দ্বিতীয় অঙ্ক
প্রথম দৃশ্য
বিজয়ার বসিবার ঘর
[বিজয়া বাহিরে কাহার প্রতি যেন একদৃষ্টে চাহিয়াছিল—পরে উঠিয়া জানালার কাছে গিয়া তাহাকে ইঙ্গিতে আহ্বান করিতে একটি বালক প্রবেশ করিল—-খালি গা, কোঁচড়ে মুড়ি তখনও চিবানো শেষ হয় নাই]
পরেশ। ডাকছিলে কেন মা-ঠাকরুন?
বিজয়া। কি করছিলি রে?
পরেশ। মুড়ি খাচ্ছিনু।
বিজয়া। এ কাপড়খানা তোকে কে কিনে দিলে পরেশ? নতুন দেখছি যে!
পরেশ। হুঁ নতুন। মা কিনে দিয়েছে।
বিজয়া। এই কাপড় কিনে দিয়েছে! ছি ছি, কি বিশ্রী পাড় রে! (নিজের শাড়ীর চওড়া সুন্দর পাড়খানি দেখাইয়া) এমনধারা পাড় নইলে কি তোকে মানায়?
পরেশ। (ঘাড় নাড়িয়া সায় দিয়া) মা কিচ্ছু কিনতে জানে না। তোমাকে কে কিনে দিলে?
বিজয়া। আমি আপনি কিনেছি।
পরেশ। আপনি? দামটা কত পড়ল শুনি?
বিজয়া। তোর তাতে কি রে? কিন্তু দ্যাখ আমি তোকে এমনি একখানা কাপড় কিনে দিই যদি তুই—
পরেশ। কখন কিনে দেবে?
বিজয়া। কিনে দিই যদি তুই একটা কথা শুনিস। কিন্তু তোর মা কি আর কেউ যেন না জানতে পারে।
পরেশ। মা জানবে ক্যাম্নে? তুমি বলো না—আমি এক্ষুনি শুনব।
বিজয়া। তুই দিঘ্ড়া চিনিস?
পরেশ। ওই ত হোথা। গুটিপোকা খুঁজতে কতদিন ত দিঘ্ড়ে যাই।
বিজয়া। ওখানে সবচেয়ে কাদের বড়ো বাড়ি তুই জানিস?
পরেশ। হিঁ—বামুনদের গো! সেই যে আর বছর রস খেয়ে যে ছাত থেকে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তেনাদের। এই যেন হেথায় গোবিন্দর মুড়ি-বাতাসার দোকান, আর ওই হোথা তেনাদের কোটা। গোবিন্দ কি বলে জানো মা-ঠাকরুন! বলে সব মাগ্যি-গোণ্ডা—আধ-পয়সায় আর আড়াই গোণ্ডা বাতাসা মিলবে না, এখন মোটে দু’ গোণ্ডা! কিন্তু তুমি যদি একসঙ্গে গোটা পয়সার আনতে দাও ত আমি পাঁচ গোণ্ডা আনতে পারি।
বিজয়া। তুই দু’পয়সার বাতাসা কিনে আনতে পারিস?
পরেশ। হিঁ, এ হাতে এক পয়সার পাঁচ গোণ্ডা গুণে নিয়ে বলব—দোকানী, এ হাতে আরো পাঁচ গোণ্ডা গুণে দাও। দিলে বলব—মা-ঠান বলে দে’ছে দুটো ফাউ দিতে—না? তবে পয়সা দুটো দেব—না?
বিজয়া। (হাসিয়া) হাঁ, তবে পয়সা দুটো হাতে দিবি। আর অমনি দোকানীকে জিজ্ঞেস করবি—ওই যে বড়ো বাড়িতে নরেনবাবু থাকত—সে কোথায় গেছে? কি রে পারবি ত?
পরেশ। (মাথা নাড়িয়া) আচ্ছা পয়সা দুটো দাও না তুমি—আমি ছুট্টে গিয়ে নিয়ে আসি।
বিজয়া। (তাহার হাতে পয়সা দিয়া) বাতাসা হাতে পেয়ে ভুলে যাবিনে ত?
পরেশ। নাঃ—(বলিয়াই দৌড় দিল। বিজয়া ফিরিয়া আসিয়া একটা চৌকিতে বসিতেই পরেশের মা প্রবেশ করিল)
পরেশের মা। পরেশকে বুঝি কোথাও পাঠালে দিদিমণি? ঊর্ধ্বমুখে ছুটেছে। ডাকলুম সাড়া দিলে না।
বিজয়া। (হাসিয়া) ও—পরেশ ছুটেছে বুঝি? তবে নিশ্চয় দিঘ্ড়ায় বাতাসা কিনতে দৌড়েছে। হঠাৎ আমার কাছে দুটো পয়সা পেলে কিনা।
পরেশের মা। কিন্তু বাতাসা ত কাছেই মেলে—সেখানে কেন?
বিজয়া। কি জানি সেখানে কে এক গোবিন্দ দোকানী আছে সে নাকি একটু বেশি দেয়।
পরেশের মা। বইগুলো যে গুছিয়ে তোলবার কথা ছিল—তুলবে না?
বিজয়া। এখন থাক গে পরেশের মা!
পরেশের মা। একটা কথা তোমায় বলতে চাই দিদিমণি, ভয়ে বলতে পারিনি।
বিজয়া। কেন তোমার ভয়টা কিসের? কি কথা?
পরেশের মা। কালীপদ বলছিল সে ত আর টিকতে পারে না। ছোটবাবু তাকে দু’চক্ষে দেখতে পারেন না। যখন তখন ধমকানি। ও ছিল কর্তাবাবুর খানসামা—অভ্যেস ছিল কলকাতায় থাকার। কাল নাকি ছোটবাবু তাকে হুকুম দিয়েছেন তার এখানে কাজ কম, উড়ে মালীর সঙ্গে বাগানে খাটতে হবে, নইলে জবাব দেওয়া হবে। বয়েস হয়েছে পারবে কেন বাগানে গিয়ে কোদাল পাড়তে দিদি?
বিজয়া। (দৃঢ়কণ্ঠে) না, তাকে কোদাল পাড়তে হবে না। ছোটবাবুকে আমি বলে দেবো।
পরেশের মা। আমাদের যদু ঘোষ গোমস্তা-মশাই বলছিল যে—
বিজয়া। এখন থাক পরেশের মা। আমার একখানি দরকারী চিঠি লেখবার আছে, পরে শুনব। এখন তুমি যাও।
পরেশের মা। আচ্ছা যাচ্ছি দিদিমণি।
[পরেশের মা চলিয়া গেলে বিজয়া জানালার কাছে গিয়া বাহিরে উঁকি মারিয়া দেখিল কিন্তু পরক্ষণেই ফিরিয়া আসিয়া একটা চিঠির কাগজ টানিয়া লইয়া লিখিতে বসিল। কালীপদ দ্বারের কাছে মুখ বাড়াইয়া ডাকিল—]
কালীপদ। মা!
বিজয়া। (মুখ তুলিয়া) পরেশের মাকে ত বলতে বলে দিয়েছি কালীপদ, বাগানে গিয়ে তোমাকে কাজ করতে হবে না।
কালী। কিন্তু ছোটবাবু—
বিজয়া। সে তাঁকে আমি বলে দেব, তোমার ভয় নেই। আচ্ছা যাও এখন।
কালী। যে কাপড়গুলো রোদে দেওয়া হয়েছে সে যে—
বিজয়া। এখন থাক কালীপদ। এই দরকারী চিঠিটা শেষ না করে আমি উঠতে পারব না।
[কালীপদ প্রস্থান করিলে বিজয়া উঠিয়া আর একবার জানালাটা ঘুরিয়া আসিয়া বসিল। চিঠির কাগজটা ঠেলিয়া দিয়া খবরের কাগজ টানিয়া লইল। ভাবে বোধ হয় অতিশয় চঞ্চল, কিছুতেই মন দিতে পারে না।]
যদু। (নেপথ্য হইতে ডাকিল) মা!
বিজয়া। কে?
যদু। (দরজার নিকট হইতে) আমি যদু। একবার আসতে পারি কি?
বিজয়া। না যদুবাবু, এখন আমার সময় নেই। আপনি আর কোন সময়ে আসবেন।
যদু। আচ্ছা মা!
[প্রস্থান]
[বিজয়া কাগজ পড়িতেছিল। অন্য ধার দিয়া অত্যন্ত সন্তর্পণে পরেশ প্রবেশ করিল। বিজয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া অত্যন্ত ব্যগ্রকণ্ঠে প্রশ্ন করিল]
বিজয়া। দোকানী কি বললে পরেশ?
পরেশ। (বস্ত্রাঞ্চলে লুকানো বাতাসার প্রতি ইঙ্গিত করিয়া।) বাতাসা ত? পয়সার ছ’গণ্ডা করে।
বিজয়া। আরে না, না,—সে নরেনবাবুর কথা কি বললে বল না?
পরেশ। (মাথা নাড়িয়া) জানিনে। দোকানী পয়সায় ছ’গণ্ডার কথা কাউকে বলতে মানা করে দেছে। বলে কি জান মা-ঠাকরুন—
বিজয়া। তুই নরেনবাবুর কথা কি জেনে এলি তাই বল না?
পরেশ। সে হোথা নেই—কোথায় চলে গেছে। গোবিন্দ বলে কি জানো মা-ঠান? বলে বারো গণ্ডার—
বিজয়া। (রুক্ষস্বরে) নিয়ে যা তোর বারো গণ্ডা বাতাসা আমার সুমুখ থেকে।
[বিজয়া জানালার কাছে সরিয়া গিয়া দাঁড়াইল]
পরেশ। (ঠোঙা দুইটা হাতে করিয়া) এর বেশি যে দেয় না মা-ঠান!
বিজয়া। (একটু পরে মুখ ফিরাইয়া কহিল) পরেশ ওগুলো তুই খেগে যা।
[বলিয়া পুনরায় জানালার বাহিরে চাহিয়া রহিল]
পরেশ। (সভয়ে) সব খাবো?
বিজয়া। (মুখ না ফিরাইয়া) হাঁ, সব খেগে যা। ওতে আমার কাজ নেই।
পরেশ। এর বেশি দিলে না যে মা-ঠান! কত তারে বলনু।
বিজয়া। না দিক গে। আমি রাগ করিনি পরেশ, বাতাসা তুই নিয়ে যা—খেগে।
পরেশ। সব একলা খাব? (একটু চুপ করিয়া) কানা ভট্চায্যিমশায়ের কাছে গিয়ে জেনে আসব মা-ঠান?
বিজয়া। কে কানা ভট্চায্যিমশাই রে? কি জেনে আসবি?
পরেশ। জেনে আসব কোথায় গেছে নরেনবাবু?
[মুখ ফিরাইতেই দেখিল নরেন ঘরে প্রবেশ করিতেছে, তাহার হাতে একটি চামড়ার বাক্স। নীচে সেটা রাখিয়া দিয়া হাত তুলিয়া বিজয়াকে নমস্কার করিল]
বিজয়া। (লজ্জিত হইয়া) যা যা আর জিজ্ঞাসা করবার দরকার নেই। তুই যা!
পরেশ। (ক্ষুণ্ণস্বরে) কানা ভট্চায্যিমশাই তেনাদের পাশের বাড়িতেই থাকে কিনা। গোবিন্দ দোকানী বললে, নরেন্দরবাবুর খবর তিনিই জানে।
বিজয়া।(শুষ্ক হাসিয়া) আসুন বসুন। (পরেশের প্রতি) তুই এখন যা না পরেশ। ভারী তো কথা—তার আবার—সে আরেকদিন তখন জেনে আসিস না হয়। এখন যা—
[পরেশ কিছু না বুঝিয়া চলিয়া গেল]
নরেন। আপনি নরেনবাবুর খবর জানতে চান? তিনি কোথায় আছেন এই?
বিজয়া। (একটু ইতস্ততঃ করিয়া) হাঁ, তা সে একদিন জানলেই হবে।
নরেন। কেন? কোন দরকার আছে?
বিজয়া। দরকার ছাড়া কি কেউ কারো খবর রাখতে চায় না?
নরেন। কেউ কি করে না করে সে ছেড়ে দিন। কিন্তু আপনার সঙ্গে ত তার সমস্ত সম্বন্ধ চুকে গেছে। আবার কেন তার সন্ধান নিচ্ছেন? ঋণ কি এখনো সব শোধ হয়নি? (বিজয়া নীরব রহিল) যদি আরও কিছু দেনা বার হয়ে থাকে, তা হলেও আমি যতদূর জানি, তার এমন কিছু আর নেই যা থেকে সেই বাকী টাকা শোধ হতে পারে। এখন আর তার খোঁজ করা বৃথা।
বিজয়া। কে আপনাকে বললে, আমি দেনার জন্যেই তাঁর সন্ধান করছি?
নরেন। তা ছাড়া আর যে কি হতে পারে, আমি ত ভাবতে পারিনে। তিনিও আপনাকে চেনেন না, আপনিও তাঁকে চেনেন না।
বিজয়া। তিনিও আমাকে চেনেন, আমিও তাঁকে চিনি!
নরেন। তিনি আপনাকে চেনেন এ কথা সত্যি, কিন্তু আপনি তাঁকে চেনেন না।
বিজয়া। কে বললে আমি তাঁকে চিনি না?
নরেন। আমি জানি। ধরুন, আমিই যদি বলি আমার নাম নরেন, তাতেও ত আপনি না বলতে পারবেন না।
বিজয়া। না বলতে সত্যিই পারব না, এবং আপনাকেও বলব এই সত্যি কথাটা আপনারও অনেক পূর্বেই আমাকে বলা উচিত ছিল। (নরেন মলিন মুখে নীরব হইয়া রহিল) অন্য পরিচয়ে নিজের আলোচনা শোনা, আর লুকিয়ে আড়ি পেতে শোনা, দুটোই কি আপনার সমান বলে মনে হয় না নরেনবাবু? আমার ত হয়। তবে কিনা আমরা ব্রাহ্ম-সমাজের, আর আপনারা হিন্দু এই যা প্রভেদ।
নরেন। (একটুখানি মৌন থাকিয়া) আপনার সঙ্গে অনেক রকম আলোচনার মধ্যে নিজের আলোচনাও ছিল বটে, কিন্তু তাতে মন্দ অভিপ্রায় কিছুই ছিল না। শেষ দিনটায় পরিচয় দেব মনেও করেছিলাম, কিন্তু কি জানি, কেন হয়ে উঠল না। কিন্তু এতে ত আপনার কোন ক্ষতি হয়নি!
বিজয়া। ক্ষতি একজনের ত কত রকমেই হতে পারে নরেনবাবু। আর যদি হয়ে থাকে সে হয়েই গেছে। আপনি এখন আর তার উপায় করতে পারবেন না। সে থাক, কিন্তু এখন যদি সত্যিই আপনার নিজের সম্বন্ধে কোন কথা জানতে চাই তা হলে কি—
নরেন। রাগ করব? না—না—না।
[প্রশান্ত নির্মলহাস্যে তাহার মুখ উজ্জ্বল হইয়া উঠিল]
বিজয়া। আপনি এখন আছেন কোথায়?
নরেন। গ্রামান্তরে আমার দূর-সম্পর্কের এক পিসী এখনো বেঁচে আছেন, তাঁর বাড়িতেই গিয়েছি।
বিজয়া। কিন্তু আপনার সম্বন্ধে যে সামাজিক গোলযোগ আছে তা কি সে গ্রামের লোকেরা জানে না?
নরেন। জানে বৈ কি!
বিজয়া। তবে?
নরেন। (একটুখানি ভাবিয়া) তাঁদের যে ঘরটায় আছি সেটাকে ঠিক বাড়ির মধ্যে বলাও যায় না। আর আমার অবস্থা শুনেও বোধ করি সামান্য কিছুদিনের জন্যে তাঁর ছেলেরা আপত্তি করেনি। তবে বেশীদিন বাড়িতে থেকে তাঁদের বিব্রত করা চলবে না সে ঠিক। (একটু চুপ করিয়া) আচ্ছা সত্যি কথা বলুন ত, কেন এ-সব খোঁজ নিচ্ছিলেন? বাবার কি আরও কিছু দেনা বেরিয়েছে? (বিজয়া চেষ্টা করিয়াও কোন কথা কহিতে পারিল না) পিতৃঋণ কে না শোধ করতে চায়? কিন্তু সত্যি বলছি আপনাকে স্বনামে বেনামে এমন কিছু আমার নেই যা বেচে টাকা দিতে পারি। শুধু এই microscope-টা আছে। এটা কলকাতায় নিয়ে যাচ্ছি, যদি কোথাও বেচে অন্যত্র যাবার খরচ যোগাড় করতে পারি। পিসীমার অবস্থাও খুব খারাপ। এমন কি খাওয়া-দাওয়া পর্যন্ত—(বিজয়া মুখ ফিরাইয়া আর একদিকে চাহিয়া রহিল) তবে যদি দয়া করে কিছু সময় দেন, তাহলে বাবার দেনা যতই হোক—আমি নিজের নামে লিখে দিয়ে যেতে পারি। ভবিষ্যতে শোধ দিতে প্রাণপণ চেষ্টা করব। আপনি রাসবিহারীবাবুকে একটু বললেই তিনি এ বিষয়ে এখন আর আমাকে পীড়াপীড়ি করবেন না।
বিজয়া। বেলা প্রায় তিনটা বাজে, আপনার খাওয়া হয়েছে?
নরেন। হাঁ, হয়েছে একরকম। কলকাতা যাব বলেই বেরিয়েছি কিনা; পথে ভাবলুম একবার দেখা করে যাই। তাই হঠাৎ এসে পড়লুম।
বিজয়া। কিন্তু, আপনার মুখ দেখে মনে হয় যেন খাওয়া এখনও হয়নি।
নরেন। (সহাস্যে) গরীব-দুঃখীদের মুখের চেহারাই এইরকম—খাওয়ার ছবিটা সহজে ফুটতে চায় না। আপনাদের সঙ্গে আমাদের তফাত ঐখানে।
বিজয়া। তা জানি। আচ্ছা আপনার microscope-দাম কত?
নরেন। কিনতে আমার পাঁচশো টাকার বেশি লেগেছিল, এখন আড়াইশো টাকা—দুশো টাকা পেলেও আমি দিই। একেবারে নতুন আছে বললেও হয়।
বিজয়া। এত কমে দেবেন? আপনার কি ওর সব কাজ শেষ হয়ে গেছে?
নরেন।কাজ? কিছুই হয়নি।
বিজয়া। আমার নিজের একটা অনেকদিন থেকে কেনবার শখ আছে—কিন্তু হয়ে ওঠেনি। আর কিনেই বা কি হবে? কলকাতা ছেড়ে চলে এসেছি; এখানে শিখবোই বা কি করে?
নরেন। আমি সমস্ত শিখিয়ে দিয়ে যাব। দেখবেন? (বিজয়ার সম্মতির অপেক্ষা না করিয়াই microscope-টা বাহির করিয়া একটি ছোট টিপায়ার উপর রাখিয়া যন্ত্রটা দেখিবার মত করিয়া লইল) আপনি ঐ চেয়ারটায় বসুন। আমি এক্ষুনি সমস্ত দেখিয়ে দিচ্ছি। অণুবীক্ষণ-যন্ত্রটির সঙ্গে যাদের সাক্ষাৎ পরিচয় নেই, তারা ভাবতেও পারে না, কতবড় বিস্ময় এই ছোট জিনিসটার ভিতর লুকোনো আছে। এই slide-টা ভারী স্পষ্ট। জীবজগতের কতবড় বিস্ময়ই না এইটুকুর মধ্যে রয়েছে। এই দেখুন—(বিজয়া যন্ত্রটায় চোখ রাখিয়া দেখিতে লাগিল) কেমন, দেখতে পাচ্ছেন ত?
বিজয়া। হাঁ পাচ্ছি। ঝাপসা ধোঁয়ায় সব একাকার দেখাচ্ছে।
নরেন। ধোঁয়া? দাঁড়ান—দাঁড়ান—বোধ হয়—(কলকব্জা কিছু কিছু ঘুরাইয়া নিজে দেখিয়া লইয়া মুখ তুলিয়া) এইবার দেখুন। ঐ যে ছোট্ট একটুখানি—কেমন আর ত ঝাপসা নেই?
বিজয়া। না। এবার ঝাপসার বদলে ধোঁয়া খুব গাঢ় হয়েছে।
নরেন। গাঢ় হয়েছে? তা কি করে হবে?
বিজয়া। (মুখ তুলিয়া) সে আমি কি করে জানব? ধোঁয়া দেখলে কি আগুন দেখছি বলব?
নরেন। তাই কি আমি বলছি? এই স্ক্রুটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিজের চোখের মত করে নিন না? এতে শক্তটা আছে কোন্খানে?
[বিজয়া কলে চোখ পাতিয়া হাত দিয়া স্ক্রু ঘুরাইতেছিল—নরেন ব্যস্ত হইয়া]
নরেন। আহা-হা করেন কি? কত ঘুরোচ্ছেন,—এ কি চরকা? দাঁড়ান, আমি ঠিক করে দিই। এইবার দেখুন (বিজয়া পুনরায় দেখিবার চেষ্টা করিতে লাগিল) কেমন, পেলেন দেখতে?
বিজয়া। না।
নরেন। না কেন? বেশ ত দেখা যাচ্ছে—পেলেন দেখতে?
বিজয়া। না।
নরেন। আপনার পেয়েও কাজ নেই। এমন মোটাবুদ্ধি আমি জন্মে দেখিনি।
বিজয়া। মোটাবুদ্ধি আমার, না আপনি দেখাতে জানেন না?
নরেন। (অনুতপ্ত-কণ্ঠে) আর কি করে দেখাব বলুন। আপনার বুদ্ধি কিছু আর সত্যিই মোটা নয়, কিন্তু আমার নিশ্চয় বোধ হচ্ছে আপনি মন দিচ্ছেন না। আমি বকে মরছি, আর আপনি মিছিমিছি ওটাতে চোখ রেখে মুখ নীচু করে হাসছেন।
বিজয়া। কে বললে আমি হাসছি?
নরেন। আমি বলছি।
বিজয়া। আপনার ভুল।
নরেন। আমার ভুল? আচ্ছা বেশ। যন্ত্রটা ত আর ভুল নয়, তবে কেন দেখতে পেলেন না?
বিজয়া। যন্ত্রটা আপনার খারাপ।
নরেন। (বিস্ময়ে) খারাপ! আপনি জানেন এরকম powerful microscope এখানে বেশী লোকের নেই? এমন বড় এবং স্পষ্ট দেখাতে—
[বলিয়া স্বচক্ষে একবার যাচাই করিয়া লইবার অতি ব্যগ্রতায়
ঝুঁকিতে গিয়া দু’জনের মাথা ঠুকিয়া গেল]
বিজয়া। উঃ। (মাথায় হাত বুলাইতে বুলাইতে) মাথা ঠুকে দিলে কি হয় জানেন? শিং বেরোয়।
নরেন। শিং বেরুলে আপনার মাথা থেকেই বেরুনো উচিত।
বিজয়া। তা বৈ কি! এই পুরানো ভাঙ্গা microscope-কে ভাল বলিনি বলে—আমার মাথাটা শিং বেরুবার মত মাথা।
নরেন। (শুষ্ক হাসি হাসিয়া) আপনাকে সত্যি বলছি এটা ভাঙ্গা নয়। আমার কিছু নেই বলেই আপনার সন্দেহ হচ্ছে—আমি ঠকিয়ে টাকা নেবার চেষ্টা করছি, কিন্তু আপনি পরে দেখবেন।
বিজয়া। পরে দেখে আর কি করব বলুন? তখন আপনাকে আমি পাব কোথায়?
নরেন। (তিক্তস্বরে) তবে কেন বললেন আপনি নেবেন? কেন এতক্ষণ মিথ্যে কষ্ট দিলেন? আমার কলকাতা যাওয়া আজ আর হলো না।
বিজয়া। (গম্ভীরভাবে) আপনিই বা কেন না বললেন এটা ভাঙ্গা!
নরেন। (মহাবিরক্ত হইয়া) একশোবার বলছি ভাঙ্গা নয়, তবু বলবেন ভাঙ্গা? (ক্রোধ সংবরণ করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া) আচ্ছা তাই ভালো! আমি আর তর্ক করতে চাইনে। এটা ভাঙ্গাই বটে। কিন্তু সবাই আপনার মত অন্ধ নয়। আচ্ছা চললুম।
[যন্ত্রটা বাক্সের মধ্যে পুরিবার উপক্রম করিল]
বিজয়া। (গম্ভীরভাবে) এখুনি যাবেন কি করে? আপনাকে যে খেয়ে যেতে হবে!
নরেন। না তার দরকার নেই।
বিজয়া। কে বললে নেই?
নরেন। কে বললে? আপনি মনে মনে হাসছেন? আমাকে কি উপহাস করছেন?
বিজয়া। আপনাকে কিন্তু নিশ্চয় খেয়ে যেতে হবে। একটু বসুন আমি এখুনি আসছি। (বিজয়া বাহির হইয়া গেল। নরেন microscope-টা বাক্সের মধ্যে পুরিয়া টিপয় হইতে নামাইয়া রাখিল। বিজয়া স্বহস্তে খাবারের থালা এবং কালীপদর হাতে চায়ের সরঞ্জাম দিয়া ফিরিয়া আসিল।) এর মধ্যেই ওটা বন্ধ করে ফেলেছেন? আপনার রাগ ত কম নয়!
নরেন। (উদাসকণ্ঠে) আপনি নেবেন না তাতে রাগ কিসের? শুধু খানিকক্ষণ বকে মরলুম এই যা।
বিজয়া। (থালাটা টেবিলের উপর রাখিয়া) তা হতে পারে। কিন্তু যেটুকু বকেছেন, সেটুকু নিছক নিজের জন্যে। একটা ভাঙ্গা জিনিস গছিয়ে দেবার মতলবে। আচ্ছা, খেতে বসুন আমি চা তৈরি করে দিই। (নরেন সোজা বসিয়া রহিল) আচ্ছা। আমিই না হয় নেব, আপনাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে না। আপনি খেতে আরম্ভ করুন।
নরেন। আপনাকে দয়া করতে ত আমি অনুরোধ করিনি।
বিজয়া। সেদিন কিন্তু করেছিলেন। যেদিন মামার হয়ে পূজোর সুপারিশ করতে এসেছিলেন।
নরেন। সে পরের জন্যে, নিজের জন্যে নয়। এ অভ্যাস আমার নেই।
বিজয়া। তা সে যাই হোক, ওটা কিন্তু আর আপনার ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া চলবে না। এখানেই থাকবে। এবার খেতে বসুন।
নরেন। এ কথার মানে?
বিজয়া। মানে একটা কিছু আছে বৈ কি?
নরেন। (ক্রুদ্ধ হইয়া) সেইটে কি তাই আমি আপনার কাছে শুনতে চাইছি। আপনি কি ওটি আটকে রাখতে চান? এও কি বাবা আপনার কাছে বাঁধা রেখেছিলেন? আপনি ত দেখছি তা হলে আমাকেও আটকাতে পারেন, বলতে পারেন বাবা আমাকেও আপনার কাছে বাঁধা দিয়ে গেছেন?
বিজয়া। (আরক্তমুখে ঘাড় ফিরাইয়া) কালীপদ, তুই দাঁড়িয়ে কি করছিস? পান নিয়ে আয়। (কালীপদ চায়ের সরঞ্জাম টেবিলে রাখিয়া চলিয়া গেল) নিন আর ঝগড়া করবেন না—এবার খেয়ে নিন।
[নরেন নিঃশব্দে গম্ভীরমুখে আহার করিতে লাগিল]
নরেন। শুনুন।
বিজয়া। শুনব পরে। আগে পেট ভরে খান।
নরেন। অনেক ত খেলুম।
বিজয়া। আরও অনেক যে পড়ে রইল।
নরেন। তা বলে আমি কি করব? আর আমি পারব না।
বিজয়া। তা জানি, আপনার কোন কিছু পারবারই শক্তি নেই। আচ্ছা microscope দেখতে শিখে আমার কি লাভ হবে?
নরেন। (সবিস্ময়ে) দেখতে শিখে কি লাভ হবে?
বিজয়া। হাঁ, তাই ত। এ শেখায় লাভ যদি আমাকে বুঝিয়ে দিতে পারেন আমি খুশী হয়ে ওটা কিনব, তা যতই কেননা ভাঙ্গা হোক।
নরেন। কিনতে হবে না আপনাকে।
বিজয়া। বেশ ত বুঝিয়েই দিন না।
নরেন। দেখুন, আপনাকে দেখাতে চেয়েছিলুম—জীবাণুর গঠন। খালি চোখে ওদের দেখা যায় না—যেন অস্তিত্বই নেই। ওদের ধরা যায় শুধু ঐ যন্ত্রটার মধ্য দিয়ে। সৃষ্টি ও প্রলয়ের কত বড় শক্তি নিয়ে যে ওরা পৃথিবীময় ব্যাপ্ত হয়ে আছে—ওদের সেই জীবন-ইতিহাস—কিন্তু আপনি ত কিছুই শুনছেন না।
বিজয়া। শুনছি বৈ কি।
নরেন। কি শুনলেন, বলুন ত?
বিজয়া। বাঃ, একদিনেই নাকি শুনে শেখা যায়? আপনিই বুঝি একদিনে শিখেছিলেন?
নরেন। (হোহো করিয়া হাসিয়া) কিন্তু আপনার যে একশো বছরেও হবে না। তা ছাড়া এ-সব আপনাকে শেখাবেই বা কে?
বিজয়া। (মুখ টিপিয়া হাসিয়া) কেন আপনি। নইলে এই ভাঙ্গা কলটা আমি ছাড়া আর কে নেবে?
নরেন। আপনার নিয়েও কাজ নেই, আমি শেখাতেও পারব না।
বিজয়া। পারতেই হবে আপনাকে। জিনিস বিক্রি করে যাবেন আপনি, আর শেখাতে আসবে আর একজন? না হয় ত আর এক কাজ করুন। শুনেছি আপনি ভাল ছবি আঁকতে পারেন। তাই আমাকে শিখিয়ে দিন। এ ত শিখতে পারব।
নরেন। (উত্তেজিত হইয়া) তাও না। যে-বিষয়ে মানুষের নাওয়া-খাওয়া জ্ঞান থাকে না—তাতেই যখন মন দিতে পারলেন না—মন দেবেন ছবি আঁকতে? কিছুতেই না।
বিজয়া। তা হলে ছবি আঁকতেও শিখতে পারবো না?
নরেন। না, আপনি যে কিছুই মন দিয়ে শোনেন না!
বিজয়া। (ছদ্ম-গাম্ভীর্যের সহিত) কিছুই না শিখতে পারলে কিন্তু সত্যিই মাথায় শিং বেরোবে।
নরেন। (উচ্চহাস্য করিয়া) সেই হবে আপনার উচিত শাস্তি।
বিজয়া। (মুখ ফিরাইয়া হাসি গোপন করিয়া) তা বৈ কি! আপনার শেখবার ক্ষমতা নেই তাই কেন বলুন না। কিন্তু চাকরেরা কি করছে? আলো দেয় না কেন? একটু বসুন, আমি আলো দিতে বলে আসি।
[বিজয়া দ্রুতপদে উঠিয়া দ্বারের পর্দা সরাইয়া অকস্মাৎ যেন ভূত দেখিয়া পিছাইয়া
আসিল। পিতা-পুত্র রাসবিহারী ও বিলাসবিহারী প্রবেশ করিয়া হাতের কাছে
দু’খানা চেয়ার অধিকার করিয়া বসিলেন। বিলাসের মুখের
উপর যেন এক ছোপ কালি মাখানো, এমনি বিশ্রী চেহারা।
বিজয়া আপনাকে সংবরণ করিয়া]
বিজয়া। আপনি কখন এলেন কাকাবাবু!
রাস। (শুষ্কহাস্যে) প্রায় আধঘণ্টা হলো এসে ঐ সামনের বারান্দায় বসে। কিন্তু তুমি কথাবার্তায় বড় ব্যস্ত বলে আর ডাকলাম না। ঐ বুঝি সেই জগদীশের ছেলে? কি চায় ও?
বিজয়া। (মৃদুস্বরে) একটা microscope বিক্রি করে উনি চলে যেতে চান। তাই দেখাচ্ছিলেন।
বিলাস। (গর্জন করিয়া) microscope! ঠকাবার জায়গা পেলে না বুঝি!
[নরেন ধীরে ধীরে অন্য দ্বার দিয়া বাহির হইয়া গেল]
রাস। আহা, ও-কথা বলো কেন? তার উদ্দেশ্য ত আমরা জানিনে। ভালও ত হতে পারে। অবশ্য জোর করে কিছুই বলা যায় না—সেও ঠিক। তা সে যাই হোক গে ওতে আমাদের আবশ্যক কি? দূরবীন হলেও না হয় কখনো কালেভদ্রে দূরেটুরে দেখতে কাজে লাগতে পারে।
[আলো হাতে করিয়া কালীপদ প্রবেশ করিল]
রাস। কালীপদ, সেই বাবুটি বোধ করি ওদিকে কোথাও বসে অপেক্ষা করছে, তাকে বলে দাওগে—ঐ যন্ত্রটা আমরা কিনতে পারব না—আমাদের দরকার নেই। এসে নিয়ে চলে যাক।
বিজয়া। (ভয়ে ভয়ে) তাঁকে বলেছি আমি নেব।
রাস। (আশ্চর্য হইয়া) নেবে? কেন, ওতে প্রয়োজন কি?
[বিজয়া নীরব]
রাস। উনি দাম কত চান?
বিজয়া। দুশো টাকা।
রাস। দুশো? দুশো টাকা চায়? বিলাস ত তাহলে নেহাত—কি বল বিলাস? কলেজে তোমাদের F. A.class-এ Chemistry তে এ-সব অনেক ঘাঁটাঘাঁটি করেছ, দুশো টাকা একটা microscope এর দাম? এ ত কেউ কখনো শোনেনি। কালীপদ, যা ওকে নিয়ে যেতে বলে আয়। এ-সব ফন্দি এখানে খাটবে না।
বিজয়া। কালীপদ, তুমি তোমার কাজে যাও। তাঁকে যা বলবার আমি নিজেই বলব।
[কালীপদর প্রস্থান
বিলাস।(শ্লেষ করিয়া) কেন বাবা তুমি মিথ্যে অপমান হতে গেলে? ওঁর হয়ত এখনো কিছু দেখিয়ে নিতে বাকী আছে। (রাসবিহারী নীরব) আমরাও অনেক রকম microscope দেখেছি বাবা, কিন্তু হোহো করে হাসবার বিষয় কোনটার মধ্যে পাইনি।
[বিজয়া তাহার দিকে সম্পূর্ণ পিছন ফিরিয়া রাসবিহারীকে]
বিজয়া। আমার সঙ্গে কি আপনার কোন বিশেষ কথা আছে কাকাবাবু?
রাস। (অলক্ষ্যে পুত্রের প্রতি ক্রুদ্ধ কটাক্ষ করিয়া ধীরভাবে) কথা আছে বৈ কি মা। কিন্তু কিনবে বলে কি ওকে সত্যিই কথা দিয়ে ফেলেছ? সে যদি হয়ে থাকে ত নিতেই হবে। দাম ওর যাই হোক তবু নিতে হবে। সংসারে ঠকা-জেতাটাই বড় কথা নয় বিজয়া, সত্যটাই বড়। সত্যভ্রষ্ট হতে ত তোমাকে আমি বলতে পারব না।
বিলাস। তাই বলে ঠকিয়ে নিয়ে যাবে?
রাস। যাক। নিক ও ঠকিয়ে। জগদীশের ছেলের কাছে এর বেশি প্রত্যাশা করো না বিলাস। কালীপদ গিয়ে বলে আসুক কাল এসে যেন কাছারি থেকে টাকাটা নিয়ে যায়।
বিজয়া। যা বলবার আমিই তাঁকে বলব। আর কারো বলার আবশ্যক নেই কাকাবাবু।
রাস। বেশ বেশ তাই বলো মা। বলে দিও ওর কোন ভয় নেই, দুশো টাকাই যেন নিয়ে যায়।
বিজয়া । রাত হয়ে যাচ্ছে, ওঁকে অনেক দূর যেতে হবে। কাল কি আপনার সঙ্গে কথা হতে পারে না কাকাবাবু?
রাস। বেশ ত মা কালই হবে। (প্রস্থানোদ্যম—সহসা ফিরিয়া) কিন্তু শুনেছ বোধ হয় তোমার মন্দিরের ভাবী আচার্য দয়ালবাবু আজ সকালেই এসে পড়েছেন—মন্দির-গৃহেই আছেন—আবার কাল সকালে আমাদের সমাজের মান্যব্যক্তি যাঁরা—যাঁদের সসম্মানে আমরা আমন্ত্রণ করেছি—তাঁরা আসবেন। তোমাদের উভয়কে তাঁদের কাছে আমি পরিচিত করিয়ে দেব। আর ক’টা দিনই বা বাঁচবো মা!
বিজয়া। (সবিস্ময়ে) তাঁরা সব কালই আসবেন? কৈ আমি ত কিছুই শুনিনি!
রাস। (সবিস্ময়ে) শোনোনি? তা হলে তাড়াতাড়িতে বলতে বোধ হয় ভুলে গেছি মা।
বুড়ো বয়সের দোষই এই।
বিজয়া। কিন্তু বড়দিনের ছুটির ত এখনো অনেক বিলম্ব কাকাবাবু!
রাস। বিলম্ব বলেই ভাবলাম শুভকর্মে দেরি আর করব না। বাড়িটা ত তাঁর মন্দিরের জন্যে মনে মনে তোমরা উৎসর্গই করেছ, শুধু অনুষ্ঠানই বাকী। যত শীঘ্র পারা যায় কর্তব্য সমাপন করাই উচিত। তাঁরাও যখন আসতে রাজী হলেন তখন পুণ্যকার্য ফেলে রাখতে মন চাইলে না। বল দিকি মা, এ কি ভাল করিনি?
বিজয়া। নরেনবাবুর বড় রাত হয়ে যাচ্চে কাকাবাবু।
রাস। ও হাঁ। বেশ, ওকে ডেকে পাঠিয়ে তাই বলে দাও, দুশো টাকাই দেওয়া হবে।
বিলাস। টাকা কি খোলামকুচি? একজনের খেয়াল চরিতার্থ করতে দুশো টাকা নষ্ট করতে হবে? তুমি তাতেই রাজি হচ্চো?
রাস। বিলাস, ক্ষুণ্ণ হ’য়ো না বাবা। তোমাদের অনেক আছে—যাক দুশো। নিয়ে যাক ও দুশো টাকা। মা বিজয়া আমার দয়াময়ী, দুঃখীকে সামান্য ক’টা টাকা যদি সাহায্য করতেই চান বিরক্ত হওয়া উচিত নয়। কিন্তু আর নয় বাবা, অন্ধকার হয়ে আসছে, চল। কাল সকালে অনেক কাজ অনেক ঝঞ্ঝাট পোহাতে হবে। চল যাই। আসি মা বিজয়া।
[রাসবিহারী নিষ্ক্রান্ত হইলেন। বিলাস বিজয়ার প্রতি একটা ক্রুদ্ধ
কটাক্ষ নিক্ষেপ করিয়া পিতার অনুসরণ করিল]
বিজয়া। (ক্ষণকাল স্তব্ধ থাকিয়া) কালীপদ?
[নেপথ্যে ‛যাই মা’ বলিয়া কালীপদ প্রবেশ করিল]
কালীপদ, নরেনবাবু বোধ হয় বাইরে কোথাও বসে আছেন। তাঁকে ডেকে নিয়ে এসো।
[কালীপদ মাথা নাড়িয়া প্রস্থান করিল
নরেন। (প্রবেশ করিয়া) এটা আমি সঙ্গে নিয়েই যাচ্ছি। কিন্তু আজকের দিনটা আপনার বড় খারাপ গেল। অনেক অপ্রিয় কথা আমি নিজেও আপনাকে বলেছি। ওঁরাও বলে গেলেন। কি জানি কার মুখ দেখে আজ আপনার প্রভাত হয়েছিল!
বিজয়া। তার মুখ দেখেই যেন আমার প্রতিদিন ঘুম ভাঙ্গে নরেনবাবু! বাইরে দাঁড়িয়ে আপনি সমস্ত কথা নিজেই শুনতে পেয়েছেন বলেই বলছি যে, আপনার সম্বন্ধে তাঁরা যে সব অসম্মানের কথা বলে গেলেন সে তাঁদের অনধিকার-চর্চা। কাল আমি সে কথা তাঁদের বুঝিয়ে দেব।
নরেন। তার আবশ্যক কি? এ-সব জিনিসের ধারণা নেই বলেই তাঁদের আমার উপর সন্দেহ জন্মেছে—নইলে আমাকে অপমান করায় তাঁদের লাভ নেই কিছু। কিন্তু রাত হয়ে যাচ্ছে, আমি যাই এবার।
বিজয়া। কাল কি পরশু একবার আসতে পারবেন না?
নরেন। কাল কি পরশু? কিন্তু তার ত আর সময় হবে না। কাল আমাকে কলকাতায় যেতে হবে। সেখানে দু’-তিনদিন থেকেই এটা বিক্রি করে আমি চলে যাব। আর বোধ করি দেখা হবে না।
[বিজয়ার দুই চক্ষু জলে ভরিয়া গেল, সে না পারিল
মুখ তুলিতে, না পারিল কথা কহিতে।]
নরেন। (একটু হাসিয়া) আপনি নিজে এত হাসাতে পারেন, আর আপনারই এত সামান্য কথায় রাগ হয়! আমিই বরঞ্চ একবার রেগে উঠে আপনাকে মোটাবুদ্ধি প্রভৃতি কত কি বলে ফেলেছি। কিন্তু তাতে ত রাগ করেন নি, বরঞ্চ মুখ টিপে হাসছিলেন দেখে আমার আরও রাগ হচ্ছিল। কিন্তু দেখা যদি আর আমাদের নাও হয় আপনাকে আমার সর্বদা মনে পড়বে।
[বিজয়া মুখ ফিরাইয়া অশ্রু মুছিতে গিয়া নরেনের চোখে পড়িয়া
গেল, সে ক্ষণকাল সবিস্ময়ে নিরীক্ষণ করিয়া]
নরেন। একি! আপনি কাঁদছেন যে! না—না, এটা নিতে পারলেন না বলে কোনো দুঃখ করবেন না। কলকাতায় আমি সত্যিই বেচতে পারব, আপনি ভাববেন না।
[এই বলিয়া সে বাক্সটি ধীরে ধীরে হাতে তুলিয়া লইল।]
বিজয়া। না আমি দেব না, ওটা আমার। রেখে দিন।
[কান্না চাপিতে না পারিয়া টেবিলের উপর মাইক্রস্কোপটির উপর মুখ গুঁজিয়া পড়িয়া
কাঁদিতে লাগিল। নরেন হতবুদ্ধিভাবে একটু দাঁড়াইয়া
ধীরে ধীরে চলিয়া গেল।]