বিকল্প

বিকল্প
(ছোটোগল্প)
আব্দুর রউফ চৌধুরী

সোমবার, সাতাশে শ্রাবণ

বর্ষার শেষ।

আকাশ থেকে যত জল ঝরে পড়ার কথা ছিল সবটুকুই হুড়মুড় করে পড়তে শুরু করেছে। বাদামকালো ছনগুলো বৃষ্টির জলে ঢলঢল, কয়েকদিন ধরেই বৃষ্টি চলছে— সকাল নেই, সন্ধ্যা নেই, শুধু বর্ষণ; আবার মাঝেমধ্যে তুফানও— ক্রুদ্ধগর্জনে, বিষাক্তনিশ্বাসে ছোবল মারছে ছনের চালে, একইসঙ্গে সাপের মতো বিদ্যুতের দলও নেচে উঠছে মেঘের আড়ালে, বজ্রপাতের মাঝেও যেন শোনা যায় ইস্রাফিলের হুংকার, বীণার টংকার। মাফিক মনে মনে ভাবে, সারা গ্রামের ওপর দিয়ে বোধ হয় অদৃশ্য নিয়তির ক্রুর অভিশাপ পড়েছে; তবুও সে সিদ্ধান্ত নিল, এই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পেরে সে অবাক, শেষ পর্যন্ত শ্বশুরবাড়ি যাবে। মাফিকের মা’রও প্রথম পুত্রবধূ দেখার সাধ অনেক, তাই তিনি ছেলের পাশে বসে তার সিদ্ধান্তের কথা শুনে শান্তির একটি নিশ্বাস ফেললেন। মা’র বুকভরা নানারকম আহ্লাদ, শখ তো বটেই, হাজার স্বপ্নও, শুধু কখনও কখনও ঠোঁটদুটো দুঃখের ভারে কেঁপে ওঠে। তিনি খড়বাঁশের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে, মন ও শরীর সামল নিয়ে, মাফিকের স্কুলজীবনের বন্ধু বাহারকে বললেন, দ্যাখ বাবা, বউমাকে ফেলে কিন্তু আসবে না।

মাফিক সঙ্গে সঙ্গে তার নির্লিপ্তভাব ভেঙে, মনের কথা গোপন রেখে, বলল, তার বাবা না দিলে বাহারের বয়ে গেছে।

মাফিকের মা আশ্চর্য হলেন না, আশ্চর্য হওয়ার কারণও আছে; মনে মনে বললেন, মানুষের চাওয়ার মধ্যে কত ভুল থাকে, অহস্র, তবুও আর্থিক অসুবিধে দূর করা গেল না। তিনি তার সন্তানদের জীবনের প্রয়োজনে নিজের সুখশান্তি ত্যাগ করতে সবসময়ই প্রস্তুত, কিন্তু আজ, কী হওয়ার কথা ছিল, আর কী হলো; এইমুহূর্তে, মৃদু অস্বস্তির কাঁটা খচখচ করছে তার মনের মধ্যে, তিনি আর তার ত্যাগের সার্থকতা উপলব্ধি করতে পারছেন না, কেউই হয়তো পারে না, তাই নিজেকে দোষি মনে করে অন্তরের ব্যথাকে নিশ্চুপে মাথা নিচু করে খুঁটতে থাকেন, জোর করে হৃদয় থেকে না-বলা যন্ত্রণাগুলো উড়িয়ে দিতে চাচ্ছেন, কিন্তু পারছেন কোথায়, তাই হয়তো বাহারের দিকে অসহায় মুখে তাকিয়ে বললেন, ওর কথায় কান দিস্ না বাবা।

কথাটি বলে বাহারের দিকেই স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন, চোখগুলো কি নিজের অক্ষমতায় ছলছল করছে, না অভিমানে জ্বলজ্বল করছে, বাহার ঠিক বুঝতে পারছে না, তাই হয়তো তাড়াতাড়ি চোখ ঘুরিয়ে নিল; তবে সে জানে, জীবনে যা করা উচিত, সবার মঙ্গল যাতে হয়, তা সবসময় প্রতিষ্ঠা করতে না পারলেও অনেক কিছুই করতে হয়, অন্যায় অবিচারের যন্ত্রণাও মুখ বন্ধ করে মেনে নিতে হয়, মনের মধ্যে শত দ্রোহ উদয় হোক-না কেন, এই পরিবারের অবস্থা ও অর্থশক্তির পরিমাণ-পরিমাপ বছরের-পর-বছর একইভাবে অপরিবর্তন থাকবে হয়তো, যা ভগ্নস্তূপের মতো, চারপাশে শুধু ধ্বংসের আবহ চলবে। সে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে, শান্তনার স্বরে বলল, না চাচিমা, ভাববেন না। আপনার বউমাকে কাঁধে করে হলেও নিয়ে আসব, তবুও একা ফিরব না।

বাহারের কথা শেষ হতে-না-হতেই প্রকৃতি আবার মেতে উঠল, বাতাস ঝকঝকে তলোয়ার যেন, সামনে যা পাচ্ছে কচুকাটা করে যাচ্ছে, মেঘের সঙ্গে হাতাহাতি-মাতামাতি করতে ভয় পাচ্ছে না।

মঙ্গলবার, আটাশে শ্রাবণ

সকাল।

ফজরের পর ধরণী যেন সদ্যস্নাতা বিধবার হাসির মতো করুণরাগে রঞ্জিত হয়ে উঠল। সুপুরিগাছের বাবুইবাসাটি যদিও তছনছ, তবুও শাবকের শুশ্রূষায় নতুন উদ্যোগে বাবুইপাখি আবার বাসা বুনতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। সেদিকে চোখ রেখে মাফিক ট্রাউজার্স পরে, একটি লুঙ্গি ব্যাগে পুরে, মাথাভাঙা ছাতাটি হাতে নিয়ে, মা’কে প্রণাম করে, চৌকাঠের অন্যপাশে পা রাখতেই তার মা’র বুকটি যেন হঠাৎ দমাক হাওয়ার ছুবল মারার মতো ধকধক করে উঠল। ছেলের মুখে সামান্য চিন্তারেখা দেখা দিলেই তিনি বজ্রপাতের শব্দের মতো চমকে ওঠেন, মাফিকের মা জানেন, তার ছেলে নিজের বুকে মুখ গুঁজে পরিবারের চাওয়া-পাওয়ার কথা ভাবে, নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, সুখ-দুঃখ, মান-অভিমান কাউকে জানতে দেয় না; একা একা একটু কেঁদে নিজেকে হালকাও করতে পারে না, এমনকি বাহারের কাছেও তার ব্যথাবেদনা, লাঞ্ছনাবঞ্চনার কথা বলতে পারে না। তার মনের মাঝখানটি যেন সবসময়ই ফাঁকা থাকে। দিনদিন সেই শূন্যতা বেড়েই চলেছে। তার চারপাশ যেন এক ঘোর লাগা অবাস্তব জগতে পরিণত হয়েছে। মাফিকের মাও যেন বাস্তবে কি ঘটছে তা বুঝতে পারছেন না, যদিও প্রাণপণ তিনি স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছেন, পারছেন কোথায়, শুধু অভিনয় করেই চলেছেন; তবে তিনি ঠিকই টের পাচ্ছেন, চৌকাঠ পেরিয়ে যাওয়া ছেলের মুখ দেখে, তার বুকজুড়ে যেন গোপনগহন ব্যথা গুমরে বেড়াচ্ছে, তাই বললেন, হে আল্লাহ, তুমি নেগাবান, আমার বাপধনকে ছহিসালামতে আমার কাছে ফিরিয়ে দিয়ো।

ঈশ্বর যেন তার আহ্বানে একেবারে ছিদ্রওয়ালা ছনের চালের ওপর এসে আসন পেতেছেন। মাফিকের মা শূন্যদৃষ্টিতে বাইরে তাকালেন। কাঁধ থেকে আঁচল কখন যে খসে পড়েছে সেদিকে তার খেয়াল নেই। তার কণ্ঠার দুটো হার প্রকটভাবে প্রকাশিত। ছেলেকে নিয়ে এত ভাবার কি প্রয়োজন? ছেলে তো আর অচেনা, অজানা জায়গায় যাচ্ছে না, যাচ্ছে তার শ্বশুরবাড়ি; তবুও কেন যেন তার ভয় হচ্ছে, ভীষণ একা একা লাগছে, দুশ্চিন্তায় মন ভারাক্রান্ত। তিনি স্তব্ধ হয়ে চৌকাঠ ধরে দাঁড়িয়ে রইলেন, তবে তার কান ঝাঁ-ঝাঁ করছে এক গোপন উত্তেজনায়। একপলকে তিনি দেখতে লাগলেন, দূরে, হাতে-ধরা মাথাভাঙাওয়ালা ছাতায় ভর দেওয়া ছায়াটি ও ছাতাবিহীন প্রতিচ্ছায়াটি এগিয়ে চলেছে। তারা চলেছে বাড়ির সামনের ঘাসজ্বলা, তবে জলেভিজে, একটুকরো জমিন মাড়িয়ে; তারপর কবরের ধসে পড়া পাঁচিল ঘেরা পাতাবাহারের ঝোঁপ গলিয়ে। হঠাৎ তারা তার দৃষ্টির আড়াল হয়ে গেল, তবে তারা ঠিকই এগিয়ে চলেছে। চলেছে— অর্জুন গাছের নিচ দিয়ে, আলোছায়ায় ষোলোকটির নকশা আঁকা ঘাস মাড়িয়ে। চলেছে, পুকুরের পাড় ঘেঁষে, যে কুঠার তার কঠিন হাতে ঝড়ে ভেঙে-পড়া আমগাছটিকে তছনছ করছে, উলটপালট করছে, তাকে পাশ কাটিয়ে। চলেছে— ছায়ারেখাচ্ছন্ন গ্রামের জানা পথটি ধরে, যদিও গ্রামের বাতাসে একরকম অচেনা ঘ্রাণ বইছে। দুজন পথিক তাদের পাশ কেটে চলে গেল, ওদের গায়ের বর্ষার গন্ধটি শুধু টের পেল ছাতাবিহীন প্রতিচ্ছায়টি; কারণ ছাতা ধরে-থাকা ছায়াটি ভেবে চলেছে অন্যকথা— বাহারকে আমার সঙ্গে আনার দুটো কারণ। প্রথমত, শায়েস্তাগঞ্জ রেলস্টেশনে আমার শ্বশুরের সঙ্গে কথা কাটাকাটির তিক্ততা তিরোহিত হয়নি আজও দুজনের মন থেকেই, কাজেই তার উপস্থিতিতে সূচনা সহজ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। দ্বিতীয়ত, যদি উদ্দেশ্য সফল না হয়, তাহলে মা’র দোষারূপ থেকে বাঁচার জন্য একজন বিশ্বস্ত লোকের প্রয়োজন রয়েছে, বিয়ে তো তার উদ্যোগেই সংঘটিত হয়েছিল। মা’র একজন বিত্তশালী বেয়াই অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে; তখন দেশজুড়ে দুর্ভিক্ষ, আর তার কবল থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য টাকাকড়ির প্রয়োজন পড়ে। আমার অমতে পুনরায় তিনি স্বামীগ্রহণ করায় তিনটে মুখ বেড়েছে, মুখ দেন যিনি, আহার দেন তিনি— এরকম কথার তিনসিকিভাগই যে পরীক্ষার অন্তর্গত— তা আমার মা’র আর বোঝার বাকি নেই, কিন্তু সময় শেষ হয়ে গেল শুধু থেকে যায় আফসোস, চেনানোর সময়ই ছাগিকে ধরতে হয় অন্যথায় দুর্ভোগ; পূর্বাহ্নে সতর্কতা ও সংযম দারিদ্র্যতাকে দূরে সরিয়ে রাখে, একমাত্র দুর্দশাগ্রস্ত লোকই ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে।

দুপুর।

শায়েস্তাগঞ্জ স্টেশন থেকে মাফিকের শ্বশুরবাড়ি আট মাইল, বেশিরভাগই বাসে, শুধু হবিগঞ্জ সদর থেকে গয়না নৌকায় মাইল খানেক। অন্যমনস্কভাবে বন্ধুসহ মাফিক বাসে উঠল। দুপুরের বাস, যাত্রীর ভিড়। বেশিরভাগই মজুর, কিছু কিছু ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীও। পথের দুধারের ক্লান্তজীবন হাই তুলে বিশ্রাম নিচ্ছে। দু-একটি খাবারের দোকান থেকে উনুনের ধোঁয়া মাঝেমধ্যে উড়ে এসে যাত্রীদের চোখেমুখে ধাক্কা খাচ্ছে। অতঃপর দুপুরের ক্লান্তিময় রহস্য মিলিয়ে যাওয়ার আগেই গয়না নৌকা করে বন্ধুসহ শ্বশুরবাড়ির ঘাটে এসে মাফিক নামল। সামনেই তার চিরপরিচিত বাংলাঘর, এরই সংলগ্নে, স্বল্পপরিসরে, গোপাটের পূর্বপাড়ে ও খালের পশ্চিমপাড়ে খালি জায়গা খরিদ করে মাফিকের শ্বশুর যে নতুন বাড়িটি নির্মাণ করেছেন তা দৈর্ঘে প্রস্থে অসমান, আটে-বাইশে, যা পূর্ব-পশ্চিমে দাঁড়িয়ে আছে। নতুন উঠোন ভরাট করার সময় গোপাটটিও ভরাট করে উঠোনের সঙ্গে একাকার করে দিয়েছেন মাফিকের শ্বশুর। নতুন বাড়ির পূর্বপ্রান্তে অপেক্ষাকৃত বাঁশখুঁটির ছোটো একটি গোয়ালঘর গড়া করা হয়েছে, খালের দিকে পেছন ফেরা। তারই দক্ষিণে, খালের পাশ ঘেঁষে, মসজিদে যাতায়াতের জন্য একটি ছোটো রাস্তা রাখা হয়েছে; তারই উত্তরপাশে একটু খালি জায়গা, সেখানে একটি গোলাপ ও দুটো গন্ধরাজের গাছে ফুটে থাকা ফুলগুলো পাশের গোবরের ঢিপির গন্ধকে প্রশমিত রাখার ব্যর্থ প্রয়াসে ব্যস্ত। গোয়ালঘরে ছয়টি বলদ ও দুটো গাভী পচা কচুরিপানার ওপর দাঁড়িয়ে তাজা কচুরিপানা খাচ্ছে, ছয়টির মধ্যে একটি ভীষণ কালো, বিদেশি হবে, দেহের শক্ত বাঁধনের ওপর মস্তবড়ো এক ঢিবি, আর পরিচ্ছন্ন লম্বা লেজটি মাছি তাড়াতে ব্যস্ত, কিন্তু দেশীয় গরুগুলোর ওপর সচ্ছন্দে মাছির মেলা জমে উঠেছে, তাদের সংখ্যা গৃহস্থের সচ্ছ¡লতার পরিচয়। গোয়ালঘরের ঠিক পশ্চিমে হাতলভাঙা টিউবওয়েলে হাতমুখ ধুয়ে মাফিক বন্ধুকে নিয়ে এগিয়ে এলো বাংলাঘরের দিকে, তখন বেলা আড়াইটা।

বিকাল।

বাংলাঘর। একটি মেহনতি ছেলে দস্তরখান হাতে নিয়ে এসে হাজির হলো। মাফিকের মন অজানা আশঙ্কায় মুষড়ে উঠল, স্ত্রীর সঙ্গে মোলাকাত মুশকিল মালুম হোতা হ্যায়। চার বছর মাত্র ছাতুখোরদের সঙ্গে বসবাস করে উর্দুতে ভাবতে শিখেছে মাফিক, একথা ভাবলেই সে অবাক হয়। পাকিস্তানির সঙ্গে সম্পর্ক কোনও দিনই গলাগলির পর্যায়ে পৌঁছোয়নি, অনেক ক্ষেত্রে গালাগালিতেই পর্যবসিত হয়েছে। পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব-বাংলার সংযুক্তির সাধ প্রথম মিলনেই মিটে গেছে, ওদের আত্মম্ভরিতার আকস্মিকতায়; তেমনই আজ বিয়ের সাধও মিটে যাবে ম্যাটিনি-শো’র শুরুতেই, এসব ভাবতেই মাফিকের অভিমানী মন ব্যথিত হয়ে উঠল। ছেলেটি বলে যাচ্ছে অনেক কিছু, সেদিকে মাফিকের খেয়াল নেই, তবে ছেলেটি যখন বলল, আপনার হউর, তখন তার চমক ভাঙল, সে বলে চলল, কোঁচ দিয়া মাছ শিকার করাত ওস্তাদ। গতকল্য ইয়াবড়ো একটা কাতলা কাবু করছইন। দেখইন কেমন তেলতেলা চেপটা পেটি।

মেহনতি ছেলেটি যখন মাফিকের থালায় কাতলার একটি পেটি তুলে দিতে যাচ্ছে তখন সে খেঁকিয়ে উঠল। ছেলেটি হতভম্ব! পরিস্থিতি বুঝতে পেরে বাহার বলল, আমার থালায় তুলে দ্যাও।

ছেলেটি নিশ্চুপে নির্দেশ পালন করল, কোনও কথা বলল না। দস্তরখান গুঁটানো পর্যন্ত নিশ্চুপ থাকে, কিন্তু রান্নাঘরে পৌঁছেই অপেক্ষারত জায়েদাকে বলল, আপা, তোমার সোয়ামির মেজাজ বড়ো কড়া। খাড়াক্খাড়া খারাপ অইয়া যায়। ব্যাপার কিতা?

উত্তর শোনার আগেই ছেলেটি পানদান নিয়ে দৌড় তুলল বাংলাঘরের দিকে। জায়েদা মনে মনে বলল, শায়েস্তাগঞ্জ রেলস্টেশনের ঘটনায় বাবাই বড্ড বাড়াবাড়ি করেছিলেন। তার দোষ কি! না নেই। চার বছর পর দেশে এসে মা’র আশীর্বাদ না নিয়ে স্ত্রীকে দেখতে আসা কি বেমানান নয়! এখন বাবা বেঁকে বসেছেন। বিয়ের পর মেয়ে কি আর তার বাপের থাকে, সেকথা কি তিনি বোঝেন না! এমন সময় তার বাবার কণ্ঠ শোনা গেল, জায়েদা যেন রান্নাঘরের পাঁচিলের বাইরে না যায়।

জায়েদার মা উত্তরে কী বললেন তা শোনা গেল না, তবে জায়েদার অন্তর জপতে লাগল, নানি আসলেই দেখা যাবে তার দামান্দকে দাব দিয়ে বশ মানাতে পারেন কিনা! জায়েদার বাবার শাসনের সুর মাগরেবের আজানের ধ্বনিকেও দমাতে পারল না, রয়ে গেল বাদ-মাগরেব পর্যন্ত।

সন্ধ্যা।

তলব এলো মাফিক ও বাহার যেন শীঘ্রই ভেতর বাড়িতে এসে উপস্থিত হয়। মাফিকের শ্বশুর বড়োঘরের প্রধান দরজার চৌকাঠে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো। কদমবুচি— পা ছোঁয়া সালাম— করে উঠে দাঁড়াতেই উভয়কে তিনি গুরুগম্ভীর স্বরে বললেন, বেশ।

মাফিক ও বাহার দুজনই চুপ। মাফিকের শ্বশুর পালঙ্কে পাতা একটি বিছানা দেখিয়ে, মুখে ম্লান হাসি টেনে আনার ব্যর্থ চেষ্টা করে বললেন, বোসো।

মাফিকের শ্বশুরের বয়স বেয়াল্লিশ, না বায়ান্ন, ঠিক বোঝা যায় না; তবে তিনি একইসঙ্গে দুজন রমণীর রহস্যোদ্ধারে ব্যাপৃত হার-না-মানা মরদ! কামঠ কুমির। সুন্নত ধরে রাখার খাঁটি সেবক। চুল ছোটো করে ছাঁটা, তাই তার ছোটো মাথাকে আরও ছোটো দেখাচ্ছে; চেহারা একসময় মোলায়েম ছিল, এখন হতাশাব্যঞ্জক যেন। এরকম চেহারা নিয়ে তিনি হাতলভাঙা চেয়ারে বসতে-না-বসতেই মাফিকের শালক রশিদ ছোটো করে কাটা আনারস ভর্তি দুটো প্লেট হাতে নিয়ে পালঙ্কের পাশের ছোটো টেবিলে রেখে, পা ছুঁয়ে প্রণাম করল উভয়কে; কিন্তু হাসিটুকু তার ঠোঁটের কোণে এসেই থেমে গেল, প্লাবিত হতে পারল না, ঘরোয়া বৈঠকে বাবার বক্তব্যে তার কিশোর মনে চার বছর পর ভগ্নীপতিকে দেখার ও পাকিস্তান সম্বন্ধে মজাদার গল্প শোনার কল্পনাচিত্রে ছিদ্র হয়ে গেল, যেন দাদির ঝাঁপিতে সযত্নে রাখা দাদার১০ বহুকালের দ্রব্যে ইঁদুর পড়েছে; তাই হাসতে গিয়েও তার সারা মুখে ছেঁড়া-দুধের ঘোলাটে রূপ ধারণ করল, তবে পরিবেশ সহজ করতে ভগ্নীপতির বাঁহাতের তিনটে আঙুল তার ডানহাতে ধারণ করে নাড়াচাড়া করতেই লাগল। মাফিকের শ্বশুর মাজহারুল শেখ ছাদের কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার মেয়ের গলায় চার বছরেও কি একটা চেইন দিতে পারলে না? এ কেমন কথা বাপু?

মাফিক ভাবল, উত্তর দেওয়ার কিইবা আছে! আবার কিছু না বললেও যে বে-আদবি হয়ে যাবে, তাই সে যেভাবে টিকচিহ্ন দিয়ে বিমানবাহিনীর ভর্তিপরীক্ষা পাশ করেছিল ঠিক তেমনই ‘জি’ বলে উপস্থিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে চাইল। সঙ্গে সঙ্গেই শেখ সাহেব হেঁকে উঠলেন, এখন তো আর কোনও বাহানা থাকতে পারে না।

মাফিক আবারও বলল, জি।

এই ‘জি’ উচ্চারণের সঙ্গে চাঁদের স্নিগ্ধতা নিয়ে উদয় হলো শেখের ঝি, মাফিকের স্ত্রী, স্বামীকে উদ্ধার করার জন্য যেন রহিমাসীতা। মাফিকের দৃষ্টি তার কপোলদ্বয়ে, রসে টুসটুসে চেরাপুঞ্জির কমলা জোড়া যেন। সামাজিক নিষেধ না থাকলে যৌবনের দর্পণ যে কপোল তার সৌন্দর্যসুধা পান করে আজ তা সে পরিপূর্ণ হতে পারত। এমনকি বাহু বাড়িয়ে যুবতী স্ত্রীকে আহ্বান জানাতে পারত, কিংবা সে তার স্ত্রীর সৌন্দর্যসুধায় নিমগ্ন হতে পারত কোনও কিছু না ভেবেই। বাস্তব কারণেই সেই সৌন্দর্যসুধা পান করা তার পক্ষে সম্ভব হলো না। এই সৌন্দর্যসুধা আত্মগ্রাস করার ক্ষমতা থেকে সে বঞ্চিত হলো, তাই এই সৌন্দর্যের চারপাশে তার মন শুধু ঘুরপাক খেতে লাগল, তার শ্বশুরের তীক্ষ্ণ  দৃষ্টিকে মনের ক্ষমতা দিয়ে ঠেলে সরিয়ে ফেললেও সে অক্ষমই রয়ে গেল। তার মন কেবলই পাগল হতে লাগল, কিন্তু পাগল কি জায়েদার স্বামী হতে পারে? স্বামী কখনও বিকল্পসত্তা হতে পারে না। হতে পারে না বলেই হয়তো সে ভাবতে লাগল, তার স্ত্রীর গভীর প্রশান্ত প্রগাঢ় সৌন্দর্য শুধু চোখে ভালো লাগার মুগ্ধদৃষ্টি আর আকর্ষণই নয়, হৃদয়ে বাস করা তার ভালোবাসার শক্তিই তাকে খুবই প্রিয়তর করে তুলেছে। একদিকে, মাফিকের দৃষ্টিতে প্রকাশ পাচ্ছে বন্ধনের সন্ধ্যাপ্রদীপের প্রজ্জ্বলিত আহ্বান; আর অন্যদিকে, জায়েদার দৃষ্টিতে প্রকাশ পাচ্ছে তার স্বামীকে দীর্ঘদিন না পাওয়ার সমস্ত যন্ত্রণার অবসানের আহ্বান; সমস্ত অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষার সমাপ্তির পরিতৃপ্তি লাভের বাসনাই যেন। হঠাৎ এই পরস্পরের মিলনরেখাকে মাজহারুল শেখের দৃষ্টি ছেদ করল। সঙ্গে সঙ্গেই মাফিকের আঁখিদ্বয় নত হলো, আর জায়েদা পুলকশিহরন জাগা অন্তর নিয়ে, দিঘির ঢেউভাঙা পদক্ষেপে, তার বাবার কাছে পৌঁছে কদমবুচি করল; তারপর সোজা হয়ে ঘরের এককোণে নিশ্চুপে দাঁড়িয়ে থাকতে চাইলেও মায়ের শেখানো সংস্কার তাকে সহজ হতে দিলো না, আর তখনই শোনা গেল আরেকটি কণ্ঠ, মাফিককে সালাম কোরো।

জায়েদা দেখল রান্নাঘরের দাওয়ায় দাঁড়িয়ে তার হাস্যময়ী নানি মুচকি হাসছেন। মুচকি হাসিতে নানিকে সাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে এগিয়ে এলো পালঙ্কে আসন পাতা স্বামীর পাশে, লাজ নম্র চলনে। মাফিক অনুভব করল পা-স্পর্শ-করা তার স্ত্রীর সুখস্পর্শ; কিন্তু সে এইভাবে উপভোগ করতে চায় না, সে চায় তার পায়ে রাখা হাতদুটো নিজের মুঠোয় লুফে নিয়ে আদর করতে, তাকে পাশে বসিয়ে সোহাগ করতে করতে নিজেকে বিলিয়ে দিতে, কিন্তু তার অন্তরের এই আকুতি পূরণের বাধা যে মাজহারুল শেখ তিনি মূর্তিপ্রতীক হয়ে বসে আছেন তারই সামনে, হাতলভাঙা চেয়ারে। শত পরাবিদ্যায়ও প্রাণসঞ্চার হবে না তার। এমনকি তিনি তো পৌরুষের অভ্রান্ত জ্ঞানান্বেষণে আত্মনিয়োগ করতে চান না। চান না দুঃখ-দ্বন্দ্ব-বিরোধ-অজ্ঞান ছোঁয়া সবকিছুর উর্ধ্বে উঠে অমৃতময় মুক্ত জীবনলাভ করতে। তার দেহ-মন-ইন্দ্রিয় সমন্বিত আত্মবুদ্ধি চৈতন্য জ্যোতিতে অপ্রকাশিত। তিনি গূঢ় সত্যকে সহজে উপলব্ধি করতে অক্ষম। আর্তি নিয়ে আর্তের আবেদন মঞ্জুরের প্রার্থিত আঁখিকে উপেক্ষা করে জায়েদার প্রতি বার্তা ঘোষিত হলো, রান্নাঘরে যাও।

বন্যার রাক্ষুসে থাবা থেকে বেঁচে যাওয়া গৃহস্থের গোলায় তুলে রাখা পরিশ্রমের ফসল যখন মহাজনের পাইক এসে নিয়ে যায়, লগ্নি টাকার চক্রবৃদ্ধি হারের সুদ গণনা করে, সাকুল্য পাওনা হিশেবে, তখন ব্যথাক্ষুব্ধ অসহায় গেরস্থবউয়ের অন্তরে যেমন আলোড়ন সৃষ্টি হয় তেমনই জায়েদার অবস্থা, পিতৃ-আদেশ পালনের উদ্দেশে অতি কষ্টে সে তার পাদুটো টেনে নিয়ে চলল রান্নাঘরের দিকে। মেয়ে চলে যাওয়ার পর মূর্তিমান শেখ সাহেব নড়েচড়ে উঠলেন। তিনি ফারসি হুঁকোয় একমনে দম নিয়ে, ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাকিয়ে ছাদের দিকে ছুড়ে মারলেন। তারপর ছাদ ছুঁই ছুঁই ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি যে বলেছিলাম অলংকারের কথা, তা তো এখনই দিতে হয়।

শেখ সাহেবের কথায় মাফিকের মগজে বজ্রপাত-বজ্রাঘাত শুরু হলো; আর বাহারের চোখে শেখ সাহেব হয়ে গেলেন সিমার, তার অসুন্দর মুখভঙ্গির কারণে। তার যুদ্ধ করা অপছন্দ, সে ঠাণ্ডা মেজাজের শান্ত পুরুষ, কিন্তু এইমুহূর্তে প্রতিবাদ না করলেই নয়, তাই বলল, যত শীঘ্র পারে মাফিক সপরিবারে চলে যাবে পাকিস্তানে। সেখানে স্বর্ণ সস্তা। অলংকার তৈরি করে দিতে তার কোনও অসুবিধে হবে না।

যে ভদ্রলোক তার মেয়েকে হাতছাড়া করতে নারাজ, তিনি কি রাজি হবেন তার মেয়েকে সুদূর পাকিস্তানে ছেড়ে দিতে, তাই শেখ সাহেব ভুরু কুঞ্চিত করে বললেন, না বাবা, আমি এসবে নেই, আমার মেয়ে যেমন ছিল তেমনই চাই।

হঠাৎ যেন পুকুর থেকে ওঠে আসা উথালপাতাল হাওয়া দরজা ঠেলে ঘরে প্রবেশ করে বাহারের মুখের কালোছায়ার প্রলেপকে আরও গাঢ় করে দিলো, সঙ্গে সঙ্গেই তার কাছে পরিবেশটাও অসহনীয় হয়ে উঠল; অন্যদিকে, শেখ সাহেবের কথায় মাফিকের বুকে উথলে উঠল প্রচণ্ড রাগ, যেন সাপ নিশ্চুপে ছোবল মারছে, আর সেখান থেকে বিষ ছড়িয়ে পড়ছে তার সমস্ত শরীরে। চেয়ারে বসা শেখ সাহেবের সিমারমূর্তি ভীষণ জীবন্ত হয়ে উঠল, তাই হয়তো মাফিক তার দিকে তাকাতে পারছে না। ঠাস করে একটি ইয়া-আলি-চড় বিছানার গায়ে বসিয়ে দিলেও তার শরীর শীতল হবে না, তাই সে নিশ্চুপে সন্ধান করতে লাগল, কী কৌশলে সে তার শ্বশুরের দুইমুখী আক্রমণ থেকে বাঁচতে পারে। বিছানার গায়ে চড় মারতে পারছে না বলেই হয়তো মাথা নত করে মনযোগ সহকারে বিছানার চাদরের ভাঁজে ভাঁজে চড়ের সমগোত্রীয় একটি উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না! বাহারও উত্তর খুঁজতে চোখ বুজে ঘনঘন নিশ্বাস নিতে লাগল, তারপর মাথাটা একটু পরিষ্কার হতেই, স্বাভাবিক স্বরে বলল, আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারলাম না।

হুঁকোর নল প্যাঁচোতে প্যাঁচোতে শেখ সাহেব বললেন, তালাক ছাড়া দ্বিতীয় পথ আমি দেখছি না।

চন্দ্রগ্রহণে আক্রান্ত পরিবেশ যেন, বরং আরও মন্থর অন্ধকারে ছেয়ে গেল। ঘরের ভেতর জ্বালানো প্রদীপের আলোও দপ করে ম্লান হয়ে গেল যেন। রাগে, দুঃখে বাহার ভিজে-তেতো গলায় বলল, বুঝি না, আপনি এমন কথা কেমন করে উচ্চারণ করতে পারলেন?

শেখ সাহেবের বলার ভঙ্গিতে কোনও অনুমতি ছিল না, ছিল সিদ্ধান্ত, তাই দৃঢ়প্রত্যয় প্রকাশ পেল যখন তিনি বললেন, আমার মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমাকেই চিন্তা করতে হবে।

ডুবন্ত মানুষ যেমন খড়কুটো আঁকড়ে জীবনের স্বপ্ন দেখে তেমনই মাফিকের অবস্থা, সে চুপসে যাওয়া ফানুসের মতো মুখ করে বলল, এখন তাহলে উঠি। আতঙ্কিত মাফিক তার শ্বশুরের দেহ পাশ কাটিয়ে প্রাণপণ দরজার দিকে এগিয়ে যেতে চেষ্টা করল, আহত মনের এক অসম্ভব প্রচেষ্টা যেন; তবে তার শ্বশুরের মনের দেয়ালে ফাটল ধরানোর জন্য যে শক্তির দরকার তা তার নেই; কারণ, তার মন-আত্মা হাড়িকাঠে ফেলা বলির পাঁঠার মতো ছটফট করছে। তখনই সে শুনতে পেল তার শ্বশুর বলছেন, তালাক দিয়ে যেতে হবে কিন্তু।

শেষের শব্দে জোর আরোপ করে বাক্য শেষ করলেন শেখ সাহেব। আকাক্সিক্ষত খবরের সন্ধান পেল না মাফিক, যা পেল তা তার কাছে খুবই সাংঘাতিক। ওপর থেকে মাফিককে শান্ত দেখালেও মনের ভেতর ভীষণ অস্থিরতা সৃষ্টি হয়ে গেছে, অসম্ভব অন্যমনস্কের ছাপ ছড়িয়ে পড়েছে তার চেহারায়, শরীর থেকে তার আত্মা যেন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে, নিজেকে সোজা করে ধরে রাখতে তার কষ্ট হচ্ছে; তার কাছে ঘরটাও যেন দুল খাচ্ছে। তার শ্বশুরকে মনের এই জটিল অবস্থা বোঝানো যাবে না, নিজেকে ভীষণ একা-একা লাগছে তার, তাই হয়তো সে কপাল কুঁচকে, বাক্য-ব্যয় না করে, রান্নাঘরের দিকে একবার তাকিয়ে, গাত্রোত্থান করল। বাহারের বুকও মুচড়ে উঠল, খাঁ-খাঁ করতে লাগল। রান্নাঘরের গলাগুলোও শব্দহীন। পরিবেশ এমনই উষ্ণ যে মেজাজ ঠাণ্ডা রাখাই কঠিন, তবুও বাহার শান্ত গলায় বলল, এই বিশেষ অর্থবহ শব্দের প্রতি সত্যিকারের একজন শিক্ষিত পুরুষের একান্ত অনীহা আছে বলেই আমি সবিনয়ে অনুরোধ করছি, আপনি বিষয়টি আবার ভেবে দেখুন।

বাহারের কথা আর বেশি এগুতে পারল না। হতাশ হয়ে সে তার বন্ধুর গমণপথ অনুসরণ করল। শেখ সাহেব নিশ্চুপভাবে, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন সেইদিকে।

রাত।

খাবার যথানিয়মে বাংলাঘরে পরিবেশন করা হলো। একসময় শেষও হলো। তারপর দুই বন্ধু পরামর্শে বসল, তবুও তারা সমস্যার সমাধান করতে পারল না। সময় যেন ঝোড়ো গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। রাতও। একসময় বাহার ঘুমিয়ে পড়ল। রাতের ঘনীভূত অন্ধকারে, ঘরের কোণে লণ্ঠনের ক্ষীণ আলোয় মাফিকের মনে রচনা করে চলল, নানা কল্পনা, ঈশাণ কোণে জমে ওঠা মেঘের মতোই গভীর। কল্পনাগুলো গভীর অন্ধকারে অর্ধদৃষ্টিতে নয়, ঊর্ধ্বদৃষ্টিতেই মুখ তুলে ভিড় জমাচ্ছে তার অন্তরে, মাথায়, সমুদ্রের ঢেউয়ের মতোই যেন চঞ্চল। তার মনের স্বাভাবিক ভারসাম্য বিনষ্ট হয়ে গেছে, আর সেখানে শুরু হয়েছে অন্ধকার-ঘরে জেগে ওঠা ক্ষুদার্থ শিশুর কাতর আর্তনাদ; বিদ্যুদ্বেগে এই-যেন তার সমস্ত শরীরজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে, তাই হয়তো তাকে শ্বাসরুদ্ধ করে দিচ্ছে। এখানে আসার পর একটি সুখবরের জন্য সে প্রতীক্ষায় ছিল, কিন্তু এখন ভাবছে, ফয়সালা না করে পালিয়ে যাওয়াই উচিত, এমনকি ধামাচাপা দিয়ে সরে পড়াই উত্তম; কিন্তু না, সে মনে মনে বলল, এসব আমার পক্ষে অসম্ভব, স্ত্রীকে উদ্ধার না করে, গা থেকে দায়িত্ব ঝেড়ে, নিরাপদ দূরত্বে সরে পড়ায়  আত্মতৃপ্তি থাকে না, বরং পৌরুষে বাঁধে। স্ত্রী যদি সঙ্গে যেতে ইচ্ছুক থাকে তাহলে তাকে রেখে যাওয়া কাপুরুষতা নয় কি! যদি যেতেই হয় তবে তার বর্তমান মনমানসিকতা একবার জেনে নেওয়া উচিত। অবশ্য গত চার বছর, পত্রালাপে বুঝতে পেরেছি জায়েদা পিতৃতন্ত্রে পরিচালিত মানুষ নয়। সে ব্যক্তিমানবীয় চিন্তাচেতনায় সমৃদ্ধ এক সজীব প্রাণী। জায়েদা তো চায় তার স্বামীর সঙ্গে, শ্বশুরবাড়ির মানুষের সঙ্গে বসবাস করে জীবন কাটাতে; বর্তমান যুগের স্ত্রী তো পারে না মধ্যযুগের সামন্ততান্ত্রিক পরিবেশে, বাপের বাড়িতে ক্রীতদাসীর মতো নিষ্ঠুর জীবন কাটাতে, সে তো মুক্ত প্রয়াসিনী; তার পক্ষে অসম্ভব পিতার নিষ্ঠুর মহিমাতটে উৎক্ষিপ্ত হওয়া। পিতৃগৃহ হয়তো তার কাছে আর্দ্র অন্ধকারের গোহর, পিতার নিষ্ঠুর গোহা, যা তার জন্য অমাবস্যার গহীন অন্ধকার, গুমরে ওঠা একবুক শ্বাস; তবুও স্বামীর ভালোবাসার জন্যে পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হওয়ার ব্যথা সহ্য করা কি তার পক্ষে সহজ! তাই ওকে একটু সময় দেওয়া প্রয়োজন, তাকে এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য শক্তিসঞ্চয় করার সময় দেওয়া উচিত; কিন্তু সেই সময় কোথায়? বিহ্বল, বিমূঢ় মাফিক অনেক রাত পর্যন্ত নিদ্রিত বাহারের পাশে শুয়ে শুয়ে এসব ভেবে চলল। কঠিন মায়া, গভীর নিদ্রা আর নিষ্ফল স্বপ্নের মধ্যে বন্দি এক প্রাণীর অসহায় অবস্থা যেন। তার মনের মধ্যে উঁকিঝুঁকি মারছে অহরহ অকথিত ব্যথা। সে শুয়ে শুয়ে, তার ডানহাতের দৃঢ়বদ্ধ মুঠোয় নিজের চুল ছিঁড়তে থাকে, তার উজ্জ্বল ললাটে যেন রক্ত জমে উঠেছে, তার অন্তর যেন তীব্র আঘাতে হা-হা করছে, তার আত্মা কখনও কখনও ফেটে পড়ছে ফুলে ওঠা গুপ্তকান্নায়, কিন্তু মুক্ত বাতায়ন দিয়ে মৃদুমন্দ বাতাসের সঙ্গে, সেই অজানা ব্যথাটি তার বুকজুড়ে তরঙ্গ ভাঙছে। সে নিজেকে ছিঁড়েখুঁড়ে ভেঙে ফেলে দিতে চাচ্ছে, এই রুদ্ধঘরের আবদ্ধ অন্ধকারে। ঘরের পরিবেশও প্রচণ্ড অভিমান নিয়ে অন্ধকারে মাথাকুড়ে মরছে। মাফিক মনে মনে বলল, প্রেমময়ী মানবীকে সামনে না রেখে স্বৈরাচারী স্বামীর মতো তালাক নামীয় অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা হয়তো তেমন কঠিন কিছুই না, কিন্তু তা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ভালোবাসার দাবি নিয়ে, সমাধিকারে আমরা পরস্পর মিলিত হয়েছি। এমতাবস্থায় কোন ক্ষমতার বলে আমার স্ত্রীর অধিকারকে হত্যা করি? এ-যে খুন-খুনের বাড়া। কথায় বলে আল্লাহর ঘর মসজিদ তোড়ো, তবু মানব মন তোড়ো না। একতরফা সিদ্ধান্ত নেওয়া নিশ্চয়ই অন্যায়। ওর মতাভিমত জেনে নিতে হবে, নির্ভুলে। ওকে বোঝে নিতে হবে ভুল না করে। এই পরীক্ষানিরীক্ষার পন্থাপদ্ধতি মনের মধ্যে তোলাপাড়া করতে করতে একসময় মাফিক ঘুমিয়ে পড়ল।

বুধবার, ঊনত্রিশে শ্রাবণ

সকাল।

মাইকে মায়াজ্জিনের কণ্ঠে উচ্চারিত হয় ফজরের আজানের শিরিণধ্বনি, ডাকাত পড়া পাড়ার পাহারাদারের চিৎকারের মতো মাফিকের কানে এসে আঘাত করলেও তার ঘুম ভাঙল না, বরং জলভাঙার ছলাৎ ছলাৎ শব্দে তার চোখ খুলল। ঘুম ভাঙার পর, বিছানায় বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই দেখল, শ্বশুরের রোজগারি ডিঙিনৌকার সাহায্যে হাওর থেকে আনা কচুরিপানা দেশীয় গরুগুলোর সামনে রাখছে। একপাশে দাঁড়ানো বিদেশি বলদের কালো চোখদুটোয় সিংহের আগুন যেন প্রকাশ পাচ্ছে, ওর স্বভাব দেখেই মনে হচ্ছে শান্তশিষ্ট বা ভদ্রমেজাজের সে নয়, তার বিশাল ঘাড় ফুলেদুলে উঠছে; সে লেজ উঁচিয়ে, শিং দুলিয়ে ক্রুদ্ধগর্জনে তাকাচ্ছে রোজগারির দিকে; রোজগারি ওর চোখে কী দেখল সে-ই জানে, তবে সে তাড়াতাড়ি কিছু কচুরিপানা তার সামনে ছুড়ে ফেলে বড়োঘরের দাওয়ায় এসে দাঁড়াল। হাফহাতা শার্ট গায়ে, রোজগারিকে পাশ কাটিয়ে মাফিক হাতমুখ ধুয়ে, ঘরে ফিরতে-না-ফিরতেই নাশতা এসে হাজির হলো। তার মনে হলো, একজন তাকে চোখে চোখে রাখছে, যা অবশ্যই আনন্দদায়ক অনুভূতি, বাদ্যযন্ত্রের কোমল সুর যেন। নাশতার রকমারি লক্ষ্য করে সে মুগ্ধ হলো; এসবে তার প্রিয়ার যত্নস্পর্শ রয়েছে তা কল্পনা করেই তার অন্তর পুলকিত; নাশতার মধ্যেই যেন মিশে আছে তার স্ত্রীর সৌন্দর্যসুধা। তার স্ত্রীর আপাত সৌন্দর্যের পেছনে যে গভীর-উদার-মার্জিত যত্ন লুকিয়ে আছে তা সে এর আগে কখনও অনুভব করেনি; এমন সুখময় সময়ে হ্যাল-বলে কামরায় প্রবেশ করল মাফিকের আরেক বন্ধু, যার সঙ্গে বাহারে কোনও পরিচয় নেই, বাহারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে মাফিক বলল, আবদ্-আল মৌলা। আমি যেমন তোমার স্কুলজীবনের সাথী তেমনই সেও আমার কলেজজীবনের সঙ্গী।

সারা মুখে হাসি ছড়িয়ে, বাহারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে, তার পাশে বসতে-না-বসতেই মৌলা বলল, আসলে আমার নাম আবদ্ আল-মাওলা।

মাফিক স্মিত মুখে, মৃদু ধমকের সুরে বলল, এতদিন ধরে জেনে এসেছি তোমার নাম আবদ্-আল মৌলা। এখন তা কেমন করে আবদ্ আল-মাওলা হয়ে গেল?

মৌলার ঠোঁটে লিকলিক করে ফুটে উঠল হাসি; এই হাসি ঠোঁটে ধারণ করে সে উত্তর দিলো, আমার আল শব্দাংশকে ভুল করে আবদ্ (গোলাম) শব্দের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছিল। আসলে যুক্ত হওয়ার কথা ছিল মাওলা (আল্লাহ) শব্দের সঙ্গে, যেমন আল-কুরআন।

মাফিক বলল, আজ কোন কারণে কুম্ভকর্ণের ঘুম ভাঙল কে জানে। তারপর যোগ করল, তাই বলে কি কামসূত্রকে আল-কামসূত্র বলতে হবে!

মৌলা বলল, বেকুবের হাঁড়ি! সম্মানসূচক শব্দের সঙ্গে আল যুক্ত হবে, গোলাম-এর সঙ্গে নয়। আমাদের বিদ্যার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত তাই আমরা লিখে থাকি আব্দুল করিম, আসলে হওয়া উচিত ছিল আবদ্ আল-করীম১১

বাহার প্রশ্ন করল, শতাধিক বছর ধরে আমাদের নামের এমনই ভুল ব্যাখা করার মূলে কী কারণ থাকতে পারে বলে আপনি মনে করেন?

মৌলা বলল, শিক্ষায় অগ্রসর হিন্দুসম্প্রদায় অন্তর্ভুক্ত পণ্ডিতদের আরবি ভাষায় অনীহা ও অজ্ঞতাই এই পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে বলে আমার ধারণা। অবশ্য মুসলিমসম্প্রদায়ের শিক্ষাসহ সর্ববিষয়ে পশ্চাৎপদতার জন্যে মূলত নিজেরাই দায়ী, ফলে আজও দেখা যাচ্ছে ব্যাঙের ছাতার মতো বেড়ে উঠছে মৌলবাদী ধ্যানধারণা, যা নতুন প্রজন্মকে প্রভাবান্বিত করছে, এতে অবশ্য আমাদের ক‚পমণ্ড‚কতা চিরস্থায়ী হচ্ছে।

কী যেন জবাব দিতে বাহার হা করল, কিন্তু এমন সময় সামনে এসে হাজির হলেন শেখ সাহেব, সঙ্গে একজন আলখাল্লাধারী মৌলোভীও; বাহারের চোয়াল বন্ধ করা আর হলো না। শেখ সাহেব পরিচয় করিয়ে দিলেন, হুজুরে আলা, পিরে কামেল, মোজাদ্দিদে যামানা…।

শেখ সাহেবের মুখ দিয়ে কথার বগবগ ফেনা উথলে ওঠার আগেই আলখাল্লাধারী মৌলোভী ফরমালেন, অতসব বলিতে নাহি।

শেখ সাহেব বিনয়াবনতভাবে বললেন, আপনার সিফাৎ কি বলে শেষ করা যায়! সামান্য উল্লেখ করতে হয় তাই করলাম।

বড়োঘর থেকে একটি বড়োচেয়ার এনে, ঝারমুছ করে বসতে দেওয়া হলো পির সাহেবকে; আর হযরত মৌলানার খানাপিনার বন্দোবস্ত করতে ব্যস্তসমস্তভাবে বড়োঘরের দিকে ত্রস্তপদে উধাও হয়ে গেলেন শেখ সাহেব। পিরে কামেলের এভাবে উপস্থিত হওয়ার কারণে মাফিকের স্বাভাবিক হাসিটুকু উবে গেল, নিজেকে খুবই একা একা, মৃত্যুহিম, আসহায় লাগছে। বন্ধুদের মুখও সময়োচিত গম্ভীর। পির সাহেব বিনা ভূমিকায় প্রশ্ন করলেন, তুমি কি-হে জায়েদার সুয়ামি?

পির সাহেবের মুখের গাম্ভীর্যতা যতই কৃত্রিম হোক-না কেন, বাস্তবিকই তাকে সহ্য করতে পারছে মাফিক, তাই বলল, আপনি আমার বন্ধু নন, আবার আমি আপনার শালকের পোলাও নই, তাই বলি— আপনি আমাকে তুমি-বলে সম্বোধন করার অধিকার কোথা থেকে পেলেন?

জায়েদার বাপ আমার শাগরেদ।

এতে আমার ওপর আপনার অধিকার বর্তায় না। জায়েদার ওপরও না। মাফিক বলল।

ঠিক আছে, মানিয়া লইলাম। না মানিয়া উপায়ই বা কি? যুবাদলকে আজকাল উত্তপ্ত করা উচিত নহে, সন্ত্রাসে ভরিয়া গিয়াছে দেশ।

রগকাটা তো আপনাদের একমাত্র পেশা।

যে কাজের দায়িত্ব নিয়া আসিয়াছি, তার বাহিরে অন্যবিষয়ে তর্ক করিতে আমি রাজি নহি।

ভালো কথা। শুনে খুশি হলাম।

একথা কি সত্যি নহে, দীর্ঘ চারি বছর জায়েদার সংবাদ নেওয়া হয় নাই।

না, সত্য নয়।

মিথ্যাও নহে বটে। স্ত্রী দীর্ঘদিন স্বামী ছাড়া একা বাস করিলে বিনা কারণেই তালাক হইয়া যায়।

তাই না কি!

মাফিককে উদ্দেশ্য করে বাহার বলল, মাওলানার প্রশ্নের উত্তরে আমাকে কিছু  বলতে দাও।

না, মৌলা ও তোমাকে কিছুই বলতে হবে না। পির সাহেবের মতো একজন কূপমণ্ড‚ক আলেমের রহস্য ভাঙার জন্য আমিই যথেষ্ট। তারপর ঘন দাড়ি-ঘেরা নূরানি চেহারার দিকে তাকিয়ে মাফিক যোগ করল, যদি তা হতো তবে তকলিফ করে আপনার এখানে আসার প্রয়োজন কী?

দাড়ি খিলাল করতে করতে আলখাল্লাধারী মৌলোভী জবাব দিলেন, স্ত্রীর সঙ্গে সহবাসের পূর্বে মোহরানা পরিশোধ করিবার নির্দেশ রহিয়াছে পাক-কুরআনে। সুরা নিসায় বর্ণিত, মোহারানা পরিশোধ করিবার তাৎপর্যতা বুঝাইয়া দিবার জন্য আসিয়াছি।

আপনারা যদি বুঝতেন কুরআন-হাদিসের মর্মবাণী, তাহলে মুসলিম সমাজের এত অধঃপতন হতো না।

আপনি কি বলিতে চাহিতেছেন? রাগত স্বরে প্রশ্ন করলেন মৌলোভী।

হাঁটু সোজা রেখে, সামনের দিকে ঝুঁকে, মাফিক উত্তর দিলো, আপনাকে জানিয়ে দিতে চাই যে, পির-পরস্ত্রীপ্রহারকারী-আলেমের পক্ষে সমান্য জ্ঞানলাভ করাও সম্ভব নয়। অন্যথায় আপনি অবশ্যই জানতেন সুরা নিসায় একথাও আছে যে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সমঝোতা হয়ে গেলে মোহরানা কেন, কোনও ব্যাপারেই আপনি কিংবা মেয়ের বাবা কিছুই বলতে পারেন না। তবুও যদি কিছু বলতে চান তাহলে তা হবে অনধিকার চর্চা।

মাফিকের তীক্ষ্ণধার কটাক্ষ গায়ে না মেখে সহজভাবে জবাব দিলেন পির, এই সমঝোতা তো আপনাদের মাধ্যে হয় নাহি।

মানে?

স্ত্রীর সহিত আপনার মিলন ঘটিয়াছিল কি করিয়া? আপনি তো চারি বছর বিদেশেই ছিলেন!

আমাদের অন্তরের মিলন নিশ্চয় আছে। তবে আপনি যে মিলনের কথা বলছেন তা অবশ্য ঘটেনি। তাছাড়া আমার সঙ্গে তার যে বোঝাপড়া হয়নি তা জানেন কি করে? না, জানেন না। আমাদের বোঝাপড়া হয়েছে বলেই তো তার প্রতি আমার মমত্ববোধ, আন্তরিক ভালোবাসা রয়েছে প্রচুর। আর এসব আমার স্ত্রী উপলব্ধি করে বলেই তো সে আমার ব্যক্তিত্বের প্রতি শ্রদ্ধাবান। প্রিয়তম রূপে আমাকে গ্রহণ করতে তার অন্তরাত্মা সবসময়ই উন্মুক্ত।

চারি বছর স্বামী ছাড়া বসবাস করিলে তা তালাক সমতুল্য বলিয়া উল্লেখ করিয়াছে বিখ্যাত কাজকান কিতাব।

মাফিক বলল, জ্ঞানীর জন্য ইঙ্গিত, আর বোকার জন্য ধাক্কা। তবে যেকথাটি আমি বলতে চাইনি, তা-ই বলতে বাধ্য করছেন, তাই না!

মৌলোভীর সুর নরম হয়ে এলো। পানপাতায় আঙুলের স্পর্শে চুনের প্রলেপ দিতে দিতে উপদেশের ভঙ্গিতে বললেন, আপনার শ্বশুরের সংশয় দূর করিবার চেষ্টা আপনি করুন। কারণ, কোনহ মাইয়ার পিতাই চাহিবে না শাদির সঙ্গে সঙ্গেই জামাই নিরুদ্দেশ হইয়া যাউক; একেবারে চার-চারিটি বছরের জন্য।

তখন সে-যে নাবালিকা ছিল সেই হিসাব কি তার মা-বাবা রাখেননি! অপ্রাপ্ত বয়স্কা মেয়ে বিয়ে দেওয়া অনুচিত নয় কি! দিলে তো ধর্ষণের দিকেই ঠেলে দেওয়া হয়। তাই না! যে-যুবক সেরকম সুযোগ গ্রহণ করল না, তার প্রশংসা না করে তার স্ত্রীকে কেড়ে নিয়ে শাস্তি দিতে চান? একবারও কি তার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করবেন না, এই ব্যাপারে তার অভিমত কি, তা জানতে চাইবেন না। আপনার ওকালতি তার আদৌ প্রয়োজন কিনা, মেয়ে বলে তার স্ত্রীকে উপেক্ষা করবেন?

মাফিকের বক্তব্যের তাৎপর্য উপলব্ধি না করেই কাঁধে জিন-ভর-করা পিরের মতো হুজুরে আলা ফরমালেন, আপনার সহিত তর্ক করিয়া সময় নষ্ট করিবার জন্য এখানে আসি নাহি। আসিয়াছি শুধু জানাইয়া দিতে যে, সসম্মানে তালাক না দিলে অন্যব্যবস্থা নেওয়া হইবে।

স্প্রিংয়ের মতো লাফ দিয়ে উঠল মৌলা, বলল, আমার বন্ধুকে সস্ত্রীক তার গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষমতা কি আমাদের নেই?

আমি লাঠালাঠি চাই না, তবে স্পষ্ট করে বলে দিচ্ছি, তালাক দেওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব। মাফিক বলল।

অতবড়ো স্পর্ধা? হুজুরে-আলা বললেন।

রাগ করবেন না হুজুরে-আলা। মিনতিভরা কণ্ঠে বাহার বলল।

সঙ্গে সঙ্গেই মৌলা যোগ করল, সত্যি কথা তেতোই হয়।

হুজুরের উচ্চঃস্বরের কথা শুনে মাফিকের শ্বশুর ত্রস্তে এসে, বক্তব্য না বোঝেই, হুমকির স্বরে বললেন, তালাক নিয়ে তবে ছাড়ব।

তিনি যেমন এসেছিলেন তেমনই আবার ঝোড়োবেগে চলে গেলেন, বড়োঘরের বারান্দায়। তবে বাংলাঘরের বায়ু উত্তপ্ত হয়েই রইল। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। শ্রাবণ শেষের ভ্যাপসা গরমে এমনিতেই অসহ্য লাগছে। কিছুক্ষণ কারও মুখ দিয়ে কোনও কথা প্রকাশ পেল না। ঘরের পরিবেশ ভারী নিঝুম। যেকোনও সময়ে বোমা বিস্ফোরণে নীরবতা ভেঙে যেতে পারে, একসময় ভাঙলও, মাফিক আলখাল্লাওলাকে বলল, তালাক দিতে হলেও স্ত্রীর উপস্থিতি প্রয়োজন। শরিয়ত সম্মত কথা। তাই আমি প্রস্তাব করি আপনার সাক্ষাতে আমার প্রশ্নের উত্তরে জায়েদা যে অভিলাষ ব্যক্ত করবে সেই মোতাবেক আমরা চলব। ঠিক আছে!

পিরের অন্তর যেন পাথর, তিনি নিজেই বুঝতে পারছেন না, তবে দীর্ঘ দাড়ি দুলিয়ে, সাপুড়ে ওঝার মতো ফতোয়া ঝাড়লেন, অর্বাচীন মাইয়ার কথায় মুরব্বীয়ান চলিবেন? কী যে বলিতেছেন!

শিশু জন্মদানের সিদ্ধান্ত যে নিতে পারে, সে কেন পারবে না তার ভবিষ্যতের ভালোমন্দ নিয়ে কথা বলতে? মানুষ তৈরির কারখানার প্রধান মিস্ত্রিকে অবজ্ঞা করা আপনার মতো পিরের কি সাজে? না, সাজে না। অজ্ঞতার অজুহাতে অপরাধ ঘুচে না— একথা আপনি অবশ্যই বোঝেন। মৌলার কথাগুলো জ্বলন্ত সীসাখণ্ডের মতো আলখাল্লাওলার কর্ণে প্রবেশ করতেই তার মুখমণ্ডল রক্তিম হয়ে উঠল। তার যেন দৃষ্টিভ্রম ঘটল। মৌলা প্রতিভাষিত কণ্ঠে পিরকে মালাউন-বলতেও দ্বিধা করল না।

পরিবেশের আকস্মিক পরিবর্তনে শঙ্কিত বাহার ব্যস্ত হয়ে বলল, এই প্রসঙ্গে আমি কিছু বলতে চাই। আলখাল্লাওলাকে শান্ত করার সদিচ্ছা তার কণ্ঠে পরিস্ফুটিত, দুটো মানুষ একত্র বসবাস করলেই মনোমালিন্যের প্রশ্ন আসে। তখন হয়তো পরিস্থিতি চরমে পৌঁছার আশঙ্কা থাকে। আর সর্বপ্রচেষ্টা ব্যর্থ হলেই তখন পৃথক হওয়ার প্রশ্ন উঠতে পারে। তাই বলি হুজুরে-আলা, মাফিক ও জায়েদাকে একত্র বসবাস করার সুযোগ করে দিন। তারপর অলংকার নিয়েই হোক বা ভালো লাগা, না-লাগা নিয়েই হোক— যেকোনও কারণে বিরোধ ঘটলে আপনি তালাকের ফতোয়া দিতে পারবেন। একদফায় তিন-তালাক, না তিনদফায় তিন-মাসে তিন-তালাক দিতে হবে— এসব ফয়সালা আপনাকেই করে দিতে হবে। তবে বিরোধের আগেই যদি আল্লাহর অপছন্দের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠেন, তাহলে তাঁর রোষে পড়ার আশঙ্কা থেকে যায়। তাই না! আপনি আমার মুরব্বীর মুর্শিদ। আশাকরি আপনার মুরিদের মেয়ের স্বামীসহবত সুখীসুন্দর জীবন করতে সরলপথ দেখিয়ে দিলে আপনাকে খুশি করতে তারও কসুর হবে না। আমরা সবাই সন্তুষ্ট চিত্তে সচেষ্ট হবো আপনার খেদমতে।

বাহারের কথায় যেন অমীমাংসিত রহস্যের গ্রন্থিমোচন ঘটল, তার ইঙ্গিত টের পেয়েই বোধ হয় তিনি উচ্চারণ করলেন, আলহামদুলিল্লাহ। পরক্ষণে যোগ করলেন, দেখিতেছি কি করিতে পারি?

বুজুর্গানে দ্বিনের বেশে, ফক্করদালাল নতুন ধান্দার ফন্দিফিকির করতে ব্যস্ত হয়ে গোপাটের অপরপাড়ে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গেই তিন বন্ধুতে পরামর্শ শুরু হলো। তারা সিদ্ধান্তও নিল। ঘাবড়ানোর কিছুই নেই। বিলম্বে হলেও কার্যসিদ্ধি হবে; কারণ, মাফিক-জায়েদার দাম্পত্যজীবন প্রেমময়। সকলই জানে নিদান-নৈরাশ্যে প্রেমই শান্তির প্রলেপ পড়িয়ে দেয়— একথা প্রমাণ্য সত্য, সঠিক প্রয়োগে প্রেম সর্বজয়ী হয়ই।

মৌলা বলল, দেখো মাফিক, তোমার শ্বশুরের কাছ থেকে একটি উপহার প্রত্যাশা করা পিরের জন্য অন্যায় কিছু নয়। সে হেসে উঠল, অর্থবহ হাসি। তারপর স্বভাবসুন্দর ভঙ্গিমায় বলতে লাগল, মোল্লা ব্যাটা বুঝতে পেরেছে যে তুমি এখানে অসহায় নয়। তোমার দল যথেষ্ট ভারী। এখানে তার জারিজুরি অচল। গত বর্ষায় তোমার কাকাশ্বশুর, এই মোল্লার প্ররোচনায় পড়ে, তার মেয়ের জামাইর কাছ থেকে জোর করে মধ্য হাওরে, নৌকায় বসে থাকা অবস্থায়ই, তালাক আদায় করেছিলেন। এরকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটানো যে সম্ভব নয় তা তোমার শ্বশুর সাহেবের মালুম হয়ে গেছে, আমার উপস্থিতিতে। যেকোনও প্রতিক‚ল পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমরা সদলবলে প্রস্তুত। যাকগে, এখন চলো ব্রিজ খেলে মনকে হালকা করি।

বাহার বলল, খাবারের কি হবে, যদি ওরা বেঁকে বসেন।

মৌলা স্মিত মুখে বলল, সেইজন্য মোটেই ভাবতে হবে না। তারপর যোগ করল, পুবের বাড়ি থেকে না এলে আসবে পশ্চিম থেকে। বাকি রইল দক্ষিণ, উত্তর। সর্বোপরি, আমি মনে করি যে, নানির তৎপরতা চলছে আমাদের পক্ষে, লোকচক্ষুর অন্তরালে। ফল প্রকাশ শুধু সময়ের ব্যাপার।

দুপুর-বিকাল-সন্ধ্যা-রাত

সময় এগিয়ে চলল। জোহর-আছর-মাগরিব-এশা পেরিয়ে রাত, গভীর রাত। জানালায় মৃদুমন্দ শব্দ উঠতেই মাফিক তড়িদবেগে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল; এরকম শব্দের জন্যই সে অপেক্ষায় ছিল। পাশের বাড়ির কুকুরের ঘেউ ঘেউ থেমে গেছে অনেক আগেই, প্রতিপক্ষ ছাড়া একতরফা চিৎকার কাঁহাতক করা যায়! বালিশের নিচে খোলে রাখা হাতঘড়ি দেখলেই সময়ের হদিশ পাওয়া যেত, বোঝা যেত রাত কত হয়েছে, কিন্তু সময়ের গতি জানার কি গরজ! না, নেই। থেমে যাক না সময়, সবকিছু, গতি হোক শুধু এই মৃদুমন্দ শব্দের; শব্দটি যাক-না বয়ে তার শিরা-উপশিরা দিয়ে, প্রিয়মিলনের উন্মেষে। মাফিক তার ভাবনার তন্ময়ভাব ত্যাগ করে, একটি শার্ট গায়ে জড়িয়ে, দরজা খুলে বেরিয়ে এলো তারাভরা চাঁদহীন আকাশের নিচে। তার দৃষ্টির সীমানায় অন্যকিছুই নেই, শুধু আমতলায় দাঁড়িয়ে থাকা দুজন মানুষের ছায়া। নিকটবর্তী হওয়া মাত্রই নানি বললেন, এই নাও তোমার ধন, রেখেছিলাম সংগোপনে।

নাতনির লজ্জাবনত থুতনিটি নাড়া দিয়ে, তাকে এগিয়ে দিয়ে, তিনি সরে গেলেন আমতলা থেকে। এক অদ্ভুত নেশায়, মাদকতায় ভয়হীন জায়েদা এগিয়ে এলো তার স্বামীর কাছে। মাফিক তাকাল তার স্ত্রীর চোখে, উল্লাসচঞ্চলস্নিগ্ধতায় ভরপুর চোখদুটো, এই চোখে জীবনের গভীরতাও, প্রেম ও করুণা খেলে বেড়াচ্ছে। মাফিক রহস্যময় আবেশে হারিয়ে যাচ্ছে। সমস্ত চেতনা দিয়েও যেন সে তার স্ত্রীকে ধরে রাখতে পারছে না। অবুঝ প্রেম স্নিগ্ধতায় ছুঁয়ে যাচ্ছে। মাফিক হাত বাড়িয়ে দিলো। স্বামীর ঈপ্সিত স্পর্শে চিকচিক করে উঠল জায়েদার কালো চুল। গোলাপের মতো ঠোঁটদুটোও আনন্দে কাঁপছে। সুউচ্চ কবরী ধীরেস্থিরে নেমে এলো মাফিকের প্রশস্ত কাঁধে— স্বচ্ছন্দে, সানন্দে, নির্ভয়ে, নিশ্চিন্তে। জায়েদার উরসে উত্থিত ব্যথা-তাড়ন-মন্থন থামিয়ে দেওয়ার জন্য মাফিক নিজের প্রশস্ত বুকে তাকে ধারণ করল জায়েদাকে; এতে কোনও কাপুরুষতা নেই, লজ্জাও নয়; শুধু দৃঢ় বন্ধনের আহ্বান।  সগর্বে ঘোষিত হলো নিবিড়-নিশ্চিন্ত নিরাপত্তা, স্বস্তি, প্রেম— নিঃস্বার্থ ভালোবাসা, নির্ভরতা ও শুভ চিন্তা। জায়েদার অশ্রুবান বন্ধ করার জন্য তার আঁখিপাতে দীর্ঘ চুমু খেলো মাফিক— গভীর, সঞ্চিত সোহাগে। সোহাগের জোরেই তো মানুষের পরমায়ু বেড়ে যায়। আনন্দতৃপ্তিতে জায়েদার আঁখিপাতা বুজে এলো, তবে মুখ ঝলমল করতে থাকে। সে তার বাহুলতা দিয়ে মাফিককে জড়িয়ে গলাবন্ধ হয়ে রইল। বাঁধভাঙা আবেগ বয়ে চলল তড়িদ্বেগে, সর্বাঙ্গে। কতক্ষণ? দুজনের কেউই জানে না। প্রকৃতি পুলকিত। লক্ষ্মী পেঁচা ডেকে উঠল, অদূরে; আর দূর আকাশে তারাগুলো  হেসে চলল। আবেগানন্দে স্পন্দিত অধর অধরের সঙ্গে বন্দি।

হঠাৎ গদগদ কণ্ঠে অভিমানিনী বলল, তুমি নাকি আমাকে ছেড়ে চলে যেতে চাইছ?

তা চেয়েছিলাম তালাক না দেওয়ার জন্য।

এই শব্দটি আর কখনও উচ্চারণ করবে না। আমাকে সঙ্গে নিয়ে চলো।

তুমি আমার সঙ্গে যাবে!

তোমার সঙ্গে যাব না তো যাব আর কার সঙ্গে শুনি?

চলো।

এক্ষুণি?

এই মুহূর্তে, এমনি বেশে, রাজি?

জায়েদার চোখের সামনে অনেক অন্যায় হয়ে গেছে, মুখ খুলে কোনও প্রতিবাদ করতে পারেনি, কিন্তু এখন চুপ করে থাকতে চাচ্ছে না, তবুও মুখ ফুটে কিছুই বলতে পারছে না, শুধু মাফিকের বুকে তার কপালের ঘাম মুছতে মুছতে ভাবতে থাকে, ঠিক পারব তো এই অন্ধকার পাড়ি দিয়ে স্বামীর সঙ্গে নতুন করে জীবন গড়তে!

Footnotes : ১ জ্যেঠিমা। ২ শ্বশুর। ৩ করতে। ৪ তাড়াতাড়ি। ৫ হয়ে। ৬ কী। ৭ মাতামহী। ৮ কন্যার স্বামী। ৯ পিতামহী। ১০ পিতামহ। ১১ ইসলামী বিশ্বকোষ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, পৃষ্ঠা ২৩।

[লেখক পরিচিতি : জন্ম : ১ মার্চ ১৯২৯। মুকিমপুর, নবীগঞ্জ, হবিগঞ্জ।  মৃত্যু : ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬। মুক্ত স্কাউট ভবন, হবিগঞ্জ। ১৯৪৭। আউশকান্দি উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু। ১৯৪৯। আউশকান্দি হাইস্কুলে শিক্ষকতার সময় পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে যোগদান। তারপর সপরিবারে পাকিস্তানে বসবাস শুরু। ১৯৬১। বিমানবাহিনীর চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ এবং সপরিবারে পূর্ব-বাংলায় প্রত্যাবর্তন। ১৯৬২। ব্রিটিশ সরকারের মিনিস্ট্রি-অফ-অ্যাভিয়েশনের গবেষণাকেন্দ্রে চাকরি গ্রহণ। ১৯৬৬—১৯৭১। ক্রমাগত পেশা বদল —  ম্যানেজার, ইলেকট্রিকমিস্ত্রি, ফিটার ইত্যাদি। ১৯৭১। মুক্তিযুদ্ধের একজন সক্রিয় সংগঠক। ১৯৭২। সিভিল সার্ভিসে যোগদান। ১৯৮৯। অবসর গ্রহণ এবং স্ত্রী সমেত বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন। সংগ্রাম-উন্মুখর বিচিত্র জীবনধারা থেকে সংগৃহিত হয় তাঁর অভিজ্ঞতা। দারিদ্র্যের প্রচণ্ড চাপ আর সামাজিক বিষমতা ও পীড়নে লেখালেখিতে প্ররোচিত। ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬।  সকাল। ১১.৪০। তাঁর প্রিয় সংগঠন হবিগঞ্জ সাহিত্য পরিষদের উদ্যোগে আয়োজিত হবিগঞ্জ মুক্ত স্কাউট ভবনে মহান একুশ স্মরণে আয়োজিত আলোচনা মঞ্চে বাংলা ভাষার পক্ষে উত্তেজিতমূলক বক্তৃতারত অবস্থায় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যু জীবনের শাশ্বত সত্য জেনে তাকে গ্রহণ করেন। প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত অসংখ্য উপন্যাস, ছোটোগল্প, প্রবন্ধ, গবেষণা সমেত রউফসৃষ্টিনিদর্শন বাংলাসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। দ্রোহী কথাসাহিত্যিক আব্দুর রউফ চৌধুরী আগামী দিনেও বেঁচে থাকবেন তাঁর সৃজনকর্মের গৌরবে।]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *