2 of 3

ভানুমতির খেল

ভানুমতির খেল

ভানুমতির খেল বা ভানুমতিকা খেল, ভোজবাজি, জাদুবিদ্যা, ইন্দ্ৰজাল, ভানুমতির ভেলকি, কুহকবিদ্যা ইত্যাদি প্রায় সমার্থক বিষয়। বাংলার পথে- প্রান্তরে জাদুবিদ্যা প্রদর্শনকারীরা তাদের জাদু দেখানোর সময় ভানুমতির খেল কথাটি ব্যবহার করে থাকে অনেক সময়। আবার অতি ধুরন্ধর বা কর্মকুশল ওস্তাদ সুনিপুণভাবে কোনো কাজ (যা অনেকক্ষেত্রে অসম্ভব বলে বিবেচিত ) করলে তার কৌশলকে ভানুমতির খেল নামে আখ্যায়িত করা হয়। এ অবস্থায় অনেক ধড়িবাজও সাধারণ মানুষের চোখে ধুলো দিয়ে কৌশলে প্রতারণা করার সুযোগ খোঁজে। এটিও সম্ভব হয় ভানুমতির খেল নামক দক্ষতা প্রয়োগের মাধ্যমে। হাত সাফাই, চোখে ধুলো দেয়া অথবা আপাত অসম্ভব কাজ কৌশলে করার জন্য এদেশে ভানুমতির খেল-প্রবাদের উদ্ভব।

কিন্তু জাদুবিদ্যা বা ভেলকির সাথে ভানুমতির নাম কেন জড়িত হলো? কে এই ভানুমতি? তার সম্পর্কে তথ্য উদ্‌ঘাটনের চেষ্টা এ নিবন্ধের লক্ষ্য। আমরা বেশ কয়েকজন ভানুমতির নাম মহাভারত, পুরাণ, সাহিত্য ও ইতিহাসে পাই। তাদের সম্পর্কে সামান্য পরিচিতি উল্লেখ করে আমরা ভোজবিদ্যার সাথে জড়িত ভানুমতির কথা বলতে চাই।

রাজা ধৃতরাষ্ট্রের বড় ছেলে দুর্যোধনের স্ত্রীর নাম ভানুমতি। তার গর্ভে লক্ষ্মণ নামে পুত্র ও লক্ষ্মণা নামে কন্যা জন্মগ্রহণ করে। কুরুক্ষেত্রযুদ্ধের ত্রয়োদশ দিনে অর্জুনপুত্র অভিমন্যুর হাতে লক্ষ্মণের মৃত্যু ঘটে। লক্ষ্মণাকে বিয়ে করেছিলেন শ্রীকৃষ্ণের পুত্র শাম্ব।

যদুবংশীয় ভানুর কন্যা ভানুমতি। নিকুম্ভ নামে এক অসুর (রামায়ণের নিকুম্ভ নয়) এই ভানুমতিকে অপহরণ করে। ফলস্বরূপ কৃষ্ণ, অর্জুন ও কৃষ্ণপুত্র প্রদ্যুম্ন কর্তৃক নিহত হয় নিকুম্ভ। পরে কনিষ্ঠ পাণ্ডব সহদেব এই ভানুমতিকে বিয়ে করেন।

চন্দ্রবংশের রাজা কনকের পুত্র কৃতবীর্য। এই কৃতবীর্যের কন্যার নাম ভানুমতি। অহংযাতি তার স্বামীর নাম।

ব্রহ্মার দ্বিতীয় পুত্রের নাম অঙ্গিরস। দেবগুরু বৃহস্পতি এই ঋষি অঙ্গিরসের পুত্র। অঙ্গিরসের স্ত্রীর নাম শুভা। অঙ্গিরসের প্রথম কন্যা হলেন ভানুমতি। ইক্ষাকুবংশীয় রাজা সগরের এক স্ত্রীর নামও ভানুমতি।

বেশ কয়েকজন ভানুমতির সংক্ষিপ্ত পরিচয় আমরা উল্লেখ করলাম। আসলে এইসব ভানুমতির সাথে আমাদের আলোচ্য ভানুমতির কোনো সম্পর্ক নেই। আমাদের ভানুমতি হলেন ভোজরাজকন্যা ভানুমতি এবং তার স্বামী হলেন মহারাজ বিক্রমাদিত্য। ভোজরাজ ছিলেন মালব দেশের রাজা।

অনেকের বিশ্বাস, ভানুমতির পিতা ভোজরাজ ইন্দ্রজালবিদ্যার প্রবর্তক। এই অঘটন-ঘটনা-পটু বিজ্ঞানের নাম ভোজরাজের নামে পরিচিত হয়েছে ভোজবিদ্যা নামে। প্রবাদ আছে যে, বিদ্যনুরাগী ভোজরাজ এই অপূর্ব মায়াবিদ্যার উৎকর্ষ সাধনের জন্য সচেষ্ট ছিলেন। সেজন্য তার চেষ্টায় ও যত্নে তার রাজ্যে এই বিদ্যার প্রসার ঘটে। তিনি নিজেও এই বিদ্যা চর্চা করতেন।

কথিত হয় যে, পিতার প্রবর্তিত এই অদ্ভুত জাদুবিদ্যায় ভোজরাজকন্যা ভানুমতি বিশেষভাবে পরাদর্শী ছিলেন। তার এই দক্ষতা সম্পর্কে নানা গল্প চালু আছে। কিংবদন্তি আছে যে, ভানুমতি একদিন জাদুবিদ্যা প্রয়োগ করে মাঠের মধ্যে সমুদ্র সৃষ্টি করে বিক্রমাদিত্যের গতিরোধ করেছিলেন। বত্রিশ সিংহাসন বা দ্বাত্রিংশৎপুত্তলিকাকথন এই ভোজবিদ্যা কৌশলের নিদর্শনমাত্ৰ।

বিক্রমাদিত্যের সভাকবি কালিদাস বলেছেন-

দেবগুরোঃ প্রসাদেন জিহ্বাগ্রে মে সরস্বতী।
তেনাহং নৃপ জানামি ভানুমত্যাস্তিলং যথা ॥

অর্থাৎ কালিদাস দেবগুরু বৃহস্পতির কৃপায় তার জিহ্বায় সরস্বতীকে অধিষ্ঠিত পেয়েছিলেন এবং সেরকম রাজা বিক্রমাদিত্যের কৃপায় তিনি জানতে পারেন যে, ভানুমতির অঙ্গের কোন্ স্থানে তিল আছে। এ থেকে বুঝা যায় যে, বিক্রমাদিত্যের সভাতেও এই বিদ্যার চর্চা ছিল। তবে কাহিনীর সত্যাসত্য নির্ণয়ের চেষ্টা না করে আমরা ভানুমতির খেল প্রবাদের উৎস অনুসন্ধানে ভোজরাজকন্যা ভানুমতি সম্পর্কিত কিংবদন্তির আশ্রয় নিলাম। ভানুমতি বিক্রমাদিত্যের স্ত্রী হিসেবে ভোজবিদ্যার চর্চা করুন আর নাই করুন এদেশে নিম্নস্তরের জাদুকরদের (কখনো বেদে জাতীয়) মুখে আজো শুনি, ‘লাগ লাগ ভেলকি লাগ, মামীর মায়ের খেলা দেখ’, কিংবা ‘লাগ ভেলকি লাগ, চোখে মুখে লাগ।’

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *