বিপদ – ৬

মিসির আলি অনেক খুঁজে-খুঁজে আফসার সাহেবের বাসায় এসেছেন। বাসা থমথম করছে। কোনো সাড়াশব্দ নেই। বাড়িতে পা দিয়েই তাঁর মনে হল অশুভ কিছু যেন এই বাড়িতে ছায়া ফেলে আছে। ভয়াবহ কিছু ঘটে গেছে। কলিং বেল টিপতেই মীরা এসে দরজা খুললেন। তিনি এমনভাবে তাকালেন যেন মিসির আলিকে চিনতে পারছেন না। মীরার চোখ লাল, হয়তো কাঁদছিলেন।

মিসির আলি বললেন, কেমন আছেন?

মীরা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, ভালো নেই।

ভেতরে আসব?

আসুন।

আফসার সাহেব কোথায়?

মীরা চুপ করে রইলেন। মিসির আলি বললেন, আমি বুঝতে পারছি বড় রকমের কোনো ঘটনা ঘটেছে। আপনি কি আমাকে দয়া করে বলবেন, কী ব্যাপার?

মীরা চাপা গলায় বললেন, আমাদের ঐ বিড়ালটা একটা বাচ্চা নিয়ে খুঁজে-খুঁজে এই বাড়িতে চলে এসেছিল। কী করে গেণ্ডারিয়ার এই বাড়ি খুঁজে পেল আমি জানি না। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি বিড়ালটা তার বাচ্চা নিয়ে চুপচাপ বসে আছে। সুমীর আব্বা একগাদা খাবার খেতে দিয়েছে। আমার প্রচণ্ড রাগ হল। রাগে প্রায় অন্ধ হয়ে গেলাম-আমাদের সমস্ত যন্ত্রণার মূলে এই বিড়াল। আমার মনে হল এদের শেষ না করতে পারলে আমাদের মুক্তি নেই। তখন আমি খুব একটা খারাপ কাজ করলাম।

কি করলেন?

খুব নোংরা, খুব কুৎসিত একটা কাজ–বলতে গিয়েও আমি লজ্জায় মরে যাচ্ছি। আমি রান্নাঘরে ঢুকলাম। রান্নাঘরের চুলায় চায়ের পানি ফুটছিল। আমি সেই ফুটন্ত পানি এনে এদের গায়ে ঢেলে দিলাম। এত বড় অন্যায় যে আমি করতে পারি, তা কখনো কল্পনা করি নি। কিন্তু করেছি, নিজের হাতে ফুটন্ত পানি ঢেলে দিয়েছি।

তারপর?

পানি ঢালার পরই মনে হল আমি এ কী করলাম, আমি এ কী করলাম! তখন আমি নিজেই এদের নিয়ে হাসপাতালে ছুটে গেছি। হাসপাতালে নিয়ে যাবার পরপরই দুটা বিড়ালই মারা যায়।

আফসার সাহেব কোথায়? উনি ঘটনাটা কীভাবে নিয়েছেন?

আমার মনে হয় সহজভাবেই নিয়েছেন। বাসায় ফিরে আমি খুব কান্নাকাটি করছিলাম। উনি আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন। আমার মাথায় হাত বোলাতে-বোলাতে বলছিলেন-মানুষমোত্রই ভুল করে। তুমিও করেছ।

ঘটনাটা কবে ঘটেছে?

গতকাল।

মীরার চোখ দিয়ে ক্রমাগত পানি পড়ছে। তিনি নিজেকে সামলাতে পারছেন না। রুমী সুমী দরজার পর্দা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মুখ শুকিয়ে এতটুকু হয়ে আছে।

মিসির আলি বললেন, আফসার সাহেব কোথায়?

মীরা বললেন, ও গিয়েছে টেনের টিকিট কাটতে। সবাইকে নিয়ে সে ঢাকার বাইরে কোথাও বেড়াতে যেতে চায়।

সেটা ভালো হবে। যান, ঘুরে আসুন।

মিসির আলি উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর কাছে মনে হচ্ছে এই পরিবারটি এখন সামলে উঠতে পারবে। বড় ধরনের দুর্ঘটনা এখন এদের কাছাকাছি নিয়ে আসবে। তা ছাড়া যেহেতু বিড়াল দুটিও এখন নেই। এটাও একধরনের মুক্তি।

মিসির আলি বললেন, আমি আজ যাই। আপনারা বাইরে থেকে ঘুরে আসুন। তারপর একদিন এসে চা খেয়ে যাব।

মীরা চোখ মুছতে-মুছতে নিচু গলায় বললেন, আপনাকে একটা ব্যাপার বলতে চাচ্ছি-আমি যখন বিড়াল দুটাকে নিয়ে রিকশা করে হাসপাতালে যাচ্ছি, তখন হঠাৎ স্পষ্ট শুনলাম, মা-বিড়ালটা বলছে— আমি আপনার পায়ে পড়ছি, আপনি আমার বাচ্চাটাকে বাঁচান। এই বেচারা সুন্দর পৃথিবীর কিছুই দেখল না। আমি কথাগুলি স্পষ্ট শুনলাম-যেন বিড়ালটা আমার মাথার ভেতর ঢুকে আমাকে কথাগুলি বলল। এই রকম কেন শুনলাম বলুন তো?

মিসির আলি কখনো মিথ্যা বলেন না-আজ বললেন। কোমল গলায় বললেন- এটা আপনার কল্পনা। অপরাধবোধে কাতর হয়ে ছিলেন বলেই কল্পনায় শুনেছেন। বিড়াল কি আর কথা বলতে পারে?

মীরা বললেন, আমারও তাই ধারণা।

বলতে-বলতে মীরা আবার চোখ মুছলেন।

মিসির আলি বাসার দিকে ফিরে চলছেন। শীতের সন্ধ্যা। আকাশ লাল হয়ে আছে। আকাশের লাল আলোয় কী অপূর্বই না দেখাচ্ছে শহরটাকে! হাঁটতে— হাঁটতে তাঁর মনে ফুল—প্রকৃতি এত সুন্দর করে নিজেকে শুধু মানুষের জন্যেই সাজায় না, তার সমস্ত জীব-জগতের জন্যেই সাজায়। মানুষ মনে করে শুধু তার জন্যেই বুঝি সাজিয়েছে, পাখি মনে করে তার জন্যে। বারান্দায় বসে-থাকা মা- বিড়াল মনে করে তাদের জন্যে। সে হয়তো তার শিশুটিকে ডেকে বলে—মা, দেখ-দেখ কী সুন্দর! কী সুন্দর!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *