ভগ্ন অংশ ভাগ

ভগ্ন অংশ ভাগ

শিবেন প্রশ্ন করল, ‘অশোকনাথ ঘোষালের নাম জানা আছে?’

দময়ন্তী বলল, ‘না।’

সমরেশ বলল, ‘হ্যাঁ, জানা আছে। যদি প্রোগ্রেসিভ ফার্মাসিউটিক্যালসের চেয়ারম্যান এ এন ঘোষালের নাম হয়।’

শিবেন মাথা নাড়ল। বলল, ‘হ্যাঁ, ওই নামই বটে। এঁর সম্বন্ধে তুই কী জানিস?’

‘তেমন কিছু নয়। অনেকগুলো কোম্পানির ডিরেক্টর, এককালে বোধ হয় বিখ্যাত ব্রিটিশ ফার্ম স্টুয়ার্ট অ্যান্ড লোম্যাক্সের চিফ ছিলেন, রায়বাহাদুর বা রায়সাহেব ধরনের খেতাব পেয়েছিলেন। ভালো লোক, কেবল ফার্মাসিউটিক্যালসই নয়, সব ইন্ডাস্ট্রির লোকেরাই এঁকে ভক্তিশ্রদ্ধা করে থাকে। বয়সের গাছপাথর নেই, অথচ শুনেছি রোজ গলফ খেলেন।’

‘বাঃ, তুই তো অনেক কিছুই জানিস দেখছি! ভদ্রলোকের বাড়ি কোথায় জানিস?’

‘নাঃ। চেয়ারম্যানরা কোথায় থাকেন সে সম্পর্কে আমার কিছুমাত্র ধারণা নেই।’

‘হাঁসপুকুর লেনের নাম শুনেছিস? জোড়াসাঁকোয়। তার তিন নম্বর বাড়িতে।’

‘অত্যন্ত সুসংবাদ। তা, আমাদের কী করতে হবে? তিনি কি ওই হাঁসপুকুর না কি বললি সেখানে আমাদের নেমন্তন্ন করেছেন?’

‘হ্যাঁ।’

‘অ্যাঁ? হ্যাঁ? হ্যাঁ মানে কী?’ সমরেশ আর দময়ন্তী সমস্বরে প্রশ্ন করল।

‘হ্যাঁ মানে হ্যাঁ। বড়োকর্তাকে অনুরোধ করেছেন যেন আগামী কাল সন্ধ্যেবেলা আমি তোদের নিয়ে ওঁর বাড়িতে যাই। বউদির সঙ্গে ওঁর কী সব পরামর্শ আছে। মিস্টার ঘোষালের নিজেরই এখানে আসার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু শরীরের অবস্থা বিবেচনা করে সে ইচ্ছে নিতান্ত অনিচ্ছায় কার্যে পরিণত করতে পারছেন না। যদি আপনি যেতে না পারেন, তাহলে কাল সকালের মধ্যে লালবাজারে বড়োকর্তাকে জানিয়ে দেবেন সেকথা। তবে, আপনি গেলে উনি খুব খুশি হবেন।’

দময়ন্তী ভয়ানক চিন্তিত হয়ে পড়ল। বলল, ‘সে তো বুঝতে পারছি। কিন্তু মিস্টার ঘোষাল আমার নাম জানলেন কোত্থেকে?’

শিবেন সহাস্যে বলল, ‘আপনার যে বেশ নাম ছড়িয়ে পড়েছে, তাতে কি কোনো সন্দেহ আছে? কাজেই, কোত্থেকে সে প্রশ্ন বাহুল্য মাত্র।’

‘ইয়ার্কি করবেন না তো! এত বড়ো একজন মানুষ, আমার সঙ্গে তাঁর কী সম্পর্ক থাকতে পারে? আপনি কিছু জানেন?’

‘একেবারেই না। কাল তো শনিবার, সন্ধ্যেবেলা ট্রাফিক বেশ বেশিই হবে। আমি সাড়ে পাঁচটা নাগাদ আসব, তাহলে ঠিক সন্ধ্যের মুখে জোড়াসাঁকোয় পৌঁছে যাওয়া হবে। তখনই সব ব্যাপারটা বোঝা যাবে।’

.

সমরেশ বলল, ‘এইরকম এঁদো গলিতে তোর চেয়ারম্যান ঘোষালের বাড়ি?’

শিবেন অত্যন্ত সাবধানে ওর ফিয়াট গাড়িটা গলিতে ঢোকাতে ঢোকাতে বলল, ‘দ্যাখ সমরেশ, প্রথমত, এই ঘোষাল আমার চেয়ারম্যান নন। দু-নম্বর, এটা গলি ঠিক, কিন্তু এঁদো নয়। দু-পাশের বাড়িগুলো দেখেছিস? এখানকার লোকেরা লাখ টাকার নীচে চেক লেখে না, বুঝলি? এইসব বাড়িগুলোর দলিলে ওয়ারেন হেস্টিংসের সই আছে। বন কেটে বসত।’

‘তা তো বুঝতেই পারছি। পলাশি যুদ্ধের আমলের যত বাড়ি। ভেতরে নিশ্চয়ই ওয়ারেন হেস্টিংসের ভূতও আছে।’

‘তা থাকা অসম্ভব নয়। এই যে, তিন নম্বর এসে গেছে। বাপরে, গেটের কী বাহার!’

কেবল গেট কেন, সমস্ত বাড়িটাই দেখবার মতো। অনেকটা সবুজ জমির মধ্যে ইংরেজি রূপকথার বইয়ে আঁকা দুর্গের মতো দেখতে বাড়িটা। দেখলে যেমন বিস্মিত হতে হয়, তেমনি কেমন ভয়ও করে। মনে হয় সত্যি সত্যি যেন এর অন্ধকার ছায়া ছায়া আনাচে কানাচে এ-বাড়ির পূর্বপুরুষদের জটলা চলেছে। যেন পুরোনো কলকাতা চলে যেতে যেতে এইখানে এসে থমকে দাঁড়িয়ে গেছে। আকাশে তখনও দিনের শেষ আলো, অন্ধকার নামতে কিছু দেরি আছে। সেজন্যে বাড়িটাতে তখনও আলো জ্বলেনি, কেবল গেটের দু-পাশে থামের মাথায় কারুকার্য করা রট-আয়রনের লণ্ঠনে আলো জ্বলছে। সেই আবছায়া আলোয় বাড়িটাকে রূপকথার দুর্গের মতোই অবাস্তব বলে মনে হচ্ছে।

শিবেনের গাড়ি গেটের সামনে দাঁড়াতে বাড়িটার মতোই এক অতি প্রাচীন দারোয়ান দরজা খুলে দিল। একমাত্র গেট খোলা ছাড়া এই দারোয়ানের আর কোনো কর্তব্য যে থাকতে পারে সেরকম মনে হল না। কিন্তু গাড়ি-বারান্দার নীচে যে অতিথিদের অভ্যর্থনা করার জন্যে দাঁড়িয়ে ছিল, সে অবশ্য অতটা প্রাচীন নয়। তার পরনে সাদা পাজামা, সাদা গলাবন্ধ হাঁটু পর্যন্ত লম্বা কোট, মাথায় সাদা গান্ধীটুপি। বিনয়ে আনত হয়ে সে অতিথিদের বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেল।

.

সাদা গান্ধীটুপি অতিথিদের যে স্বল্পালোকিত ঘরে ঢুকিয়ে বিনীতভাবে দরজায় দাঁড়িয়ে রইল, সেটা একটা লাইব্রেরি। একপাশের দেওয়ালে তিনটে রঙিন কাচ বসানো খিলেন করা লম্বাটে জানলা আর বাকি তিন পাশের দেওয়ালে মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত উঁচু বই-ভরতি অতিকায় আলমারির সার। একটা আলমারির সামনে দিকের ওপরের তাকগুলো থেকে বই পাড়ার জন্যে তলায় চাকা লাগানো একটা ঘড়াঞ্চি রাখা আছে। মেঝেয় পুরু কার্পেট। জানলাগুলোর সামনে একটা প্রকাণ্ড সেক্রেটারিয়েট টেবিল। তার সামনে গোটাচারেক কারুকার্য করা উঁচু ব্যাকরেস্টওলা চেয়ার। টেবিলের উলটোদিকে একটা রিভলভিং চেয়ারে একজন বসেছিলেন। অতিথিদের দেখে উঠে দাঁড়ালেন।

বলিরেখাচ্ছন্ন মুখ, শীর্ণকায়, পক্ককেশ গৌরবর্ণ বৃদ্ধ, চোখে মোটা কাচের মোটা ফ্রেমের চশমা, পরিষ্কার করে কামানো মুখ, পরনে চিকনের কাজ করা আদ্দির পাঞ্জাবি। একটু সামনে ঝুঁকে দাঁড়িয়েছেন, সেটা দাঁড়াবার স্বাভাবিক ভঙ্গিও হতে পারে, বয়েসের ভারেও হতে পারে। মুখে স্মিত হাসি, কিন্তু চোখের দৃষ্টি সজাগ ও তীক্ষ্ন।

শিবেন এগিয়ে গিয়ে নিজের পরিচয় দিলে, তারপর বাকি দুজনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। বৃদ্ধ হাত নেড়ে নেড়ে অতিথিদের বসতে বলে নিজেও বসলেন। কিছুক্ষণ দময়ন্তীকে দৃষ্টি দিয়ে যেন যাচাই করে নিয়ে বললেন, ‘তোমার এত কম বয়েস আমি বুঝতে পারিনি। তুমি করেই বললুম, কিছু মনে করো না।’ ভদ্রলোকের গলা অনুচ্চ এবং গম্ভীর।

দময়ন্তী মৃদু হেসে বলল, ‘মনে করব কেন? আপনি তুমি করেই বলবেন।’

বৃদ্ধও হাসলেন। বললেন, ‘ভালো কথা। তা, তুমি নিশ্চয়ই ভাবছ, আমি তোমার খোঁজ পেলুম কোত্থেকে। পেয়েছি আমার এক নাতনির কাছে, সে তোমার ছাত্রী। বি এ পড়ছে।’

‘কী নাম?’

‘সেটা বলা বারণ আছে। দেখলুম প্রোফেসর ডি ডি জি-কে সে যেমন ভক্তি করে তেমনি ভয়ও পায়। তা থাক সে কথা। আমি তোমাকে যে কারণে ডেকেছি, আগে সে কথাটা সেরে নিই। তবে তার আগে বলো কে কী খাবে। সেনসাহেব, হুইস্কি চলবে তো?’

শিবেন অম্লানবদনে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।

‘আপনার? হুইস্কি?’

সমরেশও বিনা বাক্যব্যয়ে সম্মতি জানাল।

‘আর তোমার? শেরি?’

দময়ন্তী মাথা নাড়ল। বলল, ‘না। একটু কফি হলে ভালো হত।’

‘নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। পান্নালাল, দুটো হুইস্কি, একটা কফি আর আমার জন্যে একটা ছোটো কনিয়াক নিয়ে এসো।’

দরজার কাছে চিত্রার্পিতবৎ গান্ধীটুপি হঠাৎ মাথাটা একবার সামনে ঝুঁকিয়ে দিয়ে বাড়ির ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেল।

অশোকনাথ ঘোষাল বললেন, ‘আমরা তাহলে শুরু করতে পারি?’

দময়ন্তী এইবার মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।

‘যে সমস্যাটা নিয়ে আমি তোমার সঙ্গে পরামর্শ করতে চাই, সেটা ঠিক আমার সমস্যা নয়, আমার ছেলের।’

দময়ন্তী প্রশ্ন করল, ‘আপনার ছেলে কোথায়?’

‘সে এ বাড়িতে থাকে না। যোধপুর পার্কে তার বাড়ি।’

‘আপনার কি একই ছেলে?’

‘হ্যাঁ। এক ছেলে, এক মেয়ে। মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। সে থাকে মাদ্রাজে। আমার জামাই সেখানে ডাক্তারি করে।’

‘আপনার স্ত্রী?’

‘তিনি বহুদিন গত হয়েছেন। রাকার বয়েস তখন বছর বারো। আমার মেয়ের নাম রাকা।’

‘তাঁর এখন বয়েস কত?’

অশোকনাথ মনে মনে হিসাব করে বললেন, ‘ছাপ্পান্ন। আশ্চর্য নয়? সময় বহিয়া যায়, নদীর স্রোতের প্রায়।’ বলতে বলতে একটু যেন অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন। তারপর হঠাৎ সম্বিত ফিরে পেয়ে বললেন, ‘কিন্তু সমস্যাটা তো আমার মেয়ের নয়, আমার ছেলে— অলোকনাথের।’

‘সমস্যাটা?’

‘বলছি। হোয়াইট স্টার ইন্ডাস্ট্রিস লিমিটেডের নাম শুনেছ কি না জানি না। আমার ছেলে এই কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর। ক্যামাক স্ট্রিটে এদের হেড অফিস। দুটো ফ্যাক্টরি আছে, একটা জোকায়, অন্যটা বালিটিকুরিতে। এরা হোয়াইট স্টার ব্র্যান্ড নেম-এ নানারকম ইকুইপমেন্ট বানায়। এইখানে একটা গণ্ডগোল বেঁধেছে। তাই নিয়েই তোমার সঙ্গে পরামর্শ।’

‘কী ধরনের গণ্ডগোল?’

‘বলছি। তবে তার আগে একটা অনুরোধ করতে চাই— আপনাদের সকলের কাছে। তা হল, এখানে যা কথাবার্তা হবে তা নিয়ে যেন বেশি জলঘোলা না হয়। আমি চাই তদন্তটা যথাসম্ভব গোপনে লোক জানাজানি না করে যেন করা হয়।’

শিবেন বলল, ‘তাই হবে। যথাসম্ভব গোপনেই করা হবে।’

‘বেশ। এবার তাহলে গণ্ডগোলটা কী সেটা বলি। হোয়াইট স্টার ইন্ডাস্ট্রিস লিমিটেড, আদতে ছিল সাহেবি কোম্পানি। উনিশ-শো সাতচল্লিশের পরেও অনেক দিন পর্যন্ত বিলেত থেকেই এটা চালানো হত। আটান্ন থেকে বিলেতের প্রভাব কমতে থাকে এবং ম্যানেজমেন্টে ভারতীয়রা আসতে শুরু করে। সত্তর সালে এটা পুরোপুরি ভারতীয় কোম্পানি হয়ে যায়।’

সমরেশ জিজ্ঞেস করল, ‘এখন ওর মালিক কে?’

‘মালিক ঠিক কেউ নেই, এটা পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি। তবে কোনো একজন ইন্ডাসট্রিয়ালিস্ট সম্প্রতি গোপনে এটা কিনে নেবার চেষ্টা করছিলেন।’

‘কে?’

‘সেটা সঠিক জানি না। তবে গুজব শুনেছি মহাকোশল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের যোগেশ্বর রাই নাকি এর পেছনে ছিল।’

‘আচ্ছা, এ ব্যাপারে আমরা পরে কথা বলব।’ বলল দময়ন্তী, ‘এখন বলুন গণ্ডগোলটা কী হচ্ছে?’

‘হ্যাঁ। গণ্ডগোলটা হচ্ছে সাবোটাজ। জোকা ফ্যাক্টরিতে দু-বার আগুন লাগে। তখন ভাবা হয়েছিল সে ব্যাপারটা অ্যাক্সিডেন্ট। কিন্তু বালিটিকুরিতে যা ঘটেছে, তারপর আর তা ভাবা যাচ্ছে না। তবে সে ঘটনার কথা বলবার আগে হোয়াইট স্টারের ইতিহাস একটু বলা দরকার।

‘সত্তর সালে সাহেবরা যখন চলে যায়, তখন এদের একমাত্র বালিটিকুরিতেই ফ্যাক্টরি ছিল। সেইসময় হোয়াইট স্টার খুব দুরবস্থায় পড়েছিল। বাজার মন্দা, লেবার ট্রাবল, অন্যান্য গোলমাল, সব মিলে কোম্পানির যায়-যায় অবস্থা। সেইসময় আমার ছেলে, সীতারামন আর প্রশান্ত ঘটক, এই তিনজনে শক্ত হাতে হাল ধরে। আমার ছেলে ছিল প্রোডাকশনে, সীতারামন ফাইনান্সে আর প্রশান্ত সেলসে। এদের তিনজনের মিলিত চেষ্টায় হোয়াইট স্টার আবার নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে। এমনকী ছিয়াত্তর থেকে রীতিমতো প্রত্যেক বছর শেয়ারহোল্ডারদের ডিভিডেন্ড দিতে শুরু করে। জোকায় নতুন ফ্যাক্টরি খোলে।

‘এর পরের ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত। গত দেড় বছর থেকে হোয়াইট স্টারের অবস্থা হঠাৎ আবার খারাপ হতে থাকে। এর দুটো কারণ আছে। প্রথম, এক্সপোর্ট বাজারে মার খাওয়া। দ্বিতীয়, দেশে এদের ইকুইপমেন্টের চাহিদা কমে যাওয়া।’

‘চাহিদা কমে গেল কেন?’ দময়ন্তী জিজ্ঞেস করল।

‘কমে গেল তার কারণ সরকারি নীতির পরিবর্তন। এরা যে ধরনের যন্ত্রপাতি তৈরি করে, তার চেয়ে উন্নত ধরনের মাল বিদেশ থেকে আমদানি করার ঢালাও অনুমতি দেওয়ার ফলে এ ব্যাপারটা ঘটল। হোয়াইট স্টার তখন এই অবস্থার সঙ্গে মোকাবিলা করবার জন্যে তাদের সমস্ত প্রোডাক্ট নতুন করে ঢেলে সাজাবার এবং উৎপাদন বাড়াবার ব্যবস্থা করল। এতে স্বভাবতই লেবার ইউনিয়নের সঙ্গে মন কষাকষি শুরু হল। ফলে অশান্তি বাড়ল। তার ওপর এইসব নতুন ব্যবস্থার ফলে টাকার টানাটানিও শুরু হল। অবস্থা যখন রীতিমতো সঙ্গীন, হোয়াইট স্টার সিক ইন্ডাস্ট্রি হয়ে যাবে কি না এই যখন শেয়ার বাজারে জল্পনা-কল্পনা আরম্ভ হয়েছে, তখন কোম্পানি মাস তিনেক আগে হঠাৎ দুটো প্রকাণ্ড অর্ডার পেল। একটা এক্সপোর্ট, একটা ডোমেস্টিক। এইবার, যখন সমস্ত ছবিটা পাল্টাবে এটাই সবাই ধরে নিয়েছে, ঠিক তখনই পর পর তিনটে দুর্ঘটনায় সবকিছু তছনছ হয়ে গেল।’

‘দুর্ঘটনা? অন্তর্ঘাত বা সাবোটাজ নয়?’

‘সাবোটাজ সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। জোকা ফ্যাক্টরির আগুন যদিও-বা দুর্ঘটনা বলে ধরে নেওয়া যায়, বালিটিকুরির ব্যাপারটা সেরকম কখনোই হতে পারে না। বালিটিকুরির ফাউন্ড্রি শপে যে বিস্ফোরণটা হয়, সেটা টাইম বোমার। পুলিশ এ ব্যাপারে নিশ্চিত। আর, ওই ঘটনার পর থেকে দুজন ওয়ার্কার নিরুদ্দেশ। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এরা দুজনেই ছিল মদ্যপ, দুশ্চরিত্র এবং জুয়াড়ি। সব সময়েই এদের টাকার টানাটানি চলত।’

‘অর্থাৎ, কেউ চাইছে যেন হোয়াইট স্টার উঠে দাঁড়াতে না পারে।’

‘হ্যাঁ, ব্যাপারটা তাই বটে।’

‘লেবার ইউনিয়ন কী বলছে?’

‘তারা বলছে, এটা ম্যানেজমেন্টের ষড়যন্ত্র। ফ্যাক্টরির লক-আউট ঘোষণা করার বাহানা। যে দুজন ওয়ার্কার অদৃশ্য হয়েছে, তারা নাকি নিতান্ত নিরীহ ভালো লোক ছিল। কোম্পানি গুন্ডা লাগিয়ে তাদের খুন করেছে। এই নিয়ে অশান্তি চরমে উঠেছে। বালিটিকুরির ফ্যাক্টরি কার্যত বন্ধ। জোকায় লেবার ওয়েলফেয়ার অফিসার মার খেয়ে হাসপাতালে ভরতি হয়েছে।

‘আমরা যদি ধরে না নিই যে লেবার ইউনিয়ন যা বলে তা সবই মিথ্যে, তাহলে আপনার কি মনে হয় তাদের এই ধারণার পেছনে একেবারে কোনো সত্য নেই?’

অশোকনাথ মোটা কাচের চশমার ভেতর দিয়ে স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ দময়ন্তীর দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর থেমে থেমে বললেন, ‘লেবার ইউনিয়ন যা বলে তার সবই মিথ্যে, এ ধরনের কেনা প্রত্যয় আমার নেই। তবে, তাদের যে ধারণার কথা আমি তোমাদের বললুম, সেটাও যে একেবারেই ঠিক নয় সে বিষয়েও আমার কোনো সন্দেহ নেই।’

‘কেন?’

‘আমার ছেলে এই কোম্পানির ম্যানেজমেন্টের শীর্ষে আছে। কাজেই, ম্যানেজমেন্ট ষড়যন্ত্র করছে কি করছে না, সেটা আমার চেয়ে বেশি আর কে জানবে? আমার ধারণা, এই ঘটনাগুলোর পেছনে আছে ব্যক্তিগত ঈর্ষা এবং পরশ্রীকাতরতা। আমার ছেলের নেতৃত্বে এই কোম্পানি বড়ো হোক, এটা কোনো একজন লোকের কাম্য নয়। এতদিন সে সুযোগ খুঁজছিল, গত বছরের দুরবস্থা তাকে সেই সুযোগ এনে দিয়েছে। আর এই ব্যাপারটাই তোমাকে দেখতে হবে। নিজের অহংকার আর ঈর্ষার জন্যে যে কয়েক হাজার লোককে অনাহারের মুখে ঠেলে দিতে পারে, তার মুখোশ খুলে দিতে হবে।’

‘এই কাজ পুলিশ করতে পারে না?’

অশোকনাথ তির্যক দৃষ্টিতে শিবেনের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘না। তাহলে আমার বংশের কিছু গোপন কথা, কিছু লজ্জার কথা, সর্বসমক্ষে প্রকাশিত হয়ে পড়বে। সেটা আমার পক্ষে সহ্য করা কঠিন হবে।’

‘কিন্তু কয়েক হাজার লোকের অনাহার কি আপনার বংশগৌরবের চেয়ে বড়ো নয়?’

অশোকনাথ আবার কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, ‘বড়ো ঠিকই। তবুও, যতদিন এবং যতদূর সম্ভব, এসব কথা গোপন রাখা আমার কর্তব্য বলে আমি মনে করি। যদি দেখা যায়, গোপন করা আর কোনোমতেই সম্ভব নয়, তখন পুলিশের কাছে যেতে হলে যাব। শিবেনবাবু সেকথা জানেন। আমি তাঁর কাছে উপদেশ চেয়েছিলুম এবং তোমার নাম বলেছিলুম। তখন তিনি এই আলোচনার প্রস্তাব দেন। এমনকী এই আলোচনায় তিনি উপস্থিত থাকবেন না, একথাও বলেন। তবে, আমি জানি আমি ওঁকে বিশ্বাস করতে পারি। ওঁর অনুরোধ ছিল যে আমি যেন ওঁর ওপরওলার অনুমতি নিয়ে নিই। তাতে কোনো অসুবিধে হয়নি। ওঁর ওপরওলা আমার অত্যন্ত স্নেহভাজন।’

এই কথার মধ্যে পান্নালাল ঘরে ঢুকল, তার সঙ্গে আর একটি গান্ধীটুপি। দুজনে একটা চাকা লাগানো রট-আয়রনের টেবিল ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে এল। টেবিলের ওপর পানীয় এবং তিনটে প্লেটে নানারকম খাবার সাজানো।

দময়ন্তী জিজ্ঞেস করল, ‘একী, আপনার জন্যে কিছু নেই?’

বৃদ্ধ মৃদু হেসে বললেন, ‘না। বাঁধা সময়ের বাইরে আমার কিছু খাওয়া বারণ। আমার বয়েস কত জানো? চুরাশি। এই বয়েসে খাওয়াটা সামলে রাখাই উচিত, তাই না?’

সমরেশ জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি নাকি এখনও রোজ গলফ খেলেন?’

ঘন ঘন মাথা নেড়ে অশোকনাথ বললেন, ‘না, না। কে বললে তোমাদের সে কথা? এককালে খেলতুম ঠিকই, বছর দশেক হল ছেড়ে দিয়েছি। তবে ক্লাবে রোজ যাই। এতদিনের অভ্যেস!’

.

দময়ন্তী কফির কাপ নামিয়ে রেখে বলল, ‘আপনার সন্দেহের কথা শোনবার আগে, আমার একটা সন্দেহের কথা জিজ্ঞেস করি?’

‘যোগেশ্বর রাইয়ের কথা তো?’ অশোকনাথ বললেন।

‘হ্যাঁ। আমি অবশ্য ব্যবসা সংক্রান্ত ব্যাপার ভালো বুঝতে পারি না। কিন্তু এটুকু বুঝতে পারছি যে হোয়াইট স্টারের যত দুরবস্থা হবে, ততই এটা কারুর পক্ষে কিনে নেওয়া সহজতর হবে।’

‘ঠিকই বুঝেছ। কিন্তু যোগেশ্বর রাই যদি এইসব অন্তর্ঘাতগুলোর পেছনে থাকত, তাহলে সে এমন কোনো কাজ করত না যাতে কোম্পানির একটা পুরো প্রোডাকশন ইউনিটই ধ্বংস হয়ে যায়। সে কিনলে চালু ফ্যাক্টরি কিনবে, একটা ধ্বংসস্তূপ নয়। তা ছাড়া, হোয়াইট স্টারের আজ এমন অবস্থা যে তাকে আবার পুরোপুরি চালু করতে যত টাকার দরকার, যোগেশ্বরের অত টাকা নেই। বা থাকলেও সে ঘর থেকে অত টাকা বের করবে না। আমার কাছে খবর এসেছে যে সে এখন অন্য একটা কোম্পানির দিকে ঝুঁকেছে। হোয়াইট স্টার নেবার আর কোনো বাসনা তার নেই।’

‘বেশ। এবার তাহলে আপনার সন্দেহের কথা বলুন।’

বৃদ্ধ তাঁর চশমাটা খুলে অনেকক্ষণ সেটার দিকে চেয়ে রইলেন। তারপর ফট করে টেবিলের ওপর রাখা একটা ল্যাম্প জ্বেলে দিলেন। ল্যাম্পের শেডটা এমন যে তার আলো পড়ে অতিথিদের মুখে, টেবিলের অপর প্রান্তে যিনি তাঁর মুখটা তখন আর ভালো করে দেখা যায় না। তারও কিছুক্ষণ পরে অশোকনাথ থেমে থেমে বলতে শুরু করলেন, ‘কথাটা কীভাবে বলব বুঝতে পারছি না। আমার স্ত্রী যদি বেঁচে থাকতেন, তাহলে হয়তো এসব ঘটনা আজ আর ঘটত না। আসলে, তাঁর অবর্তমানে আমি আমার ছেলেকে ঠিকমতো মানুষ করতে পারিনি।’

সমরেশ ভয়ানক আশ্চর্য হয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল। দময়ন্তী টেবিলের নীচে হাত নেড়ে ওকে বাধা দিল।

‘আমার স্ত্রী যখন মারা যান, অলোকের বয়স তখন চোদ্দো বছর। সে দার্জিলিংয়ে হোস্টেলে থেকে পড়াশুনো করত। আমি তাকে কলকাতায় নিয়ে আসি। সেটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো ভুল। কিন্তু, ঠিক সেই সময় আমার যে মানসিক অবস্থা তাতে আমি চাইছিলুম যেন সবাই আমার কাছে থাকে, আমায় ঘিরে থাকে। তা ছাড়া, রাকা বড়ো নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছিল। তারও একজন সঙ্গীর প্রয়োজন ছিল।

‘আমি অবশ্য অলোককে কখনোই অতিরিক্ত স্নেহ দেখাইনি। তবু বলব, তার কতগুলো আচরণ আমি স্নেহ বশতই মেনে নিয়েছিলুম। কলেজে পড়ার সময়ে সে রাজনীতির মধ্যে বেশ ভালোভাবে জড়িয়ে পড়েছিল। আমি ভেবেছিলুম ওটা অল্প বয়সের উত্তেজনা, বয়েস হলে কেটে যাবে। কিন্তু তা হল না। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করবার পর তাকে স্টুয়ার্ট অ্যান্ড লোম্যাক্সে ঢুকতে বললাম— সে আমার কথা শুনল না। বললুম, ঠিক আছে, আমার সঙ্গে এক জায়গায় চাকরি করতে না চাও তো সে ভালো কথা। মার্শাল অ্যান্ড ম্যাকেঞ্জির জেনারেল ম্যানেজার অ্যালান হোল্ডিং আমার বিশিষ্ট বন্ধু। তাকে লিখে দিচ্ছি, তার সঙ্গে গিয়ে দেখা করো। তাও করল না। কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে দরখাস্ত করে ইন্টারভিউ দিয়ে চাকরি নিল হোয়াইট স্টারে। আনফরচুনেটলি, আমি তখন হোয়াইট স্টারে কাউকেই চিনি না। ফলে, ওকে একেবারে অ্যাপ্রেনটিসশিপ থেকে শুরু করতে হল।’

সমরেশ এবারে আর দময়ন্তীর বাধা মানল না। বলল, ‘কিন্তু সেটাই তো ভালো, এরকমই তো হওয়া উচিত, তাই না?’

‘হ্যাঁ, সেটা যে ঠিক নয় তা বলব না। কিন্তু মনে রাখা দরকার যে সে সময়টা জীবনের একটা অত্যন্ত কঠিন পরীক্ষার শুরু। সেই পরীক্ষার নাম কেরিয়ার। আমি জানি, অনেক তথাকথিত ভদ্রসন্তানের কাছে কেরিয়ার হচ্ছে একটি ফোর লেটার্ড ওয়ার্ড। কিন্তু আমার কাছে তা নয়। আমি মনে করি, মানুষের জীবনে কেরিয়ারই সব। তাকে একেবারে শুরুতে যদি একটা উপযুক্ত ধাক্কা দেওয়া না যায়, তাহলে সব খুইয়ে পেছিয়ে পড়ার সম্ভাবনাটাই প্রবল হয়।’

‘আপনার ছেলে কিন্তু পিছিয়ে পড়েনি!’

‘সেটা তার সৌভাগ্য। আমি বলব, অত্যন্ত সৌভাগ্য। আমি শুনেছি, হোয়াইট স্টারে কাজ শুরু করে সে ইউনিয়নবাজি শুরু করেছিল, লেবার লিডার হয়ে বসেছিল। এই কাজ যদি সে মার্শাল অ্যান্ড ম্যাকেঞ্জি বা আমার কোম্পানিতে করত, তাহলে ম্যানেজমেন্ট তাকে পত্রপাঠ বিল্বপত্র শুঁকিয়ে দিত। তাকে রাস্তায় দাঁড়াতে হত। কিন্তু তার অত্যন্ত সৌভাগ্য যে হোয়াইট স্টারের তখনকার ম্যানেজিং ডিরেক্টর টোনি ওয়াকার এইসব কার্যকলাপ সত্ত্বেও তাকে পছন্দ করতেন। টোনি অবশ্য পরে আমাকে বলেছিল যে তার কর্তব্যবোধ, কাজ শেখার ইচ্ছে এবং আগ্রহ দেখে সে মুগ্ধ না হয়ে পারেনি। ফলে, বেশ তাড়াতাড়িই সে ম্যানেজমেন্ট কেডারে উঠে আসে। এবং, তার ফলে একটা সুবিধে হয় এই যে, ইউনিয়নের সঙ্গে ভবিষ্যতে দীর্ঘদিন পর্যন্ত ওর বিশেষ গোলমাল কখনো বাঁধেনি। একটা সদ্ভাব, একটা পারস্পরিক সম্প্রীতি এবং বিশ্বাস বজায় ছিল। কাজেই, আজ থেকে বছর আষ্টেক আগে সে সময়ের ম্যানেজিং ডিরেক্টর যমুনাদাস মিত্তাল যখন কোম্পানির চেয়ারম্যান হল, তখন প্রায় সর্বসম্মতিক্রমে সে ম্যানেজিং ডিরেক্টর হয়ে গেল।’

দময়ন্তী জিজ্ঞেস করল, ‘উনি তখন কোন পোস্টে ছিলেন?’

‘প্রোডাকশন ডিরেক্টর।’

‘আমি কিন্তু এখনও পর্যন্ত গোপন রাখা উচিত এরকম কোনো লজ্জাজনক ঘটনার সন্ধান পেলুম না আপনার ছেলের কথায়।’

‘আমি এইবার সেই কথাটাই বলব। বুড়ো হয়েছি, সংক্ষেপে কোনো কথা বলার আর্টটা ভুলে গেছি। আমার নাতি-নাতনিরা হাসে, ইচ্ছে করলে তোমরাও হাসতে পারো।

‘সে যাই হোক, আমার ছেলে যখন একদিকে চাকরি জীবনে উন্নতি করছে, অন্যদিকে সে একটা বিশ্রি ব্যাপারে জড়িয়ে পড়ে। সে আর তার একজন সহকর্মী একসঙ্গে একই মেয়ের প্রেমে পড়ে। কী দেখে যে দুজনেই মজেছিল, তা আমি আজও জানি না। মেয়েটি রীতিমতো কুৎসিত, প্রায় নিরক্ষর, বস্তিতে বড়ো হয়ে ওঠা একটা কদর্য ব্যাপার। অথচ এই নিয়েই দুজনের প্রতিযোগিতা, মন কষাকষি, আরও কত কী! শেষপর্যন্ত, দুর্ভাগ্য আমার যে, অলোকেরই জিত হল। সে তাকে বিয়ে করল। আমি অবশ্য তাদের এ বাড়িতে ঢুকতে দিইনি। তারা তখন কোথায় এক বস্তিতে গিয়ে ঘর ভাড়া নিয়েছিল।

‘কিন্তু, তার বন্ধুটি এই হেরে যাওয়াটা স্পোর্টিং স্পিরিটে কখনোই নিতে পারেনি। পদে পদে অলোকের উন্নতির পথে বাধা সৃষ্টি করেছে। এতদিনে তার প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার সময় এসেছে। ক্ষতি যা করবার, তা তো সে করেছেই। কিন্তু, তাকে তো এতবড়ো একটা অপরাধের পর এমনি এমনি ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে না। শাস্তি তাকে পেতেই হবে। আর সেটা কীভাবে করা যায়, তার ব্যবস্থা তোমাকে করতে হবে।’

দময়ন্তী হাসল। বলল, ‘বেশ, চেষ্টা করে দেখা যাবে। তবে তার আগে কয়েকটা প্রশ্নের জবাব পেলে ভালো হত।’

‘কী প্রশ্ন, বলো? জবাব জানা থাকলে, পাবে।’

‘আপনার ছেলেকে কি আপনি ত্যজ্যপুত্র করেছেন?’

‘না। তবে আমি তার মুখ দেখি না, সেও আমার মুখ দেখে না।’

‘আপনি কি আপনার পুত্রবধূকে কখনো দেখেছেন?’

‘দেখেছি কয়েকটা পার্টিতে। দূর থেকে।’

‘আপনার ছেলের যখন বিয়ে হয়, তখন তার বয়স কত ছিল?’

‘আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে। মানে তখন তার বয়েস তেত্রিশ।’

‘এর আগে কি তার অন্য কোনো মেয়ের প্রতি কোনো টান ছিল?’

‘আমার জানা নেই।’

‘আপনি বোধ হয় তার বন্ধুর নাম বলতেও ইচ্ছুক নন?’

‘না, ইচ্ছুক নই। তাকে খুঁজে বের করার দায়িত্ব তোমার।’

‘আপনার ছেলের সন্তানাদি কী? তাদের সম্পর্কে কিছু বলবেন?’

‘আমার ছেলের সন্তান দুটি। একটি ছেলে, একটি মেয়ে। ছেলের বয়স বাইশ বছর। গত বছর বি কম পাশ করে হোয়াইট স্টারে ম্যানেজমেন্ট ট্রেনি হয়ে ঢুকেছে। অত্যন্ত ইনটেলিজেন্ট ছেলে, যেমন চেহারা তেমনি চালচলন। জীবনে সে উন্নতি করবে, অবশ্য যদি সে তার বাপের বাধা কাটিয়ে উঠতে পারে।’

‘তার নাম কী?’

‘তার নাম অতীন্দ্রনাথ ঘোষাল। আমি ডাকি তিনু বলে। কখনো কখনো তিনকড়িও বলি!’ বলে বৃদ্ধ একটা সস্নেহ হাসি হাসলেন।

‘এবার আপনার নাতনির কথা বলুন।’

‘হ্যাঁ, সে এ বছর বি এ দেবে। তোমারই ছাত্রী। নাম বলা বারণ। এক নম্বরের বিচ্ছু। সক্কলের পেছনে লাগতে ওস্তাদ। লেখাপড়ার নাম নেই, কেবল গান আর গান।’

এবার দময়ন্তীর সস্নেহ হাসির পালা। বলল, ‘বুঝেছি। অনু, অনিন্দিতা।’

‘কে জানে? বলেছি তো, আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ— নাম বলা বারণ।’

‘আপনি বললেন যে অতীন্দ্রনাথের জীবনের উন্নতির পথে বাধা হচ্ছেন তাঁর বাবা। এ কথাটার মানে কী?’

‘মানে? কীভাবে বোঝাব জানি না। তিনু যে হোয়াইট স্টারে ঢুকেছে, তাতে তার ওপরে তার বাপের একেবারে জাতক্রোধ। বাপের ফার্মে ছেলে কাজ করছে, তাতে যেন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেছে। অথচ, বাপের জোরে তিনু কিন্তু ওখানে ঢোকেনি। যাতে কোনোরকম পক্ষপাতিত্ব না দেখানো হয় সেজন্যে হোয়াইট স্টার ম্যানেজমেন্ট ট্রেনি সিলেকশনের ভার দিয়েছিল একজন বিজনেস কন্সালট্যান্টকে। তিনি কোম্পানির নাম না দিয়ে কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন। তিনু তাই দেখে কাগজে অ্যাপ্লাই করেছিল, ইন্টারভিউ দিয়ে সিলেকটেড হয়েছিল। এতে যে কী অন্যায়টা হয়েছিল তা আমার জানা নেই। আমার পুত্র সেই থেকে ক্রমাগত তিনুকে চাকরি ছাড়ার হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। তার বক্তব্য, তিনু যদি জীবনে উন্নতি করে, তাহলে সবাই বলবে যে সে তার বাপের জোরে করেছে, নিজের ক্ষমতায় নয়। সেটা নাকি ভয়ানক লজ্জার কথা। অদ্ভুত! বাপের জোরে ছেলে উন্নতি করবে, সেটা লজ্জার কথা? অথচ, আমার ছেলে জানে না যে…’ বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গেলেন অশোকনাথ।

‘যে তার উন্নতির পেছনে আপনার অনেক অবদান আছে। তাই না?’

‘হ্যাঁ দময়ন্তী, তাই। তবে আমার অনুরোধ, একথা তাকে কখনো বলো না। ভীষণ ক্ষেপে যাবে। ভয়ানক জেদি আর একরোখা ছেলে। তবে, আমার খারাপ লাগছে কি জানো? তুই তোর ছেলেকে ব্যাক করলিনে, না করলি, কিন্তু তাই বলে চান্স পেলেই তারই একজন সহকর্মীর সঙ্গে তুলনা করে তাকে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে তার মনটা ভেঙে দিবি, এটা কী? বিশেষত, সেই সহকর্মীটি যেখানে তারই মামাতো ভাই, একসঙ্গে বড়ো হয়েছে দুজনে। হতে পারে এই মামাতো ভাই তিনুর চেয়ে লেখাপড়ায় ভালো, কিন্তু সেটাই কি সব? জীবনে খেলাধুলোর কোনো দাম নেই। তিনু যে ইউনিভার্সিটি ব্লু, সেটা কোনো বড়ো কথা নয়?’

বুড়ো ঠাকুরদার এই ব্যাকুল প্রশ্নের উত্তর দিতে পারল না দময়ন্তী। একটু চুপ করে থেকে প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা, গত পঁচিশ বছর তো আপনি আপনার ছেলের বউয়ের মুখ দেখেননি, অথচ তার ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে…’

দময়ন্তী কথাটা শেষ করতে পারল না। অশোকনাথ ফোঁস করে উঠলেন, ‘তার ছেলে-মেয়ে মানে? ওরা আমার ছেলের ছেলে-মেয়ে। ওরা তো আমার কাছে আসবেই। এটাই তো ওদের বাড়ি।’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, তা তো বটেই! আচ্ছা, এবার শেষ প্রশ্ন। আপনার নাতি তার বাবার ইচ্ছের বিরুদ্ধে হোয়াইট স্টারে চাকরি করছে কেন?’

‘কেন করবে না? সে তার বাপের ইচ্ছেয় ঢোকেনি যে তার ইচ্ছেয় ছাড়বে। আমিই বারণ করেছি। ছেলেটাকে আমেরিকায় পাঠাল না, বলল বিদেশে গেলে নাকি দেশের ঘুঘু রাজহংস হয় না। নিজেও অবশ্য যায়নি, একই যুক্তিতে। ঠিক আছে, তাই বলে ছেলেটাকে একটা ভালো চাকরিও করতে দেবে না? এত শত্রুতা!’

.

সমরেশ সোফার ওপর লম্বা হয়ে শুয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, ‘চমৎকার কেস! খাসা কেস! বালিটিকুরি না গুষ্টির পিণ্ডি কোথায় বোমা ফাটল, এখন প্রমাণ করতে হবে যে এক ম্যানেজিং ডিরেক্টরের পঁচিশ বছর আগেকার রাইভাল সেটি ছুড়েছেন। এই পঁচিশ বছর তিনি বোমাটি বগলদাবা করে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন, সুযোগ পেলেন অ্যাদ্দিন বাদে। যত্ত সব! বুড়োর ভীমরতি ধরেছে না তোর ধরেছে?’

শিবেন বলল, ‘তুই থামবি? যা বুঝিস না তাই নিয়ে বকবক করবি না। রাইভাল টাইভাল কোনো কথা নয়। বোমাটা কে ফাটিয়েছে এবং কেন, সেটা বের করাই আসল কথা। আরে, এটাই তো প্রথম এরকম ব্যাপার নয়। কাগজ পড়িস না? এই ধরনের সাবোটাজ আজকাল মাঝে মাঝেই হচ্ছে, সে খবর রাখিস?’

‘এই টাইম বোমা?’

‘হ্যাঁ। নইলে আমরা চট করে ধরলুম কী করে যে ব্যাপারটা কী? এই পদ্ধতির সঙ্গে আমরা পরিচিত।’

দময়ন্তী জিজ্ঞেস করল, ‘এরকম প্রায়ই হচ্ছে নাকি?’

‘প্রায়ই মানে ওই যে বললুম মাঝে মাঝেই হচ্ছে।’

সমরেশ বলল, ‘তার মানে ওই রাইভাল ব্যাটা রীতিমতো হাত মক্সো করেছিল, অ্যাঁ?’

শিবেন চোখ পাকিয়ে বলল, ‘ফের? তুই যা না, রাস্তায় একটু পায়চারি টায়চারি করে আয় না!’

দময়ন্তী বলল, ‘এই ঘটনাগুলো সম্পর্কে একটু বলবেন?’

শিবেন বলল, ‘তাহলে আর এক রাউন্ড চা।’

.

শিবেন বলল, ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল সাবোটাজ বা শিল্পে অন্তর্ঘাত একটা নতুন ব্যাপার নয়। ইন্ডাস্ট্রির গোড়া থেকেই আছে। কথাটা এসেছে সাবোট থেকে যার মানে কাঠের জুতো। সে যুগে ইউরোপের শ্রমিকরা ওইরকম জুতো পরত আর মালিককে শিক্ষা দিতে চাইলে একটা জুতো পা থেকে খুলে মেশিনের মধ্যে ফেলে দিত। অমনি মেশিনের দাঁতটাত ভেঙে কলের চাকা বনধ। অর্থাৎ, এ ব্যাপারটা অতীতে ছিল, বর্তমানে আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। কিন্তু এর মধ্যে যদি একটা প্যাটার্ন থাকে, একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে থাকে, তাহলে সন্দেহ হয় যে এরকম ঘটনাগুলোর পেছনে মালিক-শ্রমিকের বিরোধ নয়, কোনো ক্রিমিনাল ষড়যন্ত্র কাজ করছে। বালিটিকুরিতে যা ঘটেছে, সেটা এই ধরনেরই ব্যাপার। গত এক বছরে এটা চতুর্থ ঘটনা।

‘আগেই বলেছি, পদ্ধতিটা এক। কারখানার মধ্যে প্রোডাকশন লাইনে বিস্ফোরণ, প্রত্যেকটাই টিফিনের সময়, প্রত্যেকবারই একই ধরনের বোমা। বোমাটা বানানো সহজ, সস্তায় হয়ে যায়, খুব একটা ভয়ঙ্কর রকমের শক্তিশালী নয়, কিন্তু বেশ কিছুদিনের জন্যে কারখানা বন্ধ করে দেবার পক্ষে যথেষ্ট।’

‘কেউ মারা গেছে?’ দময়ন্তী প্রশ্ন করল।

‘না। তবে দু-একজন আহত হয়েছে।’

‘এই ঘটনাগুলোর মধ্যে কোনো যোগসূত্র আছে?’

‘আছে অবশ্যই। সেটাই এবার আমরা খুঁজে দেখছি। এতদিন এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা এই হিসেবে তদন্ত চলছিল। তবে প্রথম দর্শনে কোনো যোগসূত্র কিন্তু খুঁজে পাওয়া যায় না। যে চার জায়গায় এগুলো ঘটেছে, সেগুলো হচ্ছে ডায়মন্ডহারবারের কাছে ডায়মন্ড গ্লাস ওয়ার্কস লিমিটেড, রানিগঞ্জে সুপ্রিম সেরামিক্স লিমিটেড, আসানসোলে গ্লোব ইনসুলেটারস লিমিটেড আর এই হাওড়ার হোয়াইট স্টার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। এদের মধ্যে একমাত্র মিল হচ্ছে এরা লিমিটেড কোম্পানি আর এককালে বিদেশি মালিকানা ছিল। এ ছাড়া আর কোথাও কোনো মিল নেই।’

সমরেশ বলল, ‘আমারও তাই মনে হয়। আমি এদের সম্পর্কে জানি। হোয়াইট স্টার ছাড়া বাকি তিনটেই আমাদের কোম্পানির ক্লায়েন্ট। তবে, এদের সাবোটাজ করে কার যে কী লাভ হতে পারে তা তো বুঝতে পারছি না। যদ্দুর শুনেছি, এদের প্রত্যেকেরই অবস্থা বেশ খারাপ। ঠিক সময়ে পয়সাকড়ি দিতে পারে না, লোকজন ছাঁটাই করছে, বাজারে এদের শেয়ারের দাম পড়ে যাচ্ছে হু হু করে। এমনিতেই এই অবস্থা, তার ওপরে সাবোটাজ করা মানে কোম্পানি তুলে দেবার ধান্দা। কিন্তু কেন? ধরো, ডায়মন্ডের ম্যানেজমেন্ট এখন গুজরাতিদের হাতে, সুপ্রিম সেরামিক্স সুজত নন্দীদের, গ্লোবের অবশ্য মেজর শেয়ারহোল্ডার কেউ নেই, তবু মোটামুটি ওমপ্রকাশ সালধানাই চালাচ্ছে। তা, এখানেও তো কোনো মিল খুঁজে পাচ্ছি না।’

দময়ন্তী বলল, ‘এমন তো হতে পারে যে কেউ এদের অবস্থা একেবারে খারাপ করে দিয়ে সস্তায় কিনে নেবার চেষ্টা করছে?’

‘তা হতে পারে। তবে, চারটে কোম্পানিকে একসঙ্গে আক্রমণ করার কী দরকার? একটা একটা করে করলেই সেটা স্বাভাবিক হত, তাই না?’

শিবেন বলল, ‘দেখুন, সমরেশের কথাটা কিন্তু একেবারে উড়িয়ে দেবার মতো নাও হতে পারে। সত্যি সত্যি হয়তো প্রথম তিনটে হাত-মক্সোর ব্যাপার। আসল লক্ষ্য হোয়াইট স্টার।’

দময়ন্তী জিজ্ঞেস করল, ‘হোয়াইট স্টারই কেন?’

‘অশোকনাথের কথা শুনে একটা ব্যাপারে সন্দেহ থাকে না যে তাঁর ছেলেটি একটি একগুঁয়ে উগ্র স্বভাবের লোক। নারীঘটিত কোনো ব্যাপার থাক বা না থাক, তার উন্নতিতে বাধা দেবার লোকের বোধ হয় অভাব নেই। আর, হোয়াইট স্টার উঠে যাওয়া মানে অলোকনাথেরও বারোটা বাজানো।’

‘কিন্তু গত বছরেই অলোকনাথের বিরোধী পক্ষের জিঘাংসা বেড়ে উঠল কেন? এর আগে তো এরকম কোনো ব্যাপার ঘটেনি। অথচ, হোয়াইট স্টার বহুবার পতন-উত্থানের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে।’

‘সেটাই খোঁজ নেওয়া দরকার। গত এক বছরে কী ঘটে থাকতে পারে? অলোকনাথ কাকে ঘাঁটিয়ে থাকতে পারেন? কোনো পুরোনো শত্রু নতুন করে মাথা চাড়া দিল, না সত্যি সত্যি কোনো নারীঘটিত ব্যাপারে জড়িয়ে পড়লেন?’

সমরেশ বলল, ‘গত এক বছরে একটা ঘটনা ঘটেছে সেটা তো চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। অতীন্দ্রনাথ হোয়াইট স্টারে ঢুকেছে।’

‘এবং অশোকনাথ তার মাথায় ঢুকিয়েছেন যে তার পিতৃদেবই তার সবচেয়ে বড়ো শত্রু।’

দময়ন্তী অন্যমনস্কভাবে বলল, ‘আচ্ছা, তুমি যে মাঝে মাঝে তোমাদের কোম্পানির ব্যালান্স শিট বলে কী একটা বই নিয়ে এসে মন দিয়ে পড়ো, সেটা কী?’

সমরেশ বলল, ‘ব্যালান্স শিট হচ্ছে একটা কোম্পানির এক বছরের কৃতকর্মের ইতিহাস। তার যাবতীয় আয়-ব্যয়, লাভ-লোকসান, উন্নতি-অবনতি ইত্যাদি ইত্যাদি এই ব্যালান্স শিটে লেখা থাকে।’

‘তার মানে, এই চারটে কোম্পানিরও এই ধরনের ব্যালান্স শিট আছে?’

‘নিশ্চয়ই আছে।’

‘সেগুলো পাওয়া যায়? মানে, গোপনীয় কিছু নয় তো?’

‘না, না। এরা পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি, এদের ব্যালান্স শিট একেবারেই গোপনীয় নয়।’

‘আচ্ছা, বেশ। তাহলে শিবেনবাবু, আপনি এই চারটে কোম্পানির গত কয়েক বছরের ব্যালান্স শিট আমাকে জোগাড় করে এনে দিতে পারেন?’

শিবেন বলল, ‘পারি। কিন্তু আপনি পড়ান ইতিহাস, ব্যালান্স শিট পড়ে কি কিছু বুঝতে পারবেন? সমরেশ ইঞ্জিনিয়ার, চাকরি করে। ওই কিচ্ছু বোঝে কি না আমার সন্দেহ আছে।’

সমরেশ বলল, ‘যা যা, না বোঝার কি আছে রে? আমি কি তোর মতো পুলিশ যে ব্যালান্স শিট দেখলে ভয় পাব?’

দময়ন্তী এই ব্যাক্যালাপে বাধা দিয়ে বলল, ‘আমার বোঝার দরকার নেই। আপনি আমাকে ওগুলো এনে দিন, তারপর ওদের কোম্পানির চিফ অ্যাকাউন্ট্যান্ট বিমলবাবুকে দেখিয়ে তাঁর কাছ থেকে উপদেশ নেব।’

‘সেটা মন্দ কথা নয়—’ বলল সমরেশ, ‘বিমলদা তোমাকে এইরকম ব্যাপারে সাহায্য করতে পারলে যে কী খুশি হবেন তা আর বলার নয়। কেবল, তোমাকে আবার তেল-কই রাঁধতে হবে।’

দময়ন্তী সহাস্যে বলল, ‘তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই।’

.

বিমলচন্দ্র শিকদারের বয়েস ষাটের কাছাকাছি। মাথার সব চুল পাকা, গোঁফ ভুরু পাকা, এমনকী চোখের পাতা পর্যন্ত পেকে গেছে। কিন্তু স্বাস্থ্য একেবারে অটুট। রোজ দু-বেলা চার মাইল হাঁটেন, সকালে ছ-টা আর রাত্রে আটটা রুটি খান। আর নেমন্তন্ন করে খাওয়ালে নিয়মকানুন বড়ো-একটা মানতে পারেন না, খাওয়াটা একটু বেশিই হয়ে যায়। তবে হ্যাঁ, যেখানে-সেখানে যার-তার নেমন্তন্নে তিনি যান না। বেছে বেছে মাত্র কয়েক জনের নিমন্ত্রণই গ্রহণ করে থাকেন। বলা বাহুল্য, দময়ন্তী এইমাত্র কয়েক জনের একজন।

বিমলবাবু পরিতৃপ্ত মুখে একটা সিগারেট ধরিয়ে সোফায় বসে বললেন, ‘তোমার রান্নার প্রশংসা আর করব না দময়ন্তী, আমার খাওয়ার বহর দেখেই নিশ্চয়ই আমার মতামত বুঝতে পেরেছ। এবার তাহলে কাজের কথায় আসি। সমরেশের দেওয়া ব্যালান্স শিটগুলো আমি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখেছি। তুমি জানতে চেয়েছ যে এই চারটে কোম্পানির মধ্যে কোথায় কোথায় মিল আছে। আমি বলে যাচ্ছি, তুমি শুনে যাও।’

‘এক নম্বর, চারটে কোম্পানিই এককালে ব্রিটিশ মালিকানার প্রতিষ্ঠান ছিল, আজ পুরোপুরি ভারতীয়।

‘দু-নম্বর, এদের সকলেরই রেজিস্টার্ড হেড অফিস কলকাতায়।

‘তিন নম্বর, এদের প্রত্যেকেরই অতীতের রমরমা আর নেই, বরং অবস্থা বেশ খারাপই বলা চলে। ফলে, এদের সকলেরই শেয়ারের দাম ক্রমাগত পড়ে যাচ্ছে।

‘চার নম্বর, এদের সকলেরই কয়েক জন কমন ডিরেক্টর আছেন। যথা, রাজা বিনয়কৃষ্ণ সিংহরায়, শেঠ মূলচাঁদ আগরওয়াল, ব্যারিস্টার লালমোহন দে, মিস্টার এ এন ঘোষাল, আর মিস্টার ডি পি খান্না।

‘পাঁচ নম্বর, এ ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত। এইসব কটা কোম্পানির গত বছরের চেয়ারম্যানের বক্তৃতায় দেখতে পাচ্ছি তাঁরা আশা প্রকাশ করেছেন যে, এই বছরে তাঁরা বিরাট অর্ডার পাবেন যাতে করে কোম্পানির প্রবল উন্নতি হবে। ব্যাপারটা কাকতালীয় হতে পারে, কিন্তু এটা যে একটা মিল আছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।’

বিমলবাবু চুপ করলেন। দময়ন্তীও কোনো কথা বলল না। অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইল। তারপর হঠাৎ প্রশ্ন করল, ‘হোয়াইট স্টারে কি দুজন এ এন ঘোষাল ডিরেক্টর?’

বিমলবাবু মাথা নেড়ে বললেন, ‘না, একজন।’

‘ডিরেক্টরদের ঠিকানা দেওয়া আছে?’

‘আছে!’

‘ঘোষালদের ঠিকানাটা একটু দেবেন?’

বিমলবাবু চারটে ব্যালান্স শিটের বইয়ের পাতা উলটে বললেন, ‘ভেরি সরি। আমারই ভুল। ঠিকানাটা চেক করে দেখা উচিত ছিল। হোয়াইট স্টারের ঘোষাল থাকেন যোধপুর পার্কে। বাকি কটা কোম্পানির ঘোষাল থাকেন হাঁসপুকুর লেনে। এঁরা দুজনে ভিন্ন ব্যক্তি।’ বলে আশ্চর্য বিস্ময়ে দময়ন্তীর দিকে চেয়ে রইলেন।

দময়ন্তী হাসল। বলল, ‘এতে অবাক হবার কিছু নেই, আমি এই ঘোষালদের সম্পর্কে শুনেছি।’ বলে কিছুক্ষণ ভেবে বলল, ‘আচ্ছা বিমলদা, ডিরেক্টর কারা হন?’

বিমলবাবু হাত নেড়ে বললেন, ‘যাঁদের ডিরেকশন দেবার ক্ষমতা আছে, তাঁরাই ডিরেক্টর হন। ব্যবসাবুদ্ধিতে যাঁরা ঝানু বা টেকনিক্যালি যাঁরা খুব পাকাপোক্ত বা যাঁদের এমন মহলে যাতায়াত আছে যেখান থেকে ব্যবসা জোগাড় করা যায়, তাঁরাই ডিরেক্টর হন। যেমন ধরো, কোনো ওষুধ তৈরির কোম্পানিতে একজন ডাক্তার ডিরেক্টর হতে পারেন, আবার একজন লব্ধপ্রতিষ্ঠ উকিলও হতে পারেন।’

‘তার মানে এঁদের কোনো কমন কোয়ালিফিকেশন থাকার দরকার নেই?’

‘না। কেবল এঁদের প্রত্যেককে তাঁরা যে কোম্পানির ডিরেক্টর তার শেয়ারহোল্ডার হতে হয়। সেটাই স্বাভাবিক। যে কোম্পানিতে আমার শেয়ার নেই, সে কোম্পানির ভালোমন্দে আমার কি উৎসাহ থাকতে পারে?’

‘আর একটু বুঝিয়ে বলুন।’

‘এঁঃ, তুমি দেখছি এসব ব্যাপারে একেবারেই বোঝো না। তবে শোনো। যেকোনো প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা করতে গেলে টাকার দরকার হয়। যাকে বলে মূলধন। এই মূলধন আসে কোথা থেকে? এক, কেউ তার পকেট থেকে দিতে পারে। দুই, কেউ জনসাধারণের কাছে শেয়ার বিক্রি করে সেই টাকা ওঠাতে পারে। শেয়ার মানে অংশ, সেক্ষেত্রে যারা শেয়ার কেনে তারা সেই প্রতিষ্ঠানের অংশীদার হয়। এই দ্বিতীয় শ্রেণির প্রতিষ্ঠানগুলোকে বলা হয় পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি। এদের ডিরেক্টর বোর্ড তখন জনসাধারণের টাকায় ব্যবসা করে এবং যে লাভ হয় তার অংশ শেয়ারহোল্ডার বা অংশীদারদের মধ্যে ভাগ করে দেয়। একে বলে ডিভিডেন্ড। এখন তুমি যদি কোনো কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার না হও, অর্থাৎ তোমার টাকা যদি সেই কোম্পানিতে না খাটে, তাহলে তার উন্নতি-অবনতি নিয়ে তোমার মাথা ঘামানোর কী দরকার?’

‘কোম্পানির উন্নতি হলে আমার কী লাভ?’

‘বাঃ! লাভ নেই? উন্নতি হলে কোম্পানি তোমাকে বেশি করে লভ্যাংশ দেবে। তোমার টাকা ঘরে বেশি টাকা আনবে। তা ছাড়া, তোমার শেয়ারের দাম বাজারে বেড়ে যাবে। ধরো, তুমি কোনো কোম্পানির দশ টাকার শেয়ার একশোটা কিনলে। হাজার টাকা খরচা হল। কাল সেই কোম্পানি প্রচুর উন্নতি করল, প্রচুর লভ্যাংশ ঘোষণা করল, তখন বাজারে তার শেয়ারের দাম বেড়ে দাঁড়াল ত্রিশ টাকা। সঙ্গে সঙ্গে তোমার শেয়ারের দাম হয়ে গেল তিন হাজার টাকা। তখন যদি তুমি সেই শেয়ার বিক্রি করে দাও, তাহলে হাজার টাকায় দু-হাজার টাকা লাভ।’

‘আর যদি অবনতি হয়?’

‘তাহলে তুমি লভ্যাংশ কম পাবে বা পাবেই না। বাজারে তোমার শেয়ারের দাম কমে যাবে।’

‘কত কমবে? আমি যে দামে কিনেছি তার নীচে তো আর যাবে না?’

‘নিশ্চয়ই যাবে। দশ টাকার শেয়ারের দাম আট আনা, চার আনা, এমনকী শূন্যও হতে পারে।’

‘শেয়ারগুলো কীরকম দেখতে?’

‘বড়ো বড়ো মোটা কাগজের দলিল। তাতে কোম্পানির নামধাম আর যে কিনল তার নামধাম লেখা থাকে।’

‘তার মানে দাঁড়াল এই যে আমি যদি কোনো কোম্পানির অংশীদার হই, তাহলে কখনোই চাইব না যে সেই কোম্পানির অবনতি হোক বা কোনোরকম ক্ষতি হোক। তাই তো?’

‘হ্যাঁ, ঠিক তাই।’

‘আচ্ছা, এই শেয়ার কেনা-বেচা হয় কোথায়? দামই বা কীভাবে ঠিক হয়?’

‘শেয়ার কেনা-বেচা হয় স্টক মার্কেটে বা শেয়ার বাজারে। আর দাম ঠিক হয় কোম্পানির কাজকর্ম দেখে, ভূত ভবিষ্যৎ দেখে। দামটা ঠিক করে স্টক এক্সচেঞ্জ। তারা অনেক কিছু বিচার করে দাম ধরে। যেমন ধরো, কোনো প্রতিষ্ঠান খুব ভালো ব্যবসা করছে— তার শেয়ারের দাম বাড়বে। হঠাৎ খবর পাওয়া গেল যে তাদের ম্যানেজিং ডিরেক্টর, যিনি ঝানু ব্যবসাদার, প্রায় নিজের হাতে কোম্পানিটা চালাচ্ছিলেন, ডিরেক্টর বোর্ডের সঙ্গে ঝগড়া করে চাকরি ছেড়ে দিচ্ছেন, অমনি তার শেয়ারের দাম কমতে শুরু করবে।’

‘তার মানে, আপনি যে বললেন আমাদের এই চারটে প্রতিষ্ঠানের ব্যালান্স শিটে দেখানো ছিল যে তারা এ বছর মস্ত অর্ডার পেতে যাচ্ছে, তার ফলে তাদের কম দামের শেয়ারের দাম বেড়ে যেতে পারত?’

‘হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। বেড়ে যেতে পারত নয়, বাড়ছিল।’

‘এ বছরের অন্তর্ঘাতের ফলে উলটে তাদের দাম তাহলে আরও কমে গেল?’

‘হ্যাঁ। যাচ্ছেতাই ভাবে কমে গেল।’

‘এই দুষ্কর্ম কি তাহলে কোনো শেয়ারহোল্ডারের পক্ষে করা সম্ভব?’

‘সম্ভব, তবে উচিত নয়। যদি কোনো শেয়ারহোল্ডার এই অন্তর্ঘাতগুলোর পেছনে থাকে, তাহলে বলতে হবে সে পাগল, নয়তো তার আত্মহত্যা করার প্রবল ইচ্ছে রয়েছে।’

.

শিবেন এসে রোববার সন্ধ্যেবেলা বলল, ‘বিমল শিকদারের সঙ্গে কথা বলে কিছু লাভ হল?’

দময়ন্তী মৃদু হেসে মাথা নাড়ল। বলল, ‘হয়েছে বই কী! শেয়ার, স্টক মার্কেট, লিমিটেড কোম্পানি ইত্যাদি ব্যাপারে অনেক জ্ঞান লাভ হল।’

‘আর এই অন্তর্ঘাতগুলো? সে ব্যাপারে কিছু বুঝলেন?’

‘কিছু বুঝেছি, সবটা নয়। ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন নয় বলে মনে হচ্ছে। একটা যোগসূত্র আছে।’

সমরেশ বলল, ‘দ্যাখ, আমার মাথায় একটা থিয়োরি এসেছে। এমন তো হতে পারে যে চারজন লোক চারটে কোম্পানি কিনতে চাইছে। তারা প্রত্যেকে আলাদা আলাদাভাবে একই লোকের কাছে গেছে যে সাবোটাজ করায় এক্সপার্ট। সেক্ষেত্রে ব্যালান্স শিট দেখে সেই যোগসূত্র তুমি খুঁজে পাবে না। কারণ, চারজন খরিদ্দার আর সাবোটাজ করনেওলা বদমাইশটা সকলেই বাইরের লোক।’

শিবেন বলল, ‘দ্যাখ, তোর থিয়োরিটা একদম বাজে। এরকম সাবোটাজ এক্সপার্ট যদি কেউ থাকত যার বাজারে এত নাম যে একইসঙ্গে চার চারজন মক্কেল তার পেছনে ঘুরঘুর করছে, তাহলে সে খবরটি আমাদের কানে আসত।’

সমরেশ বলল, ‘হ্যাঁ, সে কথা ঠিক। আর একটা কথা বলি। আমি এর আগের দিন বলেছিলুম যে একজন লোক একসঙ্গে একাধিক কোম্পানি আক্রমণ করে না। সেটা অবশ্য পরে ভেবে দেখেছি, ঠিক নয়। করতে পারে, তবে যদি তেমন তেমন কোম্পানি হয়। আর সে লোকও যদি তেমন তেমন মালদার পার্টি হয়। কিন্তু এসব যা কোম্পানি, এদের কিনতে কোনো সত্যিকারের মালদার লোক এগিয়ে আসবে তা মনে হয় না। সেইজন্যেই ভাবছিলুম, হয়তো চারটে আলাদা লোক হতে পারে। তারা যে একই বছরে অ্যাকশনে নেমেছে সেটা নিতান্তই সমাপতন!’

‘না, সেটা অসম্ভব। সমাপতনেরও একটা সীমা আছে। চার চারটে লোক একই বছরে একই ঠিকাদারকে দিয়ে চারটে কারখানায় একই ধরনের বোমা ফাটিয়ে তাদের কেনবার চেষ্টা করছে, এটা হতে পারে না। অতএব, তোর থিয়োরি এবার বন্ধ কর। বউদি কি বলেন, এবার শুনি।’

দময়ন্তী বলল, ‘দেখুন, আগেই বলেছি যে আমার মনে হচ্ছে যে এই ঘটনাগুলোর মধ্যে একটা যোগসূত্র আছে এবং সেই যোগসূত্রের খবর রাখেন শ্রীঅশোকনাথ ঘোষাল। নইলে, আমাদের ডেকে, তাঁর ছেলের বউয়ের পঁচিশ বছর আগেকার প্রেমিক প্রতিহিংসা নেবার জন্যে এই কাজ করছে, এই ধরনের আষাঢ়ে গল্প শোনাতেন না। বুড়ো রামঘুঘু— আমাকে একটা লীড দিচ্ছেন বুঝতে পারছি, কিন্তু ঠিক ধরতে পারছি না।’

‘তার মানে, এই মক্সো করার ব্যাপারটা আপনি বিশেষ আমল দিচ্ছেন না, এই তো?’

‘আমি বিমলবাবুর সঙ্গে কথা যেটুকু বলেছি, তাতে বুঝেছি যে এই কারখানাগুলোর আর্থিক অবস্থা বিশেষ ভালো না হলেও তারা এখনও চলছে। তার মানে, তাদের সিকিউরিটি আছে, লোকজন ঘোরাঘুরি করছে। এর মধ্যে খামোকা রিস্ক নিয়ে, লাঞ্চ আওয়ার হলেও, কার দায় পড়েছে বলুন তো হাত-মক্সো করার? তা ছাড়া, এদের ইতিহাসও বলছে যে এদের যেমন-তেমন ভাবে পছন্দ করা হয়নি। সেখানেও একটা প্যাটার্ন আছে।’

সমরেশ বলল, ‘স্বয়ং অশোকনাথই তো এই যোগসূত্র হতে পারেন?’

‘তা পারেন। কিন্তু তিনি তো এইসব কটা কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার। তাহলে বিমলবাবুর কথায় বলতে হয় যে তিনি পাগল বা আত্মহত্যা করার চেষ্টা করছেন। তা ছাড়া, তিনি এর মধ্যে থাকলে আমাকে ডেকে পাঠাবেনই বা কেন?’

শিবেন বলল, ‘একদম ঠিক কথা। আপনি এখন তাহলে কী করতে চান?’

‘আমি কয়েক জনের সঙ্গে কথা বলতে চাই।’

‘প্রথমেই প্রশান্ত ঘটকের সঙ্গে, তাই না?’

দময়ন্তী হেসে উঠল। বলল, ‘হ্যাঁ, ধরেছেন ঠিক।’

.

গাড়িতে যেতে যেতে দময়ন্তী প্রশ্ন করল, ‘প্রশান্ত ঘটক সম্পর্কে কী কী খবর পেলেন, বলুন।’

শিবেন বলল, ‘প্রশান্ত ঘটকের বাবা স্বর্গীয় অনুতোষ ঘটক ছিলেন কলকাতার একজন লব্ধপ্রতিষ্ঠ উকিল। তাঁর তিন ছেলে, দুই মেয়ে। প্রশান্ত মেজো। অত্যন্ত মেধাবী ছেলে, লেখাপড়ায় আগাগোড়া প্রথমে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকনমিক্সের স্নাতক, তারপর হার্ভার্ড। অতঃপর চাকরি। প্রথমে কিছুদিন ছিলেন একটা ছোটো ফার্মে, তারপরে হোয়াইট স্টার। এখন সেলস ডিরেক্টর। এ ছাড়া নানারকম জনহিতকর প্রতিষ্ঠান, যাদের বলা হয় সোশ্যাল সার্ভিস অরগানাইজেশন, তাদের সঙ্গে জড়িত আছেন। বিয়ে করেননি। থাকেন উডবার্ন গার্ডেন্সে, মালকোষ অ্যাপার্টমেন্টে। সেখানেই আপাতত আমরা যাচ্ছি।’

‘আমাদের যাবার কথা শুনে আশ্চর্য হননি?’

‘হয়েছিলেন হয়তো। গলা শুনে বুঝতে পারিনি। টেলিফোনের ওই তো দোষ। অবশ্য বালিটিকুরির বিস্ফোরণের ব্যাপারে কথা বলতে চাই শুনে খুশি হলেন বলে মনে হল। তবে, আমার সঙ্গে একজন ভদ্রমহিলা আর তাঁর হাজব্যান্ড থাকবেন, কারণ সেই ভদ্রমহিলাও আমাদের তদন্তের সঙ্গে যুক্ত আছেন শুনে কিছুক্ষণ চুপ করেছিলেন। একটু অবাক হয়েছেন, সন্দেহ নেই। অফিসে যেতে বললেন প্রথমে। তারপর কী ভেবে বললেন বাড়িতে আসতে। সন্ধেবেলা।’

.

মালকোষ অ্যাপার্টমেন্ট দশতলা বাড়ি, তার সাততলায় প্রশান্ত ঘটকের ফ্ল্যাট। পালিশ করা দরজার ওপর চকচকে পেতলের নেমপ্লেটে ঘটক সাহেবের নাম লেখা। কলিং বেল বাজাতে নীল ফুলপ্যান্ট আর সাদা বুশশার্ট-পরা একটি লোক এসে দরজা খুলে দিয়ে নিঃশব্দে একপাশে সরে দাঁড়াল। তার পেছনে একটি প্রায়ান্ধকার ঘর, সিঁড়ির উজ্জ্বল আলো থেকে ভেতরে ঢুকলে প্রথমটা কিছুই ঠাহর হয় না। একটু বাদে বোঝা যায় যে ঘরটা মস্ত বড়ো, যতটা লম্বা ততটা চওড়া নয়। একদিকের লম্বা দেওয়াল জুড়ে থিয়েটার স্টেজের স্ক্রিনের মতো মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত ধূসর রঙের পর্দা ঝোলানো। তার পেছনে যে টানা জানলা আছে, সেটা পর্দার ওপর চলমান আলো দেখলে বোঝা যায়। লম্বা দেওয়ালের একদিকে একটা গ্রিলে ঢাকা বারান্দা, অন্যদিকে বোধ হয় বেডরুমে যাবার দরজা। সিঁড়ি থেকে ঘরে ঢোকার দরজাটা অন্য লম্বা দেওয়ালটার মাঝখানে। তারও দু-পাশে দুটো দরজা, কীসের কে জানে! সবাই ভেতরে ঢুকলে নীল ফুলপ্যান্ট একটা বড়ো আলো জ্বেলে দিল।

ঘরটির আসবাবপত্র মহার্ঘ না হলেও সুরুচিপূর্ণ। পুরোনো আর হালফ্যাশনের একটা সুন্দর সমন্বয়। দেওয়ালে একদিকে যামিনী রায় অন্যদিকে গণেশ কর্মকার। বইয়ের আলমারিতে রবীন্দ্রনাথ আর য়াসুনারি কাওয়াবাতার সহজ সহাবস্থান।

প্রশান্ত ঘটক সাদা ট্রাউজার্স আর হলুদ রঙের স্পোর্টস গেঞ্জি পরে একটা সোফার ওপর বসেছিলেন। অতিথিদের দেখে উঠে দাঁড়ালেন। মিউজিক সিস্টেমে মৃদু স্বরে স্বরোদ বাজছিল। সেটা বন্ধ করে দিলেন। তারপর এগিয়ে এলেন সবাইকে স্বাগত জানাতে। অত্যন্ত সুপুরুষ লম্বা রোগাটে গড়নের প্রৌঢ় ভদ্রলোক, মাথায় কাঁচা-পাকা চুল, মুখে তদ্রুপ ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, স্টিল ফ্রেমের চশমার পেছনে একজোড়া চঞ্চল, হাস্যোজ্জ্বল চোখ।

শিবেন সকলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার পর, নীল ফুলপ্যান্টকে চা আনবার আদেশ দিয়ে দময়ন্তীকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে প্রশান্ত প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি ডিটেকটিভ? আপনাকে কিন্তু দেখলে শিক্ষাজগতের লোক বলে মনে হয়।’

দময়ন্তী মৃদু হেসে বলল, ‘মূলত আমি কিন্তু শিক্ষাজগতেরই লোক। ভুবনেশ্বরী দেবী গার্লস কলেজে ইতিহাস পড়িয়ে থাকি। রহস্য খুঁজে বেড়ানোটা আমার নেশা, পেশা নয়।’

‘সে ভালো কথা। কিন্তু আপনাকে তো কেউ এই কাজে নিযুক্ত করেছে? তিনি কে? না কি আপনি পুলিশ বিভাগেই আছেন?’

‘আমি পুলিশকে সাহায্য করে থাকি ঠিকই, যদি ওঁরা চান। তবে এক্ষেত্রে আমাকে নিযুক্ত করেছেন আপনাদের প্রতিষ্ঠানের একজন শেয়ারহোল্ডার।’

‘শেয়ারহোল্ডার? লেবার ইউনিয়ন নয়?’

‘না। আপনাদের বড়ো শেয়ারহোল্ডারদের একজন। তবে তাঁর নাম বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’

‘না, না, তার দরকার নেই।’ বলে প্রশান্ত ঘটক যেন একটু স্বচ্ছন্দ হলেন। আরাম করে হেলান দিয়ে বসে বললেন, ‘আশ্চর্য! ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারলুম না। তার মানে আমাদের কোনো কোনো শেয়ারহোল্ডার ভাবছেন যে আমরা পুলিশকে দিয়ে যে তদন্ত করাচ্ছি, তার মধ্যে কোনো ফাঁক থেকে যাচ্ছে। অর্থাৎ, আমরা পুলিশকে যতটা সাহায্য করা দরকার, ততটা করছি না। ব্যাপারটা কি তাই?’

‘ব্যাপারটা অনেকটা তাই বটে। কিন্তু আপনি যে অর্থে বললেন, ঠিক সেইভাবে নয়।’

‘কীভাবে সেটা যদি একটু খুলে বলেন।’

‘বলব, কিন্তু তার আগে আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই। ইচ্ছে হলে উত্তর দেবেন, না হলে দেবেন না।’

‘তা তো বটেই। আমার সাংবিধানিক অধিকার আমার ভালোই জানা আছে। কিন্তু, এ কথাটা আপনি বললেন কেন? আপনার কি ধারণা যে এই ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন আমার এড়িয়ে যাবার দরকার হতে পারে?’

‘হ্যাঁ, পারে। কারণ, প্রশ্নগুলো ব্যক্তিগত।’

‘ব্যক্তিগত?’ প্রশান্ত আবার সোফার ওপরে খাড়া হয়ে বললেন, ‘বলেন কি? আপনি কি তদন্ত করে এই সাবোটাজগুলোর ব্যাপারে আমাকেই দোষী সাব্যস্ত করলেন নাকি?’

‘এখনও করিনি। তবে সন্দেহভাজনদের মধ্যে যে আপনি একজন, সে কথাটা ঠিক।’

‘ঠিক? কী সর্বনাশ! আপনি বোধ হয় হোয়াইট স্টারের ইতিহাস জানেন না।’

‘খুব ভালো করে জানি। এর উন্নতির পেছনে আপনার অবদানের কথাও আমাদের অজানা নয়।’

‘অজানা নয়? তবু আপনার সন্দেহভাজনদের মধ্যে আমি একজন? ভালো কথা। তাহলে শুরু করুন আপনার প্রশ্ন।’ বলে প্রশান্ত আবার পেছনে হেলান দিয়ে বসলেন। মুখের মৃদু হাসি দেখে মনে হল, বেশ মজা পাচ্ছেন, মোটেই উদবিগ্ন নন।

দময়ন্তী জিজ্ঞেস করল, ‘এই ফ্ল্যাটটা আপনার?’

‘হ্যাঁ। বছর ছয়েক আগে কিনেছি।’

‘এখানে আসার আগে কোথায় ছিলেন?’

