বিদায় দে মা ঘুরে আসি – ২

রুমীর মতো দেশের আরো বহু তরুণ এবং বহু বয়স্ক রাজনীতিবিদও তাই মনে করতেন। কিন্তু মা তো আর সেটা জানতেন না, তিনি শিউরে উঠে বলেছিলেন, ‘বলিস কিরে? পাকিস্তান আর্মির আছে সবচেয়ে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র। তাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম করবি কী দিয়ে?’

‘কিছু নেই বলেই তো আরো ভয়। লাঠি ঘাড়ে মিছিল করে, শ্লোগান দিয়ে, রাস্তায় ব্যারিকেড বানিয়ে আমরা স্বায়ত্তশাসনও পাব না, জানেও বাঁচতে পারব না, এ তুমি দেখে নিয়ো।’ মা সেদিন রুমীকে বকেছিলেন, পানি ঢেলে মাথা ঠাণ্ডা করতে বলেছিলেন। আজ মা-ই মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকেন।

.

গোলাগুলির শব্দে চারদিক ফাটছে, জানালা দিয়ে তাকালেই দূরে-দূরে আগুনের স্তম্ভ দেখা যায়, ধোঁয়ার কুণ্ডলী আকাশ আড়াল করে ফেলেছে। ফোনের লাইন কাটা। অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ। কারফিউ না দিলেই বা বেরোয় কার সাধ্যি! সামরিক আইন জারি হয়েছে। শেখ মুজিব বন্দি। আওয়ামী লীগ বেআইনি ঘোষিত।

.

৩২ ঘণ্টা পর ২৭ মার্চ সকাল ৮টায় কারফিউ উঠল কয়েক ঘণ্টার জন্য। সঙ্গে সঙ্গে মা বেরিয়ে পড়লেন রুমীকে নিয়ে, বাবা গেলেন তাঁর সহকর্মীর সঙ্গে। কোথায় কী হয়েছে তাই দেখবার জন্য, আত্মীয়-বন্ধুদের খোঁজখবর নেবার জন্য। বাঙালির এত গর্বের শহীদ মিনার আর নেই, বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গোলার আঘাতে উড়িয়ে দিয়েছে। ইকবাল হল ঝাঁঝরা, রমনা রেসকোর্সের কোণের সেই কালীমন্দির মাটিতে মিশে গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যবাহী মধুর ক্যান্টিন পুড়ে ছাই, ছাত্রদের প্রিয় মধুদাও আর নেই। নেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক। গুলির আঘাতে সব শেষ। রাজারবাগ পুলিশলাইনে প্রচণ্ড যুদ্ধের পর বাঙালি পুলিশ বেশির ভাগ প্রাণ দিয়েছে, অল্প ক’জন পালাতে পেরেছে। পাক-আর্মি ইত্তেফাক অফিস পুড়িয়েছে, পুড়িয়েছে দ্য পিপ্‌ল্‌ অফিস। ঢাকায় যত বস্তি আছে—সব আগুনে পুড়ে ছাই। ছাই হয়েছে রায়ের বাজার, নয়া বাজার, ঠাটারি বাজার, শাঁখারি পট্টি। মানুষ যে কত মরেছে, তার হদিস পাওয়া দুষ্কর। এখনো বহু জায়গায় গুলিবিদ্ধ অথবা আগুনে-পোড়া লাশ পড়ে রয়েছে। বহু লোক হাসপাতালগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে। হাজার হাজার লোক রিকশা, স্কুটারে জিনিসপত্র বোঝাই ক’রে শহর ছেড়ে পালাচ্ছে। যারা রিকশা, স্কুটার পাচ্ছে না তারা কাঁধে-হাতে সুটকেস, পোঁটলা নিয়ে হেঁটেই পালাচ্ছে। কোথায় পালাচ্ছে তাও হয়তো জানে না শুধু জানে, এখানে থেকে পালাতে হবে।

ঘটনার অবিশ্বাস্য নিষ্ঠুরতার ঘোর কাটতে সবার বেশ কয়েকদিন সময় লাগে। প্রথম ৩২ ঘণ্টা একনাগাড়ে মেরে-ধরে-জ্বালিয়ে-পুলিয়ে তারপর মিলিটারি একটু ক্ষান্ত দিয়েছে। এখন স’য়ে মারবার ফন্দি আঁটছে। সবকিছু স্বাভাবিক দেখাবার চেষ্টা করছে। বাইরের পৃথিবীকে দেখাবার চেষ্টা করছে, কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদী দুষ্কৃতকারীকে শাস্তি দিয়ে সরকার পরিস্থিতি আয়ত্তে এনেছে। আল্লাহ পাকিস্তানকে রক্ষা করেছেন।

এখন প্রতিদিন খবর-কাগজে নির্দেশ বেরোচ্ছে, সবাই যেন নিজ নিজ কাজে যোগ দেয়। রেডিও-টিভিতে ঠিকমতো অনুষ্ঠান প্রচার করার হুকুম হয়েছে। যেখান থেকে পারো যেমন করে পারো, আর্টিস্টদের ধ’রে এনে প্রোগ্রাম চালাও। চাকরিজীবী প্রযোজক, পরিচালকরা প্রাণের ভয়ে তাই করছেন।

এখন মিলিটারি ঢাকার বাইরে ছড়িয়ে পড়ছে। ঢাকা থেকে পালানো মানুষ যেসব জায়গায় জড়ো হয়েছে, সেসব জায়গায় একের পর এক গোলাগুলি চালিয়ে, আগুন লাগিয়ে ছারখার করে দিচ্ছে— জিঞ্জিরা, বিক্রমপুরের সৈয়দপুর, কুমিল্লার শ্রীরামপুর। তারপর তারা ক্রমে ক্রমে বিভিন্ন জেলায় যাচ্ছে, যাবার পথে গ্রামকে গ্রাম জ্বালিয়ে, মেশিনগানে মানুষ মারতে মারতে যাচ্ছে।

২৫ মার্চের উন্মত্ত হত্যাকাণ্ডের দুদিন পর অনেকের কানে এসেছে স্বাধীন বাংলা বেতারের কথা। শেখ মুজিবের পক্ষ থেকে মেজর জিয়া নামে এক বাঙালি আর্মি-অফিসার বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। একে অন্যকে বলাবলি করতে করতে কথাটা এখন প্রতিঘরেই ছড়িয়ে গেছে। সবাই এখন স্বাধীন বাংলা বেতার শোনার জন্য সকাল-সন্ধ্যা রেডিও’র নব্ ঘুরিয়েই চলেছে।

.

তরুণেরা ইতিমধ্যেই অন্য চিন্তা করতে শুরু করেছে। তাদের সমগ্র আত্মা বর্বর পাকিস্তানি সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে ঘৃণায় রুখে উঠেছে। তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার কথাও শুনেছে। তারা এখন যুদ্ধ করতে চায়। যুদ্ধ ক’রে মাতৃভূমিকে ঐ নরপশুদের হাত থেকে উদ্ধার করবে।

কিন্তু কেমন ক’রে তারা যুদ্ধ করবে? কোথায় করবে যুদ্ধ? অস্ত্র কই, ট্রেনিং কই? কে তাদের অস্ত্র দেবে, ট্রেনিং দেবে? তারা এখন প্রত্যেকে নিজের নিজের বন্ধুর সঙ্গে, ঘরের দরজা বন্ধ ক’রে, চুপিচুপি আলোচনা করে—কী ক’রে যুদ্ধে যাওয়া যায়? কানাঘুষোয় শোনা যাচ্ছে, দেশের কোথাও-কোথাও সীমান্ত এলাকায় যুদ্ধ হচ্ছে। পুলিশ ও ইপিআরের যেসব লোক প্রাণে বেঁচে পালাতে পেরেছে, তারাই নাকি সীমান্ত এলাকায় যুদ্ধ করছে, আর লোকজনকে সংগঠিত করছে। ঢাকায় তরুণেরা এসব শুনছে, কিন্তু সেসব জায়গায় যাবার হদিস পাচ্ছে না। তারা ‘যুদ্ধ’ খুঁজছে, যুদ্ধে যাবার রাস্তা খুঁজছে। একে অন্যকে জিজ্ঞেস করছে ভয়ে ভয়ে, সাবধানে। খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু আর আপন ভাই, চাচা, মামা ছাড়া আর কাউকে জিজ্ঞেস করছে না। আর কাউকে বিশ্বাস করা যায় না। এলিফ্যান্ট রোডের রুমী যুদ্ধ খুঁজছে, ধানমণ্ডির বাদল যুদ্ধ খুঁজছে, দিলু রোডের আলম, মণিপুরী পাড়ার বদি, হাটখোলার শাহাদত আর ফতে, অভয়দাস লেনের অ্যাসফী, কৈলাস ঘোষ লেনের কাজী, টিকাটুলির মায়া—সবাই নিজের নিজের বৃত্তে খুঁজে মরছে যুদ্ধে যাবার পথ।

মা এতসবের বিন্দুবিসর্গও টের পাননি। কোনো বাড়ির মা-ই পাননি। ছেলেরা হল মায়েদের কজের ধন। ছেলেরা জানে মায়েদেরকে এসব কথা কখনই বলতে নেই। বললেই হুলস্থুল, কান্নাকাটি। মায়েরা কি প্রাণে ধরে ছেলেদের যুদ্ধে যেতে দিতে পারে?

.

তবু ছেলেরা যুদ্ধে যায়। বেশির ভাগই মাকে লুকিয়ে, বিছানায় পাশ-বালিশ শুইয়ে, রাতের আঁধারে পালিয়ে চলে যায়। মায়ের কান্নাকাটির ভয়ে ব’লে যেতে পারে না। কিন্তু মনে মনে বিদায় চেয়ে নেয় মায়ের কাছে থেকে : একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি।

.

এপ্রিলে রুমী মাকে বলে, ‘জানো আম্মা, সীমান্ত এলাকাগুলোতে যুদ্ধ হচ্ছে।’

মা চমকে যান, বিশ্বাস করেন না। রুমী জোর দিয়ে বলে, ‘হচ্ছে। বহু জায়গায় বাঙালি-আর্মি বিদ্রোহ করেছে। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে ইপিআর, ইবিআর, পুলিশ, আনসারের লোকেরা। ঢাকা থেকে বহু ছেলে লুকিয়ে সীমান্তের দিকে চলে যাচ্ছে যুদ্ধ করবে বলে। পাক-আর্মি যেসব গ্রাম, থানা, মহকুমা জ্বালিয়ে দিয়েছে, সেখানকার লোকেরাও সীমান্তের দিকে পালিয়ে যাচ্ছে, যুদ্ধ করছে। আম্মা, আমি যুদ্ধে যেতে চাই।’

মা স্তব্ধ হয়ে যান। ভয়ে তাঁর বুক হিম। রুমী যুদ্ধে যেতে চায়! কী সর্বনেশে কথা! মাত্র বিশ বছর বয়স রুমীর, কেবল আই.এস.সি. পাস করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকেছে। এখন তো ওর পড়াশোনা করার কথা। যুদ্ধের ও কী বোঝে?

কিন্তু রুমী নাছোড়বান্দা। তার অনেক বন্ধু বাবা-মাকে না বলে লুকিয়ে যুদ্ধে চলে গেছে, কিন্তু রুমী সে-রকমভাবে যেতে চায় না। ছোটবেলা থেকে বাবা-মা তাকে শিখিয়েছেন—লুকিয়ে কিছু করবে না। যা মনেপ্রাণে করতে চাও, তা সামনাসামনি বলে করার মতো সাহস যেন তোমার থাকে। তাই রুমী শেষ পর্যন্ত মায়ের মত আদায় করেই ছাড়ে।

মা মত দেন বটে, কিন্তু তাঁর মনে হয়, তাঁর কজে ছিঁড়ে যাচ্ছে। কেউ যেন লোহার সাঁড়াশি দিয়ে তাঁর পাঁজর চেপে ধরেছে, তিনি নিশ্বাস নিতে পারছেন না।

.

রুমী চলে যায় মুক্তিযুদ্ধে। তার অনেক বন্ধুবান্ধব, চেনাজানা ছেলে আগেই গিয়েছে। আগরতলার দিকে সীমান্ত ঢাকা থেকে সবচেয়ে কাছে বলে ঢাকার প্রায় সব ছেলে এই রাস্তা দিয়েই সীমান্ত পার হয়। রুমীও তাই গিয়েছে। কিন্তু মা তো জানেন না, সে কোন্ পথ দিয়ে কেমন করে গিয়েছে, কোথায় গিয়েছে, কোথায় যুদ্ধ করছে। মা তাঁর নিজের কষ্ট ভোলার জন্যে বাড়িতে কাজের পাহাড় জমিয়ে তোলেন। বেশি কাজের মধ্যে থাকলে দুঃখ কম লাগবে! মা মোয়া বানান, আচার বানান, বাগানে নিজের হাতে কাজ করেন, কাজের লোক থাকা সত্ত্বেও একগাদা কাপড় কাচতে বসেন। আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে যান, তাদের খবরাখবর নেন।

এদিকে ঢাকায় ফুটফাট ছোটখাটো গেরিলা তৎপরতা শুরু হয়ে গেছে।

.

বিশ্বব্যাঙ্ক ও জাতিসংঘের ধারণা হয়েছে, পূর্ব পাকিস্তানে ইয়াহিয়া সরকার যা করছে, তাকে কোনোমতেই কিছুসংখ্যক বিচ্ছিন্নতাবাদী দেশদ্রোহীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া বলা চলে না। অতএব পাকিস্তানকে এ-বছর ব্যাঙ্ক থেকে সাহায্য-ঋণ দেওয়া যাবে কি না, সে বিষয়ে সরেজমিনে তদন্ত করতে ঢাকায় এসেছেন বিশ্বব্যাঙ্কের কয়েকজন প্রতিনিধি। আর জাতিসংঘের উদ্বাস্তু-বিষয়ক হাইকমিশনার প্রিন্স সদরুদ্দিন এসেছেন পূর্ব পাকিস্তানের আরো রিলিফ দেওয়া ও তার বণ্টন ব্যবস্থা সম্বন্ধে আলাপ করতে। দেশে যে স্বাভাবিক অবস্থা নেই, দেশ যে এখন স্বাধীনতার যুদ্ধে জড়িত, তা ওঁদের বুঝিয়ে দেবার জন্য একদল গেরিলা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের গাড়ি-বারান্দায় রাখা গাড়ির ওপর তিনটে গ্রেনেড ছুড়ে দিয়ে গেল ১২ জুন।

জিন্না এভিনিউতে গ্যানিজ আর ভোগ্‌ বলে দুটো দোকানে কিছু মিলিটারি-পুলিশ কেনাকাটা করছিল। গেরিলারা সেখানে গ্রেনেড ছুড়ে কয়েকজনকে মেরে দিয়ে চোখের পলকে উধাও হয়ে গেল। বিভিন্ন গেরিলা-দল ঢাকায় আসছে, আলাদাভাবে নির্দেশমাফিক ‘অ্যাকশান’ করে আবার চলে যাচ্ছে। একদল ইচ্ছে করেই আরেক দলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করে না, তবুও দেখা-সাক্ষাৎ হয়েই যায়, বন্ধুবান্ধব সব দলেই আছে। আর ঢাকা এত ছোট জায়গা।

জুলাইয়ের ১৯ তারিখে সন্ধ্যার পর আরো বড় ধরনের গেরিলা ‘অ্যাকশান’ হল ঢাকায়। একই সময়ে রামপুরার উলান, খিলগাঁওয়ের গুলবাগ আর শাহবাগের ধানমণ্ডি পাওয়ার সাবস্টেশনে হামলা হল গেরিলাদের। বিদ্যুৎ চলে গিয়ে সারা শহর অন্ধকারে ডুবে গেল। মুদির দোকানে ভিড় জমে উঠল মোমবাতি কেনার জন্য।

মা এসব গেরিলা তৎপরতার খবর শোনেন আর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ভাবেন— এত ছেলে আসে ঢাকায়, তাঁর রুমী কি আসতে পারে না একবার? কোনো একটা অ্যাকশানে! অ্যাকশান শেষে, পাঁচমিনিটের জন্যে হলেও তাঁর সঙ্গে দেখা করে যাবে? আহা, কতদিন দেখেননি ওই মুখ!

রুমীর বন্ধু মনু এসেছিল দেখা করতে, সে মাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, ‘আসবে খালাম্মা, আসবে। ওর ট্রেনিং হয়তো এখনো শেষ হয়নি। ও তো দেরিতে গেছে।’

তা বটে। রুমীর যাওয়াতে তিনিই তো বাদ সেধেছিলেন প্রথমদিকে। মা এখন মুক্তিযোদ্ধা ছেলে পেলেই তাদের হাত দিয়ে টাকা পাঠান। মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করার জন্যে অনেকেই টাকা দিতে চান। কিন্তু কোথায়, কাদের হাত দিয়ে পাঠাবেন, ভেবে পান না। আবার ভয়ও আছে। পাকিস্তানি কেউ, বা রাজাকার, বিহারিদের কেউ জেনে গেলে মহাবিপদ। রুমীর বাবা শরীফের বন্ধু ও সহকর্মী মজিদ সাহেব দশহাজার টাকা মুক্তিযুদ্ধের জন্য খরচ করবেন, স্থির করেছেন। তিনি শরীফকেই ভার দিয়েছেন এই টাকা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দিতে।

.

দেখতে দেখতে আগস্ট মাস এসে গেল। মায়ের মনের ভার যায় না কিছুতেই। আবার অন্য একধরনের স্বস্তিও আছে। ঢাকায় গেরিলা তৎপরতা ক্রমাগত বাড়ছে। রোজই হঠাৎ হঠাৎ গ্রেনেড ফাটার পিলে চমকানো শব্দ শোনা যায। বোঝা যায়, গেরিলা-বিচ্ছুগুলো কোথাও হামলা করেছে। ঐ শব্দ শুনলে সবাই খুশি হয়, ঐ শব্দ শুনলে রাত্রে ভালো ঘুম হয়। কোনোদিন ঐ শব্দ না-শুনলেই বরং মনে আতঙ্ক জাগে, তবে কী ….

না, ওরা ধরা পড়েনি। দুপুরে বা সন্ধ্যায় যদি-বা কোনো কারণে বাদ যায়, তো মাঝরাতে হঠাৎ বু— করে বিরাট এক শব্দ চারদিক কাঁপিয়ে ঢাকাবাসীর উদ্বিগ্ন স্নায়ুতে আরামের স্নিগ্ধপ্রবাহ বইয়ে দেয়। ঢাকায় বিচ্ছুদের কাজ-কারবার ক্রমেই দুঃসাহসিক হয়ে উঠছে। এইতো, ৩ আগস্ট সন্ধ্যার আগ দিয়ে স্টেটব্যাঙ্কের গেটে, মিলিটারি-পুলিশের নাকের ডগায় পথচারীদের চোখের সামনে কয়েকজন বিচ্ছু বোমা ছুড়ে দিয়ে পালিয়ে গেছে। একটাকেও ধরতে পারেনি মিলিটারিরা। ছেলেগুলোর জানের ভয় বলে কিছু নেই। গ্রেনেডের মতোই জানটাকেও হাতের মুঠোয় নিয়ে চলে ওরা। স্বাধীন বাংলা বেতারে মা শোনেন যুদ্ধক্ষেত্রে যারা যুদ্ধ করছে, তারাও এমনি অসম সাহসী। ‘মরলে শহীদ, বাঁচলে গাজী’— জানের কোনো পরোয়া নেই, জীবনমৃত্যু সত্যি সত্যিই পায়ের ভৃত্য।

.

স্বাধীনবাংলা বেতারে গান হচ্ছে :

তীরহারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেব রে।
আমরা ক’জন নবীন মাঝি হাল ধরেছি শক্ত করে রে।
ঘর-বাড়ির ঠিকানা নাই
দিন রাত্রি জানা নাই
চলার ঠিকানা সঠিক নাই।
জানি শুধু চলতে হবে
এ তরী বাইতে হবে
আমি যে সাগর মাঝিরে।

ঘরবাড়ির ঠিকানাবিহীন, দিন-রাত্রির বোধবিহীন, অথই সাগরে দিক-চিহ্নহীন জানবাজ ঐ নবীন মাঝিদের কথা মনে করে মা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদেন।

.

অবশেষে রুমী ঢাকায় এল ৮ আগস্ট সন্ধ্যাবেলা। এই দুই মাসেই তার চেহারা যেন বদলে গেছে। ঘাড় পর্যন্ত লম্বা চুল। কানের পাশে লম্বা জুলপি, মুখভর্তি ঘন দাড়ি, তামাটে গায়ের রঙ রোদে পুড়ে কালচে, দুইচোখে উজ্জ্বল ঝকমকে দৃষ্টি, গোঁফের জঙ্গল ভেদ করে ফুটে রয়েছে সেই ভুবন-ভোলানো হাসি। রুমীকে জড়িয়ে ধরে মা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদেন। বাবা আর ছোটভাই জামী ছলোছলো চোখে পাশে দাঁড়িয়ে রুমীর দিকেই তাকিয়ে থাকেন একদৃষ্টিতে।

মা জানতে চান রুমী কোথায় ছিল, কেন ছিল, কী খেত, কী করত। রুমী ছিল মেলাঘরে। মেলাঘর হল দুই নম্বর সেক্টরের হেডকোয়ার্টার্স। আগরতলা থেকে বেশ অনেকটা ভেতরে, না শহর, না গ্রাম— এক পাহাড়ি জঙ্গুলে জায়গা। টিলার ওপর বেড়ার ঘরে, তাঁবুতে সবাই থাকে। সেক্টর টু-র কম্যান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ। তিনি ২৫ মার্চের ক্র্যাকডাউনের সঙ্গে সঙ্গে বিদ্রোহ করে তাঁর সঙ্গের সৈন্য-সামন্ত নিয়ে সিলেটের তেলিয়াপাড়ায় চলে যান। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে মেজর শাফায়াত জামিল ও তাঁর সঙ্গী অফিসার ও সৈন্য নিয়ে বিদ্রোহ করে তেলিনাপাড়া চলে যান। সেখানে সেকেন্ড ও ফোর্থ বেঙ্গলের বহু বাঙালি মিলিটারি অফিসার পালিয়ে গিয়ে জড়ো হন।

রুমী যখন যায়, জুন মাসের মাঝামাঝি, ততদিনে সীমান্তের সেক্টরগুলো মোটামুটি সংগঠিত হয়ে উঠেছে। মেজর খালেদ মোশাররফ তেলিয়াপাড়া থেকে সরে প্রথমে সীমান্তঘেঁষা শ্রীমন্তপুরে ক্যাম্প করেছিলেন। পরে সীমান্তে পাকিস্তানি সৈন্যদের হামলা বাড়ছে দেখে, তিনি তাঁর হেডকোয়ার্টার্স একটু দূরে ভেতরে মেলাঘরে নিয়ে যান।

রুমী মেলাঘরে গিয়ে দেখে ঢাকার যত কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেরা, ধানমণ্ডি-গুলশানের বড়লোক বাপের গাড়ি-হাঁকানো ছেলেরা, খেলার মাঠের চৌকস ছেলেরা, ছাপোষা চাকুরে বাপের ছেলেরা— সবাই ওখানে জড়ো হয়েছে। সবাই যুদ্ধ করার জন্য গেছে। ওখানে গিয়ে রুমী তার আগের চেনা অনেক ছেলেকে দেখে— বাদল, আলম, স্বপন, বদি। ওখানে ক্যাপ্টেন হায়দার বলে একজন বাঙালি আমি অফিসার ছেলেদেরকে গেরিলা ট্রেনিং দেন। দেশের চারদিকের সীমান্ত ঘিরে যুদ্ধ চলছে, সীমান্তের ঠিক ওপাশেই ভারতের মাটিতে মুক্তিবাহিনীর সেক্টরগুলোর হেডকোয়ার্টার্স। বাংলাদেশ আর্মির পাশাপাশি রুমীরা আছে গেরিলা বাহিনীতে।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *