ভগবদগীতা-সমালোচনা – ৪র্থ পরিচ্ছেদ
সপ্তম অধ্যায়ে হৃষীকেশ “জ্ঞান এবং বিজ্ঞান” বিষয় বর্ণনা করেন। তাঁহার বিজ্ঞানটা কিন্তু মান্ধাতার আমলের; কিঞ্চিৎ জীর্ণসংস্কার না করিলে কলেজের ছাত্রগণের নিকট তাঁহার সম্মান রক্ষা দুরূহ হইবে। তিনি বলিলেন, আমার মায়ারূপা প্রভৃতি আট ভাগে বিভক্ত। যথা;–ক্ষিতি, অপ্, তেজ, মরুৎ, ব্যোম, অহঙ্কার, মন এবং বুদ্ধি। ত্রয়োদশ অধ্যায়ে স্বয়ংই আবার এই প্রকৃতিকে চতুর্ব্বিংশতি ভাগে বিভক্ত করিয়াছেন। যথা;–পঞ্চমহাভূত, অহঙ্কার, বুদ্ধি, মূল প্রকৃতি, একাদশ ইন্দ্রিয় এবং পঞ্চতন্মাত্র। দুই বিভাগের সামঞ্জস্য করা বড় সহজ নয়। আর উপর উক্ত বিভাগ (Division) গুলি ইংরাজী ন্যায় (Logic) অনুসারে incomplete ebong overlaspping হইয়াছে কি না, তাহাও ভক্তবৃন্দের বিচার করা উচিত।
শ্রীকৃষ্ণ মনে করেন, তিনি জলের রস (রসোহহম্ অপ্সু)। জলের রস পদার্থটা কি, কোন ভাষ্যকারই তাহা ব্যাখ্যা করেন নাই। শ্রীকৃষ্ণ পুনরায় বলিলেন, চারি শ্রেণীর লোকে আমাকে আরাধনা করেন; আর্ত্ত, অর্থাৎ রোগাদিতে অভিভূত, আত্মজ্ঞানাভিলাষী, অর্থাভিলাষী এবং জ্ঞানী। ইহারা সকলে পুন্যবান (সুকৃতিনঃ) এবং মহৎ (উদারাঃ) অর্থাৎ মোক্ষ-প্রাপ্ত হইবার উপযুক্ত। ম্যালেরিয়া প্রপীড়িত দরিদ্র বঙ্গ দেশের পক্ষে ইহা একটী শুভসংবাদ বটে। কেননা পীড়াগ্রস্থ বা ধনাকাঙ্খীর মোক্ষ নিশ্চিত হইলে, মুক্তির ভাবনা কাহার?
এই অধ্যায়ে আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যার কিছু বাড়াবাড়ি। কিন্তু কি উদ্দেশ্যে আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যার অবতারণা করা হইয়াছে, তাহা আর্য্য মিশনের গীতার বিজ্ঞাপন পাঠা জানা যায়। “বহির্লক্ষ্যের অর্থ লইয়াই হিন্দুধর্ম্ম বিদ্বেষিগণ আমাদের ধর্ম্মের নিন্দা এবং তৎপ্রতি বিদ্রুপ ও উফাসাত্মক নানাবিধ কটূক্তি করিয়া থাকেন। তাঁহারা বলেন যে হিন্দু ধর্ম্ম কিছুই নহে, কেননা তন্ত্র, মহাভারত, রামায়ণ, চণ্ডী লইয়াই ত হিন্দুর ধর্মশাস্ত্র; কিন্তু এ সকল গ্রন্থের বিষয় গুলি কি? ১ম, তন্ত্র–ইহাতে মদ্য, মাংস, মৎস্য, মুদ্রা এবং মৈথুন এই গুলি সাধনের উপকরণ। অথচ এই গুলি অপেক্ষা অপকৃষ্ট বস্তু আর নাই। ২য়, মহাভারত–ইহার বিষয় সামান্য ভূমি খণ্ডের জন্য ভ্রাতৃবিরোধ। ৩য়, শ্রীমদ্ভাগবৎ,–ইহাতে শ্রীকৃষ্ণের লীলা ও ষোলো হাজার গোপীর সহিত তাঁহার বিহার বর্ণনা। পাশ্চাত্য সভ্যতার ও শিক্ষার গুণে আজ কাল লোকে আর অন্ধ বিশ্বাস করিতে চাহে না। সুতরাং বহির্লক্ষ্যের অর্থ লইয়া লোকে যে শাস্ত্রকে অত্যন্ত অপকৃষ্ট বলিবে, তাহার বিচিত্র কি?” শাস্ত্রের দৃষ্টান্তে দেশে পাপের স্রোত বৃদ্ধি পাইতেছে; সুতরাং শাস্ত্রের বহির্লক্ষ্যের অর্থ প্রকৃত অর্থ নয়। তাহাদের গূঢ় তাৎপর্য্য আছে। তাহাই আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা বা অন্তর্লক্ষ্যের অর্থ। যাহাই হউক, সনাতন-ধর্ম্ম প্রচারিণী সভার সভাপতি একজন পরম হিন্দু হইয়াও যে, এই গুলি স্বীকার করিয়াছেন, ইহাই আমাদের পক্ষে যথেষ্ট।
১ম। হিন্দু শাস্ত্রের অন্ততঃ বহির্লক্ষ্যের অর্থ অর্থাৎ লোকে এবং টীকাকারগণ যাহা করিয়া থাকেন, তাহা অত্যন্ত জঘন্য, শাস্ত্রের দোহাই দিয়া লোকে পাপ কার্য্য করে। ২য়। পূর্ব্বে লোকের বিচার শক্তি ছিল না। যাহা শুনিত বা সংস্কৃত গ্রন্থে যাহা পড়িত, তাহাই অন্ধের ন্যায় বিশ্বাস করিত। ইংরাজি শিক্ষার অনুশীলক দ্বারা লোকের বিচার শক্তি বৃদ্ধি পাইয়াছে।
যদি এরূপ সপ্রমাণ করা যায় যে, আর্য্যমিশন যাহাকে বহির্লক্ষ্যের অর্থ বলেন, তাহাই প্রকৃত অর্থ; এবং তিনি যাহাকে অন্তর্লক্ষ্যের অর্থ বলিয়া প্রচার করিতে ইচ্ছুক তাহা মিথ্যা, তখন তাহার হিন্দু ধর্মের স্বপক্ষে বলিবার কিছুই থাকিবে না। অভিধানাদির সাহায্যে এবং শঙ্কর, শ্রীধর, মধুসূদন, রামানুজ প্রভৃতির টীকা হইতে শাস্ত্রের যাহা অর্থ হয়, তাহাই সত্য, তদ্বিপরীত অর্থই ভূল। তিনি ত নিজেই বলিয়াছেন, ইংরাজী শিক্ষা দ্বারা লোকের অন্ধ বিশ্বাস দূর হইয়াছে। সুতরাং কে আর পূজ্যপাদ ভাষ্যকারগণের অর্থ পরিত্যাগ করিয়া তাঁহার অর্থ গ্রহণ করিবে? শ্রীচৈতন্য দেব, একবার শ্রীধর স্বামীর ব্যাখ্যা খণ্ডন প্রয়াসী এক ভট্টাচার্য্যকে উপহাস করিয়া বলেন যে, ব্যাভিচারিণীরাই স্বামীর বাক্য অবহেলা করে। তাঁহার আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যার নমুনা শ্রবণ করুন।
চৈনাচিন কুশোত্তরম্ (৬অ–১১) “চৈল=মনিপুর, অচিন=স্বাধিষ্ঠান, কুশ=মূলাধার” ইত্যাদি, বলা বাহুল্য, চৈলাজিন কুশোত্তরং এর প্রকৃত অর্থ চৈলং বস্ত্রং অজিনং ব্যাঘ্রাদিচর্ম্ম চৈনাজিনে কুশেভ্য উত্তরে যস্য; কুশানাম্ উপরি চর্ম্ম তদুপরি বস্ত্রমাস্তীর্য্য ইত্যর্থঃ (শঙ্কর, শ্রীধর স্বামী)। ক্ষিত্যপ্তেজের আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা আছে। ক্ষিতি=মূলাধার। অপ্=স্বাধিষ্ঠান। তেজ=মনিপুর। মরুৎ=অনাহত। ব্যোম=বিশুদ্ধ। (আর্য্য মিশনের গীতা ৭অ–৪)। কখন বা চৈলাজিন হইয়া যোগীর আসন রূপে অবস্থিত কখন বা পঞ্চভূত রূপে জগৎ নির্ম্মাণে উন্মুখ মনিপুর স্বাধিষ্ঠানগণই বা কে? বিলাতি শরীরব্যবচ্ছেদ শাস্ত্রেত উহাতের কোন উল্লেখই নাই। তবে যোগের অসাধ্য কার্য্য কিছুই নাই। যোগ বলে আর্য্য মিশনের পঞ্চানন ঠাকুর কত অমূল্য বৈজ্ঞানিক সত্য বাহির করিয়াছেন দেখুন। ১৪ অধ্যায়ের ৮ শ্লোকের টীপ্পনিতে লিখিত আছে যে, “শ্বাস ঈড়া ছাড়িয়া পিঙ্গলায় যাইবার মুখে এবং পিঙ্গলা ছাড়িয়া ঈড়ায় যাইবে মুখে সুষুম্না দিয়া যায়”। “শ্বাসের গতি অনুসারে মনের গতির পরিবর্ত্তন হয়”। “সাধক গুরুপদিষ্ট উপায়ে শ্বাসে সর্ব্বদা লক্ষ্য রাখেন বলিয়া তাঁহার শ্বাসের চঞ্চলতা থাকে না। তিনি প্রাণকে যেখানে ইচ্ছা রাখিতে পারেন। বিলাতি বিজ্ঞান হইতে দেশী বিজ্ঞান কতদূর উচ্চ, পাঠকবর্গ এক্ষণে তাহা বেশ হৃদয়ঙ্গম করিতে সক্ষম হইয়াছেন। হাক্স্লি কার্ক প্রভৃতি পণ্ডিতগণ আজিও প্রাণটা কি তাহা স্থির করিতে পারেন নাই। তাঁহারা মনে করেন, lungs (ফুসফুস) এবং heart (হৃদয়) জীবনের দুইটি পা স্বরূপ; অর্থাৎ ইহাদের কার্য্যেতে জীবনের অবস্থান। কিন্তু বাঙ্গালী বৈজ্ঞানিক প্রাণের স্বরূপ তত্ত্ব অবগত হইয়া প্রাণকে শরীরের যেখানে ইচ্ছা সেখানে রাখিতে পারেন। তিনি জানিতে পারিয়াছেন যে, প্রাণ একটা বায়ু বিশেষ। “স্থান ভেবে ঊনপঞ্চাশ আখ্যা ধারণ করিয়া এই পাঞ্চভৌতিক দেহকে চালাইতেছে”। (১৬অ–২২ শ্লোকের টীকা)। চালান তাহাতে ক্ষতি নাই, তবে গ্রন্থকারকে না বায়ুগ্রস্থ করিয়া ফেলেন।
সপ্তম অধ্যায়ের ২৪ শ্লোকে ভগবান বলিলেন,–
অব্যক্তং ব্যক্তিমাপন্নং মন্যন্তে মামবুদ্ধয়ঃ।
পরং ভাবমজানন্তো মমাব্যয়মনুত্তমং।।(১)
“আমি অব্যক্ত; কিন্তু নির্ব্বোধ মনুষ্যেরা আমার নিত্য, অব্যয়, এবং অতি উৎকৃষ্ট স্বরূপ (সচ্চিদানন্দ রূপ) অবগত না হইয়া আমাকে মনুষ্য, মীন্, কুর্ম্ম, ব্রহ্মা, বিষ্ণু ইত্যাদি ভাবাপন্ন মনে করেন।” এই অধ্যায়ে ঈশ্বর ভিন্ন অন্য দেবতার আরাধনার অকিঞ্চিৎকরত্ব সম্বন্ধে কতকগুলি উপদেশ আছে, তাহা আমরা গীতানুরাগী হিন্দু মহোদয়গণকে পাঠ করিতে অনুরোধ করি।
“অন্যান্য উপাসকেরা স্বীয় প্রকৃতির বশীভূত হইয়া অর্থাৎ পুত্র লাভ, শত্রুজয়াদি বিষয় বাসনা দ্বারা অভিভূত এবং কামাদি দ্বারা হতজ্ঞান হইয়া ভূত প্রেতাদি ক্ষুদ্র দেবতার আরাধনা করিয়া থাকে”। (৭অ–২০)। আশ্বিন এবং কার্ত্তিক মাসে বঙ্গদেশে অনেক দেবতাই ষোড়শোপচারে পূজা পাইয়া থাকেন। তাহারাই এই গীতোক্ত ক্ষুদ্র দেবতা কি না তাহা ভক্ত মাত্রেরই বিশেষ করিয়া পরীক্ষা করা উচিত। কেননা বিপুল অর্থব্যয় এবং অশেষ শারীরিক এবং মানসিক কষ্ট ভোগ করিয়া ভূত পূজার ফল স্বরূপ পেতত্ব পাইতে হইলে অত্যন্ত ক্ষোভের বিষয় হইবে। শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ংই বলিয়াছেন–“দেবতা পূজকগণ দেবলোকে, পিতৃপূজকগণ পিতৃলোকে গমন করেন; যাঁহারা ভূতের উপাসক তাঁহারা ভূত হন; কিন্তু যাঁহারা ব্রহ্মোপাসক তাঁহারা ব্রহ্মকে প্রাপ্ত হন”। (৯অ–২৫)। আর দেবতা পূজারই বা আবশ্যকতা কি? বাসুদেব ত পুনঃ পুনঃ স্পষ্টাক্ষরে বলি্তেছেন–“দেবতা পূজার ফল ক্ষণস্থায়ী। বেদত্রয় বিহিত কর্ম্মে মোক্ষ হয় না। দেবপূজকদিগের পুণ্য সত্বর ক্ষয় প্রাপ্ত হয়, এবং বারম্বার জন্ম গ্রহণ করিতে হয়। (৯অ–২০-২১)। কিন্তু–
অনন্যাশ্চিন্তয়ন্তোমাং যে জনা পর্য্যুপাসতে।
তেষাং নিত্যাভিযুক্তানাম্ যোগক্ষেমং বহাম্যহম্।। (৯অ–২২)
“যাহারা অনন্যমনে আমারে চিন্তা ও আরাধনা করে, আমি সেই সকল মদেকনিষ্ট ব্যক্তিদিগকে মুক্তি প্রদান করিয়া থাকি”।
“নিকৃষ্ট জাতি বা নিতান্ত পাপাত্মা শূদ্র বা স্ত্রীলোকও ব্রহ্মকে আশ্রয় করিলে উৎকৃষ্ট গতি লাভ করিতে পারে” (৯অ–৩২)।
যদি ব্রহ্মোপাসনাই মোক্ষলাভের একমাত্র উপায় হয়, যদি ব্রহ্মকে আশ্রয় কইলে সকল পাপ সকল দুঃখের হস্ত হইতে পরিত্রাণ পাওয়া যায়, তবে কেন ভাই অনর্থক ভূতের উপাসনা করিয়া শরীর মন কলুষিত কর!
যাবানর্থ উদপানে সর্ব্বতঃ সংপ্লুতোদকে।
তাবান্ সর্ব্বেষু বেদুষু ব্রাহ্মণস্য বিজানিতঃ।। (২য়–৪৬)
“যেমন উদপানে (অর্থাৎ কূপ, বাপী, তড়াগ প্রভৃতি ক্ষুদ্র জলাশয়ে) যে সকল প্রয়োজন সিদ্ধ হয়; একমাত্র সংপ্লুতোদকে (মহাহ্রদে) সেই সকল প্রয়োজন সিদ্ধ হইয়া থাকে। সেইরূপ সমুদায় বেদে যে সকল কর্ম্মফল বর্ণিত আছে, সংশয়রহিত বুদ্ধি বিশিষ্ট ব্রহ্মনিষ্ট একমাত্র ব্রহ্মেই তৎসমুদায় প্রাপ্ত হইয়া থাকেন”।
“সাকার পূজা এবং নিরাকাএর পূজা” ইহার মধ্যে কোনটী গীতার অভিপ্রেত? বাসুদেব “মৎকর্ম্মকৃৎ,” “মদ্ভক্ত হও” “মৃত্যুর পর আমাকে প্রাপ্ত হইবে” ইত্যাদি কথা দ্বারা নরদেহধারী কৃষ্ণ মূর্ত্তির কি পূজা করিতে বলিতেছেন? কেহ কেহ এরূপ প্রশ্ন করিতে পারেন। সমাজের ভয়ে মুক্তকণ্ঠে বলিতে না পারুন, ভগবদগীতার রচিয়তা যে বেদের প্রতি আস্থা শূন্য ছিলেন, অর্থ শূন্য যজ্ঞাদি কর্ম্মকাণ্ড এবং প্রতিমাদি পূজার তাঁহার বিলক্ষণ বিদ্বেষ ছিল, মনোযোগের সহিত ভগবদগীতা পাঠ করিলেই তাহার বিলক্ষণ আভাষ পাওয়া যায়। ইতিপূর্ব্বেই আমরা তাহার অনেক পরিচয় দিয়াছি। দ্বাদশ অধ্যায়ের প্রথম শ্লোকের টীকায় হিন্দুশ্রেষ্ঠ শ্রীধর স্বামী নিজেই স্বীকার করিয়াছেন যে, “যাঁহারা সমস্ত কর্ম্মার্পণ দ্বারা একান্ত ভক্তি সহকারে সমাহিত চিত্ত হইয়া বিশ্বরূপ, সর্ব্বজ্ঞ, সর্ব্বশক্তিমান, সগুণ (২) ঈশ্বরের উপাসনা করেন তাঁহারাই শ্রেষ্ঠ।”
গীতার স্থানে স্থানে আদি দেব, বিশ্বকর্ত্তা পরমেশ্বরের যে বর্ণনা আছে, তাহা সান্ত সাকার মূর্তি নহে। বিস্ময়োৎফুল্ল নয়নে মহামতি পার্থ যে বিশ্বেশ্বরের বিশ্বরূপ দর্শন করিয়াছিলেন, তাহার আদি, অন্ত বা মধ্য কিছুই নাই। তিনি অখিল ব্রহ্মাণ্ডের গতি, ভর্ত্তা, প্রভু, সাক্ষী, নিবাস, শরণ (রক্ষক) এবং সুহৃৎ। তাঁহা হইতেই এই বিশ্ব সংসার উৎপন্ন হইয়াছে, তাঁহাতেই বিলীন হইবে। (৯অ–১৮)। সূত্রে যেরূপ মণিগণ গ্রথিত থাকে, বিশ্ব সংসার তদ্রুপ তাঁহাতে গ্রথিত আছে। তিনি অব্যক্ত রূপে সমস্ত বিশ্বে ব্যাপ্ত রহিয়াছেন। তাঁহাতে ভূত সকল অবস্থান করিতেছেন অথচ ইনি কিছুতেই অবস্থিত নন। (৯অ–৪)। অনাদি এবং নির্বিশেষস্বরূপ ব্রহ্মই জ্ঞেয়; সর্ব্বত্রই তাঁহার কর, চরণ, চক্ষু, মস্তক ও মুখ বিরাজিত আছে। তিনি সকলকে আবৃত করিয়া, অবস্থিতি করিতেছেন (১৩অ–১৪)।
প্রতিমাদি পূজারও যথেষ্ট নিন্দা গীতায় দেখিতে পাওয়া যায়। “নির্ব্বোধ মনুষ্যেরাই ব্রহ্মকে মীন, কুর্ম্ম, মনুষ্যাদির রূপধারী মনে করেন,” “নিকৃষ্ট দেবতা পূজার ফল ক্ষণ স্থায়ী। তমসাক্রান্ত অজ্ঞ লোকেই প্রতিমাদিতে ঈশ্বর বিদ্যমান আছেন মনে করেন।” (১৮অ–২২)। “ঈশ্বর ভিন্ন অন্য দেবতা শীঘ্র ফল দিবেন, এইরূপ বিফল আশা সম্পন্ন; ঈশ্বরের প্রতি বিমুখ হওয়াতে বিফল কর্ম্ম পরায়ণ নানা প্রকার কুতর্কাশ্রিত বিফল জ্ঞান যুক্ত বিচেতন (বিক্ষিপ্ত চিত্ত) ব্যক্তিরা হিংসা দ্বেষাদি রাক্ষসী; কাম দর্পাদি আসুরী প্রকৃতি আশ্রয় করিয়া ঈশ্বরকে সামান্য মানবরূপধারী জ্ঞানে অবমাননা করে। রাক্ষসী এবং আসুরী প্রকৃতি নিবন্ধনই তাহারা ঈশ্বরের স্বরূপ বুঝিতে পারে না (৯অ–১২)।
মহাত্মনস্তু মাং পার্থ দৈবীং প্রকৃতিমাশ্রিতাঃ।
ভজন্ত্যনন্যমনসো জ্ঞাত্বা ভূতাদিমব্যয়ম্।। (৯অ—১৩)
“কিন্তু হে পার্থ, মহাত্মাগণ বৈরী (সাত্ত্বিক) প্রকৃতি আশ্রয় পূর্ব্বক আমারে সকল ভূতের (জগতের) কারণ ও অব্যয় (নিত্য বা অবিনাশী) রূপ অবগত হইয়া অনন্য মনে আরাধনা করে।”(৩)
অনেকেই গীতার পরম ভক্ত বলিয়া পরিচয় দেন, কিন্তু গীতার যাহা শ্রেষ্ঠ উপদেশ তাহাই লঙ্ঘন করিয়া কাষ্ঠ প্রস্তরাদি নির্ম্মিত নিকৃষ্ট দেবতার প্রতিমা পূজা করেন।(৪) পুত্রৈশ্বর্য্য লাভের আশায় হতজ্ঞান হইয়া, চিন্ময়, অশরীরী সচ্চিদানন্দ পরব্রহ্মের পূজা পরিত্যাগ পূর্ব্বক বহু হস্ত পদ শোভিত ভূত প্রেতাদি ক্ষুদ্র দেবতার উপাসনা করেন। গীতা-সমুদ্র-মন্থন-সমুদ্ভব অমৃতকণা পরিত্যাগ পূর্ব্বক হলাহল গ্রহণের জন্য আগ্রহ কেন? পদ্মনাভ মুখপদ্ম বিনিঃসৃত গীতামৃত পাঠ করিয়াও কি আপনাদের ভ্রান্তি দূর হইবে না? গীতার যাহা শ্রেষ্ঠ রত্ন, তাহাই পদদলিত করিয়া আপনাকে “গীতা-গত-প্রাণ” বলিয়া পরিচয় দেওয়া বৃথা।
অষ্টম অধ্যায়ের প্রারম্ভে অর্জ্জুন কৃষ্ণকে আটটী প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেন। তন্মধ্যে অষ্টম প্রশ্ন এই, “সংযতচিত ব্যক্তিরা মৃত্যু কালে কি প্রকারের ব্রহ্মকে বিবিদত হন?” ভগবান বলিলেন;— “যিনি অন্তকালে আমারে স্মরণ করিয়া কলেরব পরিত্যাগ করেন, তিনি নিঃসন্দেহে আমার স্বরূপ প্রাপ্ত হন। যে ব্যক্তি একান্ত মনে অন্তকালে যে যে বস্তু স্মরণ করিয়া দেহত্যাগ করে, সে সেই সেই বস্তুর স্বরূপ প্রাপ্ত হয়” (৮অ—)। এই বৈজ্ঞানিক তত্ত্বটী বিশদরূপে বুঝাইবার জন্য শ্রীমান কৃষ্ণানন্দ স্বামী অশেষ আয়াস সহকারে কতকগুলি নজির সংগ্রহ করিয়াছেন। যথা—(১) “তৈলপায়িকা অত্যন্ত ভয় প্রযুক্ত ভ্রমর কীট চিন্তাবশতঃ দুই তিন ঘণ্টার মধ্যে নিজদেহ পরিহার পূর্ব্বক ভ্রমর ভাবাপন্ন হয়।” (২) “নন্দিকেশরী সর্ব্বদা সদাশিবের ভাবনা করিতে করিতে, সেই দেহেই শিবরূপী হইয়াছিল।” এরূপ অপরূপ রূপান্তরের বৈজ্ঞানিক কারণ যিনি বাহির করিতে সমর্থ হইয়াছেন। তিনি বলেন, “যে যে বিষয়ের তীব্র চিন্তা মন মধ্যে ক্রিয়া করিতে থাকে, মনোময় সূক্ষ্ম শরীর তদ্ভাবাপন্ন হইয়া যায়।” তবে ত শ্রীক্ষেত্রবাসী যে সকল লোক মৃত্যুকালে দারুব্রহ্মের বিকলাঙ্গরূপ ধ্যান করিতে করিতে দেহত্যাগ করেন, তাহাদিগকে পর জন্মে হস্তপদাদি শূন্য হইয়া জন্মগ্রহণ করিতে হইবে। আর ম্রিয়মান্ ব্যক্তিকে লইয়া গঙ্গা যাত্রা করান কোন ক্রমেই উচিত নয়। কেননা স্রোতস্বিণী ভাগিরথীর পার্শ্বে শয়ন করিয়া পুণ্যসলিলার স্নিগ্ধ বারি পান, এবং তরঙ্গমালাসুশোভিতা বারিরাশি দর্শ্ন করিতে করিতে যদি কেবল জলের রূপই মনে পড়ে, তবে ত পরজন্মে তাহাকে জল হইয়া থাকিতে হইবে!
উল্লিখিত মহামূল্য বৈজ্ঞানিক সত্যের ব্যাখ্যা করিয়া হৃষিকেশ বলিলেন, হে অর্জ্জুন, এখন তুমি বেশ বুঝিতে পারিয়াছ যে, অন্তিম কালে আমাকে স্মরণ করিতে না পারিলে মোক্ষ হইবে না। আর চিত্ত শুদ্ধ না হইলে মরণ সময় আমায় স্মরণ হইবে না। চিত্ত শুদ্ধির উপায়ও তুমি জান। উপস্থিত সংগ্রামে আত্মীয় স্বজনকে হত্যা কর।(৫) অতএব কাল বিলম্ব না করিয়া;—
সর্ব্বেষু কালেষু মামনুস্মর যুধ্য চ।(৬)
“সকল সময় আমাকে অনুস্মরণ কর এবং যুদ্ধ কর” এবং চিত্তশুদ্ধির এমন সহজ উপায় ইতিপূর্ব্বে আর কেহ কখন আবিষ্কার করিতে পারে নাই।
অষ্টম অধ্যায়ের শেষ ভাগে কৃষ্ণচন্দ্র পুনরায় বিজ্ঞানালোচনায় প্রবৃত্ত হইয়া বলিলেন, জগতের শুক্ল ও কৃষ্ণবর্ণ দুইটী গতি (দেবযান এবং পিতৃযান) আছে। মৃত্যুর পর ব্রহ্মবেত্তারা এই দুই পথে গমন করেন। তন্মধ্যে একতর দ্বারা অনাবৃত্তি (মোক্ষ) ও অন্যতর দ্বারা আবৃত্তি (পুনর্জন্ম) হয়। আর্য্যমিশনের গীতার পরিশিষ্ট হইতে উদ্ধৃতাংশটী পাঠ করিলেই পাঠক বর্গ দুইটী গতির বিষয় বুঝিতে পারিবেন।
“যে সকল অরণ্যবাসী শ্রদ্ধাবান তপস্বী হইয়া ব্রহ্মোপাসনা করেন; তাহারা মরনান্তে প্রথমতঃ অর্চ্চিরধিষ্ঠাত্রী দেবতাকে প্রাপ্ত হন। অন্তর উত্তরোত্তর অহরভিমানিনী দেবতা, শুক্ল পক্ষ দেবতা, উত্তরায়ণ দেবতা, সংবৎসর দেবতা, সূর্য্য, চন্দ্রমা, এবং বিদ্যুদধিষ্ঠাত্রী দেবতাকে প্রাপ্ত হন। এই স্থানে কোন এক অমানব পুরুষ ব্রহ্ম লোক হইতে উপগত হইয়া মৃত জীবকে ব্রহ্ম লোক প্রাপণ করিতে পারে না। একারণ ব্রহ্ম লোক হইতে একজন অমানব পুরুষ আসিয়া তদ্গত জীবকে ব্রহ্ম লোক প্রাপণ করে।” (ছন্দোগ্য উপনিষৎ পঞ্চম প্রপাঠক)। বলা বাহুল্য এরূপ বিজ্ঞান হিন্দু শাস্ত্র এবং গঞ্জিকালয়ের উপযুক্ত। এবং এইরূপ বিজ্ঞানকেই ডাক্তার মহেন্দ্র লাল সরকার বলেন;—
Transcendental nonsense.
—————–
(১) এই শ্লোকের যথার্থ অর্থ হিন্দু সমাজে প্রচার হইল ঠাকুর পূজা; অতএব হিন্দু ধর্ম্ম বিনষ্ট হইবে, সৌভাগ্যক্রমে শ্রীশশধর তর্কচূড়ামণি অগ্রেই তাহা বুঝিতে পারিয়াছিলেন। সুতরাং এই ঘোর বিপত্তির নিরাকরণার্থ তিনি এই শ্লোকের অনুবাদ না করিয়া এমন এক দেড় পত্র ব্যাপী বং অং (বঙ্গানুবাদ?) লিখিয়াছেন যে যাহার সহিত মূলের কিছুমাত্র সংশ্রব নাই।
(২) সগুণ শব্দের অর্থ সাকার এবং নির্গুণ অর্থে নিরাকার অনুবাদ করিয়া কোন কোন অনুবাদক সাধারণোকে প্রতারিত করিবার প্রয়াস পাইয়াছেন। শ্রীধর স্বামী এস্থলে নিরাকার সগুণ ব্রহ্মের কথাই বলিতেছেন। কেননা সাকার, অতএব সান্ত (সামা বিশিষ্ট) পদার্থের বিশ্বব্যাপী রূপ হইবে কি প্রকারে? নিরাকার নির্গুণ পরমেশ্বর কি, আমরা তাহা জানি না। বঙ্কিম বাবু বলেন, “আমরা নির্গুণ ঈশ্বর বুঝিতে পারি না, কেননা আমাদের সে শক্তি নাই। অতএব আইস, আমরা নির্গুণ ঈশ্বরের কথা ছাড়িয়া দিই। ঈশ্বরকে নির্গুণ বলিলে, স্রষ্টা, বিধাতা, পাতা, ত্রাণকর্তা কাহাকেও পাই না। এমন ঝকমারিতে কাজ কি?”
(৩) কেহ কেহ বলেন “উচ্চাধিকারীর” পক্ষেই নিরাকার উপাসনা প্রশস্ত। গীতায় কিন্তু স্পষ্টাক্ষরে লিখিত আছে যে, মহাপাপী শুদ্র, স্ত্রীলোকও ঈশ্বরকে ভজনা করিয়া মোক্ষ প্রাপ্ত হয়। অতি দুরাচার লোক ও ঈশ্বর পরায়ণ হইলে সাধু বা (উচ্ছাধিকারী) হন (৯অ—৩০)।
(৪) সত্য বটে, অজ্ঞ লোকে ঈশ্বরের স্বরূপ না জানিয়া, ঈশ্বরবোধে কোন বিগ্রহকে পূজা করিলে, অন্তর্যামী ভগবান তাহার পূজা গ্রহণ করেন [৯অ—২৩]। সকলের হৃদযজ্ঞ দয়াময় প্রভু জানেন, যে অজ্ঞ মানব তাঁহারই পূজা করিতেছে। কিন্তু গীতা পাঠা যিনি ঈশ্বরের স্বরূপ অবগত হইয়াও ইচ্ছা পূর্ব্বক মৃত্তিকাদি নির্ম্মিত মনুষ্য মূর্তির পূজা করেন, পরমেশ্বর কখনই তাহার পূজা গ্রহোন করেন না। অবজানন্তি মাং মূঢ়া মানুষীং তনুমাশ্রিতম্ “মূঢ় আমাকে সামান্য মানব জ্ঞানে অবজ্ঞা করিতেছে”, তিনি এরূপ বলেন।
(৫) (৬) তৎস্মরণং হি চিত্তশুদ্ধিং বিনা ন ভবতি। অতো যুধ্যস্ব চিত্তশুদ্ধ্যর্থং। শ্রীধর স্বামী।