ভবিতব্য
শিপ্রার অপর তটে নেমে আসে সুদীর্ঘ রজনী;
শীর্ণ তরুবীথিকারে আত্মসাৎ করে অন্ধকার;
বিদায়, বিদায়, তবে চিরতরে বিদায়, সজনী;
সমাপ্ত সুকৃতি আজি, স্বর্গচ্যুতি আসন্ন আমার॥
কী ব’লে অদৃশ্য হব? রেখে যাব কোন্ প্রতিশ্রুতি?
মাগিব কী স্মৃতিচিহ্ন? ৱিনিময় করিব কী আশা?
অন্তরের অন্তরীক্ষে গুমরিছে মর্ত্যের আকৃতি—
বিনাশ, নৈরাশ, অশ্রু, নিষ্ফলতা, কর্তব্য, পিপাসা।।
সে-পথেরই যাত্রী তুমি, শত পান্থ গেছে বিস্মরণে,
প্রাগ্রসর পদরেখা যার ‘পরে আঁকি অবিরত;
তুমিও ঘুচালে শ্রান্তি ধ্বংসশেষ এ-চিত্তভবনে,
জ্বালি ধূমাঙ্কিত দীপ নিশাক্রান্ত উদ্বাস্তুর মতো।।
তুমিও উধাও হবে, সঙ্গে ল’য়ে অন্তিম সান্ত্বনা—
স্মৃতির সমষ্টিখানি অবিচ্ছিন্ন, অনির্বচনীয়;
যাবে স্তূপীকৃত করি মূল্যহীন ভগ্ন আবর্জনা
পরিত্যক্ত হৃদয়ের কোণে কোণে আঁধারে তুমিও।।
ভেবো না, ভেবো না, সখী; স্বপ্নদুঃস্থ দীর্ঘ রাত্রি-শেষে
বসন্ত অন্তরে তব আরম্ভিবে পুন চতুরালি;
নবীন ফাল্গুনী আসি হানা দিবে রুদ্ধ দ্বারদেশে;
ফলিবে মানসক্ষেত্রে বর্ষে বর্ষে সোনার চৈতালী।।
ক্ষণিক ইন্দ্ৰত্ব লভি অনায়াস তপস্যার ফলে,
তোমার উরসস্বর্গে বিরাজিবে বহু মর্ত্যচর;
যে-হস্ত নিবদ্ধ এবে মোর ভুজে প্রাণপণ বলে,
রচিবে বরণমাল্য বারংবার সে-নিষ্কম্প্র কর।।
আজিকে আমার চিত্তে পুঞ্জিত যে-উদ্বিগ্ন বিষাদ,
ভবিতব্যভারাতুর, স্তব্ধ, মূক মেঘের সমান,
কালবৈশাখীর ঝড়ে টুটিবে সে-সংহতির বাঁধ;
চপলা দরশ দিবে; মুক্ত হবে অবরুদ্ধ দান।
তোমারে ভুলিব আমি, তুমি মোরে ভুলিবে নিশ্চয়;
মদনের চিতানলে অনঙ্গের হবে আবির্ভাব;
হরিবে অসংখ্য অলি যৌবনের অমৃতসঞ্চয়;
সর্বস্বান্ত মর্মে শুধু প’ড়ে রবে অবেদ্য অভাব।।
৯ ডিসেম্বর ১৯২৯