‘ম্যাকমোহন স্ট্রিটে, যার বর্তমান নাম বিপ্লবী উমেশ দত্ত সরণী। বাগবাজারে। আমার পৈতৃক বাড়ি সেখানেই।’

‘সে বাড়ি ছেড়ে দিলেন কেন?’

‘আমার বাবা মারা যাওয়ার পর যখন সম্পত্তি ভাগ হয়, তখন আমি বাড়ির অংশ না নিয়ে টাকা নিয়েছিলুম। যদি জিজ্ঞেস করেন কেন, তাহলে তার উত্তর হচ্ছে যে একটা দোতলা বাড়ি তিন ভাইয়ের মধ্যে ভাগ না হয়ে দু-ভাইয়ের মধ্যে ভাগ হওয়াই বাঞ্ছনীয়। যেহেতু আমি একা, অতএব আমার সরে আসাই স্বাভাবিক।’

‘সে কথা ঠিক। শুনেছি, আপনারা তিন ভাই, দুই বোন। তাঁরা কে কী করেন?’

‘আমার বড়দা বাবার মতোই, অ্যাডভোকেট। ছোটো ভাই চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। মুখার্জি অ্যান্ড ঘটকের সিনিয়ার পার্টনার। এরপর ছোটো দুই বোন। দুজনেরই বিয়ে হয়ে গেছে। একজনের শ্বশুরবাড়ি কলকাতায়, অন্যজনের কানপুরে।’

‘আপনার দুই ভাইয়ের বিয়ে হয়েছে?’

‘হয়েছে। তাদের ছেলে-মেয়ে আছে।’

‘আপনি বিয়ে করেননি কেন?’

প্রশান্ত ঘটক চোখ বুজে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর মৃদু হেসে বললেন, ‘এটা একটা স্বাভাবিক ব্যক্তিগত প্রশ্ন বটে। ভালো কথা। এর সঠিক উত্তর দেওয়া যাবে। আপনার প্রশ্নের উত্তর বলতে পারেন, ব্যর্থ প্রেম।’

‘অর্থাৎ আপনি একটি মেয়েকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু…’

প্রশান্ত আবার খাড়া হয়ে বসলেন। দময়ন্তীকে বাধা দিয়ে হাত জোড় করে বললেন, ‘না, না, একটি মেয়েকে কেন? অনেক মেয়েকেই। যাকেই বলি, ”তুমি আমাকে বিয়ে করবে?” অমনি সে দৌড়ে গিয়ে আর একজনকে বিয়ে করে বসে। এমন করলে কখনো করুর বিয়ে হয়?’

প্রশান্তর কথার ভঙ্গিতে সবাই হেসে উঠল। দময়ন্তী হাসতে হাসতে বলল, ‘আমার প্রশ্নের জবাবটা কিন্তু আপনি এড়িয়েই যাচ্ছেন, মিস্টার ঘটক।’

প্রশান্তর হাসিটা হঠাৎ থেমে গেল। ঈষৎ রুষ্ট গলায় প্রশ্ন করলেন, ‘আমার এড়িয়ে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন আছে কি, বিশেষত এমন একটা ব্যাপারে যার সঙ্গে আমাদের কারখানার বিস্ফোরণের কোনোরকম সম্পর্ক থাকার কোনো সম্ভাবনাই থাকতে পারে না?’

দময়ন্তী স্মিত মুখে বলল, ‘সম্পর্ক যে থাকতে পারে না, সে কথা কি জোর করে বলা যায়, মিস্টার ঘটক?’

‘বলা যায় না?’ বলে প্রশান্ত দু-হাত জোড় করে বললেন, ‘একটু খোলসা করে বলবেন কি, আপনার সন্দেহ? দয়া করে আমাকে একটু তমসা হইতে জ্যোতিতে লইয়া যাইবেন?’

‘আমার এখনও সঠিক কোনো সন্দেহ দানা বাঁধতে পারেনি। তবে আমাদের কাছে অভিযোগ এসেছে যে আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে আপনি কোনো একটি মেয়েকে বিয়ে করতে চেয়ে ব্যর্থ হয়েছিলেন। যাঁর কাছে হেরে গিয়েছিলেন, আজ তাঁর ওপর প্রতিহিংসা চরিতার্থ করবার জন্যে আপনি এই দুর্ঘটনাগুলো ঘটাচ্ছেন।’

স্থির, স্তম্ভিত, নিষ্পলক চোখে প্রশান্ত দময়ন্তীর কথাগুলো শুনলেন। তাঁর ফর্সা মুখটা আস্তে অস্তে লাল হয়ে উঠল। তারপর হঠাৎ মাথাটা পেছনে হেলিয়ে একটা প্রচণ্ড অট্টহাস্যে ফেটে পড়লেন। বেশ কিছুক্ষণ বাদে হাসিটা কোনোরকমে সামলে রুদ্ধ কণ্ঠে হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, ‘কে বলেছে আপনাকে এরকম কথা? আমাদের একজন শেয়ারহোল্ডার? উঃ, কী ভয়ানক ব্যাপার! মানুষের কি আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই? এতদিন আগেকার ঘটনা! বাপরে বাপ!’

দময়ন্তী অবিচলিত গলায় প্রশ্ন করল, ‘ঘটনাটা কি সত্যি নয়?’

হাত নেড়ে প্রশান্ত বললেন, ‘না, না, সত্যি এক-শো বার সত্যি। কিন্তু ব্যাপারটা কীরকম জানেন? ধরুন আমি যদি বলি, ঔরঙ্গজেবের কুশাসনের ফলেই আজকের ভারতবর্ষের এই দুরবস্থা, তাহলে আপনি হাসবেন, কিন্তু ঔরঙ্গজেবের কুশাসনটা কি মিথ্যে? সেইরকম আমি একদা একটি মেয়েকে বিয়ে করতে চেয়েছিলুম, কিন্তু পারিনি— সেটা সত্যি হলেও তার জন্যে আজ আমি আমাদের কারখানায় বোমা মেরে আর আগুন লাগিয়ে বেড়াচ্ছি, সে কথাটা কিন্তু হাস্যকরই হয়ে পড়ে।’

‘ঘটনাটা কী ঘটেছিল, একটু বলবেন?’

‘দেখুন, ব্যর্থ প্রেমের ঘটনাটা লোকে লুকিয়ে রাখে, গেয়ে বেড়ায় না। তবু বলছি, কেন বলছি, বুঝতেই পারবেন। উঃ, সে কোন কালের ব্যাপার! আমি এবং আমার এক সহকর্মী একই মেয়ের প্রেমে পড়েছিলুম। মেয়েটির দাদা আমাদের বন্ধু ছিল, আমাদের সঙ্গে একসঙ্গে কফি হাউসে আড্ডা দিত। তার মাধ্যমেই আলাপ, পরিচয় এবং ঘনিষ্ঠতা। মেয়েটি আমাকে বিয়ে করল না, করল আমার সহকর্মীকে। সেটাই অবশ্য স্বাভাবিক এবং অবশ্যম্ভাবী ছিল, কারণ তারা দুজনেই একই রাজনৈতিক দলের সদস্য ছিল আর আমি কোনো রাজনীতির মধ্যে ছিলুম না। তাদের বিয়ের পর আমি যে কিছুদিন দুঃখু-দুঃখু মুখ করে বিমনা হয়ে বেড়াইনি, এমন কথা বলতে পারব না। তবে তখন বয়েস অল্প, ভাঙা হৃদয় এবং বন্ধুত্ব জোড়া লাগতে বিশেষ সময় লাগল না। আজ আমরা তিনজনেই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। প্রেম যেটা ছিল, সেটা ঠিকই আছে, কেবল তার চরিত্রটা পালটে গেছে।’

‘আপনার এই বন্ধুর নাম-ঠিকানা বলতে আপনার কোনো আপত্তি আছে?’

‘আছে। মনে রাখবেন তারা একটি সুখী সন্তুষ্ট পরিবার। তাদের এই সন্দেহ আর অবিশ্বাসের নোংরামির ভেতর কেন টেনে আনতে যাব?’ তারপর একটু থেমে প্রশান্ত মৃদু হেসে বললেন, ‘তা ছাড়া, আপনার সেই শেয়ারহোল্ডারটি তো আছেনই। তিনি এত খবর রাখেন আর এই খবরটা রাখেন না?’

‘তা হয়তো রাখেন। সেটা পরে দেখা যাবে’খন। আমরা এখন তাহলে চলি। আপনার অনেকটা সময় নষ্ট করলুম!’

‘না, না, কী যে বলেন! তবে এবার আমি একটা প্রশ্ন করব?’

‘করুন।’

‘আমার ওপরে কি এখনও আপনার সন্দেহ আছে?’

দময়ন্তী হাসল। বলল, ‘হ্যাঁ, আছে।’ বলে উঠে দাঁড়াল।

প্রশান্তও উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘এইবার বুঝলুম পুলিশকে পুরো সাহায্য না করার অর্থ কী।’

.

শিবেন প্রশ্ন করল, ‘এবার কার সঙ্গে দেখা করবেন? অলোকনাথের সঙ্গে কি?’

দময়ন্তী বলল, ‘না। বালিটিকুরির ফ্যাক্টরির সিকিউরিটির যিনি প্রধান, আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করব।’

‘ফ্রেডারিক ডিসিলভা। আগে ক্যালকাটা পুলিশেই ছিলেন। খুব ভালো করেই চিনি। রয়েড স্ট্রিটে বাড়ি। ওঁকে এখানেই নিয়ে আসি?’

‘তাহলে খুবই ভালোই হয়।’

‘দাঁড়ান, তাহলে একটা ফোন করি।’

‘এই এখন? রাত হয়ে গেল যে!’

‘রাত? পুটেদার কাছে এখন তো সন্ধ্যেই হয়নি।’

‘পুটেদা?’

‘হ্যাঁ। ফ্রেডারিক থেকে ফ্রেডিদা পুলিশ মহলে কবে যেন পুটেদা হয়ে গেছে।’ বলে শিবেন ফোন করতে উঠল। খানিকক্ষণ কথা বলে ফোন নামিয়ে রেখে বলল, ‘পুটেদা এখনই আসবেন। এতটা উৎসাহের কারণ বিস্ফোরণ-রহস্য না আপনি সেটা ঠিক বুঝতে পারলুম না। তা সে যাকগে। এবার বলুন, প্রশান্ত ঘটকের সঙ্গে কথা বলে কী মনে হল?’

‘অত্যন্ত মসৃণ ব্যক্তিত্ব। এতই মসৃণ যে প্রায় পেছল বলা চলে।’

‘এই ঘটনার পেছনে ওঁর হাত থাকা সম্ভব?’

‘সম্ভব।’

‘আর পঁচিশ বছর আগেকার ব্যর্থ প্রেমের প্রতিহিংসা?’

‘সেটাও অসম্ভব নয়!’

এরপর আর বিশেষ কথা হল না। শিবেন আর সমরেশ বসল দাবা নিয়ে, দময়ন্তী রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকল।

ফ্রেডারিক ডিসিলভা এলেন আধ ঘণ্টা বাদে। নাম শুনলে যেমন পোর্তুগিজ জলদস্যু মার্কা অতিকায় চেহারার কোনো লোক বলে মনে হয়, আসলে মোটেই সেরকম নন। বরং পুটেদা নামটাই বেশি সংগত বলে মনে হল। ঘোরতর কৃষ্ণবর্ণ, মাথায় একরাশ পাকাচুল, শীর্ণ মুখে পাকানো পাকা গোঁফ, অনতিদীর্ঘ রোগাটে শরীর, পরনে একটা নীল হাওয়াই শার্ট আর কালো ট্রাউজার্স, পায়ে কোলাপুরি চটি। পরিষ্কার বাংলায় বললেন, ‘খুব হতাশ হলেন তো? ভেবেছিলেন একটা লালমুখো সায়েব গটমট করতে করতে আসবে। এল কিনা একটা ভেতো বাঙালি।’

সমরেশ আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি বাঙালি নাকি?’

প্রবল বেগে মাথা নেড়ে ডিসিলভা বললেন, ‘আলবত বাঙালি। ক্রিশ্চান বটি, কিন্তু নিবাস মিদনাপুর জেলার গেঁওখালির কাছে, গ্রামের নাম কুলহাটি।’

দময়ন্তী জিজ্ঞেস করল, ‘হোয়াইট স্টারে কতদিন আছেন?’

‘বেশি নয়, বছর তিনেক। পুলিশের চাকরি থেকে রিটায়ার করে পর্যন্ত এইখানেই আছি।’

‘এই বালিটিকুরিতেই?’

‘হ্যাঁ।’

‘আচ্ছা, এই কারখানায় যে বিস্ফোরণটা হয়েছিল, সে ব্যাপারে একটু বলবেন?’

‘দেখুন, বলবার তেমন কিছু নেই। সেদিন ছিল বুধবার, দুপুরবেলা পৌনে দুটো নাগাদ বিস্ফোরণ ঘটে। আমি তখন গেট অফিসে লাঞ্চ সেরে আরও তিনজন অফিসারের সঙ্গে তাস খেলছিলুম। হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দ! আমি তাড়াতাড়ি গেট অফিস বন্ধ করে কাউকে ঢুকতে বা বেরুতে বারণ করে দিয়ে আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট তরুণ চাকিকে সঙ্গে করে বেরিয়ে এলুম। দেখি, সব্বাই ফাউন্ড্রির দিকে দৌড়ুচ্ছে। আমিও দৌড়োলুম। সেখানে পৌঁছে দেখি ভয়াবহ ব্যাপার। ফাউন্ড্রি শপ একেবারে তছনছ হয়ে গেছে। দুটো কিউপোলা ভেঙে দুমড়ে পড়ে আছে, বড়ো বড়ো প্যাটার্নগুলো ছত্রাকার, ছাদের অ্যাসবেসটস অনেক জায়গায় ফেটে চৌচির, মেঝে বালিতে ভরতি। প্রথমেই লোকজন সামলে ভেতরে ঢুকলুম। আমার মনে একটাই চিন্তা, কেউ মরেনি তো? না, কেউ মরেনি! কেবল প্যাটার্ন রাখার গোডাউনের ভেতর একজন ওয়ার্কার টিফিন করছিল। সে আহত হয়েছে আর অজ্ঞান হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি তাকে হাসপাতালে পাঠাবার ব্যবস্থা করলুম।’

‘পুলিশ এল ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই। লালবাজার থেকে এক্সপার্টরা এলেন ঘণ্টা তিনেক বাদে। বোঝাই গেল, ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে টাইম বোমা। পরে শিবেনবাবুর কাছে জানতে পারি যে এরকম ঘটনা আগেও ঘটেছে— অন্য ফ্যাক্টরিতে।

‘সেদিন পুলিশ ফাউন্ড্রি, শপের দু-চারজনকে জেরা করল। কিছুই বোঝা গেল না। ফাউন্ড্রি শপে অনেক লোকের আনাগোনা, অফিসার থেকে সুইপার। তাদের সবাই সন্দেহভাজন আবার কেউই নয়। তবে, তার পরদিন থেকে দুজন ওয়ার্কার বেপাত্তা হয়ে গেল। একজন মহাবীরপ্রসাদ, চোর, মাতাল, জুয়াড়ি, দু-তিনবার হাজতবাস করে এসেছে। অন্যজন প্রভুদয়াল, এক নম্বরের চোর, বলতে পারেন ক্লেপ্টোম্যানিয়াক, চুরি না করে থাকতে পারে না, তার ওপর চরিত্রদোষও আছে। এদের দুজনের মিল হচ্ছে যে এরা সবসময় পয়সার অভাবে থাকে। ধারের ওপর ধার। আর একটা মিল, এরা কেউই ফাউন্ড্রিতে কাজ করে না।’

দময়ন্তী জিজ্ঞেস করল, ‘এরা সেদিন ফাউন্ড্রি শপে গিয়েছিল?’

‘গিয়ে থাকতে পারে। অসম্ভব নয়। তবে, কেউ তাদের লক্ষ করেনি।’

‘আচ্ছা, এরকম তো হতে পারে যে এই দুই নামকাটা সেপাই এত বড়ো গণ্ডগোল দেখেই গা-ঢাকা দিয়েছে? কারণ, তারা জানে পুলিশ তাদের হেনস্থা করতে পারে। হয়তো গোলমাল মিটলেই তারা ফিরে আসবে।’

‘হ্যাঁ, এটা যে অসম্ভব তা বলব না। বরং বলব ভীষণভাবে সম্ভব।’

‘আচ্ছা, সেদিন আপনাদের ফ্যাক্টরিতে যাঁরা যাঁরা গিয়েছিলেন, মানে বাইরে থেকে, তার কোনো রেকর্ড আছে কি?’

‘আছে। সেদিন যে কজন ভিজিটার এসেছিলেন তাদের প্রত্যেকের নাম, ঠিকানা এবং ঢোকা আর বেরুনোর সময় লেখা আছে।’

‘তাদের কেউ ফাউন্ড্রিতে গিয়েছিলেন?’

‘না। মানে, কাগজে কলমে না। ধরুন, কেউ গিয়েছেন মেশিন শপে। ফেরার সময় ফাউন্ড্রি ঘুরে গেলেন। সেটা ধরবার উপায় নেই।’

সমরেশ বলল, ‘আচ্ছা, আপনাদের হেড অফিস বা ব্রাঞ্চ অফিস থেকে যদি কেউ এসে থাকেন, তাদের নামও কি আপনারা রেকর্ড করেন?’

ডিসিলভা মাথা নেড়ে বললেন, ‘না, তাদের নাম রেকর্ড করা হয় না। তবে, হেড অফিস বা ব্রাঞ্চ অফিস থেকে সাধারণত অফিসাররাই আসেন। তাঁরা তো আর এ কাজ করতে যাবেন না।’

দময়ন্তী মৃদু হেসে বলল, ‘তাই নাকি? এ ব্যাপারে আপনার কোনো সন্দেহ নেই?’

‘না, কোনো সন্দেহ নেই।’

‘ভালো। তবে সেদিন কোনো অফিসার এসেছিলেন কিনা আপনার মনে পড়ে।’

‘না। তা ছাড়া, তাঁরা গাড়ি করে আসেন। কোম্পানির গাড়ি দারোয়ানরা চেনে। দেখলে গেট খুলে দেয়। গাড়ির ভেতরে কারা বসে আছেন সেটা আর লক্ষ করে না।’

‘তার মানে কোনো অফিসার যদি সঙ্গে করে এমন কোনো লোক গাড়িতে বসিয়ে নিয়ে আসেন, যে হয়তো সেই অফিসারের অজান্তেই কারখানার ক্ষতি হয় এমন কোনো কাজ করল, তাকে ধরবার কোনো উপায় নেই?’

ডিসিলভা একটু ভেবে বললেন, ‘না, নেই। তবে এমন ঘটনা ঘটা কি সম্ভব? কোনো অফিসার কি কারখানার ক্ষতি করতে পারেন? তাহলে তো তাঁরই ক্ষতি। আর, এটা নিশ্চয়ই আশা করা যায় যে কোনো অফিসার ঘুস খেয়ে এরকম কাজ করবেন না।’

দময়ন্তী আবার হাসল। বলল, ‘হ্যাঁ, তা আশা করা যায় বটে।’

.

ডিসিলভা চলে গেলে দময়ন্তী বলল, ‘পুলিশ হিসেবে আপনার পুটেদা কিন্তু বেশ নাইভ— সরলচিত্ত লোক।’

শিবেন বলল, ‘তা যা বলেছেন। সেইজন্যেই ওঁর বড়ো একটা উন্নতি হয়নি। সবাইকে অপক্ষপাতে বিশ্বাস করতেন। বললে বিশ্বাস করবেন না, পুলিশে এমন লোক কিন্তু বিরল নয়। আগেও ছিল, এখনও আছে। কিন্তু তা নাহয় হল, পুটেদার কাছ থেকে কিছু জানতে পারলেন?’

‘পারলুম বই কী! যেমন ধরুন, বালিটিকুরির কারখানার ক্ষতি যদি কেউ সত্যি সত্যি করতে চায়, তাহলে তাকে খুব একটা কাঠখড় পোড়াতে হবে না। মানে, ওখানকার সিকিউরিটি একেবারে নিশ্ছিদ্র নয়।’

সমরেশ জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা, অন্য যে কারখানাগুলোতে এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে, সেখানেও কি সিকিউরিটির এইরকম অবস্থা?’

শিবেন বলল, ‘হ্যাঁ, অল্পবিস্তর এরকমই। তা ছাড়া, সিকিউরিটি ব্যাপারটা একেবারে নিশ্ছিদ্র হতেও পারে না। চুরিচামারি হয়তো বেশ কিছুটা আটকাতে পারে, কিন্তু দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে যদি কেউ কারখানার ক্ষতি করতে চায়, তাহলে তাকে শেষপর্যন্ত ঠেকাতে পারে না।’

দময়ন্তী বলল, ‘বুঝতে পেরেছি।’ বলে চুপ করে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল। খানিক বাদে যেন সম্বিত ফিরে পেয়ে বলল, ‘অলোকনাথ আর অতীন্দ্রনাথ সম্পর্কে গোপনে যা যা খবরাখবর সংগ্রহ করা সম্ভব, সেটা করা যাবে কি?’

শিবেন বলল, ‘যাবে। কত দিন সময় নেবেন?’

‘সাত দিন।’

‘ঠিক আছে।’

‘আর একটা কথা। অতীন্দ্রনাথের কোনো গার্লফ্রেন্ড আছে কিনা সে সম্পর্কে বিশেষভাবে খোঁজ নেওয়া দরকার। থাকলে, তার সম্পর্কেও যাবতীয় সংবাদ সংগ্রহ করতে হবে।’

‘অতীন্দ্রনাথের যে বিবরণ তার ঠাকুরদা দিয়েছেন, তাতে তার একাধিক গার্লফ্রেন্ড থাকাই সম্ভব বলে মনে হয়।’

‘তা যদি থাকে, তাহলে তাদের সকলের সম্পর্কেই খোঁজখবর নেওয়া দরকার।’

.

শিবেন এল সাত দিন বাদে, সন্ধ্যেবেলা। হাতে একটা পেটমোটা ফাইল। সোফায় বসে সেই ফাইল খুলতে খুলতে বলল, ‘খবর অনেক কিছুই পাওয়া গেল বউদি, কিন্তু কোনোটাই তেমন জোরদার বলে মনে হচ্ছে না।’

দময়ন্তী বলল, ‘খবরগুলো শোনা তো যাক, তারপর দেখা যাবে তারা জোরদার কি জোরদার নয়।’

শিবেন বলল, ‘বেশ, তাহলে শুরু করি? প্রথম, অলোকনাথ ঘোষাল। এঁর ছাত্রজীবনের কথা আমরা অশোকনাথের মুখেই শুনেছি। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে হোয়াইট স্টারে কর্মজীবন শুরু করেন। এককালে ঘোর বামপন্থী ছিলেন, লেবার ইউনিয়নের অফিস বেয়ারাও ছিলেন। কিন্তু কাজের দিক দিয়ে কখনো ফাঁকি ছিল না। ফলে, কর্মজীবনে ক্রমাগত উন্নতি হয়ে গিয়েছে। হোয়াইট স্টারের লেবার ইউনিয়নের সঙ্গে সম্প্রতি ওঁর সম্পর্কের অবনতি হয়েছে ঠিকই, কিন্তু কয়েকজন শ্রমিক এবং শ্রমিক নেতার সঙ্গে কথা বলে দেখেছি, অলোকনাথকে মনে মনে এখনও অনেকেই অশ্রদ্ধা বা অবিশ্বাস না করারই পক্ষপাতি।’

সমরেশ জিজ্ঞেস করল, ‘ভদ্রলোক কি এখনও রাজনীতি করেন নাকি?’

‘না। প্রত্যক্ষ রাজনীতি করার তো প্রশ্নই ওঠে না। তবে, শুনলুম, এখনও নাকি বেশ বামঘেঁষা। তা সে যাই হোক, ভদ্রলোক বিয়ে করেছিলেন তাঁর বাবার অমতে আজ থেকে বছর ছাব্বিশ আগে। স্ত্রী ছিলেন রাজনৈতিক কর্মী, ছাত্রজীবনে দু-বার জেলও খেটে এসেছেন। আপনি হয়তো তাঁর প্রাকবিবাহ নাম শুনেও থাকতে পারেন। তিনি তপতী গোস্বামী।’

দময়ন্তী বলল, ‘না, তপতী গোস্বামীর নাম শুনেছি বলে মনে হচ্ছে না। পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর আগে রাজনীতি করতেন যাঁরা, খুব বিখ্যাত না হলে তাঁদের নাম শুনে থাকলেও মনে রাখা সম্ভব নয়।’

‘তা যা বলেছেন। তপতী গোস্বামী কোনোদিনই একেবারে সামনের সারির নেতা ছিলেন না। তবে, রাজনৈতিক কাজকর্ম করতেন। ওঁর বাবা কিন্তু এককালে খুব নামকরা লোক ছিলেন। মন্মনাথ গোস্বামীর নাম শুনেছেন?’

‘কোন মন্মথনাথ গোস্বামী? সংগীতাচার্য?’

‘হ্যাঁ, উনিই। ওঁর দুই মেয়ে। তপতী আর প্রণতি। প্রণতি আজ বিয়ের পর প্রণতি উকিল হয়েছেন। উনিও গান করেন। টপ্পা আর ঠুংরিতে প্রণতি উকিলের নাম বড়ো কম নয়। রেকর্ড যদিও বেশি নেই।’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, প্রণতি উকিলের নাম আমরা সবাই জানি।’ বলল সমরেশ, ‘গত বছর পূর্ব কলকাতা সংগীত সম্মেলনে হোরি আর কাজরী গেয়ে আসর মাত করে দিয়েছিলেন। তার পরেই ছিল ওস্তাদ দাউদ জৌনপুরির সরোদ। তিনি তো রেগে কাঁই।’

শিবেন হাত নেড়ে বলল, ‘ব্যস! ওই পর্যন্ত।’

দময়ন্তী বলল, ‘অনুও খুব ভালো গায়। আমাদের কলেজের সব ফাংশনে ওর গান থাকবেই। বুঝতে পারছি, গান ব্যাপারটা ওর রক্তে আছে। কিন্তু, অশোকনাথ যে বলেছিলেন যে তাঁর পুত্রবধূ নিরক্ষর, কদাকার, বস্তিতে বড়ো হয়ে ওঠা, ওঁর বাড়িতে ঢোকার অনুপযুক্ত, সেটা কী ব্যাপার?’

‘নিরক্ষর মানে আই এ পাশ। রাজনীতি করতে গিয়ে বি এ-টা পাশ করে ওঠা হয়নি। তার ওপর তপতী পড়াশুনো করেছেন শ্যামবাজারের এক গার্লস হাই স্কুলে, কোনো কনভেন্টে নয়। কিন্তু, ম্যাট্রিকে মেয়েদের মধ্যে তৃতীয় হয়েছিলেন। অতএব অশোকনাথের কাছে যে ইনি নিরক্ষর হবেন, তাতে আর আশ্চর্য কী? কদাকার? চেহারা দেখিনি, বলতে পারব না। বস্তিতে মানুষ? সেটা মিথ্যে নয়, অন্তত অশোকনাথের স্ট্যান্ডার্ডে। সংগীতাচার্য মন্মথনাথ সারা জীবন গানের মধ্যে ডুবে থেকেছেন। টাকা রোজগার করাটাই জীবনের চরম এবং পরম লক্ষ্য— এই ধারণাটাই তাঁর ছিল না। তা ছাড়া, সে যুগে স্রেফ সংগীতসাধনা করে একটা ভয়ঙ্কর ধরনের অর্থোপার্জন করার কোনো সম্ভাবনাও ছিল না। তবু বলব, খুব একটা দারিদ্র্যের মধ্যেও বোধ হয় ছিলেন না। বাড়ি ছিল বাগবাজারের অনুকূল বড়াল লেনে। পাড়াটা মধ্যবিত্ত ভদ্র এলাকা। আর একটা কথা। এই অনুকূল বড়াল লেন বেরিয়েছে বিপ্লবী উমেশ দত্ত সরণী থেকে।

দময়ন্তী মৃদু হাসল। বলল, ‘বুঝেছি। তারপর বলুন।’

‘এরপর আসছে অতীন্দ্রনাথ। অশোকনাথের কাছে সে অত্যন্ত ইন্টেলিজেন্ট হতে পারে, কিন্তু লেখাপড়ায় কখনোই খুব একটা ভালো রেজাল্ট করেনি। বরং, কোনোরকমে টেনেটুনে পাশ করেছে। স্কুলে তো এক বছর ফেলই করেছিল। কিন্তু, খেলাধুলায় এক্সপার্ট। সে টেনিসে ইউনিভার্সিটি ব্লু, এ বছর স্টেট রেপ্রেসেন্ট করতে পারে। তা ছাড়া, রোয়িং-এ খুব ভালো। ফার্স্ট ডিভিশনে ক্রিকেট খেলে। কন্দর্পকান্তি চেহারা। কেবল একটা দোষ আছে। ভয়ানক মাথাগরম ছেলে— অ্যাংরি ইয়ংম্যান বলতে যা বোঝায়। ভুরু দুটো কুঁচকেই আছে, কটা বাজে জিজ্ঞেস করতেও ভয় হয়। একটা সাড়ে তিন হর্স পাওয়ারের মোটর সাইকেল আছে, সেইটে নিয়ে বেপরোয়াভাবে ঘুরে বেড়ায়। কেবল, একটা সময় ছাড়া।’

‘কোন সময়? যখন ওর সঙ্গে ওর গার্লফ্রেন্ড থাকে?’

‘হ্যাঁ, একদম ঠিক ধরেছেন। ছেলেটার মুখের রেখাগুলো তখন নরম হয়ে আসে, মুখে হাসি ফোটে। পার্ক স্ট্রিটের একটা রেস্টুরেন্টে ছোকরাকে একদিন দেখেছি, সঙ্গে মেয়েটি ছিল। রীতিমতো হা হা করে হাসছিল।’

‘একজনই গার্লফ্রেন্ড, না একাধিক?’

‘ছেলেটির চরিত্র সেদিক দিয়ে ভালো। কো-:এডুকেশন কলেজে পড়েছে, কাজেই অনেক বান্ধবী থাকাই সম্ভব। কিন্তু যাকে দেখলে ছোকরা খুশি হয়ে ওঠে, সে একজনই।’

‘এই একজন সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছেন?’

‘নিয়েছি। কিন্তু, আপনার কি সত্যি মনে হয় যে এ মেয়েটি এই ঘটনার সঙ্গে কোনোভাবে জড়িত থাকতে পারে? নাকি বিশুদ্ধ সার সে লা ফ্যম থিয়োরি চালাচ্ছেন।’

‘পরে বলব। আগে মেয়েটির বিষয়ে বলুন।’

শিবেন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘মেয়েটির নাম বৈদেহী চ্যাটার্জি। বাবা নামকরা ডেন্টিস্ট, ডাক্তার ব্রজেন্দ্রনাথ চ্যাটার্জি! বাড়ি জাস্টিস শশিশেখর মিত্র রোডে। আপাতত বি এ পড়ছে, সেন্ট লুসিয়া কলেজে, অঙ্কে অনার্স।’

‘দেখতে কেমন?’

‘তেমন আহা মরি কিছু নয়, তবে মোটের ওপর ভালো দেখতে। রোগাপটকা, চোখে চশমা— যেমন হয় আর কী।’

‘এই বৈদেহীর সঙ্গে অতীন্দ্রনাথের পরিচয় হল কী করে?’

‘জানা যায়নি।’

অতীন্দ্রনাথের মামাতো ভাইয়ের খবর নিয়েছেন? যাঁর কথা অশোকনাথ বলেছিলেন?’

‘নিয়েছি। সে তার পিসেমশাইয়ের বাড়িতেই থাকে। জুয়েল ছেলে। লেখাপড়ায় ব্রিলিয়ান্ট, চাকরিতেও শুনেছি উন্নতি করছে। নাম পবিত্র চক্রবর্তী। মিসেস ঘোষালের মাসতুতো ভাইয়ের ছেলে। সেই ভাই অনেকদিন মারা গেছেন। ভাইয়ের স্ত্রী কোথায় আছেন জানি না, খুব সম্ভবত তিনিও বেঁচে নেই। ছেলেটির মেরিট দেখে অলোকনাথ তাকে ছেলেবেলা থেকেই নিজের ছেলের মতো করে মানুষ করেছেন এবং অশোকনাথের কথা যদি ঠিক হয়, তাহলে বলতে হবে, নিজের ছেলের চেয়ে একেই উনি বেশি ভালোবাসেন। আর সেটা খুব অস্বাভাবিক নয়। চালচলনে কথাবার্তায় এর পাশে অতীন্দ্রনাথকে বখাটে বলেই মনে হয়। পবিত্র চক্রবর্তী সার্থকনামা ছেলে।’

সমরেশ বলল, ‘একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না?’

‘একটু যে যাচ্ছে না, তা নয়। কিন্তু, ছেলেটিকে দেখলে আর তার সঙ্গে কথা বললে, তোরও বাড়াবাড়ি করতে ইচ্ছে করবে!’

দময়ন্তী বলল, ‘অশোকনাথ বলেছিলেন যে এরা দুই ভাই সহকর্মী…’

‘হ্যাঁ, এরা দুজনেই হোয়াইট স্টারে আছে। ম্যানেজমেন্ট ট্রেনি। অতীন্দ্রনাথ পার্সোনেলে আর পবিত্র কোয়ালিটি কন্ট্রোলে।’

সমরেশ বলল, ‘কোয়ালিটি কন্ট্রোলে? তার মানে পবিত্র ইঞ্জিনিয়ার?’

‘হ্যাঁ। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। তার পিসেমশাইয়ের মতো।’

দময়ন্তী জিজ্ঞেস করল, ‘পার্সোনেলে কী করতে হয়?’

‘পার্সোনেলে, মানে হোয়াইট স্টারে যারা চাকরি করেন, তাদের সম্বন্ধে যাবতীয় তথ্য জানতে হয়, তাদের দেখভাল করতে হয়, তাদের বদলি, উন্নতি বা অবনতি, শাস্তি বা পুরস্কার, ছুটিছাটা, ছাঁটাই বা নতুন লোক ঢোকানো ইত্যাদির ব্যবস্থা করতে হয়।’

‘আর কোয়ালিটি কন্ট্রোলে?’

সমরেশ বলল, ‘আমি বলছি। কোয়ালিটি কন্ট্রোলে কোয়ালিটি কন্ট্রোল করতে হয়। অর্থাৎ, যে মাল বাজারে বেরুচ্ছে সেটা সঠিক মানের হল কিনা সেটা দেখতে হয়, মাল নীচু মানের হলে সেটা বাদ দিতে হয়।’

‘কোন কাজটা বেশি কঠিন?’

‘দুটোই সমান কঠিন।’

‘কোন কাজে ফ্যাক্টরির ভেতরে ঘুরে বেড়াতে হয়?’

‘দুটোতেই হয়।’

দময়ন্তী হঠাৎ খুব চিন্তিত হয়ে পড়ল। বলল, ‘দুটোতেই হয়, না?’ বলে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইল। তারপর জিজ্ঞেস করল, ম্যানেজমেন্টে ট্রেনিরা কি ফ্যাক্টরিতে থাকে, না হেড অফিসে বসে?’

শিবেন বলল, ‘হেড অফিসে। প্রয়োজনে ফ্যাক্টরিতে যায়।’

‘বৈদেহী চ্যাটার্জির সঙ্গে একবার দেখা করা দরকার। যত শিগগির সম্ভব।’

‘দেখছি। পরশু একটা ছুটির দিন আছে। সেদিন চেষ্টা করা যাবে। ডাক্তার চ্যাটার্জিকে কিছু বলব? না, তাঁকে না জানিয়ে ব্যবস্থা করব?’

‘আপাতত না জানিয়ে ব্যবস্থা করুন।’

‘বেশ, তাই করা যাবে।’

‘আর একটা কথা। বৈদেহীর সঙ্গে যেদিন দেখা হবে, তার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ক্যামাক স্ট্রিটে হোয়াইট স্টারের হেড অফিসে অলোকনাথের সঙ্গে দেখা করার ব্যবস্থা করতে হবে। পারবেন?’

‘চেষ্টা করে দেখব।’

.

বৈদেহী এল বিকেলের দিকে। শিবেন আর রমলা আগে থেকেই এসে বসেছিল। দেখা গেল, মেয়েটি বেশ সাদাসিধে, যেমনটি শিবেন বলেছিল। ফ্যাশনের মধ্যে চোখে একজোড়া মস্ত স্টিলফ্রেমের চশমা। তবে, মেয়েটির বড়ো বড়ো চোখ আর শান্ত নির্বিরোধ মুখে এমন একটা কিছু আছে যা মনকে খুশি করে তোলে।

দময়ন্তী হাসি মুখে তাকে অভ্যর্থনা করল, সকলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। বলল, ‘বাড়ি খুঁজে পেতে কোনো অসুবিধে হয়নি তো?’

বৈদেহী মাথা নেড়ে বলল, ‘না, না, কোনো অসুবিধে হয়নি। শিবেনবাবু এমন সুন্দর ডিরেকশন দিয়ে দিয়েছিলেন যে বাড়ি ভুল করার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না।’

‘শিবেনবাবু তোমার এখানে আসাটা গোপন রাখতে বলেছিলেন?’

‘হ্যাঁ, আমি কাউকে বলিনি। বাড়িতে বলে এসেছি, বন্ধুর বাড়িতে যাচ্ছি। বলে হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছি। আমাদের বাড়ি থেকে এ বাড়ি তো খুব দূর নয়।’

‘না, তা নয়। আচ্ছা, তুমি তো জানো যে শিবেনবাবু পুলিশের লোক। আমি কে জানো?’

বৈদেহী ঘাড় কাত করে বলল, ‘হ্যাঁ, জানি। অনিন্দিতা আমাকে বলেছে।’

‘আমি তোমাকে কেন ডেকেছি, জানো?’

এইবার বৈদেহীর মুখে একটা কালো ছায়া নামল। বলল, ‘ঠিক জানি না। তবে, অনুমান করতে পারি।’

‘কেন বলো তো?’

‘অতীনের সম্পর্কে আমার সঙ্গে কথা বলতে চান তো? আমাকে বলবেন যে সে একজন ক্রিমিন্যাল, একজন ভয়ানক খারাপ লোক। আমার উচিত তার সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করা, তার মুখ না দেখা। অতীনের বাবা যা পারেননি, আপনি সেটাই করবেন। আপনি ভাবছেন যে যেহেতু আপনি ডিটেকটিভ, ক্রিমিন্যালদের নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেন, অতএব আপনি যা বলবেন আমি তা বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নেব। আমি অনুর কাছে শুনেছি আপনার সম্পর্কে অনেক কথা। আমি বিশ্বাস করি আপনি টাকা নিয়ে এত বড়ো মিথ্যেটা আমার সামনে সত্যি বলে প্রমাণ করবার চেষ্টা করবেন না। কিন্তু, আপনাকে অতীনের বাবা কী বলেছেন আমি জানি না, তবে আপনি যদি সেগুলো বিশ্বাস করে থাকেন, তাহলে সেটা মস্ত ভুল। সে কথাগুলো সব মিথ্যে, বিশ্বাস করুন, সব মিথ্যে কথা। উনি আমার বাবাকে বলে আমাকে অতীনের জীবন থেকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু, আমার বাবা আমাকে বিশ্বাস করেছেন। আপনাকেও করতে হবে।’ বলতে বলতে বৈদেহীর গলা আটকে গেল। কান্না আটকানোর আপ্রাণ চেষ্টায় মুখে রুমাল গুঁজে বসে রইল ঠিকই, কিন্তু দু-চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল পড়ে যেতে থাকল।

মেয়েটির মুখে কথা শুনে ঘরের বাকি চারজন স্তম্ভিত বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে বসে রইল। বেশ কিছুক্ষণ বাদে দময়ন্তী বিষণ্ণ গলায় বলল, ‘তোমার ধারণা ভুল, বৈদেহী। আমার বিশ্বাস অতীনের পরিবারের সামনে ভয়ঙ্কর বিপদ। তোমাকে ডেকেছি, কীভাবে সেই বিপদ থেকে তাদের উদ্ধার করা যায় সে বিষয়ে পরামর্শ করবার জন্যে।’

দময়ন্তীর কথায় বৈদেহীর বিশেষ কোনো ভাবান্তর হল না। নতনেত্রে অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বলল, ‘আমি আপনাকে কি পরামর্শ দেব? আপনি ঠাট্টা করছেন আমাকে? আপনি ওর বাবাকে বলুন, ওর মাকে বলুন।’

‘তুমি বিশ্বাস কর বৈদেহী, আমি ওর বাবাকেও চিনি না, মাকেও চিনি না। তাঁদের সঙ্গে আমার কখনো কোনোরকমভাবে যোগাযোগ হয়নি। আচ্ছা, তোমার কথা শুনে আমার মনে হচ্ছে যে অতীনের সঙ্গে তার বাবার সম্পর্ক ভালো নয়, কেন?’

‘তা, আমিও ঠিক জানি না। উনি অতীনকে দু-চক্ষে দেখতে পারেন না। খালি বলেন, আমার ছেলেটা খারাপ, নষ্ট হয়ে গেছে, ক্রিমিন্যাল হয়ে গেছে। অথচ, কী খারাপ কাজ যে অতীন করেছে, তা আমি আজও জানতে পারিনি। তবে হ্যাঁ, উনি যেরকম চেয়েছিলেন, অতীন সেরকম হয়নি। উনি চেয়েছিলেন অতীন হবে আদর্শবাদী, দেশপ্রেমিক, প্লেন লিভিং অ্যান্ড হাই থিঙ্কিং ইত্যাদি। তার বদলে, সে হয়েছে বহির্মুখী, ফুর্তিবাজ। সবসময় গোমড়া মুখে ঘরের কোণায় বসে অনবরত সমস্যা নিয়ে চিন্তা না করে, সে জীবনকে উপভোগ করতে চায়— এই বোধ হয় তার অপরাধ।’

‘অতীনের মারও কি এইরকমই মনোভাব?’

‘না। উনি আছেন বলেই অতীন বেঁচে আছে। উনি যদি ওকে সবসময়ে আগলে না রাখতেন, তাহলে ওকে বোধ হয় এতদিনে রাস্তায় দাঁড়াতে হত।’

‘তুমি যে বললে, অতীন ফুর্তি করতে ভালোবাসে, জীবনকে উপভোগ করতে চায়, তাতে তো অনেক টাকা লাগে। অতীন কি সে টাকা রোজগার করে?’

‘না, তা করে না। তবে, ও কখনো টাকা ওড়ায় না। যদি টাকায় কিছু কম পড়ে, তাহলে ওর মা লুকিয়ে টাকা দেন। ওর ঠাকুরদাও দেন। জানেন, ওর টেনিস র‌্যাকেট কিনে দিয়েছেন ওর ঠাকুরদা, রোয়িং ক্লাবের চাঁদার টাকা দেন ওর মা। ওর বাবা হলে এক পয়সাও দিতেন না। অথচ, আগামী বছর ও যাচ্ছে টেনিসে স্টেট রেপ্রেজেন্ট করতে। ওর বাবা ওর খেলাধুলো করাটাও পছন্দ করেন না। কিছুই পছন্দ করেন না।’

‘ওঁর আদর্শ বোধ হয় অতীনের মামাতো ভাই পবিত্র, তাই না?’

বৈদেহী বিস্ফারিত চোখে বলল, ‘ঠিক বলেছেন। উঃ, ওটাকে আমি সহ্য করতে পারি না। সারা বিশ্বের সমস্ত দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে কেবল জাবর কাটতে পারেন। অথচ জিজ্ঞেস করুন বিয়ন বর্গ কে অথবা এ বছর মোহনবাগানের ক্যাপ্টেনের নাম কী— হাঁ করে তাকিয়ে থাকবে। এসব ওঁর কাছে তুচ্ছ ব্যাপার।’

‘মোহনবাগান তুচ্ছ ব্যাপার?’ সমরেশ হাঁইমাই করে লাফিয়ে উঠল, ‘এ লোকটা তো মানুষ খুন করতে পারে দেখছি।’

এতক্ষণে বৈদেহীর মুখে হাসি ফুটল। ‘তা যা বলেছেন।’

দময়ন্তী একটু ভেবে প্রশ্ন করল, ‘তুমি এই পরিবারের সবাইকে কতটা চেন? খুব ঘনিষ্ঠভাবে চেন কি?’

বৈদেহী মাথা নাড়ল। বলল, ‘খুব যে একটা ঘনিষ্ঠভাবে চিনি তা নয়, তবে ওদের বাড়িতে ছোটোবেলা থেকেই যাই আর কী! আসলে আমার মা আর অতীনের মা বন্ধু, মাঝে মাঝে পরস্পরের বাড়িতে যাতায়াত হয়। অতীনের বাবাকে ছেলেবেলা থেকেই এড়িয়ে চলি। বাকি সকলের সঙ্গে সম্পর্ক ভালোই।’

দময়ন্তী মৃদু হাসল। বলল, ‘তা তো বুঝতেই পারছি। আচ্ছা, আর একটা প্রশ্ন। অতীনের বাবার স্বাস্থ্য কেমন?’

‘ভালো নয়। গত বছর একটা হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেছে। এখন খুব সাবধানে থাকেন। উত্তেজনা ওঁর পক্ষে এখন খুব ক্ষতিকারক।’

.

রমলা বলল, ‘মেয়েটি ভারি মিষ্টি। কিন্তু, অতীন ছেলেটি খুব সুবিধের বলে মনে হল না। যার বাবা তাকে উন্মার্গগামী বলে মনে করে, তার সঙ্গে তোর মেলামেশা করার দরকারটা কি?’

শিবেন বলল, ‘এঃ, উন্মার্গগামী! ভালো ভালো বাংলা বলা হচ্ছে! নিজের কথা ভুলে গেলে? তোমার বাবা তো আমাকে উন্মার্গগামী তো কম কথা, একেবারে নরকের কীট বলে ভাবতেন। পুলিশ, তার মানে নিশ্চয়ই ঘুস খায়, নিশ্চয়ই দুশ্চরিত্র। কিন্তু, তাতে কি আমার সঙ্গে মেলামেশা সব বন্ধ করেছিলে তুমি? এসব হচ্ছে ভালোবাসার ব্যাপার, বুঝেছো?’

সমরেশ হাত নেড়ে বলল, ‘ধুত্তোর ভালোবাসা! রমলা তো ঠিকই বলেছে। অতীনকে খারাপ ছেলে বলে সার্টিফিকেট দিচ্ছেন তার বাবা, তোকে তো আর তোর বাবা নরকের কীট বলেননি। বাপ নিজের ছেলেকে চিনতে ভুল করবেন না, অন্যের ছেলেকে করতে পারেন।’

শিবেন বলল, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। আর লেকচার দিতে হবে না। আপনি বলুন তো বউদি, কতদূর কী বুঝলেন?’

দময়ন্তী বলল, ‘সবটা বুঝেছি তা নয়। তবে একটা ছবি ফুটে উঠছে। কেবল একটা বিষয়ে জানা দরকার, তাহলেই সব সন্দেহের নিরসন হয়।’

‘কী বিষয়ে?’

‘যে চারটে কোম্পানিতে বিস্ফোরণ ঘটেছে, তাদের পরস্পরের মধ্যে কোনো ব্যবসায়িক সম্পর্ক আছে কিনা। অর্থাৎ, সুপ্রিম সেরামিক্স, ডায়মন্ড গ্লাস, গ্লোব ইনসুলেটারস আর হোয়াইট স্টার— এরা পরস্পরকে মাল সাপ্লাই করে কিনা। করলে, তার কোনো বিশেষ পদ্ধতি আছে কিনা।’

‘বেশ, এ খবরটা কাল পাবেন। কাল মিস্টার সুজিত নন্দীর সঙ্গে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে— অন্য ব্যাপারে— তখনই ব্যাপারটা জেনে নেওয়া যাবে। তা ছাড়া, কাল বিকেল চারটের সময় আমরা হোয়াইট স্টারের হেড অফিসে যাচ্ছি। সমরেশ অফিস থেকে এক ঘণ্টার ছুটি নিয়ে রাখিস, আমি বউদিকে কলেজ থেকে তুলে নিয়ে তোর অফিসে চলে যাব। তারপর সেখান থেকে ক্যামাক স্ট্রিট তো কয়েক মিনিটের রাস্তা।’

.

সমরেশ গাড়িতে উঠে বলল, ‘মনে হচ্ছে, রহস্যের সমাধান হয়ে গেছে।’

শিবেন বলল, ‘কী করে বুঝলি?’

‘কাল রাত দেড়টার সময় একবার ঘুম ভাঙল। দেখি দময়ন্তী প্যাট প্যাট করে ছাদের দিকে তাকিয়ে শুয়ে আছে। ঘণ্টাখানেক বাদে আবার ঘুম ভাঙল। দেখি তখন অঘোরে ঘুমোচ্ছে। অর্থাৎ, দেড়টা থেকে আড়াইটের মধ্যে…’

‘সমাধান পাওয়া গেছে— সত্যি নাকি বউদি? বোমাবাজকে ধরে ফেলেছেন?’

দময়ন্তী সজোরে মাথা নেড়ে বলল, ‘না, না, বোমাবাজকে ধরতে পারিনি। তবে ব্যাপারটা কী ঘটছে এবং কেন ঘটছে, সেটা বোধ হয় বুঝতে পেরেছি।’

‘তবে তো বোমাবাজকে ধরে ফেলার আর বেশি দেরি থাকা উচিত নয়। অতীনকে কিন্তু আমার বিশেষ সুবিধের বলে মনে হচ্ছে না। বাপের সঙ্গে যার এত শত্রুতা, তার পক্ষে এভাবে প্রতিহিংসা নেওয়াটা অসম্ভব নয়।’

‘তা হয়তো নয়। তবে, আমার ধারণা অন্যরকম। বললুম তো, বোমাবাজটি যে কে তা এখনও পুরোটা বুঝে উঠতে পারিনি। কিন্তু, আমি যে একটি খবর চেয়েছিলুম, তার কি হল?’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, সেটাই তো আপনাকে বলা হয়নি। যে চারটে কোম্পানির কথা আপনি বললেন, তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়িক সম্পর্ক আছে। সুপ্রিম সেরামিক্স, গ্লোব ইনসুলেটারস আর ডায়মন্ড গ্লাস, প্রত্যেকেই হোয়াইট স্টারকে মাল সাপ্লাই করে থাকে। এদের সকলেরই পুরোনো বাঁধা খদ্দের হল হোয়াইট স্টার।’

দময়ন্তী বলল, ‘আমি ঠিক এটাই আশা করছিলুম।’ বলে স্থির দৃষ্টিতে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল। শিবেনের গাড়ি ক্যামাক স্ট্রিটে ঢুকল।

.

অলোকনাথ ঘোষালের সঙ্গে তাঁর বাবা অশোকনাথের প্রবল সাদৃশ্য। একই ধরনের রোগাটে চেহারা, ফর্সা গায়ের রং, পাতলা ঠোঁট, তীক্ষ্ন নাক, ছোটো ছোটো করে ছাঁটা কাঁচা-পাকা চুল, সজাগ তীক্ষ্ন চোখ। মস্ত টেবিলের ওপাশে ভদ্রলোকের শরীরের অধিকাংশই অদৃশ্য, কেবল সাদা শার্টের খানিকটা আর একটা নীল সাদার ডোরাকাটা টাই দৃশ্যমান।

অনেকে আছেন, যাঁদের ঘরে ঢুকলে অতিথিরা তাঁদের প্রচণ্ড ব্যক্তিত্বে একেবারে অভিভূত হয়ে পড়েন। সেরকম শঙ্কা-জাগানো ব্যক্তিত্ব অলোকনাথের নয়। প্রথমত, ঘরে ঢুকে তাঁকে তো রীতিমতো যেন খুঁজে নিতে হয়। দ্বিতীয়ত, ঘরের দেওয়ালে একগাদা গ্রাফ, চার্ট আর বড়ো বড়ো ফ্যাক্টরির বাঁধানো ছবির বদলে একটা হাল্কা নীল রঙের নিরাভরণ শূন্যতা প্রীতিপদ বলেই মনে হয়। তৃতীয়ত, ভদ্রালোকের শান্ত, মার্জিত এবং অনুচ্চ কণ্ঠস্বর শ্রোতাকে শশব্যস্ত করে তোলে না। তবে, সেইসঙ্গে তার কথা বলার ভঙ্গি এতই শীতল এবং ধারালো যে যত তাড়াতাড়ি তাঁর সামনে থেকে সরে যাওয়া যায়, ততই শ্রেয় বলে মনে হয়। আর, আর একটা কথা বলে রাখা ভালো যে অলোকনাথকে কেউ কোনোদিন হাসতে দেখেনি এবং তাঁকে হাসানোর প্রচণ্ড দুঃসাহসিক প্রচেষ্টা দু-একজন অতীতে করে থাকলেও কখনোই তা সফল হয়নি। তার ফলে, এমনিতেই এয়ারকন্ডিশনড তাঁর ঘরে ঢুকে মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে একেবারে উত্তর মেরুর মধ্যিখানে এসে উপস্থিত হয়েছি।

প্রাথমিক ভদ্রতা বিনিময়ের পর অলোকনাথ চোখের সামনে একটা লাল কালোয় ডোরাকাটা পেন্সিল ধরে প্রশ্ন করলেন, ‘আমি আপনাদের কীভাবে সাহায্য করতে পারি?’

দময়ন্তী বলল, ‘আমি কেন এসেছি, আপনি তা জানেন নিশ্চয়ই?’

‘জানি। শুনেছি আপনি বালিটিকুরির ডিসিলভাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। এখন আমার কাছে কী জানতে চান, বলুন?’

‘আপনি কি জানেন যে বালিটিকুরির ফ্যাক্টরিত যে বিস্ফোরণ ঘটে, সেরকম ব্যাপার এর আগে অন্য কয়েকটা ফ্যাক্টরিতেও হয়েছে?’

‘হয়ে থাকতে পারে। এরকম ব্যাপার একেবারেই বিরল নয়। কিন্তু, অন্য কোনো ফ্যাক্টরিতে যদি এইরকম ঘটনা ঘটেও থাকে, তাহলে তার সঙ্গে আমাদের ঘটনাটার সম্পর্ক কোথায়? এবং, এ ব্যাপারে আমার কিছু জানা বা না জানায় আপনাদের তদন্তের কী এসে যায়?’ অলোকনাথের দৃষ্টি তখনও পেন্সিলে।

‘এসে যায়, মিস্টার ঘোষাল। গত এক বছরে আপনার ফ্যাক্টরি ছাড়াও আরও তিন জায়গায় এই একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে। এই চারটে ঘটনার মধ্যে সাদৃশ্য এতই বেশি যে সেটাকে ঠিক কাকতালীয় বলে ধরে নিতে অসুবিধে হচ্ছে। আপনারা ছাড়া অন্য তিনটে সংস্থা হচ্ছে ডায়মন্ড গ্লাস ওয়ার্কস লিমিটেড, গ্লোব ইনসুলেটরস লিমিটেড এবং সুপ্রিম সেরামিক্স লিমিটেড।’ বলে দময়ন্তী চুপ করল, যেন কোনো প্রশ্ন করে না থাকলেও অলোকনাথের কাছ থেকে কোনো মন্তব্য আশা করছিল।

অলোকনাথের দৃষ্টি পেন্সিল থেকে উঠে দময়ন্তীর মুখের ওপর পড়ল। প্রায় অশ্রুত কণ্ঠে বললেন, ‘এসব জায়গায় বোমাবাজি হয়েছে বলে জানি, কিন্তু এটা আমার জানা ছিল না যে চারটে ঘটনাই একেবারে একরকম।’

দময়ন্তী বলল, ‘হ্যাঁ। এ ছাড়া সাদৃশ্য আরও আছে। চারটে সংস্থাই অতীতে বিদেশি মালিকানায় ছিল, চারটেরই আর্থিক অবস্থা আজ বেশ খারাপ, চারজনই পরস্পর পরস্পরকে তাদের মাল সরবরাহ করে থাকে, চারটে কোম্পানিরই ডিরেক্টর বোর্ডে একজন করে মিস্টার এ এন ঘোষাল আছেন।’ বলে দময়ন্তী আবার চুপ করে গেল।

অলোকনাথ কিছুক্ষণ নিষ্পলক চোখে দময়ন্তীর দিকে তাকিয়ে থেকে অতি সামান্য উঁচুগলায় বললেন, ‘এই এ এন ঘোষালরা একই লোক নন।’

‘আমি জানি। এবং এও জানি যে তাঁরা একই পরিবারভুক্ত। তা ছাড়া মিস্টার ঘোষাল, সাদৃশ্য আরও আছে। এই চারটে কোম্পানিরই শেয়ার বাজারে শেয়ারের দাম ক্রমাগত পড়ে যাচ্ছে এবং গত আর্থিক বছরের শেষে চারজনেই ঘোষণা করেছিল যে পৃথক পৃথকভাবে তারা বড়ো অর্ডার পেয়েছে যাতে তাদের অবস্থার উন্নতি হতে পারে। এর মধ্যে আপনি কি কোনো পদ্ধতি দেখতে পাচ্ছেন?’

অলোকনাথের দৃষ্টি আবার পেন্সিলে ফিরে গেল। বললেন, ‘এখনও নয়। আপনি যে কী বলতে চাইছেন, আমি এখনও বুঝতে পারছি না।’

দময়ন্তী মৃদু হাসল। বলল, ‘মিস্টার ঘোষাল, আপনার কি মনে হয় না যে এই সাবোটাজগুলির উদ্দেশ্য একটাই— যেন এই কোম্পানিগুলোর উন্নতি না হতে পারে?’

অলোকনাথ হিমশীতল গলায় বললেন, ‘তা তো বটেই। কারুর উন্নতি করার জন্যে কেউ তো তার কারখানায় বোমা মারে না। আর কোম্পানিগুলোর সাদৃশ্যের মধ্যে আপনি এ এন ঘোষালদের কথা বললেন। আপনার কি ধারণা যে এই কারখানাগুলোর ক্ষতি করার জন্যে তাঁরা কেবল বোমা মেরে বেড়াচ্ছেন? তাতে কার লাভ?’

‘আমার ধারণার কথা আমি পরে বলব, মিস্টার ঘোষাল। তার আগে আমি জানতে চাই, আপনি কি এই চারটে সংস্থারই শেয়ারহোল্ডার বা অংশীদার?’

হঠাৎ অলোকনাথের মুখে একটা অস্বস্তির ছায়া পড়ল। বললেন, ‘এখন আর নয়, আগে ছিলুম।’

‘শেয়ারগুলো কি বিক্রি করে দিয়েছেন?’

‘না, আমার স্ত্রী আর মেয়ের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছি অনেক দিন আগে। নিজের কাছে হোয়াইট স্টারের সামান্য কয়েকটা আছে।’

‘চারটে কোম্পানির শেয়ারই এইভাবে দিয়ে দিয়েছেন?’

‘কেবল চারটে কেন? আরও অনেক কোম্পানির শেয়ার ছিল, সেগুলোও দিয়ে দিয়েছি।’

‘ছেলেকে দেননি?’

‘না। এবং দয়া করে কেন দিইনি সেকথা জিজ্ঞেস করবেন না।’

‘না, তা করব না। আচ্ছা, মিস্টার অশোকনাথ ঘোষালের এই চারটে কোম্পানির শেয়ার আছে কিনা আপনি জানেন?’

‘জানি। উনি এদের সকলেরই অংশীদার ছিলেন।’

‘ইনিও ছিলেন? এখন আর নেই?’

‘না। আমি আমার স্ত্রী আর মেয়েকে আমার শেয়ারগুলো দিয়ে দেবার পর উনি জিদ করে এবং আমার প্রতি ওঁর রাগের বশে ওঁর শেয়ারগুলো আমার ছেলেকে দান করে দেন।’

‘আপনি তো আপনার শেয়ার দান করেছেন সম্পত্তি কর বাঁচানোর জন্যে, অশোকনাথ দান করতে গেলেন কেন? স্রেফ আপনার প্রতি রাগের বশে?’

অলোকনাথের মুখে হঠাৎ এক ঝলক রক্ত উঠে এল। তবে সেটা এক লহমার জন্যে। তৎক্ষণাৎ নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, এবং আমার ছেলের প্রতি অযৌক্তিক অন্ধ স্নেহের বশে।’

‘বেশ। তার মানে আজকে কোনো এ এন ঘোষালই এই কোম্পানিগুলোর অংশীদার নন?’

‘না।’ এইবার অলোকনাথের গলাটা সামান্য উঠল, ‘অংশ নেই ঠিকই, কিন্তু এই চারটে কোম্পানির পেছনেই এদের দুজনেরই প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ অবদান আছে। কাজেই এদের কোনোটারই ক্ষতি করা এদের পক্ষে সম্ভব নয়।’

‘সেটা আমরা পরে বিচার করব মিস্টার ঘোষাল। কিন্তু, এখন এ বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ আছে কি যে, যে সাবোটাজ করছে তার উদ্দেশ্য হচ্ছে যেন এই কোম্পানিগুলোর আর্থিক অবস্থার কোনো উন্নতি না হয় এবং শেয়ার বাজারে তাদের শেয়ারের দাম ক্রমাগত পড়েই যেতে থাকে?’

‘সন্দেহের অবকাশ অবশ্যই আছে, তবে এটা একটা সম্ভাবনা সেটা মানতেই হবে। তবে, তাতে কার কী লাভ?’

‘ধরুন, আপনার কাছে কোনো কোম্পানির অনেক শেয়ার আছে, কিন্তু সেই কোম্পানিগুলোর প্রতি আপনার বিশেষ কোনো দরদ নেই, সেটা যেকোনো কারণেই হোক। সেক্ষেত্রে সেই কোম্পানির শেয়ার বাজারে দর যদি ক্রমাগত পড়ে যেতে থাকে, তাহলে তার থেকে আপনি কী লাভ করতে পারেন না? অনেক টাকার লাভ?’

অলোকনাথের দৃষ্টি ধীরে ধীরে আবার পেন্সিল থেকে দময়ন্তীর মুখে উঠে এল। তাঁর ফর্সা মুখটা ফ্যাকাশে বলে মনে হল। ফিসফিস করে বললেন, ‘হ্যাঁ করতে পারি বটে।’

‘সেক্ষেত্রে সেই কোম্পানির যদি উন্নতি হয় এবং শেয়ার বাজারে তার দর উঠতে থাকে, তাহলে সেই কোম্পানির উৎপাদন আটকানোর জন্যে বোমাবাজি করা অস্বাভাবিক নয়, তাই না?’

‘না, তা নয়।’ যন্ত্রচালিতের মতো মাথা নাড়লেন অলোকনাথ। তারপর বললেন, ‘আপনি কি বলতে চাইছেন, আমি বুঝেছি। কিন্তু আপনার অনুমান ঠিক নয়। এই চারটে কোম্পানির শেয়ার আমার পরিবারের যাদের কাছে আছে, তাদের এই প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি দরদ হয়তো নেই, কিন্তু আপনি যা ভাবছেন তা এদের পক্ষে করা সম্ভব নয়। আমি তা প্রমাণ করে দেব।’ বলে টেলিফোন তুলে বললেন, ‘মিসেস সাহা, আমার বাড়িতে আমার স্ত্রীকে একটু দেবেন।’

শিবেন প্রশ্ন করল, ‘কীভাবে প্রমাণ করবেন?’

অলোকনাথ বললেন, ‘উনি কি ভাবছেন, আপনি তা নিশ্চয়ই জানেন?’

শিবেন মাথা নাড়ল। বলল, ‘না।’

অলোকনাথ একটু যেন আশ্চর্য হলেন। বললেন, ‘জানেন না? উনি যা বলতে চাইছেন সেটা শেয়ার বাজারে একেবারে অপরিচিত খেলা নয়। এটা কোনো কোনো অসৎ ব্যবসায়ী করে থাকে। হয় কি, যখন কোনো কোম্পানির শেয়ার পড়ে যাচ্ছে, ধরুন দশ টাকার শেয়ার আট টাকা হয়েছে, তখন আপনি আপনার শেয়ার বিক্রি করে দিলেন। আপনি আট টাকা পেলেন। পরদিন শেয়ারের দাম ছ-টাকা হয়ে গেল। তখন আবার আপনি সেই শেয়ারগুলো কিনে নিলেন। এবার আপনার ঘর থেকে বেরুল ছ টাকা। দু-টাকা আপনার ঘরে রয়ে গেল। এই লেনদেনটা যদি কয়েক হাজার শেয়ারে হয়, তাহলে লাভের পরিমাণটা কম হয় না।’

শিবেন মাথা চুলকে বলল, ‘কিন্তু লাভটা যে কোথায় হচ্ছে, সেটাই তো বুঝলুম না। শেয়ারগুলো বেচে দিয়ে দশ টাকায় আপনি অন্তত আটটা টাকা পেয়েছিলেন। সেটা যখন আবার কিনে নিলেন, তখন দুটো টাকা ঘরে রইল বটে, কিন্তু দশ টাকার শেয়ারটা তো তখন ছ-টাকা হয়ে গেছে, এরপর পাঁচ টাকা কী চার টাকায় দাঁড়াবে। তখন সেটা বেচলেও তো আপনি ঘরের দু-টাকা ধরেও আট টাকা পাবেন না।’

‘আপনি ঠিকই বলেছেন। তবে, বললুম তো, এটা করে অসৎ ব্যবসায়ীরা। তারা জোর করে বা ষড়যন্ত্র করে কোনো বিশেষ শেয়ারের দাম কমায়, তারপর কেনা-বেচাটা হয়ে গেলে আবার তার দাম বেড়ে যেতে দেয় যাতে করে সেটা আবার তাদের কেনা দামে উঠে আসে। তখন, তাদের আসল দামটাও ঠিক রইল, মাঝ থেকে বেশ কিছু টাকা ঘরে এসে গেল।’

শিবেন মাথা নেড়ে বলল, ‘খেলাটা বুঝেছি, কিন্তু আপনাদের ক্ষেত্রে এ থিয়োরিটা দাঁড়াচ্ছে কী? যিনি বোমা মেরে শেয়ারের দামের ঊর্ধ্বগতি বন্ধ করলেন, তিনি কি আশা করছেন যে অদূর ভবিষ্যতে আপনাদের কোম্পানি আবার বিরাট উন্নতি করবে? আপনাদের যা ক্ষতি হয়েছে, এখন তার থেকে বেরিয়ে আসতে তো অনেক সময় লাগবে।’

‘খুব সত্যি কথা। আর সে কথাই তো আমি বলতে চাইছি।’

দময়ন্তী বলল, ‘শেয়ারগুলো যদি বিনে পয়সায় পাওয়া হয়, তাহলে এইরকম কাণ্ড করে যা পাওয়া যায়, সেটাই তো লাভ, তাই না? আমার তো কেনা দাম বলে কিছু নেই। কেবল শেয়ারগুলো আছে।’

শিবেন মাথা নেড়ে বলল, ‘সেক্ষেত্রে শেয়ারগুলো কি সোজাসুজি বিক্রি করে দেওয়াটাই যুক্তিযুক্ত নয়? এত ঝামেলা করে যে টাকা পাওয়া গেল, তার থেকে তাতে বেশি বই কম পাওয়ার তো কোনো সম্ভাবনা নেই। অবশ্য, শেয়ারগুলো বিক্রি করার যদি কোনো বাধা বা অবরোধ থাকে, তাহলে স্বতন্ত্র কথা।’

অলোকনাথ অত্যন্ত ঠান্ডা গলায় বললেন, ‘আমার আত্মীয়দের যে শেয়ার আমি দিয়েছি তাতে কোনো বাধা নেই। তারা সেই শেয়ারগুলো বিক্রি করুক, ফেলে দিক, দান করুক, যা খুশি করুক, আমার তাতে কিচ্ছু যায় আসে না। যাই হোক, বেশি কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। যদি দেখা যায় যে সেই শেয়ারগুলো সম্প্রতি অল্প কদিনের মধ্যে কেনা-বেচা হয়নি, তাহলেই বোঝা যাবে যে আপনাদের অনুমান ভুল। শেয়ার কেনা-বেচা হলে, শেয়ার কাগজের পেছনে তার রেকর্ড বা খতিয়ান থাকে, তা আপনাদের নিশ্চয়ই জানা আছে?’

বলতে বলতেই টেলিফোন বাজল। অলোকনাথ তাড়াতাড়ি ফোন তুলে বললেন, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে। হ্যালো তপতী? শোনো, তোমাকে এখনই একটা কাজ করতে হবে। মন দিয়ে শোনো, আমি তোমাকে আর অনুকে যত শেয়ার লিখে দিয়েছি, সেগুলো নিয়ে এখনই একটা ট্যাক্সি নিয়ে এখানে চলে এসো। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। কী বললে? হ্যাঁ, সবগুলোই চাই। কয়েকটা হলে চলবে না কি? খুঁজে দেখতে হবে? তার মানে? সেগুলো যত্ন করে রাখা নেই? কী? তোমার গুলো তিনুকে রাখতে দিয়েছ? তিনুকে? কে তোমাকে সেগুলো তিনুকে দিতে বলেছে? আমি তোমাকে ওগুলো দিয়েছিলুম তিনুকে দেবার জন্যে নয়। না, সেই শেয়ারগুলোতে আমার কোনো অধিকার ছিল না ঠিকই। কিন্তু তাই বলে… কী বললে? তিনুকে লিখে দিয়েছ? উফ!’ বলে দড়াম করে ফোনটা নামিয়ে রাখলেন। তারপর দু-হাতে মাথা টিপে ধরে টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়লেন।

শিবেন দময়ন্তীর দিকে ‘এবার কী করা যায়?’ দৃষ্টিতে তাকাল। দময়ন্তী বাঁ-হাতে টেবিলের নীচে একটা বরাভয় মুদ্রা দেখাল, অর্থাৎ, ‘চুপ করে বসে থাকুন। কিচ্ছু করার দরকার নেই।’

প্রায় দু-মিনিট একভাবে বসে রইলেন অলোকনাথ। তারপর হঠাৎ যেন সম্বিত ফিরে পেয়ে সোজা হয়ে বসলেন। টেবিলের তলায় হাত চালিয়ে বোধ হয় কলিং বেল বাজালেন, কারণ পাশের ঘরে গাঁক করে বেল বাজার শব্দ হল। তৎক্ষণাৎ একটি সুসজ্জিতা মহিলা নোট নেবার খাতা আর কলম হাতে ঘরে ঢুকলেন। অলোকনাথ ক্লান্ত কণ্ঠে বললেন, ‘মিসেস মজুমদার, আমার ছেলেকে একটু খুঁজে বের করতে পারেন? নিজের ডিপার্টমেন্টে যে সে নেই তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু সে অন্য যেখানেই আড্ডা দিক না কেন, তাকে এখনই একবার এখানে আসতে বলবেন?’

‘এখানে স্যার? এই আপিসে?’ মিসেস মজুমদারের গলায় অকপট বিস্ময়।

‘হ্যাঁ। এখানে। এই অফিসে।’ বললেন অলোকনাথ, ‘আর একটা কথা। এঁদের জন্যে কফি তৈরি রাখতে বলেছিলুম। দেখুন সেটা কতদূর হল।’

‘আচ্ছা, স্যার।’ বলে মিসেস মজুমদার বেরিয়ে গেলেন।

.

কফিটা এল কয়েক মিনিটের মধ্যেই। কিন্তু, অতিথিরা সেটা মুখে তোলবার আগেই হঠাৎ দরজা খুলে হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে পড়লেন প্রশান্ত ঘটক। আজকে তাঁর পরনে অফিসের পোশাক— গাঢ় ধূসর রঙের সুট, সাদা শার্ট আর গাঢ় নীল আর মেরুনে ডোরাকাটা টাই।

ঘরে ঢুকেই অতিথিদের দিকে দৃকপাত না করে অলোকনাথকে সম্বোধন করে বললেন, ‘এই যে সাহেব, তোমার জন্যে একটু আগে কয়েক মিনিটের মধ্যে দু-দুজন মহিলার টেলিফোন পেলুম। কী হয়েছে, কী?’

সাহেব বললেন, ‘তুমি মহিলাদের টেলিফোন পাবে, এতে আশ্চর্য হবার কী আছে? তার জন্যে আমাকে দায়ী করা কেন?’

‘আলবত তোমাকে দায়ী করব। তোমার গিন্নি, তোমার সেক্রেটারি এই অবেলায় আমাকে টেলিফোন করে কেন? আমার কি কাজকর্ম কিছু নেই?’

‘তপতী তোমাকে ফোন করেছিল, বটে? কী বলল সে? তবে হ্যাঁ, আগে এসো, এঁদের সঙ্গে তোমার পরিচয় করিয়ে দি।’

প্রশান্ত ঘটক অতিথিদের দিকে একঝলক তাকিয়ে বললেন, ‘দরকার নেই। পরিচয় হয়ে গেছে। এঁরা আমার বাড়ি গিয়েছিলেন এবং এই ভদ্রমহিলা বলে এসেছেন যে তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস যে আমিই আমাদের কারখানায় সাবোটাজ করছি। সেদিনই যে আমাকে গ্রেপ্তার করেননি, সেই আমার পূর্বপুরুষের ভাগ্যি।’

‘তুমি সাবোটাজ করছ বলে সন্দেহ করেছেন? কেন!’

‘সেটা পরে বলব। তা ওঁরা এখানে কী মনে করে? তোমার কাছে আমার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নিয়ে এসেছেন?’

‘না, আমার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। উনি বলছেন যে আমি নাকি বোমা মেরে কোম্পানিকে ডুবিয়ে তার শেয়ার নিয়ে শর্ট সেলিং করছি।’

হঠাৎ প্রশান্ত ভয়ানক গম্ভীর হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে দময়ন্তীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কিন্তু অলোকই কেন? এ কাজ তো যেকোনো শেয়ারহোল্ডারই করতে পারে? আমিও করতে পারি।’

দময়ন্তী মাথা নাড়ল। বলল, ‘না, যেকোনো শেয়ারহোল্ডার পারেন না। পারেন তিনি যিনি বোমা বানাতে বা বোমা নাড়াচাড়া করতে পারেন, যেসব কারখানাগুলোর কথা বললুম সেখানে অবলীলাক্রমে ঢুকতে-বেরুতে পারেন, সেইসব জায়গার প্রোডাকশন ইউনিট বা উৎপাদনকেন্দ্রগুলোতে যেতে পারেন কারুর নজরে না পড়ে, কোনো এক কোণায় বোমাটা রেখে আবার কারুর নজরে না পড়ে বেরিয়ে আসতে পারেন। এটা যেকোনো শেয়ারহোল্ডারের পক্ষে করা সম্ভব নয়। আপনার পক্ষেও সম্ভব নয়, কারণ আপনি সেলসের লোক। অন্য কোনো সংস্থার উৎপাদন কেন্দ্রে সবার অলক্ষ্যে আপনার পক্ষে ঢোকা বা বেরুনো অসম্ভব। তা ছাড়া, বোমা বানানো বা তা হাতে করে ঘুরে বেড়ানোও আপনার বা কোনো অংশীদারের পক্ষে সম্ভব নয়।’

‘আমি তো কোনো পেশাদার লোক লাগিয়ে থাকতে পারি?’

‘তা পারেন, কিন্তু সেরকম কোনো সুপার এক্সপার্ট পেশাদার যদি কেউ কলকাতার অপরাধ জগতে থাকত, তাহলে তাকে ধরতে পারুক না পারুক, পুলিশ ঠিক তার সন্ধান রাখত। কিন্তু সেরকম কেউ নেই।’

‘তবে আপনি আমার বাড়িতে গিয়ে একটা অবাস্তব গল্প ফেঁদে বসেছিলেন কেন?’

দময়ন্তী ক্ষীণ হাসল। বলল, ‘গল্পটা অবাস্তব কিনা সেইটে যাচাই করার জন্যে।’

দময়ন্তীর কথার মধ্যেই আবার ঘরের দরজাটা খুলে গেল। মিসেস মজুমদার সশঙ্ক মুখ বাড়িয়ে বললেন, ‘অতীন এসেছে স্যার।’

অলোকনাথ বললেন, ‘এখানে পাঠিয়ে দিন।’

কিন্তু মিসেস মজুমদার দরজার পেছনে অদৃশ্য হবার আগেই প্রশান্ত হাত তুলে বললেন, ‘দাঁড়াও, লীনা, এখনই পাঠিও না। একটু অপেক্ষা করতে বলো। আমি গিয়ে ডেকে আনব।’

মিসেস মজুমদার একটা ম্লান কৃতজ্ঞ হাসি হেসে বললেন, ‘আচ্ছা স্যার।’ বলে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন।

তৎক্ষণাৎ অলোকনাথের দিকে ঘুরে বসলেন প্রশান্ত। বললেন, ‘ব্যাপারটা কী! হঠাৎ তিনুকে ডেকে পাঠিয়েছ যে! এই এত বছরে, কখনো তো দেখিনি। লীনার তো ধারণা যে আজই তিনুর শেষ দিন।’

অলোকনাথ বললেন, ‘ও, তাই মিসেস মজুমদার তোমাকে ফোন করেছিলেন?’

‘হ্যাঁ। অন্যায় কিছু করেনি।’

‘নাঃ, অন্যায় আর বলি কী করে! ডু য়ু থিঙ্ক, শি ইজ দি লেটেস্ট ভিকটিম অফ দ্যাট স্টাড?’

‘হাউ ক্যান য়ু বি সো মিন, অলোক? তুমি তিনুর চরিত্র জানো না? আফটার অল, হি ইজ এ স্পোর্টসম্যান। এসব ব্যাপারে ও কখনোই নেই। লীনা ওকে স্নেহ করে।’

‘হ্যাঁ, যেমন তুমি করো, তপতী করে, মিস্টার অশোকনাথ ঘোষাল করেন। আর তাই আজ তোমার লীনা আর তপতী তোমাকে ফোন করে তিনুকে সাহায্য করতে বলেছে, নয়? মিস্টার অশোকনাথ ঘোষাল ফোন করেননি?’

প্রশান্ত বিকৃত মুখে চুপ করে রইলেন। বোঝা গেল এইসব প্রশ্নের জবাব দেবার কোনো প্রবৃত্তি তাঁর নেই। অলোকনাথ বলে চললেন, ‘কিন্তু প্রশান্ত, আজ যে প্রমাণ হবে যে আমার মানুষ চিনতে ভুল হয় না! আমি অনেক দিন আগে যখন বলেছিলুম যে তোমাদের তিনু এই বংশের মুখে চুনকালি দেবে, তখন তোমরা আমাকে গঞ্জনা দিয়েছিলে। আজ বোধ হয় তোমাদের ভুল শোধরাবার সময় এসেছে। যাও, ওকে ডেকে নিয়ে এসো।’

প্রশান্ত বিস্ফারিত চোখে বললেন, ‘তুমি প্রমাণ করতে চাইছ যে তিনু শেয়ার নিয়ে খেলছে আর সাবোটাজ করছে? তাই তুমি তপতীকে কাগজগুলো আনতে বলেছ? তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে?’

‘আমি কিছুই প্রমাণ করতে চাইছি না। প্রমাণ যা-কিছু করার করবে ওই কাগজগুলো। যা অবশ্যম্ভাবী, সেটা ঘটতে দেওয়া মাথা খারাপের লক্ষণ হতে পারে না, পারে কি?’

‘সত্যি তুমি উন্মাদ হয়ে গেছ। জানি না তিনু সত্যি সত্যি এই কাজ করেছে কিনা। যদি করেও থাকে, সেটা কিন্তু অবশ্যম্ভাবী ছিল না। তোমার ক্রমাগত দুর্ব্যবহারের জন্যেই করেছে। তুমি তোমার ছেলের সঙ্গে যা করেছ, তাতে যদি সে আজ অসামাজিক অপরাধীতে পর্যবসিত হয়, তাহলে আমি তাকে দোষ দিতে পারি না। দোষ তোমার। তুমি আজ পর্যন্ত যে কথাটা বুঝে উঠতে পারলে না তা হচ্ছে কোনো কিছুরই বাড়াবাড়ি ভালো নয়। নীতিবোধেরও না। সর্বমত্যন্তম গর্হিতম কথাটা তোমার নিশ্চয়ই শোনা আছে।’ তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রশান্ত বললেন, ‘যাকগে, আমার কী? তোমার ছেলে মরল কী বাঁচল তাতে আমার কি এসে যায়? তবে মনে রেখ, তিনু যদি শাস্তি পায়, তাহলে সে শাস্তিটা তোমারও প্রাপ্য।’

‘শাস্তি আমি সারাজীবনই পেয়ে আসছি প্রশান্ত। যাও, তিনুকে ডেকে নিয়ে এসো। সময় নষ্ট করো না।’

.

অতীন্দ্রনাথ ঘোষাল সত্যিই অত্যন্ত সুদর্শন। যেমন অসাধারণ স্বাস্থ্য তেমনি সুন্দর মুখাবয়ব। গায়ের রং তার বাবারই মতো। তার চলা বা দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে কিন্তু তার বাবার শীতলতা একেবারেই অনুপস্থিত। বরং কিছু অতিরিক্ত উষ্ণতাই প্রকট। ঘরে ঢুকে সকলকে অগ্রাহ্য করে গটগট করে হেঁটে গিয়ে অলোকনাথের টেবিলের উলটোদিকে অ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়াল।

অলোকনাথ বললেন, ‘তোমার মা তোমাকে কিছু শেয়ার দিয়েছেন। সেই কাগজগুলো কোথায়?’

অতীন্দ্রনাথ তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, ‘আছে কোথাও, বাড়িতেই।’

‘কোথায় আছে মনে করতে পারছ না?’

ভুরু কুঁচকে অতীন্দ্রনাথ বলল, ‘অনেকদিন আগেকার ব্যাপার ঠিক মনে নেই। পবিত্র বলতে পারবে।’

‘পবিত্র? সে বলতে পারবে কেন?’

‘আমার যদ্দূর মনে পড়ে মার দেওয়া শেয়ারের কাগজগুলো ও-ই কোথায় যেন যত্ন করে তুলে রেখেছিল। কোম্পানির কাগজ নিয়ে কী সব লেকচারও দিয়েছিল। বলেছিল, যেখানে-সেখানে ফেলে রাখা উচিত নয়, ইত্যাদি।’

‘চমৎকার! যাও, এখনই বাড়ি থেকে কাগজগুলো নিয়ে এসো। এই মুহূর্তে বেরিয়ে পড়ো।’

‘ঠিক আছে।’ বলে অতীন্দ্রনাথ অ্যাবাউট টার্ন করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘরে ঢুকলেন এক মহিলা। ইনি মিসেস মজুমদার নন। লম্বা-চওড়া শরীর, গায়ের রং কালো নয়, কিন্তু ফর্সাও বলা চলে না। মাথার চুল কাঁধ পর্যন্ত ছোটো করে ছাঁটা, ধারালো নাক-মুখ, চোখে সরু কালো ফ্রেমের ফ্যাশনেবল চশমা। পরনে হাল্কা সবুজ রঙের সিল্কের শাড়ি, গায়ে কাশ্মিরী সুতোর কাজ করা সাদা স্টোল। কাঁধে লম্বা চামড়ার স্ট্র্যাপওলা সোয়েডের ব্যাগ।

ভদ্রমহিলা ঘরে ঢোকা মাত্র প্রশান্ত উঠে দাঁড়িয়ে ‘এসো তপতী, আমরা তোমারই অপেক্ষা করছিলুম।’ বলে আপ্যায়ন করে একটা চেয়ারে বসে পড়লেন। বোঝা গেল, ইনিই মিসেস ঘোষাল। এঁকে যে কী করে অশোকনাথ কুৎসিত বললেন, তা তিনিই জানেন। তবে শীর্ণকায় অলোকনাথের ছেলে যে তার মায়ের কাছ থেকেই লম্বা-চওড়া ফিগারটি পেয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ থাকে না।

প্রশান্ত সকলের কাছে তপতীর পরিচয় করিয়ে দিলেন। তিনি সহাস্যে সকলকে নমস্কার করলেন বটে, কিন্তু তাঁর দুই চোখে একটা প্রচ্ছন্ন আশঙ্কা গোপন করতে পারলেন না। অভিবাদন এবং প্রত্যভিবাদনের পালা শেষ হলে ভদ্রমহিলা তাঁর স্বামীর দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তিনুকে দেখলুম এক ছুটে বেরিয়ে গেল। কোথায় গেল?’

প্রশান্ত যেন একটু আশ্চর্য হয়েই জিজ্ঞেস করলেন, ‘ছুটে বেরিয়ে যেতে দেখলে?’

তপতী বললেন, ‘হ্যাঁ। আমাকে তো দেখতেই পেল না। কোথায় গেল?’

‘আমি ওকে বাড়িতে পাঠিয়েছি ওর শেয়ারের কাগজগুলো আনবার জন্যে।’ বললেন অলোকনাথ।

‘আমি অনুর শেয়ারগুলো এনেছি। এতে হবে?’ বলে তপতী তাঁর কাঁধের ব্যাগ থেকে একটা বড়ো মোটা খাম বের করলেন।

অলোকনাথ তার ভেতর থেকে কতকগুলো বড়ো বড়ো সার্টিফিকেটের মতো দেখতে ছাপানো কাগজ বের করে সেগুলো উলটেপালটে দেখে আবার খামের ভেতর ঢুকিয়ে রাখলেন।

তপতী আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘এতে হবে?’

মাথা নাড়লেন অলোকনাথ। বললেন, ‘নাঃ। তোমার ছেলের কাগজগুলো চাই।’

‘কেন? কী আছে ওই কাগজগুলোর ভেতরে? আমি তো তোমার অফিসের শ্রীধরনকে দিয়ে ট্রান্সফার করিয়েছি। সে তো বলেছিল কোথাও কোনো গোলমাল নেই।’

‘তা হয়তো নেই। গোলমাল অন্যত্র।’

‘কীসের গোলমাল? কী করেছে তিনু? আমায় একটু বুঝিয়ে বলবে?’

‘আমি বলছি, মিসেস ঘোষাল।’ বলল দময়ন্তী, ‘ব্যাপারটা আপনারও জানা দরকার। আঘাতটা যখন আপনাকেও পেতে হবে…’

‘আঘাত? কীসের আঘাত? আর কত সহ্য করতে হবে আমাকে?’

দময়ন্তী একটা দীর্ঘনিশ্বাস টেনে বলল, ‘তাহলে শুনুন।’

.

দময়ন্তী বলছিল, ‘আপনি সাবোটাজগুলোর কথা তো শুনলেন। এখন প্রশ্ন হল, এই সাবোটাজগুলো কে করতে পারে? মনে রাখতে হবে, এগুলো কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এক বা একাধিক লোকের একটি গোষ্ঠী এই কাজটা করছে। এখন, আমরা যদি এই ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করি, তাহলে কি দেখব? প্রথমত, এই ষড়যন্ত্রটি যার মাথা থেকে বেরিয়েছে, সে হয় একটি অভিজ্ঞ, অসৎ ব্যবসায়ী যার এই ধরনের কার্যকলাপের সঙ্গে পরিচয় আছে, অথবা এমন একজন লোক যার অঙ্কে মাথা একেবারে পরিষ্কার। দ্বিতীয়ত, এই একই লোকের অথবা তার দলভুক্ত লোকেদের বিজ্ঞান সম্পর্কেও বেশ জ্ঞান আছে যাতে করে তার পক্ষে ছোটো, বহনযোগ্য অথচ শক্তিশালী টাইম বোনা বানানো সম্ভব। তৃতীয়ত, যেসব জায়গায় বিস্ফোরণ হয়েছে, সেইসব জায়গায় তার পক্ষে কারুর দৃষ্টি আকর্ষণ না করে ঢোকা এবং বের হয়ে আসা সম্ভব। চতুর্থত, তার এই চারটে কারখানাতেই অবাধ গতিবিধি আছে। এবং পঞ্চমত, এইসব কোম্পানির শেয়ারের কাগজ তার পক্ষে জোগাড় করা সম্ভব।

‘এই ধরনের কোনো লোক বা গোষ্ঠীকে কি আমরা চিনি? যদি ধরে নিই যে এই কাজ করেছে কোনো বাইরের লোক যার এই সংস্থাগুলোর সঙ্গে কোনো ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নেই, তাহলে সেটা মেনে নেওয়া কিন্তু বেশ কঠিন হয়। বরং এটা কোনো ভেতরের লোকের কাজ, সেটাই অনেক সহজ সিদ্ধান্ত।’

প্রশান্ত জিজ্ঞেস করলেন, ‘এরকম তো হতে পারে যে কোনো বাইরের লোক ভেতরের লোককে দিয়ে এই কাজ করাচ্ছে?’

‘তা অবশ্যই হতে পারে। তখন সেক্ষেত্রে প্রশ্ন হল, এই ভেতরের লোকটি কে? সে কি হোয়াইট স্টারের লোক না ডায়মন্ড গ্লাস বা অন্য দুটো কোম্পানির লোক? আমরা জানি যে হোয়াইট স্টার বাকি তিনটে সংস্থার কাছ থেকে মাল কেনে অর্থাৎ হোয়াইট স্টার পারচেজার, বাকি তিনটে সাপ্লায়ার। এখন, সাপ্লায়ারের তরফের কোনো লোকের পক্ষে পারচেজারের উৎপাদন কেন্দ্রগুলোতে অবাধে ঘোরাঘুরি করা কি সম্ভব, না তার উলটোটা? মিস্টার ঘোষাল কি বলেন?’

মি. ঘোষাল দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, ‘অবাধে ঘোরাঘুরি করা কোথাও সম্ভব নয়। তবে পারচেজারের লোকের পক্ষে সাপ্লায়ারের কারখানায় যাওয়াই বেশি হয়ে থাকে।’

‘তাহলে এবার আর একটা প্রশ্নের জবাব দরকার হবে। মিসেস ঘোষাল, আপনি কি জানেন যে কোন কোন কোম্পানির শেয়ার আপনি আপনার ছেলেকে লিখে দিয়েছেন। নাম বলার দরকার নেই, কটা কোম্পানি বললেই হবে।’

তপতী একটু চিন্তা করে বললেন, ‘সাতটা, হোয়াইট স্টারকে ধরে।’

‘বেশ। আচ্ছা মিস্টার ঘোষাল, এই সাতটার মধ্যে চারটের কথা আমরা জানি। তাদের অবস্থা পড়তির দিকে। বাকি তিনটের অবস্থা কী?’

অলোকনাথ বললেন, ‘তাদের মধ্যে দুটোর অবস্থা আমাদেরই মতো।’ বলে হঠাৎ চুপ করে কী চিন্তা করতে লাগলেন। একটু বাদে বললেন, ‘আশ্চর্য, অন্যটার সঙ্গে আমাদের কোম্পানির আশ্চর্য মিল ছিল, কিন্তু আজ আর নেই।’

প্রশান্ত বললেন, ‘রয়াল বেঙ্গল ইকুইপমেন্ট লিমিটেড?’

অলোকনাথ মাথা নাড়লেন। বললেন, ‘হ্যাঁ। ওরা আর আমরা একই ধরনের ইকুইপমেন্ট বানিয়ে থাকি। আমাদের দুজনেরই অবস্থা পড়তির দিকে ছিল। যে মস্ত অর্ডারটা আমাদের বর্তমান অবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটাতে পারত, তার কিছুটা তো ওরাও পেয়েছিল। আজ ওদের দশ টাকার শেয়ারের দাম বাইশ টাকায় উঠে এসেছে। আর আমাদের?’

দময়ন্তী জিজ্ঞেস করল, ‘ওদের ওখানে কোনো সাবোটাজ হয়নি?’

‘না। অন্তত আমার জানা নেই।’

‘ওদের সিকিউরিটি কি আপনাদের ফ্যাক্টরির চেয়ে বেশি জোরদার?’

‘একেবারেই না।’ বললেন প্রশান্ত, গুটিকয়েক লিকলিকে দরোয়ান। আর সিকিউরিটির যিনি ইনচার্জ, তিনি আবার একটি পর্বতাকার মানুষ। তিনি গেটের কাছে দাঁড়ালে হয়তো চোর-ছ্যাঁচোররা ভয় পেত, কিন্তু তিনি হরদম নাক ডাকিয়ে ঘুমোন। ফ্যাক্টরিতে ডাকাত পড়লেও উঠবেন কিনা সন্দেহ।’

দময়ন্তী বলল, ‘তাহলে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, এই ঘটনাগুলোর যোগসূত্র হচ্ছে হোয়াইট স্টার। রয়াল বেঙ্গল ইকুইপমেন্টের সঙ্গে হোয়াইট স্টারের কোনো যোগাযোগ নেই, তাই সেখানে কোনো সাবোটাজ হয়নি। অতএব যিনি নাটের গুরু তিনি এখানেই, মানে এই প্রতিষ্ঠানেই আছেন। এরকম কাউকে আপনি চেনেন, মিস্টার ঘোষাল?’

অলোকনাথ কিছু বলবার আগেই প্রশান্ত বললেন, ‘আমি চিনি।’

অলোকনাথ ব্যাকুল চোখে তুলে বললেন, ‘কে? কে?’

‘তার নাম শ্রীঅতীন্দ্রনাথ ঘোষাল। যে পাঁচটি লক্ষণের কথা আপনি বললেন, তার সব কটিই এর মধ্যে প্রবলভাবে বিদ্যমান। যেমন, প্রথমত, অঙ্কে এর মাথা প্রচণ্ড রকমের পরিষ্কার। সেদিন একটা রিপোর্টে দেখি সাতাশের সঙ্গে একান্ন যোগ দিয়ে দিব্যি অবিচলিত কলমে লিখেছে ছিয়াত্তর। আর চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ যদি সে কখনো হিসাব করে, তাহলে তার ডিপার্টমেন্টের অন্তত চারজন সেই হিসাব চেক করে নেয়। দ্বিতীয়ত যেন কী বললেন? ও হ্যাঁ, বিজ্ঞানে জ্ঞান? সেও অসাধারণ। একদিন ওকে জিজ্ঞেস করেছিলুম, বল তো ব্যাটা, ইলেকট্রিক তারে দুটো তার থাকে কেন? সে বললে, খুব সহজ, একটা দিয়ে কারেন্ট আসে, অন্যটা দিয়ে ফিরে যায়। তৃতীয়টা ছিল এই চারটে কোম্পানিতে তার অবাধ গতিবিধি আছে কিনা? হোয়াইট স্টারে আছে, তবে অন্য তিনটেতে আছে কিনা আমার জানা নেই। তবে হ্যাঁ, এসব ক্ষেত্রে সে অবশ্য লোক লাগিয়ে বোমা বসাতে পারে। চতুর্থ বোধ হয় বলেছিলেন সকলের অলক্ষ্যে সে ঘোরাঘুরি করতে পারে কিনা। মানে, সে কোনো প্রোডাকশন ইউনিটে গেল, এদিক-ওদিক ঘুরল, বেরিয়ে চলে এল, তখন সবাই তাকে দেখল অথচ খেয়াল করল না, এই তো? এটা বোধ হয় সম্ভব নয়। কারণ সে পার্সোনেলের লোক, তার কাজ অফিসে, কারখানার ভেতরে নয়। তবে সেক্ষেত্রেও সে লোক লাগাতে পারে। পঞ্চমত, শেয়ার বা কোম্পানির কাগজ। সে তো তার আছেই। তার মা দিয়েছেন। কিন্তু সে জানে যে খুব সম্ভবত সেটা তার বাবার ইচ্ছের বিরুদ্ধে। অতএব, সেগুলো সোজাসুজি বিক্রি করে দিলে অনর্থ হবার সম্ভাবনা। তাই সে র্শট সেলিং করেছে। আর তা ছাড়া তার হাবভাবটা লক্ষ্য করেছেন। তার বাবা তাকে শেয়ারের কাগজগুলো আনতে বলামাত্র সে ছুটে বেরিয়ে গেল। কোনো ইতস্তত করা নেই, কোনো আমতা আমতা করা নেই, কোনোরকম সময় নষ্ট নেই। যার মনে কোনো পাপ আছে সে-ই তো এরকম করে, তাই না?’

অতীন্দ্রনাথের গলা আবার হিমশীতল হয়ে এল। বললেন, ‘তোমার বিদ্রূপগুলো বাজে-খরচা হচ্ছে, প্রশান্ত।’

প্রশান্ত সে কথায় কর্ণপাত করলেন না। বললেন, ‘অতএব বিনা দ্বিধায় আপনারা ছেলেটাকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে যান। সেখানে তাকে আড়ং ধোলাই দিলে সে হয়তো সবই স্বীকার করে নেবে।’

প্রশান্তর কথা শুনে তপতী শিউরে উঠলেন।

অলোকনাথ বললেন, ‘তোমার এত বড়ো লেকচারটার উদ্দেশ্য কী, তা আমি বেশ বুঝতে পারছি, প্রশান্ত। তুমি এঁদের দৃষ্টি তিনুর ওপর থেকে সরিয়ে অন্য একজনের ওপর দিতে চাইছ। হ্যাঁ, একথা সত্যি যে তার অঙ্কে মাথা আছে, সে ইঞ্জিনিয়ার, ইনসপেকশনে আছে বলে আমাদের এবং সাপ্লায়ারদের কারখানায় তার অবাধ গতিবিধি এবং হয়তো অগোছালো তিনুর আলমারি থেকে শেয়ারের কাগজপত্রও তার পক্ষে বের করে নেওয়া সম্ভব। কিন্তু এ কাজ সে করবে কেন? তার কীসের অভাব? তা ছাড়া, তুমি জানো যে সে মিথ্যে কথা বলে না। আমি এখনই তাকে ডেকে সোজাসুজি জিজ্ঞেস করছি, দেখি সে কী উত্তর দেয়। আমার সামনে দাঁড়িয়ে সে কখনো মিথ্যে কথা বলতে পারবে না। আমি জানি তুমি তাকে পছন্দ করো না। আশ্চর্য, যার জন্যে আমাদের গর্বিত বোধ করা উচিত, তাকেই তুমি অপছন্দ করো।’

প্রশান্ত অবিচলিত মুখে বললেন, ‘তোমার লেকচারটাও বেশ বড়ো হয়ে যাচ্ছে। তোমার সেই জুয়েলটিকে যদি ডাকতে হয় তো ডাকো।’

দময়ন্তী বলল, ‘হ্যাঁ, সেই ভালো। তবে, একটা কথা। তাকে কেবল আপনি নন, আমরা সবাই প্রশ্ন করব।’

.

তপতী বললেন, ‘কী যে ঘটেছে, তা আমি জানি না। তবে এটুকু জানি, তিনুই বলুন আর পবিত্রই বলুন, দুজনের কেউই কোনো অপরাধ করে থাকতে পারে না। তিনু হয়তো লেখাপড়ায় ভালো নয়, পড়ার টেবিলের চেয়ে খেলার মাঠেই ওর মন বেশি পড়ে থাকে। কিন্তু লেখাপড়ায় ভালো না হলেই কি গুন্ডা-বদমাইশ হতে হবে? পবিত্র সত্যিই সবদিক দিয়ে আদর্শ ছেলে, তার পক্ষে কোনো অন্যায় কাজ করার তো কোনো প্রশ্নই ওঠে না। আপনারা এই ছেলেদুটোকে ছাড়া আর কাউকে কি ধরতে পারেন না?’

প্রশান্ত বললেন, ‘দুটোকে কোথায়? ধরা তো হয়েছে একটাকে। এই কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর স্বয়ং বলেছেন যে ছেলেটা বদমাইশ, ক্রিমিন্যাল। তার কারণ, সে লেখাপড়ায় দিগগজ নয়, সে খেলাধুলো ভালোবাসে, দেশের দশের দুরবস্থা আর অর্থনৈতিক সামাজিক সমস্যা নিয়ে কোনোমতেই মাথা ঘামতে রাজি নয়। সে আনন্দ করতে চায়, লাফাতে চায়, হাসতে চায়— সে ক্রিমিন্যাল হবে না তো কে হবে? আর ছেলেটার জিদও আছে। কতদিন বলেছি, তিনে, এখানে থাকিসনি, অন্য কোথাও চাকরি দ্যাখ। তোর মতো স্পোর্টসম্যানকে অনেক কোম্পানি লুফে নেবে। তা শুনল আমার কথা? না, এখানেই থাকবে, বাবার কাছে প্রমাণ করে দেবে যে সে অপদার্থ নয়। এখন? জেলে পচে মর!’

অলোকনাথ অবিচলিত কণ্ঠে বললেন, ‘প্রশান্ত, তুমি বড্ড বেশি বকবক করছ। আগে পুরো ব্যাপারটা শেষ হোক, তারপর যা বলবার বলো!’

দময়ন্তী বলল, ‘মিস্টার ঘটক, আপনি সত্যিই অকারণে আপনার বন্ধুর ওপর রাগ করছেন। তিনি যে তাঁর ছেলের ওপর অসন্তুষ্ট, তার জন্যে তাঁর জীবনের ঘটনা পরম্পরা যতটা দায়ী, তাঁর আপন মানসিকতা হয়তো ততটা নয়। আপনি যখন ওঁকে বিদ্রূপ করছেন, তখন আঘাতটা গিয়ে লাগছে একটা অসহায় মনে।’

প্রশান্ত বললেন, ‘বুঝিয়ে বলুন।’

‘আপনি তো তাঁকে অনেক দিন থেকেই চেনেন। অল্প বয়েসে ইনি ছিলেন একজন প্রচণ্ড আদর্শবাদী এবং গুরুতর রক্ষণশীল রাজনীতিক। এই আদর্শবাদ ও রক্ষণশীলতার জন্যে কখনো আবার কাজেও ফাঁকি দেননি। ফলে, তাঁর জীবনে উন্নতি এল অবশ্যম্ভাবীরূপে। তখন উনি বোধ হয় এই বলে নিজের সঙ্গে আপোষ করলেন যে উন্নত অবস্থার মধ্য দিয়েই উনি ওঁর রাজনৈতিক বিশ্বাসগুলোর আরও ভালো রূপ দিতে পারবেন। এদিকে এই উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে এল ক্ষমতা, এল অর্থ, এল প্রতিপত্তি। তখন আবার আপোষ। এই ক্রমাগত আপোষ একটি রক্ষণশীল মনের ওপর কী পরিমাণ চাপ সৃষ্টি করতে পারে, তা বোঝবার ক্ষমতা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের নেই। নেই, তার কারণ, আমরা তো প্রতি পদে, প্রতি মুহূর্তে সবকিছুর সঙ্গেই আপোষ করে চলেছি।

‘এই মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে আপনার বন্ধু নিশ্চয়ই সান্ত্বনা খুঁজতে গিয়েছিলেন তাঁর স্ত্রীর কাছে যাঁকে তিনি বিয়ে করেছিলেন মনের মিলের জন্যেই। কিন্তু তখন তাঁর সন্তান হয়েছে। তিনি আপনার বন্ধুকে যতটা সময় দেওয়া উচিত ছিল, ততটা দিতে পারেননি। ফলে, সান্ত্বনা পাওয়া তো দূরের কথা, আপনার বন্ধুর মনে রাগ পুঞ্জীভূত হয়ে উঠেছে। আর সেই রাগ গিয়ে পড়েছে তাঁর ছেলের ওপর। এমনিতেই পোসেসিভ বাপেদের তাদের ছেলেদের ওপর অল্পবিস্তর যৌন ঈর্ষা থাকেই। তার ওপর এক্ষেত্রে আপনার বন্ধুর মনে হল যে তাঁর ছেলে তাঁর স্ত্রীকে কেবল তাঁর কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে গেল তাই নয়, তাঁকে তাঁর আদর্শ থেকেও বিচ্যুতি করল। সেই ছেলে যত বড়ো হতে লাগল আর দেখা যেতে লাগল যে সে তার বাবার পছন্দসই আদর্শবাদী ছেলে তৈরি হচ্ছে না, রাগ ততই বাড়তে লাগল। তার মা যে তাকে গোপনে মদত দিয়ে থাকেন, আদর্শ মানেন না, তাতে রাগের আগুন আরও বাড়ল বই কমল না। এরই পাশাপাশি এল পবিত্র— আদর্শ ছেলে। স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর সমস্ত অপত্য স্নেহটা গিয়ে পড়ল এর ওপর। তাই বলছি, আপনি অকারণ রাগ করছেন, মিস্টার ঘটক। এটা আপনার অনুচিত হচ্ছে।’

দময়ন্তী চুপ করল। প্রশান্ত আর অলোকনাথ, দুজনেই কী যেন বলতে গিয়েও না বলে চুপ করে রইলেন। কেবল দেখা গেল, তপতীর দু-চোখ বেয়ে নিঃশব্দে জল পড়ে যাচ্ছে।

শিবেন নৈঃশব্দ ভেঙে বলল, ‘আপনার বিশ্লেষণা বড়ো নিষ্ঠুর হল, বউদি।’

দময়ন্তী বলল, ‘হ্যাঁ, তা অবশ্য হল। তবে কি জানেন, নিজের স্বরূপ জানা থাকে না বলে আমরা আমাদের নিজেদের সঙ্গে শত্রুতা করি, নিজেরা নিজেদের ঠকাই। আমরা যদি নিজেদের আসল চেহারাটা সম্পর্কে কোনো ভুল ধারণা পোষণ না করি, তাহলে কিন্তু অনেক মানসিক যন্ত্রণা, অনেক অন্যায় কাজের হাত থেকে বাঁচতে পারি। যেমন ধরুন, সম্পত্তিকর বাঁচানোর জন্যে মিস্টার ঘোষাল নিজের অনেক শেয়ার বেনামি করেছেন, তাতে তাঁর ভেতরে নিজের ওপরে যে রাগের সৃষ্টি হয়েছে, সেটা তিনি আরোপ করেছেন ছেলের ওপর। তাকে বঞ্চিত করে নিজে শাস্তি পাচ্ছেন। তিনি যদি নিজের সম্পর্কে নিষ্ঠুর বিশ্লেষণটা সাহস করে করতেন, তাহলে এই কষ্টটা তাঁকে পেতে হত না।’

অলোকনাথ ম্লান হেসে বললেন, ‘আপনার বিশ্লেষণটা অবশ্যই খুব ইন্টারেস্টিং, কিন্তু সমালোচনার অযোগ্য নয়।’

কথাটা শেষ হল না। তার আগেই দরজা খুলে একটি তেইশ-চব্বিশ বয়সের ছেলে ঘরে এসে ঢুকল। রোগা, বেঁটেখাটো চেহারা, মাথার চুল কদমছাঁট করে কাটা, চোখে গোল ফ্রেমের চশমা, ঠোঁটের ওপর একজোড়া মোটা গোঁফ, পরনে সাদা শার্ট আর সাদা ট্রাউজার্স। মুখে একটা শান্ত বিষণ্ণতা। একনজরে সবার ওপর চোখ বুলিয়ে অলোকনাথকে সম্বোধন করে বলল, ‘আপনি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন?’

অলোকনাথ বললেন, ‘হ্যাঁ, পবিত্র। এসো, বসো। এঁদের সঙ্গে তোমার পরিচয় আছে? পরিচয় করিয়ে দি।’ বলে সবার সঙ্গে পরিচয় করানো হল।

পবিত্র বলল, ‘এঁরা এসেছেন কেন? কোনো গণ্ডগোল হয়েছে কি?’

অলোকনাথ মাথা নাড়লেন। বললেন, ‘হ্যাঁ, শেয়ার নিয়ে আর আমাদের কারখানায় যে বোমা ফেটেছিল, তাই এঁরা তদন্ত করতে এসেছেন।’

‘শেয়ার নিয়ে? তাই কি তিনু আমার কাছে ওর শেয়ারগুলো কোথায় আছে তা নিয়ে খোঁজ করতে এসেছিল?’

‘হ্যাঁ। তুমি জানো শেয়ারগুলো কোথায় আছে?’

‘জানি বই কী! ও তো বড্ড অগোছালো ছেলে। ওর সব জিনিসপত্রের খোঁজ আমাকে রাখতেই হয়। শেয়ারগুলো কোথায় আছে বলে দিয়েছি।’

হঠাৎ দময়ন্তী প্রশ্ন করল, ‘অতীন্দ্র যখন আপনাকে এই খোঁজ দিতে বলেছিল, তখন আপনি নিশ্চয়ই আরও দু-তিনজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলছিলেন, তাই না?’

‘হ্যাঁ, তাই।’

‘অতীন্দ্র যদি আপনাকে আড়ালে প্রশ্নটা করত, তাহলেও কি আপনি বলতেন যে শেয়ারগুলো কোথায় আছে সে খবরটা আপনিই দিয়েছেন?’

‘হ্যাঁ, বলতুম বই কী! মিথ্যে কথা আমি বলি না।’

‘তাই নাকি? অতীন্দ্রের কত টাকার শেয়ার আপনি কেনা-বেচা করেছেন?’

‘আমি? শেয়ার? কি বলছেন? আমি জীবনে শেয়ার কেনা-বেচা করিনি।’

‘আপনার বয়েস খুব কম, অতএব ধরে নেওয়া যেতে পারে যে শেয়ার কেনা-বেচার গলিঘুঁচিগুলোর সঙ্গে আপনার এখনও পরিচয় হয়নি। তাহলে, সেক্ষেত্রে আপনার ভরসা এই কোম্পানিরই শেয়ার ডিপার্টমেন্টের কোনো লোক যিনি শেয়ার ব্রোকারদের সঙ্গে সম্ভাব্য মক্কেলদের পরিচয় করিয়ে দেন এবং তাদের মাধ্যমে কেনা-বেচায় সাহায্য করেন। প্রশান্তবাবু, এরকম কোনো লোক কি এই প্রতিষ্ঠানে আছেন?’

প্রশান্ত বললেন, ‘আছেন। কর্পোরেট সেকশনের শ্রীধরন এই কাজ করে থাকে। আমাদের কোম্পানির যারা শেয়ার কেনা-বেচা করে, তারা ওর মাধ্যমেই করে।’

‘বেশ। এই শ্রীধরনকে ডেকে যদি আপনি চাকরি চলে যাবার এবং হাজতবাসের ভয় দেখান, তাহলে কি সে বলবে যে সে গত এক বছরে ম্যানেজিং ডিরেক্টরের ছেলের শেয়ার কেনা-বেচা করেছে কিনা, এবং কার কথায় করেছে?’

প্রশান্ত পুলকিত মুখে বললেন, ‘আলবত বলবে! লোকটা একটু অসৎ, টাকাপয়সার প্রতি লোভও আছে, কিন্তু প্রচণ্ড ভীতু। অলোককে আর আমাকে তো যমের মতো ডরায়। আর তারপর ধরাচুড়ো পরা পুলিশের ত্র্যহস্পর্শ যোগ। দাঁড়ান, ওকে এখনই ডাকছি।’

পবিত্র তাড়াতাড়ি হাত নেড়ে বললেন, ‘দাঁড়ান কাকাবাবু, শ্রীধরনকে ডাকার দরকার নেই। আমি সত্যি সত্যি শ্রীধরনকে দিয়ে তিনুর শেয়ার কেনা-বেচা করেছি। তিনু আমাকে সনির্বন্ধ অনুরোধ করেছিল যেন এই কাজটি আমি গোপনে করে দি। আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলুম যে কাউকে বলব না। কিন্তু সেই প্রতিজ্ঞা রাখতে পারলুম না।’

দময়ন্তী জিজ্ঞেস করল, ‘গোপনে কেনা-বেচা করতে বলেছিল কেন?’

‘ওর ধারণা, এই ধরনের কাজ করলে মেসোমশাই ভয়ানক অসন্তুষ্ট হবেন। অথচ, ওর টাকার খুব দরকার ছিল।’

‘শ্রীধরনের কাছে সে নিজে গেল না কেন?’

‘শ্রীধরনের সঙ্গে ওর সম্পর্ক ভালো নয়। এই অফিসে অনেকের সঙ্গেই তিনুর সদ্ভাব নেই।’

‘কত টাকার লেনদেন হয়েছে?’

‘প্রায় এক লক্ষ টাকা।’

‘বটে! এত টাকার তার দরকার ছিল?’

‘হ্যাঁ। শুনেছি সম্প্রতি ও কিছু বদ নেশা ধরেছিল। কিন্তু কী নেশা তা আমি জানি না।’

‘ও, তাও শুনেছেন? চমৎকার! তা, যে চারটে ফ্যাক্টরিতে সাবোটাজ হয়েছে, সেগুলোও কি অতীন্দ্রই আপনাকে করতে বলেছিল?’

‘সাবোটাজ? সে সম্বন্ধে তো আমি কিছুই জানি না। শেয়ার সম্পর্কে জানি। তিনু বিক্রি করেছে, তিনু কিনেছে, টাকা ও পেয়েছে, আমি কেবল কাগজগুলো শ্রীধরনকে পৌঁছে দিয়ে তাকে সমস্ত ব্যাপারটা গোপন রাখতে বলেছি। এ ছাড়া আর আমার কিছুই জানা নেই।’

‘তাই নাকি? আচ্ছা, সারকামস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্স কাকে বলে জানেন?’

‘জানি।’

‘আচ্ছা প্রশান্তবাবু, আপনাদের সাপ্লায়ারদের ফ্যাক্টরিতে ইন্সপেকশনে কবে কবে কে গেছেন, তার গত এক বছরের কোনো রিপোর্ট আছে কি?’

‘আছে বই কী। এমনকী কোন কোন বিশেষ দিনে আর কে কে সেখানে গেছেন অথবা যাননি, তারও হিসাব আছে।’

পবিত্র একটু উষ্ণ কণ্ঠে বলল, ‘যেখানে সাবোটাজ হয়েছে সেখানে সেইদিন যদি আমি গিয়ে থাকি, তাতে প্রমাণ হয় না যে আমিই সাবোটাজ করেছি।’

দময়ন্তী বলল, ‘না, তা হয় না। কিন্তু যে যে কোম্পানির শেয়ারের দাম বাজারে পড়ে গেলে যদি কারুর সুবিধে হয়, আর ঠিক সেই সেই কোম্পানির শেয়ার নিয়েই যদি তিনি কেনা-বেচা করেন, তাহলে সেই সব কটা কোম্পানির সাবোটাজের দিনে সেখানে তাঁর উপস্থিতি কিছু একটা প্রমাণ করে বই কী।’

অলোকনাথ হাত নেড়ে ক্লান্ত গলায় বললেন, ‘ব্যস, ব্যস। যথেষ্ট হয়েছে। পবিত্র, এ কাজ তুমি কেন করলে? আমি তোমার কী অপকারটা করেছি বলতে পারো?’

পবিত্র দৃঢ়ভাবে বলল, ‘আমি কিছুই করিনি মেসোমশাই। এসব ষড়যন্ত্র। আমার বিরুদ্ধে কোনোকিছুই প্রমাণ করা যাবে না।’

দময়ন্তী মৃদু হেসে বলল, ‘সারকামস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্স ব্যাপারটা আপনি যতটা ফেলনা ভাবছেন ততটা কিন্তু নয়।’

এই কথার মধ্যে পুনরায় দরজা খুলে ঘরে ঢুকলেন মিসেস মজুমদার। বিস্ফারিত চোখে ঊর্ধ্বশ্বাসে তড়বড় করে বললেন, ‘স্যার! রায়বাহাদুর এসেছেন!’

তৎক্ষণাৎ অলোকনাথ আর প্রশান্ত সটান খাড়া হয়ে উঠে দাঁড়ালেন। তপতী উঠে তাড়াতাড়ি ঘরের এককোণে চলে গেলেন যাতে সকলের চোখের আড়ালে থাকতে পারেন। বাকি তিনজন ইতস্তত করছিল, কিন্তু ঘরে যিনি ঢুকলেন, তাঁকে দেখে তারাও উঠে দাঁড়াল। রায়বাহাদুর অশোকনাথ ঘোষাল, পরনে থ্রি-পিস সুট, গলায় বো-টাই, একটু সামনে ঝুঁকে ধীর কিন্তু দৃঢ় পদক্ষেপে ঘরে ঢুকলেন। হাতের ইশারায় সবাইকে বসতে বলে নিজে একটা চেয়ার টেনে বসলেন। বললেন, ‘আমি দুঃখিত মিস্টার অলোকনাথ ঘোষাল যে আমাকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট না করেই চলে আসতে হল।’ বলে চট করে ঘাড় ঘুরিয়ে তপতী ঘরে আছেন কিনা দেখে নিয়ে বললেন, ‘তারপর, দময়ন্তী, আসামী ধরা পড়ল?’

উত্তর দিলেন অলোকনাথ। বললেন, ‘হ্যাঁ, একজন ধরা পড়েছে।’

বৃদ্ধ মৃদু হাসলেন। বললেন, ‘বটে? সে কে?’

‘তদন্ত এখনও চলছে। শেষ না হলে নাম বলা বোধ হয় ঠিক হবে না।’ বলে পবিত্রর দিকে তাকিয়ে অলোকনাথ বললেন, ‘আচ্ছা, তুমি এখন যাও। তবে আমার অনুমতি ছাড়া অফিস থেকে বেরিয়ো না।’

পবিত্র ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই অলোকনাথ টেলিফোন তুলে সম্ভবত সিকিউরিটিকে আদেশ দিলেন যেন তাঁর অনুমতি ব্যতিরেকে পবিত্রকে অফিস থেকে বেরুতে দেওয়া না হয়। তারপর শিবেনকে বললেন, ‘আপনি সম্ভব হলে এখনই সার্চ ওয়ারেন্ট দিয়ে আমার বাড়িতে লোক পাঠান। পবিত্রর ঘর সার্চ করা উচিত। আমি জানি ওর ঘরে একটা ছোটো ল্যাবরেটরি মতন আছে, সেখানে নানারকম এক্সপেরিমেন্ট সে করে থাকে।’

শিবেন বলল, ‘ঠিক আছে। তাহলে আপনার অপারেটারকে একটু লালবাজার দিতে বলবেন?’

অলোকনাথ পুনশ্চ ফোন তুলে মিসেস সাহাকে শিবেনের কথা মতো লাইন দিতে বললেন।

প্রশান্ত গলা খাঁকারি দিয়ে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘স্যার, এঁদের যিনি নিয়োগ করেছেন, শুনেছি তিনি এই কোম্পানির একজন শেয়ারহোল্ডার বা অংশীদার। সেই অংশীদারটি কি আপনি?’

রায়বাহাদুর কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে প্রশ্নকর্তার দিকে চেয়ে থেকে বললেন, ‘এরকম গাধার মতো প্রশ্ন করো কী করে? জানো না, আমি আমার অংশ তিনকড়িকে লিখে দিয়েছি? তবে হ্যাঁ, নিয়োগ আমিই করেছি আর সেটা করেছি একজন অংশীদারের প্রতিনিধি হিসেবে।’

প্রশান্ত ভয়ানক আশ্চর্য হয়ে বললেন, ‘তিনু আপনাকে বলেছিল?’

‘আবার! আবার সেই গাধার মতো প্রশ্ন! তিনু কি এসব জানে, না বোঝে? আমি নিজেই তার প্রতিনিধিত্ব স্বীকার করেছি। তার অনুমতিটা যথাসময়ে নিয়ে নেওয়া যাবে অখন।’ বৃদ্ধের মুখ তখন চাপা হাসিতে ফুসকায়িত।

দময়ন্তী বলল, ‘মিস্টার ঘোষাল, আপনি কিন্তু গোড়া থেকেই বুঝেছিলেন এই কীর্তিটি কার। তবুও একটা বিচ্ছিরি আষাঢ়ে গল্প ফেঁদে বসেছিলেন কেন?’

‘তোমার এত বুদ্ধি দময়ন্তী, আর এইটে বুঝতে পারলে না?’

‘আমি যা বুঝেছি, বলব?’

‘বলো।’

‘বালিটিকুরির বিস্ফোরণটার পরেই আপনি ব্যাপারটা কী ঘটছে, তা ধরতে পেরেছিলেন। কিন্তু ষড়যন্ত্রটা এমনভাবে করা হয়েছে যে আপনি সোজাসুজি গিয়ে আপনার ছেলেকে কিছুই বলতে পারছিলেন না। তার কারণ, সবাই জানে যে অতীন্দ্রের প্রতি আপনার পক্ষপাত আছে, অতএব আপনি অন্য যার প্রতি দোষারোপ করছেন তাকে ফাঁসানোই যে আপনার উদ্দেশ্য, সেটাই আপনার ছেলের ভেবে নেওয়া স্বাভাবিক ছিল। তখন যদি কোম্পানির কাগজগুলো পরীক্ষা করা হত, তখন দেখা যেত যে তাদের কেনা-বেচায় অতীন্দ্র ছাড়া অন্য কোনো লোকের চিহ্নমাত্র নেই। তখন যদি শ্রীধরনের খোঁজ পাওয়া যেত, তখন তাকে কেউ চাকরি যাবার বা হাজতবাসের ভয় দেখাত না এবং তখন সে যেসব মিথ্যে কথা বলত, সেগুলো সত্য বলে মেনে নিতে কেউ দ্বিধা বোধ করত না। ষড়যন্ত্রকারিটি তখন বেশ সুচারুরূপে অতীন্দ্রর সর্বনাশটি করে মাসিমা-মেসোমশাইয়ের সংসারে মৌরসীপাট্টা নিয়ে বসত। আর মেসোমশাইয়ের শরীর খারাপ, বেশি উত্তেজনা সয় না। নিজের ছেলে জেলে গেছে, এ ধাক্কাটা বেশিদিন আর সইতে পারতেন না।

‘তখন আমাকে এই কাজে লাগিয়ে আপনি আমাদের ভুল পথে চালালেন। ফলে, নানারকম সংবাদ সংগ্রহ করে বিশ্লেষণের বন্ধুর পথে আমাদের সমস্যার সমাধান করতে হল। আমি বাইরের লোক, আমার কারুর প্রতি পক্ষপাতিত্ব থাকার কথা নয়। অতএব, আমার যুক্তিগুলো সবাইকে মন দিয়ে শুনতে হল। এবং, যেহেতু সকলেই বুদ্ধিমান লোক, অতএব সমস্ত ঘটনাটার স্বরূপ যুক্তির আলোয় সকলেই দেখতে পেলেন। তবে হ্যাঁ, কারুর কারুর চোখের সামনে কতগুলো মানসিক বিকারের পর্দা ছিল। রূঢ়ভাবে হলেও সেই পর্দাগুলো আমাদের ছিঁড়ে দিতে হয়েছে।’

রায়বাহাদুর সহাস্য মুখে মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, ‘তোমার সবকটি কথাই প্রায় ঠিক, কেবল একটি ছাড়া। আমি কিন্তু তোমাদের নেহাত ভুল পথে চালাইনি। কেবল অতীতের এক ঘটনাকে বর্তমানে এনে ফেলেছিলুম এই কারণে যে পাত্র-পাত্রীদের নাম পালটে দিলে সেটা আজকের এই ব্যাপারেও সত্য। ভেবে দ্যাখ, এই ঘটনাটা আদৌ ঘটল কেন? অলোক যার নাম করতে চায় না, সে ছেলেটি যে ব্রিলিয়ান্ট তাতে তো সন্দেহ নেই। তা নাহলে এরকম একটা ষড়যন্ত্র তার মাথা থেকে বেরোয়? কিন্তু প্রশ্ন হল, এহেন ব্রিলিয়ান্ট ছেলে এরকম একটা কাজ করতে গেল কেন? তিনকড়িকে এইভাবে না ফাঁসালেও, একদিন না একদিন তার বাপ তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিত। সে পর্যন্ত অপেক্ষা করলেই হত। এই নিষ্ঠুরতার কি দরকার ছিল? আসলে কি জানো দময়ন্তী? সম্পত্তিটা বড়ো কথা নয়, এটা ক্রাইম প্যাশিওনেল বা রিপুজনিত অপরাধ। আষাঢ়ে গল্পটা বলার একটা উদ্দেশ্য ছিল এই ইঙ্গিতটা দেওয়া যে ঈর্ষা এবং প্রতিহিংসা— এই দুটো ব্যাপার যেন তোমার দৃষ্টি এড়িয়ে না যায়।’

দময়ন্তী রুদ্ধশ্বাসে বলল, ‘বৈদেহী? আমি এইরকমই সন্দেহ করেছিলুম!’

‘দোষ তার নয় দময়ন্তী। দোষ যৌবনের আর আমার পুত্র ওই মিস্টার অলোকনাথ ঘোষালের। উনি আড়ালে ঘটকালি করেছিলেন। তাই না মিস্টার অলোকনাথ ঘোষাল?’

অলোকনাথ কোনো জবাব দিলেন না। নিঃশব্দে মাথা নীচু করে বসে রইলেন। এইসময় দরজা খুলে ঘরে ঢুকল অতীন্দ্রনাথ। ঠাকুরদাকে দেখে ফিক করে হেসেই গম্ভীর হয়ে তার বাবার টেবিলের সামনে অ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়িয়ে একটা মোটা খাম তাঁর দিকে এগিয়ে দিল। অলোকনাথ ক্লান্ত ভঙ্গিতে হাত বাড়িয়ে খামটা নিয়ে না খুলেই প্রশান্তকে দিয়ে দিলেন। বললেন, ‘ওখানে কী আছে, আমি জানি। তবু একটু চেক করে দেখো।’ তারপর মুখ তুলে ছেলেকে বললেন, ‘আজ সন্ধ্যেবেলা বাড়ি থেকে বেরুবে না আর একটু ভদ্রস্থ পোশাক-আশাক পরে থাকবে। আজই ডক্টর ব্রজেন চ্যাটার্জি আর বৈদেহীকে নিয়ে আটটা-সাড়ে আটটা নাগাদ বাড়ি আসব। বৈদেহীর বিয়ের কথাবার্তা বলবার জন্যে।’

অতীন্দ্রনাথের সমস্ত শরীরটা কঠিন হয়ে উঠল। মুষ্টিবদ্ধ হাতে দাঁতে দাঁতে চেপে বলল, ‘সেখানে আমার থাকার কি দরকার? পবিত্র থাকলেই তো হল?’

অলোকনাথ স্বভাবসিদ্ধ হিমশীতল গলায় বললেন, ‘বাজে বকো না। তোমার সঙ্গে বিয়ে আর তুমি না থেকে পবিত্র থাকলেই হবে?’

‘আমার সঙ্গে?’ ছেলেমানুষের মতো চেঁচিয়ে উঠল অতীন্দ্র। ঠাকুরদার চেয়ারের পেছনটা ধরে যেন টাল সামলাল। আর ঠিক তখনই একটা অদ্ভুত আওয়াজে সবাই পেছন ফিরে তাকাল। দেখা গেল, তপতী একহাতে মুখ ঢেকে দাঁড়িয়ে আছেন বিস্ফারিত চোখে। সেই চোখে কৃতজ্ঞতা, অনন্দ এবং হয়তো আরও অন্য কিছু।

.

প্রশান্ত অতীন্দ্রর হাত ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললেন, ‘বুঝলি তিনে, তোর বাপ আমাকে তোদের বাড়ি আজ যেতে বলেনি বটে, কিন্তু আমি যাবই। তুই ব্যাটা যা ক্যাবলা, হবু শ্বশুরের সামনে কী করতে কী করে বসবি।’

অশোকনাথ বললেন, ‘না। তুমি আজ সন্ধ্যেবেলা আমার বাড়িতে যাবে। আর যাবার সময় অনুকে নিয়ে আসবে। তিনকড়ি আসবে তার মোটর সাইকেলে বৈদেহীকে নিয়ে। আর মিস্টার অলোকনাথ ঘোষাল ডক্টর ব্রজেন্দ্রনাথ চ্যাটার্জিকে নিয়ে আসবেন। আমি এখন বউমাকে নিয়ে যাচ্ছি।’

প্রশান্ত ঘটকের মুখটা একেবারে হাঁ হয়ে গেল। খাবি খেতে খেতে বললেন, ‘বউমা, মানে তপতী?’

‘আবার গাধার মতো প্রশ্ন। তোমার পদবি ঘোটক না হয়ে দেখছি গর্দভ হওয়া উচিত ছিল। আমার বউমা আর কে হতে পারে? তুমি যদি বিয়ে করতে তাহলেও বা একটা কথা ছিল। আর হ্যাঁ, এই যে তোমরা! তোমরাও আসবে। আর সেন সাহেব, গিন্নিটিকে আনতে ভুলবেন না যেন।’

দময়ন্তী সহাস্যে মাথা নেড়ে বলল, ‘অবশ্যই যাব। কেবল একটা শেষ প্রশ্ন। যিনি আপনাকে আমার নাম বলেছিলেন, অতীন্দ্রের আড়ালে বৈদেহীর সঙ্গে যে অন্যরকমের বন্দোবস্ত হচ্ছে তার খবর দিয়েছিলেন, অতীন্দ্র এবং বৈদেহীর মনের কথা যিনি জানিয়ে ছিলেন এবং আপনার সাহায্য চেয়েছিলেন, অতীন্দ্রকে যে ফাঁসানোর কোনোরকম একটা ষড়যন্ত্র দানা বাঁধছে, সে বিষয়ে তাঁর ষষ্ঠেন্দ্রিয়ের সন্দেহের কথা বলেছিলেন এবং আজকে এই অফিসে আপনার উপস্থিতি প্রার্থনা করেছিলেন, তিনি কি একই ব্যক্তি?’

বৃদ্ধ হাসতে হাসতে প্রবল বেগে মাথা নেড়ে বললেন, ‘অবশ্যই, অবশ্যই। তিনি ছাড়া আর কে হবেন?’

‘তাই যদি হবে, তবে তাঁর সম্পর্কে কিছু আপত্তিকর কথা বলেছিলেন কেন?’

‘তার কারণ, তুমি যদি জানতে যে আমার সংবাদদাতাটি কে, তাহলে তুমি সোজাসুজি তাঁর কাছে যাবার চেষ্টা করতে। তাহলে সঙ্গে সঙ্গে মিস্টার অলোকনাথের তোমার ওপর সন্দেহ গড়ে উঠত। তোমার বিশ্লেষণ সে শুনতে হয়তো রাজিই হত না। তা ছাড়া, একসময় আমি তাঁর ওপর অনেক অন্যায় করেছি। কিন্তু তিনি যে আজ সেসব কথা ভুলে গিয়ে আমাকে একটা প্রকাণ্ড অপরাধবোধের বোঝার থেকে মুক্তি দিয়েছেন, সে কথা আমার পুত্র জানতে পারলে সে যে কী মূর্তি ধরত, তা তো আমার জানা ছিল না। ব্যস, আর নয়। এসো বউমা, আমাদের যাবার সময় হয়েছে।’

শিবেন জনান্তিকে দময়ন্তীকে বলল, ‘বুড়েকে মোক্ষম বিশেষণটি দিয়েছেন বটে— রামঘুঘু।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *