বিবেচনা সাপেক্ষ

বিবেচনা সাপেক্ষ

পড়া শেষ হতে সকলেই ওরা চুপচাপ বসে রইল খানিক। শ্রোতাদের মধ্যে দুজন বেশ নামী সাহিত্যিক। বাদবাকি সকলে মোটামুটি নামী। গল্পটা নিয়ে মনে মনে সকলেরই একটু বিচার-বিশ্লেষণ শুরু হয়েছে ভেবে আমি মনে মনে খুশি।

বেশ খানিকটা সময় নিয়ে নামী দুজনের একজন জিজ্ঞাসা করলেন, তা তোমার ইচ্ছেটা কি, নতুন লেখকের এই গল্প ছাপতে চাও?

আমি মাথা নাড়লাম, সেই রকমই ইচ্ছে বটে।

একটু ভেবে তিনি মন্তব্যসহ আবার প্রশ্ন করলেন, মাথা খাঁটিয়ে মোটামুটি মন্দ দাঁড় করায়নি, কিন্তু তোমার অতবড় কাগজে ছাপার মত স্পার্ক কিছু দেখছ কি?

আমি সায় দিলুম, খুব অবাক করার বা মুগ্ধ করার মত কিছু দেখছি না বটে। নতুন লেখকের গল্প নিয়ে সঠিক আলোচনা এরপর গড়গড়িয়ে বিস্তৃত হতে থাকল।

মোটামুটি নামীদের একজন বলল, লেখকের ভাষা বেশ সহজ তরতরে সেটা ঠিক, এজন্যেই আপনার ভালো লেগেছে বোধহয়। কিন্তু গল্পটাতে ভাবের চাপা বাঁধুনি কম, তাছাড়া ঠিক ছোট গল্পের ছকে এটাকে ফেলা যায় না–অনেকটা রিপোর্টিংয়ের মত লাগছে।

প্রতিবাদের সুরে আর একজন সমর্থনই করল তাকে। বলল, নতুন লেখকের কাছে তুমি তার বেশি আশা করো কি করে?

হাসিমুখে তৃতীয় তরুণ শ্রোতা গল্পটার বুকে অনায়াসে একটা ধারালো ছুরি চালিয়ে দেবার মত করে মন্তব্য করল, কিন্তু আগাগোড়াই উদ্দেশ্যমূলক প্রোপাগাণ্ডা ধরনের না? গল্পের রসের উপর দিয়ে উদ্দেশ্যটা এ রকম সাদাসাপটাভাবে উপচে উঠবে কেন?

আসরের দুনম্বর নামী সাহিত্যিক মুখ খুললেন এবারে, মাথা নেড়ে বললেন, সেদিক থেকে গল্পটা তো মার খেয়েইছে, তা ছাড়াও অনেক জায়গায় একটু আনরিয়েল হয়েছে। কোর্টে দাঁড়িয়ে প্রৌঢ়া বিভাবতীর জবাব আর বিচারুকের চাপা উচ্ছ্বাসের দিকটাই ভাবো না–অবাস্তব মনে হয় না?

আমি দ্বিধান্বিত মুখে জবাব দিলাম, কিন্তু লেখক তো বলছে গল্পটা সত্যি ঘটনার ছায়া নিয়ে লেখা।

মোটামুটি নামীদের একজন সপ্রতিভ মুখে বলে উঠল, সত্যের থেকে ছায়াটা যে একটু বেশিই বড় হয়ে গেছে!

সকলে হাসল একপ্রস্থ।

একনম্বর নামী লেখক এবারে দুনম্বর নামী লেখকের সমালোচনার ওপর মন্তব্য চাপালেন।-আনরিয়েলই যদি বলো তো সব থেকে বেশি অস্বাভাবিক ব্যাপার মেয়ে বিয়ের রাতে মহিলাটির তার স্বামীকে ওভাবে মোটরে চাপিয়ে ব্যাণ্ডেলে চালান করা।

ওরকম ভ্যাবলাকান্ত স্বামী গল্প-উপন্যাসেই যা দুচারটে দেখা যায়।

মোটামুটিদের একজন সোৎসাহে ঘাড় নাড়ল বারকয়েক–আমি ঠিক এই পয়েন্টটাই বলতে যাচ্ছিলাম দাদা, বিভাবতীকে সধবা রাখার দরকার কি? বিধবা করে দিলেই তো ওদিকের প্রবলেম মিটে যায়।

গল্পের সধবাকে কলমের খোঁচায় অনায়াসে বিধবা করে দেওয়া যেতে পারে, আর তাতে মেয়ে-বিয়ের রাতে ভ্যাবলাকান্ত স্বামীকে হারানোর সমস্যাও মেটে সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই। গল্পের মুখ রক্ষার খাতিরে এটুকু সংস্কার গহিত কেউ বলবে না। গল্প লিখতে বসে নিজেই কত সময় কুমারী মেয়েকেই বিধবা করেছি আর বিধবাকে শেষ পর্যন্ত কুমারী করে দিয়েছি ঠিক নেই। কিন্তু এক্ষেত্রে চুপ করেই রইলাম।

নতুন লেখকের গল্পের প্রৌঢ়া নায়িকা বিভাবতীর নাটকীয় আচরণ, জাঁদরেলপনা, কথাবার্তা, অন্ধ বিশ্বাস ইত্যাদির অবাস্তবতা নিয়ে অনেকভাবে খুঁতখুঁত করার পরে সাহিত্যিকরা আসর ভঙ্গ করল এক সময়। নামী সাহিত্যিক দুজন পরামর্শ দিয়ে গেলেন, নতুন লেখকের ওপর সুনজর যখন পড়েছে, তোমার কলম চালিয়ে ঠিকঠাক করে নাও-এ-রকম তো কতই করেছ।

আমি বললাম, দেখা যাক, ছাপতেই হবে এমন কথা নেই–তবে তোমরাও আর একটু ভেবো তো।

তারা চলে যাবার পর নিজেই আবার কেন যে নতুন করে ভাবতে বসলাম, জানি না।

.সাদাসিধেভাবে বললে গল্পটা এই রকম দাঁড়ায়ঃ

বিভাবতী একজন জাঁদরেল মহিলা। বয়স পঞ্চাশের কিছু ওপরে। বয়সকালে চেহারা বেশ ভালো ছিল বোঝা যায়। এখনো দিব্বি শক্ত-সমর্থ, মজবুত স্বাস্থ্য। বে সরকারী স্কুলের হেডমাস্টারের বউ। হেডমাস্টার বলতে নব্যযুগের হেডমাস্টার নন শৈলেশ চাটুজ্জে, নব্যযুগে পা দিয়ে টাকার মুখ দেখতে না দেখতে চাকরির মেয়াদ ফুরিয়েছে। মাস পাঁচেক হলো চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। অন্য মাস্টাররা পাঁচ জায়গায় ছেলে পড়িয়ে তার থেকে বেশি রোজগার করত, কিন্তু হেডমাস্টারের পদমর্যাদা লাভ করে তিনি তাও পারতেন না। এখন অবশ্য সে বাধা নেই, কিন্তু স্বাস্থ্যটাই বাধা। হার্টের ব্যারাম, একটু পরিশ্রম করলেই বুক ধড়ফড় করে। বিভাবতী তা করতে দেন না। ধরা-করা করলে চাকরির মেয়াদ আরো একটা বছর বাড়ানো যেত হয়ত, কিন্তু স্ত্রীর আপত্তির দরুন সে-চেষ্টা করেন নি।

এ-বাড়িতে এই স্ত্রটির আপত্তি আর মতামত একটা বিশেষ ব্যাপার। ছেলে মেয়েরা আড়ালে মন্তব্য করে, হেডমাস্টারি আসলে চিরকাল তাদের মা-ই করে আসছে।

অতিশয়োক্তি নয়। বাড়ির কর্তা থেকে শুরু করে সকলেই কর্তার দাপটে তটস্থ। সংসারের কোনো ব্যাপারে অপোজিশন বলে কিছু নেই-সেখানে বিভাবতীই সব।

তিন মেয়ে এক ছেলে। মেয়েরা বড়, ছেলে এ বছরই হায়ার সেকেণ্ডারি পাস করে বি. এ-তে ভর্তি হয়েছে। বড় মেয়ে দুটো স্কুল ফাইন্যাল পাস করে বসে ছিল। চেহারা তাদের মোটামুটি সুশ্রী। নাম রমা আর শ্যামা। গত দেড় বছরের মধ্যে তাদের বিয়ে হয়ে গেছে। খুব সামান্য ভাবেই হয়েছে। তবু ঘরে সোনাদানা যা একটু ছিল, আর সামান্য সঞ্চয় যা ছিল, সব নিঃশেষে বেরিয়ে গেছে। তাতেও কুলোয় নি, প্রাপ্য প্রভিডেন্ট ফণ্ডের তহবিল কিছুটা হালকা করতে হয়েছে। তবু স্ত্রী-টি কড়া-ক্রান্তি হিসেব করে চলেন বলেই দেড় বছরের মধ্যে দুটো মেয়ের বিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়েছে, শৈলেশ চাটুজ্জে সেটা একবাক্যে স্বীকার করেন। দ্বিতীয় মেয়ের বিয়েতে খরচের কথা ভেবে গায়ে জ্বর এসেছিল তাঁর, কিন্তু স্ত্রীর ধমক খেয়ে সে জ্বর ছেড়েছে আর বিয়েও নির্বিঘ্নে হয়ে গেছে।

বড় মেয়ে রমার বিয়ে দিয়েছেন ব্যাণ্ডেলে এক স্কুল মাস্টারের কাছে। ওই মেয়ের সংসারে আরো কয়েকটি পোষ্য আছে। তাই সদা অনটন। সে তুলনায় বর্ধমানে মেজ মেয়ে শ্যামার একটু ভালো বিয়ে হয়েছে। নিজেদের পৈতৃক ঘর-বাড়ি ওই জামাইয়ের, তার ওপর ছেলেটা মোক্তারি করে মন্দ পয়সা পায় না। বড় মেয়ে অনটনের মধ্যে আছে বলে মনে মনে বিভাবতীর তার ওপরেই টান বেশি একটু। যে কোন ছল ছুতোয় তাকে একটু সাহায্য করতে পারলে খুশি হন।

তৃতীয় মেয়ে শম্পা আগামী বছরে বি. এ. পরীক্ষা দেবে। এই মেয়েটার ভালোয় ভালোয় একটা বিয়ে দিয়ে দিতে পারলে দায় চোকে ভাবেন বিভাবতী। ছেলে কবে নিজের পায়ে দাঁড়াবে, কবে বিয়ে করবে, সে ভাবনা ভাবেন না তিনি। ভিতরে ভিতরে চিন্তা তাঁর এই মেয়েটাকে নিয়েই শম্পাকে নিয়ে।

তার প্রথম কারণ, তিন মেয়ের মধ্যে শম্পাই রীতিমত সুন্দরী। যেমন ফর্সা, তেমনি লম্বা-টম্বা-স্বাস্থ্যও সব বোনের থেকে ওরই ভালো। এই মেয়ে কলেজে যায় সেটাই তাঁর মনঃপূত নয় খুব। কিন্তু ঘরে বসিয়ে রেখেই বা কি করবেন। হায়ার সেকেণ্ডারি ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করার ফলে আর সেই সঙ্গে মেয়ের কদিন কান্নাকাটির ফলে কলেজে পড়ার অনুমতি দিতে হয়েছে। পার্ট ওয়ানও ভালোই পাস করেছে, সামনের বার পার্ট টু দেবে। বিভাবতীর ধারণা তাদের যা সঙ্গতি, মেয়ে বি. এ. পাস করলে তার বিয়ে দেওয়া আরো শক্ত হবে।

দুশ্চিন্তার দ্বিতীয় কারণ, মেয়েটার স্বভাব। অন্য দুবোনের মত একটুও নয়। হেসেখেলে ধিঙ্গিপনা করে বেড়াতে ভালো লাগে, পরিপাটি করে সাজতে-গুজতে ভালবাসে, মুখে কথার খই ফোটে, সিনেমা দেখার নামে জিভে জল আসে। বাড়ির ছেলেমেয়েদের মধ্যে মায়ের কাছে শম্পা যত দাবড়ানি খায় তেমন আর কেউ নয়। একটু বে-চাল দেখলে ওর চুলের গোছা টেনে ধরার জন্য এখনো মায়ের হাত নিশপিশ করে। আর ওর দিকে তাকালেই যেন বে-চাল দেখেন তিনি। মাকে যমের মত ভয় করে অবশ্য, কিন্তু চুপিচুপি মায়ের অমতের কাজও দুই-একটা শুধু ও-ই করে বসে। এত সাহস আর কারো নেই। এই সেদিনও ফিরতে দেরী হবে বলে কলেজ থেকে কোন দুই বান্ধবীর সঙ্গে চুপি চুপি সিনেমা দেখে বাড়ি ফিরেছিল। ছটা বেজে যেতেই মায়ের মনে ঠিক খটকা লেগেছে, ফেরার সঙ্গে সঙ্গে ধরেছেন,–কোথায় ছিলি এতক্ষণ?

ঘাবড়ে গিয়ে মেয়ে অবশ্য সত্য কথাই বলেছিল। মুখের দিকে চেয়ে সরাসরি মিথ্যে বলবে এত সাহস নেই। অতবড় মেয়েকে বিভাবতী পাখার বাঁট দিয়ে শুধু ঠেঙাতে বাকি রেখেছিল। মেয়ে কেঁদে-কেটে হাতে-পায়ে ধরে তবে রেহাই পেয়েছে। তবু না বলে সিনেমা যাবার সাহস হল কি করে তাই ভেবেই তাজ্জব বিভাবতী।

এই মেয়েটার জন্য এমনি নানা কারণে সব থেকে বেশি দুশ্চিন্তা তার। মায়ের মেজাজ ভালো থাকলে শম্পা নিজেই কত সময় শোনায়, মায়ের সদাই সৎমায়ের মত ব্যবহার তার সঙ্গে! সে যেন নিজের মেয়ে নয়! খুব মিথ্যে বলে না। বাড়ির খাটাখাটনি সব থেকে বেশি তাকেই করতে হবে–দিদিদের বিয়ের আগেও এই পক্ষপাতিত্ব ছিল। পূজোর সময় এখনো সব মেয়েদের শাড়ি দেওয়া হয়। সব থেকে ভালো শাড়ি আর জামা বড় দুই মেয়ের কাছে যাবে–ছোট মেয়ের একটা হলেই হল।

আর সেই সাদামাটা শাড়ি পরে শম্পা যখন বেরোয় আর কলেজে যায়, সে দিকে চেয়ে বিভাবতীর বুকের ভিতরটা গুড়গুড় করে কেমন–ওর শাড়ি জামা সব থেকে সুন্দর ঠেকে তার চোখে। ভাবেন আরো সাদাসিধে কিছু আনলেই যেন ভালো হত।

তিন মেয়ে এক ছেলে, কিন্তু ছেলের দলে আর একজনকেও ফেলা যায়। তিনি বাড়ির কর্তা শৈলেশ চাটুজ্জে। বিয়ে করে বিভাবতীকে ঘরে এনেছেন পঁচিশ বছর বয়সে। বড় জোর গোড়ায় পাঁচটা বছর বাদ দিলে তিরিশ থেকে আটান্ন-এই আটাশ বছর একটানা স্ত্রীর শাসনে প্রতিপালিত হয়েছেন তিনি। সেই শাসনও প্রয়োজনে কঠিন আর প্রয়োজনে কোমল। বয়স যত বেড়েছে ভদ্রলোক ততো বেশি স্ত্রীর হাতে নিজেকে সমর্পণ করেছেন। ফলে স্ত্রীটিও তাকে বয়স্ক ছেলের মতই নেড়েচেড়ে লালনপালন করে এই বয়স পর্যন্ত টেনে তুলেছেন। স্বামীর হার্টের রোগ আবিষ্কার হওয়ার পর। থেকে তো স্ত্রীর নির্দেশে তার জোরে কথা বলাও বন্ধ। তার খাওয়া-দাওয়া ওঠা-বসা। চলাফেরা সবই বিভাবতীর হিসেবমত সম্পন্ন হয়ে থাকে।

পণ্ডিতের ঘরের মেয়ে ছিলেন বিভাবতী। তার বাপের সংসার সেদিনে অসচ্ছল ছিল না। আর পড়েছিলেনও সচ্ছল ঘরেই। স্বামী বিদ্বান, বাড়িতে বিদ্বান শ্বশুর বিদ্যমান। সদাগরী অফিসে ভালো চাকরি করতেন। বউ তার চোখের মণি ছিল। কি যে আনন্দে কেটেছে সেই দিন, ভাবলেও দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়ে বিভাবতীর। সব যেন কোথায় মিলিয়ে গেল। পান্তা খেতেও নুনে কুলোয় না এখন এমন অবস্থা। সামাজিকতা নেই, আদর আপ্যায়ন নেই, বাড়িতে দুটো অতিথি এলে চক্ষু স্থির হয় সকলের। শ্বশুর খেতে– ভালবাসতেন, খাওয়াতে ভালবাসতেন। আর কোন বিলাসিতা ছিল না তার। কেবল আনো আর পরিতৃপ্তি করে খাও সকলে। সেই সস্তাগণ্ডার বাজারে বাড়িতে যেন নিত্য নেমন্তন্ন লেগেছিল।

আর তারই দুদুটো নাতনীর কি ভাবে বিয়ে হল! মনে পড়লে রাগে দুঃখে চোখে জলই আসে বিভাবতীর। দুবারই সরকারী বিধিনিষেধের দোহাই দিয়ে অব্যাহতি পেয়েছেন। বরযাত্রীদের শুধু আদরযত্ন করে খাওয়ানো হয়েছে, অন্য সকলের বরাতে জলযোগ। অথচ আশীর্বাদী হাতে করে জ্ঞাতি কুটুম্বরা সব এসেছে, মনের কথা চেপে মুখে বলেছে, বেশ ব্যবস্থা হয়েছে-যে দিনকাল পড়েছে। সকলের হাতে হাতে উপহারের বাক্স বা প্যাকেট দেখে লজ্জায় বিয়েবাড়ি ছেড়ে পালতে ইচ্ছে করেছে। বিভাবতীর। মনে হয়েছে নেমন্তন্ন করে এনে খেতে না দিয়ে তিনি যেন ভিক্ষে নেবার ব্যবস্থা করেছেন। শ্যামার বিয়ের সময় এক ঠোঁট-কাটা আত্মীয় তো বলেই বসল, আইনও রয়েছে আবার যার ইচ্ছে সে এরই মধ্যে দিব্বি খাইয়েও যাচ্ছে!

লজ্জায় মাথাই কাটা গিয়েছিল বিভাবতীর। আর চোখ ঠেলে বার বার জল আসছিল। কার নাতনীর বিয়েতে কি কথা শুনতে হল! অথচ রাগই বা করেন কি করে, মিথ্যে তো বলেনি। গত এক বছরের মধ্যে বিভাবতী কম করে দুতিনটে নেমন্তন্নে গেছেন, না খেয়ে তো ফিরতে হয় নি। কিন্তু কি করবেন, যেমন বরাত। শ্বশুর বেঁচে নেই রক্ষে। থাকলে হয়ত এই অপমানে প্রাণান্ত হত।

.

দিনকয়েকের জন্য বিভাবতী গেছলেন বড় মেয়ের বাড়ি–ব্যাণ্ডেলে। যাবার জন্য মেয়েটা কতবার যে লিখেছে ঠিক নেই। প্রথম ছেলে হবার পর থেকেই অসুখে ভুগছে। –দিনে দিনে হাড়সার হচ্ছে। মাস ছয় হল নাতির বয়স, ওটারও রিকেট না কি হয়েছে। যেমন বরাত। অবস্থা না হয় খারাপই হল, স্বাস্থ্যটাস্থ্যগুলোও তো একটু ভালো থাকতে পারে!

বিভাবতীকে বড় মেয়ের কাছে যেতে হয়েছে দিনকয়েকের জন্য। যাবার আগে শম্পাকে বাড়ির ব্যবস্থা শুধু বুঝিয়ে দেন নি–তাকে সকাল থেকে রাতের যাবতীয় কর্তব্য একের পর এক লিখে নিতে হয়েছে। আর যাওয়ার আগে পর্যন্ত বাড়ির কর্তাটিকেও ওষুধ-পথ্যের ব্যাপারে পাখী-পড়া করে বুঝিয়েছেন। তারপর ছেলেকে নিয়ে দুর্গা দুর্গা করে রওনা হয়েছেন। ছেলের কলেজ, সে সেদিনেই বিকেলে আবার ফিরে এসেছে।

কিন্তু বিভাবতী চার দিনের বেশি ব্যাণ্ডেলে থাকতে পারলেন না। মেয়ের শরীর একটুও ভালো না, তার ওপর ছমাসের রোগে নাতিটা সারাক্ষণ কাদের থাকা দরকার ঠিকই, কিন্তু চার দিনেই হাঁফ ধরে গেল বিভাবতীর, মনে হল যেন চার সপ্তাহ কেটে গেছে। মেয়ে-নাতি অসুস্থ, কিন্তু ঘর-সংসার ফেলে কতদিন তিনি মেয়ের বাড়িতে বসে থাকতে পারেন? ওদিকে কি হচ্ছে ভেবে সারাক্ষণই ভিতরটা উতলা তার। ওখানেও তো হার্টের রোগী ফেলে এসেছেন একজন, সময়মত ওষুধ খাচ্ছে কিনা, পথ্য ঠিকমত পাচ্ছে কিনা কে জানে! যে দায়িত্বজ্ঞান আর এক মেরের! তাছাড়া সকাল সাড়ে নটা না বাজতে ওর কলেজে ছোটা আছে, শ্যামলেরও কলেজ আছে, খেলা আছে। কে কাকে দেখে!

চার দিনের দিন মেয়ের চেনা-জানা কলকাতার সঙ্গী পেয়ে তিনিও ঘোষণা করলেন, আর না, এবারে যাবেন। ছুটি হলেই শ্যামলকে পাঠিয়ে দেবেন, নিজেও ফুরসত পেলে আবার আসবেন–এখান থেকে এখানে, অসুবিধে কিছু নেই। একটানা আর থাকা সম্ভব নয়, ওখানে হয়ত সব অচল হয়ে আছে।

চলনদারকেও অসুবিধেয় ফেললেন না তিনি। হাওড়া স্টেশনে নেমে নির্দিষ্ট বাসে উঠে বসে তাকে বিদায় দিলেন। এ তো আর ব্যাণ্ডেল নয় যে পথ-ঘাটের হদিস পাবেন না তিনি! কোথায় নামতে হবে জানাই আছে। আর কলকাতার রাস্তায় চলাফেরা করেও অভ্যেস আছে, এক মাছ-তরকারির বাজার ছাড়া সব কেনা-কাটাই তো নিজের হাতে করেন।

.

শম্পা বাড়ি ছিল না। কলেজ থেকে ফিরেই বেরিয়েছিল কোথায়। ফিরল সন্ধ্যার একটু আগে। বাড়িতে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গে ভাইয়ের সঙ্গে অর্থাৎ শ্যামলের সঙ্গে দেখা। ছোড়দির সাড়া পেয়েই ও হন্তদন্ত হয়ে কাছে এসে গলা খাটো করে বলল, এতক্ষণ ছিলি কোথায়? মা চলে এসেছে–আর এসে পর্যন্ত কি কাণ্ড, কাছে যেতে ভয় করছে। প্রথমেই বাবাকে খামোকা যাচ্ছেতাই বকাবকি করে নিল খানিকক্ষণ, তারপর আমাকে, আর একটু আগে ঝি-টাকে—

শোনামাত্র শম্পার খুশি মুখ থেকে প্রাণটুকুও যেন উড়ে গেল। সত্রাসে ভাইয়ের দিকে চেয়ে রইল খানিক, বলল, এত তাড়াতাড়ি তো ফেরার কথা ছিল না…

শ্যামল বলল, সেই জন্যেই তো আমিও হাঁ, তোকে বলে চুপি চুপি আজ একটা ছটার শো মারব ভেবেছিলাম-ভাগ্যিস যাই নি!

ভয়ে ভয়ে শম্পা জিজ্ঞেস করল, আমার কথা কিছু বলেছে?

না, তুই বাড়ি নেই–রাগের মাথায় এখনো খেয়ালই করে নি হয়তো। ব্যাণ্ডেলেই কিছু একটা হয়েছে বোধ হয়, বড়দির অসুখটাই বেড়ে গেল কিনা বুঝছি না।

শম্পা বলল, অসুখ বেড়ে থাকলে মা চলে আসবে কেন?

শ্যামল বলল, অই তো–তবু সেখানেই নির্ঘাৎ কিছু হয়েছে, নইলে ফিরেই এই মূর্তি কেন? মা এখন বাবার ঘরে, তুই চুপি চুপি ঘরে গিয়ে ওই স্টাইলের শাড়ি পরা বদলে ঠিকঠাক হয়ে নে তো যা–

পাংশু মুখে পা টিপে শম্পা বারান্দা ধরে এগলো। এক সারিতে ছোট বড় তিনখানা। ঘর। প্রথম খুপরি ঘরটা শ্যামলের, বোনেদের বিয়ে হবার পর দ্বিতীয় ঘরটাতে এখন। শম্পা একাই থাকে। ঘরের আলো নেবানো। তার পরের ঘরটা বাবা-মায়ের–সে ঘরে আলো জ্বলছে।

নিজের ঘরের দোরগোড়ায় এসে শম্পা দাঁড়াল একটু, তারপর সামনের দিকে ঝুঁকে শুনতে চেষ্টা করল, বাপ-মায়ের ঘরের কোন কথা কানে আসে কিনা।

পরের মুহূর্তে যা ঘটে গেল, অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠল শম্পা। আচমকা চুলের মুঠি ধরে হ্যাঁচকা টানে কে তাকে তার অন্ধকার ঘরের মধ্যে এনে ফেলল। হুমড়ি খেয়ে পড়েই যাচ্ছিল, কোন রকমে টাল সামলে আবার আর্তনাদ করে ওঠার উপক্রম।

চুপ!

মায়ের চাপা গর্জন। সঙ্গে সঙ্গে দরজা বন্ধ করার শব্দ। তারপর ঘরের আলো জ্বলে উঠল।

সামনে মা দাঁড়িয়ে। দুচোখ ধকধক করে জ্বলছে। বি, এ, পড়া মেয়েকে চুলের মুঠি ধরে এভাবে ধরে টেনে আনা কিছুই নয়, মায়ের এ-মূর্তি দেখে শম্পা থরথর করে কেঁপে উঠল।

বিভাবতী দেখছেন মেয়েকে, ওর পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখের আগুনে ঝলসে দিচ্ছেন। সমস্ত মুখ লাল, ক্রুদ্ধ উত্তেজনায় হাঁপাচ্ছেন অল্প অল্প।

ওই ছেলেটা কে?

হিসহিস শব্দটা যেন এক ঝলক গলানো শিসের মতো কানে ঢুকল শম্পার। মাথাটা ঘুরে গেছে, চোখে লাল নীল সবুজ হলদে দেখছে।

তোকে আজ খুন করে ফেলব! রেস্টুরেন্টে বসে কার সঙ্গে ঢলাঢলি করছিলি আর গিলছিলি?

মা! ত্রাসে মায়ের হাত কিংবা পা ধরার জন্য এগিয়ে আসছিল শম্পা।

আবার এক ধাক্কা খেয়ে তিন হাত দূরে ছিটকে মাটিতে বসে পড়ল। বিভাবতী সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে এসে চুলের মুঠি ধরেই তাকে হিড়হিড় করে টেনে তুলে ধাক্কা দিয়ে চৌকিতে বসিয়ে দিলেন–তোকে আমি মেরেই ফেলব আজ, বটি দিয়ে কাটব, শিক পুড়িয়ে তোর পিঠে ছ্যাকা দেব-বল শিগগীর ছেলেটা কে?

মা! বলছি মা, তুমি একটু স্থির হয়ে বোসো, তোমার পায়ে পড়ি মা

খবরদার! তুই আমাকে মা ডাকবি না। তিন দিনের জন্য গেছি, তার মধ্যে এই চরিত্র তোর? গলায় দড়ি জোটে নাকাল আমিই তোকে দড়ি এনে দেব–ভালো। চাস তো কে ছেলেটা আগে বল শিগগীর!

ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে শম্পা বলল, ওই তিনতলা লাল বাড়ির

জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করলেন কোন তিনতলা লাল বাড়ির।–ওই সামনের রাস্তার মুখের লাল বাড়ির?

শম্পা কাঁপতে কাঁপতে মাথা নাড়ল–তাই।

ঠিক এই জায়গায় বাইরে শৈলেশ চাটুজ্জের কোমল ডাক ভেসে এলো।

এ ঘরের দরজা বন্ধ কেন? শম্পা, তোর মা কোথায় রে, আমাকে ওষুধ দেবে না?

যাচ্ছি! জানালার দিকে চেয়ে তপ্ত একটা ঝাঁপটা মারলেন বিভাবতী, তারপর মেয়ের দিকে ফিরে দাঁতে দাঁত ঘষে বললেন, বসে থাক, এখান থেকে নড়বি তো আস্ত রাখব না।

দরজা খুলে বেরিয়ে গেলেন।

 আতঙ্কিত শম্পা ধরেই নিয়েছে বাবাকে ওষুধ খাইয়েই মা এক্ষুনি ফিরবে। কিন্তু তিনি ফিরলেন না। রাতে খাবার সময় হলো, তখন পর্যন্ত না। মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে তাকে, থমথমে মুখ। একবার দরজায় দাঁড়িয়ে ডাকলেন, খেতে আয়!

ভয়ে ত্রাসে মুখ-হাত পর্যন্ত ধোয়া হয় নি তখনো। বসেছিল আর প্রমাদ গুনছিল। ডাক শুনে তাড়াতাড়ি কাপড় বদলে এসে খেতে বসল। যে যার নিঃশব্দে খেয়ে উঠল। ছোড়দির মুখ দেখে শ্যামল বুঝে নিয়েছে সঙ্কটজনকই কিছু ঘটেছে। মা মাঝে মাঝে ছোড়দির দিকে যেভাবে চোখ বুলোচ্ছে তাতে তারই ভয় ধরে গেছে। আর ছোড়দিটা যেন বেঁচে নেই, কলের পুতুলের মতো হাত নড়ছে আর এক-একবার মুখে উঠছে।

খাওয়ার পাট চুকল।

সব গোছগাছ করে নিজের ভাত বেড়ে ঢাকা দিয়ে রেখে বিভাবতী হাত ধুয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। কি জন্যে যে ঠাকুর তাঁকে এই দৃশ্য দেখালেন কে জানে! নইলে আজ তো তার ব্যাণ্ডেল থেকে আসারই কথা না।…মোড়ের মাথায় যেখানে বিভাবতীর বাস থেকে নামার কথা, তার খানিক আগেই নেমে পড়তে হয়েছিল। সামনে একগাদা গাড়ি আটকে গেছে, তাই নেমে পড়েছিলেন। গরমে সেদ্ধ হওয়ার থেকে এই দুমিনিট হাঁটা ভালো।

নেমে ওধারের ফুটপাথ ঘেঁষে আসছিলেন তিনি। ওখানে একটাই হালফ্যাশনের নামী রেস্তরাঁ আছে। ঘাড় ফেরাতেই হতভম্ব কয়েক মুহূর্ত। কোণের দিকে দুটো চেয়ারে মুখোমুখি বসে খাচ্ছে শম্পা আর কে একটা ছেলে। দুজনে দুজনের দিকে ঝুঁকে কথা কইছে, এত নিবিষ্ট যে কোনদিকে চোখ নেই কারো।

ছেলেটার চেহারাপ ভালো, আর জামাকাপড়ও ফিটফাট। বিভাবতীর মাথায় তখন দাউ দাউ আগুন জ্বলে উঠেছে–কলকাতার পথেঘাটে অমন ভালো চেহারা ফিটফাট হাড়-পাজী ছোকরা তিনি অনেক দেখেছেন।

কিন্তু স্বামীকে ওষুধ খাইয়েই তক্ষুনি আবার ফিরে এসে মেয়ের ওপর চড়াও হন নি তার প্রথম কারণ, মেয়েটা আরো ভয় পাবার অবকাশ পাক, দ্বিতীয় কারণ, তিনি কিছু ভাবছেন আর কিছু মনে করতে চেষ্টা করছেন।

নিঃশব্দে মেয়ের ঘরে ঢুকে আবার দরজা বন্ধ করলেন তিনি। মেয়ের ফর্সা মুখ কাগজপানা হয়ে আছে দেখলেন। কাছে আসতেই শম্পা কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করল।

বোস!

দাবড়ানি খেয়ে বসে পড়ল আবার। তিনি দাঁড়িয়ে রইলেন।–ওই লাল বাড়ির ছেলে মানে গাঙ্গুলি জজের বাড়ির ছেলে?

গাঙ্গুলি জজ বিশ বছর আগে পেনশন নিয়েছেন। পাড়ায় তাদের নামডাক প্রতিপত্তি মন্দ নয়।

শম্পা ঘাড় গোঁজ করে সামান্য মাথা নাড়ল।

গাঙ্গুলি জজের কে হয়?

ছেলে। শম্পার গলা দিয়ে শব্দ বেরোয় না প্রায়।

 কোন ছেলে?

ছোট।

পড়াশুনা কতদূর করেছে?

এক বছর আগে এম. এ. পাশ করেছে।

বিভাবতী তীক্ষ্ণ গভীর দৃষ্টিতে মেয়েকে দেখে নিলেন একটু। মেয়ে সত্যি বলছে কিনা সেটাই বোঝার চেষ্টা হয়তো!–এখন কি করে?

কলেজের প্রোফেসারি। শম্পার গলায় কি একটু আশার সুর বাজল? সাহস করে সে কি মুখ তুলে মায়ের মুখের দিকে একবার তাকাবে? পারল না।

বিভাবতী জিজ্ঞাসা করলেন, তোর সঙ্গে কদিন ধরে আলাপ?

 শম্পা নিরুত্তর।

কদিন? বিভাবতী ঝাঁঝিয়ে উঠলেন আবার।

 দু বছর।

বিভাবতী হতভম্ব খানিক। তারপরেই দাঁত কড়মড় করে বলে উঠলেন, দু বছর ধরে আমার চোখে ধুলো দিয়ে তুই এই করে বেড়াচ্ছিস? তোর দিদিদের বিয়ের আগে থেকে?

শম্পার মুখ বিমর্ষ আবার। কেঁদে ফেলে বলে উঠল, তুমি বিশ্বাস করো মা, ও খুব ভালো ছেলে।

বিভাবতী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলেন খানিক। তারপর বললেন, কাল থেকে আমি না বলা পর্যন্ত তুই কলেজে যাবি না, আর বাড়ি থেকে এক পা বেরুবি না।

একে একে দুটো স্তব্ধ দিন কেটে গেল।

তৃতীয় দিনে লাল বাড়ির ছেলে কলে পড়ল। বাড়ির সামনে ঘুরঘুর করছিল, বিভাবত কাজের অছিলায় বেরুলেন, তারপরেই খপ করে ছেলেটার হাত ধরে বললেন, তোমার বাড়িই যাচ্ছিলাম, ভিতরে এসো আমার সঙ্গে।

বিমূঢ় তটস্থ লাল বাড়ির ছেলেকে সোজা বাড়িতে টেনে নিয়ে এলেন তিনি। এনে তাকে নিয়ে সোজা শম্পার ঘরেই ঢুকলেন।

শম্পা আঁতকে উঠে দাঁড়াল।

তুই ও ঘরে যা!

হুকুম অমান্য করার মত বুকের পাটা নেই। করুণ চোখে একবার লাল বাড়ির। ছেলের দিকে তাকিয়ে শম্পা দুরুদুরু বক্ষে ঘর ছেড়ে চলে গেল।

বোসো।

চৌকির এক কোণে কাঠ হয়ে গেল ছেলেটা।

 কি নাম?

সুনীল গাঙ্গুলী।

কি করো?

কলেজে পড়াই।

কোন কলেজে?

নাম বলল।

বিভাবতী এর পর বাড়িতে কে আছে না আছে, দাদারা কি করে না করে ইত্যাদি খবর নিলেন। বোনেদের কোথায় বিয়ে হয়েছে তাও শুনলেন। সবই মোটামুটি বড় ব্যাপার।

আমাদের অবস্থা কি জানো?

 লাল বাড়ির ছেলে সুনীল মাথা নাড়ল–জানে।

আমাদের কিছু নেই জেনেও তোমার বাবা-মা এখানে তোমার বিয়ে দিতে রাজি হবেন?

তারা রাজি হয়েছেন।

 তুমি তাদের বলেছ?

হ্যাঁ। বাবা-মা শম্পাকে বাড়িতে ডেকে নিয়ে দেখেছেন, আলাপ করেছেন। এখন আপনাদের দিক থেকে প্রস্তাবের আশা করছেন তারা। কিন্তু শম্পা ভয়ে আপনাকেও কিছু বলছিল না, আমাকেও দেখা করে কিছু বলতে দিচ্ছিল না। কেবলই বলে বি. এ. পাস করার আগে কিছু হবে না।

বিভাবতী খানিক হাঁ করে চেয়ে রইলেন ছেলেটার দিকে। প্রথমে ঘাবড়ে গেহল, নইলে মুখে বোল আছে।

শম্পা! হঠাৎ দরজার দিকে চেয়ে হাঁক দিলেন তিনি।

শুকনো নতমুখে শম্পা দোরগোড়ায় দেখা দিল।

ঘরে কি আছে দেখ, সুনীলকে খেতে দে। আর শোন, আমি এক্ষুনি ওর সঙ্গে ওদের বাড়ি যাচ্ছি।

সুনীল তক্ষুনি উঠে দাঁড়াল, খাওয়া পরে হবে, আপনি চলুন না—

তুমি বোসো।

এই হুকুমের ধরণই আলাদা। সুনীল তাড়াতাড়ি বসে বাঁচল। আর ব্যস্তসমস্ত শম্পা ছুটল রান্নাঘরের দিকে। আশায় আনন্দে থরথর করে কাঁপছে সে।

বিভাবতী লাল বাড়ি থেকে ফিরলেন যখন, সন্ধ্যা হয়ে গেছে। সুনীলই পৌঁছে। দিয়ে গেল। শম্পা উদগ্রীব হয়েই ছিল সারাক্ষণ। কিন্তু মায়ের মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই, ভালো খবর কি খারাপ খবর। খারাপ খবর হবার তো কোন কারণ নেই, তবু ত্রাস যায় না। মেজাজ ঠাণ্ডা রেখে মা কিছু করে আসতে পারে বলেই ধারণা নেই তার।

তোর বাবাকে ঠিকমত ওষুধ খাইয়েছিস?

 মাথা নাড়ল খাইয়েছে।

 তিনি সটান নিজের ঘরে চলে গেলেন।

বেরিয়ে মেয়ের ঘরে এলেন প্রায় ঘণ্টাখানেক বাদে। শম্পা শয্যায় বসেছিল। সচকিত।

চুপচাপ তিনি মেয়েকে দেখলেন একটু। বললেন, সামনের এই দশ দিনের মধ্যে বিয়ে দিতে চায় ওরা–তা না হলে ভাদ্র আশ্বিন কার্তিক এই তিন মাস আর হবে না।

বুকের ভিতর থেকে শম্পার একটা বোঝা নেমে গেল। আস্তে আস্তে মুখ তুলে তাকাল সে। কিন্তু মায়ের মুখখানা যেন অদ্ভুত শান্ত মনে হলো তার। আর তারপর যা ঘটল শম্পা কল্পনাও করতে পারে না। মা হঠাৎ পাশে বসে পড়ে দুহাতে বুকে টেনে নিল তাকে। তারপর আরো আশ্চর্য, মায়ের চোখে জল বুক চেপে ধরে মা তার পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।

আনন্দের আবেগে শম্পা দুহাতে মাকে জড়িয়ে ধরে তাঁর কোলে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।

বিভাবতী নিঃশব্দে তার পিঠে হাত বুলোচ্ছেন।

.

হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসলেন বিভাবতী। সমস্ত গা কাঁপছে। ঘামছেন দরদর করে। ঘন অন্ধকার।

এ কি দেখলেন তিনি? এ কি দেখে উঠলেন?

তিনি দেখলেন, ঘুমের মধ্যে একেবারে স্পষ্ট দেখলেন, বিগত শ্বশুর খাচ্ছেন আর হাসছেন হাসছেন আর খাচ্ছেন। মাছ মাংস পোলাউ রসগোল্লা সন্দেশ সব পরিপাটি করে খাচ্ছেন। খাচ্ছেন আর বলছেন, বেটি সেয়ানা বটে, বেশ করেছে, নিজেরটা নিজেই যোগাড় করে নিয়েছে! খেয়ে বড় তৃপ্তি হল গো বউমা।

এ রকম স্বপ্নও দেখে কেউ? বিয়ের আর মাত্র দুদিন বাকি, দিবারাত্র নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই বিভাবতীর। এই কদিনে তিন ঘণ্টা করেও ঘুমিয়েছেন কিনা সন্দেহ। বেশি রাতে শুয়েছিলেন আজও। বিছানায় গা ঠেকানো মাত্র ঘুমিয়েছেন। তার মধ্যে এই স্বপ্ন।

সকালে উঠেও অনেকক্ষণ বিমনা তিনি। কদিন ধরে ভিতরটা তার খুঁতখুঁত করছিল ঠিকই। আবার সেই জলযোগের ব্যবস্থার নামে গায়ে জ্বর আসছিল। কেবলই ভাবছিলেন কি করা যায়! স্বপ্ন দেখা আশ্চর্য নয়, কিন্তু শ্বশুর এভাবে খাচ্ছেন আনন্দ করছেন এই স্বপ্নই কল্পনাতীত।

ছেলের পক্ষ ধরেই নিয়েছে, শুধু মেয়েটি ঘরে আসবে, তার সঙ্গে আর বেশি কিছু নয়। তবু যতটা পারা যায় করবেন ঠিক করেছিলেন বিভাবতী। মেয়ের বরাতে বড় ঘর জুটেছে, অতিরিক্ত ভালো জামাই জুটেছে। মেয়ের বড় ভাগ্যটা তিনি একেবারে ছোট করে শুরু করাবেন না। যথাসাধ্য করবেন। এই যথাসাধ্য করার হিসেব দাঁড়িয়েছে আট হাজার টাকা। বিভাবতীর কল্পনার বাইরের অঙ্ক প্রায়। স্বামী প্রভিড়ে ফাণ্ড গ্রাচুইটি ইত্যাদির ইত্যাদির সব টাকা কুড়িয়েবাড়িয়ে সর্বসাকুল্যে উনিশ হাজার টাকা তার হাতে দিয়েছিলেন। ওই যথাসর্বস্ব। ছেলে না দাঁড়ানো পর্যন্ত আর কপর্দক ঘরে আসারও সম্ভবনা নেই। তবু তাই থেকে আট হাজার টাকা খরচ করার জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন বিভাবতী।

স্বপ্ন দেখার ফলে বিকেলের মধ্যে প্ল্যান আরো অনেকটা প্রশস্ত রাস্তায় এগিয়ে চলল। কাউকে কিছু না বলে বাসে চেপে ভাগ্নের বাড়ি চলে গেলেন তিনি। ভাগ্নেটা করিতকর্মা লোক। তার সঙ্গে বসে নতুন করে আর একটা হিসেব করে ফেলা হল। দুশ সোয়া দুশ লোককে পেটপুরে খাওয়াতে কম করে আরো দু হাজার টাকা লাগবে। যা তিনি খাওয়াতে চান, এর কমে হবেই না।

বিভাবতী বললেন, ঠিক আছে, তুমি সব ব্যবস্থা করে দাও। সব যোগাড়যন্ত্র করতেও তো প্রাণান্ত ব্যাপার!

সেদিক থেকে ভাগ্নে তাকে নিশ্চিন্ত করল।

খুশিমনে বিভাবতী বাড়ি ফিরলেন। তার মস্ত একটা দুর্ভাবনা গেল। কেবলই মনে হল, মেয়ের কল্যাণের জন্য শ্বশুরই এভাবে তার দ্বিধা ঘুচিয়ে দিলেন। পরে যা হবার হবেই। আর এতে মেয়ের মঙ্গলও হবেই। ইতিমধ্যে সকালেই তিনি পাড়ার বিয়েবাড়ির একতলা ভাড়া করে এসেছেন। নিজেদের আড়াই ঘরে কিছুই হবে না। বাড়ি থেকে মিনিট তিনেকের পথ ওই বিয়েবাড়ি। দোতলায় বাড়ির মালিক থাকে, একতলা বিয়ের দরুন ভাড়া দেওয়া হয়। তা সেও শ্বশুরের আশীর্বাদে আর মেয়ের ভাগ্যে একটু সুবিধেতেই পেয়েছেন তিনি। বিয়ের দিন সকাল থেকে চব্বিশ ঘণ্টার জন্য ভাড়া একশ টাকায় রফা হয়েছে।

খরচ আট হাজার থেকে এক লাফে দশ হাজারে উঠে গেল। কিন্তু ভবিষ্যতের ভাবনায় একটুও উতলা নন তিনি। মেয়ের কল্যাণ হবে মেয়ে সুখী হবে এটাই যেন বড় কথা।

বাড়ির কর্তা অর্থাৎ শৈলেশ চাটুজ্জে খোঁজ নিতে চেষ্টা করেন, কি হচ্ছে বা কি হবে! বিভাবতী ধমকেই ঠাণ্ডা করেছেন তাকে, যা হবে তা হবে, তোমাকে কে মাথা ঘামাতে বলেছে? ভাবনা-চিন্তা করে আবার হার্ট ধরে বসে পড়ো!

আমতা আমতা করে ভদ্রলোক বলেন, ইয়ে, আমি তো বেশ ভালই আছি এখন।

বিভাবতী রেগে যান, ভালো আছ সেটা আর সহ্য হচ্ছে না, কেমন? তাহলে তুমিই সব ব্যবস্থা করো, আমি গিয়ে শুই!

স্বামীটি সুড়সুড় করে ঘরে পালিয়ে বাঁচেন।

কিন্তু ভদ্রলোক আকাশ থেকে পড়লেন বিয়ের রাতে। গোধূলি লগ্নে বিয়ে। বিয়ে হয়ে গেছে। বিয়েবাড়ির এলাহি ব্যাপার দেখে কি রকম যেন অস্বস্তি বোধ করেছেন তিনি। এক-একবার এক-একদিকে ঘুরে দেখছেন, আবার চুপচাপ এক জায়গায় বসে থাকছেন।

অনেক ব্যস্ততার মধ্যেও তাঁর দিকে চোখ পড়ল বিভাবতীর। তক্ষুনি ছেলেকে দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে ছাড়লেন তাকে। বললেন, বিয়ে তো হয়ে গেছে, এখন ঘরে গিয়ে খানিক চুপচাপ শুয়ে থাকোগে যাও–একটু বাদে আমি দুধ পাঠিয়ে দিচ্ছি।

কেন, আমি তো ভালই আছি।

আঃ, যাবে তুমি?

তৎক্ষণাৎ প্রস্থান। স্ত্রীর মন ভালো না, জানেন। বড় মেয়ের শরীর খারাপ, বাচ্চাটার আরো খারাপ–তাকে আনতে পারেনি। স্ত্রীর চোখে কতবার যে জল এসেছে আর শুভদিনের অমঙ্গলের আশঙ্কায় সেই জল ঠেকিয়ে রেখেছে–সে শুধু তিনিই জানেন। বড় মেয়ে আসতে না পারার দরুন স্ত্রীর এত মন খারাপ দেখেই তারও মনটা বিষণ্ন।

ঘরে এসে শুয়ে পড়লেন তিনি, জামা-কাপড় ছাড়লেন না– একটু বিশ্রাম করে স্ত্রীর মন বুঝে আর একবার ওদিকে যেতে চেষ্টা করবেন। যে দুধ নিয়ে আসবে তারই মারফৎ স্ত্রীর অনুমতি চেয়ে পাঠাবেন।

আধ ঘণ্টার মধ্যে দুধের গেলাস হাতে স্ত্রীই হাজির। তাড়াতাড়ি উঠে বসলেন শৈলেশ চাটুজ্জে, আবার তুমি কেন?

ঘামে জবজব করছে বিভাবতীর মুখ, আর পরিশ্রমে বড় বেশি লাল হয়েছে। এক চুমুকে দুধের গেলাস খালি করে জল খেলেন শৈলেশ চাটুজ্জে, তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, সব খেতে বসে গেছে?

এক ব্যাচ হয়ে এলো। তোমার কেমন লাগছে এখন?

খুব ভালো, একবার ঘুরে আসব?

না, তোমাকে এক্ষুনি ব্যাণ্ডেলে যেতে হবে, বিশু ঠাকুরপোর নতুন গাড়িটা পেয়েছি, তোমার কিছু কষ্ট হবে না–পাকা ড্রাইভার তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসবে।

শৈলেশ চাটুজ্জে হতভম্ব হঠাৎ। কি শুনছেন ঠিক যেন বুঝছেন না। বিশু ঠাকুরপো মানে তার বড়লোক বাল্যবন্ধু বিশ্বেশ্বর ঘোষ? বললেন, আমি–মানে এখন ব্যাণ্ডেলে যাব?

হ্যাঁ, সবে তো রাত আটটা এখন, দেড় ঘন্টার মধ্যেই পৌঁছে যাবে। কেবলই মনে হচ্ছে মেয়েটা ছটফট করছে আর কাঁদছে–জামা-কাপড় তো পরাই আছে দেখছি, এই টাকা কটা রাখো, গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, আর দেরি কোরো না, এক্ষুনি চলে যাও। গাড়িতে টিফিন ক্যারিয়ারে রমা আর ওদের সকলের জন্য খাবার দিয়েছি–খায় যেন। আর তুমি গিয়েই যেন কাল-পরশুর মধ্যে ফেরার জন্য ব্যস্ত হয়ো না, এই গণ্ডগোলের মধ্যে থাকলে তোমার হার্ট আরো খারাপ হয়ে যাবে। তিন চার দিনের মধ্যে এদিকের সব চকলে আমিও যাচ্ছি–একসঙ্গে ফিরব। এই নাও, পকেটে তোমার ওষধ কটা নিয়ে নাও।

কথা বলারও ফুরসত পাচ্ছিলেন না শৈলেশ চাটুজে। এবারে বললেন, কিন্তু আজই কেন…কাল না হয় যাব…তাছাড়া আমি তো এখন বেশ…

গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, তুমি উঠবে? তুমি না গেলে এক্ষুনি আমি যাব!

 যাচ্ছি, যাচ্ছি, কিন্তু

আর কিন্তু না, শিগগীর ওঠো! লক্ষ্মীটি, তুমি মেয়েটার কাছে না গেলে আমার একটুও ভালো লাগছে না। এদিকে আমি সব সামলে নিতে পারব

শৈলেশ চাটুজ্জে নীরবে তাকালেন একবার। তার মনে হল, স্ত্রীর চোখে জল বুঝি ভেঙেই পড়বে। আর একটি কথাও না বলে যাবার জন্যে প্রস্তুত হলেন। তারপর নিঃশব্দেই গাড়িতে এসে উঠলেন। গাড়িটা চলে গেল।

বিভাবতী স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে রইলেন কয়েক মুহূর্ত। তারপর বিয়েবাড়ির দিকে চললেন। শুকনো দুচোখ খরখর করছে এখন।

হ্যাঁ, দশ মিনিট সময় নিয়েছিলেন, তার মধ্যেই ফিরেছেন তিনি।

বিয়েবাড়ির এদিকটায় চাপা উত্তেজনা একটা। বিভাবতী জানেন কিসের উত্তেজনা, কেন উত্তেজনা?

স্থির পায়ে এগিয়ে এসে পাশের একটা ছোট ঘরে ঢুকলেন তিনি। সেই ঘরে তিনজন পুলিশ এবং দুজন তাদের ওপরঅলা ভদ্রলোক।

তাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন বিভাবতী, কি বলবেন বলুন?

প্রধান অফিসারটি বললেন, যাঁর মেয়ের বিয়ে তিনি কোথায়?

 আমারই মেয়ের বিয়ে।

সিঁথির সিঁদুরের দিকে চোখ গেল অফিসারের।

 আপনার স্বামী কোথায়?

তিনি অসুস্থ, কলকাতায় নেই। আমার বড় মেয়েও অসুস্থ, আসতে পারেনি, তাকে পাঠিয়ে দিয়েছি।

অফিসারের চোখে অবিশ্বাসের দৃষ্টি, মেয়ের বিয়ে হচ্ছে, তিনি এখানে নেই?

না। বললাম তো তিনি অসুস্থ, হার্টের রোগী, বাড়িতে ডাক্তারের প্রেসকৃপশন আছে একগাদ, দেখতে পারেন।

নেমন্তন্ন চিঠি কার নামে ছাপা হয়েছে?

নেমন্তন্ন চিঠি ছাপানো হয়নি, ওসব বাজে খরচ করার পয়সা নেই।

একজন কেউ তো দাঁড়িয়ে থেকে ব্যবস্থা করিয়েছেন, তাকে ডাকুন।

আমিই দাঁড়িয়ে থেকে সব ব্যবস্থা করেছি, আর কেউ করেনি।

 ও…। অফিসারের তির্যক দৃষ্টি, লোক তো অনেক দেখছি, কত লোক খাওয়াচ্ছেন?

দু’শ।

লিখে নিলেন। কি খাওয়াচ্ছেন একবার দেখতে চাই।

 দেখলে খেয়ে যেতে হবে। আসুন–

অফিসার কেন যেন এগোতে পারলেন না। বললেন, অপরাধ নেবেন না, আমরা কর্তব্যের দায়ে এসেছি, খেতে পারব না।

আমি কর্তব্যে বাধা দেব না, খেয়ে গেলে আমার মেয়ের কল্যাণ হবে। এখানেই আনিয়ে দিচ্ছি

না না না। অফিসার ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। মহিলার দিকে চেয়ে অস্বস্তি বোধ করছেন কেন। আচ্ছা আপনি বলুন, কি খাওয়াচ্ছেন?

লুচি মাছ মাংস পোলাও দই রসগোল্লা সন্দেশ

 অফিসার লিখে নিলেন। সক্কলের জন্য এই ব্যবস্থা?

 সক্কলের জন্য।

আবার লিখলেন। তারপর আমতা আমতা করে বললেন, কিন্তু এসব তো আইনে নিষেধ করা আছে…একটু মুশকিল হলো!

আমাকে এখুনি থানায় যেতে হবে?

অফিসার মুখ তুলে তাকালেন, কিন্তু চোখে চোখ রাখতে পারলেন না। একটু ভেবে বললেন, না, আপনি যা বললেন…এতে একটা সই করে দিলেই হবে।

খাতাটা বাড়িয়ে দিলেন, কলম এগিয়ে দিলেন।

আঁকা-বাঁকা অক্ষরে বিভাবতী নাম সই করলেন। নির্দেশমত বসতবাড়ির ঠিকানাও লিখে দিলেন।

সদলবলে অফিসার চলে গেলেন। ঘরের বাইরের চাপা উত্তেজনা আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল আবার। এদিকের একটা ঘরে কি ঘটে গেল, বিয়েবাড়ির অন্দরমহলের কেউ কিছু জানতেও পারল না।

.

আসামী বিভাবতী চট্টোপাধ্যায়ের কথাবার্তা শুনে তরুণ ম্যাজিষ্ট্রেট কৌতূহল বোধ করছেন বেশ। ঘরের অনেকে হাসছেও মুখ টিপে। একধারে শুধু নতুন মেয়ে জামাই, বর্ধমানের মেয়ে জামাই আর ছেলের মুখ শুকনো।

বিভাবতী উকীল দেননি। বর্ধমানের মেজ জামাই সে চেষ্টা করতে গিয়ে ধমক খেয়ে বিরত হয়েছে। শাশুড়ী বলেছেন, নিজের ওকালতি নিজেই তিনি করতে পারবেন, এর জন্যে লোক ভাড়া করার দরকার নেই।

করেছেনও। তার বক্তব্য, স্বামীর উনিশ হাজার টাকা সম্বলের মধ্যে দশ হাজারের ওপর খরচ করে মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন, ভবিষ্যত ভাবতে গেলে চোখে অন্ধকার দেখার কথা–এই খরচ তিনি সখ করে করেননি, ফুর্তি করার জন্যও না। করার দরকার হয়েছিল তাই করেছেন।

তিনি স্বীকার করেছেন, দুশ লোক নেমন্তন্ন করা হয়েছিল, আর যা-যা খাওয়ানো হয়েছে বলে অভিযোগ, তাও সবই স্বীকার করেছেন, শুধু তিনি দোষী এটুকুই অস্বীকার করেছেন।

তরুণ বিচারক প্রশ্ন করলেন, পঞ্চাশজনের বেশি লোককে এসব খাওয়ানো নিষেধ, আপনি জানতেন না?

জানতাম। এরকম রাজ্যি-ছাড়া নিষেধ আমাদের ভিতরে পৌঁছয় না।

কেন?

কেবল নিষেধ, আর কেবল নেই! সত্যিই নেই বুঝতে পারলে কারো নিষেধ করার দরকার হত না।

সম্ভব হলে বিচারক এই আসামীটিকে মুক্তিই দিতেন বোধ করি। একেবারে ন্যুনতম লোক-দেখানো শাস্তিই ঘোষণা করলেন তিনি। বিভাবতীর পঁচিশ টাকা জরিমানা হল, অন্যথায় তিন দিন জেল।

তিন দিন জেলের উক্তি নিয়ম-রক্ষার্থে, পঁচিশ টাকা জরিমানাতেই এই বিচার-পর্ব শেষ হবে জানা কথা। কিন্তু আসামীর প্রশ্ন শুনে ভিতরে ভিতরে হয়ত অস্বস্তিই বোধ করলেন বিচারকটি। বিভাবতী তার দিকে স্থির তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, পঁচিশ টাকা জরিমানা না দিলে তিন দিন জেলে থাকতে হবে?

তরুণ বিচারক মাথা নাড়লেন।

আপনাদের জেলে ভদ্রঘরের মেয়েদের রাখার ঠিক ঠিক ব্যবস্থা সব আছে তো?

বিব্রত মুখে আবারও মাথা নাড়তে হল বিচারককে। তারপর তেমনি বিড়ম্বিত। মুখে তার আত্মীয়-পরিজনদের দিকে তাকালেন তিনি।

বিভাবতী বললেন, পঁচিশ টাকা দেবার আমার ক্ষমতা নেই, তিন দিন জেলেই থাকব। ছেলে আর মেয়েদের দিকে ফিরলেন তিনি, তোরা বাড়ি যা-তিনটে দিন দেখতে দেখতে কেটে যাবে। আর সাবধান ব্যাণ্ডেলে যেন কেউ কিছু না জানায়।

নিরুপায় জামাই দুটি শাশুড়ীর অলক্ষ্যে বিচারকের দিকে চেয়ে মাথা নেড়ে কি বোঝাতে চেষ্টা করল তারাই জানে। তিনি উঠে যাবার সঙ্গে সঙ্গে তারাও অদৃশ্য। একটু বাদেই হন্তদন্ত হয়ে ফিরল তারা। বিভাবতী অবাক হয়ে দেখলেন তাঁকে কেউ জেলখানায় নিয়ে যেতে এলো না। শুধু মেয়েরাই খুশিমুখে এগিয়ে এলো। শম্পা বলল, চলো মা, এবারে বাড়ি চলো– তুমি দেখালে বটে, হাকিম তোমার জরিমানা মকুব করে দিয়েছেন।

জরিমানা সত্যিই যে এভাবে মকুব করা যায় না, বিভাবতীর তা জানার কথা নয়। তবু সন্দিগ্ধ। জামাইদের দিকে তাকালেন, সত্যি না তোমরা জরিমানা গুনে দিয়ে এলে?

প্রাণের দায়ে মেজ জামাই আর নতুন জামাই ঘন ঘন মাথা নাড়ল। আর মেয়েরা বলে উঠল, তোমার কাছে মিথ্যে বলার সাহস আছে নাকি আমাদের, চলো শিগগীর।

আশ্বস্ত হয়ে সকলকে নিয়ে বিভাবতী বাইরের বারান্দায় এসেই তপ্ত মুখে গজ গজ করে উঠলেন, আমাদের সময় মা-বাবা শ্বশুর-শাশুড়ীরা বলত, কখনো নেই বলতে নেই- আর এদেশের লোক হয়ে আইন করে হাঁকডাক করে নেই-নেই রব তুলে দিয়েছে একেবারে–লজ্জাও করে না!

পরক্ষণে কি মনে পড়তে থমকালেন একটু, পা-ও থেমে গেল। ছেলের দিকে তাকালেন তিনি, বললেন, এখনো তো বেলা পড়েনি, তুই এক কাজ কর তো, এক্ষুনি ব্যাণ্ডেলে চলে যা, তোর বাবাকে নিয়ে আয়–কি ভাবে আছে কে জানে, সঙ্গে টাকা আছে? আছে? যা তাহলে–যাবি আর আসবি, আর সাবধানে নিয়ে আসবি

গল্পটা এই।

তখনো ভাবছিলাম আমি। ভাবছিলাম অর্থাৎ নামী আর মোটামুটি নামী লেখকদের মত আর মন্তব্য বিশ্লেষণ করছিলাম।

দীর্ঘদিন ধরে নিজে সাহিত্য করছি, কঠিন বাস্তবের পটভূমিতে অনেক গল্প লিখেছি, আর সেই সঙ্গে কড়া সম্পাদক হিসেবে কিছু সুনাম আর দুর্নাম কুড়িয়েছি। তবু সতীর্থদের মতামত আর মন্তব্যের সঙ্গে নিভৃতের অনুভূতির তেমন যোগ হচ্ছে না কেন?

প্রথম, নতুন লেখক যে বলেছে, গল্পটা সত্যের ছায়া নিয়ে লেখা–সেটা অবিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে না কেন?

দ্বিতীয়, বিভাবতীর যে কথাবার্তা আচার-আচরণ লেখক বন্ধুদের অবাস্তব মনে হয়েছে, তার একবর্ণও বদলালে গল্পটা বর্ণশূন্য হয়ে যাবে মনে হচ্ছে কেন?

তৃতীয়, গল্পটা নিছক উদ্দেশ্যমূলকই যদি হয় তো, ও-রকম একটি মহিলাকে সচক্ষে দেখার লোভ হচ্ছে কেন?

চতুর্থ, শ্রোতা-লেখকদের মন্তব্য অনুযায়ী গল্প থেকে হার্টের রোগী ভদ্রলোকটিকে উড়িয়ে দিয়ে, অর্থাৎ মহিলার সিঁথির সিঁদুর মুছে দিয়ে এই গল্পটা জটিলতা-মুক্ত করে। তোলার কথা ভাবতেও বুকের ভিতরে বাতাসের অভাব বোধ করছি কেন?

আর সব শেষে, যে মেয়ের মঙ্গল আর কল্যাণের আকাঙ্ক্ষায় মহিলার উনিশ হাজার টাকা সম্বলের থেকে দশ হাজার খরচ করার প্রেরণা আর অনায়াসে আইন ভঙ্গ করার তাড়না- কল্পনায় সেই মেয়ের মাথায় হাত রেখে কেন বলতে ইচ্ছে করছে, মঙ্গল হোক, সুখী হও!

গল্পটা ছাপব কিনা এখনো ঠিক করে উঠতে পারিনি।