বিবিধ
০১.
যারা ভালো করে পৃথিবীর ইতিহাস পড়েছেন তারা খাঁটি খবর দিতে পারবেন; আমি সামান্য যেটুকু পড়েছি তার থেকে আমার দৃঢ় প্রত্যয় হয়েছে মহাত্মাজির মতো মহাপুরুষ এ পৃথিবীতে দ্বিতীয় জন্মাননি।
বুদ্ধদেবকে কোনও ব্যাপক রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হতে হয়নি; খ্রিস্টের সামনে যে রাজনৈতিক সমস্যা এসে পড়েছিল (ইহুদিদের পরাধীনতা) তিনি তার সম্পূর্ণ সমাধান করেননি; শ্রীকৃষ্ণ এবং মুহম্মদ অন্যায়ের বিরুদ্ধে অস্ত্র গ্রহণ করার আদেশ দিতে বাধ্য হয়েছিলেন।
এই চার মহাপুরুষকেই কোটি কোটি লোক শত শত বছর ধরে স্বীকার করে নিয়ে জীবনযাত্রার পথ খুঁজে পেয়েছে; কিন্তু আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস, মহাত্মাজি যে বুদ্ধ এবং খ্রিস্টের অহিংস পন্থা নিয়ে কৃষ্ণ এবং মুহম্মদের মতো রাজনৈতিক সফলতা লাভ করেছিলেন এ জিনিস পৃথিবীতে পূর্বে কখনও হয়নি। প্রেম দিয়ে ব্যক্তিগত জীবনে হিংসার ওপর জয়ী হওয়া যায় এ কথা পৃথিবী বহু পূর্বেই মেনে নিয়েছিল, কিন্তু অস্ত্রধারণ না করে রাজনীতির ক্ষেত্রেও যে জয়ী হওয়া যায় সেই অবিশ্বাস্য সত্য প্রমাণ করে গিয়েছেন মহাত্মাজি। আমার ভয় হয়, একদিন হয়তো পৃথিবী বিশ্বাস করতেই রাজি হবে না যে, মহাত্মাজির প্রেম ইংরেজের বর্বর সৈন্যবলকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছিল। অবিশ্বাসী মানুষ আজ স্বীকার করে না যিশু মৃতকে প্রাণ দিয়েছিলেন; পাঁচশো বছর পরের অবিশ্বাসী দুটোকেই হয়তো এক পর্যায়ে ফেলবে।
***
পাঠক হয়তো জিগ্যেস করবেন, মহাত্মাজি রাজনৈতিক ছিলেন; তিনি কোনও নবীন ধর্ম প্রচার করে যাননি, তবে কেন তাঁকে ধর্মগুরুদের সঙ্গে তুলনা করি।
নবীন ধর্ম কেন সৃষ্ট হয় তার সব কটা কারণ বের করা শক্ত কিন্তু একটি জিনিস আমি লক্ষ্য করেছি। কি বুদ্ধ কি খ্রিস্ট সকলকেই তাদের আপন আপন যুগের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সংকটের সমাধান করে নিতে হয়েছিল। এ বিষয়ে পিথৌরার চর্চা বড়ই অগভীর– সে কথা পাঠককে আবার জানিয়ে রাখছি।
বুদ্ধদেবের সময় উত্তর ভারতবর্ষের বনবাদাড় প্রায় সাফ হয়ে গিয়েছে এবং ফলে আশ্রমবাসীগণ নিরাশ্রয় হয়ে পড়েছিলেন। সংঘ নির্মাণ করে তাদের অন্নবস্ত্রের ব্যবস্থা বুদ্ধদেবকে করে নিতে হয়েছিল। আমার ভাণ্ডার আছে ভরে, তোমা সবাকার ঘরে ঘরে— অর্থাৎ যৌথ পদ্ধতিতে বিরাট প্রতিষ্ঠান (সংঘ) নির্মাণ ভারতে এই প্রথম। দ্বিতীয়ত, তখন প্রদেশে প্রদেশে এত মারামারি হানাহানি যে, ব্যবসা-বাণিজ্য ভালো করে প্রসার পাচ্ছিল না। শ্ৰমণগণ এসব উপেক্ষা করে শান্তির বাণী নিয়ে সর্বত্র গমনাগমন করার ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যের অনেক অন্তরায় দূর হয়। তাই শ্ৰেষ্ঠীরা সবসময়ই সংঘের সাহায্যের জন্য অকাতরে অর্থ দিয়েছেন।
খ্রিস্ট ইহুদিদের স্বাধীন করতে চেয়েছিলেন। তবে তার পন্থা ছিল ইহুদিদের নৈতিক বলে এতখানি বলীয়ান করে দেওয়া যাতে করে পরাধীনতার নাগপাশ নিজের থেকে ছিন্ন হয়ে যায়। অরবিন্দ ঘোষও পণ্ডিচেরিতে এই মার্গেরই অনুসন্ধান করেছিলেন।
কুরুক্ষেত্রের শ্রীকৃষ্ণ যে শুধু কুরু-পাণ্ডবের যোগসূত্র স্থাপনা করার জন্য কূটনৈতিক দূত তাই নন, শেষ পর্যন্ত তিনি পাণ্ডববাহিনীর প্রধান সেনাপতির পদও গ্রহণ করেছিলেন।
মুহম্মদের প্রধান কর্ম ছিল আরবের যুযুধান, ছিন্নবিচ্ছিন্ন বেদুইন উপজাতিগুলোকে এক করে শক্তিশালী জাতি গঠন করা।
মহাত্মাজিকে সবাই রাজনৈতিক হিসেবে মেনে নিয়েছেন, কিন্তু পৃথিবীর মহাপুরুষদের সঙ্গে তুলনা করলে তাকে ধর্মগুরু বলে স্বীকার করে নিলেই ঠিক হবে।
***
প্রশ্ন উঠতে পারে, তাই যদি হয়, তবে মহাত্মাজি কোনও নবীন ধর্ম প্রবর্তন করে গেলেন না কেন?
সে তো খ্রিস্টও করে যাননি। খ্রিস্ট-তিরোধানের বহু বছর পর পর্যন্তও তাঁর অনুচরগণ বুঝতে পারেননি যে তারা এক নবীন ধর্মের প্রদীপ হাতে নিয়ে এগিয়ে চলেছেন। রামমোহন, নানকও দেখা দিয়েছিলেন ধর্ম-সংস্কারকরূপে, তাঁরা বীজ রোপণ করে গিয়েছিলেন– শাখাপ্রশাখায় পল্লবিত হল নবীন ধর্ম পরবর্তী যুগে।
মহাত্মাজির নবীন– অথচ সনাতন ধর্ম প্রবর্তিত হতে সময় লাগবে।
সেই ধর্মং শরণং গচ্ছামি!
***
গল্প শুনেছি এক গুরু যখন বুঝতে পারলেন তার এক নতুন শিষ্য একদম গবেট, তখন তাকে উপদেশ দিলেন বিদ্যাচর্চা ছেড়ে দিয়ে অন্য কোনও পন্থা অবলম্বন করতে। শিষ্য প্রণাম করে বিদায় নিল।
বহু বছর পরে গুরু যাচ্ছিলেন ভিন গাঁয়ের ভিতর। একটি আধাচেনা লোক এসে নিজের পরিচয় দিয়ে গুরুকে আপন বাড়িতে নিয়ে গেল। সেই গবেট শিষ্য। গুরু তার যত্ন-পরিচর্যায় খুশি হয়ে শুধালেন, তা বাবাজি আজকাল কী করো?
শিষ্য সবিনয়ে বলল, টোল খুলেছি।
গুরুর মস্তকে এটম বোমাঘাত। খানিকক্ষণ পরে সামলে নিয়ে শুধালেন, তা কী পড়াও?
শিষ্য বলল, আজ্ঞে সব কিছুই; তবে ব্যাকরণটা পড়াইনে।
গুরু আরও আশ্চর্য হয়ে বললেন, সে কী কথা? আমার যতদূর মনে পড়ছে তুমি তো ব্যাকরণটাই একটুখানি বুঝতে।
শিষ্য বললে, আজ্ঞে, তাই ওটা পড়াতে একটুখানি বাধো-বাধো ঠেকে।
***
রায় পির্থেীরা যে সর্ববাবদে এই শিষ্যটির মতো, সে কথা আর লুকিয়ে রেখে লাভ কী? এই দেখুন না, দিনের পর দিন সে সম্ভব-অসম্ভব কত বিষয়ে কত তত্ত্ব কথাই না বেহায়া বেশরমের মতো লিখে যাচ্ছে। কারণ? কারণ আর কী? সর্ববিষয়ে যার চৌকশ অজ্ঞতা তার আর ভাবনা কি?
কিন্তু প্রশ্ন, গবেট শিষ্য কিঞ্চিৎ ব্যাকরণ জানত বলে ওই বিষয়ে পড়াতে তার বাধোবাধো ঠেকত। পিথৌরার কি সেরকম কোনওকিছু আছে?
সেই তো বেদনা, সুশীল পাঠক, সেই তো ব্যথা।
মা সরস্বতী সম্বন্ধে কোনও কিছু লিখতে বড় বাধো-বাধো ঠেকে। চতুর্দিকে গণ্ডা গণ্ডা সরস্বতী পূজা হয়ে গেল। আমি গা-ঢাকা দিয়ে, কিংবা পালিয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছি।
আর কোনও দেবতার সেবা করার মতো সুবুদ্ধি আমার হয়নি– প্রথমজীবনে মা সরস্বতীই আমার স্কন্ধে ভর করেছিলেন, আর আমি হতভাগা তার সেবাটা কায়মনোবাক্যে করিনি বলে আজ আমার সবকিছু ভণ্ডুল বরবাদ হয়ে গিয়েছে। এখন মা সরস্বতীর দিকে মুখ তুলে তাকাতেও ভয় করে। হায়, দেবীর দয়া পির্থেীরার প্রতি হয়েছিল, কিন্তু মৃর্থ তাঁকে অবহেলা করে আজ এই নিদারুণ অবস্থায় পড়েছে। —–রায় পিথৌরা
.
০২.
দিল্লির বিখ্যাত সাধু নিজামউদ্দীন আওলিয়ার প্রখ্যাত সখা এবং শিষ্য কবি আমির খুসরৌর জন্মোৎসব কয়েক দিন হল আরম্ভ হয়েছে। আমির খুসরৌর কবর নিজামউদ্দীনের দরগার ভিতরেই– এবং সে দরগা হুমায়ুনের কবরের ঠিক সামনেই। (এ দর্গায় আরও বহু বিখ্যাত ব্যক্তির কবর আছে।)
খুসরৌর পিতা ইরানের বখ (সংস্কৃত বহীকম– ভারতীয় কোনও কোনও নৃপতি বখ পর্যন্ত রাজ্যবিস্তার করেছিলেন বলে কিংবদন্তি আছে) থেকে ভারতবর্ষে আসেন। পুত্র খুসরৌ কবিরূপে দিল্লির বাদশাহদের কাছে প্রচুর সম্মান পান।
ফারসি তখন বহুদেশের রাষ্ট্রভাষা। উত্তর ভারতবর্ষ (ফার্সি এদেশের ভাষা নয়), আফগানিস্তান (সে দেশেরও দেশজ ভাষা পশতু), তুর্কিস্তান (তারও ভাষা চুগতাই) এবং খাস ইরানে তখন ফার্সির জয়-জয়কার। এমনকি বাঙলা দেশের এক স্বাধীন নৃপ হাফিজকে বাঙলা দেশে নিমন্ত্রণ করেছিলেন।
খুসরৌ ফার্সিতে অত্যুত্তম কাব্য সৃষ্টি করে গিয়েছিলেন। ভারতের বাইরে, বিশেষ করে কাবুল-কান্দাহার এবং সমরকন্দ-বোখারা খুসরৌকে এখনও মাথার মণি করে রেখেছে।
আলাউদ্দীন খিলজী, তার ছেলে খিজর খান; বাদশা গিয়াসউদ্দীন তুগলুক, তাঁর ছেলে বাদশা মুহম্মদ তুগলুক (ইংরেজ ঐতিহাসিকদের পাগলা রাজা) এরা সবাই খুসরৌকে খিলাত ইনাম দিয়ে বিস্তর সম্মান দেখিয়েছেন।
গুজরাতের রাজা কর্ণের মেয়ে যখন দিল্লি এলেন তখন তার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে রাজকুমার খিজর খান তাকে বিয়ে করেন। ইংরেজের মুখে শুনেছি, বিয়ে নাকি প্রেমের গোরস্তান, অর্থাৎ বিয়ে হওয়ার পরই নাকি সর্বপ্রকারের রোমানস্ হাওয়া হয়ে যায়। এখানে হল ঠিক তার উল্টো। এদের ভিতর যে প্রেম হল সে প্রেম পাঠান-মোগল হারেমের গতানুগতিক বস্তু নয়– তাই অনুপ্রাণিত হয়ে খুসরৌ তাঁদের প্রেমকাহিনী কাব্যে অজর অমর করে দিলেন। সেই কাব্যের নাম ইশকিয়া–বাঙলা ভ্রমণের সময় সম্রাট আকবর সেই কাব্য শুনে বার বার প্রশংসা করেছিলেন। কর্ণের মেয়ের নাম দেবতাদেবী। শুনেছি, বাঙলায় নাকি দেবলাদেবী নাটক বহুদিন ধরে অভিনীত হয়েছে।
গিয়াসউদ্দীন তুগলুক নিজামউদ্দীনকে দু চোখে দেখতে পারতেন না। সে কাহিনী দৃষ্টিপাতে সালঙ্কার বর্ণিত হয়েছে- দিল্লি দূর অস্ত! কিন্তু গিয়াস নিজামের মিত্র খুসরৌকে রাজসম্মান দিয়েছিলেন। খুসরৌ বড় বিপদে পড়েছিলেন, একদিকে সখার ওপর বাদশাহি জুলুম, অন্যদিকে তিনি পাচ্ছেন রাজসম্মান।
মুহম্মদ তুগলক রাজা হওয়ার পর তাবৎ মুশকিল আসান হয়ে গেল। ঠিক মনে নেই (পোড়ার শহর দিল্লি একখানা বই পাইনে যে অর্ধবিস্মৃত সামান্য জ্ঞানটুকু ঝালিয়ে নেব), বোধহয় খুসরৌ বাদশা মুহম্মদের লাইব্রেরিয়ান ছিলেন।
সে এক অপূর্ব যুগ গেছে। সাধক নিজামউদ্দীন, সুপণ্ডিত বাদশা মুহম্মদ তুগলুক, ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দীন বরনী এবং সভাকবি আমির খুসরৌ।
প্রথম দেহত্যাগ করলেন শেখ-উল-মশাইখ নিজামউদ্দীন আওলিয়া, তার পর তাঁর প্রিয়সখা আমির খুসরৌ, তার পর বাদশা মুহম্মদ শাহ তুগলুক এবং সর্বশেষে জিয়া বরনী।
ইংরেজ আমাদের কত ভুল শিখিয়েছে। তার-ই একটা, এসব গুণীরা ফার্সিতে লিখতেন বলে এঁরা এদেশকে ভালোবাসতেন না। বটে? সরোজিনী নাইডু ইংরেজিতে লিখতেন, তাই তিনি ভারতবর্ষকে ভালোবাসতেন না!
খুসরৌ মাতৃভূমি ভারতবর্ষ ভালোবাসতেন এবং সে ভূমির অশেষ গুণকীর্তন করে গিয়েছেন।
এবং দূরদৃষ্টি ছিল বলে তিনি যেটুকু দেশজ হিন্দি জানতেন (হিন্দিরও তখন শৈশবাবস্থা) তাই দিয়ে হিন্দিতে কবিতা লিখে গিয়েছেন।
শুধু তাই নয়, ফার্সি এবং হিন্দি মিলিয়ে তিনি উর্দুর গোড়াপত্তন করে গিয়েছেন– জানতেন একদিন সে ভাষা রূপ নেবেই নেবে।
আবার বিপদে পড়লুম; হাতের কাছে বই নেই, তাই চেক আপ করতে পারছিনে– পণ্ডিত পাঠক অপরাধ নেবেন না– যেটুকু মনে আছে, নিবেদন করছি–
হিন্দু বাচ্চেরা ব নিগরু আজ হুসন্ ধরত হৈ
দর ওকতে সুখ জদ মুহ ফুল ঝরত হৈ
গুফতম কে বি আ আজ লবেৎ বোসে বিগরিম–
গুফত আরে রাম! ধরম নষ্ট করত হৈ!
হিন্দু বামা কী অপূর্ব সৌন্দর্যই না ধারণ করে,
কথা বলার সময় মুখ থেকে যেন ফুল ঝরে।
বললুম, আয় তোর ঠোঁটে চুমো খাব
বললে, আরে রাম! ধর্ম নষ্ট করত হৈ! –রায় পিথৌরা
.
০৩.
দিল্লির দুর্গাপূজা দেখবার মতো জিনিস। আমরা বুড়ো হয়ে গিয়েছি, কিন্তু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সমাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং ধর্মতাত্ত্বিক তথ্য সংগ্রহ করবার মতো বয়স, সময় এবং উৎসাহ যাদের আছে তারা যদি এখানে পূজার সময় গোটা তিনেক রোদ মেরে যান তবে নব হুতোম লিখে পৌরজনকে বিস্তর মধু পান করাতে পারবেন।
সবকিছু দেখিনি, যা দেখলুম তাতে খুশিই হয়েছি। রুচিবাগীরা বলেন, এরকম টাকার শ্রাদ্ধ, বাজে থিয়েটার এবং থিয়েটারকে টেক্কা দেবার জন্য কলকাতা থেকে বাঙলা ফিল আনানো; এরা যদি ট্যাক্সি করে মীরাট থেকে কলাগাছ আনালো তবে ওরা প্লেনে করে কলকাতা থেকে মাল্য যোগাড় করালে; এসব অপব্যয় আড়াআড়ি নিতান্ত অর্থহীন, মূল্যহীন এবং এদের চাপে পড়ে দেবীপূজার মাহাত্ম্য গাম্ভীর্য সমস্তই নির্মমভাবে ব্যর্থ হয়।
বহু স্থানে রুচিবাগীশদের সঙ্গে আমি একমত– একথা অস্বীকার করে মহানবমীর দিনে আমি মহাপাতক হতে চাইনে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে একথাও বলব যে, যাদের রুচি আছে, যারা দেবী-পূজার প্রথম দিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত কী কী করতে হয় সে সম্বন্ধে সুস্পষ্ট ধারণা ধরেন, তারা যদি হাত গুটিয়ে বসে থাকেন, তবে দিল্লি শহরের ঐতিহ্য-বিস্মৃত যুবক-যুবতীরা এমন কী অলৌকিক কর্ম সমাধান করতে পারবে? এদের অনেকেই পুব, পশ্চিম কোনও বাঙলায় কখনও যায়নি, বাঙলায় দুর্গাপূজার রূপ এরা কখনও দেখেনি– এদের দেখাবে কে, শেখাবে কে?
কিন্তু এদের উৎসাহ-উদ্দীপনা খাঁটি বাঙালির চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। হাঁসকে যেমন জলে ছেড়ে দিলে সে তৎক্ষণাৎ সাঁতার কাটতে আরম্ভ করে, বাঙালিকে তেমনি পৃথিবীর যে কোনওখানেই ছেড়ে দাও না কেন, বাঁশ, খড়, মাটি, রঙ যোগাড় করে ভালো-মন্দ একটি প্রতিমা বানিয়ে বসবেই বসবে, ঢাক-ঢোল সানাইয়ের অভাবে ট্যাম্বুরিন ক্লারিনেট দিয়ে কাজ চালিয়ে নেবেই নেবে।
আমার চোখে পড়ে এই উৎসাহটাই। তার বর্তমান গতি বা রূপ দেখে আমি নিরাশ হইনে। যতক্ষণ প্রাণ আছে ততক্ষণ নিরাশ হবার কোনও কারণই আমি দেখতে পাইনে।
***
দিল্লির যেসব ছেলে-ছোকরারা দেহলি প্রান্তে পড়ে এবং আমাকে যারা ব্যক্তিগত জীবনে কিছুটা মানে, তাদের উদ্দেশে আমি দু একটি কথা বলতে চাই।
দুর্গাপূজার প্রধান উদ্দেশ্য শক্তির সন্ধান, শক্তির সাধনা। এ শক্তি শারীরিক মানসিক নৈতিক সর্বপ্রকারের পার্থিব আধ্যাত্মিক শক্তি ছাড়িয়ে গিয়ে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সর্বশক্তির আধার। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অন্তরালে যেসব শক্তি আছে যাদের সন্ধান করতে গিয়ে আমাদের বাক্ এবং চিত্ত বার বার ফিরে আসে সেগুলোও ওই মূল শক্তির ভিতর সমাহিত। মানুষ যখন ধ্যানলোকে তার শারীরিক মানসিক সর্বপ্রকারের সংকীর্ণ সীমা অতিক্রম করে ব্রহ্মের সঙ্গে মিলিত হয় তখন সে শক্তি পায় সেই মূল শক্তি থেকে, আবার ক্ষুদ্রতম কীটাণুকীট যখন তার সামান্যতম প্রয়াসে নিযুক্ত হয় তখনও এই বিশ্বশক্তি তাকে অনুপ্রাণিত করে। এ শক্তির বাইরে কোনও কিছু নেই– সবকিছুই এরই ভিতরে।
শান্তির সাধনা করো আর সংগ্রামের সাধনাই করো, এই শক্তি ছাড়া অন্য পন্থা নেই।
এই জ্ঞানের মাধ্যমে আমরা জড়জগতের সৃষ্টিশক্তির অনেক সন্ধান পেয়েছি এবং শক্তির দ্বারাই আমাদের সভ্যতা গড়ে তুলেছি। শক্তিকে কেউ অস্বীকার করে না, এ শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়ালে যে আমাকে সঙ্গে সঙ্গে নিষ্পেষিত হতে হয় সে তত্ত্ব সকলেরই জানা। ঠিক তেমনি আমাদের মনের ভিতরে-বাইরে নানা ধরনের শক্তি আছে যার সন্ধান কেউ অল্পবিস্তর পেয়েছে, কেউ সাধনার জোরে বেশি পেয়েছে।
এঞ্জিনের শক্তির সামনে আমি দাঁড়াইনে, কিন্তু নৈতিক শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়ালেও যে তদ্দণ্ডেই আমার বৃহত্তর মৃত্যু সে কথা আমরা ভেবে দেখিনে। তার প্রধান কারণ আমরা সে শক্তির স্বরূপ চিনিনে– সে শক্তি তো চোখ দিয়ে দেখা যায় না, হাত দিয়ে স্পর্শ করা যায় না। এই নৈতিক শক্তির স্বরূপ মহাত্মা গাঁধী তাঁর সর্বসত্তা দিয়ে চিনতে পেরেছিলেন এবং সেই শক্তি-অশ্ব যখন তিনি তাঁর স্বরাজরথে পার্থসারথির মতো সংযোজনা করলেন তখন ইংরেজকে পরাজয় স্বীকার করতে হল।
এ শক্তি সকলেই কাজে খাটাতে পারবে সে আশা দুরাশা। পার্থসারথি হওয়া মহামানবের কর্ম কিন্তু এ শক্তিকে চিনতে পারা ততখানি কঠিন নয়। সামান্যতম পদাতিকও কৃষ্ণের রথ দেখে চিনতে পারে এবং পথ ছেড়ে সরে দাঁড়ায়। এ তত্ত্ব নেতিবাচক কিন্তু এর কমে বেঁচে থাকা অসম্ভব। তাই এর সন্ধান আমাদের অহরহ করতে হবে। নৈতিক ভুবনে শক্তিশালী হই আর না-ই হই, শক্তিমানকে যেন অন্তত চিনতে পারি।
***
এসব শক্তি ছাড়িয়ে যে বিশ্বশক্তি, যে বিশ্ব-ভাণ্ডার থেকে সর্বশক্তি উচ্ছ্বসিত হয় তার সন্ধানে মানুষ এখনও খুব বেশি অগ্রসর হতে পারেনি। কী করলে সেই শক্তি-স্রোতে আমি শরীর ভাসিয়ে দিয়ে সুধাপারাবারে পৌঁছব তার সন্ধান পেয়েছেন অতি অল্প পুরুষই। এ-যুগে তাই শ্রীঅরবিন্দ ভারতবর্ষের আধ্যাত্মিক ইতিহাসে স্বর্ণসিংহাসনে বিরাজ করছেন। সকলেই জানেন, তিনি কতবার বলেছেন, শক্তিরূপা মাতাকে আরাধনা না করে আধ্যাত্মিক জগতে গত্যন্তর নেই।
দুর্গাপূজার দিনে বাঙালি এ সত্য সর্বান্তঃকরণে স্বীকার করে। কিন্তু বাদবাকি ৩৬৪ দিন? তখন বাঙালি আবার সেই নির্জীব শক্তিহীন বাঙালি?
তাই শক্তিপূজা শুধু কয়েকটি দিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়— বছরের প্রতিদিন শক্তিকে স্মরণ করতে হয়, তাঁর সাধনা করতে হয়। –রায় পির্থেীরা
.
০৪.
প্রভাত মুখুয্যের রত্নদীপ যখন মাসিকে ধারাবাহিক হয়ে বেরোয়– আজ পিছন পানে তাকিয়ে মনে হয় সে যেন বহু যুগের কথা– তখন কী উৎসাহে বাঙালি জনসাধারণ এবং রুচিসম্পন্ন পাঠকেরাও সে-বই পড়েছিলেন! মফঃস্বলের শহরের ডাকঘরে যখন সে মাসিক আসত তখন তার জন্য কাড়াকাড়ি পড়ে যেত। আমাদের শহরে তো নিয়ম ছিল, পোস্ট মাস্টার মহাশয়ের মাসিকখানা পোস্টাপিসের সম্মুখের কালীবাড়িতে নিয়ে গিয়ে কাউকে দিয়ে চেঁচিয়ে পড়ানো– আমরা সবাই কুণ্ডুলি পাকিয়ে সেই শাস্ত্ৰ-পাঠ শুনতুম।
খ্যাতনামা, সুরুচিবান এবং শক্তিশালী বাঙালি লেখক কর্তৃক এই প্রথম এবং বলতে গেলে শেষ রগরগে বা সেনশনাল নভেল।
এখনও বহু লোকের বিশ্বাস রগরগে উপন্যাস লেখা অতিশয় অপকর্ম– পাঁচকড়ি দেনরাধম এবং দীনেন্দ্রকুমার রায় কুলোক। আমি এ দলে নেই কিন্তু সে আলোচনা আরেক দিন হবে।
কোনান ডয়েল সত্যকার পণ্ডিত লোক ছিলেন এবং তাঁর একটি অসাধারণ গুণের কথা বহু লোকের অজানা যে তিনি ইংলন্ডের মৃত কি জীবিত যে কোনও সাহিত্যাচার্যের রচনাভঙ্গি, শৈলী এবং ভাষা অনায়াসে অনুকরণ করতে পারতেন। এডগার ওয়ালেসও সুসাহিত্যিক ছিলেন– ইংলন্ডের যে কোনও সাহিত্যসভা তাঁর আশীর্বাদ কিংবা উপস্থিতি পেলে কৃতাৰ্থৰ্মন্য হতেন।
সাহিত্যে রগরগে উপন্যাসেরও বিশেষ স্থান আছে। তবে একথা ভুললে চলবে না, শুষ্ক ইতিহাসকে সরস, সজীব, সার্থক সাহিত্য করতে হলে যে রকম সুসাহিত্যিকের প্রয়োজন, রগরগে উপন্যাসের বেলাতেও তাই। গুপ্তধন রবীন্দ্রনাথ ছাড়া কেউ লিখতে পারতেন না, গোস্ট অব ক্যান্টারভিল লেখা অস্কার ওয়াইলডেই সম্ভবে।
প্রভাত মুখুয্যে যখন রত্নদীপ লেখেন তখন তিনি খ্যাতনামা লেখক। শুধু যে তিনি তখন রবীন্দ্রনাথ, চারু বন্দ্যোপাধ্যায়, মণি গাঙ্গুলী, সত্যেন দত্তের শ্রদ্ধা এবং সাহচর্য পেয়েছিলেন তা-ই নয়, ঋষিকল্প দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর পর্যন্ত তাঁর একটি গল্প পড়ে মুগ্ধ হয়ে আপন দর্শন-দ্বিরদ-দ-স্তম্ভ থেকে নেমে এসে সেই গল্প নিয়ে একটি চমৎকার আলোচনা করেন। সে আলোচনা পড়লে বাঙালি এখনও উপকৃত হবে।
সেই প্রভাত মুখোপাধ্যায় সুসাহিত্যিক-খ্যাতির শিখরে বসে লিখলেন, রত্নদীপ— রগরগে উপন্যাস!
কিন্তু হলে কী হয়–উপন্যাসখানা পড়বার সময় ক্ষণে ক্ষণে সর্বাঙ্গে রোমাঞ্চ এবং শিহরণ হলেও পরিষ্কার ধরা পড়ে মুখোপাধ্যায়ের আসল কৃতিত্ব কোথায়? প্রবঞ্চক যেদিন বউরাণীকে। ভালোবেসে এক নতুন মানুষ হয়ে জন্ম নিল, তখন তার নবজন্মের কাহিনী, তার ভিতরকার ন্যায়-অন্যায়ের দ্বন্দ্ব এবং সর্বশেষে তার নির্ভয়, পরিপূর্ণ স্বার্থত্যাগ-আত্মবিসর্জন প্রভাত মুখোপাধ্যায় বিশ্লেষণ এবং বর্ণন করেছেন এদেশে মনস্তাত্ত্বিক নভেল প্রচলিত হওয়ার বহু পূর্বেশক্তিশালী সাহিত্যিকের জোরদার কলম দিয়ে। আমার মনে হয় সে যুগে রবীন্দ্রনাথ ছাড়া কেউ ওরকম অপরের হৃদয়মনের গভীর অতলে ঢুকে এরকম রত্নদীপ তুলে আনতে পারতেন না।
তাই রত্নদীপ নিছক রগরগে উপন্যাস নয় (তা হলেও আমার মত অনেকের ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগত আপত্তি নেই), রত্নদীপ সুসাহিত্য।
***
সেই রত্নদীপ তার আলো-ছায়া ফেলেছে দেহলি-প্রান্তের রুপালি পর্দায়। তবে সে দীপ হিন্দি ভাষার ঘিউ দিয়ে জ্বালানো– হেথাকার বাঙালির এই যা আফসোস।
বয়স হয়েছে; বায়স্কোপ– সিনেমা-মুভি-পিকচার-টকি কথাগুলো এখনও রপ্ত হল না– যেতে দেখলে নাতি-নাতনিরা হাসাহাসি করবে তাই যেতে হয় গা-ঢাকা দিয়ে টাপে-টোপে। দিল্লিতে আমাকে অন্য কেউ বড় একটা চেনে না– অখ্যাত হওয়ার এই একটা মস্ত সুবিধে।
গিয়ে ভালোই করেছিলুম। ছবিখানা অত্যুত্তম না হলেও উত্তম হয়েছে। বেশিরভাগ ছবি আজকাল এতই খারাপ যে, বায়স্কোপে বসে অনেক জোয়ানরাই ঘুমোয় প্রাপ্তবয়স্কদের তো কথাই নেই; এ ছবি ঘুমের দাওয়াইরূপে সেবন করা যায় না। বেশ খাড়া হয়ে বসে দেখতে হয়।
আর ছবির নায়ক অভিনয়ে পাউল মনির পর্যায়ে উঠেছেন– অবশ্য শেষ পর্যন্ত তিনি মুনির মতো বিভিন্ন চরিত্রে একই কৃতিত্ব দেখাতে পারবেন কি না, সে কথা এখনও বলা যায় না বলেই আমার মনে হল। জমিদারবাড়িতে ঢোকার পর নায়ক সবসুদ্ধ হয়তো এক ডজন কথাও বলেছেন কি না সন্দেহ, অথচ এই কথা না-বলার টেকনিকেই তাঁর অভিনয় চরম খোলতাই পেয়েছে। সিনেমা-মৌতাতিরা এ লোকটির ওপর নজর রাখবেন।
বউরাণীও ভালো অভিনয় করেছেন, তবে মাঝে মাঝে মনে হয়েছে তার বস্তৃতান্ত্রিক অভিনয়ে যতখানি দখল, ব্যঞ্জনার ভিতরে গোপন থেকেও আত্মপ্রকাশ করার পদ্ধতি তিনি ততটা ভালো করে আয়ত্ত করতে পারেননি। সেদিক দিয়ে তার সহচরী সুচতুরা। তবে একথাও বলব, বউরাণী দর্শকের চিত্তজয় করতে সমর্থ হয়েছেন।
যতদূর মনে পড়ছে, মূল পুস্তকে বউরাণী লাজুক এবং অতিশয় স্বল্পভাষী। নায়ক কথা বলে না, নায়িকাও স্বল্পভাষী। উপন্যাসে এ জিনিস চলে, ফিলমে চালানো মুশকিল সায়লেন্ট ফিমে এই একটা মস্ত সুবিধে ছিল– তাই বোধহয় বউরাণীকে কিঞ্চিৎ এগ্রেসিভ করে গড়া হয়েছে।
আমার ভালো লাগেনি প্রধান পরিচারিকা আর জমিদার-মাতার অভিনয়। বড় বাড়াবাড়ি বলে মনে হল; তবে শুনেছি এ দেশের অধিকাংশ দর্শকই নাকি বাড়াবাড়ি (ইংরেজিতে যাকে বলে হ্যাঁম্ অ্যাকটিং) পছন্দ করেন।
আগাগোড়া নাটকেই বিস্তর ফাইন টাচেস আছে। তার জন্য প্রসার ডিরেক্টর কাকে প্রশংসা করতে হবে জানিনে। বাঙলা ছবি এ বাবদে এখন ভারতীয় অন্যান্য ছবির চেয়ে অনেক দূরে এগিয়ে আছে।
গোঁফ পরচুলা কিন্তু এখন খারাপ। ক্লোজ-আপের সময় চোখে পীড়া দেয়। শুনেছি, কোনও এক ফিলমে ক্রাইটের দাড়ি-গোঁফের প্রত্যেকটি আলাদা আলাদা করে গঁদ দিয়ে সাঁটা হয়েছিল– অতখানি না করেও দাড়িগোঁফ আরও অনেক স্বাভাবিক করা যায়।
কিন্তু এসব খুঁটিনাটি। রবিবাবু বলেছেন,
দোষ গাইতে চাই যদি তো তাল করা
যায় বিন্দুকে;
মোটের উপর শিলঙ ভালোই যাই না
বলুক নিন্দুকে।
এ ছবি মোটের উপর নয়, খণ্ডেও ভালো। প্রিমিয়ের-রাত্রে দেবকীবাবু রিগেলে উপস্থিত ছিলেন। –রায় পিথৌরা
.
সপ্তপর্ণী
কয়েক দিন হল আনন্দবাজার পত্রিকার দোল সংখ্যা বেরিয়েছে। শ্ৰীযুত প্রবোধচন্দ্র সেন এ কাগজে বাংলা সাহিত্যের অতীত ও ভবিষ্যৎ শীর্ষক একটি সুচিন্তিত এবং বহু তথ্যপূর্ণ প্রবন্ধ লিখেছেন। হিন্দি-ইংরেজি বনাম বাঙলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে যারা কৌতূহলী তাঁদের সকলকে আমি এই প্রবন্ধটি পড়তে অনুরোধ করি- তারা লাভবান হবেন।
আমার আলোচনায় জানা-অজানাতে প্রবোধচন্দ্রের অনেক যুক্তি এসে গিয়েছে এবং আসবে। প্রবোধচন্দ্র না হয়ে অন্য কোনও কাঁচা লেখক হলে আমি আমার লেখাতে পদে পদে তার উদ্ধৃতির ঋণস্বীকার করতুম– কিন্তু এর বেলা সেটার প্রয়োজন নেই, কারণ প্রবোধবাবু লব্ধপ্রতিষ্ঠ পণ্ডিত, তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য বাঙলা ভাষা যেন তার ন্যায্য হক পায় এবং সেই হক সপ্রমাণ করার জন্য কে তাঁর লেখা থেকে কতখানি সাহায্য পেল, সে সম্বন্ধে তিনি সম্পূর্ণ উদাসীন। এবং আমার বিশ্বাস, দরকার হলে তিনিও অন্য লেখকের রচনা থেকে যুক্তি-তর্ক আহরণ করতে কুণ্ঠিত হবেন না। আমার লেখা তাঁকে সাহায্য না-ই করল।
প্রাচ্যে যেসব বড় আন্দোলন হয়ে গিয়েছে, সেসব আন্দোলন শুধু যে তার জন্মভূমিতেই সফল হয়েছে তাই নয়, তার ঢেউ পশ্চিমকেও তার সুপ্তিতে জাগরণ এনে দিয়েছে, সেসব আন্দোলনকে আমরা সচরাচর ধর্মের পর্যায়ে ফেলে নবধর্মের অভ্যুদয় নাম দিয়ে থাকি। ভারতবর্ষে তাই বৌদ্ধ ও জৈনদের দুই বৃহৎ আন্দোলনকে আমরা ধর্মের আখ্যা দিয়েছি; সেমিতি ভূমিতে ঠিক ওইরকমই দুই মহাপুরুষকে কেন্দ্র করে দুটি জোরালো আন্দোলন সৃষ্ট হয় সেগুলোর নাম খ্রিস্টধর্ম এবং ইসলাম।
আজকের দিনে ধর্ম বলতে আমরা প্রধানত বুঝি, মানুষের সঙ্গে ভগবানের সম্পর্ক। পূজা-অর্চনা কিংবা কৃজ্রসাধন-ধ্যানাদি করে কী করে ভগবানকে পাওয়া যায়, ধর্ম সেই পন্থা দেখিয়ে দেয়, এই আমাদের বিশ্বাস। কিন্তু একটুখানি ধর্মের ইতিহাস অধ্যয়ন করলেই দেখতে পাবেন, ভগবানকে পাওয়ার জন্য ধর্ম যতখানি মাথা ঘামিয়েছে তার চেয়ে ঢের ঢের বেশি চেষ্টা করেছে মানুষে মানুষের সম্পর্ক সভ্যতর করার জন্য। ধর্ম চেষ্টা করেছে ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য কমাতে, অন্ধআতুরের আশ্রয় নির্মাণ করাতে– এককথায় এমন এক নবীন সমাজ গড়ে তুলতে, যেখানে মানুষ মাৎস্যন্যায় বর্জন করে, একে অন্যের। সহযোগিতায় আপন আপন শক্তির সম্পূর্ণ বিকাশ করতে পারে। বৌদ্ধ এবং জৈনধর্ম এইসব কাজেই মনোযোগ করেছে বেশি– ভগবানের সান্নিধ্য এবং তাঁর সাহায্য সম্বন্ধে সম্পূর্ণ উদাসীন হয়ে।
বিত্তশালী এবং পণ্ডিতের সংখ্যা সংসারে সবসময়েই কম ছিল বলে বড় আন্দোলনকারী মাত্রই এদের উপেক্ষা করে জনগণকে কাছে আনতে- এমনকি ক্ষেপিয়ে তুলতে চেষ্টা করেছেন আপ্রাণ। এবং তাই তাঁরা বিত্তশালী এবং পণ্ডিতের ভাষা উপেক্ষা করে যে ভাষায় কথা বলেছেন, সেটা জনগণের ভাষা। তথাগতের ভাষা তকালীন গ্রাম্য ভাষা পালি এবং মহাবীরের ভাষা অর্ধ-মাগধী। খ্রিস্টের ভাষা হিব্রুর গ্রাম্য সংস্করণ আরামেয়িক এবং মুহম্মদের ভাষা আরবি। আরবি সে যুগে এতই অনাদৃত ছিল যে আরবেরাই আশ্চর্য হল, এ ভাষায় আল্লা তাঁর কুরান প্রকাশ (অবতরণ = নাজিল) করলেন কেন? তার-ই উত্তর কুরানে রয়েছে :
আল্লা স্পষ্ট ভাষায় বলছেন, আরব পয়গম্বর যে আরবি ভাষায় কুরান অবতরণের আধার হবেন সেই তো স্বাভাবিক এবং অন্য যে কোনও ভাষায় (এবং সে যুগে হিব্রু ছিল পণ্ডিতের ভাষা– রায় পিথৌরা) সে কুরান পাঠানো হলে মক্কার লোক নিশ্চয়ই বলত, আমরা তো এর অর্থ বুঝতে পারছিনে।
গণ-আন্দোলনে সবচেয়ে বড় কথা– আপামর জনসাধারণ যেন বক্তার বক্তব্য স্পষ্ট বুঝতে পারে।
তাই মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যের চতুর্দিকে যে আন্দোলন গড়ে উঠল, তার ভাষা বাঙলা, তুকারামের ভাষা মারাঠি (তিনি ব্যঙ্গ করে বলেছেন, সংস্কৃতই কেবল সাধুভাষা? তবে কি মারাঠি চোরের ভাষা), কবীরের ভাষা সে সময়ে প্রচলিত বৈধ হিন্দি এবং তিনিও বলেছেন, সংস্কৃত কূপজল (তার জন্য ব্যাকরণের দড়িলোটার প্রয়োজন), কিন্তু ভাষা (অর্থাৎ চলতি ভাষা) বহুৎ নীর যখন খুশি ঝাঁপ দাও, শান্ত হবে শরীর। রামমোহন, দয়ানন্দ আপন আপন মাতৃভাষায় তাদের বাণী প্রচার করেছিলেন, আর শ্রীরামকৃষ্ণ যে বাঙলা ব্যবহার করে গিয়েছেন, তার চেয়ে সোজা সরল বাঙলা আজ পর্যন্ত কে বলতে পেরেছেন? এমনকি বিদ্যাসাগর মহাশয়ও তার বিপক্ষ দলকে উপদেশ দিয়েছিলেন সংস্কৃতে না লিখে বাঙলায় উত্তর দিতে। তিনি নিজেও সংস্কৃতে লেখেননি, যদিও তিনি সংস্কৃত জানতেন আর সকলের চেয়ে বেশি।
আমার মনে হয়, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের পতনের অন্যতম কারণ সেদিনই জন্ম নিল, যেদিন বৌদ্ধ ও জৈন পণ্ডিতেরা দেশজ ভাষা ত্যাগ করে সংস্কৃতে শাস্ত্রালোচনা আরম্ভ করলেন। দেশের সঙ্গে যোগসূত্র ছিন্ন হয়ে গেল, ওদিকে সংস্কৃত শাস্ত্রচর্চা করাতে ব্রাহ্মণদের ঐতিহ্য ঢের ঢের বেশি– বৌদ্ধ জৈনদের হার মানতে হল।
পৃথিবীজুড়ে আরও বহু বিরাট আন্দোলন হয়ে গিয়েছে– পণ্ডিতি ভাষাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে, মাতৃভাষার ওপর পরিপূর্ণ নির্ভর করে।
এইবারে নিবেদন, ইতিহাস আলোচনা করে দেখান তো, পৃথিবীর কোথায় কোন্ মহান এবং বিরাট আন্দোলন হয়েছে জনগণের কথা এবং বোধ্য ভাষা বর্জন করে?
এ তত্ত্ব এতই সরল যে, এটাকে প্রমাণ করা কঠিন। স্বতঃসিদ্ধ জিনিস প্রমাণ করতে গেলেই প্রাণ কণ্ঠাগত হন।
আটঘাট বেঁধে পূর্বেই প্রমাণ করেছি এসব আন্দোলন নিছক ধর্মান্দোলন (অর্থাৎ আত্মা-পরমাত্মাজনিত) নয়– এদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক অংশ অনেক বেশি গুরুত্বব্যঞ্জক।
তাই ভারতবর্ষ এখন যে নবীন রাষ্ট্র নির্মাণের চেষ্টা করছে, তার সঙ্গে এইসব আন্দোলনের পার্থক্য অতি সামান্য এবং তুচ্ছ। এই যে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা করা হয়েছে, তার সাফল্যের বৃহদংশ নির্ভর করবে জনগণের সহযোগিতার ওপর– এ কথা পরিকল্পনার কর্তাব্যক্তিরা বহুবার স্বীকার করেছেন এবং ক্রমেই বুঝতে পারছেন, উপর থেকে পরিকল্পনা চাপিয়ে কোনও দেশকে উন্নত করা যায় না যদি না নিচের থেকে, জনগণের হৃদয়মন থেকে সাড়া না আসে, সহযোগিতা জেগে না ওঠে।
আমাদের সর্বপ্রচেষ্টা, সর্বঅর্থব্যয়, সর্বসাধন, সম্পূর্ণ নিষ্ফল হবে যদি আমরা আমাদের সর্বপরিকল্পনা সর্বপ্রচেষ্টা জনগণের বোধ্য ভাষায় তাদের সম্মুখে প্রকাশ না করি। এ বিষয়ে আমার মনে কণামাত্র সন্দেহ নেই।
আমি জানি, ভারতবর্ষ এগিয়ে যাবেই, কেউ ঠেকাতে পারবে না। শুধু যারা অন্তহীনকাল ধরে ইংরেজির সেবা করতে চান, তারা ভারতের অগ্রগামী গতিবেগ মন্থর করে দেবেন মাত্র।
এ বিশ্বাস না থাকলে আমি বার বার নানা কথা এবং একাধিকবার একই কথা বলে বলে আপনাদের বিরক্তি ও ধৈর্যচ্যুতির কারণ হতুম না। –রায় পিথৌরা
.
তোমার আসন পাতব কোথায়?
মিশরের লোক নিশ্চয়ই বাঙলা পড়তে পারে, অন্তত মিশরস্থ ভারতের রাষ্ট্রদূত এ. এ. এ. ফৈজি সাহেব পারেন, এবং সত্যযুগ কাগজখানারও কিছুটা কাটতি কাইরোতে আছে। তা না হলে এ অলৌকিক ঘটনা ঘটল কী প্রকারে?
মিশর থেকে খবর এসেছে, ফৈজি সাহেবের উদ্যোগে কাইরোতে একটি মিশর-ভারত সংস্কৃতি-সঙ্ স্থাপিত হয়েছে। এই জাতীয় সঙ্ প্রতিষ্ঠিত করার জন্য অধম কোনও প্রকারের প্রস্তাব করেননি বটে কিন্তু স্মৃতি-বিলাস পাঠকের স্মরণ থাকতে পারে, মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে অধম রুদ্ধ-বাতায়ন এবং খোলা-জানালায় লিখনে কিছুটা ওকালতি করেছিল।
ভুবন-ব্যাপী রাজনৈতিক অরাজকতার মাঝখানে আমার নস্য-প্রমাণ লিখন দুটি এরকম ঝটপট ফল দেবে সে আশা আমি কস্মিনকালেও করিনি। তার শতাংশের একাংশও মনে মনে পোষণ করলে আমি আজই চিনির অনটন সম্বন্ধে গণ্ডদশেক প্রবন্ধ লিখতুম। তাই আমার এ কেরামতিটা কাকতালীয় বলে স্বীকার করে নেওয়াটাই যুক্তিযুক্ত বলে বিবেচনা করলুম।
ফৈজি সাহেবকে পূর্ব-ভারতের লোক চেনে না। ইনি বোম্বাইবাসী এবং বোম্বাইয়ের ইসলামিক রিসার্চ অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা। উৎকৃষ্ট আরবি জানেন এবং বোম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি-বিভাগ এরই আদেশ-উপদেশ অনুসারে চলে। শিয়াদের ইসমাইলিয়া সম্প্রদায় সম্বন্ধে তিনি বিস্তর গবেষণা করেছেন এবং অন্যান্য নানা বিষয়ে ইনি সুপণ্ডিত। চিন্তা-জগতে ইনি প্রগতিশীল, এবং চোস্ত আদব-কায়দা জানেন বলে ইনি রাষ্ট্রদূত বা ইচি হওয়ার উপযুক্ত।
কেউ যদি সঙ্কীর্ণমনা, প্রাদেশিক বাঙালি বলে আমার প্রতি কটুবাক্য প্রয়োগ না করেন তবে অবশ্য নিবেদন করব, আমাদের খুদাবখশ অথবা আব্দুল্লা সুহ্রাওয়ার্দীর তুলনায় ইনি এমন কিছু ভয়ঙ্কর গুণী নন। আজ আব্দুল্লা বেঁচে থাকলে তিনিই যে এ কর্মের সর্বোত্তম অধিকারী হতেন সে-বিষয়ে আমার মনে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু থাক্ এসব কথা, বাঙালি হিন্দুই যখন আজ বাঙলার বাইরে কোথাও কল্কে পায় না তখন আর মুসলমানের জন্য কোন্ কারবালায় কান্না জুড়ব? আব্দুল্লা অবশ্য কোনও অবস্থাতেই ফিরে আসবেন না, কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্য সুধীও আছেন।
সংস্কৃতিকেন্দ্রের পত্তন উপলক্ষে মিশরের পক্ষ থেকে দু জন পণ্ডিত বক্তৃতা দেন। তার একজন অল-অজহর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান গুরু বা শেখ।
সিদনা (সম্মানিত) শেখ যে অজহরের পক্ষ থেকে এ-উৎসবে যোগদান করেছেন সে বড় আনন্দের বিষয়। অজহর পৃথিবীর সবচেয়ে বুড়া বিশ্ববিদ্যালয়– তার বয়স এক হাজার সাতের কাছাকাছি। ইয়োরোপের তাবৎ বিশ্ববিদ্যালয়– তা সে অক্সফোর্ডই হোক আর প্যারিসই হোক–অজহরের হাঁটুর বয়সী এবং গোড়ার দিকে এদের সকলেই অজহরের নকল করত। ইবনে রুশদের (দার্শনিক আডেরস) যেসব বই অজহরে পড়ানো হত তারই লাতিন তর্জমা নিয়ে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন পড়ানো আরম্ভ হয়। অক্সফোর্ড-কেম্ব্রিজের ছেলেরা যে গাউন পরে সেটি প্রথম থেকেই চালু করা হয় অজহরের অনুকরণে।
মক্কা যেরকম মুসলিম-জাহানের ধর্মকেন্দ্র, অজহর ঠিক সেইরকম মুসলিম-জাহানের শিক্ষাকেন্দ্র। অজহরের সিদনা শেখ যে বাণী বলেন, যে ফতোয়া দেন (এ-স্থলে ফতোয়া আমি শব্দার্থে অর্থাৎ বিধান অনুশাসন অর্থে ব্যবহার করছি) তামাম পৃথিবীর মুসলমান সে ফতোয়া পালন করার চেষ্টা করে। মিশরের প্রধানমন্ত্রীর তো কথাই নেই, স্বয়ং রাজা পর্যন্ত এঁকে সমঝে চলেন।
সিদনা শেখ কেন্দ্রের উন্নতিকল্পে নানা প্রস্তাব পেশ করে কামনা জানিয়েছেন, মিশর-ভারতে যেন ছাত্র ও শিক্ষক বিনিময় হয়। ভারত সম্বন্ধে মিশরের কৌতূহল প্রচুর তাই তিনি ভরসা রাখেন এইসব শিক্ষক ও ছাত্র ভারতবর্ষ থেকে ফিরে গিয়ে আরবি ভাষায় ভারতবর্ষ সম্বন্ধে কেতাব লিখে মিশরবাসীর জ্ঞান বাড়াতে সমর্থ হবেন।
উত্তম প্রস্তাব, এ সম্বন্ধে কোনও সন্দেহ নেই। বরঞ্চ আমরা কিঞ্চিৎ আরবি জানি বলে মিশর সম্বন্ধে আপন মুখে ঝাল খেতে পারি, কিন্তু মিশরের লোক না জানে ইংরেজি, না জানে ভারতীয় কোনও ভাষা। তাই ভারত সম্বন্ধে মিশরের জ্ঞান এতদিন পর্যন্ত ইংরেজের কুৎসা নিন্দার ওপর নির্ভর করেছে। আজ যদি সিদনা শেখের প্রস্তাব হাড়-মাংস নিয়ে শরীর ধারণ করে তবে আমি উদ্বাহু হয়ে নৃত্য করব।
কিন্তু প্রশ্ন, যেসব ছাত্র-শিক্ষক এদেশে আসবেন তারা অধ্যয়ন করবেন কোথায়?
কলকাতা, বোম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ে? কাশী, ভট্টপল্লির চতুষ্পঠীতে? দেওবন্দ, রামপুরের মাদ্রাসায়? এঁরাই তো আমাদের ত্রিশরণ।
দেওবন্দ, রামপুর গিয়ে যে এদের মোক্ষলাভ হবে না সে-কথা বিনাবাক্য ব্যয়েই স্বীকার করে নিতে পারি। তার কারণ দেওবন্দ রামপুর পড়ায় অজহরেরই নিসাব বা পঠনবস্তু বেশ কিছুটা জল ঢেলে, মিশ্রির শরবৎ বানিয়ে। তাতে যে ভেজাল নেই সে কথাও হলপ করে বলা যায় না। তুলনা দিয়ে কথাটা বললে আমার বক্তব্য ঈষৎ খোলসা হবে। আজ যদি অক্সফোর্ডের ইংরেজ ছেলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্য, ইংলন্ডের ইতিহাস পড়তে আসে তবে যে পরিস্থিতিটা হবে তার সঙ্গেই মিশরের বিদ্যার্থীর দেওবন্দ গমনের তুলনা হতে পারে।
তবে কি তারা ভট্টপল্লিতে যাবেন?
মুশকিল! ভট্টপল্লির জীবন ও মিশরীয় মুসলমানের চলা-বসাতেই এত পার্থক্য রয়েছে যে একে অন্যকে বরদাস্ত করতে করতেই তাদের উভয়পক্ষের বেশ কয়েক বছর কেটে যাবে বহিরাগতের শাস্ত্রাধিকার আছে কি নেই, সে প্রশ্ন না-ই বা তুললুম।
অথচ ভট্টপল্লি-দেওবন্দই তো ভারতীয় ঐতিহ্যের সন্তান। তা তারা আজ যত নির্জীবই হোন না কেন, যত অনাদৃত অবহেলিতই হোন না কেন।
তবে কি তারা কলকাতা, বোম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ে দাখিল হবেন। ত্রাহি মধুসূদন, তওবা, তওবা। ভারতীয় ঐতিহ্যের কোন মণি-মাণিক্য সঞ্চিত আছেন এইসব দো-আঁসলা, অকালপকু, কেরানি-প্রসবিনী বিদ্যায়তনের শ্বেত-সমাধির মাঝখানে? ভারতীয় সাহিত্য এখানে সপত্নী-পুত্রের সম্মান পায়, ভারতীয় সঙ্গীত, স্থাপত্য, চিত্র, নাট্য এখানে বন্ধ্যা পাণ্ডিত্যের কচকচানির বিষয়বস্তু, শেক্সপিয়ার-মিল্টনের ভূত এ গোরে প্রেতের মতন নাকিসুরে কথা কয়, অর্থশাস্ত্রের মিসিং লিঙ্ক মার্শাল টাউসিগ এখানকার শাখা-প্রশাখার শাখা-মৃগ, এখানকার ইতিহাসদেবী স্মিথের, অতিবৃদ্ধা, লোলচৰ্মা রক্ষিতা এবং এখানকার দর্শন অধ্যয়ন সত্যই অমাযামিনীর অন্ধকার গৃহে অন্ধ কর্তৃক অনুপস্থিত অসিত মার্জারের অনুসন্ধান এবং মার্জারটি সে-গৃহে কস্মিনকালে প্রবেশও করেনি।
তবে কি অতিথিকে চাল-চিনি বাড়ন্ত বলে ফিরতি নৌকার সন্ধান করতে বলব? তা-ও তো পারিনে।
তাই বলি স্বাগতম, স্বাগতম–যে সামান্য আরবি জানি তাই দিয়ে বলি অহলান ওয়া সহলান। –ওমর খৈয়াম
.
গণভাষা
রাষ্ট্রভাষার স্বরূপ কী হবে এবং তার সম্প্রসারণ কতদূর, সে-কথা আলোচনা করার পূর্বে স্বাধীনতা লাভের ফলে ভারতবর্ষে যে নতুন বাতাবরণের সৃষ্টি হয়েছে সেটা ভালো করে বুঝতে হবে।
ইংরেজ জাতি পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে কিন্তু তার কেন্দ্র ইংলন্ডে। ইংরেজের আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য, বৈদগ্ধ্যের উন্নতি অনেকখানি নির্ভর করে জগৎ-জোড়া ইংরেজের ওপর; তাই ইংরেজের প্রয়োজন তার রাজত্বের সর্বদূর ভূখণ্ড এবং তার শাসকের সঙ্গে যেন ইংলন্ডের যোগসূত্র অবিচ্ছিন্ন থাকে। এই যোগসূত্রের নাম ইংরেজি ভাষা এবং এটাকে ইংরেজ কিছুতেই ছিঁড়তে দেয় না। তাতে করে যে ভূখণ্ডে সে রাজত্ব করছে তার আপন ভাষার সর্বনাশ হোক, সে দেশের বৈদগ্ধ্য উচ্ছন্নে যাক ইংরেজের কোনও আপত্তি নেই।
এ তত্ত্বটা আমরা ঠিক ঠিক বুঝতে পারিনি, কারণ, ইংরেজ যখন এদেশে আসে তখন ভারতবর্ষের রাষ্ট্রভাষা ছিল ফার্সি। সে ভাষা সমূলে উৎপাটন করে ইংরেজ এদেশে ইংরেজি চালায়। কিন্তু তাতে আমাদের কিছুমাত্র ক্ষতি হয়নি, কারণ ফার্সি এদেশের আপন ভাষা নয়, ইংরেজির মতো সে-ও বিদেশি। এমনকি আর কিছুদিন গেলে ফার্সি হয়তো নিজের থেকেই হিন্দুস্তানির জন্য রাষ্ট্রভাষার আসন ছেড়ে দিত।
ইংরেজি ভাষার সাহায্য ছাড়া ইংরেজ এ দেশটাকে ব্যাপকভাবে শোষণ করতে পারবে না বলেই সে এদেশে ইংরেজি চালিয়েছিল এবং গোড়ার দিকে এদেশে প্রাদেশিক ভাষাগুলো ইংরেজি থেকে বিস্তর মাল-মশলা আহরণ করে সমৃদ্ধিশালী হয়েছিল সে বিষয়েও কোনও সন্দেহ নেই। তার পর একটা জায়গায় এসে সবকটা প্রাদেশিক ভাষা ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। এই বাঙলা ভাষার কথাই ধরুন। আমরা এখনও নভেল, ছোটগল্প, আর দু চারখানা মামুলি প্রবন্ধ নিয়েই মাতামাতি করি। বিজ্ঞান, দর্শন, অলঙ্কার, অর্থশাস্ত্র, ফলিতবিজ্ঞান সম্বন্ধে কুচিৎ কখনও একখানা বই লেখা হয় এবং তার প্রথম সংস্করণ ফুরোতে দশ মাস লাগে, হয়তো-বা কখনও একদম ফুরোয়ই না।
তার কারণ জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা হচ্ছে ইংরেজিতে এবং ইংরেজির ভূত ঘাড় থেকে না নামা পর্যন্ত রোগী আর কোনও ভাষায় কথা কইবে না।
তুলনা দিয়ে বক্তব্যটা আরও খোলসা করি। লাতিন ভাষা যতদিন ইউরোপীয় গুণীজ্ঞানীর বিদ্যা-চৰ্চার ভাষা ছিল, ততদিন ফরাসি-জর্মন কোনও ভাষাই ব্যাপকার্থে সমৃদ্ধিশালী হতে পারেনি। তার পর লুথারের প্রটেস্টান্ট সর্ষের ঠেলায় যখন লাতিন ভূত ইউরোপের ঘাড় থেকে নামল তখন ফরাসি এসে চাপল জর্মন এবং রুশের স্কন্ধে– স্বয়ং ফ্রেডরিক দি গ্রেট জর্মনে না লিখে কাব্য রচনা করেছিলেন ফরাসি ভাষায় (এবং সে কাব্য এমন ওঁচা যে বিখ্যাত জর্মন কবি হাইনরিশ হাইনে বলেছেন, জর্মন সাহিত্যে ফ্রেডরিকের সবচেয়ে বড় অবদান- তিনি জর্মন ভাষায় কিছু রচনা করেননি)।
এই ফরাসিকে না খেদানো পর্যন্ত জর্মন ও রুশ সাহিত্য কোনও প্রকারের উন্নতি করতে পারেনি।
এইবার গোড়ার কথায় ফিরে যাই। ইংরেজের মতো ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের এমন কোনও কু-মতলব নেই যে কেন্দ্র তাবত ভারত শোষণ করে খাবেন। যুক্তপ্রদেশের দোবেজি পড়েজি হিন্দি ভাষার জোরে ভারতময় দাবড়ে বেড়াবেন ও মতলব নিয়ে হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা করা হচ্ছে না। পণ্ডিতজি ভালো হিন্দি জানেন না, তিনি জানেন অতি উত্তম উর্দু, এবং সর্দারজির হিন্দি শুনেও কোনও দোবেজি পড়েজি ঈর্ষাতুর হবেন না। তাই হিন্দি দিয়ে যদি ভারতবর্ষ শোষণ করতে হয় তবে এদের বেতন দিয়ে বাড়ি পাঠাতে হবে।
আমাদের আদর্শ হচ্ছে ভারতবর্ষকে শক্তিশালী রাষ্ট্ররূপে গড়ে তোলার। তার জন্য প্রত্যেক প্রাদেশিক ভাষাকে বলশালী হতে হবে। বলশালী হতে হলে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা প্রত্যেক প্রদেশকে আপন ভাষায় করতে হবে। ইংরেজি সে পথে অন্তরায় হয়ে আসর জমিয়ে বসেছিল, আজ যদি ইংরেজির শূন্য আসনটি হিন্দি দখল করে বসে তবে আমরা যে আবছায়ায় ছিলুম সেই আবছায়ায়ই থাকব।
এই জিনিসটিই আরেক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যেতে পারে।
ইংরেজ প্রত্যেক প্রদেশেই কয়েক হাজার বা কয়েক লক্ষ লোককে ইংরেজি শিখিয়ে আপন রাজত্ব চালিয়ে নিত। ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশের এই কয়েক লক্ষ লোকের কয়েকজন ইংরেজির মাধ্যমে একজোট হয়ে কিছুকাল পরে কংগ্রেস তৈরি করে স্বাধীনতার জন্য ইংরেজিতে বক্তৃতা দিতে শুরু করলেন। ইংরেজ তাতে কিছুমাত্র বিচলিত হল না, কারণ সে বিলক্ষণ জানত এসব লেকচার দেশের জনসাধারণ কিছুই বুঝতে পারে না বলে পোলিটিশিয়ানরা ঢাল-তলোয়ারহীন নিধিরামের মতো শুধুই তড়পাচ্ছেন। যখনই দরকার হবে এঁদের ওপর চোটপাট করে এঁদের মুখ বন্ধ করে দেওয়া যাবে। কিন্তু যখন সর্দারজি গুজরাতি ভাষায় বরদলৈএতে আগুন ছড়াতে আরম্ভ করলেন তখন ইংরেজ প্রমাদ গুনল। যে গণ-আন্দোলনের ফলে ভারতবর্ষ শেষটায় স্বরাজ পেল তার অধিকাংশ বক্তাই আপন। মাতৃভাষার মাধ্যমে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
স্বাধীনতালাভ কর্ম সমাধান হয়েছে। সেটা অপেক্ষাকৃত সরল কর্ম। কঠিনতর কর্ম হচ্ছে। দেশ থেকে দুঃখ-দারিদ্র্য দূর করে শিক্ষাবিস্তার করা, স্বাস্থ্যের উন্নতি করা। এইখানে এসে রাষ্ট্রভাষামত্ত স্বৈরতন্ত্রীরা করেন প্রথম ভুল। তারা ভাবেন রাষ্ট্র নির্মাণে জনসাধারণের আর কোনও সহযোগিতার প্রয়োজন নেই। কাজেই ইংরেজির শূন্য আসনে যদি হিন্দি এসে গেঁট হয়ে চেপে বসে তা হলে কোনও ক্ষতি তো হবেই না, বরং ইংরেজেরই মতো তাঁরা বেধড়ক রাজত্ব চালাতে পারবেন।
অর্থাৎ ইংরেজের আমলে যা হয়েছিল তারই পুনরাবৃত্তি হবে। একদল লোক হিন্দি শিখবেন, বড় বড় নোকরি করবেন, বহিরাগত হিন্দিভাষিদের সাথে কাঁধ মিলিয়ে এক নতুন অভিজাত সম্প্রদায়ের সৃষ্টি করবেন, আর বাদবাকি চাষাভূষো আমরা পাঁচজন আবছায়া থেকে তিমিরে নিমজ্জিত হব।
তাই দেখতে হবে রাষ্ট্র গঠনের সর্বপ্রচেষ্টার সঙ্গে যেন আপামর জনসাধারণ সংযুক্ত থাকে। এবং সে জিনিস মাতৃভাষা ভিন্ন অন্য কোনও মাধ্যমের দ্বারা সফল করা সম্ভবপর হয় না। রাষ্ট্রভাষার উৎকট সমর্থনকারীরা বলবেন, মাতৃভাষায় লেখা হলেই কি সব মানুষ এইসব রাষ্ট্র নির্মাণের কুটিলতম প্রচেষ্টার কথা বুঝতে পারবে?
উত্তরে বলি, সকলে পারবে না, কিন্তু অসংখ্য লোক পারবে।
আমরা ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রে শিক্ষাব্যবস্থার যে স্বপ্ন দেখছি তাতে দেশের শতকরা নব্বই জন মাইনর, মেট্রিক পর্যন্ত পড়বে। এবং সে মাইনর মেট্রিকের শিক্ষাদান অনেক বেশি উন্নত পর্যায়ের হবে। ইংরেজি বা হিন্দির জন্য তারা প্রাণপাত করবে না বলে (অবশ্য স্বেচ্ছায় রাষ্ট্রভাষা হিন্দি অপশনাল হিসেবে পড়বার ব্যবস্থা সবসময়ই রাখতে হবে আজ যেমন কেউ শেখে সংস্কৃত, কেউ শেখে ফার্সি) তারা অতি উত্তম বাংলা শিখবে এবং ইংলন্ড, ফ্রান্স, চীন, ইরানে যেরকম সাধারণ লোক মাতৃভাষায় লেখা দেশের শ্রেষ্ঠ পুস্তক পড়তে পারে, এরাও ঠিক তেমনি দেশের উন্নততম জ্ঞানচর্চার সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে। দেশের তাবত লোকেই যে উত্তম উত্তম পুস্তক পড়বে সে কথা বলা আমার উদ্দেশ্য নয় কারণ সকলেই জানেন জ্ঞানতৃষ্ণা কোনও বিশেষ শ্রেণি বা সমাজের মধ্যে নিবদ্ধ নয়, এমনকি উচ্চশিক্ষা পাওয়া না পাওয়ার ওপরও সে জিনিস সম্পূর্ণ নির্ভর করে না। কত বি.এ. এম.এ. পরীক্ষা পাসের পর চেক্ বই ছাড়া অন্য কোনও বইয়ের সন্ধানে সময় নষ্ট করে না, আর কত মাইনরের ছেলে গোগ্রাসে যা পায় তাই গেলে– তাই মাতৃভাষা দেশের সংগঠন কর্মের মাধ্যমে হলে যে কোনও তত্ত্বানুসন্ধিৎসু অল্প চেষ্টাতেই দেশের সর্বোত্তম প্রচেষ্টার সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারে। এর সত্যতা সপ্রমাণ হয় আরেকটি তথ্য থেকে ইউরোপের বহু সাহিত্যিক, ঐতিহাসিক, আবিষ্কর্তা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন না করেও যশস্বী সৃষ্টিকার হতে সমর্থ হয়েছেন।
জিনিসটা এতই সরল যে প্রবাদরূপে বলা যেতে পারে,–
গণভাষার সাহায্য ভিন্ন গণরাষ্ট্র গঠিত হতে পারে না।
জয় হিন্দি, কিন্তু রাষ্ট্রভাষা হিন্দি যেন সে পথে অন্তরায় না হয়। — ওমর খৈয়াম
.
জনমত
ইংরেজ এ-দেশ দখল করে শান্তি এনেছিল বলে প্রাচীনদের অনেকেই ইংরেজের প্রশংসা করতেন। খুনখারাবির সময় আর্তৰ্জন প্রথম কোম্পানির দোহাই দিয়ে প্রাণ বাঁচাবার চেষ্টা করত আর ছোরা তবুও এগিয়ে এলে মহারানীর দোহাই কাড়ত। সাক্ষ্য দেবার সময় আর পাঁচজন বলত লোকটা এমনি পাষণ্ড, ধর্মাবতার, যে সে মহারানীর দোহাই পর্যন্ত অমান্যি করে গেল।
তার পর এই শান্তির সুযোগ নিয়ে ইংরেজ এদেশে ব্যাপকভাবে ব্যবসা চালিয়ে আমাদের শিল্প-বাণিজ্য পয়মাল করে দিল। প্রাচীনদের অনেকেই তখন বুঝতে পারলেন, স্বর্গরাজ্যে যাবার জন্য ইংরেজ এসব পরোপকার করেনি। স্পষ্ট দেখা গেল স্বর্গরাজ্যের গাইড-বুক মথিলিখিত সুসমাচার ইংরেজ অফিসার পড়ে না। পাদ্রিদের মারফতে বিলিয়ে দেয় এদেশের গায়ে গায়ে।
তাই যখন আরম্ভ হল অনটন, বস্ত্রাভাব, দুর্ভিক্ষ তখন দেশের লোক ইংরেজকে গালাগাল দিতে আরম্ভ করল। অসহিষ্ণুজন বোমা মারল, বিচক্ষণজন তার চেয়েও মারাত্মক বৈষ্ণবপ্রেমের হাতিয়ার আবিষ্কার করলেন।
কিন্তু ততমধ্যে আমাদের অভ্যাস খারাপ হয়ে গিয়েছে। সব জিনিসেই ইংরেজকে দোষ দিয়ে আমরা বিমলানন্দ উপভোগ করতে আরম্ভ করে দিয়েছি। তাজমহলে ফাটল দেখা দিলে ইংরেজের দোষ, বন্যা হলে ইংরেজের দোষ, বৃষ্টি না হলেও ইংরেজের দোষ, আর ভূমিকম্প হলে তো আলবৎ ইংরেজের দোষ, ওই যে ব্যাটাদের আলীপুরে খাসা যন্ত্রপাতি রয়েছে তাই দিয়ে ভূমিকম্পের দিনক্ষ্যাণ আগের থেকে বাৎলে দিল না কেন? ওদের কম্ম বুঝি আপন জাহাজের তদারকি করা আর ডানপিটেদের গৌরীশঙ্কর চড়ার সময় অষ্টপ্রহর বুলেটিন ঝাড়া!
এ বদ অভ্যাসটার জন্য অবশ্যি বেবাক দোষ দিশি লোকের ঘাড়ে চাপানো যায় না। ইংরেজের কুলগুরু গ্রিকরাই বলে গিয়েছেন, দাসের বিবেক থাকতে পাবে না, দাসের স্কন্ধে দায়িতুবোধ চাপানো যায় না–দাসের পাপ-পুণ্যের জন্য প্রভু দায়ী। তাই মহাপ্রভুর আপন কর্তব্য-নির্ধারণের সময় আমাদের মতামত কী তা নিয়ে মাথা ঘামাতেন না। কোন্ রাস্তায় কটা ডাস্টবিন থাকবে তাই নিয়ে অবশ্যি মাঝে মাঝে সার্কুলার জারি করে আমাদের পরম আপ্যায়িত করেছেন এবং এই অভ্যাসের বশবর্তী হয়েই ক্রিস সায়েব লড়াইয়ের বাজারে স্বরাজ দেবার অর্থে বুঝেছিলেন আমাদের আপন লেটারহেড় ছাপাবার অধিকার হয়ে যাবে, কোন্ খ্যাংরায় কটা কাঠি থাকবে সে বিবেচনার হক্ক আমাদের ওপর বর্তাবে। আমাদের অনেকেই তখন আনন্দে আত্মহারা হয়ে বগল বাজিয়েছিলেন, পণ্ডিচেরি থেকে পর্যন্ত উদ্বাহু হয়ে নৃত্য করবার ফরমান এসেছিল।
যাক এসব কথা– সেসব দিন গেছে।
ইতোমধ্যে স্বরাজটা ধপ করে চালকুমড়োর মতো উঠোনে পড়েছে আর তাই নিয়ে যে কামড়াকামড়ি লেগেছে– থাক, বাকিটা আর বলব না– এখন আর জেলে গিয়ে ভাঙাবার মতো কোনও ক্যাশ সার্টিফিকেট পাওয়া যায় না। কিন্তু আমাদের বদ অভ্যাসটা গেল না, কিছু একটা বানচাল হলেই আমরা বলি কংগ্রেস দায়ী, ছেলেটা চাকরি না পেলে কংগ্রেসের দোষ, বউটা বাজা বেরোলে কংগ্রেসের নাক কাটো।
বেবাক ভুলে গিয়েছি যে আমরা স্বাধীন, এবং যেহেতু চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী রাজ-চক্রবর্তী নন তাই দেশের জনসাধারণ কংগ্রেসরাজের ভালো-মন্দ সবকিছুরই জন্য অংশত দায়ী।
তার অর্থ, জনগণের যেমন সর্ববিষয়ে দায়িত্ব আছে তেমনি কংগ্রেসকেও জনমত উপেক্ষা করে ফতোয়া জাহির হাতিয়ার বাহির করলে চলবে না। কংগ্রেস হয়তো উত্তরে বলবেন, জনমত না কচু! যে-দেশের দু আনা লোক ভালো করে খবরের কাগজ পড়তে পারে না, সে দেশে আবার জনমত! ইংরেজকে তাড়াবার জন্য আজেবাজে সক্কলেরই প্রয়োজন হয়েছিল বলে তারাই সব এখন রাজত্বের কর্ণধার হয়ে যাবে নাকি? বুনো শুয়ার খেদাবার জন্য যে মাচান তৈরি করা হয়েছিল সেইটে এখন রাজসিংহাসন হয়ে যাবে নাকি?
প্রশ্নটা একেবারে ন-সিকে ভুয়ো নয়, কারণ আমাদের জনগণের কার্যকলাপ সেদিন শেয়ালদায় দেখা গেল, নিত্যি নিত্যি শোফার ঠ্যাঙানোতে, খেলার মাঠের দাবড়ানোতে দেখতে পাই। জনমত যদি জনকর্মের মতোই হয় তবে তাকেই-বা কুইট ইন্ডিয়ার বখরাদার করা হবে না কেন?
কবুল। কিন্তু প্রশ্ন এবং এই আমার শেষ প্রশ্ন– কংগ্রেস যখন গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন। তখন সুস্থ জনমত গঠন করার দায়িত্ব কি কংগ্রেসেরই নয়?
ইংরেজ জনমত গঠন করতে চায়নি বিদেশি রাজা কস্মিনকালেও জনমত গঠন করে না। কাজেই ইংরেজের কথা বাদ দিন।
হিটলারও তো জনমত গঠন করেননি। তবুও তো তিনি জার্মানিকে শক্তিশালী রাষ্ট্ররূপে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন।
খাঁটি কথা। হিটলারের পূর্ববর্তী প্রধানমন্ত্রী ফ্রনিঙের আমলে জার্মান রাষ্ট্রে জনমত ছিল প্রচুর এবং রাষ্ট্র ছিল কম-জোর। এবং পার্টির প্রাচুর্য থেকে যদি জনমতের প্রসার স্বীকার করতে হয় তবে ব্রুনিঙের জার্মানির সামনে দণ্ডবৎ হয়ে প্রণাম করতে হয়। ১৯৩২ সালে জার্মানিতে সবসুদ্ধ সাতাশখানা পার্টি প্রতি গণনির্বাচনে ঝামেলা লাগাত।
হিটলার যে জনমত গড়েননি তার জন্য তাঁকে খেসারতিও দিতে হয়েছিল। সেই খেসারতির ধাক্কা সামলাবার ভার পড়েছিল গ্যোবেলসের ওপর। জার্মানির নিষ্পেষিত জনমত ছিল যুদ্ধের বিরুদ্ধে। গ্যোবেলস সায়েবের প্রপাগান্ডার চাবুক মরা-ঘোড়াকে খাড়া করেও খাড়া করতে পারল না। অর্থাৎ অস্ত্রবলে, ব্লিৎসক্ৰিগের ফলে জার্মানি লড়াই জিতেও শেষ পর্যন্ত হার মানলো।
স্ট্যালিনও জনমত চাননি কিন্তু তিনি হিটলারের চেয়ে বহুৎ বেশি হুঁশিয়ার। আর হাজার হোক রুশিয়ার ধনবন্টন পদ্ধতি জার্মানির চেয়ে অনেক বেশি সাম্যবাদী এবং গণতান্ত্রিক যদিও জার্মান মজুরের বিত্তসম্বল রুশ মজুরের চেয়ে অনেক বেশি। তা সে যা-ই হোক, লড়াই লেগে যাওয়ার পর স্ট্যালিনকেও রুশ জনমতের দর্গায় গোটাকয়েক মুরগি জবাই করে পীরকে জাগ্রত করতে হয়েছিল। কথাটা নিছক তুলনা নয়, কারণ সবাই জানেন, স্ট্যালিন বহু গির্জার দরজা খুলে দিলেন, হোলি রাশিয়ার নাম নিয়ে বিস্তর দোহাই-কিরা কাটলেন, জাপান হেরে যাওয়ার পর বললেন, এতদিন বাদে আমরা পোর্ট আর্থারের প্রতিশোধ নিতে পারলুম। আমরা কারা? জারিস্ট রাশিয়া? স্ট্যালিনিস্ট রাশিয়া? একই কথা!
মুসোলিনিও ইতালিকে শক্তিশালী করেছিলেন জনমতের কণ্ঠরুদ্ধ করে। কিন্তু লড়াই লেগে যাওয়ার পর তিনি যুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে পারলেন না। কারণ তাঁর গোয়ালে কোন গ্যোবেলস বাধা ছিল না। তাই যুদ্ধের মাঝামাঝিই ইতালির সর্বত্র দেখা যেত মুসোলিনি-বৈরী জনমতের নোটিশ লাগানো রয়েছে, যুদ্ধে যোগ দিয়ে ভারতবর্ষ দেখে নাও! অর্থাৎ লড়াইয়ে যোগ দিলে তোমাকে লিবিয়ায় যেতে হবে। সেখানে লড়াইয়ে হেরে ইংরেজের হাতে ধরা পড়বে। ইংরেজ তোমাকে ভারতবর্ষের বন্দিশিবিরে পাঠিয়ে দেবে। ব্যস! ফোকটে ভারতবর্ষ দেখা হয়ে গেল। আর ভারতবর্ষ দেখবার নামে ইতালির লোক অজ্ঞান।
মোদ্দা কথা তা হলে এই; জনমতের টুটি চেপে ধরলে দেশটাকে ঝটপট শক্তিশালী করা যায় কিন্তু যখন মার আসে তখন আর সামলানো যায় না। এই তত্ত্বটিই পূর্ববঙ্গের একটি প্রবাদে শুনেছি :
একলা ঘরের বউ-ঝি খেতে বড় সুখ।
মারতে গেলে ধরবে কে? ঐ বড় দুখ।
অর্থাৎ যে বাড়িতে শ্বশুর, ভাশুর, দেবর নেই সে বাড়ির একা বউ মনের আনন্দে যা খুশি রান্না করে খায়, কিন্তু যখন কিল মারার গোসাই সোয়ামি বউকে ঠ্যাঙাতে আরম্ভ করেন তখন তাঁকে ঠেকাবার জন্য শ্বশুর-ভাশুর কেউ নেই– এই হল বেদনা।
কিন্তু আমরা ভারতবাসী একান্নপরিবারে বিশ্বাস করি। তাই আমাদের বিশ্বাস কংগ্রেসও জনমত গড়ে তুলতে চাইবেন।
চান আর না-ই চান, আপনি-আমি তো আর চুপ করে বসে থাকতে পারিনে। কী করা যায়?
প্রথমত শিক্ষার ভিতর দিয়ে, অর্থাৎ স্কুল-কলেজে শিক্ষার বিষয়বস্তু এবং পদ্ধতির আমূল পরিবর্তন করে।
কিন্তু ততদিন কি জনমত তে-ঠ্যাঙা রেস রান করবে?
না। খবরের কাগজ রয়েছে। এ যুগসন্ধিক্ষণে সত্যযুগাকাক্ষী খবরের কাগজ মাত্রেরই দায়িত্ব অসীম।
–ওমর খৈয়াম
.
রাষ্ট্রভাষা
গল্পটা অতি পুরনো তাই আরেকবার বললে ক্ষতিবৃদ্ধি হবে না।
চাটুয্যে এসেছেন শ্রাদ্ধের নেমন্তন্নে স্মোকিং জ্যাকেট পরে। আনকোরা ইভনিং স্যুট। হালে বিলেত থেকে ফিরেছেন তাই।
বাঙ্গালাতেই কথাবার্তা হচ্ছিল। চাটুয্যে বললেন, কিছু মনে করবেন না, আমি বাঙলাটা তেমন ভালো বলতে পারিনে। সবাই চুপ। শেষটায় মুখুয্যে বললেন, তাই তো বড় বিপদে ফেললে হে চাটুয্যে, ইংরিজিটাও জানেন না, কী করা যায় বলো।
অর্থাৎ দু নৌকোয় পা দিলে মধ্যিখানে পড়ে যাবার সম্ভাবনাই বেশি।
কিংবা বলতে পারেন, এ সংসারের অধিকাংশ লোকই একটার বেশি ভাষা শিখতে পারে না (সাহিত্যিকরা বলবেন, একটা ভাষাই-বা কটা লোকে ঠিকঠিক শিখতে পারে বলো, কিন্তু এখানে উচ্চাঙ্গ বঙ্গভাষা নিয়ে রঙ্গরসের কথা হচ্ছে না)। এবং তাই নিয়ে এ পৃথিবীর গুরু সম্প্রদায়ের ভিতর শিরঃপীড়ার অন্ত নাই। আমেরিকা, ইংলন্ড, ফ্রান্স যে কোনও দেশ-মহাদেশের শিক্ষা বাবদীয় মাসিক পত্রিকা খুললেই দেখতে পাবেন সেই প্রাচীন সমস্যা নিয়ে পুনরপি আলোচনা : সেকেন্ড ল্যাগুইজ শেখানো কী প্রকারে সফল করা যায়?
আমেরিকায় লক্ষ লক্ষ ডলার খরচা করে লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়েকে ফরাসি, জর্মন শেখানো হয়, ইংলন্ডেও তাই, ছেলেমেয়েরা লেটার পেয়ে পরীক্ষা পাসও দেয় কিন্তু গর্বান্ধ বাপ-মায়েরও অন্ধত্ব ঘুচে যায় যখন দেখেন ছেলে ক্যালে বন্দরে পোর্টারকে ফরাসি ভাষায় সামান্য প্রশ্নটুকু জিগ্যেস করতে পারছে না, পারিসের ট্রেন ছাড়বে কটায়, কোন প্ল্যাটফর্ম থেকে। দেখেন, ছেলের প্রশ্ন শুনে ফরাসি পোর্টার প্রথমটায় মাথা চুলকোয়, তার পর মুখ থেকে পাইপটা নামায়, তার পর হঠাৎ তার মাথায় কী একটা খেয়াল খেলে যাওয়ায় চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, তার পর আর এক বেরাদর পোর্টারকে চেঁচিয়ে বলে, হে জ্যা, ভিয়ানিসি, ভোয়ালা আঁ মসিয়ো কি পার্ল আংলো–অর্থাৎ হেই জন, এদিকে আয়, এক ভদ্রলোক হেথায় ইংরেজি বলছেন। বাপ-মার চক্ষুস্থির, ছেলের মুখ চুন। কিন্তু কেলেঙ্কারিটার শেষ এইখানেই নয়। জ্যাঁ আসবে, ইংরেজি বলবে এবং সে ইংরেজি বাপ-ব্যাটা কেউই বুঝবে না।
হামেশাই এ ব্যাপার দুনিয়ার সর্বত্র হচ্ছে। প্যারিসে রাস্তা হারিয়ে ফেলেছেন; ফিটফাট ভদ্রলোক, লম্বা দাড়ি অধ্যাপক, পাততাড়ি বগলে স্কুলের ছোকরা সবাইকে বুজুর বলে জোর করে দাঁড় করাচ্ছেন, অতিশয় কমনীয় নমনীয় ইংরেজিতে কিংবা আপনার অতি নিজস্ব মেড ইন ইন্ডিয়া (কিংবা ইংলন্ড) মার্কা ফরাসিতে জিগ্যেস করছেন, প্লাস দ্য লা মাদলেন। কোথায়? ফলম? সর্বং শূন্যং!
কিংবা হাম্বুর্গে। ইংরেজি ছাড়ুন, ফরাসি ছাড়ুন, জর্মন ছাড়ুন। যা ইচ্ছে তাই, কিংবা যাচ্ছেতাই। ইয়া, ইয়া, ইয়েস, ইয়েস, নো, নো, আন্দারস্তেন্দ নৎ। সরি, সরি গুদ মর্নিং! হয়ে গেল আপনার পায়ে হাঁটার অভিযান। মনে মনে কানমলা খেয়ে প্রতিজ্ঞা করলেন, আর ট্রামবাসে পায়ে হেঁটে ইয়ার্কি মারা নয়, এখন থেকে শুধু ট্যাক্সি, যেখানে যাবার যাব আর আসব, কারও সঙ্গে স্পিকটি নট।
অথবা আরেকটি গল্প নিন। আমার বক্তব্য আরও খোলসা হয়ে যাবে। এক ফরাসি দোকানের সামনে বড় বড় হরফে লেখা, ইংলিশ স্পোকেন। তাই দেখে আপনার-আমার মতো ভাষা বাবদে একংজিহ্ব (মনোগ্নট) জনৈক ইংরেজ সেই দোকানে ঢুকে গড়গড় করে ইংরেজি বলে কী একটা কিনতে চাইল। দোকানদার উত্তর দেয় যেন ফরাসিতে। ইংরেজ শুধায়, ফরাসি কও কেন? ইংরেজি বলতে পারো না? সাইনবোর্ডে লিখে রাখোনি ইংলিশ স্পোকেন? সাইনবোর্ডের দিকে আঙুল দিয়ে দেখানোতে দোকানদার মামলাটার আন্দেশা করতে পারল। অনেক ধস্তাধস্তি, বহুৎ হোঁচট খেয়ে ফরাসি-ইংরেজিতে আইরিশ স্টু বানিয়ে যা বললে তার অর্থ, ঠিকই তো, ইংলিশ এখানে বলা হয়। আমাদের খদ্দেররা ইংরেজি বলেন, আমরা কিন্তু ফরাসিই বলে থাকি। দোকানদারকে দোষ দিয়ে কী হবে, সে তো আর লেখেনি, উই স্পিক ইংলিশ, সে লিখেছে, ইংলিশ স্পোকেন।
গল্পটি শুনে আমি অবিশ্বাসীর বিজ্ঞ হাসি হেসেছিলুম। পরে ভেবে দেখলুম, এতে অবিশ্বাসের কিছুই নেই। কোথাও যদি পুলিশ সাইনবোর্ড লাগায় সাবধান, এখানে মালপত্র চুরি যায় আর তার পরও যদি আপনার মাল চুরি যায় আপনি কি তবে পুলিশকে গিয়ে ধরবেন যে তারাই মাল চুরি করেছে? (পুলিশের কাছে মাফ চেয়েই বলছি, ভারতবর্ষের কথা আলাদা, আমি অন্যান্য বর্বর দেশের কথা ভাবছি)।
শিরোনামায় বলেছি রাষ্ট্রভাষা। আপনি ঘড়েল পাঠক। নিশ্চয় এতক্ষণে ধরে ফেলেছেন আমার নলটা কোনদিকে চলেছে। হিন্দি রাষ্ট্রভাষা হয়ে গিয়েছে। সহি বাৎ। আমার তাতে কোনও আপত্তি নেই। একটা কেন, পঞ্চাশটা রাষ্ট্রভাষা চালান, আমি বড়ম্বরে সায় দেব। আমি তো আর কেন্দ্রে গিয়ে নোবাবির সন্ধান করব না, কিংবা মন্ত্রণাসভায় লম্বা লম্বা ভাষণ ঝাড়বো না যে হিন্দি রাষ্ট্রভাষার নোকরি পেয়ে গিয়েছেন শুনে বৈধব্য দুঃখে হবিষ্যান্নি আরম্ভ করব?
রাষ্ট্রভাষার যে প্রয়োজন আজ সেটা উপস্থিত না হয় মেনেই নিলুম এবং হিন্দি রাষ্ট্রভাষা হয়েছে তাতে আমার আপত্তি নেই। আমার শুধু সবিনয় নিবেদন, যেসব প্রদেশে হিন্দি প্রচারিত নয়, যেমন ধরুন বাঙলা, কিংবা অন্ধ্র, কিংবা তামিলনাড়ু সেসব দেশের লোককে জোর করে হিন্দির কলমা পড়াতে যাবেন না, কারণ পূর্বেই নিবেদন করেছি, দুটো ভাষা শিখতে পারে অল্প লোকেই।
উত্তরে আপনি বলবেন, কেন, মশায়, আমাদের অনেকেই তো ইংরেজি-বাঙলা দু ভাষাতেই খাসা বক্তৃতা ঝাড়তে পারেন!
আমি বলব, ইংরেজিতে আমরা বক্তৃতা দিয়েছি আপসে অর্থাৎ আপনজনের ভিতরে। দহরম মহরম বোঝাতে গিয়ে ফ্যামিলি ওয়ে বলেছি, ট্রেন মিস করার উল্লেখ করতে গিয়ে মিস ক্যারেজ বলেছি তাতে কোনও ব্যাকরণ অশুদ্ধ হয়ে যায়নি। কারণ, যে দু চারটি ইংরেজ সভাস্থলে উপস্থিত থাকতেন তারা নানা প্রকারের পিজিন ইংলিশ শুনে শুনে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন; আমাদের ইংরেজি নিয়ে মস্করামো করতেন না। কিন্তু লালাজি দুবেজি পড়েজিরা, আমাদের টোটি-ফোটি হিন্দি শুনে তুষ্ণীভাব অবলম্বন করবেন, না মুখ ফিরিয়ে একটুখানি ফিক করে হেসে নেবেন ঠিক এঁচে উঠতে পারছি নে। লক্ষ্ণৌ দেহলি কি হিন্দি, সাহেব, বড়ি ঠাটকি হিন্দি,– মজাককি বাৎ নহি!
বিলক্ষণ, বিলক্ষণ। মোটেই মজাক করছিনে। যে মন্ত্রণাসভায় দেশের দশের ধনপ্রাণ নিয়ে আলোচনা হবে সেখানে মস্করা করতে যাবে কে?
তাই বারান্তরে আলোচনা করার বাসনা রইল, যেসব দেশে বহু ভাষা প্রচলিত সেসব দেশ এ সমস্যা সমাধান করেছে কী প্রকারে। ততদিনের জন্য জয় হিন্দ এবং
জয় হিন্দ। — ওমর খৈয়াম
.
ত্রিবেণী
ভারত ও এশিয়ার অন্যান্য দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক সম্পর্ক দৃঢ় করিবার উদ্দেশ্যে ভারতের শিক্ষাসচিব মৌলানা আবুল কালাম আজাদের সভাপতিত্বে এশিয়ার বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিক প্রতিনিধি, ভারতের বিশিষ্ট শিক্ষাব্রতী ও মুসলিম নেতৃবৃন্দের এক সম্মেলন হয়। এই সম্মেলনে বিভিন্ন দেশের সহিত সাংস্কৃতিক সহযোগিতা রক্ষাকল্পে একটি ভারতীয় পরিষদ গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হইয়াছে।
এ খবর পড়ে বিদগ্ধজন মাত্রই আনন্দিত হবেন এবং আমার বিশ্বাস বাঙালি এ আহ্বানে সাড়া দেবে সবচেয়ে বেশি কাজ করার সুযোগ পাবে কি না, সেকথা তুলে এই মঙ্গলের দিনে দ্বন্দ্ব-কলহের সূত্রপাত করতে চাইনে। বাঙালি কেন এ আহ্বানে সবচেয়ে বেশি সাড়া দেবে সেকথা আরেক দিন হবে উপস্থিত ভারতবর্ষই কেন এ প্রকারের সাংস্কৃতিক যোগাযোগের চক্রবর্তী হবে, সে আলোচনা করা যাক।
প্রাচ্যলোকে তিনটি ভূখণ্ড পৃথিবীতে যশ অর্জন করেছে। আরব-ভূমিতে দুটি ধর্মের অভ্যুদয় হয়। খ্রিস্টধর্ম ও ইসলাম এবং এ দুটি ধর্ম যে প্রাচীনতম ইহুদি ধর্মের ওপর প্রতিষ্ঠিত, তারও বিকাশ হয়েছে আরব-ভূমির অন্যতম কেন্দ্র জেরুজালেমে।
দ্বিতীয় ভূখণ্ড ভারতবর্ষ। এখানে সনাতন, বৌদ্ধ ও জৈনধর্মের উৎপত্তি ও বিকাশ।
তৃতীয় ভূখণ্ড চীন (এবং জাপানকে নিয়ে মঙ্গোলভূমি) কনফুসীয়, লায়োসে প্রচলিত পন্থাকে ধর্ম বলা যায় কি না, সে সম্বন্ধে সন্দেহ আছে, কিন্তু আমরা এখানে যে ব্যাপক অর্থে ধর্ম শব্দটি ব্যবহার করছি, তার প্রধান উদ্দেশ্য ধর্মকে সর্বপ্রকারের সংস্কৃতি ও বৈদগ্ধ্যের প্রস্থানভূমিরূপে অবলোকন করা।
সর্বশেষে আরেকটি ধর্মের উল্লেখ করা প্রয়োজন। আরব ও ভারতবর্ষের মধ্যবর্তী ভূখণ্ডের বল্খ (সংস্কৃত বহিক) নগরে জরথুস্ত্র আপন ধর্ম প্রচার করেন ও ইরানি আর্য রাজা শুশতাশ্মকে এই নবধর্মে দীক্ষিত করেন।
ভৌগোলিক দৃষ্টিবিন্দু থেকে দেখতে গেলে ভারতবর্ষ প্রথম ও তৃতীয় ভূখণ্ডের মধ্যবর্তী একদিকে বল (ইরান) ও আরবভূমি, অন্যদিকে চীন-জাপানের মঙ্গোলভূমি এবং সে যে শুধু মধ্যবর্তী তাই নয়– সর্ব বৈদগ্ধের চক্রবর্তীও বটে।
মুসলমান ধর্ম জন্ম নিল আরবভূমিতে, ইরানে সে ধর্ম সুফি মতবাদের সহায়তায় পুষ্ট হল, কিন্তু ভারতবর্ষে এসে মুসলিম বৈদগ্ধ্য যে বিকাশ ও পরিণতি পেল তার সঙ্গে কটি মুসলিম দেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে? মিশরের ইবনেতুলুন মসজিদ অতি রমণীয়, জেরুজালেমের ওমর মসজিদ এবং মসজিদ-উল-আকসা স্থাপত্যের গর্বরূপ, বুখারা-সমরকন্দও চেঙ্গিস তিমুরের কীর্তি বক্ষে ধারণ করেছে, কিন্তু তৎসত্ত্বেও এ পৃথিবীর কে না জানে তাজমহলের বাড়া ইমারত পৃথিবীর আর কোথাও নেই।
শুধু তা-ই নয়। এ ইমারত গড়ে উঠল আর্য ও সেমিতি সংস্কৃতির অভূতপূর্ব সহযোগিতার ফলে। তাজের চারু-কারুকার্য অস্মদেশীয়, কিন্তু স্থাপত্য-পরিকল্পনা যাবনিক এরকম কথা পণ্ডিতেরা বলেন, আমরাও (অর্থাৎ অর্বাচীনরা) অস্বীকার করি না, কিন্তু ভারতবর্ষের ক-জন দর্শক তাজ দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হওয়ার সময় এ সম্বন্ধে সচেতন?
সেইটেই সবচেয়ে বড় কথা এবং সেইটেই আমাদের সবচেয়ে বড় গর্ব। কোনও ইংরেজ বা মার্কিন যখন তাজের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে তখন কোনও হিন্দু তো একথা বলে না, আমাকে শোনাচ্ছ কেন? আমার এতে গর্ব করবার কী আছে? ও জিনিস তো মুসলমানের তৈরি– যাবনিক, ম্লেচ্ছদুষ্ট! (আজ পর্যন্ত এমন মুসলমানও দেখিনি যিনি রবীন্দ্রনাথের প্রশংসা শুনে কানে আঙুল দিয়ে বলেছেন, তওবা, উনি তো হিন্দু!)।
পৃথিবীতে বহু সাধক জন্মেছেন, কিন্তু বিশ্বমৈত্রী প্রচার করাতে যারা দেশ-বিদেশে সম্মান পেয়েছেন তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বিস্ময়কর কবীর, নানক, দাদু, পল্টদাস এবং অন্যান্য অর্ধশিক্ষিত অশিক্ষিত আউল বাউল সম্প্রদায়। কবীরের চেয়ে বড় সাধক জন্মাননি একথা বলা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু তাঁর সাধনার ধন যখন বিশ্বজন সমক্ষে স্বপ্রকাশ হল তখন সত্যান্বেষীরা বিস্ময় মেনে এই কথাই জিজ্ঞাসা করেছিলেন, এই অশিক্ষিত সাধক সর্বধর্ম সমন্বয়ের সন্ধান পেল কোথায়? হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-জরথুস্ত্রি সব ধর্মকে পক্ষপাতহীন সহৃদয়তায় গ্রহণ করতে হলে যে ঐতিহাসিক, ভৌগোলিক, দার্শনিক পরিপ্রেক্ষিতের প্রয়োজন এ লোক সে দিব্যদৃষ্টি পেল কী করে?
এষাস্য পরমাগতি, এখোস্য পরম সম্পদ, ইহাই পরম গতি, ইহাই পরম সম্পদ, এ সম্পদ ভারতবর্ষ পেল কী করে?
সাধনার ক্ষেত্রে, সংস্কৃতির জগতে ভারতবর্ষ একদিন যে দিব্যদষ্টি পেয়েছিল, যার ফলে তার কাছে আত্ম-পর এক হয়ে গিয়েছিল, যার কৃপায় সর্বসংস্কারমুক্ত হয়ে সে যা কিছু সুন্দর, যা কিছু মঙ্গল, যা কিছু সত্য অনায়াসে গ্রহণ করতে পেরেছিল, আজও সে সম্পদ ভারতবাসীর অবচেতন মনে সুষুপ্ত। সে সত্যযুগ পশ্চাতে ছিল, সে সত্যযুগ সম্মুখেও রয়েছে। আজাদ সাহেবের অদ্যকার প্রচেষ্টাই আমাদের মন সর্বপ্রকার সংশয় থেকে মুক্ত করতে পেরেছে।
এ ভারতভূমিতে যেরকম ইসলাম এসে তার বিকাশ পেল, জরথুস্ত্র ধর্মও এ ভূমিতে এসে আশ্রয় নিল। ঠিক তেমনি একদা এদেশ থেকে বিশ্বজয়ে বেরিয়েছিল বৌদ্ধধর্ম। চীন-জাপানে সে ধর্ম কী বিকাশ, কী পরিণতি লাভ করেছিল তার সন্ধান মাত্র কিছুদিন হল আমরা আরম্ভ করেছি। আত্মম্ভরিতা আমাদের উদ্দেশ্য নয়, তবু বলি যে জিনিস ভারতবর্ষ গ্রহণ করেছে সে সম্বন্ধে সে সচেতন– ইসলামের ভারতীয় ইতিহাস তাই সে অম্লাধিক জানে, কিন্তু যে জিনিস সে বিশ্বজগৎকে দিয়েছে, সে সম্বন্ধে সে সম্পূর্ণ অচেতন।
তাই বলি, ভারতবর্ষ পূর্বদিকে বাহু প্রসারিত করে দিয়েছে, পশ্চিমদিকে বাহু প্রসারিত করে নিয়েছে। সম্বিতে হোক্, অবচেতন অবস্থায়ই হোক, দুয়েরই সঙ্গে তার যোগাযোগ। চীন তো আরবকে চেনে না, আরবও চীনকে চেনে না।
সমস্ত প্রাচ্যের দৃঢ়ভূমি তাই ভারতবর্ষ।
— ওমর খৈয়াম
.
এ-পার গঙ্গা ও-পার গঙ্গা
নদীর এপার যখন নিশ্বাস ছেড়ে বলে ও-পারের মতো সুখ এ-পারে নেই আর ও-পারও যখন ঠিক একই কথা বলে তখন বিচক্ষণ জন বিশেষ বিচলিত হন না। কিন্তু পুব পারের প্রজারা যদি বলে পশ্চিম পারে রামরাজত্ব এবং পশ্চিম পারের প্রজারা যদি বলে পুবের জমিদার শিবতুল্য লোক এবং তদুপরি যদি দুই জমিদারের ভিতর মনের মিল না থাকে তা হলে উভয় পারের জমিদারবাড়িতে সামাল সামাল রব পড়ে যায়। রামের তখন ভয়, পাছে শিব উস্কানি দিয়ে তার জমিদারিতে প্রজা-বিদ্রোহ মাতিয়ে তোলেন, এবং শিব আগের থেকেই আপন প্রজার কিছু কিছু বকেয়া খাজনা মকুব করে দিয়ে শিবতুল্য হওয়ার চেষ্টা করেন। এ-হাল বাবতে বাঙালি মাত্রই ওকিবহাল।
কাজেই জর্মনির পূর্ব-পশ্চিম দু পারের অবস্থা বুঝতে বাঙালিকে কিছুমাত্র বেগ পেতে হয় না। উপরের তুলনাটি পেশ করা মাত্রই বিচক্ষণ জন যেমন টে শুনলেই বুঝতে পারেন টেংরার হাইস্কুলের হেডমাস্টারের মাথার টাকের কথা হচ্ছে ঠিক তেমনি বাঙালি মাত্রই রগড়ের আশায় উফুল্ল হয়ে ওঠে।
পশ্চিম জর্মনির ইংরেজ-মার্কিন-ফরাসি বড়কর্তারা বিনিদ্র যামিনী যাপন করছেন পাছে রায়তরা রাতারাতি রাতুল রুশের উস্কানিতে লাল হয়ে ওঠে, ওদিকে স্তালিনও যে পূর্ব জর্মনির দিল-দরিয়ায় গোসল করবার হেকমত খুঁজে পাচ্ছে না সেটাও লাল হরপেই মাঝে মাঝে ফুটে উঠছে।
এ সমস্যার গর্ভদান করেছিলেন লড়াই শেষ হওয়ার পূর্বে রজোভেল্ট, স্তালিন এবং চার্চিল তিন হুজুরে মিলে। জর্মনিকে দু টুকরো করে কমজোর করার মতলব তিন গাঁও বুড়োতেই করেছিলেন। বেবাক ভুলে গিয়েছিলেন যে, হিটলার একদা জর্মনির মন পেয়েছিলেন অর্ধচ্যুত রাইনল্যান্ডকে সম্পূর্ণ আপন করার জিগির তুলে, জর্মনিকে পাগল করে তুলেছিলেন খণ্ডিত সারল্যান্ডকে ফিরে পাওয়ার লোভ দেখিয়ে এবং শেষটায় ক্ষেপিয়ে তুলেছিলেন পরহস্তগত সুডেটেনল্যান্ড ও ডানৎসিখ কেড়ে নেবার কড়া মদ খাইয়ে। অর্থাৎ জর্মনির সামান্যতম টুকরো তার জাতির অঙ্গ থেকে কেটে ফেললেই জর্মনির সমস্ত শরীর– অর্থাৎ তার পূর্ণাঙ্গ জাতীয়তাবোধ ছিন্ন অঙ্গের জন্য প্রথমটায় ব্যাকুল হয়, তার পর নানা কল-কৌশলে গায়ে গত্তি লাগিয়ে নিয়ে শেষটায় চতুর্দিকে ডাণ্ডা বুলোতে থাকে। তখন তার আর শক্ৰমিত্র জ্ঞান থাকে না। ইংলন্ড, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া, রুশিয়া, কাউকে তখন সে বাদ দিয়ে কথা কয় না। এ হিড়িকে তিন মাতব্বরই যে কী রকম বেধড়ক মার খেয়েছেন তা তাদের গা চ্যাটাস চ্যাটাস শব্দ থেকে আমরা পর্যন্ত স্পষ্ট বুঝতে পারছি।
সোজা বাংলায় বলতে গেলে দাঁড়ায় : বিচ্ছেদের ফল বেদনা এবং তার থেকে জন্ম নেয় নিবিড়তম একাত্মবোধ। এই আমাদের যক্ষের ব্যাপারটাই বিবেচনা করে দেখুন না। একটুখানি ভেডুয়াগোছ ছিল বলে লোকটাকে কুবের গাঁয়ের বার করে দিলেন। বেচারি তখন হাউমাউ করে যে কান্নাকাটি করেছিল তারই নাম মেঘদূত। খাসা কাব্যি, কেউ অস্বীকার করবেন না। অথচ দেখুন, কুবের যদি ছোরার বউ-হ্যাংলামোটা একটুখানি বরদাস্ত করে নিতেন তা হলে সে আরামে খেয়েদেয়ে দু পয়সা লোকটার ছিল তো বটে– ঢেঁকুর তুলে তুলে আর আণ্ডা-বাচ্চা পয়দা করে বাকি জীবন কাটিয়ে দিত।
অবশ্য যক্ষটি অম্মদেশীয় অর্থাৎ গান্ধীপন্থি অহিংস। জর্মন হলে কী করত বলা যায় না। হয়তো ভি ওয়ান, ভি টু নিয়ে কুবেরের পেছনে তাড়া লাগাত আর কুবেরও হয়তো এটমবমের সন্ধানে মন্বন্তরব্যাপী তপস্যায় বসে যেতেন।
পাঠক বলবেন, চার্চিল তো আর মেঘদূত পড়েননি, এ তত্ত্বটা জানবেন কী করে? আলবৎ জানা উচিত। কারণ ইংরেজিতেই প্রবাদ রয়েছে অ্যাবসেন্স মেক্স হার্ট ফন্ডার। আমার বিশ্বাস চার্চিল এ প্রবাদটি জেনেশুনেই বিরহের ব্যবস্থাটা করেছিলেন। কারণ ইংরেজ আর কিছু জানুক আর না-ই জানুক, পয়সার কদরটা খুব ভালো রকমেই জানে। তাই তাদের ভিতর এ প্রবাদেরও বাড়া আরেকটা প্রবাদ আছে এবং সেটা জানে অতি অল্প ঘড়েলই– সেটা হচ্ছে, প্রেজেন্টস ফন্ডার স্টিল।
অর্থাৎ প্রেজেনস নয় প্রেজেন্টস। সাড়িডা, বালাডা কিন্যা বিবির মন যোগাও।
আমার বিশ্বাস চার্চিল যখন জর্মনিকে বৈষ্ণবার্থে খণ্ডিতা করতে রাজি হয়েছিলেন তখনই প্রেজেন্টসের কৌশলটা মনে মনে এঁচে নিয়েছিলেন। তাঁর মতলব ছিল কৃষ্ণকে কোনও গতিকে রাধার কাছ থেকে মথুরায় সরিয়ে নিয়ে রুক্মিণী-সত্যভামার ভেট দেওয়া। আমার বিশ্বাস তাই ইংরেজ এত সাত-তাড়াতাড়ি জর্মনিতে আবার খানা-দানা পাঠাতে আরম্ভ করেছে। (যুদ্ধ যখন লাগে তখন আমার এক জর্মন বন্ধুর দুই মেয়ের বয়স ছিল এক আর তিন। বন্ধু মাসখানেক হল একখানি চিঠিতে আমাকে লিখেছেন, যুদ্ধের সময় তো দক্ষিণ আমেরিকা থেকে কলা আসা বন্ধ ছিল। কাল প্রথম বাজারে কলা উঠেছে। আমার মেয়ে দুটি ছবিতে দেখা জিনিস নিজের চোখে দেখে আনন্দে চেঁচিয়ে উঠল। পদ্মার ও-পারে আমরা বলি, জর্মনিকে আবার কলা মূলাড়া দেওয়া হচ্ছে।
এবং সবচেয়ে বড় সওগাত মার্কিন-ইংরেজ-ফরাসি তিন মহাজন পশ্চিম জর্মনিকে দিয়ে ফেলেছেন সেটা হচ্ছে স্বরাষ্ট্রাধিকার। পশ্চিম জর্মনির কাজ-চালানো-গোছ একটা কনসটিটুশান তৈরি হয়ে গিয়েছে, গণনির্বাচন সমাপ্ত হয়েছে এবং হের আডেনাওয়ার এ অঞ্চলের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন।
কিন্তু মার্কিন-ইংরেজ-ফরাসি বড়কর্তারা স্তালিনকে ফাঁকি দিয়েছেন। কথা ছিল কোনও কর্তাই আপন হিস্যার জর্মনিকে স্বরাজ দেবে না– স্বরাজ যদি দিতেই হয় তবে সবাই একজোট হয়ে পূর্ণাবয়ব জর্মনিকে পূর্ণাঙ্গ স্বরাজ দেবেন। মা-ই-ফ ঝপ করে আপন হিস্যায় স্বরাজ দিয়ে অর্থাৎ প্রজাস্বত্ব আইন চালু করে দিয়ে ওপারের জমিদার শিববাবুকে বেবাক বোকা বানিয়ে দিয়েছেন।
প্যাঁচটা মন্দ নয়। কারণ নব-রাষ্ট্রপতি হের আডেনাওয়ার প্রথম বক্তৃতাতেই ও-পারের জমিদারের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। অবশ্য হিটলার যেরকম ভাষায় সুডেটেন চেয়েছিলেন ঠিক সে ভাষায় নয়– অতি মোলায়েম কণ্ঠে, কিন্তু আমরা এসব গলা চিনি, টে বললেই বুঝতে পারি টেংরার হাই স্কুলের ইত্যাদি।
অবশ্য চেম্বারলিনের মতো স্তালিনের ছাতা-বগলে ছুটোছুটি, ওড়াউড়ি করতে এখনও ঢের দেরি।
কিন্তু তাঁকেও এপিজমেন্ট করতে হচ্ছে। পূর্ব-জর্মনিকেও স্বরাজ দিতে হয়েছে।
এখন কে কত দিতে পারে? সুকুমার রায়ের মতো আমরা বলি লাগ, লাগ, লাগ–অর্থাৎ নিলামটা লেগে যাক, দর চড়ুক, বেচারি জর্মনির দু মুঠো অন্ন জুটুক, গায়ে গত্তি লাগুক।
–ওমর খৈয়াম
.
ধর্মং শরণং?
নদীতে স্নান করলে স্বাস্থ্য ভালো থাকে, দেশভ্রমণ করলে কুসংস্কার ও সঙ্কীর্ণতা থেকে মানুষ মুক্তি পায়, বস্ত্রদান ছত্রদান করলে দেশের শিল্প উন্নতিলাভ করে, মন্দির-মসজিদ গড়লে দেশের চারুকলা সমৃদ্ধিলাভ করে, তাই গঙ্গাস্নানে পুণ্য, তীর্থযাত্রায় ধর্মলাভ, দানে মোক্ষ আর উপাসনালয় নির্মাণে যে পুণ্য-ধর্ম-মোক্ষ তিনেরই সম্মেলন সে বিষয়ে এককালে কারও মনে কোনও সন্দেহ ছিল না।
অর্থাৎ যা কিছু মানুষের পক্ষে মঙ্গলদায়ক এককালে তাকেই ধর্ম নাম দিয়ে সাধুসজ্জন এবং সমাজপতিরা জনগণের মন উদ্বুদ্ধ করতেন। এখনও অশিক্ষিত লোক ধর্মের দোহাই না দিলে কোনও প্রকারের সামাজিক উন্নতির চেষ্টা করে না, এখনও বহু লোক শরীর অসুস্থ হলে ডাক্তার না ডেকে মন্ত্রতন্ত্রের আশ্রয় নেয়। দাওয়াই-দেনে-ওয়ালা সন্ন্যাসী ফকিরের বিধান এখনও মানে বহু লোক, বিধানের বিধানকে উপেক্ষা করে। এ নিয়ে মনস্তাপ করলে শিক্ষিত সম্প্রদায় বলেন, শিক্ষা বিস্তার ছাড়া অন্য কোনও উপায়ে মানুষের মন ধর্মের মোহ থেকে মুক্ত করা যাবে না। স্বাস্থ্যরক্ষা, সমাজসংস্কার, শিল্পকলার বিস্তার এখন ডাক্তার, অর্থবিদ নন্দনজ্ঞদের হাতে ছেড়ে দিতে হবে–এরা সব স্পেশালিস্ট ধর্ম এখন শুধু তাদেরই জন্য যারা পরলোকের জন্য ইহলোক ত্যাগ করতে প্রস্তুত। শিক্ষাবিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ এ তত্ত্বটা বুঝতে পেরে রাজনীতি অর্থনীতি থেকে ধর্মকে গলাধাক্কা দিয়ে বিদায় করে দেবে। যেমন ইউরোপ করেছে।
কিন্তু প্রশ্ন ইউরোপ সত্যিই কি রাজনীতি থেকে ধর্ম বাদ দিয়ে ফেলেছে?
হিটলার যখন সোশ্যালিস্টদের সাবাড় করলেন, কম্যুনিস্টদের ভিটে-মাটি উচ্ছন্ন। করলেন, ধনপতিদের কলুর বলদের মতো খাটালেন, শ্রমিকদের ইউনিয়ন পয়মাল করে দিলেন, ইহুদিদের সর্বস্ব লুণ্ঠন করলেন, তখন নাৎসিরা নিশ্চিন্ত হয়ে ভাবল, এখন রাস্তা সাফ, লন্ডন-মস্কো পৌঁছতে এখন আর কোনই বাধা নেই। ঠিক তখনই বিদ্রোহ দেখা দিল এমন এক দলের মাঝখানে যাঁদের সবাই কুসংস্কারাচ্ছন্ন, অফিসের কারবারি নামে পরিচিত হতেন। এঁরা সব ক্রিশ্চান পুরোহিতের দল, এবং এদের নির্ভীক আচরণ দেখে জর্মনির বহু আস্তিক বহু নাস্তিক বিস্ময় মানলেন, এবং আস্তে আস্তে তাদেরই চারপাশে ভিড় জমাতে লাগলেন। ১৯২৯ সালে হিটলার যখন সামান্য মন্ত্রীত্ব পেলেই বর্তে যেতেন তখন আমি গির্জাঘরে অনায়াসে বসবার জায়গা পেতুম, ১৯৩৮ সালে যখন চেম্বারলেন তাঁর কথায় কথায় বাঁদরনাচ নাচতে শুরু করেছেন তখন গির্জাঘরের ভিড়ের ঠেলায় আমি বহু রবিবার দরজা পর্যন্ত পৌঁছে নিরাশ হয়ে বাড়ি ফিরে এসেছি। ১৯২৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়োলজি বিভাগ ছাত্রাভাবে অক্কা পায় পায়, ১৯৩৮ সালে ওই বিভাগই বক্তৃতা আলোচনায় গমগম করছে। হিটলারের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে জর্মনির নাস্তিকরা তখন পর্যন্ত পাদ্রি-পুরুতের সঙ্গে দহরম মহরম আরম্ভ করেছে। এঁরা তখন যে সাহস দেখিয়েছিলেন জর্মনির লোক আজও তা ভুলতে পারেনি। এই মাত্র সেদিন পশ্চিম জর্মনির ব্রিটিশ এলাব যে গণ-নির্বাচন হয়ে গেল তাতে সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়েছে এক ধর্মের নামে গড়া রাজনৈতিক দল। জর্মনির খবর কাগজ পড়ে মনে হয়, সাধারণ জর্মন আর যেন নির্জলা রাজনৈতিকদের হাতে সবকিছু তুলে দিতে রাজি নয়। যে দলে দু চারজন পাদ্রি-পুরুত আছেন সে দলকে স্বীকার করে জর্মনি যেন তাদের আগেকার সাহসের পুরস্কার দিতে চায়।
ইটালিতেও তাই। কমরেড তল্লাত্তির মতো সর্বজনমান্য কম্যুনিস্ট নেতা পৃথিবীর অল্প দেশেই আছেন। ইটালির গত গণভোটে তার অবশ্যম্ভাবী জয় ঠেকাবার জন্য স্বয়ং পোপকে ভোট-মারে নাবতে হল। তল্লাত্তিও তখন প্রমাদ গণলেন। কমিউনিস্ট পার্টি জনসাধারণকে সন্তুষ্ট করার জন্য ইস্তাহারে জাহির করলেন, কমিউনিস্টরা জয়লাভ করলে পাদ্রি-পুরুতের টাকা-পয়সায় হাত দেবে না, গির্জা মনাস্টেরির (সংঘ) যুগ যুগ সঞ্চিত চাষা-মজুরের রক্তে রাঙা ধনদৌলত যেমন আছে তেমনি থাকবে। অর্থাৎ ধর্মকে তার অর্থ থেকে বঞ্চিত করা হবে না। তবু তাত্তিকে হার মানতে হল। আর এখন তো ভ্যাটিকান এবং মার্শাল প্লান একই জিনিস হয়ে দাঁড়িয়েছে।
স্বয়ং স্তালিন লড়াইয়ের সময় পাদ্রি সম্প্রদায়কে ডেকে এনে বহু গির্জাঘর ফেরত দিলেন। শুনেছি কোনও কোনও গির্জাঘরে নাকি হোলি রাশার নামে পুজোপার্বণও হয়েছিল। নাম ভুলে গিয়েছি কিন্তু তখন এক বড় পাদ্রি সায়েবকে নিয়ে রুশিয়া বিস্তর মাতামাতি করেছিল। যুদ্ধের পর আমেরিকার ধনতন্ত্রে ফাটল ধরাবার জন্য কোনও কোনও মার্কিন পুরোতকে রুশ সাড়ম্বর নিমন্ত্রণ, আদর, আপ্যায়নও করেছিল।
ফ্রান্সের মতো নাস্তিক দেশে ক্যাথলিকদের এখনও কতখানি শক্তি সে-কথা আর বুঝিয়ে বলতে হবে না।
প্যালেস্টাইনে নবনির্মিত ইহুদিরাজ্য চোখের সামনে গড়ে উঠল যেহোভার নামে শপথ করে করে। ইহুদিরা শুয়োরের মাংস খায় না–শাস্ত্রে বারণ- ইসরায়েল রাজ্যে এই শূকর মাংস নিষিদ্ধ। অথচ এ রাজ্যের কর্ণধারগণের শতকরা নব্বইজন যখন ইউরোপে ছিলেন তখন ভুলেও সিনাগগে (ইহুদি ভজনালয়) যেতেন না, গবগব করে শুয়োরের মাংস গিলতেন প্রশস্ত দিবালোকে, হোটেল রেস্তোরাঁর বারান্দায় বসে।
এবং এই প্যালেস্টাইনের প্রতিবেশী মিশরে রাজনৈতিক আন্দোলন করে কে? ইংরেজকে খেদাবার জন্য উঠে-পড়ে লেগেছে কারা? অজহর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রেরা। আমরা এদেশে টোল বা মাদ্রাসা বলতে যা বুঝি অজহর ঠিক সেই জিনিস। সেখানে ধর্মচর্চা হয়, সেখানকার ভূগোল পাঁচশো বছরের পুরনো, সেখানে অর্থনীতি এমনকি রাজনীতিও পড়ানো হয় না। অথচ এই অজহরের ছাত্রেরাই ট্রাম পোড়ায়, বাস জ্বালায়, আর মোকা পেলে ইংরেজকে ঠ্যাঙায়। এদের দমাবার জন্য দিনসাতেক হল নতুন আইন পাস করা হয়েছে। এবং আশ্চর্যের বিষয়, মিশরের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়টি ধর্মচর্চা করে না, ট্রামবাস পোড়াতেও চায় না, তারা আছে সরকারকে খুশি করে চাকরি পাবার তালে।
ট্রান্সজর্ডানের আমিরের তাগদ তিনি মহাপুরুষের বংশধর, তিনি রাজা এবং ধর্মগুরু দুই-ই বটেন।
ইবনে সউদের তাগদ তিনি মক্কা-নশীন তাই। মুসলিম জাহানের কেন্দ্র মক্কাশরীফ।
ইরান আফগানিস্তানের মোল্লা সম্প্রদায় এখনও সমাজচক্রবর্তী।
***
ধর্ম রাজনীতিতে প্রবেশ করবে কি না, করা উচিত কি না সে বিষয়ে ব্যক্তিগতভাবে আমি কিছু বলতে চাইনে। কারণ আমার মতের কোনও মূল্য নেই। আমি শুধু এইটুকু দেখিয়েই সন্তুষ্ট যে ধর্মকে গেট আউট বললেই সে সুড়সুড় করে বেরিয়ে যায় না। এবং তাই যদি সত্য হয় তবে ধর্মকে কী প্রকারে জনপদ-কল্যাণে নিযুক্ত করা যায় সেইটে সাদা চোখে ভালো করে তলিয়ে দেখতে হবে। এবং তলিয়ে দেখতে হলে ঈষৎ ধর্মচর্চার প্রয়োজন। সেটা কী প্রকারে করা যায় সেই হল সমস্যা। ধর্ম বলতেই যারা অজ্ঞান তাঁদের হাতে তো আর সবকিছু ছেড়ে দেওয়া যায় না।
–ওমর খৈয়াম
.
কাঠ-বেরালি?
স্বাধীনতা সংগ্রামে যারা প্রাণ দিয়েছেন তাদের কথা এ সপ্তাহে আমরা বার বার স্মরণ করেছি; দেশের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা জনারণ্যের মাঝখানে বক্তৃতামঞ্চের উপর থেকে তাদের উদ্দেশে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করেছেন। স্বাধীনতার যে দেউল নির্মিত হল তার অনির্বাণ আরতির চিরন্তন প্রদীপ হয়ে রইল তাদের স্মৃতি।
সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু এ-বেদনাটাও বুকে বাজে যে, বহু অখ্যাত অজ্ঞাত দেশবাসীর নাম আমরা এ উপলক্ষে পাঁচজনকে শোনাতে পারলুম না। তারা এমন কিছু কীর্তি রেখে যেতে পারেননি যার জন্য আমরা তাদের নাম আড়ম্বর করে স্মৃতিফলকে উত্তীর্ণ করতে পারি। অথচ আপনি আমি পাঁচজন নগণ্য লোকের চেনা-শোনার ভিতরেও এরকম ধরনের দু চারটি দেশসেবী ছিলেন।
তাঁর নাম শান্তিলাল খুশহালচন্দ শাহ। বাড়ি মহাত্মাজির দেশে, অর্থাৎ কাঠিওয়াড়ে–প্রাচীন সৌরাষ্ট্রে। রোগা-পটকা লোকটি দৈর্ঘ্যে পাঁচ ফুট হয় কি না-হয়। অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে এ-দিক ও-দিক ধাক্কা খেয়ে খেয়ে পৌঁছলেন শান্তিনিকেতনে সেখান থেকে গেলেন বন্ শহরে (অধুনা পশ্চিম জর্মনির রাজধানী) সংস্কৃতে ডক্টরেট নেবার জন্য। অধ্যাপক কিফেল (পুরাণ সম্বন্ধে ইন্ডিশে কসমগণি নামে একখানা বিরাট গ্রন্থ ইনি লিখেছেন, বিখ্যাত প্রাচ্য বিদ্যামহার্ণব অধ্যাপক য়াকোবির ইনি শিষ্য) ছোকরাকে পেয়ে ভারি খুশি।
কী মতলব তা জানার পূর্বে খামকা তর্ক করে অস্ট্রেলিয়ান শয়তানকে হুঁশিয়ার করে দেওয়াটা বিচক্ষণের কর্ম হবে না।
ভেবেছিলুম, শাহ খবরদারিটা শুনে অস্ট্রেলিয়ানকে ঠ্যাঙাবার জন্য তার ভাঙা মোটর-সাইকেল করে তদণ্ডেই বন শহর চষতে আরম্ভ করে দেবে। আদপেই না, ঠাণ্ডা হয়ে সব কথা শুনল, মিটমিটিয়ে একটুখানি হাসল।
শুধালুম, দেশে ফিরে না যেতে পারলে দেশ-সেবা করবে কী করে? তাই একটু সমঝে-বুঝে বক্তৃতাটা দিলে হয় না?
শাহ মিটমিটিয়ে হাসল।
বক্তৃতার দিন আমরা সদলবলে উপস্থিত– দেখি অস্ট্রেলিয়াও এসেছে।
সাড়ে ছ-ফুটি জর্মনদের মধ্যিখানে পাঁচফুটি শাহকে বামনাবতারের মতো দেখাচ্ছিল।
ভারতবর্ষের নানা প্রকার ঐতিহাসিক সাংস্কৃতিক অর্থনৈতিক গবেষণা করার পর শাহ নামল ইংরেজ রাজত্বের আমলে। প্রথমে আলোচনা করল সে-আমলের সর্বাঙ্গীণ দুঃখ-দৈন্য, মহামারী-দুর্ভিক্ষের, আস্তে আস্তে ফুটিয়ে তুলতে লাগল তার জন্য যে দায়ী তার বিকট বীভৎস নগ্ন ছবি এবং সর্বশেষে করল হুঙ্কারের পর হুঙ্কার দিয়ে এমিল জোলার আই একুজ (I accuse) কায়দায় ইংরেজের চতুর্দশ পুরুষের শ্রাদ্ধ।
কর্ণপটবিদারক করতালির মাঝখানে শাহ আসন গ্রহণ করল।
করতালির প্রতি নমস্কার করতে উঠে শাহ বলল, এই সামান্য নগণ্য বক্তৃতা সম্পর্কে আমার আরেকটি বক্তব্য আছে।
তার পর অতি শান্তকণ্ঠে অস্ট্রেলিয়ান হুমকির একটা সবিস্তর বয়ান দিয়ে বলল, আমি কে, আর আমার কতটুকুই-বা শক্তি? সেই সামান্য সত্তাটুকুকেও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ সইতে পারে না বলে এই সুদূর বন্ শহরের নিভৃত কোণেও সে চোখ রাঙায়, মার লাগাবে বলে ভয় দেখায়। কিন্তু আমার দেহ ক্ষুদ্র, ভয়ও সেই অনুপাতে ক্ষুদ্র।
পাঁচফুটি শাহ সেদিন জর্মনদের কাছ থেকে বাদ-‘শাহী’ কদর পেয়েছিল।
***
আমি দেশে ফিরে এলুম। কিছুদিন পরে শুনলুম, কোথাও থেকে একটা বৃত্তি যোগাড় করে শাহ বন্ শহরের মেডিকাল কলেজে ঢুকেছে। সংস্কৃতে ডক্টরেট নেওয়ার পর পরিণত বয়সে ডাক্তারি পড়া আরম্ভ করা– তা-ও আবার জর্মন মেডিকাল কলেজে! চারটিখানি কথা নয়।
তার পর শুনলুম, শাহ ডাক্তারি পাস করে জর্মন ফৌজে ডাক্তার হয়ে ঢুকেছে। তখন বুঝলুম, কেন সে এত মেহনত করে ডাক্তারি শিখল। সুভাষচন্দ্র যেরকম জাপানের সাহায্য নিয়ে ইংরেজকে পর্যুদস্ত করতে চেয়েছিলেন, আমাদের নগণ্য শাহ তেমনি জর্মন ফৌজে ঢুকেছিল সেই মতলব নিয়ে। পাঁচফুটি শাহ তো অন্য কোনও উপায়ে জর্মন ফৌজে ঢুকতে পারত না।
তার পর নাকি শাহ স্তালিনগ্রাদের দিকে জর্মন ফৌজের সঙ্গে যায়– এটা অবশ্য উড়ো খবর। শাহের জীবনের এ পর্বটা জানবার কৌতূহল সকলেরই হওয়ার কথা, কিন্তু অনেক অনুসন্ধান করেও আমি এ বিষয়ে কোনও তথ্য যোগাড় করতে পারিনি।
শাহের সর্বশেষ খবর পাই লড়াই শেষ হওয়ার বছরখানেক পরে। জর্মনিতে তখন যেসব ভারতীয় আটকা পড়ে আছেন তার একটা ফিরিস্তি ইংরেজ সরকার প্রকাশ করে। সে ফিরিস্তিতে শাহের নাম ছিল।
তার পর শাহের আর কোনও খবর পাইনি।
–প্রিয়দর্শী
.
মিজো সমস্যা : সরকার
ফিজোর ভাই মিজো না হলেও খুব যে নিকট-আত্মীয় সন্দেহ নেই। বললেন, লোকসভার একজন কংগ্রেসি সদস্য সংসদের কেন্দ্রীয় হলঘরে। উপস্থিত একজন সদস্য অতিশয় উত্মা প্রকাশপূর্বক বর্ণনা করতে লাগলেন কেন্দ্রীয় সরকার ও আসামের রাজ্য-সরকারের মনোভাব। এবং এক জায়গায় এসে উনি অতি নিপুণভাবে যে বিশেষণটি প্রয়োগ করলেন এই দুই সরকারের বিষয়ে, সেই শব্দটি জরগদব।
একদা নাগা-নেতা ফিজোকে নিয়েও ছিল এই জরপাব ভাব; এবার মিজোদের বেলায়ও দেখা গেল ওই একই ভাব। সশস্ত্র অভ্যুত্থানে যারা দেশের বাইরে চলে যেতে চায় তাদের নিন্দা করেন না এমন রাজনৈতিক নেতা ভারতে খুব বিরল। কিন্তু এবার অনেকে (তাদের ভিতর সরকারি দলের নেতারাও আছেন) প্রশ্ন করতে আরম্ভ করেছেন কেন্দ্রীয় ও আসাম রাজ্য-সরকারের সেই ঢিমে-তেতালা জমিদারি চালের, যার জন্য আজ সম্ভব হয়েছে মিজো বিদ্রোহ।
কেন্দ্রীয় সরকার, বিশেষত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আসাম সরকার জানতেন যে, চরমপন্থী মিজোরা অস্ত্রশস্ত্র যোগাড় করছে ১৯৬৩ থেকে, এবং যারা অস্ত্র যোগাড় করে তারা একদিন অস্ত্র নিয়ে দাঁড়াবে, তা-ও জানতেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নন্দজি নিজে বললেন লোকসভায় যে, অস্ত্রাদি এসেছে পাকিস্তান থেকে, এবং মিজোদের অনেককে সামরিক শিক্ষাও দিয়েছে পাকিস্তান। এটা সরকার জানেন আজ অনেকদিন। তা সত্ত্বেও না হয়েছে চেষ্টা অস্ত্র-আনার পথ বন্ধ করার, না হয়েছে চেষ্টা চরমপন্থি নেতাদের গ্রেপ্তার করার, না হয়েছে চেষ্টা অস্ত্রের গোপন গুদাম খুঁজে বের করার। এও যদি জরপাব না হয় তো কে আর হবে?
শুধু তাই কি? এই চরমপন্থী শ্রেষ্ঠ নেতা হল লালডেংগা, ও তার দক্ষিণহস্ত হল লালনুমাউইয়া, মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্টের যথাক্রমে সভাপতি ও উপ-সভাপতি। এরা, ও আরও অনেকে চট্টগ্রাম দিয়ে যেত পাকিস্তানে। এবং যেত বেড়াবার জন্য নয়। অবশেষে ১৯৬৩-র ১৭ ডিসেম্বর এই দু জনকেই গ্রেপ্তার করা হয় বেআইনিভাবে পাকিস্তানে যাওয়ার জন্য। কিন্তু কী জানি কেন, কিছুকাল পর দুজনকেই ছেড়ে দেওয়া হয়। তার জন্য দায়ী আসাম সরকার।
আজ থেকে প্রায় বছর চার-পাঁচেক আগে কেন্দ্রীয় সরকারকে দেওয়া হয়েছিল গোপন সামরিক রিপোর্ট ভারতের ওইসমস্ত পাহাড়ি সীমান্ত নিয়ে, এবং তাতে নাগা-মিজো পাকিস্তানের ষড়যন্ত্রের উল্লেখও ছিল।
মুখ্যমন্ত্রী শ্রীচালিহার নাকি চমৎকার যুক্তি। তাঁর প্রাক্তন সহযোগী ফকরুদ্দিন আলি আহমেদ সাহেব বললেন লোকসভায় যে, মুখ্যমন্ত্রী অতিরিক্ত কোনও নিরাপত্তা বাহিনী পাঠালেন না মিজো অঞ্চলে এই ভয়ে যে, তাতে মিজোরা অসন্তুষ্ট হবে, এবং হয়তো তাদের বিদ্রোহের দিন ঘনিয়ে আনবে। এমন যুক্তি কোনও মুখ্যমন্ত্রী দিতে পারেন, অবিশ্বাস্য। কিন্তু বাস্তবে তাই হয়েছে। আইজলে মাত্র ছিল এক ব্যাটালিয়ন আসাম রাইফেলস্। হালফিলে পাঠানো হয়েছে আর একটি মাত্র ব্যাটালিয়ন। সশস্ত্র মিজোদের সামনাসামনি করতে, অথবা বিদ্রোহ দমন করতে এই দুই ব্যাটালিয়ন কিছুই না। যদি কর্তৃপক্ষ অতিরিক্ত বাহিনী পাঠানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেনই তা হলে ওই সময়ে আরও বেশি কেন পাঠানো হল না? আমাদের সৈন্যবাহিনীর ঘাটিই-বা নেই কেন? ভবিষ্যতের দিকে দৃষ্টি এত কম ছিল যে, অতিরিক্ত রাস্তাঘাট তৈরির চেষ্টাও হয়নি।
অসীম অবহেলা যেমন নিরাপত্তার দিকে তেমনি রাজনৈতিক দিকে। লালডেংগা প্রমুখ মিজো নেতারা ১৯৬০ ও আগে থেকে অন্যান্য পার্বত্য অঞ্চলনেতাদের সঙ্গে মিলে কাজ করছিল। ১৯৫৫-৫৬ থেকে তারা দাবি তুলেছে, সমস্ত পার্বত্য অঞ্চল নিয়ে আলাদা রাজ্য গড়ার। স্বাধীন রাষ্ট্রের নয়, ভারতের ভিতরে থেকে আলাদা রাজ্য গড়ার। কে শোনে? আসাম সরকার ও তাঁর কর্মচারীদের ঔদ্ধত্যের ফলে ক্রমশ নাগারা গেল বিগড়ে। তাঁদের শাসক-মনোভাব শেষে অন্যান্য পার্বত্য অঞ্চলেও আনল অসন্তুষ্টি। গোড়ায় ছিল পাহাড়ি মানুষদের একটা অনুভব যে, তারা আসামের ভিতরে থেকে আসামের কর্তৃত্বধীনে নিজেদের মতো জীবনযাপন করতে পারবে না। ১৯৬০-এর ভাষা বিল, বাঙালি বিতাড়ন আন্দোলন, ১৯৬১-এর কাছাড়ে পুলিশি তাণ্ডব সব মিলে ঠেলে দিল পার্বত্য নেতাদের সম্পূর্ণ বিরোধী স্থানে।
তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী নেহরুর সঙ্গে এদের প্রতিনিধিরা সাক্ষাৎ করতে থাকেন ১৯৬০-এর নভেম্বর (২৪-২৬) থেকে। লালডেংগারা সেই বছরই বেরিয়ে চলে গেল সর্বদলীয় নেতা সম্মেলন থেকে। তখন থেকে মিজোরা চলল আলাদা পথে। এমনকি নরমপন্থী দলের নেতা থাংলুরা মশায়ও কংগ্রেস দল থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন ২৭ এপ্রিল, ১৯৬১। তাঁকেই আবার কংগ্রেস পাঠালো রাজ্যসভায়। মিজোরা ছিল দু মুখো। এক মুখে ছিল স্বায়ত্তশাসন অর্জনের কথা, অন্য মুখে ছিল সার্বভৌম রাষ্ট্র স্থাপনের কথা। আমাদের সরকার প্রথম মুখের কৌশলে ধরা দিলেন।
অন্যান্য পার্বত্য অঞ্চল-নেতারা (খাসি, গারো, মিকির ইত্যাদি) নিজেদের দাবি নামিয়ে আনল। নেফা থেকে গারো পাহাড় অবধি এক রাজ্য আর চায় না। তারা শুধু চাইল, নেহরু ফরমুলা মতে, পুরোপুরি স্বায়ত্তশাসন আসাম রাজ্যের অভ্যন্তরে। এমনকি মুখ্যমন্ত্রী চালিহাও সম্মত হলেন (১-১-৬৪)। তা সত্ত্বেও আজ দু বছর গড়িয়ে গেল, কিছুই হল না।
সরকারের না আছে সামরিক দূরদৃষ্টি, না আছে রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি। দৃষ্টিই নেই, তা কি। দূরের কি কাছের! ফল : (১) মিজো বিদ্রোহ। (২) অন্যান্য পার্বত্য অঞ্চলে তার প্রভাব, যার ফলে অন্যান্য পার্বত্য অঞ্চল শুধু স্বায়ত্তশাসনে সন্তুষ্ট না থেকে হয়তো দাবি আরম্ভ করবে ভারতীয় রাষ্ট্রস্থ রাজ্যপদ লাভের।
— দারাশিকো।