বিস্মরণী (কেন ধাও মোর পাছে পাছে)

বিস্মরণী

কেন ধাও মোর পাছে?
কিছু নেই কাছে;
দিয়েছি উজাড়ি সবই নিলখ চরণে।
জীবন্ত মরণে
আপনারে নিকামত রেখেছি বেষ্টিয়া;
স্বভাবের সার্বভৌম ক্রিয়া
ব্যাহত হয়েছে মোর নিবৃত্তির নিশ্চল তুহিনে।।

নবাগত ফাল্গুনের দিনে
ধরণী, উমার মতো, যবে মোর সমাধির মূলে
ফলে-ফুলে,
বর্ণে-গন্ধে, রূপে-রসে রচেছে প্রেমের উপহার,
তখনও মারের গৈবী ধনুর টংকার
শুনি নাই মুগ্ধ কান পেতে;
আত্মদুঃখে মেতে,
নির্জীব স্মৃতিরে বহি, ফিরেছি তাণ্ডবে,
ত্রিভুবন ছারখার করি;
শূন্য নভে
রিক্ত প্রতিধ্বনি-স্ফীত অট্টহাসি ভরি,
উড়ায়ে মরুর বায়ে ছিন্ন বেদ-বেদান্তের পাতা,
বলেছি পিশাচহস্তে নিহত বিধাতা।।

যেখানে যায় না কোনও লোক,
যেথা নাই ব্যাধি, মৃত্যু, নিরঞ্জন নিষ্কাম, নিঃশোক,
নিশ্চিহ্ন তুষারে বসে, আপনার মনে
প্রহরের জপমালা গণে,
তারেও দিইনি অব্যাহতি।
হায়, সতী,
তোমার শটিত স্মৃতি, খ’সে নিজ ভাৱে,
কামক্লিন্ন পীঠে সেথা স্থাপিত করেছে আপনারে।।

তোমার ধেয়ানে
সঁপেছি আমার নিদ্রা; কণ্টকশয়ানে
ভুঞ্জেছি, জাগর স্বপ্নে, নিশি-ডাকা সংসর্গ তোমার
একমাত্র তারা-জ্বালা গাঢ় অন্ধকার
নিয়ত এনেছে মনে অসীম, নীলিম আঁখি তব,
নিবিড়, রহস্যময়, অন্তর্দীপ্ত, দ্রব।
অগোচর নারিকেলবনে
মৃদুল মর্মর তুলে, খোলা বাতায়নে
কবোষ্ণ মলয় যবে ছুঁয়ে গেছে অলক্ষ্যে আমার,
ক্ষণিক মায়ায়
ভেবেছি, বিহ্বল হয়ে, হয়তো বা তুমি ঘুমঘোরে
রুদ্ধ কণ্ঠে করি প্রিয়সম্বোধন মোরে,
রোমাঞ্চ বিথারো দেহে উচ্ছ্বসিত কুন্তলের স্রোতে॥

আবেশ কেটেছে অশ্রুনীরে;
রুদ্ধশ্বাস গৃহ হতে ছুটেছি বাহিরে;
দেখেছি ক্ষীণাঙ্গ চাঁদ মন্দগতি কালের সৈকতে
চেয়ে আছে আশাপথ কার,
সুপ্ত কোন্ লগ্নভ্রষ্ট অভিসারিকার।
সঙ্গে সঙ্গে মোহের জোয়ারে
ডুবে গেছে শিক্ষা-দীক্ষা, ভূগোল-বিজ্ঞান একেবারে;
ভেবেছি তুমিও বুঝি শয়নবিবাগী,
দিগন্তরে,
সুখশ্রান্ত পুরীর শিখরে,
ঊর্ধ্বমুখ আকাঙ্ক্ষায় দাঁড়ায়ে, অভাগী,
করো অনুভব
সর্বস্বান্ত বিরহের আত্মস্থ গৌরব।।
আরও কিছু চাও?
ক্লান্ত আমি; অব্যাহতি দাও।
আলেয়ার ডাকে
দুর্লভ যৌবন মোর রুদ্ধ আজ পঙ্কের বিপাকে;
মুছেছে আমার ভবিষ্যৎ
অতীতের পথ
অবলুপ্ত বিনষ্ট স্বর্গের ধ্বংসস্তূপে;
চুপে চুপে
ছেড়ে গেছে অন্তর্যামী অরাজক অন্তর আমার;
আশা নাই, ভাষা নাই, কেবল ধিক্কার
রিক্ত মর্মে মাথা কুটে মরে;
মৃত্যুর পাথেয়-মাত্র রাখি নাই সঞ্চয়ন ক’রে।।

তাই বলি মিছে
ফিরো না আমার পিছে পিছে;
দিতেছি অঞ্জলি এই সর্বশেষ গান,
হে প্রলুব্ধ ছায়াময়ী, অন্তরীক্ষে করো অন্তর্ধান।।

৩০ জানুআরি ১৯৩৩

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *