বিপর্যস্ত কলকাতা
সম্প্রতি কলকাতা শহর অনবরত বৃষ্টিতে বিপর্যস্ত হয়েছে প্লাবনের প্রভাবে। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগে জাব চার্ণক কলকাতা শহর প্রতিষ্ঠা করবার পর থেকে, কলকাতার ইতিহাসে যে দুর্দৈব ঘটনা ঘটেনি তা নয়। ঝড়, জল, ভূমিকম্প ও মহামারী দ্বারা কলকাতা বহুবারই আক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু কলকাতার লোকেরা কোনদিন প্রকৃতির এ রকম মহারোষের সম্মুখীন হয়নি। বিস্মৃতির অতল গর্ভ থেকে কলকাতার দুদৈব ঘটনা সম্বন্ধে সবচেয়ে পুরানো বিবরণ যা আমার তুলে আনতে পারি, তা হচ্ছে ১৭৩৭ খ্রীষ্টাব্দের। ওই বছরে যে ঝড়-জল হয়েছিল, তাতে ধ্বসে পড়ে গিয়েছিল নব প্রতিষ্ঠিত শহরের অনেক ঘরবাড়ী। ভাগীরথী থেকে লবণ হ্রদ পর্যন্ত পূর্বদিকে যে খালটা চলে গিয়েছিল, তাতে অনেক নৌকা বিনষ্ট হয়েছিল। তারপর থেকেই ধর্মতলার পূর্বাংশের নাম হয় ডিঙ্গাভাঙ্গা। ওই ঝড়েই গোবিন্দরাম মিত্রের কুমারটুলির নবরত্ন মন্দির (যেটা শহীদ মিনারের চেয়েও উঁচু ছিল) ভূমিসাৎ হয়েছিল। কিন্তু তাতে কলকাতা শহরে প্লাবিত হয়নি। কেননা, তখনও কলকাতার ছিল গ্রাম্যরূপ। ঘরবাড়ীর সংখ্যা ছিল খুবই কম। চারদিকেই ছিল বন-জঙ্গল, মাঠ, নদী-নালা, পুষ্করিণী ইত্যাদি। অত্যধিক বৃষ্টি হয়ে জল বেরিয়ে গিয়ে পড়ত হয় ভাগীরথীতে, আর তা নয় তো লবণ হ্রদে। তবে লবণ হ্রদের জল যখন উপচে যেত তখন শিয়ালদহ-বৈঠকখানা প্রভৃতি অঞ্চল প্লাবিত হত।
১৭৩৭ খ্রীষ্টাব্দের পর আমরা যে অতিবর্ষণের খবর পাই, তা হচ্ছে সোমবার একুশে জুন ১৭৫৬ খ্রীষ্টাব্দের। দিনটা হচ্ছে সিরাজ কর্তৃক কলকাতা অবরোধের পরদিন। ওই অবরোধের সময় যে-সকল লোক নিহত হয়েছিল, তাদের ফেলে দেওয়া হয়েছিল শহরের নর্দমা ও একটা গাড্ডার মধ্যে। পরদিন অতিবর্ষণের ফলে ওই সকল মৃতদেহ পচে গিয়ে শহরে এক মহামারীর সৃষ্টি করেছিল। শহরে আবার মহামারী ঘটেছিল ১৭৬২ খ্রীষ্টাব্দে। এই মহামারীতে শহরের দেশীয় বাসিন্দাদের মধ্যে পঞ্চাশ হাজার লোক প্রায় হারিয়েছিল।
এরই আট বছর পরে আসে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর। এই দুর্ভিক্ষের সঙ্গে দেখা দেয় মহামারী। দুর্ভিক্ষ ও মহামারীর ফলে কলকাতা শহরে ছিয়াত্তর হাজার লোক মারা যায়। মেকলে এর যে বর্ণনা দিয়েছেন সেটা খুবই ভয়াবহ—‘কলকাতার রাজপথ ও অলি-গলি সমূহ মৃতদেহে পরিপূর্ণ। কোথাও বা মৃতদেহ সৎকারের অভাবে পড়ে আছে- শকুনি-গৃধিনীর উদরস্থ হচ্ছে, কোথাও বা মুমুর্ষু ব্যক্তি পথের ধারে পড়ে আর্তনাদ করছে। যারা পারছে তারা গঙ্গার ধারে বালুকার উপর মৃতদেহ ফেলে রেখে যাচ্ছে। সৎকারের লোক নেই—সৎকার করে কে? এই মড়কের সময় জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে পনের শত সাহেবও মারা যায়।’
১৭৮০ খ্রীষ্টাব্দে কলকাতায় প্রথম ইংরেজি সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়। ১৮১৮ খ্রীষ্টাব্দে বাংলা সংবাদপত্রেরও আবির্ভাব হয়। কিন্তু সেকালের সংবাদপত্রে আমরা বড় রকমের কোন ঝড়-বৃষ্টির সংবাদ পাই না। বড় রকমের ঝড়-বৃষ্টির সংবাদ পাই ১৮৬৪ খ্রীষ্টাব্দের পাঁচ অক্টোবর তারিখে। কলকাতা আক্রান্ত হয়েছিল এক অতিভীষণ ঝড় ও বর্ষণ দ্বারা। এই ঝড়ে কলকাতা বন্দরের অনেক জাহাজ বিনষ্ট হয়েছিল, শহরের বহু ঘরবাড়ী পড়ে গিয়েছিল এবং মদনমোহনতলার সামনে অবস্থিত ডাকাতে কালীর জোড়বাংলা মন্দিরটা ভূমিসাৎ হয়েছিল। ঝড়ের বেগ এত প্রবল ছিল যে শ্যামবাজারের খাল থেকে নৌকাগুলো উড়তে উড়তে উল্টাডাঙ্গায় গিয়ে পড়েছিল। এই ঝড়ে কলকাতা শহরের এরূপ ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছিল যে সেই ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ সম্বন্ধে কয়েকখানা রিপোর্ট ও বই প্রকাশিত হয়েছিল। যদিও ঝড়ের সঙ্গে অতিবর্ষণ হয়েছিল, তা সত্ত্বেও কলকাতা শহর প্লাবিত হয় নি।
১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দে কলকাতা কেঁপে উঠল এক ভূমিকম্পে। কিন্তু তাতে কলকাতার বাহিরের যত ক্ষতি হয়েছিল, শহরের তত হয়নি।
পরবর্তী নৈসর্গিক দুর্ঘটনা ঘটল ১৮৮৭ খ্রীষ্টাব্দে ২৫ মে তারিখে। এক ভীষণ ঘূর্ণিবার্তার প্রভাবে ভাগীরথীতে জলোচ্ছ্বাস হল স্ট্রাণ্ড রোডের ওপর বহু ডিঙ্গি বিক্ষিপ্ত হল; ইংলিশম্যান’ পত্রিকায় লিখিত হল যে আর সামান্য জল বাড়লেই হেয়ার স্ট্রীটে নৌকা চলাচল করবে। এই ঘূর্ণিবার্তার সময় ঘটেছিল এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। পুরীতে রথযাত্রা দেখবার জন্য (তখন রেলপথ হয়নি; পুরীর সঙ্গে প্রথম রেল সংযোগ হয় ১৮৯৯-তে) ‘স্যার জন লরেন্স’ নামক ম্যাকলীন কোম্পানির এক জাহাজে কলকাতা শহরের বিশিষ্ট অভিজাত পরিবারের ৮০০ মহিলা ও মধ্যবিত্ত ঘরের ২০০ মেয়ে ও পুরুষ যাত্রী বালেশ্বরে যাচ্ছিল। জাহাজখানা ডুবে যাওয়ায় সকলেরই সলিল সমাধি হয়। একজনও বাঁচেনি। এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় অভিভূত হয়ে কলকাতার কয়েকজন কোমলহৃদয়া ইংরেজ রমণী স্থাপিত করেছিলেন এক প্রস্তর-ফলক বড়বাজারের ছোট্টলাল দুর্গাপ্রসাদ ঘাটের দেওয়ালে। তাতে লেখা আছে — ইং ১৮৮৭ খ্রীষ্টাব্দের ২৫-এ মে তারিখের ঝটিকাতে ‘স্যার জন লরেন্স’ বাষ্পীয় জাহাজের সহিত যে সকল তীর্থযাত্রী অধিকাংশই স্ত্রীলোক, জলমগ্ন হইয়াছেন, তাঁহাদিগের স্মরণার্থে কয়েকজন ইংরেজ রমণী কর্তৃক এই প্রস্তর ফলকখানি উৎসর্গীকৃত হল’। এই ঘটনাকেই উপলক্ষ্য করে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন তাঁর ‘সিন্ধুতরঙ্গ’ কবিতা।
তারপর কলকাতা বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১২ জুন ১৮৯৬ খ্রীস্টাব্দের ভূমি কম্পে। তাতে কলকাতার বহু ঘরবাড়ি পড়ে যায়। ভূমিকম্পের সময় যাঁরা ঘোড়ায়-টানা ট্রামে করে যাতায়াত করেছিলেন, তাঁরা আহত হন আশপাশের বাড়ি থেকে ছিটকে আসা ভগ্নাংশের দ্বারা।
এরই পদানুসরণে এসেছিল কলকাতায় ১৮৯৮ খ্রীষ্টাব্দে প্লেগের মহামারী। আক্রান্ত ব্যক্তিতে হাসপাতালসমূহ পূর্ণ হয়ে গেল। হাসপাতালে স্থানাভাবের জন্য সরকার কলকাতার বড় বড় বাড়ির ছাদের উপর আক্রান্ত রোগীদের জন্য চিকিৎসালয় স্থাপন করলেন। এদিকে সাহেব ডাক্তাররা এসে মেয়েদের ঊরু ও কটির সন্ধিস্থল পরীক্ষা করবে শুনে আতঙ্কিত হয়ে লোক শহর ত্যাগ করতে লাগল। রাতারাতি ছ্যাকড়া গাড়ির ভাড়া পঞ্চাশ গুণ হয়ে গেল। (কলকাতায় শেষ প্লেগের মহামারী ঘটেছিল ১৯৪৮ খ্রীষ্টাব্দে)
কলকাতায় সবচেয়ে বড় রকমের অতিবর্ষণ ঘটেছিল ১৯০০ খ্রীষ্টাব্দে। সাতদিন অবিশ্রান্ত ধারায় বৃষ্টিপাত হয়েছিল। বাঙলার নদীনালা সব ভেসে গিয়েছিল। কিন্তু কলকাতা শহরে বন্যার জল জমে থাকেনি। এ সময়ের এক ঘটনার কথা উল্লেখ না করে থাকতে পারছি না। বর্ষণের পর যেদিন প্রথম রেল চলাচল শুরু হল, সেদিন একটি ছোট ছেলে রেল লাইনের ধার দিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ তার নজরে পড়ল যে, রেল লাইনের খানিকটা অংশ বন্যার জলে ভেসে বেরিয়ে গেছে। দূরে রেলের বাঁশী বাজছে। ছেলেটির গায়ে ছিল একখানা লাল রঙের চাদর। সে রেল লাইনের ওপর দাঁড়িয়ে লাল চাদরখানা নাড়তে লাগল। লাল চাদর দেখে ট্রেনখানা দাঁড়িয়ে গেল। সেদিন ওই ছোট ছেলেটির প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের জন্য হাজার হাজার যাত্রীর প্রাণরক্ষা হল।
১৯১৮ খ্রীষ্টাব্দে কলকাতায় আবার কয়েক দিন অতিবর্ষণ হল। কিন্তু তাতে কলকাতা শহরে জল জমেনি। তবে গ্রামগঞ্জ বন্যার জলে ভেসে গিয়েছিল। সেই বন্যায় তারকেশ্বর মন্দিরের আধখানা জলের তলায় চলে গিয়েছিল।
ওরই অনুগামী হয়ে ১৯১৮-১৯ খ্রীষ্টাব্দে এসেছিল ইনফ্যুয়েনজা মহামারী। ঘরে ঘরে মৃত্যু। কান্নার রোলে শহর নিনাদিত হয়ে উঠল। শবদাহের জন্য কাশী মিত্তির ও নিমতলাঘাটে আধ মাইলব্যাপী মড়ার খাটের লাইন পড়ে গেল।
আবার ১৯২৫ খ্রীষ্টাব্দের বর্ষাকালে একদিন রাত্রে কলকাতায় হল অতিবর্ষণ। কলকাতার পুরানো বাড়িগুলোর নীচের তলা জলে ভরে গেল। আমরা যে বাড়িতে বাস করতাম সেটা তৈরী হয়েছিল অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ পাদে। রাত্রে ঘুমের ঘোরে আমরা কিছুই টের পাইনি। সকালে উঠে দেখি, ঘরে খাটের তলায় এক হাঁটু জল। ঘর থেকে বেরিয়ে দেখি, ভিতর বাড়ির দালানে যে সব তক্তাপোষ ছিল, সেগুলো ভাসতে ভাসতে বারবাড়িতে চলে গিয়েছে। রাস্তায় কিন্তু জল জমেনি, যা জমেছিল তা নিষ্কাশিত হয়ে গিয়েছিল রাস্তার পয়ঃপ্রণালী দিয়ে।
১৯২৬ খ্রীষ্টাব্দের পর আর ইতিহাসের বিষয়বস্তু নয়। এটা পাঠকদের অভিজ্ঞতার বিষয়বস্তু। সেজন্য বিপর্যস্ত কলকাতার ইতিহাসের ছেদ এখানেই টেনে দিতে চাই। তবে এইটুকু বলতে চাই যে, গত পঞ্চাশ বছর কলকাতায় আকচার অতিবর্ষণ ঘটেছে। ১৯২৬ খ্রীষ্টাব্দের পর সবচেয়ে বড় অতিবর্ষণ ঘটেছিল ১৯৪৬ খ্ৰীষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে। তারপর ১৯৫৬, ১৯৫৯, ১৯৭০ ও ১৯৭৮ খ্রীষ্টাব্দে। কিন্তু অতিবর্ষণ ঘটলেও বিশেষ বিশেষ জায়গা (যেমন ঠনঠনিয়া কালিবাড়ির সামনে, লায়নস রেঞ্জ ও তার সন্নিহিত অঞ্চলে ও সেনট্রাল অ্যাভেন্যুতে দমকলের আড্ডার সামনে) ছাড়া কলকাতা জলবন্দী হত না। কলকাতা জলবন্দী হতে আরম্ভ হয়েছে মাত্র দশ-পনের বৎসর। পৌরসংস্থার অ্যাডমিনিসট্রেটর বলেন যে, ইদানীংকালে কলকাতা বছরে দশ বারো-বার জলমগ্ন হয়। কেন? এর উত্তর কলকাতার পয়ঃপ্রণালীর অপ্রতুলতা। কলকাতা যেভাবে বেড়ে গেছে (আয়তন ও জনসংখ্যার দিক থেকে) সে অনুপাতে তার পয়ঃপ্রণালী বাড়েনি। খাস কলকাতার ২৯.৪ বর্গমাইল আয়তনের মধ্যে মাত্র ২১.০৮ বর্গমাইলে পয়ঃপ্রণালী আছে। কলকাতার পয়ঃপ্রণালীর নলগুলির ব্যাস ৬ ইঞ্চি থেকে ১৮ ইঞ্চি। কিন্তু নলগুলির একচতুর্থাংশ ময়লাচ্ছন্ন হয়ে বুজে গেছে। এছাড়া কলকাতার মোট আয়তনের ৪৫ শতাংশে কোন পাকা নর্দমা নেই। এ-সব অঞ্চলের (যথা বাঙ্গুর কলোনী, লেক টাউন, সিঁথি প্রভৃতি) জল বাগজালার খালে গিয়ে পড়ে। খালটা অতিবর্ষণের সময় উপচে গেলে শহরের জলনিকাশ বন্ধ হয়ে যায়।
সম্প্রতি কলকাতা বিপর্যস্ত হয়েছে আন্ত্রিক ও ভেজাল তেলজনিত ব্যাধির প্রকোপে।
কিন্তু কলকাতাকে সবচেয়ে বিপদে ফেলেছে ডি. ভি. সি-র বাঁধসমূহ। এই বাঁধগুলি থেকে জল ছেড়ে দিলে দামোদরে বন্যা হয়। ষাট বছর পূর্বে ‘মডার্ন রিভিউ’ পত্রিকায় (১৯২৭, পৃষ্ঠা ৫৯৩) ‘দামোদরের বন্যায় কলকাতার বিপদ’ সম্বন্ধে একটা প্রবন্ধ লেখা হয়েছিল। কিন্তু সে প্রবন্ধের সতর্কবাণীতে কেউই কান দেননি। রাজনীতি ও তার পিছনে টাকা পয়সার লেনদেনকেই অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। হরপ্পা, মহেঞ্জোদরো থেকে আরম্ভ করে প্রাচীন ভারতের অনেকগুলি শহরই বিলুপ্ত হয়ে গেছে বন্যা কবলিত হয়ে। জানিনা, কলকাতার কপালে কি লিখন আছে।
তবে ঝড়, ঝাপট, বন্যা মহামারী ইত্যাদি ছাড়াও, কলকাতা আজ নানাভাবে বিপর্যন্ত। পথচারীদের ফুটপাথ দিয়ে হাটবার উপায় নেই, কেননা, কলকাতার অনেক রাস্তারই ফুটপাত আজ বাজারে পরিণত হয়েছে। কলকাতার অধিকাংশ টেলিফোনই আজ অচল। বাড়ীতে কোনরূপ বিপদ ঘটুক, বা আগুন লাগুক, আজ উপায় নেই থানায় টেলিফোন করে পুলিশের সাহায্যে প্রার্থনা করা, বা অ্যাম্বুলেনস্ ও দমকল বাহিনীকে খবর দেওয়া। যেখানে টেলিফোন অচল সেখানে জরুরী প্রয়োজনে ডাক্তার ডাকবারও উপায় নেই। টেলিফোনের পর ইলেকট্রিসিটির কথা ধরুন। কথায় কথায় লোডশেডিং। প্রান্তিক অঞ্চল সমূহে ইলেকট্রিসিটির সঙ্গে কলের জলের ঘনিষ্ঠ আঁতাত। লোডশেডিং হলে পানীয় জল থেকে আরম্ভ করে রান্না, স্নান, পায়খানায় যাওয়া সবই বন্ধ। ছেলেদের লেখাপড়ার তো বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে ঘনঘন লোডশেডিং। লোডশেডিং যে মাত্র মানুষকে তিতিবিরক্ত করে তুলেছে তা নয়। সম্প্রতি কনভেন্ট রোডের পাস্তুর ইনষ্টিটিউটের এক সমীক্ষা থেকে জানতে পারা যায় যে লোডশেডিং জন্তু জানোয়ারকেও বিব্রত করে তুলেছে। লোডশেডিং-এর ফলে শহরে কুকুরে কামড়ানোর সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।
যানবাহনের অবস্থা আরও শোচনীয়। মাঝপথে বাসে ট্রামে ওঠা একেবারে অসম্ভব। নিজের গাড়ী থাকলেও নিস্তার নেই। জ্যামে আটকে পড়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তেল পোড়াতে হয়। পেট্রল যে একটা দুষ্প্রাপ্য জাতীয় সম্পদ এবং এটা এভাবে নষ্ট হলে জাতির ক্ষতিই হয় এ বোধ কর্তৃপক্ষ মহলের কারোরই মাথায় ঢোকে না।
রাস্তায় সব সময়ই চলেছে মিছিল, নানা রকম শ্লোগান দিতে দিতে। মিছিলের ফলাফল নিয়ে আমরা মাথা ঘামাচ্ছি না। আমাদের বক্তব্য মিছিলে আটকে পড়ে জীবনমরণের মুখোমুখী যে সব রোগী বা যারা প্রসব বেদনায় ছটফট করছে, তাদের যথা সময়ে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া সম্ভবপর হচ্ছে না। লোক যথাসময়ে কোর্ট-কাছারী, স্কুল-কলেজ, কর্মস্থল ও পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষার হলে যেতে পারছে না।
ট্যাকসীর ভাড়া যত বাড়ছে, ট্যাকসী তত দুষ্প্রাপ্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তাছাড়া ট্যাকসীওয়ালাদের আছে জুলুম ও মরজি। উত্তরে যেতে চাইলে বলে দক্ষিণে যাব, আর দক্ষিণে যেতে চাইলে বলে উত্তরে যাব। আরোহীর বিনা অনুমতিতে সামনে প্যাসেঞ্জার তোলে। ভারতের আর কোন শহরে এ রকম অনাচার নেই।
হাসপাতালগুলোয় আর সুচিকিৎসা হচ্ছে না। গ্লুকোজের বদলে কেরোসিন দেওয়া হচ্ছে, রোগীর জন্য বরাদ্দ ওষুধের হাত পা গজাচ্ছে এবং সেগুলো বাইরের ডাক্তারখানায় চলে যাচ্ছে। হাসপাতালের যন্ত্রসরঞ্জামও বাইরে পাচার হচ্ছে। সম্প্রতি পশ্চিম বঙ্গের পূর্তমন্ত্রী যতীন চক্রবর্তী মশায় সরেজমিনে গিয়ে হাসপাতালসমূহের যেসব অনাচার ও দুর্নীতি উদঘাটন করেছিলেন তা যে কোন স্বাধীন ও সভ্য দেশের পক্ষে ল ার বিষয়। এ ছাড়া বিনা নোটিশে অনবরতই হাসপাতালের কাজ বন্ধ হয়ে যাছে।
তারপর আইনশৃঙ্খলা সম্বন্ধে কিছু না বলাই ভাল। লোকে পুলিশের কাছ থেকে ন্যায়সঙ্গত আচরণ পাচ্ছে না। মনে হয় পুলিশের একমাত্র কর্তব্যকর্ম হচ্ছে রাস্তার মোড়ে মোড়ে লরিওয়ালাদের কাছ থেকে পয়সা আদায় করা। যখন লরির ঝাঁক আসে, তখন সব লরিওয়ালাদের কাছ থেকে পয়সা আদায় না হওয়া পর্যন্ত পুলিশের সিগনাল বন্ধ হয়ে থাকে। এটাও জ্যামের একটা কারণ। তা ছাড়া, খুন-জখম, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, রাহাজানি ও চুরি-ডাকাতি ক্রমশই বেড়ে চলেছে। এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদন থেকে জানতে পারা যায় যে ১৯৭২ খ্রীষ্টাব্দে ডাকাতি ও রাহাজানির সংখ্যা ছিল ৭৭। ১৯৭৭ খ্রীষ্টাব্দে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ২২০১, ১৯৭৮-তে ২৩৬৮, ১৯৭৯-তে ২৪২৫, ১৯৮০-তে ২৫০৭ ও ১৯৮১-তে ২৫৮৯। এ যেন মনে হয় যে একটা বছর আর একটা বছরের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে। আগে ডাকাতদের লক্ষ্যস্থল ছিল ট্রেন, জুয়েলারীর দোকান, ব্যাঙ্ক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান। এখন সাধারণ গৃহস্থের বাড়ীতেও ডাকাতির সংখ্যা ক্রমশঃ বেড়ে চলেছে।
কলকাতার রাস্তাঘাটের অবস্থাও খুব খারাপ। সাধারণ লোক তো নিজ চোখেই দেখতে পায় রাস্তাঘাট কিভাবে মেরামত হয়। কেবল কর্তৃপক্ষেরই এটা দেখবার মত চোখ নেই ঠিকাদারের বিল পাশ করবার সময়। তারপর সি.এম.ডি.এ. তো রাস্তাঘাটগুলোকে ভেঙে চুরমার করে ফেলছে। পাশের বাড়ীগুলোও দুর্বল হয়ে পড়ছে। শুধু সি.এম.ডি.এ. কেন? কলকাতার টেলিফোন, ইলেকট্রিসিটি, জলকল প্রভৃতির জন্য অনবরতই রাস্তা খোঁড়া হচ্ছে, এবং যেন তেন প্রকারেন সেগুলো ঢাকা দেওয়া হচ্ছে। পূর্বাবস্থায় আর ফিরিয়ে আনা হচ্ছে না। এখন কলকাতার রাস্তায় পর্বতপ্রমাণ জঞ্জাল জমে। নিয়মিত রাস্তা ঝাঁট দেওয়া হয় না। রাস্তায় জল দেওয়ার পাট তো উঠেই গেছে। তা ছাড়া, সামান্য বৃষ্টি হলেই রাস্তা জলে ডুবে যায়।
কলকাতার বন্দরের অবস্থাও খুব খারাপ। বড় জাহাজ আর কলকাতায় আসতে পরে না। ফলে, বড় বন্দর শহর হিসাবে কলকাতা আজ তার অতীত গৌরব হরাচ্ছে।
এক কথায়, কলকাতা আজ নানাভাবে বিপর্যস্ত।