বিশ্বাসঘাতকদের জন্য (উপন্যাস)
কয়েকটি কথা
১৯৬৮ সালে অধুনালুপ্ত ‘মাসিক রহস্য পত্রিকা’য় আমার প্রথম গল্প প্রকাশিত হয়। পত্রিকার কর্ণধার গোবিন্দলাল বন্দ্যোপাধ্যায় সেই দুর্বল রচনাটি প্রকাশ করে ফেলায় কালক্রমে কীভাবে যেন লেখালিখির মধ্যে চলে এসেছি। তারপর নানা রহস্য-রোমাঞ্চ পত্রিকায় লেখালিখি, রহস্য-রোমাঞ্চ লেখক-সম্পাদকদের সান্নিধ্য এবং আশকারায় অনেক-অনেক বছর কেটে গেছে। এই উপন্যাসে সেই কেটে যাওয়া রক্তঝরা বছরগুলোর কমবেশি ছাপ পড়েছে। তাই সেইসব পরিচিতজনকে এবং সেই সময়কে কৃতজ্ঞতা জানাই। রহস্য-রোমাঞ্চ সাহিত্যের সঙ্গে, তার পরিমন্ডলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয় না থাকলে আমার পক্ষে এ-উপন্যাস লেখা কখনও সম্ভব হত না। রহস্য-রোমাঞ্চ সাহিত্য যাঁরা ভালোবাসেন তাঁদের কাছে এ-রচনাটি আমার আন্তরিক নিবেদন।
.
এক
নীতিন জোয়ারদার প্যারিসে একটি চিকিৎসক সম্মেলনে যোগ দিতে এসেছেন। সঙ্গে স্ত্রী রিনি। বিয়ের পর এই প্যারিসেই দুজনে মধুচন্দ্রিমা কাটাতে এসেছিলেন। তখনই এই শহরটার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন ওঁরা দুজনে। তারপর কেটে গেছে কুড়িটি বছর। এবার এই সম্মেলনের সুযোগে নীতিন সস্ত্রীক এসেছেন প্যারিসে—দ্বিতীয়বার।
নড়বড়ে মান্ধাতার আমলের ট্যাক্সি চড়ে ফ্রান্সের রাজধানীর সদ্য-ঘুম-ভাঙা রাজপথ ধরে ওঁরা এসে উঠলেন বিলাসবহুল গ্র্যান্ড হোটেলে। খানিকক্ষণ পুরোনো স্মৃতি রোমন্থনের রঙ্গ-রসিকতায় ডুবে গেলেন দুজনে।
তারপর রিনি স্নান সেরে নিল। তোয়ালে গায়ে জড়িয়ে বেরিয়ে এল বাথরুম থেকে। নীতিন বাথরুমে ঢুকে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দাড়ি কামাতে শুরু করলেন। একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন, রিনি কার্পেট পাতা মেঝের ওপর দিয়ে জামাকাপড়ের সুটকেসটা টেনে নিয়ে গেল চোখের আড়ালে। এবার পোশাক-টোশাক পরে ও তৈরি হয়ে নেবে। তারপর ওঁরা দুজনেই সম্মেলনের জন্য তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়বেন।
দাড়ি কামাতে-কামাতে বাথরুম থেকেই নীতিন গলা উঁচু করে কথা বলছিলেন রিনির সঙ্গে। কিন্তু হঠাৎই খেয়াল করলেন, রিনির কোনও সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। তখন তিনি স্ত্রীর নাম ধরে ডাকলেন—একবার, দুবার।
কিন্তু কোনও সাড়া নেই।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলেন নীতিন জোয়ারদার। হতবাক হয়ে আবিষ্কার করলেন, ঘরে আর কেউ নেই। রিনির ভেজা পোশাক একপাশে পড়ে আছে। আর তার কাছেই একটা সুটকেস—এই সুটকেসটা নীতিন আগে কখনও দেখেননি। তন্নতন্ন করে সব জায়গায় খুঁজেও স্ত্রীকে দেখতে পেলেন না তিনি।
একজন নিরীহ ছাপোষা ডাক্তারের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। হোটেলের ফ্ল্যাটে তিনি একা—আর কেউ নেই!
ড. নীতিন জোয়ারদারের স্ত্রী নামি হোটেলের দামি ঘর থেকে প্রকাশ্য দিবালোকে উধাও হয়ে গেছেন।
এরপরই শুরু হল খোঁজ।
হোটেলের রিসেপশনের লোকজন বলল, মিসেস জোয়ারদারকে তাঁরা হোটেল ছেড়ে বেরোতে দেখেননি।
ফরাসি পুলিশ অফিসার মুচকি হেসে বললেন, আপনার স্ত্রী আপনার সঙ্গে হোটেলে এসে উঠেছিলেন তো!
কেউ বা বললেন, উনি হয়তো কোনও ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে ইলোপ করেছেন।
মধ্যবয়স্ক একটি মানুষ বিদেশ-বিভুঁই শহরে পাগলের মতো স্ত্রীকে খুঁজে বেড়াতে লাগল।
অবশেষে গ্র্যান্ড হোটেলের একজন পরিচারকের দেওয়া সূত্র ধরে নীতিন জানতে পারলেন, দুজন লোক তাঁর স্ত্রীকে একটা লাক্সারি সিডানে করে তুলে নিয়ে গেছে। সিডানটা যে-গলিতে পার্ক করা ছিল সেখানে গিয়ে নীতিন খুঁজে পেলেন রিনির ব্রেসলেট। কিন্তু তা সত্ত্বেও পুলিশ মানতে রাজি নয় যে, রিনিকে কেউ কিডন্যাপ করেছে।
হোটেলে ফিরে এসে হতাশভাবে বসে রইল একজন বিপন্ন মানুষ। নীতিন এখন কী করবেন? কার কাছে যাবেন সাহায্যের জন্য?
পরদিন ড. জোয়ারদারকে ফোন করল একজন অজ্ঞাতকুলশীল মানুষ।
ড. জোয়ারদার?
কথা বলছি।
আপনার স্ত্রী আমাদের কাছে রয়েছেন।
নীতিন জোয়ারদার পাগলের মতো হয়ে উঠলেন। একসঙ্গে অনেক প্রশ্ন করলেন অচেনা লোকটিকে।
তারপর জানতে পারলেন, ওরলি এয়ারপোর্টে তাঁর হাতব্যাগটি পালটে গেছে আর একজনের হাতব্যাগের সঙ্গে। সেই হাতব্যাগে একটা জিনিস আছে। সেটা নিয়ে এই লোকটির সঙ্গে কোথাও দেখা করে জিনিসটা দিলে ফেরত পাওয়া যাবে রিনিকে। আর নীতিন যদি পুলিশে খবর দেন তা হলে পাওয়া যাবে রিনির লাশ। এখন যেটা ড. জোয়ারদারের পছন্দ…।
অন্ধকার ঘরের বিশাল পরদায় বয়ে চলেছে রঙিন চলচ্চিত্র। রোমান পোলানস্কির রুদ্ধশ্বাস ছবি ‘ফ্র্যানটিক’-এর বাংলায় ডাব করা সংস্করণ। নায়ক ড. নীতিন জোয়ারদারের ভূমিকায় হলিউডের প্রখ্যাত অভিনেতা হ্যারিসন ফোর্ড। ‘সিরাজ’ হোটেলের বলরুমের আবছায়া অন্ধকারে বসে বিশিষ্ট দর্শকরা ছবি দেখছেন।
‘বার্ষিক রহস্য-রোমাঞ্চ লেখক সম্মেলন’ এইবার তৃতীয় বছরে পা দিল। উদ্যোক্তারা এ-বছরে কয়েকটি ক্রাইম ছবি দেখানোর ব্যবস্থা করেছেন। ফ্লিম আর্কাইভ থেকে নিয়ে আসা হয়েছে ‘জিঘাংসা’ ও ‘চিড়িয়াখানা’। এ ছাড়া বাছাই করা কয়েকটি বিদেশি ছবি বাংলায় ডাব করে দেখানোর ব্যবস্থা হয়েছে। আজ, প্রথমদিনের ছবি ছিল ‘ফ্র্যানটিক’।
ছবি যখন শেষ হল তখন ঠিক পৌনে তিনটে।
বলরুমের সাবেকী ঝাড়লণ্ঠন জ্বলে উঠল। এ ছাড়াও অন্যান্য বাড়তি আলোয় ঝলমল করে উঠল চারদিক।
অজস্র সাদা ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে সুদৃশ্য মঞ্চ। সাদা ফুলের ঘন পটভূমিতে গল্পের গোয়েন্দা শার্লক হোমসের বিখ্যাত ছবি। মাথায় চেক-চেক টুপি। পরনে একই নকশার কোট। ঠোঁটে পাইপ। বাঁকানো লম্বা নাক। ব্যক্তিত্বময় প্রোফাইল। চোয়ালের শক্ত রেখা তাতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
কাঁধ পেরোনোর পরই প্রখ্যাত গোয়েন্দার ছবিটা শেষ। কিন্তু অনায়াসেই বাকিটা কল্পনা করে নেওয়া যায়।
অনেকক্ষণ আধো-আঁধারির পর হঠাৎ আলো জ্বলে ওঠায় ‘বেঙ্গলি ক্রাইম রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর সভাপতি ভাস্কর রাহা চোখ পিটপিট করছিলেন। চোখের আর দোষ কী! ওদেরও তো বয়স প্রায় পঁয়ষট্টি হল! পাঁচ বছর আগেই ওদের রিটায়ার করা উচিত ছিল। কিন্তু পুরু লেন্সের চশমা ওদের প্রতি পদে সাহায্য করায় ওরা এখনও হাল ছাড়েনি।
হাল ছাড়েননি ভাস্কর রাহাও। সেই কোন কালে, বলতে গেলে কিশোর বয়েসে, লেখালিখি শুরু করেছিলেন। তারপর আর থামা হয়নি। নিষ্পাপ গল্প-কবিতার পথ থেকে কবে যেন পদস্খলিত হয়ে ‘অপরাধ’ জগতে পা দিয়ে ফেলেছিলেন। ব্যস, তারপরই ফেরা-যায়-না এমন বিন্দুতে পৌঁছে গেছেন। ‘অপরাধী’ সাহিত্য চর্চা করতে-করতে কখন যেন ডুবে গেছেন ‘পাপের বোঝায়’। আর কয়েক দশকের মধ্যেই জুটে গেছে কয়েকটা খেতাব। তার মধ্যে একটা হল ‘রহস্য-রোমাঞ্চ সাহিত্যের মুকুটহীন সম্রাট’। একদিন রসিকতা করেই কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসের আড্ডায় কথাটা বলেছিলেন উৎপলেন্দু সেন। তারপর সেটাই যেন কেমন করে টিকে গেছে।
‘হ্যারিসন ফোর্ডকে ড. নীতিন জোয়ারদার বলে ভাবতে বেশ কষ্ট হয়—’ ভাস্কর রাহার পাশ থেকে উৎপলেন্দু মন্তব্য করলেন।
রাহা উৎপলেন্দুর দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, ‘ডাব করা ছবি দেখতে বসে এসব ভাববেন না, উৎপল। আমরাও তো গল্পের আইডিয়া যখন সাহেবদের থেকে লোন নিই তখন জোনাথানকে করি যতীন, ক্যাথারিনকে রীনা, আর রবার্টকে করি রবি। ধীরে-ধীরে এসব গা সওয়া হয়ে যাবে।’
বলরুমে সুন্দর করে সাজানো সারি-সারি আধুনিক চেয়ার। চেয়ারে আমন্ত্রিত অতিথিরা বসে আছেন। লেখক, প্রকাশক, সম্পাদক, পাঠক, সাংবাদিক, ফোটোগ্রাফার—সব ধরনের অতিথিই হাজির হয়েছে এই সম্মেলনে। গত দু-বছরের তুলনায় এবারের সম্মেলনে জাঁকজমক ও আয়োজন একটু বেশি। কারণ, এবার বেশ কয়েকটি ভালো স্পনসর পেয়েছেন উদ্যোক্তারা। এ ছাড়া এই সম্মেলন উপলক্ষ্যে প্রকাশকরা অন্তত তিরিশটি ক্রাইমজাতীয় বই প্রকাশ করেছেন। বলরুমের পাশের হলে একটি ছোট বইমেলারও ব্যবস্থা করা হয়েছে।
ভাস্কর রাহার বাঁদিকেই বসেছিলেন রতন বন্দ্যোপাধ্যায়। অনুষ্ঠানসূচি অনুসারে এইবার শুরু হবে গল্প পাঠ। চারজন লেখক গল্প পড়বেন, তারপর সেই গল্পগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে। চারজনের মধ্যে প্রথম নামটিই রতন বন্দ্যোপাধ্যায়ের।
ভাস্কর রাহার কথায় তিনি প্রতিবাদ করে উঠলেন। বললেন, ‘আপনি হয়তো গল্পের আইডিয়া লোন নেন, ভাস্করবাবু, কিন্তু সবাই নেয় না। আপনি তো আমার বহু গল্প পড়েছেন। বলতে পারবেন, তার একটাও আমি বিদেশি গল্প থেকে আইডিয়া নিয়ে লিখেছি!’
রাহা হাসলেন। বললেন, ‘রতনদা, বয়েস কত হল?’
একটু থতিয়ে গিয়ে রতন বললেন, ‘সাতষট্টি—আপনার চেয়ে দু-বছরের বড়। কেন?’
ভাস্কর রাহা হেসে বললেন, ‘এখনও সেই বিতর্ক! পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরছে, না সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘুরছে! আরে দাদা, আমার কাছে ”ঘুরছে” এটাই বড় কথা। সুতরাং আইডিয়া যেখান থেকেই আসুক, শেষ পর্যন্ত সাহিত্য হল কিনা সেটাই বড় কথা।’
উৎপলেন্দু চশমাটা নাকের ওপরে ঠিক করে বসালেন। তারপর ভাস্কর রাহার কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে চাপা ঠাট্টার গলায় বললেন, ‘সে কী! আপনি অ্যাদ্দিন ধরে এ-লাইনে রয়েছেন, জানেন না রতন বাঁড়ুজ্জের সব গপ্পো-উপন্যাসই সেন্ট-পারসেন্ট ওরিজিন্যাল। সাহেবরা পর্যন্ত এ-কথা একবাক্যে স্বীকার করেছে।’
ভাস্কর রাহা ছোট্ট করে হাসলেন। উৎপলেন্দু বেশ মজা করে কথা বলতে পারেন। এর একটা কারণ বোধহয়, তিনি প্রায় তিরিশ বছর ধরে ‘রূপান্তর’ নাটকের দলের সঙ্গে অভিনেতা হিসেবে যুক্ত। লেখালিখি আর অভিনয়, এই নিয়েই আছেন। কিন্তু ষাটের দোরগোড়ায় এসে স্পষ্ট বুঝতে পারেন, দুটোর কোনওটাই তাকে কিছু দেয়নি। বরং আলেয়া হয়ে তিরিশ বছর ধরে তাঁকে অক্লান্ত ছুটিয়েছে, ছুটিয়েছে।
মঞ্চের ওপরে ঘোষক অনুষ্ঠানসূচি ঘোষণা করে রতন বন্দ্যোপাধ্যায়কে মঞ্চে আসতে অনুরোধ করল।
রতন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাঁ-দিকে বসেছিল পঞ্চাশ ছুঁই-ছুঁই লেখক অর্জুন দত্ত। সে নাকে সামান্য নস্যি গুঁজে রতন বন্দ্যোপাধ্যায়কে একরকম ঠেলা মারল, ‘রতনদা, চটপট যান। আপনাকে ডাকছে—।’
সম্মেলন উপলক্ষ্যে রতন বন্দ্যোপাধ্যায় একেবারে জামাইটি সেজে এসেছেন। স্বাস্থ্য ভালো হওয়ায় তাঁকে বেশ মানিয়েছে। ধবধবে সাদা কোঁচানো ধুঁতি-পাঞ্জাবি। গলায় সোনার চেন। তার আশেপাশে পাউডারের ছোঁয়া। পাকা চুল ব্যাকব্রাশ করে আঁচড়ানো। সরু গোঁফজোড়া দেখলেই বোঝা যায় মালিক রোজ এদের যত্ন নেন।
ফোলিয়ো ব্যাগ থেকে গল্পটি বের করে ব্যাগ চেয়ারে রেখে মঞ্চের দিকে হাঁটা দিলেন রতন। সামনের সারিতে বসেছিলেন বর্ষীয়ান রহস্য-রোমাঞ্চ লেখিকা রত্নাবলী মুখোপাধ্যায়। ওঁর পাশেই অনামিকা সেনগুপ্ত। ওঁরা দুজনে হেসে রতন বন্দ্যোপাধ্যায়কে উইশ করলেন।
উৎপলেন্দু লম্বা হাই তুলে বললেন, ‘নিন, এবার একটা ওরিজিন্যাল ক্রাইম গল্প শুনুন, ভাস্করবাবু।’
ভাস্কর রাহা হাত নেড়ে বললেন, ‘এত চটে যাচ্ছেন কেন? রতনদা সত্যিই হয়তো সব ওরিজিন্যাল লেখেন—।’
উৎপলেন্দু শুধু তাচ্ছিলের একটা ‘হুঁঃ’ শব্দ করলেন।
অনামিকা ঘাড় ঘুরিয়ে জিগ্যেস করল, ‘ভাস্করদা, অনিমেষবাবু আমার কাছে ব্যাগ রেখে কোথায় গেলেন বলুন তো! আধঘণ্টা হয়ে গেল—আমার তো কোল ব্যথা করছে।’
অনামিকার বয়েস অল্প। লম্বা, ফরসা, সুন্দরী। লেখালিখি করে কম, কিন্তু সেগুলো নামি পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়। দুজন প্রকাশকের ‘ঘর’ থেকে এ-বছরের শেষে ওর দুটো বই বেরোনোর কথা।
একটা চুরুট ধরানোর জন্য ভাস্কর রাহার ঠোঁট আর আঙুল নিশপিশ করছিল। কিন্তু এয়ার কন্ডিশনড বলরুমে স্মোক করার উপায় নেই।
তিনি বললেন, ‘সত্যিই তো! পান কিনতে যাচ্ছি বলে যে চলে গেল তা তো প্রায় চল্লিশ মিনিট হবে। এই অধ্যাপকগুলোর না কাণ্ডজ্ঞানের অভাব আছে! দাও, তুমি ব্যাগটা আমার কাছে দাও—।’
অনামিকা বলল, ‘না, থাক। এখুনি হয়তো এসে পড়বেন—।’
অনিমেষ চৌধুরি ইতিহাসের অধ্যাপনা করেন বাঙুর কলেজে। লম্বায় ছোটখাটো। তবে দৈর্ঘের খামতি পুষিয়ে দিয়েছেন প্রস্থ দিয়ে। তাঁর ব্যাগটির বপুও নেহাত কম নয়। ব্যাগ হাতে যখন তিনি হেঁটে যান তখন ভারি অদ্ভুত দেখায়।
ভাস্কর রাহা উৎপলেন্দুর দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করলেন, ‘এতক্ষণ ধরে প্রফেসর কী পান কিনছে বলুন তো?’
উৎপলেন্দু হাসলেন। বললেন, ‘দেখুন গিয়ে, সস্তার পান খুঁজতে-খুঁজতে হয়তো এ-গলি ও-গলি করে তিন কিলোমিটার পথ পার হয়ে কোথাও হারিয়ে গেছে।’
‘হ্যাঁ, যেরকম অ্যাবসেন্ট মাইন্ডেড…হতেও পারে…।’
‘থামুন তো, আর বলবেন না। অন্যের বেলা অ্যাবসেন্ট মাইন্ডেড, আর নিজের বেলা টনটনে জ্ঞান। দেখছেন না, ব্যাগ রাখার জন্যে কী সুন্দর কোল বেছেছে।’ শেষ মন্তব্যটা উৎপলেন্দু করেছেন চাপা গলায়।
সব কিছুতেই তেতো মন্তব্য করা উৎপলেন্দু সেনের একরকম স্বভাবে দাঁড়িয়ে গেছে। তবে ওঁর সব মন্তব্যই যে উড়িয়ে দেবার মতো তা নয়। আসলে লেখালিখিতে ব্যর্থতা ওঁকে খানিকটা সিনিক করে তুলেছে। ওঁর চশমার পুরু কাচ অনেক বছর ধরেই ক্রোধ আর ঈর্ষায় নীল হয়ে গেছে।
এ-পর্যন্ত উৎপলেন্দুর মোট বারোটা বই বেরিয়েছে। তার মধ্যে ন-টা অনুবাদ, আর বাকি তিনটে নিজের লেখা। বইগুলো খারাপ চলেনি। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রকাশকরা কেন যে ওঁর লেখা ছাপতে চায় না কে জানে!
উৎপলেন্দুর দিকে তাকিয়ে কথাগুলো ভাবছিলেন ভাস্কর রাহা। ওঁর সঙ্গে রাহার আলাপ প্রায় পঁচিশ বছরের। রহস্য-রোমাঞ্চ সাহিত্যের অনেক ওঠানামা দেখেছেন দুজনে।
অনামিকা উৎপলেন্দুর শেষ মন্তব্যটা ভালো করে শুনতে পায়নি। ও গলা বাড়িয়ে জিগ্যেস করল, ‘কী বললেন, উৎপলদা?’
উৎপলেন্দু ভাস্কর রাহার দিকে এক পলক তাকালেন। তারপর মুচকি হেসে বললেন, ‘না…ওই অধ্যাপকদের ব্যাপার আর কী…।’
মঞ্চে তখন রতন বন্দ্যোপাধ্যায় গল্প পড়ছেন। প্রায় সকলেই মনোযোগ দিয়ে শুনছেন সেই গল্প।
গত বিশ বছর ধরে রহস্য-রোমাঞ্চ সাহিত্য চর্চা করলেও রতন বন্দ্যোপাধ্যায় খ্যাতির পুরস্কার পেয়েছেন মাত্র দশ বছর। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা চল্লিশেরও বেশি। তার মধ্যে ছোটদের জন্য লেখা কিছু গল্প-উপন্যাসও আছে।
লেখনী চর্চার বহু আগে থেকেই শরীর চর্চা করতেন রতন বন্দ্যোপাধ্যায়। দু-বার নাকি ইন্টার কলেজ বক্সিং চ্যাম্পিয়ানও হয়েছেন। বক্সিং নিয়ে ওঁর লেখা দুটো উপন্যাস বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। এ ছাড়া একটা বক্সিং শেখার বই লিখেছেন।
এইসব কারণেই ভাস্কর রাহা অনেক সময় ওঁকে ঠাট্টা করে বলেন, ‘দাদা, আপনি হলেন আমাদের লাইনের সবচেয়ে শক্তিশালী লেখক।’
উত্তরে রতন হাসেন। বলেন, ‘যে-অর্থেই বলুন, ভাস্করবাবু, কথাটা কি খুব মিথ্যে!’
এ-সম্পর্কে উৎপলেন্দুর চাপা মন্তব্য : ‘শক্তিশালী তো বটেই! নইলে কি আর ওই ফোলিও ব্যাগের মধ্যে হাফ ডজন নানান সাইজের রেডিমেড লেখা নিয়ে সম্পাদক আর প্রকাশকের দপ্তরে দপ্তরে ঘোরা যায়!’
ভাস্কর রাহা মনোযোগ দিয়ে রতন বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প শুনছিলেন। উৎপলেন্দু তাঁকে কনুইয়ের খোঁচা দিয়ে জিগ্যেস করলেন, ‘কী বুঝছেন? ওরিজিন্যাল?’
মঞ্চের দিকে চোখ রেখেই ভাস্কর বললেন, ‘জন কোলিয়ারের একটা গল্পের আবছা ছায়া আছে।’
‘আপনার কাছে ছায়াটা আবছা মনে হতে পারে, তবে আমার কাছে ছায়াটা বেশ স্পষ্ট এবং লম্বা। ইংরিজি গল্পটা আমারও পড়া।’
ভাস্কর রাহা গল্পটা মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন, কারণ প্রথম সুযোগেই রতন বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর কাছে গল্প সম্পর্কে মতামত চাইবেন। ‘মুকুটহীন সম্রাট’ হওয়ার এই জ্বালা!
রতন বন্দ্যোপাধ্যায়ের পর রত্নাবলী মুখোপাধ্যায়। বাংলা সাহিত্যের আগাথা ক্রিস্টি। গত পনেরো বছর ধরে একের পর এক চমকে দেওয়া গল্প-উপন্যাস লিখে চলেছেন। অথচ ওঁর প্রথম দিককার লেখা নিয়ে সমালোচকরা খুব একটা উৎসাহী ছিলেন না। আবার ইদানিং কয়েকটা লেখাও বেশ হতাশ করেছে।
রত্নাবলী গৃহবধূ। ফরসা গোলগাল গিন্নিবান্নি চেহারা। কথাবার্তায় মেজাজে একটু সেকেলে। তবে লেখায় ভীষণ আধুনিক। গত পাঁচ বছরে ওঁর উপন্যাস নিয়ে তিনটে হিট ছবি তৈরি হয়েছে। এখন একটা ছবি হচ্ছে হিন্দিতে। ওঁর উপন্যাস ইংরিজিতে অনুবাদ হয়ে ‘পেঙ্গুইন’ থেকে বেরিয়েছে। ওঁর লেখায় রহস্য-রোমাঞ্চ উপাদানের পাশাপাশি জীবন-দর্শন এমনভাবে জড়িয়ে থাকে যে মুগ্ধ হতে হয়। ভাস্কর রাহা বাংলা গল্প-উপন্যাস খুব বেছে পড়েন। রত্নাবলীর লেখা ওঁর খুব পছন্দের। তা ছাড়া ভদ্রমহিলা সংসারের নানান দায়দায়িত্ব সামাল দিয়ে কী করে যে সময় বের করে নিয়ে লেখেন কে জানে!
মঞ্চের দিকে রওনা হওয়ার আগে রত্নাবলী স্মিত হেসে পরিচিতজনদের দিকে এক ঝলক চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন, ‘নতুন গল্প পড়ব—।’
রত্নাবলী চলে যেতেই অনামিকা পিছনের সারির দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, ‘এই বয়েসেও প্রচুর লিখতে পারেন। হিংসে করার মতো।’
রতন বন্দ্যোপাধ্যায় তখন পরিতৃপ্ত মুখে ফিরে আসছেন নিজের চেয়ারে। ভাস্কর রাহার দিকে একবার উৎসুক চোখে তাকালেন। অর্থাৎ, গল্প কেমন লাগল। ভাস্কর রাহা ইশারায় জানালেন, পরে এ নিয়ে আলোচনা করবেন।
উৎপলেন্দু তাঁর কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বললেন, ‘ওঁর গল্পটা নিয়ে কী আলোচনা করবেন? বলবেন, কোলিয়ারের লেখা থেকে ঝেড়েছে?’
রাহা হেসে ঘাড় নাড়লেন। বললেন, ‘উঁহু—প্রশংসা করব। বলব, খুব ভালো লেখা হয়েছে।’
উৎপলেন্দু ব্যঙ্গভরে বললেন, ‘বাঃ!’
রাহা এতটুকু বিচলিত না হয়ে বললেন, ‘এ ছাড়া কোনও উপায় নেই, উৎপল। আপনি কি চান, আমি ওঁকে বলি এখন থেকে ওরিজিন্যাল লেখা শুরু করতে! ওঁর লেখকজীবনের আর কতটুকু বাকি আছে! অনামিকা হলে সত্যি কথাটা বলতাম। বাংলা রহস্য সাহিত্যকে ওর এখনও অনেক কিছু দেবার আছে।’
অনামিকা গলা লম্বা করে জানতে চাইল, ‘কী বলছেন, ভাস্করদা?’
‘না, না—কিছু না। তুমি রত্মাবলীর গল্প শোনো।’
এমন সময় দেখা গেল অনিমেষ চৌধুরি ফিরে এসেছেন।
মানুষটা চেহারায় খাটো। বেশ গোলগাল চেহারা। মাথায় কোঁকড়ানো চুল। পরনে গেরুয়া রঙের খদ্দরের পাঞ্জাবি আর ধুতি। কচমচ করে পান চিবোচ্ছেন। ঘামে তামাটে মুখ চকচক করছে। ইতি-উতি তাকিয়ে বোধহয় অনামিকাকে খুঁজছেন।
দু-সারি চেয়ারের ফাঁক দিয়ে অধ্যাপক চৌধুরি কোনওরকমে নিজের স্থূলকায় চেহারাটিকে টেনে নিয়ে আসছিলেন, উৎপলেন্দু তড়িঘড়ি তাঁকে কাছাকাছি একটা খালি চেয়ার দেখিয়ে দিলেন। অধ্যাপক অনামিকার কাছে আসতে চাইছিলেন। কিন্তু উৎপলেন্দু খালি চেয়ার দেখিয়ে দেওয়ায় ফাঁপরে পড়ে গেলেন। অনামিকাও চট করে দাঁড়িয়ে উঠে পেটমোটা চামড়ার ব্যাগটা বাড়িয়ে দিল অনিমেষ চৌধুরির দিকে।
‘অনিমেষদা, আপনার ব্যাগ—।’
অসহায়ভাবে ব্যাগটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে একটা ‘হুম’ শব্দ করে ব্যাগটা ধরলেন অধ্যাপক। তারপর ব্যাগসমেত ধপাস করে খালি চেয়ারটায় বসে পড়লেন। একই সঙ্গে ‘ফোঁস’ করে একটা শব্দ করলেন।
রতন বন্দ্যোপাধ্যায় ভাস্কর রাহাকে কী একটা বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু ঠিক তখনই রত্নাবলী মুখোপাধ্যায়ের গল্প পড়া শেষ হল। সারা হলে শোনা গেল ভদ্র করতালির শব্দ। ভাস্কর রাহা, উৎপলেন্দু, অধ্যাপক—সকলেই তাতে হাত মেলালেন।
রত্নাবলী হাসিমুখে মঞ্চ থেকে নেমে আসছিলেন, ঠিক সেই মুহূর্তে বিপর্যয়টা ঘটে গেল।
মোটামুটি নিস্তব্ধ হলে একটি মাত্র মানুষ উদ্ধত ভঙ্গিতে আচমকা উঠে দাঁড়িয়ে অশ্লীলভাবে হাততালি দিতে লাগল।
রত্নাবলী তার দিকে তাকালেন।
শুধু রত্নাবলী কেন, হলঘরের প্রায় প্রতিটি মানুষ চোখ ফেরাল সেই দুর্বিনীত তরুণীর দিকে। কে এই অসভ্য রমণী? উপস্থিত দর্শকদের কেউ কেউ তাকে চেনে হয়তো, কিন্তু সকলেই নয়।
মেয়েটির বয়েস ছাব্বিশ কি সাতাশ। গায়ে টকটকে হলদে ঢোলা-টি-শার্ট। টি-শার্টের বুকের ওপরে নীল হরফে লেখা : এক কাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই। মেয়েটির চুল স্টেপ কাট করা। ছোট-ছোট ঢেউ তুলে ঘাড় ছাড়িয়ে পিঠের ওপরে নেমে গেছে। চুলের ফাঁক দিয়ে চোখে পড়ছে কানের শৌখিন দুল। গলায় আটোসাঁটো কালো পুঁতির মালা।
মেয়েটির গায়ের রং ময়লা হলেও নাক-চোখ ধারালো। বিশেষ করে দু-চোখে যেন দুটো হিরের কুচি বসানো। ফ্যাকাসে জিনসের প্যান্টের কোমরের কাছে এক হাত রেখে আর এক হাতের আঙুলে গলার মালা অনুভব করছিল।
ও হাততালি বন্ধ করলেও সেই বেপরোয়া শব্দস্রোত সকলের কানে বাজছিল।
রতন বন্দ্যোপাধ্যায় হঠাৎই যেন সাড় ফিরে পেয়ে ভাস্কর রাহাকে জিগ্যেস করলেন, ‘ভাস্করবাবু, মেয়েটা কে বলুন তো? চেনেন নাকি?’
ভাস্কর রাহা নীচু গলায় বললেন, ‘আমি ভালো করেই চিনি। দেবারতি মানি। ”সুপ্রভাত” পত্রিকার ক্রাইম জার্নালিস্ট।’
অনুষ্ঠানের কর্মকর্তাদের একজন মাইকে বললেন, ‘আপনার কিছু বলার থাকলে মঞ্চে এসে বলতে পারেন—।’
দেবারতি মাথা ঝাঁকাল। ওর চুল সাপের মতো নড়ে উঠল এপাশ-ওপাশ। তারপর বলল, ‘আমার বলার জন্যে মঞ্চ দরকার হয় না।’ একটু থেমে চারদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল : ‘আমার নাম দেবারতি মানি। ”সুপ্রভাত” পত্রিকার ক্রাইম জার্নালিস্ট। আমি রহস্য-রোমাঞ্চ-গোয়েন্দা গল্প-উপন্যাস গোগ্রাসে গিলি। এখানে যেসব লেখক-লেখিকাকে নেমন্তন্ন করা হয়েছে তাঁদের অলমোস্ট সব লেখা আমি পড়েছি। তবে মিসেস রত্নাবলী মুখোপাধ্যায়ের কোনও তুলনা নেই। ওঁর লেখার রহস্য একমাত্র ওঁর ডিটেকটিভ করঞ্জাক্ষ রুদ্র ছাড়া আর কেউ ধরতে পারে না। ওঁর লেখা আমার সবচেয়ে ফেভারিট। সুপার্ব! ওঁর এখনকার গল্পটাও আমার ফ্যানট্যাসটিক লেগেছে। ইউ আর সিম্পলি আনপ্যারালাল, মিসেস মুখার্জি—।’
পাশে বসা কেউ একজন দেবারতির হাত ধরে টান মেরে ওকে বসিয়ে দেবার চেষ্টা করল। আর তখনই দেবারতির সুঠাম দেহ সামান্য বেসামাল হয়ে টলে গেল। সঙ্গে-সঙ্গে সকলে বুঝতে পারলেন দেবারতি দিনদুপুরে নেশা করেছে।
ভাস্কর রাহা দেবারতির কথাগুলোর মধ্যে অন্য কোনও মাত্রা খুঁজছিলেন। মেয়েটা তাহলে লাঞ্চের সময়েই মদ গিলেছে! মেয়েটার কিসের কষ্ট?
হলঘরের গুঞ্জনের ডেসিবেল মাত্রা ক্রমে চড়তে লাগল।
দেবারতি মানি জড়িয়ে-জড়িয়ে অস্পষ্টভাবে আরও কীসব কথা বলছিল। তারই মধ্যে ওকে টেনে বসিয়ে দিল কেউ। রত্নাবলী মুখোপাধ্যায় কিছুক্ষণের জন্যে বিমূঢ় হয়ে পড়েছিলেন, কিন্তু এখন আবার নিজের মর্যাদা ফিরিয়ে এনেছেন। ঠোঁটে সম্রাজ্ঞীর স্মিত হাসি ফুটিয়ে তুলে ছোট-ছোট পায়ে নেমে এলেন মঞ্চ থেকে। তাঁর কাঁচাপাকা চুল, রিমলেস আধুনিক ছাঁদের চশমা, পরনের হালকা গোলাপি-কালোয় কাজ করা জামদানি শাড়ি, মাথা সামান্য হেলিয়ে হাঁটার ভঙ্গি এক অদ্ভুত ব্যক্তিত্ব তৈরি করেছে। বোঝা যায়, তাঁকে বাংলা সাহিত্যের আগাথা ক্রিস্টি বলার সঙ্গত কারণ আছে।
সম্মেলনের তাল কেটে গেল।
এরপর গল্প পড়ার কথা রূপেন মজুমদার আর রঞ্জন দেবনাথের। সেইমতো ঘোষণাও করা হল মাইকে। কিছুক্ষণ চাপা গুঞ্জনের পর রূপেন মজুমদার মঞ্চে গেলেন। খানিকটা কল্পবিজ্ঞান মেশানো একটা ক্রাইম গল্প পড়ে শোনালেন। তারপর কেমন-লাগল-গোছের ভঙ্গিতে হাসলেন। শ্রোতাদের কেউ যখন গল্প নিয়ে কোনও প্রশ্ন তুললেন না, তখন নেমে এলেন মঞ্চ থেকে।
রূপেন মজুমদারের বয়েস প্রায় পঞ্চান্ন-ছাপ্পান্ন। পনেরো-ষোলো বছর বয়েস থেকেই তাঁর লেখা ছাপা হচ্ছে। পয়সাওয়ালা ঘরের ছেলে, তাই বাইশ বছর বয়েসেই নিজের টাকায় পরপর দুটো উপন্যাস ছেপে বের করেছিলেন। সেই বই দুটোর ভূমিকায় স্পষ্ট করে লেখা ছিল, উপন্যাস-যুগল সম্পূর্ণভাবে তাঁর মৌলিক চিন্তার ফসল। অবশ্য যে-কোনও পাঠক বই দুটো পড়ে তাঁর সঙ্গে একমত হবেন। কারণ, লেখা দুটোর প্লট যেমন দুর্বল, তেমনই সেকেলে তার ভাষা। পড়লেই মনে হয়, লেখক বঙ্কিমচন্দ্রের ছাতার নীচ থেকে এখনও বেরোতে পারেননি।
কিন্তু এসব ব্যাপার রূপেন মজুমদারকে এতটুকু দমিয়ে রাখতে পারেনি। ভদ্রলোক একের পর এক বই লিখে গেছেন। সেগুলো যে-করে-হোক ছাপাও হয়েছে। শত্রুরা বলে সম্পাদক-প্রকাশককে তোয়াজের বন্যায় ভাসিয়ে দিতে তাঁর জুড়ি নেই। তবে গত তিরিশ-চল্লিশ বছর ধরে রূপেন মজুমদারের একটাই স্লোগান : তিনিই রহস্য-রোমাঞ্চ সাহিত্যের একমাত্র মৌলিক লেখক। দুষ্টজনে ফিসফিসিয়ে বলে, রূপেন মজুমদারের ইংরেজি পড়ার অভ্যেস নেই, তাই এখনও ‘সতী’ রয়ে গেছেন। আর উৎপলেন্দু সেন ওঁকে বলেন, বাংলা রহস্য-রোমাঞ্চ সাহিত্যের একমাত্র ভার্জিন রাইটার। এখনও ওঁর ধর্ম নষ্ট হয়নি।
রঞ্জন দেবনাথকে বারবার মাইকে ডেকেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। যখন কর্মকর্তারা একেবারে হাল ছেড়ে দিয়েছেন তখনই হুট করে সে কোত্থেকে এসে হাজির হল। স্মার্ট ভঙ্গিতে মঞ্চে উঠে গিয়ে গল্প পড়তে শুরু করল।
রঞ্জন দেবনাথের চেহারা সুন্দর। লেখালিখির লাইনে না এসে অভিনয় জগতে গেলেও সে হয়তো ছাপ ফেলতে পারত। বয়েস বড়জোর চল্লিশ-বিয়াল্লিশ। চোখে এখনও চশমা ওঠেনি। গায়ের রং ফরসা, তবে সামান্য চাপা। মাথায় কোঁকড়া চুল। গালে চাপ দাড়ি, সঙ্গে মানানসই সরু গোঁফ। ধারালো নাক। উজ্জ্বল সপ্রতিভ চোখ। পরনে নীল-সবুজ স্ট্রাইপ দেওয়া ফুলহাতা শার্ট আর গাঢ় রঙের টেরিলিনের প্যান্ট।
রঞ্জনের গল্প পড়ার ভঙ্গিতে অদ্ভুত এক আত্মবিশ্বাসের ছাপ ফুটে বেরোচ্ছে। ভাস্কর রাহা ওর গল্পের প্রতিটি শব্দ প্রতিটি লাইন গভীর মনোযোগে শুনছিলেন। গল্পের নাম ‘সংসারে পাপ আছে’। বেশ নতুন ধরনের নাম।
রঞ্জন দেবনাথের প্রথম উপন্যাস ‘অন্ধকারে বাঘবন্দী খেলা’ প্রকাশিত হয়েছিল কম করেও বারো-তেরো বছর আগে। তারপর ওর একটা গল্প সঙ্কলন বেরোয়, এবং তার বছরখানেকের মধ্যেই একটা গোয়েন্দা উপন্যাস ‘পায়ের শব্দ নেই’ প্রকাশিত হয়।
রঞ্জন পত্র-পত্রিকায় কম লিখলেও পাঠকেরা ওর লেখার দিকে মনোযোগ দিয়েছিল। কিন্তু তারপর একরকম আচমকাই ও লেখা ছেড়ে দেয়। বলতে গেলে, মঞ্চ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয় গ্রিনরুমে। সম্পাদক-প্রকাশকদের সঙ্গে ওর যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, কিন্তু তারপর…।
তারপর, প্রায় এগারো বছর পর, রঞ্জন এ-বছর ‘মাসিক গোয়েন্দা’ পত্রিকার শারদীয় সংখ্যায় ‘খুনির নাম অজানা’ নামে একটা নভেলেট লেখে। ক্ষুরধার বুদ্ধি মেশানো স্মার্ট লেখা। পড়লেই বোঝা যায়, রঞ্জন এগারো বছর ধরে ওর লেখার তরোয়ালে শান দিতে ভোলেনি। এই লেখাটা বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গেই সম্পাদক ও প্রকাশকরা ওর বাড়িতে হানা দিয়ে বাকি কাজটুকু সেরে ফেলেন। তাঁরা রঞ্জন দেবনাথকে গ্রিনরুম থেকে আবার ঠেলে দেন মঞ্চের দিকে।
কিন্তু এগারো বছর বড় সুদীর্ঘ সময়। ভাবলেন ভাস্কর রাহা। এই লম্বা সময় নষ্ট করে ছেলেটা ভীষণ ভুল করেছে। নইলে এতদিনে ও প্রথম সারিতে নিজের জায়গা করে নিত।
রঞ্জন দেবনাথের গল্প পড়া শেষ। সেই সঙ্গে সম্মেলনের প্রথমদিনের কর্মসূচিতেও ইতি পড়ল। মাইকে ঘোষণা শোনা গেল, বাইরের লাউঞ্জে চা-কফির ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া পাশের হলে যে বইমেলার আয়োজন করা হয়েছে সেটা দেখতেও যেন কেউ না ভোলেন।
দর্শক-আসন থেকে সকলে উঠে পড়ে রওনা হলেন দরজার দিকে। ছাই রঙের উর্দি পরা হোটেলের কয়েকজন বেয়ারা দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে অতিথিদের অনুরোধ করছে চা-কফির কাউন্টারের দিকে এগিয়ে যেতে।
ভিড় ঠেলে ভাস্কর রাহা এগোচ্ছিলেন। ওঁর পাশে উৎপলেন্দু সেন। আর পিছনে অর্জুন দত্ত আর রতন বন্দ্যোপাধ্যায়।
এয়ার কন্ডিশনড বলরুমে চুরুটের জন্য ভাস্কর রাহার আঙুল নিশপিশ করছিল, কিন্তু তিন তারা হোটেলের আদব-কায়দা লঙ্ঘন করতে পারেননি। এখন, দরজার বাইরে বেরোনো মাত্রই, তিনি তিনবারের চেষ্টায় একটা সস্তা চুরুট ধরালেন। উৎপলও পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট ধরালেন। তারপর গম্ভীর গলায় বললেন, ‘কী ভাস্করবাবু, কেমন বুঝছেন?’
রাহা বেশ উৎসাহ নিয়ে খুশি-খুশি মুখে বললেন, ‘ভালোই তো! কে ভেবেছিল, পাঁচ বছরের মধ্যে বাংলা ক্রাইম ফিকশন এরকম একটা জায়গায় চলে আসবে! যাই বলুন উৎপল, এই সম্মেলনে এসে আমার বেশ লাগছে। ধরুন পশ্চিমে মডার্ন ক্রাইম স্টোরি শুরু হয়েছে ভলতেয়ারের হাতে—প্রায় আড়াইশো বছর আগে। তার প্রায় একশো বছর পর এডগার অ্যালান পো নিয়ে এলেন গোয়েন্দা দ্যুপাঁকে। আর আমাদের এখানে ক্রাইম কাহিনির পত্তন একশো বছরের কিছু বেশি। মানে ‘বাঁকাউল্লার দপ্তর”, গিরিশচন্দ্র বসুর ”সেকালের দারোগার কাহিনি” এইসব বইগুলো ধরলে। তার মানে, আমরা পশ্চিমের চেয়ে প্রায় দেড়শো বছর পিছিয়ে থেকে দৌড় শুরু করেছি। সে হিসেবে এখনকার অবস্থাকে তো রীতিমতো রমরমা ব্যাপার বলা যায়—’
উৎপলেন্দু ‘হুম’ করে ছোট্ট একটা শব্দ করলেন। তারপর বললেন, ‘চলুন, কফি নিই—।’
ভিড় ঠেলে ওঁরা এগোতে যাবেন, পিছন থেকে কেউ ভাস্কর রাহার জামা ধরে টানল।
রাহা একটু অবাক হয়েই পিছন ফিরে তাকালেন।
দেবারতি মানি। চোখ সামান্য কুঁচকে হাসছে।
কী সুন্দর দেখাচ্ছে! যদি বয়েসটাকে চোখের পলকে চল্লিশটা বছর কমানো যেত, তাহলে খুব ভালো হত। ভাস্কর রাহা ভাবলেন। না, দেবারতির শরীর ভাস্কর রাহাকে লোভাতুর করেনি। মেয়েটার জীবনীশক্তি, টগবগে চনমনে ব্যাপার, উচ্ছল হাসি কেমন যেন হাতছানি দেয়। বলে, কাম অন, হানি, তোমাকে দেখাব জীবন কাকে বলে! আর তখনই বয়েসটা কেমন যেন কমাতে ইচ্ছে করে।
ভাস্কর রাহা দেবারতির বুকের লেখাটা পড়লেন। বললেন, ‘এক কাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই। এখন চায়ের সময়।’ তারপর হেসে জিগ্যেস করলেন, ‘কী ব্যাপার, কিছু বলবে?’
দেবারতিকে এখন দেখে নেশা করেছে বলে বোঝা যাচ্ছে না। ওকে দেখে উৎপলেন্দু কেমন যেন একটু সিঁটিয়ে গেছেন। অর্জুন দত্ত আর রতন বন্দ্যোপাধ্যায় কৌতূহল নিয়ে দেবারতিকে দেখছেন।
দেবারতি হেসে বলল, ‘মুকুটহীন সম্রাট, আপনার সঙ্গে আমার গোপন মন্ত্রণা আছে। টপ সিক্রেট। ওদিকটায় চলুন—’
দেবারতি আঙুল তুলে হোটেলের খোলা বারান্দার দিকে দেখিয়েছে। আধখানা চাঁদের মতো গোল বারান্দা। তার রেলিঙে সুন্দর পোর্সিলেনের টবে বসানো নানান গাছ। একটা পাতাবাহার গাছে বিকেলের রোদ খেলা করছে। দুটো চড়ুই লাফাচ্ছে তার ডালে।
দেবারতিকে ভাস্কর রাহা চেনেন প্রায় চার বছর ধরে। মেয়েটাকে দেখলেই তাঁর মন ভালো হয়ে যায়। কিন্তু সব সময়েই ওর মধ্যে কিসের যেন একটা কষ্ট টের পান তিনি। সেটা কী সত্যি, না তাঁর কল্পনা—কে জানে!
‘উৎপল, আপনারা কফি খান, আমি ওর সঙ্গে একটু কথা বলে আসছি—।’
হলের লোকজনকে পাশ কাটিয়ে ভাস্কর রাহা এগিয়ে গেলেন বারান্দার দিকে। দেবারতি পিছন পিছন আসছে। পিঠে ওর হাত টের পেলেন রাহা।
বারান্দার টবের পাশে এসে দাঁড়ালেন দুজনে। ‘কী যেন নাম?’ ফুল ফুটে আছে টবের গাছে। সাদা আর গোলাপি।
নীচে তাকালেই চোখে পড়ে হোটেল চত্বর। সেখানে গাড়ির আনাগোনা। চত্বরের শেষে কয়েকটা পাম গাছ, তারপর বাহারি রেলিং, আর রেলিং পেরোলেই বড় রাস্তা। রাস্তায় সাঁ-সাঁ করে ছুটে যাচ্ছে গাড়ি, বাস, মিনিবাস। হর্ন বেজে উঠছে থেকে থেকেই। বোঝা যায় জনজীবন কত ব্যস্ত।
ভাস্কর রাহার খুব কাছে এসে দেবারতি বলল, ‘ভাস্করদা, সরি, লাঞ্চের সময় একটু খেয়েছি—’ দু-আঙুলে মাপ দেখাল দেবারতি।
‘চায়ের জন্যে গলা শুকিয়ে কাঠ। জলদি বলো, কী তোমার সিক্রেট।’
চুরুটের আগুন নিভে গিয়েছিল। সেটায় বারকয়েক ঘন-ঘন টান দিয়ে রাহা যখন বুঝলেন লাভ নেই, তখন দেশলাইয়ের কাঠি দিয়ে ছাই ঝেড়ে চুরুটটা পকেটে রেখে দিলেন। পরে আবার চেষ্টা করা যাবে।
‘ভাস্করদা, আমি একটা টপ সিক্রেট জানতে পেরেছি। শুনলে আপনার বিশ্বাস হবে না।’
ভাস্কর রাহার প্রশস্ত কপালে ভাঁজ পড়ল। কী সিক্রেট জানতে পেরেছে মেয়েটা? নাকি ওর স্বভাব অনুযায়ী ইয়ারকি মারছে?
দেবারতি মানি থেকে থেকেই লাউঞ্জের দিকে দেখছিল। সেখানে চা-কফির কাপ হাতে নিয়ে অতিথিদের জটলা।
বাতাসে ভাস্কর রাহার লম্বা চুল এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল। নভেম্বরের মাঝামাঝি, তাই শীতের ব্যাপারটা একটা ঠান্ডা আমেজের বেশি কিছু নয়। তবে বাতাসে ঝরাপাতার খবর পাওয়া যাচ্ছে।
দেবারতি ঘাড়ের কাছে আলতো আঙুল চালিয়ে চুল ঠিক করার চেষ্টা করল। তারপর একটু চিন্তার সুরে বলল, ‘এটা জানাজানি হলে কনফারেন্স একেবারে মাটি হয়ে যাবে। খবরের কাগজগুলোয় নির্ঘাত ফ্রন্টপেজ নিউজ—’
তার মানে! কী বলছে মেয়েটা! নেশার ঘোরে ভুল বকছে না তো?
দেবারতির মুখ থেকে হালকা হুইস্কির গন্ধ পাচ্ছিলেন রাহা। তিনি জরিপ নজরে দেখতে লাগলেন মেয়েটাকে।
ভাস্কর রাহা কী ভেবে বললেন, ‘দেবারতি, আমার একটা রিকোয়েস্ট রাখবে?’
‘কী বলুন—।’
‘এসব সিক্রেট ব্যাপারগুলো এখন সিক্রেটই থাক। আর চারদিন পরেই এই কনফারেন্স শেষ—তখন যা হয় কোরো—।’
দেবারতি দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়াল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘আপনি যখন বলছেন, তখন তাই হবে। ইউ আর দ্য বস—।’
প্রসঙ্গ পালটানোর জন্য রাহা জিগ্যেস করলেন, ‘আজকের গল্প তোমার কেমন লাগল?’
‘ওঃ, মিসেস মুখার্জি ওয়াজ গ্রেট। আমি ছোটবেলা থেকেই ওঁর লেখার ফ্যান। তবে রঞ্জন দেবনাথের লেখাও আমার ভালো লাগে। ভদ্রলোকের লেখায় শুধু একটাই গোলমাল—রত্নাবলী মুখোপাধ্যায়ের অসম্ভব প্রভাব। এটা কেউ যদি ওঁকে স্ট্রেটকাট বলতে পারে তবে ওঁর পক্ষ ভালো হবে। কিন্তু জানেন তো, নাম-টাম হয়ে গেলে এই লেখকগুলো কেমন স্নব হয়ে যায়।’
‘দেবারতি মানি, তুমি কিন্তু আমাকে স্নব বললে—।’
‘ওঃ নো, ভাস্করদা। আপনি এসবের বাইরে। আপনি তো জানেন, এ আমার সাজানো কথা নয়। নাইনটি টু-তে আপনার টিভি ইন্টারভিউ নেওয়ার সময় আমি পাবলিকলি এ-কথা বলেছি।’ একটু থেমে দেবারতি ভাস্কর রাহার হাত চেপে ধরল। বলল, ‘ডিয়ার ওল্ড ম্যান, আই লাভ ইউ সো মাচ—।’
তারপর জোর পায়ে হেঁটে চলে গেল অতিথিদের ভিড়ের দিকে। ভাস্কর রাহা প্রাণবন্ত এই মেয়েটার চলে যাওয়া দেখলেন।
কী সিক্রেট জেনে ফেলেছে দেবারতি? এমন সিক্রেট যা জানাজানি হলে কনফারেন্স পণ্ড হয়ে যাবে, খবরের কাগজের হেডলাইন হয়ে যাবে!
ভাস্কর রাহা পকেট থেকে আধপোড়া চুরুটটা বের করে আবার ধরালেন। বিকেলের রোদ মরে গিয়ে সন্ধ্যা নামছে। রাস্তার ওপারের বাড়িগুলো ছায়া-ছায়া হয়ে গেছে।
মাথার লম্বা-লম্বা সাদা চুলে হাত বুলিয়ে তিনি ভাবলেন, দেবারতি মানি হয়তো তাঁর অনুরোধ রাখবে। কিন্তু চারদিন পরে ও যদি সেই ‘গোপন’ খবরটা ফাঁস করে তা হলেও কী বিপদ কম হবে!
ষাটের দশক থেকে বহু ঝড়ঝাপটা সহ্য করে রহস্য-রোমাঞ্চ সাহিত্য আজকের এই অভিজাত জায়গায় উঠে এসেছে। গত তিরিশ বছরে লড়াই কম হয়নি। সমালোচক, সম্পাদক আর প্রকাশকদের অবজ্ঞা-উপেক্ষা ছিল নিয়মিত ব্যাপার। তাঁদের প্রায় সকলেরই বক্তব্য, ১৯৭০ সালে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় প্রয়াত হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে রহস্য-রোমাঞ্চ-গোয়েন্দা সাহিত্যের শাখাটিরও অপমৃত্যু ঘটেছে। সাহিত্যের কোনও একটি শাখা যদি মাত্র একজন লেখকের ওপরে নির্ভরশীল হয়, তা হলে সেই শাখার অপমৃত্যু হওয়াই ভালো। সাহিত্যের এই শাখাটি সম্পর্কে যাঁরা ভাবেন, সেইসব সম্পাদক-প্রকাশকরা তো পরে অন্যান্য লেখককে সুযোগ দেননি, প্রশ্রয় দেননি, আশকারা দেননি! নামি পত্র-পত্রিকার সূচিপত্রে তো কোনওদিনই রহস্য-গোয়েন্দা গল্পের কোনও জায়গা ছিল না!
ভাস্কর রাহা ভোলেননি সেই উপেক্ষার দিনগুলো, অবজ্ঞার দিনগুলো, অবহেলার দিনগুলো। নাকি বলা যায় লাঞ্ছনার দিনগুলো?
তারপর অনেক পথ মাড়িয়ে বহু কান্না-ঘাম-রক্তের পর মাত্র পাঁচ-সাত বছর হল রহস্য-গোয়েন্দা সাহিত্য মর্যাদার জায়গা পেয়েছে। পাঠকরা এখন রত্নবলী মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাসের জন্য অপেক্ষা করেন। তাঁরা চান ভাস্কর রাহার নভেলেট, রতন বন্দ্যোপাধ্যায়ের রোমাঞ্চকর কাহিনি। গত বছরে ভাস্কর রাহার আটটা গোয়েন্দা গল্প নিয়ে টিভিতে দেখানো হল তেরো এপিসোডের সিরিয়াল ‘তৃতীয় নয়ন’। প্রতি বৃহস্পতিবার রাত আটটায় ওই প্রোগ্রাম যখন শুরু হত তখন পথঘাট ফাঁকা হয়ে যেত। হাজার-হাজার চোখ অপেক্ষা করত টিভির সামনে—কখন ছোট পরদায় দেখা দেবে ভাস্কর রাহার শখের গোয়েন্দা সুরজিৎ সেন।
আজ ভাস্কর রাহার খ্যাতি, বাড়ি, গাড়ি—সব কিছুই লেখালিখি থেকে। কিন্তু বিলাসিতা তিনি ঘৃণা করেন। তাই হয়তো খেয়ালখুশি মতো লেখেন। যখন লিখলে প্রচুর টাকা পাওয়া যেতে পারে তখন তিনি লেখেন না। সম্পাদক-প্রকাশককে অনায়াসে হতাশ করেন। সংসারের কোনও চাহিদার দিকেই কখনও মনোযোগ দিয়ে তাকাননি। সবরকম বিলাসিতাকে বর্জন করে একটিমাত্র বিলাসিতাকে আঁকড়ে ধরে আছেন তিনি—লেখার বিলাসিতা। এই তৃপ্তির জায়গাটা তিনি নষ্ট করতে চান না।
রহস্য-গোয়েন্দা সাহিত্যের এই সফলতাও তাঁকে ভীষণ তৃপ্তি দেয়। এ যেন সুদীর্ঘকাল লড়াইয়ের পর শ্রান্ত-ক্লান্ত-রক্তাক্ত অবস্থায় হঠাৎ জিতে যাওয়া। এর আনন্দই আলাদা।
অথচ সত্তর দশকের শুরুতে অবস্থাটা কী করুণ ছিল! ‘ক্রাইম’ পত্রিকার সম্পাদক এবং কর্ণধার রামচন্দ্র সাহার কাছে লেখকরা সকলে মিলে দাবি জানিয়েছিলেন, প্রকাশিত লেখার জন্য প্রত্যেক লেখককে পাঁচ টাকা করে হলেও সম্মান-দক্ষিণা দিতে হবে। সে কি ভয়ংকর যুদ্ধের কাল! ভাস্কর রাহা, উৎপলেন্দু সেন, অনিমেষ চৌধুরি, অর্জুন দত্ত, রূপেন মজুমদার—সকলেই সামিল ছিলেন সেই দাবিতে। এঁদের জন্য বড় কাগজের দরজা ছিল বন্ধ। ছোট কয়েকটি রহস্য-রোমাঞ্চ পত্রিকাই একমাত্র সম্বল। প্রকাশিত লেখার জন্য সম্মান-দক্ষিণা না-দেওয়াটা যখন ক্রমে-ক্রমে সেই সব পত্রিকার অভ্যাস ও অধিকারে দাঁড়িয়ে গেছে, ঠিক তখনই এই স্লোগান : টাকা ছাড়া আমরা লিখব না। অন্তত পাঁচটাকা হলেও দিতে হবে।
রামচন্দ্র সাহা সেই দাবি মেনে নিয়েছিলেন। চাঁদের মাটিতে পা দেওয়ার মতোই সেটা ছিল রহস্য-গোয়েন্দা সাহিত্যের একটি স্মরণীয় ক্ষণ। রামচন্দ্র সাহা অকাল-মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন ১৯৭৪ সালে। কিন্তু ভাস্কর রাহাদের কাছে এই মানুষটা এখনও মরেনি। কখনও মরবে না।
দেবারতি মানি এসব লড়াইয়ের কী জানে! সুতরাং ওর পক্ষেই সম্ভব, পাথরের এক ঘায়ে রহস্য-গোয়েন্দা সাহিত্যের স্ফটিক-সৌধটিকে চুরমার করে দেওয়া। ওকে বারণ করতে হবে, দরকার হলে বাধা দিতে হবে। গোপন কথা গোপনই থাক। তা নইলে এই ঝড়ের ধাক্কা হয়তো সামলে ওঠা মুশকিল হবে।
ভাস্কর রাহার কপালে ভাঁজ পড়ল, চোখ ছোট হল।
কী তোর গোপন খবর, দেবারতি মানি?
.
দুই
রাত ন’টা নাগাদ তিনতলায় নিজের ঘরে বসে ছিলেন উৎপলেন্দু সেন। সামনে ছোট গোল টেবিলে ঠান্ডা জলের বোতল, ম্যাকডাওয়েলের ছোট খোকা, আর কাচের গ্লাস। গ্লাসে অল্প হুইস্কি ঢেলে জল মিশিয়ে তারিয়ে তারিয়ে চুমুক দিচ্ছিলেন। ওর নেশার সঙ্গী হয়ে বসে আছেন আরও দুজন : ‘ভয়ঙ্কর’ পত্রিকার সম্পাদক প্রেমময় চৌধুরি, আর ‘রহস্য প্রকাশন প্রাইভেট লিমিটেড’-এর প্রধান মালিক কৌশিক পাল।
কৌশিক পাল বয়েসে তরুণ। সবসময় মোটর বাইকে চড়ে ঘুরে বেড়ায়। ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত স্কুল বইয়ের ব্যবসা করে। আর আগস্ট থেকে জানুয়ারি রহস্য-রোমাঞ্চ বইয়ের ব্যবসা। কলকাতা বইমেলার সময় কৌশিক অন্তত পঁচিশটা বই বের করে। ওর মুখে কখনও কেউ হা-হুতাশ শোনেনি। সবসময়েই উৎসাহে টইটম্বুর।
নিজের গ্লাসে ছোট চুমুক দিয়ে কৌশিক বলল, ‘উৎপলদা, আপনি তা হলে ডিসেম্বরের মধ্যে আমাকে কপি রেডি করে দিচ্ছেন। দেখবেন, যেন পনেরো ফর্মার বেশি না হয়। আমি পঞ্চাশ টাকার বেশি দাম করব না।’
উৎপলেন্দু খানিকটা জড়ানো গলায় বললেন, ‘তোমার কোনও চিন্তা নেই। আঠারো-বিশটা গল্প জোগাড় করা তো—ও ঠিক হয়ে যাবে।’
উৎপলেন্দু সেনকে সম্পাদক করে একটা ভৌতিক গল্পের সংকলন বের করতে চায় কৌশিক। পশ্চিমবঙ্গের নানা জায়গার বইমেলায় ওর স্টল থাকে। তাতে ও দেখেছে, ভূতের গল্পের বেশ চাহিদা আছে। যে-বস্তুর কোনও অস্তিত্বই নেই, দেখা যাচ্ছে, তার সম্পর্কেই পাঠকের আগ্রহ বেশি। এই মন্তব্যটা করে কৌশিক হাসল।
উৎপলেন্দু কৌশিককে দেখছিলেন। বয়েসে তাঁর প্রায় অর্ধেক। এরই মধ্যে কারণবারির ব্যবহারে ঘাগু হয়ে গেছে। বলে, এটা নাকি অ্যারিস্টোক্র্যাসির লক্ষণ। এই অল্প বয়েসেই ও পাবলিশার্স অ্যাসোসিয়েশনের একজন কেউকেটা। ফলে তিন বছর ধরেই এই সম্মেলনে নেমন্তন্ন পাচ্ছে। তা ছাড়া কৌশিক ব্যবসার নানারকম অন্ধিসন্ধি জানে। সরকারি মহল থেকে বইপত্র কেনা হলে সেই লিস্টে শতকরা দশভাগ অন্তত কৌশিকের বই থাকবেই। গভর্নমেন্ট পারচেজের কথা মনে রেখেই ও অপরাধশাস্ত্রের নানা বিষয় নিয়ে বেশ কয়েকটা গুরুগম্ভীর প্রবন্ধের বইও ছেপেছে।
সম্মেলনের প্রথমদিনের ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে নানান মন্তব্য করছিল কৌশিক। উৎপলেন্দু ওর চপলতার জবাবে ‘হুঁ’, ‘হাঁ’, শব্দ করছিলেন শুধু। আর প্রেমময় চৌধুরি গম্ভীরভাবে গ্লাসের তরলের দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে ছিলেন। তাঁর মনে হচ্ছিল, গ্লাসে হুইস্কি নয়—রয়েছে কারও চোখের জল।
রহস্য-রোমাঞ্চ সাহিত্যের সবচেয়ে সফল পত্রিকা ‘ভয়ঙ্কর’। পত্রিকার বয়েস বাহান্ন বছর। তার মধ্যে প্রেমময় চৌধুরি সাঁইতিরিশটা বছর জুড়ে এর সম্পাদক হিসেবে। বলতে গেলে এই পত্রিকাতে লেখালিখি করেই রত্নাবলী মুখোপাধ্যায় অধিষ্ঠিত আজকের জায়গায় পৌঁছেছেন। একটা সময়ে প্রেমময় ও রত্নাবলী যথেষ্ট কাছাকাছি ছিলেন। তখন রত্নাবলীর বয়েস ছিল—আজ নেই। তবে তাদের বন্ধুত্বের সম্পর্ক এখনও অটুট। ‘ভয়ঙ্কর’-এর পুজো সংখ্যায় রত্নাবলী মুখোপাধ্যায় বছরের সেরা এবং সুদীর্ঘ উপন্যাসটি লেখেন। ওঁর এবারের উপন্যাস ‘দু-নয়নে ভয় আছে’ পাঠক মহলে অন্যান্যবারের মতোই সাড়া ফেলেছে।
অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর প্রেমময় হঠাৎই মুখ খুললেন।
‘উৎপলেন্দুবাবু, বিকেলে একটা ব্যাপার খেয়াল করেছেন?’
‘কী ব্যাপার?’
‘দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ওই দো-আঁশলা ডবকা রিপোর্টারটা ভাস্করবাবুকে আড়ে-আড়ে কী যেন বলছিল—’
দেবারতির বাবা দক্ষিণ ভারতের বাসিন্দা ছিলেন। মদের ব্যবসায়ী। আর মা বাঙালি। পার্ক স্ট্রিটের এক রেস্তরাঁয় গান গাইতেন। কী করে যেন দুজনের দেখা হয়েছিল, ভালোবাসা হয়েছিল, এবং বিয়ে হয়েছিল। দেবারতি নিজেই সবিস্তারে সবাইকে এ-কথা বলে। মেয়েটার জিভ বড় আলগা। ছোটবেলায় একটা গাড়ি অ্যাকসিডেন্টে ওর বাবা মারা যান। ওর মা বিয়ের পর গান-টান ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু স্বামী মারা যাওয়ার পর নিরুপায় হয়ে আবার ফিরে গেছেন পুরোনো পেশায়। সন্ধেবেলা ঝিমঝিমে আলোয় নেশাগ্রস্ত শ্রোতাদের সামনে ‘মেরি হোঁঠ ভি সেক্সি, মেরি আঁখে ভি সেক্সি…’।
দেবারতি গতবারের কনফারেন্সে একঘর লোকের সামনে চেঁচিয়ে বলেছিল, ‘আমার যা পেডিগ্রি তাতে আমার ক্যাবারে ডান্সার হওয়ার কথা। কিন্তু কী যে হল, লেখাপড়া-টড়া শিখে আই বিকেম আ রিপোর্টার। ক্রাইম জার্নালিস্ট।’
কৌশিক উৎসাহ দেখিয়ে বলল, ‘কী বলছিল, প্রেমদা? কিছু শুনতে পাননি?’
গ্লাসটা নাচিয়ে তরলে ঢেউ তুললেন প্রেমময়। ঝাপসা চোখে দেখছিলেন দেবারতির শরীর নাচছে। অনেক কিছু দুলছে। বয়েস প্রায় সত্তর হতে চলল, তবুও শরীরের জ্বালা কমে না। ভেবেছিলেন ষাট পেরোলেই এই জ্বালা-যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবেন, কিন্তু…।
বিড়বিড় করে তিনি কৌশিকের কথার জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ, শুনেছি। ও নাকি কী একটা টপ সিক্রেট জেনে ফেলেছে। সেটা ফাঁস করে দিলে নাকি একটা এক্সপ্লোশন হবে।’
‘কী সিক্রেট?’ উৎপলেন্দু জিগ্যেস করলেন।
দেবারতিকে তিনি এড়িয়ে চলেন। একবার তাঁর একটা রেডিও ইন্টারভিউর সময় মেয়েটা এমনভাবে অ্যাটাক করেছিল যে, ইন্টারভিউটাই শেষ পর্যন্ত ভেস্তে যায়। কিন্তু গতবারের সম্মেলনের সময় ফাজিল মেয়েছেলেটা তাঁকে একান্তে ডেকে নিয়ে গিয়ে বাতিল ইন্টারভিউর ক্যাসেটটা বাজিয়ে শুনিয়ে দিয়েছিল। বলেছিল, ‘উৎপলেন্দুবাবু, এই ক্যাসেটটা আমার পার্সোনাল কালেকশনে থাকবে। দ্য গ্রেট মিস্ট্রি রাইটার উৎ-প-লেন্দু সেন—।’
‘লেন্দু’ শব্দটার ওপরে অহেতুক অশ্লীলভাবে জোর দিয়েছিল মেয়েটা।
রাগে অপমানে উৎপলেন্দুর ব্রহ্মতালু পর্যন্ত জ্বলে গিয়েছিল। কিন্তু কিছুই করতে পারেননি। একে তো ‘সুপ্রভাত’ খুব নামী পত্রিকা, তার ওপর দেবারতির নিজস্ব কানেকশনও কিছু কম নেই।
উৎপলেন্দু সেন একরকম হেরেই গিয়েছিলেন দো-আঁশলা মেয়েটার কাছে।
উৎপলের প্রশ্নে প্রেমময় বললেন, ‘সেটা শুনতে পাইনি।’
ঠিক তখনই ঘরের কলিংবেল বেজে উঠল।
উৎপল কৌশিককে ইশারা করতেই ও উঠে গেল দরজা খুলতে।
প্রেমময় বা উৎপল গ্লাস বোতল ইত্যাদি আড়াল করার কোনওরকম চেষ্টাই করলেন না।
কৌশিক দরজা খুলতেই দেবারতি মানিকে দেখা গেল। অদ্ভুত আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে দরজায় মেয়েটা দাঁড়িয়ে। পরনে কালো-সাদা নকশার সালোয়ার কামিজ। কাঁধে ঝোলানো লেডিজ ব্যাগ।
প্রেমময় শরীরের জ্বালাটা আবার টের পেলেন। যৌবনে রত্নাবলী কি এতটা লোভনীয় ছিল?
কৌশিক ফিরে এসে আবার ওর জায়গায় বসে পড়ল।
‘ভেতরে আসতে পারি?’ ঠোঁঠের কোণে সামান্য হেসে জানতে চাইল দেবারতি।
প্রেমময় চৌধুরি উঠে দাঁড়িয়ে দু-হাত সামনে বাড়িয়ে এক গাল হেসে বললেন, ‘এসো, এসো। এ আবার জিগ্যেস করার কী আছে!’
দেবারতি ঘরে ঢুকে খুব সপ্রতিভ ভাবে উৎপলেন্দুর পরিপাটি বিছানায় বসে পড়ল। ‘সিরাজ’ হোটেলের তারার সংখ্যা তিন হলেও ঘরদোর বেশ ঝকমকে সুন্দর। আর দুটো তারা যোগ করে ফেলতে পারলেই অনায়াসে পাঁচ তারা হয়ে যেতে পারে।
প্রেমময় চৌধুরির ‘ভয়ঙ্কর’ কাগজে দেবারতি বেশ কয়েকবার কটা ফিচার লিখেছে। সবগুলোই সত্যঘটনার অন্তর্তদন্ত। লেখাগুলো তখন বেশ সাড়া ফেলেছিল। প্রেমময়ের মনে পড়ল, একবার নিজের দপ্তরে কাচের ঘরে মেয়েটাকে লেখালিখি সম্পর্কে নানান উপদেশ দেবার পর জিগ্যেস করেছিলেন, ‘তোমার কবে যেন অফ ডে?’
দেবারতি নিষ্পাপ মুখে জবাব দিয়েছিল, ‘কাল—মঙ্গলবার।’
‘কাল দুপুরটা ফ্রি আছ?’
‘হ্যাঁ, কেন?’
‘মানে, তোমাকে দিয়ে আগামী পুজোয় আমি একটা বড় গল্প লেখাতে চাই। তোমার ফিচারগুলো আমি খুঁটিয়ে পড়েছি—ওর মধ্যে ফিকশনাল কোয়ালিটি আছে। কাল দুপুরে তোমার বাড়ি গিয়ে সেই লেখাটার ব্যাপারে ডিটেইলসে ডিসকাস করতে পারলে ভালো হত।’ একটু থেমে আবার বলেছেন, ‘তোমার মা কি তখন বাড়িতে থাকবেন?’
দেবারতি জানে, ‘ভয়ঙ্কর’ পত্রিকায় পুজোয় বড়গল্প লিখলে চারহাজার টাকা পাওয়া যায়। ও পাঁচ সেকেন্ড সময় নিয়ে পোড় খাওয়া সম্পাদকটিকে জরিপ করল। তারপর খুব সহজ গলায় বলল, ‘আপনার কাগজে পুজোয় বড়গল্প লিখতে গেলে শুতে হয়?’
প্রেমময় হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন। কান দুটো কেমন গরম লাগছিল। দেবারতির দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন।
কিন্তু দেবারতি মানির বক্তব্য তখনও শেষ হয়নি। ও হাসতে হাসতেই বলেছে, ‘শোওয়া নিয়ে আমার কোনও শুচিবায়ু নেই। তবে যার-তার সঙ্গে শুতে আপত্তি আছে। আপনার মতো বুড়ো কোলাব্যাঙের সঙ্গে শোওয়া মানে তো আমি ঘেন্নায় ”বলো হরি, হরি বোল” হয়ে যাব—।’
উঠে দাঁড়িয়েছিল দেবারতি। ঠান্ডা গলায় বলেছিল, জানি আপনার কাগজে আমার লেখা আর ছাপা হবে না। কিন্তু কী করব প্রেমময়দা, বিশ্বাস করুন, আপনার সঙ্গে শুতে আমার আপত্তি আছে।’
মেয়েটা চলে গিয়েছিল কাচের ঘর থেকে। কিন্তু প্রেমময় চৌধুরি মাথা গরম করেননি। মাথা গরম করলে কখনও কাগজ চালানো যায় না, আর কাজও হাসিল হয় না। শিকার করতে গেলে ধৈর্য ধরতে হয়।
তিনি দেবারতির কাছে দুঃখপ্রকাশ করে সম্পর্কটা ওপর-ওপর ঠিক করে নিয়েছিলেন। তারপর দেবারতির লেখাও ছেপেছেন নিয়মিত। আর দেবারতিও ওর কাগজে প্রেমময় চৌধুরিকে নিয়ে টুকটাক নিউজ ছাপিয়ে গেছে, পাবলিসিটি দিয়েছে।
কিন্তু প্রেমময় ভোলেননি। দেবারতি মানিকে একটা চরম শাস্তি দেবার জন্য শুধু লাগসই সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছেন।
দেবারতি বসবার পর প্রেমময় এক চুমুকে গ্লাসের তরলটুকু শেষ করে জিভ বুলিয়ে নিলেন ঠোঁটে। তারপর বললেন, ‘বলো, কী ব্যাপার?’
দেবারতি আঙুল তুলে উৎপলেন্দু সেনকে দেখাল। বলল, ‘ওঁর একটা ইন্টারভিউ নেব।’
উৎপলেন্দুর চোখে মুখে প্রথমে দেখা দিল বিস্ময়, তারপরই সন্দেহ।
সেটা লক্ষ করেই দেবারতি হাসল। টান মেরে পোশাকের কয়েকটা ভাঁজ ঠিক করে নিয়ে বলল, ‘এবারের এই কনফারেন্স নিয়ে আমি একটা বড় স্টোরি করব। সন্ধেবেলা ফোন করে এডিটরের সঙ্গে কথা বলে গ্রিন সিগনাল নিয়ে নিয়েছি। অনিমেষ চৌধুরির ইন্টারভিউ দিয়ে শুরু করেছি। সেকেন্ড ক্যান্ডিডেট উৎপলেন্দু সেন। কী উৎপলবাবু, ইন্টারভিউ দেবেন তো?’
শেষ প্রশ্নটা উৎপলের দিকেই। অতএব উৎপলেন্দু সেন মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। তারপর প্রেমময় চৌধুরি আর কৌশিক পালের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ঠিক আছে, তা হলে ডাইনিং হলে দেখা হবে। সওয়া দশটা সাড়ে দশটার মধ্যে যাচ্ছি।’
ওঁরা দুজনে চলে গেলেন। যাবার আগে প্রেমময় দেবারতিকে একবার দেখলেন। ইন্টারভিউ নেবার ছল করে মেয়েটা উৎপলেন্দুর সঙ্গে শুতে আসেনি তো! মনে হয় না। কারণ বাজারে ওকে আর রঞ্জন দেবনাথকে নিয়েই যত গুজব শোনা যায়।
ঘরের দরজা বন্ধ হতেই দেবারতি একটা খালি গ্লাস টেনে নিয়ে তাতে হুইস্কি ঢালল। তারপর তাতে খানিকটা জল মিশিয়ে নিল ঢকঢক করে। চোখের ওপর থেকে চুল সরিয়ে বলল, ‘এটা কি আপনি খাওয়াচ্ছেন, না কনফারেন্সের স্পনসররা খাওয়াচ্ছে?’
উৎপলেন্দু সবজান্তা হাসি হেসে খানিকটা সহজ হতে চাইলেন। বললেন, ‘আমি খাওয়াচ্ছি। জানেন না, কনফারেন্সের এই পাঁচ দিন স্পনসররা শুধু ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ আর ডিনার খাওয়াচ্ছে। অবশ্য পাঁচদিন বিনিপয়সায় থাকার ব্যবস্থাও করে দিয়েছে এই আরামের হোটেলে—।’
দেবারতি বাঁকা চোখে তাকাল উৎপলেন্দুর দিকে। তারপর নোংরা সুরে বলল, ‘বিখ্যাত সম্পাদক আর প্রকাশককে হুইস্কি খাইয়ে লাইন করছিলেন?’
উৎপলেন্দু আক্ষেপের হাসি হাসলেন। মেয়েটা সাহসী, বেপরোয়া—তবে অভিজ্ঞতা কম। জানে না, প্রেমময় চৌধুরির মতো সম্পাদকরা সহজে গলে না। নইলে এত খাওয়ানো সত্ত্বেও পুজো সংখ্যা ‘ভয়ঙ্কর’-এ প্রতিবারে উৎপলেন্দু সেনের ছোট গল্প! একটা বড় গল্প বা উপন্যাসের জন্য উৎপল প্রেমময়কে ঠারেঠোরে কম বলেছেন! কিন্তু হা হতোস্মি! প্রেমময় চৌধুরি নির্বিবাদে উৎপলেন্দুর আতিথ্য গ্রহণ করেন—যেন সেটা তাঁর চৌদ্দ পুরুষের অধিকার। অথচ উৎপলেন্দুর ইশারাগুলো দিব্যি ন্যাকা সেজে না বোঝার ভান করেন।
আর কৌশিক! প্রকাশক হিসেবে সেদিনের ছোকরা—সে-ও কিনা সেয়ানা হয়ে গেছে! ভাস্কর রাহা, রতন বন্দ্যোপাধ্যায়, রত্নাবলী মুখোপাধ্যায়, রূপেন মজুমদার, এঁদের একটার পর একটা উপন্যাস ছেপে যাচ্ছে, অথচ উৎপলেন্দুর বেলায় ‘সম্পাদিত বই’। এ যেন ছোটবেলার সান্ত্বনা পুরস্কার। কিন্তু তবুও উৎপল নিরাসক্ত হতে পারছেন কোথায়! একটা ক্ষীণ লোভাতুর আশা ওঁকে এখনও তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। কৌশিক আর প্রেমময়ের সঙ্গে যথাসাধ্য সম্পর্ক ঠিক রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু ওঁরা যেন খুড়োর কল তৈরি করে উৎপলকে তাতে জুতে দিয়ে দৌড় করাচ্ছে।
উৎপলেন্দু সামান্য শব্দ করে হাসলেন, বললেন, ‘ম্যাডাম, আপনার তো জানা উচিত, এখনকার যুগে শুধু ভালো লিখলেই লেখা ছাপা যায় না, তার জন্যে যোগাযোগ দরকার, যোগাযোগ—।’
‘যোগাযোগ’ শব্দটার ওপরে বেশ জোর দিলেন উৎপলেন্দু।
ব্যাগ থেকে প্যাড আর পেন বের করল দেবারতি। সরলভাবে জিগ্যেস করল, ‘আপনার কি ধারণা আপনি ভালো লেখেন—তাও আপনার লেখা ছাপা হয় না?’
উৎপলেন্দুর পুরোনো ইন্টারভিউটার কথা মনে পড়ল। মেয়েটা কি আবার সেই শয়তানি পথ নিয়েছে? মাথাটা সামান্য ঝিমঝিম করছে, কিন্তু তাও গ্লাস তুলে নিলেন উৎপল। হতাশার ক্ষতের জ্বালা বড় ভয়ঙ্কর। মেয়েটা কি তার মধ্যে নুনের ছিটে দিতে এসেছে?
ঠকাস করে টেবিলে গ্লাস নামিয়ে রাখলেন উৎপলেন্দু। একটা পঁচিশ-ছাব্বিশের মেয়েকে ভয় পাওয়ার কোনও মানে হয় না। আক্রমণের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আক্রমণই করতে হবে।
সুতরাং অকুতোভয়ে মনের কথা বললেন, ‘ধারণা নয়, আমি ভালো করেই জানি যে আমি অনেকের চেয়ে ভালো লিখি। কিন্তু পত্রিকাগুলো কখনও ভালো লেখা ছাপবে না। ছাপলে ওদের মাইনে করা জনপ্রিয় লেখকগুলোর নাম-ডাকে টান পড়বে।’ একটু থেমে আবার বললেন, ‘জানেন, সেই চৌদ্দ বছর বয়েস থেকে আমার লেখা ছাপা হচ্ছে!’
‘জানি। কিন্তু তাও দেখুন, এই কনফারেন্সে আপনাকে মাঝারি লেখক হিসেবে ডাকা হয়েছে। আপনাকে গল্পপাঠের লিস্টে রাখা হয়নি।’
উৎপলেন্দুর কান গরম হল। মেয়েটা আহত মর্যাদায় ঘা দিয়েছে। তাঁকে এইভাবে হেনস্থা করার পিছনে অনুষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের নিশ্চিত হাত রয়েছে। উৎপলকে ওঁরা কিছুতেই প্রথম সারিতে আসতে দেবে না। কিন্তু তাও তিনি অনুষ্ঠানে এসেছেন। নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো।
সেই চোদ্দো বছর বয়েস থেকে তেতাল্লিশ বছর ধরে লেখালিখি! কী কষ্টের সব দিন, কী অপমানের সব দিন! চুনোপুঁটি, ক-অক্ষর-গোমাংস সব সম্পাদক-প্রকাশকরা কী হেনস্থাটাই না করেছে! ভাস্কর রাহার সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা হয়। যখনই উৎপল তাঁর প্রথম ছাপা লেখার কথা বলেন, তখনই রাহা মন্তব্য করেন, ‘কী আর করবেন, উৎপল। জ্যেষ্ঠ হলেই শ্রেষ্ঠ হয় না।’
তার মানে! জ্যেষ্ঠ হলেই কি তাহলে নিকৃষ্ট হতে হবে?
উৎপলেন্দুর কাছ থেকে কোনও উত্তর না পেয়ে দেবারতি হাসল। সুন্দর দাঁতে পেনটাকে আলতোভাবে কামড়ে ধরল। সামনের বড় আয়নায় উৎপলেন্দু সেনের বাঁ দিকের প্রোফাইল দেখা যাচ্ছিল। ফরসা মুখে লালচে আভা। চওড়া কপাল। যাত্রাদলের নায়কের মতো বাবরি চুল। তবে বয়েসের জন্য কাঁচাপাকা এবং পাতলা হয়ে গেছে। গোটা মুখে কেমন যেন ক্লান্ত, আহত, পরাজিত সৈনিকের ছাপ। তবে আত্মমর্যাদা ও অহঙ্কারের ইশারাও স্পষ্ট।
মাথা নেড়ে এক ঝটকায় চুল সরাল দেবারতি। ওর বুক নড়ে উঠল। হাতের পেনটা বিছানায় রেখে টেবিল থেকে গ্লাস তুলে চুমুক দিল। তারপর জিভ দিয়ে ‘চুকচুক’ শব্দ করে জিগ্যেস করল, ‘রহস্য-রোমাঞ্চ সাহিত্য তাহলে আপনাকে কিছু দেয়নি?’
উৎপলেন্দু মুখ তুলে মেয়েটাকে দেখলেন কিছুক্ষণ। তারপর : ‘বিশেষ কিছু দেয়নি।’
‘আচ্ছা, এটা না হয় গেল। তিরিশ বছর তো মাঝারি এক নাটকের দলে অভিনয় করলেন। যদ্দূর জানি, খুব একটা কিছু করে উঠতে পারেননি। নাটকের মেজর রোল সেরকমভাবে পাননি। সিনেমা বা টিভিতেও কোনও চান্স পাননি। এরকমটা হল কেন?’
ভেতরে-ভেতরে একটা অদ্ভুত রাগ হচ্ছিল উৎপলেন্দুর। তিনি জড়ানো গলায় বললেন, ‘ম্যাডাম, নাটক হোক আর লেখালিখি হোক, ব্যাপারটা আসলে একই। সম্পাদক বলুন, প্রকাশক বলুন আর নাটকের দলের চিফ বলুন—কালচারাল লাইনের লোকগুলো বেসিক্যালি একরকম। ওরা কাউকে সহজে উঠতে দেয় না।’
দেবারতি পেন নিয়ে প্যাডে কিছুক্ষণ কী সব লিখল। তারপর ছোট্ট করে মন্তব্য করল, ‘তা হলে আপনাকে মোটামুটিভাবে ব্যর্থ বলা যায়?’
‘হ্যাঁ, ব্যর্থ—কিন্তু সমর্থ। আমাকে ক্ষমতা প্রমাণ করার কেউ সুযোগই দিল না।’
‘সমর্থ?’ ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসল দেবারতি। তারপর চাপা গলায় বলল, ‘তাহলে বিয়ে করেননি কেন?’
উৎপলেন্দু হাসবার চেষ্টা করে বললেন, ‘এমনিই—।’
‘প্রথম প্রেমের ন্যাকামি—না আর কিছু?’ অর্থপূর্ণ নজরে উৎপলকে দেখল দেবারতি।
‘না, না, প্রথম প্রেম-টেম কিছু না।’
‘তাহলে?’
বড় অবাধ্য এই যুবতী। ভাবলেন উৎপলেন্দু। তাঁর বিয়ে না করার পিছনে কারণ একটা নিশ্চয়ই আছে। সেটা সবাইকে বলার নয়। কাউকে বলার নয়। যারা জানে তারা জানে। আর কারও জানার দরকার নেই।
উত্তর না পেয়ে দেবারতি বলল, ‘নাটকের দলে তো মেয়ে আছে। সেখানে মজা লুটছেন?’
উৎপলেন্দুর চোখে মুখে রক্তকণিকার দল হইহই করে ভিড় করল। কথা বলতে গিয়ে উত্তেজনায় জিভ জড়িয়ে যাচ্ছিল। একবার তাঁর মাইল্ড স্ট্রোক হয়ে গেছে। উত্তেজিত হওয়াটা ডাক্তারের বারণ।
অতি কষ্টে নিজেকে সংযত করে উৎপলেন্দু উত্তর দিয়েছেন, ‘ম্যাডাম, এটুকু আপনাকে বলি, আমি কনফার্মড ব্যাচেলার। আর মজা লুটতে গেলে নাটকের দল কেন, অন্য ঢের জায়গা আছে।’
চোখ নাচাল দেবারতি : ‘আছে জানি, কিন্তু আপনার যাওয়ার সাহস নেই।’ গ্লাসে শব্দ করে একবার চুমুক দিয়ে : ‘সে-সাহস থাকলে অ্যাদ্দিনে আপনার মুখেভাত হয়ে যেত।’ খিলখিল করে হেসে উঠল দুর্বিনীত নারী।
কান আরও বেশি গরম হল। ঘরটা যেন দুলে উঠল চোখের সামনে। সেই অবস্থাতেই বোতল থেকে গ্লাসে হুইস্কি ঢাললেন। জল মেশাতে ভুলে গেলেন বোধ হয়। গ্লাসে চুমুক দিতেই জ্বলন্ত কাঠকয়লা গলা বেয়ে নেমে গেল পাকস্থলীতে।
কিছুক্ষণ সময় নিয়ে উৎপলেন্দু সেন হয়তো ধৈর্য ও সংযম ফিরিয়ে নিয়ে এলেন। তারপর ব্যঙ্গের হাসি হেসে পালটা জবাব দিলেন, ‘কী করে জানলেন হয়নি?’
দেবারতি মানি উৎপলের কথায় একটুও আমল না দিয়ে বলল, ‘এ-বছরটা কিসের বছর বলুন তো?’
উৎপলেন্দু খানিকটা বিস্মিত হলেন। চুপ করে থেকে বুঝতে চাইলেন, এর পরের আঘাতটা কোন দিক থেকে আসবে।
ওঁকে চুপ করে থাকতে দেখে আবার খিলখিল করে হেসে উঠল দেবারতি। হাসতে-হাসতেই বলল, ‘ও মা! তাও জানেন না! প্রতিবন্ধী বর্ষ।’
‘তাতে কী হয়েছে?’
গ্লাসে চুমুক এবং উচ্ছৃঙ্খল হাসির পর : ‘আই থিঙ্ক ইউ আর ওয়ান, মিস্টার সেন। যৌন প্রতিবন্ধী—।’
উৎপলেন্দু আর সইতে পারেননি। তাঁর ওপরের ভদ্রতার পোশাক খসে পড়ল। এক ঝটকায় উঠে দাঁড়িয়ে অভিনেতার ঢঙে শব্দ করে হেসে বলেছেন, ‘যদি সাহস থাকে তাহলে পরীক্ষা প্রার্থনীয়, মিস মানি।’ মাথার ভেতরে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। অপমানের আগুন। দাঁতে দাঁত চেপে বাঁকা হেসে তিনি আরও যোগ করলেন, ‘গ্যারান্টি দিচ্ছি, আনন্দ পাবেন।’
আশ্চর্য! দো-আঁশলা মেয়েটা এ-কথায় এতটুকু বিব্রত হল না। বরং বিদ্রোহের হাসি হেসে বলল, ‘আপনাদের মতো হিপোক্রিটদের কথার কী দাম আছে! পরীক্ষার সময়ে হয়তো ভয়ে পিছিয়ে যাবেন—।’
উৎপলেন্দু কিছু বলে ওঠার আগেই দরজায় কলিংবেলের শব্দ।
দেবারতি চট করে উঠে পড়ল বিছানা ছেড়ে।
খানিকটা বেসামাল পায়ে দরজার কাছে গিয়ে দরজা খুলে দিলেন উৎপলেন্দু সেন।
অধ্যাপক অনিমেষ চৌধুরি।
পরনে একটা স্যান্ডো গেঞ্জি আর পাজামা। ভুঁড়ির ওপরে গেঞ্জিটা খানিকটা তুলে পাজামার দড়িটা টেনে ধরে আছেন ভদ্রলোক। উৎপলেন্দুর দিকে কাঁচুমাচু মুখে তাকিয়ে জিগ্যেস করলেন, ‘উৎপলেন্দুবাবু, আপনার কাছে একটা কাঁচি হবে?’
‘কাঁচি! কাঁচি দিয়ে কী করবেন?’
‘দেখুন না, পাজামার দড়িটায় একটা গেঁট পড়ে গেছে।’
ঠিক সেই মুহূর্তে উৎপলেন্দুকে পাশ কাটিয়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এল দেবারতি মানি।
অনিমেষ চৌধুরি ওকে দেখে যেন বোবা হয়ে গেলেন। একবার উৎপলের দিকে, আর একবার দেবারতির দিকে দেখতে লাগলেন। তারপর উৎপলের দশাসই শরীরের পাশ দিয়ে ঘরের ভেতরটায় একবার উঁকি মারার চেষ্টা করলেন।
দেবারতি অধ্যাপকের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে হাত নাড়ল। বলল, ‘হাই, প্রফেসর—!’
তারপর হোটেলের করিডর ধরে হাঁটা দিল। সালোয়ার কামিজ পরার ফলে ওর শরীরের রেখাগুলো জোরালো আলোয় বড় চোখে লাগছিল। অধ্যাপক সেদিকে হাঁ করে চেয়ে রইলেন।
উৎপলেন্দু তাঁকে বললেন, ‘পাজামার গেঁট আর খুলে কাজ নেই। যান, ঘরে যান। শুয়ে পড়ুন গিয়ে।’
করিডরের দেওয়ালে লাগানো ঘড়িতে সাড়ে দশটার ইলেকট্রনিক মিউজিক বেজে উঠল।
তিন
ক্লান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে দিয়ে দেবারতি মানি এলোমেলো চিন্তা করছিল। ঘরে হালকা সবুজ রঙের নাইট ল্যাম্প জ্বলছে। রহস্যময় আলোয় ঘরের ছায়া ছায়া আনাচ-কানাচগুলো কেমন যেন ভয় দেখাচ্ছে। কোথাও কোনও শব্দ নেই। শুধু হঠাৎ কখনও ছুটে যাওয়া গাড়ির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে বড় রাস্তা থেকে।
লেসের কাজ করা গোলাপি নাইটি পরে বিছানায় শুয়েছিল দেবারতি। মাথাটা ভীষণ ধরেছে। একটা ডিসপ্রিন ট্যাবলেট খেয়ে নিলে হয়। রাত কত এখন? বারোটা?
মাত্র তিনজনের ইন্টারভিউ নেওয়া শেষ হয়েছে ওর। অনিমেষ চৌধুরি-উৎপলেন্দু সেন আর রতন বন্দ্যোপাধ্যায়। কাল কনফারেন্সের ফাঁক-ফোকরে বাকি ইন্টারভিউগুলো সেরে নেবার চেষ্টা করবে। এগুলো মিলিয়ে সত্যি সত্যিই একটা স্টোরি লিখবে দেবারতি। কিন্তু অন্য একটা মতলবও আছে ওর। টপ সিক্রেট বোমাটি ফাটানো। কনফারেন্সের শেষ দিনে ভ্যালিডিক্টরি ফাংশানের সময় মঞ্চে দাঁড়িয়ে সভার মাঝখানে ও ডিনামাইটের পলতেয় আগুন দেবে। তারপর যা হয় হোক।
রহস্য-রোমাঞ্চ সাহিত্যকে ছোটবেলা থেকে ভালোবাসে বলেই এ-নিয়ে নোংরা কাজ দেবারতি সহ্য করতে পারে না। তাই পরশুরামের কুঠার হাতে ও লড়াইয়ে নেমে পড়েছে। জালিয়াত অক্ষম ভন্ড লেখকগুলোকে ও চুরমার করে দেবে। এইসব লেখকদের জন্যই রহস্য-রোমাঞ্চ সাহিত্য দীর্ঘদিন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটেছে। এখন এ-লাইনের অনেক লেখক সফল। তাই এখনই সবচেয়ে বেশি নিষ্ঠুর হতে হবে। আর সেই কারণেই ইন্টারভিউ নেবার ছল করে ওর টপ সিক্রেট খবর সম্পর্কে আরও কিছু জেনে নিতে চায় দেবারতি।
আমন্ত্রিত অতিথিদের সকলেই হোটেলে রয়েছেন। উদ্যোক্তারা তাঁদের জন্য মাথাপিছু একটা করে ঘর যেমন বরাদ্দ করেছেন, তেমনই দিয়েছেন রোজকার ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ আর ডিনারের কুপন। এছাড়া আজ সকালে কনফারেন্সের রেজিস্ট্রেশনের সময় পাওয়া গেছে সুদৃশ্য ব্যাগ, পেন, প্যাড, আর একটা ব্যাজ। দেবারতি ব্যাজটা ব্যাগেই রেখে দিয়েছিল—বুকে লাগায়নি। লাগানোর দরকারও নেই, কারণ উদ্যোক্তাদের প্রায় সকলেই ওকে চেনেন। তা ছাড়া ওর দৈনিক পত্রিকা ‘সুপ্রভাত’ এই সম্মেলনের অন্যতম স্পনসর।
কলিংবেল বেজে উঠল টুং-টাং।
অবাক হল দেবারতি। ওর ঘরে কে এল এত রাতে?
বিছানা ছেড়ে উঠে দরজা খুলতে গেল। অত সহজে কাউকে ভয় পায় না দেবারতি। আর তিন তারা এই হোটেলে ডাকাত পড়ার ভয় নিশ্চয়ই নেই!
কিন্তু দরজা খুলতেই ডাকাতের মুখোমুখি হল।
রঞ্জন দেবনাথ। পরনে কটসউলের হাওয়াই শার্ট আর জিনস।
‘কী ব্যাপার! এত রাতে!’
দেবারতি মানির বিস্ময়কে আমল দিল না রঞ্জন। হেসে বলল, ‘শুনলাম জনগণের ইন্টারভিউ নিয়ে বেড়াচ্ছ—তাই ভাবলাম ঘরে গিয়েই ইন্টারভিউটা দিয়ে আসি। নইলে আমার মতো খাপছাড়া খামখেয়ালি লেখক…কে আর পাত্তা দেয়…হয়তো বাদই পড়ে যাব।’
রঞ্জনটা ইয়ারকি মারতেও জানে! ভাবল দেবারতি! ও কি জানে না, ওকে দেখলেই দেবারতির বুকের ভেতরটা কেমন করে!
দেবারতি চোখের নমনীয় ইশারায় রঞ্জনকে ভেতরে ডাকল। অস্ফুটে বলল, ‘এসো—।’
রঞ্জন ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করল। চোখ নাচিয়ে মজা করে বলল, ‘কী দেবারতি মানি, বলো তোমার মিস্ট্রি রাইটারদের নামের লিস্টে অধমের শুভনাম আছে কি না। এগারো বছর লেখালেখি ছেড়ে দিয়ে ”সাধু” হয়ে গিয়েছিলাম বলে কেউ আর পাত্তা-টাত্তা দেয় না, বুঝলে।’
দেবারতি কোনওরকম ভূমিকা ছাড়াই রঞ্জনের খুব কাছে চলে এল। বিড়বিড় করে বলল, ‘বাংলা মিস্ট্রি রাইটারদের মধ্যে তুমিই একমাত্র পুরুষ লেখক। ইউ অলওয়েজ রাইট লাইক আ ম্যান। সত্যিকারের পুরুষের মতো লেখো—।’
রঞ্জন দেবারতিকে জাপটে ধরল দু-হাতে। বলল, ‘শুধু লেখা নয়, সত্যিকারের পুরুষের মতো আমি আরও অনেক কিছু করতে পারি।’
‘জানি।’ একটু থেমে : ‘আমার চেয়ে ভালো আর কে জানে!’
কানাঘুষোয় দেবারতি শুনেছে, রত্নাবলীর সেই শুরুর জীবন থেকেই রঞ্জনের সঙ্গে তাঁর একটা গাঢ় বন্ধুত্বের সম্পর্ক রয়েছে। ইদানিং দেবারতি মানির জন্যেই হয়তো সেই বন্ধুত্ব কিছুটা ফিকে হয়ে এসেছে। রঞ্জন আর রত্নাবলীর অসমবয়েসি বন্ধুত্ব নিয়ে লেখক মহলে, কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসের আড্ডায় কম আলোচনা হয় না। কিন্তু আলোচনায় কী যায় আসে! রত্নাবলী মুখোপাধ্যায় দেবারতির কোনও প্রতিদ্বন্দ্বীই নয়। অন্তত এখন।
দেবারতি রঞ্জনের আদর খেতে-খেতেই জিগ্যেস করল, ‘গল্প লেখার কদ্দূর?’
সম্মেলনের শেষ দিন সকালে একটা ওয়ার্কশপ আছে। তখন আমন্ত্রিত লেখকদের একটা করে লেখা পড়ে শোনাতে হবে। সেটা অসম্পূর্ণ লেখা হলেও চলবে। তারপর সেই লেখা নিয়ে চুলচেরা আলোচনা ও বিশ্লেষণ করা হবে।
রঞ্জন ততক্ষণে দেবারতির কানের কাছে মুখ ঘষছিল। ওর জড়ানো স্বর শোনা গেল, ‘টু হেল উইথ ওয়ার্কশপ…ফর গডস সেক, হোল্ড ইয়োর টাঙ অ্যান্ড লেট মি লাভ…।’
আবছায়া সবুজ আলোয় দুটো শরীর এক হয়ে এলোমেলো পা ফেলে এগিয়ে গেল বিছানার কাছে। আচমকা ধসে পড়া জীর্ণ বাড়ির মতোই ওরা পড়ে গেল বিছানায়।
অন্ধের মতো হাতড়ে হাতড়ে কোনওরকমে পোশাক-আশাকগুলো খুলে ফেলল ওরা। তারপর নগ্ন দেবারতিকে দেখে অনেকক্ষণ মুগ্ধ হয়ে রইল রঞ্জন। সবুজ আলোয় অদ্ভুত দেখাচ্ছে ওকে।
‘কী ভাবছ?’ রঞ্জনের গালে, দাড়িতে, আঙুল চালাল দেবারতি।
‘পথের পাঁচালি।’
‘পথের পাঁচালি!’ অবাক হল দেবারতি।
হ্যাঁ! বিভূতিভূষণের কলমে আঁকা সজীব প্রকৃতি। ভার্জিন নেচার। তুমি।’
খিলখিল করে হাসি : ‘আমি ভার্জিন নই—।’
‘ভার্জিনিটি কি শুধু শরীরে থাকে?’
আলো-আঁধারেই পুরুষ-লেখককে দেখল দেবারতি। কী সুন্দর করে কথা বলে রঞ্জন! দেবারতি জানে, শতকরা নিরানব্বইজন পুরুষই ওর শরীরের মধ্যে কৌমার্য খুঁজবে। তারা অনন্তকাল ধরে শুধু খুঁজেই যাবে, কিন্তু পাবে না।
রঞ্জনের আদরে দেবারতি আর গুছিয়ে চিন্তা করতে পারছিল না। নাঃ, লোকটা অন্যরকম করে আদর করতেও জানে!
‘রঞ্জন! রঞ্জন! আমাকে জড়িয়ে ধরো, আরও জোরে।’
আবছা আলোয় ওরা লড়াইয়ে মেতে ওঠে। ঠান্ডা বাতাস ওদের শরীরের তাপ শুষে নিতে পারে না। ওদের মসৃণ ত্বক ভিজে যায় ঘামে।
রঞ্জনকে প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে দেবারতি। যেন ওকে ছেড়ে দিলেই ও ছিটকে পড়ে যাবে অতল খাদে। আর রঞ্জন যেন শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে ঝেড়ে ফেলতে চাইছে দেবারতিকে। কিন্তু ওর প্রচণ্ড ঝটকাতেও দেবারতির হাতের বাঁধন শিথিল হয় না। ওর মুখ দিয়ে এক অদ্ভুত গোঙানি বেরিয়ে আসে। তুমুল ভূমিকম্পে সবকিছু দুলে যায়, মেঝে কেঁপে ওঠে, আলো ঝাপসা হয়ে যায়।
তারপর…একসময়…সবকিছু আবার সুস্থির হয়। দেবারতির চোখ আবার ফিরে পায় স্বাভাবিক দৃষ্টি। ওর শরীর হালকা লাগে। রঞ্জন পাশ থেকে ওকে জড়িয়ে ধরেছে।
‘দেবারতি, আই লাভ ইউ—।’
‘আই লাভ ইউ টু।’ নরম গলায় বলল দেবারতি, ‘তোমার লেখার মতোই শক্তিশালী তুমি।’
এরপর উঠে বসে ওরা। দেবারতির সিগারেটের প্যাকেট থেকে সিগারেট নিয়ে ধরায় দুজনে। একে অপরের গা ঘেঁষে বসে সিগারেটে আকুল টান দেয়।
দেবারতির মাথা ধরা কোথায় উধাও হয়ে গেছে। এখন আর সহজে ঘুম আসবে না ওর।
রঞ্জনের খোলা পিঠে আলতো নখের আঁচড় কেটে দেবারতি বলল, ‘ইউ আর এ জিনিয়াস। এগারো বছর বনবাসে থাকা তোমার ঠিক হয়নি। তুমি জানো কী করে রহস্য গল্প লিখতে হয়।’
সিগারেটে গভীর টান দিয়ে বিছানায় আধশোয়া হয়ে শুয়ে পড়ল রঞ্জন দেবনাথ, বলল, ‘দেবী, তুমি জানো না একটা সময়ে আমাকে টাকার জন্যে কী লড়াই করতে হয়েছে! একগাদা ছোট ছোট ভাই বোন রেখে বাবা মারা গেলেন। আমি তখন সবে একটা ফার্টিলাইজার কোম্পানির মার্কেটিং-এ ঢুকেছি। তখন থেকেই লেখালিখির চেষ্টা করেছি। লেখা ছাপতে প্রাণ বেরিয়ে গেছে। তারপর… তারপর হঠাৎ করেই অভাবের গল্পটা ঘুরে গেছে…।’
‘জানো, নাইনটি ওয়ান আর নাইনটি টু-তে রবীন্দ্র পুরস্কারের লিস্টে ফাইনাল রাউন্ডে রত্নাবলী মুখোপাধ্যায়ের ”জীবন যখন ফুরিয়ে যায়” উপন্যাসটা ছিল! তোমার ইচ্ছে করে না, তোমার একটা উপন্যাস ওই পুরস্কারের ফাইনাল লিস্টে যাক—কিংবা পুরস্কার-টুরস্কার পেয়ে যাক?’
চাপা গলায় হেসে উঠল রঞ্জন দেবনাথ : ‘এই ইচ্ছেটা আমার গতবছর থেকে হয়েছে—আগে ছিল না। ওই এগারোটা বছর ধরে টাকার জন্যে আমি পাগলা কুকুরের মতো ঘুরে বেড়িয়েছি।’
‘তোমার লেখাগুলো খুব ইন্টেলিজেন্ট। কিন্তু তাহলেও তার মধ্যে সরলতা আছে, হৃদয়ের ব্যাপারটা আছে। পুরোপুরি সেরিব্রাল নয়, একটু-আধটু কার্ডিয়াক কোয়ালিটিও হ্যাজ—’ খিলখিল করে হাসল দেবারতি।
সিগারেট অ্যাশটেতে ফেলে দিয়ে দেবারতিকে আবার জাপটে ধরল রঞ্জন। বলল, ‘এই মুহূর্তে কিন্তু সেরিব্রাল ব্যাপার একটুও নেই। সবটাই কার্ডিয়াক।’ আচমকা পাগলের মতো চুমু আঁকতে লাগল দেবারতির শরীরে।
‘তুমি আমার বুদ্ধিজীবী শিশু—।’
শিশু তখন দেবারতিতে প্রায় ডুবে গেছে। আজকের সুযোগ সে হারাতে রাজি নয়। অনেক অনেক দিন পর দেবারতি মানিকে সে এইভাবে কাছে পেয়েছে। এই সম্মেলনের দিনগুলোর জন্য কীভাবে যে ওরা উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করে ছিল তা শুধু ওরাই জানে!
সবুজ আলোয় শুরু হয়ে গেল দেবারতি আর রঞ্জনের ব্যস্ত দ্বিতীয় সম্মিলন।
সাড়ে দশটা বাজতেই চায়ের জন্য দশ মিনিটের বিরতি।
সকালের সেশানে ভাস্কর রাহার বক্তৃতা ছিল। তিনি শুনিয়েছেন তাঁর যৌবনকালের নানা ঘটনার কথা। কী কষ্ট করে দিন কাটিয়েছে রহস্য-রোমাঞ্চ পত্রিকাগুলো! লাল নিউজপ্রিন্টে ভাঙা টাইপ আর কাঠের বা জিঙ্কের ব্লক ব্যবহার করে ছেপে এক হাজার কি দু-হাজার কপি কোনওরকমে বিক্রি হত। দারিদ্র্যরেখায় পা ফেলে তারা পথ হাঁটত।
ষাটের দশকের শেষে আর সত্তরের দশকের শুরুতে বাজার ছেয়ে গিয়েছিল পিন আঁটা যৌন পত্রিকায়। সে-সব পত্রিকা বিক্রিও হত রমরম করে। নামী লেখকদের দু-একজন ছাড়া আর প্রায় সবাই লিখেছেন পিন আঁটা ওইসব পত্রিকায়।
তারপর একসময় হোম ডিপার্টমেন্টের নির্দেশে শুরু হয়ে গেল ধরপাকড়। তখন নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে বেশিরভাগ মালিক-সম্পাদক চালু করেন রহস্য-রোমাঞ্চ-গোয়েন্দা পত্রিকা। সেটা ছিল ওঁদের কাছে বেঁচে থাকার লড়াই। আর নড়বড়ে জমিতে দাঁড়িয়ে থাকা এই মানুষগুলোকে আঁকড়ে ধরে আশ্রয় খুঁজেছিল তখনকার রহস্য-রোমাঞ্চ লেখকরা। তখনকার অবস্থা, আর এখনকার অবস্থা! এ-যেন বস্তি থেকে মালটি-স্টোরিড বিল্ডিংয়ে রূপান্তর।
ভাস্কর রাহার বক্তৃতার পর শুরু হয়েছে চলচ্চিত্র। সত্যজিৎ রায়ের ‘চিড়িয়াখানা’। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাহিনী আর উত্তমকুমারের অভিনয়। তারই মাঝখানে এই-চা পানের বিরতি।
অনামিকা সেনগুপ্তের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছিলেন ভাস্কর রাহা। চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিলেন। কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ছিলেন আর এক আমন্ত্রিত রহস্য লেখক জ্যোতিষ্ক সান্যাল। অফিসের মিটিংয়ে বাইরে ছিলেন বলে কাল আসতে পারেননি। আজ এসে রেজিস্ট্রেশন করিয়েছেন। জ্যোতিষ্ক নীচু গলায় গল্প করছিলেন ‘কুয়াশা’ প্রকাশনা সংস্থার কর্ণধার কল্পনা সেনের সঙ্গে। সম্প্রতি ‘কুয়াশা’ থেকে জ্যোতিষ্কর একটি অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। জন গ্রিশ্যাম এর ‘টার্মিনেশন’।
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ভাস্কর রাহা বললেন, ‘শোনো অনামিকা, তোমাকে একটা মজার ঘটনা বলি—।’
অনামিকা চা খায় না। সম্ভবত ফরসা রং ময়লা হয়ে যাবে বলে। ও আগ্রহ নিয়ে তাকাল ভাস্কর রাহার দিকে।
রাহা একটা আধপোড়া চুরুট পকেট থেকে বের করে ধরালেন। তারপর তাতে টান দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, ‘অনেক আগের কথা। তুমি তখন বোধহয় জন্মাওনি। কবিরঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের ”সচিত্র তোমার জীবন” পত্রিকার একটা সংখ্যায় একবার মপাসাঁর একটা গল্প অনুবাদ করেছি। ম্যাগাজিন বেরোনোর পর দপ্তরে গেছি কপি নিতে। কবিরঞ্জনবাবু ছিলেন না। ছিল তাঁর হেড কম্পোজিটার বলাইবাবু। তাঁকে সবিনয়ে বললাম যে, এই সংখ্যায় আমার একটা লেখা আছে—কপি নিতে এসেছি। তিনি জিগ্যেস করলেন, কী লেখা? বললাম, মপাসাঁর একটা গল্প আছে…।’
আবার চায়ের কাপে চুমুক এবং চুরুটে গভীর টান।
‘…তাতে বলাইবাবু কী বলেছিলেন জানো?’
ততক্ষণে জ্যোতিষ্ক সান্যাল আর কল্পনা সেন ভাস্কর রাহার কাছাকাছি এসে গল্প শোনায় মন দিয়েছেন।
‘কী বলেছিলেন?’ আগ্রহের সুরে অনামিকা জানতে চাইল।
ভাস্কর রাহা গম্ভীর স্বরে জবাব দিলেন, ‘বলাইবাবু আমাকে জিগ্যেস করেছিলেন, আপনিই কি মপাসাঁ?’
এ-কথা শুনে সবাই হাসিতে একেবারে ফেটে পড়ল।
হইচই শুনে কখন যেন ওঁদের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছিল দেবারতি মানি। চোখ সামান্য লাল। চোখের কোল বসা। কিন্তু সেজেছে খুব সুন্দর করে। হালকা নীলের ওপরে কালো ফুল বসানো একটা সালোয়ার কামিজ পরেছে। কানে নতুন একজোড়া দুল। কপালে নীল টিপ। ঠোঁটে হালকা লিপগ্লস। চোখে সূক্ষ্ম কাজলরেখা।
ভাস্কর রাহা ওর দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করলেন, ‘কী, আমার রিকোয়েস্ট মনে আছে তো?’
ও হেসে মাথা ঝাঁকাল। হ্যাঁ, মনে আছে। তারপর বলল, ‘আজ লাঞ্চের ফাঁকে আপনার একটা ইন্টারভিউ নেব, ভাস্করদা।’
‘আমার কথা সবই তো তুমি জানো। নতুন আর কী বলব—।’
‘তবুও—।’
এমন সময় কোথা থেকে যেন প্রেমময় চৌধুরি এসে উদয় হলেন। কোনওরকম ভণিতা না করেই বেশ উঁচু গলায় জিগ্যেস করলেন, ‘এই, দেবারতি, তুমি নাকি কী একটা টপ সিক্রেট জানতে পেরেছ?’
দেবারতি ঘুরে দাঁড়িয়ে বিরক্ত হয়ে তাকাল প্রেমময়ের দিকে। লোকটা ওকে হাটের মাঝে অপ্রস্তুত করতে চায়?
ভাস্কর রাহা ভয় পেলেন। মেয়েটা খেপে গিয়ে সাঙ্ঘাতিক কিছু না বলে বসে।
‘হ্যাঁ, জানতে পেরেছি। সো হোয়াট?’
‘না, মানে, আমরা সিক্রেটটা জানতে পারব না?’
‘সময় হলেই জানতে পারবেন। একটু ধৈর্য ধরুন।’ তারপরই কী ভেবে দুষ্টুমি চোখে মেয়েটা বলল, ‘একটু হিন্টস দিতে পারি—।’
সর্বনাশ। ভাস্কর রাহা প্রমাদ গুনলেন। মেয়েটা যে যা-হোক-একটা সিক্রেট জেনেছে, এ-কথা দেখছি একেবারেই সিক্রেট থাকবে না। তিনি দেবারতিকে বাধা দেবার জন্য কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার আগেই বেপরোয়া প্রগলভা মেয়েটা মুখ খুলল।
‘পাঁচকড়ি দে আর এডগার ওয়ালেস।’
তার মানে! ভাস্কর রাহা অবাক হলেন। সিক্রেটের হিন্টস পাঁচকড়ি দে আর এডগার ওয়ালেস! একজন উনিশ শতকের বাঙালি ডিটেকটিভ কাহিনী লেখক। কোনান ডয়েল-এর ‘দ্য সাইন অফ ফোর’ কাহিনী অনুবাদ করে প্রথম বাঙালি পাঠকের কাছে শার্লক হোমসকে হাজির করেন। আর দ্বিতীয়জন ১৮৭৫ সালে জন্ম নেওয়া ব্রিটিশ লেখক। দুজনের মধ্যে মিল আছে —দুজনেই ক্রাইম কাহিনীর লেখক এবং যথেষ্ট সফল ও জনপ্রিয় ছিলেন।
ভাস্কর রাহা খালি চায়ের কাপ নামিয়ে রাখলেন পাশের টেবিলে। বিস্মিত চোখে দেবারতি মানির দিকে তাকিয়ে রইলেন।
প্রেমময় চৌধুরি কেমন আমতা-আমতা করে সরে গেলেন।
জ্যোতিষ্ক সান্যাল ভাস্কর রাহার স্নেহভাজন। বয়েস তাঁর পঞ্চাশ পেরোলেও ভাস্কর রাহার চোখে ‘ছোট ভাই’। প্রশ্রয় যেমন দেন, প্রয়োজন হলে বকুনিও ততটাই। জ্যোতিষ্ক খুব সৎ আর পরিশ্রমী। আজকের যুগে যে-দুটো গুণ মাইক্রোস্কোপ দিয়ে খুঁজতে হয়। তাই রাহা ওকে পছন্দ করেন।
জ্যোতিষ্ক ভাস্কর রাহার কাছে এসে চাপা গলায় জিগ্যেস করলেন, ‘এই পাঁচকড়ি দে আর এডগার ওয়ালেস পাবলিক দুটো কে বলুন তো?’
ভাস্কর রাহার দু-চোখে তিরস্কারের অভিব্যক্তি। জ্যোতিষ্কের দিকে হতাশভাবে তাকিয়ে ঠোঁট থেকে চুরুট নামিয়ে নিলেন। বললেন, ‘তুই কি কোনও দিনই বইটইয়ের পাতা ওলটাবি না!’
অনামিকার কান বেশ প্রখর। ও সাততাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘ওমা, এঁদের নাম জানেন না! একজন তো…।’
মাইকে ঘোষণা করা হল, সিনেমা আবার শুরু হচ্ছে।
চুরুট নিভিয়ে দিয়ে রাহা সেদিকে এগোলেন। পিছনে অনামিকা আর জ্যোতিষ্কের কথাবার্তা অস্পষ্টভাবে শোনা যাচ্ছে। দেবারতি আবার তাঁর পাশে এসে বলে গেল, ‘মুকুটহীন সম্রাট, ভুলবেন না যেন—লাঞ্চের সময়—।’
রাহা হেসে মাথা হেলিয়ে বুঝিয়ে দিলেন, মনে আছে।
ঠিক তখনই রঞ্জন দেবনাথ এসে দেবারতিকে ইশারায় ডেকে নিয়ে চলে গেল এলিভেটরের দিকে। ওরা বোধহয় নির্জনতা খুঁজছে।
বলরুমে ঢুকে নির্দিষ্ট চেয়ারের দিকে যাবার সময় রত্নাবলী মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল ভাস্কর রাহার।
‘কী মিসেস মুখার্জি, এখন নতুন কী লিখছেন?’
‘আমার আর লেখালিখি! ওই ওয়ার্কশপের গল্পটাই এখন লেখার চেষ্টা করছি। বয়েস হয়ে গেছে, এত ধকল আর সয় না।’
কী সুন্দর করে কথা বলেন রত্নাবলী! এত যশ আর খ্যাতি—অথচ তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে অহঙ্কার সেভাবে বাড়তে পারেনি। ওঁর ব্যবহার এত নরম আর মিষ্টি! অথচ লেখেন যখন তখন ঝকঝকে স্মার্ট গদ্য। লেখায় বলতে গেলে কোনও বাড়তি শব্দ থাকে না। অবশ্য দেড়-দু-বছর ধরে ওঁর লেখার ধার কিছুটা শিথিল হয়ে এসেছে। সেটা হয়তো বয়েসের জন্য।
‘দেবারতির ইন্টারভিউ দিয়েছেন?’
একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন রত্নাবলী। বললেন, ”সুপ্রভাত”-এর ওই জার্নালিস্ট মেয়েটি তো! হ্যাঁ, একটু আগে আমাকে বলেছে। ওকে বলেছি, সাতটার সময় আমার ঘরে আসতে। ও তো ঠিক আমার নীচের ঘরটাতেই থাকে।’ একটু থেমে বললেন, ‘মেয়েটা বেশ স্মার্ট। ওর একটা ফিচার পড়েছিলাম—মন্দ লেখেনি। ‘আপনি ইন্টারভিউ দিয়েছেন?’
‘না। বলেছি লাঞ্চ আওয়ারে কথা বলব।’
‘সারাদিন কনফারেন্সের এই ধকলের পর সন্ধেবেলাটা একটু বিশ্রাম নিতে ইচ্ছে করে। কাল ভাবছি একবার বাড়ি থেকে ঘুরে আসব। একজন টেলিফিল্ম প্রোডিউসারের আসার কথা আছে। তা ছাড়া আমার বৃদ্ধ কর্তাটি একা একা কী করছে সেটাও একবার দেখে আসা দরকার।’ হেসে কথা শেষ করলেন রত্মাবলী।
বলরুমের আলো নিভে গেল। শুধু ঝাড়লন্ঠনের আলো টিমটিম করে জ্বলছে।
রত্নাবলী নিজের চেয়ারে গিয়ে বসে পড়লেন।
জ্যোতিষ্ক সান্যাল ভাস্কর রাহার কানের কাছে মুখ এনে বললেন, ‘ম্যাডাম ঠিকই বলেছে। পুরুষ মানুষ—চিতায় না ওঠা পর্যন্ত বিশ্বাস নেই।’
অনামিকার কান আবার তার দক্ষতার পরিচয় দিল। ও নীচু গলায় জ্যোতিষ্ককে বলল, ‘সেইজন্যেই তো কোনও পুরুষকে আমি বিশ্বাস করি না।’
জ্যোতিষ্ক ঘাড় ফিরিয়ে তাকালেন অনামিকার দিকে, বললেন, ‘সকালে যে দেখলাম রঞ্জন দেবনাথের সঙ্গে খুব হেসে হেসে গল্প করছিলে!’
‘ওই গল্প পর্যন্তই। আমি সবসময় কেয়ারফুল থাকি।’
আধো-আঁধারিতে অনামিকার মন্তব্যটা ভাস্কর রাহার কানে গেল। তিনি আপনমনেই হাসলেন। রূপেন মজুমদারের মতো অনামিকা সেনগুপ্তও তাহলে ভার্জিন রাইটার হতে চলেছে! সবাই কেন যে বিশেষ্যকে উপেক্ষা করে বিশেষণের ওপরে জোর দেয় কে জানে! কী করে তিনি অনামিকা বা রূপেন মজুমদারকে বোঝাবেন, ভার্জিন থাকার চেয়ে রাইটার হওয়াটা অনেক বেশি জরুরি—অন্তত বাংলা সাহিত্যের পক্ষে।
ততক্ষণে গোলাপ কলোনীর গল্প আবার শুরু হয়ে গেছে পরদায়।
চার
দুর্ঘটনাটা ঘটে গেল রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ।
হোটেল ‘সিরাজ’-এর রেস্তরাঁর জগঝম্প মিউজিক ছাপিয়েও শোনা গেল শব্দটা। বিশেষ করে হোটেলের বাইরের দিকে পশ্চিমমুখো ঘরে যাঁরা ছিলেন তাঁরা প্রায় সকলেই শুনতে পেলেন। যাঁরা এই অল্প রাতেই ঘুমে ঢলে পড়েছেন, তাঁরা দুর্ঘটনার মাহেন্দ্রক্ষণটি জানতে পারলেন না। তাঁরা জানতে পারলেন না, সংঘর্ষের শব্দ কী বিশ্রী শোনায়।
প্রচণ্ড তীব্র অথচ ভোঁতা শব্দটা তিনতলার ঘরে বসেই শুনতে পেলেন ভাস্কর রাহা। ওয়ার্কশপের জন্য একটা গল্প লিখতে বসেছিলেন। গোটা চারেক পৃষ্ঠা কাটাছেঁড়া করে কোনওরকমে একটা গল্পের শুরুটা খাড়া করেছেন। সেটা পড়ে মন্দ লাগছে না। লেখালিখির ব্যাপারে ভীষণ খুঁতখুঁতে তিনি। এটাই বোধহয় তাঁর সাফল্যের চাবিকাঠি।
সম্মেলনের জন্য একটা বিমূর্ত গল্প লিখছেন তিনি। কখনও কখনও সাদামাঠা গোয়েন্দা বা রহস্য কাহিনী লেখেন বটে, তবে লিখে তৃপ্তি পান দুর্বোধ্য, জটিল, বিমূর্ত রহস্য গল্প। এ যেন পাঠকের সঙ্গে তাঁর লুকোচুরি খেলা, বুদ্ধির খেলা। তাঁর গল্প পড়াটা এখন পাঠক সমাজে এক ফ্যাশান।
লিখতে বসলেই তাঁর মনে পড়ে যায় ছোট ছেলে লালটুর কথা। লালটু প্রায় দশবছর হল চাকরি নিয়ে আমেদাবাদে। বছর তিরিশ আগে, তাঁর লেখালিখির শিক্ষানবিশীর সময় ভাস্কর রাহা নিয়মিতভাবে বিদেশি গল্প অনুবাদ যেমন করেছেন, তেমনি সেগুলো অবলম্বন করে, সেগুলোর বিষয় ও ভঙ্গিতে অনুপ্রাণিত হয়ে ‘নিজস্ব’ গল্পও কম লেখেননি। এতে তাঁর কোনও লজ্জা নেই। কারণ, পাঁচকড়ি দে-র প্রথম লেখা ‘সতী-শোভনা’-ও বিদেশি গল্প অবলম্বনে লেখা। তা ছাড়া, রাহার বরাবরের লক্ষ্য ছিল ভালো লেখা। শুধু প্লট আত্মসাৎ করেই ভালো লেখা যায় না।
যখন তিনি বাঁ দিকে বিদেশি বই রেখে মনোযোগ দিয়ে লিখতেন, তখন ‘লেখক’ পিতার একান্ত অনুগত পুত্র লালটু এসে চুপটি করে বসে থাকত তাঁর কাছে। হঠাৎই একদিন সেই বালক তাঁকে প্রশ্ন করেছিল, ‘বাবা তুমি সবসময় বই দেখে দেখে লেখো কেন?’
ভাস্কর রাহা কোনও উত্তর দিতেও পারেননি।
লিখতে-লিখতে এসব কথাই ভাবছিলেন, আর তখনই শুনতে পেলেন শব্দটা।
প্রথমটা সামান্য চমকে উঠেছিলেন। কাগজের ওপরে কলম কেঁপে উঠেছিল। কারণ ভেবেছিলেন, ঘটনা হয়তো অসামান্য। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ উৎকর্ণ হয়ে থেকেও তখন স্বাভাবিক কিংবা অস্বাভাবিক আর কোনও শব্দ কানে এল না, তখন আবার মন দিয়েছেন লেখায়। খেয়াল করেননি, হাতের চুরুট কখন নিভে গেছে।
একটু পরেই নীচ থেকে কয়েকজনের কথাবার্তার শব্দ শোনা গেল। তারপর, ক্রমে-ক্রমে, সেটা ছোটখাটো হইচইয়ে দাঁড়াল।
কলম থামালেন ভাস্কর রাহা। মোটা ফ্রেমের চশমাটা চোখ থেকে নামালেন। বিস্তৃত কপালে হাত ঘষলেন একবার। তারপর হাত চালালেন মাথার চুলে। লম্বা ধবধবে সাদা অথবা রুপোলি চুল। সিলভার ব্লন্ড যাকে বলা যায়। কিছুদিন আগেও তাঁর চুলে জাতীয় পতাকার মতো তিন-তিনটে রং খেলা করত : সাদা, লাল আর কালো। এর মধ্যে দুটো রঙের কারণ তাঁর জানা ছিল। সাদা : বয়েসের জন্য। কালো : কলপের জন্য। কিন্তু লাল? সে কি বয়েস আর কলপের দ্বৈত প্রভাব? জীবনের সাদা-কালো রং—সুখ-দুঃখ—সকলেই সহজে বুঝতে পারে। কিন্তু এমন কিছু রং জীবনে থেকে যায়—এমন কিছু অনুভূতি—যা ঠিকঠাক ব্যাখ্যা করা যায় না। তাঁর চুলের ওই লাল রঙের মতো।
এখন তাঁর শুধু সাদামাঠা জীবন। তাতে আর কোনও রং নেই।
নীচ থেকে ভেসে আসা হইচইটা যেহেতু বাড়ছিল সেহেতু লেখার টেবিল ছেড়ে উঠে পড়লেন ভাস্কর রাহা। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলেন পশ্চিমের জানলার কাছে। বড় মাপের ফ্রেঞ্চ উইন্ডো। নক্ষত্রখচিত হোটেলে যেমন হয়। জানলার পাল্লা খোলাই ছিল। তিনি ঝুঁকে পড়ে দেখার চেষ্টা করলেন। কিন্তু পাঁচ-সাতজন মানুষের জটলা ছাড়া অস্বাভাবিক আর কিছু দেখতে পেলেন না। কারণ কার্নিশে তাঁর নজর কিছুটা বাধা পাচ্ছিল।
হোটেলের বাইরের রাস্তা নির্জন, হোটেলের শান বাঁধানো টেরাস নির্জন, আর পাম গাছগুলোকেও বড় নিঃসঙ্গ নির্জন বলে মনে হল। তাহলে শব্দটা কিসের?
এমন সময় তাঁর ঘরের কলিংবেল বেজে উঠল।
তাড়াতাড়ি গিয়ে দরজা খুললেন তিনি।
দরজায় দাঁড়িয়ে উৎপলেন্দু সেন। ফরসা মুখ সামান্য লালচে। পরনে পাজামা আর হাওয়াই শার্ট। চশমার পুরু কাচের মধ্যে দিয়ে চোখ দুটো বেশ ছোট দেখাচ্ছে।
‘কী ব্যাপার, উৎপল? এত রাতে?’ ওঁকে ভেতরে ডাকলেন রাহা, ‘আসুন, ভেতরে আসুন—’
উৎপলেন্দু ঘরের ভেতরে এসে দাঁড়ালেন। চাপা গলায় জিগ্যেস করলেন, ‘নীচে কী একটা গোলমাল হয়েছে শুনেছেন?’
ভাস্কর রাহা উৎপলেন্দুকে ভালো করে খুঁটিয়ে দেখলেন। এখন রাত প্রায় পৌনে বারোটা। সুতরাং উৎপলেন্দু এখন পুরোপুরি স্থলপথের বাসিন্দা নন। কিন্তু রঙিন জলপথে তিনি কতটা ডুবে আছেন সেটাই আঁচ করতে চেষ্টা করলেন রাহা।
‘হ্যাঁ, খানিক আগে একটা শব্দ শুনলাম মনে হল।’ রাহা বললেন।
‘আমি একটা পুরোনো লেখা নতুন করে মকশো করছিলাম, হঠাৎই যেন—।’
ঘরের খোলা দরজায় এসে দাঁড়ালেন ‘সিরাজ’-এর এক্সিকিউটিভ ম্যানেজার প্রশান্ত রায়। সম্মেলনের শুরুতেই তাঁর সঙ্গে আমন্ত্রিত অতিথিদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, সতেরো জন অতিথির সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের কোনওরকম অসুবিধে হলে তাঁরা যেন তৎক্ষণাৎ প্রশান্ত রায়কে খবর দেন।
কিন্তু রাহার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে কোনও ত্রুটি তো হয়নি—শুধু একটু আগের ওই শব্দটুকু ছাড়া!
‘এক্সট্রিমলি সরি, মিস্টার রাহা,’ ভাস্কর রাহাকে লক্ষ করে প্রশান্ত রায় বললেন, ‘আপনার গাড়ির নম্বর কি ডব্লিউ এন ডব্লিউ ওয়ান থ্রি ফাইভ নাইন?’
‘হ্যাঁ, কেন?’ নিভে যাওয়া চুরুটটাকে দু-আঙুলে ঘোরাতে লাগলেন রাহা।
‘খুব আনফরচুনেট।’ ইতস্তত করে প্রশান্ত রায় বললেন, ‘আপনার গাড়িটা একটা অ্যাকসিডেন্টে জখম হয়েছে।’
ভাস্কর রাহা হাসলেন : ‘ও, এই ব্যাপার! আপনার কোনও চিন্তা নেই। আমার অ্যামবাসাডর গাড়িটার নিয়মিত জখম হওয়া দিব্যি অভ্যেস আছে।’ একটু থেমে বললেন, ‘তা কোথায় চোট লাগল। সামনে, পেছনে, না পাশে?’
আবার ইতস্তত করলেন প্রশান্ত রায়। শুকনো মুখে বললেন, ‘সামনে, পেছনে, বা পাশে নয়। আপনার গাড়ির ছাদটা জখম হয়েছে।’
ভাস্কর রাহার হাসি মিলিয়ে গেল এই উত্তরে। উৎপলেন্দু সেনও বেশ অবাক হলেন। প্রশান্ত রায় কি এখন জল-পুলিশের আন্ডারে? ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকিয়ে সেই চিহ্নই খুঁজলেন উৎপল।
ভাস্কর রাহা ঘরের সিলিংয়ের দিকে তাকালেন। তারপর ঠাট্টা করার চেষ্টা করে বললেন, ‘তাহলে কি বাজ পড়েছে?’
‘বিনা মেঘে বজ্রপাত—’ উৎপলেন্দু অস্ফুট স্বরে মন্তব্য করলেন।
প্রশান্ত রায় রহস্য-রোমাঞ্চ লেখক দুই বুদ্ধিজীবীকে পর্যায়ক্রমে দেখলেন। তারপর ঠান্ডা গলায় উত্তর দিলেন, ‘না বাজ নয়। আমাদের হোটেলের চারতলা থেকে একজন মেয়ে পড়েছে। হোটেল রেজিস্টারের রেকর্ড অনুযায়ী মেয়েটির নাম দেবারতি মানি—আপনাদের কনফারেন্সের একজন গেস্ট। আমরা থানায় খবর দিয়েছি। পুলিশ এখুনি এসে পড়বে।’
কথা শেষ করে এক্সিকিউটিভ ম্যানেজার আর দাঁড়াননি। ব্যস্ত পায়ে চলে গেছেন সিঁড়ির দিকে।
দেবারতি টপ সিক্রেট তাহলে সিক্রেটই থেকে গেল! ভাবলেন ভাস্কর রাহা। তারপর উৎপলেন্দুকে বললেন, ‘দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বসুন।’
উৎপল বসলেন একটা সোফায়। ভাস্কর চুরুট ধরালেন। তারপর অ্যাশট্রেটা হাতে নিয়ে বসে পড়লেন বিছানায়। বিষণ্ণভাবে ঘাড় নেড়ে বললেন, ‘দেবারতি কী একটা সিক্রেট জানতে পেরেছিল। বলেছিল, সেটা জানাজানি হলে নাকি এই কনফারেন্স পন্ড হয়ে যাবে। দেখুন, নিয়তির কী অদ্ভুত পরিহাস! মেয়েটা নিজে মারা গিয়ে কনফারেন্স পন্ড করল।’
নীচের কথাবার্তা, চাপা হইচই, ঘরে বসেই স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। তা ছাড়া করিডর ও সিঁড়িতে ব্যস্ত পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে ঘন ঘন।
‘মেয়েটা আত্মহত্যা করেনি তো?’ উৎপলেন্দু গলা নামিয়ে জিগ্যেস করলেন।
‘আত্মহত্যা! দেবারতি! অসম্ভব!’ তিনটে শব্দে নিজের মতামত স্পষ্ট জানিয়ে দিয়ে চুরুটে গভীর টান দিলেন রাহা।
যে-মেয়েটার আর এক নাম জীবন, সে করবে আত্মহত্যা! তা ছাড়া ওর বেঁচে থাকার আরও একটা জোরালো কারণ ছিল : গোপন রহস্য ফাঁস। গল্প-উপন্যাসে বহু খুন এবং খুনের সমাধান নিয়ে লিখেছেন ভাস্কর। কিন্তু বাস্তবে কখনও খুনের এত কাছাকাছি আসেননি। গল্পের খুন হয় লেখকের ইচ্ছেয়, খুনিও চলে লেখকের মরজি মতো। কিন্তু বাস্তবে?
‘ভাস্করবাবু, ব্যাপারটা অ্যাকসিডেন্ট নয় তো?’ উৎপলেন্দু মনে-মনে বুঝতে পারছেন সবই, কিন্তু তা সত্ত্বেও ভাবের ঘরে চুরি করছেন দীর্ঘদিনের অভ্যাসবশে।
দেবারতিকে ঘিরে এই দু-দিনের ঘটনাগুলো ভাবছিলেন ভাস্কর রাহা। মাত্র দুটো দিন। তবু মনে হয় যেন কত দিন!
উৎপলের প্রশ্নের উত্তর দিলেন একটু দেরি করে। বললেন, ‘অ্যাকসিডেন্ট কেমন করে হবে?’
ঠিক তখনই দরজায় কেউ নক করল।
পুলিশ কি এরই মধ্যে এসে পড়ল? ভাস্কর রাহা গলা তুলে বললেন, ‘দরজা খোলা আছে। ভেতরে আসুন।’
নব ঘুরিয়ে দরজা খুলে ঘরে ঢুকল অর্জুন দত্ত আর অনির্বাণ ঘোষ। অর্জুনের চোখেমুখে ভয় ও আশঙ্কা। আর অনির্বাণের মুখে চাপা উত্তেজনা।
অনির্বাণ ঘোষের বয়স পঁয়তিরিশ-ছত্রিশ। পরনে আধুনিক কাটের শার্ট-প্যান্ট। ও ‘ছায়াময়’ পত্রিকার সম্পাদক। সম্পাদক হিসেবে যত না সুনাম, তার চেয়ে বেশি সুনাম ভদ্রলোক হিসেবে। সম্ভাবনাময় শক্তিমান লেখকদের উৎসাহ দিতে ওর জুড়ি নেই। বিক্রির হিসেবে ‘ছায়াময়’-এর জায়গা ‘ভয়ংকর’-এর পরেই। তাতে অনির্বাণের কোনও আক্ষেপ নেই। কারণ প্রেমময় চৌধুরিকে ও ভীষণ শ্রদ্ধা করে।
অর্জুন দত্তের হাতে সিগারেট ছিল। সেটায় শেষ টান দিয়ে সে ভাস্কর রাহার পাশে গিয়ে বসে পড়ল। সিগারেটের টুকরোটা ঝুঁকে পড়ে ফেলে দিল অ্যাশট্রেতে। তারপর বিপদে পড়া মানুষের আর্ত গলায় বলল, ‘ভাস্করদা, দেবারতি মানি বোধহয় আত্মহত্যা করেছে।’
ভাস্কর রাহা ও উৎপলেন্দু সেন অবাক হয়ে তাকালেন অর্জুনের দিকে।
অর্জুন একটু দম নিয়ে বলল, ‘বিশ্বাস করুন, সত্যি বলছি। আমি তো ঘুমোচ্ছিলাম। হঠাৎ ঘুম ভেঙে শুনি দরজায় কেউ কলিংবেল বাজাচ্ছে। দরজা খুলেই দেখি অনির্বাণ। ও-ই আমাকে দেবারতি মানির ইয়ের…খবরটা…দিল। তারপর চলে গেল নীচে।’ একটু থামল অর্জুন। তারপর : মিনিট কুড়ি পরে ও ঘোরাঘুরি করে সব খবর এনে আমাকে দিল। কী হয়েছে জিগ্যেস করুন ওকে—’ অনির্বাণের দিকে আঙুল দেখাল অর্জুন।
‘ছায়াময়’ পত্রিকার নিয়মিত লেখক অর্জুন দত্ত। পত্রিকার বয়েস প্রায় ষোলো, কিন্তু এই ষোলো বছরে কোনও সংখ্যাতেই অর্জুনের লেখা বাদ পড়েনি। কফি হাউসের আড্ডায় শোনা যায় অর্জুন নাকি ‘ছায়াময়’-এর মালিক ভবতারণ পোদ্দারের মেয়েকে পড়াত। সেই সূত্রেই নাকি ষোলো বছর আগে পত্রিকার সূচিপত্রে নাম ঢুকেছে। তারপর ফরমায়েশি লেখা যোগান দেবার গুণে তার নামটা সূচিপত্রে স্থায়ী হয়ে গেছে।
সদাগরী অফিসে চাকরি করলেও যৌবন বয়েসে অর্জুন দত্ত প্রচুর টিউশানি করত। হয়তো টাকার খুব দরকার ছিল। পরে চাকরি করা এক মহিলার সঙ্গে ওর বিয়ে হয়। বিয়েতে ভাস্কর রাহা আর উৎপলেন্দু সেন গিয়েছিলেন। বোধহয় বিয়ের পরে পরেই অর্জুন টিউশানি করা ছেড়ে দেয়। কিন্তু তারপর থেকেই ওর লেখার পরিমাণ অন্তত তেরোগুণ বেড়ে যায়। সেটা লক্ষ করে একদিনের আড্ডায় ভাস্কর রাহা, জ্যোতিষ্ক সান্যাল, রূপেন মজুমদার ইত্যাদিকে উৎপলেন্দু বলেছিলেন, ‘আসুন মাইরি, আমরা মাসে মাসে চাঁদা তুলে অর্জুন দত্তকে ওর টিউশানির টাকাটা দিয়ে দিই। দিয়ে বলি, তুই আর লিখিস না, বাপ। আমরা যে তোর লেখার বানে ভেসে গেলাম।’
যে যাই বলুক, অর্জুন দত্ত থামেনি। অনুবাদ, ফিচার, গল্প, উপন্যাস, পাজল, কুইজ—যখন যে-ফরমায়েশ এসেছে লিখে গেছে। সে জানে, লিখে খ্যাতি আসেনি। না আসুক—লেখার তৃপ্তি তো আছে। লেখা ছেড়ে দিলে অর্জুন আর কী নিয়ে থাকবে! সবাইকে তো আর নিজের দুঃখের কথা বলা যায় না। বলা যায় না ব্যক্তিগত সমস্যার কথা। ওর স্ত্রী মনিকা চাকরি আর ঠাকুর-দেবতা নিয়ে আছে। আর অর্জুনের আছে চাকরি আর লেখা। ওদের দুজনের মাঝে ভয়ঙ্কর এক ফাঁক। অর্জুন জানে, সেই ফাঁক আর ভরাট হবে না।
অনির্বাণের চোখমুখ দেখে বেশ বোঝা যাচ্ছিল যে, ও কিছু বলার জন্য ছটফট করছে। অর্জুন দত্তকে ও মানুষ হিসেবে পছন্দ করে। তবে লেখক হিসেবে মোটেই সম্ভাবনাময় বলে ভাবে না। পত্রিকার বহু আসন্ন মুহূর্তে অর্জুন দত্ত প্রায় যে-কোনও বিষয়ে যে-কোনও ধরনের লেখা যোগান দিয়েছে। সেই সার্ভিসটাকে অনির্বাণ কখনও অস্বীকার করে না। তাই ভেতরে-ভেতরে অনেক কিছু বলার জন্য ছটফট করলেও অর্জুনকে ও প্রথমে কথা বলতে দিয়েছে। এবার ওর পালা। তিনজনেই ওর দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করছে।
‘আগামীকাল সেমিনারে আমার বলার কথা আছে সে তো জানেন। বিষয় হল, আধুনিক রহস্য সাহিত্য। ব্যাপারটা আমার কাছে বেশ ঝামেলার বলে মনে হচ্ছিল। তাই ঘরে বসে বক্তৃতার পয়েন্টসগুলো ঠিকঠাক করে নিচ্ছিলাম। তখনই শব্দটা শুনতে পেলাম। তো জানলা দিয়ে একবার উঁকি মেরেই ছুটে নীচে গেলাম। গিয়ে দেখি ভাস্করদার গাড়ির ছাদের একপাশটা তুবড়ে গেছে। গাড়ির গায়ে রক্ত। আর তার পাশেই বাঁধানো চত্বরে পড়ে আছে দেবারতি মানি। মুখটা একেবারে থেঁতলে গুঁড়িয়ে গেছে। চেনা যাচ্ছে না।’
‘তুমি তাহলে বুঝলে কী করে যে, ইয়ে…মানে…ওটাই দেবারতি?’ উৎপলেন্দু যুক্তি চেয়ে নিঃসন্দেহ হতে চাইলেন। যতটা দুঃখ পাওয়া উচিত ঠিক ততটা দুঃখ কি উৎপলেন্দু অনুভব করতে পারছেন?
‘বুঝতে পারলাম ওর সেই হলদে টি-শার্টটা দেখে। কাল কনফারেন্সে যেটা পরে ছিল। ওই যে বুকের কাছটায় লেখা, এক কাপ…।’
অনির্বাণকে বাধা দিয়ে ভাস্কর রাহা বললেন, ‘বুঝেছি। আজ সন্ধেবেলা এই টি-শার্টটা পরেই ওকে হোটেলের লবিতে ঘুরতে দেখেছি।’
‘তারপর কী হল?’
‘সেখানে তখন ম্যানেজার প্রশান্তবাবু সমেত বেয়ারা বাবুর্চি অনেকেরই ভিড় জমে গেছে। ডেডবডিটা ওরা প্রথমটায় চিনতে পারেনি। তখন আমিই দেবারতির কথা বললাম। প্রশান্তবাবু তাড়াতাড়ি রিসেপশন কাউন্টারে গিয়ে খাতা-টাতা কী সব দেখে এলেন। তারপর তিনজন লোককে ডেকে নিয়ে লিফটের দিকে এগোলেন। কী ভেবে আমিও ওঁদের সঙ্গে গেলাম। ওঁরা চারতলায় উঠে দেবারতির ঘরের কাছে গেলেন। তারপর প্রশান্তবাবু কলিংবেল বাজালেন বারবার। কোনও সাড়া নেই। তখন দরজায় ধাক্কা দিলেন। তারপর দরজার নব ঘুরিয়ে চাপ দিয়ে দরজা খোলার অনেক চেষ্টা করলেন, কিন্তু লাভ হল না। নিজেরা কিছুক্ষণ আলোচনা করে তারপর ধাক্কা মেরে দরজা ভেঙে ফেললেন। আমাদের সবাইকে বাইরে দাঁড়াতে বলে একজন লোককে সঙ্গে করে প্রশান্তবাবু ঘরে ঢুকে তন্নতন্ন করে সব জায়গা খুঁজলেন। খাটের নীচ, আলমারির পেছন, বাথরুম—কোনও জায়গা বাদ দিলেন না। কিন্তু ঘরে কেউ নেই। শুধু পশ্চিম দিকের জানলাটা হাট করে খোলা। আর জানলার কাছেই একটা গোল টেবিল—টেবিলে কাগজপত্র, বই, পেন এইসব…
‘ঘর থেকে বেরিয়ে প্রশান্ত রায় বললেন, ”যা ভেবেছি তাই—সুইসাইড। ঘরে কেউ নেই। আর ঘরের দরজা ভেতর থেকে লক করা ছিল। স্যাড বিজনেস।” ঘরের ভাঙা দরজার কাছে দুজন লোককে মাতায়েন করে প্রশান্তবাবু তখন নীচে চলে আসেন। রিসেপশন থেকে থানায় ফোন করে খবর দেন। তারপর ভাস্করদাকে খবর দিতে যান। আমি আবার নীচে গিয়েছিলাম দেবারতির ডেড বডি দেখতে। সত্যিই খুব স্যাড ব্যাপার। আমি ওপরে এসে অর্জুনদাকে সব বললাম। তারপর আপনাকে খবর দেবার জন্যে এসেছি।’
একদমে অনেকক্ষণ কথা বলে অনির্বাণ থামল। এপাশ-ওপাশ তাকিয়ে একটা খালি সোফায় অবসন্নের মতো বসে পড়ল।
ভাস্কর রাহা চুরুটে শেষ টান দিলেন। ধোঁয়ার স্বাদটা কেমন তেতো হয়ে গেছে। ‘সিরাজ’-এর এক্সিকিউটিভ ম্যানেজার তাহলে ব্যাপারটা সুইসাইড ভাবছেন! কিন্তু তিনি তো নিশ্চিত যে, দেবারতি আত্মহত্যা করেনি—করতে পারে না। গম্ভীর চাপা স্বরে তিনি বললেন, ‘উৎপল, চলুন, হতভাগা মেয়েটাকে একবার দেখে আসি।’ তাঁর বুকের ভেতরে কেমন এক কষ্ট হচ্ছিল : ‘এত হাসিখুশি, প্রাণবন্ত উচ্ছল ছিল মেয়েটা…’
এত হারামজাদী, ছেনাল, শয়তান ছিল দো-আঁশলা ওই মাগীটা! উৎপলেন্দুর মগজের ভিতরে কিলবিল করে উঠল এই নোংরা কথাগুলো। তাঁর মনে পড়ল গতকাল রাতের ইন্টারভিউর কথা। মরা মেয়েটার জন্য তাঁর খুব সামান্য খারাপ লাগছে। আর মনের বাকি অংশটায় গজগজ করছে অপমান আর জানোয়ারের মতো রাগ। কিন্তু উপায় কী! আমাদের মনের বেশিরভাগটাই জানোয়ার, আর অল্পটুকু মানুষ—ভাবলেন উৎপলেন্দু। মুখে বললেন, ‘হ্যাঁ, নীচে চলুন। একবার দেখে আসি।’
নীচে নামতেই অনিমেষ চৌধুরির সঙ্গে দেখা। রিসেপশন লাউঞ্জের এখানে ওখানে ভদ্রলোক ঘুরঘুর করছেন। এর মুখের দিকে তাকাচ্ছেন, ওর কথা শুনছেন। দেখে মনে হচ্ছে তথ্য সংগ্রহ করছেন।
‘উৎপলেন্দুবাবু, খবর শুনেছেন? দেবারতি মানি মারা গেছে—।’
উৎপলেন্দু গম্ভীরভাবে ভাস্কর রাহা আর অর্জুন দত্তের দিকে একবার দেখলেন। তারপর নীচু গলায় বললেন, ‘হুম শুনেছি।’ একটু থেমে : ‘কিন্তু আপনি এখানে কী করছেন!’
চোখেমুখে ঘুম জড়িয়ে থাকায় অধ্যাপকের গাল দুটো আরও বেশি ফুলে রয়েছে। তা ছাড়া তাঁর অন্যমনস্ক স্বভাবের প্রমাণ হিসেবে বাঁ-চোখের কোলে পিচুটিও দেখতে পেলেন উৎপলেন্দু।
উৎপলেন্দুর কানের কাছে মুখ এনে অধ্যাপক বললেন, ‘ডেটা কালেক্ট করছি। যদি তা থেকে কোনও সূত্র পাওয়া যায়।’
অধ্যাপকের যে শখের গোয়েন্দাগিরির শখ আছে তা কেউই জানতেন না। অর্জুন দত্ত জিগ্যেস করল, ‘সূত্র পেলে কী করবেন?’
‘পুলিশের তদন্তে সাহায্য করব। ক্রাইম রাইটার হিসেবে এটা আমাদের ডিউটি নয় কি? আমাদের এই কনফারেন্সে গেস্ট হয়ে এসেছেন আর যে-দুজন রিপোর্টার—প্রীতম নন্দী আর সুজন সরকার—ওঁদের বলেছি, ক্রাইম রাইটাররা যে এক্সপার্ট ওপিনিয়ন দিয়ে পুলিশকে সাহায্য করার চেষ্টা করছেন, সেকথা কাল ওঁদের কাগজের রিপোর্টে লিখতে।’
এতক্ষণে ব্যাপারটা স্পষ্ট হল ভাস্কর রাহার কাছে। সেলফ পাবলিসিটির চেষ্টা। রহস্য-রোমাঞ্চ দিয়ে শুরু করেছিলেন ভদ্রলোক। তারপর বেশিরভাগই ভৌতিক আর হরর গল্প লিখেছেন, মাঝে মাঝে কল্পবিজ্ঞান। লেখেন সাবেকী ভাষায়, তবে কলমের গতি বোধহয় অর্জুন দত্তকেও হার মানাবে। তা ছাড়া প্রকাশকের চাপে স্কুল-কলেজের ইতিহাস বইও কম লেখেননি। সেখানে লেখক হিসেবে নাম দেন এ. চৌধুরি। আর আয়কর বাঁচানোর জন্য প্রত্যেকটি বইতেই সহলেখক হিসেবে স্ত্রী অথবা ছেলের নাম জুড়ে দিয়েছেন।
ভাস্কর রাহা হাসলেন মনে-মনে। একেই বোধহয় বলে অ্যাবসেন্ট মাইন্ডেড প্রফেসর!
‘আপনার পাজামার দড়ির গেঁট খুলেছে?’ একটু হেসে জিগ্যেস করলেন উৎপলেন্দু।
‘অ্যাঁ!…ওহ, হ্যাঁ—হ্যাঁ। শেষ পর্যন্ত কোনওরকমে খুলেছি।’ থতমত খেয়ে জবাব দিলেন অনিমেষ চৌধুরি।
অর্জুন, অনির্বাণ ও ভাস্কর রাহা অবাক হয়ে তাকালেন উৎপলেন্দু সেনের দিকে। অর্থাৎ, কী ব্যাপার!
উৎপল হেসে জবাব দিলেন চাপা গলায়, ‘ও কিছু নয়, তদন্তের একটা সূত্র আর কি—!’
অধ্যাপককে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ তদন্তে ব্যস্ত রেখে ওঁরা চারজন হোটেলের বাইরের চত্বরে এলেন।
বাইরের সবক’টা আলো জ্বেলে দেওয়া হয়েছে। চত্বরের নানা জায়গায় ভিড় এবং জটলা। দেখে মনেই হয় না, রাত বারোটা বেশ কিছুক্ষণ হল পেরিয়ে গেছে।
ভিড় ঠেলে দেবারতির মৃতদেহের কাছে গেলেন ওঁরা। এক পলক দেখেই চোখ সরিয়ে নিলেন। মৃতদেহ সব সময়েই অসুন্দর।
এমন সময় একটা গুঞ্জন শোনা গেল : পুলিশ এসে গেছে।
প্রশান্ত রায় কোথা থেকে এসে হাজির হলেন ভাস্কর রাহার সামনে। হাত-মুখ নেড়ে বললেন, ‘মিস্টার রাহা, আপনারা কাইন্ডলি যে যাঁর ঘরে চলে যান। বুঝতেই পারছেন, একে এই কনফারেন্স তার ওপরে ‘সুপ্রভাত’ কানেক্টেড। লোকাল থানা ছাড়াও ডিসি-সাউথ আর ডিসি-ডিডি-ওয়ান এসে হাজির হয়েছেন। এছাড়া এসেছেন লালবাজারের ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের একজন ইন্সপেক্টর। সঙ্গে আরও লোকজন। এখন নাকি ফোরেনসিক ডিপার্টমেন্টের লোকজন কাজ করবে, ক্যামেরাম্যানরা ছবি তুলবে। ওঁরা বলছেন, কাল সকাল থেকে আপনাদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হবে। এখন তাহলে ঘরে চলে যান। প্লিজ—।’
কোনও কথা না বলে ওঁরা চারজন ফিরে চললেন লিফটের দিকে।
উৎপলেন্দু লক্ষ করলেন, খুব তাড়াতাড়ি ভিড় ফিকে হতে শুরু করেছে।
লিফটের কাছে অনেকের সঙ্গে দেখা হল। প্রেমময় চৌধুরি, রঞ্জন দেবনাথ, সুজন সরকার, অনামিকা সেনগুপ্ত, কল্পনা সেন। রঞ্জন ছাড়া বাকি সকলেই নিজেদের মধ্যে উত্তেজিত আলোচনা করছিলেন। শুধু রঞ্জন চুপচাপ।
ভাস্কর রাহাকে দেখেই কল্পনা সেন জিগ্যেস করলেন, ‘ভাস্করবাবু, কাল থেকে সেমিনারের কী হবে?’
রাহা বিষণ্ণভাবে জবাব দিলেন, ‘কী জানি। কাল সকালেই হয়তো অরগানাইজাররা জানিয়ে দেবে। এমন একটা বিশ্রী ব্যাপার—।’
‘মেয়েটা কিন্তু বড্ড বেড়েছিল—।’
অনামিকার আকস্মিক মন্তব্যে চমকে ওর দিকে তাকালেন রাহা। কই, এই মেয়েটার মধ্যে এরকম আবেগ লুকিয়ে আছে এটা তো আগে টের পাওয়া যায়নি!
তিনি শান্ত স্বরে জানতে চাইলেন, ‘বেড়েছিল মানে?’
অনামিকা একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেল। বোধহয় বুঝতে পারল, এখন এই মন্তব্য করাটা ঠিক হয়নি। কিন্তু তীর হাত থেকে বেরিয়ে গেছে।
‘না, মানে, ক্রাইম ফিকশনের জন্যে মেয়েটা বড্ড বেশি দরদ দেখাত।’
দরদ দেখাত বটে, কিন্তু সেটা মেকি দরদ নয়। নারী পরশুরাম দেবারতি সাহিত্যের এই শাখাটির উন্নতিই চেয়েছিল। তাই ফাঁকিবাজ ছদ্মবেশী লেখকদের ও সহ্য করতে পারত না। যেসব বুদ্ধিজীবী রহস্য সাহিত্যের নামে নাক সিটকান তাঁদের অনুকম্পাকে ঘেন্না করত দেবারতি। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় একবার একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘স্যার আর্থার কোনান ডয়েল, আগাথা ক্রিস্টি যে-সাহিত্য করে গেছেন, সেই সাহিত্য চর্চা করতে আমার এতটুকুও লজ্জা নেই।’ এই কথাটা বারবার সবাইকে শোনাত দেবারতি। ভাস্কর রাহাকে বলত, ‘মুকুটহীন সম্রাট, এই সাহিত্যকে ভালোবাসাটাই হচ্ছে আসল। ওয়ার্থলেস ফাঁকিবাজরাই এটার সর্বনাশ হয়ে দাঁড়াবে।’
না, দেবারতি মানির ভালোবাসায় কোনও ফাঁকি ছিল না। আজ লাঞ্চের সময় ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে ভাস্কর রাহা সেটা আর একবার অনুভব করেছেন। তখন কি ঘুণাক্ষরেও টের পাওয়া গিয়েছিল মেয়েটা এখন আর থাকবে না, ‘নেই’ হয়ে যাবে!
লিফটে লোকজন উঠছিল। প্রেমময় চৌধুরি লিফটে ওঠার আগে নেশা জড়ানো গলায় বললেন, ‘এ গ্রেট লস ফর ক্রাইম লিটারেচার অ্যান্ড জার্নালিজম। মেয়েটা এভাবে সুইসাইড করবে ভাবিনি।’
ভাস্কর রাহা কোনও জবাব দিলেন না। তাঁর শুধু মনে হল, সবাই যেন এটাকে আত্মহত্যা অথবা দুর্ঘটনা বলে চালাতে পারলেই বেঁচে যায়। কিন্তু কেন?
লিফট আবার খালি হয়ে নেমে আসার জন্য অপেক্ষা করছিলেন ওঁরা পাঁচজন : ভাস্কর রাহা, রঞ্জন দেবনাথ, অনামিকা সেনগুপ্ত, উৎপলেন্দু সেন আর কল্পনা সেন।
রঞ্জনের চোখ লাল, সামান্য ফোলা। মুখে একটা হাসি মাখিয়ে রাখার চেষ্টা করেও নিজের ঝোড়ো অবস্থাটা লুকোতে পারেনি। তা ছাড়া অল্পবিস্তর যাঁরা লেখালিখি করেন তাঁদের কাছে এটা লুকোনো মুশকিল। কারণ তাঁরা সাধারণ মানুষের তুলনায় একটু বেশি দেখতে পান।
ভাস্কর রাহা রঞ্জনের পিঠে হাত রাখলেন।
ছেলেটার শরীর সামান্য কেঁপে উঠল, কিন্তু ও ভেঙে পড়ল না। দেবারতির সঙ্গে ওর গোপন ভালোবাসার কথা গোপন রাখতে চায়। কিন্তু গোপন ভালোবাসাও তো ভালোবাসা! রঞ্জনের জন্য কষ্ট হল ভাস্কর রাহার।
‘দেবারতি সুইসাইড করেনি, ভাস্করদা—’একটু ধরা গলায় রঞ্জন বলল, ‘আর এটা অ্যাকসিডেন্টও নয়।’
এই প্রথম একজন স্পষ্ট করে ভাস্কর রাহার মতে মত দিল। দেবারতি মানির মতো মেয়েরা কখনও জীবনের সঙ্গে লড়াইয়ে হেরে যায় না।
উৎপলেন্দু বললেন, ‘দেবারতি কী একটা সিক্রেট জানতে পেরেছিল। সেটার জন্যেই কি…’
রঞ্জন দেবনাথ তাকাল উৎপলেন্দুর দিকে, বলল, ‘হতে পারে। পুলিশ তদন্ত করে নিশ্চয়ই বের করতে পারবে।’
কল্পনা সেন এতক্ষণ চুপচাপ ছিলেন। এমনিতে তিনি কম কথা বলেন। তার ওপর চেহারা ভীষণ খাটো এবং রোগা হওয়ায় তাঁকে খুব একটা কেউ গুরুত্ব দেয় না। আবার ঠিক সেই কারণেই জ্যোতিষ্ক সান্যাল তাঁকে গুরুত্ব দেন। ইদানিং ভাস্কর রাহাকে তিনি প্রায়ই বলেন, ‘বুঝলেন ভাস্করদা, আমি ডিপ্লোম্যাসি শিখে গেছি!’ এটা তাঁর অহঙ্কার। চুরুটের ধোঁয়া ছেড়ে ভাস্কর রাহা অন্তরালে হাসেন। শিশু তার সরলতা হারালে সেটা কোনও কৃতিত্বের কথা নয়। কূটনীতি আর সততা বোধহয় দুই সতীন, একসঙ্গে ঘর করতে পারে না। তাই তিনি ‘ছোট ভাই’কে জবাব দেন, ‘তুই সত্যিকারের ডিপ্লোম্যাট হলে সে-কথা বোকার মতো জাহির করে বলতিস না।’ কূটনীতির সম্পর্ক ছাড়াই কল্পনা সেন জোতিষ্কের বই ছেপেছেন—হয়তো আরও ছাপবেন।
কল্পনার ফরসা মুখে আবছা কালো ছাপ। সরু সরু আঙুলে সরু ফ্রেমের চশমাটাকে নাকের ওপরে ঠিক করে বসিয়ে ধীরে-ধীরে বললেন, ‘এটা নিয়ে কাগজে খুব নোংরামি হবে।’
তা তো হবেই। ভাস্কর রাহা ভাবলেন। খুন যে ভীষণ নোংরা কাজ!
পাঁচ
দরজায় কেউ জোরে জোরে ধাক্কা দিতেই উৎপলেন্দুর ঘুম ভাঙল।
এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলেন তিনি। দেবারতি মানিকে নিয়ে প্রাপ্তবয়স্ক স্বপ্ন। শরীরটা ঝিমঝিম করছে, ক্লান্ত লাগছে। চোখ খুলে ঝাপসাভাবে দেখতে পেলেন ডিসটেম্পার করা দেওয়ালে টাঙানো দেওয়াল-ঘড়ি। মনে হচ্ছে সাড়ে আটটা। বালিশের পাশ থেকে চশমাটা নিয়ে চোখে দিলেন। আবার দেখলেন : সাড়ে আটটাই বটে।
দরজায় আবার ধাক্কা পড়ল।
বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লেন উৎপলেন্দু। মাথা দপদপ করছে। মনে হচ্ছে টলে পড়ে যাবেন। কাল মাঝরাত পেরিয়ে ঘরে ফিরে এসে আর এক দফা বোতল নিয়ে বসেছিলেন। গ্লাসে চুমুক দিয়ে গত দু-দিনের জ্বালাটা অনেক কমে গিয়েছিল। তারপর একসময় ঘুমনোর চেষ্টা। কিন্তু ঘুম স্বল্পবসনা ক্যাবারে ডান্সারের মতো লীলায়িত ভঙ্গিতে ছলনা করেছে। ঘুম আসেনি ঠিকঠাক—কিন্তু দেবারতি এসেছে—রতি এসেছে।
লুঙ্গির কষি ঠিক করে গেঁট দিয়ে স্যান্ডো গেঞ্জির ওপরে একটা হাওয়াই শার্ট চাপিয়ে নিলেন উৎপলেন্দু। তারপর বেসামাল ক্লান্ত পায়ে দরজার কাছে গিয়ে দরজা খুললেন।
অনিমেষ চৌধুরি। পরনে গেরুয়া রঙের একটা লুঙ্গি এবং বিচিত্র এক হাতাওয়ালা গেঞ্জি। গেঞ্জিটা বোধহয় প্রফেসরের ছেলেবেলার—কারণ সাঙ্ঘাতিকভাবে এঁটে বসেছে তাঁর শরীরে, এবং তাঁর স্ফীত মধ্যপ্রদেশকে স্বমহিমায় আংশিক প্রকাশিত করে রেখেছে।
অধ্যাপকের মনে যে শান্তি নেই সেটা তাঁর মুখচোখ দেখেই দিব্যি বোঝা যাচ্ছে।
‘উৎপলেন্দুবাবু, খবর শুনেছেন।’
‘কী খবর?’ উৎপল অবাক হয়ে অধ্যাপককে দেখছিলেন। ভদ্রলোকের ঘর চারতলায়, দেবারতির ঘরের ঠিক পাশে। সেখান থেকে এই অদ্ভুত পোশাকেই নেমে এসেছেন উৎপলেন্দুর তিনতলার ঘরে!
‘পুলিশ এসে পড়েছে—’ ছাত্র পড়ানোর ভঙ্গিতে আঙুল উঁচিয়ে অধ্যাপক চৌধুরি বললেন, ‘ওরা জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে দিয়েছে। একটু আগে একজন বেয়ারা এসে আমার ঘুম ভাঙিয়ে খবরটা দিয়ে গেল। বলল, দুশো আট নম্বর ঘর—মানে, ভাস্করবাবুর ঘরে যেতে। ম্যানেজারবাবু নাকি বলেছেন। তাই আপনাকে ডাকতে এলাম। আসার সময় দেখলাম ভাস্করবাবুর ঘরের দরজা বন্ধ।’
উৎপলেন্দুর পাশের ঘরটা অর্জুন দত্তের। আর তার পাশেরটাই দুশো আট নম্বর। গলা বাড়িয়ে সেদিকে একবার উঁকি দিয়ে অন্য কথা জিগ্যেস করলেন উৎপলেন্দু, ‘কাল আপনার ডেটা কালেকশন কেমন হল? কোনও সুত্র-টুত্র পেলেন?’
‘অনেক ডেটা জোগাড় করেছি। পুলিশ যদি হেল্প চায় তো ওদের দেব। তা না হলে ওগুলোই জোড়াতালি দিয়ে একটা উপন্যাস লিখে ”ছায়াময়” পত্রিকায় চালিয়ে দেব। অনির্বাণ ছেলেটি বড় ভালো।’
ভাবতে অবাক লাগে, এই লেখকও অর্ধেক সফলতা পেয়েছে। আর উৎপলেন্দুর রচনাবলীতে শুধুই ট্র্যাজেডি। গোলমালটা যে কোথায়, এত বছরেও উৎপল সেটা ঠিক বুঝে উঠতে পারলেন না।
‘কী হল, চলুন! ভাস্করবাবুর ঘরে তাড়াতাড়ি যেতে বলেছে—।’
‘আপনি কি এই পোশাকেই যাবেন না কি। যান, জামাটা অন্তত গায়ে দিয়ে আসুন…বাইরের লোকজন থাকবে…।’
‘কেন?’ নিজের গেঞ্জি আর লুঙ্গির দিকে দেখলেন অধ্যাপক : গেঞ্জি পরে আমাকে খারাপ দেখাচ্ছে?’
‘না, তা দেখাচ্ছে না। তবে লেখক মানুষ বলে কথা, এই পোশাক পরে ওখানে গেলে লোকে পালোয়ান বলে ঠাওরাতে পারে।’
অনিমেষ চৌধুরিকে দ্বিধাগ্রস্ত এবং বিব্রত বলে মনে হল।
এমন সময় একজন উর্দি পরা বেয়ারা দরজার কাছে এসে দাড়াল। বলল, ‘স্যার, ম্যানেজারসাহেব আপনাদের দুশো আট নম্বর ঘরে যেতে বলেছেন। ওখানে পুলিশের লোকজন সব এসেছে।’
জরুরি খবরটি দিয়ে বেয়ারাটি দ্রুতপায়ে এগিয়ে গেল বাকিদের তলব করতে।
অনিমেষ চৌধুরি ছটফট করছিলেন। কী করবেন ভেবে উঠতে পারছিলেন না। একটু ইতস্তত করে বললেন, ‘আমি তাহলে যাই, চটপট ড্রেস করে আসি। দেরি করে হাজির হলে আবার আমাকেই না সন্দেহ করে বসে। স্ট্রেটকাট সুইসাইড কেস। সেটাকে ওরা হয়তো তখন মার্ডার বলে চালিয়ে দেবে…।’
‘সুইসাইড নয়। সবাই বলছে এটা নাকি স্ট্রেট কাট মার্ডার কেস।’ অধৈর্যভাবে শেষ কথাটা যোগ করলেন উৎপলেন্দু, ‘এখন যান, জলদি জামাকাপড় পরে আসুন—।’
আর অপেক্ষা করলেন না উৎপল। ঘরে ঢুকে, বলতে গেলে অনিমেষ চৌধুরির মুখের ওপরেই, দরজা বন্ধ করে দিলেন।
হাতমুখ ধুয়ে জামাকাপড় পরে তৈরি হওয়ার সময় অবাক হয়ে তিনি লক্ষ করলেন, তাঁর হাত সামান্য কাঁপছে।
পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ঘরের দরজা লক করে করিডর ধরে হাঁটা দিলেন উৎপলেন্দু। ভারি শরীর নিয়ে ধীরে-ধীরে পথ চলেন তিনি। অর্জুন দত্তের ঘরের দরজার কাছে পৌঁছোনো মাত্র দরজা খুলে বেরিয়ে এল অর্জুন, হাতে নস্যির কৌটো। আর তার ঠিক পিছনেই জ্যোতিষ্ক সান্যাল। ওঁরাও বোধহয় দুশো আট নম্বরের দিকে চলেছেন।
জ্যোতিষ্ক সান্যাল উৎপলেন্দুর দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করলেন, ‘কোথায় চললেন, দুশো আট?’
উৎপলেন্দু ঘাড় নেড়ে জানালেন, ‘হ্যাঁ। এখন সব রাস্তাই দুশো আট নম্বর ঘরের দিকে।’
একটু থমকে দাঁড়িয়ে জ্যোতিষ্ক চাপা গলায় বললেন, ‘বেয়ারাদের কাছ থেকে বেশ কিছু ইনফরমেশন পেয়েছি। গল্পের গোয়েন্দাকে তো বহুবার গাছে চড়িয়েছেন—এবার সে গাছ থেকে নেমে এসেছে—আমাদের টাইট দেবার জন্যে…’
অর্জুন দত্ত শব্দ করে নস্যি নিয়ে নস্যির ডিবে পকেটে ঢুকিয়ে রাখল। নাকে আঙুল ঘষল কয়েকবার। একটা হাঁচি ‘আসব আসব’ করায় সেটা সামলাতে কয়েক সেকেন্ড সময় নিল। তারপর হাঁটা দিল। বাকি দুজনও পা মেলালেন ওর সঙ্গে। কোনও মন্তব্য করলেন না।
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই দুশো আটের দরজায় এবং কলিংবেলের বোতামে আঙুল। দরজা খুলে দিল উর্দি পরা একজন কনস্টেবল। ওরা তিনজন ঢুকে পড়লেন ভাস্কর রাহার ঘরে।
এবং একটা ধাক্কা খেলেন তিনজনেই।
হোটেল ‘সিরাজ’-এর পশ্চিমদিকের সতেরোটা ঘরে রয়েছেন সম্মেলনে আমন্ত্রিত সতেরোজন অতিথি। তার মধ্যে দশজন রহস্য কাহিনীকার, দুজন সম্পাদক, দুজন প্রকাশক ও তিনজন সাংবাদিক। এছাড়া অনেকেই আমন্ত্রিত হয়েছেন শুধুমাত্র সম্মেলনের রোজকার অনুষ্ঠানে হাজির থাকার জন্য। তাঁদের জন্য আয়োজকরা চা ও লাঞ্চের ব্যবস্থা রেখেছেন। এর মধ্যে আবার বিশিষ্ট কয়েকজন অতিথিকে কর্তপক্ষ সামান্য সম্মান-দক্ষিণা দেওয়ারও বন্দোবস্ত করেছেন।
পশ্চিমমুখো সতেরোটা ঘর ভাগাভাগি হয়েছে এইভাবে :
পাঁচতলার পাশাপাশি চারটে ঘরে আছেন অনামিকা সেনগুপ্ত, রত্নাবলী মুখোপাধ্যায়, জ্যোতিষ্ক সান্যাল ও রূপেন মজুমদার।
চারতলায় পরপর পাঁচটা ঘরে রয়েছেন অনিমেষ চৌধুরি, দেবারতি মানি, কল্পনা সেন, রতন বন্দ্যোপাধ্যায় ও রঞ্জন দেবনাথ।
তিনতলায় আছেন প্রেমময় চৌধুরি, ভাস্কর রাহা, অর্জুন দত্ত ও উৎপলেন্দু সেন।
আর দোতলায় পরপর চারটি ঘরে আশ্রয় নিয়েছেন কৌশিক পাল, অনির্বাণ ঘোষ, সুজন সরকার ও প্রীতম নন্দী।
এই সতেরোজনের মধ্যে একজন অতিথি ‘আছেন’ থেকে ‘ছিলেন’ হয়ে গেছেন।
বড় রাস্তা থেকে দেখলে সতেরোটা ঘরের মধ্যে ষোলোটা ঘরের জানলা একটা চার বাই চার দাবার ছক তৈরি করেছে বলে মনে হবে। শুধু চারতলায় রঞ্জন দেবনাথের ঘরটাই ডান দিকে বাড়তি একটা চৌখুপি। অবশ্য আমন্ত্রিত ‘অতিথি ছাড়াও হোটেলে অন্যান্য বোর্ডার রয়েছে।
তিনতারা হোটেলের ঘর যেমন হওয়া উচিত ঘরগুলো সেরকমই। তবে সতেরোটা সিঙ্গল রুম পাওয়া যায়নি বলে আয়োজকরা নটা ডাবল রুম ভাড়া নিয়েছেন। কিন্তু কোনও অতিথির গোপনীয়তায় যেন আঁচড় না পড়ে তার জন্য ডাবল রুমগুলোকেও সিঙ্গল রুমের মতো ব্যবহার করা হয়েছে।
ভাস্কর রাহার ঘরটা ডাবল রুম। ঠিক তার নীচের ডাবল রুমটা পেয়েছেন অনির্বাণ ঘোষ। রাহার ওপরের ডাবল রুম ছিল দেবারতির। আর তার ঠিক ওপরের ডাবল রুমেই আছেন রত্নাবলী।
ঠিক একইরকম ডাবল রুম পেয়েছেন রুপেন মজুমদার, রতন বন্দ্যোপাধ্যায়, রঞ্জন দেবনাথ, উৎপলেন্দু সেন ও প্রীতম নন্দী।
তবে রুম সিঙ্গল হোক আর ডাবলই হোক, তাদের চেহারা ও চরিত্রে কোনও তফাত নেই—শুধু আয়তনের সামান্য ফারাকটুকু ছাড়া। সুতরাং তিনতারা হোটেলের একটি অভিজাত ঘরের চরিত্র যদি হঠাৎ করে লালবাজারের ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের কোনও ঘরের মতো হয়ে যায়, তা হলে ধাক্কা খাওয়ারই কথা।
জ্যোতিষ্ক সান্যাল, অর্জুন দত্ত এবং উৎপলেন্দু সেন ভাস্কর রাহার ঘরে ঢুকে ঠিক সেই ধাক্কাটাই খেলেন।
ঘরে এত লোকজন যে, ঘরের অক্সিজেন বোধহয় নাভিশ্বাস তুলছে।
বিছানায় বসে আছেন কয়েকজন। তিনজন টেবিলের কাছে। এ ছাড়া ঘরের এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন কেউ কেউ। আর পশ্চিমের খোলা জানলার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন দুজন মানুষ। তার মধ্যে একজনের মাথার চুল ধবধবে সাদা। রোগা ছিপছিপে চেহারা। গায়ের রং শ্যামলা। চোখে সরু ফ্রেমের চশমা। পরনে খদ্দরের ঢোলা পাঞ্জাবি আর পাজামা। ডান হাতের লম্বা আঙুলের ফাঁকে জ্বলন্ত সিগারেট।
আর দ্বিতীয়জন বেশ লম্বা, শক্ত পোক্ত। বয়স চল্লিশের এপিঠেই। ছোট করে ছাঁটা চুল। কাঁচাপাকা চওড়া গোঁফ। ফরসা মুখে সামান্য বসন্তের দাগ। পরনে ছাই রঙের ফুলপ্যান্ট, আর সাদা নীল চেক কাটা হাওয়াই শার্ট। হাতের শিরা এবং পেশি—দুই-ই প্রকট। আর তার চোয়ালের উদ্ধত রেখা যেন সবাইকে সাবধান করে দিচ্ছে : হুঁশিয়ার!
টেবিলের কাছাকাছি একটা সোফায় বসে ছিলেন ‘সিরাজ’-এর এক্সিকিউটিভ ম্যানেজার। জ্যোতিষ্কদের ঘরে ঢুকতে দেখেই তিনি উঠে দাঁড়ালেন। সূত্রধারের ঢঙে বলতে শুরু করলেন,
‘আপনারা তো সকলেই জানেন যে, কাল রাত সাড়ে এগোরোটা নাগাদ মিস দেবারতি মানি—আমাদের হোটেলের তিনশো আট নম্বর রুমের বোর্ডার—তাঁর ঘরের জানলা থেকে লাফ দিয়ে সুইসাইড করেছেন। যেহেতু তিনি এই কনফারেন্সের পার্টিসিপ্যান্ট ছিলেন সেহেতু এই দুর্ঘটনা—মানে, মিসহ্যাপের সঙ্গে আপনাদের ইনভলভমেন্টটাই বেশি।’ একটু দম নিলেন ম্যানেজারসাহেব তারপর : ‘আমাদের হোটেলের একটা রেপুটেশন আছে। মানে, সুনাম আছে। তাই আমরা চাই খুব একটা শোরগোল না তুলে পুলিশের ইনভেস্টিগেশন শেষ হোক—’
‘লম্বা অফসানা জলদি খতম করুন, ম্যানেজারসাহেব।’ জানলার কাছ থেকে দ্বিতীয়জন আকস্মিকভাবে রুক্ষ মন্তব্য ছুড়ে দিয়েছে। তার কপালে বিরক্তির ভাঁজ। হাতে কয়েকটা কাগজ, আর খোলা বলপয়েন্ট পেন।
প্রশান্ত রায় থতমত খেয়ে চুপ করে গেলেন।
জানলার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা শুভ্রকেশ ভদ্রলোক জ্বলন্ত সিগারেটসমেত ডান হাতটা ওপরে তুলে মাস্টারি ভঙ্গিতে বললেন, ‘আঃ, রঘুপতি। টেক ইট ইজি। এত অল্পেতে অধৈর্য হয়ে পড়ো কেন।’
রঘুপতি অবাক চোখে তাকাল বৃদ্ধের দিকে : ‘একটা ইয়াং মেয়ে কথা নেই বার্তা নেই একজন আননোন কাতিলের হাতে কোতল হয়ে গেল—আর আপনি সেটাকে বলছেন অল্প! অল্প মাই ফুট, গুপ্তাসাব। আমি খুনিকে চাই, ব্যস।’
বৃদ্ধ সিগারেটে টান দিলেন। বাঁ হাতে রঘুপতির পিঠ চাপড়ে দিলেন দু-বার। তারপর সামান্য হেসে বললেন, ‘রঘুপতি যাদব, আমার গায়ের জোর নেই মানছি, কিন্তু আমার বুদ্ধির জোরের ওপরেও তোমার ভরসা নেই! তুমি আমার কাছে সিম্পলি খুনিকে চাইছ, এই তো! কোনও চিন্তা নেই, পাবে। শুধু এক-দু’ দিন সময়ের ব্যাপার।’
ঘরের দরজায় কলিংবেল বেজে উঠল, দরজা খুলল।
ঘরে ঢুকলেন রত্নাবলী মুখোপাধ্যায়—সঙ্গে অনামিকা।
রত্নাবলী ঘরে ঢুকেই ইতস্তত করে বললেন, ‘কিছু মনে করবেন না, একটু দেরি হয়ে গেল। রাতে ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে শোওয়া অভ্যেস। অনামিকা দরজায় ধাক্কা না দিলে হয়তো ঘুম এখনও ভাঙত না—’ চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে হাসলেন তিনি।
অনামিকা এপাশ-ওপাশ তাকিয়ে সোজা এগিয়ে গেল বিছানায় বসে থাকা ভাস্কর রাহার দিকে।
হাতের সিগারেট অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিয়ে অপরিচিত সাদা-চুল বৃদ্ধ হাসি মুখে দু-হাত নেড়ে স্বাগত জানালেন রত্নাবলীকে।
‘আসুন, ম্যাডাম—বসুন।’
সাংবাদিক প্রীতম নন্দী নিজের সোফাটা ছেড়ে দিল রত্নাবলীকে।
রত্নাবলী জিজ্ঞাসার দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন বৃদ্ধের দিকে। সেই জিজ্ঞাসার অর্থ বুঝতে পেরে বৃদ্ধ স্মিত হেসে বললেন, ‘ম্যাডাম, আমি আপনার লেখার একান্ত ভক্ত। এই সম্মেলনে আপনারা যে দশজন লেখক এসেছেন তাঁদের প্রত্যেকের লেখাই আমি পড়েছি। উইলিয়াম উইলকি কলিন্সের ”দ্য ওম্যান ইন হোয়াইট” থেকে শুরু করে এডগার অ্যালান পো, আর্থার কোনান ডয়েল, রিচার্ড অস্টিন ফ্রিম্যান, জি. কে. চেস্টারটন, আগাথা ক্রিটি, জর্জ সিমেনন, নিকোলাস ব্লেক, জন ডিকসন কার, পি. ডি. জেমস ছুঁয়ে আজকের রুথ রেন্ডেল পর্যন্ত সকলের লেখা আমি পড়েছি। গোয়েন্দা কাহিনি আমার পড়তে ভালো লাগে। ভালো লাগে খুনির সঙ্গে গোয়েন্দার বুদ্ধির লড়াই।
‘ঠিক একইভাবে ”বাঁকাউল্লার দপ্তর” থেকে শুরু করে প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়, ভুবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, পাঁচকড়ি দে, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, নীহাররঞ্জন গুপ্তের বুড়ি ছুঁয়ে আজকের অনামিকা সেনগুপ্ত পর্যন্ত আমার পড়া।’ একটু দম নিলেন বৃদ্ধ। হাতে হাত ঘষলেন। তারপর শব্দ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে যেন নিজেকেই প্রশ্ন করলেন, ‘কিন্তু আমি কে?’
কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা। ঘরের সবাই চুপ। আর ঠিক তখনই দরজার কলিংবেল আবার বেজে উঠল।
দরজা খুলতেই ঘরে ঢুকলেন অনিমেষ চৌধুরি। ধুতি পাঞ্জাবি পরে একেবারে কেতাবী অধ্যাপকটি সেজে এসেছেন।
সুতরাং ষোলো কলা পূর্ণ হল, যেহেতু অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত ষোলোজন বিশেষ অতিথিই এখন এই ঘরে হাজির।
শুভ্রকেশ বৃদ্ধ আপনমনেই হাসছিলেন মুখ টিপে, আর ছোট ছোট পা ফেলে ঘুরপাক খাচ্ছিলেন ঘরের মাঝখানে। হঠাৎই পায়চারি থামিয়ে মুখ তুলে তিনি ভরাট গলায় ঘোষণা করলেন, ‘আমি এক হুনুর—থিঙ্কিং মেশিন—এখানে হুনুরি করতে এসেছি।’
ঘর আবার নিস্তব্ধ।
‘হুনুর!’ প্রেমময় চৌধুরি অবাক হয়ে উচ্চারণ করেছেন।
সেদিকে ঘুরে তাকালেন বৃদ্ধ : ‘হ্যাঁ, হুনুর। ফারসী ভাষা থেকে বাংলায় এসেছে। যার অর্থ হল তীক্ষ্নবুদ্ধি, দক্ষ ব্যক্তি—অথবা, সহজ কথায় গোয়েন্দা।’
জ্যোতিষ্ক পাশে দাঁড়ানো অর্জুন দত্তকে চাপা গলায় বললেন, ‘বুঝলেন, এই সেই মাল—গাছ থেকে নেমে এসেছে।’
বৃদ্ধ তখনও বলছিলেন, ‘আমি এখানে হুনুরি করতে এসেছি। প্যারীচাঁদ মিত্রের ”আলালের ঘরের দুলাল” বইতে ”হুনুরি” শব্দটা আছে। সেখানে তার অর্থ ”শিল্পকর্ম” বা ”সূচিকর্ম”। হাসলেন বৃদ্ধ, চোখ বুলিয়ে নিলেন সকলের মুখের ওপরে : ‘আমি এখানে অনেকটা সেই কাজই করতে এসেছি। শিল্পকর্ম—মানে গোয়েন্দাগিরি।
‘আমার নাম অশোকচন্দ্র গুপ্ত। ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে এসিজি। কারণ বয়েসকালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতাম। ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টে। চিন্তা করতে আমি ভালোবাসি বরাবরই। আর ভালোবাসি দেশি-বিদেশি ডিটেকটিভ ফিকশন বা ক্রাইম ফিকশন পড়তে। এছাড়া আর একটা আজব শখ আমার আছে—পাখি আর পাখির ডাক।’ রঘুপতি যাদবের দিকে আঙুল তুলে দেখালেন অশোকচন্দ্র : ‘রঘুপতি যাদব এক সময়ে আমার ছাত্র ছিল। তারপর কী করে যেন লালবাজারের ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের ইন্সপেক্টর হয়ে গেছে। এই ছেলেটা খুন একদম পছন্দ করে না—আর আমার নেশার কথা জানে। সেইজন্যেই হোটেল ”সিরাজ” থেকে প্রশান্তবাবুর টেলিফোন পাওয়ার পর ও আমাকে ফোন করে। বলে, ”এসিজি, ইন্টেলেকচুয়ালদের কনফারেন্সে একটা ইয়াং মেয়ে মার্ডার হয়ে গেছে। ক্রাইম রাইটারদের কনফারেন্স। ফিল ইন্টারেস্টেড?”
‘তারপর, রাইটারদের নামের সূচিপত্র শুনে, আই বিকেম ইন্টারেস্টেড। যাঁদের লেখা সবসময় পড়ি তাঁদের দশ-দশজনের সঙ্গে মুখোমুখি দেখা হবে! ভাবাই যায় না। সুতরাং কাল রাত থেকেই রঘুপতি যাদবের সঙ্গে আমি এখানে হাজির। রঘুপতির খালি এক কথা : ”পাখি যেন পালাতে না পারে—।” ‘
অশোকচন্দ্র গুপ্ত—সংক্ষেপে এসিজি—হাসলেন, বললেন, ‘বুঝতেই পারছেন, ও আমার পাখির নেশার কথা জানে। জানে, অনেকরকম পাখির ডাকই আমার চেনা। দ্যাটস অল।’
এসিজির কথা বলার ঢং দেখেই বুঝতে অসুবিধে হয় না, বক্তৃতা দেবার অভ্যেস তাঁর আছে। কথা শেষ করে দুটো হাত একজোট করে ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। সকলের উদ্দেশেই প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, ‘কারও কোনও প্রশ্ন আছে?’
কয়েক সেকেন্ড সবাই চুপচাপ। তারপর অনামিকা ফস করে বলে বসল, ‘আপনাকে দেখে ডিটেকটিভ বলে মনেই হয় না—।’
অস্বাভাবিক ক্ষিপ্র গতিতে পঁয়ষট্টি পেরোনো বৃদ্ধ ঘুরে তাকালেন অনামিকার দিকে। তাঁর চোয়ালের রেখা পলকের জন্য শক্ত হল। তারপর সুন্দর করে হেসে বললেন, ‘ওটা আমার ছদ্মবেশ, মা-মণি। আদর করে ”মা-মণি” বললাম বলে রাগ কোরো না, অনামিকা। তুমি আমার মেয়ে ঊর্মিলার মতো। ঊর্মিলা কিছুতেই মানতে চায় না আমি ডিটেকটিভ। আসলে কী জানো? চেহারা আমার শার্লক হোমসের মতো নয়, সেরকম করে পাইপ টানতেও পারি না। এরকুল পোয়ারোর মতো মোমের পালিশ দেওয়া ছুঁচলো গোঁফ আমার নেই। দেবেন্দ্রবিজয়, হুকাকাশি, রবার্ট ব্লেক বা ব্যোমকেশের মতো প্রতিভা আমার নেই। এমনকি রত্নাবলী মুখোপাধ্যায়ের বুদ্ধিমান গোয়েন্দা করঞ্জাক্ষ রুদ্র কিংবা ভাস্কর রাহার স্মার্ট ক্ষুরধার বুদ্ধি গোয়েন্দা সুরজিৎ সেনের সঙ্গেও কোনও তুলনা আমার চলে না। কারণ আমি ছাপোষা মানুষ। কোনও করিশমা আমার নেই।’ বাঁ-হাতটা মাথার পিছনদিকে ঘোরালেন তিনি : ‘দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, আমার মাথার পেছন থেকে কোনও জ্যোতি বেরোয় না।
তবে—’ একটু বিরতি দিলেন এসিজি। রূপেন মজুমদার, রত্নাবলী মুখোপাধ্যায় আর ভাস্কর রাহার দিকে একবার দেখলেন। তারপর : ‘তবে আমরা, মানে, বাস্তব জীবনের গোয়েন্দারা মোটামুটিভাবে জোড়াতালি দিয়ে কাজ চালিয়ে নিই। যা হোক করে শেষ পর্যন্ত খুনিকে ধরে ফেলতে পারি। তদন্ত করার সময়ে আমার ব্যবহারে যদি কোনও ভুল-ত্রুটি হয়ে যায় তাহলে আপনারা দয়া করে সেটা নিজ গুণে ক্ষমা করে দেবেন।’
এসিজি এমন সহজভাবে সকলের সঙ্গে কথা বলছিলেন যে, মনে হচ্ছিল সকলকেই তিনি চেনেন। অনামিকা ‘মা-মণি’ সম্বোধনে বেশ অপমানিত এবং আহত হয়েছিল। কিন্তু ও খানিকটা খুশি হয়েছিল অশোকচন্দ্র ওর লেখা পড়েছেন বলে। নতুন লেখকদের পক্ষে পাঠক পাওয়া যে কী শক্ত! কিন্তু ভদ্রলোক সকলকে অনায়াসে চিনে ফেলেছেন কেমন করে? এ কি ওর হুনুরির নমুনা, না কি…।
উত্তরটা পাওয়া গেল প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই। ছোট-ছোট পা ফেলে এসিজি ঘরের গোল টেবিলটার কাছে এগিয়ে গেলেন। টেবিলে পড়ে থাকা নানান কাগজপত্রের মধ্যে থেকে সাদা মলাটের একটা চওড়া ম্যাগাজিন তুলে নিয়ে তার পাতা ওলটাতে লাগলেন : ‘বার্ষিক রহস্য-রোমাঞ্চ লেখক সম্মেলন’-এর সুভেনির। অনুষ্ঠানের প্রথম দিনেই সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেকের হাতে এক কপি করে তুলে দেওয়া হয়েছে। এই পুস্তিকায় প্রত্যেক লেখকের ছবি এবং সংক্ষিপ্ত পরিচিতি দেওয়া আছে। গতকাল মাঝরাত থেকে এটুকু সময়ের মধ্যে এসিজি তাঁর হোমওয়ার্ক বেশ ভালোভাবেই শেষ করেছেন।
ভাস্কর রাহা এতক্ষণ চুপচাপ বসে ছিলেন। জ্বলন্ত চুরুটে টান দিচ্ছিলেন আর কৌতুকভরা চোখে প্রায় সমবয়েসি এই গোয়েন্দাকে দেখছিলেন। গল্প-কাহিনির গোয়েন্দাদের সঙ্গে কত অমিল!
এমন সময় ঘরের টেলিফোন বেজে উঠল। ভাস্কর রাহা বিছানা থেকে উঠে এগিয়ে যাচ্ছিলেন বিছানার মাথার কাছে ছোট টেবিলে রাখা সবুজ টেলিফোনটার দিকে, কিন্তু তাঁকে বাধা দিল রঘুপতি যাদব। চট করে তাঁর পথ জুড়ে দাঁড়াল। বলল, ‘মাফ কিজিয়েগা, সাহাব। ইনভেস্টিগেশন চালু হয়ে গেছে। এখন থেকে আপনাদের সব চিঠি আর ফোন কল আমরা ইন্টারসেপ্ট করব। মানে, চেক করব।’
রাহার মুখে রক্তের উচ্ছ্বাস দেখা দিলেও রঘুপতি সেটাকে আমল দিল না।
অশোকচন্দ্র রঘুপতির পুরো কথা শেষ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করেননি। ছোট্ট করে ‘সরি, মিস্টার রাহা’ বলে ম্যাগাজিনটা টেবিলে আবার রেখে দিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে পৌঁছে গেছেন টেলিফোনের কাছে। রিসিভার তুলে নিয়ে স্বাভাবিক ভারি স্বরে কথা বললেন। তারপর রিসিভার বাড়িয়ে দিলেন প্রশান্ত রায়ের দিকে : ‘আপনার ফোন—’
এক্সিকিউটিভ ম্যানেজার কথা বললেন টেলিফোনে। তাঁর কথার শতকরা নিরানব্বই ভাগই শুধু ‘ইয়েস’ আর ‘ওকে’। কথা শেষ করে রিসিভার নামিয়ে রাখলেন। তারপর ঘরের সকলের মুখের ওপর একদফা চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলতে শুরু করলেন, ‘অনেকগুলো ইম্পরট্যান্ট খবর আছে। আপনাদের কনফারেন্স আজ সাড়ে দশটায় স্টার্ট হবে। অরগানাইজাররা জানিয়েছেন—’
‘ম্যানেজারসাহেব।’ ভাস্কর রাহার পথ ছেড়ে প্রশান্ত রায়ের দিকে তাকিয়েছে রঘুপতি : ‘আপনার সিলেবাসে কি সামারি বলে কিছু নেই? কাল রাত থেকে দেখছি চার লাইন ইনফরমেশন দিতে গিয়ে চল্লিস লাইন ইনট্রোডাকশন। আপনাদের বাংলায় একে কী বলে যেন, এসিজি? বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত কী যেন?’
‘ওঃ রঘুপতি!’ হাত তুলে ইন্সপেক্টর যাদবকে ক্ষান্ত করতে চাইলেন এসিজি : ‘তোমার এখনও সেই স্টুডেন্ট লাইফের মতো মাথা গরম।’ প্রশান্ত রায়ের দিকে ঘুরে তাকালেন তিনি, বললেন, ‘মিস্টার রায়, যা বলার সংক্ষেপে সারুন।’
প্রশান্ত রায় সুট পরে ছিলেন। কোটের পকেটের কাছটায় দুটো হাত ঘষলেন কয়েকবার। তার গোলগাল ফরসা মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছিল, এইমাত্র কেউ তাঁর গালে রুজ মাখিয়ে দিয়েছে। কাল রাত থেকে এই অভদ্র ইন্সপেক্টরটা তাকে কম অপমান করেনি। যেমন গাধার মতো খাটিয়েছে তেমনই শাসন করেছে। শুধু হোটেলের রেপুটেশনের কথা মনে রেখে তিনি সব সহ্য করেছেন। তা ছাড়া ম্যানেজমেন্টও তাঁকে অর্ডার দিয়েছে পুলিশের সঙ্গে টু হান্ড্রেড পারসেন্ট কোঅপারেট করতে। অগত্যা…।
প্রশান্ত রায় একেবারে টেলিগ্রামের ভাষায় বলতে শুরু করলেন, ‘আজ থেকে কনফারেন্স শুরু হবে রোজ সাড়ে দশটায়। পুলিশকে না জানিয়ে আপনারা কেউ হোটেল ছেড়ে যাবেন না। আর পুলিশের ইনভেস্টিগেশন শেষ না হওয়া পর্যন্ত আপনারা বাইরের কোনও লোকের কাছে এ-বিষয়ে মুখ খুলবেন না। কোনও পত্রপত্রিকায় কিছু লিখবেন না। ব্রেকফাস্ট রেডি। সাড়ে দশটা পর্যন্ত পাওয়া যাবে।’
‘ব্রেকফাস্ট’ শব্দটা শোনার পর বোধহয় সকলের খেয়াল হল খিদে পেয়েছে।
রঘুপতি অশোকচন্দ্রের দিকে তাকিয়ে ইশারা করে চোখ নাচাল। অর্থাৎ, এবার কী হবে?
অশোকচন্দ্র গুপ্ত হাত তুলে গলা উঁচিয়ে বললেন, ‘উপস্থিত রহস্য ভদ্রমন্ডলী, আপনাদেরই একজন, মিস দেবারতি মানি, গতকাল রাতে তাঁর চারতলার ঘরের জানলা থেকে নীচে লাফ দিয়েছে। আপনারা অনেকেই হয়তো ভেবেছেন, ব্যাপারটা আত্মহত্যা—কিন্তু আসলে তা নয়। কেউ তাকে নীচে লাফিয়ে পড়তে সাহায্য করেছে। সম্ভবত আপনাদেরই কেউ।’ একটু থেমে অশোকচন্দ্র আনমনাভাবেই তাঁর মাথার একগোছা চুল টানলেন। তারপর বললেন, ‘ব্যাপারটা যে খুন—আত্মহত্যা নয়—তার ডেফিনিট প্রমাণ আমরা পেয়েছি। ফলে এখন একটা কাজই বাকি : খুনি পাকড়াও করা। আমি আর রঘুপতি মিলে এর মধ্যেই আপনাদের ষোলোজন সম্পর্কে ছোটখাটো একটা ডোসিয়ার তৈরি করে ফেলেছি। আপনারা তো জানেন, খুনের ব্যাপারে ডিটেকটিভ বা পুলিশের একটা জিজ্ঞাসাবাদের ব্যাপার থাকে। সেইজন্যেই আপনাদের প্রত্যেকের সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলা দরকার। আপনারা এখন ব্রেকফাস্ট, কনফারেন্স, এইসব সেরে নিতে পারেন। আমি লাঞ্চের সময় যতটা পারি কাজ সেরে নেব। তারপর সন্ধে থেকে আবার বিরক্ত করব। অতএব, আপাতত আপনারা যেতে পারেন।’
এসিজির কথা শেষ হতেই ঘরে শুরু হল গুঞ্জন।
অতিথিরা কথা বলতে-বলতে রওনা হলেন ঘরের দরজার দিকে। রঘুপতি যাদব বাজপাখির চোখে তাঁদের লক্ষ করছিল।
অনিমেষ চৌধুরি রতন বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশে পাশে হাঁটছিলেন। বললেন, ‘আমার সকাল আটটায় ব্রেকফাস্ট খাওয়া অভ্যেস। আজ ভীষণ দেরি হয়ে গেল।’
রতন বন্দ্যোপাধ্যায় অধ্যাপকের বপু নিরীক্ষণ করে হাসতে-হাসতে বললেন, ‘বুঝতে পারছি আপনার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু খুনের তদন্ত বলে কথা—।’
‘খেয়াল করেছেন, ওই গোয়েন্দা ভদ্রলোকের নামের মধ্যে কেমন একটা ইতিহাসের গন্ধ রয়েছে।’
রতন বন্দ্যোপাধ্যায় কিছু বলে ওঠার আগেই কথা বলল কৌশিক পাল, ‘হ্যাঁ—অশোক আর চন্দ্রগুপ্ত। তবে বুদ্ধি বোধহয় চাণক্যের মতো।’
ভাস্কর রাহা ওঁদের চলে যাওয়া দেখছিলেন। ওঁদের সকলের মনে ভয় আছে, আশঙ্কা আছে। কিন্তু দেবারতি মানির জন্য কতটুকু শোক-দুঃখ-তাপ রয়েছে? মেয়েটা মরেছে বারো ঘণ্টাও হয়নি—অথচ এরই মধ্যে জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে! হাসি-ঠাট্টা করা যাচ্ছে অনায়াসে! যেন দেবারতির মৃত্যু এক আচমকা টান মেরেছিল জীবনযাত্রার তারে, তারটা কাঁপতে শুরু করেছিল অনুপ্রস্থ তরঙ্গ গঠন করে। তারপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তরঙ্গের বিস্তার কমতে-কমতে এই ন’-দশ ঘণ্টায় সেই কম্পন একেবারে থেমে গেছে। বোঝাই যাচ্ছে না দেবারতি মানি নেই—কোনওদিন ছিল।
অথচ রহস্য-রোমাঞ্চ সাহিত্যের প্রতি কী দারুণ ভালোবাসা ছিল মেয়েটার!
আজ থেকে পঁচিশ তিরিশ বছর আগে এইরকম এক ভালোবাসা থেকেই এই সাহিত্যের টানে গা ভাসিয়েছিলেন ভাস্কর রাহা। এমনি গল্প-উপন্যাস যে লিখতে পারতেন না তা নয়। বেশ কয়েকটা লেখা তো ছাপাও হয়েছিল। কিন্তু অ্যালান পো, মপাসাঁ, মম, কোনান ডয়েল, ব্র্যাম স্টোকার, অ্যামব্রোজ বিয়ার্স, ব্র্যাডবেরি, রোল্ড ড্যাল এবং আরও অনেকের লেখা পড়তে-পড়তে মনের ভেতরে কী সব যেন হয়ে গেল। পথ বাঁক নিল। এক অদ্ভুত আচ্ছন্ন ভালোবাসা নিয়ে এই ‘অপরাধী’ সাহিত্যে পা রাখলেন ভাস্কর রাহা। সেই ভালোবাসা নিয়ে দুর্দিনে পথ হেঁটেছেন, ক্রমাগত লড়াইয়ে পৌঁছে গেছেন সফলতার সোনার দিনে। কিন্তু অদ্ভুত সেই ভালোবাসা—এত বছরেও এক বিন্দু কমেনি।
এরকম কম-বেশি ভালোবাসা নিয়ে আরও অনেক লেখক এসে যোগ দিয়েছেন সাহিত্যের এই বিশেষ শাখায়। তাঁরা একনিষ্ঠভাবে এই সাহিত্যের চর্চা করে গেছেন। সে-সময়ে নামি পত্রপত্রিকায় রহস্য গল্প-উপন্যাস ছাপা হত না। কিন্তু তা সত্ত্বেও এইসব ‘প্রেমিক’ লেখকরা ভিক্ষার পাত্র নিয়ে গিয়ে সেইসব নামী পত্রিকার দরজায় কড়া নাড়েননি। বরং ছোট পত্রিকায় লিখেছেন নিয়মিত। ‘মাসিক রহস্য পত্রিকা’, ‘মাসিক রোমাঞ্চ’, ‘মাসিক গোয়েন্দা’, ‘মাসিক ক্রিমিনাল’, ‘ভয়ংকর’, ‘ক্রাইম’, ‘অপরাধ’—এইসবই ছিল তাঁদের প্রিয় পত্রিকা। স্বর্গের দাসত্ব করার চেয়ে নরকের রাজত্ব তাঁদের পছন্দ ছিল।
দিনের পরে দিন কেটে গেল। সময়ও তার রং বদলাতে লাগল ধীরে-ধীরে। বেশ কয়েকটি রহস্য-রোমাঞ্চ পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেল লড়াইয়ে হেরে গিয়ে। কিন্তু জন্ম নিল কয়েকটি নতুন পত্রিকা : ‘ছায়াময়’, ‘রহস্য-রোমাঞ্চ’, ‘ভৌতিক’। আবার নতুন করে শুরু হল লড়াই।
ইতিমধ্যে কয়েকটি নামি পত্রিকা রহস্য গল্প-উপন্যাস প্রকাশ করে পাঠকের সাড়া পেয়েছে। টিভিতে প্রায় নিয়মিত হয়ে পড়েছে রহস্য-কাহিনি। ফলে রহস্য-রোমাঞ্চ জাতীয় পত্রিকাগুলোর প্রচার সংখ্যা বাড়তে লাগল। প্রকাশকরা এ-জাতীয় বই প্রকাশে মন দিলেন। লেখকরা যেন নতুন করে কোরামিন ইনজেকশান নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন তাঁদের কলম নিয়ে।
তারপর…গত পাঁচ-সাত বছরে ছবিটা একেবারে বদলে গেল। সফলতার স্বাদ এখন রহস্য-সাহিত্যিকদের অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে।
কিন্তু সেই ভালোবাসা? সেটা কি সকলের মধ্যে রয়েছে? সহজে সফলতা পাওয়ার লোভে কেউ কেউ কি এসে যোগ দেননি এই স্রোতে? আর পুরোনো লেখকরা এখনও কি ভাস্কর রাহার মতো বুকে হাত রেখে বলতে পারেন, ‘রহস্য-সাহিত্য, তোমাকে আমি প্রাণের চেয়েও ভালোবাসি।’ বোধহয় না। তবে দেবারতি মানি পারত।
আর সেইজন্যেই কি খুন হয়ে গেল মেয়েটা!
‘মিস্টার গুপ্ত,’ ভাস্কর রাহা শান্ত গলায় বললেন, ‘দেবারতির ঘরটা আমি একবার দেখতে পারি?’
ভুরু বাঁকিয়ে আড়চোখে রাহার দিকে তাকাল রঘুপতি যাদব : ‘মতলব?’
ভাস্কর রাহা রঘুপতির দিকে ফিরেও তাকালেন না। অশোকচন্দ্রের দিকে তাকিয়েই কথা বললেন আবার, ‘যদি অবশ্য আপনাদের তদন্তের কোনও অসুবিধে না হয়।’ একটু থেমে যেন স্বগত মন্তব্য করলেন, ‘মেয়েটাকে আমি বড় ভালোবাসতাম…’
রঘুপতি এবার ভাস্কর রাহার কাছাকাছি এগিয়ে এল। ঘরের মেঝেতে কার্পেট থাকা সত্ত্বেও ওর ভারি বুটের শব্দ শোনা গেল। চোয়াল শক্ত করে ঠোঁটের কোণ বাঁকিয়ে রঘুপতি চিবিয়ে চিবিয়ে উচ্চারণ করল, ‘মোহাব্বত! ইন্টারেস্টিং।’
উৎপলেন্দু সেন রত্নবলী মুখোপাধ্যায়ের দিকে তাকালেন। চাপা গলায় মন্তব্য করলেন, ‘একেবারে আনকালচারড।’ রূপেন মজুমদার ইশারায় উৎপলকে থামতে বললেন।
রত্নাবলী অনেকক্ষণ ধরেই অস্বস্তি পাচ্ছিলেন। তাই গলা তুলে রঘুপতি যাদবকে লক্ষ করে কিছু একটা বলতে গেলেন। কিন্তু ভাস্কর রাহা ইশারায় তাঁকে থামালেন। ধীরেসুস্থে পকেট থেকে চুরুট বের করে তাতে অগ্নিসংযোগ করে আরামের ভঙ্গিতে ধোঁয়া ছাড়লেন। তারপর এসিজিকে লক্ষ করে বললেন, ‘মিস্টার যাদবের শিক্ষা-দীক্ষার ব্যাপারটা আপনিই ভালো বলতে পারবেন—আপনি ওর মাস্টারমশাই ছিলেন। তা ছাড়া এখানে আমি সহবত শেখানোর ইস্কুল খুলিনি—ওটা বাড়ি থেকেই শিখে আসতে হবে।’
‘মিস্টার রাইটার—’ গর্জন করে উঠল ইন্সপেক্টর যাদব।
তার মুখ অপমানে লাল হয়ে গেছে। ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে চোখ ছোট করে সে কিছু একটা বলতে শুরু করেছিল, কিন্তু তাকে সময়মতো বাধা দিয়েছেন এসিজি।
‘রঘুপতি, তুমি কি আমাকে একটু শান্তিতে কথা বলতে দেবে না! প্লিজ, একটু চুপ করে থাকো—।’
রঘুপতি যাদব নিজেকে সামলে নিল।
ভাস্কর রাহা চুরুটে টান দিয়ে সামান্য শব্দ করে হাসলেন। হাতের চুরুটের দিকে নজর রেখেই স্পষ্ট স্বরে বললেন, ‘মিস্টার গুপ্ত গত বিশ-পঁচিশ বছরে এই ক্রাইম ফিকশন লেখালিখি নিয়ে অনেক লড়াই আমরা দেখেছি। আমরা বলতে, আমি, উৎপলেন্দু সেন, রূপেন মজুমদার, আর মিসেস মুখার্জি তো বটেই—’ ওঁদের তিনজনের দিকে ইশারা করে দেখালেন রাহা। মুখ তুলে আবার হাসলেন, বললেন, ‘কারও চোখ রাঙানিতে আমরা ভয় পাই না। তা সে সম্পাদকই হোক, প্রকাশকই হোক, কিংবা—’ রঘুপতি যাদবের দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে : ‘পেটি কোনও পুলিশ অফিসারই হোক।’
রঘুপতি একটা চাপা উত্তেজনায় কাঁপছিল, কিন্তু সে চেতনা হারায়নি। কারণ সে জানে, সেরকম বেচাল কিছু করে ফেললেই পরদিন সেটা খবরের কাগজের নিউজ হবে। বিশেষ করে যেখানে ভাস্কর রাহা আর রত্নাবলী মুখোপাধ্যায় হাজির রয়েছেন।
এসিজি প্রত্যেকের মুখের দিকে একবার করে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনি ঠিক সময়েই প্রস্তাব দিয়েছেন, ভাস্করবাবু। কারণ আমরা মিস মানির ঘরে এখন একবার যাব। আপনি সঙ্গে এলে আমার বা রঘুপতির কোনও আপত্তিই নেই। ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম—’ হাসলেন এসিজি।
রঘুপতি যাদব তখন মনে-মনে ঈশ্বরকে ডাকছিল। স্যার যদি এই পাকাচুল রাইটারটাকে শেষ পর্যন্ত খুনি বলে ঠাওরান তা হলে দারুণ হবে। ওই যে সহবত-টহবত কী সব বলল, সেগুলো ওকে হাড়ে-হাড়ে শিখিয়ে দেওয়া যাবে।
‘চলুন, তাহলে আমরা ওপরে যাই—’ রঘুপতির হাত ধরে টান মারলেন অশোকচন্দ্র : ‘চলো, রঘুপতি—।’
‘আ-আমি সঙ্গে গেলে কি কোনও অসুবিধে হবে?’ ইতস্তত করে এই অনুরোধটি পেশ করেছেন রত্নাবলী। চশমার কাচের পিছনে ওঁর চোখ সামান্য ফোলা। নীল সরু পাড়, বুটির কাজ করা, একটা সাদা টাঙ্গাইল শাড়িতে ওঁকে প্রশান্ত দেখাচ্ছে। দেবারতির ব্যাপারটার জন্য আজ যে বাড়িতে যেতে পারবেন না সে-কথা স্বামীকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছেন। দেবারতি মেয়েটা বেশ হাসিখুশি ছিল। তা ছাড়া তাঁর লেখার ভক্ত ছিল। অকারণে একজন ভক্ত পাঠক কোন লেখক হারাতে চায়!
অশোকচন্দ্র গুপ্ত চলার পথে থমকে দাঁড়িয়েছেন। ফিরে তাকিয়ে বলেছেন, ‘আসুন না, আপনারা সবাই আসুন। রঘুপতিদের ফোরেনসিক ডিপার্টমেন্ট আর ক্যামেরাম্যানরা কাল রাতেই তাদের সব কাজ সেরে ফেলেছে। এখন আর কোনও সূত্র খোওয়া যাওয়ার ভয় নেই।’
অতএব অশোকচন্দ্র এবং রঘুপতিকে অনুসরণ করে রওনা হলেন চারজন অভিজ্ঞ লেখক। এই প্রথম ওঁরা সরাসরি কোনও তদন্তে জড়িয়ে পড়েছেন।
ওঁরা ছ’-জন চলে যেতেই ভাস্কর রাহার ঘর খালি। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা কনস্টেবলটিকে রঘুপতি ঘরের বাইরে পাহারা দেবার জন্য নির্দেশ দিল। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে বাঁদিকে বাঁক নিয়ে সোজা সিঁড়ির দিকে।
ওপরে রওনা হওয়ার আগে ল্যান্ডিং-এর বারান্দা দিয়ে নীচের দিকে ঝুঁকে দেখলেন রূপেন মজুমদার। না, গত রাতের কোনও চিহ্নই চোখে পড়ছে না। ভাস্কর রাহার গাড়িটা নিয়ে যাওয়া হয়েছে থানায়। হয়তো শান বাঁধানো টেরাসে হুমড়ি খেয়ে আতসকাচ নিয়ে পরীক্ষা করলে তবেই খুঁজে পাওয়া যাবে এক তরুণীর শরীরের রক্তবিন্দুর সূক্ষ্ম চিহ্ন।
পাঁচতলায় ওঠার সিঁড়ির দিকে বাঁক নেবার সময় বাঁ দিকের খোলা বারান্দার দিকে তাকালেন ভাস্কর রাহা। সুন্দর ঝকঝকে সকাল। নীল আকাশে কোনও মলিনতা নেই। মনেই হয় না, গতকাল রাতে এই হোটেলেই ঘটে গেছে এক বিশ্রী মলিন ঘটনা।
সত্যি, দেবারতি মানি এই কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই যেন গ্রহান্তরের বাসিন্দা হয়ে গেছে!
ছয়
তিনশো আট নম্বর ঘরে ঢুকতেই এক অশরীরী অনুভূতির তরঙ্গ যেন ঝাঁকুনি দিল ভাস্কর রাহাকে।
চেহারা অথবা বিলাসিতার দিক থেকে ভাস্কর রাহার ঘরের সঙ্গে কোনও তফাত এই ঘরের নেই। অথচ ঘরটার চরিত্র যেন অন্যরকম। একটু আগেই যাকে গ্রহান্তরের বাসিন্দা বলে মনে হচ্ছিল, এখন সে যেন দুরন্ত গতিবেগে মহাকাশের দুস্তর দূরত্ব চোখের পলকে অতিক্রম করে ধূমকেতুর মতো ছুটে এসে আছড়ে পড়েছে এই ঘরের মধ্যে। দেবারতির অশরীরী আত্মা যেন কাতর স্বরে বলছে, ‘মুকুটহীন সম্রাট, আপনাদের ছেড়ে আমি যেতে চাইনি। বাট সামওয়ান ফোর্সড মি টু লিভ ইউ অল। আপনাদেরই একজন আমাকে…।’
সে কে, দেবারতি? মনে-মনে প্রশ্ন করলেন রাহা।
দেবারতি মানির ঘরের দরজায় একজন কনস্টেবল পাহারায় মোতায়েন ছিল। রঘুপতি যাদবকে দেখে সে জোড়াতালি দেওয়া ভাঙা দরজা সতর্কভাবে ঠেলে খুলে দিয়েছে। ওঁরা ঘরে ঢুকেছেন একে-একে।
ভাস্কর রাহা শরীরের পাঁচটি ইন্দ্রিয় দিয়ে দেবারতিকে অনুভব করার চেষ্টা করছিলেন। পারফিউমের হালকা গন্ধ তাঁর নাকে আসছিল।
সোজাসুজি তাকালেই বড় মাপের জানলা। পশ্চিমদিকের এই জানলা দিয়েই পড়ে মারা গেছে দেবারতি।
রূপেন মজুমদার আর উৎপলেন্দু সেন এসিজির অনুমতি নিয়ে দেবারতির বিছানার এক কোণে বসে পড়লেন। গত পরশুর রাতের কথা উৎপলের মনে পড়ল। মেয়েটা তাঁকে যৌন প্রতিবন্ধী বলে অপমান করেছিল। একজন ব্যর্থ লেখক, একজন ব্যর্থ অভিনেতা বলেছে বলে কিছু মনে করেননি উৎপল। নাথিং সাকসিডস লাইক সাকসেস। সফলতার চেয়ে বড় সাফল্য আর কিছু হয় না। উৎপল সাফল্য পাননি। সুতরাং এই বাস্তবটুকু না মেনে তাঁর উপায় নেই। কিন্তু তিনি অসমর্থ নন—কোনও দিক থেকেই অসমর্থ নন।
ভারি অদ্ভুত ব্যাপার! ভাবলেন উৎপলেন্দু। যে-মেয়েটার ওপরে তাঁর এত রাগ এত জ্বালা, তাকেই তিনি স্বপ্নের ঘোরে নায়িকা বলে কামনা করেন! স্বপ্নের ভেতরে ঘটে যাওয়া ঊরুতাড়িত মহাযুদ্ধে তিনি দেবারতি মানিকে পরাস্ত করতে আপ্রাণ চেষ্টা করেন! ফ্রয়েড দিয়ে কি এই অদ্ভুত মানসিকতার কোনও ব্যাখ্যা করা যায়?
দেবারতির বিছানার ভারি চাদর ছুঁয়ে এইসব কথাই ভাবছিলেন উৎপল। রূপেন মজুমদার তাঁর পাশে চুপটি করে বসে। চোখেমুখে সামান্য অস্বস্তির ছাপ। রত্নাবলী সুদৃশ্য ড্রেসিং টেবিলের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। বোধহয় কল্পনায় দেখছেন, দেবারতি ভুরুতে হালকা কাজল ছোঁয়াচ্ছে। আর ভাস্কর রাহা চুরুট হাতে খুব ধীরে পা ফেলে গিয়ে দাঁড়ালেন জানলার সামনে। জানলা তো নয়, মরণের দরজা!
এসিজি কখন যেন সিগারেট ধরিয়ে ফেলেছেন। এলোমেলো পায়চারি করছেন ঘরের মধ্যে। চোখ কার্পেটের নকশার দিকে। আর রঘুপতি যাদব কাগজে কী সব নোট করতে-করতে বাথরুমে ঢুকে পড়ল। একটু পরেই আবার বেরিয়ে এল। সোজা চলে গেল ওয়ার্ডরোবের দিকে। দরজার পাল্লা খুলে ভেতরটা খুঁটিয়ে দেখতে লাগল।
অনেকগুলো থমথমে মুহূর্ত কেটে যাবার পর অশোকচন্দ্র গুপ্ত কথা বললেন, ‘জানেন, প্রথমে আমরা ভেবেছিলাম দেবারতি মানি আত্মহত্যা করেছে—’ বাঁ হাত চুলের ভেতরে চালিয়ে দিলেন। কয়েক গোছা চুল ধরে আলতো করে টান মারলেন কয়েকবার। তারপর : ‘…কারণ, এই ঘরের দরজা ভেতর থেকে লক করা ছিল। হ্যাঁ, এটা ঠিকই যে, এইসব আধুনিক হোটেলের দরজা বাইরে থেকে অথবা ভেতর থেকে—দু-দিক থেকেই লক করা যায়, কিন্তু মিস মানির ক্ষেত্রে প্রবলেম হল, ওর দরজার চাবিটা আমরা পেয়েছি ওই টেবিলের ওপরে। তার অর্থ, মিস মানি নিজেই দরজা লক করেছিল ভেতর থেকে। আর তারপর ও…।’
এসিজির কথা কেড়ে নিয়ে শেষ করল রঘুপতি যাদব। ওয়ার্ডরোবের পাল্লা বন্ধ করে ও চট করে ঘুরে তাকিয়েছে এদিকে : ‘…তারপর মিস মানি লাফ দিয়েছেন ওই খিড়কি দিয়ে। সিধা গিয়ে পড়েছেন ওঁর মোটরের ছাদে।’ রাহার দিকে আঙুল তুলে দেখাল যাদব : ‘তারপর মোটর থেকে শান বাঁধানো টেরাসে। কোয়াইট আ মেসি জব। মাথাটা একেবারে চুরচুর হয়ে গেছে।’
একটু থেমে যাদব আবার বলল, ‘লেকিন তাজ্জব কী বাত হল, দেবারতি মানির ঘরের ওই দরজা—’ আঙুল তুলে দরজার দিকে দেখিয়ে সে বলেছে, ‘অন্দরসে লক করা ছিল। আর চাবিটা ছিল ওই টেবিলের ওপরে—’ জানলার কাছাকাছি রাখা গোল টেবিলটাকে ডান হাতের তর্জনী ব্যবহার করে দেখিয়ে দিয়েছে রঘুপতি যাদব।
‘কেন, তাজ্জব কী বাত কেন?’ প্রশ্নটা করেছেন রূপেন মজুমদার, ‘সুইসাইড যদি হয় তা হলে তো এরকমটাই হওয়ার কথা—’ রূপেন মজুমদার এখনও বোধহয় এই ব্যাপারটাকে আত্মহত্যা ছাড়া আর কিছু বলে ভাবতে পারছিলেন না।
‘এইরকম ভোলাটাইল মেমোরি নিয়ে আপনি ডিটেকটিভ ফিকশন লেখেন!’ ব্যঙ্গের হাসি হাসল রঘুপতি যাদব : ‘একটু আগেই তো নীচে স্যার আপনাদের বললেন, ইটস আ কেস অফ মার্ডার—প্লেইন অ্যান্ড সিম্পল। সেইজন্যেই বলেছি তাজ্জব কী বাত।’
উৎপলেন্দু সেন মাথা ঝুঁকিয়ে সিগারেট ধরালেন। তারপর বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন, বললেন, ‘প্রশান্তবাবু তো শুনলাম দরজা ভেঙে এ-ঘরে ঢুকেছেন। তারপর কেউ এসে চাবিটা টেবিলের ওপরে রেখে যায়নি তো?’
অশোকচন্দ্র গুপ্ত উৎপলের কথার জবাব দিলেন, ‘না, সেরকম কোনও সুযোগ ছিল না। এক্সিকিউটিভ ম্যানেজারের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। পুলিশ না আসা পর্যন্ত এই ঘরের দরজায় কড়া পাহারা ছিল। আমাদের অন্য কিছু ভাবতে হবে, উৎপলেন্দুবাবু।’
উৎপলেন্দুর দিশেহারা অভিব্যক্তি দেখে ভাস্কর রাহা এই প্রথম কথা বললেন, ‘অর্থাৎ, ইম্পসিবল প্রবলেম—জন ডিকসন কার।’
ভাস্কর রাহা মন্তব্যটি করেছিলেন নীচু গলায়। কিন্তু অশোকচন্দ্রের প্রখর কান সেটা শুনতে পেয়েছে। আর উৎপলেন্দু রাহার কাছাকাছি থাকায় তাঁরও শুনতে কোনও অসুবিধে হয়নি।
পায়চারি থামিয়ে একটা সোফায় নিজেকে ডুবিয়ে দিলেন এসিজি। পাকা চুলের গোছায় বাঁ হাতের আঙুল ডুবিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে মুচকি হাসলেন তিনি : ‘চমৎকার বলেছেন, ভাস্করবাবু। জন ডিকসন কার। ডিকসন কার নিজের নামে অথবা কার্টার ডিকসন ছদ্মনামে সারাজীবন শুধু ”অসম্ভব রহস্য” নিয়েই গল্প-উপন্যাস লিখে গেছেন। ব্যবহার করেছেন দুই গোয়েন্দা : ড. গিডিয়ন ফেল, আর স্যার হেনরি মেরিভেল।’ একটু থামলেন অশোকচন্দ্র, সকলের মুখের দিকে একবার তাকালেন : ‘…সুতরাং ভাস্করবাবু, একটা জিনিস তো আপনি ভালোই জানেন…এই ইম্পসিবল প্রবলেমগুলোর সমাধান খুব সাদামাঠা হয়। আমার ধারণা, দেবারতি মানির বেলাতেও এই জেনারাল রুলের কোনও হেরফের হবে না। শুধু প্রবলেমটা সলভ করতে একটু সময় লাগবে, এই যা।’
উৎপলেন্দু আর ধৈর্য ধরতে পারলেন না। বেশ বিরক্তভাবে বলে উঠলেন, ‘সেই কাল রাত থেকে এর-ওর মুখে শুনে আসছি দেবারতি খুন হয়েছে। আবার দু-একজন বলছেন সুইসাইড। আজ সকালে আপনারা বললেন ব্যাপারটা খুন—তার ডেফিনিট প্রমাণ আপনারা পেয়েছেন। অথচ দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকতে হয়েছে। দরজার চাবি পাওয়া গেছে ওই টেবিলে। এরপরেও যদি ব্যাপারটা সুইসাইড না হয়, তা হলে কোথায় সেই ডেফিনিট প্রমাণ? আমার ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে।’
কথা শেষ করার পরেও উৎপলেন্দুর মুখ সামান্য লাল। তা ছাড়া কথা বলার সময়ে বিরক্তি ছাড়াও কিছুটা রাগের ছোঁওয়া পাওয়া গিয়েছিল তাঁর ভঙ্গিতে।
উৎপলেন্দুর কথা শেষ হতেই শুরু হল নিস্তব্ধতা।
ভাস্কর রাহার চুরুট নিভে গিয়েছিল। সেটা তিনি ছাই ঝেড়ে পকেটে ঢোকালেন। এসিজি চুপচাপ তাঁর হাতের সিগারেটের অগ্নিবিন্দুর দিকে তাকিয়ে। রূপেন মজুমদার বেশ অপ্রস্তুত—কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। আর রঘুপতি যাদব জরিপ নজরে উৎপলেন্দুকে দেখছে।
নীরবতা ভেঙে প্রথম কথা বলল সে-ই।
‘ওয়ান্ডারফুল! ইনভেস্টিগেশনে হেল্প করার মতো এই প্রথম একটা ইমোশনাল রিঅ্যাকশান পাওয়া গেল।’ তারপর অশোকচন্দ্রের দিকে ফিরে, ‘স্যার, ইসকে বারে মে আপকা কেয়া রায় হ্যায়? এসবই তো আমরা চাই—ইমোশন্যাল রিঅ্যাকশন। কারণ এরকম জোশ থেকেই হয়তো মিস মানি খুন হয়ে গেছেন।’
এসিজি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার আগেই ঘরের টেলিফোন বেজে উঠল।
এবার ভাস্কর রাহা রিসিভার তুললেন।
রঘুপতি যাদব যথারীতি চটপটে পা ফেলে এগিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু রাহা টেলিফোনের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ছিলেন। পরাস্ত রঘুপতি ‘ফোঁস’ করে একটা শব্দ করল। ভাস্কর রাহা আড়চোখে ইন্সপেক্টরকে একবার দেখলেন, তারপর টেলিফোনে কথা বললেন। ঘরের সিলিং-এ আধুনিক ডিজাইনের পাখা ঘুরছিল। তার বাতাসে ভাস্কর রাহার চওড়া কপালে শনের মতো চুল উড়ছিল।
ও-প্রান্ত থেকে প্রশান্ত রায় কথা বলছিলেন, ‘ডাইনিং হলে আসার দরকার নেই। ছ’জনের ব্রেকফাস্ট পাঠাচ্ছি। তিনশো আট নম্বরে। ওকে?’
‘পাঠিয়ে দিন,’ বলে রিসিভার নামিয়ে রাখলেন রাহা। ভাবলেন, এক্সিকিউটিভ ম্যানেজারসাহেব এখনও টেলিগ্রাফিক ল্যাঙ্গুয়েজের ছক থেকে বেরোতে পারেননি। পুলিশি ধমক বলে কথা!
ব্রেকফাস্টের খবরটা সকলে শুনলেন।
উৎপলেন্দুর একটু অস্বস্তি হচ্ছিল। অকালমৃত এক তরুণীর ঘরে বসে ব্রেকফাস্ট! কিন্তু রাহা তা ভাবেননি। দেবারতির ঘরে ব্রেকফাস্ট খেলে ও ভীষণ খুশি হত। প্রাণ ভরে গল্প করত ‘মুকুটহীন সম্রাট’-এর সঙ্গে। গল্পে গল্পে সময় কেটে যেত।
এখন তফাতের মধ্যে শুধু ও নেই।
উৎপলেন্দু সেনের প্রশ্নটা তখনও ঘরের বাতাসে ভাসছিল। তাঁর দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে থেকে অশোকচন্দ্র রঘুপতিকে বললেন, ‘রঘুপতি, আর চেপে রেখে লাভ নেই। মিস মানির লেখাটা ওঁদের পড়ে শোনাও—।’
‘দেবারতি মানির লেখা!’ রত্নাবলী রীতিমতো অবাক হয়ে গেলেন : ‘কী লেখা? সুইসাইড নোট?’
‘সুইসাইড নোটই বটে—’ তেতো হাসলেন অশোকচন্দ্র। তারপর রঘুপতিকে ইশারা করলেন কাজ শুরু করতে।
রঘুপতি যাদব তার হাতের কাগজপত্র একটা সোফার ওপরে নামিয়ে রেখেছিল। ব্যস্ত পায়ে সেদিকে এগিয়ে গেল। কয়েক সেকেন্ড সেগুলো হাঁটকে একটা ফুলস্ক্যাপ কাগজ বের করে নিল। তারপর পায়ে পায়ে এসে দাঁড়াল ঘরের মাঝখানে। বলল, ‘এই কাগজটা আমরা পেয়েছি ওই গোল টেবিলের ওপরে—’ আঙুল তুলে জানলার কাছে রাখা টেবিলটা দেখাল রঘুপতি : ‘…চাবিটা যেখানে ছিল, সেইখানে। ওই টেবিলে বহত সারে কাগজাত ছিল। ওই সব কাগজাতের ভেতর থেকে এই শিটটা আমরা পেয়েছি। এতে মিস মানির হাফ ফিনিশড একটা লেখা রয়েছে। সেটাই আপনাদের পড়ে শোনাচ্ছি।’
সিগারেট আর চুরুটের ভারি গন্ধে হালকা পারফিউমের গন্ধ কখন যেন ঢাকা পড়ে গেছে। রূপেন মজুমদার, উৎপলেন্দু সেন, রত্নাবলী মুখোপাধ্যায় আর ভাস্কর রাহা—এই চারজন প্রবীণ লেখক একরাশ কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে রয়েছেন রঘুপতি যাদবের দিকে।
রঘুপতি যাদব পড়তে শুরু করল।
‘বাংলা ডিটেকটিভ ফিকশন কখনও এরকম সাকসেসফুল জায়গায় আসবে সেটা সাত-আট বছর আগেও কেউ ভাবেনি। পনেরো-বিশজন লেখকের অক্লান্ত চেষ্টার পুরস্কার বলেই এটাকে মানতে হবে। অবশ্য তার সঙ্গে সম্পাদক আর প্রকাশকের ভূমিকাও রয়েছে। ওঁরা প্যাট্রনাইজ না করলে লেখকরা কী করে সামনে আসতেন!
‘এইসব চেষ্টার পাশাপাশি চলেছে রেডিও-টিভির পাবলিসিটি। তার ওপর যোগ হয়েছে এই অ্যানুয়াল কনফারেন্স। বলতে গেলে বাংলা ক্রাইম ফিকশনের এখন আর কোনও অভাব নেই। শিক্ষিত পাঠকও এটাকে এখন অ্যাকসেপ্ট করেছে। এটা আমার দারুণ তৃপ্তির জায়গা! ব্লিসফুল স্যাটিসফ্যাকশন।
‘রহস্য-সাহিত্য নিয়ে আন্দোলনের ব্যাপারটাকে আমি বরাবর শ্রেণি-সংগ্রাম হিসেবে দেখেছি। মেইনস্ট্রিম লিটারেচারের সঙ্গে একই সারিতে কখনও একে জায়গা দেওয়া হয়নি। কুলিন ব্রাহ্মণের সঙ্গে একই সারিতে কি হরিজনকে বসানো যায়! জন্মসূত্র ধরেই মানুষকে যেমন জাতপাতের বিভেদের মধ্যে ঠেলে দেওয়া হয়, এটার বেলাতেও যেন ঠিক তাই : জন্মসূত্রেই রহস্য-সাহিত্য তৃতীয় শ্রেণির সাহিত্য। এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্যে নাক উঁচু সমালোচকদের কোনও যুক্তির দরকার হয় না। এ তো সবাই জানে, যুক্তি দেখাতে গেলে শিক্ষা-দীক্ষা প্রয়োজন। সুতরাং অশিক্ষিত সমালোচকের কাছে যুক্তির চেয়ে মতামতই হল বড় হাতিয়ার।
‘এরকম একটা অবস্থা থেকে যে-করে হোক সেই ‘হরিজন’ তার জায়গা করে নিতে পেরেছে ‘কুলীন ব্রাহ্মণ’-এর পাশে। নিশ্চয়ই কাজটা খুব সহজে হয়নি। যারা জানে তারা জানে।
‘এরকম একটা সিচুয়েশনে একটা খবর আমাকে চমকে দিল। একজন বিশ্বাসঘাতক লেখক হাজির রয়েছে এই কনফারেন্সে। খবরটা আমি যার কাছ থেকে শুনেছি তা মোটেই মিথ্যে হওয়ার নয়। ইটস ট্রুথ—বিটার ট্রুথ। আমি…।’
উর্দি পরা দুজন বেয়ারা ব্রেকফাস্ট নিয়ে ঘরে এসে ঢুকতেই থেমে গেল রঘুপতি। আয়তাকার ব্রেকফাস্ট টেবিলে খাবার-দাবারগুলো নামিয়ে নীচু গলায় ‘ম্যানেজারসাব পাঠিয়ে দিলেন।’ বলে তারা চলে গেল।
চোখের সামনে খাবার দেখে খিদেটা টের পেলেন সকলে। ভাস্কর রাহা রত্নাবলীর দিকে একপলক তাকালেন। এবং সঙ্গে-সঙ্গেই ‘বাংলা সাহিত্যের আগাথা ক্রিস্টি’ প্রথাগত বাঙালি গৃহিণী হয়ে গেলেন। খাবারের প্লেটগুলো সাজিয়ে গুছিয়ে তুলে দিতে লাগলেন প্রত্যেকের হাতে।
রঘুপতি যাদব আবার পড়তে শুরু করল,
‘…আমি যে তাঁকে চিনে ফেলেছি সেটা প্রথমটায় বুঝতে দিইনি। কিন্তু তাঁর ইন্টারভিউ নেবার সময় তিনি বোধহয় আমার ঘেন্না রাগ এগুলো সাসপেক্ট করতে পেরেছেন। তবে আই ডোন্ট কেয়ার। আজ রাতেই আমি সেই লেখককে সরাসরি সব জানিয়ে দেব। জানিয়ে দেব, কনফারেন্সের শেষ দিনে ডায়াসে উঠে আমি তাঁর সবকিছু ফাঁস করে দেব। এরকম একটা শয়তানির পানিশমেন্ট হওয়া দরকার। তা ছাড়া এতগুলো বছর ধরে…।’
থামল রঘুপতি। বলল, ‘লেখাটা এখানেই শেষ।’ তারপর কাগজটা আবার রেখে দিল অন্যান্য কাগজপত্রের সঙ্গে।
রত্নাবলী ওর হাতে ব্রেকফাস্টের প্লেট তুলে দিলেন। তারপর নিজের প্লেটটা নিয়ে এসিজির কাছাকাছি একটা সোফায় বসলেন।
অশোকচন্দ্র হাতের সিগারেট অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিয়ে খাওয়া শুরু করে দিয়েছিলেন। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছিল চিন্তায় ডুবে আছেন।
বাকি সবাই চুপচাপ খাচ্ছিলেন। বোধহয় ভাবছিলেন দেবারতির শেষ লেখাটার কথা। কে সেই বিশ্বাসঘাতক লেখক? কী বিশ্বাসঘাতকতা করেছে সে?
‘লেখাটা আর একটু থাকলে হয়তো জানা যেত দেবারতি মানি কোন লেখক সম্পর্কে অভিযোগ করছিল।’ খেতে-খেতেই হঠাৎ বললেন রূপেন মজুমদার।
এই মন্তব্যের জবাব দিল রঘুপতি : ‘লেখাটার শেষের দিকে দু-লাইন মতো হিজিবিজি করে কেটে দেওয়া। সেখানে কী লেখা ছিল কিছুতেই বোঝা যাচ্ছে না। তবে আমরা কালি কমপেয়ার করে দেখেছি—কাটাকুটিটা মিস মানির পেন দিয়েই করা হয়েছে। হো সকতা হ্যায় কে মিস মানি লাইন দুটো কেটে দিয়েছেন, নহী তো…’
‘তার মার্ডারার—’ রঘুপতির অসম্পূর্ণ কথা শেষ করলেন রত্নাবলী।
‘অ্যাবসোলিউটলি কারেক্ট, মিসেস মুখার্জি।’ এসিজি বললেন। তারপর ঘুরে তাকালেন উৎপলেন্দু সেনের দিকে : ‘মিস্টার সেন, এটাই আমাদের ডেফিনিট প্রমাণ। আশা করি আপনার আর কোন সংশয় নেই। তবে এ ছাড়াও বাড়তি কয়েকটা ইনডায়রেক্ট প্রূফ আমাদের হাতে আছে। যেমন, ওই টেবিলে একটা বই আধখোলা অবস্থায় পড়ে ছিল—’
‘কী বই?’ প্রশ্ন করলেন রূপেন মজুমদার।
ভাস্কর রাহাও কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে রইলেন অশোকচন্দ্রের দিকে। খুন হওয়ার আগে কী বই পড়ছিল মেয়েটা?
অশোকচন্দ্রের খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। তৃপ্তির ছোট্ট শব্দ তুলে তিনি সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। হাতের খালি প্লেটটা ব্রেকফাস্ট টেবিলের এক কোণে রেখে মিসেস মুখোপাধ্যায়ের দিকে তাকালেন। মুখে সৌজন্যের হাসি ফুটিয়ে অনুরোধের সুরে বললেন, ‘মিসেস মুখার্জি, যদি কাইন্ডলি আমাদের চায়ের ব্যবস্থাটা করেন—।’
টেবিলে টি-পট, মিল্ক পট, শুগার কিউব এবং সুদৃশ্য পেয়ালা-পিরিচের সেট রাখাই ছিল। সুন্দর করে হেসে আরও একবার গৃহিণী হয়ে গেলেন রত্নাবলী। তাঁকে দেখে মনেই হচ্ছিল না, তাঁর বয়েস আর কোনওদিন পঁয়ষট্টিতে পা দেবে না। তিনি সপ্রতিভভাবে চলে এলেন ব্রেকফাস্ট টেবিলের কাছে। চায়ের আয়োজন শুরু করলেন।
‘মিস্টার গুপ্ত, কী বই পড়ছিল দেবারতি?’ ভাস্কর রাহা প্রশ্ন করলেন এবার।
অশোকচন্দ্র মাথার চুলে হাত চালালেন। আপন খেয়ালেই মাথা নাড়লেন এপাশ ওপাশ। তারপর বললেন, ‘খুব ইন্টারেস্টিং বই। ”দ্য মার্ডার অফ রজার অ্যাকরয়েড”—আগাথা ক্রিস্টির লেখা।’ একটু থেমে মাথাটা বাঁ দিকে সামান্য হেলিয়ে এসিজি আচমকা প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন : ‘বইটা ইন্টারেস্টিং বললাম কেন বলুন তো?’
তৎক্ষণাৎ জবাব দিলেন উৎপলেন্দু সেন, ‘ ”ড. ওয়াটসন” অ্যাজ মার্ডারার—এটাই বইটার বিশেষত্ব। যে-চরিত্র ”আমি” হয়ে গল্পটা বলছে, সে-ই খুনি। আর মজা হল, গল্প বলার সময় খুন করার ব্যাপারটাও সে কায়দা করে পাঠককে বলে গেছে।’ একটু থেমে উৎপল ব্যঙ্গের হাসি হেসে বললেন, ‘আরও একটা কারণে বইটা উল্লেখযোগ্য—।’
‘কেন?’ জিগ্যেস করেছে রঘুপতি যাদব।
উৎপল উত্তর দিলেন অশোকচন্দ্রের দিকে তাকিয়ে, ‘এই বইটা থেকে গল্প মেরে বিখ্যাত লেখক নীহাররঞ্জন গুপ্ত ”ঘুম নেই” নামে একটা ”ওরিজিন্যাল” উপন্যাস লিখে গেছেন।’ খুকখুক করে হেসে কথা শেষ করলেন উৎপলেন্দু সেন।
রত্নাবলী একে-একে সকলের হাতে চায়ের কাপ তুলে দিয়েছেন, নিজেও নিয়েছেন। তারপর বসেছেন গিয়ে দেবারতির বিছানায়।
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে এসিজি বললেন, ‘উৎপলেন্দুবাবু দেখছি নির্ভুল খবর রাখেন। আর আপনি বলেছেনও ঠিক : এই বইটা আগাথা ক্রিস্টির অন্য সব বইয়ের চেয়ে আলাদা। সেইজন্যেই ব্যাপারটা আমার কাছে ইন্টারেস্টিং বলে মনে হয়েছে।’
‘এবারে আসা যাক দেবারতি মানির লেখাটার প্রশ্নে—’ শব্দ করে কাপে চুমুক দিলেন অশোকচন্দ্র : ‘লেখাটা থেকে আমরা কয়েকটা বেসিক ইনফরমেশন পাচ্ছি। এক : দেবারতি মানির চোখে আপনাদের দশজনের মধ্যে একজন বিশ্বাসঘাতক—বেইমান। সুতরাং, শুনতে খারাপ লাগলেও এই কনফারেন্সে ইনভাইটেড দশজন লেখকের মধ্যে কোনও একজন দেবারতিকে—খুন করেছেন…।’
রূপেন মজুমদার একটু-একটু করে ভয় পাচ্ছিলেন। ভয় পাচ্ছিলেন ভাস্কর রাহাও। ধীরে-ধীরে, একটু-একটু করে, ওঁদের উলঙ্গ সত্যের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। প্রকাশক, সম্পাদক আর সাংবাদিকরা সন্দেহের আওতার বাইরে চলে গেলেন। বাকি রইলেন দশজন লেখক। শুধু দশজন লেখক।
‘ভাস্করবাবু, কোথাও একটা ভুল হচ্ছে। আমাদের মধ্যে কেউ এই জঘন্য কাজ করতে পারে না।’ রূপেন মজুমদার নীচু গলায় নিজের অবিশ্বাসের কথা ভাঙলেন রাহার কাছে।
ভাস্কর রাহা কিছু বলে ওঠার আগেই জ্বলে উঠল রঘুপতি যাদব। বেপরোয়া সুরে সে বলে উঠল, ‘মিস্টার রাইটার, ডোন্ট ট্রাই টু প্লে সন্ত যুধিষ্টির। এখানে সন্ত কেউ নেই—সারে কে সারে পাপী হ্যায়। কিঁউ, গুপ্তাসাব?’ শেষের কথাটা এসিজিকে উদ্দেশ্য করে, তাঁর সমর্থনের আশায়।
রত্নাবলী একটু সিঁটিয়ে গেলেন। উৎপলেন্দুর গলাটা কেমন শুকিয়ে গেছে। একটু ভিজিয়ে নিতে পারলে ভালো হত।
এসিজি এবারে আর উত্তেজিত রঘুপতিকে সামাল দেবার চেষ্টা করলেন না। বরং রঘুপতির কথা যেন শুনতেই পাননি এমন ভান করে বলে চললেন, ‘ফ্যাক্ট নাম্বার টু : যে-ই হোক একজন দেবারতি মানিকে সেই খবরটা দিয়েছে। তিন : দেবারতি সেই বেইমান লেখকটিকে চিনত। চার—দেবারতি তার ইন্টারভিউ নিয়েছে। ঠিক কবে কখন ইন্টারভিউটা ও নিয়েছিল সেটা লেখা না থাকলেও অনুমানে মনে হয়, গত দু-দিনের মধ্যে এই হোটেলেই ও ইন্টারভিউটা নিয়েছে। কারণ, ওর কাগজপত্র ঘেঁটে আমরা কিছু শর্টহ্যান্ড নোটস পেয়েছি—সেগুলো আমরা ডিসাইফার করতে ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টে পাঠিয়েছি।’
একটু দম নিলেন এসিজি। চায়ের কাপ খালি হয়ে গিয়েছিল। সেটা টেবিলে আলতো করে নামিয়ে রেখে উদাস চোখে তাকালেন জানলার বাইরে। সেখানে দূরের ঘরবাড়ি, টিভি অ্যান্টেনা, পাম গাছের পাতা, নীল আকাশ আর চড়া রোদ্দুর। জানলার দিকে পিঠ দিয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন তিনি। শান্ত স্বরে শেষ কয়েকটা কথা বললেন, ‘লাস্ট এবং পাঁচ নম্বর ইনফরমেশন হল, কাল রাতে হয়তো সেই বিশ্বাসঘাতকের সঙ্গে দেবারতির একটা মোকাবিলা হয়েছিল। হয়তো এই ঘরেই। তারপর…তারপর ”নটে গাছটি মুড়োল”।’
ঘরের সবাই চুপ। শুধু কারও কারও চায়ের কাপে শেষ চুমুকের শব্দ।
কিছুক্ষণ পর অশোকচন্দ্র পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরালেন। তার প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে সিগারেট এবং চুরুট ধরালেন উৎপলেন্দু এবং ভাস্কর। ওঁদের দুজনের কপালেই চিন্তার ছাপ। নাকি দুশ্চিন্তার ছাপ?
কুলকুল করে ধোঁয়া ছাড়লেন অশোকচন্দ্র। কাশির দমক এল হঠাৎ। কাশলেন কয়েকবার। ঊর্মিলা সামনে থাকলে নির্ঘাত হাত থেকে সিগারেটটা ছিনিয়ে নিত। ওর মায়ের স্বভাব পেয়েছে। ওর মা চলে গেছে প্রায় ন’বছর। কিন্তু এই একটা ব্যাপারে ঊর্মিলা সেই শূন্যস্থানটা বুঝতে দেয়নি। অথচ হাতে জ্বলন্ত সিগারেট না থাকলে কি থিঙ্কিং মেশিন কখনও কাজ করতে পারে!
অনেকক্ষণ পর অশোকচন্দ্র গুপ্ত কথা বললেন আবার, ‘আমাদের যা বলার মোটামুটি বললাম। এবার আপনাদের পালা। ভাস্করবাবু, আপনাকে দিয়ে কি আমরা এখনই শুরু করতে পারি?’
ঘরের কার্পেটের দিকে তাকিয়ে চিন্তায় একেবারে ডুবে ছিলেন ভাস্কর রাহা। এসিজির কথায় চমকে উঠে ফিরে তাকালেন তাঁর দিকে। দুচোখে প্রশ্ন।
এসিজি আবার কথাটা বললেন।
অদ্ভুত হতাশার ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন ভাস্কর রাহা। ক্লান্ত স্বরে বললেন, ‘বলুন, কী জানতে চান।’
ঘটনার সবচেয়ে নোংরা অস্বস্তিকর অংশ শুরু হল তাহলে এইবার। ভাবলেন রত্নাবলী। কিন্তু মিস্টার গুপ্ত কি আমাদের সামনেই ভাস্করবাবুকে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন? আলাদাভাবে হলে কি ব্যাপারটা ভালো হত না!
অশোকচন্দ্র একটা সোফা টেনে নিলেন বিছানার দিকে, ভাস্কর রাহার কাছাকাছি। মেঝেতে কার্পেট থাকায় কোনওরকম শব্দ হল না। সোফায় আরাম করে বসে পায়ের ওপর পা তুলে সিগারেটে টান দিলেন। চোখ থেকে সরু ফ্রেমের চশমাটা খুলে শূন্যে উঁচু করে ধরে অদৃশ্য কিছু একটা দেখার চেষ্টা করলেন। তারপর চশমাটা আবার ঠিকঠাক করে বসালেন নাকের ওপরে। বারকয়েক নাক কুঁচকে ঘরের সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে ধীরে-ধীরে বললেন, ‘ভাস্করবাবু, আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই আবেগ আছে। একটু আগে উৎপলেন্দুবাবু সে-প্রমাণ দিয়েছেন। তা সেই আবেগগুলো হল ইলেকট্রিক পোটেনশিয়ালের মতো। দুটো মানুষের মধ্যে যখন সম্পর্ক তৈরি হয় তখন তাদের আচরণ কীরকম হবে সেটা নির্ভর করে তাদের পোটেনশিয়াল বা আবেগের ওপরে। অর্থাৎ, কোনও কন্ডাক্টরের দুটো পয়েন্টের মধ্যে পোটেনশিয়াল ডিফারেন্সের মান অনুযায়ী যেমন বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়—অনেকটা সেইরকম আর কী! আপনারা, লেখকরা, সাধারণত আবেগপ্রবণ মানুষ। আপনাদের প্রত্যেকের মধ্যেই রয়েছে তীব্র আবেগ—হাই পোটেনশিয়াল। এই তীব্র আবেগ থেকেই হয়তো ঘটে গেছে দেবারতি মানির খুনের ঘটনা। ঘটনার পর খুনি হয়তো অনুশোচনায় দগ্ধ হচ্ছে, অনুতাপে সে হয়তো মর্মাহত, কিন্তু…’ একটু থামলেন এসিজি। তারপর : ‘কিন্তু আমার কিছুই করার নেই। রঘুপতি যাদব অনেক আশা নিয়ে আমাকে ডেকে এনেছে।’
ভাস্কর রাহা নীরবে চুরুটে টান দিচ্ছিলেন। এসিজি তাঁকে এখনও কোনও প্রশ্ন করেননি। গল্পে-উপন্যাসে আর্মচেয়ার ডিটেকটিভরা প্রচুর প্রশ্ন করে থাকেন, অনেক জবানবন্দী আদায় করেন গোপনে। কিন্তু এই অহঙ্কারী পলিতকেশ বৃদ্ধ কোন পথে হাঁটতে চাইছেন?
‘ভাস্করবাবু, আপনারা লেখক মানুষ—’ আবার কথা শুরু করেছেন অশোকচন্দ্র, ‘খুন-খারাপি আপনাদের রোজকার অভ্যাসের ব্যাপার—মানে, কাগজে-কলমে। সুতরাং আপনারাই ভালো বুঝবেন, কোনও খুনের ঘটনায় কোন-কোন তথ্য তদন্তের পক্ষে জরুরি। আমি সেই তথ্যগুলোই আপনার কাছ থেকে জানতে চাইছি। পরে যদি নিতান্ত দরকার হয়, তখন দু-চারটে প্রশ্ন-টশ্ন করা যাবে।’
ভাস্কর রাহা নিজেকে গুছিয়ে নিলেন মনে-মনে। চুরুটে কয়েকবার ঘনঘন টান দিলেন। তারপর বললেন, ‘মিস্টার গুপ্ত, আপনার স্টাইলেই কয়েকটা বেসিক ইনফরমেশন আপনাকে দিই। কনফারেন্সের প্রথম দিন আমাকে একপাশে ডেকে নিয়ে গিয়ে দেবারতি বলে, ও একটা টপ সিক্রেট জানতে পেরেছে। সেটা জানাজানি হলে কনফারেন্স মাটি হয়ে যাবে, খবরের কাগজে ফ্রন্টপেজ নিউজ হবে। তবে দেবারতি তখন মদ খেয়েছিল, একটু টিপসি অবস্থায় ছিল। আমি ওকে বলেছিলাম, কনফারেন্স শেষ না হওয়া পর্যন্ত ও যেন কিছু না করে। যাই হোক, ও আমার কথায় রাজি হয়েছিল। আমার মনে হয়েছে, ওর সেই সিক্রেট ফাঁস হলে বাংলা ক্রাইম ফিকশনের মারাত্মক ক্ষতি হবে, একটা বিরাট সেটব্যাক হবে। ষাটের দশক থেকে এই সাহিত্য নিয়ে কম লড়াই হয়নি। দেবারতি সেদিনের মেয়ে—ও সে-সব লড়াইয়ের কী জানে! সুতরাং, আমি ভেবেছিলাম, পরে ওকে বুঝিয়ে নিরস্ত করব। কিন্তু সে সুযোগ আর পেলাম কোথায়!’
‘ওর এই সিক্রেট জেনে ফেলার খবরটা আপনি ছাড়া আর কে কে জানতেন? এসিজি প্রশ্ন করলেন।
ভাস্কর রাহা মাথা ঝুঁকিয়ে বসে ছিলেন, মুখ তুলে বললেন, ‘বোধহয় সবাই জেনে ফেলেছিল। কারণ, ও খুব একটা রাখো-ঢাকো মেয়ে ছিল না। তা ছাড়া ওর ভয়ডরও কম ছিল। যেমন, কনফারেন্সের দ্বিতীয় দিনে—মানে, কাল—ও একরকম হাটের মাঝে ওর সেই সিক্রেট নিয়ে প্রেমময় চৌধুরিকে একটু হিন্টস দিয়েছিল। ভারি অদ্ভুত হিন্টস—।’
কৌতূহল ফুটে উঠল অশোকচন্দ্রের উজ্জ্বল চোখে : ‘কী হিন্টস?’
‘শুধু দুজন লেখকের নাম—পাঁচকড়ি দে আর এডগার ওয়ালেস।’
এসিজি রঘুপতি যাদবের দিকে তাকালেন। রঘুপতি প্যাড আর পেন নিয়ে নোট নিতে ব্যস্ত ছিল। মুখ তুলে এসিজির সঙ্গে চোখাচোখি হতেই মাথা হেলিয়ে জানাল, সে লিখে নিয়েছে।
‘এই হিন্টসের মানে?’
‘কী জানি! বলতে পারব না। দেবারতি কখন যে সিরিয়াসলি কথা বলত আর কখন ঠাট্টা করত, সেটা বোঝা মুশকিল ছিল।’
‘আচ্ছা, এই কনফারেন্সের শুরুর দিন থেকে দেবারতি মানিকে যেভাবে দেখেছেন, যা যা ও করেছে, বলেছে—সেগুলো একটু গুছিয়ে বলুন তো।’
চুরুট নিভে গিয়েছিল। ছাই ঝেড়ে ফেলে সেটাকে পকেটে রেখে দিলেন রাহা। ছোট্ট করে গলাখাঁকারি দিয়ে নীচু গলায় অত্যন্ত ধীরে সব বলে গেলেন। অশরীরী দেবারতি মানি আবার চলেফিরে বেড়াতে লাগল ঘরের মধ্যে—অন্তত ভাস্কর রাহার চোখের সামনে।
ভাস্কর রাহার কথা শুনতে শুনতে উঠে দাঁড়িয়েছেন এসিজি। ফুরিয়ে আসা সিগারেটটা গুঁজে দিয়েছেন টেবিলের অ্যাশট্রেতে। তারপর মাথা নীচু করে একমনে শুনে গেছেন ভাস্করের কথা।
রাহার কথা শেষ হল একসময়। রত্নাবলী চোখ ঢেকে বসে রইলেন। রূপেন মজুমদার দাঁত দিয়ে নখ কাটছিলেন। আর উৎপলেন্দু কেমন এক অস্বস্তি অনুভব করছিলেন।
‘মিস মানি আপনার কোনও ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন?’
প্রশ্নটা করেছে রঘুপতি যাদব। দেবারতির শেষ লেখায় ইন্টারভিউর ব্যাপারে একটা ইঙ্গিত ছিল। বোঝাই যাচ্ছে, রঘুপতির সন্দেহভাজনের তালিকায় প্রথম স্থানটি এখনও পর্যন্ত কে দখল করে রয়েছে।
রাহা মুখ তুলে রঘুপতিকে দেখলেন। দেখে যতটা আই কিউ.র মালিক বলে মনে হয় আসলে তার চেয়ে বেশি।
শান্ত স্বরে ভাস্কর রাহা বললেন, ‘হ্যাঁ, কাল লাঞ্চের সময় ও আমার একটা ইন্টারভিউ নিয়েছিল। তখন আমরা একেবারেই মামুলি কথাবার্তা বলেছি। কারণ, দেবারতি সময়-সুযোগ পেলেই আমার ইন্টারভিউ নিত।’ একটু থেমে আবার মুখ খুললেন : ‘তবে দেবারতি আমার একার ইনটারভিউ নেয়নি। ও আমাকে বলেছিল, আমাদের দশজন লেখক-লেখিকার ইন্টারভিউ ও নেবে। তারপর সবগুলো মিলিয়ে একটা স্টোরি করবে ওর কাগজে—।’
‘সহযোগিতা করার জন্যে ধন্যবাদ, ভাস্করবাবু,’ এসিজি বললেন, ‘তবে এবার আপনাকে লাস্ট একটা রিকোয়েস্ট করব। আপনারা গোয়েন্দা কাহিনির লেখক—সুতরাং, বলতে গেলে আপনারা নিজেরাই এক-একজন গোয়েন্দা। যেমন, আপনার গোয়েন্দা সুরজিৎ সেন। দেবারতি মানিকে কেমন করে খুন করা হয়েছে সেটা আমি সুরজিৎ সেনের কাছে জানতে চাই। আশা করি আপনি এ-আর্জিটুকু মঞ্জুর করবেন।’
অশোকচন্দ্র গুপ্তের কথা বলার ঢঙে কৌতুক ছিল বটে, কিন্তু ঠাট্টা অথবা ব্যঙ্গ ছিল না।
সুতরাং রাহার চওড়া কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। সঙ্কোচ কাটিয়ে উঠতে কয়েক মিনিট সময় নিলেন। সচেতনভাবেই তিনি ইয়ান ফ্লেমিং-এর জেমস বন্ড আর ড্যাশিয়েল হ্যামেটের গোয়েন্দা স্যাম স্পেডের আদলে সৃষ্টি করেছেন সুরজিৎ সেনকে। অধ্যাপক অশোকচন্দ্র গুপ্ত যে সুরজিৎ সেনকে মনে রেখেছেন সেটা লেখকের পক্ষে যথেষ্ট শ্লাঘার বিষয়। সামান্য হেসে ক্রাইম কাহিনির অসামান্য লেখক থেমে-থেমে পেশ করলেন সুরজিৎ সেনের সমাধান।
‘সুরজিতের মনে প্রথম যে-প্রশ্নটা জাগত সেটা হল : এ-হোটেলের সব ঘরের লক একই চাবি দিয়ে খোলা যায় না তো! কারণ—।’
‘সরি, জনাব,’ রাহাকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠেছে ইন্সপেক্টর যাদব, ‘এক্সিকিউটিভ ম্যানেজারের কাছ থেকে আমরা ইনফরমেশন নিয়েছি। নো মাস্টার কি। আপনার কেতাবি জাসুসকে অওর একবার কৌশিশ করতে হবে, মিস্টার রাহা।’
রাহা রঘুপতি যাদবের দিকে একবার তাকিয়েছেন, তারপর ঠোঁটের এক চিলতে হাসি বজায় রেখেই বলেছেন, ‘তা হলে সুরজিতের প্রথম অনুমান ভুল হল। দ্বিতীয় চেষ্টা হিসেবে বলা যেতে পারে, খুনি কাজ সেরে বাইরে বেরিয়ে এসে শক্ত কোনও তার বা ওই জাতীয় কিছু দিয়ে তিনশো আট নম্বরের দরজা লক করে দেয়।’
মাথা নাড়লেন এসিজি : ‘সরি, ভাস্করবাবু। কাল রাতে আমি আর রঘুপতি হাতেকলমে সে-চেষ্টা করে দেখেছি, পারিনি। তা ছাড়া আতসকাচ দিয়ে তন্নতন্ন করে খুঁজেও আমরা দেবারতি মানির দরজার লকের গায়ে সন্দেহজনক কোনও আঁচড়ের দাগ দেখতে পাইনি।’
ভাস্কর রাহা একটু অপ্রস্তুত হলেন। তাঁর গালে রক্তের উচ্ছ্বাসের ছোঁওয়া লাগল। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে তিনি আবার বললেন, ‘ধরা যাক, দেবারতিকে খুন করার পর খুনি দরজার চাবিটা নিয়ে বেরিয়ে এল বাইরে। তারপর দরজা লক করে চাবিটা…বাইরের টেরাস থেকে ছুড়ে দিয়েছিল দেবারতির ঘরের জানলা দিয়ে। তখনই চাবিটা গিয়ে পড়ে জানলার কাছে রাখা টেবিলের ওপরে।’
কিন্তু কথা শেষ করেই আপনমনে এপাশ ওপাশ মাথা নাড়লেন ভাস্কর রাহা। বললেন, ‘নাঃ, এই সলিউশনটা বড্ড কষ্টকল্পিত…’
‘হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন, ‘ রত্নাবলী বলে উঠলেন তড়িঘড়ি করে, ‘নীচের টেরাস থেকে পাঁচতলার ঘরের জানলা দিয়ে চাবি ছুড়ে দেওয়াটা হয়তো অসম্ভব নয়, তবে অবাস্তব। তা ছাড়া কেউ দেখে ফেলার ভয়ও রয়েছে। বিশেষ করে মেয়েটা নীচে পড়ার সময় যখন অমন সাঙ্ঘাতিক একটা শব্দ হয়েছে।’
‘কারেক্ট অবজারভেশন, মিসেস মুখার্জি,’ বললেন অশোকচন্দ্র, ‘সুতরাং সুরজিৎ সেন হার মানলেন।’ হাসলেন তিনি : ‘তবুও সহযোগিতার জন্যে ধন্যবাদ, ভাস্করবাবু।’
একমাত্র কাতিলই জানে কীভাবে সে মেয়েটাকে কোতল করেছে। ভাবল রঘুপতি। আর জানলেও স্যারের কথায় সে থোড়াই অ্যাকচুয়াল সলিউশনটা বলবে! বরং উলটোপালটা আজগুবি কোনও থিয়োরি ঝটপট বাতলে দেবে।
সাত
সিগারেট শেষ হয়ে গিয়েছিল। এটা নতুন সিগারেট ধরালেন এসিজি। এভাবেই পুরোনোরা পুড়ে ছাই হয়—নতুন আসে তার শূন্যস্থান পূরণ করতে। দেবারতির জায়গাও কেউ একজন দখল করে নেবে। কিন্তু ওর মা? ভদ্রমহিলা সম্পর্কে এসিজি সংক্ষেপে যতটুকু জেনেছেন, তাতে দুঃখ হয়। ওঁর লড়াই কখনও বিশ্রাম পেল না। স্বামী আর একমাত্র মেয়ের শ্মশানে ওঁকে শ্মশানবন্ধু হতে হল। আর বেঁচে থাকার জন্য এখনও ওঁকে নীল আলোয় শরীর দুলিয়ে গান গেয়ে সকলের মনোরঞ্জন করতে হবে।
ঘরের প্রত্যেকেই অশোকচন্দ্রের কথা বলার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। কয়েক মিনিট একমনে সিগারেটে টান দিয়ে তিনি ইশারায় রঘুপতি যাদবকে কাছে ডাকলেন। যাদব তার হাতের কাগজপত্র একটা সোফায় নামিয়ে রেখে পেন পকেটে গুঁজে এগিয়ে এল এসিজির কাছে।
‘তুমি লালবাজারে ফোন করে দেবারতি মানির পোস্ট মর্টেম রিপোর্টটা তাড়াতাড়ি রেডি করার জন্যে একটু তাগাদা দাও। আজ রাতের মধ্যেই পেলে ভালো হয়। বুঝতেই পারছ, ”সুপ্রভাত” পত্রিকা এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে। আর শোনো, লাঞ্চের পর আমরা দশজন রাইটারের দশটা রুম একটু ঘুরেফিরে দেখব—।’
‘আমাদের রুম সার্চ করবেন?’ রূপেন মজুমদার আহত স্বরে জিগ্যেস করলেন।
অশোকচন্দ্র তাঁর দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, ‘এটাকে ঠিক সার্চ বলা যায় না। কারণ, কী খুঁজতে হবে সেটাই আমার জানা নেই।’
রঘুপতি যাদব ঘরের টেলিফোনের কাছে এগিয়ে গেল। রিসিভার তুলে রিসেপশনে লালবাজারের লাইন চাইল।
রত্মাবলী অশোকচন্দ্রকে দেখছিলেন। বয়েসে তাঁর চেয়ে হয়তো দু-চার বছরের ছোটই হবেন, কিন্তু কী অদ্ভুত পরিশ্রম করতে পারেন!
এছাড়া আরও একটা ব্যাপার তাঁকে অবাক করছিল। এরই মধ্যে কতরকম তথ্য জোগাড় করে ফেলেছেন ভদ্রলোক। সব তথ্য খতিয়ে দেখে একটা তত্ত্বে সেগুলোকে খাপ খাওয়াতে হবে। তবেই মিলবে অঙ্কের উত্তর। তখন উনি নিষ্ঠুর তর্জনী তুলে ধরবেন দশজনের মধ্যে একজনের দিকে। অশোকচন্দ্রকে দেখে রত্মাবলী কেমন এক ভরসা পাচ্ছিলেন। উনি নিশ্চয়ই পারবেন বেচারি মেয়েটার খুনিকে ধরতে। কিন্তু করঞ্জাক্ষ রুদ্র হলে কি পারত?
ভাস্কর রাহা উসখুস করছিলেন। হঠাৎই যেন ভীষণ ক্লান্ত মনে হচ্ছে নিজেকে। ঘরে গিয়ে একটু বিশ্রাম নিতে পারলে ভালো হত।
এসিজি বোধহয় ব্যাপারটা টের পেয়েছিলেন। ভাস্কর রাহার দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, ‘আপনি ইচ্ছে হলে এখন যেতে পারেন, ভাস্করবাবু। পরে দরকার হলে আমি দুশো আট নম্বর ঘরে যাব। আপনি অনেক তথ্য দিয়ে আমাকে সাহায্য করেছেন।’
রত্নাবলী এইবার জিগ্যেস না করে পারলেন না : ‘কিন্তু এইসব তথ্য আপনি মাথায় রাখেন কী করে?’
রত্নাবলীর দিকে তাকিয়ে মোলায়েম করে হাসলেন এসিজি : ‘মিসেস মুখার্জি, এ-ব্যাপারে আমার পদ্ধতি হুবহু শার্লক হোমসের মতো। অন্তত সেভাবে চেষ্টা করি। যেসব তথ্য আমার কোনওদিনও কাজে লাগবে না, সেগুলো আমি মন থেকে মুছে ফেলার আপ্রাণ চেষ্টা করি। যেমন, আলু-পেঁয়াজের দাম, কলকাতার জনসংখ্যা, কিংবা চাঁদের মাটিতে প্রথম কোন মহাকাশচারী পা দিয়েছিলেন। এর কারণ, আমাদের ব্রেন হল একটা ছোট্ট ঘরের মতো। সেটা আমরা পছন্দসই ফার্নিচার—মানে, তথ্য—দিয়ে সাজিয়ে নিতে পারি। সুতরাং সব তথ্যই যদি সেখানে গাদাগাদি করে ঢোকাই তাহলে দরকারি তথ্যটা সেই ভিড়ে হারিয়ে যেতে পারে। তখন সেটা কাজের সময় খুঁজে পেতে কষ্ট হয়। সেইজন্যে আমি খুব হিসেব করে সেই ঘরে নতুন ফার্নিচার ঢোকাই। কারণ, ঘরের দেওয়ালগুলো তো আর রবারের নয় যে চাইলেই জায়গা বেড়ে যাবে! বরং একটা ব্যাপারে আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন—ব্রেনে তথ্য সঞ্চয় করতে-করতে এমন একটা সময় আসবে, যখন নতুন কোনও তথ্য ঢোকানো মানেই হচ্ছে পুরোনো কোনও তথ্যকে বিসর্জন দেওয়া। অর্থাৎ, নতুন তথ্যটা মনে থাকবে বটে, কিন্তু পুরোনোটা কমপ্লিটলি ভুলে যাবেন।’
‘দারুণ বলেছেন, মিস্টার গুপ্ত—’প্রশংসার সুরে বললেন রূপেন মজুমদার।
বিনয় করে হাসলেন অশোকচন্দ্র : ‘আগেই তো বলেছি, এটা আমার কথা নয়, গোয়েন্দা-সম্রাট শার্লক হোমসের কথা। ”আ স্টাডি ইন স্কারলেট”-এ আছে। আপনারা সবাই নিশ্চয়ই পড়েছেন—হয়তো ভুলে গেছেন।’
‘না, না, আমি পড়িনি।’ রূপেন মজুমদার তাড়াতাড়ি তাঁর মৌলিকত্ব জাহির করলেন।
অশোকচন্দ্র বিস্মিত চোখে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলেন।
‘আমি তাহলে উঠছি,’ বলে উঠে দাঁড়ালেন ভাস্কর।
এসিজি আবার তাঁকে ধন্যবাদ জানালেন।
উৎপলেন্দু সেনও বোধহয় উঠতে যাচ্ছিলেন, এসিজি তাঁকে বাধা দিলেন : ‘আপনি বসুন, মিস্টার সেন। আপনার সঙ্গে তো এখনও সেরকম কথা বলাই হয়নি।’ উৎপলেন্দু বসে পড়লেন। তাঁর চোখেমুখে অস্বস্তি অত্যন্ত স্পষ্ট। খানিকটা অসহায়ভাবে তিনি ভাস্কর রাহার চলে যাওয়া দেখলেন।
সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে এসিজি উৎপলেন্দু সেনকে প্রথম প্রশ্ন করলেন, ‘দেবারতি মানিকে কীভাবে খুন করা হয়েছে বলে আপনার মনে হয়?’
‘বোধহয় কেউ ধাক্কা-টাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে। ‘দায়সারা উত্তর দিলেন উৎপল। তারপর আবার বললেন, ‘আসলে অনেকদিন আমি কোনও গোয়েন্দা গল্প লিখিনি। কারণ, গোয়েন্দা গল্প লিখতে হলে একটু বড় জায়গা দরকার—ততটা জায়গা কোনও পত্রিকা দিতে চায় না। মানে, আমাকে দিতে চায় না।’
উৎপলের কথার মধ্যে প্রচ্ছন্ন তেতো হতাশা সূক্ষ্মভাবে যেন অনুভব করতে পারলেন অশোকচন্দ্র। কিছুক্ষণ কী ভাবলেন, তারপর বললেন, ‘ঠিক আছে একটা কথার সরাসরি জবাব দিন…দেবারতিকে কে খুন করেছে?’
কে খুন করেছে সেটা উৎপলেন্দুর জানা নেই। কিন্তু যে-ই করুক, কাজটা কি খুব একটা খারাপ হয়েছে! তা ছাড়া, সত্যিই যদি উৎপলেন্দু সেন খুনিকে চিনতেন, তাহলেও কি এ-প্রশ্নের জবাবে ফস করে বলে দিতেন খুনির নাম! মনে মনে হাসলেন তিনি। মুখে বললেন, ‘কে খুন করেছে জানি না। তবে আমরা যখন গোয়েন্দা গল্প লিখি তখন এমন কাউকে খুনি সাজাই যাকে কেউ কখনও খুনি বলে ভাবতেই পারবে না। ওই ”দ্য মার্ডার অফ রজার অ্যাকরয়েড”-এর মতো।’
‘বেশ বলেছেন,’ ছোট্ট করে মন্তব্য করলেন অশোকচন্দ্র গুপ্ত। তারপর—’দেবারতি মানি আপনার কোনও ইন্টারভিউ নিয়েছিল?’
‘হ্যাঁ, নিয়েছিল। লেখালিখি নিয়ে সাধারণ কিছু প্রশ্ন—।’
‘ও.কে.। থ্যাংক ইউ,’ উৎপলেন্দুকে ধন্যবাদ জানালেন সহযোগিতার জন্য। তারপর রূপেন মজুমদারকে লক্ষ করে একই কথা জানতে চাইলেন—কীভাবে খুন করা হয়েছে দেবারতিকে।
রূপেন মজুমদার জিভের ডগা দিয়ে মাড়ির দাঁত খোঁচাচ্ছিলেন। এসিজির প্রশ্নে ছোট্ট করে একটা জড়ানো শব্দ করলেন। তারপর পকেট থেকে কয়েকটা সুপুরির কুচি বের করে মুখে ছুড়ে দিলেন। কয়েক সেকেন্ড চোয়াল নেড়ে বললেন, ‘মিস্টার গুপ্ত, কোনও সাহেবী আইডিয়া ধার করে আমি আপনাকে কিছু বলব না—যা বলব সবই নিজের। আমার প্রথম বই ”ডাকিনীর হাতছানি”-তে এই ধরনের একটা খুন ছিল। একটা বন্ধ ঘরের ভেতরে একজন যুবতী নিহত হয়ে পড়ে আছে। তার বুকে ছুরির গভীর ক্ষতচিহ্ন। কিন্তু দরজায় খিল আঁটা আর জানলায় বেশ ঘন মোটা মোটা গরাদ। মেয়েটি মরে পড়ে আছে জানলা থেকে অনেক দূরে। মানে, একটু আগে আপনি যা বললেন—ইমপসিবল প্রবলেম। কিন্তু ওই জন ডিকসন কার নামে কোনও এক সাহেবের কথা আপনি যে বললেন, তাঁর বই পড়া তো দূরের কথা, তাঁর নামই আমি কোনওদিন শুনিনি। আমার ব্যাপারটা সবসময়েই ওরিজিন্যাল। নইলে আমাদের একটা হ্যাংলাপনা আছে দেখবেন, সাহেবদের কথা গদগদ হয়ে মেনে নেওয়া। সাহেব বলিয়াছেন, তাই উহা সত্য…।’
নিজের রসিকতায় নিজেই হাসলেন রূপেন মজুমদার। আড়চোখে রত্নাবলী আর উৎপলেন্দুকে একবার দেখে নিয়ে আবার বললেন, ‘স্পষ্ট কথা বললাম বলে কিছু মনে করবেন না জানেন, সাহেবদের লেখার প্রভাবের জন্যেই আমাদের বাংলা ক্রাইম ফিকশানকে কেউ আমল দিতে চায় না। ভাবে, আমরা সবাই চোর। সেইজন্যেই তো আমার সব বইতেই লেখা থাকে, কাহিনিটি সম্পূর্ণ মৌলিক—।’
রত্নাবলী বেশ বুঝতে পারছিলেন, রূপেন মজুমদারের কথার খোঁচাটা তাঁকে লক্ষ করে যতটা উৎপলেন্দুকে লক্ষ করে ততটা নয়। আর উৎপলেন্দু হতবাক হয়ে রূপেন মজুমদারের নির্লজ্জ ঢাক পেটানো দেখছিলেন। সম্পূর্ণ অপরিচিত দুজন লোকের সামনে কেমন অনায়াসে নিজেকে জাহির করছেন। আজকের যুগে নির্লজ্জতাও বোধহয় একটা আর্ট।
রূপেন মজুমদারের অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্যে বিরক্ত হচ্ছিলেন এসিজি। কিন্তু পেশেন্টদের ওপর বিরক্ত হওয়া নার্সদের ধর্ম নয়। কারণ গূঢ় রোগলক্ষণগুলো জানতে হলে ধৈর্য ধরে পেশেন্টের সব কথা শুনতে হয়। সুতরাং মজুমদারের কথা শেষ হতেই তিনি জিগ্যেস করলেন, ‘কিন্তু আপনার ওই প্রথম বইতে যুবতীটি খুন হয়েছিল কীভাবে?’
‘ ”ডাকিনীর হাতছানি” আপনি পড়েননি?’ অবাক হওয়া হাসিতে মুখ ভরিয়ে রূপেন বললেন, ‘ঠিক আছে, আপনাকে এক কপি প্রেজেন্ট করব। আমার ঘরে বই আছে।’ তারপর খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা রঘুপতি যাদবের দিকে তাকিয়ে : ‘আপনাকেও এক কপি দেব। পড়ে দেখবেন। এমন নতুন সব আইডিয়া দিয়েছি যে, তাজ্জব হয়ে যাবেন।’
রঘুপতি যাদব পাথরের মূর্তির মতো চুপচাপ দাঁড়িয়ে এতক্ষণ সকলের কথা শুনছিল। কোনও মন্তব্য করেনি। কিন্তু রূপেনের কথার পর সে আর চুপ করে থাকতে পারল না। রূঢ় গলায় বলে উঠল, ‘আপনার ওই কিতাবের মতো আপনার ব্রেনটাও কি ঘরে জমা করে এসেছেন, মজুমদারবাবু? স্যার আপনাকে তখন থেকে কী জিগ্যেস করছেন তা আপনার মাথায় ঢুকছে না?’
রূপেন মজুমদার চোখের পলকে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন। আমতা-আমতা করে এসিজিকে বললেন, ‘খুনটা হয়েছিল জানলা দিয়ে। ছুরির হাতলে নাইলনের দড়ি বেঁধে খুনি ছুরিটা ছুড়ে মেরেছিল মেয়েটাকে লক্ষ করে। তারপর কাজ হাসিল হয়ে যেতেই দড়ি টেনে ছুরিটা নিয়ে পালিয়ে গেছে।’
‘বাঃ, কায়দাটা বেশ নতুন তো! ডিকসন কারের কোনও গল্পে এরকম ইনজিনিয়াস মোডাস অপার্যানডাই-এর কথা বলা নেই—’ প্রশংসা করলেন রত্নাবলী। কিন্তু উৎপলেন্দুর যেন মনে হল, ওঁর প্রশংসার মধ্যে কোথায় যেন বিদ্রূপের তীর লুকোনো রয়েছে।
প্রশংসায় রূপেন মজুমদার খানিকটা বেপরোয়া হয়ে ঢাক পেটাতে শুরু করলেন : ‘তাহলেই দেখুন, ওই সাহেবের চেয়ে বুদ্ধিতে আমি কিছু কম যাই না! তা ছাড়া আমার গল্পে এরকম গরাদ ছাড়া জানলা আর দু-দিক থেকেই লক করা যায় এমন সাহেবী দরজা ছিল না। এসব থাকলে খুনের কায়দা তৈরি করা তো জলের মতো সহজ!’ নাটকীয়ভাবে একটু থামলেন রূপেন মজুমদার। তৃপ্তির অহঙ্কার আর এক চিলতে হাসি তাঁর চোখেমুখে। পাতলা হয়ে আসা মাথার চুল ডান হাতের আলতো ছোঁয়ায় ঠিক করে নিলেন। তারপর সরাসরি তাকালেন এসিজির চোখে।
এসিজি বেশ বুঝতে পারছিলেন, অহঙ্কারে ভদ্রলোকের আলুথালু অবস্থা। অফিসে রূপেন মজুমদারের অধীনে যাঁরা কাজ করেন তাঁদের হয়তো বাধ্য হয়ে ওঁর লেখা বই কিনতে হয়। আর অসহায়ভাবে সবিস্তারে শুনতে হয় একজন মৌলিক প্রতিভার নানান কৃতিত্বের কথা।
‘ওই জলের মতো সহজ ব্যাপারটা যদি দয়া করে আমাদের খুলে বলেন—’, অশোকচন্দ্র বিনয়ের সুরে কথাটা বলেছেন বটে, কিন্তু সেটা যে পুরোপুরি বিনয় নয় তা বুঝতে কোনও অসুবিধে হয় না।
রূপেন মজুমদার নির্বিকার ভঙ্গিতে জবাব দিলেন, ‘কেন, খুনি খুন করেছে, ঘরের দরজা ভেতর থেকে লক করেছে। তারপর চাবিটা ওই টেবিলের ওপরে রেখে জানলা দিয়ে পালিয়ে গেছে। এ-হোটেলের কোনও ঘরের জানলাতেই গরাদ নেই—ওটাই তো সাহেবি জানলার সুবিধে।’
গতকাল রাতে ঘটনাস্থলে এসে সবকিছুই খুঁটিয়ে দেখেছেন এসিজি। রূপেন মজুমদার যত সহজ ভাবছেন, এই ঘরের জানলা দিয়ে পালানো তত সহজ নয়। কারণ জানলার বাইরে কার্নিশ বলতে কিছু নেই। তা ছাড়া জানলা দিয়ে পালাতে গেলে নীচে দাঁড়ানো লোকজনের চোখে পড়ে যাওয়ার ভয় আছে।
যেসব কিছু না বলে এসিজি ধন্যবাদ জানালেন মৌলিক রহস্য-লেখককে।
উৎপলেন্দু অনেকক্ষণ ধরেই উসখুস করছিলেন কিছু একটা বলার জন্য। এখন ফাঁক বুঝে কথা বললেন, ‘রূপেনবাবু, একটা কথা তখন থেকে ভাবছি। আপনার ”ডাকিনীর হাতছানি”-তে খুনি ওই নাইলনের দড়ি বাঁধা অবস্থায় ছুরিটা ঠিকমতো টিপ করে ছুড়তে পারল!’
রূপেন মজুমদার বিজ্ঞের মতো হেসে চটপট জবাব দিলেন, ‘খুনি তো সার্কাসের নাইফ-থ্রোয়ার ছিল, সেইজন্যেই ব্যাপারটা ইজি হয়ে গেছে। আপনাকে তো ”ডাকিনীর হাতছানি” বই দিয়েছিলাম, পড়েননি?’
উৎপলেন্দু একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘আমার ভাইপোকে পড়তে দিয়েছিলাম। ওর খুব ভালো লেগেছিল। তারপর ও যে কাকে পড়তে দিল…’ রূপেন মজুমদার গম্ভীর হয়ে গেলেন। এসিজিকে লক্ষ করে বললেন, ‘আমি একটু উঠব। ঘরে যেতে হবে। কাজ আছে।’
‘একটা কথা, মিস্টার মজুমদার। কাল বা পরশু দেবারতি কি আপনার কোনও ইন্টারভিউ নিয়েছিল?’
ভাস্কর রাহার মন্তব্য মনে পড়ল রূপেন মজুমদারের। তাই বললেন, ‘হ্যাঁ, পাঁচ-দশ মিনিট কথা বলেছিল। একেবারেই, মামুলি ইন্টারভিউ।’
‘ঠিক আছে, এবার আপনি যেতে পারেন,’ এসিজি রূপেন মজুমদারকে অনুমতি দিলেন। তখন উৎপলও অস্পষ্টভাবে এসিজিকে কী যেন বললেন। তারপর রূপেন মজুমদার আর উৎপলেন্দু সেন রওনা হলেন ঘরের দরজার দিকে।
যেতে-যেতে রূপেন উৎপলেন্দুকে বলছিলেন, ‘বুঝলেন, ওয়ার্কশপের জন্যে একটা নতুন আইডিয়া ভেবেছি। এমন লিখব না, সাহেবদেরও তাক লেগে যাবে…।’
ভদ্রলোকের ‘সাহেব’ নিয়ে অবসেশনটা এল কোথা থেকে? ভাবছিলেন উৎপলেন্দু। ওঁর অফিসের ডিরেক্টরদের মধ্যে দু-তিনজন সত্যিকারের সাহেব এখনও আছে বলে ওঁর মুখেই শুনেছেন। অবসেশনটা সেই কারণে বলে তো মনে হয় না। তাহলে কি রূপেন মজুমদার আগের জন্মে-স্বাধীনতা-সংগ্রামী ছিলেন?
অশোকচন্দ্র গুপ্ত আবার নতুন সিগারেট ধরিয়েছেন। ঘরের সিলিং-এর দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে ধোঁয়া ছাড়ছিলেন। এর মধ্যেই অনেক তথ্য পেয়েছেন তিনি। কিন্তু সব তথ্যের সঠিক অর্থ এখনও স্পষ্ট নয়। তার জন্য কিছুটা হোমওয়ার্ক দরকার।
তিনি সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পায়চারি করছিলেন। রঘুপতি যাদব দূর থেকে তার ‘স্যার’-কে লক্ষ করছিল। সে গোয়েন্দা কাহিনির তেমন ভক্ত না হলেও এটুকু বুঝতে পারছে, স্যারের এবারের লড়াইটা অন্যরকম। যাঁরা কাগজে-কলমে সকাল বিকেল ‘খুন’ করেন, সেরকম দশজন লেখকের সঙ্গে বুদ্ধির লড়াই। কাল রাত থেকে এখন, এই মুহূর্ত পর্যন্ত রঘুপতি কম নোটস নেয়নি। সেগুলো ঠান্ডা মাথায় বসে খতিয়ে দেখা দরকার। দেবারতি মানি ‘সুপ্রভাত’-এর আপকামিং ক্রাইম জার্নালিস্ট ছিল। নেহাত কম বিখ্যাত ছিল না। আজকের সব কাগজেই ওর মারা যাওয়ার খবর ছাপা হয়েছে। তবে এখনও পর্যন্ত ব্যাপারটাকে ‘আত্মহত্যা’ বা ‘দুর্ঘটনা’-র মোড়কে রাখা হয়েছে। তা ছাড়া এই খুনের সুপারফাস্ট সলিউশনের জন্য পলিটিক্যাল প্রেসারও আসতে শুরু করেছে।
অশোকচন্দ্রকে দেখে বিভ্রান্ত বলে মনে হচ্ছিল। অতএব রঘুপতি যাদবও মোটামুটি দিশেহারা। তবে এটা ঠিক, আর দু-তিন দিনের মধ্যে যদি সে কাউকে অ্যারেস্ট করতে না পারে তাহলে প্রচুর ঝামেলা হবে, হইচই হবে।
রত্নাবলী মুখোপাধ্যায় কেমন এক টেনশনে ভুগছিলেন। উৎপলেন্দু আর রূপেন চলে যাওয়ার পর থেকেই তাঁর ভীষণ একা একা লাগছে। ভুরুর কাছটা টনটন করছে। বোধহয় চশমার পাওয়ার পালটেছে। আর বুকের ভেতরটা কেমন ধড়ফড় করছে। গত সপ্তাহে ডাক্তার দেখিয়েছিলেন। এখন সেই ওষুধ চলছে। গাদা-গুচ্ছের ট্যাবলেট। ঘড়িতে প্রায় সাড়ে বারোটা বাজে। দুপুরে সামান্য কিছু খেয়ে ওষুধ খেতে হবে। তারপর বিশ্রাম। আজ আর কনফারেন্সে যাবেন না। তাতে খুব একটা ক্ষতিও নেই। কারণ আজ তাঁর শুধু শ্রোতার ভূমিকা। কিন্তু কেন যেন শরীরটা ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। এখন অশোকচন্দ্র তাঁকে কী জিগ্যেস করবেন কে জানে!
‘মিসেস মুখার্জি’, এসিজি পায়চারি থামিয়ে ঘুরে তাকিয়েছেন রত্নাবলীর দিকে : ‘জানি, আপনার খুব ক্লান্ত লাগছে। তাই পাঁচ মিনিট কথা বলেই আপনাকে আমি ছেড়ে দেব। আপনার কাহিনির নায়ক গোয়েন্দা করঞ্জাক্ষ রুদ্রের নাম আজ সব পাঠকের মুখে মুখে ফেরে। আপনার খ্যাতি প্রায় কিংবদন্তীর পর্যায়ে চলে গেছে। করঞ্জাক্ষ রুদ্র ক্ষুরধার বুদ্ধির মালিক হলেও আসলে সে-বুদ্ধি আপনারই কাছ থেকে ধার করা। সুতরাং আপনার কাছেই আমি জানতে চাইছি, দেবারতি কীভাবে খুন হয়েছে।’
রত্নাবলী একেবারে বালিকার মতো অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন, যেন চাকরির ইন্টারভিউতে তাঁকে খুব শক্ত প্রশ্ন করা হয়েছে। শাড়ির নীল পাড়ের কাছটায় আলতো করে নখের আঁচড় কাটতে লাগলেন।
কিছুক্ষণ পর বিব্রতভাবে হেসে তিনি মিহি গলায় বলতে শুরু করলেন, ‘মানে, এক্ষুনি হুট করে কিছু বলা সম্ভব নয়…তবে…ইয়ে, ভেবে দেখা যেতে পারে।’ আবার কিছুক্ষণ সময় নিয়ে তারপর : ‘ধরা যাক, খুনি দেবারতির সঙ্গে ওর ঘরে ছিল। আর, ঘরের দরজা ভেতর থেকে লক করা ছিল। একথা-সেকথা বলতে বলতে ওরা দুজনে ওই জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। তারপর খুনি আচমকা ওকে এক ধাক্কা মেরে জানলা দিয়ে ফেলে দেয় নীচে। খুনের ঠিক পরেই খুনি ভয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ে। তাই টেবিলের আধখোলা বই বা কাগজপত্রের দিকে ঠিকমতো খেয়াল করেনি। সোজা দরজা খুলে সে চলে এসেছে বাইরে। দরজায় চাবি দিয়ে চলে গেছে নিজের ঘরে।’
‘লেকিন ওই টেবিলের ওপরে যে-চাবিটা পাওয়া গেল সেটা এল কোথা থেকে—’ প্রশ্ন করেছে রঘুপতি।
ওর দিকে সরল চোখে তাকালেন রত্নাবলী। আলতো গলায় বললেন, ‘খুনি একটা নকল চাবি তৈরি করে সেটা দিয়ে দরজা লক করে চলে গেছে। আর আসল চাবিটা রেখে গেছে ওই টেবিলের ওপরে।’
অশোকচন্দ্র বেশ একটু হতাশভাবেই দেখছিলেন রত্নাবলীকে। ওঁর গল্প-উপন্যাসে করঞ্জাক্ষ রুদ্রের যে-ক্ষুরধার বুদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায় সেই তুলনায় এই সমাধানটা যেন বড্ড সাদামাঠা। অবশ্য ডিকসন কারের বইতেও বন্ধ ঘরের রহস্যের এ-জাতীয় সাদামাঠা সমাধানই পাওয়া যায়। কিন্তু তা হলেও…। বরং অবাস্তব হলেও রূপেন মজুমদারের ‘ডাকিনীর হাতছানি’-র সমাধান অনেক অভিনব।
এসিজি জিভ দিয়ে ছোট্ট একটা শব্দ করলেন। মাথা দুলিয়ে বললেন, ‘ধন্যবাদ, মিসেস মুখার্জি। তবে আমার ধারণা, দেবারতি মানির খুনের ঘটনা ঘটে গেছে হঠাৎই। মানে, আগে থেকে কোনওরকম পরিকল্পনা খুনির ছিল না। যদি সত্যিই তাই হয়ে থাকে তা হলে নকল চাবি তৈরি করার ব্যাপারটা খুব সলিড গ্রাউন্ডের ওপরে দাঁড়াচ্ছে না।’ একটু চুপ করে থেকে অস্পষ্ট স্বরে তিনি বললেন, ‘হয়তো দেবারতি মানির সিক্রেট যাতে ফাঁস না হয়, তার জন্যেই খুনিকে খুনটা করতে হয়েছে। ওই সিক্রেটটা জানতে পারলেই খুনের মোটিভ আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে যাবে।’
রত্নাবলী কোনও কথা বললেন না। হঠাৎই ঘুমে তাঁর চোখ জড়িয়ে আসছিল। ভাবছিলেন, ‘কখন শেষ হবে এই জিজ্ঞাসাবাদ? দেবারতিকে নিয়ে এত কথা এত আলোচনা আর একটুও ভালো লাগছে না। নিজে খুন হয়ে মেয়েটা আমাদের কী বিপদেই না ফেলে গেছে!’
‘আচ্ছা মিসেস মুখার্জি, এই কনফারেন্সে যেসব রাইটার এসেছেন তাঁদের কারও সঙ্গে মিস মানির ইশক ছিল—মানে, ভালোবাসা ছিল?’ নীল আকাশ থেকে বজ্রপাতের মতো প্রশ্নটা ছুড়ে দিয়েছে রঘুপতি।
এ-ব্যাপারে এসিজি গতকালই হোটেলের লোকজনের কাছে খোঁজখবর নিয়েছেন। তাতে মোটামুটিভাবে একটা নাম তিনি পেয়ে গেছেন। তাই সে-বিষয়ে লেখকদের কাউকে আর কোনও প্রশ্ন করেননি। কিন্তু রঘুপতি বোধহয় সে-ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হতে চায়।
স্পষ্টতই রত্নাবলীর ফরসা মুখ লালচে হয়। কয়েক সেকেন্ড মাথা নীচু করে বসে রইলেন তিনি। তারপর আমতা-আমতা করে বললেন, ‘সেরকমভাবে কিছু জানি না, তবে…রঞ্জন দেবনাথের সঙ্গে ওকে প্রায়ই দেখা যেত। আপনারা রঞ্জন দেবনাথকে বরং জিগ্যেস করে দেখবেন—।’
রত্নাবলী মুখোপাধ্যায়ের সুন্দর মন আর শালীনতাবোধ এসিজিকে অবাক করল। মাথার চুলের গোছায় টান মেরে তিনি বললেন, ‘আপনার এই ডিসেন্সি নিয়ে কী করে আপনি ওইসব ভয়ঙ্কর প্যাঁচালো গোয়েন্দা-কাহিনিগুলো লেখেন! ভাবতে অবাক লাগে, মিসেস মুখার্জি।’
রত্নাবলী মুখ তুলে সরাসরি দেখলেন বৃদ্ধ হুনুরের দিকে। ধীরে ধীরে বললেন, ‘মিস্টার গুপ্ত, আমরা, গোয়েন্দা-কাহিনির লেখকরা, বোধহয় অদ্ভুত জাতের মানুষ। কাগজে-কলমে তাঁরা অনায়াসে ভয়ঙ্কর সব ঘটনা ঘটাতে পারেন। কিন্তু বাস্তবে ওইসব ঘটনার মুখোমুখি হলে তাঁরা আপাদমস্তক শিউরে ওঠেন। ফলে অদ্ভুত এক পরস্পর-বিরোধী মানসিকতা নিয়ে তাঁদের দিন কাটাতে হয়…।’
‘না, না, সবাই তা নন,’ আপত্তি জানিয়ে মাথা নাড়লেন এসিজি। সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বললেন, ‘সবাই যে একরকম হয় না তার জলজ্যান্ত প্রমাণ দেবারতি। ও খুন হয়ে প্রমাণ করে দিয়েছে, আপনাদের দশজন লেখকের মধ্যে অন্তত একজন কাগজ-কলম হোক কিংবা বাস্তব, দু-জায়গাতেই অনায়াসে খুন করতে পারেন।’
‘কী শকিং ভাবুন তো!’ রত্নাবলীর মুখে ভয়ের ছায়া পড়ল।
‘শকিং—কিন্তু সত্যি।’ ঠান্ডা গলায় বললেন অশোকচন্দ্র। তারপর একটু সময় নিয়ে : ‘দেবারতি কি কাল-পরশু আপনার কোনও ইন্টারভিউ নিয়েছিল, মিসেস মুখার্জি?’
‘হ্যাঁ, কাল রাত আটটা সাড়ে আটটা নাগাদ ও আমার ঘরে এসেছিল কথা বলতে। নেহাতই সাধারণ কথাবার্তা হয়েছিল। নাইনটি ওয়ান আর নাইনটি টু-তে পরপর দু-বছর রবীন্দ্র পুরস্কারের ফাইনাল লিস্টে আমার একটা উপন্যাসের নাম উঠেছিল। সেটা নিয়েই ও বেশি কথাবার্তা বলেছিল…আমার রিঅ্যাকশন জানতে চাইছিল।’
‘ধন্যবাদ, মিসেস মুখার্জি। আপনি ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন বোঝাই যাচ্ছে। এখন গিয়ে খেয়েদেয়ে বিশ্রাম নিন। দরকার হলে পরে কথা বলব।’
অতএব ‘সভা’ শেষ।
লোহার পায়ে ঘরের কার্পেট অতিক্রম করে দরজার কাছে এলেন রত্নাবলী। মনে হল যেন দরজা পেরোলেই মুক্তি। কিন্তু কিসের হাত থেকে মুক্তি?
দরজা পেরিয়ে করিডর। তারপর শ্লথ পায়ে সিঁড়ির দিকে। তাঁর ঘরটা পাঁচতলায়, না পাঁচশো তলায়? ভুরুর কাছটা এখনও ব্যথা করছে। আর মনে পড়ছে বেপরোয়া প্রাণোচ্ছল মেয়েটার কথা। কাল রাতে ইন্টারভিউ নেবার সময় ব্যক্তিগত আক্রমণই ছিল দেবারতির প্রধান হাতিয়ার। মনেই হচ্ছিল না, কনফারেন্সের প্রথম দিনে মেয়েটা তাঁর গল্পের অমন প্রশংসা করেছিল।
ঘড়িতে তখন কটা হবে? সাড়ে সাতটা কি পৌনে আটটা। নিজের ঘরে অনামিকার সঙ্গে বসে কথা বলছিলেন, এমন সময় দরজার কলিংবেল বেজে উঠেছে।
অনামিকা উঠে গিয়ে দরজা খুলেই দেখে দেবারতি মানি। একটা কালো কর্ডের প্যান্ট আর হলুদ টি-শার্ট পরে আছে। হাতে সিগারেট।
ওকে দেখে হাসল দেবারতি। একটু ভারি গলায় বলল, ‘হাই—।’
অনামিকাকে পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকে এল দেবারতি। কোনওরকম ভূমিকা না করেই বলল, ‘মিসেস মুখার্জি, আপনার একটা ইন্টারভিউ নিতে এলাম। আপনাদের সবার ইন্টারভিউ নিয়ে একটা স্টোরি করব।’
রত্নাবলী হেসে ওকে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন, আর অনামিকাকে বলেছেন, ‘অনামিকা, তোমার সঙ্গে পরে কথা বলব। ওঁর সঙ্গে কাজটা একটু সেরে নিই।’
অনামিকা আর দাঁড়ায়নি, চলে গেছে নিজের ঘরে। দেবারতি মেয়েটাকে দেখলেই ওর কেমন অস্বস্তি হয়। ওর সামনে থেকে সরে গিয়ে অনামিকা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।
এরপর শুরু হয়েছে ইন্টারভিউ।
টেলিফোন করে রুম সার্ভিসকে কফি দিতে বলেছেন রত্নাবলী। দেবারতির মদ খাওয়ার দুর্বলতা তিনি জানেন…সকলেই জানে। কিন্তু রত্নাবলী কফির কথাই বললেন, কফির বদলে হুইস্কি বললে সৌজন্যটা বদলে যেতে পারে তোয়াজে। অন্তত লোকে তাই ভাববে।
কাগজ-কলম আর জ্বলন্ত সিগারেট যুত করে বাগিয়ে প্রথম প্রশ্ন করল দেবারতি, ‘আপনার লেখায় বিদেশি প্রভাব কতটুকু, মিসেস মুখার্জি?’
হাসলেন রত্নাবলী : ‘এমন নয় যে বলা যাবে চুরি করেছি। মানে, স্টাইল, ফর্ম এসবের প্রভাব আছে।’
‘মেইনস্ট্রিম লিটারেচার ছেড়ে হঠাৎ এই অপরাধ-সাহিত্যে এলেন কেন?’
‘ভালো প্রশ্ন করেছেন।’ কপালের ওপর থেকে চুল সরিয়ে দিলেন রত্নাবলী : ‘ছোটবেলা থেকেই দেখতাম বাড়িতে ”মাসিক রোমাঞ্চ” পত্রিকা রাখা হত। ওগুলো পড়তাম। ভালো লাগত। তারপর হঠাৎই, ১৯৪৬ নাগাদ, হাতে এল ”রহস্য রোমাঞ্চ”—সম্পাদক বিমল কর—গত বিশ বছর ধরেই যিনি মেইনস্ট্রিম লিটারেচারের ফিনোমিনন। এই পত্রিকার গল্পগুলো পড়ে বেশ অন্যরকম লাগল। তখন আমার বয়স কত? এই উনিশ কি বিশ। মনে হল, লেখালিখি করলে এইরকম গল্প-টল্পই লিখব। তারপরই আমি টুকটাক লিখতে শুরু করি। বছর তিন-চারেকের মধ্যে কয়েকটা গল্প ছাপাও হল ”মাসিক রোমাঞ্চ” পত্রিকায়।’ সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ ভাবলেন রত্নাবলী। তারপর : ‘ঠিক মনে পড়ছে না…বোধহয় পঞ্চাশের দশকের গোড়ায় সাহিত্যিক কমলকুমার মজুমদার ”তদন্ত” নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করেছিলেন। তখন আমি মোটামুটি লিখি। ওই কাগজে আমার একটা গল্প বেরিয়েছিল—।’
মুচকি হেসে দেবারতি জিগ্যেস করল, ‘এই সাহিত্য করেন বলে কোনওরকম ইনফিরিয়ারিটি কমপ্লেক্সে ভোগেন?’
মিষ্টি শব্দ করে হাসলেন রত্নাবলী। বললেন, ‘কেন, কমপ্লেক্সে ভুগব কেন? শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, বিমল কর, কমলকুমার মজুমদার, সমরেশ বসু—এঁরা যখন রহস্য-গোয়েন্দা সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তখন আমার ইনফিরিয়ারিটি কমপ্লেক্সটা আসবে কোথা থেকে! বরং সুপিরিয়ারিটি কমপ্লেক্স যদি আমার থাকত তাহলে সেটা খুব একটা দোষের হত না।’
দেবারতি খুশি হয়ে হাসল। তারপর বলল, ‘আপনার গল্পগুলো পড়ে আপনাকে যেরকম ইন্টেলিজেন্ট মনে হয় আসলে আপনি ততটা ইন্টেলিজেন্ট নন। আই. কিউ.-র ঘাটতি আছে। এর কারণ কী?’
অপমানে মুখ লাল হয়ে গেছে রত্নাবলীর। কী জবাব দেবেন এই অভদ্র দোআঁশলা ক্রাইম জার্নালিস্টের অশালীন প্রশ্নের? রাগে কপালের পাশের শিরা দপদপ করে উঠেছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও কাণ্ডজ্ঞান হারাননি রত্নাবলী। সংযত গলায় বলেছেন, ‘আপনার মনে হওয়ার ওপরে তো আমার হাত নেই—।’
হাসল দেবারতি মানি : ‘কার পেছনে কখন কোন হাত থাকে কে জানে!’
কী বলতে চাইছে মেয়েটা? কাল কনফারেন্সে এই মেয়েটাই না হাততালি দিয়ে তাঁর গল্পের প্রশংসা করছিল!
দরজায় মিষ্টি সুরে কলিংবেল বেজে উঠল।
এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে দরজার কাছে চলে গেল দেবারতি। দরজা খুলল। কফি এসে গেছে। উর্দি পরা বেয়ারা কফির কাপ সাজিয়ে দিয়ে গেল রত্নাবলীর সামনে, টেবিলের ওপরে।
দেবারতি ফিরে এল নিজের জায়গায়। কোনও কথা না বলে কফির কাপ তুলে নিয়ে চুমুক দিল।
আবার শুরু হল প্রশ্ন : ‘আপনার লেখায় এত পুরুষালী ভাব কেন?’
‘কী করে জানব! এরকম কথা আগে কেউ বলেনি।’
‘প্রেমময় চৌধুরির সঙ্গে এককালে আপনার সম্পর্ক ছিল?’
হাসলেন রহস্য-সম্রাজ্ঞী : ‘ছিল কেন, এখনও আছে—লেখক সম্পাদক সম্পর্ক।’
‘ও—’ একটু থমকে গেল দেবারতি মানি। তারপর : ‘তা হলে রঞ্জন দেবনাথের সঙ্গে সম্পর্কটা কিসের?’
মেয়েটা আমার মনের ক্ষতচিহ্নগুলো বেছে নিচ্ছে একে একে। আচ্ছা, মানুষ এত নিষ্ঠুর হয় কেন? রঞ্জন দেবনাথের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক তিনি কখনও অস্বীকার করেননি, এখনও করলেন না। সেকথাই স্পষ্ট করে বললেন সাংবাদিককে।
সিগারেটে গভীর টান দিয়ে গলগল করে ধোঁয়া ছাড়ল দেবারতি। তারপর থুতনি সামান্য উঁচু করে বলল, ‘ধরুন, আপনাকে রবীন্দ্র পুরস্কার দিয়ে আবার কেড়ে নেওয়া হল। তখন আপনার কেমন লাগবে?’
হঠাৎ কেন যেন বিস্ফোরণ ঘটে গেল রত্নাবলীর মাথার ভেতরে। অপমানে লাল চোখমুখ নিয়ে কাঁপা হোঁচট খাওয়া গলায় বললেন, ‘ধরুন, এক্ষুনি আপনাকে গলা ধাক্কা দিয়ে এই ঘর থেকে বের করে দেওয়া হল। তখন আপনার কেমন লাগবে?’
জ্বলন্ত সিগারেটটা কফির কাপে আচমকা ডুবিয়ে দিল দেবারতি। ‘ছ্যাঁক’ করে শব্দ হল একটা। তারপর ঘাড় কাত করে তাকাল : ‘নাঃ, আপনার আই. কিউ. সত্যিই কম! সেটা এখন আরও বেশি করে বোঝা যাচ্ছে।’
রত্নাবলী আর থাকতে পারলেন না। সপাং করে মুখের মতো জবাব দিলেন, ‘আই. কিউ. কী করে বাড়বে বলুন! আমার মা তো আর হোটেলে গান গাইত না—আর বাবারও মদের দোকান ছিল না!’
‘নীচুজাতের গালাগালিতে সাংবাদিকদের ধৈর্য হারালে চলে না,’ উঠে দাঁড়িয়েছে দেবারতি : ‘নমস্কার, মিসেস মুখোপাধ্যায়। আবার আমাদের দেখা হবে—সময় মতো।’
কথা শেষ করে আর দাঁড়ায়নি দেবারতি। হনহন করে চলে গেছে দরজার বাইরে। আর যাওয়ার সময় দড়াম করে বন্ধ করে দিয়ে গেছে ঘরের দরজা।
এরই নাম সাধারণ কথাবার্তা! একটু আগে অশোকচন্দ্রকে তিনি সেরকমই বলেছেন।
‘আপনার এই ডিসেন্সি নিয়ে কী করে আপনি ওই সব ভয়ঙ্কর প্যাঁচালো গোয়েন্দা-কাহিনিগুলো লেখেন! ভাবতে অবাক লাগে, মিসেস মুখার্জি।’
অশোকচন্দ্র গুপ্ত বিজ্ঞানী হতে পারেন, গোয়েন্দা হতে পারেন—কিন্তু উনি জানেন না, বাইরে যে যা-ই হোক, মেয়েরা আসলে মেয়েই।
আট
হোটেল ‘সিরাজ’-এ এসিজি আবার যখন পা দিলেন তখন সন্ধে সাতটা।
দুপুর পর্যন্ত কাজ সেরে বিদায় নিয়েছিলেন এসিজি আর রঘুপতি। তারপর ঘণ্টা চার-পাঁচ যা সময় পেয়েছেন তার খানিকটা কেটেছে বিশ্রামে, আর বাকিটা খরচ হয়েছে হোমওয়ার্কের পিছনে। বিশেষ করে পাঁচকড়ি দে আর এডগার ওয়ালেসের লেখাগুলো খতিয়ে দেখার জন্য বেশ কয়েকটা লাইব্রেরিতে এসিজি ঢুঁ মেরেছেন। এই দুই লেখকের নাম উচ্চারণ করে কোনও সূত্র দেওয়ার চেষ্টা করেছে দেবারতি? নাকি পুরো ব্যাপারটাই ছিল ওর ফাজলামি? মনে-মনে যেন একটা রুবিক কিউব নাড়াচাড়া করছিলেন অশোকচন্দ্র। কিউবের ছ’টা পিঠে খুদে কিউবগুলো তাদের নানান রং নিয়ে ছড়িয়েছিটিয়ে রয়েছে। কিউবে ঠিকঠাক মোচড় দিয়ে খুদে কিউবগুলোকে নিয়ে আসতে হবে ঠিক-ঠিক জায়গায়। তবেই পাওয়া যাবে হারানিধি নকশা। তখনই বোঝা যায়, কীভাবে খুন হয়েছে দেবারতি মানি, কে খুন করেছে ওকে, আর কেনই বা খুন করেছে।
রঘুপতি যাদব তার কাজ করে গেছে নির্ভুলভাবে। দশজন লেখকের দশটা ঘরের সঙ্গে যুক্ত বেয়ারাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে সে একেবারে ভাজা-ভাজা করে ছেড়েছে। তারপর প্রত্যেকটা ঘরের নম্বর লিখে সে হাসপাতালের বেডের মতো প্রতিটি ঘটনার আনুমানিক টাইম-চার্ট তৈরি করেছে। সেই চার্ট সামনে রেখে বহুক্ষণ বুঁদ হয়ে ছিলেন এসিজি, কিন্তু রুবিক কিউবের নকশা মেলেনি।
হোটেলের রিসেপশনে তাঁর দেখা হয়ে গেল অনিমেষ চৌধুরির সঙ্গে। ভদ্রলোক কেমন যেন সন্দেহজনকভাবে এদিক-সেদিক ঘুরঘুর করছিলেন। পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি।
এসিজিকে দেখেই তিনি একেবারে আঁতকে উঠলেন। কাছে এসে বললেন চাপা গলায়, ‘আমি একটা সিক্রেট জানি—।’
হোটেলের লবিতে রঙিন টিভি চলছে। সোফায় গা ডুবিয়ে অনেকেই সেই ছোট পরদায় মন দিয়ে বসে আছেন। লবির বাঁ দিকে একটা বড় প্যানেলে সিরামিক টাইলসের বিমূর্ত কাজ। তার ঠিক নীচেই সুদৃশ্য টবে সাজানো রয়েছে কয়েকটা গাছ।
অশোকচন্দ্রের পাঞ্জাবির হাতা ধরে তাঁকে সেদিকে নিয়ে যেতে চাইলেন অধ্যাপক। এসিজি মনে-মনে প্রমাদ গুনলেন : ‘আবার সিক্রেট!’
পান চিবোতে-চিবোতে অধ্যাপক এসিজির কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বললেন, ‘কাল রাত এগারোটা নাগাদ দেবারতি মানির ঘরের দরজায় কেউ ধাক্কা দিচ্ছিল।’
‘আপনি তখন কী করছিলেন?’ এসিজি জিগ্যেস করলেন। তিনি জানেন, অধ্যাপক চৌধুরির ঘর দেবারতির ঘরের ঠিক পাশেই।
‘শ-শ-শ। আস্তে—’ ঠোঁটে আঙুল তুলে এসিজিকে সাবধান করলেন অনিমেষ। বললেন, ‘সাবধানে বলুন, কেউ হয়তো ওভারহিয়ার করে ফেলতে পারে।’ তারপর চারপাশে একবার সতর্ক নজর বুলিয়ে নিয়ে বললেন, ‘আমি তখন একটা ক্লাস সেভেনের ইতিহাস বইয়ের প্রূফ দেখছিলাম…।’
‘তারপর?’
‘…ভাবছি কে ধাক্কা দিচ্ছে, এমন সময় শুনতে পেলাম উৎপলেন্দু সেনের গলা। দেবারতি মানিকে ডাকছেন। কী যেন পরীক্ষা করার বিষয়ে কীসব বলছেন। ওঁর গলা জড়ানো ছিল, তাই কথাগুলো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল না। কিন্তু মিস মানির উত্তরটা পরিষ্কার শুনতে পেয়েছি আমি। উনি একটু ধরা গলায় চেঁচিয়ে বললেন, ”মাতাল অবস্থায় এ-পরীক্ষা দেওয়া যায় না। যান, ঘরে গিয়ে বোতল নিয়ে শুয়ে পড়ুন।” ব্যস, আর কিছু শুনতে পাইনি আমি। তবে অবাক হয়ে ভাবছিলাম, মাতাল অবস্থায় কোন পরীক্ষা দেওয়া যাবে না। আমিও তো লেখাপড়া নিয়েই আছি—জীবনে কম পরীক্ষা দিতে হয়নি। আর পরীক্ষার খাতাও কম দেখি না। মাতাল অবস্থায় যে-কোনও পরীক্ষাই শক্ত। তা উৎপলেন্দুবাবু রাত এগারোটায় দেবারতিদেবীর ঘরে কী পরীক্ষা দিতে গিয়েছিলেন কে জানে!’
‘ধন্যবাদ, অনিমেষবাবু,’ অশোকচন্দ্র অমায়িক হাসলেন : ‘আপনার মতো সহযোগিতা সকলের কাছ থেকে পেলে এতক্ষণে খুনি ধরা পড়ে যেত।’
‘উৎপলেন্দুবাবু কিন্তু খুন করেননি—’ ব্যস্তসমস্ত হয়ে বলে উঠলেন অনিমেষ চৌধুরি, ‘ওঁকে আমি অনেকদিন ধরে চিনি। আর…ওঁকে…ইয়ে, বলবেন না যে, এ-খবরটা আমি দিয়েছি—’ একটু চুপ করে থেকে সময় নিয়ে : ‘যতই বন্ধু হোক, সত্যি কথা তো আর গোপন রাখা যায় না!’
দেবারতি মানিকে জীবিত অবস্থায় শেষ কে দেখেছিল? ভাবলেন অশোকচন্দ্র গুপ্ত। গতকাল আটটা নাগাদ রত্মাবলী মুখোপাধ্যায়ের ঘরে কফি নিয়ে গিয়েছিল একজন বেয়ারা। তখন দেবারতি ইন্টারভিউ নিচ্ছিল। এরপর পৌনে নটা নাগাদ দেবারতিকে রূপেন মজুমদারের ঘরে ঢুকতে দেখেছেন জ্যোতিষ্ক সান্যাল। সেটাও ইন্টারভিউর ব্যাপার ছিল বোধহয়। তারপর, রাত সাড়ে নটা নাগাদ, ওকে দেখা যায় করিডোরে দাঁড়িয়ে রতন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বলছে। আর সব শেষে পাওয়া খবর অনুযায়ী, রাত দশটার সময় ঘরে ডিনার চেয়ে পাঠায় দেবারতি, সঙ্গে ড্রিঙ্কস। ব্যস, এইটুকুই।
কিন্তু এখন প্রফেসর চৌধুরি যা বলছেন তাতে উৎপলেন্দু সেনই বোধহয় দেবারতিকে জীবিত অবস্থায় শেষ দেখেছেন—মানে, ওর সঙ্গে কথা বলেছেন।
অশোকচন্দ্রের কপালের ভাঁজ ঘন হল। এখনও তো অনিমেষ চৌধুরিকে নিয়ে মোট ছ’জন লেখকের সঙ্গে তাঁর কথা বলা বাকি। তাঁদের কথা থেকে আরও গুরুত্বপূর্ণ কোনও নতুন তথ্য পাওয়া যেতে পারে।
‘আচ্ছা, অনিমেষবাবু, দেবারতি কীভাবে খুন হয়েছিল বলতে পারেন?’
থতমত খেয়ে গেলেন অধ্যাপক। তারপর সতর্ক চোখে এপাশ-ওপাশ দেখে নিয়ে পানের পিক ফেললেন একটা টবের গোড়ায়। কয়েক সেকেন্ড ধরে ‘উম-ম’ শব্দ করে অবশেষে বললেন, ‘আমি জীবনে গোয়েন্দা গল্প লিখেছি একটাই : আমার লেখা প্রথম গল্প। তারপর থেকে শুধু কল্পবিজ্ঞান আর…।’
‘পিশাচতন্ত্র, তাই তো!’ হাসলেন এসিজি : ‘আপনার লেখা আমি পড়েছি। বলতে দ্বিধা নেই, আপনি পিশাচসিদ্ধ। কিন্তু তবুও যদি আমাকে একটু সাজেশন দিয়ে সাহায্য করেন।’
অধ্যাপক চৌধুরি কিছুক্ষণ ইতস্তত করে বললেন, ‘এটা ভিনগ্রহের কোনও প্রাণীর কীর্তি নয়তো!’
অশোকচন্দ্র অতি কষ্টে হাসি চাপলেন। কিন্তু তাঁর মগজের ভেতরে একটা কথা ঘুরপাক খাচ্ছিল : অধ্যাপক অনিমেষ চৌধুরি হয় নিপাট ভালোমানুষ, নয়তো ধুরন্ধরের জাসু। তিনি স্বাভাবিক সুরে বললেন, ‘থ্যাংক ইউ প্রফেসর, আমি তা হলে এবার আসি।’
অধ্যাপক চৌধুরি হাত তুলে থামালেন এসিজিকে : ‘একটা কথা, মিস্টার গুপ্ত। আমি এই মার্ডারের ব্যাপারে কিছু তথ্য জোগাড় করেছি। ওগুলো আপনাকে দেব।—যদি আপনার কোনও কাজে লাগে। কাজে লাগলে কিন্তু আমার হেল্প করার ব্যাপারটা সবাইকে বলবেন—মানে, অ্যাকনলেজ করবেন…।’
এসিজি একটু অবাক চোখে ভদ্রলোককে দেখলেন। আশ্চর্য! এত নাম-ডাক খ্যাতি হওয়া সত্ত্বেও কী নির্লজ্জ খ্যাতিলোভাতুর।
‘এ-ব্যাপারে পরে আপনার সঙ্গে কথা বলব,’ বলে অধ্যাপককে এড়িয়ে গেলেন অশোকচন্দ্র।
অনিমেষ চৌধুরি তাঁকে আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু এসিজি দ্রুতপায়ে পিঠটান দেওয়ায় সে-সুযোগ আর পেলেন না।
তিনতলায় ভাস্কর রাহার দুশো আট নম্বর ঘরের দরজা খোলাই ছিল। এসিজি সপ্রতিভ পায়ে ঢুকে পড়লেন ঘরে।
জমজমাট আসরে বোধহয় কনফারেন্স চলছিল অথবা দেবারতির রহস্যময় মৃত্যুর ব্যাপার নিয়েই আলোচনা হচ্ছিল, এসিজিকে দেখেই নিমেষে সব স্তব্ধ। ঘরের আবহাওয়া থমথমে হয়ে গেল পলকে।
ভাস্কর রাহা জ্বলন্ত চুরুট হাতে কিছু একটা বলছিলেন। তাঁকে ঘিরে বসে-দাঁড়িয়ে রতন বন্দ্যোপাধ্যায়, অনামিকা সেনগুপ্ত, রঞ্জন দেবনাথ আর প্রেমময় চৌধুরি। খানিকটা দূরে একা একটা সোফায় বসে উৎপলেন্দু সেন কী একটা লেখায় চোখ বোলাচ্ছেন। আর জানলার কাছে দাঁড়িয়ে নীচের দিকে উঁকি মেরে কী যেন দেখছিল প্রীতম নন্দী। পাশে দাঁড়িয়ে ওর সঙ্গে বোধহয় কথা বলছিলেন কল্পনা সেন।
‘ডিসটার্ব করার জন্যে দুঃখিত, ভাস্করবাবু। আপনাদের কয়েকজনের সঙ্গে আমার কথা বলা বাকি আছে—সেটা এখন সেরে নিতে চাই।’ কথাগুলো বলে অশোকচন্দ্র গুপ্ত পকেট থেকে একটা চিরকুট বের করে কী যেন দেখলেন। তারপর : ‘রতন বন্দ্যোপাধ্যায়, অনামিকা সেনগুপ্ত, রঞ্জন দেবনাথ, জোতিষ্ক সান্যাল আর অর্জুন দত্ত। শেষ দুজন ঘরে নেই দেখতে পাচ্ছি…ভাস্করবাবু, যদি কাইন্ডলি ওঁদের একটু খবর পাঠান এ-ঘরে আসার জন্যে। কথা দিচ্ছি, খুব সংক্ষেপে কাজ সারার চেষ্টা করব।’
ঘরের সবাই এখন অশোকচন্দ্রের খুব কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছেন। বাস্তবের এই গোয়েন্দা এবার কী নির্দেশ দেবে কে জানে!
‘যাঁদের নাম বললাম তাঁরা ছাড়া আর সবাই ইচ্ছে হলে চলে যেতে পারেন। তবে ভাস্করবাবু অবশ্যই থাকবেন। কারণ, ওঁর ঘরে আমরা অতিথি।’
ভাস্কর রাহা বিনীত হেসে অশোকচন্দ্রের দেওয়া সম্মান গ্রহণ করলেন। তারপর এগিয়ে গেলেন টেলিফোনের দিকে।
প্রেমময় চৌধুরি সোফায় যেমন বসে ছিলেন তেমন বসেই রইলেন। তাঁর দু-চোখে কৌতূহল আর শিরা-বের-করা আঙুলের ফাঁকে সিগারেট জ্বলছে।
উৎপলেন্দু, প্রীতম আর কল্পনা চুপচাপ চলে যাচ্ছিলেন ঘর ছেড়ে। অশোকচন্দ্র উৎপলেন্দুর পিঠে আলতো করে আঙুল ছুঁইয়ে বললেন, ‘আপনি থাকুন, উৎপলেন্দুবাবু। কয়েকটা কথা আছে আপনার সঙ্গে।
উৎপলেন্দু ছোট্ট করে ঘাড় হেলিয়ে বসে পড়লেন একটা সোফায়।
ভাস্কর রাহা অশোকচন্দ্রের কাছে এসে বললেন, ‘খবর দিয়েছি—ওরা আসছে।’
সিগারেটে শব্দ করে টান দিয়ে বারকয়েক কেশে উঠলেন অশোকচন্দ্র। তারপর গলা উঁচু পরদায় তুলে বললেন, ‘ভাস্করবাবু, সবার কাছে প্রশ্ন আমার একটাই : কীভাবে খুন হয়েছে দেবারতি মানি—।’
এসিজি প্রশ্নটা প্রথমে রাখলেন রতন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে।
রতন বন্দ্যোপাধ্যায়ের চোখেমুখে বেশ দুশ্চিন্তার ছাপ। প্রথম দিনের হাসিখুশি ফুলবাবু চেহারাটি আর নেই। আজ তাঁর বয়েস বোঝা যাচ্ছে।
রতন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাল্পনিক গোয়েন্দা শিবদাস সরখেল—অবসরপ্রাপ্ত এক বিচারপতি। সিল্কের ড্রেসিং গাউন পরা পাইপ খাওয়া এই গোয়েন্দা যেন উত্তম-সুচিত্রার পুরোনো আমলের হিট ছবির বড়লোক নায়িকার রাশভারি পিতা। শিবদাস সরখেলের জনপ্রিয়তা করঞ্জাক্ষ রুদ্রের মতো মারাত্মক না হলেও মাঝারি গোছের বলা যায়।
রতন বন্দ্যোপাধ্যায় কয়েকবার চোখ পিটপিট করলেন। চোখের কোনও দোষ নয়, মুদ্রাদোষ। তারপর বলতে শুরু করলেন, ‘আমার গোয়েন্দা শিবদাস সরখেল হলে কী ভাবতেন সেটা বলি।’ সকলের মুখের ওপরে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন, ‘ধরুন, দেবারতিকে খুন করার পর খুনি ওর চাবি দিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে এল বাইরে। তারপর স্ক্রু ড্রাইভার দিয়ে গোটা দরজাটাকে খুলে ফেলল ফ্রেম থেকে। দরজা লক করল চাবি দিয়ে। চাবি রেখে এল ঘরের ভেতরে, টেবিলে। তারপর বন্ধ দরজাটাকে ঠিকমতো সেট করে আবার স্ক্রু এঁটে বসিয়ে দিল দরজার ফ্রেমে।’
‘চমৎকার! চমৎকার!’ প্রশংসার সাধুবাদ জানালেন এসিজি : ‘কিন্তু দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, এই হোটেলের দরজাগুলো বন্ধ অবস্থায় স্ক্রু-র নাগাল পাওয়া যায় না। ওগুলো দরজা আর ফ্রেমের ভাঁজে লুকিয়ে পড়ে। শুধু এই হোটেলের কেন, বেশিরভাগ দরজার ডিজাইনই তাই। তবু আপনার মৌলিক চিন্তার জন্যে ধন্যবাদ।’
উৎপলেন্দু সেন সোফা ছেড়ে উঠে ভাস্কর রাহার কাছে গেলেন। রাহার কাছ থেকে লাইটার চেয়ে একটা সিগারেট ধরালেন। এবং সেই সুযোগে চাপা গলায় তাঁকে বললেন, ‘মৌলিক চিন্তাই বটে! জন ডিকসন কারের ”ডেড ম্যানস নক” উপন্যাসে এ-নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা আছে।’
ভাস্কর রাহা কোনও জবাব না দিয়ে উৎপলকে ইশারায় থামতে বললেন।
ঠিক সেই মুহূর্তে ঘরে ঢুকলেন জোতিষ্ক সান্যাল আর অর্জুন দত্ত। আর তার কয়েক সেকেন্ড পরেই ইন্সপেক্টর রঘুপতি যাদব।
এসিজি ওঁদের তিনজনকেই স্বাগত জানালেন।
রঘুপতির হাতে একটা মোটাসোটা ফাইল ছিল। সেটা ইশারায় দেখিয়ে অশোকচন্দ্রকে একপাশে ডেকে নিল সে। ফাইলটা খুলে কিছু কাগজপত্র দেখিয়ে চাপা গলায় অনেকক্ষণ ধরে কীসব বলল। সব শুনে অশোকচন্দ্র কিছুক্ষণ থম মেরে রইলেন। তারপর হাত তুলে ইশারা করে জানালেন, পরে হবে।
এরপর এসিজি বাকি চারজনকে একে-একে একই প্রশ্ন করলেন : কেমন করে খুন করা হয়েছে দেবারতি মানিকে? ওঁরা একে-একে উত্তর দিলেন।
অনামিকা সেনগুপ্ত : ‘আমার মনে হয়, খুন করার পর খুনি ওই ওয়ার্ডরোব অথবা বাথরুমের ভেতরে লুকিয়ে ছিল। তারপর দরজা ভাঙাভাঙি হইচই সব মিটে গেলে সে লুকিয়ে সটকে পড়ে।’
জ্যোতিষ্ক সান্যাল : ‘ব্যাপারটা সত্যি-সত্যি সুইসাইড নয়তো! দেবারতি মানি হয়তো আমাদের নাকাল করার জন্যে একটা চরম মশকরা করে গেছেন!’
অর্জুন দত্ত : ‘সরি, আমি কিছু ভেবে উঠতে পারছি না। ব্যাপারটা আমার কাছে ইম্পসিবল প্রবলেম হয়েই রয়ে গেছে।
সবার শেষে রঞ্জন দেবনাথ। ওর উত্তর এসিজিকে নাড়া দিল। এমনকি চমকে দিল আর সবাইকেও।
রঞ্জন দেবনাথ ইতিমধ্যেই বোধহয় ধাক্কা সামলে উঠেছে। এসিজি লক্ষ করেছেন, একটু আগেই ও গায়ে হাত ছুঁইয়ে অনামিকাকে ডেকে হেসে কী একটা বলেছে। তা ছাড়া এখন ওকে বেশ স্মার্ট সুন্দর দেখাচ্ছে। উজ্জ্বল দুটো চোখে ঝিলিক মারছে আত্মবিশ্বাস।
অশোকচন্দ্র রঞ্জনের ‘অন্ধকারে বাঘবন্দী খেলা’, ‘পায়ের শব্দ নেই’ এবং ‘খুনির নাম অজানা’—সবক’টা লেখাই পড়েছেন। বেশ ভালো লেখা। এই সাহিত্যের প্রথম সারিতে জায়গা করে নেওয়ার ক্ষমতা যে ওর আছে সেটা বোঝা যায়। ওর লেখা থেকে সবসময় একটা অদৃশ্য শক্তি ঠিকরে পড়ে চারিদিকে।
‘দরজা লক করা হয়েছিল ভেতর থেকে—’ রঞ্জন সিরিয়াস সুরে বলল, ‘আর খুনি পালিয়েছে জানলা দিয়ে।’
হাততালি দিয়ে উঠল রঘুপতি যাদব। আজ সকাল থেকে এই লকড রুম প্রবলেমের কত উদ্ভট সমাধান যে তাকে শুনতে হল তার কোনও হিসেব নেই। জন ডিকসন কারের বইতেও বোধহয় এত ভ্যারাইটি পাওয়া যেত না! রঘুপতি ক্রমেই ধৈর্যের শেষ সীমায় পৌঁছে যাচ্ছিল। সুতরাং এবার ও মুখ খুলল : ‘সাবাশ, রাইটারসাহেব, বহত খুব। খুনি তা হলে খিড়কি দিয়ে উড়ে পালিয়েছে!’
রঞ্জন দেবনাথ ঝটিতি ঘুরে তাকাল রঘুপতি যাদবের দিকে : ‘কেন, দড়ি বেয়ে সে নীচের তলার কোনও ঘরে পালিয়ে যেতে পারে না?’
‘তা হলে, পরে দড়ির গেঁটটা কে এসে খুলে দিয়ে যাবে সেটাও একটা প্রশ্ন—’ এই মন্তব্য করেছেন অশোকচন্দ্র গুপ্ত।
রঘুপতি হেসে বলল, ‘কেন, ভগওয়ান এসে খুলে দিয়ে যাবেন! খুনির এই সঙ্কটে ওপরওয়ালা যদি তরস না খান, রহম না করেন, তা হলে তাঁর ওপর বিসওয়াস রেখে ফায়দা কী?’
ঘরের অনেকেই হেসে উঠলেন এ-কথায়।
রঞ্জন দেবনাথের মুখ লাল হল। উত্তেজনা আর অপমানে সে এক পা এগিয়ে গেল রঘুপতির দিকে।
রঘুপতি ওকে সাবধান করল : ‘রাইটার, ডোন্ট মেক এনি মিসটেক।’
এসিজি হাত তুলে শান্ত করতে চাইলেন রঞ্জনকে : ‘মিস্টার দেবনাথ, টেক ইট ইজি।’
‘একটা ফুটো পয়সার ইন্সপেক্টরের কাছ থেকে এর বেশি বুদ্ধি আমি আশাও করি না,’ রাগে থরথর করছে রঞ্জনের গলা : ‘কারণ আই. কিউ. খুব বেশি হলে বোধহয় পুলিশে চাকরি দেওয়া হয় না। কিন্তু মিস্টার গুপ্ত, আপনার কাছে থেকে এ-প্রশ্ন শুনব এটা ভাবিনি। মনে হয় আপনার থিঙ্কিং মেশিন বিগড়ে গেছে—রিপেয়ার করতে হবে।’
এসিজি একফোঁটাও বিচলিত হলেন না রঞ্জনের কথায়। শুধু ভাবলেন, দেবারতি মানির প্রেমিক এইবার আলটাহাই পোটেনশিয়ালের প্রদর্শনী শুরু করেছে। সুতরাং নতুন ফার্নিচার সংগ্রহের জন্য তিনি তাঁর মাথার কুঠরিটাকে তৈরি রাখলেন।
কিন্তু এগিয়ে এল রঘুপতি যাদব। শক্তির মোকাবিলা করার অভ্যেস ওর অছে। চোয়াল শক্ত করে ও বলে উঠল, ‘রাইটার কে বাচ্চে! বি কেয়ারফুল! পুলিশি দাওয়াই পড়লে এরপর থেকে হাতের বদলে পা দিয়ে লিখতে হবে। হুঁঃ, মুন্না আমার বুদ্ধিতে নোবেল প্রাইজ জিতে নিয়ে এসেছে!’
ভাস্কর রাহা অনেকক্ষণ মুখ বুজে থেকেছেন। আর পারলেন না। এসিজিকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন, ‘অভদ্রতা ছাড়া কি খুনের তদন্ত করা যায় না, মিস্টার গুপ্ত? শুনেই দেখুন না রঞ্জন কী বলতে চায়—।’
এসিজি হাত তুলে শান্ত করলেন দুজনকেই। তারপর রঞ্জনকে লক্ষ করে বললেন, ‘বলুন, মিস্টার দেবনাথ, কী বলতে চান আপনি—।’
কিছুক্ষণ সময় নিয়ে নিজেকে শান্ত করল রঞ্জন। তারপর নীচু গলায় বলতে শুরু করল, ‘আমি বহুদিন লিখিনি ঠিকই, তবে তা বলে গর্দভ হয়ে যাইনি। দড়ি বেঁধে নেমে পড়ার অনেক টেকনিক আছে। তারই একটা এক্ষেত্রে ব্যবহার করা হতে পারে। এই টেকনিকে দড়িটাকে ঠিক বাঁধার দরকার হয় না। ভারি এবং শক্ত কোনও জিনিসের ফাঁক দিয়ে দড়িটাকে ঠিক ছুঁচে সুতো পরানোর মতো করে ঢুকিয়ে দিতে হবে। তারপর তার দু-মাথা এক করে একসঙ্গে ঝুলিয়ে দেওয়া যায় জানলা দিয়ে। সেই জোড়া দড়ি ধরে খুনি নেমে যেতে পারে নীচে—মানে, নীচের কোনও ঘরে। তারপর দড়ির একমাথা ধরে টান মারলেই সেটা সড়সড় করে চলে আসবে খুনির হাতে। যেমন ধরুন—’ ভাস্কর রাহার খাটের কাছে এগিয়ে গেল রঞ্জন দেবনাথ। একটা কারুকাজ করা ভারী পায়ার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ‘এই পায়াটাকে ঘিরেও দড়িটা পরানো যেতে পারে—কোনও অসুবিধে নেই। তখন ভগওয়ানকে আর তরস খেয়ে রহম করে কষ্ট করে দেবারতির ঘরে নেমে এসে দড়ির গেঁট খুলে দিয়ে যেতে হবে না—’শেষ কথাটা বাঁকা চোখে রঘুপতি যাদবের দিকে ছুড়ে দিয়ে বক্তব্য শেষ করল রঞ্জন।
‘আপনাকে অভিনন্দন জানাই, মিস্টার দেবনাথ,’ এসিজি হাসিমুখে প্রশংসা উপহার দিলেন রঞ্জনকে, ‘রূপেন মজুমদারও আমাদের জানলা দিয়ে খুনির পালানোর কথা বলেছিলেন, তবে এত সুন্দর করে যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে বলতে পারেননি। কিন্তু সমস্যা হল, দেবারতির ঘরের জানলা দিয়ে নেমে খুনি শেষ পর্যন্ত যাবে কোথায়! হয় সে খোলা জানলা দিয়ে ঢুকে পড়বে ভাস্কর রাহা কিংবা অনির্বাণ ঘোষের ঘরে…অথবা, সে নেমে পড়বে একেবারে নীচে—ভাস্করবাবুর গাড়ির ওপরে। এ তিনটে পথই সমান বিপজ্জনক—কারণ, দেবারতির খুন নিঃশব্দে হয়নি।’ একটু দম নিয়ে মাথার চুলে বারতিনেক টান মেরে তারপর : ‘সে যা-ই হোক, আপনাকে ধন্যবাদ জানাই।’
কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ। খোলা জানলা দিয়ে ঠান্ডা বাতাস আসছে। নীচ থেকে ভেসে আসছে র্যাপ মিউজিক—হোটেল ‘সিরাজ’-এর রেস্তরাঁয় আমোদ-প্রমোদ চলছে।
এসিজি একটা সিগারেট ধরিয়ে রঞ্জন দেবনাথকে দেবারতির ইন্টারভিউর কথা জিগ্যেস করলেন। কিন্তু ওর উত্তরে নতুন কোনও তথ্য পাওয়া গেল না।
জ্যোতিষ্ক সান্যাল একই প্রশ্নের উত্তরে জানালেন, দেবারতি তাঁর ইন্টারভিউ নেওয়ার সময় শুধুই খোঁচা দিয়েছে, অপমান করেছে।
সন্ধের ঠিক মুখোমুখি জ্যোতিষ্ক সান্যালকে ধরেছিল দেবারতি। কনফারেন্স রুমের বাইরের করিডরে একপাশে সরে গিয়ে কথা বলেছিলেন ওঁরা।
‘আপনি লেখেন কেন, মিস্টার সান্যাল?’
‘লিখতে ইচ্ছে করে, তাই—।’
‘কখনও মনে হয় না, শুধু-শুধু পাতার পর পাতা ভরিয়ে লিখে গিয়ে কী লাভ!’
‘না, মনে হয় না।’
চোখ ছোট করে, ঘাড় কাত করে হেসেছে রমণী। তারপর : ‘অনেক সিরিয়াস লেখক ভালো লিখতে চান, অথচ পারেন না। তাই তাঁরা লেখা ছেড়ে দেন। ভাবেন, এরকম লিখে কী লাভ! আর আপনাদের মতো লেখকদের লজিক ঠিক উলটো : আপনারা ভাবেন, লিখলে কী-ইবা ক্ষতি! তাই না?’
‘আপনি কি লেখকদের লেখার লাইসেন্স ইস্যু করার ঠিকে নিয়েছেন?’ জ্যোতিষ্ক বেশ বুঝতে পারছিলেন, ব্লাড প্রেশার ক্রমেই ওপর দিকে উঠছে।
দেবারতি মোটেই রেগে যায়নি। খিলখিল করে হেসে বলেছে, ‘আপনি লেখা ছাপানোর জন্যে যতটা সিরিয়াস লেখার জন্যে মোটেই ততটা নন।’
এইখানেই শেষ হয়েছে অপমানজনক সাক্ষাৎকার। কারণ, জ্যোতিষ্ক সান্যাল যবনিকা টেনেছেন অকস্মাৎ। দেবারতির সামনে থেকে হনহন করে চলে গেছেন।
অর্জুন দত্ত আর রতন বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, তাঁদের ইন্টারভিউ নেহাতই মামুলি ছিল।
এসিজির গম্ভীর মুখ দেখে বোঝা গেল না, তিনি সে-কথা কতটা বিশ্বাস করলেন। তাঁর শুধু একটা কথাই মনে হচ্ছিল : সকলের সঙ্গে কথা বলে দেবারতি মানির চরিত্র যতটুকু জানা গেছে, তাতে ও সাদামাঠা ইন্টারভিউ নেওয়ার মতো সাংবাদিক ছিল না। কিন্তু এখন তো আর সঠিক সত্য জানার উপায় নেই! তা ছাড়া দেবারতির ঘর থেকে পাওয়া শর্টহ্যান্ড নোটসগুলো রঘুপতি এর মধ্যে ডিসাইফার করিয়ে ফেলেছে। তাতে খাপছাড়াভাবে অনেক কথা লেখা আছে।
বিষয় : রহস্য-সাহিত্য আর রহস্য-সাহিত্যিক। তবে সেই নোটসগুলো ঠিক কোন-কোন লেখক সম্পর্কে সেটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না।
মোটামুটি হতাশ হয়ে অনামিকা সেনগুপ্তকে ইন্টারভিউর কথা জিগ্যেস করলেন অশোকচন্দ্র। কিন্তু কোনও লাভ হল না। অনামিকাও ‘মামুলি’ শব্দটার সাহায্য নিল।
অথচ সাক্ষাৎকারটা বোধহয় ঠিক মামুলি ছিল না, ভাবল অনামিকা।
‘আপনাকে লেখা ছাপানোর জন্যে খুব একটা কষ্ট করতে হবে না।’ মন্তব্য করেছিল দেবারতি মানি।
‘কেন?’ অবাক হয়ে জানতে চেয়েছিল অনামিকা।
‘সম্পাদক, প্রকাশক, সিনিয়ার লেখক—দেখবেন, সবাই আপনাকে হেল্প করবে। আড়াল আর সুযোগ পেলে আপনার লেখা সামনে-পেছনে কারেকশন করে দেবে।’ প্রগলভ হাসি—যার সবটাই অর্থময় : ‘আপনাকে দেখতে-শুনতে খারাপ নয়। এ যেন ভগবানের দেওয়া লাখ টাকার চেক। শুধু ভাঙাবেন আর খাবেন। সেরকম কোনও পরিশ্রম করার দরকার নেই।’
‘আপনার উপদেশের জন্যে ধন্যবাদ—’ ঠোঁট টিপে জবাব দিয়েছে অনামিকা।
তারপর অনেক ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে আক্রমণ করেছে দেবারতি। আর শেষ পর্যন্ত ইন্টারভিউটার ডাকনাম হয়ে গেছে ‘ঝগড়া’।
কিন্তু এসব কথা কি প্রকাশ্যে বলা যায়! তা ছাড়া খুনের সঙ্গে কী-ইবা সম্পর্ক আছে এর!
ঘরে হাজির সাতজন লেখককে জরিপ করলেন অশোকচন্দ্র। আপাতভাবে সবাইকেই খুব শান্ত আর স্বাভাবিক দেখাচ্ছে। কিন্তু অনেকক্ষণ ধরে খুঁটিয়ে দেখলেই বোঝা যায়, ওই প্রশান্ত অভিব্যক্তির আড়ালে চলেছে সর্বনাশা ঢেউয়ের উথালপাথাল।
অনিমেষ চৌধুরিকে ইন্টারভিউর কথা জিগ্যেস করা হয়নি—আর জিগ্যেস করে বোধহয় লাভও নেই। তবে অধ্যাপকের দেওয়া সূত্র ধরে উৎপলেন্দু সেনকে একটু জিজ্ঞাসাবাদ করা দরকার।
রঘুপতিকে কাছে ডাকলেন এসিজি। চাপা গলায় বললেন, ‘এখানকার কাজ শেষ হলেই তুমি ঘরগুলো সার্চ করার কাজ শুরু করে দাও। ঘরের নম্বর ধরে লিস্ট তৈরি হলে তারপর তোমার ওই টাইম-চার্টগুলো নিয়ে আর একবার বসব।’ তারপর হঠাৎই যেন মনে পড়ে গেছে এমনভাবে : ‘আচ্ছা, পি.এম. রিপোর্টের খবর কী?’
‘কাল পাওয়া যাবে। সেই সঙ্গে ফোরেনসিক রিপোর্টও মিলে যাবে।’ রঘুপতি উত্তর দিল।
নিজের ঠোঁটে তর্জনী দিয়ে টোকা মারলেন এসিজি। মাথার পাকা চুলের গোছা টানলেন কয়েকবার। তারপর বিড়বিড় করে বললেন, ‘তা হলে কাল বাদ পরশু…সম্মেলনের শেষ দিন…।’
‘শেষ দিন কী, গুপ্তাসাব?’
‘ওই শেষ দিন আমাদেরও কাজ শেষ করতে হবে। পাখি ধরতে হবে, রঘুপতি, পাখি।’
রঘুপতি যাদব একটু অবাক চোখে তার পুরোনো ‘স্যার’-কে দেখল।
এইবার উৎপলেন্দু সেনের দিকে ঘুরে তাকালেন এসিজি। চোখ ছোট করে সিগারেটে টান দিয়ে হঠাৎই কেশে উঠলেন। তারপর গম্ভীর গলায় বললেন, ‘মিস্টার সেন, কাল রাতে আপনি ক’টায় শুতে গেছেন?’
একটু সময় নিয়ে ভেবে তারপর উত্তর দিলেন উৎপলেন্দু, ‘এই এগারোটা সাড়ে এগারোটা নাগাদ।’
‘শুতে যাওয়ার আগে দেবারতিকে আপনি ডাকতে গিয়েছিলেন?’
‘না, কেন বলুন তো?’ শান্ত স্বরে কথা বললেন উৎপল।
এসিজি বেশ কয়েক সেকেন্ড উৎপলেন্দুর দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘মিথ্যে কথা বলার অভ্যেসটা আপনার কবে থেকে হয়েছে—লেখক হওয়ার আগে, না পরে?’
উৎপলেন্দু সেনের মুখ লাল হল। মাথাটা সামান্য ঝুঁকিয়ে বসে রইলেন কিছুক্ষণ।
‘আমরা খবর পেয়েছি, আপনি কাল রাত এগোরোটা নাগাদ দেবারতির ঘরের দরজায় গিয়ে ওকে ডেকেছিলেন। কী একটা রহস্যময় পরীক্ষার ব্যাপারে আপনাদের কথা হয়েছিল।’একটু থেমে এসিজি আবার যোগ করলেন, ‘স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, দেবারতি মানি আপনার সঙ্গেই শেষ কথা বলেছিল।’
কিছুক্ষণ নীরবতা। তারপর মুখ খুললেন উৎপলেন্দু সেন : ‘বুঝেছি, অনিমেষ চৌধুরি এসব খবর আপনাকে দিয়েছে…ওর ঘর দেবারতি মানির পাশেই। নির্ঘাত আড়ি পেতে সব শুনেছে…মেয়েছেলেরও অধম!’
উৎপলেন্দু ঘরে হাজির সকলের দিকে একবার তাকালেন। সবার সামনে কি বলা যায় কথাগুলো? বিশেষ করে অনামিকার সামনে? কিন্তু তাঁর বেলা তো সৌজন্য নিয়ে মাথা ঘামায়নি দেবারতি। তা হলে তিনি কেন মধ্যবিত্ত সৌজন্য নিয়ে সঙ্কোচ পাবেন? যা হওয়ার হাটের মাঝেই হোক।
‘দেবারতি মেয়েটা ভীষণ বাজে ছিল…।’
‘উৎপলদা, প্লিজ, একটু ভদ্রভাবে কথা বলুন!’ প্রতিবাদে মুখ খুলেছে রঞ্জন দেবনাথ।
‘সত্যি কথা চিরকাল একটু অভদ্রই শোনায়,’ উৎপলেন্দু প্রথমে রঞ্জনের দিকে তাকালেন, তারপর এসিজির দিকে : ‘এই কারণেই প্রথমে মিথ্যে বলেছিলাম, কারণ সত্যি কথা আপনারা সহ্য করতে পারবেন না। ভালো করে শুনুন—’ গলার স্বর কয়েক পরদা উঁচু হল তাঁর : ‘দেবারতি আমার পুরুষত্ব পরীক্ষা করতে চেয়েছিল…।’
‘সে-সাহস থাকলে অ্যাদ্দিনে আপনার মুখেভাত হয়ে যেত।’ কথাটা মনে পড়ে গিয়ে রাগে গা রি-রি করতে লাগল উৎপলেন্দুর।
রঘুপতি যাদব মাথা নীচু করে ডায়েরিতে কীসব নোট করছিল। সেদিকে আঙুল তুলে উঁচু গলায় বললেন উৎপলেন্দু, ‘ভালো করে লিখে নিন—যেন কিছু বাদ না যায়। এইমাত্র যা বললাম, সেই পরীক্ষা দিতেই ওর ঘরে কাল রাতে গিয়েছিলাম। দরজা খুললে বুঝিয়ে দিতাম, মুখেভাত হয়েছে কি হয়নি—।’
ভাস্কর রাহা উত্তেজিত উৎপলেন্দুকে শান্ত করার জন্য কাছে এগিয়ে এসেছিলেন। উৎপলের শেষ কথাটা শুনে অবাক হয়ে বললেন, ‘মুখেভাত! তার মানে!’
এসিজি আর রঘুপতিও একইসঙ্গে বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন।
কিছুক্ষণ গুম মেরে থেকে উৎপলেন্দু বললেন, ‘ও কিছু নয়, আপনারা বুঝবেন না—’ তেতো হাসলেন তিনি : ‘তা মেয়েটা দরজা খোলেনি। হয়তো ঘরে অন্য কেউ ছিল। মেয়েটা তো একা শুতে পারত না। ওর কাছে সব মাসই ভাদ্রমাস।’
‘উৎপল! আপনি কি কাণ্ডজ্ঞান হারালেন!’ তিরস্কার করে উঠেছেন ভাস্কর। কারণ তিনি লক্ষ করেছেন, কিছুক্ষণ আগেই অনামিকা সরে গেছে সামনে থেকে। ঘরের দরজার কাছে গিয়ে দেওয়ালে টাঙানো একটা ছবি মনোযোগ দিয়ে দেখার ভান করছে। ওর খানিকটা পিছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে রঞ্জন দেবনাথ।
উৎপলেন্দুর মুখের ওপর দিয়ে লু বইছিল। অসহ্য এক তাপে তাঁর কান আর গাল যেন পুড়ে যাচ্ছিল। সম্পাদক-প্রকাশকদের উপেক্ষা আর অবহেলার অপমান তিনি সয়ে চলেছেন বহু বছর ধরে। কিন্তু তাই বলে একটা হাঁটুর বয়েসি মেয়ে-জার্নালিস্টের খোঁচাও তাঁকে একইভাবে সইতে হবে! সহ্যের একটা সীমা থাকা দরকার!
একটু সময় নিয়ে শান্ত গলায় অশোকচন্দ্র জিগ্যেস করলেন, ‘দেবারতির কথাবার্তা কি আপনার স্বাভাবিক মনে হয়েছিল?’
‘না, একটু জড়ানো মনে হয়েছিল—তবে সেটা বোধহয় ড্রিঙ্ক করার জন্যে।’
এসিজি ছোট্ট একটা শব্দ করলেন মুখ দিয়ে। মাথার চুলের গোছায় টান মারলেন দুবার। তারপর ধীরে-ধীরে বললেন, ‘উৎপলেন্দুবাবু, হিসেব মতো বলতে গেলে আপনার সঙ্গে কথা বলার কিছুক্ষণ পরেই দেবারতি মানি জানলা দিয়ে নীচে লাফিয়ে পড়েছে। তার মানে, ওই সময়ে কেউ যদি দেবারতির ঘরে থেকে থাকে তা হলে সে-ই ওকে খুন করেছে।’
‘তো যান, তাকে গিয়ে ধরুন…’ উৎপলেন্দু শব্দ করে শ্বাস ফেললেন। দেবারতির খুনি ধরা পড়ল কি পড়ল না তা নিয়ে তাঁর কোনও মাথাব্যথা নেই। অসহ্য একটা বিরক্তি আর রাগ ফুলে-ফুলে উঠছিল তাঁর বুকের ভেতরে।
ভাস্কর রাহা এগিয়ে এসে উৎপলেন্দুর হাত ধরে আলতো করে টান মারলেন। বললেন, ‘চলুন, বাইরে যাই—’ তারপর এসিজিকে লক্ষ করে : ‘মিস্টার গুপ্ত, আমরা একটু বাইরের বারান্দায় যাচ্ছি। এখানে কেমন দম আটকে আসছে।’
ওঁদের দুজনকে দেখলেন এসিজি। তারপর ঘাড় নাড়লেন। অনেক ধকল যাচ্ছে এই দুই প্রবীণ লেখকের ওপর দিয়ে।
উৎপলেন্দু সেনকে নিয়ে ঘরের দরজার দিকে এগোলেন ভাস্কর রাহা। গত বিশটা বছর তিনি পথ হেঁটেছেন উৎপলের সঙ্গে। ওর মধ্যে কী সুন্দর একটা রসিক মানুষ ছিল। ক্রমাগত আঘাত পেয়ে-পেয়ে সেই মানুষটা রূঢ়ভাষী বেরসিক হয়ে গেছে।
মনে পড়ে, প্রায় আঠেরো-বিশ বছর আগে ‘মাসিক গোয়েন্দা’ পত্রিকার সম্পাদক তথা মালিক শুভব্রত চট্টোপাধ্যায়ের ছেলের পইতের নেমন্তন্ন খেতে গিয়েছিলেন ওঁরা দুজনে। খেতে বসে সামনের একটা লম্বা করিডর দেখিয়ে উৎপলেন্দু বলেছিলেন, ‘বুঝলেন ভাস্করবাবু, ওটা হচ্ছে ”উৎপলেন্দু সেন সরণি”—।’
ভাস্কর ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারেননি। অবাক হয়ে বলেছিলেন, ‘মানে?’
উৎপলেন্দু খাওয়া থামিয়ে হেসে জবাব দিয়েছেন, ‘মানে আর কী! শুভব্রতদার কাগজে গত পাঁচ বছরে বিনিপয়সায় এত লেখা লিখেছি যে, ওগুলোর পাওনা টাকা দিয়েই ওঁর বাড়ির ওই করিডরটা তৈরি হয়েছে…সোজা বাংলায় ওই করিডরটুকুর মালিক আমি।’
এরপর প্রাণখোলা হেসে উঠেছেন দুজনে।
এখন ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে-যেতে ভাস্করের মনে হল, গত বিশ বছর ধরে উৎপলেন্দু সেন সরণির সব জায়গাতেই শুধু ব্যর্থতা, দুঃখ আর হতাশার তেতো ছাপ পড়েছে। আর উৎপলের সেদিনের সেই প্রাণখোলা হাসির সঙ্গে কবে থেকে যেন চাপা কান্না মিশে গেছে।
ভাস্কর আর উৎপলেন্দু ঘর থেকে চলে যেতেই উঠে দাঁড়ালেন প্রেমময় চৌধুরি। অশোকচন্দ্রের কাছে এসে বললেন, ‘আমি আসি, মিস্টার গুপ্ত। এতদিন ধরে রহস্য-গোয়েন্দা কাগজ চালাচ্ছি, তাই ব্যাপারটা নেশার মতো হয়ে গেছে। সেইজন্যেই এতক্ষণ ধরে আপনাদের কথাবার্তা শুনছিলাম। এখন যাই—খুব টায়ার্ড লাগছে। তা ছাড়া ওষুধ খাওয়ার সময় হয়ে গেছে।’
এসিজি সৌজন্যের হাসি হাসলেন—কিছু বললেন না।
জ্যোতিষ্ক সান্যাল অর্জুন দত্তের কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে চাপা গলায় বললেন, ‘বুঝেছেন, বুড়োর ”ওষুধ” খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। শালা এমন পাবলিক, আমার একটা গল্প নিয়ে সাত মাস ধরে চেপে বসে আছে।’
অর্জুন দত্ত শুধু বললেন, ‘চলুন, আমরাও যাই। আমার একটু লেখালিখির কাজ আছে।’
ওঁরা তিনজন প্রায় একসঙ্গেই বেরোলেন ঘর ছেড়ে। যেতে-যেতে জ্যোতিষ্ক প্রেমময়কে বললেন, ‘প্রেমদা, শুনলাম আপনি নাকি কী একটা কাজে সাতাশ তারিখে দিল্লি যাচ্ছেন—।’
‘হ্যাঁ, তিনদিনের জন্যে যাব…কিন্তু এখনও টিকিটটা কাটা হয়নি।’
‘তাই নাকি! তা হলে আপনি এক কাজ করুন। আপনার ঘরে চলুন, জার্নির ডিটেইলসটা আমাকে দিয়ে দিন। আমার সেজ শালা রেলে কাজ করে। আমি ওকে দিয়ে টিকিটটা করিয়ে আপনাকে বাড়িতে পৌঁছে দেব।’
‘তা হলে তো খুব ভালো হয়,’ হাসলেন প্রেমময় : ‘বুড়ো হাড়ে আর ধকল পোষায় না।’
ওরা চলে যাওয়ার পর ঘরে এখন মাত্র তিনজন লেখক : রতন বন্দ্যোপাধ্যায়, অনামিকা সেনগুপ্ত আর রঞ্জন দেবনাথ।
এসিজি রঘুপতি যাদবকে কাছে ডাকলেন। বললেন, ‘রঘুপতি, তুমি বরং ঘরগুলো সার্চ করার কাজ শুরু করে দাও। আমি এদিকে শেষ করে তারপর যাচ্ছি। তা না হলে শুধু-শুধু রাত হয়ে যাবে। তা ছাড়া তুমি এখন অনেককেই ঘরে পেয়ে যাবে।’
‘ওকে, স্যার।’ কাগজপত্র আর ফাইল গুছিয়ে নিয়ে চলে গেল রঘুপতি।
এসিজি তখন অনামিকা আর রতনকে বললেন যে, রঞ্জন দেবনাথের সঙ্গে তিনি আলাদাভাবে কয়েকটা কথা সেরে নিতে চান।
রতন বন্দ্যোপাধ্যায় সঙ্গে-সঙ্গে বিদায় নিলেন। যাবার আগে বললেন, ‘কোনওরকম দরকার হলে আমাকে খবর দেবেন…’
অনামিকাও চলে যাচ্ছিল। কিন্তু দরজার কাছে গিয়ে হঠাৎই ও থমকে দাঁড়াল। ফিরে এসে রঞ্জনকে নীচু গলায় কী একটা বলল। তারপর চলে এল এসিজির কাছে—প্রায় মুখোমুখি।
‘মিস্টার গুপ্ত একটা কথা বলার ছিল।’
‘বোসো,’ একটা সোফায় ওকে বসতে বললেন এসিজি। নিজেও আর-একটা সোফায় বসে সিগারেট ধরালেন। তারপর : ‘বলো, কী বলবে—।’
অনামিকার নাকের ডগায় কয়েকটা সূক্ষ্ম ঘামের ফোঁটা। চোখ গভীর অথচ চঞ্চল। মাঝে-মাঝে আড়চোখে দেখছে রঞ্জনের দিকে।
‘দেবারতি ঠিক ক’টার সময় খুন হয়েছে বলুন তো?’
‘ভাস্করবাবু আর হোটেলের লোকজন যা বলছেন তাতে মনে হয় রাত সোয়া এগারোটা থেকে সাড়ে এগারোটার মধ্যে। কিন্তু হঠাৎ এ-প্রশ্ন?’
‘না, মানে, কাল রাতে একটা অদ্ভুত ব্যাপার হয়েছিল। একটু আগে উৎপলদার কথা শোনার পরই ব্যাপারটা আমার অদ্ভুত মনে হচ্ছে।’
‘কী ব্যাপার?’
‘কাল রাতে উৎপলদা দেবারতির ঘরের কাছ থেকে চলে যাওয়ার মিনিট পাঁচ-সাত পর আমি দেবারতির কাছে গিয়েছিলাম…মানে, তখন এগারোটা বেজে বড়জোর পাঁচ-সাত কি দশ মিনিট হবে—’
এসিজি একটু উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। কী বলছে অনামিকা!
‘তোমার টাইমের ব্যাপারটায় কোনও ভুল নেই তো?’
অনামিকা তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘না, না—আমি ঘড়ি দেখেছি।’
‘তুমি দেবারতির কাছে গিয়েছিলে কেন?’ এসিজি জানতে চাইলেন। সিগারেটে বারকয়েক ঘন-ঘন টান দিলেন।
‘আসলে…ওর সঙ্গে…’ একটু ইতস্তত করে অনামিকা বলল, ‘আমার একটু ইয়ে, মানে, ঝগড়া মতন হয়েছিল—ওই ইন্টারভিউ নেবার সময়। ওর কথায় আমি একটু মাথা গরম করে ফেলেছিলাম। পরে ভেবে দেখলাম, কাজটা ঠিক হয়নি। মানে, আমি তো সবে লেখালিখি করছি…”সুপ্রভাত”-এর রবিবারের পাতাতেও গল্প দিয়েছি। ওই পাতাটা যিনি দেখেন, মানে, রমাতোষ ভৌমিক, তাঁর সঙ্গে দেবারতি মানির রিলেশন বেশ ভালো। তাই মনে হল, ব্যাপারটা মিটমাট করে নিই। দেবারতি মনখোলা মেয়ে—ওকে বুঝিয়ে রিকোয়েস্ট করলে হয়তো আর কিছু মাইন্ড করবে না। সেইজন্যেই ওর ঘরে গিয়েছিলাম।’
একটু দম নিয়ে রুমালে নাক-মুখ আলতো করে মুছে অনামিকা আবার বলল, ‘তো দরজায় দাঁড়িয়ে কলিংবেল বাজিয়ে দেখি কোনও সাড়া নেই। তখন নব ঘুরিয়ে দরজা খোলার চেষ্টা করলাম। দরজা খুলল না—লক করা।’
‘ভেতর থেকে কোনও কথাবার্তার শব্দ পাওনি?’ প্রত্যাশায় চকচক করে উঠেছে বৃদ্ধ গোয়েন্দার চোখ।
‘না।’
‘কিন্তু আমার ধারণা, সেই সময়ে ঘরের ভেতরে দেবারতির সঙ্গে কেউ ছিল। সে-ই খুন করেছে দেবারতিকে।’
‘উঁহু, ওইখানেই তো যত গোলমাল।’
‘তার মানে? তুমি কি কিছু দেখেছ নাকি?’
আবার কিছুক্ষণ ইতস্তত করল অনামিকা। তারপর বলল, ‘না, কিছু দেখিনি। আর সেইজন্যেই তো ব্যাপারটার মধ্যে কেমন একটা হেঁয়ালি আছে বলে মনে হচ্ছে। ওর ঘর থেকে কোনওরকম সাড়াশব্দ না পেয়ে আমি দরজার চাবির ফুটো দিয়ে উঁকি মেরেছিলাম। দেখলাম, দরজার সোজাসুজি পশ্চিমের জানলাটা হাট করে খোলা। ঘরে আলো জ্বলছে—কিন্তু কেউ কোথাও নেই।’
‘হয়তো দেবারতি তখন টয়লেটে গিয়ে থাকতে পারে।’
‘না। কারণ চাবির ফুটো দিয়ে বাথরুমের দরজাটাও আমি দেখতে পাচ্ছিলাম। ওটা খোলা ছিল। আর, বাথরুমে কোনও আলো জ্বলছিল না।’ মাথা নাড়ল অনামিকা : ‘না, মিস্টার গুপ্ত, তখন তিনশো আট নম্বর ঘরে কেউ ছিল না।’
মাথার চুলের গোছায় টান মারতে লাগলেন এসিজি। উঠে পড়লেন সোফার আরাম ছেড়ে। কী অদ্ভুত ব্যাপার! অনামিকা দেবারতির ঘরে কাউকে দেখেনি! অথচ তার পাঁচ-সাত মিনিটের মধ্যেই খুন হয়েছে মেয়েটা। তার মানে, উৎপলেন্দুবাবু চলে যাওয়ার ঠিক পরেই দেবারতি মানি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেছে, আবার অনামিকা চলে যাওয়ার পরে-পরেই ঘরে ফিরে এসেছে খুন হওয়ার জন্য। নাঃ, একেবারে অস্বাভাবিক!
এসিজির মগজের ভেতরে রুবিক কিউবের খুদে কিউবগুলো বনবন করে ঘুরপাক খাচ্ছিল। আর একইসঙ্গে মাথা ঝিমঝিম করছিল তাঁর। ঘরেই ছিল না মেয়েটা, অথচ পট করে খুন হয়ে গেল!
রঞ্জন দেবনাথ এসিজির কাছে এগিয়ে এল। বলল, ‘থিঙ্কিং মেশিন, দিস ইজ আ রিয়েল প্রবলেম ফর ইউ।’ ওর ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি।
‘আ-আমি তা হলে যাই…’ অনামিকা বলল।
এসিজির অন্যমনস্কতার ঘোর কেটে গেল হঠাৎ। একটু চমকে উঠেই বললেন, ‘হ্যাঁ—যাও।’
অনামিকা চলে যেতেই রঞ্জন দেবনাথ একা। ওকে দেখে একটু অবাক লাগল এসিজির। সবে কাল রাতে মারা গেছে দেবারতি মানি। অথচ এর মধ্যেই রঞ্জন বেশ স্বাভাবিক হয়ে গেছে।
‘দেবারতিকে কীরকম ভালোবাসতেন, রঞ্জনবাবু?’ আচমকা প্রশ্ন করেছেন এসিজি।
রঞ্জনকে হঠাৎই একটু অপ্রস্তুত দেখাল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘হ্যাঁ, ভালোবাসতাম, তবে তার শ্রেণিবিভাগ করতে পারব না।’
পকেট থেকে সিগারেট আর লাইটার বের করল রঞ্জন। মুখ আড়াল করে সিগারেট ধরাল।
‘দেবারতি সম্পর্কে দু-চারকথা বলুন,’ অনুরোধ করলেন অশোকচন্দ্র।
‘নতুন কী আর বলব বলুন!’ সিগারেটে গভীর টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল রঞ্জন : ‘ও রহস্য-সাহিত্যকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসত। আর আমাদের মধ্যে কোনও-কোনও লেখককে বলত রেস্তোরাঁর বেয়ারা। মানে, লেখার প্রতি ভালোবাসা, নিষ্ঠা, যত্ন, কিস্যু নেই…পাঠকরা যখন যা চায় রেস্তোরাঁর বেয়ারার মতো সেটাই প্লেটে সাজিয়ে দেয়…।’
‘আপনি কি সেই বেয়ারাদের একজন?’ রঞ্জনকে একটু খোঁচা দিতে চাইলেন এসিজি।
‘জানি না। ও কখনও আমাকে নামগুলো বলেনি।’
‘আপনার সঙ্গে ওর শেষ কখন দেখা হয়েছিল?’
‘ওই সাড়ে ন’টা দশটার সময়ে…এই লেখাটেখার ব্যাপার নিয়ে ওর ঘরে বসেই কথা হচ্ছিল…’
এসিজি সরাসরি তাকালেন রঞ্জনের চোখে : ‘তা হলে ইনভেস্টিগেশনে সাহায্য করার মতো আর কিছু আপনার বলার নেই?’
রঞ্জন দেবনাথের চোখের পাতা এতটুকু কাঁপল না। ও উদ্ধতভাবে সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বলল, ‘আপনি হুনুর—এখানে হুনুরি করতে এসেছেন। খুনি ধরা আপনার কাজ, আমার নয়। বুদ্ধি থাকলে যেসব তথ্য পেয়েছেন তা থেকেই খুনি ধরা যায়। ইটস ইওর গেম। গুড বাই।’
রঞ্জন দেবনাথ দ্রুতপায়ে চলে গেল ঘর ছেড়ে। সিগারেটের ধোঁয়ার রেখার মাঝে অশোকচন্দ্র গুপ্ত দাঁড়িয়ে রইলেন পাথরের মূর্তির মতো। একা।
চোখ বুজে চুপচাপ দাঁড়িয়ে পলিতকেশ বৃদ্ধ হুনুর প্রাণপণে চেষ্টা করলেন খুনির ছবিটা দেখতে, কিন্তু অদৃশ্য এক পাগল-করা ঢেউ বারবার ছবিটাকে ঝাপসা করে দিচ্ছিল। তবে এটুকু বুঝতে পারছিলেন, দেবারতি কীভাবে খুন হয়েছে সেটা ধরতে পারলেই বাকিটা ধরে ফেলা যাবে অনায়াসে।
কিন্তু ঠিক কীভাবে খুন হয়েছে দেবারতি মানি?
নয়
আজ সম্মেলনের শেষ দিন।
দেবারতি মানির ঘটনার পরদিন থেকেই সম্মেলনের সুর কেটে গেছে। যেন যান্ত্রিকভাবে কয়েকটা রোবট তাদের মাস্টার প্রোগ্রাম অনুযায়ী কাজ করে চলেছে। দর্শক বা শ্রোতাদের মধ্যে অনেকেই চাপা আলোচনা করে চলেছেন দেবারতির মৃত্যু নিয়ে। খবরের কাগজগুলো এখনও পর্যন্ত ব্যাপারটাকে আত্মহত্যা অথবা দুর্ঘটনা বলে চালাতে চেষ্টা করছে। তবে পাঠকদের বেশিরভাগই সেটা মেনে নিতে নারাজ। তার প্রধান কারণ, সাধারণ মানুষ, যাদের রোজকার জীবন নিতান্তই সাধারণ, তারা সবসময় রহস্য-রোমাঞ্চ পছন্দ করে। কোনও খবর চাঞ্চল্যকর হলে তবেই সেটা তাদের আগ্রহ জাগায়, তারা হুমড়ি খেয়ে পড়ে সেই খবরের ওপরে।
সুতরাং বলরুমে মোটামুটি একটা অশান্তভাব ছিল। গত পরশু সকালে ভাঙা হাটে সম্মেলন শুরু হওয়ার সময়ে দেবারতি মানির আকস্মিক মৃত্যুর জন্য শোকপ্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছিল, আর পালন করা হয়েছিল এক মিনিট নীরবতা। ব্যস, তারপর থেকেই আসর জুড়ে ঘুরপাক খেয়ে চলেছে একটাই প্রশ্ন : দেবারতি মানির মৃত্যুর পিছনে রহস্যটা কী?
আজ, বার্ষিক এই অনুষ্ঠানের শেষ দিনেও, সেই একই প্রশ্ন কুরে-কুরে খাচ্ছে সবাইকে।
হলের একেবারে পিছনের সারিতে বসেছিলেন অশোকচন্দ্র গুপ্ত। চোখের কোণে, কপালে আর নাকের দুপাশে বলিরেখা প্রকট। পাঞ্জাবির পকেটে হাত ঢুকিয়ে সিগারেটের প্যাকেটটা নাড়াচাড়া করছিলেন একটা সিগারেট ধরানোর জন্য। কিন্তু এয়ার কন্ডিশন্ড বলরুমে ধূমপান নিষেধ।
এসিজির পাশেই বসে ছিল রঘুপতি যাদব। হাতে যথারীতি কাগজপত্রের ফাইল। এ-ক’দিনের ধকলে বেচারার মুখেও ক্লান্তির ছাপ পড়েছে।
ওয়ার্কশপে গল্পপাঠের আসর বসেছে। প্রত্যেক লেখক নিজের লেখা পড়ে শোনাচ্ছেন। এই লেখা প্রত্যেকে লিখেছেন গত চারদিনের মধ্যে—অর্থাৎ, কনফারেন্স শুরু হওয়ার দিন থেকে তাঁরা লেখায় হাত দিয়েছেন।
এসিজি মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন। গল্প পড়ে শোনাচ্ছিল অনামিকা সেনগুপ্ত। গল্পের বিষয় লকড় রুম প্রবেলম। জানলা-দরজা বন্ধ একটা ঘরের ভেতরে একজন মানুষ মরে পড়ে আছে। বুকে বিঁধে আছে তীর। জানলা বা দরজায় এমন কোনও ফাঁক-ফোকর নেই যা দিয়ে তীর ছোড়া যায়।
এসিজির মনে পড়ে গেল কার্টার ডিকসনের লেখা ‘দ্য জুডাস উইন্ডো’ উপন্যাসটার কথা। সেখানেও সমস্যাটা একইরকম ছিল। আর সমাধান ছিল ভারি অদ্ভুত! দরজার হাতলের প্লেটের স্ক্রুগুলো খুলে ফেলেছিল খুনি। তারপর প্লেটসমেত হাতলটা সরিয়ে নিয়েছে। ফলে দরজার গায়ে যে-ছোট্ট ফোকর তৈরি হয়েছে তাতে ক্রসবো লাগিয়ে সে তীর ছুড়েছে নির্ভুল লক্ষ্যে। তারপর আবার হাতলটা লাগিয়ে দিয়েছে জায়গা মতো। অভিনব, তবে বড্ড কষ্টকল্পিত সমাধান।
কিন্তু অনামিকার সমাধানটা অনেক সহজ-সরল এবং বাস্তব। খুন হওয়ার আগে মানুষটা দাঁড়িয়ে ছিল দরজার বাইরে। হঠাৎই খুনির ছুড়ে দেওয়া তীর এসে লাগে তার বুকে। সেই অবস্থায় সে ঢুকে পড়ে ঘরের ভেতরে। দরজা বন্ধ করে দেয়। জানলাগুলো সব আগে থেকেই বন্ধ করা ছিল। সুতরাং আহত লোকটি যখন ছটফট করতে-করতে বন্ধ ঘরের মধ্যে মারা যায়, তখনই তৈরি হয়ে যায় ‘বন্ধ ঘরের রহস্য’।
এসিজি শুনছিলেন আর অবাক হয়ে ভাবছিলেন। একই ঘটনার কতরকম সমাধান সম্ভব! দেবারতি মানির বেলাতেও তাই। দশজনের মধ্যে অন্তত ছ’জন লেখক ছ’রকম সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। প্রত্যেকটা সমাধানের মধ্যেই কোনও না কোনও ত্রুটি রয়েছে। কিন্তু সেগুলোর সাহায্য নিয়েই তিনি খুঁজে পেয়েছেন সঠিক উত্তর। বিশেষ করে অনামিকার শেষ কথাগুলো শোনার পর আর কোনও অসুবিধে হয়নি। চাবির ফুটো দিয়ে উঁকি মেরে ও ঘরে কাউকে দেখতে পায়নি, এই তথ্যটাই এসিজিকে সাহায্য করেছে সবচেয়ে বেশি। তা ছাড়া রঞ্জন দেবনাথের কাছ থেকেও তিনি কম সাহায্য পাননি। রঞ্জন উদ্ধত, তবে বুদ্ধিমান লেখক তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
কিন্তু এত সত্ত্বেও লকড রুম প্রবলেমের কিছুটা অংশ এখনও ঝাপসা থেকে গেছে।
রঘুপতির কাছ থেকে দুটো কাগজ চেয়ে নিলেন তিনি। গত দুদিনে দশটা ঘর সার্চ করে যা-যা পাওয়া গেছে তারই একটা নির্বাচিত তালিকা। আগেও অনেকবার দেখেছেন, তবু আরও একবার চোখ বোলালেন অশোকচন্দ্র।
অনামিকা সেনগুপ্ত (রুম নাম্বার ৪০৭) : রঞ্জন দেবনাথের উপহার দেওয়া দুটো গানের ক্যাসেট আর একটা বই—সমরেশ মজুমদারের ‘প্রেমের গল্প’। পাঁচ মিটার লম্বা একটা লাল রঙের নাইলনের দড়ি। একটা খালি বিয়ারের বোতল।
রত্নাবলী মুখোপাধ্যায় (রুম নাম্বার ৪০৮) : দেড় ডজন ভ্যালিয়্যাম ফাইভ ট্যাবলেট। ছ’টা সিপলক্স ক্যাপসুল। চুলে কলপ করার মেহেদি পাতার গুঁড়োর প্যাকেট। ম্যাকডাওয়েল হুইস্কির একটা ছোট বোতল—তার অর্ধেকের বেশি খালি। এক কাটিম সাদা সেলাইয়ের সুতো। একটা মাঝারি মাপের ছুঁচ। রূপেন মজুমদারের উপহার দেওয়া এক কপি ‘ডাকিনীর হাতছানি’।
জ্যোতিষ্ক সান্যাল (রুম নাম্বার ৪০৯) : একটা এয়ার পিস্তল। একটা ছোট ছুরি। একটা রহস্য উপন্যাসের সম্পূর্ণ পাণ্ডুলিপি—নাম ‘খুন জখম রাহাজানি।’।
রূপেন মজুমদার (রুম নাম্বার ৪১০) : বাইশ কপি ‘ডাকিনীর হাতছানি’। চারটি ছোট গল্প, একটি নভেলেট এবং একটি উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি : প্রত্যেকটি পাণ্ডুলিপির প্রথম পৃষ্ঠায় ওপরে বাঁদিকে বড় বড় করে লেখা ‘সম্পূর্ণ মৌলিক কাহিনি’। এক শিশি ‘থার্টি প্লাস’ ট্যাবলেট। সবক’টি রহস্য-রোমাঞ্চ পত্রিকার নাম-ঠিকানা এবং ফোন নম্বর লেখা একটি ডায়েরি।
রঞ্জন দেবনাথ (রুম নাম্বার ৪১১) : অনামিকা সেনগুপ্তের দেওয়া জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’। কয়েকটা বিদেশি রহস্য উপন্যাস। একটা ক্রসওয়ার্ড পাজলের বই। দুটো প্রেমের কবিতা—অর্ধেকটা করে লেখা। একটা বড় কাঁচি আর হাত তিনেক লম্বা একটা সাদা দড়ি। চারটে রঙিন কাচের পুতুল। তিনটে ‘কামসূত্র’ কন্ডোম।
অনিমেষ চৌধুরি (রুম নাম্বার ৩০৭) : সতেরোটি বিদেশি কল্পবিজ্ঞানের উপন্যাস—প্রত্যেকটা বইয়ের টাইটেল পেজে ইংরেজি নামের পাশে হাতে লেখা সম্ভাব্য বাংলা নাম। দুটি বিদেশি সফট পর্নো ম্যাগাজিন। এক ফাইল বলবর্ধক ‘শিলাজিৎ’ ট্যাবলেট। ন’টা অসমাপ্ত পাণ্ডুলিপি।
রতন বন্দ্যোপাধ্যায় (রুম নাম্বার ৩১০) : নিজের লেখা বিভিন্ন বই—মোট সাতষট্টি কপি। দুটি উপন্যাস, তিনটি নভেলেট এবং সাতটি ছোট গল্পের পাণ্ডুলিপি। বিভিন্ন পাঠকের লেখা একতাড়া প্রশংসাপত্র। প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর আগে পাওয়া বক্সিং চ্যাম্পিয়ানশিপের জরাজীর্ণ দুটো সার্টিফিকেট আর তার পাঁচটি করে ফটোকপি। (এই সার্টিফিকেট দুটোর ফটোকপি দেবারতি মানির ঘর থেকে পাওয়া গেছে—সম্ভবত ইন্টারভিউ নেবার সময় লেখক দিয়েছিলেন)।
ভাস্কর রাহা (রুম নাম্বার ২০৮) : হুইস্কির একটা খালি বোতল। কয়েকটা বিদেশি সাহিত্য পত্রিকা। খবরের কাগজ থেকে কেটে নেওয়া রহস্য-সাহিত্য সংক্রান্ত কয়েকটা খবরের কাটিং। দেবারতি মানির লেখা একটা ফিচারের খসড়া। ‘ভয়ংকর’ আর ‘ছায়াময়’ পত্রিকার প্রথম বছরের চারটি পুরোনো সংখ্যা। কয়েকটা আধপোড়া চুরুট। এক বাক্স আলপিন। একটা নীল রঙের ‘রেনল্ডস’ বলপয়েন্ট পেন (দেবারতি মানির ঘরে টেবিলের ওপরে পাওয়া পেনটার মতো)।
অর্জুন দত্ত (রুম নাম্বার ২০৯) : তেরোটি বিদেশি রহস্য-রোমাঞ্চ ‘সত্যকাহিনি’ জাতীয় পত্রিকা। মহিলাদের চারটে ফ্যাশান ম্যাগাজিন। ব্যায়াম করার জন্য একটা ‘বুলওয়ার্কার’। দশটা ক্যামপোজ ট্যাবলেট। নাম-না-জানা দুজন মহিলার ফটো। ‘ছায়াময়’ পত্রিকার এ-বছরের পুজো সংখ্যা।
উৎপলেন্দু সেন (রুম নাম্বার ২১০) : বাংলা সাহিত্যের নামি কয়েকজন লেখকের লেখা পাঁচটি উপন্যাস—পাঁচটি বই-ই লাল কালি দিয়ে দাগ কেটে নানান মন্তব্যে ভরতি করে দেওয়া হয়েছে। রত্নাবলী মুখোপাধ্যায়, ভাস্কর রাহা এবং রতন বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটা করে উপন্যাস (এগুলোও লাল কালিতে যথেষ্ট কলঙ্কিত)। দুটো ‘প্লেওয়ে’ আর একটা ‘ফ্যানটাসি’ পত্রিকা—তাতে ন্যুড পোস্টারের পাতাগুলো ব্যবহারে ব্যবহারে কোঁচকানো। দেবারতি মানি সম্পর্কে কটু মন্তব্য লেখা দুটো প্যাডের পাতা। পুরুষালী চিহ্নে কলঙ্কিত একটা লুঙ্গি আর একটা পাজামা। চারটে অসমাপ্ত লেখার পাণ্ডুলিপি। এক প্যাকেট ‘৭৭২’ তাস। তিনটে বিদেশি নাটকের বই।
এই তালিকার কোথাও কি লুকিয়ে রয়েছে খুনের উদ্দেশ্য বা কৌশলের কোনও ইঙ্গিত, কোনও সূত্র? অশোকচন্দ্র গুপ্ত ক্রমাগত ডুবে যাচ্ছিলেন চিন্তায়। দেবারতি মানিকে তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন চোখের সামনে। খিলখিল হেসে মেয়েটা বলছিল, ‘ইউনিভার্সিটিতে পড়ানো আর হুনুরি এক ব্যাপার নয়, স্যার। ফর ডিটেকশন ইউ নিড রিয়েল ব্রেইন। হিন্টসগুলো মনে আছে তো!’
মনে আছে। সেগুলো নানানভাবে খতিয়ে দেখেছেন এসিজি, কিন্তু তার মধ্যে খুনির স্পষ্ট পরিচয় বা সেরকম কোনও ইশারা লুকিয়ে নেই।
আরও একটা ব্যাপার ভাবিয়ে তুলেছে তাঁকে : পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট।
হাতের কাগজ দুটো রঘুপতি যাদবকে ফিরিয়ে দিয়ে পি.এম. রিপোর্টের কপিটা দেখতে চাইলেন এসিজি।
খুন হওয়ার আগে মদ খেয়েছিল দেবারতি। তা ছাড়া ওর পাকস্থলীতে পাওয়া গেছে ঘুমের ওষুধ।
মেয়েটা কি অনিদ্রায় ভুগত? তা হলে ওর ঘর সার্চ করে স্পিÏপিং পিলস পাওয়া গেল না কেন?
এসিজির দম বন্ধ হয়ে আসছিল। এক্ষুনি একটা সিগারেট ধরাতে না পারলে তিনি মরে যাবেন। রঘুপতিকে রিপোর্টের কপিটা ফেরত দিয়ে বললেন নীচু গলায়, ‘আমি বাইরের বারান্দায় আছি। তুমি কান খাড়া করে শোনো কে কী বলছে। এখন আমাদের কোনও ইনফরমেশন মিস করা চলবে না।’
রঘুপতি বাধ্য ছাত্রের মতো ঘাড় নাড়ল। এসিজি বেরিয়ে গেলেন বলরুম ছেড়ে।
বাইরের বারান্দায় এসে একটা সিগারেট ধরাতেই দেখতে পেলেন, বলরুমের আর-একটা কাচের দরজা ঠেলে ভাস্কর রাহাও বেরিয়ে আসছেন। উদ্দেশ্য বোধহয় একই : ধূমপান।
এসিজি ভাস্কর রাহাকে লক্ষ্য করে হাত নাড়লেন।
চুরুট ধরিয়ে খোলা বারান্দায় এসিজির কাছে চলে এলেন ভাস্কর। চারপাশে সোনা-রোদ, নীল আকাশ, হালকা ঠান্ডা বাতাস, টবে সাজানো গাছ। সামনের বড় রাস্তায় বেলা সাড়ে এগারোটার ব্যস্ততা।
এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে স্মিত হেসে ভাস্কর রাহা সপ্রশ্নে তাকালেন এসিজির দিকে। দেবারতি খুন হওয়ার পর থেকে এই বৃদ্ধ অধ্যাপক তাঁদের কম জিজ্ঞাসাবাদ করেননি। গতকালও তাঁর প্রশ্নবাণের হাত থেকে কেউ রেহাই পায়নি, তার ওপর ঘর তল্লাশি করার নাজেহাল ব্যাপার।
‘আজই তো শেষদিন ভাস্করবাবু—,’ ‘শেষদিন’ শব্দটার ওপরে একটু জোর দিয়ে যেন বললেন এসিজি।
ভাস্কর রাহা ঘাড় নাড়লেন নীরবে।
‘আপনি কখনও রুবিক কিউব দেখেছেন, ভাস্করবাবু?’
‘না—’ মাথা নাড়লেন ভাস্কর।
‘হাঙ্গেরির এক অধ্যাপক ছাত্রদের গ্রুপ থিয়োরি পড়াতে গিয়ে একটা কিউব তৈরি করেছিলেন ১৯৭৫ সালে। সেই অধ্যাপকের নাম আর্নো রুবিক। এই কিউবে কতকগুলো খুদে-খুদে রঙিন কিউব জুড়ে তৈরি করা হয়েছে একটা বড় কিউব। খুদে কিউবের থাকগুলোকে নানানভাবে ঘুরিয়ে বড় কিউবটার ছ’টা পিঠে নানানরকম নকশা তৈরি করা যায়। ভারি মজার ধাঁধা…।’
ভাস্কর রাহা ঠিক বুঝতে পারছিলেন না এখন তাঁর কী বলা উচিত। এই বৃদ্ধ গোয়েন্দা হঠাৎই বা তাঁকে রুবিক কিউবের গল্প শোনাচ্ছেন কেন?
এসিজি রুবিক কিউব নিয়ে যেন আপনমনেই নানান কথা বলছিলেন আর সিগারেটে টান দিচ্ছিলেন ক্রমাগত। তাঁর মাথার ভেতরে খুদে কিউবগুলো বনবন করে ঘুরপাক খেয়ে দেবারতি মানির খুনের নকশা তৈরি করার চেষ্টা করছিল।
‘আচ্ছা ভাস্করবাবু, আপনাদের মধ্যে কারা-কারা ড্রিঙ্ক করেন বলতে পারেন?’ হঠাৎই জানতে চাইলেন এসিজি।
মজা করে হাসলেন ভাস্কর, বললেন, ‘ঠিক বলতে পারব না—তবে অনেকেই এ-রসে অভ্যস্ত। এটা না হলে লেখালিখি ঠিক জমে না…।’
‘তার মানে? নেশা না করলে আপনার লিখতে অসুবিধে হয়?’
আবার প্রসন্ন হাসলেন রাহা : ‘ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলা খুব মুশকিল। মানে, আমার লেখার মূল সূত্র হচ্ছে, রহস্যের প্রত্যেকটি টুকরোকে কল্পনার সুতোয় গেঁথে খুশিমতো খেলিয়ে তারপর সেগুলো সুন্দর করে সাজিয়ে দেওয়া সাদা কাগজের পৃষ্ঠায়। একটু-আধটু নেশা করলে লাগামছাড়া কল্পনার সুতো খুশিমতো খেলা করতে পারে—অন্তত আমার তাই মনে হয়…।’
‘মাই গড!’ অবাক হয়ে বলে উঠলেন এসিজি। তাঁর চোখের নজর ভাস্কর রাহার শরীর ভেদ করে যেন চলে গেছে কোন দিগন্তে। কপালে বয়েসের কারুকাজ। বাতাসে সাদা চুল উড়ছে। দূরে পাখি ডাকছে কোথাও। আর তাঁর মগজের ভেতরে বনবন করে পাক খাওয়া খুদে কিউবগুলো চোখের পলকে নিজেদের সাজিয়ে নিয়ে ফুটিয়ে তুলল রুবিক কিউবের অভিনব এক নকশা—দেবারতি মানির খুনের নকশা।
কী আশ্চর্য! এই সামান্য একটা ব্যাপার নিয়ে এ ক’দিন কী নাজেহালটাই না হয়েছেন অশোকচন্দ্র! এখন তো বলতে গেলে সব জলের মতো স্পষ্ট! ঝাপসা যেটুকু আছে তা অতি সামান্য। রঞ্জন দেবনাথ পরশুদিন ঠিকই বলেছিল : আপনার থিঙ্কিং মেশিন বিগড়ে গেছে—রিপেয়ার করতে হবে।
‘ভাস্করবাবু, আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ—’ এসিজির গলার স্বর কাঁপছিল।
‘কেন?’ ভাস্কর রাহা এই বৃদ্ধ হুনুরের আচরণের কোনও থই পাচ্ছিলেন না।
‘এখন আমি জানি, দেবারতি মানিকে কে খুন করেছে, কীভাবে খুন করেছে। আজ সন্ধে সাতটার সময় আপনার ঘরে সবাইকে থাকতে বলবেন—।’
‘নাটকের শেষ দৃশ্য?’ ঠাট্টা করে জিগ্যেস করলেন রাহা।
‘আপনাদের সাহিত্যের ভাষায় হয়তো তাই…’ একটু থেমে সিগারেটে টান দিয়ে এসিজি বললেন, ‘তবে আমার কাছে পাখি ধরার কাজ। বুঝলেন, দেবারতি মেয়েটা বেশ বুদ্ধিমতী ছিল।’
‘কেন?’
‘খুব মজার হিন্টস দিয়েছিল। দারুণ!’ আপনমনেই হাসতে শুরু করলেন এসিজি।
রঘুপতি যাদব কখন যেন এসে হাজির হয়েছিল খোলা বারান্দায়। অশোকচন্দ্রকে হাসতে দেখে সে অবাক হয়ে জিগ্যেস করল, ‘কিঁউ স্যার, কেয়া বাত হ্যায়? কোই খাস বাত হ্যায় কেয়া?’
ওর দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে ডান হাত তুললেন এসিজি। হাসতে-হাসতেই বললেন, ‘ওহে আমার প্রাক্তন ছাত্র, অতি দুর্লভ প্রজাতির একটি পাখি আজ সন্ধেবেলা তুলে দেব তোমার হাতে…।’
রঘুপতি যাদব ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল তার ‘প্রাক্তন স্যার’-এর দিকে।
প্রতীক্ষায়-প্রতীক্ষায় যেন ধৈর্যচ্যুতির সীমারেখায় পৌঁছে গেছেন প্রত্যেকে। কারণ, ঘড়িতে এখন সাতটা বেজে পাঁচ মিনিট। ভাস্কর রাহার দুশো আট নম্বর ঘরে এখানে-ওখানে দাঁড়িয়ে বা বসে অপেক্ষা করছেন দশজন রহস্য-লেখক। তাঁদের শ্বাস-প্রশ্বাস এখন বোধহয় স্বাভাবিক নয়। ‘বার্ষিক রহস্য-রোমাঞ্চ লেখক সম্মেলন’ শেষ হয়ে গেলেও এখন হয়তো শুরু হবে তার আসল সমাপ্তি অনুষ্ঠান।
অনামিকা একটা পালিশ করা কাঠের আলমারির সামনে দাঁড়িয়ে দাঁত দিয়ে নখ কাটছিল। আর মাঝে-মাঝেই নীচু গলায় কথা বলছিল পাশে দাঁড়ানো রঞ্জন দেবনাথের সঙ্গে।
রত্নাবলী মুখোপাধ্যায় বসে ছিলেন বিছানায়। তাঁর পাশে রূপেন মজুমদার আর রতন বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁদের কাছ থেকে খানিকটা দূরে সোফায় বসে আছেন অধ্যাপক অনিমেষ চৌধুরি, জ্যোতিষ্ক সান্যাল আর অর্জুন দত্ত।
পশ্চিমের খোলা জানালার কাছে দাঁড়িয়ে ভাস্কর রাহা আর উৎপলেন্দু সেন। বাইরের গাঢ় আকাশের দিকে তাকিয়ে তাঁরা আলতো গলায় কী একটা বিষয় নিয়ে কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছেন। ঘরের বাতাসে সিগারেট আর চুরুটের ভারি গন্ধ। আবহাওয়ায় উৎকণ্ঠার পরত জমতে-জমতে মাখনের মতো পুরু হয়ে গেছে।
শেষ পর্যন্ত অধৈর্য হয়ে প্রথম নীরবতা ভাঙল রঞ্জন দেবনাথ। শোনা যায় এমন স্পষ্ট গলায় বলে উঠল, ‘মিস্টার গুপ্তের এত দেরি হচ্ছে কেন কে জানে!’
প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই দরজার কাছ থেকে শোনা গেল, ‘উনি এসে গেছেন।’
দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকেছেন হোটেলের এক্সিকিউটিভ ম্যানেজার প্রশান্ত রায়। কথাটা বলেছেন তিনিই। তাঁকে অনুসরণ করে ঘরে ঢুকলেন অশোকচন্দ্র গুপ্ত আর রঘুপতি যাদব। সঙ্গে দুজন উর্দি পরা কনস্টেবল।
প্রশান্ত রায়ের কপালে ঘামের ফোঁটা। পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছে নিয়ে তিনি বললেন, ‘মিস্টার গুপ্ত, এখন গোটা ব্যাপারটাই আপনার হাতে।’
হেসে মাথা ঝুঁকিয়ে ধন্যবাদ জানালেন এসিজি। ঘরের প্রায় মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ালেন। চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন, ‘একটা সুতো খুঁজতে গিয়ে একটু দেরি হয়ে গেল।’
‘সুতো!’ অবাক হয়ে বলে উঠেছেন রত্নাবলী।
ওঁর দিকে তাকিয়ে বিনীত হেসে এসিজি বলেছেন, ‘হ্যাঁ, ম্যাডাম, সুতো। মানে, সূত্র—দেবারতি মানির খুনের সূত্র। কারণ, দেবারতির হত্যারহস্য বলতে গেলে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা সুতোর ওপরে।’ প্রত্যেকটি লেখককে বেশ সময় নিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন এসিজি। তারপর গম্ভীর স্বরে বললেন, ‘দেবারতি মানি ছিল সাংবাদিক। ক্রাইম জার্নালিস্ট। রহস্য-সাহিত্যকে অন্তর দিয়ে ভালোবাসত ও। কী একটা টপ সিক্রেট ও জেনে ফেলেছিল কেমন করে। তাই এই কনফারেন্সে এসে ওকে খুন হতে হল। ব্রুটাল অ্যান্ড ন্যাস্টি মার্ডার। এবং খুনের পদ্ধতি বেশ জটিল এবং অভিনব—জন ডিকসন কারের বইতেও যা নেই।’ একটু থেমে তারপর : ‘তবে খুনি যে আগে থেকে প্ল্যান করে খুন করেছে তা নয়। বরং হঠাৎই খুনিকে এমন একটা নিষ্ঠুর সিদ্ধান্ত নিতে হয়। আর অনেকটা ঘটনাচক্রেই বলা যায়—খুনের পদ্ধতিটা হয়ে যায় ইনজিনিয়াস। ঠিক রূপেন মজুমদারের ”ডাকিনীর হাতছানি”-র মতো।’
হাতের জ্বলন্ত সিগারেটে শব্দ করে টান দিলেন অশোকচন্দ্র। তারপর বললেন, ‘দেবারতির টপ সিক্রেট জেনে ফেলার ব্যাপারটা মোটেই গোপন ছিল না, বরং সকলেই জেনে গিয়েছিলেন—এমনকী খুনিও। সম্পাদক প্রেমময় চৌধুরির উসকানিতে দেবারতি সকলের সামনেই একটু হিন্টস দিয়েছিল : পাঁচকড়ি দে এবং এডগার ওয়ালেস। আমি অনেক বইপত্তর ঘেঁটে মাত্র একটাই মিল পেয়েছি এই দুজন লেখকের মধ্যে। সমালোচকরা সন্দেহ করেন, এই দুজন লেখকেরই গোস্ট রাইটার বা ছায়ালেখক ছিল। অর্থাৎ, ওঁদের নামে যেসব বই প্রকাশিত হয়েছে তার অনেকগুলোই প্রকৃতপক্ষে অন্য কেউ ওঁদের হয়ে লিখে দিয়েছেন।’
‘ছায়ালেখক!’ ভাস্কর রাহা অবাক হয়ে চুরুটের ধোঁয়া ছেড়েছেন।
‘কিন্তু অন্যের নামে লিখে সেই ছায়ালেখকের লাভ কী?’ প্রশ্ন করেছেন জ্যোতিষ্ক সান্যাল।
‘উত্তর অতি সহজ। টাকার জন্যে ছায়ালেখকেরা হয়তো বেনামে বই লিখতে রাজি হয়েছিলেন।’ অশোকচন্দ্র সিগারেটের ছাই ঝেড়ে আবার শুরু করলেন, ‘পাঁচকড়ি দে-র প্রধান ছায়ালেখক ছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ পাল—পাঁচকড়ি দে-র বইয়ের প্রকাশক ”পাল ব্রাদার্স”-এর একজন স্বত্বাধিকারী। আর এডগার ওয়ালেস এত উর্বর-লেখনীর মালিক ছিলেন যে, এক-একসময় বছরে পাঁচটা, সাতটা, আটটা কিংবা ন’টা পর্যন্ত বই প্রকাশ করেছেন। তাঁর এই অনর্গল লেখার স্রোত দেখে অনেকে মনে করতেন—বা বলা ভালো, এখনও সন্দেহ করেন—তাঁর অনেক গুপ্তলেখক বা ছায়ালেখক ছিল। বুঝতেই পারছেন, সমালোচকরা শুধু সন্দেহই করতে পেরেছেন, প্রমাণ করতে পারেননি। কারণ, এই ধরনের ব্যাপার কখনও প্রমাণ করা সম্ভব নয়।
‘সুতরাং দেখা যাচ্ছে, দেবারতি যদি ঠাট্টা না করে থাকে তা হলে বোধহয় ও গোস্ট রাইটারের কথাই বলতে চাইছিল। অর্থাৎ, এই সম্মেলনে—মানে, এখন এই ঘরে—এমন একজন লেখক হাজির রয়েছেন যিনি ছায়ালেখক ব্যবহার করে একের পর এক বই প্রকাশ করে চলেছেন এবং রহস্য-সাহিত্যিক হিসেবে খ্যাতিমান হয়েছেন—।’
‘আজকের যুগে কি এই ছায়ালেখকের ব্যাপারটা স্বাভাবিক বলে মনে হয়, মিস্টার গুপ্ত?’ রত্নাবলী মুখোপাধ্যায় জিগ্যেস করেছেন এসিজিকে।
এসিজি হেসে বললেন, ‘ঠিকই ধরেছেন, ম্যাডাম। ব্যাপারটা অস্বাভাবিক বলেই সেই সিক্রেট জানাজানি হলে সেটা নিউজপেপারের হেডলাইন হয়ে যেত। তখন আপনার তো সুইসাইড করা ছাড়া কোনও উপায় থাকত না। বলুন, ভুল বলেছি?’
রত্নাবলীর মুখের রক্ত ব্লটিং পেপার দিয়ে কেউ শুষে নিল পলকে। তিনি হাসতে চেষ্টা করলেন, কিন্তু হাসিটা কান্নার মতো দেখাল। শাড়ির আঁচল ভালো করে গায়ে জড়িয়ে নিলেন। এপাশ-ওপাশ কয়েকবার তাকিয়ে মুখ নামিয়ে নিলেন। ওঁর শরীরটা একটু-একটু কাঁপছিল।
ছিলে ছেঁড়া ধনুকের মতো উঠে দাঁড়িয়েছেন ভাস্কর রাহা। তাঁর দু-চোখে বিস্ময়। কোনওরকমে বলতে গেলেন, ‘মিস্টার গুপ্ত, বোধহয় কোথাও একটা…,’ কিন্তু কথা শেষ করতে পারলেন না। তিনি স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে রইলেন বাংলা রহস্য-সাহিত্যের সম্রাজ্ঞীর দিকে। সৌম্য, স্নিগ্ধ, শান্ত। অথচ শুধু কাগজে কলমে নয়, বাস্তবেও খুন করার ক্ষমতা রাখেন।
‘কিন্তু এসব কী বলছেন আপনি!’ এসিজিকে লক্ষ্য করে বলে উঠেছে অনামিকা সেনগুপ্ত, ‘রত্নাদির হয়ে কে বই লিখে দেয়? কে সেই গোস্ট রাইটার?’
হাত তুলে অনামিকাকে আশ্বাস দিলেন এসিজি, বললেন, ‘একটু ধৈর্য ধরো, মা-মণি, সব বলছি।’
‘মাপ করবেন, মিসেস মুখার্জি—মাপ করবেন, ভাস্করবাবু। আপনাদের দক্ষ গোয়েন্দা করঞ্জাক্ষ রুদ্র বা সুরজিৎ সেনের মতো গুছিয়ে নাটকীয়ভাবে হয়তো এই শেষ দৃশ্য আমি জমাতে পারব না, তবে চেষ্টা করতে দোষ নেই। আমি আগেই তো আপনাদের বলেছি, চেহারা আমার শার্লক হোমসের মতো নয়, সেরকম করে পাইপ টানতেও পারি না। এরকুল পোয়ারোর মতো মোমের পালিশ দেওয়া ছুঁচলো গোঁফও আমার নেই। মানে, আপনাদের কাহিনির গোয়েন্দাদের মতো সর্ববিষয়ে বিশারদ আমি নই—তবে আমি কোনওরকমে জোড়াতালি দিয়ে কাজ চালিয়ে নিই। আমার হুনুরি খুব সাদামাঠা, সহজ-সরল।’
ঘরে গুঞ্জন চলছিল। প্রায় সকলেই বিধ্বস্ত রত্নাবলীর দিকে তাকিয়ে ছিলেন।
শুধু রঘুপতি যাদব চোয়াল শক্ত করে ঘরের এককোণে পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে।
‘প্রথমে বলি লকড রুম প্রবলেমের সলিউশনের কথা। মানে, কী করে খুন হয়েছিল দেবারতি মানি। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়ার জন্যে আমি আপনাদের সাহায্য চেয়েছিলাম—এবং আপনাদের অনেকেই যথাসাধ্য সাহায্য করেছেন। আপনাদের কথাবার্তা থেকেই বন্ধ ঘরের রহস্যের আসল উত্তর খুঁজে পেয়েছি আমি। তবে সেই রহস্য ফাঁস করার আগে উৎপলেন্দুবাবুকে একটা প্রশ্ন করতে চাই—’ এসিজি ঘুরে তাকালেন উৎপলেন্দু সেনের দিকে : ‘মিস্টার সেন, খুব ভেবে একটা কথা বলুন তো। খুনের দিন রাত এগারোটা নাগাদ আপনি যখন তিনশো আট নম্বর ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে দেবারতির সঙ্গে কথা বলেছিলেন তখন ওর গলার স্বর নিয়ে আপনার কোনওরকম সন্দেহ হয়নি? মনে হয়নি, দেবারতির বদলে অন্য কেউ আপনার সঙ্গে কথা বলছে?’
কিছুক্ষণ সময় নিয়ে তারপর উৎপলেন্দু জবাব দিলেন, ‘না, সন্দেহ হয়নি। তবে গলাটা একটু জড়ানো মনে হয়েছিল। তা ছাড়া, আমিও তো নেশা করে ছিলাম…।’
রত্নাবলী এতক্ষণে নিজেকে খানিকটা সামলে নিয়েছেন। শুকনো হেসে বললেন, ‘সন্দেহ হওয়ার কথা নয়, মিস্টার গুপ্ত। আমার গলা শুনে বয়েস বোঝা যায় না। তা ছাড়া একটু জড়িয়ে কথা বলেছিলাম।’ একটু ইতস্তত করে আবার বললেন, ‘তখন উৎপলেন্দুবাবুর কথার জবাবও দিয়েছি আন্দাজে। কারণ তখন তো আর ”পরীক্ষা” বলতে কিসের পরীক্ষা বুঝিনি…।’
এই কথাবার্তায় ঘরের সকলেই বেশ অবাক হয়েছেন। রত্নাবলী মুখোপাধ্যায় কেন দেবারতি মানির ঘরে এসে ওকে নকল করে অভিনয় করার চেষ্টা করবেন, এই ব্যাপারটা অনেকের কাছেই পরিষ্কার হয়নি।
অশোকচন্দ্র ফুরিয়ে আসা সিগারেট দিয়ে নতুন একটা সিগারেট ধরালেন। তাতে কয়েকবার টান দিলেন। সিগারেটের ডগায় অগ্নিবিন্দু দপদপ করে উঠল তালে-তালে। গলগল করে ধোঁয়া ছেড়ে এসিজি বলে উঠলেন, ‘এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কী করে আমি আন্দাজ করলাম, উৎপলেন্দুবাবু দেবারতির সঙ্গে কথা বলেননি—কথা বলেছেন অন্য কারও সঙ্গে, শ্রীমতী মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে।’ গালে কয়েকবার হাত বুলিয়ে নিলেন এসিজি : ‘এ-ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করেছে অনামিকা। উৎপলেন্দুবাবু চলে যাওয়ার পাঁচ-সাত মিনিট পরেই ও দেবারতির ঘরের দরজার চাবির ফুটো দিয়ে উঁকি মেরে ঘরে কাউকে দেখতে পায়নি। দেখতে পায়নি, কারণ ঘরে সত্যিই তখন কেউ ছিল না। উৎপলেন্দুবাবু দরজার কাছ থেকে সরে যাওয়ার পরই রত্নাবলীদেবী বেরিয়ে আসেন দেবারতির ঘর থেকে। দরজা বন্ধ করে সেটা বাইরে থেকে লক করে চটপট রওনা হয়ে যান পাঁচতলায় নিজের ঘরের দিকে। তার দু-চার মিনিট পরেই অনামিকা এসেছিল দেবারতিকে ডাকতে, এবং স্বাভাবিক কারণেই ও ঘরে কাউকে দেখতে পায়নি।’
রূপেন মজুমদার অধৈর্য হয়ে জিগ্যেস করলেন, ‘কিন্তু দেবারতি তখন কোথায়? ও কি তখন খুন হয়ে গেছে?’
হাসলেন এসিজি : ‘না, খুন হয়নি। ও তখন—সম্ভবত মদের সঙ্গে মেশানো—ঘুমের ওষুধ খেয়ে মিসেস মুখোপাধ্যায়ের ঘরে খুন হওয়ার জন্যে অপেক্ষা করছে।’
‘রত্নাদি দেবারতি মানির ঘরে এসেছিলেন কী করতে?’ অনামিকা।
‘উনি দেখতে এসেছিলেন, দেবারতির ঘরের পশ্চিমদিকের—মানে, টেরাসের দিকের জানলাটা খোলা আছে কি না। অর্থাৎ জানলাটা খোলা থাকাটা তাঁর প্ল্যানের পক্ষে খুব জরুরি ছিল। যাতে সবাই ভাবে, দেবারতি ওর ঘরেরই জানলা দিয়ে লাফিয়ে পড়ে মারা গেছে।’
অনেকের মুখেই হতবুদ্ধি ভাব। শুধু রঞ্জন দেবনাথ নির্বিকার। আর অনিমেষ চৌধুরি।
স্মিত হাসলেন এসিজি। রত্নাবলীর দিকে একপলক তাকিয়ে বললেন, ‘ম্যাডাম, আমার যদি কোথাও ভুল হয় তা হলে দয়া করে শুধরে দেবেন।’ তারপর অধ্যাপকের দিকে ফিরে : ‘দেবারতি ভাস্করবাবুর গাড়ির ওপরে পড়েছে রত্নাবলী মুখোপাধ্যায়ের পাঁচতলার ঘরের পশ্চিমের জানলা দিয়ে, চারতলা থেকে নয়। গালিলেও আর নিউটনের সূত্রের সাহায্য নিয়ে, ভাস্করবাবুর গাড়ির আঘাতের পরিমাণ মাপজোখ করে, মাধ্যাকর্ষণের নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখলে হয়তো সহজেই বোঝা যেত, দেবারতি হোটেলের পাঁচতলা থেকে নীচে পড়েছে—চারতলা থেকে নয়। কিন্তু যেহেতু এসব মাপজোখ বা পরীক্ষা আমরা করে দেখতে পারিনি, তাই ব্যাপারটা বুঝতে আমাকে বেশ বেগ পেতে হয়েছে।’ বাঁ হাতে মাথার পাকা চুলের গোছায় টান মারলেন অশোকচন্দ্র। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘অনামিকা যখন দেবারতির ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ওকে ডাকাডাকি করছে, তখন, ঠিক তার ওপরের ঘরে, রত্নাবলী ভীষণ পরিশ্রমের কাজ করছেন : প্রায় অচেতন দেবারতিকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে চলেছেন জানলার কাছে। অচেতন কেন? এর উত্তর খুব সহজ—সচেতন থাকলে রত্নাবলীর পক্ষে ওকে কায়দা করা সম্ভব হত না।
‘হোটেলের বেয়ারাদের কাছ থেকে খোঁজখবর নিয়ে আমরা আপনাদের প্রত্যেকের সম্পর্কে একটা করে টাইম-চার্ট তৈরি করেছি। সেই চার্ট অনুযায়ী দেবারতি মানিকে রাত সওয়া দশটা নাগাদ রত্নাবলী মুখোপাধ্যায়ের ঘরে ঢুকতে দেখা গেছে। আর-একটা ইন্টারেস্টিং ইনফরমেশন হল, রাত দশটা নাগাদ রুম সার্ভিসকে ফোন করে মিসেস মুখার্জি হুইস্কির একটা ছোট বোতল আনিয়েছিলেন। অর্ধেকের বেশি খালি বোতলটা পাওয়া গেছে তাঁর ঘরে। কিন্তু আমরা যতদূর খোঁজখবর নিয়েছি তাতে উনি ড্রিঙ্ক করতে অভ্যস্ত এ-কথা কেউ বলেননি। তা হলে তিনি হুইস্কি আনিয়েছিলেন কার জন্যে? দেবারতি মানির জন্যে। অর্থাৎ, সেই মুহূর্ত থেকেই খুনের পরিকল্পনা বাসা বেঁধেছে রত্নাবলীর মনে। তবে দেবারতিকে তিনি ঠিক কোন অজুহাতে ঘরে ডেকেছিলেন তা বলতে পারব না। শুধু এটুকু বলতে পারি, সেই হুইস্কিতেই ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে যেভাবেই হোক সেটা দেবারতিকে খাইয়ে দিয়েছিলেন রত্নাবলী। তারপর অচেতন দেবারতিকে ঘরে বন্ধ করে রেখে তিনি ওর ঘরে গিয়েছিলেন জানলাটা খুলতে—।’
উৎপলেন্দু সেন গলা খাঁকারি দিয়ে বলে উঠলেন, ‘কিন্তু আমার ডাকাডাকিতে দেবারতির ঘর থেকে রত্নাবলী সাড়া দিলেন কেন?’
উৎপলের দিকে তাকিয়ে হাসলেন এসিজি : ‘সাড়া না দিয়ে ওঁর উপায় ছিল না। কারণ, আপনি যদি দেবারতির সাড়া না পেয়ে নেশার ঝোঁকে শোরগোল শুরু করে দিতেন তা হলে রত্মাবলীর সব পরিকল্পনাই বানচাল হয়ে যেত। অচেতন দেবারতি মানিকে খুঁজে পাওয়া যেত ওঁর ঘরে, আর তারপর, প্রথম সুযোগেই দেবারতি ওঁর লেখালিখির সব রহস্য নিষ্ঠুরভাবে ফাঁস করে দিত।’
টুকরো-টুকরো সব ছবিগুলো এক অদ্ভুত যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে পরপর জুড়ে নিচ্ছিলেন ভাস্কর রাহা। বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও অস্বীকার করার উপায় নেই। রত্নাবলী মুখোপাধ্যায়ই সেই বিশ্বাসঘাতক—যাকে চিহ্নিত করতে চেয়েছিল দেবারতি।
ভাস্কর রাহা টের পাচ্ছিলেন, চুরুটের প্রিয় স্বাদ কেমন বিস্বাদ হয়ে গেছে তাঁর মুখে।
অনিমেষ চৌধুরি শব্দ করে পান চিবোচ্ছিলেন। সেই অবস্থাতেই অতি সাবধানে মুখ নেড়ে বললেন, ‘কিন্তু চাবি? চাবিটা বন্ধ ফ্ল্যাটের টেবিলের ওপরে গেল কী করে?’
এসিজি মাথা নাড়লেন, চুল টানলেন কয়েকবার। তারপর যেন আপনমনেই বললেন, ‘হুম…চাবি…লকড রুম প্রবলেম।’ মুখ তুলে একে-একে দেখলেন সবাইকে : ‘এ-ব্যাপারে আপনাদের অনেকের সাহায্যই আমি পেয়েছি। তবে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছেন ভাস্করবাবু। কারণ দেবারতির খুনের বেলায় খুনি বেরিয়ে গেছে দরজা দিয়েই, তবে চাবিটা ওর ঘরে ঢুকেছিল জানলা দিয়ে। ভাস্করবাবু বলেছিলেন, খুনি টেরাস থেকে চারতলার ঘরের জানলা দিয়ে ছুড়ে দিয়েছিল চাবিটা। আসলে চাবিটা জানলা দিয়ে ঢুকলেও সেটা নীচ থেকে আসেনি—এসেছে ওপর থেকে।
‘এলোমেলো গল্পটা এবারে খুব সংক্ষেপে গুছিয়ে নেওয়া যাক। যেভাবেই হোক দেবারতি মানি জেনে ফেলেছিল রত্নাবলী মুখোপাধ্যায় একজন ছায়ালেখক ব্যবহার করে খ্যাতির চূড়ায় পৌঁছেছেন। এতে দেবারতি ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে—কারণ সত্যি-সত্যিই ও রহস্য-রোমাঞ্চ সাহিত্যকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসত। ভাস্করবাবুর কাছেই শুনেছি, কনফারেন্সের প্রথম দিনে রত্নাবলীর গল্পপাঠের সময় ও কীরকমভাবে রিঅ্যাক্ট করেছিল। আপনারা হয়তো সেটা প্রশংসা ভেবেছেন, কিন্তু আমার শুনে মনে হয়েছে, সেটা তীব্র ব্যঙ্গ ছাড়া আর কিছু নয়। কারণ, দেবারতি—স্পষ্টভাষী। বেপরোয়া দেবারতি তখন ভেতরে-ভেতরে জ্বলছিল। আমার ধারণা, দেবারতি যখন রত্নাবলী মুখোপাধ্যায়ের ইন্টারভিউ নেয় তখন এ-নিয়ে কথা তোলে, হিন্টস দেয়, হয়তো ওর স্বভাব অনুযায়ী আক্রমণও করে। ঠিক কী হয়েছিল তা এখন একমাত্র রত্নাবলীই বলতে পারবেন।’
‘দেবারতি হুমকি দিয়ে শাসিয়ে চলে যাওয়ার পর রত্নাবলী বোধহয় দুশ্চিন্তায় পড়েন। তারপর, একটা প্ল্যান ছকে নিয়ে, সেদিনই রাত দশটা নাগাদ দেবারতিকে আবার নিজের ঘরে ডাকেন। অর্থাৎ, সমঝোতা ইত্যাদির নাম করে মেয়েটাকে ফাঁদে ফেলেন। তারপর স্লিপিং পিল মেশানো হুইস্কি খাইয়ে ওকে অজ্ঞান করে দেন। দেবারতির সঙ্গে বোধহয় কোনও ব্যাগ ছিল—আর ব্যাগেই ছিল ওর ঘরের চাবি। রত্নাবলী ওর ব্যাগটা নিয়ে নিজের ঘর বন্ধ করে চলে আসেন দেবারতির ঘরে। চাবি দিয়ে দরজা খুলতে কোনও অসুবিধে হয়নি ওঁর। তারপর পশ্চিমের বড় জানলাটা খোলার ব্যবস্থা করে গোল টেবিলটাকে সরিয়ে নিয়ে যান জানলার কাছে। টেবিলের কাগজপত্র ঘেঁটে দেবারতির অসমাপ্ত লেখাটা দেখতে পান। আর ঠিক সেই সময়েই হয়তো উৎপলেন্দু সেন নেশাগ্রস্ত অবস্থায় এসে ডাকাডাকি শুরু করেন ঘরের দরজায়।
‘রত্নাবলীর তখনকার মনের অবস্থাটা আপনারা সকলে একবার ভেবে দেখুন। ওপরের তলায় ওঁর ঘরে অচেতন হয়ে পড়ে আছে এক দুর্বিনীত জার্নালিস্ট—যে সুযোগ পেলেই সারা দুনিয়াকে রহস্য-সম্রাজ্ঞীর রহস্য জানিয়ে দেবে। চুরমার করে দেবে ওঁর মান-সম্মান, তছনছ করে দেবে ওঁর এতদিনের সাজানো বাগান। অর্থাৎ, রত্নাবলী ধ্বংস হয়ে যাবেন…চিরকালের জন্যে। সুতরাং বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন রত্নাবলী। একজন বয়স্ক গৃহবধূ শুধুমাত্র নিজের, নিজের পরিবারের, সামাজিক সম্মান আর প্রতিষ্ঠা অকলঙ্ক রাখার জন্যে কী করুণভাবে হিংস্র হয়ে উঠলেন! করুণ বলছি এই কারণে যে, ওঁর সেই অবস্থার কথা ভাবলে করুণা ছাড়া আর কোনও শব্দ মনে আসে না।
‘যাই হোক…উৎপলেন্দুবাবুকে সামাল দিয়ে রত্নাবলী দেবারতির লেখাটার শেষ দুটো লাইন কেটে দেন ওরই পেন দিয়ে। আমার ধারণা, ওই দুটো লাইনের কোথাও হয়তো রত্নাবলী মুখোপাধ্যায়ের কীর্তি সম্পর্কে স্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল। কিন্তু লেখাটা একেবারে লোপাট করতে ভরসা পাননি তিনি। কারণ, দেবারতি হয়তো পরিচিত অনেককেই বলে রেখেছে যে, ও একটা লেখা লিখছে। লেখাটা হয়তো ও কনফারেন্সের শেষ দিনে—মানে, আজ—পড়ার মতলব করেছিল। সুতরাং সেই লেখা যদি ওর ঘর থেকে খুঁজে না পাওয়া যায় তা হলে মুশকিল হতে পারে। আবার ওই লেখা অর্ধেকটা লিখে কেউ যে আচমকা আত্মহত্যা করতে পারে না, সেটাও তো ঠিক। তাহলে? সেই মুহূর্তে বিপর্যস্ত রত্নাবলী কী করবেন বুঝে উঠতে পারেননি। ওঁর তখন উদভ্রান্ত অবস্থা। তাই আধখোলা ”দ্য মার্ডার অফ রজার অ্যাকরয়েড” নিয়েও তিনি কিছু ভেবে ওঠার সুযোগ পাননি…।’
একটু হাসলেন এসিজি। কুণ্ঠিতভাবে বললেন, ‘তা ছাড়া খুনি একটু-আধটু ভুল না করলে আমাদেরই বা চলে কী করে!…হ্যাঁ, যা বলছিলাম…দেবারতি মানির ব্যাগটা বিছানার ওপরে রেখে দিয়ে চাবিটা নিয়ে তিনশো আট নম্বর ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন রত্নাবলী। ঘরের দরজা বাইরে থেকে লক করে সোজা চলে যান নিজের ঘরে। অজ্ঞান দেবারতিকে টেনেহিঁচড়ে অতিকষ্টে নিয়ে যান জানলার কাছে। তারপর ওকে জানলা দিয়ে ফেলে দেন সোজা নীচে—ভাস্করবাবুর গাড়ির ছাদে।
‘রত্নাবলী খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন, কিন্তু ওঁর বিশ্রাম নেওয়ার সময় ছিল না। কারণ, আরও একটা জরুরি কাজ তখনও বাকি। সেটা হল : দেবারতির ঘরের চাবিটা ওর ঘরে পাঠানো। সুতরাং, তাড়াতাড়ি একটা লম্বা সুতো নিয়ে ছুঁচে সুতো পরানোর মতো দেবারতির চাবির রিঙে পরিয়ে দিলেন রত্নাবলী। সুতোর দুটো মাথা এক করে—মানে, ঠিক যেভাবে রঞ্জন দেবনাথ খুনির দড়ি বেয়ে পালিয়ে যাওয়ার পদ্ধতি আমাদের শুনিয়েছিলেন—চাবির রিংটাকে জানলা দিয়ে ঝুলিয়ে দিলেন বাইরে। তারপর সেটাকে সামনে পেছনে দোল খাইয়ে কিছুক্ষণের চেষ্টায় চাবিটাকে দেবারতির জানলা দিয়ে ঢুকিয়ে দিলেন ঘরের ভেতরে। রত্নাবলীর প্ল্যানমাফিক চাবিটা গিয়ে পড়ল টেবিলের ওপরে, তবে মেঝেতে পড়লেও কোনও ক্ষতি ছিল না। এইবার সুতোর একটা মাথা ছেড়ে দিয়ে অন্য মাথাটা ধীরে-ধীরে টানতে শুরু করলেন তিনি। একসময় লম্বা সুতোটা চলে এল ওঁর হাতে, আর চাবিটা পড়ে রইল ভেতর থেকে লক করা ঘরের মধ্যে : জন্ম নিল ”বন্ধ ঘরের রহস্য।” সব কাজ শেষ হওয়ার পর রত্নাবলী ধকল কাটাতে দু-এক ঢোঁক হুইস্কি হয়তো খেয়েও থাকতে পারেন—ঠিক বলতে পারব না।’
ঠোঁট থেকে সিগারেট সরিয়ে কয়েকবার কাশলেন এসিজি। তারপর বললেন, ‘আজ সকালে তাঁর লেখালিখি নিয়ে ভাস্করবাবু আমাকে কয়েকটা কথা বলেছিলেন। তার মধ্যে একটা কথা ছিল অনেকটা এইরকম :…রহস্যের প্রত্যেকটি টুকরোকে কল্পনার সুতোয় গেঁথে খুশিমতো খেলিয়ে…ইত্যাদি-ইত্যাদি। এই কথাটা শুনেই আমার বিগড়ে যাওয়া থিঙ্কিং মেশিন মুহূর্তে ঠিকঠাক হয়ে যায়। চাবি জানলা দিয়ে ঢোকানোর রহস্যটা পলকে ফাঁস হয়ে যায় আমার কাছে। এ-জন্যে ভাস্করবাবুর কাছে আমি ঋণী।’
ভাস্কর রাহার দিকে তাকিয়ে মাথা ঝোঁকালেন এসিজি।
উত্তরে ভাস্কর ছোট্ট করে হাসলেন।
‘আশা করি আপনাদের সব প্রশ্নের জবাব আপনারা পেয়ে গেছেন?’ এসিজি প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন সকলের জন্য।
উত্তরে উৎপলেন্দু বললেন, ‘না, একটা প্রশ্নের জবাব পাইনি। কে সেই ছায়ালেখক? আমাদের মধ্যেই কেউ নিশ্চয়ই?’
অশোকচন্দ্র গুপ্ত রত্নাবলীর দিকে তাকালেন। নীচু গলায় বিড়বিড় করে বললেন, ‘জানি না। একমাত্র মিসেস মুখার্জিই বলতে পারেন।’
রত্নাবলী মুখে আঁচল গুঁজে মাথা নীচু করে বসেছিলেন। ওঁর শরীরটা সামান্য কেঁপে-কেঁপে উঠছিল। আঁচল দিয়ে বারবার চোখ মুছে কয়েকবার নাক টেনে মুখ তুললেন তিনি। চোখ লাল, চোখের কোল ফোলা। সব মিলিয়ে বিধ্বস্ত অবস্থা।
চশমাটা নাকের ওপরে ঠিক করে বসিয়ে মাথা সামান্য হেলিয়ে ভাঙা গলায় কথা বললেন তিনি, ‘এগারো বছর ধরে আমার সব লেখা রঞ্জন লিখে দিয়েছে। যেসব বইয়ের জন্যে আমার এত নামডাক সেগুলো সব রঞ্জনের লেখা…শুধু বইগুলোর টাইটেল পেজে আমার নাম ছাপা আছে।’
সবাই অবাক হয়ে তাকালেন রঞ্জন দেবনাথের দিকে। যা শুনছেন ঠিক শুনছেন তো! কিন্তু রঞ্জন দেবনাথ নির্বাক নির্বিকার।
দু-একবার ঢোঁক গিলে রত্নাবলী আবার বলতে শুরু করলেন, ‘ওর সঙ্গে আমার খুব বন্ধুত্ব ছিল। আমার লেখা ও প্রথম দিকে কারেকশান করে দিত। তারপর এক-একসময় গোটা লেখাটাই রিরাইট করে দিত। সেগুলো আমি আবার নিজের হাতে কপি করে ছাপতে দিতাম। প্রথম-প্রথম ব্যাপারটা অনেকটা খেলা বা মজার মতো ছিল। কিন্তু যেই আমার বইয়ের বিক্রি বাড়তে লাগল তখন সেটা আর নিছক খেলা রইল না। রঞ্জনের দু-একটা বই ছাপা হয়েছিল, কিন্তু সেগুলো একদম বিক্রি হত না। ওর তখন ফ্যামিলি বারডেন অনেক—খুব টাকার দরকার। তাই আমিই একদিন ওকে বললাম, ”তুমি লেখো—আর সেগুলো আমার নামে ছেপে বেরোক, তা হলে টাকা আসবে। যা পাব, তুমি অর্ধেক নেবে, আর বাকিটা আমি। অবশ্য যদি চাও সবটাই নিতে পারো। তোমাকে দিতে মন চায় না এমন কিছু তো আমার নেই…।”
শব্দ করে কেঁদে উঠলেন রত্নাবলী। কাঁদতে-কাঁদতেই বললেন, ‘আর তো লুকিয়ে রাখার কোনও মানে হয় না। রঞ্জনকে…রঞ্জনকে আমি ভীষণ ভালোবাসতাম। এখনও ভালোবাসি। ওর মতো বন্ধু হয় না। আমার জন্যে ও কম স্যাক্রিফাইস করেনি। আমার যে-উপন্যাসটা রবীন্দ্র পুরস্কারের ফাইনাল রাউন্ডে গিয়েছিল সেটাও ওর লেখা। আমার যে-বই ইংরিজিতে বেরিয়েছে সেটারও আসল মালিক রঞ্জন। সত্যি, কত যশ আর খ্যাতি থেকে বেচারা বঞ্চিত হয়েছে! আর আমি? এগারো বছর ধরে অন্যের খ্যাতি নিজের নামে যোগ করে-করে সেটা আমার হকের দাবি বলে ভাবতে শুরু করেছি। সিংহাসনে একবার বসতে পারলে কে আর সহজে নেমে আসতে চায় বলুন! আমারও ঠিক সেই দশা হয়েছিল।
‘তারপর…তারপর…বছর দুয়েক ধরে রঞ্জন নানান অজুহাতে আমাকে এড়িয়ে চলতে লাগল। নিজের নামে লিখতে শুরু করল আবার। আমার তখন কী দুরবস্থা একবার ভাবুন! সবাই লেখা চায়, কিন্তু আমার মাথায় যুতসই কোনও আইডিয়া আসে না। নিজের সঙ্গে সে যে কী কঠিন লড়াই! স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম, রূপ-যৌবন-খ্যাতি সবই একে-একে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। এখন শুধু অপেক্ষা। এরকমই একটা মানসিক অবস্থার মধ্যে এল এই কনফারেন্স। তারপর…’ দু-হাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে শুরু করলেন রত্নাবলী।
‘কিন্তু গোস্ট রাইটারের ব্যাপারটা তো প্রমাণ করা খুব শক্ত। পাঁচকড়ি দে কিংবা এডগার ওয়ালেসের ব্যাপারটা কেউ প্রমাণ করতে পারেননি।’ অশোকচন্দ্র মন্তব্য করেছেন রত্নাবলীকে লক্ষ করে।
কোনওরকমে কান্না চাপা দিয়ে রত্নাবলী ভাঙা স্বরে বললেন, ‘আমিও সেরকমই ভেবেছিলাম। কিন্তু রঞ্জন একদিন আমাকে কতকগুলো অডিয়ো ক্যাসেট শুনতে দিয়েছিল…আর, কারেকশন করা রিরাইট করা আট-দশটা ম্যানুস্ক্রিপট দেখিয়েছিল। অডিয়ো ক্যাসেটে আমাদের অনেক অন্তরঙ্গ কথা ধরা ছিল। ওগুলো দেখার পর, শোনার পর আর কোনও যুক্তি টেকে না—একেবারে অকাট্য প্রমাণ।’
আবার চোখ মুছলেন রত্নাবলী : ‘আশ্চর্য! কীভাবে ”রত্না” থেকে আমি হঠাৎ ”মিসেস মুখার্জি” হয়ে গেলাম রঞ্জনের কাছে! শেষটা এত কষ্টের হবে ভাবিনি। আপনারা…আপনারা আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি যাই, মিস্টার গুপ্ত…মাথাটা ভীষণ ব্যথা করছে…ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুতে হবে। বড় ক্লান্ত লাগছে।’
খুব ধীরে পা ফেলে রত্নাবলী মুখোপাধ্যায় চলে গেলেন ঘর থেকে। রঘুপতি যাদব নড়েচড়ে উঠেছিল, কিন্তু এসিজি তাকে হাতের ইশারায় থামালেন। রত্নাবলীর ইঙ্গিত তিনি ধরতে পেরেছেন। বিদায় যদি সত্যিই ওঁকে নিতে হয় তা হলে সম্রাজ্ঞীর মতো বিদায় নেওয়াই ভালো।
উঠে দাঁড়ালেন এসিজি। ভাস্কর রাহাকে লক্ষ করে বললেন, ‘চলি ভাস্করবাবু, পরে কখনও আবার দেখা হবে। আর একটা কথা : রঘুপতি যাদবের ফাইলে কিন্তু দেবারতি মানির ব্যাপারটা সুইসাইড বলেই লেখা হবে। আশা করি তাতে আপনাদের কোনও আপত্তি হবে না।’
কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ।
তারপর প্রশান্ত রায় এসে দাঁড়ালেন এসিজির কাছে। ইতস্তত করে বললেন, ‘কিন্তু মিস্টার গুপ্ত, দেবারতি মানি ওই সিক্রেট ব্যাপারটা জানতে পেরেছিল কেমন করে?’
তেতো হাসলেন এসিজি। বললেন, ‘সেটা তো বোঝাই যাচ্ছে। রঞ্জন দেবনাথই খবরটা দিয়েছিলেন দেবারতিকে। কারণ তিনি জানতেন, দেবারতি ব্যাপারটা জানার পর পরিণতি কী হবে।’
অশোকচন্দ্র এগিয়ে গেলেন একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা রঞ্জনের কাছে। ওর পিঠ চাপড়ে বললেন, ‘আর আপনার কোনও চিন্তা নেই। পথ পরিষ্কার। নাম-ডাক কিংবা টাকা পেতে কাল থেকে আপনার আর কোনও অসুবিধে হবে না।’
পাশেই দাঁড়ানো অনামিকার দিকে তাকালেন এসিজি : ‘মা-মণি, তুমি আমার মেয়ের মতো। একটা কথা তোমাকে বলি। এই সর্বনাশা লোকটার খপ্পরে তুমি পোড়ো না। এই লোকটা রত্নাবলী মুখোপাধ্যায়কে শেষ করেছে, দেবারতি মানিকে শেষ করেছে—এরপর কার পালা কে জানে! আইনের খাতায় এদের শায়েস্তা করার কোনও ব্যবস্থা নেই। কারণ, কোনও প্রমাণ নেই আমাদের হাতে। তাই তোমাকে সাবধান করলাম।’
সঙ্গে-সঙ্গে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেল।
হাতের ফাইল নামিয়ে রেখে ভারি পায়ে রঞ্জন দেবনাথের সামনে এসে দাঁড়াল রঘুপতি। তারপর ঘরের সবাইকে চমকে দিয়ে বিরাশি সিক্কার এক চড় কষিয়ে দিল রঞ্জনের বাঁ-গালে।
রঞ্জনের মুখটা এক ঝটকায় ঘুরে গেল। ও চিৎকার করে গালাগালি দিল রঘুপতিকে।
রঘুপতি যাদব চিবিয়ে-চিবিয়ে বলল, ‘রাইটার রঞ্জনকো গুসসা কিঁউ আতা হ্যায়?’ এবং সঙ্গে-সঙ্গে চুলের মুঠি ধরে এক ঘুষি বসিয়ে দিল ওর মুখে। তারপর টান মেরে ওকে পেড়ে ফেলল মেঝেতে।
‘কী হচ্ছে, রঘুপতি!’ এসিজি চিৎকার করে উঠলেন, ‘তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে! ইউ আর ব্রেকিং দ্য ল!’
রঘুপতি তখন মেঝেতে পড়ে যাওয়া রঞ্জন দেবনাথকে যথেচ্ছ লাথি মারছিল। রঞ্জনের গোঙানির শব্দ শোনা যাচ্ছিল বারবার।
একসময় মারধোর থামিয়ে হাঁফাতে-হাঁফাতে রঘুপতি বলল, ‘একটু-আধটু ব্রেক না করলে সে আবার কিসের কানুন, স্যার। আর তো চান্স পাব না, তাই এখনই এই কামিনাকে থোড়াসা সবক শিখিয়ে দিলাম।’
অশোকচন্দ্র হাত ধরে টেনে নিলেন রঘুপতিকে। তারপর হাঁটা দিলেন দরজার দিকে। কনস্টেবল দুজনও ওঁদের অনুসরণ করল।
করিডর ধরে ওঁরা প্রায় লিফটের দরজার কাছে চলে এসেছেন, এমন সময় পিছন থেকে ডেকে উঠেছেন রূপেন মজুমদার। ওঁরা থামতেই রূপেন দ্রুত পা ফেলে কাছে চলে এসেছেন। ওঁর হাতে দুটো বই—সেই ‘ডাকিনীর হাতছানি’।
একটা করে বই রঘুপতি যাদব আর অশোকচন্দ্র গুপ্তকে দিয়ে রূপেন মজুমদার হেসে বললেন, ‘পড়ে দেখবেন, একেবারে ওরিজিন্যাল। অন্য রাইটারদের মতো ”সাহেব বলিয়াছেন” এরকম কোনও ব্যাপার নেই।’
বই হাতে নিয়ে লিফটে করে নামতে-নামতে এসিজি ভাবলেন, মানুষ সত্যি কতরকম হয়! মানুষ তাঁকে সবসময়ই অবাক করে—রংবেরঙের পাখির মতো।
রঘুপতি যাদব হাতঘড়িতে চোখ রাখল : রাত দশটা বেজে গেছে।