বিবাহ-পৰ্ব

বিবাহ-পৰ্ব

প্রথম পরিচ্ছেদ

আজ ২৫ শে ভাদ্র, বৃহস্পতিবার। আনোয়ারাকে দেখিবার ও তাঁহার বিবাহের লগ্নপত্রাদি স্থির করিবার জন্য আবুল কাসেম তালুকদার, জব্বার আলি খাঁ প্রমুখ ২০/২৫ জন ভদ্রলোক লইয়া আজিমুল্লা ভূইঞা সাহেবের বাড়িতে আসিয়াছে। ভ্রাতুষ্পুত্রের বিবাহোপলক্ষে লোকজন আসিয়াছে, তাই গোলাপজান আজ পরমানন্দে তাহাদের নাস্তার আয়োজনে ব্যস্ত। এই সময় তাহার আদেশে একজন দাসী কূপের পারে পানি আনিতে গিয়াছিল, কিন্তু পূর্ণ কলসী উত্তোলন কালে হঠাৎ দড়ি ছিঁড়িয়া তাহা কূপ মধ্যে ডুবিয়া গেল, দাসী অপ্রতিভ হইয়া কূপের পাশে দাঁড়াইয়া রহিল। এ ঘটনা অল্প সময়েই রাষ্ট্র হইয়া পড়িল।

এই বিবাহে আনোয়ারার দাদিমার সম্পূর্ণ অমত পূর্ব হইতেই ছিল। অর্থ লোলুপ ভূঁইঞা সাহেব জননীর পায়ে ধরিয়া অনেক অনুনয়-বিনয় করিয়া তাঁহার মত গ্রহণের চেষ্টা করেন; শেষে অসমর্থ হইয়া বলেন, “মা, তুমি এ বিবাহে মত না দিলে আমাকে আর মধুপুরে দেখিতে পাইবে না।” একমাত্র পুত্র, তাই মায়ের প্রাণ পুত্রের কথায় শিহরিয়া উঠিল। তিনি ভাবিলেন, পুত্র হয় আত্মহত্যা করিবে, না হয় দেশান্তরে চলিয়া যাইবে। পুত্রস্নেহাকর্ষণে তখন বৃদ্ধার পৌত্রী বাৎসল্য শিথিল হইয়া পড়িল। তিনি এই বিবাহ সম্বন্ধে অন্য কোন বাধা-বিঘ্ন না দিয়া মিয়মনা হইয়া রহিলেন। এক্ষণে উপস্থিত দুর্ঘটনায় পুত্রকে ডাকিয়া কহিলেন, “খোরশেদ! শুভক্ষণে কুয়ার কলসী ডুবিল, সুতরাং এ বিবাহে আর কিছুতেই তোমার মঙ্গল নাই। এখনও বলিতেছি, এই বিবাহদানে নিরস্ত হও।” মায়ের কথায় পুত্রের মনে অমঙ্গলের ছায়া পড়িল বটে; কিন্তু তিনি স্ত্রী ও সম্বন্ধীর মনস্তুষ্টির জন্য ও অর্থলোভে কহিলেন, “মা, তোমাদের ও-সব মেয়েলী কথার কোন মূল্য নাই। দড়ি ছিঁড়িয়া কুপে কি আর কখনও কলসী ডুবে না?”

মা একান্ত ক্ষুব্ধ হইয়া আর কোন দ্বিরক্তি করিলেন না।

এদিকে ষোড়শোপচারে পাত্রপক্ষকে নাশতা খাওয়ান হইল। আহারান্তে তাহারা পান- তামাক ধ্বংস ও নানাবিধ গল্প-গুজবে প্রবৃত্ত হইলেন। বিবাহ সম্বন্ধে কথাবার্তাও ২/১ জন ফুসফাস ইশারা-ইঙ্গিতে পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষে কহিতে লাগিলেন। কিন্তু কাল কাহারও মুখাপেক্ষী নহে, তাহার অপরিবর্তিত নিয়মে সূর্য মধ্যগমন ত্যাগ করিয়া ক্রমে পশ্চিম দিকে হেলিয়া পড়িল। এই সময় ধীরে ধীরে উত্তর-পশ্চিম আকাশ-প্রান্তে গাঢ় মেঘের সঞ্চার হইল, তৎসঙ্গে গগনের বিশাল বক্ষ হইতে গুড় ম গুড় ম ধ্বনি হইতে লাগিল, বাতাস অল্পে অল্পে বহিয়া ক্রমশ প্রবলবেগ ধারণ করিল, শেষে ঝাঞ্ঝাবাতের সৃষ্টি করিয়া দিল। বৃষ্টিপাত আরম্ভ হইল; কিন্তু গর্জন যেরূপ হইল বর্ষণ সেরূপ হইল না। ঝঞ্ঝাবাতে সুযোগ পাইয়া লঘু সূক্ষ্ম বারিধারা আছড়াইয়া আছড়াইয়া দিগন্তে ছড়াইতে লাগিল। সঘন-বিকশিত বিদ্যুৎ-বিভায় লোক-লোচনের অশান্তি ঘটাইয়া তুলিল। দুর্বিসহ যন্ত্রনায় নারকীয় চিৎকারের ন্যায় আকাশ ভেদ করিয়া থাকিয়া থাকিয় চড়ু চড়ু কড়ু কড়ু শব্দ হইতে লাগিল। লোকে মনে করিল এইবার বুঝি মাথায় বাজ পড়ে। দুর্যোগ থামিল না; বৃষ্টি, বায়ু ও বিদ্যুৎ মিলিয়া মিশিয়া প্রকৃতিকে ক্রমশ অস্থির করিয়া তুলিল। গাছপালা তরণী-আরহী প্রভৃতি উলট পালট খাইতে লাগিল। সহসা একটা বজ্ৰ ভূঞা সাহেবের বাড়ির উপর পড়িল! ভীষণ অশণিপাতে বাটীস্থ সকলের কানে তালা লাগিল। আনোয়ারা তাহার দাদিমাকে জড়াইয়া ধরিয়া কাঁদিয়া উঠিল, ভূইঞা সাহেবের অন্তরাত্মা শুকাইয়া গেল; তিনি সভয়ে তথাপি সকলকে কহিলেন, “ভয় নাই। ‘ পরক্ষণে দেখা গেল, তাঁহার গো-শালার চালে আগুন ধরিয়াছে। নিমন্ত্রিত ভদ্রলোকেরা আগুন নিভাইতে যাইয়া দেখিলেন, ভূঞা সাহেবের পালের প্রধান গরুটি মরিয়া গিয়াছে, পাশের আরও ২/১ টি গরু ও একটি ছোট রাখাল বালক আধপোড়া হইয়া মৃতবৎ অজ্ঞান রহিয়াছে। এই রাখাল-বালকটি বৃষ্টির প্রারম্ভে গো-শালায় গরু দিয়া বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় সেখানেই বসিয়াছিল। পলকে প্রলয়কাণ্ড ঘটিয়া গেল, ভদ্রলোকেরা তাড়াতাড়ি ঘরের আগুন নিভাইয়া ফেলিলেন। সকলে বালকটিকে সেবা-শুশ্রূষা করিয়া বহু কষ্টে কথঞ্চিৎ সুস্থ করিলেন। সৌভাগ্যবশত বৃষ্টি হওয়ায় ভূঞা সাহেবের অন্যান্য ঘরগুলি আগুনের হাত হইতে বাঁচিয়া গেল।

শুভ বিবাহের প্রস্তাবদিনে উপর্যুপরি দুইটি অশুভজনক ঘটনা ঘটিল দেখিয়া ভূঞা সাহেব কেমন যেন হতবুদ্ধি হইয়া পড়িলেন, বিবাহ দেওয়ার দৃঢ়সংঙ্কল্প শিথিল হইয়া আসিল; সন্দেহের গাঢ় ছায়ায় তাঁহার অর্থলুব্ধ হৃদয় সমাছন্ন হইল। তিনি একান্ত বিমর্ষ-চিত্তে মায়ের নিকট উপস্থিত হইলেন। পুত্রকে দেখিয়া মা কহিলেন, খোরশেদ! তুমি আমার কথা শুনিতেছ না, এ বিবাহে তোমার সর্বনাশ হইবে।” ভূঞা সাহেব কহিলেন, “মা সর্বনাশের আর বাকি কি? আমার দারগা (গরুর নাম) মরায় আমি দশদিক অন্ধকার দেখিতেছি। সেই গোধনই আমার ঘরে বকরত আনিয়াছিল।” এই বলিয়া ভূঞা সাহেব বালকের ন্যায় চোখের পানি মুছিতে লাগিলেন। মা নিজ অঞ্চলে পুত্রের চোখ মুছিয়া দিয়া কহিলেন, “বাবা, সাবধান হও, তোমার পিতা বলিতেন—’নীচ বংশে কন্যা আনিলে যত দোষ না হয়, নীচ ঘরে মেয়ে বিবাহ দেওয়ায় তাহা অপেক্ষা বেশি দোষ।’ তোমার পিতার উপদেশ স্মরণ করিয়া চল; বিবাহের কথা আর মুখেও আনিও না, আমি দেখিয়া শুনিয়া সত্বরই ভাল ঘরে ভাল বরে— আমার আনারকে সমর্পণ করিতেছি। ভূঞা সাহেব মাতার কথায় অনেকটা আশ্বস্ত হইলেন।

এদিকে প্রকৃতি শান্ত হইল। পাত্রপক্ষকে কোন প্রকারে আহার করান হইল। তাঁহার ভূইঞা সাহেবের বিমর্ষভাব দেখিয়া ও আকস্মিক দুর্ঘটনার বিষয় চিন্তা করিয়া বিবাহের প্রসঙ্গ উত্থাপন করা তখন যুক্তিযুক্ত মনে করিলেন না। সকলে ভগ্নমনোরথ হইয়া বিদায় গ্রহণ করিলেন। প্রকারান্তরে বিবাহ ভাঙ্গিয়া গেল, ভূইঞা সাহেব হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচিলেন, আনোয়ারার দাদিমা বিবাহভঙ্গে উপস্থিত বিপদেও খোদাতায়ালার নিকট শোকর-গোজারী করিতে লাগিলেন। গোলাপজান বড় আশায় নিরাশ হইল।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

পরদিন প্রাতে হামিদা একখানা চিঠি হাতে করিয়া আনোয়ারার নিকট আসিয়া বসিল এবং কহিল, “সই হাদিসের একটি উপদেশ বাবাজানের মুখে শুনিয়াছিলাম—’আল্লা যখন যাহা করেন, সবই নর নারীর মঙ্গলের নিমিত্তই করিয়া থাকেন।’ তোমার বিবাহভঙ্গ এই মহতী বাণীর এক জ্বলন্ত প্রত্যক্ষ প্রমাণ। বাজ পড়িল, ঘর পুড়িল, গো-শালায় গরু মরিল, কূপে কলসী ডুবিল, ইহা তোমার মঙ্গলের নিমিত্তই ঘটিয়াছে। তাহা না হইলে চাচাজানের যেরূপ মতিগতি তাহাতে কালই তোমাকে দোজখে নিক্ষেপের বন্দোবস্ত করিয়া ফেলিতেন। দেখ, তোমার সয়া কি লিখিয়াছেন।” এই বলিয়া হামিদা চিঠিখানির উপরের ৪ লাইন ও নিচের ৩ লাইন ভাঁজ করিয়া নিচে ফেলিয়া মধ্যাংশ সইকে পাঠ করিতে দিল। আনোয়ারা হাসিয়া কহিল, “যদি সমস্ত চিঠি আমাকে পড়িতে না দাও তবে আমি উহা পড়িব না।” সরল প্রকৃতির সই যে এমন প্যাচের কথা বলিবে, হামিদা মোটেই চিন্তা করে নাই, তাই হঠাৎ ফাঁপরে পড়িল। শেষে ইতস্তত করিয়া কহিল, “যদি তুমি ভাঁজ করা নিচের অংশদ্বয় মনে মনে পড়িয়া অবশিষ্ট অংশ বড় করিয়া পাঠ কর, তবে সব চিঠি তোমাকে পড়িতে বলি।“ আনোয়ারা তথাস্তু বলিয়া চিঠিখানি হাতে লইয়া পড়িতে আরম্ভ করিল। উপরের ৪ লাইনে লেখা ছিল, “প্রাণের হামি, তোমার ১৬ই ভাদ্রের পত্র পাইয়াছি। আমার বাড়ি পৌছিবার ৩/৪ দিন পূর্বে বোধ হয় তুমি বেল্লা আসিবে। যাহা হউক, তোমার সহিত সম্মিলন সুখের আশায় হৃদয়ে যে উল্লাসলহরী খেলিতেছে, তাহা তোমাকে বুঝাইতে ভাষা পাইলাম না।” উপরের এই অংশ আনোয়ারা মনে মনে পড়িতে আরম্ভ করিয়া মুখ ফুটিয়া পড়িয়া ফেলিল। তাহার পরের অংশ আবার বড় করিয়া পড়িতে আরম্ভ করিয়াই মনে মনে পড়িতে লাগিল। হামিদা কহিল, “সই, ও কি? পরের বেলায় উচ্চভাষে, নিজের বেলায় চুপটি আসে। মনে মনে পড়িলে ছাড়িব না, বড় করিয়া পড়িয়া যাও।” আনোয়ারা বাধ্য হইয়া পড়িতে লাগিল, “যাহা হউক, প্রতি পত্রের প্রতি ছত্রে তোমার সইয়ের ভাল ঘরে ভাল করে বিবাহ দিবার অনুরোধ করিয়া আসিতেছ; আমিও এক- প্রাণে তাঁহার যোগ্য বর খুঁজিতেছি; কিন্তু তোমার অদ্যকার পত্রে তাঁহার বিবাহের সম্বন্ধের কথা শুনিয়া মর্মাহত হইলাম। যদি চাচাজান অর্থলোভে এ বিবাহ দেন, তবে একটি বেহেস্তের হুরকে দোজখে ডুবান হইবে। অতএব এ বিবাহ যাহাতে না হয়, তোমরা বাবাজানকে (শ্বশুরকে) বলিয়া তাহা করিবে। আমি বাড়ি পৌছিয়া মধুপুরে যাইয়া সব গোল মিটাইয়া দিব এবং খোদাতায়ালা সালামতে রাখিলে প্রতিজ্ঞা করিতেছি,— যেরূপে পারি তোমার সইয়ের—” এই পর্যন্ত পড়িয়া আনোয়ারা উঠিবার চেষ্টা করিল, হামিদা তাহার হাত চাপিয়া ধরিয়া কহিল, “যাও কোথা? পত্রের সকল কথা পড়িয়া শুনাইতে হইবে।” আনোয়ারা লজ্জিতাননে ছোট গলায় পড়িল, ‘প্রাণচোরা’ পুরুষ-বর আনিয়া তাঁহার শ্রীপাদপদ্মে হাজির করিব। তুমি লিখিয়াছ তোমার সইয়ের হৃদয়-দেবতা ঠিক এই গরিব বেচারার চেহারাবিশিষ্ট! এইরূপ হইলে তোমার প্রাণ উড়িবার কথাই বটে! আমার ভয় হইতেছে, যদি তোমার উড়া-প্রাণপাখী আবাসে না ফিরিয়া সইয়ের প্রাণ-চোরার হৃদয়ে বাসা লয়, তবে যে আমি নিরুপায়—পথের কাঙ্গাল! যাহা হউক, আমার নিকটে তোমার প্রবঞ্চনা- পাপের প্রায়চিত্ত হেতু সই তোমার যে উপদেশ দিয়াছেন, তাহাতে তাঁহাকে—” আবার আনোয়ারার মুখ বন্ধ হইয়া আসিল, হামিদা কৃত্রিম বিরক্তি সহকারে বলিল, “সব পত্র পড়িবে কথা দিয়াছ, অঙ্গীকার ভঙ্গের গোনার ভয় নাই?” আনোয়ারা অত্যন্ত লজ্জার সহিত ভাঙ্গা গলায় পড়িতে লাগিল, “সাধারণ মানবকন্যা বলিয়া মনে হয় না; কোন সুরবালা ভ্রমক্রমে মর্ত্যে নামিয়া মধুপুর আলোকিত করিয়াছে। তুমি বহু পুণ্যফলে তাঁহাকে সখীরূপে প্রাপ্ত হইয়াছে। তোমার সহিত আমিও ধন্য হইয়াছি। তাঁহাকে আমার হাজার হাজার সালাম জানাইবে।” এই পর্যন্ত পড়া হইলে হামিদা “ভোলার মাকে একটি কথা বলিয়া আসি” বলিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলে আনোয়ারা তাহার আঁচল চাপিয়া ধরিয়া বড় গলায় পড়িতে লাগিল, “জীবন্ময়ী—আর একটি কথা, আগামী রবিবার অপরাহ্ণে ৪টার সময় বাড়ি পৌঁছিব। যাইয়া যেন তোমাকে তোমার ফুলবাগানে উপস্থিত পাই। মনে রাখিও, এবার পুষ্পোৎসবের পালা আমার।

– তোমারই
আমজাদ

পত্রপাঠ শেষ করিয়া আনোয়ারা কহিল, “সই, তুমি বড়ই দুষ্টামি করিয়াছ। এখানকার সব কথা না লিখিলে কি চলিত না?”

হামিদা। সই, আমি দুই কানে যাহা শুনি, দুই চোখে যাহা দেখি, তাহা তাঁহাকে না জানাইয়া থাকিতে পারি না। কাছে থাকিলে মুখে বলি, দূরে গেলে পত্রে লিখি।

আনোয়ারা। আচ্ছা, তোমাদের পুষ্পোৎসবের পালা কিরূপ?

হামিদার তখন নবনীত-কমল হরিদ্রাভ গণ্ডস্থলে হিঙ্গুলের দাগ পড়িল। আনোয়ারা তাহা লক্ষ্য করিয়া কথাটি জানার জন্য সইকে বিশেষভাবে চাপিয়া ধরিল। হামিদা সইয়ের সনির্বন্ধ অনুরোধে সলজ্জভাবে কহিতে লাগিল, “গত বাসন্তি পূর্ণিমায় আমার বিবাহের ৩ বৎসর পূর্ণ হইয়াছে, এই সময় মধ্যে আমি স্বামী চিনিয়াছি। তিনি বড়ই পুষ্পপ্রিয়। তাঁহার মনস্তুষ্টির নিমিত্ত আমাদের শয়ন-ঘরের দক্ষিণে খিড়কির সম্মুখে, আমি নিজ হাতে গাছ পুতিয়া একটি ফুলের বাগান রচনা করিয়াছি। ঐ দিন বাসন্তী চন্দ্রালোকে ভুবন ভরিয়া গিয়াছে; বাগানে বেল, যুঁই, কামিনী, মল্লিকা, গোলাপ, গন্ধরাজ প্রভৃতি ফুল ফুটিয়া সৌরভে দিক মাতাইয়া তুলিয়াছে, তিনি ও আমি বাগানমধ্যে সামনা-সামনি দুইখানা চেয়ারে বসিয়া আছি। তিনি আমাকে হযরত রসূলের প্রতি বিবি খোদেজা ও বিবি আয়শার প্রেম-ভক্তির প্রভেদ বুঝাইতেছিলেন; সহসা আমার মগজে খেয়াল আসিল, হায়! এই সুখের বাসন্তী পূর্ণিমায় এমন স্বর্গীয় প্রেম-ভক্তির কথা পতিমুখে আর শুনিতে পাইব কি না কে জানে? তাই তাড়াতাড়ি চেয়ার হইতে উঠিয়া দ্রুতহস্তে পুষ্প চয়ন করিয়া একটি ফুলের মুকুট ও এক ছড়া মালা তৈয়ার করিলাম। তাঁহাকে বাতাস করিবার নিমিত্ত ফুলের পাখা পূর্বেই তৈয়ার করিয়াছিলাম, ঘর হইতে তাহা আনিলাম। অনন্তর ধীরে ধীরে মুকুটটি তাঁহার মাথায় দিয়া, মালা ছড়া তাঁহার গলায় দিয়া, ফুলের পাখায় তাঁহাকে বাতাস করিলাম। নীরবে স্মিতমুখে তিনি আমার কার্য দেখিতে লাগিলেন। পরে আমি পাখা রাখিয়া তাঁহার পায়ের কাছে বসিলাম এবং পাঁচবার পদচুম্বন করিয়া ঊর্ধ্বহস্তে দাঁড়াইয়া কহিলাম, হে আমার দয়াময় আল্লাহতায়ালা! আজ দাসীর বাসনা পূর্ণ হইল। করজোরে প্রার্থনা করিলাম—প্রভো! আমার ফুলের সম্রাট পতিদেবকে দীর্ঘজীবী কর। আমি যেন প্রতি বৎসর, এই সময় এইরূপে তাঁহার পদসেবা করিয়া ধন্য হইতে পারি।’ সই, ইহাই আমার পুষ্পোৎসব।”

আনোয়ারা হামিদার স্বামী-ভক্তির কথা শুনিয়া তাহাকে অশেষ ধন্যবাদ দিল। হামিদা পত্র হস্তে বাড়ি ফিরিল।

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

স্বামী বাড়ি পৌছিবার তিনদিন পূর্বে, হামিদা শ্বশুরালয়ে আসিয়াছে। পূর্বোল্লিখিত পত্রানুযায়ী নির্দিষ্ট রবিবার বৈকালে, সে খিড়কীর ফুলবাগানে উপস্থিত ছিল। একটু পায়চারি করিয়া নিজ হাতে সে বাগান পরিষ্কার করিতে লাগিল। শরতের ফুটন্ত ফুলগুলি তাহার মনের ভাব বুঝিয়া কটাক্ষে হাসিতে লাগিল। হামিদা রাগ করিয়া তাহাদের কতকগুলি বৃন্তচ্যুত করিয়া আঁচলে পুরিল। শেষে কামিনী-তলায় বসিয়া তাহাদিগকে নানাভাবে বিন্যাস করিয়া সুন্দর একখানি পাখা ও একগাছি মোহনমালা রচনা করিল। আশা, পথশ্রান্ত পতিকে পাখার বাতাস করিবে, প্রণয়োপহার স্বরূপ মোহনমালা তাঁহার গলায় ঝুলাইবে। পুষ্পগন্ধে অলিকুল গুন গুন ভন্‌ ভন্ করিয়া তাহাকে অস্থির করিয়া তুলিল। কেহ কেহ ফুলের পাখায়, কেহ বা মোহনমালায় উড়িয়া উড়িয়া ঘুরিয়া ঘুরিয়া বসিতে লাগিল। হামিদা তখন বিরক্ত হইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। এই সময় হঠাৎ তাহার মাথার উপর দিয়া একটি দাঁড়কাক কা—কা–খা—খা—করিতে করিতে উড়িয়া গেল। অমঙ্গলাশঙ্কায় সহসা হামিদার প্রাণ কাঁপিয়া উঠিল। সে মনে মনে ভাবিল, “হায়, মন এত উতলা হইতেছে কেন, এমন ত কখনও হয় নাই?” তাহার চিন্তার সঙ্গে সঙ্গে বেলা ডুবিল। সাঁঝের আলো নিভিয়া গেল; অন্ধকার ঘনাইয়া চোরের ন্যায় বাগানে প্রবেশ করিল। হামিদা তখন দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বিষণ্ন মনে ঘরে প্রবেশ করিল এবং মনের শান্তির জন্য ও প্রোষিত পতির মঙ্গল-কামনায় অজু করিয়া নামাজ পড়িতে বসিল।

সন্ধ্যা অতীতপ্রায়। অপরাহ্ ৪টার সময় আমজাদ হোসেনের বাড়ি পৌঁছিবার কথা; কিন্তু এতক্ষণে আসিলেন না কেন? হামিদার উদ্বেগ ক্রমশ বাড়িয়া উঠিল, মনের ভাব কাহাকেও খুলিয়া বলিতে পারিতেছে না। যুবতীর এই অবস্থা খুবই ক্লেশজনক। কিছুক্ষণ পরে হামিদার বড় জা তাহার ঘরে প্রবেশ করিয়া কহিলেন, “কি লো আছরে ঘরে ঢুকিয়াছিস্ মগরেব অতীত প্রায়, তবু যে বাহির হইতেছিস্ না? ওলো বুঝিয়াছি—

নাগর না আসায় উতলা মন-
রন্ধন ভোজনে কিবা প্রয়োজনে?”

হামিদা লজ্জা ত্যাগ করিয়া কহিল, “বুবু, সত্যি আমার মন বড় উতলা হইয়াছে, এরূপ কখনও হয় নাই। পথে বুঝি কোন বিপদ ঘটিয়াছে?” বড় জা কহিলেন, “মিছে ভাবনায় মন খারাপ করিস না, এখনও আসার সময় যায় নাই, একান্ত যদি আজ না আসে, কাল আসিবে; চল বাহিরে চল।” এই বলিয়া তিনি হমিদার হাত ধরিয়া রান্নাঘরের আঙ্গিনায় লইয়া গেলেন।

রাত্রি দেড় প্রহর, তথাপি আমজাদ আসিলেন না, বাড়ির সকলেই চিন্তিত হইলেন। হামিদার উৎকণ্ঠা চরমে উঠিল। তাহার মাথার উপর তাহার কানের কাছে—কা—কা–খা- খা—শব্দ হইতে লাগিল। পতির অমঙ্গল ভাবনায় তাহার মনে চিন্তার তুফান ছুটিল, থাকিয়া থাকিয়া গা ঘামিয়া উঠিতে লাগিল। কেবল প্রকৃতির শাসনে সে নীরব—নির্বাক। বড় জা’র অনেক সাধাসাধি সত্ত্বেও সে অনাহারে শাশুড়ীর নিকট যাইয়া শয়ন করিল; কিন্তু শয্যা কন্টকময় হওয়ায়, সারারাত্রি তাহার অনিদ্রায় অতিবাহিত হইল। পরদিন বেলা এক প্রহরের সময় টেলিগ্রাম আসিল, “আমজাদ বেলগাঁও থানার অন্তর্গত রতনদিয়া গ্রামে—নুরল এসলামের বাড়িতে কলেরায় কাতর। আপনাদের আসা আবশ্যক।” সংবাদ শুনিয়া বাড়িতে কান্নার রোল উঠিল, হামিদার মাথায় আকাশ ভাঙ্গিয়া পড়িল।

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

আজ শনিবার অপরাহ্ণ। শারদীয় পূজা উপলক্ষে শিয়ালদহ স্টেশনে লোকে লোকারণ্য। অফিস আদালত, স্কুল-কলেজ, মহাজনী আড়ত প্রভৃতি বন্ধ হইয়াছে। উকিল-মোক্তার, ছাত্র- শিক্ষক, হাকিম-মুনসেফ, কেরানী-চাপরাশী প্রভৃতি নানা-শ্রেণীর লোক গৃহে ফিরিবার জন্য প্লাটফরমে উপস্থিত। প্রায় সকল লোকের সহিত ছোট বড় নানা সাইজের নানাবর্ণের স্টিলট্রাঙ্ক, ব্যাগ ইত্যাদি। পিতা-মাতা-ভ্রাতা-ভগিনী, স্ত্রী-পুত্র-কন্যা সম্বন্ধী-স্ত্রী, শ্যালিকা, তস্য নিকট সম্পর্কীয় আত্মীয়-স্বজনের জন্য যথাযোগ্য উপহার দ্রব্যে ট্রাঙ্কাদি পরিপূর্ণ।

আজ টিকিট করা যে কত কঠিন, তাহা ভুক্তভোগী ব্যতিত অন্যকে বুঝান দায়। আবার রেলগাড়িতে উঠা তদপেক্ষা কঠিন ব্যাপার। গাড়ির বেঞ্চে আজ স্থানের অভাব। কেহ বেঞ্চের নিচে, কেহ ঝুলান বেঞ্চের উপরে আশ্রয় গ্রহণ করিল। কেহ বা দাঁড়াইয়া রহিল। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর গাড়ি ব্যতিত অন্য দুই শ্রেণীর কোন প্রভেদ রহিল না—তথাপি স্থানের অভাব, তথাপি ঘরমুখো বাঙ্গালী গাড়িতে উঠিয়া হাসিখুশী গল্পগুজবে মত্ত। ড্রাইভারের ইঙ্গিতে কলের গাড়ি গুরুতর লোকরাণ্যবোঝা বুকে করিয়া যথাসময়ে গোসাপের ন্যায় ফোঁস ফোঁস হুস্ হুস্ করিতে করিতে গন্তব্যপথে প্রস্থান করিল।

ইন্টার ক্লাস গাড়ির একটি কামরায় এক বেঞ্চে পরস্পর ঘেঁষাঘেঁষিভাবে দুইটি যুবক উপবিষ্ট। উভয়ের মাথায় তুর্কী টুপী; কিন্তু একজন কালো কোট-প্যান্টধারী, অন্যজন কালো আচকান ও সাদা পায়জামা পরিহিত। কামরার অধিকাংশ আরোহীর দৃষ্টি উভয় যুবকের উপর পতিত। একজন হিন্দু ভদ্রলোক মুখ ফুটিয়া কহিলেন, ‘আপনারা কি যমজ?” যুবকদ্বয়ের মধ্যে একজন কহিলেন, “না”।

হিন্দু। আপনাদের যেরূপ একাকৃতি, উভয়কে বদল দেওয়া চলে; এমন দুইটি কখনও দেখি নাই।

একজন বৃদ্ধ মুসলমান কহিলেন, “সব খোদাতায়ালার মরজি; নইলে, যমজ নয় অথচ এক চেহারা।” যুবকদ্বয় পরস্পরের দিকে চাহিয়া ঈষৎ হাস্য করিলেন। তৎপর কোটধারী যুবক আচকানধারী যুবককে কহিলেন, “আপনি কোথায় যাইবেন?”

আ ধা। বেলগাঁও জুট কোম্পানির অফিসে।

কোটধারী তাঁহার দিকে সবিস্ময়ে তাকাইয়া রহিলেন। তাহার পর কহিলেন, “আপনি তথায় চাকরি করেন?”

আ-ধা। জ্বি, হাঁ।

কো-ধা। আপনি কি পাটের মরশুমে মফঃস্বলে যান?

আ-ধা। জ্বি, হাঁ।

কো-ধা। গত ভাদ্রমাসে কি মফঃস্বলে গিয়াছিলেন?

আ-ধা। জ্বি।

কো-ধা। কোন্ দিকে গিয়াছিলেন?

আ-ধা। মধুপুর অঞ্চলে।

কোটধারী মনে মনে ভাবিলেন, ইনিই হামির লিখিত আনোয়ারার প্রাণ চোরা পুরুষবর হইবেন।

আ-ধা (স্মিতমুখে)। মোয়াক্কেলের নিকট মোকদ্দমার অবস্থা শুনিয়া উকিল-মোক্তারেরা যেরূপ বাদী বা আসামীকে প্রশ্ন করিয়া থাকেন, আপনার জিজ্ঞাসার ধরণ প্রায় সেইরূপই দেখিতেছি। যাহা হউক, আপনি কোথায় যাইবেন?

কোটধারী স্মতমুখে কহিলেন, “বেলতা”।

যে দিবস রাত্রিতে নুরল এসলাম ভূঞা সাহেবের নিমন্ত্রণ রক্ষা করেন, সেই দিন গল্পগুজব প্রসঙ্গে তিনি তালুকদার সাহেবের নিকট শুনিয়াছিলেন, তাঁহার কন্যার জামাতা কলিকাতায় ল-ক্লাসে পড়িতেছেন, বাড়ি বেতা, নাম আমজাদ হোসেন এবং তাহার চেহারা ঠিক তাঁহারই চেহারার মত। এক্ষণে ভাবিলেন, ইনিই তালুকদার সাহেবের জামাতা হইবেন এবং বোধহয় খিড়কীদ্বারে দৃষ্টা অলঙ্কারাদি পরিহিতা বালিকাই এই মহাত্মার সহধর্মীনী হইবেন; পরন্তু ইহার স্ত্রীই বোধহয় পত্রযোগে ইহাকে সব কথা লিখিয়া জানাইয়াছেন।

ফলতঃ এইরূপ দৈব-মিলনে, এইরূপ কথোপকথনে মনে মনে একে অন্যকে অনেকটা চিনিয়া লইলেন। তথাপি খাঁটি সত্য জানিবার জন্য আচকানধারী কোটধারীকে আবার জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি কি কলিকাতায় ল-ক্লাসে পড়েন?” কোটধারী রহস্যভাবে কহিলেন, “আপনাকে জ্যোতির্বিদ বলিয়া মনে হইতেছে?”

আ-ধা। জ্যোতির্বিদ্যায় ত’ আপনিই প্রথম পাণ্ডিত্য প্রকাশ করিয়াছেন।

কো-ধা। আমার পাণ্ডিত্য আনুমানিক।

আ-ধা। আমারও তদ্রূপ।

কো-ধা। আচ্ছা, আপনি অনুমানে আরও কিছু বলিতে পারেন কি?

আ-ধা। আপনার নাম আমজাদ হোসেন নয় কি?

কো-ধা। তারপর?

আ-ধা। মধুপুর আপনার শ্বশুরবাড়ি।

কো-ধা। তারপর?

আ-ধা। আনুমানিক গণনায় আর কিছু পাইতেছি না।

কো-ধা। অল্পদিন হইল আমিও কিছু গণনা বিদ্যা শিখিয়াছি, পরীক্ষা করিবেন কি?

আ-ধা। (হাসিয়া) তাহা হইলে আমার অদৃষ্ট বর্ণনা করুন দেখি?

কো-ধা। আপনার নাম নুরুল এসলাম, আপনি এখনও অবিবাহিত!

আ-ধা। তারপর?

কো-ধা। সম্প্রতি আনোয়ারা নাম্নী এক বেহেস্তের হুর মধুপুর আলোকিত করিয়া অবস্থান করিতেছে।

এইটুকু বলিয়া কোটধারী আচকানধারীর মুখের দিকে চাহিয়া দেখিলেন, তাঁহার মুখ আবেগ উৎকণ্ঠায় ভরিয়া গিয়াছে। তিনি সেই অবস্থায় কহিলেন, “তারপর?”

কো-ধা। আপনি সেই বেহেস্তের হুরকে কোরান পাঠে মুগ্ধ করিয়া, চিকিৎসায় আরোগ্য করিয়া বিবাহের পূর্বেই তাহার সরল মনটি চুরি করিয়া আনিয়াছেন। এখন বাকী তাহার লাবণ্যভরা দেহখানি। বোধহয়, এখন সেইটা পাইলেই আপনার মনস্কামনা পূর্ণ হয়।

আ-ধা। (লজ্জিতবাবে) আপনি সত্য গণক; খোদার ফজলে আপনার গণনা সফল হউক।

কো-ধা। গণনা খোদার ইচ্ছায় নিশ্চয়ই ফলিবে।

আ-ধা। (স্মিতমুখে) আপনার গণনা বিদ্যার গুরু কে?

কো-ধা। (স্মিতমুখে) নাম প্রকাশ নিষেধ আছে।

আচকানধারী এখন বুঝিতে পারিলেন, তাঁহার স্ত্রীই পত্রযোগে সব কথা তাঁহাকে জানাইয়াছেন।

উল্লিখিতরূপে রহস্যালাপে ক্রমে উভয়ের প্রকাশ্য পরিচয় হইয়া উঠিল। পরিচয়ে হৃদ্যতা জন্মিল।

এই সময়ে হঠাৎ নবপরিচিত যুবক যুগলের বিশ্রান্তালাপের মধ্যে এক বিষাদের ছায়া আসিয়া পড়িল। গাড়িতে কোটধারী অর্থাৎ আমজাদ হোসেনের উদরাময়ের লক্ষণ দেখা দিল। বিশেষ ভাবনার কথা। তখন কলিকাতা অঞ্চলে কলেরার খুব বাড়াবাড়ি। আচকানধারী নুরুল এসলাম চিন্তিত হইলেন। তিনি ভাল ভাল হোমিওপ্যাথিক ঔষধ এবার বাক্স পুরিয়া লইয়া বাড়ি চলিয়াছেন। ট্রাঙ্ক হইতে রুবিনীর ক্যাম্পার বাহির করিয়া এক দাগ আমজাদকে সেবন করাইলেন। রাত্রি সাড়ে ৩ টার সময় রেলের মধ্যে আর একবার দাস্ত হইল। নুরুল এসলাম আরও একদাগ ক্যাম্পার দিলেন। ভোরে উভয়ে গোয়ালন্দ স্টেশনে নামিলেন। নামিবার পর রাস্তায় আমজাদের অত্যন্ত বমি হইল, এবার তিনি খুব কাতর হইয়া পড়িলেন। নুরুল তাঁহাকে ধরাধরি করিয়া স্টিমারে তুলিলেন এবং নিচের তলায় সুবিধামত স্থান লইলেন।

নুরুল এসলাম কোম্পানির কার্যে কলিকাতায় গিয়াছিলেন, কার্য শেষ করিয়া বেলগাঁও যাইতেছিলেন। আমজাদ পূজার ছুটিতে বাড়িতে চলিয়াছেন।

আমজাদকে স্টিমারে লইয়া গিয়া নুরুল এসলাম, বিশেষ বিবেচনাপূর্বক ঔষধ প্রয়োগ করিতে লাগিলেন। ফলে স্টিমারে আর একবার মাত্র দাস্ত হইল; কিন্তু পেটে বেদনা ধরিয়া উঠিল। সম্মুখে নুরুল এসলামের নামিবার স্টেশন। আমজাদকে প্রায় সমস্ত দিন রাস্তায় কাটাইতে হইবে। তখন বেলা ১০ টা। নুরুল এসলাম ভাবিলেন, ইনি যেরূপ কাতর হইয়াছেন, তাহাতে সত্বর ভাল চিকিৎসা হওয়া আবশ্যক। এমতাবস্থায় একাকী ইহাকে দিনমানে রাস্তায় ফেলিয়া যাওয়া বা ছাড়িয়া দেওয়া কর্তব্য নহে। আমজাদের অনিচ্ছা সত্ত্বেও নুরুল পাল্কী করিয়া তাঁহাকে নিজ বাড়ি লইয়া গেলেন।

বাড়িতে লইয়া যাওয়ার পর, আমজাদের ঘন ঘন ভেদ-ভূমি হইতে লাগিল, প্রস্রাব বন্ধ হইয়া পেট ফাঁপিয়া উঠিল, রাত্রিতে খিচুনী প্রভৃতি কলেরার যাবতীয় উপসর্গ একযোগে দেখা দিল। নুরুল এসলাম মহা চিন্তিত হইলেন। আমজাদ ভাঙ্গা গলায় কহিলেন, “দোস্ত, আর বাঁচিবার আশা নাই। আমার বাড়িতে একটা তার করিয়া দাও। তোমার উপকারের প্রতিকার করিতে পারিলাম না; ইহাই আক্ষেপ থাকিল।” এই বলিয়া আমজাদ কাঁদিয়া ফেলিলেন। নুরল এসলাম তাঁহার চক্ষের পানি মুছিয়া দিয়া কহিলেন, “তুমি ভীত হইও না, ইহা অপেক্ষা কঠিন কলেরায় লোকে আরোগ্য হয়। আমি বেলগাঁও হইতে এসিস্টান্ট সার্জনকে আনিতে পাঠাইয়াছি।” এই সময় সার্জন বাবু আসিয়া উপস্থিত হইলেন, অবস্থা দেখিয়া ঔষধ দিলেন এবং রাত্রিতে আসায় চতুর্গুণ ভিজিট লইয়া বিদায় হইলেন। নুরুল ও তাঁহার ফুফু সারারাত আমজাদকে ঔষধ সেবন করাইলেন ও সেবাশুশ্রূষা করিলেন।

রাত্রি প্রভাত হইল; কিন্তু পীড়ার উপশম না দেখিয়া নুরল প্রাতে স্বয়ং বেলগাঁও যাইয়া বেতা ‘তার’ করিলেন, তারের সংবাদ পাঠক পূর্বেই পাইয়াছেন আবার আপনাদিগের পূর্বে হামিদা মনস্তাপে স্বামীর অমঙ্গল সংবাদ যে অবগত হইয়াছে, তাহাও জানেন।

‘সাধ্বী ললনার হৃদয় স্বামীর হৃদয়ের সহিত এইরূপ এক তারে বাঁধা’ এ তার টেলিফোনকে হারাইয়া দেয়। সুদূর প্রবাসে থাকিলেও স্বামীর মঙ্গলামঙ্গল সাধ্বী তারযোগে ঘরে বসিয়া জানিতে পারে। ভক্তির সংযোগ ইহা সতীহৃদয় সর্বদা জ্যোতির্ময় করিয়া রাখে। মেসমেরিজমের মূলে যেমন গভীর একাগ্রতা, এ তারের মূলে তেমনি নিরবচ্ছিন্ন পরিচিন্তা বা প্রেমের সাধনা।

তার পাইয়া আমজাদের পিতা মীর নবাব আলী সাহেব ও আমজাদের শ্বশুর ফরহাদ হোসেন তালুকদার সাহেব ছেলেকে দেখিতে রতনদিয়ায় রওয়ানা হইলেন।

এদিকে নুরল এসলাম বেলগাঁও হইতে প্রাতে আর একজন ভাল ডাক্তার লইয়া গেলেন। আল্লার ফজলে তাঁহার চিকিৎসায় আমজাদ আরোগ্যের পথে দাঁড়াইলেন। তাঁহার পিতা ও শ্বশুর রতনদিয়ায় উপস্থিত হইয়া তাঁহাকে দেখিয়া আশ্বস্ত হইলেন এবং বাড়িতে পুনরায় ‘তার’ করিলেন। মীর নবাব আলী সাহেবের পুত্রের সহিত নুরল এসলামের একাকৃতি দেখিয়া তাজ্জব বোধ করিতে লাগিলেন।

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

পাঁচ বিঘা জমি জুড়িয়া নুরল এসলামের বাড়ি। চারিদিকে অনতিউচ্চ প্রাচীর বেষ্টিত। প্রাচীরের ভিতর দিকে যথাস্থানে রোপিত ফলবান বৃক্ষাদি, পশ্চিমাংশে পুষ্করিণী। বাড়িতে নিত্যপ্রয়োজনীয় এগারোখানি ঘর; তন্মধ্যে রান্নাঘর, ভাণ্ডার ঘর ও বৈঠকখানা ঘর করগেট টিনে নির্মিত। অন্যান্য ঘরগুলি খড়ের। নুরল এসলামের পিতা টিনের ঘর ভালবাসিতেন। বৈঠকখানার ঘরখানি সাহেবী ফ্যাসানে প্রকাণ্ড আটচালা। আটচালার সম্মুখে ফুলের বাগান, তাহার সম্মুখে দূর্বাদল শোভিত পতিত ক্ষেত্র। পতিত ক্ষেত্রের প্রতি দৃষ্টিপাত করিলে মনে হয় যেন একখানি সবুজ গালিচা বিস্তৃত করিয়া রাখা হইয়াছে। বাগান হইতে পতিত ক্ষেত্রের উপর দিয়া অনতিউচ্চ সরল বাঁকা রাস্তা দক্ষিণ প্রাচীরের সদর দ্বার পর্যন্ত চলিয়া গিয়াছে। রাস্তার দুই ধারে সারি সারি গুবাকবৃক্ষ সৈন্যশ্রেণীর ন্যায় সদর্পে দাঁড়াইয়া রহিয়াছে প্রাচীরের বাহিরে অনতিদূর দিয়া গবর্নমেন্টের বাঁধা সড়ক বেলগাঁও বন্দর হইতে দক্ষিণ- পশ্চিম কোণে জেলা পর্যন্ত চলিয়া গিয়াছে।

আমজাদ হোসেনকে বৈঠকখানা ঘরের অন্দরমহল-সংলগ্ন প্রকোষ্ঠে স্থান দেওয়া হইয়াছিল। তাঁহার পিতা ও শ্বশুরকে মধ্য প্রকোষ্ঠে স্থান দেওয়া হইল। ৪/৫ দিনের মধ্যে আমজাদ সুস্থ হইয়া উঠিলে তাঁহারা বাড়ি যাইতে উদ্যত হইল; কিন্তু নুরল এসলামের বিশেষ অনুরোধে তাঁহাদিগকে আরও দুই তিন দিন তথায় থাকিতে হইল। তাঁহারা নুরল এসলামের আতিথ্য সৎকারে ও অমায়িক ব্যবহারে একান্ত মুগ্ধ হইয়া পড়িলেন। আমজাদের সহিত নুরল এসলামের বন্ধুত্ব সবিশেষ ঘনীভূত হইল। দৈবঘটনায় আমজাদ হোসেনের পীড়া উপলক্ষে ফরহাদ হোসেন তালুকদার সাহেবের সহিত পুনরায় দেখা হওয়ায়, নুরল যারপরনাই আনন্দিত হইয়াছিলেন। যাহা হউক, তাঁহাড়ের বাড়ি রওয়ানা হইবার পূর্বে আমজাদ নুরল এসলামকে কহিলেন, “এখন আমার রেলওয়ের গণনা, কার্যে পরিণত করিতে ইচ্ছা করি।” নুরল এসলাম তাঁহার বিবাহের কথা বিমাতা ও ফুফু-আম্মাকে জানাইলেন। ফুফু-আম্মা আগ্রহ সহকারে মত দিলেন। অগত্যা বিমাতাও সম্মতি জানাইলেন। নুরল এসলাম স্মিতমুখে আসিয়া বন্ধুকে কহিলেন, “শুভস্য শীঘ্রম।” আমজাদ পিতা ও শ্বশুরের নিকট বিবাহের প্রস্তাব উত্থাপন করিলেন। তালুকদার সাহেব তাঁহার বেহাইকে নুরল এসলামের পাট খরিদ, আনোয়ারার চিকিৎসা, তার দাদিমার মনের ভাব, আজিমুল্লার পুত্রের সহিত আনোয়ারার বিবাহ-প্রসঙ্গ এবং ভূঞা সাহেবের টাকার লোভ প্রভৃতি কথা খুলিয়া বলিলেন।

মীর সাহেব শুনিয়া কহিলেন, “রতনদিয়ায় দেওয়ান-গোষ্ঠী বুনিয়াদী ঘর। আমি এ ঘরের পরিচয় পূর্ব হইতেই জানি। এমন ঘরে, এমন বরে কন্যা দিতে পারিলে, ভূঞার চৌদ্দ পুরুষ স্বর্গে যাইবে। টাকার লোভে ত’ দূরের কথা, বিনা অর্থে সত্বর যাহাতে এ কার্য হয়, আমি বাড়ি যাইয়া ভূঞা শালার কান ধরিয়া তাহা করিতেছি।”

পরদিন আহারান্তে পিতা ও শ্বশুরের সহিত আমজাদ বাড়ি রওয়ানা হইলেন। যথেষ্ট শিষ্টাচার সহকারে নুরল এসলাম তাঁহাদিগকে স্টিমারে তুলিয়া দিয়া আসিলেন। বৈকালে তাঁহারা বাড়ি পৌছিলেন। আমজাদের মা ছেলেকে পাইয়া হাতে স্বর্গ পাইলেন, অন্যান্য সকলে আনন্দিত হইলেন, হামিদা স্বামী দর্শনে মৃতদেহে প্রাণ পাইল এবং দুই রাকাত শোকরানার নামাজ আদায় করিল।

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

আমজাদের পিতার যে কথা সেই কাজ। তিনি মধুপুরে ভূঞা সাহেবের বাড়িতে আসিয়া বিবাহের প্রস্তাব উত্থাপন ও বন্দোবস্ত একই সঙ্গে করিয়া ফেলিলেন।

বেতার মীরবংশ আভিজাত্যে দেশবিখ্যাত। আমজাদের পিতা বর্তমান সেই বংশের মুরুব্বী। তাঁহার মান-সম্ভ্রম যথেষ্ট। তিনি তেজস্বী কর্মবীর বলিয়া খ্যাত। মধুপুরে পুত্রের বিবাহ দিয়া তত্রত্য সকল লোকের সহিত পরিচিত। ভূঞা ও তালুকদার সাহেব তাহাকে বড় মুরুব্বী বলিয়া সম্মান করেন। তাঁহার আদেশ উপদেশ মত কার্য করা গৌরবজনক বলিয়া ভাবেন। উপস্থিত বিবাহ প্রস্তাবে ভূঞা সাহেব কোন ওজর আপত্তি করিতে সাহসী হইলেন না। তাঁহার কৃপণতা ও অর্থের লোভ দূরে পলায়ন করিল। মীর সাহেব বিবাহ-সম্বন্ধে দেনা ও পাওনা যাহা সাব্যস্ত করিলেন ভূঞা সাহেব মন্ত্রমুগ্ধ সর্পের ন্যায় তাহাতেই মাথা নোয়াইলেন। গোলাপজানও যেন কি বুঝিয়া বিশেষ কোন আপত্তি করিল না।

অতঃপর রতনদিয়ায় চিঠি লেখা হইল, “আগামী ২৭ শে আশ্বিন আমরা শুভ বিবাহের দিন স্থির করিয়াছি। তাহার পূর্বে বা পরে ভাল দিন নাই; সুতরাং ঐ তারিখেই যাহাতে এখানে চলিয়া আসিয়া বিবাহ সম্পন্ন হয়, আপনারা তাহাই করিবেন। বিবাহের পূর্বে এখান হইতে আপনাদের বাড়ি যাওয়ার আর সময় নাই, পরন্তু আবশ্যকতাও নাই। খোদা না করুন, এই পত্রানুযায়ী কার্য সম্পন্ন করিতে কোন বাধাবিঘ্ন ঘটিলে, পূর্বাহ্নে জানাইবেন। নির্দিষ্ট দিনে বিবাহ সম্পন্ন করিতে আপনাদিগের আশাপথ চাহিয়া রহিলাম।

পাত্রীকে কেবল তিন হাজার টাকার কাবিন দিতে হইবে। বস্ত্রালঙ্কার অন্যান্য ব্যয় আপনাদের ইচ্ছাধীন। আশা করি, এ বন্দোবস্তে আপনাদের অমত হইবে না।”

মীর সাহেবের পত্র পাইয়া নুরল এসলামের বাড়িতে বিবাহের ধূম পড়িয়া গেল। তিনি জুট ম্যানেজার সাহেবের নিকট এক মাসের বিদায় লইলেন। কেবল ভাদ্র মাসের খরিদ পাটে নুরল এসলাম কোম্পানিকে তিন হাজার টাকা লাভ করিয়া দিয়াছিলেন, এ নিমিত্ত কোম্পানির গুণগ্রাহী ম্যানেজার সাহেব তাহাকে বিবাহের সাহায্য বাবদ তিন শত টাকা দান করিলেন। নুরল এসলামের আত্মীয়-কুটুম্বে, বন্ধু-বান্ধবে, চাকর-চাকরানীতে তাহার বাড়ি-ঘর জনপূর্ণ হইয়া উঠিল। নুরল এসলামের মামু সাহেব, নুরল এসলামের পূর্বকথিত ভাগিনীদ্বয়ের বড়টিকে যমুনা-পারে একজন ভদ্রবংশীয় যুবকের সহিত বিবাহ দিয়াছিলেন। তিনি এফ. এ. পাস্ করিয়া সুপারিশের জোরে এখন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। তিনিও ছুটি লইয়া সস্ত্রীক বিবাহে আসিলেন।

নির্দিষ্ট দিনে নুরল এসলাম নওশা সাজিয়া, পাত্র-মিত্রসহ প্রেম প্রতিমা আনোয়ারার পাণিগ্রহণ বাসনায় মধুপুরে উপস্থিত হইলেন। আজ ভূঞা সাহেবের বৃহৎ ভবন আনন্দ- কোলাহলে মুখরিত। হামিদাও সইয়ের বিবাহে আসিয়াছে। সে শুভ বিবাহে আনন্দে আত্মহারা। আনোয়ারা আজ তাহার আশাতীত আশাসাফল্যে সলাজ-প্রেম-রোমাঞ্চ- কলেবরা। তাহার দাদিমা আশাপূর্ণ হেতু উৎফুল্লা ও ব্যয়বাহুলে মুক্তহস্তা। অন্যান্য রমণীগণও বিবাহের আনন্দে আনন্দিতা। কেবল একটি স্ত্রীলোক আজ আন্তরিক আনন্দিতা না হইলেও, কেবল লোকলজ্জা ভয়ে মৌখিক আনন্দ প্রকাশ করিতেছেন। বলা বাহুল্য, ইনি আনোয়ারার বিমাতা—গোলাপজান।

ভূঞা সাহেব যথাসময়ে, পাত্রপক্ষ ও স্বপক্ষ জনগণকে নাশ্তা ও পোলাও পরিতৃপ্তির সহিত ভোজন করাইলেন। দীনহীন কাঙ্গালেরা উদর পুরিয়া আহার করতঃ ভূঞা সাহেবকে আশীর্বাদ করিতে লাগিল। অপরাহ্ণে পাত্রপক্ষ হইতে নয় শত টাকার অলঙ্কার, তিন শত টাকার শাড়ী প্রভৃতি বস্ত্রাদি ও তিন হাজার টাকার কাবিননামা বাড়ির মধ্যে পাঠান হইল। হামিদা ৬০টাকা মূল্যের একটি অঙ্গুরী সখিত্বের দিনর্শনস্বরূপ সইয়ের অঙ্গুলিতে পরাইয়া দিল এবং তাহার আগুল্ফ-লম্বিত কেশরাশি বিনাইয়া বিনাইয়া চিত্রবিচিত্রভাবে খোঁপা করিয়া বাঁধিয়া দিল। আনোয়ারার দাদিমার আদেশে হামিদার পুণ্যশীলা জননী আনোয়ারাকে বস্ত্রালঙ্কার পরিধান করাইলেন। আর ৪ জন স্বভাবসুশীলা ভদ্রমহিলা আয়া-স্বরূপ হামিদার মাতার সাহায্য করিলেন। হস্তস্পর্শে লজ্জাবতী লতা যেমন সহজে সঙ্কুচিত হইয়া পড়ে, বালিকা বিবাহের বস্ত্রালঙ্কার পরিধান করিয়া লজ্জায় সেইরূপ জড়সড় হইয়া পড়িল; কিন্তু সমাগত স্ত্রীলোকেরা তাহাকে দুলহীন সাজে দেখিতে ইচ্ছা করায়, হামিদার মা হাত ধরিয়া তুলিয়া কন্যাকে মহিলামণ্ডলীর মাঝে দাঁড় করিয়া ধরিলেন। অকস্মাৎ বিজলীর আলোকে যেমন চক্ষু ঝলসিয়া যায়, কন্যার উত্থানমাত্র রমণীমণ্ডলীর চক্ষুও সেইরূপ ধাঁধিয়া গেল। তাঁহারা বাণীনিন্দিত মধুকণ্ঠে সমস্বরে বলিয়া উঠিলেন, “বাহবা বাহবা।” সে পবিত্র ধ্বনি অন্দরমহল হইতে আনন্দকোলাহল-মুখরিত ভূঞা সাহেবের বহির্ভবন মধুময় করিয়া অনন্তের পথে উত্থিত হইল। কন্যা লজ্জার ভারে অর্ধস্ফুট গোলাপকলিকার ন্যায় নিম্নদৃষ্টিতে দাঁড়াইয়া রহিল। তাহার দেহলাবণ্য প্রভায়, অনুপম কারুকার্যমণ্ডিত পরিহিত ভূষণের সৌন্দর্য অধিকতর চাকচিক্যময় হইয়া উঠিল। তাহার স্বর্ণাভ অঙ্গের জ্যোতিঃফলিত রেশমি বস্ত্রের দীপ্তি আরও উজ্জ্বল দেখাইতে লাগিল। বালিকা ইতঃপূর্বে যাহার প্রেমে আত্মপ্রাণ উৎসর্গ করিয়াছে অথচ যাঁহাকে সহজে পাওয়া কঠিন বা একেবারেই পাওয়া যাইবে না বলিয়াই মনে করিয়াছিল; পরন্তু না পাইলে তাঁহার পবিত্র স্মৃতি আশ্রয় করিয়া—খোদাতায়ালার সান্নিধ্যলাভের চেষ্টা করিবে ভাবিয়াছিল; ওহো! বালিকার কি সৌভাগ্য, সে আজ তাঁহারই প্রদত্ত বস্ত্রালঙ্কারে ভূষিতা! সে আজ সেই দুষ্প্রাপ্য প্রেমাধার যুবকবরকে উপস্থিত মুহূর্তে পতিত্বে বরণ করিতে উদ্যত!

বালিকার হৃদয়ের অনুরাগ-জ্যোতিঃ এখন তাহার সুন্দর মুখে প্রতিফলিত। অন্তরের জ্যোতি বাহিরের জ্যোতিতে আসিয়া মিশিয়াছে, তাহাতে বোধ হইতেছে যেন দুইটি যৌগিক তাড়িতের সম্মিলনে পরিস্ফুট জড়িল্লতার উৎপত্তি হইয়াছে, জ্যোতির সহিত জ্যোতি মিলনে বালিকা আজ সত্যই জ্যোতির্ময়ী মূর্তি ধারণ করিয়াছে। সত্য সত্যই সে আজ বিবাহের সাজে সৌন্দর্যের মহিমান্বিত পাটরাণী সাজিয়াছে।

সমাগত স্ত্রীলোকেরা অনিমেষ দৃষ্টিতে বালিকার রূপ দেখিতে লাগিলেন। তাহার পর সমালোচনা আরম্ভ করিলেন। কেহ কহিলেন, “এমন রূপ জন্মেও দেখি নাই।” কেহ কহিলেন, “এত মেয়ে নয়, সাক্ষাৎ পরী।” কেহ বলিলেন, “এ মেয়ে পরীও নহে, পরীদিগের মাথার মণি।” আবার কেহ বলিলেন, “যেমন মা ছিলেন তেমনই মেয়ে হয়েছে।” গোলাপজান সেখানে উপস্থিত ছিলেন, তাহাকে খুশি করার জন্য আর একজন স্ত্রীলোক কহিলেন, “বাদশার মাও, ছোটবেলায় এইরূপ ছিল।” বাদশার মার ব্যথায় ব্যথী আর একজন কহিলেন, বাদশার মা বুঝি এখন বুড়ি হয়েছেন? ষাটের কোলে তাঁহার রূপ এখনো ঘরে ধরে না।” তাহা শুনিয়া অন্য একজন অল্প বয়স্ক রমণী তাঁহাকে কহিলেন, “ছি, ছি, তুমি বল কি? বাদশার মাকে কন্যার পায়ের”–এই পর্যন্ত বলিয়াই জিভ কাটিল। একজন প্রবীনা চতুরা দেখিলেন বিবাদ বাঁধে; তাই তিনি তাড়াতাড়ি কহিলেন, “বাদশার মার যে রূপ, তাহা অন্যের নাই।” বাদশার মা রাগ সমলাইয়া কহিলেন, “আমাদের গাঁয়ের রেবতী ঠাকুরের কন্যা এ মেয়ের চেয়ে বেশি সুন্দরী।” একজন মুখরা পাড়াবেড়ানী নারী সেখানে উপস্থিত ছিল, সে কহিল, “থোও থোও, রেবতী ঠাকুরের কন্যাকে আমি না দেখিলে হইত। এ মেয়ের বাঁদীর যোগ্যও সে হইবে না। আমি অনেক স্থানে অনেক মেয়ে দেখিয়াছি, এমন খুবছুরত মেয়ে কোথাও দেখি নাই।” রূপ সমালোচনা ক্রমে এইরূপ বাড়িয়া চলিল দেখিয়া দুলহীনের দাদিমা কহিলেন, “থাক মা, সকল রূপের বড়াই মিছা। তোমরা দোয়া কর, আমার আনার যেন খোদাভক্তি ও পতি-ভক্তিতে সকলের সেরা হয়।”

২৭ শে আশ্বিন সোমবার রাত্রিতে শুভক্ষণে আনন্দ-কোলাহল মধ্যে মোহাম্মদ নুরুল এসলাম মোসাম্মাৎ আনোয়ারা খাতুনের পাণিগ্রহণ করিলেন।

নুরল এসলাম বিবাহ করিয়া সস্ত্রীক বাড়ি ফিরিতে উদ্যত হইলেন। আনোয়ারা দাদিমার অঞ্চল ধরিয়া রোদন করিতে লাগিল। বৃদ্ধাও অশ্রু সম্বরণ করিতে পারিলেন না, নিরুদ্ধ নয়নবারি দরবিগলিত ধারায় তাঁহার বক্ষঃস্থল প্লাবিত করিতে লাগিল, তিনি শোকমোহে কতর হইয়াও পৌত্রিকে প্রবোধ ও উপদেশ দিতে লাগিলেন, “চিরদিন পিতৃগৃহে বাস করা কন্যার কর্তব্য নহে; শরিয়ত মত দুনিয়ায় পতি-গৃহই তাহার প্রকৃত আবাসস্থল; পরন্তু পতিসেবা না করিলে স্ত্রীলোকের নামাজ, রোজা, ধর্মকর্ম সব বিফল। অতএব, তুমি পতিসেবামাহাত্ম্যে ধর্মকর্ম রক্ষা করিবে। পতিকুলের তৃপ্তিসাধন ও মুখোজ্জ্বল করিবে; তাই বৎসে, তোমাকে পতিগৃহে পাঠাইতেছি। বিদায়ের সময় আসন্ন হইয়াছে, আর অধিক কি বলিব।

এই সারগর্ভ উপদেশ দিয়া বৃদ্ধা এবং স্বয়ং চোখের পানি মুছিতে মুছিতে রোরুদ্যমানা পৌত্রীকে তাহার স্বামীর সহিত বিদায় দিলেন। দুইটি চাকরানী কন্যার সঙ্গে গেল।

নুরল এসলাম মঙ্গলমত বাড়ি পৌঁছিলেন। এ বাড়িতেও দুলহীনের রূপ-সমালোচনা পূর্ণমাত্রায় চলিল। কেহ কহিলেন, “এমন খুবছুরত মেয়ে কোন্ দেশে ছিল?” কেহ বলিলেন, “ছেলে দেশে-বিদেশে ঘুরিয়া এমন রত্ন সংগ্রহ করিয়াছেন।” নুরল এসলামের ছোট ভগিনী মজিদা বারম্বার ঘোমটা খুলিয়া নববধূর মুখ দেখিতে লাগিল। ডেপুটি সাহেব ২৫ টাকা দর্শনী দিয়া সম্বন্ধী-পত্নীর মুখ দেখিলেন। দেখিয়া কহিলেন, “পাত্রী বটে, এমনটি কখনও দেখি নাই!”

সপ্তম পরিচ্ছেদ

আজ ফুলশয্যা। মুসলমানের ফুলশয্যার সম্বন্ধে কোন বিশেষ আচারবিধি না থাকিলেও, যিনি ইহার বিধানকর্ত্রী তিনি বিশেষ সখ করিয়া এই ফুলশয্যার বন্দোবস্ত করিয়াছেন। একমাত্র ভাই, জগৎ-সেরা বৌ; তাই-সর্বগুণসম্পন্না ভগিনী রশিদনের উদ্যেগে আজ এই মহোৎসব।

রাত্রি এক প্রহর। সকলের আহার শেষ হইয়াছে। নুরল এসলাম আহারান্তে বৈঠকখানায় বন্ধু-বান্দব পরিবৃত হইয়া গল্পগুজব করিতেছিলেন। গল্প করিতেছিলেন মুখে, কিন্তু মনটি তাঁর অন্তঃপুরে; চক্ষুদ্বয় তাঁহার দেওয়ালের সংলগ্ন ঘড়ির দিকে কর্ণদ্বয় তাঁহার অন্ত-পুরের আহ্বান শ্রবণে সতর্কিত ও ব্যকুলভাবে উৎকণ্ঠিত। ক্রমে ঘড়িতে ১১টা বাজিল। বন্ধুগণ একে একে উঠিয়া স্ববাসে প্রস্থান করিলেন। নুরল এসলাম তখন ওজু করিয়া পরম ভক্তিপূর্ণ চিত্তে এশার নামাজ পড়িলেন। অনন্তর আরাম-কেদারায় গা ঢালিয়া দিয়া ভবিষ্যৎ জীবনের একখানি মানচিত্র মানসপটে অঙ্কিত করিতে লাগিলেন। অঙ্কন যেখানে ভাল হইল না, সেখানে মুছিয়া নূতন করিয়া গড়িতে লাগিলেন।

এদিকে রশিদন্নেছার আদেশে দাসীরা ফুলশয্যা রচনায় ব্যস্ত। রশিদনের ছোট ভাগিনী মজিদা ও বৈমাত্রেয় ভগিনী সালেহা সেখানে উপস্থিত। রশিদন মজিদাকে কহিলেন, “কি লো, সাঁজের ফুলগুলি কোথায় রাখিয়াছিস?” মজিদা দৌড়াইয়া গিয়া গৃহাভ্যন্তর হইতে সাজিভরা ফুল আনিল, তাহাতে রক্তপদ্ম, বেলী, চামেলী, গোলাপ, জবা—নানা জাতীয় ফুল ছিল। রশিদনের আদেশে দাসীরা পূর্বেই নুরল এসলামের শয়ন ঘরখানি পরিষ্কার-পরিছন্ন করিয়া রাখিয়াছিল; এক্ষণে শয্যা রচনা করিয়া ফুলগুলি যথোপযুক্তস্থানে সন্নিবেশ করিল। লোবান জ্বালান হইল। ফুলের সৌরভে, লোবানের সুগন্ধে ফুলময়গৃহ পরী নিকেতন হইয়া উঠিল।

অতঃপর মজিদা, সালেহা প্রভৃতি নববধূকে ঘরে দিতে ঘিরিয়া লইয়া আসিল। এই সময় নববধূর বড়ই বিপন্ন অবস্থা। প্রেম ও লজ্জা একসঙ্গে বালিকাকে লইয়া টানাটানি আরম্ভ করিল। শেষে প্রেম তাহাকে ধীরে—অতি ধীরে ঘরে উঠিতে উপদেশ দিল।

কিয়ৎক্ষণ পরে নুরল এসলাম সলজ্জভাবে বাসর ঘরে প্রবেশ করিলেন। ননদেরা নববধূকে দুনিয়ার বেহেস্তের বাগানে ফেলিয়া পলায়ন করিল। বালিকা অবগুন্ঠনে নীরবে দাঁড়াইয়া রহিল। যুবকও নীরব। নীরবতার পীযুষপানে উভয়ে কিছুক্ষণ নির্বাক হইয়া রহিলেন। শেষে বালিকা ধীর শরমকম্পিতচরণে একটু অগ্রসর হইয়া চির-আকাঙ্ক্ষিত স্বামীর দুর্লভ চরণ চুম্বন করিল; যেন বসন্তের সুখানিলস্পর্শে নবমঞ্জরিত মাধবীলতা দুলিতে দুলিতে সহকারমূলে আনত হইল। নুরল এসলাম তখনই সেই কনক-প্রতিমার চম্পকবিনিন্দিত কোমলকরাঙ্গুলি করে ধারণ করিয়া ধীরে—অতি ধীরে উঠাইলেন এবং প্রেমপুরিত মধুর কণ্ঠে কহিলেন, “চূরি করিয়া কি এমনি করিয়াই ধরা দিতে হয়?” নিমেষমধ্যে আনোয়ারার মানস- নেত্রে সেই খিড়কীদ্বারে নৌকাদর্শন হইতে আরম্ভ করিয়া এতদিনের আশা-নৈরাশ্য ও সুখমোহবিজড়িত মর্মকোণে লুক্কায়িত গুপ্ত কাহিনীগুলি চিত্রের ন্যায় জীবন্ত হইয়া উঠিল লজ্জায় তাহার সুকোমল গণ্ড কর্ণমূল পর্যন্ত আরক্ত হইয়া গেল। মুখমন্ডলে প্রভাতকালে রক্তপদ্মের উপর শিশির বিন্দুর মত স্বেদবিন্দু ফুটিয়া উঠিল; কিন্তু লজ্জায় সে মুখ ফুটিয়া কিছু বলিতে পারিল না। মুখে অবগুন্ঠন থাকায় নুরল এসলামও প্রাণ প্রতিমার এই অপার্থিব মাধুরী দেখিতে পাইলেন না। তিনি কিয়ৎক্ষণ আত্মহারাবৎ দণ্ডায়মান থাকিয়া প্রিয়তমার মুখের নিকট মুখ লইয়া মৃদুহাস্যে পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন, “টগর জবার দাম পাইয়াছেন?” এবার বালিকা কথা না বলিয়া আর থাকিতে পারিল না। লজ্জা তার গলা চাপিয়া ধরিলেও টগর ও জব্বার নামে প্রেম ও বিস্ময় বালিকাকে উত্তেজিত করিয়া তুলিল, সে তখন কহিল, “আপনি টগর-জবার নাম জানিলেন কি করিয়া?”

যুবক। সেই দিনই প্রেম বৈঠকখানায় আসিয়া আমার কানে কানে বলিয়া গিয়াছিল।

প্রেমের ভয়ে লজ্জা আর বালিকাকে পীড়ন করিতে সাহস পাইল না। বালিকা স্বামীর কথার উত্তরে কহিল,–-“টগর-জবার নগদ মূল্য পাই নাই। কিন্তু তাহার বদলে যে মহামূল্য রত্ন পাইয়াছি, তাহাতে জিন্দেগী সফল মনে করিতেছি।”

যুবক। কি রত্ন লাভ করিয়াছেন?

বালিকা। এই ত, সম্মুখে উপস্থিত।

যুবক। কই, দেখিত’ না?

বালিকা ধীরে নিজহস্তে স্বামীর হস্ত গ্রহণ করিয়া কহিল, “এইত।” নুরল এসলাম আনন্দে উৎফুল্ল হইয়া স্ত্রীকে কহিলেন, “আজ আমিও কোহিনূর লাভ করিয়া ধন্য হইলাম; এখন আসুন, উভয়ে একত্রে এজন্য খোদাতালার শোকরগোজারী করি।” এই বলিয়া তিনি স্ত্রীকে আপন বামপার্শ্বে বসিতে ইঙ্গিত করিলেন। বালিকা পতির পবিত্র প্রথম আদেশ সসম্মানে পালন করিতে তাহার পার্শ্বে উপবেশন করিল। যুবক কহিলেন, “আমার কথিত বাক্যে মোনাজাত করিবেন ও আমিন আমিন বলিবেন।” এই বলিয়া ঊর্ধ্ব হস্তে বলিতে লাগিলেন “হে আল্লাহুতা’লা! আজ আমরা, তোমার নবীর সুন্নত পালন করিলাম। কিন্তু দয়াময়! দুর্বল আমরা, নির্বোধ আমরা যাহাতে আমরা আমাদের এই নূতন জীবনের কর্তব্য সুসম্পন্ন করিতে পারি, তাহার শক্তি আমাদিগকে দাও। হে প্রেমময়! যেন আমাদের প্রেম তোমারই প্রেমের জন্য হয়। হে মধুর! হে সুন্দর! যেন আমাদের চির-জীবন মধুময় হয় ও আমাদের কর্ম সৌন্দর্যময় হয়। হে আমাদের অস্তিত্বের স্বামী, যেন আমরা এক মনে এক প্রাণে সর্বদা তোমার সেবা করিতে পারি। আমিন্ ইয়া রাব্বিল আলামিন, আমিন!”

মোনাজাত অন্তে নুরল এসলাম গাত্রোত্থান করিলেন; কিন্তু বালিকা উঠিল না; নুরল এসলাম তাহার ঘোমটা খুলিয়া দিলেন, দেখিলেন—তাহার শতদল নিন্দিত নেত্রদ্বয় হইতে মুক্তাফল গড়াইতেছে। মুখমণ্ডল আনন্দে উৎফুল্ল, নয়নযুগল হইতে অশ্রুবিগলিত! প্রেমময় স্বামীর পত্নীভাবে এই প্রথম ব্যবহার। নুরল এসলাম কহিলেন, “কাঁদিতেছেন কেন?” প্ৰেম বালিকাকে কহিল—–উত্তর দাও? লজ্জা কহিল—ছি! প্রেমের কথায় তোমার এই স্বর্গীয়ভাবের মাধুর্য নষ্ট করিও না। নুরল এসলাম কোন উত্তর পাইলেন না; কিন্তু ভাবদৃষ্টে বুঝিলেন, এ মুক্তাফল শোকর-গোজারীর দক্ষিণা। অতঃপর তিনি প্রিয়তমার কর ধরিয়া ফুলাসনে আরোহন করিলেন।

অষ্টম পরিচ্ছেদ

সুখে, আমোদ-আহ্লাদে দেখিতে দেখিতে এক সপ্তাহ কাটিয়া গেল। যানাভাবে এ পর্যন্ত নববধূ স্বামীসহ ফিরানীতে যাইতে পারে নাই। আগামীকল্য যাওয়ার দিন স্থির হইয়াছে। পূর্ব রাত্রি শয়ন-মন্দিরে নুরল এসলাম একটি সুন্দর ক্ষুদ্র বাক্স স্ত্রীর সম্মুখে খুলিলেন। পরে তাহা হইতে এক গোছা চুল বাহির করিয়া ঈষদ্ হাস্যে কহিলেন, “না বলিয়া লইয়া আসিয়াছিলাম, অপরাধ ক্ষমা করিয়া আপনার বস্তু আপনি গ্রহণ করুন।” চুল দেখিয়া স্ত্রী প্রথমে কিছু বুঝিতে পারিল না। শেষে যখন স্মরণ হইল যে, দাদিমা তাহাকে বলিয়াছিলেন, ‘ডাক্তার সাহেব নিজ হাতে তোমার মাথার চুল কাটিয়া নিজ হাতে জলপটী বসাইয়া দিয়াছিলেন, তখন ভাবিল, এ চুল তাহারই মাথার হইবে; তথাপি পতিকে জিজ্ঞাসা করিল, “ইহা কোথায় পাইলেন?”

পতি। হাতে লইয়া দেখুন। স্ত্রী চুল হাতে লইয়া দেখিয়া কহিল, “ইহা আমার মাথার বলিয়াই বোধ হইতেছে।”

পতি। নিশ্চয় তাহাই।

স্ত্রী। সামান্য চুলের প্রতি আপনার যত্ন দেখিয়া লজ্জিত হইতেছি।

পতি। আমার নিকট ইহার মূল্য আমার জীবনের মূল্যের সমান। স্ত্রীর মুখ অধিকতর রক্তিমাভ হইয়া উঠল।

পতি। যদি আপনাকে না পাইতাম তবে এই কেশগুচ্ছ আমার জীবনের অবলম্বন হইত। স্থানান্তরে বিবাহের প্রস্তাব চলিলে আমি ঘটককে এই চুল দেখাইয়া বলিয়া দিতাম, এইরূপ সুচিক্কণ কেশযুক্তা পাত্রী না পাইলে বিবাহ করিব না। ঘটক এমন রত্ন কোথাও পাইত না; আমারও বিবাহ করা ঘটিত না।

স্ত্রী। যদি পাওয়া যাইত?

পতি। অসম্ভব।

স্ত্রী। এত বড় দুনিয়া; এত স্ত্রীলোক; পাওয়া অসম্ভব নয়?

পতি জেরায় ঠকিয়া আমতা আমতা করিয়া কহিলেন, “অসম্ভব সম্ভব হইলে কি করিতাম, সে বিচার তখন হইত।”

স্ত্রীর রক্তিমাভ গোলাপ গণ্ডে ঈষৎ মলিনতার ছায়া পড়িল। সে কহিল, “বাবাজান ইতঃপূর্বে আমার বিবাহ সম্বন্ধে স্থানান্তরে দেড় হাজার টাকার গহনা, দেড় হাজার টাকা নগদ এবং তিন হাজার টাকার কাবিন চাহিয়াছিলেন, তাহাও দিতে সম্মত হইয়াছিল; যদি আপনার নিকট তাহাই চার্জ করিতেন তবে কি করিতেন?”

পতি। আমি গরিব মানুষ, তথাপি ধার-কর্জ করিয়া আপনাকে আনিতাম!

স্ত্রী। আপনাকে নগদ টাকা-পয়সা কিছুই দিতে হয় নাই, কেবল মাত্র তিন হাজার টাকার কাবিন দিয়াছেন। আমি শুনিয়াছি, আপনি এই কাবিন দিতে অনেক ওজর-আপত্তি করিয়াছিলেন। আমাকে পাওয়া যদি এতই বাঞ্ছনীয় হইয়াছিল, তবে শুধু কাবিন দিতে এত ইতস্তত করিয়াছিলেন কেন?

পতি। কাবিনে বড় ভয় হইয়াছে। বাবাজান শেষে আবার বিবাহ করিয়া অর্ধেক তালুক কাবিন দিয়া গিয়াছেন; শুনিতে পাইতেছি, মা (বিমাতা) নাকি সেই সম্পত্তি লইয়া পৃথক হইবেন। তিনি অর্ধেক ও আপনি তিন হাজার আদায় করিলে, কালই আমাকে পথে বসিতে হইবে।

পতি দুঃখের স্বরে এ কথাগুলি বলিলেন।

স্ত্রী পতির মনের ভাব বুঝিয়া তাঁহার ভাবান্তর উৎপাদনের জন্য কহিল, “এশার নামাজ পড়িয়াছেন?”

পতি। না। আজ নটায় ঘরে আসিয়াছি, নামাজ এখানেই পড়িব। স্ত্রী তখন ঘরের দক্ষিণ দিকের দ্বারের কাছে তাঁহার ওজুর জন্য একখানি জলচৌকি ও পানি রাখিয়া দিল। পতি ওজু করিতে বসিলেন। এই সময় স্ত্রী তাহার ট্রাঙ্ক হইতে রেশমি রুমালে জড়ান এক জোড়া চটিজুতা বাহির করিয়া লইয়া পতির পার্শ্বে উপস্থিত হইল। অনন্তর নিজ হস্তে তাঁহার চরণ ধৌত করিয়া নিজ হস্তে জুতাজোড়া পরাইয়া দিল এবং পরম ভক্তির সহিত তাঁহার কদমবুসি করিল। পতি স্ত্রীর এইরূপ ব্যবহারে বিস্ময়ে সুখ-সাগরে মগ্ন হইতেছিলেন। কিন্তু তখন কিছু না বলিয়া নামাজ পড়িতে আরম্ভ করিলেন। স্ত্রী পতির পান-তামাক প্রস্তুত করিয়া নিজে নামাজে প্রবৃত্ত হইল।

নামাজ অন্তে পতি স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ জুতা কোথায় পাইলেন?”

স্ত্রী। আপনি আমাকে ‘আপনি’ বলেন কেন?

পতি। আপনি আমাকে ‘আপনি’ বলেন কেন?

স্ত্রী হাসিয়া উঠিল; তারপর কহিল, “আপনি আমার পরম পূজনীয়, তাই ‘আপনি’ বলি।”

পতি। আপনি আমার মাথার মণি, এই নিমিত্ত ‘আপনি’ বলি।

স্ত্রী। আমি আপনার বাঁদী। বাঁদীর সহিত মনিবের ‘আপনি’ বলা মানায় না।

পতি। আর আমি যে আপনার কেনা; সুতরাং মুখ সামলাইয়া কথা বলা উচিত।

স্ত্রী। আপনি অমন কথা বলিলে আমি আর আপনার সহিত কথা বলিব না।

পতি। আচ্ছা, আমি এখন হইতে আপনাকে ‘তুমি’ বলিব; কিন্তু তুমি আমাকে ‘আপনি ‘ বলিলে, বুঝিব তুমি আমাকে অন্তরের সহিত ভালবাস না।

“ভালবাস না”–এই কথায়, এই চিন্তায় স্ত্রী হৃদয়ে যাতনা বোধ করিতে লাগিল, সে পতির হাত টানিয়া নিজ বুকে স্থাপন করিল। পতি হস্তস্পর্শে অনুভব করিতে লাগিলেন, উত্তাপে জল যেমন টগবগ করিয়া ফুটিতে থাকে, স্ত্রীর হৃৎপিণ্ড সেইরূপ স্পন্দিত হইতেছে। তখন পতি স্ত্রীকে কহিলেন, “প্রেমময়ী, তুমি আমাকে এতখানি ভালবাসিয়াছ? আমি যে ইহার শতভাগের এক ভাগও প্রতিদান করিতে পারি নাই। প্রাণাধিকে, তুমি মানবী না দেবী?” স্ত্রীর চক্ষু পতিপ্রেমে অশ্রুভারাক্রান্ত হইয়া উঠিল।

পতি পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘এ জুতা কোথায় পাইয়াছ?”

স্ত্রী। আমাদের বৈঠকখানা ঘরে।

পতি একটু চিন্তা করিয়া কহিলেন, “হ্যাঁ ঠিক; মনে হইতেছে, তোমাদের বাড়িতে রাত্রিতে যখন আহার করি, তখন বৃষ্টি নামিয়াছিল। আহারান্তে নৌকায় যাইবার সময় চটিজুতায় যাওয়া অসুবিধা মনে করিয়া পাচককে নৌকা হইতে বুট আনিতে বলি, সে বুট জুতা আনিয়া দেয় এবং চটি ভুলিয়া নৌকায় তোলা হয় নাই।” পতি এই কথা বলিয়া স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এই জুতা যে আমার, তাহা তুমি কিরূপে চিনিলে?”

স্ত্রী। আপনার পায়ে দেখিয়াছিলাম!

পতি। এই সামান্য জুতা এতদূর বহন করিয়া আনিবার কি দরকার ছিল।

স্ত্রী। জুতা সামান্য নয়, ইহা নিত্য দরকারী। এই বলিয়া সে কহিতে লাগিল, বৈঠকখানায় চটি পাইয়া চিনিলাম ইহা আপনার। তখনই আল্লার কাছে মোনাজাত করিলাম, ‘দয়াময়! দাসী যেন এই জুতা তাঁহার চরণে নিজ হাতে পরাইতে পারে।” আল্লাহ আজ দাসীর বাসনা পূর্ণ করিলেন।

ইহা শুনিয়া পতি বিবাহের পূর্বেই তাঁহার প্রতি স্ত্রীর প্রেম কতদূর গভীর হইয়াছিল বুঝিতে পারিলেন এবং বুঝিয়া স্বর্গীয় আনন্দ অনুভব করিলেন।

অতঃপর নবদম্পতি নিদ্রার কোলে শায়িত হইলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *