বিসর্জন – ২

দ্বিতীয় অঙ্ক

প্রথম দৃশ্য

  মন্দির

রঘুপতি জয়সিংহ ও নক্ষত্ররায়

নক্ষত্ররায়।              কী জন্য ডেকেছ গুরুদেব?
রঘুপতি।                                           কাল রাত্রে
স্বপন দিয়েছে দেবী, তুমি হবে রাজা
নক্ষত্ররায়।               আমি হব রাজা! হা হা! বল কী ঠাকুর
রাজা হব? এ কথা নূতন শোনা গেল!
রঘুপতি।              তুমি রাজা হবে।
নক্ষত্ররায়।                                  বিশ্বাস হয় না মোর।
রঘুপতি।              দেবীর স্বপন সত্য। রাজটিকা পাবে
তুমি, নাহিকো সন্দেহ।
নক্ষত্ররায়।                                          নাহিকো সন্দেহ!
কিন্তু, যদি নাই পাই?
রঘুপতি।                                       আমার কথায়
অবিশ্বাস?
নক্ষত্ররায়।                          অবিশ্বাস কিছুমাত্র নেই,
কিন্তু দৈবাতের কথা–যদি নাই হয়!
রঘুপতি।              অন্যথা হবে না কভু।
নক্ষত্ররায়।                                       অন্যথা হবে না?
দেখো প্রভু, কথা যেন ঠিক থাকে শেষে।
রাজা হয়ে মন্ত্রীটারে দেব দূর করে,
সর্বদাই দৃষ্টি তার রয়েছে পড়িয়া
আমা-‘পরে, যেন সে বাপের পিতামহ।
বড়ো ভয় করি তারে–বুঝেছ ঠাকুর?
তোমারে করিব মন্ত্রী।
রঘুপতি।                                       মন্ত্রিত্বের পদে
পদাঘাত করি আমি।
নক্ষত্ররায়।                                        আচ্ছা, জয়সিংহ
মন্ত্রী হবে। কিন্তু, হে ঠাকুর, সবই যদি
জানো তুমি, বলো দেখি কবে রাজা হব।
রঘুপতি।              রাজরক্ত চান দেবী।
নক্ষত্ররায়।                                      রাজরক্ত চান!
রঘুপতি।              রাজরক্ত আগে আনো, পরে রাজা হবে।
নক্ষত্ররায়।              পাব কোথা!
রঘুপতি।                            ঘরে আছে গোবিন্দমাণিক্য।
তাঁরি রক্ত চাই।
নক্ষত্ররায়।                                 তাঁরি রক্ত চাই!
রঘুপতি।                                                   স্থির
হয়ে থাকো জয়সিংহ, হোয়ো না চঞ্চল!–
বুঝেছ কি? শোনো তবে–গোপনে তাঁহারে
বধ ক’রে, আনিবে সে তপ্ত রাজরক্ত
দেবীর চরণে।–
                                      জয়সিংহ, স্থির যদি
না থাকিতে পারো, চলে যাও অন্য ঠাঁই।–
বুঝেছ নক্ষত্ররায়? দেবীর আদেশ,
রাজরক্ত চাই–শ্রাবণের শেষ রাত্রে।
তোমরা রয়েছ দুই রাজভ্রাতা–জ্যেষ্ঠ
যদি অব্যাহতি পায়, তোমার শোণিত
আছে, তৃষিত হয়েছে যবে মহাকালী,
তখন সময় আর নাই বিচারের।
নক্ষত্ররায়।               সর্বনাশ! হে ঠাকুর, কাজ কী রাজত্বে!
রাজরক্ত থাক্‌ রাজদেহে, আমি যাহা
আছে সেই ভালো।
রঘুপতি।                                    মুক্তি নাই, মুক্তি নাই
কিছুতেই! রাজরক্ত আনিতেই হবে!
নক্ষত্ররায়।               বলে দাও, হে ঠাকুর, কী করিতে হবে।
রঘুপতি।              প্রস্তুত হইয়া থাকো। যখন যা বলি
অবিলম্বে করিবে সাধন; কার্যসিদ্ধি
যতদিন নাহি হয়, বন্ধ রেখো মুখ।
এখন বিদায় হও।
নক্ষত্ররায়।                                   হে মা কাত্যায়নী!

[ প্রস্থান

জয়সিংহ।              একি শুনলাম! দয়াময়ী মাতঃ, একি
কথা! তোর আজ্ঞা! ভাই দিয়ে ভ্রাতৃহত্যা!
বিশ্বের জননী!–গুরুদেব! হেন আজ্ঞা
মাতৃ-আজ্ঞা ব’লে করিলে প্রচার!
রঘুপতি।                                                      আর
কী উপায় আছে বলো।
জয়সিংহ।                                         উপায়! কিসের
উপায় প্রভু! হা ধিক্‌! জননী, তোমার
হস্তে খড়্গ নাই? রোষে তব বজ্রানল
নাহি চণ্ডী? তব ইচ্ছা উপায় খুঁজিছে,
খুঁড়িছে সুরঙ্গপথ চোরের মতন
রসাতলগামী? একি পাপ!
রঘুপতি।                                             পাপপুণ্য
তুমি কিবা জানো!
জয়সিংহ।                                    শিখেছি তোমারি কাছে।
রঘুপতি।              তবে এস বৎস, আর-এক শিক্ষা দিই।
পাপপুণ্য কিছু নাই। কে বা ভ্রাতা, কে বা
আত্মপর! কে বলিল হত্যাকাণ্ড পাপ!
এ জগৎ মহা হত্যাশালা। জানো না কি
প্রত্যেক পলকপাতে লক্ষকোটি প্রাণী
চির আঁখি মুদিতেছে! সে কাহার খেলা?
হত্যায় খচিত এই ধরণীর ধূলি।
প্রতিপদে চরণে দলিত শত কীট–
তাহারা কী জীব নহে? রক্তের অক্ষরে
অবিশ্রাম লিখিতেছে বৃদ্ধ মহাকাল
বিশ্বপত্রে জীবের ক্ষণিক ইতিহাস।
হত্যা অরণ্যের মাঝে, হত্যা লোকালয়ে,
হত্যা বিহঙ্গের নীড়ে, কীটের গহ্বরে,
অগাধ সাগর-জলে, নির্মল আকাশে,
হত্যা অকারণে, হত্যা অনিচ্ছার বশে–
চলেছে নিখিল বিশ্ব হত্যার তাড়নে
ঊর্ধ্বশ্বাসে প্রাণপণে, ব্যাঘ্রের আক্রমে
মৃগসম, মুহূর্ত দাঁড়াতে নাহি পারে।
মহাকালী কালস্বরূপিণী, রয়েছেন
দাঁড়াইয়া তৃষাতীক্ষ্ণ লোলজিহ্বা মেলি–
বিশ্বের চৌদিক বেয়ে চির রক্তধারা
ফেটে পড়িতেছে, নিষ্পেষিত দ্রাক্ষা হতে
রসের মতন, অনন্ত খর্পরে তাঁর–
জয়সিংহ।              থামো, থামো, থামো!–
                                               মায়াবিনী, পিশাচিনী,
মাতৃহীন এ সংসারে এসেছিস তুই
মা’র ছদ্মবেশ ধরে রক্তপানলোভে?
ক্ষুধিত বিহঙ্গশিশু অরক্ষিত নীড়ে
চেয়ে থাকে মা’র প্রত্যাশায়, কাছে আসে
লুব্ধ কাক, ব্যগ্রকণ্ঠে অন্ধ শাবকেরা
মা মনে করিয়া তারে করে ডাকাডাকি,
হারায় কোমল প্রাণ হিংস্রচঞ্চুঘাতে–
তেমনি কি তোর ব্যবসায়? প্রেম মিথ্যা,
স্নেহ মিথ্যা, দয়া মিথ্যা, মিথ্যা আর-সব,
সত্য শুধু অনাদি অনন্ত হিংসা! তবে
কেন মেঘ হতে, ঝরে আশীর্বাদসম
বৃষ্টিধারা দগ্ধ ধরণীর বক্ষ-‘পরে–
গ’লে আসে পাষাণ হইতে দয়াময়ী
স্রোতস্বিনী মরুমাঝে–কোটি কণ্টকের
শিরোভাগে, কেন ফুলে ওঠে বিকশিয়া?
ছলনা করেছ মোরে প্রভু! দেখিতেছ
মাতৃভক্তি রক্তসম হৃদয় টুটিয়া
ফেটে পড়ে কিনা আমারি হৃদয় বলি
দিলে মাতৃপদে। ওই দেখো হাসিতেছে
মা আমার স্নেহপরিহাসবশে। বটে,
তুই রাক্ষসী পাষাণী বটে, মা আমার
রক্ত-পিয়াসিনী! নিবি মা আমার রক্ত,
ঘুচাবি সন্তানজন্ম এ জন্মের তরে–
দিব ছুরি বুকে? এই শিরা-ছেঁড়া রক্ত
বড়ো কি লাগিবে ভালো? ওরে, মা আমার
রাক্ষসী পাষাণী বটে! ডাকিছ কি মোরে
গুরুদেব? ছলনা বুঝেছি আমি তব।
ভক্তহিয়া-বিদারিত এই রক্ত চাও!
দিয়েছিলে এই-যে বেদনা, তারি পরে
জননীর স্নেহহস্ত পড়িয়াছে। দুঃখ
চেয়ে সুখ শত গুণ। কিন্তু, রাজরক্ত!
ছিছি! ভক্তিপিপাসিতা মাতা, তাঁরে বলো
রক্তপিপাসিনী!
রঘুপতি।                                বন্ধ হোক বলিদান
তবে!
জয়সিংহ।                       হোক বন্ধ।–না না, গুরুদেব, তুমি
জানো ভালোমন্দ। সরল ভক্তির বিধি
শাস্ত্রবিধি নহে। আপন আলোকে আঁখি
দেখিতে না পায়, আলোক আকাশ হতে
আসে। প্রভু, ক্ষমা করো, ক্ষমা করো দাসে।
ক্ষমা করো স্পর্ধা মূঢ়তার। ক্ষমা করো
নিতান্ত বেদনাবশে উদ্‌ভ্রান্ত প্রলাপ।
বলো প্রভু, সত্যই কি রাজরক্ত চান
মহাদেবী?
রঘুপতি।                            হায় বৎস, হায়! অবশেষে
অবিশ্বাস মোর প্রতি?
জয়সিংহ।                                       অবিশ্বাস? কভু
নহে। তোমারে ছাড়িলে, বিশ্বাস আমার
দাঁড়াবে কোথায়? বাসুকির শিরশ্চ্যুত
বসুধার মতো, শূন্য হতে শূন্যে পাবে
লোপ। রাজরক্ত চায় তবে মহামায়া,
সে রক্ত আনিব আমি। দিব না ঘটিতে
ভ্রাতৃহত্যা।
রঘুপতি।                             দেবতার আজ্ঞা পাপ নহে।
জয়সিংহ।              পুণ্য তবে, আমিই সে করিব অর্জন।
রঘুপতি।              সত্য করে বলি, বৎস, তবে। তোরে আমি
ভালোবাসি প্রাণের অধিক–পালিয়াছি
শিশুকাল হতে তোরে, মায়ের অধিক    
স্নেহে–তোরে আমি নারিব হারাতে।
জয়সিংহ।                                                          মোর
স্নেহে ঘটিতে দিব না পাপ, অভিশাপ
আনিব না এ স্নেহের ‘পরে।
রঘুপতি।                                                ভালো ভালো,
সে কথা হইবে পরে–কল্য হবে স্থির।

[ উভয়ের প্রস্থান

দ্বিতীয় দৃশ্য

মন্দির

অপর্ণা

গান

           ওগো পুরবাসী,
আমি দ্বারে দাঁড়ায়ে আছি উপবাসী।
জয়সিংহ, কোথা জয়সিংহ! কেহ নাই
এ মন্দিরে। তুমি কে দাঁড়ায়ে আছ হোথা
অচল মূরতি–কোনো কথা না বলিয়া
হরিতেছ জগতের সার-ধন যত!
আমরা যাহার লাগি কাতর কাঙাল
ফিরে মরি পথে পথে, সে আপনি এসে
তব পদতলে করে আত্মসমর্পণ!
তাহে তোর কোন্‌ প্রয়োজন! কেন তারে
কৃপণের ধন-সম রেখে দিস পুঁতে
মন্দিরের তলে–দরিদ্র এ সংসারের
সর্ব ব্যবহার হতে করিয়া গোপন!
জয়সিংহ, এ পাষাণী কোন্‌ সুখ দেয়,
কোন্‌ কথা বলে তোমা-কাছে, কোন্‌ চিন্তা
করে তোমা-তরে–প্রাণের গোপন পাত্রে
কোন্‌ সান্ত্বনার সুধা চিররাত্রিদিন
রেখে দেয় করিয়া সঞ্চিত!–ওরে চিত্ত
উপবাসী, কার রুদ্ধ দ্বারে আছ বসে?

গান

ওগো পুরবাসী,
আমি দ্বারে দাঁড়ায়ে আছি উপবাসী।
হেরিতেছি সুখমেলা,               ঘরে ঘরে কত খেলা,
শুনিতেছি সারাবেলা     সুমধুর বাঁশি।

রঘুপতির প্রবেশ

রঘুপতি।              কে রে তুই এ মন্দিরে!
অপর্ণা।                                          আমি ভিখারিনী।
জয়সিংহ কোথা?
রঘুপতি।                                  দূর হ এখান হতে
মায়াবিনী! জয়সিংহে চাহিস কাড়িতে
দেবীর নিকট হতে, ওরে উপদেবী!
অপর্ণা।              আমা হতে দেবীর কি ভয়? আমি ভয়
করি তারে, পাছে মোর সব করে গ্রাস!

গাহিতে গাহিতে প্রস্থান

তৃতীয় দৃশ্য

মন্দির-সম্মুখে পথ

জয়সিংহ

দূর হোক চিন্তাজাল! দ্বিধা দূর হোক!
চিন্তার নরক চেয়ে কার্য ভালো, যত
ক্রূর, যতই কঠোর হোক। কার্যের তো
শেষ আছে, চিন্তার সীমানা নাই কোথা–
ধরে সে সহস্র মূর্তি পলকে পলকে
বাষ্পের মতন; চারি দিকে যতই সে
পথ খুঁজে মরে, পথ তত লুপ্ত হয়ে
যায়। এক ভালো অনেকের চেয়ে। তুমি
সত্য, গুরুদেব, তোমারি আদেশ সত্য–
সত্যপথ তোমারি ইঙ্গিতমুখে। হত্যা
পাপ নহে, ভ্রাতৃহত্যা পাপ নহে, নহে
পাপ রাজহত্যা!–সেই সত্য, সেই সত্য!
পাপপুণ্য নাই, সেই সত্য! থাক্‌ চিন্তা,
থাক্‌ আত্মদাহ, থাক্‌ বিচার বিবেক!–
কোথা যাও ভাই-সব, মেলা আছে বুঝি
নিশিপুরে? কুকী রমণীর নৃত্য হবে?
আমিও যেতেছি।–এ ধরায় কত সুখ
আছে–নিশ্চিন্ত আনন্দসুখে নৃত্য করে
নারীদল, মধুর অঙ্গের রঙ্গভঙ্গ
উচ্ছ্বসিয়া উঠে চারি দিকে, তটপ্লাবী
তরঙ্গিণী-সম। নিশ্চিন্ত আনন্দে সবে
ধায় চারি দিক হতে–উঠে গীতগান,
বহে হাস্যপরিহাস, ধরণীর শোভা
উজ্জ্বল মূরতি ধরে। আমিও চলিনু।

গান

আমারে   কে নিবি ভাই, সঁপিতে চাই আপনারে।
আমার এই    মন গলিয়ে কাজ ভুলিয়ে সঙ্গে তোদের নিয়ে যা রে।
তোরা কোন্‌  রূপের হাটে, চলেছিস  ভবের বাটে
পিছিয়ে  আছি আমি আপন ভারে।
তোদের ঐ  হাসিখুশি  দিবানিশি  দেখে মন  কেমন করে।
আমার এই  বাধা টুটে  নিয়ে যা লুটেপুটে,                
পড়ে থাক্‌  মনের বোঝা ঘরের দ্বারে।
যেমন ঐ  এক নিমেষে  বন্যা এসে      
ভাসিয়ে নে যায় পারাবারে॥
এত যে  আনাগোনা,   কে আছে  জানাশোনা–
কে আছে  নাম ধরে মোর ডাকতে পারে।
যদি সে  বারেক এসে  দাঁড়ায় হেসে
চিনতে পারি দেখে তারে॥
দূরে অপর্ণার প্রবেশ
ওকিও অপর্ণা, দূরে দাঁড়াইয়া কেন!
শুনিতেছ অবাক হইয়া, জয়সিংহ
গান গাহে? সব মিথ্যা, বৃহৎ বঞ্চনা,
তাই হাসিতেছি–তাই গাহিতেছি গান।
ওই দেখো পথ দিয়ে তাই চলিতেছে
লোক নির্ভাবনা, তাই ছোটো কথা নিয়ে
এতই কৌতুকহাসি, এত কুতূহল,
তাই এত যত্নভরে সেজেছে যুবতী।
সত্য যদি হ’ত, তবে হ’ত কি এমন?
সহজে আনন্দ এত বহিত কি হেথা?
তাহা হলে বেদনায় বিদীর্ণ ধরায়,
বিশ্বব্যাপী ব্যাকুল ক্রন্দন থেমে গিয়ে
মূক হয়ে রহিত অনন্তকাল ধরি।
বাঁশি যদি সত্যই কাঁদিত বেদনায়,
ফেটে গিয়ে সংগীত নীরব হত তার।
মিথ্যা বলে তাই এত হাসি–শ্মশানের
কোলে বসে খেলা, বেদনার পাশে শুয়ে
গান, হিংসা-ব্যাঘ্রিণীর খরনখতলে
চলিতেছে প্রতিদিবসের কর্মকাজ!
সত্য হলে এমন কি হত? হা অপর্ণা,
তুমি আমি কিছু সত্য নই, তাই জেনে
সুখী হও–বিষণ্ন বিস্ময়ে, মুগ্ধ আঁখি
তুলে কেন রয়েছিস চেয়ে! আয় সখী,
চিরদিন চলে যাই দুই জনে মিলে
সংসারের ‘পর দিয়ে, শূন্য নভস্তলে
দুই লঘু মেঘখণ্ড-সম।

রঘুপতির প্রবেশ

রঘুপতি।                                           জয়সিংহ!
জয়সিংহ।              তোমারে চিনি নে আমি। আমি চলিয়াছি
আমার অদৃষ্টভরে ভেসে নিজ পথে,
পথের সহস্র লোক যেমন চলেছে।
তুমি কে বলিছ মোরে দাঁড়াইতে? তুমি
চলে যাও–আমি চলে যাই।
রঘুপতি।                                               জয়সিংহ!
জয়সিংহ।              ওই তো সম্মুখে পথ চলেছে সরল–
চলে যাব ভিক্ষাপাত্র হাতে, সঙ্গে লয়ে
ভিখারিনী সখী মোর। কে বলিল, এই
সংসারের রাজপথ দুরূহ জটিল!
যেমন ক’রেই যাই, দিবা-অবসানে
পঁহুছিব জীবনের অন্তিম পলকে,
আচার বিচার তর্ক বিতর্কের জাল
কোথা মিশে যাবে। ক্ষুদ্র এই পরিশ্রান্ত
নরজন্ম সমর্পিব ধরণীর কোলে–
দু-চারি দিনের এই সমষ্টি আমার,
দু-চারিটা ভুলভ্রান্তি ভয় দুঃখসুখ,
ক্ষীণ হৃদয়ের আশা, দুর্বলতাবশে
ভ্রষ্ট ভগ্ন এ জীবনভার, ফিরে দিয়ে
অনন্তকালের হাতে, গভীর বিশ্রাম।
এই তো সংসার! কী কাজ শাস্ত্রের বিধি,
কী কাজ গুরুতে!
                                         প্রভু! পিতা! গুরুদেব!
কী বলিতেছিনু! স্বপ্নে ছিনু এতক্ষণ।
এই সে মন্দির–ওই সেই মহাবট
দাঁড়ায়ে রয়েছে, অটল কঠিন দৃঢ়
নিষ্ঠুর সত্যের মতো। কী আদেশ দেব!
ভুলি নাই কী করিতে হবে। এই দেখো–
ছুরি দেখাইয়া
তোমার আদেশ-স্মৃতি অন্তরে বাহিরে
হতেছে শাণিত। আরো কী আদেশ আছে
প্রভু!
রঘুপতি।                       দূর করে দাও ওই বালিকারে
মন্দির হইতে।–মায়াবিনী, জানি আমি
তোদের কুহক।–দূর করে দাও ওরে!
জয়সিংহ।              দূর করে দিব? দরিদ্র আমারি মতো
মন্দির-আশ্রিত, আমারি মতন হায়
সঙ্গীহীন, অকণ্টক পুষ্পের মতন
নির্দোষ নিষ্পাপ শুভ্র সুন্দর সরল
সুকোমল বেদনাকাতর, দূর করে
দিতে হবে ওরে? তাই দিব গুরুদেব!
চলে যা অপর্ণা! দয়ামায়া স্নেহপ্রেম
সব মিছে! মরে যা অপর্ণা! সংসারের
বাহিরেতে কিছুই না থাকে যদি, আছে
তবু দয়াময় মৃত্যু। চলে যা অপর্ণা!
অপর্ণা।               তুমি চলে এস জয়সিংহ, এ মন্দির
ছেড়ে, দুইজনে চলে যাই।
জয়সিংহ।                                             দুইজনে
চলে যাই! এ তো স্বপ্ন নয়। একবার
স্বপ্নে মনে করেছিনু স্বপ্ন এ জগৎ।
তাই হেসেছিনু সুখে, গান গেয়েছিনু।
কিন্তু সত্য এ যে। বোলো না সুখের কথা
আর, দেখায়ো না স্বাধীনতা-প্রলোভন–
বন্দী আমি সত্য-কারাগারে।
রঘুপতি।                                              জয়সিংহ
কাল নাই মিষ্ট আলাপের। দূর করে
দাও ওই বালিকারে।
জয়সিংহ।                                      চলে যা অপর্ণা!
অপর্ণা।               কেন যাব!
জয়সিংহ।                           এই নারী-অভিমান তোর?
অপর্ণা।               অভিমান কিছু নাই আর। জয়সিংহ,
তোমার বেদনা, আমার সকল ব্যথা
সব গর্ব চেয়ে বেশি। কিছু মোর নাই
অভিমানে।
জয়সিংহ।                           তবে আমি যাই। মুখ তোর
দেখিব না, যতক্ষণ রহিবি হেথায়।–
চলে যা অপর্ণা!
অপর্ণা।                                  নিষ্ঠুর ব্রাহ্মণ, ধিক্‌
থাক্‌  ব্রাহ্মণত্বে তব। আমি ক্ষুদ্র নারী
অভিশাপ দিয়ে গেনু তোরে, এ বন্ধনে
জয়সিংহে পারিবি না বাঁধিয়া রাখিতে।    

[ প্রস্থান

রঘুপতি।              বৎস, তোলো মুখ, কথা কও একবার!
প্রাণপ্রিয় প্রাণাধিক, আমার কি প্রাণে
অগাধ সমুদ্রসম স্নেহ নাই! আরো
চাস? আমি আজন্মের বন্ধু, দু দণ্ডের
মায়াপাশ ছিন্ন হয়ে যায় যদি, তাহে
এত ক্লেশ?
জয়সিংহ।                           থাক্‌ প্রভু, বোলো না স্নেহের
কথা আর। কর্তব্য রহিল শুধু মনে।
স্নেহপ্রেম তরুলতাপত্রপুষ্পসম
ধরণীর উপরেতে শুধু, আসে যায়
শুকায় মিলায় নব নব স্বপ্নবৎ।
নিম্নে থাকে শুষ্ক রূঢ় পাষাণের স্তূপ
রাত্রিদিন, অনন্ত হৃদয়ভারসম।

[ প্রস্থান

রঘুপতি।             জয়সিংহ, কিছুতে পাই নে তোর মন,
                এত যে সাধনা করি নানা ছলে-বলে।

[ প্রস্থান

চতুর্থ দৃশ্য

মন্দিরপ্রাঙ্গণ

জনতা

গণেশ।       এবারে মেলায় তেমন লোক হল না!
অক্রূর।       এবারে আর লোক হবে কী করে? এ তো আর হিঁদুর রাজত্ব রইল না। এ যেন নবাবের রাজত্ব হয়ে উঠল। ঠাকরুনের বলিই বন্ধ হয়ে গেল, তো মেলায় লোক আসবে কী!
কানু।      ভাই, রাজার তো এ বুদ্ধি ছিল না, বোধ হয় কিসে তাকে পেয়েছে।
অক্রূর।       যদি পেয়ে থাকে তো কোন্‌ মুসলমানের ভূতে পেয়েছে, নইলে বলি উঠিয়ে দেবে কেন?
গণেশ।       কিন্তু যাই বলো, এ রাজ্যের মঙ্গল হবে না।
কানু।      পুরুত-ঠাকুর তো স্বয়ং বলে দিয়েছেন, তিন মাসের মধ্যে মড়কে দেশ উচ্ছন্ন যাবে।
হারু।     তিন মাস কেন, যেরকম দেখছি তাতে তিন দিনের ভর সইবে না। এই দেখো-না কেন, আমাদের মোধো এই আড়াই বছর ধরে ব্যামোয় ভুগে ভুগে বরাবরই তো বেঁচে এসেছে, ঐ, যেমন বলি বন্ধ হল অমনি মারা গেল।
অক্রূর।       না রে, সে তো আজ তিন মাস হল মরেছে।
হারু।     নাহয় তিন মাসই হল, কিন্তু এই বছরেই তো মরেছে বটে।
ক্ষান্তমণি।        ওগো, তা কেন, আমার ভাসুরপো, সে যে মরবে কে জানত। তিন দিনের জ্বর–ঐ, যেমনি কবিরাজের বড়িটি খাওয়া অমনি চোখ উল্‌টে গেল।
গণেশ।       সেদিন মথুরহাটির গঞ্জে আগুন লাগল, একখানা চালা বাকি রইল না!
চিন্তামণি। অত কথায় কাজ কী! দেখো-না কেন, এ বছর ধান যেমন সস্তা হয়েছে এমন আর কোনোবার হয় নি। এ বছর চাষার কপালে কী আছে কে জানে!
হারু।     ঐ রে, রাজা আসছে। সকালবেলাতেই আমাদের এমন রাজার মুখ দেখলুম, দিন কেমন যাবে কে জানে। চল্‌, এখান থেকে সরে পড়ি।

[ সকলের প্রস্থান

চাঁদপাল ও গোবিন্দমাণিক্যের প্রবেশ

চাঁদপাল।              মহারাজ, সাবধানে থেকো। চারি দিকে
চক্ষুকর্ণ পেতে আছি, রাজ-ইষ্টানিষ্ট
কিছু না এড়ায় মোর কাছে। মহারাজ,
তব প্রাণহত্যা-তরে গুপ্ত আলোচনা
স্বকর্ণে শুনেছি।
গোবিন্দমাণিক্য।                            প্রাণহত্যা! কে করিবে?
চাঁদপাল।              বলিতে সংকোচ মানি। ভয় হয়, পাছে
সত্যকার ছুরি চেয়ে নিষ্ঠুর সংবাদ
অধিক আঘাত করে রাজার হৃদয়ে।
গোবিন্দমাণিক্য।         অসংকোচে বলে যাও। রাজার হৃদয়
সতত প্রস্তুত থাকে আঘাত সহিতে
কে করেছে হেন পরামর্শ?
চাঁদপাল।                                            যুবরাজ
নক্ষত্ররায়।        
গোবিন্দমাণিক্য।                        নক্ষত্র!
চাঁদপাল।                                       স্বকর্ণে শুনেছি
মহারাজ, রঘুপতি যুবরাজে মিলে
গোপনে মন্দিরে বসে স্থির হয়ে গেছে
সব কথা।
গোবিন্দমাণিক্য।                        দুই দণ্ডে স্থির হয়ে গেল
              আজন্মের বন্ধন টুটিতে! হায় বিধি!
চাঁদপাল।              দেবতার কাছে তব রক্ত এনে দেবে–
গোবিন্দমাণিক্য।         দেবতার কাছে! তবে আর নক্ষত্রের
নাই দোষ। জানিয়াছি, দেবতার নামে
মনুষ্যত্ব হারায় মানুষ। ভয় নাই,
যাও তুমি কাজে। সাবধানে রব আমি।

[ চাঁদপালের প্রস্থান

রক্ত নহে, ফুল আনিয়াছি মহাদেবী!
ভক্তি শুধু– হিংসা নহে, বিভীষিকা নহে।
এ জগতে দুর্বলেরা বড়ো অসহায়
মা জননী, বাহুবল বড়োই নিষ্ঠুর,
স্বার্থ বড়ো ক্রূর, লোভ বড়ো নিদারুণ,
অজ্ঞান একান্ত অন্ধ–গর্ব চলে যায়
অকাতরে ক্ষুদ্রেরে দলিয়া পদতলে।
হেথা স্নেহ-প্রেম অতি ক্ষীন বৃন্তে থাকে,
পলকে খসিয়া পড়ে স্বর্থের পরশে।
তুমিও, জননী, যদি খড়্গ উঠাইলে,
মেলিলে রসনা, তবে সব অন্ধকার!
ভাই তাই ভাই নহে আর, পতি প্রতি
সতী বাম, বন্ধু শত্রু, শোণিতে পঙ্কিল
মানবের বাসগৃহ, হিংসা পুণ্য দয়া
নির্বাসিত। আর নহে, আর নহে, ছাড়ো
ছদ্মবেশ। এখনো কি হয়নি সময়?
এখনো কি রহিবে প্রলয়রূপ তব?
এই-যে উঠিছে খড়্গ চারি দিক হতে
মোর শির লক্ষ্য করি, মাতঃ, একি তোরি
চারি ভুজ হতে? তাই হবে! তবে তাই
হোক। বুঝি মোর রক্তপাতে হিংসানল
নিবে যাবে। ধরণীর সহিবে না এত
হিংসা। রাজহত্যা! ভাই দিয়ে ভ্রাতৃহত্যা
সমস্ত প্রজার বুকে লাগিবে বেদনা,
সমস্ত ভায়ের প্রাণ উঠিবে কাঁদিয়া।
মোর রক্তে হিংসার ঘুচিবে মাতৃবেশ,
প্রকাশিবে রাক্ষসী-আকার। এই যদি
দয়ার বিধান তোর, তবে তাই হোক!

জয়সিংহের প্রবেশ

জয়সিংহ।              বল্‌ চণ্ডী, সত্যই কি রাজরক্ত চাই?
এই বেলা বল্‌, বল্‌ নিজ মুখে,বল্‌
মানবভাষায়, বল্‌ শীঘ্র–সত্যই কি
রাজরক্ত চাই?
নেপথ্যে।                         চাই।
জয়সিংহ।                                     তবে মহারাজ,
নাম লহ ইষ্টদেবতার। কাল তব
নিকটে এসেছে।
গোবিন্দমাণিক্য।                           কী হয়েছে জয়সিংহ?
জয়সিংহ।              শুনিলে না নিজকর্ণে? দেবীরে শুধানু
সত্যই কি রাজরক্ত চাই–দেবী নিজে
কহিলেন “চাই’।
গোবিন্দমাণিক্য।          দেবী নহে জয়সিংহ,
কহিলেন রঘুপতি অন্তরাল হতে,
পরিচিত স্বর।
জয়সিংহ।                               কহিলেন রঘুপতি?
অন্তরাল হতে?–নহে নহে, আর নহে!
কেবলি সংশয় হতে সংশয়ের মাঝে
নামিতে পারি নে আর! যখনি কূলের
কাছে আসি, কে মোরে ঠেলিয়া দেয় যেন
অতলের মাঝে! সে যে অবিশ্বাস-দৈত্য!
আর নহে! গুরু হোক কিম্বা দেবী হোক,
একই কথা!–
ছুরিকা-উন্মোচন॥॥ ছুরি ফেলিয়া
ফুল নে মা! নে মা! ফুল নে মা!
পায়ে ধরি, শুধু ফুল নিয়ে হোক তোর
পরিতোষ! আর রক্ত না মা, আর রক্ত
নয়! এও যে রক্তের মতো রাঙা, দুটি
জবাফুল! পৃথিবীর মাতৃবক্ষ ফেটে
উঠিয়াছে ফুটে, সন্তানের রক্তপাতে
ব্যথিত ধরার স্নেহ-বেদনার মতো।
নিতে হবে! এই নিতে হবে! আমি
নাহি ডরি তোর রোষ। রক্ত নাহি দিব!
রাঙা’ তোর আঁখি! তোল্‌ তোর খড়্গ! আন্‌
তোর শ্মশানের দল! আমি নাহি ডরি।

[ গোবিন্দমাণিক্যের প্রস্থান

এ কী হল হায়! দেবী গুরু যাহা ছিল
এক দণ্ডে বিসর্জন দিনু–বিশ্বমাঝে
কিছু রহিল না আর!

রঘুপতির প্রবেশ

রঘুপতি।              সকল শুনেছি
আমি। সব পণ্ড হল, কী করিলি, ওরে
অকৃতজ্ঞ!
জয়সিংহ।                           দণ্ড দাও প্রভু!
রঘুপতি।                                            সব ভেঙে
দিলি! ব্রহ্মশাপ ফিরাইলি অর্ধপথ
হতে! লঙ্ঘিলি গুরুর বাক্য! ব্যর্থ করে
দিলি দেবীর আদেশ! আপন বুদ্ধিরে
করিলি সকল হতে বড়ো! অজন্মের
স্নেহঋণ শুধিলি এমনি করে!
জয়সিংহ।                                                    দণ্ড
দাও পিতা!
রঘুপতি।                            কোন্‌ দণ্ড দিব?
জয়সিংহ।                                               প্রাণদণ্ড।
রঘুপতি।             নহে। তার চেয়ে গুরুদণ্ড চাই। স্পর্শ
             কর্‌ দেবীর চরণ।
জয়সিংহ।                                করিনু পরশ।
রঘুপতি।             বল্‌ তবে, “আমি এনে দিব রাজরক্ত
শ্রাবণের শেষ রাত্রে দেবীর চরণে।’
জয়সিংহ।             আমি এনে দিব রাজরক্ত, শ্রাবণের
শেষ রাত্রে দেবীর চরণে।
রঘুপতি।                                            চলে যাও।
Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *