বিধুমাস্টার
বিধু মাস্টারের কথা আমি কখনো ভুলতে পারব না। তাঁর স্মৃতি হয়তো আজীবন আমায় বহন করে বেড়াতে হবে। মাত্র ক-টা মাস তিনি আমার কাছে এসেছিলেন, তারপর চলে গেলেন—শুধু এই ক্ষণিকের পরিচয় আজ অমর হয়ে রয়েছে।
বেশ মনে আছে, সে দিনটা ছিল রবিবার। আমি সকাল বেলা কৌমুদী খুলে ধাতুরূপ মুখস্থ করছি চোখ বন্ধ করে দুলে দুলে, এমন সময় বাইরে কে যেন ডাকলেন, হারাণবাবু আছেন? হারাণবাবু!
আমি জানলা দিয়ে মুখ বার করে প্রশ্ন করলুম, কাকে চাই?
—এখানে হারাণবাবু বলে কি কেউ থাকেন?
—থাকেন। তিনি আমার কাকা।
—তাঁকে একবার ডেকে দাও তো।
—কী দরকার?
—তাঁর কি একজন টিউটর চাই?
সত্যিই তো, মেজোকাকা আমাদের জন্য একজন টিউটর চাই বলে খবরের কাগজে একটা বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন। কথাটা আমি একেবারে ভুলেই গেছলুম। বললুম আপনি বুঝি সেই বিজ্ঞাপন দেখেই আসছেন?
—হ্যাঁ।
—তা ভেতরে এসে বসুন। আমি মেজোকাকাকে ডেকে দিচ্ছি।
ছিপছিপে, লম্বা, কালোপানা লোকটা অত্যন্ত দ্বিধায়, অতিসন্তর্পণে আমাদের বৈঠকখানায় প্রবেশ করলেন। আমি বললুম, বসুন আপনি।
তিনি ভয়ে ভয়ে যেন একবার আমার দিকে তাকিয়ে পাশের একখানা বেঞ্চে বসলেন। আনাড়ি লোকটাকে দেখে আমার মাস্টারের প্রতি সকল শ্রদ্ধা তিরোহিত হল। বললুম, ওই চেয়ারটায় বসুন না!
তিনি প্রথমে বললেন, থাক থাক। তারপর একখানা চেয়ারে গিয়ে বসলেন। আমি ফ্যানটা খুলে দিয়ে আস্তে আস্তে ওপরে চলে গেলুম মেজোকাকাকে ডেকে দিতে। মেজোকাকা উঠে এলেন, আমিও এলুম তাঁর পিছু পিছু, আর এল ঝন্টু, মিন্টু চাঁদু ও রেবা। মেজোকাকা বৈঠকখানায় ঢুকতেই তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে হাতজোড় করে তাঁকে নমস্কার করলেন। মেজোকাকা বললেন, আপনি তো আজ সকালের কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে আসছেন?
তিনি বললেন, হ্যাঁ।
মেজোকাকা আবার বলতে আরম্ভ করলেন, এই পাঁচটি ছেলে-মেয়েকে পড়াতে হবে। রাতে তিন ঘণ্টা। মাইনে তো লিখেই দিয়েছি—সাত টাকা। কামাই চলবে না।
তিনি বললেন, না কামাই করবই-বা কেন?
মেজোকাকা বললেন, তা আপনি থাকেন কোথায়?
—শ্রীনাথ দাস লেনে।
—আপনার নাম?
—শ্ৰীবিধুভূষণ চট্টোপাধ্যায়।
—কদ্দূর লেখাপড়া আছে?
—ম্যাট্রিক পাস। কথাটা শুনে মেজোকাকা ঠোঁট কামড়াতে লাগলেন, টেবিলের ওপর বারকয়েক ডান হাত দিয়ে আঘাত করলেন, তারপর বললেন, আপনি ফোর্থ ক্লাসের ছেলেকে পড়াতে পারবেন তো?
ফোর্থ ক্লাসে পড়ি কেবল আমি। এদের দলের মধ্যে বয়সে সবচেয়ে বড়ো। আমার বুক গর্বে ফুলে উঠল। আমি বিধু মাস্টারের মুখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলুম। তিনি বললেন, তা আর পারব না কেন?
মেজোকাকা বললেন, বেশ ভালো। সোমবার থেকে কাজে লাগবেন। সন্ধ্যা ছটার সময় ঠিকমতো আসবেন। তারপর আমাদের বললেন, ইনি তোদের নতুন মাস্টার, এনার কাছে মন দিয়ে পড়বি, বুঝলি?
তারপর সোমবার দিন তিনি এলেন ঠিক ছ-টার সময়ে। আমাদের সকলের নাম জিজ্ঞেস করলেন—আমাদের বইগুলো উলটে-পালটে দেখলেন—বেশিক্ষণ দেখলেন আমার ইংরেজি বইখানা। বললেন, বেশ শক্ত বই পড়ানো হয় তো!
তাঁর কথা শুনে আমার কী আনন্দই না-হল। আমি বললুম, আমাদের আবার ইংরেজি ফিজিকস, কেমিস্ট্রি পড়ানো হয়।
তিনি অবাক হয়ে গেলেন, বললেন, তাই নাকি?
আমি তাঁকে আমাদের সায়েন্স বইখানা এনে দেখালুম। তিনি বললেন, কী পড়া হয়েছে?
—প্রপারটিস অব এয়ার আর ব্যারোমিটার।
আমার কথাগুলো শুনে তিনি বেশ চমকে গেলেন, আর আমি খুব কৌতুক বোধ করলুম। তিনি তখন রেবাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম কী খুকি?
রেবা লজ্জায় মুখ নীচু করে রইল। নতুন লোক দেখলে ওর ওইরকম লজ্জা। আমি বললুম, বল না রে কী নাম?
তিনি তখন রেবার পশমের মতো কোমল চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। রেবাও অনেক কষ্টে বলল, লেবা।
ও ‘র’ উচ্চারণ করতে পারে না। তিনি বললেন, বাঃ বেশ নাম তো তোমার, খাসা নাম তো তোমার!
কিন্তু দিন যত বয়ে গেল রেবার লজ্জাও তত কমে যেতে লাগল আর বিধু মাস্টারও রেবাকে বেশি ভালোবাসতে লাগলেন। শুধু রেবাকেই না, তিনি আমাদের সবাইকে খুব ভালোবাসতেন। তিনি পড়াতে আসবার পর প্রায়ই একজন ফেরিওয়ালা সুর করে হেঁকে যেত, চাই অবাক জলপান, স্বাধীন ভাজা, ঘুগনিদানা!
মাস্টারমশাইও আমাদের প্রায় ওই কিনে খাওয়াতেন। নতুন মাইনে পেয়ে তিনি আমাদের সবাইকে বারো আনার কুলফি বরফ খাইয়েছিলেন। সবাই তাই মাস্টারকে খুব ভালোবাসত। তাঁকে আদৌ দেখতে পারতুম না কেবল আমি। কেন তা জানি না। তথাপি আমার অনিচ্ছায় তাঁর অধীনে থাকতে হত, কারণ মেজোকাকার হুকুম। মেজোকাকাকে আবার সবারচেয়ে ভয় করি, মায় বাবার চেয়েও। সুতরাং আমি খুঁজতে লাগলুম মাস্টারের ভুল-ত্রুটি, যাতে আমি তাঁর হাত থেকে রেহাই পাই। একদিন আমি জিজ্ঞেস করলুম, মাস্টারমশাই, পাহাড়ের হাইট মাপতে গেলে ব্যারোমিটার কী দরকার লাগে?
তিনি বললেন, দরকার লাগে নাকি? কে বলল?
–স্কুলের মাস্টার।
–তা হবে, কোথায় লেখা আছে বলো তো?
—সায়েন্সের বইতে।
—দেখি সায়েন্সের বই!
আমি তাঁর হাতে বইখানা তুলে দিয়ে বললুম, কিছুই বুঝতে পারিনি মাস্টারমশাই।
তিনি বইয়ের পাতা খুলতে খুলতে বললেন, বেশ, বুঝিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু আমায় বোঝানো দূরের কথা, তিনি নিজেই হয়তো সেই ইংরেজি অংশটার সঠিক অর্থ হৃদয়ঙ্গম করতে পারলেন না। অগত্যা অনেকক্ষণ পরে তর্জমা করে দিলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, বুঝতে পেরেছ?
আমি বললুম, কিছুই না। তিনি বললেন, আচ্ছা আমি তোমার বইখানা বাড়ি নিয়ে যাচ্ছি, একবার পড়ে ভালো করে বুঝিয়ে দেব।
বইখানা নিয়ে গেলেন সত্যি, সেটা আমায় ফিরিয়েও দিলেন যথাসময়ে; কিন্তু আমার প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারলেন না। কথাটা কাকাকে বলতে তিনি বললেন, আচ্ছা কেমন পড়ায় তা আমি দেখছি।
পরের দিন থেকে তিনি আমাদের কাছে বসে পড়া শুনতে লাগলেন। মাস্টারমশাইয়ের পড়ানোর তিনি প্রায়ই ভুল ধরতেন। হয়তো বলতেন, লুসি গ্রে’র শেষের স্ট্যাঞ্জা দুটো আরও বিশদভাবে বুঝিয়ে দিন। ওই যে ওর—
O’er rough and smooth trips along
And never looks behind;
And sings a solitary song
That whistles in the wind
ওর ভাবার্থটাও ভালো করে বুঝিয়ে দেওয়া উচিত, বুঝেছেন কিনা?
এসব ক্ষেত্রে মাস্টারমশাই কোনো কথা বলতেন না বড়ো-একটা। কাকাকে তিনি বেশ সমীহ করে চলতেন।
তিনি বড়ো একটা বুদ্ধির অঙ্ক কবতে পারতেন না। একদিন কাকার সামনে তিনি একটা অঙ্ক এক্স দিয়ে কষছিলেন। কাকা বললেন, সব গোলমাল হয়ে গেল মাস্টারমশাই!
তিনি বললেন, কেন?
কাকা বললেন, ও অঙ্ক তো অ্যালজেব্রার প্রসেস অনুযায়ী আপনি করতে পারবেন না!
যাই হোক, তিনি কিন্তু কোনো উপায়েই আমায় অঙ্কটা বুঝিয়ে দিতে পারলেন। তিনি চলে যাবার পর কাকা বললেন, মাস্টার তত সুবিধের নয়।
এমন সময়ে বিশ্বকর্মা পূজা এল। আমরা বললুম, মাস্টারমশাই, আমাদের ঘুড়ি লাটাই কিনে দিতে হবে।
তিনিও রাজি হলেন, কারণ তিনি সম্প্রতি মাইনে পেয়েছিলেন। তিনি আমাদের সেন্ট জেমস স্কোয়ারের দক্ষিণ কোণের একটা মনিহারি দোকান থেকে এক টাকার প্রায় ঘুড়ি-লাটাই কিনে দিলেন। কিন্তু আমাদের তিনি যা কিনে দিতেন সে সম্বন্ধে কাউকে কিছু বলা নিষেধ ছিল। এসব লুকিয়ে লুকিয়ে আমাদের দিতেন। রেবার জন্মদিনে তিনি তিন টাকা দামের একটা কলের রেলগাড়ি কিনে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, কাউকে বোলো না যেন ঘুণাক্ষরে।
বিশ্বকর্মা পূজার দিনচারেক পর একদিন শ্রীনাথ দাস লেনে মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে দেখা। আমি নমস্কার করলুম। তিনি বললেন, এই যে, পিন্টুযে! কোথায় চলেছ?
আমি বললুম, আপনি কোথায় থাকেন মাস্টারমশাই?
তিনি বললেন, এইখানেই।
—চলুন না দেখে আসি।
কী জানি কেন মাস্টারমশাইয়ের বাড়ি দেখবার জন্যে আমি অত্যন্ত উতলা হলুম। তিনি দ্বিধায় আমায় নিয়ে গেলেন তাঁর অপূর্ব গৃহে। টিনের চাল দেওয়া একখানা মেটে বাড়ির দোতলায় একখানা ছোট্ট ঘরে থাকেন। সরু ভাঙা সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে ভয় করে। ফালি বারান্দাটা মানুষের ভারে সামান্য কাঁপে। আস্তে আস্তে তাঁর পিছু পিছু তাঁর ঘরের দিকে গেলুম। তিনি গিয়ে তাঁর ঘরের তালা খুললেন। অপরিষ্কার ও অপরিসর ঘর। দেওয়ালে কতকগুলো ক্যালেন্ডার টাঙানো। একপাশে একখানা বিবেকানন্দের ছবি। মেঝের ওপর একটা খাটিয়া পাতা, তার ওপর আবার একটা কালো ও তেল চিটচিটে বালিশ। মাস্টারমশাই আমায় বসিয়ে ‘আসছি’ বলে কোথায় চলে গেলেন সহসা। আর আমি তাঁর ঘরঘানা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলুম। বড়ো দুঃখ হল তাঁর দারিদ্রক্লিষ্ট অবস্থা দেখে। ঘরের মধ্যে আর একখানা কাপড়ও নেই। যদিও-বা একখানা আছে, তাও শতছিন্ন এবং অত্যন্ত কালো। একটি জামা ও একখানিমাত্র কাপড়ে তাঁকে দিন কাটাতে হয়। আমার বড়ো অনুকম্পা জাগল তাঁর প্রতি। তাঁকে যে আমি এত ঘৃণা করতুম তা একেবারে বিস্মৃত হলুম। হঠাৎ যেন আমি একেবারে বদলে গেলুম।
এমন সময়ে মাস্টারমশাই একঠোঙা খাবার নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। আমি ব্যথিত সুরে বললুম, ওসব আবার কেন মাস্টারমশাই!
তিনি আমার কথা শুনে একটু যেন আশ্চর্যান্বিত হলেন। আমতা আমতা করতে লাগলেন, না-না, এ আর এমনকী!
আমি বুঝলুম যে তাঁর শ্রমের পারিশ্রমিকটা এমন করে অপচয় করা তাঁর শরীরের বিন্দু বিন্দু রক্ত গ্রহণ করার শামিল। আমি তীব্র প্রতিবাদ করলুম, না, এ কখনো হবে না।
আমার দৃঢ়প্রতিজ্ঞা দেখে তাঁর মুখের চিরপ্রফুল্ল হাসি অকস্মাৎ যেন মিলিয়ে গেল। তিনি মুখ চুন করে বললেন, এ কী বলছ পিন্টু?
আর সাহস হল না কিছু বলতে। যাই হোক, বাড়ি ফেরার পথে সেদিনই আমি প্রতিজ্ঞা করলুম যে মাস্টারমশাই যাতে আমাদের জন্যে তাঁর মাইনে থেকে কিছু খরচ না-করেন তার ব্যবস্থা করতে হবে। হাজার হোক বেচারা ওই ক-টি টাকা। সম্বল করে কলকাতায় বাস করছেন।
কিন্তু আমার প্রতিজ্ঞামতো কাজ করবার আগেই একটা বিশ্রী ঘটনা ঘটে গেল। মেজোকাকা একদিন আমার ট্রানস্লেশনের খাতাখানা দেখতে দেখতে মাস্টারমশাইকে বললেন, এসব কী পড়াচ্ছেন মাস্টারমশাই। ইংরেজি আপনি দেখছি কিছুই জানেন না! I live in a boarding সেনটেন্সটার মধ্যে in’ কী এমন অপরাধ করেছে যে ওকে তুলে আপনি at বসিয়ে দিলেন! আসলে ওর ভুল কোথায় তা তো দেখতে পেলেন না। আর Every bush and every tree was in bud সেনটেন্সটার ‘was’ কেটে ‘were’ করলেন কোনgrammar অনুযায়ী? আপনি ফোর্থ ক্লাসের ছেলে পড়াবেন কেমন করে?
মাস্টার লজ্জায় মুখ নীচু করে রইলেন। আর আমি? আমি ভাবতে লাগলুম ভারী বিপদের কথা। মেজোকাকা বললেন, তাই বলি ছেলেরা এত খারাপ হয়ে যাচ্ছে কেন! পিন্টু তোর হাফ-ইয়ারলির প্রোগ্রেস-রিপোর্টটা নিয়ে আয় তো!
আমি ভয়ে ভয়ে আমার প্রোগ্রেস-রিপোর্ট নিয়ে এলুম। মেজোকাকা বললেন, দেখুন কী বিশ্রী রেজাল্ট! ইংরেজিতে তো ফেল! আর সবে রগ ঘেঁষিয়ে পাস করেছে। এর পর আর আপনাকে রাখতে আমি সাহস করি না। তাহলে ওদের পায়ে কুড়ল মারা হয়। আমরা অন্য মাস্টার দেখব। আপনার বাকি মাইনেটা দু তারিখে নিয়ে যাবেন।
মেজোকাকার কথায় মাস্টারমশাই একটি প্রতিবাদ পর্যন্ত করলেন না, নীরবে নিঃশব্দ পদক্ষেপে প্রস্থান করলেন। আমি তাঁর মুখের দিকে তাকাতে পারলুম না। এর জন্যে দোষী তো আমি! আমি তো মাস্টারমশায়ের ভুলগুলো মেজোকাকাকে বলে বলে তাঁর মন একেবারে চটিয়ে রেখেছিলুম!
আমি অপরাধীর মতো বসে রইলুম মুখ নীচু করে।