বুড়ো লোকটি – উপন্যাস – মতি নন্দী
‘হারামজাদা। নিজের জন্য পান কিনতে তো ভুল হয় না, আমি কিছু আনতে বললেই মনে থাকে না!’ কাশীনাথের শীর্ণ অষ্টআশি বছরের কাঠামোটা চিৎকারের দমকে দুমড়ে ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা হল।
পুলিন দ্রুত এগিয়ে এসে বাবার দুটো কাঁধ ধরে খাটে বসাল। ‘এনে দিচ্ছি বাবা জিলিপি এনে দিচ্ছি, তুমি চুপ করে বোসো তো।’ অপ্রতিভ তিক্ত স্বরে কাশীনাথকে শান্ত করিয়ে পুলিন ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দালানে টেবলে ভাত খেতে ব্যস্ত বলাকাকে বলল, ‘বউমা ড্রুকের জেলি পেলুম না, কিষানেরটা এনেছি।’ কথাটা বলে সে বলাকার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল অনুমোদনের আশায়। বলাকা মাছের ঝোল মাখা ভাত চিবোতে চিবোতে একটা কাঁটা দাঁতে ধরে ফেলেছে। সেটা মুখ থেকে টেনে বার করতে করতে বলল, ‘বাবা ছোটো মাছ আনবেন না, কাঁটা বেছে খেতে দেরি হয়ে যায়। আজ তো এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে, তার ওপর বাজারও এল দেরি করে।’
পুত্রবধূর বিরক্ত মুখে বলা—কথা এবং বাবার ‘হারামজাদা’, দুটো ধাক্কা পরপর পেয়ে পুলিন পায়ে চটি গলিয়ে বেরিয়ে পড়ল ফ্ল্যাট থেকে। রান্নাঘরে তখন পাউরুটিতে জেলি মাখাতে মাখাতে ভারতী একটু গলা তুলে বলল, ‘বউমা পাউরুটি সেঁকে খেলে অম্বল হবে না, দোব সেঁকে?’
‘না না না, ঘণ্টা দুয়েক পরে ওগুলো চিমড়ে সুখতলা হয়ে যাবে, মুখে দিতে পারব না।’
‘পেঁপে দিলুম, পেট ঠান্ডা রাখবে। ডিমের খোসা ছাড়ালুম না।’
‘কুচুনের সন্দেশ এসেছে?’
‘দুটো এনেছে, তোমায় একটা দোব।’
‘না, ওকে বিকেলে একটা দেবেন, বাকিটা ফ্রিজে তুলে রাখুন। কাল ওকে টিফিনের সঙ্গে দেবেন।’
হাতঘড়ি দেখে বলাকা প্রায় লাফিয়ে উঠল। পাতে ভাত আর আধখাওয়া মাছ ফেলে রেখে বেসিনে গিয়ে হাত ধুতে ধুতে বলল, ‘মা আর দু—মিনিট নয়তো ন—টার শান্তিপুরটা পাব না। এটা মিস করলে সেই ন—টা কুড়ির কৃষ্ণনগর। তাহলে ব্যাঙ্কে পৌঁছতে পৌঁছতে, ট্রেন লেট করলে সাড়ে দশটা, আর ম্যানেজারের বিরক্ত মুখ দেখতে হবে।’
স্টিলের টিফিন বক্স বলাকার ব্যাগে ভরে দিয়ে ভারতী অপেক্ষা করল। দালানের অন্য প্রান্তে টাঙিয়ে দেওয়ালে রাখা রামকৃষ্ণ—সারদা—বিবেকানন্দ এবং তাদের পিছনে দাঁড়ানো কালীমাতার একটি বাঁধানো ছবি। বলাকা ছবিটির সামনে আধমিনিট চোখ বন্ধ করে জোড় হাতে দাঁড়াবে। তারপরই শাশুড়ির হাত থেকে এক হাত লম্বা ব্যাগটা প্রায় ছিনিয়ে নিয়েই কাঁধে টাঙাতে টাঙাতে জুতো পায়ে গলিয়ে বেরিয়ে যাবে।
ভারতী তিনতলার সিঁড়ি দিয়ে নামা তার বউমার পায়ের শব্দ দোতলা পর্যন্ত শোনে দরজা বন্ধ করতে এসে।
দালানের লাগোয়া দুটি শোবার ঘর, একটি কাশীনাথের অন্যটি অনীশের, পুলিন ও ভারতীর নিজস্ব কোনো ঘর নেই। দুটি ঘরের মধ্য দিয়ে যাওয়া যায় রাস্তার দিকে তিন হাত চওড়া আট হাত লম্বা বারান্দায়। ভারতী ছেলের ঘরের মধ্য দিয়ে বারান্দায় এল কাশীনাথের ঘর এড়িয়ে। ছেলেমানুষের মতো খাই—খাই বাতিক হয়েছে শ্বশুরের। যেহেতু রান্নাবান্নার দায়িত্বে সে তাই তার উপরই বুড়োর চোটপাট।
গতকালই কাশীনাথ তাকে বলে, ‘পুলিনটা অ্যাতো তেল দেয় কেন অনীশ আর বলাকাকে, ওরা হাজার হাজার টাকা রোজগার করে বলে? এ সংসারে খাবার লোক কি শুধু ওই দুজনই, আমি কি কেউ নই? আমার পেনশনের টাকা কি শুধু আমি একাই খাই, সংসারে দিই না? পুলিন তো শুধু বাজার খরচটা দেয়, তাও কেপ্পনের মতো বাজার করে, বলেছিলুম বড়ি দিয়ে তেঁতুলের অম্বল করতে, করেছিলে? বললে দোকানে বড়ি পাওয়া যায়নি। কলকাতা শহরে কি একটাই বড়ির দোকান? বাপের জন্য কি একটু দরদও নেই ছেলের? কত কষ্ট করে পয়সা খরচ করে বড়ো করলুম ছেলেকে, বুড়ো বয়সে সেই ছেলে আমাকে দেখবে শুনবে এটা তো আশা করবে যেকোনো বাপই, ঠিক কিনা?’
ভারতী মেঝের দিকে তাকিয়ে চুপ করে ছিল। অভিজ্ঞতা থেকে জানে জবাব দিলেই শ্বশুর চিৎকারে ফেটে পড়ে নোংরা কথা বলা শুরু করবে। ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেও বিপদ, চিৎকারটা তাড়া করবে।
আজকের দাবি বড়ির অম্বল নয় জিলিপি। কাশীনাথ পুরুলেন্সের চশমার ছয় ইঞ্চি সামনে কাগজটা ধরে খুঁটিয়ে খবরের কাগজ পড়ে। প্রতিদিনের বাজারদর থেকে সে ক—দিন আগে জেনেছিল ইলিশমাছ শ্যামবাজার, মানিকতলা বাজারে দেড়শো টাকা কিলোয় বিকিয়েছে। সেই রাতেই সকলকে শুনিয়ে গজগজ করল, ‘বাজারে ইলিশ উঠেছে অথচ একদিনও খেতে পেলুম না। কবে একশো টাকায় নামবে তার জন্য বসে থাকো আর তেলাপিয়া খেয়ে যাও।’
পুলিনের মনে পড়ল তখন তার বয়স বছর সাত, বাবা বাজার করে ফিরে থলিটা নামিয়ে বলল, ‘ইলিশ খাব কী, সাড়ে চার টাকা সের, ভাবতে পার?’
পুলিন বলে, ‘খবরের কাগজের দরে আর বাজারের দরে অনেক তফাত। কাল তোমাকে ইলিশ খাওয়াব, দেখি কত খেতে পার।’
ভারতী শুনেই আঁতকে উঠে বলেছিল, ‘কত খেতে পার মানে? এই বয়সে গুচ্ছের ইলিশ খেয়ে হজম করতে পারবেন? তারপর যে কাণ্ড হবে সে তো তোমাকেই পরিষ্কার করতে হবে।’
শুনেই কাশীনাথের চিৎকার, ‘হ্যাঁ পরিষ্কার করতে হবে। যত দিন আমি বাঁচব তত দিন পরিষ্কার করতে হবে, না পারলে এ সংসার থেকে দূর হয়ে যাও।’ এরপর বহুবার বলা কথাটা কাশীনাথ বলে, ‘এ ফ্ল্যাট আমার নামে ভাড়া নেওয়া বেয়াল্লিশ সাল থেকে। এখনও আমিই ভাড়া গুনি। ইলেকট্রিক বিল, ঝিয়ের মাইনে, গ্যাসের দাম দিচ্ছি পেনশনের টাকা থেকে। এটা মনে রাখিস।’
পুলিন মুখ বুজে মাথা নীচু করে শুধু শুনে যায়। কোথাও সরে গিয়ে যে মুখ লুকোবে তেমন একটা জায়গা এই ফ্ল্যাটে নেই।
কাশীনাথ এই ফ্ল্যাট ভাড়া নেয়, যখন জাপানি সেনা হু হু করে এগিয়ে আসছে ভারতের দিকে। রেঙ্গুন দখল করে ফেলেছে। হেঁটে জঙ্গল, পাহাড়, নদী পার হয়ে বহু বাঙালি পরিবার তখন কলকাতায় পৌঁছতে শুরু করেছে। যুদ্ধের প্রস্তুতি দেখছে কলকাতার মানুষ। এ আর পি, সিভিক গার্ড, ব্ল্যাক আউট দেখতে দেখতে আর ধ্বংসের গুজব শুনতে শুনতে মানুষের মনে আতঙ্ক ছড়াল এবার নির্ঘাৎ কলকাতাকে জমিতে মিশিয়ে দেবে জাপানি বোমা। দলে দলে পরিবার প্রাণভয়ে গ্রামের দিকে পালাতে শুরু করল কলকাতার নিজস্ব বা বাসাবাড়ি ছেড়ে। খালি বাড়ি বা ঘর বা ফ্ল্যাট তখন যথেচ্ছ পাওয়া যাচ্ছে। জলের দরে বাড়ি বিক্রি হচ্ছে, নামমাত্র ভাড়ায় ঘর পাওয়া যাচ্ছে। তখন কাশীনাথ বি অ্যান্ড এ রেলওয়েতে মালগাড়ির গার্ডের চাকরিতে। খবর পেল চারতলা ‘গুহ ভবন’ বাড়ির তিনতলায় দু—ঘরের একটা ফ্ল্যাট খালি রয়েছে। গুহ এস্টেটের ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করে সে ভাড়া নেয়। ওরা চেয়েছিল পঞ্চাশ টাকা মাসিক ভাড়া, কাশীনাথ বলেছিল চল্লিশ টাকা, এককথায় ম্যানেজার রাজি হয়ে যায়। পরে সে আফশোস করে, তিরিশ টাকা বললে হত!
এই ফ্ল্যাটেই কাশীনাথ বিয়ে করে, ছাদে হোগলার ম্যারাপ বেঁধে লোক খাওয়ায়, এই ফ্ল্যাটেই পুলিন জন্মায়, তার ঠাকুরদা, ঠাকুমা আর মা এখানেই মারা যায়, এখন ফ্ল্যাট ভাড়া আটান্ন বছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে দুশো টাকা। তেমনি কাশীনাথের পেনশনও বেড়েছে। আর বেড়েছে তার অধৈর্যতা, তিক্ত কথাবার্তা, চিৎকার, খুঁত ধরা, কর্তৃত্ব ফলানো, অভিমান আর ছেলেমানুষি কাজকর্ম।
একবার হঠাৎ কাশীনাথের ইচ্ছে হল পেঁয়াজি খাবে। ছেলেকে ইচ্ছাটা জানিয়ে বলে, ‘এখুনি কাত্তিকের দোকান থেকে আটটা নিয়ায়।’
‘আটটা!’ পুলিন অবাক হয়ে বলেছিল, ‘এই বয়সে আটটা!’
‘হ্যাঁ আটটা। তোর বয়সে বারোটা খেতুম। যা যা দৌড়ে যা।’
‘সাড়ে এগোরোটা বাজে, এখন সকালের ভাজা ঠান্ডা বাসি হয়ে গেছে, বিকেলে এনে দোব।’
‘ঠিক দিবি তো।’
পুলিন বিকেলে এনে দিয়েছিল। ঠোঙার মুখ ফাঁক করে কাশীনাথ একটা একটা করে গুনে দেখে, দাঁড়িয়ে থাকা ছাপ্পান্ন বছর বয়সি ছেলের হাতে একটা পেঁয়াজি তুলে দিয়ে বলেছিল, ‘যা।’ পঞ্চাশ বছর আগে সে এইভাবেই গুজিয়া তুলে দিত পুলিনের হাতে।
পুলিন ইতস্তত করতেই কাশীনাথ খেঁকিয়ে বলে ওঠে, ‘তেলেভাজা এখন বুঝি আর মুখে রোচে না বাবুর, তবে কি চপ কাটলেট ফিসফ্রাই চাই?’
পেঁয়াজিটা হাতে নিয়ে পুলিন ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
আজ কাশীনাথের ইচ্ছে হয়েছে জিলিপি খাবার।
বাড়ি থেকে পঞ্চাশ গজ দূরে বগলা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। জন্ম থেকেই দোকানটা দেখে আসছে পুলিন। বগলার পাশে বছর পাঁচেক হল আর একটা মিষ্টির দোকান হয়েছে, ‘মিঠাইরাজা।’ নামটা পুলিনকে প্রথমে একটু অবাক করে। যত মিষ্টির দোকান সে এ পর্যন্ত দেখেছে তাতে ‘ভাণ্ডার’ বা ‘অ্যান্ড সন্স’ নামের শেষে জোড়া থাকে। দোকানটাও সাজানো গোছানো ফিটফাট। কাচের কাউন্টার, আলমারি, বসে খাওয়ার জন্য ছোটো ছোটো চারটে টেবল। সফট ড্রিংকস, আইসক্রিম, দই রাখার জন্য দুটো বিরাট রেফ্রিজারেটার, বনবন ঘুরছে পাখা, গোটা ছয়েক টিউব লাইটের আলো কাচে ধাক্কা দিয়ে জেল্লা বাড়িয়েছে। কাজের লোকগুলো পরিচ্ছন্ন জামাকাপড় পরা! স্টিলের ট্রে—তে রাখা বেশিরভাগ মিষ্টিই ছানার এবং রসছাড়া। দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে মিষ্টিগুলো দেখতে দেখতে পুলিনের চোখ ঝকঝক করে উঠেছিল চন্দ্রপুলি দেখে।
ছোটোবেলায় বড়ো তিজেল হাঁড়ি মাথায় চন্দ্রপুলিওলাকে তিনতলার বারান্দা থেকে দেখলেই সে চিৎকার করে ডেকে দাঁড় করাত। মা—র কাছ থেকে দু—আনা পয়সা নিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে নেমে আসত। নারকোল আর চিনির পাকে তৈরি দুটো চন্দ্রপুলি শালপাতার উপরে রেখে সে উঠে আসত ধীরে ধীরে। মা—র সামনে শালপাতাটা ধরে বলত, ‘তুমি একটা নাও।’ মা প্রথমে না না করে শেষে আধখানা ভেঙে মুখে দিত।
পুলিন অবশেষে দোকানে বসা লোকটিকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘চন্দ্রপুলির দাম কত?’
‘চার টাকা পিস।’
‘একটা চার টাকা!’ অবাক হয়ে পুলিন তাকিয়ে থেকেছিল তার ছোটোবেলার এক আনার চন্দ্রপুলির দিকে।
লোকটি লক্ষ করেছিল পুলিনের মুখের ভাব পরিবর্তন। পরামর্শ দেবার মতো গলায় বলল, ‘ক্ষীরের চন্দ্রপুলি, একটা খেয়ে দেখুন না।’
‘না থাক।’
পুলিন ফিরে এল বাড়ির কোলাপসিবল গেট পর্যন্ত। কয়েক সেকেন্ড ভেবে নিয়ে ফিরে গেল মিঠাই রাজায়। একটা ক্ষীরের চন্দ্রপুলি কিনল। দোকানের লোকটি হেসে বলল, ‘আগেকার চন্দ্রপুলির সঙ্গে এটার কতখানি তফাত বুঝতে পারবেন একটু মুখে দিলেই। যারাই খেয়েছে আবার কিনতে এসেছে। কলকাতা শহরে তিন—চারটে মাত্র দোকানে এমন চন্দ্রপুলি পাবেন।’
সাইজটা ছোটোবেলার চন্দ্রপুলির থেকে লম্বায় প্রায় এক ইঞ্চি বেশি। বাড়ির গেটের কাছে এসে পুলিন একটা কোনা ভেঙে মুখে দিয়ে জিভ আর টাকরায় মাখিয়ে তারিয়ে তারিয়ে যখন খাচ্ছে তখনই বাড়ি থেকে বেরোচ্ছিল চারতলার প্রণববাবু, কলেজে ফিজিক্স পড়ান। তাকে দেখেই পাতলা কাগজে মোড়া চন্দ্রপুলিটা সে পকেটে ঢুকিয়ে নিল।
‘পুলিনবাবু কাল আপনাকে খুব মিস করেছি।’ প্রণববাবু তড়বড় করে বলে যান, ‘ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড আর জুভেন্টাসের খেলা ছিল। ভাবলুম আপনাকে ডেকে আনি। ফুটবল ম্যাচ একা একা দেখে সুখ নেই। তারপর মনে হল রাত সাড়ে এগারোটায় কোনো ভদ্দরলোককে ডেকে এনে খেলা দেখা, যথেষ্ট পাগলামি হয়ে যাবে।’
‘ইসস আমাকে ডাকলেন না?’ পুলিন ক্ষুব্ধ গলায় বলেছিল। যদিও প্রণববাবু কথিত ক্লাব দুটোর নাম সে এই প্রথম শুনল।
‘অত রাতে আপনি আসতেন? মিসেস আপত্তি করতেন না?’
‘আমার মিসেস তেমন নয়।’ তারপর গলা নামিয়ে চোখ টিপে বলল, ‘দু—জনেই ফিফটি পেরিয়ে গেছি, রাতে একজন না থাকলে অন্যজন হাত—পা ছড়িয়ে আরামে শোবার একটা তো সুযোগ পাবে।’
একটা দারুণ ভালো রসিকতা করা হল ভেবে পুলিন একাই হেসে উঠেছিল। কুঁড়ে, মাটো, লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে পারে না, এইসব বিশেষণই সে নিজের সম্পর্কে শুনে এসেছে কৈশোর থেকে এবং এখনও শুনতে হয় বিশেষ করে বাবার কাছ থেকে। কিন্তু সে যে কুঁড়ে নয়, বুদ্ধিহীন নয় এবং বাইরের লোকের কাছে সপ্রতিভ এটা বোঝতে সুযোগের জন্য সে ওঁত পেতে থাকে। তার মনে হল প্রণববাবুকে অন্তত বোঝাতে পেরেছে সে মাটো নয়, যথেষ্ট রসিক।
ক্ষীরের চন্দ্রপুলি পকেটে নিয়ে পুলিন তিনতলায় উঠে এসে ভারতীকে চোখের ইশারায় রান্নাঘরে ডেকে এনে চন্দ্রপুলিটা দেখায়। আধখানা ভেঙে নিজে মুখে পুরে বাকিটা ভারতীকে দিয়ে বলে, ‘খাও।’
‘বাহ, খুব সুন্দর খেতে তো, পেলে কোথা?’ চিবোনোর বদলে ভারতী চকোলেট চোষার মতো করে চুষতে লাগল।
‘বগলার পাশেই মিঠাই রাজা বলে একটা মিষ্টির দোকান হয়েছে বছর পাঁচেক। খুব সাজিয়ে ছিমছাম করে চালাচ্ছে, যেমন বিক্রি তেমনি মিষ্টিরও দাম, ওখানেই দেখলুম চন্দ্রপুলি,লোভ সামলাতে পারলুম না। অনেকদিন খাইনি। দাম বলল এক—একটা চার টাকা। ভাবো একবার, ছোটোবেলায় খেতুম এক আনায় একটা!’ পুলিন চোখ বড়ো করে তাকাল ভারতীর দিকে।
ভারতী বলল, ‘দিনকাল কীভাবে বদলে গেছে দেখেছ! তবে সেই চন্দ্রপুলির থেকে এটা কিন্তু খেতে অনেক ভালো, বেশি দাম দিয়েও খাওয়া যায়।’
‘সেইজন্যই দোকানটার এত বিক্রি, অবশ্য বগলারও বিক্রি আছে।’
এবার ভারতী গলা নামিয়ে বলল, ‘এই চন্দ্রপুলির গপ্পো যেন বাবার কাছে কোরো না, তাহলেই হুকুম হবে এখুনি চারটে নিয়ে আয়, তার মানে ষোলো টাকা।’
‘পাগল হয়েছ। বাবা জানেই না মিঠাইরাজা বলে একটা দোকান এখানে হয়েছে। জানিয়ে আর কাজ নেই।’
কাশীনাথ পাঁচ বছর আগেও হেঁটে পার্কে গিয়েছে, একদিন সাইকেলের ধাক্কা খেয়ে রাস্তায় পড়ে যায়। দুটি ছেলে তাকে তিনতলায় তুলে দিয়ে বলে যায়, ‘দাদু একা আর রাস্তায় বেরোবেন না, গাড়ি চাপা যাবেন।’ এরপর কাশীনাথ শুধু মাসে একবার পেনশন তুলতে পুলিনকে সঙ্গে নিয়ে ব্যাঙ্কে যায়, গলি থেকে বেরিয়ে বাঁদিকে পঞ্চাশ গজ গেলেই ব্যাঙ্ক, মিঠাইরাজা দোকানটা ডানদিকে, তাই নতুন কোনো দোকান হল বা পুরোনো কোনো দোকান উঠে গেল তা জানে না।
বাবার আবদারের জিলিপি কিনতে পুলিন যখন বগলা মিষ্টান্নের সামনে তখন তার পিছন দিয়ে বলাকা হনহন করে হেঁটে গেল মেট্রো রেলের স্টেশনের দিকে, শ্বশুরকে দেখেও দেখল না। পুলিন কিন্তু দেখতে লাগল পিছন থেকে। বলাকা আগের থেকে একটু ভারী হয়ে গেলেও লম্বা বলে বেঢপ লগে না। বলাকার মা বিয়ের আগে মেয়ের যা বয়স বলেছিল সেই হিসাবমতো সে অনীশের থেকে এক বছরের ছোটো। ওর পাশে অনীশকে কম বয়সিই মনে হয়। পুলিন ভালো করে লক্ষ করল পুত্রবধূকে পিছন থেকে। মুখ বাদে শরীরের বাঁধুনি তাকিয়ে দেখার মতো এবং রাস্তার লোকেরা দেখছেও। মুখটা বাদে কারণ বলাকার চোয়াল কানের কাছ থেকে শুরু হয়ে ক্রমশ ঝুলে চিবুকটা গলার কণ্ঠার সামনে থেমেছে। ফলে গাল দুটি অস্বাভাবিক লম্বা, সেই অনুপাতে কান দুটিও। ঠোঁট দুটি ছোট্টে এবং রং মরচে ধরা লোহার মতো, চোখ দুটি বড়ো এবং গোলাকার। ওকে কদাচিৎ হাসে দেখেছে পুলিন। এক ধরনের শুকনো কাঠিন্য ছড়িয়ে থাকে মুখে, যেজন্য সে ছেলের বউকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলে।
.
বিয়ের আগে প্রথম যেদিন অনীশ বাবা—মায়ের সঙ্গে পরিচয় করাতে আনে, বলাকার আগে ছিল সন্দেশের বাক্স। অনীশ বলেছিল তার বান্ধবী ব্যাঙ্কে কাজ করে, এম এ পাশ, বাক্সটা ভারতীর হাতে দিয়ে বলাকা প্রণাম করে, পুলিনকেও। তাকে শ্বশুরের ঘরে না বসিয়ে ভারতী নিয়ে যায় নিজেদের ঘরে, যেটা এখন বলাকা আর অনীশের শোয়ার ঘর। পুলিন লক্ষ করেছিল মেয়েটি খুঁটিয়ে ঘরের আসবাবপত্র, জানালা, দেওয়াল, খাট, বিছানা, পাখা দেখছে কথাবার্তার ফাঁকে। পুলিন অস্বস্তিবোধ করে ওর সঙ্গে চোখ বোলাচ্ছিল জিনিসপত্রের উপর। বিছানার চাদরের সবুজ নকশা আর জানালার সবুজ পাল্লা রংচটা একই চেহারা নিয়েছে। পেতলের ফুলদানিটা মাটির মতো মনে হচ্ছে। পাপোষের রোম উঠে নারকেলদড়ি বেরিয়ে এসেছে, ইলেকট্রিক জয়েন্ট বক্সের কাঠের ঢাকনা নেই, তালগোল পাকানো তারে ঝুল জমে। একে একে সে ঘরের মধ্যে অনেক খুঁত আর অন্যমনস্ক অবহেলা খুঁজে পেয়ে সংকোচ বোধ করেছিল।
বগলা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের শোকেসের উপর কাঠের বারকোসে রাখা আঢাকা জিলিপিগুলো দেখে সে বিরক্ত স্বরে দোকানের লোকটিকে বলল, ‘ঢেকে রাখতে পার না? রাস্তার ধুলো পড়ছে।’
সেদিন বলাকাকে মেট্রোরেলে তুলে দিয়ে আসার জন্য অনীশ বেরিয়ে যেতেই সে ঠিক এইরকম গলায় ভারতীকে বলেছিল, ‘ফুলদানিটা মেজেঘষে চকচকে করে রাখতে পার না?’
দোকানি তার কথা গায়ে না মেখে বলল, ‘জিলিপি ভেজে আসে আর উড়ে যায়, ধুলো পড়ার টাইমই পায় না, ক—টা দোব?’
‘দশটা।’
সেদিন ভারতী রাত্রে ফুলদানিটা মেজে চকচকে করে বলেছিল, ‘কালই বাজার থেকে ফুলো এনো, রজনীগন্ধা।’
শালপাতায় মুড়ে ছ—টা রজনীগন্ধার ছড় পরদিনই বাজার থেকে পুলিন আনে। কাশীনাথ তখন সবে কলঘর থেকে বেরিয়েছে। চোখে পড়ল রজনীগন্ধার গোছাটা খাওয়ার টেবলে।
‘এটা কীরে?’ পুরু কাচের আড়াল থেকে তার চোখদুটো খোসা ছাড়ানো লিচুর মতো দেখাল।
পুলিন বলল, ‘ফুল, রজনীগন্ধা।’
‘ফুল কী হবে, আমাদের ঘরে তো ঠাকুর দেবতা নেই। আছে তো শুধু রামকৃষ্ণর ছবিটা তাও উঁচুতে টাঙানো, মালা হলে তবু দেওয়া যেত।’
‘পুজোর জন্য না হলে কি ফুল কিনতে নেই?’
‘কেন নেই! মড়ার খাটে বাঁধার জন্য ফুল লাগে। তুই ওগুলো বরং আমার খাটের চারকোণে বেঁধে দে, খাটে শুয়ে মনে হবে তোর কাঁধে চড়ে নিমতলায় যাচ্ছি।’
ভারতী আঁতকে উঠে বলে, ‘এ কি অলুক্ষুণে কথা বলছেন বাবা!’
কাশীনাথ ভ্রু কুঁচকে তাকাল। ‘অলুক্ষুণে কেন? আমি কি কোনোদিন মরব না? পুলিন কি খাটে কাঁধ দিয়ে নিয়ে যাবে না?’
পুলিন ক্ষুব্ধ স্বরে বলল, ‘ফুল কিনে আনাই দেখছি ভুল হয়েছে। এইসব কথা শুনতে হবে জানলে আনতুম না।’
কাশীনাথ বলল, ‘ভুল কেন হবে, ফুল তো ভালো জিনিস, দেখলে মন ভালো হয়, গন্ধে ফুরফুর করে মেজাজ, ফুলগুলো বিছানায় ছড়িয়ে দিয়ে শুবি। ভালো ফুলশয্যে হবে।’
রাগে টকটকে হয়ে উঠল পুলিনের ফরসা মুখ। রজনীগন্ধার ছড়াগুলো মুঠোয় ধরে মুচড়ে দালানের কোনায় ছুড়ে ফেলে চেঁচিয়ে ওঠে, ‘মরো মরো, আমি নাচতে নাচতে খই ছড়িয়ে ঘাটে নিয়ে যাব। কাকে কী বলতে হয় সেই জ্ঞানটুকু হারিয়েছ?’
কাশীনাথ গায়ে মাখল না কথাগুলো, বলল, ‘আমি মরলে তোর কি কিছু সুবিধে হবে? তাহলে বল আজই আমি গঙ্গায় গিয়ে ডুবে মরব।’
‘তাই মরো, হাড়ে বাতাস লাগবে।’ বলেই পুলিন নিজের ঘরে ঢুকে যায়।
কাশীনাথ দলাপাকানো ফুল আর কুঁড়িগুলো মেঝে থেকে তুলে নিয়ে নিজের ঘরে এসে খাটে ছড়িয়ে দিয়ে ভারতীকে ডাকল।
‘বউমা আমি কি খুব খারাপ কথা বলেছি? এই বিছানায় শুলে তো ফুলশয্যাই হবে নাকি?’
‘তা হবে; তবে ফুল ছড়ানো বিছানায় শোয়ার একটা বয়স আছে, আপনি আশি পার হয়ে গেছেন, এটা মনে রাখেন না কেন?’ নরম গলায় বলে ভারতী। শ্বশুরকে দেখে সে অন্তর থেকেই কষ্ট পায়, মায়া বোধ করে। পঞ্চাশ বছর আগে ক্যানসারে বউ মারা যায়। ভারতী তার শাশুড়িকে দেখেনি। আটত্রিশ বছর ধরে নিঃসঙ্গ, বিপত্নীক, নির্বান্ধব মানুষটিকে সে বোঝার চেষ্টা করে চলেছে, তবে বুঝে ফেলেছে এমন দাবি করার মতো অবস্থায় এখনও সে আসেনি।
‘আশি বছর হলে কি ফুলের গন্ধ নেওয়া বারণ, ফুলের পাপড়ি গায়ে লাগানো অন্যায়?’ কাশীনাথের চোখ দুটো অসহায়ের মতো দেখাল পুরু কাচের ওধারে।
‘কে বলল বারণ! এখন তো আপনি বেশি করে আরাম করবেন, শখ মেটাবেন! জীবনের বেশিরভাগটাই খাটাখাটুনিতে কাটিয়েছেন, এবার হাত—পা ছড়িয়ে বাকি দিনগুলো কাটাবেন।’
কাশীনাথ অবাক চোখে পুত্রবধূর দিকে তাকিয়ে ছিল, ‘তুমি বলছ আরাম করব, শখ মেটাব, বলছ?’
‘হ্যাঁ বলছি। বলুন কী শখ আছে আপনার?’
‘একবার ধুতি পাঞ্জাবি পরে বড়ো রাস্তা পর্যন্ত হেঁটে যাব, তুমি থাকবে আমার সঙ্গে। পুলিনের বিয়ের সময় করানো তসরের পাঞ্জাবি আর কাঁচি পাড় ধুতি তোমার ঘরের দেরাজে আছে, এনে দেবে?’
ভারতী কাঠের আলমারির নীচের তাকে পুরোনো শাড়ি, ধুতি, প্যান্ট, বাতিল বেডকভার আর বালিশের ওয়াড়ের তলা থেকে বার করল কাশীনাথের তসরের পাঞ্জাবি। রং জ্বলে গেছে, খয়েরি ছোপ পড়েছে, ভাঁজ থেকে কাপড় কেটে গেছে। কাঁচি ধুতিটারও একই অবস্থা। শ্বশুরকে সে দেখিয়ে বলল, ‘বাবা এ দুটো তো ফেলে দিতে হবে। বাসনউলিও এগুলো নেবে না।’
‘তোমরা একটু নজরও রাখনি? বার করে যদি মাঝে মাঝে রোদে দিতে তাহলে এখনও পরার মতো থাকত। শুধু নিজেদের জামাকাপড়ের যত্ন নিলেই কি হয়ে গেল!’ তিক্ত তীক্ষ্ন স্বর ফিরে এল কাশীনাথের গলায়। ভারতী অপরাধীর মতো মুখ নামিয়ে রইল। তার হাত থেকে পাঞ্জাবি আর ধুতিটা নিয়ে কাশীনাথ মেঝেয় ফেলে দু—পা দিয়ে মাড়িয়ে রাগ চাপতে চাপতে বলল, ‘যাও ফেলে দিয়ে এসো, আমার শখ মিটে গেছে।’
এর মাস ছয়েক পর অনীশ যখন মাকে জানাল বলাকার বাবা—মা বিয়ের কথা পাকা করতে আসবে, ভারতী ছেলেকে বারান্দায় ডেকে নিয়ে বলে, ‘আমাদের তো কোনো দাবিদাওয়া নেই, শুধু একটা জিনিস চাইব, তোর দাদুর জন্য তসরের একটা পাঞ্জাবি আর কাঁচিপাড় একটা ধুতি।’
অনীশ শুনেই বলেছিল, ‘ওরা নিজের থেকেই মেয়েকে অনেক কিছু দেবে। সোফা, খাট, স্টিলের আলমারি, ফ্রিজ, ড্রেসিংটেবল, টি—ভিও। কিন্তু এসব রাখার জায়গা কোথায়? বলাকাকে বলেছি কিছু দেবার দরকার নেই। আমাদের যা আছে তাই দিয়েই তোমাকে থাকতে হবে। মা, এটা প্রেস্টিজের ব্যাপার। আমি যে রাতে দাদুর খাটের পাশে ফোল্ডিং খাটে শুই, এটা বলাকা জানে না। বলেছি দাদু মেঝেয় শোয় আমি খাটে শুই। ধুতি, পাঞ্জাবি চাইলে মান থাকবে না। ও দুটো আমিই দাদুকে কিনে দেব।’
কথা রেখেছিল অনীশ। দর্জি আনিয়ে কাশীনাথের মাপ নিয়ে তসরের পাঞ্জাবি বানিয়ে দেয়, কিনে আনে বাক্সেভরা ময়ূরপুচ্ছ ধুতি যার পাড় ছয় ইঞ্চি চওড়া। খুব খুশি হয়েছিল কাশীনাথ। কিন্তু সেগুলো পরে তার আর বড়ো রাস্তা পর্যন্ত হেঁটে যাওয়া হয়নি। তার আগেই সাইকেলের ধাক্কার জের সামলাতে গৃহবন্দি হয়ে পড়ে।
.
দশটা জিলিপি কাগজের ঠোঙায় নিয়ে পুলিন সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় নামছিল দোতলার উমা। সালোয়ার কামিজ পরা, বয়স পঁচিশ, দীর্ঘদেহী বলিষ্ঠ গড়ন, মুখে আলগা একটা লাবণ্য আছে, সাধারণ সায়ান্স গ্র্যাজুয়েট। ওকে শিশু বয়স থেকে দেখে আসছে পুলিন।
‘চললে কোথায়?’
‘কাজে।’
‘আজ ক—টা?’
‘তিনটে।’
‘কোথায় কোথায়?’
‘একটা শোভাবাজারে, একটা সল্টলেকে আর একটা ফুলবাগানে, দুটো অবাঙালি।’ ব্যস্তভাবে উমা নেমে গেল।
উমার কাজ মেয়েদের ফিজিয়োথেরাপি আর মালিশ করা। দিনে তিন—চারটি মহিলাকে মালিশ ও ফিজিয়োথেরাপি করে। বাড়ি গিয়ে একঘণ্টার মালিশে ষাট টাকা, ফিজিয়োথেরাপিতে একশো টাকা। দুটোই সে শিখেছে টাকা খরচ করে। তা ছাড়া সে যুক্ত একটি হেলথ ক্লাবের সঙ্গে। সেখান থেকেও মন্দ আয় হয় না। নানারকমের বাতের আর হাড়ের অসুখ যত বাড়ছে ততই উমার রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে। এখন সে মাসে কমকরে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত রোজগার করে। বছর চারেক আগে উমা যখন কলেজছাত্রী, ভারতী তখন এক রাত্রে পাশাপাশি শুয়ে পুলিনকে বলেছিল, ‘উমাকে আমার খুব ভালো লাগে, তোমার কেমন লাগে?’
‘আমারও লাগে। স্বভাবটা খুব নরম, ব্যবহার মিষ্টি, সাজগোজের বাহার নেই। দেখা হলেই জিজ্ঞাসা করে ‘কাকাবাবু কেমন আছেন?’ ভালো আছি বললে কাকিমার কথাও জিজ্ঞেস করে।’
ভারতী বলে, ‘ওদের পরিবারটা অবস্থাপন্ন নয়, কিন্তু অল্পের মধ্যেই কী সুন্দর গুছিয়ে চলে, একটুও বাজে খরচ নেই। ছেলেমেয়েরা যেমন চালচলনে ভদ্র তেমনি খুব পরিশ্রমীও। এই গুণগুলো ওরা পেয়েছে মায়ের কাছ থেকে।’
একটুক্ষণ চুপ করে থেকে ভারতী প্রায় স্বগতোক্তির মতো বলল, ‘উমাকে বউ করে আনতে খুব ইচ্ছে করে, একটা লক্ষ্মীশ্রী আছে ওর মুখে। ওরাও তো বামুন, তুমি কী বলো?’
‘আমি বললেই তো হবে না, অনি কী বলে সেটাই আসল কথা। ছেলে লেখাপড়া শিখেছে। নিজস্ব বোধবুদ্ধি তৈরি হয়েছে, বড়ো সার্কেলে ঘোরাঘুরি করে, অতবড়ো কোম্পানিতে ভালো পোস্টে ঢুকেছে, ভবিষ্যতে আরও ওপরে উঠবে। ওর রুচির সঙ্গে আমাদের রুচি মিলবে এমন তো কোনো কথা নেই। তবে উমা আমাদের সংসারে এলে খুব খুশি হব।’
আমি ভাবছি একবার অনির কাছে কথাটা পাড়ব। আমার কেমন যেন মনে হয় একটা সম্পর্ক ওদের মধ্যে গড়ে উঠেছে। তোমার মনে আছে উচ্চচমাধ্যমিক পরীক্ষার আগে উমা সন্ধেবেলায় অনির কাছে বিজ্ঞান আর অঙ্ক পড়তে আসত, এই ঘরে বসে অনি পড়াত?’
‘মনে আছে।’
‘আমি রান্নাঘরে ব্যস্ত থাকতুম, তুমি বাবার ঘরে বসে টিভি দেখতে। একদিন কী একটা দরকারে ঘরে গিয়ে দেখি ওরা দু—জন নেই, বইখানা পড়ে রয়েছে।’
‘ওরা কোথায় ছিল?’
‘বারান্দায়, অন্ধকার বারান্দায়, আমার সাড়া পেয়ে তাড়াতাড়ি চোরের মতো দু—জনে ঘরে ঢুকে এল। তখনই আমার মনে হয়েছিল কিছু একটা চলছে, তোমাকে তখন বলিনি।’
‘অনির বয়স কম, উমারও। উঠতি বয়সে ওরকম একটু—আধটু হয়ে থাকে। ও নিয়ে কেউ চিন্তা করে না। একটু বয়স বাড়লেই সব ঠিক হয়ে যায়। তোমার হয়নি?’
‘নাহ।’
‘লজ্জা পাচ্ছ কেন, বলেই ফেলো না।’
‘বললুম তো, কিছু হয়নি।’
‘আমারও হয়নি।’
‘জানি।’
‘জানি মানে? কী করে জানলে প্রেম করিনি? তুমি তো আমাদের পাড়ায় থাকতে না, এখান থেকে আধমাইল দূরে ছিল তোমার বাপের বাড়ি, তা হলে জানলে কী করে?’
উলটোমুখে পাশ ফিরে শুতে শুতে ভারতী বলল, ‘জানার জন্য পাড়ায় থাকতে হবে কেন? এত বছর ঘর করে তা হলে কী বুঝলুম, ওকাজ তোমার দ্বারা সম্ভব নয়।’
এরপর পুলিন ‘তোমার দ্বারা সম্ভব নয়,’ কথাটার অর্থ উদ্ধার করতে ক্রমশ জীবনটাকে পিছিয়ে নিয়ে গিয়ে কৈশোর পর্যন্ত পৌঁছল এবং অবাক হয়ে গেল এমন একটি মেয়েকেও খুঁজে না পেয়ে যার কাছ থেকে সে সামান্যতম ইঙ্গিত পেয়েছে যাতে হৃদয় ব্যস্ত হয়ে ওঠে। ঘুমিয়ে পড়ার আগে সে নিজের অতীত জরিপ করার ফলটা মনে মনে নিজেকে শুনিয়ে দিল—চেষ্টা করলে কি আর প্রেমে পড়তে পারতুম না। চেষ্টাই করিনি। আসলে আমি ভালো ছেলে ছিলুম।
.
ছেলেকে খাওয়ার টেবলে একা পেয়ে ভারতী জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘উমাকে তোর কেমন লাগে রে অনি?’
হঠাৎ এমন প্রশ্নে যে—কোনো বুদ্ধিমান যুবক মুহূর্তে হুঁশিয়ার হয়ে যায়, বিজনেস ম্যানেজমেন্ট পড়া তুখোড় যুবক, এ দেশে ব্যবসায়ে সদ্য প্রবেশ করা সুইডিশ রং প্রতিষ্ঠান স্টান্ডার্ড পেইন্টসের ট্রেনি মার্কেটিং একজিকিউটিভ অনীশ আলগা ভঙ্গিতে বলল, ‘উমাকে তো ভালোই লাগে। যথেষ্ট সরল যা ওর বয়স মেয়েদের মধ্যে চট করে দেখা যায় না। পড়াতে গিয়ে দেখেছি তো কী পরিশ্রম করে এক—একটা ব্যাপার বোঝার জন্য, সত্যিই এজন্য ওকে শ্রদ্ধা করতে হয়। হায়ার সেকেন্ডারিতে ফার্স্ট ডিভিশন পাবে এটা আশা করিনি।’
শ্রদ্ধা শব্দটি ভারতীকে একটু দমিয়ে দিল। এমন গম্ভীর মনোভাব যার প্রতি তাকে বিয়ে করার মতো হালকা—ভারতীর মনে হয় বিয়ে বা দাম্পত্য জীবনকে গুরুতরভাবে নেওয়ার কোনো মানে হয় না—প্রস্তাব ছেলের কাছে পাড়া যায় কি না সেটাও ভেবে দেখা দরকার। পুলিন বলেছিল ছেলের রুচির সঙ্গে ওর বড়ো চাকরির সঙ্গে আমাদের ইচ্ছে মিলবে এমন কোনো কথা নেই।
অনীশ নিজের থেকেই বলল, ‘হঠাৎ উমাকে কেমন লাগে একথা আচমকা জিজ্ঞাসা করলে কেন, ব্যাপারটা কী? বিয়েটিয়ের কথা ভাবছ নাকি?’
ভারতী অপ্রতিভ হয়, ধরা পড়ে। ঢোঁক গিলে বলে, ‘যদি ভেবেই থাকি তাতে দোষের কী? তুই কি ওর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হোসনি? অনি, আমার চোখ কিন্তু শকুনের মতো।’
চোখ বড়ো করে অনি বলে, ‘শকুনের চোখ থাকে ভাগাড়ের দিকে। তুমি আমাকে ভাগাড় ভাবলে।’ বলে হতাশায় মাথা নাড়ল সে।
‘কথা ঘোরাসনি, তোকে আমি কী ভাবি তা ভালো করেই জানিস। উমাকে আমার, আমাদের খুব পছন্দ। ওকে বউ করে আনলে সংসারটা সুখের হবে।’
হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল অনীশ। টেবল থেকে উঠে বেসিনে গিয়ে হাত ধুয়ে তোয়ালেতে হাত মুখ মুছে বলল, ‘সংসার সুখের হবে তুমি ভাবলে কিন্তু আমার কথাটা তুমি ভাবলে না। হ্যাঁ, উমার সঙ্গে সামান্য ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল তখন আমি কলেজে পড়ি। কিন্তু তারপর আমার বয়স বাড়ল অভিজ্ঞতা বাড়ল, সময়ও বদলে গেল, আমার জগৎ এই ছোট্ট সংসার ছাড়িয়ে বাইরে ছড়াতে লাগল, আমি আরও ওপরে তাকাতে শিখলাম, আমি ঠিক করে ফেললাম নিজেকে আরও বাড়াতে হবে, উন্নতি করতে হবে, প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। এর মধ্যে অন্যায় তো কিছু নেই। আমার অ্যাম্বিশানের মধ্যে উমাকে জায়গা দেওয়া যায় না, মা।’
ভারতী একদৃষ্টে তাকিয়েছিল ছেলের দিকে। তাদের একমাত্র সন্তান। বুদ্ধিদীপ্ত ঝকঝকে চোখ, সুন্দর নাক কপাল, চুলের একটা গুচ্ছ ফরসা কপালের উপর ছোরার মতো বেঁকে ঝুলে রয়েছে, গলার স্বর জলস্রোতের মতো মসৃণ, উচ্চচারণ স্পষ্ট। প্রায় ছয় ফুট দীর্ঘ, ছিপছিপে। ওর কথা বলা, হাসির শব্দ, তাকানো, হাঁটার ভঙ্গি এই পরিবারের বা এই বাড়ির এমনকী এই পাড়ারও কারোর সঙ্গে মেলে না। ভারতী গর্বিত তার ছেলের জন্য।
অনীশের কথাগুলো মুগ্ধের মতো শুনছিল ভারতী। শুনতে শুনতে তার মনে হয় সত্যিই অন্যায় হবে তাদের পছন্দ অনির উপর চাপিয়ে দিলে। বড়ো হয়েছে, লেখাপড়া শিখেছে। ওর মাপের মেয়ে উমা নয়, ওর সঙ্গে খুব খাপ খাবে না এটা সে বোঝে। তবুও উমাকে তার পছন্দের বড়ো কারণ মেয়েটি এই সংসারের মানসিকতার সঙ্গে মানানসই হবে। সহজভাবে দুধের সঙ্গে দুধ মেশার মতো মিশে যাবে, ছানাকাটা হয়ে যাবে না।
অনীশ স্পষ্টভাবে তার উচ্চচাকাঙ্ক্ষার কথা জানিয়ে দেওয়ায় ভারতী ক্ষুণ্ণ হল না, অভিমানও জমল না তার মন বরং হাঁফ ছেড়েই বাঁচল। অনি বড়ো হতে চায় এবং হওয়ার পথে একধাপ এগিয়েছে। রোজ সকাল আটটায় একটা সাদা অ্যাম্বাসাডর গাড়ি এসে দাঁড়ায় গলি আর বড়ো রাস্তার মোড়ে। অফিসের গাড়ি, তাতে আরও দু—জন থাকে। কোট—টাই পরা অনি ছোটো চামড়ার ব্যাগ হাতে গাড়ির পিছনের সিটে বসে। ভারতী বারান্দা থেকে দেখে গলির বা এ—বাড়ি ও—বাড়ি থেকে কেউ অনিকে দেখছে কি না। চাকরি করতে অফিস গাড়ি পাঠিয়ে নিয়ে যায়, এটা তো বড়ো কাজ করারই লক্ষণ, ছেলের বড়ো হওয়ার পথে একটা ঢিলও পড়ে থাকলে ভারতী তা সরিয়ে ফেলে দেবে।
সেই রাতেই অন্ধকার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভারতী গলা নামিয়ে পুলিনকে জানাল, ‘অনিকে বলেছি।’
‘কী বলেছ?’ ভ্যাপসা গরম, হাওয়া নেই। ভিজে গামছায় গা মুছে গামছাটা শরীরে জড়িয়ে পুলিন টুলে বসেছিল।
‘উমার কথা।’
‘নিশ্চয় রাজি হয়নি।’
ভারতী অবাক হয়ে বলল, ‘তুমি জানলে কী করে?’
পুলিন বাবার অন্ধকার ঘরের দরজার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘অনি কি ঘুমিয়ে পড়েছে?’
‘তাড়াতাড়ি না ঘুমোলে সকাল আটটার মধ্যে তৈরি হওয়া যায় না। ওর জন্যই বাবা আগের মতো বেশি রাত পর্যন্ত টিভি দেখতে পারেন না।’
সাত বছর আগে কাশীনাথ দেড় হাজার টাকায় একটা সাদা—কালো ছোটো টিভি সেট কেনে। সারা গুহভবনে এখন ওই একটিই সাদা—কালো সেট টিকে রয়েছে। পুলিন একবার বলেছিল, ‘বাবা এবার একটা কালার টিভি কেনো।’ শুনেই কাশীনাথ জানতে চায়, ‘দাম কত?’
পুলিন বলেছিল, ‘হাজার বারো—চোদ্দো পড়বে।’ নির্বিকার স্বরে কাশীনাথ জানিয়ে দিয়েছিল ‘তা হলে তুই কিনে দ্যাখ।’
‘অনি কোনোদিনই টিভি দেখা পছন্দ করেনি, দেখলে নাকি বুদ্ধি মোটা হয়ে যায়। কী জানি! আমার তো বেশ ভালোই লাগে।’ কথাটা বলে পুলিন অন্ধকারে ভারতীর মুখ দেখার চেষ্টা করল।
‘কোনটা যে তোমার খারাপ লাগে এখনও তো সেটা জানলুম না।’
‘অনেক কিছুই তো তুমি জান না, এটাও নয় নাই জানলে। অনি যে রাজি হবে না সেটাও তুমি জানতে না। ছেলেটা যে বদলে যাচ্ছে সেটা তুমি একদমই লক্ষ করোনি। করলে উমার সঙ্গে কেন, আমাদের পছন্দের যেকোনো মেয়ের সঙ্গে ওর বিয়ে দেওয়ার চিন্তা তুমি করতে না। গোবর গণেশ মার্কা ছেলে নয়, ভীষণ পরিশ্রমী, এরা নিজের ভালোমন্দ সম্পর্কে টনটনে হয়। মেয়ে পছন্দটা ওকেই করতে দাও। চলো ঘরে যাই।’ পুলিন উঠে দাঁড়াল।
বিছানায় পাশাপাশি শুয়ে প্রায় পাঁচ মিনিট কাটাবার পর ভারতী বলল, ‘ঘুমোলে?’
‘না।’
‘একটা কথা মনে এল।’ ভারতী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার বলল, ‘বিয়ের পর অনির জন্য তো একটা ঘর দরকার হবে।’
‘হবেই তো।’
‘কোন ঘরে থাকবে?’
‘কেন, এই ঘরে!’ দ্রুত উত্তর দিয়েই পুলিনের খেয়াল হল ভারতীর গলার স্বরে কেমন যেন দ্বিধা আর অস্বস্তি ছিল। স্ত্রীর দিকে পাশ ফিরে সে বলল, ‘তোমার তাতে আপত্তি আছে?’
‘আপত্তি কেন হবে, তা হলে আমরা থাকব শোব কোথায়? ঘর তো মোটে দুটো। ও ঘরে রয়েছে বাবা। আমরা ও ঘরে গেলে বাবা যাবেন কোথায়?’
সমস্যাটা এবার বুঝতে পারল পুলিন। শাশুড়ি মারা যাওয়ার পর ভারতী এই সংসারে আসে। তখন এই ঘরটা তারা দু—জন পায়। সংসারে লোক মাত্র তিনজন। কাশীনাথ স্থানান্তরিত হয়ে চলে আসে দ্বিতীয় ঘরে, একটা ক্যাশবাক্স আর সিঙ্গল খাট, কাঠের আলমারি, টেবল, চেয়ার নিয়ে কাশীনাথ তিরিশ বছর ধরে রয়েছে সেই ঘরে। অনীশ পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত বাবা—মায়ের সঙ্গে শুয়েছে। এক রাত্রে ভারতী টের পায় ছেলে জেগে রয়েছে। পরদিনই সে স্বামীকে বলে ‘তুমি মেঝেয় শোও, অনিকে নিয়ে আমি খাটে শোব। ও বড়ো হচ্ছে, অনেক কিছু বুঝতে শিখেছে।’
ক্লাস এইটে পড়র সময় অনীশ বলল সে দাদুর ঘরে শোবে। কাশীনাথ খুশি হয়ে বলল, ‘দাদুভাই আমার সঙ্গেই খাটে শোবে।’ অনীশ শুধু একরাত সেই সিঙ্গল খাটে দাদুর সঙ্গে শোয়ার পরই বলেছিল ‘আমি কাল থেকে মেঝেয় শোব, দু—জনে ওই খাটে শোয়া যায় না।’
খাটের পাশে আড়াই হাত খালি জায়গা তারপরই কাঠের আলমারি আর টেবল। টেবলটা সরিয়ে ঘরের অন্য কোথাও রাখার জায়গা না—পাওয়ায় সেই আড়াই হাতেই অনি রাতে কয়েকদিন শোয়। সকালে ঘুম থেকে উঠে শতরঞ্চি সমেত তোষক আর বালিশ গুটিয়ে খাটের নীচে ঠেলে দিত। তারপর সে কিনে আনে একটা ফোল্ডিং খাট। বিয়ের আগে পর্যন্ত তাতেই সে শুয়ে এসেছে।
‘তা হলে আমরা থাকব শোব কোথায়?’ সমস্যাটা পুলিন আর ভারতীকে মনে মনে সিঁটিয়ে রেখেছিল। সমাধান খুঁজতে অবাস্তব প্রস্তাব নিয়ে দু—জনে কথা বলত। ভারতী বলেছিল, ‘রাতে বারান্দায় শুলে কেমন হয়?’
পুলিন চোখ কপালে তুলে বলে, ‘ওই খোলা বারান্দায়? পাগল হয়েছ? বৃষ্টি এলে তখন কী করবে? শীতকালে ঠান্ডায় তো নিমোনিয়া ধরবে। তা ছাড়া বারান্দাটায় দু—জন শোয়ার মতো জায়গা কোথায়? কাঠের পুতুলের মতো সারারাত চিৎ হয়ে থাকতে হবে,আমার দ্বারা তা হবে না।’
ভারতী কোনো তর্কের মধ্যে আর যায়নি। দু—জনের মাথার মধ্যে অবিরাম শোবার জায়গা নিয়ে খোঁজাখুঁজি চলেছিল দু—মাস ধরে। তারা যে অনীশের বিয়ে হলে অথৈ জলে পড়বে তাই নিয়ে ছেলের মধ্যে কোনো উদবেগ দেখতে না পেয়ে পুলিন ক্ষুব্ধ হয়ে স্ত্রীকে বলে, ‘লক্ষ করেছ আমাদের রাতের থাকা নিয়ে ও একটি কথাও বলছে না। এটা যে কত বড়ো সমস্যা সেটা কি ও বুঝতে পারছে না?’
‘পারবে না কেন!’ ভারতী ক্ষোভের সঙ্গে অভিমান মিশিয়ে বলে, ‘বুদ্ধিমান লেখাপড়া জানা ছেলে বাবা—মায়ের অসুবিধের দিকটা একবারও ভাববে না তাই কি হয়?’
সেই মুহূর্তে পুলিনের মনে বিদ্যুৎ চমকের মতো মনে হয়েছিল, বাবার এত বছর ধরে বেঁচে থাকার কোনো মানে হয়?
‘আচ্ছা, বাবাকে অনির ফোল্ডিং খাটটায় শুতে বললে কেমন হয়।’ চিন্তাটা হঠাৎই এসে গেল পুলিনের মাথায়।
ভারতী আঁতকে উঠে বলে, ‘শুনলেই বাবা যা বলবেন তাতে বাড়ি ছেড়ে হয় চলে যেতে হবে নয়তো দু—জনকেই গলায় দড়ি দিতে হবে। তুমি বলে দেখতে পার।’
পুলিন তার যাবতীয় সাহস জড়ো করে বাবার ঘরে আসে, কাশীনাথ তখন প্রতিদিনের মতো দেওয়ালে বালিশ রেখে ঠেস দিয়ে দু—পা ছড়িয়ে টিভি দেখছিল। পুলিন খাটের একধারে বসে টিভির দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। একটা বাংলা সিরিয়াল দেখানো হচ্ছে। এটা সে এক বছর আগেও চলতে দেখেছিল। বিজ্ঞাপন দেখানোর বিরতি সময়ে পুলিন বলল ‘কত পর্ব চলছে?’
‘পাঁচশো দশ।’ দ্রুত উত্তর দিল কাশীনাথ।
‘ভালো লাগছে দেখতে?’
‘প্রত্যেকটা পর্ব দেখেছি একটাও মিস করিনি। তুই দেখিস না কেন, বউমা এসেও তো দেখতে পারে।’
পুলিনের মনে হল বাবার মেজাজ আজ নরম রয়েছে, নয়তো এমন উদার আহ্বান সচরাচর ঘটে না। সিরিয়াল আবার শুরু হল বিজ্ঞাপন দেখানোর পর। ভারতী তার মধ্যে একবার এসে বলল, ‘বাবা চা খাবেন?’ কাশীনাথ মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানাল।
সিরিয়াল শেষে পুলিন বলল, ‘বাবা, অনির এবার বিয়ে দোব ঠিক করেছি।’
‘কার সঙ্গে? ওই দোতলার মেয়েটা?’
‘না। অনি নিজেই ঠিক করেছে।’
‘তা হলে তুই বিয়ে দিবি বললি কেন, ও তো নিজেই বিয়ে করছে, যেমন তুই করেছিলি?’
পুলিন চোখ নামিয়ে মাথা নীচু করল। বাবা অসত্য কিছু বলেননি, তবে তফাত একটা আছে। অনি ভাবসাব করে বিয়ে করছে। ভারতীকে সে তিন—চার বার মাত্র চোখে দেখেছিল বিয়ের আগে আর, কথা যা বলেছিল সেটা না—বলারই মতো। যেমন দিলীপ বাড়ি আছে? দরজা থেকে ভারতী বলেছিল, ‘দাদা এইমাত্র বেরোল। কিছু বলতে হবে?’ ‘না থাক। বোলো আমি এসেছিলুম।’ আর একবার পুলিন কড়া নাড়তে ভারতী দরজা খোলে। ‘কাকাবাবু আছেন?’ ‘আছেন। বাবা আহ্নিক করছেন, আপনি বাইরের ঘরে বসুন।’ এই রকমই ছিটেফোঁটার বেশি কথা বন্ধুর বোনের সঙ্গে হয়নি অথচ কাশীনাথ বলে দিল অনির মতো সে নিজেই বিয়ে করেছে।
বাবা খুব ভালোভাবেই জানে তার বিয়েটা ভাবসাবের বিয়ে নয়। ভারতীর বাবা এসে বিয়ের কথা পাড়ে, কাশীনাথ ওদের বাড়ি গিয়ে মেয়ে দেখে সম্মতি দিয়েছিল।
পুলিন এটা নিয়ে কিছু বললেই কাশীনাথের সঙ্গে তার কথা কাটাকাটি হবে এবং সে তিরিশ বছর পর এখন কোনো প্রমাণই দাখিল করতে পারবে না যে ভারতীর সঙ্গে বিয়ের আগে তার হৃদয়ের সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। এমনকী ভারতীকে বিয়ে করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছাও তার মনে কখনো উঁকি দেয়নি যদিও সামান্য খাটো মাথার, গৌরাঙ্গী মাধ্যমিক পাশ সুন্দর মুখশ্রীর বন্ধুর বোনের প্রতি সে দুর্বলতা দেখাতে পারত।
‘সেদিন একটা মেয়ে এসেছিল। আগে কখনো দেখিনি, ওই মেয়েটাকেই কি অনি বিয়ে করবে বলছে?’
‘হ্যাঁ।’
‘ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ আমাকে দেখল, ভাবলুম বলি, কী দেখছ অমন করে, আমি কি জেলেপাড়ার সং?’
পুলিন শিউরে উঠল, ‘ভাগ্যিস বাবা বলেনি। মেয়েটি তা হলে হবু শ্বশুর ঘর সম্পর্কে কী ধারণা করে বসত।
‘তা অনি আর মেয়ে পেল না। অমন ঘোড়ার মতো মুখওলা মেয়েকে পছন্দ করল কী করে?’
পুলিন চুপ করে রইল। কাশীনাথের প্রশ্নটা ভারতীও রাত্রে বিছানায় শুয়ে ক্ষুব্ধ বিস্ময় নিয়ে বলেছিল, ‘মুখটা যেন কেমন, গোল গোল চোখে যেভাবে তাকিয়ে কথা বলছিল মনে হচ্ছে যেন ধমকাচ্ছে, গলার স্বরটাও তেমনি পুরুষ মানুষের মতো।’
‘যাকগে, এ নিয়ে তুমি যেন অনিকে কিছু বলতে যেয়ো না।’ পুলিন বউকে ঠান্ডা গলায় বলেছিল, ‘মানিয়ে নেবার চেষ্টা কোরো। অনি যদি ওকে নিয়েই সুখী হয় তাতে আমাদের কী বলার আছে।’
সেদিন বাবার কথার পিঠে কথানা বলে পুলিন মাথা নামিয়ে থেকে ‘যেমন তুইও করেছিলি’ মিথ্যেটা মেনে নেয়। বাবার সঙ্গে যে কথাটা বলার জন্য সে এসেছে সেটা অনেক জরুরি। পুরোনো কাসুন্দি ঘেঁটে আসল কথা থেকে সরে গেলে চলবে না। বাবার মেজাজ আজ নরম রয়েছে।
‘বাবা, বিয়ে হলে তো অনিকে আমার ঘরটা ছেড়ে দিতে হবে।’
‘তা তো হবেই, তোর বিয়ের পর তো ও ঘরে আমি তোদের থাকতে দিয়েছিলুম।’
‘তা হলে আমরা কোথায় যাব, মানে আমরা কোথায় থাকব?’
পুলিন জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল, তার মনে হল কাশীনাথ থমকে গিয়ে উত্তর খুঁজছে। খবরের কাগজটা তুলে নিয়ে চোখের সামনে ধরল। পুলিন বুঝল বাবা বিব্রত হয়েছে। রাতে খবরের কাগজ পড়তে পারে না, কাগজটা চোখের সামনে ধরা মানে চিন্তা করছে।
মিনিট দুয়েক পর পুলিন নীচু গলায় বলল, ‘বাবা, বলছিলুম কি আমরা এই ঘরেই রাতে শোব। দিনের বেলায় দরকার হবে না। অনি আর বউ তো কাজে বেরিয়ে যাবে তারপর সারাদিন আমরা ও ঘরে থাকব, শুধু রাতে—।’
পুলিনের কথা শেষ হতে না দিয়ে কাশীনাথ বলে, ‘এ ঘরে জায়গা কোথায় যে তোরা শুবি?’
‘জায়গা হয়ে যাবে যদি তুমি অনির ফোল্ডিং খাটটায় শোও। আর এই খাটটা যদি বার করে দেওয়া যায় তা হলে অনেকটা জায়গা বেরোবে, আমরা মেঝেয় শোব।’
‘খাটটা বার করে কোথায় রাখবি?’
কাশীনাথের উৎসুক স্বর শুনে পুলিন হালকা বোধ করল। সহজ গলায় বলল, ‘বার করে রাখব কেন, খাটটা বিক্রি করে দোব।’ কথাটা বলে পুলিন বাবার মুখের দিকে তাকিয়েই বুঝল বিরাট ভুল করে ফেলেছে।
‘হারামজাদা!’ যে কটা দাঁত এখনও রয়েছে কাশীনাথ সেগুলো চেপে ধরে বলল ‘বিক্রি করে দোব, বলতে লজ্জা করল না? আমার চাকরির টাকায় এই খাটটা কিনেছি। পেরেছিস তুই একটা কিছু নিজের পয়সায় কিনতে?’
চা নিয়ে এল ভারতী। কাশীনাথের শেষ বাক্যটি তার কানে গেছে। জড়োসড়োভাবে কাপটাকে শ্বশুরের সামনে ধরল।
‘এত দেরি হল কেন? জল চড়িয়ে চা—পাতা কিনতে গেছলে?’
ভারতী চুপ করে রইল। চেঁচাবার জন্য শ্বশুর একটা উত্তর চাইছে, উত্তরটা সে জোগাল না।
‘খাট বিক্রির বুদ্ধিটা কি তোমার মাথা থেকে বেরিয়েছে?’
ভারতী চুপ। কাশীনাথের অনুমানটা অর্ধেক সত্য। পুলিন আর ভারতী দু—জনে মিলে মাথা ঘামিয়ে শোবার জায়গা বার করতে গিয়ে খাটটাকে বিদায় দেওয়াই বাস্তব পন্থা বলে মনে করে গত রাতে নিজেদের মধ্যে কথা বলে।
‘কী, চুপ করে আছ কেন? আমি জানি এসব কুচুটে বুদ্ধি পুলিনের মাথা থেকে বেরোবে না, ও চিরকাল বোকা, চালাক হলে পয়সা রোজগার করতে পারত।’
‘পয়সা রোজগারটাই কি মানুষের জীবনে বড়ো ব্যাপার, বাবা?’ ভারতী মৃদুস্বরে অনিশ্চিতভাবে বলল।
‘নিশ্চয় বড়ো ব্যাপার’, কাশীনাথ ধমকে উঠল। ‘টাকার জোরেই মানুষ বড়ো হয়, খাতির পায়, পুলিনকে কেউ কি সমীহ করে, না পাত্তা দেয়?’
‘না, কেউ দেয় না সমীহও করে না।’ ভারতীর কণ্ঠস্বরে চাপা আগুন। পুলিন প্রায় চমকে উঠে বউয়ের দিকে তাকাল, ধকধক করছে ভারতীর চোখ। ‘আপনাকেই বা ক—জন খাতির করে? উঠতে বসতে ছেলেকে অপমান করেন কেন, কী অপরাধ করেছে সে? একটা ছেলেকে তবু সে তৈরি করেছে, এই পাড়ায় কেউ নেই অনির মতো এত বড়ো চাকরি করে। আপনি তো পারেননি নিজের ছেলেকে তৈরি করতে। আপনার থেকে আপনার ছেলে অনেক মান বাড়িয়েছে এই রায় পরিবারের।’
অনুচ্চচ কঠিন গলা ভারতীর। পুলিন তার বউয়ের এমন কঠোর ভঙ্গি এই প্রথম দেখছে। এই প্রথম একজন বাবার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ দেখাল আর সেটা করল কি না অত্যন্ত নরম শান্ত স্বভাবের ভারতী। শ্বশুরের সামনে যে মাথায় কাপড় না দিয়ে কখনো থাকে না এখন তার ঘোমটা খসে পড়েছে, চোখের কোল চিকচিক করছে জলে।
কাশীনাথও অবাক হয়ে গেছে। পুরু কাচের পিছনে তার চোখের অবিশ্বাসী মণি বিস্ফারিত, হাতে ধরা কাপটা থর থর কেঁপে উঠল। বাবার মুখ দেখে পুলিন বুঝল আঘাত পেয়েছে। বউকে মৃদু ধমকে বলল, ‘যাও এখান থেকে।’
ভারতী ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে পুলিন অপরাধীর মতো হাত জোড় করে বলল, ‘ওর কথায় কিছু মনে কেরো না বাবা, আমি ওর হয়ে মাপ চাইছি। ইদানীং খুব দুশ্চিন্তায় রয়েছে।’
‘কীসের দুশ্চিন্তা! শোয়ার জায়গা নিয়ে?’ চায়ে চুমুক দিয়ে কাশীনাথ বলল।
‘শুধু শোবার জায়গা নয়, ওই মেয়েটিকে তোমার বউমারও ভালো লাগেনি।’
‘তা হলে বিয়ে দিচ্ছিস কেন?’
‘অনি পছন্দ করেছে।’
‘অনি পছন্দ করেছে বলেই তাকে বউ করে ঘরে তুলতে হবে? আমি যদি বউমাকে দেখে পছন্দ না—করতুম তা হলে কি ভারতী এই পরিবারে ঢুকতে পারত?’
‘দিনকাল পালটে গেছে বাবা।’
‘পালটে গেছে যে সেটা তো এক্ষুনি বুঝতে পারলুম। মেয়েটার নাম কী? বাড়িতে আছে কে কে?’
‘নাম বলাকা। আছে বাবা—মা আর দুই বোন এক ভাই। বাবা আসামে চা—বাগানে ছিল বড়োবাবু। রিটায়ার করে টালিগঞ্জে বাড়ি করে রয়েছে। এই বঙ্গেরই লোক, পৈতৃক বাড়ি বর্ধমানের কৈচর বলে একটা গ্রামে। সেখানে খুড়তুতো ভাইয়েরাই জমিজমা ভোগ করছে। ওরা কখনো যায় না। বলাকা চাকরি করে ইস্ট ইন্ডিয়া ব্যাঙ্কের শ্যামনগরের ব্রাঞ্চে। দুই বোনের একজন স্কুলে পড়ায় আর একজন কাজ করে একটা ট্র্যাভেল এজেন্সিতে। ভাই যাদবপুরে বিএ পড়ছে।’
স্ত্রীর কাছ থেকে যতটুকু শুনেছিল পুলিন সেটাই সংক্ষেপে বলে।
মন দিয়ে শুনে কাশীনাথ বলে, ‘চা—বাগানের বড়োবাবু ছিল যখন তখন বেশ দু—পয়সা কামিয়েছে। মেয়েরাও রোজগেরে। মনে হয় অবস্থাপন্ন সচ্ছল, দেবেথোবে ভালোই।’
পুলিন ঢোক গিলে বলে, ‘অনি বলেছে কোনো দাবিদাওয়া নয়। এমনকী কোনোরকম জিনিসপত্তরও চাওয়া চলবে না।’
কাশীনাথ অবাক হয়ে বলে, ‘বউভাতের খরচ, ঘড়ি, আংটি, সোনার বোতাম এগুলো দেবে তো? তোর শ্বশুর তো দিয়েছিল।’
‘বউভাতের খরচ অনি নিজে দেবে, বাড়িভাড়া করে লোক খাওয়াবে। অনি আংটি পরে না, সোনার বোতামও নয়, ওর দু—হাজার টাকা দামের ঘড়ি আছে তাই ওসবের কোনো দরকার নেই বলে দিয়েছে।’
‘বাব্বা, তোর ছেলে তো খুব পয়সা করে ফেলেছে! কিছুই নেবে না যখন তখন কোন দুখ্যে অমন একটা মদ্দকে বিয়ে করা? একটা সুন্দর নরমসরম চেহারার মেয়েকে তো বিয়ে করতে পারে।’
এবার পুলিন যতটা সম্ভব গলাটা শক্ত করে বলল, ‘বাবা, অনির হবু শ্বশুর শাশুড়ি সামনের রোববার আসবে পাকা কথা বলতে, তুমি একটু বুঝে শুনে ভদ্রভাবে কথা বোলো।’
‘তার মানে? আমি কি অভদ্র?’
জবাব না দিয়ে পুলিন ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। সেদিন রাতে তাদের দু—জনের মধ্যে শোয়ার সমস্যা নিয়ে আবার কথা হয়েছিল। পুলিন হতাশ হয়ে বলে, ‘শেষ পর্যন্ত ওই ফোল্ডিং খাটের জায়গাটাতেই আমাদের দু—জনকে মেঝেয় শুতে হবে।’
ভারতী বড়ো করে শ্বাস ফেলে বলে, ‘অনেক কিছুই মেনে নিয়েছি এটাও মেনে নিতে হবে। ছেলের বিয়ে দিয়ে যে এমন আতান্তরে পড়তে হবে আগে কি ভেবেছিলুম।’
‘আগে ভাবলে কী করতে শুনি? বিয়ে করতে বারণ করতে?’
‘সেকী! অত স্বার্থপর হব কেন। শুধুমাত্র রাতে শোয়ার জায়গার জন্য অনিকে বঞ্চিত করব, একথা বলতে পারলে কী করে?’
‘কী বললুম আর কী তার মানে করলে! বঞ্চিত করার কথা উঠছে কেন। একটা জোয়ান ছেলের তো এই বয়সেই বউ দরকার তা কি আমি বুঝি না? রাতে অন্য কোথাও শোওয়া, মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য, তেমন একটা ব্যবস্থার কথা ভাবা দরকার। যতদিন না ব্যবস্থা হয় অনি বিয়ে পিছিয়ে দিক।’
উত্তেজিত স্বরে ভারতী বলল, ‘বলছ কী! রোববার ওরা বিয়ের কথা বলতে আসবেন আর এখন বলব বিয়ে পিছিয়ে দিতে, তাও এমন একটা কারণে যা শুনলে লোকে হাসবে আর আমাদের মাথা খারাপ হয়েছে ভাববে।’
‘একটু শান্ত হও, আজ তোমার মাথাটা সত্যিই গরম হয়েছে। বাবাকে যেভাবে বললে তাতে আমার চোখ কপালে উঠে গেছল। এত বছর পর এই প্রথম তোমায় সত্যিকারের রাগতে দেখলুম, অবশ্য রাগারই কথা।’
অনুতপ্ত স্বরে ভারতী বলল, ‘কী যে হয়ে গেল তখন মাথার মধ্যে। ‘কুচুটে বুদ্ধি’ কথাটা শুনেই মাথায় রক্ত উঠে গেল। এমন কথা জীবনে কেউ কখনো আমার সম্পর্কে বলেনি। যত বয়স বাড়ছে বাবা যেন আমাদের ওপর নিষ্ঠুর হয়ে উঠছেন।’
‘বলে ভালোই করেছ। কখনো কেউ প্রতিবাদ করেনি, পালটা জবাব দেয়নি তাই যখন তখন অপমান করে গেছে। আসলে দোকানটা থেকে যদি দু—হাত ভরে টাকা রোজগার করতে পারতুম তাহলে আজ এভাবে অপমান করতে পারত না।’
.
পুলিন যে দোকানটার কথা বলল আসলে সেটি ছিল ভারতীর বাবা দুর্গাশঙ্করের ঘড়ি সারাইয়ের দোকান। একসময় তিনি রোলেক্স ঘড়ি কোম্পানিতে মেকানিক ছিলেন। মেয়ে জন্মাবার পরই দোকান করেন। নাম দেন ‘ভারতী ওয়াচ রিপেয়ারার।’ একমাত্র ছেলে দিলীপকে তিনি কাজ শিখিয়ে তৈরি করেছিলেন দোকানে বসাবার জন্য। দোকানটা ছিল চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের ওপর চোরবাগানে মহাজাতি সদনের কাছাকাছি, ব্যবসার পক্ষে খুব ভালো জায়গা। ছেলের বন্ধু সরল সাদাসিধে ঠান্ডা স্বভাবের পুলিনকে তিনি খুব পছন্দ করতেন। তৃতীয় বিভাগে মাধ্যমিক পাশ করার পর পরীক্ষার মার্কশিট হাতে নিয়ে কাশীনাথ তার ছেলেকে জানিয়ে দেন ‘অনেক হয়েছে, পয়সা নষ্ট করে আর পড়ে কাজ নেই। এবার হাতের কাজটাজ কিছু শেখ নইলে ভবিষ্যতে দু—মুঠো অন্নও জুটবে না।’
মাথা নীচু করে পুলিন শোনে এবং পরের হপ্তায় হেদুয়ার কাছে রেডিয়ো ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ নামে তিনটি ঘর নিয়ে গড়া কলেজে ভরতি হয়। সেখান ছ—মাস শিক্ষা নেবার পরে নিজের হাতে একটা ট্রানজিস্টার তৈরি করে কাশীনাথকে চমৎকৃত করে দেয়। কাশীনাথই পরামর্শ দেয় ‘তুই এবার ট্রানজিস্টার তৈরি করে বিক্রির ব্যবসা কর। রিটায়ার করছি চারমাস পর। পি এফ গ্র্যাচুইটি, ছুটি বিক্রি আর খানিকটা পেনশন বিক্রি করে হাজার সত্তর—পঁচাত্তর মতো পাব, আমাদর রেলের কয়েকজন মিলে কো—অপারেটিভ করে ফ্ল্যাটবাড়ি বানাবে বেলঘরিয়ায়, জমি কেনা ঠিক হয়ে গেছে। আমাকে বলছে মেম্বার হতে, তিন ঘরের ফ্ল্যাট ষাট থেকে সত্তর হাজার টাকা পড়বে। লোন পাওয়া যাবে। যদি ব্যবসা করতে পারিস তো বল। আগেকার ভালভওলা রেডিয়ো তো লোপাট হয়ে গেছে, এখন তো ট্রানজিস্টারের যুগ। ভালো করে আগে ভেবে দেখ, যদি এটা তৈরির ব্যবসা করতে পারবি মনে করিস তাহলে হ্যাঁ বলবি, আমি তাহলে ওদের বলে দোব মেম্বার হব না। আর যদি পারবি না ভাবিস তাহলেও বলে দিবি, তাহলে কো—অপারেটিভের মেম্বর হয়ে যাব। দেরি করিসনি, একমাসের মধ্যে জানাবি।’
ব্যবসার কিছুই জানে না পুলিন, সে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল দুর্গাশঙ্করকে। তিনি প্রবলভাবে বাঙালির ব্যবসায়ে নামায় বিশ্বাসী; নিজে চাকরি ছেড়ে দোকান করেছেন এবং তার কাজের গুণে খদ্দের পেয়েছেন এবং নামও ছড়িয়েছে। চাকরি থেকে যে বেতন পেতেন এখন তা দ্বিগুণ রোজগার করেন। ছেলের বন্ধুকে তিনি উৎসাহ দিয়ে বললেন, ‘এই তো চাই। বাঙালিরা শুধু চাকরি খোঁজে, যেমন তেমন একটা চাকরি পেলেই খুশি। অবাঙালিদের দেখো তো, সামান্য পুঁজি নিয়ে শুরু করে, এইতো ভগবতীলাল ছ—বছর আগেও হাতিবাগান বাজারে বসে কাটাকাপড় বেচত, এখন দ্যাখো ওখানেই ট্রামরাস্তার ওপর কাটপিসের দোকান দিয়েছে। ঝকঝকে কাউন্টার দেওয়ালে কাচের মস্ত বড়ো শোকেস। কী করে উন্নতিটা করল বলো তো?’
পুলিন হতভম্বের মতো তাকিয়ে থাকে দুর্গাশঙ্করের দিকে তারপর পাশে দাঁড়ানো মেয়ে ভারতীর দিকে। ছ—বছরে ভগবতীলালের উন্নতির কারণ জানতে তারপর সে এধার—ওধার তাকায়। দুর্গাশঙ্করই তাকে উদ্ধার করে বলেন, ‘পরিশ্রম। যেটা বাঙালিরা একদমই করে না, সেই পরিশ্রম। লজ্জা ঘেন্না ত্যাগ করে মুটের মতো ভগবতী খেটেছে দিনে আঠারো ঘণ্টা। আজ দেখো সে কোথায় উঠে গেছে। অবশ দেশওয়ালি ভাইরাও নানাভাবে ওকে সাহায্য করেছে।’
পুলিন নীচু গলায় তখন বলেছিল, ‘দিলীপও খুব খাটে, ও ঠিক উন্নতি করবে।’
‘নিশ্চয় করবে। ও কি আমার মতো বসে বসে শুধু ঘড়িই সারাবে? নামি বড়ো বড়ো কোম্পানির ঘড়ি বিক্রির এজেন্সি নিয়ে শো রুম খুলবে। আমার দোকানের পোজিশানটা দেখেছ? তুমি বাবা চাকরির দিকে যেয়ো না। ট্রানজিস্টার পাশে রেখে নাপিত দাড়ি কামাচ্ছে দেখেছি, মুচি জুতো সারাচ্ছে তাও দেখেছি, শুনেছি চাষি খেতে হাল দিচ্ছে আলের ওপর রাখা ট্রানজিস্টারের গান শুনতে শুনতে। জিনিসটার বাজার বিরাট। দেখতে সুন্দর এমন খোলের মধ্যে ভরে, কমদামে যদি মফস্সলের দিকে ভালো সেলসম্যান দিয়ে বিক্রি করতে পার তাহলে নিশ্চয় ব্যবসা দাঁড়াবে। কিন্তু তুমি একা একা মাসে ক—টা ট্রানজিস্টার তৈরি করতে পারবে? তোমাকে তো অনেকগুলো লোক রাখতে হবে, তাদের মাইনে দিতে হবে, একটা ছোটো কারখানা মতন করতে হবে, একটা অফিসও চাই, অনেক টাকার ব্যাপার!’
পুলিন বলেছিল, ‘বাবা ষাট—সত্তর হাজার টাকা দিতে পারবেন বলেছেন।’
দুর্গাশঙ্কর টাকার অঙ্ক শুনে হেসে ফেলে বলেন, ‘লাল সাদা সবুজ নানান রঙের ক্যাবিনেটে ছোটো ছোটো পকেট ট্রানজিস্টার বিক্রি হচ্ছে দেড়শো টাকায়। তুমি বরং তোমার ক্যাপিটালের জোর অনুযায়ী নাপিত মুচি চাষিদের কথা ভেবে কমদামি ট্রানজিস্টার তৈরি করো।’
পুলিন চাঁদনিচক বাজারের এক ট্রানজিস্টার ক্যাবিনেট নির্মাতার কাছ থেকে কাঠের কমদামি ক্যাবিনেট কিনে ঘরে বসেই সাতটি ট্রানজিস্টার তৈরি করে ফেলল বাবার দেওয়া টাকায়। কলকাতা আর বিবিধ ভারতী ছাড়া তাতে অন্য কোনো কেন্দ্র ধরা যায় না। সেগুলোর একটি নিয়ে শ্যামবাজারে এক বড়ো গ্রামোফোন রেকর্ড, টেপরেকর্ডার ও রেডিয়ো বিক্রেতার দোকানে যায় যদি তারা বিক্রির জন্য রাখে। তার ট্রানজিস্টারের চেহারা দেখেই দোকানের মালিক সবিনয়ে জানিয়ে দেন প্রদর্শনের জন্য তারা রাখতে পারবেন না। পরামর্শ দেন বিরাটি কি চাকদায় বরং বিক্রির চেষ্টা করুন। পুলিন কিন্তু দমে যায়নি। সে সত্যি সত্যিই বিরাটিতে গিয়ে এক স্টেশনারি দোকানের মালিককে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বেশি কমিশনের প্রস্তাব দিয়ে রাজি করায়। দশদিন পরে গিয়ে সে স্তম্ভিত হয়ে শুনল যে দুটি ট্রানজিস্টার রেখে গেছল সে দুটিই বিক্রি হয়ে গেছে।
সেদিন পুলিন বাড়ি ফেরে আড়াইশো গ্রাম রাবড়ির ভাঁড় হাতে নিয়ে। কাশীনাথ অবাক হয়ে বলে ‘ব্যাপার কী?’
লাজুক হেসে পুলিন বলেছিল, ‘আজ প্রথম রোজগার করলুম।’
‘আজ আর রুটি নয় লুচি দিয়ে রাবড়ি খাব।’ এই বলে কাশীনাথ টিন থেকে ময়দা বার করে মাখতে শুরু করে। আনন্দ হলে অন্তরে খুশি উপচে পড়লে লুচি খাবার ইচ্ছা তাকে তাড়না করে। স্ত্রী মারা যাবার পর সে রাঁধুনি রেখেছে। সন্ধ্যাবেলায়ই রাতের রান্না করে ঢাকা দিয়ে রেখে সে চলে যায়। তার যাবার পরই পুলিন রাবড়ি নিয়ে আসে তাই কাশীনাথকেই ময়দা মেখে লুচি ভাজতে হয়।
দালানে তখন খাওয়ার টেবল ছিল না। ঘরের টেবলে বসে খেয়েছিল পুলিন, আর কাশীনাথ খাটে দেওয়ালে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে কোলে থালা নিয়ে আলগা অলসভাবে রাবড়ির ঝোল মাখানো লুচি চিবোতে চিবোতে বলেছিল, ‘তাহলে তুই রোজগার করলি। আমি তো ভেবেছিলুম যে টাকাটা তোকে দিয়েছি সেটা আর ফিরে আসবে না, মানুষ যে কত ভুল ভাবে!’
পুলিন কথা না বলে টেবলে ডেকচিতে রাখা লুচি তুলে খেয়ে যেতে থাকে। রাবড়ির সবটাই বাবা খাক এটাই তার মনোগত বাসনা। কাশীনাথ লক্ষ করে পুলিন শুধু লুচি খাচ্ছে। রাবড়ির ভাঁড়টা ছেলের দিকে বাড়িয়ে ধরে সে বলে, ‘খেয়েনে। রাতে এত ভারী জিনিস খেলে আমার অম্বল হবে।’
পুলিন ভাঁড়টা নিয়ে নেয়। কাশীনাথ আঙুল চাটতে চাটতে বলে, ‘একটু বড়ো করে এবার শুরু কর। তোকে যেভাবে খাটতে দেখলুম মনে হচ্ছে দাঁড়িয়ে যাবি। এই দুটো ঘরে তো আর কারখানা হয় না। আরও বড়ো জায়গা চাই, টেবিল চাই, আলমারি চাই, যন্ত্রপাতি চাই, গোটা দুয়েক লোকও রাখতে হবে, তাদের মাইনে দিতে হবে। ইনভেস্ট করতে হয়রে, যাকে বলে লগ্নি। কুঁতিয়ে কুঁতিয়ে মাল তৈরি করলে বিক্রিও হবে তেমনি করে, ওতে ব্যবসা চলে না। তুই একটু বেশি টাকা ঢাল।’
পুলিন লক্ষ করেছিল কথাগুলো বলার সময় কাশীনাথের চোখদুটো উদ্দীপনায় ঝকঝক করে উঠল চশমার পিছনে, উৎসাহে তেজি গলার স্বর যুবকদের মতো। এ যেন অন্য এক কাশীনাথ। ব্যাজার মুখো খিটখিটে লোকটা ছেলের দুটো ট্রানজিস্টার বিক্রির সাফল্যেই চনমন করে উঠেছে। পুলিনের মনে হয়েছিল বাবা বোধহয় মনে মনে তাকে নিয়ে অনেক কিছু ভাবছে। মৃদস্বরে সে বলেছিল, ‘টাকা ঢালতে বলছ কিন্তু টাকা কোথায়?’
কাশীনাথ বলেছিল ‘সে তোকে ভাবতে হবে না। প্রথমে অল্প টাকা দিয়ে শুরু কর, বাজার বুঝে নে। তুই আনকোরা নতুন আমিও তো এই ব্যবসার কিছু জানি না, বুঝিও না। একত্রিশ বছর ধরে শুধু গার্ডের চাকরিই করেছি আর সংসার চালাবার কথা ভেবেছি। তোরা মায়ের চিকিৎসায় যে ক—টা টাকা জমিয়েছিলুম তাও গেল, উপরন্তু ধারও হল। আস্তে আস্তে সেটা শোধ করলুম। তাই বলছিলুম প্রথমেই বেশি টাকা লাগিয়ে শুরু না করে বরং পরিশ্রম দিয়ে পুষিয়ে নে। তোর তো ঝাড়া হাত—পা। বউ—বাচ্চচা নেই, সংসারও চালাতে হয় না, আমি তোকে হাজার তিরিশ দেব।’
পুলিন অবাক হয়ে বলেছিল, ‘তাহলে তোমার কো—অপারেটিভের ফ্ল্যাট! সেটার কী হবে?’
‘কী আবার হবে! ফ্ল্যাট হবে না।’ কাশীনাথ নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে বলে হেসেছিল। ‘তোর দরকারটা আগে। আমাদের দুটো ঘর তো রয়েছে, বাপবেটার চলে যাবে।’
শুনে গভীর সুখ পেয়েছিল পুলিন। ট্রানজিস্টার বিক্রির খবরটা দিলীপের বাবাকে জানাবার জন্য পরদিনই সে ওদের বাড়ি যায়। প্রায় একমাস পর সে এল। সদর দরজা খুলল ভারতী। ভারী চোখ থমথমে মুখ। অন্যান্যবারের মতো পাতলা হাসি ফুটল না। পুলিনকে ভিতরে আসার জন্য ‘আসুন’ বলল না। ভিতর থেকে ওর মা—র গলা শোনা গেল, ‘কে এলোরে খুকি?’ জবাব দিল পুলিন, ‘আমি কাকিমা।’ ভিতর থেকে বেরিয়ে এলেন দিলীপের মা কিরণ। ময়লা শাড়ি চুল আলুথালু।
পুলিন বলল, ‘দিলীপ বাড়ি আছে?’
কিরণ আঙুল আকাশের দিকে তুলে বলেন, ‘ওখানে আছে।’ এই সময় আঁচলটা দাঁতে চেপে ডুকরে উঠে ভারতী ছুটে ভিতরে চলে যায়।
শোনামাত্র ধক করে ওঠে পুলিনের বুক। ওখানে আছে তার মানে মারা গেছে কি? আশঙ্কার কথাটা মুখ দিয়ে বার করতে না পেরে বলল, ‘ওখানে মানে?’
প্রাণপণে কান্না চেপে কিরণ বললেন, ‘দিলীপ পিকনিক করতে গেছিল পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে জয়নগরে, সেখানে পুকুরে ডুবে মারা গেছে, দশ দিন আগে।’
শুনেই পুলিনের মাথা থেকে সব রক্ত বুকে নেমে এসে জমাট বেঁধে গেল। মাথাটা খালি, দৃষ্টি ঝাপসা, জিভ আড়ষ্ট, কানেও কোনো শব্দ ঢুকছে না। মুখ দিয়ে আর্তনাদের মতো ‘আহহ’ ছাড়া আর কোনো শব্দ বেরোল না।
‘শোনামাত্রই ওনার স্ট্রোক হয়, এখন একটু ভালো।’ কিরণ অসহায় চোখে পুলিনের দিকে তাকিয়ে রইলেন। একটা ভয়ংকর বিপর্যয় এই পরিবারের উপর নেমে এসেছে সম্পূর্ণ আচমকা। এখন দুটো ট্রানজিস্টার বিক্রির কথা হাসিহাসি মুখে বলা যায় না। সে বিছানায় শোয়া দুর্গাশঙ্করের পাশে গিয়ে তার হাত মুঠোয় ধরে বসে থাকে। দুর্গাশঙ্কর ক্ষীণস্বরে বলে যান, ‘সাঁতার জানত না তবু বন্ধু ডুবে যাচ্ছে দেখে জলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কেন যে অমন বোকামি করতে গেল। পুলিন আমি বড়ো একা হয়ে গেলুম। কত আশা ছিল ওর ওপর। নিজে ডুবল আমাকেও ডুবিয়ে দিয়ে গেল।’ দুর্গাশঙ্করের চোখের জল গড়িয়ে নামল কানের পাশ দিয়ে।
দুর্গাশঙ্কর এর পর কয়েকদিন মাত্র দোকানে গেছেন মেরামতির জন্য নেওয়া ঘড়িগুলো খদ্দেরদের ফেরত দিতে। নতুন একটিও কাজ আর নেননি। কাজ করার ইচ্ছা এবং সামর্থ্য তিনি হারিয়ে ফেলেন, দোকান বন্ধ হয়ে থাকে। তিনি নিজেই একদিন বিছানায় শুয়ে জিজ্ঞাসা করেন পুলিনকে ‘তোমার রেডিয়ো তৈরির ব্যবসার কতদূর? শুরু করেছ?’
পুলিন বলেছিল, ‘করব তো ভেবে রেখেছি, প্রথমে দরকার একটা ঘর। তৈরি করে প্রথমে লোককে দেখাতে হবে জানাতে হবে। কাগজে বিজ্ঞাপন দিতে অনেক খরচ। মালপত্র কেনা, কারিগর রাখা, দোকান সাজানো এসবের জন্য হাজার পঞ্চাশ টাকা নিয়ে না নামলে শুরু করা যাবে না। বাবা দেবে তিরিশ হাজার, ভাবছি ওই দিয়েই শুরু করব।’
শুনে দুর্গাশঙ্কর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কী যেন ভেবে নিয়ে বললেন, ‘তুমি কাল সকলের দিকে একবার আসতে পারবে?’
পুলিন পরদিন সকাল দশটায় যায়। দুর্গাশঙ্করের খাটের পাশে দাঁড়িয়ে কিরণ, ভারতীকে দেখতে পেল না সে। ধীর স্বরে থেমে থেমে দুর্গাশঙ্কর বললেন, ‘আমার শরীর খুব ভালো নয় পুলিন, যেকোনো সময় যেকোনো দিন আমার আয়ু শেষ হয়ে যেতে পারে, তার নোটিশ যমরাজ আমায় ধরিয়ে দিয়েছে।’ তিনি স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করলেন। কিরণের মুখে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। শক্ত মনের মানুষ। ভবিষ্যৎকে মেনে নিয়েছেন, ভেঙে পড়েননি।
পুলিন বিচলিত হল দুর্গাশঙ্করের কথায়। বাঁ—হাতের মুঠোয় ওঁর হাতটা ধরে সে বলল, ‘এসব কথা থাক কাকাবাবু, আপনি এখনও অনেকদিন বাঁচবেন।’
ম্লান হেসে দুর্গাশঙ্কর বলেন, ‘তোমার কাকিমাও তাই বলেছে। কিন্তু আমি তো বুঝি যার একটা স্ট্রোক হয়ে গেছে আর একটা যেকোনো দিন হতে পারে। ভয়ে ভয়ে সারাক্ষণ থাকার মতো কষ্টকর আর কিছু হতে পারে না।’
‘ভয়টাকে ভুলে থাকার চেষ্টা করলেই তো পারেন।’ কথাটা বলে পুলিনের মনে হয়েছিল খুব বোকার মতো বলা হল। ভয় এমন ব্যাপার যত ভুলে থাকার চেষ্টা করা যায় ততই চেপে বসে। এটা সে ছোটোবেলা থেকে জানে। কাশীনাথ শিশু পুলিনের রাস্তায় বেরিয়ে যাওয়া বন্ধ করতে বলেছিল, একতলার সিঁড়ির পাশের ঘরটায় জটে বুড়ি দুপুরে চুপটি করে একটা থলি নিয়ে বসে থাকে। বাচ্চচাদের একা পেলেই খপ করে ধরে থলিতে পুরে নেয়। তার পর মাঝ রাত্তিরে কেটে টুকরো করে কালিয়া রেঁধে খায়, খবরদার দুপুরে নীচে নামবে না। পুলিন এখনও সিঁড়ির পাশের ঘরের সামনে দিয়ে যাবার সময় একবার ঘরটার দিকে তাকায়।
দুর্গাশঙ্কর তারপর বলেন, ‘ভুলে থাকার জন্যই তো বাবা তোমাকে আজ আসতে বললুম। আমার দোকানটা দু—মাস বন্ধ রয়েছে। আর কোনোদিন খুলতে পারব বলে মনে হয় না। এদিকে ভারতীও বেশ বড়ো হয়েছে। ওর বিয়ের কথাও ভাবতে হচ্ছে।’
স্থির দৃষ্টিতে পুলিনের মুখের দিকে তাকিয়ে দুর্গাশঙ্কর। অস্বস্তি বোধ করে সে চোখ সরিয়ে নিতেই দেখল কিরণও তার মুখের দিকে তাকিয়ে। অবশেষে কিরণই কোনো ভণিতা না করে সহজভাবে বললেন, ‘দোকানটা যৌতুক দেব যদি ভারতীকে বিয়ে করো।’
পুলিনের কানে ‘যদি’ শব্দটা খচ করে লাগল। একটা দোকান করার মতো জায়গা সে খুঁজছে। যে জায়গায় ‘ভারতী ওয়াচ’ সেখানে দোকান পাওয়া সে স্বপ্নেও ভাবতে সাহস পায়নি। ভারতীকে তার ভালো লাগে ঠিকই, কিন্তু সেটা হৃদয়ের উপরের স্তর ছুঁয়ে, ভালো লাগাটা কামনার স্তর পর্যন্ত এখনও পৌঁছায়নি। দোকান ঘর এবং ভারতী এই দুয়ের প্রভাবে তার মনের মধ্যে এখন যে এলোমেলো অবস্থা তৈরি হল ‘যদি’ শব্দটা তার ফলে চাপা পড়ে গেল।
‘এ ব্যাপারে আমি আপনাদের কোনো কথা দিতে পারব না, আমার বাবাকে বলুন।’ নম্রস্বরে পুলিন জানায়।
‘তা তো বলবই’, দুর্গাশঙ্কর বলেন, ‘তার আগে তোমার মতটা জানা দরকার। ভারতীকে তোমার কেমন লাগে, পছন্দ হয়?’
মুখ নামিয়ে পুলিন অস্ফুটে বলেছিল, ‘হ্যাঁ।’ আড়চেখে দেখে দু—জনের মুখে স্বস্তির ছায়া পড়ল।
সন্ধ্যায় ছেলের তৈরি ট্রানজিস্টারে খবর শুনছিল কাশীনাথ। বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল পুলিন। খবর শেষ হতে সে ঘরে ঢুকল। রেডিয়ো বন্ধ করে কাশীনাথ বলল, ‘আওয়াজ বেশ পরিষ্কার আসছে।’
‘বন্ধ করলে কেন। এরপর তো গান হবে, শুনবে না?’
‘ব্যাটারি খরচ হবে।’ এক কথায় কাশীনাথ জানিয়ে দিল গান শোনার থেকে টাকার সাশ্রয়ে তার সুখ বেশি।
ইতস্তত করে পুলিন বলল, ‘দিলীপের বাবা আজ একটা কথা বললেন, দোকানটা আর তিনি রাখবেন না। ছেলে মারা যাওয়ার পর থেকেই, একদম ভেঙে পড়েছেন, কাজ করার ক্ষমতাও আর নেই। মনে হয় না বেশিদিন বাঁচবেন।’
ছেলের বন্ধুর বাবার বাঁচা—মরা নিয়ে কাশীনাথ সমবেদনা জানাতে একটি কথাও খরচ না করে উৎসুক হয়ে জানতে চাইল, ‘দোকানটা তাহলে কী করবে, বেচে দেবে?’
‘ওটা আমাকে দিয়ে যেতে চান,’ বলেই পুলিন বাবার মুখে কীরকম ভাবান্তর ঘটে দেখার জন্য তাকাল। কাশীনাথ বিমূঢ়। ঠোঁট দুটো ফাঁক হয়ে গেল। স্ত্রী মারা যেতে যে ধাক্কা লেগেছিল তার অন্তরে এটা যেন তার থেকেও বেশি। গলার কণ্ঠা দু—তিনবার নড়ে উঠল। বিশ্বাস করতে পারছে না চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের উপর অমন ব্যবসার জায়গায় দোকানটা দিয়ে দেবে ছেলের বন্ধুকে, তাই কখনো হয়!
‘তুই ঠিক বলছিস? লোকটা নিজে তোকে বলেছে?’
‘হ্যাঁ, আমাকে বলেছেন আজ সকালেই।’
‘অমনি অমনি দিয়ে দেবে? কিছু নেবেটেবে না?’
পুলিন চুপ রইল। বলতে অস্বস্তি হচ্ছে, শুনলেই বাবা যদি ‘না’ বলে দেয়!
‘কীরে টাকার অ্যামাউন্টটা কত?’
‘টাকা চাননি।’
‘তবে?’
‘মেয়ের বিয়ে দিতে চান।’
‘তোর সঙ্গে?’
পুলিন মুখ নামিয়ে নিরুত্তর। কাশীনাথ ‘হুমম’ শব্দ করে চিন্তায় ডুবে গেল। পুলিন একটু একটু করে আশার আলো দেখতে থাকল। বাবা এককথায় নাকচ করেনি।
‘খুঁতো মেয়ে?’
‘না।’
‘কানা—খোঁড়া, বোবা—কালা নয়তো?’
‘না।’
‘দেখতে শুনতে কেমন? তোর সঙ্গে আলাপ—সালাপ কত দিনের?’
পুলিন ফাঁপরে পড়ল। ‘আলাপ—সালাপ’ বলতে বাবা কী বোঝাতে চায় সেটা সে আন্দাজ করে হুঁশিয়ার হয়ে গেল। ‘কত দিনের’ শব্দটাই ভয়াবহ। ছেলে কত বছর হল বখেছে বাবা এটাই জেনে নিতে চাইছে।
‘দু—তিনবার দেখেছি। রং ফরসা তবে একটু বেঁটে। মাধ্যমিক পাশ।’
‘কত ফরসা, তোর মায়ের থেকেও?’
কাশীনাথ ঘোর কৃষ্ণবর্ণ এবং গৌরবর্ণের প্রতি প্রবলভাবে দুর্বল আর সেই কারণেই আটটি পাত্রী নাকচ করে ধবধবে রঙের একটি সুন্দরী গরিব নিরক্ষর মেয়েকে বিয়ে করে ঘরে আনে নিজে খরচ দিয়ে। কাশীনাথের বাবা—মাও ছিলেন কালো। এবার তার বংশ ফরসা রঙের হবে এই আশা নিয়ে স্ত্রীকে গর্ভবতী করে হৃৎপিণ্ড গলার কাছে তুলে এনে অপেক্ষা করছিল কয়েকটা মাস। পুলিন মায়ের রং আর মুখশ্রী পাওয়ায় কাশীনাথ গুহ ভবনের পাঁচটি ফ্ল্যাটের এবং একতলার দোকানের কর্মচারীদের টেবল পেতে ছাদে খাওয়ায় ছেলের অন্নপ্রাশনে। দ্বিতীয় সন্তান অবধারিত বাবার রং পাবে এই বদ্ধমূল ধারণায় সে দ্বিতীয়বার পিতা হয়নি।
‘মায়ের মতো অতটা নয় তবে গৌরবর্ণ।’ পুলিন এই বলে আতঙ্কিত চোখে তাকায়। কাশীনাথ একটি ‘হুমম’ দিয়ে চিন্তাগ্রস্ত হয় পড়ে। কয়েক সেকেন্ড পর সে বলে, ‘বিয়ের পরে না আগে দোকানটা লেখাপড়া করে দেবে?’
‘সেটা তুমিই জিজ্ঞেস করে নিয়ো।’
‘তুই ওনাকে এসে দেখা করতে বল।’
পুলিন রিকশায় করে নিয়ে আসে দুর্গাশঙ্করকে। তিনতলায় উঠতে তিনি দু—বার সিঁড়িতে জিরোন। কাশীনাথ ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে হাতজোড় করে ‘আসুন আসুন’ বলে দুর্গাশঙ্করকে হাত ধরে নিয়ে ঘরের একমাত্র চেয়ারটিতে বসায়। পুলিন অবাক হয়ে গেছিল বাবার অমায়িক আচরণে ও কথায়, এক ঘণ্টা আগে সে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল দুর্গাশঙ্করকে নিয়ে আসতে। দেখে গিয়েছিল ময়লা গেঞ্জি আর পাজামা পরা, গালে পাঁচ দিনের দাড়ি, চুলও সেই রকম। এখন একেবারে অন্য চেহারা। ধবধবে পাঞ্জাবি আর পাজামা, কামানো চকচকে গাল, পাট করে আঁচড়ানো চুল, নতুন চেহারার এক কাশীনাথ! হবু বেয়াইয়ের সামনে নিজেকে পরিচ্ছন্ন মার্জিত সজ্জন সদালাপী প্রমাণ করার জন্য ভোল পালটে ফেলেছে এক ঘণ্টার মধ্যেই। পুলিন বুঝল বাবা ইতিমধ্যেই নীচের চুলকাটার সেলুনে গিয়ে দাড়ি কামিয়ে এসেছে, বেড কভারটা বদলে দিয়েছে, বালিশের ওয়াড় ময়লা ছিল, বালিশগুলোই পাশের ঘরে চালান হয়ে গেছে।
‘ছেলের কাছে সব শুনেছেন নিশ্চয়।’ দুর্গাশঙ্কর কথা শুরু করেছিলেন নম্র বিনীত ভাবে। হাত জোড় করে প্রার্থীর মতো বলেন, ‘আমার একমাত্র মেয়েটিকে দয়া করে আপনার পুত্রবধূরূপে গ্রহণ করে আমাকে যদি উদ্ধার করেন এই আশা নিয়েই এসেছি।’
কাশীনাথ দু—হাতে দুর্গাশঙ্করের মুঠো ধরে ব্যস্ত হয়ে বলে, ‘আরে আরে এ তো আমার সৌভাগ্য। দুর্গার কন্যা মা লক্ষ্মী আমার ঘরে আসবে আমি তো ভাবতেই পারছি না। আমিই তো উদ্ধার হব।’
পুলিন তখন ভাবল, বাবা এমনভাবে কথা বলা শিখল কবে, পুরোটাই তো অভিনয়! ছেলে একটা দোকান পাবে এটাই তো ওর একমাত্র স্বার্থ এই বিয়েতে রাজি হওয়ার পিছনে।
‘আমি খুব গরিব—।’
দুর্গাশঙ্করকে থামিয়ে কাশীনাথ বলে ওঠে, ‘আহাহাহা, গরিব বড়োলোকের কথা আসছে কেন। আমার কোনো দাবি নেই, যা দেবেন পুলিনকেই দেবেন। আমি শুধু একবারটি মা লক্ষ্মীকে দেখে আসব।’
মেয়ে দেখতে কাশীনাথ গিয়েছিল। চল্লিশ মিনিট ছিল। পুলিন সঙ্গে যায়নি। ফিরে এসে কাশীনাথ বলে, ‘লোকটা ভদ্দরলোক, দোকানটা বিয়ের আগেই লিখে দেবে বলেছে। বুদ্ধিমতী মেয়ে। ক—টা কথা জিজ্ঞেস করলুম, দু—একটা উত্তরে ধোঁকা দিল। সংসার চালাতে এমন মেয়েই দরকার। রংটা ফরসা কিন্তু তোর মায়ের মতো অতটা নয়। বিয়ের দিন ঠিক করে এলুম সামনের ফাল্গুনে।’
বিয়ের দু—সপ্তাহ পর রাতে বিছানায় এটা সেটা গল্প করতে করতে ভারতীকে জিজ্ঞাসা করেছিল পুলিন, ‘বাবা কী বলেছিল তোমাকে দেখতে গিয়ে?’
‘বিশেষ কিছু নয়। প্রথমেই বললেন শাশুড়ি, ননদ, দেওর পাবে না, একা সংসার করতে হবে, পারবে? রান্না জানো? আমি ঘাড় নাড়লুম। তারপর, সিনেমা দ্যাখো? বললুম, না। গান শোনো? বললুম, হ্যাঁ। কী গান? বললুম কীর্তন আর শ্যামাসংগীত। হাসি হাসি মুখ দেখে বুঝলুম আশি নম্বর পেয়ে গেছি। তার পর বললেন, দুর্যোধনের বোনের নাম কী? বললুম দুঃশলা। তার পর, বিকর্ণ কর্ণের কে হন? বললুম কেউ না, দুর্যোধনের ভাই ছিলেন বিকর্ণ। ব্যাস আর কিছু জিজ্ঞাসা করেননি।’
‘তাই বাবা বলেছিল বুদ্ধিমতী মেয়ে! সিনেমা দেখি না, কীর্তন শ্যামাসংগীত শুনি, তুমি কি ভেবেছ বাবা ওসব বিশ্বাস করেছে? মোটেই নয়। অত ভালো মেয়ে সাজতে গেলে কেন?’
‘ওর ঠেঁটো ধুতি—পাঞ্জাবি, কাঁধের উড়ুনি আর খোঁচা খোঁচা চুল দেখে মনে হল সেকেলে লোক। যে উত্তর পেলে খুশি হবেন তাই বলছি।’
‘বাবা কিন্তু ঠিক ধরে ফেলেছে। আমাকে সেদিনই বলেছিল ধোঁকা দিয়ে মিথ্যে উত্তর দিয়েছে, বুদ্ধিমতী মেয়ে। সাবধানে থেকো। পরে কোনোদিন এটা নিয়ে তোমাকে খোঁটা দেবে।’
.
তিরিশ বছর পর সেদিনের সেই রাতের মতো বিছানায় শুয়ে পুলিনের মনে পড়ল ভারতীকে সে বলেছিল পরে কোনোদিন বাবা খোঁটা দেবে। ‘কুচুটে বুদ্ধি’ কথাটা সেই খোঁটাই। আসলে খাট বিক্রি করে দেওয়ার কথাটা তার মুখ থেকেই প্রথমে বেরোয়। ভারতী তাতে সায় দিয়েছিল মাত্র। ওকে কুচুটে বলায় সেও মনে আঘাত পায়।
ভারতী পাশ ফিরে বলল, ‘রাতে শোয়ার সমস্যাটা তো শুধু আমাদের একার নয়, এ পাড়ায় অল্পবিস্তর সব ঘরেই রয়েছে। নীচের উমাদেরই কথা ধরো না! স্বামী—স্ত্রী, তিন ছেলে এক মেয়ে। ওরা রাতে কী করে শোয়? ওই যে সামনের একুশ নম্বর বাড়ি ওখানে একতলা দোতলায় তো চার ঘর ভাড়াটে, চারটে পরিবার থাকে চারটে ঘর নিয়ে। কী করে থাকে?’
‘ওপরের প্রণববাবু, আমাদের পাশের মজুমদাররা এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত। দু—জনেরই একটি করে মেয়ে। বিয়ে হলে শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে। তখন বাবা—মা হাত—পা ছড়িয়ে দুটো ঘরে থাকবে। অনি যদি মেয়ে হত তা হলে আমাদের এমন ঝঞ্ঝাটে পড়তে হত না।’
ক্ষীণ একটা আপশোস পুলিনের গলায় পেয়ে ভারতী বলল, ‘ছেলেরা রোজগার করে বাপ—মাকে খাওয়ায়। মেয়ে রোজগেরে হলেও তাকে তো শ্বশুরবাড়ি যেতে হবে। টাকা তো তখন আর বাপের বাড়িতে দেবে না। অনি যাকে বিয়ে করছে সেও তো চাকরি করে, সে কি মাইনের টাকা বাড়িতে দিয়ে আসবে?’
‘মেয়ে যে শ্বশুরবাড়ি যাবেই এটা ধরে নিচ্ছ কেন? অনেক ছেলে ভাগনে—ভাগনি ভাইপো— ভাইঝিদের মানুষ করার জন্য যেমন আইবুড়ো থেকে যায় আজীবন তেমনি অনেক চাকুরে মেয়েও বিয়ে না করে বাপের সংসার টানে যতদিন না কোনো ভাই কি বোন রোজগার শুরু করছে।’
কৌতূহলে টান হয়ে ভারতী জিজ্ঞেস করল, ‘তার পর সে কী করে?’
হাই তুলে পুলিন বলল, ‘যদি প্রেমিকট্রেমিক থাকে তখন তাকে বিয়ে করে, নয়তো পলিটিক্স করে কিংবা কোনো গুরুর কাছে দীক্ষা নেয়। তোমাকে তো বলেছিলুম ব্রতীনের কথা, বতু বিয়ে করল আটচল্লিশ বছর বয়সে, রেখার বয়স তখন পঁয়তাল্লিশ। বোন নার্সিংয়ের চাকরি পেল, ভাই একটা প্রাইভেট ফার্মে ঢুকল তারপর ওরা রেজিস্ট্রি করল। ব্রতীন আঠারো বছর অপেক্ষা করেছিল। একেই বলে প্রেম।’ পুলিন পাশ ফিরে ভারতীকে একহাতে জড়িয়ে ধরে কথা শেষ করল, ‘তুমি বিয়ের আঠারো মাসের মধ্যেই আমাকে ভুলে গেছিলে।’
ভারতী পুলিনের দিকে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে বলল, ‘গেছিলুমই তো।’ পাছার উপরে ব্যস্ত পুলিনের হাতটা আঁকড়ে ধরে আবার বলল, ‘জ্বালাতন করলে আঠারো মিনিটেই ভুলে যাব।’
‘আঠারো মিনিট নয়। আট মিনিটের বেশি লাগবে না, তারপর আমাকে ভুলে যেতে হয় যেয়ো। তোমাকে তখন কী দারুণ দেখাচ্ছিল যখন বাবাকে বললে আপনি তো পারেননি ছেলেকে তৈরি করতে, আমরা পেরেছি। সারা মুখে কি তেজ, চোখ দিয়ে আগুন ঠিকরোচ্ছে, নাকের পাটা ফুলে উঠেছে যেন মা দুগ্গা মহিষাসুর বধ করছে!’
‘এখন মায়ের নাম মুখে এনো না, পাপ হবে।’
অন্যদের রাতে শোয়ার সমস্যাটা জানতে ভারতী পরের দিন দোতলায় উমাদের ফ্ল্যাটের কলিংবেল বাজাল। দরজা খুললেন উমার মা জয়ন্তী। ভারতীকে দেখেই অবাক এবং সাদর আহ্বান, ‘আসুন, ভেতরে আসুন। কতকাল পরে দেখা পেলুম। সেই সাত—আট মাস আগে সিঁড়িতে একবার দেখা হয়েছিল তারপর এই।’
‘আমি তো বছরে তিন—চারবার বেরোই। দেখা হবে কী করে। আপনি তো রোজ টিউশনিতে বেরোন, বেশ আছেন। মাঝে মাঝে কষ্ট করে ক—টা সিঁড়ি ভেঙে ওপরে এলেই তো পারেন।’ বলতে বলতে ভারতী ভিতরে ঢুকে এল। তার হাতে পুলিনের একটা পাঞ্জাবি। সেটা তুলে দেখিয়ে বলল, ‘কী মুশকিলে পড়ে গেছি ভাই, বিকেলে উনি বেরোবেন, লন্ড্রি থেকে কাচিয়ে আনা পাঞ্জাবিটা বার করে দেখি দুটো বোতাম ভাঙা, ছুঁচ সুতোর বাক্স খুলে দেখি একটাও বোতাম নেই। দোকান থেকেও যে এনে দেবে এমন কেউ নেই। উনি বেরিয়েছেন ফেরার ঠিক নেই, আর আমার শ্বশুরকে তো জানেনই।’ বাকিটা আর বলার দরকার মনে করল না ভারতী, জয়ন্তী শুধু হাসল।
‘আপনার দুটো বোতাম দরকার এই তো, বসুন, দেখছি আছে কি না।’
বসার জন্য ভারতী নিজেই ঘরে ঢুকল। এটা কাশীনাথের ঠিক নীচের ঘর। ঘরে খাট তক্তপোশ নেই, শুধু বই খাতায় ভরা একটা টেবল আর স্টিলের দুটো ফোল্ডিং চেয়ার। দেওয়ালে সাঁটা আলনা থেকে ঝুলছে শার্ট—প্যান্ট, পাজামা, লুঙ্গি। পরিপাটি ভাঁজ করা ঘরের একধারে গোটানো তোষক আর বালিশ। ভারতী বুঝে গেল তিন ভাই এখানে রাতে শোয়। বাবা—মা—মেয়ে শোয় পাশের ঘরে। একসঙ্গে? কিন্তু খাটটা তো অতবড়ো নয়! একজন তাহলে মেজেয় শোয়। কে? একটা প্লাস্টিকের বাক্স হাতে নিয়ে জয়ন্তী পাশের ঘর থেকে এলেন।
‘আপনার দুটো বোতামের একটা পেয়েছি আর একটা—’ জয়ন্তী আলনায় ঝোলানো শার্টগুলোর কাছে গিয়ে নেড়েচেড়ে দেখে বললেন, ‘নাঃ বোতামগুলো বড়ো বড়ো। আচ্ছা বসুন ওনার পাঞ্জাবিটা দেখি।’
‘না না না আপনি অত ব্যস্ত হবেন না।’ বলতে বলতে ভারতী জয়ন্তীকে অনুসরণ করে পাশের ঘরে ঢুকল। দেওয়াল থেকে হ্যাঙ্গার সমেত পাঞ্জাবি তিনি নামিয়ে ফেলেছেন।
‘গলার কাছের বোতামটা কখনো ওনাকে লাগাতে দেখিনি। এখন আপনি নিয়ে যান। কালকেই কিনে এনে আমি লাগিয়ে দেব।’ জয়ন্তী ছোট্ট কাঁচি দিয়ে বোতামের সুতো কাটতে শুরু করলেন। ভারতী আর আপত্তি করল না। একনজরে সে দেখে নিল ঘরটা। উমার বাবা সামান্য চাকরি করেন এক বিলিতি ওষুধ কোম্পানির গোডাউনে। অসচ্ছল পরিবার। ঘরের সবকিছুই বিবর্ণ, পালিশচটা, কিন্তু গুছিয়ে রাখা। খাটের নীচে তাকিয়ে যা দেখবে ভেবেছিল সেটি নেই—শতরঞ্চিতে মোড়া গোটানো তোষক। ভারতীর ভ্রু কুঁচকে উঠল।
‘শুনলাম অনীশের নাকি বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।’ জয়ন্তী বললেন, স্বরে কোনো ঔৎসুক্য নেই।
‘মোটামুটি ঠিক। রোববার মেয়ের বাড়ির লোক আসবে পাকা কথা বলতে।’ ভারতী সংযত গলায় বলল।
অনির বিয়ের জন্য কথা হচ্ছে এ খবর দোতলা পেল কী করে? তারা তিনজন আর অনি ছাড়া আর কারোর তো জানার কথা নয়!
ভারতী ভাবতে শুরু করল। নিজেকে আর শ্বশুরকে শুরুতেই বাদ দিল। উনি হয়তো নীচের দোকানদারদের কাউকে বলে থাকতে পারেন। অনি সকালে বেরিয়ে রাতে ফেরে। এ বাড়ির কারোর সঙ্গে তার দেখা হয় না।
‘অনীশ বিয়ের পর এ বাড়িতেই থাকবে?’ জয়ন্তীর গলায় এবার সামান্য কৌতূহল।
‘এখানে থাকবে না তো যাবে কোথায়?’ ভারতী যথাসম্ভব বিস্মিত হল।
‘বিয়ে মানে তো একজন লোক বাড়া, ওদের জন্য আলাদা ঘরও চাই। তাই বলছিলুম অনীশ এখন অনেক টাকার চাকরি করে, হয়তো বড়ো ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে অন্য কোথাও থাকবে।’
‘থাকতে চায় যদি থাকবে, কী আর করা যাবে। যাদের ছেলে আছে ঘর কম তাদেরই এই সমস্যায় পড়তে হবে। আপনাকেও কি পড়তে হচ্ছে না? তিন ছেলে এক মেয়ে আপনারা দু—জন, রাতে শোন কীভাবে?’
ভারতী উত্তরের জন্য তাকিয়ে রইল। প্রশ্নটা কথার পিঠে স্বাভাবিক করতে পেরে সে স্বস্তি পেয়েছে। জয়ন্তীকে বিচলিত দেখাল না।
‘রমু ওর বন্ধুর সঙ্গে পড়াশোনা করে রাতে ওদের বৈঠকখানাতেই শোয়। আর বাচ্চচু আমাদের পাড়ার নবজীবন সংঘের ক্লাব ঘরে শোয়, পাহারার কাজটাও হয়। ও ঘরে উমার বাবা আর তপু। এঘরে আমি আর উমা। তবে ছেলেদের বলে দিয়েছি বড়ো হয়ে বিয়েথা যখন করবে তখন কিন্তু আলাদা হয়ে সংসার পাতবে। এখানে একসঙ্গে থাকা চলবে না।’
.
যা জানার তা জানা হয়ে গেছে। ভারতী উঠে দাঁড়াল, ‘যাই, এখন গিয়ে পাঞ্জাবিতে লাগাই। কালকেই আমি বোতাম দিয়ে যাব।’.
‘একদম নয়। এই সামান্য জিনিস কেউ ফেরত নেয় না ফেরত দেয়ও না। আপনি ফেরত দিলে কিন্তু আমি লজ্জা পাব।’
ভারতী হাসিমুখে ফিরে এল। শোয়ার সমস্যা এরা যেভাবে সমাধান করেছে তাদের পক্ষে সেভাবে সম্ভব নয়। একুশ নম্বর বাড়ির ভাড়াটেরা কী করে সেটা পুলিনকে দিয়ে খোঁজ করাতে হবে। সন্ধ্যাবেলায় সে রান্নাঘরে পুলিনকে ডেকে দোতলায় যা দেখে আর শুনে এসেছে তা জানিয়ে বলল, ‘একুশ নম্বরের চণ্ডীবাবু তো তোমার খুব চেনা, ওকে একবার জিজ্ঞেস করে দেখো না।’
পুলিন তখনই বেরিয়ে গেল চণ্ডীবাবুকে ধরতে। একটু পরেই অফিস থেকে ফিরল অনীশ। হাতে একটা পলিথিনের ব্যাগ, তাতে দোকানের নাম ছাপা। ভারতী একটু অবাক হয়েই বলল, ‘আজ যে এত তাড়াতাড়ি!’
কিছুদিন হল অনীশ অফিসের ছুটির পর টালিগঞ্জে বলাকাদের বাড়ি ঘুরে শেষ মেট্রোয় বাড়ি ফিরছে।
‘এগুলো কিনতে নিউ মার্কেটে গেছলুম। দ্যাখো তো কেমন হল। দুটো বেডকভার, তোমাদের আর দাদুর খাটের জন্য, রোববার পেতে দিয়ো। পুরোনোগুলোর যা চেহারা হয়েছে। আর ফ্ল্যাটটা একটু পরিষ্কার—পরিচ্ছন্ন করে রেখো, রান্নাঘরটাও। বলাকার মা আসতে পারেন।’
অনীশ স্নান করতে যাওয়ার পর ভারতী বেডকভার দুটো খুলে যখন দেখছে তখন পুলিন ফিরে এল। ভারতী মুগ্ধ চোখে বলল ‘এই দ্যাখো, অনি কিনে আনল। সুন্দর না? ময়ূরগুলো কত বড়ো বড়ো, চার কোণে চারটে হরিণ সঙ্গে বাচ্চচা।’
পুলিন একটা বেডকভার হাতে নিয়ে দুই আঙুল দিয়ে কাপড় ঘষে ভারী গলায় বলল, ‘দামি, দুটো শ—পাঁচেক টাকা তো হবে, আমাদের ঘরে বেমানান, তুলে রাখো এখন, বাবার চোখে যেন না পড়ে। দেখতে পেলে খ্যাচ খ্যাচ করবে টাকার ছেরাদ্দ হচ্ছে বলে।’
অনি কলঘর থেকে বেরিয়ে ওদের দু—জনের পাশ দিয়ে ঘরের দিকে যেতে যেতে বলল, ‘পছন্দ হয়েছে?’
‘খুব সুন্দর।’ ভারতী উচ্ছ্বসিত স্বরে বলল, ‘এত দামি জিনিস কিনতে গেলি কেন?’
‘ওদের দেখাবার জন্য।’
অনীশ ঘরে ঢুকে গেল। পুলিন আর ভারতী পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল বিভ্রান্তের মতো। অনীশ এখন খাটে শুয়ে সকালের দুটো ইংরেজি খবরের কাগজ উলটেপালটে দেখবে, পড়বে। তারপর নীচু স্বরে টেপ রেকর্ডারে চোখ বুজিয়ে কিছুক্ষণ শুনবে কোনো খেয়াল বা ঠুংরি। ততক্ষণ পুলিন ও ভারতী বারান্দায় পাশাপাশি দাঁড়িয়ে বা টুলে চুপ করে বসে থাকবে, কাশীনাথ তার ঘরে তখন টিভি দ্যাখে।
আজ বারান্দায় পুলিনের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে নীচু গলায় ভারতী বলল, ‘চণ্ডীবাবুর কাছে গেছলে?’
পুলিন বলল, ‘গেছলুম। যা দেখলুম আমাদের পক্ষে ওভাবে থাকা সম্ভব নয়। স্বামী—স্ত্রী তিনটে ছেলে। দশ, আট আর চার বছরের। একটা মাত্র শোওয়ার ঘর। রান্নাঘরটা টালির চালের। তক্তপোশটার প্রতি পায়ায় তিনটে ইট। ওর নীচে দুটো ছেলে ঘুমোয়। ছোটটাকে নিয়ে ওরা তক্তায় শোয়। ওভাবে আমরা খাটের নীচে শুতে পারব না।’
‘কেন পারব না! তিনটে ইটের ওপর খাট থাকলে সেটা কী কম উঁচু হবে? হামাগুড়ি দিয়ে ঢোকা যায়।’
‘তুমি বেঁটে, পারবে আমি পারব না।’
‘তুমি হামাগুড়ি দেবে কেন, মেঝেয় শুয়ে একপাক গড়িয়ে গেলেই ঢুকে যাবে। খাটের তলায় বসে তো আর নাম জপ করবে না, শুধু শোবে।’
‘তাহলে বাবাকে গিয়ে তুমি বলো।’
‘আমি! পাগল হয়েছ, সেদিন বললেন কুচুটে বুদ্ধি, এবার বলবেন ডাইনি বুদ্ধি। তার থেকে তুমিই বলে দেখো।’
পুলিন আর কথা না বাড়িয়ে চুপ করে রইল। একটু পরে ভারতী বলল, ‘নীচের উমার মা জিজ্ঞেস করল বিয়ের পর অনি কি এ বাড়িতেই থাকবে, না বড়ো ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে অন্য কোথাও থাকবে?’ গলা আরও নামিয়ে এরপর সে বলল, ‘অন্য কোথাও থাকলে তো ভালোই। তাতে ওরও সুবিধে আমাদেরও সুবিধে।’
‘সুবিধে তো হবেই। ও যে মাপের চাকরি করে তাতে এইরকম বাড়িতে থাকা মানায় না, এতে সম্মান নষ্ট হবে । কত বাইরের লোকজন আসবে তাদের বসাবে কোথায়? যখন ছাত্র ছিল তখন বন্ধুরা এলে দাদুর ঘরে বসাত। বাবা খালি গায়ে লুঙ্গি পরে থাকত। অল্পবয়সি ছেলেরা ওদিকে তাকাতই না। কিন্তু এখন অনির স্ট্যাটাস তো অন্যরকম। ওর নিজেরই উচিত সল্টলেক ফল্ট লেকের দিকে ফ্ল্যাট ভাড়া করে চলে যাওয়া। নিশ্চয় ও ব্যাপারটা নিয়ে আমাদের আগেই ভেবেছে তবু ওকে একবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে জিজ্ঞেস কোরো।’
যতটা সম্ভব গলা চেপে ভারতী ঝেঁঝেঁ উঠে বলল, ‘সবসময় তুমি বলো তুমি জিজ্ঞেস করো, তোমার এই কুঁকড়ে পিছিয়ে যাওয়া স্বভাবের জন্যই ব্যবসাটা লাটে ওঠে। সেই সময় থেকেই বাবা আমাদের সঙ্গে শেয়াল কুকুরের মতো ব্যবহার শুরু করেন। ওনাকে দোষ দোব কী, কষ্ট করে রোজগারের অতগুলো টাকা যদি নর্দমা দিয়ে চলে যায় তাহলে দাগা পাবেন না? তিন ঘরের কো—অপারেটিভ ফ্ল্যাট পেয়েও পেলেন না, সেই দুঃখ কী কোনোদিন ভুলতে পারবেন?’
গলায় উঠে আসা বাষ্প চাপতে চাপতে ভারতী থেমে গেল। পুলিন অপ্রতিভ। ছাব্বিশটা বছর কেটে যাওয়ার পর, ট্রানজিসটার তৈরি করে ব্যবসায়ী হবার উচ্চচাকাঙ্ক্ষা ধুলোয় লুটিয়ে পড়ার পর, ভারতী তাকে ধিক্কার দিল। এতগুলো বছর তাহলে সে মনে মনে স্বামীকে কী চোখে দেখেছে, কত অশ্রদ্ধা করেছে? বারান্দার পাঁচিল আঁকড়ে পুলিন ভিতরে ভিতরে ধসে পড়তে লাগল। কথাগুলো এতকাল না বলে পুষে রেখেছিল কেন, সম্পর্কটা সুন্দরভাবে ধরে রাখার জন্য? আর ক—টা বছরই বা বাঁচব! ততদিন কি ভারতী তার ক্ষোভ, রাগ ধরে রাখতে পারত না।
আড়চোখে পুলিন তাকাল। রাস্তার আলো আবছা হয়ে লেগে রয়েছে ভারতীয় মুখে, শক্ত হয়ে রয়েছে চোয়াল, এক দৃষ্টে সামনে তাকিয়ে। একটি কথাও না বলে পুলিন ঘরের ভিতরে এল। অনীশ তার পায়ের শব্দ চোখ খুলে দেখে নিয়েই চোখ বন্ধ করল।
‘অনি একটা কথা ছিল।’
অনীশ এবার পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। এমন গম্ভীর ব্যক্তিত্বপূর্ণ স্বর বাবার গলা দিয়ে বেরোতে পারে তার ধারণায় ছিল না।
‘বলো।’
‘তোর বিয়ে হলে আমি আর তোর মা শোব কোথায় সেটা ভেবেছিস?’
অনীশ আবার চোখ বন্ধ করে পাঁচ সেকেন্ড পর খুলে বলল, ‘তুমি ভেবেছ?’
ফাঁপরে পড়ল পুলিন, তারা যা ভেবেছে সেটা বলা যায় না। নিজেকে কঠিন করে নিয়ে বলল, ‘কোথায় একটা ফ্ল্যাট নিয়ে যদি থাকিস তাহলে সবারই সুবিধে হয়।’
‘এটা কি মায়েরও ইচ্ছে?’
‘হ্যাঁ, ওরও।’
‘এখন ডিসেন্ট একটা ফ্ল্যাটের ভাড়া কত জানো?’
পুলিন জানে না। ইতস্তত করে বলল, ‘কত?’
‘একটু ভালো জায়গায় পাঁচ হাজার টাকা, আটশো স্কোয়ার ফুট সাইজটা আমাদের এই ফ্ল্যাটের মতো, তাও কলকাতার কিনারে ভি আই পি, সন্তাোষপুর, বেহালার মতো জায়গায়। বলাকার অসুবিধে হবে শ্যামনগর যাতায়াতে।’
‘তোর কোম্পানি তোকে দেবে না?’
‘এখন নয়, আর এক ধাপ উঠলে পাব।’
‘কবে উঠবি?’
অনীশের মুখে বিরক্তি ফুটে উঠল। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘কবে উঠব সেটা জ্যোতিষী বলতে পারবে। এই তো চাকরিতে ঢুকলুম মাস ছয়েকও হয়নি।’
‘তাহলে এখনি বিয়ে করছিস কেন?’
অনীশ উঠে বসল বিছানায়। চোখে দপ করে উঠল রাগ। তীব্র স্বরে বলল, ‘ব্যাপার কী? এভাবে কথা বলছ যে! আমার বিয়ে করায় তোমাদের আপত্তি আছে কিনা সেটা পরিষ্কার করে খুলে বলো।’
পুলিন জানত না কথায় কথায় প্রসঙ্গটা এমন জায়গায় এসে পড়বে। বিপন্ন হয়ে সে বারান্দার দরজার দিকে তাকাল। ভারতী দাঁড়িয়ে।
‘মা তোমাকেও বলছি স্পষ্ট করে বলো বিয়েতে তোমার মত আছে কি নেই?’
‘আছে। তুই বিয়ে করবি আমাদের কোনো অসুবিধে হবে না।’
অনীশ তাকাল তার বাবার দিকে। পুলিন মুখ কালো করে ঘর থেকে দালানে বেরিয়ে এসে খাবারের টেবলের চেয়ারে বসে পড়ল। একটু আগে ভারতীই বলেছিল আমি অন্য কোথাও থাকলে তো ভালোই। ওরও সুবিধে আমাদেরও সুবিধে। অথচ কী নির্বিকারভাবে বলল আমাদের কোনো অসুবিধে হবে না। এভাবে কথা পালটে নিয়ে তার মুখ পুড়িয়ে দেবে এমনটা সে কল্পনাও করতে পারে না। পুলিন দুই মুঠোয় চুল টেনে ধরল। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল টেবলে পড়ে থাকা রঙিন পলিথিন ব্যাগটার দিকে। সে তো চেষ্টা করল কুঁকড়ে পিছিয়ে যাওয়ার স্বভাবটা থেকে নিজেকে বার করে আনতে। আনা হল না। অনি এখন থেকে কী ভাববে তার সম্পর্কে!
তার চটকা ভাঙল ভারতীর কথায়, ‘ঘরে যাও, অনিকে খেতে দোব।’
পুলিন উঠে কাশীনাথের ঘরে ঢুকল। টিভি—তে খবর পড়া হচ্ছে। খাটের একধারে বসে সে তাকিয়ে রইল টিভি—র দিকে। কানে কিছু ঢুকছে না। স্ক্রিনে কালো কালো কিছু মূর্তি নড়ে চড়ে উঠছে। পুলিন স্পষ্টভাবে কিছু দেখতে পাচ্ছে না। খবর শেষ হতেই কাশীনাথ বলল, ‘সুইচটা অফ করে দে।’ কথাটা পুলিনের কানে পৌঁছল না। কাশীনাথ বিরক্ত হয়ে বলল, ‘কীরে কথাটা কানে গেল? টিভি বন্ধ করে দে।’ পুলিন উঠে গিয়ে বন্ধ করল। ‘হল কী তোর?’ কাশীনাথ অবাক হয়ে বলল।
‘কিছু না।’ কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে পুলিন বলল, ‘আচ্ছা বাবা, আমাকে ব্যবসার জন্য টাকাটা না দিলে আজ তুমি বেলঘরিয়ায় তিন ঘরের একটা ফ্ল্যাটে থাকতে, এর থেকে ভালোভাবে থাকতে, ঠিক কিনা।’
‘ভালোভাবে থাকতুমই তো।’
‘তাহলে আমাকে শেয়াল—কুকুর ভাবতে না, মনের শান্তি নিয়ে আজ থাকতে।’
কাশীনাথ যেন ধাঁধায় পড়ে গেল। সেইভাবে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইল। বাবার দৃষ্টি অগ্রাহ্য করে পুলিন বলল, ‘তোমার মনের শান্তি আমি নষ্ট করেছি আমার অযোগ্যতা দিয়ে।’
‘হঠাৎ এসব কথা বলছিস কেন?’
‘বলছি না, স্বীকার করছি, ছাব্বিশ বছর পর মনটাকে হালকা করলুম।’
‘এভাবে দুম করে আমি অযোগ্য বললেই কি মন হালকা হয়ে যায়? দেখবি ওই হালকা জায়গাটার আবার একটা ওজন বসে গেছে। দাঁড়িপাল্লায় পাষাণ ফেরানোর জন্য যেমন দু—দিকে সমান সমান ওজন চাপাতে হয় তেমনি মনটাকে ঠিক রাখতে শান্তি আর অশান্তি দুটোই সমানভাবে চাই।’
পুলিন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে দেখে কাশীনাথ আবার বলল, ‘বুঝতে পারলি না?’
পুলিন মাথা নেড়ে বলল, ‘খানিকটা বুঝেছি।’
‘বয়স আর একটু বাড়ুক পুরোটা বুঝতে পারবি।’
অনীশ ঘরে ঢুকল, এবার সে ফোল্ডিং খাটটা পাতবে। পুলিন তার মুখের দিকে না তাকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
পুলিনের খিদে নষ্ট হয়ে গেছে। একটা রুটি কোনোরকমে খেয়ে সে ঘরে এসে আলো নিবিয়ে খাটে শুয়ে পড়ল দেওয়ালের দিকে মুখ করে। বাইরে খাওয়ার টেবলে ভারতী। পুলিনের চোখে ঘুম নেমে আসছে। দালানে চেয়ার সরাবার, রান্নাঘরে বাসন রাখার শব্দ সে শুনল। টের পেল ভারতী ঘরে ঢুকল, আলো জ্বেলে নেবাল। বিছানায় তার পাশে শুয়ে পড়ল। অন্যদিন বাহুতে ছোঁয়া লাগে, এখন লাগছে না। ধীরে ধীরে পুলিন ঘুমের মধ্যে ডুবে যেতে লাগল।
পচা গরমে দখিনা বাতাস শরীরের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়ার মতো একটা স্নিগ্ধ অনুভূতি পুলিনকে ঘুমের তলদেশ থেকে ধীরে ধীরে তুলে দিচ্ছে। শিশুকে আদর করার মতো মমতা—ভরা একটা হাত তার বাহু গলা ঘাড়ের উপর সান্ত্বনা ছড়িয়ে দিচ্ছে। পুলিন নিশ্বাস চেপে রইল। হাতটা ভারতীর।
‘আমার কী যেন হয়েছে’ ফিস ফিস করে নিজেকে শোনাবার জন্যই যেন ভারতী আবেদনের মতো মিনতিভরা স্বরে বলে চলল, ‘তোমাকে আজ অপমানই করলুম। কটু কথা বলেছি, ছেলের সামনে মিথ্যেবাদী করে দিয়েছি। অনিকে বলে দিয়েছি বিয়ে করলে অসুবিধে হবে একথা আমিও বলেছি। কিন্তু অনি আমার ছেলে, একমাত্র ছেলে। ওর মনে আঘাত লাগুক এমন কোনো কথা ওকে বলতে পারব না, এমন কোনো কাজও আমি করতে পারব না। তুমি ভুল বুঝো না আমায়।’
ভারতী কথা বলা কয়েক সেকেন্ড থামিয়ে আবার শুরু করল, ‘বড়ো এলোমেলো অস্থির হয়ে পড়ছি। অনেকদিনের জমে থাকা রাগ আর চেপে রাখতে পারছি না। এমন কিন্তু আমি ছিলুম না। তোমাকে আজও আমি আগের মতো ভালোবাসি, ভক্তি করি। মেয়ে ছিলুম, বউ হলুম এখন মা হয়েছি। আমার বদলটাকে দয়া করে বোঝো, রাগ করতে হয় কোরো কিন্তু সেই সঙ্গে বোঝার চেষ্টাটাও কোরো।’
পুলিন নিঃসাড়ে একইভাবে ঘুমের ভান করে রইল। ভারতীর হাত তার বাহু থেকে সরে গেছে। পুলিন সুখাবেশে তলিয়ে যেতে লাগল।
.
রবিবার সকাল থেকেই ব্যস্ত হয়ে পড়ল অনীশ। পুলিন গামছা মাথায় জড়িয়ে সিলিঙের কোনা থেকে ঝুল ঝাড়ল, পাখার ব্লেডে জমা ঝুল পরিষ্কার করল, দালানের মেঝেয় সোডা ছড়িয়ে ঝাঁটা দিয়ে ঘষল, ন্যাতা দিয়ে মুছে দিল ভারতী। বেডকভার দুটো বিছানায় পাতবে বলে বার করল পুলিন। অনীশ তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘এখন নয় ময়লা হয়ে যাবে, বিকেলে পাঁচটায় ওরা আসবে তার আগে পাতবে।’ সকলের উৎসাহ কর্মতৎপরতার সঙ্গে শামিল হবার চেষ্টা কাশীনাথের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছে। কোথায় কী নোংরা জমে, কোনটা অগোছালো, ফোল্ডিং খাটটা বারান্দায় বার করে দেওয়া, চারতলার প্রণববাবুর থেকে দুটো বেতের চেয়ার চেয়ে আনা ইত্যাদি নির্দেশ ও পরামর্শ দিতে দিতে বলল, ‘ওদের তো জলখাবার দিতে হবে, কী খেতে দেওয়া হবে?’
পুলিন বলল, ‘রাজভোগ সন্দেশ শিঙাড়া, আবার কী?’
কাশীনাথ বলল, ‘বাজার থেকে এনে তোর শ্বশুরকে তাই দিয়েছিলুম, এদেরও কী তাই দেওয়া যায়!’
পুলিনের মাথায় ‘এদেরও কী’ কথাটা ধাক্কা দিল। সে কথাটা কঠিন করে বলল, ‘কেন এরা কী? লাটসাহেব? মেয়ের বাড়ির লোক তো, তবে?’
কাশীনাথ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই ভারতী বলল, ‘খাবার কীসে করে দেবে? ভালো কাপ ডিশ গেলাস চামচ তো নেই, প্লেটও নেই। স্টিলের প্লেটে কী ওদের খেতে দোব, না ওই মোটা কাচের গেলাসে জল দোব? আগে ওগুলো কিনে আনো তবে খাবারের কথা ভাবো।’
পুলিন উদবিগ্ন হয়ে অনীশকে বলল, ‘আজ রোববার সব জায়গায় দোকান বন্ধ, তুই এখুনি শ্যামবাজারে যা, মনে হয় পেয়ে যাবি।’
অনীশ বেরিয়ে পড়ল তখনি। সিঁড়ি দিয়ে সে নেমে যাচ্ছে তখন ভারতী ছুটে দরজার কাছে গিয়ে চেঁচিয়ে বলল, ‘অনি দুশো গ্রাম চা আনিস আড়াইশো টাকা কিলোর।’
দালানে দাঁড়িয়ে পুলিন ইলেকট্রিক বালবের কাচের শেডের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ওটা পরিষ্কার করা হল না।’
ভারতী বলল, ‘থাকগে, অত কেউ নজর করবে না। আর শোনো বগলা থেকে মিষ্টি এনো না, মিঠাইরাজার মিষ্টি অনেক ভালো। ক্ষীরের চন্দ্রপুলিটা যদি পাওয়া যায় তা হলে অবশ্যই এনো।’
মেট্রোর গিরিশ পার্ক স্টেশনে অপেক্ষা করছিল অনীশ। তিনজন এসেছে, বলাকার বাবা শিবেন, মা গীতা আর ছোটোবোন বিশাখা। তিন মিনিট হেঁটেই তারা গুহ ভবনে পৌঁছে যায়। কাশীনাথ আর পুলিন পাটভাঙা ধুতি আর পাঞ্জাবি এবং ভারতী চওড়া জরি পাড় বুটিদার সাদা টাঙ্গাইল পরে তিনজনকে অভ্যর্থনা জানিয়ে কাশীনাথের ঘরে নতুন বেডকভার পাতা খাটে এবং বেতের চেয়ারে বসাল। বালিশগুলো উঁচু হয়ে রয়েছে বেডকভারের নীচে। জিনস আর কালো টি শার্ট পরায় অনীশকে যেন আরও ফরসা দেখাচ্ছে। সে ওদের পরিচয় করিয়ে দিল বাবা মা দাদুর সঙ্গে।
কাশীনাথ কথা শুরু করল, ‘আসতে কোনো অসুবিধে হয়নি তো?’
‘না না কিচ্ছু অসুবিধে হয়নি।’ শিবেন দ্রুত জবাব দিলেন, ‘মেট্রো হয়ে খুব সুবিধে হয়েছে, বাড়ি থেকে বেরিয়ে আপনাদের এখানে পৌঁছতে ঠিক পঁয়ত্রিশ মিনিট লাগল, বাসে এলে কম করে পঞ্চাশ মিনিট তো লাগতই।’
‘উইক ডে হলে লাগবে এক ঘণ্টা।’ পুলিন নিজেকে কথাবার্তার মধ্যে ঢুকিয়ে নিল। ‘আপনারা সাউথ ক্যালকাটায় কতদিন আছেন?’
‘টালিগঞ্জে বাড়ি করেছি বছর দুই, তার আগে পাঁচ বছর ছিলাম চেতলায়, তার আগে আসামে। বলাকা কলেজে আর ইউনিভার্সিটিতে পড়েছে কিন্তু কলকাতায়।’
গীতা বললেন, ‘বেকবাগানে আমার মেজদার বাড়িতে থেকে পড়ত। আমার বাপের বাড়ি কলকাতায়, আপনাদের বাড়ি থেকে বেশি দূর নয় আহিরিটোলায়।’
‘তাই নাকি!’ কাশীনাথ উৎসাহিত হল, ‘আহিরিটোলার কোথায়?’
‘বি কে পাল পার্কের উলটোদিকে।’
ভারতী লক্ষ করছিল ওদের হাবভাব কথা বলার ধরন, তার ভালো লাগল। বলার ভঙ্গিতে গেরস্থালি ঢঙ, নাক উঁচু ভাব নেই। যেটার সে আশঙ্কা করেছিল অনির সমীহ করে ওদের সম্পর্কে কথাবলা থেকে। এখন তার মনে হচ্ছে নিজেদের অত খাটো করে ভাবার কোনো দরকার নেই। স্বচ্ছন্দ বোধ করে সে বলল, ‘কলকাতার এদিককার লোক পেলে বাবার আর কথা নেই, খালি পুরোনো দিনের গল্প করে যাবেন আর বলবেন কী ছিল আর কী হয়েছে।’
‘এদিককার লোক বলতে কিন্তু শুধু আমি একাই। উনি আর আমার মেয়েরা কিন্তু নয়। ওরা উত্তর কলকাতা একদম চেনে না।’
ভারতী হাসিমুখে বলল, ‘মামার বাড়িতে তো গেছে।’
গীতা বলল, ‘ছোটোবেলায় কয়েকবার গেছে, দু—দিনের বেশি থাকেনি। এত লোক আমাদের বাড়িতে, তিন ভাইয়ের এগারোটি ছেলেমেয়ে, থাকার জায়গা কোথায়! তাও তো মেজদা থাকত না।’
ভারতী কৌতূহলী হল, ‘কোথায় থাকতেন?’
উত্তর দিলেন শিবেন, ‘মেজোশালা প্রথম চাকরি নিয়ে যান সুইজারল্যান্ডে। আট বছর সেখানে থেকে যান জার্মানির বায়ার্স কোম্পানিতে, সেখানেও ন—বছর কাটিয়ে ছ—বছর আগে ফিরে এসে জয়েন করেন এই স্টান্ডার্ড পেইন্টসে। ইস্টার্ন রিজিয়নে মার্কেটিঙের টপম্যান এখন। উনিই তো অনীশকে সিলেক্ট করেন।’
বিশাখা চুপ করে বসে আছে দেখে অনীশ বলল, ‘মামা, মামার বাড়ি, মেজদা এসব তো হল, জানো মা বিশাখার নজরুলের গানের ক্যাসেট বেরিয়েছে!’
‘ওমা, তাই নাকি!’ ভারতী সত্যিই অবাক হল। ‘কই আমাকে তো তুই আগে বলিসনি। নজরুলের গান আমার ভীষণ ভালো লাগে। ছোটোবেলায় রেডিয়োয় নজরুলগীতি হলেই শুনতে বসে যেতুম, অনি ওর ক্যাসেট কিন্তু আমায় শোনাবি।’
কাশীনাথ এবার বলল, ‘আমাদের স্কুলে নন্তু বলে একটা ছেলে ছিল খুব নজরুলের গান গাইত। তখন রবীন্দ্রসংগীত গাওয়ার এত চল ছিল না।’
পুলিন অনেকক্ষণ কথা বলেনি। এবার তার মনে হল একটা কথা সে বলতে পারে। ‘বাবা কিন্তু ভালো তবলা বাজাতেন। ছোটোবেলায় একবার দেখেছি পাড়ায় লক্ষ্মীপুজোর জলসায় বাবা সংগত করেছিলেন ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের গানের সঙ্গে।’
‘ওরে বাব্বা, তাহলে তো উনি খুবই ভালো বাজাতেন।’ শিবেন বললেন।
কাশীনাথ মুখে হাসি ছড়িয়ে বলল, ‘ছেলে বাপের প্রশংসা তো করবেই। আমি খুব ভালো বাজাতুম না, ইচ্ছে ছিল খুব বড়ো তবলচি হব। বউবাজারে কেরামত উল্লা খাঁ সাহেবের কাছে যেতুম, মসিত খাঁর ছেলে, ফারুকবাদ ঘরানার স্টাইল আর টেকনিক গিলে খেয়েছিলেন। কিন্তু আমার যা চাকরি তাতে ওর উগরে দেওয়া জিনিস চেটে নেওয়ারও টাইম পেতুম না। শেষকালে রেওয়াজ ছেড়ে দিলুম, একসময় তবলাটাও ভুলে গেলুম।’
কাশীনাথের হাসিটা যে কষ্টের হাসি পুলিন এবং ঘরের সকলেই বুঝতে পারল। ভারতী তার শ্বশুরকে একটা নতুন ভূমিকায় দেখতে পেল। মানুষটির এই গুণের কথা তিরিশ বছরেও সে জানত না এমনকী পুলিনও কখনো তাকে বলেনি। থিয়েটারের পর্দার মতো ধীরে ধীরে তার অশ্রদ্ধা বিতৃষ্ণা সরে গিয়ে মঞ্চে কাশীনাথকে সামনে এনে দিল নায়ক চিহ্নিত করে। ঘরের সবাই ঘোর কৃষ্ণবর্ণ অষ্টআশি বছর বয়সি শীর্ণ লোকটির উপস্থিতিকে আর অগ্রাহ্য করতে পারছে না।
এবার বিশাখা বলল, বলার জন্য উপযুক্ত কারণ ছাড়াই, ‘ছোটো মামার শালির কবিতার বই গত বছর সাহিত্য আকাদেমি অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে।’
পুলিন বলল, ‘তাই নাকি!’
কবিতার বই বা অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড ঘরের কাউকে আকর্ষণ করল না। অনীশ বলল, ‘মা এবার একটু চায়ের ব্যবস্থা করো।’
শিবেন বলে উঠলেন, ‘শুধু চা কিন্তু সঙ্গে টা নয়।’
গীতা বললেন, ‘আজ বেলায় খাওয়া হয়েছে একদম খিদে নেই।’
ভারতী অনুযোগ মিশিয়ে বলল, ‘প্রথম এলেন মিষ্টিমুখ করাব না তাই কী কখনো হয়। বসুন।’
শিবেন বা গীতা আর কথা বাড়াল না। ওদের মুখ দেখে ভারতীয় মনে হল ঘর পছন্দ হয়েছে, ওরা এখানে মেয়ে দেবে। ঘর থেকে তার সঙ্গে অনীশও বেরিয়ে এল। রান্নাঘরে বাক্সে আর ভাঁড়ে মিষ্টি রয়েছে। নতুন কেনা প্লেটে অনীশ সেগুলো সাজাতে লাগল, ভারতী চায়ের জল চড়াল বার্নারে।
‘আমার তো বেশ ভালোই লাগল।’ ভারতী বলল। ‘ক—দিন ধরে তুই যা বলছিলিস ভাবছিলুম না জানি কী। হ্যাঁরে বলাকার মামা তোকে চাকরি দিয়েছে বলল, কই সেটা তো আমাদের জানাসনি!’
‘এটা কী একটা জানাবার মতো কথা! চাকরি দেবে আবার কী? এটা কর্পোরেট কোম্পানি, কারোর নিজের ব্যবসা নয় যে ধরাধরি করলেই চাকরি দিয়ে দেবে।’
ছেলের গলার স্বরে বিরক্তি আর ঝাঁঝ দেখে ভারতী অনুতপ্তের মতো বলল, ‘সিলেক্ট করেছে বলল কি না, তাই বললুম।’
‘ও নিয়ে তোমায় মাথা ঘামাতে হবে না। এদিকে দেখো ঠিকঠিক দেওয়া হল কি না।’
ভারতী তিনটে প্লেটের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে। তুই দুটো প্লেট নে আমি বাকিটা নিচ্ছি। পরে জলের গ্লাস নিয়ে যাব। ততক্ষণ চা—টা ভিজুক।’
‘একটা ট্রে থাকলে ভালো হত, তখন বললে না কেন কাপ ডিশের সঙ্গেই কিনে আনতুম।’
প্লেট হাতে ঘরে ঢোকার সময় ভারতী শুনল শিবেন বলছেন, ‘মেজোশালা ভীষণ ভালোবাসে বলাকাকে, অনীশের কথা তো উনিই আমাদের বলেন। মেজদাই তো ওকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে এসে আলাপ করিয়ে দিলেন। বলাকার সঙ্গে তো অনীশের পরিচয় হল তখনই।’
ভারতী তার প্লেট গীতার হাতে দেবার জন্য বাড়িয়ে ধরল, ‘একি এত মিষ্টি!’ বলে গীতা আঁতকে ওঠার ভান করল।
শিবেন আর বিশাখার হাতে প্লেট না দিয়ে অনীশ খাটের উপর রেখে বলল, ‘টেবল থাকলে চলাফেরার অসুবিধে হবে বলে রাখিনি। বিশাখা একটাও ফেলে রাখবে না।’
গীতা বললেন, ‘খুকু মিষ্টি খেতে ভালোবাসে।’
শিবেন প্লেটের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কোথাকার মিষ্টি, দেখছি সীতাভোগ রয়েছে।’
পুলিন বলল, ‘হ্যাঁ, আপনার দেশের। এখানকার একটা দোকান তৈরি করে আর চন্দ্রপুলিটা আমাদের এখানকার। খেয়ে দেখুন কলকাতার আর কোনো জায়গায় এমন টেস্টফুল চন্দ্রপুলি পাবেন না।’
শিবেন চামচ দিয়ে চন্দ্রপুলির একটা কোনা ভেঙে মুখে দিয়ে চোখ বন্ধ করে চিবিয়েই চোখ খুলে বললেন, ‘চমৎকার’। স্ত্রীকে বললেন, ‘খেয়ে দেখো, খুকু তুই আগে এটা খা।’
পুলিন আর চুপ করে থাকতে পারল না, বলল, ‘এটা কিন্তু আমি পছন্দ করে এনেছি। অনি মিঠাইরাজা থেকে কিনে যাবার সময় ওদের দিস।’
‘না না, কিনে দিতে হবে না,’ ‘শিবেন আপত্তি করে উঠল। ‘আমরা কিনে নোব।’
ভারতী আরও চন্দ্রপুলি নিয়ে এল। প্রত্যেকের প্লেটে দুটি করে দিয়ে বলল, ‘অনি কিনে দেবে আমার তরফ থেকে বলাকার জন্য।’ এই বলে সে চা আনতে গেল, সঙ্গে গেল পুলিন।
‘ভদ্দরলোক তখন কী যেন বলছিল? অনির কথা নাকি বলাকার মেজোমামাই ওদের বলেন? ‘ ভারতী চা কাপে ঢালতে ঢালতে বলল, ‘হঠাৎ একথা উঠল যে?’
‘বাবাই জিজ্ঞেস করল অনির খবর আপনারা পেলেন কী করে তাইতেই উনি এটা বললেন। তুমি কী ভেবেছ ওপরওলার ভাগনি বলে অনি বিয়ে করতে রাজি হয়েছে, পরে উন্নতি করে দেবে?’
পুলিন মাথা নাড়ল। ‘অনি ভালোবেসেই বিয়ে করছে, মেয়েটার গুণ অনেক।’
অনীশ রান্নাঘরে এসে বলল, ‘হয়েছে? আমাকে দুটো কাপ দাও। আর একটু দুধ দাও, ওরা বেশি দুধ দিয়ে খায়। বাবা বেশ ভালোই মিষ্টি কিনে এনেছে, তবে রাজভোগ কেউ খায়নি।’
ভারতী বলল, ‘গোটা দশেক চন্দ্রপুলি কিনে দিস।’
বিয়ের প্রস্তাব দিলেন গীতা। ‘আমরা সামনের মাঘেই ওদের বিয়ে দিতে চাই।’
শিবেন বললেন, ‘ও মাসে পাঁচটা বিয়ের দিন আছে। একুশ তারিখ রবিবার পড়ছে। মেজোশালা মঙ্গলবার কুয়ালালামপুর চলে যাবেন, সেখান থেকে ব্যাঙ্কক হয়ে ফিরতে ফিরতে দিন পনেরো হয়ে যাবে। ওর যাবার আগেই শুভ কাজটা সেরে ফেলতে চাই।’
খাটের একধারে চুপচাপ পা ঝুলিয়ে এতক্ষণ বসেছিল কাশীনাথ। কথাবার্তায় অংশ নেয়নি। হঠাৎ সে বলে উঠল, ‘আপনার মেজোশালা ফিরে আসুক, তখনই বিয়েটা ফাল্গুন মাসে হবে।’
সবাই তটস্থ হয়ে তাকাল তার দিকে। কাশীনাথের গলার স্বর রূঢ়, তার তাকানোটাও গোঁয়ারের মতো। যেন ইচ্ছে করেই নিজের কর্তৃত্ব দেখাবার জন্য চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে।
‘কেন মাঘে হলে অসুবিধে কী?’ পুলিন বলল।
‘আমার বিয়ে ফাল্গুনে হয়েছে, তোর বিয়েও ফাল্গুনে হয়েছে, অনির বিয়েও ফাল্গুনে হবে।’
কথা হুকুম দেওয়ার মতো ঘোষণা করে কাশীনাথ উঠে দাঁড়াল। সবার অবাক হওয়া মুখের উপর চোখ বুলিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার সময় বলল, ‘বরের বাড়ি যেমন চাইবে তেমনভাবেই বিয়ে হবে।’
কাশীনাথ ফ্ল্যাটের দরজা খুলে বেরিয়ে ইতস্তত করে সিঁড়ি ধরে ছাদে উঠে গেল।
প্রথম কথা বলল ভারতী। ‘ওনার বয়স হয়েছে, শরীরটাও ভালো নেই, আপনারা কিছু মনে করবেন না। বিয়ে মাঘ মাসেই হবে।’
পুলিনও বলল, ‘হ্যাঁ, মাঘ মাসেই হবে, ছেলের বাবা হিসেবেই বলছি।’
‘না না আমরা কিছু মনে করছি না। বুড়োমানুষ অনীশের কাছে শুনেছি আশি পার হয়েছেন এই বয়সে উলটোপালটা কথা বলতেই পারেন।’ শিবেন সান্ত্বনা দেবার মতো করে বললেন।
ভারতী হাত ধরল গীতার। ‘আসুন, বিয়ের পর অনিরা যে ঘরে থাকবে সেটা এখনও আপনার দেখা হয়নি।’
পাশের ঘরে বিশাখা আর গীতা এসে চোখ বুলিয়ে দেখে খাটে বসল।
গীতা বলল, ‘ও ঘরের থেকে মনে হচ্ছে এটা যেন বড়ো।’
‘হ্যাঁ, দু—দিকেই দু—ফুট করে বড়ো। আমার বিয়ে হতে আমি এই ঘরটা পেয়েছিলুম, এবার পাবে বলাকা।’
আচমকা বিশাখা বলে উঠল, ‘তা হলে আপনারা থাকবেন কোথায়, আর কোনো ঘর আছে?’
সঙ্গে সঙ্গে ভারতী বলল, ‘ছাদে একটা খালি ঘর আছে, সেটা ভাড়া নেবার কথা হচ্ছে।’
পরে ভারতী ভেবে দেখেছিল, এমন একটা মিথ্যা কথা হঠাৎ মুখ দিয়ে বেরোল কেন! ওদের চোখে ছোটো হয়ে যাওয়ার ভয়ে? ছোটো হয়ে যাবে অনীশ সেইজন্য? ছাদের ঘরের কথা বলে তখনকার মতো সামাল দিয়ে সে অনেকটা ভরসা এই ভেবে পায় যে, ওরা নিশ্চয় ছাদ দেখতে যাবে না। ছাদে কোনো ঘর নেই।
‘ঘরটা অনেক দিন মনে হয় পেইন্ট করা হয়নি, ইলেকট্রিক অয়ারিং বদলানোও দরকার। গদিটা কত দিনের মাসিমা?’
ভারতীর মনে হল মেয়েটি ইচ্ছে করেই তাদের প্রাচীনত্ব নিয়ে খোঁচা দিয়ে বলল, আরও হয়তো বলত, হাতে মায়ের একটা চিমটি পেয়ে চুপ করে গেল। কাশীনাথের একগুঁয়েমিরই পালটা প্রতিক্রিয়া এগুলো।
পুলিন এসে তাগিদ দিল, ‘শিবেনবাবু ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন যাবার জন্য।’
যাবার সময় ভারতী আবার বলল, ‘কিছু মনে করবেন না। শ্বশুরকে সামলাতে হিমশিম খেতে হয়, যত বয়স বাড়ছে ছেলেমানুষ হয়ে যাচ্ছেন।’
শিবেন বললেন, ‘ছেলেমানুষ হয়ে যেতে পারা তো ভাগ্যের কথা। আমি রোজ চেষ্টা করি ছেলেমানুষ হয়ে যেতে, পারছি কই।’ বলেই হেসে উঠে পরিবেশ হালকা করতে চাইলেন।
গীতা এতক্ষণে বুঝে গেছেন আসল কথাবার্তা কার সঙ্গে বলতে হবে; তাই ভারতীর হাত ধরে তিনি বললেন, ‘বিয়ের তারিখ ঠিক করে পরে জানিয়ে দোব। কিছু নেবেন না বললে আমরা কিন্তু শুনব না। আমার তিন মেয়ে। বুঝতেই পারছেন দায় সামনে কতটা, তাহলেও বড়ো মেয়েকে যতটা পারি সাজিয়ে দোব। খাট আলমারি না নিলেও ফ্রিজ, টিভি, ওয়াশিং মেশিন দুই মেয়ে তাদের দিদিকে বলে নিশ্চয় আপত্তি করবেন না। অনীশকে আমি বুঝিয়ে রাজি করাব।’
মাথা হেলিয়ে চওড়া হাসি ছাড়া ভারতী আর কোনোভাবে সম্মতি জানাতে পারল না। সে দেখল গীতা চোখের ইশারায় তার পা দেখিয়ে বিশাখাকে প্রণাম করতে ইঙ্গিত করছেন। সে পরপর পুলিন ও ভারতীকে প্রণাম করে বলল, ‘আমি কিন্তু আবার আসব, মাসিমা মেসোমশাই আপনারাও যাবেন আমাদের বাড়িতে।’
পুলিন আপ্লুত। অনীশকে বলল, ‘ওদের সঙ্গে যা, ট্রেনে তুলে দিয়ে আয়।’
ভারতী সিঁড়ির মাথা পর্যন্ত এসে দাঁড়াল। যতক্ষণ পায়ের শব্দ পাওয়া যায় শুনে ফিরে এসেই পুলিনকে বলল, ‘একবার শিগগিরি রাস্তাটা দেখে এসো, বাবা কোথায় গেলেন, খুঁজে দেখো।’
ব্যস্ত উদবিগ্ন পুলিন পায়ে চটি গলিয়ে বেরিয়ে পড়ল, ভারতী কাপ ডিশ প্লেটগুলো রান্নাঘরের বেসিনে রেখে বারান্দায় এসে ঝুঁকে যতদূর সম্ভব সদ্য সন্ধ্যার এবং ম্লান রাস্তার আলোয় দেখা যায় দু—দিক তাকিয়ে শ্বশুরকে খোঁজার চেষ্টা করল। দেখল পুলিন সেন্ট্রাল অ্যাভিন্যুর মোড়ে দাঁড়িয়ে এধার—ওধার তাকিয়ে বাবাকে খুঁজছে।
ভারতীর মন হল কাশীনাথ রাস্তায় নেই। সে পাঁচ তলার ছাদে উঠে এল। চৌকো ছাদ, তার এককোণে ইটের চারটে পায়ার উপর লম্বা জলের ট্যাঙ্ক। একতলা থেকে পাম্পে জল তুলে রাখা হয়। ছাদে আর আছে দুটো টিভি অ্যান্টেনা, এর একটা কাশীনাথের অন্যটা চারতলার এক গুজরাটি পরিবারের। ভারতী শ্বশুরকে বলেছিল, ‘মাসে নব্বুই টাকা। বাবা কেবল কানেকশানটা নিয়ে নিন না, সবাই তো নিয়েছে। অনেক রকমের জিনিস, খেলা, সিনেমা দেখতে পাবেন।’
‘সবাই নিলেই কী আমায় নিতে হবে। কাজকম্ম সিকেয় তুলে তখন তুমিই তো সিনেমা দেখতে বসে যাবে, তাও রক্ষে ঘরে পড়াশুনোর পাট নেই। দোতলার ওদের তো টিভি নেই, ছেলেমেয়েরা পড়াশুনো করে বলে নেই।’
ভারতী ছাদে ট্যাঙ্কের গা ঘেঁষে রাস্তার দিকের পাঁচিলে হাত রেখে কাশীনাথকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। এই রাস্তায় তাদের ছাদটিই পাঁচতলায়। অনেকদূর পর্যন্ত চোখ গিয়ে সেন্ট্রাল অ্যাভিন্যুর ওপারে পাশাপাশি দুটো ছ—তলা বাড়িতে দৃষ্টি রাখা যায়। বিস্তৃত একটা শূন্যতা, নেমে আসা হেমন্ত সন্ধ্যার ঘোলাটে আলো, তার পটভূমিতে সাদা পাঞ্জাবি পরা শীর্ণ চেহারাটিকে ভারতীর মনে হল চারদিক থেকে তাড়াখাওয়া বেড়ালের মতো কাশীনাথ একটা কোণে আশ্রয় নিয়েছে আত্মরক্ষার জন্য। কাশীনাথের শরীরটা যদি একটু নড়ে উঠত তা হলে সে অন্যরকম ভাবত। বৃদ্ধ মানুষটিকে তার অন্তত আশ্রয়প্রার্থী মনে হত না।
‘বাবা, হিম পড়বে, ঠান্ডা লাগবে নীচে আসুন, ওরা চলে গেছে।’
মন্থরভাবে কাশীনাথ ঘুরে দাঁড়াল।
‘আমি কি খুব অসভ্যতা করলুম?’
ভারতী উত্তর দিল না।
‘আমার জন্য অনির বিয়ে কি ভেঙে যাবে?’
‘না।’
‘তোমার বাবা কিন্তু হাত জোড় করে আমার কাছে এসেছিলেন।’
‘তখন ওটাই রীতি ছিল, সময় তো বদলে গেছে।’
‘কতটা বদলেছে?’
‘আজ তো দেখলেনই। বাবা, এদের কাউকে দোষ দেওয়া ঠিক হবে না। আপনি একটা সময়ের, এরা আর একটা সময়ের।’
‘তুমি মধ্যিখানের সময়ের!’
‘হ্যাঁ। এবার নীচে আসুন।’
‘কয়েকটা কথা বলার আছে বউমা, খুব গুরুতর কিছু নয়, চলো নীচে যাই।’
ফিরে এসে ভারতী বলল, ‘চা খাবেন? অনি ভালো চা এনেছে।’
‘এদের জন্য এনেছে, অন্য দিন তো আনে না! এই ব্যাপারটাই বলতে চাই। দুপুর থেকে তোমাদের মধ্যে এমন একটা ভাব দেখলুম যেন বাড়িতে লাটসাহেব আসবে। ঘরদোর পরিষ্কার কী নতুন চাদর পাতা, কাপ ডিশ কেনা, চা কেনা এসব ঘরের লোকের জন্য তোমরা করো না। ভাবতে ভাবতে মাথাটা গরম হয়ে উঠেছিল, তখনই লোকটা বলল, ওর মেজোশালা অনিকে সিলেক্ট করেছে। তার মানে তার অনুগ্রহেই চাকরিটা পেয়েছে। শুনেই মনে হল বুঝিয়ে দেওয়া দরকার চাকরি দিয়ে মাথা কিনে নাওনি।’
ভারতী বলল, ‘বাবা শিবেনবাবু কিন্তু মাথা কিনে নেওয়ার মতো করে কথা বলেননি, বেশ ভদ্র বিনয়ীই তো দেখলুম। বসুন চা করে আনি।’
চা করছিল ভারতী তখন ফিরে এল পুলিন। ঘরে উঁকি দিয়ে টিভি চালিয়ে কাশীনাথকে বসে থাকতে দেখে তার চোখ বিরক্তিতে ভরে গেল।
‘কোথায় গেছলে তুমি? গোরু খোঁজার মতো এধার—ওধার ছাতুবাবুর বাজার পর্যন্ত ঘুরে এলুম।’ গলা চড়ে গেল পুলিনের, ‘আমাদের সঙ্গে যা করো তা করো সেটা ওদের সঙ্গে করতে গেলে কেন? কীরকম ছোটোলোক ভাবল আমাদের, ছি ছি লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছিল।’
কাশীনাথ টিভি বন্ধ করে দিল। দেওয়ালে হেলান দিয়ে খাটে পা ছড়িয়ে বসল। ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে বলল, ‘লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছিল? কই তোর মাথাটা তো দেখছি ঘাড়ের ওপর ঠিকই রয়েছে।’ চোখ পিট পিট করল কাশীনাথ।
এমন হালকা কথার কী জবাব দেবে ঠিক করতে না পেরে পুলিন বলল, ‘এটা ফাজলামো করার মতো ব্যাপার নয়। তোমাকে সামনে রেখে ভদ্রলোকদের সঙ্গে কথা বলা যায় না। কী কুক্ষণেই যে তোমার ছেলে হয়ে জন্মেছিলুম।’
কাশীনাথের চোখ দুটি স্থির হয়ে গেল। গাঢ় হয়ে উঠল মণি। চশমার পুরু কাচ ভেদ করে ধিক্কার আর ঘৃণার মতো চাহনি বেরিয়ে আসছে।
‘হাঁ কুক্ষণেই, তবে তুই নয় আমি। কী কুক্ষণে তোকে জন্ম দিয়েছি সেটাই ভেবে আসছি যেদিন তুই বললি বাবা ব্যবসা আর চালাতে পারছি না, দোকানটা তুলে দোব। মনে পড়ে? মাত্র দু—বছর চালালি।’
পুলিনের অন্তরাত্মা কেন্নোর মতো গোল হয়ে গুটিয়ে গেল বাবার কথার ছোঁয়ায়। সে জানে এবার শুনতে হবে, আমার টাকা শোধ করে দিবি বলেছিলিস। পঁচিশ বছর হয়ে গেল একটা আধলাও শোধ করতে পারিসনি। দোকানটা একটা মেড়োকে ভাড়া দিয়েও আজও তুই বসে বসে ভাড়ার টাকা খাস।
‘কী রে পুলিন, মাথাটা তো দেখছি এখনও ঘাড়ের ওপর ঠিক রয়েছে, বাবুর চুলে আবার টেরি কাটা!’ এরপরই গলার স্বর বদলে গেল, ‘হারামজাদা, তোর জন্য আজ আমার এই দুরবস্থা। ছোটোলোক বানিয়েছিস তো তুই, সংসারটাকে গরিব করেছিস তো তুই। কোথায় শোব এই সমস্যায় আজ কী পড়তে হত তোকে?’
চা নিয়ে আসছিল ভারতী, শ্বশুরের গলা শুনে থমকে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে পড়ল, পুলিন ঘর থেকে বেরিয়ে এল। ভারতীর মুখের দিকে একঝলক তাকিয়ে দালানে চেয়ারে বসল দু—হাতে মুখ ঢেকে। চা নিয়ে ঘরে ঢুকল ভারতী, থমথমে মুখ।
‘টেবিলে রেখে যাও।’
কাপটা রেখে বেরিয়ে এসে সে দেখল পুলিন ফোঁপাচ্ছে। ভারতী তার পিঠের কাছে দাঁড়িয়ে আলতোভাবে মাথায় হাত রাখল। পুলিন মুখ তুলল, চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে।
‘আমি আত্মহত্যা করব। সত্যিই অপদার্থ! বেঁচে থাকার মানে হয় না।’
ভারতী এর আগেও স্বামীর মুখে এমন কথা শুনেছে। সে শুধু পুলিনের মাথায় হাত রেখে নীরবে দাঁড়িয়ে রইল।
তার মতো আর কেউ জানে না দুটো বছর ধরে পুলিন নিরন্তর কী পরিশ্রম করে গেছল।
একবার হতাশ হয়ে পুলিন বলেছিল, ‘এত কম টাকা নিয়ে এমন ব্যবসা দাঁড় করানো যায় না। পাঁচ—ছ লাখ টাকা নিয়ে নামলে কলকাতার বাইরে গ্রামের দিকে বিক্রি হবার তবু একটু আশা থাকত। বড়ো বড়ো কোম্পানি কী সুন্দর সুন্দর ক্যাবিনেটে কম দামে ট্রানজিস্টার বিক্রি করছে সারা দেশ জুড়ে। এদের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া যায় না।’
আর একদিন বলেছিল, ‘এবার দোকানটা বন্ধ করে দোব, গত তিনদিনে চারটে মাত্র বিক্রি হয়েছে। দুটো মাত্র মেকানিক, মাইনে দিতে পারিনি তাদের। কতদিন আর বাবার টাকা দিয়ে চালাব।’
পুলিন ব্যবসার কথা ভারতীর সঙ্গে আলোচনা প্রথম দিকে করত তারপর আর করত না। ভারতীও ঔৎসুক্য দেখাত না, কী খারাপ খবর শুনতে হবে এই ভয়ে। অবশেষে একদিন রাতে বাড়ি ফিরে খাওয়ার পর বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিশ্চিন্ত স্বরে পুলিন বলেছিল, ‘বন্ধ করে দিয়ে এলুম, পাকাপাকি। তোমার নামে ব্যবসা, ঘরটা ভাড়াও নেওয়া তোমার নামে, চাবি তোমার কাছে রেখে দিয়ো। ভাড়া তিন মাসের বাকি।’
শুনেই কেঁপে গেছল ভারতীর বুক। অস্ফুটে বলেছিল, ‘একেবারে বন্ধ করে দিলে?’
‘হ্যাঁ, দেনা বাড়িয়ে লাভ কী?’
‘চেষ্টা করে দেখো না।’
‘নাহ, হবার নয়।’
দু—দিন পর কাশীনাথ ভারতীকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘পুলিন ঘরে বসে কেন, বেরোবে না?’
ক্ষীণস্বরে ভারতী বলেছিল, ‘শরীর ভালো নয়, জ্বরজ্বর লাগছে।’
তিন—চার দিন পর কাশীনাথ রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আবার জিজ্ঞাসা করে, ‘জ্বর কি এখনও সারেনি?’
ভারতী আর মিথ্যা বলার সাহস পেল না, বলল, ‘ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছেন। দোকান আর খুলবেন না।’
কাশীনাথ বজ্রাহতের মতো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ঘরে গিয়ে গুম হয়ে বসে থাকে। তিন—চার দিন সে কারোর সঙ্গে কথা বলেনি। ভারতী দুরু দুরু বুকে অপেক্ষা করে কবে কাশীনাথ ফেটে পড়বে। ফেটে পড়েনি। সকালে সে বেরিয়ে যায় দুপুরে ফিরে ভাত খেয়ে ঘুমিয়ে আবার বিকেলে বেরিয়ে রাত্রে ফেরে। কোথায় যায় কী করে কেউ জানে না।
একদিন একটি লোক এসে পুলিনকে খুঁজল। ফ্ল্যাটের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে লোকটির সঙ্গে দু—চারটা কথা বলেই সে ঘরে এসে প্যান্ট পরতে লাগল বেরোবার জন্য। ভারতী জিজ্ঞাসা করল, ‘কোথায় বেরোচ্ছ?’
‘স্বরূপ পোদ্দার কথা বলতে চায়, লোক পাঠিয়েছে যাই শুনে আসি কী বলে।’
ঘণ্টাখানেক পরে পুলিন ফিরে আসে। ভারতী জিজ্ঞাসু চোখে শুধু তাকিয়ে থাকে। পুলিনের মুখে চোখে উদ্দীপনার ছোঁয়া দেখে তার মনে হল কিছু একটা ভালো খবর সে দেবে। হাওয়াই শার্ট খুলতে খুলতে পুলিন বলল, ‘ব্যবসায়ী বটে। ঠিক নজর রেখেছে আমার দোকান ঘরটার দিকে। ক—দিন বন্ধ দেখেই বুঝেছে আমি আর বোধহয় খুলব না। কী বলল জান?’ ধাঁধা জিজ্ঞাসা করার মতো চোখ নিয়ে পুলিন তাকিয়ে ছিল।
ভারতী বলল, ‘ঘরটা নিতে চায়।’
পুলিনের চোখের উপর দিয়ে মুহূর্তের জন্য হতাশার মেঘ ভেসে গিয়ে আবার রোদ ফুটে উঠল। ‘ভারতী নামটাও নিতে চায়। আমার দোকান থেকে প্রায় একশো গজ দূরে ওর শাড়ির দোকান সরস্বতী। এয়ারকন্ডিশনড, কাচের দরজা। রাজস্থান থেকে ওদের জরিটরি বসানো দামিদামি শাড়ি আনায়। আমার ছোট্ট সাইনবোর্ডে ভারতী ট্রানজিস্টরস নামটা চোখে পড়া থেকেই স্বরূপ পোদ্দারের ইন্টারেস্ট তৈরি হয়। আজ বলল, আপনার দোকানটা একদিন বাইরে থেকে দাঁড়িয়ে দেখলাম, দেখেই বুঝে গেলাম বেশিদিন চলবে না। তালা পড়তেই বুঝলাম আপনি ব্যবসা তুলে দিয়েছেন।’
ভারতী অধৈর্য হয়ে বিরক্ত স্বরে বলল, ‘এইসব বলার জন্য লোকটা ডেকে নিয়ে গেল?’
‘আরে না, সরস্বতীর সঙ্গে মিল রেখে ভারতী নাম দিয়ে ও ফ্রিজ আর টিভি—র দোকান খুলতে চায়। কলকাতায় টিভি শুরু হয়েছে এবার টিভি সেট কেনার ধুম পড়ে যাবে। ওই সঙ্গে টেপ রেকর্ডার, ক্যাসেট ম্যাসেট আরও কী কী সব রাখবে।’
‘বুঝলুম, তাতে তোমার কী?’
‘আমাকে পঁচিশ হাজার টাকা দিতে চেয়েছে যদি ঘরটা ওকে ছেড়ে দিই।’ বলেই পুলিন অপেক্ষা করল ভারতীয় চোখ কতটা জ্বলজ্বল করে ওঠে দেখার জন্য। তার বদলে পেল কঠিন দৃষ্টি।
‘পঁচিশ হাজার টাকা নিয়ে করবে কী?’
‘বাবাকে দিয়ে দোব।’
‘তারপর খাবে কী? বাচ্চচা ছেলেটাকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করতে হবে। তুমি কি ভেবেছ সেজন্য বাবা টাকা দেবেন? সে আশা কোরো না।’
‘তা অবশ্য করি না কিন্তু যেভাবে বাবা কথা না বলে বাইরে বাইরে থাকছেন তাতে মনে হচ্ছে এটা ঝড়ের পূর্ব লক্ষণ। ঝঞ্ঝাট বাধাবার আগেই সেটা থামিয়ে দিতে চাই। পঁচিশ হাজার পেলে অনেকটা তো নরম হবেন।’
‘না, টাকা এখন দেওয়ার দরকার নেই।’
ভারতীর গলা রূঢ়, দুটো ঠোঁট টিপে তার আপত্তিকে শক্ত করে ধরে রেখেছে। তার চিন্তা বৃদ্ধ শ্বশুরের ছোড়া বাক্যবাণ নিয়ে নয়, দু—বছরের অনীশের ভবিষ্যতের কথা ভেবে।
‘বাবার কষ্টে রোজগারের টাকা নষ্ট করলুম সেটা ওকে ফেরত দোব না, বলছ কী!’
‘ঠিকই বলছি। তোমাকে টাকা দিয়েও রিটায়ার করে পাওয়া টাকা এখনও ওনার ব্যাঙ্কে রয়েছে, আর এখন পেনশন যা পাচ্ছেন এগুলো যোগ করে যদি দেখো তাহলে হেসে খেলে বাবার বাকি জীবন চলে যাবে। আমাদের সংসারে তো কোনো বাজে খরচ নেই। কারোর কোনো নেশা নেই, সিনেমা থিয়েটারে যাওয়া নেই, লোকজনও কেউ আসে না, আমরাও কোথাও যাই না। টাকা ফেরত দেওয়ার থেকে অন্য কিছু ভাবো।’
‘আর কী ভাবব। পোদ্দারকে বলেছি ঘর নেওয়া আছে বউয়ের নামে, শ্বশুরই এটা পঞ্চান্ন সালে ভাড়া নিয়েছিলেন, বউকে জিজ্ঞেস না করে আপনাকে কিছু বলতে পারব না, কালকে আপনাকে জানাব।’
‘ভালোই বলেছ। এখনও চব্বিশ ঘণ্টা হাতে আছে, ভেবেচিন্তে ভবিষ্যতের কথা ভেবে বলবে।’
‘আচ্ছা চল্লিশ হাজার টাকা চাইলে কেমন হয়?’ সমর্থন পাবে আশা নিয়ে পুলিন তাকাল ভারতীর দিকে।
মাথা নাড়ল ভারতী, ‘অনিকে মানুষ করতে হলে এখনও কুড়ি—বাইশ বছর লাগবে। চল্লিশ হাজারে কতদিন আর চলবে, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ানোর খরচ যা তাতে ওই টাকা তো পাঁচ—সাত বছরেই শেষ হয়ে যাবে। অন্য কিছু ভাবো। বাবাকে কিন্তু ঘুণাক্ষরেও কিছু বোলো না।’
ভেবে বার করল ভারতীই, চব্বিশ ঘণ্টা নয় চার ঘণ্টাতেই সে ভেবে ঠিক করে ফেলেছে। বিকেলে কাশীনাথ বেরিয়ে যাবার পর পুলিন বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। ভারতী তাকে ঘরে ডাকল।
‘শোনো থোক টাকা নয়, আমার কাছ থেকে লেখাপড়া করে ভাড়া নিক। আমরা চোরবাগানে যে বাড়িতে থাকতুম সেটা বাবা ওইভাবেই নিয়েছিলেন দত্তবাবুর কাছ থেকে। উনিই ছিলেন মূল ভাড়াটে। এখানে আমি মূল ভাড়াটে। তখন বাবা দোকানঘরটা ভাড়া নিয়েছিলেন পঁচাত্তর টাকায়। সেই ভাড়াই এখনও চলে আসছে। কেউ যদি এখন ওপাড়ায় এমন জায়গায় একটা দোকান ভাড়া নিতে চায় তাহলে কত সেলামি আর কত ভাড়া দিতে হবে?’
‘ওরে বাব্বা এখন তো লাখ টাকা সেলামিই দিতে হবে, বেশিও হতে পারে। ভাড়া ধরো হাজার টাকা।’
‘আর তুমি পঁচিশ হাজার শুনেই লাফাচ্ছ!’
‘তাহলে কত বলব, লাখ টাকা?’
‘হাঁস মেরে সব ডিম একসঙ্গে পাওয়ার লোভটা সামলাও। সেলামি টেলামি চাই না, মাসে মাসে দু—হাজার টাকা ভাড়া দিক আমাদের আর বাড়িওলার যা ভাড়া সেটা তাকে দিক। গিয়ে বলো। দেখবে প্রথমে রাজি হবে না। ঝানু ব্যবসায়ী ওরা, ঠিক বোঝে পঁচিশ তিরিশ বছর পর ওই ঘরটার দাম কত দাঁড়াবে। তুমি কিন্তু কোনো গরজ দেখাবে না।’
পরদিন পুলিন যায় স্বরূপ পোদ্দারের সঙ্গে কথা বলতে। ফিরে এসে একগাল হেসে ভারতীকে বলল, ‘তোমার একখানা মাথা আছে বটে। অত টাকা ভাড়ার কথা বলব, এটা তো ভাবতেই পারতুম না, পারলেও বলতে সাহসে কুলোত না।’
‘ভণিতা রাখো। লোকটা রাজি হল?’
‘কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে কী ভেবে নিয়ে বলল, ঠিক আছে তবে দু—হাজার নয় দেড় হাজার।’
‘তুমি রাজি হয়ে গেলে?’
‘পাগল। বললুম এক পয়সাও কম নয়। বউ তাহলে মাথা ফাটিয়ে দেবে।’ বলেই পুলিন জোরে হেসে উঠল। এভাবে শব্দ করে ওকে এই প্রথম ভারতী হাসতে শুনল, বোধহয় কাশীনাথ অনুপস্থিত বলে। ‘দু—হাজারেই রাজি হল। এক মাসের ভাড়া অ্যাডভান্সও দিয়ে দিল, এই দেখো।’ পুলিন পকেট থেকে একগোছা নোট বার করে ভারতীর চোখের সামনে ধরল। ‘কাল স্ট্যাম্পপেপার নিয়ে একজন কর্মচারী আসবে তোমাকে সই করাতে।’
‘কখন আসবে?’ ভারতী ভীতস্বরে বলে উঠল, ‘বাবা থাকার সময় যেন না আসে।’
‘আরে আমি কী অত বোকা, বলেছি এই সময়ে এগারোটায় আসতে।’ নোটগুলো স্ত্রীর হাতে দিয়ে পুলিন বলল, ‘এবার থেকে বাজার খরচটা আমি দোব বাবাকে বলে দিয়ো।’
‘বললেই বলবেন, টাকা পেলে কোথায়?’
‘বলবে চাকরি পেয়েছি একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে।’
‘তাহলে তোমাকে রোজ ন—টায় খেয়েদেয়ে জামাপ্যান্ট পরে বেরোতে হবে।’
পুলিন বিপন্নের মতো বলল, ‘তাই তো! খেয়াল করিনি!’
ভারতী বলল, ‘আমার মনে হয় ওনাকে বলে দেওয়াই ভালো। একদিন তো জানতে পারবেনই।’
‘সেই ভালো, তুমি কালই বলে দিয়ো নইলে কাঁটার মতো খচখচ করবে।’
‘আমি কেন তুমি বলতে পার না? সব ব্যপারেই আমাকে সামনে ঠেলে দেওয়া!’ প্রায় মুখঝামটা দিয়ে ভারতী দ্রুত ঘরে ঢুকে গেল টাকাটা রেখে আসতে।
তিনদিন পর কাশীনাথ ভাত খেয়ে ঘুমোবার উদ্যোগ করছে, পুলিন ইশারায় ভারতীকে ঘরের দিকে আঙুল দেখিয়ে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে যায়।
একটা বছর দশেকের পুরোনো পাতলা র্যাপার গায়ে দিয়ে পাশ ফিরে কাশীনাথ শুয়ে। ভারতী খাটের ধারে দাঁড়িয়ে বলল, ‘বাবা ঘুমিয়ে পড়েছেন?’
মুখ না ফিরিয়েই কাশীনাথ বলল, ‘না’।
‘একটা কথা বলব বলে এসেছি। দোকানঘরটা ভাড়া দেওয়া হয়েছে।’
কাশীনাথের দিক থেকে সাড়া এল না।
‘আপনার ছেলে বলছিলেন এবার থেকে বাজার খরচটা উনিই দেবেন।’
কাশীনাথ নীরব। ভারতী মিনিটখানেক দাঁড়িয়ে থেকে ঘর থেকে বেরিয়ে এল।
পুলিন চিলড্রেনস পার্কের বেঞ্চে ঘণ্টাখানেক বসে থেকে ফিরে এল। গুহ ভবনের কোলাপসিবল গেট পেরিয়ে সিমেন্ট বাঁধানো উঠোন। বাঁদিকে ওপরে যাবার সিঁড়ির আগে সাত—আট হাতের একটা চাতাল। তার একদিকে দেওয়ালে ইলেকট্রিক মিটার বক্সগুলো, অন্যদিকে সার দিয়ে লেটারবক্স। সিঁড়িটা ঘুরে দোতলায় উঠেছে, ঠিক তার তলার ফাঁকা জায়গাটিতে পাঁচিল তুলে বানানো হয়েছে ছোট্ট একটা ঘর। তাতে দরজা আছে, মাথায় আছে টিনের আচ্ছাদন। ঘরে কেউ বাস করে না কারণ বাসযোগ্য নয়। ঘরটিকে সবাই ‘ফালতু ঘর’ বলে।
ছ—টা ফ্ল্যাটের প্রত্যেকটির লেটার বক্স আছে। পুলিন তাদের বক্সে শেষ কবে চিঠি পেয়েছে মনে করতে পারে না। উঠোন থেকে চাতালে পা রেখেই দেখল চারতলার প্রণববাবু লেটার বক্স থেকে চিঠি বার করছেন। পুলিনকে দেখে তিনি বললেন, ‘এই দুপুরে! কোথা থেকে?’
‘একটু কাজে বেরিয়েছিলুম। আপনি চললেন কোথায়, কলেজে?’
‘হ্যাঁ, তিনটের সময় ক্লাস।’ প্রণববাবু দক্ষিণ কলকাতায় একটি কলেজে বিজ্ঞানের শিক্ষক।
‘পুলিনবাবু একটা কথা জিজ্ঞাসা করব। আপনার বাবা কি এখান থেকে চলে যাবেন?’
হতভম্ব পুলিন শুধু বলল, ‘তার মানে!’
‘এমনিই বললাম, আমার এক ছাত্রকে পড়াতে যাই ভবানীপুরে। ছাত্রটির বাবা ফ্ল্যাট বাড়ি তৈরি করে বিক্রি করেন। পরশু পড়াতে গেছি দেখি আপনার বাবা ছাত্রের বাড়ি থেকে বেরোলেন, আমার পাশ দিয়েই গেলেন আমাকে দেখতে পেলেন না। কৌতূহল হল। ছাত্রের বাবাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ধুতিপরা যে ভদ্রলোক এইমাত্র বেরিয়ে গেলেন তিনি আমার নীচের ফ্ল্যাটে থাকেন; পাশ দিয়েই গেলেন অথচ আমাকে চিনতে পারলেন না! তখন তিনি বললেন, বেহালার পর্ণশ্রীতে একটা ষোলো ফ্ল্যাটের বাড়ি করছি। ওই ভদ্রলোক ঘুরতে ঘুরতে বাড়ি তৈরি হচ্ছে দেখে খোঁজ নেন। কেয়ারটেকারের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে এসেছিলেন কথা বলতে। উনি একটা একঘরের ফ্ল্যাট চান। একঘরের ফ্ল্যাট দুটি মাত্র, আর দুটিই বুকড হয়ে গেছে। শুনে ভদ্রলোকের কী আপশোস। বারবার বলতে লাগলেন কেউ যদি বুকিং ফিরিয়ে নেয় তাহলে অবশ্যই যেন ওকে একবার চিঠি দিয়ে জানাই। ঠিকানাও লিখে দিয়ে গেছেন, এই বলে তিনি কাগজটাও দেখালেন। দেখি আপনার বাবা কাশীনাথ রায়ের নাম আর এ বাড়ির ঠিকানা লেখা। বুড়ো মানুষ একা ফ্ল্যাটে থাকবেন কী করে, এটা তো যেকোনো মানুষকেই ভাবাবে, তাই জিজ্ঞাসা করলাম। আপনি কিছু মনে করলেন না তো।’
কথাগুলো বলতে প্রণববাবুর খুব বেশি দেড় মিনিট লাগল, পুলিনের জীবনের সবথেকে অবাক আর চেতনা অসাড় করা দেড়টা মিনিট।
‘না না না মনে করব কেন, বাবা রিটায়ার করার পর থেকেই তো একা থাকতে চাইছিলেন। হাঁপিয়ে উঠেছিলেন একই বাড়িতে একই ঘরে টানা প্রায় ষাট বছর বাস করে। একটা পরিবর্তন চাইছেন।’
প্রণববাবু আর কথা বাড়াননি। পুলিন উত্তেজিতভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠে এল তিনতলায়। ভারতী দরজা খুলে দিল। ভিতরে ঢুকেই পুলিন প্রথমে ঘরের ভিতরে তাকিয়ে দেখল কাশীনাথ র্যাপার মুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছে। ফিসফিস করে সে ভারতীকে বলল, ‘এ ঘরে এসো, কথা আছে।’
পুলিনের মুখের ভাব দেখে ভারতীর প্রথমেই মনে হল, স্বরূপ পোদ্দার কি ঘরটা নেবে না বলেছে? সে স্বামীর পিছনে প্রায় দৌড়ে গেল।
‘বাবা রোজ বেরিয়ে যায় কেন এইমাত্র জানতে পারলুম। উফফ কী লোক রে বাবা! নীচে প্রণববাবুর সঙ্গে দেখা, তিনি যা বললেন সে এক অবিশ্বাস্য কাণ্ড!’
‘কী বললেন প্রণববাবু?’
এরপর পুলিন যা শুনেছে হুবহু তা বলে গেল। শুনতে শুনতে ভারতীর চোখ কখনো বিস্ফারিত হল কখনো পাতা কুঁকড়ে গেল। কথা শেষ করে পুলিন পাশের ঘরের দেওয়ালের দিকে আঙুল তুলে বলল, ‘এতসব ভেবে রেখেছেন অথচ কিচ্ছুটি জানতে দেননি।’
ভারতী গালে হাত দিয়ে আনমনার মতো দেওয়ালটার দিকে তাকিয়ে। পুলিন বুঝল ভাবছে। ভাববার জন্য একটা সূত্র ধরিয়ে দিতে সে বলল, ‘প্রণববাবুকে তার ছাত্রের প্রোমোটার বাবা নিশ্চয় আরও কিছু বলেছে যেটা উনি আমাকে বলেননি।’
‘প্রণববাবুকে আরও কিছু বলেছে মানে?’
‘মানে একটা বুড়ো লোক একা একঘরের ফ্ল্যাটে থাকবেন কেন? নিশ্চয় কৌতূহলী হয়ে ভদ্রলোক বাবাকে জিজ্ঞাসা করেছেন, বাবাও একটা কারণ বলেছেন। কারণটা কী হতে পারে বলে তোমার মনে হয়? আমি তো প্রণববাবুকে একটা কারণ তখন মান বাঁচাতে বলে দিলুম। কিন্তু সেটা তো ঠিক নয়, বাবার মোটেই এই পাড়া এই বাড়ি এই ফ্ল্যাট একঘেয়ে লাগে না বরং অন্য কোথাও গেলে ডাঙায় তোলা মাছের মতো অবস্থা হবে।’
ভারতী বলল, ‘আমাদের পাড়ায় এক বিধবা বুড়ি ছিল। সে লোকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে খেতে চাইত, বলত ছেলেরা খেতে দেয় না, ছেলের বউয়েরা দুর ছাই করে বলে ঘাটে যাবেন কবে, নাতি—নাতনিরা একটুও মানে না। লোকেরা সহানুভূতিতে গলে গিয়ে খেতে দিত, পুরোনো ধুতিকাপড় পরার জন্য দিত। এমনকী এক আধ দিন থাকতেও দিত। বুড়ির ছেলে বউয়েরা সেইসব লোকেদের বাড়ি গিয়ে বলত, সব মিথ্যে কথা, ওকে খেতে যথেষ্টই দেওয়া হয়, পরার কাপড় বিছানা—বালিশ সব দেওয়া হয়, এমনকী হাতে দু—চার টাকাও দেওয়া হয়। বুড়ি সাতাত্তর বছর পেরিয়েছে তাই ভীমরতিতে ধরেছে। লোকে কিন্তু বিশ্বাস করেছিল বুড়িকেই। মারা যাওয়ার পর, যে ঘরটায় বুড়ি থাকত সেখানে একটা পলিব্যাগ থেকে আটশো টাকা, চারটে নতুন থানকাপড় আর বহুকালের বাসি সন্দেশ জিবেগজা বেরোল। বাবা এই বুড়ির মতো কিছু বলেননি তো?’
পুলিন চিন্তিত মুখে বলল, ‘হতেও পারে, আশ্চর্যের কিছু নয়। হয়তো বলেছেন ছেলে আর ছেলের বউ আমাকে দেখে না, ভালো করে খেতে দেয় না, বিদায় করতে পারলে বাঁচে, এমন হতশ্রদ্ধার মধ্যে আর থাকতে চাই না তাই আলাদা হয়ে থাকার জন্য একটা ফ্ল্যাট খুঁজছি।’
‘তোমার ধারণা যদি সত্যি হয় মানে বাবা যদি এইরকম কথা লোকটিকে বলে থাকেন, আর তিনি যদি তা প্রণববাবুকে বলে দেন তা হলে তো এ—বাড়িতে আমাদের মুখ দেখানোই দায় হবে।’ ভারতীর চোখে ভয় ফুটে উঠল।
‘হবেই তো। তবে এটা আমার অনুমান। অত ঘাবড়াচ্ছ কেন। ব্যাপারটা আসলে কী সেটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ওকে জিজ্ঞাসা করে জেনে নেবার চেষ্টা করব। ভালো কথা বাবা কী বললেন বাজার করা নিয়ে?’
‘জবাব দেননি, ঘুমের ভান করে রইলেন।’
শুনে কালো হয়ে গেল পুলিনের মুখ। বলল, ‘বিকেলে চা দেবার সময় একবার বোলো।’
কাশীনাথ বেরোবার জন্য ধুতি পাঞ্জাবি পাম্পশু পরে তৈরি। ভারতী চায়ের কাপ নিয়ে ঢুকল।
‘বউমা কী যেন বলছিলে তখন?’ কাপটায় চুমুক দিয়ে কাশীনাথ তাকিয়ে রইল।
‘দোকান ঘরটা একজনকে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। আপনার ছেলে বলছিল এবার থেকে বাজারটা উনিই করবেন, আপনাকে আর টাকা দিতে হবে না।’ ভারতী আশা—নিরাশা মেশানো অনুভূতি নিয়ে অপেক্ষা করল।
‘ভালোই তো! পুলিন বড়ো হয়েছে, বাবাও হয়েছে, খরচ—খরচার সব দায়িত্ব তো ওরই নেওয়ার কথা। আমিও এইভাবে নিয়েছিলুম। তোমাদের ছেলেটিও ভবিষ্যতে নেবে। শুধুই বাজার করা, আর সব খরচ নেবে না কেন?’
ভারতী শ্বশুরের প্রথমদিকের কথায় আশান্বিত হচ্ছিল, শেষ বাক্যটিতে প্রমাদ গুনল। দু—হাজার টাকায় মাস চালানো হয়তো যায় কিন্তু সেটা হবে গরিবদের মতো। সামনের বছরই অনিকে কিন্ডারগার্টেন স্কুলে ভরতি করাবে বলে তারা ভেবে রেখেছে। সেও একটা খরচ যা বছর বছর বাড়তে থাকবে, ভাড়ার টাকা আর বাড়বে না!
‘ভাড়ার টাকাটা এমন নয় যে সব কিছু খরচের দায় নেওয়া যায়।’
ভারতীর স্বরে প্রায় ভিক্ষুকের মিনতি, ‘বাকি সবকিছু আপনি যেমন দিচ্ছেন তেমনিই দেবেন।’
‘না, দোব না’।
ভারতী অবিশ্বাসী চোখে তাকাল। রূঢ় প্রত্যাখান সে আশা করেনি, তার চোখে জল এসে গেল।
‘বাবা তাহলে আমরা যে বিপদে পড়ে যাব।’
‘পড়লে পড়বে। যদি রান্নাবান্না বন্ধ হয়ে যায় যাবে। ইলেকট্রিক লাইন যদি কেটে দেয় দেবে। ভাড়া বাকি পড়লে যদি মামলা হয় হবে। আমি আর কোনো কিছুর মধ্যে নেই।’
ভারতী মাথা নামিয়ে দাঁড়িয়ে। খালি কাপ রেখে দিয়ে কাশীনাথ তার পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল। ভারতী ডাকল, ‘বাবা। আমরা কী অপরাধ করেছি?’
থমকে দাঁড়াল কাশীনাথ। ‘তোমরা করোনি আমি করেছি। অপদার্থ পুত্রের জন্ম দিয়ে। আমার কষ্ট তোমরা বুঝবে না, ছেলে বড়ো হোক তখন টের পাবে।’ বলেই সে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে গেল।
ভারতীর মনে হল কাশীনাথ এমনভাবে ‘তখন টের পাবে’ কথাটা উচ্চচারণ করল যেন অভিশাপ দিল। অনি বড়ো হলে কী হবে, আর এক পুলিন? সে খাটের উপর ধীরে ধীরে বসে পড়ল। অনেকক্ষণ থম হয়ে থেকে সে ঠিক করে ফেলল অনিকে সে নিজে বড়ো করে তুলবে। সেজন্য শ্বশুরের সব গঞ্জনা সে সহ্য করবে। যত কষ্ট করতে হয় করবে, ছেলের গায়ে কষ্টের আঁচড়টুকু লাগতে দেবে না।
সেদিন রাতে পুলিন চারতলায় গেল প্রণববাবুর সঙ্গে দেখা করতে। তিনি রেডিয়ো শুনছিলেন। পুলিনকে দেখে অবাক হয়ে বললেন, ‘ব্যাপার কী?’
‘ব্যাপার কিছুই নয়, একটা অনুরোধ নিয়ে এসেছি। ভবানীপুরে আপনার ছাত্রের বাবাকে একটা কথা যদি বলে দেন তা হলে আমরা শান্তি পাব স্বস্তি পাব।’
‘কীরকম অনুরোধ?’
‘তিনি যেন বাবাকে ফ্ল্যাট বিক্রি না করেন। কেউ বুকিং ছেড়ে দিলেও যেন চিঠি দিয়ে বাবাকে না জানান। বাবার শরীর একদম ভালো নয়, একটা স্ট্রোকের মতো হয়ে গেছে, ডায়বিটিসও আছে। একা থাকবেন, যদি হঠাৎ কিছু হয়ে যায়, তখন কে দেখবে, কে ডাক্তার ডাকবে, কে হাসপাতালে নিয়ে যাবে? এসব কথা ভদ্রলোককে জানিয়ে দেবেন। বাবা এইসব কথা জানিয়েছে কিনা জানেন?’ পুলিন সাক্ষীকে জেরা করা উকিলের মতো তাকিয়ে রইল।
‘আমি বলতে পারব না কী জানিয়েছেন। তবে এইটুকু বলতে পারি লোকটি অত্যন্ত ব্যস্ত মানুষ, যা করবেন না বা পারবেন না তাই নিয়ে সময় নষ্ট করেন না। আপনার বাবার সঙ্গে পাঁচ মিনিটের বেশি কথা বলেছেন বলে তো মনে হয় না। তার মধ্যে অসুখবিসুখের কথা শুনবেন এমন লোক উনি নন। যাই হোক চা খাবেন?’
পুলিন মনে মনে আশ্বস্ত বোধ করছে। বাবা মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ছেলেবউয়ের নামে নিন্দে মন্দ করে ফেলতে পারবে না। এজন্য কম করে মিনিট পনেরো কথাবার্তা আর শ্রোতার আগ্রহ থাকা দরকার, দুটোই নিশ্চয় পাননি।
চা খেয়ে ইস্ট বেঙ্গল ক্লাবের কট্টর ভক্ত প্রণবের সঙ্গে মোহনবাগান সমর্থক, যদিও কখনো খেলা দেখতে ময়দানে যায় না, পুলিন কলকাতার ফুটবলে কে সেরা তাই নিয়ে কিছু তর্কাতর্কি করে সময় কাটিয়ে নীচে নেমে আসে।
‘কথা বললুম প্রণববাবুর সঙ্গে, নিশ্চিন্ত থাকতে পার বাবা আমাদের সম্পর্কে কিছু বলেননি। ওহহ কী ভয়েই না ছিলুম।’ পুলিন রাত্রে খাবার টেবিলে বসে নীচু গলায় বলে। ভারতী কোনোরকম আগ্রহ দেখাল না এই নিয়ে কথা বলায়। পুলিন তাইতে আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘আমার কথাটা কী শুনতে পেলে না?’
‘পেয়েছি।’
ঘুমন্ত অনিকে কলঘর থেকে ঘুরিয়ে এনে বিছানায় শুইয়ে ভারতী ভূমিকা না করেই বলল, ‘বাবা বলেছেন আর সংসারের খরচ দেবেন না। তোমাকেই সব টানতে হবে।’
ধড়মড়িয়ে উঠে বসল পুলিন।
‘সব খরচ মানে?’
‘সব খরচ মানে সব খরচ। ঝিয়ের মাইনে থেকে গ্যাসের দাম, কাগজের দাম, ইলেকট্রিক বিলও।’ নিস্পৃহ গলায় বলল ভারতী। অন্ধকারে স্ত্রীর মুখটা দেখার ব্যর্থ চেষ্টা করে পুলিন বলল, ‘এইভাবে টাইট দিচ্ছেন। ঠিক আছে আমিও দোব। কাল থেকে সবাই কচু ভাতে ভাত খাব, বাবাকেও তাই দিয়ো।’
‘আমি নয় তুমি দিয়ো। তবে বলে রাখছি অনিকে কচু ভাতে কিন্তু খাওয়াতে পারব না।’
পরদিন পুলিন বাজার থেকে আর কিছু না কিনে মানকচুর একটা দু—কেজির খণ্ড কিনে আনল। দেখে হতভম্ব হয়ে গেল ভারতী।
‘সত্যি সত্যিই তা হলে আনলে! ঠিক আছে সেদ্ধ করে দিচ্ছি তোমরা খেয়ো, আমি পারব না উপোস দোব।’
ভারতী কচু সেদ্ধ করে তেল নুন কাঁচালঙ্কা দিয়ে চটকে দলা পাকিয়ে রেখে ভাতের হাঁড়ি টেবলে বসিয়ে দিয়ে, গলা চড়িয়ে ঘরে শুয়ে কাগজ পড়া পুলিনকে উদ্দেশ করে বলল, ‘বাবা এলে ভাত বেড়ে দিয়ো। তুমিও খেয়ে নিয়ো। অনিকে নিয়ে আমি বেরোচ্ছি।’
‘বেরোচ্ছি মানে!’ খবর কাগজ হাতে পুলিন ঘর থেকে বিস্মিত মুখে বেরিয়ে এল। ‘এখন এগারোটার সময় কোথায় যাবে।’
বাচ্চচা অনিকে জুতো পরাতে পরাতে ভারতী বলল, ‘যেদিকে দু—চোখ যায় যাব। বুড়ো মানুষকে আমি শুধু কচুভাতে ধরে দিতে পারব না।’
‘শুধু কচুভাতে কেন? কাল বেগুন এনেছি কুমড়ো পটল আলু এনেছি। এসবই কি রেঁধে ফেলেছ কাল?’
‘কিছু আছে এখনও। ওগুলো রাঁধলে তুমি টাইট দেবে কী করে? ভাড়ার টাকাগুলো আলমারির ওপরের তাকে আছে, ওখান থেকে যা পারো কিনে এনে খেয়ো।’
দড়াস করে দরজা বন্ধের শব্দ পুলিনকে ভাবিয়ে দিল। ভারতীর মধ্যে এত রাগ থাকতে পারে সেটা জানা ছিল না তার। ছেলেকে নিয়ে এখন গেল কোথায়, এই বাড়িরই অন্য কোনো ফ্ল্যাটে না শ্যামসুন্দরের মন্দিরে? কোন ফ্ল্যাটে সে খোঁজ নেবে? দু—ঘরের ফ্ল্যাটে দুপুরবেলায় বাইরের স্ত্রীলোক এসে বসে থাকলে বাসিন্দারা যে বিরক্ত হবে এ বোধটা ভারতীর আছে। আর একটা জায়গার কথা তার মনে পড়ল, বাপের বাড়ি! এটা তার প্রথমেই ধরে নেওয়া উচিত ছিল।
পায়ে চটি গলিয়ে পুলিন বেরিয়ে পড়তে যাচ্ছে তখনই ফিরল কাশীনাথ। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে সে ঘরে ঢুকে গেল।
দরজার কাছ থেকে পুলিন চেঁচিয়ে বলল, ‘টেবিলে ভাত আছে খেয়ে নিয়ো।’
জবাবে কাশীনাথ বলল, ‘বউমাকে দেখলাম ছেলেকে নিয়ে পার্কে বসে রয়েছে।’
পুলিন বেরোল তবে শ্বশুড়বাড়ির দিকে নয়, পাড়ার চিলড্রেন্স পার্কের উদ্দেশে। ঘিঞ্জি বসতবাড়ি সমৃদ্ধ এলাকার মধ্যে ওয়েসিসের মতো একচিলতে খোলা রেলিংঘেরা জমি। অল্প ঘাস আছে, মাঝখানে একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ, পাঁচ বছর আগেও পার্কটি রেলিংঘেরা ছিল, এখন কোমর সমান ইটের পাঁচিল। চারদিকে চারটি কাঠের বেঞ্চ ছিল, এখন তা সিমেন্টের। তার একটিতে ভারতী বসে, অনি পাঁচিলের মাথা ধরে ঘুলঘুলিতে পা রেখে ওঠা যায় কী করে সেই চেষ্টায় ব্যস্ত।
‘একী! এখানে এভাবে বসে? লোকে দেখলে বলবে কী?’ পুলিন বিরক্ত ক্ষুব্ধ স্বরে বলল, ‘চলো, বাড়ি চলো। খুব রাগ দেখানো হয়েছে, বাবা ফিরেছেন।’ অনিকে কোলে তুলে নিল পুলিন। ভারতী কথা না বলে থমথমে মুখে উঠে দাঁড়াল।
বাইরের দরজা ভেজানো। পুলিন পাল্লা ঠেলে ঢুকতে গিয়ে থমকে রইল। কাশীনাথ টেবলে বসে ভাত খাচ্ছে। ভারতী পিঠে ঠেলা দিয়ে বলল, ‘ঢোকো।’
দু—জনকে দেখে কাশীনাথ বলল, ‘বউমা ভাতে করলে কেন, পুলিন খুব ভালো কচুই এনেছে, বাটা করলে আরও ভালো খেতে লাগত। কাল বাটা কোরো।’
অনিকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়েছে পুলিন। কাশীনাথ হাত বাড়িয়ে ডাকল, ‘এসো দাদু একটু খেয়ে যাও।’
‘না।’ বলেই ভারতী টেনে নিল ছেলেকে।
কাশীনাথ অবাক চোখে তাকিয়ে বলল, ‘যে খাবার ওকে খেতে দেবে না সেটা বুড়ো শ্বশুরকে খেতে দেওয়া যায়! এ খাবার তোমরাও খাওনি তার বদলে বাইরে থেকে খেয়ে এলে।’
‘না আমরা বাইরে খাইনি।’ পুলিন জোরে প্রতিবাদ করতে চেষ্টা করল কিন্তু গলার স্বর বসে গেল।
ভারতী ছুটে গিয়ে ভাতের থালাটা তুলে নিয়ে রান্নাঘরে যেতে যেতে বলল, ‘আর খেতে হবে না আপনাকে। ঘরে যা আছে তাই দিয়ে আপনাকে রেঁধে দিচ্ছি।’
কাশীনাথ মিট মিট করে ছেলের দিকে তাকিয়ে নীচু গলায় বলল, ‘হারামজাদা, জব্দ করবি ভেবেছিলিস? জব্দ করতে হলে ক্ষমতা থাকা চাই। তোর মতো অপদার্থ রামছাগলের কম্ম নয় কাশীনাথ রায়কে জব্দ করা।’ এরপরই গলা তুলে বলল, ‘কাল ইলেকট্রিক বিল জমা দেবার শেষ দিন। মনে করে টাকা নিয়ে যাবি।’
বাধ্য ছেলের মতো মাথা নেড়ে পুলিন নিজের ঘরে ঢুকে গেল। কাশীনাথ উঠে রান্নাঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়াল।
‘এই কুচুটে বুদ্ধিটা কার, তোমার?’
দুটো বার্নার জ্বালিয়ে ভারতী রাঁধছিল। মুখ না ফিরিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল, ‘হ্যাঁ। কাল—পরশুই গ্যাস দিয়ে যাবে, টাকাটা বার করে রাখবেন আর সারাদিন টোটো করে ঘুরে বেড়ানোটা বন্ধ করুন, ওভাবে ফ্ল্যাট খুঁজে বার করা যায় না।’
কাশীনাথ বলল, ‘ফ্ল্যাট খুঁজছি কে বলল?’
‘আমার কুচুটে বুদ্ধি বলল। এখানে আপনার অসুবিধেটা কী হচ্ছে?’
‘কিছুই হচ্ছে না, শুধু পুলিনটাকে সহ্য করতে পারছি না।’ বলেই কাশীনাথ তার ঘরে ফিরে এল।
এরপর কাশীনাথ তৈরি হতে থাকা বাড়ি খুঁজে বার করার জন্য আর কলকাতা চষে বেড়ায়নি। তার বদলে গুহ ভবনের তিন তলায় নিজের ঘর থেকেই ছেলে আর ছেলের বউ—এর জীবন নাজেহাল করে তোলায় ব্যস্ত থেকেছে বছরের পর বছর। বয়স যত বেড়েছে ততই রুক্ষ অযৌক্তিক হয়েছে তার আচরণ, বাজার খরচ বাদে সংসারের যাবতীয় খরচ মায় নাতির বিদ্যাশিক্ষার দায়ও সে বহন করে গেছে। একমাত্র সেই যে পরিবারের প্রধান পুরুষ এই অভিধাটিকে পুলিন ও ভারতীর চেতনায় ঢুকিয়ে দিতে দিনের পর দিন সে কঠিন কর্কশ বাক্যে, ক্রীতদাসদের প্রতি প্রভুর মতো ব্যবহারে, সুযোগ পেলেই পুলিনকে অপমানকর কথা বলে বুঝিয়ে দিয়েছে এই সংসার টিকে আছে তার দয়ায় তার টাকায়।
বিরাট আশা ছিল কাশীনাথের ব্যবসা করে পুলিন ধনী হবে নামি হবে। আশাভঙ্গের যন্ত্রণা সে শোষণ করে নিতে পারেনি, যন্ত্রণা সে ফিরিয়ে দিয়েছে পুলিনকে। তার দৃঢ় ধারণা বা বদ্ধমূল বিশ্বাস ছেলে তাকে ঠকিয়েছে, তার প্রত্যাশার অবমাননা করেছে, মমতাহীন ছিল সে পুলিনের প্রতি। ভারতীর জন্য বরাবরই একটা চাপা স্নেহ সে লালন করে এসেছে। নিজে পছন্দ করে যাকে ঘরে এনেছে সে কখনো মন্দ হতে পারে না, তার কোনো খুঁত থাকতে পারে না এমন একটা আত্মম্ভরিতা সে পোষণ করে।
কাশীনাথের সবথেকে দুর্বল জায়গা তার নিজের চেহারা। সে জানে হাস্যকরভাবে সে অসুন্দর। একবার হাওড়ায় যাচ্ছিল বাসে কাজে যোগ দিতে। বাসে একজনের পকেটমার হয়। সারা বাস পকেটমার সন্দেহে তার দিকেই তাকাতে থাকে। বাস থেকে নামিয়ে তার শরীর তল্লাসি করেছিল তিনজন। ভিড় জমে যায়। সেদিনের অপমান আর লজ্জা এখনও সে বহন করে চলেছে। তার ধারণা এটা ঘটেছিল তার চেহারার জন্য। এইজন্য সে উপেক্ষিত হয় লোকবহুল অনুষ্ঠানে এবং কর্মস্থলেও।
অনীশের স্কুলের বা কলেজের বন্ধুরা প্রায়ই আসত। তারা এলেই ছুতো করে কাশীনাথ বেরিয়ে যেত গুহ ভবন থেকে। অনীশ এটা লক্ষ করে একদিন বলেছিল, ‘দাদু আমার বন্ধুরা এলেই দেখেছি, তুমি বেরিয়ে যাও, কেন?’
কাশীনাথ দুর্বল একটা প্রতিবাদ করার চেষ্টা করে বলেছিল, ‘কে বলল তোর বন্ধুরা এলেই বেরিয়ে যাই। বাইরে কী আমার কাজকম্ম থাকতে পারে না? তোদের কথার মধ্যে আমি বসে থেকে কী করব। তার থেকে বরং ওই সময় লন্ড্রি থেকে কাপড়গুলো আনা যায়। সেদিন কলঘরের টিউবলাইটটা কিনতে বেরিয়েছিলুম।’
বাইরের কেউ উপেক্ষা বা অবজ্ঞা করলে কাশীনাথ তা সহ্য করতে পারে না।
অনীশের এক কলেজের বন্ধু তার খোঁজে প্রথমবার এসে দরজা খুলেই দাঁড়ানো কাশীনাথকে বলেছিল, ‘অনীশ আছে?’ কাশীনাথ বলেছিল, ‘বেরিয়েছে।’ বন্ধুটি ইতস্তত করে বলে, ‘খুব দরকার ছিল, এই বইটা ওকে দিয়ে দেবেন রেয়ার দামি বই, হারাবেন না যেন। আর বলবেন আজ বিকেলে যেন অবশ্যই কফি হাউসে অপুর সঙ্গে দেখা করে।’ এই বলে অনীশের বন্ধু মোটা একটা পুরোনো বই কাশীনাথের হাতে দিল। ঠিক তখনই ভিতর থেকে পুলিন উৎসুক মুখে বেরিয়ে আসে। তাকে দেখা মাত্র অনীশের বন্ধু কাশীনাথের হাত থেকে বইটি প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে পুলিনকে জিজ্ঞাসা করে, ‘আপনি কি অনীশের বাবা?’ পুলিন ‘হ্যাঁ’ বলতে সে বইটা পুলিনের হাতে দিয়ে বলে, ‘এটা অনিশকে দিয়ে দেবেন, ও চেয়েছিল। ছেঁড়াখোড়া বই একটু যত্ন করে রেখে দেবেন। আমার নাম অপু, বিকেলে কফি হাউসে থাকব, ও যেন আমার সঙ্গে দেখা করে।’ যাবার আগে বন্ধুটি আবার বলল, ‘বইয়ের অনেক পাতা খোলা রয়েছে, আপনি যেন খোলাখুলি করবেন না।’
তরুণটি চলে যাবার পরই কাশীনাথ রাগে ফেটে পড়ল।
‘আপনি কি অনীশের বাবা?’ অনীশের বন্ধুর গলা নকল করে ভেংচে ওঠে কাশীনাথ। ‘আমাকে বিশ্বাস করল না। অনির সঙ্গে আমার চেহারার মিল নেই তাই করল না।’
এর পাঁচ বছর পর অনীশের হবু শ্বশুর শিবেন ভট্টাচাযকে তার স্ত্রী ও মেয়ের সামনে কাশীনাথ বলে দেয়, ‘বরের বাড়ি যেমন চাইবে তেমনভাবেই বিয়ে হবে।’
বিয়ে অবশ্য তেমনভাবে হয়নি। অনীশ যেমন চেয়েছিল সেইভাবেই হয়। পুলিন ও ভারতী আর বরের সঙ্গে বরযাত্রী হয়ে প্রণববাবু, উমার দুই ভাইও টালিগঞ্জে যায় ভাড়া করা মিনিবাসে, কাশীনাথ একা ছিল ফ্ল্যাটে। বউভাতেও সারা গুহভবন মায় দারোয়ান ও ঠিকে ঝি পর্যন্ত বাড়ির আধ মাইল দূরে ভাড়া নেওয়া ‘মিত্রা হাউসে’ নিমন্ত্রণে যায়, কাশীনাথ থেকে যায় ফ্ল্যাটে একা।
‘যাব না। আমার ইচ্ছে। আর কিছু বলার আছে?’ তিনটি বাক্যে কাশীনাথ বুঝিয়ে দিয়েছিল তাকে নড়ানো যাবে না সিদ্ধান্ত থেকে। কেউই তাকে জোরাজুরি কী মিনতি পর্যন্ত করেনি।
তারা রাত্রে কোথায় শোবে? প্রশ্নটার উত্তর খুঁজতে খুঁজতে শেষপর্যন্ত বউভাতের এক সপ্তাহ আগে ভারতী হাল ছেড়ে দিয়ে বলে, ‘বাবার খাটের পাশে, যেখানে ফোল্ডিং খাটে অনি শোয়, সেখানেই মেঝেতে শোব, কী আর করা যাবে! ইট দিয়ে ওনার খাট উঁচু করতে রাজি না হলে তখন কষ্ট করে রাত কাটানো ছাড়া আর উপায় কী?’
পুলিন বলেছিল, ‘ইটের কথাটা বাবাকে বলে দ্যাখো। ওখানে যদি শুতে হয় তাহলে সাইজমতো তোশক করাতে হবে। এতবড়ো বালিশগুলো জায়গাটায় আঁটবে না।’
‘দোকান থেকে রেডিমেড কিনে আনো। আমাদের পুরোনো বালিশে নতুন ওয়াড় পরিয়ে আপাতত ওরা কাজ চালাক। অনি বলেছে আস্তে আস্তে সব নতুন করে নেবে। দরজা জানলায় পর্দাও ঝোলাবে। খাওয়ার টেবিলটা বাঁদিকে একটু সরাতে হবে ফ্রিজ রাখার জন্য। নতুন টিভিটা আমি বলি কী ওদের ঘরেই থাকুক। কেবলওয়ালাকে তুমি বলে রেখো লাইন নোব। বাবার ঘরেরটা যেমন আছে তেমনই থাকুক।’
পুলিন শিউরে উঠে বলে, ‘ওরে বাবা, এই সেটটা তো ওনার স্মৃতিস্তম্ভ। নড়ানড়ির কোনো প্রশ্নই ওঠে না। ফ্রিজ, কালার টিভির কথা কিচ্ছু এখন ওকে বোলো না। আগে ইটের কথাটা পেড়ে দেখো কী হয়!’
সাইকেলের ধাক্কা খাওয়ার পর কাশীনাথ গুহ ভবনের গেটের বাইরে একা যান না, শুধু মাসে একবার বাড়ি থেকে তিনশো গজ দূরের ব্যাঙ্কে পেনশন তুলতে যান, সঙ্গে থাকে পুলিন কেননা সেন্ট্রাল অ্যাভিন্যুটা পার হতে হয়। ট্র্যাফিক পুলিশ গাড়ি থামিয়ে ওকে রাস্তা পার হতে সাহায্য করে।
বিকেলে ছাদে পায়চারি করে নেমে আসতেই ভারতী চা দিয়ে কাশীনাথকে বলল, ‘বাবা এখন কিছু খাবেন?’
শ্বশুরকে নরম অবস্থায় পাওয়ার জন্য কী করতে হবে ভারতী তা জানে। যেসব মুখরোচক খাদ্য বা কুখাদ্য পঞ্চাশ—ষাট বছর আগে খেয়েছিলেন স্মৃতি থেকে সেগুলো এখন টেনে বার করাই তার শখ।
‘খিদে তেমন এখন পাচ্ছে না। বাড়িতে পলতা আছে?’
‘নেই।’
‘থাকলে বলতুম ব্যাসন দিয়ে পলতার বড়া ভেজে দাও। পুলিনকে কাল বাজার যাওয়ার সময় বলে দিয়ো যেন কাঁকড়া আনে, কোম্পানির বাগানের কাছে ফটিকের দোকানে লঙ্কা মাখানো লালরঙের কাঁকড়া ভাজা পাওয়া যেত, যেমন ঝাল তেমনি টেস্ট। ওর দোকানটা মোদো মাতালের আড্ডা ছিল। কাছেই তো রামবাগান!’
ভারতী শুনেছে রামবাগান বেশ্যাপাড়া। দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল তার মাথায়। ‘বাবা আপনি রামবাগানে মাতালদের দোকানে গিয়ে খেতেন?’
ভারতীর চোখেমুখে গলার স্বরে বিস্ময় ভেঙে পড়ল। কাশীনাথ তাই দেখে সন্ত্রস্ত হয়ে তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘রামবাগানে কে বলল, কোম্পানি বাগানের কাছে বলেছি। আমি তো একদিন মাত্র বিকেলে কিনে খেয়েছি, আমার সঙ্গে বাদু আর সত্যও ছিল। মাতালরা তো বিকেলে আসত না, সন্ধের পর আসত।’
কটুভাষী বদরাগী শ্বশুরকে এভাবে কৈফিয়ত দিতে দেখে ভারতী বুঝে গেল সর্বদা উঁচিয়ে থাকা ওর আক্রমণের অস্ত্রগুলো এখন নীচে নেমে গেছে। সে সুযোগটা নিয়ে বলল, ‘বাবা, একটা কথা বলব। অনির বিয়ে হলে আমাদের দু—জনের রাতে শোয়ার অসুবিধা হবে সেটা তো জানেন।’
‘জানিই তো।’
‘এই ঘরেই মেঝেতে শুতে হবে এইটুকু ফালি জায়গায়। তাই বলছিলুম কী খাটটা যদি ইট দিয়ে একটু তুলে দেওয়া যায় তাহলে কিছুটা জায়গা বেরোবে। অনেকের বাড়িতেই তো এভাবে শোয়।’ ঝুলি থেকে বেড়ালটা বার করে ভারতী দুরুদুরু বুকে তাকিয়ে রইল।
‘পারবে ওভাবে দু—জনে শুতে? যদি পারো তাহলে তুলে দাও, শুধু তো রাতটুকু থাকা।’
হাঁফ ছেড়ে ভারতী বলল, ‘কালই পলতার বড়া আপনাকে খাওয়াব। কিন্তু বাবা, কাঁকড়া কী করে ভাজতে হয় আমি জানি না।’
‘জান না! ঠিক আছে অন্যভাবে রাঁধো। তোমার শাশুড়ি কাঁকড়া বানাত লাউ চিংড়ির মতো। পুলিনকে বোলো কাল একটা লাউও আনতে।’
‘সে তো কালকের ব্যাপার, এখন কী খাবেন?’ ভারতী খুশি চাপতে চাপতে বলল। ইট এখন সে চিবিয়ে চিবিয়ে খেতে পারে। চিড়ে ভাজা করে দোব? পেঁয়াজ, কাঁচালঙ্কা, চিনে বাদাম, ধনেপাতা, গোলমরিচ গুঁড়ো দিয়ে?’ ভারতী দু—সেকেন্ড থেমে বলল, ‘শশা আছে দোব? ঝুরি ভাজাও আছে।’
ভারতী দেখল তার চুরাশি বছর বয়সি শ্বশুরের গলার কণ্ঠা নড়ে উঠল।
বলাকার সঙ্গে মানিয়ে নিতে কোনো অসুবিধে হয়নি ভারতীর কেননা শাশুড়িদের মতো বিধিনিষেধ আরোপ বা বউয়েদের করণীয় কাজ সম্পর্কে সে কখনো একটি কথাও বলেনি। সে জানে মেয়েটি চাকরি করে, প্রায় আট—ন ঘণ্টা বাইরে থাকে, লেখাপড়া করেছে। হাসে না, কথা কম বলে এবং যথেষ্ট পরিণত। বলাকা যতক্ষণ ফ্ল্যাটে থাকে নিজের ঘরেই বেশিরভাগ সময় থাকে। সে অফিসে বেরিয়ে যাওয়ার পর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘরটার দখল পায় পুলিন আর ভারতী।
প্রায় তিরিশ বছর যে ঘরে দু—জনে দিনরাত বাস করেছে, সে ঘরকে তারা বলে এসেছে ‘আমাদের ঘর’ সেই ঘরই এখন তাদের কাছে অন্যরকম লাগে। এটা এখন ‘ওদের ঘর’। অভ্যাস বশে ভারতী একবার ঢুকে পড়েছিল, বলাকা তখন গা ধুয়ে খাটে লম্বা হয়ে শুয়ে ট্রেনে কেনা ম্যাগাজিন পড়ছিল। মুখের সামনে থেকে সেটা নামিয়ে জিজ্ঞাসু চোখে শুধু তাকায়। অপ্রতিভ ভারতী তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসেছে।
ঘরের কাঠের আলমারিটা ছিল ভারতীর শাশুড়ির, সেটাই সে তিরিশ বছর ধরে ব্যবহার করে এসেছে, এটাকে ঘর থেকে বার করে নেওয়া হয়নি কেননা আর কোথাও রাখার জায়গা নেই। এখনও তার আর পুলিনের এবং কাশীনাথেরও জামাকাপড় তাতে রয়েছে। অনীশ আয়না লাগানো একটা স্টিলের আলমারি থেকে বার করা দরকার। ইতস্তত করে ভারতী ঘরে ঢুকে চাবি দিয়ে পাল্লা খুলে জিনিসটি বার করে নিয়েই দ্রুত বেরিয়ে এসেছে। তার তখন মনে হয় নিজেকে অনধিকারীর মতো।
দুপুরে ওদের ঘরের খাটে পুলিন আর ভারতী পাশাপাশি শুয়ে সকাল থেকে দাঁড়ানো, চেয়ারে বসা আর হাঁটাচলা করা শরীরকে বিশ্রাম দেয়। এমনই এক দুপুরে ভারতী বলে, ‘মনে হচ্ছে না চুরি করে অন্যের ঘরে শুয়ে আছি।’
পুলিন বলে, ‘ঘরের কোনো জিনিসে হাত দিতে ভয় করে। এধার—ওধার হলে ধরে ফেলতে পারে বউমা, আর তখন যদি দুটো কথা শোনায়! অবশ্য জানি কিছু বলবে না, তেমন মেয়ে নয় তাহলেও—।’
‘তাহলেও কী?’
‘তাহলেও কেন জানি মনে হয় হয়তো বলবে এবার থেকে ঘরে তালা দিয়ে বেরোব।’
ভারতী বলল, ‘তুমি একটু বেশি বেশি ভাব। বউমা মোটেই ওরকম মেয়ে নয়। অত্যন্ত ভদ্র আমাকে সম্মান দিয়ে কথা বলে, সংসারের কোনো ব্যাপারে নাক গলায় না।’
পুলিন বলল, ‘বড্ড গম্ভীর, ভালো করে কথা বললেও মনে হয় যেন অসন্তুষ্ট হয়ে কথা বলছে। বোধহয় নানা ধরনের লোকের সঙ্গে কথা বলতে বলতে এমন গলা হয়ে গেছে। ব্যাঙ্কের চাকরি তো।’
ভারতী বলল, ‘গম্ভীর মনে হয় ওর মুখটার জন্য। ছেলেমেয়েরা যেন মায়ের মুখ না পায়।’
‘আমি কিন্তু মায়ের মুখ পেয়েছি, গায়ের রংটাও, বাবা তাই চেয়েছিলেন।’
‘অনির মুখ কার মতো হোক চেয়েছিলে?’
‘ওর মায়ের মতো।’
ভারতী পুলিনের বাহুতে চিমটি কেটে বলল, ‘মিথ্যে কথা এই বুড়ো বয়সে আর বোলো না।’
‘বলব না কেন, অনির মাকে তার শ্বশুর পছন্দ করেছিল তো মুখ আর রং দেখে। বাবা কিন্তু বলাকাকে কেন জানি একদম পছন্দ করেন না। ভয় হয় কোনোদিন কী ফট করে ওকে বলে বসেন।’
ভারতী বলল, ‘বুঝতে পারি না অনি কী দেখে বলাকাকে পছন্দ করল, মনে হয়তো দু—জনে সমবয়সি।’
পুলিন বলল, ‘আমারও মনে হয়েছে কী করে পছন্দ করল, বোধহয় চাকরি করে বলে, এখন তো ব্যাঙ্কের মাইনে ভালো।’
ক্ষুব্ধ স্বরে ভারতী বলল, ‘তুমি বলছ টাকার লোভে অনি বিয়ে করেছে?’
পুলিন লজ্জিত স্বরে বলল, ‘আরে না না তুমি ওইভাবে দেখছ কেন, কখন কী হয়ে যায় মানুষের কেউ কী তা বলতে পারে, বউ স্বাবলম্বী হলে বউ ছেলেমেয়ে বিপদে পড়বে না। অনি ভালোই করেছে।’
কিছুক্ষণ দু—জনে চুপ থাকার পর ভারতী বলল, ‘মনে হয় বউমার বাচ্চচা হবে।’
পুলিন কথা বলল না। ভারতী পিঠ ফিরিয়ে চোখ বন্ধ করল।
বলাকার সন্তান প্রসবের কুড়ি দিন আগে বিরোধের মেঘ ঘনিয়ে উঠল। বিকেলে কাশীনাথ পুত্রবধূকে ডেকে জানতে চাইলেন, ‘নাতবউয়ের বাড়ির লোকেদের বলেছ মেয়েকে নিয়ে যেতে।’
‘কেন বাবা?’ ভারতী হঠাৎ এমন একটা কথায় অবাক হল।
‘কেন কী! মেয়েদের প্রথম সন্তান বাপের বাড়িতে হয়। পুলিন হয়েছিল, আমিও হয়েছি। তুমি কোথায় হয়েছ?’
‘হাসপাতালে, তবে আমি প্রথম সন্তান নই। দাদা হয়েছে মামার বাড়িতে কোতরংয়ে।’
‘তবে! অনিকে বলো শ্বশুরবাড়িতে জানাতে। ওদেরও তো দায়দায়িত্ব আছে প্রথম মেয়ের প্রথম সন্তান। ওদের তো নিজের থেকে বলা উচিত।’
শ্বশুরের কথাটা ভারতীর মনে ধরল। সন্ধ্যায় শ্যামনগর থেকে বলাকা ফিরে আসার পর যখন সে গা ধুয়ে ঘরে এসেছে তখন ভারতী পরোটা আর তরকারির প্লেট ছোট্ট টেবলটায় রেখে বলল, ‘বউমা তোমার মা কী বলেছেন কোথায় ডেলিভারি হবে?’
বিস্মিত চোখে বলাকা কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে বলল, ‘কেন, নার্সিং হোমে হবে! যে ডাক্তারকে দেখাচ্ছি তিনি ‘পরিচর্যা’ নার্সিং হোমের সঙ্গে অ্যাটাচড, ওখানেই ভরতি হব।’
শুনে থিতিয়ে গেল ভারতী। নার্সিং হোমের ব্যবস্থা ইতিমধ্যেই তাহলে করে রাখা হয়েছে অথচ সে তা জানে না। ব্যবস্থাটা নিশ্চয় অনিই করেছে, তাকে একবার বলতেও তো পারত।
‘প্রথম সন্তান, বাপের বাড়িতে হলে ভালো হত।’
পরোটা ছিঁড়তে ছিঁড়তে বলাকা বলল, ‘একই ব্যাপার। বাড়িতে তো এখন আর হয় না, হয় হাসপাতালে বা নার্সিং হোমে। সেটা টালিগঞ্জে না হয়ে শ্যামবাজারে একই কথা। সাত তারিখ থেকে দেড় মাসের ছুটি নিচ্ছি।’
ভারতীর মনে হল, বলাকার যুক্তিও ফেলে দেবার মতো নয়, ‘একই কথা’। ডেলিভারির পর বাপের বাড়ি গিয়ে থাকতে পারে। মা আছে, দুই বোন আছে যত্ন আত্তিতে কার্পণ্য হবে না। বাচ্চচা নাড়ানাড়ি তার থেকে বলাকার মা বেশি করেছেন।
কাশীনাথ আবার জিজ্ঞাসা করল, ‘বলেছ বউমা?’
‘বলেছি। শ্যামবাজারে নার্সিং হোমে ডেলিভারি হবে।’
ভারতী ভাবতে পারেনি কথাটা শুনে কাশীনাথ রাগে জ্বলে উঠবে। গলা চড়িয়ে সে বলে উঠল, ‘না হবে না, হবে না, আমি বলছি হবে না। এ বংশের বউয়েরা প্রথম সন্তান বিইয়েছে তাদের বাপ—মায়ের কাছে। তুমিও তো বাপের বাড়ি গিয়ে থেকেছিলে, সেখান থেকে তোমার বাবাই মেডিকেল কলেজে ভরতি করায়। প্রথমবার বাপের বাড়িতে থাকাটাই আমাদের নিয়ম। বিয়োতে গিয়ে যদি মরে তাহলে বাপ—মা আমাদের দুষতে পারবে না।’
ভারতী বিরক্ত হয়ে বলল, ‘এসব কী অলুক্ষুণে কথা বলছেন!’
কাশীনাথ প্রায় চিৎকার করে উঠল ‘ঠিকই বলছি, আমার পিসি মরেছে, একমাত্র বোনও মরেছে। এসব তো তুমি জান না।’
গলা চেপে ভারতী বলল, ‘বাবা আস্তে বলুন, ও ঘরে বলাকা রয়েছে শুনতে পাবে।’
‘শুনবে পাবে পাক, আমি ভয় করি নাকি।’
স্বর প্রখর করে ভারতী বলল, ‘কাউকে আপনার ভয় করতে হবে না, বলাকার ডেলিভারি ও যেখানে চাইছে সেখানেই হবে, আপনি মাথা গলাবেন না।’
‘বটে, তুমিও দলে ভিড়ে গেছ!’
‘বলাকা আমার ছেলের বউ, ওর শাশুড়ি আমারও মতামত দেবার অধিকার আছে আর সেটা আপনার থেকে বেশিই আছে।’
চশমার পিছনে কাশীনাথের চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল। দাঁত চেপে একান্ন বছর বয়সি পুত্রবধূকে বলল, ‘বেশিই আছে, অধিকার বেশিই আছে! বেরোও ঘর থেকে, আর একটা কথা বললে এই ফ্ল্যাট থেকে বার করে দোব।’
ভারতী কথা না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে চেয়ারে বসে রইল গুম হয়ে। একবার তাকাল বলাকার ঘরের দিকে। ঘরে পাখা ঘুরছে, পর্দাটা কেঁপে কেঁপে উঠছে, আলো জ্বলছে, বোধহয় কিছু একটা পড়ছে। নিশ্চয় কাশীনাথের চেঁচিয়ে বলা কথাগুলো কানে গেছে। কোনো একটা ছুতো করে ঘরে গিয়ে বলাকার মুখের ভাবটা এখন কেমন দেখার ইচ্ছে হল ভারতীর।
‘বউমা’ বলে পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকল ভারতী। আয়নার সামনে বসে চুল এলিয়ে বলাকা চিরুনি চালাচ্ছে মাথা থেকে চুলের ডগা পর্যন্ত। মুখ ফিরিয়ে তাকাল সে।
‘কাল তোমায় টিফিনের জন্য পরোটা করে দোব, রোজ রোজ পাঁউরুটি একঘেঁয়ে লাগে না? কেমন হয়েছে আজ পরোটা? এক একদিন এক একরকম খেলে মুখের অরুচিটা কাটাবে। লেবুর আচার খানিকটা দিয়ে দোব, আর ঝালঝাল আলু পেঁয়াজের চচ্চচড়ি।’
যতক্ষণ ধরে সে বলে গেল বলাকা স্থির চোখে তার মুখের দিকে ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে রইল। ভারতী বুঝে গেল বলাকা ও ঘরে চেঁচিয়ে বলা কাশীনাথের কথাগুলো শুনেছে।
‘আপনি রোজ যা দেন তাই দেবেন।’ বলেই মুখ ফিরিয়ে নিয়ে চল আঁচড়াতে শুরু করল।
এরপর আর ঘরে থাকা যায় না। ভারতী রান্নাঘরে ফিরে এল রুটি করার জন্য। পুলিন গেছে নবজীবন সংঘের বার্ষিক মিটিঙে, সেখানে সে পাঁচজন সহ—সভাপতির একজন। কিছুক্ষণ পর অফিস থেকে ফিরল অনীশ। দালানে পা দিয়েই ভারতীকে উদ্দেশ করে বলল, ‘কাল টেলিফোনের লোক আসবে কানেকশান দিতে। দুপুরে তৈরি থেকো।’ বলেই সে ঘরে ঢুকে গেল।
আধঘণ্টা পর অনীশ দালানে চেয়ার টেনে বসে বলল, ‘মা খেতে দাও।’
টেবলে খাবার থালা রেখে ভারতী বলল, ‘কই বউমা এল না?’
অনীশ আর বলাকা রাতের খাওয়া একসঙ্গে খায়। দু—জনকেই সকালে সাড়ে আটটার মধ্যে বেরোতে হয়। অন্যদের থেকে ওরা তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ে।
অনীশ মুখ নামিয়ে বলল, ‘খাবে না, মাথা ধরেছে।’
ভারতীর অসুবিধা হল না বুঝতে কেন খাবে না। সে এই নিয়ে কোনো কথা না বলে অন্য প্রসঙ্গে গেল। ‘তোর বাবা অনেকদিন আগে বলেছিল একটা ফোন এবার থাকা দরকার, বাড়িতে দুটো চাকরে লোক, কত রকমের দরকার পড়তে পারে। আগে চাকরে বলতে ছিল তোর দাদু, সে তো আজ চব্বিশ বছর আগের কথা। তোর ফোনটোন যা আসত ওপরে, ওরা ডেকে দিত।’
খাওয়া থামিয়ে অনীশ বলল, ‘বলাকার ডেলিভারি এখানেই নার্সিং হোমে হবে। বংশের কার কোথায় হয়েছে ওসব নিয়ে চুরাশি বছরের একটা লোক কী বলল না বলল তাই নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। দাদুকে চুপ করে থাকতে বোলো। যা শুনলুম তাতে লজ্জায় মাথাকাটা যায়।’
অনীশের থমথমে মুখে, গাঢ় গলায় বলা কথাগুলো শুনে ভারতী স্বর নামিয়ে বলল, ‘বলেছি তো, আপনি এ ব্যাপারে মাথা ঘামাবেন না, বললেই কী শোনেন, আমাকে বললেন ফ্ল্যাট থেকে বার করে দোব।’
‘হুঁ উউউ,’ অনীশ গম্ভীর হয়ে গেল। খাওয়া শেষ করে ঘরে গিয়ে দু—মিনিট পর বেরিয়ে এল, হাতে নোটের গোছা।
‘এই নাও দু—হাজার, মাসে মাসে যা দিচ্ছি তার সঙ্গে আরও দু—হাজার করে দেব। দাদু যা যা খরচ করে সেই সেই খরচ তুমি এই টাকা থেকে করবে। কুলোবে?’
ভারতী ঘাড় নাড়ল, ‘হয়ে যাবে।’
‘দেখি বিষদাঁত ভাঙে কিনা।’ বলে অনীশ ঘরে ফিরে গেল।
পুলিন ফিরে আসামাত্র ভারতী হাতছানি দিয়ে ডেকে তাকে রান্নাঘরে নিয়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করল।
‘কী ব্যাপার!’
পুলিনকে একটার পর একটা শিহরন জাগিয়ে ভারতী সন্ধ্যা থেকে যা যা ঘটেছে সংক্ষেপে দ্রুত বলে গেল নীচু স্বরে।
‘ছি ছি ছি বাবা এভাবে বললেন। এখন তো ছেলের বউয়ের কাছে মুখ দেখানো দায় হয়ে উঠবে। টাকাটা মনে হচ্ছে বউমাই দিয়েছে।’
‘আমারও তাই মনে হচ্ছে, টাকাগুলো এখন রাখি কোথায়। এখন ও ঘরে গিয়ে আলমারি খুলে টাকা রাখতে পারব না। বাবার ঘরেও রাখা যাবে না।’
‘আঁচলে ভালো করে বেঁধে নাও। শুতে এমন কিছু অসুবিধে হবে না। কাল আলমারিতে তুলে রেখো।’
পরদিন টেলিফোনের তার রাস্তা থেকে বাড়ির গা বেয়ে উঠল। রিসিভারটা রাখা হল অনীশের ঘরে টেবলের উপর। কাশীনাথ বারান্দায় দাঁড়িয়ে টেলিফোন মিস্ত্রিদের কাজ নীরবে দেখল, পরীক্ষা করার জন্য একজন লাইনম্যান নীচে থেকে ফোন করল। ঘরের রিসিভার বেজে উঠতে ভারতী আর পুলিন মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। ভারতীই বলল, ‘তুমি ধরো।’
পুলিন রিসিভার তুলে বলল ‘হ্যালো’।
‘ঠিক শুনতে পাচ্ছেন তো?’
‘পাচ্ছি।’
‘আপনার টেলিফোন নম্বরটা অফিস থেকে আজই জানিয়ে দেবে, এখন রাখুন।’
রিসিভার রেখে পুলিন উত্তেজিত মুখে ভারতীর দিকে তাকাল। সে এই দ্বিতীয়বার ফোনে কথা বলল, তাও আট বছর পর। অনীশের এক বন্ধু ফোন করেছিল। প্রণববাবুর ছেলে নেমে এসে খবর দেয়। অনীশ বাড়ি ছিল না, পুলিন উপরে গিয়ে ফোনে কথা বলেছিল।
‘বেশ সুন্দর, রংটা পাকা টমেটোর মতো!’ ভারতী সন্তর্পণে আঙুল দিয়ে রিসিভারটা ছুঁয়ে লাজুক স্বরে বলল, ‘আমি কখনো ফোনে কথা বলিনি।’
‘বলো না। কার সঙ্গে কথা বলবে?’
‘কারোর নম্বরই তো জানি না। জানলে অনির সঙ্গে কথা বলতুম।’
‘এবার থেকে একটা নোট বইয়ে সবার নম্বর লিখে রেখে দিতে হবে। অনির অফিসের, বউমার অফিসের, অনির শ্বশুর বাড়ির।’ থেমে গেল পুলিন। সে আর কাউকে পেল না যাকে ফোন করা যায়।
ভারতী বলল, ‘এ বাড়িতে এই নিয়ে চারটে ফোন হল।’
বিকেলে কাশীনাথকে চা দিয়ে ভারতী বলল, ‘ফোনটা দেখেছেন বাবা, ভারি সুন্দর রংটা। দেখুন না গিয়ে।’
‘তোমরা দ্যাখো। টেলিফোন একটা দেখার জিনিস নাকি, কলকাতা শহরে অমন হাজার হাজার আছে’। কথাটা বলে কাশীনাথ চায়ে চুমুক দিল। ভারতীর মুখের ঔজ্জ্বল্য মলিন হয়ে গেল।
পয়লা তারিখেই গুহ এস্টেটের সরকার বিমানবাবু সকাল দশটায় প্রতি মাসের মতো কলিংবেল বাজাল। দরজা খুলে পুলিন অন্যান্যবারের মতো বলল, ‘দাঁড়ান।’ এরপর এত বছর যা করেছে—কাশীনাথের কাছে গিয়ে বলা, ‘বাবা ভাড়া নিতে এসেছে’—তা না করে সে ভারতীর কাছে গিয়ে বলল, ‘ভাড়ার টাকাটা দাও।’
ভাড়ার টাকা নিয়ে বিল দিয়ে ব্যস্ত বিমানবাবু চলে গেল। অন্যান্য ফ্ল্যাট আর নীচের দোকানগুলো থেকে তাকে ভাড়া নিতে হবে। বিলটা ভারতীকে দিয়ে পুলিন বলল ‘আলমারিতে রেখে দাও, বাবাকে বলার দরকার নেই। দশরথের মায়ের মাইনেটা আজই দিয়ে দিয়ো।’
রাত্রে পুলিন আর ভারতী মেঝেয় শুয়ে। চারটি পায়ার নীচে আটটা ইট দিয়ে তোলা খাটে কাশীনাথ শুয়ে। দু—জনের শরীরের নিম্নাংশ খাটের নীচে।
‘হ্যাঁরে পুলিন, আজ যে ভাড়া নিতে এল না!’
পুলিন জবাব দেবার আগেই ভারতী বলল, ‘এসেছিল বাবা, আপনি তখন কলঘরে ছিলেন, বললুম একটু পরে আসতে তাইতে বিমানবাবু বললেন কাল আসবেন।’
ভারতী ফিসফিস করে পুলিনকে বলল, এত রাতে কিছু বোলো না। কী শুরু করে দেবেন কে জানে।’
‘বউমা দশরথের মায়ের টাকাটা কাল চেয়ে নিয়ো।’
‘নোব, এখন আপনি ঘুমোন।’
পরদিন দুপুরে ভাত খেতে বসে কাশীনাথ আবার বলল, ‘কই বিমানবাবু তো এল না যে?’
শ্বশুর কী তাণ্ডব শুরু করে দেবেন ভাড়া দিয়ে দেওয়া হয়েছে শুনলে, সেই আতঙ্কে ভারতীর মাথায় কী দুর্বুদ্ধি চাপল কে জানে, কিছু না ভেবেই সে বলে দিল, ‘এসেছিলেন, বললেন ভাড়ার টাকা ওদের সেরেস্তায় গিয়ে দিয়ে আসতে। নতুন নিয়ম করেছে এখন যে মালিক হয়েছে, পয়লায় না দিলে ওদের ওখানে গিয়ে দিতে হবে। আপনি টাকাটা দিন উনি বিকেলে দিয়ে আসবেন।’
‘এরকম নিয়ম করেছে, কই আগে তো জানায়নি! জানানো উচিত ছিল। এবার থেকে টাকা রাতেই তোমাকে দিয়ে রাখব, দশরথের মায়েরটাও।’
কাশীনাথ তার ক্যাশবাক্সের তালা খুলে দুশো টাকা বার করে ভারতীর হাতে দিয়ে বলল, ‘বিলটা আমাকে দিয়ো। আর শোনো, টেলিফোনের টাকা কিন্তু আমি দোব না। আমাকে না জানিয়ে তোমরা এটা নিয়েছ, আমার কোনো দায়দায়িত্ব নেই।’
সন্ধ্যায় ভারতী ভাড়ার বিলটা কাশীনাথকে দিয়ে বলল, ‘বাবা এই যে বিল। এবার থেকে ভাড়ার টাকা আগের রাতেই দিয়ে রাখবেন।’
কাশীনাথের দেওয়া দুশো টাকা ভারতী কোথায় রাখবে ঠিক করতে সাত—পাঁচ ভেবে অবশেষে বলাকাকে বলল, ‘বউমা তোমার কাছে ছেঁড়া ফাটা কোনো ব্যাগ আছে আমি টাকা রাখব।’
‘কত বড়ো।’
‘এই যেটা নিয়ে তুমি অফিস যাও অতবড়ো হলেই হবে।’
‘ওটা তো বেশ বড়ো, কত টাকা রাখবেন?’
বলাকার অবাক হওয়া দেখে ভারতী তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, ‘অল্প টাকা মাসে মাসে রাখব।’
‘আপনি ব্যাক সেভিংসে রাখুন না। এই তো এখানেই আমাদের একটা ব্রাঞ্চ রয়েছে। আমি টেলিফোনে শ্যামনগর থেকে বলে দেব।’
ব্যাঙ্ক, চেকবই, পাসবই, সইকরা এগুলো নিয়ে সে শ্বশুরকে ব্যস্ত থাকতে দেখেছে। অত হিসেবনিকেশ আর সই করতে হবে ভেবে ভারতী অস্বস্তি বোধ করে বলল, ‘সামান্য টাকার জন্য আবার ব্যাঙ্ক কেন, হুটপাট দরকারের জন্য হাতের কাছে ক—টা টাকা রাখব।’
বলাকা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, ‘তাহলে আমার এই ব্যাগটাই নিন না। আমি তো ছুটি নিচ্ছিই, ব্যাঙ্কে যাব না। পরে একটা কিনে নেব।’
সেই থেকে শুরু হল ভারতীর গোপনে টাকা জমানো। কাশীনাথের মাসে মাসে দেওয়া যাবতীয় টাকা সে বলাকার দেওয়া হাত ব্যাগটায় ভরে দেয়। শ্বশুরকে না জানিয়ে তার দেওয়া খরচের টাকা সরিয়ে রেখে, ছেলের দেওয়া টাকা আর দোকান ভাড়ার দু—হাজার টাকা দিয়ে তার সংসারের যাবতীয় ব্যয় নির্বাহের ব্যাপারটি আর জানে শুধু পুলিন।
ছেলের আত্মমর্যাদা রক্ষা করতে গিয়ে সে যে শ্বশুরের সঙ্গে চাতুরি করছে এটাই তার মনের মধ্যে গুমোট তৈরি করে এক এক সময় দমবন্ধ করে দেয়। মাঝে মাঝে তার আপশোস হয়, মুখ ফসকে বলা মিথ্যেটা সে বলেছিল শ্বশুরের তাণ্ডব শুরুর ভয়ে। সংসারের একচ্ছত্র অধিপতির সিংহাসনে বসে একটা লোক প্রায় ষাট বছর রাজত্ব করে আসছে প্রবল প্রতাপে। হঠাৎ তার হাত থেকে শাসন ও পালনের দায়িত্বটা আচমকা কেড়ে নিলে এই তিরাশি বছর বয়স্ক মানুষটি যে কীভাবে খেপে উঠবেন সেটা মনে হতেই ভয়ে কিছু না ভেবেই হঠাৎ এমন একটা মিথ্যা কথা বলার জের তাকে টেনে চলতে হবে, সেটা কল্পনাতেও আনতে পারে না।
পুলিন বলেছিল, ‘বলেছ ঠিক আছে, কাউকে জানিয়ো না, বাবাকে নয় অনিকেও নয়। বাবা টাকা দিলেই নিয়ে নিয়ো, না নিলে কিন্তু ধরা পড়ে যাবে।’ একটা অপরাধ ঢাকতে আর একটা অপরাধ করার মতো ভারতী প্রতি মাসে টাকা নিয়েছে। আর ব্যাগে রেখে দিয়েছে। কাশীনাথ জানে সংসারের প্রধান খরচগুলো মেটাচ্ছে সে। তার বিরক্তি, রাগ, হুকুম, গালমন্দ সে অব্যাহত রেখেছে।
বলাকার ছেলে হল নার্সিং হোমে সিজারিয়ান করে। সুস্থ সবল শিশু সাত পাউন্ড ওজন। ভারতী পাঁচটা ফ্ল্যাটে সন্দেশ দিয়ে এসেছিল নিজে।
‘এবার তো ঠাকুমা হলেন’ কথাটা সব জায়গাতেই শুনতে হয়েছে। শুনে তার বুক ভরে গেছল খুশিতে। টালিগঞ্জ থেকে সবাই এসেছিল নার্সিং হোমে এবং শ্যামবাজার থেকেই মেট্রোয় চড়ে তারা ফিরে যায়। ভারতীর অনুরোধেও তারা গুহ ভবনে আসেনি, তার মনে হয়েছিল কাশীনাথের জন্যই তারা এল না। হয়তো বলাকা টেলিফোনে ওদের বলেছে কাশীনাথের কথা।
তার নাতি হওয়ার কথা সন্দেশ হাতে নিয়ে কাশীনাথকে জানাতেই প্রথম প্রশ্ন।
‘দেখতে কেমন হয়েছে? মায়ের মতো নয়তো? রং কেমন?’
‘সদ্য জন্মাল। এখন তো সব বাচ্চচাকেই একই রকম লাগবে। ক—টা মাস যাক মুখ চোখ তৈরি হোক তবে কেমন দেখতে হয়েছে বলা যাবে। আর গায়ের রং বাপের মতোই হয়েছে।’
‘পেট কেটে বাচ্চচা হয়েছে বললে। এই আজকালকার একটা ফ্যাশান।’
‘ফ্যাশান নয় বাবা এটার দরকার ছিল। আপনার পিসি আর বোন হয়তো মরতেন না যদি সিজারিয়ান করে বাচ্চচা হত। তখন গ্রামে এসব ব্যবস্থা ছিল না।’
‘আমিও তো গ্রামে দাইয়ের হাতে জন্মেছি, কই মা তো মরেনি!’
‘সেটা তাঁর ভাগ্য।’
এগুলো কি আমায় খেতে হবে?’ প্লেটে চারটে সন্দেশের দিকে কাশীনাথ বলল আঙুল দেখিয়ে।
‘খাবার জন্যই তো দিয়েছি!’ ভারতী বিভ্রান্তের মতো তাকাল।
‘নিয়ে যাও, নষ্ট কোরো না।’
প্রথম ঠাকুমা হওয়ার আনন্দ দপ করে উবে গেল ভারতীর অন্তর থেকে তিক্ত স্বরে বলল, ‘ঠিক আছে আপনাকে খেতে হবে না, নীচের দারোয়ানকে দিয়ে দোব,’ প্লেটটা তুলে নিয়ে সে চলে যায়।
নার্সিং হোম থেকে বলাকা তার বাচ্চচা নিয়ে সোজা বাপের বাড়ি চলে গিয়ে ফিরে আসে গুহ ভবনে একমাস পর। উমা যখন বেরোচ্ছিল সেই সময় ট্যাক্সিটা এসে গেটের সামনে থামে। প্রথমে নামল অনীশ, হাত বাড়িয়ে তোয়ালে জড়ানো শিশুকে সে দু—হাতে নিল, বলাকা ট্যাক্সি থেকে নামছে, উমা ছুটে গিয়ে অনীশের হাত থেকে বাচ্চচাকে দু—হাতে প্রায় কেড়ে নিয়ে বলল, ‘আমাকে দাও অনিদা।’
উমা অনির ছেলেকে নিয়ে তিনতলায় এল। ওর হাত থেকে নাতিকে নিয়ে ভারতী হাতে নাচিয়ে পুলিনের হাতে দিল। পুলিন ঘরে গিয়ে কাশীনাথের সামনে ধরে বলল, ‘বাবা অনেক ভাগ্য করলে লোকে পুতির মুখ দেখে।’
মিটমিট করে তাকিয়ে কাশীনাথ ক্যাশবাক্সের চাবিটা ফতুয়ার পকেট থেকে বার করে ছেলের দিকে বাড়িয়ে বলল, ‘বাক্সটা খোল, ডানদিকের নীচের খোপে দুটো রুপোর টাকা আছে, একটা নিয়ে ওর হাতে দে। হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন, চাবিটা নে।’
ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বলাকা, অনীশ, উমা আর ভারতী। এক হাতে তোয়ালে জড়ানো ঘুমিয়ে কাদা হয়ে থাকা নাতি, অন্য হাতে চাবি নিয়ে পুলিন ক্যাশবাক্স খুলে ডানদিকের নীচের খোপ থেকে পঞ্চম জর্জের মুখের ছাপ দেওয়া একটা রুপোর টাকা বার করল।’
‘এবার এটা ওর হাতে দে।’
পুলিন ঘুমন্ত বাচ্চচার মুঠোয় টাকাটা গুঁজে দেবার চেষ্টা করছে তখনই বলাকা শ্বশুরের হাত থেকে ছেলেকে ছিনিয়ে নিয়ে, টাকাটা ছুড়ে দিল। সেটা লাগল কাশীনাথের বাহুতে।
‘দরকার নেই অমন টাকায়।’ এই বলে বলাকা প্রকাশ্যে দাদাশ্বশুরের বিরুদ্ধে ঘোষণা করে দিল তার যুদ্ধ, যেটা আগেই ঘোষণা করেছিল তার স্বামী। ভারতী আর উমা হতবুদ্ধি হয়ে তাকিয়ে।
কেউ কথা না বলে ফিরে এল দালানে। ছেলেকে নিয়ে বলাকা তার ঘরে ঢুকল। একটা বিশ্রী পরিস্থিতির কবলে পড়েছে সবাই। উমা বাইরের লোক, সব থেকে অপ্রতিভ সে। ‘আমি যাই’ বলে সে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে হাঁফ ছাড়ল।
‘কী যে করব ভেবে পাচ্ছি না।’ চুলে আঙুল ডুবিয়ে অনীশ বলল, ‘ছোটোবেলা থেকেই দেখে আসছি দাদুর এই ধরনের ব্যবহার। কিছু করার নেই, কোথাও যে ফ্ল্যাট দেখে উঠে যাব তাও সম্ভব হচ্ছে না। আমাদের অফিসটা আবার দুদিকে এতদূর যে, মেট্রো থেকে দূর হয়ে গেল বলাকার অসুবিধা হবে। এই বাড়িটা সব থেকে সুবিধাজনক বলেই অন্য কোথাও থাকার চেষ্টা করিনি। এবার দেখছি করতে হবে।’
অনীশ নিজের ঘরে চলে যাবার পর ভারতী বলল, ‘নতুন অতিথি এল আর কী অভ্যর্থনা পেল!’
পুলিন গলা চেপে বলল, ‘বাবার বয়স হয়েছে, আর ক—দিনই বা থাকবেন। একটু ধৈর্য ধরে থাকো।’
ক—দিন নয়, কাশীনাথ দিব্যি বহাল তবিয়তে পাঁচটা বছর কাটিয়ে অষ্টআশিতে পড়ল এবং পাঁচটা বছরে নিজের পুত্র আর পুত্রবধূ ছাড়া আর কাউকে তার বিষাক্ত গঞ্জনার শিকার করেনি। অনীশের অন্য কোথাও থাকার চেষ্টাটা ধীরে ধীরে থিতিয়ে এসেছে। অন্যত্র ফ্ল্যাট নিয়ে থাকতে হলে মাসে মাসে যে টাকা ভাড়া দিতে হবে সেটা বাঁচিয়ে জমাচ্ছে স্বামী—স্ত্রী। জমানো টাকার সঙ্গে ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়ে ফ্ল্যাট কিনতে বদ্ধপরিকর হয়েছে বলাকা। অনীশও লোন পাবে তার অফিস থেকে আর দু—বছর পর পাবলিক রিলেশনস ম্যানেজারের পদে অধিষ্ঠিত হলে। বলাকার মেজোমামা অনীশকে ধৈর্য ধরতে বলেছেন।
কম কথাবলা বলাকা কথা বলা আরও কমিয়ে দিয়েছে। যতটুকু বলে তা শুধু শাশুড়ির সঙ্গেই। সে অফিসে চলে যাবার পর বাচ্চচা কুচুন তার ঠাকুমার সবটুকু সময় দখল করে নেয়। বলাকার দেওয়া ব্যাগে টাকা রাখতে রাখতে আর জায়গায় কুলোচ্ছিল না। পুলিনকে দিয়ে সে একটা সুদৃশ্য ঝোলা কিনে আনিয়েছে। তার মধ্যে রেখেছে মুঠো মুঠো নোট।
একদিন দুপুরে অনীশের ঘরে টিভি দেখতে দেখতে পুলিন বলল, ‘কত জমল গুণে দেখেছ কী? মাসে মাসে বাবা দিয়েছে প্রায় আট—নশো টাকা। কুচুনের জন্মানোর সময় থেকে দিচ্ছেন। একদিন গুনে দেখতে হবে।’
কুচুনকে অনীশ এন্টালির এক ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভরতি করে দিয়েছে। স্কুলের বাস আসে সকাল সাড়ে ছ—টায় সেন্ট্রাল অ্যাভিন্যুর মোড়ে দাঁড়ায়। পুলিন তাকে বাসে তুলে দিয়ে আসে। স্কুল ছুটি হয় সওয়া এগারোটায়। বাস কুচুনকে নামিয়ে দিয়ে যায় বারোটায়। ভোরে ঘুম থেকে ওঠা কুচুন ক্লান্ত হয়ে ফেরে। স্নান করে ভাত খেয়েই সে ঘুমিয়ে পড়ে।
দুপুরে ঘুমন্ত কুচুনের পাশে খাটে শুয়ে ভারতী বলল, ‘অনেক টাকা, ঝোলাটার পেট ফুলে উঠেছে। অত টাকা নিয়ে আমরা কী করব বলো তো? কী ঠিক করেছি জানো, টাকাগুলো অনিকে দিয়ে দোব।’
পুলিন চমকে উঠল। ‘তার মানে?’
‘ফ্ল্যাট কিনতে ওদের সময় লাগছে টাকার জন্য। পাঁচ—সাত লাখ টাকা জমানো কী সোজা কথা! এই টাকাটা পেলে ওদের সুবিধে হবে।’
‘ঝোলাটা বার করো, গুনে দেখা যাক।’
ভারতী চাবি দেওয়া আলমারি খুলে রঙিন ঝোলাটা বার করে হাতে তুলে ধরে ওজন পরখ করে বলল, ‘এক কিলো তো হবেই।’
‘দরজা দুটো বন্ধ করো, পাখাটাও। নয়তো হাওয়ায় নোট উড়বে।’
ভারতী ঝোলা উপুড় করে মেঝেয় নোটগুলো ঢেলে বলল, ‘বাব্বা, এত নোট, একটুও তো বুঝতে পারিনি। টাকা পেতুম আর চোখ বুজে ঝোলায় ঢুকিয়ে দিতুম। আচ্ছা তুমি একসঙ্গে এত নোট কখনো দেখেছ?’
পুলিন স্তূপ করা নোট মুঠোয় তুলে ধরে মেঝেয় ফেলে দিতে দিতে বলল, ‘দেখিনি। বউমা নিশ্চয় রোজ দেখে। এবার এক কাজ করো, নোটগুলো আলাদা আলাদা করো। পাঁচ, দশ, পঞ্চাশ, একশো করে ভাগা দিয়ে রাখো।’
দু—জনে দ্রুত হাতে চারভাগা করার পরও এক টাকা ও দু—টাকার প্রচুর নোট থেকে গেল।
পুলিন বলল, ‘ওগুলো পরে গুনব, আগে এই বড়োগুলো গুনে ফেলা যাক। তাড়াতাড়ি করো।’
ভারতী বলল, ‘গুনে গুনে তো যোগ দিতে হবে, দাঁড়াও কাগজ আর পেনটা আনি।’
টেলিফোনের পাশে রাখা ডটপেন আর প্যাঠ, ভারতী নিয়ে এল। দু—জনে নোটগুলো গুনে কাগজে টুকে রেখে যোগ দিল। পুলিন যোগফল দেখে বিশ্বাস করতে না পেরে আবার যোগ করল। তারপর ভারতীকে বলল, ‘তুমি একবার যোগ দাও তো।’ ভারতী যোগ করে বলল, ‘ঠিকই তো আছে, একান্ন হাজার সাতশো বাইশ। খুচরো এক—দুটাকাগুলো তাও গোনা হয়নি। গুনলে আরও দু—তিনশো হবে।’
‘তার মানে বাহান্ন হাজার টাকা!’ পুলিনের মুখ দিয়ে আর কথা সরল না।
‘হবে না? সাড়ে চার বছরের জমানো টাকা।’
‘বাবা এখনও পর্যন্ত জানেন তার টাকাতেই বাজার ছাড়া আর সব খরচ চলছে। আর তার দেওয়া টাকাগুলো যে—।’ পুলিন আঙুল দিয়ে মেঝেয় থোক করে রাখা নোটগুলো দেখাল।
ভারতী শুনে মুচকি হাসল। ‘ব্যাঙ্কে বাবার কত টাকা জমেছে এতদিনে আমরা জানি না। মাসে মাসে পেনশন যা পান সেটা তো কম নয়।’
‘চার বছর আগে পেনশন বেড়ে হয়েছে পাঁচ হাজার টাকা! এটা আমি জানি।’
রান্নাঘরে জমিয়ে রাখা আছে রাবার ব্যান্ড। ভারতী তার গোটা দশেক এনে নোটগুলো বান্ডিল করে ঝোলায় ভরে রাখল। ঝোলার পেটমোটা ভাবটা কমে গেল।
‘একটা কথা ভেবে দেখো, অনিকে টাকাগুলো দিতে গেলেই জিজ্ঞেস করবে পেলে কোত্থেকে, তখন কী বলবে? বাবার কাছ থেকে নিয়েছি, তোর কাছ থেকেও নিয়েছি, এই কথা বলবে?’ পুলিন জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে রইল।
ভারতীর কপালে ভাঁজ পড়ল, বলল, ‘ যা সত্যি তাই বলব, এ টাকা তোর ঠাকুরদা মাসে মাসে দিয়েছে, আমি তুলে রেখেছিলুম।’
‘আর অমনি হাত পেতে অনি নিয়ে নেবে? ঠাকুরদার টাকা নেওয়া বন্ধ করার জন্যই তো ও টাকা দিয়ে যাচ্ছে। তুমি গাছেরও খেয়েছ তলারও কুড়িয়েছ।’
‘আমিই শুধু খেয়েছি আর কুড়িয়েছি! তুমিই তো রাস্তা দেখলে। বিমানবাবুকে দাঁড় করিয়ে বাবার কাছে না গিয়ে আমার কাছে এসে টাকা চাইলে, মনে পড়ে? এখন তুমি তুমি বলে আমাকে দেখাচ্ছ।’ ক্রুদ্ধ ভারতী ঝোলাটা আলামারিতে রেখে চাবি দিয়ে ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে গেল।
বিকেলে চা খেতে খেতে ভারতীকে পুলিন বলল, ‘এখন অনিকে কিছু বলার দরকার নেই। সাড়ে চার বছর যখন কেটেই গেল আর দু—তিনটে বছর যাক। কুচুনকে জামাজুতো পরিয়ে দাও পার্কে নিয়ে যাব।’ তারপর যোগ করল, ‘বাবাকে কোনোভাবে চটিয়ো না, যা খেতে চাইবে দেবে। দেখি ঝালমুড়িওলাটাকে পাই কি না।’
কুচুনকে নিয়ে পুলিন বেরিয়ে যাবার পর ভারতী শ্বশুরকে চা দিতে গিয়ে দেখল কাশীনাথ বেডকভার মুড়ি দিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে।
‘বাবা চা এনেছি।’
কাশীনাথ সাড়া দিল না। ভারতী আবার ডাকল। সাড়া মিলল না। এবার সে শ্বশুরের কাঁধ ধরে নাড়া দিয়ে বলল, ‘উঠুন, ‘পাশ ফিরল কাশীনাথ, ঘোলাটে চোখে তাকিয়ে রইল, মুখ দেখে ছ্যাঁৎ করে উঠল ভারতীর বুক। শ্বশুরের কপালে হাত রেখে বলল, ‘এ কি গা পুড়ে যাচ্ছে!’
ভারতী জলপটি নিয়ে কাশীনাথের পাশে বসল। দ্বিতীয় কেউ এখন ফ্ল্যাটে নেই। সে অসহায় বোধ করল। থার্মোমিটার বাড়িতে নেই। ভারতী ছুটল চারতলায়। প্রণববাবুর বউয়ের কাছে থেকে থার্মোমিটার এনে কাশীনাথের জ্বর দেখল, একশো চার ডিগ্রি!
এবার সে কাশীনাথকে ঘুরিয়ে মাথার নীচে কুচুনের রাবারক্লথ রেখে মাথায় জল ঢালতে শুরু করল। একটু পরেই পুলিন ফিরল কুচুনকে নিয়ে, হাতে বাবার জন্য ঝালমুড়ির ঠোঙা।
‘কী হয়েছে বাবার?’
‘ভীষণ জ্বর, ডাক্তারবাবুকে একবার ডাকতে হবে।’
তিনটে বাড়ির পরেই থাকেন ডাক্তার চক্রবর্তী। পুলিন ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘উনি তো এখন বেরিয়ে গেছেন বড়োবাজারের চেম্বারে বসার জন্য।’
‘তাহলে কাছাকাছি কোনো ডাক্তারখানায় দেখো কাউকে পাও কিনা, পপুলার মেডিক্যালে তো একজন বিকেলে বসে শুনেছি। যত টাকা ফি চাইবে দোব।’ ভারতী ব্যাকুল স্বরে বলল।
পুলিন ব্যস্ত হয়ে বেরিয়ে গেল। মাথায় জল ঢালা ছাড়া আর কী করবে ভারতী ভেবে পাচ্ছে না। চোখ বন্ধ করে কাশীনাথ আচ্ছন্নের মতো শুয়ে। শ্বাস গভীরভাবে নিচ্ছে, মুখ থেকে ক্ষীণ ঘরঘর শব্দের সঙ্গে সে মাথাটা এপাশ ওপাশ করল। ভারতী পাশের ঘরে গিয়ে ফোন করল অনীশকে।
দাদুর হঠাৎ ভীষণ জ্বর, আমার ভালো ঠেকছে না। তোর বাবা ডাক্তার ডাকতে গেছে। পারলে তুই এখুনি চলে আয়।’
পুলিনের সঙ্গে এল অল্পবয়সি এক ডাক্তার। নাড়ি দেখলেন, রিস্টওয়াচের দিকে তাকিয়ে। প্রশ্ন করলেন, ‘কখন থেকে জ্বর হয়েছে?’
ভারতী বলল, ‘দুপুরে ভাত খেয়ে শুয়েছেন। তখনও দেখেছি অন্যদিনের মতোই স্বাভাবিক, ঘণ্টাখানেক আগে চা দিতে এসে দেখি জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে।’
‘বয়স কত এনার?’
পুলিন বলল, ‘অষ্টআশি।’
ডাক্তারের ভ্রূ কুঁচকে উঠল। চোখের পাতা টেনে তুলে দেখে বললেন, ‘মনে হচ্ছে ম্যালেরিয়া, ম্যালিগনান্ট হতে পারে। ওঁকে হসপিটালাইজ করুন, নয়তো কোনো নার্সিং হোমে নিয়ে যান। জ্বরের জন্য একটা ট্যাবলেট দিচ্ছি, তবে ওর রক্ত পরীক্ষা করা দরকার।’
বাড়িতে আসার জন্য ডাক্তারবাবু ডবল ফি নিলেন আশি টাকা। তিনি চলে যাবার পর পুলিন বিপন্ন মুখে বলল, ‘নার্সিং হোম কী হাসপাতাল যেখানেই যাই না কেন বাবাকে নিয়ে যাবটা কেমন করে?’
‘অ্যাম্বুলেন্স করে। নয়তো কীসে করে এমন অবস্থায় নিয়ে যাবে? একটু আগে অনিকে ফোন করেছি, ও আসছে, যা করার ওই করবে। তুমি আগে ওষুধটা আনো।’
সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় উমার বাবার সঙ্গে দেখা হতে পুলিন তাকে জানিয়ে দিল বাবার ম্যালিগনান্ট ম্যালেরিয়া হয়েছে। একটু পরেই জয়ন্তী হাজির হল উদবিগ্ন মুখে।
ভারতীর কাছে সব শুনে তিনি চেয়ারে বসে পড়লেন। কারোরই এখন কিছু করার নেই কাশীনাথের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া। জয়ন্তী একবার শুধু অস্ফুটে বলল, ‘বয়সও তো হয়েছে, এখন ধাক্কাটা সামলানো শক্ত।’
অনীশ এসে পৌঁছল ট্যাক্সিতে। ভারতীর কাছে সব শুনে সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে দিল পরিচর্যা নার্সিং হোমে। ওদের নিজস্ব অ্যাম্বুলেন্স আছে।
পুলিনের আনা ট্যাবলেট প্রায় অজ্ঞান কাশীনাথকে খাওয়ানো বা গেলানো সম্ভব হল না। পুলিন নীচে নেমে গেটে দাঁড়িয়ে রইল। অ্যাম্বুলেন্সের গাড়ি দেখেই হাত নেড়ে থামিয়ে স্ট্রেচারসহ দু—জনকে ওপরে নিয়ে আসে।
কাশীনাথকে যখন অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হচ্ছে তখন তার মুখ থেকে রক্ত বেরিয়ে এল। অনীশ তা লক্ষ করেছিল, সঙ্গে থাকা পুলিনকে কিছু বলল না।
নাতিকে নিয়ে ভারতী তিনতলার বারান্দা থেকে দেখল কাশীনাথের নার্সিং হোমে যাওয়া। কিছুক্ষণ পরেই বলাকা ফিরল।
‘বাবাকে অনি নার্সিং হোমে নিয়ে গেল একটু আগে।’
হতভম্ব বলাকা বলল, ‘কী হয়েছে? সকালে তো দেখলাম দিব্যি রয়েছেন।’
‘তোমার শ্বশুর একজন ডাক্তার ডেকে আনেন, তিনি বলে গেলেন ম্যালেরিয়া হতে পারে। কী যে হবে কে জানে।’ ভারতী শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কাশীনাথের খাটের দিকে। টেবিলের উপর পড়ে রয়েছে ঝালমুড়ির ঠোঙা। ভারতী বারান্দায় গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ঘরে এসে খাটে বসে পড়ল। তখন মনে পড়ল বলাকাকে খেতে দিতে হবে। তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে গিয়ে চায়ের জল চড়াল।
‘বউমা কী খাবে এখন, চিড়ে ভেজে দোব?’
‘থাক মা খিদে নেই। দাদুর কথা শুনে খাওয়ার ইচ্ছে চলে গেছে। বরং চা দিন।’
বলাকাকে চা দিয়ে ভারতী কাশীনাথের ঘরে এল। বিছানায় বেডকভারটা পেতে বালিশটা মাথার দিকে রাখতে গিয়ে মেঝেয় পড়ে গেল ক্যাশবাক্সের চাবিটা। এটা যক্ষের ধনের মতো কাশীনাথ সঙ্গে করে রাখে। চাবিটা সে ক্যাশবাক্সের উপর রেখে দিল। আবার সে খাটে বসে বাহুতে বাহু রেখে মাথা হেলিয়ে দিল। উৎকণ্ঠা তাকে গ্রাস করেছে। অবসন্ন হয়ে পড়ছে হৃদয়। বুড়ো মানুষটা তাকে বলেছিল ‘ধুতি—পাঞ্জাবি পরে একবার বড়ো রাস্তা পর্যন্ত হেঁটে যাব, তুমি থাকবে আমার সঙ্গে।’ সাইকেলের ধাক্কা খাওয়ার পর বুড়োমানুষটার হেঁটে যাওয়া আর হয়নি। অনি তসরের পাঞ্জাবি তৈরি করে দিয়েছিল আর কিনে এনেছিল ছয় ইঞ্চি পাড়ের ধুতি। সে দুটো এখনও আলমারিতে তোলা আছে।
ঘণ্টা দুয়েক পর ফোন বেজে উঠল পাশের ঘরে। ভারতী ছুটে গেল। রিসিভার কানে লাগিয়ে শুনে যাচ্ছে বলাকা। কাকে যেন বলল, ‘হ্যাঁ মাকে বলছি।’
ভারতী ব্যগ্র হয়ে বলল, ‘বউমা, অনির ফোন? বাবা কেমন আছে?’
‘দশ মিনিট আগে মারা গেছেন। আপনি কাউকে সঙ্গে নিয়ে এখুনি যান, নার্সিং হোমটা তো চেনেন, আমাকে দেখতে যেতেন। দাদুকে আর ওরা বাড়িতে আনবেন না। ওখান থেকেই শ্মশানে নিয়ে চলে যাবেন।’
একবার থরথর করে কেঁপে উঠেই বিহ্বলতা কাটিয়ে শত হয়ে গেল ভারতী।
‘ভাল কথা, কিছু টাকাও সঙ্গে করে নিয়ে যেতে বলল, ওর কাছে বেশি টাকা নেই।’
ভারতী আলমারি খুলে ঝোলাটা বার করল। নোটের বান্ডিলগুলোর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। বলাকাও তাকিয়ে রয়েছে চোখে বিস্ময় নিয়ে। ভারতী একটা বান্ডিল বার করে নিয়ে বলল, ‘এটা এখন তোমার কাছে রেখে দাও।’ তারপর সে কাপড়ের থাকের নীচের থেকে টেনে বার করল তসরের পাঞ্জাবি আর ময়ূরপুচ্ছ ধুতিটা।
‘বউমা সেদিন অনি যে ব্যাগটায় করে শার্ট কিনে আনল, সেটা আছে? থাকলে দাও। আর চিরুনিটাও দাও।’
বলাকা স্টিলের আলমারি থেকে শার্টটা বার করে নিয়ে খালি পলিথিনের ব্যাগটা দিল। টাকা, ধুতি, পাঞ্জাবি, চিরুনি তাতে ভরে নিয়ে ভারতী বলল, ‘দেখি উমার ভাই যদি যায় তো ওকে নিয়েই যাব।’
শাড়ি বদলিয়ে চটি পরে ভারতী বেরিয়ে পড়ল। দোতলায় উমাদের সকলেই ফ্ল্যাটে রয়েছে। ভারতী বলামাত্র জয়ন্তী বললেন, ‘নিশ্চয় যাবে। এতরাতে আপনি একা যাবেন কী! রমু যাবে সঙ্গে।
রমু আর ভারতী ট্যাক্সিতে পাঁচ মিনিটেই পৌঁছে গেল। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে অনীশ আর পুলিন। তারা ভারতীকে নিয়ে গেল দোতলায়। একটা ছোট্ট কেবিনে কাশীনাথ খাটে শুয়ে। চোখে চশমা। পরনে ফতুয়া—পাজামা। ব্যাগ থেকে ভারতী ধুতি আর পাঞ্জাবি বার করল। টাকার বান্ডিলটা ছেলের হাতে তুলে দিয়ে বলল,
‘অনি, এ দুটো চিনতে পারিস?’
‘হ্যাঁ।’
‘দাদুকে পরিয়ে দে। আয় তুলে ধর।’
দু—জনে ধুতি পরাল পাজামার উপরেই। ফতুয়া খুলে পরাল পাঞ্জাবিটা। ভারতী চিরুনি দিয়ে কাশীনাথের যে ক—টা চুল রয়েছে পাতা কেটে আঁচড়ে দিল।
‘চন্দন পেলে ভালো হত। ফুল দিবি না?’
‘ওহ হ্যাঁ, নিশ্চয়। বাবা তুমি চট করে যাও শ্যামবাজার বাজারে। আর দু—প্যাকেট ধূপও আনবে।’
‘শোনো। রজনীগন্ধা আনবে।’
অনীশের কাছ থেকে টাকা নিয়ে পুলিন বাজারের দিকে রওনা হল, সঙ্গে রমু।
‘হ্যাঁরে অনি, কীভাবে নিয়ে যাবি?’
‘গুরুদুয়ারা শিখ প্রবন্ধকের গাড়িতে। নার্সিং হোম থেকেই ফোন করে দিয়েছে।’
‘চল বাইরে গিয়ে দাঁড়াই।’
দু—জনে নেমে এসে গেটের সামনে দাঁড়াল। ভারতী জিজ্ঞাসা কর,. ‘কী হয়েছিল দাদুর?’
‘বাড়িতে ডাক্তার যা আন্দাজ করেছিল তাই। কলকাতায় এখন খুব হচ্ছে এই টাইপের ম্যালেরিয়া। এখানে কিছু করার ছিল না।’
‘এবার থেকে মশারি টাঙিয়ে শুবি, কুচুনের জন্যই বিশেষ করে।’
‘রমুকে কী বাড়ি চলে যেতে বলব? দাহ শেষ হতে ভোর হয়ে যাবে।’
‘কীসে দাহ হবে? চিতা সাজিয়ে না ইলেকট্রিক চুল্লিতে? আমাদের বংশের সবাই কিন্তু চিতায় উঠেছে।’ ভারতীর মুখে পাতলা হাসি খেলে গেল।
‘দাদুকে দিয়েই ট্র্যাডিশনটা ভাঙব।’ অনীশও হাসল।
‘এখানকার বিল মিটিয়ে দিয়েছিস? ঠিক কত টাকা বান্ডিলটায় আছে জানি না, টাকাগুলো তোর দাদুর।’
অনীশ ভ্রূ তুলল সঙ্গে কাঁধও। তাই দেখে ভারতী বলল, ‘নিজের জন্য কাউকে একটা পয়সাও খরচ করতে দেননি। আমার বিয়ের পর থেকে আজ পর্যন্ত আমি অন্তত দেখিনি।’
নার্সিং হোমের টাকা মিটিয়ে দিতে অনীশ ভিতরে গেল। এসে পড়ল রমু আর পুলিন। একজনের হাতে রজনীগন্ধা স্টিকের বোঝা, অন্যজনের হাতে পদ্মফুল।
‘রমু তুমি কি এখন বাড়ি যাবে?
‘না জেঠিমা, মা বলেছে শেষপর্যন্ত থাকতে।’
অনীশ বেরিয়ে এল। ‘ফোন করলাম, বলে কুড়ি মিনিট আগে গাড়ি বেরিয়ে গেছে। আরে ওই তো এসে গেছে।’
কাচের গাড়ি থেকে দুটি লোক স্ট্রেচার নামাল। দোতলায় গেল। স্ট্রেচার মেঝেয় পাততেই ভারতী রজনীগন্ধার কলি স্টিক থেকে ছিঁড়ে নিয়ে স্ট্রেচারে ছড়িয়ে দিল কয়েকমুঠো।
‘এবার শোয়ান ওকে।’
লোকদুটি কাশীনাথকে শোয়াবার পর ভারতী বাকি স্টিকগুলো দেহের দুপাশে সাজিয়ে রাখল। পদ্মর পাপড়ি ছড়িয়ে দিল দেহের উপর। চুলে আর একবার চিরুনি দিয়ে বলল, ‘দাড়িটা খোঁচা খোঁচা হয়ে রয়েছে। এখন তো কামিয়ে দেওয়া যাবে না।’
ড্রাইভারের পেছনে লম্বা টানা সিটে বসল চারজন। ফুলছড়ানো শয্যায় শুয়ে তসরের পাঞ্জাবি আর ধুতি পরে বউমাকে সঙ্গে নিয়ে কাশীনাথ চলল নিমতলা শ্মশানের উদ্দেশে।
.
দু—দিন পর দুপুরে ভারতী কাশীনাথের ক্যাশবাক্সটি খুলে পেল ব্যাঙ্কের পাসবই চেকবই, এক খণ্ড কাগজ আর একশো টাকা। পাসবই খুলে দেখল জমার ঘরে রয়েছে দু—লক্ষ চল্লিশ হাজার পঁয়ষট্টি টাকা। কাগজে তিন লাইনে পরিষ্কার অক্ষরে লেখা রয়েছে—’আমার মৃত্যুর পর ব্যাঙ্কে আমার যত টাকা আছে সবই আমার ছেলে আইনতই পাবে কিন্তু আমার শোয়ার খাটটি পাবে বউমা। ওর শুতে খুব কষ্ট হয়। আর হবে না । ইতি শ্রীকাশীনাথ রায়।’