এল মিত্রা। হাতে রানার ওয়ালথার পিপিকে পিস্তলটা।
‘এই নিরীহ শান্তিপ্রিয় বস্তুটি বালিশের তলায় থাকলে অস্বস্তি লাগছে। জিনিসটা আপনার কাছেই থাক-কোনও কাজে লেগে যেতে পারে।’
ঘণ্টা দেড়েক পার হয়ে গেল। বাতি নিভিয়ে দিয়ে বিছানায় শুয়ে উসখুস করছে রানা। কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছে না। বালিশে মিত্রার চুলের মেয়েলি সুবাস। মনে হচ্ছে বিছানায় এখনও লেগে আছে মিত্রার দেহের উত্তাপ। বৃষ্টি থেমে গেছে। বেশ কিছুক্ষণ, তাই দ্বিগুণ জোরে শোনা যাচ্ছে ব্যাঙের ডাক। জানালার বাইরে। টিপ টিপ জোনাকির দীপ জ্বলছে, এখনও পুরোদস্তুর শহর হয়ে উঠতে পারেনি জায়গাটা।
একটা সিগারেট ধরাল রানা। লাইটার নেভাবার ঠিক আগের মুহূর্তে দেখতে পেল ও আবছা একটা লম্বা মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে ঠিক ঘরের মাঝখানে। হাতের পিস্তলটা ওর দিকে তাক করা। চমকে উঠল রানা।
‘এক বিন্দু নড়াচড়া করলেই খুলি ফুটো করে দেব,’ মৃদু অথচ গম্ভীর কণ্ঠস্বর। # মরার মত কাঠ হয়ে পড়ে থাকল রানা। অসতর্ক থাকার জন্যে ভয়ানক রাগ হলো নিজের ওপর। একবার ভাবল বালিশের তলায় পিস্তলটার কথা। কিন্তু এখন চেষ্টা করা বৃথা। দেখা যাক কী হয়।
‘কে?’ জিজ্ঞেস করল রানা।
‘তোমার যম!’ সংক্ষিপ্ত উত্তর।
এক পা এক পা করে পিছিয়ে গেল লোকটা। পিস্তলটা তেমনি ধরা। টেবিল ল্যাম্পটা জ্বেলে দিল সে। লোকটার চেহারা দেখেই অবাক হয়ে উঠে বসল রানা বিছানার ওপর।
‘তুই! তুই শালা এত রাতে এ ঘরে ঢুকেছিস কী করতে?
উজ্জ্বল হাসিতে উদ্ভাসিত সোহেলের মুখ।
দিয়েছিলাম তো ঘাবড়ে, বোক-চন্দর? টেরও পেলি নে জলজ্যান্ত মানুষটা ঢুকলাম ঘরের ভেতর? কালই শালা তোর চাকরি খেয়ে দেব আমি দেখিস বুড়োকে বলে।
ওর একান্ত প্রিয় নাইন মিলিমিটার হ্যাঁমার লেস লুগার পিস্তলটা প্যান্টের নীচে তলপেটের কাছে লুকোনো হোলস্টারে ঢুকিয়ে দিল সোহেল।
‘আরে যা যা! তোর মত দশটা বয়-বেয়ারা আমার এক ডাকে ছুটে আসে, তা জানিস? তুই আমার কচু করতে পারবি। আর একটু হলে যেই হার্টফেলটা করতাম-বারোটা বেজে যেত তোর। কিন্তু দোস্ত, মনে হচ্ছে আজ রাতের সব ঘটনাই তোর জানা?’
‘স-অব, স-অব! সব দেখেছি তো আমি। আহাহা! তোর কপালে যখন জলপট্টি লাগাচ্ছিল না, উ-উ-হ! জিভ দিয়ে একটা বিশেষ শব্দ বের করল সোহেল। তখন আমার কী ইচ্ছে করছিল জানিস? মনে হচ্ছিল নিজেই নিজের। কপালে একটা ইট মেরে গিয়ে হাজির হই সামনে।
হাসল রানা। একটা সিগারেট ছুঁড়ে দিল সোহেলের দিকে। খপ করে সেটা ধরে নিয়ে হাতল-বিহীন একটা চেয়ারে উল্টো হয়ে বসল সোহেল। সিগারেটটা ধরিয়ে নিয়ে হঠাৎ বলল, আমার কথা হেড-অফিসের সবাই ভুলে গেছে, নারে? কেউ আমার কথা কিছু বলে না? একটা করুণ সুর ধ্বনিত হলো ওর কণ্ঠে।
বলবে না কেন? সবাই বলে।’ মিথ্যে কথা বলল রানা। নিত্যনতুন কাজের চাপে অতীতকে মনে রাখবার উপায় আছে? ও নিজেই তো প্রায় ভুলতে বসেছিল। তবু বলল, ‘কেন, তোর ওই সিঙ্গাপুর অ্যাসাইনমেন্ট-এর দৃষ্টান্ত দিয়ে সেদিন মেজর জেনারেল তো এক লেকচারই ঝেড়ে বসল আমাদের ওপর।
কেন জানি কথাটা অকপটে বিশ্বাস করল সোহেল। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়ল ওর। বলল, ‘কী দিন ছিল, তাই না রে? তারপর হঠাৎ শশব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল। কাছে এসে এক টানে রানার পট্টি খুলে দিল।
ন্যাকামি হচ্ছে, না? মাথায় ব্যাণ্ডেজ বেঁধে একেবারে সিনেমার হিরো! আঁ? খোল, শালা!’
কপালের আঘাতটা ভাল করে পরীক্ষা করে দেখল সোহেল। তারপর পকেট থেকে বের করল একটা মলমের কৌটো। কৌটোর নীচের দিকটা শক্ত করে চেপে ধরে রানার দিকে বাড়িয়ে দিল। ঢাকনিটা খুলে দিল রানা। কালো মত ওষুধ।
কী ওষুধ রে?’ জিজ্ঞেস করল রানা।
‘আইয়োডেক্স। ডাক-বাংলোর ফাস্ট-এইড বক্সে পেলাম। শিশিটা ভেঙে গেছে বলে বোধহয় এই কৌটোয় তুলে রেখেছে লেবেল লাগিয়ে।’
রানার কপালে লাগিয়ে দিল সোহেল মলমটা। তারপর আঙুল দুটো নির্দ্বিধায় রানার পরিষ্কার শার্টে মুছে নিয়ে পকেট থেকে গোটা দুই নোভালজিন ট্যাবলেট বের করে দিল।
‘এ দুটো মেরে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ু। সাড়ে তিনটে বাজছে। আমি বাকি রাতটুকু পাহারা দেব।’
‘বেশ। অতি উত্তম প্রস্তাব। আর সকালে গোটা আষ্টেক ডিম পোচ, ছ’স্লাইস বাটার টোস্ট, চারটে অমৃত সাগর কলা আর ফাস ক্লাস করে এক কাপ কফি বানিয়ে নিয়ে আসবি বেল বাজানো মাত্র। নইলে ম্যানেজারকে বলে তোর কান…’
কানটাকে কী করা হবে হাতের ইঙ্গিতে দেখাল রানা। মৃদু হাসল সোহেল। তারপর রানার ওষুধ খাওয়া হয়ে গেলে জানালা গলে বেরিয়ে গেল জোনাক-জ্বলা অন্ধকারে।
নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ল রানা।